Search This Blog

Thursday, September 26, 2019

সালাম দেয়ার নিয়ম, গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

সালাম দেয়ার নিয়ম, গুরুত্ব ও ফজিলত

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য পথ নির্দেশিকা হিসাবে প্রদান করা হয়েছে।মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বন্ধন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই প্রয়োজন সামাজিক রীতি-নীতি সম্পর্কে জানা। একে অপরকে কিভাবে অভিভাদন জানাতে হবে, সেটাও অবগত হওয়া। মানব জাতিকে ইসলাম এটা শিখিয়ে দিয়েছে, যার ভাষা আকর্ষণীয় এবং পদ্ধতিও চমৎকার। ইসলামের এই চমৎকার অভিবাদন পদ্ধতি অপরিচিত মানুষের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়। পরস্পরের মাঝে মনোমালিন্য দূর করে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরী করতঃ শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের নিকট ভালবাসার সৌরভ খুঁজে পায়। অনুভব করে সুসম্পর্কের কোমল পরশ। যে বাতাসে শত্রুতার গন্ধ নেই, আছে বন্ধুত্বের আবেহায়াত। যাতে হিংসার লেশ মাত্র নেই, আছে পরোপকারের ভিত। ক্ষতির আশংকা নেই, আছে সমূহ কল্যাণ। অহংকারের ভাব নেই, আছে বিনয়ের সমারোহ। মনে কষ্ট দেওয়ার কথা নেই, আছে মন জুড়ানোর বাণী। নিঃসন্দেহে সেই অভিবাদনটা হচ্ছে السلام عليكم (আস-সালা-মু আলাইকুম)। অর্থাৎ আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।

কোনো মুসলমানের সাথে দেখা হলে কে কাকে সালাম দিবে এবং কখন, কিভাবে সালাম প্রদান করবে এ সম্পর্কিত সবিস্তার আদব বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। এগুলো সাধ্যমত মেনে চললে পাস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে এবং অগণিত নেকী অর্জিত হবে। নিম্নে সালামের আদব, গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

সালামের সংজ্ঞা

সালাম এর আভিধানিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা। তাই اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম) অর্থ হলো আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

পরিভাষায় একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যে বাক্য দ্বারা একে অপরের সাথে ভালবাসা-বন্ধুত্ব, শান্তি-নিরাপত্তা, কল্যাণ ও দো‘আ কামনা করে তারই নাম সালাম।

সালাম প্রচলনের ইতিকথা

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই একে অপরের সাথে দেখা- সাক্ষাতের সময় পরস্পর ভাব বিনিময়ের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন জাতি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, আদর্শ ও রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য বেছে নিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরের দেখা-সাক্ষাতে আদাব, নমস্কার, নমঃনমঃ ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপ ও আমেরিকার খৃষ্টান সম্প্রদায় Good Morning, Good Afternoon, Good Evening, Good Night বলে একে অপরকে সম্ভাষণ জানিয়ে থাকে। তেমনি Good Bye, Ta Ta বলে বিদায় জানাতে দেখা যায়।

প্রাক ইসলামী যুগে আরব সমাজে اَنْعَمَ اللهُ بِكَ عَيْنًا (আন‘আমাল্লাহু বিকা আইনান) অর্থাৎ আপনার দ্বারা আল্লাহ আপনার প্রিয়জনদের চক্ষু শীতল করুন এবং اَنْعِمْ صَبَاحًا (আনয়ামা ছবাহান) অর্থাৎ আপনার প্রত্যুষ সুন্দর-সমৃদ্ধ হোক বা শুপ্রভাত ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রাক ইসলামী যুগে ব্যবহৃত শব্দগুলো পরিহার করে পরস্পরকে اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম) বলে অভিবাদন জানাতে নির্দেশ দেন।

সালাম আল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত একটি বিধান

সালামের এই বিধান মহান আল্লাহ স্বয়ং প্রবর্তন করেছেন। এ মর্মে নিম্নোক্ত হাদীছটি প্রনিধন যোগ্য।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আদম (আ.)-কে তাঁর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সৃষ্টি করে বলেন, যাও এবং অবস্থানরত মালায়িকাহ্’র (ফেরেশতাদের) ঐ দলটিকে সালাম করো। আর তাঁরা তোমার সালামের উত্তরে কি বলে তা শ্রবণ করো। তাঁরা যে উত্তর দেবে তা তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালামের উত্তর। অতঃপর আদম (আ.) গিয়ে তাঁদের উদ্দেশে বললেনঃ ’’আসসালা-মু ’আলায়কুম’’। অতঃপর মালায়িকাহ্ উত্তর দিলেন, ’’আসসালা-মু ’আলায়কা ওয়া রহমাতুল্ল-হ’’। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তাঁরা (ফেরেশতাগণ) ’’ওয়া রহমাতুল্ল-হ’’ অংশটি বৃদ্ধি করেছেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যে ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে সে আদম (আ.)-এর আকৃতিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সে উচ্চতায় হবে ষাট হাত। তখন হতে আজ পর্যন্ত সৃষ্টিকুলের উচ্চতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে আসছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬২৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৩২৬, ৬২২৭;  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০৫৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪১, আহমাদ ৮১৭১, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৭৫৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১৬২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৩৫, শু‘আবুল ঈমান ৮৮৬৯, আল জামি‘উস্ সগীর ৫৫৪৫, সহীহুল জামি ৩২৩৩,আধুনিক প্রকাশনী ৩০৮০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩০৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা ওরই অনুরূপ কর।” (সূরা নিসা ৮৬ আয়াত)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

অর্থাৎ “তোমার নিকট ইব্রাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে কি? যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ’সালাম।’ উত্তরে সে বলল, ’সালাম।” (সূরা যারিয়াত ২৪-২৫ আয়াত)।

সালামের শব্দ

সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘আস-সালামু আলায়কুম’ বলতে হবে। عليك السلام (আলায়কাস সালাম) বলা সুন্নাত নয়।

আবূ জুরাই আল-হুজাইমী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আলায়কাস সালামু’ ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আলায়কাস সালাম’ বল না। কারণ এটা হ’ল মৃতের প্রতি সালাম’। আবূদাঊদ হা/৫২০৯; তিরমিযী হা/২৭২১; ছহীহাহ হা/১১০৯।

অন্য বর্ণনায়

জাবির ইবনু সুলাইম (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট এসে বললাম, আলাইকাস সালাম’। তিনি বললেনঃ ’আলাইকাস সালাম বল না, বরং ’আসসালামু ’আলাইকা’ বল। তারপর তিনি দীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করেন। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭২২)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রয়োজনে তিনবার সালাম দেওয়া যায়। যেমন সালাম দেওয়ার পর কেউ শুনতে না পেলে বা অনুমতির ক্ষেত্রে তিনবার সালাম দেওয়া যায়। হাদীছে এসেছে,

আবূ তামীম আল-হুজাইমী (রাঃ) হ’তে তার বংশের জনৈক ব্যক্তির সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে খোঁজ করে না পেয়ে বসে রইলাম। এরই মধ্যে আমি তাকে একদল লোকের মাঝে দেখতে পেলাম, কিন্তু আমি তাকে চিনতাম না। তাদের মাঝে তিনি মীমাংসা করছিলেন। কাজ শেষে কয়েকজন তাঁর সাথে উঠে দাঁড়াল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এটা দেখে তাকে বললাম, আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ! আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ আলায়কাস সালামু ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আলায়কাস সালামু হল মৃত ব্যক্তির জন্য সালাম। এ কথাটি তিনি তিন বার বললেন। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় যেন বলে, আস-সালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার সালামের উত্তর দিলেন, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ, ওয়া আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭২১; ছহীহাহ ১৪০৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালামে অতিরিক্ত শব্দ যোগ করা

ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে এভাবে সালাম করল ’আসসালামু আলাইকুম’ আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসে গেলে তিনি বললেন, ’’ওর জন্য দশটি নেকী।’’ তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ’আসসালামু আলাইকুম অরহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম পেশ করল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের উত্তর দিলেন এবং লোকটি বসলে তিনি বললেন, ’’ওর জন্য বিশটি নেকী। “তারপর আর একজন এসে ’আসসালামু আলাইকুম অরহমাতুল্লাহি অবারাকাতুহ’ বলে সালাম দিল। তিনি তার জবাব দিলেন। অতঃপর সে বসলে তিনি বললেন, ’’ওর জন্য ত্রিশটি নেকী।’’ (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৫১,  সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৮৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৫, আহমাদ ১৯৪৪৬, দারেমী ২৬৪০)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ’’এই জিব্রীল (জিব্রাইল/জিবরাঈল) আলাইহিস সালাম তোমাকে সালাম পেশ করছেন।’’ তিনি বলেন, আমিও উত্তরে বললাম, ’অআলাইহিস সালামু ওয়ারহমাতুল্লহি অবারাকাতুহ।’

