Tuesday, October 8, 2019

পবিত্রতা, সালাত ও আনুসঙ্গিক বিষয়ে জাল-জইফ হাদিসসমূহঃ



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পবিত্রতা, সালাত ও আনুসঙ্গিক বিষয়ে জাল-জইফ হাদিসসমূহঃ
(যেগুলো বর্তমান যুগের শিক্ষিত আলেমগণ ওয়াজ-নসিহতে বলে বেড়ায়)
(ইহা বিদআতীদের সংশোধনীমূলক শিক্ষণীয় একটি অধ্যায়)

এই অধ্যায়ে সংশোধনীমূলক শিক্ষনীয় বিষয়সমূহঃ (বিস্তারিত নীচে)

১. ‘কুলুখ’ ব্যবহার না করলে গোর আযাব হওয়াঃ
২. বেলালের ফযীলতে কুলুখের উল্লেখঃ
৩. খোলা স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করাঃ
৫. শবে বরাত বা শবে কদরের গোসলঃ
৬. ওযু, গোসল ইত্যাদির নিয়্যাতঃ
৭. ওযুর আগের দোয়াঃ                                                                             
৮. ওযুর ভিতরের দোয়াঃ
৯. ওযুর সময়ে কথা না বলাঃ
১০. ওযুর পরে সূরা ‘কাদ্র’ পাঠ করাঃ
১১. মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তাঃ
১২. মসজিদে বাতি জ্বালানো ও ঝাড়ু দেয়াঃ
১৩. আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি চোখে বুলানোঃ
১৪. আযানের জাওয়াবে ‘সাদাকতা ও বারিরতা’ঃ
১৫. আযানের দোয়ার মধ্যে ‘ওয়াদ দারাজাতার রাফীয়াহ’ঃ
১৬. আযানের দুআয়: ‘‘ওয়ারযুকনা শাফাআতাহু’’ঃ
১৭. আযানের সময় কথা বলার ভয়াবহ পরিণতি!ঃ
১৮. সালাতের ৫ প্রকার ফযীলত ও ১৫ প্রকার শাস্তিঃ 
১৯. সালাত মুমিনদের মি’রাজঃ
২০. ৮০ হুক্বা বা ১ হুকবা শাস্তিঃ 
২১. জামাআতে সালাত আদায়ে নবীগণের সাথে হজ্জঃ
২২. মুত্তাকী আলিমের পিছনে সালাত নবীর পিছনে সালাতঃ
২৩. আলিমের পিছনে সালাত ৪৪৪০ গুণ সাওয়াবঃ
২৪. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাক‘আত সংখ্যার কারণঃ
২৫. উমরী কাযাঃ
২৬. কাফ্ফারা ও এস্কাতঃ
২৭. বিভিন্ন সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াত নির্ধারণ করাঃ
২৮. তারাবীহের সালাতের দোয়া ও মুনাজাতঃ
২৯. সালাতুল আওয়াবীনঃ
৩০. সালাতুল হাজাতঃ
৩১. সালাতুল ইসতিখারাঃ
৩২. হালকী নফলঃ
৩৩. আরো কিছু বানোয়াট ‘নামায’ঃ
৩৪. সপ্তাহের ৭ দিনের সালাতঃ

বিস্তারিত আলোচনা


১. ‘কুলুখ’ ব্যবহার না করলে গোর আযাব হওয়াঃ
প্রচলিত একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘‘হাদীসে আছে, যাহারা বাহ্য-প্রস্রাবের পর কুলুখ ব্যবহার না করিবে তাহাদের ন্যায় কঠিন গোর আযাব কাহারও হইবে না’’[1]
কথাটি এভাবে ঠিক নয়। এভাবে একে হাদীস বললে, রাসূলুল্লাহ () -এর নামে মিথ্যা বলা হবে। সম্ভবত এখানে একটি সহীহ হাদীসের অনুবাদ বিকৃত ভাবে করা হয়েছে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্র না হওয়া কবর আযাবের অন্যতম কারণ। একটি হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুললাহ () বলেছেন:
أَكْثَرُ عَذَابِ اَلْقَبْرِ مِنْ اَلْبَوْلِ
‘‘কবরের অধিকাংশ শাস্তি পেশাব থেকে।’’[2]
উপরের কথাটি সম্ভবত এ হাদীসের বিকৃত অনুবাদ। এ হাদীস এবং এ অর্থের অন্য সকল হাদীসে পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্র হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কোনো হাদীসেই বলা হয় নি যে, ‘কুলুখ’ ব্যবহার না করলে কোনো অন্যায় হবে বা শাস্তি হবে।
মলমূত্র ত্যাগের পর পরিপূর্ণরূপে পবিত্র হওয়া ইসলামের অন্যতম বিধান। রাসূলুল্লাহ  ও সাহাবীগণ ইস্তিন্জার সময় কখনো শুধু পাথর বা ঢিলা ব্যবহার করতেন। শুধু পাথর বা কুলুখ ব্যবহার করে পবিত্রতা অর্জন করলে মূল ওয়াজিব আদায় হবে এবং কোনোরূপ অপরাধ বা গোনাহ হবে না। তবে পানি ব্যবহার করা সর্বাবস্থায় উত্তম। বিভিন্ন হাদীসে পানি দ্বারা ইসতিনজা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ  সাধারণভাবে পানি দ্বারা ইসতিনজা করতেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।[3]
কুলুখ ও পানি উভয়ের ব্যবহার, অর্থাৎ প্রথমে পাথর বা কুলুখ ব্যবহারের পরে পানি ব্যবহারের কথা দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। ফকীহগণ এভাবে কুলুখ ও পানি উভয়ের ব্যবহার উত্তম বলে উল্লেখ করেছেন।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। মলমুত্র পরিত্যাগের পরে পবিত্র হওয়ার দুটি পর্যায় রয়েছে: (ক) পবিত্রতা। অর্থাৎ মলমুত্র ত্যাগের পরে বসা অবস্থাতেই পানি বা পাথর দ্বারা ময়লা স্থানকে পরিষ্কার করা। একে আরবীতে ইসতিনজা বা ইসতিজমার বলা হয়। (খ) সতর্কতা। এর অর্থ ইসতিনজার পরেও উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটতে গেলে দু এক ফোটা পেশাব বেরিয়ে আসতে পারে বলে ভয় পেলে গলা খাঁকারি দিয়ে বা কয়েক পা হাঁটাচলা করে সন্দেহ থেকে মুক্ত হওয়া। আরবীতে একে ‘ইসতিবরা’ বলা হয়।
হাদীস শরীফে প্রথম পর্যায়ে ইসতিনজার জন্য পানি বা পাথর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে পেশাবের পরে বসা অবস্থাতেই তিনবার পুরুষাঙ্গ টান দেয়ার কথা বলা হয়েছে।[4] এ ছাড়া আর কোনো বিষয় হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। রাসূলুল্লাহ  বা তাঁর সাহাবীগণ ইসতিনজার সময় পাথর বা ‘কুলুখ’ ব্যবহার করতে গিয়ে কখনো উঠে দাঁড়ান নি, হাঁটাচলা, লাফালাফি, গলাখাকারি ইত্যাদি কিছুই করেন নি। পেশাব ও পায়খানা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বাভাবিকভাবে বসা অবস্থাতেই পাথর বা পানি ব্যবহার করে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেছেন।
পরবর্তী যুগের আলিমগণ সন্দেহের ক্ষেত্রে সতর্কতার জন্য এরূপ হাঁটা চলার বিধান দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মানুষের তবিয়ত বিভিন্ন প্রকারের। যদি কারো একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে উঠে দাঁড়িয়ে বা দুই এক পা হেঁটে, গলাখাকারি দিয়ে বা এধরনের কোনো কাজের মাধ্যমে তারা ‘পেশাব একদম শেষ হয়েছে’ -এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। আর যার মনে হবে যে, বসা অবস্থাতেই সে পরিপূর্ণ পাক হয়ে গিয়েছে তার জন্য সুন্নাতের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।[5]
কাজেই কুলুখ করা বলতে যদি আমরা ‘কুলুখ নিয়ে হাঁটাচলা করা’ বুঝি, অথবা দাবি করি যে, রাসূলুল্লাহ () এরূপ হাঁটাচলা করেছেন বা করতে বলেছেন তাহলে তাঁর নামে মিথ্যা দাবি করা হবে।
[1] মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো'মেনীন, পৃ. ৮৪।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১২৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৯৩; আল-বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজা ১/৫১।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান (কিতাবুত তাহারাহ, বাবুল ইসতিনজা বিল মা) ১/৩০ (নং ১৯)।
[4] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১৮; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/৩৪৭।
[5] আব্দুল হাই লাখনবী, মাজমূআতুল ফাতাওয়া, উর্দু ১/১৫৫।
২. বেলালের ফযীলতে কুলুখের উল্লেখঃ
প্রচলিত একটি বইয়ে রয়েছে: ‘‘হযরত () একদিন বিলাল (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলেন, ওহে বিলাল! আমি মিরাজের রাত্রিতে বেহেস্তের মধ্যে তোমার পায়ের চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছি। বলত এরূপ পুণ্যের কোন্ কাজ তোমার দ্বারা সম্পাদিত হইতেছে? তদুত্তোরে বিলাল (রা) বলিলেন, আমি বাহ্য-প্রসাবের পর কুলূখ ব্যবহার করি, পবিত্রতার দিকে লক্ষ রাখি ও সদা সর্বদা অজুর সহিত থাকি। হুজুর  বলিলেন ইহাই তো সকল নেক কাজের মূল।’’[1]
বিভিন্ন হাদীসে বেলালের এ মর্যাদা প্রসঙ্গে তিনটি বিষয় বর্ণিত: ওযু করলেই দু রাক‘আত সালাত আদায় করা, আযান দিলেই দু রাক‘আত সালাত আদায় করা এবং ওযু ভাঙ্গলেই ওযু করা। প্রথম বিষয়টি বুখারী ও মুসলিম সংকলিত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিষয়টি ইবনু খুযাইমা, হাকিম প্রমুখ মুহাদ্দিস কর্তৃক সংকলিত।[2] কুলুখের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। লক্ষণীয় যে, সাহাবীগণ মল-মূত্র পরিত্যাগের পরে কুলুখ ব্যবহার করতেন। এজন্য বিভিন্ন হাদীসে পানি ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৮৪-৮৫।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৮৬, ৬/২৭৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯১০; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ২/২১৩; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৫৭, ৩/৩২২।
