বিসমিল্লাহির
রাহমানির রাহিম
মজুদদারী বা মুনাফাখোরীদের ভয়াবহ পরিনতি
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সদস্যরা একে অপরের
উপর নির্ভরশীল। কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে তার প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহ
করা সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় তথা ব্যবসার মাধ্যমে পণ্য
বিক্রয় ও মুনাফা লাভের বিধান প্রবর্তন করেছেন। খ্যাতনামা ফকীহ ইবনু কুদামা (রহঃ) এ
প্রসঙ্গে বলেন,
‘সার্বিকভাবে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হওয়ার ব্যাপারে
সকল মুসলমান ঐক্যমত পোষণ করেছেন। আর প্রজ্ঞার দাবীও তাই। কেননা মানুষের প্রয়োজন তার
সাথীর নিকট যা রয়েছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট। অথচ তার সাথী বিনিময় ব্যতীত তা প্রদান করবে
না। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয় বিধিসম্মত ও জায়েয করে তাদের উভয়েরই উদ্দেশ্যে পৌঁছা ও প্রয়োজন
পূরণ করার পথ প্রবর্তন করা হয়েছে’। (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী
(রিয়াদ: দারু আলামিল কুতুব, ৩য় সংস্করণ, ১৪১৭হিঃ/১৯৯৭খ্রিঃ), ৬/৭)।
সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা অবলম্বন করা
এবং সর্ব প্রকার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সুসংবাদ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন,
আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা (আখিরাতে) নবীগণ, সিদ্দীকগণ
(সত্যবাদীগণ) ও শহীদগণের সাথে থাকবে। (সুনান আত তিরমিজী
(তাহকীককৃত) ১২০৯; গায়াতুল মারাম ১৬৭, সুনানে দারেমী (দামেশক: দারুল কলম, ১৪১৭ হিঃ/১৯৯৬খ্রিঃ), ২/৬৯৮, হা/২৫৩৯; আল-হাকেম আন-নায়সাপুরী,
আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪১১হিঃ/১৯৯০খ্রিঃ),
২/৮; ছহীহ তারগীব হা/১৭৮২, ছহীহ লি-গায়রিহী; তারাজু‘আতুল আলবানী হা/১৪৪)। হাদিসের মানঃ
যঈফ (Dai'f)।
অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী পণ্য ক্রয় করে, বিক্রয়
করে এবং সত্য কথা বলে সে ক্বিয়ামতের দিন উক্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের সাথে থাকবে। এটি
বিশাল একটি মর্যাদা। যা এই পেশার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নির্দেশ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
আরো বলেন,
উবায়দ
ইবনু রিফা’আহ্ তাঁর পিতার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন,
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে ব্যবসায়ীগণ
বদকাররূপে উপস্থিত হবেন। অবশ্য যারা মুত্তাক্বী, পরহেযগার, নেককার ও সত্যবাদী হবেন
তারা এরূপ হবেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৯৯,
সুনান আততিরমিযী ১২১০, সুনান ইবনু মাজাহ ২১৪৬, সহীহাহ্ ১৪৫৮, ৯৯৪, দারিমী ২৫৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
রাফি
ইবনু খাদীজ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল!
কোন্ ধরনের উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, নিজের
হাতের কাজ (কায়িক পরিশ্রমের কাজ) এবং প্রত্যেক সঠিক ক্রয়-বিক্রয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭৮৩, আহমাদ ১৭২৬৫, সহীহাহ্ ৬০৭,
সহীহ আত্ তারগীব ১৬৮৮, শু‘আবুল ঈমান ৮৩৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
যে ব্যবসায় মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা ও সংশয়
থাকে না তাকে ‘বায়য়ে মাবরূর’ বলে।
কাতাদা (রহঃ) বলেন, আল্লাহর রিযিকের মধ্যে
একটি রিযিক এবং আল্লাহর হালালকৃত বস্ত্তগুলির মধ্যে একটি হালাল ঐ ব্যক্তির জন্য, যে
সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে ব্যবসা করে’। (বায়হাকী, আস-সুনানুল
কুবরা (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪১৪হিঃ /১৯৯৪খ্রিঃ), ৫/৪৩২)।
ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে জাতীয় ও সামষ্টিক
স্বার্থকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছে। এজন্য যেসব কারবারের ফলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী
বিশেষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, আর আপামর জনসাধারণের ওঠে নাভিশ্বাস, সেসব কারবারকে নিষিদ্ধ
ঘোষণা করেছে। অত্যধিক মুনাফা লাভের প্রত্যাশায় মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী
মজুদ করে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার পদতলে তাদেরকে পিষ্ট করা এবং খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য
পণ্যে ভেজাল প্রদান করে মুনাফা লুটে নেয়া তেমনি নিষিদ্ধ কারবার। উপরন্তু এগুলো অন্যায়ভাবে
অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার শামিল। আর আল্লাহ রববুল আলামীন কুরআন মাজীদে অন্যায়ভাবে অন্যের
সম্পদ ভক্ষণ করার বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ বাণী উচ্চারণ করে হুঁশিয়ারী প্রদান করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের
পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত। আর তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ
তোমাদের প্রতি দয়াশীল’ (নিসা ৪/২৯)। সাইয়িদ
কুতুব (রহঃ) বলেন,
‘মুমিনদের মধ্যে সম্পদ আবর্তনের প্রত্যেক পদ্ধতি
যার অনুমতি আল্লাহ দেননি বা তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন তার সবই অন্যায়ভাবে অন্যের মাল
ভক্ষণ করার মধ্যে শামিল রয়েছে। যেমন- প্রতারণা, ঘুষ, জুয়া, মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করা এবং সকল প্রকার অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়’। (সাইয়িদ কুতুব, ফী যিলালিল কুরআন (জেদ্দা: দারুল ইলম, ১২তম সংস্করণ,
১৪০৬হিঃ/১৯৮৬খ্রিঃ), ৫/৬৩৯)।
এখানে
মুনাফাখোরী সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হলোঃ-
মুনাফার সংজ্ঞা
মুনাফা শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে رِبْحٌ । যেমন বলা হয়, ‘ব্যবসায়ী
