Friday, August 2, 2019

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আতঃ বিদআতীদের স্থান জাহান্নামে-


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম 

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আতঃ
 বিদআতীদের স্থান জাহান্নামে-
       (বিদআতীদের কোনো আমল আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না) 

 

সংজ্ঞা :
‘জন্মের সময়কাল’কে আরবীতে ‘মীলাদ’ বা  ‘মাওলিদ’ বলা হয়। সে হিসাবে ‘মীলাদুন্নবী’-র অর্থ দাঁড়ায় ‘নবীর জন্ম মুহূর্ত’। নবীর জন্মের বিবরণ, কিছু ওয়ায ও নবীর রূহের আগমন কল্পনা করে তার সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নাবী সালামু আলায়কা’ বলা ও সবশেষে জিলাপী বিতরণ- এই সব মিলিয়ে ‘মীলাদ মাহফিল’ ইসলাম প্রবর্তিত ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহা’ নামক দু’টি বার্ষিক ঈদ উৎসবের বাইরে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে তৃতীয় আরেকটি ধর্মীয়(?) অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
উৎপত্তি :
ক্রুসেড বিজেতা মিসরের সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হিঃ) কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম কারো মতে ৬০৪ হিঃ ও কারো মতে ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান রাসূলের মৃত্যুর ৫৯৩ বা ৬১৪ বছর পরে। এই দিন তারা মীলাদুন্নবী উদযাপনের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হ’তেন। গভর্ণর নিজে তাতে অংশ নিতেন।[1] আর এই অনুষ্ঠানের সমর্থনে তৎকালীন আলেম সমাজের মধ্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন আবুল খাত্ত্বাব ওমর বিন দেহিইয়াহ (৫৪৪-৬৩৩ হিঃ)। তিনি মীলাদের সমর্থনে বহু জাল ও বানাওয়াট হাদীছ জমা করেন।
হুকুম :
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2]
তিনি আরো বলেন,وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে সাবধান থাক। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত ও প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী’।[3] জাবের (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম’।[4]
ইমাম মালেক (রহঃ) স্বীয় ছাত্র ইমাম শাফেঈকে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সময়ে যেসব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমান কালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না। যে ব্যক্তি ধর্মের নামে ইসলামে কোন নতুন প্রথা চালু করল, অতঃপর তাকে ভাল কাজ বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বলে রায় দিল, সে ধারণা করে নিল যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন’।[5]
মীলাদ বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের ঐক্যমত :
‘আল-ক্বাওলুল মু‘তামাদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, চার মাযহাবের সেরা বিদ্বানগণ সর্বসম্মতভাবে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাঁরা বলেন, এরবলের গভর্ণর কুকুবুরী এই বিদ‘আতের হোতা। তিনি তার আমলের আলেমদেরকে মীলাদের পক্ষে মিথ্যা হাদীছ তৈরী করার ও ভিত্তিহীন ক্বিয়াস করার হুকুম জারী করেছিলেন।
উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম :
মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খ আহমাদ সারহিন্দী, আল্লামা হায়াত সিন্ধী, রশীদ আহমাদ গাংগোহী, আশরাফ আলী থানভী, মাহমূদুল হাসান দেউবন্দী, আহমাদ আলী সাহারানপুরী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম ছাড়াও আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ সকলে এক বাক্যে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদ‘আত ও গুনাহের কাজ বলেছেন।
মৃত্যু দিবসে জন্মবার্ষিকী :
জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঠিক জন্মদিবস হয় ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার। ১২ রবীউল আউয়াল সোমবার ছিল তাঁর মৃত্যুদিবস। অথচ ১২ রবীউল আউয়াল রাসূলের মৃত্যুদিবসেই তাঁর জন্মবার্ষিকী বা ‘মীলাদুন্নবী’র অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
একটি সাফাই :
মীলাদ উদযাপনকারীরা বলে থাকেন যে, মীলাদ বিদ‘আত হ’লেও তা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’। অতএব জায়েয তো বটেই বরং করলে ছওয়াব আছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষকে কিছু বক্তব্য শুনানো যায়। উত্তরে বলা চলে যে, ছালাত আদায় করার সময় পবিত্র দেহ-পোষাক, স্বচ্ছ নিয়ত সবই থাকা সত্তেবও ছালাতের স্থানটি যদি কবরস্থান হয়, তাহ’লে সে ছালাত কবুলযোগ্য হয় না। কারণ এরূপ স্থানে ছালাত আদায় করতে আল্লাহর নবী (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছালাত আদায়ে কোন ফায়দা হবে না।
তেমনি বিদ‘আতী অনুষ্ঠান করে নেকী অর্জনের স্বপ্ন দেখা অসম্ভব। হাড়ি ভর্তি গো-চেনায় এক কাপ দুধ ঢাললে যেমন পানযোগ্য থাকে না, তেমনি সৎ আমলের মধ্যে সামান্য শিরক-বিদ‘আত সমস্ত আমলকে বরবাদ করে দেয়। সেখানে বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দুই ভাগে ভাগ করা যে আরেকটি গোমরাহী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্বিয়াম প্রথা :
সপ্তম শতাব্দী হিজরীতে মীলাদ প্রথা চালু হওয়ার প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে আল­ামা তাক্বিউদ্দীন সুবকী (৬৮৩-৭৫৬ হিঃ) কর্তৃক ক্বিয়াম প্রথার প্রচলন ঘটে বলে কথিত আছে।[6] তবে এর সঠিক তারিখ ও আবিষ্কর্তার নাম জানা যায় না।
এদেশে দু’ধরনের মীলাদ চালু আছে। একটি ক্বিয়ামযুক্ত, অন্যটি ক্বিয়াম বিহীন। ক্বিয়ামকারীদের যুক্তি হ’ল, তারা রাসূলের ‘সম্মানে’ উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর দ্বারা তাদের ধারণা যদি এই হয় যে, মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তবে এই ধারণা সর্বসম্মতভাবে কুফরী। হানাফী মাযহাবের কিতাব ‘ফাতাওয়া বাযযারিয়া’তে বলা হয়েছে,مَنْ ظَنَّ أنَّ أرواحَ الأمواتِ  حاضرةٌ نَعْلَمُ يَكْفُرُ-  ‘যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহ হাযির হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি কাফের’।[7] অনুরূপভাবে ‘তুহফাতুল কুযাত’ কিতাবে বলা হয়েছে, ‘যারা ধারণা করে যে, মীলাদের মজলিসগুলিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তাদের এই ধারণা স্পষ্ট শিরক’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় তাঁর সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ধম্কি প্রদান করেছেন।[8] অথচ মৃত্যুর পর তাঁরই কাল্পনিক রূহের সম্মানে দাঁড়ানোর উদ্ভট যুক্তি ধোপে টেকে কি?
মীলাদ অনুষ্ঠানে প্রচারিত বানাওয়াট হাদীছ ও গল্পসমূহ :
(১) ‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি না হ’লে আসমান-যমীন কিছু্ সৃষ্টি করতাম না’।[9]
(২) ‘আমি আল্লাহর নূর হ’তে সৃষ্ট এবং মুমিনগণ আমার নূর হ’তে’।
(৩) ‘নূরে মুহাম্মাদী’ হ’তেই আরশ-কুরসী, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে’।
(৪) ‘আদম সৃষ্টির সত্তর হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ পাক তাঁর নূর হ’তে মুহাম্মাদের নূরকে সৃষ্টি করে আরশে মু‘আল্লায় লটকিয়ে রাখেন’।
(৫) ‘আদম সৃষ্টি হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় নক্ষত্ররূপে মুহাম্মাদের নূর অবলোকন করে মুগ্ধ হন’।
(৬) ‘মে‘রাজের সময় আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতা সহ আরশে আরোহন করতে বলেন, যাতে আরশের গৌরব বৃদ্ধি পায়’ (নাঊযুবিল্লাহ)।
(৭) রাসূলের জন্মের খবরে খুশী হয়ে আঙ্গুল উঁচু করার কারণে ও সংবাদ দান কারিণী দাসী ছুওয়াইবাকে মুক্ত করার কারণে জাহান্নামে আবু লাহাবের হাতের মধ্যের দু’টি আঙ্গুল পুড়বে না। এছাড়াও প্রতি সোমবার রাসূলের (ছাঃ) জন্ম দিবসে জাহান্নামে আবু লাহাবের শাস্তি মওকূফ করা হবে বলে হযরত আববাস (রাঃ)-এর নামে প্রচলিত তাঁর কাফের অবস্থার একটি স্বপ্নের বর্ণনা।
(৮) মা আমেনার প্রসবকালে জান্নাত হ’তে বিবি মরিয়ম, বিবি আসিয়া, মা হাজেরা সকলে দুনিয়ায় নেমে এসে সবার অলক্ষ্যে ধাত্রীর কাজ করেন।
(৯) নবীর জন্ম মুহূর্তে কা‘বার প্রতিমাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, রোমের অগ্নি উপাসকদের ‘শিখা অনির্বাণ’গুলো দপ করে নিভে যায়। বাতাসের গতি, নদীর প্রবাহ, সূর্যের আলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি...।
উপরের বিষয়গুলি সবই বানাওয়াট। দেখুন : মওযূ‘আতে কাবীর প্রভৃতি। মীলাদ উদযাপনকারী ভাইদের এই সব মিথ্যা ও জাল হাদীছ বর্ণনার দুঃসাহস দেখলে শরীর শিউরে ওঠে। যেখানে আল্লাহর নবী (ছাঃ) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা হাদীছ রটনা করে, সে জাহান্নামে তার ঘর তৈরী করুক’।[10]
তিনি আরও বলেন, لاَ تُطْرُوْنِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেভাবে নাছারাগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে।... বরং তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[11]
যেখানে আল্লাহপাক এরশাদ করছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছুটো না। নিশ্চয়ই তোমার কান, চোখ ও বিবেক সবকিছুকে (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৬)। সেখানে এই সব লোকেরা কেউবা জেনে শুনে কেউবা অন্যের কাছে শুনে ভিত্তিহীন সব কল্পকথা ওয়াযের নামে মীলাদের মজলিসে চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাবতেও অবাক লাগে।
‘নূরে মুহাম্মাদী’র আক্বীদা মূলতঃ অগ্নি উপাসক ও হিন্দুদের অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদার নামান্তর। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। এরা ‘আহাদ’ ও ‘আহমাদের’ মধ্যে ‘মীমের’ পর্দা ছাড়া আর কোন পার্থক্য দেখতে পায় না। তথাকথিত মা‘রেফাতী পীরদের মুরীদ হ’লে নাকি মীলাদের মজলিসে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন্ত চেহারা দেখা যায়। এই সব কুফরী দর্শন ও আক্বীদা প্রচারের মোক্ষম সুযোগ হ’ল মীলাদের মজলিসগুলো। বর্তমানে সরকারী রেডিও-টিভিতেও চলছে যার জয়জয়কার। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন- আমীন!
উৎসঃ
[1]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (দারুল ফিকর, ১৯৮৬) পৃঃ ১৩/১৩৭।
[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭।
[4]. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫; নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েন-এর খুৎবা’ অধ্যায়।
[5]. আল-ইনছাফ, পৃঃ ৩২।
[6]. আবু ছাঈদ মোহাম্মাদ, মিলাদ মাহফিল (ঢাকা ১৯৬৬), পৃঃ ১৭।
[7]. মীলাদে মুহাম্মাদী পৃঃ ২৫, ২৯।
[8]. তিরমিযী, আবূদাঊদ; মিশকাত হা/৪৬৯৯ ‘আদাব’ অধ্যায়, ।
[9]. দায়লামী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২৮২।
[10]. বুখারী হা/১০৭।
[11]. বুখারী হা/৩৪৪৫।