৩. খোলা স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করাঃ
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছে: ‘‘হাদীসে আছে যারা খোলা জায়গায় বসিয়া বাহ্য-প্রসাব করিবে, ফেরেস্তাগণ তাহাদিগকে বদদোয়া করিতে থাকিবেন’’।[1]
কথাটি এভাবে সঠিক নয়। খোলা বলতে মাথার উপরে খোলা বা চারিপাশে খোলা কোনো স্থানে মলমুত্র পরিত্যাগ করলে এরূপ বদদোয়ার কথা কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে বলে যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জানতে পারি নি। মলমুত্র ত্যাগের সময় সতর অন্য মানুষের দৃষ্টি থেকে আবৃত রাখা জরুরী। অন্য মানুষকে সতর দেখিয়ে মলমুত্র ত্যাগ করতে, মলমুত্র ত্যাগের সময় কথা বলতে হাদীস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মানুষের রাস্তায়, মানুষের পানির ঘাটে বা পুকুরে এবং মানুষের ব্যবহারের ছায়ায় মলত্যাগকে হাদীস শরীফে অভিশাপের বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[2]
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৮৭।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২২৬; আবূ দাঊদ, আস-সুনান ১/৭।
৪. ফরয গোসলে দেরি করাঃ
গোসল ফরয হলে তা দেরি করলে পাপ হবে বা সে অবস্থায় মাটির উপর হাঁটলে মাটি অভিশাপ দিবে ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। গোসল ফরয হলে তা যথাসম্ভব দ্রুত সেরে নেয়া উত্তম। তবে গোসলের মূল প্রয়োজন সালাত আদায় বা কুরআন পাঠের জন্য। এছাড়া মুমিন গোসল ফরয থাকা অবস্থায় সকল কর্ম, যিক্র ও দোয়া করতে পারেন। কাজেই নামাযের ক্ষতি না হলে গোসল দেরি করলে গোনাহ হয় না। রাসূলুল্লাহ () অনেক সময় প্রথম রাত্রিতে গোসল ফরয হলেও গোসল না করে শুয়ে পড়তেন এবং শেষ রাত্রিতে গোসল করতেন বলে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[1]
[1] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৯২।
৫. শবে বরাত বা শবে কদরের গোসলঃ
এ দু রাতে গোসল করার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তা সবই বানোয়াট। এ দু রাত্রিতে গোসলের ফযীলতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। পরর্বতীতে এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলো উল্লেখ করার আশা রাখি।
৬. ওযু, গোসল ইত্যাদির নিয়্যাতঃ
নিয়্যাত নামে ‘নাওয়াইতু আন...’ বলে যা কিছু প্রচলিত আছে সবই পরবর্তী যুগের আলিমদের বানানো কথা। এগুলোকে হাদীস মনে করলে বা রাসূলুল্লাহ () এরূপ নিয়্যাত পাঠ করেছেন বা এভাবে নিয়্যত করতে বলেছেন বলে মনে করলে বা দাবি করলে তা ভিত্তিহীন মিথ্যা দাবি হবে।
নিয়্যাত অর্থ উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা (inteneion)। উদ্দেশ্যের উপরেই ইবাদতের সাওয়াব নির্ভর করে। নিয়্যাত মানুষের অন্তরের আভ্যন্তরীণ সংকল্প বা ইচ্ছা, যা মানুষকে উক্ত কর্মে উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করেছে। নিয়্যাত করতে হয়, বলতে বা পড়তে হয় না। রাসূলুল্লাহ  কখনো জীবনে একটিবারের জন্যও ওযু, গোসল, নামায, রোযা ইত্যাদি কোনো ইবাদতের জন্য কোনো প্রকার নিয়্যাত মুখে বলেন নি। তাঁর সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-সহ চার ইমাম বা অন্য কোনো ইমাম ও ফকীহ কখনো কোনো ইবাদতের নিয়্যাত মুখে বলেন নি বা বলতে কাউকে নির্দেশ দেন নি।
পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম এগুলো বানিয়েছেন। তাঁরাও বলেছেন যে, মনের মধ্যে উপস্থিত নিয়্যাতই মূল, তবে এগুলো মুখে উচ্চারণ করলে মনের নিয়্যাত একটু দৃঢ় হয়। এজন্য এগুলো বলা ভালো। তাঁদের এ ভালোকে অনেকেই স্বীকার করেন নি। মুজাদ্দিদে আলফে সানী ওযু, নামায, রোযা ইত্যাদি যে কোনো ইবাদতের জন্য মুখে নিয়্যাত করাকে খারাপ বিদ‘আত হিসাবে নিন্দা করেছেন এবং কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছেন। আমি ‘‘এহ্ইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]
[1] এহ্ইয়াউস সুনান: সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন ও বিদআতের বিসর্জন, পৃ. ১৩৮-১৫৭।
৭. ওযুর আগের দোয়াঃ
ওযূর পূর্বে পাঠের জন্য প্রচলিত একটি দুআ[1]:
بِسْمِ اللهِ الْعَلِىِّ الْعَظِيْمِ وَالْحَمْدُ للهِ عَلَى دِيْنِ الإِسْلاَمِ، الإِسْلاَمُ حَقٌّ وَالْكُفْرُ بَاطِلٌ وَالإِسْلاَمُ نُوْرٌ وَالْكُفْرُ ظُلْمَةٌ
এ দোয়াটি বানোয়াট। বিভিন্ন হাদীসে ওযুর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি হাদীসে ‘বিসমিল্লাহ ওয়া আল-হামদু লিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে ও প্রশংসা আল্লাহ নিমিত্ত) বলার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তবে উপরের দোয়াটির কথা কোনো হাদীসে আছে বলে জানা যায় না।
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ১২৭।
৮. ওযুর ভিতরের দোয়াঃ
বিভিন্ন পুস্তকে ওযুর প্রত্যেক অঙ্গ ধৌত করার সময় পাঠের জন্য বিশেষ দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাত ধোয়ার দোয়া, কুল্লি করার দোয়া, নাক পরিষ্কার করার দোয়া ... ইত্যাদি। এ দোয়ার ভিত্তি যে হাদীসটির উপরে সে হাদীসটি বানোয়াট। ইমাম দারাকুতনী, ইমাম নাবাবী, ইমাম সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সকলেই হাদীসটিকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
[1] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৫৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃ. ১২০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৭০-৭১; আলী কারী, আল-আসরারুল মারফূআ, পৃ. ৩৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩০।
৯. ওযুর সময়ে কথা না বলাঃ
ওযুর সময়ে কথা বলা যাবে না, বা কথা বললে কোনোরূপ অন্যায় হবে এ মর্মে কোনো হাদীস নির্ভরযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তা কোনো কোনো আলিমের কথা মাত্র।
১০. ওযুর পরে সূরা ‘কাদ্র’ পাঠ করাঃ
সহীহ হাদীসে ওযুর পরে পাঠ করার জন্য একাধিক দোয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে আমি দোয়াগুলো সনদ সহ আলোচনা করেছি। আমাদের দেশে অনেক পুস্তকে এ সকল সহীহ দোয়ার বদলে কিছু বানোয়াট কথা লেখা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে লেখা আছে: ‘‘অজু করিবার পর ছুরা ক্বদর পাঠ করিলে সিদ্দীকের দরজা হাছিল হইবে। (হাদীছ)’’[1]। ‘আলীর প্রতি রাসূলুল্লাহ ()-এর ওসীয়ত’ নামক জাল হাদীসটিতে এরূপ কিছু কথার উল্লেখ আছে। ওসীয়তটির বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ১৩২-১৩৩।
১১. মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তাঃ
মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য সালাত আদায়, আল্লাহর যিকির, দীনের আলোচনা ইত্যাদি। মসজিদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ () বলেন:
إِنَّمَا هِىَ لِذِكْرِ اللَّهِ وَالصَّلاَةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ
‘‘এগুলো শুধু আল্লাহর যিক্র, সালাত ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য’’[1]
মসজিদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং হারানো বা পলাতক কিছু খোঁজ করতে, উচ্চস্বরে কথা বলতে বা চিৎকার করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে।[2] এ ছাড়া সাধারণ জাগতিক কথাবার্তা বলার কোনো সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা কোনো সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ মসজিদের মধ্যেই কবিতা পাঠ করতেন, জাহিলী যুগের গল্প-কাহিনী আলোচনা করতেন। জাবির (রা) বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ  إِذَا صَلَّى الْفَجْرَ جَلَسَ فِي مُصَلاَّهُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَيَتَحَدَّثُ أَصْحَابُهُ وَيَذْكُرُونَ حَدِيثَ الْجَاهِلِيَّةِ وَيُنْشِدُونَ الشِّعْرَ وَيَضْحَكُونَ وَيَتَبَسَّمُ .
