Search This Blog

Thursday, December 5, 2019

মিলাদ কিয়ামে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাজির-নাজির বিশ্বাস করা শিরকি আক্বিদাহ।


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মিলাদ কিয়ামে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাজির-নাজির বিশ্বাস করা শিরকি আক্বিদাহ।

ভূমিকাঃ বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের শতকরা ৯৫ জনই যেকোনো অনুষ্ঠানে স্থানীয় কিছু আলেম যেমন, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং আশ পাশের লোকজনকে ডেকে নিয়ে মধুর সুরে ছন্দাকারে মিলাদ কিয়াম পাঠ করে থাকে। এরপর জিলাপী বা মিষ্টি বিতরন করা হয়। আবার যিনি মিলাদ কিয়াম করলেন অর্থাৎ ঐসব হুজুরকে কিছু হাদিয়াও দিয়ে থাকে।
আমি নিজে বেশ কয়েকটি পিরের দরবার ঘুরেছি এবং দেখেছি যে, দরবারে এই মিলাদ কিয়াম খুবই গুরুত্বসহকারে পাঠ করা হয়। অনেকে কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় বেহুশ হওয়া ঐ লোকটি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও পড়ে না, পেশাব করে পানিও নেয় না। বাড়ির সব মহিলারা বেপর্দায় চলাফেরা করে। এরকম হাজারো ফরজ ইবাদত আছে সেগুলো তারা পালন করে না। পির বাবায় বলেছে রাসুল (সাঃ) খুশি থাকলে আল্লাহ খুশি থাকবেন। পির বাবা আর মুরিদরা প্রকাশ্যে বলে থাকে মিলাদ কিয়ামে রাসুল (সাঃ) উপস্থিত হোন এবং সালামের জবাব দেন। সবচেয়ে বড় খবর হলো এরা মিলাদ কিয়াম অনুষ্ঠানে রাসুল (সাঃ) কে দেখে থাকেন।
রাসুল (সাঃ) কখন এলেন, কখন গেলেন সব নাকি তারা দেখে। শুধু তাই নয় তারা ডানে বায়ে তাকালে আল্লাহ তায়ালাকেও নাকি দেখে। স্বপ্নে তো ঘন্টায় ঘন্টায় দেখে। আমি এদেরকে বললাম আপনারা সব দেখেন আমি দেখি না কেনো? তারা জবাবে বলে আমার নাকি সে চোখ নেই। অথচ যারা ফরজ , ওয়াজিব ও সুন্নত ইবাদতের ৯৮% মানে না তারা নাকি আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) কে দেখেন। যাই হোক আলোচ্য বিষয় হলো, মিলাদ কিয়ামে রাসুল (সাঃ) উপস্থিত হয় কিনা।

প্রথমে জেনে নেই দরুদ ও মিলাদ কিয়াম একই কিনা?

বিদআতী পির অলি ও আলেমগণ দরুদ পড়ার দলীল দিয়ে মিলাদ কিয়াম ফরজ করে নিয়েছেন।
আল্লাহ যা করতে বলেন বা নিষেধ করেন তা পালন করা  ফরজ। তেমনি কোরআন ও হাদিসে দরুদ পড়ার হুকুম এসেছে এবং দরুদ ও সালাম কিভাবে পেশ করতে হয় তা রাসুল (সাঃ) শিখে দিয়েছেন।

কোরআন হতে-

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾ (الاحزاب: ٥٦
“নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি সালাত-দরুদ পেশ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি সালাত পেশ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।” (সূরা আহযাব ৫৬ আয়াত)

সহিহ হাদিস হতে-

হাদিস গ্রন্থ রিয়াদুস সলেহিন হতে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করার আদেশ সংক্রান্ত ১১ টি হাদিস নিম্নে দেয়া হলোঃ


নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করার আদেশ, তার মাহাত্ম্য ও শব্দাবলীঃ

(১৪০৫)
 ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আম্‌র আ'স (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, “যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার দরুন তার উপর দশটি রহমত (করুণা) অবতীর্ণ করবেন।"
(মুসলিম) (মুসলিম ৩৮৪, তিরমিযী ৩৬১৪, নাসায়ী ৬৭৮, আবূ দাউদ ৫২৩, আহমাদ ৬৫৩২)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪০৬)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি সব লোকের চাইতে আমার বেশী নিকটবর্তী হবে, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আমার উপর দরূদ পড়বে।”
(তিরমিযী ৪৮৪)
হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস
(১৪০৭)
আওস ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমুআর দিন। সুতরাং ঐ দিন তোমরা আমার উপর অধিকমাত্রায় দরূদ পড়। কেননা, তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।” লোকেরা বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তো (মারা যাওয়ার পর) পচে-গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের দরূদ কিভাবে আপনার কাছে পেশ করা হবে?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ পয়গম্বরদের দেহসমূহকে খেয়ে ফেলা মাটির উপর হারাম করে দিয়েছেন।” (বিধায় তাঁদের শরীর আবহমান কাল ধরে অক্ষত থাকবে।)
(আবূ দাউদ ১০৪৭, ১৫৩১, নাসায়ী ১৩৭৪, ইবনু মাজাহ ১৬৩৬, আহমাদ ১৫৭২৯, দারেমী ১৫৭২)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪০৮)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই অভিশাপ দিলেন যে, “সেই ব্যক্তির নাক ধূলা-ধূসরিত হোক, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হল, অথচ সে (আমার নাম শুনেও) আমার প্রতি দরূদ পড়ল না।” (অর্থাৎ, ‘(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ বলল না।)
(তিরমিযী ৩৫৪৫, আহমাদ ৭৪০২)
হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস
(১৪০৯)
উক্ত রাবী থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা আমার কবরকে উৎসব কেন্দ্রে পরিণত করো না (যেমন কবর পূজারীরা উরস ইত্যাদির মেলা লাগিয়ে করে থাকে)। তোমরা আমার প্রতি দরূদ পেশ কর। কারণ, তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের পেশকৃত দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়।”
(আবূ দাউদ ২০৪২, আহমাদ ৭৭৬২, ৮২৩৮, ৮৫৮৬, ৮৬৯৮, ৮৮০৯)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪১০)
উক্ত রাবী থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে কোনো ব্যক্তি যখন আমার উপর সালাম পেশ করে, তখন আল্লাহ আমার মধ্যে আমার আত্মা ফিরিয়ে দেন, ফলে আমি তার সালামের জবাব দিই।”
(আবূ দাউদ ২০৪১, আহমাদ ১০৪৩৪)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪১১)
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার কাছে আমি উল্লিখিত হলাম (আমার নাম উচ্চারিত হল), অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না।”
(তিরমিযী ৩৫৪৬, আহমাদ ১৭৩৮)
হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস
(১৪১২)
ফাযালা ইবনে উবাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি লোককে নামাযে প্রার্থনা করতে শুনলেন। সে কিন্তু তাতে আল্লাহর প্রশংসা করেনি এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরূদও পড়েনি। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “লোকটি তাড়াহুড়ো করল।” অতঃপর তিনি তাকে ডাকলেন ও তাকে অথবা অন্য কাউকে বললেন, “যখন কেউ দু‘আ করবে, তখন সে যেন তার পবিত্র প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনা যোগে ও আমার প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করে দু‘আ আরম্ভ করে, তারপর যা ইচ্ছা (যথারীতি) প্রার্থনা করে।”
(আবূ দাউদ ১৪৮১, তিরমিযী ৩৪৭৬, ৩৪৭৭, নাসায়ী ১২৮৪, আহমাদ ২৩৪১৯)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪১৩)
আবূ মুহাম্মাদ কা‘ব ইবনে উজরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (একদা) আমাদের নিকট এলেন। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার প্রতি কিভাবে সালাম পেশ করতে হয় তা জেনেছি, কিন্তু আপনার প্রতি দরূদ কিভাবে পাঠাব?’ তিনি বললেন, “তোমরা বলোঃ-
‘আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।’
যার অর্থ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ তথা মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর রহমত বর্ষণ কর; যেমন রহমত বর্ষণ করেছিলে ইব্রাহীমের পরিবারবর্গের উপর। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও অতি সম্মানার্হ। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিজনবর্গের প্রতি বরকত নাযেল কর; যেমন বরকত নাযেল করেছ ইব্রাহীমের পরিজনবর্গের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও মহা সম্মানীয়।”
(সহীহুল বুখারী ৩৩৭০, ৪৭৯৭, ৬৩৫৭, মুসলিম ৪০৬, তিরমিযী ৪৮৩, নাসায়ী ১২৮৭-১২৮৯, আবূ দাউদ ৯৭৬, ইবনু মাজাহ ৯০৪, আহমাদ ১৭৬৩৮, ১৭৬৩১, ১৭৬৬৭, দারেমী ১৩৪২)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪১৪)
আবূ মাসঊদ বদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা সা'দ ইবনে উবাদা (রাঃ)-এর মজলিসে উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কাছে এলেন। বাশীর ইবনে সা‘দ তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মহান আল্লাহ আমাদেরকে আপনার প্রতি দরূদ পড়তে আদেশ করেছেন, কিন্তু কিভাবে আপনার উপর দরূদ পড়ব?’ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরুত্তর থাকলেন। পরিশেষে আমরা আশা করলাম, যদি (বাশীর) তাঁকে প্রশ্ন না করতেন (তো ভাল হত)। ক্ষণেক পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তোমরা বলো,
‘আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।’
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ তথা মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর রহমত বর্ষণ কর; যেমন রহমত বর্ষণ করেছিলে ইব্রাহীমের পরিবারবর্গের উপর। আর তুমি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিজনবর্গের প্রতি বরকত নাযেল কর; যেমন বরকত নাযেল করেছ ইব্রাহীমের পরিজনবর্গের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও মহা সম্মানীয়।
আর সালাম কেমন, তা তো তোমরা জেনেছ।”
(মুসলিম ৪০৫, তিরমিযী ৩২২০, নাসায়ী ১২৮৫, ১২৮৬, আবূ দাউদ ৯৭৯, আহমাদ ১৬৬১৯, ১৬৬২৪, ২১৮৪৭, মুওয়াত্তা মালিক ৩৯৮, দারেমী ১৩৪৩)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(১৪১৫)
আবূ হুমাইদ সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা কিভাবে আপনার প্রতি দরূদ পেশ করব?’ তিনি বললেন, “তোমরা বলো, “আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আযওয়া-জিহি অযুর্রিয়্যাতিহি কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম, অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউ অআলা আযওয়া-জিহি অযুর্রিয়্যাতিহি কামা বারাকতা আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ কর; যেমন তুমি ইব্রাহীমের বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ করেছ। আর তুমি মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর বরকত বর্ষণ কর যেমন তুমি ইবরাহীমের বংশধরের উপর বরকত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত।
(সহীহুল বুখারী ২৩৬৯, ৬৩৬০, মুসলিম ৪০৭, নাসায়ী ১২৯৪, আবূ দাউদ ৯৭৯, ইবনু মাজাহ ৯০৫, আহমাদ ২৩০৮৯, মুওয়াত্তা মালিক ৩৯৭)
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দঃ উল্লেখিত দলীলসমূহের কোথাও মিলাদ কিয়ামের কথা লেখা নেই। পড়তে বলা হয়েছে দরুদ ও সালাম এবং কিভাবে তা পাঠ করবো তা ১৪১৩, ১৪১৪  ও ১৪১৫ নং হাদিসে বলা হয়েছে, সেখানে মিলাদ কিয়াম চালু হলো কিভাবে?