এই গ্রন্থদ্বয়ের কোন কোন বর্ণনায় ’অবারাকাতুহ’ শব্দ এসেছে, আবার কোন কোন বর্ণনায় তা আসেনি। তবুও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর অতিরিক্ত বর্ণনা গ্রহণীয়। (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৫২,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২০১, ৩২১৭,  ৬২৪৯, ৬২৫৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬১৯৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৪৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ২৬৯৩, ৩৮৮১, ৩৮৮২, নাসায়ী ৩৯৫২, ৩৯৫৩, ৩৯৫৪,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২৩২, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৬৯৬, আহমাদ ৩২৭৬০, ২৩৯৪১, ২৪০৫৩, ২৫৩৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কথা বলার পূর্বেই সালাম দেওয়া

কথা বলার আগেই সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৭; ছহীহাহ হ৩৩৮২; ছহীহুল জামে ৬১২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! দু’জন লোকের মধ্যে সাক্ষাৎ হ’লে কে প্রথম সালাম দিবে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার বেশী নিকটবর্তী’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৪৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৯৪,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৭, আল জামি‘উস্ সগীর ৩৭৭৪, সহীহুল জামি ২০১১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭০৩, শু‘আবুল ঈমান ৮৭৮৭, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৩৩০৪, শু‘আবুল ঈমান ৮৭৮৭,  তাখরীজুল কালিমিত তাইয়্যিব ১৯৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রথমে সালাম না দিলে রাসূল (ছাঃ) কথা বলার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আগে সালাম দেয় না তোমরা তাকে (কথা বলার) অনুমতি দিও না’। (ছহীহাহ হা/৮১৭; ছহীহুল জামে হা/৭১৯০)।

সালামের পুনরাবৃত্তি

তিনবার সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) কোন কোন কথা তিনবার বলতেন। আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন কথা বলতেন তখন তা বুঝে নেয়ার জন্য তিনবার বলতেন। আর যখন তিনি কোন গোত্রের নিকট এসে সালাম দিতেন, তাদের প্রতি তিনবার সালাম দিতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৯৫, ৯৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৫,  ছহীহাহ ৩৪৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম আদান-প্রদানের নিয়ম-পদ্ধতি (কে কাকে সালাম দিবে)

চলমান ব্যক্তি উপবিষ্টকে, আরোহী পদব্রজে ব্যক্তিকে, কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যককে এবং ছোটরা বড়দেরকে সালাম দিবে।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বয়োকনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৩১, ৬২৩৪; সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭০৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১১৪৯, সহীহ আল জামি‘উস্ সগীর ৮০৯০, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৭৬৮, শু‘আবুল ইমান ৮৮৬৪, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৯১৮৮, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৫১৯৯, দারিমী ২৬৩৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৯৭, আবূ ইয়া‘লা ৬২৩৪, আহমাদ ৮১৬২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৪৫, আধুনিক প্রকাশনী ৫৭৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৬৮৫)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আরোহী ব্যক্তি পায়ে হেঁটে চলা ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং পদব্রজে গমনকারী উপবিষ্টমান ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং অল্পসংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দেবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৩২, ৬২৩৩; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৩৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৯, আহমাদ ১০৬২৪, তিরমিযী ২৭০৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১১৪৫, সহীহুল জামি ৮০৮৯, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭০৪, সহীহ আদাবুল মুফরাদ ৭৬৯, মালিক ৩৫২৪, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৪৩, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৮৬৯, শু‘আবুল ঈ‘মান ৮৮৬২, দারিমী ২৬৩৪, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৯১৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ছোটরা সালাম করবে বড়দেরকে, এটাই আদব। কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছোটদের সালাম দিয়েছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল বালকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন এবং তাদের সালাম দিলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৪৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৫৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২০২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৯৬, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৮০০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১২৭৮, আবূ ইয়া‘লা ৩৩৬৬, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১০১৬৩, দারিমী ২৬৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যতোবার দেখা ততোবার সালাম

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যখন তোমাদের কেউ নিজের কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে, সে যেন প্রথমে সালাম দেয়। আর যদি তাদের উভয়ের মধ্যখানে বৃক্ষ, দেয়াল বা পাথরের আড়াল পড়ে যায়, অতঃপর পুনরায় সাক্ষাৎ হয়, তবে যেন দ্বিতীয়বার সালাম দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৫০, আবূ দাঊদ ৫২৩০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৮৬, সহীহুল জামি‘ ৭৮৯, আবূ ইয়া‘লা ৬৩৫০, শু‘আবুল ঈমান ৮৮৫৬, আল আদাবুল মুফরাদ ১০১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শিশুদের সালাম দেওয়া

শিশুদের সালাম দেওয়া মুস্তাহাব। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ)....আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল বালকের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সময় তিনি তাদের সালাম দিলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৫৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪৭৮, ইসলামিক সেন্টার ৫৫০০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইহূদী-নাছারাদেরকে আগে সালাম না দেওয়া

ইহূদী-নাছারা ও বিধর্মীদেরকে আগে সালাম দেওয়া যাবে না। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানকে প্রথমে সালাম দেবে না। তোমাদের কেউ যদি পথে কোন ইয়াহূদী বা খ্রিষ্টানের সাক্ষাৎ পাও, তবে রাস্তাকে এতটা সংকীর্ণ করে রাখবে, যাতে সে রাস্তার একপাশ দিয়ে অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৫৫৫৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৬০২, ২৭০০; সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৪১১, ৭০৪, সহীহুল জামি ১৩১৬০, আল জামি‘উস্ সগীর ১৩১৬০, ইরওয়া ১২৭১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭২৫, শু‘আবুল ঈমান ৮৯০৩, বুখারী আদাবুল মুফরাদ ২৮৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে তারা সালাম দিলে উত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’ বলতে হবে। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমাদেরকে আহলে কিতাব (অর্থাৎ- ইয়াহূদী ও নাসারাগণ) সালাম দেয়, তখন তোমরাও বলবে ’’ওয়া আলায়কুম’’ (অর্থাৎ- তোমাদের ওপরও)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৫৮, ৬৯২৬; সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২০৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬৩, শু‘আবুল ঈমান ৯১০২, আবূ ইয়া‘লা ২৯১৬, আহমাদ ১১৯৪৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২২৪২, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭২৬, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৬৯৭, আধুনিক প্রকাশনী ৫৮১৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৭১১, তিরমিযী ৩৩০১, আহমাদ ১১৫৩৭, ১১৯৪৮, ১২০১৯, ১২০৫৮, ১২৭৯৯, ১২৮২৮, ১৩০৪৭, ১৩৩৫৫, ইরওয়া ৫/১১৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুসলিম-অমুসলিম সম্মিলিত সমাবেশে সালাম দেওয়া

মুসলমানকে সালাম দেওয়া ইসলামের নির্দেশ। কিন্তু অমুসলিমকে আগে সালাম দেওয়া নিষেধ। একই বৈঠকে মুসলিম ও অমুসলিম সম্মিলিতভাবে থাকলে সালাম কিভাবে দিবে সে বিষয়ে নিম্নোক্ত হাদীছ।-

উসামাহ্ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সমবেত জনতার নিকট দিয়ে গমন করলেন, যাদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম, মুশরিক তথা পৌত্তলিক ও ইয়াহূদী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সালাম দিলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৫৪; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৫৫১, আন্তর্জাতিক নাম্বার ১৭৯৮,  সহীহ ইবনু হিব্বান ৬৫৮১, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৬৩, আহমাদ ২১৮১৫, শু‘আবুল ঈমান ৮৯১৬, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ৭০৭৬, আল আদাবুল মুফরাদ ১১০৮, তিরমিযী ২৭০২, আধুনিক প্রকাশনী ৫৮১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৭০৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এই হাদীছে মুসলিম-অমুসলিম একত্রে থাকলে সালাম কিভাবে দিতে হয়, সে পদ্ধতি বাৎলে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের রাসূলের সাথে বিরোধের কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে সাথে শত্রুকে ক্ষমা করে দেওয়ার মহানুভবতা ফুটে উঠেছে। আল্লাহ আমাদেরকে এ হাদীছের প্রতি আমল করার তাওফীক দিন-আমীন!