‘‘রাসূলুল্লাহ  যে স্থানে ফজরের সালাত আদায় করতেন সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের পরে তিনি উঠতেন। তাঁর বসা অবস্থায় সাহাবীগণ কথাবার্তা বলতেন, জাহেলী যুগের কথা আলোচনা করতেন, কবিতা পাঠ করতেন এবং হাসতেন। আর তিনি শুধু মুচকি হাসতেন।’’[3]
আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি জাল হাদীসে মসজিদের মধ্যে ‘দুনিয়ার কথা’ বলার কঠিন নিন্দা করা হয়েছে। একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:
مَنْ تَكَلَّمَ بِكَلاَمِ الدُّنْيَا فِيْ الْمَسْجِدِ أَحْبَطَ اللهُ أَعْمَالَهُ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً
‘‘যে ব্যক্তি মসজিদের মধ্যে ‘দুনিয়াবী কথা’ বলবে, আল্লাহ তার চল্লিশ বছরের আমল বাতিল বা বরবাদ করে দিবেন।’’
আল্লামা সাগানী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস একবাক্যে হাদীসটিকে জাল বলেছেন। মোল্লা কারী বলেন: ‘‘এ কথাটি যেমন সনদগতভাবে বাতিল, তেমনি এর অর্থও বাতিল।’’[4]
অনুরূপ আরেকটি জাল ও বানোয়াট কথা:
اَلْحَدِيْثُ فِيْ الْمَسْجِدِ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ الْبَهِيْمَةُ الْحَشِيْشَ
‘‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খায়, যেরূপ পশু ঘাস-খড় খায়।’’
একই অর্থে আরেকটি জাল ও ভিত্তিহীন কথা
اَلْكَلاَمُ فِيْ الْمَسْجِدِ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
‘‘মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খায়, যেরূপ আগুন কাঠ খায়।’’
কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আলিম জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে এ বাক্যটিকে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইরাকী, ফাইরোযআবাদী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একমত যে, এ বাক্যটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সনদহীন একটি কথা যা রাসূলুল্লাহ () এর নামে বলা হয়েছে।[5]
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৩৬।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৭৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৯৭; তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৬১০; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ২/২৭৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৫; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/৪৪৭।
[3] সহীহ মুসলিম ১/৪৬৩, নং ৬৭০, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪০৪, ৬/৫১।
[4] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ ৩৯; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূ‘আত, পৃ ৩৬; মোল্লা কারী, আল-আসরার পৃ. ২২৭; আল-মাসনূ, পৃ. ১৪৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৪৪।
[5] তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূ‘আত, পৃ. ৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ১১৩; আল-মাসনূ, পৃ. ৬৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৪৪।
১২. মসজিদে বাতি জ্বালানো ও ঝাড়ু দেয়াঃ
মসজিদ পরিষ্কার করা, ঝাড়ু দেয়া, বাতি জ্বালানো ইত্যাদি সাধারণভাবে নেক কর্ম। কিন্তু অন্যান্য সকল বিষয়ের মত এ বিষয়েও বিশেষ পুরস্কারের নামে কিছু জাল হাদীস বানানো হয়েছে। মসজিদে বাতি জ্বালালে এত এত সাওয়াব, বা এত হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করবে, এত হজ্জ বা এত উমরার সাওয়াব মিলবে... ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট।[1]
[1] তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূ‘আত, পৃ. ৩৭।
১৩. আযানের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি চোখে বুলানোঃ
আমাদের দেশে অনেক ধার্মিক মুসলিম আযানের সময় ‘‘আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’’ বাক্যটি শুনলে দুই হাতের আঙুলে চুমু খেয়ে তা দিয়ে চোখ মুছেন। এ মর্মে একটি বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীসকে সত্য মনে করেই তাঁরা এ কাজ করেন। এ বানোয়াট হাদীসটি বিভিন্ন ভাবে প্রচারিত। এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আযানের এ বাক্যটি শুনে নিজে মুখে বলবে:
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ  نَبِيًّا
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ () তাঁর বান্দা ও রাসূল, আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দীন হিসাবে ও মুহাম্মাদ -কে নবী হিসাবে গ্রহণ করে’’, আর এ কথা বলার সাথে দু হাতের শাহাদত আঙ্গুলের ভিতরের দিক দিয়ে তার দু চক্ষু মুছবে তার জন্য শাফায়াত পাওনা হবে।
কেউ কেউ বলেন: আযানের এ বাক্যটি শুনলে মুখে বলবে:
مَرْحَباً بِحَبِيْبِيْ وَقُرَّةِ عَيْنِيْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ
‘‘মারহাবা! আমার প্রিয়তম ও আমার চোখের শান্তি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহকে’’, এরপর তার বৃদ্ধাঙ্গলিদ্বয়কে চুমু খাবে এবং উভয়কে তার দু চোখের উপর রাখবে। যদি কেউ এরূপ করে তবে কখনো তার চোখ উঠবে না বা চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হবে না।
এ জাতীয় সকল কথাই বানোয়াট। কেউ কেউ এ সকল কথা আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। মোল্লা আলী কারী বলেন, ‘‘আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা প্রমাণিত হলে তা আমল করার জন্য যথেষ্ট হবে।’’ তবে হাদীসটি আবু বাকর (রা) থেকেও প্রমাণিত নয়। ইমাম সাখাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মোল্লা আলী কারীর বক্তবব্যের টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সুফী  আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ লিখেছেন, তাঁর উস্তাদ ও প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারীর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মোল্লা আলী কারী এ বিষয়ে ইমাম সাখাবীর বিস্তারিত আলোচনা জানতে পারেন নি। ফলে তার মনে দ্বিধা ছিল। প্রকৃত বিষয় হলো, আবু বাকর (রা) বা অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটির কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় নি। মুহাদ্দিসগণ একমত হয়েছেন যে, এ বিষয়ক সকল বর্ণনা বানোয়াট।[1]
এখানে তিনটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ঃ
(১) রোগমুক্তি, সুস্থতা ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ‘আমল’ অনেক সময় অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রহণ করা হয়। এজন্য এ প্রকারের ‘আমল’ করে ফল পাওয়ার অর্থ এটাই নয় যে, এগুলো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কেউ রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে কোনো শরীয়ত সম্মত আমল করতে পারেন। তবে বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া এরূপ ‘আমল’-কে হাদীস বলা যায় না।
(২) রাসূলুল্লাহ ()-কে মহববত করা ঈমানের অংশ ও অত্যন্ত বড় নেককর্ম। যদি কেউ এ জাল হাদীসটির জালিয়াতি অবগত না হওয়ার কারণে এর উপর আমল করেন এবং রাসূলুল্লাহ ()-এর নাম শুনে হৃদয়ে মহববত ও ভালবাসা নিয়ে এভাবে আঙুলে চুমু খান, তবে তিনি এ জাল হাদীসে বর্ণিত সাওয়াব না পেলেও, মূল মহববতের সাওয়াব পাবেন, ইনশা আল্লাহ। তবে জেনেশুনে জাল হাদীসের উপর আমল করা জায়েয নয়।
(৩) এ জাল হাদীসের পরিবর্তে মুমিন একটি সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে পারেন। দু হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছার বিষয়টি বানোয়াট হলেও উপরের বাক্যগুলো মুখে বলার বিষয়ে অত্যন্ত বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ  বলেছেন: ‘‘যদি কেউ মুআযযিনকে শুনে বলে:
أَشْهَدُ (وَأَنَا أَشْهَدُأَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِمُحَمَّدٍ  رَسُوْلاً وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا
‘‘এবং আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। এবং মুহাম্মাদ () তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি তুষ্ট ও সন্তুষ্ট আছি আল্লাহকে প্রভু হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে এবং মুvহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হিসেবে।’’
রাসূলুল্লাহ () বলেন, যদি কেউ এভাবে উপরের বাক্যগুলো বলে, তবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’’[2]
[1] দেখুন: ইমাম সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৮৩-৩৮৪, নং ১০২১, মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ২১০, নং ৮২৯, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১৩৪, নং ৩০০, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৭৪, নং ৯৪০, আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/২০৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩৯।
[2] মুসলিম১/২৯০, নং ৩৮৬, ইবনু খুযাইমাহ ১/২২০, ইবনু হিববান ৪/৫৯১।
১৪. আযানের জাওয়াবে ‘সাদাকতা ও বারিরতাঃ
ফজরের আযানে ‘আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ শুনলে উত্তরে বলা হয়: ‘‘সাদাকতা ও বারিরতা (বারারতা)’। এ কথাটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ  বলেছেন: ‘‘মুয়াযযিনকে যখন আযান দিতে শুনবে তখন মুয়াযযিন যা যা বলবে তোমরা তাই বলবে।’’[1] অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর কাছে ছিলাম। তখন বিলাল দাঁড়িয়ে আযান দিলেন। বিলাল আযান শেষ করলে রাসূলুল্লাহ  বললেন : ‘‘এ ব্যক্তি (মুয়াযযিন) যা বলল, তা যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলে তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]
উপরের হাদীসদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, মুয়াযযিন যা বলবেন, আযান শ্রবণকারী তাই বলবেন। কোনো ব্যতিক্রম বলতে বলা হয় নি। তবে মুসলিম সংকলিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ () এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো, মুয়াযযিন ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বললে, শ্রোতা ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলবেন। এ হাদীসে তিনি বলেছেন : ‘‘এভাবে যে ব্যক্তি মুয়াযযিনের সাথে সাথে আযানের বাক্যগুলো অন্তর থেকে বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[3] 
তাহলে, উপরের দুটি বাক্য ছাড়া বাকি সকল বাক্য মুয়ায্যিন যেভাবে বলবেন, ‘জওয়াব দানকারীও’ ঠিক সেভাবেই বলবেন। ‘আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বাক্যটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এর জওয়াবেও এ বাক্যটিই বলতে হবে। এ বাক্যটির জন্য ব্যতিক্রম কিছু বলতে হবে তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। এজন্য মোল্লা আলী কারী ‘‘সাদাকতা ওয়া বারিরতা’’ বাক্যটিকে জাল হাদীসের তালিকাভুক্ত করে বলেছেন: ‘‘শাফিয়ী মাযহাবের লোকেরা এ বাক্যটি বলা মুস্তাহাব বলেছেন, তবে হাদীসে এর কোন অস্তিত্ব নেই।’’[4]
[1] বুখারী ১/২২১, মুসলিম ১/২৮৮।
[2] হাদীসটি হাসান। সহীহ ইবনু হিববান ৪/৫৫৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩২১, মুসনাদ আহমাদ ২/৩৫২, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১০, ৬/১৪৬, সহীহুত তারগীব ১/১৭৭।
[3] সহীহ মুসলিম ১/২৮৯, নং ৩৮৫।
[4] দেখুন: মোল্লা আলী কারী, আল আসরারুল মারফুয়া, ১৪৬ পৃ
১৫. আযানের দোয়ার মধ্যে ‘ওয়াদ দারাজাতার রাফীয়াহঃ
রাসূলুল্লাহ  বলেন: ‘‘যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন সে যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে। এরপর আমার উপর সালাত পাঠ করবে ; কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ তাঁকে দশবার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন। এরপর আমার জন্য ‘ওসীলা’ চাইবে ; কারণ ‘ওসীলা’ হলো জান্নাতের এমন একটি মর্যাদা যা আল্লাহর একজন মাত্র বান্দাই লাভ করবেন এবং আমি আশা করি আমিই হব সে বান্দা। যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওসীলা’ প্রার্থনা করবে, তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হয়ে যাবে।’’[1]
