Search This Blog

Thursday, September 26, 2019

রাসুল (ছাঃ)-এর উপর নির্যাতনকারীদের ভয়াবহ পরিনতি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

রাসুল (ছাঃ)-এর  উপর নির্যাতনকারীদের ভয়াবহ পরিনতি

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তিনি তাঁর রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, অপর সমস্ত ধর্মের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট”। (সুরা  ফাতহ ৪৮/২৮)।

তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

“আর আমরা তো আপনাকে সমগ্র মানুষের জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”। (সুরা সাবা ৩৪/২৮)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাক। কেননা তুমি উপদেশদাতা বৈ কিছুই নও। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও”। (সুরা গাশিয়া ৮৩/২১-২২)।

আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন ‘ইসলাম’কে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাসূল (ছাঃ) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অকথ্য নিপীড়ন নীরবে সহ্য করেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর উপর শত্রুদের নির্যাতন ও তাদের ভয়াবহ পরিণতি এখানে তুলে ধরা হলোঃ-

রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র-মাধুর্য

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বন্ধু ও শত্রু সকলের মুখে সমভাবে তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। কঠোর প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সম্মুখে অকুণ্ঠ চিত্তে তাঁর সততা, আমানতদারী ও সচ্চরিত্রতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭, ৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪১, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৬, ৭৫৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহপাক নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সুরা ক্বলম ৬৮/৪)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’। (হাকেম হা/৪২২১; ছহীহাহ হা/৪৫)।

তাই দেখা যায়, নবুঅত-পূর্ব জীবনে সকলের নিকটে প্রশংসিত হিসাবে তিনি ছিলেন ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত, আমানতদার) এবং নবুঅত পরবর্তী জীবনে চরম শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশেও তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতা, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা, দয়া ও সহমর্মিতা, পরোপকার ও পরমত সহিষ্ণুতা, লজ্জা ও ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলীর জীবন্ত প্রতীক।

আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’। (সুরা আহযাব ৩৩/২১)।

তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং খালি চোখে আকাশের তারকারাজি গণনা করা অসম্ভব।

অধিকাংশ নবী-রাসূল বিভিন্ন প্রকার মুজিযা লাভ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম মুজিযা ছিল তাঁর চরিত্র। তিনি মানুষের অন্তরসমূহ পরিবর্তন এবং আত্মাকে পবিত্র করে দিতেন চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে। এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহঃ) লিখেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে এক বার আসত, সে ভীত হয়ে পড়ত। আর যে কেউ তাঁর পাশে এসে বসতো সে মহববতে আকৃষ্ট হয়ে যেত। (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/২২৬ পৃঃ)।

রাসূল  (ছাঃ)-এর উপরে কাফেরদের নির্যাতনঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে কাফিরদের নির্যাতন ছিল দুই ধরনের।

(ক) মানসিক ও  (খ)  দৈহিক।

মানসিক নির্যাতনঃ

কাফিররা পরিকল্পিতভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নানা অপবাদ আরোপ করে মানসিকভাবে তাঁকে কষ্ট দিত। তাদের আরোপিত অপবাদসমূহ যেমন-

 (১) পাগল (সুরা তূর ৫২/২৯),

 (২) কবি (সিুরা ছাফফাত ৩৭/৩৫-৩৬),

(৩) জাদুকর ও

(৪) মিথ্যাবাদী (সুরা ছোয়াদ ৩৮/৪),

(৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী (সুরা আনফাল ৮/৩১; সুরা ফুরক্বান-২৫/৫),

 (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী (সুরা ফুরক্বান-২৫/৪),

(৭) মিথ্যা রটনাকারী (সুরা নাহল-১৬/১০১; সুরা ফুরক্বান-২৫/৪),

(৮) ভবিষ্যদ্বক্তা (সুরা তূর ৫২/২৯),

(৯) পথভ্রষ্ট (সুরা তাত্বফীফ ৮৩/৩২),

(১০) বেদ্বীন (আর-রাহীকুল মাখতূম, ১৭তম সংস্করণ ২০০৫ইং, পৃঃ ৮৬)।

(১১) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী

(১২) জামা‘আত বিভক্তকারী (আর-রাহীকুল মাখতূম, ১৭তম সংস্করণ ২০০৫ইং, পৃঃ ৮৬)।

(১৩) জাদুগ্রস্ত (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/৪৭),

(১৪) কুরায়েশরা রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) - (সাহাবীদেরকে) বললেন, এতেও কি তোমরা আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ না যে, আল্লাহ তা’আলা কিভাবে কুরায়শদের গালমন্দ ও অভিসম্পাতকে আমার ওপর হতে সরিয়ে দিয়েছেন? তারা ’মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে গালাগালি করে এবং ’মুযাম্মাম’-কে অভিসম্পাত দেয়। অথচ আমি মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) মুযাম্মাম নই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৭৭৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৫৩৩, সুনান আননাসায়ী ৩৪৩৮, মুসনাদে ‘আবূদ ইবনু হুমায়দ ১১৩৬, আস সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ৫৬, ১৭৬০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৫) ‘রা‘ইনা’ (সুরা বাক্বারা ২/১০৪) প্রভৃতি।