এখন মূল আলোচনায় আসি।

রাসূলুল্লাহ ()-এর ‘ইলমুল গাইব’ ও মীলাদে উপস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি প্রচলিত বানোয়াট কথা যে, তিনি ‘হাযির-নাযির’। হাযির-নাযির দুটি আরবী শব্দ। (حاضر) হাযির অর্থ উপস্থিত ও (ناظر) নাযির অর্থ দর্শক, পর্যবেক্ষক বা সংরক্ষক। ‘হাযির-নাযির’ বলতে বোঝান হয় ‘সর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক’। অর্থাৎ তিনি সদা-সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত বা বিরাজমান এবং তিনি সদা সর্বদা সবকিছুর দর্শক। স্বভাবতই যিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক তিনি সর্বজ্ঞ ও সকল যুগের সকল স্থানের সকল গাইবী জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই যারা রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘হাযির-নাযির’ দাবি করেন, তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি শুধু সর্বজ্ঞই নন, উপরন্তু তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
সম্মানিত পাঠক, নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
প্রথমত: এ গুণটি শুধু আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, বান্দা যেখানেই থাক্ তিনি তার সাথে আছেন, তিনি বান্দার নিকটে আছেন... ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ ()-এর সম্পর্কে কখনোই ঘুণাক্ষরেও কুরআন বা হাদীসে বলা হয় নি যে, তিনি সর্বদা উম্মাতের সাথে আছেন, অথবা সকল মানুষের সাথে আছেন, অথবা কাছে আছেন, অথবা সর্বত্র উপস্থিত আছেন, অথবা সবকিছু দেখছেন। কুরআনের আয়াত তো দূরের কথা একটি যয়ীফ হাদীসও দ্ব্যর্থহীনভাবে এ অর্থে কোথাও বর্ণিত হয় নি। কাজেই যারা এ কথা বলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা কথা বলেন। কোনো একটি সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি বলেছেন ‘আমি হাযির-নাযির’। অথচ তাঁর নামে এ মিথ্যা কথাটি বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা ইমাম কখনোই বলেন নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ () হাযির-নাযির’।
দ্বিতীয়ত: কুরআন-হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () ‘ইলমুল গাইব’ বা গোপন জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করা উক্ত সকল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা।[1]
তৃতীয়ত: আমরা দেখেছি, বিভিন্ন হাদীসে তিনি বলেছেন, উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কবরে উপস্থিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ ()-কে হাযির-নাযির বলে দাবি করার অর্থ দরুদ-সালাম কবরে পৌঁছানোর হাদীসগুলোকে মিথ্যা বলে গণ্য করা। উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কাছে উপস্থিত হয় না, বরং তিনিই উম্মাতের কাছে উপস্থিত হন!! কাজেই যারা এ দাবিটি করছেন, তাঁরা শুধু রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। উপরন্তু তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ  -কে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করেন, নাঊযু বিল্লাহ! নাঊযু বিল্লাহ!!
[1] এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলোর জন্য দেখুন গ্রন্থকার রচিত ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ১৯৬-২০৭।
এ সকল মিথ্যার উৎস ও কারণঃ
এখানে পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ () এরূপ ইলমুল গাইবের অধিকারী, হাযির-নাযির, ইত্যাদি যখন কোনো হাদীসেই বর্ণিত হয়নি এবং কুরআনেও এভাবে বলা হয়নি, তখন কেন অনেক মানুষ এগুলো বলছেন? তাঁরা কি কিছুই বুঝেন না?
এ বইয়ের পরিসরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইলমুল গাইব, হাযির-নাযির ও অন্যান্য বিষয়ে বানোয়াট কথা রাসুলুল্লাহ ()-এর নামে বলার পিছনে দুটি কারণ প্রধান:
প্রথম কারণ: এ বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা বা বিভিন্ন আলিমের কথার উপর নির্ভর করা। পাশাপাশি দ্ব্যার্থবোধক বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের উপর নির্ভর করে সেগুলোকে নিজের মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করা। আর এ সকল দ্ব্যর্থবোধক আয়াত ও হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যাকে বজায় রাখতে অগণিত আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট অর্থকে বিকৃত করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করা।
অতিভক্তির নামে ‘মিথ্যা’ ও মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতে সত্য ওহীর ‘ব্যাখ্যা’ এ দুটিই ধর্ম বিকৃত করে। খৃস্টধর্মের বিকৃতি এর সুস্পষ্ট নমুনা। আমরা মিথ্যা ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তাওহীদকে শিরকে রূপান্তরিত করার কিছু নমুনা উল্লেখ করেছি। বস্ত্তত সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা তিনটি পর্যায়ে ঈসা (আ)-এর ধর্মকে বিকৃত করেন: (১) ঈসার (আ) নামে অতিভক্তিমূলক কিছু কথা প্রচলন করেন, যা তিনি বলেন নি, এমনকি প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান তাঁর বক্তব্যেও তা নেই। (২) ঈসা মাসীহের কিছু দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট কথাকে নিজেদের এ সকল বানোয়াট কথার পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করতে শুরু করেন। (৩) এ সকল মিথ্যা ও ‘দলীল’-এর ভিত্তিতে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথাগুলো নানারকমের ব্যাখ্যা করে বাতিল করতে থাকেন। আল্লাহ বলেন:
 ‘হে কিতাবীগণ, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং ‘তিন’ বলো না ...।[1]
অর্থাৎ আল্লাহ যতটুকু বলেছেন ততটুকুই বল। তাকে আল্লাহর ‘কালিমা’ বল; কারণ আল্লাহ তাকে পিতা ছাড়া ‘হও’ বাক্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে বলো না যে, তিনি আল্লাহর অনাদি-অনন্ত কালাম বা জ্ঞানের মুজাস্সাম বা দেহরূপ। তাঁকে আল্লাহর রূহ বল; কারণ তিনি আল্লাহর সৃষ্ট একটি আত্মা। কিন্তু এ থেকে বাড়িয়ে বলো না যে, যেহেতু তিনি আল্লাহর রূহ কাজেই তিনি আল্লাহর যাতের অংশ ও আল্লাহরই মত জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে আল্লাহকে আল্লাহ (পিতা), কালিমা (পুত্র) ও রূহ (পবিত্র আত্মা) তিন ব্যক্তিতে ভাগ করে ত্রিত্ববাদের শিরকে লিপ্ত হয়ো না।
