বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পির-মুরিদ ও বিদআতিরা যেসব কারণে জাহান্নামি
পর্ব-১
পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ বনাম ইসলাম
(শয়তানের ওহী কার উপর নাযিল হয়?)
পিরতন্ত্র
বা সুফিবাদ রাসুল সাঃ এর যুগে ছিল না। সাহাবীগণের যুগেও ছিল না। কুরআন ও হাদিসের কোথাও
পিরতন্ত্র বা সুফিবাদের কথা উল্লেখ নেই। তবে অলি বা আউলিয়া শব্দটি কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ
আছে। এখন যারা নিজেদেরকে পির বা সুফি নামকরণ করে একটা দরবার বা আস্তানা খুলে দিব্যি
ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা কি আসলে অলি? আমি বিভিন্ন পিরের দরবার থেকে প্রকাশিত
বইগুলো পর্যালোচনা করে যা পেয়েছি তাহলো, পির বা সুফিগণ অলি সংক্রান্ত কুরআন ও হাদিসগুলোর
সরল অনুবাদ বাদ দিয়ে তারা নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্যে মনগড়া অনুবাদ বা ব্যাখ্যা তাদের
প্রকাশিত বইগুলোতে উল্লেখ করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে তারা কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে
ওয়াজও করেন। পির বা সুফিগণ তাদের দরবারকে বানিয়েছেন বিদআত সম্প্রচারের কেন্দ্র। ইবলিশ
শয়তান এখানেই সাফল্য যে, মুসলমানদের একটা বিশাল অংশ বিপদগামী করতে সে সক্ষম হয়েছে।
পির বা সুফিগণ তাদের পুস্তকসমূহে বা ওয়াজ মাহফিলে এমন এমন হাদিস বা সুন্দর সুন্দর অপরিচিত
শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেন যা ইতোপূর্বে কেউ শোনেনি। এ প্রসঙ্গে রাসুল সাঃ বলেন,
আবূ
হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর
রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “শেষ যুগে আমার উম্মতের মধ্যে এমন
কতক লোক হবে (বিদআতী পির-অলি-মুরিদ ও আলেম), যারা তোমাদেরকে সেই হাদিস বর্ণনা করবে,
যা তোমরা এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষরাও শ্রবণ করেনি সুতরাং তোমরা তাদের হতে সাবধান থেকো।”
(মুসলিম ১৫, ১৬), হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
কথিত
পির বা সুফিদের মূল দলিল হচ্ছে, জাল-জইফ হাদিস, মুরুব্বীদের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণ ও মিথ্যে
কিচ্ছা কাহিনী।
প্রশ্ন
হতে পারে, কথিত ভন্ড পির বা সুফিগণের এইসব
কাল্পনিক দলিল বা ওহির উৎস কোথায়? কে তাদেরকে এইসব দলিল বা ওহি সরবরাহ করে? এর উৎস
জানতে হলে আমাদেরকে প্রথমে ওহি সম্পর্কে জানতে হবে।
ওহীঃ
ওহী
বা ওয়াহী শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা
গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ইলকা বা মনের
মধ্যে কোনো কথা নিক্ষেপ করা ও ইলহাম বা গোপনে শিক্ষা ও উপদেশ দান করার অর্থে ব্যবহৃত
হয়। ব্যবহারিক ভাবে ওহী দ্বারা ইসলামে আল্লাহ কর্তৃক রাসূলদের প্রতি প্রেরিত বার্তা
বোঝানো হয়। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে,
"নিশ্চয়
আমি তোমার নিকট ওহী পাঠিয়েছি, যেমন ওহী পাঠিয়েছি নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট
এবং আমি ওহী পাঠিয়েছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়া‘কূব, তার বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব,
ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের নিকট এবং দাঊদকে প্রদান করেছি যাবূর।" (সুরা আন নিসা-১৬৩)
ওহীর নিয়ম:
আল্লাহ
তিনটি নিয়মে মানুষের কাছে তথা নবি-রাসূলদের কাছে ওহী প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন:
“কোন
মানুষের জন্যে সমীচীন নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন; কিন্তু (১) ওহীর মাধ্যমে
অথবা (২) পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা (৩) তিনি কোন দূত প্রেরণ করবেন, অতঃপর আল্লাহ্
যা চান, সে তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। (সূরা শূরা: ৫১) অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই ওহী
করেন।
মোটকথা,
আল্লাহ তায়ালা তিনভাবে নবি-রাসূলদের প্রতি ওহী করেন:
(১) এলহাম:
নবি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্তরে যে বিষয়কে জাগ্রত করতেন সেটাই হল এলহাম।
সেটাই হল পরোক্ষ ওহী বা ওহী গাইর মাতুল। এটা কোন ফেরেশতার মাধ্যমে ছিল না। বিষয়টি
যেমন জাগ্রত অবস্থায় হতো তেমনি স্বপ্ন যোগেও হতো। এমতাবস্থায় সাধারণত: আল্লাহ্ তাআলার
পক্ষ থেকে শব্দ বা বাক্য অবতীর্ণ হয় না; কেবল বিষয়বস্তু অন্তরে জাগ্রত হয়, যা পয়গম্বরগণ
নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন। আর সেটাই হচ্ছে মুহাদ্দেছীনদের পরিভাষায় হাদিস বা সুন্নাহ্।
আল্লাহ
তায়ালা বলেন,
(১)
"রাসুল নিজে থেকে কোন কথা বলেন না ৷ নিশ্চয়ই এটা ওয়াহী ব্যতিত আর কিছু নয় ৷ (সুরা
আন নাজম ৫৩ : ৩ ও ৪ )
(২)
"তোমর নিকট যা ওয়ীহ আসে, তুমি তাঁরই অনুসরন করো, আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত
তুমি ধৈর্য ধারণ করো ৷ বস্তুতঃ তিনিই হলেন উত্তম নির্দেশ দাতা "। (সুরা ইউনুস
১০ : ১০৯ )
(৩)
"কোন রসুল আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোন নির্দেশ আনতে পারেন না “ ৷ (সুরা আর রাদ
১৩ : ৩৮ )
(৪)
“তিনি যদি আমাদের নামে কোন কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতেন,তবে অবশ্যই আমরা তাকে
পাকড়াও করতাম ডান হাত দিয়ে, তারপর অবশ্যই
আমরা কেটে দিতাম তার হৃদপিণ্ডের শিরা”। (সুরা হাক্বাহ ৬৯ : ৪৪-৪৬)
(৫)
"অতঃএব আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তদনুযায়ী বিচার
করুন ৷ আপনির নিকট যে সত্য বানী এসেছ, আপনি তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন
না ৷ (সুরা মায়দাহ ৫ : ৪৮ )
হাদিসও ওহিঃ
“রাসূল
তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (হাশরঃ ৭)
“নিশ্চয়
আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা
করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)
“আল্লাহ্
মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদেরই ভিতর থেকে তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ
করেছেন। যে তাদেরকে তাঁর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে পবিত্র করবে এবং
তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে। যদিও তারা ইতোপূর্বে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত
ছিল।” (সূরা আল ইমরান: ১৬৪)
“হে
আমাদের পালনকর্তা! তাদের মধ্যে থেকে তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের
নিকট আপনার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে
কিতাব
ও হিকমত শিক্ষা প্রদান করবে এবং তাদেরকে শিরক ও পাপাচারের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করবে।
নিশ্চয় আপনি মহা পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।” (সূরা বাকারাঃ ১২৯)
“আল্লাহ
সেই বান্দাকে উজ্জ্বলতা দান করুন, যে আমার কথা শুনেছে, মুখস্থ করেছে ও ধারণ করে রেখেছে।
অতঃপর যারা তা শুনে নি তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কেননা কতক জ্ঞান বহনকারী, নিজে
জ্ঞানী নয়। আর কতক জ্ঞান বহনকারী ব্যক্তি তার চেয়ে বেশী জ্ঞানীর নিকট তা পৌঁছিয়ে
থাকে।” (ত্বাবরানী)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে যা ছেড়ে যাচ্ছি,
তা শক্তভাবে গ্রহণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব এবং
তাঁর নবীর সুন্নাত’ (আত-তারগীব হা/৬২)।
ইমাম মালেক বিন আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
ইমাম
মালেক বিন আনাস (রাঃ) মুরসাল সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
এরশাদ করেছেন যে, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট
হবে না, যতদিন তোমরা সে দু’টিকে কঠিনভাবে ধরে থাকবে। সে দু’টি বস্তু হল : আল্লাহর কিতাব
ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’ (মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(২) পর্দার অন্তরাল থেকে
সরাসরি কথা বলা:
আল্লাহ
তায়ালা মুসা (আঃ)এর সাথে তূর পর্বতে পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলেছিলেন। আর
আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে মেরাজে গিয়ে আরশে পাকে হয়েছিল।
আল্লাহ দর্শন না দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে তাঁদের সাথে কথা বলেছেন এবং ওহী করেছেন
আর সে সময় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন।
পির-মুরিদ
বা সুফিগণ এবং অনেক আলেম বলে থাকেন যে, মিরাজে গিয়ে নাকি রাসুল সাঃ আল্লাহকে সরাসরি
দেখেছিলেন। আসলে কি তাই? পির-মুরিদ বা সুফিগণ এবং অনেক আলেম আল্লাহকে সচক্ষে দেখার
পক্ষে অনেক দলিল উপস্থাপন করে থাকে। এসব করার
কারন হলো তারা মুরিদকে বুঝায় যে, যেকোনো বিপদ-আপদে পিরকে স্মরণ করলে পির সেখানে গিয়ে
হাজির হয় এবং মুরিদকে রক্ষা করে। এ ছাড়া আরো শিক্ষা দেয় যে, মুরিদ চোখ বন্ধ করলে তার
মুরিদকে দেখতে পায় আবার পিরও তার দরবার থেকে মুরিদের সব কার্যকলাপ দেখতে পায়। আসলে
এই ক্রিয়াকলাপের পিছনে শয়তানের যে চক্রান্ত আছে সেটা মুরিদ বুঝতে পারে না।
যাই
হোক রাসুল সাঃ আল্লাহকে সচক্ষে দেখেছিলেন কিনা তার আসল রহস্য জানা প্রয়োজন।
ভন্ডরা
সূরা নজম, ৭-১২ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে প্রমাণ করেছে যে, মিরাজে গিয়ে রাসুল সাঃ নাকি
আল্লাহকে দেখেছেন।
আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
আর
তিনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন। অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো। আর খুব নেমে
এলো। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এ মাহবুব (দ:)-এর মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইলো; বরং তার চেয়েও
কম। তখন (আল্লাহ) ওহী করলেন আপন বান্দার প্রতি যা ওহী করার ছিল। (মহানবীর) অন্তর মিথ্যা
বলেনি যা তিনি দেখেছেন। তবে কি তোমরা তাঁর সাথে তিনি যা দেখেছেন তা নিয়ে বিতর্ক করছো? সূরা নজম, ৭-১২ নং আয়াত।
মুফতী
আহমদ এয়ার খান সাহেবের ‘তাফসীরে নূরুল এরফানসহ অনেক তাফসিরকারী উক্ত আয়াতের বিভিন্নভাবে
ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, মিরাজে রাসুল সাঃ আল্লাহকে সচক্ষে দেখেছেন।
রাসুল
সাঃ আসলে আল্লাহকে দেখেছেন নাকি জিবরিল আঃকে দেখেছেন, আসুন সত্যটা জেনে নেই।
যারা
দাবী করেন যে, মি‘রাজের রজনীতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে
সরাসরি দেখেছেন, তাদের এ দাবীর খণ্ডন করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেছেন,
“মাসরুক
রহ. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কাছে হেলান দিয়ে বসেছিলাম।
তখন তিনি বললেন, “হে আবু আয়েশা! তিনটি কথা এমন, যে এর কোন একটি বলল, সে আল্লাহ সম্পর্কে
ভীষণ অপবাদ দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেগুলো কী? তিনি বললেন, যে এ কথা বলে যে, মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার রবকে দেখেছেন, সে আল্লাহর উপর ভীষণ অপবাদ দেয়। আমি তো
হেলান অবস্থায় ছিলাম, এবার সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! থামুন। আমাকে
সময় দিন, ব্যস্ত হবেন না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কি বলেন নি: “তিনি (রাসূল) তো তাঁকে
(আল্লাহকে) স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন।” [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ২৩] অন্যত্রে “নিশ্চয়ই
তিনি তাকে আরেকবার দেখেছিলেন” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৩] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, আমিই এ উম্মতের
প্রথম ব্যক্তি, যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তিনি তো ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। কেবল এ দু’বার-ই আমি
তাকে তার আসল আকৃতিতে দেখেছি। আমি তাকে আসমান থেকে অবতরণ করতে দেখেছি। তাঁর বিরাট দেহ
ঢেকে ফেলেছিল আসমান ও জমিনের মধ্যবতী সবটুকু স্থান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা আরও বলেন,
তুমি কি শোন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“তিনি (আল্লাহ) দৃষ্টির অধিগম্য নন, তবে দৃষ্টিশক্তি
তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী ও সম্যক পরিজ্ঞাত।” [সূরা আল-‘আনআম, আয়াত: ১০৩]
এরূপ তুমি কি শোন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “মানুষের এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ
তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন
দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে যে তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সর্বোচ্চ ও প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৫১] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু
‘আনহা বলেন, আর ঐ ব্যক্তিও আল্লাহর উপর ভীষণ অপবাদ দেয়, যে এমন কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কোনো কথা গোপন রেখেছেন। কেননা আল্লাহ
তা‘আলা বলেন, “হে রাসূল!আপনার রবের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন, যদি
তা না করেন তবে আপনি তাঁর বার্তা প্রচারই করলেন না।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৬৭] তিনি
(আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) আরো বলেন, যে ব্যক্তি এ কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ওহী ব্যতীত কাল কী হবে তা অবহিত করতে পারেন, সেও আল্লাহর
উপর ভীষণ অপবাদ দেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “বল,আসমান ও জমিনে আল্লাহ ব্যতীত গায়েব
সম্পর্কে কেউ জানে না।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬৫। (মুসলিম, হাদীস নং ১৭৭।)
মাসরুক রহ. বলেন,
“আমি
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজ
রজনীতে যদি আল্লাহর দর্শন না পেয়ে থাকেন,তাহলে আল্লাহর এ বলার অর্থ কি দাঁড়াবে? “এরপর
তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং আরোনিকটবর্তী;
ফলে তাদের মধ্যে ধনুকের ব্যবধান রইল বা তারও কম। তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা ওহী
করবার তা ওহী করলেন।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৮-১০] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন,
তিনি তো ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
কাছে (সাধারণ) পুরুষের আকৃতিতে আসতেন। কিন্তু তিনি এবার (আয়াতে উল্লিখিত সময়) নিজস্ব
আকৃতিতেই এসেছিলেন। তাঁর দেহ আকাশের সীমা ঢেকে ফেলেছিল।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৭৭।)
তাছাড়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মি‘রাজের রাতে আল্লাহকে সরাসরি দেখার
কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেছেন, তিনি আল্লাহর নূর অবলোকন করেছেন। যেমন নিম্নোক্ত
হাদীস তার প্রমাণ:
আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“আমি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন?
তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “তিনি (আল্লাহ) নূর, আমি
কি করে তা দৃষ্টির অধিগম্য করব? (কীভাবে তাকে দেখব?)।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৭৮।)
আব্দুল্লাহ
ইবন শাকীক রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘ আনহুকে বললাম, যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
সাক্ষাৎ পেতাম, তবে অবশ্যই তাঁকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতাম। আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
বললেন, কী জিজ্ঞেস করতেন। তিনি বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম যে, আপনি কি আপনার রবকে
দেখেছেন? আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, “এ কথা তো আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
তিনি বলেছেন, আমি নূর দেখেছি।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৭৮।)
তোমরা
জেনে রাখ যে, তোমাদের কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তার রবকে দেখতে সক্ষম হবে না।”
(মুসলিম, হাদীস নং ১৬৯)
উপরোক্ত দলিলসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, দুনিয়ায় রাসুল সাঃ সচক্ষে আল্লাহকে
কখনই দেখেননি। অন্যদের তো প্রশ্নই আসে না।
মু’মিনরা জান্নাতে আল্লাহকে
দেখতে পাবে
আল্লাহর দিদার একমাত্র মু’মিন বান্দাহর জন্যই। কাফিররা
এ নি‘আমত থেকে বঞ্চিত হবে। আখেরাতে আল্লাহর সাক্ষাতের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য
আয়াত ও বাণী রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেছেন, যারা আখিরাতে আল্লাহর
দেখাকে অস্বীকার করবে তারা কাফির। (মাজমু‘উল ফাতাওয়া, ৬/৪৮৬।)
আল্লাহ
তা‘আলা বলেছেন,
“সেদিন
কতক মুখমণ্ডল হবে হাস্যোজ্জ্বল। তাদের রবের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপকারী।” [সূরা: আল-কিয়ামাহ,
আয়াত: ২২-২৩]
“যারা
ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম (জান্নাত) এবং আরও বেশি। আর ধূলোমলিনতা ও
লাঞ্ছনা তাদের চেহারাগুলোকে আচ্ছন্ন করবে না। তারাই জান্নাতবাসী। তারা তাতে স্থায়ী
হবে।” [সূরা: ইউনুস, আয়াত: ২৬] এখানে যিয়াদাহ বলতে আল্লাহর দীদারকে বুঝানো হয়েছে।
কোনো
কোনো আয়াতে আল্লাহর দীদারকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে,
“বল,
আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ।
সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে
শরীক না করে।” [সূরা: আল-কাহফ, আয়াত: ১১০]
“তারা
যা চাইবে, সেখানে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং আমার কাছে রয়েছে আরও অধিক।” [সূরা: কাফ:
৩৫]
আখিরাতে
যদি মু’মিনরা আল্লাহকে দেখতে না পায়, তবে আল্লাহ কাফিরদেরকে এ নি‘আমত থেকে বঞ্চিত করার
কী অর্থ? কেননা কাফিররা আল্লাহকে দেখতে পাবে না। আল্লাহ বলেছেন,
“কখনো
নয়, নিশ্চয় সেদিন তারা তাদের রব থেকে পর্দার আড়ালে থাকবে।” [সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত:
১৫]
আবদুল্লাহ
ইবন কায়স রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
“দুটি
জান্নাত এমন যে, এগুলোর পাত্রাদি ও সমুদয় সামগ্রী রুপার তৈরি। অন্য দুটি জান্নাত এমন,
যেগুলোর পাত্রাদি ও সমুদয় সামগ্রী স্বর্ণের তৈরি।“আদন” নামক জান্নাতে জান্নাতিগণ আল্লাহর
দীদার লাভ করবেন। এ সময় তাঁদের ও আল্লাহর মাঝে তাঁর মহিমার চাদর ব্যতীত আর কোনোঅন্তরায়
থাকবে না।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৮০।)
সুহায়ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“জান্নাতিগণ
যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বলবেন, তোমরা কী চাও? আমি আরো
অনুগ্রহ বাড়িয়ে দিই। তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারা আলোকোজ্জ্বল করে দেন নি, আমাদের
জান্নাতে দাখিল করেন নি এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দেন নি?রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরপর আল্লাহ তা‘আলা আবরণ তুলে নিবেন। আল্লাহর দীদার অপেক্ষা
অতি প্রিয় কোনো বস্তুতাদের দেওয়া হয় নি।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৮১।)
‘আতা ইবন ইয়াযীদ আল-লায়সী থেকে বর্ণিত। আবু হুরাইরা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে অবহিত করেছেন যে,
“কিছু
সংখ্যক লোক রাসূলল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, হে আল্লাহর রাসূল,
কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের প্রভুকে দেখতে পাবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন, পূর্ণিমার রাতের চাঁদ দেখতে তোমাদের কি কোনোরূপ অসুবিধা হয়? তারা
বললো, না হে আল্লাহর রাসূল। তিনি আবার বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখতে কি তোমাদের
কোনোরূপ অসুবিধা হয়? সবাই বললো, না। রাসূলুল্লাহ্ু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, তোমরা ঐরূপ স্পষ্টভাবেই আল্লাহকে দেখতে পাবে। (মুসলিম, হাদীস নং ১৮২।)
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
“রাসূলুল্লাহ্
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের
দিন আমরা কি আমাদের রবকে দেখতে পাবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
হ্যাঁ। তিনি আরো বললেন, ঠিক দুপুরে মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে কি তোমাদের
কোনো অসুবিধা কিংবা কষ্ট হয়? তারা বললো, না, হে আল্লার রাসূল! তিনি বললেন, কিয়ামতের
দিন আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে তোমাদের ততটুকু কষ্ট হবে, যতটুকু ঐ দু’টির যে কোনো একটি
দেখতে কষ্ট হয়।” (মুসলিম, হাদীস নং ১৮৩।)
উক্ত
হাদীসসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আখেরাতে মু’মিনরা আল্লাহকে দেখতে পাবে। তবে জাহমিয়্যাহ,
মু‘তাযিলা, ইবাদ্বিয়্যাহ (খারেজী সম্প্রদায়ের একটি দল) ইত্যাদি বাতিল সম্প্রদায়রা পরকালেও
আল্লাহকে দেখাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে আল্লাহর কোনো রূপ বা আকৃতি নেই, তার কোনো
দিক নেই, আকার নেই, তিনি দুনিয়াতেও নেই আবার দুনিয়ার বাইরেও নেই, উপর নিচ, ডান বাম
ইত্যাদি কোনো দিকই নেই। তাই তারা আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করেন।
(৩) জিবরাঈল (আঃ) এর মারফতে:
তৃতীয়
পদ্ধতিটিই সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয়েছে আল্লাহর ওহী বা নির্দেশনা নাযিলের ক্ষেত্রে।
আর তা হয়েছে জিবরাঈল (আঃ) এর মারফত। তাঁকে আমীনুল ওহী বলা হয়। কুরআনে রূহুল আমীন
বলা হয়েছে। রাসূল কারীম (সম্মানিত দূত) বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
“বিশ্বস্ত
রূহ (জিবরীল ফেরেশতা) উহা (কুরআন) নিয়ে অবতরণ করেছেন।”(সূরা শুআরাঃ ১৯৩) আল্লাহ্ আরও বলেন:
“নিশ্চয়
উহা (কুরআন) সম্মানিত রাসূল (দূত জিবরীল (আঃ)এর আনিত বাণী। যিনি শক্তিশালী, আরশের মালিকের
নিকট মর্যাদাশালী, ফেরেশতাগণের মান্যবর এবং আল্লাহর বিশ্বাসভাজন।” (সূরা তাকভীরঃ ১৯-২১)
আল্লাহ আরও বলেন,
“নিশ্চয়
এই কুরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনিত বাণী।” (সূরা হাক্কাহঃ ৪০)
কুরআনে
মৌমাছিকে করা ইলহাম বুঝাতেও ওহী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে,
"আর
তোমার রব মৌমাছিকে ইংগিতে জানিয়েছে যে, ‘তুমি পাহাড়ে ও গাছে এবং তারা যে গৃহ নির্মাণ
করে তাতে নিবাস বানাও।’ (সুরা আন নাহল-৬৮)
অন্য স্থানে বলা হয়েছে,
"আর
আমি মূসার মায়ের প্রতি নির্দেশ পাঠালাম, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার
ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে। আর তুমি ভয় করবে না এবং চিন্তা
করবে না। নিশ্চয় আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব’।"
(সুরা আল কাসাস-৭)
হে
রাসূল! আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছিয়ে দিন।” (মায়েদাঃ ৬৭)
“নিশ্চয়
আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা
করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)
“তিনি
নিজের পক্ষ থেকে প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে কোন কথা বলেন না, তিনি যা বলেন তা ওহী, যা তাঁর
নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।” (সূরা নাজমঃ ৩-৪)
ওহী নাজিল হওয়ার ধরণঃ
হাদিসঃ
(ক) উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে
বর্ণিত। হারিস ইবনু হিশাম (রাঃ) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট ওয়াহী কিরূপে আসে?’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ [কোন কোন সময় তা ঘণ্টা বাজার মত আমার নিকট আসে। আর এটি-ই
আমার উপর সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয় এবং তা শেষ হতেই মালাক (ফেরেশতা) যা বলেন আমি তা মুখস্থ
করে নেই, আবার কখনো মালাক মানুষের রূপ ধারণ করে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি যা বলেন আমি
তা মুখস্থ করে নেই।] ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি তীব্র শীতের সময় ওয়াহী নাযিলরত অবস্থায়
তাঁকে দেখেছি। ওয়াহী শেষ হলেই তাঁর ললাট হতে ঘাম ঝরে পড়ত। (সহিহ বুখারী হাদিস নং-৩২১৫;
মুসলিম ৪৩/২৩, হাঃ ২৩৩৩, আহমাদ ২৫৩০৭, ২৬২৫৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ
২)
হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih), সহীহ বুখারী (তাওহীদ)-হাদিস নং-২, ১/ ওয়াহ্য়ীর সূচনা।
(খ) জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ্ আনসারী (রাঃ)
ওয়াহী স্থগিত হওয়া প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ একদা আমি হাঁটছি, হঠাৎ আসমান হতে একটি শব্দ শুনতে পেয়ে আমার দৃষ্টিকে উপরে
তুললাম। দেখলাম, সেই ফেরেশতা, যিনি হেরা গুহায় আমার নিকট এসেছিলেন, আসমান ও যমীনের
মাঝে একটি আসনে উপবিষ্ট। এতে আমি শংকিত হলাম। অবিলম্বে আমি ফিরে এসে বললাম, ‘আমাকে
চাদর দ্বারা আবৃত কর, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর।’ অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন,
‘‘হে বস্ত্রাবৃত রাসূল! (১) উঠুন, সতর্ক করুন; আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন;
এবং স্বীয় পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র রাখুন; (৫) এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন।’’ (সূরাহ্ঃ
মুদ্দাস্সির ৭৪/১-৫) অতঃপর ওয়াহী পুরোদমে ধারাবাহিক অবতীর্ণ হতে লাগল। ‘আবদুল্লাহ ইবনু
ইউসুফ (রহ.) ও আবূ সালেহ্ (রহ.) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হিলাল ইবনু রাদ্দাদ (রহ.) যুহরী
(রহ.) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইউনুস ও মা’মার فواده -এর স্থলে بَوَادِرُهُ শব্দ উল্লেখ করেছেন।
(সহিহ
বুখারী হাদিস নং-৩২৩৮, ৪৯২২, ৪৯২৩, ৪৯২৪, ৪৯২৫, ৪৯২৬, ৪৯৫৪, ৬২১৪;মুসলিম ১/৩৮ হাঃ ১৬১,
আহমাদ ১৫০৩৯) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩ শেষাংশ)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih), সহীহ বুখারী (তাওহীদ)-হাদিস নং-৪, ১/ ওয়াহ্য়ীর সূচনা।
(গ)
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘ওয়াহী দ্রুত আয়ত্ত করার
জন্য আপনি ওয়াহী নাযিল হওয়ার সময় আপনার জিহবা নাড়বেন না।’’ (সূরাহ্ কিয়ামাহ ৭৫/১৬)-এর
ব্যাখ্যায় ইবনু ‘আব্বাস বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াহী
অবতরণের সময় তা আয়ত্ত করতে বেশ কষ্ট করতেন এবং প্রায়ই তিনি তাঁর উভয় ঠোঁট নড়াতেন।’
ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) বলেন, ‘আমি তোমাকে দেখানোর জন্য ঠোঁট দুটি নাড়ছি যেভাবে আল্লাহর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নড়াতেন।’ সা‘ঈদ (রহ.) (তাঁর শিষ্যদের) বলেন,
‘আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.)-কে যেরূপে তাঁর ঠোঁট দুটি নড়াতে দেখেছি, সেভাবেই আমার ঠোঁট
দুটি নড়াচ্ছি।’ এই বলে তিনি তাঁর ঠোঁট দুটি নড়ালেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা অবতীর্ণ
করলেনঃ ‘‘ওয়াহী দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য আপনি ওয়াহী নাযিল হবার সময় আপনার জিহবা নড়াবেন
না, এর সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমার’’- (সূরাহ্ ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬)।
ইবনু
‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘‘এর অর্থ হলোঃ তোমার অন্তরে তা হেফাযত করা এবং তোমার দ্বারা তা
পাঠ করানো। ‘‘সুতরাং আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’’- (সূরাহ্
কিয়ামাহ ৭৫/১৮)। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুন এবং চুপ থাক।
‘‘তারপর এর বিশদ বর্ণনার দায়িত্ব তো আমারই’’- (সূরাহ্ কিয়ামাহ ৭৫/১৯)। অর্থাৎ তুমি
তা পাঠ করবে, এটাও আমার দায়িত্ব। তারপর যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
-এর নিকট জিবরীল (‘আ.) আসতেন, তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে কেবল শুনতেন। জিবরীল চলে যাবার
পর তিনি যেমন পাঠ করেছিলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ও তদ্রূপ
পাঠ করতেন।
(সহিহ
বুখারী হাদিস নং-৪৯২৭, ৪৯২৮, ৪৯২৯, ৫০৪৪, ৭৫২৪; মুসলিম ৪/৩২ হাঃ ৪৪৮, আহমাদ ৩১৯১)
(আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪-এর শেষাংশ), হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih), সহীহ বুখারী (তাওহীদ)-হাদিস নং-৫,
১/ ওয়াহ্য়ীর সূচনা।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে
পাওয়া গেলো যে, ওহী দুই প্রকার। যথাঃ
(১) 'মাতলু' বা আল কুরআন।
(২) 'গায়রে মাতলু' বা সুন্নাতে রাসুল।
আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো শয়তানের
ওহী কার উপর নাযিল হয়?