এসব নির্যাতনের পরিণতিতে এরা দুনিয়াতে হেদায়াত বঞ্চিত হয় এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

মহান আল্লাহ বলেন,

 “দেখ, ওরা তোমার জন্য কেমন সব উপমা দেয়। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা পথ পেতে পারে না”। (সুরা বনু ইসরাঈল ১৭/৪৮)।

দৈহিক নির্যাতনঃ

উপরোক্ত মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি এরা রাসূল (ছাঃ)-এর উপর শারীরিক নির্যাতনও করত। নিম্নে কয়েকজনের নির্যাতন ও তাদের পরিণতি উল্লেখ করা হলোঃ-

(১) আবু লাহাব ও তার পরিবার কর্তৃক নির্যাতন এবং পরিণতিঃ

রাসূল (ছাঃ) কম-বেশী সকল কাফির- মুশরিক নেতাদের পক্ষ থেকে নির্যাতিত হয়েছেন। তন্মধ্যে আবু লাহাব অন্যতম। আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আব্দুল ওয্যা। সে ছিল আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। সে লালিমাযুক্ত গৌরবর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ায় তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হতো। এছাড়া ‘আব্দুল ওযযা’ নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। বিধায় পবিত্র কুরআনে তার আসল নাম বর্জন করা হয়েছে। তাছাড়া আবু লাহাব ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচা ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিল। তার পরেও সে নবী করীম (ছাঃ)-কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ নানা রকম নির্যাতন করত।

 ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ এ আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা (পর্বতে) আরোহণ করলেন এবং আহবান জানালেন, হে বানী ফিহর! হে বানী আদী! কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রকে। অবশেষে তারা জমায়েত হল। যে নিজে আসতে পারল না, সে তার প্রতিনিধি পাঠাল, যাতে দেখতে পায়, ব্যাপার কী? সেখানে আবূ লাহাব ও কুরাইশগণও আসল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বল তো, আমি যদি তোমাদের বলি যে, শত্রুসৈন্য উপত্যকায় চলে এসেছে, তারা তোমাদের উপর হঠাৎ আক্রমণ করতে প্রস্তুত, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ আমরা আপনাকে সর্বদা সত্য পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, ’’আমি তোমাদেরকে কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করছি।’’ আবূ লাহাব [রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে] বলল, সারাদিন তোমার উপর ধ্বংস নামুক! এজন্যই কি তুমি আমাদের জমায়েত করেছ? তখন অবতীর্ণ হল, ’’ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের হস্ত দু’টি এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার অর্জন তার কোন উপকারে লাগেনি।’’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৭০, ১৩৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৩৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র আছে, ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর রাসূল (ছাঃ)-কে মারার জন্য আবু লাহাব একটি পাথরও তুলেছিল। (ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, ভাষান্তর: খাদিজা আখতার রেযায়ী (ঢাকা : আল-কোরআন একাডেমী লন্ডন, ১৯৯০), ১১০ পৃঃ)।

তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুওয়াত পূর্বকালে রাসূল (ছাঃ)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু নবী হওয়ার পরে সে তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে এই দুই মেয়ের সাথেই একের পর এক ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। (সায়্যিদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলাযিল কুর‘আন, (মিশর: আল-মাকতাবাতুল ইসলামী), ৩/২৮২পৃঃ)।

রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (উপনাম ত্বাইয়েব বা তাহের) মারা গেলে আবু লাহাব খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলে, মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الأبتر) হয়ে গেল। যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়।

হজ্জের মৌসুমে আবু লাহাব রাসূল (ছাঃ)-এর পিছে লেগে থাকত। যেখানেই রাসূল (ছাঃ) দাওয়াত দিতেন, সেখানেই সে তাঁকে গালি দিয়ে লোকদেরকে ভাগিয়ে দিত এবং বলত,  ‘এ লোকটি বিধর্মী মিথ্যাবাদী তোমরা এর কথা বিশ্বাস করো না’। (আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯)। হাদিসের মান: সহিহ।

এমনকি ‘যুল মাজায’ নামক বাজারে যখন তিনি লোকদের বলছিলেন, তোমরা বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাহ’লে সফলকাম হবে’, তখন পিছন থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে সে পাথর ছুঁড়ে মারে। তাতে রাসূলের পায়ের গোঁড়ালী পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়। (ছহীহ ইবনু হিববান, হাকেম ২/৬১১; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ হাসান; তফসীরে কুরতুবী)।

এভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর সে একের পর এক নির্যাতন অব্যাহত রাখে।

আবু লাহাবের শেষ পরিনতি

অবশেষে আবূ লাহাবের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াবী গযব নেমে আসে। আবু লাহাবের মৃত্যু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও জঘন্যভাবে হয়। বদর যুদ্ধের সাত দিন পর তার গলায় প্লেগের ফোঁড়া দেখা দেয়। সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে নির্জন জায়গায় ফেলে আসে। সেখানে ধুকে ধুকে তার মৃত্যু হয়। তার লাশটি পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করেনি। শেষ পর্যন্ত দেহ পঁচতে শুরু করলে গর্ত খুঁড়ে চাকর দ্বারা পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হেঁচড়ে সে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হয়। (আর-রাহীকুল মাখতূম, ২৫২-২৫৩ পৃঃ)।