মিলাদ কিয়ামে রাসূলুল্লাহ ()-কি হাযির-নাযির হোন?
রাসূলুল্লাহ ()-এর ‘ইলমুল গাইব’ ও মীলাদে উপস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা যে, তিনি ‘হাযির-নাযির’। হাযির-নাযির দুটি আরবী শব্দ। (حاضر) হাযির অর্থ উপস্থিত ও (ناظر) নাযির অর্থ দর্শক, পর্যবেক্ষক বা সংরক্ষক। ‘হাযির-নাযির’ বলতে বোঝান হয় ‘সর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক’। অর্থাৎ তিনি সদা-সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত বা বিরাজমান এবং তিনি সদা সর্বদা সবকিছুর দর্শক। স্বভাবতই যিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক তিনি সর্বজ্ঞ ও সকল যুগের সকল স্থানের সকল গাইবী জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই যারা রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘হাযির-নাযির’ দাবি করেন, তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি শুধু সর্বজ্ঞই নন, উপরন্তু তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
সম্মানিত পাঠক, নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
প্রথমত: এ গুণটি শুধু আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, বান্দা যেখানেই থাক্ তিনি তার সাথে আছেন, তিনি বান্দার নিকটে আছেন... ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ ()-এর সম্পর্কে কখনোই ঘুণাক্ষরেও কুরআন বা হাদীসে বলা হয় নি যে, তিনি সর্বদা উম্মাতের সাথে আছেন, অথবা সকল মানুষের সাথে আছেন, অথবা কাছে আছেন, অথবা সর্বত্র উপস্থিত আছেন, অথবা সবকিছু দেখছেন। কুরআনের আয়াত তো দূরের কথা একটি যয়ীফ হাদীসও দ্ব্যর্থহীনভাবে এ অর্থে কোথাও বর্ণিত হয় নি। কাজেই যারা এ কথা বলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা কথা বলেন। কোনো একটি সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি বলেছেন ‘আমি হাযির-নাযির’। অথচ তাঁর নামে এ মিথ্যা কথাটি বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা ইমাম কখনোই বলেন নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ () হাযির-নাযির’।
দ্বিতীয়ত: কুরআন-হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () ‘ইলমুল গাইব’ বা গোপন জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করা উক্ত সকল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা।[1]
তৃতীয়ত: আমরা দেখেছি, বিভিন্ন হাদীসে তিনি বলেছেন, উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কবরে উপস্থিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ ()-কে হাযির-নাযির বলে দাবি করার অর্থ দরুদ-সালাম কবরে পৌঁছানোর হাদীসগুলোকে মিথ্যা বলে গণ্য করা। উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কাছে উপস্থিত হয় না, বরং তিনিই উম্মাতের কাছে উপস্থিত হন!! কাজেই যারা এ দাবিটি করছেন, তাঁরা শুধু রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। উপরন্তু তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ  -কে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করেন, নাঊযু বিল্লাহ! নাঊযু বিল্লাহ!!
[1] এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলোর জন্য দেখুন গ্রন্থকার রচিত ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ১৯৬-২০৭।
এ সকল মিথ্যার উৎস ও কারণ
এখানে পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ () এরূপ ইলমুল গাইবের অধিকারী, হাযির-নাযির, ইত্যাদি যখন কোনো হাদীসেই বর্ণিত হয়নি এবং কুরআনেও এভাবে বলা হয়নি, তখন কেন অনেক মানুষ এগুলো বলছেন? তাঁরা কি কিছুই বুঝেন না?
এ বইয়ের পরিসরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইলমুল গাইব, হাযির-নাযির ও অন্যান্য বিষয়ে বানোয়াট কথা রাসুলুল্লাহ ()-এর নামে বলার পিছনে দুটি কারণ প্রধান:
প্রথম কারণ: এ বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা বা বিভিন্ন আলিমের কথার উপর নির্ভর করা। পাশাপাশি দ্ব্যার্থবোধক বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের উপর নির্ভর করে সেগুলোকে নিজের মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করা। আর এ সকল দ্ব্যর্থবোধক আয়াত ও হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যাকে বজায় রাখতে অগণিত আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করা।
অতিভক্তির নামে ‘মিথ্যা’ ও মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতে সত্য ওহীর ‘ব্যাখ্যা’ এ দুটিই ধর্ম বিকৃত করে। খৃস্টধর্মের বিকৃতি এর সুস্পষ্ট নমুনা। আমরা মিথ্যা ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তাওহীদকে শিরকে রূপান্তরিত করার কিছু নমুনা উল্লেখ করেছি। বস্ত্তত সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা তিনটি পর্যায়ে ঈসা (আ)-এর ধর্মকে বিকৃত করেন: (১) ঈসার (আ) নামে অতিভক্তিমূলক কিছু কথা প্রচলন করেন, যা তিনি বলেন নি, এমনকি প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান তাঁর বক্তব্যেও তা নেই। (২) ঈসা মাসীহের কিছু দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট কথাকে নিজেদের এ সকল বানোয়াট কথার পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করতে শুরু করেন। (৩) এ সকল মিথ্যা ও ‘দলীল’-এর ভিত্তিতে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথাগুলো নানারকমের ব্যাখ্যা করে বাতিল করতে থাকেন। আল্লাহ বলেন:
 ‘হে কিতাবীগণ, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং ‘তিন’ বলো না ...।[1]
অর্থাৎ আল্লাহ যতটুকু বলেছেন ততটুকুই বল। তাকে আল্লাহর ‘কালিমা’ বল; কারণ আল্লাহ তাকে পিতা ছাড়া ‘হও’ বাক্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে বলো না যে, তিনি আল্লাহর অনাদি-অনন্ত কালাম বা জ্ঞানের মুজাস্সাম বা দেহরূপ। তাঁকে আল্লাহর রূহ বল; কারণ তিনি আল্লাহর সৃষ্ট একটি আত্মা। কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে বলো না যে, যেহেতু তিনি আল্লাহর রূহ কাজেই তিনি আল্লাহর যাতের অংশ ও আল্লাহরই মত জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে আল্লাহকে আল্লাহ (পিতা), কালিমা (পুত্র) ও রূহ (পবিত্র আত্মা) তিন ব্যক্তিতে ভাগ করে ত্রিত্ববাদের শিরকে লিপ্ত হয়ো না।
আল্লাহ তাঁকে ‘আল্লাহর কালিমা’ ও ‘আল্লাহর রূহ’ বলেছেন। প্রচলিত বাইবেলে তিনি আল্লাহকে পিতা বলেছেন, নিজেকে, শিষ্যদেরকে ও সকল মুমিনকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁকে আল্লাহ, আল্লাহর যাতের (সত্তার) অংশ বা ‘তিন আল্লাহর একজন’ বলা হয় নি। অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহর একত্ব, শরীয়ত পালন, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা, মানুষ, গাইব সম্পর্কে অজ্ঞ, আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কাউকে নাজাত দিতে অক্ষম ইত্যাদি বলা হয়েছে। সাধু পল প্রথমে কিছু অতিভক্তিমূলক মিথ্যা চালু করলেন: ঈসা স্বয়ং আল্লাহ, তিনি আল্লাহর যাতের অংশ, আল্লাহর বাক্যের মুজাস্সাম বা দেহরূপ (God Incarnate), তিনি সৃষ্ট নন, বরং জন্ম দেওয়া (ঔরসজাত), তিনি পিতার মতই জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী, মধ্যস্থ ও মুক্তিদাতা, তাকে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত পালন লাগে না... ইত্যাদি। এরপর তাওরাত-ইঞ্জিলের দ্ব্যর্থবোধক কিছু কথার ইচ্ছামাফিক ব্যাখ্যা করে সেগুলিকে ‘দলীল’ হিসেবে পেশ করলেন। এরপর তাদের উদ্ভাবিত ‘মিথ্যা’ ও নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা এ দুটির ভিত্তিতে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের তাওহীদ ও শরীয়ত বিষয়ক সকল নির্দেশ বাতিল করে দেন। ‘‘কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ বইটি পড়লে পাঠক বিস্তারিত জানতে পারবেন।
‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ নামক বইটি পড়লে পাঠক দেখবেন যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে যারা বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যেও একই কারণ বিদ্যমান। খারিজী, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া, মুরজিয়া, মু’তাযিলী ইত্যাদি সকল সম্প্রদায়ই কুরআন-সুন্নাহ মানেন। একটি কারণেই তারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। নিজেদের পছন্দমত কিছু ওহী বহির্ভূত ‘মত’ তৈরি করা, এরপর কুরআন-হাদীসের কিছু দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যকে দলীল হিসেবে পেশ করা। সর্বশেষ এ সকল ‘মত’ ও ‘ব্যাখ্যা’র ভিত্তিতে ওহীর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ব্যাখ্যার নামে বাতিল ও অকার্যকর করা।
‘ইলমুল গাইব’ ও ‘হাযির-নাযির’ বিষয়টি ইসলামের প্রথম কয়েকশত বছর ছিল না। পরবর্তী কালে এর উৎপত্তি। এ বিষয়েও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আসমান-যমীনের মধ্যে কেউ গাইব জানেন না। বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ  ‘গাইব’ জানেন না। মাক্কী সূরায়, মাদানী সূরায়, মদীনায় অবতীর্ণ একেবারে শেষ দিকের সূরায় সকল স্থানেই তা বলা হয়েছে।[2] এর বিপরীতে একটি আয়াতেও বলা হয় নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ () ‘আলিমুল গাইব’। তিনি ‘গাইবের সবকিছু জানেন’ এ কথা তো দূরের কথা ‘তিনি গাইব জানেন’ এ প্রকারের একটি কথাও কোথাও বলা হয় নি। তবে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ বলেছেন, এগুলো গাইবের সংবাদ যা আপনাকে ওহীর মাধ্যমে জানালাম... ইত্যাদি।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ () অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি ‘গাইব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক নয়, তিনি মনের কথা জানেন না, তিনি গোপন কথা জানেন না এবং তিনি ভবিষ্যত জানেন না। আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী (রাঃ) থেকে অনেকগুলো সহীহ সনদে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেয়া হবে না, বাধা দেয়া হবে। আমি বলব : এরা তো আমারই উম্মাত। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ
‘‘আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।’’[3]
এ সকল অগণিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে একটি হাদীসেও তিনি বলেন নি যে, আমি ‘আলিমুল গাইব’, বা আমি সকল গোপন জ্ঞানের অধিকারী, অথবা আমি তোমাদের সকল কথাবার্তা বা কাজ কর্মের সময় উপস্থিত থাকি, অথবা আমি ঘরে বসেই তোমাদের সকল কাজ কর্ম ও গোপন বিষয় দেখতে পাই ...  এরূপ কোনো কথাই তিনি বলেন নি।
তবে রাসূলুল্লাহ () ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করেছেন, অনেক মানুষের গোপন বিষয় বলেছেন, কোনো কোনো হাদীসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্নে বা সালাতে দাঁড়িয়ে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম সবকিছু দেখেছেন। তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে পিছনের মুসল্লীদেরকেও দেখতে পান বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কখনোই বলেন নি যে, তিনি পর্দার আড়ালে, মনের মধ্যে বা দূরের কোনো কিছু দেখেন। বরং বারংবার এর বিপরীত কথা বলেছেন।
এখন মুমিনের দায়িত্ব এ সব কিছু সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করা। কুরআনের বিভিন্ন সুস্পষ্ট আয়াত ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, রাসুলুল্লাহ () ‘গাইব’ জানতেন না। আবার কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে ওহীর মাধ্যমে গাইবের অনেক বিষয় জানিয়েছেন। তাঁর জ্ঞান ছিল সকল নবী-রাসূলের জ্ঞানের চেয়ে বেশি ও পূর্ণতর।
একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো ব্যাখ্যায় যেতে নেই। প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করলেও গুরুত্বের কম বেশি হবে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে। স্পষ্ট কথাকে অস্পষ্ট কথার জন্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বাতিল করা যাবে না। বরং প্রয়োজনে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথার জন্য অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। ‘খবর ওয়াহিদ’ বা একক হাদীসের জন্য কুরআনের স্পষ্ট বাণী বা মুতাওয়াতির ও মাশহূর হাদীস বাতিল করা যাবে না। প্রয়োজনে কুরআন বা প্রসিদ্ধ হাদীসের জন্য একক ও দ্ব্যর্থবোধক হাদীসের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করতে হবে।
[1] সূরা (৪) নিসা: ১৭১ আয়াত।
[2] দেখুন: সূরা (৬) আন‘আম: ৫০, ৫৯; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৮৮; সূরা (৯) তাওবা: ১০১; সূরা (১০) ইউনুস: ২০; সূরা (১১): হূদ: ৩১; সূরা (২১) আম্বিয়া: ১০৯, ১১১; সূরা (২৭) নামল: ৬৫; সূরা(৪৬) আহকাফ: ৯; সূরা (৭২) জিন: ২৫ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১, ১৭৬৬, ৫/২৩৯১, ২৪০৪, ২৪০৬, ৬/২৫৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪।
দলীল ও ব্যাখ্যার তুলনামূলক পর্যালোচনা
যারা রাসূলুল্লাহ -এর ইলমুল গাইবের বা হাযির-নাযির হওয়ার দাবি করেন তাঁরা নিজেদের পছন্দ বা বিভিন্ন আলিমের বক্তব্যের ভিত্তিতে একটি ‘মত’ গ্রহণ করেন। এরপর এ সকল দ্ব্যর্থবোধক বা ফযীলত বোধক আয়াত ও হাদীসকে তাঁদের মতের পক্ষে ব্যাখ্যা করে সে ব্যাখ্যাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। এরপর তাঁদের ‘মত’ ও ‘ব্যাখা’র ভিত্তিতে অগণিত সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দেন। পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের জন্য এখানে তাঁদের এরূপ কয়েকটি ‘দলীল’ আলোচনা করছি।