সশব্দে সালাম ও উত্তর দেওয়া

এমন শব্দে সালাম ও সালামের উত্তর দিতে হবে যাতে অন্যরা শুনতে পায়। তবে কোথাও ঘুমন্ত মানুষ থাকলে এমনভাবে সালাম দিবে যাতে জাগ্রত লোকেরা শুনতে পায় এবং ঘুমন্ত লোকের কোন অসুবিধা না হয়।

মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, ‘এরপর থেকে আমরা দুধ দোহন করতাম। আমাদের সবাই যার যার অংশ পান করতো। আর আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য তাঁর অংশ উঠিয়ে রাখতাম। মিক্বদাদ (রাঃ) বলেন, তিনি রাত্রে এসে এমনভাবে সালাম দিতেন যাতে নিদ্রারত লোক উঠে না যায় এবং জাগ্রত লোক শুনতে পায়’। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫২৫৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০৫৫, আহমাদ হা/২৩৮৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সমাবেশে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়  সালাম দেওয়া

 কোন সভায় প্রবেশকালে ও বের হওয়ার সময় উপস্থিত সদস্যদের উদ্দেশ্যে সালাম দেওয়া সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মজলিসে পৌঁছবে তখন যেন সে সালাম করে। এরপর যদি তার সেখানে বসতে ইচ্ছা হয় তবে বসবে। অতঃপর যখন উঠে দাঁড়াবে তখনও সে যেন সালাম দেয়। শেষেরটির চাইতে প্রথমটি বেশী উপযুক্ত নয়’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)  সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭০৬,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২০৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৮৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৯৬, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭০৭, আহমাদ ৯৬৬৪, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১০১৭৪, আল আদাবুল মুফরাদ ৯৮৬, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ২০২, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুস্ সগীর ১০৪৬, ছহীহাহ ১৮৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

এক সাথে অনেকে বা দলগতভাবে চলার সময় ঐ দলের পক্ষ থেকে একজন সালাম দিলে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘পথ অতিক্রমকালে দলের একজন যদি সালাম দেয় তাহ’লে তা সকলের জন্য যথেষ্ট। এমনিভাবে উপবিষ্টদের একজন তার উত্তর দিলে তা সকলের জন্য যথেষ্ট’।  (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২১০; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৪৮; ইরওয়া ৭৭৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১১৪৮, ১৪১২; সহীহুল জামি‘ ৮০২৩, আবূ ইয়া‘লা ৪৪১, শু‘আবুল ঈমান ৮৯২২, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৮৪০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া

বাড়ীতে বা গৃহে প্রবেশকালে প্রবেশকারী সালাম দিবে, যদিও ঐ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ ঐ ঘরে বসবাস না করে। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন পরস্পরে সালাম করবে। এটি আল্লাহর নিকট হ’তে প্রাপ্ত বরকমন্ডিত ও পবিত্র অভিবাদন’। (নূর ২৪/৬১)।

অন্যের বাড়ীতে বা ঘরে প্রবেশকালেও সালাম দিবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নিবে এবং এর বাসিন্দাদের সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’। (নূর ২৪/২৭)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

 আবূ উমামাহ আল-বাহিলী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তিন প্রকার লোকের প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর দায়িত্বে থাকে। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য বের হয়, তার মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ তার দায়িত্বশীল। অতঃপর আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন কিংবা তাকে নিরাপদে তার নেকী ও গানীমাতসহ তার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন। দ্বিতীয়ত, যে ব্যক্তি আগ্রহ সহকারে মসজিদে যায়, আল্লাহ তার দায়িত্বশীল। এমন কি তার মৃত্যুর পর আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন কিংবা তাকে নিরাপদে তার নেকী ও গানীমাতসহ তার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন। তৃতীয়ত, যে ব্যক্তি নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে মিলিত হয়ে সালাম বিনিময় করে, আল্লাহ তার জিম্মাদার। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৪৯৪, ছহীহ ইবুন হিববান ৪৯৯; ছহীহ আত-তারগীব ৩২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এমনকি পরিত্যক্ত ঘরে প্রবেশ করলে বলবে, ‘আমাদের উপরে ও আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’। (মুওয়াত্ত্বা হা/৩৫৩৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০৫৫, সনদ হাসান)।

কতাদাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন গৃহবাসীকে সালাম দেবে। আর যখন ঘর থেকে বের হবে, তখন গৃহবাসীকে সালাম দিয়ে বিদায় গ্রহণ করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৫১, শু‘আবুল ঈমান ৮৮৪৫, সহীহুল জামি ৫২৬, আল জামি‘উস্ সগীর ৫২৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৫০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

পেশাব-পায়খানারত ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়া

পেশাব-পায়খানারত ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া উচিত নয়। মুহাজির ইবনু কুনফুয (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন প্রস্রাব করছিলেন। তিনি তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু তিনি (প্রস্রাবের পর) যে পর্যন্ত না উযূ করলেন তার সালামের কোন উত্তর দিলেন না। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজর পেশ করে বললেন, উযূ না করে আমি আল্লাহর নাম নেয়া পছন্দ করিনি (এ কারণেই তোমার সালামের উত্তর দেইনি)। (আবূ দাঊদ)।

মুহাম্মাদ ইবনু বাশার (রহ.).....মুহাজির ইবনু কুনফুয (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) প্রস্রাব করছিলেন, এমতাবস্থায় তিনি তাকে সালাম করেন। কিন্তু তিনি (সা.) উযু করার আগে সালামের উত্তর দেননি; উযূ করার পর সালামের উত্তর প্রদান করেছেন। (নাসায়ী)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৭, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৫০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৭, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ৮৩৪, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ৩৮, আহমাদ ১৮৫৫৫, ২০২৩৬; দারিমী ২৬৩১, ইবনু হিব্বান-এর ‘মাওয়ারিদ ১৮৯, মুসতাদরাক হাকিম (১/১৬৭), নাসায়ী’র “সুনানুল কুবরা” (১/৯০), সহীহাহ্ ৮৩৪, বায়হাক্বী (১/৯০)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ হাদিস থেকে শিক্ষাঃ

(ক) হাদিসটি প্রমাণ করে পেশাব পায়খানার সময় আল্লাহর যিকর করা অপছন্দনীয়।

(খ) উচিত হলো, কেউ পেশাব-পায়খানার সময় সালাম দিলে উযু বা তায়াম্মুম করার পর তার উত্তর দেয়া।

মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র (রহঃ)....ইবনু উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন প্রস্রাব করছিলেন। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম করল। কিন্তু তিনি তার জবাব দিলেন না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭০৯, আন্তর্জাতিক নাম্বার ৩৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭০৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ৭২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পরিচিত-অপরিচিত  সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া

মুসলিম মাত্রেই সালাম দেওয়া উচিত। সে আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, পরিচিত হোক বা অপরিচত।

’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন্ ’আমলটি উত্তম? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অপরকে খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)  ৪৬২৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২, ২৮; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৯, সুনান ইবনু মাজাহ ৩২৫৩,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৪, আহমাদ ৬৫৪৫, ৬৮০৯, ৬৫৮১, নাসায়ী ৫০০০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৯৪৪, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৭৭৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫০৫, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১১৭৩১, শু‘আবুল ঈমান ৩৩৫৯, আধুনিক প্রকাশনী ১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম বহনকারী ও প্রেরণকারীর উত্তর দেওয়া

কেউ কারো মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করলে যে সালাম বহন করে নিয়ে আসবে, তাকে ও সালাম প্রদানকারীকে উত্তর দেওয়া উচিত। হাদীছে এসেছে,

গালিব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হাসান (রাঃ)-এর বাড়ির দরজায় বসা ছিলাম। এ সময় এক জন লোক এসে বলল, আমার পিতা আমার দাদার সূত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, আমাকে আমার পিতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পাঠালেন। তিনি বললেন, তাঁর নিকট গিয়ে তাঁকে সালাম জানাবে। তিনি বলেন, আমি তাঁর নিকট পৌঁছে বললাম, আমার পিতা আপনাকে সালাম দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘আলায়কা ওয়া আলা আবীকাস সালাম (তোমার ও তোমার পিতার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৫৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২৩১; ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৬৯১, শু‘আবুল ঈমান ৮৯২০, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৩৪৩০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

ইশারায় সালাম ও উত্তর না দেওয়া

ইশারায় সালাম দেওয়া যাবে না। তবে কেউ বোবা হলে কিংবা দূরে অবস্থানকারী হলে মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দিতে পারে। অনুরূপভাবে বধিরকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও মুখে উচ্চারণসহ ইশারায় সালাম বা উত্তর দেওয়া যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ইহুদী-নাছারাদের সালামের ন্যায় সালাম দিও না। কেননা তাদের সালাম হচ্ছে হাত দ্বারা ইশারার মাধ্যমে’। (ছহীহুল জামে ৭৩২৭; ছহীহাহ ১৭৮৩)।

মুসলিম পুরুষের সাথে মুছাফাহা করা

মুসলমান পুরুষের সাথে সালাম বিনিময়ের পাশাপাশি মুছাফাহা করা মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

বারাআ ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’জন মুসলিম পারস্পরিক সাক্ষাতে মুসাফাহা করলে তারা বিছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করা হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৭০৩, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭২৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫২১২, সহীহাহ ৫২৫, ৫২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুছাফাহার ক্ষেত্রে নিজের হাত আগেই টেনে নেওয়া সমীচিন নয়। হাদীছে এসেছে, ‘রাসূল (ছাঃ) যখন কারো সাথে মুছাফাহা করতেন, তখন ঐ ব্যক্তির হাত ছাড়তেন না, যতক্ষণ না সে রাসূল (ছাঃ)-এর হাত ছেড়ে দিতো।  (ছহীহাহ-২৪৮৫)।

