Thursday, June 6, 2019

রিজিক বৃদ্ধির প্রথম আমল -আল্লাহর উপর ভরসা করা।


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম


রিজিক বৃদ্ধির প্রথম আমল -আল্লাহর উপর ভরসা করা

মো: ইজাবুল আলম, এম এ, সি ইন এড, ইসলামিক স্টাডিজ (রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক, মহাপরিচালক, পিএমএমআরসি, ।




রিজিক বৃদ্ধির প্রথম- আমল আল্লাহর উপর ভরসা করা

আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া অবলম্বন করা, তাঁর নির্দেশাবলি পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা। পাশাপাশি আল্লাহর ওপর অটল আস্থা রাখা, তাওয়াক্কুল করা এবং রিজিক তালাশে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ, যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 
“আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সূরা আত-তালাক, আয়াত : ২-৩)
অর্থাৎ যে আল্লাহকে ভয় করবে এবং আনুগত্য দেখাবে, আল্লাহ তার সকল সংকট দূর করে দেবেন এবং তার কল্পনাতীত স্থান থেকে রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। আর যে কেউ তার উদ্দেশ্য হাসিলে একমাত্র আল্লাহর শরণাপন্ন হয় তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। বলা বাহুল্য এই তাকওয়ার পরিচয় মেলে হালাল উপার্জনে চেষ্টা এবং সন্দেহযুক্ত কামাই বর্জনের মধ্য দিয়ে।
(১) ইবনু রজব (রহঃ) বলেছেন, ‘দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে মঙ্গল লাভ ও অমঙ্গল প্রতিহত করতে আন্তরিকভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।(ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ৪৩৬।)
(২) হাসান (রহঃ) বলেছেন,‘মালিকের উপর বান্দার তাওয়াক্কুলের অর্থ, আল্লাহই তার নির্ভরতার স্থান- একথা সে মনে রাখবে’(ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ৪৩৭।)
(৩) ইবনু উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘কল্যাণ অর্জনে ও অকল্যাণ দূরীকরণে সত্যিকারভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং এতদসঙ্গে আল্লাহ যে সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে বলেছেন তা অবলম্বন করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।(মাজমূ‘ ফাতাওয়া ও রাসাইলু ইবনে উছায়মীন ১/৬৩।)
এই সংজ্ঞাটি তাওয়াক্কুলের উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা, যার মধ্যে সব দিকই শামিল রয়েছে। (এতে একদিকে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা এবং অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার কথা রয়েছে।
(৪) ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘তাওয়াক্কুল দ্বীনের অর্ধেক; বাকী অর্ধেক হ’ল ইনাবা’। কেননা দ্বীন হ’ল সাহায্য কামনা ও ইবাদতের নাম। এই সাহায্য কামনা হ’ল তাওয়াক্কুল এবং ইবাদত-বন্দেগী হ’ল ইনাবা। আরবী ‘ইনাবা’ অর্থ আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ ও তওবা করে ফিরে আসা।
আল্লাহর উপর ভরসার মর্যাদা ও গুরুত্ব ব্যাপক জায়গা জুড়ে রয়েছে। তাওয়াক্কুল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপকতা এবং বিশ্ববাসীর প্রয়োজনের আধিক্যের ফলে তাওয়াক্কুলকারীদের দ্বারা এর আঙিনা সদাই ভরপুর থাকে। (ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ২/১১৩।)
সুতরাং তাওয়াক্কুল জড়িয়ে আছে ওয়াজিব (ফরয), মুস্তাহাব, মুবাহ সবকিছুরই সাথে। এমনকি যেসব নাস্তিক আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে ক্ষেত্রবিশেষে তারাও নিজেদের লক্ষ্য পূরণে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করে। আসলে মানুষের প্রয়োজনের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কাজেই প্রয়োজন পূরণার্থে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হয়।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বান্দা যদি কোন পাহাড় সরাতে আদিষ্ট হয় আর যদি সে কাজে সে আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়ও সরিয়ে দিতে পারবে।(ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন ১/১৮১।)