অন্যান্য হাদীসে তিনি ‘ওসীলা’ প্রার্থনার নিম্নরূপ পদ্ধতি শিখিয়েছেন:
 ‘‘হে আল্লাহ, এই পরিপূর্ণ আহবান এবং আসন্ন সালাতের প্রতিপালক, আপনি প্রদান করুন মুহাম্মাদকে () ওসীলা এবং মহামর্যাদা এবং তাঁকে উঠান সম্মানিত অবস্থানে, যা আপনি তাঁকে ওয়াদা করেছেন।’’
তিনি বলেছেন, ‘‘মুয়াযযিনের আযান শুনে যে ব্যক্তি উপরের বাক্যগুলো বলবে, তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত পাওনা হয়ে যাবে।’’[2]
ইমাম বুখারীসহ সকল মুহাদ্দিস এভাবেই দোয়াটি সংকলন করেছেন। আমাদের দেশে প্রচলিত আযানের দোয়ার মধ্যে দুটি বাক্য অতিরিক্ত রয়েছে, যা উপরের দোয়াটিতে নেই। প্রথম বাক্যটিতে (والفضيلة : ওয়াল ফাদীলাতা)-র পরে ‘والدرجة الرفيعة(এবং সুঊচ্চ মর্যাদা) বলা এবং দ্বিতীয় বাক্যটি দোয়ার শেষে : ‘إنك لا تخلف الميعااد’ (নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না) বলা। দ্বিতীয় বাক্যটি একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে।[3] আর প্রথম বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’আহ) একেবারেই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা হাদীস নির্ভর। ইবনু হাজার, সাখাবী, যারকানী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’য়াহ) বানোয়াট।[4]
[1] সহীহ মুসলিম ১/২৮৮, নং ৩৮৪।
[2] সহীহ বুখারী ১/২২২, নং ৫৮৯, ৪/১৭৪৯, নং ৪৪৪২।
[3] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪১০ (৬০৩-৬০৪)।
[4] ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/২১১, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ২২২-২২৩, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১০৭, মোল্লা আলী কারী আল-মাসনূ’, পৃ. ৭০-৭১, আল-আসরার, পৃ. ১২২, মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ. ১/৫৩২।
১৬. আযানের দুআয়: ‘‘ওয়ারযুকনা শাফাআতাহুঃ
কেউ কেউ আযানের দুআর মধ্যে আরেকটি বাক্য সংযোজন করে বলেন: (وارزقنا شفاعته): ‘‘এবং আমাদেরকে তাঁর শাফাআত রিযক দান করুন/ প্রদান করুন’’। এ বাক্যটিও ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে আযানের দুআর মধ্যে এ বাক্যটি বর্ণিত হয় নি। আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ ()-এর শাফাআতের রিযক লাভের জন্য দুআ করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। তবে দুটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়:
প্রথম: মাসনূন দুআর মধ্যে অতিরিক্ত কোনো শব্দ বা বাক্য সংযোজন বা পরিবর্তন হাদীস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে এবং সাহাবীগণ এরূপ কর্মের প্রতিবাদ করতেন। ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্ত্তত কখন কোন্ দুআ করলে আল্লাহ সবচেয়ে খুশি হন এবং মুমিনের সবচেয়ে বেশি লাভ হয় তা সবচেয়ে ভাল জানতেন রাসূলুল্লাহ ()। কাজেই তাঁর শেখানো কোনো দুআর মধ্যে পরিবর্তন বা সংযোজনের অর্থ হলো তাঁর দুআটিকে অসম্পূর্ণ বলে ধারণা করা বা মাসনূন দুআতে পরিপূর্ণ ফযীলত, বরকত বা কামালাত লাভ হলো না বলে কল্পনা করা। এতে সুন্নাতকে অপছনদ করা হয় ও বিদআতের উৎপত্তি হয়। রাসূলুল্লাহ () বলেছেন: (مَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ): যে আমার সূন্নাতকে অপছন্দ করবে তার সাথে আমার সম্পর্ক নেই (সে আমার উম্মাত নয়)।’’[1]
দ্বিতীয়: আযানের দুআয় শাফাআত প্রার্থনা সংযোজন রাসূলুল্লাহ ()-এর প্রতিশ্রুতিতে অনাস্থা প্রমাণ করে। কারণ তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তাঁর শেখানো বাক্যে তাঁর জন্য ‘‘ওয়াসীলা’’ প্রার্থনা করবে তাঁর শাফাআত তার জন্য ওয়াজিব হবে। কাজেই মুমিন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে মাসনূন দুআ পাঠ করে দৃঢ় আশা করবেন যে, তাঁর জন্য শাফাআত পাওনা হলো।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/১৯৪৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/১০২০, নং ১৪০১।
১৭. আযানের সময় কথা বলার ভয়াবহ পরিণতিঃ
আযানের সময় কথা বলার নিষেধাজ্ঞা বুঝাতে এ ‘হাদীসটি’ বলা হয়:
مَنْ تَكَلَّمَ عِنْدَ الأَذَانِ خِيْفَ عَلَيْهِ زَوَالُ الإِيْمَانِ
‘‘যে ব্যক্তি আযানের সময় কথা বলবে, তার ঈমান বিনষ্ট হওয়ার ভয় আছে।’’ আল্লামা সাগানী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, বাক্যটি হাদীসের নামে বানানো ভিত্তিহীন জাল কথা। আযানের সময় কথা বলা যাবে না মর্মে কোনো নির্দেশনা হাদীসে বর্ণিত হয় নি।[1]
[1] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৮০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/২৯৫, ৩১৫।
১৮. সালাতের ৫ প্রকার ফযীলত ও ১৫ প্রকার শাস্তিঃ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন হাদিসঃ
কুরআন-হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, ৫ ওয়াক্ত ফরয সালাত যথাসময়ে আদায় করা মুমিনের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। সালাতই মুমিনের পরিচয় এবং ঈমান ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য। সালাত পরিত্যাগকারী ‘কাফিরদের দলভুক্ত’ বলে গণ্য হবে। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম সালাতেরই হিসাব গ্রহণ করা হবে। এভাবে অগণিত সহীহ হাদীস থেকে আমার ফরয সালাতের গুরুত্ব ও সালাতে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি জানতে পারি।
কিন্তু সাধারণ মানুষদের অবাক করার জন্য জালিয়াতগণ এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সমাজে প্রচলিত অনেক গ্রন্থেই কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসের পরিবর্তে এ সকল বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথাগুলো লেখা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের ক্যালেন্ডার, পোস্টার ইত্যাদিতেও এ সকল বানোয়াট কথাগুলি লিখে প্রচার করা হয়। এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ জাল হাদীস আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। এ জাল হাদীসটির সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:
যে ব্যক্তি যথারীতি ও গুরুত্ব সহকারে নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে পাঁচ প্রকারে সম্মানিত করবেন: রুজী রোজগার ও জীবনের সংকীর্ণতা হতে তাকে মুক্ত করবেন, তার উপর হতে কবরের আযাব উঠিয়ে দিবেন, কিয়ামতের দিন তার আমলনামা ডান হাতে দান করবেন, সে ব্যক্তি পুলসিরাতের উপর দিয়ে বিদ্যুতের মত পার হয়ে যাবে এবং বিনা হিসাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে অলসতা করে তাকে পনের প্রকারের শাস্তি দেওয়া হয়। তন্মধ্যে পাঁচ প্রকার দুনিয়াতে, তিন প্রকার মৃত্যুর সময় তিন প্রকার কবরে এবং তিন প্রকার কবর হতে বের হওয়ার পর। এ পনের বা চৌদ্দ প্রকারের শাস্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রায় সকল প্রচলিত নামায শিক্ষা, আমলিয়াত ইত্যাদি বইয়ে পাওয়া যায়। এজন্য এ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাগুলো লিখে বইয়ের কলেবর বাড়াচ্ছি না।
এ দীর্ঘ হাদীসটি পুরোটিই ভিত্তিহীন ও জাল। কোনো হাদীসগ্রন্থে এ হাদীসটি পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম তাদের ওয়ায নসীহত মূলক গ্রন্থে অন্য সকল প্রচলিত কথার সাথে এই কথাগুলোও হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ইমামগণ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন যে, এই কথাগুলো বাতিল ও জাল কথা। কোন্ ব্যক্তি এ জালিয়াতি করেছে তাও তাঁরা উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী, সয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।[1]
শাইখুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধলভী (রাহ) তাঁর ‘ফাযায়েলে নামায’ গ্রন্থে এ জাল হাদীসটি আরবী ইবারত-সহ পুরোপুরি  উল্লেখ করেছেন। তিনি হাদীসটি উল্লেখ করার আগে বলেছেন, কেউ কেউ বলেছেন, এ কথাটি নাকি হাদীসে আছে.... । হাদীসটি উল্লেখ করার পরে তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে, ইমাম যাহাবী, ইমাম সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি জাল ও বাতিল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। এর সনদের জালিয়াতদের পরিচয়ও তাঁরা তুলে ধরেছেন।[2]
এভাবে আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) হাদীসটির জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁর আমানত আদায় করেছেন। কিন্তু অনুবাদে এ আমানত রক্ষা করা হয় নি। আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) -এর এ আলোচনা অনুবাদে উল্লেখ করা হয় নি। অনুবাদের শুরুতে বলা হয়েছে: ‘‘এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে..’’। শেষে শুধুমাত্র লেখা হয়েছে ‘যাওয়াজির ইবন হাজার মাক্কী (রাহ)’। এতে সাধারণ পাঠক একে নির্ভরযোগ্য হাদীস বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ()-এর কথা বলেই বিশ্বাস করছেন। অথচ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কোনো জাল হাদীসকে ‘জাল’ বলে উল্লেখ না করে ‘হাদীস’ বলে বর্ণনা করা কঠিন হারাম। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
[1] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/২৬৪; ইবনু হাজার, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২৯৫; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৯৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১১৩-১১৪।
[2] হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী, ফাযায়েলে আমল, পৃ. ১০৪-১০৮।
১৯. সালাত মুমিনদের মি’রাজঃ
একটি অতি প্রচলিত ভিত্তিহীন সনদহীন জাল হাদীস
اَلصَّلاَةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِيْنَ
‘‘নামায মুমিনদের মিরাজ।’’[1]
এখানে লক্ষণীয় যে, এ অর্থের কাছাকাছি অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। মুমিন সালাতের মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করেন, সালাতে দাঁড়ালে আল্লাহ মুমিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন... ইত্যাদি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এগুলোর পরিবর্তে অনেকে এ ভিত্তিহীন কথাটিকে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বলে তাঁর নামে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী হয়ে যান।
[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১২৩।
২০. ৮০ হুক্বা বা ১ হুকবা শাস্তিঃ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও সনদহীন একটি বানোয়াট কথামাত্র।
‘‘মাজালিসুল আবরার নামক কেতাবে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ () ফরমাইয়াছেন, যেই লোক সময়মত নামায পড়িল না, নামাযের ওয়াক্ত শেষ হইবার পরে কাযা পড়িল, সেই লোকও জাহান্নামে ৮০ হুকবা শাস্তি ভোগ করিবে। ৮০ বছরে এক হুকবা আর ৩৬০ দিনে এক বৎসর। ৩৬০ * ৮০ = ২৮,৮০০ দিন। অতএব তাকে ২৮,৮০০ দিন এক ওয়াক্ত নামায না পড়িবার জন্য দোজখের আগুনে জ্বলিতে হইবে। আর আখেরাতের দিন হইবে দুনিয়ার এক সহস্র বৎসরের তুল্য। এই হিসাবে এক ওয়াক্ত নামায তরককারীকে দুই কোটি অষ্টাশি লক্ষ বৎসর জাহান্নামের আগুনে শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।’’[1]
শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া কান্ধালভী (রাহ) এ হাদীসটিকে তার ‘ফাযায়েলে নামায’ গ্রন্থে নিম্নরূপে উদ্ধৃত করেছেন:
مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ حَتَّى مًضًى وًقْتُهَا ثُمَّ قَضَى عُذِّبَ فِيْ النَّارِ حُقْباً، وَالْحُقْبُ ثَمَانُوْنَ سَنَةً، وَالسَّنَةُ ثَلاَثُمِائَةٍ وَسِتُّوْنَ يَوْماً، كُلُّ يَوْمٍ مِقْدَارُهُ أَلْفُ سَنَةٍ.