উল্লেখ্য, মুছাফাহা এক হাতে অর্থাৎ দু’জনের দু’হাতে হবে। দু’জনের চার হাতে নয়।

সালামের সময় মাথা না ঝুঁকানো

সালাম প্রদানের সময় কারো সামনে মাথা অবনত করা বা ঝুঁকানো যাবে না। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মধ্য হতে কেউ যদি তাঁর কোন মুসলিম ভাইয়ের কিংবা কোন বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে, তবে কি সে (তাঁর সম্মানার্থে) মাথা নত করবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ না। লোকটি বলল : তবে কি সে আলিঙ্গন করবে এবং তাকে চুম্বন করবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ না। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, তাহলে কি তার হাত ধরবে এবং পরস্পর করমর্দন করবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৮০,  সুনান ইবনু মাজাহ ৩৭০২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ২৭২৮; ছহীহাহ ১৬০। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

গায়র মাহরাম মহিলাদের সাথে মুছাফাহা না করা

গায়র মাহরাম অর্থাৎ যাদের সাথে বিবাহ বৈধ এরূপ মহিলাদের সাথে মুছাফাহা করা হারাম। উমায়মা বিনতে রুকায়কা (রাঃ) বলেন, বায়আত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কতক মহিলা সমভিব্যাহারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাদের বলেন, যতদূর তোমাদের সামর্থ্যে ও শক্তিতে কুলায়। আমি মহিলাদের সাথে মুসাফাহা (করমর্দন) করি না। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৮৭৪,  সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৫৯৭, নাসায়ী ৪১৮১, আহমাদ ২৬৪৬৬, মুয়াত্তা মালেক ১৮৪২, ইবনু হিব্বান ৫৬৫৩, আল-হুমায়দী ৩৪১, আল-হাকিম ফিল মুসতাদরাক ৪/৭১, সহীহাহ ৫২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কারো মাথায় লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করা উত্তম, তার সাথে বৈধ নয় মহিলাকে স্পর্শ করা অপেক্ষা’। (ছহীহুল জামে ৭১৭৭, ৫০৪৫; ছহীহ আত-তারগীব ১৯১০)।

সালামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সালাম নামক এই শান্তির বাণীটি সামাজিক জীবনে এক বিশাল স্থান দখল করে আছে। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক আকর্ষণীয় চুম্বক শক্তি যা মনের সকল প্রকার দূরত্ব, মনের কালিমা ও অনৈক্য দূর করে সবাইকে কাছে এনে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়।

সালাম প্রচারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশনাঃ

ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া ও আহমাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ইউনুস (রহঃ)....মু’আবিয়াহ ইবনু সুওয়াইদ ইবনু মুকাররিন (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বারা ইবনু আযিব (রাযিঃ) এর নিকটে গমন করেছিলাম। সে সময় আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাতটি জিনিসের আদেশ করেছেন এবং সাতটি জিনিস হতে বারণ করেছেন। তিনি আমাদের অসুস্থ ব্যক্তির খোজ-খবর নেয়া, জানাযায় শরীক হওয়া, হাঁচিদাতার উত্তর দেয়া, শপথ পূরণ করা কিংবা বলেছেন শপথকারীর শপথ পূরণ করা, নির্যাতিতের সাহায্য করা, দাওয়াতকারীর ডাকে (দাওয়াতে) সাড়া দেয়া এবং সালামের প্রসার করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি আমাদেরকে সোনার আংটি পরিধান করা, রূপার বাসনে পান করা, মায়াসির (এক প্রকার তুলতুলে রেশমী কাপড়) ও কাস্সী (রেশম সংমিশ্রিত এক রকম মিসরী কাপড়) পরিধান করা এবং মিহি রেশমী কাপড়, মোটা রেশমী কাপড় ও খাটি রেশমী কাপড় ব্যবহার করতে বারণ করেছেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫২৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০৬৬,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২৩৯, ২৪৪৫, ৫১৭৫, ৫৬৩৫, ৫৬৬০, ৫৮৩৮, ৫৮৪৯, ৫৮৬৩, ৬২২২, ৬২৩৫, ৬৬৫৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৮০৯, নাসায়ী ১৯৩৯, ৩৭৭৮, ৫৩০৯, আহমাদ ১৮০৩৪, ১৮০৬১, ১৮১৭০, রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫২১৫, ইসলামিক সেন্টার ৫২২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা গড়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলে দেব না, যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালবাসতে লাগবে? (তা হচ্ছে) তোমরা আপোসের মধ্যে সালাম প্রচার কর।’’ (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৮৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৮৮, আবূ দাউদ ৫১৯৩, সুনান ইবনু মাজাহ ৬৮, ৩৬৯২, আহমাদ ৮৮৪১, ৯৪১৬, ৯৮২১, ১০২৭২, ২৭৩১৪)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

নবী করীম (ছাঃ) শুধু নির্দেশই দেননি বরং নিজেও বাস্তব জীবনে এর উপর আমল করে উম্মতের সামনে এক অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সবাইকে আগেই সালাম দিতেন। তিনি এমন একজন বিশ্বনেতা ছিলেন, যার কথা ও কর্মে ছিল অপূর্ব মিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার মানুষকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ-এর জীবনাচরণেই রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ’। (আহযাব ২১)।

তুফাইল ইবনে উবাই ইবনে কা’ব হতে বর্ণিত, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ’আনহু-এর কাছে আসতেন এবং সকালে তাঁর সঙ্গে বাজার যেতেন। তিনি বলেন, ’যখন আমরা সকালে বাজারে যেতাম, তখন তিনি প্রত্যেক খুচরা বিক্রেতা, স্থায়ী ব্যবসায়ী, মিসকীন, তথা অন্য কোন ব্যক্তির নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাকে সালাম দিতেন।’ তুফাইল বলেন, সুতরাং আমি একদিন (অভ্যাসমত) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ’আনহু-এর নিকট গেলাম।

তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে বাজারে যেতে বললেন। আমি বললাম, ’আপনি বাজার গিয়ে কী করবেন? আপনি তো বেচা-কেনার জন্য কোথাও থামেন না, কোন পণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন না, তার দর-দাম জানতে চান না এবং বাজারের কোন মজলিসে বসেনও না। আমি বলছি, এখানে আমাদের সাথে বসে যান, এখানেই কথাবার্তা বলি।’ (তুফাইলের ভুঁড়ি মোটা ছিল, সেই জন্য) তিনি বললেন, ’ওহে ভুঁড়িমোটা! আমরা সকাল বেলায় বাজারে একমাত্র সালাম পেশ করার উদ্দেশ্যে যাই; যার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়, আমরা তাকে সালাম দেই।’ (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৫০, মুওয়াত্তা মালিক ১৭৯৩)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকারঃ

এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের কতিপয় অধিকার রয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে,

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার তথা কর্তব্য রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে রাসূল (ছাঃ)! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন,

(১) যখন তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম দিবে।

(২) সে যখন তোমাকে দাওয়াত দিবে তখন তুমি তার দাওয়াত কবুল করবে।

(৩) সে যখন তোমার কাছে পরামর্শ বা উপদেশ চাইবে, তুমি তাকে সৎপরামর্শ দিবে।

(৪) সে হাঁচি দিয়ে যখন ‘আল-হামদুল্লিাহ’ বলবে তুমি তার হাঁচির জবাব দিবে।

(৫) সে যখন অসুস্থ হবে তখন তাকে দেখতে যাবে।

(৬) সে যখন মারা যাবে তখন তুমি তার সঙ্গী হবে’ (জানাযা পড়বে ও দাফন করবে)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৫২৫, ( সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)   ৫৫৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬২, আহমাদ ৮৮৪৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১০৯০৯, শু‘আবুল ঈমান ৮৭৩৭, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১৪০৫, সহীহ আদাবুল মুফরাদ ৯৯১, সহীহ আত্ তারগীব ৩৪৯৪, সহীহ আল জামি ৩১৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং বুঝা গেল সালাম অপর মুসলমান ভাইয়ের একটি অধিকার।

এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা কারো সালামের জবাব উত্তমভাবে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

‘তোমরা যখন বিশেষ শব্দে সালাম প্রাপ্ত হবে তখন তোমাদের প্রতি প্রদত্ত সালামের চাইতে উন্নত ভাষায় সালাম দিবে। অথবা ঐ ভাষাতেই উত্তর দিবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বিষয়ের হিসাব সংরক্ষণকারী’। (নিসা ৮৬)।

নিরাপদে জান্নাত লাভের উপায়ঃ

আবূ ইউসুফ আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “হে লোক সকল! তোমরা সালাম প্রচার কর, (ক্ষুধার্তকে) অন্নদান কর, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ এবং লোকে যখন (রাতে) ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা নামায পড়। তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’ (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৮৫৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৪৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪৮৫, সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৩৪, ৩২৫১, দারেমী ১৪৬০)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

