বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত
আক্বীদার দ্বন্দ্ব নিরসনঃ (আল কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক)
কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো বিষয় জানতে এদের উপর
ক্লিক করুনঃ
৫। তাওবা ও ইস্তেগফারে রিজিক বৃদ্ধি পায়, অভাব-অনটন দূর হয়: (ইহা পরীক্ষিত):
২৬। গান-বাজনা করা ও শোনা ইসলামে হারাম-গান বাজনার ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কি?
২৭। ছবি ও মূর্তির ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কি?
২৮। শুকরের মাংস নিষিদ্ধ কেন? কোরআন ও বাইবেল ভিত্তিক আলোচনাঃ
২৯। কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
৩০। ইসলামি অর্থনীতি : শান্তি ও সমৃদ্ধির অব্যর্থ ব্যবস্থা
৩১। ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
৩২। ঘুষের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায়
২৭। ছবি ও মূর্তির ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কি?
২৮। শুকরের মাংস নিষিদ্ধ কেন? কোরআন ও বাইবেল ভিত্তিক আলোচনাঃ
২৯। কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
৩০। ইসলামি অর্থনীতি : শান্তি ও সমৃদ্ধির অব্যর্থ ব্যবস্থা
৩১। ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
৩২। ঘুষের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায়
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদার দ্বন্দ্ব নিরসনঃ (আল কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক)
ভূমিকা :
আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য (যারিয়াত ৫৬)। আর ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম দু’টি শর্ত হ’ল-
(১) যাবতীয় ইবাদত শুধুমাত্র তাঁর জন্যই নিবেদিত হ’তে হবে। যেমন- ছালাত, ছিয়াম,
হজ্জ-যাকাত, নযর-নিয়ায, যবেহ, কুরবানী, ভয়-ভীতি, সাহায্য, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুকরণ, অনুসরণ করতে হবে এবং তিনি যেভাবে ইবাদত করতে
বলেছেন সেভাবেই তা সম্পাদন করতে হবে। উপরোক্ত শর্ত দু’টির সাথে আক্বীদা-বিশ্বাস
বিশুদ্ধ হওয়া অতীব জরূরী। অত্র প্রবন্ধে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কিত কয়েকটি
ভ্রান্ত আক্বীদা আলোচনা করা হ’ল-
অনেকের বিশ্বাস আছে
যে,
(১) আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। অথচ মহান আল্লাহ বলছেন, তিনি আরশের উপর সমাসীন। এ মর্মে
পবিত্র কুরআনে ৭টি আয়াত বর্ণিত হয়েছে।(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও বলেছেন যে, আল্লাহ আসমানে আছেন। ছাহাবী
(রাঃ) এবং তাবেঈগণ সকলেই বলেছেন আল্লাহ আসমানে আছেন। তাছাড়া সকল ইমামই বলেছেন,
আল্লাহ আসমানে আছেন। এরপরেও যদি বলা হয়, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাহ’লে কি ঈমান
থাকবে এবং আমল কবুল হবে?
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান- একথা ঠিক নয়, বরং পবিত্র কুরআন বলছে,
আল্লাহ আরশে সমাসীন। এ মর্মে বর্ণিত দলীলগুলো নিম্নরূপ-
(১) আল্লাহ বলেন, إِنَّ رَبَّكُمُ
اللهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ. ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি আসমান ও
যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)।
(২) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী
ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ (ইউনুস ১০/৩)।
(৩) ‘আল্লাহই ঊর্ধ্বদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত-
তোমরা এটা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হ’লেন’ (রা‘দ
১৩/২)।
(৪) ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমাসীন’ (ত্ব-হা ২০/৫)।
(৫) ‘তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু
ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই রহমান, তাঁর সম্বন্ধে যে
অবগত আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখ’ (ফুরক্বান ২৫/৫৯)।
(৬) ‘আল্লাহ তিনি, যিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী
সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন’ (সাজদাহ ৩২/৪)।
(৭) ‘তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে
সমাসীন হয়েছেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)।
উল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশে
সমাসীন আছেন। কিভাবে সমাসীন আছেন, একথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম মালেক (রহঃ)
বলেন,الاستواء
معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال
عنه بدعة. ‘ইসতেওয়া বা সমাসীন হওয়া বোধগম্য, এর প্রকৃতি অজ্ঞাত, এর
প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদ‘আত’।(২)
আল্লাহ তা‘আলা আসমানের উপর আছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
আল্লাহ তা‘আলা আসমানের উপর আছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَّخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُوْرُ، أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُّرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُوْنَ كَيْفَ نَذِيْرِ-
‘তোমরা কি (এ বিষয়ে) নিরাপদ হয়ে গেছ যে, যিনি আকাশের উপর রয়েছেন
তিনি তোমাদের সহ ভূমিকে ধসিয়ে দিবেন না? আর তখন ওটা আকস্মিকভাবে থরথর করে কাঁপতে
থাকবে। অথবা তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ যে, আকাশের উপর যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর
পাথর বর্ষণকারী বঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে কিরূপ ছিল আমার
সতর্কবাণী’? (মুলক ৬৭/ ১৬-১৭)।
২. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিছু সৃষ্টিকে উপরে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ
বলেন, بَل رَّفَعَهُ اللهُ إِلَيْهِ ‘বরং
আল্লাহ তাকে (ঈসাকে) নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন’ (নিসা
৪/১৫৮)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, إِذْ قَالَ
اللهُ يَا عِيْسَى إِنِّيْ مُتَوَفِّيْكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ. ‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন,
হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে
নিচ্ছি’ (আলে ইমরান ৩/৫৫)।
৩. আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে আছেন, এর প্রমাণে আল্লাহ্র রাসূল
(ছাঃ)-এর হাদীছ-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِيْ كِتَابِهِ، فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ : إِنَّ رَحْمَتِيْ غَلَبَتْ غَضَبِيْ-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِيْ كِتَابِهِ، فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ : إِنَّ رَحْمَتِيْ غَلَبَتْ غَضَبِيْ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ মাখলূক সৃষ্টির ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন তাঁর কাছে আরশের উপর
রক্ষিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন- অবশ্যই আমার করুণা আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ
করেছে’।(৩)
৪. আমরা দো‘আ করার সময় দু’হাত উত্তোলন করে আল্লাহ্র নিকট চাই। এতে
সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আরশের উপর আছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
عَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللهَ حَيِيٌّ كَرِيْمٌ يَسْتَحْيِيْ إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا خَائِبَتَيْنِ-
সালমান ফারেসী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ লজ্জাশীল ও মহানুভব। যখন কোন ব্যক্তি তাঁর নিকট দু’হাত
উত্তোলন করে দো‘আ করে, তখন তাকে শূন্য হাতে ব্যর্থ মনোরথ করে ফেরত দিতে তিনি
লজ্জাবোধ করেন’।(৪)
৫. প্রত্যেক রাতে আল্লাহ তা‘আলার দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি আরশের উপর সমাসীন। এর প্রমাণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ
৫. প্রত্যেক রাতে আল্লাহ তা‘আলার দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি আরশের উপর সমাসীন। এর প্রমাণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছ :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ
اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُوْلُ : مَنْ يَّدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং
বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আছ যে আমার কাছে কিছু
চাইবে আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে আর আমি তাকে ক্ষমা
করে দিব’।(৫)
৬. মু‘আবিয়া বিন আল-হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَتْ لِيْ جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِىْ قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّئْبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِىْ آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُوْنَ لَكِنِّىْ صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَيَّ. قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا؟ قَالَ ائْتِنِيْ بِهَا فَأَتَيْتُهُ بِهَا. فَقَالَ لَهَا : أَيْنَ اللهُ؟ قَالَتْ فِي السَّمَاءِ. قَالَ مَنْ أَنَا؟ قَالَتْ أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ. قَالَ أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ-
‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহুদ ও জাওয়ানিয়্যাহ (ওহুদের নিকটবর্তী একটি স্থান) নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান (সাধারণ মানুষ)। তারা যেভাবে ক্রদ্ধ হয় আমিও সেভাবে ক্রদ্ধ হই। কিন্তু আমি তাকে এক থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে একে আমি সাংঘাতিক (অন্যায়) কাজ বলে গণ্য করি। তাই আমি বলি যে, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। আমি তাকে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে মুক্তি দিয়ে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার নারী’।(৬)
‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহুদ ও জাওয়ানিয়্যাহ (ওহুদের নিকটবর্তী একটি স্থান) নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান (সাধারণ মানুষ)। তারা যেভাবে ক্রদ্ধ হয় আমিও সেভাবে ক্রদ্ধ হই। কিন্তু আমি তাকে এক থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে একে আমি সাংঘাতিক (অন্যায়) কাজ বলে গণ্য করি। তাই আমি বলি যে, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। আমি তাকে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে মুক্তি দিয়ে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার নারী’।(৬)
৭. বিদায় হজ্জের ভাষণে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণকে উদ্দেশ্য
করে বলেছিলেন, তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, তখন কি বলবে? ঐ সময় উপস্থিত
ছাহাবীগণ বলেছিলেন, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন
করেছেন। একথা শুনার পর আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) তাঁর হাতের আঙ্গুল আসমানের দিকে উত্তোলন
করে বলেছিলেন, হে আল্লাহ! তাদের কথার উপর সাক্ষি থাক’।(৭)
৮. আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,
كَانَتْ زَيْنَبُ تَفْخَرُ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَقُوْلُ: زَوَّجَكُنَّ أَهَالِيْكُنَّ وَزَوَّجَنِي اللهُ تَعَالَى مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَاوَاتٍ.
‘যয়নব (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে, আর আমার বিয়ে আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর থেকে সম্পাদন করেছেন’।(৮)
৯. ইসরা ও মি‘রাজ-এর ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করি যে, আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)-কে যখন একের পর এক সপ্ত আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল নবী-রাসূলগণের এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্যের জন্য সপ্ত আসমানের উপর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর যখন আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত নিয়ে মূসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন মূসা (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছিলেন, তোমার উম্মত ৫০ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। যাও আল্লাহ্র নিকট ছালাত কমিয়ে নাও। এরপর কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্ত হয়। এরপর মূসা (আঃ) আরও কমাতে বলেছিলেন, কিন্তু রাসূল (ছাঃ) লজ্জাবোধ করেছিলেন।(৯)এ সময় আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) ছালাত কমানোর জন্য সপ্ত আকাশের উপর উঠতেন। আবার ফিরে আসতেন মূসা (আঃ)-এর নিকট ষষ্ঠ আসমানে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে আছেন।
‘যয়নব (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন যে, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে, আর আমার বিয়ে আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর থেকে সম্পাদন করেছেন’।(৮)
৯. ইসরা ও মি‘রাজ-এর ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করি যে, আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)-কে যখন একের পর এক সপ্ত আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল নবী-রাসূলগণের এবং আল্লাহ্র সান্নিধ্যের জন্য সপ্ত আসমানের উপর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর যখন আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত নিয়ে মূসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন মূসা (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছিলেন, তোমার উম্মত ৫০ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। যাও আল্লাহ্র নিকট ছালাত কমিয়ে নাও। এরপর কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্ত হয়। এরপর মূসা (আঃ) আরও কমাতে বলেছিলেন, কিন্তু রাসূল (ছাঃ) লজ্জাবোধ করেছিলেন।(৯)এ সময় আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) ছালাত কমানোর জন্য সপ্ত আকাশের উপর উঠতেন। আবার ফিরে আসতেন মূসা (আঃ)-এর নিকট ষষ্ঠ আসমানে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে আছেন।
১০. ফেরাঊন নিজেকে আল্লাহ দাবী করেছিল। সে কাফের হওয়া সত্ত্বেও তার
বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ আরশের উপর আছেন। ফেরাঊন বলল, ‘হে হামান! তুমি আমার জন্য এক
সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরী কর, যাতে আমি অবলম্বন পাই আসমানে আরোহণের, যেন আমি দেখতে পাই
মূসা (আঃ)-এর মা‘বূদকে (মুমিন ৪০/৩৭-৩৮)।
সালাফে ছালেহীন থেকে আমরা যা পাই তা হচ্ছে, আল্লাহ আসমানের উপর
আরশে অবস্থান করছেন। আবুবকর (রাঃ) থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বর্ণনা
করেন, তিনি বলেন, যখন আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাত হয়, আবু বকর (রাঃ) এসে তাঁর
(ছাঃ) কপালে চুমু খেয়ে বলেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি জীবনে ও
মরণে উত্তম ছিলেন। এরপর আবু বকর (রাঃ) বলেন, হে মানব জাতি! তোমাদের মধ্যে যারা
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ইবাদত করতে, তারা জেনে রাখ যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ
করেছেন। আর তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্র ইবাদত কর তারা জেনে রাখ যে, আল্লাহ আকাশের
উপর (আরশে)। তিনি চিরঞ্জীব।(১০)
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। কেননা আল্লাহ বলেন, রহমান আরশে সমাসীন। আর তার আরশ সপ্ত আকাশের উপর।১১
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। কেননা আল্লাহ বলেন, রহমান আরশে সমাসীন। আর তার আরশ সপ্ত আকাশের উপর।১১
ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, الله في
السماء
وعلمه في كل مكان
لا يخلو منه مكان- ‘আল্লাহ আকাশের উপর এবং তাঁর জ্ঞানের পরিধি সর্বব্যাপী
বিস্তৃত। কোন স্থানই তাঁর জ্ঞানের আওতার বহির্ভূত নয়’।(১২)
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন,
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন,
‘সুন্নাহ সম্পর্কে আমার ও আমি যেসকল আহলেহাদীছ বিদ্বানকে দেখেছি
এবং তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছি যেমন সুফিয়ান, মালেক ও অন্যান্যরা, তাদের মত হল এ
কথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোন (হক্ব) উপাস্য নেই এবং