তার ব্যবসায় লাভ করেছে’, ‘তার ব্যবসা লাভজনক হয়েছে’। (আল-মাওসূ‘আতুল
ফিক্বহিয়্যাহ (কুয়েত: ওযারাতুল আওক্বাফ ওয়াশ শুউন আল-ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ ১৪১২হিঃ/১৯৯২
খ্রিঃ), ২২/৮৩; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত (নয়াদিল্লী : দার লিইশা‘আতে ইসলামিয়াহ, তাবি), পৃ:
৩২২)।
কুরআন মাজীদ ও হাদীছে এ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ
লক্ষ্য করা যায়। যেমন আল্লাহ রববুল আলামীন বলেন, ‘কিন্তু তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি
এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত হয়নি। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/১৬)।
আবূ
হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ তোমরা কাউকে মসজিদে বেচা-কেনা করতে দেখলে বলবে, আল্লাহ তোমার এ ব্যবসায়ে তোমাকে
লাভবান না করুন। এভাবে কাউকে মসজিদে হারানো জিনিস অনুসন্ধান করতে দেখলে বলবে, আল্লাহ
তা তোমাকে ফেরত না দিন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৭৩৩,
সুনান আততিরমিযী ১৩২১, ইরওয়া ১২৯৫, দারিমী ১৪৪১)।
আর মুনাফার ইংরেজী প্রতিশব্দ Profit। মুনাফার
সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ড. মাহমূদ আব্দুর রহমান আব্দুল মুনঈম বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের
মাধ্যমে সম্পদ বা মূলধন বৃদ্ধি হওয়া’। (ড. মাহমূদ আব্দুর
রহমান আব্দুল মুনঈম, মু‘জামুল মুছতালাহাত ওয়াল আলফায আল-ফিক্বহিয়্যাহ (কায়রো: দারুল
ফাযীলাহ, ১৯৯৯), ২/১২০)।
ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদূন বলেন,‘সস্তায়
পণ্য ক্রয় করে বেশী দামে বিক্রি করে মূলধনের প্রবৃদ্ধি ঘটানোর মাধ্যমে উপার্জনের প্রচেষ্টা
চালানো হ’ল ব্যবসা। ...আর ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত এ বাড়তি পরিমাণটাকেই
বলা হয় মুনাফা’। (মুক্বাদ্দামা ইবনে খালদূন (কায়রো: দারু ইবনিল জাওযী, ১৪৩১/২০১০),
পৃ: ৩২৮)।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানী মুনাফার সংজ্ঞা প্রদান
করতে গিয়ে বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত
বাড়তি সম্পদকে মুনাফা বলা হয়। ... পরে তা পরোক্ষ অর্থে কর্মের ফল হিসাবে যা ফিরে আসে
তা বোঝায়’। (রাগিব ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল
কুরআন (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, ১৪২০ হিঃ), পৃ: ১৯১)।
মোদ্দাকথা হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত
লভ্যাংশকে বলা হয় মুনাফা। আর মিথ্যা, ধোঁকা ও অবৈধ উপায়ে লাভ করার নেশায় যে মত্ত থাকে
তাকে বলা হয় মুনাফাখোর (Profiteer)।
সূদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য
অনেকে সূদ ও মুনাফাকে একই মনে করেন। এমনকি
‘সূদ তো মুনাফার মতই’ বলতেও দ্বিধা করেন না। অথচ এ দুই এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা
নিম্নরূপঃ
(ক) সূদ
হলো একই জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা, যা হারাম। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ স্বর্ণ স্বর্ণের বিনিময়ে,
রূপা রূপার বিনিময়ে, গম গমের বিনিময়ে, যব যবের বিনিময়ে, খেজুর খেজুরের বিনিময়ে, লবণ
লবণের বিনিময়ে লেনদেন করা হলে, সেক্ষেত্রে সমপরিমাণে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে নগদে আদান
প্রদান করতে হবে। আর যে ব্যক্তি একই জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে বেশি দেয় ও বেশি দাবী করে
বেশি গ্রহণ করবে, তাহলে সে সুদ লেনদেনকারী বলে গণ্য হবে। অতএব এ ব্যাপারে গ্রহীতা ও
দাতা উভয়েই সমান অপরাধী। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮০৯,
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৪৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৮৪, ১৫৮৮, আহমাদ ১১৯২৮)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
আর মুনাফা হলো হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত
লভ্যাংশ।
(খ) সূদ
হ’ল ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূল অর্থের সাথে প্রদেয় অতিরিক্ত
অর্থ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক ঋণ যা লাভ নিয়ে আসে, সেটিই সূদ’। (ইরওয়া হা/১৩৯৭-এর আলোচনা দ্রঃ)।
পক্ষান্তরে মুনাফা হ’ল উৎপাদনের মূল্য ও উৎপাদন
খরচের পার্থক্য।
(গ) সূদ
পূর্ব নির্ধারিত। অপরপক্ষে মুনাফা অর্জিত হয় পরে।
(ঘ) সূদে
কোন ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা নেই। অপরপক্ষে কোন উদ্যোগে বা কারবারে মুনাফা না হয়ে লোকসানও
হ’তে পারে। এক্ষেত্রে মূলধন সরবরাহকারী এবং উদ্যোক্তা উভয়ের ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা
বিদ্যমান।
(ঙ) সূদ
কখনই ঋণাত্মক হ’তে পারে না। বড় জোর খুবই কম
বা তাত্ত্বিকভাবে শূন্য হ’তে পারে। মুনাফা ধনাত্মক, শূন্য এমনকি ঋণাত্মক (অর্থাৎ লোকসান)
হ’তে পারে।
(চ) সূদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগ
করে না। পক্ষান্তরে মুনাফা উদ্যোক্তা ও পুঁজির যোগানদাতার সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ফল।
(প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, সূদ (রাজশাহী
: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, ২০১০), পৃ: ১০-১১)।
ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফাখোরী
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল
করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
ব্যবসার লক্ষ্য হ’ল সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটানো
বা মুনাফা লাভ করা। ব্যবসার মাধ্যমে মূলধনের মুনাফা লাভ ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েয। মহান
আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তোমাদের
পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত...’ (নিসা ৪/২৯)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু
কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘ধন-সম্পদ উপার্জনে তোমরা অবৈধ পন্থা সমূহ অবলম্বন করো না। তবে ক্রেতা
ও বিক্রেতার সম্মতিতে বৈধ ব্যবসা করো এবং এর মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করো’। (হাফেয ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (কায়রো: মাকতাবাতুছ
ছাফা, ১৪২৫হিঃ/২০০৪খ্রিঃ), ২/১৬১)।
মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে হালাল উপায়ে যে মুনাফা
বা লাভ অর্জন করে, কুরআন মাজীদে তাকে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ (فضل الله) বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ
বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর’। (সুরা জুমু‘আহ ৬২/১০)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে
দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বের হবে’। (সুরা মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় হালাল-হারাম বাছ-বিচার
না করে যেকোন উপায়ে মুনাফা অর্জনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে অবৈধ
ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত মুনাফা অবৈধ বা হারাম। কারণ তা শোষণের হাতিয়ার।
ইসলামী শরী‘আতে মুনাফা বা লাভের কোন পরিমাণ
নির্ধারিত নেই। বরং তা সাধারণ বাজারদরের উপর নির্ভরশীল। মূলতঃ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে
লক্ষ্যণীয় হলোঃ
(১) তাতে যুলুম না থাকাঃ
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যুলম থেকে বেঁচে থাকবে, কারণ কিয়ামতের (কিয়ামতের)
দিন যুলম অন্ধকারের ন্যায় গ্রাস করবে। আর কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কারণ কৃপণতা তোমাদের
পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতাই তাদেরকে প্ররোচিত করেছে রক্তপাতের জন্য এবং
হারাম কাজকে হালাল করার দিকে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
১৮৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৭৮, আহমাদ ১৪৪৬১,
সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৫০১, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৪১৬১, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্
৮৫৮, সহীহ আত্ তারগীব ২২১৫, সহীহ আল জামি ১০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২) ক্রেতা-বিক্রেতা
উভয়ের সম্মতি। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ঘোষণা করেছেন,
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি
অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ’’। (সুরা নিসা ৪/২৯)।
আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ক্রয়-বিক্রয় কেবল পারস্পরিক সম্মতিতে অনুষ্ঠিত
হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ২১৮৫, ইরওয়া ১২৮৩, ইবনু হিববান
৪৯৬৭; ইরওয়াউল গালীল ১২৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উরওয়া বিন আবিল জা‘দ আল-বারেকী (রাঃ) থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট পশুর একটি চালানের
সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দীনার দিয়ে বললেন, উরওয়া! তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের
জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের
সাথে দরদাম করে এক দীনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক
লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হ’ল। লোকটি বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সাথে দরদাম করল। তখন
আমি তার নিকট এক দীনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও এক দীনার
নিয়ে চলে এলাম। এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এই হচ্ছে আপনার দীনার এবং এই হচ্ছে
আপনার বকরী। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটা তুমি কিভাবে করলে? উরওয়া (রাঃ) বলেন, আমি তখন
তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার হাতের লেন-দেনে
বরকত দিন’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৬৪২, সুনান
আবূদাঊদ ৩৩৮৪, সুনান আততিরমিযী ১২৫৮; আহমাদ ১৯৩৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, বৈধভাবে শতভাগ
লাভ করলেও তাতে কোন সমস্যা নেই।
সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের এক ফৎওয়ায়
বলা হয়েছে, الإسلامية،
‘ব্যবসায়ে লাভ বা মুনাফা নির্ধারিত নেই। বরং সরবরাহ ও চাহিদার অবস্থা অনুপাতে মুনাফা
কম বা বেশী হতে পারে। কিন্তু মুসলিম ব্যক্তি ব্যবসায়ী হৌক বা অন্য কেউ হোক তার জন্য
উত্তম হল, ক্রয়-বিক্রয়ে সরল ও উদার হওয়া এবং ক্রেতার সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ক্রয়-বিক্রয়ে
ধোঁকা না দেয়া। বরং সে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অধিকার সমূহের প্রতি খেয়াল রাখবে’। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৩/৯১, ফৎওয়া নং ৬১৬১)।
সঊদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল
আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) এক ফৎওয়ায় বলেন,
‘লাভ বা মুনাফার কোন পরিমাণ নির্ধারিত নেই।
বরং বেশী ও কম লাভ করা জায়েয। তবে বাজারে পণ্য যদি নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট মূল্যে মওজুদ
থাকে তাহলে বিক্রেতার জন্য মানুষকে ধোঁকা দেয়া ঠিক নয়। বরং তার কর্তব্য হল মানুষকে
জানিয়ে দেয়া যে, এই দ্রব্যটি এত মূল্যে (বাজারে) মওজুদ আছে। কিন্তু আমি এই মূল্যে আমার
এই পণ্যটি বিক্রি করব না। এক্ষণে ক্রেতা যদি বেশী মূল্যে তা ক্রয় করতে পসন্দ করে তাতে
কোন দোষ নেই। তবে বিক্রেতা বাজার দাম সম্পর্কে মানুষকে অবগত করবে। আর মূল্য যদি নির্ধারিত
না থাকে তাহলে সে যেকোন মূল্যে বিক্রি করতে পারে’।
ইসলাম সূদের মাধ্যমে মুনাফা লাভের পন্থাকে
হারাম ঘোষণা করেছে। তার পরিমাণ কম বা বেশী যাই হোক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ!
আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের পাওনা যা বাকী রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যিকারের
মুমিন হয়ে থাক’। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৭৮)।
ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সুদের মাধ্যমে সম্পদ (বাহ্যত)
বেশি হলেও পরিণামে তা স্বল্পই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
২৮২৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৯, আহমাদ ৩৭৫৪, শু‘আবুল ঈমান ৫১২৩ সহীহ আল জামি ৩৫৪২)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
সারকথা হলো ইসলামী অর্থনীতিতে বৈধ ও সুবিচারপূর্ণ
মুনাফা হচ্ছে-
(১) যা সাধারণ সুস্থ-শান্ত অবস্থায় চাহিদা ও সরবরাহের
নিয়মাধীন উন্মুক্ত স্বাধীন বাজারে লেনদেনের দরুন অর্জিত হয়।
(২) উৎপাদন ব্যবস্থা ও পণ্য বিক্রয়ের কাজে নিযুক্ত
শ্রমজীবিদের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করার পর ব্যবসায়ীদের নিকট যতটা উদ্বৃত্ত থাকবে।
(৩) ব্যবহারকারীদের ক্রয়ক্ষমতা থেকে আনুপাতিক মূল্যে
যা অর্জিত হবে। (মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, ইসলামী
অর্থনীতি বাস্তবায়ন (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮০), পৃ: ১৪)।
মুনাফাখোরী প্রতিরোধে ইসলামের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ
ইসলাম মুনাফাখোরীকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে
এবং তা প্রতিরোধের জন্য কয়েক ধরনের কারবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যথা-
(১) পণ্যমূল্য জানে না এমন ক্রেতার নিকট থেকে
বেশী মূল্য আদায় করা ইসলামে নিষিদ্ধ এবং এটা এক ধরনের ধোঁকার শামিল। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ
(রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন,
‘কোন বিক্রেতা সম্পর্কে যদি জানা যায় যে, সে
ক্রেতাদেরকে ধোঁকা দেয় তাহ’লে সে শাস্তির হকদার হবে। এমনকি আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর
আনুগত্য অবলম্বন না করা পর্যন্ত তাকে মুসলমানদের বাজারে বসা থেকে নিষেধ করা হবে। অন্যদিকে
প্রতারিত ব্যক্তি বিক্রয় ভঙ্গ করে পণ্য ফিরিয়ে দিয়ে মূল্য গ্রহণ করতে পারে। আর যদি
এই অত্যাচারী প্রতারক তওবা করে এবং অত্যাচারিতদের কাছে তাদের পাওনা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব
না হয়, তাহলে সে ক্রেতার সাথে কৃত প্রতারণা ও যুলুমের পরিমাণ মাফিক ছাদাক্বা করবে।
যাতে এর দ্বারা আল্লাহর যিম্মা (পাকড়াও) থেকে সে রেহাই পায়’। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া (সঊদী আরব: আর-রিআসাহ আল-আম্মাহ
লিশুঊনিল হারামাইন আশ-শরীফাইন, তাবি), ২৯/৩৬০-৩৬১)।
(২) অনেক
সময় ব্যবসায়ীরা বেশী মুনাফা অর্জনের জন্য নিজের পণ্যের প্রশংসা করে মিথ্যা কসম করে।
এতে হয়ত সাময়িক লাভ হয়, কিন্তু এরূপ ধোঁকাপূর্ণ ব্যবসায়ে বরকত থাকে না। আবূ হুরাইরাহ্
(রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে
বলতে শুনেছি, মিথ্যা কসম পণ্য চালু করে দেয় বটে, কিন্তু বরকত নিশ্চিহ্ন করে দেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন ২০৮৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৪০১৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬০৬, সুনান আবূদাঊদ ৩৩৩৫, আহমাদ ২২৬০১, আধুনিক প্রকাশনীঃ
১৯৪২ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
ব্যবসায়ে পণ্যের কাটতি বাড়ানোর জন্য রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) কসম করাকে নিষেধ করেছেন স্পষ্ট ভাষায়।
আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ, আবূ কুরায়ব ও ইসহাক
ইবনু ইব্রাহীম (রহঃ)...আবূ কাতাদাহ্ আনসারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে, তোমরা বিরত থাকো ব্যবসায়ের মধ্যে অধিক কসম
খাওয়া থেকে। কেননা সেটা পণ্য বিক্রয়ে সহায়তা করে কিন্তু বারাকাত বিনষ্ট করে করে
দেয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০১৮, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ১৬০৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২২০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৮১, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৮০)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
ব্যবসা-বাণিজ্যে অত্যধিক কসম করা নিষিদ্ধ হওয়ার
কারণ সম্পর্কে শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল
বালিগাহ’তে বলেন,
‘দু’টি কারণে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অত্যধিক
কসম করা অপসন্দনীয়। ১. এটা ক্রেতাদের ধোঁকা দেওয়ার শামিল। ২. তা হৃদয় থেকে আল্লাহর
নামের মর্যাদা দূরীভূত হওয়ার কারণ। আর মিথ্যা কসম পণ্যের কাটতি বৃদ্ধি করে। কেননা তখন
কাটতি বাড়ার ভিত্তি হয় ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়া এবং তা (মিথ্যা কসম) বরকত নির্মূল করে।
কেননা তার (বিক্রেতার) জন্য ফেরেশতামন্ডলীর দো‘আ বরকতের ভিত্তি। আর পাপের কারণে সেই
বরকত দূরীভূত হয়ে যায়। এমনকি ফেরেশতাগণ তার উপর বদদো‘আ করে’। (শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (বৈরূত: দারুল