প্রথম দলীল: কুরআনে বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ -কে ‘শাহিদ’ ও ‘শাহীদ’ (شاهد وشهيد) বলা হয়েছে।[1] এ শব্দ দুটির অর্থ ‘সাক্ষী’, ‘প্রমাণ’, ‘উপস্থিত’ (witness, evidence, present) ইত্যাদি। সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুফাস্সিরগণ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে () দীন প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে ও সাক্ষীরূপে প্রেরণ করেছেন। যারা তাঁর প্রচারিত দীন গ্রহণ করবেন, তিনি তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এছাড়া পূর্ববর্তী নবীগণ যে তাদের দীন প্রচার করেছেন সে বিষয়েও তিনি এবং তাঁর উম্মাত সাক্ষ্য দিবেন। অনেকে বলেছেন, তাঁকে আল্লাহ তাঁর একত্বের বা ওয়াহদানিয়্যতের সাক্ষী ও প্রমাণ-রূপে প্রেরণ করেছেন।[2]
এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক স্থানে মুমিনগণকেও মানব জাতির জন্য ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[3] অনেক স্থানে আল্লাহকে ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[4]
যারা রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী’ বা ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন তাঁরা এই ‘দ্ব্যর্থবোধক’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন। এরপর সেই অর্থের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআনের সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী বাতিল করে দেন। তাঁরা বলেন, ‘শাহিদ’ অর্থ উপস্থিত। কাজেই তিনি সর্বত্র উপস্থিত। অথবা ‘শাহিদ’ অর্থ যদি সাক্ষী হয় তাহলেও তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ না দেখে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। আর এভাবে তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাযির-নাযির ও সকল স্থানের সকল গোপন ও গাইবী জ্ঞানের অধিকারী।
তাঁদের এ ব্যাখ্যা ও দাবির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
প্রথমত: তাঁরা এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মতামত গ্রহণ না করে নিজেদের মর্জি মাফিক ব্যাখ্যা করেন এবং সাহাবী-তাবিয়ীদের ব্যাখ্যা বাতিল করে দেন।
দ্বিতীয়ত: তাঁরা একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যাকে মূল আকীদা হিসাবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন। তাঁরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করলেন, যে অর্থে একটি দ্ব্যর্থহীন আয়াত বা হাদীসও নেই। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা কোনো ইমামও কখনো এ কথা বলেন নি।
তৃতীয়ত: তাঁদের এ ব্যাখ্যা ও দাবি মূলতই বাতিল। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রত্যেক মুসলিমকেই ‘ইলমে গাইবের অধিকারী’ ও হাযির-নাযির বলে দাবি করতে হবে। কারণ মুমিনগণকেও কুরআনে ‘শাহীদ’ অর্থাৎ ‘সাক্ষী’ বা ‘উপস্থিত’ বলা হয়েছে এবং বারংবার বলা হয়েছে যে, তাঁরা পূর্ববর্তী সকল উম্মাত সহ পুরো মানব জাতি সম্পর্কে কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবেন। আর উপস্থিত না হলে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। কাজেই তাঁদের ব্যাখ্যা ও দাবি অনুসারে বলতে হবে যে, প্রত্যেক মুমিন সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান এবং সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। কারণ না দেখে তাঁরা কিভাবে মানবজাতির পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন?!
দ্বিতীয় দলীল: কুরআন কারীমে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
 ‘‘নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর (closer) এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। এবং আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর।’’[5]
এখানে ‘আউলা’ (أولى) শব্দটির মূল হলো ‘বেলায়াত’  (الولاية), অর্থাৎ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ‘আউলা’ অর্থ ‘অধিকতর ওলী’। অর্থাৎ অধিক বন্ধু, অধিক নিকটবর্তী, অধিক যোগ্য বা অধিক দায়িত্বশীল (more entitled, more deserving, worthier, closer)।
এখানে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর (closer) বলতে ভক্তি, ভালবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতা বুঝানো হচ্ছে। মুমিনগণ রাসূলুল্লাহকে তাঁদের নিজেদের চেয়েও বেশি আপন, বেশি প্রিয় ও আনুগত্য ও অনুসরণের বেশি হক্কদার বলে জানেন। এই ‘আপনত্বের’ একটি দিক হলো যে, তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আবার উম্মাতের প্রতি রাসূলুল্লাহ ()-এর দরদ ও প্রেম উম্মাতের আপনজনদের চেয়েও বেশি। রাসূলুল্লাহ () স্বয়ং এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেছেন। জাবির, আবূ হুরাইরা প্রমুখ সাহাবী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন:
‘‘প্রত্যেক মুমিনের জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতে আমি তার অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর বাণী পাঠ কর: ‘‘নবী মু’মিনগণের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর’’। কাজেই যে কোনো মুমিন যদি মৃত্যুবরণ করে এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীগণ যারা থাকবে তারা সে সম্পদ গ্রহণ করবে। আর যদি সে ঋণ রেখে যায় বা অসহায় সন্তান-সন্ততি রেখে যায় তবে তারা যেন আমার কাছে আসে; তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে। কারণ আমিই তার আপনজন।’’[6]
কিন্তু ‘হাযির-নাযির’-এর দাবিদারগণ দাবি করেন যে, এখানে দৈহিক নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই তিনি সকল মুমিনের কাছে হাযির আছেন।
এখানেও আমরা দেখছি যে একটি বানোয়াট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তারা কুরআন ও হাদীসে অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ()-এর ব্যাখ্যাকেও গ্রহণ করছেন না। সর্বোপরি তাদের এ ব্যাখ্যা সন্দেহাতীতভাবেই বাতিল। কারণ এ আয়াতেই বলা হয়েছে যে ‘‘আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর’’। অন্যত্রও বলা হয়েছে যে, ‘‘আত্মীয়গণ একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর।’’[7] তাহলে এদের ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের বলতে হবে যে, সকল মানুষই হাযির নাযির। কারণ সকল মানুষই কারো না কারো আত্মীয়। কাজেই তারা সদাসর্বদা তাদের কাছে উপস্থিত এবং তাদের সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন!
অন্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী () ও মুমিনগণ মানুষদের মধ্যে ইবরাহীম (আ)-এর সবচেয়ে ‘নিকটতর’ বা ‘ঘনিষ্ঠতর’ (أولى)।[8] এখানে দাবি করতে হবে যে, সকল মুমিন ইবরাহীমের নিকট উপস্থিত...!
অন্য হাদীসে ইবনু আববাস (রা) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ () মদীনায় আগমন করেন, তখন ইহূদীদের আশূরার সিয়াম পালন করতে দেখেন। তিনি তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তারা বলে, এ দিনে আল্লাহ মূসা (আ) ও ইস্রাঈল সন্তানদেরকে ফেরাউনের উপর বিজয় দান করেন। এজন্য মূসা (আ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিন সিয়াম পালন করেন। তখন তিনি বলেন:
نَحْنُ أَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ (مِنْهُمْ) وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
‘‘তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ)-এর নিকটতর। একথা বলে তিনি এ দিনে সিয়াম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন।’’[9] এখন আমাদের দাবি করতে হবে যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য মূসার কাছে উপস্থিত!!
তৃতীয় দলীল: আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
একদিন রাসূলুল্লাহ  আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন। সালাতের পরে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে (মিম্বরে আরোহণ করে) তিনি বলেন: হে মানুষেরা, আমি তোমাদের ইমাম। কাজেই তোমরা আমার আগে রুকু করবে না, সাজদা করবে না, দাঁড়াবে না এবং সালাত শেষ করবে না। (অন্য বর্ণনায়: কাতারগুলো পূর্ণ করবে।) কারণ আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই আমার সামনে এবং আমার পিছনে, যখন তোমরা রুকু কর এবং যখন তোমরা সাজদা কর। (অন্য বর্ণনায়: সালাতের মধ্যে এবং রুকুর মধ্যে আমি আমার পিছন থেকে তোমাদেরকে দেখি যেমন আমি সামনে থেকে তোমাদেরকে দেখি।)[10]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ  বলেন:
‘‘তোমরা কি এখানে আমার কিবলাহ দেখতে পাচ্ছ? আল্লাহর কসম, তোমাদের রুকু, সাজদা এবং বিনম্রতা আমার কাছে অপ্রকাশিত থাকে না এবং আমি তোমাদেরকে আমার পিঠের পিছনে দেখি।’’[11]
এ হাদীস থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারছি। তা হলো অন্যান্য মানুষ যেভাবে সামনে দেখে রাসূলুল্লাহ () পিছনেও সেভাবে সাহাবীগণের রুকু-সাজদা ইত্যাদি দেখতেন। ইসলামী আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এখানেও তিনটি ধারা বিদ্যমান:
(ক) মুতাযিলী ও ‘আকল’ বা জ্ঞানবুদ্ধির অনুসারী বলে দাবিদার কিছু মুসলিম। তাঁরা সহীহ হাদীসে প্রমাণিত এ বিষয়টিকে তাঁর ‘বাশারিয়্যাত’ বা মানবত্বের সাথে সাংঘর্ষিক বলে কল্পনা করে এ অর্থের হাদীসগুলি ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন: এখানে ‘দেখি’ অর্থ ‘ধারণা করি’, কারণ ‘দেখা’ আরবীতে ‘ধারণা’ বা মনের দেখা অর্থে ব্যবহৃত হয়, অথবা দেখি অর্থ আমাকে সংবাদ দেওয়া হয়... ইত্যাদি। তাঁদের দাবি: কুরআন প্রমাণ করে যে, তিনি মানুষ, আর মানুষ পিছনে দেখতে পরে না, অতএব কুরআনের অর্থ সংরক্ষণের জন্য এ হাদীসের এরূপ ব্যাখ্যা জরুরী। তাঁরা দাবি করেন, তাদের এ ব্যাখ্যা আরবী ভাষা ও কুরআন-হাদীসের ব্যাবহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে এরূপ ব্যাখ্যা ওহীর বিকৃতি মাত্র। মানবত্ব ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বৈপরীত্য কল্পনা করার কারণেই এ বিকৃতি।
(খ) শীয়া ও পরবর্তীকালে সুন্নীগণের মধ্যকার অতিভক্তিতে নিমজ্জিত মুসলিমগণ। তাঁরা ‘পিছনে দেখা’-র এ হাদীসটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন, তা হলো: ‘বিশ্বের সকল স্থান ও সময়ের সবকিছু দেখতে পাওয়া’। এর ভিত্তিতে তাঁরা তাঁকে ‘আলিমুল গাইব’ ও ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন। এরপর তাঁর বাশারিয়্যাত বিষয়ক ও ‘গাইব না জানা’ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যাপূর্বক বাতিল করেন।
(গ) সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ধারা। তাঁরা বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব ও ‘পশ্চাত-দর্শন’ উভয় বিষয়কে স্বাভাবিক ও প্রসিদ্ধ অর্থে গ্রহণ করেন এবং সরল অর্থে বিশ্বাস করেন।
হাদীসটি পাঠ করলে বা শুনলে যে কেউ অনুভব করবেন যে, বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও দর্শনের বিষয়ে। মানুষ যেরূপ সামনের দিকে দেখতে পায়, রাসূলুল্লাহ () সালাতের মধ্যে সেভাবেই পিছনে দেখতে পেতেন। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায় যে, এ দর্শন ছিল সালাতের মধ্যে ও রুকু সাজদার মধ্যে। অন্য সময়ে তিনি এইরূপ দেখতেন বলে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তা সত্ত্বেও যদি তা মনে করা হয় যে, তিনি সর্বদা এইরূপ সামনে ও পিছনে দেখতে পেতেন, তবুও এ হাদীস দ্বারা কখনোই বুঝা যায় না যে, তিনি দৃষ্টির আড়ালে, ঘরের মধ্যে, পর্দার অন্তরালে, মনের মধ্যে বা অনেক দূরের সবকিছু দেখতে পেতেন। তা সত্ত্বেও যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত ও বিরোধী না হতো, তবে আমরা এই হাদীস থেকে দাবি করতে পারতাম যে, তিনি এভাবে সর্বদা সর্বস্থানের সর্বকিছু দেখতেন এবং দেখছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন আয়াতে ও অগণিত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বারংবার এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। মূলত মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়মত রাসূল ()-কে এরূপ ঝামেলা ও বিড়ম্বনাময় দায়িত্ব থেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী বলেন:
‘‘হাদীসের বাহ্যিক বা স্পষ্ট অর্থ থেকে বুঝা যায় যে, পিছন থেকে দেখতে পাওয়ার এ অবস্থাটি শুধুমাত্র সালাতের জন্য খাস। অর্থাৎ তিনি শুধু সালাতের মধ্যেই এইরূপ পিছন থেকে দেখতে পেতেন। এমনও হতে পারে যে, সর্বাবস্থাতেই তিনি এইরূপ দেখতে পেতেন।.... দাঊদী[12] নামক ব্যাখ্যাকার একটি উদ্ভট কথা বলেছেন। তিনি এ বর্ণনায় ‘পরে’ শব্দটির অর্থ ‘মৃত্যুর পরে’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে পেশ করা হবে। সম্ভবত তিনি আবূ হুরাইরার (রা) হাদীসের সামগ্রিক অর্থ চিন্তা করেন নি, যেখানে এ কথার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে...।[13]