বাংলাদেশসহ
পৃথিবীর অনেক দেশে পির বা সুফি আছে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে আওলাদে রাসুল বলেও দাবী
করে। আবার আওলাদে রাসুল ছাড়াও পির বা সুফি আছে। এরা দাবী করে যে, এরাই আসল অলি যাদেরকে
নাকি আল্লাহ বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এইসব পির বা
সুফিদের দরবারগুলোতে রাসুল সাঃ এর কোনো সুন্নাহ নেই। কুরআন ও হাদিসের কোনো নির্দেশনা
নেই। তারা ইসলাম প্রচারের অন্তরালে শিরক, কুফর আর বিদআত প্রচার কাজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত।
ইসলামকে তারা নিজেদের মতো সাজিয়ে দিব্যি ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই ধর্ম
ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্যে এরাও অনেক দলিল
উপস্থাপন করে আসছে। শত শত বই লিখেছে। লক্ষ লক্ষ মুরিদ বানিয়েছে। এক দল আলেম তাদের পক্ষ
নিয়ে মাঠে-ময়দানে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আর দলিল দিয়ে প্রমাণ করছে
যে, তাদের এই পির ব্যবসা নাকি বৈধ। অনেক সময় এরা মুরিদকে অনেক কেরামতিও দেখায় আর বলে,
এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে। মুরিদগণ তাদের এই কর্মকান্ড দেখে মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে।
আসলে তাদের এই কেরামতি আর দলিলগুলো আসে কোথা থেকে? আমাদের নিকট এটা সুস্পষ্ট যে, এইসব
পির বা সুফিগণ আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর প্রতি ১০০% আনুগত্যশীল নয়। মূলত এদের প্রতি যে
ওহী আসে ইবলিশ শয়তানের পক্ষ থেকে। নিম্নে দলিলগুলো তার প্রমাণঃ
(ক) তুমি
যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী
করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে
সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত)
পাবেনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬-১৭)
(খ) সে (ইবলিস) বললো : আপনার ক্ষমতার শপথ
আমি তাদের (পির-মুরিদ ও বিদআতি আলেমদের) সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, আপনার একান্ত অনুগত
দাসদের ছাড়া। (আল কুরআন, সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৮২-৮৩)
(গ) ‘আমি অবশ্যই (পির-মুরিদ ও বিদআতি আলেম)
তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, মিথ্যা আশ্বাস দেব, তাদের নির্দেশ দেব, যার ফলে তারা পশুর কর্ণ
ছেদ করবে এবং তাদের নির্দেশ দেব ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।’ (সুরা নিসা,
আয়াত : ১১৯)
সে
প্রতিশ্রুতি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আসলে শয়তান তাদের যে ওয়াদা
দেয় তা প্রতারণা মাত্র। (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ১২০)
(ঘ) শয়তান তাদের মন্দ কাজসমূহকে তাদের
দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহরী করে তোলে এবং এভাবে তাদের সরল সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টি করে। (সূরা ২৯ আনকাবুত : আয়াত ৩৮)
(ঙ) হিদায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ও প্রমাণিত
হবার পর যারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদেরকে তাদের এ আচরণ শোভন ও চমৎকার করে
দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা আকাংখায় লিপ্ত করে রাখে। (সূরা ৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত ২৫)
(চ) তাদের উপমা হলো শয়তান। শয়তান মানুষকে
(প্ররোচনা দিয়ে) বলে : ‘কুফুরি (আল্লাহর হুকুম অমান্য) করো।’ অতপর সে যখন কুফুরি করে
বসে, তখন শয়তান তাকে বলে : ‘তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই, আমি তো আল্লাহ রব্বুল
আলামীনকে ভয় করি।’ ফলে উভয়ের পরিণতিই হবে জাহান্নাম। (সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ১৬-১৭)
(ছ) (হে মানুষ!) আমি কি তোমাদের সংবাদ দেবো,
শয়তানরা কাদের উপর নাযিল হয় (কাদের ঘাড়ে চেপে বসে)? -তারা চেপে বসে ঘোরতর মিথ্যাবাদী
পাপাসক্তদের ঘাড়ে; যারা কান পেতে থাকে এবং মিথ্যা কথা ছড়ায়। (সূরা ২৬ আশ্ শোয়ারা :
আয়াত ২২১-২২৩)
(জ) “শয়তান তাদের উপর প্রভাব ও আধিপত্য
বিস্তার করে নিয়েছে। ফলে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। এরাই শয়তানের দল। সাবধান
হও, শয়তানের দল অবশ্যি পরাস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১৪-১৯)
(ঝ) হে আদম সন্তানেরা (সতর্ক হও)! শয়তান
যেনো ধোকা প্রতারণার (ফবপবরাব) মাধ্যমে তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন থেকে বিচ্যুত
করে) ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, যেভাবে সে (ধোকা প্রতারণার মাধ্যমে) তোমাদের
(আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল। তাদের পরস্পরকে তাদের গোপন অংগ দেখানোর
জন্যে সে তাদের বিবস্ত্র করে দিয়েছিল। সে এবং তার দলবল এমনভাবে (বা এমন স্থান থেকে)
তোমাদের দেখতে পায় যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাওনা। আমি শয়তানগুলোকে সেই সব লোকদের
অলি (অভিভাবক) বানিয়ে দিয়েছি, যারা ঈমান আনেনা, ঈমানের পথে চলেনা। (সূরা ৭ আল আ’রাফ
: আয়াত ২৭)
(ঞ)
তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই সে তোমাদের ডাহা দুশমন। (সূরা ২
আল বাকারা : আয়াত ১৬৮)
(ট) হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা হক
(সত্য); সুতরাং এই পৃথিবীর জীবন যেনো কিছুতেই তোমাদের প্রলুব্ধ ও প্রতারিত না করে এবং
সেই মহা প্রতারক (শয়তান) ও যেনো আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোকায় না ফেলে। শয়তান তো তোমাদের
ডাহা শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারীদের (এমন সব কাজের)
আহবান জানায়, যাতে তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়ে যায়। (সূরা ৩৫ ফাতির
: আয়াত ৫-৬)
(ঠ)
সে বললো : ‘পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন : যা তুই
অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। (আল কুরআন, সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৪-১৫; সূরা ১৫ হিজর
: আয়াত ৩৬-৩৭; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৯-৮০)
(ড) আদম সন্তানদের মধ্যে যারাই তোর অনুসরণ
করবে, তোর সাথে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্তি করবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)
(ঢ)
‘আমি আশ্রয় চাই খান্নাসের কুমন্ত্রণার ক্ষতি থেকে।’ অর্থাৎ সে এতোটা বদ যে, বারবার
সামনে এসে কুমন্ত্রণা দেয় এবং পিছিয়ে যায়, বারবার প্রকাশ হয়ে কুমন্ত্রণা দেয় এবং গোপন
হয়ে যায়। (সূরা ১১৪ আন্ নাস : আয়াত ৪)
(ণ) কতক লোক এমন আছে যারা অজ্ঞতা নিয়ে
আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। (সূরা
২২ হজ্জ: আয়াত ৩)
(ত) নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে
তোমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে অহি করে (উস্কে
দেয়)। তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো, তবে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা ৬ আল
আনআম : আয়াত ১২১)
(থ) এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর বিরুদ্ধে
মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের শত্রুতা করার অবকাশ দিয়েছি। তারা পরস্পরকে মনোহরী কথা বলে
প্রতারণার উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দেয়। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১১২)।
(দ) যখন আল্লাহর বিচার ফায়সালা শেষ হবে,
তখন শয়তান (একটি বিবৃতি দিয়ে) বলবে : আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা-ই
ছিলো সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে
দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার (ধ) কোনো কর্তৃত্ব ছিলনা; আমি তো
কেবল তোমাদের আহবান করেছি, আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার
প্রতি দোষারোপ করোনা; বরং তোমরা নিজেদেরকেই তিরস্কার করো। আমি (আল্লাহর শাস্তি থেকে)
তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা, আর তোমরাও আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা। ইতোপূর্বে তোমরা
যে আমাকে আল্লাহর শরিক ও সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিলে আমি সেটা (সে মর্যাদা) অস্বীকার করছি।
নিশ্চয়ই যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা ১৪ ইবরাহিম : আয়াত ২২)
(ন) শয়তান তো কেবল তাদের উপরই কর্তৃত্ব
ও আধিপত্য করে, যারা তাকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, আর যারা আল্লাহর সাথে
শরিক করে। (সূরা ১৬ আন নহল : আয়াত ১০০)
(প)
যারা আখিরাতে বিশ্বাস করেনা, তাদেরকে নিজের প্রতি অনুরক্ত ও পরিতুষ্ট করা এবং নিজেরা
যেসব অপকর্ম করে, তাদেরকে দিয়েও সেসব অপকর্ম করানোর উদ্দেশ্যেই শয়তান কুমন্ত্রণা দেয়।
(সূরা আনআম : আয়াত ১১৩)।
(ফ) যে কেউ আল্লাহর যিকর (কুরআন এবং আল্লাহর
ইবাদত) থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, আমরা তার সাথি-বন্ধু হিসেবে শয়তানকে নিয়োগ করি। তখন
তারাই ঐ লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলা থেকে বিরত রাখে; অথচ তারা মনে করে তারা সঠিক পথেই
চলছে। অবশেষে যখন (কিয়ামতের দিন) আমার কাছে উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে : ‘হায়,
(পৃথিবীতে) আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব থাকতো।’ কতইনা নিকৃষ্ট সাথি
এই শয়তান। (তখন তাদের বলা হবে) আজ তোমাদের অনুতাপ তোমাদের কোনো কাজেই আসবেনা। যেহেতু
তোমরা তো যুলুম-সীমালংঘন করে এসেছো, তাই তোমরা সকলেই আযাবের শরিকদার। (হে নবী!) তুমি
কি শুনাতে পারবে বধিরকে? কিংবা পথ দেখাতে পারবে কি অন্ধকে? আর ঐ ব্যক্তিকে যে সুস্পষ্ট
বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত? (সূরা ৪৩ যুখরুফ : আয়াত ৩৬-৪০)।
(ব)
সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে-আল-বাক্বারাহ ১৬৯
সে
এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে
পাওনা। [আল-আ’রাফ ৭:২৭]।
(ভ) মহানবী (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান
মানুষের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৮৮,মুসলিম, ২১৭৫ )।
শয়তানের সবচেয়ে প্রিয় কাজ
কোনটি?
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইবলীস
পানির উপর তার আরশ স্থাপন করে তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত
সেই যে সর্বাধিক ফিতনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে
বলে, তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণই
করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত আমি তাকে ছেড়ে দেই নি।
অতঃপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যাঁ, তুমি একটি বড় কাজ করেছ। বর্ণনাকারী
আ’মাশ বলেন, আমার মনে হয়, তিনি বলেছেনঃ অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।
(মুসলিম- ৬৮৪৬)
এর
পরের হাদিসে আছে, হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেনঃ শয়তান তার সৈন্য বাহিনীকে প্রেরণ করতঃ লোকদেরকে ফিতনায় লিপ্ত করে। তাদের মধ্যে
সে-ই তার নিকট সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী যে অধিক ফিতনা সৃষ্টিকারী। (মুসলিম (৬৮৪৭)।
পির বা সুফিগণ শয়তান
পক্ষ থেকে যে দিক নির্দেশনা পায় তার প্রমাণঃ
সুফীদের বিরাট এক দলের লেখনী থেকে জানা যায় যে, তারা শয়তানের
কাছ থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকেন। তাবলিগী নিসাব ফাযায়েলে আমাল বইয়ে
হজরত জুনাইদ (রঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি একবার শয়তানকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখিয়া
জিজ্ঞাসা করিলেন, মানুষের সামনে উলঙ্গ হইয়া থাকিতে তোর কি লজ্জা হয় না? শয়তান বলিল,
ইহারা কি মানুষ? মানুষ তো উহারা, যাহারা শোনিযিয়ার মসজিদে বসা আছেন। যাহারা আমার শরীরকে
দুর্বল করিয়াছি, আমার কলিজাকে পুড়িয়া কাবাব করিয়া দিয়াছে। হজরত জুনাইদ (রহঃ) বলেন,
আমি শোনিজিয়ার মসজিদে গিয়া দেখিলাম কয়েকজন বুযুর্গ হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়া মোরাকাবায়
মশগুল রহিয়াছেন। তাঁহারা আমাকে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, খবীস শয়তানের কথায় কখনও ধোকায়
পড়িও না।
মাসূহী
(রহঃ) হইতেও অনুরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে যে, তিনি শয়তানকে উলঙ্গ দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,
মানুষের মধ্যে এইভাবে উলঙ্গ হইয়া চলাফেরা করিতে তোর লজ্জা হয় না? সে বলিতে লাগিল, খোদার
কসম, ইহারা তো মানুষ নয়। যদি মানুষ হইত তবে ইহাদের সহিত আমি এমনভাবে খেলা করিতাম না,
যেমন বাচ্চারা ফুটবল নিয়া খেলা করে। মানুষ ঐ সমস্ত লোক, যাহারা আমাকে অসুস্থ করিয়া
দিয়াছে। এই কথা বলিয়া সে সুফিয়ায়ে কেরামের জামাতের দিকে ইশারা করিল।
(দেখুনঃ
ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ৩৭৬-৩৭৭ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
থেকে ২০০১ সালে প্রথম প্রকাশিত)।
পির-মুরিদ ও বিদআতিদের তরিকা
হচ্ছে শয়তানের তরিকাঃ
“আবদুল্লাহ
ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে (সিরাতে মুস্তাকিম বুঝানোর জন্য)
প্রথমে একটি সোজা দাগ দিলেন। আর বললেন এটা হলো আল্লাহর রাস্তা । অতপর ডানে বামে অনেকগুলো
দাগ দিলেন আর বললেন এই রাস্তাগুলো শয়তানের রাস্তা । এ রাস্তাগুলোর প্রতিটি রাস্তার
মুখে মুখে একেকটা শয়তান বসে আছে যারা এ রাস্তার দিকে মানুষদেরকে আহবান করে। অতপর রাসূলুল্লাহ
(সা:) নিজের কথার প্রমাণে নীচের প্রথম আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।” (মুসনাদে আহমদ ৪১৪২;
নাসায়ী ১১১৭৫; মেশকাত ১৬৬)।
আল্লাহ (সুব:) বলেন:
অর্থ:
“আর সঠিক পথ বাতলে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব, এবং পথের মধ্যে কিছু আছে বক্র। আর তিনি
যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে হিদায়াত করতেন।”(সুরা নহল ১৬:৯)।
স্বপ্নে তারা কাকে দেখে?
পির-মুরিদ বা সুফিগণের অনেক দলিলের মধ্যে একটা দলিল
হচ্ছে, এদের প্রতি রাতের স্বপ্ন। এদের গোসল, অযু ও সালাতসহ সকল ইবাদত সহিহ নয়। বানানো
দোয়া, দরুদ আর মিলাদ কিয়াম হচ্ছে এদের মূল ইবাদত। যা ১০০% বিদআত। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত
আদায় করে না, সে নাকি প্রায় রাতেই রাসুল সাঃকে স্বপ্নে দেখে। আসলে স্বপ্নে যাকে দেখে
সে হলো শয়তান।
“‘দেওয়ানবাগী
স্বপ্নে দেখেন ঢাকা এবং ফরিদপুরের মধ্যবর্তী স্থানে এক বিশাল বাগানে ময়লার স্তূপের
উপর বিবস্ত্র অবস্থায় নবীজীর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে (নাওযুবিল্লাহ)। মাথা দক্ষিণ দিকে,
পা উত্তর দিকে প্রসারিত। বাম পা হাঁটুতে ভাঁজ হয়ে খাড়া আছে। আমি উদ্ধারের জন্য পেরেশান
হয়ে গেলাম। তাঁর বাম পায়ের হাঁটুতে আমার ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে দেহে
প্রাণ ফিরে এল। এবং তিনি আমাকে বললেন, ”হে ধর্মের পুনর্জীবনদানকারী, ইতিপূর্বে আমার
ধর্ম পাঁচবার পুনর্জীবন লাভ করেছে।” (সূত্র: রাসূল কি সত্যিই গরিব ছিলেন-দেওয়ানবাগ
থেকে প্রকাশিত)। অনেকেই স্বপ্ন দেখে। এখানে একটা দলিল দেয়া হলো মাত্র।
এই স্বপ্ন আসলেই কি সত্য?
রাসুল সাঃ কি বলেন,
(ক) আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় আর খারাপ স্বপ্ন
শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। [৩২৯২] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫১৩)
হাদিসের
মানঃ সহিহ, সহীহ বুখারী (তাওহীদ)-হাদিস নং-৬৯৮৪,৯১/ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যে লোক আমাকে স্বপ্নে
দেখে সে শীঘ্রই জাগ্রত অবস্থাতেও আমাকে দেখবে। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধরতে পারে না।
[মুসলিম ৪২/১, হাঃ ২২৬৬, আহমাদ ৮৫১৬] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫২২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih), সহীহ বুখারী (তাওহীদ)-হাদিস নং-৬৯৯৩, ৯১/ স্বপ্নের
ব্যাখ্যা করা
পির-মুরিদ ও বিদআতিরা
শয়তানের দল, তাই এরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেঃ
আল্লাহ
তাআলা ইরশাদ করেন, ‘শয়তান তাদের বশীভূত করে নিয়েছে। অতঃপর আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে।
তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত : ১৯)।
পিরের
দরবারের কোনো অনুষ্ঠানে গেলে পির-মুরিদগণ যখন ওয়াজ শুরু করেন তখন অনেক স্বপ্নের কথা
বলে থাকে। তারা বলেন যে, অমুক জাকের ভাই বা অমুক আশেকে রাসুল স্বপ্নে আল্লাহ ও রাসুল
সাঃকে দেখেছেন। বাবাজানকে দেখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণ মুসলমান এসব স্বপ্ন দেখুক
আর না দেখুক এরা কিন্তু হরহামেশাই দেখে থাকে। অথচ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সঠিকভাবে আদায়
করে না। তাদের এই স্বপ্ন আসলেই কি সত্য? মিথ্যে স্বপ্ন বর্ণনাকারী কিয়ামতে কঠিন আজাব
ভোগ করবে।
আবদুল্লাহ
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বপ্ন না দেখেও
স্বপ্ন দেখার ভান করবে (মিথ্যা বর্ণনা দেবে), তাকে দুইটি গমের মাঝে গিরা দিতে বলা হবে,
অথচ তা সে করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের কথা কান পেতে শুনলো, অথচ
তারা তাকে তা শোনাতে চায় নি; তাহলে তার কানে কেয়ামতের দিন সিসা ঢালা হবে। যে ব্যক্তি
ছবি অঙ্কন করবে কেয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাকে বলা হবে, তাতে রুহ সঞ্চার
করতে; অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ৬৬৩৫)
ইমাম
মুনাবি (রহ.) বলেন, ‘দুইটি গমের মাঝে তাকে গিরা দিতে বলা হবে’ এই কথার অর্থ হচ্ছে,
তাকে সর্বদা শাস্তি দেওয়া হবে। জাগ্রত অবস্থার মিথ্যা কথা বললে যে শাস্তি, ঘুমন্ত অবস্থায়
মিথ্যা বললে তারচেয়েও বেশি শাস্তি। এর কারণ কী? কারণ স্বপ্নে ব্যাপারে মিথ্যা বলার
অর্থ হলো আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলা। কারণ, স্বপ্ন নবুয়তের একটি অংশ। তাই নবুওয়তের অংশও
আল্লাহর পক্ষ থেকেই। সবার নিকট বিদিত যে, মানুষের ওপর মিথ্যা বলার চেয়ে আল্লাহর ওপর
মিথ্যা বলার শাস্তি ভয়াবহ ও কঠিন। ’ (ফায়জুল কাদির, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা : ৯৯)।
মূলত
এরা স্বপ্নে শয়তানকে দেখেই বলে অমুক অমুক দেখেছি। এসব শয়তানী স্বপ্নের ছড়াছড়ি ভন্ড
পিরের দরবারে গেলে শোনা যায়।
সতর্ক লোকগণ যেভাবে সতর্ক
হয়ঃ
যারা
সতর্ক সচেতন লোক, শয়তানের পক্ষ থেকে যখনই তারা কোনো কুচিন্তা, কুমন্ত্রনা ও প্ররোচনা
অনুভব করে, তখনই তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সাথে সাথে তাদের চোখ খুলে যায়, তারা সজাগ
সতর্ক হয়ে যায় এবং সত্য পথ ও সঠিক কর্মপন্থা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। (সূরা ৭ আ’রাফ
: ২০।
উপরোক্ত
আলোচনার প্রেক্ষিতে এটাই প্রমাণিত যে, প্রথম দুই প্রকার ওহী ছাড়াও আরো এক প্রকার ওহী আছে। তাহলো ওহীশ শয়তান। শয়তান তার ওহী
কথিত পির-মুরিদ ও বিদআতিদের উপর নাজিল করে থাকে।
পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ- ইসলাম
কি বলে?
