Search This Blog

Thursday, March 28, 2024

রাসুল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের ফজিলত ও গুরুত্ব

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

রাসুল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের  ফজিলত ও গুরুত্ব

 

দরুদ শব্দটি কুরআন-হাদিসে নেই। এটি ফারসি শব্দ। তবে কুরআন-হাদিসে এর প্রতিশব্দ ও পরিভাষা হলো ‘আস-সালাতু ওয়াস সালামু আলান্নাবিয়্যি।’ অর্থাৎ নবী (সা.)-এর প্রতি সালাত ও সালাম।

দুনিয়ার মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে যেসব নবী-রাসূলকে প্রেরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল।

মূল হাদিসঃ

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা এমন, এক ব্যক্তি যেন একটি গৃহ নির্মাণ করল; তাকে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করল, কিন্তু এক পাশে একটি ইটের জায়গা খালি রয়ে গেল। অতঃপর লোকজন এর চারপাশে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল ঐ শূন্যস্থানের ইটটি লাগানো হল না কেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই সে ইট। আর আমিই সর্বশেষ নবী। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৫৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৮৫৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৮৬, আহমাদ ৭৪৯০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু করুণা রূপেই প্রেরণ করেছি”।। (সুরা আম্বিয়া ২১/১০৭)।

রাসূল (ছাঃ)-এর তাঁর চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও দাওয়াতের ফলেই আমরা সত্যের দিশা পেয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনিই শাফা‘আত করবেন। এই মহামানবের প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাঁর জন্য দো‘আ করেন। আর তাঁর প্রতি দরূদ পাঠের জন্য সকল মুমিনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এপ্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন,

“নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তার ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোআ-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত পাঠ কর এবং তাকে যথাযথ ভাবে সালাম জানাও”। (সুরা আহযাব ৩৩/৫৬)।

এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা ও তাঁর উচ্চ মর্যাদার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। তাই রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত ও সালাম পাঠ করা একটি গুরুত্ব্পূর্ণ ইবাদত। আর প্রত্যেকটি ইবাদত সম্পাদন করতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে।

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) পাঠের অর্থ

‘ছালাত’ শব্দটি কুরআন ও হাদীছে ব্যবহৃত একটি পরিচিত শব্দ। পবিত্র কুরআন ও হাদীছে ছালাত শব্দটি দু’টি ইবাদতকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি হলো, ‘ছালাত’ যা নামায হিসাবে উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত। আর দ্বিতীয়টি হলো, নবী মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর প্রতি ‘দরূদ’ পাঠ করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর ক্ষেত্রে ছালাতের অর্থ ফেরেশতাদের সামনে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর প্রশংসা। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে ছালাতের অর্থ দো‘আ’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৯৭-এর অংশ, ৩৩৭০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৪৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত হলো আল্লাহর রহমত, তাঁর সন্তুষ্টি এবং ফেরেশতাদের সামনে তাঁর প্রশংসা। আর ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে ছালাত হলো- নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করা এবং তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর উম্মতদের পক্ষ থেকে ছালাতের অর্থ হলৈা- তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর ব্যাপারে সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/২৩২; আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, (কুয়েত: ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুঊনিল ইসলামিয়া, ২য় প্রকাশ ১৯৮৩), ২৭/২৩৪ পৃঃ)।

আহমদ বিন ফারিস (৩৯৫ হিঃ) বলেন, ছালাত শব্দের অর্থ দো‘আ বা প্রার্থনা। ...আর আল্লাহর পক্ষ থেকে ছালাত অর্থ- রহমত। হাদীছে এসেছে, আল্লাহ! আবূ আওফার বংশধরের প্রতি সালাম বর্ষণ করুন’।

মূল হাদিসঃ

‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকজন যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট নিজেদের সাদাকা নিয়ে উপস্থিত হতো তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহ! অমুকের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। একদা আমার পিতা সাদাকা নিয়ে হাযির হলে তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ! আবূ আওফা’র বংশধরের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৯৭, ৪১৬৬, ৬৩৩২, ৬৩৫৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৩৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৭৮, আহমাদ ১৯১৩৩) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৪০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৪০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অর্থাৎ রহমত বা করুণা করুন। (ইবনে ফারিস, মু‘জামু মাক্বায়িসিল লূগাহ, ৩/৩০০-৩০১ পৃঃ; গৃহীত: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহে বেলায়াত (৫ম প্রকাশ, ২০০৯) পৃঃ ১৪৯)।

রাসূল (ছাঃ)-এর উপর সালাম পাঠের অর্থ

‘সালাম’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- শান্তি, নিরাপত্তা, অভিবাদন ইত্যাদি। (ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী), পৃঃ ৪৭০)।

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি সালামের অর্থ হলো- রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করা। যেমন প্রত্যেক মুছল্লী ছালাতের ২য় ও শেষ বৈঠকে এই বলে নবী করীম (ছাঃ)-কে সালাম প্রদান করেন, ‘আপনার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল হোক হে নবী’!

মূল হাদিসঃ

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা সালাতের (বৈঠকে) আত্তাহিয়্যাতু.....বলতাম, তখন আমাদের একে অপরকে সালামও করতাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে ইরশাদ করলেনঃ তোমরা বলবে-

"আত্তাহিয়াতু লিল্লা-হি ওয়াস্ সলাওয়া-তু ওয়াত তাইয়িবা-তু আসসালা-মু ’আলাইকা আইয়ুহান নাবিইয়্যু ওয়া রহমাতুল্ল-হি ওয়াবারাকুহু আসসালা-মু ’আলাইনা- ওয়া’আলা- ইবা-দিল্লা-হিস্ স-লিহীন"

অর্থ”-‘যাবতীয় মৌখিক, দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত আল্লাহরই জন্য। হে (মহান) নবী! আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত (বর্ষিত)- হোক। সালাম আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর সালিহ্ বান্দাদের প্রতি; আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন প্রকৃত ইলাহ্ নেই। এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।’’

কেননা, তোমরা এরূপ করলে আসমান ও যমীনে আল্লাহর সকল নেক বান্দাকে তোমরা যেন সালাম করলে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২০২, ৮৩১, ৮৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৮৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০২, সুনান আততিরমিযী ২৮৯; সুনান আবূদাঊদ ৯৬৮; সুনান ইবনু মাজাহ ৮৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) ও সালাম এক সাথে পেশ করা উত্তম। যেমনটি আল্লাহ নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। (অতএব) হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর’। (সুরা আহযাব ৩৩/৫৬)।

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইবনু কাছীর (রহঃ) (৭০০-৭৭৮ হিঃ) বলেন, এই আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কদর, মান-সম্মান ও ইয্যত মানুষের নিকট প্রকাশ পেয়ে যায়। তারা যেন জানতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং রাসূলের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর ফেরেশতারা রাসূলের জন্য দো‘আ করে থাকেন। মালায়ে আ‘লার এই খবর দিয়ে জগতবাসীকে আল্লাহ তা‘আলা এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারাও যেন তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাতে থাকে। যাতে আল্লাহর দরবারের ফেরেশতামন্ডলী ও দুনিয়াবাসীর মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আহযাব ৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ)।

কোন কোন বিদ্বানের মতে, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি শুধু ছালাত (দরূদ) পাঠ করা যায়। আবার শুধু সালামও পেশ করা যায়। কেননা রাসূল (ছাঃ) প্রথমে ছাহাবীদেরকে শুধু সালাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ ছালাত (দরূদ) পাঠের নির্দেশ দেওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে দরূদ শিক্ষা দেন।

মূল হাদিসঃ

আবদুর রহমান ইবনু আবূ লায়লা (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ)-এর সাথে আমার দেখা হলে তিনি বললেন, হে ’আবদুর রহমান! আমি কি তোমাকে একটি কথা উপহার দিব যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে শুনেছি? উত্তরে আমি বললাম, হাঁ আমাকে তা উপহার দিন। তিনি বললেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার প্রতি আমরা ’সালাম’ কিভাবে পাঠ করবো তা আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা আপানার ও আপনার পরিবারে প্রতি ’সালাত’ কিভাবে পাঠ করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা বলো,

“আল্লা-হুম্মা সল্লি ’আলা- মুহাম্মাদিও ওয়া ’আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- সল্লায়তা ’আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ’আল- আ-লি ইবরা-হীমা ইননাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক ’আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া ’আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- বা-রাকতা ’আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ’আলা- আ-লি ইবরা-হীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ’’-