কুতুব আল-ইলমিইয়াহ), ২/২০৩)।
(৩) নাজাশঃ নাজাশ শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে- অর্থাৎ কোন
জিনিসের অতিরিক্ত প্রশংসা করা। (মু‘জামুল মুছতালাহাত ওয়াল
আলফায আল-ফিক্বহিয়্যাহ, ৩/৪০০)।
এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ইবনু
হাযম আন্দালুসী (রহঃ) বলেন, ‘বিক্রেতা কর্তৃক জিনিস বিক্রি করার জন্য কাউকে নিযুক্ত
করা যাতে সে বেশী দাম বলে। বস্ত্ততঃ সে তা ক্রয় করার জন্য নয়; বরং অন্যকে প্রতারিত
করার জন্য এরূপ দাম বলে। যাতে ক্রেতা তার দাম শ্রবণ করে আরো বেশী দাম বলে’। (ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা বিল-আছার (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ,
তাবি), ৭/৩৭২)।
‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে,
‘নাজাশ হ’ল কেউ পণ্যের বেশী দাম বলবে অথচ তা কেনার ইচ্ছা তার নেই। এর দ্বারা সে বিক্রেতার
লাভ এবং ক্রেতার ক্ষতি সাধন করতে চায়’। (ইবনু রুশদ আল-কুরতুবী,
বিদায়াতুল মুজতাহিদ ওয়া নিহায়াতুল মুকতাছিদ (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪০৮হিঃ/১৯৮৮খ্রিঃ), ২/১৬৭)।
ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন নাজাশের মধ্যে এটিও অন্তর্ভুক্ত
যে, বিক্রেতা বলবে, আমি এই জিনিসটি এত দামে ক্রয় করেছি। অথচ সে মিথ্যাবাদী। ক্রেতা
যাতে ধোঁকায় পড়ে বেশী দামে ক্রয় করে সেজন্য সে মিথ্যা দামের কথা বলে। অথবা বিক্রেতা
বলবে, এই পণ্যের জন্য আমাকে এত দাম দেয়া হয়েছে। অথবা বলবে, এই পণ্যের এত মূল্য হাঁকা
হয়েছে। অথচ সে মিথ্যাবাদী। তার উদ্দেশ্য হ’ল ক্রেতাদেরকে ধোঁকা দেয়া। যাতে তার এই কল্পিত
মিথ্যা দামের চেয়ে তারা বেশী দাম বলে। এটিও নাজাশ। যা থেকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ
করেছেন।
এটি মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করা এবং মিথ্যা
বলে তাদের ধোঁকা দেয়া। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা বা দোকানদাররা যদি এ মর্মে ঐক্যমত পোষণ করে
যে, কোন পণ্য আমদানী হলে কেউ কারো চেয়ে বেশী দাম বলবে না। যাতে আমদানীকারক সস্তা মূল্যে
তাদের নিকট সেই পণ্যটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর সবাই এর সুবিধাভোগী হয়। শায়খ ছালেহ
ফাওযান বলেন, এটি হারাম, নাজাশের অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার
নামান্তর’। (ড. ছালেহ বিন ফাওযান, আল-বুয়ূ আল-মানহী আনহা
ফিল ইসলাম (রিয়াদ : মাকতাবাতুছ ছাফাদী, ১ম প্রকাশ, ১৪১১/১৯৯১), পৃঃ ২৪-২৫)।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রামবাসীর পক্ষে শহরবাসী কর্তৃক বিক্রয়
করা হতে নিষেধ করেছেন এবং তোমরা প্রতারণামূলক দালালী করবে না। কোন ব্যক্তি যেন তার
ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় না করে।
কেউ যেন তার ভাইয়ের বিবাহের প্রস্তাবের উপর
প্রস্তাব না দেয়। কোন মহিলা যেন তার বোনের (সতীনের) তালাকের দাবী না করে, যাতে সে তার
পাত্রে যা কিছু আছে, তা নিজেই নিয়ে নেয়। (অর্থাৎ বর্তমান স্ত্রীর হক নষ্ট করে নিজে
তা ভোগ করার জন্য)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২১৪০,
২১৪৮, ২১৫০, ২১৫১, ২১৬০, ২১৬২, ২৭২৩, ২৭২৭, ৫১৪৪, ৫১৫২, ৬৬০১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৩৩৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪১৩, সুনান আবূদাঊদ ৩৪৩৮, সুনান আননাসাঈ ৩২৩৯, আহমাদ ৯৫২৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৯৯২
, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২০০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, ، ‘এ ধরনের বিক্রয় নিষিদ্ধ
হওয়ার কারণ হ’ল, এটি ক্রেতার সাথে প্রতারণা করা ও তাকে ধোঁকা দেয়ার শামিল’। (আল-মুগনী,
৬/৩০৪-৫)।
ইবনে
উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাশ নিষিদ্ধ করেছেন।
(সুনান ইবনু মাজাহ ২১৭৩, ২১৭৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২১৪২, ৬৯৬৩, সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৭১০, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ১৫১৬, সুনান নাসায়ী ৪৪৯৭, ৪৫০৫, আহমাদ ৪৫১৭, ৫২৮২, ৫৮২৭৮, ৬৪১৫, মুয়াত্তা
মালেক ১৩৯২, দারেমী ২৫৬৭, বায়হাকী ৫০/২৭০, ইরওয়া ১৩১৮, গায়াতুল মারাম ৩৩৫, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন ৩৬৭৬, ইসলামিক সেন্টার ৩৬৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৪) তালাক্কীঃ
আল্লামা তাহের পট্টনী ‘তালাক্কী’র সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন,
‘গ্রামের লোক শহরে প্রবেশের পূর্বেই শহুরে
তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার সাথে আনীত পণ্যের বাজার মন্দার মিথ্যা সংবাদ প্রদান করবে
অল্পমূল্যে তা ক্রয় করার জন্য। এটাই হচ্ছে তালাক্কী’। (আব্দুর
রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪১০হিঃ/১৯৯০
খ্রিঃ), ৪/৩৪৫)।
ড. ওয়াহবা আয-যুহায়লী বলেন, শহুরে গ্রাম থেকে
পণ্য নিয়ে শহরের দিকে আগত লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের পণ্য কিনে নিয়ে পরে তার ইচ্ছামত
দামে শহর-নগরবাসীদের কাছে বিক্রি করাকে তালাক্কী বলে’। (ড.