সুতরাং একজন মুসলিম তার যাবতীয় কাজে আল্লাহর উপর ভরসাকে একটা মুস্তাহাব বিষয় ভাবতে পারে না; বরং সে তাওয়াক্কুলকে একটি দ্বীনী দায়িত্ব বা আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করবে।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, যে মূল থেকে ইবাদতের নানা শাখা-প্রশাখা উদগত হয়েছে তা হ’ল : আল্লাহর উপর ভরসা, তাঁর নিকট সত্য দিলে আশ্রয় নেওয়া এবং আন্তরিকভাবে তাঁর উপর নির্ভর করা। তাওয়াক্কুলই আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকারোক্তির সারকথা। এর মাধ্যমেই তাওহীদের চূড়ান্তরূপ নিশ্চিত হয়। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালবাসা, ভয়, রব ও উপাস্য হিসাবে তাঁর নিকট আশা-ভরসা এবং তাঁর নির্ধারিত তাকদীর বা ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকার মত মহতী বিষয়গুলো তাওয়াক্কুল থেকেই উৎপত্তি লাভ করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুল বান্দার নিকট বালা-মুছীবতকে পর্যন্তউপভোগ্য বিষয় করে তোলে, সে তখন বালা-মুছীবতকে আল্লাহর দেওয়া নে‘মত মনে করতে থাকে। বস্ত্ততঃ পবিত্র সেই মহান সত্তা তিনি যাকে যা দিয়ে ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন। তিনি মহা অনুগ্রহশীল। (শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ, তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৮৬।)
তাওয়াক্কুলের হুকুম :
নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা শীর্ষস্তরের ফরযসমূহের অন্তর্গত একটি বড় ফরয। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরয। এটি উচ্চাঙ্গের ফরয সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহর জন্য ইখলাছ বা বিশুদ্ধচিত্তে কাজ করা ফরয। ওযূ ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতার জন্য গোসলের ব্যাপারে যেখানে আল্লাহ তা‘আলা একটি আয়াতে একবার বলে তা ফরয সাব্যস্ত করেছেন, সেখানে একাধিক আয়াতে তিনি তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করতে নিষেধ করেছেন’। (মাজমু‘ ফাতাওয়া ৭/১৬।)
বরং তাওয়াক্কুল ঈমানের শর্ত। এজন্য আল্লাহর বাণী “আল্লাহর উপরে তোমরা ভরসা কর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (মায়েদাহ ৫/২৩) এই আয়াতের মর্মার্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, বান্দার থেকে তাওয়াক্কুল দূর হয়ে গেলে সাথে সাথে ঈমানও দূর হয়ে যাবে।
তাওয়াক্কুল তাওহীদে উলূহিয়্যা বা উপাস্যের একত্ববাদের যেসব ভিত্তি রয়েছে তন্মধ্যে একটি। সূরা ফাতিহার পাঁচ নং আয়াত একথার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধকরণমূলক আয়াত সমূহ :
তাওয়াক্কুল শব্দটি কুরআন মাজীদে ৪২ জায়গায় এসেছে। কখনো তা একবচনে, কখনো বহুবচনে, কখনো অতীতকালের শব্দে, কখনো বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের শব্দে, কখনোবা আদেশবাচক শব্দে। সবগুলো শব্দই আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা এবং তাঁর নিকট কার্যভার অর্পণ অর্থে এসেছে।
তাওয়াক্কুলের মাহাত্ম্য ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে কুরআন মাজীদের বর্ণনাভঙ্গি নানারূপ ধারণ করেছে। এখানে তার কিছু তুলে ধরা হ’ল।
(ক) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুলের আদেশ :
কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে তাঁর নবীকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন : ‘অতএব তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর। তুমি তো স্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (নামল ২৭/৭৯)
আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তুমি তাঁর ইবাদত কর ও তাঁর উপরেই ভরসা কর’ (হূদ ১১/১২৩)।
আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর তুমি ভরসা কর সেই চিরঞ্জীব সত্তার উপর, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর। বস্তুতঃ জান্নাতী বান্দাদের পাপসমূহের খবর রাখার ব্যাপারে তিনিই যথেষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৫৮)।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ- ‘এতদসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। আর তিনিই হচ্ছেন মহান আরশের মালিক’ (তওবা ৯/১২৯)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘তুমি বল, তিনি তো সেই দয়াময় (আল্লাহ)। আমরা তাঁর উপর ঈমান এনেছি এবং ভরসা করেছি। অতঃপর কারা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল তা অচিরেই তোমরা জানতে পারবে’ (মুলক ৬৭/২৯)।
আর আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবীকে তাওয়াক্কুল করার হুকুম দেওয়ার অর্থ তাঁর উম্মতকে হুকুম দেওয়া।
(খ) আল্লাহ কর্তৃক তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করার আদেশ : আল্লাহ তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর উপর ভরসা করতে আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ৩/১২২)।
(গ) মুমিনরা তাদের রবের উপর ‘তাওয়াক্কুলকারী’ বিশেষণে বিশেষিত : আল্লাহর উপর ভরসা করা দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় গুণ। এটি তাদের এমন একটি প্রতীক, যা দ্বারা অন্যদের থেকে তাদের পৃথক করা যায়। মুমিনদের জন্য এটি একটি সুস্পষ্ট চিহ্ন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)।
‘তারা তাদের মালিকের উপরই ভরসা করে’- বাক্যটির মর্মার্থ হ’ল- তারা আল্লাহকে ছাড়া কাউকে আকাঙ্ক্ষা করে না; তিনি ছাড়া কেউ তাদের উদ্দেশ্য নয়; তারা তাঁর নিকট ছাড়া কোথাও আশ্রয় নেয় না; তারা কেবলই তাঁর নিকট তাদের প্রয়োজন পূরণের আবেদন জানায়; তারা তাকে ছাড়া আর কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। তারা জানে যে, তিনি যা চান তাই হয় এবং তিনি যা চান না তা হয় না। তিনিই ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রয়োগকারী, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর হুকুম রদ করার শক্তিও কারো নেই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ)।
( তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৩৭৯।)
(ঘ) নবীগণের তাওয়াক্কুলের কতিপয় উদাহরণ :
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণের জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদের নিকট তাদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা তাদের ঈমানী শক্তির কারণে বলেছিল,‘হে আমাদের মালিক! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আর তোমার নিকটেই তো প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহিনা ৬০/৪)। অর্থাৎ আমাদের যাবতীয় কাজে আমরা তোমারই উপর ভরসা করি এবং তোমারই নিকট সব কাজ সমর্পণ ও সোপর্দ করেছি। এমনিভাবে তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং যাবতীয় কাজ আল্লাহর কাছে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করেছিলেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তারা তাওয়াক্কুলকে সাথী করে নিয়েছিলেন। দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-কে তো তাঁর জাতি পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল। এজন্য তারা প্রচুর জ্বালানী কাঠ যোগাড় করেছিল। সুদ্দী বলেন, সে সময় একজন মহিলা অসুস্থ হ’লে সে মানত করত যদি সে সুস্থ হয়ে ওঠে তাহ’লে ইবরাহীমকে পোড়ানোর জন্য এক বোঝা কাঠ সে বয়ে দিয়ে আসবে। (তাফসীর ইবনে কাছীর ৩/৩৭৪।)
তারপর তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে পোড়ানোর জন্য বড় একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে কাঠ জমা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন যখন খুব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার লেলিহান শিখা বিস্তার করতে থাকে, তখন মিনজানীক নামক এক ধরনের যন্ত্রে করে তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে ঐ আগুনে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার সময় ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে তিনি বলেন, ‘ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে ফেলা হয় তখন তিনি বলেছিলেন ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’।(ছহীহ বুখারী হা/৪৫৬৩।)