পির
শব্দের অর্থঃ পির শব্দটি ফার্সি। এটি আরবি
শব্দ নয়। কুরআন হাদিসের পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত কোন শব্দও নয়। শব্দগতভাবে এর অর্থ হল
‘জ্ঞানি’। পিরতন্ত্র বা পির ব্যবসা রাসুল সাঃ এর যুগে ছিল না। সাহাবীগণের যুগেও ছিল
না। মক্কার ইমামগণ নিজেদেরকে কখনো পির ঘোষণা দেয়নি। ইহা পরবর্তী যুগে এসে অতি ধর্মান্ধ
কতিপয় ভন্ড লোক নিজেদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধি ঘোষণা দিয়ে পির-অলি নামকরন করে এই অতি
মুনাফার ধর্ম ব্যবসা চালু করে। তাদের দরবারগুলোকে বানিয়েছে শিরক, কুফর আর বিদআত প্রচারের
কেন্দ্র। এইসব ভন্ডরা এমন সুন্দর সুন্দর শব্দ
ও বাক্য বানিয়েছে যা শুনলে অনেকেই বিশ্বাস করে। তাদের ইবাদত-বন্দেগী সবই নতুন পদ্ধতিতে
করা হয়। এরাও সালাত আদায় করে, সাওম পালন করে, হ্জ্জ করে কিন্তু এগুলো মূলতই দৃশ্যমান।
এদের উপর শয়তানের পক্ষ থেকে যে ওহী আসে তাই তারা প্রচার করে। এজন্যেই তাদের চাকচিক্যময়
দরবার আর বিদআতি কর্মকান্ড দেখে সহজেই লোকজন আকৃষ্ট হয়। এরাও কিন্তু শিরক, কুফর আর
বিদআত নিয়েও আলোচনা করে। কিন্তু তারা নিজেরাই যে শিরক, কুফর আর বিদআতের মধ্যে নিমজ্জিত
সেটা যাচাই করার হিতাহিত জ্ঞান তাদের নেই।
আসলে পির বা সুফিবাদ ইসলামে আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা নিচে বিস্তারিত জানবো-ইনশা
আল্লাহ।
পারস্য
দেশে যারা পির নামে অবহিতঃ পারস্যের অগ্নিপূজারীদের পূরোহিতকে বলা হয় পীরে মুগাঁ। মুগঁ
এর বহুবচন মুগাঁ-মানে অগ্নিপূজারীগণ। পীরে মুগাঁ মানে অগ্নি পূজারীদের পীর। ফারসী ভাষায়
পীরে মুগাঁর অর্থ করা হয়েছে "আতাশ পোরস্তুকা মুরশেদ" অর্থাৎ অগ্নিপূজারীদের
পীর। তবে মুগাঁরা যখন তাদের পীরকে ডাকেন তখন পীরে মুগাঁ বলে ডাকেন না, পীর বলেই ডাকেন।
পীরতন্ত্র বা সুফিবাদঃ বিস্তারিত
পির
কাকে বলে? পির কতো প্রকার ও কিকি? এর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা পৃথিবীর সকল পির বা সুফিগণ
তাদের দরবার থেকে প্রকাশিত বইগুলোতে বিভিন্ন দলিল দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, পির ইসলামে
আছে, পির ধরা জায়েজ, পিরের অসিলা ধরা জায়েজ, অভাব অনটন ও বিপদ-আপদে পিরকে ডাকলে পির
তার মুরিদকে রক্ষা করে, পিরকে সেজদা করা জায়েজ, পির মারা গেলে তার কবরকে মাজার বানিয়ে
বিভিন্ন উৎসব পালন করা জায়েজ, তাদের বানানো বিভিন্ন দোয়া দরুদ দিয়ে জিকির করা জায়েজ,
সালাতের মধ্যে পিরকে ক্বলবে খেয়াল করে সালাত আদায় করা জায়েজ, সালাত, সাওম ও হজ্জ পালন
না করে পিরকে আঁকড়ে ধরে রাখা জায়েজ, সমস্যা হলেই পিরের নিকট মানত করা জায়েজ, কিয়ামতে
পির শাফায়েত করে মুরিদকে জান্নাতে নিয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেহেতু
সকলের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা প্রায় একই তাই সকল বই থেকে উল্লেখ না করে শুধূ দেওয়ানবাগী
পিরের দরবার থেকে প্রকাশিত “মুক্তি কোন পথে” নামক বই থেকে এর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা তুলে
ধরা হলোঃ অন্যদের কথা বিভিন্ন আলোচনায় আসবে।
“মুক্তি কোন পথে” নামক বই থেকে-
পীর
ফার্সি শব্দ। অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে- মুসলিম শিক্ষাগুরু,পুণ্যাত্না,মহাপুরুষ,
মুরুব্বী। সমাজে প্রচলিত অর্থে আধ্যাত্নিক শিক্ষাগুরুকে "পীর" নামে অভিহিত
করা হয়ে থাকে। পীর শব্দটি আরবী মুর্শেদ শব্দের সমার্থক, যা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন-"আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন,আপনি কখনো তার জন্য কোন ( মুর্শেদ
বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।" (সূরা-আল কাহ্ফ-১৮:আয়াত-১৭)।
পারস্য
দেশের সূফী সাধকগণ মুর্শেদ অর্থে পীর শব্দটি ব্যবহার করতেন,যা কালক্রমে আমাদের সমাজে
প্রচলিত হয়েছে।
মোটকথা,
পীর বলতে হাদী শ্রেণির অলী- আল্লাহ্গণকে বুঝায়।
যে
সকল মহামানব গভীর সাধনার মাধ্যমে নিজের ভেতরে আল্লাহ্র পরিচয় পেয়েছেন,অতঃপর তা শিক্ষাদানের
মাধ্যমে মানুষের সাথে আল্লাহ্র যোগসূত্র স্থাপন করে দিতে সক্ষম,তিনিই মুর্শেদ বা পীর
হওয়ার উপযুক্ত।
পীর
হওয়ার জন্য প্রথমে অলী- আল্লাহ্ হওয়া প্রয়োজন।
মানুষকে
হিদায়েত করার মত আধ্যাত্নিক ক্ষমতাসম্পন্ন অলী- আল্লাহ্ হওয়া ব্যতীত কেউ পীর দাবি করলে,
সেটি ভন্ডামী ছাড়া কিছুই নয়।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বা
তাওয়াজ্জোহর স্তর ভেদে পীর বা অলী-আল্লাহ্ চার প্রকার।
যথা
–
১। অলী-আল্লাহ্,
২। অলীয়ে কামেল,
৩। অলীয়ে মোকাম্মেল, এবং
৪। মোজাদ্দেদে জামান।
অলী-আল্লাহ্
সম্পর্কে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ ওহীর কিতাব পবিত্র কুরআনুল হাকীমে এরশাদ করেন-
"জেনে
রেখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই, এবং তাঁরা দুঃখিতও হবে না।" (সূরা-ইউনুস-১০:
আয়াত-৬২)।
এমনিভাবে
আওলিয়ায়ে কেরামের শিরোমণি,জামানার মোজাদ্দেদ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন-
"নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে
এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।"
(আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৩৬)।
এ
কারণে যে অলী- আল্লাহ্ (পীর) যত বেশি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী,তাঁর মুরিদেরা তত
সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়। (সূত্র মুক্তি কোন পথে-পৃষ্ঠাঃ১১২থেকে১১৩)
আরো কিছু সংজ্ঞাঃ
মুর্শিদঃ
পির
শব্দটি ফার্সি। আরবীতে বলা হয় মুর্শীদ। মুর্শীদ শব্দের অর্থ হলো পথপ্রদর্শক। যিনি
আল্লাহর আদেশ-নিষেধ আল্লাহ তায়ালা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তার
নাম মুর্শীদ বা পথপ্রদর্শক। যাকে ফার্সীতে বলে পীর। মুরীদ শব্দটিও আরবী। যার অর্থ হল
ইচ্ছাপোষণকারী।
মুরিদঃ
যে
ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষন করে কোন
বুযুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করে, সে ব্যক্তিকে বলা হয় মুরীদ।
এই
হলো মোটামুটি পির বা সুফিগণের ভাষ্যমতে পির-মুরিদ বা অলির সংজ্ঞা।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে
পির-মুরিদ সম্পর্কে কি বলে-আসুন জেনে নেই-
মহান আল্লাহ তায়ালা’র বানী,
“আর
সেদিনের ভয় করো, যখন কেউ কারো সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও
কবুল হবে না; কারো কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ নেওয়া হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে
না”। (বাক্বারা ২:৪৮)
“তোমরা
অনুসরণ করো যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে
অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না”। (আ’রাফ ৭:৩)।
“এটিই
আমার দেখানো পথ, এটিই অনুসরন কর এবং অন্য কোন পথ অনুসরন কর না, অন্যান্য পথগুলো তার
পথ থেকে তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিবে। আল্লাহ্ তোমাদের এটি আদেশ করছেন যাতে তোমরা তাকওয়া
অবলম্বন করতে পার।” (সূরা আল আনআ’ম :১৫৩)।
“যে
ব্যক্তি তার কাছে প্রকৃত সত্য স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করবে আর ঈমানদারদের
পথ ছেড়ে অন্য নিয়মনীতির অনুসরণ করবে, তাকে আমি সেদিকেই ধাবিত করব যেদিকে সে ধাবিত হয়েছে,
তাকে আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দিব, কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল সেটি।” (সূরা আন-নিসা,
৪ :১১৫)
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও ছালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী
হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ
হ’ল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত
হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর
রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আখেরী যামানায় বহু ধোকাবাজ মিথ্যাবাদী
হবে; যারা তোমাদের কাছে এমন এমন হাদীস নিয়ে উপস্থিত হবে, যা তোমরা এবং তোমাদের বাপ
দাদারাও কোন দিন শ্রবণ করেনি। সুতরাং তোমরা তাদের থেকে সাবধান থেকো; তারা যেন তোমাদেরকে
ভ্রষ্টতা ও ফিতনায় না ফেলে।” (মুসলিম ১৬)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
উক্ত আবূ হুরাইরা(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর
রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা
বলে, সে যেন নিজের বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।” (বুখারী ১১০, ৬১৯৭, মুসলিম ৪)-হাদিসের
মানঃ সহিহ হাদিস।
ইমাম মালেক বিন আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
ইমাম
মালেক বিন আনাস (রাঃ) মুরসাল সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
এরশাদ করেছেন যে, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট
হবে না, যতদিন তোমরা সে দু’টিকে কঠিনভাবে ধরে থাকবে। সে দু’টি বস্তু হল : আল্লাহর কিতাব
ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’ (মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “হে কুরাইশদল! তোমরা আল্লাহর নিকট নিজেদেরকে
বাঁচিয়ে নাও, আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর নিকট কোন উপকার করতে পারব না। হে বানী
আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হে (চাচা) আব্বাস
বিন আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর দরবারে আপনার কোন কাজে আসব না। হে আল্লাহর রসূলের
ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আপনার জন্য আল্লাহর দরবারে কোন উপকারে আসব না। হে আল্লাহর রসূলের
বেটী ফাতেমা! আমার কাছে যে ধন-সম্পদ চাইবে চেয়ে নাও, আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোন উপকার
করতে পারব না।”(বুখারী ২৭৫৩, মুসলিম ৫২৫নং)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
“তোমরা
কখনো তাদের মতো হয়োনা – যাদের কাছে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সুস্পস্ট নিদর্শন আসার পরও তারা
বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আর (নিজেদের মধ্যে) নানা ধরণের মতানৈক্য সৃষ্টি
করছে; এরাই হল সেসব মানুষ – যাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে।” (সূরা আল ইমরান, ৩ :১০৫)
শরিয়াহ মানার প্রয়োজনঃ
কুরআন-সুন্নাহ
মোতাবেক সহিহ আক্বিদাহ হলো আল্লাহ (সুব:) কর্তৃক প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (সা:) কর্তৃক
প্রদর্শিত শরিয়ার আইন-বিধান কঠোরভাবে মান্য করা জরুরী। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ (সুব:)
বলেন:
“তিনি
তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; (তা হচ্ছে ঐ জীবন ব্যবস্থা)
যার ব্যাপারে তিনি নূহ (আ:) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আমি (আল্লাহ) তোমার কাছে যে
ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দ্বীন
কায়েম করো এবং এই ব্যাপারে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সুরা শু’রা ২৬:১৩)।
এই
আয়াত দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহ (সুব:) জীবন ব্যাবস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং ঐ
জীবন ব্যাবস্থাই কায়েম করা আদেশ করেছেন। সুতরাং মুসলিমের কর্তব্য হলো আল্লাহ কর্তৃক
নির্ধারিত জীবন ব্যাবস্থাই পালন করবে এবং কায়েম করবে। অন্য কারো হুকুম যদি আল্লাহর
হুকুমের বিরোধী হয় তাহলে তা প্রত্যাখান করতে হবে।
কিন্তু
পীর-মাশায়েখগণ বলেন: পীর যদি হুকুম করেন তা মানতে হবে যদিও আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তের
প্রকাশ্য বিরোধী হয়। যেমন চরমোনাই পীর বলেন:
“কামেল
পীরের আদেশ পাইলে নাপাক শারাব দ্বারাও জায়নামাজ রঙ্গিন করিয়া তাহাতে নামাজ পড়”।
শরীয়তের কামেল পীর সাহেব যদি এমন কোন হুকুম দেন, যাহা প্রকাশ্যে শরীয়তের খেলাফ হয়,
তবুও তুমি তাহা নিরাপত্তিতে আদায় করবে। কেননা, তিনি রাস্তা সব তৈরী করিয়াছেন। তিনি
তাহার উঁচু-নিচু অর্থাৎ ভালমন্দ সব চিনেন, কম বুঝের দরুন জাহেরিভাবে যদিও তুমি উহা
শরীয়তের খেলাফ দেখ কিন্তু মূলে খেলাফ নহে।” (‘আশেক মাশুক’ মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ
এছহাক রচিত ৩৫ নং পৃষ্ঠায়।)
অথচ
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা:) এর হুকুমের বিরূদ্ধে কারো হুকুম মানার কোন সুযোগ নেই।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
“উম্মে
হুসাইন (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন: স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের
কারো আনুগত্য চলবে না”। (জামেউল আহাদীস: হা: ১৩৪০৫, মুয়াত্তা: হা: ১০, মু’জামূল কাবীর:
হা: ৩৮১, মুসনাদে শিহাব: হা: ৮৭৩ আবি শাইবা: হা: ৩৩৭১৭, কানযুল উম্মাল: হা: ১৪৮৭৫)।
এছাড়া নিম্নের হাদীসটিতে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে:
“আলী (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) একটি সেনাদল
যুদ্ধাভিযানে প্রেরণ করলেন। এক আনসারী ব্যক্তিকে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করলেন এবং সাহাবীদেরকে
তার কথা শুনা ও মানার জন্য নির্দেশ দিলেন। অতপর তাদের কোন আচরণে সেনাপতি রাগ করলেন।
তিনি সকলকে লাকড়ি জমা করতে বললেন। সকলে লাকড়ি জমা করলো এরপর আগুন জ্বালাতে বললেন।
সকলে আগুন জ্বালালো। তারপর সেনাপতি বললো রাসূলুল্লাহ (সা:) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য
করার এবং আমার কথা শুনা ও মানার নির্দেশ দেন নাই? সকলেই বললো, হ্যা। তিনি বললেন, তাহলে
তোমরা সকলেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়। সাহাবীগণ একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। এবং বললেন,
আমরাতো আগুন থেকে বাঁচার জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে এসেছি। এ অবস্থায় কিছুক্ষন
পর তার রাগ ঠান্ডা হলো এবং আগুনও নিভে গেল। যখন সাহাবারা মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করলেন
তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে উপস্থাপন করা হলো। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:)
বললেন ‘তারা যদি আমীরের কথা মতো আগুনে ঝাঁপ দিতো তাহলে তারা আর কখনোই তা থেকে বের হতে
পারতো না। প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য কেবল ন্যায় এবং সৎ কাজেই।”(সহীহ মুসলিম হা:নং: ৪৮৭২,
সহীহ বুখারী হা: নং: ৪৩৪০, সহীহ মুসলিম বাংলা; ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক তরজমা; হা: নং:
৪৬১৫।)
এ
হাদীস থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শরিয়তের বিরূদ্ধে কারো হুকুমের আনুগত্য করা যাবে
না। অথচ পীর সাহেবদের কাছে কুরআন ও হাদিসে বর্নিত এসকল বিষয়ের কোনই গুরুত্ব নেই। এমনকি
তাদের ধর্ম ও মাযহাব ভিন্ন বলে তারা দাবী করে থাকে। যেমন: ‘ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে
খোদা’ এর ৭২ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে
অর্থ:
“মাওলানা রুমি ফরমাইয়াছেন: প্রেমিক লোকদের জন্য মিল্লাত ও মাজহাব ভিন্ন। তাহাদের মিল্লাত
ও মাজহাব শুধু মাবুদ কেন্দ্রিক।”
উল্লেখ্য
যে, সকল মুসলিমদের দ্বীনই আল্লাহ কেন্দ্রিক এবং আল্লাহর কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে গোপন
কোন বিষয় নেই বরং দ্বীনে ইসলাম স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার একটি ধর্ম। তাহলে পীর সাহেবরা
খোদা কেন্দ্রিক কোন ধর্মের কথা বলতে চাচ্ছেন যা অন্যদের ধর্ম থেকে আলাদা? তাহলে দ্বীনে
ইসলামের মধ্যে এমনো কোন বিষয় আছে কি যা রাসূলুল্লাহ (সা:) উম্মতের সকলের সামনে প্রকাশ
করেননি? এটাতো শীয়াদের বক্তব্য । পির সাহেবরাও কি শিয়াদের মতাদর্শকে সমর্থণ করছে?
তাছাড়া
ছয় লতিফা সম্পর্কে চরমোনাইয়ের পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক সাহেব বলেন, ‘ছয়
লতিফার কথা কুরআনে পাক ও হাদীস শরীফে নাই, তবে আল্লাহ পাকের ওলীগণ আল্লাহ পাককে পাইবার
জন্য একটা রাস্তা হিসাবে ইহা বাহির করিয়াছেন। যদি লতীফার ছবক আদায় করিতে চান, তবে
একজন উপযুক্ত পীরের দরবারে থাকিতে হইবে। (‘ভেদে মা’রেফাত বা ইয়াদে খোদা’ পৃষ্ঠা নং:
৫০)।
তাহলে
প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহ (সুব:) কে পাইবার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) কি কোন রাস্তা বলে
দেননি? যদি বলে দিয়ে থাকেন তাহলে নতুন করে রাস্তা বানানোর দরকার পরলো কি? তাছাড়া
আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তা উম্মতের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া সাধারণ কোন শাখাগত বিষয় নয়
যে, বিষয়টি উম্মতের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
পীর ধরা এবং মুরীদ হওয়া ইসলামে
সম্পূর্ণ নাজায়েজঃ
পীর
ধরা এবং মুরীদ হওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নাজায়েয কাজ। এটি না ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে,
না ছিল ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের যুগে। পরবর্তীকালে কিছু লোক অমুসলিমদের অনুকরণে
নিজেরা পীর সেজে মূর্খ লোকদের মুরীদ বানিয়ে বিনা পুঁজির ব্যবসা করছে। যদিও তাতে কোন
মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না এবং এই বিশাল ব্যবসায় কোন আয়করও দিতে হয় না। মহান আল্লাহ
তার ‘অসীলা’ অর্থাৎ নৈকট্য অন্বেষণ করতে বলেছেন (মায়েদাহ ৩৫) । এর অর্থ ‘পীর’ বা কোন
মাধ্যম ধরা নয়। বরং এর অর্থ ‘তাঁর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে’ তাঁর নৈকট্য সন্ধান
করা (ইবনে কাছীর, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রঃ) । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পীর ধরতে বলেননি। বরং
তাঁর এবং তাঁর খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত আঁকড়ে ধরতে বলেছেন (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৫)।
পীরের কাছে মুরীদ হওয়া
নাকি ফরজ: ভন্ডদের দলিলসহ আলোচনাঃ
কুরআনের
নির্দেশ অনুযায়ী ফরজ বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ (সুব:)। ইরশাদ হচ্ছে:
“বিধান দিবার অধিকার আল্লাহরই।”(সূরা ইউসুফ ১২:৪০)
আল্লাহ
(সুব:) আরও ইরশাদ করেছেনঃ “জেনে রেখো সৃষ্টি এবং বিধান তাঁরই।”(সূরা আরাফ ৭:৫৪।)
পীর-সূফীদের
আক্বীদাহ হলো পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরজ। যেমন চরমোনইয়ের পীর সাহেব ‘মাওয়ায়েজে
এসহাকিয়া’ নামক কিতাবে বলেন: ‘পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরজ’। তিনি আরও বলেন, ‘যদি কারো
দুইজন পীর হয় তবে দুই পীর তোমার দুই ডানা ধরে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। কোনই ক্ষতি নাই।’
(‘মাওয়ায়েজে এছহাকিয়া’ সৈয়দ মা:মো: মোমতাজুল করীম রচিত: পৃষ্ঠা নং: ৫৫-৫৬ ) এছাড়া
তিনি আরও বলেন: ‘যার কোন পীর নাই তার পীর শয়তান।’ এজন্য তারা একটি আরবী বাক্য তৈরী
করেছে যাতে সাধারণ মানুষের আরবী দেখে এটাকে কুরআন-হাদীস মনে করে বিনা আপত্তিতে মেনে
নেয়। সে বাক্যটি হলো: مَنْ
لَيْسَ
لَهٌ شَيْخٌ فَشَيْخُه شَيْطَانٌ
অর্থ: “যার কোন পীর নাই তার পীর শয়তান।” (‘ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে খোদা’ মাওলানা
সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক রচিত: পৃষ্ঠা নং: ২৩।)
এ
আরবী বাক্য শুনে অনেকেই এটিকে হাদীস বলে বিশ্বাস করে অথচ এটি কোন হাদীস নয় পীর-সূফীদের
মনগড়া একটি বাক্য মাত্র। পীরদের যতগুলো সিলসিলা রয়েছে প্রায় সকলের আক্বিদাই এরকম
। যেমন চরমোনাই পীরদের আক্বিদাহ তাদের বই থেকে উপরে উল্লেখ করা হলো।
এনায়েতপুরী
পীর ও তার অনুসারীদের আক্বীদাহ-বিশ্বাসও একই রকম। তাদের রচিত কিতাব ‘শরীয়তের আলো’
নামক কিতাবে উল্লেখ আছে, ‘পীর ধরা সবার জন্য ফরজ’। (‘শরীয়তের আলো’ খাজা বাবা এনায়েতপুরী
সাহেবের অনুমোদন ক্রমে মাওলানা মো: মকিম উদ্দিন প্রণীত। প্রকাশক পীরজাদা মৌ: খাজা কামার
উদ্দিন (নুহ মিয়া)।)
সুরেশ্বরী
পীর লিখেছেন: ‘পীরের নিকট দীক্ষিত না হইলে কোন বন্দেগী কবূল হয় না।'(নুরে হক গঞ্জে
নুর, পৃষ্ঠা নং ২৫, সুরেশ্বর দরবার এর পক্ষে সৈয়দ শাহ নূরে মঞ্জুর মোর্শেদ (মাহবুবে
খোদা) ও ভ্রাতাগণ কর্তৃক প্রকাশিত, একদশ সংস্করণ ১৯৯৮।)
যার পীর নেই তার পীর শয়তানঃ
রুহুল
আমিন লিখেন: ‘‘তিনি (তরিকতে রসুল-এর লেখক) উক্ত পুস্তকের ৬ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত কথাটি
হাদিস বলিয়া প্রকাশ করেছেন: ‘‘যার পীর নাই তার পীর শয়তান’’। কিন্তু লেখক ইহা কোন বিশ্বাসযোগ্য
হাদিসে দেখিয়েছেন? ইহার সনদ কি? যতক্ষণ তিনি এই হাদিসের সনদ পেশ করতে না পারেন ততক্ষণ
উহা জাল হাদিস বলিয়া গণ্য হবে।’’[1]
তিনি
আরো বলেন: ‘‘কোরাণ, হাদিস, এলমে তাছাওয়ফে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ লেখক (তাঁর দিকে অসীলা সন্ধান
কর) আয়াতটির অর্থে লিখেছেন যে, পীর ধরা ফরজে আয়েন, যে ব্যক্তি পীরের নিকট মুরিদ না
হয়ে মরে যায় সে নিশ্চয় কাফের হয়ে মরে। পাঠক, পীর-শ্রেষ্ঠ মাওলানা শাহ অলিউল্লাহ দেহলবী
(রহ) কওলোল জমিলের ১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মুরিদ হওয়া সুন্নত । আরও লিখেছেন ‘‘মুরিদ হওয়া
ওয়াজেব নহে, সুন্নত বলে সমস্ত পীর ও এমামগণের এজমা হয়েছে।’’ আরও আছে যে, দীন এসলামের
এমামগণ মুরিদ না হওয়া ব্যক্তির উপর এনকার (আপত্তি) করেন নাই।... যে আয়াতে অছিলা চেষ্টা
করার হুকুম করা হয়েছে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তফসিরে বয়জবি ২/১৪৮ পৃষ্ঠায়, কবিরের ৩/৩৩৯
পৃষ্ঠায়, এবনে জরির ৬/১৩১/১৩২ পৃষ্ঠায়, মায়ালেম ও খাজেনের ২৩৯ পৃষ্ঠায় ও তফসিরে মাদারেকের
১/২১ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে যে, ‘অছিলা’ শব্দের অর্থ ‘এবাদত, কোরবত ও নেকির কার্য্যকলাপ’।
আয়তের মর্ম্ম এই যে, তোমরা এবাদতের কার্য্যগুলি কর। ইহাতে ‘পীর অনুসন্ধান’ কিরূপে সাব্যস্ত
হবে? দ্বিতীয়, যাহার পীর নাই, তাহার পীর শয়তান হবে, লেখক ইহাকে হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন,
কিন্তু ইহা হাদিস নহে। তবে লেখকের পীর গ্রহণ ফরজ হওয়ার দাবী ইহাতে কিরুপে সাব্যস্ত
হবে?’’[2]
[1]
মোহাম্মদ রুহুল আমিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২-৩।
[2]
মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বাগমারির ফকিরের ধোকাভঞ্জন, পৃ. ৫১-৫৩।
আলহাজ
মাওলানা সৈয়দ হযরত জাকির শাহ্ নকশ্বন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা
করে কামেল মুর্শিদ বা পীরের কাছে যাওয়ার জন্য যেসব দলিল উপস্থপান করেছেন তাহলোঃ
পিরের দলিলঃ
সুরা
মায়িদার ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘লিকুল্লিন্ জ্বাআল্না মিন্কুম শির আতাও
অমিন্ হাজ্বা’।
অর্থ
: আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দুইটি পথ দিয়েছি, একটি হলো শরিয়তের পথ অপরটি হলো মারেফতের
পথ’।
ইমাম
আজম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, শরিয়তের এলেমের দ্বারা শরীরের বাহিরের দিক অর্থাৎ, জাহেরকে
দূরস্থ করে এবং এল্মে মারেফতের দ্বারা, শরীরের ভিতরকে পাকপবিত্র করে।
সুরা
মায়িদার ৪৮ নং আয়াতের সরল অনুবাদ নিম্নরুপঃ
৪৮.
“আর আমরা আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি ইতোপূর্বেকার কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্নকারী
ও সেগুলোর তদারককারীরূপে।(১) সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী আপনি তাদের
বিচার নিষ্পত্তি করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ
করবেন না।(২) তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমরা একটা করে শরীয়ত ও স্পষ্টপথ নির্ধারণ করে
দিয়েছি।(৩) আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে
যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। কাজেই সৎকাজে তোমরা প্রতিযোগিতা
কর। আল্লাহ্র দিকেই তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছিলে,
সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন”।
প্রিয়
পাঠকঃ পিরের অনুবাদ আর সরল অনুবাদের সাথে কোনো মিল নেই। তথা আয়াতের অপব্যাখ্যা করা
হয়েছে।
পিরের দলিলঃ
সুরা
কাহাফ এর ১৭ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘অমাই ইয়ুদ্বলিল ফালান্ তাজ্বিদালাহু অলিয়্যাম
মুরশিদা’।
অর্থ:
তারাই হতভাগা বা গোমরাহ, যারা কামেল মুর্শিদ বা পীরের সান্নিধ্যে গেল না এবং ছোহবত
লাভ করল না। হক্কানী পীরকামেলের ছোহবতে না গেলে, আল্লাহতায়া’লা তাদেরকে পথভ্রষ্ট বা
গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সুরা
কাহাফ এর ১৭ নং আয়াতের সরল অনুবাদ নিম্নরুপঃ
“তুমি
সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন
অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত।
এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি
যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না”।
প্রিয়
পাঠকঃ পির সাহেব এখানে আয়াতের শেষাংশের অপব্যাখ্যা করেছেন।
পিরের দলিলঃ
সুরা
তওবাহ’এর ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজ্বিনা আমানুত্ তাকুল্লাহা
অকূনূ মাআছ্ ছোয়া দিক্বীন’।
অর্থ:
হে ঈমানদার বিশ্বাসীগণ! তোমরা সত্যবাদিদের সঙ্গী হইয়া যাও। এই আয়াতে পীরকামেলর নিকট
এবং সত্যবাদিদের কাছে যাওয়ার জন্য আল্লাহতায়া’লা হুকুম করেছেন। হে পাঠকগণ, আপনারা চিন্তা
করিয়া দেখুন, আল্লাহর আদেশ অমান্য করিলে তার পরিণাম কী হইতে পারে।
সুরা
তওবাহ’এর ১১৯ নং আয়াতের সরল অনুবাদ নিম্নরুপঃ
১১৯.