ওয়াহবা আয-যুহায়লী, আল-ফিক্বহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু (দামেশক: দারুল ফিকর, ৩য় সংস্করণ
১৪০৯হিঃ/১৯৮৯খ্রিঃ), ৪/২৩৯)।
মুনাফাখোরীর পথকে রুদ্ধ করার জন্য রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বাজারে মাল আসার পূর্বেই বাইরে বাইরে এভাবে ক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ যেন অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের
সময় নিজের ক্রয়-বিক্রয়ের কথা না বলে। পণ্যদ্রব্য বাজারে উপস্থিত করার আগে তোমরা অগ্রগামী
হয়ে তা কিনতে যাবে না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৪৩৬,
সুনান ইবনু মাজাহ ২১৭১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২১৩৯, ২১৬৫, ৫১৪২, সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ৩৩৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪১২, সুনান আততিরমিযী ১২৯২, সুনান আননাসায়ী
৩২৪৩, ৪৫০৩, ৪৫০৪, আহমাদ ৪৫১৭, ৪৭০৮, ৫২৮২, ৫৩৭৫, ৫৮২৮, ৫৯৯৮, ৬০২৪, ৬০৫২, ৬১০০, ৬২৪০,
৬৩৭৫, মুয়াত্তা মালেক ১৩৯০, দারেমী ২১৭৬, ২৫৬৭, বায়হাকী ৫/৩৪৫, ৭/১৭৯, ইবনু হিব্বান
৬৯৭৯, আল-হাকিম ফিল-মুসতাদরাক ৩/৩৭৪, ইরওয়া ১২৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উল্লেখিত ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে মূল বাজারে পণ্যদ্রব্যের
আমদানী ব্যাহত হয়। ফলে পণ্যের সঠিক মূল্যও নির্ধারিত হয় না। কেননা সঠিক মূল্য নির্ধারণ
সম্ভব হয় বাজারে পণ্যের আমদানী ও তার চাহিদা অনুপাতে। কিন্তু উক্ত অবস্থায় বিক্রেতা
বাজারের দর-দাম কিছুই জানতে পারে না। এজন্য নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
ইবনু আবূ উমার (রহঃ)....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ)
হতে বর্ণিত। তিনি বলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা এগিয়ে
গিয়ে পণ্যবাহী কাফিলার সাথে মিলিত হয়ে না। যদি কেউ এরূপ করে এবং তার থেকে কোন বস্তু
ক্রয় করে নেয় তবে বিক্রেতা বাজারে পৌছার পর বিক্রয় বহাল রাখা বা বাতিল করার ব্যাপারে
ইখতিয়ার পাবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৭১৫, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ১৫১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৬৮১, ইসলামিক সেন্টার ৩৬৮১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ২১৫০, ২১৬২, ২৭২৭, সুনান আততিরমিযী ১২২১, সুনান আননাসায়ী ৪৪৮৭, ৪৪৯৬, ৪৫০১,
সুনান আবূ দাউদ ৩৪৩৭, ৩৪৪৩, আহমাদ ৭২৬৩, ৭৭৬৬, ৮৭১৫, ৮৮৭৬, ৮৯৬৯, ৮৯৮৩, ৯০৫৫, ২৭২৪৯,
মুয়াত্তা মালেক ১৩৯১, দারেমী ২৫৬৬, ইরওয়া ১৩১৭, দারেমী, ২/৭০৫, ২৫৬৬)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন,
এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে বিক্রেতার ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা যদি সে বাজারে পৌঁছতে পারত, তাহলে বেশী মূল্যে বিক্রি করতে
পারত।... অনুরূপভাবে এটা সাধারণ লোকদেরও ক্ষতির কারণ। কেননা তাতে শহরের সকল অধিবাসীর
হক রয়েছে। যে অধিক মুখাপেক্ষী তার কাছে পণ্য পৌঁছিয়ে দেয়া নাগরিক কল্যাণের দাবী। সুতরাং
তালাক্কীর মাধ্যমে তাদের একজনের সকল মাল একচেটিয়াভাবে দখল করা এক ধরনের যুলুম’। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ২/২০১)।
(৫) ইসলামে মজুদদারীকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যাতে মুনাফাখোরির কোন সুযোগ না থাকে। কারণ মুজদদারির উদ্দেশ্যই হচ্ছে অত্যধিক মুনাফা
অর্জন।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসলমাহ ইবনু কা’নাব (রহঃ).....মা’মার
(রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গুদামজাতকারী
ব্যক্তি পাপাচারী। অতঃপর সাঈদকে বলা হলো, আপনি তো গুদামজাত করেন। সাঈদ (রহঃ) বললেন
যে, মা’মার এ হাদীস বর্ণনা করছেন- তিনিও গুদামজাত করে থাকেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৭৭,
ইসলামিক সেন্টার ৩৯৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘মজুদদারী নিষিদ্ধ হওয়ার
ব্যাপারে এ হাদীছটি দ্ব্যর্থহীন’। (ইমাম নববী, আল-মিনহাজ
শারহু ছহীহ মুসলিম (বৈরূত: দারুর রাইয়ান লিত-তুরাছ, ১৪০৭ হিঃ/১৯৮৭খ্রিঃ), ১১/৪৩)।
উল্লেখ্য যে, সাধারণভাবে পণ্য মজুদ করা দোষের
নয়।
মা’মার (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাওরী
(রহ.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কেউ তার পরিবারের জন্য বছরের বা বছরের কিছু অংশের খাদ্য
জোগাড় করে রাখলে এ সম্পর্কে আপনি কোন হাদীস শুনেছেন কি? মা’মার বলেনঃ তখন আমার কোন
হাদীস স্মরণ হলো না। পরে একটি হাদীসের কথা আমার মনে হল, যা ইবনু শিহাব যুহরী (রহ.)
