Search This Blog

Thursday, August 15, 2019

বিতর ছালাত পড়ার ছহীহ নিয়ম (সর্বাধিক দলিল সংবলিত)

বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

বিতর ছালাত পড়ার ছহীহ নিয়ম

(সর্বাধিক দলিল সংবলিত)


বিতর ছালাত পড়ার হুকুম

(ক) খারিজাহ্ ইবনু হুযাফাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা এমন এক সালাত  দিয়ে তোমাদের সহযোগিতা করেছেন (পাঞ্জেগানা সালাত ছাড়া) যা তোমাদের জন্যে লাল উটের চেয়েও অনেক উত্তম। তা হলো বিতরের সালাত। আল্লাহ তা’আলা এ সালাত তোমাদের জন্য ’ইশার সালাতের পর থেকে ফজরের (ফজরের) সালাতের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মাঝে আদায়ের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৭,সুনান আবূ দাঊদ ১৪১৮, সুনান আত্ তিরমিযী ৪৫২, দারাকুত্বনী ১৬৫৬, সুনান ইবনু মাজাহ ১১৬৮, দারিমী ১৫৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ বেজোড়, তিনি বেজোড় ভালোবাসেন। হে কুরআনের বাহকগণ! তোমরা বিতর সালাত পড়ো। এক বেদুঈন বললো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন? রাবী বলেন, (তা) তোমার জন্য নয় এবং তোমার সাথীদের জন্যও নয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭০, সুনান আবূ দাঊদ ১৪১৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৬, সুনান আত্ তিরমিযী ৪৫৩, সুনান আননাসায়ী ১৬৭৫, আহমাদ ১২২৫, সহীহ আত্ তারগীব ৫৯২)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিতর সালাত সুন্নাহ মুআক্কাদাহ

বিতর সালাত সুন্নাহ মুআক্কাদাহ। ফরয বা ওয়াজিব নয়।

হাদিসঃ

আসেম ইবনু দমরা আস-সালূলী (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় বিতর বাধ্যতামূলক সালাত  নয় এবং তোমাদের ফরয সালাতের সম-পর্যায়ভুক্তও নয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের সালাত আদায় করেছেন, অতঃপর বলেছেনঃ হে আহলে কুরআন! তোমরা বিতরের সালাত পড়ো। নিশ্চয় আল্লাহ বিতর (বেজোড়), তিনি বিতরকে ভালবাসেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৬৯, সুনান আততিরমিযী ৪৫৩-৫৪, সুনান আননাসায়ী ১৬৭৫-৭৬, ৩৬৮,  সুনান আবূ দাঊদ ১৪১৬, আহমাদ ৬৫৪, ৭৬৩, ৭৮৮, ৮৪৪, ৯২৯, ১২৬৫; দারিমী ১৫৭৯, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবাহ ২/২৯৬, মুসান্নাফ ইবনু আব্দুর রাযযাক ৩/৩ হাদীস নং ৪৫৬৯, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৩; নাসাঈ হা/১৬৭৬; মির‘আত ২/২০৭; ঐ, ৪/২৭৩-৭৪; শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লা-হিল বা-লিগাহ ২/১৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যে সমস্ত হাদীস ওয়াজিব সাব্যস্ত করার জন্য পেশ করা হয় তা দুর্বল কিংবা অস্পষ্ট। উপরোক্ত হাদীসের ন্যায় স্পষ্ট নয়। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন বুগ্ইয়াতুল মুতাত্বউয়ে ফী ছলাতি তাত্বওউ‘ পৃষ্ঠা ৪৬-৬৬। যারা বিতরকে ওয়াজিব বলে তাদেরকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহাবা ‘উবাদাহ বিন সামিত মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন।

হাদিসঃ

ইবনু মুহাইরীয (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। বনু কিনানাহর আল-মুখদাজী সিরিয়াতে আবূ মুহাম্মাদ নামক এক ব্যক্তিকে বলতে শুনেছেন, বিতর ওয়াজিব। মুখদাজী বলেন, আমি ’উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) এর কাছে গিয়ে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি বললেন, আবূ মুহাম্মাদ মিথ্যা বলেছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফারয করেছেন। যে ব্যক্তি তা যথাযথভাবে পালন করবে, আর অবহেলাহেতু এর কোনটি পরিত্যাগ করবে না, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর অঙ্গীকার করেছেন। আর যে ব্যক্তি তা (যথাযথভাবে) আদায় করবে না, তার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিবেন কিংবা জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪২০, ৪২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যা এশার ফরয ছালাতের পর হতে ফজর পর্যন্ত সুন্নাত ও নফল ছালাত সমূহের শেষে আদায় করতে হয়। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৯২-৯৩।)

বিতর ছালাত খুবই ফযীলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে বা সফরে কোনো অবস্থাতেই বিতর ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পরিত্যাগ করতেন না। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আ-দ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৯ সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) ১/৪৫৬।)

রাতের নফল ছালাতসহ বিতর ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাকআত পর্যন্ত পড়া যায় এবং তা প্রথম রাত্রি, মধ্য রাত্রি, ও শেষ রাত্রি সকল সময় পড়া চলে।

হাদিসঃ

(ক) গুযায়ফ ইবনু হারিস (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ’আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয গোসল রাতে প্রথম অংশে না শেষ অংশে করতেন? ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, কোন কোন সময় তিনি রাতের প্রথম প্রহরে এবং কোন কোন সময় রাতের শেষ প্রহরে গোসল করতেন। আমি বললাম, আল্লাহ তা’আলা অনেক বড়। সব প্রশংসাই আল্লাহ তা’আলার জন্যে। যিনি দীনের ’আমলের ব্যাপারে সহজ (ব্যবস্থা) করে দিয়েছেন। আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বিতরের সালাত  রাতের প্রথম ভাগে আদায় করে নিতেন না শেষ ভাগে আদায় করতেন? ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো রাতের প্রথম ভাগেই আদায় করতেন, আবার কখনো শেষ রাতে আদায় করতেন। আমি বললাম, আল্লাহ তা’আলা অনেক বড়। সব প্রশংসা তাঁর যিনি দীনের কাজ সহজ (ব্যবস্থা) করে দিয়েছেন। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি তাহাজ্জুদের সালাতে অথবা অন্য কোন সালাতে শব্দ করে ক্বিরাআত (কিরআত) পড়তেন, না আস্তে আস্তে? তিনি বললেন, কখনো তো শব্দ করে ক্বিরাআত (কিরআত) পড়তেন, আবার কখনো নিচু স্বরে। আমি বললাম, আল্লাহ অনেক বড় ও সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য, যিনি দীনের কাজ সহজ ও প্রশস্ত করে দিয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৩, সুনান আবূ দাঊদ ২২৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৬৭৯, আহমাদ ২৪২০২, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবদুল্লাহ ইবনু ক্বায়স (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ’আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত রাক্’আত বিতরের সালাত  আদায় করতেন। ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো চার ও তিন (অর্থাৎ সাত), আবার কখনো ছয় ও তিন (অর্থাৎ নয়), কখনো আট ও তিন (অর্থাৎ এগার) আবার কখনো দশ ও তিন (অর্থাৎ তের) রাক্’আত বিতরের সালাত আদায় করতেন। তিনি সাত-এর কম ও তের-এর বেশী বিতরের সালাত আদায় করতেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৪, আবূ দাঊদ ১৩৬২, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪৮০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ বিতরের সালাত প্রত্যেক মুসলিমের আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। তাই যে লোক বিতরের সালাত পাঁচ রাক্’আত আদায় করতে চায় সে যেন পাঁচ রাক্’আত আদায় করে। যে লোক তিন রাক্’আত আদায় করতে চায় সে যেন তিন রাক্’আত আদায় করে। আর যে লোক এক রাক্’আত আদায় করতে চায় সে যেন এক রাক্’আত আদায় করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৫, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২২, সুনান আননাসায়ী ১৭১০, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১১৯০, সহীহ আল জামি‘ ৭১৪৭, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪৭৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(ঘ) আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ভোরে উপনীত হওয়ার আগেই বিতর সালাত পড়ো। (সুনান ইবনু মাজাহ ১২৮৯, মুসলিম ৭৫১-২, সুনান আততিরমিযী ৪৬৮, সুনান আননাসায়ী ১৬৮৩, ১৬৮৪; আহমাদ ১০৭১৩, ১০৯০৯, ১০৯৩১, ১১২৭৮; দারিমী১৫৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতির রাতে বিতর সালাত আদায় করতো, কখনো রাতের প্রথমভাগে, কখনো মধ্যভাগে এবং কখনো শেষভাগে তাঁর বিতর পড়তেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৮৬, আহমাদ ৮২৭, ১২১৯, ১২৬৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(চ) মাসরূক (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়িশাহ (রাঃ) কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিতরের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, তিনি প্রতি রাতেই বিতর সালাত আদায় করতো, কখনো রাতের প্রথম ভাগে, কখনো রাতের মধ্যভাগে, কখনো শেষভাগে। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি রাতের শেষভাগ পর্যন্ত তা বিলম্বিত করতেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৮৫, বুখারী ৯৯৬, মুসলিম ৭৪১-২, তিরমিযী ৪৫৬, নাসায়ী ১৬৮১, আহমাদ ১৪৩৫, আহমাদ ২৪৪৫৩ দারিমী ১৫৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যদি কেউ বিতর পড়তে ভুলে যায় অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে স্মরণ হলে কিংবা রাতে বা সকালে ঘুম হতে জেগে উঠার পরে সুযোগ মত তা আদায় করবে।