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক”।
প্রিয়
পাঠকঃ পির সাহেব এখানে সত্যবাদি বলতে শুধু পিরকামেল ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন। এর অর্থ পিরের
সত্যবাদি আর অন্য মুসলমানরা মিথ্যেবাদী। মূলত জাহেল মুরিদদেরকে এভাবেই ভুল বুঝিয়ে মগজ
ধোলাই করা হয়।
পিরের দলিলঃ
সুরা
মায়িদাহ-এর ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজ্বিনা আমানুত্ তাকুল্লাহা
অবতাগূ ইলাইহিল অসীলাতা ওয়াজ্বাহিদু ফি ছাবিলিহী লা আল্লাকুম তুফলিহুন’।
অর্থ
: হে ঈমানদার বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহকে পাইবার জন্য উছিলা অন্বেষণ
কর। তার পথে জেহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’। মশহুর তাফসিরে উছিলা দ্বারা শুদ্ধ
মানুষ বা চৈতন্য গুরু ধরার কথা বলা হয়েছে। (এখানে ‘চৈতন্য গুরু’ দ্বারা কামেল পীর বা
মুর্শিদ বুঝানো হয়েছে।)
সুরা
মায়িদাহ-এর ৩৫ নং আয়াতের সরল অনুবাদ ও প্রকৃত ব্যাখ্যা নিম্নরুপঃ
(৩৫)
“হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় (ওসীলা) অম্বেষণ কর [1] ও
তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার”।
প্রিয়
পাঠকঃ পির সাহেব এখানে ওসিলা বলতে কামেল পির বা মুর্শিদকে বুঝিয়েছেন। তিনি পির ব্যবসাকে
জায়েজ করতে, মুরিদকে ধোকা দিতে মনগড়া ব্যাখ্যা করেছেন।
ওসিলার প্রকৃত ব্যাখ্যাঃ
(১)
অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ কর। (الْوَسِيلَةَ) শব্দটি وسل ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ সংযোগ স্থাপন
করা। পূর্ববর্তী মনীষী, সাহাবী ও তাবেয়ীগণ ইবাদাত, নৈকট্য, ঈমান সৎকর্ম দ্বারা আয়াতে
উল্লেখিত وسيلة শব্দের
তাফসীর করেছেন। হাকেমের বর্ণনা মতে হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ ‘ওসীলা শব্দ দ্বারা
নৈকট্য ও আনুগত্য বোঝানো হয়েছে’। ইবন জরীর আতা, মুজাহিদ ও হাসান বসরী রাহিমাহুমুল্লাহ
থেকে এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। এ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, تَقَرَّبُوْا إلَيْهِ بِطَاعَتِهِ وَالعَمَلِ بِمَا يُرْضِيْهِ অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর তার
আনুগত্য ও সন্তুষ্টির কাজ করে। [তাবারী; ইবন কাসীর]
অতএব,
আয়াতের সারব্যাখ্যা এই দাঁড়ায় যে, ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা'আলার নৈকট্য
অন্বেষণ কর। অন্য বর্ণনায় হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে এ আয়াত তেলাওয়াত
করতে শুনে বললেন যে, ওসীলা অর্থ, নৈকট্য। তারপর তিনি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে যারা সংরক্ষণকারী তারা সবাই এটা ভালভাবেই জানেন
যে, ইবন উম্ম আব্দ (ইবন মাসউদ) তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত।
[মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩১২; অনুরূপ তিরমিযী: ৩৮০৭; মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৯৫]
এক
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জান্নাতের একটি উচ্চ স্তরের নাম
'ওসীলা'। এর ঊর্ধ্বে কোন স্তর নেই। তোমরা আল্লাহর কাছে দোআ কর যেন তিনি এ স্তরটি আমাকে
দান করেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ১১৩৭৪ আবু সাঈদ আল-খুদরী হতে] অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন মুয়াযযিন আযান দেয়, তখন মুয়াযযিন যা বলে, তোমরাও তাই
বল। এরপর দুরূদ পাঠ কর এবং আমার জন্য ওসীলার দোআ কর’। [মুসলিমঃ ৩৮৪]
উপর্যুক্ত
ওসীলা শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণের তাফসীর থেকে জানা গেল যে,
যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ হয়, তাই অসীলা। পক্ষান্তরে শরীআতের পরিভাষায়
তাওয়াসসুলের অর্থ হল - আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা পালন করে এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন
তা পরিত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা ও জান্নাতে পৌঁছা।
ওসীলা
শব্দটি কুরআন কারীমে দুটি স্থানে এসেছেঃ সূরা আল-মায়েদার ৩৫ নং আয়াত এবং সূরা আল-ইসরার
৫৭ নং আয়াত। আয়াতদ্বয়ে ওসীলার অর্থ হলঃ আল্লাহকে সন্তুষ্টকারী কাজের মাধ্যমে আল্লাহর
নৈকট্য অর্জন। হাফেয ইবন কাসীর রাহেমাহুল্লাহ প্রথম আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ ইবন আব্বাস
রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, ওসীলার অর্থ নৈকট্য। অনুরূপ তিনি মুজাহিদ, আবু
ওয়ায়িল, হাসান বসরী, আবদুল্লাহ ইবন কাসীর, সুদ্দী, ইবন যায়েদ ও আরো একাধিক ব্যক্তি
হতেও তা বর্ণনা করেন। আর সম্মানিত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দ্বিতীয়
আয়াতটি নাযিল হওয়া প্রসংগে বলেছেনঃ আয়াতটি আরবদের কিছু সংখ্যক লোকের ব্যাপারে নাযিল
হয়েছে, যারা কিছুসংখ্যক জিনের উপাসনা করত। অতঃপর জিনেরা ইসলাম গ্রহণ করল, অথচ তাদের
উপাসনাকারী মানুষেরা তা টেরই পেল না। [মুসলিম: ৩০৩০; বুখারী ৪৭১৪]
অসীলার প্রকারভেদঃ
অসীলা
দু প্রকারঃ শরীআতসম্মত অসীলা ও নিষিদ্ধ অসীলা।
১. শরীআতসম্মত অসীলাঃ
তা হল শরীআত অনুমোদিত বিশুদ্ধ ওসীলা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। আর তা জানার সঠিক
পন্থা হল কুরআন ও সুন্নার দিকে প্রত্যাবর্তন এবং ওসীলা সম্পর্কে এতদুভয়ে যা কিছু এসেছে
সেগুলো জেনে নেয়া। অতএব যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নায় এ দলীল থাকবে যে, তা শরীআত অনুমোদিত,
তাহলে তাই হবে শরীআতসম্মত অসীলা। আর এতদ্ব্যতীত অন্য সব অসীলা নিষিদ্ধ। শরীআতসম্মত
অসীলা তিন প্রকারঃ
প্রথমঃ আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের কোন একটি
নাম অথবা তার মহান গুণাবলীর কোন একটি গুণ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জন। যেমন
মুসলিম ব্যক্তি তার দো’আয় বলবেঃ হে আল্লাহ! আপনি যে পরম করুণাময় ও দয়ালু সে ওসীলা
দিয়ে আমি আপনার কাছে আমাকে সুস্থতা দানের প্রার্থনা করছি। অথবা বলবে আপনার করুণা যা
সবকিছুতে ব্যপ্ত হয়েছে, তার ওসীলায় আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, যেন আমায় ক্ষমা
করে দেন এবং দয়া করেন, ইত্যাদি। এ প্রকার তাওয়াসসুল শরীআতসম্মত হওয়ার দলীল হল আল্লাহ
তা'আলার বাণীঃ “আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাকে সে সব নামেই
ডাক।” [সূরা আল-আরাফঃ ১৮০]
দ্বিতীয়ঃ সে সকল সৎ কর্ম দ্বারা আল্লাহ তা'আলার
নৈকট্য অর্জন, যা বান্দা পালন করে থাকে। যেমন এরকম বলা যে, ‘হে আল্লাহ! আপনার প্রতি
আমার ঈমান, আপনার জন্য আমার ভালবাসা ও আপনার রাসূলের অনুসরণের ওসীলায় আমায় ক্ষমা
করুন’ অথবা বলবেঃ ‘হে আল্লাহ। আপনার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
জন্য আমার ভালবাসা এবং তার প্রতি আমার ঈমানের ওসীলায় আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি
যেন আমায় বিপদমুক্ত করেন’। এর দলীল আল্লাহ তা'আলার বাণীঃ “যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক!
আমরা ঈমান এনেছি; সুতরাং আপনি আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের
আযাব হতে রক্ষা করুন।” [সূরা আলে-ইমরানঃ ১৬] আর এ বিষয়ের দলীলের মধ্যে রয়েছে তিন
গুহাবাসীর কাহিনীও, যা সহীহ বুখারীতে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। [বুখারীঃ ৩৪৬৫]
তৃতীয়ঃ এমন সৎ ব্যক্তির দোআর ওসীলায় আল্লাহর
নৈকট্য অর্জন, যার দোআ কবুলের আশা করা যায়। যেমন এমন ব্যক্তির কাছে কোন মুসলিমের যাওয়া,
যার মধ্যে সততা, তাকওয়া ও আল্লাহর আনুগত্যের হেফাযত লক্ষ্য করা যায় এবং তার জন্য
আল্লাহর কাছে দোআর আবেদন করা যাতে বিপদ থেকে মুক্তি ঘটে ও তার বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।
শরীআতে এ প্রকার অনুমোদিত হওয়ার দলীল হল, সাহাবাগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
কাছে ব্যাপক ও নির্দিষ্ট সকল প্রকার দোআ করার আবেদন জানাতেন। হাদীসে রয়েছে, এক ব্যক্তি
জুমার দিন মিম্বরমুখী দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তখন দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন।
লোকটি
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! গবাদি
পশু ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে দোআ করুন, যেন তিনি
আমাদের জন্য বৃষ্টি অবতরণ করেন। আনাস বলেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম হস্তদ্বয় উঠিয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমাদের পানি দিন, হে আল্লাহ! আমাদের
পানি দিন।” আনাস বলেনঃ আল্লাহর কসম, আমরা আকাশে কোন মেঘ, ছড়ানো ছিটানো মেঘের খণ্ড
বা কোন কিছুই দেখিনি। আমাদের মধ্যে ও সেলা পাহাড়ের মধ্যে কোন ঘর-বাড়ী ছিলো না। তিনি
বললেনঃ এরপর সেলা পাহাড়ের পেছন থেকে ঢালের মত একখণ্ড মেঘের উদয় হল। মেঘটি আকাশের
মাঝ বরাবর এসে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর বৃষ্টি হল। [বুখারীঃ ১০১৩, মুসলিমঃ ৮৯৭] তবে এ প্রকার
অসীলা গ্রহণ শুধু ঐ ব্যক্তির জীবদ্দশায়ই হতে পারে, যার কাছে দোআ চাওয়া হয়। তবে তার
মৃত্যুর পর এটা জায়েয নেই; কেননা মৃত্যুর পর তার কোন আমল নেই।
২. নিষিদ্ধ অসীলাঃ তা হল- যে বিষয়টি শরীআতে ওসীলা হিসাবে
সাব্যস্ত হয়নি, তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জন। এটি কয়েক প্রকার, যার কোন
কোনটি অন্যটি থেকে অধিক বিপজ্জনক। তন্মধ্যে রয়েছে-
*মৃত
ও অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকে আহবান করার মাধ্যমে, তাদের দ্বারা পরিত্রাণের আবেদন এবং তাদের
কাছে অভাব মোচন, বিপদ থেকে মুক্তিদান প্রভৃতি প্রার্থনা করার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার
নৈকট্য অর্জন। এটা শির্কে আকবার বা বড় শির্ক যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়।
*কবর
ও মাযারের পাশে ইবাদাত পালন ও আল্লাহকে ডাকা, কবরের উপর সৌধ তৈরী করা এবং কবরে প্রদীপ
ও গেলাফ দেয়া প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। এটা ছোট শির্কের অন্তর্ভুক্ত,
যা তাওহীদ পরিপূর্ণ হওয়ার অন্তরায় এবং বড় শির্কের দিকে পৌঁছিয়ে দেয়ার মাধ্যম।
*নবীগণ
ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিবর্গের সম্মান এবং আল্লাহর কাছে তাদের মান ও মর্যাদার ওসীলায়
আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। এটা হারাম। বরং তা নবআবিস্কৃত বেদ'আতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তা
এমনই তাওয়াসসুল যা আল্লাহ বৈধ করেননি এবং এর অনুমতিও দেননি। এ ধরনের ওসীলা অবলম্বন
রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের যুগে পরিচিত ছিল না। ইমাম
আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘দো'আকারী এ কথা বলা মাকরূহ যে, আমি আপনার কাছে অমুক
ব্যক্তির যে হক রয়েছে কিংবা আপনার অলীগণ ও রাসূলগণের যে হক রয়েছে কিংবা বায়তুল্লাহ
আল-হারাম (কাবা শরীফ) ও মাশ'আরুল হারামের যে হক রয়েছে তার ওসীলায় প্রার্থনা করছি’।
[আত-তাওয়াসসুল ওয়াল অসীলা থেকে সংক্ষেপিত]
পিরের দলিলঃ
সুরা
ফতেহার ৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়া’লা বলেন, ‘ইহ্দিনাছ্ ছিরাত’ল মুস্তাক্বীম”
অর্থ
: আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’।
পিরের দলিলঃ
৭
নং আয়াত প্রথম অংশ- ‘ছির ত্বোয়াল্লাজ্বীনা আন্ আম্তা আলাইহিম’।
অর্থাৎ,
‘সেই সকল মানুষের পথে, যাদেরকে আপনি নিয়ামত এবং বাতেনি চক্ষু দান করেছেন’।
৭
নং আয়াত প্রথম অংশের সরল অনুবাদ নিম্নরুপঃ
“তাদের
পথ, যাদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন”।
প্রিয়
পাঠকঃ পির সাহেব এখানে আয়াতের অতিরিক্ত বাক্য
“এবং বাতেনি চক্ষু দান করেছেন” সংযোজন করেছেন।
উক্ত আয়াতাংশের প্রকৃত ব্যাখ্যাঃ
এ
হল ‘স্বিরাত্বে মুস্তাক্বীম’ তথা সরল পথের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, সেই সরল পথ হল ঐ পথ, যে
পথে চলেছেন এমন লোকেরা যাঁদেরকে তুমি নিয়ামত, অনুগ্রহ ও পুরস্কার দান করেছ। আর নিয়ামত
ও পুরস্কারপ্রাপ্ত দলটি হল নবী, শহীদ, চরম সত্যবাদী (নবীর সহচর) এবং নেক লোকদের দল।
যেমন আল্লাহ সূরা নিসার মধ্যে বলেছেন, ‘‘আর যে কেউ আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য করবে
(শেষ বিচারের দিন) সে তাদের সঙ্গী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ
নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ। আর সঙ্গী হিসাবে এরা অতি উত্তম।।’’ (সূরা নিসা ৬৯)
এই আয়াতে এ কথাও পরিষ্কার ক’রে বলে দেওয়া হয়েছে যে, পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লোকদের পথ হল
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের পথ, অন্য কোন পথ নয়।
পিরের দলিলঃ
৭নং
আয়াত-দ্বিতীয় অংশ- গাইরিল মাগদুবি আলাইহীম ওলাদ-দ্বোয়াল্লীন’।
অর্থ
: সেই সমস্ত মানুষের পথে নয়, যেই সমস্ত মানুষ
আপনার গজবে নিপত্তি এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে’। হুজুর পুরনূর (সঃ) এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক
নর-নারীর জন্য এলেম তলব করা ফরজ’। (রাওয়াহুল বায়হাক্কি ওয়া ইবনে মাযহা)।
৭নং
আয়াত-দ্বিতীয় অংশের সরল অনুবাদঃ
“তাদের
পথ, যারা ক্রোধভাজন (ইয়াহুদী) নয় এবং যারা পথভ্রষ্টও (খ্রিষ্টান) নয়”।
উক্ত
আয়াতাংশের প্রকৃত ব্যাখ্যাঃ
কোন
কোন বর্ণনা দ্বারা সুসাব্যস্ত যে, مَغْضُوْبٌ عَلَيْهِمْ (ক্রোধভাজনঃ যাদের উপর আল্লাহর গযব
নাযিল হয়েছে তারা) হল ইয়াহুদী। আর ضَالِّيْنَ (পথভ্রষ্ট) বলতে খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো
হয়েছে। ইবনে আবী হাতেম বলেন, মুফাসসিরীনদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, {المَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ} হল ইয়াহুদীরা এবং {الضَّالِّينَ} হল খ্রিষ্টানরা। (ফাতহুল ক্বাদীর)
তাই সঠিক পথে চলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য অত্যাবশ্যক হল যে, তারা ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টান
উভয় জাতিরই ভ্রষ্টতা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। ইয়াহুদীদের সব থেকে বড় ভ্রষ্টতা
এই ছিল যে, তারা জেনে-শুনেও সঠিক পথ অবলম্বন করেনি। তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের বিকৃতি
ও অপব্যাখ্যা করতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করতো না। তারা উযাইর (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র
বলতো। তাদের পন্ডিত ও সাধু-সন্নাসীদের হালাল ও হারাম করার অধিকার আছে বলে মনে করতো।
আর খ্রিষ্টানদের সব থেকে বড় ত্রুটি এই ছিল যে, তারা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি
ক’রে তাঁকে আল্লাহর পুত্র এবং তিনের এক সাব্যস্ত করেছে। দুঃখের বিষয় যে, উম্মাতে মুহাম্মাদিয়ার
মধ্যেও এই ভ্রষ্টতা ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। যার কারণে তারা দুনিয়াতে লাঞ্ছিত এবং ঘৃণিত
হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভ্রষ্টতার গহ্বর থেকে বের করুন; যাতে তারা অবনতি ও দুর্দশার
বর্ধমান অগ্নিগ্রাস থেকে সুরক্ষিত থাকে।
পির সাহেবের শেষ বক্তব্যঃ
আমরা
জাগতিক বা জাহেরি শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রথমে মক্তব-মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল,
কলেজ, ইউনির্ভাসিটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করে থাকি। তেমনি আল্লাহকে পাওয়া
এবং তার নৈকট্যলাভ করার জন্য, হক্কানি কামেল পীর বা আউলিায়াদের তরিকার পথ অনুসরণ করতে
হয়। তাঁরা আত্মাকে এছলাহ্ বা আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরি লাভের উদ্দেশ্যে,
হরহামেশা অজিফা-কালাম, ধ্যান-মোরাকাবার শিক্ষা দিয়ে আল্লাহতায়া’লার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন
করিয়ে থাকেন।
ফাযায়েলে
আমাল [লেখকঃ যাকারিয়া কান্ধলভী] বইতে পির ধরার জন্যে কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যাঃ
"ফাযায়েলে
আমাল" বইটিতে পীর ধরার দলীল হিসেবে সুরা ফাতিহার ৭ নং আয়াত পেশ করা হয়েছে ।
[অর্থঃ]
সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ ।
লেখক
বলেছেন এখানে ৭নং আয়াতে নেয়ামতপ্রাপ্ত বলতে নাকি পীর মাশায়েখদেরকে বুঝানো হয়েছে । আসলে
কী তাই?
চলুন
দেখি আল্লাহ তায়ালা কি বলেন ঐ নেয়ামতপ্রাপ্তদের পরিচয় সম্পর্কে ।
আল্লাহ
তায়ালা বলেন, “আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের
প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ
ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। (সুরা নিসা:৬৯) এরাই হল এই
নেয়ামত প্রাপ্ত দল। (তাফছিরে ইবনে কাসির, ১ম খন্ড ১১১ পৃষ্ঠা)
বইঃ"পীর ধরার অকাট্য
দলীল"-লেখকঃ আযহারুল ইসলাম, মানিকগন্জ পীরের দলিলঃ
"পীর
ধরার অকাট্য দলীল" বইটাতে পীর ধরার অকাট্য দলীল হিসেবে কোরআনের তিনটি আয়াতকে ব্যবহার
করা হয়েছে । অবশ্য এই বইটার ১৯নং পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই বলেছেন, "পীরের কথা কোরআন
শরীফে এবং হাদিস শরীফের কোথাও নেই"। তাছাড়া বলেছেন,"পীর ফার্সি শব্দ যার
মানে আরবীতে শায়খ বাংলায় শিক্ষক ও ইংরেজীতে (Teacher)."
যে
আয়াত তিনটির মর্মে তিনি পীর ধরার দলিল দিয়েছেন এগুলো হলো যথাক্রমে-
(১).সূরা
আত তাওবাহ এর ১১৯ নং আয়াত,
(২).সূরা
আল মায়িদাহ এর ৩৫নং আয়াত
(৩).সূরা
আল লোকমান এর ১৫ নং আয়াত ।
এগুলোর
বাংলা উচ্চারণসহ সঠিক অর্থগুলো নিচে দেখুনঃ
(১)."কুনু মা'আছ ছাদিক্বিন"অর্থঃ"'সত্যবাদীদের
সাথে থাকো'"(সূরা আত তাওবাহ এর ১১৯ নং আয়াতের অংশ)
(২)."ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলাহ"অর্থঃ'তোমরা
তার নৈকট্যের উপায় তালাশ করো'(সূরা আল মায়িদাহ এর ৩৫ নং আয়াতের অংশ)।
(৩)."ওয়াত্তাবিয়ি ছাবিলা মান আনাবা
ইলাইয়া"অর্থঃ'যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে'(সূরা আল লোকমান এর ১৫ নং
আয়াতের অংশ)
এগুলোর
বাংলা উচ্চারণসহ অর্থ ঐ জাহেল (মূর্খ) পীর সাহেব কিভাবে তার বইয়ে উল্লেখ করেছে তা নিচে
দেখুনঃ
(১)."কুনু মা'আছ ছাদিক্বিন"অর্থঃ"'তোমরা
সকলেই একজন সাদিক লোকের সঙ্গী হয়ে থাক'"(সূরা আত তাওবাহ এর ১১৯ নং আয়াতের অংশ)
(২)."ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াছিলাহ"অর্থঃ'তোমরা(আমাকে
চিনবার জন্য) একটি অছিলা তালাশ কর'(সূরা আল মায়িদাহ এর ৩৫নং আয়াতের অংশ)
(৩)."ওয়াত্তাবিয়ি ছাবিলা মান আনাবা
ইলাইয়া"অর্থঃ'আমার দিকে যে ব্যক্তি রুজু হয়েছে অর্থাত্ আমাকে যে পেয়েছে,জেনেছে
এবং আমাকে চেনার কায়দা জানে তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রুপে অনুসরণ করে মেনে, সে যেমন চলে
তেমন চল,যেমন করে তেমন কর,যেমন বলে তেমন বল,সোজা কথায় তার হাতে একটা মরা মানুষ হও ।
যে ভাবে নাড়ে তেমন নড় নিজের বুদ্ধিকে বিক্রয় করে দাও'(সূরা আল লোকমান এর ১৫ নং আয়াতের
অংশ)
অপব্যাখ্যাগুলো
শুধুমাত্র পীর ধরার জন্য করা হয়েছে ।
[নোটঃ ১ নং আয়াতটিতে বলা হয়েছে "ছাদিকীন" যা
বহুবচন এবং বলা হয়েছে সত্যনিষ্ঠদের সাথী হও। কিন্তু উনি বলতেছেন,"তোমরা সকলেই
একজন সাদিক লোকের সঙ্গী হয়ে থাক" . এখানে সাদিক হলো একবচন তারপরে আবার এর পূর্বে
তোমরা সকলেই একজন একজন শব্দগুলো যোগ করে দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে ২নং আয়াতটিতে (একটি)
ওয়াছিলা তালাশ করার কথা বলেছেন যাতে একমাত্র পীরকেই ওয়াছিলা হিসেবে বুঝানো যায় । মূলত
ওয়াছিলা শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে । যেমনঃ "নৈকট্যের উপায়,বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মানিত
স্থান,উপায়,উপকরণ"। এখানে পীরদের কথা বুঝানো হয়নি । এখানে আয়াতগুলিত যদিও পীর
বা শায়খ এর কথা নেই তারপরও আমরা যদি ওয়াছিলা অর্থ পীর ধরে নিই তবে দেখুন বিপদটা কোথায়
হয়ঃ আজানের দোয়ায় আমরা বলি,"আতি মোহা'ম্মাদানিল ওয়াছিলাতা ওয়াল ফাযিলাহ"
। অর্থঃ মোহা'ম্মাদ (ছা) কে দান করো "'বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান'"
ও সুমহান মর্যাদা । এখানে ওয়াছিলা অর্থ যদি পীর ধরে নিই তবে অর্থ দাড়াবে,"মোহা'ম্মাদ
(ছা) কে দান করো "'একজন পীর'" ও সুমহান মর্যাদা"(নাউযুবিল্লাহ)।
একই
তিন নং আয়াতটাকে ঠুকরে ঠুকরে একেবারে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে ।]
আয়াত
তিনটিতে পীর শব্দটা যোগ করার জন্য এত অপব্যাখ্যা করা হচ্ছিল । ধরুন কোরআনে অনেক স্থানে
বলা হয়েছে,"তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো ","তাদের বাসস্থান
হলো জাহান্নাম সেখানে তারা চিরকাল থাকবে","তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ
দাও" ।
এখন
আমি যদি বলি যে এগুলো বলা হয়েছে পীরদের সম্পর্কে তবে তা কি আপনি মেনে নিবেন?
এবার
সম্পূর্ণ আয়াত তিনটি সঠিক অর্থসহ দেখুনঃ
[সূরা
মায়িদাহঃ আয়াত ৩৫]
[অর্থঃ]
হে মুমিনগণ ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্যের উপায় তালাশ করো এবং তাঁর পথে জেহাদ করো
যাতে তোমরা সফলকাম হও।
[সূরা
লোকমানঃ আয়াত ১১৯]
[অর্থঃ]
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।
[সুরা
লোকমানঃ আয়াত ১৫]
[অর্থ]
পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান
তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সত্ভাবে একত্রে অবস্থান
করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে । অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই
দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো ।
এখন প্রশ্ন হলোঃ
১.
ছাদিকিন (সত্যবাদি,সত্যনিষ্ঠ) কারা (পীরেরা নাকি অন্য কেউ)?
২.
অছিলা কি (পীর না অন্য কেউ)?
৩.
কারা আল্লাহ তায়ালার অভিমুখী? (পীরেরা নাকি অন্যরা)
১নং প্রশ্নের উত্তরঃ
[সুরা
হুজুরাতঃ আয়াত ১৫]
[অর্থঃ]
তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং
আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যবাদী (ছাদিক্বিন)।
২নং প্রশ্নের উত্তরঃ
এক্ষেত্রে
আযহারুল ইসলাম পীর সাহেব লিখেছেন, অছিলা শব্দের অর্থ "নৈকট্য লাভের উপায়"
। এতে আমরাও একমত । তবে নৈকট্য লাভের উপায় যে পীর তাতে আমরা একমত নই ।
"ওয়াবতাগু
ইলাইহিল অছিলাহ" বলতে বুঝানো হয়েছে "আল্লাহর নৈকট্যের উপায় তালাশ করো"
আল্লাহর
নৈকট্যের উপায় বলতে কি বুঝানো হয়েছে একটু দেখা যাক হাদিস থেকেঃ
রাছুলুল্লাহ
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম ইরশাদ করেন,"তোমরা তাহাজ্জুদকে আবশ্যক করে নাও
। কারণ তা তোমাদের পূর্ববর্তী আল্লাহওয়ালাগণের নিদর্শন এবং তা তোমাদের প্রতিপালকের
নৈকট্য লাভের মাধ্যম, তোমাদের গুনাহ সমূহের কাফফারা এবং তোমাদেরকে গুনাহ হতে নিবৃত্তকারী।
(তিরমিযী, মিশকাত)
এছাড়াও
বহু হাদিছ হতে প্রমাণিত হয় আল্লাহ ছুবহা'নাহু ওয়া তাআ'লার ইবাদাতই হচ্ছে তার নৈকট্য
লাভের উপায় । এক হাদিছে রয়েছে "বান্দা যখন সিজদায় যায় তখন সে আল্লাহ ছুবহা'নাহু
ওয়া তাআ'লার সবচেয়ে বেশী নৈকট্য লাভ করে ।"
৩নং প্রশ্নের উত্তরঃ
[সুরা
আলে ইমরান : আয়াত 102]
হে
ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাকো এবং অবশ্যই অনুগত
(অভিমুখী) না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না । যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতি অভিমুখী হয়
প্রকৃতপক্ষে সেই মুসলিম ।
প্রিয়
মুসলমান ভাইয়েরাঃ উপরোক্ত আলোচনায় কয়েকজন পিরের লিখিত বই থেকে যৎসামান্য দলিল তুলে
ধরা হয়েছে মাত্র। পৃথিবীর সকল পির বা ভন্ড অলিদের আকিদাহ প্রায় একই। তাদের এই ব্যবসাকে
চালু রাখতে কুরআন ও হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা এমনিভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, উচ্চ পর্যায়ের
একজন আলেমও সহজে ভুল ধরতে পারে না। যেহেতু পির-অলি ও বিদআতি আলেমগণ কুরআন ও হাদিসকে
তারা নিজেদের মতো করে মনগড়া ব্যাখ্যা করেন যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই তাই তাদের
ব্যাখ্যা ভুল বলে পরিগণিত হবে।
রাসুল সাঃ বলেন,
“যে
ব্যক্তি নিজের মতবাদকে কেন্দ্র করে তার নিয়ন্ত্রনে কুরআনের ব্যাখ্যা করে- যে ব্যক্তি
কুরআনের নির্দেশ অনুসারে স্বীয় মতবাদ স্থির করে না; বরং স্বীয় মতবাদের নির্দেশ
অনুসারে কুরআনের ব্যাখ্যা করে, শাব্দিক অর্থে ঐ ব্যাখ্যা শুদ্ধ হলেও বস্তুত
তা ভুল পরিগণিত।” (মেশকাত)।
আল্লাহ বলেন,
হে
নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না কোন
কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের
জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের
প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের
প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের
কোনই গুরত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতি
দানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। (কাহাফঃ ১০৩-১০৫)।
আল্লাহ আরো বলেন,
সঠিক
পথ প্রদর্শনের পরও যারা বিশ্বাসীদের ব্যতীত অন্য কারও অনুকরন করে এবং মতানৈক্য ও বিরোধিতা করছে আল্লাহর রাসুল নবি করিম (সঃ) কে তবু তাদেরকে তিনি তার পছন্দ মতো বিপথে চলতে
দেবেন এবং জাহান্নামের অগ্নিতে জ্বালাবেন। (কোরআন-৪:১১৫)।
আল্লাহ
আরো বলেন,
“তোমরা
কি কোরআনের কোন কোন অংশ (আয়াত) মানো আর কোন কোন অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের
মধ্য থেকে এরুপ কাজ করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য
লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী
সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্য কলাপ সম্বন্ধেবে- খবর নন। (বাকারা-৮৫)।
ছূফী মতবাদের জন্ম। ছূফীদের
পিছনে ছালাত আদায় করা কতোটুকু বৈধ?