এখানে লক্ষণীয় যে, দাঊদীর যুগ বা হিজরী ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত এরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাকারীরাও ‘দেখা’ বলতে ‘উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে উপস্থিত করা হলে দেখেন’ বলে দাবি করতেন। তিনি মদীনায় নিজ কবরে অবস্থান করে সবত্র সবকিছু দেখেন অথবা সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত হয়ে সব কিছু দেখেন বলে কেউ কল্পনা করে নি। সর্বোপরি পিছনে ‘দেখা’ বা ‘গায়েবী দেখা’ দ্বারা ‘সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিতি’ বা সবকিছু দেখা প্রমাণিত হয় না। কুরআনে বলা হয়েছে যে, শয়তান ও তার দল মানুষদেরকে গায়েবীভাবে দেখে:
‘‘সে (শয়তান) ও তার দল তোমাদিগকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।’’[14]
এখানে কি কেউ দাবি করবেন যে, যেহেতু ‘‘তেমাদিগকে দেখে’ (يراكم) বর্তমান কালের ক্রিয়া, সেহেতু শয়তান ও তার দলের প্রত্যেকে ‘হাযির ও নাযির’: তারা সদা সর্বদা সকল স্থানের সকল মানুষকে একই ভাবে দেখছে?
চতুর্থ দলীল: বিভিন্ন হাদীসে উম্মাতের বিভিন্ন কর্ম রাসূলুল্লাহ -এর নিকট পেশ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উম্মাতের দরুদ-সালাত তাঁর নিকট পেশ করা হয় অর্থে অনেকগুলো সহীহ হাদীস বর্ণিত। এছাড়া উম্মাতের সাধারণ কর্মও তাঁর নিকট পেশ করা হয় অর্থে হাদীস বর্ণিত।
এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
‘‘আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর; তোমরা কথা বল এবং আমিও তোমাদের সাথে কথা বলি। এবং আমার মৃত্যু তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমাদের কর্ম আমার কাছে পেশ করা হবে। আমি ভালকর্ম দেখলে  সেজন্য আল্লাহর প্রশংসা করব এবং খারাপকর্ম দেখলে তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছ ক্ষমা চাইব।’’ ইমাম হাইসামী বলেন: সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস সনদের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন।[15]
এরূপ একটি বক্তব্য  প্রসিদ্ধ তাবিয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব (৯০ হি) থেকেও দুর্বল সনদে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ কিভাবে উম্মাতের জন্য ‘‘শাহিদ’’ হবেন বা সাক্ষ্য দিবেন তা ব্যাখ্যা করতে ইবনুল মুসাইয়িব বলেন:  
‘‘প্রতি দিনই সকালে বিকালে রাসূলুল্লাহ -এর সামনে তাঁর উম্মাতকে পেশ করা হয়, ফলে তিনি তাদেরকে তাদের নামে ও কর্মে চিনতে পারেন। এজন্য তিনি তাদের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’[16]
উম্মাতের আমল রাসূলুল্লাহ ()-এর নিকট পেশ করার এ সকল হাদীসকে তাঁর ‘হাযির-নাযির’ ও ‘আলিমুল গাইব’ হওয়ার ‘দলীল’ হিসেবে পেশ করা হয়। এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:
(১) উপরের হাদীসটি এবং সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িবের বক্তব্য নিশ্চিতভাবে ‘হাযির-নাযির’ ও ‘আলিমুল গাইব’ মতটি বাতিল প্রমাণ করে। কারণ এগুলি প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সদা-সর্বদা সবত্র হাযির (উপস্থিত) বা সবকিছুর নাযির (দর্শক) নন; বরং বরং উম্মাতের আমল তাঁর কাছে ‘হাযির’ করা হলে তিনি শুধু ‘আমলের’ নাযির বা দর্শক হন। তিনি উম্মাতের নিকট হাযির হন না; বরং উম্মাতের আমল তাঁর নিকট হাযির করা হয়।
(২) আমরা দেখেছি যে, দশজনেরও অধিক সাহাবী থেকে অনেক সহীহ সনদে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, তাঁর ওফাতের পরে সাক্ষী বা হাযির-নাযির হয়ে উম্মাতের সকল কর্ম দেখাশুনা করার ঝামেলা মহান আল্লাহ তাঁকে দেন নি। বরং তাদের অনেকের পরিবর্তন-উদ্ভাবন তিনি জানবেন না। দু-একটি দুর্বল বা একক হাদীসের মর্যিমাফিক ‘‘ব্যাখ্যা’’-কে আকীদার মূল বানিয়ে তার ভিত্তিতে কুরআন এবং মুতাওয়াতির হাদীসগুলির সুস্পষ্ট নির্দেশনা ব্যাখ্যার নামে বাতিল করার অর্থ ‘মিথ্যা’ ও ‘ব্যাখ্যা’ দ্বারা ধর্ম বিকৃত করা।
চতুর্থ দলীল: মহান আল্লাহ বলেন:
‘‘তুমি কি দেখ নি কেমন করলেন তোমার রব হস্তীবাহিনীর সাথে।’’[17]
রাসূলুল্লাহ ()-এর ‘‘হাযির নাযির’’ ও ‘‘ইলমুল গাইব’’ প্রমাণ করতে এ আয়াত উল্লেখ করা হয়। তাঁরা বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ () তাঁর জন্মের পূর্বেও আবরাহার হস্তীবাহিনীর বিপর্যয় দেখেছিলেন। এথেকে বুঝা যায় যে, তিনি পূর্বের ও পরের সকল কিছু দেখেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং সদা-সর্বত্র হাযির বা বিরাজমান!!
এদের কেউ হয়ত সত্যিই অজ্ঞ এবং কেউ জ্ঞানপাপী। তা নাহলে আরবী ভাষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকলেই জানেন যে, আরবীতে ‘‘দেখা’’ বলতে শুধু চক্ষুর দেখা বুঝানো হয় না, জানা বা জ্ঞানলাভও বুঝানো হয়। কুরআনে এরূপ ব্যবহার অগণিত। দুটি নমুনা দেখুন। কাফিরদের বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন:
‘‘তারা কি দেখে নি আমি ধ্বংস করলাম তাদের পূর্বে কত জাতি?’’[18]
তাঁদের যুক্তির ধারায় এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবূ জাহল-সহ সকল কাফিরই ‘‘হাযির-নাযির’’ বা অতীত-বর্তমান সবকিছুর দর্শক। তারা নূহ (আ) এবং অন্যান্য নবীদের (আ) যুগের কাফিরগণের ধ্বংসলীলার সময় উপস্থিত ছিল ও তা অবলোকন করেছিল!! অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
 ‘‘তোমরা কি দেখ নি কিভাবে সৃষ্টি করলেন আল্লাহ সপ্ত আসমানকে স্তর-বিন্যস্তকরে?’’[19]
আমরা কি বলব যে, কুরআন পাঠকারী ও শ্রোতা সকলেই সপ্ত আকাশ সৃষ্টির সময় ‘‘হাযির’’ বা উপস্থিত ছিলেন এবং তা অবলোকন করেছিলেন?!
‘‘হাযির-নাযির’’, ‘‘ইলমুল গাইব’’ ইত্যাদি বিষয়ের সকল ‘‘দলীল’’-ই এরূপ। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে এ সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যারা বলেন, তাঁরা তাঁদের কথাগুলোর পক্ষে একটিও দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করছেন না। তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক বা দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত বা হাদীসকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং এরপর এরূপ ব্যাখ্যার উপরে নির্ভর করে তাঁরা অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীস বাতিল করে দেন। যারা এরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান তাঁদের অনেকের নেক নিয়্যাত ও ভক্তি-ভালবাসা হয়ত নির্ভেজাল। তবে তাঁরা ভাল উদ্দেশ্যে ওহীর নামে মিথ্যা বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে এমন কথা বলেছেন যা তিনি কখনোই নিজের বিষয়ে বলেন নি।
দ্বিতীয় কারণ: এ সকল কথাকে রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদা-বৃদ্ধিকর বলে মনে করা এবং এ সকল কথা বললে তাঁর প্রতি ভক্তি, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি বা পূর্ণতা পাবে বলে মনে করা।
নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ()-এর ভক্তি ও ভালবাসা এবং তাঁর প্রশংসা করা ঈমানের মূল ও মুমিনের অন্যতম সম্বল। তবে এ জন্য কুরআনের অগণিত আয়াত ও অগণিত সহীহ হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশের বাইরে আমাদের যয়ীফ, মিথ্যা, বানোয়াট কথা বলতে হবে, বা যুক্তি, তর্ক, ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি দিয়ে কিছু কথা বানাতে হবে এ ধারণাটিই ইসলাম বিরোধী।
সর্বোপরি, আমরা যে বিষয়টিকে তাঁর জন্য মর্যাদাকর বলে মনে করছি সেটা প্রকৃতপক্ষে অমর্যাদাকর হতে পারে। হাযির-নাযির বিষয়টিই দেখুন। আমরা জানি, মর্যাদাহীন ব্যক্ত্যিই মর্যাদাশীল ব্যক্তির নিকট ‘হাযির’ হন। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, প্রশাসক, বিচারক এবং সকল পর্যায়ের মর্যাদাময় মানুষদের কাছে সাধারণ মানুষেরা ‘হাযির’ হন। এ সকল মর্যাদাময় মানুষেরা কখনোই সাধারণ মানুষদের কাছে ‘হাযিরা’ দিয়ে বেড়ান না। প্রয়োজনে কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ মানুষদের তথ্যাদি নিয়ে তাদের কাছে হাযির হন।
 সহীহ হাদীসগুলো রাসূলুল্লাহ -এর এ মর্যাদাই প্রমাণ করেছে। তিনি তাঁর পবিত্র কবরে অবস্থান করছেন। মহান আল্লাহ অগণিত ফিরিশতা নিয়োগ করেছেন যারা পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর নিকট পেশ করেন। এটিই তো মর্যাদার পূর্ণতা। কিন্তু অতিভক্তির নামে যদি কেউ দাবি করেন যে, তিনি নিজেই উম্মাতের দ্বারে দ্বারে হাযিরা দিয়ে বেড়ান তবে তা তাঁর মর্যাদা বাড়াবে না কমাবে তা পাঠক একটু চিন্তা করুন।
এজন্য মুমিনের নাজাতের একমাত্র উপায় সকল ক্ষেত্রে বিশেষত, আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহর উপর নির্ভর করা। আমলের ক্ষেত্রে কোনো আমল কারো জন্য জরুরী আর কারো জন্য কম জরুরী বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের বিষয় তা নয়। তা সকলের জন্য সমান। এজন্য আলিমগণ বলেছেন যে, বিশ্বাসের ভিত্তি হবে কুরআন কারীম বা মুতাওয়াতির হাদীসের উপর। অর্থাৎ যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সে বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ () তাঁর সকল সাহাবীকে জানিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই জানিয়েছেন। আর এরূপ বিষয় অবশ্যই কুরআনে থাকবে বা ব্যাপক প্রচারিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে থাকবে।
বিশ্বাসের ভিত্তি ‘গাইবী’ বিষয়ের উপরে। এ সকল বিষয়ে ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফয়সালা দেয়া যায় না। কর্ম বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে সুস্পষ্ট বিধান নেই এরূপ অনেক নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হয়, এজন্য সেক্ষেত্রে কিয়াস ও ইজতিহাদের প্রয়োজন হয়। যেমন মাইক, ধুমপান ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেরূপ নয়। এগুলোতে নতুন সংযোজন সম্ভব নয়। এজন্য আকীদা বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন ইমামগণ।[20] আল্লাহর গুণাবলি, নবীগণের সংখ্যা, মর্যাদা, ফিরিশতাগণের সংখ্যা, সৃষ্টি, কর্ম, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইজতিহাদের কোনো সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যেভাবে যতটুকু বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা ওহীর কথাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারি না।
এজন্য মুমিনের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, কুরআন কারীমের সকল কথাকে সমানভাবে গ্রহণ করা এবং কোনো কথাকে প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কথাকে বাতিল বা ব্যাখ্যা না করা। অনুরূপভাবে সকল সহীহ হাদীসকে সহজভাবে মেনে নেয়া। ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। যে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু নেই এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি, সে বিষয়ে চিন্তা না করা, কথা না বলা ও বিতর্কে না জড়ানো।
দলীলের উৎসঃ
[1] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫; সূরা (৪৮) ফাত্হ: ৮; সূরা (৭৩) মুয্যাম্মিল: ১৫; সূরা (২) বাকারা: ১৪৩; সূরা (৪) নিসা: ৪১; সূরা (১৬) নাহ্ল: ৮৯; সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর ২২/১৮, ২৬/৭৩; ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/৪৯৮।
[3] সূরা (২) বাকারা, ১৪৩; সূরা (২২) হজ্জ, ৭৮ আয়াত।
[4] সূরা (৪) নিসা: ৭৯, ১৬৬; সূরা (৫) মায়িদা: ১১৭; সূরা (১০) ইউনূস: ২৯; সূরা (১৩) রা’দ: ৪৩; সূরা (১৭) ইসরা (বানী ইসরাঈল): ৯৬; সূরা (২৯) আনকাবূত: ৫২; সূরা (৩৩) আহযাব: ৫৫; সূরা (৪৬) আহকাফ: ৮; সূরা (৪৮) ফাত্হ: ২৮ আয়াত।
[5] সূরা (৩৩) আহযাব, ৬ আয়াত।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮০৫, ৮৪৫, ৪/১৭৯৫; ৫/২০৫৪; ৬/২৪৭৬, ২৪৮০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৯২, ৩/১২৩৭, ১২৩৮।
[7] সূরা (৮) আনফাল: ৭৫ আয়াত।
[8] সূরা (৩) আল-ইমরান, ৬৮।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৪৪, ১৪৩৪, ১৭৬৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৫।
[10] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬২, ২৫৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩২০, ৩২৪।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৫৯।
[12] আবূ জাফর আহমাদ ইবনু সাঈদ দাঊদী নামক একজন আলিম সহীহ বুখারীর একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন। তাঁর পরিচয় বা ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ইবনু হাজার আসকালানী ফাতহুল বারী রচনায় এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি থেকে অনেক সময় উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন।
[13] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫১৫, ২/২২৫।
[14] সূরা : ৭ আ’রাফ, ২৭ আয়াত।
[15] বায্যার, আল-মুসনাদ ১/৩০৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৮/৫৯৪; বূসীরী, ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারাহ ৭/৭৪;& আলবানী, যায়ীফাহ ২/৪০৪-৪০৬; হুওয়াইনি, আল-ফাতাওয়া আল-হাদীসিয়্যাহ (শামিলা) ২/১৪-১৫।
[16] কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল মাওতা ও উমূরিল আখিরাহ, পৃ. ২৪৯; আল-জামিয় লি আহকামিল কুরআন ৫/১৯৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫০০।
[17] সূরা (১০৫) ফীল: ১ আয়াত।
[18] সূরা (৬) আনআম: ৬ আয়াত।
[19] সূরা (৭১) নূহ: ১৫ আয়াত।
[20] বিস্তারিত দেখুন: গ্রন্থকার রচিত: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৭০-৭৩।