মূসা (আঃ)-কে দেখুন, কিভাবে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর জাতিকে তার উপর ভরসা করতে হুকুম দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,  ‘আর মূসা (তার নির্যাতিত কওমকে সান্ত্বনা দিয়ে) বলল, হে আমার কওম! যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাক, তাহ’লে তাঁর উপরেই তোমরা ভরসা কর। যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাক’ (ইউনুস ১০/৮৪)।
শায়খ সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, আয়াতের অর্থ এই যে, মূসা (আঃ) তাঁর উম্মাতকে আল্লাহ কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তারা যেন স্বৈরাচারীদের ভয়ে পিছটান না দেয়; বরং সামনে এগিয়ে যায়, তাদের ভয় না করে, তাদের দেখে তটস্থ ও সন্ত্রস্ত না হয়। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে তারা যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে। তারা যেন বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সত্যি-সত্যিই বাস্তবায়ন করবেন, যদি তারা মুমিন হয়।(তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ৪৩৮।)
উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। ওহোদ যুদ্ধের প্রাক্কালের ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্ম বিধায়ক’- বাক্যটি ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন, আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) এটি বলেছিলেন যখন কাফিররা বলেছিল, ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম তত্ত্বাবধায়ক’! (আলে ইমরান ৩/১৭৩)। (বুখারী হা/৪৫৬৩)।
সুতরাং যখন ইসলাম বিরোধীরা মুসলমানদের হুমকি দেয় এবং শত্রুপক্ষের জনশক্তি ও অস্ত্র শক্তির ভয় দেখায়, তখন এই তাওয়াক্কুলই মুমিনদের একমাত্র অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহর উপর ভরসাকারীদের কিছু সত্য ঘটনা :
আল্লাহর উপর ভরসাকারী নেককারদের কাহিনী শুনলে বান্দা আল্লাহর উপর অবশ্যই তাওয়াক্কুলে উদ্বুদ্ধ হবে। আল্লাহর উপর সত্য ভরসা করে তারা কী ফল লাভ করেছে তা জানলে নিশ্চয়ই তার আগ্রহ বাড়বে। আর ভরসাকারীদের শিরোমণি তো আমাদের রাসূল (ছাঃ)।
নবী করীম (ছাঃ) ও তরবারিওয়ালা :
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে নজদের (বর্তমানে রিয়ায অঞ্চল) দিকে জিহাদে রওয়ানা হ’লেন। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ী ফিরতে লাগলেন, তখন তিনিও তাঁর সঙ্গে ফিরলেন। রাস্তায় প্রচুর কাটাগাছে ভরা এক উপত্যকায় তাঁদের দুপুরের বিশ্রাম নেওয়ার সময় হ’ল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (বিশ্রামের জন্য) নেমে পড়লেন এবং ছাহাবীগণও গাছের ছায়ার খোঁজে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি বাবলা গাছের নীচে অবতরণ করলেন এবং তাতে স্বীয় তরবারি ঝুলিয়ে দিলেন। আর আমরা অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম। অতঃপর হঠাৎ (আমরা শুনলাম যে,) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে ডাকছেন। সেখানে দেখলাম, একজন বেদুঈন তার কাছে রয়েছে। তিনি বললেন, আমার ঘুমের অবস্থায় এই ব্যক্তির হাতে আমার তরবারিখানা খোলা অবস্থায় দেখলাম। (তারপর) সে আমাকে বলল, আমার নিকট হ’তে তোমাকে (আজ) কে বাঁচাবে? আমি বললাম, আল্লাহ। এ কথা আমি তিনবার বললাম। তিনি তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। অতঃপর তিনি বসে গেলেন। (অথবা সে বসে গেল) (বুখারী ও (মুসলিম হা/৮৪৩।))।