জান্নাতবাসীর প্রতি অভিবাদনঃ

হাশরের ময়দানে বিচার-ফায়ছালা হয়ে যাওয়ার পর ভাল কাজের জন্য একদল যাবে জান্নাতে আর মনদ কাজের জন্য একদল যাবে জাহান্নামে। (সূরা হাক্কাহ)।

যারা অফুরন্ত নে‘মত ভরা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদেরকে ফেরেশতাগণ অভিবাদন জানিয়ে জান্নাতের দিকে নিতে নিতে বলবেন, سَلَمًا، سَلَمًا ‘তোমাদের প্রতি শান্তি-শান্তি’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর ফিরিশতাগণ তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রত্যেক দরজা দিয়ে আসবেন, আর বলবেন, سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ (সালা-মুন আলাইকুম) আপনারা যে ধৈর্যধারণ করেছেন তার বিনিময়ে শান্তি পরকালের ঘর কতই না উত্তম’। (রা‘দ ২৩-২৪)।

স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদেরকে স্বাগত জানাবেন ‘মহান দয়ালু রবের পক্ষ থেকে সালাম বলা হবে’। (ইয়াসীন ৫৮)।

অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম বা শান্তি। তোমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাক। অতঃপর তোমরা চিরস্থায়ী আবাস গ্রহণ করতঃ জান্নাতে প্রবেশ কর’ (যুমার ৭৩)।

সালাম অহংকার দূর করে বিনয় সৃষ্টি করেঃ

অহংকার পতনের মূল। গর্ব-অহংকার যেমনি মানব জীবনকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে তেমনি বিনয়, ভদ্রতা-নম্রতা মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণে সাহায্য করে। অহংকারী দাম্ভিক ব্যক্তিকে যেমন কেউ পসন্দ করে না, তেমনি তাকে আল্লাহর ভালবাসেন না। আল্লাহ বলেন, ‘যমীনে গর্বভরে চল না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন অহংকারী দাম্ভিককে ভালবাসেন না’। (লোক্বমান ১৮)।

অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার অন্তরে এক বিন্দু অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! সকলেই তো এটা পছন্দ করে যে, তার পোশাক ভালো হোক, জুতো জোড়া ভালো হোক, এসব কি অহংকারের মধ্যে শামিল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা নিজেও সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দও করেন। আর অহংকার হলো হককে বাতিল করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৯১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫২, সহীহুল জামি ৭৬৭৪, সহীহ আত্ তারগীব ২৯১২, আবূ দাঊদ ৪০৯২, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৪৩৩, আহমাদ ৪০৫৮, শু‘আবুল ঈমান ৬১৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং এ অহংকার নামক মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচতে চাইলে, আল্লাহর ভালবাসা পেতে হ’লে এবং জান্নাত লাভের বাসনা করলে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাতে হবে।

প্রথমে সালাম প্রদানকারী গর্ব-অহংকার থেকে যেমন মুক্ত থাকে তেমন বিনয়ীও হ’তে পারে। বিনয় আল্লাহর গযবে হ’তে রক্ষা করে তাঁর রহমতের অধিকারী বানায়। অহংকার ব্যক্তিকে কলুষিত করে আর বিনয় মানুষের জীবনকে পবিত্র করে। অহংকার শত্রুতা সৃষ্টি করে আর বিনয় শত্রুকেও পরম বন্ধুতে পরিণত করে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অহংকার নামক মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য সালামের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া।

সালাম কৃপণতা দূর করেঃ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মু’মিনের মধ্যে দু’টি স্বভাব একত্রে জমা হতে পারে না, কৃপণতা এবং অসদাচরণ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৮৭২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৯৬২, সহীহ আত্ তারগীব ২৬০৮, শু‘আবুল ঈমান ১০৩৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মানব সভ্যতার প্রথম থেকেই দানশীল ব্যক্তিকে মানুষ ভালবাসে, সম্মান করে। অন্যদিকে বখীল লোককে সমাজের লোকেরা ঘৃণা করে, অশ্রদ্ধা করে।

জাবের (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ) -এর খেদমতে হাযির হয়ে বললেন, আমার বাগানে অমুক ব্যক্তির একটি খেজুর গাছ আছে। ঐ গাছটি আমাকে কষ্ট দেয়। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই লোকটিকে ডেকে এনে বললেন, তোমার খেজুর গাছটি আমার নিকট বিক্রি কর। সে বলল, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি তা বিক্রি না কর তাহ’লে আমাকে দান কর। সে বলল, না। এবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বেহেশতের একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে তা বিক্রি কর। সে বলল, না। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) বললেন,

‘আমি তোমার চেয়ে অধিক কৃপণ আর কাউকে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, তোমার চেয়েও সেই ব্যক্তি বড় কৃপণ, যে সালাম দিতে কৃপণতা করে’। (আহমাদ, বাইহাক্বী, ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ২৭১৬, হাদীছ হাসান)।

আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তিঃ

আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি হ’তে হ‘লে সালাম দেওয়ার ব্যাপক প্রতিযোগিতা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার নিকট অগ্রগণ্য সে ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৪৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৯৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৭, আল জামি‘উস্ সগীর ৩৭৭৪, সহীহুল জামি ২০১১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৭০৩, শু‘আবুল ঈমান ৮৭৮৭, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৩৩০৪, শু‘আবুল ঈমান ৮৭৮৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম ব্যক্তিকে সমাজে পরিচিত করে তোলেঃ

মানুষের সাথে পরিচয়ের সর্বোত্তম মাধ্যম হ’ল ‘সালাম’। বিনা কষ্টে, বিনা মূল্যে অত্যন্ত ফলদায়ক অভিবাদনটির নাম اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ (আস-সালা-মু আলাইকুম)। এটি কেবল একটি বাক্য নয়, বরং এক মহা চুম্বক শক্তির নাম। এর মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করা যায়। সুতরাং আপনি যাদের কাছে দাওয়াত দিচ্ছেন, তাদেরকে ব্যাপক সালাম দিয়ে তাদের কাছে পরিচিত হেŠন। তাহ’লেই আপনার দাওয়াত তাদের কাছে গ্রহণীয় হবে, গোটা সমাজে সাড়া জাগাবে। আপনার সম্পর্ক বাড়বে ও দল ভারী হবে। কাফেলা এগিয়ে যাবে বিজয়ের লক্ষ্য পানে।

’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন্ ’আমলটি উত্তম? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অপরকে খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬২৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২, ৬২৩৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৪, আহমাদ ৬৫৮১, ৬৭৬৫,  নাসায়ী ৫০০০, সুনান ইবনু মাজাহ ৩২৫৩, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৯৪৪, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৭৭৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫০৫, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১১৭৩১, শু‘আবুল ঈমান ৩৩৫৯, আধুনিক প্রকাশনী ১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ার নিয়ামকঃ

সামাজিক শান্তি ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজন ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আর সালামের মাধ্যমেই ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়, শত্রুতা ও পরশ্রীকাতরতা দূর হয়। মহানবী (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দেব, যার উপর ’আমল করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। (তা হলো) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৩১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৪, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৫১৯৩, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৬৯২, আহমাদ ৯০৮৫, আল জামি‘উস্ সগীর ১৩০৩৭, সহীহুল জামি ৭০৮১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৬৯৪, তিরমিযী ২৬৮৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৯৪৪০, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৭৪৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ২৩৬, শু‘আবুল ঈমান ৬৬১৩, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ২১৫৯৫, আল মুসতাদরাক ৭৩১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালাম সামাজিক জীবনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ঃ

মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠে পরিবার। আর বহু পরিবার, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠে সমাজ। মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। ধনীর যেমন প্রয়োজন হয় গরীবের, গরীবেরও তেমন প্রয়োজন হয় ধনীর। প্রয়োজনের তাকীদে একে অপরের বাড়ি-ঘরে যেতে হয়। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে অন্যের বাড়িতে প্রবেশ করার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। তা হ’ল সালাম প্রদানের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা। অন্যথা বিনা বাক্য ব্যয়ে ফিরে আসবে। এতে করে সকলের সম্মান রক্ষা পাবে, মান-ইযযতের হিফাযত হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের নিজেদের গৃহে ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ কর না, যতক্ষণ না গৃহবাসীর সম্মতি লাভ করবে এবং তাদেরকে সালাম দিবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম পদ্ধতি। যাতে তোমরা উপদেশ লাভ করতে পার’। (নূর ২৭)।

বিনা অনুমতিতে ও বিনা সালামে অপরের বাড়িতে প্রবেশ করার কারণে মানুষের সম্ভ্রমের হানি ঘটে। সন্দেহ সৃষ্টি হয়। বাড়ীওয়ালা কি অবস্থায় আছে তা বুঝা যায় না। এতে তার ইযযত বিনষ্ট হওয়ার কারণে রুষ্ট হ’তে পারে। আর এভাবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়।

পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় সালামঃ

সম্পর্ক একবার তৈরি হয়ে গেলে যে আর নষ্ট হবে না, একথা বলা মুশকিল। শয়তান সবসময় পিছনে লেগে আছে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করার জন্য। কিন্তু প্রকৃত মুমিন কখনো শয়তানের চক্রান্ত সফল হ’তে দেয় না। যদি কখনো কোন কারণে সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরেও যায়, তাহ’লে মুমিন তা পূনর্গঠনে তৎপর হয়ে উঠবে, এটাই ঈমানের স্বাভাবিক দাবী। কারণ দু’জন মুসলমানের পক্ষে তিন দিনের বেশী সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে রাখা ইসলামে জায়েয নয়। সম্পর্ক রক্ষা ও পুনর্গঠনে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দিবে তাকে উত্তম বলা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ যদি সম্পর্ক পুনর্গঠনে পিছিয়ে যায় তার জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে।

আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে তিনদিনের বেশি সময় অপর কোন মুসলিম ভাইকে ত্যাগ করে। তারা কোথাও একে অপরের মুখোমুখি হলে একজন এদিকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং অপরজন ওদিকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাদের দু’জনের মধ্যে উত্তম সে ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম করে কথাবার্তা আরম্ভ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০২৭,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০৭৭, ৬২৩৭; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬০, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৯৩২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৯১১, সহীহুল জামি ৭৬৬০, আহমাদ ২৩৬৫৪, সহীহ আত্ তারগীব ২৭৫, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩১৪, মুওয়াত্ত্বা মালিক ৩৩৬৫, মা‘রিফাতুস্ সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাক্বী ৬৩৬৫, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৩৬৮, আহমাদ ১৩৩৫৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৬৬৯, শু‘আবুল ঈমান ৬৬১৭, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৩৮৫২, আস্ সুনানুল কাবীর লিল বায়হাক্বী ২০৫২১,  সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)  ৫৬৪৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬০৭৭,  ইরওয়া ২০২৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণঃ

আল্লাহ তা‘আলা যে সালাম আদম (আঃ)-কে শিখিয়েছিলেন এবং আদম (আঃ) থেকে যে সালাম এখন পর্যন্ত চলছে এবং ক্বিয়ামতের আগ পর্যন্ত চলবে; আর আমাদেরকে নবী (ছাঃ) যে সালাম প্রতিষ্ঠা করে একে দো‘আ, সম্ভাষণ, সংস্কৃতি হিসাবে চালু করে দিয়েছেন, সে সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ আজকের মুসলিম সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কতিপয় নমুনা নিম্নে পেশ করা হ’ল।-

১। অফিসের বড় ছাহেব তার পিয়নকে বললেন, শহীদ ছাহেবকে আমার সালাম দাও। অর্থাৎ এ সালামের মানে হ’ল শহীদ ছাহেব যেন তার সাথে দেখা করে। এখানে সালামকে তারা অফিসিয়াল কোড ওয়ার্ড হিসাবে ব্যবহার করেন।

২। মুদি দোকানদার তার এক কর্মচারীকে দিয়ে মহ’ললার এক বাসার গৃহকর্তার কাছে সালাম পাঠায়। মুদি দোকানদার এ সালাম পাঠায় বাসার কর্তার কাছে পাওনা তাগাদার জন্য। এ সালাম পাওনা তাগাদার সালাম।

৩। এক ভদ্রলোক তার পড়শীকে নিজের ছেলে পাঠিয়ে সালাম জানালেন। তার মানে পড়শীর কাছে পূর্বে টাকা ধার চেয়েছিলেন। ছেলেকে দিয়ে সালাম পাঠিয়ে তা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সালাম পেয়েই যেন ছেলের হাতে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন।

৪। দু’জনের মধ্যে কোন এক ব্যাপারে প্রচন্ড বিতর্ক চলছে। বিতর্কের শেষ পর্যায়ে একজন অপরজনকে বললেন, খুব হয়েছে ভাই, এবার সালাম! সালাম দিয়ে বিতর্ক থেকে কেটে পড়া মানে তিনি আর তর্ক করতে রাযী নন।

৫। ঈদের দিন শিশুরা স্বজনদের বাসায় বাসায় গিয়ে, মুরুববীদের সালাম দেয় সালামীর জন্য। প্রকৃত পক্ষে তারা এ দিনে সালাম দিয়ে সালামী বা টাকা কুড়াতে আসে। মূল উদ্দেশ্য সালাম দিতে আসা নয়। একে বিনোদনী আদুরে ভিক্ষা বলা যায়।

৬। অফিসে এসে বড় ছাহেবকে সালাম দেওয়ার অভ্যাস আছে অনেকের। কোন না কোন অসীলায় তারা দেখা করবেনই এবং একটা সালাম দেবেনই। এখানে বড় ছাহেবকে সালাম দেওয়া মানে বড় ছাহেবের নযরে আসা, আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা।

আসলে সালামকে এসব উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বরং এ সালামকে শুধুমাত্র আমাদের পারস্পরিক দো‘আ ও আশির্বাদ হিসাবে দান করা হয়েছে। সুতরাং সালামকে আসল উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ইসলামী সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করার শামিল।

শুধু সালামের অপব্যবহারই নয়, আজকে আমাদের মুসলিম সমাজে সালামের বিকৃত উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান সালামকে বিকৃত করে ফেলেছে। তারা সালামের শুদ্ধ বানান লিখেছে ‘সেলাম’। সালাম-এর ব্যাখ্যায় লিখেছে ‘সালাম’ হচ্ছে ‘সেলাম-এর রূপভেদ’। তাদের মতে ‘আস-সালা-মু আলাইকুম’-এর শুদ্ধ বানান হচ্ছে ‘সেলাম আলায়কুম’ যার অর্থ (লেখা হয়েছে) ‘নমস্কার’।

আজকের যুবকরা বিভিন্ন স্টাইলে সালাম প্রদান করে থাকে। যেমন-

(১) সেলামালিকুম

(২) শ্লামালিকুম (৩) আস্সালামালিকুম

(৪) আস্লামালিকুম

(৫) সালামালিকুম।

সালামের এই বিকৃত রূপ এখন প্রকৃত হ’তে যাচ্ছে। আগামীতে এই ‘সালাম’ আরও কত বিকৃত হবে তা আল্লাহ মা‘লূম। এজন্য আমরাই দায়ী। বিকৃত আর অপব্যবহার যে আমরাই করছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। আসুন! আমরা সালামের অপব্যবহার ও বিকৃত উচ্চারণ থেকে বিরত হই।

পরিশেষে সকলের নিকট এই নিবেদন করতে চাই, আসুন! নিজেকে অহংকার মুক্ত করতে, আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হ’তে, জনপ্রিয়, জননন্দিত ও অধিক পরিচিত হ’তে, ইসলামের উত্তম কাজটি করতে, নিজেকে একজন আদর্শবান, সুন্দর ও অনুপম মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে, সালাম দেওয়াকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করি। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, বিজ্ঞ-মূর্খ, কুলি-মজুর, সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে সালাম দেওয়ার মত একটি মন তৈরী করি এবং নিজেকে সকলের প্রিয় মানুষে পরিণত করি। আমাদের সমাজকে একটি আদর্শ, সুন্দর নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার জন্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সৌরভ দিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত একটি জনপদ তৈরি করতে আসুন! সালামের ব্যাপক প্রচলন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন!

এক হাতে মুছাফাহা  নাকি দুই হাতে মুছাফাহা

সর্বাগ্রে মুছাফাহার অর্থ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে। যাতে মাসআলাটি বুঝতে সহজ হয়। মুছাফাহা-এর অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, هِيَ مُفَاعَلَةٌ مِنَ الصَّفْحَةِ وَالْمُرَادُ بِهَا الْإِفْضَاءُ بِصَفْحَةِ الْيَدِ إِلَى صَفْحَةِ الْيَدِ ‘এটা صفحة থেকে বাবে مفاعلة-এর মাছদার বা ক্রিয়ামূল। যার অর্থ হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’। (ফাৎহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৪, ‘মুছাফাহা’ অনুচ্ছেদ)।

ইবনুল আছীর (রহঃ) ‘আন-নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন,وَمِنْهُ حَدِيثُ المُصَافَحَة عِنْدَ اللِّقاء وَهِيَ مُفُاعلَة مِنْ إلْصاقِ صَفْح الكَفِّ بالكَفِّ، وَإِقْبَالِ الوجْه عَلَى الوجْه ‘এক হাতের তালুর ভিতরের অংশের সাথে অন্য হাতের তালুর ভিতরের অংশ মিলানো এবং পরস্পরের চেহারা মুখোমুখি করা। (ইবনুল আছীর, আন-নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৮৮)।