আল্লাহ তাঁকে ‘আল্লাহর কালিমা’ ও ‘আল্লাহর রূহ’ বলেছেন। প্রচলিত বাইবেলে তিনি আল্লাহকে পিতা বলেছেন, নিজেকে, শিষ্যদেরকে ও সকল মুমিনকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁকে আল্লাহ, আল্লাহর যাতের (সত্তার) অংশ বা ‘তিন আল্লাহর একজন’ বলা হয় নি। অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহর একত্ব, শরীয়ত পালন, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা, মানুষ, গাইব সম্পর্কে অজ্ঞ, আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কাউকে নাজাত দিতে অক্ষম ইত্যাদি বলা হয়েছে। সাধু পল প্রথমে কিছু অতিভক্তিমূলক মিথ্যা চালু করলেন: ঈসা স্বয়ং আল্লাহ, তিনি আল্লাহর যাতের অংশ, আল্লাহর বাক্যের মুজাস্সাম বা দেহরূপ (God Incarnate), তিনি সৃষ্ট নন, বরং জন্ম দেওয়া (ঔরসজাত), তিনি পিতার মতই জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী, মধ্যস্থ ও মুক্তিদাতা, তাকে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত পালন লাগে না... ইত্যাদি। এরপর তাওরাত-ইঞ্জিলের দ্ব্যর্থবোধক কিছু কথার ইচ্ছামাফিক ব্যাখ্যা করে সেগুলিকে ‘দলীল’ হিসেবে পেশ করলেন। এরপর তাদের উদ্ভাবিত ‘মিথ্যা’ ও নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা এ দুটির ভিত্তিতে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের তাওহীদ ও শরীয়ত বিষয়ক সকল নির্দেশ বাতিল করে দেন। ‘‘কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ বইটি পড়লে পাঠক বিস্তারিত জানতে পারবেন।
‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ নামক বইটি পড়লে পাঠক দেখবেন যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে যারা বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যেও একই কারণ বিদ্যমান। খারিজী, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া, মুরজিয়া, মু’তাযিলী ইত্যাদি সকল সম্প্রদায়ই কুরআন-সুন্নাহ মানেন। একটি কারণেই তারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। নিজেদের পছন্দমত কিছু ওহী বহির্ভূত ‘মত’ তৈরি করা, এরপর কুরআন-হাদীসের কিছু দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যকে দলীল হিসেবে পেশ করা। সর্বশেষ এ সকল ‘মত’ ও ‘ব্যাখ্যা’র ভিত্তিতে ওহীর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ব্যাখ্যার নামে বাতিল ও অকার্যকর করা।
‘ইলমুল গাইব’ ও ‘হাযির-নাযির’ বিষয়টি ইসলামের প্রথম কয়েকশত বছর ছিল না। পরবর্তী কালে এর উৎপত্তি। এ বিষয়েও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আসমান-যমীনের মধ্যে কেউ গাইব জানেন না। বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ  ‘গাইব’ জানেন না। মাক্কী সূরায়, মাদানী সূরায়, মদীনায় অবতীর্ণ একেবারে শেষ দিকের সূরায় সকল স্থানেই তা বলা হয়েছে।[2] এর বিপরীতে একটি আয়াতেও বলা হয় নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ () ‘আলিমুল গাইব’। তিনি ‘গাইবের সবকিছু জানেন’ এ কথা তো দূরের কথা ‘তিনি গাইব জানেন’ এ প্রকারের একটি কথাও কোথাও বলা হয় নি। তবে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ বলেছেন, এগুলো গাইবের সংবাদ যা আপনাকে ওহীর মাধ্যমে জানালাম... ইত্যাদি।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ () অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি ‘গাইব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক নয়, তিনি মনের কথা জানেন না, তিনি গোপন কথা জানেন না এবং তিনি ভবিষ্যত জানেন না। আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী (রাঃ) থেকে অনেকগুলো সহীহ সনদে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেয়া হবে না, বাধা দেয়া হবে। আমি বলব : এরা তো আমারই উম্মাত। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّكَ لاَ تَدْرِيْ مَا عَمِلُوا بَعْدَكَ
‘‘আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।’’[3]
এ সকল অগণিত সহীহ হাদীসের বিপরীতে একটি হাদীসেও তিনি বলেন নি যে, আমি ‘আলিমুল গাইব’, বা আমি সকল গোপন জ্ঞানের অধিকারী, অথবা আমি তোমাদের সকল কথাবার্তা বা কাজ কর্মের সময় উপস্থিত থাকি, অথবা আমি ঘরে বসেই তোমাদের সকল কাজ কর্ম ও গোপন বিষয় দেখতে পাই ...  এরূপ কোনো কথাই তিনি বলেন নি।
তবে রাসূলুল্লাহ () ভবিষ্যতের সংবাদ প্রদান করেছেন, অনেক মানুষের গোপন বিষয় বলেছেন, কোনো কোনো হাদীসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্নে বা সালাতে দাঁড়িয়ে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম সবকিছু দেখেছেন। তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে পিছনের মুসল্লীদেরকেও দেখতে পান বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কখনোই বলেন নি যে, তিনি পর্দার আড়ালে, মনের মধ্যে বা দূরের কোনো কিছু দেখেন। বরং বারংবার এর বিপরীত কথা বলেছেন।
এখন মুমিনের দায়িত্ব এ সব কিছু সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করা। কুরআনের বিভিন্ন সুস্পষ্ট আয়াত ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, রাসুলুল্লাহ () ‘গাইব’ জানতেন না। আবার কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে ওহীর মাধ্যমে গাইবের অনেক বিষয় জানিয়েছেন। তাঁর জ্ঞান ছিল সকল নবী-রাসূলের জ্ঞানের চেয়ে বেশি ও পূর্ণতর।
একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো ব্যাখ্যায় যেতে নেই। প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করলেও গুরুত্বের কম বেশি হবে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে। স্পষ্ট কথাকে অস্পষ্ট কথার জন্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বাতিল করা যাবে না। বরং প্রয়োজনে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথার জন্য অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবোধক কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। ‘খবর ওয়াহিদ’ বা একক হাদীসের জন্য কুরআনের স্পষ্ট বাণী বা মুতাওয়াতির ও মাশহূর হাদীস বাতিল করা যাবে না। প্রয়োজনে কুরআন বা প্রসিদ্ধ হাদীসের জন্য একক ও দ্ব্যর্থবোধক হাদীসের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করতে হবে।
[1] সূরা (৪) নিসা: ১৭১ আয়াত।
[2] দেখুন: সূরা (৬) আন‘আম: ৫০, ৫৯; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৮৮; সূরা (৯) তাওবা: ১০১; সূরা (১০) ইউনুস: ২০; সূরা (১১): হূদ: ৩১; সূরা (২১) আম্বিয়া: ১০৯, ১১১; সূরা (২৭) নামল: ৬৫; সূরা(৪৬) আহকাফ: ৯; সূরা (৭২) জিন: ২৫ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১, ১৭৬৬, ৫/২৩৯১, ২৪০৪, ২৪০৬, ৬/২৫৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪।
দলীল ও ব্যাখ্যার তুলনামূলক পর্যালোচনা