অন্য বর্ণনায় আছে, জাবের (রাঃ) বলেন যে, আমরা ‘যাতুর রিক্বা’-তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। অতঃপর (ফেরার সময়) যখন আমরা ঘন ছায়া বিশিষ্ট একটি গাছের কাছে আসলাম, তখন তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ছেড়ে দিলাম। (তিনি বিশ্রাম করতে লাগলেন।) ইতিমধ্যে একজন মুশরিক আসল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তরবারি গাছে ঝুলানো ছিল। তারপর সে তা (খাপ থেকে) বের করে বলল, তুমি কি আমাকে ভয় করছ? তিনি বললেন, না। সে বলল, তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? তিনি বললেন, আল্লাহ।
আবু বকর ইসমাঈলীর ছহীহ গ্রন্থে রয়েছে, সে বলল, আমার হাত থেকে তোমাকে কে বাঁচাবে? তিনি বললেন, আল্লাহ। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তার হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তরবারিখানা তুলে নিয়ে বললেন, (এবার) তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? সে বলল, তুমি উত্তম তরবারিধারক হয়ে যাও। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল? সে বলল, না। কিন্তু আমি তোমার কাছে অঙ্গীকার করছি যে, তোমার বিরুদ্ধে কখনো লড়বো না। আর আমি সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গীও হব না, যারা তোমার বিরুদ্ধে লড়বে। সুতরাং তিনি তার পথ ছেড়ে দিলেন। অতঃপর সে তার সঙ্গীদের নিকট এসে বলল, আমি তোমাদের নিকটে সর্বোত্তম মানুষের নিকট থেকে আসলাম (বুখারী হা/২৯১০, ২৯১৩, ৪১৩৫, ৪১৩৭)
একেই বলে ভরসা, আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।
নবী করীম (ছাঃ) গিরিগুহায় :
আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘(ছাওর) গিরিগুহায় থাকাকালে আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললাম, (হে আল্লাহর রাসূল!) কেউ যদি তার দু’পায়ের নিচ দিয়ে তাকায় তাহ’লে তো সে অবশ্যই আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, হে আবুবকর! দু’জন ভাবছ কি? আল্লাহ তো তাদের (আমাদের) তৃতীয়জন’। (বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৭১।)
এই হ’ল ভরসা ও আল্লাহতে সমর্পণ, যা ভীষণ সঙ্কট কালে বান্দার থেকে খোলাখুলি ফুটে উঠেছে। বান্দা অন্তর থেকে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার উপর ভরসা করেছে এবং তার নিকটেই নিজের যাবতীয় কাজ অর্পণ করেছে, বিশেষ করে যখন আল্লাহর নিকট সমর্পণ ব্যতীত তার আর কোন অবলম্বন অবশিষ্ট নেই।
জনৈকা মহিলা ও তার ছাগপাল :
মহিলা ও তার ছাগল পালের ঘটনায় তাওয়াক্কুলের গুরুত্বের চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়েছে। ভরসা করলে একজন মানুষ কী ফল লাভ করতে পারে সে কথাও এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) তাঁর গ্রন্থে নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।
 ‘জনৈকা মহিলা মদীনায় বাড়ীতে ছিল। অতঃপর সে মুসলিম সেনাদলের সাথে যুদ্ধে যাত্রা করেছিল। বাড়ীতে সে ১২টা ছাগল এবং তার কাপড় বুননের একটা তাঁত/কাঁটা/মাকু রেখে গিয়েছিল। বাড়ী ফিরে এসে সে দেখে, তার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর তার সেই তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। সে তখন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলল, হে আমার মালিক! তুমি তো তোমার রাস্তায় যে বের হবে তার হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছ। এদিকে আমি তোমার রাস্তায় বের হয়ে ফিরে এসে দেখছি আমার ছাগপাল থেকে একটা ছাগল আর আমার কাপড় বুননের তাঁত/কাঁটা/মাকু নেই। আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি, আমার ছাগল ও তাঁত/কাঁটা/মাকু ফিরিয়ে দাও। উক্ত মহিলা তার মালিকের নিকট কঠিনভাবে যে শপথ করেছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বার বার তার উল্লেখ করলেন। অবশেষে মহিলাটি সকাল বেলা তার ছাগল ও অনুরূপ একটা ছাগল আর তাঁত/কাঁটা/মাকু এবং অনুরূপ একটা তাঁত/ কাঁটা/মাকু ফিরে পেল’। (আহমাদ হা/২০৬৮৩; ছহীহাহ হা/২৯৩৫, হাদীছ ছহীহ।) সুবহানাল্লাহ! কী ভীষণ ব্যাপার!!
