Thursday, September 26, 2019

গীবত একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহ ও এর ভয়াবহতা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

গীবত একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহ ও এর ভয়াবহতা

ভূমিকাঃ

 ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। জীবনের প্রতিটি ধাপেই ইসলাম তার সুমহান সৌন্দর্য নিয়ে বিস্তৃত। শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত সম্পাদনের নামই ইসলাম নয়। ইসলামকে ইসলামের মানদণ্ডে মেনে চললে ব্যক্তি, পরিবার আর সমাজের সর্বত্র তৈরি হবে এক প্রশান্তিময় আবহ।

কিন্তু ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য সম্পর্কে আমরা সঠিকভাবে অবহিত নই বলে প্রাত্যহিক জীবনে এমন কিছু কাজ করে ফেলি যেগুলো অনেক বড় অপরাধ। যেগুলোর কারণে সৃষ্টি হয় সামাজিক কলহ-বিবাদ। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো পরনিন্দা তথা গিবত করা। এটি একটি মারাত্মক নিন্দনীয় কাজ ও কবিরা গুনাহ।

গীবতের পরিচয়

‘গীবত’ (الغِيْبَةُ) আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হ’ল- পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, দোষারোপ করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষগুলো অন্যের সামনে তুলে ধরা। (ইবনু ফারেস, মু‘জামু মাক্বাঈসিল লুগাহ, ৪/৪০৩; ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৭৪০)।

গীবতের পারিভাষিক অর্থ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভাষায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

ইয়াহইয়া ইবনু আইয়্যুব, কুতাইবাহ ও ইবনু হুজর (রহঃ)....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জান, গীবত কী জিনিস? তারা বললেন, আল্লাহ ও তার রসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, (গীবাত হলো) তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাই এর মধ্যে বাস্তবিকই থেকে থাকে তবে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে যা বলছ তা যদি তার মধ্যে প্রকৃতই থেকে থাকে তাহলেই তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৫৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৪০৭, সুনান আবূদাঊদ ৪৮৭৪; সুনান আততিরমিযী ১৯৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইমাম মুহিউদ্দীন নববী (রহঃ) বলেন, ‘গীবত হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা, যা সে অপসন্দ করে। চাই সেই দোষ-ত্রুটির সম্পর্ক তার দেহ-সৌষ্ঠব, দ্বীনদারিতা, দুনিয়া, মানসিকতা, আকৃতি, চরিত্র, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, স্ত্রী, চাকর-বাকর, পাগড়ি, পোষাক, চলাফেরা, ওঠা-বসা, আনন্দ-ফুর্তি, চরিত্রহীনতা, রূঢ়তা, প্রফুল্লতা-স্বেচ্ছাচারিতা বা অন্য যেকোন কিছুর সাথেই হোক না কেন। এসবের আলোচনা আপনি মুখে বলে, লিখে, আকার-ইঙ্গিতে, চোখের ইশারায়, হাত দিয়ে, মাথা দুলিয়ে বা অন্য যেকোন উপায়েই করুন না কেন, তা গীবত’। (নববী, আল-আয্কার, পৃ. ৩৩৬)।

মোটকথা কারো মধ্যে যদি সত্যিকারার্থেই কোন দোষ-ত্রুটি থাকে, আর সেটা নিয়ে আলোচনা করা যদি তিনি অপসন্দ করেন, তাহ’লে সেই সত্যি কথাটা অপরকে বলে দেওয়ার নামই হ’ল গীবত বা পরনিন্দা। আর যদি সেই দোষ তার ভিতর না থাকে, তবে সেটা ‘বুহতান’ বা অপবাদ।

গীবতের কতিপয় পরিভাষা : হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘গীবতের তিনটি ধরন আছে। যার প্রত্যেকটি আল্লাহর কিতাব কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে- গীবত, ইফ্ক এবং বুহতান।

(১) গীবত (পরনিন্দা): গীবত হচ্ছে তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু দোষ-ত্রুটির কথা বলা, যা বাস্তবেই তার মাঝে বিদ্যমান আছে।

(২)  ইফ্ক (মিথ্যা রটনা): তোমার কাছে কারো দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে যে সংবাদ পৌঁছেছে, সেটা বলে বেড়ানো বা যাচাই না করে অন্যকে বলে দেওয়া। (যেমন- মা আয়েশা (রাঃ)-এর ব্যাপারে ঘটেছিল)।

(৩) বুহতান (অপবাদ): রাসূলের উক্তি তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলা, যা তার মাঝে নেই’। (তাফসীরে কুরতুবী, ১৬/৩৩৫; মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব, ২/৪০১)।

তবে গীবতের আরো কিছু পরিভাষা আছে। যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

(৪) নামীমাহ (চোগলখুরী): পরস্পরের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অরেকজনকে বলা। এটাকে নামীমাহ বা চোগলখুরী বলা হয়।  (ইবনে মানযূর, লিসানুল আরব ১২/৫৯২; ইবনুল আছীর, আন-নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীছ, ৫/২৫৬)।

ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, ‘অনেকে ইখতিলাফ করেন যে, ‘গীবত’ ও ‘নামীমাহ’ কি একই জিনিস নাকি ভিন্ন কিছু? এ ব্যাপারে সঠিক কথা হ’ল উক্ত দুই পরিভাষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ‘নামীমাহ’ হলো ফাসাদ সৃষ্টি করার মানসিকতা নিয়ে একজনের অপসন্দনীয় কথা অন্যকে বলে দেওয়া, সেটা জেনে হোক বা না জেনে হোক। আর ‘গীবত’ হলো কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, যা সে অপসন্দ করে। এখানে সূক্ষ্ম পার্থক্য হলোঃ ‘নামীমাহ’-তে দ্বন্দ্ব বা অশান্তি সৃষ্টি করার হীন উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু ‘গীবতে’ সেই উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে’।  (ফাৎহুল বারী ১০/৪৭৩)।

নামীমাহ ধরনগত দিক থেকে গীবতের মতো হলেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটা গীবতের চেয়েও মারাত্মক ও সমাজবিধ্বংসী কর্মকান্ড। কেননা চোগলখুরীর মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে।

(৫)  হুমাযাহ ও লুমাযাহ: পবিত্র কুরআনের ‘সূরা হুমাযাহ’-তে এই দু’টি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ‘হুমাযাহ’ শব্দের অর্থ হ’ল ‘সম্মুখে নিন্দাকারী’। আর ‘লুমাযাহ’ শব্দের অর্থ হ’ল ‘পিছনে নিন্দাকারী’। আবুল ‘আলিয়াহ, হাসান বাছরী, রবী‘ বিন আনাস, মুজাহিদ, আত্বা প্রমুখ বিদ্বান বলেন, ‘হুমাযাহ’ হ’ল সেই ব্যক্তি, যে মানুষের মুখের উপর নিন্দা করে এবং দোষারোপ করে। আর ‘লুমাযাহ’ হ’ল সেই ব্যক্তি যে পিছনে তার অনুপস্থিতিতে নিন্দা করে’। (তাফসীরে কুরতুবী, ২০/১৮১)।

(৬) শাত্মঃ ‘শাত্ম:’ এর অর্থ হ’ল- তিরস্কার করা, ভৎর্সনা করা, গালি দেওয়া, ব্যঙ্গ করা, কটূক্তি করা। অর্থাৎ সত্য কথার বিপরীতে কারো দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, সেটা নিয়ে ঠাট্টা করা বা কটূক্তি করাকে ‘শাত্ম’ বলা হয়। (আব্দুর রঊফ মুনাভী, আত-তাওক্বীফ, পৃ.২৫৪; নাযরাতুন নাঈম, ১১/৫১৬৩)।

সাধারণ মানুষকে নিয়ে কটূক্তি করলে সেটা মহাপাপ। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে যদি কেউ কটূক্তি করে, তাহ’লে তাকে হত্যা করা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে পৃথিবীর সকল মাযহাবের সকল আলেম একমত। রাসূলকে নিয়ে ব্যঙ্গকারীকে ‘শাতিমুর রাসূল’ বলা হয়। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রচিত ‘আছ-ছামিরুল মাসলূল ‘আলা শাতিমির রাসূল’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

গীবতের মাধ্যমসমূহ

গীবতের বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে মানুষ অপরের গীবত করে থাকে। আলেমদের মতে গীবতের মূল মাধ্যম চারটি :

(১) জিহবার গীবত: গীবতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হ’ল জিহবা। আলাপচারিতা, কথা-বার্তা ও বক্তৃতায় যবানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী গীবত হয়।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয় বান্দা পরিণাম চিন্তা ব্যতিরেকেই এমন কথা বলে যে কথার কারণে সে ঢুকে যাবে জাহান্নামের এমন গভীরে যার দূরত্ব পূর্ব (পশ্চিম) এর দূরত্বের চেয়েও বেশি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪৭৭, ৬৪৭৮; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৭১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৮৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৬০২৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র তিনি বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা কোন কোন সময় এমন কথা মুখ দিয়ে বলে, যাতে আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং এজন্যই তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন, অথচ বান্দা এ বিষয়ে ওয়াকিফহাল থাকে না। পক্ষান্তরে বান্দা কোন কোন সময় এমন কথা বলে, যাতে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন। এ কথা তাকে জাহান্নামের দিকে নিক্ষেপ করে, অথচ বান্দা এ বিষয়ে ওয়াকিফহাল থাকে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৮১৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪৭৭, ৬৪৭৮; সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৮৭৬, আহমাদ ৮৪১১, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৭১০৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৭০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহর কিতাব ও রাসূলকে নিয়ে উপহাস করা, গীবত পরনিন্দা বা চোগলখুরি, গালি দিয়ে মুসলিমকে কষ্ট দেওয়াসহ প্রভৃতি কথার মাধ্যমে বান্দা গুরুতর পাপ করে ফেলে। তাই জিহবার হেফাযত অত্যন্ত যরূরী। (আব্দুল আযীয রাজেহী, তাওফীকুর রাবিবল মুন‘ইম ৮/৪২০)।

(২) অন্তরের গীবত: কুধারণা, হিংসা, অহংকার এবং কেউ গীবত করলে সেটা অন্তর দিয়ে মেনে নেওয়া বা তা সমর্থন করার মাধ্যমে অন্তরের গীবত হয়। ইবনে হাজার হায়তামী (রহঃ) বলেন, গীবত হচ্ছে কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করা’। (হায়তামী, আয-যাওয়াজির আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের ২/২৮)।

ইমাম মাক্বদেসী (রহঃ) বলেন, ‘মুসলিমদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করার মাধ্যমে অন্তরের গীবত সংঘটিত হয়’। (নাজমুদ্দীন আল-মাক্বদেসী, মুখতাছার মিনহাজিল ক্বাছেদীন, পৃ.১৭২)।

ইমাম গাযালী বলেন, মুখের ভাষায় গীবত বা পরনিন্দা করার ন্যায় মনে মনে কুধারণা পোষণ করাও হারাম। অর্থাৎ ভাষার ব্যবহারে কারো গীবত করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে মনে মনে কাউকে খারাপ বলা বা খারাপ ধারণা করাও হারাম’। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না’। (সুরা হুজুরাত ৪৯/১২)।

মহান আল্লাহ একমাত্র গায়েব জানেন এবং মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের খবর রাখেন। আর ইবলীসের কাজ হচ্ছে বান্দাকে ধোকা দিয়ে তার মনের মধ্যে মন্দ ধারণা প্রোথিত করা। আর বান্দা যদি কারো প্রতি খারাপ ধারণা করে ফেলে, তাহ’লে ইবলীসকে সত্যায়ন করা হয়ে যায়। আর ইবলীসকে সত্যায়ন করা হারাম। ফলে কারো ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করাও হারাম। কারণ কুধারণার মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি বা গোয়েন্দাগিরি করার মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা আরেক ধরনের কাবীরা গুনাহ। তাই আল্লাহ অত্র আয়াতে কুধারণার মাধ্যমে অন্তরের গীবত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ছিদ্রান্বেষণ করতে নিষেধ করেছে। তারপর বিশেষভাবে গীবত না করার আদেশ প্রদান করেছেন। (গাযালী, ইহ্য়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১৫০)।

(৩)  ইশারা-ইঙ্গিতের গীবত: কখনো কখনো চোখ, হাত ও মাথার ইশারার মাধ্যমেও গীবত হয়ে থাকে।

 আয়েশা (রাঃ) বলেন, খাটো মহিলা (আমাদের ঘরে) প্রবেশ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বসেছিলেন। আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে এভাবে ইশারা করে বললাম, ‘সে তো বেঁটে মহিলা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি তো তার গীবত করে ফেললে’। (মুসনাদে আহামাদ হা/২৫৭০৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাত ওয়ান নামীমাহ, হা/৭০; পৃ.২৪, সনদ হাসান)।

 অপর বর্ণনায় সেই আগন্তুক মহিলার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, সাফিয়্যাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে আপনার জন্য এতটুকুই যে, সে এরূপ অর্থাৎ তিনি খাটো। তিনি বললেনঃ তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যা সমুদ্রে মিশিয়ে দিলে তাতে সমুদ্রের পানি রং পাল্টে যাবে। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নকল করলাম। তিনি বললেনঃ আমাকে এতো এতো সম্পদ দেয়া হলেও আমি কারো অনুকরণ পছন্দ করবো না। (সুনান আবূদাঊদ ৪৮৭৫; সুনান আততিরমিযী ২৫০২)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘আয়েশা (রাঃ) গীবত করার উদ্দেশ্যে ছাফিয়্যা (রাঃ)-এর দোষ বর্ণনা করেননি; বরং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তার ব্যাপারে খবর দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তথাপি সেটা গীবতের পর্যায়ভুক্ত ছিল’। (আসকালানী, ফাৎহুল বারী ১০/৪৬৯)।

সুতরাং গীবতের প্রকাশ হচ্ছে সেই দোষ বর্ণনা দেওয়ার মতোই। সংকেত, অঙ্গভঙ্গি, চোখ টেপা, ইশারা-ইঙ্গিত এবং অপরকে হেয় করা বুঝায় এমন প্রত্যেক কিছুই গীবতের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে গীবতকে সমর্থন দেওয়াও গীবত। কেননা গীবত শ্রবণকারীও গীবতের দায় এড়াতে পারবে না, যদি না সে অন্তর দিয়ে সেটা প্রত্যাখ্যান করে এবং মুখের ভাষায় সেটার প্রতিবাদ করে। (তাহানাওয়ী, কাশ্শাফু ইছত্বিলাহাতিল ফুনূন ওয়াল উলূম ২/১২৫৬)।

(৪)  লেখার মাধ্যমে গীবত: মানুষের মনের ভাব ও মতামত প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হ’ল লেখা। গাযালী (রহঃ) বলেন, ‘লেখার মাধ্যমেও গীবত হয়ে থাকে। কেননা কলম দুই ভাষার একটি’। (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/১৪৫)।

ড. সাঈদ ইবনে ওয়াহফ আল-কাহত্বানী (রহঃ) বলেন, ‘গীবত শুধু মুখের ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং গীবতকারী যে কোন মাধ্যমে অপরের কুৎসা রটাতে পারেন। হ’তে পারে সেটা ইশারা-ইঙ্গিত, কাজ-কর্ম, অঙ্গ-ভঙ্গি, ভেংচানো, খোঁটা দেওয়া ও লেখালেখির মাধ্যমে অথবা যার নিন্দা করা হচ্ছে তিনি অপসন্দ করেন এমন যে কোন মাধ্যমে’। (কাহত্বানী, আফাতুল লিসান, পৃ. ৯)।

গীবতের ধরনসমূহ

গীবত বলা হয় অপরের এমন সমালোচনা, যা শুনলে তার খারাপ লাগবে বা মন খারাপ হবে। এই সমালোচনা অন্যের দৈহিক ত্রুটি, বংশগত দোষ, চারিত্রিক ত্রুটি, কাজ-কর্ম, পোষাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া সম্পর্কিত দোষ হ’লেও তা গীবত। গীবতের রকমভেদ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণনা এসেছে। এখানে ইমাম নববী (রহঃ)-এর ‘আল-আযকার’, ইমাম গাযালী (রহঃ)-এর ‘ইহয়াউ উলূমিদ্দীন’ এবং ‘মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব’ থেকে একত্রে এবং সংক্ষিপ্তাকারে গীবতের ধরনগুলো তুলে ধরা হলোঃ-

