বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
রাসুল (সাঃ) কি গায়েব জানতেন?
কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক দ্বন্দ্ব নিরসন।
গায়েব শব্দের আভিধানিক সংজ্ঞাঃ আরবি ‘গায়েব’ শব্দটি ক্রিয়ামূল, মাছদার। যে বস্তু
চোখের দৃষ্টি থেকে লুক্কায়িত তাকে গায়েব বলা হয়।
অদৃশ্যের সকল খবর জানা এবং অদৃশ্যের সকল বিষয়
অন্য কারো মারফত ছাড়া নিজস্বভাবে জানা। এধরণের গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন।
পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে ইহকালীন ও পরকালীন
দৃশ্য-অদৃশ্যের সকল বিষয়ের বিস্তারিত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই রয়েছে। তবে আল্লাহ
তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করেছেন।
বিশেষ করে আমাদের নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর শান
অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার স্বত্বা ও সিফাত সম্পর্কে এবং অতীত ও ভবিষ্যতের অসংখ্য ঘটনার
মাধ্যমে আলমে বরযখ, কবরের অবস্থা, হাশরের ময়দানের চিত্র, জান্নাত ও জাহান্নামের পরিস্থিতি
ইত্যাদি বিষয়ে অনেক জ্ঞান দান করেছেন যা অন্য কোন নবি এবং নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাকেও
দেওয়া হয়নি এবং এর অনেক বিষয় নবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাতকে জানিয়ে
ছিলেন। এটাকে গায়েব জানা বলা হয় না। কারণ এগুলি অদৃশ্যের সকল গায়েব না। দ্বিতীয়ত যতোটুকু
জেনেছেন তা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি আবার উম্মাতকে জানিয়েছেন।
সুতরাং নবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
দৃশ্য-অদৃশ্যের সকল বিষয়ের গায়েব জানতেন এবং পৃথিবীর শুরু থেকে যা কিছু ঘটেছে এবং কিয়ামত
পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সবকিছুই তিনি জানেন, অথবা তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুপরবর্তী
সময়ে কখন কোথায় কী হচ্ছে, তা সবকিছুই তিনি জানেন বা দেখছেন, এমন আক্বীদা পোষন করা স্পষ্ট
কুফুরী ও শিরিকী আকীদা, যা ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাস।
মনে রাখতে হবে যে, নবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়া সাল্লামের সাথে সাধারণ থেকে সাধারণ বেআদবী যেমন কুফুরীর কারণ, ঠিক তেমনিভাবে তাকে
খোদায়ী গুণ, যেমন ‘আলীমুল গায়েবের গুণে গুণান্বিত করে খোদার আসনে বসানোও সুস্পষ্ট শিরক
এবং শানে উলূহিয়্যাতের সাথে চরম বেআদবী।
কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং নবি সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অগণিত হাদিস দ্বারা উল্লেখিত আক্বীদা প্রমানিত। সেগুলোর মধ্য
হতে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস এখানে পেশ করা হল।
কুরআন হতে দলিলঃ
১নং আয়াতঃ
অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া
আসমান-যমীনে অন্য কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেনা। এবং তারা জানে না কখন তারা উত্থিত হবে।
(সূরা নামল, আয়াত-৬৫)।
২নং আয়াতঃ
অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আমি তোমাদেরকে বলি
না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভান্ডার রয়েছে। এবং আমি গায়েব জানি না, এবং আমি তোমাদের
এটাও বলিনা যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যা প্রত্যাদেশ হয় আমি কেবল তারই অনুসরন
করি। (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৫০)।
৩ নং আয়াতঃ
অর্থ: কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহরই রয়েছে।
তিনি বারি বর্ষণ করেন, এবং তিনি জানেন জরায়ুতে কী রয়েছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী
অর্জন করবে। এবং কেউ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সর্বজ্ঞ,