হাদিসঃ

যায়দ ইবনু আসলাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে লোক বিতরের সালাত আদায় না করে শুয়ে পড়েছে (আর উঠতে পারেনি), সে যেন (ফজরের সালাতের পূর্বে) ভোর হয়ে গেলেও তা পড়ে নেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৮, ১২৭৯, সুনানআত্ তিরমিযী ৪৬৬, ৪৬৫, সহীহ আল জামি ৬৫৬৩, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৩১, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১১৮৮, আহমাদ ১১২৬৪, ১৪৩১, নায়ল ৩/২৯৪, ৩১৭-১৯, মির‘আত ৪/২৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যান্য সুন্নাত-নফলের ন্যায় বিতরের ক্বাযাও আদায় করা যাবে। রাসুল সাঃ ১২ রাকাত কাযা সালাত আদায় করতেন। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮; নায়লুল আওত্বার ৩/৩১৮-১৯)।

বিতর ছালাত কাযা আদায়ের বিধান

(ক)  সাঈদ ইবনু মানসূর ও কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ)...আয়িশাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। ব্যথা-বেদনা বা অন্য কোন কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাত্রিকালীন কোন সালাত কাযা হয়ে গেলে দিনের বেলা তিনি বারো রাকাআত সালাত আদায় করে নিতেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬২৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৪৬, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬১৩, ইসলামীক সেন্টার ১৬২০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(খ) আলী ইবনু খশরাম (রহঃ)....আয়িশাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন আমল বা কাজ করলে তা সর্বদা অর্থাৎ নিয়মিতভাবে করতেন। আর রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়লে বা অসুস্থ হলে পরিবর্তে দিনের বেলা বারো রাকাআত সালাত আদায় করে নিতেন। আয়িশাহ (রাযিঃ) বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কখনো ভোর পর্যন্ত সারারাত জেগে ইবাদাত করতে এবং রমযান মাস ছাড়া এক নাগাড়ে পুরো মাস সিয়াম পালন করতে দেখিনি। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬২৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৪৬, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬১৪, ইসলামীক সেন্টার ১৬১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

(গ) সা’দ ইবনু হিশাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সালাত  আদায় করলে, তা নিয়মিত আদায় করতে পছন্দ করতেন। কোন দিন যদি ঘুম বেশী হয়ে যেত অথবা অন্য কোন সমস্যা দেখা দিত, যাতে তাঁর জন্যে রাত্রে দাঁড়ানো সম্ভব হত না, তখন তিনি দুপুরে বারো রাক্আত সালাত আদায় করে নিতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৭, বায়হাক্বী ৩/৩০; মির‘আত ৪/২৬৪-৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তাহাজ্জুদ ছালাতের ক্ষেত্রেও একই বিধান। যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করেন কিন্তু কোনো কারণে যদি পড়তে না পারেন তাহলে দিনের বেলায় ১২ রাকাত ছালাত আদায় করবেন।

(ঘ) হারূন ইবনু মা’রূফ এবং আবূত তহির ও হারমালাহ (রহঃ)....উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ তার (রাতের বেলার) অযীফাহ্ বা করণীয় কাজ কিংবা তার কিছু অংশ করতে ভুলে গেলে তা যদি সে ফাজর ও যুহরের সালাতের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে আদায় করে নেয় তাহলে তা এমনভাবে তার জন্য লিখে নেয়া হবে যেন সে তা রাতের বেলায়ই সম্পন্ন করেছে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৬৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৪৭ , (ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬১৫, ইসলামীক সেন্টার ১৬১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিতর ছালাত  এর রাকাত সংখ্যা

প্রথমতঃ বিতর ছালাত এক রাক‘আত:- (সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত)

বিতর মূলতঃ এক রাক‘আত। কারণ যতো ছালাতই আদায় করা হোক এক রাক‘আত আদায় না করলে বিতর হবে না। এ মর্মে অনেক ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু  সমাজে বেশী প্রচলিত আছে যে, এক রাকাত ছালাত বলতে কিছু নেই। উক্ত মর্মে কিছু উদ্ভট দলীলও উল্লেখ করা হয়। যেমন:

 (ক) আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) এক রাক‘আত বিতর পড়তে নিষেধ করেছেন। তাই কোন ব্যক্তি যেন এক রাক‘আত ছালাত আদায় করে বিজোড় না করে। (ইবনু আব্দিল বার্র, আত-তামহীদ, আল-আহকামুল উস্তা ২/৫০ পৃঃ; আলোচনা দ্রঃ টীকা, মুওয়াত্ত্বা মালেক, তাহক্বীক্ব : ড. তাক্বিউদ্দীন আন-নাদভী হা/২৫৮)।

তাহক্বীক্ব: আব্দুল হক্ব বলেন, উক্ত বর্ণনার সনদে ওছমান বিন মুহাম্মাদ বিন রবী‘আহ রয়েছে। (আল-আহকামুল উস্তা ২/৫০ পৃঃ)।

ইমাম নববী বলেন, এক রাক‘আত বিতর নিষেধ মর্মে মুহাম্মাদ বিন কা‘ব-এর হাদীছ মুরসাল ও যঈফ। (খুলাছাতুল আহকাম হা/১৮৮৮; কাশফুল খাফা)।

উক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য না হলেও ‘হেদায়ার’ ভাষ্য গ্রন্থ ‘আল-ইনাইয়াহ’ কিতাবে তাকে খুব প্রসিদ্ধ বলে দাবী করা হয়েছে। অর্থাৎ এক রাক‘আত বিতর পড়ার বিরোধিতা করা হয়েছে। (হেদায়াহ ২/১৮৪ পৃঃ)।

(খ) হুছাইন (রাঃ) বলেন, ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর কাছে যখন এই কথা পৌঁছল যে, সা‘দ (রাঃ) এক রাক‘আত বিতর পড়েন। তখন তিনি বললেন, আমি এক রাক‘আত ছালাতকে কখনো যথেষ্ট মনে করিনি’। (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৪২২)।

অন্যত্র সরাসরি তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণনা এসেছে,  ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমি কখনো এক রাক‘আত ছালাত যথেষ্ট মনে করি না’। (খুলাছাতুল আহকাম ফী মুহিম্মাতিস সুনান ওয়া ক্বাওয়াইদিল ইসলাম হা/১৮৮৯)।

তাহক্বীক্ব: ইমাম নববী (রাঃ) উক্ত আছার উল্লেখ করার পর বলেন, এটি যঈফ ও মাওকূফ হাদিস। ইবনু মাসঊদের সাথে হুছাইনের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। ইবনু হাজার আসক্বালানীও তাই বলেছেন। (তাহক্বীক্ব মুওয়াত্ত্ব মুহাম্মাদ ২/২২ পৃঃ)।

 (গ) আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, ‘এক রাক‘আত বিতর পড়া ঠিক নয়। তাছাড়া ছালাত কখনো এক রাক‘আত হয় না’। (ছহীহ মুসলিম শরহে নববী ১/২৫৩ পৃঃ, হা/১৭৫১-এর হাদীছের আলোচনা দ্রঃ)।

তাহক্বীক্ব: উক্ত বক্তব্যের কোন সত্যতা নেই। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) যেহেতু এক রাক‘আত বিতর পড়েছেন এবং পড়তে বলেছেন, সেহেতু অন্য কারো ব্যক্তিগত কথার কোন মূল্য নেই।

জ্ঞাতব্য: ইমাম ত্বাহাবী বলেন, ‘বিতর ছালাত এক রাক‘আতের অধিক। এক রাক‘আত বিতর সম্পর্কে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। (ত্বাহাবী হা/১৭৩৯)।

হেদায়া কিতাবে বিতর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু এক রাক‘আত বিতর সম্পর্কে কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তিন রাক‘আতের কথা বলা হয়েছে। (হেদায়া ১/১৪৪-১৪৫ পৃঃ)।

মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান তার ‘তালীমুস্-সালাত’ বইয়ে বিতর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন প্রায় ছয় পৃষ্ঠা। কিন্তু কোথাও এক রাক‘আত বিতর-এর কথা উল্লেখ করেননি। (ঐ, পৃঃ ১৬৯-১৭৪)।

ড. ইলিয়াস ফায়সাল ‘নবীজীর নামায’ বইয়ে লিখেছেন, ‘বিতর সর্বনিম্ন তিন রাকাআত। আমরা জানি যে, দু’ রাকাআতের নিচে কোনো নামায নেই। .. হাদীস শরীফ থেকে বোঝা যায় যে, বিতর হল সর্বনিম্ন তিন রাকাআত’। (ঐ, পৃঃ ২৪১)।

“মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে” বইয়ে ৩২০ থেকে ৩৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিতর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও এক রাক‘আত বিতরের কথা বলা হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে যে, তিন রাকআতের কম বিতর পড়া যায় না। ভাবখানা এমন যে, তারা জানেন না বা হাদীছে কোন দিন দেখেননি যে বিতর ছালাত এক রাক‘আতও আছে।

আমরা শুধু এতটুকু বলব যে, সাধারণ মুছল্লীদেরকে যে কৌশলেই ধোঁকা দেয়া হোক, আল্লাহ সে বিষয়ে সর্বাধিক অবগত। কেউই তাঁর আয়ত্বের বাইরে নয়। অতএব সাবধান!