(১)  শারীরিক গঠন বা অবয়বের গীবত: যেমন তাচ্ছিল্য করে বলা হয়- কানা, খোঁড়া, ল্যাংড়া, লম্বু, খাটো, বাঁটু, কালা, হলদে, ধলা, অন্ধ, ট্যারা, টেকো মাথা, চোখে ছানি পড়া, ঠোঁট মোটা, কান ছোট, নাক বোঁচা, ঠসা প্রভৃতি। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যদি এগুলো অপসন্দ করেন, তবে সেটা গীবত হয়ে যাবে।

(২)  চারিত্রিক আচার-আচরণের গীবত: যেমন কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা- ফাসেক্ব, খিয়ানতকারী, পিতামাতার অবাধ্য, গীবতকারী, পাক-নাপাকের ব্যাপারে উদাসীন, চোর, ছালাত পরিত্যাগকারী, যাকাত অনাদায়কারী, ব্যভিচারী, অহংকারী, বদমেজাযী, কাপুরুষ, দুর্বল মনের অধিকারী, ঝগড়াটে, নির্লজ্জ, দুশ্চিরিত্র, স্বেচ্ছাচারী, তাড়াহুড়াপ্রবণ, ঢিলা, রূঢ়, লম্পট, বেয়াদব, অভদ্র, পেটুক, বাচাল, নিদ্রাকাতর, অবিবেচক, অলস, ধূর্ত, প্রবঞ্চক, ধূমপায়ী, বিড়িখোর, নেশাখোর ইত্যাদি।

(৩)  বংশের গীবত: যেমন অবজ্ঞা করে বলা- অজাত, ছোটলোক, নিগ্রো, মুচি, চামার, মেথর, কাঠমিস্ত্রি, ভ্যানচালক, কামার, তাঁতি, পাঠান, বিহারী, বাঙ্গাল প্রভৃতি। বংশের দিকে বা পিতামাতার দিকে সম্বন্ধ করে অপসন্দনীয় যাই বলা হবে, সেটাই গীবত।

(৪) পোষাক-পরিচ্ছদের গীবত: যেমন কারো পোষাক সম্পর্কে বলা, চওড়া আস্তিন, দীর্ঘ আঁচল, নোংরা পোষাক পরিধানকারী, লম্বা আঁচলওয়ালী ইত্যাদি।

(৫)  পরোক্ষ গীবত: পরোক্ষ গীবত বলতে এমন পরনিন্দাকে বুঝায়, যা সরাসরি না বলে ভিন্ন আঙ্গিকে বলা হয়ে থাকে। নিমেণ তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলোঃ-

(ক)  কোন ব্যক্তির প্রসঙ্গ বলতে বলতে বা শুনতে শুনতে বলা- ‘আল্লাহ তার নির্লজ্জতা থেকে পানাহ দিন’ অথবা ‘গোমরাহী থেকে পানাহ চাই’ ইত্যাদি বলা। মূলতঃ এভাবে বলে আলোচিত ব্যক্তির নির্লজ্জতা ও গোমরাহীর কথা উল্লেখ হয়ে থাকে।

(খ) ‘কিছু লোক এই করে’ বা ‘কিছু মানুষ এই বলে’ বলা। এই ‘কিছু’ শব্দের মাধ্যমে সম্বোধিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে বুঝানো হয়, তাহ’লে সেটা গীবত।

(গ) ‘অমুক পন্ডিত’, ‘অমুক ছাহেব’, ‘অমুক নেতা’ ইত্যাদি তাচ্ছিল্যের সাথে বলা। অর্থাৎ দোষ বা ত্রুটি বর্ণনার সময় সম্বোধিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেও শ্রোতা বুঝে নিতে পারে কাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে।

(ঘ) কোন ব্যক্তির ব্যাপারে বলা ‘অমুক ভাই/বন্ধু অপমানিত হওয়ার কারণে বা তার অমুক দোষ-ত্রুটির কারণে আমি কষ্ট পেয়েছি’। আলেমদের মতে, এখানে দো‘আর মাধ্যমে বর্ণিত ব্যক্তির গীবত করে ফেলা হয়। কারণ তার সেই ত্রুটি গোপন ছিল, কিন্তু সে দো‘আ করার মাধ্যমে সেটা সবার সামনে প্রকাশ করে দিল। যদি তার দো‘আ করার উদ্দেশ্য থাকতো, সে নির্জনে সেই ভাইয়ের জন্য দো‘আ করতে পারত।

পরোক্ষ গীবতের এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এগুলোকে গীবত মনে করে না। অথচ এগুলোও সর্বনাশা গীবত।

গীবতের প্রকারভেদ

ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় গীবত মূলতঃ তিন প্রকার। (আল-মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব ২/৪০৯)।

(১)  হারাম গীবত: কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটির বর্ণনা দেওয়া, যেটা সে পসন্দ করে না। এটা হারাম গীবত।

(২) ওয়াজিব গীবত: মুসলিম সমাজকে বা ব্যক্তিকে সতর্ক ও সাবধান করার জন্য দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব। যেমন- ইলমুল জারাহ ওয়াত তা‘দীলের ক্ষেত্রে যদি মুহাদ্দিছগণ রাবীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করতেন, তাহ’লে ছহীহ-যঈফ, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য হাদীছসমূহের মান নির্ধারণ করা কখনোই সম্ভব হ’ত না। তাই এক্ষেত্রে দোষ বর্ণনা করা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে যদি বর বা কনে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, তাহ’লে তাদের দোষ-ত্রুটি স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া ওয়াজিব। কারণ দোষ বর্ণনা না করলে জিজ্ঞেসকারীকে ধোঁকা দেওয়া হবে। কোন ব্যক্তি যদি খিয়ানতকারী অসৎ লোকের সাথে ব্যবসা করতে চায়, সেই ব্যক্তিকে সতর্ক করার জন্য ঐ অসৎ লোকের দোষ বর্ণনা করা ওয়াজিব। কারণ সে না জেনে না বুঝে তার সাথে ব্যবসা করে ধোঁকায় পড়তে পারে। তাই তাকে সাবধান করা অপরিহার্য। এভাবে আরো কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে দোষ বর্ণনা করা হারাম নয়; বরং তখন দোষ বর্ণনা করা অপরিহার্য হয়ে যায়।

(৩)  মুবাহ বা জায়েয গীবত : যদি নিন্দা করার পিছনে যুক্তিসঙ্গত বা শরী‘আত সম্মত কোন কারণ থাকে, তবে সেই গীবত করা মুবাহ বা জায়েয। যেমন- যুলুমের বিচার প্রাপ্তির জন্য শাসকের কাছে নালিশ করার সময় গীবত করা। কোন ব্যক্তি যদি মযলূম হয়ে বিচারকের কাছে গিয়ে বলে, ‘অমুক ব্যক্তি আমার টাকা আত্মসাৎ করেছে, আমার প্রতি যুলুম করেছে, আমার বাড়িতে চুরি করেছে ইত্যাদি। তবে এটা হারাম গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। অনুরূপভাবে আলেম বা মুফতীর কাছে কোন বিষয়ে ফৎওয়া নেওয়ার জন্য অন্যায়কারীর গীবত করা জায়েয। অবজ্ঞা করার উদ্দেশ্য না করে স্রেফ পরিচয় দেওয়ার জন্য কারো ত্রুটি বর্ণনা করা জায়েয। যেমন- কানা, কালো, খোড়া ইত্যাদি।

গীবতের বিধান

গীবত করার বিধান দুই ভাগে বিভক্ত।

(১) গীবত করার বিধান।

(২) গীবত শোনার বিধান।

(১) গীবত করার বিধান: গীবত একটি জঘন্য পাপ। গীবতের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত ৪৯/১২)।

এখানে মানব স্বভাবের তিনটি মারাত্মক ত্রুটি বর্ণনা করা হয়েছে। যা সমাজের শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট করে। প্রথমটি হলো ‘অহেতুক ধারণা’ এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘ছিদ্রান্বেষণ’ তৃতীয়টি হলো ‘গীবত’।

ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘গীবত কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, এতে কোন ইখতেলাফ নেই। যে ব্যক্তি কারো গীবত করবে, তার তওবা করা অপরিহার্য’।  (তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৭)।

ইমাম হায়তামী বলেন, অত্র আয়াত ও অসংখ্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, গীবত করা কবীরা গুনাহ’। (হায়তামী, আয-যাওয়াখের ‘আন ইক্বতিরাফিল কাবায়ের, পৃ. ৩৭১)।

তাছাড়া বর্ণিত আয়াতে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর কারণ হ’ল- মৃত মানুষের গোশত খাওয়া হ’লে সে বুঝতে পারে না কে তার গোশত খাচ্ছে। অনুরূপ যার গীবত করা হয়, সেও বুঝতে পারে না কে তার গীবত করছে। (তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৫)।

হাদীছেও গীবতের ক্ষেত্রে মৃত ভক্ষণের কথা এসেছে এর নিকৃষ্টতা বুঝানোর জন্য। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,

মুসতাওরিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের পরোক্ষ নিন্দা করে বা মন্দ বলে এক গ্লাস খেলো, আল্লাহ তা’আলা তাকে সে পরিমাণ জাহান্নামের আগুন খাওয়াবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের অপদস্থ ও অপমানের বিনিময়ে কাপড় পরিধান করল, আল্লাহ তা’আলা সেটার বিনিময়ে তাকে সমপরিমাণ জাহান্নামের আগুনের পোশাক পরিধান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কাউকে দাঁড় করায় বা নিজে দণ্ডায়মান হয়ে লোকেদেরকে নিজের বুজুর্গি শোনায় বা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়, কিয়ামতের দিন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা শোনানোর জন্য এবং দেখানোর জন্য তাকে দাঁড় করাবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০৪৭, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৮১, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৯৩৪, সহীহুল জামি ৬০৮৩, আহমাদ ১৮০১১, শু‘আবুল ঈমান ৬৭১৭, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৭১২০, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৬৯৭, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৮৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মূলতঃ গীবতের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা হয়। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিরদিনের জন্য এটা হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন,

আবূ বকরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কথা উল্লেখ করে বলেন, (মিনায়) তিনি তাঁর উটের উপর উপবেশন করলেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর উটের লাগাম ধরে রেখেছিল। তিনি বললেনঃ ‘এটা কোন্ দিন?’ আমরা চুপ করে রইলাম আর ধারণা করলাম যে, অচিরেই তিনি এ দিনটির আলাদা কোন নাম দিবেন। তিনি বললেনঃ ‘‘এটা কি কুরবানীর দিন নয়?’ আমরা বললাম, ‘জি হ্যাঁ।’ তিনি জিজ্ঞেসঃ ‘এটা কোন্ মাস?’ আমরা নীরব রইলাম আর ধারণা করলাম যে, অচিরেই তিনি এর আলাদা কোন নাম দিবেন। তিনি বললেনঃ ‘এটা কি যিলহাজ্জ মাস নয়?’ আমরা বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেনঃ ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস, তোমাদের এ শহর মর্যাদা সম্পন্ন। এখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা (আমার এ বাণী) যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট এসব কথা পৌঁছে দেয়। কারণ উপস্থিত ব্যক্তি সম্ভবত এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছাবে, যে এ বাণীকে তার চেয়ে অধিক আয়ত্তে রাখতে পারবে।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১০৫, ১৭৪১, ৩১৯৭, ৪৪০৬, ৪৬৬২, ৫৫৫০, ৭০৭৮, ৭৪৪৭; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৭৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৭৯, আহমাদ ২০৪০৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আমর ইবনুল আছ একদিন একটা মরা গাধার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। গাধাটির দিকে ইশারা করে তার সাথীদের বললেন,‌ ‘একজন মুসলিমের গোশত খাওয়া বা গীবত করার চেয়ে কোন মানুষের জন্য এই (মরা গাধার) গোশত খেয়ে পেট ভর্তি করা উত্তম’। (ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৮; সনদ ছহীহ)।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ.) বলেন, ‘অত্র হাদীছ এটা প্রমাণ করে যে, গীবত করা কবীরা গুনাহ’। (ফাৎহুল বারী ১০/৪৭০)।

গীবতকারীরা এই ঘৃণ্য পাপের কারণে সে পরকালেও ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা আমাকে উপরে নিয়ে গেলেন, আমি সেখানে এমন লোকেদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ তামার তৈরি। সেসব নখ দ্বারা তারা তাদের মুখমণ্ডলে ও বক্ষ খোঁচাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল (আ.) বললেনঃ এরা সেসব লোক, যারা মানুষের মাংস খায় (পরোক্ষ নিন্দা করে) এবং মানুষের পিছনে লেগে থাকে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০৪৬, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৭৮, আহমাদ ৯৩৩৪০, শু‘আবুল ঈমান ৬৭১৬, সহীহ আত্ তারগীব ২৮৩৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৮, সহীহুল জামি‘ ৫২১৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৫৩৩)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) গীবত শোনার বিধান: গীবত করা যেমন মহাপাপ তেমনি খুশি মনে পরনিন্দা শোনাও পাপ। মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন যেন তা উপেক্ষা করে’। (সুরা ক্বাছাছ ২৮/৫৫)।

ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘গীবত শোনা এবং এর দিকে কান পেতে থাকা বৈধ নয়। গীবতকারী এবং গীবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান পাপী’। (মাওসূ‘আতুল আখলাক্ব ২/৪০৭)।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘গীবতকারীর উপরে মানুষের দোষ-ত্রুটির বর্ণনা দেওয়া যেমন হারাম, ঠিক তেমনি সেটার নিন্দা শ্রবণ করা এবং তার স্বীকৃতি দেওয়াও হারাম’। (নববী, আল-আযকার, পৃ.২৯১)।

তিনি বলেন, ‘গীবত শ্রবণকারীর কর্তব্য হ’ল নিন্দাকারীকে প্রতিহত করা এবং তাকে ধমক দেওয়া। যদি কথার মাধ্যমে বিরত না রাখতে পারে, তবে হাত দিয়ে বাধা দিবে। যদি হাত বা মুখ দিয়ে বাধা দিতে না পারে, তাহ’লে সেই মজলিস পরিত্যাগ করবে। আর বয়স্ক লোক, বাধা দেওয়ার অধিকার আছে এমন ব্যক্তি, গণ্য-মান্য লোকের গীবত শোনার ব্যাপারে আলোচিত পরিস্থিতির চেয়ে আরো সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে’। (আল-আযকার, পৃ. ২৯৪)।

সালাফগণ গীবতের ব্যাপারে এতটাই কঠোর ছিলেন যে, কোন বৈঠকে কারো নিন্দা করা হ’লে সেই বৈঠকই পরিত্যাগ করতেন। ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) দাওয়াতের মেহমান হয়ে এক খাবার মজলিসে হাযির হ’লেন। লোকজন বলল, ‘অমুক ব্যক্তি এখনো আসেনি’। একজন বলে উঠল, ‘সে একটু অলস প্রকৃতির লোক’। তখন ইবরাহীম (রহ.) বললেন, ‘যে বৈঠকে বসলে আমার মাধ্যমে কোন মুসলিম ভাইয়ের গীবত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, এমন মসলিসে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সমীচীন নয়’। একথা বলে তিনি না খেয়েই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। (সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১৬৬)।

গীবত অতীব ভয়ংকর গুনাহ। কিন্তু দুই ধরনের গীবত আরো বেশী ভয়াবহ। তন্মধ্যে একটি হলো আলেম-ওলামার গীবত এবং অপরটি হ’ল মৃত মানুষের গীবত।

(১) আলেমদের গীবত করাঃ

আলেমদের গীবত দুই রকমের। (১) সাধারণ মানুষ কর্তৃক আলেমদের নিন্দা বা গীবত করা এবং (২) আলেম কর্তৃক অপর মানুষের দোষকীর্তন করা। উভয়টাই মারাত্মক এবং দ্বীন-দুনিয়া উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।