এই মহিলা আল্লাহর উপর প্রকৃত অর্থে ভরসা করেছিল। ফলে আল্লাহ কেবল তার ছাগলই হেফাযত করেননি; বরং তাওয়াক্কুলের বরকতে তাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।
জনৈকা মহিলা ও তার চুলা :
ইমাম আহমাদ (রহঃ) আরেকটি ঘটনা তাঁর সনদে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘অতীতকালে দু’জন স্বামী-স্ত্রী ছিল। ধন-সম্পদ বলতে তাদের কিছুই ছিল না। স্বামী বেচারা একদিন সফর করে বাড়ী ফিরে এল। সে ছিল প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে সে তার স্ত্রীর নিকটে বলল, তোমার কাছে খাবার মত কিছু আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ, সুসংবাদ শোন তোমার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক এসেছে। [তার কাছে আসলে কিছুই ছিল না, কেবলই আল্লাহর উপর আশা-ভরসা ও নির্ভর করে সে একথা বলেছিল]। পুরুষ লোকটা বলল, তোমার ভাল হোক, তোমার কাছে কিছু থাকলে একটু জলদি কর। সে বলল, হ্যাঁ আছে বৈকি। একটু ছবর কর, আমরা আল্লাহর রহমতের আশা করছি। এভাবে যখন তার ক্ষুধা দীর্ঘায়িত হয়ে চলল তখন সে তার স্ত্রীকে বলল, তোমার উপর রহম হোক, ওঠো, দেখ, তোমার কাছে রুটি-টুটি থাকলে তা নিয়ে এস। আমি তো ক্ষুধায় একবারে শেষ হয়ে গেলাম। স্ত্রী বলল, এই তো চুলা পেকে এল বলে, তাড়াহুড়ো কর না। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলে যখন স্বামীটা আবার কথা বলবে বলবে এমন সময় স্ত্রী মনে মনে বলল, আমি উঠে গিয়ে আমার চুলাটা দেখি না। সে গিয়ে দেখল, চুলা ছাগলের সিনার/রানের গোশতে ভরপুর হয়ে আছে, আর তার যাঁতা দু’টো থেকে আটা বের হয়ে চলেছে। সে যাঁতার নিকট গিয়ে তা ঝেড়ে মুছে আটা বের করে নিল এবং চুলা থেকে ছাগলের সিনার/রানের গোশত বের করে আনল। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যাঁর হাতে আবুল কাসেম মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবন তাঁর শপথ! মহিলাটি যদি তার দু’যাঁতায় যা আটা ছিল এবং ঝাড়ামুছা না করত তাহ’লে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত যাঁতাটি তাকে আটা দিয়ে যেত’। (আহমাদ হা/৯৪৪৫, হায়ছামী মাজমাউয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে (হা/১৭৮৭৪)এর বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। তবে শায়খ আলবানী ও শু‘আয়েব আরনাউত যঈফ বলেছেন। ছহীহাহ হা/২৯৩৭-এর আলোচনা দ্রঃ।)
ওমর (রাঃ) ও কুষ্ঠরোগী এবং খালিদ (রাঃ) ও বিষ :
হাদীছের গ্রন্থগুলোতে দু’টি ঘটনার উল্লেখ আছে কিছু লোক যা দুষ্কর মনে করে।
একটি ঘটনা ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। তিনি একজন কুষ্ঠরোগীর সাথে বসে খেয়েছিলেন। (তিরমিযী হা/১৮১৭, সনদ যঈফ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/২৫০২২; মূল বইয়ে ভুলবশতঃ ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ছাপা হয়েছে।)
দ্বিতীয় ঘটনা হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর বিষ পানের সাথে জড়িত। আবুস সাফার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার খালিদ বিন ওয়ালীদ হিরা নগরে অবস্থান করছিলেন। তখন লোকেরা তাকে বলল, ‘আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন, অনারবরা যেন আপনাকে বিষ পান না করিয়ে দেয়। তিনি তখন বললেন, তোমরা আমার নিকট বিষ নিয়ে এস। তাঁর নিকট বিষ নিয়ে আসা হ’ল। তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা পান করে নিলেন। বিষে তার মোটেও কোন ক্ষতি হ’ল না’। (মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৭১৮৬।)
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলার উপর তাঁর কঠিন তাওয়াক্কুলের নিদর্শন মেলে।
আলেমগণ এ ঘটনার বেশ কিছু দিক উল্লেখ করেছেন। যেমন-
(১) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রোগ সংক্রমণের বিষয়কে দৃঢ়ভাবে নাকচ করতে চেয়েছেন এবং কুষ্ঠরোগী থেকে নবী করীম (ছাঃ)-এর দূরে থাকার আদেশ লঙ্ঘন করতে চাননি।
(২) ওমর (রাঃ) কুষ্ঠ রোগীকে সমবেদনা জানাতে এরূপ করেছিলেন।