ছূফী
মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ। এটি রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের যুগে পরিচিত
ছিল না। এমনকি হিজরী তৃতীয় শতক পর্যন্ত ছূফীবাদ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেনি (ইবনু তায়মিয়াহহ,
মাজমূঊল ফাতাওয়া ১১/০৫)। হিন্দু, পারসিক ও গ্রীক দর্শনের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর
মধ্যে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে মারেফাতের নামে ছূফীবাদের সূচনা হয়। সর্বপ্রথম ইরাকের
বছরা নগরীতে যুহ্দ বা দুনিয়া ত্যাগের প্রেরণা থেকে এটা শুরু হয়। প্রবল আল্লাহভীতি ও
দুনিয়াত্যাগের বাড়াবাড়ি, সার্বক্ষণিক যিকর, আযাবের আয়াত পাঠে বা শুনে অজ্ঞান হওয়া বা
মৃত্যু বরণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে শুরু হয় ছূফীবাদের যাত্রা। ছূফীবাদের পরিভাষায় এই
অবস্থাকে ‘হাল’ বলে।
তাদের আক্বীদাকে তিনটি
মাযহাবে ভাগ করা যায়ঃ
১- প্রাচ্য দর্শনভিত্তিক মাযহাব, যা দক্ষিণ
এশীয় হিন্দু ও বৌদ্ধদের নিকট থেকে এসেছে। এই মাযহাবের অনুসারী ছূফীরা মা‘রেফাত হাছিল
করার জন্য দেহকে চরমভাবে কষ্ট দিয়ে স্বীয় ক্বলবকে তাদের ধারণা মতে জ্যোতির্ময় করার
চেষ্টা করে থাকে। প্রায় সকল ছূফীই এরূপ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন।
২- খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে আগত মাযহাব,
যা ‘হুলূল’ ও ‘ইত্তেহাদ’ দ’ুভাগে বিভক্ত। হুলূল অর্থ ‘মানুষের দেহে আল্লাহর অনুপ্রবেশ’।
হিন্দু মতে ‘নররূপী নারায়ণ’। ইরানের আবু ইয়াযীদ বিস্তামী (মৃঃ ২৬১ হিঃ) ওরফে বায়েযীদ
বুস্তামী ছিলেন এই মতের হোতা। এই মাযহাবের অন্যতম নেতা হুসাইন বিন মনছূর হাল্লাজ (মৃঃ
৩০৯ হিঃ) নিজেকে সরাসরি আল্লাহ (আনাল হক্ব) বলে দাবী করায় মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে
শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
৩- ইত্তেহাদ বা ওয়াহদাতুল উজূদ বলতে অদ্বৈতবাদী
দর্শন বুঝায়, যা ‘হুলূল’-এর পরবর্তী পরিণতি হিসাবে রূপ লাভ করে। এর অর্থ হ‘ল আল্লাহর
অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। অস্তিত্ব জগতে যা কিছু আমরা দেখছি, সবকিছু একক এলাহী
সত্তার বহিঃপ্রকাশ। এই আক্বীদার অনুসারী ছূফীরা
স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য করে না। এদের মতে মূসা (আঃ) -এর সময়ে যারা বাছুর পূজা
করেছিল, তারা মূলতঃ আল্লাহকে পূজা করেছিল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে সবই আল্লাহ। আল্লাহ
আরশে নন, বরং সর্বত্র ও সবকিছূতে বিরাজমান। অতএব, মানষের মধ্যে মুমিন ও মুশরিক বলে
কোন পার্থক্য নেই। যে ব্যক্তি মুর্তিপুজা করে বা পাথর, গাছ, মানুষ, তারকা ইত্যাদি পুজা
করে, সে মূলতঃ আল্লাহকেই পুজা করে। সবকিছুর মধ্যে মুমিন আল্লাহর নূর বা জ্যোতির প্রকাশ
রয়েছে। তাদের ধারণায় খৃষ্টানরা কাফের এজন্য যে, তারা কেবল ঈসা (আঃ)-কেই প্রভূ বলেছে।
যদি তারা সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ বলত, তাহ’লে তারা কাফের হ’ত না। বলা বাহুল্য এটাই হল
হিন্দুদের ‘সর্বেশ্বরবাদ’। তৃতীয় শতাব্দী হিজরী থেকে চালু এই সব কুফরী আক্বীদার ছূফী
সম্রাট হলেন সিরিয়ার মুহিউদ্দিন ইবনু আরাবী (মৃঃ ৬৩৮হিঃ)। বর্তমানে এই আক্বীদাই মা‘রেফাতপন্থী
ছূফীদের মধ্যে ব্যপকভাবে প্রচলিত। এদের দর্শন হ‘ল এই যে, প্রেমিক ও প্রেমাষ্পদের মধ্যকার
সম্পর্ক এমন হ’তে হবে যেন উভয়ের অস্তিত্বের মধ্যে কোন ফারাক না থাকে’। বলা বাহুল্য
‘ফানাফিল্লাহ-র উক্ত আক্বীদা সম্পূর্ণরূপে কুফরী আক্বীদা। এই আক্বীদাই বর্তমানে চালু
আছে।
মাসীবী
বলেন, আমরা একদিন ইমাম মালেক (রহঃ)-এর নিকট বসা ছিলাম, জনৈক নাছীবী বলল, হে আবু আব্দিল্লাহ!
আমাদের এলাকায় ছূফী নামে কিছু লোক রয়েছে, যারা অনেক খায়। এরপর ক্বাছীদাহ (দীর্ঘ কবিতা)
আবৃত্তি করে এবং একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে যিকির শুরু করে। ইমাম মালেক বললেন, তারা
কি শিশু? সে বলল, না। তিনি বললেন, তারা কি পাগলের দল? সে বলল, না বরং আলেম-ওলামা। তিনি
বললেন, কোন মুসলমান এমনটি করে বলে জানি না (কাযী ইয়ায, তারতীবুল মাদারেক ২/৫৩-৫৪; ইবনুল
জাওযী, তালবীসু ইবলীস ১/৩২৭)। মারওয়ান বিন মুহাম্মাদ দামেশকী বলেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষের
নিকট দ্বীন নিরাপদ নয়- ছূফী, গল্পকার ও বিদ‘আতী’ (কাযী ইয়ায, তারতীবুল মাদারেক ৩/২২৬)।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, কোন লোক যদি দিনের প্রথম প্রহরে ছূফী মতবাদ গ্রহণ করে তাহ’লে
তুমি তাকে যোহরের সময় হ’তে না হ’তেই একেবারে আহম্মক অবস্থায় পাবে (বায়হাক্বী, মানাক্বিবুশ
শাফেঈ ২/২০৭)। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন ছূফী মতবাদে ঢুকে থাকবে সে আর
কখনো সুস্থ আক্বীদায় ফিরতে পারবে না’ (ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস ১/৩২৭)। তিনি আরো
বলেন, আমি ছূফীদের সংস্পর্শে গিয়ে কেবল দু’টি বিষয়ে উপকৃত হয়েছি। তারা বলে, ‘সময় তরবারী
তুল্য। তুমি যদি তাকে না কাটো তাহ’লে সে তোমাকে কাটবে। আর তুমি যদি আল্লাহকে নিয়ে ব্যস্ত
না হও, তাহ’লে বাতিল তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবে’ (ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ৩/১২৪)।
আবু যুর‘আকে ছূফী হারেছ মুহাসেবী ও তার কিতাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
‘তোমরা অবশ্যই এই কিতাবগুলো থেকে দূরে থাকবে। কারণ সেগুলো বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতায় ভরপুর।
তোমাদের জন্য আবশ্যক হ’ল হাদীছের অনুসরণ করা। তাতে তোমরা এমন কিছু পাবে, যা তোমাদের
জন্য যথেষ্ট (যাহাবী, মীযানুল ই‘তিদাল ১/৪৩১)। আবুবকর তুরতুশী বলেন, ‘ছূফী মাযহাব বাতিল
এবং মূর্খতা ও ভ্রষ্টতাপূর্ণ। কেবল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীছের মধ্যে ইসলাম রয়েছে’
(কুরতুবী, তাফসীর সূরা ত্বোয়াহা ৯০ আয়াত, ১১/২৩৮)। ইমাম কুরতুবী বলেন, ছূফী তরীকা সত্য
থেকে অনেক দূরে, মানুষের জন্য অনুপযোগী ও সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক (তাফসীরে কুরতুবী
১১/২৩৮)।
এছাড়া
ইবনু তায়মিয়াহহ, ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু কুদামাহ, যাহাবী, ইবনুল জাওযী (রহঃ) সহ বহু বিদ্বান
উক্ত মতবাদের সমালোচনা করে স্বতন্ত্র গ্রন্থ সমূহ রচনা করেছেন (বিস্তারিত দ্র. দ্রঃ
দরসে কুরআন, মা‘রেফতে দ্বীন, আত-তাহরীক, ২য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, জানুয়ারী ১৯৯৯; আব্দুর
রহমান আল-ওয়াকীল, হাযিহী হিয়াছ ছূফিয়াহ, ১-১৮৮ পৃ.; ড. সাঈদ আব্দুল আযীম জামীল গাযী,
আছ-ছূফিয়াহ)।
সুতরাং
ছূফীদের মধ্যে যারা বিশেষত হুলূল ও ইত্তেহাদ তথা অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদা
পোষণ করে এবং সেমতে আমল করে, যা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত সেসব ইমামের পিছনে জেনে শুনে ছালাত
আদায় করা সিদ্ধ হবে না।
সুফীবাদের বিভিন্ন তরীকার
বিবরণঃ
সুফীদের
রয়েছে বিভিন্ন তরীকা। স্থান ও কাল অনুযায়ী অসংখ্য সুফী তরীকা আত্ম প্রকাশ করার কারণে
এর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য সুফী তরীকা আত্মপ্রকাশ
করেছে। তার মধ্যে নিম্নের কয়েকটি তরীকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায়ই সুফী তরীকার
পীর ও মুরীদদের মুখে এ সমস্ত তরীকার নাম উচ্চারণ করতে শুনা যায়। এ সমস্ত তরীকা হচ্ছেঃ
(১) কাদেরীয়া তরীকাঃ আব্দুল কাদের জিলানীকে
(মৃত ৫৬১ হিঃ) এ তরীকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুফীরা দাবী করে থাকেন। কিন্তু নিরপেক্ষ
বিশ্লেষণ ও তার জীবনী অধ্যায়ন করলে জানা যায় যে, তিনি কোন তরীকা প্রতিষ্ঠা করে যান
নি। তার নামে যে সমস্ত কারামত বর্ণনা করা হয় তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
(২) নকশবন্দীয়া তরীকাঃ মুহাম্মাদ বাহাউদ্দ্বীন
নকশবন্দীকে (মৃত ৭৯১ হিঃ) এই তরীকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
(৩) চিশতিয়া তরীকাঃ খাজা মঈন উদ্দ্বীন চিশতীকে
(মৃত ৬২০ হিঃ) এ তরীকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ভারতের আজমীরে তার মাজার
রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম সকলেই এ মাজার যিরারত করে থাকে।
(৪) মুজাদ্দেদীয়া তরীকাঃ মুজাদ্দেদ আলফে
ছানীকে (মৃত ১০৩৪ হিঃ) এই তরীকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবী করা হয়।
(৫) সোহরাওয়ার্দী তরীকাঃ শিহাব উদ্দ্বীন
উমার সোহরাওয়ার্দীর (মৃত ৬৩২ হিঃ) নামে এই তরীকাটির নিসবত করা হয়। এই পাঁচটি তরীকার
নামই আমাদের দেশের সুফীদের মুখে ব্যাপকভাবে উচ্চারণ করতে শুনা যায়।
সুফীবাদের স্তর পরিক্রমাঃ
(ক) শরীয়তঃ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যাবতীয়
বিধানকে শরীয়ত বলা হয়। সর্বপ্রথম শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হয়। শরীয়তের যাবতীয় বিধানের
মধ্য দিয়ে সুফী তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অনুগত
করেন। শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ সুফী হতে পারবে না। সুফীরা এ কথাটি জোর দিয়ে
বললেও তাদের আচার-আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ অনেক সুফীকেই দেখা যায় তারা মারেফতের
দোহাই দিয়ে শরীয়তের বিধান মানতে আদৌ প্রস্ত্তত নন।
(খ) তরীকতঃ সুফীদের পরিভাষায় তরীকত হচ্ছে;
শরীয়তের যাবতীয় বিধান অনুশীলনের পর তাকে আধ্যাত্মিক গুরুর শরণাপন্ন হতে হবে। এ পর্যায়ে
তাকে বিনা প্রশ্নে গুরুর আনুগত্য করতে হবে।
(গ) মারেফতঃ সুফীদের পরিভাষায় মারেফত হচ্ছে,
এমন এক স্তর যার মধ্যে বান্দাহ উপনীত হলে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এ স্তরে
পৌঁছতে পারলে তার অন্তর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তখন তিনি সকল বস্ত্তর আসল তত্ত্ব উপলব্ধি
করতে শুরু করেন। মানব জীবন ও সৃষ্টি জীবনের গুপ্ত রহস্য তার নিকট স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।
(ঘ) হাকিকতঃ সুফীদের ধারণায় তাদের কেউ এ
স্তরে পৌঁছতে পারলে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রেমের স্বাদ ও পরমাত্মার সাথে তার যোগাযোগ
হয়। এটা হচ্ছে সুফী সাধনার চুড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফী ধ্যানের মাধ্যমে
নিজস্ব অস্তিত্ব আল্লাহর নিকট বিলীন করে দেন।
উপরোক্ত
নিয়মে ভক্তদের নামকরণ করা ও স্তরভেদ করা একটি বানোয়াট পদ্ধতি। ইসলামের প্রথম যুগে এগুলোর
কোন অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীতে সুফীরা এগুলো নিজের খেয়াল খুশী মত তৈরী করেছে।
সুফীদের বিভিন্ন ভ্রান্ত
আক্বিদাহসমূহঃ
অলী-আওলীয়াদের আহবানঃ
সুফীদের
বিরাট একটি অংশ নবী-রাসূল এবং জীবিত ও মৃত অলী-আওলীয়াদের কাছে দুআ করে থাকে। তারা বলে
থাকেঃ ইয়া জিলানী, ইয়া রিফাঈ, ইয়া রাসূলুল্লাহ ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁকে ছাড়া
অন্যেকে আহবান করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করবে,
সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
‘তুমি
আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্ত্তকে ডাকবে না যে তোমার উপকার কিংবা ক্ষতি কোনটিই করতে পারে
না। যদি তুমি তাই কর তবে তুমি নিশ্চিত ভাবেই জালেমদের মধ্যে গন্য হবে। (সূরা ইউনুসঃ
১০৬)।
আল্লাহ
তাআলা আরও বলেনঃ
‘এবং
ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কে বেশী পথভ্রষ্ট যে আল্লাহ ব্যতীত এমন ব্যক্তিদেরকে আহবান করে
যারা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের ঐ আহবান থেকে সম্পূর্ণ বেখবর
রয়েছে? (সূরা আহকাফঃ ৫)।
গাউছ, কুতুব, আবদাল ও নুজাবায়
বিশ্বাসঃ
সুফীরা
বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীতে কতিপয় আবদাল, কুতুব এবং আওলীয়া আছেন, যাদের হাতে আল্লাহ তাআলা
পৃথিবী পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব সোপর্দ করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা তাদের ইচ্ছামত
পৃথিবীর কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
তাবলীগি
নেসাব ফাযায়েলে আমাল বইয়ে এই ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, হজরত
শাইখুল বলেছেনঃ আমি আমার আব্বাজানের নিকট প্রায়ই একটা ঘটনা শুনতাম। উহা এই যে, জনৈক
ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রয়োজনে পানি পথে যাইতেছিল। পথিমধ্যে যমুনা নদী পড়িল, তাহার অবস্থা
তখন এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, নৌকা চলাও মুশকিল ছিল, লোকটি পেরেশান হইয়া গেল। লোকজন তাহাকে
বলিল অমুক জঙ্গলে একজন কামেল লোক থাকেন, তাহার নিকট গিয়া স্বীয় প্রয়োজন পেশ কর। তিনি
নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করিবেন। তবে তিনি প্রথমে রাগ করিবেন। তাহাতে তুমি নিরাশ হইও না।
লোকটি তাহাদের কথায় জঙ্গলের মধ্যে গিয়া দেখিলেন সেই দরবেশ তাহার বিবি বাচ্চাসহ একটি
ঝুপড়ির মধ্যে বাস করিতেছে। সেই ব্যক্তি স্বীয় প্রয়োজন ও যমুনার অবস্থা বর্ণনা করিল,
দরবেশ প্রথমে অভ্যাস মোতাবেক রাগ করিয়া বলিল, আমার হাতে কি আছে? আমি কি করিতে পারি?
লোকটি কান্নাকাটি করিয়া আপন সমস্যার কথা বলিল, তখন দরবেশ বলিলঃ যাও, যমুনার কাছে গিয়া
বলঃ আমাকে ঐ ব্যক্তি পাঠাইয়াছে, যে জীবনে কখনও কিছু খায় নাই এবং বিবির সহিত সহবাস করে
নাই.......শেষ পর্যন্ত। লোকটি যমুনায় গিয়া দরবেশের কথা জানাইল। যমুনা তাহার কথা মত
শান্ত হইয়া গেল। সেই লোকটি পার হইয়া যাওয়ার পর যমুনা আবার ভীষণ আকার ধারণ করিল। (দেখুনঃ
ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)
প্রিয়
পাঠক বৃন্দ লক্ষ্য করুন, এটি এমন একটি বিশ্বাস যা মক্কার মুশরিকরাও পোষণ করতো না। তারা
যখন সাগর পথে ভ্রমণ করার সময় বিপদে আক্রান্ত হত, তখন তারা সকল দেব-দেবীর কথা ভুলে গিয়ে
বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের
সেই কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ
‘তারা
যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে
উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫) অথচ বর্তমান সময়ের অসংখ্য
মুসলিমকে দেখা যায় তারা চরম বিপদের সময়ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে কল্পিত অলী-আওলীয়াদেরকে
আহবান করে থাকে, যা মক্কার মুশরিকদের শির্ককেও হার মানিয়েছে। কেননা মক্কার লোকেরা শুধু
সুখের সময়ই আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো, কিন্তু বিপদের সময় তারা সেগুলোকে ভুলে গিয়ে
এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে
শির্ক করছে। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বর্তমানের মাজার পূজারী মুসলিমের শির্কের
চেয়ে মক্কার আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের শির্ক অধিক হালকা ছিল। মোটকথা মক্কার মুশরিকদের
তাওহীদে রুবুবীয়া সম্পর্কে যে অগাধ বিশ্বাস ছিল তা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
হে
নবী! আপনি জিজ্ঞেস করুন, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা
কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা
মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে
উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও ভয় করছ না? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
তিনি
আরও বলেনঃ
‘তিনি
আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন। (সূরা সাজদাঃ ৫) এখানে বিশেষভাবে
স্মরণ রাখা দরকার যে, غوث অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা। এটি আল্লাহর
গুণ। কোন মানুষ গাউছ হতে পারে না। ঢাকা শহরের মহাখালীতে মাসজিদে গাউছুল আযম নামে বিশাল
একটি মসজিদ রয়েছে। আমরা সকলেই জানি এখানে গাউছুল আযম দ্বারা বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীকে
বুঝানো হয়েছে। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। যারা আব্দুল কাদের জিলানী
(রঃ)কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো, তারা কি
এ ধরণের কথার মাধ্যমে আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)কে আল্লাহর সমান করে দেন নি? শুধু তাই
নয় সুফীদের একটি দল বিশ্বাস করে যে, আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন
করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন। (নাউযুবিল্লাহ)।
সুফী তরীকার মাশায়েখগণ বিপদ
হতে উদ্ধার করতে পারেনঃ
সুফীরা
বিশ্বাস করেন যে, তাদের মাশায়েখ ও অলীগণ বিপদ হতে উদ্ধার করতে সক্ষম। তাই বিপদে তারা
তাদের অলীদেরকে আহবান করে থাকে। তারা বলে থাকে মদদ ইয়া আব্দুল কাদের জিলানী, হে উমুক,
হে উমুক ইত্যাদি। এভাবে বিপদাপদে পড়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহবান করা প্রকাশ্য শির্কের
অন্তর্ভূক্ত আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
‘আর
যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নাই। পক্ষান্তরে
যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সূরা আনআমঃ ১৭) আল্লাহ্ তাআলা
আরও বলেনঃ
আপনি
বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্
চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম।
ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদাতা
ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮)
এবাদতের সময় সুফীদের অন্তরের
অবস্থাঃ
সুফীরা
দ্বীনের সর্বোচ্চ স্তর তথা ইহসানের ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ মাশায়েখদের দিকে মনোনিবেশ
করে থাকে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘ইহসান
হল, এমনভাবে তুমি আল্লাহ পাকের ইবাদত করবে যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁকে দেখতে
না পাও তবে বিশ্বাস করবে যে, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। (সহীহ মুসলিম)
নবী-রাসূলদের সম্পর্কে সুফীদের
ধারণাঃ
নবী-রাসূলদের
ব্যাপারে সুফীদের বিভিন্ন ধারণা রয়েছে। তাদের কতিপয়ের কথা হচ্ছে,
অর্থাৎ আমরা এমন সাগরে সাতার কাটি, নবীগণ যার তীরে
দাঁড়িয়ে থাকেন। অর্থাৎ সুফীগণ এমন মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন, যা নবীদের পক্ষেও সম্ভব নয়।
অলী-আওলীয়াদের ব্যাপারে তাদের
বিশ্বাসঃ
অলী-আওলীয়াদের
ক্ষেত্রে সুফীদের আকীদা হচ্ছে, তাদের কেউ নবীদের চেয়ে অলীগণকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। আবার
কেউ কেউ মনে করেন যে, অলীগণ এবং আল্লাহর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহর সকল গুণই অলীদের
মধ্যে বর্তমান। যেমন সৃষ্টি করা, রিযিক প্রদান করা, কাউকে জীবন দান করা, কাউকে মৃত্যু
দান করা ইত্যাদি আরও অনেক। এ জাতীয় বিশ্বাস যে শির্ক তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ
নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বাড়াবাড়িঃ
সুফীরা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূরের তৈরী মনে করে। তারা নিম্নের বানোয়াট হাদীছটিকে
দলীল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
অর্থাৎ
আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন শব্দে একই অর্থে সুফীদের
কিতাবে সনদবিহীন ভাবে এই বানোয়াট হাদীছটি উল্লেখিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের
দেশের অধিকাংশ সুন্নী মুসলমানও এই আকীদাই পোষণ করে থাকে। অথচ কুরআন ও সহীহ হাদীছের
ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরের তৈরী ছিলেন
না এবং তিনি সর্বপ্রথম সৃষ্টিও ছিলেন না। সহীহ হাদীছ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা
সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিষটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। তারপর কলমকে কিয়ামত
পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন। (সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ১৩৩) তিনি আরও বলেনঃ
‘আল্লাহ্
তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেনঃ লিখ। কলম বললঃ হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব?
আল্লাহ্ বললেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত আগমণকারী প্রতিটি বস্ত্তর তাকদীর লিখ।
আমাদের
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরের তৈরীও ছিলেন না এবং তিনি প্রথম
সৃষ্টিও নন। তিনি মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
হে
নবী! আপনি বলুন যে, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। (সূরা কাহাফঃ ১১০) এ ছাড়া কুরআনের
আরও অনেক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী আদমেরই
একজন ছিলেন। সুতরাং সমস্ত বনী আদম যেহেতু মাটির তৈরী, তাই তিনিও একজন মাটির তৈরী মানুষ
ছিলেন। কেবল ফেরেশতাকেই আল্লাহ নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারীতে
আয়েশা (রাঃ)এর হাদীছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
ফেরেশতাদেরকে
সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে। জিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়া বিহীন অগ্নি থেকে। আর
আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে ঐ বস্ত্ত থেকে যার বিবরণ তোমাদের কাছে পেশ করা হয়েছে।
সুতরাং
তিনি মাটির তৈরী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাকে নবুওয়ত ও রেসালাতের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন।
নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে সুফীরা আরও বিশ্বাস করে যে, তিনি হচ্ছেন
সৃষ্টি জগতের কুববা তথা গম্বুজ। তিনি আরশে সমুন্নত। সাত আসমান, সাত যমীন আরশ-কুরসী,
লাওহে মাহফুয, কলম এবং সমগ্র সৃষ্টিজগত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথার সত্যতা যাচাই করতে বুসেরীর কাসীদাতুল বুরদার একটি
লাইন দেখুনঃ
হে
নবী! আপনার দয়া থেকেই দুনিয়া ও আখেরাত সৃষ্টি হয়েছে। আর আপনার জ্ঞান থেকেই লাওহে মাহফুয
ও কলমের জ্ঞান উদ্ভাসিত হয়েছে। সুফীদের কতিপয় লোকের বিশ্বাস যে, তিনি হচ্ছেন সর্বপ্রথম
সৃষ্টি। এটিই প্রখ্যাত সুফী সাধক ইবনে আরাবী ও তার অনুসারীদের আকীদা। কতিপয় সুফীবাদের
মাশায়েখ এ মতকে সমর্থন করেন না; বরং তারা এ কথাগুলোর প্রতিবাদ করেন এবং তারা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানুষ মনে করেন ও তাঁর রেসালাতের স্বীকৃতি প্রদান করেন। তবে তারা
রাসূলের কাছে শাফাআত প্রার্থনা করেন, আল্লাহর কাছে তাঁর উসীলা দিয়ে দুআ করেন এবং বিপদে
পড়ে রাসূলের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকেন। আসুন দেখি বুসেরী তার কবিতায় কি বলেছেনঃ
‘হে
সৃষ্টির সেরা সম্মানিত! আমার জন্য কে আছে আপনি ব্যতীত, যার কাছে আমি কঠিন বালা মসীবতে
আশ্রয় প্রার্থনা করবো?’’ (নাউযুবিল্লাহে) সুফীবাদের সমর্থক ভাইদের কাছে প্রশ্ন হলো
বুসেরীর কবিতার উক্ত লাইন দু’টির মধ্যে যদি শির্ক না থাকে, তাহলে আপনারাই বলুন শির্ক
কাকে বলে? পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে শির্ক
মিশ্রিত এ জাতীয় কবিতা পাঠ্য করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এগুলো পাঠ করে ইসলামী
শিক্ষার নামে শির্ক ও বিদআতী শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষকগণ
যদি শির্ক মিশ্রিত সিলেবাস
নির্ধারণ
করে তা দিয়ে আমাদের জাতি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে আমরা তাওহীদের সঠিক শিক্ষা
পাবো কোথায়?