আবু লাহাবের স্ত্রী ছিল আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى ) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল অর্থাৎ সুন্দরের উৎস। সেও স্বামীর একান্ত সহযোগী ছিল এবং সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকত। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায় حمالة الحطب বা খড়িবাহক বলা হতো। অর্থাৎ ঐ শুষ্ক কাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন বিস্তার করে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করত আড়ালে থেকে। সেকারণে আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। আবু লাহবের স্ত্রী আরওয়া ওরফে উম্মে জামীল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিল। সে রাসূল (ছাঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার সম্মুখে কাঁটা ছড়িয়ে বা পুঁতে রাখত। যাতে রাসূল (ছাঃ) কষ্ট পান। এই মহিলা ছিল একজন কবি। সে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলত। সূরা লাহাব নাযিল হলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে পাথর খন্ড নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (ছাঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পায়নি। তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসা মূলক কবিতা বলে ফিরে আসে। উক্ত কবিতায় সে ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলে। যেমন  ‘নিন্দিতের আমরা নাফরমানী করি। তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি। তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করি’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৭৭৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৫৩৩, সুনান আননাসায়ী ৩৪৩৮, মুসনাদে ‘আবূদ ইবনু হুমায়দ ১১৩৬, আস সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ৫৬, ১৭৬০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? জবাবে তিনি বললেন, না, দেখতে পায়নি। আল্লাহ আমার জন্য তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৩৫-৩৩৬)।

রাসূল (ছাঃ) যখন ছালাত আদায় করতেন তখন বকরীর নাড়িভুড়ি এমনভাবে ছুঁড়ে মারত যে, সেসব গিয়ে তাঁর গায়ে পড়ত। আবার কখনও কখনও উনুনের ওপর হাঁড়ি চাপানো হ’লে সে হাঁড়িতে নিক্ষেপ করত। রাসূল (ছাঃ) তাদের অত্যাচারে ঘরের ভিতরে নিরাপদে ছালাত আদায় করার জন্য একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন। (ইবনে হিশাম ১/৪১৬ পৃঃ)।

মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিত। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, সে রাতের বেলায় একাজ করত। একদিন সে বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ে। তখন ফেরেশতা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরেন এবং হালাক করে দেয়’। (কুরতুবী)।

একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটবর্তী হয়ে বলল, আমি  ‘নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সাথী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি (সুরা নাজম ৫৩/১-২) এই আয়াত দু’টিকে অস্বীকার করে একটা হেঁচকা টানে রাসূল (ছাঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন,  ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’। কিছুদিন পরে উতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে ‘যারক্বা’ (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল,  ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল। (শায়খ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ, মুখতাছার সীরাতে রাসূল, ১/১৩৫ পৃঃ)।

এভাবে আবু লাহাব, তার স্ত্রী আরওয়া ওরফে উম্মে জামীল ও তাদের পুত্র উতায়বার নির্যাতনের প্রতিকার মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই কার্যকর হলো।

(২) আবু জাহল কর্তৃক অত্যাচার ও পরিণতিঃ

ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ছিল আবু জাহল। তার মূল নাম আমর ইবনে হিশাম। জাহেলী যুগে তার উপাধি ছিল আবুল হাকাম। অর্থাৎ জ্ঞানের পিতা। তার আচরণের কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার নাম রাখেন আবু জাহল অর্থাৎ মূর্খের পিতা।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আবূ জাহল (মক্কার কাফির কুরায়শদেরকে) বলল, তোমাদের সামনে মুহাম্মাদ কি তার চেহারা মাটিতে লাগায়? (অর্থাৎ সে সালাত আদায় করে?) বলা হলো, হ্যাঁ।

তখন আবূ জাহল বলল, লাত ও ’উযযার শপথ! আমি যদি তাকে এরূপ করতে দেখি, তাহলে আমি (পা দিয়ে) তার ঘাড় মাড়িয়ে দেব। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে আসলো, তখন তিনি সালাত আদায় করছিলেন। তখন আবূ জাহল নবী (সা.)- এর দিকে অগ্রগামী হচ্ছিল, তৎক্ষণাৎ দেখা গেল, সে তড়িৎবেগে পিছনের দিকে হটছে এবং উভয় হাত দ্বারা নিজেকে আত্মরক্ষা করে চলছে। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি দেখছি আমার ও মুহাম্মাদ-এর মধ্যস্থলে আগুনের পরিখা ও ভয়ঙ্কর দৃশ্য এবং ডানাবিশিষ্ট দল। উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যদি সে (আবূ জাহল) আমার কাছাকাছি হত, তাহলে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তার এক এক অঙ্গ ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৫৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৯৫৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৯৭, মুসনাদে আহমাদ ৮৮১৭, আবূ ইয়া'লা ৬২০৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬৫৭১, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১১৬৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