‘‘যে ব্যক্তি ওয়াক্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করল না, এবং এরপর সে কাযা করল, তাকে জাহান্নামে এক হুক্বা শাস্তি প্রদান করা হবে। এক হুকবা ৮০ বছর এবং এক বৎসর ৩৬০ দিন এবং প্রত্যেক দিনের পরিমাণ এক হাজার বৎসরের সমান।’’ হাদীসটি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন:
كذا في مجالس الأبرارقلتلم أجده فيما عندي من كتب الحديث
‘‘মাজালিসুল আবরার নামক গ্রন্থে এভাবে লিখা হয়েছে। আমার বক্তব্য হলো, আমার নিকটে যত হাদীসের পুস্তক রয়েছে সেগুলোর কোনো পুস্তকেই আমি এ হাদীসটি দেখতে পাই নি।...’’[2]
আর তাঁর মত একজন মুহাদ্দিস যে হাদীস কোনো হাদীসের গ্রন্থে খুঁজে পান নি সে হাদীসের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বস্ত্তত, হাদীসটি ভিত্তিহীন ও সনদহীন একটি বানোয়াট কথামাত্র। কোথাও কোনো প্রকার সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও এ কথাটি সংকলিত হয় নি। জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে শেষ যুগের কোনো কোনো আলিম তা নিজ গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে সংকলন করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ কথাটি যে কোনো হাদীসের গ্রন্থে নেই এবং ‘মাজালিসুল আবরার’-এর লেখক সনদবিহীনভাবে তা উল্লেখ করেছেন, তা জানা সত্ত্বেও অনেক ভাল আলিম ওয়াযে-আলোচনায় এবং লিখনিতে এ ‘হাদীস’ ও অনুরূপ অনেক জাল ও দুর্বল হাদীস উল্লেখ করেন। মানুষের হেদায়েতের আগ্রহেই তাঁরা তা করেন। মনে হয়, তাঁরা চিন্তা করেন, কুরআন কারীমের হাজার হাজার আয়াত এবং প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত হাজার হাজার সহীহ হাদীস মানুষদের হেদায়াত করতে আর সক্ষম নয়। কাজেই এগুলোর পাশাপাশি কিছু দুর্বল (!) হাদীসও আমাদের না বলে উপায় নেই!! অথচ রাসূলুল্লাহ () বলেছেন যে, জাল বলে সন্দেহকৃত হাদীস উল্লেখ করাও হাদীস জালিয়াতির মতই কঠিনতম পাপ। আমরা কি অন্যের হেদায়তের আগ্রহে নিজেদের জন্য জাহান্নাম ক্রয় করব?!
[1] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩১।
[2] শাইখুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধালভী, ফাযায়েলে নামায, পৃ. ৫৭-৫৮।
২১. জামাআতে সালাত আদায়ে নবীগণের সাথে হজ্জঃ
জামাআতে সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। কুরআনে মুমিনগণকে একত্রে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অগণিত সহীহ হাদীসে জামাআতে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামাআত ছেড়ে একা সালাত আদায়কারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে। আযান শোনার পরেও যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা ভয়ের ওযর ছাড়া জামাআতে না এসে একা সালাত আদায় করবে তার সালাত কবুল হবে না বলে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে।
‘জামাতে সালাত আদায়ের’ বিধান সম্পর্কে ফিকহী পরিভাষাগত মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, কেউ বলেছেন ওয়াজিব ও কেউ বলেছেন ফরয। এ মতভেদ একান্তই পরিভাষাগত। কারণ সকলেই একমত যে, পুরুষের জন্য ওযর ছাড়া ফরয সালাত একা আদায় করলে কঠিন গোনাহ হবে। সালাত হবে কি না সে বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে।
এ সকল সহীহ হাদীসের পাশাপাশি জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস তৈরি করেছে। আর এ বিষয়েও সহীহ হাদীসগুলো বাদ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সব জাল হাদীসই বই পুস্তকে লেখা হয় ও ওয়াযে বলা হয়। সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইশা ও ফজরের সালাত জামাতে আদায় করলে সারারাত্র তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের সাওয়াব হবে, ফজরের সালাত জামাতে আদায় করলে আল্লাহর দায়িত্বে থাকা যাবে ... ইত্যাদি। কিনত এ সকল ‘সামান্য’ সাওয়াবের কথায় মন না ভরায় জালিয়াতগন বানিয়েছে:
مَنْ صَلَّى صَلاَةَ الصُّبْحِ فِيْ الْجَمَاعَةِ فَكَأَنَّمَا حَجَّ مَعَ آَدَمَ خَمْسِيْنَ حَجَّةً..
‘‘যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাআতে আদায় করল সে যেন আদম (আ) এর সাথে ৭০ বার হজ্জ করল ...।’’ এভাবে প্রত্যেক ওয়াক্তের সাথে একজন নবীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে...।[1]
অনুরূপ বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: যে ব্যক্তি ফজর ও ইশার সালাত জামাতে আদায় করল, সে যেন আদমের (আ) পিছনে সালাত আদায় করল...। এভাবে এক এক সালাতের জন্য এক এক নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে...।[2]
[1] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ.৮৩; সাগানী, আল-মাউদূ‘আত পৃ. ৪২; পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৩৯, ১০৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৫৫।
[2] অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ ১০২-১০৩।
২২. মুত্তাকী আলিমের পিছনে সালাত নবীর পিছনে সালাতঃ
জামাআতে সালাত আদায়ের কারণে সাওয়াব বৃদ্ধির কথা সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। বিভিন্ন হাদীসে কুরআনের তিলাওয়াত ও জ্ঞানে পারদর্শী, হাদীসের জ্ঞানে পারদর্শী, হিজরত ও অন্যান্য নেক আমলে অগ্রবর্তী ব্যক্তিগণকে ইমামতি প্রদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে ইমামের ‘তাকওয়া’ বা ‘ইলমের’ কারণে মুক্তাদিগণের ‘সাওয়াব’ বা ‘বরকত’ বেশি হবে, এরূপ অর্থে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ অর্থে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই অত্যন্ত যয়ীফ অথবা বানোয়াট। এইরূপ একটি ভিত্তিহীন কথা:
مَنْ صَلَّى خَلْفَ عَالِمٍ تَقِيٍّ، فَكَأَنَّمَا صَلَّى خَلْفَ نَبِيٍّ
‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুত্তাকি আলিমের পিছনে সালাত আদায় করল, সে যেন একজন নবীর পিছনে সালাত আদায় করল।’’
ফিক্হের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হেদায়া’-র প্রণেতা আল্লামা আলী ইবনু আবী বাক্র মারগীনানী (৫৯২ হি) জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে এ কথাটিকে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ কথাটি কোনো হাদীস নয়। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা কোনো গ্রন্থে সংকলিত হয় নি। এজন্য আল্লমা যাইলায়ী, ইরাকী, ইবনু হাজার, সুয়ূতী, সাখাবী, তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ কথাটিকে জাল হাদীস হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন।[1]
[1] মারগীনানী, হেদায়া ১/৫৭; যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ২/২৬; ইবনু হাজার, আদ-দিরাইয়া ১/১৬৮; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩১১; মোল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৫২; আল-আসরার, পৃ. ১৪৭, ২৩৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৭, ১২২, ৩৩৭; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূ‘আত, পৃ. ৪০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৫৫।
২৩. আলিমের পিছনে সালাত ৪৪৪০ গুণ সাওয়াবঃ
এই জাতীয় আরেকটি বানোয়াট কথা হলো,
اَلصَّلاَةُ خَلْفَ الْعَالِمِ بِأَرْبَعَةِ آلاَفٍ وَأَرْبَعِمِائَةٍ وَأَرْبَعِيْنَ صَلاَةً
‘আলিমের পিছনে সালাতে ৪৪৪০ গুণ সাওয়াব।’[1]
[1] মোল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৫২; আল-আসরার, পৃ. ১৪৭।
২৪. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাক‘আত সংখ্যার কারণঃ
পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাক‘আত সংখ্যা ১৭ হলো কেন, ফজর ২ রাক‘আত, যুহর ৪ রাক‘আত, আসর ৪ রাক‘আত, মাগরিব ৩ রাক‘আত ও ইশা ৪ রাক‘আত হলো কেন, বিত্র ৩ রাক‘আত হলো কেন, ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত সকল কথাই ভিত্তিহীন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ওয়াক্তের সালাতকে বিভিন্ন নবীর আদায় করা বা প্রতিষ্ঠিত বলে যে সকল গল্প বলা হয় সবই ভিত্তিহীন। এ জাতীয় অনেক ভিত্তিহীন কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত। এখানে একটি গল্প উল্লেখ করছি।