(এক)  নবী-রাসূলগণের পরে হকপন্থী আলেমগণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। সাধারণ কোন মানুষের চেয়ে তাদের মর্যাদা অনেক বেশী। কেননা তারা নবীদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন<

কাসীর বিন ক্বায়স (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দিমাশক-এর মসজিদে আবুদ্ দারদা (রাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম, এমন সময় তার নিকট একজন লোক এসে বললো, হে আবুদ্ দারদা! আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শহর মদীনাহ্ থেকে শুধু একটি হাদীস জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি শুনেছি আপনি নাকি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আর কোন উদ্দেশে আমি আপনার কাছে আসিনি। তার এ কথা শুনে আবুদ্ দারদা (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি (কুরআন ও হাদীসের) ’ইলম সন্ধানের উদ্দেশে কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছিয়ে দিবেন এবং মালায়িকাহ্ ’ইলম অনুসন্ধানকারীর সন্তুষ্টি এবং পথে তার আরামের জন্য তাদের পালক বা ডানা বিছিয়ে দেন। অতঃপর ’আলিমদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দু’আ করে থাকেন, এমনকি পানির মাছসমূহও (ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে)। ’আলিমদের মর্যাদা মূর্খ ’ইবাদাতকারীর চেয়ে অনেক বেশী। যেমন পূর্ণিমা চাঁদের মর্যাদা তারকারাজির উপর এবং ’আলিমগণ হচ্ছে নবীদের ওয়ারিস। নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম (ধন-সম্পদ) মীরাস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে রেখে যান না। তাঁরা মীরাস হিসেবে রেখে যান শুধু ’ইলম। তাই যে ব্যক্তি ’ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১২, আহমাদ ২১২০৮, আবূ দাঊদ ৩৬৪১, তিরমিযী ২৬৮২, ইবনু মাজাহ্ ২২৩, সহীহুত্ তারগীব ৭০, দারিমী ৩৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং আলেমদের মান-মর্যাদা যেহেতু বেশী, তাই তাদের পরনিন্দায় পাপের ভয়াবহতাও বেশী।

সাধারণ মানুষের গীবত করা মৃত মানুষের গোশত ভক্ষণের মতো জঘন্য পাপ। কিন্তু আলেমগণের গোশত আরো বিষাক্ত। তাদের গীবত করলে বান্দার ঈমান ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। ইহ ও পরকালে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, ‘আলেমদের গোশত বিষাক্ত। যে ব্যক্তি এর ঘ্রাণ নিবে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর যে ব্যক্তি এটা ভক্ষণ করবে সে মৃত্যুবরণ করবে’। (আব্দুল বাসেত আল-আলমাভী, আল-মু‘ঈদ ফী আদাবিল মুফীদ ওয়াল মুস্তাফীদ, পৃ. ৭১)।

একবার এক ব্যক্তি হাসান ইবনে যাকওয়ান (রহঃ)-এর কাছে এসে জনৈক আলেমের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের কথা বলা শুরু করল। ইবনে যাকওয়ান (রহঃ) তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থামো! আলেমদের কোন দোষ বর্ণনা করবে না; তাহ’লে আল্লাহ তোমার অন্তরের মৃত্যু ঘটাবেন’। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আছ-ছাম্তু, পৃ. ২৬৮)।

 ইবনু আসাকির (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আলেম-ওলামার সমালোচনায় স্বীয় জিহবাকে প্রবৃত্ত করবে, আল্লাহ তার দৈহিক মৃত্যুর আগেই অন্তরের মৃত্যু দিয়ে তাকে পরীক্ষা করবেন’। (ইবনুল আয্রাক্ব, বাদাই‘উস সুলূক, ১/৩৯০)।

আবুবকর খাওয়ারিযমী (রহঃ) বলেন, ‘জেনে রেখো! উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে আলেমগণের সম্মান ও মর্যাদা অতি উচ্চমানে। তাঁদের গোশত বিষাক্ত। যে এই গোশতের ঘ্রাণ নিবে, সে অসুস্থ হয়ে যাবে। যে তা ভক্ষণ করবে, সে আরো মারাতমকভাবে অসুস্থ হবে। আমি মানবজাতি ও শাসকদেরকে অছিয়ত করছি- তারা যেন ওলামায়ে কেরামের সাথে সদ্ব্যবহার করে। যে ব্যক্তি তাদেরকে সম্মান করবে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সম্মান করবে। আর যে তাদেরকে অপমান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অপমান করবে। কারণ তাঁরা নবী-রাসূলদের ওয়ারিছ ও আল্লাহর অলীদের শ্রেষ্ঠ দল। তাদের সিলসিলা অতি পবিত্র। কুরআনের ভাষায় তাদের মূল সুদৃঢ় এবং শাখা আকাশে উত্থিত’। (আবূ বকর খাওয়ারিযমী, মুফীদুল ‘উলূম ওয়া মুবীদুল হুমূম, পৃ. ৩২৯)।

সুতরাং আলাপ-আলোচনায়, গল্প-আড্ডায় এবং সোস্যাল মিডিয়ায় আলেমদের ব্যক্তিগত দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা অন্যান্য কবীরা গুনাহের চেয়েও অনেক প্রভাব বিস্তারকারী মহাপাপ। কেননা এর প্রভাব শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সমালোচনায় লিপ্ত হ’লে জনসাধারণের হৃদয়ে তাদের ব্যাপারে ঘৃণা সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণ আলেমদের বর্জন করার সাথে সাথে তাদের উপকারী ইলম থেকেও নিজেদের বঞ্চিত করে বসেন। তবে কোন আলেম যদি শিরক-বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতার দিকে মানুষকে আহবান করে, তবে তাদের থেকে জনগণকে সতর্ক করা অন্যান্য আলেমদের ওপর ওয়াজিব হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এটা ব্যক্তি পর্যায়ের দোষ নয়; দ্বীনী পর্যায়ের ত্রুটি। ফলে এটা হারাম গীবতের মধ্যে গণ্য হবে না।

(দুই)  আলেম কর্তৃক অন্য কারো নিন্দা করা দ্বীন-দুনিয়া উভয়ের জন্য হুমকি স্বরূপ। কারণ সমাজের মানুষ আলেম-ওলামাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন এবং তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করে থাকেন। সেই আলেমরাই যখন শারঈ কোন ওযর ছাড়া অন্যায়ভাবে অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করেন, তখন সাধারণ মানুষ আশাহত হয়ে যায় এবং তাদের কাছ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। শায়খ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘আলেম-ওলামারা গীবত করলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হন এবং তাদের মর্যাদাহানি হয়। উপরন্তু তারা শরী‘আতের যে কথা বলেন, তার প্রতি মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং তাদের কথার মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণের আগ্রহ থাকে না। মূলতঃ আলেমদের দোষ চর্চা করার কারণে শরী‘আতের মর্যাদা বিনষ্ট হয়। তখন মানুষ এমন সব জাহেল-মূর্খদের দারস্থ হয়, যারা না জেনে ফৎওয়া দিয়ে থাকে’। (ওছায়মীন, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২১/৪৩; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ-দার্ব ২/১২)।

তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষের গীবতের চেয়ে আলেমদের গীবতের ভয়াবহতা বেশী। কেননা সাধারণ মানুষের গীবত ব্যক্তি পর্যায়ে হয়ে থাকে। এই গীবতের মাধ্যমে শুধু গীবতকারী এবং যার দোষ বর্ণনা করা হয় তার ক্ষতি হয় (অন্য কারো কোন ক্ষতি হয় না)। কিন্তু আলেমদের গীবত পুরো ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। কেননা আলেমগণ ইসলামের পতাকা বহনকারী। তাদের কথা-বার্তা বা পরনিন্দার মাধ্যমে (জনগণের কাছে তাদের) বিশ^স্ততা যখন লোপ পেয়ে যায়, তখন ইসলামের নিশান ভূলুণ্ঠিত হয়। ফলে এই ক্ষতি গোটা মুসলিম উম্মাহর উপর আপতিত হয়’। (ওছায়মীন, শরহ রিয়াযুছ ছালেহীন, ১/২৫৬)।

ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ গীবত হ’ল বক্তা ও ওলামায়ে কেরামের গীবত। কেননা তারা সাধু সেজে নিজেদের মাক্বছাদ প্রকাশ করে। আর মানুষ মনে করে তারা গীবত করছে না। অথচ তিনি অজ্ঞতার মধ্যে নিমগ্ন। তার জানা নেই তিনি একই সময়ে দুই গুনাহ করছেন- (১) গীবত ও (২) রিয়া। তার সামনে যখন কোন ব্যক্তির আলোচনা করা হয়, তখন তিনি বলেন, আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি আমাদের বাদশাহর দরবারে আসা-যাওয়ার পরীক্ষা থেকে নিরাপদ রেখেছেন, অথবা বলেন, দুনিয়া অর্জনের লাঞ্ছনা থেকে আমাদের হেফাযত করেছেন অথবা দো‘আয় বলেন, হে আল্লাহ! আমাদেরকে অমুকের নির্লজ্জতা ও অসম্মান থেকে রক্ষা করুন। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরের দোষ প্রকাশ করা। তিনি শুকরিয়া আদায় বা দো‘আ করলেও শোকর ও দো‘আ কোনটিই তার মূল উদ্দেশ্য থাকে না।

কখনো কখনো কোন ব্যক্তির গীবত করার উদ্দেশ্যে তার প্রশংসা করা হয়। যেমন- অমুক ব্যক্তি কতই না ভালো! অমুক অনেক ইবাদত করে, তবে তার মধ্যে একটি খারাপ অভ্যাস রয়েছে, এমনকি আমাদের মধ্যেও রয়েছে, তা হচ্ছে ধৈর্য কম থাকা। লক্ষ্য করুন! বাহ্যত এ কথার মাধ্যমে তিনি নিজের নিন্দা করছেন; কিন্তু লক্ষ্য হচ্ছে অপরের দোষ বলা। কিন্তু তিনি এমন পন্থা অবলম্বন করেছেন যে, শ্রোতারা বক্তার ইখলাছ ও নিজেকে ছোট মনে করা দেখে ভাবেন তিনি কতই না পরহেযগার! অথচ বাস্তবে এই বক্তা তিনটি গুনাহে লিপ্ত (১) গীবত (২) রিয়া ও (৩) আত্মপ্রশংসা। (গাযালী, ইহ্ইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩/১৪৫-১৪৬)।

সুতরাং হকপন্থী আলেম-ওলামার অবশ্য কর্তব্য হ’ল অপরের নিন্দা ও দোষ চর্চা থেকে বেঁচে থাকা। কেননা আলেমগণ গীবতে লিপ্ত হ’ল প্রকারান্তরে তারা দ্বীন ইসলামের ক্ষতিসাধন করেন। গীবতকারী আলেমরা মানুষের কাছে নিন্দিত হন এবং তাদের দ্বীনী উপদেশও জনগণের কাছে উপেক্ষিত হয়। ফলে আলেমের ব্যক্তিগত দোষের কারণে দ্বীনের ক্ষতি হয়ে যায় অনেক বেশী।

(২)  মৃত মানুষের গীবত করা:

মৃত মানুষের দোষ-ত্রুটি চর্চা করার ভয়াবহতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। কারণ গীবত নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মৃত মানুষের নিন্দা করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলাদাভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,

আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কোনো সঙ্গী মারা গেলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার সম্পর্কে কটুক্তি করো না। (সুনান আবূদাঊদ হা/৪৮৯৯; ছহীহুল জামে‘ ৭৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ ৪৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আযীমাবাদী (রহঃ) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে জীবিত মানুষের গীবত করার চেয়ে মৃত মুসলিমের গীবত করা অধিকতর খারাপ ও ভয়াবহ। কেননা জীবিত মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া এবং মীমাংসা করে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু মৃত মানুষের ব্যাপারে সেই সুযোগটা থাকে না’। (আওনুল মা‘বূদ ১৩/২৪২)।

তবে মৃত ব্যক্তি যদি কোন অন্যায় বা পাপের প্রচলন করে এবং তার প্রভাব জীবিতদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়, তবে জীবিতদের সতর্ক করার জন্য সেই মৃত ব্যক্তির অন্যায় কাজের সমালোচনা করা ওয়াজিব।

ইমাম মানাভী (রহঃ) বলেন, ‘জীবিত ব্যক্তির চেয়ে মৃত ব্যক্তির গীবত করা অধিক ভয়াবহ। এই গীবত শুধু তখনই না জায়েয হবে যখন মৃত ব্যক্তির দোষ বর্ণনাতে কোন সংশোধনের উদ্দেশ্য থাকে না। অন্যথা তার (মৃত ব্যক্তির) বিদ‘আত বা অন্যায় কাজ থেকে সতর্ক করা (এবং এর জন্য সমালোচনা করা) শুধু বৈধই নয়; বরং ওয়াজিব’। (মানাভী, আত-তায়সীর শারহু জামি‘ইছ ছাগীর ১/১৪২)।

গীবতের কারণ সমূহ

নানাবিধ কারণে মানুষ গীবতের মতো জঘন্য পাপে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। নিমেণ কতিপয় কারণ ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করা হ’ল-

(১)  আল্লাহর ভয় কম থাকাঃ

যেকোন পাপ সংঘটিত হওয়ার মূল কারণ হ’ল আল্লাহর ভয় না থাকা। যদি কারো হৃদয়ে আল্লাহভীতির চিহ্ন থাকে, তাহ’লে তিনি কখনোই গীবতের মত জঘন্য পাপে জড়াবেন না। কিন্তু বাহ্যিক পরহেযগার যদি অন্যায়ভাবে গীবত চর্চা করেন, তাহ’লে তার তাক্বওয়া পূর্ণাঙ্গ নয় বলে প্রমাণিত হয়।

ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, সে যা তা বলে ফেলে’। (ইবনু হাযম, হাজ্জাতুল ওদা‘, পৃ. ৩৮৪)।

কিন্তু বান্দা যখন আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে, তখন সে মেপে মেপে কথা বলে। পরনিন্দা করতে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন দু’জন ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমলনামা লিপিবদ্ধ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে’। (সুরা ক্বা-ফ ৫০/১৭-১৮)।

অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরকুল শিরোমণি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘সে ভালো-মন্দ যা কিছু বলে সব লিখে নেওয়া হয়। এমনকি ‘আমি খেয়েছি, পান করেছি, গিয়েছি, এসেছি, দেখেছি’ তার এই কথাগুলোও লেখা হয়। তারপর বৃহস্পতিবারে তার কথা ও আমল (লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা আল্লাহর সামনে) পেশ করেন’। (তাফসীর ইবনে কাছীর ৭/৩৯৯; ফাৎহুল ক্বাদীর ৫/৯৩)।

(২) অলস-অবসর ও বেকারত্বঃ

সবচেয়ে বেশী গীবত চর্চা হয় অবসর সময়ে। মানুষের যখন কর্ম ব্যস্ততা থাকে না, তখন সে অবসর পায়। আর এই অবসর সময় অতিবাহিত করার জন্য চলে যায় গল্পের আড্ডায়, চা স্টলে, ক্লাবে, রাস্তার মোড়ে, হাট-বাজারে অথবা ইন্টারনেটের সুবিস্তৃত প্রান্তরে। শুরু হয় অপ্রয়োজনীয় গাল-গল্প। এক পর্যায়ে মুখরোচক কথায় মানুষের নিন্দা ও দোষকীর্তন শুরু হয়ে যায়। চায়ের চুমুকে চুমুকে গীবতের চর্চা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হ’লেও সত্য যে, আল্লাহর ঘর মসজিদে গীবত করতেও তাদের বুক কেঁপে উঠে না। ছালাতের পরে মুসলিম ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের মহোৎসবে মেতে উঠে। মহিলারাও পিছিয়ে নেই; বরং তারা অবসর সময়ে গীবত চর্চাতে পুরুষের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকে।