একবার আবু জাহল বলল, হে কুরায়েশ ভাইয়েরা! তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, মুহাম্মাদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা ও উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না? আমাদের পিতা ও পিতামহকে সারাক্ষণ গালমন্দ করেই চলেছে। এ কারণে আমি আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমি একটি ভারী পাথর নিয়ে বসে থাকব, মুহাম্মাদ যখন সিজদায় যাবে, তখন সে পাথর দিয়ে তাঁর মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিব। এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত। ইচ্ছে হলে তোমরা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবে, ইচ্ছে হলে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। এরপর আবদে মানাফ আমার সাথে যেরূপ ইচ্ছে ব্যবহার করবে এতে আমার কোন পরোয়া নেই। কুরায়েশরা প্রস্তাব শুনার পর বলল, কোন্ ব্যাপারে আমরা তোমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় ফেলে রেখেছি? তোমাকে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তুমি যা করতে চাও করতে পার। সকালে আবু জাহল একটি ভারী পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। কুরায়েশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জাহলের তৎপরতা দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে রইল। রাসূল (ছাঃ) যথারীতি হাযির হয়ে ছালাত আদায় করতে শুরু করলেন। তিনি যখন সিজদায় গেলেন, তখন আবু জাহল পাথর নিয়ে অগ্রসর হ’ল। কিন্তু পরক্ষণে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এলো। তার হাত যেন পাথরের সাথে আটকে রইল। কুরায়েশদের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বলল, আবুল হাকাম! তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম, তা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম, মুহাম্মাদ এবং আমার মাঝখানে একটা উট এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর কসম! অত বড় লম্বা ঘাঁড় ও দাঁতবিশিষ্ট উট আমি কখনো দেখিনি। উটটি আমাকে হামলা করতে অগ্রসর হচ্ছিল। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, উটের ছদ্মবেশে ছিলেন জিবরীল (আঃ)। আবু জাহল যদি কাছে আসত, তবে তাকে পাকড়াও করা হতো। (ইবনে হিশাম ১/২৯৮-২৯৯ পৃঃ)।

আবু জাহল একদিন ছাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গালমন্দ করে ও শাসিয়ে দেয়। রাসূল  (ছাঃ) নীরব রইলেন, কোন কথা বললেন না। এরপর আবু জাহল নবী করীম (ছাঃ)-এর মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করল। এতে তাঁর মাথা ফেটে রক্ত বের হ’ল। এরপর আবু জাহল কা‘বার সামনে কুরায়েশদের মজলিসে গিয়ে বসল। আব্দুল্লাহ ইবনে জুদয়ানের একজন দাসী এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। ইতিমধ্যে হামযাহ শিকার করে ফিরছিলেন। সেই দাসী তাকে ঘটনা শুনালেন। হামযাহ ঘটনা শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন কুরায়েশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক। তিনি দেরী না করে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আবু জাহলকে যেখানে পাব সেখানেই আঘাত করব। এরপর তিনি সোজা কা‘বা ঘরে আবু জাহলের সামনে গিয়ে বললেন, ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী! তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছিস, অথচ আমিও তাঁর প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী?  (নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরের শেষ দিকে যিলহজ্জ মাসে হামযাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন)।

এ কথা বলে হাতের ধনুক দিয়ে আবু জাহলের মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে, মাথায় বড় ধরনের জখম হয়ে গেল। এ ঘটনার সাথে সাথে আবু জাহলের গোত্র বনু মাখযূম এবং হামযাহ (রাঃ)-এর গোত্র বনু হাশেমের লোকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠলো। আবু জাহল সকলকে এই বলে থামিয়ে দিল যে, আবু আমরকে কিছু বল না, আমি তার ভাতিজাকে আসলেই খুব খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছিলাম। (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৫৩ পৃঃ; ইবনে হিশাম ১/২৯১-২৯২ পৃঃ)।

ইয়াসির বনু মাখযূমের ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্র মুসলমান হন। ফলে তাঁদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তা অবর্ণনীয়। আবু জাহলের নির্দেশে বনু মাখযূমের এই ক্রীতদাস মুসলিম পরিবারের উপরে নৃশংসতম শাস্তি নেমে আসে। তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে ফেলে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের এই শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,  ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। ইয়াসিরের দুই পায়ে দু’টি রশি বেঁধে দু’দিকে দু’টি উটের পায়ে উক্ত রশির অন্য প্রান্ত বেঁধে দিয়ে উট দু’টিকে দু’দিকে জোরে হাঁকিয়ে নেওয়া হয়। তাতে জোরে হেঁচকা টানে ইয়াসিরের দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি শাহাদতবরণ করেন। (ইবনে হিশাম  ১/৩২০ পৃঃ)।

অতঃপর পাষাণ হৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ। অতঃপর তাদের একমাত্র পুত্র আম্মারের উপরে শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতনের পালা। তাকে উত্তপ্ত কংকরময় বালুর উপরে হাত, পা বেঁধে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রেখে নির্যাতন করা হয়। একদিন আম্মারকে পানিতে চুবিয়ে আধামরা অবস্থায় উঠিয়ে বলা হ’ল, তুমি যতক্ষণ মুহাম্মাদকে গালি না দিবে এবং লাত, মানাত ও উযযা দেব-দেবীর প্রশংসা না করবে, ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন।

পরেই তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে কান্না-জড়িত কণ্ঠে সব ঘটনা খুলে বললেন ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-  ‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার জন্য কোন চিন্তা নেই)’ (সুরা নাহল ১৬/১০৬)। পরে আবুবকর (রাঃ) আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরিদ করে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপ :

‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হ’তে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ ও আবু জাহলকে’। (সুবুলুল হুদা, ২/৩৬২; সীরাতে ইবনে ইসহাক ১/১৯১)।

আবু জাহল এর শেষ পরিনতি

রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথীদের বিভিন্নভাবে অত্যাচার করার পরিণাম বদর প্রান্তরে এমন ভয়াবহ হবে আবু জাহল তা ভাবতে পারেনি। দুর্বৃত্ত নেতার চারিদিকে ছিল তীর ও তলোয়ার বাহিনীর পাহারা। মুসলিম মুজাহিদের প্রচন্ড হামলায় সেই পাহারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মুসলমানরা লক্ষ্য করলেন যে, আবু জাহল একটি ঘোড়ার পিঠে আরোহী। তার মৃত্যু তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল।

আবদুর রহমান ইবনু ’আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বদর যুদ্ধের দিন সৈনিকদের কাতারে দাঁড়িয়ে আমার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখি যে, আমি দু’জন কমবয়সী আনসার যুবকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। তখন আমি মনে মনে এ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করলামঃ আহা! কতই না উত্তম হত, যদি আমি এ দু’জনের চেয়ে বীর যোদ্ধার মাঝখানে দাঁড়াতাম। এমন সময় তাদের একজন আমাকে খোঁচা মেরে বলল, চাচাজান! আপনি কি আবূ জাহালকে চিনেন? আমি বললামঃ হ্যাঁ, চিনি, তবে বৎস! তাকে তোমার কি প্রয়োজন? সে বলল, আমি শুনেছি সে না-কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দেয়। আল্লাহর কসম! আমি যদি তাকে দেখতে পাই, তবে আমাদের মধ্যে (তথা আমার ও আবূ জাহাল-এর মধ্যে) একজনের নির্ধারিত মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত আমরা উভয়ে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হব না।

আবদুর রহমান বলেনঃ তার এ কথা শুনে আমি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলাম। ঠিক এমনি সময়ে অপর তরুণটিও আমাকে অনুরূপ খোঁচা মেরে একই কথার পুনরাবৃত্তি করল। আমাদের কথা-বার্তা শেষ না হতেই হঠাৎ দেখতে পেলাম আবূ জাহাল লোকেদের মাঝে ঘুরাফেরা করছে। তখন আমি তরুণদেরকে বললামঃ তোমরা উভয়ে যার ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চাচ্ছ, ঐ হলো সে ব্যক্তি। আমার কথা শুনামাত্রই তারা উভয়ে তলোয়ার হাতে দ্রুতবেগে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছুটে এসে ঘটনাটি তাঁকে জানাল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছ? তারা উভয়েই বললঃ আমিই তাকে হত্যা করেছি।

এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ আচ্ছা! তাকে হত্যা করার পর তোমরা কি স্বীয় তলোয়ার মুছে ফেলেছ? তারা বলল, না। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের তলোয়ার দেখে বললেনঃ তোমরা উভয়েই তাকে হত্যা করেছ। এই বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা দিলেন, তার (আবূ জাহাল-এর) পরিত্যক্ত মালের অধিকারী হবে মু’আয ইবনু ’আমর ইবনুল জামূহ। এ তরুণদ্বয় ছিলেন মু’আয ইবনু ’আমর ইবনুল জামূহ ও মু’আয ইবনু ’আফরা (রাঃ)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪০২৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৪১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৬১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৫২, আহমাদ ১৬৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এরপর নবী করীম (ছাঃ) বললেন, চলো আমাকে তার লাশ দেখাও। আমরা রাসূল (ছাঃ)-কে আবু জাহলের লাশের নিকটে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, এ হচ্ছে এই উম্মাতের ফেরাঊন। (আর-রাহীকুল মাখতূম ২৪৭ পৃঃ)।

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) কা’বার কাছে সালাত আদায় করছিলেন। এ সময় কুরায়শদের একদল লোক সেখানে বসা ছিল। তখন তাদের মধ্য হতে একজন বলল, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে অমুক গোত্রের উটের নাড়িভুড়ি এনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে, অতঃপর এ লোক [রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বলল] যখন সিজদায় যাবে তখন তা তার দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দেবে। অতঃপর তাদের মধ্য হতে সর্বাপেক্ষা বড় পাপিষ্ঠটি উঠে গেল। যখন নবী (সা.) সিজদায় গেলেন তখন সে তা তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দিল। এমতাবস্থায় নবী (সা.) সিজদারত রইলেন। সেই পাপিষ্ঠরা খুব হাসাহাসি করতে লাগল, এমনকি হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ল। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি [ইবনু মাসউদ (রাঃ)] ফাতিমাহ’র নিকট গিয়ে বললেন, তিনি দৌড়িয়ে আসলেন। অথচ নবী (সা.) তখনো পূর্ববৎ সিজদায় রয়েছিলেন। ফাতিমাহ (রাঃ) নাড়িভুঁড়িটি নবী (সা.) -এর ওপর হতে সরিয়ে ফেললেন এবং ঐ সকল পাপিষ্ঠ কাফিরদের লক্ষ্য করে গালমন্দ করলেন। বর্ণনাকারী ইবনু মাউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত শেষ করে তিনবার বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি কুরায়শদেরকে ধরাশয়ী কর। আর রাসূল (সা.) -এর নিয়ম ছিল, তিনি যখন কোন বিষয়ে দু’আ বা বদদু’আ করতেন কিংবা আল্লাহর কাছে চাইতেন, তখন তিন তিনবার বাক্যগুলো উচ্চারণ করতেন। অতঃপর তিনি (সা.) (কাফিরদের নাম ধরে) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি ১. ’আমর ইবনু হিশাম (আবূ জাহল), ২. ’উতবাহ্ ইবনু রবী’আহ্, ৩, শায়বাহ্ ইবনু রবী’আহ, ৪. ওয়ালীদ ইবনু ’উতবাহ, ৫. উমাইয়্যাহ ইবনু খালফ, ৬. ’উকবাহ্ ইবনু আবূ মু’আয়ত্ব এবং ৭. ’উমারাহ্ ইবনুল ওয়ালীদেরকে পাকড়াও কর।

বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! তিনি (সা.) যে সকল লোকের নাম নিয়ে বদদু’আ করেছিলেন, আমি বদরের যুদ্ধে তাদের লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। অতঃপর তাদেরকে টেনে বদরের একটি অনাবাদ কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ঐ কূপে যাদেরকে নিক্ষেপ করা হলো, তাদের ওপর লা’নাতের পর লা’নাত রয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৪৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫২০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৫৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৯৪, মুসনাদে আহমাদ ২২২৫, আবূ ইয়া'লা ২৬০৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ১৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১১০৬১, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৮১৮৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ৩৪৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

বদর যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) যার জন্য যে স্থানটি দেখিয়েছিলেন যুদ্ধ শেষে দেখা গেলো সে সেই স্থানেই পড়ে আছে-১

আনাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের নিকট (কুরায়শ নেতা) আবূ সুফইয়ান-এর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পৌছলে রাসূলুল্লাহ (সা.) পরামর্শ করলেন, তখন (আনসার নেতা) সা’দ ইবনু উবায়দাহ্ (রাঃ) উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে মহান সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! আপনি যদি আমাদেরকে সওয়ারীসহ দরিয়াতে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ করেন, তবে আমরা ঝাপিয়ে পড়ব। আর যদি বারকুল গিমাদ’ পর্যন্তও আমাদের বাহনকে ছুটে যেতে আদেশ করেন, তা করতেও আমরা প্রস্তুত। বর্ণনাকারী [আনাস (রাঃ)] বলেন, এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) লোকেদেরকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করে নিলেন। এরপর তারা রওয়ানা হয়ে বদর’ নামক স্থানে এসে অবতরণ করলেন। এখানে পৌছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা অমুক নিহত হওয়ার স্থান আর তা অমুকের আর তা অমুকের। এ সময় তিনি (সা.) (স্থান দেখিয়ে) স্বীয় হাত জমিনে রাখলেন। বর্ণনাকারী বলেন, (যুদ্ধ শেষে) দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ (সা.) যার জন্য যে স্থানটি দেখিয়েছিলেন, তাদের একটিও এদিক-সেদিক সরে পড়েনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৫১৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৭৯, সুনান আবূ দাউদ ২৬৮১, সুনান আননাসায়ী ২০৭৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮/৪৮০, মুসনাদে বাযযার ২২২, মুসনাদে আহমাদ ১৩৭২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বদর যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) যার জন্য যে স্থানটি দেখিয়েছিলেন যুদ্ধ শেষে দেখা গেলো সে সেই স্থানেই পড়ে আছে-২

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা মক্কাহ্ এবং মদীনার মাঝামাঝি স্থানে ’উমার (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম, তখন আমরা নতুন চাঁদ দেখতে চেষ্টা করি। আমি ছিলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন লোক। অতএব আমি চাঁদ দেখে ফেললাম। আর আমি ব্যতীত অন্য কেউই চাঁদ দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেনি। আমি ’উমার (রাঃ)-কে বললাম, আপনি কি চাঁদ দেখছেন না? কিন্তু তিনি তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ’উমার (রাঃ) বললেন, শীঘ্রই আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে তা দেখব। অতঃপর ’উমার (রাঃ) বদর যুদ্ধের ঘটনাবলী বর্ণনা করতে লাগলেন এবং বললেন, যুদ্ধের একদিন আগে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে ঐ সমস্ত স্থানগুলো দেখিয়ে দিলেন, যে যে স্থানে কাফিরদের লাশ পড়ে থাকবে। তিনি বললেন, ইনশা-আল্ল-হ আগামীকাল এ জায়গা অমুক (কাফির)-এর লাশ পড়বে। ইনশাআল্ল-হ আগামীকাল এ স্থানে অমুকের লাশ পড়বে। উমার (রাঃ) বলেন, সেই মহান সত্তার শপথ! যিনি তাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন; যে সকল স্থান রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দিষ্ট করেছিলেন, ঐ স্থান হতে একটুখানিও এদিক-সেদিক সরে পড়েনি।

