বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
জাল হাদিসের কবলে বাংলাদেশী পির-অলি ও আলেম সমাজঃ (পর্ব-১)
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিষয়ক জাল হাদীসঃ
ভূমিকাঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সীমাহীন ও অতুলনীয় মর্যাদা, ফযীলত, মহত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করা
হয়েছে কুরআন কারীমের অগণিত আয়াতে এবং অগণিত সহীহ হাদীসে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের ভাব-গম্ভীর
ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন ও আত্মিক অনুপ্রেরণা অনেক মুমিনকে আকৃষ্ট করতে পারে না।
এজন্য অধিকাংশ সময়ে আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল আয়াত ও সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে সাধারণত একেবারে
ভিত্তিহীন বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীসগুলো আমরা সর্বদা আলোচনা করি, লিখি ও ওয়ায নসীহতে
উল্লেখ করি।
আমরা দেখেছি যে, মুসলিম সমাজে
প্রচলিত জাল হাদীসের অন্যতম তিনটি ক্ষেত্র: (১) ফাযায়িল বা বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব
বিষয়ক গ্রন্থাদি, (২) পূববর্তী নবীগণ বা কাসাসুল আম্বিয়া জাতীয় গ্রন্থাদি এবং (৩) রাসূলুল্লাহ
(ﷺ)-এর
জন্ম, জীবনী, মুজিযা বা সীরাতুন্নবী বিষয়ক গ্রন্থাদি। যুগের আবর্তনে ক্রমান্বয়ে এ সকল
বিষয়ে জাল ও ভিত্তিহীন কথার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি
যে, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ হিজরী শতকে সংকলিত সীরাত, দালাইল বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে
অগণিত ভিত্তিহীন ও জাল বর্ণনা স্থান পেয়েছে, যেগুলো পূর্ববর্তী কোনো হাদীসের গ্রন্থ
তো দূরের কথা, কোনো সীরাত বা মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থেও পাওয়া যায় না।
আল্লামা আবুল কালাম আযাদ
তার ‘রাসূলে রহমত’ গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনা ও নিরীক্ষা করে এ জাতীয় কিছু বানোয়াট ও
ভিত্তিহীন গল্পের উল্লেখ করেছেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের পূর্বে আসিয়া (আ) ও মরিয়ম (আ)-এর শুভাগমন, মাতা আমিনাকে
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গর্ভধারণের শুরু থেকে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সময়ে হযরত আমিনার কোনোরূপ
কষ্টক্লেশ না হওয়া... ইত্যাদি।[1]
কেউ কেউ মনে করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা দ্বারা আমরা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করছি। কত জঘন্য চিন্তা!
মনে হয় তাঁর সত্য মর্যাদায় ঘাটতি পড়েছে যে, মিথ্যা দিয়ে তা বাড়াতে হবে!! নাঊযু বিল্লাহ!
মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সবচেয়ে অসন্তুষ্ট হন মিথ্যায় এবং সবচেয়ে জঘন্য মিথ্য হলো আল্লাহ ও
তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা।
লক্ষণীয় যে, আল্লাহ পূর্ববর্তী
নবীগণকে (আ) মূর্ত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনেক মুজিযা প্রদান করেছিলেন। মুহাম্মাদ ﷺ-কেও তিনি অনেক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
মুজিযা দিয়েছেন। তবে তাঁর মৌলিক মুজিযা বিমূর্ত বা জ্ঞানবৃত্তিক। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন,
বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানুষকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মুজিযা অনুধাবনে সক্ষম করে। অনেক সময় সাধারণ মুর্খ মানুষদের দৃষ্টি
আকর্ষণ, অবাক করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে গল্পকার, ওয়ায়িয বা জালিয়াতগণ অনেক মিথ্যা গল্প
কাহিনী বানিয়ে হাদীস নামে চালিয়েছেন।
অনেক সময় এ বিষয়ক মিথ্যা
হাদীসগুলো চিহ্নিত করাকে অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও শানের সাথে বেয়াদবী বলে ভাবতে পারেন। বস্ত্তত তাঁর নামে
মিথ্যা বলাই তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি বেয়াদবী ও দুশমনী। যে মিথ্যাকে শয়তানের প্ররোচনায়
মিথ্যাবাদী তাঁর মর্যাদার পক্ষে ভাবছে সে মিথ্যা মূলত তাঁর মর্যাদা-হানিকর। মিথ্যার
প্রতিরোধ করা, মিথ্যা নির্ণয় করা এবং মিথ্যা থেকে দূরে থাকা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেন্দ্রিক কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছি।
উৎসঃ
[1] মাও. আবুল
কালাম আযাদ, রাসূলে রহমত (বাংলা সংস্করণ, ই. ফা. বা), পৃ. ৬৯-৮০।
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অলৌকিক জন্মগ্রহণঃ
রাসূলুল্লাহ ﷺ অলৌকিকভাবে মাতৃগর্ভে
স্থান নেন এবং মাতৃগর্ভ থেকে অলৌকিকভাবে বের হয়ে আসেন মর্মে নানা রকমের গল্প প্রচলিত।
এগুলি সবই সনদবিহীন, দলীলবিহীন ও মনগড়া মিথ্যা। বিশ্বের কোনো গ্রন্থে এ মর্মে সনদ-সহ
কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস পাওয়া যায় না।
এখানে একটি কথা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক
হবে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে বা অজ্ঞতাবশত মনে করেন, অলৌকিকত্ব সম্ভবত
মর্যাদার মাপকাঠি। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। এ ভুল ধারণাকে পূঁজি করে খৃস্টান মিশনারিগণ
আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে অপপ্রচার চালান। তাদের একটি লিফলেটে বলা হয়েছে: কে বেশি
বড়: হযরত মুহাম্মাদ ﷺ না ঈসা মসীহ? ঈসা মসীহ বিনা পিতায় জন্মলাভ করেছেন আর মুহাম্মাদ
ﷺ-এর পিতা ছিল। ঈসা
মসীহ মৃতকে জীবিত করতেন কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ করতেন না। ঈসা মসীহ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেন নি কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন।... এভাবে মুসলিম আকীদার কিছু বিষয়কে
বিকৃত করে এবং প্রচলিত ভুল ধারণাকে পূঁজি করে তারা মুসলিম জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা
করছে।
অলৌকিকত্ব কখনোই মর্যাদার
মাপকাঠি নয়। নবীদেরকে আল্লাহ অলৌকিকত্ব বা মুজিযা প্রদান করেন হেদায়েতের প্রয়োজন অনুসারে,
মর্যাদা অনুসারে নয়। মর্যাদার মানদন্ড আল্লাহর ঘোষণা। এছাড়া দুনিয়ার ফলাফল আমরা
পর্যালোচনা করতে পারি। মিশনারি প্রতারণার একটি দিক দেখুন:
ঈসা (আ)-এর জন্ম অলৌকিক।
এছাড়া মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে বা কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করা ইত্যাদি মুজিযা তাকে প্রদান
করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি নয়। কারণ প্রথমত আল্লাহর
ঘোষণা। দ্বিতীয়ত জাগতিক ফলাফলও তা প্রমাণ করে। প্রচলিত বাইবেল থেকে বিচার করলে বলতে
হবে যে, হেদায়েতের ক্ষেত্রে ঈসা (আ)-এর দাওয়াতের ফল সবচেয়ে কম। আল্লাহর হুকুমে তিনি
রুগীকে সুস্থ করেছেন ও মৃতকে জীবিত করেছেন। বরং বাইবেল পড়লে মনে হয় জিনভুত ছাড়ানো ছাড়া
আর কোনো বিশেষ কাজই তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি অনেক অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করতে বা অনেক
মৃত হৃদয়কে জীবিত করেতে পারেন নি। আল্লাহর হুকুমে তিনি অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন,
কিন্তু বিশ্বাসে অন্ধকে চক্ষু দান করতে পারেন নি। মাত্র ১২ জন বিশেষ শিষ্যের বিশ্বাসও
এত দুর্বল ছিল যে, একজন তাঁকে কয়েকটি টাকার বিনিময়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করল এবং তাঁর
প্রধান শিষ্য তাঁর গ্রেফতারের পর পুলিশের ভয়ে তাঁকে অস্বীকার করেন ও গালি দেন! [1] কিতাবুল
মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম বইটি পড়ে বিস্তারিত জানুন।
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ তাঁর
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে অনেক অলৌকিকত্ব প্রদান করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অলৌকিকত্ব হলো লক্ষাধিক
মানুষকে বিভ্রান্তির অন্ধত্ব থেকে বিশ্বাসের আলোক প্রদান করা ও লক্ষাধিক মৃত হৃদয়কে
জীবন দান করা। কাজেই অলৌকিকত্ব সম্পর্কে মিথ্যা, দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য কথাবার্তাকে
গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, সেগুলোকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার মাপকাঠি বা নবুয়তের প্রমাণ মনে করা ইসলামের মূল চেতনার
বিপরীত। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা, নুবুওয়াত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে কুরআনই যথেষ্ট। এর
পাশাপাশি সহীহ হাদীসগুলির উপর আমরা নির্ভর করব। আমাদের মানবীয় বুদ্ধি, আবেগ বা যুক্তি
দিয়ে কিছু বাড়ানো বা কমানোর কোনো প্রয়োজন আল্লাহর দীনের নেই।
উৎসঃ
[1] পবিত্র
বাইবেল: মথি ২৬/২০-৭৫; মার্ক ১৪/১৭-৭২; লূক ২২/১-৬২; যোহন ১৮/১-২৭।
২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্ম থেকেই কুরআন জানতেনঃ
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন,
রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর
নামে একটি জাল কথা:
كَانَ
ﷺ عَالِماً
بِالْقُرْآنِ بِتَمَامِهِ
وَتَالِيًا لَهُ
مِنْ حِيْنِ
وَلاَدَتِهِ
‘‘তিনি জন্মলগ্ন থেকেই পুরো
কুরআন জানতেন এবং পাঠ করতেন।’’[1]
এ কথা শুধু মিথ্যাই নয়, কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের সুস্পষ্ট বিরোধী।
আল্লাহ বলেন: ‘‘আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি এবং ঈমান কি...’’[2] অন্যত্র
বলেন: ‘‘আপনি আশা করেন নি যে, আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এ তো কেবল আপনার প্রতিপালকের
অনুগ্রহ।’’[3]
উৎসঃ
[1] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৮।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[3] সূরা (২৮) কাসাস: ৮৬ আয়াত।
[2] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[3] সূরা (২৮) কাসাস: ৮৬ আয়াত।
৩. রাসুলূল্লাহ জন্ম থেকেই লেখা পড়া জানতেন!
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন:
ওয়ায়িজদের মিথ্যাচারের একটি নমুনা:
لَمْ
يَكُنْ ﷺ
أُمِّيًّا بَلْ
كَانَ قَادِراً
عَلَى الْكِتَابَةِ
وَالتِّلاَوَةِ مِنِ
ابْتِدَاءِ الْفِطْرَةِ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন না। তিনি প্রকৃতিগতভাবে শুরু থেকেই লিখতে
ও পড়তে সক্ষম ছিলেন।’’
এ কথাটিও ভিত্তিহীন মিথ্যা এবং তা কুরআনের সুস্পষ্ট বিরোধী। আল্লাহ
বলেন: ‘‘আপনি তো এর পূর্বে কোনো পুস্তক পাঠ করেন নি এবং নিজ হাতে কোনো পুস্তক লিখেন
নি যে, মিথ্যাচারীরা সন্দেহ পোষণ করবে।’’[1]
উৎসঃ
[1] সূরা
(২৯) আনকাবূত: ৪৮ আয়াত।
৪. আপনি না হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম নাঃ
এ ধরনের বানোয়াট কথগুলোর
একটি:
لَوْلاَكَ
لَمَا خَلَقْتُ
الأَفْلاَكَ
‘‘আপনি না হলে আমি আসমান
যমিন বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না।’’
আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস
একবাক্যে কথাটিকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ শব্দে এ বাক্য কোনো হাদীসের
গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয় নি।[1]
এখানে উল্লেখ্য যে, এ শব্দে
নয়, তবে এ অর্থে দুর্বল বা মাওযূ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
উৎসঃ
[1] আল্লামা
সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ ৫২; মোল্লা কারী, আল-আসরার পৃ. ১৯৪; আল-মাসনূ ১১৬; আল-আজলূনী,
কাশফুল খাফা ২/২১৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪৪১; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসারুল মারফূয়া,
পৃ. ৪৪।
৫. আরশের গায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নামঃ
উমার (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ বলেন,
لَمَّا
اقْتَرَفَ آَدَمُ
الْخَطِيْئَةَ قَالَ:
يَا رَبِّ،
أَسْأَلُكَ بِحَقِّ
مُحَمَّدٍ لَمَّا
غَفَرْتَ لِيْ.