মুহাম্মাদ (ছাঃ) আললাহ্র রাসূল। আর আল্লাহ আকাশের উপর তাঁর আরশে সমাসীন। তিনি যেমন
ইচ্ছা তাঁর সৃষ্টির নিকটবর্তী হন এবং যেমন ইচ্ছা তেমন নীচের আকাশে অবতরণ করেন’।(১৩)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন,
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন,
‘আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করা
হ’ল যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি থেকে দূরে সপ্তম আকাশের উপরে তাঁর আরশে সমাসীন। তাঁর
ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিধি সর্বত্র বিস্তৃত। এর উত্তরে তিনি (ইমাম আহমাদ) বলেন,
হ্যাঁ! তিনি (আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন এবং তাঁর জ্ঞানের বহির্ভূত কিছুই
নেই।(১৪)
হাদিসের উৎসঃ
(১.) ইমাম
ইবনু তায়মিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া ৩/১৩৫।
(২.) শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া,
আর-রিসালা আত-তাদাম্মুরিয়্যাহ, পৃঃ ২০।
(৩.) বুখারী হা/৩১৯৪ ‘সৃষ্টির
সূচনা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/২৩৬৪ ‘দো‘আ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহ্র রহমতের প্রশস্ততা’
অনুচ্ছেদ।
(৪.) তিরমিযী হা/৩৫৫৬, ইবনু
মাজাহ হা/৩৮৬৫, হাদীছ ছহীহ।
(৫.) বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম
হা/৭৫৮; আবুদাঊদ হা/১৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/১৩৬৬; মিশকাত হা/১২২৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘তাহাজ্জুদের
প্রতি উৎসাহিতকরণ’ অনুচ্ছেদ।
(৬.) ছহীহ মুসলিম হা/৫৩৭ ‘মসজিদ
সমূহ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ।
(৭.) ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮ ‘হজ্জ’
অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৯।
(৮.) বুখারী হা/৭৪২০ ‘তাওহীদ’
অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০।
(৯.) মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত
হা/৫৮৬২।
(১০.) বুখারী, আত-তারীখ, ১ম
খন্ড, পৃঃ ২০২; ইবনুল ক্বাইয়িম, ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ৮৩-৮৪; আর-রাহীকুল
মাখতূম, পৃঃ ৪৭০।
(১১.) ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়্যাহ,
পৃঃ ৯৯।
(১২.) ঐ, পৃঃ ১০১।
(১৩.) ঐ, পৃঃ ১২২।
(১৪.) ঐ, পৃঃ ১৫২-১৫৩।
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন : যুক্তির নিরিখে
ইতিপূর্বে পেশকৃত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে
প্রতীয়মান হয়েছে যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন। এ বিষয়ে নিম্নে
যুক্তিভিত্তিক আলোচনা পেশ করা হ’ল-
(১) মানুষ যখন ছালাতের মধ্যে সিজদাবনত থাকে তখন
তার মন-প্রাণ কোথায় যায়? অবশ্যই উপরের দিকে; নীচের দিকে নয়।
(২) মানুষ যখন দু’হাত উত্তোলন করে দো‘আ করে, তখন
কেন উপরের দিকে হাত উত্তোলন করে? এক্ষেত্রে মানুষের বিবেক বলবে, আল্লাহ উপরেই
আছেন; সর্বত্র নন।
(৩) মানুষ যখন টয়লেটে যায়, তখন কি সাথে মহান
আল্লাহ থাকেন? আল্লাহর শানে এমন কথা বলা চরম ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়।
(৪) মানুষ যেমন তার নির্মিত বাড়ী সম্পর্কে সবই
বলতে পারে যে, বাড়ীতে কয়টা ঘর আছে, কয়টা স্তম্ভ আছে। এক কথায় সবই তার জানা। তেমনি
বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা আরশের উপর সমাসীন থেকে বিশ্ব জাহানের সব খবর রাখেন। আল্লাহ
আরশের উপরে থাকলেও তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বব্যাপী।
(৫) মানুষ যেখানেই যায় সেখানেই চন্দ্র-সূর্য
দেখতে পায়। মনে হয় সেগুলো তার সাথেই আছে। চন্দ্রটা বাংলাদেশ, ভারত, সঊদী সব জায়গা
থেকে মানুষ দেখতে পায়। চন্দ্র আল্লাহরই সৃষ্টি, তাকে সব জায়গা থেকে মানুষ দেখতে
পাচ্ছে। অথচ সেটা আসমানেই আছে। অনুরূপ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আরশের উপর থেকে সকল
সৃষ্টির সব কাজ দেখাশুনা করেন- এটাই বিশ্বাস করতে হবে।
(৬) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন:-
‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে আছেন
আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে যে, তিনি আরশে আছেন। কিন্তু
আরশ আকাশে, না যমীনে অবস্থিত আমি তা জানি না। সেও কুফরী করবে। কেননা উপরে থাকার
জন্যই আল্লাহকে ডাকা হয়; নীচে থাকার জন্য নয়। আর নীচে থাকাটা আল্লাহর রুবূবিয়্যাত
এবং উলূহিয়্যাতের গুণের কিছুই নয়’।[1]
তাই আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলার আরশের
উপর থাকাটাই শোভা পায়, নীচে নয়। কেননা আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, রিযিকদাতা,
জীবন-মৃত্যু সব কিছুরই মালিক ও হক উপাস্য। তাঁর জন্য সৃষ্টির গুণের কোন কিছুই শোভা
পায় না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমাসীন; সর্বত্র বিরাজমান নন।
আল্লাহ
সর্বত্র বিরাজমান মর্মে কুরআনুল কারীমের যেসব আয়াত উল্লেখ করা হয় তার জবাব নিম্নে
আলোচনা করা হ’ল :
(১) মহান আল্লাহ বলেন,‘আকাশ
ও যমীনে তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু জানেন এবং তোমরা যা
অর্জন কর সেটাও তিনি অবগত আছেন’ (আন‘আম
৬/৩)।
(২) আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِيْ فِي السَّمَآء إِلَهٌ وَفِي الْأَرْضِ إِلَهٌ وَهُوَ الْحَكِيْمُ الْعَلِيْمُ. ‘তিনিই
ইলাহ নভোমন্ডলে, তিনিই ইলাহ ভূতলে এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ’ (যুখরুফ ৪৩/৮৪)।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় পেশ করে যারা আল্লাহ সর্বত্র
বিরাজমান বলে দাবী করেন, তাদের কথা বাতিল। কেননা আকাশে যত সৃষ্টি আছে তাদের সবার
প্রভু, মা‘বূদ আল্লাহই। তারা সবাই আল্লাহর ইবাদত করে। তেমনি যারা যমীনে আছে তাদের
প্রভু ও মা‘বূদও একমাত্র আল্লাহ। তারাও সবাই ভয়-ভীতি সহকারে আল্লাহরই ইবাদত করে।[2]
(৩) মহান আল্লাহ বলেন,
‘তুমি কি লক্ষ্য কর না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে
যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে
চতুর্থজন হিসাবে তিনি থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও এমন কোন গোপন পরামর্শ হয়
না, যাতে ষষ্ঠজন হিসাবে তিনি থাকেন না। তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা
যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ (জ্ঞানের দিক দিয়ে) তাদের সাথে আছেন। অতঃপর তারা যা
করে, তিনি তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে
সম্যক অবগত’ (মুজাদালাহ ৫৮/৭)।
এ
আয়াত দ্বারা অনেকে যুক্তি পেশ করে বলেন যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। তাদের এ দাবী
ভিত্তিহীন। কারণ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, افتتح الآية بالعلم، واختتمها بالعلم. ‘মহান
আল্লাহ আয়াতটি ইলম দ্বারাই শুরু করেছেন এবং ইলম দ্বারাই শেষ করেছেন’।[3]
এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ জ্ঞানের
মাধ্যমে তাদের সাথে আছেন।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘উল্লিখিত আয়াতের
ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহর জ্ঞান তাদের সঙ্গে’। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের
উপর এবং তাঁর জ্ঞান তাদের সব কিছু অবহিত’।[4]
(৪) আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান বলে অনেকে নিম্নের
আয়াত পেশ করে যুক্তি দেয়- وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ. ‘তোমরা
যেখানেই থাক না কেন- তিনি (জানার দিক দিয়ে) তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যা কিছু কর
আল্লাহ তা দেখেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)।
ইয়াহ্ইয়া বিন ওছমান বলেন, ‘আমরা একথা বলব না,
যেভাবে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায় বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, সবকিছুর সাথে মিশে
আছেন এবং আমরা জানি না যে তিনি কোথায়; বরং বলব আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং আরশের উপর
সমাসীন, আর তাঁর জ্ঞান, ক্ষমতা, দেখা-শুনা সবার সাথে। এটাই উক্ত আয়াতের অর্থ। ইবনু
তায়মিয়া বলেন, যারা ধারণা করে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাদের কথা বাতিল। বরং
আল্লাহ স্বয়ং আরশের উপরে সমাসীন এবং তাঁর জ্ঞান সর্বত্র রয়েছে।[5]
উক্ত আয়াতের (হাদীদ ৪) ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু
কাছীর (রহঃ) বলেছেন,
أي: رقيب عليكم، شهيد على أعمالكم حيث أنتم، وأين كنتم، من بر أو بحر، في ليل أو نهار، في البيوت أو القفار، الجميع في علمه على السواء، وتحت بصره وسمعه، فيسمع كلامكم ويرى مكانكم، ويعلم سركم ونجواكم.
‘অর্থাৎ তিনি তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক এবং তোমরা
যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের কার্যসমূহের সাক্ষী। তোমরা ভূভাগে বা সমুদ্রে,
রাতে বা দিনে, বাড়িতে বা বিজন মরুভূমিতে যেখানেই অবস্থান কর না কেন সবকিছুই
সমানভাবে তাঁর জ্ঞান এবং তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টির মধ্যে আছে। তিনি তোমাদের কথা শোনেন,
তোমার অবস্থান দেখেন এবং তোমাদের গোপন কথা ও পরামর্শ জানেন’।[6]
উছমান
বিন সাঈদ আর-দারেমী বলেন,
أنه حاضر كل نجوى ومع كل أحد من فوق العرش بعلمه لأن علمه بهم محيط وبصره فيهم نافذ لا يحجبه شيء عن علمه وبصره ولا يتوارون منه بشيء وهو بكماله فوق العرش بائن من خلقه يعلم السر وأخفى (طه : 7) أقرب إلى أحدهم من فوق العرش من حبل الوريد قادر على أن يكون له ذلك لأنه لا يبعد عنه شيء ولا تخفى عليه خافية في السموات ولا في الأرض فهو كذلك رابعهم وخامسهم وسادسهم لا أنه معهم بنفسه في الأرض.
‘তিনি আরশের উপরে থেকেই প্রত্যেক গোপন পরামর্শ ও
প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে উপস্থিত থাকেন। কেননা তাঁর জ্ঞান
তাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে এবং তাঁর দৃষ্টি তাঁদের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে। তাঁর
জ্ঞান ও দৃষ্টি থেকে কোন কিছুই আড়াল করতে পারে না এবং তারা তাঁর নিকট থেকে কোন
কিছুই গোপন করতে পারে না। তিনি তাঁর পূর্ণ সত্তাসহ তাঁর সৃষ্টি থেকে দূরে
আরশের উপরে সমাসীন আছেন। তিনি গোপন ও সুপ্ত বিষয় জানেন (ত্ব-হা ৭)। তিনি আরশের উপরে থেকেই
তাদের কারো নিকট ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষা নিকটে অবস্থান করেন। তাঁর জন্য এমনটি হওয়ার
বিষয়ে তিনি সক্ষম। কারণ কোন কিছুই তাঁর থেকে দূরে নয় এবং আকাশমন্ডলী ও যমীনের কোন
কিছুই তাঁর নিকট গোপন থাকে না। তিনি গোপন পরামর্শের সময় চতুর্থ জন, পঞ্চম জন
ও ষষ্ঠজন হিসাবে আবির্ভূত হন। তবে তিনি স্বয়ং তাঁর সত্তাসহ তাদের সাথে পৃথিবীতে
বিরাজমান নন’।[7]
(৫) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ ‘আমি
তার ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষাও নিকটতর’ (ক্বাফ
৫০/১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لاَّ تُبْصِرُوْنَ. ‘আর
আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৮৫)। যারা এ আয়াত
দ্বারা দলীল পেশ করে বলেন, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাদের ধারণা ঠিক নয়।
এখানে উভয় আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ
তা‘আলার ফেরেশতারা মানুষের নিকটবর্তী। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ.‘আমি
কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ৯)। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমে
জিবরীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পবিত্র কুরআন পৌঁছে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে
ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমে ও তাঁর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মানুষের ঘাড়ের শাহ
রগ অপেক্ষা নিকটতর। আর মানুষের উপর ফেরেশতার যেমন প্রভাব থাকে, তেমনি শয়তানেরও।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ وَقَدْ وُكِّلَ بِهِ قَرِيْنُهُ مِنَ الْجِنِّ وَقَرِيْنُهُ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ. قَالُوْا وَإِيَّاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ وَإِيَّاىَ إِلاَّ أَنَّ اللهَ أَعَانَنِىْ عَلَيْهِ فَأَسْلَمَ فَلاَ يَأْمُرُنِىْ إِلاَّ بِخَيْرٍ.
‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার জিন
সহচর অথবা ফেরেশতা সহচর নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথেও
কি হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, আমার সাথেও, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে
আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। সে আমাকে কেবল ভাল কাজেরই
পরামর্শ দেয়’।[8] অনুরূপভাবে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِيْ مِنْ الْإِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ. ‘শয়তান
মানুষের মধ্যে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে’।[9]
এজন্যই
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيْدٌ. ‘স্মরণ
রেখো, দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭)। আল্লাহ আরো বলেন, مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ. ‘মানুষ
যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (ক্বাফ ১৮)। আমরা যা কিছু বলি সবই
ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই রয়েছে তোমাদের জন্য
তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লেখকবর্গ, তারা জানে তোমরা যা কর’।[10]
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন,
উভয় আয়াতে নিকটবর্তী বুঝাতে ফেরেশতাদের নিকটবর্তী হওয়া বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ এখানে উভয়
আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফেরেশতাগণ।
(১) প্রথম আয়াতে (ক্বাফ ১৬) নিকটবর্তিতাকে শর্তযুক্ত (مقيد) করা
হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ- إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيْدٌ- مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ-
‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি
তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।
স্মরণ রেখো, দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে;
মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৬-১৮)। উল্লিখিত
আয়াতে إِذْ يَتَلَقَّي শর্ত
দ্বারা বুঝা যায় যে, দু’জন ফেরেশতার নিকটবর্তিতাই এখানে উদ্দেশ্য।
(২)
দ্বিতীয় আয়াতে (ওয়াকি‘আহ ৮৫) নিকটবর্তিতাকে
মৃত্যুকালীন সময়ের সাথে শর্তযুক্ত (مقيد) করা
হয়েছে। আর মানুষের মৃত্যুর সময় যারা তার নিকট উপস্থিত থাকেন তারা হলেন ফেরেশতা।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, حَتَّىَ إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لاَ يُفَرِّطُوْنَ. ‘অবশেষে
যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিত দূতগণ তার প্রাণ হরণ করে নেয়
এবং তারা কোন ত্রুটি করে না’ (আন‘আম
৬/৬১)।
উল্লিখিত আয়াতে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা হচ্ছেন
ফেরেশতা। তারা সেখানে একই স্থানে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।[11]
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি আয়াত দু’টিতে
ফেরেশতাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহ’লে আল্লাহ নিকটবর্তিতাকে নিজের দিকে কেন সম্পর্কিত
করলেন? এর জবাবে বলা যায় যে, ফেরেশতাদের নিকটবর্তিতাকে আল্লাহ নিজের দিকে
সম্পর্কিত করেছেন। কারণ তার নির্দেশেই তারা মানুষের নিকটবর্তী হয়েছে। আর তারা তার
সৈন্য ও দূত। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘যখন
আমি উহা পাঠ করি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৮)। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট জিবরীল
(আঃ)-এর কুরআন পাঠ উদ্দেশ্য। অথচ আল্লাহ পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে যেহেতু জিবরীল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কুরআন পাঠ করেন সেহেতু
আল্লাহ কুরআন পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন।[12]
আমরা কুরআন-হাদীছ থেকে এবং আলেমদের থেকে যা
পাচ্ছি তা হ’ল আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমাসীন; সর্বত্র বিরাজমান নন। কারণ
কুরআন-হাদীছের সঠিক অর্থ না জানার কারণেই আমরা ভুল করে থাকি। তাই কুরআন-হাদীছের
দলীল পাওয়ার পরেও যদি না বুঝার ভান করি তাহ’লে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন আমাদেরকে
ছেড়ে দিবেন না।
(২) আল্লাহ কি নিরাকার?