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, যেভাবে তুমি রহমত বর্ষণ করেছো ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! তুমি বারাকাত নাযিল কর মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি, যেভাবে তুমি বারাকাত নাযিল করেছো ইব্রাহীম ও ইব্রাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। তুমি বড় প্রশংসিত ও সম্মানিত)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯১৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৯৭; রিয়াযুছ ছালেহীন ১৪০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের কাছে তাশরীফ আনলেন। তখন তাঁর চেহারায় বড় হাসি-খুশী ভাব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার রব বলেছেন, আপনি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নন যে, আপনার উম্মাতের যে কেউ আপনার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আমি তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবো? আর আপনার উম্মাতের কোন ব্যক্তি আপনার ওপর একবার সালাম পাঠালে আমি তার উপর দশবার সালাম পাঠাবো? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৮, সুনান আননাসায়ী ১২৮৩, ছহীহুল জামে ৭১, দারিমী ২৮১৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

সুতরাং এক সাথে ছালাত ও সালম প্রদান করাই উত্তম। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি পাওয়া যায়। আর যার উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন আল্লাহ তাকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসেন।

আল্লাহ বলেন,

‘তিনি তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও রহমতের দো‘আ করে তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনার জন্য। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ঈমানদারগণের প্রতি অতীব দয়ালু’। (সুরা আহযাব ৩৩/৪৩)।

শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘যখন রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত ও সালাম একত্রিত হয় তখন চাহিদা পূরণ হয় এবং ভীতি দূর হয়। আর সালাম ভীতি দূর করে এবং অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে। আর ছালাত চাহিদা পূরণ করে এবং পরিপূর্ণতাকে নিশ্চিত করে’। (মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে‘ ৪/৩৪৭-৩৮৪ পৃঃ)।

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের হুকুম

বিদ্বানগণের মতে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) পাঠ কখনো ওয়াজিব আবার কখনো মুস্তাহাব। ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে তাশাহহুদের পর দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর ইমাম আবূ হানীফা ও মালেক (রহঃ)-এর মতে সুন্নাত। (আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-বাসসাম, তায়সীরুল আল্লাম শরহে উমদাতুল আহকাম, ১ম খন্ড (কুয়েত  জমঈয়াতু ইহয়াইত তুরাছ আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খৃঃ/১৪১৪ হিঃ), পৃঃ ২৬৮)।

হানাফী ও মালেকী মাযহাব মতে সূরা আহযাবের ৫৬নং আয়াতের আদেশ অনুযায়ী জীবনে একবার হলেও দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। (আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ২৭/২৩৪ পৃঃ)।

 ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেন, যখনই রাসূল (ছাঃ)-এর নাম আসবে তখনই তার প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। (আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ২৭/২৩৪ পৃঃ)।

আর মুস্তাহাব হলো, হাদীছে উল্লেখিত বিভিন্ন সময়ে। যেমন জুম‘আর দিনে, মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়, আযানের পরে, দো‘আর শুরুতে ইত্যাদি।

দরূদ পাঠের ফজিলত

নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা তাঁর উম্মতের প্রতি অবশ্য পালনীয় একটি ইবাদত। এই ইবাদত পালনের মাধ্যমে দরূদ পাঠকারী অনেক ছওয়াবের অধিকারী হয়ে থাকে, যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি ফযীলত উল্লেখ করা হলোঃ-

(১) আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত লাভঃ

দরূদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২১,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০৮, সুনান আবূ দাঊদ ১৫৩০, সুনান আননাসায়ী ১২৯৬, সুনান আততিরমিযী ৪৮৫, আহমাদ ৮৮৫৪, দারেমী ২৮১৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৫৬, রিয়াযুছ ছালেহীন ১৩৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের কাছে তাশরীফ আনলেন। তখন তাঁর চেহারায় বড় হাসি-খুশী ভাব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার রব বলেছেন, আপনি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নন যে, আপনার উম্মাতের যে কেউ আপনার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আমি তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবো? আর আপনার উম্মাতের কোন ব্যক্তি আপনার ওপর একবার সালাম পাঠালে আমি তার উপর দশবার সালাম পাঠাবো? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৮, সুনান আননাসায়ী ১২৮৩, ছহীহুল জামে ৭১, দারিমী ২৮১৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য রহমত। তিনি বান্দার সকল ভাল কাজকেই ১০গুণ করে বৃদ্ধি করেন। (সুরা আন‘আম ৬/১৬০)।

’আবদুর রহমান ইবনু ’আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে একটি খেজুর বাগানে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর দরবারে সাজদারত হলেন। সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ভীত হয়ে পড়লাম। আল্লাহ না করুক তাঁকে তো আবার আল্লাহ মৃত্যুমুখে পতিত করেননি? ’আবদুর রহমান বলেন, তাই আমি তাঁর কাছে এলাম, পরখ করে দেখার জন্য। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাথা উঠালেন এবং বললেন, কি হয়েছে? আমি তাঁকে আমার আশংকার কথা বললাম। ’আবদুর রহমান বলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন আমাকে বললেনঃ জিবরীল (আঃ) আমাকে বললেন, আমি কি আপনাকে এই সুসংবাদ দিবো না যা আল্লাহ তা’আলা আপনার ব্যাপারে বলেন? যে ব্যক্তি আপনার ওপর দরূদ পাঠ করবে আমি তার প্রতি রহমত বর্ষণ করব। যে ব্যক্তি আপনার প্রতি সালাম পাঠাবে আমি তার প্রতি শান্তি নাযিল করব।

(নবী করীম (ছাঃ) বলেন) ‘আর এজন্য আমি শুকরিয়ার সিজদা করি’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩৭, আহমাদ ১৬৬৫, ১৬৬৪, সহীহ আত তারগীব ১৬৫৮, হাকিম ২০১৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(২) ফেরেশতা কর্তৃক আল্লাহর কাছে রহমতের জন্য দো‘আঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠকারীর জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবুদ্ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা জুমু‘আর দিন আমার ওপর বেশী পরিমাণ করে দরূদ পড়ো। কেননা এ দিনটি হাজিরার দিন। এ দিনে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) হাজির হয়ে থাকেন। যে বক্তি আমার ওপর দরূদ পাঠ করে তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হতে থাকে, যে পর্যন্ত সে এর থেকে অবসর না হয়। আবুদ্ দারদা বলেন, আমি বললাম, মৃত্যুর পরও কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা নবীদের শরীর ভক্ষণ করা মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। অতএব নবীরা কবরে জীবিত এবং তাদেরকে রিযক্ব  দেয়া হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৩৬৬, ইরওয়াহ ১/৩৫, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১৬৩৭, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৭২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

তিনি আরো বলেন,

আমের ইবনু রবীআ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন কোন মুসলিম ব্যাক্তি আমার প্রতি দুরূদ পাঠ করে এবং যতক্ষণ সে আমার প্রতি দুরূদ পাঠরত থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য দুআ করতে থাকেন। অতএব বান্দা চাইলে তার পরিমাণ (দরূদ পাঠ) কমাতেও পারে বা বাড়াতেও পারে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৯০৭; ছহীহুল জামে‘ ৫৭৪৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৩) পাপ মোচন, ছওয়াব ও মর্যাদা লাভঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ গুনাহ মাফ, ছওয়াব ও মর্যাদা লাভের অন্যতম মাধ্যম।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করবেন। তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর আল্লাহর নৈকট্যের জন্য দশটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২২, সুনান আননাসায়ী ১২৯৭, হাকিম ১/৫৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) ক্বিয়ামতের দিন মর্যাদা লাভঃ

দুনিয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি যারা যত বেশী দরূদ পাঠ করবে ক্বিয়ামতের দিন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর তত বেশী নিকটবর্তী হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে আমার প্রতি বেশি পরিমাণে দরূদ পাঠ করেছে। (সুনান আততিরমিযী ৪৮৪, রিয়াযুছ ছালেহীন ১৩৯৮; ছহীহ আত-তারগীব ১৬৬৮)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

(৫) রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত লাভঃ

দরূদ পাঠের আরেকটি ফযীলত হলো ক্বিয়ামতের দিন রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত লাভ করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল অথবা আমার জন্য ‘অসীলার’ দো‘আ করল ক্বিয়ামতের দিন তার ব্যাপারে শাফা‘আত করা আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে’। (ইমাম ইসমাঈল বিন ইসহাক্ব আল-কাযী (১৯৯-২৮২ হিঃ) : ফাযলুছ ছালাত ‘আলান নাবী (ছাঃ), তাহক্বীক : আলবানী (বৈরূত : মাকতাবা ইসলামিয়া, ২য় প্রকাশ, ১৩৮৯ হিঃ ১৯৯৬ খৃঃ), পৃঃ ৫১, নং ৫০)।

