Saturday, October 18, 2025

মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ দলকে ভোট দিবেন?


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ দলকে ভোট  দিবেন?

(ইসলামি দল ব্যতীত যারা অন্য দলকে ভোট দিয়ে অন্যায়ের সহযোগী হয় তারা জাহান্নামী)

 

(কিছু কথাঃ বইটিতে মোট ৩৩৫ পৃষ্ঠা আছে। অনেক বড় হওয়ায় হয়তো পড়ার ধৈর্য্য থাকবে না তবে সংযোজিত অধ্যায়গুলো আগে পড়ে নিবেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনামলের অপহরণ, গুম, খুন, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আয়নাঘরে আটক, জঙ্গি নাটক, আলেম নির্যাতন, শাপলা হত্যাকান্ড, বিডিআর হত্যাকান্ডসহ সকল অপরাধের তথ্য এই বইয়ে পাবেন, প্রতিটি অধ্যায় কুরআন হাদিস থেকে ব্যাপক দলিল দিয়ে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য বিষয়েও পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি, বইটি অধ্যয়ন করলে জ্ঞান বৃদ্ধি ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশসহ বিশাল এক জ্ঞানের ভান্ডার খুলে যাবে ইংশাআল্লাহ। অনৈসলামিক দলের আলেমগণ বইটি অধ্যয়ন করলে হয়তো আপনাদের শরীর জ্বলবে, তবে আপনাদের আহবান করছি আপনারা তওবা করে ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসবেন। নচেত এই বইয়ের বিপরীত ভাষ্যমূলক একটি বই লিখে দেখাবেন যে, কোন্ পথ সঠিক? ইসলামের রাজনীতি করা/ইসলামি সংগঠন করা/ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়া বা আহবান করা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ, আপনারা (অনৈসলামিক দলের নেতা-কর্মী/সমর্থক/ভোটার) এই পথে থাকবেন নাকি অনৈসলামিক দলকে সমর্থন বা ভোট দিয়ে অন্যায়ের সহযোগিতা করে জাহান্নামে যাবেন? বিষয়টি আপনাদের ক্লিয়ার করতে হবে।)

মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ দলকে ভোট  দিবেন?

আপনি মুসলিম হিসেবে কোন্ দলকে ভোট দিবেন এটা জানার আগে আমাদের জানতে হবে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত গণতন্ত্র ইসলাম সম্মত কিনা? মানবরচিত সংবিধান কুরআন বিরোধী কিনা? ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আমলের বিভিন্ন অপকর্ম। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পরাজয়ের কারণ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গংদের কুরআন হাদিস অনুযায়ী ইহকালীন-পরকালীন শাস্তি, ৩৬ জুলাই এর উত্থান (আল্লাহ তায়ালার বিশেষ এক নিয়ামত),, বিএনপির বিগত শাসনামল, পাপ থেকে মুক্তির উপায় ইত্যাদি। এরপর চিন্তা করবেন বা সিদ্ধান্ত নিবেন অন্যান্য অনৈসলামিক দলকে মুসলিম হিসেবে ভোট দেয়া বা সমর্থন করা যাবে কিনা। আসুন প্রথমে জেনে নেই বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের সংবিধানে কী আছে?

বাংলাদেশের সংবিধানে মোট ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৭টি তফসিল রয়েছে। এই সংবিধানটি ১১টি ভাগ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। মানবরচিত এই সংবিধানটির মধ্যে এমন চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে যা সরাসরি কুরআন বিরোধী। একজন মুসলমান সেই বিষয়গুলো মানলে বা বিশ্বাস করলে তার ঈমান থাকবে না এবং সে মুসলিম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। বিষয়গুলো নিম্নরুপঃ

সংবিধান

(১) সকল ক্ষমতার মালিক জনগণঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বের অধীনে কার্যকর হবে"।

আসলে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ নাকি আল্লাহ তায়ালা আসুন এতদবিষয়ে আমরা জেনে নেই।

আল্লাহ তা’আলা কুরআনে শাসনব্যবস্থা, শাসক ও শাসিত সম্পর্কে বহু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সে সকল দিকনির্দেশনা অবলম্বনেই তৈরি ইসলামী রাজ্য-শাসন নীতিমালা। এর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাগ্রে লক্ষণীয় আয়াতটি হলো- “(হে নবী, তুমি) বল, হে আল্লাহ! সার্বভৌম শক্তির মালিক! আপনি যাকে চান ক্ষমতা দান করেন, আর যার থেকে চান ক্ষমতা কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে চান লাঞ্ছিত করেন। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। (সূরা আলে ইমরান: ২৬)।

এ আয়াতে শাসক ও শাসিত সকলের জন্যই হেদায়েত রয়েছে, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ তাআলা। তিনিই বিশ্বজগতের অধিপতি। অনাদি থেকে অনন্ত তাঁরই একচ্ছত্র ক্ষমতা। সমস্ত কিছু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো শাসক বা জনগণ কোনো রাষ্ট্র ও ক্ষমতার মালিক নয়। আল্লাহ তা’আলা যখন যাকে চান কোনো অঞ্চলের সাময়িক শাসনক্ষমতা দান করেন।

আল্লাহ তায়ালা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

আল্লাহ বলেন-‘তিনিই আল্লাহ। যিনি আকাশমণ্ডলীকে উঁচুতে স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ছাড়া, যা তোমরা দেখতে পাও। অতঃপর তিনি আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেন। সূর্য এবং চাঁদকে নিয়োজিত রেখেছেন বিশেষ কাজে। প্রতিটি বস্তু এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি এসব নিদর্শন সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার, (একদিন) তোমাদের স্বীয় প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত হতে হবে।’ (সূরা : রা’দ, আয়াত : ০২)।

মহান রব নিজেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন ঠিক এভাবেই-‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব। সর্বস্বত্বার ধারক। তাকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব তারই। কে আছে যে, তার অনুমতি ছাড়া তার কাছে সুপারিশ করবে? মানুষের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যা ইচ্ছা করেন তদ্ব্যতীত তার জ্ঞানের কিছুই তারা (সৃষ্টি) আয়ত্ত্ব করতে পারে না। তার ‘কুরসি’ আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত। এদের রক্ষণাবেক্ষণ তাকে বিন্দুমাত্রও ক্লান্ত করে না। আর তিনি মহান শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ৫৫)।

মহান আল্লাহ বলেন, "তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।" (সুরাহ আল-বাকারাহঃ আয়াত-২৫৫)।

মহান আল্লাহ বলেন, "নভোমন্ডল, ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।" (সুরাহ আল-মায়েদাহঃ আয়াত-১২০)।

মহান আল্লাহ বলেন, "যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।" (সুরাহ আল-বাকারাহঃ আয়াত-১৬৫)।

আল্লাহ সর্বশক্তিমান (সব কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান) এরকম ৩৯টি কুরআনের আয়াত রয়েছে।

কাজেই প্রত্যেক শাসককে মনে রাখতে হবে, এ শাসনক্ষমতা আল্লাহ তাআলার দান। আল্লাহ্ই এ শাসনভার দিয়েছেন। তাই শাসকের কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। যথাযথভাবে শোকর আদায়ের পন্থা হল, আল্লাহর চাওয়া ও নির্দেশনা পালন করা। আল্লাহ তা’আলা যখন যাকে শাসনক্ষমতা দেন, তিনি চান তাঁর বান্দারা যেন তাঁর প্রতি অনুগত থেকে তাঁরই বিধানাবলি পালন ও মানুষের মধ্যে বাস্তবায়ন করে, তাঁর দ্বীন ও কালিমা প্রতিষ্ঠা করে।

তাই শাসককে আল্লাহর অনুগত থেকে তাঁর বিধানাবলি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। যদি তা করা হয়, তাহলেই আল্লাহ তাআলার এ দানের শোকর ও হক আদায় করা হবে। কিন্তু যদি কোনো শাসক তা না করে, বরং আল্লাহর অবাধ্যতা করে নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়ে অন্যায়-অনাচার ও সীমালঙ্ঘন করতে থাকে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা একসময় তার থেকে এ ক্ষমতা নিয়ে অন্য কাউকে দান করবেন। যেন পরবর্তীরা আল্লাহর দ্বীন ও কালিমা প্রতিষ্ঠা করে। একই শিক্ষা পরবর্তীদেরকেও মনে রাখতে হবে- এ ক্ষমতা তাদের জন্যও সাময়িক।

আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করলে তিনি যে কোনো সময় তাদেরকে এ দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে আবার অন্য কাউকে তা দান করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই চলে আসছে। আল্লাহ তাআলার নীতি হল, আল্লাহর নেক বান্দাগণই যমীনে শাসনভারের প্রকৃত হকদার। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে : আমি যাবুরে উপদেশের পর লিখে দিয়েছিলাম, ভূমির উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দাগণ। (সূরা আম্বিয়া : ১০৫)।

সুতরাং কুরআন কারীমের বার্তা অনুযায়ী নেককার ব্যক্তিই শাসনক্ষমতার প্রকৃত হকদার।

অতএব যে নেককার নয়, তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে থাকা একরকম জবরদখল। তার যোগ্যতা নেই, অধিকার নেই, তবুও সে এই পদে বসে আছে। তার উচিত স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে নেককার ব্যক্তির কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করা। অথবা কালবিলম্ব না করে নিজেকে শুধরে নেওয়া। নেককার হয়ে যাওয়া। সুতরাং বোঝা গেল, শাসনক্ষমতার বিষয়টি কেবল দুনিয়াবী বিষয় নয়; বরং এর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান রাখে, আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই একসময় তাদেরকে বিজয়ী করবেন, শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন। এটা আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি। কুরআন কারীমে তিনি ইরশাদ করেন : তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে নিজ খলীফা বানাবেন, যেমন খলীফা বানিয়েছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তাদের জন্য তিনি সেই দ্বীনকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যে দ্বীনকে তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তারা যে ভয়-ভীতির মধ্যে আছে, তার পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। এর পরও যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। (সূরা নূর : ৫৫)।

মুসলিম হিসেবে আমাদের সকলকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহই সকল ক্ষমতার মালিক। আল্লাহ তায়ালার এই ক্ষমতার সাথে যখনই অন্য কাউকে শরিক করা হয় যে, তারাও ক্ষমতার মালিক তখন এটা সুস্পষ্ট শিরক হয়ে যাবে।

কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘রাজত্বে তাঁর কোন শরীক নেই’। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/১১১)। তিনি আরো বলেন, ‘তুমি বল, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন’। (সুরা আলে ইমরান ৩/২৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান’। (সুরা মূলক ৬৭/১)।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘যার হাতে রয়েছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব। যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন না এবং তাঁর রাজত্বে কোন শরীক নেই’। (সুরা ফুরক্বান ২৫/২)।

আল্লাহর বাণী থেকে বুঝা গেল আল্লাহই সকল ক্ষমতার মালিক। মানুষকে ক্ষমতার মালিক বা উৎস বানানো তাঁর সাথে শরীক স্থাপনের শামিল, যা স্পষ্ট শিরক।

সংবিধানে উল্লেখিত শিরকের বাণীটি এদেশের সকল মুসলমানই জেনেশুনে ও ইচ্ছেকৃতভাবেই মেনে চলছে। এর দায়ভার সকল মুসলিম ভোটারদের উপর পড়বে। কারণ ভোটারগণই এমন একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে যারা ক্ষমতায় গিয়ে সাংবিধানিকভাবে শিরক চালু রাখে। মুসলিম ভোটারদের উচিত এমন একটি দলকে ভোট দেয়া যারা সংসদে গিয়ে মানবরচিত সংবিধান বাতিল করে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নিবে এবং তদানুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করবে।

সংবিধান

(২) জাতীয়তাবাদঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের (৯) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।

জাতীয়তাবাদ একটি কুফরি মতবাদ। আসুন ইসলাম কী বলে আমরা জেনে নেই।

জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম একটি জটিল সম্পর্কযুক্ত বিষয়, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। কিছু মুসলিম বিশ্বাস করেন যে জাতীয়তাবাদ ইসলামের একতার ধারণার (উম্মাহ) পরিপন্থী, কারণ এটি মুসলিমদের বিভিন্ন দেশের সীমানায় বিভক্ত করে দেয়। অন্যদিকে, কিছু মুসলিম আছেন যারা ইসলাম ও জাতীয়তাবাদকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন, যা ইসলামী জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত, যেখানে মুসলিম স্বার্থকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়া হয়।

জুবায়র ইবনু মুত্ব’ইম (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আসাবিয়্যাতের দিকে ডাকে বা গোত্রের দিয়ে আহবান করে লোকদেরকে সমবেত করে সে আমার দলভুক্ত নয়। আর ঐ ব্যক্তিও আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসবিয়্যাতের ভিত্তিতে যুদ্ধ করে এবং সেও নয় যে আসাবিয়্যাতের উপর মারা যায়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১২১, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯০৭, গায়াতুল মারাম হা/ ৩০৪)।

ওয়াসিলাহ্ ইবনুল আসক্বা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! ’’আসাবিয়্যাহ্’’ কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’আসাবিয়্যাহ্ হলো তোমার গোত্রকে অন্যায়ের কাজে সাহায্য করা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯০৫, সুনান আবূ দাঊদ ৫১১৯, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৪৯)।

জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেনঃ হে লোক সকল শোনো, তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল তাকওয়ার কারণেই। (ইমাম আহমাদ, আল মুসনাদ, হাদিস নং ২৩৪৮৯)।

জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের মধ্যে সংঘাতঃ

উম্মাহ ধারণা: ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম, যেখানে সকল মুসলিমকে একটি একক উম্মাহর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয়তাবাদ এই ধারণার পরিপন্থী, কারণ এটি একটি জাতিকে অন্য জাতি থেকে আলাদা করে এবং একে অপরের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

জাহেলিয়াত:

কিছু ইসলামিক বিশ্বাসে, জাতীয়তাবাদকে "জাহেলিয়াত" বা অজ্ঞতার যুগে ফিরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

অন্যান্য জাতির প্রতি মনোভাবঃ

জাতীয়তাবাদ অনেক সময় অন্য জাতি বা দেশ, এমনকি মুসলিমদের প্রতিও ঘৃণা বা বৈষম্যমূলক মনোভাব তৈরি করতে পারে।

ইসলামী জাতীয়তাবাদঃ

সংজ্ঞাঃ

এটি এমন এক ধরনের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যেখানে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামবাদকে একত্রিত করে মুসলিম স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়া হয়।

মূল ধারণাঃ

এই ধারণায়, ইসলামি পরিচয়ই প্রধান, এবং মুসলিমরা একটি একক জাতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

জাতীয়তাবাদ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, শরিয়া বিরোধী ও সম্পূর্ণ হারাম মতবাদ। কেননা, মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য একমাত্র জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলাম দান করেছেন। এটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চূড়ান্ত জীবন ব্যবস্থা। কারণ তা সরাসরি মহান সৃষ্টকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল কৃত।

সুতরাং ইসলাম ছাড়া যত মতবাদ, মতাদর্শ, আইডোলজি এবং থিয়োলজির আবির্ভাব হবে সবই বাতিল, অগ্রহণযোগ্য ও জাহেলিয়াত হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যেমন: ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম বা সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। কোনো মুসলিমের জন্য এ সকল মতবাদে বিশ্বাস রাখা জায়েজ নাই। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু (ধর্ম/মতাদর্শ) অনুসন্ধান করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত।” (সূরা আলে ইমরান: ৮৫)।

অতএব ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামের মধ্যে একটি টানাপোড়েন বিদ্যমান। একদিকে, জাতীয়তাবাদ বিভেদ তৈরি করে এবং উম্মাহর একতার ধারণাকে খর্ব করে। অন্যদিকে, ইসলামী জাতীয়তাবাদ নামে একটি ধারণা রয়েছে, যেখানে জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলো ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।” (সূরা রূম: ৩২)।

একটি কুফরি মতবাদ সংবিধানে সংযোজন করে মুসলিম জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে। অথচ ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম, যেখানে সকল মুসলিমকে একটি একক উম্মাহর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এই কুফরি মতবাদের সংবিধানকে মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করা ও মেনে চলা সমীচিন নয়। আপনি হয়তো একজন মুসলিম ভোটার হিসেবে এমন একটি দলকে ভোট দিলেন যারা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর এই সংবিধানকে মেনে চলে ও তদানুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করে তাহলে এই অন্যায় কাজের সহযোগী হিসেবে আপনাকে কিয়ামতে  কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সংবিধান

(৩) ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ

বাংলাদেশের সংবিধানের ১২তম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা' সম্পর্কিত নীতিগুলো বর্ণিত হয়েছে।

সেক্যুলারিজম এর সঠিক বাংলা অনুবাদ হবে ধর্মহীনতা। যারা এর অনুবাদ করেন ধর্মনিরপেক্ষতা, তাদের এই অনুবাদে ভিন্ন কিছু বোঝানোর সুযোগ রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধানের মূল অংশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এটি ধর্মহীনতা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বরং সব নাগরিকের সমান ধর্মীয় অধিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দে উল্লেখিত হয়েছে। অতএব সেক্যুলারিজমকে নির্দ্বিধায় ইসলামবহির্ভূত একটি মতবাদ বলা যায়, ধর্মহীনতা বলা যায়, আসলেই যে অর্থে এর উদগাতা এটি তৈরি করেছেন। মৌলিক বইপত্র, এনসাইক্লোপেডিয়া ও ডিকশনারিতে এর দার্শনিক ও প্রচারকরা যে সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন। এটি সঠিক অর্থে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই অনুসরণ করতে পারে না। ধর্মহীন মানুষই কেবল বাস্তব অর্থে সেক্যুলার হতে পারে।

কোনো মুসলমানও পরিবর্তিত এবং ব্যাখ্যামূলক অর্থ ছাড়া যেমন বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার লাভ, নিজেদের বানানো এমন অর্থ ছাড়া কোনো মুসলমান সরাসরি সেক্যুলার হতে পারে না। সেক্যুলারিজম একটি ধর্মহীন মতবাদ। এর প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ধর্মহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ধর্মীয় জীবনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা। এই নাস্তিক্যবাদী মতাদর্শের মোকাবিলা করতে ধর্মগুলোকে বহু কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। তবে একমাত্র ইসলাম এই মতাদর্শের সাথে কম্প্রোমাইজ না করে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে টিকে রয়েছে। এই ধর্মহীন মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেই দ্বীন হিসেবে পৃথিবীতে এগিয়ে চলেছে। কারণ, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো নিছক ধর্মমাত্র নয়। কিছু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়।

ইসলাম মানুষের জীবনের সব দিক নিয়ে নির্দেশনা দেয়। যে ইসলামে বিশ্বাসী সে জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী শরীয়তে বিশ্বাসী হতে বাধ্য। নিছক ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম হয়ে জীবনের বহু দিক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান মতো চলে প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায় না।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা, ০২ : ২০৮)।

আল্লাহ আরও বলেন,

ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১০২)।

এখানে ঈমান ও ইসলামে পূর্ণাঙ্গ দাখিল হতে এবং মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে বলা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এ কথাও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে,

আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন-ধর্ম বা জীবনবিধান হচ্ছে ইসলাম। (সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৯)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,

আর যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা তালাশ বা অবলম্বন করবে, তার কাছ থেকে সেটি কোনো দিনই গ্রহণ করা হবে না। আর সে ব্যক্তি পরকালে হবে ব্যর্থ ও মহা ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ৮৫)।

ইসলামের এ স্পষ্ট ঘোষণা থেকে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল হয়ে যায় যে, ইসলামে থাকাবস্থায় মুসলিমদের পক্ষে আংশিক বা পূর্ণ ইসলাম ত্যাগ করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বানিয়ে রাখার অধিকারও নেই। ইসলামের পাশাপাশি অপর কোনো ধর্ম বা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করারও উপায় নেই। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো পর্যায়ে ধর্মহীন হওয়ার অবকাশও নেই। মুসলমানদের কেবল মুসলমান হতে হবে, সেক্যুলার মুসলমান হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ইসলামের প্রথম দিকে মক্কার কাফির মুশরিকরা আল্লাহর নবীর নিকট একটি সমঝোতা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল যে, কিছুদিন আপনি আমাদের উপাস্য দেবদেবীর উপাসনা করবেন আর কিছুদিন আমরা আপনার আল্লাহর ইবাদত করব। সব ধর্মের একটি সমন্বিত ধর্মীয় সংস্কৃতি চালুর চিন্তা থেকেই এ প্রস্তাব তারা দিয়েছিল। এর জবাবে আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিলেন,

‘হে রাসূল, আপনি বলে দিন, হে অবিশ্বাসীরা, তোমরা যাদের উপাসনা করো আমি তাদের উপাসনা করি না। আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও। তোমরা যাদের উপসনা করো আমি তার ইবাদতকারী নই। আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তাঁর উপসনাকারী নও। তোমাদের ধর্মকর্ম ও পরকালীন পরিণামফল তোমাদের আর আমার ধর্মকর্ম ও পরকালীন পরিণামফল আমার।’ যার শেষ পঙ্ক্তিটির আরবী হলো, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।’

এখানে কাফির-মুশরিকদের সাথে ধর্মকর্ম, বিশ্বাস ও উপাসনা এক হওয়া যেকোনো দিনই সম্ভব নয়, সে কথাটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমাদের ধর্ম ও পারলৌকিক প্রতিফল একরকম, আমার ধর্ম ও পারলৌকিক প্রতিফল অন্যরকম। এটি সব ধর্মের সত্যতা, বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতার মিউচুয়াল ঘোষণা নয়। কোরআন বরং এখানে অন্যান্য ধর্ম থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ও স্বকীয় ঘোষণা করেছে। অতএব, এ আয়াতের অর্থ, মর্ম বক্তব্য ও বার্তা অনুধাবন করেই এর প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। এর গড়পড়তা ব্যবহার কোরআনের উদ্দেশ্যের সাথে যায় না।

ইসলামী বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্তারের ফলে মুসলিমদের দ্বীন ও দুনিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে আমরা তার কিছু কুফল বর্ণনা করছি:

(১) সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্তারের ফলে রাষ্ট্রী্য় জীবনে আল্লাহর বিধানকে নিষিদ্ধ করা, জীবনের সকল শাখা থেকে শরীয়তকে বিতাড়িত করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিলকৃত ওহীর পরিবর্তে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী কাফেরদের তৈরি বিধানকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আল্লাহর বিধানকে মানা ও মানব-রচিত বিধান প্রত্যাখ্যান করার আহ্বানকে তারা প্রগতির অন্তরায়, পশ্চাৎগামী ও রক্ষণশীলতা জ্ঞান করে। আল্লাহর দিকে দা‘ঈ বা আহ্বানকারীদেরকে তারা নানাভাবে হেয় ও উপহাস করে, সরকারি চাকুরী ও ক্ষমতা থেকে দূরে রাখে, যেন তারা জাতি ও যুবকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হয়।

(২) সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের কাজই হচ্ছে ইসলামী ইতিহাসকে বিকৃত করা, তাতে মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটানো ও দিগ্বিজয়ী ইসলামী আন্দোলনের ফসল স্বর্ণযুগকে ব্যক্তি স্বার্থ ও জঙ্গীবাদ বা জংগলীপনার ফলাফল বলে গালমন্দ করা এবং সমাজে এ জাতীয় ধ্যান-ধারণা তৈরি করা।

(৩) সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার সেবাদাসরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তাদের সেকুলার মতাদর্শের সেবক বানানোর কাজে লিপ্ত। এ কাজ তারা বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করে, যেমন:

(ক) শিক্ষা উপকরণ ও সিলেবাস দ্বারা ছাত্রদের মাঝে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করা।

(খ) ধর্মীয় শিক্ষার নির্ধারিত সময় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা ও সংকুচিত করা।

(গ) নির্দিষ্ট কতক ধর্মীয় বিষয় পাঠদানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, যে বিষয়গুলো সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারে কিংবা সে মতবাদের ভ্রষ্টতার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।

(ঘ) শরীয়ত তথা কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন ভাষ্যের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ও অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে বিকৃতি ঘটানো, যেন মানুষ বুঝে শরীয়ত সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করে, অথবা ন্যূনতম পক্ষে বুঝে যে, ইসলামের সাথে তার সংঘর্ষ নেই।

(ঙ) পূর্ণাঙ্গভাবে দ্বীন পালনকারী শিক্ষকদেরকে পাঠদান ও শিক্ষাঙ্গন থেকে দূরে রাখা এবং ছাত্রদেরকে তাদের সাথে মিশতে না দেওয়া। এ কাজ তারা বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করে, যেমন দাফতরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা, অথবা অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো পথে তাদেরকে মগ্ন করে দেওয়া।

(চ) ধর্মীয় বিষয়কে গুরুত্বহীন ও অতিরিক্ত বিষয়ের মান দেওয়া, যেমন শেষ পিরিয়ডে রাখা, যখন ছাত্রদের মাঝে ক্লান্তির ভাব সৃষ্টি হয়, যেন তারা ধর্মীয় শিক্ষায় উজ্জীবিত না হয়। আবার এমনভাবে এ বিষয়কে শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা যে এর সাথে ছাত্রদের পাশ-ফেলের সম্ভাবনা না থাকা।

(৪) সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, সত্য দ্বীনের অনুসারী ও মিথ্যা-বিকৃত দ্বীনের অনুসারী যেমন মুসলিম-ইয়াহূদী-খৃস্টান ও নাস্তিকদের থেকে পার্থক্য তুলে দেয়া, অতঃপর সবাইকে এক মানদণ্ডে রাখা ও বাহ্যিকভাবে সবাইকে সমান মর্যাদা দেয়া, যদিও সত্যিকার অর্থে তারা কাফের, নাস্তিক, পাপাচারী ও অপরাধীদেরকে তাওহীদের ধারক-বাহক, আল্লাহর আনুগত্যকারী ও ইমানদার লোকদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

এ মতবাদের সামনে মুসলিম, খৃস্টান, ইয়াহূদী, ব্রাহ্মণ, মূর্তিপূজক সবাই সমান, তাদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব তখনই তাদের কাছে মুখ্য হবে যখন কেউ তাদের মতবাদের আহ্বানে সাড়া দিবে।

এ মতবাদের ধ্বজাধারীদের দৃষ্টিতে খৃস্টান, ইয়াহূদী, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ বা সমাজতন্ত্রীর সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে বৈধ, কোনো সমস্যা নেই, অনুরূপ তার দৃষ্টিতে মুসলিম দেশে ইয়াহূদী অথবা খৃস্টান অথবা অন্য কোনো কুফরি ধর্মের অনুসারীর শাসক হতে সমস্যা নেই।

তারা জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদের আড়ালে মুসলিম দেশের কর্তৃত্ব কাফেরদের হাতে তুলে দিতে চায়।

বরং জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদ ও দেশের অখণ্ডতাকে মূলনীতি ও একমাত্র ঐক্যের বন্ধন হিসেবে দেখে। কুরআনুল কারীমের যে অংশ অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে হাদিস তাদের এ তথাকথিত জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদ নীতি বিরুদ্ধ হয়, তাকেই তারা ছুড়ে ফেলে ও প্রত্যাখ্যান করে। আর বলে: এটা দেশীয় একতা ও ঐক্য বিনষ্টকারী!

(৫) এ মতবাদের অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার প্রসার করা এবং পারিবারিক সিস্টেম ধ্বংস করা। এ জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন:

(ক) অশ্লীলতাকে বৈধতা দেওয়া ও তার জন্য কাউকে শাস্তি প্রদান করা যাবে না মর্মে আইন প্রণয়ন করা; যার দৃষ্টিতে ব্যভিচার ও সমকামিতা ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, যে ব্যক্তি স্বাধীনতা! প্রত্যেকের জন্য নিশ্চিত করা জরুরি।

(খ) শালীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও সেগুলোর সহায়তায় নিয়োজিত পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও রেডিও-টেলিভিশনের অনুমোদন দেওয়া ও তাতে অংশ গ্রহণ করা। কখনো পরোক্ষভাবে আবার কখনো প্রত্যক্ষভাবে সেসব অশ্লীলতা প্রচারে রত থাকা।

(গ) স্কুল-ভার্সিটি, সামাজিক সংগঠন ও সংস্থাসমূহে পর্দা নিষিদ্ধ করা এবং অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতাকে চাপিয়ে দেওয়া।

(৬) বিভিন্নভাবে ইসলামী দাওয়াত বাধাগ্রস্ত করা, যেমন:

(ক) ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশ ও প্রচারণায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা, পক্ষান্তরে যেসব বই-পুস্তকের কারণে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করবে, ইসলামী ঈমান-আকিদা বিনষ্ট হবে ও শরীয়তের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হবে, সেগুলো অধিকহারে প্রকাশ ও বিতরণ করা।

(খ) সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতাবলম্বী লোকদের বিভিন্ন মিডিয়ায় সুযোগ দেওয়া, যেন তারা দেশের অধিকাংশ মানুষের সামনে তাদের পথভ্রষ্টতা প্রচার করার সুযোগ পায় ও শরীয়তকে বিকৃত করতে সক্ষম হয়; পক্ষান্তরে যেসব আলেম মানুষের সামনে দ্বীনের হাকিকত তুলে ধরবেন তাদেরকে মিডিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়, অথবা ইসলামিক মিডিয়াগুলো বন্ধ করা হয়।

(৭) সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দা‘ঈদের হয়রানী করে বেড়ানো, তাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা, তাদের উপর বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করা এবং তাদেরকে বিভিন্ন খারাপ বিশেষণে বিশেষায়িত করা; সমাজে প্রচার করা যে, তারা রক্ষণশীল, বিবেক প্রতিবন্ধী ও পশ্চাতমুখী; আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে বৈরিতা পোষণকারী, চরমপন্থি ও উগ্রবাদী, বাস্তবতা বুঝে না, তারা মূল বস্তু ত্যাগ করে খোসা ধরে রাখে ইত্যাদি।

(৮) এ মতবাদের অনুসারীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, যেসব মুসলিম সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে আপোষ করে না তাদেরকে নিঃশেষ করে দেওয়া, তাদেরকে দেশান্তর করে দেওয়া, অথবা জেলে দেওয়া অথবা হত্যা করা।

(৯) এ মতবাদের অনুসারীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের আবশ্যকতা অস্বীকার করা, জিহাদ নিষিদ্ধ করা এবং জিহাদকে একপ্রকার ডাকাতি ও বর্বরতা জ্ঞান করা। কারণ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অর্থ আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করা, যেন পৃথিবীর বুকে ইসলামী হুকুমত ব্যতীত দাপুটে ও শক্তিধর কোনো হুকুমত না থাকে; পক্ষান্তরে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার সকল শাখা থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা। ধর্ম সম্পর্কে তাদের সবচেয়ে সুন্দর উক্তি হচ্ছে: “মানুষ ও তার উপাস্যের মাঝে ধর্ম বিশেষ এক বন্ধন, যার প্রভাব ইবাদতগৃহের বাইরে ব্যক্তির কথা, কাজ ও চরিত্রে প্রতিফলিত হবে না”। অতএব আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্যে জিহাদের অনুমতি তাদের দৃষ্টিতে না-থাকাই স্বাভাবিক।

ধর্মনিরপেক্ষ ও তার অনুসারীদের নিকট সম্পদ ও ভূ-খণ্ড রক্ষা ব্যতীত যুদ্ধ করা বৈধ নয়; দ্বীনের সুরক্ষা, দ্বীন প্রচার ও তার বিজয়ের জন্য জিহাদ করা তাদের নিকট বর্বরতা ও সীমালঙ্ঘনের শামিল, যা সভ্য প্রগতিশীল মানুষের নিকট গ্রাহ্য নয়!!

(১০) তারা জাতীয়তা ও দেশাত্মবোধের দাওয়াত দেয়, তার ভিত্তিতে তারা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার স্বপ্ন দেখে। তাদের নিকট একতার মানদণ্ড হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, অথবা ভাষা, অথবা ভূ-খণ্ড অথবা পার্থিব কোনো স্বার্থ; ধর্মের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হওয়া তাদের সংবিধানে বৈধ নয়, বরং দ্বীন তাদের দৃষ্টিতে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির বড় কারণ। তাদের কেউ এমনও বলেছে: “রক্তাক্ত শতাব্দীগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, পরকালীন জীবনের নিরাপত্তার জিম্মাদার কথিত ধর্ম বা দ্বীন শান্তিকে ধ্বংস করেছে”।

আমরা এখানে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের জন্ম দেওয়া মুসলিম দেশে বিদ্যমান কয়েকটি কুফল উল্লেখ করলাম, বস্তুত তার কুফল আরো অধিক, আরো ব্যাপক।

কেউ দৃষ্টি দিলে এ সকল কুফল অথবা তার বেশিরভাগ কুফল অধিকাংশ মুসলিম দেশে অনুভব করবে বা স্বচক্ষে দেখবে। আরো দেখবে যে, মুসলিম দেশের গভীর পর্যন্ত এ সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীয় শিকড় শক্তিশালী করেছে।

একজন মুসলিম তার ডানে-বামে মুসলিম অধ্যুষিত যে কোনো দেশের দিকে তাকালে খুব সহজে, বিনা কষ্টে ও অনায়াসে সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার এক বা একাধিক কুফল দেখতে পাবে, বরং তার বিবিধ কুফল থেকে মুক্ত কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ব্যক্তির ক্ষেত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই হাদিসটি হুবহু মিলে যায়।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে আমাদের অতিরিক্ত বর্ণনা করেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, লাঞ্ছিত হোক দ্বীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম এবং শালের গোলাম। তাকে দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। এরা লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হলে তা কেউ তুলে দিবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ঘোড়ার লাগাম ধরে জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যার মাথার চুল উস্ক খুস্ক এবং পা ধূলি মলিন। তাকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে আর (দলের) পেছনে পেছনে রাখলে পেছনেই থাকে। সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোন বিষয়ে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ কবূল করা হয় না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ২৮৮৭, (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৬৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৬৮৫ শেষাংশ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লেখিত বিশেষণের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও পড়বে যারা ইসলামের কোনো একটি কথা বা কাজকে সমালোচনার বিষয় বস্তু বানায়। যে ব্যক্তি ইসলামি শরিয়াহকে বাদ দিয়ে মানব রচিত আইনে শাসন কার্য পরিচালনা করে সেই ধর্মনিরপেক্ষ। যে ব্যক্তি ইসলামে নিষিদ্ধ বিষয়, যেমনঃ ব্যভিচার, মদ, গান-বাজনা, সুদিকারবার ইত্যাদিকে বৈধ বিবেচনা করে এবং বিশ্বাস করে যে, এগুলো থেকে বারণ করা মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও ব্যক্তিগত স্বার্থে বাঁধা দেওয়ার নামান্তর, সে ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ। যে ব্যক্তি শারঈ দণ্ড বিধি, যেমনঃ হত্যার শাস্তি, পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুর শাস্তি, ব্যভিচারি ও মদ্যপের উপরবে ত্রাঘাতের শাস্তি, চোর ও ডাকাতের হাত কাটার শাস্তি কায়েমে বাঁধা দেয় অথবা অসম্মতি প্রকাশ করে, অথবা দাবি করে যে, এসকল দণ্ডবিধি যুগপোযুগী নয়, এগুলো নিষ্ঠুর ও জঘন্য, তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ।

তাদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম হলো, আল্লাহ তায়ালা ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেনঃ তবে কি তোমরা কিতাবের কিয়দংশ বিশ্বাস করো এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস করো? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। (সূরা বাকারা, আয়াত৮৫)।

সুতরাং যে ব্যক্তি সেই বিধানগুলো গ্রহণ করে যা তার মনঃপুত হয়, যেমনঃ পারিবারিক আইন, কতিপয় ইবাদত; আর যেগুলো তার মনঃপুত হয় না সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে, সে ব্যক্তিও এই আয়াতের বিধানের মধ্যে পড়বে।

একই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, আমি দুনিয়াতেই তাদেরকে তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেব  এবং এতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হবে না। এরাই হলো সে সকল লোক যাদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া আর কিছু নেই। (সূরা হুদ, আয়াত ১৫-১৬)।

ধর্মনির পেক্ষ মানুষদের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়া কামাই করা, দুনিয়ার মজা উপভোগ করা। এমনকি ইসলামে সেটি হারাম হলেও, কোনো ফরজ ইবাদত পালনে প্রতিবন্ধক হলেও। তাই তারা এ আয়াতের হুমকির অধীনে পড়বে এবং এই আয়াতের অধীনেও পড়বেঃ যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সে সকল লোককে যা ইচ্ছা অতিসত্ত্বর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্যে জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ১৮)।

অতএব সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এক প্রকার ধর্মহীনতা। কোনো মুসলিম যদি ঘোষণা দেয় যে, সে কোনো ধর্ম মানে না তথা সে ইসলামও মানে না তাহলে সে কাফির হবে। তাই এই কুফরি মতবাদ সংযোজিত সংবিধান কোনো মুসলমান মানতে পারে না। যারা এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবে বা ভোট দেয় তারা ইসলামের শত্রু, তারা ধর্মহীন।

সংবিধান

(৪) যেকোনো দন্ড মওকুফ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যাস্তঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ (৪৯) অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেওয়া দণ্ড মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করতে এবং কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করতে পারেন। 

বাংলাদেশ সংবিধানের ১ম পরিচ্ছেদ ৪৯ নং ধারায় উল্লেখ আছে  “কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে−কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে−কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে”।

উক্ত ধারার ক্ষমতাবলে একজন রাষ্ট্রপতি যেকোনো খুনীসহ যেকোনো অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন।

কিন্তু ইসলামে ক্ষমা করার বিষয়টি ছেড়ে দেয়া হয়েছে নিহতের পরিবারের উপর। কেউ কাউকে খুন করলে নিহতের পরিবার অভিযোগ দায়ের করলে ইসলাম তাকে তিনটি শর্ত দিয়ে দেয়। শর্ত তিনটি হচ্ছে,

(ক)  নিহতের পরিবার খুনের পরিবর্তে খুনীকে খুন করবে তথা কিসাস আদায় করবে।

(খ)  অথবা দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ আদায় করবে।

(গ)  নতুবা ক্ষমা করে দিবে।

এখানে তিনটির যেকোনো একটি করতে হবে। দুইটি এক সাথে আদায় করা যাবে না।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস্ তথা হত্যার পরিবর্তে হত্যা নির্ধারণ করা হলো। স্বাধীনের পরিবর্তে স্বাধীন, দাসের পরিবর্তে দাস এবং নারীর পরিবর্তে নারী। তবে কাউকে যদি তার ভাই (মৃত ব্যক্তি) এর পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করে দেয়া হয় তথা মৃতের ওয়ারিশরা ক্বিসাসের পরিবর্তে দিয়াত গ্রহণ করতে রাজি হয় তবে ওয়ারিশরা যেন ন্যায় সঙ্গতভাবে তা আদায়ের ব্যাপারে তাগাদা দেয় এবং হত্যাকারী যেন তা সদ্ভাবে আদায় করে। এ হচ্ছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে লঘু সংবিধান এবং (তোমাদের উপর) তাঁর একান্ত করুণা। এরপরও কেউ সীমালংঘন করলে তথা হত্যাকারীকে হত্যা করলে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (সুরা আল বাক্বারাহ্: ১৭৮)।

ক্বিসাস সত্যিকারার্থে কোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। বরং তাতে এমন অনেকগুলো ফায়েদা রয়েছে যা একমাত্র বুদ্ধিমানরাই উদ্ঘাটন করতে পারেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বিসাসের ফায়েদা বা উপকার সম্পর্কে বলেন:

‘‘হে জ্ঞানী লোকেরা! ক্বিসাসের মধ্যেই তোমাদের সকলের বাস্তব জীবন লুক্কায়িত আছে। (কোন হত্যাকারীর উপর ক্বিসাসের বিধান প্রয়োগ করা হলে অন্যরা এ ভয়ে আর কাউকে হত্যা করবে না। তখন অনেকগুলো তাজা জীবন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে) এতে করে হয়তো বা তোমরা আল্লাহ্ভীরু হবে’’। (সুরা আল বাক্বারাহ্: ১৭৯)।

আ’য়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘তিনটি কারণের কোন একটি কারণ ছাড়া অন্য যে কোন কারণে কোন মুসলিমকে হত্যা করা জায়িয নয়। উক্ত তিনটি কারণ হচ্ছে: (১) ব্যভিচারী বিবাহিত স্বাধীন পুরুষ। তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। (২) কেউ কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে তাকে তার পরিবর্তে হত্যা করা হবে। (৩) কেউ ইসলামের গন্ডী থেকে বের হয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তাকে হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসি দেয়া হবে অথবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে তাড়ানো হবে তথা তাকে কোথাও স্থির হতে দেয়া যাবে না’’। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫৩, সুনান আন নাসায়ী ৯১, হা’কিম ৩৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সাঈদ ইবনু আবূ সাঈদ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ সুরাই আল কাবি (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শোনো হে খুযাআহ গোত্রের লোকেরা! তোমরা হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছো। আর আমি তার রক্তমূল্য পরিশোধ করবো। আমার এ কথার পর যাদের কোনো লোককে হত্যা করা হবে তখন নিহতের পরিবার দু’টি বিকল্প অবস্থার যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারবে। দিয়াত গ্রহণ করবে অথবা হত্যা করবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫০৪; সুনান আততিরমিযী ১৪০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বললেন, যে কোনো লোককে হত্যা করা হয়েছে তার দু’টি বিকল্প অবস্থার যে কোনো একটি গ্রহণের স্বাধীনতা আছে। হয় তো তাকে রক্তমূল্য দেয়া হবে, অন্যথায় কিসাস কার্যকর হবে। তখন ইয়ামেনের অধিবাসী আবূ শাহ নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! (এ নির্দেশ) আমাদের জন্য লিখিয়ে দিন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আবূ শাহ এর জন্য লিখে দাও। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫০৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১২; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩১৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৫৫; সুনান আততিরমিযী ১৪০৬, ১৪০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩১৭১, ইসলামীক সেন্টার ৩১৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে বিচারকের দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি সর্বপ্রথম হত্যাকৃতের ওয়ারিশদেরকে ক্ষমার পরামর্শ দিবেন।

আনাস্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ক্বিসাস্ সংক্রান্ত কোন ব্যাপার উপস্থাপন করা হলে তিনি সর্বপ্রথম ক্ষমারই আদেশ করতেন’’। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৯৭; সুনান ইব্নু মাজাহ্ ২৭৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইসলামি ৯টি দন্ডবিধির মধ্যে খুন একটি। কেউ কাউকে খুন করলে তার শাস্তি কী হবে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা বা সমাধান কুরআন হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম হিসেবে এর বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। খুনের ব্যাপারে ক্ষমা করার এখতিয়ার শুধুমাত্র হত্যাকৃত ওয়ারিশদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। রাসুল সা. সময়ে তিনি অনেক খুনের বিচার করেছেন অথচ রাষ্ট্রপতি বা একজন বিচারক হিসেবে তিনি কখনো নিজ থেকে কাউকে ক্ষমা করেননি।

আর আমাদের মানবরচিত সংবিধানে গুরুতর কেউ অপরাধ করলে অপরাধীকে ক্ষমা করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে যা কুরআন ও হাদিস পরিপন্থী।

বিগত  ২০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে “ঢাকা টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত “শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর: রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসির আসামি মুক্তির মিছিল” তথ্যানুযায়ী জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কোনো আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়নি। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে মাত্র তিনজন ফাঁসির আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়। কিন্তু শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৮ জন ফাঁসির আসামির সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এক গণক্ষমায় ২০ জন ফাঁসির আসামিকে মুক্তি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। অবশ্য ক্ষমার শুরুটা তার আগের বছর। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েই জিল্লুর রহমান জাতীয় সংসদের তৎকালীন উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করেন। চার মামলায় পলাতক শাহাদাবকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন আদালত। লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির নেতা আইনজীবী নুরুল ইসলাম অপহরণ ও হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে আফতাব উদ্দিন বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। গডফাদার বাবার মতোই সন্ত্রাসে হাত পাকানো এই বিপ্লব ২০১১ সালে আত্মসমর্পণ করলে বাবা তাহের ছেলের প্রাণভিক্ষা চান রাষ্ট্রপতির কাছে। জিল্লুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে তাদের বাড়িতে অনেক গেছেন, তাদের আপ্যায়নও পেয়েছেন। মওকুফ হয়ে যায় বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডের সাজা।

এরপর ক্ষমার মালিক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ক্ষমা পান শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ। তার আরেক পরিচয়, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই তিনি। দুটি খুনের মামলায় তার যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডের সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি। ২০১৮ সালের ২৭ মে মুক্তি পান এই শীর্ষ সন্ত্রাসী।

এভাবে একের পর এক মৃত্যুদণ্ড মওকুফের ঘটনা দেশের ইতিহাসে আর নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান একাই চার বছরে ক্ষমা করেন ২১ জন ফাঁসির আসামিকে।

আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও কম-বেশি বজায় রাখেন সেই ধারা। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা পাওয়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

২০১৪ সালের মার্চে সংসদ অধিবেশনে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৮ জন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামির সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি।

উল্লেখিত তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে, সাংবিধানিক আইনটি সম্পূর্ণরুপে ইসলাম বিরোধী। যাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছে এরা সকলেই খুনী ও বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। ঐ খুনী যদি আপনার পরিবারের কাউকে খুন করতো তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হতো। অতএব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ (৪৯) একটি ইসলাম বিরোধী আইন। এই সংবিধান যারা প্রনয়ন করেছে বা এখনো যারা এই সংবিধানকে বাস্তবায়ন করে চলছে তারা মূলত ইসলামি শরিয়াহ আইনের শত্রু তথা আল্লাহর শত্রু। এখন আপনি একজন মুসলিম ভোটার হিসেবে যদি এমন একটি দলকে ভোট দেন যারা এই সংবিধানকে বাস্তবায়ন করে তাহলে আপনিও আল্লাহদ্রোহীতে পরিনত হবেন।

 

 

 

 

 

 

পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ডানপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দল আছে। ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে কিছু দল আছে যারা ইসলামকে সমর্থন করে কিন্তু ইসলামি আইন অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না। এরাও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে আর কিছু দল আছে যারা সরাসরি ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় বা ইসলামি আইন অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় লড়াই করে যাচ্ছে।

বামপন্থী দলগুলো ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম বা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা কিংবা ইসলামি আইন অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা তাদের সংবিধানে নেই। এ নিয়ে তারা কথাও বলেন না কাজও করেন না। বরঞ্চ তারা ক্ষমতায় থাকলে ইসলামপন্থী দলগুলোর উপর দমন, নিপিড়ন, নির্যাতন, জেলবন্দী, মামলা, হামলা, অপহরণ, গুম, খুন ইত্যাদি করে থাকে। বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে যারা মুসলমান তারাও সালাত আদায় করে, কালিমা পাঠ করে, হজ্জ করে, সাওম রাখে, দান করে তথা ইসলামি কিছু কর্মকান্ড পালন করে থাকে। কিন্তু এরা ইসলামি আইন, জিহাদ, ইসলামি দাওয়াতীর কাজের ঘোর বিরোধী।

অনৈসলামিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ

(ক)  কুরআনকে এরা সংবিধান হিসেবে মেনে নেয় না।

(খ) ইসলামি আইন অনুসারে এরা রাষ্ট্র পরিচালনা করে না।

(গ)  ইসলামি আইন অনুসারে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করে না।

(ঘ)  তারা সমাজে সালাত প্রতিষ্ঠা করে না।

(ঙ) যাকাত আদায় করে না।

(চ)  তারা সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাঁধা দেয় না।

অথচ আল্লাহ বলেন,

“আমি তাদেরকে পৃথিবীতে (রাজ) ক্ষমতা দান করলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর আয়ত্তে”। (সুরা আল হজ্জ ৪১)।

(ছ)  পর্দার বিধান প্রতিষ্ঠিত করে না।

(জ)  রাষ্ট্রীয়ভাবে অবাধ মেলামেশা, অশ্লীলতা/বেহায়াপনা বন্ধের ব্যবস্থা করে না।

(ঝ)  মদের আমদানী, মদের উৎপাদন, মদ বিক্রি ও মদ পানের লাইসেন্স দিয়ে থাকে।

(ঞ) রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজে সুদের প্রচলন করে থাকে।

(চ) তাদের শাসনামলে রাষ্ট্রের মধ্যে অপহরন, গুম ,খুন, নির্যাতন বা অত্যাচার, ধর্ষণ, যিনা/ব্যভিচার, সমকামিতা, লিভটুগেদার, মদ, জুয়া, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখরবাজি, অস্ত্রবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ সকল প্রকার অনৈতিক/অমানবিক ও অনৈসলামিক কর্মকান্ড ঘটে থাকে।

(জ) দলের নেতারা সরাসরি বলে থাকেন, তারা ইসলামি শরিয়াহ আইন মানে না, বিশ্বাস করে না।

(ঞ) এরা সমাজে পতিতাবৃত্তি চালু রাখার পক্ষে মত দিয়ে থাকে।

এরকম হাজার হাজার ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড আছে যেগুলো অনৈসলামিক দলের নেতাগণ ক্ষমতায় গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করে থাকে।

এখন আপনি একজন মুসলিম ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যখন অনৈসলামিক দলের প্রতীকে সিল মারলেন আর তখনই ঘোষণা দিয়ে বললেন যে, আমি আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর আইন মানি না। তথা আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধাচরন করলেন। তাহলে আপনি একজন মুসলমান হিসেবে এযাবত যতো আমল করলেন সব বরবাদ হয়ে যাবে। আসুন আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এ সম্পর্কে কী বলেন তা জেনে নেই।

(ক) আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত”। (সুরা আল মুজাদালা ২০)।

(খ) আল্লাহ বলেন, “আর যে ব্যক্তি তার নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং বিশ্বাসীদের পথ ভিন্ন (ইসলামি দল ব্যতীত) অন্য পথ (অনৈসলামিক দল) অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে সে ফিরে যেতে চায় এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কত মন্দ আবাস!”। (সুরা নিসা ১১৫)।

(গ) আল্লাহ বলেন, “তোমরা সীমালংঘনকারী অপরাধী পাপিষ্ঠদের (নেতৃত্বের) আনুগত্য করো না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং সংস্কার সংশোধন করে না।” (সূরা আশ শুয়ারা ১৫১-১৫২)।

(ঘ) আল্লাহ আরও বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং তাঁর রাসূলের আর সেই সব লোকের , তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত (আমীর) হয়েছে।” (সূরা আন নিসা ৫৯)।

(ঙ) আল্লাহ বলেন, “যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সাক্ষ্য (সৎ লোক) বর্তমান রয়েছে তা যদি সে গোপন করে (অসৎ লোককে ভোট দেয়) তবে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? জেনে রেখ, তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ মোটেই বেখবর নন।” (সূরা আল বাকারাহ ১৪০)।

(চ) আল্লাহ বলেন, “কল্যাণকর কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা কর, আর গুনাহ ও সীমালংঘনের ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করো না।” (সূরা আল মায়িদাহ ২)।

(ছ) আল্লাহ বলেন, “মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না।” (সূরা আলে ইমরান ২৮)।

(জ) আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করো।” (সূরা আত তালাক ২)।

(ঝ) আল্লাহ আরও বলেন, “তোমরা কখনই সাক্ষ্য গোপন করবে না, যে সাক্ষ্য গোপন করে তার মন পাপের কালিমাযুক্ত।” (সূরা আল বাকারাহ ২৮৩)।

(ঞ) আল্লাহ বলেন, “হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাক, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দাও; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীনই হোক, আল্লাহ উভয়েরই যোগ্যতর অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়-বিচার করতে খেয়াল-খুশীর অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কেটে চল, তাহলে (জেনে রাখ) যে, তোমরা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন”। (সুরা নিসা ১৩৫)।

(ট) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহ তা’আলার অবাধ্যতা করল। আর যে আমীরের (নেতার) আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল। প্রকৃতপক্ষে ইমাম (নেতা) হলেন ঢাল স্বরূপ। তার পিছন থেকে যুদ্ধ করা হয়, তার দ্বারা (শত্রুদের কবল থেকে) নিরাপত্তা পাওয়া যায়। সুতরাং শাসক যদি আল্লাহর প্রতি ভয়প্রদর্শন পূর্বক প্রশাসন চালায় এবং ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে এর বিনিময়ে সে সাওয়াব (প্রতিদান) পাবে। কিন্তু সে যদি এর বিপরীত কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে তার গুনাহও তার ওপর কার্যকর হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৬১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৯৫৭, ৭১৩৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩৫, আহমাদ ৮১৩৪, সহীহ আল জামি ৬০৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৯৫, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঠ) উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি কোনো বিকলাঙ্গ কুৎসিত গোলামকেও তোমাদের শাসক (নেতা) নিযুক্ত করা হয়। আর সে আল্লাহ তা’আলার কিতাব অনুযায়ী তোমাদেরকে পরিচালিত করে, তাহলে অবশ্যই তোমরা তার কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৬২, ৩৬৬৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২৯৮, সহীহ আল জামি ১৪১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩০০৪, ইসলামীক সেন্টার ৩০০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ড) ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক মুসলিমের (তার শাসনকর্তার নির্দেশ) শোনা এবং আনুগত্য করা অপরিহার্য; তার মনঃপূত হোক বা না হোক, যতক্ষণ না তাকে গুনাহের দিকে নির্দেশ করে। কিন্তু যদি তাকে গুনাহের কাজের নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তা শোনা ও আনুগত্য করা কর্তব্য নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৬৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৪৪, ২৯৫৫,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৫৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৬২৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৭০৭, সহীহ আল জামি‘ ৩৬৯৩, আহমাদ ৬২৭৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৪৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৫৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ণ) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ অচিরেই আমার পরে এমন সব লোক তোমাদের নেতা হবে, যারা সুন্নাতকে বিলুপ্ত করবে, বিদআতের অনুসরণ করবে এবং নামায নির্দিষ্ট ওয়াক্ত থেকে বিলম্বে পড়বে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি তাদের (যুগ) পাই, তবে কী করবো? তিনি বলেনঃ হে উম্মু আবদ-এর পুত্র! তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো যে, তুমি কী করবে? যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে, তার আনুগত্য করা যাবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৮৬৫, আহমাদ ৩৭৮০, সহীহাহ ২/১৩৯, সহীহ আবু দাউদ ৪৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

উল্লিখিত আলোচনায় এটাই প্রতীয়মান যে, আল্লাহ ও রাসুল সাঃ যা করতে বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ইসলাম বিচ্যূত হওয়া যাবে না। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনাকে অবশ্যই ইসলামি দলকে ভোট প্রদান করতে হবে। যদি তা না করে, অন্য দল বা পথ মতকে সমর্থন করেন তাহলে আপনার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে।

আল্লাহ বলেন,

“আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন আইন/ধর্ম/পথ/মত গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত”। (সুরা ইমরান ৮৫০)।

আপনি একদিকে মুসলমান হিসেবে ধর্মকর্ম পালন করবেন আবার ভোটের সময় অন্য দলকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে সমাজে মদ, সুদ, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা প্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগীতা করবেন, আপনি কেমন মুসলমান?

আল্লাহ বলেন,

”আর তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সহায়তা করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তি দাতা।” (সূরা মায়িদা: ২)।

আপনি নিজেকে যখন মুসলমান হিসেবে দাবী করবেন তখন অবশ্যই আপনাকে ইসলামের আদেশ নিষেধগুলো মেনে চলতে হবে। নিষেধমূলক কাজের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে সহযোগীতা করা যাবে না।

আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না”। (সুরা আলে ইমরান ১০২)।

এখানে আল্লাহ তায়ালা একজন মুমিন ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ  মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করলেন কেনো? তার মানে আপনি উপরোক্ত কর্মকান্ডের জন্যে পুরোপুরি মুসলমান না। এরকম আরো আছে।

বর্তমান যুগে কোন্ পদ্ধতিতে ইসলামি খিলাফত বা ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে?

আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালানো বা বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তাতে আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, পরিপূর্ণ রাজত্ব এবং পরিচালনা ক্ষমতার দাবী অনুযায়ী তাঁর হুকুম কার্যকর করার নামান্তর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলিম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও অথচ তাদের প্রতি শুধু এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মা‘বূদের ইবাদাত করবে, যিনি ব্যতীত মা‘বূদ হওয়ার যোগ্য কেউ নয়। তিনি তাদের অংশী স্থাপন করা হতে পবিত্র।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩১)।

এখানে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী-নাসারাদের ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসেবে নামকরণ করেছেন। কারণ, তারাও আল্লাহর বিধানের মতো বিধান রচনা করতো। তাদের রচিত বিধানের অনুসারীদেরকে গোলাম বা বান্দা হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে ঐ সব পাদ্রি ও আলিমদের কাছে নতি স্বীকার করতো এবং তাদের অনুসরণ করতো। আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তারা তো তাদের ইবাদাত করে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে। আর সাধারণ লোকেরা তাদের অনুসরণ করে থাকে। এটার নামই ইবাদাত।

আপনি জেনে নিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না; বরং অন্যের বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করতে চায়, তাদের ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতে তাদেরকে ঈমানহীন (মুনাফিক), দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতে কাফির, যালেম ও ফাসিক বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তাঁর রাসূলের দিকে এসো তখন আপনি মুনাফিকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত।

অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোনো কথা বলুন, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের (রাসূলগণের) আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার রবর কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নিবে।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬০-৬৫)।

এখানে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবীদার মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেনঃ

(১) মুনাফিকদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা তাগুতের নিকট বিচার-ফায়সালার জন্য গমণ করে থাকে। প্রত্যেক ঐ বিষয় বা ব্যক্তির নামই তাগুত, যে আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে। সমস্ত বিচার-ফায়সালা এবং হুকুমের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “জেনে রাখো! তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ করা। আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের রব।” (সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪)।

(২) তাদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে আহ্বান করা হলে তারা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

(৩) তারা কোনো বিপদে পড়লে অথবা তাদের কৃতকর্ম মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে শপথ করে বলে থাকে যে, সৎ উদ্দেশ্য এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখা ব্যতীত আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। বর্তমানে যারা ইসলামের বিধান বাদ দিয়ে বানব রচিত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালায়, তাদের কথাও একই রকম। তারা বলে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো যুগোপযোগী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের উপকার সাধন করা।

আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত চরিত্রের অধিকারী মুনাফেকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরের খবর জানেন এবং তাদেরকে নসীহত করার জন্য এবং কঠোর ভাষায় কথা বলার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ দিয়েছেন। রাসূল পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো, যাতে শুধুমাত্র তাঁদেরই অনুসরণ করা হয়। অন্য মানুষের অনুসরণ নয়। তাদের চিন্তাধারা ও মতবাদ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের রুবূবীয়্যাতের শপথ করে তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ব্যতীত কারও ঈমান সংশোধন হবে না।

(ক) সকল প্রকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রাসূলের দিকে ফিরে আসা।

(খ) রাসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য অন্তরকে প্রশস্ত করা।

(গ) পরিপূর্ণভাবে রাসূলের ফায়সালাকে মেনে নেওয়া এবং কোনো প্রকার শীথিলতা ব্যতীত তা বাস্তবে রূপদান করা।

দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতসমূহে আল্লাহ বলেন,

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফির।” (সূরা আলমায়েদা, আয়াত: ৪৪)।

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম।” (সূরা আলমায়েদা, আয়াত: ৪৫)।

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসিক।” (সূরা আলমায়েদা, আয়াত: ৪৭)।

যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনটি আয়াতে পরপর কাফির, যালেম এবং ফাসিক বলেছেন। তিনটি গুণই কি এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে? অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করল না, সে কাফির, ফাসিক এবং যালেমও বটে। কেননা আল্লাহ কাফিরদেরকে যালেম এবং ফাসিক হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ বলেন, “বস্তুতঃ কাফিররাই প্রকৃত যালেম।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪)।

আল্লাহ বলেন, “তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফুরী করেছে এবং ফাসিক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮৪)।

সুতরাং যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে এবং অন্য বিধানকে অধিক উপযোগী ও উপকারী মনে করে তার মাধ্যমে মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফির হয়ে যাবে। এদের অন্তর্ভুক্ত ঐ সমস্ত লোক, যারা মানুষের জন্য পথ হিসাবে ইসলাম বিরোধী বিধান রচনা করে। তারা তাদের রচিত বিধানকে মানুষের জন্য অধিক উত্তম ও উপযোগী মনে করেই তৈরি করে থাকে। এ কথা স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মানুষ এক পথ ছেড়ে দিয়ে যখন অন্য পথে চলে, তখন এটা মনে করেই চলে যে, প্রথম পথের চেয়ে দ্বিতীয় পথটি উত্তম।

উপরোক্ত আলোচনায় এটাই প্রমানিত যে, আল্লাহর আইন দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা ও যাবতীয় বিচারিক কার্যক্রম চালাতে হবে। মুসলিম নেতাগণ কোনোক্রমেই মানুষের তৈরী আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর আইন আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠিত করবে কারা?

এই পৃথিবীটা বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত। কোনো কোনো রাষ্ট্রে মুসলমানের সংখ্যা বেশী আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খৃস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের সংখ্যা বেশী। যেসব রাষ্ট্রে মুসলমানের সংখ্যা বেশী সেইসব রাষ্ট্রের মুসলিম নেতৃবৃন্দের উচিৎ ছিল সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু তা না করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু দল আছে যারা ইসলাম পন্থী আর কিছু দল আছে ইসলাম পরিপন্থী। ইসলাম পরিপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সংবিধানে কুরআন ও সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসেবে লিপিবদ্ধ নেই। তারা ক্ষমতায় গেলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে মানবরচিত আইনে রাষ্ট্র শাসন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে “সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ” যা ইসলামে শিরক/কুফরি বাক্য হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই অনেক আলেম বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটদানকে নাজায়েজ ঘোষণা দিয়েছে।

অনেক আলেম আছেন যারা ইক্বামাতে দ্বীন বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। তারা বলেন যে, আগে তাওহীদের দাওয়াত দিতে  হবে। সমাজ থেকে আগে বিদআত, শিরক. কুফর উচ্ছেদ করতে হবে। আমি সেইসব আলেমদের বলছি, হ্যাঁ আগে তাওহীদের দাওয়াতই দিতে হবে। রাসুল সাঃ সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াতই দিতেন। আপনারা কি জানেন, রাসুল সাঃ এর তাওহীদের দাওয়াত দেয়াই মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল না, তাঁর মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। (এখানে তাওহীদ বলতে কালিমা, নামাজ রোজা, হজ্জ, যাকাত, ইসলামি শাসন ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থাসহ সকল প্রকার ইবাদত এবং আল্লাহ ও রাসুল সা এর আদেশ নিষেধ ও আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা)।

কাফির মুশরিকগণ যখন বুঝতে পেরেছে যে, রাসুল সাঃ এর কালিমার দাওয়াত শুধু দাওয়াতই না এটাকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের কর্তৃত্ব বিনাশ করা বা তাদের দেব দেবীর প্রভুত্ব ধ্বংশ করা তখনই তারা সম্মিলিতভাবে রাসুল সাঃ কে সমূলে নির্মূল করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাসুল সাঃ নবুয়তপ্রাপ্ত হোন ৬১০ সালে, হিজরত করেন ৬২২ সালে, হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের অভিযান-মার্চ ৬২৩ সালে, উবায়েদ ইবনে আল হারিসের অভিযান-এপ্রিল ৬২৩ সালে, আল খাররার অভিযান-মে ৬২৩ সালে, আবওয়া অভিযান-আগস্ট ৬২৩ সালে, বুওয়াত অভিযান-সেপ্টেম্বর ৬২৩ সালে, সাফওয়ান অভিযান-সেপ্টেম্বর ৬২৩ সালে, উশাইরা অভিযান-ডিসেম্বর ৬২৩ সালে, নাখলা আক্রমণ-জানুয়ারি ৬২৪ সালে, এরপর রাসুল সাঃ বদরের যুদ্ধে অংশ নেন ২ হিজরির ১৭ রমজান, ৬২৪ সালে। এভাবে রাসুল সাঃ এর জীবদ্দশায় ২৭টি বড় ধরনের যুদ্ধ (গাজওয়া), ৬০টি ছোটখাটো দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ (সারিয়া) সংঘটিত হয়। এর মধ্যে রাসুল সাঃ সশরীরে ১৯টি যুদ্ধে অংশ নেন।

আবূ ইসহাক (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যায়দ ইবনু আরকামের পাশে ছিলাম। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়টি যুদ্ধ করেছেন? তিনি বললেন, ঊনিশটি। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কয়টি যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে ছিলেন? তিনি বললেন, সতেরটিতে। বললাম, এসব যুদ্ধের কোনটি সর্বপ্রথম সংঘটিত হয়েছিল? তিনি বললেন, ‘উশাইরাহ বা ‘উশায়র। বিষয়টি আমি ক্বাতাদাহ (রহ.)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনিও বললেন, ‘উশায়র। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৯৪৯, ৪৪০৪, ৪৪৭১,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৯২৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২৫৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৬৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত তথ্য মোতাবেক জানা যায় যে, রাসুল সাঃ এর দাওয়াতী কাজ সমাপ্তই হয়নি কেবল চলমান তাতেই কাফির মুশরিকদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে।

যারা বলেন আগে দাওয়াত পরে খেলাফত, তাদেরকে আমি বলছি আমাদের সমাজ থেকে দাওয়াতী কাজ দিয়ে সুদ আর মদ উচ্ছেদ করে দেখান দেখি। সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইলে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োজন। আপনি এমন এক রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেন, যারা সরকার গঠন করে সুদের প্রচলন ঘটালো, মদের লাইসেন্স দিলো, সেখানে দাওয়াতী কাজ  দিয়ে ১০০ বছরেও সেসব উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংস্কার করতে হলে এমন এক দল প্রতিনিধি বা খলিফা বা নেতা নির্বাচিত করতে হবে বা ক্ষমতায় বসাতে হবে যারা সরকার গঠন করে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে।

এখন প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে কারা বা কিভাবে কায়েম হবে?

এখানে অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, রাসুল সাঃ সশস্ত্রে জিহাদে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। এই ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে মুসলিম সমাজের কিছু জিহাদী কর্মী সশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় বোমা ফাটিয়ে বা অতর্কিত হামলা চালিয়ে জান মালের ক্ষতি করে বসে। এরুপ কর্মকান্ডের জন্যে বহির্বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের নিকট ইসলামি ফোবিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদেরকে জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করছে।

এখানে আসল কথা হলো, রাসুল সাঃ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় কাফির মুশরিকদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি। যখন বাঁধা এসেছে সেই বাঁধাকে প্রতিহত করতে তিনি যুদ্ধে গিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা রাসুল সাঃ কে প্রেরণ করে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন। রাসুল সাঃ আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি। এখানে জনগণের পরামর্শক্রমে রাসুল সাঃ কে নির্বাচিত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু রাসুল সাঃ এর ইন্তেকালের পর পরবর্তী যারা প্রতিনিধি বা খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা ঠিকই অন্যান্য সাহাবাগণের পরামর্শক্রমেই হয়েছেন।

নির্বাচন একটি প্রাচীন পদ্ধতি ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি বিধান। ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, আল্লাহর নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর দাফন-কাফনের আগে ইসলামী বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান এবং খলিফা নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে হজরত আবু বকর (রা.)-কে সাহাবাদের মতামতের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত করা হয়।

নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ইসলাম সর্বদা ব্যক্তির সততা, যোগ্যতা, খোদাভীতি, ঈমান-আমল, জ্ঞান ও চারিত্রিক গুণাবলীকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া যেমন জরুরি, প্রার্থী বা নির্বাচিত ব্যক্তিও তেমন সৎ-যোগ্য, জ্ঞানী-গুণী, চরিত্রবান, খোদাভীরু, আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ, দেশপ্রেমিক, মানবদরদি ও দায়িত্বানুভূতিসম্পন্ন হওয়া তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন।

মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবেন বা ভোট দিবেন?

কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা বা মিটিং মিছিলে উপস্থিত হওয়া কিংবা সেই দলের কাউকে ভোট দেয়া- যার অর্থ হচ্ছে আপনি সেই দলকে বা সেই দলের নেতা কর্মীদের আপনি ভালবাসেন, পছন্দ করেন, তাদেরকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। আপনি কি জানেন, দুনিয়ার এই ভালবাসা বা বন্ধুত্ব কিয়ামতেও থাকবে। তথা আপনি যেই নেতাকে ভালবাসেন সেই নেতা জান্নাতে গেলে আপনিও জান্নাতে যাবেন আর সেই নেতা জাহান্নামে গেলে তার সাথে আপনিও জাহান্নামে যাবেন। তাই আপনাকে দুনিয়ায় থাকতেই এমন নেতা নির্বাচন করে নিয়ে তার সাথে চলাফেরা করতে হবে যিনি আপনাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাসুল সা. বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে উঠে। সুতরাং তার বন্ধু নির্বাচনের সময় এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত, সে কাকে বন্ধু নির্বাচন করছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১৯, সুনান আততিরমিযী ২৩৭৮, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৯২৭, সহীহুল জামি‘ ৩৫৪৫, আহমাদ ৮৪১৭, শু‘আবুল ঈমান ৯৪৩৮, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/১৬৫, আল মুসতাদরাক ৭৩১৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

কিন্তু দেখা যায়, আপনি এমন একটি অনৈসলামিক দলের নেতাকে ভালবাসেন বা সমর্থন করেন যিনি ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, মদ, জুয়া, যিনা/ব্যভিচার, চাঁদাবাজিসহ সকল অপকর্মের সাথে জড়িত। সেই নেতা শুধু নামে মুসলমান কিন্তু ইসলামের কিছুই নেই তার ভিতরে, এমন নেতাকে বা এমন নেতার দলকে সমর্থন করা কিংবা সেই দলকে ভোট দেয়া ইসলামে নিষেধ। যারা ক্ষমতায় গেলে ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক রাষ্ট্র শাসন করবে না এমন দলকে ভোট দেয়া বা তাদের কোনো কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা জায়েজ নেই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“সৎ কাজ ও আত্মসংযমে তোমরা পরস্পর সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যের সাহায্য করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে অতি কঠোর”। (সুরা আল মায়েদা-২)।

কিয়ামতে আপনার সেই নেতার সাথেই হাশর হবে যাকে আপনি ভালবাসেন, যাকে ভোট দেন, যাকে সমর্থন করেন এপ্রসঙ্গে রাসুল সাঃ বলেন,

আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ এক ব্যক্তি একদলকে ভালবাসে, কিন্তু (’আমলে) তাদের সমপর্যায়ের হতে পারেনি। তিনি বললেনঃ মানুষ যাকে ভালবাসে, সে তারই সাথী হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৭০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪১,  হাদীস সম্ভার ৩৪১৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৭৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৬২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি আরো বলেন,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! কিয়ামত কখন হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার জন্য পরিতাপ। কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুত করেছ? সে জবাবে বলল, আমি কিছুই করিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি তার সাথেই হবে যাকে তুমি ভালোবাসো। (রাবী) আনাস (রাঃ) বলেনঃ ইসলাম আবির্ভাবের পর মুসলিমদেরকে আমি কোন কথায় এতটা খুশি হতে দেখিনি, যতটা তারা খুশি হয়েছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীতে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৯, (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৬৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬০৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৩৯, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩২, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ২৭০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৩৪৯৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ২০৩১৭, আহমাদ ১২০১৩, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৩৫৫৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৮, দারাকুত্বনী ৩, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৩০৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৪১০, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ২৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৭০, ইসলামিক সেন্টার ৬৫২১, হাদীস সম্ভার ৩৪১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি আরো বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কি অভিমত? যে কোন কওম বা দলকে ভালোবাসে; কিন্তু তাদের সাথে (কখনো) সাক্ষাৎ হয়নি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে ব্যক্তি তার সাথেই আছে, যাকে সে ভালোবাসে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ৬১৬৮, ৬১৬৯, ৬১৭০; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪০, সুনান আততিরমিযী ২৩৮৭, সুনান আবূ দাঊদ ৫১২৭, সহীহুল জামি‘ ৬৬৮৯, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩৩, বাযযার ৩০১৪, আহমাদ ১৩৩৮৮, আবূ ইয়া‘লা ৫১৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫৭, শু‘আবুল ঈমান ৪৯৭, সুনানুর নাসায়ী আল কুবরা ১১১৭৮, দারাকুত্বনী ২, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৭২০৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৭৯৫, হাদীস সম্ভার ৩৪১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৭৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৫২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর হয়। অতএব তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে। (হাদীস সম্ভার ৩৪১২, আহমাদ ৮০২৮, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩৫, সুনান আততিরমিযী ২৩৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ যার (রাঃ)-কে বললেনঃ হে আবূ যার! ঈমানের কোন্ শাখাটি অধিক মজবুত? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রসূলই অধিক অবগত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে পরস্পর সখ্যতা স্থাপন করা এবং শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ঘৃণা করা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১৪, শু‘আবুল ঈমান ৯৫১৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৭২৮, সহীহুল জামি‘ ২৫৩৯, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১১৩৭২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অসৎ লোককে সমর্থন করা, ভোট দেয়া, তাকে ভালবাসা বা তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রাখার  শেষ পরিনতি কিয়ামতে ভোগ করতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“অপরাধী সেদিন স্বীয় হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায় আফসোস! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম। হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে (ভাল না বাসতাম, সমর্থন না করতাম, ভোট না দিতাম) বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! সে তো আমাকে উপদেশ বাণী থেকে (ইসলামী দল থেকে/ইসলামের পথ থেকে)  বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে তা আসার পর, শয়ত্বান মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতক”। (সুরা আল ফুরকান ২৭-২৯)।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সৎলোকের সাহচর্য ও অসৎলোকের সাহচর্য যথাক্রমে কস্তুরী বিক্রেতা (আতরওয়ালা) ও কর্মকারের হাপরে ফুঁক দেয়ার মতো। কস্তুরী বিক্রেতা হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু দান করবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে কিছু কস্তুরী ক্রয় করবে। আর অন্ততপক্ষ কিছু না হলেও তার সুঘ্রাণ তোমার অন্তর ও মস্তিষ্ককে সঞ্জীবিত করবে। পক্ষান্তরে হাপরে ফুঁকদানকারী তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে। আর কিছু না হলেও তার দুর্গন্ধ তুমি পাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১০, (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ২১০১, ৫৬৩৪; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৮৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬২৮, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩১, সহীহুল জামি‘ ২৩৬৮, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৬৪, বাযযার ৩১৯০, আহমাদ ১৯৬৬০, আবূ ইয়া‘লা ৪২৯৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৬১, আল মুসতাদরাক ৭৭৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৫৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৫০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কিয়ামতে বন্ধুরাই পরস্পর শত্রু হবে। এপ্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“বন্ধুরা সেদিন হয়ে পড়বে একে অন্যের শত্রু, মুত্তাকীরা ছাড়া”। (সূরা আয্-যুখরুফ  আয়াত নং - ৬৭ )।

আপনি যাকে ভালবাসেন, যাকে সমর্থন করেন, যাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে কুরআর সুন্নাহ বিরোধী আইন পাশ করাতে এবং তা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করতে সহযোগিতা করেছেন সেইসব নেতাসহ জাহান্নামে গিয়ে আপনাদের মাঝে যেসব কথোপকথন হবে তা নিম্নরুপঃ

অসৎ ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করায় দুনিয়াতে ছোট হোক বা বড় হোক সকল অনুসৃত ব্যক্তি এবং তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা এবং আযাবের ভয়াবহতা দেখে জাহান্নামে প্রবেশের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করবে। অনুসারীরা অনুসৃত ব্যক্তির কাছে জাহান্নামের আগুনের আযাব থেকে পরিত্রাণ চাইবে। কিন্তু তাদের সেদিন কোন কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না। এমতাবস্থায় তাদের মাঝে চরম তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে-

“এ এক বাহিনী, তোমাদের সাথে (জাহান্নামে) প্রবেশকারী। তাদের জন্য নেই কোন অভিনন্দন। বরং তারা জাহান্নামে জ্বলবে। (তখন অনুসারীরা) বলবে, বরং তোমরাও তো (জাহান্নামী), তোমাদের জন্যও কোন অভিনন্দন নেই। তোমরাই তো পূর্বে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছ। কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল। তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! এটা যে আমাদের সম্মুখীন করেছে, জাহান্নামে তার শাস্তি দ্বিগুণ বর্ধিত করুন”। (সুরা ছোয়াদ ৩৮/৫৯-৬১)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

“যখন তারা জাহান্নামে পরস্পরে বিতর্কে লিপ্ত হবে, তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। এখন কি তোমরা আমাদের থেকে জাহান্নামের (আযাবের) কিছু নিবারণ করবে? অহংকারীরা বলবে, আমরা তো সবাই জাহান্নামে আছি। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন”। (সুরা মুমিন ৪৭/৪৮)।

পৃথিবীতে যারা মূর্খ ও পথভ্রষ্ট আলেম এবং তাদের যারা অনুসারী ছিল জাহানণামে তারা পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হ’য়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ডান দিক থেকে আসতে। তারা বলবে, বরং তোমরাতো বিশ্বাসী ছিলে না এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্বও ছিল না। বস্তুত তোমরাই ছিলে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিপালকের কথা সত্য হয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই শাস্তি আস্বাদন করতে হবে। আমরা তোমাদের বিভ্রান্ত করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিলাম। সুতরাং তারা সকলেই সেইদিন শাস্তিতে শরীক হবে”। (সুরা ছা-ফফাত ৩৭/২৭-৩৩)।

কিয়ামতে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের অনুসারীদের মাঝে কথোপকথন

যেসব মুসলিম শাসক বা নেতা রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়ে রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইন দিয়ে শাসন কাজ চালায়, যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে না, যারা যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করে না, পর্দার বিধান প্রতিষ্ঠিত করে না, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি রোধ করে না এমন নেতা বা শাসককে যারা ভোট দেয়, সমর্থন করে এরা সকলেই জাহান্নামে যাবে এবং ক্বিয়ামাতের দিন তাদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং কঠিন হবে। সেইদিন ভোটারগণ সেইসব নেতাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট অভিযোগ দায়ের করবে।

এপ্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা (পীর আউলিয়া/শিক্ষক/মুরুব্বী/হুজুর ইত্যাদি) ও বড় লোকদের অনুসরণ করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রভু! তাদের দ্বিগুণ আযাব প্রদান করুন এবং তাদের উপর মহা লা‘নত বর্ষণ করুন”। (সুরা আহযাব ৩৩/৬৭-৬৮)।

এ মর্মে আরো বলা হয়েছে,

“দুর্বলরা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হ’তাম। অতঃপর ক্ষমতাদর্পীরা দুর্বলদের বলবে, তোমাদের নিকট সৎপথের দিশা আসার পরেও আমরা কি তোমাদেরকে ওটা হতে নিবৃত করেছিলাম? বস্তুতঃ তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। অতঃপর দুর্বল লোকেরা পুনরায় বলবে, বরং প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো রাত-দিনে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর শরীক স্থাপন করি। যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং আমি কাফেরদের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে দেব। সুতরাং তাদেরকে (দুর্বলদেরকে) তারা (ক্ষমতাদর্পীরা) যা করতো তারই প্রতিফল দেওয়া হবে”। (সুরা সাবা ৩৪/৩১-৩৩)।

মু’মিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু বানানো নিষেধ

আবূ সা’ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, মু’মিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু বানাবে না এবং তোমার খাদ্য আল্লাহভীরু লোক ছাড়া যেন অন্য কেউ না খায়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১৮, সুনান আততিরমিযী ২৩৯৫, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩২, সহীহুল জামি‘ ৭৩৪১, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫৪, আহমাদ ১১৩৩৭, আবূ ইয়া‘লা ১৩১৫, দারিমী ২০৫৭, শু‘আবুল ঈমান ৯৩৮২, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৭৪, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৩১৩৬, আল মুসতাদরাক ৭১৬৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

সৎ নেতা বা ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা ও পরস্পরকে ভালবাসার ফজিলত

(ক) মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ যারা আমার সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশে পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার উদ্দেশে সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে আমার গুণগান করে, আমার উদ্দেশে পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং আমারই ভালোবাসা অর্জনের জন্য নিজেদের সম্পদ পরস্পরের মধ্যে ব্যয় করে, তাদেরকে ভালোবাসা আমার জন্য ওয়াজিব হয়।

আর তিরমিযীর এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন, ’’আমার মহত্ব ও সম্মানের খাতিরে যারা পরস্পর মহববত করে, তাদের জন্য পরকালে বিরাট নূরের মিনার হবে, যা দেখে নবী ও শাহীদগণ ঈর্ষা করবেন’’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১১, মুওয়াত্ত্বা মালিক ৩৫০৭, সুনান আততিরমিযী ২৩৯০, সহীহ আত্ তারগীব ৩০১৯, আহমাদ ২২০৮০, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৯৩, হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১৩১, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৩৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার বান্দাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে যে, তাঁরা নবীও নন, শাহীদও নন; কিন্তু কিয়ামতের দিন নবীগণ ও শাহীদগণ আল্লাহ তা’আলার কাছে তাঁদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবেন। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! তাঁরা কারা? আমাদেরকে বলুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তাঁরা সেসব লোক, যারা শুধু আল্লাহ তা’আলার ক্বুরআনের খাতিরে একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের মধ্যে কোন নিকট আত্মীয়তার সম্পর্কও নেই, তাঁদের পরস্পরের মধ্যে ধন-সম্পদের লেনদেনের সম্পর্কও নেই। আল্লাহর কসম! তাদের মুখমণ্ডলে উজ্জ্বল হবে অথবা তাঁরা স্বয়ং আলোকবর্তিকা হবে। তারা সে সময় ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না, যখন সকল মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হবে; তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না, যখন সকল মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আয়াত পাঠ করলেনঃ অর্থাৎ- ’’সাবধান! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুগণের কোন ভয় নেই। তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না’’- (সূরাহ্ ইউনুস ১০ : ৬২)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১২, সুনান আবূ দাঊদ ৩৫২৭, সহীহ আত্ তারগীব ৩০২৬, আহমাদ ২২৮৯৭, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৮৪২, হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৫, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ১১২৩৬, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিয়ে গমন করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তখন লোকজন ছিল। তাঁর কাছে উপস্থিত লোকেদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি এ ব্যক্তিকে আল্লাহরই উদ্দেশে ভালোবাসি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কি তাকে এ কথা জানিয়েছ? লোকটি বলল : না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ উঠো এবং তাকে জানিয়ে দাও। তখন লোকটি উঠে তার নিকট গেল এবং তাকে জানিয়ে দিলো। তখন লোকটি জবাবে বলল, তোমাকে সে সত্তা ভালোবাসবেন, যাঁর সন্তুষ্টির জন্য তুমি আমাকে ভালোবেসেছ।

রাবী [আনাস (রাঃ)] বলেনঃ অতঃপর লোকটি ফিরে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন লোকটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাই জানাল, যা গমনকারী বলেছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির সাথে থাকবে, যাকে তুমি ভালোবাসো। আর তুমি তোমার নিয়্যাতের বিনিময় পাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১৭, শু‘আবুল ঈমান ৯০১১, সুনান আবূ দাঊদ ৫১৫২, সুনান আততিরমিযী ২৩৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আপনি কার আনুগত্য করবেন?

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠন সর্বত্র আনুগত্য এক অপরিহার্য বিষয়। এগুলির কোন স্তরে আনুগত্য না থাকলে সেটা ভালভাবে চলবে না, সেখানে নিয়ম-শৃংঙ্খলা থাকবে না। ফলে সেখানে কোন কাজ সুচারুরূপে পরিচালিতও হবে না। তাই সর্বস্তরে আনুগত্যের কোন বিকল্প নেই।

আনুগত্য মানে হলো কারো প্রতি অনুগত থাকা বা কারো প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। আপনি যখন কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে পছন্দ করবেন, সেই দলের নেতা কর্মীদের ভালোবাসবেন, আপনার নেতার কথা মতো বা নির্দেশনা মোতাবেক চলবেন তখন আপনি যে সেই দল বা নেতার প্রতি আনুগত্যশীল সেটাই বুঝাবে। ইসলামে এই আনুগত্যশীলতার বিষয়ে কিছু বিধি নিষেধ আছে। কারো প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া মানে তার সন্তুষ্টির জন্য সব ধরনের কাজ করা। কিন্তু একজন মুমিন মুসলমানের যাবতীয় আনুগত্য ও অনুসরণ নিঃশর্তভাবে নিবেদিত হবে কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতাদের, যে আদেশ বা নিষেধ পালন করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ হবে, কেবল সে ক্ষেত্রেই একজন মুসলিম তাঁদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে অন্যথা তাদের আনুগত্য করা যাবে না।

আপনি কার সাথে বন্ধুত্ব করবেন আর কার সাথে বন্ধুত্ব করবেন না, কার আনুগত্য করবেন আর কার অনুগত্য করবেন না  এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তুমি নিজেকে তাদেরই সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তাঁর মুখমন্ডল (দর্শন বা সন্তুষ্টি) লাভের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। আর তুমি তার আনুগত্য করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে”। (সুরা আল কাহফ ২৮)।

আনুগত্যের এ বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

“তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বপ্রাপ্তদের আনুগত্য কর। অতঃপর কোনো বিষয়ে সে দায়িত্বশীলদের সাথে তোমরা মতবিরোধ করলে সত্যিকারার্থে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনে থাকলে বিরোধপূর্ণ সে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, এটা তোমাদের জন্য উত্তম এবং পরিণতির দিক থেকে তা খুবই ভাল”। (সূরা আন নিসা  ৫৯)।

যাদের প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া যাবে না

(ক) কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য: মুসলমানদের জন্য কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য নিষিদ্ধ।

আল্লাহ বলেন,

“আর তুমি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ কর না। তাদের দেওয়া কষ্টসমূহ উপেক্ষা কর এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। বস্তুতঃ তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’। (সুরা আহযাব ৩৩/৪৮)।

কাফেরদের আনুগত্য না করে বরং তাদের সাথে জিহাদ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “অতএব তুমি কাফেরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি তাদের বিরুদ্ধে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম কর”। (সুরা ফুরক্বান ২৫/৫২)।

(খ) আহলে কিতাবদের আনুগত্য: আহলে কিতাব তথা ইহুদী-নাছারাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন।

তিনি বলেন,

“হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের কোন একটি দলের কথা মেনে নাও, তাহ’লে ওরা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে ফেলবে”। (সুরা আলে ইমরান ৩/১০০)।

(গ) অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করা: পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অনুমান ভিত্তিক কথা বলে এবং ধারণার অনুসরণ করে। এজন্য অধিকাংশ মানুষের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করে বলেন,

“অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমান ভিত্তিক কথা বলে”। (সুরা আন‘আম ৬/১১৬)।

(ঘ) মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠদের আনুগত্য: যারা মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যাচার করে তাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করে বলেন, “অতএব তুমি মিথ্যারোপ- কারীদের আনুগত্য করবে না”। (সুরা কলম ৬৮/৮)।

অনুরূপভাবে অধিক শপথকারীর আনুগত্য করতেও আল্লাহ নিষেধ করে দেন। তিনি বলেন,

“আর তুমি তার আনুগত্য করবে না, যে অধিক শপথ করে, যে লাঞ্ছিত”। (সুরা কলম ৬৮/১০)।

পাপীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন,

“আর তুমি ওদের মধ্যকার কোন পাপিষ্ঠ অথবা কাফেরের আনুগত্য করবে না”। (সুরা দাহর ৭৬/২৪)।

সীমালংঘনকারীদের আনুগত্য করতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা সীমালংঘনকারীদের আদেশ মান্য কর না”। (সুরা শু‘আরা ২৬/১৫১)।

উদাসীন ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের আনুগত্য করতে নিষেধ করে তিনি বলেন,

“আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য কর না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে”। (সুরা কাহ্ফ ১৮/২৮)।

যেসব মুসলিম নেতা কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক রাষ্ট্র শাসন করে না, আল্লাহর আইন দিয়ে বিচারিক কাজ চালায় না সেসব নেতার প্রতি আনুগত্যশীল হলে তাকে ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। যেমন.