যারা রাসূলুল্লাহ -এর ইলমুল গাইবের বা হাযির-নাযির হওয়ার দাবি করেন তাঁরা নিজেদের পছন্দ বা বিভিন্ন আলিমের বক্তব্যের ভিত্তিতে একটি ‘মত’ গ্রহণ করেন। এরপর এ সকল দ্ব্যর্থবোধক বা ফযীলত বোধক আয়াত ও হাদীসকে তাঁদের মতের পক্ষে ব্যাখ্যা করে সে ব্যাখ্যাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। এরপর তাঁদের ‘মত’ ও ‘ব্যাখা’র ভিত্তিতে অগণিত সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে দেন। পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের জন্য এখানে তাঁদের এরূপ কয়েকটি ‘দলীল’ আলোচনা করছি।
প্রথম দলীল: কুরআনে বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ -কে ‘শাহিদ’ ও ‘শাহীদ’ (شاهد وشهيد) বলা হয়েছে।[1] এ শব্দ দুটির অর্থ ‘সাক্ষী’, ‘প্রমাণ’, ‘উপস্থিত’ (witness, evidence, present) ইত্যাদি। সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুফাস্সিরগণ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে () দীন প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে ও সাক্ষীরূপে প্রেরণ করেছেন। যারা তাঁর প্রচারিত দীন গ্রহণ করবেন, তিনি তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এছাড়া পূর্ববর্তী নবীগণ যে তাদের দীন প্রচার করেছেন সে বিষয়েও তিনি এবং তাঁর উম্মাত সাক্ষ্য দিবেন। অনেকে বলেছেন, তাঁকে আল্লাহ তাঁর একত্বের বা ওয়াহদানিয়্যতের সাক্ষী ও প্রমাণ-রূপে প্রেরণ করেছেন।[2]
এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক স্থানে মুমিনগণকেও মানব জাতির জন্য ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[3]  অনেক স্থানে আল্লাহকে ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[4]
যারা রাসূলুল্লাহ ()-কে ‘সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী’ বা ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন তাঁরা এই ‘দ্ব্যর্থবোধক’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন। এরপর সেই অর্থের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআনের সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী বাতিল করে দেন। তাঁরা বলেন, ‘শাহিদ’ অর্থ উপস্থিত। কাজেই তিনি সর্বত্র উপস্থিত। অথবা ‘শাহিদ’ অর্থ যদি সাক্ষী হয় তাহলেও তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ না দেখে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। আর এভাবে তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাযির-নাযির ও সকল স্থানের সকল গোপন ও গাইবী জ্ঞানের অধিকারী।
তাঁদের এ ব্যাখ্যা ও দাবির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
প্রথমত: তাঁরা এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মতামত গ্রহণ না করে নিজেদের মর্জি মাফিক ব্যাখ্যা করেন এবং সাহাবী-তাবিয়ীদের ব্যাখ্যা বাতিল করে দেন।
দ্বিতীয়ত: তাঁরা একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যাকে মূল আকীদা হিসাবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন। তাঁরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করলেন, যে অর্থে একটি দ্ব্যর্থহীন আয়াত বা হাদীসও নেই। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা কোনো ইমামও কখনো এ কথা বলেন নি।
তৃতীয়ত: তাঁদের এ ব্যাখ্যা ও দাবি মূলতই বাতিল। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রত্যেক মুসলিমকেই ‘ইলমে গাইবের অধিকারী’ ও হাযির-নাযির বলে দাবি করতে হবে। কারণ মুমিনগণকেও কুরআনে ‘শাহীদ’ অর্থাৎ ‘সাক্ষী’ বা ‘উপস্থিত’ বলা হয়েছে এবং বারংবার বলা হয়েছে যে, তাঁরা পূর্ববর্তী সকল উম্মাত সহ পুরো মানব জাতি সম্পর্কে কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবেন। আর উপস্থিত না হলে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। কাজেই তাঁদের ব্যাখ্যা ও দাবি অনুসারে বলতে হবে যে, প্রত্যেক মুমিন সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান এবং সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। কারণ না দেখে তাঁরা কিভাবে মানবজাতির পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন?!
দ্বিতীয় দলীল: কুরআন কারীমে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
 ‘‘নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর (closer) এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। এবং আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর।’’[5]
এখানে ‘আউলা’ (أولى) শব্দটির মূল হলো ‘বেলায়াত’  (الولاية), অর্থাৎ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ‘আউলা’ অর্থ ‘অধিকতর ওলী’। অর্থাৎ অধিক বন্ধু, অধিক নিকটবর্তী, অধিক যোগ্য বা অধিক দায়িত্বশীল (more entitled, more deserving, worthier, closer)।
এখানে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর (closer) বলতে ভক্তি, ভালবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতা বুঝানো হচ্ছে। মুমিনগণ রাসূলুল্লাহকে তাঁদের নিজেদের চেয়েও বেশি আপন, বেশি প্রিয় ও আনুগত্য ও অনুসরণের বেশি হক্কদার বলে জানেন। এই ‘আপনত্বের’ একটি দিক হলো যে, তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আবার উম্মাতের প্রতি রাসূলুল্লাহ ()-এর দরদ ও প্রেম উম্মাতের আপনজনদের চেয়েও বেশি। রাসূলুল্লাহ () স্বয়ং এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেছেন। জাবির, আবূ হুরাইরা প্রমুখ সাহাবী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন:
‘‘প্রত্যেক মুমিনের জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতে আমি তার অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর বাণী পাঠ কর: ‘‘নবী মু’মিনগণের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর’’। কাজেই যে কোনো মুমিন যদি মৃত্যুবরণ করে এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীগণ যারা থাকবে তারা সে সম্পদ গ্রহণ করবে। আর যদি সে ঋণ রেখে যায় বা অসহায় সন্তান-সন্ততি রেখে যায় তবে তারা যেন আমার কাছে আসে; তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে। কারণ আমিই তার আপনজন।’’[6]
কিন্তু ‘হাযির-নাযির’-এর দাবিদারগণ দাবি করেন যে, এখানে দৈহিক নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই তিনি সকল মুমিনের কাছে হাযির আছেন।
এখানেও আমরা দেখছি যে একটি বানোয়াট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তারা কুরআন ও হাদীসে অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ()-এর ব্যাখ্যাকেও গ্রহণ করছেন না। সর্বোপরি তাদের এ ব্যাখ্যা সন্দেহাতীতভাবেই বাতিল। কারণ এ আয়াতেই বলা হয়েছে যে ‘‘আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর’’। অন্যত্রও বলা হয়েছে যে, ‘‘আত্মীয়গণ একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর।’’[7] তাহলে এদের ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের বলতে হবে যে, সকল মানুষই হাযির নাযির। কারণ সকল মানুষই কারো না কারো আত্মীয়। কাজেই তারা সদাসর্বদা তাদের কাছে উপস্থিত এবং তাদের সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন!
অন্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী () ও মুমিনগণ মানুষদের মধ্যে ইবরাহীম (আ)-এর সবচেয়ে ‘নিকটতর’ বা ‘ঘনিষ্ঠতর’ (أولى)।[8] এখানে দাবি করতে হবে যে, সকল মুমিন ইবরাহীমের নিকট উপস্থিত...!
অন্য হাদীসে ইবনু আববাস (রা) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ () মদীনায় আগমন করেন, তখন ইহূদীদের আশূরার সিয়াম পালন করতে দেখেন। তিনি তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তারা বলে, এ দিনে আল্লাহ মূসা (আ) ও ইস্রাঈল সন্তানদেরকে ফেরাউনের উপর বিজয় দান করেন। এজন্য মূসা (আ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিন সিয়াম পালন করেন। তখন তিনি বলেন:
نَحْنُ أَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ (مِنْهُمْ) وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
‘‘তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ)-এর নিকটতর। একথা বলে তিনি এ দিনে সিয়াম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন।’’[9] এখন আমাদের দাবি করতে হবে যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য মূসার কাছে উপস্থিত!!
তৃতীয় দলীল: আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