فَقَالَ اللهُ:
يَا آَدَمُ،
وَكَيْفَ عَرَفْتَ
مُحَمَّداً وَلَمْ
أَخْلُقْهُ؟ قَالَ:
يَا رَبِّ،
لأَنَّكَ لَمَّا
خَلَقْتَنِيْ بِيَدِكَ
وَنَفَخْتَ فِيَّ
مِنْ رُوْحِكَ
رَفَعْتُ رَأْسِيْ
فَرَأَيْتُ عَلَى
قَوَائِمِ الْعَرْشِ
مَكْتُوْباً لاَ
إِلهَ إِلاَّ
اللهُ مُحَمَّدٌ
رَسُوْلُ اللهِ
فَعَلِمْتُ أَنَّكَ
لَمْ تُضِفْ
إِلَى اسْمِكَ
إِلاَّ أَحَبَّ
الْخَلْقِ إِلَيْكَ.
فَقَالَ اللهُ:
صَدَقْتَ يَا
آَدَمُ، إِنَّهُ
لأحَبُّ الْخَلْقِ
إِلَيَّ، ادْعُنِيْ
بِحَقِّهِ فَقَدْ
غَفَرْتُ لَكَ،
وَلَوْلاَ مُحَمَّدٌ
مَا خَلَقْتُكَ.
‘‘আদম (আ) যখন (নিষিদ্ধ গাছের
ফল খেয়ে) ভুল করে ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন: হে প্রভু, আমি
মুহাম্মাদের হক্ক (অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে (ﷺ) চিনলে, আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টিই করি নি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি
যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন
আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটি সমূহের উপর লিখা রয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর
রাসূলুল্লাহ’। এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলেই আপনি আপনার
নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই
আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তার হক্ক (অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে
ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ ﷺ না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।’’[1]
ইমাম হাকিম নাইসাপূরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। কিন্তু সকল
মুহাদ্দিস একমত যে হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাউযূ কিনা তাতে তাঁরা মতভেদ করেছেন। ইমাম
হাকিম নিজেই অন্যত্র এ হাদীসের বর্ণনাকারীকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
আমরা দেখেছি যে, হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইবনুল জাওযী অনেক
সহীহ বা হাসান হাদীসকে মাউযূ বলেছেন। এজন্য তাদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের কাছে গ্রহণযোগ্য
নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।
এ হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য
করলে দেখা যায় যে সনদটি খুবই দুর্বল, যে কারণে অনেক মুহাদ্দিস একে মাউযূ হাদীস বলে
গণ্য করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল-ফিহরী নামক
এক ব্যক্তি দাবী করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক একব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান
ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা, তার দাদা থেকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা
করেছেন।
বর্ণনাকারী আবুল হারিস একজন
অত্যন্ত দুর্বল রাবী। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৮২ হি) খুবই দুর্বল
ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নি। কারণ
তিনি কোনো হাদীস ঠিকমত বলতে পারতেন না, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নিজেই
তার ‘মাদখাল ইলাস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন:
عبد
الرحمن بن
زيد بن
أسلم روى
عن
أبيه
أحاديث
موضوعة
لا
يخفى
على
من
تأملها
من
أهل
الصنعة
أن
الحمل
فيها
عليه
‘‘আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ
ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে
যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির
অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।’’[2]
এ হাদীসটি উমার (রা) থেকে অন্য কোন তাবিয়ী বলেন নি, আসলাম থেকেও তাঁর
কোন ছাত্র তা বর্ণনা করেন নি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র
ছিল। তাঁর কোন ছাত্র এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শুধুমাত্র আব্দুর রহমান দাবী করেছেন
যে তিনি এ হাদীসটি তাঁর পিতার কাছে শুনেছেন। তাঁর বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা
করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম
যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম
বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে,
এ কথাটি মূলত ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী
বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এ কথাটি উমার (রা) এর নিজের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু আব্দুর রহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এ হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ
(ﷺ) এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।[3]
এ মর্মে আরেকটি যয়ীফ হাদীস
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের কথা হিসাবে হাকিম সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনু ওয়ালিক এর
সূত্রে বলেন, তাকে আমর্ ইবনু আউস আনসারী নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে
তাবি-তাবিয়ী সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাহ (১৫৭ হি) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দিআমাহ
আস-সাদূসী (১১৫ হি) বলেছেন, তাকে তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (৯১হি) বলেছেন, তাকে ইবনু
আববাস (রা) বলেছেন:
أَوْحَى
اللهُ
إِلَى
عِيْسَى
يَا
عِيْسَى
آَمِنْ
بِمُحَمَّدٍ
وَأْمُرْ
مَنْ
أَدْرَكَهُ
مِنْ
أُمَّتِكَ
أَنْ
يُؤْمِنُوْا
بِهِ
فَلَوْلاَ
مُحَمَّدٌ
مَا
خَلَقْتُ
آَدَمَ
وَلَوْلاَ
مُحَمَّدٌ
مَا
خَلَقْتُ
الْجَنَّةَ
وَلاَ
النَّارَ
وَلَقَدْ
خَلَقْتُ
الْعَرْشَ
عَلَى
الْمَاءِ
فَاضْطَرَبَ
فَكَتَبْتُ
عَلَيْهِ
لاَ
إِلَهَ
إِلاَّ
اللهُ
مُحَمَّدٌ
رَسُوْلُ
اللهِ
فَسَكَنَ.
‘‘মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-এর
প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপরে ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের
যারা তাঁকে পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ (ﷺ) না হলে আদমকে সৃষ্টি করতাম না। মুহাম্মাদ (ﷺ) না হলে জান্নাত ও জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না। আমি পানির উপরে আরশ
সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলাম: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।’’[4]
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম যাহাবী
প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘বরং হাদীসটি মাউযূ বলেই প্রতীয়মান হয়।’’ কারণ এর একমাত্র বর্ণনাকারী
এ ‘আমর্ ইবনু আউস আল-আনসারী’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিসের নামে হাদীসটি
বর্ণনা করেছে। অথচ তাঁদের অন্য কোনো ছাত্র এ হাদীসটি তাঁদের থেকে বর্ণনা করে নি। এ
লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। এ জানদাল ইবনু
ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনো রাবী তার নাম বলেন নি বা তার কোনো পরিচয়ও জানা যায় না। এজন্য
যাহাবী ও ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, এটি ইবনু আববাসের নামে বানানো জাল হাদীস।[5]
এ অর্থে আরো জাল হাদীস মুহাদ্দিসগণ
উল্লেখ করেছেন।[6]
হাদিসের উৎসঃ
[1] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭২।
[2] হাকিম, আল-মাদখাল, পৃ. ১৫৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫০; আলবানী, সিলসিলাতুয যায়ীফাহ ১/৯০।
[3] তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত ৬/৩১৩-৩১৪; আল-মু‘জামুস সাগীর ২/১৮২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭২; ইবন কাসির, তারীখ ২/৩২৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৫৩; আলবানী, সিলসিলাতু যায়ীফাহ ১/৮৮-৯৯; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ ১/২৩৭, আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৬, ২/২১৪, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার পৃ: ১৯৪, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৫/২২৭।
[4] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭১।
[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৯; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।
[6] যাহাবী, তারতীবু মাউদূ‘আত, পৃ ৭৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৪৪-২৪৫, ৩২৫।
[2] হাকিম, আল-মাদখাল, পৃ. ১৫৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৫০; আলবানী, সিলসিলাতুয যায়ীফাহ ১/৯০।
[3] তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত ৬/৩১৩-৩১৪; আল-মু‘জামুস সাগীর ২/১৮২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭২; ইবন কাসির, তারীখ ২/৩২৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৫৩; আলবানী, সিলসিলাতু যায়ীফাহ ১/৮৮-৯৯; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ ১/২৩৭, আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৬, ২/২১৪, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার পৃ: ১৯৪, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৫/২২৭।
[4] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৭১।
[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৯; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।
[6] যাহাবী, তারতীবু মাউদূ‘আত, পৃ ৭৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২৪৪-২৪৫, ৩২৫।
৬. খলীলুল্লাহ ও হাবীবুল্লাহঃ
প্রচলিত একটি হাদীসে বলা
হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
اِتَّخَذَ
اللهُ
إِبْرَاهِيْمَ
خَلِيْلاً
وَمُوْسَى
نَجِيًّا
وَاتَّخَذَنِيْ
حَبِيْباً
ثُمَّ
قَالَ
وَعِزَّتِيْ
وَجَلاَلِيْ
لأُوْثِرَنَّ
حَبِيْبِيْ
عَلَى
خَلِيْلِيْ
وَنَجِيِّيْ
‘‘আল্লাহ ইবরাহীমকে (আ) খালীল
(অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেছেন, মূসাকে (আ) নাজীই (একান্ত আলাপের বন্ধু) হিসাবে
গ্রহণ করেছেন এবং আমাকে হাবীব (প্রেমাস্পদ) হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বলেছেন,
আমার মর্যাদা ও মহিমার শপথ, আমি আমার হাবীবকে আমার খালীল ও নাজীই-এর উপরে অগ্রাধিকার
প্রদান করব।’’
হাদীসটি ইমাম বাইহাকী ‘শু‘আবুল ঈমান’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি তাঁর
সনদে বলেন, দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী মাসলামা ইবনু আলী আল-খুশানী (১৯০হি) বলেন, আমাকে
যাইদ ইবনু ওয়াকি, কাসিম ইবনু মুখাইমিরা থেকে, আবূ হুরাইরা থেকে বলেন...।’’ হাদীসটি
উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেন, ‘‘এ ‘মাসলামা ইবনু আলী’ মুহাদ্দিসগণের কাছে দুর্বল।’’[1]
মাসলামা ইবনু আলী নামক এ
রাবীকে মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ যুর‘আ, বুখারী ও অন্যান্য
মুহাদ্দিস তাকে ‘মুনকার’ বা আপত্তিকর বলেছেন। নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে
‘মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবীকেই মাতরূক বলেন।
হাকিম তাকে জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[2] এজন্য অনেক
মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন; কারণ একমাত্র এ পরিত্যক্ত রাবী ছাড়া কেউ
এ হাদীসটি বলেন নি। অপরপক্ষে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ বলে গণ্য করেছেন।[3]
এর বিপরীতে বুখারী, মুসলিম
ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ
ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- কেও ‘‘খালীল’’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:
إِنَّ
اللهَ
تَعَالى
قَدْ
اتَّخَذَنِيْ
خَلِيْلاً
كَمَا
اتَّخَذَ
إبراهيم
خليلا
‘‘মহান আল্লাহ আমাকে খালীল
(অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যেরূপ তিনি ইবরাহীমকে খালীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’’[4]
হাদিসের উৎসঃ
[1] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ২/১৮৫।
[2] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৯৭; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২০; ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ৩/৩৩-৩৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/১৩২-১৩৩; তাকরীব, পৃ. ৫৩১।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২১১-২১৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৩; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব,পৃ.১৫-১৬; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ১৫।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৭। আরো দেখুন, বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৭।
[2] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৯৭; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২০; ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ৩/৩৩-৩৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/১৩২-১৩৩; তাকরীব, পৃ. ৫৩১।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২১১-২১৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৭২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৩; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব,পৃ.১৫-১৬; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ১৫।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৭। আরো দেখুন, বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৭।
৭. আমি শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে...