আল্লাহ তা‘আলার আকার আছে, তিনি নিরাকার নন।
নিরাকার অর্থ যা দেখে না, শুনে না। কিন্তু আল্লাহ সবকিছু দেখেন, শোনেন। তিনি এ
বিশ্বজাহান ও সমস্ত সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও পরিচালক। তিনি মানুষকে
রিযিক দান করেন, রোগাক্রান্ত করেন ও আরোগ্য দান করেন। সুতরাং তাঁর আকার নেই, একথা
স্বীকার করা তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
আল্লাহ শুনেন, দেখেন, উপকার-ক্ষতি, কল্যাণ-অকল্যাণ
বিধান করেন। তিনি জীবন-মৃত্যুর মালিক, সকল সমস্যার একমাত্র সমাধানদাতা। সুতরাং
মহান আল্লাহ নিরাকার নন; বরং তাঁর আকার আছে।
(১) আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ. ‘কোন
কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা
৪/৫৮)।
(৩) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘ওটা এজন্য যে, আল্লাহ
রাত্রিকে প্রবিষ্ট করেন দিবসের মধ্যে এবং দিবসকে প্রবিষ্ট করেন রাত্রির মধ্যে এবং
আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা’ (হজ্জ
২২/৬১)।
(৪) ‘হে নবী! তুমি বল, তারা কত কাল ছিল, আল্লাহই
তা ভাল জানেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর
দ্রষ্টা ও শ্রোতা’ (কাহফ ১৮/২৬)।
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীবকে আল্লাহ তা‘আলা দেখেন ও তাদের সকল কথা
শুনেন। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না’।[13]
ক্বাতাদা (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর থেকে কেউ বেশী
দেখেন না ও শুনেন না’।[14] ইবনু
যায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের সকল কাজকর্ম দেখেন এবং তাদের সকল কথা
শুনেন। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’।[15]
বাগাবী (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীব যেখানেই
থাকুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের দেখেন এবং তাদের সর্বপ্রকার কথা শ্রবণ করেন।
তাঁর দেখার ও শুনার বাইরে কোন কিছুই নেই’।[16]
(৫) আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূণ (আঃ)-কে লক্ষ্য
করে বলেন, لاَ تَخَافَا إِنَّنِيْ مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা
ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি’ (ত্ব-হা ২০/৪৬)। এখানে আল্লাহ মূসা ও
হারূণের সাথে থাকার অর্থ হচ্ছে- তিনি আরশের উপর সমাসীন। আর মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর
উভয়ের সাথে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
(৬) আল্লাহ আরো বলেন, ‘কখনই নয়, অতএব তোমরা উভয়ে
আমার নিদর্শন সহ যাও, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শ্রবণকারী’ (শু‘আরা ২৬/১৫)। পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাই
এখানে প্রযোজ্য।
(৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা কি মনে করে যে,
আমি তাদের গোপন বিষয় ও গোপন পরামর্শের খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফেরেশতারা
তো তাদের নিকট অবস্থান করে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন’ (যুখরুফ ৪৩/৮০)।
(৮) আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, তোমরা
কাজ করতে থাক, আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন’ (তওবা ৯/১০৫)।
(৯) আল্লাহ বলেন, ‘সে কি অবগত নয় যে, আল্লাহ
দেখেন’? (আলাক্ব ৯৬/১৪)।
(১০) আল্লাহ বলেন, ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি
(ছালাতের জন্য) দন্ডায়মান হও এবং দেখেন সিজদাকারীদের সাথে তোমার উঠাবসা। তিনি তো
সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (শু‘আরা
২৬/২১৮-২২০)।
(১১) আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের কথা
শ্রবণ করেছেন, যারা বলে যে, আল্লাহ দরিদ্র আর আমরা ধনী। তারা যা বলেছে তা এবং
অন্যায়ভাবে তাদের নবীদের হত্যা করার বিষয় আমি লিপিবদ্ধ করব এবং বলব, তোমরা দহন
যন্ত্রণা ভোগ কর’ (আলে ইমরান
৩/১৮১)।
(১২) আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সেই
নারীর কথা, যে তার স্বামীর বিষয়ে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর নিকটও
ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা,
সর্বদ্রষ্টা’ (মুজাদালাহ ৫৮/১)।
(১৩) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবাদেরকে
বলেছিলেন, فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُوْنَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، تَدْعُوْنَ سَمِيْعًا بَصِيْرًا قَرِيْبًا. ‘তোমরা
বধির কিংবা অনুপস্থিতকে ডাকছ না; বরং তোমরা ডাকছ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ও
নিকটতমকে’।[17]
(১৪) আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘একদিন বায়তুল্লাহর নিকট একত্রিত হ’ল দু’জন
ছাকাফী ও একজন কুরাইশী অথবা দু’জন কুরাইশ ও একজন ছাকাফী। তাদের পেটে চর্বি ছিল
বেশি, কিন্তু তাদের অন্তরে বুঝার ক্ষমতা ছিল কম। তাদের একজন বলল, আমরা যা বলছি
আল্লাহ তা শুনেন- এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? দ্বিতীয়জন বলল, আমরা জোরে বললে
শুনেন, কিন্তু চুপি চুপি বললে শুনেন না। তৃতীয়জন বলল, যদি তিনি জোরে বললে শুনেন,
তাহ’লে গোপনে বললেও শুনেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন, ‘তোমরা কিছু গোপন
করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
দিবে না- উপরন্তু তোমরা মনে করতে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন
না’।[18]
(১৫)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (হজ্জ ২২/৭৫)।
আবু দাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘এ আয়াতটিই হচ্ছে
জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের বাতিল কথার প্রত্যুত্তর। কেননা জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়
আল্লাহর নাম ও গুণবাচক নাম কোনটাই সাব্যস্ত করে না। সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা যে
দেখেন-শুনেন এটাও সাব্যস্ত করে না এ ধারণায় যে, সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সাদৃশ্য হবে।
তাদের এ ধারণা বাতিল। এজন্য যে, তারা আল্লাহকে মূর্তির সাথে সাদৃশ্য করে দিল। কারণ
মূর্তি শুনে না এবং দেখেও না (মা‘আরিজুল
কবূল, ১/৩০০-৩০৪)।
মু‘তাযিলা সম্প্রদায় বলে, আল্লাহর কর্ণ আছে
কিন্তু শুনেন না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখেন না। এভাবে তারা আল্লাহর সমস্ত গুণকে
অস্বীকার করে। অর্থাৎ কোন গুণ-বৈশিষ্ট্য ছাড়া তারা শুধু নামগুলো সাব্যস্ত করে।
প্রকৃতপক্ষে তাদের মতবাদ জাহমিয়্যাদের মতবাদের ন্যায়। তাদের উভয় মতবাদই
কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কোন কিছুর সাথে তুলনা
ব্যতিরেকে আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্ত করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে কুরআন-হাদীছ সাব্যস্ত
করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা,
সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর
কোন সাদৃশ্য স্থির করো না’ (নাহল
১৬/৭৪)। আল্লাহ তা‘আলা যে শুনেন, দেখেন, এটা কোন সৃষ্টির শুনা, দেখার সাথে
তুলনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর দেখা-শুনা তেমন, যেমন তাঁর জন্য শোভা পায়। এ
দেখা-শুনা সৃষ্টির দেখা-শুনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়’।[19]
আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য করা হারাম।
কারণ (১) আল্লাহর যাত-ছিফাত তথা আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং
সৃষ্টজীবের গুণ-বৈশিষ্ট্য এক নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা তার জন্যই
প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা সর্বদা জীবিত আছেন ও থাকবেন। কিন্তু সৃষ্টিকুলকে
মৃত্যুবরণ করতেই হবে। তাহলে কি করে আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের তুলনা করা যায়?
(২) সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করায়
সৃষ্টিকর্তার মান-ইয্যত নষ্ট হয়। ত্রুটিযুক্ত সৃষ্টজীবের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ মহান
আল্লাহকে তুলনা করা হ’লে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ত্রুটিযুক্ত করা হয়।
(৩) স্রষ্টা ও সৃষ্টজীবের নাম-গুণ আছে। কিন্তু
উভয়ের প্রকৃতি এক নয়।
হাদিসের
উৎসঃ
[1]. ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আবসাত, পৃঃ ৫১।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭৪।
[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/১২-১৩; ইমাম আহমাদ, আর-রাদ্দু আলাল
জাহমিয়্যাহ, পৃঃ ৪৯-৫১।
[4]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/১৮৮-৮৯।
[5]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/১৯১-৯৩।
[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৫৬০।
[7]. উছমান বিন সাঈদ আদ-দারেমী, আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ, তাহকীক :
বদর বিন আব্দুল্লাহ বদর (কুয়েত : দারু ইবনিল আছীর, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃঃ ৪৩-৪৪।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৬৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[9]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কুমন্ত্রণা’
অনুচ্ছেদ।
[10]. ইনফিতার ৮২/১০-১২; তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৪০৪।
[11]. আল-কাওয়াইদুল মুছলা ফী ছিফাতিল্লাহি ওয়া আসমায়িহিল হুসনা, পৃঃ
৭০-৭১।
[12]. ঐ।
[13]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/২৩২ পৃঃ।
[14]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২।
[16]. মা‘আলিমুত তানযীল, ৫/১৬৫।
[17]. বুখারী হা/৭৩৮৬ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[18]. হা-মীম সাজদাহ ৪১/২২; বুখারী হা/৭৫২১ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়,
অনুচ্ছেদ-৪১।
[19]. মা‘আরিজুল কবূল ১/৩০৪।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাটির তৈরী না নূরের?
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে মাটি থেকে, জিন জাতিকে আগুন থেকে এবং
ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ মাটির তৈরী একথা পবিত্র কুরআনের বহু
স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও মানুষ ছিলেন এবং তিনিও
মাটির তৈরী ছিলেন। এক্ষেত্রে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে অনেকে বিশ্বাস করে যে,
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নূরের সৃষ্টি, অথচ কুরআন-সুন্নাহ বলছে তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি।
সাধারণভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পিতা-মাতা মাটির
তৈরী সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাদের উভয়ের মিলনের ফলে তিনি জন্ম লাভ করেছেন। মাটির
মানুষ থেকে মাটির মানুষই সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির মানুষ থেকে কি
করে নূরের তৈরী মানুষের জন্ম হ’তে পারে?