মালিক ইবনু আওসের সূত্রে উমার থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বনূ নাযীরের খেজুর বিক্রি করতেন এবং পরিবারের জন্য এক বছরের খাদ্য জোগাড় করে রাখতেন।
(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৩৫৭, ২৯০৪, আধুনিক প্রকাশনী-
৪৯৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
তবে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে
মুনাফাখোরির উদ্দেশ্যে মজুদ করলে অবশ্যই তা অপরাধ হবে।
(৬) ঈনা ক্রয়-বিক্রয়ঃ
কোনো ব্যক্তি কারো নিকট বাকীতে নির্দিষ্ট দামে কোন জিনিস বিক্রি করবে এবং সেটি তার
নিকট হস্তান্তর করবে। অতঃপর মূল্য গ্রহণের পূর্বে বিক্রিত মূল্যের চেয়ে কম দামে নগদে
বস্তুটি ক্রয় করে নিবে। অতঃপর নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ১ম ক্রেতার কাছ থেকে ১ম নির্ধারিত
মূল্য গ্রহণ করবে। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে ‘বায়য়ে ঈনা’ বলা হয়। যেমন বিক্রেতা ১ বছরের
জন্য কারো কাছে ১২০০০/- টাকায় একটি জিনিস বিক্রি করল। অতঃপর ক্রেতা মূল্য গ্রহণের পূর্বেই
বিক্রেতা দশ হাযার টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে সেটি ক্রয় করে নিল। পরে মেয়াদান্তে সে ১ম
ক্রেতার কাছ থেকে ১২০০০/- অসুল করে নিল। এভাবে সে ২০০০/- টাকা বেশী লাভ করল। এটিকেই
বলা হয় ‘বায়য়ে ঈনা’। ক্রেতা পণ্যের পরিবর্তে নগদ মূল্য গ্রহণ করার কারণে একে ‘বায়য়ে
ঈনা’ বলা হয়। (আল-ফিক্বহুল মুয়াসসার ফী যাওয়িল কিতাবি
ওয়াস সুন্নাহ (মিসর: মাকতাবাতুল হুদা আল-মুহাম্মাদী, ২য় সংস্করণ, ১৪৩৭/২০১৬), পৃঃ ২২৮)।
অথবা বিক্রিত মূল বস্ত্তটি বিক্রেতার কাছে
ফিরে আসার কারণে একে বায়য়ে ঈনা বলে। (আল-বুয়ূ আল-মানহী
আনহা ফিল ইসলাম, পৃঃ ২১-২২)।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘ঐক্যমত সত্ত্বেও
এটি ক্রয়-বিক্রয়দ্বয়কে বাতিল করে দিবে। কেননা এটা কৌশল’। (মাজমূঊল
ফাতাওয়া ২৯/৩০)।
শায়খ ছালেহ ফাওযান বলেন, الربا، ‘এটা হারাম। কারণ এটা সূদ খাওয়ার কৌশল। যেন
আপনি বর্তমান মূল্যের চেয়ে বাকীতে বেশী মূল্যে বিক্রয় করলেন এবং স্রেফ সূদ খাওয়ার কৌশল
ও মাধ্যম হিসাবে পণ্যকে গ্রহণ করলেন’। (আল-বুয়ূ আল-মানহী
আনহা ফিল ইসলাম, পৃঃ ২১-২২)।
বনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যখন তোমরা ঈনা পদ্ধতিতে
ব্যবসা করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে তখন
আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না আসা
পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিবেন না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৪৬২, সিলসিলা ছহীহাহ ১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(৭) নিজের কাছে মজুদ নেই এমন জিনিস বিক্রি করা
ইসলামে নিষিদ্ধ। যেমন- ক্রেতা কোন ব্যবসায়ীর কাছে এসে কোন নির্দিষ্ট পণ্য কিনতে চাইল।
অথচ সেই পণ্যটি এই ব্যবসায়ীর কাছে মজুদ নেই। এবার নগদে বা বাকীতে ক্রেতা ও বিক্রেতা
চুক্তি ও মূল্যের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছল। তখন পর্যন্ত ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা পণ্যের
মালিক নন। অতঃপর ব্যবসায়ী সেই পণ্য ক্রয় করে এনে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করল। এ ধরনের
ক্রয়-বিক্রয় হারাম। (আল-বুয়ূ আল-মানহী আনহা ফিল ইসলাম,
পৃঃ ১৯-২০)।
হাকিম ইবনু হিযাম (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা
তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোনো ব্যক্তি আমার নিকট এসে এমন জিনিস কিনতে চায় যা আমার
কাছে নেই। আমি কি বাজার থেকে তার জন্য ঐ জিনিস কিনে আনবো? তিনি বলেনঃ তোমার কাছে যা
নেই তা বিক্রি করো না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫০৩,
সুনান ইবনু মাজাহ ২১৮৭, সুনান আততিরমিযী ১২৩২, সুনান আননাসাঈ ৪৬১৩; ইরওয়া ১২৯২)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
শেষ কথাঃ
পরিশেষে বলা যায়, মজুদদারির ফলে মানুষকে তাদের
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়। মানুষের রক্ত চুষে মজুদদাররা তাদের
স্বার্থপরতা, অবৈধ লাভ ও লোভের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এর ফলে জনগণ দারুণ ক্ষতির সম্মুখীন
হয়। এজন্য ইসলামে মজুদদারী হারাম। এটি তাদের উপর কৃত এক প্রকার যুলুম। (বাদায়েউছ ছানায়ে ৫/১২৯)। এতে কোনই সন্দেহ নেই। কারণ