(ক) সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিপতিত হওয়া: আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করে কাফের-মুশরিকদের আনুগত্য করলে স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিপতিত হতে হবে। আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে”। (সুরা আহযাব ৩৩/৩৬)।

(খ) কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন: কাফের-মুশরিকদের আনুগত্য করলে এরা মুসলমানদেরকে কুফরীর দিকে ধাবিত করে দিতে পারে। আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের কোন একটি দলের কথা মেনে নাও, তাহ’লে ওরা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে ফেলবে”। (সুরা আলে ইমরান ৩/১০০)।

তিনি আরো বলেন, “তারা চায় তোমরা কাফের হয়ে যাও যেমন তারা কাফের হয়ে গেছে। যাতে তারা ও তোমরা সমান হয়ে যাও”। (সুরা নিসা ৪/৮৯)।

অন্যত্র তিনি বলেন, “বস্তুতঃ যদি তারা সক্ষম হয়, তবে তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে”। (সুরা বাক্বারাহ ২/২১৭)।

(গ) পরকালীন জীবনে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হবে: আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে কাফেরদের আনুগত্য করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, “আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে এবং তাঁর সীমাসমূহ লংঘন করবে, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি”। (সুরা নিসা ৪/১৪)।

(ঘ) আমলসমূহ বাতিল হয়ে যাবে: যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে কাফেরদের অনুসরণ করে তাদের আমলসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই যারা কুফরী করে ও মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে এবং তাদের নিকট হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাবার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে, তারা কখনোই আল্লাহর কোনরূপ ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সত্বর তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট করবেন”। (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/৩২)।

বর্তমানে আমরা কার প্রতি আনুগত্যশীল হবো

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা জানতে পারলাম, কোনো অনৈসলামিক দলের নেতা, কাফির, মুশরিক, মুনাফিক এবং যারা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমে বাঁধা প্রদান করে তাদের প্রতি আনুগত্যশীল হলে তার ঈমান আমল সব নষ্ট হয়ে যাবে। ইহকাল ও পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তথা তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।

বর্তমানে আমাদের মাঝে রাসুল সা. নেই, সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণ নেই তাহলে মুসলমান হিসেবে আমরা এখন কার আনুগত্য করবো? এপ্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো। রাসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য করো। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট ফিরে যাবে; যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতকে বিশ্বাস কর। এটাই তোমাদের জন্যে সুন্দর ও উত্তম উপায়”। (সূরা ৪/নিসা – ৫৯)।

‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোনো বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে।

মুফাসসিরীনের এক জামা'আত-যাদের মধ্যে আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ সাহাবায়ে কেরামও রয়েছেন-বলেছেন যে, ‘উলুল আমর’ এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক, যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ইমাম সুদ্দী এ মত পোষণ করেন। (এখানে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব বলতে অনৈসলামিক দলের শাসকদের বুঝাবে না)।

‘আমর’ শব্দের অর্থ হলো ইসলামী শরিয়াহ বা ইসলামী আইন। যারা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ বা বিচারকার্য পরিচালনা করেন, তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তারপর আমরা আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ বিধানের উপর; কাজেই আপনি তার অনুসরণ করুন। আর যারা জানে না তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করবেন না”। (সুরা আল জাসিয়া ১৮)।

আমাদের দেশের অনেক আলেম ওলামা, পীর-অলি, গাউস, কুতুব নিজেদেরকে ‘উলিল আমর’ দাবী করে থাকেন। তারা এটাই বুঝাতে চান যে, তারা রাসুল সা. এর পরবর্তী খলিফা বা প্রতিনিধি। ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নাকি তাদেরকে দেয়া হয়েছে। আসলে এসব ভুল ধারণা।

“উলিল আমর” বলতে একমাত্র মুসলিম শাসক বা ইসলামি দলের নেতাদেরকেই বুঝাবে।

সূরা নিসা  ৫৯ নং আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে জানলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে।

শানে নুযূল:

ছহীহ বুখারীর কিতাবুত তাফসীর ও মাগাযী এবং তাফসীর ইবনে কাছীর, কুরতুবী, ত্বাবারী সহ অধিকাংশ তাফসীরে এসেছে যে, আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ বিন ক্বায়েস সাহমী সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ।-

’আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠালেন এবং একজন আনসারীকে তাঁদের আমীর নিযুক্ত করে সেনাবাহিনীকে তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি (’আমীর) তাদের উপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের দৃঢ়ভাবে বলছি যে, তোমরা কাঠ জড় কর এবং তাতে আগুন জ্বালাও। এরপর তোমরা তাতে প্রবেশকরবে। তারা কাঠ জড় করল এবং তাতে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন তারা প্রবেশ করতে ইচ্ছা করল, তখন একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল।

তাঁদের কেউ কেউ বলল, আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্যই তো আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করেছি। তাহলে কি আমরা (সবশেষে) আগুনেই প্রবেশ করব? তাঁদের এসব কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ আগুন নিভে যায়। আর তাঁর (’আমীরের) ক্রোধও দমিত হয়ে যায়। এ ঘটনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বর্ণনা করা হলে তিনি বললেনঃ যদি তারা তাতে প্রবেশ করত, তাহলে কোন দিন আর এ থেকে বের হত না। জেনে রেখো! আনুগত্য কেবল বৈধ কাজেই হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৪৫, ৪৩৪০; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৫৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৪০, আহমাদ ৭২৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, ঐ সময় সেনাপতি বলেন,  ‘তোমরা থাম। আমি তোমাদের সাথে স্রেফ হাসি-ঠাট্টা করতে চেয়েছিলাম মাত্র’। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৮৬৩, আহমাদ ১১২৪৫, সহীহাহ ২৩২৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

 ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নিসা ৫৯ আয়াতটি অত্র ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৫৮৪, ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা নিসা ৫৯ আয়াত, সহিহ মুসলিম ৩৩/৮, হাঃ ১৮৩৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪২২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪২২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লিখিত শানে নুযূল ও তাফসীর থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, আয়াতেأُولِى الأَمْرِ  দ্বারা মূলতঃ শাসন ক্ষমতার অধিকারী শাসক, প্রশাসক, যুদ্ধের সেনাপতি, কর্তৃত্বশীল নেতৃবৃন্দকে বুঝানো হয়েছে। কোন আলেম বা ফক্বীহকে নয়। কেননা সাধারণত কোনো আলেম বা ফক্বীহ আদেশ দানের ক্ষমতা রাখেন না। যেমন মদীনায় রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পূর্বে মাক্কী জীবনে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের উপর শাসক নও”। (সুরা গাশিয়া ৮৮/২১-২২)।

উপরোক্ত আয়াত দুটি দ্বারা বুঝা যায় যে, মদীনায় রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এরও শাসন ক্ষমতা ছিল না এবং তিনি দন্ডবিধি তথা হুদূদ কায়েম করার অধিকারী ছিলেন না। অনুরূপভাবে আলেম, ফক্বীহ ও মুজতাহিদগণও উপদেশদাতা মাত্র, হুদূদ কায়েমকারী নন। তবে তাদের মধ্যে কেউ শাসন ক্ষমতার অধিকারী হ’লে তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, أُولِى الأَمْرِ-এর অর্থ কোনো কোনো মুফাসসির ‘ওলামা, ফুক্বাহা’ করায় ওটাকে পুঁজি করে মাযহাবীরা প্রথমে ইমাম চতুষ্টয়কে মান্য করা ওয়াজিব করেছেন। অতঃপর চার ইমামের একই বিষয়ে চার ধরনের ফৎওয়া থেকে যার যার সুবিধা অনুযায়ী ফৎওয়া গ্রহণ করেছেন। সেই সাথে চার ইমামের যেকোন একজনের ফৎওয়া মানা ওয়াজিব করা হয়েছে। এভাবে শূন্য থেকে বিন্দু বানিয়ে সেখান থেকে সিন্ধু বানানো হয়েছে।

“উলিল আমর” সম্পর্কে রাসুল সা. আরো বলেছেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহ তা’আলার অবাধ্যতা করল। আর যে আমীরের (নেতার) আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল। প্রকৃতপক্ষে ইমাম (নেতা) হলেন ঢাল স্বরূপ। তার পিছন থেকে যুদ্ধ করা হয়, তার দ্বারা (শত্রুদের কবল থেকে) নিরাপত্তা পাওয়া যায়। সুতরাং শাসক যদি আল্লাহর প্রতি ভয়প্রদর্শন পূর্বক প্রশাসন চালায় এবং ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে এর বিনিময়ে সে সাওয়াব (প্রতিদান) পাবে। কিন্তু সে যদি এর বিপরীত কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে তার গুনাহও তার ওপর কার্যকর হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৬১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩৫, আহমাদ ৮১৩৪, সহীহ আল জামি‘ ৬০৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এখানে আমির বলতে মুসলিম শাসকদের বুঝানো হয়েছে।

হারিস আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ করছি। যথা- ১. সর্বদা মুসলিম জামা’আতের সাথে থাকো, ২. আমীরের (শাসকদের) আদেশ-নিষেধ মান্য করো, ৩. আমীরের (শাসকদের) আনুগত্য করো, ৪. হিজরত করো, ৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করো। আর যে ব্যক্তি মুসলিম জামা’আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যায়, সে যেন তার গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে। আর যে ব্যক্তি জাহিলী যুগের রসম-রিওয়াজের দিকে আহবান করে, সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত। যদিও সে সওম পালন করে, সালাত আদায় করে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৯৪, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৮৬৩, আহমাদ ১৭১৭০, সহীহ আল জামি ১৭২৪, সহীহ আত্ তারগীব ৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইসলামি দলের নেতার প্রতি আনুগত্যশীল না হলে তারা মহাক্ষতিগ্রস্ত হবে

(ক) জাহিলিয়াতের মৃত্যু: ইসলামি দলের নেতার প্রতি আনুগত্যশীল না হলে তার জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমীরের (শাসকের) আনুগত্যের অবাধ্য হলো এবং মুসলিম জামা’আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, এমতাবস্থায় সে মারা গেলে তার মৃত্যু জাহিলিয়্যাত যুগের উপর হবে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকার নিচে যুদ্ধ করে যার হক বা বাতিল হওয়া সম্পর্কে অজানা; বরং সে যেন দলীয় ক্রোধের বশীভূত হয়ে অথবা দলীয় স্বার্থ রক্ষায় লোকেদেরকে আহবান করে কিংবা দলীয় প্রেরণায় মদদ জোগায়। এমতাবস্থায় সে মারা গেলে জাহিলিয়্যাতের উপরই মৃত্যুবরণ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মাতের বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করল এবং ভালো-মন্দ সকলকে নির্বিচারে আক্রমণ করতে লাগল। এমনকি তাত্থেকে আমার উম্মাতের কোনো মু’মিনেরও পরোয়া করল না এবং আশ্রিত তথা নিরাপত্তায় অধিকারী ব্যক্তির সাথে যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার চুক্তিও পূরণ করল না, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৬৯,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৮০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৪৮, সুনান আননাসায়ী ৪১১৪,সুনান  ইবনু মাজাহ ৩৯৪৮, আহমাদ ৮০৬১, সহীহাহ্ ৪৩৩, সহীহ আল জামি‘ ৬২৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৬৩৩, ইসলামিক সেন্টার ৪৬৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) দলীল-প্রমাণ না থাকা: ইসলামি দলের নেতার প্রতি আনুগত্যশীল না হলে ক্বিয়ামতের দিন তার কোনো দলীল থাকবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইমাম বা শাসকের আনুগত্য থেকে দূরে সরে গেল, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, তার ঘাড়ে কোনো বায়’আত নেই, সে জাহিলিয়্যাতের ন্যায় মৃত্যুবরণ করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৭৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৫১, সহীহাহ্ ৯৮৪, সহীহ আল জামি‘ ৬২২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৬৪০, ইসলামিক সেন্টার ৪৬৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইসলামি দলের নেতার প্রতি আনুগত্যশীল হওয়ার ফজিলত

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের ওপর ফরয করা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় কর, তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা মাসটির সিয়াম (রোযা) পালন কর, আদায় কর তোমাদের ধন-সম্পদের যাকাত এবং তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর। তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৭১, আহমাদ ২১৬৫৭, সুনান আততিরমিযী ৬১৬, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ৮৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কোনো মুসলিম নেতা অনৈসলামিক দলের এমপি প্রার্থী হলে তা কতোটুকু ইসলাম সম্মতঃ

আমরা জানি অনৈসলামিক দল ক্ষমতায় গেলে তারা কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন না করে মানবরচিত আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। এইসব অনৈসলামিক রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো মুসলমান সম্পৃক্ত থাকতে পারে না। এইসব দলের হয়ে কোনো মুসলিম নেতা ইলেকশন করতে পারে না।

যে সরকার আল্লাহর নাযিলকৃত আইন দিয়ে রাষ্ট্র শাসন করে না বা শরিয়াহ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না সেই সরকারে কোনো মুসলমানের জন্য যোগ দেয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে মনোনীত করা জায়েয নয়। তাই এ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য কোনো মুসলমান নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করা জায়েয নেই।

তবে কোনো মুসলমান যদি এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয় কিংবা অন্যকে নির্বাচিত করে যে, এর মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে তারা বর্তমান শাসনব্যবস্থার উপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সেটা জায়েয। তবে, সে ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি প্রার্থী হবেন তিনি এমন কোনো পদ গ্রহণ করতে পারবেন না যা ইসলামি শরিয়ার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

কিন্তু এপর্যন্ত এমন কোনো এমপি, মন্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়নি যিনি অনৈসলামিক দলের এমপি/মন্ত্রী হয়ে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে ইসলাম কায়েমে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। আর দলের কারনে তার পক্ষে একাজ করাও সম্ভব নয়। তাই যিনি ইসলামের পক্ষে কাজ করতে চান তাকে সরাসরি ইসলামি দলের হয়ে কাজ করতে হবে। অনৈসলামিক দলের নেতা যতোই বুযুর্গ হোক বা নিজেকে সৎ লোক বলে দাবী করুক তিনি যখনই অনৈসলামিক দলের এমপি প্রার্থী হবেন তখনই ধরে নেয়া হবে তিনি আল্লাহর আইন ও সুন্নাহ বিরোধী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন।

যেসব মুসলিম ভোটার ইসলামি দলকে ভোট দেয় না

(তারা কারা)

আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ, আওয়ামীলীগের সহযোগি অন্যান্য রাজনৈতিকসমূহ, সব বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপিসহ সকল অনৈসলামিক রাজনৈতিক দলসমূহ, সব নারীবাদী সংগঠন, সব অফিসের দালালগণ, চোরা কারবারী,  মাজার পূজারী, কথিত পীর/দরবেশ/আউলিয়া/গাউস/কুতুব, ভবঘুরে কথিত জটাধারী বাবা, মদ বা নেশা ও নারী ব্যবসায়ী, নেশাখোর, সুদখোর, ঘুষখোর, ব্যভিচারী, দুর্নীতিবাজ, নারী পাচারকারী, উলঙ্গ নারী (শর্ট ড্রেস পরিধান করা নারী/পর্দাহীন নারী), নাটক-সিনেমার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ, গায়ক,  নৃত্য শিল্পী, জুয়াড়ু, অবৈধ মেলামেশাকারী, সমকামী, লিভ টুগেদার, পার্ক ও তারকা হোটেল ব্যবসায়ী, বাংলা-কলা-দর্শন-সংস্কৃতি-জ্যোতিরবিদ্যা সহ এজাতীয় বিভাগের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়া ছাত্র শিক্ষক, ইসলাম বিদ্বেষী সকল কবি, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক বা লেখক, সংগীত বিদ্যার সাথে জড়িতরা, সব বখাটেরা, সকল পতিতা, হিজড়া, সকল আওয়ামী মুক্তি যোদ্ধা, অধিকাংশ ব্যাংকার, বিভিন্ন NGO ও সমিতি, ভারতীয় অনুসারীরা, অধিকাংশ খেলোয়াড়, সকল দুই নম্বর ব্যবসায়ী, মজুদদারী, চরিত্রহীন নারী পুরুষ, সকল আধুনিক নারী পুরুষ, পাশ্চাত্য পড়ুয়া অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী, পাশ্চাত্য কৃষ্টি-কালচারে বড় হওয়া ব্যক্তিরা, সকল ট্যাটু ব্যবহারকারী, সকল হাফ প্যান্ট পরিধানকারী নারী/পুরুষ, যেসব নারী সাজগোজ করে পর্দা ছাড়া বাহিরে বের হয়, সকল আওয়ামী আলেম, সকল টিকটকার, সকল নাস্তিক, যাত্রা গান/সার্কাস ও লালন ভক্তরা, পহেলা বৈশাখ তথা মঙ্গলশোভা যাত্রার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ, কনসার্ট এর আয়োজকগণ, কথিত বিজ্ঞান মনোস্ক ও সংস্কৃতিমনারা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে এক স্বৈরশাসকের পতন

আমরা জানি, বিগত ০৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে “৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার” এক অভ্যত্থানে বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিস্ট, খুনি, অপহরণকারী, গুমকারী, নির্যাতনকারী, অর্থপাচারকারী, ব্যাংক ডাকাতসহ হাজারো অপরাধের সাথে জড়িত রাক্ষুসী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাসহ তাদের সমর্থিত দলীয় সকল নেতা কর্মী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অপরাধ এবং ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতা কর্মীদের বিভিন্ন অপরাধ ও কেনো তাদের পতন ঘটলো এসব জানার আগে আওয়ামীলীগ গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস একটু জানা প্রয়োজন।

শেখ মুজিব ও তার কন্যা শেখ হাসিনা দুজনের হাতেই পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগের। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট  শেখ হাসিনা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।

শেখ হাসিনার প্রণীত সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনেই দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়াও দলটির সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। এ সময় দলটির পক্ষে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির প্রথমে নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। তখন দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় শামসুল হককে। ওই সময় জেলে থাকা মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ১৯৫২ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ‘অসুস্থ’ দেখিয়ে শেখ মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরের বছর ১৯৫৩ সালের সম্মেলনে শেখ মুজিবকে পরিপূর্ণ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে। নাম পরিবর্তন নিয়ে ওই সময় দলের মধ্যে একটা বিরোধও তৈরি হয়। এদিকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট বিরোধে ১৯৫৭ সালে দলটির সভাপতি মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এদিকে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

এর আগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে অন্যান্য দলের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের আওতায় পড়ে। এটি ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ১৯৬৬ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। এ দায়িত্বে থাকেন ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন না এমন সিদ্ধান্ত হলে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। যার ফলে ১৯৭৪ সালে এএইচএস কামরুজ্জামান দলের সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-দুর্ভিক্ষসহ বিভিন্ন কারণে শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছেড়ে একদলীয় শাসন চালু করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেন শেখ মুজিব। ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) গঠন করে তিনি নিজেকে আজীবন দলটির সভাপতি ঘোষণা করেন। এ সময় শেখ মুজিবের হাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও বিলুপ্ত হয়। তার জীবদ্দশায় এর আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সামরিক আইনে বাকশালের কার্যক্রমসহ সব রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করা হয়। রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মো. সায়েম ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ওই সময় বাকশাল থেকে বেরিয়ে জোহরা তাজউদ্দীনসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন। তবে নেতৃত্বের বিরোধে আওয়ামী লীগ (মালেক) এবং আওয়ামী লীগ (মিজান) দুই ধারায় বিভক্ত হয়।

দ্বিধাবিভক্তি চলাকালে ১৯৮১ সালে বিদেশে নির্বাসনে থাকার পর হঠাৎ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। ওই বছরই ১৭ মে দেশে ফিরে তিনি দলের দায়িত্বও নেন। এরপর থেকে টানা ৪৪ বছর তিনি একই পদে বহাল ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা ১১ মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে ৬ জনকে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পেয়েছেন।

শেখ হাসিনার দলের দায়িত্বকালে ২১ বছর পর (১৯৯৬-২০০১ সালে) আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে আবার দলটি ক্ষমতায় আসার পর ভোটারবিহীন নির্বাচন, রাতের ভোট ও ডামি ভোটের মাধ্যমে টানা ৪ মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়। এই সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে দলটি ও তার নেতাকর্মীরা হত্যা, খুন, অর্থ পাচার, লুটপাট, ব্যাপক দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত হয়। পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন।

আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভারতে বসে প্রতিনিয়ত অনলাইনে যুক্ত হয়ে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতাকর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে দলটি।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ১২ মে ২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার হাতেই আওয়ামী লীগ নামক দেশের অন্যতম পুরোনো দলটির পতন হলো।

এদিকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতে গত ১১ মে ২০২৫ তারিখে  সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন করেছে। এর ফলে দলটি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে।

পত্রিকায় প্রকাশিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার অপহরণ, গুম, খুন ও নির্যাতন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের বিবরণ

(১) বিগত  ০১ জুলাই ২০২৫ তারিখে  “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “রাষ্ট্রীয় মদদে গুম-র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ঠুরতা গুম কমিশনের প্রতিবেদনে” শিরোনামে জানা যায় যে,

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে গুম ছিল একটি সুপরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত রাষ্ট্রীয় চর্চা। র‌্যাব-২, সিপিসি-৩, টিএফআই সেল এবং সিটিটিসি এর মতো ইউনিটগুলোতে নির্যাতনের জন্য বিশেষ কৌশল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো। ঘূর্ণায়মান চেয়ার, ‘পুলি সিস্টেম’ (যেখানে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখা হত), এবং শব্দনিরোধক নির্যাতনকক্ষ গড়ে তোলা হয়েছিল যাতে ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে না পায়। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপনীয় ও কার্যকর রাখার একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন।

শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি গুমের শিকাররা মানসিক নির্যাতন ও সন্ত্রাসেরও শিকার হয়েছিলেন। অর্ধেকের বেশি ভুক্তভোগীকে খাবার দেওয়া হতো না, চোখ বেঁধে ও হাতকড়াসহ একাকী সেলে রাখা হতো। দিনের পর দিন ঘুমাতে না দিয়ে জাগিয়ে রাখা, খালি পায়ের উপর বসিয়ে রাখা, মশার কামড় সহ্য করানো—এসব ছিল তাদের দৈনন্দিন দুঃখ।

নারীত্বের ওপর নিষ্ঠুর ও অপমানজনক নির্যাতনঃ

নারীদের নির্যাতনের মাত্রা ছিল আরও নিষ্ঠুর। এক নারী ভুক্তভোগী জানান, তাকে ওড়না ছাড়া জানালার দিকে মুখ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যেন পুরুষ প্রহরীরা তার শরীর উপভোগ করতে পারে। পিরিয়ড চলাকালে প্রয়োজনীয় প্যাড চাওয়ার সময় হাসাহাসি করা হয়। এটি ছিল নারী সত্তার ওপর নগ্ন ও সামাজিক আঘাত।

নির্মম প্রহার, বৈদ্যুতিক শক ও যৌনাঙ্গে নির্যাতনঃ

প্রায় সকল ভুক্তভোগীই লাঠিপেটা, পিঠে থেঁতলে দেওয়া, পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে পায়ের তালুতে আঘাত—এসব নিয়মিত শাস্তির শিকার হয়েছেন। শুধু হাত-পা নয়, যৌনাঙ্গেও বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো । কেউ বলেছেন, প্যান্ট খুলে ক্লিপ লাগিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হতো, যা তাদের অজ্ঞান হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেত।

ভয়াবহ "ওয়াটারবোর্ডিং" ও ঘূর্ণায়মান চেয়ারের নির্যাতনঃ

মুখে পানি ঢেলে শ্বাসরোধ করে শ্বাসকষ্ট তৈরি করা হতো, যা "ওয়াটারবোর্ডিং" নামে পরিচিত। এতে ভুক্তভোগীরা মনে করতেন তারা ডুবে যাচ্ছেন। র্যানব ও ডিজিএফআই ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার শরীর দ্রুত ঘোরানোর মাধ্যমে শারীরিক যন্ত্রণার এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছিল। এতে অনেকেই প্রস্রাব বা পায়খানা করে ফেলতেন, কেউ কেউ জ্ঞান হারাতেন।

যৌন নির্যাতন: রাষ্ট্রীয় পরিকল্পিত অপমানঃ

পুরুষদের যৌনাঙ্গ চেপে ধরা, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, প্রস্রাব করাতে বাধ্য করে শক দেওয়া—এসব ছিল গোপন কিন্তু বহুল প্রচলিত নির্যাতনের অংশ। এক ভুক্তভোগী বলেছিলেন, “আমি পাঁচ ফুট উপরে উঠছি মনে হয়েছিল, এমন শক লাগছিল। আমার দুই পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছিল, কিন্তু সেটা টেরই পাইনি, কারণ ব্যথার কেন্দ্র ছিল অন্য স্থানে।”

অনেক ভুক্তভোগী আজও তাদের শরীরে ফাটা চামড়া, হাড়ের জোড়া নষ্ট, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং যৌন অঙ্গের বিকলতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। মানসিকভাবে অনেকেই সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছেন। এক পিতা জানিয়েছেন, তার ১৬ বছরের ছেলেটি ২০ মাস ১৩ দিন গুম অবস্থায় থাকার পর ফিরে এসে একাকী হয়ে গেছে, হঠাৎ চিৎকার করে, ফেনা ফেলে, ঘুম ভেঙে ওঠে এবং ওষুধ খেতে চায় না। তারা বিচার, চিকিৎসা বা আইনগত সহায়তায় এখন অসহায়।

এই ভয়াবহ নিপীড়নের প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মচারীর কাজ নয়, বরং একটি পরিকল্পিত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত দমননীতি। গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদন শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দলিল। এই দলিল আমাদের সামনে রাষ্ট্রের নির্মম ও কুরুচিকর চেহারা উন্মোচন করেছে।

গুম আর নিখোঁজ নয়—এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, গুম হয়েছে রাষ্ট্রের পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রের যন্ত্র দিয়ে, এবং রাষ্ট্রের মদদে।

(২) বিগত ০২ জুলাই ২০২৫ তারিখে “কালবেলা” পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে জনসাধারণকে গুমের পর চালানো হতো ১৭ ধরনের নির্যাতন। উক্ত পত্রিকা অনুযায়ী এখানেও নির্যাতনের কিছু ধরণ উল্লেখ করা হলোঃ

নারীদের জন্য বিশেষ শাস্তি : নিষ্ঠুর আঘাত: আঘাতের স্থায়ী চিহ্ন: ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন: নখ উপড়ে ফেলা: নখের নিচে সুচ ঢুকিয়ে নির্যাতন : নির্যাতনের আরেক পদ্ধতি ‘বাঁশ ডলা’: বৈদ্যুতিক শক: ওয়াটার বোর্ডিং: নির্যাতনে ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ও চেয়ার: চলত যৌন নির্যাতনও: প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক : যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক : ভুক্তভোগীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব :

সূত্র মতে জানা যায়, বিভিন্ন বাহিনীর দায়িত্বশীলরা ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে গুম ও নির্যাতন সম্পৃক্ত আলামত ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। তা সত্ত্বেও কমিশন এমন সব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে যেগুলো ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। উদাহরণ হিসেবে কমিশন জানিয়েছে, একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বন্দিশালায় নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হতো ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই) মানুষ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে ছিল সাউন্ডপ্রুফ ব্যবস্থা (শব্দ নিরোধক), যার ফলে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে পারত না।

(৩) বিগত ১১ জুন ২০২৫ তারিখে “সমকাল” পত্রিকায় প্রকাশিত  “৬৭ শতাংশ গুমের ঘটনায় জড়িত পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি-সিটিটিসি” শিরোনামে জানা যায়,

আওয়ামী লীগের শাসনামলের এক হাজার ৮৩৭টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। এর মধ্যে এক হাজার ৭৭২ অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এক হাজার ৪২৭ জন ভুক্তভোগী ফিরলেও ৩৪৫ ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। গুমের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার; আদালত ছিল সহযোগীর ভূমিকায়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) গুমের ৬৭ শতাংশ ঘটনায় জড়িত। একটি গুমের ঘটনায় একাধিক সংস্থার জড়িত থাকার নজির রয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআইর মতো গোয়েন্দা সংস্থাও গুমে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, গুমে সম্পৃক্ততা রয়েছে বিজিবিরও। গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআই, এনএসআইর আটক, গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা নেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান, তাঁর সেলে আরেক বন্দি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করতেন। কিন্তু তাঁর নাম জানেন না। কমিশন এমন এক ভুক্তভোগীকে পেয়েছে, যিনি পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন।

কমিশন প্রতিবেদনে বলছে, যে ২৫৩ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্য মিলেছে, সেগুলো ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের ৩৬ জেলায় ঘটেছে। সর্বোচ্চ ৫১টি ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। এই ২৫৩ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জন ১৮ বছরের কম বয়সী তথা শিশু ছিল গুমের সময়। ২২৮ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ৬৬ জন ছিলেন শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগীদের এক দিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত গুম করে রাখা হয়। পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া ২৫৩ ব্যক্তি গড়ে ৪৭ দিন করে গুম ছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম হওয়া ১০১ জনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। মধ্যে তাদের ৩৭ জন বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের, ৩১ জন ইসলামী ছাত্রশিবিরের, ২৫ জন জামায়াতের, দু’জন করে ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের এবং একজন করে খেলাফত ও তাবলিগের। আওয়ামী লীগেরও দু’জন রয়েছেন। দু’জন হিন্দু, বাকিরা মুসলিম। দু’জন নারী।

গুমের শিকার এক বিএনপিকর্মী কমিশনকে জানান, ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালায় গুম থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অর্থের তথ্যের জন্য তাঁকে নির্যাতন করা হয়। খালেদা জিয়া ঢাকা দূতাবাসগুলোকে কী উপহার পাঠান, দূতাবাসগুলো কী উপহার পাঠায়, তা জানতে চেয়ে মারধর করা হতো।

এক জামায়াতকর্মী কমিশনকে জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর কারণে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। চার হাত পায়ে বাঁশ ঢুকিয়ে মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে পানি ঢালা হতো। এতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু কিছু ঘটনা এক দশক আগের। সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফোন কলরেকর্ড পাওয়া যায়নি। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, একজন র্যানব সদস্যের ছবি পাওয়া গিয়েছিল, যিনি গোপন বন্দিশালায় আটক এক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করেন মুক্তিপণের টাকার জন্য। টাকা দেওয়ার পর সেই নিখোঁজ ব্যক্তি আর ফেরেননি। যে নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল, সেটির প্রকৃত মালিকের পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। নম্বরটি পুনরায় বিক্রি করা হয়েছে।

কমিশন প্রথম প্রতিবেদনে যে দুটি গোপন বন্দিশালার কথা জানায়, এর একটি ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি), আরেকটি র্যা বের গোয়েন্দা ইউনিটের। গত ৫ আগস্টের পর এগুলো থেকে গুমের প্রমাণ মুছে ফেলতে হাসপাতাল-ক্লিনিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। যে বন্দিশালাকে হাসপাতাল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সেটিতে বন্দি ছিলেন ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান। তাঁর সাক্ষাতে এর বর্ণনা রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও দিয়েছেন। কমিশন গত বছরের ১৬ অক্টোবর গোপন বন্দিশালাটি পরিদর্শন করে। ৫ আগস্টের পর প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা দেখতে পাওয়া কথা উল্লেখ করা হয় কমিশনের প্রতিবেদনে।

(৪) হাসিনার শাসনে রাষ্ট্রীয় ‘জল্লাদ বাহিনী’ হয়ে ওঠে সোয়াটঃ

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫

সূত্র: আমার দেশ

র‌্যাবের মতো সোয়াট বাহিনী ছিল এক বিভীষিকার নাম। শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যায় সোয়াটের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চরমপন্থা মোকাবিলায় এ বাহিনী গঠিত হলেও হাসিনার সরকার একে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সোয়াট বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘেরাও করে রাতে অভিযান পরিচালনা করেছে।

সোয়াট হচ্ছে স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিকস টিম। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে ঢাকার বিশেষ পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একটি বিশেষ দল। এই সোয়াট শেখ হাসিনার আমলে হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের ‘জল্লাদ বাহিনী’। গ্রেপ্তার বা আইনি প্রক্রিয়ায় কাউকে বিচারের জন্য উপস্থাপনের পরিবর্তে অনেক মানুষের জীবনে ভয়ংকর পরিণতি বয়ে এনেছিল সোয়াট। কখনো তা করা হতো প্রকাশ্য সংঘর্ষের নামে, কখনোবা অপারেশন ক্লিনআপের আড়ালে।

পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাহিনীটিকে মূলত তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিয়ে জল্লাদের ভূমিকায় ব্যবহার করতেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখন পলাতক। পালিয়ে যাওয়ার আগে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীকে জনসেবার বদলে করে গেছেন চরম বিতর্কিত।

২০১৬ সালের জাহাজবাড়ী অভিযান সোয়াটের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সাজানো ওই অভিযানে ৯ তরুণকে ডিবি থেকে বিশেষ পোশাক পরিয়ে কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলে (জাহাজবাড়ী নামে পরিচিত) নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ দেখানো হয়। নিহতদের পরিবারগুলোকে লাশও দেওয়া হয়নি। পুরো অভিযানে সোয়াট সদস্যরা মূল ভূমিকা পালন করেন।

পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে মূল ভূমিকা পালন করা সোয়াটের ওই তথাকথিত অভিযানে নিহত ৯ তরুণের মধ্যে একজন ছিলেন গার্মেন্টকর্মী মতিউর রহমান। তার বাবা সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ে ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের নাসির উদ্দিন। পেশায় তিনি একজন কৃষক। নাসির উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, “আমার ছেলে জঙ্গি ছিল না। তাকে মারার পর পুলিশ আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ১৩-১৪ দিন আমাকে রেখে ওরাই বলেছিল ‘তোমার ছেলে জঙ্গি না’।”

এরপর ২০১৭ সালের মার্চে ঢাকার পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে সোয়াটের অভিযানে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ‘আত্মঘাতী’ হওয়ার দাবি করা হয়। গাজীপুরের পাতারটেক অভিযানেও একই কৌশল দেখা যায়। সেখানে সন্দেহভাজনদের আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ না দিয়ে সরাসরি গুলি চালানো হয়। পরিবারের অভিযোগ, নিহতরা আগে থেকেই গুম অবস্থায় ছিলেন। একই ভাবে সিলেটের আতিয়া মহলে চার দিনব্যাপী অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ না দিয়ে ভারী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সোয়াটের কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে সোয়াট সদস্যসহ নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনও প্রাণ হারান।

চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকার অভিযানে সরাসরি গুলি চালানো হয় এবং নিহতদের পরিচয় যাচাই না করার অভিযোগ ওঠে। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরেও দিনের পর দিন চলা অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং বিস্ফোরণে নারী ও শিশুর প্রাণহানি ঘটে।

রাজশাহী ও বগুড়ায় তথাকথিত জঙ্গি দমন অভিযানে ছোট ঘর বা ফ্ল্যাট ঘিরে বিস্ফোরণ ও গুলি চালানো হয়, যেখানে নিহতদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিহতরা নিরীহ ছাত্র বা ভুলভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

গুম থেকে ফিরে আসা তরুণ প্রকৌশলী মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, “বাংলাদেশে ‘জঙ্গি দমনের’ নামে গত দেড় দশকে যে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চলেছে, তার কেন্দ্রে ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের অধীন সিটিটিসি ও তাদের স্পেশাল অপারেশন বাহিনী সোয়াট। এদের হাতেই নির্বিচারে প্রাণ গেছে বহু নারী-পুরুষ ও শিশুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিচয় অজানা থেকেছে। বিচার তো দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো, বিশেষ করে সোয়াটকে এক ধরনের জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল তারা।”

সোয়াটের আইনি কাঠামো ও প্রশ্নঃ

সোয়াট মূলত সিটিটিসির একটি বিশেষায়িত ট্যাকটিক্যাল ইউনিট এবং এটি মূলত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল। কিন্তু গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরও শেখ হাসিনার আমলে বিভিন্ন সাজানো অভিযানের সময় তারা বিচারবহির্ভূত হত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার তীব্র ঘৃণার কারণে পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে কিলিং মেশিনারিতে পরিণত করেছিলেন। র্যাঠব আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত ও কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। সোয়াটকেও জল্লাদের ভূমিকায় নামানো হয়েছিল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ না দিয়ে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হতো। বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে এভাবে খুনোখুনিতে লিপ্ত করায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বাহিনীগুলোর প্রতি চরম ভীতি ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে এটি (সোয়াট) এক ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে বিচার বা তদন্তের জায়গায় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই সমাধান করা হতো।’

সোয়াটের রাজনৈতিক ব্যবহার: আন্দোলন ও বিরোধী মত দমন অভিযান নিয়ে বিতর্ক

আওয়ামী লীগ আমলে সোয়াট বাহিনীর অতিরিক্ত ও ভারী অস্ত্রের প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় উপস্থিতিÑ এই ইউনিটকে ঘিরে বিতর্ক আরো ঘনীভূত হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে সোয়াটের উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ ওই প্রশ্নের আরো একটি উদাহরণ হয়ে ওঠে।

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমনে সোয়াট সদস্যদের ‘সাদা পোশাকে’ অভিযান পরিচালনার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ রয়েছে, কিছু ‘সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা নস্যাৎ’ অভিযানে আটক ব্যক্তিদের পরবর্তী সময়ে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি ঘেরাও করে রাতের বেলায় অভিযান, তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযানে সোয়াটের অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে। নির্বাচনপূর্ব সময়ে সোয়াটকে এমনভাবে ব্যবহারকে অনেকে ‘রাজনৈতিক দমন-নীতির অংশ’ বলেই মনে করেন।

এ বিষয়ে নরওয়ের এমএফ নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক) ড. সাইমুম পারভেজ আমার দেশকে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ দমনকে রাজনীতিমুক্ত করতে হলে সব গণতন্ত্রপন্থি দলের মধ্যে্ রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। দমনমূলক আইন ও ব্যববস্থা পাল্টে পরিশোধনমূলক সন্ত্রাসবাদ দমন পলিসি নিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সন্ত্রাসবিষয়ক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শুধু র্যাষব নয়, সিটিটিসিও (যার অধীনে সোয়াট পরিচালিত) মার্কিন সহায়তার যোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহযোগিতা নিষিদ্ধ।

আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগে দুর্বলতাঃ

আমেরিকা বা জাতিসংঘের (ইউএন) সহযোগিতায় সোয়াট সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণের বাস্তব প্রয়োগ, মানবাধিকার সচেতনতা বা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সোয়াট বাহিনীর সদস্যদের পর্যাপ্ত মানসিক প্রস্তুতি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। অনেক সময় তাদের অভিযানের পেছনে রাজনৈতিক নির্দেশনাও কাজ করে বলে অভিযোগ উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে সোয়াট বাহিনী মাঝেমধ্যেই প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা পায়। তবে এ ধরনের সহায়তা কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে কীভাবে এই বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে বিদেশি পার্টনারদেরও সমালোচনা করা হয়েছে।

সোয়াট বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চরমপন্থা মোকাবিলা। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, বহু সময় এই বাহিনী রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপারেশন পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি জবাবদিহি, নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই হতে পারে একটি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা বাহিনীর বৈশিষ্ট্য।

শেখ হাসিনার আমলে সিটিটিসি ও এর বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের নেতৃত্বে থাকা বেশিরভাগই পলাতক। এখন সিটিটিসির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাসুদ করিম। সোয়াটের বিষয়ে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিলেও তার জবাব মেলেনি।

(৫) হত্যার শিকার বিএনপির ৪৭৭১ নেতাকর্মীঃ

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫

সূত্র: আমার দেশ

জুলাই বিপ্লবের পর রাজনীতির মাঠে বিএনপি জোরালো অবস্থান নিয়ে সভা-সমাবেশসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এর আগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করতে গিয়ে চরম বাধার সম্মুখীন হয় দলটি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও তার সরকারের চরম রোষানলের শিকার হয় দলটি।

দলের হাইকমান্ড থেকে তৃণমূলের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার। হামলা-মামলা, খুন-গুম, কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ ও তালাবদ্ধ রাখাসহ এমন নির্যাতন নেই, যা করা হয়নি। হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার মামলায় প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

হাসিনার নিষ্ঠুরতায় সে সময় ক্রসফায়ার ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৪ হাজার ৭৭১ নেতাকর্মীকে। গুম করা হয় ১ হাজার ২০৪ জনকে। গত বছরের জুলাই বিপ্লবেই নিহত হয়েছেন ৪২২ নেতাকর্মী। খালেদা জিয়ার নামে মামলা ছিল ৩৬টি এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৩৫টি।

খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও তারেক রহমানকে দেশছাড়াঃ

ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল সড়কের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ টোকেনমূল্যে ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল সড়কের ২ একর ৭২ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আগে থেকেই ওই বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ ছিল।

এই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছিলেন, তার বেড রুমের দরজা ভেঙে টেনে-হিঁচড়ে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তার সত্যতা মেলে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যে। ক্ষমতায় থাকাকালে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বহু আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার। যেদিন সময় পাব বের করে দেব। বের করে দিয়েছি।’

সেদিন মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার ৩৮ বছর বসবাস করা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেন বাংলাদেশে আর ফিরতে না পারেন সে জন্য একেক পর এক ‘মিথ্যা মামলায়’ হয়রানি করা হয়। এক-এগারো সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান তারেক রহমান। এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি। এ সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে একে একে ১৩৫টি মামলা দেওয়া হয়। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে গণমাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

গুমের শিকার ৪২৩, এখনো নিখোঁজ ২৮ জনঃ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ (দীর্ঘদিন ভারতে কারাভোগের পর সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন), সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হীরু, বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজ, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল সভাপতি আমিনুল ইসলাম জাকির, তেজগাঁও থানা বিএনপির নেতা সাজেদুল হক সুমন, সাজেদুলের খালাতো ভাই জাহিদুল করিমসহ ৪২৩ জন। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২৮ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা নিয়ে কেউ যাতে প্রশ্ন করতে না পারেন সেজন্য বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল-জুলুম, ক্রসফায়ার ও আয়নাঘরে বন্দি করে নির্যাতনের পথ বেছে নেওয়া হয় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন অনেকে।

ক্রসফায়ারে হত্যা ২২৭৬

বিএনপির নেতাকর্মীদের গুম, খুন ও মামলা সংক্রান্ত নথি নিয়ে কাজ করছে বিশেষায়িত একটি সেল। এ সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন খান জানান, ২০০৭ সাল থেকে ’২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের মাধ্যমে বিএনপির ২২৭৬ জন নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলায় নিহত হয়েছে ২০০ নেতাকর্মী ও সমর্থক। এছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা দেশের ৬৪ জেলায় যাকে হুমকি মনে করেছেন তাকেই হয় ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা, না হয় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের বিষয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, দেশের জনগণের অধিকার হরণ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন সুবিন্যস্ত করার জন্য শেখ হাসিনা গুম ও খুনের পথ বেছে নেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি ক্রসফায়ারের নাটক শুরু করেন।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে দলটির ৪২২ নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। এছাড়া গুরুতর আহত হন কয়েক হাজার।

মামলায় পর্যুদস্ত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ কর্মীরাঃ

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এক লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে। এসব মামলায় নেতাকর্মীরা জামিন ও হাজিরা নিয়ে আদালতপাড়ায় নিয়মিত দৌড়াচ্ছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে দেড় হাজারের মতো নেতাকর্মীর, যার ৯৯ ভাগই মিথ্যা ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক।

এর মধ্যে দলটির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা দেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় ১৩৫টি। আর মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় ৬৪টি।

বিএনপি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব ছাড়াও অন্য নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের চারটি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার ১৯টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ৩২টি, ড. আবদুল মঈন খানের একটি, নজরুল ইসলাম খানের ছয়টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছয়টি, সালাহউদ্দিন আহমেদের ৩৫টি, বেগম সেলিমা রহমানের চারটি ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১৩৪টি, মিজানুর রহমান মিনুর ১৮টি, জয়নুল আবদিন ফারুকের ১২টি, প্রফেসর জয়নাল আবেদীনের (ভিপি) সাতটি, মনিরুল হক চৌধুরীর তিনটি, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর ১৪টি, হাবিবুর রহমান হাবিবের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। এছাড়া সদ্য মৃত্যুবরণ করা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে তিনটি, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম পাঁচটি, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ১১টি, বরকত উল্লাহ বুলুর ১৩৫টি, মো. শাহজাহানের ১৭টি, আবদুস সালাম পিন্টুর ১৯টি, মোসাদ্দেক আলী ফালুর ৯টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর চারটি, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের ১৭টি, শামসুজ্জামান দুদুর ১১টি, অ্যাডভোকেট আহমদ আযম খানের ছয়টি, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের ১৮টি, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি মামলা দেওয়া হয়েছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ৪৯টি, এম কে আনোয়ার ১৯টি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ৪১টি ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৮টি, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন চারটি ও সাদেক হোসেন খোকা ২৭টি মামলা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ১১৯টি, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের ১৫টি, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বিরুদ্ধে ১০০, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান সরোয়ার ১৪টি, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, খায়রুল কবির খোকনের ২১টি, হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৪৫১টি, হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে ১৪টি, ফজলুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা।

যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদের বিরুদ্ধে ৪১টি, মাহবুবের রহমান শামীমের বিরুদ্ধে ৯টি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ৪৭টি, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ১৯টি, আসাদুল হাবিব দুলুর ১৪টি, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের তিনটি, অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিনের ১৭টি ও শামা ওবায়েদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা।

ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপনের বিরুদ্ধে দুটি, প্রচার সম্পাদকের বিরুদ্ধে সাতটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের ১১টি, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের চারটি, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালের ১৭টি, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৫টি, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন উজ্জ্বলের তিনটি, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেনের ৯টি, কৃষিবিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জোহা খানের সাতটি, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপুর ৮৭টি, গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়ার পাঁচটি, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং বিএনপির বন ও পরিবেশ সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ১৬টি, পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তীর সাতটি, গ্রামসরকার সম্পাদক আনিসুজ্জামান খান বাবুর পাঁচটি, কারাবন্দি প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ৩৮টি, শিশু সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর ছয়টি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক আমজাদ হোসেনের চারটি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসাইনের বিরুদ্ধে ২৫টি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন শওকতের পাঁচটি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিমের বিরুদ্ধে ২১টি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নুর ৪০টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের বিরুদ্ধে ১২৬টি মামলা দেওয়া হয়।

অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে সহসম্পাদক সাইফুল ইসলাম শিশিরের বিরুদ্ধে ৯টি, অ্যাডভোকেট সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার ১১টি, আবু সাঈদ চাঁদের ১৪টি, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের ২২টি, মেজর হানিফের পাঁচটি, আকবর আলীর ১০টি, এ কে এম সেলিম রেজা হাবিবের ছয়টি, মাহমুদুল হক রুবেলের ৯টি, অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলমের সাতটি, অ্যাডভোকেট খন্দকার আব্দুল হামিদ ডাবলুর তিনটি, হাসান উদ্দিন সরকারের ৯টি, আমিনুল ইসলামের ২৫টি, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুর ১৪টি, তারিকুল আলম তেনজিংয়ের পাঁচটি, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারীর ১৩টি, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের ২১টি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দফায় দফায় হামলা-ভাঙচুরঃ

বিএনপি দপ্তরের দাবি, নেতাকর্মীদের যেভাবে হত্যা নির্যাতন করা হয়েছে, তেমনি বিএনপির রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করার জন্য দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শতাধিকবার হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেতরে বোমা রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অভিযান চালানো, অভিযানের নামে অফিস থেকে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নথি ও দলের সদস্যদের দেওয়া চাঁদার টাকা লোপাট করা হয়েছে।

সবশেষ ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখনকার ডিবি প্রধান (বর্তমানে পলাতক) হারুনুর রশীদের পরিকল্পনায় নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বোমা রাখা হয়। বোমা উদ্ধারের নামে অভিযান পরিচালনা করে টানা ৭৪ দিন কার্যালয় বন্ধ করে দেয় পুলিশ।

সে সময় জানানো হয়, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট বিএনপি কার্যালয়ের সামনে স্টিকার দিয়ে ঘেরাও করে তদন্ত চালায়। তখন পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ‘ক্রাইম সিন’ লিখে বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার অর্থ, তা পেরিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে কেউ প্রবেশ করতে বা বের হতে পারবেন না।

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১/১১-র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব-জেলে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এই পুরোটা সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে বন্ধ ছিল বিএনপি কার্যালয়। এরপর আর কখনো এত দীর্ঘসময় বন্ধ ছিল না কার্যালয়টি। এরপর ২০০৯ সালের পর কয়েকবার বিএনপি অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এসব তল্লাশির পর ১-২ দিন করে কখনো কখনো বিএনপি কার্যালয় বন্ধ ছিল।

সবশেষ ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ভাঙচুর করে এবং দলের প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় চার দিন কার্যালয়টি বন্ধ করে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি আমার দেশকে বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গুম, খুন ও মামলার রাস্তা বেছে নেন।

বিশেষ করে যেসব নেতাকে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে হুমকি হিসেবে মনে করতেন, তাকে মামলা দিয়ে বা গুম করে ফেলতেন, নতুবা ক্রসফায়ারে দিয়ে হত্যা করতেন। এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন আর গুম-খুনের ভয়কে উপেক্ষা করে সাড়ে ১৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান হাসিনা।

শহীদ উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসরা এখনো দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের লুট করা টাকা দিয়ে এখনো দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের গুম-খুনের দায়ে গুরুত্ব বিবেচনায় হাসিনার বিচার করা ও দোসরদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা।

জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন একটি ঐতিহাসিক দলিল উল্লেখ করে একে সংরক্ষণ করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান বিএনপির এই যুগ্ম মহাসচিব। পাশাপাশি গুম-খুন হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও দলের হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবার মামলা প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

(৬) শেখ হাসিনার নির্দেশে বিচারের নামে হত্যাঃ

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫

সূত্রঃ আমার দেশ

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি বিচারিক হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে। পরিকল্পিতভাবে অভিযোগ সাজিয়ে, সাক্ষী তৈরি করে, অনুগত আদালতের মাধ্যমে রায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, পদচ্যুত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহিন, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম গং।

তাদের সহযোগী ছিলেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মরহুম মাহবুবে আলম, গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ হায়দাল আলী, রানা দাশগুপ্ত, জিয়াদ আল মালুমসহ প্রসিকিউটশন টিম। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জুডিশিয়াল কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেন শেখ হাসিনা। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ নামের আত্মজীবনীতে স্বীকার করেন, ‘রায়গুলো গণভবন থেকে আসত।’

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান ওই বিচার সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘বিচার হলেই তো মন্তব্য করার প্রসঙ্গ আসে। ওই সময় যেটা হয়েছে, সেটাকে বিচার বলা মুশকিল। সরকার একটা নির্দেশনা দিয়েছিল আর ট্রাইব্যুনাল সেটি বাস্তবায়ন করেছে।

শেখ হাসিনার জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার নেতাদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা।

এছাড়া আওয়ামী ‘টার্গেটেড’ জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, দলটির নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপি নেতা আবদুল আলীম, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা আবদুস সোবহান ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার। তারা পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে বন্দি অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

যেভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে জুডিশিয়াল কিলিং

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারির মাধ্যমে জেনারেল মঈন উদ্দিনের সহযোগিতায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় বাংলাদেশকে। ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল মঈনের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, কীভাবে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিজয়ী করা হয়েছিল।

এর আগেই ভারতের অনুগতদের মাধ্যমে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠন করা হয়েছিল জরুরি আইনের সময়। তাদের এজেন্ডা ছিল জুডিশিয়াল কিলিংয়ের রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা। নির্বাচনের আগে ভারতের পরিকল্পনা ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘বিজয়ী হলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে’। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এই বিচারের নামে রীতিমত জুডিশিয়াল কিলিংয়ের আয়োজন ছিল স্পষ্ট।

সে সময় বিচার চলাকালীন ‘সেফ হাউস কেলেঙ্কারি’ ও ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’ প্রকাশের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং মিশনের চিত্র প্রকাশ পেয়েছিল দৈনিক আমার দেশ-এ। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের অনুগত গণমাধ্যমগুলো এ বিষয় ধামাচাপা দিতেই ছিল ব্যস্ত। বরং উল্টো জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পক্ষে জনমত তৈরি করতে মিডিয়া ট্রায়ালে ব্যস্ত ছিল তারা।

(৭) গুম কমিশনের প্রতিবেদন- গুম-খুনে জড়িত জিয়াউলসহ ২৩ কমান্ডার চিহ্নিতঃ

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ২৫

সূত্র: আমার দেশ

গত পনেরো বছরে বিপুলসংখ্যক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এই গুমের সঙ্গে রাষ্ট্রের পাঁচটি বাহিনীর চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে র্যা বের কর্মকর্তারা ৬০ শতাংশ গুমে জড়িত ছিলেন। গত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

পাঁচজনই ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক ও পরিচালক। তারা হলেন- লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) তৌহিদুল ইসলাম।

অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠন করে গত বছরের ২৭ আগস্ট। কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে দুটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান বিচার গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুম করা হতো তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। এরা হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক এবং পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন- বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চিহ্নিত কর্মকর্তারা।

তৃতীয় ধাপে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন। গুম কমিশন গুমের এক হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়েছে। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে এখনো ৩৪৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গুম কমিশনে যারা অভিযোগ দায়ের করেছেন, এখনো তাদের অনেককে হুমকি বা ‘থ্রেট’ করা হচ্ছে। ভিকটিমরা ভয়ে আছে। এসব থ্রেট করার প্রমাণ গুম কমিশনে রয়েছে। কমিশন গুম-খুনের জন্য জিয়াউল আহসানসহ ২৩ জন কমান্ডারকে চিহ্নিত করেছে।

(৮) বিশ্ব সিরিয়াল কিলার জিয়াউলের শিকার ১০৩০ জনঃ

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫

সূত্র: আমার দেশ

একজন আসামি আছে যার ব্যাপারে তদন্ত করে পেয়েছি সে মাথায় গুলি করে এক হাজার ৩০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। গুম করে মানুষদের আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। তার একটা নেশা ছিল এই গুম ব্যক্তিদের হাত-পা-চোখ বেঁধে নৌকায় করে মাঝ বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যেত। গুলি করে লাশটা নদীতে ফেলত। গুলিটা ভিকটিমের মাথার কাছে নিয়ে করত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম-সেটা কেন? তার জবাব-গুলি করার পর নিহত ব্যক্তির মগজ ও রক্তের গরম ছিটা হাতে লাগলে দারুণ ফিলিংস অনুভব হতো।

কে এই ভয়ানক খুনি, কে এই সিরিয়াল কিলার? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের এ বক্তব্যের সূত্র ধরে আমার দেশ অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই হিংস্র খুনি বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত র্যা বের বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় নিজের টিম নিয়ে এই খুনগুলো করেছেন তিনি। গুম করা ব্যক্তিকে খুন করতে তিনি বলতেন-‘গলফ করো’।

অর্থাৎ ওকে খুন করো। জিয়াউল আহসান এখন কেরানীগঞ্জ বিশেষ কারাগারের ধলেশ্বরী ভবনে ডিভিশনপ্রাপ্ত সেলে বন্দি আছেন। টেলিফোনে জানতে চাইলে বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সায়েফ উদ্দিন নয়ন জানান, সুনির্দিষ্ট কী অপরাধে তিনি কারাগারে আছেন বলতে পারছি না। তবে তিনি ১৫টি মামলায় (ধারা ৩০২, ৩০৭, ১০৯, ৩২৬) বন্দি আছেন।

এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জিয়াউল আহসানের নৃশংসতার অসংখ্য কাহিনি জানা গেছে। পলাতক শেখ হাসিনা এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের নির্দেশেই বেশি মানুষকে গুম-খুন করেছেন জিয়াউল আহসান। তিনি হাসিনা ও তারিক সিদ্দিকের একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাদের নির্দেশে গুম করে আয়নাঘরে রাখতেন ভিকটিমদের। সেখান থেকে বিভিন্ন কায়দায় খুন করে লাশ গুম করে দেওয়া হতো। জিয়াউল আহসান গুম হওয়া ব্যক্তিদের যমটুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে করে পোস্তগোলা ব্রিজ, কাঞ্চন ব্রিজ কিংবা কাঁচপুর ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে লাশ ফেলে দিতেন শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে। একদিনে একজনকে দিয়ে ১১টি এবং আরেকজনকে দিয়ে ১৩টি খুন করারও রেকর্ড আছে। কখনো মাইক্রোবাসেই ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হতো। এরপর লাশ রেললাইনের ওপর শুইয়ে দিতেন। ট্রেন এসে লাশ দ্বিখণ্ডিত, ত্রিখণ্ডিত করত।

২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে কমলাপুর থেকে টঙ্গি পর্যন্ত ট্রেনে কাটা যত অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ পাওয়া যেত, তা সবই জিয়াউল আহসানের খুন করা। বেশিরভাগ খুন করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে। একটি নির্দিষ্ট নৌকা ছিল। সেই নৌকায় করে যমটুপি পরা ব্যক্তিদের মাঝনদীতে নিয়ে টুপি খুলতেন। চোখ বাঁধা অবস্থায়ই থাকত। মাথার একেবারে কাছে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ও মগজ এসে পড়ত জিয়াউল আহসানের হাতে। তখন তিনি উল্লাস করতেন। কখনো আবার দেখা যেত আগেই হত্যা করা লাশ নৌকায় তুলে নিচে ও উপরে সিমেন্টভর্তি বস্তার সঙ্গে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতেন, যাতে লাশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। হতভাগ্য বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর শেষ পরিণতিও ঘটে জিয়াউলের হাতে।

শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে সীমান্তের ওপারে তাদের হাতে তুলে দেওয়ারও অনেক ঘটনা আছে। সিলেট সীমান্তে এমন ৭ জনকে তুলে দেওয়ার নজির একটি রেকর্ডে উল্লেখ আছে। একবার মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে ৫০ কেজিরও বেশি ওজনের একটি বস্তা পাঠানো হয় জিয়াউল আহসানের বাসায়। গাড়িতে করে যিনি এই বস্তা জিয়াউলের বাসায় নিয়ে যান, তার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, ‘এটি ছিল টাকার বস্তা’।

কে এই মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান? তার চাকরিজীবন সম্পর্কে খোঁজ করে জানা গেছে, তিনি সেনাবাহিনীর ২৪তম লং কোর্সের কর্মকর্তা। পরিচিতি নম্বর বিএ-৪০৬০। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে যেকোনো বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আয়নাঘর, টেলিমনিটরিং ইত্যাদি সব অপরাধের চিহ্নিত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি এই জিয়াউল আহসান। তারিক সিদ্দিকই তার প্রধান বস। তিনিই তাকে ‘মনস্টার’ বা দানব বানিয়েছেন।

জিয়াউল আহসান ২০০৯ সালে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাসব-২ এর টুআইসি হিসেবে যোগদান করেন। লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র্যা ব সদর দপ্তরে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র্যানবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ওই বছরের মে মাসে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যায় তিনি র্যা বের অভিযান পরিচালনা করেন। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনাও তার নির্দেশনায় ঘটে। ২০১৫ সালে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। তাকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পদে পদায়ন করা হয়। এক বছর পর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২১ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতির পর তিনি এনটিএমসির মহাপরিচালক হন।

জিয়াউল আহসানের গুম সংক্রান্ত অপরাধ সম্পর্কে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে গুম কমিশনের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কমিশন নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, সামগ্রিক গুমের তদন্ত করছে। গুম কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কীভাবে গুম করা হতো, গুমের পর খুন করা হতো এবং লোমহর্ষক নির্যাতন করা হতো। গুমে ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তারেক সিদ্দিকের মাধ্যমে গুমের কিংবা খুন করার নির্দেশগুলো দিতেন। কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। সাদা পোশাকে এক বাহিনীর সদস্যরা গুম করত, প্রচার করা হতো অন্য বাহিনীর নাম। এক বাহিনীর সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে আসত টার্গেট মানুষটিকে, হস্তান্তর করত অন্য বাহিনীর হাতে। যত গুম হয়েছে তার মধ্যে জিয়াউল আহসানের টিমই বেশি করেছে। গুমের শিকার হওয়া মানুষদের মধ্যে জিয়াউল আহসান ও তার টিম হত্যাই করেছে এক হাজার ৩০ জনকে। এজন্য বুড়িগঙ্গার পোস্তগোলা ঘাট নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। কত মানুষকে তিনি গুম করেছেন এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়।

বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনকালে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক বড় বড় যত অপকর্ম করিয়েছেন, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জিয়াউল আহসান। অপহরণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড করা সবকিছুতেই তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। জুলাই-আগস্টের গণহত্যায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন এই কর্মকর্তা। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার (আইকেবি) লেখাতেও জিয়াউল আহসানের অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। জিয়াউল আহসান তাকে মেরে ফেলতে পারেনÑএমন তথ্যে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন। একদিন সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে বোমা আতঙ্কও দেখা দেয়।

গুম-খুনে জড়িত জিয়াউলসহ বিভিন্ন বাহিনীর ২৩ কমান্ডারকে চিহ্নিত গুম কমিশনের

গত পনেরো বছরে বিপুলসংখ্যক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এই গুমের সঙ্গে রাষ্ট্রের পাঁচটি বাহিনীর চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে র্যা বের কর্মকর্তারা ৬০ শতাংশ গুমে জড়িত ছিলেন। গত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পাঁচজনই ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক ও পরিচালক। তারা হলেন- লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) তৌহিদুল ইসলাম। অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠন করে গত বছরের ২৭ আগস্ট। কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে দুটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম আমার দেশকে জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরে কমিশন গুমসংক্রান্ত চূড়ান্ত রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করবে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুম করা হতো তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। এরা হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক এবং পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন- বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চিহ্নিত কর্মকর্তারা। তৃতীয় ধাপে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন। গুম কমিশন গুমের এক হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়েছে। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে এখনো ৩৪৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গুম কমিশনে যারা অভিযোগ দায়ের করেছেন, এখনো তাদের অনেককে হুমকি বা ‘থ্রেট’ করা হচ্ছে। ভিকটিমরা ভয়ে আছে। এসব থ্রেট করার প্রমাণ গুম কমিশনে রয়েছে। কমিশন গুম-খুনের জন্য জিয়াউল আহসানসহ ২৩ জন কমান্ডারকে চিহ্নিত করেছে।

জিয়াউল আহসান সম্পর্কে সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া

র‌্যাবে কর্মরত থাকাকালে জিয়াউল আহসান কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে লিখেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ‘বিজিবি, র্যা ব, এসএসএফ ও আনসার নিয়ে আমার যত অভিজ্ঞতা’ বিষয়ে জিয়াউল আহসানকে নিয়ে লেখেন : “যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত, তা ছিল র্যায়ব-এ প্রেষণে থাকা আমাদের অফিসারদের দ্বারা সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অপহরণ ও হত্যা।

তরুণ, ক্যারিয়ারমুখী অফিসারদের র্যাাবে পাঠানো হতো, সেখানে কিছুদিন কাজ করে তারা এমন এক চরিত্র নিয়ে ফিরত, যেন তারা পেশাদার খুনি। একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও), নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) এবং সৈনিকদের মধ্যেও। আমি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই চাইছিলাম তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হোক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানালে তিনি আমার কথায় সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিলেন, এমনকি বললেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী থেকেও র্যা ব খারাপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বাস্তবে রূপ নেয়নি।

কয়েক দিন পর আমি কর্নেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও ডিজি এসএসএফ) মুজিবকে—যিনি তখন র্যামবের এডিজি (ADG) ছিলেন—ডেকে বলি যেন তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (এখন মেজর জেনারেল) জিয়াউল আহসানকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং আর যেন কোনো ‘ক্রসফায়ার’ না ঘটে। কর্নেল মুজিব এ ব্যাপারে আমাকে কথা দেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় তাকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হয়। পরের কয়েক দিন পত্র-পত্রিকা লক্ষ করলাম, নতুন কোনো ক্রসফায়ারের খবর নেই—এতে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পেলাম।

এরপর কর্নেল মুজিব একাধিকবার আমাকে এসে জানিয়েছিলেন, সত্যিই ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হয়েছে। কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি ঘটনা ঠিকই ঘটছে কিন্তু সেগুলোর খবর চাপা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে যখন কর্নেল মুজিব র্যাবব ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যান, আর কর্নেল জিয়াউল আহসানÑযিনি আগে র্যাববের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বে ছিলেনÑনতুন ডিজি বেনজীর আসার সঙ্গে সঙ্গে এডিজি র্যােব হিসেবে দায়িত্ব নেন।

এরপর আর্মি নিরাপত্তা ইউনিট (ASU) সূত্রে খবর পাই যে, কর্নেল জিয়া নিজের আবাসিক টাওয়ারে একজন গার্ড রেখেছেন, বাসায় অস্ত্র রাখছেন এবং পুরো ফ্ল্যাটে সিসিটিভি বসিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলা হয় গার্ড সরিয়ে নিতে, ক্যামেরাগুলো খুলে ফেলতে, বাসায় অস্ত্র রাখা থেকে বিরত থাকতে এবং অফিসিয়াল কোয়ার্টারে যে সামরিক নিয়মকানুন আছে, সেগুলো মেনে চলতে।

পরবর্তীকালে তার আচরণ আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। ডাইরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (DMI) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে কর্নেল জিয়া কোনো কর্ণপাত করেননি। পরে আর্মি নিরাপত্তা ইউনিটের (ASU) কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল তাকে আলাপের জন্য ডাকেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল আমাকে জানান, জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে যেন সে এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছে যার মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরো দিয়ে ঠাসা—বোঝানোর কোনো উপায় নেই।”

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিমের লেখা থেকে আরো জানা যায়, ঢাকা সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জিয়াউল আহসানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিনি এও লেখেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিক, প্রধানমন্ত্রী মিলিটারি সেক্রেটারি ও অ্যাসিসট্যান্ট মিলিটারি সেক্রেটারির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে জিয়াউল আহসান তার নির্দেশকে তখন চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন।

এত বড় সিরিয়াল কিলার বিশ্বে নেইঃ

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত ১৫ জন সিরিয়াল কিলারের কাহিনি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ জনকে পর্যন্ত খুন করার ইতিহাস রয়েছে। যিনি তিন বা ততোধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে অস্বাভাবিক মানসিক তৃপ্তিলাভ করেন, পুলিশের ভাষায় সেই ব্যক্তি ‘সিরিয়াল কিলার’। অর্থাৎ, যে ধারাবাহিক বা একের পর এক মানুষ হত্যা করে, তাকেই সিরিয়াল কিলার বলা হয়।।

খুনের নেশায় মত্ত থাকে সিরিয়াল কিলাররা। বিশ্বের কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলারদের ভয়ংকর কাহিনিকে ম্লান করে দিয়েছেন জিয়াউল আহসান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের বক্তব্যে এসেছে, জিয়াউল আহসান ১ হাজার ৩০ জনকে গুম-খুন করেছেন অত্যন্ত নৃশংস বীভৎসতায়। এর আগে বাংলাদেশে সিরিয়াল কিলার হিসেবে খুলনার এরশাদ শিকদার ও চাঁদপুরের রসুখাঁর কাহিনি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি, দুদকের মামলাঃ

শুধু গুম-খুন, নৃশংসতাই নয়, মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুস নেওয়ার মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, স্ত্রী নুসরাত জাহান ও জিয়াউল আহসানের নামে-বেনামে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের নামে ২৪ জানুয়ারি মামলা করেছে। তাদের ১২টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৪২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, জিয়াউল আহসান অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডার নাগরিকত্ব নিয়ে সেদেশে বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তিনি দুবাই, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল টাকা পাচার করেছেন। দুদক সূত্র জানায়, স্পেস ইনোভেশন লিমিটেড নামে জিয়াউল আহসানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংক হিসাবেও ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া তার দুটি প্রতিষ্ঠান এআই ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও এআই ল্যান্ডস্কেপ লিমিটেডের নামে ২৫ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের মূল কারণ সমূহ

ছাত্র-জনতার এক রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হোন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের প্রাথমিক কারণ হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলি বর্ষণে শতশত মানুষ হত্যা। এ সময়  জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সে অনুযায়ী ১৪০০ জন মানুষ নিহত এবং ১৮ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে।

তবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের কারণের পেছনে রয়েছে হাসিনার দীর্ঘ শাসনামল জুড়ে,

(১) ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ,

(২) বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের অপহরণ, গুম ও খুন,

(৩) বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি নিপীড়ন,

(৪) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন,

(৫) সরকার ঘনিষ্ঠদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার,

(৬) সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ,

(৭) দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি,

(৮) ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি,

(৯) সরকারি প্রতিষ্ঠানের পারিবারিক নামকরণ,

(১০) মানি লন্ডারিং ও অবকাঠামো প্রকল্পে দুর্নীতি,

(১১) আয়না ঘরে নির্যাতন,

(১২) আলেমদের উপর অন্যায় অত্যাচার করা বা নির্যাতন করা,

(১৩) শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামির জনসভায় রাতে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন করে আলেমদের উপর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা,

(১৪) জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মুসলামানদের হত্যা করা,

(১৫) বিডিআর হত্যার সাথে জড়িত থাকা,

(১৬) ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করা,

(১৭) জনসাধারণকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো,

(১৮) মিথ্যে স্বাক্ষ্য দেয়া,

(১৯) ঘুষ, দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়া,

(২০) একপক্ষীয় বিচার ব্যবস্থা,

(২১) একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম,

(২২) জামায়াত শিবির ও বিএনপি নিধনে চরম নির্যাতন করা,

(২৩) মসজিদগুলোকে দলীয় করণ,

(২৪) বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বী নারীদের ধরে এনে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা

ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট গভীর জন অসন্তোষ। গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বানোয়াট পরিসংখ্যান আর বিভিন্ন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রচারণার মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার চেষ্টা করা হলেও তা হাসিনা সরকারের চূড়ান্ত পতন ঠেকাতে পারেনি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামল থেকে শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গা থেকেই এখানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দুঃশাসনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র উপস্থাপন করা হলো।

নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদঃ

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা কায়েম করেন, যে ব্যবস্থায় পাঁচ বছর পরপর নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনো ধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল না। এসব নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি বা করতে পারেনি, আর অংশগ্রহণ করলেও ব্যাপক ভোট জালিয়াতির স্বীকার হয়। জালিয়াতি শুধু যে নির্বাচনের দিন হয়েছে তা নয়, নির্বাচনের আগের সময়গুলোতেও বিরোধী দলগুলোকে স্বাধীনভাবে কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দেওয়া হয়নি, হাজার হাজার গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে, এলাকা ছাড়া করে নির্বাচনের মাঠ প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন করা হয়।

২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসন লাভ করে সরকার গঠনে করে। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সরকারি প্রশাসন ও দলীয় কর্মীদের ব্যবহার করে আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিরোধী দল ছাড়া নিজ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে 'ডামি' প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করে তারা।

এভাবে বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর নিয়মিত নির্বাচন হলেও জনগণের কাছে কোনো ধরণের জবাবদিহিতা করতে হয়নি হাসিনা সরকারকে। জবাবদিহিতাহীন এই একচেটিয়া শাসনের ফলেই দেশে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং অর্থনৈতিক সংকটে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণঃ

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে রীতিমতো আইন করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় ২০১৩ সালে সংশোধিত আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৩ সালে প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা আইন। এসব আইনের মাধ্যমে 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা', 'মানহানি', 'মিথ্যা তথ্য প্রচার', 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত', 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র বিরোধিতা করা ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে আটক ও অনির্দিষ্টকাল কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

এভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট সাত হাজার একটি মামলা হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস)। সে অনুসারে, পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় চার হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত এবং এক হাজার ৫৪৯ জন গ্রেপ্তার হন। এ সময় মাসে গড়ে মামলা করা প্রায় ২৪টি এবং গ্রেপ্তার করা হয় গড়ে ২৬ জনকে। মামলায় অভিযুক্তের মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

সাংবাদিকরা অভিযুক্ত হয়েছেন সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য, যাদের মধ্যে ঢাকার বাইরের সাংবাদিকেরাই বেশি। ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার দায়ে এ আইনে মামলা হয়েছে ৯০৮টি, আর ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে মামলা হয় ১৯০টি, যার বেশির ভাগ মামলা করেন তার সমর্থকরা। এরপর বেশি মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় শিশুরাও বাদ যায়নি। এ সময় মামলায় ২৮ শিশুকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা ও গ্রেপ্তার ছাড়াও সংবাদ প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় ছিল দলীয় ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ।

এ ছাড়া নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে সরকার বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া থেকে শুরু করে ফেসবুক, গুগল, টিকটকের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি করপোরেশনগুলোর কাছে বিভিন্ন ইউজার অ্যাকাউন্ট ও পেইজ বন্ধ করা, কনটেন্ট মুছে ফেলার অনুরোধ পাঠিয়েছে।

গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাঃ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ও ভিন্নমত দমনের জন্য গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। গত দেড় দশকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাসা, অফিস কিংবা রাস্তা থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে পরবর্তীতে অস্বীকার করা হয়। তাদের অনেকে ফিরে আসেন, কারো লাশ পাওয়া যায়, আবার অনেকে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। স্বজনরা দিনের পর দিন বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তাদের কোনো খোঁজ পাননি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হন। তাদের মধ্যে ৮৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন বা পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৩৮৩ জনকে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি আর তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।

গুমের ঘটনায় কুখ্যাত গোপন বন্দীশালা 'আয়না ঘর' নামে পরিচিতি পায়, যা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেকটরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) নিয়ন্ত্রণাধীন। হাসিনা সরকার গুমের শিকার ব্যক্তিরা নিজেরা পালিয়ে আছেন বলে স্বজনদের সঙ্গে পরিহাস করলেও দেখা যায়, সরকার পতনের দুইদিনের মধ্যে গুমের শিকার অন্তত তিনজন 'আয়না ঘর' থেকে ফিরে আসেন।

সন্ত্রাস, জঙ্গি, মাদক দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা ছিল নিয়মিত ঘটনা। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যেত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী, জঙ্গি বা মাদক চোরাকারবারি নিহতের খবর। ঘটনাগুলোর বর্ণনা থাকত প্রায় হুবহু এক—কথিত সন্ত্রাসীকে নিয়ে অস্ত্র বা মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার মুখে ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার কথা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার ও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৬১৭।

ব্যাংক কেলেঙ্কারিঃ

শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন ছিল নিয়মিত ঘটনা। মেগাসিরিয়ালের বিভিন্ন পর্বের মতো গত দেড় দশকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ফারমার্স ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে। যে প্রক্রিয়ায় এই কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে—প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া; সরাসরি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ লুণ্ঠন; ব্যাংক মালিক হয়ে লুটপাট অর্থাৎ স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংক উদ্যোক্তা হয়ে জনগণের হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন; নিয়ম ভঙ্গ করে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের পরস্পরকে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঋণ প্রদান; ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংক মালিক এবং পরবর্তীতে আরও লুটপাট; রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মদদে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্যাংক দখল; রাজনৈতিক মদদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংক ঋণ ও লুটপাট, ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন: অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুণ্ঠনের হোতাদের বিচার না করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা, উদারভাবে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি, প্রতিবছর জনগণের করের অর্থ লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে ঢালা ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। হাসিনা সরকারের মদদে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণের নামে লুণ্ঠনের কারণে ১৫ বছরের শাসনকালে খেলাপি ঋণ আট গুণ বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অবশ্য এরসঙ্গে বারবার পুনঃতফসিল করা দুই লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকখাতে মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশের বেশি।

শেয়ারবাজার কারসাজিঃ

গত ১৫ বছরে কারসাজি ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অন্তত এক লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। সে সময় লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এই ঘটনার পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শেয়ারবাজার জালিয়াতির পেছনে ৬০ জনকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মতো সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজার কারসাজি করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি, প্লেসমেন্ট বাণিজ্য, আইপিও প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অমনিবাস হিসাবের আড়ালে সন্দেহজনক লেনদেন ইত্যাদি। প্রতিবেদনে অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। ফলে, পরবর্তীতেও শেয়ারবাজারে কারসাজি চলতে থাকে।

জ্বালানিখাতে লুণ্ঠনঃ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানের নামে হাসিনা সরকার দেশি-বিদেশি বেসরকারি মালিকানাভিত্তিক ও বিদেশি ঋণনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও আমদানি নির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন কোনো জবাবদিহি করতে না হয়, সেজন্য রীতিমতো আইন করে আদালতে বিচার চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত রহিত করা হয়।

বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে বেসরকারি মালিকানায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয় এবং দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি ও কয়লা আমদানির ব্যবস্থা করা হয়।

২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার পরিমাণ প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটানোর কথা বলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৪ বার। সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন, মাতারবাড়ি প্রকল্পের জন্য জাপানের কাছ থেকে চার দশমিক চার বিলিয়ন, কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক দশমিক ৯৮ বিলিয়ন এবং রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নেয়।

এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও জ্বালানি আমদানি বাবদ বাড়তি খরচ দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। সামনে কয়লা ও এলএনজি আমদানি আরও বাড়বে, সেইসঙ্গে ২০২৭ সাল থেকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় এভাবে বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান হয়নি, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীদেরকেও। গ্যাস সংকটের পাশাপাশি লাগামছাড়া লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নামার ঘটনা ঘটেছে।

দুর্নীতি ও অর্থপাচারঃ

দীর্ঘ স্বৈরশাসনে এমন এক স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও মাস্তানদের সমন্বয়ে এক মাফিয়া রাজত্বের কায়েম হয়। এই মাফিয়ারা ক্ষমতাসীন পরিবারের আশীর্বাদে রীতিমতো দায়মুক্তি নিয়ে দখল, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও অর্থপাচারে লিপ্ত হয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতার মধ্যেও সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশিত হয় তার মধ্যে কয়েকটি হলো—উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগে জমি কিনে জমির দাম বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি, অবৈধ বালু উত্তোলনে পৃষ্ঠপোষকতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটায় বিপুল দুর্নীতি, ভুয়া দলিলের মাধ্যমে খাসজমি দখল, নিয়োগ দুর্নীতি ইত্যাদি।

সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক চোরাকারবার, মানবপাচার, অর্থপাচার করে বিদেশে জমি-বাড়ি কেনার খবর পাওয়া যায়। সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া মুনাফা করেছে, ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন করেছে এবং হুন্ডি ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে। সরকারের আমলারা দুর্নীতি করে শত শত কোটি অবৈধ অর্থ অর্জন করেছে। সরকারি দলের মাস্তান ও পুলিশ রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি করেছে। খোদ পুলিশ ও র্যারব প্রধান বেনজীর দুর্নীতির অবৈধ অর্থে শত শত একর জমি কিনে ও দখল করে রিসোর্ট, বাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ নিজের ভাইদের পাসপোর্ট জালিয়াতি ও সামরিক কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে 'সিন্ডিকেট' তৈরির মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সমস্ত ঠিকাদারি কাজের অর্ধেক মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিয়েছেন।

এভাবে বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতিলব্ধ আয়, ব্যাংক থেকে লোপাট করা ঋণের অর্থ ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে, যে অর্থ ব্যবহার করে আমলা, রাজনীতিবিদ, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল সম্পত্তি কিনেছে। দুর্নীতির মাত্রা ও পাচারের প্রকৃত অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন থেকে। সংস্থাটির ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়।

বিদেশি ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্পঃ

২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়, তার ৭৬ শতাংশই নেওয়া হয় হাসিনা সরকারের আমলে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ যে পরিমাণে বৃদ্ধি পায় সেই তুলনায় রপ্তানি আয় ও রিজার্ভ বাড়েনি। কারণ এই বিদেশি ঋণ নিয়ে এমন সব ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে না। তাছাড়া ঋণ নিয়ে করা প্রকল্পের ব্যয় যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলেও সেই প্রকল্প আর অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক থাকে না।

যেসব মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে সরকার উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে, সেগুলো বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ব্যয়বহুল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন: প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের খরচ প্রতিবেশী ভারত ও চীন তো বটেই, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপের তুলনায়ও বেশি পড়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বাস র্যাইপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পও বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল তকমা পেয়েছে। ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়ও সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত অন্যান্য দেশের ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি পড়েছে। বাংলাদেশের কয়লা, গ্যাস ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণ ব্যয়ও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই ধরণের অস্বাভাবিক ব্যয়ের পেছনে দায়ী হলো অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্প পরিকল্পনার সমস্যা। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে এসব ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ করে সরকারঘনিষ্ঠ দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী লাভবান হলেও দেশের ঋণের বোঝা বেড়েছে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। যার খেসারত হিসেবে টাকার অবমূল্যায়ন ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠে যায়।

বৈষম্য বৃদ্ধিঃ

হাসিনা শাসনামলে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক হারে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকটে তুলনামূলক কম দামে চাল-ডাল-তেল-চিনি কেনার জন্য টিসিবি আর ওএমএসের লাইন দীর্ঘ হয়েছে, ব্রয়লার মুরগির উচ্চমূল্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের মুরগির গিলা-কলিজা কেনা বেড়েছে, অন্যদিকে দেশে বিলাসবহুল গাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে।

যখন দেশের বেশিরভাগ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমসিম খেয়েছেন, অনেকেই খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, তখনও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য চার শতাংশ পুঞ্জিভূত। অন্যদিকে সবচেয়ে গরীব পাঁচ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ।

খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশের আয়ে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরীব পাঁচ শতাংশের ভাগ ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৬১ এবং শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত একযুগে দেশের মোট আয়ে পাঁচ শতাংশ ধনীর ভাগ যখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে, সবচেয়ে দরিদ্র পাঁচ শতাংশের ভাগ তখন আগের চেয়ে কমে অর্ধেক হয়েছে। এ কারণেই আয় বৈষম্যবিষয়ক গিনি সহগ ২০১০ সালের দশমিক ৪৫৮ থেকে ২০২২ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯, যা উচ্চ আয়বৈষম্যকেই নির্দেশ করে।

দেশের সম্পদ যে কতিপয় বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে তা ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য থেকেও বোঝা যায়। দেশে ৫০ কোটি ডলার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে। হাসিনা সরকার এই বৈষম্য বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের 'স্বাভাবিক' প্রক্রিয়া হিসেবে প্রচার করলেও ওই সরকারের আমলে বিকশিত নির্দিষ্ট ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণেই তা ঘটেছে। দেশের মালিক গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদেরকে অতি নিম্ন মজুরি দিয়ে এবং কর্মস্থলের নিরাপত্তার পেছনে যথেষ্ট ব্যয় না করেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে গেছেন। সেইসঙ্গে ছিল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির নামে লুটপাট ও অর্থপাচারের বিপুল সুযোগ।

সরকার ধনীদের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই বেশি কর আহরণ করেছে। যার ফলে সরকারের কর-রাজস্ব আয়ের ৬৫ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে এসেছে, আর ৩৫ শতাংশ এসেছে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর বাবদ। এভাবে বৈষম্যমূলক কর-ব্যবস্থা, অতিনিম্ন মজুরি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির অবাধ সুযোগের কারণেই হাসিনা শাসন আমলে এক দেশে দুই অর্থনীতির সৃষ্টি হয়েছিল।

বিচারহীনতাঃ

যেসব ক্ষেত্রে বিচার করলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সুবিধা হয়, সেসব মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন হলেও যেসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বা দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি-গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব ক্ষেত্রে ঘটনার তদন্ত ও বিচার দিনের পর দিন ঝুলে ছিল। সামান্য কটূক্তি বা মানহানির মামলার অনেকের দ্রুত সাজা হয়ে গেলেও আগুন পুড়ে বা ভবন ধসে শ্রমিক হত্যার জন্য কোনো কারখানা মালিকেরই সাজা হওয়ার নজির নেই। এমনকি রানা প্লাজা ভবন ধস বা তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডের মতো দুনিয়া তোলপাড় করা ঘটনারও বিচার হয়নি।

অথচ ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য রাতের বেলাতেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিচার হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি বা ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠনের অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারির। বিচার হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কিংবা নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের।

বিগত ১৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ২১৮৫ বিচারকের ১৮৪১ জনই আ.লীগ আমলের। এভাবে হাসিনা সরকার আদালতগুলোতে তাদের দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগকে একপক্ষীয় করে নিয়েছিলো। যার ফলে সাধারণ জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত ছিলো।

কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্বঃ

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্ভর এমন এক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে, যেখানে কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু তাতে দেশে তরুণদের যথেষ্ট ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান হয়নি। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ (১ম কোয়ার্টার, জানুয়ারি-মার্চ) অনুসারে, বেকারের হার মোট শ্রমশক্তির ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বা  ২৫ লাখ ৯০ হাজার দেখানো হলেও, বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ বেকারত্বের এই হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেকারত্বের সংজ্ঞা হিসেবে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এমন মানুষদেরকে ধরা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মজুরি বিবেচনায় সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা কাজ জীবিকা নির্বাহের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়।

দেশে বেকারত্বের পরিমাণ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস জরিপ থেকে। ২০২৩ সালের জরিপ অনুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা এক কোটি ২৮ লাখ পড়ালেখা বা কাজ কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত নন, যা দেশে তরুণদের বেকারত্বের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। বেকার তরুণদের ভেতর আবার উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুসারে, কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার এক শতাংশ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১২ শতাংশ। আবার স্বল্প শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান হলেও সেটা মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতে অতিনিম্নমজুরির হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পথে অভিবাসী হওয়ার হার বেড়ে চলেছে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) 'মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ টু ইতালি ভায়া লিবিয়া' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ পথে নৌকায় করে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালে এই পথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশির হার ছিল পাঁচ শতাংশ, ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ এবং ২০২২ সাল শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালে এভাবে ইতালিতে প্রবেশ করেছেন ১৫ হাজার ২২৮ বাংলাদেশি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল সাত হাজার ৮৩৮। বর্তমানে ইতালিমুখী বোট পিপলের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।

তীব্র শ্রমশোষণঃ

দেশের অর্থনীতির বিকাশ এমন পথে ঘটেছে যে দেশের বেশির ভাগ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের শ্রমজীবী মানুষের ৮৪ দশমিক নয় শতাংশই কাজ করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেখানে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, কর্মপরিবেশ, ইউনিয়ন করার অধিকারসহ কোনো ধরনের শ্রম অধিকারেরই নিশ্চয়তা থাকে না। এসব খাতের শ্রমিকদের 'কাজ নাই, মজুরি নাই' ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। এদের কোনো নির্দিষ্ট  কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম, সবেতন ছুটি, বিমা, পেনশন, গ্র্যাচুইটির অধিকার থাকে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও কারখানা মালিকেরা শ্রমিকদের যে মজুরি দেন, তা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়নি। যে ৪২টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে, সেটাও জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় খুবই কম।

দেশের বৃহত্তম রপ্তানিখাত গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ২০২৩ সালে যে ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়, তা শ্রমিকদের দাবির অর্ধেক এবং পরিবারসহ দারিদ্রসীমার উপরে বসবাসের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশও ভয়ংকর অনিরাপদ, যার ফলে নিয়মিত অকালমৃত্যু ঘটছে। পরিবহন, নির্মাণ, শিল্প, কৃষি, দিনমজুর, ইস্পাত, জাহাজ-ভাঙা, পাথর-ভাঙা ইত্যাদি কোনো খাতেই শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই। দেশে কোন কোন খাতে, কী কারণে, শ্রমিকেরা নিয়মিত হতাহত হচ্ছেন, পঙ্গুত্ববরণ করছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও সরকার রাখার প্রয়োজন মনে করে না। নেই যথাযথ চিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কার্যকর প্রতিরোধের আয়োজন।

বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে কমপক্ষে নয় হাজার ২৬৩ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কর্মস্থলে সরাসরি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের কারণে প্রতিবছর ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেন বহু শ্রমিক, যার কোনো হিসাব কারও কাছেই নেই। দেশের বিভিন্ন ইটভাটা, চাতাল, করাত কল, ইস্পাত কারখানা, জাহাজ-ভাঙা শিল্প, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা, চামড়া, পাথর-ভাঙা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক কর্মপরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করার ফলে ঠিক কত শ্রমিক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, কত শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ধুঁকছেন, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না।

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিঃ

হাসিনা সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও দেখা গেছে, সারা বিশ্বে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যখন কমেছে তখনও বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মূল্য কমেনি, বরং বেড়েছে। ফলে এই মূল্যস্ফীতির পেছনে যে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এভাবে যে কাঠোমগত সমস্যাগুলো উন্মোচিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. বাজারে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য

২. দেশে খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতি এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিষয়ক বিভ্রান্তি

৩. নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা

বিদেশ থেকে কাঁচা চিনি আমদানি করে পরিশোধন করে দেশে বিক্রি করে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি—দেশবন্ধু, আবদুল মোনেম, এস আলম, মেঘনা, সিটি। এসব গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোই দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। দেশে ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশই আমদানি করে টিকে, মেঘনা, সিটি ও এস আলম—এই চার কোম্পানি। দেশে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি কোম্পানি, সেইসঙ্গে ডিম ও মাংসের বাজারেরও বড় একটি অংশ তাদের দখলে। বিগ ফোর নামে পরিচিত এই কোম্পানিগুলো হলো কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ এবং প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান–চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে আট থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছে।

এভাবে দেশের নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে এরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানান পরিস্থিতির অযুহাতে ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি ও উৎপাদনের পরিমাণ এবং এসবের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে। এদের কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটর ডাল—এই আটটি পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় এই সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করলেও সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

বানোয়াট পরিসংখ্যানঃ

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয়, কৃষির উৎপাদন ও ভোগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইত্যাদি বহু পরিসংখ্যানে জালিয়াতি করা হয়। যেমন: দেশে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দেখানো হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রশ্ন বহুদিনের। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবের সঙ্গে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি, শিল্পখাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি বেসরকারি বিনিয়োগের।

বন-নদী-পরিবেশের ক্ষতিঃ

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের উন্নয়ন মডেলের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পরিবেশ বিষয়ে তারা সংবেদনশীল ছিল না। প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থে দেড় দশকে অবাধে বন ও নদী দখল, পানি ও বায়ু দূষণ, গাছ ও পাহাড় কাটা, জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ। কলকারখানার বর্জ্য-দূষণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নদী দূষিত হয়েছে। ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদ দূষণে মৃতপ্রায়। শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে একদিকে বন ও জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে শিল্প বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি তরল বর্জ্য নদী ও জলাশয়ে নির্গত করবার কারণে পানি দূষিত হয়ে চারপাশের কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদন কমেছে, খাল-বিলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, স্থানীয় লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগে ভুগছেন অনেকে।

এভাবে মুষ্টিমেয় শিল্প মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার জোগান দিতে গিয়ে নদ-নদী, খাল-বিল দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জোরে অবৈধ বালু উত্তোলন করে শত শত কোটি টাকা লুণ্ঠন করছে সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের 'বাংলাদেশে বালু উত্তোলন মানচিত্র-২০২৩' শিরোনামে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুসারে, দেশের ৭৭টি নদীর ১৩২টি পয়েন্ট থেকে ২৬৫ ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৫৪ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ১৯২ জন প্রভাবশালী। নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হন।

ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানা ও ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্ট ধুলা নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে বায়ু দূষণে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম দূষিত রাজধানীর তালিকায় স্থান পেয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ অনুসারে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশে পরিণত হয়েছে। এই দূষিত বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ছয় দশমিক আট বছর। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে সরকার নিজেই বায়ু ও পানি দূষণকারী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, সেইসঙ্গে আইন করে দূষণের মানমাত্রা শিথিল করেছে। যেমন: বাংলাদেশে বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্গত বায়ুদূষণকারী উপাদানের সর্বোচ্চ মাত্রা বাংলাদেশে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী চীন কিংবা জাপানের সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতিঃ

প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও জালিয়াতির নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের বিনিময়ে হাসিনা সরকার বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতকে একতরফা নানান সুবিধা দিয়ে গেছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ট্রানজিট, সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতীয় সরকারি-বেসরকারি কোম্পানির প্রবেশাধিকার, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রয় ইত্যাদি। অথচ এ সময় ভারত বাংলাদেশকে আন্তসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাটুকুও দেয়নি, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করেনি, পাট পণ্য রপ্তানির ওপর এন্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে এবং নির্বিচারে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল এই ১৪ বছরে ৫৯৪ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। হাসিনা সরকারের দিক থেকে এসব সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ তো দূরের কথা, কড়া প্রতিবাদ জানানোরও কোনো নজির নেই। ভারতকে যে বাংলাদেশ এক তরফাভাবে নানান সুবিধা দিয়ে গেছে তা শেখ হাসিনা নিজেও স্বীকার করেছেন। ২০১৮ সালের মে মাসে ভারত সফর শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'ভারতকে যা দিয়েছি, তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে।' 'দিল্লির পাশে থাকছে ঢাকা, মোদির কাছে "প্রতিদান" চান হাসিনা' শিরোনামে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সংবাদের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'আমি কোনো প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে?' শেখ হাসিনা তার পুরো শাসনামলে ভারতকে এক তরফা সুবিধা দিয়ে যাওয়া ও প্রতিদান না চাওয়ার নীতিতে অটল ছিলেন।

এসব কারণে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বারুদের বিশাল স্তূপের মতো জমা হচ্ছিল। জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে শত শত তরুণকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করলে ঘটনা বারুদের এই স্তূপে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে। যা শেষ পর্যন্ত হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে।

শেখ হাসিনা ও তার দলের উপর আল্লাহ তায়ালার ক্ষুব্ধতা ও ৩৬ জুলাই এর উৎপত্তি

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার নেতা কর্মীরা শত শত অপরাধের সাথে জড়িত যা প্রমানিত। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে শত শত মামলা দায়ের হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে। এসব মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলমান অবস্থায় আছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা নিজেকে অনেক শক্তিশালী নেতা মনে করতেন। তাদের ভিশন ছিলো ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ২.২৫ টায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলকে সমূলে মূলোৎপাটন করেন এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা কোনো মতে তার প্রাণ নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সেই দিন ছাত্র জনতার হাতে তুলে দিয়ে ২০৬ খানা হাড় আলাদা করাতে পারতেন কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা এমন সব অপরাধের সাথে জড়িত যা ক্ষমার অযোগ্য। সেইসব অপরাধের শাস্তি দুনিয়ায় ভোগ করার জন্যই মূলত আল্লাহ তায়ালা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আসুন আমরা জেনে নেই, কোন্ কোন্ অপরাধের কারনে  আল্লাহ তায়ালা ফ্যাসিস্ট হাসিনার উপর ক্ষুব্ধ হলেন আর কেনইবা ৩৬ জুলাই এলো।

ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগ

(ইসলামি দল গঠন না করা)

আওয়ামীলীগ গঠনের সময় ৯৯% নেতাই মুসলিম ছিলেন। মুসলিম হিসেবে তাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো একটি ইসলামি দল গঠন করা এবং কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা। এব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আমি তাদেরকে পৃথিবীতে (রাজ) ক্ষমতা দান করলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর আয়ত্তে”। (সুরা আল হাজ্জ ৪১)।

আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন,

“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। এরূপ লোকই সফলতা লাভকারী”। (সুরা আলে ইমরান ১০৪)।

তিনি আরো বলেন, “তোমরাই উত্তম জাতি। বিশ্ব মানবের জন্য তোমাদের উত্থান। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে”। (সুরা আলে ইমরান ১১০)।

কথা ছিলো আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা দান করলে তারা রাষ্ট্রে নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে তথা রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করে গরিবদের মাঝে সমবন্টন করবে এবং সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করবে তথা সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাত, অশ্লীলতা/বেহায়াপনা, যিনা/ব্যভিচার, ধর্ষণ, বেপর্দাসহ সকল অনৈসলামিক কাজ নিষেধ করবে কিন্তু আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তা না করে উল্টো “আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকে মুসলিম শব্দটিই বাদ দিয়ে দেয় এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ ধারণ করে। আরো একটু বিস্তারিত জেনে নেই।

শেখ মুজিব ইসলাম ও মুসলিম শব্দটি মোটেই পছন্দ করতেন না। যে কারণে তিনি নিজ দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন। এমন কি দেশ স্বাধীনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম এবং মুসলিম শব্দটি বাদ দেন।

[১] প্রতিষ্ঠাকালীন সময় নিজ দলের নাম ছিল ''আওয়ামী মুসলিম লীগ'' পাকিস্তান আমলেই মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ''আওয়ামী লীগ'' করা হয়।

[২] ছাত্রলীগের পূর্ব নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর 'মুসলিম' শব্দ বাদ দিয়ে শুধু 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ' করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নাম রাখা হয় !