রাসূল (ছাঃ) বিবাহ করেছিলেন, তাঁর সন্তান-সন্ততিও ছিল। তাঁরা সবাই
মাটির মানুষ ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) খাবার খেতেন, সাধারণ মানুষের মতই জীবন-যাপন করতেন
এবং তাঁর প্রয়োজন ছিল পেশাব-পায়খানার। অন্য সব মানুষের মত নবী করীম (ছাঃ) মৃত্যু
বরণও করেছেন। সুতরাং কোন জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ রাসূল (ছাঃ)-কে নূরের সৃষ্টি বলতে
পারে না। পূর্বযুগের কাফেররা নবী-রাসূলদেরকে মেনে নিতে চাইতো না; কারণ তাঁরা সবাই
মাটির মানুষ ছিলেন। সকল নবী-রাসূলগণ যেমন মাটির মানুষ ছিলেন তেমনি নবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ)ও মাটির মানুষ ছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বিশদ বিবরণ উপস্থাপিত হয়েছে।
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি
করেছেন। তিনি বলেন, وَلَقَدْ
خَلَقْنَا
الْإِنْسَانَ
مِنْ سُلاَلَةٍ مِّنْ طِيْنٍ ‘আমি
তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার মূল উপাদান হ’তে’ (মুমিনূন ১২)।
পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ যে মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন, এ মর্মে কুরআন থেকে
দলীল :
(১) নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, فَقَالَ الْمَلأُ
الَّذِيْنَ
كَفَرُوْا
مِنْ قَوْمِهِ مَا نَرَاكَ إِلاَّ بَشَراً مِّثْلَنَا ‘আর
তার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা যারা কাফের ছিল, তারা বলল, আমরা তো তোমাকে আমাদের মতই
মানুষ ব্যতীত কিছু দেখছি না’ (হূদ ২৭)।
(২) আল্লাহ বলেন, قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ لَكُم مِّن ذُنُوْبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُّسَـمًّى قَالُواْ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا তাদের
রাসূলগণ বলেছিলেন, আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে, যিনি আকাশ সমূহ ও পৃথিবীর
সৃষ্টিকর্তা? তিনি তোমাদেরকে আহবান করেন তোমাদের পাপ মার্জনা করার জন্য এবং
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দিবার জন্য? তারা বলত, তোমরা তো আমাদের মতই
মানুষ’ (ইবরাহীম ১০)।
(৩) আল্লাহ বলেন,قَالَتْ لَهُمْ
رُسُلُهُمْ
إِن نَّحْنُ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ ‘তাদের
রাসূলগণ তাদেরকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মত মানুষ’ (ইবরাহীম ১১)।
(৪) আল্লাহ বলেন, وَمَا مَنَعَ
النَّاسَ
أَنْ يُؤْمِنُوْا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَى إِلاَّ أَنْ قَالُوْا أَبَعَثَ اللهُ بَشَراً رَّسُوْلاً ‘যখন
তাদের নিকট আসে পথ-নির্দেশ, তখন লোকদেরকে এই উক্তিই বিশ্বাস স্থাপন হ’তে বিরত
রাখে, আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?’ (বানী
ইসরাঈল ৯৪)।
(৫) আল্লাহ বলেন, وَأَسَرُّواْ النَّجْوَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ هَلْ هَذَا
إِلَّا
بَشَرٌ
مِّثْلُكُمْ ‘যারা যালিম তারা গোপনে পরামর্শ করে, এতো তোমাদের মত
একজন মানুষই’ (আম্বিয়া ৩)।
(৬) নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, فَقَالَ الْمَلَأُ
الَّذِيْنَ
كَفَرُوا
مِن قَوْمِهِ مَا هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ ‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, এতো
তোমাদের মত একজন মানুষ’ (মুমিনুন ২৪)।
(৭) আল্লাহ বলেন, وَقَالَ الْمَلَأُ
مِن قَوْمِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِلِقَاء الْآخِرَةِ وَأَتْرَفْنَاهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا مَا هَذَا إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يَأْكُلُ مِمَّا تَأْكُلُوْنَ مِنْهُ وَيَشْرَبُ مِمَّا تَشْرَبُوْنَ، وَلَئِنْ أَطَعْتُمْ بَشَراً مِثْلَكُمْ إِنَّكُمْ إِذاً لَّخَاسِرُونَ- ‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ, যারা কুফরী করেছিল ও আখিরাতের
সাক্ষাৎকারকে অস্বীকার করেছিল এবং যাদেরকে আমি দিয়েছিলাম পার্থিব জীবনে প্রচুর
ভোগ-সম্ভার, তারা বলেছিল, এতো তোমাদের মত একজন মানুষ, তোমরা যা আহার কর সেও তাই
আহার করে এবং তোমরা যা পান কর সেও তাই পান করে। যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজন
মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মুমিনূন ৩৩-৩৪)।
(৮) মূসা এবং হারূণ (আঃ) সম্পর্কে ফেরাঊন ও তার কওম বলল,فَقَالُوْا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُوْنَ- ‘তারা বলল, আমরা কি এমন দু’ব্যক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করব,
যারা আমাদেরই মত এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’ (মুমিনূন ৪৭)।
(৯) ঈসা (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ‘নিশ্চয়ই
আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের অনুরূপ; তিনি তাঁকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি
করলেন’ (আলে ইমরান ৫৯)।
মুহাম্মাদ
(ছাঃ) মাটির তৈরী এ সম্পর্কে কুরআনের দলীল :
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ سُبْحَانَ
رَبِّي
هَلْ كُنتُ إَلاَّ بَشَراً رَّسُوْلاً ‘বলুন,
পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক! আমি তো শুধু একজন মানুষ, একজন রাসূল’ (বানী ইসরাঈল ৯৩)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, قُلْ إِنَّمَا
أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً ‘বলুন,
আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মা‘বূদ
একজন। সুতরাং যে তাঁর প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তাঁর
প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে’ (কাহফ ১১০)।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, قُلْ إِنَّمَا
أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ ‘বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি অহী
হয় যে, তোমাদের মা‘বূদ একমাত্র (সত্য) মা‘বূদ’ (হা-মীম
সিজদা ৬)।
উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত নবী রাসূলগণ মাটির
মানুষ ছিলেন। অনুরূপভাবে আমাদের নবীও মাটির মানুষ ছিলেন। মানুষের অভ্যাস ভুলে
যাওয়া, অপারগ ও অসুস্থ হওয়া, ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগা, বিবাহ করা, সন্তান-সন্ততি হওয়া
ইত্যাদি। এ সকল গুণ নবী-রাসূল সবার মাঝেই ছিল। তাঁদের সবার পিতা-মাতা ছিল, তাঁদের
সবার স্ত্রী-পরিবার ছিল। তাঁরা খেতেন, পান করতেন, রোগ ও বালা-মুছীবতে পতিত হতেন।
তাঁরা অনেক সময় ভুলেও যেতেন। এ সকল গুণ দ্বারা সহজেই বুঝা যায় যে, তাঁরা সবাই
মাটির সৃষ্টি মানুষ ছিলেন, নূরের তৈরী ছিলেন না।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন, এ সম্পর্কে হাদীছের দলীল :
রাসূল (ছাঃ)-এর অনেক সময় ভুল-ত্রুটি হ’ত। ছালাত আদায়ের সময় যখন
তিনি ভুলে যেতেন, তখন বলতেন, إِنَّمَا
أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ، أَنْسَى
كَمَا تَنْسَوْنَ، فَإِذَا
نَسِيتُ فَذَكِّرُونِىْ- ‘নিশ্চয়ই
আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমি ভুলে যাই, যেমনভাবে তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি
ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে’।[1]
সকল ফেরেশতা নূর থেকে সৃষ্টি এবং আদম সন্তান সবাই পানি ও মাটি থেকে
সৃষ্টি। আর জিন জাতি আগুন থেকে সৃষ্টি। যেমন হাদীছে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)
বলেন, خُلِقَتِ الْمَلاَئِكَةُ مِنْ
نُوْرٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ
مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُمْ ‘সকল ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা
হয়েছে এবং জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদম জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে
সেই সমস্ত ছিফাত দ্বারা, যে ছিফাতে তোমাদের ভূষিত করা হয়েছে’। অর্থাৎ মানব জাতিকে
মাটি ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।[2]
এই হাদীছটি সমাজে বহুল প্রচলিত হাদীছকে বাতিল করে। তা হচ্ছে ‘হে
জাবের আল্লাহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন’। অনুরূপ অন্য যে
হাদীছগুলোতে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) নূরের তৈরী, সেগুলোও বাতিল। কারণ উপরোক্ত
হাদীছটি প্রমাণ করে যে, সকল ফেরেশতা নূর থেকে
সৃষ্ট; আদম সন্তান নয়।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন, এ সম্পর্কে মনীষীগণের অভিমত :
ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) বলেন, সমস্ত নবী এবং ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মাদ
(ছাঃ) আল্লাহর বান্দা, তাঁরা সমস্ত মানুষের মতই সৃষ্ট মানব। সবার জন্ম হয়েছে
নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে। শুধুমাত্র আদম এবং ঈসা (আঃ) ব্যতীত। অবশ্য আদমকে আল্লাহ
তা‘আলা মাটি থেকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, কোন নারী পুরুষের সংমিশ্রণ ছাড়া। আর ঈসা
(আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন তাঁর মায়ের পেট থেকে কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়া।[3]
শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এ বিশ্বাসের উপর
মৃত্যুবরণ করবে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাটির মানুষ নয় বা আদম সন্তান নয় অথবা
বিশ্বাস করে যে, তিনি অদৃশ্যের খবর জানেন, এটা কুফরী এবং একে বড় কুফরী গণ্য করা
হবে অর্থাৎ ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী কুফরী।[4]
কুরআন বলছে, সকল নবী-রাসূল মাটির তৈরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও
বলেছেন, আমি তোমাদের মতই মানুষ। বিদ্বানগণ বলছেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাটির
মানুষ, সকল নবী-রাসূল এবং সকল সাধারণ মানুষের মত। এরপরেও যদি কেউ মিথ্যা বানোয়াট
হাদীছ উল্লেখ করে বলে, তিনি নূরের তৈরী, তাহ’লে সে হবে আক্বীদাভ্রষ্ট।
রাসূল
সম্পর্কে জাল বা বানাওয়াট হাদীছ সমূহঃ
(১) জাবের (রাঃ) একদা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আরয করলেন, ইয়া
রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হউক। আপনি বলুন, আল্লাহ
তা‘আলা সর্বপ্রথম কোন বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তরে বললেন, হে
জাবের! আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম তাঁর নূর দ্বারা তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সে নূরকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগ দ্বারা কলম, এক ভাগ
দ্বারা লাওহে মাহফূয ও একভাগ দ্বারা আরশে আযীম সৃষ্টি করেছেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আসমান-যমীন ফেরেশতা, জিন প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে
থাকে।[5] এই হাদীছটি বাতিল, কোন হাদীছ গ্রন্থে হাদীছটি পাওয়া যায় না।
(২) লাওহে মাহফূয সৃষ্টির পর তাতে আল্লাহর নামের পার্শ্বে
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম অর্থাৎ কালেমায় তাইয়িবাহ লিখে রাখা হয়। ওমর (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, জান্নাতে আদম (আঃ) যখন আল্লাহর একটি আদেশ লংঘন
করে পরে নিজ ভুল বুঝতে পারলেন, তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট এভাবে প্রার্থনা
করলেন, হে আল্লাহ রাববুল আলামীন! আপনি আমাকে মুহাম্মাদের অসীলায় ক্ষমা করে দিন।
আল্লাহ পাক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আদম! তুমি মুহাম্মাদকে চিনলে কিভাবে, তাঁকে তো
আমি এখন পর্যন্ত সৃষ্টি করিনি? তখন আদম (আঃ) বললেন, হে দয়াময় প্রভু! আমাকে সৃষ্টি
করে যখন আপনি আমার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলেন, তখন আমি চক্ষু মেলে তাকিয়ে দেখলাম,
আরশের গায়ে লেখা রয়েছে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা-হ’। তখন আমি
ভাবলাম, নিশ্চয়ই আপনি ঐ ব্যক্তির নাম আপনার নিজের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন, যিনি
আপনার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, হে আদম! তুমি ঠিকই বলেছ।
নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ সৃষ্টি জগতের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। এমনকি তাঁকে
সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।[6]
ইমাম ত্বহাবী বলেন, হাদীছটি আহলুল ইলমের নিকট নিতান্ত
দুর্বল।[7] আবূদাঊদ, আবূ যুর‘আ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম দারা-কুত্বনী এবং ইবনে
হাজার আস-ক্বালানী সবাই বলেন, হাদীছটি দুর্বল।[8] ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)
বলেন, হাদীছটি যে দুর্বল এ ব্যাপারে সবাই একমত। নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন,
হাদীছটি বানাওয়াট।[9] ইমাম আলুসী হানাফী বলেন, হাদীছটির কোন ভিত্তিই নেই।[10]
(৩) হাদীছে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় প্রিয়তম নবী (ছাঃ)-কে
লক্ষ্য করে বলেছিলেন, لو لاك
ما خلقت الأفلاك ‘যদি আপনাকে
সৃষ্টি না করতাম, তবে নিশ্চয়ই এ কুল-মাখলূক সৃষ্টি করতাম না’।[11] হাদীছটি
বানাওয়াট, বাতিল।
(৪) হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আপনি না হ’লে আসমান-যমীন কিছুই সৃষ্টি
করতাম না।[12] ইবনু জাওযী বলেন, হাদীছটি যে বানাওয়াট এতে কোন সন্দেহ নেই।
ইমাম দারা-কুত্বনী বলেন, হাদীছটি দুর্বল। ফালাস বলেন, হাদীছটি বানাওয়াট।[13]
(৫) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, اَوَّلُ
مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ অর্থাৎ
আল্লাহ রাববুল আলামীন সর্বপ্রথম আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন।[14] এটা হাদীছ নয়;
বরং ছূফীদের বানাওয়াট কথা।
(৬) হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আপনি না হ’লে আসমান-যমীন, আরশ-কুরশী,
চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদি কিছুই সৃষ্টি করা হ’ত না। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, এটি
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ নয়। এটি কোন বিদ্বান তাঁদের হাদীছ গ্রন্থে হাদীছে
রাসূল বলে উল্লেখ করেননি এবং ছাহাবায়ে কেরাম থেকেও বর্ণিত হয়নি। বরং এটি এমন একটি
কথা, যার বক্তা জানা যায় না।[15]
(৭) আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় নক্ষত্র
রূপে মুহাম্মাদের নূর অবলোকন করে মুগ্ধ হন।
(৮) মি‘রাজের সময় আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতা সহ আরশে আরোহন করতে
বলেন, যাতে আরশের গৌরব বৃদ্ধি পায়’ (নাঊযুবিল্লাহ)।
(৯) রাসূলের জন্মের খবরে খুশি হয়ে আঙ্গুল উঁচু করার কারণে ও সংবাদ
দানকারিণী দাসী ছুওয়াবাকে মুক্তি দেয়ার কারণে জাহান্নামে আবু লাহাবের হাতের দু’টি
আঙ্গুল পুড়বে না। এছাড়াও প্রতি সোমবার রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম দিবসে জাহান্নামে আবু
লাহাবের শাস্তি মওকূফ করা হবে বলে আববাস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দেখা একটি
স্বপ্নের বর্ণনা তাঁর নামে সমাজে প্রচলিত আছে, যা ভিত্তিহীন।
(১০) মা আমেনার প্রসবকালে জান্নাত হ’তে বিবি মরিয়াম, বিবি আসিয়া ও
মা হাজেরা দুনিয়ায় নেমে এসে সবার অলক্ষ্যে ধাত্রীর কাজ করেন।
(১১) নবীর জন্ম মুহূর্তে কা‘বার প্রতিমাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, রোমের
অগ্নি উপাসকদের ‘শিখা অনির্বাণ’গুলো দপ করে নিভে যায়। বাতাসের গতি, নদীর প্রবাহ,
সুর্যের আলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি...।[16] উপরের বিষয়গুলো সবই বানাওয়াট ও ভিত্তিহীন।[17]
পরিশেষে বলব, আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনা
মোতাবেক সঠিক আক্বীদা পোষণ করতে হবে। তাঁদের প্রতি যথাযথ ঈমান আনতে হবে। তাহ’লেই
প্রকৃত মুমিন হওয়া যাবে। ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে যেমন মুমিন হওয়া যাবে না, তেমনি
পরকালে নাজাতও মিলবে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন-আমীন!