একদিন রাসূলুল্লাহ  আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন। সালাতের পরে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে (মিম্বরে আরোহণ করে) তিনি বলেন: হে মানুষেরা, আমি তোমাদের ইমাম। কাজেই তোমরা আমার আগে রুকু করবে না, সাজদা করবে না, দাঁড়াবে না এবং সালাত শেষ করবে না। (অন্য বর্ণনায়: কাতারগুলো পূর্ণ করবে।) কারণ আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই আমার সামনে এবং আমার পিছনে, যখন তোমরা রুকু কর এবং যখন তোমরা সাজদা কর। (অন্য বর্ণনায়: সালাতের মধ্যে এবং রুকুর মধ্যে আমি আমার পিছন থেকে তোমাদেরকে দেখি যেমন আমি সামনে থেকে তোমাদেরকে দেখি।)[10]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ  বলেন:
‘‘তোমরা কি এখানে আমার কিবলাহ দেখতে পাচ্ছ? আল্লাহর কসম, তোমাদের রুকু, সাজদা এবং বিনম্রতা আমার কাছে অপ্রকাশিত থাকে না এবং আমি তোমাদেরকে আমার পিঠের পিছনে দেখি।’’[11]
এ হাদীস থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ ()-এর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারছি। তা হলো অন্যান্য মানুষ যেভাবে সামনে দেখে রাসূলুল্লাহ () পিছনেও সেভাবে সাহাবীগণের রুকু-সাজদা ইত্যাদি দেখতেন। ইসলামী আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এখানেও তিনটি ধারা বিদ্যমান:
(ক) মুতাযিলী ও ‘আকল’ বা জ্ঞানবুদ্ধির অনুসারী বলে দাবিদার কিছু মুসলিম। তাঁরা সহীহ হাদীসে প্রমাণিত এ বিষয়টিকে তাঁর ‘বাশারিয়্যাত’ বা মানবত্বের সাথে সাংঘর্ষিক বলে কল্পনা করে এ অর্থের হাদীসগুলি ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন: এখানে ‘দেখি’ অর্থ ‘ধারণা করি’, কারণ ‘দেখা’ আরবীতে ‘ধারণা’ বা মনের দেখা অর্থে ব্যবহৃত হয়, অথবা দেখি অর্থ আমাকে সংবাদ দেওয়া হয়... ইত্যাদি। তাঁদের দাবি: কুরআন প্রমাণ করে যে, তিনি মানুষ, আর মানুষ পিছনে দেখতে পরে না, অতএব কুরআনের অর্থ সংরক্ষণের জন্য এ হাদীসের এরূপ ব্যাখ্যা জরুরী। তাঁরা দাবি করেন, তাদের এ ব্যাখ্যা আরবী ভাষা ও কুরআন-হাদীসের ব্যাবহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে এরূপ ব্যাখ্যা ওহীর বিকৃতি মাত্র। মানবত্ব ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বৈপরীত্য কল্পনা করার কারণেই এ বিকৃতি।
(খ) শীয়া ও পরবর্তীকালে সুন্নীগণের মধ্যকার অতিভক্তিতে নিমজ্জিত মুসলিমগণ। তাঁরা ‘পিছনে দেখা’-র এ হাদীসটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন, তা হলো: ‘বিশ্বের সকল স্থান ও সময়ের সবকিছু দেখতে পাওয়া’। এর ভিত্তিতে তাঁরা তাঁকে ‘আলিমুল গাইব’ ও ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন। এরপর তাঁর বাশারিয়্যাত বিষয়ক ও ‘গাইব না জানা’ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যাপূর্বক বাতিল করেন।
(গ) সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ধারা। তাঁরা বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব ও ‘পশ্চাত-দর্শন’ উভয় বিষয়কে স্বাভাবিক ও প্রসিদ্ধ অর্থে গ্রহণ করেন এবং সরল অর্থে বিশ্বাস করেন।
হাদীসটি পাঠ করলে বা শুনলে যে কেউ অনুভব করবেন যে, বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও দর্শনের বিষয়ে। মানুষ যেরূপ সামনের দিকে দেখতে পায়, রাসূলুল্লাহ () সালাতের মধ্যে সেভাবেই পিছনে দেখতে পেতেন। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায় যে, এ দর্শন ছিল সালাতের মধ্যে ও রুকু সাজদার মধ্যে। অন্য সময়ে তিনি এইরূপ দেখতেন বলে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তা সত্ত্বেও যদি তা মনে করা হয় যে, তিনি সর্বদা এইরূপ সামনে ও পিছনে দেখতে পেতেন, তবুও এ হাদীস দ্বারা কখনোই বুঝা যায় না যে, তিনি দৃষ্টির আড়ালে, ঘরের মধ্যে, পর্দার অন্তরালে, মনের মধ্যে বা অনেক দূরের সবকিছু দেখতে পেতেন। তা সত্ত্বেও যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত ও বিরোধী না হতো, তবে আমরা এই হাদীস থেকে দাবি করতে পারতাম যে, তিনি এভাবে সর্বদা সর্বস্থানের সর্বকিছু দেখতেন এবং দেখছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন আয়াতে ও অগণিত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বারংবার এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। মূলত মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়মত রাসূল ()-কে এরূপ ঝামেলা ও বিড়ম্বনাময় দায়িত্ব থেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী বলেন:
‘‘হাদীসের বাহ্যিক বা স্পষ্ট অর্থ থেকে বুঝা যায় যে, পিছন থেকে দেখতে পাওয়ার এ অবস্থাটি শুধুমাত্র সালাতের জন্য খাস। অর্থাৎ তিনি শুধু সালাতের মধ্যেই এইরূপ পিছন থেকে দেখতে পেতেন। এমনও হতে পারে যে, সর্বাবস্থাতেই তিনি এইরূপ দেখতে পেতেন।.... দাঊদী[12] নামক ব্যাখ্যাকার একটি উদ্ভট কথা বলেছেন। তিনি এ বর্ণনায় ‘পরে’ শব্দটির অর্থ ‘মৃত্যুর পরে’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে পেশ করা হবে। সম্ভবত তিনি আবূ হুরাইরার (রা) হাদীসের সামগ্রিক অর্থ চিন্তা করেন নি, যেখানে এ কথার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে...।[13]
এখানে লক্ষণীয় যে, দাঊদীর যুগ বা হিজরী ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত এরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাকারীরাও ‘দেখা’ বলতে ‘উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে উপস্থিত করা হলে দেখেন’ বলে দাবি করতেন। তিনি মদীনায় নিজ কবরে অবস্থান করে সবত্র সবকিছু দেখেন অথবা সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত হয়ে সব কিছু দেখেন বলে কেউ কল্পনা করে নি। সর্বোপরি পিছনে ‘দেখা’ বা ‘গায়েবী দেখা’ দ্বারা ‘সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিতি’ বা সবকিছু দেখা প্রমাণিত হয় না। কুরআনে বলা হয়েছে যে, শয়তান ও তার দল মানুষদেরকে গায়েবীভাবে দেখে:
‘‘সে (শয়তান) ও তার দল তোমাদিগকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।’’[14]
এখানে কি কেউ দাবি করবেন যে, যেহেতু ‘‘তেমাদিগকে দেখে’ (يراكم) বর্তমান কালের ক্রিয়া, সেহেতু শয়তান ও তার দলের প্রত্যেকে ‘হাযির ও নাযির’: তারা সদা সর্বদা সকল স্থানের সকল মানুষকে একই ভাবে দেখছে?
চতুর্থ দলীল: বিভিন্ন হাদীসে উম্মাতের বিভিন্ন কর্ম রাসূলুল্লাহ -এর নিকট পেশ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উম্মাতের দরুদ-সালাত তাঁর নিকট পেশ করা হয় অর্থে অনেকগুলো সহীহ হাদীস বর্ণিত। এছাড়া উম্মাতের সাধারণ কর্মও তাঁর নিকট পেশ করা হয় অর্থে হাদীস বর্ণিত।
এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
‘‘আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর; তোমরা কথা বল এবং আমিও তোমাদের সাথে কথা বলি। এবং আমার মৃত্যু তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমাদের কর্ম আমার কাছে পেশ করা হবে। আমি ভালকর্ম দেখলে  সেজন্য আল্লাহর প্রশংসা করব এবং খারাপকর্ম দেখলে তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছ ক্ষমা চাইব।’’ ইমাম হাইসামী বলেন: সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস সনদের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন।[15]
এরূপ একটি বক্তব্য  প্রসিদ্ধ তাবিয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব (৯০ হি) থেকেও দুর্বল সনদে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ কিভাবে উম্মাতের জন্য ‘‘শাহিদ’’ হবেন বা সাক্ষ্য দিবেন তা ব্যাখ্যা করতে ইবনুল মুসাইয়িব বলেন:  
‘‘প্রতি দিনই সকালে বিকালে রাসূলুল্লাহ -এর সামনে তাঁর উম্মাতকে পেশ করা হয়, ফলে তিনি তাদেরকে তাদের নামে ও কর্মে চিনতে পারেন। এজন্য তিনি তাদের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’[16]
উম্মাতের আমল রাসূলুল্লাহ ()-এর নিকট পেশ করার এ সকল হাদীসকে তাঁর ‘হাযির-নাযির’ ও ‘আলিমুল গাইব’ হওয়ার ‘দলীল’ হিসেবে পেশ করা হয়। এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:
(১) উপরের হাদীসটি এবং সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িবের বক্তব্য নিশ্চিতভাবে ‘হাযির-নাযির’ ও ‘আলিমুল গাইব’ মতটি বাতিল প্রমাণ করে। কারণ এগুলি প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সদা-সর্বদা সবত্র হাযির (উপস্থিত) বা সবকিছুর নাযির (দর্শক) নন; বরং বরং উম্মাতের আমল তাঁর কাছে ‘হাযির’ করা হলে তিনি শুধু ‘আমলের’ নাযির বা দর্শক হন। তিনি উম্মাতের নিকট হাযির হন না; বরং উম্মাতের আমল তাঁর নিকট হাযির করা হয়।
(২) আমরা দেখেছি যে, দশজনেরও অধিক সাহাবী থেকে অনেক সহীহ সনদে বর্ণিত, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, তাঁর ওফাতের পরে সাক্ষী বা হাযির-নাযির হয়ে উম্মাতের সকল কর্ম দেখাশুনা করার ঝামেলা মহান আল্লাহ তাঁকে দেন নি। বরং তাদের অনেকের পরিবর্তন-উদ্ভাবন তিনি জানবেন না। দু-একটি দুর্বল বা একক হাদীসের মর্যিমাফিক ‘‘ব্যাখ্যা’’-কে আকীদার মূল বানিয়ে তার ভিত্তিতে কুরআন এবং মুতাওয়াতির হাদীসগুলির সুস্পষ্ট নির্দেশনা ব্যাখ্যার নামে বাতিল করার অর্থ ‘মিথ্যা’ ও ‘ব্যাখ্যা’ দ্বারা ধর্ম বিকৃত করা।