সর্ববিষয়ে অবগত । (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৩৪)।
৪ নং আয়াতঃ
অর্থ:
অদৃশ্যের চাবিকাঠি কেবল আল্লাহর নিকট রয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। (সুরা আন‘আম, আয়াত- ৫৯)।
৫নং আয়াতঃ
অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন! আল্লাহ তা‘আলা যা
ইচ্ছা করেন, তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল মন্দের উপরও আমার কোনো অধিকার নেই। যদি আমি গায়েব
জানতাম তাহলে আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করত না। (সুরা আ‘রাফ, আয়াত-১৮৮)।
উল্লেখিত সবগুলো আয়াতে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে
একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ ( চাই সে নবি হোক কিংবা ফেরেশতা ) অদৃশ্যের জ্ঞান
রাখে না।
হাদিস হতে দলিলঃ
১নং হাদিস:
হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যে
ব্যক্তি তোমাকে বলে নবীজি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়েব জানেন, সে মিথ্যাবাদী।
কারণ নবীজি (স.) নিজেই বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩৮০, ৩২৩৪, আধুনিক প্রকাশনী
৬৮৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮৬৬, ৬৮৭৬, ৩৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৩৮০)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
২নং হাদীস:
নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম
একবার তার কতক বিবির নিকট গমন করলেন, তখন তাদের ঘরে যে খেজুর ছিল তার চেয়ে উত্তম খেজুর
দেখে বললেন, তোমরা এ খেজুর কোথা থেকে পেলে? তারা বলল, আমরা আমাদের দুই সা’ (নিম্নমানের
খেজুর) এর বিনিময়ে এক সা’ (উত্তম খেজুর) গ্রহন করেছি। (মুসান্নাফে
আব্দুর রায্যাক,হাদীস নং: ১৬১৯১)।
এবার বলুন, নবীজী সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেনই তাহলে বিবিদেরকে কেনো প্রশ্ন করলেন যে, তোমরা
এ খেজুর কোথা থেকে পেলে?
৩নং হাদীস:
আনাস
(রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট রি-ল, যাকওয়ান, উসাইয়াহ
ও বানূ লাহ্ইয়ান গোত্রের কিছু লোক এসে বলল, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। এবং তারা তাঁর
নিকট তাদের গোত্রের মুকাবেলায় সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সত্তর জন আনসার পাঠিয়ে তাদের সাহায্য করলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা তাঁদের
ক্বারী নামে আখ্যায়িত করতাম। তাঁরা দিনের বেলায় লাকড়ি সংগ্রহ করতেন, আর রাত্রিকালে
সালাতে মগ্ন থাকতেন। তারা তাঁদের নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। যখন তাঁরা ‘বীরে মা‘উনাহ’ [উসফান
ও হুজাইল এর মধ্যবর্তী স্থান] নামক স্থানে পৌঁছল, তখন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল এবং তাঁদের
হত্যা করে ফেলল। এ সংবাদ শোনার পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিল,
যাকওয়ান ও বানূ লাহ্ইয়ান গোত্রের বিরুদ্ধে দু‘আ করে এক মাস যাবৎ কুনূতে নাযিলা পাঠ
করেন। ক্বাতাদাহ (রহ.) বলেন, আনাস (রাঃ) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা তাদের সম্পর্কে
কিছুকাল যাবৎ কুরআনের এ আয়াতটি পড়তে থাকেনঃ ‘‘আমাদের সংবাদ আমাদের কাওমের নিকট পৌঁছিয়ে
দাও যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন
আর তিনি আমাদের সন্তুষ্ট করেছেন।’ অতঃপর এ আয়াত উঠিয়ে নেয়া হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩০৬৪, ১০০১, আধুনিক প্রকাশনীঃ
২৮৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৮৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
সম্মানিত পাঠক! নবীজি সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেন যে, তারা সত্তরজন জালীলুর কদর সাহাবীকে শহীদ
করে ফেলবে, তাহলে কি নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে প্রেরণ করতেন?