তাছাড়া অবসর সময়গুলোতে মিডিয়া পাড়াও মুখরিত হয়ে উঠে পরনিন্দার অনুশীলনে। কোথায় কে কি করেছে বা না করেছে- তা সুনিপুণভাবে ফুটে ওঠে গীবতকারীর স্ট্যাটাসে। শুরু হয় লাইক-কমেন্ট আর শেয়ারের উম্মাতাল ঝড়। যেন সবাই পাপের ভাগ-বাটোয়ারাতে উঠে পড়ে লেগেছে। জাহান্নামের পথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছে। তাই তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : দু’টি নিআমাতের ব্যাপারে অনেক মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়; একটি সুস্থতা অপরটি অবসরতা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১৫৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪১২, সুনান তিরমিযী ২৩০৪, ইবনু মাজাহ ৪১৭০, সহীহুল জামি' ৬৭৭৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৪৩৫৭, মুসনাদে আবৃদ ইবনু হুমায়দ ৬৮৪, মুসনাদে আহমাদ ৩২০৭, শুআবুল ঈমান ৪৫১৩, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১০৬৩৫, আল মু'জামুল আওসাত্ব ৬৩১, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৭৮৪৫, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬৭৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) অধিক ঠাট্টা-মশকরা করার প্রবণতাঃ

অনেক সময় হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-মশকারার মাধ্যমে পরনিন্দা করা হয়। মানুষের শারীরিক গঠন, কথার ভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাড়ি-গাড়ি প্রভৃতি নিয়ে আমরা মজা করার চেষ্টা করি। যেন আমরা হেসে-খেলে নিজের দেহকে আগুনের খোরাক বানাচ্ছি। গীবতের বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, ‘ক্রীড়া-কৌতুক, ঠাট্টা-রসিকতা এবং কৌতুক-মশকরায় সময় কাটানোর জন্য গীবত করা হয়। মানুষকে হাসানোর জন্য অঙ্গ-ভঙ্গি নকল করে অপরের দোষ বর্ণনা করা হয়। মূলতঃ এর উৎপত্তি স্থল হ’ল অহংকার ও দাম্ভিকতা’। (গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১৪৭)।

(৪) আত্মমর্যাদা ও অহমিকাঃ

অহংকার ও আত্মমর্যাদাবোধ মানুষের বিবেকের চোখ অন্ধ করে দেয়। তখন সে মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতে থাকে। যেমন কারো সম্পর্কে বলা সে তো মূর্খ, কিছুই বোঝে না। এই কথার উদ্দেশ্য হ’ল তার চেয়ে আমি বেশী জানি। মূলতঃ বুদ্ধি-বিবেক লোপ পাওয়ার কারণে সে অন্যের দোষকীর্তন করে থাকে।

মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন (রহঃ) বলেন, ‘কখনো যদি কারো হৃদয়ে সামান্য অহমিকাও প্রবেশ করে, তাহ’লে সেই পরিমাণ তার বিবেক লোপ পায়, সেটা কম হোক বা বেশী হোক’। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আত-তাওয়াযু‘ ওয়াল খুমূল, পৃ. ২৭২)।

সুতরাং যে নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করবে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে, অথবা কারো ব্যাপারে মনে ঘৃণা পুষে রাখবে, নিশ্চিতভাবে তার মাধ্যমে গীবত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

(৫)  রাগ ও প্রতিশোধঃ

রাগ মানুষকে অনেক নীচে নামাতে পারে। রাগের বশবর্তী হয়ে মানুষ অনেক অস্বাভাবিক কাজ করে ফেলতে পারে। রাগের কারণে মুখের ভাষা বল্গাহীন হয়ে যায় এবং মুখ দিয়ে বেফাঁশ কথা-বার্তা বের হয়। মনের ঝাল মিটানোর জন্য অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে লাগামহীন কথা বলা হয়। সেজন্য ভিন্নমত পোষণকারী, শত্রু ও অসদাচরণকারীর উপর রেগে গিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাওয়া থেকে সাবধান থাকা উচিত। কারণ শয়তান রাগের সুযোগে বান্দার উপর আক্রমণ করে বসে এবং তার মাধ্যমে গীবত করিয়ে নেয়। আর মানুষ যখন রাগের আগুনে দগ্ধ হয়, তখন সে পশুর মত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।

আবূ হুরাইরাহ হতে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট বললঃ আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেনঃ তুমি রাগ করো না। লোকটি কয়েকবার তা বললেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক বারেই বললেনঃ রাগ করো না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১১৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬৭৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫৭৩, আহমাদ ২৩১৭১, ছহীহুত তারগীব ২৭৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

 জা‘ফর ইবনে মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন, ‘রাগ সকল অকল্যাণের চাবিকাঠি’। (রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৩৬৩)।

ইবনে তীন (মৃ. ৬১১ হি.) বলেন, ‘রাগ করো না, এই উপদেশের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণকে একত্রিত করেছেন। কেননা রাগ সম্পর্কচ্ছেদের দিকে ধাবিত করে এবং কোমলতা থেকে বঞ্চিত রাখে। কখনো কখনো রোষানলে পতিত ব্যক্তির ক্ষতি করতে প্ররোচিত করে। ফলে দ্বীনদারিতা চরমভাবে হ্রাস পায়’। (আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী ১০/৫২০)।

এই বিষয়টি সবার কাছে পরীক্ষিত যে, অনেক সময় মানুষ রাগের বশবর্তী হয়ে এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পরনিন্দা করে থাকে।

(৬) শত্রুতা ও হিংসাঃ

গীবতের একটি প্রত্যক্ষ কারণ হ’ল শত্রুতা ও হিংসা। শত্রুর দোষ-ত্রুটি যত সামান্যই হোক তা প্রকাশ করে গীবতকারী মনের ঝাল মেটানোর চেষ্টা করে। অনুরূপভাবে হিংসার আগুন পরনিন্দার প্রবণতাকে উসকে দেয়। ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, ‘হিংসার কারণে মানুষ গীবতে লিপ্ত হয়। সে যখন কাউকে দেখে যে, সবাই তার প্রশংসা করে এবং সম্মান করে তখন সে হিংসায় জ্বলে যায় এবং অন্য কোন কিছুর ক্ষমতা না থাকায় তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করতে থাকে, যেন তার প্রশংসা ও সম্মান না করা হয়। সে কামনা করে মানুষের মাঝে তার মর্যাদা না থাকুক, যাতে মানুষ তাকে সম্মান করা থেকে বিরত থাকে। কেননা মানুষের মুখে ঐ ব্যক্তির প্রশংসা শোনা তার কাছে অনেক কঠিন মনে হয়। এটাই হিংসা। এটা রাগ বা ক্ষোভ না। কারণ যার উপর রাগ করা হয় তার থেকে কোন অপরাধ দাবী করা হয় না। পক্ষান্তরে হিংসা উত্তম বন্ধু ও নিকটাত্মীয়দের সাথেও হয়ে থাকে’। (ইহয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩/১৭৪)।

(৭)  অন্যের প্রতি কুধারণাঃ

কুধারণাকে বলা হয় মনের গীবত। কারো ব্যাপারে মনে খারাপ ধারণা তৈরী হ’লে পরনিন্দার দুয়ার খুলে যায়। কুধারণার ভিত্তিতে করা গীবতের ভয়াবহতা বেশী। কারণ সাধাণভাবে গীবত হ’ল ব্যক্তির মাঝে যে দোষ-ত্রুটি বাস্তবেই থাকে, সেই বাস্তবসম্মত বিষয়টিই অন্যের কাছে বলে ফেলা গীবত। কিন্তু কুধারণার মাধ্যমে অধিকাংশ সময় ব্যক্তির মাঝে যে দোষ নেই তা কল্পনা করা হয় এবং সন্দেহমূলকভাবে তা অন্যের কাছে প্রচার করা হয়। সেজন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতে কুধারণা পোষণ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরাইরাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। ধারণা বড় মিথ্যা ব্যাপার। তোমরা দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পর হিংসা পোষণ করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না এবং পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়ো না; বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০৬৪, ৫১৪৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫২৫) । হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনু রাসলান বলেন, ‘কুধারণা থেকে বিরত থেকে তুমি তোমার অন্তরকে নীরব রাখ। কেননা মুসলিমের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা অন্তরের গীবত। আর এটা নিষিদ্ধ’। (ইবনু রাসলান আর-রাম্লী, শরহ সুনান আবী দাঊদ ১৯/১৩৯)।

(৮)  নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে না তাকানোঃ

মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। কম-বেশী সবার মাঝে দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান। কিন্তু যারা নিজেদের দোষ-ত্রুটির দিকে নযর দেয় না এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না, তারাই অপরের নিন্দাবাদে বেশী তৎপর থাকে। তাই তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের চোখে সামান্য খড়-কুটো দেখতে পায়, কিন্তু নিজের চোখে আস্ত গাছের গুঁড়ি দেখতে ভুলে যায়’। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৭৬১; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০১৩)।

অর্থাৎ মানুষ অন্যের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেক বড় করে দেখে এবং সেগুলো নিয়ে গীবতে লিপ্ত হয়। কিন্তু নিজের মধ্যে যে তার চেয়ে শতগুণ মারাত্মক ত্রুটি আছে সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ থাকে না।

(৯)  ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির নৈকট্য কামনাঃ

বিভিন্ন অফিস-আদালত ও সংগঠনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা নেতার কাছে ভালো সাজার জন্য অন্যের দোষ চর্চা করা কিছু মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। অন্যকে অযোগ্য প্রমাণিত করে নিজেকে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপনের কোশেশ থেকে এই গীবতের উৎপত্তি হয়। আবার কখনো নিজের দোষ ঢাকার জন্য গীবত করা হয়, যাতে নিজের ত্রুটিকে হালকা প্রমাণিত করা যায়।

ইমাম গাযালী বলেন, ‘গীবতকারী যখন বুঝতে পারে যে, অমুক ব্যক্তি উচ্চপদস্থ লোকের কাছে তার দোষ বর্ণনা করবে বা তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে, তখন সে পূর্ব থেকেই ঐ লোকের দোষ বর্ণনা করা শুরু করে, যাতে তার সম্পর্কে কিছু বলা হ’লে সেটা শোনার মতো অবস্থা না থাকে। অথবা সত্য বিষয়গুলো দিয়ে আলোচনা শুরু করে, যাতে পরবর্তীতে মিথ্যা বলতে পারে। তখন প্রথম সত্যের সাথে মিথ্যা চালিয়ে

দিবে। আবার কখনো কখনো সে নিজের দোষ থেকে নির্দোষ হওয়ার জন্য অন্যের গীবত করে। এমতাবস্থায় অপর ব্যক্তির নাম নিয়ে বলা হয়- সেও তো এরকম করেছে কিংবা এ কাজে সেও আমার সাথী ছিল’। (ইহ্য়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৩/১৪৬-১৪৭)।

(১০) গীবতের মজলিসে বসা এবং গীবতের পরিবেশে বেড়ে ওঠাঃ

পরিবেশ ও সঙ্গের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া মানুষের স্বভাব। বিবেকের লাগাম টেনে এটাকে যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা যায়, তাহ’লে বন্ধু-বান্ধব ও আশ-পাশের লোকের প্রভাবে পরনিন্দার ঘেরাটোপে আটকে যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া গীবতের পরিবেশে বেড়ে উঠলে গীবতকে পাপ মনে করার মানসিকতা লোপ পেয়ে যায়। ইমাম গাযালী বলেন, ‘অন্যের দেখাদেখি এবং তার সুরের সাথে সুর মিলানোর জন্য অনেকে গীবতে লিপ্ত হয়। আপন সঙ্গী কারো ব্যাপারে মন্দ আলোচনা করলে সে মনে করে তার মতো না বললে সে বুঝি বেজার হয়ে যাবে কিংবা বন্ধুত্ব ছেড়ে দিবে। তখন সে তার বন্ধুর কথার ন্যায় কথা বলতে থাকে এবং এটাকে সামাজিকতা মনে করে। সে মনে করে এর মাধ্যমে সে পরিবেশের সাথে তাল মিলাচ্ছে। অনেক সময় সঙ্গী-সাথীরা কারো প্রতি রাগ দেখালে সেও তার ওপর রাগ দেখায়, সে তার বন্ধুদের একথা বুঝাতে চায় যে, বিপদ-আপদে, দুঃখ-কষ্টে সর্বদা সে তাদের সাথেই আছে’। (ইহ্য়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৩/১৪৬)।

গাযালী (রহঃ)-এর কথাটা যে কতটা বাস্তবসম্মত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক সময় আমরা শুধু মুখ রক্ষার স্বার্থে, সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এবং সামাজিকতা বজায় রাখার নিমিত্তে গীবত চর্চা করি। এমনকি কখনো কখনো গীবত অপসন্দ করা সত্ত্বেও ঈমানী দুর্বলতার কারণে এখান থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারি না। অথচ আমরা জানি গীবত করা যেমন মহাপাপ, তেমনি মুগ্ধ হয়ে গীবত শোনা এবং তাতে সায় দেওয়াও পাপ।

গীবতের পরিণাম ও ভয়াবহতা

গীবত বা পরনিন্দা একটি সর্বনাশা মহাপাপ। এই পাপের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট হয়। কারণ পরনিন্দার মাধ্যমে অন্যের সম্মান হানি করা হয় এবং তার মর্যাদার ওপর চরমভাবে আঘাত করা হয়, যা আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের উপর হারাম করেছেন। দুনিয়া ও আখেরাতে গীবতকারীর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হয়। নিম্নে গীবতের পরিণাম ও ভয়াবহতা সংক্ষেপে তুলে ধরা হ’ল।-

(১)  গীবত একটি ভয়াবহ কাবীরা গুনাহঃ

মুসলিমের জীবনে অন্যান্য কবীরা গুনাহের চেয়ে গীবতের প্রভাব ও পরিণাম অপেক্ষাকৃত বেশী ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গীবতের ভয়াবহতা বুঝাতে যে উপমা দিয়েছেন, অন্য কোন মহাপাপের ব্যাপারে এত শক্তভাবে বলেননি। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেছেন,

আমি একবার ছাফিয়া [রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী]-এর দিকে ইশারা করে বললাম,‘সে তো বেঁটে মহিলা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি তো তার গীবত করে ফেললে’। (আহমাদ ২৫৭০৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাত ওয়ান নামীমাহ, ৭০; পৃ. ২৪)। হাদিসের মানঃ হাসান।

অপর বর্ণনায় এসেছে.

 আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, সাফিয়্যাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে আপনার জন্য এতটুকুই যে, সে এরূপ অর্থাৎ তিনি খাটো। তিনি বললেনঃ তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যা সমুদ্রে মিশিয়ে দিলে তাতে সমুদ্রের পানি রং পাল্টে যাবে। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নকল করলাম। তিনি বললেনঃ আমাকে এতো এতো সম্পদ দেয়া হলেও আমি কারো অনুকরণ পছন্দ করবো না। (সুনান আবূদাঊদ ৪৮৭৫; সুনান আততিরমিযী ২৫০২)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘এই গীবত এতটাই দুর্গন্ধময় ও জঘন্য যে, যদি এটাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়, তবে সমগ্র সাগরের পানির স্বাদ ও গন্ধ উভয়টাই পরিবর্তন হয়ে যাবে’। (শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন ৬/১২৬)।

ইবনে আল্লান (রহঃ) বলেন, ‘গীবতের এই কথা সৃষ্টিকূলের সবচেয়ে বড় সৃষ্টি সমুদ্রের সাথে মিশে যদি এত ভয়াবহ হ’তে পারে, তবে গীবতের চেয়ে শক্তিশালী পাপ আর কি হ’তে পারে’। (ইবনু আল্লান, দালীলুল ফালিহীন ৮/৩৫২)।

অর্থাৎ নিন্দাবাদের ছোট্ট একটি কথা যদি বিশাল সমুদ্রের রঙ বদলে দিতে পারে, বিস্তীর্ণ সাগরের পানির স্বাদ পরিবর্তন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তবে এই গীবত আমাদের দ্বীনদারিতা ও আমলনামার কি অবস্থা করে ছাড়বে তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদীছটি পরনিন্দার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ধমকের অন্যতম অথবা সবচেয়ে বড় ধমক। গীবতের নিন্দাবাদে এত কঠোর হাদীছ আছে বলে আমার জানা নেই’। (মানাভী, ফায়যুল ক্বাদীর, ৫/৪১১)।

সুতরাং হাদীছের বাণী ও ওলামায়ে কেরামের ভাষ্যগুলো পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায় গীবত কত মারাত্মক পাপ। তাছাড়া এখানে আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হ’ল মুসলমানদের মাঝে গীবত এত সন্তর্পণের বিচরণ করে যে, নেককার বান্দারাও নিজের অজান্তে এই পাপে জড়িয়ে যেতে পারেন।

(২)  গীবত মৃত মানুষের গোশত খাওয়ার চেয়েও নিকৃষ্ট পাপঃ

মানুষের গোশত খাওয়া হারাম। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করো না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক’। (সুরা হুজুরাত ৪৯/১২)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ গীবতের এই উপমা দিয়েছেন এজন্য যে, মৃত মানুষের গোশত খাওয়া যেমন ঘৃণ্য এবং হারাম, ঠিক তেমনি দ্বীন ইসলামে গীবত করা হারাম এবং নফসেরে জন্য ঘৃণার্হ’।

ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেমন তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকে। একইভাবে তার অবশ্য কর্তব্য হ’ল তার জীবিত ভাইয়ের গোশত খাওয়া বা গীবত করার থেকে বিরত থাকা’। (তাফসীরে কুরতুবী ১৬/৩৩৫)।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে গেলে অপর একজন সেই ব্যক্তির সমালোচনায় লিপ্ত হয়। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘দাঁত খেলাল কর’। সে বলল, ‘আমি তো গোশত খাইনি; দাঁত খেলাল করব কেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি তো (এইমাত্র) তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করলে’। (ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৩৭, সনদ ছহীহ লি গাইরিহী)।

আমর ইবনুল ‘আছ একদিন একটা মরা গাধার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচিছলেন। গাধাটির দিকে ইশারা করে তার সাথীদের বললেন, ‘একজন মুসলিমের গোশত খাওয়া বা গীবত করার চেয়ে কোন মানুষের জন্য এই (মরা গাধার) গোশত খেয়ে পেট ভরানো উত্তম’।  (ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৮, সনদ ছহীহ)।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তির গীবতের চেয়ে নিকৃষ্ট লোকমা কেউ গ্রহণ করে না’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৪, সনদ ছহীহ)।

একবার ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) কিছু মানুষকে দাওয়াত করলেন। তারা এসে খাবারের জন্য বসে এক ব্যক্তির দোষচর্চা শুরু করল। তখন ইবরাহীম (রহ.) বললেন, আমাদের পূর্বকালের লোকেরা গোশত খাওয়ার আগে রুটি খেত। আর আপনারা তো আগেই গোশত খাওয়া শুরু করে দিলেন (অর্থাৎ গীবত শুরু করে দিয়েছেন)। (আবুল লাইছ সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১২৩)।

(৩)  যিনা-ব্যভিচার ও সূদ-ঘুষের চেয়েও নিকৃষ্ট পাপ গীবতঃ

সমাজে প্রচলিত পাপগুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয় জঘন্য পাপ হ’ল ব্যভিচার ও সূদ। লম্পট, যেনাকার ও সূদ-ঘুষখোর নর-নারীকে সমাজের সবাই ঘৃণা করে। তাদেরকে কেউ অন্তরে ঠাঁই দেয় না। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হ’ল সূদ-ঘুষ ও যিনা-ব্যভিচারের চেয়েও ক্ষতিকর, ঈমান বিধ্বংসী ও নিকৃষ্ট পাপ হ’ল গীবত। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হ’ল মুসলিম সমাজের অনেকেই ব্যভিচার ও সূদের পাপ থেকে নিজেকে হেফাযত করতে পারলেও অবলিলায় গীবতের পাপে জড়িয়ে পড়েন। বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘গীবতের বাহাত্তরটি দরজা আছে। তন্মধ্যে নিকটবর্তী দরজা হ’ল কোন পুরুষ কর্তৃক তার মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। আর সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল অপর ভাইয়ের সম্মানহানি করা (অর্থাৎ গীবত করা)’। (তাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭১৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫৩৭; ছহীহাহ হা/১৮৭১, সনদ ছহীহ)।

আমরা জানি, যিনা-ব্যভিচার এমনিতেই নিকৃষ্ট মানের পাপ। ব্যভিচারীকে মানুষ সবসময় ঘৃণার চোখে দেখতে অভ্যস্ত। তার উপর আপন মায়ের সাথে এমন জঘন্য কাজের কথা মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। আবার এই কল্পনাতীত গুনাহটাই নাকি সূদের সবচেয়ে লঘু স্তর। তাহ’লে সূদ আরো কত ভয়াবহ পাপ? আর সেই সূদের চেয়েও বড় পাপ হ’ল গীবত। তাহ’লে এই গীবত কত নিকৃষ্ট, জঘন্য ও নিন্দনীয় পাপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওলামায়ে কেরাম বলেন, সূদের চেয়ে গীবতের পাপ মারাত্মক হওয়ার কারণ হ’ল মুসলিম ব্যক্তির সম্পদের চেয়ে তার মান-মর্যাদা অনেক বেশী মূল্যবান। তাই তার সম্পদ আত্মসাৎ করার চেয়ে তার সম্মান নষ্ট করার ভয়াবহতা অনেক বেশী। (ফাৎহুল ক্বারীবিল মুজীব ১১/৩৯১)।

অপর এক হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মাঝে খুৎবাহ দিলেন। খুৎবাতে তিনি সূদের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, ‘কোন ব্যক্তির জন্য ছত্রিশবার ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ হ’ল এক দিরহাম সূদ গ্রহণ করা। আর সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল মুসলিম ভাইয়ের সম্মানে আঘাত দেওয়া বা গীবত করা’। (ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১, সনদ ছহীহ)।

(৪) গীবতকারী কবরে শাস্তিপ্রাপ্ত হবেঃ

মৃত্যুর পর থেকেই গীবতকারীর পরকালীন শাস্তি শুরু হয়ে যায়।

 ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তিনি বললেনঃ এদের ‘আযাব দেয়া হচ্ছে, কোন গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব হতে সতর্ক থাকত না। আর অপরজন চোগলখোরী করে বেড়াত। তারপর তিনি একখানি কাঁচা খেজুরের ডাল নিয়ে ভেঙ্গে দু’ভাগ করলেন এবং প্রত্যেক কবরের উপর একখানি গেড়ে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কেন এমন করলেন? তিনি বললেনঃ  আশা করা যেতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত এ দু’টি শুকিয়ে না যায় তাদের আযাব কিছুটা হালকা করা হবে। ইবনুল মুসান্না (রহ.) আ‘মাশ (রহ.) বলেনঃ আমি মুজাহিদ (রহ.) হতে অনুরূপ শুনেছি। সে তার পেশাব হতে সতর্ক থাকত না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২১৮, ২১৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৬৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তাদের একজন মানুষের গীবত করত। আর অপরজন পেশাবের  (ছিটার) ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না’। (মুসনাদে আবী ইয়া‘লা মাওছিলী হা/২০৫০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৫, সনদ ছহীহ)।

ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, ‘কবরের আযাব তিন ভাগে বিভক্ত : এক-তৃতীয়ংশ গীবতের কারণে, এক-তৃতীয়াংশ পেশাব থেকে সতর্ক না থাকার কারণে আর এক-তৃতীয়াংশ চোগলখুরীর কারণে হবে’। (ইবনু হাজার হায়তামী, আয-যাওয়াজির আন-ইক্বতিরাফিল কাবায়ির, ২/১৮; ইবনু আবীদ্দুনইয়া, আছ-ছামত, পৃ. ১২৯)।

(৫)  গীবত বান্দার দ্বীনদারীকে ধ্বংস করেঃ

আখেরাত পিয়াসী বান্দার জীবনে অমূল্য সাধনার ফসল হ’ল তার দ্বীনিয়াত। এটাকে উপজীব্য করে সে তার পার্থিব জীবন পরিচালনা করে। কিন্তু গীবত ও পরনিন্দা তার দ্বীনিয়াতকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। তার পরহেযগারিতার বুকে কুঠারাঘাত করে বসে। নীরব ঘাতকের মত তার ধার্মিকতায় পঁচন ধরিয়ে দেয়। বান্দা যদি গীবত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তবে তার ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারে না।

উসামা ইবনে শরীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উপস্থিত থাকা অবস্থায় বেদুইনরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো, এতে কি আমাদের গুনাহ হবে, এতে কি আমাদের গুনাহ হবে? তিনি বলেনঃ আল্লাহর বানদাগণ! কোন কিছুতেই আল্লাহ গুনাহ রাখেননি, তবে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ইজ্জতহানি করে তাতেই গুনাহ হবে। তারা বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যদি (রোগীর) চিকিৎসা না করি তবে কি আমাদের গুনাহ হবে? তিনি বলেনঃ আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা করো। কেননা মহান আল্লাহ বার্ধক্য ছাড়া এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার সাথে প্রতিষেধকেরও ব্যবস্থা করেননি (রোগও রেখেছেন, নিরাময়ের ব্যবস্থাও রেখেছেন)। তারা বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বান্দাকে যা কিছু দেয়া হয় তার মধ্যে উত্তম জিনিস কী? তিনি বলেনঃ সচ্চরিত্র। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৪৩৬, সুনান আততিরমিযী ২০৩৮, সুনান আবূ দাউদ ৩৮৫৫, আহমাদ ১৭৯৮৫, গায়াতুল মারাম ২৩৬, সহীহাহ ৪৩৩, মিশকাত ৪৫৩২, ৫০৭৯, আল-আদাবুল মুফরাদ ২৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এজন্য সালাফে ছালেহীন শুধু ছালাত-ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং গীবত থেকে বিরত থাকাকেও ইবাদত গণ্য করতেন। কেননা গীবতের ছিদ্র বন্ধ না থাকলে আমলনামার ঝুলিতে কোন নেকী অবশিষ্ট থাকে না। তাই তো আব্দুল করীম ইবনে মালেক (রহঃ) বলেন, ‘আমরা সালাফে ছালেহীনকে এমন পেয়েছি যে, তারা শুধু ছালাত, ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং মানুষের সম্মানে হস্তক্ষেপ বা গীবত পরিহার করাকেও ইবাদত হিসাবে গণ্য করতেন’। (আছ-ছাম্তু, পৃ. ১৩০)।

হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! গীবত মুমিনের দ্বীনিয়াতের জন্য এতটাই দ্রুততম ক্ষতিকারক যে, এটা তার দেহে থেকে গোশত কামড়ে খাওয়ার চেয়েও মারাত্মক’। (ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাতি ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ২১)।

 

তাছাড়া গীবত বান্দার হৃদয়কে রোগাক্রান্ত করে দেয়, ফলে তার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মুমিনের স্তর থেকে ফাসেক্বের স্তরে ছিটকে পড়ে। ওছমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) বলেন,‌ ‘রাখাল যেভাবে গাছ কেটে ফেলে, পরনিন্দা ও চোগলখুরী সেভাবে ঈমানকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে’। (শামসুদ্দীন সাফ্ফারীনী, গিযাউল আলবাব, ১/১০৫)।

 সুফইয়ান ছাওরী (রহ.) বলেন, ‘গীবত থেকে বেঁচে থাক! মানুষের দোষচর্চা করা থেকে সবধান থাক। অন্যথায় তোমার দ্বীনদারী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’। (আছ-ছাম্তু, পৃ. ১৭১)।

 আবূ হাতেম বুস্তী (রহ.) বলেন, ‘সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হ’ল আল্লাহর যিক্র করা এবং সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবসা হ’ল মানুষের সমালোচনা করা’। (ইবনু আব্দিল বার, বাহজাতুল মাজালিস, পৃ. ৮৬)।

(৬) গীবতের মাধ্যমে নেক আমল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ঃ

পরনিন্দা একটি মারাত্মক পাপ, যা বান্দার নেক আমলের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং আমলের নেকী অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। যেমন কেউ যদি ছিয়াম রেখে গীবত করে, তাহ’লে সে ছিয়ামের ফযীলত ও নেকী লাভে বঞ্চিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি (সিয়ামরত অবস্থায়) মিথ্যা কথা বলা ও এর উপর ’আমল করা ছেড়ে না দেয়, তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৯৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯০৩, ৬০৫৭, সুনান আবূ দাঊদ ২৩৬২, সুনান তিরমিযী ৭০৭, সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৮৯, আহমাদ ১০৫৬২, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৯৯৫, ইবনু হিব্বান ৩৪৮০, সহীহ আত্ তারগীব ১০৭৯, সহীহ আল জামি‘ ৬৫৩৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অত্র হাদীছের মর্মার্থ হ’ল, কেউ যদি ছিয়ামরত অবস্থায় গীবতের মতো পাপে জড়িয়ে পড়ে, তাহ’লে সে ঐ ছিয়ামের মাধ্যমে কোন উপকারিতা হাছিল করতে পারবে না। যদি সেটা ফরয ছিয়াম হয়, তবে তার ফরযিয়াত আদায় হয়ে যাবে এবং তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে না। কিন্তু ছিয়ামের পুরস্কার ও ছওয়াব লাভে সে বঞ্চিত হবে। কারণ সে ছিয়াম রেখে মানুষের গোশত ভক্ষণ করেছে’। (আতিয়্যাহ মুহাম্মাদ সালিম, শারহে বুলূগুল মারাম, ৭/১৪৭)।

অনুরূপভাবে হাদীছে ছিয়ামকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ঢাল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গীবত সেই ঢালের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, সওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সায়িম। যাঁর কবজায় মুহাম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিস্কের গন্ধের চাইতেও সুগন্ধি। সায়িমের জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯০৪, ১৮৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ২৫৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫১, আহমাদ ৭৭৯৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৬৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন, ‘ছিয়ামরত অবস্থায় কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকলে সেই ছিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাল হবে। সুতরাং দুনিয়াতে যদি কেউ কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে, তাহ’লে আখেরাতে সেটা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হবে। আবূ উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ (রাঃ) বলেন, ‘অত্র হাদীছে ইঙ্গিত রয়েছে যে, গীবত ছিয়ামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে’। (ইবনু হাজার আসকালানী, ফাৎহুল বারী ৪/১০৪)।

হাফছাহ বিনতে সীরীন (রহঃ) বলেন, ‘ছিয়াম ততক্ষণ ঢাল থাকে, যতক্ষণ না ছায়েম এটাকে ভেঙ্গে ফেলে। আর গীবতের মাধ্যমে ঢাল ভেঙ্গে যায়’। (মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক্ব, ৫/৪৮)।

আবূল আলিয়া (রহঃ) বলেন, ‘ছিয়াম পালনকারী যতক্ষণ না কারো গীবত করে, ততক্ষণ সে ইবাদতের মধ্যেই থাকে। এমনকি বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থাতেও সে ইবাদতরত থাকে’। (মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক্ব, ৪/৩০৭)।

অর্থাৎ গীবত করলে ছিয়াম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সালাফগণ নিজেদের নেক আমলের হেফাযতের জন্য গীবত থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতেন। আবূল মুতাওয়াক্কিল বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) এবং অন্যন্য ছাহাবায়ে কেরাম ছিয়ামরত অবস্থায় মসজিদে বেশী অবস্থান করতেন। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘আমরা আমাদের ছিয়ামকে পবিত্র রাখার জন্য এমন করে থাকি’। (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/১২০; ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ, ২/৭৬)।

মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ছিয়ামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, সে যেন গীবত ও মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকে’। (হান্নাদ ইবনে সির্রী, কিতাবুয যুহ্দ, ২/৫৭২)।

শুধু ছিয়ামই নয়; যে কোন ইবাদতকে পবিত্র রাখার জন্য গীবত থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। সালাফগণ বলেছেন, ‘তুমি যদি তিনটি কাজ করতে অপারগ হয়ে যাও, তবে অবশ্য অপর তিনটি কাজ থেকে দূরে থাকবে: (১) যদি ভালো কাজ না করতে পার, তবে অবশ্যই অন্যায় থেকে দূরে থাকবে, (২) যদি মানুষের উপকার করতে না পার, তবে অবশ্যই তাদের ক্ষতি করার থেকে দূরে থাকবে এবং (৩) যদি ছিয়াম রাখতে না পার, তবে অবশ্যই মানুষের গোশত খাওয়া বা পরনিন্দা থেকে বিরত থাকবে’। (সামারকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন, পৃ. ১৬৬)।