জালিয়াতদের তৈরী একটি জঘন্য
মিথ্যা কথা:
أَنَا
خَاتِمُ
النَّبِيِّيْنَ،
لاَ
نَبِيَّ
بَعْدِيْ
إِلاَّ
أَنْ
يَشَاءَ
اللهُ
...
‘‘আমি শেষ নবী, আমার পরে
নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।’’
কুরআন কারীমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে শেষ নবী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ সকল
হাদীস-গ্রন্থে বিশুদ্ধতম সনদে সংকলিত অসংখ্য সাহাবী থেকে বর্ণিত অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে, তাঁর পরে কোনো নবী হবে না। তিনিই নবীদের অট্টালিকার
সর্বশেষ ইট। তিনিই নবীদের সর্বশেষ। তাঁর মাধ্যমে নবুওতের পরিসমাপ্তি।
কিন্তু এত কিছুর পরেও পথভ্রষ্টদের
ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি। মুহাম্মাদ ইবনু সাঈদ নামক দ্বিতীয় হিজরী শতকের এক যিনদীক বলে,
তাকে হুমাইদ বলেছেন, তাকে আনাস ইবনু মালিক বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘‘আমি শেষ নবী, আমার পরে নবী নেই, তবে আল্লাহ যদি চান।’’[1]
এ যিনদীক ছাড়া কেউই এ অতিরিক্ত
বাক্যটি ‘‘তবে আল্লাহ যদি চান’’ বলেন নি। কোনো হাদীসের গ্রন্থেও এ বাক্যটি পাওয়া যায়
না। শুধু এ যিনদীকের জীবনীতে ও মিথ্যা হাদীসের গ্রন্থে মিথ্যাচারের উদাহরণ হিসাবে এ
মিথ্যা কথাটি উল্লেখ করা হয়। তা সত্ত্বেও কাদীয়ানী বা অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়
এ মিথ্যা কথাটি তাদের বিভ্রান্তির প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে চায়।
সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের চিহ্ন
যে, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ ও অভিরুচি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর কাছে সমর্পিত।
এরই নাম ইসলাম। মুসলিম যখন হাদীসের কথা শুনেন তখন তাঁর একটি মাত্র বিবেচ্য: হাদীসটি
বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে কিনা। হাদীসের অর্থ তাঁর মতের বিপরীত বা পক্ষে তা নিয়ে তিনি
চিন্তা করেন না বরং নিজের মতকে হাদীসের অনুগত করে নেন। আর পথভ্রষ্টদের পরিচয় যে, তারা
নিজেদের অভিরুচি অনুসারে কোনো কথাকে গ্রহণ করে। এর বিপরীতে সকল কথা ব্যাখ্যা করে। এরা
কোনো কথা শুনলে তার অর্থ নিজের পক্ষে কিনা তা দেখে। এরপর বিভিন্ন বাতুল যুক্তিতর্ক
দিয়ে তা সমর্থন করে। কোনো কথা তার মতের বিপক্ষে হলে তা যত সহীহ বা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশই
হোক তারা তা বিভিন্ন ব্যাখ্য করে বিকৃত করে।
হাদিসের উৎসঃ
[1] ইবনুল
জাওযী, আল-মাউযূআত ১/২০৬, ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীআহ ১/৩২১, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৬৪।
নূর মুহাম্মাদীঃ
আরবী ভাষায় ‘নূর’ (نور) শব্দের অর্থ আলো, আলোকচ্ছটা, উজ্জ্বলতা (light, ray of light,
brightness) ইত্যাদি। আরবী, বাংলা ও সকল ভাষাতেই নূর, আলো বা লাইট যেমন জড় ‘আলো’ অর্থে
ব্যবহৃত হয়, তেমনি আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক আলো বা পথ প্রদর্শকের অর্থেও ব্যবহৃত
হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবী বলেন, ‘‘আরবী ভাষায় নূর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য
আলো বা জ্যোতিকে বলা হয়। অনুরূপভাবে রূপকার্থে সকল সঠিক ও আলোকজ্জ্বল অর্থকে ‘নূর’
বলা হয়। বলা হয়, অমূকের কথার মধ্যে নূর রয়েছে। অমুক ব্যক্তি দেশের নূর, যূগের সূর্য
বা যুগের চাঁদ...।’’[1]
নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি বর্তমান
মুসলিম সমাজে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে বিতর্ক ও হানাহানির অন্যতম বিষয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে
নূরের তৈরি বলে বিশ্বাস করা অনেক দীনদার আলিম ও মুমিনের দৃষ্টিতে ঈমানের অন্যতম শর্ত।
যারা তা বিশ্বাস করেন না তাঁদেরকে তাঁরা কাফির বা কাফিরের ন্যায় বিভ্রান্ত ও রাসূলুল্লাহ
ﷺ-এর দুশমন বলে গণ্য
করেন। এর বিপরীতে অন্য অনেক আলিম ও দীনদার মুমিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নূরের তৈরি বলে
মনে করাকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেন। বিশেষত, তাঁকে মহান আল্লাহর ‘যাত’ অর্থাৎ সত্ত্বার
নূর অথবা সিফাত অর্থাৎ বিশেষণের নূর-এর অংশ বলে বিশ্বাস করাকে তারা শিরক বলে গণ্য করেন।
এ বিষয়ক হাদীসগুলি আলোচনার পূর্বে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ
করছি:
(১) ‘রাসূলুল্লাহ
ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’-
এরূপ কোনো কথা কুরআন কারীমে নেই। কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায়
কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, নূর বলতে মুহাম্মাদ ﷺ- কে বুঝানো হয়েছে।
বিষয়টি আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
(২) ‘রাসূলুল্লাহ
ﷺ নূর দ্বারা সৃষ্ট’-
এ অর্থে প্রচলিত কিছু হাদীস আমরা আলোচনা করব। তবে লক্ষণীয় যে, মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ
হাদীসগ্রন্থগুলিতে এ বিষয়ে একটি হাদীসও পাওয়া যায় না। সুপ্রসিদ্ধ সিহাহ-সিত্তা, মুসনাদ
আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ শাফিয়ী, মুসনাদ আহমাদ ইত্যাদি প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলির
মধ্যে এ বিষয়ে কোনো হাদীসই পাওয়া যায় না।
(৩) রাসূলুল্লাহ
ﷺ সম্পর্কিত যে কোনো
একটি হাদীস অনেক হাদীস গ্রন্থে সংকলিত। বিশেষত ঈমান-আকীদা ও দীনের প্রয়োজনীয় হাদীসগুলো
মূলত সকল গ্রন্থেই সংকলিত। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রাকৃতিক কর্ম, পারিবারিক
সম্পর্ক বা তাঁর জীবনের অতি সামান্য বিষয়ের একটি হাদীস আমরা সিহাহ-সিত্তা সহ প্রায়
সকল গ্রন্থে দেখতে পাই। অথচ নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক কোনো হাদীস এ সকল গ্রন্থের একটি গ্রন্থেও
পাওয়া যায় না।
(৪) হাদীস
সংকলকগণ হাদীস গ্রন্থগুলিতে ঈমান, আকীদা, শারীয়াহ, আহকাম, পরিবার, প্রকৃতি ইত্যাদি
সকল বিষয়ের শিরোনাম দিয়ে অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন। ‘নূর মুহাম্মাদ’
বিষয়ক একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদ কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই।
(৫) উম্মাতের
ইমাম ও বুজুর্গগণ আকীদা ও ফিকহের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি তাদের গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু প্রসিদ্ধ তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, চার ইমাম-সহ ইসলামের প্রথম অর্ধ-সহস্র বৎসরের
মধ্যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমাম ও বুজুর্গগণ রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলিতে ‘নূর
মুহাম্মাদী’ বিষয়ক কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। শুধু ৪র্থ/৫ম হিজরী শতক থেকে শীয়াগণের
গ্রন্থে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক বক্তব্য পাওয়া যায়।
(৬) শীয়াগণের
মধ্যে প্রকাশিত নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক বক্তব্যগুলি ৬ষ্ঠ-৭ম হিজরী শতক থেকে সাধারণ মুসলিম
আলিমগণের মধ্যেও প্রচারিত হতে থাকে। পরবর্তী ৫০০ বৎসর এ বিষয়ক হাদীসগুলি ‘ফযীলত’ বিষয়ক
আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। শীয়াগণ ছাড়া অন্য কেউ একে আকীদার অন্তর্ভূক্ত করেন নি।
(৭) ইমাম
আযম আবূ হানীফা-সহ প্রসিদ্ধ চার ইমাম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় হাজার বৎসর যাবৎ
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ আকীদা বিষয়ে অগণিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। আকীদার
খুটিনাটি অতি সামান্য বিষয়ও তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘মুহাম্মাদ ﷺ নূরের তৈরি’ বলে
বিশ্বাস করাকে আকীদার বিষয় বলে কেউ উল্লেখ করেন নি।
(৮) কুরআন-হাদীসে
বারংবার বলা হয়েছে যে, মানুষ মাটির তৈরি। সৃষ্টির উপাদান বলতে মূলত প্রথম সৃষ্টিকেই
বুঝানো হয়। এরপর তার বংশধররেরা বংশ-পরম্পরায় সে উপাদান ধারণ করে। কুরআনে আদম (আ)-কে
মাটি থেকে সৃষ্টি করার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ জাগতিক প্রক্রিয়ায়
জন্মগ্রহণ করে। কাউকেই নতুন করে ‘মাটি’ দিয়ে তৈরি করা হয় না। তবে সকল মানুষকেই মাটির
তৈরি বলা হয়। আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ
قَالَ
رَبُّكَ
لِلْمَلائِكَةِ
إِنِّي
خَالِقٌ
بَشَرًا
مِنْ
صَلْصَالٍ
مِنْ
حَمَإٍ
مَسْنُونٍ
‘‘যখন তোমার রবব ফিরিশতাগণকে
বললেন, আমি ‘বাশার’ (মানুষ) সৃষ্টি করছি গন্ধযুক্ত কাদার শুস্ক ঠন্ঠনে মাটি হতে।’’[2]
আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
خُلِقَتِ
الْمَلاَئِكَةُ
مِنْ
نُورٍ
وَخُلِقَ
الْجَانُّ
مِنْ
مَارِجٍ
مِنْ
نَارٍ
وَخُلِقَ
آدَمُ
مِمَّا
وُصِفَ
لَكُمْ
‘‘ফিরিশতাগণকে নূর থেকে সৃষ্টি
করা হয়েছে, জিনকে সৃষ্টি করা নির্ধুম আগুনের শিখা থেকে, আর আদমকে কী থেকে সৃষ্টি করা
হয়েছে তা তো তোমাদের বলা হয়েছে।’’[3]
অর্থাৎ শুধু ফিরিশতাগণই নুর থেকে সৃষ্ট; কোনো মানুষ বা জিন নয়।
(৯) কুরআন-হাদীসে
বারংবার রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে ‘বাশার’ বা মানুষ বলা হয়েছে। কুরআন-হাদীসে ‘বাশার’ শব্দ অন্য কোনো
অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। কুরআন ও হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং অন্যান্য নবী-রাসূলের
মানুষ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বারংবার বলা হয়েছে। কাফিরগণ নবীগণের নুবুওয়াত
অস্বীকার করত এ কথা বলে যে, ‘তোমরা আমাদের মতই মানুষ’। এর প্রতিবাদে আল্লাহ বারংবার
বলেছেন, হ্যাঁ, নবীগণ তোমাদের মতই মানুষ, তবে তাঁরা আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত মানুষ।[4]
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাশারিয়্যাত বা
মানুষ হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
قُلْ
إِنَّمَا
أَنَا
بَشَرٌ
مِثْلُكُمْ
يُوحَى
إِلَيَّ
أَنَّمَا
إِلَهُكُمْ
إِلَهٌ
وَاحِدٌ
‘‘বলুন, আমি তোমাদের মত মানুষ
মাত্র; আমার কাছে ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ।’’[5]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
قُلْ
سُبْحَانَ
رَبِّي
هَلْ
كُنْتُ
إِلَّا
بَشَرًا
رَسُولا
‘‘বলুন: সুবহানাল্লাহ! আমি
তো একজন মানুষ রাসূল বৈ কিছুই নই।’’[6]
বিভিন্ন হাদীসেও রাসূলুল্লাহ ﷺ বারংবার বলেছেন, আমি মানুষ
মাত্র, আমি তোমাদের মতই মানুষ...। কুরআন ও হাদীসের এ সকল বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান যে,
মানুষ হিসেবে রাসূলুল্লাহ ﷺ মাটির উপাদান থেকেই সৃষ্ট।
এখন প্রশ্ন হলো, এ সকল বক্তব্যের বিপরীতে কুরআন-হাদীসে অন্য কোনো বক্তব্য দ্বারা কি
ব্যতিক্রম কিছু প্রমাণিত হয়? আমরা এখানে বিষয়টি আলোচনা করব।
হাদিসের উৎসঃ
[1] কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৫৬।
[2] সূরা (১৫): হিজর: ২৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩৮) সাদ: ৭১ আয়াত।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪, নং ২৯৯৬।
[4] সূরা (১১) হূদ: ২৭; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১; সূরা (১৭) ইসরা/বানী ইসরাইল: ৯৩-৯৪; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩; সূরা (২৩) মুমিনুন: ২৪, ৩৩-৩৪; সূরা (২৬) শুআরা: ১৫৪; ১৮৬; সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ১৫; সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬।
[5] সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত এবং সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬ আয়াত।
[6] সূরা (১৭) ইসরা/বনী ইসরাঈল: ৯৩।
[2] সূরা (১৫): হিজর: ২৮ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩৮) সাদ: ৭১ আয়াত।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪, নং ২৯৯৬।
[4] সূরা (১১) হূদ: ২৭; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১০-১১; সূরা (১৭) ইসরা/বানী ইসরাইল: ৯৩-৯৪; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৩; সূরা (২৩) মুমিনুন: ২৪, ৩৩-৩৪; সূরা (২৬) শুআরা: ১৫৪; ১৮৬; সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ১৫; সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬।
[5] সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত এবং সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৬ আয়াত।
[6] সূরা (১৭) ইসরা/বনী ইসরাঈল: ৯৩।
(ক) আল-কুরআন ও নূর মুহাম্মাদীঃ
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে
নিজেকে ‘নূর’ বলেছেন:
اللهُ
نُورُ
السَّمَاوَاتِ
وَالأَرْضِ
...