তিনি কি এতটাই নির্দয়? (নাঊযুবিল্লাহ)
৪নং হাদীস:
খাইবার যুদ্ধের পর যাইনাব বিনতে হারিস নামক
এক ইয়াহুদী মহিলা কোন কৌশলে নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিষ মিশ্রিত
বকরীর গোশত হাদিয়া পেশ করল। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোশত মুখে দেওয়া
মাত্রই ‘গোশতের টুকরাটিই’ বিষ মিশ্রিত হওয়ার বিষয়টি নবীজীকে জানিয়ে দিল। সাথে সাথে
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোশত রেখে দিলেন। ইতিমধ্যে নবীজীর সঙ্গী সাহাবী
বিশর ইবনে বারা (রাযি.) তা গলধঃকরণ করে ফেলেন। ফলে এর বিষক্রিয়ায় তিনি ইন্তিকাল করেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর বিষক্রিয়ায় কিছুটা আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ফলে তিনি চিকিৎসা স্বরূপ শিংগা লাগান। এবং পরবর্তীতে যখন নবীজী মৃত্যরোগে আক্রান্ত
হন তখনও তিনি উক্ত বিষক্রিয়া অনুভব করেছিলেন। (সহীহ বুখারী
(তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪২৪৯, ৩১৬৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৯১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৯২২, আল
বিদায়া ওয়ান নিহয়া: ৪/১২৭-১২৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
এখন পাঠকের নিকট আমার প্রশ্ন
হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েব জানতেন তাহলে কি তিনি বিষমিশ্রিত
গোশত নিজে মুখে দিতেন এবং নিজ সাহাবীকে খেতে দিতেন?
গায়েব না জানা সংক্রান্ত কতিপয় সহিহ হাদিসসমূহ
(১) সাহল ইবনু সা‘দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমাহ (রাযি.)-এর গৃহে এলেন, কিন্তু
‘আলী (রাযি.)-কে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতিমাহ (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার চাচাত
ভাই কোথায়? তিনি বললেনঃ আমার ও তাঁর মধ্যে বাদানুবাদ হওয়ায় তিনি আমার সাথে রাগ করে
বাইরে চলে গেছেন। আমার নিকট দুপুরের বিশ্রামও করেননি। অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে বললেনঃ দেখ তো সে কোথায়? সে ব্যক্তি খুঁজে এসে বললোঃ
হে আল্লাহর রাসূল, তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এলেন, তখন ‘আলী (রাযি.) কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরের এক পাশের চাদর পড়ে গেয়ছে এবং
তাঁর শরীরে মাটি লেগেছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শরীরের
মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেনঃ উঠ, হে আবূ তুরাব! উঠ, হে আবূ তুরাব! (সহীহ বুখারী (তাওহীদ প্রকাশনী) ৪৪১, ৩৭০৩, ৬২০৪, ৬২৮০; সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬১২৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪০৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪২২, ইসলামিক
ফাউন্ডেশনঃ ৪২৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাসুল সাঃ
গায়েব জানলে এভাবে আলী (রাঃ)-র খোঁজ করতে বলতেন না।
(২) আয়িশাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাঁর নিকট আসেন, তাঁর নিকট তখন এক মহিলা ছিলেন। আল্লাহর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম র্ জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ইনি কে?’ ‘আয়িশাহ (রাযি.) উত্তর
দিলেন, অমুক মহিলা, এ বলে তিনি তাঁর সালাতের উল্লেখ করলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘থাম, তোমরা যতটুকু সামর্থ্য রাখ, ততটুকুই তোমাদের করা উচিত।
আল্লাহর শপথ! আল্লাহ্ তা‘আলা ততক্ষণ পর্যন্ত (সওয়াব দিতে) বিরত হন না, যতক্ষণ না তোমরা
নিজেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়। আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল সেটাই, যা আমলকারী নিয়মিত
করে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৩, ১১৫১;
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৮৫, আহমাদ ২৪৯৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪১)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাসুল সাঃ
গায়েব জানলে মহিলাটির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন না।
(৩) উবাদাহ ইবনু সামিত (রাযি.) বর্ণনা করেন যে,
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লায়লাতুল কদ্র সম্পর্কে জানানোর জন্য
বের হলেন। তখন দু’জন মুসলমান বিবাদ করছিল। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের লাইলাতুল ক্বাদর
সম্পর্কে জানানোর জন্য বেরিয়েছিলাম; কিন্তু তখন অমুক অমুক বিবাদে লিপ্ত থাকায় তা (লাইলাতুল