চতুর্থ দলীল: মহান আল্লাহ বলেন:
‘‘তুমি কি দেখ নি কেমন করলেন তোমার রব হস্তীবাহিনীর সাথে।’’[17]
রাসূলুল্লাহ ()-এর ‘‘হাযির নাযির’’ ও ‘‘ইলমুল গাইব’’ প্রমাণ করতে এ আয়াত উল্লেখ করা হয়। তাঁরা বলেন, এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ () তাঁর জন্মের পূর্বেও আবরাহার হস্তীবাহিনীর বিপর্যয় দেখেছিলেন। এথেকে বুঝা যায় যে, তিনি পূর্বের ও পরের সকল কিছু দেখেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং সদা-সর্বত্র হাযির বা বিরাজমান!!
এদের কেউ হয়ত সত্যিই অজ্ঞ এবং কেউ জ্ঞানপাপী। তা নাহলে আরবী ভাষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকলেই জানেন যে, আরবীতে ‘‘দেখা’’ বলতে শুধু চক্ষুর দেখা বুঝানো হয় না, জানা বা জ্ঞানলাভও বুঝানো হয়। কুরআনে এরূপ ব্যবহার অগণিত। দুটি নমুনা দেখুন। কাফিরদের বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন:
‘‘তারা কি দেখে নি আমি ধ্বংস করলাম তাদের পূর্বে কত জাতি?’’[18]
তাঁদের যুক্তির ধারায় এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবূ জাহল-সহ সকল কাফিরই ‘‘হাযির-নাযির’’ বা অতীত-বর্তমান সবকিছুর দর্শক। তারা নূহ (আ) এবং অন্যান্য নবীদের (আ) যুগের কাফিরগণের ধ্বংসলীলার সময় উপস্থিত ছিল ও তা অবলোকন করেছিল!! অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
 ‘‘তোমরা কি দেখ নি কিভাবে সৃষ্টি করলেন আল্লাহ সপ্ত আসমানকে স্তর-বিন্যস্তকরে?’’[19]
আমরা কি বলব যে, কুরআন পাঠকারী ও শ্রোতা সকলেই সপ্ত আকাশ সৃষ্টির সময় ‘‘হাযির’’ বা উপস্থিত ছিলেন এবং তা অবলোকন করেছিলেন?!
‘‘হাযির-নাযির’’, ‘‘ইলমুল গাইব’’ ইত্যাদি বিষয়ের সকল ‘‘দলীল’’-ই এরূপ। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে এ সকল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যারা বলেন, তাঁরা তাঁদের কথাগুলোর পক্ষে একটিও দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করছেন না। তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক বা দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত বা হাদীসকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং এরপর এরূপ ব্যাখ্যার উপরে নির্ভর করে তাঁরা অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীস বাতিল করে দেন। যারা এরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান তাঁদের অনেকের নেক নিয়্যাত ও ভক্তি-ভালবাসা হয়ত নির্ভেজাল। তবে তাঁরা ভাল উদ্দেশ্যে ওহীর নামে মিথ্যা বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে এমন কথা বলেছেন যা তিনি কখনোই নিজের বিষয়ে বলেন নি।
দ্বিতীয় কারণ: এ সকল কথাকে রাসূলুল্লাহ ()-এর মর্যাদা-বৃদ্ধিকর বলে মনে করা এবং এ সকল কথা বললে তাঁর প্রতি ভক্তি, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি বা পূর্ণতা পাবে বলে মনে করা।
নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ()-এর ভক্তি ও ভালবাসা এবং তাঁর প্রশংসা করা ঈমানের মূল ও মুমিনের অন্যতম সম্বল। তবে এ জন্য কুরআনের অগণিত আয়াত ও অগণিত সহীহ হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশের বাইরে আমাদের যয়ীফ, মিথ্যা, বানোয়াট কথা বলতে হবে, বা যুক্তি, তর্ক, ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি দিয়ে কিছু কথা বানাতে হবে এ ধারণাটিই ইসলাম বিরোধী।
সর্বোপরি, আমরা যে বিষয়টিকে তাঁর জন্য মর্যাদাকর বলে মনে করছি সেটা প্রকৃতপক্ষে অমর্যাদাকর হতে পারে। হাযির-নাযির বিষয়টিই দেখুন। আমরা জানি, মর্যাদাহীন ব্যক্ত্যিই মর্যাদাশীল ব্যক্তির নিকট ‘হাযির’ হন। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, প্রশাসক, বিচারক এবং সকল পর্যায়ের মর্যাদাময় মানুষদের কাছে সাধারণ মানুষেরা ‘হাযির’ হন। এ সকল মর্যাদাময় মানুষেরা কখনোই সাধারণ মানুষদের কাছে ‘হাযিরা’ দিয়ে বেড়ান না। প্রয়োজনে কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ মানুষদের তথ্যাদি নিয়ে তাদের কাছে হাযির হন।
 সহীহ হাদীসগুলো রাসূলুল্লাহ -এর এ মর্যাদাই প্রমাণ করেছে। তিনি তাঁর পবিত্র কবরে অবস্থান করছেন। মহান আল্লাহ অগণিত ফিরিশতা নিয়োগ করেছেন যারা পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর নিকট পেশ করেন। এটিই তো মর্যাদার পূর্ণতা। কিন্তু অতিভক্তির নামে যদি কেউ দাবি করেন যে, তিনি নিজেই উম্মাতের দ্বারে দ্বারে হাযিরা দিয়ে বেড়ান তবে তা তাঁর মর্যাদা বাড়াবে না কমাবে তা পাঠক একটু চিন্তা করুন।
এজন্য মুমিনের নাজাতের একমাত্র উপায় সকল ক্ষেত্রে বিশেষত, আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহর উপর নির্ভর করা। আমলের ক্ষেত্রে কোনো আমল কারো জন্য জরুরী আর কারো জন্য কম জরুরী বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের বিষয় তা নয়। তা সকলের জন্য সমান। এজন্য আলিমগণ বলেছেন যে, বিশ্বাসের ভিত্তি হবে কুরআন কারীম বা মুতাওয়াতির হাদীসের উপর। অর্থাৎ যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সে বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ () তাঁর সকল সাহাবীকে জানিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই জানিয়েছেন। আর এরূপ বিষয় অবশ্যই কুরআনে থাকবে বা ব্যাপক প্রচারিত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসে থাকবে।
বিশ্বাসের ভিত্তি ‘গাইবী’ বিষয়ের উপরে। এ সকল বিষয়ে ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফয়সালা দেয়া যায় না। কর্ম বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে সুস্পষ্ট বিধান নেই এরূপ অনেক নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হয়, এজন্য সেক্ষেত্রে কিয়াস ও ইজতিহাদের প্রয়োজন হয়। যেমন মাইক, ধুমপান ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেরূপ নয়। এগুলোতে নতুন সংযোজন সম্ভব নয়। এজন্য আকীদা বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন ইমামগণ।[20] আল্লাহর গুণাবলি, নবীগণের সংখ্যা, মর্যাদা, ফিরিশতাগণের সংখ্যা, সৃষ্টি, কর্ম, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইজতিহাদের কোনো সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যেভাবে যতটুকু বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা ওহীর কথাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারি না।
এজন্য মুমিনের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, কুরআন কারীমের সকল কথাকে সমানভাবে গ্রহণ করা এবং কোনো কথাকে প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কথাকে বাতিল বা ব্যাখ্যা না করা। অনুরূপভাবে সকল সহীহ হাদীসকে সহজভাবে মেনে নেয়া। ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে সাহাবীগণের অনুসরণ করা। যে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু নেই এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি, সে বিষয়ে চিন্তা না করা, কথা না বলা ও বিতর্কে না জড়ানো।
দলীলের উৎসঃ
[1] সূরা (৩৩) আহযাব: ৪৫; সূরা (৪৮) ফাত্হ: ৮; সূরা (৭৩) মুয্যাম্মিল: ১৫; সূরা (২) বাকারা: ১৪৩; সূরা (৪) নিসা: ৪১; সূরা (১৬) নাহ্ল: ৮৯; সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর ২২/১৮, ২৬/৭৩; ইবন কাসীর, তাফসীর ৩/৪৯৮।
[3] সূরা (২) বাকারা, ১৪৩; সূরা (২২) হজ্জ, ৭৮ আয়াত।
[4] সূরা (৪) নিসা: ৭৯, ১৬৬; সূরা (৫) মায়িদা: ১১৭; সূরা (১০) ইউনূস: ২৯; সূরা (১৩) রা’দ: ৪৩; সূরা (১৭) ইসরা (বানী ইসরাঈল): ৯৬; সূরা (২৯) আনকাবূত: ৫২; সূরা (৩৩) আহযাব: ৫৫; সূরা (৪৬) আহকাফ: ৮; সূরা (৪৮) ফাত্হ: ২৮ আয়াত।
[5] সূরা (৩৩) আহযাব, ৬ আয়াত।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮০৫, ৮৪৫, ৪/১৭৯৫; ৫/২০৫৪; ৬/২৪৭৬, ২৪৮০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৯২, ৩/১২৩৭, ১২৩৮।
[7] সূরা (৮) আনফাল: ৭৫ আয়াত।
[8] সূরা (৩) আল-ইমরান, ৬৮।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৪৪, ১৪৩৪, ১৭৬৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৫।
[10] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬২, ২৫৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩২০, ৩২৪।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৫৯।
[12] আবূ জাফর আহমাদ ইবনু সাঈদ দাঊদী নামক একজন আলিম সহীহ বুখারীর একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন। তাঁর পরিচয় বা ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ইবনু হাজার আসকালানী ফাতহুল বারী রচনায় এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি থেকে অনেক সময় উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন।
[13] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫১৫, ২/২২৫।