তিনি আরো বলেন,

’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা মুয়াযযিনের আযান শুনলে উত্তরে সে শব্দগুলোরই পুনরাবৃত্তি করবে। আযান শেষে আমার ওপর দরূদ পাঠ করবে। কারণ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে (এর পরিবর্তে) আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। এরপর আমার জন্য আল্লাহর কাছে ’ওয়াসীলা’ প্রার্থনা করবে। ’ওয়াসীলা’ হলো জান্নাতের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু একজন পাবেন। আর আমার আশা এ বান্দা আমিই হব। তাই যে ব্যক্তি আমার জন্য ’ওয়াসীলা’র দু’আ করবে, কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন তার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে পড়বে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৬৫৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৮৪, সুনান আবূ দাঊদ ৫২৩, সুনান আননাসায়ী ৬৭৮, সুনান আততিরমিযী ৩৬১৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৬৯০, ইরওয়া ২৪২, সহীহ আল জামি‘ ৬১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৬) জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা লাভঃ

জান্নাতে উচ্চমর্যাদা লাভের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের কোন বিকল্প নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

ব্যক্তি যত বেশী আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তি (জান্নাতে) মর্যাদায় তত বেশী আমার নিকটবর্তী হবে’। (বায়হাক্বী; আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯; ছহীহ  তারগীব হা/১৬৭৩)।

(৭) ফেরেশতারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে দরূদ পৌঁছানঃ

দুনিয়াতে রাসূলের উপরে কেউ দরূদ পাঠ করলে বা সালাম পেশ করলে ফেরেশতারা তা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পৌঁছে দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আনাস (রাঃ)] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কিছু মালাক (ফেরেশতা) আছেন যারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান। তারা আমার উম্মাতের সালাম আমার কাছে পৌঁছান। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৪, সুনান আননাসায়ী ১২৮২, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ২৮৫৩, হাকিম ২/৪২১, দারিমী ২৮১৬, আহমাদ হা/৩৬৬৬, ৪২১০; ইবনে হিববান ৯১৪; ছহীহ  তারগীব ১৬৬৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,

তোমরা আমার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ কর। কেননা আল্লাহ আমার কবরের কাছে ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। যখন আমার উম্মতের কোন লোক আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে, তখন ফেরেশতা আমাকে জানায় যে, নিশ্চয়ই অমুকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি এই সময়ে দরূদ পাঠ করেছে’। (ছহীহুল  জামে‘ হা/১২০৭)।

অন্য হাদীছে এসেছে,

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর কবরের উপর একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে থাকেন এবং যখনই কেউ দরূদ পাঠ করে তখনই তাকে বলেন, হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! অমুকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করেছেন। (ছহীহ  আত-তারগীব ও তাহযীব ২/২৯৬; হা/১৬৬৭)।

উল্লেখ্য যে, এই দরূদ পাঠের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের কাছে যাওয়া শর্ত নয়; বরং বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সময় দরূদ পাঠ করলেই রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে তা পৌঁছানো হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমার কবরকে উৎসব কেন্দ্রে পরিণত করো না। তোমরা আমার প্রতি দরূদ পেশ কর। কারণ তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের পেশকৃত দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়’।

মূল হাদিসঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থান বানিও না, আর আমার কবরকেও উৎসবস্থলে পরিণত করো না। আমার প্রতি তোমরা দরূদ পাঠ করবে। তোমাদের দরূদ নিশ্চয়ই আমার কাছে পৌঁছে, তোমরা যেখানেই থাক না কেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৬, সুনান আবূ দাঊদ ২০৪২, সহীহ আল জামি‘ ৭২২৬)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুসলিম সমাজে বর্তমানে ধর্মের নামে আলেম-ওলামার কবরকে কেন্দ্র করে যে অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে সেগুলোর কোনটিই জায়েয নয়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন,

‘সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নবী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছিল। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি’।

মূল হাদিসঃ

 আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বাহ ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) [শব্দাবলী আবূ বকর এর] ... জুনদুব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তাকে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের মধ্যে থেকে আমার কোন খলীল বা একান্ত বন্ধু থাকার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে মুক্ত। কারণ মহান আল্লাহ ইবরাহীমকে যেমন খলীল বা একান্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সে রকমভাবে আমাকেও খলীল বা একান্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমি আমার উম্মাতের মধ্য থেকে কাউকে খলীল বা একান্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলে আবূ বকরকেই তা করতাম। সাবধান থেকো তোমাদের পূর্বের যুগের লোকেরা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবরসমূহকে মাসজিদ (সাজদার স্থান) হিসেবে গ্রহণ করত। সাবধান তোমরা কবরসমূহকে সাজদার স্থান বানাবে না। আমি এরূপ করতে তোমাদেরকে নিষেধ করে যাচ্ছি। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১০৭৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৩২, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১০৬৯, ইসলামীক সেন্টার ১০৭৭, ছহীহুল জামে‘ ২৪৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উবাইদুল্লাহ ইবনু ’আবদুল্লাহ ইবন ’উতবাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। আয়িশাহ ও ’আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযি.) বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মৃত্যু পীড়া শুরু হলে তিনি তাঁর একটা চাদরে নিজ মুখমণ্ডল আবৃত করতে লাগলেন। যখন শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো, তখন মুখ হতে চাদর সরিয়ে দিলেন। এমতাবস্থায় তিনি বললেনঃ ইয়াহুদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের (নবীদের) কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। (এ বলে) তারা যে (বিদ’আতী) কার্যকলাপ করত তা হতে তিনি সতর্ক করেছিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৩৫, ৪৩৬, ১৩৩০, ১৩৯০, ৩৪৫৩, ৩৪৫৪, ৪৪৪১, ৪৪৪৩, ৪৪৪৪, ৫৮১৫, ৫৮১৬; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১০৭৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৩১; আহমাদ ১৮৮৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৮) রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সালামের জবাব দানঃ

কেউ যদি সালাম পেশ করে তাহলে রাসূল (ছাঃ) সেই সালমের জবাব দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ আমার ওপর সালাম পাঠ করলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমার কাছে আমার রূহ ফেরত দেন যাতে আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৫, সুনান আবূ দাঊদ ২০৪১, সহীহ আল জামি‘ ৫৬৭৯, বায়হাক্বীর দা‘ওয়াতে কাবীর ১৭৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৯) দরূদ পাঠের মাধ্যমে চিন্তা দূর হয়ঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠের কারণে চিন্তা দূর হয় এবং পাপ মোচন হয়। উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে আরয করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনার উপর অনেক বেশী দরূদ পাঠ করি। আপনি আমাকে বলে দিন আমি (দু’আর জন্য যতটুকু সময় বরাদ্দ করে রেখেছি তার) কতটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পাঠাবার জন্য নির্দিষ্ট করব? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়। আমি আরয করলাম, যদি এক-তৃতীয়াংশ করি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়, যদি আরো বেশী কর তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর। আমি আরয করলাম, যদি অর্ধেক সময় নির্ধারণ করি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার মন যতটুকু চায় কর। যদি আরো বেশী নির্ধারণ কর তাহলে তোমর জন্যই ভালো। আমি বললাম, যদি দুই-তুতীয়াংশ করি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়। যদি আরো বেশি নির্ধারণ কর তোমার জন্যই কল্যাণকর। আমি আরয করলাম, তাহলে আমি আমার দু’আর সবটুকু সবসময়ই আপনার উপর দরূদ পড়ার কাজে নির্দিষ্ট করে দেব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে, তোমার দীন-দুনিয়ার মকসুদ পূর্ণ হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৯, তিরমিযী ২৪৫৭, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১০) দরূদ পাঠের দ্বারা অন্তর পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করলে অন্তর পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমার প্রতি দরূদ পাঠ কর। নিশ্চয়ই আমার উপর তোমাদের দরূদ তোমাদের (অন্তরের) পবিত্রতা। আর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট ‘ওয়াসীলা’ চাও’।  (সিলসিলা ছহীহা হা/৩২৬৮)।

(১১) দো‘আ কবুল হয়ঃ

হামদ ও ছানা তথা আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করার পরে দো‘আ করা হলে তা কবুল হয়।

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালাত আদায় করছিলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর কাছে ছিলেন আবূ বকর ও ’উমার (রাঃ)। সালাত শেষে আমি যখন বসলাম, আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করলাম, এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলাম। তারপর আমি আমার নিজের জন্য দু’আ করতে লাগলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, চাও, তোমাকে দেয়া হবে। চাও, তোমাকে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩১, সুনান আততিরমিযী ৫৯৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অপর দিকে দরূদ পাঠ না করে দো‘আ করলে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দো‘আ দরূদ পাঠ না করা পর্যন্ত আড়াল করে রাখা হয়’। (আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭২১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫২৩; ছহীহাহ হা/২০৩৫)।