‘‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর
নূর (জ্যোতি)..... ’’[1]
ইমাম তাবারী বলেন: ‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ একথা বলতে আল্লাহ
বুঝাচ্ছেন যে, তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যকার সকলের হাদী বা পথ প্রদর্শক। তাঁরই
নূরেই তাঁরা সত্যের দিকে সুপথপ্রাপ্ত হয়।... ইবনু আববাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:
‘আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর’ অর্থ তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিবাসীদের হাদী
বা পথ-প্রদর্শক।... আনাস থেকে বর্ণিত, আল্লাহ বলছেন, আমার হেদায়াতই আমার নূর...।’’[2]
আল্লাহ বারবার দ্ব্যার্থহীনভাবে
কুরআনকে নূর বলেছেন। তিনি বলেন:
الَّذِينَ
يَتَّبِعُونَ
الرَّسُولَ
النَّبِيَّ
الأُمِّيَّ
... فَالَّذِينَ
آمَنُوا
بِهِ
وَعَزَّرُوهُ
وَنَصَرُوهُ
وَاتَّبَعُوا
النُّورَ
الَّذِي
أُنزِلَ
مَعَهُ
أُوْلَئِكَ
هُمْ
الْمُفْلِحُونَ
‘‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক
এ উম্মী নবীর...যারা তাঁর উপর ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তাঁর
সাথে যে নূর (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।’’[3]
অন্যত্র কুরআনকে ‘রূহ’ ও ‘নূর’ বলা হয়েছে:
وَكَذَلِكَ
أَوْحَيْنَا
إِلَيْكَ
رُوحًا
مِنْ
أَمْـرِنَا
مَا
كُنْتَ
تَدْرِي
مَا
الْكِتَابُ
وَلا
الإِيمَانُ
وَلَكِنْ
جَعَلْنَاهُ
نُورًا
نَهْدِي
بِهِ
مَنْ
نَشَاءُ
مِنْ
عِبَادِنَا
‘‘এভাবে আমি আপনার প্রতি
প্রত্যাদেশ করেছি রূহ (আত্মা), আমার নির্দেশ থেকে, আপনি তো জানতেন না যে, কিতাব কি
এবং ঈমান কি! কিন্তু আমি একে (এ রূহ বা আল-কুরআনকে) নূর বানিয়ে দিয়েছি, যা দিয়ে আমি
আমার বানদাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পর্থ-নির্দেশ করি...।’’[4]
অন্যত্র মূসা (আ) এর উপর অবর্তীণ তাওরাতকেও নূর বলা হয়েছে:
قُلْ
مَنْ
أَنْزَلَ
الْكِتَابَ
الَّذِي
جَاءَ
بِهِ
مُوسَى
نُورًا
وَهُدًى
لِلنَّاسِ
‘‘বলুন, তবে কে নাযিল করেছিল
মূসার আনীত কিতাব, যা মানুষের জন্য নূর (আলো) ও হেদায়াত (পথ-প্রদর্শন) ছিল।’’[5]
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, তাওরাত ও ইনজীলের মধ্যে নূর ছিল:
إِنَّا
أَنزَلْنَا
التَّوْرَاةَ
فِيهَا
هُدًى
وَنُورٌ...وَآتَيْنَاهُ
الْإِنجِيلَ
فِيهِ
هُدًى
وَنُورٌ
‘‘আমি অবতীর্ণ করেছি তাওরাত,
যার মধ্যে হেদায়াত ও নূর ... আমি তাকে (ঈসাকে) প্রদান করেছি ইনজীল যার মধ্যে হেদায়াত
ও নূর...।[6]
কুরআনে আরো কয়েকটি স্থানে ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ শব্দ বা বাক্যাংশ
ব্যবহৃত। যেমন এক স্থানে বলেছেন:
يُرِيدُونَ
لِيُطْفِئُوا
نُورَ
اللَّهِ
بِأَفْوَاهِهِمْ
وَاللَّهُ
مُتِمُّ
نُورِهِ
وَلَوْ
كَرِهَ
الْكَافِرُونَ
‘‘তারা ‘আল্লাহর নূর’ ফুৎকারে
নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ ‘তাঁর নূর’ পূর্ণ করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’’[7]
এখানে ‘আল্লাহর নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণের বিভিন্ন
মত রয়েছে। আল্লামা কুরতুবী বলেন: এখানে ‘আল্লাহর নূরের’ ব্যাখ্যায় ৫টি মত রয়েছে: (১)
আল্লাহর নূর অর্থ আল-কুরআন, কাফিররা কথার দ্বারা তা বাতিল করতে ও মিথ্যা প্রমাণ করতে
চায়। ইবনু আববাস ও ইবনু যাইদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। (২) আল্লাহর নূর অর্থ ইসলাম,
কাফিররা কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। সুদ্দী এ কথা বলেছেন। (৩) আল্লাহর
নূর অর্থ মুহাম্মাদ (ﷺ), কাফিররা অপপ্রচার ও নিন্দাচারের মাধ্যমে তাঁর ধ্বংস চায়। দাহ্হাক
এ কথা বলেছেন। (৪) আল্লাহর নূর অর্থ আল্লাহর দলীল-প্রমাণাদি, কাফিররা সেগুলো অস্বীকার
করে মিটিয়ে দিতে চায়। ইবনু বাহর এ কথা বলেছেন। (৫) আল্লাহর নূর অর্থ সূর্য। অর্থাৎ
ফুৎকারে সূর্যকে নেভানোর চেষ্টা করার মত বাতুল ও অসম্ভব কাজে তারা লিপ্ত। ইবনু ঈসা
এ কথা বলেছেন।[8]
كِتَابٌ
أَنزَلْنَاهُ
إِلَيْكَ
لِتُخْرِجَ
النَّاسَ
مِنْ
الظُّلُمَاتِ
إِلَى
النُّورِ
‘‘এ কিতাব। আমি তা আপনার
প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন...।’’[9]
এখানে স্বভাবতই অন্ধকার ও আলো বলতে ‘জড়’ কিছু বুঝানো হয় নি। এখানে অন্ধকার
বলতে অবিশ্বাসের অন্ধকার এবং আলো বলতে আল-কুরআন অথবা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য
আয়াতেও ‘নূর’ বা ‘আল্লাহর নূর’ বলতে ‘কুরআন’, ‘ইসলাম’ বা ‘মুহাম্মাদ ﷺ’ অর্থ গ্রহণ করেছেন মুফাস্সিরগণ[10]। এ ধরনের একটি
আয়াত:
يَا
أَهْلَ
الْكِتَابِ
قَدْ
جَاءَكُمْ
رَسُولُنَا
يُبَيِّنُ
لَكُمْ
كَثِيرًا
مِمَّا
كُنْتُمْ
تُخْفُونَ
مِنَ
الْكِتَابِ
وَيَعْفُو
عَنْ
كَثِيرٍ
قَدْ
جَاءَكُمْ
مِنَ
اللَّهِ
نُورٌ
وَكِتَابٌ
مُبِينٌ.
يَهْدِي
بِهِ
اللَّهُ
مَنِ
اتَّبَعَ
رِضْوَانَهُ
سُبُلَ
السَّلامِ
وَيُخْرِجُهُمْ
مِنَ
الظُّلُمَاتِ
إِلَى
النُّورِ
بِإِذْنِهِ
وَيَهْدِيهِمْ
إِلَى
صِرَاطٍ
مُسْتَقِيمٍ.