(৭)  দুনিয়া ও আখেরাতে নিজের ত্রুটি প্রকাশ পায়ঃ

পৃথিবীর কোন মানুষ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কম-বেশী সবার মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। কেউ যদি নিজের দিকে নযর না দিয়ে অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং গীবত করে, তাহ’লে তার দোষ-ত্রুটিগুলো যে কোন মাধ্যমে আল্লাহ প্রকাশ করে দেন। মূলত গীবতকারীর ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে দিয়ে আল্লাহ তাঁর মুসলিম বান্দার পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেন। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুসলমানদেরকে পরনিন্দা থেকে সাবধান করেছেন।

আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে সেসব লোক যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন। (সুনান আবূদাঊদ ৪৮৮০; ছহীহুল জামে‘ ৭৯৮৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্যত্র তিনি (ছাঃ) বলেন,

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার গুপ্ত (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয় ফাঁস করে দিবে, আল্লাহ তার গোপন বিষয় ফাঁস করে দিবেন, এমনকি এই কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৪৬; ছহীহুত তারগীব ২৩৩৮, আত-তালীকুর রাগীব৩/১৭৬, সহীহাহ ২৩৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আযীমাবাদী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীছে মুসলিমের দোষ প্রকাশকারীদের প্রতি কঠিন ধমক দেওয়া হয়েছে। তারা যদি এই নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত না থাকে, তবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকলেও সেখানেই অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের পাকড়াও করবে’। (আওনুল মা‘বূদ ১৩/২২৪)।

ইবনু হাজার হায়তামী (রহঃ) বলেন, ‘মুমিনগণ সকলে একটি দেহের ন্যায়। শরীরের একটি অংশ ব্যথাহত হ’লে পুরা শরীরে ব্যথিত হয়। সুতরাং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যে অপরের দোষ চর্চা করে, সে মূলত নিজেরই দোষ চর্চায় লিপ্ত হয়’। (হায়তামী, আয-যাওয়াজির ২/৯)।

অর্থাৎ অন্যের দোষ আলোচনা করার মাধ্যমে সে নিজের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। সে যদি নির্জনেও কোন পাপ করে অথবা তার এমন কোন ত্রুটি আছে যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানত না- এমন বিষয়গুলো অন্যের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাবে। হয় সে নিজেই নিজের অজান্তে তার দোষ বলে দিবে অথবা কোন আলামত বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। সেজন্য অন্যের ত্রুটি গোপন রাখার প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক।

ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি দোষ গোপন রাখে এবং সদুপদেশ দেয়। আর পাপিষ্ট ব্যক্তি গোপন বিষয় ফাঁস করে দেয় এবং পরনিন্দা করে’। (ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম ১/২২৫)।

(৮)  ক্বিয়ামতের দিন অন্যের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে চাপেঃ

ক্বিয়ামতের দিন কড়ায়গন্ডায় গীবতের বদলা নেওয়া হবে। যার গীবত করা হয়েছে তার পাপের বোঝা গীবতকারীর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে, অথচ সেই গীবতকারী হয়ত সারা জীবনে একবারও সেই পাপ করেনি, তথাপি পরনিন্দার কারণে সেই পাপের ঘানি তাকে টানতে হবে। আবার নিজের কষ্টার্জিত আমল- ছালাত, ছিয়াম, দান-ছাদাক্বাহ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেওলাওয়াত প্রভৃতি ইবাদতের নেকীগুলো গীবতের পরিমাণ অনুযায়ী তাকে দিয়ে দিতে হবে। হাশরের ময়দানে মানুষ যখন একটা নেকীর জন্য হন্যে হয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকবে, সেই কঠিন মুহূর্তে নিজের নেকী অন্যকে দিয়ে দিতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জানো, (প্রকৃত) গরীব কে? সাহাবায়ে কিরাম বললেনঃ আমরা তো মনে করি, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা, ধনদৌলত নেই, সে-ই গরীব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি গরীব হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করে আসবে; কিন্তু সাথে সাথে সেসব লোকেদেরকেও নিয়ে আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো অপবাদ রটিয়েছে, কারো সম্পদ খেয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে; এমন ব্যক্তিদেরকে তার নেকীগুলো দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে অথচ পাওনাদারদের পাওনা তখনো বাকি, তখন পাওনাদারদের গুনাহ তথা পাপ তার ওপর ঢেলে দেয়া হবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১২৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সুনান আততিরমিযী ২৪১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৮৪৫, সহীহুল জামি‘ ৮৭, সহীহ আত্ তারগীব ২২২৩, শু‘আবুল ঈমান ৩৩, আহমাদ ৮০২৯, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা ৬৪১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪১১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫৬১, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৭৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সহজ কথায় আমরা যদি গীবতের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে হোক অপর মুসলিমের অধিকার নষ্ট করি, তবে ক্বিয়ামতের দিন আমাদের সম্পাদিত নেক আমলের নেকীগুলো তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে। যদি নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে যার গীবত করা হয়েছে তার পাপের বোঝাগুলো নিজের মাথায় নিতে হবে এবং এভাবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে হবে। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, ‘তোমরা গীবত থেকে সাবধান থাক। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আগুন যেভাবে কাঠ পুড়িয়ে দেয় তার চেয়েও দ্রুতগতিতে গীবত নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়’। (ইবনু আবীদ্দুনইয়া, যাম্মুল গীবাহ ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ৪৭)।

(৯) পরকালের কঠিন শাস্তি ভোগঃ

নিজের নেকীগুলো অন্যকে দিয়ে যখন গীবতকারী দেওলিয়া হয়ে যাবে, তখন তার জন্য শাস্তি অবধারিত হয়ে যাবে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা আমাকে উপরে নিয়ে গেলেন, আমি সেখানে এমন লোকেদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ তামার তৈরি। সেসব নখ দ্বারা তারা তাদের মুখমণ্ডলে ও বক্ষ খোঁচাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল (আ.) বললেনঃ এরা সেসব লোক, যারা মানুষের মাংস খায় (পরোক্ষ নিন্দা করে) এবং মানুষের পিছনে লেগে থাকে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০৪৬, সুনান আবূ দাঊদ ৪৮৭৮, আহমাদ ৯৩৩৪০, শু‘আবুল ঈমান ৬৭১৬, সহীহ আত্ তারগীব ২৮৩৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৮, সহীহুল জামি‘ ৫২১৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৫৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, ‘শোকের সময় মুখ ও বুক খামচানো পুরুষ মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়; বরং এগুলো ভাড়াটে বিলাপকারিণী মহিলাদের স্বভাব। মূলত এই উপমা দেওয়ার মাধ্যমে হাশরের মাঠে গীবতকারীদের শোচনীয় ও লাঞ্ছনাদায়ক অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে’। (আওনুল মা‘বূদ ১৩/১৫৩)।

(১০)  জান্নাতে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিতঃ

গীবতকারী মুসলিম যদি গীবত থেকে তওবা না করে মারা যায়, তবে তিনি প্রথম সুযোগে জান্নাতে যেতে পারবে না; বরং তাকে গীবতের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। যারা মুমিনদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং তাদের নিন্দা করে, ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ খাওয়ানো হবে।

সাহল ইবনু মু’আয ইবনু আনাস আল জুহানী (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোনো মু’মিনকে মুনাফিক থেকে রক্ষা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার শরীর জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য একজন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করবে তাকে মহান আল্লাহ জাহান্নামের সেতুর উপর প্রতিরোধ ব্যবস্থা করবেন যতক্ষণ না তার কৃত কর্মের ক্ষতিপূরণ হয়। (সুনান আবূদাঊদ ৪৮৮৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

ইয়াহইয়া ইবনু রাশিদ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ)-এর অপেক্ষায় বসে রইলাম। তিনি বেরিয়ে এসে আমাদের নিকট বসলেন এবং বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যার সুপারিশ আল্লাহর নির্ধারিত কোন হাদ্দ বাস্তবায়িত করার পথে বাধা সৃষ্টি করে, সে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যে ব্যক্তি জেনে বুঝে মিথ্যা মামলা দেয়, সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। যে ব্যক্তি কোন ঈমানদারের এমন দোষ বলে বেড়ায় যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের আবর্জনার মধ্যে বসবাস করাবেন। অতএব তাকে শীঘ্রই তার কথা থেকে তওবা এবং ত্যাগ করা উচিত। (সুনান আবূদাঊদ ৩৫৯৭; মুস্তাদরাকে হাকেম ২২২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আশরাফ বলেন, গীবত থেকে ফিরে আসার অর্থ হ’ল শাস্তি পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গীবতকারী জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পাবে না। (মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ৬/২৩৬৭)।

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

‌‌গীবত দুরারোগ্য ব্যাধির ন্যায়। গীবতের রোগ মরণ ব্যাধি ক্যান্সার অপেক্ষাও ভয়াবহ। ক্যান্সার মানুষের শরীর নিঃশে^ষ করে দেয়, আর গীবত কর্মফল ধ্বংস করে দেয়। দুনিয়াতে তাকে অপদস্থ করে এবং পরকালে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। অথচ আমরা নিত্যদিন গীবত করার মাধ্যমে আমাদের অতি আদরের দেহটাকে আগুনের খোরাক বানাচ্ছি। সুতরাং জীবদ্দশাতেই গীবত ও পরনিন্দা থেকে বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে। এ নিবন্ধে আমরা গীবত থেকে পরিত্রাণ লাভের কতিপয় উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।

(১)  গীবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়াঃ

গীবত থেকে বাঁচার জন্য সর্বপ্রথম এর ভয়াহতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যরূরী। কারণ কোন কিছুর ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে সেই ক্ষতিকারক বিষয় থেকে সতর্ক থাকা যায় না। সুতরাং গীবত যে ভয়াবহ পাপ সেটা যদি কেউ না জানে এবং গীবতের স্বরূপ তার কাছে অস্পষ্ট থাকে, তবে তার মাধ্যমে গীবতের পাপ হওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু সে যদি জানে গীবত সাধারণ কোন কাবীরা গুনাহ নয়, এটা যেনা-ব্যভিচার, সূদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতির চেয়েও মারাত্মক। এই পরনিন্দা ঋণের মতো, যা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। যার দোষ-চর্চা করা হয়, ক্বিয়ামতের দিন তাকে নিজের কষ্টার্জিত আমলের নেকী ও ছওয়াব বাধ্য হয়ে দিতে হবে। আর যদি নিজের নেকী না থাকে, তবে সেই ব্যক্তির পাপের বোঝা গীবতকারীর উপরে চাঁপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে উল্টোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এসব বিষয় কেউ অবহিত হ’লে তার জন্য গীবত পরিহার করা অনেকটা সহজ হবে।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,  ‘তোমরা আল্লাহর যিক্রে নিমগ্ন থাক, কেননা এটা (অন্তরের) প্রতিষেধক। আর অবশ্যই মানুষের দোষ চর্চা করা থেকে সাবধান থাকবে, কেননা এটা একটা রোগ’। (আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহদ, পৃ. ১০১)।

গীবত থেকে সবাইকে বাঁচতে হবে। কেননা তা কর্মফল নষ্টকারী। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেছেন, ‌ ‘তুমি বাঘ থেকে যেভাবে পলায়ণ কর, গীবতকারী থেকে সেভাবে পালিয়ে যাও’। (ড. আব্দুল মুহসিন ক্বাসেম, খুতুওয়াতুন ইলাস সা‘আদাহ, পৃ. ১১৬)।

(২)  জিহবার হেফাযত করাঃ

জিহবা ঘটিত পাপগুলো খুব সহজে করা হয়, ফলে এর ভয়াবহতাও বেশী। গীবত মূলত জিহবার মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ আল্লাহর অসন্তুুষ্টিমূলক কথা বলে এবং তাকে দূষণীয় মনে করে না। অথচ এই কথার দরুন সত্তর বছর ধরে সে জাহান্নামে পতিত হতে থাকবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৭০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪৭৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৭১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৮৮, সুনান আততিরমিযী ২৩১৪, আহমাদ ৭১৭৪, ৭৮৯৮, ৮২০৬, ৮৪৪৪, ৮৭০৩, ৮৯৬৭, ১০৫১৪, মুয়াত্তা মালেক ১৮৪৯, সহীহাহ ৫৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন হাদীছে জিহবা সংযত করার ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন।

মু’আয (রাঃ) ইবনু জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন একটা ’আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে (সহজে) জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করলে, কিন্তু যার পক্ষে আল্লাহ এটা সহজ করে দেন, তার পক্ষে এটা খুবই সহজ। তা হচ্ছে, আল্লাহর ’ইবাদাত করবে, কাউকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। নিয়মিত সালাত ক্বায়িম করবে, যাকাত দিবে, রমাযানের সিয়াম পালন করবে এবং বায়তুল্লাহর হাজ্জ (হজ/হজ্জ) করবে। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে মু’আয! আমি কি তোমাকে কল্যাণের দরজাসমূহ বলে দিব না? (জেনে রেখ) সিয়াম (কুপ্রবৃত্তির মুকাবিলায়) ঢালস্বরূপ। দান-সদাক্বাহ্ (সাদাকা) গুনাহকে নির্মূল করে দেয় যেমনিভাবে পানি আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেয়। মানুষের মধ্য-রাত্রির (তাহাজ্জুদের) সালাত  (আদায়ের মাধ্যমে গুনাহ শেষ হয়ে যায়)। অতঃপর (তার প্রমাণে কুরআনের এ আয়াত) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাঠ করলেনঃ ’’সৎ মু’মিনদের পাঁজর বিছানা থেকে আলাদা থাকে (অর্থাৎ- তারা শয্যা ত্যাগ করে ’ইবাদাতে রত থাকে) আর নিজেদের পরওয়ারদিগারকে আশা-নিরাশার স্বরে ডাকতে থাকে। যে সম্পদ আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে। কোন মানুষই জানে না, এ সৎ মু’মিনদের চোখ ঠাণ্ডা করার জন্য কি জিনিস লুক্বায়িত রাখা হয়েছে। এটা হলো তাদের কৃত সৎ ’আমলের পুরস্কার’’- (সূরাহ্ আস্ সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) ৩২: ১৬-১৭)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমি কি তোমাকে বলে দিব না, (দীনের) কাজের খুঁটি স্তম্ভ কি এবং তার উচ্চশিখরই বা কি? আমি বললাম, হাঁ, বলে দিন, হে আল্লাহর রসূল! তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, দীনের (সমস্ত কাজের) আসল হচ্ছে ইসলাম (অর্থাৎ- কালিমাহ্)। আর তার স্তম্ভ হলো সালাত আর উচ্চশিখর হচ্ছে জিহাদ। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাকে এ সকলের মূল বলে দিব না? আমি উত্তর দিলাম, হে আল্লাহর নবী! অবশ্যই তা বলে দিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর জিহবা ধরে বললেন, এটাকে সংযত রাখ। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমরা মুখ দ্বারা যা বলি, এ সম্পর্কেও কি (পরকালে) আমাদের জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সর্বনাশ, কি বললে হে মু’আয! (জেনে রেখ কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন) মানুষকে মুখ অথবা নাকের উপর উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তার কারণ মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অসংযত কথা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৯, আহমাদ ২১৫৫১, সুনান আততিরমিযী ২৬১৬, সুনান ইবনু মাজাহ্ ৩৯৭৩, সহীহুল জামি‘ ৫১৩৬; দ্রষ্টব্য হাদীস : ৮০৯৭, ৫৩০৩, (তাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর ৭৪১; ছহীহুত তারগীব ২৭৪১,)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং কথা বলার আগে ভাবতে হবে, যে কথাটি বলা হবে তা আদৌ উচিত হবে কি-না। আগে চিন্তা করতে হবে উচ্চারিত কথাগুলো গীবত হচ্ছে কি-না। কেননা অন্তরের ভাবনাগুলোই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে।

ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয (রহঃ) বলেন, উপমা হ’ল বক্ষস্থিত বড় পাতিলের মত, তাতে যা থাকে তা সিদ্ধ হয়। আর জিহবা হ’ল সেই পাতিলেন চামচ। সুতরাং ব্যক্তির আলাপচারিতা তুমি একটু খেয়াল করে দেখ। কেননা তার হৃদয়ে টক-মিষ্টি, মিঠা-লোনা যাই থাক না কেন, জিহবার চামচ দিয়ে তোমাকে তাই সে পরিবেশন করবে এবং তার কথার মাধ্যমে তোমাকে তার হৃদয়ের স্বাদ সম্পর্কেও অবহিত করবে’।  (আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ১০/৬৩)।

সুতরাং অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করতে পারলে, জিহবা সংযত করার রাস্তাটাও সহজ হয়ে যাবে।

(৩)  কল্যাণকর কথা বলা নতুবা চুপ থাকাঃ

অধিকাংশ গীবত কথা-বার্তার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সেজন্য প্রয়োজনীয় কথা বলা ছাড়া মুখটাকে বন্ধ রাখতে পারলে নানা পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই ভালো কথা বলে, নতুবা যেন চুপ থাকে। অপর এক বর্ণনায় ’’প্রতিবেশী’’র স্থলে রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই আত্মীয়ের হক আদায় করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪২৪৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৩৫, ৬৪৩৮; মুসনাদে আহমাদ ৬৬২১, সুনান আততিরমিযী ১৯৬৭, ২৫০০; ইরওয়া ২৫২৫, সুনান আবূ দাঊদ ৩৭৪৮, ৫১৫৪; সুনান ইবনু মাজাহ ৩৬৭৫, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৫১৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রায্যাক ১৯৭৪৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫০৬, দারিমী ২০৩৬, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৭৭৮, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৭১০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে চুপ থাকাও ইবাদতে পরিণতি হ’তে পারে। এক ব্যক্তি সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে বললেন, ‘আমাকে নছীহত করুন। তিনি বললেন, ‘কোন কথা বলবে না’। লোকটি বলল, সমাজে বসবাস করে কেউ কি কথা না বলে থাকতে পারে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যদি কথা বলতেই হয়, তবে সঠিক কথা বল অথবা চুপ থাক’। (ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৩৪০)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তুমি যতক্ষণ চুপ থাকবে, ততক্ষণ নিরাপদ থাকবে। আর যখন কথা বলবে, তখন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে (হিসাব) লেখা শুরু হবে’। (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৮১৫৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৬৬, সনদ হাসান)।

আল্লাহ বলেন, ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সুরা ক্বা-ফ ৫০/১৮)।

আবূ সাঈদ (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি বলে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম সন্তান সকালে ঘুম থেকে উঠলে, তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বার কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলে, আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আমরা তোমার সাথে জড়িত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব, আর তুমি বাঁকা পথ অনুসরণ করলে আমরাও বাঁকা পথ অনুসরণ করব। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৮৩৮, সুনান আততিরমিযী ২৪০৭, সহীহুল জামি‘ ৩৫১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৮৭১, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৪/৩০৯, আহমাদ ১১৯০৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, হ’ল দেহের আমীর। যখন জিহবা কোন অপরাধ করে, তখন অন্যান্য অঙ্গও অপরাধ করে। আর জিহবা যখন নিষ্কলুষ থাকে, তখন অন্যান্য অঙ্গও পরিচ্ছন্ন থাকে’। (ইবনু আবীদ্দুন্য়া, আছ-ছাম্তু, পৃ. ৬৯)।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই। যমীনের বুকে দীর্ঘ সময় কারাগারে রাখার মতো জিহবার চেয়ে উপযুক্ত কোন বস্তুত নেই’। (আল-বাহরুল মুহীত্ব ২/১৭৪)।

 ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘জিহবা বান্দার যাবতীয় গুনাহের অন্যতম প্রবেশদ্বার। কথার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার উপায় হ’ল- চুপ থাকা বা মুখ দিয়ে অনর্থক কোন কথা উচ্চারণ না করা। কেউ যদি জিহবার পাপ থেকে নিরাপদ থাকতে চায়, তবে সে যেন কথা বলার আগে একটু চিন্তা-ভাবনা করে নেয় যে, এই কথায় আমার কোন ফায়দা আছে কি-না? যদি কথাটি অনর্থক হয়ে থাকে, তবে তা বলা থেকে বিরত থাকবে, আর যদি অনর্থক না হয়, তবুও ভেবে দেখবে, আমার এই কথার করণে এর চেয়ে উত্তম কিছু আমার হাতছাড়া হচ্ছে কি-না? যদি মুখের এই কথার কারণে উত্তম কোন কিছু হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে এই কথা বলা থেকেও চুপ হয়ে যাবে’। (ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ১৫৮)।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িমের উক্ত নীতির অনুসরণ করতে পারলে, গীবতের পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।

(৪) আল্লাহর যিকরে জিহবাকে সিক্ত রাখাঃ

যিকর বান্দাকে গীবতের পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন রাখে। আল্লাহর স্মরণে সিক্ত জিহবা সর্বদা কল্যাণকর কাজেই ব্যস্ত থাকে। ফলে নানাবিধ পাপের পঙ্কিলতা থেকে ব্যক্তি সুরক্ষিত থাকে। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা ও অশ্লীলতার মতো গর্হিত কথাবার্তা থেকে জিহবাকে মুক্ত রাখা যায়। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হ’ল সে চুপ থাকতে পারে না। কোন না কোন কথা তাকে বলতেই হয়। সেজন্য আল্লাহর যিকরে রসনাকে ব্যস্ত রাখা না হ’লে এবং শরী‘আতের বিধি-বিধানের ব্যাপারে আলোচনা করা না হ’লে জিহবা হারাম ও রবের অসন্তুষ্টিমূলক কথাবার্তায় লিপ্ত হবেই। আল্লাহর যিকর ছাড়া এত্থেকে উত্তরণের বিকল্প কোন পথ নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ কথা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত যে, কেউ যদি স্বীয় রসনাকে আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত রাখতে পারে, তবে সে অন্যায় কথাবার্তা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারবে। আর তার জিহবা যিকর থেকে নীরস-শুষ্ক থাকলে তার জিহবা বাতিল, অনর্থক ও অশ্লীল কথা দ্বারা সিক্ত হবে’। (ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবিলুছ ছায়্যিব, ১/৯৮)।

সুতরাং পরনিন্দা থেকে পরিত্রাণ লাভে করণীয় হ’ল স্বীয় রসনাকে যিকরে ব্যস্ত রাখা। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, ‘প্রকৃত কয়েদী তো সেই ব্যক্তি, যার অন্তর মহান রবের স্মরণ থেকে বন্দী হয়ে গেছে। প্রকৃত বন্দী তো সেই ব্যক্তি, যাকে তার প্রবৃত্তি বন্দী করে ফেলেছে’। (ইবনে তাইমিয়াহ, আল-মুস্তাদরাক ‘আলা মাজমূ‘ইল ফাতাওয়া, ১/১৫৪)।

(৫)  গীবত করার সময় নেকী বিনষ্ট হওয়ার কথা মনে করাঃ

কারো দোষ বর্ণনা করার আগে মানুষ যদি একটু চিন্তা করে দেখে যে, আমি যে লোকের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করছি, তার কাছে আমি চিরদিনের জন্য ঋণী হয়ে যাচ্ছি। এই ঋণ নিজের কষ্টার্জিত ছওয়াব প্রদান অথবা তার পাপগুলো নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে পরিশোধ করতে হবে। ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষ যখন পাগলপরা হয়ে একটা নেকীর জন্য ছোটাছুটি করবে, সেই কঠিন মুহূর্তে নেকী দিয়ে গীবতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেই কঠিন মুহূর্তে নিজের ছওয়াবের ঝুলি থেকে একটা নেকী অপরকে দিয়ে দেওয়া আদৌ সহজ ব্যাপার নয়। ভয়বাহ সেই দৃশ্যপট হৃদয়ের আয়নায় মেলে ধরতে পারলে, গীবত করার আগে মানুষ বারবার ভাবতে বাধ্য হবে।

এজন্য আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহ.) বলেন, ‘আমি যদি কারো গীবত করতাম, তাহ’লে আমার পিতামাতার গীবত করতাম। কারণ তারাই আমার নেকী লাভ করার অধিক হকদার’।  (নববী, আল-আযকার পৃ. ৩৪০; ইবনুল মুফলিহ, আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, ১/২৯২)।

হাসান বছরী (রহঃ)-কে বলা হ’ল অমুক ব্যক্তি আপনার গীবত করেছে। তখন তিনি গীবতকারীর উদ্দেশ্যে এক থালা মিষ্টান্ন উপহার পাঠালেন। আর বলে দিলেন, আমি শুনেছি আপনি আমাকে আপনার কিছু নেকী হাদিয়া দিয়েছেন। বিনিময়ে আমার উপহারটুকু গ্রহণ করবেন’। (আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, ১/২৯২)।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) বলেন, ‘গীবতের রোগ থেকে আরোগ্যের উপায় হ’ল গীবতকারী তার নিন্দাবাদের কারণে নিজেকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির সামনে উপস্থাপন করবে। আর একথাটি ভালোভাবে জানবে যে, ক্বিয়ামতের দিন গীবত তার নেকীগুলোকে গীবতকৃত ব্যক্তির দিকে স্থানান্তর করে দিবে। সে গীবতের মাধ্যমে যার সম্মান নষ্ট করেছে। যদি তার নেকী না থাকে, তবে গীবতকৃত ব্যক্তির পাপগুলো তার উপর চাঁপিয়ে দেয়া হবে’। (মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল ওয়াহ্হাব, আল-কাবায়ের, পৃ. ১৪৫)।

(৬)  গীবতকারীদের মজলিস পরিত্যাগ করাঃ

গীবতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে অন্যতম অনুঘটক হিসাবে কাজ করে পরিবেশ ও সঙ্গ। অনেক সময় বাধ্য হয়ে গীবত শুনতে হয়, অথচ গীবত শোনাও সমান গুনাহ। মজলিসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গল্পচ্ছলে গীবত হয়ে যায়। সেজন্য নিন্দুক ও গীবতকারীর সঙ্গ ও বৈঠক পরিত্যাগ করা উচিত। গীবতকারীকে যদি বাহ্যিক দ্বীনদারও মনে হয়, তবুও তার ব্যাপারে সতর্ক-সাবধান থাকা অপরিহার্য।

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) মসজিদে ছালাত আদায় করার পরে কারো সাথে কোন গল্প করতেন না। সোজা বাড়িতে চলে যেতেন। একদিন শাক্বীফ ইবনে ইবরাহীম বলখী (রহঃ) তাকে বললেন, ‘আচ্ছা! আপনি তো আমাদের সাথেই ছালাত আদায় করেন, কিন্তু আমাদের সাথে বসেন না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে ছাহাবী ও তাবেঈদের সাথে বসে কথা বলি’। আমরা বললাম, ‘ছাহাবী-তাবেঈদের আপনি কোথায় পেলেন’? তিনি বললেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে ইলম চর্চায় মনোনিবেশ করি। তখন তাদের কথা ও কর্মের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তোমাদের সাথে বসে আমি কি করব? তোমরা তো একত্রে বসলেই মানুষের গীবত করা শুরু করে দাও’। (খত্বীব বাগদাদী, তাকয়ীদুল ইলম, পৃ. ১২৬; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ৩/৩২৪)।

খালীদ রাবা‘ঈ (রহঃ) বলেন, একদিন আমি মসজিদে বসেছিলাম। এসময় লোকজন এক ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। আমি তাদের নিষেধ করলে তারা অন্য আলোচনা শুরু করল। তারপর তারা আবার পরনিন্দা শুরু করে দিল। এবার আমিও তাদের সাথে কিছুটা শরীক হ’লাম। ঐ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, বিরাট লম্বা এক কৃষ্ণকায় লোক আমার কাছে আসল। তার হাতে শূকরের গোশত ভরা একটি বাটি। সে আমাকে বলল, খাও! আমি বললাম, শূকরের গোশত? আল্লাহর কসম! আমি কিছুতেই এগুলো খাব না। তখন সে আমাকে ভয়ানক ধমক দিয়ে বলল, তুমি তো এর চেয়েও খারাপ গোশত খেয়েছ। তারপর সে গোশতগুলো আমার মুখে চেপে ধরল। এমন সময় আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। খালীদ রাবা‘ঈ বলেন, ‘আল্লাহর কসম! এরপর থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ দিন পর্যন্ত আমি কিছু খেলেই মুখে সেই শূকরের গোশতের দুর্গন্ধ অনুভূত হ’ত’। (ইবনুল আহনাফ ইয়ামানী, বুস্তানুল কুরআন ফী ই‘রাবি মুশকিলাতিল কুরআন ৩/১২৮)।

(৭)  মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করাঃ

মানুষের দোষ-ত্রুটি যথাসম্ভব না জানার চেষ্টা করা উচিত। কারণ কারো ত্রুটি-বিচ্যুতি জানলেই তো সেটা অপরকে বলে ফেলার ক্ষেত্র তৈরী হয়। সালাফগণ কিভাবে অন্যের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতেন, তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ যথেষ্ট হবে। আবূ আলী দাক্কাক্ব (রহঃ) বলেন, ‘একবার হাতিম (রহঃ)-কে এক মহিলা একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু সে সময় অসতর্কতাবশত সেই মহিলার মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়ে যায়। ফলে মহিলাটি বেশ লজ্জায় পড়ে যান। তখন হাতিম (রহঃ) বলেন, ‘একটু জোরে বলুন’। আসলে তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, তিনি কানে কম শোনেন। এই ভেবে মহিলাটি খুব খুশি হন যে, তিনি কিছু শুনতে পাননি। এই ঘটনার কারণে হাতিম (রহঃ)-কে اَلْأَصَمُّ (বধির বা শ্রবণশক্তিহীন) উপাধি দেওয়া। ফলে তিনি ইতিহাসে ‘হাতিম আল-আছম’ নামেই পরিচিত। (খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ, ৯/১৪৯; মাদারিজুস সালিকীন, ৩/৯৩)।

সুতরাং মানুষের দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে হাতিম আল-‘আছম (রহঃ)-এর ন্যায় হ’তে পারলে গীবতের অভ্যাস ত্যাগ করা যাবে।

(৮) নিজের ভুল-ত্রুটির দিকে অধিক মনোনিবেশ করাঃ

মানুষ মাত্রেরই দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান। কারোটা প্রকাশ পায়, কারোটা পায় না। সেজন্য নিজের দোষ-ত্রুটি নিয়ে অধিক চিন্তা করা উচিৎ, তাহ’লে ভুল সংশোধন সহজ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যদি তোমার বন্ধুর ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা মনে করতে চাও, তবে নিজের দোষ-ত্রুটির কথা স্মরণ কর’। (ইবনু হাজার হায়তামী, আয-যাওয়াজির ২/১৮)।

 বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মুযানী (রহঃ) বলেন, ‘যদি তোমরা কোন ব্যক্তিকে এমন দেখ যে, সে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ভুলে গিয়ে শুধু অপর মানুষের দোষ-ত্রুটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, তবে জেনে রেখ! নিশ্চিতভাবে সে ধোঁকার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে’। (ইবনু আবিদ্দুন্য়া, যাম্মুল গীবতি ওয়ান নামীমাহ, পৃ. ২৩)।

মূলতঃ অপরের ভুল-ত্রুটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকে মনোনিবেশ করতে পারা আল্লাহর বিশেষ নে‘মত। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ যখন বান্দাকে পাপের লাঞ্ছনা থেকে আনুগত্যের সম্মানের দিকে বের করে আনতে চান, তখন নির্জনতায় তাকে ঘনিষ্ঠ করে নেন, অল্পেতুষ্ট রাখার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করেন এবং নিজের দোষ-ত্রুটির দিকেই তার দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখেন। যাকে এই গুণ দেওয়া হয়েছে, তাকে যেন দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ দান করা হয়েছে’। (ইবনুল মুফলিহ, আল-আদাবুশ শার‘ইয়াহ, ১/২২৬)।

ইবনুস সাম্মাক (রহঃ) বলেন, ‘জিহবার সাহায্যে তুমি সচরাচর হিংস্রতা প্রদর্শন করে থাক এবং গীবতের মাধ্যমে চারপাশের মানুষকে নির্মমভাবে ভক্ষণ কর। তুমি যুগ যুগ ধরে মানুষকে কষ্ট দিয়েছ। এমনকি তোমার এই হিংস্রতা থেকে কবরবাসীও রেহাই পায়নি। তুমি তাদেরও গীবত ও সমালোচনা করেছ। এই হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্য তোমাকে নিম্নোক্ত তিনটি উপায়ের কোন একটি অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে।-

(১) তুমি যখন তোমার ভাইয়ের এমন কোন দোষ নিয়ে সমালোচনা করবে, যা তোমার মাঝেও বিদ্যমান, তখন চিন্তা করবে, একই বিষয়ে নিজের ও অন্যের সাথে দ্বৈত আচরণের কারণে তোমার রব তোমার সাথে কেমন আচরণ করবেন?