এক রাক‘আত বিতর ছালাত পড়ার ছহীহ হাদীছ সমূহ

(ক) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সালাত দু দু রাকআত করে পড়তেন এবং এক রাকআত বিতর পড়তেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭৪, ১১৭৫, ১১৭৬,  ১৩১৮, ১৩১৯, ১৩২০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭২-৭৩, ৯৯১, ৯৯৩, ৯৯৫, ৯৯৮, ১১৩৭; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৬৪৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫৩, ৭৩১-৪, ৭৪১-৩, ৭৫০, ৭৫১-৩, ৭৫১-২, সুনান আততিরমিযী ৪৩৭, ৪৬১, ৪৬৭, ৪৬৯, ৫৯৭; সুনান আননাসায়ী ১৬৬৬-৭৪, ১৬৮২, ১৬৮৯-৯৫; সুনান আবূ দাঊদ ১২৯৫, ১৩২৬, ১৪২১, ১৪৩৬, ১৪৩৮, আহমাদ ৪৫৫৭, ৪৮৩২, ৪৮৬৩, ৪৯৬৭, ৫০১২, ৫০৭৭, ৫১৯৫, ৫৩১৯, ৫৩৭৬, ৫৪৪৭, ৫৪৫৯, ৫৪৭৯, ৫৫১২, ৫৫২৪, ৫৭২৫, ৫৭৫৯, ৫৯০১, ৫৯৭২, ৬১৩৪, ৬১৪১, ৬২২২, ৬৩১৯, ৬৩৩৭, ৬৩৮৫, ৬৪০৩; মুওয়াত্ত্বা মালিক ২৬৯, দারিমী ১৪৫৮-৫৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৬৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূল (ছাঃ) এক রাকআত বিতর পড়ার নির্দেশও দিয়েছেন। যেমন-

(খ) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আর বিতর এক রাক্আত শেষ রাতে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৪২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ রাত্রের (নফল) সালাত দু’ রাক্আত দু’ রাক্আত করে (আদায় করতে হয়)। কারো ভোর হয়ে যাওয়ার আশংকাবোধ হলে সে যেন (দু’ রাক্আতের) সাথে সাথে আরো এক রাক্আত আদায় করে নেয়। তাহলে এ রাক্আত পূর্বে আদায় করা সালাতকে বেজোড় করে দেবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৩, ৪৭২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৩৪, ১৬৩৩, ১৬৩৫, ১৬৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৯)।

(ঘ) মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহঃ)...ইবনু উমর (রাঃ) সুত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিতরের সালাত শেষ রাত্রে (আদায়কৃত সালাত সমুহের সাথে মিলিত) একটি রাকআত। (সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ১৬৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আবূ আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ বিতরের সালাত প্রত্যেক মুসলিমের আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। তাই যে লোক বিতরের সালাত পাঁচ রাক্আত আদায় করতে চায় সে যেন পাঁচ রাক্আত আদায় করে। যে লোক তিন রাক্আত আদায় করতে চায় সে যেন তিন রাক্আত আদায় করে। আর যে লোক এক রাক্আত আদায় করতে চায় সে যেন এক রাক্আত আদায় করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৫, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২২, সুনান ইবনু মাজাহ ১১৯০, সহীহ আল জামি ৭১৪৭, সুনান আল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪৭৭৩, সুনান আননাসায়ী ১৭১০, ১৭১১-১৭১৩; আহমাদ ১৪২২,২৩০৩৩; দারিমী ১৫৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ বেজোড়, তিনি বেজোড় ভালোবাসেন। হে কুরআনের বাহকগণ! তোমরা বিতর সালাত  পড়ো। এক বেদুঈন বললো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন? রাবী বলেন, (তা) তোমার জন্য নয় এবং তোমার সাথীদের জন্যও নয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭০, সুনান আবূ দাঊদ ১৪১৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৬৬, সুনান আত্ তিরমিযী ৪৫৩, সুনান আননাসায়ী ১৬৭৫, আহমাদ ১২২৫, সহীহ আত্ তারগীব ৫৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত হাদীছগুলো থাকতে কেনো বলা হয় যে, এক রাক‘আত কোন ছালাত নেই? সর্বশেষ হাদীছটিতে সরাসরি আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ এক বিজোড়, না তিন, না পাঁচ বিজোড় তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? হাদীছের গ্রন্থগুলো বিভিন্ন মাদরাসায় পড়ানো হয়, বরকতের জন্য ‘খতমে বুখারী’ নামে লোক দেখানো অনুষ্ঠানও করা হয়। কিন্তু উক্ত হাদীছগুলো কি তাদের চোখে পড়ে না? এটা অবশ্যই মাযহাবী নীতিকে ঠিক রাখার অপকৌশল মাত্র। রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে যদি এভাবে অবজ্ঞা ও গোপন করা হয়, তবে ক্বিয়ামতের মাঠে কে উদ্ধার করবে? যে সমস্ত ব্যক্তি ও মাযহাবের পক্ষে ওকালতি করা হচ্ছে তারা কি বিচারের দিন কোন উপকারে আসবে?

ঢাকার ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া’-এর শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মতিন ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ বইয়ে বিতর ছালাত সম্পর্কে ৯৮-১৩১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অনেক আলোচনা করেছেন। ছলে বলে কৌশলে মিথ্যা ও উদ্ভট তথ্য দিয়ে প্রচলিত তিন রাক‘আত বিতরকে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। আর এক রাক‘আত বিতরের হাদীছগুলো সম্পূর্ণই আড়াল করেছেন। একজন সচেতন পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন কিভাবে তিনি প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন। দুনিয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ গোপন করলেও পরকালে তাঁর কথা ঠিকই মনে পড়বে। কিন্তু কোন লাভ হবে কি? আল্লাহ বলেন, ‘যালিম সেদিন তার হাত দুইটি দংশন করবে আর বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের পথে চলতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, অমুককে যদি সাথী হিসাবে গ্রহণ না করতাম। আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল- আমার নিকট বিধান আসার পর। শয়তান মানুষের জন্য মহাপ্রতারক’ (ফুরক্বান ২৭-২৯)। অতএব লেখকের চিন্তা করা উচিৎ তিনি কাকে অনুসরণ করে পথ চলছেন!

চার খলীফাসহ অধিকাংশ ছাহাবী, তাবেঈ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এক রাক‘আত বিতরে অভ্যস্ত ছিলেন। (নায়লুল আওত্বার ৩/২৯৬; মির‘আত ৪/২৫৯)।

দ্বিতীয়তঃ বিতর ছালাত তিন রাকআত

এক সঙ্গে তিন রাকআত বিতর পড়ার ছহীহ দলীলসমূহ

(ক) আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। তিনি শেষের রাক‘আতে ব্যতীত বসতেন না। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪০; বায়হাক্বী হা/৪৮০৩, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪১; তা’সীসুল আহকাম ২/২৬২ পৃঃ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিশেষ সতর্কতা: মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত لاَ يَقْعُدُ (বসতেন না) শব্দকে পরিবর্তন করে পরবর্তী ছাপাতে  لاَيُسَلِّمُ (সালাম ফিরাতেন না) করা হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী সকল মুহাদ্দিছ لاَ يَقْعُدُ দ্বারাই উল্লেখ করেছেন। (হাকেম হা/১১৪০; ফাৎহুল বারী হা/৯৯৮-এর আলোচনা দ্রঃ; আল-আরফুশ শাযী ২/১৪ পৃঃ)।

আরো দুঃখজনক হলো- আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) নিজে স্বীকার করেছেন যে, আমি মুস্তাদরাক হাকেমের তিনটি কপি দেখেছি কিন্তু কোথাও لاَيُسَلِّمُ (সালাম ফিরাতেন না) শব্দটি পাইনি। তবে হেদায়ার হাদীছের বিশ্লেষক আল্লামা যায়লাঈ উক্ত শব্দ উল্লেখ করেছেন। আর যায়লাঈর কথাই সঠিক। (আল-আরফুয যাশী শারহু সুনানিত তিরমিযী ২/১৪)।