‘‘হে কিতাবীগণ, আমার রাসূল
তোমাদের কাছে এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি তার অনেক কিছু তোমাদের কাছে
প্রকাশ করেন এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করেন। তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে এক নূর
ও সুস্পষ্ট কিতাব। হেদায়াত করেন আল্লাহ তদ্বারা যে তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে তাকে
শান্তির পথে এবং বের করেন তাদেরকে অন্ধকার থেকে নূরের দিকে তাঁর অনুমতিতে এবং হেদায়াত
করেন তাদের সঠিক পথে।’’[11]
এ আয়াতে ‘নূর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাস্সিরগণ মতভেদ করেছেন।
কেউ বলেছেন, নূর অর্থ কুরআন, কেউ বলেছেন, ইসলাম, কেউ বলেছেন, মুহাম্মাদ ﷺ। এ তিন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। সবাই সঠিক পথের আলোক বর্তিকা
বা হেদায়াতের নূর বুঝিয়েছেন।[12]
যারা এখানে নূর অর্থ কুরআন
বুঝিয়েছেন, তাঁদের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ: (১) এ আয়াতের প্রথমে যেহেতু
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলা হয়েছে, সেহেতু শেষে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে ‘কুরআনকে’
বুঝানো হয়েছে। (২) কুরআনে বিভিন্ন স্থানে কুরআনকে ব্যাখ্যাতীতভাবে
‘নূর’ এবং ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলা হয়েছে। কাজেই এখানেও দুটি বিশেষণ দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো
হয়েছে। (৩) দুটি শব্দ দ্বারা একই বিষয় বুঝানো কুরআনের একটি রীতি। যেমন আল্লাহ বলেন:
‘আমি মূসাকে কিতাব ও ফুরকান প্রদান করি’[13]। এখানে কিতাব ও ফুরকান বলতে একই কিতাব
‘তাওরাত’ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে উপরের আয়াতেও ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই
কিতাব ‘কুরআন’-কে বুঝানো হয়েছে। (৪) পরের আয়াতে এ দুটি বিষয়ের জন্য
এক বচনের সর্বনাম ব্যবহার করে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যদ্বারা’। এ থেকে
বুঝা যায় যে, এখানে ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে একই জিনিস বুঝানো হয়েছে যদ্বারা
আল্লাহ যাকে চান হেদায়াত করেন। ‘নূর’ ও ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ উভয়কে বুঝাতে ‘‘একবচনের’’
সর্বনাম ব্যবহার নিশ্চিত প্রমাণ যে, এখানে উভয় বিশেষণ দ্বারা একটি বিষয় নির্দেশ করা
হয়েছে। (৫) এখানে আল্লাহ বলেছেন: ‘হেদায়াত করেন আল্লাহ যাহা দ্বারা’:
কুরআনের পরিভাষায় এ কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; বরং কুরআনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেন নি যে, তিনি
মুহাম্মাদ ﷺ-কে
দিয়ে কাউকে হেদায়াত করেন; বরং বলেছেন যে, তিনি কুরআন দিয়ে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন।[14]
যারা ‘নূর’ অর্থ ইসলাম বলেছেন,
তাঁদের বক্তব্য: এ আয়াতে প্রথমে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর
কথা এবং শেষে কিতাব বা কুরআনের কথা বলা হয়েছে। কাজেই মাঝে নূর বলতে ইসলামকে বুঝানো
স্বাভাবিক। এ ছাড়া কুরআনে অনেক স্থানে ‘নূর’ বলতে ইসলাম বুঝানো হয়েছে। আরবীতে ‘আলো’
বুঝাতে দুটি শব্দ রয়েছে: ‘দিয়া (ضياء) ও নূর (نور)। প্রথম আলোর মধ্যে উত্তাপ রয়েছে, আর দ্বিতীয় আলো স্নিগ্ধতাপূর্ণ আলো।
পূর্ববর্তী শরীয়াতগুলোর বিধানের মধ্যে কাঠিন্য ছিল। পক্ষান্তরে ইসলামী শরীয়তের সকল
বিধিবিধান সহজ ও জীবনমুখী। এজন্য ইসলামী শরীয়তকে নূর বলা হয়েছে।[15]
যারা এখানে ‘নূর’ অর্থ ‘মুহাম্মাদ
(ﷺ) বুঝিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন যে, ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে কুরআনকে বুঝানো
হয়েছে। কাজেই ‘নূর’ বলতে মুহাম্মাদ ﷺ-কে বুঝানো সম্ভব। এ বিষয়ে ইমাম তাবারী বলেন:
يَعْنِيْ
بِالنُّوْرِ
مُحَمَّداً
ﷺ
الَّذِيْ
أَنَارَ
اللهُ
بِهِ
الْحَقَّ
وَأَظْهَرَ
بِهِ
الإِسْلاَمَ
وَمَحَقَ
بِهِ
الشِّرْكَ
فَهُوَ
نُوْرٌ
لِمَنِ
اسْتَنَارَ
بِهِ
يُبَيِّنُ
الْحَقَّ
وَمِنْ
إِنَارَتِهِ
الْحَقَّ
تَبْيِيْنُهُ
لِلْيَهُوْدِ
كَثِيْراً
مِمَّا
كَانُوا
يُخْفُوْنَ
مِنَ
الْكِتَابِ.
‘‘নূর (আলো) বলতে এখানে
‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বুঝানো হয়েছে, যাঁর দ্বারা আল্লাহ হক্ক বা সত্যকে আলোকিত করেছেন,
ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং শির্ককে মিটিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা আলোকিত
হতে চায় তার জন্য তিনি আলো। তিনি হক্ক বা সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর হক্ককে আলোকিত করার
একটি দিক হলো যে, ইহূদীরা আল্লাহর কিতাবের যে সকল বিষয় গোপন করত তার অনেক কিছু তিনি
প্রকাশ করেছেন।’’[16]
এছাড়া কুরআনে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ‘নূর-প্রদানকারী প্রদীপ’ বলা হয়েছে:
يَا
أَيُّهَا
النَّبِيُّ
إِنَّا
أَرْسَلْنَاكَ
شَاهِدًا
وَمُبَشِّرًا
وَنَذِيرًا
وَدَاعِيًا
إِلَى
اللَّهِ
بِإِذْنِهِ
وَسِرَاجًا
مُنِيرًا
‘‘হে নবী, আমি আপনাকে পাঠিয়েছি
সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে
এবং আলোকোজ্জ্বল (নূর-প্রদানকারী) প্রদীপরূপে।[17]
এভাবে আমরা দেখলাম যে, কুরআনে সঠিক পথের নির্দেশক হিসেবে কুরআনকে ‘নূর’
বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো কোনো আয়াতে ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কুরআনের এ সকল
বর্ণনা থেকে বুঝা যায় না যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, কুরআন বা ইসলাম নূরের তৈরী বা নূর থেকে সৃষ্ট। আমরা বুঝতে পারি যে,
এখানে কোনো সৃষ্ট, জড় বা মূর্ত নূর বা আলো বুঝানো হয় নি। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ, ইসলাম ও কুরআন কোনো জাগতিক,
‘জড়’, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা মূর্ত ‘আলো’ নয়। এ হলো বিমূর্ত, আত্মিক, আদর্শিক ও সত্যের
আলোকবর্তিকা, যা মানুষের হৃদয়কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে বিশ্বাস, সত্য
ও সুপথের আলোয় জ্যোতির্ময় করে।
উৎসঃ
[1] সূরা (২৪) নূর: ৩৫ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর ১৮/১৩৫। আরো দেখুন, ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/২৯০।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৫৭ আয়াত।
[4] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন্‘আম: ৯১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ ও ৪৬ আয়াত।
[7] সূরা (৬১) সাফ: ৮ আয়াত। পুনশ্চ, সূরা (৯) তাওবা: ৩২ আয়াত।
[8] কুরতুবী, তাফসীর ১৮/৮৫।
[9] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১ আয়াত।
[10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৭; সূরা (৪) নিসা: ১৭৪; সূরা (৫) মায়িদা: ১৬; সূরা (৬) আন‘আম: ১২২; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৫; সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৩; সূরা (৫৭) হাদীদ: ২৮ আয়াত ...।
[11] সূরা (৫) মায়িদা: ১৫-১৬ আয়াত।
[12] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১; কুরতুবী, তাফসীর ৬/১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[13] সূরা (২) বাকারা: ৫৩ আয়াত।
[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[15] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১৯।
[16] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১।
[17] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫-৪৬ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর ১৮/১৩৫। আরো দেখুন, ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/২৯০।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৫৭ আয়াত।
[4] সূরা (৪২) শূরা: ৫২ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন্‘আম: ৯১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ ও ৪৬ আয়াত।
[7] সূরা (৬১) সাফ: ৮ আয়াত। পুনশ্চ, সূরা (৯) তাওবা: ৩২ আয়াত।
[8] কুরতুবী, তাফসীর ১৮/৮৫।
[9] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ১ আয়াত।
[10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৭; সূরা (৪) নিসা: ১৭৪; সূরা (৫) মায়িদা: ১৬; সূরা (৬) আন‘আম: ১২২; সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৫; সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৩; সূরা (৫৭) হাদীদ: ২৮ আয়াত ...।
[11] সূরা (৫) মায়িদা: ১৫-১৬ আয়াত।
[12] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১; কুরতুবী, তাফসীর ৬/১১৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[13] সূরা (২) বাকারা: ৫৩ আয়াত।
[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৫।
[15] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২১৯।
[16] তাবারী, তাফসীর ৬/১৬১।
[17] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫-৪৬ আয়াত।
(খ) হাদীস শরীফে নূর মুহাম্মাদীঃ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থে কিছু হাদীস প্রচলিত রয়েছে। একথা
ঠিক যে, সৃষ্টির মর্যাদা আল্লাহর ঘোষণায় ও তার নিজের কর্মের মধ্যে নিহিত, তার সৃষ্টির
উপাদান, বংশ ইত্যাদিতে নয়। এজন্য আগুনের তৈরী জিন ও নূরের তৈরী ফিরিশতার চেয়ে মাটির
তৈরী মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বেশি মর্যাদাবান। এরপরও যখন আমরা জানতে পারি যে, সৃষ্টির
উপাদানেও আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে তখন আমাদের তা ভাল লাগে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর
মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো কথা তা যতই ভাল লাগুক, তা গ্রহণের আগে তার বিশুদ্ধতা
যাচাই করা। কোনো কথাকে তার অর্থের ভিত্তিতে নয়, বরং সাক্ষ্য প্রমাণের বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে
প্রথমে বিচার করা হয়। এরপর তার অর্থ বিচার করা হয়। লক্ষণীয় যে, এ অর্থের অধিকাংশ হাদীস
একেবারেই ‘সনদবিহীন’ জাল কথা এবং কিছু হাদীস ‘সনদওয়ালা’ জাল কথা।
৮. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র দাঁতের নূরঃ
فِيْ
لَيْلَةٍ
مِنَ
اللَّيَالِيْ
سَقَطَتْ
مِنْ
يَدِ
عَائِشَةَ
إِبْرَتُهَا
فَفُقِدَتْ
فَالْتَمَسَتْهَا
وَلَمْ
تَجِدْ
فَضَحِكَ
النَّبِيُّ
ﷺ
وَخَرَجَتْ
لُمْعَةُ
أَسْنَانِهِ
فَأَضَاءَتِ
الْحُجْرَةَ
وَرَأَتْ
عَائِشَةُ
بِذَلِكَ
الضَّوْءِ
إِبْرَتَهَا
‘‘এক রাতে আয়েশা (রা)-এর
হাত থেকে তাঁর সূচটি পড়ে যায়। তিনি তা হারিয়ে ফেলেন এবং খোঁজ করেও পান নি। তখন নবীজী
(ﷺ) হেসে উঠেন এবং তাঁর দাঁতের আলোকরশ্মি বেরিয়ে পড়ে। এতে ঘর আলোকিত হয়ে
যায় এবং সে আলোয় আয়েশা (রা) তাঁর সূচটি দেখতে পান।’’
এটি একটি সনদবিহীন ভিত্তিহীন মিথ্যা কাহিনী। আমরা দেখেছি যে, অনেক আলিম
সহীহ কথার সাথে অনেক বাতিল কথাও সংকলন করেন। এতে অনেক সময় সাধারণ মুসলিম বিভ্রান্ত
হন। যেমন দশম হিজরী শতকের একজন আলিম মোল্লা মিসকীন মুহাম্মাদ আল-ফিরাহী (৯৫৪ হি) কর্তৃক
ফার্সী ভাষায় লিখিত ‘মা‘আরিজুন নুবুওয়াত’ নামক সীরাতুন্নবী বিষয়ক
একটি গ্রন্থ এক সময় ভারতে প্রসিদ্ধ ছিল। এ গ্রন্থে উপরের মিথ্যা হাদীসটি সংকলিত রয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লামা লাখনবী বলেন: ‘‘এ কথা ঠিক যে, এ জাল কথাটি ‘মা‘আরিজুন
নুবুওয়াত’ ও আরো অন্যান্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থে সংকলিত। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ
শুকনো-ভিজে সবকিছুই জমা করতেন। কাজেই এ সকল বইয়ের সব কথার উপরে শুধু ঘুমন্ত বা ক্লান্ত
(অজ্ঞ বা অসচেতন) মানুষেরাই নির্ভর করতে পারে। ...’’[1]
উৎসঃ
[1] আব্দুল
হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪৫-৪৬।
৯. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী (রা) নূর থেকে
সৃষ্টঃ
خُلِقْتُ
أَنَا
وَعَلِيٌّ
مِنْ
نُوْرٍ،
وَكُنَّا
عَنْ
يَمِيْنِ
الْعَرْشِ
قَبْلَ
أَنْ
يَخْلُقَ
اللهُ
آدمَ
بِأَلْفَيْ
عَامٍ،
ثُمَّ
خَلَقَ
اللهُ
آَدَمَ
فَانْقَلَبْنَا
فِيْ
أَصْلاَبِ
الرِّجَالِ.