কবর ও মাজার সম্পর্কে সুফীদের
আকীদাঃ
সুফীও
সুফিবাদের প্রভাবিত ব্যক্তিগণ অলী-আওলীয়া ও তরীকার মাশায়েখদের কবর পাকা করা, কবরের
উপর গম্বুজ নির্মাণ, তাতে বাতি জ্বালানো, কবর ও মাযার যিয়ারত করার উপর বিশেষ গুরত্ব
প্রদান করে থাকে। এমন কি সুফীরা বেশ কিছু মাজারের চার পাশে তাওয়াফও করে থাকে মিশরে
সায়্যেদ বদভীর কবরের চতুর্দিকে সুফীরা কাবা ঘরের তাওয়াফের ন্যায় তাওয়াফ করে থাকে। ভারতের
আজমীরে তথাকথিত খাজা মইনুদ্দ্বীন চিশতীর কবরেও এহেন তাওয়াফ করে থাকে চিশতীয়া তরীকার
অনুসারীরা। অথচ সকল মুসলিমের কাছে অতি সুস্পষ্ট যে তাওয়াফ এমন একটি এবাদত, যা কাবা
ঘরের চতুর পার্শ্বে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। সুতরাং কোন কবরকে কেন্দ্র
করে তাওয়াফ করা বড় শির্ক, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
এবং
তারা যেন এই সুসংরক্ষিত (পবিত্র) গৃহের তওয়াফ করে। (সূরা হাজ্জঃ ২৯) নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেনঃ
হে আল্লাহ্! আমার কবরকে পূজার স্থানে পরিণত করো না,
যাতে এর ইবাদত করা হয়। আল্লাহ্ অভিশাপ করেছেন ঐ জাতিকে যারা তাদের নবীদের কবর সমূহকে
কেন্দ্র করে মসজিদ তৈরী করেছে।’’ (মুসনাদে আহমাদ) আবু হুরায়রা (রাঃ) এর সূত্রে বুখারী
ও মুসলিমের বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
ইহুদী
খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লানত। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত
করেছে।’’
আলী
(রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি আবুল হায়্যায আল আসাদীকে বলেন, আমি কি তোমাকে এমন আদেশ দিয়ে
প্রেরণ করব না, যা দিয়ে নবী (সাঃ) আমাকে প্রেরণ করেছিলেন?
কোন
মূর্তি পেলেই তা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলবে। আর কোন কবর উঁচু পেলেই তা ভেঙ্গে মাটি বরাবর
করে দিবে।’’ (মুসলিম)
এমনিভাবে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, কবর পাকা করতে, চুনকাম করতে, তার
উপর বসতে, কবরে লিখতে। আর তিনি অভিশাপ করেছেন ঐ সমস্ত ব্যক্তিদেরকে যারা কবরকে মসজিদ
বানায় এবং সেখানে বাতি জ্বালায়। (মুসলিম) সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন (রাঃ)এর যুগে
ইসলামী শহর সমূহে কোন কবর পাকা করা বা কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা হয় নি। না নবী
(সাঃ) এর কবরে না অন্য কারও কবরে। এরপরও কি আমাদের সমাজের বিপথগামী লোকদের হুশ হবে
না?
মৃত আওলীয়ার নামে মান্নত
পেশ করাঃ
সুফীবাদে
বিশ্বাসীগণ মৃত অলী-আওলীয়াদের কবর ও মাজারের জন্য গরু, ছাগল, হাস-মুরগী-কবুতর, টাকা-পয়সা
ইত্যাদি মানত করাকে ছাওয়াবের কাজ মনে করে থাকে। অথচ কুরআন ও সহীহ হাদীছের মাধ্যমে জানা
যায় যে মানত হচ্ছে বিরাট একটি এবাদত, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্যে করা সম্পূর্ণ
শির্ক।
সুতরাং
মান্নত যেহেতু আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত, তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও সন্তুষ্টি
ও নৈকট্য অর্জনের জন্য তা পেশ করা শির্ক। যেমন কেউ বললঃ উমুক ব্যক্তির জন্য নযর মেনেছি।
অথবা এই কবরের জন্য আমি মান্নত করেছি, অথবা জিবরীল (আঃ) এর জন্য আমার মানত রয়েছে। উদ্দেশ্য
হল এগুলোর মাধ্যমে তাদের নৈকট্য অর্জন করা। নিঃসন্দেহে ইহা শির্কে আকবরের অন্তর্গত।
এ থেকে তাওবা করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
‘তোমরা
যাই খরচ কর বা নযর মান্নত কর, আল্লাহ্ সে সম্পর্কে অবগত থাকেন। আর জালেমদের জন্য কোন
সাহায্যকারী নেই। (সূরা বাকারাঃ ২৭০) কোন বস্ত্তকে আল্লাহর ইলমের সাথে সম্পৃক্ত করা
হলে সে বিষয় হল ছাওয়াব অর্জনের স্থান। আর যে বিষয়ে ছওয়াব পাওয়া যায় সেটাই তো ইবাদত।
আর ইবাদত মাত্রই গাইরূল্লাহর জন্য সম্পাদন করা অবৈধ। আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
তারা
মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। (সূরা দাহরঃ
৭) আর এ ধরণের মান্নত যদি আল্লাহ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় করা হয়,
যেমন কেউ মানত করল, আমি আজমীরে কিংবা আব্দুল কাদের জিলানী অথবা খাজা উদ্দেশ্যে একটি
ছাগল যবেহ করবো, তাহলে শির্ক হবে এবং তা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
ইসলামের রুকনগুলো পালনের
ক্ষেত্রে সুফীদের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
সুফীবাদে
বিশ্বাসীগণ মনে করেন যে, তাদের কল্পিত অলীদের উপর নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি
কোন কিছুই ফরজ নয়। কেননা তারা এমন মর্যাদায় পৌঁছে যান, যেখানে পৌঁছতে পারলে এবাদতের
প্রয়োজন হয় না। তাদের কথা হচ্ছেঃ
মারেফত
হাসিল হয়ে গেলে এবাদতের কোন প্রয়োজন নেই। তারা তাদের মতের পক্ষে কুরআনের একটি আয়াতকে
দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
তুমি
ইয়াকীন আসা পর্যন্ত তোমার রবের এবাদত কর। (সূরা হিজিরঃ ৯৯) সুফীরা বলে থাকে এখানে ইয়াকীন
অর্থ হচ্ছে, মারেফত। এই মারেফত হাসিল হওয়ার পূর্ণ পর্যন্ত আল্লাহর এবাদত করতে হবে।
তা হাসিল হয়ে গেলে এবাদতের আর কোন প্রয়োজন নেই। তাদের এই কথাটি সম্পূর্ণ বাতিল। ইবনে
আব্বাস (রাঃ)সহ অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এখানে ইয়াকীন অর্থ হচ্ছে, মৃত্যু। (দেখুনঃ ইবনে
কাছীরঃ (৪/৫৫৩)
সুতরাং
তাদের কথা হচ্ছে নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি এবাদত সাধারণ লোকেরা পালন করবে।
সুফীদের যিকির ও অযীফাঃ
নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মুসলিম ঘুম থেকে উঠে, ঘুমানোর সময়, ঘরে প্রবেশ
কিংবা ঘর হতে বের হওয়ার সময় থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সকল যিকির-আযকার
পাঠ করতে হবে, তার সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু সমস্ত সুফী তরীকার লোকেরা এ সমস্ত
যিকির বাদ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের বানোয়াট যিকির তৈরী করে নিয়েছে। নকশবন্দী তরীকার লোকেরা
যিকরে মুফরাদ তথা শুধু الله (আল্লাহ) الله (আল্লাহ) বলে যিকির করে। শাযেলী তরীকার لا إله إلا
الله এবং অন্যান্য তরীকার লোকে শুধু هوهو হু হু বলে যিকির করে থাকে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেনঃ
এভাবে আওয়াজ করে বা আওয়াজবিহীন একক শব্দ দ্বারা যিকির করার কোন দলীল নেই; বরং এগুলো
মানুষকে বিদআত ও গোমরাহীর দিকে নিয়ে যায়। (মাজমুআয়ে ফতোয়াঃ পৃষ্ঠা নং- ২২৯) আমাদের
দেশের বিভিন্ন পীরদের মুরীদদেরকে যিক্রে জলী ও যিক্রে খফী নামে বিভিন্ন ধরণের বিদআতী
যিকির করতে দেখা যায়, যেগুলোর কোন শরঈ ভিত্তি নেই।
চুলে
ও দাড়িতে জট বাঁধাঃ
সুফীবাদের
নামে কতিপয় লোকের মাথায় ও দাড়িতে ঝট বাঁধতে দেখা যায়, কারও শরীরে লোহার
শিকল,
কাউকে উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। এটি সাহাবী, তাবেয়ী বা তাদের পরবর্তী
যুগের কোন আলেম বা সাধারণ সৎ লোকের নিদর্শন ছিল না। এমন কি আব্দুল কাদের জিলানী, শাইখ
আহমাদ রেফায়ী এবং সুফীরা যাদেরকে সুফীবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন তাদের কেউ এ ধরণের
লেবাস গ্রহণ করেন নি।
অলী-আওলীদের নামে শপথঃ
অলী-আওলীয়ার
নামে শপথ করা সুফী তরীকার লোকদের একটি সাধারণ ব্যাপার। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
সাল্লাম বলেনঃ
যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল সে শির্ক করল। (আবু দাউদ)
আমাদের
সমাজে অনেককেই দেখা যায়, মায়ের নামে, বাবার নামে, সন্তানের নামে বা চোখে হাত, মাথায়
হাত দিয়ে কসম ইত্যাদি করে থাকে। এগুলি সম্পূর্ণ শিরক।
জিন-ইনসান সৃষ্টির উদ্দেশ্যঃ
সুফীদের
কথা হচ্ছে, জিন-ইনসানসহ সমস্ত সৃষ্টি জগত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আফসোসের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের অনেক বক্তাকেই অত্যন্ত মধুর
কণ্ঠে ওয়াজ করার সময় এবং মিলাদ শরীফ পাঠের সময় বলতে শুনা যায় যে, নবী না আসিলে ধরায়
কোন কিছুই সৃষ্টি হত না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
আর
আমি মানব এবং জিনকে কেবল আমার দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬) সুতরাং
জিন-ইনসান ও অন্যান্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হচ্ছে মহান আল্লাহর এবাদত তথা
পৃখিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা।
সুফীরা জান্নাতের আশা ও জাহান্নামের ভয় করে নাঃ
সুফীরা
মনে করেন জাহান্নামের ভয়ে এবং জান্নাতের আশায় আমল করা ঠিক নয়। তাদের কথা হচ্ছে আল্লাহর
মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াই সুফী সাধকের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
তারা
সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা আশা ও ভীতি (জান্নাতের আশা ও জাহান্নামের ভীতি) সহকারে আমাকে
ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত। (সূরা আম্বীয়াঃ ৯০)
গান-বাজনাঃ
সুফীবাদের
দাবীদার কিছু লোক গান, বাজনা ও নৃত্যের মাধ্যমে যিকির করে থাকে। অথচ ইসলাম এগুলোকে
সুস্পষ্টভাবে হারাম বলে ঘোষণা করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আখেরী
যামানায় কোন কোন জাতিকে মাটির নিচে দাবিয়ে দেয়া হবে, কোন জাতিকে উপরে উঠিয়ে নিক্ষেপ
করে ধ্বংস করা হবে। আবার কারো চেহারা পরিবর্তন করে শুকর ও বানরে পরিণত করা হবে। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো কখন এরূপ করা হবে? তিনি বললেনঃ
‘‘যখন গান-বাজনা এবং গায়িকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে’’। (ইবনে মাজাহ)।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু
লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’
(বুখারী হা/৫৫৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের
বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫০৩; বাংলা মিশকাত ৮ম
খণ্ড হা/৪৩০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আবু ওমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় কর না,
তাদের ক্রয় কর না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম’
(ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
নাফে‘ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
একদা
ইবনু ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেলে তিনি তাঁর দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে
রাস্তা হতে সরে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে’ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি
বললাম, না। তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, আমি একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে
রাস্তা হতে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস
করলাম (ছহীহ আবূদাঊদ হা/ ৪৯২৪, সনদ ছহীহ)।
অত্র
হাদীছ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের শব্দ যেন কানে না আসে তার সম্ভবপর
চেষ্টা করতে হবে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী
করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যখন আমার উম্মত নেশাদার দ্রব্য পান
করবে, গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হবে এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হবে তখন অবশ্যই
তিনটি ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে- (১) বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ধসে যাবে (২) উপর থেকে অথবা কোন
জাতির পক্ষ থেকে যুলুম অত্যাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে (৩) অনেকের পাপের দরুণ আকার-আকৃতি
বিকৃত করা হবে। আর এ গজবের মূল কারণ তিনটি। (ক) মদ পান করা (খ) নায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে
মত্ত হওয়া (গ) বাদ্য যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হওয়া। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার উম্মতের কিছু সম্প্রদায়
রাত্রী অতিবাহিত করবে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য-পানীয়তে ভোগ বিলাসী হয়ে এবং বিভিন্ন ধরনের
বিনোদন আনন্দ প্রমোদে। এমতাবস্থায় তাদের সকাল হবে শুকুর ও বানরের আকৃতিতে রূপান্তরিত
হয়ে’ (সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৬০৪, ২৬৯৯)। অত্র হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এক শ্রেণীর
অর্থশালী মানুষেরা নানা ধরনের মদ ও পানীয়ের ব্যবস্থা করে অতি ভোগ-বিলাসে দিনাতিপাত
করবে। নানা ধরনের আমোদ-প্রমোদে ও বিনোদনে রাত্রী যাপন করবে। এর মাধ্যম হবে নায়িকা,
মদ ও বাদ্য যন্ত্র। এ ধরণের লোকেরা শুকুর ও বানরে পরিণত হবে। হয় তাদের আকৃতি শুকুর
ও বানরের মত হবে, অথবা তাদের হালাল-হারামের বিবেচনা থাকবে না। এজন্য নবী করীম (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে শুকুরের সাথে তুলনা করেছন। তাদের চাল-চলন হবে বিজাতিদের
মত অর্থাৎ তাদের স্ত্রী ও মেয়েরা বিজাতিদের মত নানা পোশাক পরবে। আর এদের কাছে যেনা
হবে সাধারণ কাজ। এদের বাড়ী-গাড়ি হবে কুকুর ও বিভিন্ন ধরনের মূর্তিতে পরিপূর্ণ। তাই
তাদেরকে বানরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ তারা বিজাতিদের অনুকরণ করবে। হাদিসের মানঃ
সহিহ হাদিস।
আবু মালিক আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী
করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার কিছু উম্মত মদ পান করবে এবং
তার নাম রাখবে ভিন্ন। তাদের নেতাদেরকে গায়িকা ও বাদ্য যন্ত্র দিয়ে সম্মান করা হবে।
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভুমিকম্পের মাধ্যমে মাটিতেই ধসিয়ে দিবেন। আর তাদেরকে বানর ও
শুকুরে পরিণত করবেন’ (বুখারী, ইবনে মাজাহ হা/৪০২০)। হাদীছে বুঝা গেল মানুষ মদ্যপান
করবে, তবে মদের নাম অন্য হবে। আর নেতা ও দায়িত্বশীলদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে বাদ্য
যন্ত্র ও গায়িকা। এদের চরিত্র হবে নোংরা, এদের প্রিয় কাজ হবে অশ্লীলতা। তাদের স্বভাব
ও কৃষ্টি-কালচার হবে শুকুর ও বানোরের ন্যায়। এরা স্বপরিবারে পাশ্চাত্যদের স্বভাব চরিত্র
গ্রহণ করবে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দাস ছাওবান (রাঃ) থেকে
বর্ণিতঃ
নবী
করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি সবচেয়ে যাদের বেশি ভয় করি তারা
হচ্ছে নেতা ও এক শ্রেণীর আলেম সমাজ। অচিরেই আমার উম্মতের কিছু লোক মূর্তিপূজা করবে।
আর অতি শীঘ্রই আমার উম্মতের কিছু লোক হিন্দু বা বিজাতিদের সাথে মিশে যাবে’ (ইবনে মাজাহ
হা/৩৯৫২, হাদীছ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সুফীদের যাহেরী ও বাতেনীঃ
সুফীরা
দ্বীনকে যাহেরী ও বাতেনী এই দু’টি স্তরে ভাগ করে থাকে। শরীয়তকে তারা যাহেরী স্তর হিসেবে
বিশ্বাস করে, যা সকলের জন্য মান্য করা জরুরী। বাতেনী স্তর পর্যন্ত শুধু নির্বাচিত ব্যক্তিরাই
পৌঁছতে পারে। ইসলামী শরীয়তে যাহেরী ও বাতেনী বলতে কিছু নেই। কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে
যা আছে, তাই ইসলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
আমার
পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে
সময় আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন
বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের
পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সুন্নাহ, তিরমিযী, অধ্যায়ঃ
কিতাবুল ইল্ম। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান সহীহ। মুসনাদে আহমাদ, (৪/১২৬), মাজমুওয়ায়ে
ফাতাওয়া ১০/৩৫৪)।
ইলমে লাদুন্নী নামে কল্পিত
এক বিশ্বাসঃ
সুফীরা
বেশী বেশী ইলমে লাদুন্নীর কথা বলে থাকে। ইলমে লাদুন্নী বলতে তারা বুঝাতে চায় যে, এটি
এমন একটি ইলম যা আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে সুফীরা পেয়ে থাকে। সাধনা ও চেষ্টার মাধ্যমে
এটি অর্জন করা যায় না। তাদের কল্পিত কথা হচ্ছে অলী-আওলীয়ারা আল্লাহর পক্ষ হতে ইলমে
লাদুন্নী অর্জন করে থাকে।
তাদের
বানোয়াট কথার মধ্যে এটিও একটি বানোয়াট ও কল্পিত কথা এবং আল্লাহর নামে চরম মিথ্যাচার
ছাড়া আর কিছুই নয়। এই উম্মতের প্রথম কাতারের সৎ লোক তথা সাহাবীদের মাঝে এ ধরণের কথা
শুনা যায় নি। তারা ঈমান, আমল ও তাকওয়ায় এত বেশী অগ্রগামী ছিলেন যে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের
প্রশংসায় কুরআনে একাধিক আয়াত নাযিল করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তাদের অনেককেই জান্নাতী বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
শরীয়ত ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান
অর্জনের ক্ষেত্রে সুফীবাদের মূলনীতিঃ
সকল
মাজহাবের লোকগণ ইসলামের মূলনীতি হিসেবে কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে থাকেন।
কিন্তু সুফীবাদের মূলনীতি সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তাদের মূলনীতির ব্যাপারে যথেষ্ট
গড়মিল রয়েছে। কতিপয় সুফীবাদে কুরআন ও হাদীছকে বাদ দিয়ে নিম্নে মূলনীতিগুলোর উপর তারা
সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকেন। আবার কতিপয় সুফী তরীকার লোকেরা কুরআন ও হাদীছের সাথে
আরও অনেকগুলো কাল্পনিক মূলনীতি থেকে তথাকথিত আত্মশুদ্ধির জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা
গ্রহণ করে থাকে। আসুন আমরা তাদের এ মূলনীতিটি একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
১) কাশ্ফঃ
বিভিন্ন
দিক নির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সুফীগণের সবচেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য মূলনীতি
হচ্ছে কাশফ। সুফীদের বিশ্বাস হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে একজন সুফী সাধকের হৃদয়ের
পর্দা উঠে যায় এবং তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাদের পরিভাষায়
একেই বলা হয় কাশফ।
সুফীগণ
কাশফের সংজ্ঞায় বলেছেন, যে পর্দার আড়ালে যে সমস্ত গায়েবী তথ্য ও প্রকৃত বিষয়সমূহ লুকায়িত
আছে তা পাওয়া ও দেখার নামই হচ্ছে কাশফ। কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের
মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন, আল্লাহর
আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের
অবস্থা এবং সাত আসমানে ও জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন। এমন কি তাদের অবগতি ব্যতীত
গাছের একটি পাতাও ঝড়েনা, এক বিন্দু বৃষ্টিও বর্ষিত হয় না, আসমান-যমীনের কোন কিছুই তাকে
অক্ষম করতে পারে না। এমন কি লাওহে মাহফুযে যা আছে, তাও তারা অবগত হতে পারেন। এমনি আরও
অসংখ্যক্ষমতা অর্জনের দাবী করে থাকেন, যা একমাত্র মহান আল্লাহর গুণ।
কাশফের একটি উদাহরণঃ
তাবলীগি
নেসাব ফাযায়েলে আমাল নামক বইয়ের মধ্যে কাশফ-এর একাধিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য
আমরা এখানে মাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
শায়খ
আবু ইয়াজিদ কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ আমি শুনিয়াছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার লা-ইলাহা
ইল্লাল্লাহ পড়ে সে দোযখের আগুন হইতে নাজাত পাইয়া যায়। আমি এই খবর শুনিয়া এক নেছাব অর্থাৎ
সত্তর হাজার বার আমার স্ত্রীর জন্য পড়িলাম এবং কয়েক নেছাব আমার নিজের জন্য পড়িয়া আখেরাতের
সম্বল করিয়া রাখিলাম। আমাদের নিকট এক যুবক থাকিত। তাহার সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ ছিল যে,
তাহার কাশ্ফ হয় এবং জান্নাত-জাহান্নামও সে দেখিতে পায়। ইহার সত্যতার ব্যাপারে আমার
কিছুটা সন্দেহ ছিল। একবার সেই যুবক আমাদের সহিত খাওয়া-দাওয়ায় শরীক ছিল। এমতাবস্থায়
হঠাৎ সে চিৎকার দিয়া উঠিল এবং তাহার শ্বাস বন্ধ হইয়া যাওয়ার উপক্রম হইল এবং সে বলিলঃ
আমার মা দোযখে জ্বলিতেছে, আমি তাহার অবস্থা দেখিতে পাইয়াছি। কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ আমি
তাহার অস্থির অবস্থা লক্ষ্য করিতেছিলাম। আমার খেয়াল হইল যে, একটি নেছাব তাহার মার জন্য
বখশিয়া দেই। যাহা দ্বারা তাহার সত্যতার ব্যাপারেও আমার পরীক্ষা হইয়া যাইবে। অর্থাৎ
তাহার কাশ্ফ হওয়ার ব্যাপারটাও পরীক্ষা হইয়া যাইবে। সুতরাং আমার জন্য পড়া সত্তর হাজারের
নেছাবসমূহ হইতে একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশিয়া দিলাম। আমি আমার অন্তরে ইহা গোপন
রাখিয়াছিলাম। কিন্তু ঐ যুবক তৎক্ষনাৎ বলতে লাগিল চাচা! আমার মা দোযখের আগুন হইতে রক্ষা
পাইয়া গিয়াছে।
কুরতুবী
(রহঃ) বলেনঃ এই ঘটনা হইতে আমার দুইটি ফায়দা হইল। এক. সত্তর হাজার বার কালেমা তাইয়্যেবা
পড়ার বরকত সম্পর্কে যাহা আমি শুনিয়াছি উহার অভিজ্ঞতা। দুই. যুবকটির সত্যতার (তার কাশ্ফ
হওয়ার) একীন হইয়া গেল।
দেখুনঃ
ফাযায়েলে আমাল, ১ম খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর-২০০১ ইং। দারুল কিতাব,
৫০ বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০ থেকে প্রকাশিত) এমনি আরও অনেক শির্কী ও বিদআতী কথা ফাযায়েলে
আমল বইটিতে রয়েছে, যা সচেতন পাঠক একটু খেয়াল করে বইটি পড়লে সহজেই ধরতে পারবেন।
প্রিয়
পাঠক ভাই ও বন্ধুগণ! জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে
যতটুকু বলা হয়েছে, তা ব্যতীত অন্য কোন খবর জানার কোন উপায় নেই। কারণ এগুলো গায়েবী বিষয়।
আল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদেরকে
যতটুকু বলেছেন, আমরা শুধু ততটুকুই জানি। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এর অতিরিক্ত কিছু দাবী
করে, তাহলে সে মিথ্যাবাদী। তা বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট শির্ক।
আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
আপনি
বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্
চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম।
ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধু একজন ভীতি প্রদর্শক ও সু-সংবাদ
দাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আরাফঃ ১৮৮) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
আপনি
বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য
বিষয় অবগতও নই। আমি এমনও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ অহীর অনুসরণ করি, যা
আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা
কর না? (সূরা আনআমঃ ৫০)
আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
‘তিনি
অদৃশ্যের জ্ঞানী। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত কোন
রাসূল ব্যতীত। (সূরা জিনঃ ২৬-২৭)
আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ
যে
ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে চক্ষে দেখেছেন
সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যাচার করল। যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ তিনি গোপন করেছেন, সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যা
রচনা করল। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ হে রসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার
প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন
না। (সূরা মায়িদাঃ ৬৭) আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াস সাল্লাম (গায়েবের) আগাম খবর দিতে পারতেন সেও আল্লাহর উপর চরম মিথ্যা রচনা করল।’’
(তিরমিযী, হাদীছটি সহীহ)
বুখারী
শরীফে রবী বিনতে মুআওভিয (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন কতিপয় ছোট মেয়ে দফ তথা একদিকে খোলা ঢোল বাজাচ্ছিল
এবং বদরের যুদ্ধে নিহত তাদের পিতাদের বীরত্ব গাঁথা বর্ণনা করছিল। মেয়েদের মধ্য হতে
একটি মেয়ে বলে ফেললঃ
‘‘আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন, যিনি আগামীকালের
খবর বলতে পারেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ বালিকার কথার প্রতিবাদ
করে বললেনঃ এই কথা অর্থাৎ আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন, যিনি আগামীকালের খবর বলতে
পারেন- এটি বাদ দাও। আর বাকী কথাগুলো বলতে থাকো। (সহীহ বুখারী হাদীছ নং- ৪০০১)
এমনি
আরো অনেক দলীল-প্রমাণ কুরআন ও সহীহ হাদীছে রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে জানা যায় যে, আল্লাহ
ছাড়া গায়েবের খবর অন্য কেউ জানে না।
২) নবী ও মৃত অলী-আওলীয়াগণঃ সুফীদের আরও কথা হচ্ছে, তারা আমাদের
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে জাগ্রত অবস্থায় সরাসরি মিলিত হয়ে থাকেন।
শুধু তাই নয় তারা অন্যান্য নবীদের রুহের সাথেও সাক্ষাত করেন ও তাদের আওয়াজ শুনেন এবং
বিভিন্ন দিক নির্দেশনা লাভ করেন। মৃত অলী-আওলীয়া, ফেরেশতাদের সাথেও তারা সাক্ষাত করেন
এবং তাদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
৩) খিজির আলাইহিস সালামঃ
সুফীদের
মধ্যে খিযির (আঃ)এর ব্যাপারে অনেক কাল্পনিক ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। তাঁর সাথে সাক্ষাতের
বিষয়েও অসংখ্যকাহিনী বর্ণিত রয়েছে। তাদের ধারণা খিজির (আঃ) এখনও জীবিত আছেন। তিনি যিকির