সুধী পাঠক! ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫ হিঃ) নিজে হাদীছটি সংকলন করেছেন আর তিনিই সঠিকটা জানেন না!! বহুদিন পরে এসে যায়লাঈ (মৃঃ ৭৬২ হিঃ) সঠিকটা জানলেন? অথচ ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ)ও একই সনদে উক্ত হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে একই শব্দ আছে। অর্থাৎ لاَ يَقْعُدُ (বসতেন না) আছে।

(খ) ইবনু ত্বাঊস তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। মাঝে বসতেন না। (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৪৬৬৯, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭)।

(গ) ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। শেষের রাক‘আতে ছাড়া তিনি বসতেন না। (মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১৪৭১, ৪/২৪০; বিস্তারিত দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হা/৪১৮-এর আলোচনা)।

 (ঘ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। প্রথম রাক‘আতে ‘সাবিবহিসমা রাবিবকাল আ‘লা’ দ্বিতীয় রাক‘আতে ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফেরূন’ এবং তৃতীয় রাক‘আতে ‘কুল হুওয়াল্লা-হুল আহাদ’ পড়তেন এবং তিনি রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। অতঃপর যখন তিনি শেষ করতেন তখন শেষে তিনবার বলতেন ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’। শেষবার টেনে বলতেন। (নাসাঈ হা/১৬৯৯, ১/১৯১ পৃঃ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদীছও প্রমাণ করে রাসূল (ছাঃ) একটানা তিন রাক‘আত পড়েছেন, মাঝে বৈঠক করেননি।

 (ঙ) আত্বা (রাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন কিন্তু মাঝে বসতেন না এবং শেষ রাক‘আত ব্যতীত তাশাহহুদ পড়তেন না। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪২)।

এমন কি পাঁচ রাক‘আত পড়লেও রাসূল (ছাঃ) এক বৈঠকে পড়েছেন।

(চ)  উম্মু সালামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাত বা পাঁচ রাকআত বিতর সালাত আদায় করতো এবং এর মাঝখানে সালাম ফিরাতেন না, কথাও বলতেন না। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৯২, সুনান আততিরমিযী ৪৫৭, সহীহাহ ২৯৬১, নাসাঈ ১৭১৭, ১/১৯৩ পৃঃ, শারহুস সুন্নাহ ১/২৩১ পৃঃ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুধী পাঠক! যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তারাই সমাধান পেশ করেছেন। সুতরাং তিন রাকআত বিতর পড়ার ক্ষেত্রে মাঝে তাশাহ্হুদ পড়া যাবে না; বরং একটানা তিন রাক‘আত পড়তে হবে। তারপর তাশাহ্হুদ পড়ে সালাম ফিরাতে হবে।

জ্ঞাতব্য: তিন রাকআত বিতর পড়ার ক্ষেত্রে দুই রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে পুনরায় এক রাকআত পড়া যায়। তিন রাক‘আত বিতর পড়ার এটিও একটি উত্তম পদ্ধতি।

নাফি‘ (রহ.) হতে বর্ণিত। ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘উমার (রাযি.) বিত্র সালাতের এক ও দু’ রাক‘আতের মাঝে সালাম ফিরাতেন (অর্থাৎ দুই রাকাত পড়ে সালাম ফেরাতেন অতঃপর আরো এক রাকাত পড়তেন)। অতঃপর কাউকে কোন প্রয়োজনীয় কাজের নির্দেশ দিতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৯৯১, ইফাবা হা/৯৩৭, ২/২২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৬২; ইরওয়াউল গালীল হা/৪২০-এর আলোচনা দ্রঃ, ২/১৪৮ পৃঃ; দেখুনঃ আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান, পৃঃ ২২; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৬৮৭১, ৬৮৭৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯৩২ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৩৭ শেষাংশ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লেখ্য যে, তিন রাকআত বিতরের মাঝে সালাম দ্বারা পার্থক্য করা যাবে না মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (ইওয়াউল গালীল হা/৪২১, ২/১৫০ পৃঃ; আহমাদ হা/২৫২৬৪)।

তিন এর অধিক বিতর ছালাত পড়ার নিয়ম

৫ রাকআত বিতরে একটানা পাঁচ রাক‘আত শেষে বৈঠক ও সালামসহ বিতর করবে।

হাদিসঃ

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রে (তাহাজ্জুদের সময়) তের রাক্’আত সালাত আদায় করতেন। তের রাক্’আতের মাঝে পাঁচ রাক্’আত বিতর। আর এর মাঝে (পাঁচ রাক্’আতের) শেষ রাক্’আত ব্যতীত কোন রাক্’আতে ’তাশাহুদ’ পড়ার জন্যে বসতেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৬, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মির‘আত ৪/২৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সাত ও নয় রাক‘আত বিতরে ছয় ও আট রাক‘আতে প্রথম বৈঠক করবে। অতঃপর সপ্তম ও নবম রাক‘আতে শেষ বৈঠক করে সালাম ফিরাবে।

হাদিসঃ

সা’দ ইবনু হিশাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন ’আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। তাঁর কাছে বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ’খুলুক’ (স্বভাব-চরিত্র) ব্যাপারে কিছু বলুন। ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআন পড়ো না? আমি বললাম, হ্যাঁ পড়ি। এবার তিনি বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নৈতিকতা ছিল আল-কুরআন। আমি বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিতর ব্যাপারে বলুন। তিনি বললেন, (রাতের বিতর সালাতের জন্যে) আমি পূর্বে থেকেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর মিসওয়াক ও উযূর পানির ব্যবস্থা করে রাখতাম।

আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁকে ঘুম হতে সজাগ করতে চাইতেন, উঠাতেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমে মিসওয়াক করতেন, তারপর উযূ করতেন ও নয় রাক্’আত সালাত আদায় করতেন। অষ্টম রাক্’আত ব্যতীত কোন রাক্’আতে তিনি বসতেন না। আট রাক্’আত পড়া শেষ হলে (’তাশাহহুদে’) বসতেন। আল্লাহর যিকর করতেন। তাঁর প্রশংসা করতেন। তাঁর নিকট দু’আ করতেন অর্থাৎ আত্তাহিয়্যাতু পাঠ করতেন। তারপর সালাম ফিরানো ব্যতীত নবম রাক্’আতের জন্যে দাঁড়িয়ে যেতেন। নবম রাক্’আত শেষ করে তাশাহুদ পাঠ করার জন্যে বসতেন। আল্লাহর যিকর করতেন। তাঁর প্রশংসা করতেন। তাঁর নিকট দু’আ করতেন (অর্থাৎ তাশাহুদ পড়তেন)। এরপর আমাদেরকে শুনিয়ে সশব্দে সালাম ফিরাতেন।

তারপর বসে বসে দু’ রাক্’আত আদায় করতেন। হে বৎস! এ মোট এগার রাক্’আত হলো। এরপর যখন তিনি বার্ধক্যে পৌঁছে গেলেন এবং তাঁর শরীর ভারী হয়ে গেল, তখন বিতরসহ সাত রাক্’আত সালাত আদায় করতেন। আর পূর্বের মতোই দু’ রাক্’আত বসে বসে আদায় করতেন। প্রিয় বৎস! এ মোট নয় রাক্’আত হলো। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সালাত  আদায় করলে, তা নিয়মিত আদায় করতে পছন্দ করতেন। কোন দিন যদি ঘুম বেশী হয়ে যেত অথবা অন্য কোন সমস্যা দেখা দিত, যাতে তাঁর জন্যে রাত্রে দাঁড়ানো সম্ভব হত না, তখন তিনি দুপুরে বারো রাক্’আত সালাত আদায় করে নিতেন। আমার জানা মতে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো এক রাতে সম্পূর্ণ কুরআন পড়েননি। অথবা ভোর পর্যন্ত সারা রাত্র ধরে সালাত আদায় করেননি এবং রমাযান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে গোটা মাস সওম পালন করেননি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৭, বায়হাক্বী ৩/৩০; মির‘আত ৪/২৬৪-৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তিন রাকআত বিতর পড়ার সময় দুই রাক‘আতের পর তাশাহ্হুদ পড়া

এটা ভুল পদ্ধতিঃ

তিন রাকআত বিতর একটানা পড়তে হবে। মাঝখানে কোন বৈঠক করা যাবে না। এটাই সুন্নাত। কিন্তু আমাদের ভারত উপমহাদেশে ভুল পদ্ধতিতে তিন রাকআত বিতর পড়া হয়। দেখা যায়, মুছল্লীগণ মাঝখানে বৈঠক করে ও তাশাহ্হুদ পড়ে। মুহিউদ্দ্বীন খান লিখেছেন, ‘প্রথম বৈঠকে কেবল আত্তাহিয়্যাতু পড়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দুরূদ পড়বে না এবং সালাম ফিরাবে না। যেমন মাগরিবের নামাযে করা হয়, তেমনি করবে’। (তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭১)।