‘‘আমাকে ও আলীকে নূর থেকে
সৃষ্টি করা হয়। আদমের সৃষ্টির ২ হাজার বৎসর পূর্বে আমরা আরশের ডান পার্শ্বে ছিলাম।
অতঃপর যখন আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন তখন আমরা মানুষদের ঔরসে ঘুরতে লাগলাম।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি একটি মিথ্যা ও জাল হাদীস। জা’ফর ইবনু আহমাদ
ইবনু আলী আল-গাফিকী নামক একজন মিথ্যাবাদী জালিয়াত এ হাদীসটি বানিয়েছে এবং এর জন্য একটি
সনদও সে বানিয়েছে।[1]
হাদিসের উৎসঃ
[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২৫৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২০;
ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৫১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪৩৪।
১০. রাসূলুল্লাহকে ﷺ আল্লাহর নূর, আবূ বকরকে
তাঁর নূর... থেকে সৃষ্টিঃ
‘‘আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর
থেকে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বাক্রকে আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বাকরের নূর
থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মাতকে উমারের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন...।’’
এটি একটি সনদ-সহ জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি মিথ্যা ও বানোয়াট।
আহমাদ ইবনু ইউসূফ আল-মানবিযী নামক এক ব্যক্তি এ মিথ্যা কথাটির প্রচারক। সে এ কথাটির
একটি সুন্দর সনদও বানিয়েছে।[1]
এ অর্থে আরেকটি বানোয়াট কথা:
‘‘আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর
থেকে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বাক্রকে আমার নূর থেকে, উমারকে আবূ বাকরের নূর থেকে এবং নবী-রাসূল
ব্যতীত মুমিনগণের সকলকেই উমারের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।’’[2]
এ অর্থে আরেকটি ভিত্তিহীন কথা:
‘‘আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর
থেকে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বাক্রকে আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন, উমার ও আয়েশাকে আবূ
বাকরের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন আর আমার উম্মাতের মুমিন পুরুষগণকে উমারের নূর থেকে এবং
মুমিন নারীগণকে আয়েশার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।’’[3]
হাদিসের উৎসঃ
[1] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩১৪; ইবনু হাজার,
লিসানুল মীযান ১/৩২৮; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৭।
[2] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ১/১৭১।
[3] কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৮৬।
[2] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ১/১৭১।
[3] কুরতুবী, তাফসীর ১২/২৮৬।
১১. আল্লাহর মুখমন্ডলের নূরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সৃষ্টি:
নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক সম্পূর্ণ
সনদবিহীন একটি জাল কথা:
خَلَقْتُ
مُحَمَّداً
مِنْ
نُوْرِ
وَجْهِيْ
‘‘আমি মুহাম্মাদকে আমার মুখমন্ডলের
নূর থেকে সৃষ্টি করেছি।’’[1]
উৎসঃ
উৎসঃ
[1] সিররুল আসরার, পৃ. ১০।
১২. রাসূলুল্লাহর নূরে ধান-চাউল সৃষ্টি!
জালিয়াতদের বানানো আরেকটি
মিথ্যা কথা:
الأَرُزُّ
مِنِّي
وأنا
مِنَ
الأَرُزِّ
خُلِقَتِ
الأَرُزُّ
مِنْ
بَقِيَّةِ
نُوْرِيْ
‘‘চাউল আমা হতে এবং আমি চাউল
থেকে। আমার অবশিষ্ট নূর থেকে চাউলকে সৃষ্টি করা হয়।’’[1]
উৎসঃ
উৎসঃ
[1] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৬৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৪৭; শাওকানী,
আল-ফাওয়াইদ ১/২১১।
১৩. ঈমানদার মুসলমান আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টিঃ
দাইলামী (৫০৯) তার ‘আল-ফিরদাউস’
নামক পুস্তকে ইবনু আববাস (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন:
اَلْمُؤْمِنُ
يَنْظُرُ
بِنُوْرِ
اللهِ
الَّذِيْ
خُلِقَ
مِنْه
‘‘মুমিন আল্লাহর নূরের দ্বারা
দৃষ্টিপাত করেন, যে নূর থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’[1]
এটি একটি সনদ-বিশিষ্ট জাল হাদীস। এর একমাত্র রাবী মাইসারাহ ইবনু আব্দু
রাবিবহ দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ জালিয়াত। ইমাম বুখারী, আবূ দাউদ,
আবূ হাতিম, ইবনু হিববান-সহ সকল মুহাদ্দিস
এ বিষয়ে একমত। তাঁরা তার ‘রচিত’ অনেক জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।[2]
উৎসঃ
উৎসঃ
[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৪/১৭৮; সাখাবী,
আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৩৬; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৯০।
[2] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৫৭৪-৫৭৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৩৮-১৩৯।
[2] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৫৭৪-৫৭৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৩৮-১৩৯।
১৪. নূর মুহাম্মাদীর ময়ূর রূপে থাকা:
এ বিষয়ক প্রচলিত অন্যান্য
কাহিনীর মধ্যে রয়েছে নূর মুহাম্মাদীকে ময়ূর আকৃতিতে রাখা। এ বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন।
কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসের গ্রন্থে এর কোনো প্রকার সনদ, ভিত্তি বা উল্লেখ পাওয়া
যায় না। বিভিন্ন ভাবে গল্পগুলো লেখা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা শাজারাতুল ইয়াকীন নামক
একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নূর মোবরককে একটি ময়ূর আকৃতি দান করত স্বচ্ছ ও শুভ্র মতির পর্দার
ভিতরে রেখে তাকে সে বৃক্ষে স্থাপন করলেন... ক্রমান্বয়ে সে নূর থেকে সব কিছু সৃষ্টি
করলেন... রূহগণকে তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করতে নির্দেশ দিলেন.. ইত্যাদি...। জাল হাদীসের
জাল বই ছাড়া কোথাও এর সনদ পাওয়া যায় না।
১৫. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তারকা-রূপে ছিলেন:
আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা,
রাসূলুল্লাহ ﷺ আদম সৃষ্টির পূর্বে তারকারূপে বিদ্যমান ছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন
ভাষ্য প্রচলিত। যেমন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ফাতেমাকে (রা) বলেন, জিবরাঈল তোমার ছোট চাচা ...। এ বিষয়ে প্রচলিত
সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ একটি ইসলামী কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত
একটি খুতবার বইয়ে লেখা হয়েছে:
উপরের কথাগুলোর অনুবাদে উক্ত
পুস্তকে বলা হয়েছে: ‘‘হযরত আবূ হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম (ﷺ) হযরত জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? তিনি
উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি
যে, চতুর্থ পর্দায় (আসমানে) একটি সিতারা আছে যা প্রতি ৭০ হাজার বছর পর সেখানে উদিত
হয়। আমি উহা এ যাবত ৭০ হাজার বার[1] উদিত হতে দেখেছি। এতদশ্রবণে হুজুর
(ﷺ) বল্লেন, হে জিব্রাঈল, শপথ মহান আল্লাহর ইজ্জতের, আমি সেই সিতারা।
(বুখারী শরীফ)।’’[2]
এ সকল কথা সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা যা হাদীস নামে প্রচলিত।[3] তবে
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এ ভিত্তিহীন কথাটিকে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে চালানো
হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, সীরাহ হালাবিয়া গ্রন্থের লেখক একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের উপর নির্ভর
করে এ জাল হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আমরা কি একটু যাচাই করব না? এ সকল ইসলামী
কেন্দ্রে এমন অনেক আলিম রয়েছেন যারা যুগ যুগ ধরে ‘বুখারী’ পড়াচ্ছেন। বুখারী শরীফের
অনেক কপি সেখানে বিদ্যমান। কিন্তু কেউই একটু কষ্ট করে পুস্তকটি খুলে দেখার চেষ্টা করলেন
না। শুধু সহীহ বুখারীই নয়, ‘তারীখ বুখারী’, বুখারীর লেখা বা অন্য কারো লেখা কোনো গ্রন্থেই
এ কথাটি সনদ-সহ বর্ণিত হয় নি। অথচ সে জাল কথাটিকে বুখারীর নামে চালানো হলো।
কেউ কেউ এ ভিত্তিহীন কথাটিকে
শুধু বুখারীর নামে চালানোর চেয়ে ‘বুখারী ও মুসলিম’ উভয়ের নামে চালানোকে উত্তম (!) বলে
মনে করেছেন। উক্ত প্রসিদ্ধ দীনী কেন্দ্রের একজন সম্মানিত মুহাদ্দিস, যিনি বহু বছর যাবৎ
ছাত্রদেরকে ‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম’ পড়িয়েছেন তিনি এ হাদীসটি উল্লেখ করে লিখেছেন:
‘‘মুসলিম শরীফ ও বুখারী শরীফ।’’[4]
আমরা মনে করি যে, এ সকল বুযুর্গ
ও আলিম জেনেশুনে এরূপ মিথ্যা কথা বলেন নি। তাঁরা অন্য আলিমদের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর
করেছেন। কিন্তু আলিমদের জন্য এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। এখন আমরা যতই বলি না কেন
যে, এ হাদীসটি বুখারী বা মুসলিমে কোথাও নেই, আপনারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে অনুসন্ধান
করুন...সাধারণ মুসলিম ও ভক্তগণ সে সকল কথায় কর্ণপাত করবেন না। তাঁরা কোনোরূপ অনুসন্ধান
ছাড়াই বলতে থাকবেন, এতবড় আলিম কি আর না জেনে লিখেছেন!!
হাদিসের উৎস:
[1] অনুবাদে এভাবেই লেখা হয়েছে, যদিও মূল
আরবীতে ৭২ লেখা হয়েছে।
[2] শাহ মুহাম্মদ মোহেববুল্লাহ, পীর সাহেব ছারছিনা শরীফ, খুতবায়ে ছালেহীয়া, পৃ. ৪২।
[3] ইবনু তাইমিয়া, আল-ইসতিগাসাহ ফির রাদ্দি আলাল বাকরী ১/১৩৮; মাজমূউল ফাতাওয়া ১৮/৩৬৬-৩৬৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪২-৪৩।
[4] আল্লামা মুহ. মুস্তফা হামীদী, মীলাদ ও কিয়াম (ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত লাইব্রেরী), পৃ. ১৮।
[2] শাহ মুহাম্মদ মোহেববুল্লাহ, পীর সাহেব ছারছিনা শরীফ, খুতবায়ে ছালেহীয়া, পৃ. ৪২।
[3] ইবনু তাইমিয়া, আল-ইসতিগাসাহ ফির রাদ্দি আলাল বাকরী ১/১৩৮; মাজমূউল ফাতাওয়া ১৮/৩৬৬-৩৬৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪২-৪৩।
[4] আল্লামা মুহ. মুস্তফা হামীদী, মীলাদ ও কিয়াম (ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত লাইব্রেরী), পৃ. ১৮।
১৬. নূর মুহাম্মাদীই (ﷺ) প্রথম সৃষ্টি:
‘নূর মুহাম্মাদী প্রথম সৃষ্টি’
অর্থে নিম্নের হাদীসটি সমাজে বহুল প্রচলিত:
أّوَّلُ
مَا
خَلَقَ
اللهُ
نُوْرِيْ
‘‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার
নূর সৃষ্টি করেছেন’’।
সুদীর্ঘ হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেন:
أوَّلُ
مَا
خَلَقَ
اللهُ
نُوْرَ
نَبِيِّك
مِنْ
نُوْرِهِ....
‘‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার
নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন।’’ এরপর এ লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
এ নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান
এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।....