ক্বাদরের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কিত জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আর হয়তো বা এটাই তোমাদের
জন্য মঙ্গলজনক হবে। তোমরা তা অনুসন্ধান কর (রমাযানের) ২৭, ২৯ ও ২৫ তম রাতে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৯, ২০২৩, ৬০৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৭)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাসুল সাঃ
গায়েব জানলে লাইলাতুল ক্বাদরের নির্দিষ্ট তারিখ বলে দিতেন।
(৪) আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমি আমার পর তোমাদের জন্য সবচাইতে বেশি যে ব্যাপারে ভয় করি তা হলো দুনিয়ার চাকচিক্য ও তার সৌন্দর্য, যা তোমাদের ওপর উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! কল্যাণ কি মন্দ নিয়ে আসতে পারে? তখন তিনি (সা.) কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা ধারণা করলাম, তার ওপর ওয়াহী নাযিল হচ্ছে। অতঃপর তিনি (সা.) ঘাম মুছে বললেন : সে প্রশ্নকারী কোথায়? বর্ণনাকারী বলেন: যেন তিনি (সা.) প্রশ্নকারীর কথাটি প্রশংসার যোগ্য মনে করেছেন। তখন তিনি (সা.) বললেন : কল্যাণ কখনো মন্দ আনে না। (এটার উদাহরণ,) নালার পার্শ্বের উর্বরতা উৎপাদন করে তা মূলত (ভক্ষণকারীকে) ধ্বংস করে না বা ধ্বংসের নিকটবর্তী নিয়ে যায় না; কিন্তু তৃণভোজী জানোয়ার যখন অতিমাত্রায় খায়, অবশেষে যখন কোমরের উভয় পার্শ্ব ফুলে উঠে তখন সূর্যের সামনে রৌদ্রে গিয়ে বসে এবং মলমূত্র ত্যাগ করে। পরে আবার তৃণভূমির দিকে ফিরে গিয়ে তাথেকে ভক্ষণ করে। বস্তুত দুনিয়ার মাল সম্পদ শ্যামল-সবুজ সুস্বাদু বটে। যে তা বৈধভাবে উপার্জন করে এবং বৈধ পথে ব্যয় করে তখন তা তার পক্ষে উত্তম সাহায্যকারী। কিন্তু যে তা অবৈধ পথে উপার্জন করে তখন তার উদাহরণ ঐ জন্তুর ন্যায়, যে খায় কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না এবং দুনিয়াবী মাল-সম্পদ কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হবে। (মিসকাতুল মাশাবিহ মিসকাত ৫১৬২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৩১১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৫২, মুসনাদে আহমাদ ১১১৭৩, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩২৫৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩২২৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৫৯২০)। হাদিসের মান সহিহ।
রাসুল সাঃ যদি গায়েব জানতেন
তাহলে তিনি চুপ থাকতেন না, সরাসরি জবাব দিতেন। আর এই চুপ থাকার অর্থই হচ্ছে তাঁকে আল্লাহর
পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া।
(৫) আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
একবার সালাতের ইক্বামাত দেয়া হলে সবাই দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করছিলেন, তখন আল্লাহর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে বেরিয়ে আসলেন। তিনি মুসাল্লায় দাঁড়ালে
তাঁর মনে হলো যে, তিনি জানাবাত অবস্থায় আছেন। তখন তিনি আমাদের বললেনঃ স্ব স্ব স্থানে
দাঁড়িয়ে থাক। তিনি ফিরে গিয়ে গোসল করে আবার আমাদের সামনে আসলেন এবং তাঁর মাথা হতে পানি
ঝরছিল। তিনি তাকবীর (তাহরীমাহ) বাঁধলেন, আর আমরাও তাঁর সাথে সালাত আদায় করলাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৭৫, ৬৩৯, ৬৪০; সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ১২৫৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬০৫, আহমাদ ১০৭২৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৬৭,
ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(৬) রাসুল সাঃ যদি গায়েব জানতেন তাহলে তাঁর সহধর্মিণী
আয়িশাহ (রাঃ) এর বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দেয়ার বিষয়ে এক মাস অপেক্ষা করতেন না। এক মাস
পর যখন আয়িশাহ (রাঃ) এর পবিত্রতার বিষয়ে ওহি নাজিল হলো তখন রাসুল সাঃ জানতে পারলেন
যে, তাঁর সহধর্মিণী পবিত্র। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৪১৪১, ২৫৯৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৮২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৮৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(৭) ইব্রাহিম ইবনু মুনযির (রহঃ)...ইবনু উমর (রাঃ)
থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইল্ম গায়েব
এর চাবি কাঠি পাঁচটি, যা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানেনা। তা হল, আগামী দিন কি হবে তা আল্লাহ