মোল্লা আলী ক্বারী হানাফীও মুছাফাহার অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন,اَلْمُصَافَحَةُ: هِيَ الْإِفْضَاءُ بِصَفْحَةِ الْيَدِ إِلَى صَفْحَةِ الْيَدِ ‘মাছাফাহ হ’ল হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’। (মিরক্বাত শরহে মিশকাত, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৪)।

আল্লামা মুরতাযা যুবায়দী হানাফী কামূসের শরাহ ‘তাজুল আরূস’ গ্রন্থে مصافحة-এর এই অর্থই লিখেছেন যে,

الرَّجُلُ يُصَافِحُ الرَّجُلَ إِذَا وَضَعَ صَفْحَ كَفِّهِ فِيْ صَفْحِ كَفِّهِ وَصَفْحَا كَفَّيْهِمَا وَجْهَاهُمَا وَمِنْهُ حَدِيثُ الْمُصَافَحَةِ عِنْدَ اللِّقَاءِ وَهِيَ مُفَاعَلَةٌ مِنْ إِلْصَاقِ صَفْحِ الْكَفِّ بِالْكَفِّ وَإِقْبَالِ الْوَجْهِ عَلَى الْوَجْهِ- (তাজুল আরূস শরহে কামূস, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৮১)।

প্রকাশ থাকে যে, মুছাফাহা করা নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। আর এটি গুনাহ মাফ হওয়ার মাধ্যমও বটে। হযরত বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا ‘যখন দু’জন মুসলমান পরস্পরে সাক্ষাৎকালে মুছাফাহা করে তখন তাদের পৃথক হওয়ার পূর্বেই উভয়ের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়’। (তিরমিযী হা/২৭২৭ ‘অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায় ‘মুছাফাহার বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ)।

মুছাফাহা সুন্নাত হওয়া সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছটিও প্রণিধানযোগ্য।

হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন,

‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ তার ভাই বা বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলে সে কি তার দিকে ঝুঁকবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। সে বলল, তাহ’লে কি সে আলিঙ্গন করবে এবং চুম্বন করবে? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। পুনরায় সে প্রশ্ন করল, তবে কি সে হাত ধরে মুছাফাহা করবে? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ’।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৮০,  সুনান ইবনু মাজাহ ৩৭০২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ২৭২৮; ছহীহাহ ১৬০। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

উপরোক্ত হাদীছদ্বয় মুছাফাহা সুন্নাত হওয়ার দলীল। রাসূল (ছাঃ)-এর অসংখ্য হাদীছ দ্বারা এটাও প্রমাণিত রয়েছে যে, মুছাফাহা এক হাতে বরং ডান হাত দ্বারা করা সুন্নাত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) বলেন,

 ‘তোমরা আমার এই হাতের তালু দেখছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি এই হাতের তালুকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হাতের তালুতে রেখেছি’। (মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৭২৬, ৪/১৮৯; মাওয়ারিদুয যামআন হা/৯৪০; আরনাউত্ব বলেন, হাদীছটির রাবীগণ ছিকাহ (বিশ্বস্ত)। তবে এর সনদ ইযত্বিরাবের দোষে দুষ্ট)।

মুসনাদে আহমাদের আরেক বর্ণনায় আছে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেন,

‘আমি আমার এই হাত দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে সাধ্যমত নেতার কথা শোনার ও মান্য করার উপর বায়‘আত করেছি’। (মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৭৮৬, ছহীহ লি-গায়রিহি)।

উপরোক্ত হাদীছ দু’টিতেيد  ও كف শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, বায়‘আতের জন্য এক হাত ব্যবহার করা হয়েছে। আর মুছাফাহার জন্যও এটিই সুন্নাতী পদ্ধতি।

ছাহাবায়ে কেরাম সাধারণতঃ নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আসতেন এবং তাঁর কাছে বায়‘আত ও মুছাফাহা করতেন। হযরত আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

 ‘অতঃপর যখন আল্লাহ আমার মনে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টি করলেন, তখন আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললাম, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার নিকটে বায়‘আত করতে চাই। তিনি তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলে আমি আমার হাত টেনে নিলাম। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে আমর! তোমার কি হ’ল? আমি বললাম, আমি কিছু শর্ত আরোপ করতে চাই। তিনি বললেন, কি শর্ত? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সব গুনাহকে মিটিয়ে দেয়’। (মুসলিম, হা/৩২১)।

প্রকাশ থাকে যে, হাতের উপর হাত রাখাকে বায়‘আত বলে। মুছাফাহারও এটাই সুন্নাতী তরীকা। মুছাফাহাও এক হাতের তালুর সাথে আরেক হাতের তালু মিলানোকে বলা হয়। (আন-নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীছ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৩)।

এজন্য মুছাফাহারও সুন্নাতী তরীকা সেটাই, যেটা উক্ত হাদীছে উল্লিখিত হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন, তখন আমি অপবিত্র ছিলাম। তিনি আমার হাত ধরলেন। তারপর আমি তাঁর সাথে হাঁটতে থাকলাম। তিনি যখন বসলেন, তখন আমি সরে পড়লাম’।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য আরেকটি বর্ণনায় নিম্নোক্ত শব্দ আছে, ‘আমি অপবিত্র অবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমার দিকে তাঁর হাত বাড়ালেন আমি তাঁর কাছ থেকে আমার হাত টেনে নিলাম এবং বললাম, আমি অপবিত্র। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সুবহানাল্লাহ। মুসলমান অপবিত্র হয় না’। (শারহু মা‘আনিল আছার, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬)।

উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের শব্দগুলি সম্পর্কে চিন্তা করুন! হাদীছ দু’টিতেই يد শব্দটি একবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এ দু’টি হাদীছই এক হাতে মুছাফাহা করা সুন্নাত হওয়ার অকাট্য দলীল। উক্ত হাদীছ দু’টি থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, নবী করীম (ছাঃ) মুছাফাহার জন্য তাঁর এক হাত বাড়িয়েছেন। আর দ্বিতীয় হাদীছে একথাও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তাঁর যে এক হাতকে মুছাফাহা করার জন্য বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন অপবিত্রতার কারণে তা টেনে নিয়েছিলেন। এজন্য অধিকাংশ বিদ্বান এই হাদীছগুলিকে এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে অকাট্য দলীল মনে করেন। এখানে এই ব্যাখ্যারও কোন সুযোগ নেই যে, এটা বায়‘আতের নির্দিষ্ট অবস্থা ছিল। বরং এখানে পারস্পরিক সাক্ষাতের বিষয়টা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট।

এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে উল্লেখিত হাদীছগুলি ছাড়াও আরো অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু হাদীছে দুর্বলতা থাকায় মাত্র কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা হ’ল। আসুন এখানে উক্ত হাদীছগুলির সমর্থনে কতিপয় হানাফী বিদ্বানের মতও উল্লেখ করছি, যাতে মাসআলাটি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। ফিক্বহে হানাফীর প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত গ্রন্থ ‘হেদায়াতে’ আল্লামা মারগীনানী লিখেছেন,‘মুছাফাহা করাতে কোন দোষ নেই। কারণ এটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মাসআলা’। (হেদায়া, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৫৫ ‘অপসন্দ’ অধ্যায়)।

উপরোক্ত উক্তিতে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে, মুছাফাহা এক হাতে হবে, না দুই হাতে? সেকারণ বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য অন্যান্য ফক্বীহদের মতামতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যরূরী। আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী হানাফী লিখেছেন,

 ‘এর সারকথা এই যে, যদি মানুষ হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করতে সক্ষম না হয় তাহ’লে স্বীয় দুই হাত পাথরের উপরে রাখবে। অতঃপর দুই হাতকে চুম্বন করবে। অথবা স্রেফ এক হাত রাখবে। আর ডান হাত রাখাই সর্বোত্তম। কেননা যে কোন সম্মানজনক কাজে এই হাতই ব্যবহার করা হয়। কারণ ‘আল-বাহরুল আমীক্ব’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, হাজারে আসওয়াদ আল্লাহর ডান হাত। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সাথে মুছাফাহা করেন। আর মুছাফাহা ডান হাত দ্বারা হয়ে থাকে। (রাদ্দুল মুহতার হাশিয়া দুর্রুল মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৪৭। উল্লেখ্য, ‘হাজারে আসওয়াদ আল্লাহর ডান হাত’ মর্মে মারফূ‘, মওকূফ ও মাকতূ সূত্রে বর্ণনা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কোনটি মওযূ‘, কোনটি মুনকার, কোনটি যঈফ। (বিস্তারিত দ্রঃ আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২২৩, ২৬৮৬)।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানাফীর নিম্নোক্ত উক্তিও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়,