অথচ উক্ত আমলের পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই। তবে জাল হাদিস আছে। যেমন:

(ক) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মাগরিবের ছালাতের ন্যায় বিতরের ছালাত তিন রাক‘আত। (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৩১১; মাজমাউল বাহরাইন হা/১০৮৭)।

তাহক্বীক্ব: ইবনুল জাওযী বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়। (তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৭)।

 (খ) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা) বলেন, মাগরিবের ছালাত দিনের বিতর ছালাত। (মালেক, মুওয়াত্ত্বা হা/২৫৪)।

তাহক্বীক্ব: অনেকে উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বিতর ছালাত মাগরিব ছালাতের ন্যায় প্রমাণ করতে চান। অথচ তা ত্রুটিপূর্ণ। বর্ণনাটি কখনো মারফূ‘ সূত্রে এসেছে, কখনো মাওকূফ সূত্রে এসেছে। তবে এর সনদ যঈফ। মুহাদ্দিছ  শু‘আইব আরনাঊত বলেন,  ঐ অংশটুকু ছহীহ নয়। (তাহক্বীক্ব মুসনাদে আহমাদ হা/৫৫৪৯)।

(গ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, রাত্রির তিন রাক‘আত বিতর দিনের বিতরের ন্যায়। যেমন মাগরিবের ছালাত। (দারাকুৎনী হা/১৬৭২; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৩০৯ ও ৯৩১০; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩১)।

তাহক্বীক্ব: ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া যাকে ইবনু আবীল হাওয়াজিব বলে। সে যঈফ। সে আ‘মাশ ছাড়া আর কারো নিকট থেকে মারফূ হাদীছ বর্ণনা করেনি। (সুনানু দারাকুৎনী হা/১৬৭২; তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৭)।

ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া ইবনু হাযিব কূফী আ‘মাশ থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেছে। কিন্তু সে যঈফ। তার বর্ণনা আ‘মাশ থেকে বর্ণিত অন্যান্য বর্ণনার বিরোধিতা করে। (বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩১)।

এছাড়াও ইমাম দারাকুৎনী উক্ত বর্ণনার পূর্বে তার বিরোধী ছহীহ হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে মাগরিবের মত করে বিতর পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন-

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা (মাগরিবের ছালাতের ন্যায়) তিন রাক‘আত বিতর পড় না, পাঁচ, সাত রাক‘আত পড়। আর মাগরিবের ছালাতের ন্যায় আদায় কর না’। ইমাম দারাকুৎনী উক্ত হাদীছকে ছহীহ বলেছেন। (দারাকুৎনী ২/২৪ পৃঃ, সনদ ছহীহ, ত্বাহাবী হা/১৭৩৯)।

বিশেষ জ্ঞাতব্য: ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ ও ‘নবীজীর নামায’ শীর্ষক বইয়ে যঈফ হাদীছটি দ্বারা দলীল পেশ করা হয়েছে। কিন্তু ছহীহ হাদীছটি সম্পর্কে কোন কিছু বলা হয়নি। এটা দুঃখজনক। (মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ৩২৪; নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৯)।

ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,

 ‘তিন রাক‘আত বিতরে দ্বিতীয় রাক‘আতে বৈঠক করার পক্ষে আমি কোন মারফূ ছহীহ দলীল পাইনি’। (মির‘আতুল মাফাতীহ হা/১২৬২-এর আলোচনা দ্রঃ)।

কুনূত (القنوت)

“কুনূত” অর্থ বিনম্র আনুগত্য। কুনূত দু’প্রকার। কুনূতে রাতেবাহ ও কুনূতে নাযেলাহ। প্রথমটি বিতর ছালাতের শেষ রাকআতে পড়তে হয়। দ্বিতীয়টি বিপদাপদ ও বিশেষ কোন জরূরী কারণে ফরয ছালাতের শেষ রাকআতে পড়তে হয়। বিতরের কুনূতের জন্য হাদীছে বিশেষ দো‘আ বর্ণিত হয়েছে।

হাদিসঃ

হাসান ইবনু আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার নানা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিতর সালাতের কুনূতে পড়ার জন্য কতগুলো বাক্য শিক্ষা দিয়েছেঃ

“আল্লাহুম্মাহদিনী ফীমান হাদাইতা ওয়া’আ-ফিনী ফীমান ’আ-ফাইতা ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লাইতা ওয়া বা-রিক লী ফীমা আ’তাইতা ওয়াক্বিনী শাররা মা ক্বাদাইতা, ইন্নাকা তাক্বদী ওয়ালা ইউকদা ’আলাইকা ওয়া ইন্নাহু লা ইয়াযিল্লু মান ওয়ালাইতা ওয়ালা ইয়াইয্যু মান ’আ-দাইতা তাবা-রাকতা রববানা ওয়া তা’আলাইতা।’’

অর্থঃ হে আল্লাহ্! যাদের প্রতি তুমি উদারতা প্রদর্শন করেছো, তাদের সাথে আমাকেও উদারতা প্রদর্শন করো, যাদের তুমি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছো, তাদের সাথে আমারও অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো, যাদের তুমি হিদায়াত দান করেছো তাদের সাথে আমাকেও হিদায়াত দান করো। তোমার নির্ধারিত অকল্যাণ থেকে আমাকে রক্ষা করো। তুমি আমাকে যা দান করেছো তাতে বরকত দাও। কেবল তুমিই নির্দেশ দিতে পারো, তোমার উপর কারো নির্দেশ চলে না। তুমি যার পৃষ্ঠপোষকতা দাও, সে কখনও অপমানিত হয় না। হে আমাদের রব! তুমি পবিত্র, কল্যাণময় ও সুউচ্চ। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭৮, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২৫, সুনান আত্ তিরমিযী ৪৬৪, সুনান আননাসায়ী ১৭৪৫, দারিমী ১৬৩৪, ইবনু খুযায়মাহ্ ১০৯৫, ইরওয়া ৪২৯, আহমাদ, ১৭১৮, ১৪২৫ ১৭২০, ২৭৮২০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৭৩, সহীহ আবী দাউদ ১১৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুনূত পড়ার ছহীহ নিয়ম

বিতরের কুনূত দুই নিয়মে পড়া যায়। শেষ রাকআতে ক্বিরাআত শেষ করে হাত বাঁধা অবস্থায় দু‘আয়ে কুনূত পড়া। (ইরওয়াউল গালীল ২/৭১ পৃঃ, ২/১৮১ পৃঃ)।

অথবা ক্বিরাআত শেষে হাত তুলে দু‘আয়ে কুনূত পড়া। রুকূর আগে বিতরের কুনূত পড়া সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রুকূর আগে বিতরের কুনূত পড়তেন।

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর ছালাত আদায় করতেন। প্রথম রাক‘আতে সূরা আ‘লা, দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা কাফেরূন এবং তৃতীয় রাক‘আতে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। আর তিনি রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। যখন তিনি ছালাত থেকে অবসর হতেন তখন বলতেন, ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’। শেষের বারে টেনে বলতেন। (নাসাঈ হা/১৬৯৯, ১/১৯১ পৃঃ, সনদ ছহীহ)।

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) যখন বিতর পড়তেন তখন রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৮২, ইরওয়াউল গালীল ৪২৬, সুনান আননাসায়ী ১৬৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী আগে কুনূত পড়াকেই উত্তম বলেছেন। (মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/২৮৭ পৃঃ, হা/১২৮০)।

রুকুর পরেও কুনুত পড়া যায়।

হাদিসঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফজরের সালাতে দুআ কুনূত পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বলেন, আমরা (কখনো) রুকূর আগে বা (কখনো) রুকূর পরে দুআ কুনূত পড়তাম। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৮৩, ১১৮৪, ১২৪৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১০০২,১০০১, ৭৯৮, ৩১৭০, ৪০৮৮, ৪০৯০-৪০৯২, ৪০৯৪-৪০৯৬, ৬৩৯৪; সুনান আননাসায়ী ১০৭০, ১০৭১, ১০৭৭, ১০৭৯; আহমাদ ১৪৪৪, ১৪৪৫, ১২২৯৪, ১২৪৩৮, ১২৭০৭, ১৩৫৩৯; দারিমী ১৫৯৬, ১৫৯৯, ইরওয়াহ ১৬০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিতর ছালাতের কুনুত কোনটি---কুনূতে নাযেলাহ নাকি কুনুতে রাতেবাহ

(সঠিকটা জেনে নেই)

কুনূতে নাযেলাহ

যুদ্ধ, শত্রুর আক্রমণ প্রভৃতি বিপদের সময় অথবা কারুর জন্য বিশেষ কল্যাণ কামনায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে বিশেষভাবে এই দোআ পাঠ করতে হয়। “কুনূতে নাযেলাহ” ফজর ছালাতে অথবা সব ওয়াক্তে ফরয ছালাতের শেষ রাকআতে রুকূর পরে দাঁড়িয়ে “রববানা লাকাল হাম্দ” বলার পরে দু’হাত উঠিয়ে সরবে পড়তে হয়।

হাদিসঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন লোককে বদ্দু’আ অথবা কোন লোককে দু’আ করতে চাইলে রুকূ’র পরে কুনূত পড়তেন। তাই কোন কোন সময় তিনি,  “সামি’আল্ল-হু লিমান হামিদাহ, রব্বানা- লাকাল হামদু” বলার পর এ দু’আ করতেন,

“আল্ল-হুম্মা আনজিল ওয়ালীদ ইবনিল ওয়ালীদ। ওয়া সালামাতাবনি হিশা-ম, ওয়া ’আইয়্যা-শাবনি রবী’আহ্, আল্লা-হুম্মাশদুদ ওয়াত্ব আতাকা ’আলা- মুযারা ওয়াজ্’আলহা- সিনীনা কাসিনী ইউসুফা।”

অর্থাৎ হে আল্লাহ! ওয়ালীদ ইবনু ওয়ালীদকে, সালমাহ্ ইবনু হিশামকে, ’আইয়্যাশ ইবনু আবূ রবী’আকে তুমি মুক্তি দান করো। হে আল্লাহ! ’মুযার জাতির’ ওপরে তুমি কঠিন ’আযাব নাযিল করো। আর এ ’আযাবকে তাদের ওপর ইউসুফ (আঃ)-এর বছরগুলোর ন্যায় দুর্ভিক্ষের রূপ ধারণ করে দাও।’ তিনি উচ্চস্বরে এ দু’আ পড়তেন।

কোন কোন সালাতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ’আরাবে এসব গোত্রের জন্যে এভাবে দু’আ করতেন, ’হে আল্লাহ! তুমি অমুক অমুকের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করো।’ তারপর আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেছেন,  “লাইসা লাকা মিনাল আমরি শাইয়ুন” অর্থাৎ ’’এ ব্যাপারে আপনার কোন দখল নেই’’- (সূরাহ্ আ-লি ’ইমরান ৩: ১২৮)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৮৮,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৫৬০, ৭৯৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৪৩৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৭৭; ছিফাত ১৫৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮-৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪১৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪২০১)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 কুনূতে নাযেলাহর জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে নির্দিষ্ট কোন দো‘আ বর্ণিত হয়নি। অবস্থা বিবেচনা করে ইমাম আরবীতে দো‘আ পড়বেন ও মুক্তাদীগণ ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন।

হাদিসঃ

আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এক মাস পর্যন্ত প্রতিদিন যুহর, ’আসর, মাগরিব, ’ইশা ও ফাজ্রের (ফজরের) সালাতের শেষ রাক্’আতে “সামি’আল্ল-হু লিমান হামিদাহ” বলার পর দু’আ কুনূত পড়তেন। এতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বানী সুলায়ম-এর কয়েকটি গোত্র, রি’ল, যাকওয়ান, ’উসাইয়্যাহ্ এর জীবিতদের জন্যে বদ্দু’আ করতেন। পেছনের লোকেরা ’আমীন’ ’আমীন’ বলতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯০, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৪৩ , মির‘আত ৪/৩০৭; ছিফাত ১৫৯ পৃঃ, আহমাদ ২৭৪৬, ইবনু খুযাইমাহ ৬১৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বা শক্তির বিরুদ্ধে এমনকি এক মাস যাবৎ একটানা বিভিন্নভাবে দো‘আ করেছেন।

হাদিসঃ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এক মাস পর্যন্ত (রুকূ’র পরে) ’দু’আ কুনূত’ পাঠ করেছেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা ত্যাগ করেছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৪৫, সুনান আননাসায়ী ১০৭৯, আহমাদ ১২৯৯০, ১৩৬০১, ১৩৬৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে হযরত ওমর (রাঃ) থেকে এ বিষয়ে একটি দো‘আ বর্ণিত হয়েছে। যা তিনি ফজরের ছালাতে পাঠ করতেন এবং যা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে দৈনিক পাঁচবার ছালাতে পাঠ করা যেতে পারে। যেমন-

“আল্লা-হুম্মাগফির লানা ওয়া লিল মু’মিনীনা ওয়াল মু‘মিনা-তি ওয়াল মুসলিমীনা ওয়াল মুসলিমা-তি, ওয়া আল্লিফ বায়না কুলূবিহিম, ওয়া আছলিহ যা-তা বায়নিহিম, ওয়ানছুরহুম ‘আলা ‘আদুউবিকা ওয়া ‘আদুউবিহিম। আল্লা-হুম্মাল‘আনিল কাফারাতাল্লাযীনা ইয়াছুদ্দূনা ‘আন সাবীলিকা ওয়া ইয়ুকাযযিবূনা রুসুলাকা ওয়া ইয়ুক্বা-তিলূনা আউলিয়া-আকা। আল্লা-হুম্মা খা-লিফ বায়না কালিমাতিহিম ওয়া ঝালঝিল আক্বদা-মাহুম ওয়া আনঝিল বিহিম বা’সাকাল্লাযী লা তারুদ্দুহূ ‘আনিল ক্বাউমিল মুজরিমীন।”

অনুবাদ: হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এবং সকল মুমিন-মুসলিম নর-নারীকে ক্ষমা করুন। আপনি তাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিন ও তাদের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসা করে দিন। আপনি তাদেরকে আপনার ও তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন। হে আল্লাহ! আপনি কাফেরদের উপরে লা‘নত করুন। যারা আপনার রাস্তা বন্ধ করে, আপনার প্রেরিত রাসূলগণকে অবিশ্বাস করে ও আপনার বন্ধুদের সাথে লড়াই করে। হে আল্লাহ! আপনি তাদের দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে দিন ও তাদের পদসমূহ টলিয়ে দিন এবং আপনি তাদের মধ্যে আপনার প্রতিশোধকে নামিয়ে দিন, যা পাপাচারী সম্প্রদায় থেকে আপনি ফিরিয়ে নেন না’। (বায়হাক্বী ২/২১০-১১। বায়হাক্বী অত্র হাদীছকে ‘ছহীহ মওছূল’ বলেছেন।)

অতঃপর প্রথমবার বিসমিল্লাহ... সহ  আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা ওয়া নাসতাগ ফিরুকা ওয়ানুমিনু বিকা -----এবং দ্বিতীয়বার বিসমিল্লাহ... সহ ইন্না না‘বুদুকা ...বর্ণিত আছে। (বায়হাক্বী ২/২১১ পৃঃ।)

উল্লেখ্য যে, উক্ত ‘কুনূতে নাযেলাহ’ থেকে মধ্যম অংশটুকু অর্থাৎ আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা ওয়া নাসতাগ ফিরুকা ওয়ানুমিনু বিকা------ নিয়ে সেটাকে ‘কুনূতে বিতর’ হিসাবে চালু করা হয়েছে, যা নিতান্তই ভুল। এই দো‘আটি ওমর (রাঃ) ফজরের ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ হিসাবে পড়তেন। এটাকে তিনি বিতরের কুনূতে পড়েছেন বলে আমি জানতে পারিনি। (ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৮, ২/১৭২ পৃঃ।)

বাংলাদেশের ৯৫% মুসলমান বিতরের কুনূতে যে দু‘আ পাঠ করে থাকে, সেটা মূলতঃ কুনূতে নাযেলাহর মধ্যম অংশ। বাংলাদেশের প্রচলিত সকল নামাজ শিক্ষা বইগুলোতে এই দোয়াটির কথাই লেখা আছে।

কুনূতে নাযেলাহর মধ্যম অংশ, যা আমাদের সমাজে প্রচলিত

“আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা ওয়া নাসতাগ ফিরুকা ওয়ানুমিনু বিকা ওয়ানাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনী আলাইকাল খাইর। ওয়া নাসকুরুকা আলা নাক ফুরুকা ওয়ানাখলাউ উয়ানাত রুকু মাইয়্যাফযুরুকা।  আল্লাহুম্মা ইয়্যাকানা বুদু ওয়ালাকা নুছালি্ল ওয়া নাস জুদু ওয়া ইলাইকা নাসয়া ওয়া নাহফিদু ওয়া নারজু রাহমাতাকা ওয়া নাখশা আজাবাকা ইন্না আজাবাকা বিলকুফফারি মূলহিক।”

অনুবাদ: হে আল্লাহ! আমরা তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি, তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তোমার ভরসা করিতেছি । তোমার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছি, তোমার উপর ঈমান আনিতেছি, তোমার ভরসা করিতেছি তোমার গুণগান করিতেছি এবং তোমারই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি । আমরা তোমাকে অস্বীকার করি না । যাহারা তোমার হুকুম অমান্য করে তাহাদের সঙ্গে আমরা সংশ্রব সংসগ্র পরিত্যাগ করি । হে আল্লাহ! আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই খেদমতে হাজির হই এবং তোমার রহমতের আশা করি ও তোমার শাস্তিকে ভয় করি । নিশ্চই তোমার আজাব অবিশ্বাসীগণ ভোগ করিবে।