ও দ্বিনী মাহফিলে হাজির হন। সুফীরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে দ্বীনি
বিষয়ের জ্ঞান, শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও যিকির-আযকার শিক্ষা করেন। তাদের এ কথাটি বানোয়াট।
কোন মৃত ব্যক্তির সাথে জীবিত মানুষের কথা বলার ধারণা একটি কুফরী বিশ্বাস।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শেষ জীবণে একদা আমাদেরকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করলেন। সালাম
ফিরানোর পর তিনি বললেনঃ
আজকের
রাত্রির গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের কোন ধারণা আছে কি? আজকের এই রাত্রিতে যারা জীবিত
আছে, আজ থেকে শুরু করে একশত বছর পর পৃথিবীতে তাদের কেউ আর জীবিত থাকবেনা। (বুখারী হাদীছ
নং- ১১৬)
এই
হাদীছ থেকে জানা গেল যে, খিযির (আঃ)ও ইন্তেকাল করেছেন। তিনি কিয়ামতের পূর্বে কারও সাথে
সাক্ষাত করবেন না।
৪) ইলহামঃ
আল্লাহর
পক্ষ হতে মুমিন ব্যক্তির অন্তরে যে ইলম পতিত হয়, তাকে ইলহাম বলে। এভাবে প্রাপ্ত অন্তরের
ইলহাম অনুযায়ী মুমিন ব্যক্তি কাজ করতে পারে বা সিদ্বান্ত নিতে পারে। তবে তা দ্বারা
দলীল গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সুফীরা তাদের কল্পিত অলীদের কল্পিত ইলহামকে
শরীয়তের একটি বিরাট দলীল মনে করে এবং সুফীবাদের ভক্তরা তা পালন করা আবশ্যক মনে করে।
তারা মনে করে অলীরা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হন। এ জন্য সুফীরা অলীদের
স্তরকে নবুওয়তের স্তর থেকে উত্তম মনে করে থাকে। কেননা নবীরা দ্বীনের ইলম গ্রহণ করতেন
ফেরেশতার মাধ্যমে আর অলীরা গ্রহণ করেন সরাসরি বিনা মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট থেকে।
৫) ফিরাসাতঃ
ফিরাসাত অর্থ হচ্ছে অন্তদৃষ্টি। সুফী সাধকরা দাবী
করে যে, অন্তর্দিষ্টির মাধ্যমে তারা মানুষের অন্তরের গোপন অবস্থা ও খবরাদি বলে দিতে
পারেন। অথচ কুরআন ও হাদীছের ভাষ্য দ্বারা বুঝা যায় অন্তরের খবর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ
জানে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
‘চোখের
চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন। (সূরা গাফেরঃ ১৯)
৬) হাওয়াতেফঃ
সুফীদের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে হাতাফ। এর মাধ্যমে
তারা আল্লাহ্ তাআলা, ফেরেশতা, জিন, অলী, এবং খিযির (আঃ)এর কথা সরাসরি অথবা স্বপ্নের
মাধ্যমে শুনতে পায় বলে দাবী করে থাকে।
৭)
সুফীদের মিরাজঃ
সুফীরা
মনে করে অলীদের রূহ উর্ধ্ব জগতে আরোহন করে, সেখানে ঘুরে বেড়ায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন
জ্ঞান ও রহস্য নিয়ে আসতে পারে।
৮) স্বপ্নের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ
প্রাপ্তিঃ
স্বপ্ন
হচ্ছে সুফীদের অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য মূলনীতি। তারা ধারণা করে স্বপ্নের মাধ্যমে তারা
আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে কিংবা তাদের
কোন মৃত বা জীবিত অলী ও শায়েখের কাছ থেকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম প্রাপ্ত হওয়ার ধারণা
করে থাকে। স্বপ্নের ব্যাপারে সঠিক কথা হচ্ছে, নবীগণের স্বপ্নই কেবল অহী এবং তার মাধ্যমে
প্রাপ্ত বিধান অনুসরণযোগ্য। কিন্তু সাধারণ মুমিনদের স্বপ্নের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তা
দ্বারা শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।
৯) মৃত কল্পিত অলী-আওলীয়াদের
সাথে সুফীদের যোগাযোগঃ
বর্তমান
চরমোনাই পীরের পিতা মৃত মাওলানা ইসহাক তার ভেদে মারেফত বইয়ে লিখেছেনঃ হযরত থানবী লিখিয়াছেন,
জনৈক দরবেশ সাহেবের মৃত্যুর পর এক কাফন চোর কবর খুড়িয়া দরবেশের কাফন খুলিতে লাগিল।
দরবেশ সাহেব চোরের হাত ধরিয়া বসিলেন। তা দেখে চোর ভয়ের চোটে চিৎকার মারিয়া বেহুঁশ হইয়া
মরিয়া গেল। দরবেশ তার এক খলীফাকে আদেশ করিলেন চোরকে তার পার্শ্বে দাফন করিতে। খলীফা
এতে আপত্তি করিলে দরবেশ বলিলেনঃ কাফন চোরের হাত আমার হাতের সঙ্গে লাগিয়াছে, এখন কেয়ামত
দিবসে ওকে ছাড়িয়া আমি কেমনে পুলছেরাত পার হইয়া যাইব? (ভেদে মারেফতঃ ২৭-২৮ পৃঃ)।
পির বা অলি-আওলীয়ার উসিলা
গ্রহণ কতোটুকু বৈধঃ
সকল
প্রকার সুফী তরীকার লোকদের আকীদার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই যে, তারা মৃত অলীদের উসীলা
দিয়ে দুআ করে থাকেন, গুনাহ্ থেকে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। উসীলা অর্থ
হচ্ছে, যার মাধ্যমে কারও নৈকট্য অর্জন করা যায়, তাকে উসীলা বলা হয়। আর কুরআন ও হাদীছের
পরিভাষায় যে সমস্ত বিষয় দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা যায়, তাকে উসীলা বলা হয়।
কুরআন মাযীদে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
হে
ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নিকট উসীলা প্রার্থনা কর এবং তাঁর পথে জিহাদ
কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা মায়িদাঃ ৩৫) সাহাবী, তাবেয়ী এবং পূর্ববর্তী সম্মানিত
উলামায়ে কিরাম থেকে উসীলার যে অর্থ বর্ণিত হয়েছে, তাহল ভাল আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর
নৈকট্য অর্জন করা। ইমাম ইবনে যারীর (রঃ) وَابْتَغُوا إِلَيْه
الْوَسِيلَة এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহর সন্তোষ
জনক আমল করার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা কর। ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেন, উসীলা অর্থ নৈকট্য। মুজাহিদ, হাসান, আবদুল্লাহ
ইবনে কাছীর, সুদ্দী এবং ইবনে যায়েদ থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। কাতাদাহ (রঃ) বলেন,
আল্লাহর আনুগত্যমূলক এবং সন্তোষ জনক কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর। উপরোক্ত
কথাগুলো বর্ণনা করার পর ইবনে কাছীর (রঃ) বলেন, উসীলার ব্যাখ্যায় যা বলা হলো, এতে ইমামদের
ভিতরে কোন মতবিরোধ নেই। কাজেই আয়াতের মাঝে উসীলার অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। (দেখুন তাফসীরে
ইবনে কাছীর, ৩/১০৩) উপরোক্ত আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে যারা আম্বীয়ায়ে কিরাম, আওলীয়াদের
ব্যক্তিসত্বা এবং তাদের সম্মানের উসীলা দেয়া বৈধ মনে করে, তাদের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ
বাতিল এবং কুরআনের আয়াতকে পরিবর্তনের শামিল। এমনকি কুরআনের আয়াতকে এমন অর্থে ব্যবহার
করা, যার কোন সম্ভাবনা নেই এবং যার পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন মুফাসসিরের উক্তি নেই। আমাদের
দেশের কিছু তথাকথিত আলেম উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা এখানে পীর
ধরতে বলেছেন। পীরই হলো উসীলা। পীর না ধরলে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। এ ধরণের ব্যাখ্যা
সম্পূর্ণ বানোয়াট। পূর্ব যুগের গ্রহণযোগ্য কোন আলেম এ ধরণের ব্যাখ্যা করেননি।
দুআ-মুনাজাতে শরীয়ত অনুমোদিত
অসীলা-বিস্তারিতঃ
দুআ-মুনাজাতে
শরীয়ত অনুমোদিত অসীলা হলো তিন প্রকার। এই তিন প্রকার অসিলা ব্যতীত এমনকি রাসুল সাঃ
এর অসিলা ধরে দুআ করাও ইসলামে নাজাজে।
এক : আল্লাহ তাআলার সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর
গুণাবলীর মাধ্যমে দুআ করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আল্লাহর
রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। অতএব তোমরা সে সব নামের মাধ্যমে তাঁর কাছে দুআ কর। (সূরা
আরাফ : ১৮০)
যেমন
আমরা বলি ইয়া রাহমান! আমার উপর রহম করুন। ইয়া রাযযাক! আমাকে রিযক দান করুন ইত্যাদি।
এভাবে
আল্লাহ তাআলার নামের অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা যায়।
এটা
দুআ-মুনাজাতের একটি উত্তম পদ্ধতিও বটে। বড় কথা হল, আল্লাহ আমাদের-কে তাঁর নামের অসীলা
নিয়ে দুআ-প্রার্থনা করতে আদেশ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নামের অসীলা দিয়ে দুআ করতেন।
হাদীসে
এসেছে -
আনাস
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত
হতেন তখন বলতেন : হে চিরঞ্জীব, চিরন্তন সত্ত্বা! আপনার রহমতের অসীলায় আপনার কাছে সাহায্য
প্রার্থনা করছি। (বর্ণনায় : তিরমিজী)
এ
হাদীসে আমরা দেখলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার দু’টো
নাম ও তাঁর রহমত নামক গুণের অসীলায় দুআ করলেন। আবার ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যূমু
বলে তার মহান দুটো নামের অসীলা নিয়েছেন।
আল্লাহ
তাআলার সুন্দর নাম ও গুণাবলীর অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করার দৃষ্টান্ত সহীহ হাদীসে
অসংখ্য রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সুন্দর
নাম ও গুণাবলীর অসীলায় দুআ করার জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।
দুই. নিজের সুন্দর ও ভাল কোন নেক আমলের অসীলা
দিয়ে দুআ করা:
যেমন
বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে এসেছে :
আব্দুল্লাহ
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও
যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ
করে। আকস্মাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে এবং তাদের উপর গুহামুখ বন্ধ করে দেয়।
এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, 'তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারবে এমন
কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া
কর তাহলে হয়ত নাজাত পেতে পার।'
তাদের
একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে
আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবার-দুগ্ধ
পেশ করতাম না। একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে
চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি তাদের জন্য রাতের খাবার
দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান
বা মালিকানাধীন গোলাম-পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি পেয়ালা হাতে তাদের
জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের
রাতের খাবার-দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য
করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দোয়ার ফলে পাথর সামান্য
সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
নবী
কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ ! আমার একজন
চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা
ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক
সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত ও অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ
দিরহাম দিই, এ শর্তে যে, আমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতে রাজি হল।
আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না, তবে
বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে
প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ
! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে আছি,
তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল, তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমি কয়েকজন
শ্রমিক নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দেই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত,
সে নিজের মজুরি রেখে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার
ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, 'হে আল্লাহর বান্দা!
আমার মজুরি পরিশোধ কর।' আমি তাকে বললাম, 'তুমি যা কিছু দেখছ, উট-গরু-বকরি-গোলাম, সব
তোমার মজুরি।' সে বলল : হে আল্লাহর বান্দা!
তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, 'উপহাস করছি না।' অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল
এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি
অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল।
তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। (বর্ণনায় : সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এ
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম, নিজের সৎকর্মসমূহের মধ্যে যে কাজটি সুন্দর ও নির্ভেজাল
আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত তার অসীলায় দুআ করা হয়েছে। ও দুআ কবুল হয়েছে।
তাই
নিজের নেক আমলের অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা জায়েয।
তিন : জীবিত নেককার লোকদের কাছে যেয়ে দুআ-মুনাজাতে
তাদের অসীলা করা
যেমন
কোন ব্যক্তি একজন আল্লাহভীরু-পরহেযগার মানুষের কাছে যেয়ে বলল, জনাব আমি নতুন ব্যবসা
শুরু করেছি। আপনি একটু দুআ করুন, আমি যেন ব্যবসায় সফল হতে পারি।
এ
কাজটিও একটি অসীলা। আমরা অনেকেই মুত্তাকী ও নেককার মানুষ দেখলে তাদের কাছে অনুরূপভাবে
উস্তাজ, মুরব্বীদের কাছে দুআ চেয়ে থাকি। এটা না জায়েয নয়। বরং এটি শরীয়ত অনুমোদিত
একটি অসীলা। সহীহ হাদীস দ্বারা এ ধরনের অসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণিত।
যেমন
-
সাহাবী
আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মানুষ অনাবৃষ্টির শিকার হল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এক জুমআয় খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল,' ইয়া রাসূলাল্লাহ!
সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর পরিজন উপোস থাকছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে
দুআ করুন।' তখন তিনি হাত তুলে দুআ করলেন। আকাশে
আমরা কোন মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম না। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! তাঁর হাত নামানোর আগেই
পর্বতের মত মেঘ আকাশ ছেয়ে গেল। এরপর তিনি মিম্বর থেকে নামার আগেই আমরা দেখলাম তার
দাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। সেদিন তার পরের দিন, তারও পরেরদিন বৃষ্টি হল এমনকি পরবর্তী
জুমআর দিনও বৃষ্টি হতে থাকল।
আবার
সেই বেদুঈন দাঁড়াল অথবা অন্য কেউ। বলল, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
আর মাল-সামান ডুবে যাচ্ছে। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন।' রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দুটো উত্তোলন করে বললেন: ' হে আল্লাহ! আমাদের
পক্ষে করে দিন, আমাদের বিপক্ষে নয়।' তাঁর
হাত দিয়ে মেঘের দিকে ইশারা করা মাত্র মেঘ কেটে গেল। (বর্ণনায় : বুখারী, হাদীস নং
৯৩৩)
এ
হাদীস থেকে আমরা জানলাম, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে
দুআ করতে বলেছেন। এটা হল দুআ করার ক্ষেত্রে অসীলা গ্রহণ। এভাবে আমরা নেককার লোকদের
কাছে দুআ চাই।
এ
কাজটিকে যে 'দুআ মুনাজাতে অসীলা গ্রহণ' হিসাবে
ধরা হয় আমরা তা জানতে পারি অন্য একটি হাদীসে।
সহীহ
বুখারীতে এসেছে -
যখন
অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিত তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রা. আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের
মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। তখন তিনি বলতেন : হে আল্লাহ! আমরা আপনার নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে (অসীলায়) আপনার কাছে দুআ করতাম, আপনি আমাদের বৃষ্টি
দিতেন। আর এখন আমরা আপনার কাছে আপনার নবীর চাচার অসীলায় (দুআ করছি) আপনি আমাদের বৃষ্টি
দান করুন। লোকজন বলল, তখন বৃষ্টি হত। (বর্ণনায় : বুখারী, হাদীস নং ৩৭১০)
এ
দুটো হাদীস থেকে আমরা যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম।
এক. কাউকে এ কথা বলা যে, আপনি আমাদের জন্য
আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করুন, এর অর্থ হল, দুআর ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিকে অসীলা বা মাধ্যম
করা। এটা জায়েয। যেমন সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
জীবদ্দশায় তাকে অসীলা করে দুআ করেছেন।
দুই. যার অসীলা দিয়ে দুআ করবে তার জীবিত
হওয়া ও উপস্থিত থাকা শর্ত। যেমন আমরা দেখতে পেলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম জীবিত থাকাকালে তাঁর অসীলা দিয়ে দুআ করা হল। তিনি যখন চলে গেলেন, তখন
তাঁরই জীবিত এক মুরুব্বী বয়োবৃদ্ধ আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর অসীলা দিয়ে বৃষ্টির
জন্য দুআ করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীলা করা হল না।
তিন. কোন মৃত ব্যক্তির অসীলা দেয়া জায়েয
নয়। তিনি যত বড় রাসূল, নবী, অলী বা পীর-বুযুর্গ-গাউস-কুতুব যে-ই হোন না কেন। যদি
জায়েয হত তাহলে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দুআর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের অসীলা দিতেন। তাকে বাদ দিয়ে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর অসীলা নিতেন
না।
চার. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
মৃত্যুর পর তার নাম বা মর্যাদার অসীলা দিয়ে দুআ-মুনাজাত করা যে ঠিক নয় এ বিষয়ে সাহাবায়ে
কেরামের ঐক্যমত হয়েছে।
কারণ,
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বললেন : হে আল্লাহ! আমরা আপনার নবীর অবর্তমানে তাঁর চাচা
আব্বাসের অসীলায় দুআ করছি... তখন কোন সাহাবী প্রতিবাদ করলেন না। কেউ বললেন না, 'কেন,
আমরা এখনো যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিয়ে বা তার মর্যাদার
অসীলা দিয়ে দুআ করি তাহলে দোষের কী?'
কারণ,
তারা জানতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তার অসীলা
দিয়ে দুআ করা ঠিক নয়। এ রকম অসীলা প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস আলোচনা করা যেতে পারে।
ইমাম
আহমদসহ আরো অনেক মুহাদ্দিস সাহাবী উসমান বিন হানীফ রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা
করেন যে, এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে
বলল, আপনি আল্লাহ তাআলার কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে সুস্থতা দান করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: 'যদি তুমি চাও আমি তোমার জন্য
দুআ করব। আর যদি চাও, তাহলে দুআ বিলম্বিত করব। আর এটা তোমার জন্য কল্যাণকর।' অন্য এক
বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, 'যদি তুমি চাও, ধৈর্য ধারণ করবে, তাহলে এটা তোমার জন্য
কল্যাণকর।' লোকটি বলল, 'আপনি তাঁর কাছে দুআ করুন।'
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে নির্দেশ দিলেন, তুমি অজু কর। সে সুন্দরভাবে
অজু করল। এরপর দু রাকাআত নামাজ আদায় করল। অতপর এভাবে দুআ করল : হে আল্লাহ! আমি আপনার
কাছে প্রার্থনা করছি। আপনার নবী মুহাম্মাদ, রহমতের নবীর মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি।
হে মুহাম্মাদ! আমি আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য আপনার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম।
হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করুন। বর্ণনাকারী উসমান বিন হানীফ বলেন,
লোকটা দুআ করল আর সে সুস্থ হয়ে গেল।
(সহীহ
ইবনে মাজাহ ও সহীহ তিরমিজীতে শায়খ আলবানী রহ. হাদীসটির সূত্রকে বিশুদ্ধ বলে উল্লেখ
করেছেন) এ হাদীস থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম :
এক. অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিল তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাতে। যেমন
লোকটি বলল, 'দুআ করুন।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'তুমি
চাইলে দুআ করতে পারি।'
এ
কথার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
কাছে দুআ চাইতে এসেছিল।
আর
এটা হল, অনুমোদিত অসীলার তৃতীয় প্রকার। যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
দুই. যদি লোকটির উদ্দেশ্য হত রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা বা সম্মানের অসীলা দিয়ে দুআ করা, তাহলে
সে তো তার বাড়িতে বসেই তার অসীলা দিয়ে দুআ করতে পারত।
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
তার জন্য দুআ করার ওয়াদা দিলেন। সাথে সাথে তাকে বললেন, 'তুমি যদি অন্ধত্বের উপর ধৈর্য
ধারণ কর, তা তোমার জন্য কল্যাণকর।' এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সেই কথার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন :
আল্লাহ
তাআলা বলেন: আমি আমার কোন বান্দাকে যখন তার প্রিয় বস্তুদুটো (চক্ষুদ্বয়) নিয়ে পরীক্ষা
করি আর সে তাতে ধৈর্য ধারণ করে তাহলে আমি এর বিনিময়ে তাকে জান্নাত দান করব। (সহীহ
বুখারী)
তিনি
লোকটার জন্য দুআ করার আগে তাকে নসীহত করলেন। বিপদে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। কিন্তু
লোকটি ধৈর্য ধারণের চেয়ে দুআ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিল।
চার. লোকটি যে বলল, 'হে মুহাম্মাদ! আমি আমার
প্রয়োজন পূরণের জন্য আপনার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম।'
এ
কথার অর্থ হল, আপনাকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করার মাধ্যমে আমার প্রভূর দিকে মুখ করলাম।
এটা
হল, নেক আমলকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়। এটা তো শরীয়ত অনুমোদিত অসীলা। যা ইতিপূর্বে
দ্বিতীয় প্রকার শরীয়ত সম্মত অসীলায় আলোচিত হয়েছে।
পাঁচ. এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মুজিযা প্রকাশ পেয়েছে। তার দুআয় একজন অন্ধ মানুষ দৃষ্টিশক্তি
ফিরে পেয়েছে।
ছয়.
এ সকল দিক বিবেচনায় এ হাদীস দিয়ে কোনভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
জীবদ্দশায় বা তার অনুপস্থিতিতে তার নাম, মর্যাদা, সম্মানের অসীলা দিয়ে দুআ করার বৈধতা
প্রমাণিত হয় না।
নবী
আদম আলাইহিস সালাম কি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা
দিয়ে দুআ করেছিলেন? একটি দুর্বল ও মুনকার হাদিস যা প্রত্যাখ্যাতঃ
আমাদের
সমাজে এ কথা প্রচলিত আছে যে, নবী আদম আলাইহিস সালাম নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর নবী মুহাম্মাদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দিয়ে দুআ করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তার তওবা
কবুল করে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই দুআ-মুনাজাতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দেয়া একটি প্রমাণিত ও অনুমোদিত বিষয়। বরং এটি একটি সুন্নাত।
প্রচলিত
এ কথার ভিত্তি হল একটি দুর্বল ও মুনকার হাদীস। যা আল কুরআনের আয়াতের বিরোধী হওয়ার
কারণে মুনকার বা প্রত্যাখ্যাত হাদীস বলে গণ্য হয়েছে।
সেই হাদীসটি হল :
হাকেম
তার মুস্তাদরাক কিতাবে ( ৬১৫/২ নম্বরে) আবু হারিস আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম আল ফাহরীর
সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইসমাঈল ইবনে মুসলিমাহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এই সূত্রে
যে, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম তার পিতা থেকে, পিতা তার দাদা থেকে, দাদা উমার
ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন আদম আলাইহিস সালাম ভুল
করলেন, তখন বললেন, 'হে আমার প্রভূ! আমি মুহাম্মাদ এর হকের অসীলায় আপনার কাছে প্রার্থনা
করছি যেন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন।' তিনি
বললেন, 'হে আদম! তুমি কিভাবে চিনলে মুহাম্মাদকে, অথচ আমি তো তাকে এখনো সৃষ্টি করিনি?'
আদম
বললেন, 'হে আমার প্রভূ! আপনি যখন আমাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন, আপনার রূহ আমার মধ্যে
ফুঁকে দিলেন তখন আমি মাথা উঠালাম। দেখলাম, আপনার আরশের খুটির উপর লেখা আছে, লা-ইলাহা
ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আমি বুঝে নিলাম, এটা আপনার সৃষ্টির সর্বোত্তম
নাম না হলে আপনি নিজের নামের সাথে লিখতেন না।'
তখন আল্লাহ তাআলা বললেন : 'আমি তোমাকে ক্ষমা করে
দিলাম। যদি মুহাম্মাদ না হত, তা হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।'
যে কারণে এ হাদীসটি দুর্বল :
এ
হাদীসের সনদে দু জন বর্ণনাকারী : আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম ও মুসলিম আল ফাহরী।
আব্দুর
রহমান বিন যায়েদ সম্পর্কে ইমাম হাকেম লিখেছন: ইমাম বুখারী ও মুসলিম তার হাদীস গ্রহণ
করতেন না। তিনি দুর্বল। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেছেন, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ হাদীস
জাল করত ও মিথ্যা হাদীস রচনা করত।
ইমাম
জাহাবী রহ. আল মিযান কিতাবে লিখেন, মুসলিম আল ফাহরী বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী।
ইবনে
হিব্বান তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।
এ
সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হলে যুগের শীর্ষস্থানীয় হাদীস বিশারদ শায়খ আলবানী রহ.
সংকলিত কিতাব التوسل : أنواعه
وأحكامه
للشيخ الألباني
দেখা
যেতে পারে। এই কিতাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীলা করার
হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করেছেন স্পষ্টভাবে।
এ
হাদীসটি কেন প্রত্যাখ্যান করতে হবে ?