(১২) বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হওয়া থেকে রক্ষাঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করলে আল্লাহ বান্দাকে দুনিয়া ও আখেরাতে বিপদ ও আশাহত হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে সমস্ত লোক কোন দরবারে বসেছে অথচ তারা আল্লাহ তা’আলার যিকর করেনি এবং তাদের নবীর প্রতি দরূদও পড়েনি, তারা বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হবে। আল্লাহ তা’আলা চাইলে তাদেরকে শাস্তিও দিতে পারেন কিংবা মাফও করতে পারেন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৩৮০, সহীহাহ ৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দরূদ পাঠ ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি

নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা যেমন ফজিলতপূর্ণ কাজ, তেমনি তা ছেড়ে দেওয়াও অনেক ক্ষতির কারণ। নিম্নে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে কয়েকটি ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করা হলো।

(১) আল্লাহ অপমানিত করবেনঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠে অলস ব্যক্তিকে ইসলাম তিরস্কার করেছে এবং তিনি অপমানিত হবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সেই ব্যক্তির নাসিকা ধূলায় ধূসরিত হোক (অপমানিত হোক), যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয়েছে অথচ সে আমার উপর দরূদ পড়েনি’।

মূল হাদিসঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট আমার নাম উচ্চারিত হয় কিন্তু সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার কাছে রমাযান মাস আসে আবার তার গুনাহ ক্ষমার আগে সে মাস চলে যায়। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট তার বৃদ্ধ মা-বাপ অথবা দু’জনের একজন বেঁচে থাকে অথচ তারা তাকে জান্নাতে পৌঁছায় না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৭, সুনান আততিরমিযী ৩৫৪৫, সহীহ আত্ তারগীব, হাকিম ১/৫৪৯, রিয়াযুছ ছালেহীন ১৪০০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্য হাদীছে এসেছে, একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে উঠে বললেন, আমীন। অনুরূপ তৃতীয় ধাপেও উঠে বললেন, আমীন। অতঃপর তিনি (এর রহস্য ব্যক্ত করে) বললেন, আমার নিকট জিবরীল উপস্থিত হয়ে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রামাযান পেল অথচ পাপমুক্ত হ’তে পারল না আল্লাহ তাকে তাঁর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেন। তখন আমি (প্রথম) আমীন বললাম। তিনি আবার বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে অথবা তাদের একজনকে জীবিতাবস্থায় পেল অথচ তাকে জাহান্নামে যেতে হবে, আল্লাহ তাকেও তাঁর রহমত থেকে দূর করুন। এতে আমি আমীন বললাম। অতঃপর তিনি বললেন, যার নিকট আপনার (নাম) উল্লেখ করা হয় অথচ সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করে না, আল্লাহ তাকেও দূর করুন। এতে আমি আমীন বললাম’। (ইবনে হিববান হা/৪০৯, ৯০৭; ছহীহ তারগীব হা/৯৮২)।

(২) কৃপণ গণ্য হবেঃ

দরূদ পাঠে অলস ব্যক্তি আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির পরিবর্তে আল্লাহর কাছে বখীল হিসাবে গণ্য হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

খলীফাহ্ আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রকৃত কৃপণ হলো সে ব্যক্তি, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হবার পর আমার ওপর দরূদ পাঠ করেনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩৩, সুনান আততিরমিযী ৩৫৪৬, ইরওয়া ৫, আহমাদ ১৭৩৬, হাকিম ১/৫৪৯, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৪০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না, সবচেয়ে বখীল কে? সকলে বলল, অবশ্যই হে আল্লাহ রাসূল! তিনি বললেন, যার নিকট আমার নাম উল্লেখ করা হ’ল, অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। সেই হ’ল সবচেয়ে বড় কৃপণ’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৮৪)।

সুতরাং দরূদ পাঠের মাধ্যমে সে কৃপণতা থেকে মুক্ত হতে পারে।

(৩) জান্নাতের পথ ভুলিয়ে দেয়া হবেঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ না করলে জান্নাতের পথ ভুলে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠাতে ভুলে গেলো সে জান্নাতের পথই ভুলে গেলো। (সুনান ইবনে মাজাহ ৯০৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৮২, সহীহাহ ২৩২৭)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(জিব্রীল (আঃ) এসে বললেন) আপনি আমীন বলুন (এই কথার উপর) যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হ’ল অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করল না, অতঃপর মারা গেল। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ তাকে তার রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন। জিব্রীল বললেন, আপনি আমীন বলুন! অতঃপর আমি আমীন (হে আল্লাহ! কবুল কর) বললাম’। (ছহীহ ইবনে হিববান হা/২৩৮৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৭৯)।

(৪) কিয়ামতের দিন দুঃখ-কষ্টে থাকার কারণঃ

নবী করীম (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করা না হ’লে পরকালে দুঃখ-কষ্টের মাঝে পতিত হ’তে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন কোন জাতি কোন বৈঠকে বসে আর সেখানে যদি তারা আল্লাহকে স্মরণ না করে ও নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ না করে তাহ’লে তাদের জন্য ক্বিয়াতের দিন সেটি আফসোসের কারণ হবে, যদিও তারা পুরস্কার হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করে’। (হাকেম ১/৫৫০; মুসনাদে আহমাদ হা/৯৯৬৬; ছহীহাহ)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠের সময়

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে কোন মুসলিম ব্যক্তি দিনে বা রাতে যে কোন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে পারে। এর ফলে সে প্রভূত কল্যাণ লাভ করবে ও অনেক অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকবে, যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। তবে ইসলামী শরী‘আত কিছু কিছু সময় বা স্থানে দরূদ পাঠ করাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থান নিম্নরূপঃ

(এক) ছালাতের মধ্যেঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠের অন্যতম সময় হ’ল ছালাতের মধ্যে। ছালাত অবস্থায় নিম্নোক্ত স্থানে দরূদ ও ছালাত পাঠ করতে হয়ঃ-

(১) তাশাহহুদের সময়ঃ

প্রত্যেক মুছল্লী তাশাহহুদের মধ্যে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি সালাম প্রদান করবে।

আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যখন সালাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাশাহহুদের বৈঠকে বসতাম তখন বলতাম, ’’বান্দাদের পূর্বে আল্লাহর প্রতি সালাম, তারপর অমুক ও অমুকের প্রতি সালাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা “আল্লাহর প্রতি সালাম বর্ষিত হোক’’ এরূপ বলো না। কেননা আল্লাহ নিজেই সালাম বা শান্তিদাতা। বরং তোমরা সালাতের তাশাহহুদের বৈঠকে বসে বলবে,

“আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সলাওয়াতু ওয়াত্-ত্বায়্যিবাতু। আসসালামু ’আলাইকা আইউহান্ নাবিয়্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আস্সালামু ’আলাইনা ওয়া ’আলা ’ইবাদিল্লাহিস সালিহীন’’

(অর্থঃ আমাদের সব সালাম ও অভিবাদন, সালাত ও দু’আ এবং পবিত্রতা মহান আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ বর্ষিত হোক। আমাদের ও আল্লাহর সকল নেক বান্দার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। কেননা তোমরা যখন এটা পাঠ করবে তখন তা আসমান ও যমীন অথবা আসমান ও যমীনের মাঝে আল্লাহর যত নেক বান্দা আছে সবার নিকটেই পৌছে যাবে। “আশহাদু আল্-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রসূলুহু’’- (অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নাই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রসূল)। এরপর তোমরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী দু’আ পাঠ করবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৯৬৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৮৩৫, ৮৩১, ১২০২;  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৮৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০২; সুনান আততিরমিযী ২৮৯; সুনান আননাসাঈ ১২৫২; সুনান ইবনে মাজাহ ৮৯৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ৭৮৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

(২) প্রত্যেক ছালাতের তাশাহহুদের পরেঃ

প্রত্যেক ছালাতের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর দরূদ পড়তে হয়। নবী করীম (ছাঃ) নিজের উপর তাশাহহুদ ও তাশাহহুদের পরে দরূদ পাঠ করতেন এবং উম্মতদেরকে পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন।

ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে তাশাহহুদের পর দরূদ পড়া ওয়াজিব। আর ইমাম আবু হানীফা ও মালেক (রহঃ)-এর মতে সুন্নাত। (আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান বিন ছালেহ আল-বাসসাম, তায়সীরুল আল্লাম শরহে উমদাতিল আহকাম (কুয়েত : জামইয়াতু ইহইয়াইত তুরাছ আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খৃঃ/১৪১৪ হিঃ) ১/২৬৮)।