আমাদের দেশে অতি প্রসিদ্ধ কোনো কোনো পুস্তকে লেখা হয়েছে: ‘‘বেতের নামায ওয়াজিব হইবার কারণ এই  যে, এরশাদুত্বালেবীন কিতাবে লিখিত আছে হযরত () মেরাজ শরীফে যাইবার সময়ে যখন বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তাশরীফ নিয়াছিলেন তখন সমস্ত পয়গম্বরের রুহ মোবারক হযরত ()-এর সাক্ষাত ও আশীর্বাদের জন্য আসিলে জিব্রাইল (আ) এর আদেশানুযায়ী হযরত () ইমাম হইয়া এক রাকাত নামায পড়িলেন। তার পর মিকাইল (আ) ৭০ হাজার ফেরেশতা লইয়া হযরত ()-এর মোলাকাত ও দোয়ার প্রত্যাশী হইলে জিব্রাইল (আ)-এর আদেশ অনুযায়ী রাসূল () পূনরায় আরও এক রাকাত নামায পড়িলেন। ইহার পর ইস্রাফীল (আ) ৭০ হাজার ফেরেশতা লইয়া হযরত ()-এর দোওয়ার প্রত্যাশী হইলে জিব্রাইল (আ)-এর হুকুম অনুযায়ী আবার হযরত () তাহাদিগকে মুক্তাদি করিয়া এক রাকাত নামায পড়িলেন। অতঃপর আজরাঈল (আ) বহু ফেরেশতা লইয়া এরূপ বাসনা করিয়া উপস্থিত হইলে জিব্রাইল (আ) বলিলেন, হে প্রিয় পয়গম্বর আপনি ইহাদিগকে সঙ্গে করিয়া দোওয়া কুনুত পাঠ করান। হযরত () তাহাই করিলেন সুতারং ঐ তিন রাকাত নামাযই আমাদের উপর ওয়াজিব হইয়াছে এবং বেতের নামাযে দোওয়া কুনূত পড়াও ওয়াজেব হইয়াছে।’’[1]
কোনো কোনো জালিয়াত ঘুরিয়ে বলেছে যে, তিনি মি’রাজের রাত্রিতে মূসা (আ) এর জন্য এক রাক‘আত, তাঁর নিজের জন্য আরেক রাক‘আত এবং শেষে আল্লাহর নির্দেশে তৃতীয় রাক‘আত সালাত আদায় করেন। ...[2]
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ১৯২-১৯৩।
[2] অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ ১১৫।
২৫. উমরী কাযাঃ
সালাত মুমিনের জীবনের এমন একটি ফরয ইবাদত যার কোনো বিকল্প নেই বা কাফ্ফারা নেই। যতক্ষণ হুশ বা চেতনা থাকবে সালাত আদায় করতেই হবে। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, দৌঁড়িয়ে, হেঁটে, ইশারায় বা যেভাবে সম্ভব সালাত আদায় করতে হবে। চেতনা রহিত হলে সালাত মাফ হয়ে যাবে।
কোনো বিশেষ কারণে একান্ত বাধ্য হয়ে দুই এক ওয়াক্ত সালাত ছুটে গেলে কাযা করতে হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক ওয়াক্তের সালাতের কাযা করার কোনোরূপ বিধান হাদীস শরীফে দেয়া হয় নি। কারণ, কোনো মুসলিম সালাত পরিত্যাগ করতে পারে, এরূপ চিন্তুা  রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীগণের যুগে ছিল না। সাহাবীগণ বলতেন, একজন মুসলিম অনেক পাপ করতে পারে, কিন্তু মুসলিম কখনো সালাত পরিত্যাগ করতে পারে না।
পরবর্তী যুগের মুসলিম ফকীহগণ এ বিষয়ে মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত সালাত ত্যাগ করলে সে ব্যক্তি কাফির বা অমুসলিমে পরিণত হবে। কেউ বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি ‘সালাতের’ গুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করেন, কিন্তু অলসতা হেতু সালাত ত্যাগ করেছেন, তিনি ‘কাফিরের মত’ কঠিন পাপী বলে গণ্য হবেন, কিন্তু ‘কাফির’ বা অমুসলিম বলে গণ্য হবেন না। আর যদি কেউ মনে করেন যে, ৫ ওয়াক্ত সালাত নিয়মিত আদায় না করেও তিনি নামাযী মুসলমানদের মতই মুসলমান, তাহলে সে ব্যক্তি সালাতের গুরুত্ব অস্বীকার করার কারণে প্রকৃত কাফির বলে গণ্য হবেন।
সর্বাবস্থায় সকলেই একমত যে, ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ সময়ের সালাত পরিত্যাগ করলে পরে সে সালাতের ‘কাযা’ করার বিষয়ে হাদীসে কোনোরূপ বিধান দেয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু জাল হাদীস তৈরি করেছে। এছাড়া সমাজে কিছু প্রচলিত ভিত্তিহীন কথাবার্তাও এ বিষয়ে প্রচলিত আছে। দু’টি ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। প্রথমত, উমরী কাযা ও দ্বিতীয়ত, কাফ্ফারা বা এস্কাত। এ বিষয়ে জালিয়াতদের বানানো একটি হাদীস:
قَالَ رَجُلٌيَا رَسُوْلَ اللهِإِنِّيْ تَرَكْتُ الصَّلاَةَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ فَاقْضِ مَا تَرَكْتَفَقَالَيَا رَسُوْلَ اللهِ، كَيْفَ أَقْضِيْ؟ فَقَالَصَلِّ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ صَلاَةً مِثْلَهَا، قَالَيَا رَسُوْلَ اللهِقَبْلُ أَمْ بَعْدُ؟ قَالَلاَ بَلْ قَبْلُ
‘‘এক ব্যক্তি বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমি সালাত পরিত্যাগ করেছি। তিনি বলেন, তুমি যা পরিত্যাগ করেছ তা ‘কাযা’ কর। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমি কিভাবে তা ‘কাযা’ করব? তিনি বলেন, প্রত্যেক ওয়াক্তের সালাতের সাথে অনুরূপ সালাত আদায় কর। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আগে, না পরে? তিনি বলেন, না, বরং আগে।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি জাল, ভিত্তিহীন ও বাতিল।[1] যদি কোনো মুসলিম দীর্ঘদিন সালাতে অবহেলার পরে অনুতপ্ত হয়ে নিয়মিত  সালাত শুরু করেন, তখন তার প্রধান দায়িত্ব হবে বিগত দিনগুলোর পরিত্যক্ত সালাতের জন্য বেশি বেশি করে কাঁদাকটি ও তাওবা করা। এর পাশাপাশি, অনেক ফকীহ বলেছেন যে, ঐ ব্যক্তি পরিত্যক্ত সালাতগুলো নির্ধারণ করে তা ‘কাযা’ করবেন। এভাবে ‘উমরী কাযা’ করার কোনো নির্ধারিত বিধান কুরআন বা হাদীসে নেই। এ হলো সাবধানতামূলক কর্ম। আশা করা যায় যে, তাওবা ও কাযার মাধ্যমে আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন।
[1] জূযকানী, আল-আবাতীল ২/৫০; ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/২৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৮০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৩৫।
২৬. কাফ্ফারা ও এস্কাতঃ
ইসলামে সিয়াম বা রোযার জন্য কাফ্ফারার বিধান রয়েছে। কোনো মুসলিম অপারগতার কারণে সিয়াম পালন করতে না পারলে এবং কাযার ক্ষমতাও না থাকলে তিনি তার প্রতিটি ফরয সিয়ামের পরিবর্তে একজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবেন। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে প্রতিটি সিয়ামের পরিবর্তে একটি ফিত্রার পরিমাণ খাদ্য প্রদানের বিধান দিয়েছেন ফকীহগণ।
কিন্তু সালাতের জন্য এরূপ কোনো কাফ্ফারার বিধান হাদীসে নেই। কারণ সিয়ামের ক্ষেত্রে যে অপারগতার সম্ভাবনা রয়েছে, সালাতের ক্ষেত্রে তা নেই। যতক্ষণ চেতনা আছে, ততক্ষণ মুমিন ইশারা-ইঙ্গিতে যেভাবে পারবেন সেভাবেই তার সাধ্যানুসারে সালাত আদায় করবেন। কাজেই অপারগতার কোনো ভয় নেই। আর দীর্ঘস্থায়ীভাবে চেতনা রহিত হলে সালাতও রহিত হবে।
তবুও পরবর্তী যুগের কোনো কোনো ফকীহ সাবধানতামূলকভাবে সালাতের জন্যও কাফফারার বিধান দিয়েছেন। নিয়মিত সালাত আদায়কারী কোনো মুমিন যদি মৃত্যুর আগে অসুস্থতার কারণে কিছু সালাত আদায় করতে না পারেন, তবে মৃত্যুর পরে তার জন্য সিয়ামের মত প্রত্যেক সালাতের বদলে একটি করে ‘ফিতরা’ প্রদানের বিধান দিয়েছেন।
কেউ কেউ এ বিধানকে আবার আজীবন সালাত পরিত্যাগকারী ও সালাতকে অবজ্ঞা ও উপহাসকারীর জন্যও প্রয়োগ করেছেন। এরপর খাদ্যের বদলে কুরআন প্রদানের এক উদ্ভট বিধান দিয়েছেন। প্রচলিত একটি পুস্তকে এ বিষয়ে লিখা হয়েছে: ‘‘এস্কাত করিবার নিয়ম এই যে, প্রথমত মুর্দার বয়স হিসাব করিবে। তম্মধ্য হইতে পুরুষের বার বছর ও স্ত্রী লোকের ৯ বছর (নাবালেগী) বয়স বাদ দিয়া বাকী বয়সের প্রত্যেক বৎসর ৮০ তোলা সেরের ওজনের ১০ মন ও ১০ সের ময়দার মূল্য ধরিয়া । ঐ মূল্যের পরিবর্তে নিজে এক জেলদ কোরআন শরীফ সকলের সম্মুখে কোন গরীব মিছকীনের নিকট হাদিয়া করিয়া দিবে। এবং সকলের মোকাবেলা বলিবে যে, অমুকের উপরোক্ত হুকুকের জন্য খোদায়ী পাওনা এত হাজার, এত শত, এত মণ ময়দার পরিবর্তে এই কালামুল্লাহ তোমার নিকট হাদীয়া করিলাম। ঐ গরীব বা মিছকীন দুইজন সাক্ষীর মোকাবিলা উহা কবুল করিলে ঐ কালামুল্লাহ তাহারই হইয়া গেল এবং ময়দা আদায় করা তাহার উপর ওয়াজিব হইয়া গেল।’’[1]
এ উদ্ভট নিয়মটি শুধু বানোয়াটই নয়, আল্লাহর দীনের সাথে চরম উপহাস! এর চেয়ে বড় উপহাস আর কি হতে পারে!! আজীবন সালাত অবমাননা করে, সালাতকে নিয়ে অবজ্ঞা উপহাস করে, মরার পরে এক জিলদ ‘কুরআন’ ফকীরকে দিয়েই মাফ!!!