[14] সূরা : ৭ আ’রাফ, ২৭ আয়াত।
[15] বায্যার, আল-মুসনাদ ১/৩০৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৮/৫৯৪; বূসীরী, ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহারাহ ৭/৭৪;& আলবানী, যায়ীফাহ ২/৪০৪-৪০৬; হুওয়াইনি, আল-ফাতাওয়া আল-হাদীসিয়্যাহ (শামিলা) ২/১৪-১৫।
[16] কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল মাওতা ও উমূরিল আখিরাহ, পৃ. ২৪৯; আল-জামিয় লি আহকামিল কুরআন ৫/১৯৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫০০।
[17] সূরা (১০৫) ফীল: ১ আয়াত।
[18] সূরা (৬) আনআম: ৬ আয়াত।
[19] সূরা (৭১) নূহ: ১৫ আয়াত।
[20] বিস্তারিত দেখুন: গ্রন্থকার রচিত: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৭০-৭৩।
প্রশ্ন
রাসুল (সাঃ) সত্যিই কি মিলাদ-কিয়াম অনুষ্ঠানে হাজির-নাজির হোন?
জবাবঃ
মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই চলে আসছে হক্ব ও বাতিলের দ্বন্দ ও সংঘাত। যুগে যুগে এ দ্বন্দ ও সংঘাতকে মিটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে আগমন করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূল, ওলামা-মাশায়েখ সংগ্রমী ও মহাপুরুষগণ। বাতিলের অবসান ঘটিয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠা করতে সবাই করেছেন আমরণ সংগ্রাম।
বর্তমানেও বাতিলের সয়লাবে আচ্ছাদিত হয়ে আছে আমাদের দেশ ও সমাজ। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে বিশ্বমানবতার মুক্তির কান্ডারী, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র যবান থেকে নিসৃত হয়েছে অমীয় বাণী, “আমার উম্মত এমন এক যমানার সম্মুখীন হবে যখন ঈমান নিয়ে টিকে থাকা জলন্ত অঙ্গার হাতে রাখার ন্যায় কষ্টকর হবে”। -সুনানে তিরমিযী: হা. নং-২২৬০, মুসনাদে আহমাদ: হা. নং-৯০৭৩।
সেই মহামানবের চিরন্তন বাণীর জলন্ত বাস্তবায়ন মনে হয় বর্তমান মুসলিম উম্মাহর ক্ষণে ক্ষণে অনুভব হচ্ছে। দেশী-বিদেশী, জাতি-বিজাতী চতুর্মূখী হায়েনাদের আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত আজ মুসলিম উম্মাহর সস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করার স্থানটুকুও নেই। নেই ঈমান-আকীদা নিয়ে বেঁচে থাকার মত সুন্দর ও নিরাপদ কোন পরিবেশ। চারিদিকে চলছে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা ও বাড়াবাড়ি। যার ফলে আজ দীনের নামে বদ-দীন এবং শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারে ছেয়ে গেছে সমাজ।
এমনি এক বহুল প্রচলিত বিদ‘আত ও কুসংস্কার হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করা। এর ভ্রান্তি সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করা হল:-
হাযির ও নাযির (حاضر و ناظر) শব্দ দু’টি আরবী শব্দ। হাযির অর্থ সর্বস্থানে সর্বাবস্থায় উপস্থিত বা বিদ্যমান। আর নাযির অর্থ সর্বদ্রষ্টা। যখন এ দু’টি শব্দকে একত্রে মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়, তখন অর্থ হয় ঐ সত্ত্বা; যার অস্তিত্ব বিশেষ কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নয় বরং তাঁর অস্তিত্ব একই সময়ে গোটা দুনিয়াকে বেষ্টন করে রাখে এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিষের শুরু থেকে শেষ অবস্থা পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টির সামনে থাকে।
হাযির নাযির সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকীদা:
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সকলেই একমত যে, পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে হাযির-নাযির কথাটি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারেই প্রযোজ্য হয়। হাযির-নাযির হওয়া একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই সিফাত। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেহ এসব গুনের অধিকারী হতে পারে না। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা কোন পীর-বুযুর্গ, ওলী-দরবেশও হাযির-নাযির হতে পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা কোন পীর-বুযুর্গ, ওলী-দরবেশকে হাযির-নাযির বলে বিশ্বাস করা কুফুর ও শিরকের শামিল এবং ইসলামী আক্বীদার পরিপন্থী কাজ।
হাযির-নাযির সম্পর্কে বিদ‘আতীদের আকীদা:
বিদ‘আতীদের আকীদা হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযির বা সর্বত্র বিরাজমান। তাদের এই বিশ্বাসের পেছনে মীলাদে ‘কিয়াম’ করার স্বপক্ষে দলীল দাঁড় করানোর চিন্তা-চেতনা কাজ করছে। তা এভাবে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে দুরূদ পাঠ করা হলে, তিনি তা জানেন এবং দেখেন। কারণ তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তাই তাঁর উপস্থিতিতে ‘কিয়াম’ করতে হবে। তাদের আকীদা মতে শুধু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামই নন; বরং সকল বুযুর্গানে দীনও হাযির-নাযির সর্বত্র বিদ্যমান। তারাও পৃথিবীর সব কিছুকে হাতের তালুর মত দেখতে পান। তারা দূরের ও কাছের আওয়াজ শুনতে পান। মুহুর্তের মধ্যে গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন এবং হাজার হাজার মাইল দূরের হাজতমন্দ ব্যক্তির হাজত পূরণ করতে পারেন।
খন্ডন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযির এ কথার দ্বারা যদি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বত্র শারীরিকভাবে বিদ্যমান থাকা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা অযৌত্তিক এবং সুস্পষ্ট ভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। কারণ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওযা মুবারকে আরাম করছেন এবং সমস্ত আশেকীনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে গিয়ে হাজিরা দেন, তাঁর রওযা মুবারক যিয়ারত করেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বত্র ‘হাযির-নাযির’  দ্বারা যদি তাঁর ‘রূহানী হাজিরী’ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে অর্থাৎ এটা বোঝানো হয় যে, দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র রূহের জন্য সর্বস্থানে বিচরণ করার অনুমতি রয়েছে, তাহলে বলা হবে, সর্বস্থানে বিচরণের অনুমতি থাকার দ্বারা বাস্তবেই সর্বস্থানে উপস্থিত থাকা জরূরী নয়। বরং তিনি রওযা মুবারকে আরাম করছেন। অতএব এখন যদি কেউ অন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপস্থিতির কথা দাবী করে, তাহলে সেটা হবে একটা স্বতন্ত্র দাবী। এর স্বপক্ষে দলীল চাই। অথচ এর স্বপক্ষে কোন দলীল নাই। সুতরাং দলীল বিহীন এমন আকীদা পোষণ করা না-জায়িয হবে। আর বিদ‘আতীরা তাদের দাবীর পক্ষে যে, দলীল পেশ করে থাকে তার দ্বারা কোনভাবেই হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, ‘হাযির-নাযির’ তা সাব্যস্ত হয় না।
বিদ‘আতীদের দলীল ও তার খন্ডনঃ
১ নং দলীলঃ বিদ‘আতীরা তাদের দাবীর পক্ষে সবচেয়ে জোরালোভাবে যে দলীল পেশ করে থাকে তা হল, সূরা আহযাবের একটি আয়াত যাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কয়েকটি দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ হল: “হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি ‘শাহিদ’ (তথা সাক্ষ্যদাতা), সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও আলো বিস্তারকারী প্রদীপরূপে”। -সূরা আহযাব: ৪৫-৪৬।
এখানে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘শাহিদ’ (شاهد) বলা হয়েছে, যার অর্থ ‘সাক্ষ্যদাতা’ও হতে পারে আবার ‘হাযির-নাযির’ ও হতে পারে। সাক্ষ্যদাতাকে ‘শাহিদ’ এজন্য বলা হয় যে, সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘শাহিদ’ এ কারণে বলা হয়েছে যে, তিনি গায়েব (অদৃস্য বিষয়কে) দেখে সাক্ষ্য দেন। অন্যথায় অন্যান্য নবীগণ তো সাক্ষ্য প্রদান করে থাকেন। তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণের মাঝে পার্থক্য থাকল কোথায়?
অথবা এ কারণে ‘শাহিদ’ বলা হয়েছে যে, তিনি কিয়ামতের দিন সকল নবীর পক্ষে চাক্ষুস সাক্ষ্য প্রদান করবেন। আর এ সাক্ষ্য দেওয়া দেখা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এটাই হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির হওয়ার প্রমাণ।
অনুরূপভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবাশশির (সুসংবাদদাতা), নাযীর (সতর্ককারী) এবং দায়ী ইলাল্লাহ (মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্ববানকারী) হওয়াও তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার প্রমাণ বহন করে।  কেননা এসব কাজ তো অন্যান্য নবীগণ করেছেন। বাকি তাঁরা করেছেন শুনে-শুনে আর হুজুর এসকল কাজ করেছেন দেখে-দেখে।