 হাদীসের নামে জালিয়াতি - মীলাদুন্নবী () উদযাপন , . আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

মীলাদুন্নবী () উদযাপন
আমি ‘এহইয়াউস সুনান’ ও ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকদ্বয়ে মীলাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আলিমগণের মতামত ও সুন্নাত পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1] আমরা দেখেছি যে, মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর মীলাদ, সীরাত, শামাইল ও হাদীস আলোচনা করা, দরুদ-সালাম পাঠ করা, মহববত বৃদ্ধি করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত-সম্মত ইবাদত পালন করা হয়। নাম ও পদ্ধতিগত কারণে বিভিন্ন মতভেদ দেখা দিয়েছে। তবে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহ -এর জন্ম পালনের প্রচলন ছিল না। মীলাদুন্নবীর সমর্থক কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য দেখুন:
(ক) নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী (৮৫২ হি) মীলাদুন্নবী উদ্যাপন সমর্থন করেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘‘মাওলিদ পালন মূলত বিদ‘আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনের কোনো একজনও এই কাজ করেন নি।’’[2]
(খ) এ শতকের অন্য একজন প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান সাখাবী (৯০২ হি.)। তিনিও মীলাদুন্নবী উদ্যাপনের সমর্থক। তিনি লিখেছেন : ‘‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনের কোনো একজন থেকেও মাওলিদ পালনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদ্যাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সকল দেশের ও সকল বড় বড় শহরের মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ  -এর জন্মমাস পালন করছেন... বরকত লাভ করছেন। ’’[3]
(গ) নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী মীলাদের সমর্থনে অনেক পুস্তিকা রচনা করেন। ‘হুসনুল মাকদাস ফী আমালিল মাওলিদ’ পুস্তিকায় তিনি মীলাদের সমর্থনে বলেন:
‘‘মীলাদ পালন হলো: মানুষদের একত্রিত হওয়া, সাধ্যমত কুরআন তিলাওয়াত করা, রাসূলুল্লাহ -এর জন্ম এবং জন্মের সময় যে সকল অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল তা আলোচনা করা, এরপর দস্তরখান বিছানো হলে খাদ্য গ্রহণ করে প্রস্থান করা। এর অতিরিক্ত কিছুই করা হয় না। আমার মতে এরূপ কর্ম বিদআতে হাসানা, এর জন্য সাওয়াব পাওয়া যাবে; কারণ এতে  রাসূলুল্লাহ -এর তাযীম, তাঁর পবিত্র জন্মে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা হয়। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এ বিষয়টি উদ্ভাবন করেন তিনি ইরবিলের শাসক আল-মালিকুল মুযাফ্ফর আবূ সায়ীদ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি)...।’’[4]
(ঘ) দশম হিজরীর অন্যতম প্রসিদ্ধ সীরাতুন্নবী ও মীলাদুন্নবী গবেষক মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালিহী শামী (৯৪২ হি)। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘সীরাহ শামিয়্যাহ’ গ্রন্থে মীলাদুন্নবী উদযাপনের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য আলিমগণের বক্তব্য, যুক্তি, স্বপ্ন ও কাশফ উদ্ধৃত করে দীর্ঘ অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনিও সুস্পষ্টত উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদুন্নবী পূর্ববর্তী যুগে ছিল না, সর্বপ্রথম ইরবিলের শাসক কুকবূরী তা প্রচলন করেন।[5]
(ঙ) মীলাদের সমর্থক লাহোরের প্রখ্যাত আলিম সাইয়্যিদ দিলদার আলী (১৯৩৫ খৃ) মীলাদের পক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘‘মীলাদের কোনো আসল বা সূত্র প্রথম তিন যুগের কোনো সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয় নি; বরং তাঁদের যুগের পরে এর উদ্ভাবন ঘটেছে।’’[6]
(ছ) মীলাদের সমর্থনে বিগত ৮০০ বৎসরে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম অনেক দলীল, যুক্তি, মত, কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদির কথা লিখেছেন। তবে তাঁরা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে মীলাদ ছিল না। এজন্য তা  বিদআতে হাসানা।
(জ) মীলাদের সমর্থক সকল আলিমই আনুষঙ্গিক দলীলের উপর নির্ভর করেছেন। যেমন, মীলাদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম পাঠ, দান-সাদকা ইত্যাদি নেক আমল করা হয়, কাজেই তা মন্দ হবে কেন? আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহ -এর জন্মের সংবাদ পেয়ে খুশি হয়ে তার দাসীকে মুক্ত করে, এজন্য তিনি কাফির হয়েও কবরে উপকার লাভ করেন, রাসূলুল্লাহ নিজের জন্ম বিষয়ে কথা বলেছেন, সাহাবীগণ একে অপরের কাছে তাঁর গুণাবলি শুনতে চাইতেন, তাঁরা সালাতে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ -এর আগমন বিষয়ক কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন.... কাজেই মীলাদ-কিয়াম কুরআন-সুন্নাহ সম্মত ...। আমরা স্বভাবতই বুঝি যে, রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীগণ মীলাদুন্নবী পালন করেছেন মর্মে কোনো একটি যয়ীফ বা জাল হাদীসও যদি থাকতো তাহলে কেউই এ সকল আনুষঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক দলীল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করতেন না। বরং সরাসরি উক্ত দলীল পেশ করতেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হিজরী ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ‘ঈদ মীলাদুন্নবী’ উদ্ভাবন ও প্রচলন হওয়ার পরে বিগত প্রায় ৮০০ বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর অগণিত আলিম মীলাদকে পছন্দ করেছেন এবং এর পক্ষে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর পক্ষে জালিয়াতি করেন নি। বরং মীলাদের সমর্থক আলিমগণও মীলাদ প্রসঙ্গে জাল হাদীস বর্ণনা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে কিছু নির্লজ্জ জালিয়াত এ বিষয়ে জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ করেছে।
কিছু অংশে লেখকের লেখা আমাদের কাছে স্পষ্ট বোধগম্য হয়নি যে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন। আমরা লেখকের সাথে অচিরেই এই বিষয়ে কথা বলে অস্পষ্ট  বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ
----------------------------------------------------------------------------------------------
[1] দেখুন: এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫১৬-৫৫৫; রাহে বেলায়াত, পৃ. ৬৩৮-৬৪০।
[2]
শামী, মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) /৩৬৬
[3]
শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ /৩৬২
[4]
সুয়ীতী, আল-হাবী ফিল ফাতাওয়া /১৮১-১৮২।
[5]
শামী, সীরাত শামিয়্যাহ /৩৬২।
[6]
সাইয়িদ দিলদার আলী, রাসূলুল কালাম ফিল মাওলিদ ওয়াল কিয়াম, ১৫ পৃ।
জাল বইয়ের জাল হাদীস
হিজরী দশম শতকের প্রসিদ্ধ আলিম ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী (৮৯৯-৯৭৪/১৪৯৪-১৫৬৬ হি)-এর নামে তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা গত ১৯৯৩ খৃ (১৪১৪ হি) ‘‘আন-নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়িদি ওয়ালাদি আদাম’’ (বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আদম সন্তানদের নেতার জন্মের মধ্যে) নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। এ বইটির মধ্যে মীলাদের পক্ষে সাহাবীগণের নামে অনেকগুলো সনদ বিহীন জাল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এ জাল বইটির প্রথম অধ্যায় নিম্নরূপ:
‘‘প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদুন্নবী ()-এর মর্যাদা বর্ণনায়। আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে। উমার (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে সে ইসলামকে জীবিত করবে। উসমান (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে যেন বদর বা হুনাইনের যুদ্ধে যোগদান করলো। আলী (রা) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে এবং মীলাদুন্নবী পাঠের কারণ হবে, সে দুনিয়া হতে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হাসান বসরী (রাহ) বলেন: আমার কামনা হয় যে, যদি আমার উহদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তবে আমি তা মীলাদুন্নবী পড়ার জন্য ব্যয় করতাম। ... ইমাম শাফিয়ী (রাহ) বলেন: যদি কেউ মীলাদুন্নবীর জন্য বন্ধুদেরকে জমায়েত করে, খাবার প্রস্ত্তত করে, স্থান খালি করে দেয়, দান-খয়রাত করে এবং তার কারণে মীলাদুন্নবী পড়া হয় তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণের সাথে উত্থিত করবেন এবং সে জান্নাতে থাকবে।...’’
এভাবে আরো অনেক তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণের নামে মীলাদুন্নবী ‘পড়া’-র ফযীলতে অনেক বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এখানে দুটি বিষয় আলোচনা করব: (১) বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নামে একটি জাল বই এবং (২) এ সকল হাদীস ও বক্তব্য সবই নির্লজ্জ জালিয়াতদের বানানো মিথ্যা কথা। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) আল্লামা ইবনু হাজার হাইতামীর পুরো নাম: আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাজার শিহাবুদ্দীন মাক্কী শাফিয়ী। তিনি মীলাদুন্নবী উদযাপন ও মীলাদ পালনের সমর্থক ছিলেন। মীলাদুন্নবী বিষয়ক তাঁর রচিত একটি গ্রন্থের নাম ‘‘ইতমামুন নি’মাতিল কুবরা আলাল আলাম বিমাওলিদি সাইয়িদি ওয়লাদি আদাম’’, সংক্ষেপে: ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’। গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ। বিগত ৪০০ বৎসরে অনেক আলিম এ গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন এবং গ্রন্থটির অনেক পান্ডুলিপি বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বিদ্যমান।
এখানে আরব বিশ্বের কয়েকটি গ্রন্থাগার ও পান্ডুলিপি নম্বর উল্লেখ করছি। ইরাকের সুলাইমানিয়া প্রদেশের ওয়াকফ গ্রন্থাগার (মাকতাবাতুল আওকাফ), নং ১৩/৪৫৬-আইন এবং পান্ডুলিপি নং তা/মাজামী/২১৫-২১৮।  সৌদি আরবের রিয়াদস্থ বাদশাহ ফয়সল গবেষণা কেন্দ্র, পান্ডুলিপি নং- ০২৬৩৩, ১৫২২-ফা-কাফ এবং পান্ডুলিপি বিষয়ক অধিদপ্তর, পান্ডুলিপি গ্রন্থাগার, নং ১৫৮৫, ৭০৩০, ১৪৪৬। মরক্কোর খাযানাতু তাতওয়ান গ্রন্থাগারে, পান্ডুলিপি নং ১৩/৪৫৬-আইন। ইয়ামানের সানআ শহরের বড় মসজিদের প্রাচীন গ্রন্থাগার: মাকতাবাতুল জামিয়িল কাবীর, পান্ডুলিপি নং ২২-মীম-জীম। সিরিয়ার দামেশক শহরের যাহিরিয়া গ্রন্থাগার, পান্ডুলিপি নং ৮৭২২, ৮১৬৪, ১১৩০১, ১১৩৪১, ৮৫৭১, ১১৩৬১, ৯৪৮৩, ৯৫৫৩। এ সকল পান্ডুলিপির ভিত্তিতে এ বইটি ইদানিং বৈরুত থেকে ছাপা হয়েছে।
(২) তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থটির সাথে এ সকল পান্ডুলিপির কোনোরূপ মিল নেই। বস্ত্তত বইটির কভারের নাম ও লেখকের নাম ছাড়া ভিতরের সবই জাল।
(৩) ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’-র মূল পান্ডুলিপিগুলোর বক্তব্য নিম্নরূপ:
‘‘আল্লাহর প্রশংসা করছি সকল পরিপূর্ণ প্রশংসা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সর্বোত্তম ও পূর্ণতম কৃতজ্ঞতা... মীলাদুন্নবী পালনের মূলভিত্তি বর্ণনা করার জন্য আমি একটি পুস্তিকা লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম....। এটি লিখতে আমি উদ্বুদ্ধ হলাম তার কারণ মীলাদ পালনের মূলভিত্তি বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করেছে যে তা বিদআত কি না। আর গল্পকার বক্তা ও ওয়ায়িজগণ ব্যাপকভাবে জাল হাদীস এবং ভিত্তিহীন গল্প ও কবিতা বলছেন। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল () থেকে একটুও লজ্জাবোধ করেন না- নির্লজ্জভাবে তাঁদের নামে মিথ্যা বলেন- কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কখনো মুর্খতার কারণে। এজন্যই ইমামগণ বলেছেন: প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব দায়িত্ব হাত দিয়ে, জিহবা দিয়ে বা অন্তর দিয়ে এদের প্রতিবাদ করা।... প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদ পালনের মূল ভিত্তি বর্ণনার জন্য। পাঠক জেনে রাখুন যে, মীলাদ পালন বিদআত; কারণ রাসূলুল্লাহ () যে তিন যুগের কল্যাণের সাক্ষ্য দিয়েছেন সে তিন যুগের সালফ সালিহীন কোনো ব্যক্তি থেকে এ কর্ম বর্ণিত হয় নি। তবে তা বিদআতে হাসানা বা ভাল বিদআত। কারণ এর মধ্যে অনেক ভাল কাজ অন্তর্ভুক্ত। যেমন দরিদ্রদের ব্যাপক কল্যাণ ও সহযোগিতা করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি যিকর ও দরুদ পাঠ.....। ক্রুশের অনুসারী খৃস্টানগণ যদি তাদের নবীর জন্মের রাতকে সবচেয়ে বড় ঈদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে তবে এ কাজে ইসলামের অনুসারীদের অধিকার অধিকতর। .....।’’[1]
(৪) আমরা দেখছি যে, মূল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের প্রথমেই ইবন হাজার হাইতামী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের যুগের একজন মানুষও মীলাদুন্নবী পালনের কথা জানতেন না। খৃস্টান সম্প্রদায় ২৫ ডিসেম্বর যীশুখৃস্টের জন্মদিনকে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ হিসেবে পালন করেন। বিশেষত ৫ম হিজরী শতকের শেষে ৪৯১ হি/ ১০৯৭ খৃ থেকে খৃস্টান ক্রুসেডারগণ সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক ও মিসরের বিভিন্ন দেশ দখল করে খৃস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সকল দেশে দখলদার খৃস্টানগণ মহাসমারোহে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ পালন করতেন। বিষয়টি মুসলিমদেরকে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ পালনের প্রেরণা দেয়। শতবর্ষ পরে ষষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে এসে মুসলিম সমাজও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করে।
পক্ষান্তরে জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের মূল বক্তব্য যে, খুলাফায়ে রাশেদীন সকলেই মীলাদ পালন করতেন এবং মীলাদ পালনকেই দীনের সবচেয়ে বড় বিষয় বলে প্রচার করতেন। চার খলীফা যখন এভাবে মীলাদের মহাগুরুত্ব প্রচার করতেন তখন স্বভাবতই তাঁদের যুগের সকল সাহাবী-তাবিয়ী প্রতিদিনই মহাসমারোহে তা পালন করতেন!!
(৫) আলিমদের উদ্ধৃতিও জাল ‘নিমাতুল কুবরা’-র জালিয়াতি প্রমাণ করে। সীরাহ হালাবিয়্যাহর লেখক আল্লামা হালাবী (১০৪৪ হি), তাফসীর রুহুল বায়ানের লেখক আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (১১২৭ হি), ‘জা’আল হক্ক’ গ্রন্থের লেখক মুফতি আহমাদ ইয়ার খান প্রমুখ আলিম মীলাদের পক্ষে ইবন হাজার হাইতামী থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি তা বিদআতে হাসানা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মীলাদের পক্ষে সাহাবী-তাবিয়ীগণ থেকে কোনো হাদীস উদ্ধৃত করেছেন বলে কেউই উল্লেখ করেন নি। পান্ডুলিপির বর্ণনায় রচিত গ্রন্থগুলোতেও উপরে উদ্ধৃত মূল পান্ডুলিপির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।[2]
(৬) এভাবে আমরা নিশ্চিত যে, মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নি’মাতুল কুবরার নাম চুরি করে প্রকাশিত একটি জাল বই। তবে লক্ষ্যণীয় যে, এ জাল বইটি যদি জাল না হয়ে ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী শাফিয়ীর নিজের লেখা বলে প্রমাণ হতো তাতেও এ গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতা প্রমাণ হতো না। ইবন হাজার মাক্কী শাফিয়ী তো দূরের কথা, স্বয়ং ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস মাক্কী শাফিয়ীও বা অন্য কোনো ইমাম, মুজতাহিদ, পীরানে পীর বা বুজুর্গও যদি এভাবে সনদবিহীন কোনো কথা উদ্ধৃত করেন তবে তা সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই না করে কোনো মুসলিম কখনোই গ্রহণ করবেন না। ইমাম শাফিয়ী উদ্ধৃত অনেক হাদীস পরবর্তী শাফিয়ী ফকীহগণ দুর্বল বা জাল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হানাফী, মালিকী, হাম্বালী, কাদিরী, চিশতী, শাযিলী... সকল মাযহাব ও তরীকার আলিমগণ একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্রথম পর্বে আমরা এ সকল বিষয় আলোচনা করেছি।
(৭) রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীগণের হাদীসের ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে তিনিও বুঝতে পারবেন যে, এগুলো সবই জাল কথা। কোনো ইংরেজি ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে পানি খাওয়ার ইংরেজি (eating water), অথবা আরবী ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে ‘‘নামায পড়া’’-র আরবী ‘‘قراءة الصلاة’’ লিখলে কোনো যাচাই ছাড়াই বুঝা যায় যে, ডকুমেন্টটি জাল এবং জালিয়াত একজন বাঙালী। তেমনি ‘মীলাদ পাঠের’ আরবী (قراءة المولدقراءة الميلاد) শুনলে কুরআন-হাদীসের আরবী বিষয়ে অভিজ্ঞ যে কেউ নিশ্চিত বুঝবেন যে, কথাটি কখনোই সাহাবীদের যুগের কারো কথা নয়; বরং সুনিশ্চিত জাল কথা এবং এ জালিয়াত তুর্কী বা তুর্কী যুগের তুর্কী ভাষা দ্বারা প্রভাবিত কোনো আরব জালিয়াত। ৬০০ হিজরীর দিকে মীলাদ উদযাপন শুরু হলে প্রথম কয়েক শত বৎসর একে (الاحتفال بالمولد) ‘মীলাদ উদযাপন, (عمل المولد) মীলাদ পালন ইত্যাদি বলা হতো। বিগত ২/৩ শত বৎসর যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যে মীলাদ মাহফিলে মীলাদ বিষয়ক পুস্তিকা পাঠের প্রচলন হয়েছে। এজন্য বিগত ১/২ শত বৎসর যাবৎ মীলাদ অনুষ্ঠানকে অনেক সময় ‘‘মীলদুন্নবী পাঠ’’ বলা হয়। জালিয়াতগণ এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন।
[1] ইবন হাজার হাইতামী, আন-নিমাতুল কুবরা (মিসরের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি, নং ৪৪৯) পৃষ্ঠা -৩।
[2]
হালাবী, আস-সীরাহ আল-হালাবিয়্যাহ /১৩৭; ইসমাঈল হাক্কী, রুহুল বায়ান /, ৪৭; ইসমাঈল পাশা বাবাতী বাগদাদী, ঈযাহুল মাকনূন /৬৬১; হাদিয়্যাতুল আরিফীন /৭৮; মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জাআল হক (অনুবাদ অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, মোহাম্মদী কুতুবখানা, চট্রগ্রাম, ১৯৮৮), দ্বিতীয়াংশ ৩৯-৪০।
আরো কয়েকটি জাল হাদীস
মীলাদ পালনের পক্ষে জালিয়াতদের বানানো আরো দুটি হাদীস:
‘‘ইবন আববাস বলেন, একদিন তিনি নিজ বাড়িতে রাসূলুল্লাহ -এর জন্মের ঘটনাবলি বর্ণনা করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ আগমন করেন এবং বলেন: তোমাদের জন্য আমার শাফাআত পাওনা হলো।’’ (জালিয়াত লক্ষ্য করে নি যে, ইবন আববাসের বয়স ৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেই রাসূলুল্লাহ -এর ইন্তেকাল হয়। তিনি কি ৫/৬ বৎসর বয়সে ছেলেমেয়েদের হাদীস শুনাচ্ছিলেন!)
আবূ দারদা (রা) বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ -এর সাথে আমির আনসারীর (রা) বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি তাঁর সন্তান ও পরিবারের মানুষদের তাঁর  জন্মের ঘটনাবলি শেখাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন: আজই সেই দিন। তখন রাসূলুল্লাহ বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য রহমতের দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন এবং ফিরিশতাগণ তোমাদের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে।’’
বর্তমানে মীলাদের পক্ষের কোনো কোনো আলিম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি), আব্দুল হক্ক ইলাহাবাদী ও অন্যান্য আলিমের নামে এ সকল হাদীস উদ্ধৃত করছেন। এগুলোর কোনোরূপ সনদ কেউ উল্লেখ করেন নি। এমনকি ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে সংকলিত কোনো গ্রন্থে এগুলো সনদসহ বা সনদ ছাড়া সংকলিত হয়েছে বলেও কেউ প্রমাণ বা দাবি করেন নি।
৬০০ বছর যাবৎ সকল ইমাম ও বুজুর্গই কি মীলাদ বিরোধী?
সম্মানিত পাঠক, ইহূদী-খৃস্টানগণ তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি কিতাবের নামে জালিয়াতি করে তাদের ধর্মকেই বিকৃত করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম উম্মাহও ইহূদী-খৃস্টানদের হুবহু অনুকরণ করে বিভ্রান্তির গভীরে নিমজ্জিত হবে বলে রাসূলুল্লাহ () উম্মাতকে বারবার সাবধান করেছেন।[1] আমরা দেখি যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রবণতা ইহূদী-খৃস্টানদের মতই ব্যাপকতা লাভ করে। তবে মহান আল্লাহ দীন ইসলামকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। সাহাবীদের যুগ থেকে উম্মাতকে সনদ সংরক্ষণ ও সনদ-যাচাইয়ের তাওফীক দিয়ে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করার পথটি রক্ষা করেছেন। ইহূদী-খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সনদ সংরক্ষণ ও বিচারের ব্যবস্থা না থাকায় সহীহ ও জাল এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, পার্থক্য করার কোনো যুক্তিসম্মত পদ্ধতি নেই, ফলে প্রত্যেকে নিজ নিজ যুক্তি-বুদ্ধি ও পছন্দ অনুসারে কিছু সহীহ ও কিছু জাল বলে দাবি করেন। আর ইসলামের মধ্যে জালিয়াতগণ অনেক জালিয়াতি করলেও যাচাই করার পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু যদি কেউ জালিয়াতি করতে চান বা জাল কথা গ্রহণ করতে চান তবে তার কথা ভিন্ন।
সম্মানিত পাঠক, ন্যূনতম পর্যায়ের সাধারণ জ্ঞানের যে কোনো মুসলিম বুঝতে পারেন যে, এ কথাগুলো জাল। কারণ এগুলোর কোনো সনদ নেই। ইসলামের প্রথম ৬/৭ শত বছরের মধ্যে লিখিত কোনো গ্রন্থে সনদ-বিহীনভাবেও এ মিথ্যা কথাগুলো উল্লেখ করা হয় নি। তবে এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে গ্রহণ করা আরো ভয়ঙ্কর বিষয়। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) মীলাদের সমর্থকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ উদযাপন করেন নি। পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ গবেষক প্রফেসর ড. তাহির কাদিরী রচিত ‘মীলাদুন্নবী’ গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তিনি নিজেও নিশ্চিত করেছেন যে, বাদশাহ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি) প্রথম মীলাদ উদযাপন শুরু করেন। এছাড়া তিনি মীলাদের সমর্থনে গত ৮০০ বৎসরের অনেক প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ পালন করেন নি।[2] এখন উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করার অর্থ সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী তিন প্রজন্মের সকলকে বিভ্রান্ত বলে দাবি করা (নাউযূ বিল্লাহ)। কারণ রাসূলুল্লাহ () ও খুলাফায়ে রাশেদীনের এতগুলো বক্তব্য জানার পরেও যারা মীলাদ পালন করেন নি তাদের চেয়ে হতভাগা-বদকার ও রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদার শত্রু আর কে হতে পারে!! (নাঊযু বিল্লাহ)