(৩) যে আল্লাহর উপর শক্তিশালী ভরসা রাখে সে হাদীছلاَ عَدْوَى ‘রোগ সংক্রমণ বলে কিছু নেই’-এর উপর আমল করবে; আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলে দুর্বল সে ‘কুষ্ঠরোগী থেকে পালিয়ে যাও’ (فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ) হাদীছের উপর আমল করবে। (বুখারী হা/৫৭০৭; মিশকাত হা/৪৫৭৭।)
আর খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থ ভরসা করেছিলেন বলেই বিষ তাঁর উপর কোনই ক্রিয়া করতে পারেনি। তাই বলে অন্য কারো জন্য বিষ পানে খালিদ (রাঃ)-এর অনুকরণ আদেশ সিদ্ধ হবে না। বিদ্বানগণ তাঁর ঘটনারও বেশ কিছু দিক তুলে ধরেছেন। যেমন-
(১) এটি ছিল খালিদ (রাঃ)-এর কারামত। তাই অন্য কারো পক্ষে তার অনুসরণ বৈধ হবে না। নচেৎ বিষের প্রভাবে সে নিহত হ’তে পারে।
(২) হ’তে পারে যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে খালিদের জন্য এমন কোন অঙ্গীকার ছিল যে, বিষ তাকে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই খালিদ (রাঃ) আল্লাহর উপর ভরসা করে তা পান করে নিয়েছিলেন।[24]
(৩) কিছু বর্ণনায় এসেছে, শত্রুপক্ষ যাতে এ দৃশ্য দেখে তার অনুগত হয় এবং মুসলমানদের জান-মালের কোন ক্ষতি না করে সেজন্য তিনি বিষ পান করেছিলেন।
ঋণ গ্রহিতা ও আল্লাহকে স্বাক্ষী মানা
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বনী ইসরাঈলের কোন এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অপর ব্যক্তির নিকট এক হাযার দীনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আন, আমি তাদের সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর ঋণদাতা বলল, তাহ’লে একজন যামিনদার উপস্থিত কর। সে বলল, যামিনদার হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যিই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাযার দীনার দিয়ে দিল। তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাযার দীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জান, আমি অমুকের নিকট এক হাযার দীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিন হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তাতে সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথা সময়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার নিকট সোপর্দ করলাম। এই বলে সে কাষ্ট খন্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠ খন্ডটি সমুদ্রে ভেসে চলল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়ত ঋণগ্রহীতা কোন নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠ খন্ডটির উপর পড়ল, যার ভিতরে মাল ছিল। সে কাষ্ট খন্ডটি তার পরিবারের জ্বালানীর জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাযার দীনার নিয়ে হাযির হ’ল এবং বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সব সময় যানবাহন খুঁজেছিলাম। কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হ’তে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাযার দীনার নিয়ে ফিরে চলে এল। (বুখারী হা/২২৯১, ‘কিতাবুল কিফালাহ’)।
আল্লাহর উপর ভরসাতেই খাদ্যের ব্যবস্থা
নবি করিম (সাঃ) একদিন সাহাবী মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) কে বললেন, মুয়াজ ইবনে জাবাল তুমি ইয়েমেনে যাও। সেখানে তুমি ইসলামের দাওয়াত দাও। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) ইয়েমেনে চলে গেলেন এবং ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে মুসলমানের সংখ্যা ২/৩শ ছাড়িয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে কাফের-মুশরিকদের মাথা নষ্ট হয়ে গেল। তারা মুসলমানদের উপর অন্যায় অত্যাচার শুরু করে দিল। অন্যায় অত্যাচার জুলুম নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পেলে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) নবি করিম (সাঃ) এর নিকট চিঠি লিখলেন। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করলেন যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এখানকার অবস্থা ভাল না, ইতিমধ্যে এখানে ২/৩শ মুসলমান হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে কাফের-মুশরিকরা আমাদের উপর অনেক অন্যায় অত্যাচার করছে। এখন আমরা কী করবো। উত্তরে নবি করিম (সাঃ) মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে বললেন, হে মুয়াজ ইবনে জাবাল, তুমি মুসলমানদের নিয়ে মদিনায় চলে এসো। আদেশ পেয়ে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) মুসলমানদের নিয়ে মদিনায় চলে এসে নবি করিম (সাঃ)-কে সালাম দিলেন। নবি করিম (সাঃ)মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে বললেন, হে মুয়াজ তুমি এই ইয়েমেনবাসীদের নিয়ে ঐ মরুভূমিতে বসবাস শুরু করে দাও। ওখানে তাদেরকে ইমাম দিবো, মুয়াজ্জিন দিবো, যাতে ইয়েমেনবাসী দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। এরপর কোনো সমস্যা হলে তোমরা আমার নিকট এসো। বসবাসের বেশ কিছু দিন পর তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিল। ইয়েমেনবাসী সকলে মিলে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে খাদ্যের জন্যে নবি করিম (সাঃ) এর নিকট পাঠালেন। আব্দুল্লাহ হাঁটতে হাঁটতে মসজিতে নব্বিতে পৌঁছতে সকাল প্রায় সাতটা বেজে গেছে। এসে দেখেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইশরাকের সলাত আদায় করছেন এবং সলাতে  সুরা হুদ তেলোয়াত করছেন। পিছনে থেকে আব্দুল্লাহ সেই তেলোয়াত শুনছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তেলোয়াত করছেন, وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
আর পৃথিবীতে কোন বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে। (সুরা হুদ-আয়াত-৬)।
আব্দুল্লাহ এই তেলোয়াত শুনে, ভাবতে লাগলেন- সকল প্রাণীর রিজিক যেখানে আল্লাহ তায়ালা ব্যবস্থা করেন, সেখানে রাসুল (সাঃ) এর নিকট খাদ্য চেয়ে কোনো লাভ হবে না। আব্দুল্লাহ রাসুল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাত না করেই নিজ এলাকায় ফিরে এসে সবাইকে ঘোষণা দিলেন যে, খাদ্য আসছে। কিন্তু সারা দিন যায় খাদ্য আসে না, রাত হয়ে যায় খাদ্য আসে না। ইয়েমেনবাসী আব্দুল্লাহকে বলল কোথায় খাদ্য? সকলে তো ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। আব্দুল্লাহ বলল, খাদ্য আসছে। রাত প্রায় ১০টার দিকে দেখা গেলো, দুইজন লোক খাদ্য রান্না করে নিয়ে তাদের নিকট হাজির। ইয়েমেনবাসী সকলে পরম তৃপ্তিসহকারে খাদ্য খেল এবং বেশ কিছু খাদ্য অবশিষ্ট রয়ে গেল। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে, উক্ত অবশিষ্ট খাদ্য তারা রাসুল (সাঃ)-কে প্রদান করবেন। পরদিন সকালে উক্ত খাদ্যগুলো নিয়ে ৫/৬ জন লোক (আব্দুল্লাহসহ) রাসুল (সাঃ) এর নিকট হাজির হলো এবং বলল যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আপনি যে খাদ্যগুলো প্রেরণ করেছিলেন, তার কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেছে এগুলো আমরা আপনাকে দিতে এসেছি। রাসুল (সাঃ) একথা শুনে বললেন, আমি তো কোনো খাদ্য প্রেরণ করিনি। আর আমার নিকট তো কেউ আসেনি। ইয়েমেনবাসী বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ আমাদের খাদ্য সংকট দেখা দিলে আমরা এই আব্দুল্লাহকে আপনার নিকট গতকাল প্রেরণ করেছিলাম। রাসুল (সাঃ) বললেন, আব্দুল্লাহ তো আমার নিকট আসে নি। আব্দুল্লাহ বলল, আমি এসেছিলাম। এসে দেখি, আপনি ইশরাকের সলাত আদায় করছেন এবং সলাতে সুরা হুদ তেলোয়াত করছেন। আর বলছেন, সকল জীবের খাদ্যদাতা একমাত্র আল্লাহ। তাই আপনার নিকট খাদ্য না চেয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে ফিরে গেলাম। এরপর এই ঘটনা ঘটল।
একথা শুনে রাসুল (সাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ার পক্ষ থেকে এ খাদ্য রান্না করে পাঠানো হয়েছে।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা উল্লেখিত ঘটনাগুলো এটাই শিক্ষা দেয় যে, আমরা সকল কাজে কর্মে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপরই ভরসা করবো। সকল সমস্যার সমাধানকারী যেখানে আল্লাহ। সেখানে আমরা কেনো অন্যের নিকট সাহায্য চাইবো? (সমাপ্ত)


No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...