এর সাথে বান্দার হক জড়িত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
‘যুলুম তিন প্রকার। ১. এমন যুলুম যা আল্লাহ
উপেক্ষা করবেন না। ২. এমন যুলুম যা মাফ করে দেয়া হবে এবং ৩. এমন যুলুম যা ক্ষমা করা
হবে না। যে যুলুম ক্ষমা করা হবে না তা হ’ল শিরক। আল্লাহ শিরকের পাপ ক্ষমা করবেন না।
আর যে যুলুম ক্ষমা করে দেয়া হবে তা হ’ল বান্দা ও আল্লাহর মাঝে কৃত যুলুম। আর যে যুলুমকে
উপেক্ষা করা হবে না তা হ’ল বান্দাদের একের প্রতি কৃত অন্যের যুলুম। আল্লাহ তাদের একজনের
কাছ থেকে অন্যজনের ক্বিছাছ গ্রহণ করবেন’। (সিলসিলা ছহীহাহ
হা/১৯২৭, হাদীছ হাসান)।
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমদানী পণ্য সরবরাহকারী
ব্যবসায়ী রিযিক প্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত। (সুনান
ইবনু মাজাহ ২১৫৩, দারেমী ২৫৪৪, মিশকাত ২৮৯৩, গায়াতুল মারাম ৩২৭)।
মামার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নাদলা (রাঃ) থেকে
বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাপিষ্ঠ ব্যক্তি
ছাড়া কেউ মজুতদারি করে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২১৫৪, সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬০৫, সুনান আততিরমিযী ১২৬৭, সুনান
আবূ দাউদ ৩৪৪৭, আহমাদ ১৫৩৩১, ২৬৭০৩, দারেমী ২৫৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উমার উবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি মুসলিমদের
বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দরিদ্রতার কষাঘাতে
শাস্তি দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২১৫৫, আহমাদ ১৩৬, বায়হাকী
৯/৩৩৮, তাখরীজুল মুখতার ২৫১, আত-তালীকুর রাগীব ৩/২৬-২৭, মিশকাত ২৮৯৫)।
আবূ
হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি
দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
(১) যার নিকট নির্জন প্রান্তরে অতিরিক্ত পানি
আছে, সে তা পথিক মুসাফিরকে পান করতে বাধা দেয়।
(২) যে বিক্রেতা আসরের পর তার পণ্য ক্রেতার
নিকট বিক্রয় করে আর আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে, সে এতো এতো মূল্যে তা ক্রয় করেছে
এবং ক্রেতা তার কথা বিশ্বাস করেছে, অথচ আসল ব্যাপার তার বিপরীত।
(৩) যে ব্যক্তি কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের
অভিপ্রায়ে শাসকের আনুগত্য করার শপথ করে, শাসক তাকে কিছু দিলে শপথ পূর্ণ করে এবং না
দিলে শপথ ভঙ্গ করে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২০৭, ২৮৭০, সহীহ
বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩৫৮, ২৩৬৯, ২৬৭২, ৭২১২, ৭৪৪৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
১৯৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৮, সুনান আততিরমিযী ১৫৯৫, সুনান আননাসায়ী ৪৪৬২, সুনান
আবূ দাউদ ৩৪৭৪, আহমাদ ৭৩৯৩, ৯৮৬৬, বায়হাকী ফিস সুনান ১০/১৭৭, বায়হাকী ফিশ শু'আব ৩৪৪৪,
আল-হাকিম ফিল-মুসতাদরাক ২/৬, মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক ২০৯৯৯, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব
৯৫৫। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না,
তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক
শাস্তি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা? তারা তো বিফল হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। তিনি বলেনঃ (১) যে ব্যক্তি পায়ের গোছার নিচে পরিধেয় ঝুলিয়ে পরে, (২) যে ব্যক্তি
দান করার পর খোঁটা দেয় এবং (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে নিজের মাল বিক্রয় করে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৯৪, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ১০৬, সুনান আততিরমিযী ১২১১, সুনান আননাসায়ী ২৫৬৩, ২৫৬৪, ৪৪৫৮, ৪৪৫৯, ৫৩৩৩,
সুনান আবূ দাউদ ৪০৮৭, আহমাদ ২০৮১১, ২০৮৯৫, ২০৯২৫, ২০৯৭০, ২১০৩৪, দারেমী ২৬০৫, গায়াতুম
নারাম ১৭০, ইরওয়া ৯০০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(সমাপ্ত)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক
ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
লেখকের
অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন
------------------------------
Please Share On
No comments:
Post a Comment