হাদিসের উৎসঃ
[1]. বুখারী, হা/৪০১; মুসলিম, হা/১২৭৪।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭০১।
[3]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা, ১/২৯।
[4]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৫/৩১৯।
[5]. মৌলভী মুহাম্মদ যাকির হুসাইন, মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা
(সঃ), পৃঃ ৪১।
[6]. মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৪১।
[7]. তাহযীবুত তাহযীব ২/৫০৮ পৃঃ।
[8]. ইমাম নাসাঈ, কিতাবুয যু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন, পৃঃ ১৫৮, হা/৩৭৭।
[9]. সিলসিলা যঈফা হা/২৫।
[10]. গায়াতুল আমানী ১/৩৭৩।
[11]. মুকামমাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৪০।
[12]. আবুল হাসান আল-কাত্তানী, তানযীহুশ শরী‘আত আন আহাদীছিশ
শী‘আ, ১/৩২৫।
[13]. ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত, ২/১৯।
[14]. মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৭৭।
[15]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৯৬।
[16]. মৌলুদে দিল পছন্দ, মৌলুদে ছাদী, আল-ইনছাফ, মিলাদ মাহফিল
প্রভৃতি দ্রষ্টব্য।
[17]. বিস্তারিদ দ্রঃ মাওযু‘আতে কবীর প্রভৃতি; ডঃ মুহাম্মাদ
আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ, পৃঃ ১২।
ইসলামী গান ও কবিতায় ভ্রান্ত আক্বীদা
কুরআন মাজীদের আয়াত
ও হাদীছে নববী দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের ইবাদত ও সৎ
আমল কবুল হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে ঈমান-আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া। আর তা
হচ্ছে শিরক মুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক আক্বীদা হওয়া। নানা কারণে অনেক
আগে থেকেই বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে আক্বীদা ও আমলে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু হওয়া সত্তেবও আক্বীদা নির্ভুল না
হওয়ার কারণে পরকালীন জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলেছেন।
তাই আমল করার পূর্বে সঠিক আক্বীদা পোষণ করা ও তা ব্যাপকভাবে চর্চা করা
প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
দেশে প্রচলিত কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা :
বাংলাদেশের
মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহের প্রধান বিষয় হচ্ছে আল্লাহর
সত্তা এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে ভুল বিশ্বাস। দ্বিতীয় বিষয়টি হ’ল
মহানবী শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ভুল ধারণা ও বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে
প্রচলিত ভুল ধারণা ও বিশ্বাসের মূল কারণগুলি নিম্নরূপ :
১. দেশের ধর্মীয়
ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সঠিক
আকাইদ শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা।
২. তাক্বলীদে শাখছী
বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সঠিক আক্বীদা গ্রহণ
না করে মাযহাবের দোহাই দিয়ে তার অপব্যাখ্যা করা।
৩. আলেম ও বক্তাদের
মুখে শোনা কথা বাছ-বিচার না করে গ্রহণ করা ও তা প্রচার করা।
৪. দলীল-প্রমাণ
ছাড়া আলেমগণ ধর্মীয় বই-পুস্তকে জাল-যঈফ বর্ণনা ও ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা লিখে
থাকেন। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকগণ আলেম লেখকদের পদাংক অনুসরণ
করে নিজ রচিত কবিতা, ইসলামী গান ও গযল, প্রবন্ধ এবং সিরাতুন্নবী গ্রন্থে
সেসব ভ্রান্ত আক্বীদা প্রচার করেন।
প্রসঙ্গ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য :
বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে কাব্য সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারা ও ঐতিহ্য
সৃষ্টিতে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকগণের অসামান্য অবদান রয়েছে। বলতে গেলে মুসলিম
বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় আমাদের প্রিয় নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ
(ছাঃ)-এর প্রশংসামূলক নানা কথা নিয়ে। বিশেষ করে পুঁথি-সাহিত্যের মাধ্যমে
না‘ত বা রাসূল প্রশস্তি ব্যাপক আকারে প্রকাশিত হয়। ষোড়শ শতকের শেষার্ধ
থেকে মুসলিম কবিগণ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে
কাব্য রচনা শুরু করেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সেই শুরুকাল থেকেই
কবিগণ কাব্য রচনার সূচনাতেই রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশস্তি গাইতে গিয়ে আবেগ তাড়িত
হয়ে অথবা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অতিমাত্রায় ভক্তিভরে
‘অতিমানব’ অথবা আল্লাহর ‘সমকক্ষ’ জ্ঞান করেছেন। বিশেষত বাংলা কবিতা ও কাব্য
সাহিত্যে ‘নূরনবী’ প্রসঙ্গটি বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন সপ্তদশ
শতকের শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওল তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের সূচনা করেছেন এভাবে-
‘পূর্বেতে আছিল
প্রভু নৈরূপ আকার।
ইচ্ছিলেক নিজ সখা
করিতে প্রচার।
নিজ সখা মহাম্মদ
প্রথমে সৃজিলা।
সেই যে জাতির মূলে
ভূবন নিরমিলা।
তাহার পিরিতে প্রভু
সৃজিল সংসার।
আপনে কহিছে প্রভু
কোরান মাঝার।[1]
এখানে কবি আল্লাহকে
নিরাকার সত্তা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অথচ সঠিক আক্বীদা হল আল্লাহর আকার আছে।
তিনি নিরাকার নন। তবে তাঁর সাথে অন্য কিছুর সাদৃশ্য নেই (শূরা ৪২/১১)।
কবি মুহাম্মাদ
খান ‘মকতুল হুসেইন’ কাব্যের শুরুতে মহানবী (ছাঃ)-এর প্রশস্তি এভাবে বর্ণনা
করেছেন :
মুহাম্মাদ নবী নাম
হৃদয়ে গাঁথিয়া
পাপীগণ পরিণামে
যাইবে তরিয়া।
দয়ার আঁধার নবী
কৃপার সাগর
বাখান করিতে তার
সাধ্য আছে কার।
যার প্রেমে মুগ্ধ
হইয়া আপে নিরঞ্জন
সৃষ্টি স্থিতি করিলেক
এ চৌদ্দ ভূবন।[2]
অষ্টাদশ শতকের কবি
সৈয়দ হামজা পুঁথিকাব্যে রাসূল প্রশস্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
মোহাম্মদ নামে নবী
সৃজন করিয়া
আপনার নূরে তাঁকে রাখিলা
ছাপাইয়া।[3]
আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে ‘নূরনবী’ প্রসঙ্গ :
মুসলিম জাগরণ ও
ইসলামী চেতনা সৃষ্টির দিশারী রূপে আধুনিক বাংলা কাব্য-সাহিত্যে কবি গোলাম
মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), জাতীয় কবি কাযী নজরুল ইসলাম এবং কবি ফররুখ আহমদ
(১৯১৮-১৯৭৪) স্মরণীয় হয়ে আছেন। ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যের বিচিত্র রূপ তাঁরা ইসলামী গান ও কবিতার
মধ্য দিয়ে সুনিপুণভাবে দক্ষ শিল্পীর মত চিত্রিত করেছেন। তাঁদের অবদান
অনস্বীকার্য। তা সত্তেবও প্রচলিত ভুল কথার অন্ধানুসরণ করে তাঁরাও ভুল
আক্বীদা কাব্যাকারে লিখে গেছেন। এখানে কয়েকজন প্রথিতযশা কবির লিখিত কবিতার
কিছু চরণ উল্লেখ করছি।
কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) :
কবি গোলাম
মোস্তফা মুসলিম নবজাগরণের কবি। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও চিন্তাধারায় ইসলামী
তাহযীব ও তামাদ্দুন এবং মুসলিম ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর
প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালবাসা থেকেই তিনি ‘বিশ্বনবী’ রচনায় অনুপ্রাণিত
হয়েছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে তিনি মুহাম্মাদ
(ছাঃ)-কে ‘নূরের তৈরী নবী’ রূপে আখ্যায়িত করে মিথ্যা কথা প্রচারে
ভূমিকা রেখেছেন এবং বিশ্বনবীর সুমহান মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছেন।
তাছাড়া তার রচিত
না‘তে রাসূল-
নিখিলের চির সুন্দর
সৃষ্টি
আমার মুহাম্মাদ
রাসূল,
আমার ….।
নূরের রবি যে আমার নবী
পূর্ণ করুণা ও
প্রেমের ছবি
আমার …।[4]
তারপর আরো অগ্রসর
হয়ে কবি গীত রচনা করলেন এভাবে-
তুমি যে নূরের
রবি
নিখিলের ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি।
ইয়া নবী সালাম
আলাইকা
ইয়া হাবীব সালাম
আলাইকা
সালাওয়া তুল্লা
আলাইকা।
চাঁদ সুরুয আকাশে
আসে
সে আলোয় হৃদয় না হাসে
এলে তাই হে নব রবি
মানবের মনের আকাশে
ইয়া নবী সালাম
আলাইকা
…..।
রাসূলকে ‘নূরনবী’
আখ্যায়িত করে ভ্রান্ত আক্বীদাপূর্ণ উপরোক্ত গীত কবিতাটি গীতিকার কবি গোলাম
মোস্তফা ও বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আববাস উদ্দীন আহমদ-এর দ্বৈত কণ্ঠে কলিকাতায়
তৎকালীন গ্রামোফোন কোম্পানীতে রেকর্ড হয়।[5] তৎপর তা ‘বাংলা মীলাদ’ নাম ধারণ
করে বাংলা মুলুকে ‘মৌলুদ’ অনুষ্ঠানে ‘কিয়াম’ কালে বাংলা ‘দরূদ ও সালাম’ রূপে
পাঠ করার কিংবদন্তীর মর্যাদা (?) অর্জন করেছে। আজও বাংলা অঞ্চলের সর্বত্র
সমানভাবে নবীর উপর সালাম পৌঁছানোর নামে বাংলা কবিতার সুর মূর্ছনা মীলাদ
প্রেমিকদের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার তোলে। ভাবতে অবাক লাগে, একজন বাঙালী কবি
রচিত গীত কবিতা দরূদ ও সালাম রূপে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ ও উপকরণে পরিণত
হ’তে পারে কিভাবে? এ দেশের আলেমগণ কিভাবে দ্বীন ইসলামের এই বিকৃতি চোখ বুঁজে
মেনে নিয়েছেন, সেটাই প্রশ্ন।
কাযী নজরুল ইসলাম (মৃঃ বাংলা ১৩০৬/১৯৭৮ইং) :
জাতীয় কবি কাযী
নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব। তাঁর কবিতা, ইসলামী গান ও গযল এবং না‘তে রাসূল
পাঠে আমরা মুগ্ধ ও বিমোহিত হই। নব জাগরণে অনুপ্রাণিত হই। আমরা নির্দ্বিধায়
বলতে পারি বাংলা কাব্য সাহিত্যের বিশাল আঙিনায় তাঁর রচিত ইসলামী কবিতা ও
না‘তে রাসূল নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। তা সত্তেবও কবির অনেক না‘তে
রাসূল ও ইসলামী গান ভুল আক্বীদায় কলুষিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি না‘তে রাসূলের
দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল-
১. মুহাম্মাদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে
ঐ নামে এত মধু থাকে কে জানিত আগে
মুহাম্মাদ নাম যতই জপি…..।
২. আমার মুহাম্মাদ নামের ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়।
৩. নাম মুহাম্মাদ বোলরে মন, নাম আহমদ বোল।
৪. মুহাম্মাদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে
তাই কিরে তোর কণ্ঠেরি গান এতই মধুর লাগে।
৫. মুহাম্মাদ মোর নয়নমণি মুহাম্মাদ নাম জপমালা
মুহাম্মাদ নাম শিরে ধরি, মুহাম্মাদ নাম গলে পরি।[6]
ফররুখ আহমাদ (১৯১৮-১৯৭৪) :
বাংলা সাহিত্যের
আধুনিক কাব্যধারায় ইসলামের গৌরব মহিমা পুনরুদ্ধার ও মুসলিম পুনর্জাগরণের
স্বপ্ন ও সম্ভাবনার শ্রেষ্ঠ রূপকার ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। তাঁকে বলা হয়
‘মুসলিম রেঁনেসার কবি’। সকল জড়তা পায়ে দলে জেগে উঠার হাতছানি রয়েছে তাঁর
কাব্য ও কবিতায়। এতদসত্তেবও সমাজের চলমান ধ্যান-ধারণা দ্বারা কবি কিছুটা
বিচ্যুৎ-বিভ্রান্ত হয়েছেন। যেমন একটি না‘তে রাসূল লিখতে গিয়ে কথিত ‘নূরনবী’
নামে ভ্রান্ত আক্বীদা তিনিও প্রকাশ করেছেন এভাবে-
ওগো নূরনবী হযরত
আমরা তোমারি উম্মত।
তুমি দয়াল নবী,
তুমি নূরের রবি,
তুমি বাসলে ভাল জগত
জনে
দেখিয়ে দিলে পথ।
আমরা তোমার পথে চলি
আমরা তোমার কথা বলি
তোমার আলোয় পাই যে
খুঁজে
ঈমান, ইজ্জত।
সারা জাহানবাসী
আমরা তোমায় ভালবাসি,
তোমায় ভালবেসে মনে
পাই মোরা হিম্মত।[7]
বিশ্বের
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে সরকারীভাবে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে শিশু-কিশোরদের
জন্য পাঠ্যপুস্তকে মহানবী (ছাঃ) সম্পর্কে মারাত্মক এক মিথ্যা আক্বীদা
পরিবেশন করা খুবই পরিতাপের বিষয়। মানব জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব
অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। আজকের শিশু-কিশোরগণ আগামী দিনে মুসলিম সমাজের
কান্ডারী। শিশু-কিশোরদের মন কাদামাটির মত কোমল। এ সময় তাদেরকে যেমন খুশি
তেমন করে গড়ে তোলা যায়। এ সময়ের শিক্ষা পাথরে খোদিত নকশার ন্যায়। তাই
শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে কোমলমতি কিশোর মনের গহীন কোণে আমাদের প্রিয় রাসূল
মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস শিখিয়ে ‘বিষ বৃক্ষের’ উপর
তাদের অনাগত ভবিষ্যত জীবনের ভিত রচনা করা হচ্ছে। সরকার ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন
কমিটির সম্মানিত সদস্যগণের প্রতি আবেদন, ভবিষ্যতে কোন কবিতা ও প্রবন্ধ
পাঠ্যপুস্তকের জন্য নির্বাচন করার প্রাক্কালে ভুল-শুদ্ধ যাচাই-বাছাই করবেন।
বিল্লালের গযল,
চরমোনাইয়ের গযল, আমার প্রিয় ইসলামী গান, শাহী গযল প্রভৃতি নামকরণে বাজারে
প্রচুর ইসলামী গযলের বই-পুস্তক পাওয়া যায়। এ সকল বই-পুস্তকে হাম্দ ও না‘তের
নামে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে নানা প্রকার ভ্রান্ত ও শিরক মিশানো
আক্বীদা বিস্তার লাভ করছে। স্কুল ও মাদরাসার কচিকাঁচা বালক-বালিকারা সেইসব
বই থেকে গযল মুখস্থ করে মীলাদুন্নবী-সীরাতুন্নবী অনুষ্ঠানে, ওয়ায-মাহফিলে
গাইতে থাকে। ওয়ায়েযীন ও বক্তাগণ ইসলামী জালসায় সুর করে গযল গেয়ে থাকেন।
বিশেষ বিশেষ দিবসে রেডিও এবং টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে নামজাদা
কণ্ঠ শিল্পীগণ ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পথে-প্রাপ্তরে, ফসলের মাঠে
কৃষক-শ্রমিক কাজ করতে করতে ইসলামী গান গায়। নদীর বুকে নৌকার মাঝিরা এসব গান
গায়। কবি-সাহিত্যিকরা কেউ বুঝে কেউ না বুঝে সেগুলো লিখেছেন। মানুষ তা কণ্ঠে
তুলে নিয়ে দিবা-রাত্রি গাইছে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। সকলেই নিজেকে তাওহীদী
আক্বীদায় বিশ্বাসী খাঁটি মুসলিম বলে ধারণা করে। যদিও তার কণ্ঠে গাওয়া
সঙ্গীতটি তাকে ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা এবং
রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কিত ভ্রান্ত আক্বীদার বিষমিশ্রিত কয়েকটি ইসলামী সঙ্গীতের
দৃষ্টান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-
১. নবী মোর পরশমণি,
নবী মোর সোনার খনি
নবী নাম জপে যে জন
সেই তো দোজাহানের ধনী।
নবী মোর নূরে
খোদা তার তরে সকল পয়দা
আদমের কলবেতে তারই
নূরের রওশনী…
নবী মোর পরশমণি, নবী
মোর সোনার খনি।[8]
প্রখ্যাত
কণ্ঠশিল্পী আব্দুল আলীমের কণ্ঠে এই সঙ্গীতটি সরকারী প্রচার মাধ্যমে সর্বদাই
প্রচারিত হয়। গণমানুষের নিকট সঙ্গীতখানি খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর ভিতর এমন
সব বিষয় রয়েছে, যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে শিরকে আকবর (বড় শিরক) হয় এবং
মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।
২. সব মানুষের সেরা
মানুষ নবীজি আমার
নূরের বাতি দাও
জ্বেলে দাও নয়নে আমার।
তোমার দয়ার কাঙাল
আমি
কাঁদি সারা দিবস
যামী।
দূর কর দূর কর মনে
মিটাও অাঁধিয়ার।[9]
৩. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
মুহাম্মাদ রাসুল
……
নূরের নবী প্রেমের ছবি
নাইকো তাহার তুল,
ও ভাই নাইকো তাহার
তুল
লা ইলাহা…..।[10]
৪. দূর আরবে ফুটেছিল
একটি নূরের ফুল (২ বার)
সে ফুল আমার
কমলীওয়ালা রাসূলে মাকবুল
……
নূর নবীজীর দরূদ তাকে করে
যে আকুল…
রাসূলে মাকবুল, আমার
রাসূলে মাকবুল।[11]
৫. দিবা নিশি জপি
আমি আল্লাহ নবীর নাম
ঐ নামের গুণে পুরবে
জানি (২ বার) আমার মনস্কাম
আল্লাহ নবীর নাম
……
ঐ নামে যে পরবে
মালা, জীবন হবে তার উজালা
…. আল্লা নবীর নাম।[12]
৬. ডেকে লও
রাসূলুল্লাহ, রওজা পাকের কিনারে
আমি সহিতে পারি না
বিরহ জ্বালা, ধন্য কর দীদারে
আমি কেঁদে কেঁদে
হইগো সারা, ধন্য কর দীদারে।
আজো রওজায় শুয়ে থেকে
হায়,
কাঁদেন তিনি
উম্মাতের মায়ায়।[13]
৭. নূরুন আলা নূর
মুহাম্মাদ নূরের খাজিনা
তোমার নূরের বদন
দেখতে আমি দেওয়ানা।
তোমার নূরে জগৎ
জাহান সৃজিয়াছেন
আল্লাহ মহান
……..