[৩] পাকিস্তান আমলে কুরআন তেলোয়াত করে আঃ লীগের মিটিং শুরু করা হতো আর খোদা হাফেজ বলে মিটিং শেষ করা হতো। দেশ স্বধীনের পর তারা দলীয় সংগীত গেয়ে মিটিং শুরু করেন আর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে মিটিং শেষ করেন !

[৪] ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর বঙ্গবন্ধু রেডিও, টেলিভশন ও জনসমাবেশের শুরুতে কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দেন। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর খোন্দকার মোস্তাক আহমদ তা পূণরায় চালু করেন !

[৫] স্বাধীনের পর মুসলমানের দূরভাগ্যের কারণে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' শিরকী গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হয়। এই গানটি  একটি শিরিকী গান। এতে করে প্রতিনিয়ত স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের ঈমান নষ্ট হচ্ছে !

[৬] ধর্মনিরেপেক্ষতার অজুহাত তুলে দেশের প্রথম সংবিধান অর্থাৎ ১৯৭২ এর সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম বাদ দেওয়া হয়।

[৭] ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের মনোগ্রাম থেকে ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ অর্থ ''পড় সে প্রভুর নামে যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন।'' কুরআনের আয়াতটি মুছে দেওয়া হয় !

[৮] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে “রাব্বি জিদনী ঈলমা” অর্থ “হে রব্ আমাকে জ্ঞান দাও”। ধর্মনিরপেক্ষের অযুহাত দিয়ে কুরআনের এই আয়াতটি মুছে দেওয়া হয় !

[৯] চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে “ইকরা বিস্মী রাব্বিকাল্লাজি খালাক” অর্থ ''পড় সে প্রভুর নামে যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন।'' কুরআনের এই আয়াতটি মুছে দেওয়া হয় !

[১০] ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ভারতের নাস্তিক কুদরাত- এ-খুদার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী শিক্ষা বাদ দেওয়া হয় !

[১১] ৭৩ সালে ভারতের 'র' এর প্রশিক্ষনের মাধ্যমে ৫০ হাজার মুসলিম বিদ্ধেষী মুজিব বাহিনী গঠন করে স্বৈরাচারী কায়দায় ও হাজার হাজার আলেম ওলামা মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

[১২] দেশ স্বাধীনের পর ইসলাম বিরোধী নাটক সিনেমা করে রাজাকারের মূখে দাড়ি ও মাথায় টুপি লাগিয়ে ইসলামের ক্ষতি করা হয় ! অথচ যুদ্ধ চলাকালীন সময় কোনো রাজাকারের মাথায় টুপি ও মূখে দাড়ি ছিল না।

[১৩] সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি মুছে দিয়ে, সলিমুল্লাহ হল নাম করণ করা হয় !

অপরাধ মুসলিম ও ইসলাম, অথচ ভারতের মতো কট্টর হিন্দুয়ানী দেশে দুইশত বছর ধরে পুরানো বিদ্যাপীট আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালেয় নামের সাথে মুসলিম শব্দটি আজও টিকে আছে।

[১৪] ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে, ফজলুল হক হল নাম করণ করা হয় !

[১৫] জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। অথচ এর পাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়নি !

[১৬] নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ‘ইসলাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে, নজরুল কলেজ নাম করণ করা হয়।

[১৭] সমস্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, অফিস আদালত ভারতের সাথে মিলিয়ে শুক্রবারের পরিবর্তে রবিবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যাতে মুসলমানের জুমার নামজের বিঘ্ন ঘটানো যায় !

[১৮] ঢাকার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রোডের নাম পরিবর্তন করে, তার স্থলে ইন্দিরা গান্ধী রোড কারা হয়।

[১৯] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে সূর্য সেন হল নামকরণ করা হয়।

[২০] মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় "পূর্ব পাকিস্তান ইসলামিক একাডেমী" থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা আঃ লীগের বিরুদ্ধে প্রচরণা চালিয়েছিল বলে দোষারোপ করার পর শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামিক একাডেমী বন্ধ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের কারণে ঐ সময় সৌদি আরব-সহ সকল মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে।

আওয়ামীলীগের সংবিধান প্রনয়ন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠনকাঠামো নির্ধারণকারী সর্বোচ্চ আইন। ১৯৭২ সালে গঠিত কার্যত আওয়ামী লীগের "এক দলীয়" ও 'বিতর্কিত' সংবিধান সভা এই গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে এবং তা একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। মুজিববাদের চার নীতি, যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন। এরপর ১৯৭২ এর ২৩ মার্চ পরবর্তী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে তা কার্যকর হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহুত গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ১১ এপ্রিল ১৯৭২ ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং মহিলা সদস্য রাজিয়া বানুসহ বাকি সবাই আওয়ামীরীগের। এ কমিটি ১১ অক্টোবর ১৯৭২ গণপরিষদের সংবিধান বিল উত্থাপন করে তা ৪ নভেম্বর গনপরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর থেকে এ সংবিধান কার্যকর হয়।

এই ৩৪ সদস্যের মধ্যে ৩২ জনই ছিলেন মুসলমান আর ০২ জন ছিলেন হিন্দু। ৩৪ সদস্যের ২৪ জনই ছিলেন আইনজীবি, চারজন অধ্যাপক, একজন ডাক্তার আর একজন ছিলেন সাংবাদিক।

প্রথমত সংবিধানটি হাতে লেখা হয়। এর মূল লিপিকার ছিলেন এ কে এম আব্দুর রউফ। অঙ্গসজ্জায় ছিলেন শিল্পী হাশেম খান এবং অঙ্কনের কাজ করেছেন শিল্পী জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। চামড়ায় বাঁধানোর কাজটি করেন সৈয়দ শাহ শফি। এই কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। গণপরিষদ কর্তৃক গৃহিত হওয়ার পর সংবিধানটি বাংলা ও ইংরেজিতে ছাপানো হয়।

আওয়ামীলীগের কুরআন বিরোধী সংবিধান প্রনয়ন

আমরা সংবিধান প্রনয়নের উপর্যুক্ত তথ্যানুযায়ী জানতে পারলাম, ৩৪ সদস্যের ৩২ জনই ছিলেন মুসলমান। মুসলিম হিসেবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নেয়া। এপ্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(ক) আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি পূর্ণ কোরআন শরীফ পরম সত্যতার সাথে এ জন্যেই নাযিল করেছি যে, তুমি সে অনুযায়ী মানুষের উপর আল্লাহর প্রদর্শিত পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং বিচার ফায়সালা করবে।(কোরআনকে যারা এ কাজে ব্যবহার করতে চায় নি তারা এ মহান আমানতের খিয়ানত করে) তুমি এ খিয়ানতকারীদের সাহায্য পক্ষ সমর্থনকারী হয়ো না। (সুরা আন নিসা: ১০৫)।

(খ)  আল্লাহ বলেন, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো, তাদের মনের খেয়াল খুশী ও ধারনা বাসনা অনুসরন করো না। (সুরা আল মায়েদা: ৪৯)।

(গ)  আল্লাহ বলেন, তুমি কি জান না যে, আকাশ ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহর। (সুরা আল বাকারাঃ ১০৭)।

(ঘ)  “হুকুম বা বিধান একমাত্র আল্লাহরই”। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪০)।

তিনি আরও বলেন,

(ঙ) “তারা কি তবে জাহেলিয়াতের বিধান চায়? দৃঢ়-বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা আর কে হতে পারে?” (সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫০)।

(চ) “আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি সহকারে পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব (বিধি-বিধান) ও মানদণ্ড পাঠিয়েছি যাতে লোকেরা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর আমি লৌহ অবতীর্ণ করেছি যাতে প্রচণ্ড শক্তি ও মানবমণ্ডলীর জন্য বিবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর এর উদ্দেশ্য হচ্ছে,আল্লাহ্ জেনে নেবেন,কে গায়েবকে আশ্রয় করে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহাশক্তিধর ও মহা পরাক্রান্ত।” (সূরা হাদীদ : ২৫)।

মানব রচিত আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করা বা কোনো অপরাধের শাস্তির রায় দেয়া মুসলিম বিচারকদের জন্যে সম্পূর্ন নিষেধ। যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত আইনে বিচারের রায় দেয় তারা মুসলমান হয়েও কাফের, জালেম ও ফাসেক। এরা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আল্লাহ বলেন,

(ক) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফয়সালা ও শাসনকার্য পরিচালনা করেনি,তারা কাফের।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৪)।

(খ)  “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা জালেম।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৫)।

(গ)  “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা ফাসেক (পাপাচারী)।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৭)।

(ঘ) “(হে নবী!) অতএব,আল্লাহ্ তায়ালা যা নাযিল করেছেন,তার ভিত্তিতে আপনি তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করুন এবং আপনার নিকট যে সত্যের আগমন ঘটেছে,তার পরিবর্তে তাদের প্রবৃত্তির (দাবীর) অনুসরণ করবেন না।” (সূরা মায়েদাহ্: ৪৮)।

(ঙ) “তারা কি জাহেলীয়াতের (মূর্খতাজাত) বিচার-ফয়সালা পেতে চায়? প্রত্যয়ের অধিকারী লোকদের জন্য বিচার-ফয়সালা প্রদানের প্রশ্নে আল্লাহর চেয়ে কে অধিকতর উত্তম হতে পারে?” (সূরা মায়েদাহ্ : ৫০)।

(চ) “হে রাসূল! তাদের বলে দিন:) আর তোমরা এ বিষয়ে (আল্লাহর অভিভাবকত্ব সম্বন্ধে) যে মতভেদই করো না কেনো, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছেই সোপর্দ। তিনিই আল্লাহ্-আমার প্রতিপালক; আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তাঁরই অভিমুখী হই।” (সূরা শুরা : ১০)।

(ছ) “হে ঈমানদারগণ! ন্যায়কে আশ্রয় করে আল্লাহর জন্য সাক্ষী হিসাবে দণ্ডায়মান হয়ে যাও এমনকি যদি তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা ও ঘনিষ্ঠ জনদের বিরুদ্ধেও হয়; সে ব্যক্তি ধনীই হোক বা গরীব হোক তাদের উভয়ের (বিরোধে লিপ্ত পক্ষদ্বয়ের) জন্য আল্লাহ্ই অধিকতর ঘনিষ্ঠ। অতএব,ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখার ব্যাপারে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তোমরা যদি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও,তা হলে (জেনে রাখ) তোমরা যা কিছু করছ অবশ্যই আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অবহিত।” (সূরা নিসা : ১৩৫)।

(জ) “(হে নবী!) অবশ্যই আমি সত্য সহকারে আপনার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যাতে আল্লাহ্ আপনাকে যা প্রদর্শন করেছেন তার সাহায্যে লোকদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করেন। আর আপনি খেয়ানতকারীদের (অন্যায়কারীদের) সপক্ষে বিতর্ককারী হবেন না।” (সূরা নিসা : ১০৫)।

(ঞ) “হে দাউদ! নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে ধরণির বুকে (আমার) প্রতিনিধি বানিয়েছি, অতএব, সত্যতা সহকারে লোকদের মাঝে বিচার-ফয়সালা কর।” (সূরা সাদ : ২৬)।

আওয়ামীলীগের ইসলামি শরিয়াহ আইন না মানা

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর এদেশের সহজ সরল মুসলমানদেরকে বোকা বানাতে মাঝে মধ্যে তিনি বলতেন “মদিনা সনদ” অনুযায়ী এই দেশ পরিচালিত হবে। আবার কখনো বলতেন, তারা “কুরআন ও সুন্নাহ” বিরোধী আইন পাশ করবে না। এসব হচ্ছে প্রজাদের সাথে প্রতারণা করা। মূলত আওয়ামীলীগ একটি অনৈসলামিক বামপন্থী রাজনৈতিক দল। তারা কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে না নিয়ে নিজেদের মনগড়ামূলক একটি মানবরচিত সংবিধান প্রনয়ন করেছেন। তাহলে তারা কেমনে মদিনা সনদের কথা বলে। তাদের গঠনতন্ত্রেই তো ইসলাম নেই। যেসব রাজনৈতিক দল বা দলের নেতৃবৃন্দ ইসলামি শরিয়াহ আইন মানে না বা ইসলামি শরিয়াহ আইন মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করার পরিকল্পনা নেই তারা কাফির।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলিম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও অথচ তাদের প্রতি শুধু এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মা‘বূদের ইবাদাত করবে, যিনি ব্যতীত মা‘বূদ হওয়ার যোগ্য কেউ নয়। তিনি তাদের অংশী স্থাপন করা হতে পবিত্র।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩১)।

এখানে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী-নাসারাদের ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসেবে নাম করণ করেছেন। কারণ, তারাও আল্লাহর বিধানের মত বিধান রচনা করত। তাদের রচিত বিধানের অনুসারীদেরকে গোলাম বা বান্দা হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে ঐ সব পাদ্রি ও আলিমদের কাছে নতি স্বীকার করত এবং তাদের অনুসরণ করত। আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তারা তো তাদের ইবাদাত করে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে। আর সাধারণ লোকেরা তাদের অনুসরণ করে থাকে। এটার নামই ইবাদাত। (তিরমিযী, অধ্যায়: তাফসীরুল কুরআন)।

আল্লাহ বলেন,

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফির।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৪)।

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৫)।

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসিক।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৭)।

যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনিটি আয়াতে পরপর কাফির, যালেম এবং ফাসিক বলেছেন।

যে কোনো রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব (১) নাগরিকদের বৈষম্যহীন অধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা (২) বহির্শত্রুর আগ্রাসন থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলামেও এ দুটি বিষয়কে রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বগুলির অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে ‘‘জিহাদ’’-এর বিধান প্রদান করা হয়েছে। আর প্রথম দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে আইন ও বিচারব্যবস্থা বিষয়ক নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে।

ইসলামী আইন ও আইন প্রয়োগের দুটি দিক রয়েছে: (১) আইন ও (২) বিচারব্যবস্থা। ইসলামী আইন বিষয়ে অনেক অপপ্রচার থাকলেও যে কোনো মতের ও ধর্মের গবেষক ইসলামী বিচারব্যবস্থার শ্রেষ্ঠতের বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। বিচারকের নিরপেক্ষতা, বিচারের সচ্ছতা, সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষ্য-প্রমাণের সঠিকত্ব প্রমাণ, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, সন্দেহের সুযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকললের জন্য ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম অত্যন্ত কার্যকর, মানবিক ও সচ্ছ বিচারব্যবস্থা প্রদান করেছে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিচারব্যবস্থার অনেক বিষয় ইসলামী বিচারব্যবস্থা থেকে গৃহীত।

ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সাম্পদিক, অধিকার বিষয়ক ও অন্যান্য সকল দেওয়ানী (civil) আইনের বিষয়েও অবিকল একই কথা বলতে হবে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি দেওয়ানী, সামাজিক, পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে ইসলামী আইন গৃহীত, প্রচলিত বা স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের দেশের ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বিচারব্যবস্থা ও দেওয়ানী আইন সবই মূলত ইসলামী।

এগুলির পাশাপাশি ইসলামে ‘‘অপরাধ আইন’’ রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের অপরাধ-আইনের উদ্দেশ্য অপরাধীর শাস্তি ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। ইসলামের অপরাধ আইনেরও একই উদ্দেশ্য। পার্থক্য শাস্তির প্রকৃতিতে। ইসলামে অল্প কয়েকটি অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট সকল অপরাধের ক্ষেত্রে যুগ, জাতি ও সমাজের প্রেক্ষাপটে শাসক, পার্লামেন্ট, সরকার বা বিচারক শাস্তির প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারেন।

ইসলামে নির্ধারিত শাস্তিগুলি নিম্নরূপ: (১) ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (২) ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানির শাস্তি অনুরূপ অঙ্গহানি। (৩) চুরির শাস্তি কব্জি থেকে হাত কেটে দেওয়া। (৪) ব্যভিচারের শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত ও বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (৫) কারো বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ করে তা ৪ জন সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে না পারলে অভিযোগকারী ও সাক্ষীগণের শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত। (৫) জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (৬) মদপানের শাস্তি ৪০ বা ৮০ বেত্রাঘাত।

শায়খ ইবনে বায (রহ.)   বলেন যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে মানুষের বানানো আইন আল্লাহর শরিয়াহ থেকে উত্তম অথবা শরিয়াহ বাতিলযোগ্য অথবা শরিয়াহর কিছু অংশ অগ্রহনযোগ্য-সে কাফির।

অতএব আওয়ামীলীগসহ অন্যান্য যতো ডানপন্থী বামপন্থী রাজনৈতিক দল আছে আর সেই দলের নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা যদি “ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা” মূখী না হয় তাহলে তারা কাফিরের মধ্যে গণ্য হবে।

আওয়ামীলীগ প্রজাদের কল্যাণে তেমন কাজ করেনি

শাসকদের মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র ও জনসাধারণের কল্যাণমূলক কাজ করা। ভয়ভিতি প্রদর্শন করে প্রজাদের কোনঠাসা করে রাখা শাসকদের বড় অন্যায়। রাসুল সা. যখন কাউকে কোনো রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করতেন এবং যেসব উপদেশ দিতেন তা নিম্নরুপ,

(ক)  আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো কাজে কোনো সাহাবীকে পাঠাতেন তখন বলতেন, তোমরা জনগণকে আশার বাণী শুনাবে। হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে তাদের জন্য অবহেলা-ঘৃণা সৃষ্টি করবে না। তাদের সাথে সহজ-সরল বিধান নীতি ব্যবহার করবে, কঠোরতা অবলম্বন করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১২৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৪১৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩২, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩৫, আহমাদ ১৯৬৯৯, সহীহাহ্ ৯৯২, সহীহ আল জামি‘ ৪৬৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের সাথে উদার ব্যবহার করো, কঠোরতা পরিহার করো, তাদেরকে সান্ত্বনা দাও এবং ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়ো না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১২৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৪২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৪, আহমাদ ১২৩৩৩, সহীহাহ্ ১১৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ)  ইবনু আবূ বুরদাহ্ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (একদিন) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দাদা আবূ মূসা ও মু’আয (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠালেন এবং অতঃপর বললেনঃ তোমরা মানুষের জন্য সহজসাধ্য কাজ করবে, কঠিন ও কষ্টদায়ক কাজ চাপিয়ে দিও না। তাদেরকে সুসংবাদ দাও, হতাশা ও নৈরাশ্যজনক কথা তাদেরকে শুনাও না। পরস্পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করবে, মতানৈক্য করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১২৪, ৩০৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৩, আহমাদ ১৯৬৯৯, সহীহাহ্ ১১৫১, সহীহ আল জামি‘ ৮০৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রজাদের কল্যাণে কাজ না করলে তার শাস্তি

(ক) আমর ইবনু মুররাহ্(রহঃ) হতে বর্ণিত। একদিন তিনি মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-কে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের মধ্যে যে ব্যক্তিকে কোনো কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, আর সে তাদের প্রয়োজন, চাহিদা ও অভাব-অভিযোগের প্রতি পরোয়া করে না (গাফিল থাকে); আল্লাহ তা’আলাও তার প্রয়োজন, চাহিদা ও অভাব-অভিযোগ (মিটানো) থেকে আড়ালে থাকেন। অতঃপর মু’আবিয়াহ্ (রাঃ) মানুষের প্রয়োজন ও অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য একজন লোক নিয়োগ করেন।

তিরমিযী’র অপর এক বর্ণনা ও আহমাদ-এর বর্ণনাতে আছে, আল্লাহ তা’আলা ঐ শ্রেণীর লোকের চাহিদা, প্রয়োজন ও অভাব মোচনের ব্যাপারে আকাশমন্ডলীর সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৮, সুনান আততিরমিযী ১৩৩২, সুনান আবূ দাঊদ ২৯৪৮, আহমাদ ১৮১৯৬, সহীহ আত্ তারগীব ২২০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ শাম্মাখ আল আযদী (রহঃ) তার এক চাচাতো ভাই হতে বর্ণনা করেন। যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী ছিলেন। একদিন তিনি মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তিকে মানুষের কোনো কাজের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। অতঃপর সে মুসলিম, মাযলূম অথবা দুস্থ লোকেদের জন্য তার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখেন, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রয়োজন বন্ধ করে দেবেন যখন সে চরম অভাবে নিপতিত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৯, শু‘আবুল ঈমান ৬৯৯৯, আহমাদ ৩/৪৪১)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ) উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি যখনই কোনো দেশে প্রতিনিধি বা শাসক পাঠাতেন তখন তাদের ওপর শর্তারোপ করে দিতেন- তোমরা তুর্কি ঘোড়ায় আরোহণ করবে না, ময়দার রুটি খাবে না, পাতলা মিহিন কাপড় পরবে না, মানুষের প্রয়োজন মিটানো থেকে তোমার দরজা বন্ধ করবে না। যদি তোমরা এর মধ্য হতে কোনটি করো, তাহলে তোমরা শাস্তিযোগ্য অপরাধী হবে। অতঃপর কিছুদূর পর্যন্ত তিনি তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৩০, শু‘আবুল ঈমান ৭০০৯)।

আওয়ামীলীগ অন্যায় অত্যাচার বা নির্যাতনের সাথে জড়িত

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা জনসাধারণের উপর দুইভাবে নির্যাতন চালাত। (এক) আওয়ামী প্রশাসন তথা আওয়ামী পুলিশ, র্যা ব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোক দ্বারা, (দুই) আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী তথা সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি দ্বারা।

আওয়ামী প্রশাসনের লোক লোকজন ধরে নিয়ে রিমান্ডের নামে বা রিমান্ড ছাড়াই আবার আয়না ঘরে আটকে রেখে কিভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত তা উপরোল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নির্যাতনের হাত থেকে নারীরাও রেহাই পায়নি। হাজার হাজার ছাত্র নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত হযেছে দাঁড়ি টুপিওয়ালা লোকগুলো। জঙ্গি তকমা লাগিয়ে শত শত তরুনদের নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। এই নির্যাতনের মাত্রা এতোই বেশী যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার সংখ্যা নিরুপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশকে পুলিশি স্টেটে পরিণত করে। ২০০৯ সালে আইন সংশোধন করে পুলিশকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়। পুলিশকে প্রমোশন দিয়ে তাদের গ্রেড বাড়িয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বেতন ভাতা বাড়িয়ে দিয়ে পুলিশকে চতুমূর্খী সুযোগ সুবিধা তৈরী করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই কাজের ফলে পুলিশ নিজ দায়িত্বে সরকারের খাস গোলামে পরিণত হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা গত সাড়ে পনেরো বছর বিরোধীদলের আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ দলীয় বা সাংগঠনিকভাবে মাঠে সক্রিয় থেকে বিরোধীদলের আন্দোলন ঠেকাতে না পারলেও পুলিশকে দিয়ে আন্দোলন দমাতে পেরেছে। আর পুলিশও দলীয় ভূমিকা পালন করতে গিয়ে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে, ২০১৫ সালে রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ২২ হাজার অভিযোগ এসেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগের তদন্ত শেষে শাস্তিও হয়েছে ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের। চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৭৬ জন।

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এটাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। অতীতে আমাদের দেশে এধরনের ঘটনা কদাচিত ঘটলেও গত সাড়ে ১৫ বছরে এ ধরনের রিমান্ড ও হেফাজতে নির্যাতনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশী বেড়েছিলো।

এদিকে আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীদেরও আয়নাঘর ছিলো। যেখানে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো।

আওয়ামী প্রশাসন ও আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী দ্বারা বিরোধী দলীয় লোকজন ও সাধারণ লোকজন পথে ঘাটে, হাটে বাজারে, মসজিদে, আদালতসহ সর্বত্র নির্যাতন হতে হতে সকলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিলো। লোকজন আওয়ামীদের ভয়ে জোড়ে কাঁদতে পারতো না, কেউ জোড়ে আল্লাহর নাম নিতে পারতো না, কোনো অন্যায় কাজে প্রতিবাদ করলেই তার উপর নেমে আসতো অবর্ণনীয় নির্যাতন। সেই নির্যাতন শুধু ঐ ব্যক্তির উপরই হতো না বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের উপরও নির্যাতন করা হতো। এমনকি সেই নির্যাতিত ব্যক্তির বাড়িতে সুন্দরী কোনো মেয়ে থাকলে তাকেও খেসারত দিতে হতো।

লক্ষ লক্ষ জনসাধারণ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আওয়ামীলীগ একটি অত্যাচারী দল। আর যেহেতু তারা অত্যাচারী দল হিসেবে প্রমাণিত তাই তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।

অন্যায় অত্যাচার বা জুলুম সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ)...জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাক। কেননা কিয়ামত দিবসে অত্যাচার অন্ধকারে পরিণত হবে। তোমরা কৃপণতা থেকে সাবধান হও। কেননা এ কৃপণতাই তোমাদের আগেকার কাওমকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতা তাদের খুন-খারাবী ও রক্তপাতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং হারাম বস্তুসমূহ হালাল জ্ঞান করতে প্রলোভন দিয়েছে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪০, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুলুম কিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকারের রূপ ধারণ করবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে,আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন।যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দুর করবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪২, ৬৯৫১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে যালিম হোক অথবা মাযলুম। (অর্থাৎ যালিম ভাইকে যুলুম থেকে বিরত রাখবে এবং মাযলুম ভাইকে যালিমের হাত হতে রক্ষা করবে)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৩, ২৪৪৪, ৬৯৫২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাতটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তারপর তিনি উল্লেখ করলেন, অসুস্থদের খোঁজখবর নেয়া, জানাযায় পিছে পিছে যাওয়া, হাঁচির জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ্ বলা, সালামের উত্তর দেয়া, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, আহবানকারীর প্রতি সাড়া দেয়া, কসমকারীকে দায়িত্ব মুক্ত করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৫, ১২৩৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যের ওপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। আপদ-বিপদ ও দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জুলুম। তাই আল্লাহ তাআলা সবাইকে তা থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনু আবদুর রহমান ইবনু বাহরাম আদ দারিমী (রহঃ)....আবু যার (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ওহে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজ সত্তার উপর অত্যাচারকে হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের মধ্যেও তা হারাম বলে ঘোষণা করছি। অতএব তোমরা একে অপরের উপর অত্যাচার করো না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৬৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন। (সুরা: নাহল, আয়াত ৯০)।

আল্লাহ্ তা‘আলা যালিমদের জন্য জাহান্নামে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। যা তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘আমি যালিমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানি। যা তাদের মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দিবে। এটা কতই না নিকৃষ্ট পানীয় এবং সে জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়’’। (সুরা কাহ্ফ : ২৯)।

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন: “অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল!’’ (সুরা শু‘আরা’: ২২৭)।

কেউ কেউ কোন যালিমকে অনায়াসে মানুষের উপর যুলুম করতে দেখলে এ কথা ভাবে যে, হয়তো বা সে ছাড় পেয়ে গেলো। তাকে আর কোন শাস্তিই দেয়া হবে না। না, ব্যাপারটা কখনোই এমন হতে পারে না। বরং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে কিয়ামতের দিনের কঠিন শাস্তির অপেক্ষায় রেখেছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ‘‘কাজেই মানুষকে সতর্ক কর সেদিনের ব্যাপারে যেদিন তাদের উপর ‘আযাব আসবে। যারা জুলুম করেছিল তারা তখন বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে অল্পদিনের জন্য সময় দাও, আমরা তোমার আহবানে সাড়া দিব আর রাসূলদের কথা মেনে চলব।’ (তখন তাদেরকে বলা হবে) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলনি যে, তোমাদের কক্ষনো পতন ঘটবে না? অথচ তোমরা সেই লোকগুলোর বাসভূমিতে বসবাস করছিলে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল আর তোমাদেরকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল আমি তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলাম। আর আমি বহু উদাহরণ টেনে তোমাদেরকে বুঝিয়েও দিয়েছিলাম। তারা যে চক্রান্ত করেছিল তা ছিল সত্যিই ভয়ানক, কিন্তু তাদের চক্রান্ত আল্লাহ্র দৃষ্টির ভিতরেই ছিল, যদিও তাদের চক্রান্তগুলো এমন ছিল যে, তাতে পর্বতও টলে যেত। (অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক না কেন) তুমি কক্ষনো মনে কর না যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে দেয়া ওয়া‘দা খেলাপ করবেন, আল্লাহ মহা প্রতাপশালী, প্রবল প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’’ (সুরা ইবরাহীমঃ ৪২-৪৭)।

মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা অনেক বড় জুলুম। এই ধরনের জুলুমের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। বিত্তবানরা দারিদ্র্য শ্রেণিকে ও ক্ষমতাবানরা সাধারণ লোকের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন, নিপীড়ন করে। ফলে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ-আপদ। যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন,

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ)....হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, তিনি একবার সিরিয়ায় কয়েকজন মানুষের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাদেরকে উত্তপ্ত সূৰ্যতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল এবং তাদের মাথার উপর গরম তেল ঢালা হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, এটা কী? তাকে বলা হলো যে, তাদেরকে খাযনার জন্যে সাজা দেয়া হচ্ছে। তখন তিনি বললেন, হুশিয়ার! আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সেসব লোকেদের সাজা দিবেন, যারা এ জগতে মানুষকে (অন্যায়) সাজা দেয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৫১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪১৯, ইসলামিক সেন্টার ৬৪৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুলুমের ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত: ২২৭)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা: আনআম, আয়াত: ৫৭)।

জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

আবূ বকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জুলুম এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মত মারাত্মক আর কোন গুনাহ নাই, যার শাস্তি আল্লাহ ত্বরিতে দুনিয়াতে দেন এবং আখেরাতের জন্যও জমা রাখেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪২১১, সুনান আততিরমিযী ২৫১১, সুনান আবূ দাউদ ৪৯০২, সহীহাহ ৯১৭, আত-তালীকুর রাগীব ৩/২২৮, সুনান ইব্নু মাজাহ্ ৪২৮৬; ইব্নু হিববান ৪৫৫, ৪৫৬ বায্যার, হাদীস ৩৬৯৩; আহমাদ ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪, ১৯৮৬১, ১৯৮৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ কামিল জাহদারী (রহঃ)....আবূ মাসউদ বাদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি আমার এক ক্রীতদাসকে চাবুক দিয়ে প্রহার করছিলাম। হঠাৎ আমার পিছনে থেকে একটি শব্দ শোনলাম, হে আবূ মাসউদ! জেনে রেখো! রাগের কারণে আমি শব্দটি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। বর্ণনাকারী বলেন, যখন তিনি আমার কাছাকাছি এলেন তখন দেখতে পেলাম, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তিনি বলছেনঃ হে আবূ মাসউদ! তুমি জেনে রেখো, হে আবূ মাসউদ! তুমি জেনে রেখো! বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমি চাবুকটি আমার হাত থেকে ফেলে দিলাম। এরপর তিনি বললেন, হে আবূ মাসউদ! তুমি জেনে রেখো যে, এ গোলামের উপর তোমার ক্ষমতার চেয়ে তোমার উপর আল্লাহ তা’আলা অধিক ক্ষমতাবান। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম, এরপর কখনও কোন কৃতদাসকে আমি প্রহার করবো না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪১৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪১৬০, ইসলামিক সেন্টার ৪১৫৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ).....হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, তিনি একবার সিরিয়ায় কয়েকজন মানুষের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাদেরকে উত্তপ্ত সূৰ্যতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল এবং তাদের মাথার উপর গরম তেল ঢালা হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, এটা কী? তাকে বলা হলো যে, তাদেরকে খাযনার জন্যে সাজা দেয়া হচ্ছে। তখন তিনি বললেন, হুশিয়ার! আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সেসব লোকেদের সাজা দিবেন, যারা এ জগতে মানুষকে (অন্যায়) সাজা দেয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৫১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪১৯, ইসলামিক সেন্টার ৬৪৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যের ক্ষতি করলে বা কষ্ট দিলে কিংবা অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করলে

(ক) আবূ সিরমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করবে, আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিবে আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩৪২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৯৪০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৬৩৫, আহমাদ ১৫৩২৮, ইরওয়া ৮৯৬)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) সাহল ইবনু মু’আয ইবনু আনাস আল জুহানী (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোনো মু’মিনকে মুনাফিক থেকে রক্ষা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার শরীর জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য একজন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করবে তাকে মহান আল্লাহ জাহান্নামের সেতুর উপর প্রতিরোধ ব্যবস্থা করবেন যতক্ষণ না তার কৃত কর্মের ক্ষতিপূরণ হয়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৮৮৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

যুলুমমূলক কাজে সহযোগিতা করলে অথবা যুলুমে সহায়তা করলে

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে।’ (সূরা হূদ: ১১৩)।

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কারো যুলুমমূলক মামলায় সহযোগিতা করে অথবা যুলুমে সহায়তা করে, তা থেকে নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত সর্বদাই সে আল্লাহর গযবে নিপতিত থাকে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৯৭, ইরওয়া ৭/৩৫০, সহীহাহ ৪৩৮, ১০২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

আওয়ামীলীগ আলেম ওলামাদের  নির্যাতনের সাথে জড়িত

আওয়ামীলীগকে উদ্দেশ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আওয়ামীরা শুধু বিরোধী দল ও আলেম-উলামাদের ওপর নির্যাতন করেনি। ১৮ কোটি মানুষের ওপর নির্যাতন করেছে। মানুষকে বেইজ্জতি করেছে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে।

গত সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আলেম-উলামাদের ওপর  অমানবিক জুলুম ও নির্যাতন করেছে। এমনকি ইসলামের দাওয়াত মাহফিলেও তারা বাধা দিয়েছে। এ মন্তব্য করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আলতাফ হোসেন চৌধুরী।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক এবং মসজিদ ইমাম ও খতিবদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানি সবচেয়ে বেশি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব মোস্তফা জামান।

একাত্তরকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ দেশের আলেমদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাসনাত আব্দুল্লাহ।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় জুমার নামাজের বয়ানে আওয়ামী লীগ সরকারের জুমুল-নির্যাতন নিয়ে কথা বলায় মাওলানা মুজাহিদুল হক (৩৫) নামে এক ইমামকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের মুরাটিয়া গ্রামের মধ্যপাড়া জামে মসজিদে এ ঘটনা ঘটে।

আলেম ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর নির্যাতন করেছে আওয়ামী লীগ, অভিযোগ ফখরুলের |

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমদ বলেছেন,  ‘আওয়ামী লীগের দুঃশাসন আামাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। এই আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের টাকা লুটপাট করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এ জালিম সরকার আলেম ওলামাদের অনেক নির্যাতন করেছেন। তাদের বিনা কারণে জেল, জুলম অত্যাচার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।’

২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মের কথা। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের একটি সাধারণ সমাবেশ ঠেকাতে পুরো রাষ্ট্র উঠেপড়ে লাগে। দিনের আলোতে পুলিশ-র্যা বসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য শাখাগুলোর সদস্যরা আলেমদের ওপর বেপরোয়া হামলা, গুলি আর নির্যাতন শুরু করে। পথে পথে রক্ত। লাশ। এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে সবার মনে নজিরবিহীন ভয় ধরিয়ে দিয়ে শাপলা চত্বর থেকে আলেমদের নির্মূল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। গুলির মুখেও ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নে তারা শাপলা ছাড়ছিলেন না। দিন শেষে রাত ঘনিয়ে এলে নির্যাতনের ধরন পালটে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু করে বেপরোয়া গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ। জীবন রক্ষায় দিগ্বিদিক ছুটতে গিয়েও গুলির মুখে পড়েন নানা বয়সি আলেমরা। এক বিভীষিকাময় রাত তাদের ওপর দিয়ে যায় ৫ মে। হেফাজতের নেতাকর্মী তথা আলেমদের নির্মূলের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনার ইচ্ছা পূরণে পুলিশের তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও র্যা ব ডিজিসহ অনেক কর্মকর্তা সেই নিষ্ঠুর নির্যাতন আর খুনের দিনটিকে ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ হিসাবে অবহিত করে উল্লাস করেছিলেন। আজ সেই বিভীষিকাময় কালোদিন। শেখ হাসিনার শাসনামলে হেফাজতের নেতাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ কোনো সত্য প্রকাশ করতে পারেনি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ৬১ জনকে হত্যার তালিকা প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে পড়ে। অধিকারের আদিলুর রহমান শুভ্রকে নেওয়া হয় জেলে। ওই সংগঠনের ওপর নেমে আসে আরও ভোগান্তি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ হত্যায় জড়িত সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকারসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। ‘সমাবেশ দমন করতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে গুলি চালায় স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বাহিনী। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিকিউশন হেফাজতের অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে। শেখ হাসিনাসহ ৯ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত করে মামলা রেকর্ডভুক্ত করা হয়। ৯ আসামির মধ্যে ৪ জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার। হাসিনাসহ ৫ পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনা কী পরিমান আলেম ওলামা নির্যাতন করেছে তার বর্ণনা এখানে তুলে ধরলে কয়েকশ পাতা লাগবে। সংক্ষিপ্তাকারে এ কথাই বলছি যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছিলো ইসলামিক ফোবিয়া। তিনি চেয়েছিলেন ইসলামের পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ এই দেশে প্রতিষ্ঠা করতে। তার এটাও বিশ্বাস ছিলো যে, এই আলেম ওলামা দ্বারাই তার একসময় পতন ঘটবে। তাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা আলেম ওলামাদের উপর স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন। আলেম ওলামা নির্যাতন করলে তার কী শাস্তি হতে পারে আসুন আমরা তা জেনে নেই।

আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের বিধান মানুষের কাছে পৌছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে থাকেন আলেমগণ। পৃথিবী থেকে রাসুল (সাঃ) বিদায় নেয়ার পর তারা তারই রেখে যাওয়া এ গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এজন্য আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে তারা অনেক সম্মানিত হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে আলেমদের সম্মানের ব্যাপারে অনেক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন:

অর্থাৎ, হে নবী (সাঃ) আপনি বলুন! যারা জ্ঞানী এবং যারা জ্ঞান রাখে না তারা কি সমান হতে পারে? (সুরা যুমারঃ ৯)।

আলেমগণ দ্বিনের অতন্দ্র প্রহরী। দ্বিন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট। তাঁরা নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে সব ধরনের বাতিল মতবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সর্বদা অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। তাঁরা হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জান-মাল ব্যয় করাটা গৌরবের মনে করেন। বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করতে কালক্ষেপণ করেন না। তাঁদের হাতেই জিন্দা হয় সুন্নত। দূরীভূত হয় বিদয়াত-রুসুমাত।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ইবরাহীম ইবনু ’আবদুর রহমান আল ’উযরী (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক আগত জামা’আতের মধ্যে নেক, তাক্বওয়াসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য মানুষ (কিতাব ও সুন্নাহর) এ জ্ঞান গ্রহণ করবেন। আর তিনিই এ জ্ঞানের মাধ্যমে (কুরআন-সুন্নাহ) সীমালঙ্ঘনকারীদের রদবদল, বাতিলপন্থীদের মিথ্যা অপবাদ এবং জাহিল অজ্ঞদের ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে বিদূরিত করবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৪৮, বায়হাক্বী ১০/২০৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তাআলা তাঁদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষ্য। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’ (সুরা: আলে ইমরান: ১৮)।

আল-কুরআনে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের সঙ্গেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের আনুগত্যেও। ইরশাদ হয়েছে,

‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাঁদের।’ (সুরা : নিসা, আয়াত: ৫৯)।

যেকোনো শরঈ সমস্যা নিরসনে তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে।’ (সুরা : নাহল: ৪৩)।

আলেমদের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসিম

(ক) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের দুনিয়ার বিপদসমূহের কোন একটি বিপদ দূর করে দিবে, আল্লাহ তা’আলা তার আখিরাতের বিপদসমূহের মধ্য হতে একটি (কঠিন) বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত লোকের অভাব (সাহায্যের মাধ্যমে) সহজ করে দিবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিনে তাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে (প্রকাশ করবে না), আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে। যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোন পথ বা পন্থায় অনুপ্রবেশ করার সন্ধান করে, আল্লাহ তা’আলা এর বিনিময়ে তার জান্নাতে প্রবেশ করার পথ সহজ করে দেন। যখন কোন দল আল্লাহর কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং জ্ঞানচর্চা করে, তাদের ওপর আল্লাহর তরফ থেকে স্বস্তি ও প্রশান্তি নাযিল হতে থাকে, আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয় এবং মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তা’আলা মালায়িকাহ্’র নিকট তাদের উল্লেখ করেন। আর যার ’আমল তাকে পিছিয়ে দেয় তার বংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২০৪,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৭৪৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) কাসীর বিন ক্বায়স (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দিমাশক-এর মসজিদে আবুদ্ দারদা (রাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম, এমন সময় তার নিকট একজন লোক এসে বললো, হে আবুদ্ দারদা! আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শহর মদীনাহ্ থেকে শুধু একটি হাদীস জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি শুনেছি আপনি নাকি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আর কোন উদ্দেশে আমি আপনার কাছে আসিনি। তার এ কথা শুনে আবুদ্ দারদা (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি (কুরআন ও হাদীসের) ’ইলম সন্ধানের উদ্দেশে কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছিয়ে দিবেন এবং মালায়িকাহ্ ’ইলম অনুসন্ধানকারীর সন্তুষ্টি এবং পথে তার আরামের জন্য তাদের পালক বা ডানা বিছিয়ে দেন। অতঃপর ’আলিমদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দু’আ করে থাকেন, এমনকি পানির মাছসমূহও (ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে)। ’আলিমদের মর্যাদা মূর্খ ’ইবাদাতকারীর চেয়ে অনেক বেশী। যেমন পূর্ণিমা চাঁদের মর্যাদা তারকারাজির উপর এবং ’আলিমগণ হচ্ছে নবীদের ওয়ারিস। নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম (ধন-সম্পদ) মীরাস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে রেখে যান না। তাঁরা মীরাস হিসেবে রেখে যান শুধু ’ইলম। তাই যে ব্যক্তি ’ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১২, সহীহ লিগয়রিহী : আহমাদ ২১২০৮, সুনান আবূ দাঊদ ৩৬৪১, সুনান আততিরমিযী ২৬৮২, সুনান ইবনু মাজাহ্ ২২৩, সহীহুত্ তারগীব ৭০, দারিমী ৩৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ উমামাহ্ আল বাহিলী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দুই ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। এদের একজন ছিলেন ’আবিদ (’ইবাদাতকারী), আর দ্বিতীয়জন ছিলেন ’আলিম (জ্ঞান অনুসন্ধানকারী)। তিনি বললেন, ’আবিদের ওপর ’আলিমের মর্যাদা হলো যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির ওপর। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা’আলা, তাঁর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) এবং আকাশমণ্ডলী ও জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে ও মাছ পর্যন্ত ’ইলম শিক্ষাকারীর জন্য দু’আ করে।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৩, সুনান আততিরমিযী ২৬৭৫, সহীহুত্ তারগীব ৮১, দারিমী ১/৯৭-৯৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  দারিমী এ হাদীস মাকহূল (রহঃ) থেকে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং দুই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেননি। আর তিনি বলেছেন, ’আবিদের তুলনায় ’আলিমের মর্যাদা এমন, যেমন তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের ওপর আমার মর্যাদা। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ কথার প্রমাণে কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে ’আলিমরাই তাঁকে ভয় করে’’- (সূরাহ্ ফাত্বির/মালায়িকাহ্ ৩৫: ৮)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৪,  দারিমী ২৮৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(ঙ) হাসান আল বসরী (রহঃ) হতে মুরসালরূপে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বনী ইসরাঈলের দু’জন লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তাদের একজন ছিলেন ’আলিম, যিনি ওয়াক্তিয়া ফরয সালাত  আদায় করার পর বসে বসে মানুষকে তা’লীম দিতেন। আর দ্বিতীয়জন দিনে সিয়াম পালন করতেন, গোটা রাত ’ইবাদাত করতেন। (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হল) এ দু’ ব্যক্তির মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়ে উত্তম কে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওয়াক্তিয়া ফরয সালাত আদায় করার পরপরই বসে বসে যে ব্যক্তি তা’লীম দেয়, সে ব্যক্তি যে দিনে সিয়াম পালন করে ও রাতে ’ইবাদাত করে তার চেয়ে তেমন বেশী মর্যাদাবান। যেমন- তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের ওপর আমার মর্যাদা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৫০, দারিমী ৩৪০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(চ)  আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ তা’আলা আমার কাছে ওয়াহী পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি ’ইলম (বিদ্যা) হাসিল করার জন্য কোন পথ ধরবে, আমি তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দিব। আর যে ব্যক্তির দুই চোখ আমি নিয়ে নিয়েছি, তার বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করব। ’ইবাদাতের পরিমাণ বেশি হবার চেয়ে ’ইলমের পরিমাণ বেশি হওয়া উত্তম। দীনের মূল হলো তাক্বওয়া তথা হারাম ও দ্বিধা-সন্দেহের বিষয় হতে বেঁচে থাকা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৫৫, বায়হাক্বী ৫৭৫১, সহীহুল জামি‘ ১৭২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আলেম ওলামাদেরকে নির্যাতন বা শত্রুতা করার পরিনতি

কোনো আল্লাহ্’র ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করা অথবা তাঁকে যে কোনভাবে কষ্ট দেয়াও আরেকটি কবীরা গুনাহ্। কারণ, তাদেরকে কষ্ট দেয়া মানে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কষ্ট দেয়া। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কষ্ট দিবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন এবং আখিরাতে রয়েছে তার জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কষ্ট দেয় আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা’নত করবেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি’’। (সুরা আহযাব: ৫৭)।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করলো আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। ফরয আমল চাইতেও আমার নিকট অধিক প্রিয় এমন কোন আমল নেই যার মাধ্যমে কোন বান্দাহ্ আমার নিকটবর্তী হতে পারে। এতদ্সত্ত্বেও কোন বান্দাহ্ যদি লাগাতার নফল আমলের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হয় তখন আমি তাকে ভালোবাসি। আর আমি কখনো কাউকে ভালোবাসলে তার কান আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই শুনে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই। তার চোখও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই দেখে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই। তার হাতও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই ধরে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই। তার পাও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুর প্রতিই চলে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই। সে আমার নিকট কোন কিছু চাইলে আমি তাকে তা দিয়ে থাকি। আমার নিকট সে কোন কিছু থেকে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে তা থেকে আশ্রয় দিয়ে থাকি। আমি কোন কিছু করতে এতটুকুও ইতস্তত করি না যতটুকু ইতস্তত করি কোন মু’মিনের জীবন নিতে। সে মৃত্যু চায় না। আর আমি তাকে কোন ভাবেই দু:খ দিতে চাই না’’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

অতএব যারা আলেম ওলামাদের সাথে শত্রতা পোষণ করবে, আলেমদের নির্যাতন করবে, তাদের মনে কষ্ট দিবে সেই অত্যাচারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়াতেই শাস্তি ভোগ করাবেন এবং পরকালেও শাস্তি দিবেন। মূলত বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী দুঃশাসনামলে আলেমগণ দিনের পর দিন অত্যাচারিত হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে  প্রকাশ্যে বদদোয়া না করলেও অন্তরে বদদোয়া সমসময়েই থাকতো। আলেমগণসহ মজলুম ব্যক্তিগণ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে সব সময়ই ঘৃণা করতো, তারা অপেক্ষায় ছিল কখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার উপর গযব নাজিল হয়। পরিশেষে মজলুমের বদদোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন ও ৩৬ জুলাই এর উৎপত্তি ঘটিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সমূলে ধ্বংস করলেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করা

ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসনামলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও ইসলামকে নিয়ে অনেক কটূক্তি করা হয়েছিল কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী আওয়ামীরা কটূক্তিকারীদের শাস্তি দিতে তেমন কোনো আইন তৈরী করেনি। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করলে ইসলামে শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড, ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ার কারণে আওয়ামীরা মুসলমান হয়েও এই আইন তারা গ্রহণ করেনি অথচ ২০০৯ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর তার পিতার কটূক্তির  শাস্তি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা পরিবারের সুরক্ষা আইন তৈরী করে যা নিম্নে আলোচনা করা হলো,

২২ অগাস্ট ২০১৬ তারিখে বিবিসি নিউজ এ প্রকাশিত, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনলাইনে অবমাননা করলে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবনের বিধান রেখে নতুন একটি খসড়া আইনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন এ খসড়া আইনটির নাম হচ্ছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬'।

এই আইনের ১৫ নং ধারায় ৫ এর উপ-ধারায় বলা হয়েছে, "কোন ব্যক্তি যদি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাহাতে মদদ প্রদান করে; তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি, সত্ত্বা বা বিদেশী নাগরিক ডিজিটাল সন্ত্রাসী কার্যসংঘটনের অপরাধ করিয়াছে বলিয়া গণ্য হবে"।

এই একই ধারায় আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয়াবলীর বিরুদ্ধে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোন প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা করে তাহলে সেটিও অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর ৩৯ নং আইনে বলা হয়েছে,

যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার বানানো আইনে শাস্তি কার্যকরের কিছু উদাহরণ নিস্নে দেয়া হলো,

(১) শেখ মুজিবের ছবিতে মন্তব্য করায় ৪ মাসের জেল: অঝোরে কাঁদলেন শিক্ষার্থী। (০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, আরটিভি)।

(২) বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি, কর্নেল রশিদের জামাতার ৭ বছরের কারাদণ্ড। (সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২, দ্যা ডেইলি স্টার)।

(৩) প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর মামলায় যুবকের ১০ বছরের কারাদণ্ড। (২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকা টাইমস)।

(৪) বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার দায়ে প্রধান শিক্ষকের ১ বছরের কারাদণ্ড। (৮ আগস্ট ২০২২, সময় টিভি)।

(৫)  ‘বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি: জাবি শিক্ষার্থীর ৭ বছর কারাদণ্ড। (০৬ জুন ২০২২ বাংলা ট্রিবিউন)।

(৬) বঙ্গবন্ধু অবমাননা: দুই শিক্ষককে বঙ্গবন্ধুর লেখা বই পড়তে আদালতের নির্দেশ। (২২.০২.২০২২ সমকাল(।

(৭) আওয়ামী’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে ফেসবুকে পোস্ট, তরুণের ১০ বছরের কারাদণ্ড। (২৪ জানুয়ারি ২০২২, প্রথম আলো)।

(৮) প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য প্রচারের দায়ে ৭ বছরের কারাদণ্ড। ( জানুয়ারি ২০, ২০২২  দ্য ডেইলি স্টার বাংলা)।

(৯) শেখ হাসিনার ছবি বিকৃত করায় বিএনপি নেতার ৭ বছর জেল।( ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ সমকাল)।

(১০) বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা, তারেক রহমানের ২ বছরের কারাদণ্ড।  (০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ যুগান্তর)।

(১১)  ‘বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা’র দায়ে ১৩ শিক্ষক কারাগারে। (২৩ অগাস্ট ২০১৭, বিবিসি)

(১২) শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে ইউএনও গ্রেফতার ও হেনস্তা। (২১ জুলাই ২০১৭, বাংলা ট্রিবিউন)।

(১৩) সাইবার ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাজাঃ

বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীকে ব্যঙ্গ করায় ৭ বছর কারাদণ্ড। (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, প্রথম আলো)।

এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে।

ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করার মানবরচিত আইনে শাস্তির উদাহরণ

কুষ্টিয়ার বাসিন্দা সেলিম খানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত, দাঙ্গা সংগঠিত করা, ইসলামি ধর্মীয় বিশ্বাস অবমাননা এবং ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর ভেড়ামারা থানায় মামলা করেছিলেন একই জেলার বাসিন্দা হানিফ শাহ।

সেলিমের বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআন ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

এই আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সর্বোচ্চ শাস্তি বর্তমানে দুই বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং এটি জামিনযোগ্য অপরাধ।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তি

২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে পাঁচ বছর কারাদন্ড এবং অনধিক দশ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান আছে। এছাড়া একাধিকবার একই অপরাধ সংগঠিত করলে সাজার পরিমাণ এ সাজার দ্বিগুণ। যা অপরাধের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য ও অপ্রতুল বিধায় কেউ কেউ মহানবীসহ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ইতোপূর্বে নানা ধরনের মন্তব্য ও কটূক্তি করেছে এবং করে আসছে। যদিও তা কুরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও সংবিধান বিরোধী। মুসলিম শরীয়া আইনে এ ধরনের জঘন্য অপরাধের জন্য কঠিন সাজার বিধান রয়েছে। পাশাপাশি সংবিধান লঙ্ঘন করলেও তা সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। যার শাস্তি ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনসহ অর্থদন্ড। সুতরাং উল্লেখিত অপরাধের জন্য প্রচলিত আইনে যে সাজার বিধান রয়েছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সার্বিক বিবেচনায় প্রচলিত আইন সংশোধন ক্রমে এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত যে আইন তৈরী করা আছে তা সার্বজনীন আইন। এককভাবে ইসলামের জন্য নয়। এছাড়া আইন যতোটুকু আছে তার কার্যকারিতা ছিলো না, ছিলো শুধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কটূক্তি করলে তার শাস্তির কার্যকারিতা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা, তার বোন রেহেনা ও তাদের সন্তানদের জন্য একটা সুরক্ষা আইনও তৈরী করা হয়েছিল। সেই আইন বলে সেনাবাহিনীর এসএসএফ তাদের পাহাড়া দিয়ে রাখতো। যেমন,

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইন ২০০৯ প্রণয়ন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবিত দুই কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের আজীবন বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আইনটি ১৩ অক্টোবর, ২০০৯ তারিখে (২০০৯ সালের ৬৩ নম্বর আইন) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ও সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।

এই আইনের অধীনে একজন ‘ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন’-এর (ভিআইপি) জন্য স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, তাদের জন্যও আজীবন একই ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।  

এছাড়া, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক সদস্যের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এই আইনে।

বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী আইন ২০২১ সালে প্রণীত হয় যাতে ভিভিআইপি যেমন রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের যেকোনো স্থানে সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

যদি কোনো ব্যক্তি এই ব্যক্তিদের শারীরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, তাহলে এসএসএফ সদস্যদের তাকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রয়েছে। ঐ ব্যক্তি গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে কিংবা গ্রেপ্তার প্রচেষ্টায় বাধা দিলে, যথাযথ হুঁশিয়ারি প্রদানের মাধ্যমে এসএসএফ তার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ বা যেকোনো প্রয়োজনীয় উপায়ে হুমকি নিরসন করতে পারে।  কী মারাত্মক আইন!

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট ২০১৪  শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এই দুই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। এরপর ২৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উক্ত আইন বাতিলের অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

সেখানে বলা হয়, বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যদের নিরাপত্তা আইন- ২০০৯ (২০০৯ সালের ৬৩ নম্বর আইন) প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছিল। পরে ২০১৫ সালের ১৫মে উক্ত আইন অনুসারে বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি দেয়ার জন্য গেজেট জারি করা হয়। কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য আইনটি করা হয়েছিল। যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।

রাসুল সাঃ কে  গালমন্দ করলে বা কটূক্তি করার ইসলামি বিধান

কেউ রাসুল সাঃ কে  গালমন্দ করলে বা কটূক্তি করলে বা ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করলে সে নিজেকে মুসলমান দাবী করলেও ইসলাম তাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে। ইসলামি বিধান মোতাবেক তাকে হত্যা করা ফরজ। মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেনঃ

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আর পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হলো, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের একদিকের হাত এবং অপরদিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নির্বাসিত (কারাগারে আবদ্ধ) করা হবে। এটাই তাদের ইহকালের অপমান, আর পরকালে তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে’’। (সূরা আল-মায়িদাহ ৩৩-৩৪)।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো, তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নির্দেশ-নিদর্শন ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে ঠাট্টা করছিলে? অজুহাত দেখিয়ো না, তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরিতে লিপ্ত হয়েছ। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬৫-৬৬)।

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তারা যদি চুক্তি সম্পন্ন করার পর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বিনের নিন্দা করে, তবে কাফিরদের প্রধানদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, হয়তো তারা নিরস্ত হবে। বস্তুত এরা এমন লোক, যাদের প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য নেই।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২)।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের (অর্থাত্ মুনাফিকদের) মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং (তাঁর সম্পর্কে) বলে, সে তো আপাদমস্তক কান (কান কথা শুনে)। বলে দাও, তোমাদের পক্ষে যা মঙ্গলজনক, সে তারই জন্য কান। সে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং মুমিনদের কথা বিশ্বাস  করে।  তোমাদের  মধ্যে যারা (বাহ্যিকভাবে) ঈমান এনেছে, তাদের জন্য সে রহমত (সুলভ আচরণকারী)। যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত আছে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৬১)।

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তারা কি জানে না, কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করলে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, যাতে সে সর্বদা থাকবে? এটা তো চরম লাঞ্ছনা!’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৬৩)।

আরেক আয়াতে এসেছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৬)।

উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কষ্ট দেয় বা অবমাননা করে সে যেন আল্লাহকেই কষ্ট দেয় বা অবমাননা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে কষ্ট দেয় বা অবমাননা করে সে কাফের। (আস সারিমুল মাসলুল, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪; আস সাইফুল মাসলুল, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৭০)।

হাদিস এ রাসুল সাঃ অবমাননার শাস্তি

(১) ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। জনৈক অন্ধ লোকের একটি উম্মু ওয়ালাদ’ ক্রীতদাসী ছিলো। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দিতো এবং তাঁর সম্পর্কে মন্দ কথা বলতো। অন্ধ লোকটি তাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে বিরত হতো না। সে তাকে ভৎর্সনা করতো; কিন্তু তাতেও সে বিরত হতো না। এক রাতে সে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দিতে শুরু করলো এবং তাঁর সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে লাগলো, সে একটি একটি ধারালো ছোরা নিয়ে তার পেটে ঢুকিয়ে তাতে চাপ দিয়ে তাকে হত্যা করলো। তার দু’ পায়ের মাঝখানে একটি শিশু পতিত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হলো। ভোরবেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘটনাটি অবহিত হয়ে লোকজনকে সমবেত করে বলেনঃ আমি আল্লাহর কসম করে বলছিঃ যে ব্যক্তি একাজ করেছে, সে যদি না দাঁড়ায় তবে তার উপর আমার অধিকার আছে।

একথা শুনে অন্ধ লোকটি মানুষের ভিড় ঠেলে কাঁপতে কাঁপতে সামনে অগ্রসর হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এসে বসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সেই নিহত দাসীর মনিব। সে আপনাকে গালাগালি করতো এবং আপনার সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলতো। আমি নিষেধ করতাম; কিন্তু সে বিরত হতো না। আমি তাকে ধমক দিতাম; কিন্তু সে তাতেও বিরত হতো না। তার গর্ভজাত মুক্তার মতো আমার দু’টি ছেলে আছে, আর সে আমার খুব প্রিয়পাত্রী ছিলো। গত রাতে সে আপনাকে গালাগালি শুরু করে এবং আপনার সম্পর্কে অপমানজনক কথা বললে, আমি তখন একটি ধারালো ছুরি নিয়ে তার পেটে স্থাপন করে তাতে চাপ দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা সাক্ষী থাকো, তার রক্ত বৃথা গেলো। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৬১)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। উকল অথবা উরাইনাহ গোত্রের কিছু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলো। মদীনায় বসবাস তাদের পক্ষে অনুপযোগী হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে উটের পালের নিকট গিয়ে এগুলোর পেশাব ও দুধ পান করতে আদেশ দেন। অতএব তারা সেখানে চলে গেলো। পরে তারা সুস্থ হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাখালকে হত্যা করে এবং উট পালকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।

দিনের প্রথমভাগে এ খবর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌঁছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পিছনে লোক পাঠান। উঠন্ত বেলায় তাদের ধরে নিয়ে আসা হয়। তাঁর আদেশে তাদের হাত-পা কাটা হয় এবং লৌহ শলাকা তাদের চোখে বিদ্ধ করে উত্তপ্ত রোদে ফেলে রাখা হয়। তারা পানি চাইলেও তা দেয়া হয়নি। আবূ কিলাবাহ বলেন, এরা এমন একটি গোত্রের, যারা চুরি করেছে, হত্যা করেছে, ঈমান আনার পর কুফরী করেছে এবং সর্বোপরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৬৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) ইকরিমাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। আলী (রাঃ) কিছু সংখ্যক মুরতাদকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) তা জানতে পেরে বলেন, আমি কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী অনুসরণ করে এদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কাউকে আল্লাহর শাস্তির উপকরণ দ্বারা শাস্তি দিও না। তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য মোতাবেক এদের মৃত্যুদন্ড দিতাম। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করে তোমরা তাকে হত্যা করো। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত এ হাদীস শুনে আলী (রাঃ) বলেন, আহ! ইবনু আব্বাস (রাঃ) সত্য বলেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তাকে হত্যা করা বৈধ নয় তিনটি অপরাধের যে কোনো একটিতে লিপ্ত না হলেঃ (১) বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করবে, (২) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে অথবা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হবে অথবা তাকে দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হবে, (৩) আর কাউকে হত্যা করলৈ তার বিনিময়ে কিসাসস্বরূপ তাকেও হত্যা করা যাবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বললেন, ‘কে আছ যে কা‘ব ইবনু আশরাফ-এর (হত্যার) দায়িত্ব নিবে? কেননা সে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দিয়েছে।’ মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফের নিকট গিয়ে বললেন, ‘এ ব্যক্তি অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কষ্টে ফেলেছে এবং আমাদের নিকট হতে সাদাকা চাচ্ছে।’ রাবী বলেন, তখন কা‘ব বলল, ‘এখনই আর কী হয়েছে?’ তোমরা তো তার থেকে আরো পেরেশান হয়ে পড়বে।’ মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা তাঁর অনুগত হয়েছি, এখন তাঁর শেষ ফল না দেখা পর্যন্ত তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা পছন্দ করি না।’ রাবী বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) এভাবে তার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত কথা বলতে থাকেন, অতঃপর তাকে হত্যা করে ফেলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩০৩১, ২৫১০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৮০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৮১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৬) আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নবীকে গালি দেয়, তাকে মৃত্যুদণ্ড দাও। (জামেউল আহাদিস, হাদিস: ২২৩৬৬)।

(৭) মুহাম্মদ ইবন বাশশার (রহঃ) ও হাম্মাদ ইবন মা’আদা (রহঃ)..আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইয়ামনে (সুবেদার করে) পাঠান। পরে তিনি মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ)-কে পাঠান। যখন তিনি সেখানে পৌঁছলেন, তখন বললেনঃ হে জনগণ! আমি তোমাদের নিকট রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দূত হিসেবে এসেছি। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) তার বসার জন্য একটি তাকিয়া স্থাপন করলেন। এমন সময় এক ব্যক্তিকে আনা হলো, যে প্রথমে ইয়াহুদী ছিল, পরে ইসলাম গ্রহণ করে পরে আবার কাফির হয়ে যায়। মু’আয (রাঃ) বললেনঃ এই ব্যক্তিকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী হত্যা না করা পর্যন্ত আমি বসবাে না। তিনি তিনবার এরূপ বলেন। এরপর যখন তাকে হত্যা করা হয়, তখন তিনি বসেন। (সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৪০৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর সম্মানের অবমাননা করে, গালি দেয় বা তাঁর শানে বেয়াদবি ও কটুক্তি করে কিংবা ইসলাম ধর্মের অবমাননা করে সে কাফের এবং তাকে হত্যা করা মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর আবশ্যক।

ইসলামের এই বিধান আওয়ামীদের অধিকাংশ নেতা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা তা গ্রহণ করেনি বা আইন তৈরী করেনি। এজন্য তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তাঁর রাসূলের দিকে এসো তখন আপনি মুনাফিকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত।

অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোনো কথা বলুন, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের (রাসূলগণের) আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার রবর কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নিবে।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬০-৬৫)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফির, যালিম, ফাসিক। (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৪, ৪৫, ৪৭)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার বাহিনী মানুষ হত্যার সাথে জড়িত

২০০৯ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় এসে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে বিশেষ করে প্রশাসনিক ডিপার্টমেন্টগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাদের চাকরি দিয়ে তার শাসন ক্ষমতা শক্তিশালী করেন। প্রত্যেক স্বৈরশাসকদের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধরে ধরে আটক করা, নির্যাতন করা ও হত্যা করা। এসব মিশনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছিলেন খুবই দক্ষ। আলোচিত কিছু হত্যাকান্ডের খাত এখানে উল্লেখ করা হলোঃ-

(ক) বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ধরে বিনা অপরাধে ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ডের সাথে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা জড়িত।

(খ)  বিডিআর হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত।

(গ)  শাপলা চত্বরে আলেম হত্যার সাথে জড়িত।

(ঘ)  জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মুসলিম হত্যার সাথে জড়িত।

(ঙ) রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার সাথে জড়িত।

(চ)  গুম করে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত।

আসুন ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলের বিভিন্ন হত্যাকান্ডের হিসেব নিকাশ সম্পর্কে জেনে নেই

(ক) ‘২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে এ দেশে প্রায় ৩ হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেঃ

বিগত ১৪ আগস্ট ২০২০ তারিখে “আমাদের সময়” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়-

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল  বলেন, ‘২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে এ দেশে প্রায় ৩ হাজার মানুষ পুলিশ, র্যা ব, ডিবির হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। তাদের অধিকাংশই বিরোধী দলের নেতাকর্মী।

গত ১০ বছর সময়ের মধ্যে এই দেশের জেল কাস্টডিতে মারা গেছেন ৭৯৫ জন, গুম হয়েছেন ৬০১ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ হাজার ৮০৬ জন নারী, ১ হাজার ৯৩৪ শিশু নির্যাতিত হয়েছে, ১৮ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।’

গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ১৯৬ জন এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং অথবা কাস্টডিয়াল ডেথের শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালে হয়েছে ৩৮৮ জন, ২০১৮ সালে হয়েছে ৪৬৬, ২০১৭ সালে হয়েছে ১৬২, ২০১৬ সালে হয়েছে ১৯৫ জন।

এই ধরনের গুম-খুন- অত্যাচার- নিপীড়ন-নির্যাতন হত্যা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ ধারা-২(২)(ক) অধীনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় বলে মন্তব্য করেন বিএনপি।

(খ) আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পাঁচ বছর আট মাসে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেঃ

বিগত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “কালের কন্ঠ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়-

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পাঁচ বছর আট মাসে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। বছরে গড়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৩১১টি। আর পাঁচ বছর আট মাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি। পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৬ হাজার ৫৫৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে সাড়ে তিন হাজার খুনের ঘটনা ঘটে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে দুই হাজার ৪৫২টি।

(গ)  আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিচার ছাড়াই ১৯২৬ জনকে হত্যাঃ

বিগত ০৪ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়-

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অলিউল্লাহ মোল্লা ২০১৬ সালের ১০ জুলাই পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। তাঁর পরিবার বলছে, ওই দিন বিকেলে অলিউল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা–কর্মী। পরদিন সকালে অলিউল্লাহর মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।

পুলিশ তখন দাবি করেছিল, ঘটনার দিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় টহলরত পুলিশ অলিউল্লাহকে থামার সংকেত দেয়। তিনি না থেমে উল্টো পুলিশের দিকে বোমা ও গুলি ছোড়েন। তখন পুলিশের পাল্টা গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে পুলিশের নথিতে এ ঘটনাকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ উল্লেখ করে অলিউল্লাহর পরিচয় লেখা হয় ‘সন্ত্রাসী’।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এমন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এই হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে।

এভাবে মানুষ মারার প্রতিটি ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে প্রায় একই রকম গল্প বলা হয়। এসব যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সেটা শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর প্রশাসন আগাগোড়াই অস্বীকার করে গেছে। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরের ক্রসফায়ারের তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এতে দেখা যায়, এই সাত বছরেই ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২৯৩ জন। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতা–কর্মীও রয়েছেন।

এসবির হিসাবে সাত বছরে ক্রসফায়ারে নিহতের যে সংখ্যা বলা হয়েছে, আসকের হিসাবে সেই সংখ্যা আরও ১২০ জন বেশি।

‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এসব ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। যার একটা বড় নজির ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা। র্যাএব-১১–এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ১১ জন র্যা ব সদস্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব খুনে জড়ান।

হত্যার পর ২৩ ধরনের পরিচয়ঃ

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো নিয়ে এসবির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিহতদের নামের পাশে পরিচয়ের ঘর রয়েছে। তাতে নিহত ব্যক্তিদের ২৩ ধরনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা–কর্মীও রয়েছেন। তবে বেশির ভাগ নামের পাশে ‘সন্ত্রাসী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বন্দুকধারী’ বা ‘অস্ত্রধারী’, ‘মাদক কারবারি’, ‘জলদস্যু’, ‘বনদস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘ছিনকাইকারী’, ‘মামলার আসামি’, ‘চরমপন্থী’ ইত্যাদি পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকেও এসব পরিচয়ে ক্রসফায়ারে মারা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

উল্লিখিত সাত বছরে ক্রসফায়ারে নিহত ৪৭৭ জনের পরিচয় লেখা হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদক কারবারি। এরপর সবচেয়ে বেশিজনের (৩০০ জন) পরিচয়ের ঘরে লেখা হয়েছে ডাকাত, রোহিঙ্গা ডাকাত ও ছিনতাইকারী। নিহত ১৪২ জনের পরিচয় ‘সন্ত্রাসী’ লেখা।

এতে ৫ জনকে বিএনপি ও অন্যান্য সংগঠনের সদস্য এবং ৯ জনকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে তালিকায় ২০১৭ সালের পর থেকে নিহত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় আর উল্লেখ করেনি এসবি।

এ ছাড়া জলদস্যু, বনদস্যু ও দস্যু পরিচয়ে ৮৩ জন, দুষ্কৃতকারী পরিচয়ে ৩৩ জন, বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি পরিচয়ে ১৭ জন, অন্যান্য মামলার আসামি পরিচয়ে ১৬ জন, চরমপন্থী পরিচয়ে ১৬ জন এবং অস্ত্রধারী বা বন্দুকধারী পরিচয়ে ৩৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তা ছাড়া ধর্ষক বা ধর্ষণের আসামি পরিচয়ে ৭ জন, মানব পাচারকারী পরিচয়ে ৯ জন ও স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী সদস্য পরিচয় দেওয়া হয় ৬ জনের।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৫২ জনের কোনো পরিচয় ক্রসফায়ার–সংক্রান্ত পুলিশের নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া পাহাড়ি বিভিন্ন সশস্ত্র দল ও সংগঠনের সদস্য পরিচয়ে ৬ জন, চোরাকারবারি পরিচয়ে ৩ জন এবং অপহরণকারী পরিচয় দেওয়া হয়েছে ২ জনের।

কোন এলাকায় কতো হত্যাঃ

ক্রসফায়ারের পুলিশি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, যা আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, এখানে নিহত হন ২৯১ জন। এরপরেই রয়েছে খুলনা, সেখানে নিহত ২৬০ জন। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচার ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হয়।

এই সময়ে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই কোনো না কোনো সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা কক্সবাজারে। সাত বছরে (২০১৫–২১) এই জেলায় ২২৬ জন নিহত হন পুলিশ, র্যা বসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ক্রসফায়ারে। জেলা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ারে ঘটনা ঢাকায়; এখানে নিহত ১৫১ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ৭০ জন। সবচেয়ে কম ঘটনা শেরপুর, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে। এসব জেলায় সাত বছরে একজন করে নিহত হন।

জড়িত কোন কোন বাহিনীঃ

পুলিশের বিশেষ শাখার নথিতে (২০১৫–২১ সাল) ১ হাজার ৭টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ১ হাজার ২৯৩ জন নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫১টি ঘটনায় পুলিশ ও ২৯৩টিতে র্যাাব যুক্ত ছিল। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যুক্ত ছিল ৪৬টি ঘটনায়। ১০টি ঘটনায় পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি ইত্যাদি বাহিনী যৌথভাবে অংশ নেয়। বাকি ঘটনাগুলোয় কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বাহিনী যুক্ত ছিল।

নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেশিঃ

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। এটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এ বছরের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হয়। তার আগে ৪ মে থেকে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। যদিও এই অভিযানের পরও দেশে মাদকের কারবার কমেনি, বরং বেড়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে খবর বের হয়েছিল।

এসবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩০০টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ৩৫৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ২০২টি ঘটনায় জড়িত ছিল পুলিশ, ৯৬টিতে ছিল র্যানব, পুলিশের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীর যৌথ অভিযান ছিল একটি এবং বিজিবি ও র্যা বের যৌথ অভিযান ছিল একটি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২২৭ জনকে মাদক কারবারি আখ্যা দেওয়া হয়। বাকিদের মধ্যে ৪৬ জনের পরিচয় লেখা হয়েছে ডাকাত বা ছিনতাইকারী।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে; ওই বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারের ২৪১টি ঘটনায় ৩০৭ জন নিহত হন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ১২৮ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন, যা আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু। এর আগে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৫ জন। মাঝের বছরগুলোতে ২০১০ সালে ৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২ জন, ২০১২ সালে ৫৮ জন ও ২০১৩ সালে ৪২ জন নিহত হন।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ক্রসফায়ার ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিপক্ষকে দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। এ জন্য নির্বাচনের আগে-পরে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে।

বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে তাদের ৬৫১ জন নেতা–কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির বলছে, এই সময়ে একইভাবে তাদের ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ক্রসফায়ার থেকে গুলিতে অভ্যস্ততাঃ

শেখ হাসিনা সরকারের একপর্যায়ে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গুম করার ভয়ংকর প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগ দিয়ে গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ভুক্তভোগীদের বড় অংশই ছিল বিরোধী দলের নেতা–কর্মী।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে শেখ হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদে দেশে পাঁচ শতাধিক মানুষ গুমের শিকার হন। পরবর্তী সময়ে অনেকের লাশ পাওয়া যায়। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কেউ কেউ অনেক পরে ছাড়া পান। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের হিসাবে এখনো ১৫৮ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সংগঠনটি নিখোঁজ এই ব্যক্তিদের তালিকা গত ১৮ আগস্ট ২০২৪ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দিয়ে আসে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে মৃত্যু ও গুমের ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আর এটা করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা অনেকটা ‘বন্দুকবাজ’ হয়ে ওঠে বলেও আলোচনা রয়েছে।

(ঘ)  শাপলা চত্বর গণহত্যাঃ

বিগত ০৫ মে ২০২৫ তারিখে “যুগান্তর পত্রিকায়” প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়-

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে নিহতদের মধ্যে ৯৩ জনের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ঘটনার পরপর হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে ৬১ জন নিহতের তথ্য জানিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছিল শাপলা চত্বরের অভিযানে কেউ মারা যায়নি। যদিও তাদের এই বক্তব্য কেউই বিশ্বাস করেনি।

প্রসঙ্গত, ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননা ও নারীনীতির বিরোধিতাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। এতে হাজার হাজার কওমি আলেম শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মুসলমান মহাসমাবেশে অংশ নেন।

সেদিন রাত গভীর হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সরিয়ে দেয় তাদের। অভিযানে ব্যাপক গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়া হয়। হেফাজতে ইসলামের দাবি, ওইদিন অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৯৩ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে এবার।

(ঙ) বিডিআর হত্যাকান্ডঃ

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।

ওই ঘটনার পর হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনে করা মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। এছাড়া আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই হত্যাকান্ডের সাথে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার অনুগত কিছু নেতাকর্মী জড়িত। এছাড়া বিশেষ বাহিনীর কিছূ অফিসারও জড়িত। তবে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে বলে সঠিক তথ্যটি বলা যাচ্ছে না।

বিগত ১১ আগস্ট ২০২৫তারিখে “নয়া দিগন্ত” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

২০০৯ সালের ২৫ ফেরুয়ারি ঘটে যাওয়া দেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ সরকারের মদদ ও প্রতিবেশী ভারতের সম্পৃক্ততার তথ্য জানার অপরাধেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব:) জাহিদুল ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলাম।

গতকাল ১০ আগস্ট ২০২৫ তারিখ রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে দেয়া এক অভিযোগে জেবুন্নাহার দাবি করেন, তার স্বামীকে ‘জঙ্গি’ অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকেও দুই শিশুকন্যাসহ ৪ মাস ৭ দিন গুম করে অমানবিক নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে নতুন অভিযোগ পাওয়ার খবর দৈনিক নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করে প্রসিকিউটর গাজী এইচ তামিম বলেছেন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেজর (অব:) জাহিদুল ইসলামকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা এবং তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে গুমের ঘটনার একটি অভিযোগ গতকাল ট্রাইব্যুনালে জমা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেয়ার পর জেবুন্নাহারের পক্ষে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনার একটি মেজর জাহিদকে হত্যা। মূলত বিডিআর বিদ্রোহে আ’লীগ ও ভারত সম্পৃক্ততা জেনে যাওয়ায় মেজর জাহিদকে হত্যা করা হয়েছিল।

যে সব ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা হলেন : সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক; ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান মো: মনিরুল ইসলাম; সিটিটিসির সাবেক প্রধান মো: আসাদুজ্জামান; মিরপুর বিভাগের তৎকালীন ডিসি মাসুদ আহমেদ; রূপনগর থানার তৎকালীন ওসি সহিদ আলম; রূপনগর থানা-পুলিশের তৎকালীন অজ্ঞাত সদস্যরা।

(চ)  বাংলাদেশের গুম কমিশনের তথ্যমতে, রাজনৈতিক কারণে এখনো অন্তত ২১১ জন নিখোঁজঃ

৩০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

বাংলাদেশের গুম কমিশনের তথ্যমতে, রাজনৈতিক কারণে এখনো অন্তত ২১১ জন নিখোঁজ। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের গড়া সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর অন্যতম সংগঠক আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, এ সংখ্যা ৩৫০ জনেরও বেশি।

গুম হওয়াদের বেশিরভাগই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামপন্থি অন্যান্য দলের নেতাকর্মী। অথচ একটি ঘটনারও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।

জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গুম আন্তর্জাতিক আইনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও লাতিন আমেরিকার মতো বাংলাদেশও শেখ হাসিনার আমলে সেই কালো মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে।

তবুও আশা জাগা নিয়া একটি খবর এসেছে ২৮ আগস্ট ২০২৫। উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম বৈঠকে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।  প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে গুমের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। প্রতিটি জেলায় ট্রাইব্যুনাল হবে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে। ১২০ দিনে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে ট্রাইব্যুনালকে।

১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

গুম কমিশনের প্রতিবেদন-গুম-খুনে জড়িত জিয়াউলসহ ২৩ কমান্ডার চিহ্নিত।

(ছ)  বিশ্ব সিরিয়াল কিলার জিয়াউলঃ

১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

বিশ্ব সিরিয়াল কিলার জিয়াউল মাথায় গুলি করে এক হাজার ৩০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। গুম করে মানুষদের আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। তার একটা নেশা ছিল এই গুম ব্যক্তিদের হাত-পা-চোখ বেঁধে নৌকায় করে মাঝ বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যেত। গুলি করে লাশটা নদীতে ফেলত। গুলিটা ভিকটিমের মাথার কাছে নিয়ে করত। গুলি করার পর নিহত ব্যক্তির মগজ ও রক্তের গরম ছিটা হাতে লাগলে দারুণ ফিলিংস অনুভব করতো।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বক্তব্যের সূত্র ধরে আমার দেশ অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই হিংস্র খুনি বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত র্যা বের বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় নিজের টিম নিয়ে এই খুনগুলো করেছেন তিনি। গুম করা ব্যক্তিকে খুন করতে তিনি বলতেন-‘গলফ করো’।

অর্থাৎ ওকে খুন করো। জিয়াউল আহসান এখন কেরানীগঞ্জ বিশেষ কারাগারের ধলেশ্বরী ভবনে ডিভিশনপ্রাপ্ত সেলে বন্দি আছেন। টেলিফোনে জানতে চাইলে বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সায়েফ উদ্দিন নয়ন জানান, সুনির্দিষ্ট কী অপরাধে তিনি কারাগারে আছেন বলতে পারছি না। তবে তিনি ১৫টি মামলায় (ধারা ৩০২, ৩০৭, ১০৯, ৩২৬) বন্দি আছেন।

(জ)  জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মুসলিম হত্যাঃ

১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ২০১৬ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুরে সাতজনকে হত্যার মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১  আজ ১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখ সোমবার এই পরোয়ানা জারি করেছেন।

শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৬ সালে মাদ্রাসাপড়ুয়া সাত ছাত্রকে গুম করা হয়। পরে গাজীপুরের জয়দেবপুরে একটি বাড়িতে বাইরে থেকে তাদের তালাবদ্ধ করা হয়। জঙ্গি অভিযোগ চালিয়ে সাতজনকে হত্যা করা হয়।

জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করেছে আ.লীগঃ

বিগত শনিবার, ১১ জানুয়ারি , ২০২৫ তারিখে “গ্রামের কাগজ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-

বিগত সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার নামে বিরোধী দল ও মতকে দমন করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের অনুকম্পায় ক্ষমতায় টিকেছিল বলে উল্লেখ করে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের নিরীহ মুসলমানদের জঙ্গি তকমা লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের নাটক সাজিয়ে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে দাবি করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার কৌশল অবলম্বন করেছিল আওয়ামী লীগ।

শনিবার (১১ জানুয়ারি ২০২৫) রাজধানীর এফডিসিতে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গি প্রচারণা নিয়ে ছায়া সংসদে তিনি এসব কথা বলে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনায় প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন হয় নাই। এর সঙ্গে অন্যকোনো রাষ্ট্রের বা গোষ্ঠীর যোগসূত্র রয়েছে কি না তা পুনঃতদন্তের প্রয়োজন আছে। আন্দাজ, অনুমান ও কল্পিত কাহিনীর মাধ্যমে বিচার করায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সবাই খালাস পেয়েছে। ৪০০ বছরের ফৌজদারি মামলার ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে এমন একটি নজির নাই যেখানে দ্বিতীয়বার স্বীকারোক্তি নিয়ে একজন মানুষকে সাজা দেয়া যায়। যা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় ডিজিএফআই-এর বিশেষ সেলে আটক রেখে মুফতি হান্নানকে দিয়ে তারেক রহমান, আলী আহসান মুজাহিদ, আব্দুস সালাম পিন্টুসহ শীর্ষ বিরোধী নেতাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গি ইস্যু ব্যবহার করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতের আমির শফিকুল ইসলামের মতো শীর্ষ রাজনীতিবিদকে সন্ত্রাসী হিসেবে জেলে আটকে রেখেছিল। ধর্মীয় উগ্রবাদকে সামনে এনে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার নামে বিগত সরকার বিরোধী দল ও মতকে দমন করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের অনুকম্পায় ক্ষমতায় টিকেছিল।

সভাপতির বক্তব্যে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, পতিত আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা রকম অপকৌশল অবলম্বন করেছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল জঙ্গি দমনের নামে মানুষ হত্যা। তারা পশ্চিমা বিশ্বসহ ভারতকে দেখাতে চেয়েছিল বাংলাদেশে ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত উগ্রবাদী জঙ্গি রয়েছে। যে জঙ্গিরা শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের জন্য হুমকি। আওয়ামী সরকারই এই জঙ্গিবাদ দমন করতে পারবে। বিশ্ববাসীর কাছে জঙ্গিবাদ দমনে আওয়ামী লীগ নিজেকে রোল মডেল হিসেবে দাবি করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার কৌশল অবলম্বন করেছিল। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে তারা বার বার নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জঙ্গি তকমা লাগিয়ে নানা রকম নাটক সাজিয়ে হত্যা করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে দাড়ি রাখা, টুপি পরা, বোরকা পরা, মসজিদে নামাজ আদায় করা ব্যক্তিদের টার্গেট করা হতো। এমনকি যেসব বাসা-বাড়ি থেকে ফজরের নামাজ আদায়ে মসজিদে যেত তাদেরকে টার্গেট করা হতো জঙ্গি আখ্যায়িত করার জন্য।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট নানা রকম পুরস্কার, পদোন্নতি ও প্রণোদনা বিনিময়ে জঙ্গি ধরার অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে পরিস্থিতি দেখে মনে হতো সারা দেশ জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, র্যা ব, পুলিশ, ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থা কার আগে কে তথাকথিত জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কার করবে, মিডিয়া কাভারেজ নেবে, দেশে-বিদেশে বাহবা কুড়াবে, যেকোনো মূল্যে জঙ্গি দমনের সাফল্য দেখাতে হবে - এমন পরিস্থিতি চলছিল। তথাকথিত সাফল্য দেখাতে গিয়ে এসব বাহিনী তৎকালীন আওয়ামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বহু মানুষ হত্যার মাধ্যমে অনেক পরিবারকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। প্রায় সব জঙ্গি দমন ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো গল্প সাজানো ছিল।

‘দেশকে জঙ্গি তকমা দেয়া ছিল আওয়ামী শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান হাতিয়ার’ শীর্ষক ছায়া সংসদে প্রাইম ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকদের পরাজিত করে ঢাকা কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। ছায়া সংসদটি আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।

প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক নয়ন মুরাদ, সাংবাদিক আহমেদ সরওয়ার ও সাংবাদিক রিয়াজ রায়হান। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।

বিগত ০২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “ফ্যাসিস্ট হাসিনার কথিত ইসলামি জঙ্গিরা গেল কোথায়” শিরোনামে জানা যায়, বাংলাদেশে গত দেড় দশক ধরে চালানো তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলো মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস, জাতীয় নির্বাচন অথবা রাজনৈতিক উত্তেজনার আগমুহূর্তে হঠাৎ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘জঙ্গি আস্তানা’র সন্ধান, ‘বড় হামলা নস্যাৎ করা হয়েছে’ এমন খবর প্রচার করা হতো।

প্রেস ব্রিফিংগুলো ছিল প্রায়ই একই ভাষায়—‘বড় হামলার পরিকল্পনা ভেঙে পড়েছে’, ‘ষড়যন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে’, ‘জঙ্গিদের জাল উপড়ে ফেলা হয়েছে’। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো বড় জঙ্গি হামলা, অভিযান বা জঙ্গিবিরোধী কোনো নাটক দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি এক জটিল প্রশ্নকে সামনে এনেছে তা হলো—এতদিন ধরে যাদের ‘সক্রিয় জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল তারা হঠাৎ করে কোথায় গেল?

আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ঢাকতে রাষ্ট্রীয় মদতে একের পর এক জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে। ওই আমলে এমন একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ যেন জঙ্গির অভয়ারণ্য। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিকতা দেখলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অসারতা ফুটে ওঠে। ২০০৯-১০ সালে জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের নামে প্রথম দফা গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়। ২০১১ সালে রাজশাহী, দিনাজপুর ও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বিস্ফোরক উদ্ধার এবং ২০১৩ সালে শাহবাগ-হেফাজত উত্তাপের সময়ে নানা স্থানে নাটকীয় গ্রেপ্তার-নির্দেশনা ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে অনেককে ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক করা হয়; ব্লগার হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন অভিযানে অনেককেই হত্যা করা হয় বন্দুকযুদ্ধে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক অপারেশন চালানো হয়। ‘থান্ডারবোল্ট’, ‘শোলাকিয়া’, ‘সানডেভিল’, ‘ইগল হান্ট’ ইত্যাদি। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সময়ে সিলেটের শিববাড়ি, আশকোনা, কল্যাণপুর, গাজীপুরসহ জেলায় জেলায় অভিযানে অনেক তরুণকে জঙ্গি তকমা দিয়ে হত্যা করা হয়। কোভিডকালে বড় আকারের হামলার নাটক না থাকলেও গ্রেপ্তার অভিযান চালু ছিল; ২০২৩-২৪ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিবসের আগে হঠাৎ করে ‘জঙ্গি গ্রেপ্তারের নাটক’ দফায় দফায় দেখা গেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর এ ধরনের ঘটনা আর দেখা যায়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান মূলত ভারতীয় বয়ান এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার ছিল। বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থান হচ্ছে, এদের দমাতে না পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরি হবে—এভাবে ভারতীয়দের সহায়তায় ইউরোপ এবং আমেরিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সফলও হয়েছে। এ কারণে বহির্বিশ্ব থেকে বড় ধরনের কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়নি হয়তো। বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান রোধে আওয়ামী সরকার দরকার বলে বহির্বিশ্বের অনেক দেশকে বুঝাতে চেয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার।’

শেখ হাসিনার আমলে নিপীড়নের শিকার মুফতি হারুন ইজহার আমার দেশকে বলেন, অবৈধ ক্ষমতার মসনদকে টিকিয়ে রাখতে বিদেশিদের কাছে হাসিনা জঙ্গিফোবিয়া তৈরি করে নিজেকে মৌলবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে জাহির করে। আর এজন্য তার প্রয়োজন পড়ে জঙ্গি নাটকের। এমন নাটকের প্রাসঙ্গিকতাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে জুলাই বিপ্লব।

(ঝ) খুন-সন্ত্রাসের মাফিয়া ডন আসাদুজ্জামান কামালঃ

বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার  দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়- খুন-সন্ত্রাসের মাফিয়া ডন আসাদুজ্জামান কামাল।

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব নিয়েই রাজারবাগে পুলিশের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলকে তিনি দেখে নেবেন। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’ তিনি তার কথা রেখেছেন। গুমের হুকুম দেওয়া, ক্রসফায়ারের অনুমতি প্রদান, রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শায়েস্তাকরণ ও অপহরণ মাদকের ব্যবসাসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। নানা অপকর্ম করে কামাল পরিণত হন সন্ত্রাসের মাফিয়া ডন হিসেবে।

জুলাই বিপ্লবে গণহত্যার নির্দেশদাতাঃ

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সরাসরি যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনে ১৪০০ জনের মতো নিহত হয়। তাদের বেশিরভাগ মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় কাজে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।

রিপোর্টে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১২ জুলাই তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে পুলিশ, র্যা ব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে আসাদুজ্জামান খান কামাল অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরো দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন। এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই বৈঠকেও আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন। কামালের ধানমন্ডির বাসায় কোর কমিটির বৈঠকে তিনি নির্দেশ জারি করতেন।

কামালের অপকর্ম ছিল কয়েক ভাগে বিভক্ত। প্রথমত তিনি যত রকম পুলিশ নিয়োগ, পোস্টিং হতো সবকটি থেকে নিয়মিত অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করতেন। মেধা বা পরীক্ষার ভিত্তিতে নয়, কামালের একটি তালিকার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব নিয়োগ হতো। সে তালিকায় যে শুধু কামালের পছন্দের ব্যক্তি থাকত এমনটি নয়, সারা দেশে যে মাফিয়াচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে চক্রের লোকেরা পাঠাত তালিকা এবং বস্তাভর্তি টাকা। সে টাকা এবং তালিকা অনুযায়ী কাজ করতেন কামাল। ফলে পুলিশ বাহিনী পরিণত হয়েছিল কামালের অনুগত এক বাহিনীতে।

সূত্র জানায়, কামালের আরেকটি বড় অপকর্ম হলো তিনি ছাত্রলীগ, যুবলীগকে অকাতরে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন। কামালের ১০ বছরের মন্ত্রিত্বের সময় প্রায় ৩২ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সবই দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডারদের। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের জন্য এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি গড়ে তুলেছিলেন হেলমেট বাহিনী। এই হেলমেট বাহিনী বিরোধী দল ও মতের ওপর চড়াও হতো। এভাবেই একটি ‘প্যারালাল সন্ত্রাসী বাহিনী’ তৈরি করেছিলেন কামাল।

ফ্যাসিবাদী আমলে পুলিশ পদক পাওয়ার গল্প

বিগত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শেষ ১১ বছরে পুলিশ পদক পান এক হাজার ৬৫৬ জন। বিরোধী দলমতকে দমন-পীড়ন, গুম-খুন ও জঙ্গিনাটক মঞ্চায়নসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের দেওয়া হয় এসব পদক। পদক দেওয়া হয় তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদেরও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদক দেওয়া হয় ‘রাতের ভোট’খ্যাত ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের। অতীতের রেওয়াজ ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া সব আইজিপি এসব পুরস্কারে ভূষিত হন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুককে বেদম পেটানোর পর টানা দুই বছর হারুন অর রশিদকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিতে ভূমিকা রাখায় ২০১৬ সালে তাকে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী স্বার্থরক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। র্যা বে দায়িত্ব পালনকালে গুম-খুনে জড়িত বর্তমানে গ্রেপ্তারে থাকা বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানকেও করা হয় ‍পুরস্কৃত। এছাড়াও মনিরুল ইসলাম, বিপ্লব কুমার সাহা, প্রলয় জোয়ার্দারের মতো পুলিশ কর্মকর্তারাও হত্যা, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের পুরস্কার হিসেবে এসব পদক পান।

পুলিশের পদকপ্রাপ্তদের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হাসিনার ক্ষমতার শেষ ১১ বছরে (২০১৩-২৩) এক হাজার ৬৫৬ পুলিশ সদস্যকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪০ জন, ২০১৪ সালে ২০ জন, ২০১৫ সালে ৮৬ জন, ২০১৬ সালে ১০২ জন, ২০১৭ সালে ১৩২ জন, ২০১৮ সালে ১৮২ জন, ২০১৯ সালে ৩৪৯ জন, ২০২০ ও ২০২১ সালে ২৩০ জন, ২০২২ সালে ১১৫ জন এবং ২০২৩ সালে ৪০০ জন পুরস্কার পান। তারা এসব পুরস্কার অর্জন করেন বিএনপি ও জামায়াতকর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমন, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সুনাম প্রতিষ্ঠা এবং সাজানো জঙ্গিনাটক মঞ্চায়ন করার মাধ্যমে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম ও সিটিটিসির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় জঙ্গি নিধনের নামে বিরোধী মত দমন ও ইসলামি ভাবধারার তরুণ-তরুণীদের হত্যার স্কোয়াড। জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে আলেমসহ মেধাবী তরুণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যাকেই শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে বাধা মনে হয়েছে, তাকেই হত্যা করা হয়। এ অপকর্মে জড়িত ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখা, র্যা বের গোয়েন্দা বিভাগ, এসবির সংশ্লিষ্ট উইং, সিটিটিসি, এটিইউ এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট উইং।

বিগত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “গণঅভ্যুত্থান দমনে তিন লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল” শিরোনামে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে সারা দেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশে পুলিশ মোট তিন লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। এর মধ্যে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ডই ছোড়া হয় ঢাকা মহানগরে। জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, তদন্ত চলাকালে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এক স্মারকের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি সংক্রান্ত ২১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রাপ্ত হই। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার ও পিস্তলসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে শুধু ঢাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশে ব্যবহার করা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি।

তিনি আরো জানান, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে নিরীহ, নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হাজার হাজারকে গুরুতর জখম ও অঙ্গহানি, নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, অপহরণ, মিথ্যা মামলা দায়ের, জীবিত ও মৃত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে দেওয়া, চিকিৎসা ও জানাজা-দাফনে বাধা, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পরিবর্তনে বাধ্য করা, নিহতদের মরদেহ পরিবারকে না দিয়ে বেওয়ারিশ পরিচয়ে তড়িঘড়ি করে দাফন, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়, হাসপাতালে আহতদের ওপর পুনরায় হামলা এবং আন্দোলনরত ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়।

বিগত ০৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, “আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে হত্যার নির্দেশনা ছিল শেখ হাসিনার।”

এতোক্ষণে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে এটাই প্রমাণিত যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার অনুগত বাহিনী হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। পরকালে আমলের দিক থেকে যেমন সর্বপ্রথম সালাতের হিসেব নেয়া হবে তেমনি বিচারের দিক থেকে সর্বপ্রথম নরহত্যার বিচার করা হবে। সালাত ও নরহত্যা এই দুটাতেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা আটকে যাবে। আসুন কুরআন হাদিস অনুযায়ী ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের কেমন শাস্তি হবে তা জেনে নেই।

পৃথিবীতে যতো রকমের গুনাহের কাজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করা। এরপর সবচেয়ে বড় গুনাহ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। হত্যাকারীর জন্য মহান আল্লাহ দুনিয়ায় বড় শাস্তি এবং আখেরাতে তীব্র আযাবের ঘোষণা দিয়েছেন।

আল্লাহ  তায়ালা বলেন,

“কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা। ...আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন”। (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৯২-৯৩)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল”। (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩২)।

আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন মানুষের (অপরাধের) মধ্যে সর্বপ্রথম নরহত্যার (অপরাধের) বিচার করা হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৩৩, ৬৮৬৪, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬১৫, ২৬১৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৭৮, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩৯৬, ১৩৯৭, নাসায়ী ২৯৯১, ২৯৯২, ২৯৯৩, ২৯৯৪, ২৯৯৬, আহমাদ ৩৬৬৫, ৪২০১, সহীহাহ ১৭৪৮, আধুনিক প্রকাশনী ৬০৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬০৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ফজরের নামায পড়লো, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকলো। অতএব তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারিকে নষ্ট করো না। যে ব্যক্তি তাকে হত্যা করবে, আল্লাহ তাকে তলব করে এনে উল্টো মুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৪৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনে ’আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম যিম্মীকে হত্যা করবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধ অবশ্যই চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যাবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৮৬, ২৬৮৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৬৬, ৬৯১৪, নাসায়ী ৪৭৫০, গায়াতুল মারাম ৪৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৯৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রিফা’আ ইবনে শাদ্দাদ আল-কিতবানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমর ইবনুল হামিক আল-খুযাঈ (রাঃ) -র নিকট আমি যে বাক্যটি শুনেছি তা না থাকলে আমি মুখতারের মাথা ও দেহের মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলা করতাম (তাকে হত্যা করতাম)। আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন লোকের জানের নিরাপত্তা দেয়ার পর তাকে হত্যা করলো সে কিয়ামতের দিন বিশ্বাসঘাতকতার ঝান্ডা বয়ে বেড়াবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৮৮, আহমাদ ২১৪৩৯, ২১৪৪, রাওদুন নাদীর ৭৫১, ৭৫২, সহীহাহ ৪৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অবৈধভাবে কাউকে হত্যা করলে তার শাস্তিঃ

অবৈধভাবে কেউ কাউকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করলে তার শাস্তি হচ্ছে, ক্বিসাস্ তথা হত্যার পরিবর্তে হত্যা অথবা দিয়াত তথা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদ। তবে এ ব্যাপারে হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা রাজি থাকতে হবে অথবা আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে নির্ধারিত সম্পদ। অনুরূপভাবে হত্যাকৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা হত্যাকারীকে একেবারে ক্ষমাও করে দিতে পারে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস্ তথা হত্যার পরিবর্তে হত্যা নির্ধারণ করা হলো। স্বাধীনের পরিবর্তে স্বাধীন, দাসের পরিবর্তে দাস এবং নারীর পরিবর্তে নারী। তবে কাউকে যদি তার ভাই (মৃত ব্যক্তি) এর পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করে দেয়া হয় তথা মৃতের ওয়ারিশরা ক্বিসাসের পরিবর্তে দিয়াত গ্রহণ করতে রাজি হয় তবে ওয়ারিশরা যেন ন্যায় সঙ্গতভাবে তা আদায়ের ব্যাপারে তাগাদা দেয় এবং হত্যাকারী যেন তা সদ্ভাবে আদায় করে। এ হচ্ছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে লঘু সংবিধান এবং (তোমাদের উপর) তাঁর একান্ত করুণা। এরপরও কেউ সীমালংঘন করলে তথা হত্যাকারীকে হত্যা করলে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (সুরা আল বাক্বারাহ্  ১৭৮)।

রাসুল সাঃ বলেন,

আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তাকে হত্যা করা বৈধ নয় তিনটি অপরাধের যে কোনো একটিতে লিপ্ত না হলেঃ (১) বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করবে, (২) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে অথবা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হবে অথবা তাকে দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হবে, (৩) আর কাউকে হত্যা করলে তার বিনিময়ে কিসাসস্বরূপ তাকেও হত্যা করা যাবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫৩, নাসায়ী : ৭/৯১; হাকিম : ৪/৩৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ আরো বলেন,

 সাঈদ ইবনু আবূ সাঈদ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ সুরাই আল কাবি (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শোনো হে খুযাআহ গোত্রের লোকেরা! তোমরা হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছো। আর আমি তার রক্তমূল্য পরিশোধ করবো। আমার এ কথার পর যাদের কোনো লোককে হত্যা করা হবে তখন নিহতের পরিবার দু’টি বিকল্প অবস্থার যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারবে। দিয়াত গ্রহণ করবে অথবা হত্যা করবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫০৪, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি আরো বলেন,

যুহায়র ইবনু হারব ও উবায়দুল্লাহ্ ইবনু সাঈদ (রহঃ)....আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা যখন তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মক্কাহ (মক্কা) বিজয় দান করলেন- তখন তিনি লোকদের উদ্দেশে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তিনি প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করলেন। অতঃপর বললেন, নিশ্চিত আল্লাহ তা’আলা হস্তী বাহিনীর মক্কায় (মক্কায়) প্রবেশে বাধা প্রদান করেছেন এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদেরকে মক্কাহ (মক্কাহ) অভিযানে বিজয়ী করেছেন। আমার পূর্বে কারও জন্য এখানে রক্তপাত বৈধ ছিল না। আর আমার জন্যও একদিনের কিছু সময় এখানে যুদ্ধ করা হালাল করা হয়েছিল। আমার পরে আর কারও জন্য তা কখনও হালাল করা হবে না। অতএব এখানকার শিকারের পশ্চাদ্ধাবণ করা যাবে না, এখানকার কাটাদার গাছও উপড়ানো যাবে না এবং এখানকার পতিত জিনিস তোলা যাবে না। তবে ঘোষণা প্রদানকারী (তা তুলে নিতে পারবে)।

কারও কোন আত্মীয় নিহত হলে তার জন্য দুটি অবস্থার যে কোন একটি গ্রহণের অধিকার রয়েছেঃ হয় ফিদয়া (রক্তপণ) গ্রহণ করতে হবে নতুবা হত্যাকারীকে কিসাস স্বরূপ হত্যা করতে হবে। আব্বাস (রাযিঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! কিন্তু ইযখির ঘাস যা আমরা কবরে দিয়ে থাকি এবং আমাদের ঘরের চালায় ব্যবহার করি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কিন্তু ইযখির ঘাস (এর কাটার অনুমতি দেয়া হল)। ইয়ামানের অধিবাসী আবূ শাহ (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে (এ কথাগুলো) লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আবূ শাহকে লিখে দাও।

ওয়ালীদ (রহঃ) বলেন, আমি আওযাঈ (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ "হে আল্লাহর রসূল! আমাকে লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করুন"-তাঁর এ কথার অর্থ কী? তিনি বললেন, যে ভাষণ তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিতে শুনলেন তা। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩১৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৫৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫০৫; সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩১৭১, ইসলামীক সেন্টার ৩১৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ বলেন,

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, যখন আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) মক্কা-বিজয় দান করলেন তখন তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লোকদের সামনে দাড়িয়ে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা ও গুণগান করার পর বললেনঃ যার আপন কেউ নিহত হয়েছে সে দুটি বিকল্পের মধ্যে একটি গ্রহণ করতে পারে। সে চাইলে খুনীকে ক্ষমাও করতে পারে অথবা তাকে হত্যাও করতে পারে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১২, ২৪৩৪, ৬৮৮০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩১৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৫৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০৫, নাসায়ী ৪৭৮৫, ৪৭৮৬, ৪৫০৫, আহমাদ ৭২০১, ইরওয়া ৪/২৪৯, ৭/২৫৮, ২১৯৮, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে বিচারকের দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি সর্বপ্রথম হত্যাকৃতের ওয়ারিশদেরকে ক্ষমার পরামর্শ দিবেন।

রাসুল সাঃ বলেন,

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কোনো কিসাস জনিত বিবাদ পেশ করা হলে তিনি ক্ষমা করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৯৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পিতা-মাতা অথবা দাদা-দাদী তাদের কোন সন্তানকে হত্যা করলে তাদেরকে তার পরিবর্তে হত্যা করা যাবে না।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ সন্তান হত্যার অপরাধে পিতাকে হত্যা করা যাবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৬২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০০, ইরওয়া ২২১৪, আহমাদ : ১/২২ ইব্নুল জারূদ্, হাদীস ৭৮৮ বায়হাক্বী : ৮/৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে তাদেরকে সন্তান হত্যার দিয়াত অবশ্যই দিতে হবে এবং তারা হত্যাকৃতের ওয়ারিসি সম্পত্তি হিসেবে উক্ত দিয়াতের কোন অংশই পাবে না।

আমর ইবনে শু’আইব (রহঃ) থেকে বর্ণিত। মুদলিজ গোত্রীয় আবূ কাতাদা নামক এক ব্যক্তি নিজ পুত্রকে হত্যা করে। উমার (রাঃ) তার থেকে একশত উট আদায় করেন, যার মধ্যে ছিল তিরিশটি হিক্কা, তিরিশটি জাযাআ এবং চল্লিশটি গর্ভবতী উষ্ট্রী। অতঃপর তিনি বললেন, নিহতের ভাই কোথায়? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ হত্যাকারীর জন্য (নিহতের) উত্তরাধিকার স্বত্ব নাই। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৪৬, আহমাদ ৩৪৯, মুয়াত্তা মালেক ১৬২০, ইরওয়া ১৬৭০, ১৬৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ ছাড়াও হত্যাকারী ব্যক্তি হত্যাকৃত ব্যক্তির যে কোন ধরনের ওয়ারিশ হলেও সে উক্ত ব্যক্তির ওয়ারিসি সম্পত্তির কিছুই পাবে না। এমনকি দিয়াতের কোন অংশও নয়।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হত্যাকারী (নিহতের) ওয়ারিস হবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৪৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২১০৯, ইরওয়া ১৬৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হত্যাকারী কোন মুসলিমকে কোন কাফির হত্যার পরিবর্তে ক্বিসাস্ হিসেবে হত্যা করা যাবে না। বরং তাকে উক্ত হত্যার পরিবর্তে দিয়াত দিতে হবে।

(ক) আবূ জুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ’আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) কে বললাম, আপনাদের নিকট এমন কোন জ্ঞান আছে কি যা অন্যদের অজ্ঞাত? তিনি বলেন, না, আল্লাহর শপথ! লোকেদের নিকট যে জ্ঞান আছে তা ব্যতীত বিশেষ কোন জ্ঞান আমাদের নিকট নাই। তবে আল্লাহ যদি কাউকে কুরআন বুঝবার জ্ঞান দান করেন এবং এই সহীফার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দিয়াত ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা আছে (তাহলে স্বতন্ত্র কথা)। এই সহীফার মধ্যে আরো আছেঃ কোন কাফেরকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৫৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১১, ১৮৭০, ৩০৪৭, ৩০৩৪, ৩১৭২, ৩১৮০, ৬৭৫৫, ৬৯০৩, ৬৯১৫, ৭৩০০, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪১২, ২১২৭, নাসায়ী ৪৭৩৪, ৪৭৩৫, ৪৭৪৪, ৪৭৪৫, ৪৭৪৬, ৪৫৩০, আহমাদ ৬০০, ৬১৬, ৪৮৪, ৯৬২, ৯৯৪, ১০৪০, দারেমী ২৩৫৬, ইরওয়া ২২০৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আমর ইবনে শু’আইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন কাফেরকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৫৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪১৩, ইরওয়া ২২০৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন কাফেরকে হত্যার অপরাধে কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না এবং চুক্তিভুক্ত কোন যিম্মীকেও তার চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় হত্যা করা যাবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হত্যাকারী যে কোন পুরুষকে যে কোন মহিলা হত্যার পরিবর্তে হত্যা করা যাবে। অনুরূপভাবে হত্যাকারী ব্যক্তি যেভাবে হত্যাকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ঠিক সেভাবেই হত্যাকারীকে হত্যা করা হবে।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এক ইয়াহূদী একটি দাসীর মাথা দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে পিষে দিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, কে তোমাকে এরূপ করেছে? অমুক ব্যক্তি, অমুক ব্যক্তি? যখন জনৈক ইয়াহূদীর নাম বলা হল- তখন সে দাসী মাথার দ্বারা হ্যাঁ সূচক ইশারা করল। ইয়াহূদীকে ধরে আনা হল। সে অপরাধ স্বীকার করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন। তখন তার মাথা দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে পিষে দেয়া হল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪১৩, ২৭৪৬, ৫২৯৫, ৬৮৭৬, ৬৮৭৭, ৬৮৭৯, ৬৮৮৪, ৬৮৮৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৫৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৭২, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৬৫, ২৬৬৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩৯৪, নাসায়ী ৪০৪৪, ৪৭৪১, ৪৭৪২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫২৭, ৪৫২৮, ৪৫২৯, ৪৫৩৫, ১২৩৩৭, ১২৫৯৪, ১২৬৯৪, দারেমী ২৩৫৫, ইরওয়া ১২৫২, আত-তালীকু আলাত তানকীল ২/৮৮,আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা যেহেতু বিনা কারনে, বিনা বিচারে হাজার হাজার নিরীহ লোকদেরকে অপহরণ, গুম, খুন করেছে সেইহেতু ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের প্রতিটি হত্যার বিপরীতে হত্যা করা ফরজ। বর্তমানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫২টি ফৌজদারী মামলা দায়ের হয়েছে। এসবের মধ্যে হত্যা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের বিরুদ্ধেও হত্যাসহ অনেক মামলা দায়ের হয়েছে। এখন দেখা যাক, রাস্ট্র ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের হত্যার পরিবর্তে কিরুপ বিচার করে।

ক্বিসাস সত্যিকারার্থে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। বরং তাতে এমন অনেকগুলো ফায়েদা রয়েছে যা একমাত্র বুদ্ধিমানরাই উদ্ঘাটন করতে পারেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বিসাসের ফায়েদা বা উপকার সম্পর্কে বলেন:

‘‘হে জ্ঞানী লোকেরা! ক্বিসাসের মধ্যেই তোমাদের সকলের বাস্তব জীবন লুক্কায়িত আছে। (কোন হত্যাকারীর উপর ক্বিসাসের বিধান প্রয়োগ করা হলে অন্যরা এ ভয়ে আর কাউকে হত্যা করবে না। তখন অনেকগুলো তাজা জীবন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে) এতে করে হয়তো বা তোমরা আল্লাহ্ভীরু হবে’’। (সুরা আল বাক্বারাহ্ ১৭৯)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা যতো মানুষ খুন করেছে তার সঠিক বিচারে যদি সমপরিমান ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের হত্যা করা হয় তাহলে পরবর্তী অন্য কোনো শাসক স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সাহস পাবে না। শুধু এক শাসকের বিচারেই কিয়ামত পর্যন্ত অন্যায় বা অবৈধভাবে কিংবা বিনা বিচারে হত্যাকান্ড বন্ধ হয়ে যাবে। প্রজাদের সে লক্ষ্যে কাজ করা ফরজ।

হত্যাকারী সনাক্ত করা না গেলে রাষ্ট্র তার ক্ষতিপূরণ দিবেঃ

সাহল ইবনে আবূ হাসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তাকে তার কওমের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত লোক জানিয়েছেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে সাহল এবং মুহাইয়্যাসা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে খায়বার এলাকায় গেলেন। অতঃপর মুহাইয়্যাসার নিকট লোক মারফত খবর পৌঁছলো যে, আবদূল্লাহ ইবনে সাহলকে হত্যা করে তার লাশ খায়বারের একটি গর্তে অথবা একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছে। মুহাইয়্যাসা (রাঃ) ইহূদীদের নিকট গিয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! তোমরাই তাকে হত্যা করেছো। তারা বললো, আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে হত্যা করিনি।

অতঃপর তিনি তার গোত্রে ফিরে এসে তাদের নিকট এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি ও তার বড় ভাই হুয়াইয়্যাসা এবং আবদুল রহমান ইবনে সাহল (রাঃ) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলেন। খায়বারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুহাইয়্যাসা (রাঃ) কথা বলতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেনঃ জ্যেষ্ঠকে, জ্যেষ্ঠকে অগ্রাধিকার দাও। তিনি বয়সে বড় বুঝাতে চাচ্ছিলেন। হুওয়াইয়্যাসা কথা বললেন, তারপর মুহাইয়্যাসা কথা বললেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইহূদীরা হয় তোমাদের সঙ্গীর দিয়াত প্রদান করবে অথবা যুদ্ধের ঘোষণা দিবে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি সম্পর্কে পত্র লিখলে ইহূদীরা প্রতি উত্তরে লিখে পাঠায়, আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে হত্যা করিনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুওয়াইয়্যাসা, মুহাইয়্যাসা ও আবদুর রহমান (রাঃ)-কে বললেনঃ তোমরা কি শপথ করে তোমাদের সঙ্গীর খুনের বদলা দাবি করতে পারো? তারা বললো, (আমরা শপথ করবো) না। তিনি বলেনঃ তারা তো মুসলিম নয় (মিথ্যা শপথ করবে)।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের অর্থাৎ (রাষ্ট্রের) পক্ষ থেকে তার দিয়াত পরিশোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট একশত উষ্ট্রী পাঠান এবং সেগুলি তাদের বসতিতে পৌঁছে গেলো। সাহল (রাঃ) বলেন, সেগুলির মধ্যকার একটি লাল উষ্ট্রী আমাকে লাথি মেরেছিল। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৭৭, ২৬৭৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৭০২, ৩১৭৩, ৬১৪২, ৬৮৯৮, ৭১৯২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪২২, নাসায়ী ৪৭১০, ৪৭১১, ৪৭১২, ৪৭১৩, ৪৭১৪, ৪৭১৫, ৪৭১৬, ৪৭১৭, ৪৭১৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৬৩৮, ৪৫২০, ৪৫২১, ৪৫২২, ৪৫২৩, আহমাদ ১৫৬৬৪, ১৬৬২৫, মুয়াত্তা মালেক ১৬৩০, ১৬৩১, দারেমী ২৩৫৩, ইরওয়া ১৬৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

খুনীকে ক্ষমা করবে কে, রাষ্ট্রপতি নাকি নিহতের পরিবার?

বাংলাদেশ সংবিধানের ১ম পরিচ্ছেদ ৪৯ নং ধারায় উল্লেখ আছে  “কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে−কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে−কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে”।

উক্ত ধারার ক্ষমতাবলে একজন রাষ্ট্রপতি যেকোনো খুনীসহ যেকোনো অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন।

উক্ত সাংবিধানিক ধারা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী তথা আল্লাহ ও রাসুল সা. এর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণার শামিল। একমাত্র অনৈসলামিক দলগুলোই কুরআন বিরোধী এই আইন বাস্তবায়ন করে চলছে। কোনো অনৈসলামিক দলকে সমর্থন করা বা ভোট দেয়া মানেই উক্ত কুরআন বিরোধী আইনকে সমর্থন করা তথা আল্লাহ ও রাসুল সা. এর বিরুদ্ধে যাওয়া। আপনি একজন মুসলমান হয়ে অনৈসলামিক দলকে ভোট দিয়ে নিজের ঈমান আমল কি নষ্ট করবেন?

ইসলামে ক্ষমা করার বিষয়টি ছেড়ে দেয়া হয়েছে নিহতের পরিবারের উপর। কেউ কাউকে খুন করলে নিহতের পরিবার অভিযোগ দায়ের করলে ইসলাম তাকে তিনটি শর্ত দিয়ে দেয়। শর্ত তিনটি হচ্ছেঃ-

(ক)  নিহতের পরিবার খুনের পরিবর্তে খুনীকে খুন করবে তথা কিসাস আদায় করবে।

(খ)  অথবা দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ আদায় করবে।

(গ)  নতুবা ক্ষমা করে দিবে।

এখানে তিনটির যেকোনো একটি করতে হবে। দুইটি এক সাথে আদায় করা যাবে না।

প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা, আল্লাহর এই আইন আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে চালু নেই। (ব্যতীক্রম ১/২টি রাষ্ট্র)। যেসব রাষ্ট্রে অনৈসলামিক দল ক্ষমতায় আছে সেইসব রাষ্ট্রে ইসলামি কোনো সমাজ ব্যবস্থা নেই। অথচ মুসলিম নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যে, তারা সরকার গঠন করলে ইসলামি আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে কিন্তু সেই দায়িত্ব থেকে তারা সরে এসে মানবরচিত আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এর জন্যে দায়ী মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও সেইসব ভোটার যারা তাদেরকে ভোট দিয়ে ইসলাম বিমূখী হতে সহযোগীতা করছে।

ইসলামি শরিয়াহ আইনে ৯টি দন্ডবিধির মধ্যে খুন বা হত্যা একটি। কেউ কাউকে ইচ্ছেকৃতভাবে হত্যা করলে তার শাস্তির বিধান কি হবে ইসলামে তা পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে। অথচ এই ইসলামি শরিয়াহ আইন বাংলাদেশের মুসলিম শাসকগণ গ্রহণ না করে তারা মানবরচিত আইনে রাষ্ট্র শাসন করে আসছে। এটা আল্লাহ ও রাসুল সা. এর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা। আমরা জানি যে, যারা ইসলামি বিধান মোতাবেক বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফির, মুশরিক, জালিম ও মুনাফিক। এদের স্থান হবে জাহান্নামে । আর এদের যারা সমর্থক বা ভোটার তাদেরকেও এদের সাথে জাহান্নামে যেতে হবে।

জনসাধারণকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো ও মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়ার সাথে আওয়ামী গংরা জড়িত

প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও কোণঠাসা করে রাখার নিকৃষ্ট পদ্ধতি হলো মামলায় জড়ানো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বছরের পর বছর জেলখানায় রেখে বিরোধী শক্তি দমন করে স্বৈরতন্ত্র দীর্ঘায়িত করেছিলেন।  বিরোধী দলকে দমন করতে যেসব মামলা দেয়া হয়েছিল তার ৯৫% মামলাই ছিল মিথ্যে। এইসব মামলার বাদি ও সাক্ষী এরা সবাই ছিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাজানো। বর্তমানে সেইসব সাক্ষী ও বাদিরা স্বীকারোক্তি দিচ্ছে যে, তাদেরকে জোড়পূর্বক ও হুমকি ধমকি দিয়ে এসব করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এখন আসুন আমরা জেনে নেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা কতোগুলো মিথ্যে মামলা সাজিয়েছিল,

(ক) ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪২৮২৫ মামলা, গ্রেপ্তার ৫০৩২৬৫৫:

বিগত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মামলার জালে বন্দি বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা।  আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাজার হাজার মামলা দায়ের হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। মামলার বেড়াজালে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরছাড়া। অনেকে আবার রয়েছে আত্মগোপনে। গত ১৫ বছরে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮২৫টির বেশি মামলা হয়েছে বলে বিএনপি’র দপ্তর সূত্র জানিয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনের বেশি।

(খ) কারও ৪৫০, কারও ৩০০, বিএনপি নেতাদের কার বিরুদ্ধে কত মামলা:

বিগত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখা এ হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে।

(গ) নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা, কোন পথে এগুচ্ছে বিএনপি:

বিগত ০৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ২০০৯ সালের পর গত ৫ জুলাই  ২০২৪ পর্যন্ত সারা দেশে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩ মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। শুধু গত বছরের (২০২৩) ২৮ অক্টোবর থেকে তিন মাসের মধ্যে সারা দেশে ১ হাজার ৬৪৫ মামলায় প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে পাইকারি গ্রেফতারের পাশাপাশি গণহারে মামলার সাজা দেওয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ঢাকার বিভিন্ন আদালত। বিএনপি ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যমতে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে এখনো অন্তত ৯০টি মামলা চলমান রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নামে প্রায় ৫০টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০টি, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ৫০টি মামলা রয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ৩৫৭টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশি, যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ৪ শতাধিক, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির ৬০টি মামলা রয়েছে। প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর ৩১৫টি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনুর ২২৬টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে রয়েছে ২১২টি মামলা। একইচিত্র বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ও জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও।

খালেদা জিয়ার মামলা: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলা তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থায় ৪টি মামলা হলেও বাকিগুলো পরবর্তী সরকারের আমলে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৫ সালে।

তারেক রহমানের মামলা: বিএনপি ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যমতে, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৭ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে ৮২টির বেশি মামলা হয়েছে।

(ঘ) বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে নাশকতার ৮১০৫ মামলা, বিচার হয়েছে ১৯৬৭টির:

বিগত  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সাল এবং ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৮ হাজার ১০৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৬৭টি মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ১ হাজার ২৪১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শাজাহান খান তাঁর প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ এবং ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে  প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মামলা–সংক্রান্ত ওই সব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিএনপি ও তার দোসররা নির্বাচন প্রতিহতের নামে অযৌক্তিক ও জনসম্পৃক্ততাহীন আন্দোলনের মাধ্যমে আগুন-সন্ত্রাস, নিরীহ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা এবং জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করার অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে। এই অশুভ শক্তি শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানকেই অস্বীকার করছে না, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষার যে জনবান্ধব ধারার সৃষ্টি হয়েছে, তা বানচাল করে অতীতের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাইছে। বাংলাদেশকে তারা আবারও উগ্র জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-লুটপাটের সেই দুঃসহ দিনগুলোতে ফিরিতে নিতে চায়।

প্রধানমন্ত্রী জানান, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের ‘সন্ত্রাসীদের’ হাতে গাড়ির চালক, চালকের সহকারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাধারণ মানুষসহ ১৮৮ জন নিহত হন। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৪ হাজার ৯৭৩ জন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিএনপি জামায়াতকে ঘিরে যেসব অপবাদ তৈরী করেছে সেসব অপবাদের সাথে মূলত আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই জড়িত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মব তৈরী করতো আর দায়ভার চাপিয়ে দিতো বিএনপি জামায়াতের উপর। ফ্যাসিস্ট হাসিনা যেসব খুনের বর্ণনা দিয়েছে এই খুনগুলো তাদেরই তৈরী। বিএনপি জামায়াত জড়িত নয়। হয়তো আত্ম রক্ষার্থে বাঁধা দিতে গিয়ে কেউ যদি আহত নিহত হয় সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

(ঙ) জামায়াত-শিবির নিধনে পতিত আওয়ামীলীগের সর্বশক্তি প্রয়োগঃ

বিগত ২৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে,

জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে দলটির ৩৫৮ জন শহীদ হন। ক্রসফায়ারে নিহত হন ৮৬ জন। মহিলা জামায়াতের ছয়জন এবং ছাত্রী সংস্থার একজন বিভিন্ন সময় শহীদ হন। ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। এরমধ্যে জামায়াতের পুরুষ ৯১ হাজার ৬৭৫ জন, নারী এক হাজার ৮৭ জন, ছাত্র ১৭ হাজার ৪৬৩ জন এবং ৬৭৬ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হন। বিভিন্নভাবে আহত হন ৭৫ হাজার ৫৮৫ নেতাকর্মী। পঙ্গু হন পাঁচ হাজার ২০৪ জন। পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতিত হন ৯৬ হাজার ৯৩ জন আর গুম-অপহরণের শিকার হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে এখনো অন্তত সাতজন নিখোঁজ।

আওয়ামী শাসনামলে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাঁচ হাজার বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ওই সময়ে জামায়াতের তিন হাজার ২১টি দলীয় অফিস বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষতি হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জামায়াত নেতাদের সংশ্লিষ্ট ২২০টি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাটে ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সমর্থিত ৮৫৮ নেতাকর্মী শহীদ হন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব শহীদের আলাদা দলীয় পরিচয় দিতে চাইছে না দলটি। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যেসব সমর্থক নিহত হয়েছেন, তাদের পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।

শিবির সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী আমলে তাদের ১০১ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। মামলা হয় ১৭ হাজারের বেশি। ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৬৬ হাজার নেতাকর্মী।

সূত্রমতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল জামায়াতের। অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই চলত দলীয় কার্যক্রম। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকেই চরম জুলুম-নির্যাতন ও দমনের মুখে পড়ে দলটি। একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরও। অবশ্য ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে জামায়তবিরোধী অবস্থানের জানান দেয় আওয়ামী লীগ।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের নামে প্রহসনঃ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে দলটিকে দমনে সর্বোচ্চ তৎপরতা শুরু করে আওয়ামী সরকার। সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে সাজানো মামলায় বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে একে একে দলটির সাবেক আমির ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কারা হেফাজতে চিকিৎসার নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করে জামায়াত।

ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে সাজানো মামলা, সাক্ষী আর আওয়ামী আস্থাভাজন বিচারকদের মাধ্যমে এ বিচার কার্যক্রম চালানো হয়। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে বিচারিক হত্যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল আওয়ামী সরকার। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও প্রবাসী আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন ফাঁসের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া জোর করে সাক্ষ্য দেওয়ারও অভিযোগ করেন অনেক সাক্ষী।

হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারঃ

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার আর বানোয়াট মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মিছিল-মিটিং করলেই ধাওয়া বা ঘেরাও করে যেমন গ্রেপ্তার করা হতো, তেমনি দিনে-রাতে বাসাবাড়ি, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া গেলেই ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিচিত নেতাকর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারতেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বা নিরাপদ স্থানে থাকতেন সবাই। এতে অনেকেই চরম হয়রানির পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হন। পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন।

দলীয় সূত্রমতে, বিগত আওয়ামী শাসনামলে ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটিএম আজহারুল ইসলাম ছাড়া তেমন নেতাকর্মী জেলে না থাকলেও অধিকাংশ মামলা এখনো চলমান।

শুধু জামায়াত শিবির ও বিএনপিরাই নয় অন্যান্য দলের বা মতের লোক বিশেষ করে আলেমদের ধরে মিথ্যে মামলা দিয়ে জেল খাটানো, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা আবার অনেককে অপহরণ, গুম, খুন করা ছিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিত্য দিনের নাস্তা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পুরো দেশটাকে জেলখানা বানিয়ে জনসাধারণকে জিম্মি করে রেখেছিলেন।

উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করে যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা জনসাধারণের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে তাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছিলো। কিন্তু মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়া এক জঘন্য অপরাধ। ফ্যসিস্ট হাসিনা গংদের এই অপকর্মের জন্য শাস্তি পেতে হবে। আসুন কুরআন হাদিস এসম্পর্কে কী বলে তা জেনে নেই।

বর্তমান সময়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সর্বাধিক যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে জেলে পাঠানো। জমিজমা সংক্রান্ত, যৌতুক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।

অথচ মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে কাউকে ফাঁসানো যে অন্যায় এই হিতাহিত জ্ঞান মানুষের দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। এরুপ অন্যায়ের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে মানবরচিত ও ইসলামি আইনে শাস্তি পেতে হবে। মানবরচিত আইনে এই শাস্তির বিধান রাজনৈতিক কারণে নড়চড় হয়ে থাকে। দুর্বল চিত্তের লোককগুলো  শাস্তি পায় কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যে মিথ্যে মামলাগুলো দায়ের করা হয় সেগুলো ক্ষমতাসীন দল যতোদিন থাকে ততোদিন প্রতিপক্ষ মিথ্যে মামলায় শাস্তি পেতে থাকে কিন্তু ক্ষমতাসীণ দল বিরোধী দলে পরিনত হলে তারাও একইভাবে মিথ্যে মামলায় জড়াতে থাকে আর শাস্তি পেতে থাকে। এভাবেই চলে রাজনৈতিক খেলা। এই খেলা খেলতে গিয়ে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদাতাগণ রাজনৈতিক কারণে দুনিয়ায় শাস্তি না পেলেও  এদেরকে কিয়ামতে পাকড়াও করা হবে। সেইদিন কোনো রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। এদের প্রত্যেককেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতেই হবে।

মানবরচিত আইনে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদানের শাস্তি

মানুষ ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশায় আগের তুলনায় বতর্মানে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আদালতমুখী হয়েছে। যার ফলে দৈনিক আদালতেও বিভিন্ন বিষয়ে হচ্ছে প্রচুর মামলা। আর এসব ক্ষেত্রে আদালতে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী অপরিহার্য। সাক্ষ্য ছাড়া বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন না।

অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেকেই মিথ্যে মামলা দায়ের করেন। আবার অনেকে কার্যসিদ্ধির জন্য আদালতে মিথ্যে সাক্ষ্য উপস্থাপন করেন। এই সাবির্ক ক্ষেত্রে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক যদি বুঝতে পারেন মামলায় সাক্ষী মিথ্যে কথা বলছে বা মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে, তাহলে তিনি আইনানুসারে মিথ্যে সাক্ষীকে সাজা দিতে পারবেন।

সাক্ষ্য গ্রহণের আগে প্রত্যেক সাক্ষীকে শপথ আইনের ৫ ধারা অনুসারে সত্য বলার হলফ পাঠ করতে হয়। এই হলফ করার পর হলফকারী সত্যকে সত্য হিসাবে এবং মিথ্যেকে মিথ্যে হিসেবে তুলে ধরতে বাধ্য।

এ ছাড়া দন্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যে সাক্ষী সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সত্য বলার জন্য আইনত বাধ্যগত ব্যক্তি যদি এমন কোনো বিবৃতি আদালতে প্রদান করে যা সে মিথ্যে বলে জানে বা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তবে সে বা ওই ব্যক্তি মিথ্যে সাক্ষী দেয় বলে গণ্য হবে।

কিছুদিন আগেও উটকো ঝামেলার ভয়ে মানুষ সহজে আদালতের দ্বারস্থ হতো না। তবে ইদানীং আদালত অনেকটাই মানুষের আস্থার জায়গা করে নিয়েছে। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আছে বলেই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কোনো ঝামেলা হলেই দেখা যায় আদালতের দ্বারস্থ হতে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধান বাংলাদেশের শ্রমগণকে এই অধিকার দিয়েছে। অন্য কোনো আইন দ্বারা এই অধিকার খবর্ করা যাবে না। আইনের সাধারণ নীতি অনুযায়ী, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেনো আইনের বিচারে সাজা না পায়। আদালত এবং আইন সুনিদির্ষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই কাউকে সাজা দিয়ে থাকেন। বিচারিক দৃষ্টিতে সাবির্ক প্রেক্ষিত অনুযায়ী দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমা প্রমাণের পরিমাণ বা মাত্রার পরিমাপক হিসেবে দুটি মানদন্ড আছে। যেমন,

(ক) ফৌজদারি মানদন্ড যা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ বা সন্দেহাতীত প্রমাণ এবং

(খ) দেওয়ানি মানদন্ড যা সম্ভাব্য ভারসাম্যপূবর্ক প্রমাণ করা হয় প্রত্যেক মোকদ্দমার চুড়ান্ত বিচারিক পর্যায়ে।

দেশের আদালত এবং থানাগুলোর দিকে একটু খেয়াল করে তাকালেই দেখা যায় প্রতিনিয়ত মিথ্যে মামলা হচ্ছে। আদালতে এ সব ধরনের মামলা-মোকদ্দমা প্রমাণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ জরুরি বটে। আমরা সহজেই বুঝতে পারি  অনেকে মিথ্যে মামলা দায়েরের পর তা প্রমাণ করার জন্য মিথ্যে সাক্ষীর ব্যবস্থা করে। এ সংক্রান্ত কাজে যদি আদালতে প্রমাণিত হয় সাক্ষী মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে, তবে আইন তাকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যে মামলা দায়ের এবং মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তবে তার জন্য আইনে রয়েছে প্রেক্ষিত অনুযায়ী শাস্তির বিধান।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইন ২০০০(সংশোধনী-২০০৩)-এর সঙ্গে সবাই কম-বেশি পরিচিত। এই আইনে মামলার হারটাও অনেক বেশি। এই আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন তবে ওই ব্যক্তির সাত বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অথর্দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। তবু এই আইনে অনেক মিথ্যে মামলা দায়ের এবং মিথ্যে মামলায় মিথ্যে সাক্ষ্য উপস্থাপিত হচ্ছে।

ফৌজদারি কাযির্বধি ২৫০ ধারায় মিথ্যে মামলার শাস্তির বিধান রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেয়ার সময় প্রমাণ পান যে, মামলাটি মিথ্যে ও হয়রানিমূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২০৯ ধারা মতে, মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ  দুই বছর কারাদন্ডসহ অথর্দন্ডে দন্ডিত হবে।

আবার ২১১ ধারায় বলা হয়েছে, মিথ্যেভাবে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করেন তবে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পযর্ন্ত কারাদন্ড বা অথর্দন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।

মিথ্যে সাক্ষী বা সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে দন্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পযর্ন্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

দন্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান বলে আইনত বাধ্য হয়ে বা কোনো বিষয়ে কোনো ঘোষণা করার জন্য আইনবলে বাধ্য হয়ে এরূপ কোনো বিবৃতি প্রদান করে, যা মিথ্যে এবং যা সে মিথ্যে বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তা হলে ওই ব্যক্তি মিথ্যে সাক্ষ্য দেয় বলে পরিগণিত হবে। কোনো বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোনোভাবে দেয়া হোক না কেনো তা এই ধারায় অন্তভুর্ক্ত হবে।

দন্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিচারবিভাগীয় মোকদ্দমায় কোনো পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যে সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে সেই ব্যক্তির যে কোনো বণর্নার কারাদন্ড হতে পারে, যার মেয়াদ সাত বছর তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। কেউ যদি আবার অন্য কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান করে তবে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদন্ড এবং অথর্দন্ড হতে পারে।

সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য মৃত্যুদন্ডের শাস্তির বিধানও রয়েছে। দন্ডবিধির ১৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যে সাক্ষ্য দান বা মিথ্যে সাক্ষ্য তৈরি করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে অথবা ১০ বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং তাকে অর্থদন্ডেও দন্ডিত করা হবে। আবার যদি ওই মিথ্যে সাক্ষ্যের ফলে কোনো নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড কাযর্কর হয়, তবে যে ব্যক্তি অনুরূপ মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান করবে তাকেও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।

মানবরচিত আইনে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তি অনেক ভয়াবহ। এতদসত্বেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা এইসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের বানানো সাক্ষী দিয়ে হাজার হাজার মিথ্যে মামলায় মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে হাজার হাজার লোককে জেল খাটিয়েছে , অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মিথ্যে মামলার যারা বাদী ও সাক্ষী তারা এখন স্বীকার করছে যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা তাদেরকে মিথ্যে মামলা দায়ের করতে ও সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে।  তাহলে এদের এখন কী শাস্তি হবে?

ইসলামি আইনে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদানের শাস্তি

(ইসলামে মিথ্যে সাক্ষ্য দানের ভয়াবহতা)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দেহে জিহবা ও দুই ঠোঁট সংযোজন করেছেন (সুরা বালাদ ৯০/৯), যাতে তারা কথা বলতে পারে। আর আল্লাহর দেওয়া মুখ ও ঠোঁট দিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত সত্য কথা বলবে, সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিবে যদিও তা তার নিজের, নিজ পিতা-মাতার এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ (সূরা নিসা, আয়াত ১৩৫)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত ৮)।

উত্তম সাক্ষ্য দাতার  আলোচনায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি উত্তম সাক্ষী সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবো না? তলব (আহবান) করার পূর্বেই যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দেয় সে হলো উত্তম সাক্ষী। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২২৯৫, ২২৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রয়োজনের সময় সাক্ষ্য না দিয়ে তা গোপন করা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত।

 ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, যে ব্যক্তি তা গোপন করে নিশ্চয় তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে সম্বন্ধে সম্যক অবগত।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৩)।

মিথ্যে সাক্ষ্য না দেওয়ার হুকুম

সকল বিদ্বান একমত যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবীরা গুনাহ। (বুখারী হা/৫৯৭৬; মুসলিম হা/৮৭)।

আবূ বকরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের সব থেকে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললামঃ অবশ্যই সতর্ক করবেন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার গণ্য করা, পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসলেন এবং বললেনঃ মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, দু’বার করে বললেন এবং ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৭৬, ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৬০, ১৬১, ১৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া আল্লাহর বান্দার অন্যতম গুণ। আল্লাহ বলেন,‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয় তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে’। (সুরা ফুরক্বান ২৫/৭২)।

আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হ’ল, না জেনে কথা কথা বলার ন্যায় অপরাধ’। (মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়া (রহঃ) বলেন, আল্লাহর বাণী,وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ এর অর্থ হ’ল ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া’। (দ্র. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা ইসরা ৩৬ নং আয়াতের তাফসীর)।

অনুরূপভাবে সাক্ষ্য গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষীর মত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’। (সুরা বাক্বারাহ ২/২৮৩)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও সাক্ষ্য গোপন করা সবচেয়ে বড় গুনাহ’। (তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা বাক্বারাহ ২/২৮৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র:)।

অনুরূপভাবে সাক্ষীর জন্যও ওয়াজিব হ’ল সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক (সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’। (সুরা আন নিসা ৪/১৩৫)।

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কুফল

(১) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবীরা গুনাহঃ

কবীরা গুনাহের অন্যতম হলো মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫৩, ৫৯৭৭, ৬৮৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬১-১৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৮, আহমাদ ১২৩৩৮, আধুনিক প্রকাশনী ২৪৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৪৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi)।

আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপন করা ও পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। অতঃপর ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৭৬; ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩০১, গাইয়াতুল মারাম ২৭৭,আধুনিক প্রকাশনী ৫৫৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪৩৮)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদীছ হ’তে মিথ্যা সাক্ষ্যদান যে একটি মহা পাপ তা তিনভাবে প্রমাণিত হয়। প্রথমত: এ কাজ করলে মহাপাপী হ’তে হয়, যা শিরকের মত মহাপাপের সাথে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা মূর্তিরূপ অপবিত্রতা বর্জন কর এবং মিথ্যা কথা (সাক্ষ্য) হ’তে দূরে থাক’। (সুরা হজ্জ ২২/৩০)।

দ্বিতীয়ত: রাসূল (ছাঃ) হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু এই দুষ্কর্মের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে সকলকে সাবধান করতে উঠে বসে তা উল্লেখ করলেন।

তৃতীয়ত: তা বার বার উল্লেখ করে তার অনিষ্টকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং জিহবার এমন পাপ অত সহজ নয়, যত সহজে মানুষ তা জিহবা দ্বারা করে থাকে। (আবদুল হামিদ ফায়যী, জিভের আপদ পৃ: ৪০)।

(২) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের সমতুল্য আপরাধঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের ন্যায় মহাপাপ। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আল্লাহর সাথে শিরক করার সাথে সমতুল্য। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পড়লেন, ‘অতএব তোমরা মূর্তির অপবিত্রতা হ’তে দূরে থাক, মিথ্যা কথা পরিহার কর, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না’ (হজ্জ ২২/৩০-৩১)। (বায়হাকী শু‘আবুল ঈমান হা/৪৫২১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৭০৩৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৩০১, সনদ হাসান)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য শিরকের মত’ (হজ্জ ২২/৩০)। (ইবনু কাছীর, সূরা হজ্জ ৩০-এর তাফসীর দ্রঃ; নাযরাতুন নাঈম ৮/৪৭৮০)।

এর কারণ হচ্ছে, ‘মিথ্যা কথা’ শব্দটি ব্যাপক। এর সবচেয়ে বড় প্রকার হচ্ছে শিরক। তা যে শব্দের মাধ্যমেই হোক না কেন। আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরীক করা এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকার তথা ইবাদতে তাঁর বান্দাদেরকে অংশীদার করা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। অনুরূপভাবে পারস্পরিক লেন-দেন ও সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যাও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এ সঙ্গে মিথ্যা কসমও একই বিধানের আওতায় আসে। (কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) (সঊদী আরব: বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স ১৪৪০ হিঃ), পৃ. ১৭৬৬-১৭৬৭)।

(৩) অন্যের প্রতি যুলুমঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অন্যের প্রতি যুলুম করার শামিল। এই যুলুমের দ্বারা কখনো অন্যের সম্পদ এমনকি কখনো অন্যের জীবনও চলে যেতে পারে।

উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন দুই ব্যক্তি উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে সাক্ষী ব্যতীত শুধু প্রাপ্যের দাবী নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসেছিল।এমতাবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আমি যদি তোমাদের কাউকে তার ভাইয়ের হক (তোমাদের একজনের মিথ্যার বলার দরুন) প্রদান করি, তখন আমার সে ফায়সালা দোষী ব্যক্তির জন্য হবে জাহান্নামের একখন্ড আগুন। এ কথা শুনে তারা উভয়েই বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার অংশটি আমার সঙ্গীকে দিয়ে দিন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না; বরং তোমরা উভয়ে (সমানভাবে) ভাগ-বণ্টন করে নাও। আর ভাগ-বণ্টনের মধ্যে হক পন্থা অবলম্বন করবে এবং পরস্পরের মধ্যে লটারী করে নিবে। অতঃপর তোমরা একে অপরকে ঐ অংশ থেকে ক্ষমা করে দিবে।

অপর এক বর্ণনাতে আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আমি তোমাদের মাঝে এ ফায়সালা স্বীয় জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা করছি। এ ব্যাপারে আমার নিকট কোনো ওয়াহী অবতীর্ণ হয়নি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৭০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৮৪, ইরওয়া ১৪২৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৪) অন্যের হক নষ্ট করা হয়ঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে অন্যের হক নষ্ট করা হয়। একজনের হক অন্যকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং অন্যকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর এটা যেহেতু বান্দার হক সেহেতু বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।

কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ ও ’আলী ইবনু হুজর (রহঃ)....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা কি বলতে পার, অভাবী লোক কে? তারা বললেন, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা কড়ি) ও ধন-সম্পদ নেই সে তো অভাবী লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক ’আমল থেকে দেয়া হবে, অমুককে নেক আমল থেকে দেয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হাক তার নেক ’আমল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪১৮, সহীহাহ (৮৪৫), আহকামুল জানাইয (৪), ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ।

(৫) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে নাঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে ব্যক্তির ভাল আমলও আল্লাহর নিকটে গ্রহণীয় হবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) ছিয়াম সম্পর্কে বলেন ‘যে লোক মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করল না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই’। (বুখারী হা/৬০৫৭; আবূদাঊদ হা/২৩৬২; তিরমিযী হা/৭০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৬৮৯)।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করলো না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০৫৭, সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৮৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭০৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৩৬২, আধুনিক প্রকাশনী ৫৬২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৫১৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৬) হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করাঃ

মিথ্যা সাক্ষ্যের দ্বারা আল্লাহর হালালকৃত বিষয় অনেক সময় হারাম করা হয় আবার অনেক সময় হারামকে হালাল করা হয়।

(৭)  ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামতঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করে সালাম দেয়ার প্রচলন ঘটবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফলে স্বামীর ব্যবসায়ে স্ত্রীও সহযোগিতা করবে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করা হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যদানের প্রচলন হবে এবং সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে, লেখনীর প্রসার ঘটবে’। (আহমাদ হা/৩৮৭০; ছহীহাহ হা/৬৪৭; ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/৮০১)।

(৮) জাহান্নামে যাওয়ার কারণঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য অনেকের জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হ’তে পারে। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, কোন লোক জ্ঞাতসারে নিজ পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পিতা বলে দাবী করলে সে আল্লাহর সাথে কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল’।  (সহিহ বুখারী হা/৩৫০৮; সহিহ মুসলিম হা/৬১)।

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, কোন লোক যদি নিজ পিতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও অন্য কাকে তার পিতা বলে দাবী করে তবে সে আল্লাহর কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে বংশ সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার কোন বংশ সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ৩৫০৮,  ৬০৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২৪৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী বানানো হলেও সাক্ষ্য না দেয়া

(১) নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মাতা আমার পিতাকে তার মালের কিছু আমাকে দান করতে বললেন। পরে তা’ দেয়া ভালো মনে করলে আমাকে তা দান করেন। তিনি (আমার মাতা) তখন বললেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সাক্ষী মানা ব্যতীত আমি রাজী নই। অতঃপর তিনি (আমার পিতা) আমার হাত ধরে আমাকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে গেলেন, আমি তখন বালক মাত্র। তিনি বললেন, এর মা বিনতে রাওয়াহা একে কিছু দান করার জন্য আমার নিকট আবেদন জানিয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যতীত তোমার আর কোন ছেলে আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আছে। নু‘মান (রাঃ) বলেন, আমার মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, আমাকে অন্যায় কাজে সাক্ষী করবেন না। আর আবূ হারীয (রহ.) ইমাম শা‘বী (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আমি অন্যায় কাজে সাক্ষী হতে পারি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫০, ২৫৮৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(২) ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা। ‘ইমরান (রাঃ) বলেন, আমি বলতে পারছি না, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (তাঁর যুগের) পরে দুই যুগের কথা বলেছিলেন, বা তিন যুগের কথা। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের পর এমন লোকেরা আসবে, যারা খিয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না। সাক্ষ্য দিতে না ডাকলেও তারা সাক্ষ্য দিবে। তারা মান্নত করবে কিন্তু তা পূর্ণ করবে না। তাদের মধ্যে মেদওয়ালাদের প্রকাশ ঘটবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫১, ৩৬৫০, ৬৪২৮, ৬৬৯৫, মুসলিম ৪৪/৫২ হাঃ ২৫৩৫, আহমাদ ১৯৮৫৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) আবদুল্লাহ (ইবনু মাস‘ঊদ) (রাঃ) সূত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম ব্যক্তি, অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী। অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী এরপরে এমন সব ব্যক্তি আসবে যারা কসম করার আগেই সাক্ষ্য দিবে, আবার সাক্ষ্য দেয়ার আগে কসম করে বসবে। ইবরাহীম (নাখ্ঈ) (রহ.) বলেন, আমাদেরকে সাক্ষ্য দিলে ও অঙ্গীকার করলে মারতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫২, ৩৬৫১, ৬৪২৯, ৬৬৫৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৩৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৩৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩০২, ২৩০৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৯, আহমাদ ৪১৩০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে প্রমাণিত হলে করণীয়

ইমামদের মতে, যে ব্যক্তি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা প্রমাণিত হবে তার নাম চারদিকে প্রচার করে দিতে হবে (কুরতুবী)।

ওমর (রাঃ) বলেন, ‘তার পিঠে চাবুক মারতে হবে, মাথা ন্যাড়া করে দিতে হবে, মুখ কালো করে দিতে হবে এবং দীর্ঘদিন অন্তরীণ রাখতে হবে’।

ওমর (রাঃ)-এর আদালতে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনি তাকে একদিন প্রকাশ্যে জনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং ঘোষণা করে দেন যে, এ ব্যক্তি হচ্ছে অমুকের ছেলে অমুক, এ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, একে নিচে রাখো। তারপর তাকে কারাগারে বন্দী করেন’। (বায়হাকী, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আছার, ১৪/২৪৩; কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), পৃঃ ১৭৬৭)।

আওয়ামী মিথ্যে সাক্ষ্য দাতাদের পরকালীন শাস্তি

(১) আল-আশ্আছ ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার এবং এক ইহূদীর যৌথ মালিকানাধীন এক খন্ড জমি ছিল। সে আমার অংশ অস্বীকার করলে তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট পেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেনঃ তোমার কি দলীল-প্রমাণ আছে? আমি বললাম, না। তিনি ইহূদীকে বলেনঃ শপথ করো। আমি বললাম, এ সম্পর্কে সে শপথ করার সাথে সাথে আমার সম্পত্তি নিয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন (অনুবাদ) ’’নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই’’। (সূরা আল ইমরানঃ ৭৭)...আয়াতের শেষ পর্যন্ত। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২২, আহমাদ ২১৩৩০, ইরওয়া ২৬৩৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ, ইবনু নুমায়র এবং ইসহাক ইবনু ইবরাহীম আল হানযালী (রহঃ).....আবদুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত চূড়ান্ত কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে অথচ সে মিথ্যাবাদী। এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটবে যে, তিনি তার প্রতি রেগে থাকবেন। রাবী বলেন, আশ’আস ইবনু কায়স তথায় প্রবেশ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আবূ আবদুর রহমান (আবদুল্লাহ) তোমাদেরকে কি বর্ণনা করলেন? তদুত্তরে সকলে উক্ত হাদীসটির কথা বললেন। তিনি বললেন, আবূ আবদুর রহমান সত্যই বর্ণনা করেছেন, ঘটনাটি আমাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। ব্যাপার হলো ইয়ামানে জনৈক ব্যক্তির সাথে আমারও একখণ্ড ভূমি ছিল। এর মীমাংসা করার জন্য আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খিদমাতে উপস্থিত হই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দাবীর স্বপক্ষে তোমার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি? আমি বললাম, না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তা হলে বিবাদীর কসম নেয়া হবে। আমি বললাম, এ ব্যক্তি তো কসম করবেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত চূড়ান্ত কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের সম্পদ গ্রাস করে অথচ সে মিথ্যাবাদী আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় তার সাক্ষাৎ ঘটবে যে, আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকবেন। এরপর এ আয়াত নাযিল হয়, “যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা এবং নিজেদের কসম তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না; তাদের জন্য রয়েছে মর্মম্ভদ শাস্তি"- (সূরাহ্ আলে ইমরান ৩: ৭৭)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩৫৭, ২৪১৬, ২৫১৫, ২৬৬৬, ২৬৬৯, ২৬৭৩, ২৬৭৬, ৪৫৪৯, ৬৬৫৯, ৬৬৭৬, ৭১৮৩, ৭৪৪৫, ২৩৫৩, ২৪১৭, ২৫১৬, ২৬৬৭, ২৬৭০, ২৬৭৭, ৪৫৫০, ৬৬৬০, ৬৬৭৭, ৭১৮৪, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৯৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩২৪৩, আহমাদ ৩৫৬৬, ৩৫৮৬, ৩৯৩৬, ৪০৩৯, ৪২০০, ৪৩৮১, রাওদুন নাদীর ২৪০, ৬৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ ও আলী ইবনু হুজুর (রহঃ)....আবূ উমামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের হক বিনষ্ট করে তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে রেখেছেন। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! অতি সামান্য বস্তু হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আরাক (বাবলা গাছের মত এক ধরনের কাঁটাযুক্ত) গাছের ডাল হলেও এ শাস্তি দেয়া হবে*। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ২৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৭, নাসায়ী ৫৪১৯, আহমাদ ২১৭৩৬, মুয়াত্তা মালেক ১৪৩৫, দারেমী ২৬০৩, রাওদুন নাদীর ২৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫২. ইসলামিক সেন্টারঃ ২৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার এই মিম্বারের নিকট দাঁড়িয়ে মিথ্যা শপথ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়, যদিও তা একটি সবুজ মিসওয়াকের জন্যও হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩২৪৬, আহমাদ ১৪২৯৬, ১৪৬০৬, মুয়াত্তা মালেক ১৪৩৪, রাওদুন নাদীর ২৪০, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৪৮, ইরওয়া ২৬৯৭। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এই মিম্বারের নিকট কোন পুরুষ অথবা নারী মিথ্যা শপথ করলে সে যেন জাহান্নামে তার আবাস নির্দ্ধারণ করলো, তা একটি কাঁচা দাঁতনের জন্য হলেও। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩২২৬, আহমাদ ১০৩৩৩, বায়হাকী ফিস সুনান ৬/৬৮, ইরওয়া ৮/৩১৩, মিশকাত ৩৭৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়

(১) অন্যায় কাজে সাক্ষ্য দেওয়া যাবে নাঃ

মুমিনগণ সব সময় সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবেন। সে কখনো মিথ্যার সাক্ষী হবে না।

মুহাম্মাদ ইবনু সাববাহ, যুহায়র ইবনু হারব ও উসমান ইবনু আবূ শাইবা (রহঃ)....জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৮,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩৩৩,  সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৭, তিরমিযী ১২০৬, আহমাদ ৩৭২৯, ৩৭৯৯, ৩৮৭১, ৪০৭৯, ৪২৭১, ৪৩১৫, ৪৩৮৯, ৪৪১৪, দারেমী ২৫৩৫, ইরওয়া ৫/১৮৪, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৪৮, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আমির (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত সম্মত নই। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। [নু‘মান (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৮৭, ২৫৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৬৯-৪০৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬২৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৩৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) সাক্ষ্য গোপন করা যাবে নাঃ

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যেমন অপরাধ তেমনি সাক্ষ্য গোপন রাখাও অপরাধ। যেহেতু উভয়টি নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে। যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে অন্যায়ভাবে ফেঁসে যায়, তখন সত্য সাক্ষ্য দিয়ে তাকে উদ্ধার করা নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং কেউ তা গোপন করলে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা আমল কর, আল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত’। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৮৩)।

(৩) মুসলিম, বালেগ, আক্বেল ও আদেল ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে নাঃ

কোন বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলিম, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ হ’তে হবে। এক্ষেত্রে কাফের, নাবালক ও ফাসেকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। (সুরা তালাক ৬৫/৩, সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৮২-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য)।

(৪) বিচারক প্রকাশ্য বিষয় দেখে ফায়ছালা দিবেনঃ

বিচারক প্রকাশ্য বিষয় দেখেই বিচার করবেন, চাই সে সাক্ষ্য মিথ্যা হোক বা সত্য। উম্মে সালামা (রাঃ) সূত্রে নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। আর তোমরা আমার কাছে বিবাদ মীমাংসার জন্য এসে থাক। তোমাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষ অপেক্ষা দলীল-প্রমাণ পেশ করায় বেশি পারদর্শী হ’তে পারে। ফলে আমি আমার শোনার কারণে যদি কাউকে তার অন্য ভাইয়ের হক দিয়ে দেই, তাহ’লে যেন সে তা গ্রহণ না করে। কেননা আমি তার জন্য জাহান্নামের একটা অংশই নির্ধারণ করে দিচ্ছি’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৯৬৭, ৭১৬৯, ২৪৫৮, ইবনে হিববান ৫০৭০, আধুনিক প্রকাশনী ৬৪৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) বিচারকের নিকট সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হ’লে সে সাক্ষ্য অনুযায়ী বিচার করা যাবে নাঃ

সাক্ষ্যের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের দায়িত্বশীলা, কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৫৮, ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৭৫১, ৫১৮৮, ৫২০০, ৭১৩৮,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮২৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৭০৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯২৮,  আহমদ ৪৪৮১, ৫১৪৮, ৫৮৩৫, ৫৮৬৭, ৫৯৯০, আল লুলু ওয়াল মারজান-১১৯৯। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

অন্য হাদীসে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  ইবনু বুরাইদাহ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’ প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক প্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পরিশেষে বলা যায়, মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। মিথ্যে মামলা  ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মানবরচিত আইনে যেমন কঠোর শাস্তির বিধান আছে তেমনি ইসলামি বিধান মোতাবেক এর ভয়াবহতাও ভয়ংকর। জাহান্নামে যাওয়ার যতোগুলো কারণ আছে তার মধ্যে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান একটি। তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য যে, দুনিয়াবী কিছু স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে সত্য পথে গমন করা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা অবৈধ অর্থ সম্পদ উপার্জনের সাথে জড়িত

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবজি, চুরি, ডাকাতি, দখলবাজি, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, ব্যাংক ডাকাতি, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ, ধোঁকাবাজী ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করার সাথে জড়িত। আওয়ামীলীগকে সমর্থন করে এমন কোনো লোক নেই যে সে অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ অর্জন করে না। আসুন আমরা ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা কীরুপ অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ অর্জন করেছে তা  জেনে নেই।

(ক) বিগত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে “দৈনিক ইনকিলাব” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার বোন শেখ রেহেনা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকী জড়িত।

(খ) বিগত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “সর্বজন কথা” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,

ব্যাংক কেলেঙ্কারিঃ

শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন ছিল নিয়মিত ঘটনা। মেগাসিরিয়ালের বিভিন্ন পর্বের মতো গত দেড় দশকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ফারমার্স ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে। যে প্রক্রিয়ায় এই কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে—প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া; সরাসরি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ লুণ্ঠন; ব্যাংক মালিক হয়ে লুটপাট অর্থাৎ স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংক উদ্যোক্তা হয়ে জনগণের হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন; নিয়ম ভঙ্গ করে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের পরস্পরকে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঋণ প্রদান; ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংক মালিক এবং পরবর্তীতে আরও লুটপাট; রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মদদে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্যাংক দখল; রাজনৈতিক মদদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংক ঋণ ও লুটপাট, ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন: অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুণ্ঠনের হোতাদের বিচার না করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা, উদারভাবে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি, প্রতিবছর জনগণের করের অর্থ লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে ঢালা ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। হাসিনা সরকারের মদদে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণের নামে লুণ্ঠনের কারণে ১৫ বছরের শাসনকালে খেলাপি ঋণ আট গুণ বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

শেয়ারবাজার কারসাজিঃ

গত ১৫ বছরে কারসাজি ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অন্তত এক লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। সে সময় লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এই ঘটনার পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শেয়ারবাজার জালিয়াতির পেছনে ৬০ জনকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মতো সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজার কারসাজি করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি, প্লেসমেন্ট বাণিজ্য, আইপিও প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অমনিবাস হিসাবের আড়ালে সন্দেহজনক লেনদেন ইত্যাদি। প্রতিবেদনে অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। ফলে, পরবর্তীতেও শেয়ারবাজারে কারসাজি চলতে থাকে।

জ্বালানিখাতে লুণ্ঠনঃ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানের নামে হাসিনা সরকার দেশি-বিদেশি বেসরকারি মালিকানাভিত্তিক ও বিদেশি ঋণনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও আমদানি নির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন কোনো জবাবদিহি করতে না হয়, সেজন্য রীতিমতো আইন করে আদালতে বিচার চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত রহিত করা হয়।

বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে বেসরকারি মালিকানায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয় এবং দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি ও কয়লা আমদানির ব্যবস্থা করা হয়।

২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার পরিমাণ প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটানোর কথা বলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৪ বার। সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন, মাতারবাড়ি প্রকল্পের জন্য জাপানের কাছ থেকে চার দশমিক চার বিলিয়ন, কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক দশমিক ৯৮ বিলিয়ন এবং রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নেয়।

এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও জ্বালানি আমদানি বাবদ বাড়তি খরচ দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। সামনে কয়লা ও এলএনজি আমদানি আরও বাড়বে, সেইসঙ্গে ২০২৭ সাল থেকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় এভাবে বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান হয়নি, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদেরকেও। গ্যাস সংকটের পাশাপাশি লাগামছাড়া লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নামার ঘটনা ঘটেছে।

দুর্নীতি ও অর্থপাচারঃ

দীর্ঘ স্বৈরশাসনে এমন এক স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও মাস্তানদের সমন্বয়ে এক মাফিয়া রাজত্বের কায়েম হয়। এই মাফিয়ারা ক্ষমতাসীন পরিবারের আশীর্বাদে রীতিমতো দায়মুক্তি নিয়ে দখল, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও অর্থপাচারে লিপ্ত হয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতার মধ্যেও সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশিত হয় তার মধ্যে কয়েকটি হলো—উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগে জমি কিনে জমির দাম বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি, অবৈধ বালু উত্তোলনে পৃষ্ঠপোষকতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটায় বিপুল দুর্নীতি, ভুয়া দলিলের মাধ্যমে খাসজমি দখল, নিয়োগ দুর্নীতি ইত্যাদি।

সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক চোরাকারবার, মানবপাচার, অর্থপাচার করে বিদেশে জমি-বাড়ি কেনার খবর পাওয়া যায়। সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া মুনাফা করেছে, ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন করেছে এবং হুন্ডি ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে। সরকারের আমলারা দুর্নীতি করে শত হাজার কোটি টাকা অবৈধ অর্থ অর্জন করেছে। সরকারি দলের মাস্তান ও পুলিশ রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি করেছে। খোদ পুলিশ ও র্যাআব প্রধান বেনজীর দুর্নীতির অবৈধ অর্থে শত শত একর জমি কিনে ও দখল করে রিসোর্ট, বাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ নিজের ভাইদের পাসপোর্ট জালিয়াতি ও সামরিক কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে ‘সিন্ডিকেট’ তৈরির মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সমস্ত ঠিকাদারি কাজের অর্ধেক মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিয়েছেন।

এভাবে বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতিলব্ধ আয়, ব্যাংক থেকে লোপাট করা ঋণের অর্থ ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে, যে অর্থ ব্যবহার করে আমলা, রাজনীতিবিদ, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল সম্পত্তি কিনেছে। দুর্নীতির মাত্রা ও পাচারের প্রকৃত অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন থেকে। সংস্থাটির ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়।

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিঃ

হাসিনা সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও দেখা গেছে, সারা বিশ্বে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যখন কমেছে তখনও বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মূল্য কমেনি, বরং বেড়েছে। ফলে এই মূল্যস্ফীতির পেছনে যে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার সম্পর্ক রয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এভাবে যে কাঠামোগত সমস্যাগুলো উন্মোচিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. বাজারে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য;

২.দেশে খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতি এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিষয়ক বিভ্রান্তি;

৩. নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা।

বিদেশ থেকে কাঁচা চিনি আমদানি করে পরিশোধন করে দেশে বিক্রি করে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি—দেশবন্ধু, আবদুল মোনেম, এস আলম, মেঘনা, সিটি।৩০ এসব গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোই দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। দেশে ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশই আমদানি করে টিকে, মেঘনা, সিটি ও এস আলম—এই চার কোম্পানি। দেশে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি কোম্পানি, সেইসঙ্গে ডিম ও মাংসের বাজারেরও বড় একটি অংশ তাদের দখলে। বিগ ফোর নামে পরিচিত এই কোম্পানিগুলো হলো কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ এবং প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান–চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে আট থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছে।

এভাবে দেশের নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে এরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানান পরিস্থিতির অজুহাতে ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি ও উৎপাদনের পরিমাণ এবং এসবের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে। এদের কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটর ডাল—এই আটটি পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় এই সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করলেও সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

(গ) বিগত ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে “দৈনিক ইত্তেফাক” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুয়ায়ী জানা যায়,

নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপিয়ে গত এক যুগে লুটপাট করা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা! এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪৯ টাকার অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। বইয়ের মান ও আকার কমিয়ে এবং নিউজপ্রিন্টে ছাপিয়ে লোপাট করা হয় ২৪৫ কোটি টাকা, আর অযাচিত বিল, অতিরিক্ত সম্মানী, আয়কর কর্তন না করা, অগ্রিম সমন্বয় না করাসহ নানা কারণ দেখিয়ে আরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

(ঘ) বিগত ১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “শেয়ারবাজার নিউজ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, রেস্টুরেন্টের নামে ৮০ কোটি টাকার ঋণ লোপাট, আসামি এস আলমসহ ২০ জন।

(ঙ) বিগত ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে  “প্রথম আলো” প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,

শ্বেতপত্র প্রতিবেদন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ আমলে পাচার ২৮ লাখ কোটি টাকা।

(চ) বিগত ২৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে “দৈনিক ইত্তেফাকা” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ডিজিএফআই'র সহায়তায় ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হাসিনার দোসররা।

(ছ) বিগত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এস আলম ও পরিবারের ১২৫টি ব্যাংক হিসাবে আছে সাড়ে ২২ কোটি টাকা।

বিগত ১৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ  এস আলমের বিরুদ্ধে।” শিরোনামে জানা যায়, বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে নামে-বেনামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে ব্যাংক মাফিয়াখ্যাত এস আলম গ্রুপ। এই অর্থের বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলা দায়ের করেছে। পাশাপাশি আরো প্রায় ৩৪টি অভিযোগের তদন্ত চলছে।

দুদক জানিয়েছে, এস আলম গ্রুপ ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয় এবং ওই অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই গ্রুপটি ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে বলে অভিযোগ। তদন্তে উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে ভুয়া চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর নামে প্রতিষ্ঠান খুলেও ঋণ নেওয়া হয়।

(জ) বিগত ২৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে “দ্য ডেইলি স্টার বাংলা” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, অবৈধভাবে ১,৫৩৯ কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগে এস আলমের সাইফুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা।

(ঝ) বিগত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “দৈনিক জনযোগ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, দুবাই রিসোর্টসহ সাড়ে তিনশ বিঘা জমির মালিক নাসা গ্রুপ চেয়ারম্যান।

নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবারের নামে বিপুল সম্পদের খোঁজ মিলেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সভায় উপস্থাপিত তথ্যে জানা যায়, তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের নামে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জমি, বাড়ি, প্লট, মার্কেট, হাসপাতাল, ওয়ারহাউজ এবং বিদেশে রিসোর্টসহ বিপুল সম্পদের তালিকা পাওয়া গেছে।

(ঞ) বিগত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “সমকাল” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,

‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই চুরি’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)। তথ্যচিত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি (২৩৪ বিলিয়ন) ডলার পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার এবং তা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে।

(ট) বিগত   ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার  দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে জানা যায়-কামালের যত দুর্নীতিঃ

আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরো ২০০ কোটি টাকার বেশি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ব্যাংকের নগদ অর্থ, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। অনুসন্ধানে তাদের ব্যাংক হিসাবেই শত কোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তার এপিএস মনিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।

দুদক জানতে পেরেছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্লা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্লা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো। এর মধ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেট এলাকায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।

সূত্র জানায়, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদের নিয়োগ দেওয়া হতো। ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮-১২ লাখ টাকা নিত কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। এই দুর্নীতিতে কামাল ছাড়াও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান ও সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন জড়িত।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা এতোপরিমাণ সরকারি বেসরকারি অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ বা দুর্নীতি করে যার হিসাব লিখে শেষ করা যাবে না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দোসরদের এমন কেউ আছে যাদের রেখে যাওয়া অর্থ সম্পদ তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ৫০০ বছর বসে খেলেও শেষ হবে না।

উপর্যুক্ত তথ্য অনুযায়ী আমরা নিশ্চিত যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ উপার্জনের সাথে জড়িত। কিন্তু অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ উপার্জন করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। ইহকালে যেমন আইনীগতভাবে শাস্তি পেতে হবে তেমনি কিয়ামতেও জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। অবৈধভাবে অর্থ সম্পদ উপার্জনকারী কখনো জান্নাতে যাবে না। আসুন এবিষয়ে ইসলাম কী বলে আমরা জেনে নেই।

আল্লাহতায়ালা বলেন, “কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, সে আত্মসাৎ করবে। আর যে কেউ কিছু আত্মসাৎ করবে, সে তার আত্মসাৎ করা বস্তু নিয়ে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। অতঃপর (সেদিন) প্রত্যেকে যে যা অর্জন করেছে, তা পূর্ণ মাত্রায় প্রদত্ত হবে এবং তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না”। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬১)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ)....আদী ইবনু উমাইরাহ্ আল-কিন্দী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ আমরা তোমাদের মধ্যে যাকে আদায়কারী নিযুক্ত করি, আর সে একটি সূচ পরিমাণ বা তার চাইতেও কম মাল আমাদের কাছে গোপন করে, তাই আত্মসাৎ বলে গণ্য হবে এবং তা নিয়েই কিয়ামতের দিন সে উপস্থিত হবে। রাবী বলেন, তখন একজন কৃষ্ণকায় আনসারী (সাহাবী) তার দিকে অগ্রসর হলেন, আমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনার দায়িত্বভার আপনি বুঝে নিন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কী হয়েছে? তিনি আরয করলেন, আমি আপনাকে এরূপ এরূপ (কঠিন ভাষা) বলতে শুনেছি। তখন তিনি বললেন, আমি এখনও বলছি, তোমাদের মধ্যকার যাকেই আমি কর্মচারী নিযুক্ত করি আর সে অল্প বিস্তর যা-ই আদায় করে এনে উপস্থিত করে, তারপর তাকে যা-ই দেয়া হয় তা-ই গ্রহণ করে এবং যা থেকে নিষেধ করা হয় তা থেকে বিরত থাকে (তার জন্য ভয়ের কারণ নেই)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৩৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৯১, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের ধন অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকগণকে ঘুষ দিও না”। (সুরা আল বাকারা ১৮৮)।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ ইবনু কা’নাব (রহঃ)....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর ধোকাবাজি করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশে অগোচরে শত্রুতা করো না এবং একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। তাকওয়া এখানে, এ কথা বলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার তার বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইযযত-আবরু হারাম। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৩৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৪, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯৫৯, সহীহ আত্ তারগীব ২৯৫৮, আহমাদ ৭৭২৭, শু‘আবুল ঈমান ৬৬৬০, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩০৯, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বান্দার হক

বান্দার হককে আমরা তুচ্ছ মনে করি, কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করা আল্লাহর হক নষ্ট করার চেয়েও ভয়াবহ।

হক দুই প্রকারঃ-

(ক) আল্লাহর প্রতি হক,

(খ) বান্দার প্রতি হক

 আল্লাহর প্রতি হকঃ

আল্লাহর হক নষ্ট করলে আল্লাহ চাইলে শিরক ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী (শিরক) করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন (শিরক) করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়”। (সূরা নিসা: ১১৬)।

তবে এই আয়াতে উল্লেখিত গুনাহ হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত যেগুলো আল্লাহর হক সেগুলো পালন না করার গুনাহ।

বান্দার প্রতি হকঃ

বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ ক্ষমা করার এখতিয়ার আল্লাহ নিজ হাতে রাখেন নি। যেমন, আমি যদি একজনকে ধোঁকা দিয়ে ১ টি টাকাও নিয়ে নিই, কোন কথা বা গালির সাহায্যে মনে কষ্ট দেই, তবে একমাত্র সেই লোক (যার হক নষ্ট করলাম) সে বাদে আর কেউ ক্ষমা করতে পারবে না।

বান্দার হকের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেনঃ-

আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬২৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪৮৪, মিশকাত তাহকীক সানী ৩৩, সহীহাহ ৫৪৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৬০৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকারীর ভয়াবহ পরিণতি

ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা কবিরা গুনাহ বা বড় ধরনের অপরাধ। আর দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করা আরো জঘন্য পাপ। কেননা, দেশের সম্পদের মধ্যে দেশের সব মানুষের হক আছে। তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্রাস করা দেশের সব মানুষের হক মেরে দেওয়ার নামান্তর।

আর পরকালে এমন আত্মসাৎকারীর পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। যে যা আত্মসাৎ করবে, তাই নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে তিনি খিয়ানত করবেন। আর যে ব্যক্তি খিয়ানত করবে সে কিয়ামতের দিন সেই খিয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে।

অতঃপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬১)

রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয় ও অসদ্ব্যবহার ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না।

পরকালে এমন ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। মহানবী (সা.) বলেন,

খাওলাহ্ আনসারীয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, কিছু লোক আল্লাহর দেয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১১৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৮৮৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৮৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কসম করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই (রাষ্ট্রীয়) সম্পদে কেউ কারো চেয়ে বেশি হকদার নয়। আমিও কারো চেয়ে বেশি হকদার নই। এই সম্পদে সব মুসলমানের অধিকার আছে, তবে মালিকানাধীন দাস ছাড়া। (আল ফাতহুর রব্বানি, পৃষ্ঠা: ৮৭)।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে দক্ষ ও সৎ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বর্ণনা থেকে তার একটি ধারণা লাভ করা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার ও এদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বলব? আমাদের দৃষ্টান্ত হলো এমন একটি যাত্রীদলের মতো, যারা তাদের সম্পদ একত্র করে এবং তাদের একজনের হাতে অর্পণ করে যে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করবে। এখন সেই ব্যক্তির জন্য কি বৈধ হবে কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া?’ (মানাকিবু আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা: ১০২)।

কোনো ব্যক্তি তাঁর সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলে তা ইসলামী আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে। কেননা, এর ফলে রাষ্ট্র যেমন যোগ্য কর্মী ও প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি একজন যোগ্য ব্যক্তি তার প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে নবীযুগের একটি ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা যেতে পারে,

আবূ হুমায়দ সা‘ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আযদ গোত্রের ইবনু উতবিয়া নামের এক লোককে সাদাকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে তার বাবার ঘরে কিংবা তার মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না। তখন সে দেখত পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি দেয় না? যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, সাদাকার মাল হতে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, আর গাভী হলে হাম্বা হাম্বা রব করবে আর বকরী হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ  করতে থাকবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর দু’হাত এই পরিমাণ উঠালেন যে, আমরা তাঁর দুই বগলের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। তিনি তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৯৭, ৯২৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪০৮., ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লিখিত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে কোনো ব্যক্তিকে যদি উপহার দেওয়া হয়, তবু তা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।

আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে। এমন ব্যক্তি অপরাধের শাস্তি না পেয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। এ মর্মে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

হাসান বাসরী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মা’কিল ইবনু ইয়াসারের কাছে তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসলাম। এ সময় ’উবাইদুল্লাহ্ প্রবেশ করল। তখন মালিক (রাঃ) বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করে শোনাব, যা আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল এবং তার মৃত্যু হল এ হালতে যে, সে ছিল খিয়ানাতকারী, তাহলে আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৫১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪২, আহমাদ ২০১৩১, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদিসে এসেছে,

 হাসান বাসরী (রহ.) হতে বর্ণিত যে, ’উবাইদুল্লাহ্ ইবনু যিয়াদ (রহ.) মাকিল ইবনু ইয়াসারের মৃত্যুশয্যায় তাকে দেখতে গেলেন। তখন মাকিল (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করছি যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, কোন বান্দাকে যদি আল্লাহ্ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৫০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪২, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আত্মসাৎ, খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা ভয়ংকর অপরাধ। যারা দুনিয়ায় এগুলোর সঙ্গে জড়িত হবে, তাদের হাশরের ময়দানে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শপথ ভঙ্গকারীর জন্য কিয়ামতের দিন একটা পতাকা দাঁড় করানো হবে। আর বলা হবে যে, এটা অমুকের পুত্র অমুকের বিশ্বাসঘাতকতার নিদর্শন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৭৮, ৩১৮৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৭৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৬৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে, তাদের বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ংকর। জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা থেকে সাবধান! সামান্য সুখ যেন আজীবনের কান্নায় রূপ না নেয়!