ছাড়া আর কেউ জানেনা। মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানেনা। বৃষ্টি কখন আসবে
তা আল্লাহ ব্যতিত আর কেউ জানেনা। কোন ব্যাক্তি জানেনা তার মৃত্যু কোথায় হবে এবং কিয়ামত
কবে সংঘটিত হবে তা আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানেনা। (ইসলামিক
ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৩৩৬, ৬৮৭৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৬৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৮) ইয়াহ্ইয়া
ইবনু সুলায়মান (রহঃ)..আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গায়েবের চাবি পাঁচটি। এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেনঃ কিয়ামতের
জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা’আলারই রয়েছে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন
নাম্বারঃ ৪৪১৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৭৭৮)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৯) উমর ইবনু হাফস্ ইবনু গিয়াস (রহঃ)....আবদুল্লাহ
(রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে
এক ফসলি জমিতে চলছিলাম। সে সময় তিনি একটি খেজুর শাখার ছড়ির উপর ভর দিয়ে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ তিনি ইয়াহুদীদের একটি দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন তারা একজন আরেকজনকে
বলাবলি করতে লাগল, রূহ সম্বন্ধে তাকে প্রশ্ন করো। তাদের কেউ বলল, কি সন্দেহ তৈরি হয়েছে
তোমাদের যে, তোমরা তাকে প্রশ্ন করবে? তোমাদের যেন এমন কথার সম্মুখীন না হতে হয়, যা
তোমরা অপছন্দ করো। এরপরও তারা বলল, তাকে অবশ্যই প্রশ্ন করো। পরিশেষে তাদের কেউ উঠে
গিয়ে তাকে রূহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করল। রাবী বলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
চুপ রইলেন। তার কোন উত্তর দিলেন না। আমি বুঝতে পারলাম, তার উপর ওয়াহী অবতীর্ণ হচ্ছে।
রাবী বলেন, আমি নিজের স্থানে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর ওয়াহী অবতীর্ণ শেষ হলে তিনি বললেন,
"তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে; বলো, রূহ আমার প্রতিপালকের একটি আদেশ
মাত্র এবং তোমাদের অতি নগণ্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে" (সূরা আল ইসরা ১৭:৮৫)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৯৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৯৪,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮০২, ইসলামিক সেন্টার ৬৮৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
রাসুল সাঃ যদি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি রুহ সম্পর্কে বলে দিতেন। চুপ থাকতেন না।
(১০) আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা ফজরের সালাতের সময় বিলাল (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে বিলাল! ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক সন্তুষ্টিব্যঞ্জক যে ‘আমাল তুমি করেছ, তার কথা আমার নিকট ব্যক্ত কর। কেননা, জান্নাতে (মি’রাজের রাতে) আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বিলাল (রাযি.) বললেন, আমার নিকট এর চেয়ে (অধিক) সন্তুষ্টিব্যঞ্জক হয় এমন কিছুতো আমি করিনি। দিন রাতের যে কোন প্রহরে আমি তাহারাত ও পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে তাহারাত দ্বারা সালাত আদায় করেছি, যে পরিমাণ সালাত আদায় করা আমার তাক্দীরে লেখা ছিল। (সহিহ বুখারী তাওহীদ প্রকাশনী ১১৪৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬২১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৫৮, আহমাদ ৯৬৭৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৮৩)। হাদিসের মান সহিহ।
প্রিয় পাঠক, রাসুল সাঃ যদি গায়েব জানতেন তাহলে
তো বিলাল (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করতেন না। তিনি নিজেই বিলাল (রাযি.)-কে ডেকে জান্নাতে
যাওয়ার বিষয়টি বলে দিতেন।