[1] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ১৮১।
সুন্নাত-নফল সালাত বিষয়কঃ
ফরয সালাত যেমন মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, তেমনি নফল সালাতও সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। ফরযের অতিরিক্ত কর্মকে ‘‘নফল’’ বলা হয়। কিছু সময়ে কিছু পরিমাণ ‘‘নফল’’ সালাত পালন করতে রাসূলুল্লাহ  উৎসাহ দিয়েছেন, বা তিনি নিজে তা পালন করেছেন। এগুলোকে ‘সুন্নাত’ও বলা হয়। যে সকল নফল সালাতের বিষয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেগুলোকে ‘‘সন্নাতে মুয়াক্কাদাহ’’ বলা হয়। এ ধরনের কিছু সুন্নাত সালাত সম্পর্কে হাদীসে বেশি গুরুত্ব প্রদানের ফলে কোন ফকীহ তাকে ওয়াজিব বলেছেন।
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সাধারণভাবে যত বেশি পারা যায় নফল সালাত আদায়ের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এক সাহাবী প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কর্ম কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ () বলেন: ‘‘তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করবে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সাজদা কর, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।’’[1]
অন্য এক যুবক সাহাবী রাসূলুল্লাহ -এর কাছে আবেদন করেন যে, তিনি জান্নাতে তাঁর সাহচর্য চান। তিনি বলেন: ‘‘তাহলে বেশি বেশি সাজদা করে (নফল সালাত পড়ে) তুমি আমাকে তোমার বিষয়ে সাহায্য কর।’’[2]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন : ‘‘সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, কাজেই যার পক্ষে সম্ভব হবে সে যেন যত বেশি পারে সালাত আদায় করে।’’  হাদীসটি হাসান।[3] 
সাধারণভাবে নফল সালাত ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বা স্থানে বিশেষ সালাতের বিশেষ ফযীলতের কথাও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে আল্লামা মাওসিলীর আলোচনা থেকে জানতে পেরেছি যে, সহীহ হাদীস থেকে নিম্নলিখিত বিশেষ সুন্নাত-নফল সালাতের কথা জানা যায়: ফরয সালাতের আগে পরে সুন্নাত সালাত, তারাবীহ, দোহা বা চাশত, রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল ওযু, ইসতিখারার সালাত, কুসূফের সালাত, ইসতিসকার সালাত ও সালাতুত তাসবীহ। এছাড়া পাপ করে ফেললে দু রাক‘আত সালাত আদায় করে তাওবা করার কথাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে ‘সালাতুল হাজাত’ বর্ণিত হয়েছে।
সুন্নাত-নফল সালাতের বিষয়ে এত সহীহ হাদীস থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। অন্যান্য জাল হাদীসের মতই এগুলোতে অনেক আকর্ষণীয় অবান্তর সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। জালিয়াতগণ দুটি ক্ষেত্রে কাজ করেছে। প্রথম, সহীহ হাদীসে উল্লিখিত সুন্নাত-নফল সালাতগুলোর জন্য বানোয়াট ফযীলত, সূরা বা পদ্ধতি তৈরি করেছে। দ্বিতীয়, বিভিন্ন সময়, স্থান বা কারণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির সালাতের উদ্ভাবন করে সেগুলোর কাল্পনিক সাওয়াব, ফযীলত বা আসরের কাহিনী বানিয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত এ বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তা বা জাল হাদীস এখানে উল্লেখ করছি।
সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সুন্নাত-নফল সালাত বিষয়ক জাল হাদীসগুলো বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না। শুধুমাত্র এ সকল সালাত বিষয়ক মনগড়া পদ্ধতিগুলো আলোচনা করব। এরপর জালিয়াতগণ মনগড়াভাবে যে সকল সালাত ও তার ফযীলতের কাহিনী বানিয়েছে সেগুলো উল্লেখ করব।
[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৫৩।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৫৩।
[3] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/৮৪, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪৯, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২২৬।
২৭. বিভিন্ন সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াত নির্ধারণ করাঃ
সহীহ হাদীসে প্রমাণিত এ সকল সালাতের কোনো সালাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াত নির্ধারণ করে দেয়া হয় নি। এ সকল সালাতের জন্য নির্ধারিত সূরা পাঠের বিষয়ে, বা অমুক রাকআাতে অমুক সূরা বা অমুক আয়াত এতবার পাঠ করতে হবে বলে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই বানোয়াট কথা। কাজেই ইসতিখারার সালাতের প্রথম রাক‘আতে অমুক সূরা, দ্বিতীয় রাক‘আতে অমুক সূরা, তাহাজ্জুদের সালাতে প্রথম রাকআতে অমুক সূরা, দ্বিতীয় রাক‘আতে অমুক সূরা বা আয়াত, চাশতের সালাতে প্রথম বা দ্বিতীয় রাক‘আতে অমুক সূরা বা আয়াত ... শবে কদরের রাতের সালাতে অমুক অমুক সূরা বা আয়াত পড়তে হবে.... ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট।
যে কোনো সূরা বা আয়াত দিয়ে এ সকল সালাত আদায় করা যাবে। কোনো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াতের কারণে এ সকল সালাতের সাওয়াব বা বরকতের কোনো হেরফের হবে না। সূরা বা আয়াতের দৈর্ঘ্য, মনোযোগ, আবেগ ইত্যাদির কারণে সাওয়াবের কমবেশি হয়।
২৮. তারাবীহের সালাতের দোয়া ও মুনাজাতঃ
রামাদানের কিয়ামুল্লাইলকে ‘সালাতুত তারাবীহ’ বা ‘বিশ্রামের সালাত’ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ () এর যুগে তিনি নিজে ও সাহাবীগণ রামাদান ও অন্যান্য সকল মাসেই মধ্যরাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ৪/৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একাকি কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ আদায় করতেন। উমার (রা) এর সময় থেকে মুসলিমগণ জামাআতে তারাবীহ আদায় করতেন। সাধারণত ইশার পর থেকে শেষরাত্র বা  সাহরীর পূর্ব সময় পর্যন্ত ৫/৬ ঘণ্টা যাবৎ তাঁরা একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবীহের সালাত আদায় করতেন।
যেহেতু এভাবে একটানা কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা খুবই কষ্টকর, সেহেতু পরবর্তী সময়ে প্রতি ৪ রাক‘আত সালাত আদায়ের পরে প্রায় ৪ রাক‘আত সালাতের সম পরিমাণ সময় বিশ্রাম নেয়ার রীতি প্রচলিত হয়। এজন্যই পরবর্তীকালে এ সালাত ‘সালাতুত তারাবীহ’ বলে প্রসিদ্ধ হয়।
এ ‘বিশ্রাম’ সালাতের বা ইবাদতের কোনো অংশ নয়। বিশ্রাম না করলে সাওয়াব কম হবে বা বিশ্রামের কমবেশির কারণে সাওয়াব কমবেশি হবে এরূপ কোনো বিষয় নয়। বিশ্রাম মূলত ভালভাবে সালাত আদায়ের উপকরণ মাত্র। বিশ্রামের সময়ে মুসল্লী যে কোনো কাজ করতে পারেন, বসে বা শুয়ে থাকতে পারেন, অন্য নামায আদায় করতে পারেন, কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন বা দোয়া বা যিকর-এ রত থাকতে পারেন। এ বিষয়ে কোনো নির্ধারিত কিছুই নেই।
গত কয়েক শতাব্দী যাবত কোনো কোনো দেশে প্রতি চার রাক‘আত পরে একটি নির্ধারিত দোয়া পাঠ করা হয় এবং একটি নির্ধরিত মুনাজাত করা হয়। অনেক সময় দোয়াটি প্রতি ৪ রাক‘আত অন্তে পাঠ করা হয় এবং মুনাজাতটি ২০ রাক‘আত অন্তে পাঠ করা হয়। দোয়াটি নিম্নরূপ:
سُبْحَانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ ، سُبْحَانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظَمَةِ (وَالْهَيْبَةِوَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوتِ ، سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِي لا يَنَامُ وَلا يَمُوتُ (أبَداً أَبَداً)، سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ (رَبُّنَا وَرَبُّ الْمَلائِكَةِ وَالرُّوحِ، (لا إلَهَ إلا اللَّهُ نَسْتَغْفِرُ اللَّهَ ، نَسْأَلُك الْجَنَّةَ وَنَعُوذُ بِك مِنْ النَّارِ)
মুনাজাতটি নিম্নরূপ:
اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلْكَ الْجَنَّةَ وَنَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ بِرَحْمَتِكَ يَا عَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَا جَبَّارُ يَا خَالِقُ يَا بَارُّ اَللّهُمَّ أَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
এ দোয়া ও মুনাজাতের কথাগুলো ভাল, তবে রাসূলুল্লাহর () শেখানো বা আচরিত নয়। তারাবীহের বিশ্রামের সময়ে এগুলো পড়লে কোনে বিশেষ সাওয়াব হবে বলে কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল হাদীসেও বলা হয় নি। এমনকি অন্য কোনো সময়ে তিনি এ বাক্যগুলো এভাবে বলেছেন বা বলতে শিখিয়েছেন বলে বর্ণিত হয় নি। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বা অন্য কোনো ইমাম তারাবীহে এ দুআ-মুনাজাত পড়তে বলেন নি। ১০০০ হিজরী পর্যন্ত রচিত হানাফী ফিকহের কোনো গ্রন্থে এ দুআ ও মুনাজাতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরিশতাদের তাসবীহ হিসেবে এ দুআর কয়েকটি বাক্য বণিত। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহর কিছু ফিরিশতা একটি নূরের সমুদ্রে এ দোয়াটি পাঠ করেন... যে ব্যক্তি কোনো দিবসে, মাসে বা বছরে এ দোয়াটি পাঠ করবে সে এত এত পুরস্কার লাভ করবে। তবে কিয়ামুল্লাইল বা তারাবীহের সাথে এ দুআকে জড়ানো একেবারেই ভিত্তিহীন।[1]
আমাদের উচিত এ সকল বানোয়াট দোয়া না পড়ে এ সময়ে দরুদ পাঠ করা। অথবা কুরআন তিলাওয়াত বা মাসনূন যিক্র-এ মশগুল থাকা।
কোনো কোনো প্রচলিত পুস্তকে তারাবীহের দু রাকআত অন্তে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করতে বলা হয়েছে[2]:
هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّىْ يَا كَرِيْمَ الْمَعْرُوْفِ يَا قَدِيْمَ الإِحْسَانِ أَحْسِنْ إِلَيْنَا بِإِحْسَانِكَ الْقَدِيْمِ ثَبِّتْ قُلُوْبَنَا عَلَى دِيْنِكَ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ
এ দোয়াটিও ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
[1] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৯৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১৪৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩২৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৫৩৮।
[2] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২২৮।
২৯. সালাতুল আওয়াবীনঃ
রাসূলুল্লাহ () নিজে ও তাঁর সাহাবীগণ মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হুযাইফা (রা) বলেন, ‘‘আমি নবীজী ()-র কাছে এসে তাঁর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে ইশা’র সালাত পর্যন্ত নফল সালাতে রত থাকলেন।’’ হাদীসটি সহীহ।[1]
অন্য হাদীসে আনাস (রা) বলেন, ‘‘সাহাবায়ে কেরাম মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতেন এবং নফল সালাত আদায় করতেন।’’ হাদীসটি সহীহ। তাবিয়ী হাসান বসরী বলতেন, মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ের নামাযও রাতের নামায বা তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে।[2]
বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো সাহাবী তাবিয়ীগণকে এ সময়ে সালাত আদায়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।[3]
এ সকল হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে মুমিন কিছু নফল সালাত আদায় করবেন। যিনি যত বেশি সালাত আদায় করবেন তিনি তত বেশি সাওয়াব লাভ করবেন। এ সময়ের সালাতের রাক‘আত সংখ্যা বা বিশেষ ফযীলতে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি।