ফুযালাহ্ ইবনু ’উবায়দ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। তখন একজন লোক এলেন। তিনি সালাত  আদায় করলেন এবং এই দু’আ পড়লেন, “আল্লা-হুম্মাগফিরলী ওয়ারহামনী’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও আমার ওপর রহম কর)। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! তুমি তো নিয়ম ভঙ্গ করে বড্ড তাড়াহুড়া করলে। তারপর তিনি বললেন, তুমি সালাত শেষ করে দু’আর জন্য বসবে। আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে। আমার ওপর দরূদ পড়। তারপর তুমি যা চাও আল্লাহর কাছে দু’আ করবে।

ফুযালাহ্ (রাঃ)বলেন, এরপর আর এক ব্যক্তি এলো, সালাত আদায় করলো। সে সালাত শেষে আল্লাহর প্রশংসা করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! আল্লাহর কাছে দু’আও কর। দু’আ কবূল করা হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩০, সুনান আততিরমিযী ৩৪৭৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৪৩, নাসায়ী ১/১৮৯, আহমাদ ৬/১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) বিতর ছালাতের দো‘আঃ

হাসান ইবনু ’আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দু’আ কুনূত পাঠ করার জন্য আমাকে কিছু ক্বালিমাহ্ শিক্ষা দিয়েছেন। সে ক্বালিমাগুলো হলো,

“আল্ল-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদায়তা ওয়া ’আ-ফিনী ফীমান ’আ-ফায়তা, ওয়াতা ওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লায়তা, ওয়াবা-রিক লী ফীমা- আ’ত্বায়তা, ওয়াক্বিনী শাররা মা- ক্বযায়তা, ফাইন্নাকা তাক্বযী ওয়ালা- ইউক্বযা- ’আলায়কা, ওয়া ইন্নাহূ লা- ইয়াযিল্লু মাওঁ ওয়ালায়তা, তাবা-রাকতা রব্বানা- ওয়াতা’আ-লায়তা।’’

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হিদায়াত দান করো সে সব মানুষের সঙ্গে যাদের তুমি হিদায়াত দান করেছ (নবী রসূলগণ)। তুমি আমাকে দুনিয়ার বিপদাপদ থেকে হিফাযাত করো ওসব লোকের সঙ্গে যাদেরকে তুমি হিফাযাত করেছ। যাদের তুমি অভিভাবক হয়েছো, তাদের মাঝে আমারও অভিভাবক হও। তুমি আমাকে যা দান করেছ (জীবন, জ্ঞান সম্পদ, ধন, নেক ’আমল), এতে বারাকাত দান করো। আর আমাকে তুমি রক্ষা করো ওসব অনিষ্ট হতে যা আমার তাকদীরে লিখা হয়ে গেছে। নিশ্চয় তুমি যা চাও তাই আদেশ করো। তোমাকে কেউ আদেশ করতে পারে না। তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে কেউ অপমানিত করতে পারে না। হে আমার রব! তুমি বারাকাতে পরিপূর্ণ। তুমি খুব উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন’’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৭৩, সুনান আবূ দাঊদ ১৪২৫, সুনান আতআত্ তিরমিযী ৪৬৪, সুনান আননাসায়ী ১৭৪৫, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১১৭৮, আহমাদ ১৭১৮, দারিমী ১৬৩৪, ইবনু খুযায়মাহ্ ১০৯৫, ইরওয়া ৪২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) জানাযার ছালাতেঃ

জানাযার ছালাতের দ্বিতীয় তাকবীরের পরে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করবে। যেমন হাদীছে এসেছে,

জনৈক ছাহাবী বলেন, ‘জানাযা ছালাতের সুন্নাতী পদ্ধতি হ’ল, ইমাম তাকবীর দিবে অতঃপর মনে মনে প্রথম তাকবীরের পরে সূরা ফাতেহা পাঠ করবে। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর ছালাত (দরূদ) পাঠ করবে। (ইমাম শাফেঈ কিতাবুল উম্ম ১/২৩৯-২৪০; বায়হাকী ৪/৩৯; গৃহীত : আহকামুল জানায়েয, পৃঃ ১৫৫, ইবনুল জারূদ ২৬৫)।

(দুই) খুৎবা বা বক্তৃতায়ঃ

জুম‘আর খুৎবাসহ অন্যান্য খুৎবায় আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রশংসার সাথে সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে হবে। জুম‘আর খুৎবা প্রসঙ্গে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, খুৎবায় হাম্দ, দরূদ ও নছীহত থাকা ওয়াজিব। (ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃঃ ১৯৬)।

(তিন) আযানের পরেঃ

আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা মুয়াযযিনের আযান শুনলে উত্তরে সে শব্দগুলোরই পুনরাবৃত্তি করবে। আযান শেষে আমার ওপর দরূদ পাঠ করবে। কারণ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে (এর পরিবর্তে) আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। এরপর আমার জন্য আল্লাহর কাছে ’ওয়াসীলা’ প্রার্থনা করবে। ’ওয়াসীলা’ হলো জান্নাতের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু একজন পাবেন। আর আমার আশা এ বান্দা আমিই হব। তাই যে ব্যক্তি আমার জন্য ’ওয়াসীলা’র দু’আ করবে, কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন তার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে পড়বে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৬৫৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৮৪, সুনান আবূ দাঊদ ৫২৩, সুনান আননাসায়ী ৬৭৮, সুনান আততিরমিযী ৩৬১৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৬৯০, ইরওয়া ২৪২, সহীহ আল জামি‘ ৬১৩, রিয়াযুছ ছালেহীন ১০৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চার) দো‘আর সময়ঃ

রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা দো‘আ কবুলের পূর্বশর্ত।

 

ফুযালাহ্ ইবনু ’উবায়দ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। তখন একজন লোক এলেন। তিনি সালাত  আদায় করলেন এবং এই দু’আ পড়লেন, ’’আল্লা-হুম্মাগফিরলী ওয়ারহামনী’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও আমার ওপর রহম কর)। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! তুমি তো নিয়ম ভঙ্গ করে বড্ড তাড়াহুড়া করলে। তারপর তিনি বললেন, তুমি সালাত শেষ করে দু’আর জন্য বসবে। আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে। আমার ওপর দরূদ পড়। তারপর তুমি যা চাও আল্লাহর কাছে দু’আ করবে।

ফুযালাহ্ (রাঃ)বলেন, এরপর আর এক ব্যক্তি এলো, সালাত আদায় করলো। সে সালাত শেষে আল্লাহর প্রশংসা করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! আল্লাহর কাছে দু’আও কর। দু’আ কবূল করা হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩০, সুনান আততিরমিযী ৩৪৭৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৪৩, সুনান আননাসায়ী ১/১৮৯, সুনান আবূদাঊদ ১৪৮১; আহমাদ ৬/১৮, রিয়াযুছ ছালেহীন ১৪০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত অন্য হাদীছে এসেছে,

‘নবী (ছাঃ) ও তার পরিবারবর্গের প্রতি দরূদ পেশ করা না হলে সমস্ত দো‘আ কবুল হওয়া থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে’। (তাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত হা/৭২১; আলবানী: ছহীহুল জামে‘ হা/৪৫২৩; সিলসিলা ছহীহা হা/২০৩৫; ছহীহ তারগীব হা/১৬৭৫)।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, দুআ আকাশ যমিনের মধ্যবর্তী স্থানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, তোমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যতক্ষণ তুমি দুরূদ পাঠ না কর ততক্ষণ তার কিছুই উপরে উঠে না। (সুনান আততিরমিযী ৪৮৬; সিলসিলা সহীহা ২০৫৩)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(পাঁচ) মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ঃ

ফাতিমা আল-কুবরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদে ঢুকতেন তখন মুহাম্মাদের (স্বয়ং নিজের) প্রতি দুরুদ ও সালাম পাঠ করতেন এবং বলতেনঃ “রব্বিগফির লী যুনুবী ওয়াফতাহ লী আবওয়াবা রহমতিকা।”

“হে আমার প্রভু! আপনি আমার পাপগুলি ক্ষমা করুন এবং আমার জন্য আপনার অনুগ্রহের দরজাগুলি খুলে দিন”।

যখন তিনি মাসজিদ হতে বের হতেন তখনও মুহাম্মাদের (নিজের) প্রতি দুরুদ ও সালাম পাঠ করতেন এবং বলতেনঃ

“রব্বিগফির লী যুনুবী ওয়াফতাহ লী আবওয়াবা ফাদলিকা।”

(হে আল্লাহ্! আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমার জন্য আপনার অনুগ্রহের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দিন)। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩১৪, সুনান ইবনু মাজাহ ৭৭১, আহমাদ ২৫৮৭৭-৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবু হুমাইদ কিংবা আবু উসাইদ সাঈদী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে তখন সে যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাম পাঠায়। অতঃপর বলে:

"আল্ল-হুম্মাফ তাহলী আবওয়া-বা রহমতিক"

যার অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাগুলো খুলে দিন। আর যখন সে মসজিদ থেকে বের হয় তখন সে যেন বলে:

“আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিকা”

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট সমূহ কল্যাণ কামনা করি”। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৪৬৫, সুনান ইবনু মাজাহ ৭৭২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৫৩৭-১৫৩৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭১৩, দারিমী ২৬৯, ১৩৯৪, ২৬৯১, আহমাদ (৩/১৯৭), ইবনুস-সুন্নী ৮৮, নাসায়ী ৭২৯, আহমাদ ১৫৬২৭, ২৩০৯৬, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৫২২, ইসলামীক সেন্টার ১৫২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছয়) রাসূল (ছাঃ)-এর নাম উচ্চারিত হলেঃ

কথা বলা ও লেখার সময় যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নাম আসবে তখনই দরূদ পাঠ করতে হবে। সাথে সাথে যারা রাসূল (ছাঃ)-এর নাম শুনবেন তারাও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০৮, সুনান আবূ দাঊদ ১৫৩০, সুনান আননাসায়ী ১২৯৬, সুনান আততিরমিযী ৪৮৫, আহমাদ ৮৮৫৪, দারেমী ২৮১৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করবেন। তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর আল্লাহর নৈকট্যের জন্য দশটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২২, সুনান আননাসায়ী ১২৯৭, হাকিম ১/৫৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

খলীফাহ্ ’আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রকৃত কৃপণ হলো সে ব্যক্তি, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হবার পর আমার ওপর দরূদ পাঠ করেনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৩৩, সুনান আততিরমিযী ৩৫৪৬, ইরওয়া ৫, আহমাদ ১৭৩৬, হাকিম ১/৫৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট আমার নাম উচ্চারিত হয় কিন্তু সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার কাছে রমাযান মাস আসে আবার তার গুনাহ ক্ষমার আগে সে মাস চলে যায়। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট তার বৃদ্ধ মা-বাপ অথবা দু’জনের একজন বেঁচে থাকে অথচ তারা তাকে জান্নাতে পৌঁছায় না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৭, সুনান আততিরমিযী ৩৫৪৫, সহীহ আত্ তারগীব, হাকিম ১/৫৪৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(সাত) জুম‘আর দিনেঃ

জুমআর রাতে (বৃহ্স্পতিবার দিবাগত রাতে) ও (জুমআর) দিনে প্রিয়তম হাবীব মহানবী (সাঃ)-এর শানে অধিকাধিক দরুদ পাঠ করা কর্তব্য।

(ক) আওস ইবনু আওস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সর্বোত্তম দিনগুলোর মধ্যে জুমু‘আহর দিনটি উৎকৃষ্ট। কাজেই এ দিনে তোমরা আমার প্রতি বেশী পরিমাণে দরূদ পাঠ করবে। কেননা তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। বর্ণনাকারী বলেন, তারা বললো, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের দরূদ আপনার কাছে কিভাবে উপস্থিত করা হবে অথচ আপনি তো মাটির সাথে মিশে যাবেন? বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা বললো, আপনি তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ নবীদের দেহকে মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫৩১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) তিনি আরো বলেন, “জুমআর রাতে ও দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরুদ পাঠ কর। আর যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০ বার রহ্মত বর্ষণ করবেন।” (বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪০৭নং)।

(গ) আবুদ্ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা জুমু‘আর দিন আমার ওপর বেশী পরিমাণ করে দরূদ পড়ো। কেননা এ দিনটি হাজিরার দিন। এ দিনে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) হাজির হয়ে থাকেন। যে বক্তি আমার ওপর দরূদ পাঠ করে তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হতে থাকে, যে পর্যন্ত সে এর থেকে অবসর না হয়। আবুদ্ দারদা বলেন, আমি বললাম, মৃত্যুর পরও কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা নবীদের শরীর ভক্ষণ করা মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। অতএব নবীরা কবরে জীবিত এবং তাদেরকে রিযক্ব  দেয়া হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৩৬৬, ইরওয়াহ ১/৩৫, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১৬৩৭, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৭২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

 (আট) ছাফা ও মারওয়ায়ঃ

হজ্জ ও ওমরাহ সম্পাদন কালে ছাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ করার সময় ছাফা ও মারওয়ার উপরে উঠে দরূদ পাঠ করার প্রমাণ রয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,

‘যখন তোমরা (মক্কায়) আগমন করবে তখন সাতবার কা‘বাঘর তাওয়াফ করবে। অতঃপর মাকামে ইবরাহীমের নিকট দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। অতঃপর ছাফার নিকটে আসবে এবং এমন জায়গায় দাঁড়াবে যেখান থেকে কাবাঘর দেখা যায়। অতঃপর সাতটি তাকবীর দিবে। তাকবীরের মাঝে মাঝে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করবে এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবে এবং নিজের জন্য যা ইচ্ছা চাইবে। তারপর মারওয়ায়ও এরূপ করবে। (ফাযলুছ ছালাত আলান নাবী (ছাঃ), পৃঃ ৭৩, হা/৮১)।

(নয়)  যে কোন মজলিসেঃ

যে কোন ইসলামী মজলিসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ জরুরী। ‘প্রত্যেক মজলিসে আল্লাহ্কে স্মরণ করা ও নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব’।

আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে সমস্ত লোক কোন দরবারে বসেছে অথচ তারা আল্লাহ তা’আলার যিকর করেনি এবং তাদের নবীর প্রতি দরূদও পড়েনি, তারা বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হবে। আল্লাহ তা’আলা চাইলে তাদেরকে শাস্তিও দিতে পারেন কিংবা মাফও করতে পারেন। (সুনান আততিরমিযী ৩৩৮০; ছহীহা ৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দশ) রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের সামনেঃ

আবদুল্লাহ ইবনে দীনার (রহঃ) বলেন,

‘আমি আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর উপর দরূদ পাঠ করতে দেখেছি। তারপর আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর কবরেও এরূপ করেছেন’। (ফাযলুছ ছালাত আলান নাবী (ছাঃ), হা/৯৮)।

অন্য বর্ণনায় আছে,

আমি ইবনে ওমরকে দেখেছি যখন তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন তখন তিনি মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। আবু বকরের প্রতি সালাম, আমার পিতার প্রতি সালাম। অতঃপর তিনি দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’। (ফাযলুছ ছালাত আলান নাবী (ছাঃ), হা/৯৯)।

দরুদ বনাম মিলাদ কিয়াম

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তার ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোআ-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত পাঠ কর এবং তাকে যথাযথ ভাবে সালাম জানাও”। (সুরা আহযাব ৩৩/৫৬)।

রাসুল সাঃ এর উপর কিভাবে দরুদ ও সালাম পেশ করতে হয় তা আমরা উপরোল্লিখিত আলোচনায় জানতে পেরেছি। দরুদ ও সালাম পেশ করার ভাষা বা শব্দাবলী কি সেটাও আমরা শিখেছি। এর বাহিরে দরুদ ও সালাম পেশ করার অন্য কোনো শব্দাবলী তৈরী করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে এক শ্রেণির আলেম দরুদ ও সালাম পেশ করার রাসুল সাঃ এর তরিকার বাহিরে মিলাদ ও কিয়াম বানিয়েছে যা সম্পূর্ণ বিদআত। এইসব মিলাদ কিয়াম গানের সুরে, নেচে নেচে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে গাওয়া হয়। মিলাদ কিয়ামের পক্ষে যেসব দলিল পেশ করা হয় তা কুরআন হাদিস সমর্থিত নয়।

বর্তমান সমাজে দেখা যায়, মারেফতপন্থী লোকেরা সহীহ হাদিসে উল্লেখিত দরুদগুলো বাদ দিয়ে তারা নিজেরা মনগড়া মতো দরুদ বানিয়ে নিয়েছে। যেমন: দরুদে মাহি, দরুদে তাজ, দরুদে হক্বানী, দরুদে তুনাজ্জিনা, দরুদে ফুতুহাত, দরুদে রুইয়াতে নবী (সাঃ), দরুদে শিফা, দরুদে খইর, দরুদে আকবার, দরুদে লাখী, দরুদে হাজারী, দরুদে রুহী, দরুদে বীর, দরুদে নারীয়া, দরুদে শাফেয়ী, দরুদে গাওসিয়া, দরুদে মুহাম্মদীএরকম শত শত। আধুনিক যুগের কথিত পির-আউলিয়াগণও তাদের মতো করে দরুদ বানিয়ে নিয়েছে। তাদের রচিত পুস্তকগুলোতে সহীহ হাদিসে উল্লেখিত দরুদগুলো দেখা যায় না। সেইসব পুস্তকে তাদের মুরিদদেরকে সলাতে দরুদে ইব্রাহিম এর পরিবর্তে  বানানো দরুদ দিয়ে সলাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া আছে।

আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) পড়তে বলেছেন দরুদ, সেখানে তারা আবিষ্কার করলো মিলাদ ও কিয়াম। এগুলো সবই বিদআত। আমরা রাসুল (সাঃ) এর উম্মত হিসেবে কুরআন ও সহীহ হাদিসের বাহিরে যাবো না। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

এখানে সহিহ হাদিস ভিত্তিক দুইটি দরুদ উল্লেখ করা হলোঃ-

(১ নং দরুদ):

আবদুর রহমান ইবনু আবূ লায়লা (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কা‘ব ইবনু ‘উজরাহ্ (রাঃ)-এর সাথে আমার দেখা হলে তিনি বললেন, হে ‘আবদুর রহমান! আমি কি তোমাকে একটি কথা উপহার দিব যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে শুনেছি? উত্তরে আমি বললাম, হাঁ আমাকে তা উপহার দিন। তিনি বললেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার প্রতি আমরা ‘সালাম’ কিভাবে পাঠ করবো তা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা আপানার ও আপনার পরিবারে প্রতি ‘সালাত’ কিভাবে পাঠ করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা বলো,

‘‘আল্লা-হুম্মা সল্লি ‘আলা- মুহাম্মাদিও ওয়া ‘আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- সল্লায়তা ‘আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ‘আল- আ-লি ইবরা-হীমা ইননাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক ‘আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া ‘আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- বা-রাকতা ‘আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ‘আলা- আ-লি ইবরা-হীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ’’-

(অর্থঃ- হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, যেভাবে তুমি রহমত বর্ষণ করেছো ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! তুমি বারাকাত নাযিল কর মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি, যেভাবে তুমি বারাকাত নাযিল করেছো ইব্রাহীম ও ইব্রাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। তুমি বড় প্রশংসিত ও সম্মানিত)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৯১৯ সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৩৭০, ৪৭৯৭, ৬৩৫৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৯৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২ নং দরুদ):

আবূ হুমায়দ আস্ সা‘ইদী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা আপনার প্রতি কিভাবে দরূদ পাঠ করব? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা বল,

‘‘আল্লা-হুম্মা সল্লি ‘আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আয্ওয়া-জিহী ওয়া যুররিইয়্যাতিহী কামা- সল্লায়তা ‘আলা- আ-লি ইব্র-হীমা ওয়াবা-রিক ‘আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আয্ওয়া-জিহী ওয়া যুররিইয়্যাতিহী কামা- বা-রকতা ‘আলা- আ-লি ইব্র-হীমা ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদ’’।

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ এবং তাঁর পত্নীগণ ও বংশধরগণের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করো, যেভাবে তুমি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিজনের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছো এবং মুহাম্মাদ এবং তাঁর পত্নীগণ ও বংশধরগণের প্রতি তোমার কল্যাণ নাযিল করো, যেভাবে তুমি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবার-পরিজনের প্রতি কল্যাণ নাযিল করেছো। অবশ্যই তুমি খুব প্রশংসিত এবং খুব সম্মানিত।)।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত),৯২০,সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৩৬০, ৩৩৬৯,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৯৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪০৭, সুনান আবূ দাঊদ ৯৭৯, সুনান আননাসায়ী ১২৯৪, সুনান ইবনু মাজাহ্ ৯০৫, আহমাদ ২৩৬০০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৯১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৮০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো দরুদ আছে। এখানে যে দুইটি দরুদ উল্লেখ করা হয়েছে তা আমরা সালাতে তাশাহুদ বৈঠকে এবং অন্যান্য সময় ও স্থানে পাঠ করতে পারবো। মিলাদ ও কিয়ামে অংশ না নিয়ে এইসব দরুদ সালাতের ভিতর ও বাহিরে পাঠ করবেন। 

সংক্ষিপ্ত কয়েকটি দরুদ

(১) “আল্লা-হুম্মা সাল্লি ওয়াসাল্লিম ‘আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ

অর্থঃ “হে আল্লাহ! আপনি সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর।

(রাসুল সাঃ এলন, যে কেউ সকাল বেলা আমার উপর দশবার দরুদ পাঠ করবে এবং বিকাল বেলা দশবার দরুদ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ দ্বারা সৌভাগ্যবান হবে। (তাবরানী হাদীসটি দুই সনদে সংকলন করেন, যার একটি উত্তম। (দেখুন, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১২০; সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৭৩)।

(২) আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে মুসলিম ব্যক্তির দান-খয়রাত করার সামর্থ্য নাই, সে যেন তার দোয়ায় বলে,

“আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া রাসূলিকা ওয়া সাল্লি আলাল-মুমিনীনা ওয়াল-মুমিনাত ওয়াল-মুসলিমীনা ওয়াল মুসলিমাত

অর্থঃ (হে আল্লাহ! তোমার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদকে দয়া করো এবং মুমিন নারী-পুরুষ ও মুসলিম নারী-পুরুষ সকলকে দয়া করো)। এটাই তার জন্য যাকাতস্বরূপ। (আল-আদাবুল মুফরাদ ৬৪৪, হাকিম, ইবনে হিব্বান)।

(৩) সাঈদ ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল উমাবী (রহ.)....যায়দ ইবনু খারিজাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, তোমরা আমার ওপর দরূদ পাঠ কর এবং বেশি বেশি দুআ কর আর তোমরা বল

“আল্ল-হুম্মা সল্লি আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া ‘আলা আ-লি মুহাম্মাদিন

অর্থঃ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও তার বংশধরের ওপর রহমত বর্ষণ কর)। (সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ১২৯২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২৯৩, নাসায়ীর “আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লাতা ৩৫, মুসনাদে আহমাদ ১৭১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(৪) কুতায়বাহ্ (রহ.)...আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার ওপর সালাম পাঠানোর নিয়ম তো আমরা জানি, কিন্তু আপনার ওপর। দরূদ কিভাবে পাঠ করব? তিনি (সা.) বলেন, তোমরা বলবে-

“আল্ল-হুম্মা সল্লি আলা মুহাম্মাদিন ’আবদিকা ওয়া রসূলিকা কামা- সল্লায়তা ’আলা- ইবর-হীমা ওয়াবা-রিক ’আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- বা-রকতা ’আলা- ইবর-হীম।"

অর্থঃ (হে আল্লাহ! তুমি তোমার দাস ও তোমার রসূল মুহাম্মাদ (সা.) -এর ওপর রহমত বর্ষণ কর। যেমন তুমি ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর ওপর রহমত বর্ষণ করেছিলে। আর তুমি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরের ওপর বরকত বর্ষণ কর, যেমন তুমি ইবরাহীম (আঃ)-এর ওপর বরকত বর্ষণ করেছিলে)। (সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত)১২৯৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২৯৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৯৮, ৬৩৫৮, সুনান ইবনু মাজাহ ৯০৩, আহমাদ ১১০৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দরুদ পাঠে যেহেতু অনেক ফজিলত রয়েছে তাই ছোট্ট এই দরুদগুলো জিকিরের মতো নিষিদ্ধ সময় ব্যতীত সব সময় পাঠ করতে থাকবো। দরুদগুলো সালাতের বাহিরে ফরজ সালাতের পরে ১০ বার করে পাঠ করতে পারেন, এ ছাড়া সকাল বিকেল ও রাতে ঘুমানোর আগে পাঠ করবেন।

সাত অবস্থায় নবী সাঃ এঁর উপর দরুদ ও সালাম পড়া মাকরুহ বা অপছন্দনীয়

(ক)  স্ত্রী সহবাসকালে।

(খ) পেশাব পায়খানার সময়।

(গ)  ব্যবসার মাল চালু করার সময়।

(ঘ) হোছট খাওয়ার সময়।

(ঙ) আশ্চর্যজনক সংবাদ শ্রবণের সময়।

(চ) যবেহ করার সময়।

(ছ) হাঁচি দেওয়ার সময়। (ফতোয়ায়ে শামী,১/৩৮৩ পৃষ্ঠা)।

এক দল ফিরিস্তা, যাঁরা দোয়া পাঠ বা জিকিরকারীদের খুঁজে বেড়ান

আল্লাহ বলেন,

“তুমি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখ, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে থাকে এবং তুমি তাদের নিকট হতে স্বীয় দৃষ্টি ফিরায়ো না। (সূরা কাহাফ ২৮ আয়াত)।

রাসুল (সাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর কিছু ফেরেশতা আছেন, যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে-ফিরে আহলে যিকির খুঁজতে থাকেন। অতঃপর যখন কোন সম্প্রদায়কে আল্লাহর যিকিররত অবস্থায় পেয়ে যান, তখন তাঁরা একে অপরকে আহ্বান করে বলতে থাকেন, ‘এস তোমাদের প্রয়োজনের দিকে। সুতরাং তাঁরা (সেখানে উপস্থিত হয়ে) তাদেরকে নিজেদের ডানা দ্বারা নিচের আসমান পর্যন্ত বেষ্টিত করে ফেলেন। অতঃপর তাঁদেরকে তাঁদের প্রতিপালক জানা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার বান্দারা কি বলছে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছে, আপনার মহত্ত্ব বর্ণনা করছে, আপনার প্রশংসা ও গৌরব বয়ান করছে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি আমাকে দেখেছে?’

ফেরেশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! তারা আপনাকে দেখেনি। আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা আমাকে দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘যদি তারা আপনাকে দেখত, তাহলে আরও বেশী বেশী ইবাদত, গৌরব বর্ণনা ও তসবীহ করত। আল্লাহ বলেন, ‘ কি চায় তারা?’ ফিরিশতারা বলেন, ‘তারা আপনার কাছে জান্নাত  চায়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি জান্নাত দেখেছে?’ ফিরিশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা তা দেখেনি। আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা তা দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা তা দেখলে তার জন্য আরও বেশী আগ্রহান্বিত হত। আরও বেশী বেশী তা প্রার্থনা করত। তাদের চাহিদা আরও বড় হত। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি থেকে পানাহ চায়?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা জাহান্নাম থেকে পানাহ চায়।

আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি জাহান্নাম দেখেছে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা তা দেখেনি। আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা তা দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা তা দেখলে বেশী বেশী করে তা হতে পলায়ন করত। বেশী বেশী ভয় করত। তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি তাদেরকে মাফ করে দিলাম। ফেরেশতাদের মধ্য থেকে একজন বলেন, ‘কিন্তু ওদের মধ্যে অমুক ওদের দলভুক্ত নয়। সে আসলে নিজের কোন প্রয়োজনে সেখানে এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘(আমি তাকেও মাফ করে দিলাম! কারণ,) তারা হল এমন সম্প্রদায়, যাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত (হতভাগা) থাকে না।

মুসলিমের আবূ হুরাইরা কর্তৃক এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অবশ্যই আল্লাহর অতিরিক্তি কিছু ভ্রাম্যমান ফেরেশতা আছেন, যারা জিকিরের মজলিস খুঁজতে থাকেন। অতঃপর যখন কোন এমন মজলিস পেয়ে যান, যাতে আল্লাহর যিকির হয়, তখন তাঁরা সেখানে বসে যান। তাঁরা পরস্পরকে ডানা দিয়ে ঢেকে নেন। পরিশেষে তাঁদের ও নিচের আসমানের মধ্যবর্তী জায়গা পরিপূর্ণ করে দেন। অতঃপর লোকেরা মজলিস ত্যাগ করলে তাঁরা আসমানে উঠেন। তখন আল্লাহ আয্যা অজাল্ল অধিক জানা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এলে?’ তাঁরা বলেন, ‘আমরা পৃথিবী থেকে আপনার এমন কতকগুলি বান্দার নিকট থেকে এলাম, যারা আপনার তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ পড়ে এবং আপনার নিকট প্রার্থনা করে। তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কি প্রার্থনা করে?’ তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আপনার জান্নাত প্রার্থনা করে। তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে?’

তাঁরা বলেন, ‘না, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে?’ তাঁরা বলেন, ‘আপনার জাহান্নাম থেকে, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে?’ তাঁরা বলেন, ‘না। তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জাহান্নাম দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘আর তারা আপনার নিকট ক্ষমা চায়। তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম, তারা যা প্রার্থনা করে তা দান করলাম এবং যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তা থেকে আশ্রয় দিলাম। তাঁরা বলেন, ‘হে প্রতিপালক! ওদের মধ্যে অমুক পাপী বান্দা এমনি পার হতে গিয়ে তাদের সাথে বসে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি তাকেও ক্ষমা করে দিলাম! কারণ তারা সেই সম্প্রদায়, তাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত হয় না।(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৭৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৮৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ৩৬০০, আহমাদ ৭৩৭৬, ৮৪৮৯, ৮৭৪৯, রিয়াযুস সালেহীন-১/১৪৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দরুদ-সালাম বিষয়ক কিছু প্রচলিত বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য কথা

(১) জুমুআর দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দরুদের ফযীলতঃ

জুমুআর দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে সহীহ হাদীসে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ দিনে নির্ধারিত সংখ্যক দরুদ পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ দিনে বা রাতে ৪০ বার, ৫০ বার, ১০০ বার, ১০০০ বার বা অনুরূপ কোনো সংখ্যায় দরুদ পাঠ করলে ৪০, ৫০ ১০০ বছরের গোনাহ মাফ হবে, বা বিশেষ পুরস্কার বা ফযীলত অর্জন হবে অর্থে কোনো সহীহ হাদীস নেই। মুমিন যথাসাধ্য বেশি বেশি দরুদ ও সালাম এ দিনে পাঠ করবেন। নিজের সুবিধা ও সাধ্যমত ‘ওযীফা তৈরি করতে পারেন। যেমন আমি প্রতি শুক্রবারে অথবা প্রতিদিন ১০০, ৩০০ বা ৫০০ বার দরুদ ও সালাম পাঠ করব।

(২) দরুদে মাহি বা মাছের দরুদঃ

দরুদে মাহি ‘মাছের দরুদ-এর কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনাবলি সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। অনুরূপভাবে এ দরুদের ফযীলতে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। এ বানোয়াট কাহিনীটিতে বলা হয়েছে, যে, রাসূলুল্লাহর () যুগে একব্যক্তি নদীর তীরে বসে দরুদ পাঠ করতেন। ঐ নদীর একটি রুগ্ন মাছ শুনে শুনে দরুদটি শিখে ফেলে এবং পড়তে থাকে। ফলে মাছটি সুস্থ হয়ে যায়। পরে এক ইহূদীর জালে মাছটি আটকা পড়ে। ইহূদীর স্ত্রী মাছটিকে কাটতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে মাছটিকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। মাছটি ফুটন্ত তেলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দরুদটি পাঠ করতে থাকে। এতে ঐ ইহূদী আশ্চার্যান্বিত হয়ে মাছটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর () দরবারে উপস্থিত হয়। তাঁর দোয়ায় মাছটি বাকশক্তি লাভ করে এবং সকল বিষয় বর্ণনা করে। .... পুরো ঘটনাটিই ভিত্তিহীন মিথ্যা।

(৩) দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, তুনাজ্জিনা, ফুতুহাত, শিফা ইত্যাদিঃ

দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, দরুদে তুনাজ্জিনা, দরুদে ফুতুহাত, দরুদে রুইয়াতে নবী (), দরুদে শিফা, দরুদে খাইর, দরুদে আকবার, দরুদে লাখী, দরুদে হাজারী, দরুদে রূহী, দরুদে বীর, দরুদে নারীয়া, দরুদে শাফেয়ী, দরুদে গাওসিয়া, দরুদে মুহাম্মাদী .....।

এ সকল দরুদ সবই পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো। এগুলোর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।

এ সকল দরুদের বাক্যগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাল কথার সমন্বয়। তবে এভাবে রাসূলুল্লাহ থেকে বিশেষ ভাবে পড়ার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। এ সকল দরুদের বাক্যগুলো বিন্যাস পরবর্তী মানুষদের তৈরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ ফযীলত লাভ হতে পারে। তবে এগুলোর বিশেষ ফযীলতে বর্ণিত কথাগুলো বানোয়াট।

যেমন, (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি) হাদীস সম্মত একটি দরুদ। আবার (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন বি ‘আদাদি কুল্লি দায়িওঁ ওয়া বি ‘আদাদি কুল্লি ইল্লাতিওঁ ওয়া শিফা) কথাটির মধ্যে কোনো দোষ নেই। এ বাক্যের মাধ্যমে দরুদ পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ সাওয়াব পাওয়ার আশা করা যায়। তবে এগুলোর জন্য কোনো বিশেষ ফযীলতের কথা রাসুলুল্লাহ () থেকে প্রমাণিত নয়। সকল বানানো দরুদেরই একই অবস্থা। কোনো কোনো বানানো দরুদের মধ্যে আপত্তিকর কথা রয়েছে।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

 

লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন

(MSHRC)

------------------------------

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...