এ হাদীসটির অর্থ ইতোপূর্বে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক।
কারণ, তাতে বলা হয়েছে: ফিরিশতাগণ নূর থেকে, জিনগণ আগুন থেকে এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট।
আর এ হাদীসে বলা হচ্ছে যে, ফিরিশতা, জিন, ইনসান ও মহাবিশ্বের সব কিছুই নূর থেকে সৃষ্ট।
তারপরও এ হাদীসটির বক্তব্য আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। যদি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তবে আমরা তা
নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই কুরআন ও সুন্নাহ-এর
নির্দেশ অনুসারে আমরা সনদ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই এবং নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:
(ক) বিশ্বে
বিদ্যমান কোনো হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আমরা বলেছি, একটি হাদীস
সাধারণত অনেকগুলি হাদীসের গ্রন্থে সনদ-সহ সংকলিত থাকে। কিন্তু এ হাদীসটি কোনো হাদীস
গ্রন্থেই সংকলিত হয় নি।
(খ) আমরা
দেখেছি যে, ইতিহাস, সীরাত, আকীদা, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও বহুসংখ্যক
সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদবিহীন বা সনদ-সহ সংকলিত। ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে
এ সকল বিষয়ক কোনো একটি গ্রন্থেও এ হাদীসটির কোনো উল্লেখ নেই।
(গ) যতটুকু
জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বাক্র মুহাম্মাদ
ইবনু আলী তাঈ হাতিমী (৫৬০-৬৩৮হি /১১৬৫-১২৪০খৃ) সর্বপ্রথম এ কথাগুলোকে ‘হাদীস’ হিসেবে
উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইবনু আরাবী তাঁর পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও
বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওযর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে
কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন।
বিশেষত মুজাদ্দিদে আলফে সানী
শাইখ আহমাদ ইবনু আব্দুল আহাদ সারহিন্দী (১০৩৪ হি) ইবনু আরাবীর এ সকল ভিত্তিহীন বর্ণনার
প্রতিবাদ করেছেন বারংবার। কখনো কখনো নরম ভাষায়, কখনো কঠিন ভাষায়।[1] এক চিঠিতে তিনি
লিখেছেন : ‘‘আমাদের নস্স বা কুরআন ও হাদীসের পরিষ্কার অকাট্য বাণীর সহিত কারবার, ইবন
আরাবীর কাশফ ভিত্তিক ফস্স বা ফুসূসুল হিকামের সহিত নহে। ফুতূহাতে মাদানীয়া বা মাদানী
নবী ﷺ -এর হাদীস আমাদেরকে ইবন আরাবীর ফতূহাতে মাক্কীয়া জাতীয় গ্রন্থাদি
থেকে বেপরওয়া করিয়া দিয়াছেন।’’[2] অন্যত্র প্রকৃত সূফীদের প্রশংসা করে লিখেছেন :
‘‘তাহারা নসস, কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বাণী, পরিত্যাগ করত শেখ মহিউদ্দীন ইবন আরাবীর
ফসস বা ফুসূসুল হিকাম পুস্তকে লিপ্ত হন না এবং ফুতূহাতে মাদানীয়া, অর্থাৎ হাদীস শরীফ
বর্জন করত ইবন আরাবীর ফুতূহাতে মাক্কীয়ার প্রতি লক্ষ্য করেন না।’’[3] ‘‘... নস্স বা
আল্লাহর বাণী পরিত্যাগ করত ফসস বা মহিউদ্দীন আরবীর পুস্তক আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং ফতূহাতে
মাদানীয়া বা পবিত্র হাদীস বর্জন করত ফুতূহাতে মাক্কিয়া পুস্তকের দিকে লক্ষ্য করেন না।’’[4]
সর্বাবস্থায়, ইবনু আরাবী
এ বাক্যটির কোনো সূত্র উল্লেখ করেন নি। কিন্তু তিনি এর উপরে তাঁর প্রসিদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বের
ভিত্তি স্থাপন করেন। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের লগোস তত্ত্বের (Theory of Logos) আদলে
তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী তত্ত্ব’ প্রচার করেন। খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, আল্লাহ সর্বপ্রথম
তার নিজের ‘জাত’ বা সত্ত্বা থেকে ‘কালেমা’ বা পুত্রকে জন্মদান করেন, পুত্র ‘নূর থেকে
জাত নূর’ (light of light) এবং পুত্র থেকেই আল্লাহ সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ইবনু
আরাবী বলেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে
সৃষ্টি করেন। ক্রমান্বয়ে কথাটি ছড়াতে থাকে। বিশেষত ৯/১০ম হিজরী শতক থেকে লেখকগণের মধ্যে
যাচাই ছাড়াই অন্যের কথার উদ্ধৃতির প্রবণতা বাড়তে থাকে। শ্রদ্ধাবশত, ব্যস্ততা হেতু অথবা
অন্যান্য বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে একজন লেখক আরেকজন লেখকের কাছ থেকে গ্রহণ করতে থাকেন।
যে যা শুনেন বা পড়েন তাই লিখতে থাকেন, বিচার করার প্রবণতা কমতে থাকে। এভাবে বিগত কয়েক
শতক যাবৎ সীরাত, মীলাদ, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক অগণিত গ্রন্থে এ হাদীসটি উদ্ধৃত
করা হয়।
(ঘ) যতদূর
জানা যায় সর্বপ্রথম দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এ
বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেন। অর্থাৎ ইবনু আরাবীর পূর্বে ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর এ হাদীসটি
কেউ উল্লেখই করেন নি। হাদীসটির অর্থ অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে পরবর্তী ৩০০ বৎসরে হাদীসটি
ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু এর কোনো সনদ বলা তো দূরের কথা হাদীসটি কোন্ গ্রন্থে
সংকলিত তাও কেউ বলতে পারেন নি। এরপর থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, হাদীসটি বাইহাকী
বা আব্দুর রায্যাক সান‘আনী সংকলন করেছেন। এ দাবিটি ভিত্তিহীন। আব্দুর রায্যাক সান‘আনী
বা বাইহাকী রচিত কোনো গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। দশম শতকের প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা
আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-কাসতালানী (৯২৩ হি) তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাত-গ্রন্থ ‘আল-মাওয়াহিব
আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত রয়েছে বলে উল্লেখ
করেছেন।[5] তার বক্তব্যের উপর নির্ভর করে এরপর অনেকেই লিখেছেন যে, হাদীসটি ‘মুসান্নাফ
আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক
গ্রন্থের প্রাচীন পান্ডুলিপি এবং ছাপানো গ্রন্থে কোথাও এ হাদীসটি নেই। লক্ষণীয় যে,
যারা হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে সংকলিত বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা কেউই হাদীসটির
কোনো সনদ উল্লেখ করেন নি, সনদ বিচার তো দূরের কথা।
(ঙ) দশম
শতক থেকেই অনেক আলিম নিশ্চিত করেছেন যে, এ হাদীসটি ভিত্তিহীন, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক
বা অন্য কোনো গ্রন্থে তা নেই। ইমাম সুয়ূতী, শাইখ আব্দুল্লাহ গুমারী, শাইখ আহমাদ গুমারী,
শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও অন্যান্য প্রাচীন, সমকালীন,
সালাফী ও সূফী সকল মতের মুহাদ্দিস একমত যে, এ কথাটি হাদীস নয়; কোনো হাদীসের গ্রন্থে
এর অস্তিত্ব নেই। ইমাম কাসতালানীর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী
(৯১১ হি)। তিনি এ হাদীসটির কোনো সনদ খুঁজে না পেয়ে লিখেন:
ليس
له
إسناد
يعتمد
عليه
‘‘এ হাদীসটির কোনো সনদ নেই
যার উপর নির্ভর করা যায়।’’[6]
(চ) বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী ও
মুহাদ্দিস আল্লামা শাইখ আবুল ফাইয আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৩৮০/১৯৬০)
এবং আল্লামা শাইখ আবুল ফাদল আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৪১৩/১৯৯৩)।
তাঁদের দাদা সাইয়িদ মুহাম্মাদ সিদ্দীক ইবন আহমাদ হাসানী মরোক্কোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী,
পীর ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের পিতা মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক পিতার স্থলাভিষিক্ত
প্রসিদ্ধ পীর, মুহাদ্দিস এবং ‘যাবিয়া সিদ্দীকিয়া’ বা ‘সিদ্দীকিয়া খানকা’-র পরিচালক
ছিলেন। তাঁরা উভয়েই মুহাদ্দিস, ফকীহ ও তাসাউফের ইমাম বলে সুপরিচিত। তাঁরা সকলেই
তাসাউফ, আকীদা, হাদীস ও ফিকহে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সালাফীগণ ও শাইখ আলবানীর বিরুদ্ধে
তাঁরা অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে এ হাদীসের জালিয়াতির বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্য
পোষণ করেছেন।
শাইখ আহমাদ গুমারী ইমাম সুয়ূতীর
‘জামি-সাগীর’ গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস বিষয়ে ‘আল-মুগীর আলাল আহাদীসিল মাউদূআতি ফিল
জামিয়িস সাগীর’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি এ হাদীসটি প্রসঙ্গে বলেন:
وهو
حديث
موضوع،
لو
ذكره
بتمامه
لما
شك
الواقف
عليه
في
وضعه،
وبقيته
تقع
في
نحو
ورقتين
من
القطع
الكبير
مشتملة
على
ألفاظ
ركيكة
ومعان
منكرة
‘‘‘হাদীসটি জাল। যদি পুরো
হাদীসটি উল্লেখ করা হয় তবে পাঠক হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে কোনো সন্দেহ করবেন না।
হাদীসের অবশিষ্ট বক্তব্য বৃহদাকৃতির প্রায় দু পৃষ্ঠা, যার মধ্যে অনেক অসংলগ্ন ফালতু
কথা এবং আপত্তিকর অর্থ বিদ্যমান।’’[7]
শাইখ আব্দুল্লাহ গুমারী মীলাদ মাহফিলের পক্ষে অনেক প্রমাণ পেশ করেছেন।
পাশাপাশি মীলাদ মাহফিলে জাল হাদীস আলোচনার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মীলাদ মাহফিলের জাল
হাদীস প্রসঙ্গে রচিত ‘ইরশাদুত তালিবিন নাজীব ইলা মা ফিল মাওলিদিন নাবাবী মিনাল আকাযীব’
বইয়ে তিনি বলেন:
‘‘মীলাদ মাহফিলের জাল হাদীসগুলির অন্যতম: ‘হে জাবির
আল্লাহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন। সুয়ূতী খাসাইসুল কুবরা
গ্রন্থে বলেন: হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে সংকলিত এবং ‘হাবী গ্রন্থে সুয়ূতী
বলেন: হাদীসটির নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ নেই। এ বক্তব্যটি সুয়ূতীর পক্ষ থেকে বড় রকমের
অবহেলা ও ঢিলেমি। সুয়ূতী এতবড় অবহেলা করবেন আমি তা মনে করতাম না। কারণ, প্রথমত: মুসান্নাফ
আব্দুর রায্যাক বা হাদীসের অন্য কোনো গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। দ্বিতীয়ত: হাদীসটির একেবারেই
কোনো সনদ নেই। তৃতীয়ত: সুয়ূতী হাদীসটির অবশিষ্ট বক্তব্য উল্লেখ করেন নি। (হুসাইন ইবন