(১১) জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার একজন ক্রীতদাস (কোনো এলাকা হতে মদীনায় এসে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে হিজরত করার বায়’আত করলো (অর্থাৎ- সে সর্বদা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে থাকার উদ্দেশে অঙ্গীকার করলো)। সে যে ক্রীতদাস তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন না। অতঃপর (কিছু দিন পর) ক্রীতদাসের মুনীব তাঁকে (খুঁজতে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে) নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, এ ক্রীতদাসকে আমার কাছে বিক্রি করে দাও। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু’টি হাবশী (কৃষ্ণাঙ্গ) ক্রীতদাসের বিনিময়ে তাকে ক্রয় করে নিলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনদিন কোনো ব্যক্তিকে সে ক্রীতদাস না মুক্ত ব্যক্তি, তা জিজ্ঞেস না করে কোনো বায়’আত গ্রহণ করতেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮১৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০০৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬০২, সুনান আবূ দাউদ ৩৩৫৮, সুনান আননাসায়ী ৪১৮৪, ৪৬২১, সুনান আততিরমিযী ১২৩৯, ১৫৯৬, সুনান ইবনু মাজাহ ২৮৬৯, আহমাদ ১৪৭৭২, ইবনু হিব্বান ৪৫৫০, ৫০২৭, ৬৫১৯, বায়হাকী ফিস সুনান ৫/২৮৬, ৩৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
রাসুল সাঃ যদি গায়েব জানতেন
তাহলে ক্রিতদাস সম্পর্কে জানতেন।
এতদসংক্রান্ত আরো বহু সহিহ হাদিস
আছে, যেগুলো পড়লে জানা যায় রাসুল (সাঃ) গায়েবী বিষয়ে পূর্ব থেকে কিছু জানতেন না। যার
ফলে তিনি অনেক সময় চুপ থাকতেন, এরপর ওহি এলে তিনি বলতেন।
উপরোল্লিখিত আলোচনা দ্বারা একথা দিবালোকের
ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীমুল গায়েব ছিলেন
না। সাথে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীমুল
গায়েব না হওয়ায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যে মর্যাদা দান করেছেন তাতে সামান্যতমও ঘাটতি আসবে
না, বরং যথার্থই বাকী থাকবে। কারণ নবি বা রাসূল হওয়ার জণ্রে গায়েবের ইলম থাকা শর্ত
নয়, তার নিকট ওহী আসা শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক আক্বীদা পোষন করার তাওফীক
দান করুন। (আমীন)
নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের
গায়েব জানা সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত আক্বীদা
বিদ‘আতী ও রেজাখানীদের আক্বীদা হলো, পৃথিবীর
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সবকিছুই নবীজী
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানেন এবং তার মৃত্যুপূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যখন
যেখানে যা কিছুই ঘটছে, সবকিছুই তিনি জানেন। তারা এর স্বপক্ষে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ
করেন। নিম্নে সেগুলো জাওয়াব সহ উল্লেখ করা হলোঃ
১নং আয়াত:
অর্থঃ আল্লাহ তা‘আলার শান এটা নয় যে, তিনি
তোমাদেরকে গায়েবের বিষয়ে অবগত করবেন, তবে তিনি স্বীয় রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনিত
করেন। (সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত- ১৭৯)।
বিদ‘আতীদের বক্তব্য হলো, উক্ত আয়াত দ্বারা
বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে গায়েবের বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন।
২য় আয়াত:
অর্থঃ
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনোনিত রাসূল ব্যতীত গায়েবের বিষয়ে কাউকে অবহিত করেন না। (সূরা জিন্ন-আয়াত-২৬-২৭)।
তারা বলে, এই আয়াত স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে,
আল্লাহ তা‘আলা নবীজীকে অদৃশ্যের বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন।
খন্ডনঃ এ কথা সর্বস্বীকৃত যে, আল্লাহ তা‘আলা
আম্বিয়ায়ে কিরামকে ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু বিষয়ে গায়েবের জ্ঞান
দান করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা এটা প্রমানিত হয় না যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে অদৃশ্যের সকল জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।
২নং আয়াতের পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ
إِنْ
أَدْرِي
أَقَرِيبٌ
مَا
تُوعَدُونَ
أَمْ
يَجْعَلُ
لَهُ
رَبِّي
أَمَدًا
(২৫)
এ আয়াতে مَا تُوعَدُونَ
দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আযাব অথবা কিয়ামত, তাহলে আয়াতের অর্থ হয়, হে নবী আপনি বলে দিন,
তোমাদেরকে যে (আযাব বা কিয়ামতের) প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা নিকটে নাকি আমার প্রভু
তার জন্য কোন সময় নির্ধারন করেছেন, তা আমার জানা নেই। (সূরা
জিন-আয়াত-২৫)।
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হলো যে,
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আযাব অথবা কিয়ামতের সময় সম্পর্কে জানেন না।
তাহলে এ কথা বলা কিভাবে সহিহ হলো যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অদৃশ্যের
সকল বিষয়ে অবগত?