তোমার নূরের লোভে
লোভী তামাম দুনিয়া।
তোমার নূরে পয়দা হয়ে
ফেরেশতাদের সিজদা লয়ে
পাইল তাজীম আদম নবী
তারই উছিলায়
তোমার নূরের
তাজাল্লীর ঐ ইশকে দেওয়ানা।[14]
-মাওলানা আ.জ.ম. অহিদুল আলম।
৮. মরণকালে দিও গো
দেখা হে প্রিয় রাসূল আমায়
হৃদয় মাঝে তোমারি
নাম জপি সারাক্ষণ।[15]
৯. নবী রাসূলকে
মুর্দা বলে কোন সে অবুঝ দল
……
নবী রাসূলগণ কবর
শরীফে জিন্দা আছেন হায়
মূসা নবীকে একদা
রাসূল নামাজ হালে পায়।
মোদের নবী
হায়াতুন্নবী আছেন জিন্দা হালে
মোদের লাগি দোয়ায় রত
আছেন সাঁঝ সকালে।
উম্মতেরা করছে কি
কাজ নবী দেখতে পায়
সেই নবীকে মুর্দা
বলা কাদের শোভা পায়।
……
মাযহাব মানা ফরজ বলে
সঠিক আলেমেরা
মাযহাব যারা ছাড়িবে
তারা হবে যে গোমরা
কোন বাতিল দল মাযহাব
মানে না মোদের জামানায়
সত্য আলোর রশ্নি
ছেড়ে অাঁধারে কাতরায়।[16]
…. মাঃ হায়দার হুসাইন
১০. ও গো নবী সরোয়ার
তুমি হাবীব আল্লার
…….
সৃষ্টি করে নূরকে
তোমার অতি তাজীমে
সবার আগে রাখেন খোদা
আরশে আজীমে
সে পাক নূরেতে তোমার
গড়েন তামাম সংসার
সৃষ্টি হল আরশ,
কুরসি, জমিন ও আসমান।
…..
পেলে দিদার প্রভুর
নূরে মিলে গেল নূর।[17]
-মাওলানা কবি রুহুল আমীন খান।
১১. সব নবীদের সেরা
তুমি আখেরী রাসূল,
……..
পয়দা হল নিখিল জাহান
তোমারি পাক নূরে
ধরা হতে আধার কালো
পালিয়ে গেল দূরে।[18]
– মাওলানা আ.জ.ম. ওবায়দুল্লাহ
১২. নূর মুহাম্মাদ ছল্লাল্লাহু সব নবীর সুলতান
তুমি লাহুতের
মেহমান,
………….
চাঁদ-সুরুজে তোমার
দ্যুতি
গ্রহ তারায় তোমার
জ্যোতি
আরশ ফালাক সকল তোমার
নূরেতে রৌশন।[19]
-মাওলানা কবি রুহুল আমীন খান।
জনৈক কবি লিখেছেন,
আকার কি নিরাকার সেই
রববানা
আহমদ আহাদ বিচার হলে
যায় জানা
আহমদ নামেতে দেখি
মিম হরফে লেখেন নবী
মিম গেলে আহাদ বাকী
আহমদ নাম থাকে না।
আরেকজন কবি লিখেছেন,
আহমদের ঐ ‘মিম’-এর
পর্দা
উঠিয়ে দেখরে মন
দেখবি সেথা বিরাজ
করে
একজন মুসলিম
গীতিকারের রচিত কথিত ভক্তিমূলক গান দেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীরা সরকারী
প্রচার মাধ্যমে সর্বদাই গেয়ে থাকেন। যার কথাগুলি খুবই আপত্তিজনক। কথাগুলি
হ’ল-
ছায়া বাজি পুতুল
রূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি
নাচি পুতুলের কি দোষ
তুমি হাকিম হইয়া
হুকুম কর,
পুলিশ হইয়া ধর
সর্প হইয়া দংশন কর
ওঝা হইয়া ঝাড়।
তুমি মার তুমি
বাঁচাও
তুমি খাওয়াইলে আমি
খাই, আল্লাহ…
এই যে দুনিয়া কিসের
লাগিয়া
এত যত্নে গড়াইলেন
সাঁই
এই যে দুনিয়া……।
হিন্দু ধর্মেঃ
হিন্দু ধর্মাবলম্বী
পন্ডিত শ্রীমৎ শংকরাচার্য্য অদ্বৈতবাদ মতবাদ প্রচার করেছেন। যার সারকথা হ’ল
সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি অভিন্ন বস্ত্ত। জগতে যা কিছু বিদ্যমান তার সবকিছুই
স্রষ্টার অংশ বিশেষ। যার আরেক নাম সর্বেশ্বরবাদ। যার অর্থ সব জড় ও জীব জগতের
মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। এই বিশ্বাস থেকেই হিন্দুরা সকল সৃষ্ট বস্ত্তর
পূজা করার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করার দাবী করে।
খৃষ্টান ধর্মেঃ
খৃষ্টানরা দাবী করে
যে, ঈশ্বর সর্বপ্রথম তার নিজের ‘যাত’ বা সত্তা থেকে ‘কালেমা’ বা পুত্র যীশু
খৃষ্টকে সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে তিনি সৃষ্টি করেন। খৃষ্ট
ধর্মের ‘সৃষ্টিতত্ত্বের’ আদলে সপ্তম হিজরী শতকের ছূফী মহিউদ্দীন ইবনুল
আরাবী
(৫৬০-৬৩৮ হিঃ) বলেন, ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম ‘নূরে মুহাম্মাদী’ সৃষ্টি করেন এবং
তার থেকে সকল সৃষ্টি জগতকে পয়দা করেন। জাবির (রাঃ)-এর নাম জড়িয়ে- ‘সর্বপ্রথম
আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তার নূর থেকে সৃষ্টি করেন’- এই মিথ্যা কথাটি
সর্বপ্রথম ইবনুল আরাবী তার রচিত বই-পুস্তকে ‘হাদীছ’ নাম দিয়ে উল্লেখ করেন।[21]
আমরা স্পষ্টভাবে
দেখতে পাই যে, হিন্দু ধর্মের ‘অদ্বৈতবাদ’, খৃষ্টান ধর্মের ‘বহু ঈশ্বরবাদ’
এবং ইবনুল আরাবী উদ্ভাবিত মুসলমানদের ‘নূরে মুহাম্মাদী তত্ত্ব’-এর মধ্যে
কোনই প্রভেদ নেই। বরং চমৎকার মিল রয়েছে। তিন ধর্মের তিনটি মতবাদের মৌলিক কথা
একটিই। আর তা হচ্ছে জগতের সকল সৃষ্টিই হিন্দুর ‘ঈশ্বর’, খৃষ্টানের ‘খোদা’
এবং মুসলমানের ‘আল্লাহর’ সত্তা থেকে সৃজিত হয়েছে।
‘আল্লাহর নূরে
নবী পয়দা, নবীর নূরে জগত পয়দা’ যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘নূরনবী’, এই বচন যারা
হাদীছ নামে প্রচার করেন এবং এ আক্বীদা পোষণ করেন তাদের কথার অর্থ দাঁড়ায় যে,
‘আল্লাহর সত্তা’ বা ‘যাত’ একটি ‘নূর’ বা নূরানী বস্ত্ত এবং আল্লাহ স্বয়ং
নিজের সেই যাতের বা ‘সত্তার’ অংশ থেকে তাঁর নবীকে পয়দা করেছেন (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ আল্লাহ তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
গুরুত্বের
সাথে বিবেচনার দাবী রাখে যে, কোন হাদীছ গ্রন্থেই ছহীহ, যঈফ, হাসান কোন
সূত্রেই রাসূল (ছাঃ) থেকে তিনি ‘নূর নবী’ বা ‘নূর দ্বারা তৈরী’ এমন একটি
হাদীছও বর্ণিত হয়নি। হিজরী সাতশত শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ছাহাবী, তাবেঈ,
তাবে তাবেঈ, সালাফে ছালেহীন, চার ইমাম সহ কোন মুসলিম আলেম ‘নূরনবী’
সংক্রান্ত কিছুই জানতেন না। যদি তাঁরা জানতেন তাহ’লে অবশ্যই ইতিহাস ও সীরাত
গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ করে যেতেন। কিন্তু তা নেই। এমনকি ইসলামের ইতিহাসের
প্রথম পাঁচশত বছরে কোন দল-উপদল বা বাতিল ফের্কার পক্ষ হ’তেও ‘নূর নবী’ বিষয়ক
কিছু আলোচিত হয়নি।
কিন্তু
বিচিত্র এই দেশ। বিচিত্র এ দেশের মানুষ। কবির ভাষায়- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে
পাবে নাক তুমি…। সব সম্ভবের এই দেশে কে শোনে কার কথা। প্রমাণবিহীন বাংলা
বই-পুস্তক আর ওয়ায-মাহফিলে বক্তাদের মুখে শোনা কথার উপর নির্ভরশীল হয়ে
কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার সকলেই বিভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাস স্থাপন
করে বা না করে অভ্যাসগত শিরকের পঙ্কিলে আটকে গেছে। যার শেষ পরিণাম অত্যন্ত
ভয়াবহ। কারণ আল্লাহ শিরকের ফলাফল সম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন,
‘যদি তারা শিরক করে তাহ’লে তাদের আমল সমূহ নষ্ট হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৮৮)।
সঠিক আক্বীদা :
ইহুদীরা ওযায়ের
(আঃ), খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ) ও আরবের মুশরিকরা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)
সম্পর্কে অতি ভক্তি ও বাড়াবাড়ি করে শিরকে নিপতিত হয়েছিল। এজন্য পবিত্র কুরআন
ও হাদীছে আবদিয়াত (বান্দা), বাশারিয়াত (মানবত্ব), গায়েবি খবর সম্পর্কে না
জানা প্রভৃতি বিষয়ে বারবার আলোচনা করা হয়েছে। যাতে ঈমানদারগণ রাসূলের
আনুগত্য ও ভালবাসার পাশাপাশি তাঁর প্রতি অতি ভক্তি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা
করতে পারে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত রাসূলের পরিচিতি বর্ণনা করে
বলেন, ‘বল, আমি তোমাদের মতই মানুষ; আমার প্রতি অহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ
একমাত্র ইলাহ’ (হামীম সাজদা ৪১/৬)।
রাসূল (ছাঃ) নিজেই
নিজের বৈশিষ্ট্য পেশ করে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমি
ভুলে যাই, যেমনভাবে তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ
করিয়ে দিবে’।[22] সৃষ্টির
বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সকল
ফেরেশতা নূর থেকে এবং জ্বিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদমকে
(মানব জাতি) সৃষ্টি করা হয়েছে সেই সব ছিফাত দ্বারা, যে ছিফাতে তোমাদের ভূষিত
করা হয়েছে (অর্থাৎ মানব জাতিকে মাটি ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে)।[23] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কেবলমাত্র ফেরেশতাগণ
‘নূর’-এর তৈরী। মানব জাতি কিংবা তার মধ্য হ’তে নবী-রাসূলগণ নূরের তৈরী নয়।
আলেমগণের
উচিত, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও ছহীহ হাদীছগুলির উপর নির্ভর করা এবং সেই
মুতাবিক সঠিক ও বিশুদ্ধ আক্বীদা গ্রহণ ও প্রচার করা। সঠিক আক্বীদা গ্রহণের
কথা বলা হ’লে যদি আপনি বলেন, ‘এগুলি ওহাবীদের কথা। ওহাবীদের নিকট থেকে
আক্বীদা শিখতে হবে না। এদেশে ইসলাম প্রচার করেছে ওলী-আউলিয়াগণ। এতদিন পর
ওহাবীরা এসেছে নতুন করে আক্বীদা শিখাতে’? এসব উক্তি করে আপনি নিজেকে দলীয়
সংকীর্ণতার কুটিল পঙ্কিলে নিমজ্জিত করলেন। পবিত্র কুরআনের আয়াত ও রাসূল
(ছাঃ)-এর হাদীছ ‘ওহাবী’ অথবা ‘সুন্নী’ এ রকম বিভাজন করে বর্ণিত হয়নি।
এক্ষেত্রে আপনি ঈমানদার কি-না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। বিদ‘আতী ও কুফরী
আক্বীদা-আমল সমর্থন করা হ’লে তিনি পাক্কা ‘সুন্নী’। আর তার বিরোধিতা করলে
কা‘বা মসজিদের ইমাম ছাহেব হ’লেও তিনি ওহাবী। কি চমৎকার অভিধা! এসব গোঁড়ামি
ছেড়ে পরকালীন নাজাতের লক্ষ্যে সকলকে কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত ছহীহ আক্বীদা
গ্রহণ করতে হবে। ভ্রান্ত আক্বীদা ও শয়তানী পথ ছাড়তে হবে। এছাড়া কোন গত্যন্তর
নেই।
উপসংহার :
বাংলা ভাষায় রচিত
কাব্য ও কবিতায়, গযল ও গানে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা
আবহমান কাল থেকে প্রচার হয়ে আসছে। প্রচলিত শত শত গযল ও ইসলামী সঙ্গীতের মধ্য
থেকে কয়েকটি মাত্র দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। সকল দলীয় সংকীর্ণতার
ঊর্ধ্বে থেকে পরকালীন মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে অতীতের ভুল সংশোধন করে নেওয়া
মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আসুন!