এই দোয়াটি এখন থেকে বিতর ছালাতে কেউ পড়বেন না। শুধু মাত্র  বিপদাপদ ও বিশেষ কোনো জরূরী কারণে ফরয ছালাতের শেষ রাকআতে পড়বেন। বিতর ছালাতে নয়।

কুনুতে রাতেবাহ

(এইটা সঠিক)

রাসূল (ছাঃ) বিতর ছালাতে পড়ার জন্য হাসান (রাঃ)-কে যে দু‘আ শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা মুছল্লীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব বিতরের কুনূত হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষা দেওয়া দু‘আ পাঠ করতে হবে।

“আল্লাহুম্মাহদিনী ফীমান হাদাইতা ওয়া’আ-ফিনী ফীমান ’আ-ফাইতা ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লাইতা ওয়া বা-রিক লী ফীমা আ’তাইতা ওয়াক্বিনী শাররা মা ক্বাদাইতা, ইন্নাকা তাক্বদী ওয়ালা ইউকদা ’আলাইকা ওয়া ইন্নাহু লা ইয়াযিল্লু মান ওয়ালাইতা ওয়ালা ইয়াইয্যু মান ’আ-দাইতা তাবা-রাকতা রববানা ওয়া তা’আলাইতা।’’

জামাআতে ইমাম ছাহেব ক্রিয়াপদের শেষে একবচন...‘নী’-এর স্থলে বহুবচন.... ‘না’ বলতে পারেন।

অর্থঃ হে আল্লাহ্! যাদের প্রতি তুমি উদারতা প্রদর্শন করেছো, তাদের সাথে আমাকেও উদারতা প্রদর্শন করো, যাদের তুমি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছো, তাদের সাথে আমারও অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো, যাদের তুমি হিদায়াত দান করেছো তাদের সাথে আমাকেও হিদায়াত দান করো। তোমার নির্ধারিত অকল্যাণ থেকে আমাকে রক্ষা করো। তুমি আমাকে যা দান করেছো তাতে বরকত দাও। কেবল তুমিই নির্দেশ দিতে পারো, তোমার উপর কারো নির্দেশ চলে না। তুমি যার পৃষ্ঠপোষকতা দাও, সে কখনও অপমানিত হয় না। হে আমাদের রব! তুমি পবিত্র, কল্যাণময় ও সুউচ্চ।

আবুল হাওরা সা‘দী (রাঃ) বলেন, হাসান ইবনু আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে কতিপয় বাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। সেগুলো আমি বিতর ছালাতে বলি। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭৮, নুনান আবূ দাঊদ ১৪২৫, সুনান আতআত্ তিরমিযী ৪৬৪, সুনান আননাসায়ী ১৭৪৫, আহমাদ ১৭১৮, দারিমী ১৬৩৪, ইবনু খুযায়মাহ্ ১০৯৫, ইরওয়া ৪২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লেখ্য যে, বিতরের কুনূত জামা‘আতের সাথে পড়লে শব্দগুলো বহুবচন করে পড়া যাবে। (আহমাদ, ইরওয়া হা/৪২৯; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩২৬৬)।

জ্ঞাতব্য: অনেকে কুনূতে বিতর ও কুনূতে নাযেলা একাকার করে ফেলেছেন। (তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭২-১৭৩; নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৩-২৪৪)।

অথচ কুনূতে নাযেলা ফরয ছালাতের জন্য। দুঃখজনক হল- মাযহাবী বিদ্বেষের কারণে এর প্রচলন করা হয়েছে।

ফজর ছালাতে নিয়মিত কুনূত পড়া সঠিক নয়

অনেক মসজিদে ফজর ছালাতে নিয়মিত কুনূত পড়া হয়। দু‘আ হিসাবে ‘কুনূতে নাযেলা’ না পড়ে বিতরের কুনূত পড়া হয়। এটা আরো দুঃখজনক। কুনূতে নাযেলা প্রত্যেক ফরয ছালাতে পড়া যায়। সে অনুযায়ী ফজর ছালাতেও পড়বে।

হাদিসঃ

আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে এক মাস পর্যন্ত প্রতিদিন যুহর, ’আসর, মাগরিব, ’ইশা ও ফাজ্রের (ফজরের) সালাতের শেষ রাক্’আতে ’সামি’আল্ল-হু লিমান হামিদাহ’ বলার পর দু’আ কুনূত পড়তেন। এতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বানী সুলায়ম-এর কয়েকটি গোত্র, রি’ল, যাকওয়ান, ’উসাইয়্যাহ্ এর জীবিতদের জন্যে বদ্দু’আ করতেন। পেছনের লোকেরা ’আমীন’ ’আমীন’ বলতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯০, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৪৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

কিন্তু নির্দিষ্ট করে নিয়মিত শুধু ফজর ছালাতে পড়া যাবে না। কারণ এর পক্ষে যতগুলো হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সবই যঈফ। যেমন,

(ক) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু পর্যন্ত ফজরের ছালাতে কুনূত পড়েছেন। (আব্দুর রাযযাক ৩/১১০; দারাকুৎনী ২/৩৯; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ২/২০১; আহমাদ হা/১২৬৭৯, ৩/১৬২)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে আবু জা‘ফর রাযী নামে একজন মুযতারাব রাবী আছে। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম বর্ণনা করেছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫৭৪; তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৯)।

 (খ) উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের ছালাতে কুনূত পড়তে নিষেধ করেছেন। (দারাকুৎনী ২/৩৮; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ২/২১৪)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়ালী, আমবাসা ও আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে সকলেই যঈফ। উম্মে সালামা থেকে নাফের শ্রবণ সঠিক নয়। (দারাকুৎনী হা/১৭০৭-এর আলোচনা দ্রঃ)।

ইবনু মাঈন বলেন, সে হাদীছ জাল করত। ইবনু হিববান বলেন, সে জাল হাদীছ বর্ণনাকারী। যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। (তানক্বীহ, পৃঃ ৪৫১)।

অতি বাড়াবাড়ি করে উক্ত হাদীছ জাল করে নিষেধের দলীল তৈরি করা হয়েছে।

অতএব ফজর ছালাতে নিয়মিত কুনূত পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত পড়াটা ছাহাবীদের চোখেই বিদ‘আত বলে গণ্য হয়েছে। যেমন,

আবু মালেক আশজাঈ (রাঃ) বলেন, আমি আব্বাকে বললাম, আপনি তো রাসূল (ছাঃ), আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছেন। এমনকি কূফাতে আলী (রাঃ)-এর পিছনে পাঁচ বছর ছালাত আদায় করেছেন। তারা কি কুনূত পড়তেন? তিনি বললেন, হে বৎস! এটা বিদ‘আত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯২, সুনান আননাসায়ী ১০৮০, সুনান আতআত্ তিরমিযী ৪০২, সুনান ইবনু মাজাহ ১২৪১, ইরওয়া ৪৩৫, আহমাদ ১৫৮৭৯, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৬৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুনূত পড়ার পূর্বে তাকবীর দেওয়া ও হাত উত্তোলন করে হাত বাঁধা

এটা ভুল পদ্ধতি

বিতর ছালাতে ক্বিরাআত শেষ করে তাকবীর দিয়ে পুনরায় হাত বাঁধার যে নিয়ম সমাজে চালু আছে তা ভিত্তিহীন। অথচ মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান লিখেছেন, ‘তৃতীয় রাকআতে কেরাআত সমাপ্ত করে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে কান পর্যন্ত হাত তুলে আল্লাহ আকবার বলবে। এরপর হাত বেঁধে নিয়ে দোআ কুনূত পাঠ করবে। এটা ওয়াজিব’। (তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭১)।

অথচ উক্ত দাবীর পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই। এটা সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি।

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বিতর ছালাতে কুনূত পড়তেন। আর তিনি যখন ক্বিরাআত শেষ করতেন, তখন তাকবীর দিতেন এবং দুই হাত তুলতেন। অতঃপর কুনূত পড়তেন। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৭০২১-২৫; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৫০০১)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি ভিত্তিহীন। আলবানী (রহঃ) বলেন,

আছরামের সনদ সম্পর্কে আমি অবগত নই। এমনকি তার কিতাব সম্পর্কেও অবগত নই।... আমার একান্ত ধারণা, এই বর্ণনা সঠিক নয়। (ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৭, ২/১৬৯ পৃঃ)।

উল্লেখ্য যে, উক্ত ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারাই ড. ইলিয়াস ফায়সাল দলীল পেশ করেছেন। (নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৬২৪৭)।

আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার মধ্যে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়ার কথা নেই। এ মর্মে কোনো দলীলও নেই। অথচ এটাই সমাজে চলছে। বরং এটাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে।