পরকালে এই সম্পদের ‘পাই টু পাই’ হিসাব দিতে হবে।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হতে মাফ করিয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যে দিন তার কোন দ্বীনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট হতে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।

আবূ ‘আবদুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (রহ.) বলেন, ইসমাঈল ইবনু উয়াইস (রহ.) বলেছেন, সাঈদ আল-মাকবুরী (রহ.) কবরস্থানের পার্শ্বে অবস্থান করতেন বলে আল-মাকবুরী বলা হত। আবূ ‘আবদুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (রহ.) এও বলেছেন, সাঈদ আল-মাকবুরী হলেন, বনূ লাইসের আযাদকৃত গোলাম। ইনি হলেন সাঈদ ইবনু আবূ সাঈদ। আর আবূ সাঈদের নাম হলো কায়সান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৯, ৬৫৩৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কসম খেয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার পরিণাম

মিথ্যা কসম খাওয়া কবিরা গুনাহ। চাই তা কোনো বিপদ থেকে বাঁচার জন্যই হোক বা কারো সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করার জন্যই হোক। আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন,

’আবদুল্লাহ্ ইবনু ’আমর (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ কবীরা গুনাহসমূহের (অন্যতম) হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতামাতার নাফরমানী করা, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কসম করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬৭৫, ৬৮৭০, ৬৯২০, আধুনিক প্রকাশনী- ৬২০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬২১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

মিথ্যা শপথ করে সম্পদ আত্মসাতের পরিনাম

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা’। (সুরা নিসা: ২৯)।

আরও বর্ণিত হয়েছে- ‘কিন্তু যারা কুফুরি করে, তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু জানোয়ারের মতো উদরপূর্তি করে; আর জাহান্নামই তাদের নিবাস।’ (সুরা মুহাম্মদ: ১২)।

‘আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলিমদের অর্থ সম্পদ (যা তার জিম্মায় আছে) আত্মসাৎ করার উদ্দেশে মিথ্যা কসম খায়, সে আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় মিলিত হবে যে, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেনঃ ‘‘যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে--এর শেষ পর্যন্ত’’- (আলে ‘ইমরান : ৭৭)। এরপর আশ‘আস (রাঃ) এসে বলেন, আবূ ‘আবদুর রহমান (রাঃ) তোমার নিকট যে হাদীস বর্ণনা করছিলেন (সে হাদীসে বর্ণিত) এ আয়াতটি তো আমার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আমার চাচাতো ভাইয়ের জায়গায় আমার একটি কূপ ছিল। (এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বিবাদ হওয়ায়) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমার সাক্ষী পেশ কর। আমি বললাম, আমার সাক্ষী নেই। তিনি বললেন, তাহলে তাকে কসম খেতে হবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে তো কসম করবে। এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীস বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে সত্যায়িত করে এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩৫৬-২৩৫৭, ২৪১৬, ২৫১৫, ২৬৬৬, ২৬৬৯, ২৬৭৩, ২৬৭৬, ৪৫৪৯, ৬৬৫৯, ৬৬৭৬, ৭১৮৩, ৭৪৪৫, ২৩৫৩, ২৪১৭, ২৫১৬, ২৬৬৭, ২৬৭০, ২৬৭৭, ৪৫৫০, ৬৬৬০, ৬৬৭৭, ৭১৮৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৮, আহমাদ ৩৫৭৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জানো, (প্রকৃত) গরীব কে? সাহাবায়ে কিরাম বললেনঃ আমরা তো মনে করি, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা, ধনদৌলত নেই, সে-ই গরীব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি গরীব হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করে আসবে; কিন্তু সাথে সাথে সেসব লোকেদেরকেও নিয়ে আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো অপবাদ রটিয়েছে, কারো সম্পদ খেয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে; এমন ব্যক্তিদেরকে তার নেকীগুলো দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে অথচ পাওনাদারদের পাওনা তখনো বাকি, তখন পাওনাদারদের গুনাহ তথা পাপ তার ওপর ঢেলে দেয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সুনান আততিরমিযী ২৪১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৮৪৫, সহীহুল জামি ৮৭, সহীহ আত্ তারগীব ২২২৩, শু‘আবুল ঈমান ৩৩, আহমাদ ৮০২৯, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪১১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫৬১, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৭৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ ও আলী ইবনু হুজুর (রহঃ).....আবূ উমামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের হক বিনষ্ট করে তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে রেখেছেন। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! অতি সামান্য বস্তু হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আরাক (বাবলা গাছের মত এক ধরনের কাঁটাযুক্ত) গাছের ডাল হলেও এ শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫২. ইসলামিক সেন্টারঃ ২৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ)....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, এদের দিকে নযরও দেবেন না এবং এদেরকে পবিত্রও করবেন না, বরং এদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। যে ব্যক্তির নিকট অতিরিক্ত পানি থাকা সত্ত্বেও তা পথিককে দেয় না। যে ব্যবসায়ী আসরের পর* তার পণ্য সামগ্ৰী ক্রেতার নিকট আল্লাহর কসম করে বিক্রি করে আর বলে, আমি এ পণ্য এতো এতো মূল্যে ক্রয় করেছিলাম, আর ক্রেতা তাকে সত্যবাদী মনে করে, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তার উল্টো। যে ব্যক্তি ইমামের (রাষ্ট্রপ্রধান) হাতে কেবল পার্থিব স্বার্থে বাই’আত করে, যদি ইমাম তাকে কিছু পার্থিব সুযোগ দেয়, তাহলে সে তার বাই’আতের প্রতিজ্ঞা পূরণ করে, আর যদি তা থেকে কিছু না দেয় তাহলে আর প্রতিজ্ঞা পূরণ করে না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৯৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৮, ইসলামিক সেন্টারঃ ২০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ব্যবসায়ীক মালপত্র/খাদ্য দ্রব্য মজুদদারী করলে

অধিক মুনাফা লাভের আশায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী খাদ্য দ্রব্য বা অন্যান্য মালামাল গোপনে মজুদ করে রাখে। এতে রাষ্ট্রে খাদ্য দ্রব্য বা অন্যান্য মালামালের সংকট দেখা যায় ও দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। যারা এরুপ কাজ করে তারা পাপিষ্ঠ লোক।

মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নাদলা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কেউ মজুতদারি করে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২১৫৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬০৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২৬৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৪৪৭, আহমাদ ১৫৩৩১, ২৬৭০৩, দারেমী ২৫৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ সাঈদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তুমি মু’মিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো (পাপীষ্ঠ লোকের) সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেযগার লোকে খায়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৮৩২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আওয়ামীদের দেহ হারাম মালে গঠিত তাই তাদের দেহ জান্নাতে যাবে না

হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্থ বা সম্পদ উপার্জনের মাধ্যমগুলো যেমন সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতী, ছিনতাই, ওজনে কম দেয়া, মিথ্যে কথা বলে পণ্য বিক্রি করা, নারী পাচার করা, যিনার মূল্য, কুকুরের মূল্য ইত্যাদি ইত্যাদি এর সাথে যারা জড়িত তারা জান্নাতে যাবে না।

হালাল রিজিক ইবাদত কবুলের অন্যতম প্রধান শর্ত। রিজিক হালাল বা পবিত্র এবং বৈধ হওয়ার জন্য দুটি শর্ত রয়েছে।

প্রথমতঃ ব্যবহার্য, ভোগ্য বা উপভোগ্য বস্তু বা বিষয়টি হালাল তথা পবিত্র ও অনুমোদিত হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ তা প্রাপ্তি বা অর্জনের পথ বা মাধ্যম হালাল বা বৈধ হতে হবে। এ দুইয়ের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে ঐ রিজিক হালাল বা পবিত্র হবে না।

রাসুল সাঃ বলেন,

(ক) আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহ হারাম খাদ্য দিয়ে প্রতিপালিত হয়েছে, সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৮৭, সহীহাহ্ ২৬০৯, শু‘আবুল ঈমান ৫৭৫৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহের গোশত/গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৭২, আহমাদ ১৪৪১, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৭২, দারিমী ২৭৭৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ)  আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা পুত-পবিত্র, তিনি পুত-পবিত্র জিনিসকেই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা’আলা যে কাজ করতে রসূলদের প্রতি নির্দেশ করেছেন তদ্রূপ এই একই কাজের নির্দেশ মু’মিনদেরকেও করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : ’’হে রসূলগণ! পাক-পবিত্র হালাল রুযী খাও এবং নেক আ’মাল কর’’- (সূরা আল মু’মিনূন ২৩ : ৫১)। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ ’’হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা উপজীবিকা স্বরূপ দান করেছি সেই পাক-পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর’’- (সূরা আল বাকারা ২ : ১৭২)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দৃষ্টান্ত হিসেবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন যে, এ ব্যক্তি দূর-দূরান্তের সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ধূলাবালুতে মাখা। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’ হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে ডাকছে, হে রব্! হে রব্! কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পরনের পোশাক হারাম। আর এ হারামই সে ভক্ষণ করে থাকে। তাই এমন ব্যক্তির দু’আ কিভাবে কবুল হতে পারে? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৮৯, আহমাদ ৮৩৪৮, দারিমী ২৭১৭, সহীহ আল জামি‘ ২৭৪৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৭১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২১৫, ইসলামীক সেন্টার ২২১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের সামনে এমন একটি যুগ আসবে, যখন কেউ কি উপায়ে ধন-সম্পদ উপার্জন করলো, হারাম না হালাল উপায়ে- এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রকার পরোয়া করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০৫৯, ২০৮৩,  নাসায়ী ৪৪৫৪, সহীহ আল জামি‘ ৮০০৩, সহীহ আত্ তারগীব ১৭২২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৯১৬ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৩১)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। আর এ উভয়ের মধ্যে এমন অনেক সন্দেহভাজন বিষয় বা বস্ত্ত আছে, যে ব্যাপারে অনেক মানুষই এগুলো হালাল, কি হারাম- এ বিষয়ে অবগত নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় হতে বিরত থাকবে, তার দীন ও মান-মর্যাদা পুত-পবিত্র থাকবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহে পতিত থাকবে, সে সহসাই হারামে জড়িয়ে পড়বে। বিষয়টি সেই রাখালের ন্যায়, যে রাখাল তার পশুপালকে নিষিদ্ধ এলাকার সীমার কাছাকাছি নিয়ে চরালো, তার পাল অজান্তেই নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

সাবধান! প্রত্যেক দায়িত্বশীলেরই (প্রশাসন বা সরকারেরই) চারণভূমি (নিষিদ্ধ এলাকা) আছে, আর আল্লাহ তা’আলার নিষিদ্ধ চারণভূমি হারামসমূহকে নির্ধারিত করেছেন। মনে রাখতে হবে, মানব দেহের ভিতরে একটি গোশতপিন্ড আছে, যা ভালো থাকলে গোটা শরীরই ভালো থাকে। আর এটি নষ্ট হয়ে গেলে বা বিকৃতি ঘটলে সমস্ত শরীরটাই নষ্ট হয়ে যায়। সেই গোশতপিন্ডটিই হলো ’কলব’ (অন্তঃকরণ)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২০৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত ৩৩৩০, আহমাদ ১৮৩৭৪, দারিমী ২৫৭৩, সহীহ আত্ তারগীব ১৭৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(ক) “হে মানবগণ! পৃথিবীর মধ্যে যা বৈধ-পবিত্র, তা হতে ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”। (সুরা আল বাক্বারাহ  ১৬৮)।

(খ) “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা জীবিকা স্বরূপ দান করেছি তা হতে পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর যদি তোমরা তারই ইবাদত করে থাকো”। (সুরা আল বাক্বারাহ  ১৭২)।

(গ) “হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু হতে আহার করুন ও সৎকর্ম করুন; আপনারা যা করেন সে সম্বন্ধে আমি অবগত”। (সুরা মুমিনূন ৫১)।

কিয়ামতে আওয়ামী অর্থ সম্পদ আত্মসাৎকারীদের  নিকট থেকে যেভাবে প্রতিশোধ নেয়া হবে

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গংরা সরকারি যেমন অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছে তেমনি জোড়পূর্বক জনসাধারণের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এছাড়াও জনসাধারণকে গালি দেয়া, কথায় কথায় অপমান করা, অপবাদ দেয়া,  চড় থাপ্পর মারা, অপহরণ, গুম, খুন করা ইত্যাদি ঘটনার সাথে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গংরা জড়িত। এরা যদি এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতেই মজলুমদের নিকট থেকে মাফ চেয়ে না নেয় বা তাদের পাওনা পরিশোধ করে না যায় তাহলে কিয়ামাতে ঐসব আত্মসাৎকারী বা নির্যাতনকারীদের নিকট থেকে তাদের জীবনে অর্জিত সওয়াবের বিনিময়ে প্রতিশোধ নেয়া হবে। এপ্রসঙ্গে রাসুল সা. বলেন,

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জানো, (প্রকৃত) গরীব কে? সহাবায়ে কিরাম বললেনঃ আমরা তো মনে করি, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা, ধনদৌলত নেই, সে-ই গরীব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি গরীব হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করে আসবে; কিন্তু সাথে সাথে সেসব লোকেদেরকেও নিয়ে আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো অপবাদ রটিয়েছে, কারো সম্পদ খেয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে; এমন ব্যক্তিদেরকে তার নেকীগুলো দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে অথচ পাওনাদারদের পাওনা তখনো বাকি, তখন পাওনাদারদের গুনাহ তথা পাপ তার ওপর ঢেলে দেয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিসকাতুল মাশাবিহ মিসকাত ৫১২৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সুনান আততিরমিযী ২৪১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৮৪৫, সহীহুল জামি‘ ৮৭, সহীহ আত্ তারগীব ২২২৩, শু‘আবুল ঈমান ৩৩, আহমাদ ৮০২৯, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪১১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫৬১, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৭৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৩)। হাদিসের মান সহিহ।

(খ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন হকদারদের হক আদায় করা হবে, এমনকি যে বকরীর শিং নেই, তার জন্য শিংওয়ালা বকরী থেকে বিনিময় আদায় করে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮২, সুনান আততিরমিযী ২৪২০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৫৮৮, সহীহুল জামি‘ ৫০৬২, সহীহ আত্ তারগীব ৩৬০৩, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ১৩৬, আহমাদ ৭২০৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬৩, আস্ সুনানুল কুবরা ১১৮৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ)...আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মু’মিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের উপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ও অন্যায় ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকে পৃথিবীতে তার আবাসস্থল যেরূপ চিনত, তার চাইতে অধিক তার জান্নাতের আবাসস্থল চিনতে পারবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪০, ৬৫৩৫, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২২৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঘ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তির কোন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অত্যাচারঘটিত; যেমন- মানহানি বা অন্য কোন বিষয়ের কোন হক থাকে, তবে সে যেন সেদিনের পূর্বেই তার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নেয়, যেদিন তার কাছে কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে, তাহলে অত্যাচারিতের হক অনুসারে তার কাছ থেকে নেক ’আমল নিয়ে নেয়া হবে। আর যদি তার নেক না থাকে, তবে অত্যাচারিত ব্যক্তির পাপকে তার ওপর চাপানো হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৯, ৬৫৩৪, সহীহুল জামি ৬৫১১, সহীহ আত্ তারগীব ২২২২, আহমাদ ১০৫৭৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬১, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৭০, আর মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৩৫, আল মু‘জামুস্ সগীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৪৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৭৮০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা ঘুষ বাণিজ্যের সাথে জড়িত

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার শাসনকাল দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রীয় কাজে নিযুক্ত প্রত্যেকের বিশেষ করে প্রশাসনিক কাজে যারা নিয়োজিত তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গংদের প্রত্যেকেই ঘুষ-দুর্নীতির সাথে যেমন জড়িত তেমনি তাদের অধীনস্থ কর্মচারীরাও ঘুষ-দুর্নীতির সাথে জড়িত। বাংলাদেশে বেশ কিছু ডিপার্টমন্টে আছে যেখানে ৩৬৫ দিন জুড়েই ঘুষ-দুর্নীতি চলে। শুধু সরকারি অফিসেই না বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টেও ঘুষ বাণিজ্য চলে দেদারছে। বিশেষ জরিপে দেখা গেছে, একমাত্র ইসলামি সংগঠনের সাথে জড়িত ঈমানদার মুত্তাকি মুসলমান ব্যতিত বাকি সকলেই ঘুষ-দুর্নীতি তথা অবৈধ ইনকামের সাথে জড়িত।

বিগত ২০ জুলাই ২০২৫ তারিখে “কালবেলা” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সরকারি চাকুরেদের ঘুষ প্রবণতা বাড়ছে।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনে ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। দুদক গত ১১ মাসে যেসব দুর্নীতির মামলা করেছে; সেখানে আসামির তালিকায় সরকারি চাকরিজীবীরাই শীর্ষে। দুদকের পর এবার সরকারি অন্য সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) জরিপে উঠে এসেছে প্রায় একই ধরনের তথ্য। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেবা দেওয়ার বিনিময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ ঘুষ নিচ্ছেন। আর এ ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় ৩৩ শতাংশ সরাসরি ঘুষ নেন; তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ আদায়কারীর শতকরা হারও প্রায় সমান। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বা পরোক্ষভাবে ঘুষ নেন ঘুষখোরদের ২১ শতাংশ। সরাসরি ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা শহরের তুলনায় গ্রাম বা মফস্বলে কর্মরতদের মধ্যে বেশি। ঘুষখোররা ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা নেন প্রায় ৯৮ শতাংশ। টাকা ছাড়াও ভ্রমণের টিকিট, মূল্যবান উপহার সামগ্রী এমনকি খাদ্য পানীয় নেওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়।

জরিপের তথ্যানুসারে, সবচেয়ে বেশি ঘুষ-দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, এক বছরে বিআরটিএতে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হন। এ হার আইনপ্রয়োগকারীর সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ভূমি নিবন্ধন অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

এ ছাড়া কর্মচারীরা ঘুষ না চাইলেও সেবাগ্রহীতাদের মধ্যেও স্বেচ্ছায় ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা দ্রুত সেবা পেতে ঘুষ দিয়ে থাকেন বলে বিবিএসের জরিপে মতামত দিয়েছেন। এ হিসাবটাও কম নয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ নাগরিক সরকারি সেবা পেতে স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন। স্বেচ্ছায় ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা গ্রামের থেকে শহরে বেশি। যেখানে গ্রামের ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ নাগরিক স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন, সেখানে শহের এ হার ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে, অনেকে আবার সেবা পাওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সরকারি চাকরিজীবীদের ঘুষ দিয়ে থাকেন। বিবিএসের জরিপে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের কাছে কেউ ঘুষ চাননি, এটাকে তারা কাজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে মতামত দিয়েছেন।

রাসুল সাঃ বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়ের ওপর অভিসম্পাত করেছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৫৩, সুনান আবূ দাঊদ ৩৫৮০, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১৩, সুনান আততিরমিযী ১৩৩৭, আহমাদ ৬৫৩২, ইরওয়া ২৬২০, সহীহ আল জামি‘ ৫১১৪, সহীহ আত্ তারগীব ২২১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঘুষ লেনদেন করা ইসলামে হারাম। এটা এক প্রকার জিম্মি। ঘুষ দিলে কাজ হবে না দিলে ফাইল বা কাজ আটকে রেখে দিনের পর দিন ঘুরানো হয় তথা জিম্মি করে রাখা হয়। কোনো সরকারি কর্মচারী বেতনের অতিরিক্ত কোনোভাবেই নিতে পারবে না। এটা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। এপ্রসঙ্গে রাসুল সা. বলেন,

(ক) বুরায়দাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো লোককে যদি আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করি এবং তাকে সে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেই। অতঃপর যদি সে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে, তবে তা হলো খিয়ানাত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৪৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯৪৩, সহীহ আল জামি‘ ৬০২৩, সহীহ আত্ তারগীব ৭৭৯, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২৩৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) মুসতাওরিদ ইবনু শাদ্দাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের শাসনকার্যে নিযুক্ত হবে, তার যদি স্ত্রী না থাকে তবে সে একজন স্ত্রীর ব্যবস্থা করতে পারে। আর যদি তার খাদিম না থাকে, তাহলে একজন খাদিম রাখতে পারে। আর যদি তার কোনো ঘর না থাকে, তাহলে একটি ঘরেরও ব্যবস্থা করতে পারে। অপর এক বর্ণনাতে আছে, সে যদি তা ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করে, তবে তা খিয়ানাত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৫১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯৪৫, মুসতাদরাক লিল হাকিম ১৪৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আদী ইবনু ’উমায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হে মানব সকল! তোমাদের কাউকে যদি আমাদের কোনো কাজে নিযুক্ত করা হয়। অতঃপর সে যদি তা থেকে একটি সুঁই পরিমাণ অথবা তার চেয়ে অধিক কিছু লুক্কায়িত রাখে, তাহলে সে খিয়ানাতকারী বলে সাব্যস্ত হবে। কিয়ামতের দিনে সে তা বহন করে উত্থিত হবে। তখন জনৈক আনসারী দাঁড়িয়ে বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমার ওপর যে কাজ অর্পণ করেছেন, তা অনুগ্রহপূর্বক প্রত্যাহার করে নিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কেন এটা বলছ? লোকটি বলল, আমি শুনেছি যে, আপনি এরূপ এরূপ (ভীতিকর) কথা বলেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, আমি আবারও বলছি, যাকে আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করি, তখন সে যেন তার কম ও বেশি যাই হোক (সবকিছু) আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়। অতঃপর তাকে যা কিছু দেয়া হবে, শুধু তাই গ্রহণ করবে। আর যা থেকে নিষেধ করা হবে, তা থেকে সর্বদা বিরত থাকে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৫২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৬৩৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩৩, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৮১, আহমাদ ১৭৭২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৯১, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবূ হুমায়দ সা’ঈদী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত করলেন। সে কাজ শেষ করে তাঁর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটা আপনার জন্য আর এ জিনিসটি আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ তুমি তোমার বাপ-মার ঘরে বসে থাকলে না কেন? তা হলে দেখতে তোমার জন্য হাদিয়া পাঠানো হয় কি না? এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার ওয়াক্তের সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাশাহ্হুদ পাঠ করলেন ও আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। এরপর বললেনঃ রাজস্ব আদায়কারীর অবস্থা কী হল? আমি তাকে নিযুক্ত করে পাঠালাম আর সে আমাদের কাছে এসে বলছে, এটা সরকারী রাজস্ব আর এ জিনিস আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। সে তার বাপ-মার ঘরে বসেই থাকল না কেন? তাহলে দেখত তার জন্য হাদিয়া দেয়া হয় কি না?

ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণ, তোমাদের মাঝে কেউ কোন বস্তুতে খিয়ানত করলে, কিয়ামতের দিন সে ঐ বস্তুটিকে তার কাঁধে বহন করা অবস্থায় আসবে। সে বস্তুটি যদি উট হয় তা হলে উট আওয়াজ করতে থাকবে। যদি গরু হয় তবে হাম্বা হাম্বা করতে থাকবে। আর যদি বক্রী হয় তবে ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। আমি (বাণী) পৌঁছিয়ে দিলাম। রাবী আবূ হুমায়দ বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হস্ত মুবারক এতটুকু উঠালেন যে, আমরা তাঁর দু’বগলের শুভ্রতা দেখতে গেলাম। আবূ হুমায়দ বলেন, এ কথাগুলো যায়দ ইবনু সাবিতও আমার সঙ্গে শুনেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। কাজেই তোমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬৩৬, ৯২৫; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯৪৬, আহমাদ ২৩৬৫৯, আধুনিক প্রকাশনী ৬১৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬১৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অবৈধ ইনকাম সম্পূর্ণ হারাম। হারাম মালে গঠিত দেহ কখনো জান্নাতে যাবে না। যারা অবৈধ অর্থ সম্পদ ভক্ষণ করে তাদের দান খয়রাত বা দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। এজন্যেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের দোয়া আর আল্লাহ তায়ালা কবুল করেননি।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা চাঁদাবাজির সাথে জড়িত

চাঁদাবাজি আরেকটি মারাত্মক অপরাধ। কোন প্রভাবশালী চক্র কর্তৃক জোর পূর্বক কাউকে কোথাও নিজ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অথবা নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে বাধ্য করাকে সাধারণত চাঁদাবাজি বলা হয়।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সকলেই চাঁদাবজির সাথে জড়িত ছিলো। এর একটা উদাহরণ এখানে তুলে দলা হলো,

বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,

কাউন্সিলর শামীমের মাধ্যমে কারওয়ান বাজারে ছিল কামালের চাঁদাবাজিঃ

কারওয়ান বাজারে কাঁচাবাজারে প্রত্যেকদিন প্রায় দেড় কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। পলাতক ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামীমের মাধ্যমে ওই টাকা তুলতেন কামাল। ওই টাকা আবার তিনি দুই ভাগে ভাগ করে দিতেন। ৫ আগস্টের পর শামীম পলাতক রয়েছেন। শামীমের মাধ্যমে ২০০ জনের একটি বড় গ্যাং তৈরি করেছিলেন কামাল। ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা চাঁদা তুলতেন। কারওয়ান বাজার ইত্তেফাক গলির কাঁচা তরকারি বিক্রেতা আরমান জানান, ‘পুরো কারওয়ান বাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের নিয়ন্ত্রণে। তার হয়ে এই এলাকায় চাঁদা তুলতেন কাউন্সিলর শামীম। শামীম আওয়ামী লীগের পতনের পর পলাতক রয়েছেন। তিনি আরো জানান, শামীমের লোকজন এই এলাকায় চাঁদা তুলত। ওই টাকা হাতবদল হয়ে কামালের কাছে যেত। আমি চাঁদা না দেওয়ার কারণে একমাস ব্যবসা করতে পারিনি। পরে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করে আবার ব্যবসা শুরু করি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক পাইকারি বিক্রেতা জানান, ‘চাঁদা না দেওয়ার কারণে তাকে কামালের লোকজন লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে।

দস্যুতার সাথে  চাঁদাবজির খুবই একটা  মিল আছে। কারণ চাঁদা না দিলে তার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। আর একাজটি একটি সন্ত্রাসী দলের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই করা হয়। এখানে জোড় খাটানো হয় ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। মানুষের হক নষ্ট করা হয়। চাঁদা উত্তোলনকারী, চাঁদা লেখক ও চাঁদা গ্রহণকারী সবাই কবিরা গুনাহ্’র সমান অংশীদার। এরা যালিমের সহযোগী অথবা সরাসরি যালিম।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধেই (শাস্তির) ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ আচরণ করে বেড়ায়। বস্ত্তত: এদের জন্যই রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি’’। (সুরা শূরা: ৪২)।

তিনি আরো বলেন:

“তোমরা যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না তথা তাদেরকে যুলুমের সহযোগিতা করো না। অন্যথায় তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। আর তখন আল্লাহ্ ছাড়া কেউ তোমাদের সহায় হবে না। অতএব তখন তোমাদেরকে কোন সাহায্যই করা হবে না’’। (সুরা হূদ্: ১১৩)।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ)....জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাক। কেননা কিয়ামত দিবসে অত্যাচার অন্ধকারে পরিণত হবে। তোমরা কৃপণতা থেকে সাবধান হও। কেননা এ কৃপণতাই তোমাদের আগেকার কাওমকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতা তাদের খুন-খারাবী ও রক্তপাতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং হারাম বস্তুসমূহ হালাল জ্ঞান করতে প্রলোভন দিয়েছে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪০, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা দখলবাজির সাথে জড়িত

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা যেমন সরকারি বেসরকারি অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ, ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, দস্যুতা ও চাঁদাবজির সাথে জড়িত তেমনি এরা দখরবাজির সাথেও জড়িত। এখানে কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো-

(ক) বিগত ২৩ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মিরপুরে সরকারি জমিতে আওয়ামী গডফাদার ইলিয়াস মোল্লার দখলবাজি।

ঢাকার মিরপুরের দুয়ারীপাড়ায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ৪৭৩টি প্লটসহ প্রায় ২৬ একর জমি ২৮ বছর আগে দখল করেছিলেন ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। মিরপুর ১ নম্বরে ঢাকা চিড়িয়াখানার নামে বরাদ্দ হওয়া প্রায় দুই একর জমি দখল এবং মিরপুর ২ নম্বরে তুরাগ নদের অংশ ভরাট করে দুই শতাধিক বস্তিঘর গড়ে তোলারও অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

ইলিয়াস মোল্লার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির জন্য তিনি অর্ধশত সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন বস্তি, মার্কেট, দোকান ও বাসস্ট্যান্ড থেকে এই ক্যাডার বাহিনী নিয়মিত চাঁদা তুলত।

(খ) বিগত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “সমকাল” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সাদেক খানের নেশাই ছিল দখলবাজি!

ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সাদেক খান। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও সংলগ্ন এলাকায় দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারসহ বহু অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এলাকায় তাঁর পরিচিতি দখলবাজ হিসেবে। সরকারি জমি, হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি, অন্যের জায়গা দখল করেছেন দেদার। বাদ যায়নি কবরস্থান, শ্মশানও। দখল করা জায়গায় নিজের নামে করেছেন আবাসন প্রকল্প, পেট্রোল পাম্প, মার্কেট কিংবা বস্তি।  

এরকম হাজার হাজার তথ্য আছে যা লিখলে আরো কয়েকশত পেজ নষ্ট হবে। তবে আমরা সকলেই অবগত যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা সকলেই জোড়পূর্বক অন্যের জমি বা সম্পদ দখল করেছে যা প্রমাণিত।

আসলে যখন মানুষের মন থেকে আল্লাহভীতি উঠে যায় তখন তার শক্তি, বুদ্ধি সবই তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। সে এগুলোকে নির্বিচারে যুলুম-নিপীড়নে ব্যবহার করে। যেমন শক্তির বলে অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করা। ভূমি জবরদখল এরই একটি অংশ। এর পরিণাম খুবই মারাত্মক।

সালিম (রহঃ) তাঁর পিতা ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে অন্যায়ভাবে কারো কিছু জমিন নিয়েছে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক জমিন পর্যন্ত ধসিয়ে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৯৫৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৫৪, সহীহ আল জামি ৫৯৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইয়া’লা ইবনু মুররাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে কেউ অন্যায়ভাবে কারো এক বিঘত জমি নিয়ে নেয়, আল্লাহ তাকে তার জমিনের সাত তবকের শেষ পর্যন্ত খুঁড়তে বাধ্য করবেন। অতঃপর তার গলায় তা শিকলরূপে পরিয়ে দেয়া হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের (হাশরের) বিচার শেষ করা হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৯৬০, আহমাদ ১৭৫৭১, সহীহাহ্ ২৪০, সহীহ আল জামি‘ ২৭২২, সহীহ আত্ তারগীব ১৮৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জমির সীমানা বা আইল পরিবর্তন করাও এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আবুত্ব তুফায়ল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ’আলী -কে জিজ্ঞেস করা হলো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাদেরকে (অর্থাৎ- আহলে বায়তকে) স্বতন্ত্রভাবে কিছু বলেছেন কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ তিনি (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন কোন বিষয়ে আমাদেরকে স্বতন্ত্র রাখেননি, যাতে অন্য লোক অন্তরভুক্ত হয়নি। তবে আমার তলোয়ারের এ খাপের ভিতরে যা আছে। অতঃপর তিনি খাপের ভিতর হতে এক খন্ড লিখিত কাগজ বের করলেন তাতে লিখা ছিল, সে ব্যক্তির ওপর আল্লাহর লা’নাত যে গায়রুল্লাহর নামে যাবাহ করে। আর সে ব্যক্তির ওপরও আল্লাহর লা’নাত যে জমিনের সীমানা পরিবর্তন করে। আল্লাহর লা’নাত ঐ ব্যক্তির ওপর, যে নিজের পিতাকে অভিসম্পাত দেয় এবং আল্লাহর লা’নাত সে ব্যক্তির ওপর, যে কোন বিদ্’আতীকে আশ্রয় দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪০৭০, সুনান আননাসায়ী ৪৪২২, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৭০, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা- ৬০২, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যের জিনিস নিজের দাবী করলে

যুহারর ইবনু হারব (রহ)..আবূ যার (রযিঃ) বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি জেনে শুনে নিজ পিতার পরিবর্তে অন্য কাউকে পিতা বলে, সে কুফুরী করল। আর যে ব্যক্তি এমন কিছুর দাবী করে যা তার নয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয় এবং সে যেন জাহান্নামে তার আবাসস্থল বানিয়ে নেয়। আর কেউ কাউকে কাফির বলে ডাকলে বা আল্লাহর দুশমন’ বলে ডাকল, যদি সে তা না হয় তাহলে এ কুফুরী সম্বোধনকারীর প্রতি ফিরে আসবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬১, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১৯, আহমাদ ২০৯৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১২১, ইসলামিক সেন্টারঃ ১২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

মিথ্যে কথা বলা ও জনসাধারণকে মিথ্যে আশ্বাস দেয়া ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের প্রতিদিনের রুটিন

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর প্রতিদিন গোলাম আজম, আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী আর তারেক জিয়া সম্পর্কে এতো মিথ্যে কথা বলতো যা হিসেব করা কঠিন। রাজনৈতিকভাবে এরা মিথ্যে কথা বলা ছাড়াও সাধারণ জনগণকেও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে রাখতো। দেশের উন্নয়ন নিয়েও এরা মিথ্যে প্রতিবেদন তৈরী করতো। অথচ মিথ্যে কথা বলা ও মিথ্যে আশ্বাস দেয়া একটি কবিরাহ গুণাহ ও জাহান্নামে যাওয়ার একটি কারণ। আসুন এব্যাপারে ইসলাম কী বলে আমরা তা জেনে নেই।

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন: ‘‘(অনুমান ভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক’’। (সুরা যারিয়াত : ১০)।

মুবাহালার আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে, মিথ্যুকদের উপর আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পতিত হোক’’। (সুরা আ’লি ’ইমরান : ৬১)।

মিথ্যা মানুষকে ইহকালে ঘৃণিত ও নিন্দিত করে এবং পাপের পথে পরিচালিত করে। আর পাপ তাদের জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে। তাই মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব সুদূর প্রসারী।  এখানে মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ-

(১) মিথ্যা হিদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত করে: মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সুপথ প্রদর্শন করেন না’। (সুরা মুমিন/গাফের ৪০/২৮)।

(২) প্রশান্তি বিলুপ্ত ও সন্দেহ সৃষ্টি করে: মিথ্যা মানুষের মনে সন্দেহ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মিথ্যাবাদীর অন্তরে সর্বদা অস্থিরতা বিরাজ করে এবং এটি তার মানসিক প্রশান্তি বিদূরিত করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয় তা পরিত্যাগ করে যাতে সন্দেহ নেই তা গ্রহণ কর। কেননা সত্য হচ্ছে প্রশান্তি আর মিথ্যা হচ্ছে সন্দেহ’। (সুনান আততিরমিযী হা/২৫১৮; মিশকাত হা/২৭৭৩; ইরওয়াউল গালীল হা/১২)।

(৩) অন্তরকে পীড়িত করে: মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়। তারা আল্লাহ ও ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এর দ্বারা তারা কেবল নিজেদেরকেই ধোকা দেয়। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারেনা। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি তাদের মিথ্যাচারের কারণে’। (সুরা বাক্বারাহ ২/৮-১০)।

(৪) মিথ্যা শপথকারী আল্লাহর ক্রোধের পাত্র: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিম ব্যক্তির সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ঠান্ডামাথায় মিথ্যা শপথ করে, সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে, আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত থাকবেন’। (বুখারী হা/৪৫৪৯; মিশকাত হা/৩৭৫৯)।

আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে (গুনাহ ক্ষমা করে) পবিত্র করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। একথা শুনে আবু যার (রাঃ) বললেন, তাদের জন্য তো ধ্বংস ও অধঃপতন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা কারা? তিনি বললেন, (১) যে ব্যক্তি টাখনুর নীচে কাপড়  ঝুলিয়ে পরে (২) যে দান করে খোঁটা দেয় (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম দ্বারা নিজের মাল বিক্রি করে। (মুসলিম হা/১০৬; মিশকাত হা/২৭৯৫)।

(৫) মিথ্যা পাপ ও জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে: মিথ্যা মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। আর পাপ তাকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা মিথ্যা পাপাচারের পথ বাতলিয়ে দেয়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাকে কাযযাব (চরম মিথ্যুক) বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪)।

তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর। কেননা সত্য নেকীর সাথে রয়েছে। আর উভয়টি জান্নাতে যাবে। আর মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা মিথ্যা পাপের সাথে রয়েছে। আর উভয়টি জাহান্নামে যাবে’। (ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/৭২৪)।

(৬) মিথ্যা বলা মুনাফিকী: মিথ্যা বলা মুনাফিকের পরিচায়ক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি। (১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে (২) ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে (৩) আমানত রাখা হ’লে খেয়ানত করে। (বুখারী হা/৩৩)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যার মধ্যে চারটি স্বভাব পাওয়া যাবে সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মধ্যে তার একটি দেখা যাবে তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব রয়েছে। যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে। (১) তার নিকট আমানত রাখা হ’লে তা খিয়ানত করে (২) কথা বললে মিথ্যা বলে (৩) ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে (৪) ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে’। (বুখারী হা/৩৪; মুসলিম হা/৫৮৩; মিশকাত হা/৫৬)।

(৭) মিথ্যাবাদীর মর্মান্তিক শাস্তি: মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথা, কাজ ও আচরণের ফলে সমাজে বহু ঝগড়া বিবাদ ও দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। আবার মিথ্যার কারণে যুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের অনেক লোমহর্ষক কাহিনী চাপা পড়ে থাকে। তাই মহান আল্লাহ মিথ্যাবাদীর জন্য মর্মান্তিক শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। একদিন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে আজ কেউ স্বপ্ন দেখেছ কি? কেননা আমাদের কেউ এরূপ স্বপ্ন দেখে থাকলে তা বর্ণনা করত এবং তিনি আল্লাহ যা চাইতেন সে অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে দিতেন।

যথারীতি একদিন (ফজর ছালাত শেষে) তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ আজ কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? আমরা বললাম, না। তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি যে, দু’জন ব্যক্তি আমার নিকটে আসল। অতঃপর তারা আমাকে পবিত্র ভূমির (শাম বা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের) দিকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে এবং অপর ব্যক্তি একমুখ বাঁকানো ধারালো লোহার সাঁড়াশী হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে উক্ত বসা ব্যক্তির গালের এক পাশ দিয়ে ওটা ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পিছন পর্যন্ত চিরে দিচ্ছে। অতঃপর গালের অপর পার্শ্ব দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পিছন পর্যন্ত চিরে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে গালের প্রথমাংশটি ভাল হয়ে যায়। তখন আবার সে তাই করে (এভাবে একবার এ গাল, একবার ওগাল চিরতে থাকে)। ... অতঃপর তারা আমাকে ব্যাখ্যা বলে দিল যে, যাকে সাঁড়াশী দিয়ে গাল চেরা হচ্ছিল সে হ’ল মিথ্যাবাদী। তার কাছ থেকে মিথ্যা রটনা করা হ’ত। এমনকি তা সর্বত্র ছড়িয়ে যেত। ফলে তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত (কবরে) ঐরূপ আচরণ করা হবে। (বুখারী হা/১৩৮৬; মিশকাত হা/৪৬২১)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা যেহেতু মিথ্যে বলার সাথে জড়িত তাই তাদেরকে কঠিন আজাবে ভুগতে হবে।

মুজিববর্ষ  উদযাপন ও মুজিবের ১০ হাজার ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণে জনগণের ৪ হাজার কোটি টাকা অপচয়

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা ভেবেছিলো এই বাংলাদেশকে তারা আজীবন শাসন করবে। সেই লক্ষ্যে ভারতে যেমন যত্রতত্র তাদের বিভিন্ন দেববেীর মূর্তি স্থাপন করে রাখা হয়েছে তেমনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাস্তার মোড়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সর্বত্র শেখ মুজিবের ১০ হাজার মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব মূর্তি স্থাপন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় কোমলমতি শিশুদের দিয়ে প্রণাম বনাম পূজা করাতে বাধ্য করা হয়েছিলো।

বিগত ২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে “দৈনিক ইত্তেফাক” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ পালন ও শেখ মুজিবের ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে ওই অর্থ অপচয় ও ক্ষতিসাধন করার অভিযোগ রয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মুজিববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় মুজিববর্ষের সময়কাল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ছয় অর্থবছরে ১২৬১ কোটি ৫ লাখ টাকা খরচ করেছে বলে জানায় অন্তর্বর্তী সরকার।

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকাস্থ বিজয় সরনী মোড়ে স্থাপিত স্বর্ণ মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলে। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মূর্তিগুলোও এক এক করে ভেঙ্গে ফেলা হয়। এখানো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য কিছু ম্যূরাল বা ভাস্কর্য দেখা যায়।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতের আদলে শেখ মুজিবের মূর্তি স্থাপন করে মুর্তির দেশ বানাতে চেয়েছিলো। অথচ ইসলামে এই মূর্তি বানানো, মূর্তি পূজা করা বা মূর্তিকে সম্মান করা শিরক। ফ্যাসিস্ট হাসিনা একদিকে নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে, হজ্জ করে, মাথায় পট্টি লাগায় ও হাতে তাসবিহ নিয়ে জিকিরের দৃশ্য দেখায় অন্য দিকে দেশে বিদেশে গিয়ে মূর্তি পূজা করে এবং এদেশের মুসলমানদেরকে মূর্তি পূজা করাতে বাধ্য করাতে চেয়েছিলো।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার বাবাকে চিরঞ্জিব রাখতে গিয়ে জনগণের এই চার হাজার কোটি টাকা যে ব্যয়  করলো তার ক্ষতিপূরণ দিবে কে?

মূলত এসব শিরকি কাজের অন্তরালে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

যাই হোক, এখন আমরা জানবো শেখ মুজিবের মূর্তি পূজা ইসলাম কী বলে?

কোনো প্রাণীর-মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামী শরীয়তে কঠিন কবীরা গুনাহ ও হারাম । মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি সকল বিষয় কঠিনভাবে নিষিদ্ধ এবং এগুলো কুফরী কাজ। কেউ কেউ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান। এটা চরম ভুল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই  পরিত্যাজ্য। কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের স্পষ্ট নির্দেশ-

প্রথম আয়াতঃ

‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্ত্ত অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ (সূরা হজ্জ : ৩০)।

এই আয়াতে পরিস্কারভাবে সবধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকান্ড  বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

আরো লক্ষণীয় বিষয় এই যে. উপরের আয়াতে সকল ধরনের মূর্তিকে ‘রিজস’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজ্স’ অর্থ নোংরা ও অপবিত্র বস্ত্ত। বোঝা যাচ্ছে যে, মূর্তির সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক।

দ্বিতীয় আয়াতঃ

অন্য আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

‘এবং তারা বলেছিল, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে এবং কখনো পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে।’ (সূরা নূহ : ২৩)।

এখানে কাফের সম্প্রদায়ের দুটো বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে :

১. মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা।

২. মূর্তি ও ভাস্কর্য পরিহার না করা। তাহলে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভাস্কর্যপ্রীতিও কুরআন মজীদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। অতএব এটা যে ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য তা তো বলাই বাহুল্য।

উপরের আয়াতে উল্লেখিত মূর্তিগুলো সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে প্রতিমার পূজা নূহ্ (আঃ)-এর কওমের মাঝে চালু ছিল, পরবর্তী সময়ে আরবদের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল। ওয়াদ ‘‘দুমাতুল জান্দাল’’ নামক জায়গার কাল্ব গোত্রের একটি দেবমূর্তি, সূওয়া‘আ, হল, হুযায়ল গোত্রের একটি দেবমূর্তি এবং ইয়াগুছ ছিল মুরাদ গোত্রের, অবশ্য পরবর্তীতে তা গাতীফ গোত্রের হয়ে যায়। এর আস্তানা ছিল কওমে সাবার নিকটবর্তী ‘জাওফ’ নামক স্থান। ইয়া‘উক ছিল হামাদান গোত্রের দেবমূর্তি, নাসর ছিল যুলকালা‘গোত্রের হিময়ার শাখার মূর্তি। নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাসর ছিল। তারা মারা গেলে, শায়ত্বন তাদের কওমের লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মাজলিস করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পুণ্যবান লোকের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কাজেই তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐ সব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দেয়। (সহীহ (বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৪৯২০, আধুনিক প্রকাশনী ৪৫৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তৃতীয় আয়াতঃ

কুরআন মজীদে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে পথভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে-

‘ইয়া রব, এরা (মূর্তি ও ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে!’ (সূরা ইবরাহীম : ৩৬)।

অন্য আয়াতে এসেছে-

‘আর তারা বলেছিল, তোমরা পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদের এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ সুওয়াকে, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে। অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে।’ (সূরা নূহ : ২৩-২৪)।

কুরআন মজীদে একটি বস্ত্তকে ভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে  চিহ্ণিত করা হবে এরপর ইসলামী শরীয়তে তা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য থাকবে-এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে।

চতুর্থ আয়াতঃ

কুরআনের ভাষায় মূর্তি ও ভাস্কর্য হল বহুবিধ মিথ্যার উৎস। ইরশাদ হয়েছে-

তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে উপাসনা কর (অসার) মূর্তির এবং তোমরা নির্মাণ কর ‘মিথ্যা’। (সূরা আনকাবুত : ১৭)।

মূর্তি ও ভাস্কর্য যেহেতু অসংখ্য মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশের উৎস তাই উপরের আয়াতে একে ‘মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট মনোনীত ধর্ম ও একমাত্র শান্তিময় ধর্ম হলো ইসলাম ধর্ম, যাতে নেই কোন ধরণের সঙ্কীর্ণতা ও লাগামহীন স্বাধীনতা এবং নেই এমন কোন আদেশ যা পালন  করা  দুষ্কর এবং নেই এমন কোন নিষেধ, যা বর্জন করা অসম্ভব। বরং তাতে রয়েছে সহজতা ও পূর্ণতা এবং ব্যাপকতা ও কোমলতা।

কিন্তু এই ধর্মের প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার দরুন মুসলিমদের মাঝে ইয়াহুদী, খ্রিস্টান, মুশরিক ও বিভিন্ন অমুসলিমদের সীমাহীন অপসংস্কৃতি ও অসভ্যতা অনুপ্রবেশ করেছে, যার অন্যতম হলো প্রাণীর ছবি আঁকা ও তোলা এবং ভাষ্কর্য ও মূর্তি প্রস্তুত করা। তাই এই বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সংক্ষেপে কিছু বিধি নিষেধ উল্লেখ করা  হলো।

প্রাণীর ছবি আঁকা, বিনা প্রয়োজনে ছবি তোলা,  সংরক্ষণ করা ও প্রদর্শন করার বিধান

হাদিসে বর্ণিত আছে যে,

(ক) আবূ ত্বলহা (রাঃ) হতে বর্ণিত।

তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ফেরেশতা ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর থাকে এবং ঐ ঘরেও না, যে ঘরে ছবি থাকে।

লায়স (রহ.) ..আবূ ত্বলহা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে (এ বিষয়ে) শুনেছি। (সহীহ (বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন). ৫৯৪৯,৩২২৫, আধুনিক প্রকাশনী ৫৫১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) মুসলিম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (একবার) মাসরূকের সাথে ইয়াসার ইবনু নুমাইরের ঘরে ছিলাম। মাসরূক ইয়াসারের ঘরের আঙিনায় কতগুলো মূর্তি দেখতে পেয়ে বললেনঃ আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে শুনেছি এবং তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, (কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সব থেকে শক্ত শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি তৈরি করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫০, মুসলিম ৩৭/২৬, হাঃ ২১০৯, আহমাদ ৩৫৫৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। প্রাকৃতিক দৃশ্য বা জড় বস্ত্ত এর অন্তর্ভুক্ত নয়।

* এই হাদীস হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১। এই হাদীসটির দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃত ইসলাম ধর্মে জীবজগতের বা জীবজন্তুর ছবি বা মূর্তি তৈরি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে।

২। এই হাদীসটির মধ্যে জীবজগতের বা জীবজন্তুর ছবি বা মূর্তি তৈরি করা হতে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে; কেননা এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়। এবং জীবজগতের বা জীবজন্তুর ছবি বা মূর্তি  তৈরি করার বিষয়টি হলো আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করার একটি মাধ্যম এবং উপাদান।

৩। এই হাদীসটিকে লক্ষ্য করে একথাও বলা হয় যে, যারা  আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করার জন্য মূর্তি বা প্রতিমা তৈরি করে, তাদের জন্য এই হাদীসটি প্রযোজ্য। সুতরাং  মূর্তি বা প্রতিমা নির্মাতাদের জন্য এই হাদীসটি খাস রয়েছে। তাই তারাই কেয়ামতের দিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।

(গ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যারা এ জাতীয় (প্রাণীর) ছবি তৈরী করে, কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেয়া হবে। তাদের বলা হবেঃ তোমরা যা বানিয়েছিলে তাতে জীবন দাও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫১, ৭৫৫৮; মুসলিম ৩৭/২৬, হাঃ ২১০৮,আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ঘরের এমন কিছুই না ভেঙ্গে ছাড়তেন না, যাতে কোন (প্রাণীর) ছবি থাকত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঙ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাবূক যুদ্ধের) সফর থেকে ফিরে আসলেন। আমি আমার কক্ষে পাতলা কাপড়ের পর্দা টাঙিয়েছিলাম। তাতে ছিল প্রাণীর) অনেকগুলো ছবি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এটা দেখলেন, তখন তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেনঃ কিয়ামতের দিন সে সব লোকের সব থেকে শক্ত আযাব হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির (প্রাণীর) সদৃশ তৈরী করবে। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ এরপর আমরা ওটা দিয়ে একটি বা দু’টি বসার আসন তৈরী করি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫৪, ৫৯৫৫, ২৪৭৯; মুসলিম ৩৭/২৬, হাঃ ২১০৭, আহমাদ ২৪১৩৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি একবার ছবিওয়ালা গদি ক্রয় করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তা দেখে) দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন, প্রবেশ করলেন না। আমি বললামঃ যে পাপ আমি করেছি তা থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ এ গদি কিসের জন্যে? আমি বললামঃ আপনি এতে বসবেন ও টেক লাগাবেন। তিনি বললেনঃ এসব ছবির প্রস্তুতকারীদের কিয়ামতের দিন ‘আযাব দেয়া হবে। তাদের বলা হবে, যা তোমরা তৈরী করেছিলে সেগুলো জীবিত কর। আর যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫৭, ৫৯৬১, ২১০৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথী আবূ ত্বলহা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। এ হাদীসের (এক রাবী) বুসর বলেনঃ যায়দ একবার অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমরা তার সেবা শুশ্রূষার জন্যে গেলাম। তখন তার ঘরের দরজাতে ছবিওয়ালা পর্দা দেখতে পেলাম। আমি নবী সহধর্মিণী মাইমূনাহ (রাঃ)-এর পালিত ‘উবাইদুল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ছবির ব্যাপারে প্রথম দিনই যায়দ আমাদের কি জানায়নি? তখন ‘উবাইদুল্লাহ বললেন, তিনি যখন বলেছিলেন, তখন কি তুমি শোননি যে, কারুকাজ করা কাপড় বাদে?

ইবনু ওয়াহ্ব অন্য সূত্রে আবূ ত্বলহা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫৮,৩২২৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪২০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর নিকট কিছু পর্দার কাপড় ছিল, তা দিয়ে তিনি ঘরের এক দিকে পর্দা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেনঃ আমার থেকে এটা সরিয়ে নাও, কেননা এর ছবিগুলো সালাতের মধ্যে আমাকে বাধা দেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৫৯,৩৭৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) সালিমের পিতা ‘আবদুল্লাহ (ইবনু ‘উমার) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ জিবরীল (আ.) (একবার) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট (আগমনের) ওয়াদা করেন। কিন্তু তিনি আসতে দেরী করেন। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে পড়লেন। তখন জিবরীলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটল। তিনি যে মনোকষ্ট পেয়েছিলেন সে বিষয়ে তাঁর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন জিবরীল (আঃ) বললেনঃ যে ঘরে ছবি বা কুকুর থাকে সে ঘরে আমরা কক্ষনো প্রবেশ করি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৬০, ৩২২৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঞ) আবূ জুহাইফাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তের মূল্য, কুকুরের মূল্য ও যিনাকারীর উপার্জন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। আর তিনি সুদ গ্রহীতা, সুদদাতা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে উল্কি অঙ্কণকারী আর যে তা করায় এবং ছবি নির্মাতাকে অভিশাপ করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৬২, ২০৮৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

* এই হাদীস হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১। মুসলিম ব্যক্তির প্রতি একটি অপরিহার্য কর্তব্য হলো এই যে, সে যেন সদা সর্বদা নিরিবিলিতে এবং প্রকাশ্যভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সজাগ ও সতর্ক থাকে। এবং প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা মোতাবেক নিজেকে পরিচালিত করে। এই ধর্মের নিষিদ্ধ ও হারাম বিষয়গুলি বর্জন করে। এটাই হলো ইহকাল ও পরকালে সুখময় জীবন লাভের একটি নিদর্শন।

২। প্রকৃত ইসলাম ধর্ম মানুষের জন্য পবিত্র ও হালাল মাল এবং সম্পদ উপার্জন করার সমস্ত পথ খুলে দেওয়ার প্রতি অতি আগ্রহী। তাই সমস্ত বৈধ পন্থায় যেমন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকর্ম এবং শিল্পের মাধ্যমে মাল উপার্জন করার প্রতি মানুষকে উৎসাহ প্রদান করে। এবং অবৈধ বা হারাম উপায়ে মাল উপার্জন করা অবৈধ ও হারাম ঘোষণা করে। সুতরাং রক্ত বিক্রয় করে তার মূল্য নেওয়া, কুকুর বিক্রি করে তার মূল্য গ্রহণ করা এবং ব্যভিচার অথবা অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে অথবা সুদ ইত্যাদি লেনদেনের মাধ্যমে সম্পদ বা মাল উপার্জন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

৩। এই হাদীসটির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃত ইসলাম ধর্মে শরীরের কোনো অঙ্গে উল্কি করা এবং জীবজগতের ছবি বা মূর্তি তৈরি করা নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম।

(ট) ক্বাতাদাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট ছিলাম। আর লোকজন তাঁর কাছে নানান কথা জিজ্ঞেস করছিল। কিন্তু জবাবে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর (হাদীস) উল্লেখ করছিলেন না। অবশেষে তাঁকে ছবির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি বললেনঃ আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোন প্রাণীর ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাকে কঠোরভাবে হুকুম দেয়া হবে ঐ ছবির মধ্যে জীবন দান করার জন্যে। কিন্তু সে জীবন দান করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫৯৬৩, ২২২৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

* এই হাদীস হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১। প্রকৃত ইসলাম ধর্মে জীবজগতের বা জীবজন্তুর মূর্তি বা ছবি তৈরি করা ও বিক্রয় করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। তবে জীবজগৎ বা জীবজন্তু ছাড়া অন্যান্য জিনিসের মূর্তি বা ছবি তৈরি করা বৈধ। সুতরাং বৃক্ষ, নদী, পাহাড়-পর্বত এবং ভবন ইত্যাদির মূর্তি বা ছবি তৈরি করা সদাসর্বদা বৈধ।

২। প্রকৃত ইসলাম ধর্মে কাল্পনিক প্রাণীর মূর্তি খোদাই করা অথবা নির্মান করা কিংবা ছবি তৈরি করাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। কেননা এইগুলি তো স্বভাবিকভাবে আকৃতির দিক দিয়ে প্রকৃত জীবজগৎ  বা জীবজন্তুর মতই যদিও সেগুলির সমতুল্য প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে কোনো জীবজন্তুর অস্তিত্ব নেই।

(ঠ) এছাড়া আরো অনেক হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের আছার, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও ফুকাহা কেরামের কথা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোন প্রাণীর ছবি আঁকা বিনা ঠেকায় ছবি তোলা ও সংরক্ষণ করা বা প্রদর্শন করা সম্পূর্ণভাবে হারাম। ঠিক তেমনি কোন ব্যক্তির ছবি চাই সেটা কোন আলিম বা বুযুর্গের ছবি হোক না কেন নিজের সাথে বা ঘরে বরকত বা সৌন্দর্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা বা ঝুলিয়ে রাখা শরী‘আতের দৃষ্টিতে নাজায়িয তথা হারাম বরং শাস্তি ও অভিশাপযোগ্য কাজ। আরো দেখুন (সহীহ বুখারী হা. নং ৫৯৫৩, ২২২৫, ১৩৪১, সহীহ মুসলিম হা.নং ৯৬৯, ৫২৮, ২১১১, ২১১২, ২১০৭, নাসাঈ হা.নং ৫৩৬৫, সহীহ ইবনে হিব্বান হা.নং ৫৮৫৩ মুসান্নাফে আবদুররাজ্জাক্ব হা.নং ১৯৪৯২, ১৯৪৮৬, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা হা.নং ২৫৭০৬, ৩৪৫৩৮ শরহুননববী খ.২,পৃঃ ১৯৯ ফাতহুল বারী খ. ১০ পৃঃ৪৭০ উমদাতুল ক্বারী খ. ১৫ পৃ. ১২৪ ফাতাওয়ায়ে  আলমগীরী-৫/৩৫৯ ইমদাদুল মুফতীন পৃঃ ৮২৯)।

অতএব শেখ মুজিবের মূর্তি সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে পরকালে শাস্তি পেতে হবে। এছাড়া শেখ মুজিবের “জন্মশত বার্ষিকী” পালনে বন্দনাকারীরাও রেহাই পাবে না।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শেখ পরিবারের নামে নামকরণ করা

বিগত ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে “দৈনিক শিক্ষাডটকম” এ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, শেখ পরিবারের নামে থাকা ৮০৮ স্থাপনার নাম পরিবর্তন।

বিগত সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের নামে প্রতিষ্ঠিত ৯৭৭টি অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮০৮টির নাম পরিবর্তন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে বাকি ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের নাম।

প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বিগত সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের ৯৭৭টি অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের নাম শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে সেনানিবাস, বিমানঘাঁটি, নৌ-বাহিনীর জাহাজ, মেগাসেতু, সড়ক, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা এভাবে পুরো দেশটাকে শেখ পরিবার বানাতে চেয়েছিলো।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা লোক দেখানো ইবাদতের সাথে জড়িত

ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনামলে আমরা দেখেছি, যখন ভোট আসতো তখন ফ্যাসিস্ট ও ভারতের সেবাদাসী শেখ হাসিনা মাথায় কালো পট্টি বাঁধতো, হাতে তাসবিহ দেখা যেতো, সালাত আদায় ও সকালে কুরআন পড়ার দৃশ্য দেখা যেতো, বোরখা পরিহিত অবস্থায় হজ্জ করতো। হাসিনার দেখাদেখি অন্য নেতারাও ধার্মিক সাজতো। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান তার এক বক্তব্যে বলে, সে নাকি ২২ বছর ধরে প্রতিদিন ৮০ রাকাত জাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আর সারাদিন কুরআন পড়ে।

এভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার গংরা বাংলাদেশের সহজ সরল মুসলমানদের ধোকা দিতে বিভিন্ন সময় ধার্মিক সাজতো। একদিকে ধার্মিক সাজতো আর অন্যদিকে আলেম হত্যা করে উৎসাহ করতো। ফ্যাসিস্ট ও ভারতের সেবাদাসী শেখ হাসিনা প্রতিদিন জামায়াত শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীদের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে গোসল করতো। যাই হোক, এইসব বক ধার্মিক হাসিনা গংদের কোনো আমল বা ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হবে না।

আল্লাহ তা‘আলার নিকটে আমল কবুল হওয়ার জন্য রিয়া বা লৌকিকতামুক্ত এবং কুরআন-সু্ন্নাহ নির্দেশিত নিয়মে হওয়া অপরিহার্য। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, সে ছোট শির্ক করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেমন লোক দেখানো সালাত। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,

“নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করে। আর তিনি তাদের সাথে (সেটার জবাবে) কৌশল অবলম্বনকারী। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় যে তারা সালাত আদায় করছে; কিন্তু আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে”। (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২)।

স্বীয় কাজের কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এবং লোকেরা শুনে বাহবা দিক এ নিয়তে যে কাজ করবে সে শির্কে নিপতিত হবে। এরূপ বাসনাকারী সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কিয়ামতের দিন) শুনিয়ে দিবেন। আর যে লোক দেখানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কিয়ামতের দিন) দেখিয়ে দিবেন।” (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৩১৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৬৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭২০৫, ইসলামিক সেন্টার ৭২৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অর্থাৎ তিনি এসব লোককে কিয়ামতের দিন মানুষের সামনে অপমানিত করবেন এবং কঠোর শাস্তি দিবেন।

যে আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের সন্তুষ্টিকল্পে ইবাদত করবে তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন,

“আমি অংশীবাদিতা (শির্ক) থেকে সকল অংশীদারের তুলনায় বেশি মুখাপেক্ষীহীন। যে কেউ কোনো আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সাথে শরীক করে, আমি তাকে ও তার আমল উভয়কেই বর্জন করি”। (জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি খ্যাতি অর্জনের জন্য কোন কাজ করে, আল্লাহ তা’আলা তার দোষ-ক্রটিকে লোক সমাজে প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য কোন কাজ করে, আল্লাহ তা’আলাও তার সাথে লোক দেখানোর আচরণ করবেন (প্রকৃত সাওয়াব হতে সে বঞ্চিত থাকবে)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৩১৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪৯৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)   ৭৩৬৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৮৭, সুনান আততিরমিযী ২৩৮১, সুনান ইবনু মাজাহ ৪২০৬, সহীহুল জামি' ১১৫৫৫, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৫২৯৮, মুসনাদে ‘আবদ ইবনু হুমায়দ ৭৭৮, মুসনাদে আহমাদ ১১৩৭৫, আবূ ইয়া'লা ১০৫৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪০৬, শুআবূল ঈমান ৬৮১৮, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ১৬৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা অবৈধ টাকা দান খয়রাত করার সাথে জড়িত

আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা নিয়োগ বাণিজ্য, চাদাঁবাজি, দখরবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন কাজে দুর্নীতি ও ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন খাত থেকে তারা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছে এবং এসবের বিরাট একটি অংশ বিদেশে পাচার করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা যে পরিমান অবৈধ টাকা উপার্জন করেছে তা যদি আরো ৫০০ বছর তাদের পরবর্তী বংশধর বসে বসে খায় তবু শেষ হবে না। অবৈধ উপার্জনকারী এইসব নেতারা অবৈধ টাকায় হজ্জ করতো, ঈদ উল আজহায় সবচেয়ে বড় ও দামী গরুটা কুরবানী দিতো, ঈদ উল ফিতরের সময় মাইকিং করে কাপড় বিতরণ করতো, আবার মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান খয়রাত করতো। ২০২৫ সালের ঈদ উল আজহা উপলক্ষে কুরবানীর  হাটে তেমন বড় ও দামী গরু বিক্রি না হওয়ায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আক্ষেপ করে বলেন, আওয়ামী নেতারা না থাকায় হাটে বড় গরু বিক্রি হয়নি।

যেহেতু তারা কোটি কোটি টাকার মালিক তাই তাদেরকে যোগ্যতা না থাকা সত্বেও মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি করা হতো। এখন কথা হলো, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবজি, দখলবাজি, চুরি-ডাকাতী, মানবপাচার, মাদক-কারবারি, মদ ব্যবসা, নারী ব্যবসা, ঠকবাজি, জুয়াচুরি, ওজনে কম দেয়া, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা,  মজুদদারী করা তথা অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা কাউকে বা কোথাও দান-খয়রাত করলে তা কবুল হবে কিনা?

দান-সদকা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে মানুষ পাপমুক্ত হতে পারে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা নেক আমলসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন জ্বালানি কাঠ খেয়ে ফেলে। দান-খয়রাত গুনাহসমূহ বিলীন করে দেয়, যেমন পানি আগুনকে বিলীন করে (নিভিয়ে) দেয়। নামাজ মুমিনের নুর (আলো) এবং রোজা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার ঢাল। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২১০)।

তবে দান-সদকার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও পাপমুক্তির জন্য শর্ত রয়েছে, তা হলো, হালাল পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে দান-সদকা করতে হবে। হারাম পথে উপার্জিত সম্পদ দান করলে কোনো সওয়াব নেই। নামাজ পড়তে যেমন অজু আবশ্যক, নইলে সেই নামাজের কোনো মূল্য নেই, তেমনি হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ দান করাও মানুষের কোনো উপকারে আসে না।

 ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাক-পবিত্রতা ছাড়া সালাত এবং হারাম ধন-সম্পদের দান-খয়রাত কবূল হয় না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩০১,সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪২৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৪, সুনান আননাসায়ি ১৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪২৬, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যার জীবন-জীবিকা হারাম, পেটে হারাম খাদ্য, পরনে হারাম পোশাক, সে অবস্থা থেকে তাওবা করে ও মানুষের হক আদায়ে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্যের আশা করা অনর্থক। কারণ দোয়া কবুল হওয়ার জন্য এগুলো সব হালাল হওয়া শর্ত।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা পুত-পবিত্র, তিনি পুত-পবিত্র জিনিসকেই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা’আলা যে কাজ করতে রসূলদের প্রতি নির্দেশ করেছেন তদ্রূপ এই একই কাজের নির্দেশ মু’মিনদেরকেও করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : ’’হে রসূলগণ! পাক-পবিত্র হালাল রুযী খাও এবং নেক আ’মাল কর’। (সূরা আল মু’মিনূন ২৩ : ৫১)।

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ ’’হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা উপজীবিকা স্বরূপ দান করেছি সেই পাক-পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর’’। (সূরা আল বাকারা ২ : ১৭২)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দৃষ্টান্ত হিসেবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন যে, এ ব্যক্তি দূর-দূরান্তের সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ধূলাবালুতে মাখা। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’ হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে ডাকছে, হে রব্! হে রব্! কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পরনের পোশাক হারাম। আর এ হারামই সে ভক্ষণ করে থাকে। তাই এমন ব্যক্তির দু’আ কিভাবে কবুল হতে পারে? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৮৯, আহমাদ ৮৩৪৮, দারিমী ২৭১৭, সহীহ আল জামি‘ ২৭৪৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৭১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২১৫, ইসলামীক সেন্টার ২২১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হালাল উপায়ে অর্জিত সম্পদ কম হলেও তাতে বরকত ও কল্যাণ রয়েছে। তা থেকে সদকাকৃত সামান্য সম্পদও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে সদকাকারীর উপকারে আসবে।

কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ).....আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন ব্যক্তি তার হালাল ও পবিত্র উপার্জিত একটি খেজুর দান করলে আল্লাহ তা’আলা ডান হাতে তা গ্রহণ করেন এবং তোমাদের কেউ যেভাবে উটের বা ঘোড়ার বাচ্চা লালন পালন করে বড় করে থাকে, তিনিও সেভাবে এটা বাড়াতে থাকেন। অবশেষে তা পাহাড় অথবা এর চেয়েও অনেক বড় হয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২১২, ইসলামীক সেন্টার ২২১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কিন্তু হারাম উপায়ে অর্জিত পাহাড়সম সম্পদের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরকত নেই। তা থেকে অকাতরে খরচ করলেও তা কবুল হয় না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো বান্দা হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ দান-সাদাকা করলে তা কবূল করা হবে না এবং (ঐ অর্থ-সম্পদ) নিজের কাজে ব্যবহার করলেও তাতে বরকত হবে না। আর ঐ অর্থ-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে গেলে তা তার জন্য জাহান্নামের পুঁজি হবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মন্দের দ্বারা মন্দ মিটিয়ে দেন না, তবে সৎকাজ দ্বারা মন্দকাজ নির্মূল করেন। কেননা অবশ্যই মন্দ মন্দকে মিটাতে পারে না। আহমাদ ৩৬৭২, শারহুস্ সুন্নাহ্ ২৯৩০)।

উপর্যুক্ত তথ্যাদি দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, আওয়ামী অবৈধ উপার্জনকারীদের কোটি কোটি টাকা দান খয়রাত করে কোনো লাভ নেই। কারণ উক্ত টাকা তার বৈধভাবে উপার্জিত নয়। উক্ত টাকা অন্যের। তাদের দান খয়রাত আল্লাহ তায়ালা তো কবুল করবেই না বরঞ্চ হারাম মাল ভক্ষণ করার কারণে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে।

রাসুল সাঃ বলেন,

(ক) আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহ হারাম খাদ্য দিয়ে প্রতিপালিত হয়েছে, সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৮৭, সহীহাহ্ ২৬০৯, শু‘আবুল ঈমান ৫৭৫৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহের গোশত/গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৭২, আহমাদ ১৪৪১, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৭২, দারিমী ২৭৭৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

সমাজে অশ্লীলতা প্রসারে আওয়ামীরা জড়িত

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দিন দিন অশ্লীলতার প্রসার বেড়েই চলছে। তবে এই প্রসারটা বিএনপির আমলে ঘটলেও আওয়ামী আমলে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে। যার ফলে বাসা থেকে বের হলেই নজরে পড়ে পর্দাহীন, উলঙ্গ, বেহায়া, হাফ প্যান্ট বা টাইট শার্ট প্যান্ট পরিহিত নারীদের সমাগম। হাটে বাজারে সর্বত্র দেখা যায় এদের চলাফেরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পার্ক, হোটেল মোটেল, রিসোর্টসহ সব জায়গায় চলছে এদের অবৈধ মেলামেশা। বিয়ে ছাড়াই অবৈধ বসবাস  (লিভটুগেদার), সমকামিতা ও কনসার্টে সুন্দরী নারীদের নাচিয়ে পুরুষদের যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলা, সুন্দরী প্রতিযোগীতার নামে মেয়েদের উলঙ্গ করে সৌন্দর্য উপভোগ করা ইত্যাদি যেনো এখন আরো সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এগুলো যে ইসলামে হারাম বা এসবের কারণে তরুণ তরুণীরা যে বিপথগামী হচ্ছে বা একটি সমাজ নষ্ট হচ্ছে সেদিকে রাষ্ট্র শাসকদের কোনো ভূমিকা নেই, কোনো নজর নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার শাসনামলে নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে নেশা ও নারীদের সাথে অবাধ মেলামেশা করার একটা বিরাট সুযোগ করে দিয়েছিলো । সেই সাথে অবৈধ টাকা উপার্জনেরও বিভিন্ন খাত তৈরী করে দেয়া হয়েছিল। যার ফলে আওয়ামী নেতা-কর্মীরা টাকা, নেশা আর নারীদের নিয়ে ফূর্তি করে সময় কাটাতো আর মানুষ খুন করতো। যেহেতু ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা অশ্লীলতা প্রসারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে তাই এদেরকে চরম শাস্তি পেতে হবে।

অশ্লীলতা মানব চরিত্র ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার। তাই এর নিকটবর্তী হ’তে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার নিকটবর্তী হবে না’। (সুরা আন‘আম ৬/১৫১)।

অশ্লীলতার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। যা ইসলামে হারাম। এর কাছে যেতেও আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ’। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/৩২)।

ইসলামের নির্দেশ হলো ব্যক্তি নিজে পাপ করবে না, সক্ষমতা থাকলে অন্যকেও তা করতে দেবে না এবং পাপের প্রসার ঘটাবে না। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে নিজে পাপ কাজে লিপ্ত হয় এবং তার প্রসার ঘটায়, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। (সুরা: নুর, আয়াত: ১৯)।

সমাজে অন্যায় ও অপরাধ বিস্তারে নেতৃস্থানীয় মানুষই বেশি দায়ী। কেননা মানুষ তাদের ভয় পায় এবং তারা কোনো অন্যায় করলে সেটা সমাজে বৈধতা লাভ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন তার সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদের সৎ কাজ করার আদেশ দিই, কিন্তু তারা সেখানে অসৎ কাজ করে। অতঃপর তার জন্য শাস্তি ন্যায়সংগত হয়ে যায় এবং আমি তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করি। (সুরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১৬)।

পাপিষ্ঠ আওয়ামীদের কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য নেক্কার ব্যক্তিগণও বিভিন্নভাবে শাস্তি ভোগ করছে।

রাসুল সা. বলেন,

যাইনাব বিনত জাহাশ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তবর্ণ চেহারা নিয়ে ঘুম থেকে জাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ’লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্’! আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই। নিকটবর্তী এক দুর্যোগে আরব ধ্বংস হয়ে যাবে। ইয়াজূজ-মা’জূজের (প্রতিরোধ) প্রাচীর আজ এতটুকু পরিমাণ খুলে গেছে। সুফ্ইয়ান নব্বই কিংবা একশ’র রেখায় আঙ্গুল রেখে গিঁট বানিয়ে দেখলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আমরা কি ধ্বংস হয়ে যাব অথচ আমাদের মাঝে নেককার লোকও থাকবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭০৫৯, ৩৩৪৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সা. আরো বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন লোককে সৎ কাজের দিকে আহবান করবে, তার জন্যও সে পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ তাদের সাওয়াবের কোন অংশ একটুও কমবে না। অনুরূপ যে ব্যক্তি কাউকে গোমরাহীর দিকে আহবান করে তারও সে পরিমাণ গুনাহ হবে, যতটুকু গুনাহ তার অনুসারীদের জন্য হবে। অথচ এটা অনুসারীদের গুনাহকে একটুও কমাবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৫৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৯৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৬০, ইসলামিক সেন্টার ৬৬১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী নেতারা তাদের অনুসারী বা সমর্থক বা ভোটারদের ইসলামের পথে তথা ভালো পথে না ডেকে অশ্লীলপথে সব সময় আহবান করে এসেছে। ঐসব নেতাদের দ্বারা অশ্লীলপথে যতজন অনুসারী এসেছে তাদের দ্বারা যতো পাপ কাজ সংঘটিত হচ্ছে সব পাপের দায়ভার ঐ নেতার উপর চাপানো হচ্ছে। এটা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তাহলে বুঝুন আওয়ামী নেতাদের পাপের বোঝা কতো বড় হবে।

আওয়ামীরা যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণের সাথে জড়িত

ইসলামী আইন ছাড়া পৃথিবীর কোনো মানবরচিত আইনে যিনা/ব্যভিচার এর শাস্তির কথা উল্লেখ নেই। শুধু ধর্ষণ বা গণধর্ষণ এর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানবরচিত আইনে নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সহবাস করলে আর ঐ নারী যদি আদালতে এমনকি তার স্বামীর বিরুদ্ধে হলেও অভিযোগ দায়ের করে তা ধর্ষণ হিসেবে আমলে নিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। ধর্ষণ বা গণধর্ষণ  একটি প্রকাশিত বিষয়। আজ হোক আর কাল হোক এটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু নারী-পুরুষের সম্মতিক্রমে অবৈধ যেসব মেলামেশা হচ্ছে তা কিন্তু মানবরচিত আইনে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। অথচ ইসলামে শুধু ধর্ষণই না নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে যিনা/ব্যভিচার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এই যিনা/ব্যভিচার বা ধর্ষণ পৃথিবী জুড়ে দিন দিন বেড়েই চলছে। মানবরচিত আইনেও পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর থাকলেও সামান্যতম ধর্ষণ কমছে না।  পৃথিবীর উন্নত ও সভ্য জাতি হিসেবে যারা দাবী করেন সেইসব রাষ্ট্রেই এই ধর্ষণের সংখ্যা আরো বেশী। সম্মতিক্রমে বা লিভটুগেদার হিসেবে অবাধ মেলামেশার সংখ্যা তো কোটি কোটি।

কোন্ দেশে ধর্ষণেরর সংখ্যা কতো আসুন তা জেনে নেই। এই ধর্ষণের সংখ্যা নির্ণয় করা হয় থানায় বা আদালতে ধর্ষিতার অভিযোগ দেয়ার উপর ভিত্তি করে।

১. আমেরিকা: পৃথিবীর এই সুপার পাওয়ার দেশটি ধর্ষণ এর দিক থেকেও সুপার পাওয়ার। এখানে ধর্ষকদের ৯৯%ই পুরুষ। বাকি ১% ধর্ষণ নারীদের মাধ্যমে হয়। U.S Bureau of Justice এর হিসেব মতে ধর্ষিতদের ৯১ শতাংশ নারী ও বাকি ৯ শতাংশ পুরুষ। National Violence Against Women Survey এর তথ্যমতে প্রতি ৬ জন নারীর একজন ও প্রতি ৩৩ জন পুরুষের একজন আমেরিকায় ধর্ষণ এর শিকার হয়। মাত্র ১৬% ধর্ষণ কেস রিপোর্ট করা হয় আমেরিকায়।

২. দক্ষিন আফ্রিকা: ২০১২ সালে দক্ষিন আফ্রিকাতে ৬৫০০০ ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন নির্যাতনের রিপোর্ট হয়েছে। “পৃথিবীর ধর্ষণের রাজধানী” হিসেবে দক্ষিন আফ্রিকা বিখ্যাত। ৪০০০ নারীর উপর একটি জরিপ চালালে তাদের প্রতি ৩ জনের একজন বলেন তারা ধর্ষণের শিকার। Medical Research Council (MRC) এর এক জরিপে দেখা গেছে দক্ষিন আফ্রিকার ২৫% পুরুষ জীবনে একবার হলেও ধর্ষণ করেছে। শিশু ধর্ষণের হার দক্ষিন আফ্রিকায় সবচাইতে বেশি। এখানে কেউ যদি ধর্ষণ করে ধরা পরে তাকে মাত্র দুই বছর সাজা ভোগ করতে হয়।

৩. সুইডেন: ইউরোপ এর মধ্যে সর্বাধিক ধর্ষণ হয় সুইডেন এ এবং পৃথিবীর মধ্যে ৩য়। সুইডেন এ প্রতি ৪ জনে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। সুইডিশ পুলিশ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ সালে সুইডেন এ ধর্ষণ এর হার পূর্ববর্তী ১০ বছরের তুলনায় ৫৮% শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪. ভারত: ধর্ষণ এর হার যেনো ভারতে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভারতে নারীদের উপর নির্যাতনের মধ্যে সবচাইতে কমন হল ধর্ষণ। National Crime Records Bureau এর তথ্যমতে ২০১২ সালে ভারতে ২৪৯২৩টি ধর্ষণ এর রিপোর্ট করা হয়েছে। তবে ভারতে ধর্ষণ হলে তার রিপোর্ট হয় একদম ই নগণ্য মাত্রায়। তবে আশাঙ্কা জনক বিষয় হলো রিপোর্ট করা ধর্ষণ কেস এর ৯৮% নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার পিতা, নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী বা পরিচিতদের মাধ্যমে। ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা  ঘটে।

৫. যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্য পৃথিবীর ৫ম মারাত্মক ধর্ষণপ্রবন দেশ হিসেবে পরিচিত। ইংল্যান্ড ও ওয়ালেস এ প্রতিবছর প্রায় ৮৫০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এছাড়া ৪,০০,০০০ এর উপরে নারী প্রতিবছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতি ৫ জনে ১ জন নারী ১৬ বছরের পরে কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

৬. জার্মানি: সরকারি হিসেব মতে ২,৪০,০০০ নারী ও কিশোরী জার্মানিতে এই ধর্ষণের কারনে মাড়া গেছে। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে জার্মানিতে ৬,৫০,৭৩৯৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

৭. ফ্রান্স: এই দেশটি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত  ধর্ষণ ও কোনো অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। অথচ এখন প্রতিনিয়তই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সরকারি মতে ফ্রান্সে প্রতিবছর ৭৫০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। তবে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের মাত্র ১০% পুলিশে অভিযোগ করে।

৮. কানাডা: কানাডাতে ধর্ষণ হয়েছে এমন রেকর্ড আছে ২,৫১,৬৯১৮ জনের। কানাডাতে যে পরিমান ধর্ষণ হয় তার মাত্র ৬% রেকর্ড হয়। কানাডার প্রতি তিনজন নারীর একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। Justice Institute of British Columbia এর একটি রিপোর্ট মতে কানাডার প্রতি ১৭ জন নারীর একজন ধর্ষণ এর শিকার হয়।

৯. শ্রীলঙ্কা: জাতিসংঘের এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৪.৫% শ্রীলঙ্কান পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় ধর্ষণ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে ৯৬.৫% ধর্ষক কোনো আইনের আওতায় আসে না। ৬৪.৯% ধর্ষক একের অধিক বার ধর্ষণ করে। এছাড়া ২.৭% পুরুষ অন্য পুরুষকে ধর্ষণ করে।

১০. ইথিওপিয়া: জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ইথিওপিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ইথিওপিয়ায় এটা মোটামুটি কমন ব্যাপার যে কারো কোনো মেয়ে পছন্দ হলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে যতদিন না সেই মেয়ে গর্ভবতী হয় ততদিন ধর্ষণ করতে থাকে। এছাড়া ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী সদস্যরাও নিয়মিত সিভিলিয়ান নারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে ধর্ষণের হিসাব

(১)  বিগত ২৬ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত “বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান” শিরোনামে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ: গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। পুলিশের হিসাব বলছে, গত বছর ধর্ষণের কারণে ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যান। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১ নারী ও ১৪ শিশু।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): আসকের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন: গত বছর ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৫৬।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম: ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৩৮৩ শিশু। ২০১৮ সালের চেয়ে গত বছর শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে।

(২)  বিগত ৩ মার্চ ২০২১ তারিখে “বিবিসি নিউজ বাংলা” পত্রিকায় প্রকাশিত “বাংলাদেশে পাঁচ বছরে থানায় সাড়ে ২৬ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা” শিরোনামে জানা যায়, বাংলাদেশের পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের থানাগুলোয় ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে।

আগের বছরগুলোর তুলনায় গত দুই বছরে থানায় ধর্ষণের মামলার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪,৩৩১টি। ২০১৭ সালে মামলা হয়েছে ৪,৬৮৩টি। ২০১৮ সালে ৪,৬৯৫টি।

(৩) বিগত ৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে “দ্য ডেইলি স্টার বাংলা” পত্রিকায় প্রকাশিত “৫ বছরে ১২ হাজার নারী-কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা, ৬ হাজারের বেশি ধর্ষণ” শিরোনামে জানা যায়, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫ শতাংশেরও বেশি।

এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯ জন নারী ও কন্যাশিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২০৭ জনকে যৌন সহিংসতার পর হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৮ জনই শিশু।

এছাড়া, অন্তত ৫০ জন ভয়াবহ সহিংসতার ট্রমা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।

সিক্সটিন ডেজ অব অ্যাক্টিভিজম এর তথ্যানুসারে প্রতি ৯ ঘণ্টায় অন্তত ১ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়।

যাই হোক, ধর্ষণের হিসেব লিখে শেষ করা যাবে না। ধর্ষণের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সংস্থা আছে। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্ষণের খবর দেখে এর সংখ্যা নির্ণয় করে। আর পুলিশ মাস শেষে বাংলাদেশের সকল থানা থেকে ধর্ষণের মামলা থেকে এর সংখ্যা নির্ণয় করে থাকে। তাহলে এখানে বোঝা যাচ্ছে, অনেক ধর্ষণের ঘটনা নিরব থেকে যায় যা মামলা হয় না, পত্রিকায় আসে না। সেহিসেবে উল্লেখিত হিসেবের চেয়ে প্রকৃত ঘটনা আরো অনেক বেশী।

যে হিসেবগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো শুধুই ধর্ষণের হিসেব। কিন্তু বাংলাদেশেও প্রতিদিন বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বাসা বাড়ি, পার্কসহ বিভিন্ন বিনোদন স্পটে লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বা কোথাও সরাসরি সেক্স স্পটে রুম ভাড়া নিয়ে যিনা/ব্যভিচার করে যাচ্ছে যার হিসেব কেউ রাখে না, পত্রিকায় আসে না। আর এই সেক্সচুয়াল কাজে ধর্ষণ ছাড়াও আওয়ামীলীগের ৯৫% নেতা কর্মী জড়িত। যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণ কাজে শুধু আওয়ামীলীগই না অন্যান্য দলের লোকেরাও প্রায় সমান হারে জড়িত। ইসলামি সংগঠন বা দলের সাথে জড়িত নেতা-কর্মী বা সমর্থকগণ সব সব সময় যিনা/ব্যভিচার বা ধর্ষণকে এড়িয়ে চলে। এরপরও ব্যতিক্রম দেখা যায়, যার পরিমাণ হয়তো  লাখে একজন আর অনৈসলামিক দলের মধ্যে যিনা/ব্যভিচার বা ধর্ষকের সংখ্যা একশতে ৯৫ জন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের ধর্ষণের হিসেব লিখে শেষ করা যাবে না। যেহেতু পুলিশ ও  বিচার বিভাগে আওয়ামীদের নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়েছিলো তাই ধর্ষিতারা কোনো ন্যায় বিচার পায়নি। অনেকে ভয়ে মামলা করেনি বা হুমকি ধমকির ভয়ে অনেকে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ধর্ষণ করানো ছাড়াও তার নিজ দলের লোকদের সব সময় চাঙ্গা রাখতে তাদের নিজেদের মধ্যে অবাধ মেলামেশাকে বৈধ করে দিয়েছিলো। নারী পুরুষ বিবাহ বহির্ভুত যেভাবেই সেক্স করুক না কেনো ইসলাম এর জন্য ইহকাল ও পরকালে নির্ধারিত শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছে। আর এটাই  ইসলামে নির্ধারিত নয়টি দন্ডবিধির মধ্যে একটি ইসলামি শরিয়াহ আইন।

যিনা/ব্যভিচার বা ধর্ষণের শাস্তি

ইসলামের মূল লক্ষ্যসমুহের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হলো, মানুষের ইজ্জত-আবরু ও বংশের হেফাজত করা। যিনার মাধ্যমে ইসলামের এ মহান উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হয় বিধায় ইসলামে এটি হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং যে সব মানবিক অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এটি তন্মধ্যে গুরুতর ও অন্যতম। ব্যভিচার একটি মহাপাপ যা অনেকগুলো অপরাধের নায়ক।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(ক) “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ ও অসৎ পন্থা।” (সূরা বনী ইসরাঈল ৩২)।

তিনি অন্য স্থানে বলেন:

(খ) “কোন রকম অশ্লীলতার কাছেও যেও না তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (সূরা আল আনআম ১৫১)।

তিনি আরো বলেন,

(গ) ‘তারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন মা‘বূদকে ডাকে না শরী‘আত সম্মত কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করে না এবং যেনা করে না। আর যে ব্যক্তি এই সকল কাজ করে সে শাস্তি ভোগ করবে। ক্বিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং এ শাস্তি লাঞ্ছিত অবস্থায় সে অনন্তকাল ভোগ করতে থাকবে’। (সুরা ফুরক্বান ৬৮)।

অশ্লীল কাজসমূহের মধ্যে যিনা বা ব্যভিচার সর্বাধিক অশ্লীল কাজ। ইসলাম পর্দার বিধান পালন, দৃষ্টি অবনতকরণ ও পরনারীর সাথে নির্জনে অবস্থান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যভিচারের পথ ও মাধ্যম রুদ্ধ করে দিয়েছে।

‘আলকামাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে চলতে ছিলাম, তখন তিনি বললেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –এর সাথে ছিলাম, তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংযত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সওম পালন করে। সওম তার প্রবৃত্তিকে দমন করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯০৫, ৫০৬৫, ৫০৬৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩২৯১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪০০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২০৪৬, সুনান ইবনু মাজাহ ১৮৪৫, ১৮৪৬, ১৮৪৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১০৮১, নাসায়ী ২২৪০, ২২৪১, ২২৪২, আহমাদ ৩৫৮১, দারেমী ২১৬৫, ২১৬৬, বুলগুলমারাম, ৯৬৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

তিনটি কারণ ব্যতীত কোনো মুসলিমকে হত্যা করা বৈধ নয়

(ক) আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তাকে হত্যা করা বৈধ নয় তিনটি অপরাধের যে কোনো একটিতে লিপ্ত না হলেঃ (১) বিবাহিত লোক ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করবে, (২) আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে অথবা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হবে অথবা তাকে দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হবে, (৩) আর কাউকে হত্যা করলৈ তার বিনিময়ে কিসাসস্বরূপ তাকেও হত্যা করা যাবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(খ) আবূ উমামা ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) (ছাদের) উপর থেকে বিদ্রোহীদের প্রতি তাকালেন। হত্যার ব্যাপারে আলোচনা করতে শুনে তিনি বললেনঃ তারা আমাকে হত্যার সংকল্প করছে। কেন তারা আমাকে হত্যা করবে? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ তিনটি কারণের কোন একটি বিদ্যমান না থাকলে কোন মুসলিমকে হত্যা করা বৈধ নয়। বিবাহিত ব্যক্তি যেনা করলে, তাকে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করা অথবা যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে অথবা যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হয়ে যায়। আল্লাহর শপথ! আমি জাহিলী যুগেও কখনো যেনা করিনি এবং ইসলামী যুগেও না, আমি কোন মুসলিমকে হত্যা করিনি এবং আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে মুরতাদ হইনি। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৩৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২১৫৮, নাসায়ী ৪০১৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫০২, আহমাদ ৪৩৯, ৪৫৪, ৫১১, ১৪০৫, ২২৯৭, বায়হাকী ফিস সুনান ৮/১৯৪, আল-হাকিম ফিল মুসতাদরাক ৪/৩৫০, ইরওয়া ৭/২৫৪, তাখরীজুল মাখতার ৩০০-৩০২, ৩৪২, ৩৪৬, ৩৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, ’’আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’’ তার রক্তপাত বৈধ নয়। কিন্তু তিন শ্রেণীর লোক হত্যার যোগ্যঃ জানের (হত্যার) বদলে জান (হত্যা), বিবাহিত যেনাকারী এবং মুসলিম জামাআত থেকে পৃথক হয়ে দীন ত্যাগকারী। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৩৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৮৭৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৬৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৭৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪০২, নাসায়ী ৪০১৬, ৪৭২১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৫২, আহমাদ ৩৬১৪, ৪০৫৫, ৪২৩৩, ৪৪১৫, ২৪৯৪৭, দারেমী ২৪৪৭, বায়হাকী ফিস সুনান ৭/২১৩, ২৮৩, ২৮৪, ইবনু হিব্বান ৪৪০৮, ৫৯৭৭, দারাকুতনী ৩/৭২, ইরওয়া ২১৯৬, যিলালুল জান্নাহ ৬০, আধুনিক প্রকাশনী ৬৩৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শাস্তির বিধান

অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে হলে

এই কেসে, শরিয়া আইনে দুজনকেই প্রকাশ্যে জনগণেরে উপস্থিতে ১০০ বেত্রাঘাত করতে হবে এবং সাথে এক বছরের জন্য নির্বাসন বা জেল। এছাড়া খাঁটিভাবে তওবা করতে হবে। আর বেত্রাঘাতের ক্ষেত্রে এটাই ইসলামী শরীয়াতের সবচেয়ে বড় শাস্তি।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে এক’শ ঘা করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরী করবে এদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের অভিভূত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক। ঈমানদারদের একটি দল যেন এদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা আন নূর ২৪:২)।

হাদিস অনুয়ায়ী শাস্তির বিধান নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

(ক)  যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে শুনেছি যে, অবিবাহিত লোক যিনা করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে একশত চাবুক মারার ও এক বছরের জন্য দেশান্তর করার হুকুম দেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৫৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৮৩১, ২৩১৪, আধুনিক প্রকাশনী ৬৩৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যিনাকারীকে) বেত্ৰাঘাত করেছেন ও নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন, আবূ বকর (রাঃ) বেত্ৰাঘাত করেছেন ও নির্বাসন দিয়েছেন এবং উমার (রাঃ)-ও বেত্ৰাঘাত করেছেন এবং নির্বাসন দণ্ডও প্রদান করেছেন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৮, ইরওয়া ২৩৪৪, বুলগুলমারাম ১২১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(গ)  উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা আমার কাছ থেকে (দীনের বিধান) শিখে নাও। আল্লাহ তাদের (মহিলিাদের জন্য একটি পথ করে দিয়েছেন। যদি অবিবাহিত পুরুষ অবিবাহিত নারীর সাথে যেনা করে তবে তাদের প্রত্যেককে এক বছরের নির্বাসনসহ এক শত বেত্রাঘাত করতে হবে। আর যদি বিবাহিত পুরুষ বিবাহিত নারীর সাথে যেনা করে তবে তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত এবং রজম করতে হবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩০৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৫৮, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৪, ১৪৫১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪১৫, আহমাদ ২২১৫৮, ২২১৯৫, ২২২০৮, ২২২২৩, ২২২৭৪, দারেমী ২৩২৭, ইরওয়া ২৩৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৬৭, ইসলামিক সেন্টার ৪২৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঘ) আবূ হুরায়রা, যায়েদ ইবনে খালিদ ও শিবল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললো, আমি আপনাকে আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমাদের মধ্যে কিতাবুল্লাহর বিধান অনুযায়ী মীমাংসা করে দিন। তার তুলনায় অধিক বিচক্ষণ তার প্রতিপক্ষ বললো, হাঁ আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব অনুসারে ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে বক্তব্য পেশের অনুমতি দিন। তিনি বলেনঃ বলো।

লোকটি বললো, আমার পুত্র এই ব্যক্তির শ্রমিক ছিল, সে তার স্ত্রীর সাথে যেনা করেছে। আমি তার পক্ষ থেকে এক শত বকরী এবং একটি গোলাম পরিশোধ করেছি। অতঃপর আমি কতক বিজ্ঞ লোককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমাকে বলা হয় যে, আমার পুত্রকে এক শত বেত্রাঘাত করতে হবে এবং এক বছরের নির্বাসন দিতে হবে, আর এই ব্যক্তির স্ত্রীকে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আমি অবশ্যই তোমাদের দু’জনের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করবো। তুমি তোমার এক শত বকরী ও গোলাম ফেরত লও এবং তোমার পুত্রকে এক বছরের নির্বাসনসহ এক শত বেত্রাঘাত করা হবে। আর হে উনাইস! তুমি আগামী কাল সকালে তার স্ত্রীর নিকট যাবে। সে যদি স্বীকারোক্তি করে তবে তাকে রজম করবে। অধস্তন রাবী হিশাম বলেন, উনায়স (রাঃ) পরদিন সকালে তার নিকট গেলো এবং সে স্বীকারোক্তি করলে তিনি তাকে রজম করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৪৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬৩৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩২৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯৭ – ১৬৯৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৫৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৩, নাসায়ী ৫৪১০, ৫৪১১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৪৫, আহমাদ ১৬৫৯০, ১৭০৩৮, মুয়াত্তা মালেক ১৫৫৬, দারেমী ২৩১৭, ইরওয়া ১৪৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিবাহিত নারী পুরুষ হলে

এই কেসে, যে অবিবাহিত তাঁকে ১০০ বেত্রাঘাত করতে হবে। আর যে বিবাহিত তাকে শরিয়াতের আইন মাফিক পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। আর যদি দুজনেই বিবাহিত হয় তবে দুজনকেই পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড। যাতে করে সে তার কুকর্মের উপযুক্ত ফলাফল ভোগ করতে পারে আর হারাম কাজে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন করে মজা উপভোগ করেছিল, এখন তেমনি করে ঠিক তার উল্টা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। এ মৃত্যুদণ্ডেও যদি তাদের পাপের পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত না হয় এবং তারা উভয়েই তওবা না করে মারা যায় তাহলে তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেয়া হবে। এই ধরণের বিচার প্রকাশ্য জনসম্মুখে কার্যকর করতে হবে, যাতে অন্যরা দেখে এই কাজ করতে সাহস না পায়।

সহিহ হাদিস অনুয়ায়ী শাস্তির বিধান নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

(ক)  উমার (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেছেন, তন্মধ্যে ’রজমের’ আয়াত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজম করেছেন এবং তারপরে আমরাও রজম করেছি। আর রজমের দণ্ড আল্লাহর কিতাবের মাঝে অপরিহার্য সত্য ঐ সমস্ত পুরুষ ও নারীর ওপর যারা বৈবাহিক হওয়া সত্ত্বেও যিনা করে। যখন তা প্রমাণসাপেক্ষ হয় অথবা গর্ভধারিণী হয় অথবা স্বীকারোক্তি দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৫৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৮৩০, ২৪৬২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩১০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯১, দারিমী ২৩৬৮, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩২, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৩, আহমাদ ৩৯১, ইরওয়া ২৩৩৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩৫৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (খ) বুরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

একদা মায়েয ইবনে মালেক (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, ‘আক্ষেপ তোমার প্রতি, চলে যাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর’। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন এবং সামান্য একটু দূরে গিয়েই পুনরায় ফিরে আসলেন এবং আবারও বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবারও তাঁকে পূর্বের ন্যায় বললেন। এইভাবে তিনি যখন চতুর্থবার এসে বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! আমি তোমাকে কোন্ জিনিস হতে পবিত্র করব? তিনি বললেন, যিনা হতে। তাঁর কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ছাহাবাদেরকে) জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটি কি পাগল’? লোকেরা বলল, না তো? তিনি পাগল নন। তিনি আবার বললেন, ‘লোকটি কি মদ পান করেছে’? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তাঁর মুখ শুঁকে দেখেন; কিন্তু মদের কোন গন্ধ তাঁর মুখ হতে পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সত্যই যিনা করেছ’? তিনি বললেন, জি হ্যাঁ। এরপর তিনি রজমের নির্দেশ দিলেন, তখন তাঁকে রজম করা হল। এই ঘটনার দুই/তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ছাহাবাদের সম্মুখে) এসে বললেন, তোমরা মায়েয ইবনে মালেকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা সে এমন তওবাই করেছে, যদি তা সমস্ত উম্মতের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়, তবে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে।

অতঃপর আয্দ বংশের গামেদী গোত্রীয় একটি মহিলা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, তোমার প্রতি আক্ষেপ! চলে যাও, আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার কর এবং তওবা কর। তখন মহিলাটি বলল, আপনি মায়েয ইবনে মালেককে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাকেও কি সেভাবে ফিরিয়ে দিতে চান? দেখুন, আমার এই গর্ভ যিনার! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি (সত্যই গর্ভবতী)? মহিলাটি বলল, জি হ্যাঁ।

অতঃপর তিনি বললেন, যাও, তোমার পেটের বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আনছারী এক লোক মহিলাটির সন্তান প্রসব হওয়ার সময় পর্যন্ত তাকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। সন্তান প্রসব হওয়ার পর ঐ লোকটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে এসে বলল, হুযুর! গামেদী মহিলাটির গর্ভ খালাছ হয়ে গিয়েছে। এবার তিনি বললেন, এই শিশু বাচ্চাটিকে রেখে আমরা মহিলাটিকে রজম করতে পারব না। এমতাবস্থায় যে, তাকে দুধ পান করাবার মত কেউই নেই। এমন সময় আর একজন আনছারী দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমিই তার দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করব। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তাকে রজম করলেন।

অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহিলাটিকে বললেন, ‘তুমি চলে যাও এবং সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর’। অতঃপর সন্তান প্রসবের পর যখন আসল, তখন বললেন, আবারও চলে যাও এবং তাকে দুধ পান করাও এবং দুধ ছাড়ান পর্যন্ত অপেক্ষা কর। পরে যখন বাচ্চাটির দুধ খাওয়া বন্ধ হয়, তখন মহিলাটি বাচ্চার হাতে এক খণ্ড রুটির টুকরা দিয়ে তাকে সঙ্গে করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে উপস্থিত হল। এইবার মহিলাটি বলল, হে আল্লাহর নবী! এই দেখুন (বাচ্চাটির) দুধ ছাড়ান হয়েছে, এমনকি সে নিজের হাতের খানাও খেতে পারে। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাচ্চাটিকে একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিলেন। পরে মহিলাটির জন্য গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। অতএব তার জন্য বক্ষ পর্যন্ত গর্ত খনন করা হল। তৎপর লোকদেরকে নির্দেশ করলেন, তারা মহিলাটিকে রজম করল। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার মাথায় একখণ্ড পাথর নিক্ষেপ করতেই রক্ত ছিটে এসে তাঁর মুখমণ্ডলের উপর পড়ল। তাই তিনি মহিলাটিকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে গাল-মন্দ করলেন। (এটা শুনে) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে খালেদ, থাম! সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! মহিলাটি এমন (খালেছ) তওবা করেছে, যদি কোন বড় যালেমও এই ধরনের তওবা করে, তারও মাগফেরাত হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়ার আদেশ করলেন। অতঃপর তার জানাযা পড়লেন এবং তাকে দাফনও করা হল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৬২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩২৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৮২, ইসলামিক সেন্টার ৪২৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(গ)  আবূ হুরায়রা, যায়েদ ইবনে খালিদ ও শিবল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তারা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললো, আমি আপনাকে আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমাদের মধ্যে কিতাবুল্লাহর বিধান অনুযায়ী মীমাংসা করে দিন। তার তুলনায় অধিক বিচক্ষণ তার প্রতিপক্ষ বললো, হাঁ আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব অনুসারে ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে বক্তব্য পেশের অনুমতি দিন। তিনি বলেনঃ বলো।

লোকটি বললো, আমার পুত্র এই ব্যক্তির শ্রমিক ছিল, সে তার স্ত্রীর সাথে যেনা করেছে। আমি তার পক্ষ থেকে এক শত বকরী এবং একটি গোলাম পরিশোধ করেছি। অতঃপর আমি কতক বিজ্ঞ লোককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমাকে বলা হয় যে, আমার পুত্রকে এক শত বেত্রাঘাত করতে হবে এবং এক বছরের নির্বাসন দিতে হবে, আর এই ব্যক্তির স্ত্রীকে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আমি অবশ্যই তোমাদের দু’জনের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করবো। তুমি তোমার এক শত বকরী ও গোলাম ফেরত লও এবং তোমার পুত্রকে এক বছরের নির্বাসনসহ এক শত বেত্রাঘাত করা হবে। আর হে উনাইস! তুমি আগামী কাল সকালে তার স্ত্রীর নিকট যাবে। সে যদি স্বীকারোক্তি করে তবে তাকে রজম করবে। অধস্তন রাবী হিশাম বলেন, উনায়স (রাঃ) পরদিন সকালে তার নিকট গেলো এবং সে স্বীকারোক্তি করলে তিনি তাকে রজম করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৪৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩১৫, ২৬৪৯, ২৬৯৬, ২৭২৫, ৬৬৩৩, ৬৮২৮, ৬৮৩২, ৬৮৩৩, ৬৮৩৬, ৬৮৪৩, ৬৮৬০, ৭১৯৫, ৭২৬০, ৭২৭৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৪৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৩, নাসায়ী ৫৪১০, ৫৪১১, আহমাদ ১৬৫৯০, মুয়াত্তা মালেক ১৫৫৬, দারেমী ২৩১৭, ইরওয়া ১৪৬৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২১৬৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঘ)  আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একদিন জনৈক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলো। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে ছিলেন। লোকটি উচ্চস্বরে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি যিনা করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন লোকটি সেদিকে গিয়ে আবার বলল, আমি যিনা করেছি। তখনও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অবশেষে যখন লোকটি চারবার স্বীকারোক্তি দিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে বললেন, তুমি কি পাগল? লোকটি (দৃঢ়তার সাথে) বলল, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি কি বিবাহিত? সে বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সাহাবীদের উদ্দেশে) বললেন, একে নিয়ে যাও এবং ’রজম’ কর।

(হাদীসের এক বর্ণনাকারী) ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, আমার নিকট এমন এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যিনি জাবির ইবনু ’আব্দুল্লাহ থেকে শুনেছেন, আমরা তাকে মদীনাতেই ’রজম’ করেছি। অতঃপর যখন তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করছিল (তীব্র যাতনা অনুভূত হয়ে) তখন সে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমরা ’হাররাহ্’ নামক স্থানে তাকে পেলাম এবং সেখানেই তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করলাম। পরিশেষে সে মৃত্যুবরণ করল।

বুখারীর অপর বর্ণনাতে জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, সে বলল, ’হ্যাঁ’। এরপর বর্ণিত আছে যে, অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যার নির্দেশ করলেন। সুতরাং ঈদগাহের মাঠে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো যখন তার দেহে আঘাত হানতে ছিল, তখন সে অসহ্য যন্ত্রণায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু পরে তার নাগাল পাওয়া গেল ও রজম করা হলো। অতঃপর তার জানাযার সালাতও আদায় করালেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৬০, ৩৫৬৫, ৩৫৬৬, ৩৫৬৭, ৩৫৮১, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫২৭২, ৫২৭০, ৬৮২০, ৬৮২৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯১, ১৬৯২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪২৮, ১৪২৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪২৮, ৪৪৩০, ৯৫৩৫, বায়হাকী ফিস সুনান ৮/২১৯, ২২৮, আত-তহাবী ৩/১৪৩, ইরওয়া ৭/৩৫৩, নাসায়ী ১৯৫৬, আহমাদ ১৪৪৬২, সহীহ আত্ তারগীব ২৩৩৫, আধুনিক প্রকাশনী ৪৮৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঙ) আবূ গাসসান মালিক ইবনু আবদুল ওয়াহিদ মিসমাঈ (রহঃ)…..ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাযিঃ) এর মাধ্যমে হাদীস শুনিয়েছেন যে,

জুহাইনাহ গোত্রের এক মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আগমন করল। সে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি হদ (শারীআত কর্তৃক নির্ধারিত ব্যভিচারের শাস্তি) এর উপযোগী হয়েছি। অতএব আমার উপর তা কার্যকর করুন। তখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিভাবককে ডাকালেন এবং বললেন, তাকে ভালভাবে দেখাশোনা করো। তারপর সে যখন সন্তান প্রসব করবে তখন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে তাই করলো। এরপর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি (শাস্তি প্রদানের) নির্দেশ দিলেন। তখন মহিলার কাপড় শক্ত করে বাধা হলো। এরপর তিনি শাস্তি কার্যকর করার আদেশ দিলেন। তাকে পাথর মারা হলো।

অতঃপর তিনি তার উপর জানাযার সালাত আদায় করলেন। তখন উমর (রাযিঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি তার (জানাযার) সালাত আদায় করলেন অথচ সে তো ব্যভিচার করেছিল? তিনি বললেন, নিশ্চয়ই সে এমনভাবে তওবা করেছে, যদি তা মদীনার সত্তরজন লোকের মধ্যে বণ্টিত হতো, তবে তাদের জন্য তাই যথেষ্ট হতো। তুমি কি তার চেয়ে অধিক উত্তম তওবাকারী কখনও দেখেছো? সে-তো নিজের জীবন আল্লাহর জন্য দিয়ে দিয়েছে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩২৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৮৪, ইসলামিক সেন্টার ৪২৮৫, নাসায়ী ১৯৯৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৫, আহমাদ ১৯৩৬০, ১৯৪০২, ১৯৪০২, ১৯৪২৪, ১৯৪৫২, দারেমী ২৩২৫, ইরওয়া ২৩৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(চ)  আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একদিন কতিপয় ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে জানালো যে, তাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী যিনা করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ’রজমের’ ব্যাপারে তোমরা তাওরাতে কি জেনেছ? তারা বলল, আমরা দোষীকে অপমান করি এবং চাবুক মারা হয়। ’আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছ। তাওরাতে অবশ্যই ’রজমের’ দণ্ড রয়েছে, তা নিয়ে আসো! অবশেষে তারা তা এনে খুলল ঠিকই কিন্তু তাদের একজন ’রজমের’ আয়াতের উপর স্বীয় হাত দিয়ে ঢেকে রেখে দিল এবং তারপর এর আগের ও পরের আয়াত পড়ল।

তখন ’আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বললেন, তোমার হাত উঠাও! সে হাত উঠাল। তখন দেখা গেল, সেখানে রজমের আয়াত বিদ্যমান রয়েছে। ইয়াহূদীরা বলল, হে মুহাম্মাদ! সে সত্য বলেছে। এখানে রজমের আয়াত বিদ্যমান আছে। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দুজনকে রজম করে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। তখন তাদের উভয়কে ’’রজম’’ করা হলো। অন্য রিওয়ায়াতে আছে, ’আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম বললেন, তোমার হাত উঠাও! সে হাত উঠাল। তখন সেখানে স্পষ্টভাবে রজমের আয়াত বিদ্যমান দেখা গেল। [আয়াত গোপনকারী] সেই লোকটি বলল, হে মুহাম্মাদ! সত্যিই তাওরাতে রজমের আয়াত বিদ্যমান আছে; কিন্তু আমরা নিজেদের মাঝে তা গোপন রাখতাম। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উভয়কে রজম করার নির্দেশ দিলেন। তখন তাদের উভয়কে রজম করা হলো। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৬৫৯, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩২৯, ৩৬৩৫, ৪৫৫৬, ৬৮১৯, ৬৮৪১, ৭৩৩২, ৭৫৪৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৪৬, ৪৪৪৯, আহমাদ ৪৪৮৪, ৪৬৫২, ৬৩৪৯, মুয়াত্তা মালেক ১৫৫১, দারেমী ২৩২১, ইরওয়া ১২৫৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১২৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১২৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(ছ) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া ও আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ)…..বারা ইবনু আযিব (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখ দিয়ে একজন ইয়াহুদীকে কালি মাখা এবং বেত্ৰাঘাতকৃত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি বলেন, তোমরা কি তোমাদের কিতাবে ব্যভিচারের শাস্তি এরূপই পেয়েছ? তারা বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তাদের মধ্য হতে একজন আলিম (পাদরী) ব্যক্তিকে ডাকালেন এবং বললেন, তোমাকে সে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, যিনি মূসা (আঃ) এর প্রতি তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন, এরূপই কি তোমরা তোমাদের কিতাবে ব্যভিচারীর শাস্তি পেয়েছ?

তখন ইয়াহুদী আলিম ব্যক্তি বললেন, না। তিনি আরো বললেন, আপনি যদি আমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে এভাবে না বলতেন তবে আমি আপনাকে জানাতাম না যে, এর প্রকৃত শাস্তি রজম (পাথর নিক্ষেপ করা)। কিন্তু আমাদের সমাজের সম্ভান্ত ব্যক্তিদের মাঝে এর ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেছে। অতএব, আমরা যখন এতে কোন সম্ভান্ত লোককে পেতাম, তখন তাকে ছেড়ে দিতাম এবং যখন কোন নিঃস্ব ব্যক্তিকে পাকড়াও করতাম তখন তার উপর শারীআতের প্রকৃত শাস্তিحَد বাস্তবায়িত করতাম। পরিশেষে আমরা বললাম, তোমরা সকলেই এসো, আমরা সবাই মিলে এ ব্যাপারে একটি শাস্তি নির্ধারিত করে নেই, যা ভদ্র ও অভদ্র সকলের উপরই প্রযোজ্য হবে। সুতরাং আমরা ব্যভিচারের শাস্তি কালি লাগানো এবং বেত্ৰাঘাত করাকেই স্থির করে নিলাম, পাথর নিক্ষেপের পরিবর্তে।

তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে তোমার নির্দেশ رجم বাস্তবায়িত (পুনর্জীবিত) করলাম, যা তারা বাতিল করে ফেলেছিল। সুতরাং তিনি তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেন। অবশেষে ঐ ইয়াহুদীকে পাথর মারা হল। এরপর মহান আল্লাহ এ আয়াতঃ “হে রসূল! যারা কুফরী কাজে দ্রুতগামী তাদের কার্যকলাপ যেন আপনাকে চিন্তিত না করে। … অতঃপর সেই বাণী পর্যন্ত যদি তোমরা তা প্রদত্ত হও, তবে তা ধারণ কর”- (সূরা ময়িদাহ ৫:৪১) পর্যন্ত অবতীর্ণ করেন। তারা (ইয়াহুদীরা) বলতো যে, তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গমন করো, যদি তিনি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে- কালি লাগানো এবং বেত্ৰাঘাতের নির্দেশ প্রদান করেন, তবে তোমরা তা কার্যকর করবে; আর যদি তিনি রজমের নির্দেশ দেন তবে তা প্রত্যাখ্যান করবে। আল্লাহ তা’আলা (এ মর্মে) আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াত মুতাবিক বিচারকার্য পরিচালনা করে না তারাই হলো কাফির (অস্বীকারকারী) সম্প্রদায়”- (সূরা ময়িদাহ ৫:৪৪)।

“আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াত অনুসারে বিচার করে না তারাই হলো অত্যাচারী দল”- (সূরা ময়িদাহ ৫:৪৫)। “আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াত অনুযায়ী বিচার করে না তারাই হলো সীমালঙ্ঘনকারী দল” (সূরা ময়িদাহ ৫:৪৭)। এ সবগুলো আয়াত কাফিরদের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০০, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৮, ২৩২৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৪৭, ৪৪৪৮, আহমাদ ১৭০৫৪, ইরওয়া ২৬৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৯১, ইসলামিক সেন্টার ৪২৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ)  ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, মা’ইয ইবনু মালিক যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলেন, তখন তিনি তাঁকে বললেন, তুমি কি (কোনো মহিলাকে) চুমু দিয়েছিলে, অথবা চোখ দ্বারা ইশারা দিয়েছিলে? সে বলল, না, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে কি তুমি তার সাথে সঙ্গম করেছ? কথাটি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনো ইশারা-ইঙ্গিতে বলেননি, বরং দৃঢ়কণ্ঠে বললেন। সে বলল, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ’রজমের’ নির্দেশ করলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৬১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৮২৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪২৭, আহমাদ ২১২৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জোড় পূর্বক ধর্ষণ করলে ধর্ষিতা দোষী সাব্যস্ত হবে না

(ক) ওয়ায়িল ইবনু হুজর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে জনৈকা মহিলা সালাতের উদ্দেশে বের হলো। এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে ধরে নিয়ে জোরপূর্বক যিনা করলে মহিলাটির চিৎকারে পুরুষটি পালিয়ে যায়। তখন মুহাজিরদের একটি দল সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তখন মহিলাটি বলল, ঐ লোকটি আমার সাথে এরূপ এরূপ করেছে। তারা তখন ঐ লোকটিকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত করল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ মহিলাটিকে বললেন, চলে যাও আল্লাহ তা’আলা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর যে লোকটি মহিলাটির সাথে যিনা করেছিল। যিনাকারীর ব্যাপারে হুকুম করলেন, একে পাথর নিক্ষেপে হত্যা কর। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, লোকটি এমনভাবে তওবা্ করেছে যদি মদীনার সকল লোক এরূপ তওবা্ করত, তাহলে তাদের সকলের পক্ষ থেকে তা কবুল করা হতো। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৭২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৭৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৫৪,আহমাদ ২৭২৪০, সহীহাহ্ ৯০০, সহীহ আত্ তারগীব ২০২৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) লায়স (রহ.)…নাফি’ (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সফীয়্যাহ বিন্ত আবূ ’উবায়দ তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, সরকারী মালিকানাধীন এক গোলাম গনীমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসীর সঙ্গে জবরদস্তি করে যিনা করে। তাতে তার কুমারীত্ব মুছে যায়। ’উমার (রাঃ) উক্ত গোলামকে কশাঘাত করলেন ও নির্বাসন দিলেন। কিন্তু দাসীটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে কশাঘাত করলেন না। যুহরী (রহ.) কুমারী দাসীর ব্যাপারে বলেন, যার কুমারীত্ব কোন আযাদ ব্যক্তি ছিন্ন করে ফেলল, বিচারক ঐ কুমারী দাসীর মূল্য অনুপাতে তার জন্য ঐ আযাদ ব্যক্তির নিকট হতে কুমারীত্ব মুছে ফেলার দিয়াত গ্রহণ করবেন এবং ওকে কশাঘাত করবেন। আর বিবাহিতা দাসীর ক্ষেত্রে ইমামদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোন জরিমানা নেই। কিন্তু তার উপর ’হদ’ জারি হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৯৪৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৮০, শারহুস্ সুন্নাহ্ ২৫৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন: নিশ্চয় আল্লাহ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। আর তাঁর উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এবং আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়াদির একটি ছিল রজমের আয়াত। আমরা সে আয়াত পড়েছি, বুঝেছি, আয়ত্ত করেছি। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাথর মেরে হত্যা করেছেন। আমরাও তাঁর পরে পাথর মেরে হত্যা করেছি। আমি আশংকা করছি যে, দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পর কোন লোক এ কথা বলে ফেলতে পারে যে, আল্লাহর কসম! আমরা আল্লাহর কিতাবে পাথর মেরে হত্যার আয়াত পাচ্ছি না। ফলে তারা এমন একটি ফর্য ত্যাগের কারণে পথভ্রষ্ট হবে, যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির উপর পাথর মেরে হত্যা অবধারিত যে বিবাহিত হবার পর যিনা করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে অথবা গর্ভ বা স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৬২, ৩৪৪৫, ৩৯২৮, ৪০২১, ৬৮৩০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৩২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪১৮, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৫৩, আহমাদ ১৫১, ১৫৫, মালেক ১৫৫৮, দারেমী ২৩২২, বুলগুলমারাম ১২০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৭৩, ইসলামিক সেন্টার ৪২৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

যিনাকারীকে প্রকাশ্যে জনসাধারণের উপস্থিতিতে পাথর মেরে হত্যা করতে হবে যাতে উক্ত শাস্তি দেখে ভয়ে অন্যরা অনুরুপ কাজে লিপ্ত না হয়।

তবে বর্তমানে প্রকাশ্যে জনসাধারণের উপস্থিতিতে গুলি করে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়েও হত্যা করা যেতে পারে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবরচিত আইনে ধর্ষকের শাস্তিস্বরুপ ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান আছে। তবে ইসলামের সাথে এখানে পার্থক্য হলো, মানবরচিত আইনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় গোপন কক্ষে আর ইসলামি আইনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় প্রকাশে।

বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন কারা করবে?

বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামি শরিয়াহ আইন নাই। ইসলামি শরিয়াহ আদালতও নেই। অথচ যারা এই সংবিধান প্রনয়ণ করেছিলো তাদের প্রায় সকলেই মুসলমান। তারা মুসলমান হয়ে আল্লাহ ও রাসুল সা. এর সাথে গাদ্দারী করেছে। সেই অনৈসলামিক সংবিধান এখনো কার্যকর আছে যার উপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্রটি চলছে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল আছে যারা দীর্ঘ বছর ধরে  ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে নিরলস দাওয়াতী কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের মাথায় পাশ্চাত্য শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র আর কুফরী মতবাদের গণতন্ত্র বিতর্কীত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমনভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে যেখান থেকে মুসলমান বের হতে পারছে না।

তবে আমাদের নিজেস্ব জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে আমরা কোন্ পথে হাঁটছি।

বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইনের বাস্তবতা নেই বলে যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণ এর মতো একটি জঘন্য অপরাধ করে প্রচলিত আইনের ফাঁক দিযে অপরাধী জামিনে মুক্ত হচ্ছে। আপনি অনৈসলামিক কোনো দলের নেতা-কর্মী, আপনি চান না বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন হোক কিন্তু সেই ধর্ষক যদি আপনার মায়ের সাথে, বোনের সাথে, মেয়ের সাথে বা আপনার স্ত্রীর সাথে ধর্ষণ করে আর আপনি আদালতে মামলা করে ন্যায় বিচার পেলেন না তখন আপনার কেন লাগবে। অতএব আসুন আমরা সকলে মিলে বাংলাদেশে এই আটটি ইসলামি শরিয়াহ আইন চালু করি।

ইসলামি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকারভেদ

(ক) যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণ,

(খ) যিনা এর উপর মিথ্যা অপবাদ,

(গ) খুন বা হত্যা,

(ঘ) চুরি,

(ঙ) ডাকাতি (সন্ত্রাস, অপহরণ, দস্যুতা ও লুন্ঠন),

(চ) মাদক গ্রহণ,

(ছ) ইসলাম ধর্ম ত্যাগ,

(জ) ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (বাদায়ে উস সানায়ে, ৭ম খন্ড),

(ঝ) সালাত পরিত্যাগকারীকেও অসংখ্য আলিম মুরতাদ গণ্য করেন।

(তথ্য সূত্রঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত- অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল)।

বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন চালু থাকলে যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণের সাথে জড়িত আওয়ামীসহ অন্যদের, যদি অবিবাহিত হতো তাহলে তাদের শাস্তি হতো নিম্নরুপ,

(ক) নারী পুরুষ উভয়কে ১০০টি চাবুক মারা হতো আর এক বছরের জেল দেয়া হতো। আর বিবাহিত হলে,

(খ) নারী পুরুষ উভয়কে প্রকাশ্যে জনসাধারনের সম্মুখে মাটিতে কোমর পর্যন্ত পুতে দূর থেকে পাথর মেরে হত্যা করতে হতো।

যেহেতু ইসলামি শরিয়াহ আইন বাংলাদেশে চালু নেই এবং মানবরচিত আইনেও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত তাই আল্লাহ তায়ালা এদেরকে কিয়ামতে কঠিন শাস্তি ভোগ করাবেন।

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ (রহঃ)...আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা কথা বললেন না, তাদের (গুনাহ থেকে) পবিত্র করবেন না। রাবী আবূ মু’আবিয়াহ বলেন, তাদের প্রতি তাকাবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (এরা হলো)

(ক) ব্যভিচারী বুড়ো,

(খ) মিথ্যাবাদী শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধান ও

(গ) অহঙ্কার দরিদ্র ব্যক্তি। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী  ১৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ২০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

সামুরাহ ইবনু জুনদাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুল সাঃ বলেন,

যিনারাকীরা উলংগ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌছে যাবে; অত:পর আগুন যখন স্তমিত হয়ে যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এই আচারণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭০৪৭, ৮৪৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৮৩১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৭৫, আহমাদ ২০১১৫, আধুনিক প্রকাশনী ৬৫৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ করো। কেননা এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে।

যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে হয় তা হচ্ছে,

(ক)  তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে,

(খ)  তার আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং

(গ)  তার দারিদ্রতা চিরস্থায়ী হবে।

আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে,

(ক) সে আল্লাহর অসন্তোষ,

(খ) কঠিন হিসাব ও

(গ) জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।’ (বায়হাকি, হা নং ৫৬৪)

আবু ওমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমি একদা ঘুমিয়ে ছিলাম আমার পাশে দু’জন লোক আসল, তারা আমার বাহু ধরে নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখি আমি কিছু লোকের পাশে যারা খুব ফুলে আছে তাদের গন্ধ এতবেশী যেন মনে হচ্ছে ভাগাড়। আমি বললাম এরা কারা? নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এরা ব্যাভিচারী-ব্যাভিচারিণী। (আত-তারগীব ৩৪২৪)।

মূলত আল্লাহর আইন অনুসারে না চলার কয়েকটি পর্যায় হতে পারে,

(ক) আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনে বিচার-ফয়সালা পরিচালনা জায়েয মনে করা।

(খ) আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইন দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা উত্তম মনে করা।

(গ) আল্লাহর আইন ও অন্য কোনো আইন শাসনকার্য ও বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের মনে করা।

(ঘ) আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য কোনো আইন প্রতিষ্ঠা করা।

উপরোক্ত যে কোনো একটি কেউ বিশ্বাস করলে সে সর্বসম্মতভাবে কাফির হয়ে যাবে। (এর জন্য দেখুন: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-শাইখ প্রণিত গ্রন্থ ‘তাহকীমুল কাওয়ানীন)।

অতএব পির-অলি, বড় পির, রাসুল সাঃ এর আওলাদ, মুফতি, হাফেজ, মুহাদ্দিস, এ নেতা ও নেতা, বড় মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে পরকালে ১০০% কোনো মুক্তি নেই, যদি না আপনি ইসলামি আইন বিষয়ক কুরআন ও হাদিস না মানেন, না প্রচার করেন, না বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না  কোন কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত  ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতি দানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।” (সুরা কাহাফঃ ১০৩-১০৫)।

মূল কথা হলো, আমাদের দেশে খুন, যিনা/ব্যভিচার/ধর্ষণ, যিনার মিথ্যে অপবাদ দেয়া, আল্লাহদ্রোহীতা, চুরি/ডাকাতি, দস্যুতাসহ শত শত অপরাধের বিচার ইসলামি আইনে কার্যকর করা হয় না। কারণ আমাদের দেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম নেই। অথচ মুসলিম নেতৃবৃন্দ যখন ক্ষমতায় আসবে তাদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নিয়ে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু তারা তা না করে মানবরচিত আইনে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। এজন্যেই আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতে দলীয় নেতাসহ তাদের সবাইকে ডেকে তাদের আমলনামা দেখাবেন এবং সেই নেতার সাথেই তাদের পরবর্তী বসবাস হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“স্মরণ কর,  যখন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ আহবান করব। যাদেরকে ডান হাতে তাদের আমলনামা দেওয়া হবে, তারা তাদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরের আঁটির ফাটলে সুতো বরাবর (সামান্য পরিমাণ)ও যুলুম করা হবে না”। (সুরা আল ইসরা (বণি ইসলাইল) ৭১)।

অর্থাৎ কিয়ামতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নেতার নাম দ্বারা ডাকা হবে এবং সবাইকে এক জায়গায় জমায়েত করা হবে। রাসুল সাঃ বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কি অভিমত? যে কোন কওম বা দলকে ভালোবাসে; কিন্তু তাদের সাথে (কখনো) সাক্ষাৎ হয়নি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে ব্যক্তি তার সাথেই আছে, যাকে সে ভালোবাসে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৬৮, ৬১৬৯, ৬১৭০; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪০, সুনান আত তিরমিযী ২৩৮৭, সুনানে আবূ দাঊদ ৫১২৭, সহীহুল জামি‘ ৬৬৮৯, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩৩, বাযযার ৩০১৪, আহমাদ ১৩৩৮৮, আবূ ইয়া‘লা ৫১৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫৭, শু‘আবুল ঈমান ৪৯৭, সুনানুর নাসায়ী আল কুবরা ১১১৭৮, দারাকুত্বনী ২, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৭২০৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৭৯৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতএব আজকে আপনি যে দল নেতার পিছে দৌঁড়াচ্ছেন কিয়ামতে তার পিছেই থাকতে হবে। তথা সে জাহান্নামী হলে আপনার স্থানও সেই জায়গাতেই হবে। তাই সকল দল মত বাদ দিয়ে ইসলামের পথে ফিরে আসুন। নইলে কিয়ামতে আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে এবং জিজ্ঞাসা করা হবে আপনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ইসলামের জন্যে কী কী দায়িত্ব পালন করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৫৮, ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৭৫১, ৫১৮৮, ৫২০০, ৭১৩৮,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮২৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৭০৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯২৮,  আহমদ ৪৪৮১, ৫১৪৮, ৫৮৩৫, ৫৮৬৭, ৫৯৯০, আল লুলু ওয়াল মারজান-১১৯৯। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

আওয়ামী সরকার সুদভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের সাথে জড়িত

কাফির মুশরিকগন খুব ভালো করেই জানে যে মুসলমানদের মূল শক্তি হচ্ছে ঈমানি শক্তি। এই ঈমানি শক্তি ধ্বংস করতে তারা মুসলিম সমাজে সুকৌশলে সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, সমকামিতা, যেনা/ব্যভিচারসহ সকল প্রকার বেহাপনার প্রচলন ঘটিয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বে যখন ইসলামের জয়জয়কার তখন এরা মুসলমানদের ঈমানি শক্তিতে টিকে থাকতে না পেরে প্লান করে মুসলিম সমাজে প্রথম মদের প্রচলন ঘটায়।

“ফ্রাঞ্চের জনৈক বিশিষ্ট পন্ডিত হেনরী তাঁর গ্রন্থ “ খাওয়াতির মাওয়ানিহ ফিল ইসলাম” এ লিখেছেন, “প্রাচ্যবাসীকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র এবং মুসলমানদেরকে খতম করার জন্য এই মদই ছিল অব্যর্থ তলোয়ার।” আমরা আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত আমাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্ত আমাদের ব্যবহৃত অস্ত্রে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়নি। ফলে তাদের বংশ বেড়েই চলছে। এরা যদি আমাদের এ উপঢৌকন গ্রহণ করে নিতো; যে ভাবেই তাদের একটি বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী গ্রহণ করে নিয়েছে তাহলে তারাও আমাদের কাছে পদানত ও অপদস্ত হয়ে যেত। আজ যাদের ঘরে আমাদের সরবরাহকৃত মদের প্রবাহ বইছে, তারা আমাদের কাছে এতই নিকৃষ্ট ও পদদলিত হয়ে গেছে যে, তারা তাদের মাথাটি পর্যন্ত তুলতে পারছে না।

জনৈক বৃটিশ আইন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, “ইসলামি শরীয়তের অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এও একটি বৈশিষ্ট্য যে এতে মদপান নিষিদ্ধ। আমরা দেখেছি, আফ্রিকার লোকেরা যখন এর ব্যবহার শুরু করে, তখন থেকেই তাদের মধ্যে উন্মাদনা সংক্রমিত হতে থাকে। আর ইউরোপের লোকেরা যখনই এই বস্তুকে চুমুক দিতে শুরু করেছে কাজেই আফ্রিকার লোকদের জন্য যেমন এর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন, তেমনি ইউরোপের লোকদের জন্যও এর কারনে কঠিন শাস্তি বিধান করা অপরিহার্য”। (সূত্র: অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল। প্রকাশক-ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ,  প্রকাশকাল- মে ২০০৬, পৃষ্ঠা নং-৪৩-৪৪।)

উপরোক্ত লেখা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুসলমানদের ঈমানি শক্তি ধ্বংস করতে কাফির মুশরিকগণ বিভিন্ন ঈমান বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। সারা বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্রে  মদ এখন সরকারিভাবে অনুমোদিত।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে সুদের প্রচলন থাকলেও তখন ব্যাংক সিস্টেম না থাকায় সরকারিভাবে তা অনুমোদন ছিল না। পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ব্যাংক সিস্টেম চালু হওয়ায় সুদরে প্রচলন এখন সরকারিভাবে কার্যকর করা হচ্ছে। আমাদের দেশে ব্যাংক, এনজিও, সমিতি ও ইন্স্যুরেন্সসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদভিত্তিক লেনদেন হচ্ছে। কাফির মুশরিকগণ মুসলিম সমাজে সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরে তারা নিজেদেরকে ধন্য মনে করছে। আর আমরা মুনাফিক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান তা বাস্তবায়ন করে চলছি।

বর্তমানে সুদের সাথে প্রত্যেকেই জড়িত। যাদের ব্যাংকে একাউন্ট আছে তারা প্রত্যেকেই সুদ খায়। আবার যারা চাকরি করেন তাদের প্রোভিডেন্ট ফান্ডে সুদ দেয়া হয়। কয়জন ব্যক্তি আছেন যারা অবসরে আসার সময় সুদের টাকা বাদ দিয়ে মূল টাকা নিয়ে ঘরে ফিরেন। অবসরে আসার পর পেনশনের টাকা উচ্চ হারে সুদী প্রতিষ্ঠানে রেখে সেই সুদের টাকায় পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করে। একদিকে প্রতিনিয়ত সুদ খাচ্ছে অন্যদিকে মাথায় লম্বা টুপি, গায়ে জুব্বা, হাতে তাশবিহ নিয়ে আল্লাহু আল্লাহু যিকির করে বেড়ায়। এরা আবার জান্নাত খোঁজে। যাই হোক বর্তমানে আমরা ঈমান হারা মুসলমানে পরিনত হয়েছি। আসুন আমরা সুদ ও সুদখোরের ভয়াবহ পরিনতি সম্পর্কে জেনে নেই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যারা সুদ খায় তারা তার ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এ জন্য যে তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই মত। অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন।অতএব যার নিকট তার রব-এর পক্ষ হতে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে”। (সূরা বাকারা: ২৭৫)।

বর্তমানে সুদ আমাদের দেশ ও জাতিকে অক্টোপাসের মত বেঁধে ফেলেছে। সুদ ছাড়া আমাদের অর্থনীতির চাকা যেন বন্ধ। যার কারণে পত্রিকা ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মানুষকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট অংকের লাভের বিনিময়ে অর্থ ডিপোজিট করতে আহবান করা হচ্ছে। বিভ্রান্ত ও সৎ পথ থেকে বিচ্যুত কিছু আলেমের ফতোয়াও প্রচার করা হচ্ছে এই মর্মে যে, সুদী ব্যাংকের সাথে লেন্তদেন করা জায়েয এবং নির্দিষ্ট অংকে ইন্টারেস্ট বা সুদ গ্রহণ করাও জায়েয।

কিন্তু এ বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ানক। প্রকাশ্যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতা ও তাঁদের প্রকাশ্য নাফরমানী। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন:

“রসূলের আহবানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহবানের মত গণ্য করো না; তোমাদের মধ্যে যারা চুপি চুপি সরে পড়ে, আল্লাহ তাদের জানেন। সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে ”। (সূরা নূর- ৬৩)।

ইসলাম ধর্মে একথা সর্বজন বিদিত যে, কুরআন সুন্নাহ্‌র দলীল অনুযায়ী সুদী ব্যাংকে অর্থ রেখে সেখান থেকে নির্দিষ্টহারে ফায়েদা বা ইন্টারেষ্ট গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে সুদ। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সুদকে হারাম করেছেন। সুদ কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। সুদ অর্থ-সম্পদের বরকতকে মিটিয়ে দেয়, আল্লাহর ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়। সুদের কারণে আমল কবূল হয় না।

রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহ্‌ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে তিনি বলেন, “নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র তিনি পবিত্রতা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ্‌ তা‘আলা রাসূলদের (আঃ) প্রতি যা নির্দেশ পাঠিয়েছেন, মুমিনদের প্রতিও তাই পাঠিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন: 

“হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু থেকে খাদ্য গ্ৰহণ করুন এবং সৎকাজ করুন; নিশ্চয় আপনারা যা করেন সে সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবগত”। (সুরা আল-মুমিনুন: ৫১)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা পুত-পবিত্র, তিনি পুত-পবিত্র জিনিসকেই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা’আলা যে কাজ করতে রসূলদের প্রতি নির্দেশ করেছেন তদ্রূপ এই একই কাজের নির্দেশ মু’মিনদেরকেও করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : ’’হে রসূলগণ! পাক-পবিত্র হালাল রুযী খাও এবং নেক আ’মাল কর’’। (সূরা আল মু’মিনূন ২৩ : ৫১)।

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ ’’হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা উপজীবিকা স্বরূপ দান করেছি সেই পাক-পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর’’। (সূরা আল বাকারা ২ : ১৭২)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দৃষ্টান্ত হিসেবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন যে, এ ব্যক্তি দূর-দূরান্তের সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ধূলাবালুতে মাখা। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’ হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে ডাকছে, হে রব্! হে রব্! কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পরনের পোশাক হারাম। আর এ হারামই সে ভক্ষণ করে থাকে। তাই এমন ব্যক্তির দু’আ কিভাবে কবুল হতে পারে? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৮৯, আহমাদ ৮৩৪৮, দারিমী ২৭১৭, সহীহ আল জামি‘ ২৭৪৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৭১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২১৫, ইসলামীক সেন্টার ২২১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতএব হারাম খেলে দুআ কবূল হবে না, ইবাদত কবূল হবেনা। কামাই-রোজগারে বরকত হবে না। হারাম অর্থে পরিবার-সন্তানদের লালন পালন করলে তারাও সৎভাবে গড়ে উঠবে না। উপরোন্ত ক্বিয়ামতের কঠিন মাঠে জবাবদিহি তো করতে হবেই।

প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত যে,

ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগপর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ্ তা’আলার নিকট হতে সরতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কি কাজে তা বিনাশ করেছে; তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা হতে তা উপার্জন করেছে এবং তা কি কি খাতে খরচ করেছে এবং সে যত টুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মুতাবিক কি কি আমল করেছে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪১৬, সহীহাহ ৯৪৬, তা’লীকুর রাগীব ১/৭৬, বাওযুন নায়ীর ৬৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জেনে রাখুন! সুদ একটি অন্যতম কাবীরা গুনাহ। কুরআন ও হাদীছে কঠিনভাবে সুদকে হারাম করা হয়েছে। সুদের যাবতীয় প্রকার-প্রকৃতি ও যে নামেই ব্যবহার করা হোক তা নিষিদ্ধ।

আল্লাহ্‌ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার। এবং তোমরা সেই আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদেরকে দয়া করা হয়”। (সূরা আল ইমরান্ত ১৩০-১৩২)।

আল্লাহ আরো বলেন, “মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদ হিসেবে যা প্রদান করে থাক আল্লাহর কাছে তা ধন্তসম্পদ বৃদ্ধি করে না। (সূরা রূম- ৩৯)।

সুদ একটা সামাজিক অভিশাপ। যার ফলে সমাজের হাজার মানুষ আজ পরিবার নিয়ে পথে নামছে। নিঃস্ব অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরছে। এটা এক জঘন্যতম কবীরা গুনাহ। কুরআন-হাদিসের মধ্যে সুদখোরের ব্যাপারে ভীষণ ভয়াবহ শাস্তির কথা এসেছে। এখানে কিছু উল্লেখ করা হলোঃ-

(১)  সুদখোর মাতাল হয়ে হাশরের ময়দানে উঠবেঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যারা সূদ খায়, তারা (কিয়ামতে) সেই ব্যক্তির মত দন্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দিয়েছে। তা এ জন্য যে, তারা বলে, ‘ব্যবসা তো সূদের মতই।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ ও সূদকে অবৈধ করেছেন। অতএব যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে, তারপর সে (সূদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়েছে, সুতরাং (নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে) যা অতীত হয়েছে তা তার (জন্য ক্ষমার্হ হবে), আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু যারা পুনরায় (সূদ খেতে) আরম্ভ করবে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সূরা বাকারা-২৭৫)।

(২) সুদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণাঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর যদি তোমরা (সূদ বর্জন) না কর, তাহলে আল্লাহ ও তার রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ সুনিশ্চিত জানো।[1] কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরা কারো উপর অত্যাচার করবে না এবং নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না”। (সূরা বাকারা- ২৭৯)।

(৩) সুদখোর জাহান্নামীঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যারা সূদ খায়, তারা (কিয়ামতে) সেই ব্যক্তির মত দন্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দিয়েছে। তা এ জন্য যে, তারা বলে, ‘ব্যবসা তো সূদের মতই।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ ও সূদকে অবৈধ করেছেন। অতএব যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে, তারপর সে (সূদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়েছে, সুতরাং (নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে) যা অতীত হয়েছে তা তার (জন্য ক্ষমার্হ হবে), আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু যারা পুনরায় (সূদ খেতে) আরম্ভ করবে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সূরা বাকারা-২৭৫)।

 (৪) সুদখোরের সুদে অর্জিত সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়ঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 “আল্লাহ্ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ কোন অধিক কুফরকারী, পাপীকে ভালবাসেন না”। (সূরা বাকারা-২৭৬)।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সূদের দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন তার শেষ পরিণতি হলো নিঃস্বতা”। (মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীস নং ২২৬২)।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সূদের দ্বারা সম্পদ বাড়িয়েছে, পরিণামে তার সম্পদ হ্রাসপ্রাপ্ত হবেই। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৯, আত-তালীক ৩/৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) সুদখোর মুমিনের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায়ঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে সুদের যে অংশই (কারো কাছে) অবশিষ্ট রয়ে গেছে, তা ছেড়ে দাও। (সূরা বাকারা- ২৭৮)।

(৬) লানত সুদখোরের প্রতি, সুদদাতার প্রতি, এর লেখকের প্রতি ও সাক্ষী দু’জনের প্রতিঃ

জাবির (রাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন, যে ব্যক্তি সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সুদের কাগজপত্র লিখে, যে দু’জন সুদের সাক্ষী হয় তাদের সকলের ওপর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন, (গুনাহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে) তারা সকলেই সমান। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮০৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩৩৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২০৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৮৪৭, আহমাদ ৩৭২৯, ৩৭৯৯, ৩৮৭১, ৪০৭৯, ৪২৭১, ৪৩১৫, ৪৩৮৯, ৪৪১৪, দারেমী ২৫৩৫, ইরওয়া ৫/১৮৪, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৪৭, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)। (Sahih)।

(৭) সুদখোরের পেট হবে ঘরের মত বড়ঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মিরাজের রাতে আমাকে একদল লোকের নিকট নিয়ে আসা হলো। তাদের পেট ছিল ঘরের মত বিশাল, তার মধ্যে সাপ ভর্তি ছিলো, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বলেনঃ এরা সুদখোর। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৩, আহমাদ ৮৬৪০, য‘ঈফ আত্ তারগীব ১১৬৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮২৮, যইফ আল জামি ১৩৩)।

(৮) সুদখোর রক্তের নদীতে সাঁতার কাটবেঃ

সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আজ রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানে লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খন্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হল সুদখোর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০৮৫, ৪৪৫, ১৩৮৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৯৪০ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (৯) সুদখোরের দোয়া কবুল হবে নাঃ

জাবির (রাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন, যে ব্যক্তি সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সুদের কাগজপত্র লিখে, যে দু’জন সুদের সাক্ষী হয় তাদের সকলের ওপর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন, (গুনাহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে) তারা সকলেই সমান। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮০৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩৩৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২০৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৮৪৭, আহমাদ ৩৭২৯, ৩৭৯৯, ৩৮৭১, ৪০৭৯, ৪২৭১, ৪৩১৫, ৪৩৮৯, ৪৪১৪, দারেমী ২৫৩৫, ইরওয়া ৫/১৮৪, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৪৭, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অভিশপ্ত লোকের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না।

(১০) সুদখোর আপন মায়ের সাথে যিনা করার সমতুল্যঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সুদের গুনাহর সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হলো আপন মাকে বিবাহ (যেনা) করা। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৪, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৫০, ৫১, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং ২২৫৯; সহীহুল জামে‘, হাদীস নং ৩৫৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১১) সূদের এক টাকা ভক্ষণ করা ৩৬ বার ব্যভিচার করা থেকেও কঠিনঃ

আব্দুল্লাহ ইবন হানযালা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “জেনেশুনে কোনো লোকের সূদের এক টাকা ভক্ষণ করা ৩৬ বার ব্যভিচার করা থেকেও কঠিন”। (মুসনাদে আহমদ ৫/২২৫; সহীহ আল-জামে‘ ৩৩৭৫)।

(১২) সুদের পাপের ৭৩টি ন্তর রয়েছেঃ

আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সুদের পাপের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৫, ইবনুস সালাম এর তাখরিজুল ঈমান ৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কোনো শাসক বা বিচারকের নিকট সুপারিশের পর কোনো হাদিয়া (উপহার) গ্রহণ করলে তা সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোনো শাসক বা বিচারকের নিকট সুপারিশ করে, আর সে সুপারিশ স্বরূপ তার নিকট কোনো হাদিয়া (উপহার) পাঠায় এবং তিনি তা গ্রহণ করেন। তাহলে সে সুদের দরজাসমূহের মধ্য থেকে কোনো একটি বিরাট দরজায় প্রবেশ করল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৫৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৪১, সহীহাহ্ ৩৪৬৫, সহীহ আল জামি‘ ৬৩১৬, সহীহ আত্ তারগীব ২৬২৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

সুদী ব্যাংকে বা সুদী কারবারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা হারাম

সূদী ব্যাংকের বিষয়টি স্পষ্ট। সুদী কারবার করে এমন ব্যাংকে চাকুরী করা হারাম। কারণ, এতে গুনাহের কাজে সহযোগিতা করা হয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:  “পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” (সূরা মায়িদাহ: ২)।

আল্লাহ তা‘আলা সূদকে হারাম করেছেন এবং সূদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। (সুরা আলবাক্বারাহ ২/২৭৮-৭৯)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

হাম্মাদ ইবনু সাববাহ, যুহায়র ইবনু হারব ও উসমান ইবনু আবূ শাইবা (রহঃ).....জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৪৮, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

অতএব সূদী ব্যাংকে চাকুরীজীবি সূদ ভক্ষণকারীর ন্যায় পাপী হবে এবং তার যাবতীয় উপার্জন হারাম হবে। কিয়ামতের দিন পাপীদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, আর আমরা তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে অগ্রসর হব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’। (সুরা ফুরক্বান ২৫/২৩)।

সুদ এক জঘন্যতম কবীরা গুনাহ। সুদখোর,  সুদের কারবারী ও জড়িত ব্যক্তিবর্গ, ও সুদের প্রচলনকারীসহ সকলকে কিয়ামতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশের প্রথম সরকার হচ্ছে আওয়ামীলীগ আর যেহেতু তারাই প্রথম সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়িয়েছে তাই সুদ যতোদিন এই বোংলাদেশে চালু থাকবে ততোদিন সুদভিত্তিক গুণাহ তাদের আমলনামায় যোগ হতে থাকবে এবং কিয়ামতে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে। এখন আপনি ভোটার এই দল বা অনুরুপ দল যারা সুদভিত্তিক সমাজ গঠনে কাজ করে তাদেরকে ভোট দিলেন বা সমর্থন করলেন তাহলে আপনিও তাদের সাথে জাহান্নামে যাবেন। কারণ অন্যায়ের যারা সহযোগী তারা জাহান্নামী।

বাংলাদেশে মদ আমদানী, মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসা ও মদ পানের লাইসেন্স প্রদানের সাথে আওয়ামীলীগ জড়িত

ফ্রাঞ্চের জনৈক বিশিষ্ট পন্ডিত হেনরী তাঁ গ্রন্থ “খাওয়াতির মাওয়ানিহ ফিল ইসলাম” এ লিখেছেন,“ প্রাচ্যবাসীকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র এবং মুসলমানদেরকে খতম করার জন্য এই মদই ছিল অব্যর্থ তলোয়ার। আমরা আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত আমাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্ত আমাদের ব্যবহৃত অস্ত্রে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় নি। ফলে তাদের বংশ বেড়েই চলছে। এরা যদি আমাদের এ উপঢৌকন গ্রহণ করে নিতো; যে ভাবেই তাদের একটি বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী গ্রহণ করে নিয়েছে তাহলে তারাও আমাদের কাছে পদানত ও অপদস্ত হয়ে যেত। আজ যাদের ঘরে আমাদের সরবরাহকৃত মদের প্রবাহ বইছে,তারা আমাদের কাছে এতই নিকৃষ্ট ও পদদলিত হয়ে গেছে যে, তারা তাদের মাথাটি পর্যন্ত তুলতে পারছে না।

(সূত্র: অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, পৃষ্ঠা নং-৪৩। প্রকাশক-ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশকাল-মে ২০০৬।)

মূলত মুসলমানদের মূল পারমানবিক শক্তি হচ্ছে ঈমানি শক্তি। কাফির মুশরিকগণ ভালভাবেই জানে মুসলমানদের পরাজিত করতে এবং আজীবন দাসে পরিনত করতে হলে আমাদের ঈমানি শক্তি নষ্ট করতে হবে। আর ঈমানি শক্তি নষ্ট করা মূল হাতিয়ার হচ্ছে মুসলিম সমাজে ব্যাপকহারে মদের প্রচলন ঘটানো। এই কৌশলটাই যুগ যুগ ধরে কাফির মুশরিকগণ প্রয়োগ করে আসছে। যা মুসলিম শাসকবৃন্দ বুঝতে পারছে না।

বাংলাদেশে মদের বারের সংখ্যা

২৪ মে ২০১৫ তারিখে “যুগান্তর পত্রিকায়” প্রকাশিত এক তথ্য মতে, সারা দেশে মদের বার রয়েছে ১১৮টি। এর মধ্যে ক্লাব-বার ২৮টি। এসব ক্লাব-বারের বেশিরভাগই আবার ঢাকায়। রাজধানীতে ক্লাব বারের সংখ্যা ১৭টি। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে।

২৬ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে “শেয়ার বিজনেস” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত- দেশে বর্তমানে মদপানের অনুমতি রয়েছে ১৪২২৩ জনের। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ৮১০০ জনের। আর অনুমতিপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ৭২৩ জন। জেলা শহরের চেয়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে কোমল পানীয় মদ পানকারী বেশি। কোনো কোনো জেলায় দেখা গেছে, ৫০ জনেরও নিচে মদ পানকারীর পারমিট রয়েছে।

১৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে “দৈনিক সংগ্রাম” পত্রিকায় প্রকাশিত-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) হিসেবে রাজধানীতে বৈধ মদের বার ৫০ থেকে ৬০টি এবং সিসা বার বা সিসা লাউঞ্জ রয়েছে ১০৫টি। অনেক বারের আইনি ভিত্তি থাকলেও সেখানে যে মদ বা সিসা বিক্রি হয় তার বেশির ভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই।

১৯ জুন ২০১৮ তারিখে “দৈনিক যুগান্তর” পত্রিকায় প্রকাশিত, বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত বারের সংখ্যা মাত্র ৯৬টি।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ২৩৭টি বার লাইসেন্স রয়েছে, যার মধ্যে ১২৩টি হোটেল বার, ৬২টি রেস্টুরেন্ট বার, ৪৮টি ক্লাব বার এবং ৪টি রিসোর্ট বার। এই সংখ্যাটি শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত বারের সংখ্যা, তবে অবৈধ বা ভেজাল মদের বারের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

যেভাবে মদপানের পারমিট বা লাইসেন্স করতে হয়

বংলাদেশে মদপানের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকারের যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়োগ প্রাপ্ত সেটি হল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর/Narcotics Control Department. ঠিকানা: ৪৪১, তেজগাও শিল্পাঞ্চল। ঢাকা- ১২০৮।

লাইসেন্সর জন্য  নির্দিষ্ট ফরম পুরন করে এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি সহকারে জমাদান সাপেক্ষে পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয়।

নির্ধারিত পারমিট ফিঃ

(ক)  বিদেশী মদ/ ফরেন লিকিওর এর জন্য---- ২,০০০ টাকা

(খ) দেশী মদের জন্য-----------------------------৮০ টাকা

আনুষাঙ্গিক কাগজপত্রঃ

আবেদনটির যৌক্তিকতা প্রমানে ডাক্তারি সার্টিফিকেট।

প্রিয় পাঠকঃ আমাদের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশে মদ পান আইনীগতভাবে সম্পূর্ণ জায়েজ। মদের বারের সংখ্যা  ও মদ পানকারীর লাইসেন্স সংখ্যা সরকারি হিসেবে যাই থাকুক, আপনি কখন কোথায় মদ পান করতে চান সেখানেই হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। শুধু মদই না যেকোনো নেশা জাতীয় দ্রব্যে এখন হাতের নাগালেই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে মদের কারখানা

কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলায় অবস্থিত একটি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি চিনি কল। তবে উপজাত হিসেবে এই কারখানা থেকে মদ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে।

অবস্থানঃ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের অধীন চুয়াডাঙ্গা জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনায় এই শিল্প কমপ্লেক্সটি অবস্থিত।

ইতিহাসঃ

১৯৩৮ সালে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের অধীনে স্থাপিত হয়। সে সময় এর অধীনে একটি চিনি কারখানা, একটি ডিষ্টিলারী ইউনিট ও একটি ওষুধ কারখানা যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।

অবকাঠামোঃ

এই বৃহদায়তন শিল্প-কমপ্লেক্সটি চিনি কারখানা, ডিষ্টিলারি ওয়াটার, বাণিজ্যিক খামার ও জৈব সারকারখানার সমন্বয়ে গঠিত। এর ভুমির পরিমান ৩ হাজার ৫৭২ একর। যার ২ হাজার ৪৫০ একর কৃষিজমি। এসব কৃষিজমিতে আখ চাষ করা হয়।

উৎপাদন ক্ষমতাঃ

প্রতিষ্ঠার সময় কেরু এ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিঃ এর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ছিল ১০১৬ মেট্রিক টন। জাতীয়করণের পরে ১৯৭৮-৮৫ সাল এই সময়ে অস্ট্রেলীয় কারিগরি সহযোগিতায় এর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫০ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন ক্ষমতা প্রতি অর্থবছরে ১১৫০ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়।

উৎপাদিত পণ্যঃ

এখানকার মূল পণ্য হচ্ছে আখ থেকে উৎপাদিত চিনি। তবে আখ থেকে চিনি বের করে নেওয়ার পর যে উপজাত-দ্রব্য (চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড) পাওয়া যায় তা থেকেও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হয়। উপজাত-দ্রব্য হতে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছে দেশি মদ, বিদেশি মদ, ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার এবং নতুন উৎপাদিত পণ্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার । এখানে নয়টি ব্র্যান্ডের ‘ফরেন লিকার’ বা বিদেশি মদ তৈরি হয়। ফরেন লিকারগুলো হচ্ছেঃ

• ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি

• গোল্ড রিবন জিন

• ফাইন ব্র্যান্ডি

• চেরি ব্র্যান্ডি

• ইমপেরিয়াল হুইস্কি

• অরেঞ্জ ক্রেকাউট

• সারিনা ভদকা

• রোজা রাম

• ওল্ড রাম

এই ফরেন লিকার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দর্শনায় কেরুর নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র হতে ১৮০, ৩৭৫ ও ৭৫০ মিঃলিঃ লিটারের বোতলে বাজারজাত করা হয়। বছরে প্রায় ৩৯ লাখ ২০ হাজার বোতল ফরেন লিকার উৎপাদিত হয় এখানে। আর বাংলা মদের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৬ লাখ লিটার। যা দেশের ১৩টি বিক্রয় কেন্দ্র হতে বাজারজাত করা হয়।

১৮ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে “বিবিসি নিউজ“ বাংলায় প্রকাশিত, মদের চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশে, উৎপাদনও বাড়াচ্ছে কেরু অ্যান্ড কোং। বাংলাদেশের একমাত্র অ্যালকোহল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোং বলছে, গত ছয় মাসে তাদের উৎপাদিত দেশি মদের বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

উক্ত প্রতিষ্ঠানটি ছাড়াও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে চোলাই মদসহ ভেজাল মদ তৈরীর অসংখ্য অবৈধ কারখানা আছে। এইসব ভেজাল মদ পান করে মাঝে মধ্যে অনেক লোকের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় দেখা যায়।

বাংলাদেশে নতুন অ্যালকোহল বিধিমালা

(আওয়ামী আমলে)

বাংলাদেশে অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী, এখন থেকে ২১ বছরের কম বয়সীদের মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি অ্যালকোহল সেবন ও ব্যবহারের জন্য সরকার অনুমতিরও বিধান রেখেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণাল থেকে জারিকৃত বিধিমালা-২০২২ বলা হয়েছে, অ্যালকোহলের বিক্রয়, বিপণন, আমদানি-রফতানি, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবনে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য এই বিধানগুলো যুক্ত করা হয়।

এ বিধিমালায় মূলত অ্যালকোহল জাতীয় মাদকদ্রব্য কোথায় বেচাকেনা হবে, মদ্যপায়ীরা কোথায় বসে মদ পান করবেন, পরিবহন করতে পারবেন কি না – এসব বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে বলে বলছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ফলে এখন থেকে অ্যালকোহল আমদানি, রফতানি, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, বিপণন ও ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণের জন্য অ্যালকোহল পারমিট, লাইসেন্স বা পাস গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মদ বা মদ্য জাতীয় পানীয় পানের জন্য পারমিট আর পরিবহনের জন্য পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এ বিধিমালায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, বিধিমালা না থাকার কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পারফিউম স্যানিটাইজার তৈরিতে কিংবা শিল্পে ব্যবহৃত অ্যালকোহল খেয়ে মারা যাওয়া কিংবা অন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও এসেছে। এবারই প্রথম বিধিমালা করা হলো। এর আগে এ সংক্রান্ত কোন বিধিমালা ছিলো না। শৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি অ্যালকোহলের নামে খারাপ কিছু যেন বিক্রি না হয় আর সরকার যাতে রাজস্ব পায়- এসব বিষয় বিবেচনা করে নতুন এই বিধিমালা করা হয়েছে।

যা আছে নতুন বিধিমালায়

• ২১ বছরের নীচে কোন ব্যক্তিকে মদ্যপানের পারমিট দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এর বেশি বয়সী যে কেউ পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদমর্যাদার কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে।

• হোটেল, রেস্তোরাঁয় বা যেসব স্থানে সাধারণ খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি অ্যালকোহল সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পরিবেশন করা হয় তারা বার স্থাপনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

• কোন এলাকায় ১০০ জন দেশি মদ বা বিদেশি মদের পারমিটধারী থাকলে অ্যালকোহল বিক্রয়ের লাইসেন্স দেওয়া যাবে। অর্থাৎ কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানে যদি কমপক্ষে ১০০ জন সদস্য থাকেন যাদের এই পারমিট আছে সেখানেই অ্যালকোহল বিক্রি করা যাবে।

• কোনো ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে ২০০ জন অ্যালকোহল পারমিটধারী থাকলে তাদেরকে বার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে।

• অ্যালকোহল বহন বা পরিবহনের জন্য অধিদফতর থেকে পাসের জন্য আবেদন করা যাবে। রেল, সড়ক, নৌ ও আকাশপথের যে কোনো পথেই অ্যালকোহল পরিবহন করা যাবে। তবে সেটা পাসে উল্লেখ থাকতে হবে।

• পারমিটধারী ক্লাব সদস্যরা ক্লাবের নির্ধারিত স্থানে বসে মদপান করতে পারবেন।

• অ্যালকোহলে কোন ধরনের ভেজাল মেশানো যাবে না।

• ইপিজেড, থিমপার্ক বা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে যেখানে বিদেশি নাগরিক থাকবে সেখানে বার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে।

• বিধিমালার অধীনে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ডিউটি ফ্রি শপ ও প্রকল্প এলাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যক বার স্থাপন লাইসেন্স দেওয়া যাবে। যেমন ক্লাব ও রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে একটি করে আবার পাঁচ তারকা বা তার চেয়ে বেশি মানসম্পন্ন সাতটিরও বেশি বারের লাইসেন্স দেওয়া যাবে।

• বিদেশি মদের জন্য ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

• বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে এমন কোন দেশ থেকে অ্যালকোহল আমদানি করে বিলাতিমদ উৎপাদন করা যাবে।

• সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ ও যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল ব্যবহার ছাড়া বিয়ার উৎপাদন করা যাবে না।

• সরকার নির্ধারিত বিয়ার ছাড়া অন্য কোন বিয়ার উৎপাদন করা যাবে না।

• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজ বাসায় মদপান করতে পারবেন।

• বিদেশী মদ আমদানি বা রফতানির জন্য আবেদন করা যাবে।

• বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না এমন ইথাইল অ্যালকোহল, অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, রেক্টিফাইড স্পিরিট, স্ট্রং অ্যালকোহল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেথিলেটেড স্পিরিট এবং শিল্প, গবেষণাগার ও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য অ্যালকোহল আমদানি করা যাবে।

• যে ব্রান্ডের জন্য রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হবে সেই ব্রান্ডের অ্যালকোহল আমদানি করতে হবে।

• তবে পর্যটন কর্পোরেশন, বার বা সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ মদ আমদানি করতে পারবে না।

• যেসব ক্লাবে মদ্যপানের পারমিটধারী সদস্যের সংখ্যা দুশো বা তার চেয়ে বেশি সেসব ক্লাব তাদের চাহিদা ৪০ শতাংশ আমদানি করতে পারবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন এসব বিধিমালা সঠিকভাবে মানা হলে এটি যেমন সরকারের রাজস্ব বাড়াবে, তেমনি ক্রমবর্ধমান চাহিদা নিরসনে হোটেল রেস্তোরাঁগুলোও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বার স্থাপন করতে পারবে, যে সুযোগ এতোদিন অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।

এখন সরকারের অনুমোদিত কিছু ওয়্যার হাউজ, লাইসেন্সকৃত পানশালা ছাড়াও অল্প কিছু তারকা হোটেলগুলো থেকে মদ ক্রয়ের সুযোগ আছে পারমিটধারী ব্যক্তিদের জন্য। তবে বিয়ার, ওয়াইন, হুইস্কি কিংবা ভদকার মতো বিদেশি মদের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক থাকায় প্রায়ই ভেজাল মেশানো মদ্যপানের মতো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

মদের বারগুলোতে কী হয়

১৯ জুন ২০১৮ তারিখে “দৈনিক যুগান্তর” পত্রিকায় প্রকাশিত, বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত বারের সংখ্যা মাত্র ৯৬টি।

থ্রি স্টার, ফাইভ স্টার ও সেভেন স্টারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এইসব মদের বারগুলো অবস্থিত।

বেশীরভাগ মদের বারগুলোতে চার ধরণের পাপ কাজ সংঘটিত হয়। যেমন,

(ক) মদ পান ।

(খ) জুয়ার আসর।

(গ)  নাচ গানের আসর ও

(ঘ)  যিনা/ব্যভিচার।

বাংলাদেশে মদের লাইসেন্স দেয়ার প্রথম উদ্যোক্তা কে?

বিগত ০৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে “বাংলা ট্রিবিউন” পত্রিকায় প্রকাশিত-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এসে মদ, জুয়া, রেস খেলা বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, জিয়াউর রহমানসহ তারাই মদের লাইসেন্স চালু করে।’

মুসলিম মদপানকারীকে লাইসেন্স প্রদান

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৬৩ নং আইন) এর তৃতীয় অধ্যায় এর ১১ (১) ধারায় বলা হয়েছে,  পারমিট ব্যতীত কোনো ব্যক্তি অ্যালকোহল পান করিতে পারিবেন না এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অন্যূন কোনো সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোনো মুসলমানকে অ্যালকোহল পান করিবার জন্য পারমিট প্রদান করা যাইবে না। এবং বাংলাদেশে নতুন অ্যালকোহল বিধিমালায় বলা হয়েছে, মুসলিমদের ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদমর্যাদার কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে।

প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরাঃ বাংলাদেশে বর্তমানে যতোগুলো মদের বার ও মদ বিক্রির দোকান আছে এবং যারা ব্যবসায়ী তারা কি সবাই অমুসলিম? এইসব মদ বিক্রির স্থানে যারা মদ ক্রয় করতে যায় তারা কি সবাই অসুস্থ? প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল মদ বিক্রি হচ্ছে আর যারা ক্রয় করছে তারা কারা? আইনে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমান মদ পান করতে চাইলে তার ডাক্তারী সার্টিফিকেট থাকতে হবে। কয়জনের এই সার্টিফিকেট আছে? আর ইসলামে যেখানে বলা হয়েছে মদ নিজেই এক প্রকার রোগ তা দিয়ে কিভাবে চিকিৎসা হতে পারে। আর ইসলামে এই মদপানকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এর শাস্তির বিধান তৈরী করা হয়েছে, মদের ব্যবসাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আর আমরা ইসলামি বিধিনিষেধ তোয়াক্বা না করে মুসলিম সমাজে সেটাই আইনগতভাবে চালু করেছি। আবার দাবী করি আমি মুসলমান।

প্রত্যেক সরকারই মদের সাথে জড়িত

বাংলাদেশকে এপর্যন্ত আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি  ঘুরেফিরে শাসন করে আসছে। কিন্তু প্রত্যেক সরকারের আমলেই মদের আরো উন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামীলীগের আমলে মদকে আরো শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। অথচ যে মদের লাইসেন্স সরকার দিচ্ছে  সেই মদকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে মদ আমদানী, মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসা ও মদ পানের লাইসেন্স প্রদানের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি পেতে হবে। ইসলামি শরিয়াহ আইনে ৯টি দন্ডবিধির মধ্যে মদ একটি। ইসলামি শরিয়াহ আইনে শুধু মদ পানকারীর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু মদ আমদানী, মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসা ও এদের সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়নি তবে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা চালু হলে ইজমা-কিয়াসের উপর ভিত্তি করে উল্লেখিত জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে।

মদ বা মাদক বা নেশাদার জাতীয় দ্রব্য সেবন ইসলামে নিষেধ

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কর্ম। অতএব তোমরা এগুলি থেকে বেঁচে থাক। যাতে তোমরা কল্যাণ প্রাপ্ত হও। শয়তান তোমাদের মাঝে মদ ও জুয়ার মাধ্যমে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করতে চায় এবং আল্লাহর যিক্র ও ছালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে চায়। তাহলে কি তোমরা বিরত থাকবে”? (সুরা মায়িদাহ ৯০-৯১)।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

“লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। তুমি বল: উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং উপকারও আছে মানুষের জন্য, তবে এদের পাপ উপকারের চেয়ে অধিক”। (সূরা বাকারা-২১৯)।

(ক) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন সুদ সম্পর্কিত সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো নাযিল হয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে বের হয়ে আসেন এবং শরাবের ব্যবসাও নিষিদ্ধ (হারাম) ঘোষণা করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৫৯, ২০৮৪, ২২২৬, ৪৫৪০, ৪৫৪১, ৪৫৪২, ৪৫৪৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৩৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৮০, নাসায়ী ৪৬৬৫, আ৩৪৯০, আহমাদ ২৩৬৭৩, দারেমী ২৫৬৯, ২৫৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ‘উমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বারের উপর (দাঁড়িয়ে) খুৎবা প্রদানকালে বললেনঃ নিশ্চয় মদ হারাম সাব্যস্ত (নাযিল) হয়েছে। আর তা সাধারণত পাঁচ প্রকারের জিনিস দ্বারা প্রস্তুত হয়; যথা- আঙ্গুর, খেজুর, গম, যব ও মধু। আর মদ তা-ই যা জ্ঞান-বুদ্ধিকে বিলুপ্ত করে দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৩৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৫৮৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৪৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩০৩২, আবূ দাঊদ ৩৬৬৯, নাসায়ী ৫৫৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সামুরা (রাঃ) শরাব বিক্রয় করেন এ কথা উমার (রাঃ) জানতে পেরে বললেন, আল্লাহ সামুরাকে ধ্বংস করুনঃ সে কি জানে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ইহূদীদের অভিসম্পাত করুন, তাদের প্রতি চর্বি হারাম করা হয়েছিল; কিন্তু তারা তা গলিয়ে বিক্রয় করতো’’। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২২২৩, ৩৪৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৪২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৮২, নাসায়ী ৪২৫৭, আহমাদ ১৭১, দারেমী ২১০৪, ইরওয়া ১২৯০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২০৬৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২০৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর থেকে বর্ণিত ‘যে ব্যক্তি মদ পান করবে আল্লাহ তার উপর ৪০ দিন সন্তুষ্ট হবেন না’। (আহমাদ হা/২৭৬৪৪; তারগীব হা/৩৪১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

মদ খোর (পাপের ক্ষেত্রে) মূর্তিপূজকের সমতুল্য

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদখোর (পাপের ক্ষেত্রে) মূর্তিপূজকের সমতুল্য। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৭৫, সহীহাহ ৬৭৭)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

ইসলামি আইনে মদ পানকারী বা নেশাদার দ্রব্য গ্রহণকারীর দুনিয়ায় শাস্তি

(ক) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ মদ পানকারী এ ব্যক্তিকে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটে নিয়ে আসা হলো। তিনি তাকে দু’খানা ছড়ি (এক যোগে ধরে তার) দ্বারা চল্লিশের মত কোড়া মারলেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ ১ম খলিফা আবু বাকর (রাঃ) এরূপ কোড়া মেরেছেন, উমার (রাঃ) তার খিলাফতকালে এ ব্যাপারে লোকদের সাথে পরামর্শ করলেন। আবদুর রহমান ইবনু আওফ বলেনঃ সর্বাপেক্ষা হালকা শাস্তি হচ্ছে আশি (কোড়া)। ‘উমার (রাঃ) ঐ (৮০-র) আদেশই জারি করলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৭৩, ৬৭৭৬;  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৪৪, ৪৩৪৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৩৬১৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৪৩, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৭৯, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৭০, আহমাদ ১১৭২৯, ১২৩৯৪, ১২৪৪৪, ১২৮০৫ দারেমী ২৩১১, সহীহ আল-জামি ৪৯৭৪, আধুনিক প্রকাশনী ৬৩০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

অপর এক বর্ণনায়, আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদ পানকারীকে জুতা ও খেজুরের ডাল দ্বারা চল্লিশবার প্রহার করতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬১৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৪৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘উকবাহ ইবনু হারিস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নু‘আয়মান অথবা (রাবীর সন্দেহ) নু‘আয়মানের পুত্রকে মদ্যপায়ী অবস্থায় আনা হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরে যারা ছিল তাদেরকে নির্দেশ দিলেন তাকে প্রহার করার জন্যে। রাবী বলেন, তারা তাকে প্রহার করল, যারা তাকে জুতা মেরেছিল তাদের মাঝে আমিও ছিলাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৭৪, ৬৭৭৫, ২৩১৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) সায়িব ইবনু ইয়াযীদ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে, আবূ বাকর এবং ‘উমার (রাঃ)-এর খিলাফাতের প্রারম্ভে মদ্যপায়ীকে আনা হত। তখন আমরা আমাদের হাত, জুতা এবং চাদর দ্বারা প্রহার করতাম। কিন্তু ‘উমার -এর খিলাফাতের শেষ দিকে তিনি চল্লিশ চাবুক মারতেন। পরিশেষে তারা অতিমাত্রায় মদ্যপানের দরুন ব্যাপকভাবে পাপকার্যে জড়িয়ে পড়ল, তখন তিনি আশি চাবুক মারেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬১৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৭৯, আহমাদ ১৫৭১৯, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮১২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(ঘ) ‘আবদুর রহমান ইবনু আযহার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এমন একটি ঘটনা যা এখনো আমি চোখে দেখছি। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এমন ব্যক্তিকে আনা হলো যে মদ পান করেছিল। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লোকেদেরকে বললেনঃ তোমরা একে প্রহার করো। সুতরাং তাদের কেউ জুতার দ্বারা, আবার কেউ লাঠির দ্বারা এবং কেউ খেজুরের ডাল দ্বারা লোকটিকে প্রহার করল। রাবী ইবনু ওয়াহব বলেনঃ مِيْتَخَةْ এর অর্থ হলো- খেজুরের কাঁচা ডাল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমিন থেকে কিছু মাটি উঠিয়ে তার মুখে নিক্ষেপ করলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬২০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আব্দুর রাহমান ইবনু আযহার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনে অবস্থানকালে জনৈক মাতালকে তাঁর নিকট আনা হলো। তিনি তার মুখমন্ডলে মাটি ছুঁড়ে মারলেন এবং তাকে প্রহার করতে সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন। তারা তাদের জুতা ও হাতে যা কিছু ছিলো তা দিয়ে তাকে প্রহার করতে লাগলেন, যতক্ষণ না তিনি তাদের বললেন যে, থামো। অতঃপর তারা প্রহার বন্ধ করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর আবূ বাকর (রাঃ) মদ পানের জন্য চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেন। অতঃপর উমারও তার খিলাফাতের প্রথম পর্যায়ে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে আশিটি বেত্রাঘাত করেন। অতঃপর উসমান (রাঃ) আশি এবং চল্লিশ দু’ ধরণের শাস্তিই প্রয়োগ করেন। অতঃপর মু‘আবিয়াহ (রাঃ) মদ পানের শাস্তি আশি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮৮, ৪৪৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আনা হলো, যে মদ পান করেছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা তাকে প্রহার করো। সুতরাং আমাদের কেউ তাকে হাত দ্বারা, কেউ চাদর দ্বারা, কেউ জুতার দ্বারা প্রহার করল। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এরূপ কাজের জন্য তোমরা তাকে নিন্দা ও ভৎর্সনা করো। সুতরাং লোকেরা তার সম্মুখপানে তিরস্কার করতে বলল, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না, তোমার কি আল্লাহর ‘আযাবের ভয় নেই। তুমি এরূপ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে আসতে লজ্জাবোধ হলো না? অতঃপর জনৈক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ তোমাকে হেয় ও লাঞ্ছিত করুক। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এরূপ বলো না (বদ্দু‘আ করো না)। এরূপ বলে তার ওপর শায়ত্বনকে প্রাধান্য দিও না; বরং তোমরা এভাবে বলো- হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করো। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৩৬২১, ৩৬২৬ সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৮১, ৬৭৭৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৭৭, আহমাদ ৭৯৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) ‘উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তির নাম ছিল ‘আবদুল্লাহ, কিন্তু তাকে ‘হিমার’ (গাধা) উপাধিতে ডাকা হতো। সে (অবোধের ন্যায় কথাবার্তা বলে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাসাতো। একদিন মদ্যপায়ীর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করেছিলেন। এরপর আবার একদিন তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আনা হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে চাবুক মারার নির্দেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহ! তার ওপর তোমার অভিসম্পাত বর্ষিত হোক। কতবারই না তাকে এ অপরাধে আনা হলো? এমতাবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাকে অভিশাপ দিও না। আল্লাহর শপথ! আমি তার সম্পর্কে জানি যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে ভালোবাসে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬২৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) সাওর ইবনু যায়দ আদ্ দায়লামী হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘উমার মদ্যপায়ীর দণ্ডের ব্যাপারে সাহাবীগণের নিকট পরামর্শ চাইলেন। তখন ‘আলী বললেনঃ আমি মনে করি তাকে আশিবার চাবুক মারা হোক। কেননা যখন সে মদ পান করে, তখন সে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর নেশাগ্রস্থের দরুন আবোল-তাবোল কথা বকতে থাকে, এমনকি তখন সে মিথ্যা অপবাদও রটায়। তখন ‘উমার মদ্যপায়ীকে আশিবার চাবুক মারার নির্দেশ দিলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬২৪, মালিক ১৬৩৩, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮১৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) হুসাইন ইবনুল মুনযির আর-রাকাশী ওরফে আবূ সাসান (রহঃ) বলেন, একদা আমি উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন ওয়ালীদ ইবনু উকবাহকে ধরে আনা হলো। হুমরান এবং অপর এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলো। তাদের একজন সাক্ষ্য দিলো যে, সে তাকে মদ খেতে দেখেছে। অপর ব্যক্তি সাক্ষ্য দিলো যে, সে তাকে মদ বমি করে ফেলতে দেখেছে। উসমান (রাঃ) বললেন, মদ পান না করলে তা বমি করতে পারে না। তাই তিনি আলী (রাঃ)-কে তার উপর শাস্তি বাস্তবায়িত করতে নির্দেশ দিলেন। আলী (রাঃ) হাসান (রাঃ)-কে বললেন, তুমি তাকে শাস্তি দাও। হাসান (রাঃ) বলেন, যিনি খিলাফাতের সুবিধা ভোগ করছেন তিনি ভার বহন করবেন।

অতঃপর আলী (রাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফারকে বললেন, তুমি তার উপর হাদ্দ কার্যকর করো। অতএব তিনি একটি চাবুক নিয়ে তাকে প্রহার করতে শুরু করলেন। আর আলী (রাঃ) তা গণনা করতে থাকলেন। যখন তিনি চল্লিশে পৌঁছলেন আলী (রাঃ) বললেন, থামো, যথেষ্ট হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেছেন। আমি মনে করি, আবূ বাকরও চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেছেন, কিন্তু উমার আশিটি বেত্রাঘাত করেছেন। এর প্রতিটি সুন্নাত। তবে আমি চল্লিশটি পছন্দ করি। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮০, ৪৪৮১, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৩৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০৭, আহমাদ ৬২৫, ১১৮৮, ১২৩৪, দারেমী ২৩১২, ইরওয়া ৩০৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঞ) ইবনুল হাদ (রহঃ) সূত্রে অনুরূপ সমার্থবোধক হাদীস বর্ণিত। তিনি বলেন, তাকে প্রহারের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেনঃ তোমরা তাকে মৌখিক ধমক দিয়ে নসীহত করো। সুতরাং তারা তার নিকট এসে বললেন, তুমি আল্লাহকে ভয় করনি, তুমি আল্লাহকে ভয় করনি এবং তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে লজ্জিত হওনি। অতঃপর তারা তাকে ছেড়ে দিলেন। হাদীসের শেষাংশে তিনি বলেনঃ বরং তোমরা বলো, হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দাও, হে আল্লাহ! তার উপর করুণা বর্ষণ করো। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

চতুর্থবার মদপানকারীর শাস্তি

(ক) মুআবিয়াহ ইবনু আবূ সুফিয়ান (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকেরা মদ পান করলে, তাদের বেত্রাঘাত করো। পুনরায় পান করলে বেত্রাঘাত করো। আবারো পান করলে বেত্রাঘাত করো, পুনরায় পান করলে বেত্রাঘাত করো, আবারো পান করলে তাদের হত্যা করো। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত করো। আবার মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত করো, আবার মাতাল হলে বেত্রাঘাত করো, চতুর্থবারও যদি এর পুনরাবৃত্তি হয়, তবে তাকে হত্যা করো। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, উমার ইবনু আবূ সালামাহও পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও আবূ হুরাইরাহ সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেনঃ কেউ মদ পান করলে তাকে বেত্রাঘাত করো। চতুর্থবারও যদি এরূপ করে তবে তাকে হত্যা করো। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, অনুরূপভাবে সুহাইল পর্যায়ক্রমে আবূ সালিহ ও আবূ হুরাইরাহ সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেনঃ চতুর্থবার যদি তারা মদ পান করে তাহলে তাদের হত্যা করো।

একইভাবে ইবনু আবূ নুআইম ইবনু উমারের সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) এবং আশ-শারীদ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে আল জাদলী মুআবিয়াহ (রাঃ)-এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ সে তৃতীয় বার বা চতুর্থবার মদ পান করলে তাকে হত্যা করো। (সুনান আবু দাউদ (তাহকীককৃত) ৪৪৮৪, সুনান ইবনে মাজাহ ২৫৭২, ২৫৭৩, আহমাদ ৭৭০৪, ৭৮৫১, ১০১৬৯, ১০৩৫১, দারেমী ২১০৫, আত-তালীকুর রাগীব ৩/১৮৭, সহীহাহ ১৩৬০।) হাদিসের মানঃ হাসান সহীহ।

(খ) মুআবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ পানকারী প্রসঙ্গে বলেনঃ যখন তা পান করবে তখন তাকে কোড়া মারো, তারপর পান করলে কোড়া মারো, তারপর ৩য় বার পান করলেও তাকে কোড়া মারো, তারপর ৪র্থ বার মদ পান করলে তার গর্দান কেটে দাও। (ইবনু মাজাহ ২৫৭৩, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৪৪৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮২, আহমাদ ১৬৪০৫, ১৬৪১৭, ১৬৪২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(আবূ হুরাইরা, শারীদ, শুরাহবিল ইবনু আওস, জারীর, আবুর রামদা আল-বালাবী ও আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, মু‘আবিয়ার হাদিসটি অনুরূপভাবে সাওরী বর্ণনা করেছেন আসিম হতে, তিনি আবূ সালিহ হতে, তিনি মু‘আবিয়া হতে, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। ইবনু জুরাইজ এবং আমর বর্ণনা করেছেন সুহাইল ইবনু আবী সালিহ হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি আবূ হুরাইরা হতে, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে একই বিষয়ে আবূ সালিহ কর্তৃক মু’আবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত এই হাদীসটি অত্যাধিক সহীহ্। আবূ ঈসা বলেন, আমি ইমাম বুখারী (রহঃ) -কে একথা বলতে শুনেছি। তিনি আরো বলেছেন, পূর্বে মদ পানকারীকে মেরে ফেলার হুকুম ছিল। পরে সেটাকে বাতিল করা হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক-মুহাম্মাদ ইবনু মুনকাদিরের সূত্রে, তিনি জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) -এর সূত্রে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “যে লোক মাদকদ্রব্য সেবন করে সে লোককে চাবুক পেটা কর। যদি সে লোক চতুর্থবার তা সেবন করে তাহলে তাকে মেরে ফেল।” জাবির (রাঃ) বলেন, তারপর একজন লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আনা হল সে লোক চতুর্থবার সুরা পান করেছিল। তাকে তিনি বেত্রাঘাত করলেন কিন্তু হত্যা করেননি। ইমাম যুহরীও কাবীসা ইবনু যুয়াইব (রাঃ) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট হতে একই কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি (কাবীসা) বলেছেন, প্রথমে হত্যার হুকুম ছিল, পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়েছে।

অভিজ্ঞ আলিমগণ এরূপ আমল করেছেন। আমরা এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনরকম দ্বিমত দেখতে পাইনি। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ একমত যে, মদ্য পানকারীকে মেরে ফেলা যাবে না। তাছাড়া এই বক্তব্যকে অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস আরো বেশি মজবুত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যে লোক এরকম সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্রভু নেই এবং আমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল’ -তার রক্তপাত (হত্যা) করা বৈধ হবেনা। তবে এ ধরণের তিন প্রকার মানুষকে হত্যা করা যাবেঃ কোন মানুষের হত্যাকারী, বিবাহিত যিনাকারী এবং নিজের দ্বীন পরিত্যাগকারী (মুরতাদ)।

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মদ পান করে তাকে চাবুক মারো। যদি সে (পর্যায়ক্রমে) চতুর্থবারও মদ পান করে, তাহলে তাকে হত্যা কর। রাবী বলেন, অতঃপর একদিন জনৈক ব্যক্তিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত করা হলো, যে চতুর্থবার মদ পান করেছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে প্রহার করলেন কিন্তু হত্যা করেননি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬১৭, সহীহ আত্ তারগীব ২৩৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কাউকে শরীয়াতের দন্ড দেয়ার সময় সে তাতে মরে গেলে আমার দুঃখ হয় না। কিন্তু মদ পানকারী ছাড়া। সে মারা গেলে আমি জরিমানা দিয়ে থাকি। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ শাস্তির ব্যাপারে কোন সীমা নির্ধারণ করেননি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৭৭৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৪৮৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)  ৩৬২৩, আহমাদ ১০৮৪, ইরওয়া ২৩৮১, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পরকালীন শাস্তি

(ক) আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৭৬, আহমাদ ২৬৯৩৮, সহীহাহ ৬৭৫, ৬৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি শরাব পান করে এবং মাতাল হয়, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না। সে মারা গেলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর যদি সে তওবা করে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন। সে পুনরায় শরাব পানে লিপ্ত হলে কিয়ামতের দিন অল্লাহ তা‘আলা অবশ্যি তাকে ‘‘রাদগাতুল খাবাল’’ পান করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘রাদগাতুল খাবাল’ কী? তিনি বলেনঃ জাহান্নামীদের দেহ থেকে নির্গত পুঁজ ও রক্ত। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৭৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৮৬২, নাসায়ী ৫৬৬৪, ৫৬৭০, আহমাদ ৬৬০৬, ৬৭৩৪, দারেমী ২০৯১, সহীহাহ ৭০৯, আত-তালীক আলা ইবনু খুযাইমাহ ৯৩৯, তাখরীজুল ঈমান লি ইবনুস সালাম ৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 “চল্লিশ দিন সালাত কবুল হবে না” এ কথার অর্থ কি?