সে লক্ষ্য সামনে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়-দায়িত্ব পালন করি।
নির্ভুল আক্বীদা প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক সহযোগিতা দান করি। আল্লাহ তাওফীক দান
করুন- আমীন!
[1]. মুহাম্মদ শাহাব উদ্দীন, সাহিত্য সাধনায় কয়েকজন মুসলিম প্রতিভা
(ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ডিসেম্বর ২০০৪), পৃঃ ১৭।
[2]. ঐ, পৃঃ ১৮।
[3]. তদেব।
[4]. ঐ, পৃঃ ৩৪।
[5]. ঐ, পৃঃ ৩৫।
[6]. ঐ, পৃঃ ২০।
[7]. বাংলা সহজপাঠ, পঞ্চম শ্রেণী, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড,
ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ: নভেম্বর, ২০১২, পৃঃ ৯৬-৯৭; ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা ৪র্থ
শ্রেণী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড,ঢাকা।
[8]. ডাঃ এম.এ. সামাদ, আমার প্রিয় ইসলামী গান, পৃঃ ৭৮, প্রথম প্রকাশ :
মার্চ ২০০৫। প্রকাশক : সাহিত্য সোপান, বগুড়া।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৪।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০।
[11]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭১।
[12]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৭।
[13]. শাহী গযল বা হিযবুল্লাহ জাগরণী, পৃঃ ১৭; ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত
লাইব্রেরী, নেছারাবাদ, পিরোজপুর।
[14]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭।
[15]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯।
[16]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭।
[17]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৭।
[18]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬২।
[20]. মোঃ আবু তাহের বর্ধমানী, অধঃপতনের অতল তলে, পৃঃ ৬৪।
[21]. ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃঃ ২৫৯
তৃতীয় প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ২০০৮।
[23]. মুসলিম; মিশকাত হা/৫৭০১।
মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে প্রচলিত জাল হাদীছের
পর্যালোচনা
ভূমিকা: জ্ঞান এবং অজ্ঞতা পরস্পরবিরোধী দু’টি শব্দ। জ্ঞান মানুষকে সত্য ও
আলোর পথ দেখায়। আর অজ্ঞতা মানুষকে বিভ্রান্ত ও ধ্বংস করে। সব অজ্ঞতা মেনে নেয়া
যায়, কিন্তু স্বয়ং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে যখন মুসলিম জাতির একটি
বিরাট অংশ চরম অজ্ঞতা প্রসূত আক্বীদা পোষণ করে তখন কষ্ট চেপে রাখা বড় কঠিন হয়ে
যায়। নিম্নে আমরা রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে প্রচারিত মিথ্যা কিছু হাদীছ পর্যালোচনা
করতে চাই, যেন সমাজে গেঁড়ে বসে থাকা অজ্ঞতার প্রহেলিকা কিছুটা হলেও অপসারণ করা
সম্ভব হয়। আল্লাহুল মুসতাআন
হাদীছ-১: আল্লাহ আদম (আঃ)-কে বললেন, ولولا محمد ما خلقتُك ‘মুহাম্মাদ যদি না হ’ত তবে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’।[1]
পর্যালোচনা: এটা একটি বানোয়াট হাদীছ।
হাদীছ-২ : لولاك لما خلقت الأفلاك ‘আপনাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য না হ’লে আমি বিশ্বমন্ডল সৃষ্টি করতাম
না’।
পর্যালোচনা: হাদীছটি বানোয়াট। এই বিষয়ে ইমামদের পর্যালোচনামূলক উক্তিগুলি
তুলে ধরা হ’ল-
(১) ইমাম ছাগানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটি জাল।[2]
(২) ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেছেন, مَوْضُوع بِلَا شكّ (এটা) নিঃসন্দেহে বানোয়াট।[3]
(৩) শায়খ জামালুদ্দীন ক্বাসেমী (রহঃ) বলেছেন, والأحاديث التي وضعها المطرون الغلاة كحديث: "لولاك ما خلقت الأفلاك ‘চরমপন্থীরা যে সকল
হাদীছ বানিয়েছে তন্মধ্যে একটি হ’ল- ‘যদি আপনি না হ’তেন তবে বিশ্বমন্ডল কিছুই
সৃষ্টি করতাম না’।[4]
(৪) একটি বিশ্ববিখ্যাত আক্বীদার গ্রন্থে লেখা হয়েছে, لولاك..لما خلقت الأفلاك وهو غلو فاحش يجب التوبة منه ‘আপনাকে প্রেরণের
উদ্দেশ্য না হ’লে আমি বিশ্বমন্ডল সৃষ্টি করতাম না’-(এই ধরণের কথা বলা) মারাত্মক
বাড়াবাড়ি। এ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব’।[5]
(৫) শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এ হাদীছটিকে মাওযূ‘ তথা বানোয়াট
বলেছেন। যেমনটা ইমাম ছাগানী ‘আল-আহাদীছুল মাওযূ‘আহ’ গ্রন্থে (পৃঃ ৭) বলেছেন। তবে
শায়খ (মোল্লা আলী) আল-ক্বারীর উক্তি (৬৭, ৬৮)- ‘কিন্তু এর অর্থটি ছহীহ’, এটা
দায়লামী ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে মারফূ‘ হিসাবে (নিমেণাক্ত ভাষায়) বর্ণনা করেছেন-
‘আমার কাছে জিবরীল আসলেন। এরপর বললেন, يا محمد لولاك لما خلقت الجنة، ولولاك ما خلقت النار ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি না হ’তেন তাহ’লে জান্নাত সৃষ্টি করতাম না
এবং আপনি যদি না হ’তেন তবে জাহান্নাম সৃষ্টি করতাম না। ইবনে আসাকিরের অন্য এক
বর্ণনায় এসেছে, لولاك ما خلقت الدنيا ‘আপনি যদি না হ’তেন তাহ’লে দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না’।
আমি (আলবানী) বলছি : দায়লামীতে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা বিশুদ্ধ
প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত (হাদীছটির অর্থ সঠিক) এ মর্মে দৃঢ়চিত্ত হওয়া যাবে না। আর
আমি কাউকে দেখছি না যিনি এ মর্মে বর্ণনা করেছেন। যদিও আমি এর সনদটি সম্পর্কে অবহিত
হইনি, তবুও হাদীছটি যে দুর্বল এ মর্মে কোন দ্বিধা বোধ করছি না।
আর দায়লামী কর্তৃক এককভাবে বর্ণিত হওয়াটাই হাদীছটির দুর্বলতা
প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অতঃপর আমি এর যঈফ, বরং অত্যন্ত যঈফ হওয়ার পক্ষে জোর দিলাম
যখন (দায়লামীর) ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (১/৪১/২) হাদীছটির সনদ সম্পর্কে অবহিত হ’লাম।
(হাদীছটি) উবায়দুল্লাহ বিন মূসা আল-কুরাশীর সনদে বর্ণিত...। আমার দৃষ্টিতে এটির
সমস্যা হ’ল সনদের রাবী ‘আব্দুছ ছামাদ’। উক্বায়লী বলেছেন, حديثه غير محفوظ، ولا يعرف إلا به ‘তার হাদীছ সংরক্ষিত
নয় এবং তার মাধ্যম ব্যতীত (হাদীছটি অন্য কোন মাধ্যমে বা সনদে) জানা যায় না’... আর
ইবনে আসাকিরের বর্ণনাটি ইবনুল জাওযীও তার ‘আল-মাওযূআত’ গ্রন্থে (১/২৮৮-২৮৯) একটি
দীর্ঘ হাদীছের মধ্যে ‘সালমান’ হতে মারফূরূপে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, إنه موضوع নিশ্চয়ই এটা (হাদীছটি)
বানোয়াট। সুয়ূত্বী ‘আল-আলী আল-মাছনুআহ’ গ্রন্থে (১/২৭২) তা (ইবনুল জাওযীর বক্তব্য)
সমর্থন করেছেন। অতঃপর আমি আনাস (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছ পেয়েছি। অচিরেই আমরা এ
বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ’।[6]
(৬) শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) বলেছেন, কতিপয় লোক এটা বলেন যে,
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,لولاك لما خلقت الأفلاك ‘হে নবী! যদি আপনি না হতেন তবে আমি আকাশ (ও যমীন) সৃষ্টি করতাম
না’।-এই কথাটির কোন প্রমাণই হাদীছের কোন গ্রন্থে সনদের সাথে বিদ্যমান নেই। এই
সনদবিহীন বাক্যটিকে শায়খ হাসান বিন মুহাম্মাদ ছাগানী (৬৮০ হিঃ) ‘موضوع’ অর্থাৎ মনগড়া
বলেছেন’।[7]
জ্ঞাতব্য : আজলূনী ও মোল্লা আলী ক্বারী ‘হাসান আছ-ছাগানী’ হ’তে এই
বাক্যটির موضوع (বানোয়াট) হওয়া বর্ণনা
করার পর লিখেছেন, ‘معناه صحيح’ অর্থাৎ এই (বানোয়াট বর্ণনাটির) অর্থটি বিশুদ্ধ বা ছহীহ। বিষয় হ’ল
যে, যখন এই রেওয়ায়াতটি বাতিল, মনগড়া এবং আল্লাহ ও রাসূলের উপর মিথ্যাচার, তখন কোন
দলীলের ভিত্তিতে এর অর্থ বা মর্মকে ছহীহ বলা হয়েছে?