মুহাম্মাদ) দিয়ারবাকরী (৯৬৬ হি) রচিত ‘তারীখ খামীস’ নামক গ্রন্থে হাদীসটির অবশিষ্ট
বক্তব্য বিদ্যমান। যদি কেউ হাদীসে অবশিষ্ট অংশ পাঠ করেন তবে নিশ্চিত হবেন যে, হাদীসটি
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জাল করা। শাইখ মুহাম্মাদ নাসির দারয়ীর
বংশধর এক ব্যক্তি একটি গ্রন্থ রচনা করে... এতে সে এক ভয়ঙ্কর মহাপাপ করে..। সে বলে হাদীসটি
ইমাম আব্দুর রায্যাক সুফইয়ান ইবন উআইনা থেকে, তিনি যাইদ ইবন আসলাম থেকে তিনি মুহাম্মাদ
ইবনুল মুনকাদির থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ... আমি এ ব্যক্তির অসভ্যতা
ও দুঃসাহস দেখে অবাক হই! মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে যে হাদীসের
অস্তিত্ব নেই সে হাদীসের জন্য সে কিভাবে একটি সহীহ সনদ জাল করল!’’[8]
এ হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে রচিত পুস্তক ‘মুরশিদুল হায়ির লিবায়ানি
ওয়াদয়ি হাদীসি জাবির’ নামক পুস্তকে তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য আমাদের গ্রন্থের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
আমি তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
‘‘এ পুস্তিকাটি আমি রচনা করেছি... উদ্দেশ্য হলো অশুদ্ধ
হাদীসগুলি থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে পবিত্র করা। এ সকল হাদীস
নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষদের মধ্যে এবং
অনেক আলিম-বুজুর্গের মধ্যে কথাগুলি নবীজী ﷺ-এর
ফযীলত বলে গণ্য। এগুলি খন্ডন করা বা প্রতিবাদ করাকে তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর
সাথে বেয়াদবী ও নিন্দা বলে গণ্য করেন। তাঁরা বুঝেন না যে, তাঁদের কথা ও মতের মধ্যে
কী ভয়ঙ্কর পাপ বিদ্যমান। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ
বলেছেন: ‘‘আমার নামে যে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে অবস্থান করতে হবে।’’ ... তাঁর
প্রশংসা বা মর্যাদা বাড়ানো তাঁর নামে মিথ্যার কোনো অযুহাত হতে পারে না। যদিও ফযীলত
বা সাওয়াব বা মর্যাদা বিষয়ক হাদীসের বিষয়ে কিছু ঢিল দেওয়া হয়, তবে তা অবশ্যই পরিচিত
ও প্রমাণিত হাদীস দ্বারা হতে হবে। তাঁর নামে মিথ্যা বলে জাহান্নামী হওয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি
থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। ... বলা হয় যে, আব্দুর রায্যাক জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন....।
ইবনু আরাবী হাতিমী ‘তালকীহুল আযহান ওয়া মিফতাহু মা’রিফাতিল ইনসান’ গ্রন্থে এবং দিয়ারবাকরী
‘খামীস ফি তারীখ আনফাস নাফীস’ গ্রন্থে এ হাদীসটির পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। আব্দুর
রায্যাক হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলে যারা উল্লেখ করেছেন তাদের কথা সঠিক নয়। কারণ তাঁর
মুসান্নাফ গ্রন্থে, জামি গ্রন্থে বা তাফসীর গ্রন্থে এ হাদীসটির কোনো অস্তিত্ব নেই।
... হাদীসটি যে জাল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ হাদীসের মধ্যে (কয়েক শতক পরে
উদ্ভাবিত) সূফীগণের পরিভাষা বিদ্যমান। বর্তমান যুগের একজন শানকীতী আলিম এ হাদীসের জন্য
একটি জাল সনদ তৈরি করেছেন। তিনি লিখেছেন হাদীসটি আব্দুর রায্যাক ইবনুল মুনকাদিরের সূত্রে
জাবির থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ মিথ্যাচারের জন্য তিনি পাপী হবেন। মোট কথা হাদীসটি আপত্তিকর
জাল হাদীস। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে এর কোনোরূপ অস্তিত্ব বা উৎস পাওয়া যায় না।..... আর
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নূর হওয়ার অর্থ তিনি বিমূর্ত ও রূপক অর্থে
নূর। যে অর্থে কুরআন এবং অন্যান্য বিষয়কে নূর বলা হয়। কারণ তিনি জ্ঞান, বিবেক ও হৃদয়ের
নূর।
এ জাতীয় আরেকটি প্রকাশ্য মিথ্যা কথা: ‘‘আপনি না হলে আমি মহাবিশ্ব সৃষ্টি
করতাম না।’ মীলাদের গ্রন্থে কোনো কোনো লেখক লিখেছেন, আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ
ﷺ
জিবরাঈল (আ)-কে বলেন, হে জীবরাঈল, আপনার বয়স কত? ..... আমিই সেই তারকা’। এটি একটি জঘন্য
মিথ্যা, যে এটি বানিয়েছে আল্লাহ তাঁকে লাঞ্ছিত করুন! বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত কোনো কোনো
সূফী উল্লেখ করেছেন, জিবরাঈল (আ)-কে পর্দার অন্তরাল থেকে ওহী দেওয়া হতো। একবার পর্দা
উঠানো হলে তিনি দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ
তাকে ওহী দিচ্ছেন। তখন জিবরাঈল (আ) বলেন: আপনিই ওহী দিচ্ছেন আর আপনার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি!..
যে ব্যক্তি এ নোংরা প্রলাপ বানিয়েছে তাকে আল্লাহ লানত করুন! ... মীলাদুন্নবী গ্রন্থগুলিতে
একেবারে ভিত্তিহীন অস্তিত্বহীন হাদীস বিদ্যমান, যেগুলি অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ এরূপ অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ি
নিষেধ করেছেন। এজন্য এ সকল বই পাঠ করা হারাম। ফাযাইল বিষয়ক হাদীস এ অজুহাতে এগুলি বলা
জায়েয নয়। কারণ ফাযাইল বিষয়ে যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে উম্মাতের ইজমা রয়েছে
যে, ফাযাইলের ক্ষেত্রেও জাল হাদীস গ্রহণ করা যায় না; বরং জাল হাদীস উল্লেখ করাই হারাম;
(শুধু জাল হিসেবে চিহ্নিত করে তা উল্লেখ করা যায়)। ... রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর
মর্যাদা কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ি করে তাঁর নামে
যা বলা হয় তার কোনো প্রয়োজনই তাঁর নেই। তিনি বলেছেন[9]: খৃস্টানগণ যেভাবে ঈসার (আ)
বিষয়ে অতিভক্তি-অতিপ্রশংসা করেছে তোমরা আমার বিষয়ে সেরূপ অতিভক্তি-অতিপ্রশংসা করবে
না; আমি তো বান্দা বা দাস বৈ কিছুই নই; কাজেই আমার বিষয়ে বলবে: আল্লাহর দাস ও তাঁর
রাসূল।’’[10]
আল্লামা আব্দুল্লাহ গুমারী
‘ইসলাহু আবইয়াতিল বুরদাহ’ পুস্তকে বলেন:
‘‘সুয়ূতী হাবী পুস্তকে বলেছেন:
হাদীসটি প্রমাণিত নয়। এটি সুয়ূতীর একটি নিন্দনীয় ঢিলেমি; বরং হাদীসটি সুস্পষ্টত জাল
এবং আপত্তিকর। সূফীদের পরিভাষা এর মধ্যে সুস্পষ্ট; যেমন এতে ‘হাইবাতের মাকাম, খাশিয়াতের
মাকাম ইত্যাদি সূফী পরিভাষা ব্যবহৃত (এগুলি প্রমাণ করে যে এ হাদীসটি জাল; কারণ এ সকল
পরিভাষা কয়েকশত বৎসর পরে প্রচলিত হয়েছে) ....। জাবির (রা) এ হাদীস বর্ণনার দায়ভার থেকে
সম্পূর্ণ মুক্ত এবং আব্দুর রায্যাক কখনো এ হাদীসটি শুনেন নি। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি
হাদীসটি প্রচার করেন তিনি ইবন আরাবী হাতিমী। আমি জানি না তিনি কার থেকে হাদীসটি পেয়েছেন।
তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তাহলে অবশ্যই কোনো দরবেশ সূফী এ হাদীসটি জাল করে বানিয়েছেন।’’[11]
আরো অনেক সূফী ও তরীকাপন্থী মুহাদ্দিস এ হাদীসটির জালিয়াতি প্রসঙ্গে
বই-পুস্তক রচনা করেছেন। সূফী-সালাফী মতভেদের কারণে, সূফী মত প্রমাণের জন্য বা বুজুর্গগণের
দোহাই দিয়ে তাঁরা জাল হাদীস প্রশ্রয় দেন নি।
হাদিসের উৎস:
[1] উদাহারন স্বরূপ দেখুন: মাকতুবাত শরীফ
১/১, মাকতুব ৩১, (পৃষ্ঠা ৬৭, ৬৮) মাকতুব ৪৩।
[2] প্রাগুক্ত, ১/১, মাকতুব ১০০, পৃষ্ঠা ১৭৮।
[3] প্রগুক্ত, ১/১, মাকতুব ১৩১, পৃ: ২১০।
[4] প্রাগুক্ত, ১/২, মাকতুব ২৪৩, পৃ: ২১১।
[5] কাসতালানী, আল-মাহওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ১/৩৬-৩৭।
[6] সুয়ূতী, আল-হাবী ১/৩৮৪-৩৮৬।
[7] আহমাদ গুমারী, আল-মুগীর (বৈরুত, দারুর রায়িদ আল-আরাবী ), ভূমিকা: পৃষ্ঠা ৬-৭।
[8] গুমারী, ইরশাদুত তালিব, পৃ ৯-১০; মাউসূআতুর রাদ্দি আলাস সুফিয়্যাহ (শামিলা) ১১০/২৯।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭১, ৬/২৫০৩।
[10] আব্দুল্লাহ গুমারী, মুরশিদুল হায়ির (শামিলা ৩.২৮), পৃষ্ঠা ৮-১৩।
[11] গুমারী, ইসলাহু আবইয়াতিল বুরদা, পৃ ৭৫; মাউসূআতুর রাদ্দি আলাস সুফিয়্যাহ (শামিলা) ১১০/২৯।
[2] প্রাগুক্ত, ১/১, মাকতুব ১০০, পৃষ্ঠা ১৭৮।
[3] প্রগুক্ত, ১/১, মাকতুব ১৩১, পৃ: ২১০।
[4] প্রাগুক্ত, ১/২, মাকতুব ২৪৩, পৃ: ২১১।
[5] কাসতালানী, আল-মাহওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ১/৩৬-৩৭।
[6] সুয়ূতী, আল-হাবী ১/৩৮৪-৩৮৬।
[7] আহমাদ গুমারী, আল-মুগীর (বৈরুত, দারুর রায়িদ আল-আরাবী ), ভূমিকা: পৃষ্ঠা ৬-৭।
[8] গুমারী, ইরশাদুত তালিব, পৃ ৯-১০; মাউসূআতুর রাদ্দি আলাস সুফিয়্যাহ (শামিলা) ১১০/২৯।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৭১, ৬/২৫০৩।
[10] আব্দুল্লাহ গুমারী, মুরশিদুল হায়ির (শামিলা ৩.২৮), পৃষ্ঠা ৮-১৩।
[11] গুমারী, ইসলাহু আবইয়াতিল বুরদা, পৃ ৭৫; মাউসূআতুর রাদ্দি আলাস সুফিয়্যাহ (শামিলা) ১১০/২৯।
অন্যান্য পর্ব দেখতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
(৪) প্রচলিত ১১৩টি জাল-জইফ হাদিসঃ যেগুলো আলেমগণ মুখস্থ বলে বেড়ায়ঃ
(৫) দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালাকে কি স্বচক্ষে দেখা যায়? কথিত পির-আউলিয়াগণ দেখেনঃ
(৬) আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদার দ্বন্দ্ব নিরসনঃ (আল কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক):
(৭) বাংলাদেশে প্রচলিতশির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কার পর্যালোচনাঃ
(৮)আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম কি ৯৯ টি? সহিহ হাদিস ভিত্তিক আলোচনাঃ
(৯) বিদআত কি? বিদআতীদের শেষ ও করুণ পরিনতি- মাজহাব মানা বিদআত কেনো? বিদআতী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করার হুকুম কি?
(১০)ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আতঃ বিদআতীদের স্থান জাহান্নামেঃ
কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো বিষয় জানতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
« مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا »
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।”
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, গুলশান-ঢাকা।
No comments:
Post a Comment