অনুরূপ এ আয়াতে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘সিরাজ’ ও ‘মুনীন’ (তথা আলো বিস্তারকারী প্রদীপ) বলা হয়েছে। যার অর্থ সূর্য। এটা প্রথিবীর সর্বস্থানে বিদ্যমান, প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যমান। তদ্রুপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও সর্বস্থানে বিদ্যমান। সুতরাং এই আয়াতের প্রত্যেকটি বাক্য থেকে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়া প্রামাণিত হয়।
জবাব: বিদ‘আতী ভায়েরা এ সত্যটুকুও অনুধাবন করতে পারেননি যে, সূর্য সর্বস্থানে বিদ্যমান নয়; বরং যেখানে দিন সূর্য শুধু  সেখানেই বিদ্যমান থাকে। আর যেখানে রাত সেখানে সূর্য অবিদ্যমান। সুতরাং এই উপমার মাধ্যমে বিদ‘আতীদের দাবী প্রমাণিত হয় না; বরং এর বিপরীতে তার বক্তব্য দ্বারাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বত্র হাযির-নাযির না হওয়া প্রমাণিত হয়। আর নবীগণ গায়েব সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করেন, এর দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের সবকিছু জানা ও দেখা প্রমাণিত হয় না। বরং আল্লাহ তা‘আলার ওহী ও ইলমের মাধ্যমে যতটুকু জানেন তাঁরা শুধু ততটুকুই অবগত হয়ে থাকেন এর বেশি নয়।
অনুরূপভাবে বিদ‘আতীরা ‘শাহিদ’ শব্দের যে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও প্রবৃত্তি নির্ভর বৈ কিছুই না। কারণ ‘শাহিদ’ শব্দটি ইসমে ফায়েলের সীগা। যার অর্থ নিশ্চিত ও সঠিক সংবাদ প্রচার করা। এর জন্য সাক্ষ্যদাতাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সাক্ষ্য দেওয়া জরূরী নয়। কারণ অন্যের মাধ্যমে কোন কিছু নিশ্চিতভাবে জেনেও তার সংবাদ দেওয়াকে শাহিদ বলা হয়।
২ নং দলীলঃ বিদ‘আতীরা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির পক্ষে যেসব হাদীসে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভবিষ্যত বাণী ইরশাদ করেছে। যেমন একটি হাদীস, “আমি তোমাদের ঘরে বৃষ্টির ন্যায় ফেতনা পড়তে দেখছি”। এছাড়া জান্নাত-জাহান্নাম, হাউযে কাউসার, বরযখ ইত্যাদির খবর প্রদান সম্বলিত হাদীস সমূহ তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার পক্ষে পেশ করে থাকে। যার দ্বারা বুঝা যায় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হাযির-নাযির’ এর ক্ষমতা দিয়েছেন।
জবাবঃ এ ব্যাপারে শেখ সা‘দী রহ: সুন্দর বলেছেন, “কেউ হযরত আ: কে জিজ্ঞাসা করেছেন ব্যাপর কি? শত সহস্র মাইল দূরে মিসর থেকে হযরত ইউসূফ আ: এর জামার ঘ্রাণ পান। অথচ কেনানের নিকটে এক কুপে হযরত ইউসূফের ভাইয়েরা যখন তাকে নিক্ষেপ করলো আপনি তা দেখতে পেলেন না? উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের অবস্থা হল আকাশে চমকানো বিদ্যুতের ন্যায়। যা উদ্দীপ্ত হয়েই নিভে যায় (অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলার মেহেরবানীর ফয়জান হয়, তখন আমরা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দেখতে পাই। তবে এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না, অল্প সময় পরই শেষ হয়ে যায়।) কখন আমরা বহু উঁচু আসনে বসি, আবার কখন আমার নিজের পায়ের পিঠ পর্যন্তও দেখতে পাই না”। -গুলিস্তা: খ. ২, পৃ. ৭৩। সারকথা ঐ কথাগুলী তিনি নিজের পক্ষ থেকে বলেননি বরং আল্লাহ তা‘আলা তাকে জানিয়েছেন ওহীর মাধ্যমে এবং ঐ কথাগুলী উম্মতকে জানানোর জন্য আদেশ করেছেন। এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, নবীগণ হাযির-নাযির নন; বরং তাদেরকে যতটুক জানানো হয়, তাঁরা শুধু ততটুকুই জেনে থাকেন।
এছাড়াও বিদ‘আতীরা আরো অনেক আয়াত ও হাদীসের দ্বারা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাযির-নাযির হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করে থাকে, যেখানে তারা কুরআন ও হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা ও প্রবৃত্তির শরনাপন্ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটির দ্বারাই তাঁর ‘হাযির-নাযির’ হওয়া প্রমাণিত হয় না।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের দলীলঃ
১ নং দলীলঃ আল্লাহ তা‘আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর ঘটনা সম্পর্কে অবগত করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, “আর আপনি (তূর পর্বতের) পশ্চিম পার্শে উপস্থিত ছিলেন না, যখন আমি মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর কাছে হুকুম প্রেরণ করি। আপনি তা প্রত্যক্ষও করেননি। -সূরা কাসাস: ৪৪
একটু চিন্তা করুন! স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের আয়াত নাযির করে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ঘটনা শুনিয়ে বলছেন, আপনি তূর পর্বতের পশ্চিম পার্শ্বে হাযিরও ছিলেন না নাযিরও ছিলেন না অর্থাৎ ঘটনাস্থলে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন না এবং ঘটনা প্রত্যক্ষও করেননি। তাই কুরআনের আয়াত নাযিল করে আমি আপনাকে সেই ঘটনা শুনাচ্ছি। কিন্তু আমার বিদ‘আতী ভায়েরা আজ দূর থেকেই বলতে চাচ্ছেন যে, তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তা প্রত্যক্ষ করেছেন। কুরআন-হাদীস সম্পর্কে কি পরিমাণ অজ্ঞ হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে?
এখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে, হযরত মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় আপনি তূর পর্বতের পশ্চিম পার্শ্বে হাযিরও ছিলেন না নাযিরও ছিলেন না। রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি হাযির নাযির হতেন, তাহলে একথার কোন অর্থ থাকত না।
২ নং দলীলঃ অপর আরেক স্থানে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আপনার আশপাশের পল্লীবাসী ও মদীনাবাসীর মাঝে এমন কিছু মুনাফিক রয়েছে যারা মুনাফিকতায় সিদ্ধ। আপনি তাদেরকে জানেন না। আমি তাদেরকে জানি”। -সূরা তাওবা: ১০১
৩ নং দলীলঃ আল্লাহ তা‘আলা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হযরত ইউসুফ ‘আলাইহিস সালাম ও তাঁর ভাইদের ঘটনা বিস্তারিত জানানোর পর ইরশাদ করেন, “(হে নবী) এসব অদৃশ্য সংবাদসমূহের একটি কাহিনী, যাহা আমি ওহীর আপনাকে জানাচ্ছি, আর আপনি সেই সময় তাদের নিকট উপস্থিত ছিলেন না যখন তারা ষড়যন্ত্র করে নিজেদের সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিল (যে তারা ইউসুফকে কুয়ায় ফেলে দিবে)”। -সূরা ইউসুফ: ১০২
এখানে আল্লাহ তা‘আলা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে নবী হযরত ইউসুফ আ: এর দশ ভাই মিলে যখন হযরত ইউসুফ আ: কে কুপে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্র করে ছিল তখন আপনি সেখানে হাযির ছিলেন না এবং এ ঘটনার নাযিরও ছিলেন না, তাই ওহী নাযিল করে আপনাকে আমি তাঁর কাহিনী অবগত করছি।
৪ নং দলীলঃ হযরত মারয়াম রা: এবং হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম-এর ঘটনা অবগত করার পর  ইরশাদ করেন, “(হে নবী) এসব অদৃশ্যের সংবাদ, যা ওহীর মাধ্যমে আপনাকে দিচ্ছি। তখন আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন কে মারয়ামের তত্ত্বাবধান করবে- (এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) তারা নিজ-নিজ কলম নিক্ষেপ করছিলেন এবং তখনও আপনি তাদের কাছে (হাযির) ছিলেন না, যখন তারা (এ বিষয়ে) একে অন্যের সাথে বাদানুবাদ করছিল (তখন আপনি ঘটনার নাযিরও ছিলেন না)”। -সূরা আলে-ইমরান: ৪৪
৫ নং দলীলঃ অনুরূপভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর হাযির-নাযির হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ রা: হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের  পক্ষ হতে পৃথিবীতে বিচরণকারী কিছু ফেরেশতা নিয়োগ করা হয়েছে, যারা (পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে) আমার উম্মতের প্রেরিত সালাম আমার নিকট পৌঁছে দেয়। -নাসায়ী শরীফ: হা. নং- ১২৮২, মুস্তাদরাকে হাকেম: হা. নং- ৩৫৭৬
হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাযির-নাযিরই হন, তাহলে ফেরেশতাদের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট সালাম পৌঁছানোর প্রয়োজনটা কী? এ ধরণের অসংখ্য ঘটনা হাদীসের কিতাবের পাতায় পাতায় বিদ্যমান যার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে তিনি হাযির-নাযির নন।
সুতরাং এসকল কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘হাযির-নাযির’ নন বরং আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে যতটুকু অবগত করেন, তিনি ততটুকুই জানেন, এর বেশি কিছুই তিনি জানেন না। তাকে হাযির-নাযির বিশ্বাস করা শিরকী আকীদা, যার দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি তাওবা করে নতুনভাবে ঈমান না আনলে সে কখনো বেহেস্তে যেতে পারবেনা।
(সমাপ্ত)
কোরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আরো বিষয় জানতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, গুলশান-২,ঢাকা, বাংলাদেশ।



No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...