(খ) এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে মানতে হলে হাজার বৎসরের সকল হাদীস সংকলক মুহাদ্দিসকে নবীজী ()-এর দুশমন (!!) বলে গণ্য করতেই হবে। কারণ, ইবন আববাস (রা), আবূ দারদা (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের মর্যাদা বিষয়ক রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীস এবং আবূ বকর (রা), উমার (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের হাদীসগুলো তাঁরা গোপন করেছেন। এ সকল সাহাবী (রা) থেকে সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদে বর্ণিত অতি সাধারণ বিষয়ে অগণিত হাদীস তাঁরা সংকলন করলেন, অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তাঁরা কেউ কোনোভাবে সংকলন করলেন না!!
ইসলামের প্রথম হাজার বৎসরে সংকলিত হাদীসগ্রন্থগুলোতে হাঁটাচলা, পানাহার, মলমূত্র ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। কিন্তু ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘ইহতিফালুল মাওলিদ’ (মীলাদ উদযাপন) ইত্যাদি নামে এ সকল হাদীসের গ্রন্থে একটি অধ্যায় তো দূরের কথা, একটি পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদও তারা লিখেন নি এবং একটি হাদীসও তাঁরা সংকলন করেন নি।
(খ) ইমাম আবূ হানীফাসহ চার ইমাম ও ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ফকীহ একইভাবে রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদা ও মীলাদের দুশমন বলে গণ্য হবেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ফিকহী গ্রন্থগুলোতে অতি সামান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কারো গ্রন্থে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘তাযীমুল মাওলিদ’ (মীলাদের তাযীম) ইত্যাদি নামে কোনো একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা মাসআলা তাঁরা লিখলেন না। এর গুরুত্বও বললেন না!
(গ) উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল আলিমই মীলাদ-বিরোধী ও রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদার দুশমন (!!!) বলে গণ্য হবেন। কারণ, ৬০৪ হিজরী সালে মীলাদুন্নবী পালনের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে বিগত ৮০০ বৎসরে উম্মাতের আলিম ও বুজুর্গগণ মীলাদুন্নবী বিষয়ে হাজার হাজার পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। কিন্তু এর আগের ৬০০ বৎসরে একজন আলিম বা বুজুর্গ মীলাদুন্নবী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন নি। মীলাদের সমর্থক আলিমগণও বারবার উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদ বিষয়ক প্রথম বই রচনা করেন আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনু দেহিয়া (৬৩৩ হি.)। তাঁর রচিত এ বইয়ের নাম: ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’।[3] পূর্ববর্তী ৬০০ বৎসরের ইমাম, ফকীহ, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ কেউ মীলাদ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও লিখেন নি। তাঁরা অনেক বই লিখেছেন, কিন্তু তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ) বা ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) বিষয়ে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ বা বাক্যও লিখেন নি!
আমরা যখন বলি যে, ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর মীলাদ পালন ছিল না, পরে উদ্ভব হয়েছে তখন বিষয়টি খুবই সহজ হয়ে যায়। যেহেতু তাঁদের সময়ে কেউ মীলাদ পালন করার বিষয়টি জানতই না সেহেতু তাঁরা এ বিষয়ে কিছু লিখেন নি। কিন্তু যখন প্রমাণ হয় যে, হাদীসে নববী এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে মীলাদের গুরুত্ব বিদ্যমান তখন বিষয়টি ভিন্ন হয়ে যায়। হাদীসে মীলাদের এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মীলাদের বিষয়ে একটি লাইন লিখলেন না! জীবনে মীলাদ পালন করলেন না! তাঁরা কেমন মুসলমান???
বিষয়টি কী প্রমাণ করে? স্বভাবতই প্রমাণ করে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরে মুসলিমগণ ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) ইত্যাদি কিছুই জানতেন না। কিন্তু যদি কেউ উপরের হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করেন তবে তাকে মানতেই হবে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ইমাম, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ সকলেই মীলাদ বিরোধী ছিলেন। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তাঁরা মীলাদ বিষয়ক হাদীস গোপনের মত মহাপাপ করেছেন।
(ঘ) ইমাম শাফিয়ীর প্রতিটি বক্তব্য সংকলন ও আলোচনা করেছেন বাইহাকী, নাবাবী ও অন্যান্য শাফিয়ী মুহাদ্দিস-ফকীহ। ইবন হাজার হাইতামী শাফিয়ীর নামে জালকৃত এ বইয়ে মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর এ মহান বক্তব্যটি তাঁরা সকলেই গায়েব করে দিয়েছেন! শাফিয়ী মাযহাবের কোনো গ্রন্থে এ বক্তব্য নেই। এমনকি ইবন হাজার হাইতামীর লেখা শাফিয়ী মাযহাবের বড়বড় ফিকহী গ্রন্থেও তিনি মীলাদ বিষয়ে ইমাম শাফিয়ীর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেন নি। আমাদের মানতে হবে যে, এ বক্তব্য জাল অথবা নাবাবী, বাইহাকী, গাযালী, সুয়ূতী, ইবন হাজার আসকালানী, ইবন হাজার হাইতামী ও সকল শাফিয়ী ফকীহ তাঁদের ঈমানী ত্রুটির কারণে মীলাদের প্রসঙ্গ গোপন করেছেন!!
[1] খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৫৪১-৫৬০।
[2]
. তাহির কাদিরী, মীলাদুন্নবী (লাহোর, মিনহাজুল কুরআন পাবলিকেশন্স ২০০৪) পৃ ৫০৩, ৬১৫, ৬২৬-৬৩১, ৬৩৮-৬৩৯, ৯২৬।
[3]
ইবন খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল ইয়ান /৪৪৯; সুয়ূতী, আল-হাবী (শামিলা) /২৭২, /১৮১-১৮২; ইবন হাজার হাইতামী, তুহফাতুল মুহতাজ ফী শরাহিল মিনহাজ (শামিলা) ৩১/৩৭৬-৩৭৭, ৩৮১; মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জাআল হক /৪০-৪১।
৮০০ বছরের সকল মীলাদ-পন্থীই কি সত্যগোপনকারী?
সম্মানিত পাঠক, এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ৮০০ বৎসর যাবৎ অগণিত আলিম মীলাদের পক্ষে বইপত্র লিখেছেন। তাঁরা সকলেই মীলাদকে বিদআতে হাসানা বলেছেন এবং ইসলামের প্রথম তিন যুগে কেউ মীলাদ পালন করেন নি বলে বারবার নিশ্চিত করেছেন। উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ মানতে হলে আমাদের মানতে হবে যে, তাঁরা সকলেই সত্য গোপন করেছেন এবং মীলাদের অবমর্যাদা করেছেন। তাঁরা আবূ লাহাবের আমল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, অথচ রাসূলুল্লাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুস্পষ্ট হাদীসগুলো গোপন করেছেন। হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইতিহাস, তাসাউফ ইত্যাদি বিষয়ে সকল দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করে পানাহার, শয়ন-নিদ্রা, মলমূত্র এবং অন্যান্য অতি সাধারণ বিষয়ের হাদীসগুলো তারা সংগ্রহ, সংকলন ও যাচাই-বাছাই করলেন, অথচ মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তারা সংকলন বা মূল্যায়ন কিছুই করলেন না!!
সম্মানিত পাঠক, খৃস্টান প্রচারকণ বাংলাদেশের মুসলিমদের নানাবিধ প্রতারণার মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করছেন। জালিয়াতিতে ভরা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’, ইঞ্জিল শরীফ ইত্যাদিকে ‘আল্লাহর কালাম’ হিসেবে পেশ করে তারা মুসলিমদের প্রতারণা করছেন। আমরা যখন ময়দানে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জালিয়াতি প্রমাণ করতে যাই তখন তারা বিভিন্ন অযুহাতে পালিয়ে যান বা এড়িয়ে যান। কিন্তু ময়দান ফাঁকা হলেই তারা সরল মুসলিমদের বলেন, কুরআনেই তো আছে তাওরাত-ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম, সেগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। আর আমাদের হাতের এগুলোই আদি-অকৃত্রিম তাওরাত-ইঞ্জিল। কাজেই এগুলো বিশ্বাস না করলে মুসলমান থাকা যাবে না!!
জাল হাদীসের বিষয়টিও একইরূপ। বিগত দেড় হাজার বছর যাবৎ যত জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ পেয়েছে, উম্মাতের আলিমগণ সেগুলোর জালিয়াতি উন্মোচন করেছেন। কিন্তু যারা যে কোনোভাবে নিজের মত প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর তারা জালিয়াতির এ সকল প্রমাণ খন্ডনের চেষ্টা না করে এবং হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধান না করেই সাধারণ মুসলিমদের সামনে এগুলোকে হাদীস হিসেবে পেশ করে নিজেদের মত প্রমাণের চেষ্টা করছেন। জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের ও মীলাদ বিষয়ক অন্যান্য জাল হাদীসের একই অবস্থা।
জালিয়াতি ও বিকৃতির অগণিত অকাট্য প্রমাণ জানার পরেও ইহূদী-খৃস্টানগণ বিভিন্ন অজুহাতে তাদের জাল ধর্মগ্রন্থগুলো প্রচার করে চলেছেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও কিছু মানুষ এরূপই করছেন। তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ জাল বইটির জালিয়াতি সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এবং এতে উল্লেখিত হাদীসগুলো সনদবিহীন ও ভিত্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও মীলাদ সমর্থক কিছু আলিম এ বইটির অনুবাদ ও প্রচার করছেন। হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধানের কোনোরূপ চেষ্টাও করছেন না। ইহূদী-খৃস্টান ধর্মে জাল কথাগুলো সহীহ কথার সাথে মিশে গিয়েছে। তবে সনদ ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য যাচাইয়ের পথ খোলা রেখেছেন। হাজার বছর চলে গেলেও এবং হাজার হাজার প্রসিদ্ধ ইমাম আলিমের নামে জালিয়াতি করলেও কোনো জাল কথাই ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। সত্যানুসন্ধানীর জন্য নিরপেক্ষ ও বস্ত্তনিষ্ঠ যাচাইয়ের পথ উন্মুক্ত।
রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের নামে মীলাদের পক্ষে এতগুলো হাদীস দেখে মুমিনের জন্য আনন্দিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁর ঈমানের দাবি যে, তিনি প্রথমেই এগুলোর সনদ ও সূত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। নয়শত বা হাজার বছর পরে একজন আলিম একটি হাদীস বলছেন, তাহলে নিশ্চয় পুরাতন কোনো গ্রন্থে তা রয়েছে। মীলাদের পক্ষের বা বিপক্ষের প্রত্যেক আলিমের দায়িত্ব এগুলোর সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই। যদি সনদ পাওয়া যায় ও গ্রহণযোগ্য হয় তবে সেগুলো মেনে নেওয়া প্রত্যেক মুমিনের ঈমানের দাবি। আর যদি সনদ না পাওয়া যায় বা সনদ জাল বলে প্রমাণ হয় তবে এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। ইবন হাজার হাইতামী এবং অন্যান্য ইমাম ও মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসের সনদ না জেনে বা অন্তত হাদীসের কোন গ্রন্থে তা সংকলিত তা নিশ্চিত না হয়ে সনদ-বিহীন হাদীস উল্লেখ করা ভয়ঙ্কর হারাম কর্ম এবং কোনো খতীব, ওয়ায়িজ বা লেখক এরূপ করলে তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে শাস্তি দেওয়া জরুরী।[1]
সম্মানিত পাঠক, মীলাদ ও অন্য যে কোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভিন্ন মত পোষণ করা, ইজতিহাদ করা ও প্রমাণ পেশ করার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কিন্তু তাই বলে জালিয়াতি!! মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
[1] ইবন হাজার হাইতামী, আল-ফাতাওয়া আল-হাদীসিয়্যাহ (বৈরুত, তুরাস), পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪ ১২১-১২২।