(৩) আব্দুল হাই লাখনবী বলেন: প্রচলিত
আরেকটি জাল ও মিথ্যা কথাঃ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ
পর্যন্ত সকলের ও সকল কিছুর বিস্তারিত জ্ঞান প্রদত্ত হয়েছিলেন। যা কিছু অতীত হয়েছে এবং
যা কিছু ভবিষ্যতে ঘটবে সবকিছুরই বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি জ্ঞান তাঁকে দেয়া হয়েছিল। ব্যাপকতায়
ও গভীরতায় রাসূলুল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে কোনো পার্থক্য
নেই। শুধুমাত্র পার্থক্য হলো, আল্লাহর জ্ঞান অনাদি ও স্বয়ংজ্ঞাত, কেউ তাঁকে শেখান নি।
পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহর জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তাঁর প্রভুর শেখানোর মাধ্যমে।’’
আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, এগুলো সবই সুন্দর
করে সাজানো মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। ইবনু হাজার মাক্কী তার ‘আল-মিনাহুল মাক্কিয়াহ’ গ্রন্থে
ও অন্যান্য প্রাজ্ঞ আলিম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এ কথাগুলো ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, সামগ্রিক ও ব্যাপক জ্ঞানের
অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। একমাত্র তিনিই সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বা আলিমুল গাইব।
এ জ্ঞান একমাত্র তাঁরই বিশেষত্ব ও তাঁরই গুণ। আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্য কাউকে এ গুণ প্রদান
করা হয় নি। হ্যাঁ, আমাদের নবী (ﷺ)-এর
জ্ঞান অন্য সকল নবী-রাসূলের (আ) জ্ঞানের চেয়ে বেশি। গাইবী বা অতিন্দ্রিয় বিষয়াদি সম্পর্কে
তাঁর প্রতিপালক অন্যান্য সবাইকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার চেয়ে অধিকতর ও পূর্ণতর শিক্ষা
দিয়েছেন তাঁকে। তিনি জ্ঞান ও কর্মে পূর্ণতম এবং সম্মান ও মর্যাদায় সকল সৃষ্টির নেতা।
(আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৮)।
মোল্লা আলী কারীও অনুরূপ কথা বলেছেন। (মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩২৩-৩২৫)।
একটি হাদিসের ব্যাখ্যা
উসমান ইবনু আবু শাইবাহ ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম
(রহঃ)....হুযাইফাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সকল বিষয় ফিতনার কথা
বর্ণনা করলেন। তারপর যে স্মরণ রাখবার সে স্মরণ রাখল এবং যে ভুলে যাবার সে ভুলে গেল।
তিনি বলেন, আমার এ সঙ্গীগণ জানেন যে, তন্মধ্যে কতক বিষয় এমন আছে, যা আমি ভুলে গেছি।
কিন্তু সেটা সংঘটিত হতে দেখে আমার তা আবার মনে পড়ে যায়। যেরূপ কোন লোক দূরে চলে গেলে
তার চেহারার কথা মানুষ ভুলে যায়। অতঃপর তাকে দেখে সে চিনে নেয়। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭১৫৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৯১,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৯৯৯, ইসলামিক সেন্টার ৭০৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উক্ত হাদিস দিয়ে অনেকে প্রমাণ
করার চেষ্টা করে যে, রাসুল সাঃ ভবিষ্যতের সব খবর জানেন বলে কিয়ামত পর্যন্ত সকল ফিতনার কথা বলেছেন। আসলে
তিনি যা বলেছেন বা বলেন সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তিনি
বলতে পেরেছেন।
বিদআতী আলেমদের তর্কের অবসান
রাসূল (সাঃ) অনেক সময় অনেক ঘটনার বা ভবিষ্যতের
কথা অগ্রিম বলতেন। এ সংক্রান্ত অনেক হাদিস আছে। বিদআতী আলেমগণ সেই সব হাদিস দিয়েই প্রমাণ
করতে চান যে, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানতেন। কিন্তু
বিদআতীরা এটা ভাল করেই জানে যে, রাসূল (সাঃ)
যা বলতেন তা ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হতো। তবেই তিনি বলতে পারতেন।
সমাজের অনেক লোক আছে যারা তাবিজ দেয়, আবার
অনেকে জিনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের কথা বলে থাকে। জিন না বললে ঐ ব্যক্তি কিছুই বলতে পারে
না। নিজ থেকে বলতে গেলে ভবিষ্যত ও অতীতের কথা ভুল হবে। তদ্রুব রাসূল (সাঃ) নিজ থেকে কিছুই বলতেন না। আল্লাহর পক্ষ
থেকে জিবরিল (আঃ) এসে কখনো বলতেন, আবার কখনো