● আবু আব্দিল্লাহ ইবনে মানদাহ [মৃত্যু: ৩৯৫ হিজরি] বলেন:

“চল্লিশ দিন সালাত কবুল হবে না” অর্থ: মদপানের শাস্তি হিসেবে চল্লিশ দিনের সালাতের সওয়াব পাবে না। যেমন ফকিহগণ বলেছেন: জুমার দিন খুতবা চলাকালীন যদি কেউ কথা বলে সে জুমা পড়বে কিন্তু তার জুমা হবে না। অর্থাৎ তার এই অপরাধের কারণে তাকে জুমার সালাতের সওয়াব প্রদান করা হবে না।” (তাযীম কাদরিস সালাত ২/৫৮৭ ও ৫৮৮)।

 ● ইমাম নওবী রহ. [মৃত্যু: ৬৭৬ হি: /১২৭৭ খৃ:] বলেন:

“আর সালাত কবুল না হওয়ার অর্থ হল, এতে তার সওয়াব হবে না। যদিও ফরয আদায়ের জন্য তা যথেষ্ট হবে এবং তা পুনরায় আদায় করার প্রয়োজন নাই।” (শরহে মুসলিম)।

সুতরাং মদ্যপানকারীর জন্য আবশ্যক হচ্ছে, যথানিয়মে সালাত অব্যাহত রাখা। অন্যথায় সালাত পরিত্যাগের কারণে গুনাহের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে। মদপানের সাথে সালাত পরিত্যাগের জন্য কঠিন (কুফরি পর্যায়ের) গুনাহ হবে। কেননা সালাত তার উপর অবধারিত ফরজ এবং ইসলামে পাঁচটি রোকনের অন্যতম। সুতরাং সওয়াব থেকে বঞ্চিত হলেও যথাসময়ে যথানিয়ম পূর্ণ যত্ন সহকারে সালাত আদায় করা আবশ্যক। যেমন: বিশেষ কোন অপরাধের কারণে কোন কোম্পানির পক্ষ থেকে তার কর্মচারীকে কাজ অব্যাহত রাখার শর্তে বেতন থেকে বঞ্চিত করা হয়।

(গ) কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ).....জাবির (রহঃ) হতে বর্ণিত। ‘জাইশান’ থেকে জনৈক লোক আসলো। জাইশান ইয়ামানের একটি অঞ্চল। অতঃপর সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাদের অঞ্চলে তারা শস্য দিয়ে প্রস্তুত 'মিয্র' নামক যে মদ পান করে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এটা কি নেশা তৈরি করে? সে বলল, হ্যাঁ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নেশা উদ্রেক করে এমন সবই নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা'আলা ওয়াদা করেছেন, যে লোক নেশাযুক্ত জিনিস পান করবে তাকে তিনি “তীনাতুল খাবাল” পান করিয়ে ছাড়বেন। মানুষেরা বলল, হে আল্লাহর রসূল! তীনাতুল খাবাল কি? তিনি বললেন, জাহান্নামবাসীদের ঘাম বা জাহান্নামবাসীদের মলমূত্র। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫১১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫০৪৭, ইসলামিক সেন্টার ৫০৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবূ রাবী' আতাকী ও আবূ কামিল (রহঃ).....ইবনু উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যা কিছু নেশা তৈরি করে তা-ই মদ। আর যা নেশা উদ্রেক করে তাই নিষিদ্ধ। যে লোক দুনিয়াতে মদ পান করবে, আবার সব সময় এ কাজ করে তওবা না করেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে, সে আখিরাতে তা পান করতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫১১৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০০৩. ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫০৪৮, ইসলামিক সেন্টার ৫০৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদের উপর দশভাবে অভিসম্পাত করা হয়েছেঃ স্বয়ং মদ (অভিশপ্ত), মদ উৎপাদক, যে তা উৎপাদন করায়, তার বিক্রেতা, তার ক্রেতা, তার বহনকারী, তা যার জন্য বহন করা হয়, এর মূল্য ভোগকারী, তা পানকারী ও তা পরিবেশনকারী (এদের সকলেই অভিশপ্ত)। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৬৭৪, ৫৬৮৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৭৭, আহমাদ ইরওয়া ১৫২৯, রাওদুন নাদীর ৫৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশভাবে মদের উপর অভিসম্পাত করেছেনঃ মদ প্রস্তুতকারী, তা উৎপাদনকারী, যে তা উৎপাদন করায়, তা যার জন্য উৎপাদন করা হয়, তা বহনকারী, যার জন্য তা বহন করা হয়, তার বিক্রেতা, তার ক্রেতা, তা পরিবেশনকারী এবং যার জন্য পরিবেশন করা হয়। এভাবে তিনি দশজনের উল্লেখ করেছেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮১, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২৯৫, গায়াতুল মারাম ৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়ায় মদ পান করেছে অতঃপর তাত্থেকে তওবা করেনি, সে আখিরাতে তাত্থেকে বঞ্চিত থাকবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৫৭৫, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৭৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫১১৭, ৫১১৮, ৫১১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০০৩, তিরমিযী ১৮৬১, নাসায়ী ৫৬৭১, ৫৬৭৩, ৫৬৭৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৬৭৯, আহমাদ ৪৬৭৬, ৪৭১৫, ৪৮০৮, ৪৮৯৭, মুয়াত্তা মালেক ১৫৯৭, দারেমী ২০৯০, রাওদুন নাদীর ৫৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করে, সে আখেরাতে তা পান করতে পারবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৩৭৪)। হাদিসের মানঃ  সহিহ (Sahih)।

(ঝ) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়া ও লটারীতে অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদানকারী এবং সর্বদা মদপানকারী জান্নাতে যাবে না’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৫৩, নাসায়ী ৫৬৭২, দারিমী ২১৩৮, সহীহাহ্ ৬৭৩, সহীহ আল জামি ৭৬৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

 (ঞ) ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন। (১) সর্বদা মদপানকারী, (২) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও (৩) পরিবারে বেপর্দার সুযোগ দানকারী (দায়ূছ)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৫৫, নাসায়ী ২৫৬৩, আহমাদ ৫৩৭২, সহীহ আল জামি‘ ৩০৫২, সহীহ আত্ তারগীব ২৩৬৬)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

 (ট) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নেশাদার দ্রব্য পানকারী জান্নাতে যাবে না। পিতামাতার অবাধ্য ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। খোটা দানকারী জান্নাতে যাবে না’। (তারগীব হা/২৩৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

মদের কারখানা, মদের দোকান বা মদের বার কিংবা মদ ব্যবসা মুসলমানদের জীবিকার উৎস

দর্শনা কেরু এন্ড কোং মদের কারখানাসহ মদ বিক্রির দোকানে, মদের বারে শত শত মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতিটি স্থানেই সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে অসংখ্য মুসলিম ব্যক্তি চাকরি করছে। এরা একদিকে মদের দোকানে বা কারখানায় চাকরি করে অর্থ উপার্জন করছে অন্য দিকে অনেকে সালাত আদায়সহ ধর্মীয় কর্মও পালন করছে। কিন্তু তাদের উপার্জিত অর্থ কি হালাল! আসুন সহিহ হাদিস ভিত্তিক বিষয়গুলো জেনে নেই।

(ক) ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদের উপর দশভাবে অভিসম্পাত করা হয়েছেঃ স্বয়ং মদ (অভিশপ্ত), মদ উৎপাদক, যে তা উৎপাদন করায়, তার বিক্রেতা, তার ক্রেতা, তার বহনকারী, তা যার জন্য বহন করা হয়, এর মূল্য ভোগকারী, তা পানকারী ও তা পরিবেশনকারী (এদের সকলেই অভিশপ্ত)। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৬৭৪, ৫৬৮৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৭৭, আহমাদ ইরওয়া ১৫২৯, রাওদুন নাদীর ৫৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশভাবে মদের উপর অভিসম্পাত করেছেনঃ মদ প্রস্তুতকারী, তা উৎপাদনকারী, যে তা উৎপাদন করায়, তা যার জন্য উৎপাদন করা হয়, তা বহনকারী, যার জন্য তা বহন করা হয়, তার বিক্রেতা, তার ক্রেতা, তা পরিবেশনকারী এবং যার জন্য পরিবেশন করা হয়। এভাবে তিনি দশজনের উল্লেখ করেছেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৩৮১, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২৯৫, গায়াতুল মারাম ৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা পুত-পবিত্র, তিনি পুত-পবিত্র জিনিসকেই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা যে কাজ করতে রসূলদের প্রতি নির্দেশ করেছেন তদ্রূপ এই একই কাজের নির্দেশ মু’মিনদেরকেও করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : ‘‘হে রসূলগণ! পাক-পবিত্র হালাল রুযী খাও এবং নেক আ‘মাল কর’’- (সূরা আল মু’মিনূন ২৩ : ৫১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ ‘‘হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা উপজীবিকা স্বরূপ দান করেছি সেই পাক-পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর’’। (সূরা আল বাকারা ২ : ১৭২)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দৃষ্টান্ত হিসেবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন যে, এ ব্যক্তি দূর-দূরান্তের সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ধূলাবালুতে মাখা। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি দু’ হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে ডাকছে, হে রব্! হে রব্! কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পরনের পোশাক হারাম। আর এ হারামই সে ভক্ষণ করে থাকে। তাই এমন ব্যক্তির দু‘আ কিভাবে কবুল হতে পারে? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৮৯, আহমাদ ৮৩৪৮, দারিমী ২৭১৭, সহীহ আল জামি‘ ২৭৪৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৭১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(ক) হে মানবগণ! পৃথিবীর মধ্যে যা বৈধ-পবিত্র, তা হতে ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/১৬৮)।

(খ) হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা জীবিকা স্বরূপ দান করেছি তা হতে পবিত্র বস্ত্তসমূহ ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর যদি তোমরা তারই ইবাদত করে থাকো । (সুরা আল বাক্বারাহ ২/১৭২)।

(গ) হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্ত্ত হ’তে আহার করুন ও সৎকর্ম করুন; আপনারা যা করেন সে সম্বন্ধে আমি অবগত। (সুরা মুমিনূন ৫১)।

মনে রাখবেন,

(ক) জাবের (রা.) বলেন, রাসূল(সা.) বলেছেন, যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন।  জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহের গোশত/গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৭২, আহমাদ ১৪৪১, শু‘আবুল ঈমান ৮৯৭২, দারিমী ২৭৭৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) আবূ বাকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দেহ হারাম খাদ্য দিয়ে প্রতিপালিত হয়েছে, সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৮৭, সহীহাহ্ ২৬০৯, শু‘আবুল ঈমান ৫৭৫৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

সবশেষে এটাই বলতে চাই, মদ বা মদ জাতীয় সকল নেশাদার দ্রব্যই হারাম। মদের ব্যবসা হারাম। মদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপার্জিত অর্থও হারাম। বর্তমানে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই মদের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা সহজলভ্য করতে সরকারিভাবে আইনও পাশ করা হয়েছে। এর থেকে পরিত্রানের উপায় হচ্ছে, প্রকৃত ইমানদার, মুত্তাকি মুসলিম শাসক নিযুক্ত করা এবং মাদকের ভয়াবহতা সমাজে তুলে ধরা এবং নিজের আমল সংশোধনসহ ইসলামি পরিবার গঠন করা। নেক্বার মেয়েকে বিয়ে করে নেক্বার সন্তান জন্ম দেয়া ও তাদেরকে ইসলামি বিধান মোতাবেক গড়ে তোলা।

বাংলাদেশ থেকে যিনা/ব্যভিচার, সুদ, মদ, মূর্তি, মাজার পূজাসহ অনুরুপ ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ শুধু বছরের পর বছর ওয়াজ মাহফিল করলে কিয়ামত পর্যন্ত দূর করা সম্ভব নয়। সুদের প্রচলন আর মদের ব্যবসা এগুলো রাষ্ট্রীয় বিষয়। সরকার যদি বন্ধ না করে তাহলে এগুলো বন্ধ হবে না। আর সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে এসব দূর করতে চাইলে ইসলামি সরকার গঠন করতে হবে। আওয়ামীলীগ, বিএনপি আর জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় রেখে কোনো দিন সম্ভব নয়। কুয়ার মধ্যে মরা বিড়াল রেখে যতোই বালতি বালতি পানি উত্তোলন করুন যেমন পানির গন্ধ দূর হবে না তেমনি আওয়ামীলীগ, বিএনপি আর জাতীয় পার্টি বা অনুরুপ অনৈসলামিক দল ক্ষমতায় রেখে সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে ইসলামি বিরোধী কার্যকলাপও দূর করা সম্ভব নয়। আগে সিক্যুলারিজম সরকার পরিবর্তন করতে হবে। 

নারী নেতৃত্বে অভিশপ্ত জাতি

ইসলামে নারীর ক্ষমতায়ন বলতে তাদের সমান নৈতিক অধিকার, আর্থিক স্বাধীনতা, ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগকে বোঝায়, যা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামে নারীকে সম্পত্তি, মা ও পরিবারে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যা তাকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করে। তবে এই অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজে ভিন্ন হতে পারে।

ইসলামে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের দিকসমূহ:

সমান নৈতিক মর্যাদা:

ইসলামে পুরুষ ও নারীর সমান নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা উভয়েই কর্মফল অনুযায়ী পরকালে সমান পুরস্কার লাভের অধিকারী হবে।

আর্থিক স্বাধীনতা:

নারীরা সম্পত্তির মালিক হতে পারে, ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে এবং দান করতে পারে। তাদের সম্পদ তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ গ্রহণ করতে পারে না।

শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা:

ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ, যা নারীর জ্ঞানচর্চা ও সমাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়।

পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা:

ইসলাম নারীকে মা, স্ত্রী, কন্যা ও বোন হিসেবে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। পরিবারে শান্তির পরিবেশ তৈরি করা এবং সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করে তোলা তার অন্যতম দায়িত্ব।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবদান:

ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে নারী আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অংশীদার হয়েছেন এবং জ্ঞানচর্চা ও সমাজসেবায় অবদান রেখেছেন।

বর্তমান বিশ্বে নারীগণ পুরুষের পাশাপাশি সবজায়গাতেই তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে নিচ্ছে। ইসলাম এসব বিষয়ে বাঁধা প্রদান করছে না। তবে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উলঙ্গ বেহায়াপনা, পর্দাহীনতা ও পুরুষের উপর নারীদের কর্তৃত্বের স্বাধীনতা ইসলাম প্রদান করে না। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী নেতৃত্ব সিদ্ধ নয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর মর্যাদা প্রদান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষেরা স্বীয় ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে। ফলে পুণ্যবান স্ত্রীরা (আল্লাহ ও স্বামীর প্রতি) অনুগতা থাকে এবং পুরুষের অনুপস্থিতিতে তারা তা (অর্থাৎ তাদের সতীত্ব ও স্বামীর সম্পদ) সংরক্ষণ করে যা আল্লাহ সংরক্ষণ করতে আদেশ দিয়েছেন। যদি তাদের মধ্যে অবাধ্যতার সম্ভাবনা দেখতে পাও, তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদের সাথে শয্যা বন্ধ কর এবং তাদেরকে (সঙ্গতভাবে) প্রহার কর, অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তাহলে তাদের উপর নির্যাতনের বাহানা খোঁজ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ”। (সুরা আন নিসা-৩৪)।

নারী নেতৃত্ব নিয়ে রাসুল সা. বলেন,

আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ সংবাদ আসলো যে, পারস্যের (ইরানের) অধিবাসীরা কিস্রার কন্যাকে তাদের সম্রাজ্ঞী নিযুক্ত করেছে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে জাতি কক্ষনো সফলকাম হতে পারে না, যারা দেশের শাসনভার কোনো মহিলার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৯৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ৪৪২৫, ৭০৯৯, সুনান আননাসায়ী ৫৩৮৮, সুনান আততিরমিযী ২২৬২, সহীহাহ্ ২৬১৩, ইরওয়া ২৪৫৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪০৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪০৮০)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আমরা বাংলাদেশে ঘুরেফিরে দুইটি নারী পরিবারের নিকট জিম্মি হয়ে গেছি। এবলয় থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। দেখা যাচ্ছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিদায় নিলে তার মেয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবে অথবা তার ভাগ্নি টিউলিপ। এদিকে বেগম খালেদা জিয়া বিদায় নিলে তার ছেলের বউ বা নাতনী জাইমা দায়িত্ব নিবে। এভাবে দুই পরিবারের রাজনীতি চলতে থাকবে। আর আমরা ভোটারগণ নারী নেতৃত্বের পিছনে দৌঁড়াতে গিয়ে আল্লাহর অভিশাপে পরিনত হয়ে যাচ্ছি।

যেহেতু আওয়ামীলীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য অরাজনৈতিক দলগুলো নারী নেতৃত্বে বিশ্বাসী ও কার্যকরী তাই এই দলগুলো বয়কট করা প্রয়োজন। একজন বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ কখনো নারীর পায়ের তলায় বসবাস করতে পারে না।

ফ্যাসিস্ট হাসিনামলে মসজিদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা

বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারে সেজন্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা জেনারেল শিক্ষা থেকে ইসলাম উঠে দিয়েছে। এরপর মাদ্রাসা শিক্ষাকে চতুর্দিক থেকে কোণঠাসা করা হয়েছিলো। এভাবে একটি জেনারেশনকে চিরদিনের জন্যে ইসলাম থেকে বিমুখ করে রাখতে চেয়েছিলো। আমরা অলরেডি এর প্রভাব পড়তে দেখেছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় আর ইসলামকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাওয়ায় এই সময়ের শিক্ষার্থীরা ইসলাম বিচ্যূত হয়েছে। যার ফলে তারা শিক্ষকসহ পিতৃসমতুল্য লোকদেরকে অপমানিত করতে, মারতে, অন্যের সাথে খারাপ আচরন করতে দ্বিধাবোধ করতো না। তাদের মধ্যে সভ্যতা ছিলো না।

ঠিক অনুরুপভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা মসজিদ ও ইসলামি ফাউন্ডেশন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাংলাদেশের সকল মসজিদের ঈমামদের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিলো।

প্রতি জুমার দিনে দেখা যেতো মসজিদে মসজিদে সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা আর পুলিশের উপস্থিতি। যেসব এলাকায় জামায়াত শিবিরের তৎপরতা বেশী সেইসব এলাকায় এদের ঘোরাঘুরি বেশী দেখা যেতো। কোনো ঈমাম বা মুসল্লী সরকার বিরোধী কোনো বক্তব্য দিলেই জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে ধরে নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হতো। এমনও দেখা গেছে সালাতরত অবস্থায় পুলিশ পিছন থেকে মসল্লী ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

বিগত ০৮ অক্টোবর ২০২২ তারিখে “আজকের পত্রিকায়” প্রকাশিত  “আজকে মসজিদে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়: মির্জা ফখরুল” তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে মসজিদে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিছুদিন আগে দেখেছিলাম, এখন আছে কিনা জানি না—খুতবা যে হবে, সেটাও তারা নির্ধারণ করে দেয়। এর চেয়ে খারাপ কথা আর কী হতে পারে। সেই কাজগুলো করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। কিছুদিন আগে দেখেছিলাম যে, মসজিদে মসজিদে পুলিশ সব দাঁড়িয়ে থাকে, এখনো থাকে।’

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারের কারণে আমাদের বহু আলেম-ওলামা আজকে কারাগারে। এখানে বিশিষ্ট আলেম, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষদের কারাগারে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আলেমদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা দেয়নি, মামলা প্রত্যাহার করেনি। উপরন্তু আলেম-ওলামাদের কী করে নাজেহাল করা যায়, মিথ্যা মামলা দেওয়া যায় মিথ্যা নাটক সাজিয়ে, সেই কাজগুলো তারা করেছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, এরা (সরকার) সবার ওপর অত্যাচার করছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার করছে, তাদের উপাসনালয়গুলো ভেঙে দেয়, দুর্গাপূজার মণ্ডপ ভেঙে দেয়, তাদের সম্পত্তি দখল করে। জনাব মির্জা ফখরুল সাহেব যা বলেছেন তা সবই সত্য।

এরা সারা বাংলাদেশের সকল মসজিদ নিয়ন্ত্রণ করতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা থেকে। তৎকালীন এর মহাপরিচালক শামীম আফজাল ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন।

সেসময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ইসলাম বলতে কিছু ছিলো না। এক মূর্তাদ তৎকালীন মহাপরিচালক শামীম আফজাল ঈমাম প্রশিক্ষণ দেয়ার নাম করে ঈমামদের ডেকে এনে জুহরের সালাতের সময় বিদেশী সুন্দরী বালিকাদের নাচিয়ে ঈমামদের ঈমান আমল নষ্ট করেছিলো।

বিগত ২৭  নভেম্বর, ২০১০ তারিখে  ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অশ্লীল ব্যালে নৃত্য পরিবেশন করা হয়েছে প্রশিক্ষণরত ইমামদের সামনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে আগারগাঁও কার্যালয়ে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়।

আগারগাঁও ফাউন্ডেশন অফিসের সপ্তম তলার হলরুমে যখন সারা দেশ থেকে আগত বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সামনে এ অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করা হয়, ইমামরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের নির্দেশে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানে বোর্ড অব গভর্নরসের অনেক সদস্য উপস্খিত ছিলেন।

নৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন ইমাম জানান, ঠিক যখন জোহরের আজান শুরু হয় তখন ডিজি অনুষ্ঠান ঘোষককে নির্দেশ দেন এবার ব্যালে ড্যান্সের ঘোষণা দাও। আজান চলাকালে নাচ শুরু হলে কয়েকজন ইমাম আপত্তি জানালেও থামেনি দু’জন তরুণ-তরুণীর অশ্লীল নৃত্য।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর একটি টিম তিনজন শিক্ষকের নেতৃত্বে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আসেন। ডিজি প্রথমে তাদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। সেখানে তিনি ওহাবি আন্দোলন এবং মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করেন।

এরপর তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যান সপ্তম তলায়। পঞ্চম তলায় তখন শ’খানেক ইমামের প্রশিক্ষণ চলছিল। সেখান থেকে ইমামদের ক্লাস বাদ দিয়ে সাত তলায় হলরুমে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। হলরুমে প্রথমে হামদ-নাত ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এরপর ডিজি অনুষ্ঠান ঘোষককে নির্দেশ দেন,¬ এবার ব্যালে ড্যান্সের ঘোষণা করা হোক। তখন ঘোষক ব্যালে ড্যান্সের ঘোষণা দিলে একজন মার্কিন ছাত্র এবং ছাত্রী স্টেজে উঠে নৃত্য শুরু করে। ছাত্রীটি সাদা গেঞ্জি এবং জিন্সের প্যান্ট পরিহিত ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইমাম জানান জীবনে এমন ঘটনার মুখোমুখি হবো তা কল্পনাও করিনি। ইসলামি একটি প্রতিষ্ঠানে ইমামতির প্রশিক্ষণ নিতে এসে উলঙ্গ অশ্লীল নাচ দেখতে হবে তা চিন্তারও অতীত। হাত ধরাধরি করে বুকে বুক মিলিয়ে যে অশ্লীল নৃত্য করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারা দেশে শুধু ইসলামই ধ্বংস করা হয়নি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

বিগত ২১ মার্চ ২০২৫ তারিখে “বিডিটুডে ডট নেট” পত্রিকায় প্রকাশিত “শেখ হাসিনার ১৫ বছরে ইফা ছিল দুর্নীতির আখড়া” শিরোনামের মাধ্যমে জানা যায়, পতিত আওয়ামী সরকারের দুর্নীতির ভয়াল থাবা পড়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা)। মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর জালিয়াতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল সরকারি ধর্মীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। মৌলিক কাজ বাদ দিয়ে আওয়ামী বন্দনায় ব্যস্ত রাখা হয়েছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এমনকি আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু বাস্তবায়নেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করা হতো ইফার কর্মীদের। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে।

সূত্র বলছে, সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের (মৃত) নেতৃত্বেই তার দীর্ঘ ১১ বছর মেয়াদে সবচেয়ে বেশি অপকর্ম হয়েছে। একই সঙ্গে বিগত ১৫ বছরে দায়িত্ব পাওয়া বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নররা এবং আওয়ামীপন্থি হিসেবে দাবিদার বেশ কিছু কর্মকর্তা দাপটের সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। এতে একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের শত শত কোটি টাকা নষ্ট হয়েছে। একচেটিয়া দুর্নীতি-অনিয়ম হলেও কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেতেন না এতদিন। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়ন ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলোচনায় উঠে এসেছে এসব দুর্নীতি। ইফার সর্বশেষ বোর্ড সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অডিটে ইফার দুর্নীতির খণ্ডচিত্রঃ

২০০৯ থেকে ২০১৮ অর্থবছরের এক অডিট রিপোর্টে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয় বলে তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদপ্তরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে বিশেষ অডিট টিমের অনুসন্ধানে ইফার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যউপাত্ত উঠে আসার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তড়িঘড়ি করে কয়েক দফায় মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের অব্যয়িত ৭৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের ব্যবহারঃ

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জনবলের বড় অংশ ছিল মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক। ইমাম-মোয়াজ্জিন সংশ্লিষ্ট এসব শিক্ষকদের অনেকটা দলীয়ভাবে ব্যবহার করে পতিত আওয়ামী সরকার। দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামের বিরুদ্ধে নানা কর্মকাণ্ডে হাসিনার সরকার যখন সমালোচনার মুখে পড়ত, তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিতর্কিত ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের নির্দেশে গণশিক্ষার শিক্ষকদের ঢাকায় এনে সরকারের পক্ষে সমাবেশ করা হতো। এতে চরম বির্বত ও বিতর্কের মুখে পড়তেন ইমাম-মোয়াজ্জিনরা। অবশ্য আওয়ামীপন্থি নিশ্চিত করে বহু শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় সে সময়। তারা এসব কাজে বেশি তৎপর থাকতেন।

সবশেষ ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আগেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনবিরোধী কাজে লাগানো হয় গণশিক্ষার শিক্ষকদের। ওই আন্দোলনকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আখ্যা দিয়ে গণশিক্ষার শিক্ষকদের মাধ্যমে ৪ আগস্ট আগারগাঁওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে মানববন্ধন করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আ. হামিদ জমাদ্দার এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি ড. বশিরুল আলমের নির্দেশে ওই কর্মসূচি আয়োজন করা হয় বলে জানা যায়। গণশিক্ষা প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদার এই মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন।

শেখ মুজিবের ম্যুরাল বানানোর উদ্যোগঃ

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আগারগাঁও প্রধান কার্যালয়ে শেখ মুজিবের ম্যুরাল বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ধর্মীয় একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যুরাল বানানোর এ উদ্যোগে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

ইসলামিক প্রতিষ্ঠান হয়ে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডঃ

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হয়েও একের পর এক অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের শিক্ষার্থী, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অভিভাবকদের নিয়ে আগারগাঁওয়ে ফাউন্ডেশন ভবনে ২০১০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া। এ সময় ওই শিল্পীর সঙ্গে করমর্দনও করেন ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল। কাঙ্গালিনী সুফিয়ার একতারা ও নাচ-গানে বিব্রত হন উপস্থিত ইমামরা। এ ছাড়া একই বছর ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল ইফার ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে জাতীয় শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে হামদ ও নাতের বিচারক হিসেবে আঁখি আলমগীরসহ এমন শিল্পীদের আনা হয়, যাদের অনেকেই ইসলামি সংগীত করেন না। এ নিয়ে অনেকেই তখন প্রশ্ন তোলেন।

মৌলিক গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রমে স্থবিরতাঃ

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা ইসলামি বিশ্বকোষ। ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরে ইসলামি বিশ্বকোষের নতুন একটি খণ্ডও প্রকাশ করা হয়নি। কিছু পুনর্মুদ্রণ করলেও তা ছিল যৎসামান্য ও অপ্রতুল। একইভাবে গত ১৫ বছরে কোনো মৌলিক গবেষণামূলক পুস্তক প্রকাশ করা হয়নি। অনুবাদ সাহিত্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কোনো বই অনুবাদ করা হয়নি।

একদিকে মৌলিক গবেষণামূলক বই প্রকাশ বন্ধ, অন্যদিকে অপ্রয়োজনে নিজের নামে ২৫টির বেশি বই প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটির লাখ লাখ টাকা অপচয় করেন তৎকালীন ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল। আরো অবাক করা বিষয় হলো, অন্যকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করেন সামীম আফজাল।

সূত্র জানায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ থেকে পত্রিকা ও সাময়িকীসহ এ পর্যন্ত চার হাজার ৫৯৬টি টাইটেলের বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখা ৬৩টি বই আছে। শুধু মুজিব সম্পর্কিত বই আছে ৩৪টি। বাকিগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত। এসব বই ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার, বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কর্মকর্তা ডা. শাহাদাত হোসেনসহ আওয়ামীপন্থি বিভিন্ন লেখকের বই রয়েছে।

উল্লেখিত বিষয় ছাড়াও ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি লক্ষ্যচ্যুত, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনিয়মে ছাপাখানায় লোকসান, মসজিদ পাঠাগারে দলীয় মতাদর্শের বই ও কমিশন বাণিজ্য, বায়তুল মোকাররমে দোকান বরাদ্দ ও হস্তান্তরে দুর্নীতি-অনিয়ম, বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম নিয়োগে অনিয়ম-জালিয়াতি, ৪৭ কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি, জাল সনদে চাকরি করছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ফারমার্স ব্যাংকে এফডিআর ইত্যাদি বিষয়গুলো উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনে পবিত্র কোরআনুল করিম মুদ্রণ ও ক্রয়ে ৫২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচি পালন না করে তিন কোটি ১৬ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে ৪৫ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। কোনো ধরনের আইন, বিধিবিধান ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শত শত কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। এতে সরকারের শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হয়। পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই না করে তিন কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা লোপাট করা হয়। পুস্তক প্রকাশনার অর্থ বিধিবহির্ভূতভাবে ওয়ার্কশপ খাতে ব্যয় করা হয়।

কাফির মুশরিকদের সাথে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের বন্ধুত্ব স্থাপন

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার পরিবারের লোকজনের মাঝে ইসলামের কোনো প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয় না। ইসলামের যেটুকু ধর্মকর্ম পালন করে তারা দেখাতো তা ছিলো এদেশের মুসলমানদের ধোকা দেয়ার হাতিয়ার। মূলত এদের মধ্যে খৃস্টান, ইহুদি ও হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দেখা যায়। এই শেখ পরিবারটি যেমন ঠিক একইভাবে তাদের দলকেও পরিচালিত করতো। যার ফলে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের মাঝেও কাফির মুশরিকদের  আদর্শ দেখা যায়।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় বিগত ২৬ অক্টোবর ২০০২ সালে মার্কিন নাগরিক ক্রিস্টিন ওভারমায়ারকে বিয়ে করেন। তিনি খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের সন্তানের নাম সোফিয়া ওয়াজেদ।

রেদওয়ান সিদ্দিক ববির স্ত্রীর নাম পেপি কিভিনিয়ামি। তিনি খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের স্বামীর নাম ক্রিস পার্সি। তিনিও খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী।

এতে বুঝা যাচ্ছে , বাংলাদেশের কোনো মুসলমান এদের যোগ্য না, আর এটাও পরিস্কার যে শেখ পরিবার মুসলিম বিদ্বেষী এবং তারা খৃস্টান, ইহুদি ও হিন্দুদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনামলে আমরা দেখেছি, হাসিনা গংরা ভারতকে বাংরাদেশ ইজারা দেয়া ছাড়াও তারা নিজেদের জীবন যৌবন পর্যন্ত দিয়েছে। তার বড় প্রমাণ বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতেই থাকার স্থান পেয়েছে এবং বিগত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, হাসিনার সাথে ৭৩৪ জন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট নেতা ভারতে পালিয়ে অবস্থান করছে।

যাই হোক বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে এটাই প্রমাণিত যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার পরিবার ও দল কাফির মুশরিকদের সাথে একটা পারিবারিক বন্ধুত্ব সম্পর্ক রয়েছে। অথচ ইসলামে কাফির মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষেধ। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেছেন,

“মুমিনগণ যেন ঈমানদারদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক রূপে গ্রহণ না করে। যে এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। অবশ্য তাদের নির্যাতন থেকে বাচার জন্য এরূপ করলে আল্লাহ্ মাফ করবেন”। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৮)।

আবূ সা’ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, মু’মিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু বানাবে না এবং তোমার খাদ্য আল্লাহভীরু লোক ছাড়া যেন অন্য কেউ না খায়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০১৮, সুনান আততিরমিযী ২৩৯৫, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৩২, সহীহুল জামি‘ ৭৩৪১, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫৪, আহমাদ ১১৩৩৭, আবূ ইয়া‘লা ১৩১৫, দারিমী ২০৫৭, শু‘আবুল ঈমান ৯৩৮২, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৭৪, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৩১৩৬, আল মুসতাদরাক ৭১৬৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আল্লাহ তায়ালা অন্য জায়গায় কাফিরদের সাথে সম্পর্ক রাখা তো দূরের কথা তাদের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,

“হে নবী! কাফির এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান, আর তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন করুন”। (সূরা আত তাওবা, আয়াত: ৭৩)।

আরও বলা হয়েছে,

“হে ঈমানদার লোকেরা! লড়াই করো সেইসব কাফিরদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের কাছাকাছি রয়েছে। তারা যেন তোমাদের মধ্যে দৃঢ়তা ও কঠোরতা দেখতে পায়”। (সূরা আত তাওবা, আয়াত: ১২৩)।

সূরা আল মুমতাহিনা-এ বলা হয়েছে,

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি সংগ্রাম করার জন্য এবং আমার সন্তোষ লাভের আশায় বের হয়ে থাকো তাহলে আমার ও তোমাদের যারা শত্রু তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো কিন্তু যে সত্য তোমাদের কাছে এসেছে তা মেনে নিতে তারা অস্বীকার করেছে। রাসূল ও তোমাদের নির্বাসিত করার যে আচরণ তারা শুরু করেছে তা এজন্য যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে”। (সূরা আল মুমতাহিনা, আয়াত: ১)।

এতো গেল দূর সম্পর্কীয় কাফিরদের কথা। এবার বলা হয়েছে যাদের সাথে রক্তের বাঁধন রয়েছে তারাও যদি কুফরী করে, তাদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক না রাখার জন্য। ইরশাদ হচ্ছে-

“হে ঈমানদারেরা! নিজের পিতা এবং ভাইও যদি ঈমানের চেয়ে কুফরীকে বেশী ভালোবাসে তাদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। যে ব্যক্তিই এ ধরনের লোকদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে সেই যালিম হিসেবে গণ্য হবে”। (সূরা আত তাওবা, আয়াত : ২৩)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানকে প্রথমে সালাম দেবে না। তোমাদের কেউ যদি পথে কোন ইয়াহূদী বা খ্রিষ্টানের সাক্ষাৎ পাও, তবে রাস্তাকে এতটা সংকীর্ণ করে রাখবে, যাতে সে রাস্তার একপাশ দিয়ে অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৫৫৫৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬৭, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৪১১, সহীহুল জামি‘ ১৩১৬০, আল জামি‘উস্ সগীর ১৩১৬০, ইরওয়া ১২৭১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭২৫, শু‘আবুল ঈমান ৮৯০৩, সুনান আততিরমিযী ১৬০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কিয়ামতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা কাফির মুশরিকদের সাথী হবেঃ

আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ (দুনিয়াতে) যাকে ভালবাসে (কিয়ামতে) সে তারই সাথী হবে।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসে, কিন্তু (আমলে) তাদের সমকক্ষ হতে পারেনি। তিনি বললেন, মানুষ যাকে ভালবাসে, সে তারই সাথী হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ৬১৭০,  ৬১৬৮, ৬১৬৯,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৮, সুনান আততিরমিযী ২৩৮৭, সুনান আবূ দাঊদ ৫১২৭, সহীহুল জামি‘ ৬৬৮৯, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩৩, বাযযার ৩০১৪, আহমাদ ১৩৩৮৮, আবূ ইয়া‘লা ৫১৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫৭, শু‘আবুল ঈমান ৪৯৭, সুনানুর নাসায়ী আল কুবরা ১১১৭৮, দারাকুত্বনী ২, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৭২০৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৭৯৫,  হাদীস সম্ভার ৩৪১৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৭৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৬২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! কিয়ামত কখন হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার জন্য পরিতাপ। কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুত করেছ? সে জবাবে বলল, আমি কিছুই করিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি তার সাথেই হবে যাকে তুমি ভালোবাসো। (রাবী) আনাস (রাঃ) বলেনঃ ইসলাম আবির্ভাবের পর মুসলিমদেরকে আমি কোন কথায় এতটা খুশি হতে দেখিনি, যতটা তারা খুশি হয়েছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীতে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৬৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬০৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৩৯, সহীহ আত্ তারগীব ৩০৩২, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ২৭০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৩৪৯৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ২০৩১৭, আহমাদ ১২০১৩, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৩৫৫৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৮, দারাকুত্বনী ৩, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৭/৩০৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৪১০, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ২৯৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যেহেতু ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা প্রকাশ্যে কাফির মুশরিকদের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব আছে আর যেহেতু আওয়ামী নেতা-কর্মী বা ভোটারগণ আওয়ামীলীগকে ভালবাসে, তাদের সাথেই উঠাবসা তাই কিয়ামতে এদেরও সাথী হবে ঐসব কাফির মুশরিকগণও। তথা কাফির মুশরিকরা জাহান্নামে যাবে তাদের সাথেও আওয়ামী গংরাও জাহান্নামে যাবে।

জামায়াত-শিবির নিধনে পতিত আওয়ামীলীগের সর্বশক্তি প্রয়োগ

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, সূত্র: আমার দেশ

পতিত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশি রোষানলের শিকার হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। একটানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা সরকার।

বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ পাঁচ নেতার ফাঁসি কার্যকরসহ সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের জীবন বিপন্ন করে তৎকালীন সরকার।

মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে এখনো কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন কেন্দ্রীয় এক নেতা। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড, ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম-অপহরণ, হামলা, গুলিসহ নানাভাবে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালায় ফ্যাসিবাদী সরকার।

দলীয় কার্যক্রমে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ও অন্যসব কার্যালয়। বাতিল করা হয় দলটির নিবন্ধন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বিপন্ন হয় অনেকের শিক্ষাজীবন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও অপপ্রচারে র্যাকব-পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় শক্তি, মিডিয়া এবং আওয়ামী নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হয়।

আওয়ামী নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি মহিলা জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নেতাকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরাও। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চারদিন আগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আওয়ামী সরকার। অবশ্য হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় জামায়াত-শিবির। মাত্র ২৬ দিনের মাথায় নিষিদ্ধের আদেশটিও বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।

জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে দলটির ৩৫৮ জন শহীদ হন। ক্রসফায়ারে নিহত হন ৮৬ জন। মহিলা জামায়াতের ছয়জন এবং ছাত্রী সংস্থার একজন বিভিন্ন সময় শহীদ হন। ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। এরমধ্যে জামায়াতের পুরুষ ৯১ হাজার ৬৭৫ জন, নারী এক হাজার ৮৭ জন, ছাত্র ১৭ হাজার ৪৬৩ জন এবং ৬৭৬ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হন। বিভিন্নভাবে আহত হন ৭৫ হাজার ৫৮৫ নেতাকর্মী। পঙ্গু হন পাঁচ হাজার ২০৪ জন। পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতিত হন ৯৬ হাজার ৯৩ জন আর গুম-অপহরণের শিকার হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে এখনো অন্তত সাতজন নিখোঁজ।

আওয়ামী শাসনামলে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাঁচ হাজার বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ওই সময়ে জামায়াতের তিন হাজার ২১টি দলীয় অফিস বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষতি হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জামায়াত নেতাদের সংশ্লিষ্ট ২২০টি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাটে ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সমর্থিত ৮৫৮ নেতাকর্মী শহীদ হন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব শহীদের আলাদা দলীয় পরিচয় দিতে চাইছে না দলটি। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যেসব সমর্থক নিহত হয়েছেন, তাদের পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।

শিবির সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী আমলে তাদের ১০১ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। মামলা হয় ১৭ হাজারের বেশি। ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৬৬ হাজার নেতাকর্মী।

সূত্রমতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল জামায়াতের। অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই চলত দলীয় কার্যক্রম। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকেই চরম জুলুম-নির্যাতন ও দমনের মুখে পড়ে দলটি। একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরও। অবশ্য ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে জামায়তবিরোধী অবস্থানের জানান দেয় আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী জুলুম-নির্যাতন প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে কঠিন আঘাত করা হয় জামায়াতের ওপর। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ওপর পিলখানায় আঘাতের পর জামায়াতকে বেছে নিয়েছিল তাদের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। ওই আঘাত দিয়ে তারা মনে করেছিল জামায়াত এ দেশের মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। দেশের মানুষের সঙ্গে আর থাকতেই দেবে না, কাজও করতে দেবে ন। শেষ করে দেবে। ওই পথেই তারা এগিয়েছিল।

জামায়াত আমির আরো বলেন, তারা প্রথম আঘাত হিসেবে জামায়াত নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে অত্যন্ত বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য ট্রায়ালের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে সাজা দিয়েছে। কাউকে ফাঁসি দিয়েছে, কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ব্রিটেনের একজন বিচারক বলেছেন এটা ছিল ‘জেনোসাইড অব জাস্টিজ’ বা বিচারিক গণহত্যা। এরপর তারা অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করা জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এককভাবে তখন লক্ষ্যবস্তু ছিল জামায়াত। তবে কঠিন সময়ে জামায়াত তার কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ করেনি। শেষ আঘাত হিসেবে আওয়ামী সরকার জামায়াতকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করে।

জামায়াতের ওপর আওয়ামী দমননীতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, এটা হাসিনার একটা কৌশল ছিল। পশ্চিমা দেশগুলোর মনরক্ষায় মৌলবাদ ধ্বংসের কাজে সম্পৃক্ততা ছিল হাসিনা সরকারের। অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে তারা রাজনীতিও করেছে। তাদের রাজনীতিটা ঘোলাটে। পরিষ্কার কোনো অবস্থান তাদের দেখা যায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই তাদের স্ট্যান্ডগুলো নেয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে তারা খুব কম কৌশল নেয়। এতে তারা দলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের নামে প্রহসনঃ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে দলটিকে দমনে সর্বোচ্চ তৎপরতা শুরু করে আওয়ামী সরকার। সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে সাজানো মামলায় বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে একে একে দলটির সাবেক আমির ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কারা হেফাজতে চিকিৎসার নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করে জামায়াত।

এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয় দলটির নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুস সুবহান, নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ এবং সাতক্ষীরা জেলা আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুল খালেক মণ্ডলের। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে এখনো কারাগারে আছেন দলটির সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম।

ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে সাজানো মামলা, সাক্ষী আর আওয়ামী আস্থাভাজন বিচারকদের মাধ্যমে এ বিচার কার্যক্রম চালানো হয়। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে বিচারিক হত্যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল আওয়ামী সরকার। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও প্রবাসী আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন ফাঁসের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া জোর করে সাক্ষ্য দেওয়ারও অভিযোগ করেন অনেক সাক্ষী।

হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারঃ

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার আর বানোয়াট মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মিছিল-মিটিং করলেই ধাওয়া বা ঘেরাও করে যেমন গ্রেপ্তার করা হতো, তেমনি দিনে-রাতে বাসাবাড়ি, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া গেলেই ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিচিত নেতাকর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারতেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বা নিরাপদ স্থানে থাকতেন সবাই। এতে অনেকেই চরম হয়রানির পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হন। পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন।

দলীয় সূত্রমতে, বিগত আওয়ামী শাসনামলে ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটিএম আজহারুল ইসলাম ছাড়া তেমন নেতাকর্মী জেলে না থাকলেও অধিকাংশ মামলা এখনো চলমান।

এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল জানান, জামায়াত নেতাকর্মীদের মামলা এখনো চলমান। তবে সরকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে জামায়াতের মামলাগুলোও প্রত্যাহার হবে বলে আশা করছি।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন জানান, বিচারিক প্রক্রিয়ায় মাত্র হাজারখানেক মামলা শেষ হয়েছে। আর সরকার যে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া করছে, তাতে প্রাথমিকভাবে জামায়াতের ৬০০ মামলা আছে। এ ছাড়া মহানগর দক্ষিণের এক হাজার ৭০৫টি এবং উত্তরের এক হাজার 0৫০০ মামলার তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা এখনো চলমান। এর মধ্যে আমিরে জামায়াত থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সারা দেশের শীর্ষ নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী মামলাগুলোয় হাজিরার ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়েছে। আইনজীবীরাই হাজিরা দিচ্ছেন।

আদালত ও থানায় বিপুল খরচঃ

আওয়ামী আমলে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মামলা চালাতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে জামায়াত ও শিবিরের। দলীয়ভাবে কিছু খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবার থেকেও লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের পেছনেই নয়, থানা পুলিশ এবং জেলখানায় নির্যাতন থেকে রেহাই পেতেও অনেককে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।

বারবার গ্রেপ্তার, রিমান্ডে বর্বর নির্যাতনঃ

জামায়াত নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অন্যতম একটি প্রক্রিয়া ছিল দফায় দফায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নির্যাতন। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। অনেক প্রক্রিয়া করে আদালত একবার জামিনে মুক্তির আদেশ দিলেও জেলগেট থেকে ফের আটক করে নতুন বা পুরোনো মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হতো। এভাবে অসংখ্য নেতাকর্মীকে বছরের বছর পর জেলে কাটাতে হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন আর দীর্ঘ জেলজীবন থেকে মুক্তি পেলেও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।

কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে চার বছর জেল খাটেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। গ্রেপ্তারের পর একটানা ৬৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। আজও সে নির্যাতনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। একই ভাবে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের শিকার হন জামায়াতের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা।

এ বিষয়ে ড. মাসুদ বলেন, রিমান্ডের বিভিন্ন সময় আমাকে ক্রসফায়ার, ছাদ থেকে ফেলা দেওয়াসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমাকে শারীরিকভাবে ব্যাপক নির্যাতনের একপর্যায়ে অবস্থা খারাপ হলে গোপনে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও জানাজানির আশঙ্কায় পরে ডিবিতে নিয়ে নামমাত্র চিকিৎসা দেওয়া হয়। ব্রেন ও পায়ের নিচে আঘাতের কারণে এখনো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি সুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার হলেও আদালতে নেওয়া হতো হুইলচেয়ারে।

জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, আদালত ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ রায় দিলেও তা মানত না পুলিশ। মুক্তির সময় জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো। চিকিৎসার আদেশ দিলেও আওয়ামী চিকিৎসকরা আমাদের ভর্তি না করে সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দিত।

একই ভাবে জামায়াতের বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেনসহ শীর্ষ অনেক নেতা দফায় দফায় রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি এক থেকে চার বছর পর্যন্ত জেল খেটেছেন। এ ছাড়া রিমান্ডে ও কারাগারে নির্যাতনের শিকার কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য অধ্যাপক তাসনীম আলম মুক্তির পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বর্তমানে প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন তিনি। এভাবে বহু নেতাকর্মীর জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে আওয়ামী সরকার।

গুম-অপহরণঃ

শুধু গ্রেপ্তার-নির্যাতনই নয়, জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ ও দীর্ঘদিন গুম করে রাখা হয় গত সাড়ে ১৫ বছরে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী গুম হওয়া বেশ কয়েকজন ফিরে আসার পর নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। তবে এক যুগ আগে ইবি শাখা শিবির নেতা ওয়ালী উল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসসহ বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া অন্তত সাতজনের এখনো সন্ধান মেলেনি। জামায়াত পরিবারের সদস্যরাও রেহাই পাননি গুম থেকে। এর মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী এবং মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান আট বছর পর আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। আরো তিন শিবির নেতা তিন বছর গুমের পর অসুস্থ অবস্থায় ফেরত আসেন।

সব অফিস ছিল বন্ধঃ

জামায়াত দমনের অংশ হিসেবে একপর্যায়ে দলটির কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সব কার্যালয় অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট সরকার। কার্যালয়সহ জামায়াত নেতাদের বাসা, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় থাকত পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি। এ অবস্থায় বিকল্প অফিস এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে চলত জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম।

কুরআন-হাদিসের আলোচনায় ছিল বাধাঃ

আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক বই প্রকাশ্যে রাখা ও পড়ার ক্ষেত্রে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি জামায়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের লেখা তাফসির ও অন্যান্য ইসলামী বইপত্রও পড়া এবং বহন করা যেত না। কোথাও ধর্মীয় বই পেলেই জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালানো হতো। ধর্মীয় অনেক বই বেচাকেনা বা প্রকাশনায়ও ছিল বাধা। কাউকে আটক করলেই সঙ্গে ধর্মীয় বই রেখে তাকে জিহাদি বই আখ্যা দিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রচার চালাত পুলিশ-র‌্যাব।

কার্যক্রম দেখলেই পুলিশের অ্যাকশনঃ

মিছিল-মিটিং বা কোনো কর্মসূচি পালন করলেই চালানো হতো পুলিশি অ্যাকশন। টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ ছাড়াও অতর্কিত গুলি চালানো হতো জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর। ধরে নিয়ে কাছ থেকে গুলি করারও বহু ঘটনা ঘটেছে। নেতাকর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা চালিয়ে সেটাকে পুলিশের ওপর হামলা-আক্রমণ বলে অপপ্রচার চালানো হতো বিভিন্ন মিডিয়ায়। এতে গ্রেপ্তার-নির্যাতন সহজ হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। শুধু প্রকাশ্যে নয়, কোনো বাসা বা অফিসে সাংগঠনিক বৈঠক বা কোরআন-হাদিসের আলোচনা করার খবর পেলেই তা রাষ্ট্রবিরোধী গোপন কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার করে নির্যাতন চালাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের যুব বিভাগের সেক্রেটারি হাসানুল বান্না চপল বলেন, ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আমার বাসায় হানা দেয় ডিবি পুলিশ। পরিবারকে জিম্মি করে বিনা অপরাধে আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলেই চোখ বেঁধে শুরু হয় নির্যাতন। একপর্যায়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে লাশ গুম করারও হুমকি দেওয়া হয়। দীর্ঘ দুই মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেও পরবর্তীতে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি আমার। শুধু আমি নই, দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী এমন পরিস্থিতির শিকার হন। তবে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার শিবিরঃ

শিক্ষাঙ্গনকে শিবিরমুক্ত করতে ব্যাপক ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী সরকার। ছাত্রলীগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে একের পর এক হামলা, গ্রেপ্তারসহ চতুর্মুখী নির্যাতন চালানো হয়। শিবির সন্দেহ হলেই ধরে নির্যাতন ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যেন অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এতে প্রকাশ্য কার্যক্রম চালানো তো দূরের কথা, শিবির পরিচয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

শিবির সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী আমলে ১৭ হাজার ১৮১টি মামলায় শিবিরের ৬৬ হাজার ২৪০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। রিমান্ডে নির্যাতিত হন ১৯ হাজার ১৯৬ জন। অনেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হন। এ সময় ১০১ জন শহীদ, ৩১ হাজার ২৫৭ জন আহত এবং ১৩৩ জন পঙ্গু হন।

শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ জানান, শিবির নেতাকর্মীদের নামে এখনো ১১ হাজার রাজনৈতিক মামলা চলমান। এগুলো নিষ্পত্তির জন্য আইন উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের ইতিহাসে গত দেড় দশক ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়। ওই সময় হাসিনার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ছাত্রশিবির। তাই শিবির নিধনের এক জঘন্য কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ। চিরুনি অভিযানের নামে হাসিনার পোষা বাহিনী শিবিরের নেতাকর্মীদের মেস ও বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। তারা অসংখ্য নিরপরাধ কর্মীর সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের অধিকার হরণ করে। কোরআন-হাদিসের ক্লাস, ঘরোয়া প্রোগ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি মসজিদে নামাজরত অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে গুম ও হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করেনি।

শিবির সভাপতি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার শিবিরের ১০১ জনকে হত্যা এবং সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে চিরতরে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওই সময় অজস্র কর্মীকে গুম করে। এখনো তাদের মধ্যে সাতজন নিখোঁজ। সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো, রাবি শিবির সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীসহ সারা দেশের প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে ভিকটিমদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়। শিবির সম্পৃক্ততার কারণে হাজারো বৈধ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে ক্লাস-পরীক্ষায়ও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। অসংখ্য শিবিরকর্মী তাদের ছাত্রজীবন সময়মতো শেষ করতে পারেননি। কারো কারো গোটা ক্যারিয়ারই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে শত শত যোগ্য ও মেধাবী যুবককে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ বা পেশাগত জীবন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ওই ভয়াল ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করেছি।

ক্রসফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডঃ

২০১৬ সালের ১ জুলাই ঝিনাইদহের নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় শিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুনকে। কিন্তু তাকে আটকের কথা অস্বীকার করে পুলিশ। একপর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে মামুনকে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ১৯ জুলাই রাতের আঁধারে হত্যা করে পুলিশ। এভাবে ঝিনাইদহ এলাকায়ই একের পর এক জামায়াত-শিবিরের অন্তত ১৭ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। জামায়াত-শিবির দমনে সম্ভাবনাময় ও সক্রিয় নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি ক্রসফায়ার নাটকের মধ্য দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায় ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ ও র‌্যাব।

দলীয় সূত্রমতে, পতিত আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের ৮৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ার দেওয়া হয় ঝিনাইদহে। একই ভাবে ক্রসফায়ার আর হত্যা-নির্যাতনের জন্য আতঙ্কিত জনপদ ছিল সাতক্ষীরা। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী।

ঝিনাইদহে হত্যা-নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরে সদর উপজেলা জামায়াতের আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা ড. হাবিবুর রহমান বলেন, সে সময় খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা গেছে। পুলিশ ধরলেই বেঁচে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। প্রথমে গুম করত পুলিশ, পরে টিভিতে ক্রসফায়ারের কথা জেনে পরিবার গিয়ে লাশ শনাক্ত করত।

নির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট উপজেলা পরিষদ থেকে ডিসি ও ইউএনওর উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার হন ড. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ওই সময় জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতাকর্মী শহরে ঢুকতে বা কোথাও বসে কথা বলতে পারতেন না। প্রকাশ্যে কোনো বৈঠকও করা যেত না। খবর পেলেই পুলিশ হানা দিত। ডিএসবির মুরাদ নামে এক পুলিশ সদস্য (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ধরিয়ে দেওয়ার কাজ করত। কামরুল নামে সাবেক এক শিবিরকর্মী এখনো গুম আছে বলেও তিনি জানান।

ক্রসফায়ারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির দমনে ভয়াবহ তৎপরতা চালানো হয় সাতক্ষীরায়। মাওলানা সাঈদীর রায়কে ঘিরে আন্দোলনের সময় ওই এলাকায় গুলি করে অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করে পুলিশ। অনেককে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার জামায়াতকর্মী আব্দুল্লাহ রুম্মান বলেন, আওয়ামী আমলে সাতক্ষীরা ছিল একটি আতঙ্কের জনপদ। এখানে জামায়াত নেতাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নেতাকর্মীদের ধরে পায়ে গুলি, মিছিল-মিটিং বা বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে মামলা, হামলার ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। বিগত ১৫ বছর এ এলাকার জামায়াত নেতাকর্মীরা কেউ নিজের বাড়িতে ঠিকমতো থাকতে পারেননি। কারো জানাজায় গেলেও ধরে নিয়ে যেত পুলিশ।

রেহাই পাননি নারী কর্মীরাওঃ

২০০৯ সালে পিরোজপুরে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার চার নেত্রীকে বোরকা পরা অবস্থায় ইসলামী বই-পুস্তকসহ আটক করে জঙ্গি বলে প্রচার চালিয়ে আওয়ামী সরকার তার ইসলাম নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করে। এরপর বিগত ১৬ বছরে দেশের সর্বত্র ইসলাম পালন করাকে ভয়ানক দেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালায় বিগত পতিত সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোয় বোরকা ও হিজাব-নিকাব পরা, নামাজ আদায় করা, ইসলামী বই পড়া ও সংগ্রহে রাখার কারণে জঙ্গি বলে নারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ছাড়াও রমজান মাসের ইসলামী আলোচনা, কোরআন তালিম, তারাবির নামাজ এবং দলীয় সাধারণ প্রোগ্রামগুলোয় সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সশস্ত্রভাবে হানা দিয়ে শত শত নারীকে গ্রেপ্তার করে। বোরকা পরতে না দিয়ে বেপর্দা অবস্থায় জেল থেকে কোর্টে হাজিরা দিতে আনা হয় অনেককে। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম পালনের কারণে। বিগত সময়ে জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগ ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার এক হাজার ৮৭৮ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ করে আওয়ামী সরকার। ওই সময়ে ছাত্রী সংস্থার এক কর্মী ও জামায়াতের ছয় নারী শহীদ হন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রী সংস্থার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, আওয়ামী শাসনামলে আমাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত কোথাও আমাদের নেতাকর্মীরা গত সাড়ে ১৫ বছরে স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ করতে পারেননি। হাজার হাজার নেতাকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। এখনো পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মী পঙ্গু অবস্থায় আছেন। এসব জুলুম-নির্যাতনের প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের সবার দাবি।

ফরমায়েশি রায়ে’ আল্লামা সাঈদীর ফাঁসি ট্রাইব্যুনালে

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, সূত্র: আমার দেশ

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিচারিক (জুডিশিয়াল) হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। ট্রাইব্যুনালে আল্লামা সাঈদীকে জুডিশিয়াল কিলিং নিশ্চিত করতে রায় দিয়েছিলেন এটিএম ফজলে কবীর, জাহাঙ্গীর হোসেন ও আনোয়ারুল হক। এই তিন বিচারকের দেওয়া রায়ে আল্লামা সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

জনরোষের ভয়ে পরে আপিল বিভাগে বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে আজীবন কারাগারে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। কারণ, ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী তখন নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একদিনে দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল। সরকার আপিল বিভাগের ফরমায়েশি রায়ে আল্লামা সাঈদীকে আজীবন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করে।

আপিল শুনানি করে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আজীবন কারাগারে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বিভক্ত রায়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

পরে আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল। রিভিউ পিটিশন যখন শুনানি হয়, তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং মির্জা হোসাইন হায়দার। শামসুদ্দিন মানিক তখন অবসরে চলে যান।

আল্লামা সাঈদীর পক্ষে আপিল ও রিভিউ পিটিশন শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এসএম শাজাহান। তিনি আমার দেশকে জানান, মামলাটি যে সাজানো হয়েছিল, সে বিষয়গুলো আপিল ও রিভিউ উভয় শুনানিতে স্পষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু আসামিপক্ষের কোনো তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তিকেই গ্রাহ্য করা হয়নি। এমনকি ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলায় তার স্ত্রীর করা মামলাটি আপিল বিভাগের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তখন তদন্তের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে পিরোজপুর আদালতে গিয়ে পরীক্ষা করেন, তারপরও কোনো কাজ হয়নি।

পরিকল্পিতভাবে সাজানো মামলায় সাক্ষীদের বয়স, অভিযোগে উল্লিখিত ঘটনার স্থান ও সময় নিয়ে ছিল বিভ্রান্তি। যদিও বিচারের চিরন্তন নীতি অনুযায়ী অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত দণ্ড দেওয়া যায় না। আল্লামা সাঈদীর মামলায় ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড ও আপিল বিভাগের আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া দুটি অভিযোগের কেস স্টাডি পর্যালোচনা এবং স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত নিজামুল হক নাসিমের বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই ‘জুডিশিয়াল কিলিংয়ের’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

পরিকল্পিতভাবে সাজানো মামলায় ২০টি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল শুধু প্রসিকিউশনের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত দেখিয়ে রায় দেয়। দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ছয়টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় রায়ে। আপিল বিভাগও এ দুটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আজীবন কারাগারে রাখার নির্দেশ দেয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দুটি অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় বিচারটি ছিল সাজানো। স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত নিজামুল হক নাসিমের বক্তব্য অনুযায়ী, রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। এমনকি আল্লামা সাঈদীর মামলাটি সবার আগে রায় দেওয়ার প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করেছিলেন নিজামুল হক নাসিম। রায়ের একটি খসড়া বেলজিয়াম থেকে আহমদ জিয়াউদ্দিনের টিম লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

যালিম বা অত্যাচারী শাসক হিসেবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলীয়  নেতা কর্মীদের ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি

জনগণের জান-মালের হেফাজত করা রাষ্ট্রীয় শাসকদের মৌলিক দায়িত্ব ও প্রধান কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের দায়িত্বশীলা, কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৫৮, ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৭৫১, ৫১৮৮, ৫২০০, ৭১৩৮,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮২৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৭০৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯২৮,  আহমদ ৪৪৮১, ৫১৪৮, ৫৮৩৫, ৫৮৬৭, ৫৯৯০, আল লুলু ওয়াল মারজান-১১৯৯। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

অন্যত্র রাসুল সাঃ বলেছেন,

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দশ বা ততোধিক লোকের অভিভাবক বা জিম্মাদার হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তার গলায় শিকল পরা অবস্থায় উপস্থিত করবেন। তার হাত গর্দানের সাথে বাঁধা অবস্থায় থাকবে, তার নেক ’আমল তাকে রক্ষা করবে অথবা তার কৃত অপরাধ তাকে ধ্বংস করবে। নেতৃত্বের প্রথম অবস্থা তিরস্কার ও নিন্দা, মধ্যম অবস্থায় লজ্জা, আর অবশেষে কিয়ামতের দিন অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭১৪, আহমাদ ২২৩০০, সহীহাহ্ ৩৪৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৭১৮, সহীহ আত্ তারগীব ২১৭৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

রাসুল সাঃ আরো বলেছেন,

মু’আবিয়াহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে মু’আবিয়াহ্! তুমি যদি কোনো কাজের জন্য শাসক বা জিম্মাদার নিয়োগপ্রাপ্ত হও, তাহলে আল্লাহকে ভয় করবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি [মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)] বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ কথার পর থেকে আমি সর্বদা এ ধারণা করছিলাম যে, আমি একদিন এ দায়িত্বে নিযুক্ত হব। শেষ অবধি আমি এ পরীক্ষায় উপনীত হলাম। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭১৫, আহমাদ ১৬৯৩৩, দালায়িলিন্ নুবূওয়্যাহ্ লিল বায়হাক্বী ৪৪৬)।

ন্যায়পরায়ণ শাসকদের পুরস্কার

যারা ন্যায় ও সততার সঙ্গে ক্ষমতা ও পদের সঠিক ব্যবহার করেন, আখিরাতে তাদের মহাপুরস্কারে ভূষিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ, যুহায়র ইবনু হারব ও ইবনু নুমায়র (রহঃ).....আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ন্যায় বিচারকগণ (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বারসমূহে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপাৰ্শ্বে উপবিষ্ট থাকবেন। তার উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ- সমান মহিয়ান)। যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬১৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮২৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৭০, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন লোকদের মাঝে ন্যায়নিষ্ঠ শাসকই আল্লাহ্ তা’আলার সবচাইতে প্রিয় ও নিকটে উপবেশনকারী হবে। তাদের মাঝে যালিম শাসকই আল্লাহ তা’আলার সবচাইতে ঘৃণিত এবং তার নিকট হতে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী হবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩২৯, রাওয (২/৩৫৬-৩৫৭), মিশকাত, তাহকীক ছানী (৩৭০৪), শারহুস্ সুন্নাহ্ ২৪৭২।

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,

উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন সহনশীল ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হবেন আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারী। আর কিয়ামতের দিন যালিম ও অত্যাচারী শাসক হবে আল্লাহর নিকট সকল মানুষের মধ্যে নিকৃষ্টতম। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭১৯, শু‘আবুল ঈমান ৬৯৮৬, য‘ঈফাহ্ ১১৫৭)।

উত্তম শাসকের পরিচয়

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে উত্তম শাসক (নেতা) ও নিকৃষ্ট শাসকদের ব্যাপারে কি জানিয়ে দিব না? উত্তম শাসক হচ্ছে তারাই যাকে তোমরা ভালবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে, আর তোমরা তাদের জন্য দু’আ কর এবং তারাও তোমাদের জন্য দুআ করে। নিকৃষ্ট শাসক হচ্ছে তারাই যাকে তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, আর তোমরা তাদেরকে অভিশাপ প্রদান কর এবং তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ প্রদান করে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২২৬৪, সহীহাহ ৯০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

স্বৈরশাসকদের  ভয়াবহ পরিণতি

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জুলুম কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এর পরিণাম ভয়াবহ। শাসক যদি অত্যাচারী হয়, তাহলে দেশের জনগণ যেমন শান্তি পায় না, অত্যাচারী ব্যক্তি নিজেও শান্তিতে থাকতে পারে না। দীর্ঘদিনের অন্যায়-অবিচারে জনমনে তার ওপর চাপা ক্ষোভ জন্ম নেয় এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। এ ক্ষোভের বিস্ফোরণ যখন হয়, তখন অত্যাচারীর শক্তিশালী মসনদ উল্টে যায় নিমেষেই।

অত্যাচার বা জুলুম সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ)...জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাক। কেননা কিয়ামত দিবসে অত্যাচার অন্ধকারে পরিণত হবে। তোমরা কৃপণতা থেকে সাবধান হও। কেননা এ কৃপণতাই তোমাদের আগেকার কাওমকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতা তাদের খুন-খারাবী ও রক্তপাতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং হারাম বস্তুসমূহ হালাল জ্ঞান করতে প্রলোভন দিয়েছে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪০, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুলুম কিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকারের রূপ ধারণ করবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে,আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন।যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দুর করবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪২, ৬৯৫১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাতটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তারপর তিনি উল্লেখ করলেন, অসুস্থদের খোঁজখবর নেয়া, জানাযায় পিছে পিছে যাওয়া, হাঁচির জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ্ বলা, সালামের উত্তর দেয়া, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, আহবানকারীর প্রতি সাড়া দেয়া, কসমকারীকে দায়িত্ব মুক্ত করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৫, ১২৩৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু আবদুর রহমান ইবনু বাহরাম আদ দারিমী (রহঃ)....আবু যার (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ওহে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজ সত্তার উপর অত্যাচারকে হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের মধ্যেও তা হারাম বলে ঘোষণা করছি। অতএব তোমরা একে অপরের উপর অত্যাচার করো না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৬৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জুলুমের শাস্তি ভয়াবহ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ জুলুমের কাজে জড়িত, তাকে আমি গুরুতর শাস্তি আস্বাদন করাব।’ (সুরা ফুরকান: ১৯)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর যারা জালিম, তাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই”। (সুরা শুরা: ০৮)।

রাসুল সাঃ বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি জনৈক ব্যক্তিকে বলতে শুনেছেন, অত্যাচারী মূলত কারো কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে না; বরং নিজেই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) এটা শুনে বললেনঃ হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এরূপই। এমনকি ’’সবারা’’ (সারস পাখি)-ও অত্যাচারীর অত্যাচারের কারণে নিজের বাসায় থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে, পরিশেষে মৃত্যুবরণ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৬, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৭৯)।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন। (সুরা: নাহল, আয়াত ৯০)।

অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী শাসক সর্বনিকৃষ্ট

আয়িয ইবনু ’আমর হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ শাসকদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট শাসক সে, যে অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৮৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬২৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৩০, আহমাদ ২০৬৩৭, সহীহাহ্ ২৮৮৫, সহীহ আল জামি ২০৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৫৮১, ইসলামিক সেন্টার ৪৫৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শাসকদের ডানে বামে পরামর্শক হিসেবে দুই জন ফেরেশ্তা থাকে

সা’ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন এক মুসলিম ও এক ইয়াহূদীর মধ্যে পরস্পর বিবাদ নিয়ে ’উমার (রাঃ)-এর নিকট আসলো। এমতাবস্থায় ’উমার (রাঃ) তা সত্যায়িত করে ইয়াহূদীর পক্ষে রায় দিয়ে দিলেন। তখন ইয়াহূদী ’উমার (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললঃ আল্লাহর কসম! আপনি হক বিচার করেছেন। অতঃপর ’উমার তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করে বললেনঃ তুমি কিভাবে জানলে (হক বিচার হয়েছে)? উত্তরে ইয়াহূদী বললঃ আল্লাহর কসম! আমরা তাওরাত কিতাবে পেয়েছি, যে শাসক ন্যায়বিচার করে তার ডানপাশে একজন মালাক (ফেরেশতা) থাকেন এবং বামপাশে একজন মালাক থাকেন। তারা তার কাজটিকে সহজসাধ্য করে দেন এবং ন্যায় ও সঠিক কাজ করার মধ্যে সাহায্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ন্যায়ের সাথে থাকেন। কিন্তু যখন তিনি ন্যায় ও হক পন্থা পরিহার করেন, তখন মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) উপরে চলে যান এবং তার সঙ্গ পরিত্যাগ করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৪২, মালিক ১৪৬১, সহীহ আত্ তারগীব ২১৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

অত্যাচারী শাসকদের ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি

পরকালে অত্যাচারী শাসকদের শাস্তি তো অবশ্যম্ভাবী। কখনো ইহকালেও তারা বিভিন্ন শাস্তির সম্মুখীন হয়। আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর বিভিন্ন বিপদ চাপিয়ে দেন।

আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা অত্যাচারীকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর তাকে এমনভাবে পাকড়াও করেন যে, সে আর ছুটে যেতে পারে না। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আয়াত পাঠ করলেন- অর্থাৎ- এরূপ তোমার প্রভুর পাকড়াও যে, যখন তিনি অত্যাচারী গ্রামবাসীদের পাকড়াও করেন।  (সূরাহ হূদ ১১/১০২)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৬৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮৩, সুনান আততিরমিযী ৩১১০, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১১২৪৫, সুনান ইবনু মাজাহ ২৪০১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৩৫১২, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৭৩২২, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৬৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৪১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইহকালীন শাস্তি

আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারী অবাধ্যদের ইহকালীন বিভিন্ন শাস্তির কথা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। সেগুলোর কয়েকটি এখানে বর্ণনা করা হলোঃ

(এক) জুলুম কখনো স্থায়ী হয় না। অত্যাচারের মূলোৎপাটন হবেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“অতঃপর তারা যখন সে উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদের দেওয়া হয়েছিল, তখন আমি তাদের সামনে সবকিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম। এমনকি যখন তাদের প্রদত্ত বিষয়াদির জন্য তারা খুব গর্বিত হয়ে পড়ল, আমি অকস্মাৎ তাদের পাকড়াও করলাম। ফলে তারা সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে গেল। এভাবে যারা জুলুম করেছিল, তাদের মূলোচ্ছেদ করা হলো”। (সুরা আনআম: ৪৪-৪৫)।

অত্যাচারীদের এ আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে, তারা যেন পার্থিব শাস্তি থেকে নিজেদের নিরাপদ মনে না করে। পার্থিব জীবনেও তারা বিভিন্ন শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে, যেমনটা পূর্ববর্তী লোকেরা হয়েছে।

(দুই) জালিমের ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আমি কত জনপদকেই ধ্বংস করেছি, যখন তারা জুলুমে রত ছিল। এসব জনপদ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, কত কূপ হয়েছে পরিত্যক্ত এবং কত সুদৃঢ প্রাসাদ ধ্বংস হয়েছে”। (সুরা হজ: ৪৫)।

(তিন) আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। বর্ণিত হয়েছে,

“আমি কত জনপদকেই তো অবকাশ দিয়েছিলাম, এরা ছিল জালিম। অবশেষে আমি তাদের পাকড়াও করেছি”। (সুরা হজ: ৪৮)।

(চার) অত্যাচারী ফেরাউনের পরিণতি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে,

“ফেরাউন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহমিকা প্রদর্শন করছিল। তারা মনে করেছিল, তারা আমার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে না। অতঃপর আমি তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ জালিমদের পরিণতি কী হয়েছে”। (সুরা কাসাস: ৩৯-৪০)।

ক্ষমতা গ্রহণের পর যারা স্বৈরাচারী হবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। ইহকালেও নেমে আসতে পারে যেকোনো বিপদ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আমর ইবনু মুররাহ্(রহঃ) হতে বর্ণিত। একদিন তিনি মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-কে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের মধ্যে যে ব্যক্তিকে কোনো কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, আর সে তাদের প্রয়োজন, চাহিদা ও অভাব-অভিযোগের প্রতি পরোয়া করে না (গাফিল থাকে); আল্লাহ তা’আলাও তার প্রয়োজন, চাহিদা ও অভাব-অভিযোগ (মিটানো) থেকে আড়ালে থাকেন। অতঃপর মু’আবিয়াহ্ (রাঃ) মানুষের প্রয়োজন ও অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য একজন লোক নিয়োগ করেন।

তিরমিযী’র অপর এক বর্ণনা ও আহমাদ-এর বর্ণনাতে আছে, আল্লাহ তা’আলা ঐ শ্রেণীর লোকের চাহিদা, প্রয়োজন ও অভাব মোচনের ব্যাপারে আকাশমন্ডলীর সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৮, সুনান আততিরমিযী ১৩৩২, সুনান আবূ দাঊদ ২৯৪৮, আহমাদ ১৮১৯৬, সহীহ আত্ তারগীব ২২০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তাই অধীনের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করা ও তাদের প্রতি ইনসাফ করা অত্যাবশ্যক। কারণ শাসক যখন জুলুম-অত্যাচার শুরু করে, তখন তার ওপর থেকে আল্লাহর সাহায্যের হাত উঠে যায়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ইবনু আবী আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে পর্যন্ত বিচারক কোন প্রকার যুলুম না করে সে পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলা তার সহায়তা করেন। সে যে মুহুর্তে কোন প্রকার যুলুম করে ফেলে তখন তিনি তাকে পরিত্যাগ করেন এবং শাইতান তাকে জড়িয়ে ধরে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩৩০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৪১, সুনান ইবনু মা-জাহ ২৩১২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আবূ শাম্মাখ আল আযদী (রহঃ) তার এক চাচাতো ভাই হতে বর্ণনা করেন। যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী ছিলেন। একদিন তিনি মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তিকে মানুষের কোনো কাজের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। অতঃপর সে মুসলিম, মাযলূম অথবা দুস্থ লোকেদের জন্য তার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখেন, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রয়োজন বন্ধ করে দেবেন যখন সে চরম অভাবে নিপতিত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৯, ৩৭২৮, শু‘আবুল ঈমান ৬৯৯৯, আহমাদ ৩/৪৪১, সহীহ আবূ দাউদ ২৬১৪, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩৩২, ১৩৩৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

আবূ বকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জুলুম এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মত মারাত্মক আর কোন গুনাহ নাই, যার শাস্তি আল্লাহ ত্বরিতে দুনিয়াতে দেন এবং আখেরাতের জন্যও জমা রাখেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪২১১, সুনান আততিরমিযী ২৫১১, সুনান আবূ দাউদ ৪৯০২, সহীহাহ ৯১৭, আত-তালীকুর রাগীব ৩/২২৮, সুনান ইব্নু মাজাহ্ ৪২৮৬; ইব্নু হিববান ৪৫৫, ৪৫৬ বায্যার, হাদীস ৩৬৯৩; আহমাদ ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪, ১৯৮৬১, ১৯৮৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যালিমরা কখনো সফল হয় না। এপ্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না”। (সুরা: আনআম, আয়াত: ৫৭)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংরা তাদের শাসন ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে অনেক প্লান করেছিলো। কিন্তু তাদের সেই প্লান আর সফল হয়নি।

পরকালীন শাস্তি

আল্লাহ্ তা‘আলা যালিমদের জন্য জাহান্নামে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। যা তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

“আমি যালিমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানি। যা তাদের মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দিবে। এটা কতই না নিকৃষ্ট পানীয় এবং সে জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়”। (সুরা কাহ্ফ : ২৯)।

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন: “অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল!’’ (সুরা শু‘আরা’: ২২৭)।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

“কাজেই মানুষকে সতর্ক কর সেদিনের ব্যাপারে যেদিন তাদের উপর ‘আযাব আসবে। যারা জুলুম করেছিল তারা তখন বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে অল্পদিনের জন্য সময় দাও, আমরা তোমার আহবানে সাড়া দিব আর রাসূলদের কথা মেনে চলব।’ (তখন তাদেরকে বলা হবে) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলনি যে, তোমাদের কক্ষনো পতন ঘটবে না? অথচ তোমরা সেই লোকগুলোর বাসভূমিতে বসবাস করছিলে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল আর তোমাদেরকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল আমি তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলাম। আর আমি বহু উদাহরণ টেনে তোমাদেরকে বুঝিয়েও দিয়েছিলাম। তারা যে চক্রান্ত করেছিল তা ছিল সত্যিই ভয়ানক, কিন্তু তাদের চক্রান্ত আল্লাহ্র দৃষ্টির ভিতরেই ছিল, যদিও তাদের চক্রান্তগুলো এমন ছিল যে, তাতে পর্বতও টলে যেত। (অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক না কেন) তুমি কক্ষনো মনে কর না যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে দেয়া ওয়া‘দা খেলাপ করবেন, আল্লাহ মহা প্রতাপশালী, প্রবল প্রতিশোধ গ্রহণকার “। (সুরা ইবরাহীমঃ ৪২-৪৭)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

মা’ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তিকে যদি আল্লাহ তা’আলা প্রজাপালনের দায়িত্ব প্রদান করেন। আর সে তাদের জন্য কল্যাণকর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় বা না পারে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৮৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৫০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪২, দারিমী ২৮৩৮, সহীহাহ্ ২৬৩১, সহীহ আল জামি ৫৭৪০,আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

হাসান বাসরী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মা’কিল ইবনু ইয়াসারের কাছে তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসলাম। এ সময় উবাইদুল্লাহ্ প্রবেশ করল। তখন মালিক (রাঃ) বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করে শোনাব, যা আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল এবং তার মৃত্যু হল এ হালতে যে, সে ছিল খিয়ানাতকারী, তাহলে আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৫১, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত ৩৬৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯-২৬১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪২, আহমাদ ২০১৩১, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,

ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জুলুম বা অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণ হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন ২৪৪৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৮, সুনান আততিরমিযী ২০৩০, সহীহ আত্ তারগীব ২২১৬, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩৭৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৮৫৮ মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ৩৫২৪৪, আহমাদ ৫৮৩২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫১৭৮, শু‘আবুল ঈমান ১০৮৩২, দারিমী ২৫১৬, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৬৪৫৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কিয়ামতে আওয়ামীরা আমলের দিক থেকে নিঃস্ব হবে

আওয়ামী ও আওয়ামী প্রশাসনসহ আওয়ামী সমর্থক সকলেই অন্যায় অত্যাচারী বা জুলুমবাজ, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎকারী ইত্যাদি পাপের সাথে জড়িত। এইসব অন্যায়কারী আওয়ামীরা যদি মৃত্যুর আগে অন্যের সম্পদ ফিরিয়ে না দেয় বা মাফ চেয়ে না নেয় এমনকি সামান্য কথা দ্বারাও যদি কেউ আঘাত প্রাপ্ত হয়ে থাকে আর যদি মাফ চেয়ে না নেয় তাহলে কিয়ামতে তার সওয়াব থেকে তা পরিশোধ করা হবে। মজলুম ব্যক্তিকে বলা হবে তুমি আজ যা মন চায় অত্যাচারী লোকের নিকট থেকে সওয়াব নিতে থাকো, একসময় অত্যাচারী ব্যক্তি সওয়াব বা আমলের  দিক থেকে নিঃস্ব হবে এবং পরিশেষে মজলুম ব্যক্তির গুণাহ ঐ অত্যাচারী ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। যার ফলে মজলুম ব্যক্তি পরিপূর্ণ সওয়াব নিয়ে জান্নাতে যাবে আর অত্যাচারী ব্যক্তি নিঃস্ব হয়ে জাহান্নামে যাবে। আসুন রাসুল সা. এবিষয়ে কী বলেছেন তা আমরা জেনে নেই।

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জানো, (প্রকৃত) গরীব কে? সহাবায়ে কিরাম বললেনঃ আমরা তো মনে করি, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা, ধনদৌলত নেই, সে-ই গরীব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি গরীব হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করে আসবে; কিন্তু সাথে সাথে সেসব লোকেদেরকেও নিয়ে আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো অপবাদ রটিয়েছে, কারো সম্পদ খেয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে; এমন ব্যক্তিদেরকে তার নেকীগুলো দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে অথচ পাওনাদারদের পাওনা তখনো বাকি, তখন পাওনাদারদের গুনাহ তথা পাপ তার ওপর ঢেলে দেয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিসকাতুল মাশাবিহ মিসকাত ৫১২৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সুনান আততিরমিযী ২৪১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৮৪৫, সহীহুল জামি‘ ৮৭, সহীহ আত্ তারগীব ২২২৩, শু‘আবুল ঈমান ৩৩, আহমাদ ৮০২৯, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪১১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫৬১, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৭৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৩)। হাদিসের মান সহিহ।

(খ) আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন হকদারদের হক আদায় করা হবে, এমনকি যে বকরীর শিং নেই, তার জন্য শিংওয়ালা বকরী থেকে বিনিময় আদায় করে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮২, সুনান আততিরমিযী ২৪২০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৫৮৮, সহীহুল জামি‘ ৫০৬২, সহীহ আত্ তারগীব ৩৬০৩, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ১৩৬, আহমাদ ৭২০৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬৩, আস্ সুনানুল কুবরা ১১৮৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ)...আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মু’মিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের উপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ও অন্যায় ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকে পৃথিবীতে তার আবাসস্থল যেরূপ চিনত, তার চাইতে অধিক তার জান্নাতের আবাসস্থল চিনতে পারবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪০, ৬৫৩৫, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২২৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঘ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তির কোন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অত্যাচারঘটিত; যেমন- মানহানি বা অন্য কোন বিষয়ের কোন হক থাকে, তবে সে যেন সেদিনের পূর্বেই তার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নেয়, যেদিন তার কাছে কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে, তাহলে অত্যাচারিতের হক অনুসারে তার কাছ থেকে নেক ’আমল নিয়ে নেয়া হবে। আর যদি তার নেক না থাকে, তবে অত্যাচারিত ব্যক্তির পাপকে তার ওপর চাপানো হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৯, ৬৫৩৪, সহীহুল জামি ৬৫১১, সহীহ আত্ তারগীব ২২২২, আহমাদ ১০৫৭৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬১, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৭০, আর মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৩৫, আল মু‘জামুস্ সগীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৪৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৭৮০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমলনামা তিন প্রকার- ১. ঐ ’আমলনামা, যাকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন না। আর তা হলো, আল্লাহ তা’আলার সাথে শরীক করা। আল্লাহ মহীয়ান-গরীয়ান বলেন-  অর্থাৎ- “অংশীবাদীদেরকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন না’’, ২. ঐ ‘আমলনামা, যাতে মানুষের পারস্পরিক জুলুম-অত্যাচার লিপিবদ্ধ আছে। সে আমলনামাকে আল্লাহ তা’আলা এমনিতেই ছাড়বেন না। এমনকি একজনের কাছ থেকে অপরজনের প্রতিশোধ নেবেন এবং ৩. ঐ ’আমলনামা, যার প্রতি আল্লাহ তা’আলা ভ্রূক্ষেপ করবেন না। এ আমলনামা হলো বান্দা ও আল্লাহ তা’আলার মধ্যকার জুলুম সংক্রান্ত বিষয়। এটা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। যদি তিনি ইচ্ছে করেন, তাকে শাস্তি দেবেন। আর যদি ইচ্ছে করেন, তাকে ক্ষমা করে দেবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৩, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৭৩, য‘ঈফুল জামি ৩০২২)।

বিশ্বাসঘাতক মুসলিম শাসকদের পরিনতি

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করলে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করে গরিবদের মাঝে সমবন্টন করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে তথা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা চালূ করবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পর সেই মুসলিম শাসকগণ ইসলামি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে তারা মানবরচিত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। এজন্যে কিয়ামতে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য একটি করে পতাকা খাড়া করে রাখা হবে, যাতে তাদেরকে চেনা যায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকদের জন্য একটি করে পতাকা উত্তোলিত (খাড়া) করা হবে, আর বলা হবে- এটা অমুকের পুত্র, অমুকের বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৭৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৫, সুনান আবূ দাঊদ ২৭৫৬, সুনান আততিরমিযী ১৫৮১, আহমাদ ৪৬৪৮, সহীহ আল জামি‘ ১৬৮৩, সহীহ আত্ তারগীব ৩০০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তিনি আরো বলেছেন,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকদের জন্য একটি করে পতাকা দেখা যাবে, যার মাধ্যমে তার পরিচয় পাওয়া যাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪২৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৭, আহমাদ ১২৪৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি আরো বলেছেন,

আবূ সা’ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকদের নিতম্বের সাথে তার জন্য (অপরাধ অনুপাতে) একটা করে পতাকা রাখা হবে।

অপর বর্ণনাতে আছে, কিয়ামত দিবসে প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুপাতে পতাকা উত্তোলিত হবে। সাবধান! রাষ্ট্র প্রধানের বিশ্বাসঘাতকতাই হবে সর্ববৃহৎ (অপরাধ)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭২৭,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৪২৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৮, সুনান আততিরমিযী ২১৯১, আহমাদ ১১৩০৩, সহীহাহ্ ১৬৯০, সহীহ আল জামি ৫১৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ)....আবূ সাঈদ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক ধোকাবাজের জন্য কিয়ামত দিবসে একটি পতাকা থাকবে আর তা তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী উচু করা হবে। সাবধান জনগণের শাসক হয়ে যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তার চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক আর নেই। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৩৮৮, ইসলামিক সেন্টার ৪৩৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অত্যাচারী আওয়ামীলীগের সমর্থক/কর্মী/ভোটার তথা সহযোগীদের করুন পরিনতি

আওয়ামীলীগ একটি অত্যাচারী রাজনৈতিক দল হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই অত্যাচারের মূল নায়ক। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে তথা আওয়ামীলীগকে অত্যাচারী হতে সহযোগীতা করেছে আরো ১৩টি রাজনৈতিক দল। যথাঃ- (১) জাতীয় পার্টি, (২) জাতিয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ), প্রধান- হাসানুল হক ইনু, (৩) ওয়ার্কাস পার্টি, প্রধান- রাসেদ খান মেনন, (৪) বাংলাদেশ সাম্যবাদি দল(এম,এল) প্রধান- দীলিপ বড়ুয়া, (৫) বাংলাদেশ গনতন্রী পার্টি, প্রধান- নুরুর রহমান সেলিম, (৬) গন আজাদী লীগ, প্রধান- হাজি আবদুস সামাদ, (৭) বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল(বিএসডি), প্রধান-রেজাউল রশিদ খানের, (৮) গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র, প্রধান- জাকির হোসেনের, (৯) কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি), (১০) নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, প্রধান-ড.কামাল হোসেনের, (১১) বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ, (১২) শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, (১৩) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ প্রধান- মোজাফফর আহমেদর।