 ‘আলেমগণ এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, যেকোন সম্মানজনক কাজে ডান হাতকে এগিয়ে দেয়া মুস্তাহাব। যেমন- ওযূ, গোসল, কাপড়, জুতা, মোজা অথবা পাজামা পরিধান করা, মসজিদে প্রবেশ করা, মিসওয়াক করা, চোখে সুরমা লাগানো, নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, বগলের লোম তুলে ফেলা, মাথা মুন্ডন করা, ছালাতে সালাম ফিরানো, পায়খানা থেকে বের হওয়া, পানাহার, মুছাফাহা করা, হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করা, আদান-প্রদান প্রভৃতি। এছাড়া অন্যান্য কাজে বাম হাতকে অগ্রবর্তী করা মুস্তাহাব। (আন-নিহায়া, ১ম খন্ড, ২৪৮ পৃঃ ‘ওযূ’ অধ্যায়)।

উপরোক্ত বক্তব্যের স্পষ্ট মর্ম এই যে, আল্লামা আইনী (রহঃ) মুছাফাহা করার সময় ডান হাত অগ্রসর করাকে মুস্তাহাব আখ্যা দিচ্ছেন। যা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুকূলে।

আল্লামা যিয়াউদ্দীন হানাফী নকশাবন্দী (রহঃ) স্বীয় لوامع العقول গ্রন্থে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ

إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ فَتَصَافَحَا وَحَمِدَا اللهَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন,وَالظَّاهِرُ مِنْ آدَابِ الشَّرِيعَةِ تَعَيُّنُ الْيُمْنَى مِنَ الْجَانِبَيْنِ لِحُصُولِ السُّنَّةِ- ‘অর্থাৎ শারঈ আদব থেকে স্পষ্টভাবে এটা বুঝা যায় যে, মুছাফাহা সুন্নাতী তরীকায় হওয়ার জন্য উভয় পক্ষের ডান হাত নির্ধারিত। যদি উভয়ের বাম হাত মিলানো হয় অথবা একজনের ডান হাত এবং অন্য জনের বাম হাত তবুও মুছাফাহা সুন্নাত সম্মত হবে না। (লাওয়ামিউল উকূল-এর বরাতে তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৯৭)।

হানাফী ফক্বীহদের গ্রন্থসমূহ থেকে উল্লেখিত উদ্ধৃতি সমূহ দ্বারা একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, ফুক্বাহায়ে কেরাম ডান হাতে মুছাফাহা করাকে সুন্নাত ও মুস্তাহাব মনে করেন। এ ধরনের স্পষ্ট উদ্ধৃতি থাকা সত্ত্বেও কেন কিছু মানুষ এক হাতে মুছাফাহা করাকে ইহুদী-নাছারাদের সাদৃশ্য আখ্যা দিতে গিয়ে এক হাতে মুছাফাহাকারীদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করে?

এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছগণের আরো স্পষ্ট উদ্ধৃতি সমূহ ফিক্বহী বই-পুস্তক সমূহে এবং হাদীছের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলিতে মওজূদ রয়েছে। সংক্ষিপ্ততার দিকে খেয়াল রেখে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করাই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে।

শেষে এই মাসআলাটিও খোলাসা করা যরূরী যে, ইমাম বুখারী কি দুই হাতে মুছাফাহা করার প্রবক্তা এবং তিনি স্বীয় ছহীহ বুখারীতে যে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন, সেটা কি দুই হাতে মুছাফাহার দলীল হ’তে পারে? হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূল (ছাঃ) আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। তখন আমার হাত তার দুই হাতের তালুতে ছিল’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬২৬৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রকাশ থাকে যে, এই হাদীছের সম্পর্ক সাক্ষাতের সময় মুছাফাহার সাথে নয়। বরং এ হাদীছে একথার উল্লেখ রয়েছে যে, নবী করীম (ছাঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে তাশাহহুদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আর এটা শিক্ষা দানের সময় ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এক হাত রাসূল (ছাঃ)-এর দুই হাতের মধ্যে ছিল। বুঝা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত অবস্থায় তিন হাতে মুছাফাহা আবশ্যক হচ্ছে। আর এ পদ্ধতির প্রবক্তা দুই হাতে মুছাফাহা করার মত পোষণকারীও নয়। দু’হাতে মুছাফাহার প্রবক্তারা উভয়ের দুই হাতে মুছাফাহার পক্ষে মত পোষণ করেন।

হানাফী ফক্বীহদের উদ্ধৃতি সমূহ থেকে একথা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উপরোক্ত পদ্ধতি শিক্ষা দান ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ছিল। হানাফী ফিক্বহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হেদায়া’র পাদটীকায় বলা হয়েছে, ‘নবী করীম (ছাঃ) এজন্য ইবনু মাসঊদের হাত ধরেছিলেন, যাতে তিনি সচেতন থাকেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর কোন কথা তার থেকে ছুটে না যায়’। (হিদায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৩)।

আল্লামা যায়লাঈ হানাফী (রহঃ) এ ব্যাপারে বলেন। (নাছবুর রায়াহ ১/৪২১)।

অর্থাৎ ইবনু আববাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তাশাহহুদের উপর ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত তাশাহহুদ সম্পর্কিত বর্ণনা প্রাধান্য পাওয়ার অন্যতম কারণ এই যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। তখন আমার হাত রাসূল (ছাঃ)-এর দুই হাতের মধ্যে ছিল। এটি অধিক মনোযোগ ও গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।

এখানে একথা সম্পূর্ণরূপে প্রতীয়মান হ’ল যে, নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর হাত ধরা মুছাফাহার জন্য নয়; বরং গুরুত্ব প্রদান ও নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ছিল। যাতে কোন কথা ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে না যায়।

প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (রহঃ)ও এমনটাই লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইবনু মাসঊদের হাদীছ একথা প্রমাণ করে যে, সাক্ষাৎ করার সময় যে মুছাফাহা করা হয় তার দ্বারা তা উদ্দেশ্য নয়। বরং এই ধরনের হাতে হাত রাখা ঠিক তেমনি ছিল, যেমনটি গুরুজন ছোটদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দেওয়ার সময় তার হাতকে নিজের হাতে ধরে রাখে’। (মাজমূ‘আ ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৪)।

শিক্ষা দেওয়ার সময় হাত ধরার আরো কিছু বর্ণনা হাদীছের গ্রন্থসমূহে মওজূদ রয়েছে। হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ এভাবে এসেছে,

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার হাত ধরে বললেন, আল্লাহর কসম হে মু‘আয! আমি তোমাকে ভালবাসি (দু’বার)। তিনি বললেন, হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি প্রতি ছালাতের পর এই দো‘আটা পড়তে ছাড়বে না। ‘হে আল্লাহ! আপনাকে স্মরণ করার জন্য, আপনার শুকরিয়া আদায় করার জন্য এবং আপনার সুন্দর ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করুন’। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫২২; মুসনাদে আহমাদ ৫/২৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এই হাদীছটি একথার স্পষ্ট দলীল যে, আল্লাহর রাসূল ছাহাবায়ে কেরামকে কোন কথা বুঝাতে এবং তাঁর দিকে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাদের হাত ধরতেন। শিক্ষার এ বিশেষ পদ্ধতি হানাফী ফক্বীহদের মাঝেও পাওয়া যায়।

আল্লামা জালালুদ্দীন খাওয়ারিযমী হানাফী হেদায়ার ব্যাখ্যা ‘কেফায়া’র মধ্যে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এ বর্ণনাটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,

‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এই হাদীছটিকে শিক্ষার তাকীদ হিসাবে ধরা হয়েছে। কারণ মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানী (রহঃ) বলেন, ইমাম আবু ইউসুফ আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন। আবু ইউসুফ বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা বলেন, হাম্মাদ আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন। হাম্মাদ বলেন, আলক্বামা আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। আলক্বামা বলেন, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন’। (কেফায়া শরহে হেদায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৯)।

উক্ত বর্ণনায় হানাফী ইমামগণের একে অপরের হাত ধরে তাশাহহুদ শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি উপরোক্ত ইবনু মাসঊদের হাদীছের উপর আমল করা। আসলে সব ইমামই উক্ত হাদীছকে শিক্ষা দানের পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এই পদ্ধতিকে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখতিয়ার করেছিলেন। এটি প্রচলিত মুছাফাহার সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়।

পরিশেষে আমরা আমাদের আলোচনাকে এমন একটি হাদীছ দিয়ে শেষ করতে চাই, যেটি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাধ্যমত তাঁর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তথা পবিত্রতা, মাথা আঁচড়ানো, জুতা পরার ক্ষেত্রে ডান দিক থেকে শুরু করা পসন্দ করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এই হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করতে গিয়ে হানাফী ফক্বীহদের মধ্য থেকে বড় বড় ইমাম ও ফক্বীহগণ যেমন আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী হানাফী, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানাফী, আল্লামা যিয়াউদ্দীন হানাফী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমূহে এমনকি মুছাফাহার ক্ষেত্রেও ডান হাত অগ্রসর করাকে মুস্তাহাব ও সুন্নাত আখ্যা দিয়েছেন। যা উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে সুস্পষ্ট হলো।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

...........................................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস

  বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস মূল গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) (১) উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্...