   বিদআতিদের শেষ পরিনতি-জাহান্নাম

১.বিদা’তিকে সহযোগিতাকারীর উপর আল্লাহর অভিশাপঃ
আলী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
আল্লাহ অভিশাপ করেছেন সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো নামে জবাই করে, আর যে জমির সীমা চুরি করে, আর যে মাতা পিতাকে অভিশাপ দেয়, আর যে বিদা’তিকে আশ্রয় দেয়। (মুসলিম,কিতাবুল আযাহী,হাদিস-১৯৭৮)
২.বিদআতির আমল আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্যঃ
আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যা দ্বীনে নেই, সেই কাজটি আল্লাহর কাছে পরিত্যাজ্য।
(বুখারি ও মুসলিম,আলল’লুউ ওয়াল মারজান,২য় খণ্ড,হাদিস-১১২০)
৩.বিদআতির তাওবা গ্রহণযোগ্য হবে না,যতক্ষণ না সে বিদআত সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়ঃ
আনাস ইবনু মালেক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম)বলেছেনঃ
আল্লাহ তা’আলা বিদা’তিদের তাওবা গ্রহন করেন না ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ না সে বিদআত থেকে সম্পূর্ণ তওবা করে। (তারবানী,সহীহুত তারগীব ওয়াততারহীব,১ম খণ্ড,হাদিস-৫২)
৪.রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) এর অসন্তুষ্টির কারণঃ
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) কিয়ামতের দিন বিদআতি লোকদের প্রতি বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন।
সাহাল ইবনু সাআদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
আমি হাউজে কাওসারে তোমাদের অপেক্ষাই থাকব। যে ব্যাক্তি সেখানে আসবে সে পানি পান করবে। আর যে ব্যক্তি একবার পান করবে সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। কিছু লোক এমন আসবে যাদের আমি চিনি এবং তারাও আমাকে চিনবে। আমি মনে করব, তারা আমার উম্মাত। তারপর তাদেরকে আমার কাছ পর্যন্ত পৌছতে দেওয়া হবে না। আমি বলবো, এরা তো আমার উম্মত। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ,আপনি জানেন না, আপনি দুনিয়া থেকে চলে আসার পর এসব লোকেরা কেমন বিদআত সৃষ্টি করেছে। তারপর আমি বলবো, তাহলে দূর হোক, দূর হোক সে সকল লোকেরা যারা আমার পর দ্বীন পরিবর্তন করেছে।
(বুখারি ও মুসলিম,আলল’লুউ ওয়াল মারজান,২য় খণ্ড,হাদিস-১৪৭৬)
৫.আল্লাহ, ফেরেশতা ও লোকসকলের অভিশাপঃ
আসেম (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, আনাস (রাযিঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) কি মদিনাকে হেরেম আখ্যা দিয়েছেন? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ অমুক স্থান থেকে অমুক স্থান পর্যন্ত। এ স্থানের গাছ কাটা যাবে না। রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এখানে কোন বিদআত সৃষ্টি করবে তার উপর আল্লাহ,ফেরেস্তাসমূহ ও লোকসকলের অভিশাপ হবে। (বুখারি ও মুসলিম,আলল’লুউ ওয়াল মারজান,২য় খণ্ড,হাদিস-৮৬৫)
৬.বিদআত প্রলচলনকারীর গুনাহের ভাগ পাওয়াঃ
কাসীর  ইবনু আবিদল্লাহ (রাহঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহ থেকে কোন একটি সুন্নাহ কে জীবিত করেছে আর অন্য লোকেরা সে অনুযায়ী আমল করেছে, তাকে সব আমলকারীর সমান সওয়াব দেওয়া হবে। আবার তাদেরকেও কম দেওয়া হবে না। আর যে  বিদআত চালু করেছে ও লোকেরা সে অনুযায়ী আমল করেছে,তাকে সব আমলকারীর সমান পাপ দেওয়া হবে। আবার তাদের পাপে কম করা হবে না। (ইবনু মাজাহ,১ম খণ্ড,হাদিস-১৭৩,সহিহ)
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম)বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি লোকজনকে হেদায়াতের দিকে আহবান করবে, তাকে সে হিদায়াত মতে আমলকারী সকল লোকের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। আর লোকজনের সওয়াবে কোন কম করা হবে না। এমনিভাবে যে  লোকজনকে গোমরাহীর দিকে ডাকবে, তাকে সে গোমরাহী মতে আমলকারীর সমান পাপ দেওয়া হবে। আবার তাদের পাপ ও কম করা হবে না। (মুসলিম,কিতাবুল ইলম)।
৭. সুন্নাহ হতে বঞ্চিতঃ
হাসসান ইবনু আতিয়্যাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি দ্বীনে কোন বিদআত যতটুকু গ্রহন করবে,আল্লাহ তা’আলা  তার থেকে ততটুকু সুন্নাহ উঠিয়ে নেন। তারপর কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে সে সুন্নাত ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (দারিমী-সহিহ,মিসকাত,হাদিস-১৮৮,সহিহ)
৮.শয়তানের প্রিয় হওয়াঃ
সুফিয়ান সাওরী (রাযিঃ) বলেনঃ
শয়তান পাপের পরিবর্তে বিদআতকে বেশী পছন্দ করে। কারণ পাপ থেকে তো লোকেরা তাওবা করে নেয়, কিন্তু বিদআত থেকে তওবা করে না।
বিঃদ্রঃ বিদআতি তো সওয়াব অর্জনের উদ্দেশে বিদআত করে। কেও কি কোন আমলের জন্য তওবা করে?
৯.ফিতনা ও কষ্টদায়ক শাস্তিঃ
ইমাম মালেক (রাহঃ) থেকে জিজ্ঞাসা করা হল, হে আবু আব্দিল্লাহ,এহরাম কোথা হতে বাধব? উত্তরে তিনি বললেন, আমি মসজিদে নববী তথা কবরের কাছ থেকে এহরাম বাধতে চাই। ইমাম মালেক (রাহঃ) বললেন, এমন কর না, আমার ভয় হয় তুমি ফেতনায় পতিত হবে। লোকটি বলল, এখানে ফেতনার কি আছে? আমি তো শুধু কয়েক মাইল পূর্বে এহরাম বাধতে চাইছি। ইমাম মালেক (রাহঃ) বললেন, এর চেয়ে বড় ফিতনা আর কি হবে যে, তুমি মনে করছ যে, এহরাম বাধার সওয়াবে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আগে বেড়ে যাচ্ছ। আমি আল্লাহ তা’আলাকে বলতে শুনেছি, যারা আল্লাহর রাসুল (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) এর আদেশ অমান্য করে তাদের ভয় থাকা উচিত যেন, তারা কোন ফিতনা বা কষ্টদায়ক শাস্তিতে পতিত না হয়। (আল ইতিছাম,আলকাউলুল আসমা ফি যাম্মিল ইবতিকা,পৃষ্ঠা-২১,২২)
১০.নেক আমল গ্রহণযোগ্য না হওয়াঃ
ফুযায়িল ইবনু আয়ায (রাযিঃ) বলেনঃ
যখন তোমরা বিদআত পন্থী কোন লোক আসতে দেখবে তখন সে রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তা গ্রহন করো। বিদআতির কোন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। যে ব্যাক্তি বিদআতিকে সাহায্য করল, সে যেন দ্বীন ধ্বংস করতে সাহায্য করল। (খাছায়িছু আহলেসুন্নাহ,পৃষ্ঠা-২২)
প্রিয় পাঠকগণ সতর্ক হোন নিজ আমলের ক্ষেত্রে। যাচাই বাছাই করে দেখুন আপনার আমল রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহুয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) এর আমলের সাদৃশ্য কিনা।
আল্লাহ বলেনঃ
ওহে যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহ্কে মেনে চলো ও রসূলের আজ্ঞা  পালন  করোআর তোমাদের  ক্রিয়াকর্ম বিফল করো না -(সুরা মুহাম্মাদ-৩৩)।

কোরআন ও সহীহ হাদিস হতে বিদআতীদের শেষ পরিনতির আরো দলীল

১। হে নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না  কোন কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত  ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতি দানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। (কাহাফঃ ১০৩-১০৫)
২। যারা তাঁর (রাসুলসঃ)  হুকুমের বিরুদ্ধাচারন করে  এ বিষয় তাদের সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য যে, তারা মহাবিপদ গ্রস্ত হবে অথবা যন্ত্রনা দায়ক আযাব তাদেরকে পাকড়াও করবে।  (নূর-৬৩)
৩। আমাদের উপস্থাপিত ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় যে কোন নতুন নিয়ম পদ্ধতি বা মতবাদের প্রচলন করবে, যা তার সামগ্রিক প্রকৃতির সাথে কিছু মাত্র খাপ খায় না, তা অবশ্যই প্রত্যাখান করতে হবে।( বুখারী ও মুসলিম)
৪। সঠিক পথ প্রদর্শনের পরও যারা বিশ্বাসীদের ব্যতীত অন্য কারও অনুকরন করে এবং মতানৈক্য  ও বিরোধিতা করছে আল্লাহর রাসুল নবি করিম  (সঃ) কে তবু তাদেরকে তিনি তার পছন্দ মতো বিপথে চলতে দেবেন এবং জাহান্নামের অগ্নিতে জ্বালাবেন। (কোরআন-৪:১১৫)
৫।“ হোজায়ফা  (রাঃ) হতে বর্নিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, , মুসলিম সমাজে এমন লোকদের আবির্ভাব হইবে যাহারা আমার নীতি ছাড়া অন্য নীতিও অবলম্বন করিবে। তাহাদের কোন কোন কাজ ভালো এবং কোন কাজ মন্দও দেখিতে পাইবে।”(বুখারী)
৬। “যে ব্যক্তি নিজের মতবাদকে কেন্দ্র করে তার নিয়ন্ত্রনে কোরআনের ব্যাখ্যা করে-যে ব্যক্তি কোরআনের নির্দেশ অনুসারে স্বীয় মতবাদ স্থির করে না; বরং স্বীয় মতবাদের নির্দেশ অনুসারে কোরআনের ব্যাখ্যা করে, শাব্দিক অর্থে ঐ ব্যাখ্যা শুদ্ধ হলেও বস্তুত তা ভুল পরিগণিত।”(মেশকাত)
৭।“ তোমরা কি কোরআনের কোন কোন অংশ (আয়াত) মানো আর কোন কোন অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্য থেকে এরুপ কাজ  করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্য কলাপ সম্বন্ধেবে- খবর নন। (বাকারা-৮৫)
৮। “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করতে চাইবে, তার থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না। আখেরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)
৯। নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন: হযরত হারিসুল আশয়ারী (রঃ)হতে বর্ণিত। নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি (১) জামায়াত বদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) তার আদেশ মেনে চলব (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, যে ব্যক্তি ইসলামি সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত দূরে সরে গেল, সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল, তবে সে যদি সংগঠনে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের নিয়ম নীতির দিকে (লোকদের) আহবান জানায় সে জাহান্নামী। যদিও সে রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)।
(সমাপ্ত)
প্রশ্ন
কথিত পির-অলিগণ  ঈদ ই মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষে কেনো?

উত্তরঃ কথিত পির-অলিদের বিনা পুঁজিতে অর্থ উপার্জনের যতোগুলো পথ আছে, ঈদ ই মিলাদুন্নবী সেগুলোর মধ্যে একটি। এধরনের পর্বগুলো থেকে প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা ইনকাম হয়। এই সহজ পথটি কেউ কি কখনো হাত ছাড়া করে? এই ধরনের পর্বগুলো যদি না থাকে তাহলে তাদের দরবারে লোকজন কোন উপলক্ষে আসবে। মূলত অর্থ ইনকাম অন্য দিকে মুরিদদের দরবার মুখী করার জন্যই এই পর্বগুলো পালন করতে হয়। 

কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো বিষয় জানতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ

'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
 “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
« مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا »
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, গুলশান-ঢাকা।

ইসলামি সকল পর্ব এক সাথে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন-
    Please Share On 

No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...