(২) তুমি যখন কোন বিষয়ে কারো সমালোচনা করবে, তখন ভাববে এই বিষয়টি তোমার মধ্যে তার চেয়েও বেশী মাত্রায় বিদ্যমান। এটা করতে পারলে অন্যের গীবত ও সমালোচনা থেকে বেঁচে থাকা অধিকতর সহজ হবে।

(৩) যখন তুমি কোন বিষয়ে অন্যের সমালোচনা করবে তখন চিন্তা-ভাবনা করবে যে, মহান আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তোমাকে এই দোষ থেকে মুক্ত রেখেছেন। ফলে এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তুমি তার সমালোচনা থেকে মুক্ত রাখবে। তুমি কি এই নীতিবাক্যটি শোননি, ‘(কারো ত্রুটি দেখলে) তুমি তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ো। সেই সঙ্গে ঐ সত্তার প্রশংসা কর, যিনি তোমাকে মুক্ত রেখেছেন’। (ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/১০১-১০২)।

নিজের ত্রুটির প্রতি লক্ষ্য না রেখে, অপরের দোষ চর্চায় মানুষ লিপ্ত হয়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ অন্যের চোখের সামান্য ময়লা দেখতে পায় কিন্তু নিজের চোখের উটও (বড় ময়লা) দেখতে পায় না। (আদাবুল মুফরাদ হা/২৪০, ৩৫১; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩১)।

(৯)  আল্লাহর কাছে দো‘আ করাঃ

বান্দা নিজের অজান্তেই গীবতে লিপ্ত হয়। অনেক সময় দ্বীনদার ব্যক্তিদের মাধ্যমেও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গীবত হয়ে যায়। তাই জিহবার হেফাযত অপরিহার্য।

হাসান ইবনে ছালেহ (রহঃ) বলেন, ‘আমি পরহেযগারিতা অনুসন্ধান করলাম। কিন্তু জিহবার চেয়ে কম পরহেযগারিতা অন্য কোন অঙ্গে পেলাম না’। (যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৩৬৮)।

এজন্য জিহবার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পাপ থেকে জিহবাকে হেফাযত করা অবশ্য কর্তব্য। আর এটা সহজসাধ্য নয়; বরং জিহবার হেফাযত ত্যাগ ও সাধনার ব্যাপার। মুহাম্মাদ বিন ওয়াসে‘ (রহঃ) বলেন, ‘দীনার-দিরহাম সংরক্ষণের চেয়ে জিহবার হেফাযত করা অত্যন্ত কঠিন’। (গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১১১)।

গীবত থেকে স্বীয় রসনাকে হেফাযত করা খুব কঠিন, তাই এই কঠিন ব্যাপারটি আল্লাহর সহযোগিতা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই গীবত সহ জিহবার যাবতীয় পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর তাওফীক্ব কামনা করতে হবে এবং তাঁর দরবারে দো‘আ করতে হবে।

(১০)  গীবতের ব্যাপারে সালাফদের সতর্কতা অবগত হওয়াঃ

নবী-রাসূল, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের জীবন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। তারা গীবত থেকে কিভাবে সতর্ক থাকতেন এবং কি পদক্ষেপ নিতেন, সেগুলো অবহিত হ’লে গীবত থেকে বাঁচা যাবে। এখানে সালাফদের জীবনী থেকে কয়েকটি কাহিনী তুলে ধরা হ’ল।-

(১) আবুবকর (রাঃ) জিহবাকে খুবই ভয় পেতেন। একদিন ওমর (রাঃ) তাঁর কাছে আসলেন। এসে দেখেন আবুবকর (রাঃ) নিজের জিহবা ধরে টানাটানি করছেন। ওমর (রাঃ) বললেন, কি করছেন, থামুন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! তখন আবুবকর (রাঃ) বলেলেন, এই জিহবাই আমাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেছে। (মুয়াত্তা মালেক হা/৩৬২১; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৭৩, সনদ ছহীহ)।

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব (রহঃ) বলেন, একবার আমি মানত করলাম যে, যদি কারো গীবত করি তাহ’লে একদিন করে ছিয়াম রাখব। এভাবে আমি গীবত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি গীবত করি আবার ছিয়ামও রাখি। ফলে আমি নিয়ত করলাম, একবার গীবত করলে এক দিরহাম করে ছাদাক্বাহ করব। এবার আমি দিরহামের ভালোবাসায় গীবত পরিত্যাগ করতে সক্ষম হ’লাম’। (যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২২৮; ইয়াসীর হামাদানী, হায়াতুত তাবেঈন, পৃ. ৯৬৪)।

(৩) ত্বাউক্ব ইবনে ওয়াহ্হাব বলেন, একবার আমি অসুস্থ অবস্থায় মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহঃ)-এর কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি কি অসুস্থ? বললাম, হ্যাঁ! আমি তার কাছে নিজের রোগের ব্যাপারে আরয করলাম। তিনি আমাকে বললেন, অমুক ডাক্তারের কাছে যাও এবং তার কাছে পরামর্শ নেও। একটু পরে আরেকজন ডাক্তারের কথা উল্লেখ করে বললেন, তুমি বরং অমুকের কাছে যাও। সে আগের জনের চেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার। কথাটা শেষ হ’তেই বললেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! আমি হয়ত প্রথম ডাক্তারের গীবত করে ফেললাম’। (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, ৫/৩১৪; ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/১৪৩)।

উল্লেখ্য যে, কাউকে সতর্ক করার জন্য কারো দোষ বর্ণনা করা জায়েয এবং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিব। সেকারণ কেউ যদি কোন অনভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, তবে তাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু ইবনু সীরীন (রহঃ)-এর ঘটনার ক্ষেত্র হয়ত ভিন্ন রকম ছিল। হয়ত উভয়ই ভালো ও সমমানের ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু প্রথম জনকে অনুত্তম বলে ফেলার কারণে এটাতেও তিনি গীবত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন। মূলত ইবনু সীরীন এত শক্তভাবে গীবত পরিহার করার চেষ্টা করতেন যে, অনেক ক্ষেত্রে বৈধ গীবতকেও পরিহার করতেন। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘গীবতের একটি প্রকার আছে, অথচ অধিকাংশ মানুষ সেটাকে গীবতই মনে করে না। সেই গীবতটা হ’ল, অমুকের চেয়ে অমুক বেশী জ্ঞানী বলা। কেননা এই কথার দ্বারা যাকে কম জ্ঞানী মনে করা হয় তাকে হেয় করা হয়। আর এটা তো সবার জানা কথা যে, গীবত হ’ল কারো পিছনে এমন কথা বলা যা সে অপসন্দ করে’। (আব্দুল ওয়াহ্হাব আশ-শা‘রানী, তাম্বীহুল মুগতার্রিন, পৃ. ২০৩)।

(৪) মাইমূন ইবনে সিয়াহ (রহঃ) গীবতের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন। তিনি নিজে কারো গীবত করতেন না এবং তার সামনে কাউকে গীবত করতেও দিতেন না। কাউকে গীবত করতে দেখলে তাকে ধমক দিতেন এবং নিষেধ করতেন। অন্যথা সেখান থেকে উঠে চলে যেতেন। (আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/১০৭; ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ২/১৩৭)।

(৫) ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ‘যেদিন আমি জেনেছি, গীবতের মাধ্যমে গীবতকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারপর থেকে কোন দিন আমি কারো গীবত করিনি’। (বুখারী, তারীখুল কুবরা ৫/৫৮৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৪৩৯-৪১)।

বকর ইবনে মুনীর (রহঃ) বলেন, আমি আবূ আব্দুল্লাহ বুখারীকে বলতে শুনেছি, ‘আমি আশা করি, আমি আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাযির হব যে, কারো গীবত করার ব্যাপারে আমি হিসাবের সম্মুখীন হব না’। (তাহযীবুল কামাল ২৪/৪৪৬; শাযারাতুয যাহাব ৩/২৫৪)।

ইমাম বুখারীর এই কথা প্রসঙ্গে হাফেয যাহাবী বলেন, ‘তিনি সত্যই বলেছেন। কারণ জারাহ ও তা‘দীলের ক্ষেত্রে কেউ যদি তাঁর শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাসের দিকে গভীর দৃষ্টি দেয়, তাহ’লে তিনি খুব সহজেই ইমাম বুখারীর তাক্বওয়াপূর্ণ সামালোচনা-রীতি অনুধাবন করতে পারবেন। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারবেন যে, তিনি যাদের যঈফ বা দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। একারণে অধিকাংশ সময় সমালোচনার ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘মুনকিরুল হাদীছ, সাকাতু আনহু, ফীহি নাযরুন’ ইত্যাদি। খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি কাউকে কায্যাব (মহা মিথ্যুক) অথবা হাদীছ রচনাকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। অধিকন্তু তিনি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, আমি যখন কারও ক্ষেত্রে বলি, তার হাদীছ বর্ণনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তখনই মূলত সে সবার কাছে অভিযুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, তার পূর্বোক্ত বক্তব্য, আমি আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাযির হব যে, কারো গীবত করার ব্যাপারে আমি হিসাবের সম্মুখীন হব না, কথাটার সারমর্ম এটাই’। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৪৩৯-৪৪১)।

(৬) প্রখ্যাত তাবেঈ রাবী‘ ইবনু খুছাইম (রহঃ) গীবতের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতেন। জনৈক সালাফ বলেছেন, আমি বিশ বছর যাবৎ রাবী‘ ইবনে খুছাইমের সাথে চলেছি। কিন্তু কাউকে নিন্দা করে একটা শব্দও তাকে বলতে শুনিনি। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবাল ৪/২৫৯)।

(৭) ওয়াহিব ইবনুল ওয়ার্দ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! গীবত পরিত্যাগ করা আমার কাছে এক পাহাড় স্বর্ণ আল্লাহর পথে ছাদাক্বাহ করার চেয়েও প্রিয়তর’। (মুহাম্মাদ ইসমাঈল মুক্বাদ্দাম, আল-ই‘লাম, পৃ. ৭০; আত-তাওবীখ ওয়াত-তানবীহ, ক্রমিক: ১৬৯)।

(৮) আব্দুল কারীম ইবনে মালেক (রহঃ) বলেন, ‘আমরা সালাফে ছালেহীনকে এমন পেয়েছি যে, তারা শুধু ছালাত ও ছিয়ামকে ইবাদত মনে করতেন না; বরং মানুষের সম্মান রক্ষার জন্য গীবত পরিহার করাকেও ইবাদত গণ্য করতেন’। (হিলয়াতুল আওলিয়া, পৃ. ৩/১৫২)।

(৯) এক ব্যক্তি হাসান বছরী (রহঃ)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আপনি আমার গীবত করেছেন’। তখন হাসান বছরী বললেন, ‘তোমার মর্যাদা আমার কাছে এত বেশী না যে, আমি গীবত করে নিজের নেকীগুলো তোমাকে দিয়ে দেব’। (নববী, আল-আযকার, পৃ. ৩৪০)।

(১০) সুফিয়ান ইবনুল হুছাইন বলেন, একদিন আমি ইয়াস ইবনে মু‘আবিয়া (রহঃ)-এর কাছে বসেছিলাম। এক লোক আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি সেই লোকের ব্যাপারে কিছু কথা বললাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চুপ থাকো! তুমি কি রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? বললাম, না। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বাইজেন্টাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? বললাম, না। তখন তিনি বললেন, তোমার থেকে রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নিরাপত্তা লাভ করেছে, কিন্তু তোমার মুসলিম ভাই তোমার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ হ’তে পারেনি’। এরপর থেকে আমি কখনো কারো ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে সমালোচনা করিনি। (সামারকান্দি, তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃ. ১৬৫)।

(১১) ইমাম মালেক (রহঃ) মদীনাবাসীর প্রশংসা করে বলেন, আমি এই শহরে এমন কিছু মানুষের সাক্ষাত পেয়েছি, যাদের কোন ভুল-ত্রুটি ছিল না। কিছু মানুষ তাদের ভুল খুঁজে বের করার চেষ্ট করে নিজেরাই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আর আমি মদীনাতে এমন কিছু মানুষেরও সন্ধান পেয়েছি, যাদের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু তারা অপর মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে নীরবতা অবলম্বন করত। ফলে তাদের দোষ-ত্রুটি আল্লাহ গোপন রেখেছেন এবং মানুষের স্মৃতি

থেকে বিস্মৃত করে দিয়েছেন’। (আব্দুর রহমান সাখাবী, আল-জাওয়াহিরু ওয়াদ্দুরার, ৩/১০৬৭; ওমর মুক্ববিল, মাওয়াইযুছ ছাহাবাহ, পৃ. ১০৩)।

(১২) মদীনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ক্লাসে হাযিরা নিচ্ছেন। ছায়েম নামে একজন ছাত্রকে অনুপস্থিত পেলেন। তিনি ছাত্রদের কাছে ছায়েমের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলেন। তারপর একটু কৌতুক করে বললেন, ‘ছায়েম তো ছিয়াম রেখে ঘুমাচ্ছে। মন্তব্যটা করেই প্রফেসর ছাহেব, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে উঠলেন। কারণ ছায়েমের ব্যাপারে তার মন্তব্যটিকে গীবত মনে হওয়ায় তিনি লজ্জিত হয়েছেন। পরের দিন ছায়েম যখন ক্লাসে আসল, তিনি সব ছাত্রের সামনে গীবতের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ছায়েমের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং ছায়েমকে অনেকগুলো বই উপহার দিলেন।

পরিশেষে বলা যায়, তলায় ছিদ্র বিশিষ্ট বালতিতে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, সেই বালতি কখনো পূর্ণ হবে না। বালতি পূর্ণ করতে হ’লে তার ছিদ্রটা বন্ধ করতে হবে। অনুরূপভাবে গীবতের মাধ্যমে আমলনামার পাত্রটা ছিদ্র করে ফেললে আমলের নেকী তাতে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়; ফলে গীবতকারী ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।

সুতরাং আমরা জিহবার হেফাযত করি। গীবত থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। কথাবার্তা, আলাপচারিতা এবং গল্পের আড্ডায় কারো গীবত হয়ে যায় কি-না সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারো নামে লেখালেখি ও বক্তব্য দেওয়ার আগেও চিন্তা করে দেখতে হবে যে, এই লেখা, শেয়ার, পোস্ট, কমেন্টের মাধ্যমে কোন ভাইয়ের মর্যাদাহানি হচ্ছে কি-না বা কারো গোপন বিষয় প্রকাশ পাচ্ছে কি-না? মহান আল্লাহ আমাদের সার্বিক জীবনকে গীবত থেকে নিরাপদ রাখুন। সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন। পার্থিব জীবনের সফরে কেবল তাঁর ইবাদতে ব্যস্ত থাকার সৌভাগ্য দান করুন। আমৃত্যু ছিরাতে মুস্তাক্বীমে অটল থেকে পরিশুদ্ধ ঈমান নিয়ে কবরে যাওয়ার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন

(MSHRC)

------------------------------

Please Share On

No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...