(বর্ণনাকারী বলেন,) অতঃপর লাশগুলোকে একটি (অনাবাদ) কূপের মাঝে একটির উপর অপরটিকে নিক্ষেপ করা হলো এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) কূপটির কাছে এসে বললেন, হে অমুকের পুত্র অমুক! হে অমুকের পুত্র অমুক! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তোমরা কি তা ঠিক ঠিক পেয়েছ? তবে আমার আল্লাহ আমাকে যা ওয়াদা দিয়েছেন, আমি অবশ্য তা ঠিক ঠিকভাবে পেয়েছি। তখন ’উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কিভাবে এমন দেহসমূহের সাথে কথা বলছেন, যাদের মধ্যে কোন প্রাণ নেই। তিনি বললেন, আমি তাদেরকে যা বলছি, তোমরা তা তাদের চেয়ে বেশি শুনছ না, অবশ্য তারা আমার কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৯৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭১১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৭৩, আবূ ইয়া'লা ১৪০, মুসনাদে বাযার ২২২, আবূ ইয়া'লা ১৪০, আল মু'জামুস্ সগীর লিত্ব তবারানী ১০৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(৩) খালাফের পুত্রদ্বয়ের কটূক্তি ও নিপীড়নঃ

উমাইয়া ও উবাই ছিল খালাফের পুত্র। তারা নানাভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কষ্ট দিত। উমাইয়ার অভ্যাস ছিল যে, যখন রাসূল (ছাঃ)-কে দেখত, তখনই কটূক্তি করত, তাঁকে অভিশাপ দিত। মহান আল্লাহ বলেন,  ‘দুর্ভোগ প্রত্যক ঐ ব্যক্তির, যে সামনে ও পিছনে লোকের নিন্দা করে’ (হুমাযাহ ১০৪/১)। ইবনে হিশাম বলেন, হুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগালি করে এবং পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয়। (ইবনে হিশাম ১/৩৫৬-৩৫৭ পৃঃ)।

উমাইয়া ইবনে খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন বেলাল (রাঃ)। ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া বেলালের গলায় দড়ি বেঁধে মক্কার উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত। বালকেরা তাঁকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেত। এরকম করার ফলে তাঁর গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেত। উমাইয়া নিজে তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করত। এরপর উত্তপ্ত বালুর উপর জোর করে শুইয়ে রাখত। এ সময়ে তাঁকে অনাহারে রাখা হ’ত। এমনকি কখনো কখনো তাঁকে দুপুরের তীব্র রোদে মরু বালুকার উপর শুইয়ে বুকের উপর ভারী পাথর চাঁপা দিয়ে রাখত। (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৪৫ পৃঃ)।

একবার সা‘দ ইবনে মু‘আয (রাঃ) মক্কায় উমাইয়া ইবনে খালাফকে বলেছিলেন, হে উমাইয়া! আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, মুসলমানরা তোমাকে হত্যা করবে। একথা শুনে উমাইয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এ ভয় তার সব সময় ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনও মক্কার বাইরে যাবে না। আবু জাহলের পীড়াপীড়িতে উমাইয়া বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সবচেয়ে দ্রুতগামী উট ক্রয় করে। যাতে করে বিপদের সময় খুব দ্রুত পালিয়ে আসতে পারে। যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সময় তার স্ত্রী তাকে বলছিল, আবু ছাফয়ান! আপনার ইয়াছরেবী ভাই যে কথা বলেছিলেন, আপনি কি সে কথা ভুলে গেছেন? সে বলল, না ভুলিনি, আমি তো ওদের সাথে কিছুদূর যাব। (আর-রাহীকুল মাখতূম ১৪৮ পৃঃ)।

মক্কায় জাহেলী যুগ থেকেই আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ও উমাইয়া ইবনে খালাফের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। বদর যুদ্ধের দিনে উমাইয়া তার সন্তান আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি বর্ম নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে উমাইয়া বলল, আমি কি তোমার প্রয়োজনে লাগতে পারি? তোমার বর্মগুলোর চেয়ে আমরা উত্তম। আজকের মত দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। তোমাদের কি দুধের প্রয়োজন নেই?  যে ব্যক্তি আমাকে বন্দী করবে মুক্তিপণ হিসাবে আমি তাকে অনেক দুধেল উটনী দেব।

এ কথা শুনে আব্দুর রহমান বর্মগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং উমাইয়া ও তার পুত্রকে বন্দী করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন।

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বলেন, আমি তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বেলাল (রাঃ) উমাইয়াকে দেখে ফেললেন। তিনি তাকে দেখে বললেন, ওহে কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খালফ! হয় আমি বেঁচে থাকব নতুবা তুমি বেঁচে থাকবে। এরপর উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ওহে আনছাররা! এই দেখো কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খালফ, এবার হয় আমি থাকব নতুবা সে থাকবে।

বর্ণনাকারী বলেন, ততক্ষণে লোকেরা আমাদেরকে ঘিরে ফেললেন। আমি তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু একজন ছাহাবী তলোয়ার তুলে উমাইয়ার পুত্র আলীর পায়ে আঘাত করলেন। সাথে সাথে সে ঢলে পড়ল। এদিকে উমাইয়া এমন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে যে, আমি এত বিকট শব্দ কখনও শুনিনি। আমি বললাম, পালাও পালাও। কিন্তু আজতো পালানোর পথ নেই। আল্লাহর শপথ! আজ আমি তোমার কোন উপকারে আসতে পারব না। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, উত্তেজিত ছাহাবাগণ উমাইয়া ও তার পুত্র আলীকে ঘিরে ফেলে আঘাতে আঘাতে হত্যা করে ফেলল। (আর-রাহীকুল মাখতূম, ২৪৯ পৃঃ)।