বিগত  ১৫/০৯/২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টার সাক্ষ্যে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার নানা প্রেক্ষাপট ও বিবরণ তুলে ধরেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীকে ডিমরালাইজ করা, বিচারবিভাগকে দলীয়করণ, স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা, শাপলা হত্যাকাণ্ড, তিনটি ভুয়া জাতীয় নির্বাচন, আয়নাঘর সৃষ্টি ও ঘুম খুনের কালচার চালু, জঙ্গি নাটক সৃষ্টি এবং তার নিজের ওপর নির্যাতনের কাহিনী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেন মাহমুদুর রহমান। তিনি তার সাক্ষ্যে বিচার বিভাগ, আইনজীবী, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সেনাবাহিনী, ১৫ বছরের ডিজিএফআই প্রধানসহ অনেকের নাম উল্লেখ করে তাদের ফ্যাসিবাদী হাসিনার সহযোগী বলে মন্তব্য করেন।

মাহমুদুর রহমান তার সাক্ষ্যে বলেন, শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পিছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ তার সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দীক মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি যুগিয়েছে।

তিনি বলেন, আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, সাবেক এটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চীফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য।

মাহমুদুর রহমান বলেন, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছে।

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনারবৃন্দ এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যবৃন্দ বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধবংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারি, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার এবং তাদের সংগীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, শমশের মবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিসবাহউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দীকি, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন।

মাহমুদুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পিছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী এবং ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪- এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে ৩ সেনা প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না। ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। এদের মধ্যে লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মোঃ আকবর হোসেন, লে. জেনারেল সাইফুল আমিন,লে. জেনারেল তাববেজ শামস এবং লে. জেনারেল হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট। র্যাএবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিলো।

উপরোল্লিখিত ব্যক্তি ও দল ছাড়াও আওয়ামীলীগকে ফ্যাসিস্ট হয়ে গড়ে উঠতে সহযোগীতা করেছে, করছে এবং করবে আওয়ামীলীগের সমর্থক, কর্মী ও ভোটারগণ।

এইসব সমর্থক, কর্মী, ভোটার ও অন্যান্য জড়িত ব্যক্তিবর্গকে আওয়ামীলীগের সহযোগি হিসেবে কঠিন আযাবে ভুগতে হবে। ইহকালীন শাস্তি ছাড়াও তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে কিয়ামতে এক ভয়ানক শাস্তি। দুনিয়ায় নেমে আসবে তাদের উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গযব। তাদের গযবের কারণে দেশের সকলেই শাস্তি ভোগ করবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“এবং তোমরা ঐ জালিমদের প্রতি একটুও ঝুঁকবে না, অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে”। (সুরা হুদ: ১১৩)।

রাসূলু সাঃ বলেছেনঃ

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কারো যুলুমমূলক মামলায় সহযোগিতা করে অথবা যুলুমে সহায়তা করে, তা থেকে নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত সর্বদাই সে আল্লাহর গযবে নিপতিত থাকে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৯৭, ইরওয়া ৭/৩৫০, সহীহাহ ৪৩৮, ১০২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

অত্যাচারী আওয়ামীলীগের সহযোগি মুসলিমরা ইসলাম থেকে খারিজ

রাসূলু সাঃ বলেছেনঃ

(ক) আওস ইবনু শুরাহবীল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অত্যাচারীর সাথে এ উদ্দেশে চলে যে, সে তার শক্তি বৃদ্ধি করবে; আর সে এটা জানে যে, সে জুলুমকারী, তবে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৫, বায়হাক্বী’র শু‘আবুল ঈমান ৭৬৭৫, আত্ তারগীব ১৩৬২, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৬১৮)।

রাসূলু সাঃ আরো বলেছেনঃ

(খ) কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ নির্বোধ লোকেদের নেতৃত্ব থেকে আমি তোমাকে আল্লাহ তা’আলার হিফাযাতে অর্পিত করলাম। তিনি (কা’ব ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! এটা কিরূপে হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ শীঘ্রই আমার পরে বিভিন্ন যুগে তাদের (নির্বোধ ও যালিমরূপে আমীর ও শাসক) আবির্ভূত হবে আর যে ব্যক্তি তাদের সান্নিধ্যে থাকবে এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিবে এবং তাদের অন্যায় ও জুলুমের সহযোগিতা করবে, সে আমার দলভুক্ত নয় এবং তাদের সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আমার হাওযে কাওসারে* আসতে পারবে না। আর যে তাদের নিকট যাবে না এবং তাদের মিথ্যাকে সত্যায়িত করবে না এবং তাদের অন্যায়ের কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। তারাই হবে আমার দলভুক্ত। আর আমিও তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি। আর তারা হাওযে কাওসারে আমার নিকট আগমন করবে।

* হাওযে কাওসার দ্বারা উদ্দেশ্য জান্নাত। অর্থাৎ - জান্নাতে তাদেরকে আমার নিকট আসতে দেয়া হবে না অথবা তারা হাওযে কাওসারে আমার নিকট আসার অনুমতি পাবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭০০, সুনান আন নাসায়ী ৪২০৭, সুনান আততিরমিযী ৬১৪, ২২৫৯, আহমাদ ১৮১২৬, সহীহ আত্ তারগীব ২২৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আওয়ামী আলেমদের করুন পরিনতি

বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ আওয়ামী আলেম আছে। এদের অনেকে কুরআনের হাফেজ, মুহাদ্দিস, অনেকে পির আউলিয়া গাউস কুতুব, অনেকে মসজিদের ঈমাম। এরাও কুরআন হাদিসে অনেক দক্ষ কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে এইসব আলেম কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মুসলমানদেরকে ভুল বুঝানো হতো। ভিন্ন মতাবলম্বী আলেমদের ধরে এনে ক্রসফায়ারে হত্যা করে এরা বলতো ঐসব আলেম জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে জড়িত তাদেরকে হত্যা করা জায়েজ। আওয়ামী আলেমদের বিষয়ে ফয়সালা হচ্ছে, এরা যেহেতু ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী তাই এদেরকে জাহান্নামের আগুন পাকড়াও করবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“এবং তোমরা ঐ জালিমদের প্রতি একটুও ঝুঁকবে না, অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে”। (সুরা হুদ: ১১৩)।

অপব্যাখ্যাকারীদের উদ্দেশ্যে রাসুল সা. বলেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদেরকে খুৎবা দিতে গিয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলেন। অতঃপর বললেন, একশ্রেণীর লোকের এই স্বভাব কেন যে, তারা এরূপ শর্তারোপ করে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই? আর আল্লাহর কিতাবে নেই, এমন সকল প্রকার শর্তই বাতিল বলে সাব্যস্ত হবে। এভাবে যদি একশ’ শর্তও করে, তবুও আল্লাহ তা’আলার শারী’আতই (বিধানই) অগ্রগণ্য এবং আল্লাহ তা’আলার দেয়া শর্তই সর্বাধিক সুদৃঢ়। তাই উত্তরাধিকার-স্বত্ব একমাত্র মুক্তকারীর বলে গণ্য হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮৭৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২১৬৮, ৩৬৬৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫০৪, সুনান আননাসায়ী ৩৪৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৬৩৪, ইসলামিক সেন্টার ৩৬৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

কুরআন অবমাননাকারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে চরম দুর্ভোগ ও ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। বর্ণিত হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী মহাপাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের আবৃত্তি শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে (নিজ মতবাদে) অটল থাকে। যেন সে তা শোনেইনি। সুতরাং ওকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।’ (সুরা: জাসিয়া, আয়াত : ৭-৮)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা মায়েদা ৩৩)।

রাসুল সাঃ বলেন,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মি’রাজের রাতে আমি বহু লোককে দেখেছি যে, তাদের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল (আ.) বললেনঃ এরা আপনার উম্মাতের মধ্যে বক্তাগণ, যারা লোকেদেরকে ভালো কাজের আদেশ করত; কিন্তু নিজেদেরকে ভুলে যেত। অর্থাৎ- নিজেরা সৎকাজ করত না। (শারহুস্ সুন্নাহ্ ও বায়হাক্বী’র ’’শু’আবুল ঈমান’’)

ইমাম বায়হাক্বী (রহিমাহুল্লাহ)-এর অপর এক বর্ণনায় আছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে এমন সব খত্বীব বা বক্তা হবে, যারা এমন সব কথা বলবে, যা তারা নিজেরা কার্যকর করবে না। তারা আল্লাহ তা’আলার কুরআন পাঠ করবে; কিন্তু সে মতো ’আমল করত না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪৯, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৪১৫৯, সহীহ আত্ তারগীব ২৩২৭, শু‘আবুল ঈমান ৪৯৬৫, আহমাদ ১৩৪২১, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৪০৬৯, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামীলীগ পতনের মূল কারণ

আওয়ামীলীগ পতনের অনেক কারণ থাকলেও ইসলামের দৃষ্টিতে মূল কারণ হলো ৪টি। যথাঃ

(ক) নির্যাতন অব্যাহত থাকা ও দিনের পর দিন নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করা,

(খ) অপহরণ, গুম ও নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা,

(গ) সরকারি-বেসরকারিসহ অন্যায়ভাবে অন্যের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করা,

(ঘ) মাজলুমের বদদোয়া অব্যাহত থাকা,

মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। তাই মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তিনি ব্যক্তির দু’আ রদ হয় নাঃ ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোযাদার যতক্ষণ না ইফতার করে এবং মজলুমের দু’আ। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার দু’আ মেঘমালার উপরে তুলে নিবেন এবং তার জন্য আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং আল্লাহ্ বলবেনঃ আমার মর্যাদার শপথ! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো, একটু বিলম্বেই হোক না কেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭৫২, সুনান আততিরমিযী ৩৫৯৮, যঈফাহ ১৪৫৮, রোযাদার ও মাযলুমের দুয়ার কথা সহীহ এবং ন্যায়পরায়ণ ইমাম এর স্থলে মুসাফিরের কথা সহীহ। সহীহাহ ৫৯৬, ১৭৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ/যঈফ [মিশ্রিত]।

(খ)  ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠান এবং তাকে বলেন, মাযলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৮, ১৩৯৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৬৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ)  ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানের (শাসক নিয়োগ করে) পাঠানোর সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেনঃ তুমি আহলে কিতাবের কাছে যাচ্ছ। কাজেই তাদের কাছে যখন পৌঁছবে তখন তাদেরকে এ কথার দিকে দাওয়াত দিবে তারা যেন সাক্ষ্য দিয়ে বলে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যদি তারা তোমার এ কথা মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। যদি তারা এ কথাও মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর সাদাকা (যাকাত) ফরজ করেছেন- যা তাদের ধনীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হবে। তোমার এ কথা যদি তারা মেনে নেয়, তবে (কেবল) তাদের উত্তম মাল গ্রহণ হতে বিরত থাকবে এবং মযলুমের বদদু‘আকে ভয় করবে। কেননা, তার (বদদু‘আ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৯৬, ১৩৯৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৪০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৪০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(ঘ)  আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তুমি অত্যাচারিতের বদদুআ থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কেননা সে আল্লাহ তা’আলার কাছে নিজের অধিকার প্রার্থনা করে। আল্লাহ তা’আলা কোন হকদারকে নিজের পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৪, শু‘আবুল ঈমান ৭৪৬৪, আর জামিউস্ সগীর ১১২৩, য‘ঈফুল জামি‘ ১১০, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/২০২)।

৩৬ জুলাই এর উৎপত্তি

(আল্লাহ তায়ালার এক  বিশেষ নিয়ামত)

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বলুন, 'হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত করো। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশালী”। (সুরা আলে ইমরান ২৬)।

বাংলাদেশকে আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দল শাসন করেছে। কিন্তু কারো শাসনামলই ভালো ছিলো না। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা নিজেদের সুবিধা মোতাবেক রাষ্ট্র শাসন করেছে। কেউ প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেনি। এইসব রাজনৈতিক দল ইসলাম নিয়েও কাজ করেনি। তিনটি দলই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী।

২০০১ সালে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে এবং পাঁচ বছর রাষ্ট্র শাসন করে। এই পাঁচ বছরে বিএনপি বর্তমান আওয়ামীলীগের মতোই  অন্যায় অত্যাচার ও মানুষ হত্যাসহ বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে এই দলটিকে, দলের সমর্থক ও নেতা-কর্মীদের শাস্তি দিতে আল্লাহ তায়ালা স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা দান করেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“এরূপে আমি যালেমদের কৃতকর্মের ফলে তাদের এক দলকে অন্য দলের উপর প্রবল করে থাকি”। (সুরা আল আনআম ১২৯)।

রাসুল সা. বলেন,

“যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না (তথা ইসলামি আইন মোতাবেক বিচারিক কার্যক্রম ও রাষ্ট্র শাসন করে না) এবং আল্লাহর নাযীলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না (তথা কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নেয় না), তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন”।  (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৪০১৯, সহীহাহ ১০৬। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস।

আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপিসহ দেশের সাধারণ জনগণকে এমন শাস্তি দেয়া শুরু করলো যা কল্পনার বাহিরে। অপহরণ, গুম, খুন, নির্যাতন, হামলা মামলা করে পুরো দেশটাকে কোণঠাসা করে রাখলো। বিশেষ করে এই দেশের আলেমদেরকে প্রতি পদে পদে অত্যাচার করা হতো। মন খুলে কেউ কাঁদতে পর্যন্ত পারতো না। কেউ একটু জোড়ে “লা ইলা হা ইল্লাল্লাহ” বললেই জঙ্গি ট্যাগ  লাগিয়ে তাকে ধরে নিয়ে তার চোখ উপরে ফেলা হতো, দেহের অঙ্গগুলো বিচ্ছিন্ন করে শাস্তি দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো।

এখন দেখা গেলো বিএনপির নিজেস্ব অপরাধের কারণে সাধারণ জনগণও শাস্তি পেতে লাগলো।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,

“তোমরা এমন ফিতনাকে ভয় করো, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম (অত্যাচারী-অপরাধী) কেবল তাদিগকেই ক্লিষ্ট করবে না এবং জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর”।’(সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ২৫)।

এদিকে আওয়ামীলীগের অন্যায় অত্যাচার, অপহরণ, গুম, খুন, ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্ম দিন দিন বাড়তে থাকলে দেশের জনগণ গোপনে-নিভৃতে দুই হাত তুলে কাঁদতো আর আল্লাহকে বলতো, হে আল্লাহ! তুমি এই যালিমকে হেদায়েত দান করো আর হেদায়েত যদি নসিবে না থাকে তাহলে তাকে তুমি ধবংস করো। আল্লাহ তায়ালা মাজলুমদের দোয়া কবুল করে নিলেন। এরপর শুরু হলো আওয়ামীলীগের উপর আল্লাহ তায়ালার এ্যাকশন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলীয় নেতা কর্মীরা এমন সব পাপকার্যের সাথে জড়িত যার শাস্তি দুনিয়াতেই ভোগ করতে হবে। যেমন,

জুলুম করা, কোনো মুসলমানের ইজ্জত নষ্ট করা, লোক দেখানো আমল করা, আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করা, যিনা/ব্যভিচার করা,  অহংকার করা, সুদ-ঘুষের সাথে জড়িত হওয়া, মদপান ও জুয়াখেলা করা, চুরি ডাকাতি ছিনতাই করা, মিথ্যা কসম ও ধোঁকা দেয়া,  জাকাত না দেওয়া,  হিংসা করা।

আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে আওয়ামীলীগকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারতেন কিন্তু তা না করে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে বেঁচে রেখেছেন যাতে তার কৃত কর্মফলের অনুশোচনা করে ইসলামের পথে ফিরে আসে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে”। (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ৪১)।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:

“আল্লাহ যদি মানুষকে তার অন্যায় কাজের কারণে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতেন তাহলে কোনো প্রাণীকেই তিনি এ পৃথিবীতে জীবিত ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তবে তাদের শাস্তির নির্ধারিত মেয়াদ যখন এসে পড়ে তখন তারা এক মুহূর্ত পেছনেও থাকতে পারে না এবং সামনেও এগোতে পারে না”। (সূরা নাহল : আয়াত ৬১)।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: “আর প্রত্যেক জাতির জন্য একটি সময় নির্ধারিত আছে। অতএব, তাদের নির্ধারিত সময় যখন এসে যায়, তখন তারা তা থেকে এক মুহূর্ত পিছিয়েও থাকতে পারে না বা এগোতেও পারে না”। (সূরা আরাফ : আয়াত ৩৪)।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘তুমি কখনো মনে করো না যে, যালিমরা যা করে যাচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা সে ব্যাপারে গাফিল। বরং তিনি তাদেরকে সুযোগ দিচ্ছেন কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। যে দিন সবার চক্ষু হবে স্থির বিস্ফারিত। সে দিন তারা ভীত-বিহবল হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছুটোছুটি করবে। তাদের চক্ষু এতটুকুর জন্যও নিজের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে একেবারেই আশা শূন্য’’। (সুরা ইব্রাহীম : ৪২-৪৩)।

আল্লাহ তায়ালা আওয়ামীলীগকে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত নিজেদেরকে শোধরানোর জন্য সময় দিয়েছিলেন কিন্তু তারা নিজেদেরকে শোধরায়নি। এরপর আল্লাহ তায়ালা এদের উপর রাগান্বিত হোন ও ৩৬ জুলাই এর উৎপত্তির অসিলা তৈরী করে দেন।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারিতে সরকার গঠন করার পর তার শাসনকাল দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি সেক্টরে আওয়ামী দলীয় নেতা কর্মীদের চাকরি দিয়ে পুরো রাষ্ট্রকে আওয়ামীকরণ করেন। প্রশাসনে বাছাই করে ছাত্রলীগদের চাকরি দেয়া হয়। এভাবে পুরো দেশকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার হাতের মুঠোয় নেন। এতেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার মনে স্বস্তি আসেনি। তিনি ভবিষ্যতে বিদ্রোহীদের দমন করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ সমরে রাখেতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়া শুরু করেন এবং সেই সাথে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধারা বেশ ভূমিকা পালন করেন। তখন থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা  আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর এক গভীর আস্থা তৈরী হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি, যাতায়াত সুবিধা ও  চিকিৎসা সুবিধাসহ সব রকমের সুযোগ সুবিধা তৈরী করে দেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা  ভাবলেন এই মুক্তিযোদ্ধাগণ এখন বয়স্ক। তারা আর কতোদিন বাঁচবেন তাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের নাতি নাতনীদের চাকরিতে ৩০% কোটা তৈরী করে দিলেন যাতে ভবিষ্যতে এরা রাষ্ট্র কাঠামো থেকে আওয়ামীলীগের পক্ষে লড়তে পারেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার এই ৩০% কোটাই তার পতনের মূল অসিলা হয়ে দাঁড়ায়। এর আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পতনের জন্য বিএনপি, জামায়াতসহ অনেক দল হরতাল, অবরোধসহ শত শত মিটিং মিছিল করেছে কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনার একটা চুলও নাড়াতে পারেনি।

এই কোটা থেকেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের আন্দোলন শুরু হয় ও ৩৬ জুলাই এর উৎপত্তি ঘটে। আসুন আমরা কোটা সংস্কার নিয়ে কিছু আলোচানা করি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের কোটা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে তা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস ভূমিকার কারণে কয়েকশ নিরস্ত্র নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন হাজারো ছাত্র-জনতা। এক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের।

এক নজরে ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনাবলী

মার্চ ২০১৮

কোটাভিত্তিক পদ কমানো, শূন্য পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণের দাবিতে রাস্তায় নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য, ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ পিছিয়ে থাকা জেলার মানুষদের জন্য, পাঁচ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য এবং এক শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা ছিল।

শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের বিক্ষোভ উপেক্ষা করে ২১ মার্চ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটাব্যবস্থা বহালই থাকবে বলে ঘোষণা দেন।

এপ্রিল ২০১৮

প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সারাদেশে কয়েক হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে, মিছিল বের করে এবং মহাসড়ক অবরোধ করতে শুরু করে।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে অন্তত ৭৫ জন আহত হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর শাহবাগ মোড় ও এর আশেপাশের এলাকা।

১১ এপ্রিল শেখ হাসিনা কোটাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিলের ঘোষণা দেন।

জুন-জুলাই ২০১৮

ওই বছরের ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর সহিংস হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে।

৩ অক্টোবর ২০১৮

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (যেসব পদ আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি বলে পরিচিত ছিল) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে আরও বলা হয়, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বিবেচনা করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।

৫ জুন ২০২৪

কোটা সংস্কারের দাবিতে এবার আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, হাইকোর্ট সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয় এবং শহীদ মিনারে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে।

২-৬ জুলাই ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'র ব্যানারে সংগঠিত হয় এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনঃবহালের দাবিতে টিএসসি এলাকায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

পরের কয়েকদিন দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস ও এর আশপাশে মিছিল-সমাবেশ করে।

গত ৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৫ জুন হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন ৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচির ডাক দেয়।

৭ জুলাই ২০২৪

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচির কারণে ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যায়। এদিন ছয়টির বেশি ব্যস্ত সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এ বিক্ষোভকে 'অযৌক্তিক' উল্লেখ করে বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

৮ জুলাই ২০২৪

অবরোধ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে। এতে করে ঢাকাবাসী ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে ঢাকায় যাতায়াতে মারাত্মক অসুবিধা হয়। বিক্ষোভকারীরা একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে সব অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার এক দফা দাবি জানান।

১০ জুলাই ২০২৪

সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

এই রায় সত্ত্বেও সরকার একটি ডেডিকেটেড কমিশন এবং পরবর্তী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

১১ জুলাই ২০২৪

এদিন হাইকোর্ট জানান, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কারে সংসদে আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সতর্কবার্তা দেয়, মন্ত্রীরা আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানালেও তা উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচি পালন করে। কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়।

১২ জুলাই ২০২৪

ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে এবং কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা। এদিন সাবেক আইনমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আন্দোলন চলতে থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

১৩ জুলাই ২০২৪

১৩ জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, 'মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।'

১৪ জুলাই ২০২৪

সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনকারীরা। সেদিন সন্ধ্যায় একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বিতর্কিত মন্তব্য করেন, মন্তব্যে তিনি আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার'র সঙ্গে তুলনা করেন। এই মন্তব্যের পর রাতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন 'তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার'।

১৫ জুলাই ২০২৪

আওয়ামী লীগের নেতারা শিক্ষার্থীদের স্লোগানে 'রাজাকার' শব্দ ব্যবহারের নিন্দা জানান। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা 'আমি রাজাকার' স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে আহত বিক্ষোভকারীদের ওপরও হামলা চালায়। সেদিন উভয়পক্ষের তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়।

১৬ জুলাই ২০২৪

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলা হয়েছে। সরকার ছয়টি জেলায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করে।

সেদিন শিক্ষার্থীরা ঢাবি ও রাবির অধিকাংশ হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করে।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে।

১৭ জুলাই ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিন নিহতদের 'গায়েবানা জানাজা' চলাকালে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা পরদিন থেকে সারাদেশে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি ঘোষণা করে; হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেয়।

এদিন আন্দোলনকারীরা স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে যোগদানের আহ্বান জানায় এবং সাধারণ নাগরিকদেরও সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানায়।

এদিন শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বিক্ষোভকারীদের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানান এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন। অনুপ্রবেশকারীরা যাতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য তিনি শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

১৮ জুলাই ২০২৪

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগের লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ১৯টি জেলায় সংঘর্ষের ফলে সহিংসতায় কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করা হয়।

বিকেল থেকে সারাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা বিটিভি ভবন, সেতু ভবন ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোল প্লাজায় সন্ধ্যায় আগুনের ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের দমনে শক্তি প্রয়োগ করে।

রাত ৯টার দিকে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও ক্যারিয়ারগুলোকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ সরকারি কর্মকর্তারা মহাখালীর একটি ডেটা সেন্টারে আগুন লাগার ফলে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন।

১৯ জুলাই ২০২৪

এদিন দিনব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন কয়েকশ মানুষ। জুমার নামাজের পর সারাদেশে, বিশেষ করে ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষ তীব্র হয়। নরসিংদীর কারাগার, মেট্রোরেল স্টেশন, বিআরটিএ অফিসসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে, কয়েকজন মন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগ করতে হবে, হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দিতে হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে হবে।

এদিন মধ্যরাত থেকে সরকার দেশব্যাপী কারফিউ ঘোষণা করে এবং সেনা মোতায়েন করে।

২০ জুলাই ২০২৪

কারফিউয়ের প্রথম দিনে অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বাড়ানো হয় এবং দুই দিনের সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।

এদিন তিনজন সমন্বয়ক আট দফা দাবি নিয়ে তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন, যা পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবি থেকে মূল পয়েন্টে ভিন্ন।

গভীর রাতে সবুজবাগের একটি বাসা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে সাদা পোশাকে কয়েকজন জোর করে তুলে নিয়ে যায়।

২১ জুলাই ২০২৪

পূর্বাচলের একটি ওভারব্রিজের নিচে জ্ঞান ফেরে নাহিদ ইসলামের। তিনি অভিযোগ করেন, তাকে চোখ বেঁধে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছিল। বাম উরু ও কাঁধে গুরুতর জখম, সারা শরীরে মারধরের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

এদিন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

এদিন কারফিউর মধ্যে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ, ইইউ, যুক্তরাজ্য সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় তিন বাহিনীর প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন।

২২ জুলাই ২০২৪

টানা তিন দিন পুলিশি অভিযানে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এক হাজার ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রায় ২০ হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন থানায় প্রায় ৫০টি মামলা দায়ের করা হয়। ষড়যন্ত্র ও সহিংসতার সন্দেহে বিএনপি ও জামায়াত জোটের কয়েকশ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২৩ জুলাই ২০২৪

সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা বিক্ষোভে নিহত ও আহতের বিচার দাবি করে।

এদিন কারফিউর মধ্যেও বিরোধী নেতা ও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গ্রেপ্তার অভিযান চলমান ছিল। কিছু কিছু এলাকায় এদিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সচল হয়। তবে বন্ধ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

২৪ জুলাই ২০২৪

কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদকে পাঁচ দিন পর পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা জানান, অজ্ঞাত কয়েকজন তাদের চোখ বেঁধে তুলে নিয়েছিল এবং বিক্ষোভ শেষ করার ঘোষণা দেওয়ার জন্য নির্যাতন করেছিল।

২৫ জুলাই ২০২৪

সেনা মোতায়েনের পর শেখ হাসিনা প্রথম জনসমক্ষে আসেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন। তিনি অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর প্রতিরোধ করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। আহত-নিহতদের খোঁজ না নিয়ে মেট্রোরেল পরিদর্শন করায় আন্দোলনকারী ও সাধারণ জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এদিন জাতীয় পার্টির নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ এবং ব্যবসায়ী ডেভিড হাসনাতসহ কয়েক ডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তখনো বন্ধ ছিল। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আন্দোলনকারীদের ওপর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানায়।

২৬ জুলাই ২০২৪

পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়কে তুলে নেয়। এদিন জাতীয় ঐক্য ও সরকার পতনের আহ্বান জানায় বিএনপি। শেখ হাসিনা এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। আবু সাঈদ হত্যার বিষয়ে পুলিশের এফআইআরে মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুলিশের গুলি নয়, বরং বিক্ষোভকারীদের ইটপাটকেলের কথা উল্লেখ করা হয়।

২৭ জুলাই ২০২৪

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরতে এলাকায় এলাকায় 'ব্লক রেইড' পরিচালনা শুরু হয়। ডিবি আরও দুই সমন্বয়ককে তুলে নেয় এবং সমন্বয়কদের 'নিরাপত্তা হেফাজতে' নেওয়া হয়েছে বলে জানায়।

এদিন ১৪টি বিদেশি মিশন সরকারের প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। ১৭ বছর বয়সী হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে ভাঙচুরের মামলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এদিন শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান। দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে এমন সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২৮ জুলাই ২০২৪

দেশব্যাপী পুলিশের অভিযান চলমান ছিল। শুধু ঢাকাতেই ২০০টিরও বেশি মামলায় দুই লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট সচল হলেও বন্ধ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন প্রধান হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে ছয় সমন্বয়কের এক টেবিলে বসে খাওয়ার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই একটি ভিডিও ও লিখিত বিবৃতিতে আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দেন ছয় সমন্বয়ক।

তবে বাইরে থাকা অন্য সংগঠকরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। হেফাজতে থাকা ছয়জনকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এদিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনে ১৪৭ জনের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

২৯ জুলাই ২০২৪

ছয় সমন্বয়কারীকে আটক ও হয়রানির প্রতিবাদে আবারও রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের মুখে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এদিন সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়।

এদিন অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতেও আদালতের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। শুনানিতে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে 'মশকরা' বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।

৩০ জুলাই ২০২৪

এদিন কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেশব্যাপী শোক পালনের আহ্বান জানায় সরকার। এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা। লাখো মানুষ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযগমাধ্যমে তাদের প্রোফাইলে লাল রঙের ছবি আপলোড করে।

একই দিন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাবেশ করেন, অভিভাবকরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা জনসমক্ষে হতাহতের জন্য সরকারের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ বিক্ষোভে যোগ দিতে শুরু করেন।

৩১ জুলাই ২০২৪

বিক্ষোভকারীরা 'জাস্টিসের জন্য মার্চ' কর্মসূচি ঘোষণা করে। পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিসোটা ব্যবহার করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। ঢাকা হাইকোর্ট চত্বরে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আইনজীবীদের একটি দল বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে অবস্থান কর্মসূচি করে। সব শিক্ষার্থীদের পুলিশ হেফাজত ও কারাগার থেকে মুক্ত না করলে এইচএসসি পরীক্ষা বর্জন করা হবে বলে ঘোষণা দেন কয়েকশ পরীক্ষার্থী।

১ আগস্ট ২০২৪

সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। জাতিসংঘ একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়, এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন ডিবির হেফাজত থেকে ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা নিহতদের জন্য দোয়া-প্রার্থনা ও মিছিল কর্মসূচি করে।

২ আগস্ট ২০২৪

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে আরও দুজন নিহত হন। বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও পুলিশি দমন-পীড়নের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। সহিংসতায় নিহতদের বিচার চেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত লাখো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের সদস্য ও রাজনৈতিক কর্মীরা 'দ্রোহ যাত্রা'তে যোগ দেয়।

সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য ও বেশ কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে কবিতা আবৃত্তি ও গান করেন।

বিক্ষোভকারীরা ৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। ফেসবুক আবারও সাত ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছয় সমন্বয়ক জানান, ডিবি অফিসে তাদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা এদিন বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, গণভবনে তার দরজা আলোচনার জন্য খোলা রয়েছে।

৩ আগস্ট ২০২৪

ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষ সমবেত হয়। দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা করে পুলিশ।

এদিন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

৪ আগস্ট ২০২৪

সারাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। এদিন মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে 'শক্ত হাতে নাশকতাকারীদের প্রতিহত করার' আহ্বান জানান।

সরকারের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনার রূপরেখা দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিক্ষোভকারীরা সারাদেশে নাগরিকদের 'মার্চ টু ঢাকা' করার আহ্বান জানান। শুরুতে ৬ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা একদিন আগে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

৫ আগস্ট ২০২৪

এদিন হাজারো মানুষ কারফিউ ভেঙে ঢাকার একাধিক মোড়ে জড়ো হয়ে রাজধানীতে প্রবেশের চেষ্টা করে। দুপুর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রধানমন্ত্রী আরও বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তাকে জানানো হয় যে, এই ধরনের ব্যবস্থা অকার্যকর হবে।

সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছিল। পরে সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা করে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পর পদত্যাগ করতে রাজি হন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। তিনি হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে যান। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন উদযাপন করতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভাঙচুর চলে।

আল্লাহ তায়ালা এভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটান। ৩৬ জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিম্নরুপঃ

(ক) শহিদদের তালিকা: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় বা ওএইচসিএইচআর'র  তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত জুলাই-অগাস্টে  ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু।

(খ) বেওয়ারিশ দাফন: রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ ১১৪ জনকে গণকবর দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বাইরে সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আরো বেশ কয়েকজন শহিদকে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম দাফন করেছে।

(গ) আহতদের সংখ্যা: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সারা দেশে অন্তত ১৪ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মতে, আহত ১৩ হাজার ৮১১ জন। তবে 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫'-এ বলা হয়েছে, আহত হয়েছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আহত ১৩ হাজার ৮১১ জন। তাদের তথ্য পর্যালোচনা করে ১ হাজার ৪৬৬ জনকে পাওয়া গেছে, যারা স্থায়ীভাবে অক্ষম। এর মধ্যে অতি গুরুতর আহত ১৩৪ জন, গুরুতর আহত ৮০০ জন। ৪৯৩ জন এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন আর দুই চোখ হারিয়েছেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে ২১ জনের। এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে সাতজনের। এছাড়া মোটামুটি আহত তিন হাজার এবং সামান্য আহত সাত হাজার জন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যারা পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন তাদের অতি গুরুতর (এ শ্রেণি) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তারা সারা জীবন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারবেন না। সরকার তাদের ভাতা দেবে। গুরুতর আহত ব্যক্তিরা (বি শ্রেণি) নিজে কাজ করে চলতে পারবেন। তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সরকার। তাদের কেউ কাজের উপযুক্ত হয়ে না উঠলে তাকেও ভাতা দেওয়া হবে। বাকি আহতদেরও প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সরকার।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত ৭৫ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১১ জন, থাইল্যান্ডে ৫৬ জন, তুরস্কে সাতজন ও রাশিয়ায় একজনকে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন ২৯ জন। এখনও থাইল্যান্ডে ৩৯ ও তুরস্কে সাতজন চিকিৎসার জন্য আছেন। এ পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৯১০ টাকা। আর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা দেশে চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাদের খরচ সরকার বহন করেছে।

নিক্যাপিংয়ে চিরপঙ্গু শত শত তরুণ

(একটি অঞ্চলের তথ্য তুলে দলা হলো)

বিগত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুয়ায়ী জানা যায়, শেখ হাসিনার দুঃশাসনে গুম, খুন ও ক্রসফায়ার ছিল নিয়মিত ঘটনা। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চলের মানুষ। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্ধশত মানুষকে হত্যা করা হয়।

৬০ হাজার নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয় ৯৭৮ হয়রানিমূলক মামলায়। এছাড়াও নির্যাতনের বহু কায়দা ছিল বিরোধীদের দমনে। এর মধ্যে একটি ছিল টার্গেট নিক্যাপিং বা হাঁটুতে আঘাতের মাধ্যমে পঙ্গু করে দেওয়া। এর মাধ্যমে চিরপঙ্গু করে দেওয়া হয় ওই অঞ্চলের কয়েকশ তরুণকে, যাদের মধ্যে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৮৫ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে।

বিরোধী মত দমনে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ ও র্যা ব এসব ভয়াবহ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে ভয়াবহ এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও এ-সম্পর্কিত অনেকগুলো অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে যারা এসব গর্হিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তারা এখনো রয়ে গেছেন অধরা।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব মিশনের মূল হোতা ছিলেন সাতক্ষীরার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সদ্যসাবেক সচিব ও সাতক্ষীরার সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাজমুল আহসান এবং সাতক্ষীরা সরকারি হাসপাতালের তৎকালীন সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম। এর মধ্যে ডা. জাহাঙ্গীর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটকের পর ভুক্তভোগীদের পরিকল্পিতভাবে নিক্যাপিং করতে পুলিশকে সহায়তা করতেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব সরকারি কর্মকর্তা এখনো অধরাই রয়ে গেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার সাবেক এসপি মঞ্জুরুলকে জুলাই বিপ্লবের পর গ্রেপ্তার বা শাস্তি না দিয়ে শুধু বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, তাও একটি প্রমোশন দিয়ে। অবসরে পাঠানোর আগে তিনি অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক হিসেবে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার নোয়াখালীতে কর্মরত ছিলেন। ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর তাকে অবসরে পাঠানো হয়। সাবেক ডিসি নাজমুল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে গত ১৭ আগস্ট অবসরে যান। তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

(ঘ)  জুলাই যোদ্ধা ১৪০১ জন: জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত ১ হাজার ৪০১ জনকে 'জুলাই যোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।

(ঙ)  শহিদ ১০ নারী: শহিদ ১০ জন নারীর মধ্যে সাত জন ঢাকায়, দুই জন নারায়ণগঞ্জে ও এক জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সাত জনই গুলিবিদ্ধ হন নিজ বাসার বারান্দা ও ছাদে। তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সড়কে।

(চ) ঢাকায় পাঁচ এলাকায় ৩২৪ জন শহিদ: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩২৪ জন।

(ছ) শহিদদের মধ্যে শ্রমজীবী বেশি: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন শ্রমজীবী মানুষরা। কমপক্ষে ২৮৪ জন শ্রমজীবী মানুষ গণঅভ্যুত্থানে শহিদ হয়েছেন। দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক, ট্রাকের চালক-সহকারী, দোকানের কর্মী, রেস্তোরাঁর কর্মচারী ও পোশাককারখানার শ্রমিকরা গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন। শ্রমজীবীদের পর সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২৬৯ জন শিক্ষার্থী শহিদ হয়েছেন। আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। মোট মৃত্যুর ৩৩ শতাংশই শিক্ষার্থী।

(জ) ছয় সাংবাদিক শহিদ: পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ছয় সাংবাদিক। আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক। নিহতরা হলেন-ঢাকা টাইমসের স্টাফ রিপোর্টার হাসান মেহেদী, দৈনিক ভোরের আওয়াজের প্রতিবেদক শাকিল হোসাইন, নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি আবু তাহের মুহাম্মদ তুরাব, ফ্রিল্যান্সার ফটোসাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়, সিরাজগঞ্জে দৈনিক খবরপত্রের প্রতিবেদক প্রদীপ কুমার ভৌমিক ও হবিগঞ্জে বানিয়াচং থানার সামনে নিহত হন স্থানীয় সাংবাদিক হোসেন আখুঞ্জি।

(ঝ) স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণঃ রকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মাঝে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে ৩৬ জেলার আহত ৪,৫৫১ জন জুলাই যোদ্ধাকে এ কার্ড দেওয়া হচ্ছে। বাকি জেলার আহতরাও পর্যায়ক্রমে এ কার্ড পাবেন।

উল্লেখ্য যে, ৩৬ জুলাই এ ছাত্র জনতার আন্দোলনকে দমন করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার অনুগত বাহিনীকে অত্যাধুনিক মারনাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। এমনকি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি করারও নির্দেশ দেয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশ পেয়ে তার অনুগত বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করে।

আন্দোলনকারীদের ওপর ‘ছত্রীসেনা’ দিয়ে বোম্বিং করার নির্দেশ দেন হাসিনা

বিগত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ“ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, জুলাই আন্দোলনকারীদের অবস্থান ড্রোনের মাধ্যমে নির্ণয় করে, ছত্রীসেনা ব্যবহার করে হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং ও গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার ৪টি ফোনকলের রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয়। এসব ফোনকলগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র ফজলে নুর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামাল এবং জাসদের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে করা কথপোকথনের ছিলো।

জবানবন্দিতে তানভীর জোহা বলেন, তিনি মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে বিটিআরসি, এনটিএমসি, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর হতে বিভিন্ন অডিও ক্লিপ,ভিডিও ফুটেজ, সিডিআর, আইপিটিআর, সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ বিধি মোতাবেক মামলার বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। এতে শেখ হাসিনার ৬৯টি কথোপকথনের রেকর্ডও রয়েছে। যাতে আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে আন্দোলন দমনে তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কথা জানাচ্ছিলেন।

এসব ফোনালাপে স্পষ্ট করেই মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়ার কথা বলতে শোনা যায়। আন্দোলনকারীদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই যেন গুলি করা হয় এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের শাস্তি দিতে ৩৬ জুলাই এর উত্থান ঘটিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট হাসিনার স্বৈরাচারীতার সমাপ্তি ঘটালেন। এ যেনো আল্লাহ তায়ালার বিশেষ এক নিয়ামত। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে গণভবন দখল নিতে কোথা থেকে লাখ লাখ লোক আসতে লাগলো অথচ সে সময়ও হাসিনা গং প্রশাসন গুলি করে মানুষ হত্যায় মত্তহারা। সেইসব গুলি উপক্ষো করে লোকজন চলে আসে গণভবনে। শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচাতে ফ্যাসিস্ট ও ভারতের সেবাদাসী শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহেনাকে নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে ভারতে পালাতে বাধ্য হয়। এতো কিছুর পরেও, ভারতে পালানোর আগে সালমানকে রেহানার ফোন-‘মার্শাল ল জারি করছে না কেন’ বলে কৈফিয়ত তলব করে। প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫,“ আমার দেশ”।

সাজানো একটা সংসার, লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী রেখে তড়িঘড়ি করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া এটা তার দুনিয়ার শাস্তি কিন্তু পরকালে তার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ শাস্তি।

আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ ‘‘কাজেই মানুষকে সতর্ক কর সেদিনের ব্যাপারে যেদিন তাদের উপর ‘আযাব আসবে। যারা জুলুম করেছিল তারা তখন বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে অল্পদিনের জন্য সময় দাও, আমরা তোমার আহবানে সাড়া দিব আর রাসূলদের কথা মেনে চলব।’ (তখন তাদেরকে বলা হবে) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলনি যে, তোমাদের কক্ষনো পতন ঘটবে না? অথচ তোমরা সেই লোকগুলোর বাসভূমিতে বসবাস করছিলে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল আর তোমাদেরকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল আমি তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলাম। আর আমি বহু উদাহরণ টেনে তোমাদেরকে বুঝিয়েও দিয়েছিলাম। তারা যে চক্রান্ত করেছিল তা ছিল সত্যিই ভয়ানক, কিন্তু তাদের চক্রান্ত আল্লাহ্‌র দৃষ্টির ভিতরেই ছিল, যদিও তাদের চক্রান্তগুলো এমন ছিল যে, তাতে পর্বতও টলে যেত। (অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক না কেন) তুমি কক্ষনো মনে কর না যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে দেয়া ওয়া‘দা খেলাপ করবেন, আল্লাহ মহা প্রতাপশালী, প্রবল প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’’ (সুরা ইবরাহীমঃ ৪২-৪৭)।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের দুনিয়ার শাস্তির বাস্তবতা

(ক)  ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসনের অবসান।

(খ)  নিজের জীবন বাঁচাতে ভারতে পলায়ন।

(গ)  অন্যান্য নেতারাও বিদেশে পলাতক।

(ঘ)  আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ রাজনীতির নিষিদ্ধতা।

(ঙ)  দেশে আটকা পড়া নেতা কর্মীদের একের পর এক আটক।

(চ)  অপহরণ, গুম, খুন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত একের পর এক মামলা দায়ের।

(ছ)  আটক নেতা কর্মীদেরকে রিমান্ডে নেয়া।

(জ)  নিজেদের গড়া ট্রাইবুনালেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের বিচার শুরু।

(ঞ) অনেক কালো আইন বাতিল।

(ট)  পলাতক আসামীদের ধরতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেয়া।

(ঠ)  ভারতে বসে পার্টি পরিচালনা করা এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

(ড)  একটা সাজানো সংসার ভেঙ্গে তছনছ হওয়া।

এরপর এদের বিচার হবে, অনেকের ফাঁসি হবে, অনেকের জেল জরিমানাও হবে। স্বৈরশাসক ইহকালেও শান্তি পায় না, পরকালেও পাবে না ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বিগত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “ভারতে আওয়ামী আস্তানা উদঘাটন” শিরোনামে জানা যায়, জুলাইয়ের ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের আস্তানা উদ্ঘাটিত হয়েছে। তারা কলকাতায় মূল আস্তানা গেড়েছেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (আইবি) বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কলকাতায় অবস্থান নেওয়া এমন ৭৩৪ পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিস্টের একটি ডেটাবেস তৈরি করেছে। এই ডেটাবেসে তাদের নাম-ঠিকানা, পাসপোর্ট ও টেলিফোন নম্বরও উল্লেখ রয়েছে।

বিগত ০৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত “ডিজিএফআইয়ের সাবেক ৫ ডিজির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা” শিরোনামে জানা যায়, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বিরোধী দল ও মতের লোকদের গুম করে র্যা বের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল ও জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান করে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বুধবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ অভিযোগ আমলে নেন। একইসঙ্গে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী রয়েছেন।এছাড়া ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালক হলেন—লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল হামিদুল হক।

বিগত ১২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে “আমার দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত  “ওয়ারেন্টভুক্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে কারা পালিয়েছেন, কারা হেফাজতে আছেন” শিরোনামে জানা যায়,

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গুম, খুন ও গণহত্যার তিনটি মামলায় এখন পর্যন্ত ২৫ জন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করা হয়েছে। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে লেফটেনেন্ট জেনারেল ও মেজর জেনারেল পদমর্যাদার ৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।

এর মধ্যে দুইজন সার্ভিং মেজর জেনারেল রয়েছেন। যার মধ্যে একজন মেজর জেনারেল শেখ মো. সারওয়ার হোসেন সেনা হেফাজতে রয়েছেন। অপর জন শেখ হাসিনার সাবেক মিলিটারি সেক্রেটারি মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ পালিয়ে গেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল ও মেজর জেনারেলের বাকি সবাই পালিয়ে গেছেন।

পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক ৫ মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস, মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদীন এবং মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। আরেকজন সাবেক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম এখনও পলাতক। তিনি ডিজিএফআই-এর সাবেক পরিচালক। এর মধ্যে লে. জেনারেল (অব.) আকবর ভারতে পালিয়ে আছেন বলে ইতোমধ্যে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। পলাতক বাকি জেনারেলদের অবস্থান জানা যায়নি।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ২ মামলায় গত ৮ অক্টোবর ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়া ৩০ আসামির মধ্যে এক মামলায় ১৭ জন এবং আরেক মামলায় ১৩ জন আসামি।

দুই মামলায় শেখ হাসিনা ও তারিক সিদ্দিক কমন আসামি হওয়ায় মোট আসামির সংখ্যা ২৮ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ২৩ জন।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালে একই দিনে জুলাই গণহত্যায় রামপুরায় ২৮ জনকে হত্যার দায়ে অভিযোগ দায়ের ও ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়া অপর মামলায় ৪ জন আসামি। এর মধ্যে দু’জন সেনা কর্মকর্তা। এরা হলেন, লে. কর্নেল রিদওয়ান ও লে. কর্নেল মুন। তারা দু'জন বিজিবির কর্মকর্তা এবং এ মামলার অপর দুই আসামী পুলিশের সদস্য।

শনিবার সেনাসদরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অ্যাডজুটেন্ট) মো. হাকিমুজ্জামান জানান, ওয়ারেন্টভুক্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত। ১৫ জন চাকরিরত এবং একজন এলপিআর-এ আছেন। কর্মরত ও এলপিআর-এ থাকাদের মধ্যে মাত্র একজন সিটিআইবি ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ পালিয়ে গেছেন। বাকি ১৫ জন তাদের হেফাজতে আছেন।

ব্রিফিংয়ে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে ট্রাইব্যুনালের ওয়ারেন্ট কপির সাথে বিশ্লেষণ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, সে অনুসারে বর্তমানে সেনা হেফাজতে থাকা কর্মরত সেনা কর্মকর্তারা হলেন:

১. সিটিআইবি ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন,

২. সিটিআইবি ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী,

৩. সিটিআইবি ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী,

৪. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম,

৫. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার,

৬. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল কে এম আজাদ,

৭. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান,

৮. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম,

৯. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান,

১০. র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন,

১১. র‌্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম,

১২. র‌্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল,

১৩. র‌্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, এবং বিজিবির দুই কর্মকর্তা-

১৪. লে. কর্নেল রিদওয়ান ও

১৫. লে. কর্নেল মুন।

এগুলো হচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ তার দোসরদের দুনিয়ার শাস্তির কিছু নমূনা। আমরা অপেক্ষা করবো সামনের দিনে আদালত কী রায় দেয়, কয়জনের ফাঁসি দেয় আর কয়জনের যাবজ্জীবন দেয় নাকি সমঝোতার মাধ্যমে সবাই বেখসুর খালাস পেয়ে যায়।

বর্তমানে আওয়ামীলীগ ও অন্যান্য অনৈসলামিক দলের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য

আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন শারী’আত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখে, সেটাকে যেন নিজ হাতে পরিবর্তন করে দেয়। যদি নিজ হাতে সেগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখে নিষেধ করবে। আর যদি মুখে নিষেধ করারও সাধ্য না থাকে, তাহলে অন্তরে সেটা ঘৃণা করবে। এটা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৮১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯, সুনান আবূ দাঊদ ১১৪০, সুনান আততিরমিযী ২১৭২, সুনান ইবনু মাজাহ ৪০১৩, সুনান আননাসায়ী ৫০০৮, সহীহ আত্ তারগীব ২৩০২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৫৬৪৯, আহমাদ ১১১৫০, মুসনাদ আবূ ইয়া‘লা ১২০৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩০৭, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ১১৭৩৯, হিলইয়াতুল আওলিয়া ১০/২৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬৪২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদিসে ইসলাম বিরোধী বা অত্যাচারী শাসকদেরকে বাঁধা দেয়ার তিনটি উপায় বলা হয়েছে। যথাঃ

(ক) হাত দ্বারা প্রতিহত করাঃ

কোনো জুলুমবাজ বা অত্যাচারী ব্যক্তি বা শাসকদেরকে দমন করতে চাইলে আর নিজের বা নিজেদের শক্তি সামর্থ থাকলে হাত বা লাঠি দ্বারা দমন করতে হবে। তবে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় আইনের কারণে আইন নিজ হাতে তুলে নেয়া যাবে না। এতে একধরণের মব তৈরী হবে এবং রাষ্ট্রে বা সমাজে বিশৃংখলা দেখা দিবে। শাসক যদি খুবই শক্তিশালি হয় এবং দিনের পর দিন যদি অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকে সেক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিহত করতে হবে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেই ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ছাত্র-জনতা তাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

(খ) কথার দ্বারাঃ

যদি অত্যাচারীকে হাত দ্বারা বাঁধা দেয়ার শক্তি সামর্থ না থাকে তাহলে কথা বা বাক্য দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। এখানে কথা বা বাক্য বলতে,  সামনাসামনি বা সরাসরি কথা দ্বারা প্রতিহত করা, লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করা, যেমন-পত্রিকায় লেখালেখি করা, ইমেলের মাধ্যমে, চিঠি দিয়ে, টিভিতে টকশোর মাধ্যমে, ফেইসবুক, ইউটিউব, ব্লগ, ওয়েবসাইটসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করে প্রতিবাদ করতে হবে।

 (গ) ঘৃণা করাঃ

কোনো অত্যাচারীকে প্রতিহত করতে বা দমন করতে সামনাসামনি যুদ্ধ করা বা কথার দ্বারা যদি শক্তি না থাকে তাহলে মনে মনে ঘৃণা করতে হবে। তবুও অত্যাচারীর ভয়ে অত্যাচারীর সহযোগি হওয়া যাবে না।

বর্তমান সময়ে কোনো অত্যাচারী রাজনৈতিক দল বা এমনটি যদি মনে যে, এই দলকে ভোট দিলে বা সমর্তন করলে আর তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসলে আওয়ামীলীগের মতো অত্যাচারী হয়ে উঠবে এবং সরাসরি প্রতিহত করার যদি শক্তি না থাকে তাহলে দেশের জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে গোপনে ভোট দিয়ে ক্ষমতাচ্যূত করা বা ক্ষমতা হ্রাস করা।

যেহেতু অত্যাচারী আওয়ামীলীগ দেশ থেকে পালিয়েছে আর তারা যাতে কোনোদিন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্যে তাদেরকে ভোচ দেয়া যাবে না। এছাড়া আওয়ামীলীগ ছাড়াও বাংলাদেশে অন্যান্য রাজনৈতিক যতো দল আছে এবং যারা ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করে না বা করবে না তাদেরকে ভোট দেয়া যাবে না। এপ্রসঙ্গে রাসুল সাঃ বলেন,

উম্মু সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শীঘ্রই তোমাদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক ব্যক্তি শাসক হবে যাদের কতগুলো কাজ তোমরা পছন্দ করবে এবং কতগুলো কাজ অপছন্দ করবে। যে লোক (তাদের) অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, সে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে, আর যে লোক তাকে ঘৃণা করবে সেও দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যে লোক তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং তার অনুসরণ করবে সে অন্যায়ের অংশীদার বলে গণ্য হবে। প্রশ্ন করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না? তিনি বললেন, না, তারা যে পর্যন্ত নামায আদায় করে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২২৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

শক্তি দ্বারা ও ভোট প্রদানে বিরত থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে তার উপর গজব নাজিল হয়

(ক) কায়েস ইবনে আবূ হাযেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ বকর (রাঃ) দাঁড়ালেন, আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলেন, অতঃপর বলেন, হে লোকসকল! তোমরা তো এই আয়াত তিলাওয়াত করো (অনুবাদঃ) ’’হে ঈমানদারগণ! আত্মসংশোধন করাই তোমাদের কর্তব্য, তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’’ (সূরা মাইদাঃ ১০৫)। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ লোকেরা মন্দ কাজ হতে দেখে তা পরিবর্তনের চেষ্টা না করলে অচিরেই আল্লাহ তাদের উপর ব্যাপকভাবে শাস্তি পাঠান। আবূ উসামা (রাঃ) -এর অপর সনদে এভাবে উক্ত হয়েছেঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪০০৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২১৬৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৩৮, তাখরীজুল মুখতার ৫৪-৫৮, সহীহাহ ১৫৬৪, সহীহুল জামি ১৯৭৪, আহমাদ ৩০, আবূ ইয়া‘লা ১৩১, অন্য রিওয়ায়তে আবূ দাঊদ ৪৩৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) জারীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে পাপাচার হতে থাকে এবং তাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতা থাকা সত্বেও তাদের পাপাচারীদের বাধা দেয় না, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর ব্যাপকভাবে শাস্তি পাঠান। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪০০৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪৩, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৩৩৯, আহমাদ ১৮৭৩১, ১৮৭৬৮, আত-তালীকুর রাগীব ৩/১৭০, সহীহ আত্ তারগীব ২৩১৬, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২০৬৮৬)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ) নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের বিষয়ে অলসতা করাকে ঐ সম্প্রদায়ের সাথে তুলনা করা যায়, যারা নৌকায় স্থান পাওয়ার জন্য লটারি করেছে এবং লটারি অনুসারে তাদের কেউ নৌকার নিচে এবং কেউ উপরে বসেছে। নৌকার নিচের লোকেরা উপরের লোকেদের পাশ দিয়ে পানির জন্য গমনাগমন করত, ফলে উপরের লোকেদের কষ্ট হত। একদিন নিচের লোকেদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি কুঠার হাতে নিয়ে নৌকার তলায় কাঠ কোপাতে আরম্ভ করল। তখন উপরের লোকেরা তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, সর্বনাশ! তুমি কি করছ? লোকটি বলল, তোমরা আমাদের কারণে কষ্ট পাচ্ছ। আর আমাদেরও পানি একান্ত প্রয়োজন। এমতাবস্থায় যদি তারা তার হস্তদ্বয় ধরে ফেলে, তাহলে তাকেও রক্ষা করবে, নিজেরাও রক্ষা পাবে। আর যদি তাকে তার কাজের উপরই ছেড়ে দেয়, তাহলে তাকেও ধ্বংস করবে, নিজেদেরকেও ধ্বংস করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৩৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ২৬৮৬, সুনান আততিরমিযী ২১৭৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৬৯, সহীহ আত্ তারগীব ২৩০৯, আহমাদ ১৮৩৭০, আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২১৯৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ মহীয়ান-গরীয়ান জিবরীল (আ.)-কে আদেশ করেন যে, অমুক শহর বা জনপদটিকে সেটার বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দাও। তখন জিবরীল (আ.)বললেনঃ হে প্রভু! ঐ জনপদে তোমার অমুক বান্দা রয়েছে, যে এক মুহূর্ত তোমার নাফরমানি করেনি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন, তার ও তাদের সকলের ওপর শহরটিকে উল্টিয়ে দাও। কারণ ঐ ব্যক্তির মুখমণ্ডলে পাপীদের পাপাচার দেখে আমার সন্তুষ্টির জন্য এক মুহূর্তের জন্যও পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ- সে পাপীদের পাপ এক মুহূর্তের জন্যও খারাপ মনে করেনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৫২, শু‘আবুল ঈমান ৭৫৯৫)।

(ঙ) আদী ইবনু ’আদী আল কিন্দী (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মুক্ত গোলাম আমাদের নিকট বর্ণনা করেন যে, আমার দাদাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা’আলা কোন জাতিকে তাদের বিশেষ কোন লোকের পাপের কারণে শাস্তি প্রদান করবেন না, যতক্ষণ না ঐ জাতির অধিকাংশ লোক ঐ পাপের কথা জানতে পারবে যে, তাদের মধ্যে খারাপ কাজ করা হচ্ছে এবং তারা সেটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিরোধ না করে। যখন তারা এরূপ করে, তখন আল্লাহ তা’আলা ঐ জাতির সকলকে ব্যাপকভাবে শাস্তি প্রদান করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪৭, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৪১৫৫)।

(চ) আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বনী ইসরাঈল গোত্র যেখন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে গেল, তখন তাদের ’আলিমগণ প্রথমত তাদেরকে সেটা থেকে নিষেধ করলেন। যখন তারা বিরত হলো না, তখন তারাও তাদের মাজলিসে বসতে লাগল এবং তাদের সাথে একত্রে খাদ্য খেতে ও মদ পান করতে লাগল। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাদের কারো কারো অন্তর কারো কারো অন্তর দ্বারা কলুষিত করে দিলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা দাঊদ (আ.) ও ’ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.)-এর যবানিতে তাদের ওপর অভিসম্পাত করলেন। এ অভিসম্পাত তাদের পাপের কারণে ও সীমালঙ্ঘন করার কারণে হয়েছে।

রাবী বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালিশে হেলান দিয়ে শুয়েছিলেন। এ কথা বলে তিনি উঠে বসলেন এবং বললেনঃ ঐ পবিত্র সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা অত্যাচারী ও পাপীদের পাপকার্য থেকে নিষেধ করবে। (তিরমিযী ও আবূ দাঊদ)।

অন্য বর্ণনায় আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কসম! তোমরা তাদেরকে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। অত্যাচারীদের হস্তদ্বয় ধরে ফেলবে, তাদেরকে সৎকাজের প্রতি অনুপ্রাণিত করবে এবং সৎকাজের উপর স্থিতিশীল রাখবে। নতুবা আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কারো কারো অন্তরকে কারো কারো অন্তরের সাথে মিলিয়ে দেবেন। তারপর বনী ইসরাঈলকে যেভাবে অভিসম্পাত করেছিলেন, সেভাবে তোমাদেরকেও অভিসম্পাত করবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪৮, সুনান আবূ দাঊদ ৪৩৩৭, সুনান আততিরমিযী ৩০৪৭, সুনান ইবনু মাজাহ ৪০০৬)।

(ছ) অত্যাচারীর সহযোগীদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন নাঃ

হুযায়ফাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঐ পবিত্র সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, নিম্নোক্ত দু’টো বিষয়ের মধ্যে একটি অবশ্যই হবে। হয় অবশ্যই তুমি সৎকাজের আদেশ দান করবে এবং মন্দকাজ হতে নিষেধ করবে; নতুবা অনতিবিলম্বে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর ’আযাব নাযিল করবেন। অতঃপর তোমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে; কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করা হবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৪০, সুনান আততিরমিযী ২১৬৯, সহীহুল জামি‘ ৭০৭০, সহীহ আত্ তারগীব ২৩১৩, আহমাদ ২৩৩০১, আবূ ইয়া‘লা ৫০৩৫, শু‘আবুল ঈমান ৭৫৫৮ হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/২৭৯, আল মুজামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৯৭, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ১৩৭৯, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২০৬৯৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে

উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শেষ যামানায় আমার উম্মাতের ওপর তাদের শাসকদের পক্ষ থেকে কঠিন বিপদ আপতিত হবে। ঐ বিপদ থেকে শুধু সেসব লোকই রেহাই পাবে, যারা আল্লাহ তা’আলার দীন সম্পর্কে জ্ঞাত থাকবে। সে তার নিজের মুখ, হাত ও অন্তর দ্বারা সত্যকে প্রকাশ করার জন্য জিহাদ করবে। এ ব্যক্তির সৌভাগ্য তার জন্য অগ্রগামী হয়েছে। অন্য আরেক ব্যক্তি হবে, যে আল্লাহ তা’আলার দীন সম্পর্কে জানবে, এতে বিশ্বাস স্থাপন করবে। অন্য এক ব্যক্তি হবে, যে আল্লাহর দীন সম্পর্কে জানবে; কিন্তু চুপচাপ থাকবে। যখন কাউকে কোন নেক কাজ করতে দেখবে, তখন তাকে ভালোবাসবে। আর যখন কাউকে অসৎকাজ করতে দেখবে, তখন তাকে ঘৃণা করবে। এ ব্যক্তিও অন্তরে ভালোবাসা ও বিদ্বেষভাব লুকায়িত রাখার কারণে পরিত্রাণ পাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৫১, শু‘আবুল ঈমান)।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতে তাঁর বান্দাকে জিজ্ঞেস করবেন

আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ মহীয়ান-গরীয়ান কিয়ামতের দিন বান্দাকে জিজ্ঞেস করবেন এবং বলবেন, যখন শারী’আত বিরোধী কাজ সংঘটিত হতে দেখছিলে, তখন তোমার কি হয়েছিল যে, তুমি এতে নিষেধ করতে পারনি? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঐ বান্দাকে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে প্রমাণ শিখিয়ে দেয়া হবে। যখন আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করার মর্যি করবেন, তখন সে বলবে, হে আল্লাহ! আমি মানুষের জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে ভীত ছিলাম এবং তোমারই ক্ষমার আশা পোষণ করেছিলাম। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৫৩, শু‘আবুল ঈমান ৭৫৭৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬৮, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ১০৮৯, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৯২৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম বা খিলাফত প্রতিষ্ঠায় মুসলিম ভোটারদের করণীয়

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। এরূপ লোকই সফলতা লাভকারী”। (সুরা আলে ইমরান ১০৪)।

তিনি আরো বলেন, “তোমরাই উত্তম জাতি। বিশ্ব মানবের জন্য তোমাদের উত্থান। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে”। (সুরা আলে ইমরান ১১০)।

ভোটারদের দেখতে হবে কোন্ দলটি আল্লাহর পথে আছে, কোন্ দলটি সৎ কাজের আদেশ দেয়, কোন্ দলটি মন্দ কাজে বাঁধা দেয়, আরো দেখতে হবে সেই দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে ইসলামি শাসনব্যবস্থা বা খিলাফত কায়েম করবে কিনা সেই দলকে সমর্থন করা বা সেই দলকে ভোট দেয়া ভোটারদের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ইসলামি দল ব্যতিত অন্য কোনো দলকে ভোট দিলে বা সমর্থন করলে বা সেই দলের মিটিং মিছিলে যোগদান করলে আপনি যতো বড় অলি আউলিয়া বা হুজুর হোন কেনো আপনার কোনো আমল কিয়ামতে আল্লাহর নিকট গৃগিত হবে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন (পথ, মত, মানুষের তৈরী আইন বা অনৈসলামিক দলকে সমর্থন করবে) অবলম্বন করতে চাইবে, তার থেকে সে দ্বীন বা আমল কবুল করা হবে না। আখেরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“হে নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না  কোন কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত  ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতি দানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে”। (সুরা কাহাফঃ ১০৩-১০৫)।

আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন,

“আর কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করাব, আর তা কতই না মন্দ আবাস!” (সুরা আন নিসা ৪:১১৫)।

অতএব, যে বলবে তিনি মুসলমান তাকে অবশ্যই আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর তৈরী আইনের মধ্য দিয়েই জীবন যাপন করতে হবে। আপনি কিন্তু সেই শর্ত মেনে নিয়েই মুসলমান হয়েছেন বা নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিচ্ছেন। মুসলমান হিসেবে আপনাকে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো আইন, মতবাদ বা পথ গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত করতে আপনাকে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এর সাথে সম্পৃক্ত রাখা চলবে না। আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরে রাখতে চাইলে জামায়াত বদ্ধ হয়ে ইসলামের রাজনীতি অবশ্যই করতে হবে। কোনো ক্রমেই অনৈসলামিক দলকে বা রাজনীতিকে ভোট দেয়া বা সমর্থন করা কিংবা মিটিং মিছিলে যোগ দেয়া যাবে না। কারণ অনৈসলামিক দলের নেতাগণ ভোটে নির্বাচিত হয়ে মানুষের তৈরী আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আর ইসলামি দলের নেতাগণ বিজয়ী হলে আল্লাহর আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এখন আপনি মুসলমান হিসেবে কাকে ভোট দিয়ে কার পক্ষে থাকতে চান? এখানে বিবেকের উপর নির্ভর করে জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ধারণ করার দায়িত্ব আপনার। যদিও জান্নাত ও জাহান্নাম আল্লাহ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত, এখন শুধু সত্যায়নটা করে দেখাবেন আপনার স্থানটা কোথায়?

রাসুল সাঃ এর সময়ে দাওয়াতী কাজের বাঁধাকে প্রতিহত করতে রাসুল সাঃ সাহাবাদের সাথে নিয়ে আল্লাহর হুকুমে সশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জিহাদে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন ঠিক বর্তমান যুগে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে একটি ইসলামি দলকে ভোট প্রদানের মাধ্যমে সরকার গঠনে সহযোগিতা করা এক প্রকার জিহাদ। তাই হয় নিজে একটি ইসলামি দল গঠন করে সেই লক্ষ্যে কাজ করবেন অথবা অন্য একটি ইসলামি দলে যোগদান করে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাবেন।

মুসলিম হিসেবে আপনাকে অবশ্যই কুরআনকে পূংখানুপূংখরুপে মানতে হবে। আপনি এমন একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন বা সমর্থন করেন যে দলটি ইসলামি শরিয়াহ আইন মানে না বা বিশ্বাস করে না সেই দলে থেকে আপনি সালাতও আদায় করেন, হজ্জও করেন, সাওমও রাখেন  আবার আল্লাহ ও রাসুল সা. এর বিরুদ্ধাচারণও করেন  এমন মুসলমান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমরা কি কুরআনের কোনো কোনো অংশ (আয়াত) মানো আর কোনো কোনো অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্য থেকে এরুপ কাজ  করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্য কলাপ সম্বন্ধেবে- খবর নন”। (সুরা আল বাকারা-৮৫)।

অতএব ইসলামি দল ব্যতীত অন্য কোনো দলকে একজন মুসলমানের ভোট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।

আহলে হাদিস বাংলাদেশ বা সালাফিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

আপনারা বহু বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে শিরক, বিদায়াত ও কুফর উচ্ছেদ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এর সাথে সহিহ হাদিস ভিত্তিক আমল বা ইবাদত করার জন্যও মুসলিমদের আহ্বান করে আসছেন। আলহামদুলিল্লাহ পূর্বের তুলনায় অনেক আহলে হাদিস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আহলে হাদিসের মূল কথা হলো, সকল বিধান বাতিল করো, ওহির বিধান চালু করো। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ওহির বিধান কীভাবে চালু করবেন? আপনারা প্রচলিত গণতন্ত্রকে কুফরী মতবাদ দিচ্ছেন। আমিও মানি এটা কুফরী মতবাদ। কুফরী মতবাদের উপর ভিত্তিতে করে যেসব রাজনৈতিক দল গঠিত তাদেরকে আপনারা সাপোর্ট করেন না। এই কারণে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলা বাংলাদেশের কোনো ইসলামিক দলকে আপনারা যেমন সমর্থন করেন না আবার তাদেরকে ভোটও দেন না। যতগুলো ইসলামিক দল আছে তাদের মধ্যে জামায়াত শিবিরকে আপনারা কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছেন না। শুধু একটাই দোহাই তাদের মানহাজ ঠিক নাই, তারা কুফরী গণতন্ত্রকে সাপোর্ট করে, তারা রাজাকার। অথচ আপনাদের কয়েক কোটি ভোট যায় কোথায়? কোন দলকে ভোট দেন? তাদের মানহাজ ঠিক আছে তো?

আপনারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলাম কায়েমের বিপক্ষে, সরাসরি খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে, ইকামাতে দ্বিন প্রতিষ্ঠার ব্যাখ্যা দেন ভিন্নভাবে তাহলে , "সকল বিধান বাতিল করো, ওহির বিধান চালু করো" কীভাবে করবেন?

শুধু ঐ ওয়াজ মাহফিল আর বই পুস্তক ছাপিয়ে হাতে হাতে দিলেই কি শিরক ও বিদায়াত উচ্ছেদ হবে?

না উচ্ছেদ হবে না।

তার কারণ বাংলাদেশকে কোনো ইসলামি দল শাসন করছে না, বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন চালু নেই। তার প্রমান হলো, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামীলীগের লোকজন চারদিকে গুজব ছড়াতে লাগলো যে, মোল্লারা এখন বাংলাদেশ শাসন করবে, এই দেশ তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আবার ৩৬ জুলাই আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত বা যারা সমর্থক তারাও ভাবতে লাগলো এবার আওয়ামীলীগের ইসলাম বিরোধী বিশেষ করে সারা বাংলাদেশে স্থাপিত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হবে তথা শিরক উচ্ছেদ করা যাবে। এইটা ভেবে উৎসুক জনতা শেখ মুজিবসহ আরও অনেকের মূর্তি ভেঙ্গে ফেললো। এদিকে আহলে হাদিসরা ঐ মুহূর্তটাকে সুযোগ নিয়ে মাজার ভাঙ্গা শুরু করলো এবং মাজারপন্থীদের সাথে সংঘর্ষে অনেকে আহত হলো।

বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজরে এলে তারা খুবই কঠোর হলেন। মাননীয় ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ডিসি ও এসপিদের নির্দেশ দিলেন এই মাজার ভাঙ্গার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে যেনো গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়। ব্যস অনেকেই গ্রেফতার হয়ে এখন তারা জেলখানায়। সরকারের মাজার ভাঙ্গার বিপরীত পদক্ষেপ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেলো যে, তারাও সেক্যুলার, শিরক, বিদায়াত ও কুফর উচ্ছেদ হোক এটা তারা চান না। এখন আহলে হাদিসদের বলছি, যেহেতু সরকার ইসলামপন্থী না তাহলে মাজার ভাঙবেন কীভাবে? এখন কিয়ামত পর্যন্ত যদি অনৈসলামিক দল ক্ষমতায় থাকে আর কিয়ামত পর্যন্ত যদি ওয়াজ নসীহত করে যান কোনোদিনও তো ওহির বিধান চালু করতে পারবেন না। তাই আসুন বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো একটি ইসলামি দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতা অর্পণ করি এরপর সংসদে সংবিধান পরিবর্তন করে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নিয়ে ইসলামি সমাজতন্ত্র চালু করতে হবে। মনে রাখবেন, ইসলামি সরকার ছাড়া বা রাষ্ট্রে ইসলামি শরিয়াহ আইন চালু ব্যতীত কিয়ামত পর্যন্ত শিরক, বিদায়াত ও কুফর উচ্ছেদ করা সম্ভব না। সেই ইসলামি সরকার হয় আপনারা গঠন করবেন না হয় অন্যকে ভোট দিয়ে ইসলামি সরকার গঠনে সহযোগিতা করবেন।

বিএনপির বিগত শাসনামল

বিএনপি বাংলাদেশকে কয়েকবার শাসন করেছে। সর্বশেষ ২০০১ সালের ০১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি জোট সরকার গঠন করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলো। বিগত ১৬ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে “বিবিসি বাংলা নিউজ” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, নির্বাচনের পর নতুন আরেক পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দুদের উপর হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং লুটপাটের অভিযোগ আসতে থাকে। এসব ঘটনার সাথে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা জড়িত বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তখনো বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায় কাল। এমন অবস্থায় ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপিয়ান কমিশনের রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পরেও পরিস্থিতির কোন বদল হয়নি।

আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও, সাথে সাথে সংসদে যোগ দেবার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের ‘সন্ত্রাসীরা’ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে। অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর লুটপাটের অভিযোগও তোলেন তিনি।

বিগত ২২ আগস্ট ২০২৩ তারিখে “বাসস” কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা যায়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগের ২২ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে বিএনপি। সেদিন কোথায় ছিল তাদের গণতন্ত্র।

তিনি বলেন, ‘বিএনপির মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা নাকি তাদের ২২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছি। ফখরুল সাহেব, আপনারা আমাদের ২২ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছেন। আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, সেই দিন কোথায় ছিল গণতন্ত্র? ২০০১ সালে অস্বাভাবিক সরকার গদিতে বসেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল।’

বিগত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে “বাসস” কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি’র শাসনামলের নিন্দা জানিয়ে ওই পাঁচ বছরকে বাংলাদেশকে ৫০ বছর পিছিয়ে দেয়ার সময়কাল বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।

পোস্টটিতে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের হত্যা, নির্যাতন, দখল, দলীয়করণ, দ্রব্যমুল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতি, ব্যাপক লুটপাট, দুর্নীতি ও অর্থপাচার, জঙ্গি উত্থান গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনার ভিডিও চিত্র তুলে ধরেন তিনি।

সজীব ওয়াজেদ জয় আরও বলেন, তারেক রহমান হাওয়া ভবনকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্রে পরিনত করে এই ভবনকে ঘুষ, পার্সেন্টেজ দেওয়ার অঘোষিত নিয়মে পরিনত করেছিল। ব্যাপক দলীয়করন ও সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃত্রিম ভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সাধারন জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তারা।

বিগত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত “জিয়ার আদর্শ বিক্রি করে বিএনপি দেশকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে: ফয়জুল করীম” ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘জিয়ার আদর্শ বিক্রি করে বিএনপি পাঁচবার দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে। এ দেশের মানুষ আর চোর-ডাকাত, গুন্ডা-চাঁদাবাজকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভোট দেবে না।’

বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে এটাই প্রমাণিত যে, বিএনপির শাসনামলে আওয়ামীলীগের মতোই অপহরণ, গুম, খুন, অন্যায়, অত্যাচার, চাঁদাবজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, চুরি, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, ঘুষ, দুর্নীতিসহ সকল অপকর্মের সাথে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিলো।

অথচ বিএনপির বিভিন্ন অপকর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম তেমন অবগত না হওয়ার কারণ হলো ২০০৯ সালে একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাহিনীর গুলির শব্দ শুনতে পেতো। বুদ্ধি হওয়ার পর সে জানতে পারতো তার বাবা, চাচা না হয় তার বড় ভাইকে পুলিশ হাত কড়া পড়িয়ে নির্যাতন করতে করতে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। । ঐ শিশুগুলো শৈশব থেকেই আওয়ামীলীগের অপহরণ, গুম ,খুন, অন্যায়-অত্যাচার, ক্রস ফায়ারসহ দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে আওয়ামী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যারফলে নতুন প্রজন্ম অতীতকে নিয়ে ঘাটাঘাটি না করায় বিগত শাসকদের বিভিন্ন অপকর্ম জানা থেকে বিরত থাকে।  ৩৬ জুলাই সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলেরই একটা জোট ও উদ্দেশ্য গঠিত হয়েছিলো যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে তাড়াও দেশ বাঁচাও। যারফলে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা  পালাতে বাধ্য হয়।

৫ আগস্ট ২০২৪ এরপর বিএনপির কর্মকান্ড

৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা  পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের সর্ব স্তরের জনগণ যখন আনন্দ ফূর্তি করছে আর সেই সময়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা চারদিকে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, অস্ত্রবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কর্তৃত্ব দখল করাসহ সেই পূর্বের মতোই বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে যা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনই করে নাই, তার আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনি ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর বিএনপি ধরে নিয়েছে তারা ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। শুধু এই একটি মাত্র দলই সারা দেশটাকে এক নৈরাজ্যকর করে তুলেছে।

বিগত ২৪ আগস্ট ২০২৫ তারিখে “প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত ‘এবার আমাদের পালা’ সংস্কৃতি নতুন বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত: টিআইবি অনুযায়ী জানা যায়, দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের ক্ষমতার অপব্যবহারে ‘এবার আমাদের পালা’ স্বরূপ আচরণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বলে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে, কর্তৃত্ববাদ পতনের পর থেকে দেশব্যাপী দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, মামলা–বাণিজ্য, গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, জামিন–বাণিজ্য, ট্যাগ–বাণিজ্য ও দলীয় আধিপত্যকেন্দ্রিক সহিংসতা চলছে, যা নতুন বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভীষ্টের জন্য অশনিসংকেত।

টিআইবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথাগুলো বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, মুখে সংস্কার অথচ কার্যত আধিপত্য, দখল ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় গণতান্ত্রিক ‘নতুন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার গণ–আকাঙ্ক্ষাকে রীতিমতো পদদলিত করা হচ্ছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, কর্তৃত্ববাদ পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে বিবেচিত, তাদের নেতা–কর্মীদের একাংশের কার্যক্রম পতিত কর্তৃত্ববাদী আমলের সরকারি দলের বহুমুখী ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বার্থসিদ্ধিমূলক অসুস্থ চর্চার প্রতিচ্ছবি হিসেবেই বিকশিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতাপ্রত্যাশী ও প্রভাবশালী দলগুলোর নেতা–কর্মীদের একাংশের সরাসরি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসাজশমূলক সম্পৃক্ততায় দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে এই যোগসাজশে নির্বিকারভাবেই যুক্ত থাকছে পতিত রাজনৈতিক শক্তিও।’

টিআইবি বলেছে, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় নেতা–কর্মীদের অনেকেই দখলদারি, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে লিপ্ত হয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত তার মাত্রা বাড়ছে। ‘এবার আমাদের পালা’—এই সংস্কৃতির চর্চায় লিপ্ত হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সরকার, বিশেষ করে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার নজিরের পাশাপাশি অংশীদারত্বের দৃষ্টান্ত পুনরুজ্জীবিত করেছেন। পরিবহন টার্মিনাল, খনিজ সম্পদ, সেতু, বাজার ও জলমহাল দখল ও চাঁদাবাজির চক্রের পুনরুত্থানও রাজনৈতিক অঙ্গনে অতীতের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দুঃশাসনের ধারাবাহিকতাকে জিইয়ে রাখছে।

টিআইবির উল্লেখিত প্রতিবেদনটিই প্রমাণ করে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের পর থেকে বিএনপির ক্ষুধার্ত নেতা-কর্মীরা পুরো দেশাটাকে কীভাবে জিম্মি করে রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ এক স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আরেক চাঁদাবাজ দলের হাতে বন্দী হয়েছে।

ইসলামি শরিয়াহ আইন নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য ক্লিয়ার

আওয়ামীলীগ বলেন, বিএনপি বলেন আর জাতীয় পার্টি বলেন যতো অনৈসলামিক রাজনৈতিক দল আছে প্রত্যেক দলের একই কথা তারা “ইসলামি শরিয়াহ আইন মানে না, তারা বিশ্বাস করে না।”

বিগত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে “দৈনিক ইত্তেফাক” পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, “বিএনপি শরীয়াহ আইনে বিশ্বাস করে না: মির্জা ফখরুল”।

যেহেতু অনৈসলামিক দলগুলো ইসলামি শরিয়াহ আইনে বিশ্বাসী না, তারা ইসলামি শরিয়াহ আইন মানে না তাই এই দলগুলোকে সমর্থন করা বা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে ইসলাম বিরোধী আইন পাশ করতে সহযোগিতা করা যাবে না। যারা এই অন্যায়ের সহযোগী হবে তারা জাহান্নামী।

বর্তমানে বিভিন্ন পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া ও জনগণের চাক্ষুষ প্রমান তথ্য উপাত্ত থেকে বিএনপির নিম্নলিখিত অপরাধ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ পাওয়া যাচ্ছে,

(১) বিএনপির নেতা কর্মীদের দ্বারা চাঁদাবাজির ব্যাপকতা বেড়েই চলছে। দলীয় নেতা কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধে বিএনপির হাইকমান্ড নেতাগন সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ।

(২) সারা দেশে আওয়ামীলীগের স্থলাভিষিক্ত হয়ে বিএনপির নেতা কর্মীরা দখলবাজি করেই চলছে। এক এক করে আওয়ামীলীগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করা হচ্ছে।

(৩) কোথাও কোথাও অস্ত্রবাজি করতে দেখা যাচ্ছে।

(৪) সকল টেন্ডারিং কাজে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে।

(৫) আওয়ামীলীগের ফেলে যাওয়া অর্থ সম্পদ নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

(৬) নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সার্বক্ষণিক মারামারি ও গোলাগুলিতে ব্যস্ত।

(৭) নিজেদের দলীয় চেইন অব কমান্ড কেউ মেনে চলছে না।

(৮) চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও ধর্ষণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

(৯) সম্প্রতি পুলিশকে আক্রমণ করতে দেখা যাচ্ছে।

(১০) একক প্রার্থীকে সহযোগিতা না করে সকল নেতাই নিজ নিজ এলাকার এমপি হতে ব্যস্ত।

(১১) ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর প্রথম ১০ মাসে বিএনপির হাতে ১২৩ জন খুন। এরপর খুনের হিসাব আরও বেড়েই চলছে।

(১২) সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করায় জনমনে বিএনপির প্রতি অনীহা ও ঘৃণাভাব এসে গেছে।

(১৩) সকল কাজে ঘুষ দুর্নীতি তথা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে নেতা কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে।

(১৪) ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

(১৫) সারা দেশে নেতা কর্মীরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাদেরকে শোকজ করছে, বহিস্কার করছে আবার তারাই বিএনপি হয়ে কাজও করছে, বিএনপির এই যে একটা মেকানিজম জনগণ তা বুঝে গেছে। তাদের এইসব আই ওয়াশ শাস্তি জনগণ বিশ্বাস করে না।

পরিশেষে এ কথাই বলছি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামিক ও অনৈসলামিক দুই ভাগে বিভক্ত। ইসলামিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা ও আল্লাহর আইন দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা। অপর দিকে অনৈসলামিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। এখন ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদএই চারটিই হচ্ছে কুফুরি মতবাদ। যদি কোনো মুসলমান এই চারটির যেকোনো একটিতে বিশ্বাস করে ও তদানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় সহযোগিতা করে তাহলে তার ঈমান থাকবে না। অথচ এদেশের ৭০% মুসলমান অনৈসলামিক দলগুলোকে ভোট দেয় যাতে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত না হয় তথা ইসলামি শরিয়াহ আইন কায়েম না হয়।

আপনি একজন ভোটার পায়ে হেঁটে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে অনৈসলামিক দলের প্রতীকে যখন সিল মারলেন তখনই আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আল্লাহকে দেখিয়ে বললেন তোমার আইন মানিনা, আমি মানবরচিত আইনকে সমর্থন করলাম, ভোট দিলাম। কিয়ামতে আপনার এই হাত, পা ও চোখ সাক্ষ্য দিবে। আল্লাহ ও রাসূল সা. এর সাথে বিদ্রোহ করা ও অনৈসলামিকদলকে ভোট দিয়ে অন্যায়ের সহযোগী হওয়ার কারণে আপনাকে ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি পেতে হবে যার শেষ পরিণতি জাহান্নাম। অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশে পীর, আউলিয়া, গাউস, কুতুব, দাদা হুজুর, হাফেজ, মুফতি, মুহাদ্দিস, কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, সহীহ আমলধারী সালাফিসহ লক্ষ লক্ষ আলেম বা হুজুর বা শায়েখ আছেন তারা যদি অনৈসলামিক দলকে ভোট দেয় তাহলে কি তারাও জাহান্নামী? হ্যাঁ তারাও জাহান্নামী। কারণ দুনিয়ায় তারা ভোটের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলেছে তারা আল্লাহর আইন মানে না। আর সে জন্যে তাদের অন্যান্য আমলগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। এখন হয়তো বলবেন, ইসলামিক দল কোনটি তার নাম বলুন? উত্তর হবে, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ইসলামিক দল আছে আপনি যেকোনো একটি দলে যোগদান করুন। পছন্দ না হলে নিজে ইসলামিক দল গঠন করুন। তবুও একজন মুসলমান নিজের ঈমান আমল বিসর্জন দিয়ে অনৈসলামিক দল করতে পারে না। সালাত, সাওম, হজ্জ্ব, জাকাত যেমন ফরজ তেমনি ইসলামের পথে আহ্বান করা, ইসলামী সংগঠন করা বা ইসলামের রাজনীতি করা ও আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করাও ফরজ।

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামকে শুধু দাঁড়ি, টুপি আর পাঞ্জাবীর মধ্যে রেখে ঈমানদার, মুত্তাকী মুসলমান হওয়া যাবে না।

কিয়ামতে আল্লাহ তায়ালা অনৈসলামিক দলের নেতাদের বলবেন, তোমাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছিলাম, কথা ছিলো তোমরা রাষ্ট্রে সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করে গরিবদের মাঝে সমবন্টন করবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে ও অন্যায়ের বিরোধিতা করবে কিন্তু তোমরা তা করনি। সেদিন এই নেতারা কোনো জবাব দিতে পারবে না।

পার্টির নেতা হিসেবে প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কিয়ামতে জিজ্ঞাসা করা হবে ইসলামের জন্য কী দায়িত্ব পালন করেছো, কেউ জবাব দিতে পারবে না।

কিয়ামতে কর্মীরা আল্লাহর নিকট অভিযোগ দায়ের করে বলবে, এই নেতাদের কারণে আমরা বিপদগামী হয়েছি, এদেরকে কঠিন শাস্তি দিন। জাহান্নামে নেতা কর্মীরা একে অপরকে দোষারূপ করে তর্ক করবে।

অতএব ওহে মুসলমান! আপনারা কীসের লোভে কার পিছনে ছুটছেন? মনে রাখবেন, রাসূল সা. এর আদৰ্শ, তাঁর আইন, তাঁর সুন্নাহ বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার আদৰ্শ ধারণ করে জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা গংদের বিচারিক রায়

(১) ফাঁসিঃ-------জন

(২) যাবজ্জীবন কারাদন্ডঃ------জন

(৩) ফাঁসির রায় কার্যকরঃ -------তারিখে

অপেক্ষায় আছি----------------------

আল্লাহর রোষানল থেকে আওয়ামীদের মুক্তির উপায়

আমরা চাক্ষুষ প্রমাণ, বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত থেকে নিশ্চিত যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ তার সকল দোসর কোনো না কোনো গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত। তারা এমন কিছু অপরাধ বা পাপ কাজ করেছে যা ক্ষমা করা যায় না। দুনিয়ার আইনেও না, আল্লাহর আইনেও না। এমন অপরাধের সাথে আরও অন্যান্য অনৈসলামিক দলের নেতা-কর্মীরাও জড়িত যারা এক সময় এই দেশকে শাসন করেছে। এখন আওয়ামীলীগসহ অন্যান্য অপরাধীদের মুক্তির উপায় কী?

মুক্তির একমাত্র উপায় মানুষের হক বুঝে দেয়া ও আল্লাহর নিকট খাস দিলে তওবা করা। একজন পাপী কীভাবে তওবা করবে কিংবা পাপ থেকে মুক্তির উপায় জানতে “পাপ তওবা ও মুক্তির উপায়” এর উপর ক্লিক করুন।

“পাপ তওবা ও মুক্তির উপায়”

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক

বইয়ের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।

(ক) আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)।

(খ) তিনি আরো বলেন, “তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)।

(গ)  আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন লোককে সৎ কাজের দিকে আহবান করবে, তার জন্যও সে পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ তাদের সাওয়াবের কোন অংশ একটুও কমবে না। অনুরূপ যে ব্যক্তি কাউকে গোমরাহীর দিকে আহবান করে তারও সে পরিমাণ গুনাহ হবে, যতটুকু গুনাহ তার অনুসারীদের জন্য হবে। অথচ এটা অনুসারীদের গুনাহকে একটুও কমাবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৫৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৯৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৬০, ইসলামিক সেন্টার ৬৬১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার কথা পৌঁছিয়ে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়। আর বনী ইসরাঈলের ঘটনাবলী বর্ণনা কর। এতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে কেউ ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামকেই তার ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নিল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৬১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২১২, হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(সমাপ্ত)

Author and compiler:

Md. Izabul Alam-M.A., C.In., Ed. (Islamic Studies-Rangpur Carmichael University College, Rangpur), prominent Islamic thinker, researcher, writer and Blogger.

(1) GENERAL DIRECTOR-MEDINA SAHIH HADITH RESEARCH CENTER (MSHRC)

(2) GENERAL DIRECTOR- PURE MUSLIM MAKING RESEARCH CENTER (PMMRC),

(3) DIRECTOR-Bangladesh BCS Coaching (BBC)

(4) PRINCIPAL -PGDHRM TRAINING INSTITUTE (PTI)

(5) PRINCIPAL- BANGLADESH ONLINE UNIVERSITY (BOU)

(6) GENERAL DIRECTOR AND CONSULTAT-PRIVATE INVESTIGATION SERVICES (PIS)

(7) EDITOR-BDC CRIME NEWS24

 

No comments:

Post a Comment

মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ দলকে ভোট দিবেন?

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম মুসলিম হিসেবে আপনি কোন্ দলকে ভোট   দিবেন? (ইসলামি দল ব্যতীত যারা অন্য দলকে ভোট দিয়ে অন্যায়ের সহযোগী হয় তারা জা...