কুনূত পড়ার পর মুখে হাত মাসাহ করা

এটা ছহীহ নয়

বিতর ছালাতে কুনূত পড়ার পর মুখে হাত মাসাহ করার কোন ছহীহ হাদীছ নেই। উক্ত মর্মে যে বর্ণনাগুলো এসেছে সেগুলো সবই যঈফ বা জাল হাদিস।

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, তোমরা দেওয়ালকে পর্দা দ্বারা আবৃত কর না। যে ব্যক্তি অনুমতি ব্যতীত তার ভাইয়ের চিঠির প্রতি লক্ষ্য করবে সে (জাহান্নামের) আগুনের দিকে লক্ষ্য করবে। তোমরা তোমাদের হাতের পেট দ্বারা আল্লাহর কাছে চাও, পিঠ দ্বারা চেও না। আর যখন দু‘আ শেষ করবে তখন তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল মাসাহ করবে’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২৪৩, ইরওয়াউল গালীল, ২/১৮০, হা/৪৩৪; সুনান আবূ দাঊদ ১৪৮৫, আদ্ দা‘ওয়াতুল কাবীর ৩০৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৩১৫১, য‘ঈফ আল জামি‘ ৩২৭৪। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আব্দুল মালেক ও ইবনু হিসান নামে দুইজন দুর্বল রাবী রয়েছে।

স্বয়ং ইমাম আবুদাঊদ উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ‘এই হাদীছ অন্য সূত্রেও মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর প্রত্যেক সূত্রই দুর্বল। এটিও সেগুলোর মত। তাই এটাও যঈফ’। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৮৫)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

উল্লেখ্য যে, উক্ত মর্মে আরো কয়েকটি বর্ণনা আছে সবই যঈফ। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৯২, সুনান ইবনু মাজাহ, পৃঃ ৮৩, হা/১১৯৩ ও ৩৯৩৫; তাবারাণী, হাকেম ১/৫৩৬; সুনান আততিরমিযী, ২/১৭৬ পৃঃ, হা/৩৩৮৬)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

ইমাম মালেক (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক, সুফিয়ান (রহঃ) থেকেও অনুরূপ বক্তব্য এসেছে।

ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) মুখে হাত মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই হাদীছ অন্য সূত্রেও মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটিই সীমাহীন দুর্বল। এই সূত্রও সেগুলোর মত। তাই এটাও যঈফ’। (সুনান আবু আবুদাঊদ হা/১৪৮৫, পৃঃ ২০৯)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে বিতরের দু‘আ শেষ করে মুখে দু’হাত মাসাহ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু শুনিনি। (ইরওয়াউল গালীল ২/১৭৯-৮২)।

ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) বলেন, ‘এটা এমন একটি আমল যা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়; আছার দ্বারাও সাব্যস্ত হয়নি এবং ক্বিয়াস দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং উত্তম হল, এটা না করা’। (আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/১৭৯-৮২, হা/৪৩৪-এর আলোচনা দ্রঃ)।

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

‘দু‘আয় রাসূল (ছাঃ) দুই হাত তুলেছেন মর্মে অনেক ছহীহ হাদীছ এসেছে। কিন্তু তিনি দুই হাত দ্বারা তার মুখ মাসাহ করেছেন মর্মে একটি বা দু’টি হাদীছ ছাড়া কোন বর্ণনা নেই। যার দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করা যায় না’। (মাজমূউ ফাতাওয়া ২২ খন্ড, পৃঃ ৫১৯)।

 শায়খ আলবানী (রহঃ) এ সংক্রান্ত হাদীছগুলো পর্যালোচনা শেষে বলেন, ‘দু‘আর পর মুখে দু’হাত মাসাহ করা সম্পর্কে কোনো ছহীহ হাদীছ নেই’।

সায়িব ইবনু ইয়াযীদ হতে বর্ণিত। তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত উঠিয়ে দু’আ করার সময় হাত দিয়ে মুখমন্ডলে মাসাহ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২৫৫, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৯২, আহমাদ ১৭৯৪৩, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৬৩১, আদ্ দা‘ওয়াতুল কাবীর ৩১০, য‘ঈফ আল জামি‘ ৪৩৯৯। কারণ এর সানাদে হাফস্ ইবনু হাশিম একজন মাজহূল রাবী। আর ইবনু লাহ্ই‘আহ্ একজন দুর্বল রাবী)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

বিতর সালাতের কিরাআত

(ক) আবদুল আযীয ইবনু জুরাইজ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আয়িশাহ (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের সালাতে কি (সূরা) পড়তেন? তিনি বলেন, তিনি প্রথম রাকাতে সূরাহ আলা, দ্বিতীয় রাকআতে সূরাহ কাফিরূন, তৃতীয় রাকআতে সূরাহ ইখলাস ও মুআব্বিযাতাইন (সূরাহ ফালাক ও নাস) পড়তেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭৩, সুনান আততিরমিযী ৪৬৩, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) উবাই ইবনু কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের সালাতে সূরাহ আলা, সূরাহ কাফিরূন ও সূরাহ ইখলাস পড়তেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৭১, ১১৭২, সুনান আননাসায়ী ১৭২৯-৩০, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দৃষ্টি আকর্ষণ

আমাদের দেশের অনেক মুছল্লী এশার ছালাতের পরই  নিয়মিত এক রাকাত ছালাত আদায় করে থাকেন, এটা সঠিক নয়। এশার ছালাতের পর বিতর আদায় করতে চাইলে অবশ্যই তাকে ছহিহ নিয়মে তিন রাকাত বিতর আদায় করতে হবে। এক রাকাত আদায় করতে হবে তাহাজ্জুদের ছালাতের পর। এক রাকাত বিতর পড়ার যেসব হাদিস এসেছে সেগুলোর বেশীর ভাগেই শেষ রাতে পড়তে বলা হয়েছে। একটি হাদিসে এশার ছালাতের পর এক রাকাত ছালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এশার ছালাতের পর এক রাকাত ছালাত তারাই পড়বেন যারা শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়েন না বা শেষ রাতে উঠতে পারবেন না। রাতের প্রথমভাগে এশার পর হাতে যদি সময় না থাকে তখন এক রাকাত পড়তে সমস্যা নেই তবে তিন রাকাত পড়াই উত্তম।

দলিল দেখুনঃ

(ক) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আর বিতর এক রাক্আত শেষ রাতে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৪২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ রাত্রের (নফল) সালাত দু’ রাক্আত দু’ রাক্আত করে (আদায় করতে হয়)। কারো ভোর হয়ে যাওয়ার আশংকাবোধ হলে সে যেন (দু’ রাক্আতের) সাথে সাথে আরো এক রাক্আত আদায় করে নেয়। তাহলে এ রাক্আত পূর্বে আদায় করা সালাতকে বেজোড় করে দেবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৫৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৩, ৪৭২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৩৪, ১৬৩৩, ১৬৩৫, ১৬৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৯)।

(গ) মুহাম্মদ ইবনু বাশশার (রহঃ)...ইবনু উমর (রাঃ) সুত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিতরের সালাত শেষ রাত্রে (আদায়কৃত সালাত সমুহের সাথে মিলিত) একটি রাকআত। (সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ১৬৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এশার ছালাতের পর এক রাকাত  বিতর

’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তাঁর নিকট প্রশ্ন করা হলো যে, আমীরুল মু’মিনীন মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে? তিনি বিতরের সালাত এক রাক্’আত আদায় করেন। (এ কথা শুনে) ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বললেন, তিনি একজন ’ফকীহ’, যা করেন ঠিক করেন।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ বলেন, মু’আবিয়াহ্ ’ইশার সালাতের পর বিতরের সালাত এক রাক্’আত আদায় করেছেন। তার কাছে ছিলেন ইবনু ’আব্বাস-এর আযাদ করা গোলাম। তিনি তা দেখে ইবনু ’আব্বাসকে ব্যাপারটি জানিয়ে দিলেন। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বললেন, তার সম্পর্কে কিছু বলো না। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যের মর্যাদা লাভ করেছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৭৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৭৬৪, ৩৭৬৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ছহিহ হাদিছঁ অনুযায়ী এক রাকাত ছালাত আদায় করা যাবে।

শেষ রাতে বিতর এর ছালাত আদায় করা অধিক উত্তম

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ শেষরাতে জাগতে পারবে না বলে আশংকা করলে সে যেন রাতের প্রথমভাগেই বিতর পড়ে নেয়, অতঃপর ঘুমায়। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রাতের শেষভাগে সালাত পড়ার আশা করে সে যেন শেষরাতে বিতর পড়ে। কেননা শেষ রাতের কিরাআত (শুনার জন্য ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়। তাই তা অধিক উত্তম। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৮৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫১, সুনানআততিরমিযী ৪৫৫, আহমাদ ১৪৩৩৫, ২৭৫২১, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬২৬, ইসলামীক সেন্টার ১৬৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন.এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

.................................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...