উবাই ইবনে খালাফ উমাইয়ার ভাই। উকবা ইবনে আবু মুঈত্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। উকবা উবাইয়ের কথা মত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।  (ইবনে হিশাম, ১/৩৬১-৩৬২ পৃঃ)।

সে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে দেখে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত এবং হত্যার হুমকিও দিত। নবী করীম (ছাঃ) মক্কায় থাকাকালে দেখা হ’লে সে গর্বভরে বলত, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার কাছে ‘আওদ’ নামের একটি ঘোড়া রয়েছে; ওকে আমি প্রতিদিন তিন ছা‘ (সাড়ে সাত কিলোগ্রাম) খাবার খাওয়াচ্ছি। সেই ঘোড়ার পিঠে বসে একদিন আপনাকে হত্যা করব। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলতেন, উল্টাও হ’তে পারে। ইনশাআল্লাহ আমিই তোমাকে হত্যা করব। (আর-রাহীকুল মাখতূম, ৪৮ নং টিকা, ৩০৪ পৃঃ)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদের যুদ্ধে ময়দানে পৌঁছার পর উবাই ইবনে খালাফ একথা বলে সামনে অগ্রসর হ’ল যে, মুহাম্মাদ কোথায়? হয়ত আমি থাকব নতুবা তিনি থাকবেন। ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ওকে আসতে দাও। এই দুর্বৃত্ত কাছে এলে রাসূল (ছাঃ) হারেছ ইবনে সাম্মার (রাঃ) নিকট থেকে ছোট একটি বর্শা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। এটা ছিল ঠিক তেমনি, যেমন গায়ে মাছি বসলে উট একটুখানি ঝাঁকুনি দেয়, এতে মাছি উড়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) এরপর উবাইয়ের মুখোমুখি হ’লেন, ইবনে খালাফের শিরস্ত্রাণ ও বর্মের মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা (গলার কাছে) খালি ছিল। নবী করীম (ছাঃ) সেই স্থান লক্ষ্য করে হাতের বর্শা নিক্ষেপ করলেন।

এতে উবাই ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল এবং তার মিত্রদের কাছে ফিরে গেল। তার গলার কাছে সামান্য কেটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু রক্ত বের হয়নি। আঘাতও তেমন ছিল না। তবুও সে চিৎকার করে বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করেছেন। লোকেরা তাকে বলল, কি বাজে বকছ? তোমার আঘাত তো তেমন গুরুতর নয়। গলায় সামান্য আঁচড় লাগার মত দেখা যাচ্ছে। উবাই বলল, তিনি মক্কায় আমাকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে হত্যা করব। কাজেই আল্লাহর শপথ! আমার প্রাণ চলে যাবে। (যাদুল মা‘আদ, ২/০৭ পৃঃ)।

সে গাভীর মত চিৎকার করে বলত, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! আমি যে যন্ত্রণা অনুভব করছি, সেই কষ্ট-যন্ত্রণা যদি যিল-মাযাযের অধিবাসীরা অনুভব করত, তাহ’লে তারা সবাই মারা যেত।  (মুখতাছার সীরাতুর রাসূল, ২৫০ পৃঃ)।

অন্যত্র আছে, সে বারবার বলছিল, মুহাম্মাদ মক্কায় বলছিলেন, আমিই তোমাকে হত্যা করব। তিনি যদি আমাকে থুথুও নিক্ষেপ করতেন, তবুও আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত। (আর-রাহীকুল মাখতূম, ১৪৭ পৃঃ)।

অবশেষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু উবাই ইবনে খালাফ মক্কায় ফেরার পথে সারিফ নামক স্থানে মারা যায়। (ইবনে হিশাম, ২/৮৪ পৃঃ)।

(৪) কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদানঃ

উরওয়াহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ’আবদুল্লাহ্ ইবনু আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-কে বললাম, মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কঠোরতম কী আচরণ করেছে, সে সম্পর্কে আপনি আমাকে বলুন। তিনি বললেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার আঙ্গিণায় সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় ’উকবাহ ইবনু আবূ মু’আইত আসল এবং সে রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘাড় ধরল এবং তার কাপড় দিয়ে তাঁর গলায় পেচিয়ে খুব শক্ত করে চিপা দিল। এ সময় আবূ বক্র (রাঃ) হাজির হয়ে তার ঘাড় ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাকে সরিয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা কি এ ব্যক্তিকে এ জন্য হত্যা করবে যে সে বলে ’আমার রব আল্লাহ্’; অথচ তিনি তোমাদের রবের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ সহকারে তোমাদের কাছে এসেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৮১৫, ৩৬৭৮, ৩৮৫৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৪৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’। (সুরা গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।

আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’। (মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন

(MSHRC)

------------------------------

Please Share On

No comments:

Post a Comment

ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস

  বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস মূল গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) (১) উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্...