স্বপ্ন যোগে আবার কখনো এলহাম এর মাধ্যমে জানতে পারতেন। তবে যা কিছু হতো সব আল্লাহর
পক্ষ থেকে।
অতএব যারা বলেন যে, রাসুল (সাঃ) গায়েব জানতেন,
এই কথা বলা মানে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো। যা শিরক। রাসুল (সাঃ) কে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর
সব ধরনের জ্ঞান দান করেছেন। যেমন আপনি কোনো এক বিষয়ে পারদর্শী এটা আল্লাহর দেয়া জ্ঞান।
কিন্তু আমরা গায়েব জানি না। পিরপন্থীরা গায়েব জানার কথা বলবে এই কারনে যে, তারা মাঝে
মধ্যে জিনের মাধ্যমে তার মুরিদের অনেক ভাল মন্দ বলে থাকেন। আর মুরিদরা তার এই প্রতারনার
ফাঁদে পড়ে অন্ধ ভক্ত হয়ে যায়। এই পির মুরিদকে বলে যে, তিনি যা কিছু করেন বা বলেন তা
আল্লাহ বলে দেয় বলে তিনি সেই কাজটা করতে পারেন বা বলতে পারেন। এ কথা না বললে তার মুরিদ
তো তাকে বিশ্বাস করবে না। যেমন, বাংলাদেশের প্রখ্যাত জনৈক এক পির বলেন যে, তিনি আল্লাহর
সাথে সরাসরি কথা বলেন।
যাই হোক রাসুল (সাঃ) গায়েব জানতেন
না, তিনি যা কিছু বলতেন সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়ার পর বলতেন। সেটা সরাসরি
ওহির মাধ্যমে হোক বা স্বপ্ন যোগে হোক কিংবা এলহামের মাধ্যমে হোক।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
(১) "আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো অহী,
যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”। (সুরা আন নাজম ৫৩: ৩ ও ৪
)।
(২) “তিনি যদি আমাদের নামে কোনো কথা রচনা করে
চালাতে চেষ্টা করতেন, তবে অবশ্যই আমরা তাকে পাকড়াও করতাম ডান হাত দিয়ে, তারপর অবশ্যই আমরা কেটে দিতাম তার হৃদপিণ্ডের শিরা”।
(সুরা হাক্বাহ ৬৯ : ৪৪-৪৬)।
(সমাপ্ত)
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য
করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social
Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে
দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের)
জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে
নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)।
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে
আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন।
(সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)।
ইয়াহইয়া ইবনু আইয়্যুব, কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ
ও ইবনু হুজর (রহঃ).....আবু হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সে পথের অনুসারীদের
প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না। আর
যে লোক বিভ্রান্তির দিকে ডাকে তার উপর সে রাস্তার অনুসারীদের পাপের অনুরূপ পাপ বর্তাবে।
এতে তাদের পাপরাশি সামান্য হালকা হবে না। (সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ৬৬৯৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
২৬৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৬০, ইসলামিক সেন্টার ৬৬১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার কথা পৌঁছিয়ে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়।
আর বনী ইসরাঈলের ঘটনাবলী বর্ণনা কর। এতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে কেউ ইচ্ছে করে আমার
উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামকেই তার ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নিল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৬১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২০৩,
ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২১২, হাদিস সম্ভার ১৫৪৮,
রিয়াদুস সলেহিন ১৩৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক
ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, বিবিসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
...........................................................................................
কুরআন
ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক
করুন।
Please Share On
No comments:
Post a Comment