কিছু জাল বা অত্যন্ত যয়ীফ সনদের হাদীসে এ সময়ে ৪ রাক’আত,  ৬ রাক’আত, ১০ বা ২০ রাক’আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি এ সময়ে ৪ রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জিহাদ করার সাওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কোনো কথা বলার আগে ৬ রাক’আত সালাত আদায় করবে তাঁর ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অথবা তাঁর সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। যে ব্যক্তি এ সময়ে ১০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য জান্নাতে বাড়ি তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি এ সময়ে ২০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য আল্লাহ জান্নাতে বাড়ি তৈরি করবেন। এসকল হাদীস সবই বানোয়াট বা অত্যন্ত যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী এ সময়ে ৬ রাক‘আত নামায আদায় করলে ১২ বছরের সাওয়াব পাওয়ার হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
আমাদের দেশে এ ৬ রাক‘আতে সূরা ফাতিহার পরে কোন্ সূরা পাঠ করতে হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী বলেছেন, সালাতুল মাগরিবের পর থেকে সালাতুল ইশা পর্যন্ত যে নফল সালাত আদায় করা হয় তা ‘সালাতুল আওয়াবীন’ অর্থাৎ ‘বেশি বেশি তাওবাকারীগণের সালাত’।[5] বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () চাশতের নামাযকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]
[1] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১, ৫/৮০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯; আবূ দাউদ, সুনান ২/৩৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[3] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৬।
[4] তিরমিযী, সুনান ২/২৯৮, নং ৪৩৫, ইবনু মাজাহ, সুনান ১/৩৬৯, নং ১১৬৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৫, বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ৩/১৩৩, ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬, শাওকানী, নাইলুল আউতার ৩/৬৫-৬৭, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০।
[5] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ২/১৪; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯।
[6] মুসলিম, সহীহ ১/৫১৫-৫১৬; ইবনু খুযাইমা, সহীহ ২/২২৭-২২৮; হাকিম, মুসতাদরাক ১/৪৫৯।
৩০. সালাতুল হাজাতঃ
ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থে ‘সালাতুল হাজাত’ বা ‘প্রয়োজনের সালাত’ বিষয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটিতে বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে বা কোনো মানুষের কাছে কারো কোনো প্রয়োজন থাকলে সে ওযু করে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করবে এবং এর পর একটি দোয়া পাঠ করে আল্লাহর কাছে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রার্থনা করবে।
ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারী ফাইদ ইবনু আব্দুর রাহমান দুর্বল রাবী। এজন্য হাদীসটি দুর্বল। এ ব্যক্তিকে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস মুনকার, মাতরূক ও মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[1]
আমাদের দেশে ‘সালাতুল হাজাত’ নামে আরো অনেক বানোয়াট পদ্ধতি প্রচলিত। যেমন: ‘‘হাজতের (খেজের আ.)-এর নামাজ। এ নামাজ ২ রাকাত। ... মনের বাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য খেজের (আ) জনৈক বোজর্গ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়াছেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা কাফেরুন দশবার.... ইত্যাদি।’’ এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।[2]
[1] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৩৪৪; ইবনু হাজার, তাহযীব ৬/২২৯; তাকরীব, পৃ. ৪৪৪; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৬১; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১১০।
[2] মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮।
৩১. সালাতুল ইসতিখারাঃ
ইস্তিখারার জন্য সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওযু করে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসতাখীরুকা বি ‘ইলমিকা...’ দোয়াটি পাঠ করতে হবে।[1] কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে এ বিষয়ে বিভিন্ন বানোয়াট পদ্ধতি ও দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বানোয়াট পদ্ধতি নিম্নরূপ: ‘কোনো জিনিসের ভাল মন্দ জানিতে হইলে এশার নামাজের পর এস্তেখারার নিয়তে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়িয়া নিয়া পরে কয়েক মর্তবা দুরূদ শরীফ পাঠ করিয়া ‘ছুবহানাক লা ইলমা লানা ইল্লা মা আল্লামতানা ...’ ১০০ বার পাঠ করিয়া আবার ২১ বার দরূদ শরীফ পাঠ করিয়া পাক ছাপ বিছানায় শুইয়া থাকিবে...।[2]
অন্য পুস্তকে বলা হয়েছে: ‘‘হযরত আলী (কার্রা) বলিয়াছেন যে, স্বপ্নে কোন বিষয়ের ভালমন্দ জানিতে হইলে নিম্নোক্ত নিয়মে রাত্রে শয়ন করিবার পূর্বে দুই রাকাত করিয়া ছয় রাকাত নামায পড়িবে। প্রথম রাকতে সূরা ফাতেহার পরে সূরা ওয়াশ্শামছে ৭ বার ....।’’[3] এটিও ভিত্তিহীন কথা।
[1] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯১, ৫/২৩৪৫, ৬/২৬৯০; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১১/১৮৩।
[2] মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮।
[3] মো. শামছুল হুদা, নেয়ামুল কোর্আন, পৃ. ২০২-২০৩।
৩২. হালকী নফলঃ
রাসূলুল্লাহ () শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায়ের পরে বিত্র আদায় করতেন। এরপর দুই রাক‘আত নফল সালাত আদায় করতেন। একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিত্র-এর পরে দু রাক‘আত নফল সালাত আদায় করলে ‘তাহাজ্জুদ’ বা কিয়ামুল্লাইলের সাওয়াব পাওয়া যায়।[1]
হাদীস দ্বারা এতটুকুই প্রমাণিত। এ বিষয়ক প্রচলিত জাল ও ভিত্তিহীন কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘বেতের নামাজ পড়ার পর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করিলে একশত রাকাত নামাজ পড়ার ছওয়াব হাসিল হয়। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহার পর সূরা একলাছ ৩ বার করিয়া পাঠ করিয়া নামাজ আদায় করিতে হয়...। এগুলি সবই ভিত্তিহীন কথা বলে প্রতীয়মান হয়।[2]
[1] দারিমী, আস-সুনান ১/৪৫২।
[2] মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮।
৩৩. আরো কিছু বানোয়াট ‘নামায’ঃ
বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মনগড়া ও ভিত্তিহীন ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে আরো কিছু ‘নামায’ প্রচলিত রয়েছে সমাজে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হেফজুল ঈমান নামাজ, কাফফারা নামাজ, বুজুর্গী নামাজ, দৌলত লাভের নামাজ, শোকরের নামাজ, পিতামাতর হকের নামাজ, ইত্যাদি ইত্যাদি।[1]
[1] লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০৩-১১৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৫৭-৮৫; মো. বসির উদ্দীন আহমদ, নেক আমল, পৃ. ১৬৮-১৭৫।
৩৪. সপ্তাহের ৭ দিনের সালাতঃ
সপ্তাহের ৭ দিনের দিবসে বা রাতে নির্ধারিত নফল সালাত ও তার ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীসই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা। মুমিন নিয়মিত তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি সালাত আদায় করবেন। এছাড়া যথাসাধ্য বেশি বেশি নফল সালাত তিনি আদায় করবেন। এগুলোর জন্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত সাওয়াবের আশা করবেন। কিন্তু জালিয়াতগণ কাল্পনিক সাওয়াব ও ফযীলতের কাহিনী দিয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছে, যাতে সপ্তাহের প্রত্যেক দিনে ও রাতে বিশেষ বিশেষ সালাতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত্রির নফল নামায, শুক্রবার দিবসের নফল নামায, শনিবার রাত্রির নফল নামায, শনিবার দিনের নামায .... ইত্যাদি নামে প্রচলিত সবই বানোয়াট কথা।
যেমন, আনাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবীর নামে হাদীস হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে এত রাক‘আত সালাত আদায় করবে.... এতে জান্নাতে বালাখানা, ইত্যাদি অপরিমেয় সাওয়াব লাভ করবে। শুক্রবার দিবসে অমুক সময়ে অমুক পদ্ধতিতে এত রাক‘আত সালাত আদায় করবে... এতে এত এত পুরস্কার লাভ করবে...। শনিবার রাত্রিতে যে ব্যক্তি এত রাক‘আত সালাত অমুক পদ্ধতিতে আদায় করবে সে অমুক অমুক পুরস্কার লাভ করবে। শনিবার দিবসে অমুক সময়ে অমুক পদ্ধতিতে এত রাক‘আত সালাত আদায় করলে অমুক অমুক ফল পাওয়া যাবে ....।
এ ভাবে সপ্তাহের ৭ দিনের দিবসে ও রাত্রিতে বিভিন্ন পরিমাণে ও পদ্ধতিতে, বিভিন্ন সূরা বা দোয়া সহকারে যত প্রকারের সালাতের কথা বলা হয়েছে সবই বানোয়াট ও জাল কথা।
আমাদের দেশে প্রচলিত বার চাঁদের ফযীলত, নেক আমল, ওযীফা ইত্যাদি সকল পুস্তকেই এই সব মিথ্যা কথাগুলো হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ মুহাদ্দিসগণ সকলেই এগুলোর জালিয়াতির বিষয়ে একমত।
অনেক সময় অনেক বড় আলিমও জনশ্রুতির উপরে অনেক কথা লিখে ফেলেন। সবার জন্য সব কথা ‘তাহকীক’ বা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না। সপ্তাহের ৭ দিন বা রাতের নামাযও কোনো কোনো বড় আলিম উল্লেখ করেছেন। তবে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল যুগের মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার, জূযকানী, ইবনুল জাওযী, সুয়ূতী, মুহাম্মাদ তাহির পাটনী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আজলূনী, শাওকানী প্রমুখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস।[1]
সালাত বা নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। মুমিন যত বেশি পারবেন তত বেশি নফল সালাত আদায় করতে চেষ্টা করবেন। তবে এর সাথে কোনো মনগড়া পদ্ধতি যোগ করা বা মনগড়া ফযীলতের বর্ণনা দেয়া বৈধ নয়।
[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১১৩-১১৯; যাহাবী, তারতীবুল মাওদূ‘আত, পৃ. ১৫৮-১৬০; ইবনুল কাইয়েম, আল-মানার, পৃ. ৪৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪৯-৫২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৫৮-৮৭; তাহির পাটনী, তাযকিরাতুল মাউদূ‘আত, পৃ. ৪২; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮৮, ২৯৫-২৯৭, ৩২৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা, ২/৫৫৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪৭-৫৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৬৯-৭২।
উৎসঃ হাদীসের নামে জালিয়াতি   ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
(সমাপ্ত)
কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো বিষয় জানতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
 “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
« مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا »
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচিালক-পিএমএমআরসি, গুলশান-ঢাকা।






No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...