মোল্লা আলী ক্বারী লিখেছেন যে, দায়লামী ইবনে আববাস হ’তে মারফূ
হিসাবে বর্ণনা করেছেন যে,أتاني جبريل فقال: يا محمد لولاك ما خلقت الجنة، ولولاك لما خلقت النار ‘জিবরীল আমার নিকটে আসলেন ও বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি না
হ’তেন তাহ’লে জান্নাত সৃষ্টি হত না। আপনি যদি না হ’তেন তবে জাহান্নাম সৃষ্টি হত
না’।[8]
এই রেওয়ায়াতটি ‘কানযুল উম্মাল’[9] ও ‘কাশফুল খফা’[10] গ্রন্থে
দায়লামীর উদ্ধৃতিতে ‘ইবনে আববাস (ইবনে ওমর) হতে’ সনদে বর্ণিত আছে। দায়লামীর (মৃঃ
৫০৯ হিঃ) ‘ফিরদাউসুল আখবার’ গ্রন্থে এই রেওয়ায়াতটি সনদবিহীন ও উদ্ধৃতি ব্যতিরেকে
উল্লেখ আছে।[11]
সুতরাং এই রেওয়ায়াতটিও সনদবিহীন ও উদ্ধৃতিবিহীন হওয়ার কারণে
বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত।
মুহাদ্দিছ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হারূন বিন ইয়াযীদ
আল-খাল্লাল (মৃঃ ৩১১ হিঃ) কোন সনদ ও উদ্ধৃতি ব্যতিরেকেই বর্ণনা করেছেন যে, يَا مُحَمَّدُ، لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ آدَم ‘হে মুহাম্মাদ! যদি
আপনি না হ’তেন তবে আদমকে সৃষ্টি করতাম না’।[12] এই রেওয়ায়াতটিও সনদবিহীন হওয়ার
কারণে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত। মোল্লা আলী ক্বারী ইবনে আসাকির হ’তে বর্ণনা করেছেন
যে, لولاك ما خلقت الدنيا ‘যদি আপনি না হ’তেন
তবে দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না’।[13]
ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়াতটি ‘তারীখে দিমাশক্ব’ (৩/২৯৬, ২৯৭), ইবনুল
জাওযীর ‘কিতাবুল মাওযূ‘আত’ (১/২৮৮, ২৮৯) এবং সুয়ূত্বীর ‘আল-আলী আল-মাছনূআহ ফিল
আহাদীছিল মাওযূ‘আ’ (১/২৭২) গ্রন্থসমূহে মওজূদ আছে। ইবনে জাওযী বলেছেন, এটা বানোয়াট
হাদীছ। এতে কোন সন্দেহ নেই। এর সনদে দু’জন মাজহূল রাবী ও যঈফ রাবী রয়েছেন। যঈফ
রাবীদের মধ্যে আবুস সুকাইন ও ইবরাহীম ইবনুল ইয়াসা অন্যতম। দারাকুৎনী বলেছেন, أَبُو السكين ضَعِيف আবুস সুকাইন যঈফ রাবী।
আর ইবরাহীম ও ইয়াহইয়া বছরী উভয়ই মাতরূক বা প্রত্যাখ্যাত রাবী। আহমাদ বিন হাম্বল
বলেছেন, حرقنا حَدِيث يَحْيَى الْبَصْرِيّ ‘আমরা ইয়াহইয়া আল-বছরী
বর্ণিত হাদীছ জ্বালিয়ে দিয়েছি। আর ফাল্লাস বলেছেন, كَانَ كذابا يحدث أَحَادِيث مَوْضُوعَة ‘তিনি মহামিথ্যুক ছিলেন। দারাকুৎনী বলেছেন, مَتْرُوك তিনি মাতরূক বা
পরিত্যাক্ত’।[14]
অর্থাৎ (ইবনে জাওযীর নিকটে) এই হাদীছটি সন্দেহাতীতভাবে বানোয়াট। আর
এর তিনজন রাবী আবুস সুকাইন, ইবরাহীম ইবনুল ইয়াসা ও ইয়াহইয়া আল-বাছরীও সমালোচিত।
সুয়ূত্বী বলেছেন, موضوع ‘এটা বানোয়াট’।[15] এর রাবী খলীল বিন মুর্রাও অত্যন্ত যঈফ’।[16]
সাইয়েদুনা ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি মারফূ‘ হাদীছে লেখা হয়েছে যে, لولا محمد ما خلقتك (হে আদম!) যদি
মুহাম্মাদ না হত তবে আপনাকে সৃষ্টি করতাম না’।[17]
যদিও এই রেওয়ায়াতটিকে হাকেম ‘ছহীহুল ইসনাদ’ বলেছেন; কিন্তু এই
রেওয়ায়েতটি কতিপয় কারণে বানোয়াট-
(ক) হাফেয যাহাবী বলেছেন, بل هو موضوع وعبد الرحمن واه ‘বরং এটা বানোয়াট। সনদে আব্দুর রহমান (বিন যায়েদ বিন আসলাম)
অত্যন্ত দুর্বল’।[18]
(খ) আব্দুর রহমান বিন যায়েদ সম্পর্কে হাকেম স্বয়ং লিখেছেন, عبد الرَّحْمَن بن زيد بن أسلم روى عَن أَبِيه أَحَادِيث مَوْضُوعَة لَا يخفى على من تأملها من أهل الصَّنْعَة أَن الْحمل فِيهَا عَلَيْهِ ‘আব্দুর রহমান
বিন যায়েদ বিন আসলাম তার পিতা হ’তে বানোয়াট হাদীছসমূহ বর্ণনা করতেন। আহলে ইলমদের
মধ্যে গোপনীয় নয় যে, অত্র বানোয়াট হাদীছটি ইনিই (আব্দুর রহমান বিন যায়দ বিন আসলাম)
রটনা করেছেন’।[19] অর্থাৎ তিনি তার পিতার নামে মিথ্যা বলে হাদীছ বানাতেন।
জ্ঞাতব্য : মুসতাদরাক হাকেমের রেওয়ায়াতটিও আব্দুর রহমান বিন যায়দ
বিন আসলাম বিশুদ্ধতার শর্ত মোতাবেক স্বীয় পিতা হ’তেই বর্ণনা করেছেন।
(গ) আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম আল-ফাহরী অজ্ঞাত পরিচয় রাবী। অথবা তিনি
হচ্ছেন আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন রশীদ (প্রসিদ্ধ মহামিথ্যুক)’।[20] সুতরাং এটা
স্পষ্ট যে, এই বানোয়াট বর্ণনাটিকে হাকেমের ‘ছহীহুল ইসনাদ’ বলা ভুল।
মুসতাদরাকের অন্য আরেকটি রেওয়ায়াতের মধ্যে ইবনে আববাস (রাঃ) হতে
বর্ণিত আছে যে, فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّار ‘যদি মুহাম্মাদ না হ’তেন তবে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না। যদি
মুহাম্মাদ না হ’তেন তবে আমি জান্নাতও সৃষ্টি করতাম না জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম
না’।[21] এই রেওয়ায়াতটি কতিপয় কারণে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত-
(ক) হাফেয যাহাবী বলেছেন, أظنه موضوعا على سعيد আমি অনুধাবন করছি যে, এটা সাঈদ (বিন আবী আরূবাহ)-এর উপরে
মিথ্যাস্বরূপ সম্বন্ধিত করা হয়েছে’।[22]
(খ) আমর বিন আওস মাজহূল রাবী’।[23]
(গ) সাঈদ বিন আবী আরূবাহ ‘মুখতালিত্ব’ রাবী’।[24]
(ঘ) সাঈদ বিন আবী আরূবাহ ও ক্বাতাদা উভয়ই মুদাল্লিস রাবী। যদি এই
রেওয়ায়াতটি উভয়ের থেকে প্রমাণিতও হয় তবুও তা প্রত্যাখ্যাতই ছিল।
(ঙ) আবুশ শায়খ ইস্পাহানীর ‘ত্বাবাক্বাত’ (হা/৪৯৪, ৩/২৮৭) গ্রন্থে
জানদাল বিন ওয়ালিক্ব-এর সনদ হ’তে এই রেওয়ায়াতটি ثنا محمد بن عمر المحاربي عن سعيد بن اوس الانصاري عن سعيد بن ابي عروبة সনদে বর্ণিত আছে। এতে মুহাম্মাদ বিন ওমর নামক অজ্ঞাত পরিচয় রাবী
রয়েছেন। যিনি ‘আমর বিন আওস’কে ‘সাঈদ বিন আওস’ দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
সারকথা: ‘لولاك ما خلقت الافلاك’ এবং এই মর্মের সকল রেওয়ায়াতই বানোয়াট ও বাতিল। আল্লাহ তাআলা
বলেছেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন ও মানুষকে
কেবলমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’।
(৭) মুফতী মুবাশ্বির আহমাদ রববানী বলেছেন, এই রেওয়ায়াতটি
বানোয়াট.....। মির্যা গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানী এই হাদীছটিকে চুরি করে স্বীয় গ্রন্থ
‘হাক্বীতুল ওহী’[25] গ্রন্থে লিখেছেন এবং দাবী করেছেন যে, ‘আল্লাহ তাআলা
আমাকে এই বাক্যের দ্বারা সম্বোধন করেছেন, لولاك ما خلقت الافلاك যদি আপনি না হ’তেন তবে আসমান-যমীন সৃষ্টি করতাম না’।[26]
অর্থাৎ ব্রেলভীরা বলে যে, এর দ্বারা নবীকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্বাদিয়ানীরা
বলছেন যে এর দ্বারা গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানীকে বুঝানো হয়!
(৮) আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) বলেছেন, এই রেওয়ায়াতটি ছহীহ
নয়। মুহাদ্দিছগণ একে বানোয়াট বলেছেন। দেখুন : ইমাম শাওকানীর ‘আল-ফাওয়ায়েদুল
মাজমূ‘আ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ’ ও মোল্লা আলী ক্বারীর ‘মাওযূ‘আতে কাবীর’ ইত্যাদি।
আর হাকেমের কিছু রেওয়ায়াত ‘فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّارَ’ ‘যদি মুহাম্মাদ না হ’ত তবে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না। আর যদি
মুহাম্মাদ না হ’ত তবে আমি জান্নাতও সৃষ্টি করতাম না জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম
না’-হাদীছটিকে এর সমর্থনে পেশ করা হয়েছে যে, হাকেম একে ছহীহ বলেছেন এবং বালক্বীনী
তাকে সঠিক বলেছেন; তো এর জবাব এই যে, ইমাম যাহাবী তাকে খন্ডন করেছেন এবং বলেছেন
যে, কারো জন্য হালাল নয় যে, ‘মুসতাদরাক হাকেম’-এর উপর নির্ভর করে, যতক্ষণ না সে
আমার ‘তালখীছ’ গ্রন্থটি দেখে। আর হাকেমের শৈথিল্যবাদিতা মুহাদ্দিছদের মধ্যে
প্রসিদ্ধ। ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেছেন, হাদীছটির মধ্যে আমর বিন আওস রয়েছেন। জানি না
তিনি কে’।[27]
অতঃপর তিনি বলেছেন, ‘এমনই আরেকটি বর্ণনা হাকেম ও ইবনে আসাকির হ’তে
সমর্থনস্বরূপ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু সবগুলিই এটি নির্দেশ করছে যে, কোনটিই
ছহীহ নয়’।[28]
উপসংহার : জাল, যঈফ ও এই সমস্ত বানানো হাদীছগুলি সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে।
ধর্মের নামে অধর্মের চোরা গলি দিয়ে ভক্তের পকেট সাফ করা হচ্ছে, নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে জাহান্নামে। অতএব জাতি সাবধান! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন।
[1]. ড. ত্বাহেরুল
ক্বাদিরী, মীলাদুন্নবী (ছাঃ) পৃঃ ১৭১। এটা একটা দীর্ঘ হাদীছ। যেখানে বলা হয়েছে-
হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন আদম ভুল
করে বসলেন তখন তিনি আল্লাহর দরবারে আরয করলেন যে, হে আমার রব! আমি আপনার কাছে
মুহাম্মাদের অসীলায় ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ
বললেন, হে আদম! তুমি মুহাম্মাদকে কিভাবে চিনলে? অথচ তাকে আমি (এখনো) সৃষ্টি করিনি?
আদম বললেন, আমি এভাবে চিনলাম যে, যখন আপনি আমাকে আপনার হাত দ্বারা সৃষ্টি করলেন ও
আপনার পক্ষ হ’তে আমার ভিতরে রূহ ফুঁকে দিলেন; (তখন) আমি মাথা উঠিয়ে আরশের
পায়াগুলির উপর এই লেখাটি দেখলাম যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর
রাসূলুল্লাহ’। তখন আমি অবগত হলাম যে, আপনি আপনার নামের সাথে এমন একজন ব্যক্তির
নামকে সংযুক্ত রেখেছেন যিনি আপনার নিকটে সমগ্র মাখলূকের চাইতে অধিক পসন্দনীয়।
আল্লাহ বললেন, হে আদম! তুমি সত্য বলেছ। প্রকৃতপক্ষেই মুহাম্মাদ আমার কাছে সমস্ত
সৃষ্টি হ’তে উত্তম। আর যখন তুমি তার অসীলাতে আমার কাছে আবেদন করলে তখন আমি তোমাকে
মাফ করে দিলাম। আর মুহাম্মাদ যদি না হ’ত তবে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’ (ত্বাবারানী,
আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৬৫০২ ইত্যাদি)। এটা বানোয়াট হাদীছ।
[2]. আল-মাওযূ‘আত হা/৭৮, আরবী পাঠ-وَمِنْهَا قَوْلهم: لَوْلاكَ لَمَا خَلَقْتُ الأَفْلاكَ
[3]. তালখীছু কিতাবিল মাওযূ‘আত হা/১৯৫।
[4]. ক্বাওয়ায়িদুত তাহদীছ পৃঃ ১৫৫।
[5]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ পৃঃ ৩৫৬।
[6]. সিলসিলাহ যঈফা হা/২৮২, আরো দেখুন : আলবানী, সিলসিলা যঈফা
হা/২৫।
[7]. দেখুন : মাওযূআত আছ-ছাগানী (হা/৭৮); মুহাম্মাদ ত্বাহের
আল-ফাত্তানী আল-হিন্দীর (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ) ‘তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত’ (পৃঃ ৮৬);
শাওকানীর আল-ফাওয়ায়েদুল মাজমূআ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আ (পৃঃ ৩২৬); মোল্লা আলী
আল-ক্বারী হানাফীর ‘আল-আসরারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আ (পৃঃ ৩৮৫); আজলূনীর
‘কাশফুল খফা’ (হা/২১২৩) এবং আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌনবীর ‘আল-আছারুল মারফূআহ ফিল
আখবারিল মাওযূ‘আ’ (পৃঃ ৪০)।
[8]. আল-আসরারুল মারফূ‘আহ পৃঃ ২৮৮।
[9]. হা/৩২০২৫, ১১/৪৩১।
[10]. হা/৯১, ১/৪৫।
[11]. হা/৮০৯৫, ৫/৩৩৮।
[12]. আস-সুন্নাহ হা/২৭৩, পৃঃ ২৩৭।
[13]. আল-আসরারুল মারফূআহ পৃঃ ২৮৮।
[14]. কিতাবুল মাওযূ‘আত (তাহক্বীক্বকৃত নুসখা) হা/৫৪৯, ২/১৯,
(পুরাতন নুসখা) ১/২৮৯, ২৯০।
[15]. আল-লাআলী আল-মাছনূআহ ১/২৭২।
[16]. দেখুন : তাক্বরীবুত তাহযীব, রাবী নং ১৭৫৭।
[17]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক হা/৪২২৮, ২/৬১৫, তিনি বলেছেন, এই
হাদীছটি ‘ছহীহুল ইসনাদ’।
[18]. তালখীছুল মুসতাদরাক ২/৬৭২।
[19]. আল-মাদখালু ইলাছ ছহীহ পৃঃ ১৫৪, রাবী নং ৯৭।
[20]. দেখুন : লিসানুল মীযান ৩/৩৫৯, ৩৬০ (নতুন প্রকাশ) ৪/১৬১, ১৬২।
[21]. হা/৪২২৭, ২/৬১৫, এবং তিনি বলেছেন, ‘এই হাদীছটি ছহীহুল
ইসনাদ’।
[22]. তালখীছুল মুসতাদরাক ২/৬৭১।
[23]. দেখুন : মীযানুল ই‘তিদাল ৩/২৪৬; লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।
[24]. রাবীর হিফয শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বিবেক-বুদ্ধি দুর্বল হয়ে
যাওয়া, হাদীছকে সঠিকভাবে মনে রাখতে না পারায় হাদীছের বাক্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াকে
ইখতিলাত্ব বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ইখতিলাত্ব হতে পারে। যেমন বয়স বেড়ে যাওয়া,
বই-পুস্তক পুড়ে যাওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি হওয়া কিংবা সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটার
কারণে মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি (দ্রঃ তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ পৃঃ ১২৫)। এবং
যে রাবীর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় তাকে ‘মুখতালিত্ব’ রাবী বলা হয়।- লেখক।
[25]. পৃঃ ৯৯।
[26]. আহকাম ওয়া মাসায়েল পৃঃ ৫৯, ৬০।
[27]. ফাতাওয়া ছানাইয়া ১/৩৩৫।
[28]. ঐ, ১/৩৩৬।
(সমাপ্ত)
'আপনিও হোন ইসলামের
প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি
Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking
ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের
করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা
আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি
হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের
মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
« مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا »
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান
জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে
কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের
সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে
জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা
কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস)
আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১)।
হাদিস সম্ভার, হাদিস নং
১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।
লেখক ও সংকলকঃ
No comments:
Post a Comment