যদি
কোন হাদীসে সরাসরি আল কুরআনের বিপরীত কথা বলা হয়, তাহলে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করা
হবে।
মুস্তাদরাক
হাকেমে বর্ণিত, আদম আ. এর অসীলা গ্রহণের এ হাদীসটি আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন,
তার বিরোধী।
এ
হাদীসে বলা হয়েছে, 'নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের অসীলা
দেয়ার কারণে আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার ক্ষমা লাভ করেছিলেন।' কিন্তু আল কুরআন বলছে অন্য কথা।
দেখুন আল্লাহ তাআলা বলেন :
অতপর
আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেল। ফলে তখনই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয়
তিনি তাওবা কবুলকারী অতি দয়ালু। (সূরা বাকারা, আয়াত ৩৭)
এ
আয়াত থেকে আমরা জানলাম, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওবা ও ইস্তেগফার করার কিছু বাক্য
আদম আলাইহিস সালামের অন্তরে ঢেলে দেয়া হল। তিনি এ কথাগুলো বলার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা
তার তাওবা কবুল করে নিলেন।
অন্য
আয়াতে আল্লাহ তাআলা তা বলে দিয়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে :
তারা
উভয়ে বলল, হে আমাদের প্রভূ! আমরা নিজেদের উপর জুলুম করেছি। আর যদি আপনি আমাদের ক্ষমা
না করেন এবং আমাদের উপর দয়া না করেন তাহলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত
হব। (সূরা আল আরাফ, আয়াত ২৩)
সকল
মুফাসসিরে কুরআন এ বিষয়ে একমত, তাওবা করার জন্য আল্লাহ যে বাণী আদম আলাইহিস সালামকে
শিখিয়েছিলেন তা হল সূরা আরাফে বর্ণিত উপরোল্লেখিত দুআ।
অতএব
এখন যদি কেউ বলে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীলা দেয়ার কারণে
তার তাওবা কবুল হয়েছে, তাহলে সে আল কুরআনের বিপরীত কথা বিশ্বাস করল ও প্রচার করল।
এটা কুরআন প্রত্যাখ্যান অর্থাৎ হিজরুল কুরআনের অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর কুরআন প্রত্যাখ্যান
করা যে কবীরা গুনাহ তাতে চুল পরিমাণ সন্দেহ নেই।
আল্লাহকে পেতে পির-অলিদের
মাধ্যম প্রয়োজন কিনাঃ
স্রষ্টা
ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম মানার ব্যাপারটা অত্যন্ত বিপজ্জনক বিষয়। পরিতাপের বিষয় যে, অনেক
মুসলমানই এ সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা রাখেনা। ফলে আমরা আল্লাহর সাহায্য সহযোগিতা
থেকে বঞ্চিত হতে চলেছি, যে সাহায্য করার কথা তিনি কুরআনে তাঁর কাছে আশ্রয় কামনা এবং
তাঁর শরীয়তের অনুসরণ করার শর্তে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন : আর মু'মিনদের সাহায্য
করা আমার দায়িত্ব। [সূরা আর-রূম: ৪৭] যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনিও তোমাদের
সাহায্য করবেন, এবং তোমাদের পদযুগলে স্থিতি দিবেন। [সূরা মুহাম্মাদ: ৭] আল্লাহর জন্যই
যাবতীয় সম্মান, আর তাঁর রাসূলের জন্য, এবং মু'মিনদের জন্য। [সূরা আল-মুনাফিকূন: ৮]
(তোমরা দুর্বল হয়োনা, এবং তোমরা চিন্তা করোনা, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা ঈমানদার
হও)। [সূরা আলে-ইমরান: ১৩৯] সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে মাধ্যম বলতে কি বুঝায়, এ ব্যাপারে
মানুষ তিনটি দলে বিভক্তঃ
এক : একদল হচ্ছে তারা যারা শরীয়ত প্রণেতা
হিসাবে প্রেরিত একমাত্র মাধ্যম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কেও মানতে
নারাজ, বরং তারা দাবী করছে, - আর কত জঘন্যই না তাদের এ দাবী - যে, শরীয়ত শুধুমাত্র
সাধারণ মানুষের জন্য, উপরন্ত তারা এ শরীয়ত কে "ইলমে জাহীর" বা প্রকাশ্য বিদ্যা
হিসাবে নামকরণ করেছে, তারা তাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে কতেক বাজে চিন্তা-ধারণা ও কুসংস্কারকে
গ্রহণ করে "ইলমে বাতেন" বা গোপন বিদ্যা নামে চালু করেছে, আর এর দ্বারা যা
অর্জিত হয় তার নাম দিয়েছে (কাশ্ফ)। মূলত তাদের এই কাশ্ফ ইবলীশি কুমন্ত্রণা আর শয়তানী
মাধ্যম ছাড়া কিছুই নয়, কারণ এটা ইসলামের সাধারণ মুলনীতির পরিপন্থী, এ ব্যাপারে তাদের
দলগত শ্লোগান হলোঃ এ কথা (আমার মন আমার রব থেকে সরাসরি বর্ণনা করেছে)। এতে করে তারা
শরীয়তের আলেমদের সাথে ঠাট্টা করছে, এবং এ বলে দোষ দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের বিদ্যা
অর্জন করছ ধারাবাহিক ভাবে মৃতদের থেকে আর তারা তাদের বিদ্যা সরাসরি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী
রব এর কাছ থেকে অর্জন করছে। এ সমস্ত কথা দ্বারা তারা অনেক সাধারন মানুষকে আকৃষ্ট করে
তাদের পথভ্রষ্ট করছে। আর শরীয়ত নিষিদ্ধ অনেক কাজ তারা এভাবে জায়েয করেছে যার বিবরণ
তাদের কুসংস্কারপূর্ণ বই গুলিতে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এ ব্যবস্থার অবসান
কল্পে আলেমগণ তাদেরকে কাফের এবং ধর্ম বিচু্যতির কারণে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিতে
বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ তারা জানতনা বা জেনেও না জানার ভান করত যে, ইসলামের প্রথম মূলনীতি
হলোঃ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অবতীর্ণ পদ্ধতির বাইরে কেউ আল্লাহর
ইবাদাত করলে সে কাফের হিসাবে গণ্য হবে; কেননা আল্লাহ বলেন: সুতরাং তারা যা বলছে তা
নয় বরং আপনার রবের শপথ, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে তাদের মধ্যকার ঝগড়ার মাঝে বিচারক
মানবেনা অতঃপর তাদের অন্তরে আপনার ফয়সালার ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব
থাকবেনা, এবং পরিপুর্ণভাবে তা মেনে নিবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমানদার হতে পারবেনা।
[সূরা আন্-নিসা: ৬৫] আর এভাবেই শরীয়তের ইলমের বিরোধীতা ও তার আলোকে নির্বাপিত করার
কাজ শয়তান তাদের মনে সৌন্দর্য মন্ডিত করে দেখায়। ফলে তারা নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ঘুরতে
থাকে এবং তাদের খেয়াল খুশি মোতাবেক আল্লাহর ইবাদত করতে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ
তা'আলা তাদের যে চিত্র অংকন করেছেন তা তাদের ক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রতিয়মান হয়। আল্লাহ
তা'আলা বলেন : (বলুন: আমি কি তোমাদেরকে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের
সংবাদ দেব? (তারা হলো ঐ সব লোক) যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা পন্ড হয়ে গেছে,
অথচ তারা মনে করত কত সুন্দর কাজই না তারা করছে, তারাই সে সব লোক যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ
ও তার সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেছে, ফলে তাদের সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে গেছে, সুতরাং
কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন ওজন স্থাপন করবোনা)। [সূরা আল-কাহ্ফ: ১০৩-১০৫] এ গ্রুপ
শতধা বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লেগেছে, কারণ তারা সহজ সরল পথ থেকে দূরে সরে গেছে,
যে পথ ছিল আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্তদের পথ, অভিশপ্ত বা পথহারাদের পথ নয়। তাদের সমস্ত গ্রুপই
জাহান্নামে যাবে, কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: (আমার উম্মত
তিয়াত্তর ফেরকা বা গ্রুপে বিভক্ত হবে, বাহাত্তরটি জাহান্নামে আর একটি জান্নাতে যাবে
- যারা আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে পথে আছি, তার উপর থাকবে)। হাদিসটি আবু দাউদ, নাসায়ী,
ইবনে মাজাহ, তিরমিযি সবাই আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আন্হু) থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা
করেছেন।
দুই : যারা মাধ্যম সাব্যস্ত করতে গিয়ে সীমালংঘন
করেছে, আর মাধ্যমের ভুল ব্যাখ্যা করে এর উপর এমন কিছু জিনিস চাপিয়েছে, যা চাপানো কক্ষনো
জায়েয নয়। তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য নবী ও নেক্কার
ব্যক্তিবর্গকে এমনভাবে মাধ্যম মানতে শুরু করেছে যে তাদের বিশ্বাস আল্লাহ তা'আলা কারো
কোন আমল এদের মাধ্যম হয়ে না আসলে কবুল করবেননা; কারণ এরাই হচ্ছে তার কাছে যাওয়ার অসীলা।
(নাউজুবিল্লাহ)। এতে করে তারা আল্লাহ তা'আলাকে এমন সব অত্যাচারী বাদশাহদের বিশেষণে
বিশেষিত করেছে যারা তাদের প্রাসাদে প্রচুর দারোয়ান নিযুক্ত করে রেখেছে যাতে করে কোন
শক্তিশালী মাধ্যম ছাড়া তাদের কাছে পৌঁছা কক্ষনো সম্ভব হয়ে উঠেনা। অথচ আল্লাহ তা'আলা
পবিত্র কুরআনে বলেন: (যখন আপনাকে আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে তখন (বলুন)
আমি নিকটে, আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে আমি তার ডাকে সাড়া দেই, সুতরাং তারা যেন
আমার হুকুম মেনে নেয় এবং আমার উপরই ঈমান আনে যাতে করে তারা সৎপথ লাভ করে) আল্লাহ তা'আলার
এ বাণীর সাথে পূর্ব বর্ণিত লোকদের বিশ্বাসের সংগতি কতটুকু? এ আয়াত ইঙ্গিত করছে যে,
আল্লাহর কাছে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে তার উপর সঠিকভাবে ঈমান আনা এবং তার প্রর্দশিত
পথে ইবাদাত করা। দৃশ্যনীয় যে, এ আয়াতে ইবাদতের কথা ঈমানের পূর্বে উল্লেখ করে নেক আমল
বা সৎকাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে; কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার
জান্নাত হাসিলের জন্য এটা প্রধান শর্ত। আল্লাহ তা'আলা কুরআনে অসীলা শব্দের উল্লেখ করেছেন
এবং তা দ্বারা পূর্ণ আনুগত্য করাকেই বুঝিয়েছেন কারণ এটা (অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসূলের
পূর্ণ আনুগত্যই) একমাত্র মাধ্যম যা তাঁর নৈকট্য দিতে পারে এবং তার রহমতের দরজা খুলতে
ও জান্নাতে প্রবেশ করাতে সক্ষম। তাই বলছেনঃ (হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং
তার কাছে অসীলা (পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে নৈকট্য) অন্বেষণ কর আর তার রাস্তায় জিহাদ
কর যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।) [সূরা আল-মায়িদাহ্: ৩৫] নেককার বান্দাদেরকে যারা
অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে এমন মুর্খ, চেতনাহীন লোকদেরকে আল্লাহ তা'আলা পরিহাস করেছেন
কারণ তারা নেককার বান্দাদেরকে অসীলা বানাচ্ছে, অথচ নেককার বান্দারা নিজেরাই এই অসীলা
তথা আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা নৈকট্য হাসিলের অধিক মুখাপেক্ষী। আর এ ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য
লাভের দ্বিতীয় কোন পথ নেই, যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেন: (তারা যাদের আহবান করছে তারা
নিজেরাই তাদের প্রভূর নৈকট্য লাভের জন্য অসীলা খুঁজছে। তারা তার রহমতের আশা করছে, তার
শাস্তির ভয় করছে, নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর শাস্তি ভীতিপ্রদ)। [সূরা আল-ইসরা: ৫৭] বড়ই পরিতাপের
বিষয় যে, এ সমস্ত অমনযোগী লোকেরা যাদেরকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে তাদের সত্তার উপর
ভরসা করে থাকার ফলে নেক আমল করা থেকে বিরত থাকছে, খারাপ কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। যা
মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ হয়েছে। তারা ভুলে গেছে বা ভুলে থাকার ভান করছে যে, আল্লাহ
তা'আলা তাঁর রাসূলকে - যিনি সমস্ত মানব সন্তানের নেতা - তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ
(বলুনঃ আমি আমার নিজের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখিনা)। [সূরা আল-আ’রাফ: ১৮৮]
অনুরুপভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কলিজার টুকরা কন্যাকে সম্বোধন
করে বলেছেনঃ (হে ফাতিমা ! আমার কাছে যত সম্পদ আছে তার থেকে যা ইচ্ছা হয় চেয়ে নাও, আমি
আল্লাহর কাছে তোমার কোন কাজে আসবনা )। [বুখারী ও মুসলিম] তিনি আরো বলেন : (যখন কোন
মানুষ মারা যায় তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, কেবলমাত্র তিনটি আমল ব্যতীত...)।
[মুসলিম] যদি নবীগণ ও নেক্কার লোকদের ব্যক্তিসত্তার অসীলা গ্রহণ জায়েয না হওয়ার ব্যাপারে
কোন দলীল না থাকত, বরং আমাদের সামনে উমর (রাদিয়াল্লাহু আন্হু) এর সেই ঘটনাটিই শুধু
থাকত, যাতে তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃতু্যর পর তাঁর অসীলা বাদ
দিয়ে তার চাচা আব্বাসের দুআ'র শরণাপন্ন হয়েছিলেন, তবে অসীলাবাদী এ দলের মুলোৎপাটনে
তাই যথেষ্ট হত।
তিন : যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম
বলতে বুঝেছেন সেই রিসালাতকে যার মানে হলো দ্বীন প্রচার, শিক্ষাদান ও দ্বীনের প্রশিক্ষণ।
তারা এই রিসালাতের উচ্চ মর্যাদা এবং এর প্রতি মানব জাতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন।
ফলে তারা শরয়ী বিধান লাভের উদ্দেশ্যে এবং ঐশী বাণী বা ওহীর আলোকে আলোকিত হওয়ার জন্য
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বড় মাধ্যম এবং বৃহৎ অসীলা হিসাবে গ্রহণ
করেছেন। যেমনিভাবে তারা কুরআন অধ্যয়ন করছেন তেমনিভাবে তারা রাসূলের পবিত্র জিবনী ও
তার সুন্নাত অধ্যয়ন করছেন। এতে তাদের শ্লোগান হচ্ছে আল্লাহর বাণীঃ (নিশ্চয়ই তোমাদের
কাছে আল্লাহর কাছ থেকে নূর এবং সুস্পষট গ্রন্থ এসেছে, এর দ্বারা যারা আল্লাহর সন্তুষটির
পিছনে ধাবিত হয় আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত প্রদান করেন, আর তাদেরকে তাঁর ইচ্ছা মোতাবেক
অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান, এবং সরল সোজা পথে পরিচালিত করেন )। [সূরা আল-মায়িদাহ্:
১৫, ১৬] এরাই হলো মুক্তি প্রাপ্ত দল যাদের কথা পূর্বোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এবং
তাদেরকেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়: এ গ্রুপের পথ বিপদসংকুল,
কন্টকাকীর্ণ। কেননা সত্যিকার ইসলাম আজ অপরিচিত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ মুসলমান এর থেকে
অনেক দুরে সরে গেছে। তারা এ দ্বীনকে বিদআ'ত ও মনগড়া রসম রেওয়াজে পরিবর্তন করেছে। এই
রোগ অতি পুরাতন, এ ব্যাপারে সংস্কারকদের ভুমিকা খুব ভয়াবহ ও কষ্টসাধ্য। উমর বিন আব্দুল
আজীজ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন (আমরা এমন কাজ সংসকার করতে চেষ্টা করছি যাতে আল্লাহ
ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারী নেই, যে কাজ করতে গিয়ে বৃদ্ধরা তাদের জীবন শেষ করেছে,
আর ছোট ছোট ছেলেরা যুবক হতে চলেছে, বেদুঈনগণ তাদের বাস্তু ত্যাগ করে চলে গেছে। তারা
এটাকে দ্বীন (ধর্ম) মনে করেছে অথচ এটা আল্লাহর কাছে দ্বীন বলে সাব্যস্ত নয়।) অবশ্য
এটা নতুন কিছু নয়, কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীনের এ করুণ দৃশ্যের
কথা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেছেন (ইসলাম অপরিচিত হিসাবে শুরু হয়েছে। যেভাবে তা শুরু হয়েছিল
সেভাবে আবার (অপরিচিত) অবস্থায় ফিরে আসবে। সুতরাং গরীব (এই অপরিচিত) দের জন্যই সুসংবাদ)
হাদীসটি মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আন্হু)থেকে বর্ণিত। অপর বর্ণনায় এসেছে
(বলা হলঃ হে আল্লাহর রাসূল এই গরীব (অপরিচিত) রা কারা? বললেনঃ বিভিন্ন গোত্র থেকে উত্থিত
বিক্ষিপ্ত কতক ব্যক্তিবর্গ) আহমাদ, ইবনে মাজা। তিরমিযির এক (হাছান) বর্ণনায় এসেছে
(এই গরীবদের জন্য সুখবর যারা আমার সুন্নাতের যে অংশ মানুষ নষ্ট করেছে তা পূণঃ সংস্কার
করে চালু করেছে)। মুসনাদে আহমাদে অপর এক সহীহ বর্ণনায় এসেছে (এই গরীব (অপরিচিত) গণ
হলোঃ অনেক খারাপ লোকের মাঝখানে এমন কিছু ভাল লোক, যাদের অনুসারীর চেয়ে বিরোধীরাই হবে
বেশী)। সুতরাং এ গ্রুপকেই সংসকার কাজে এগিয়ে যেতে হবে, সংস্কারের আলোতে মুসলমানদের
জাগিয়ে পুনরায় সঠিক ইসলামের দিকে ফিরিয়ে নিতে হবে। আর বিরোধীতা ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের
আমরা তাই বলব যা আল্লাহ তা'আলা তাদের পূর্বসুরীদেরকে বলেছেনঃ (আমাদের কি হলো যে, আমরা
আল্লাহর উপর ভরসা করবনা অথচ তিনি আমাদেরকে যাবতীয় পথের দিশা দিয়েছেন? আর আমরা তোমাদের
শত আঘাতের বিপরীতে ধৈর্য্য ধারণ করবো, ভরসাকারীগণ যেন শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা করেন)।
[সূরা ইব্রাহীম: ১২]
জীবিত বা মৃত পির-অলিদের
নিকট কোনো সাহায্য চাওয়া যাবে কিনাঃ
“আহমাদুল্লাহ
মাইজভান্ডারী” নামের একজন তার মুরিদকে দীক্ষা দেন যে, “যে কেহ আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা
করবে, আমি তাকে উন্মুক্ত সাহায্য দান করবো। আমার দরবারের এই প্রকৃতি হাশর তক জারি থাকবে।”
এপ্রসঙ্গে
কুরআন ও হাদিস কি বলে-
“আমরা
শুধুমাত্র তোমারই ইবাদত করি, এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।” [সুরা আল-ফাতিহাঃ
৫]
আল্লাহ
(সুব) বলেনঃ “আল্লাহ ছাড়া এমন অন্যের কাছে দোয়া কর না যারা না পারে তোমার উপকার করতে,
আর না পারে তোমার ক্ষতি করতে। যদি তা কর তবে নিশ্চয়ই তুমি মোশরেকদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
(সূরা ইউনুস ১০; ১০৬)।
আল্লাহ্
আরো বলছেন, বিপদগ্রস্থ মানুষ একমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় এবং আল্লাহই তার কষ্ট
দূর করে দেনঃ
‘‘বিপদগ্রস্ত
ব্যক্তির ডাকে কে সাড়া দেয়, যখন সে দুয়া করে? আর কে তার কষ্ট দূর করে? [সুরা নামলঃ
৬২]
‘‘বল,
‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার
অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের
নৈকট্য সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর
শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’ সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল:
৫৬-৫৭ আয়াত। তাবারী,
কুরআন
মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক, আমি তোমাদের দুআ
কবুল করব। [সূরা মুমিন : ৬০]
অন্যত্র
ইরশাদ করেছেন, বলে দাও, আমি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের কোনো
ক্ষতি করার এখতিয়ার রাখি না এবং কোনো উপকার করারও না। [সূরা জিন : ২১]
অপর
এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো কষ্ট দেন তবে এমন কেউ
নেই তিনি ছাড়া, যে তা দূর করবে আর তিনি যদি তোমার কোনো মঙ্গলের ইচ্ছা করেন তবে এমন
কেউ নেই, যে তার অনুগ্রহ রদ করবে। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন।
তিনি অতিক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সূরা ইউনুস : ১০৭]
“বল
আমি আমার নিজের কোনো উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি
গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমি
তো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে”। [সূরা আ’রাফ:১৮৮]
আল্লাহ
তাআলা ব্যতীত দুনিয়াতে কোনো মানুষকে কোনো কিছু দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তিনি তাঁর ক্ষমতা
বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য আয়াতে বলেন, “তিনি রাতকে দিনে প্রবিষ্ট করেন এবং দিনকে রাতে
রূপান্তরিত করেন। তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকটি আবর্তন করে
এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত। তিনিই আল্লাহ; তোমাদের পালনকর্তা, (এ বিশাল) সাম্রাজ্য
তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদের ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আঁটিরও অধিকারী নয়”। (সুরা
ফাতির : আয়াত ১৩)
রাসুল
সাঃ বলেন, মানুষ যখন মারা যায় তিনটি ব্যতীত তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়, (সেই আমলত্রয়ী
হচ্ছে) সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। [সহিহ মুসলিম:৩০৮৪]
উক্ত
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, মৃত পির-অলিদের তার মুরিদকে সাহায্য করার কোনো ক্ষমতা নেই।
কোন
মানুষ, অলি-আওলিয়া, পীর-ফকির দূরের কথা, এমনকি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর কাছেও দুয়া করা জায়েজ নয়ঃ
রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুয়া করে কোন কিছু চাইতে হবে একমাত্র আল্লাহ্
তাআ’লার কাছেই।
আব্দুল্লাহ্
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খচ্চরের পিঠে তার পিছনে আরোহী হিসেবে বসা ছিলাম। তখন তিনি আমাকে
বললেন,
“হে
যুবক শোনো! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দেবো, তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ করবে, তো তিনি
তোমাকে সংরক্ষণ করবেন, আল্লাহকে স্মরণ করলে তাঁকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে
তো আল্লাহর কাছেই চাইবে; যখন সাহায্য চাইবে তো আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ,
সমস্ত মানুষ যদি তোমার কোন উপকার করতে চায় তবে আল্লাহ্ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে
দিয়েছেন, তা ব্যতীত আর কোন উপকার করতে পারবে না। আর যদি সমস্ত মানুষ তোমার কোন অনিষ্ট
করতে চায় তবে আল্লাহ্ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তা ব্যতীত আর কোন অনিষ্ট
করতে পারবে না। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে।”
[তিরমিযীঃ
২৫১৬, মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৬৬৯; তাফসীরে রূহুল মাআনী ৬/১২৮; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৮;
হাশিয়াতুত তহতাবী আলালমারাকী ৩৭৮, হাদীসটি সহীহ্ (হাসান)]
আল্লাহ্কে
সংরক্ষণ করার অর্থ, আল্লাহর তাওহীদ ও অধিকার সংরক্ষণ। আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও শরী‘আতের
বিধি-বিধানের সীমারেখা সংরক্ষণ।
আল্লাহ
বলেন, ‘‘সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে
যে কিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দিবে না? এবং তারা তার প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও
নয়। যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্র করা হবে তখন তারা হবে তাদের শত্রু এবং তারা তাদের
ইবাদত অস্বীকার করবে।’’ সূরা (৪৬) আহকাফ: ৫-৬ আয়াত।
আল্লামা
রুহুল আমিন (১৩৬৪হি/১৯৪৫খৃ) দুআ, ডাকা বা প্রার্থনা বিষয়ক শিরকগুলো (মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বাগমারির ফকিরের ধোকাভঞ্জন,
পৃ. ১-১৪ নামক পুস্তকে) ব্যাখ্যা করেন। তিনি হাফিযুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন শিহাবুদ্দীন
ইবনুল বায্যায রচিত ফাতাওয়া বায্যাযিয়্যাহ, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবীর আল-কাওলুল জামীল,
শাহ আব্দুল আযীয দেহলবীর তাফসীরে আযীযী, শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর রেসালায়ে নুযূর, শাহ
ইসহাক দেহলবীর মিআত মাসাইল, কাযী সানাউল্লাহ পানিপথীর এরশাদুত্তালিবীন, মাওলানা আব্দুল
হাই লাখনবীর মাজমুআ ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত
নিম্নরূপ শিরকগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন:
আল্লাহ
ছাড়া অন্য কাউকে গাইবী ইলম বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, মনোবাঞ্ছা পূরণকারী বা কল্যাণ-অকল্যাণে
সক্ষম বলে ধারণা করা শিরক। বিপদে আপদে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিপদ মোচনের জন্য ডাকা
বা কারো দিকে মনোনিবেশ করা শিরক। (ইয়া শাইখ আব্দুল কাদির, শাইয়ান লিল্লাহ): হে শাইখ
আব্দুল কাদের জিলানী, আল্লাহর জন্য আমাকে কিছু দিন, অথবা হে খাজা শামসুদ্দীন পানিপতি,
আল্লাহর জন্য আমাকে কিছু দিন.. ইত্যাদি বলা শিরক।
মহান
আল্লাহ তাঁর ওলীদেরকে বিশ্বের সকল স্থানের মানুষদের ডাক শোনা, অবস্থা জানা বা সাহায্য
করার অলৌকিক জ্ঞান বা ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।
যদি
সালাত-সালাম বলার জন্য কেউ দূর থেকে ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’ বলে তবে তা বৈধ। আর যদি কেউ
ধারণা করে যে, রাসূলুল্লাহ বা কোনো ওলী দূর থেকে ডাকলে শুনতে পান, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ
করার ক্ষমতা রাখেন, দুনিয়ার কার্য নির্বাহ করেন অথবা বিশ্ব পরিচালনায় কোনোভাবে আল্লাহর
কাজের অংশীদার আছেন বা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে দূর থেকে ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া ওলিয়াল্লাহ
ইত্যাদি বলে ডাকে তবে তা সুস্পষ্ট শিরক। এরূপ শিরক বাতিল করতেই নবীগণ প্রেরিত হয়েছিলেন।
নবীগণ
বা ওলীগণ সব সময় হাযির-নাযির, বা দূরের ডাক শুনেন ও দুআ করেন বলে ধারণা করা হারাম ও
সুস্পষ্ট শিরক।
পীরগণের
রূহ হাযির বা লোকদের অবস্থা জানেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।
কেউ
যে কোনো স্থান থেকে ডাকলে ‘গাওস আযম’ তা শুনতে পারেন বা তার অবস্থার দিকে লক্ষ্য করেন
বলে আকীদা পোষণ করা শিরক।
উপরোক্ত
আলোচনায় এটাই প্রমাণিত যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে পির-অলিদের (জীবিত বা মৃত) নিকট কোনো
সাহায্য চাইবে সে শিরক করবে। কিন্তু দেখা যায়, পিরের মাজারে গিয়ে তার মুরিদগণ আল্লাহর
নিকট কোনো সাহায্য না চেয়ে মৃত পিরকে বাবা বাবা বলে ডাকছে, তার নিকট বিভিন্ন সমস্যার
কথা জানাচ্ছে এবং সাহায্য করার জন্যে আকুতি মিনতি করছে। আবার মানত করছে ও টাকা পয়সাও
দিচ্ছে। এগুলো শিরক, কুফর আর বিদআতি কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছুই না। পরিনতি জাহান্নাম।
মুসলমানরা কার নিকট বায়াত করবে, পিরের নিকট না রাষ্ট্র প্রধানের নিকট?
আল্লাহতায়ালা বলেন,
নিশ্চয় যারা আপনার কাছে বাই’আত করে তারা তো আল্লাহরই হাতে বাই’আত করে। আল্লাহর হাত(২) তাদের হাতের উপর। তারপর যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম বর্তবে তারই উপর এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে তিনি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দেন। (সুরা আল-ফাতহ, আয়াত নং-১০)।
ব্যাখ্যাঃ
আল্লাহ বলেন, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে বাই’আত করেছে, তারা যেন স্বয়ং আল্লাহর হাতে বাই’আত করেছে। কারণ, এই বাই’আতের উদ্দেশ্য আল্লাহর আদেশ পালন করা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। রাসূলের আনুগত্য যেমন আল্লাহর আনুগত্যেরই নামান্তর, তেমনিভাবে রাসূলের হাতে বাই’আত হওয়া আল্লাহর হাতে বাই’আত হওয়ারই নামান্তর। কাজেই তারা যখন রাসূলের হাতে হাত রেখে বাই’আত করল, তখন যেন আল্লাহর হাতেই বাই’আত করল। মহান আল্লাহ এ কথা বলে সাহাবীদের সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তাদের কথা শুনছিলেন, তাদের অবস্থান অবলোকন করছিলেন, তাদের বাহ্যিক অবস্থা ও মনের অবস্থা জেনে নিয়েছিলেন। সে সময় লোকেরা যে হাতে বাইয়াত করছিলো তা আল্লাহর প্রতিনিধি রাসূলের হাত ছিল এবং রাসূলের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে এ বাইয়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। [ইবন কাসীর, কুরতুবী]
আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন,
“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত যা তাদের অন্তরে বিদ্যমান। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন। (সুরা ফাতহ- ১৮)
আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন,
“হে নবী, ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন র্গভজাত সন্তান বলে মথ্যিা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা র্প্রাথনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।” (সুরা মুমতাহিনা- ১২)
আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের দিকে বের হলেন, হীম শীতল সকালে আনসার ও মুহাজিররা পরীখা খনন করছেন, আর তাদের এ কাজ করার জন্য তাদের কোন গোলাম ছিল না। যখন তিনি তাদের দেখতে পেলেন যে, তারা কষ্ট ও ক্ষুধায় আক্রান্ত, তখন বললেন, হে আল্লাহ! সুখের জীবন আখিরাতের জীবন। তুমি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দাও। প্রত্যুত্তরে তারা বলে উঠেনঃ আমরা সেই লোক যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে জিহাদের বায়আত গ্রহন করেছি, যতদিন আমরা বেঁচে থাকি। (সহিহ বুখারি হাদিস ২৬৩৮ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।
ইসহাক ইবনু ইব্রাহীম (রহঃ) … মুজাশি’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাতিজাকে নিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে উপস্থিত হলাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে হিজরতের উপর বায়আত নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘হিজরত তো হিজরতকারীগণের জন্য অতীত হয়ে গেছে’। আমি বললাম, ‘তাহলে আপনি আমাদের কিসের উপর বায়আত নিবেন?’ তদুত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘ইসলাম ও জিহাদের উপর’। (সহিহ বুখারি হাদিস ২৭৫৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।
ইবরাহীম ইবনু মূসা (রহঃ) … মুজাশি ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, মুজাশি‘ তাঁর ভাই মুজালিদ ইবনু মাসউদ (রাঃ) কে নিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাচে এসে বললেন, ‘এ মুজালিদ আপনার কাছে হিজরত করার জন্য বাইয়াত করতে চায়। ‘তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরতের প্রয়োজন নেই। কাজেই আমি তার কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে বায়য়াত নিচ্ছি।’ (সহিহ বুখারি হাদিস ২৮৬১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।
আবূ অলীদ উবাদাহ ইবনু সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত,
তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এই মর্মে বাইয়াত করলাম যে, দুঃখে-সুখে, আরামে ও কষ্টে এবং আমাদের উপর (অন্যদেরকে) প্রাধান্য দেওয়ার অবস্থায় আমরা তাঁর পূর্ণ আনুগত্য করব। রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে তার নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াই করব না; যতক্ষণ না তোমরা (তার মধ্যে) প্রকাশ্য কুফরী দেখ, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলীল রয়েছে। আর আমরা সর্বদা সত্য কথা বলব এবং আল্লাহর ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করব না।’ (রিয়াদুস সালেহীন ৩/১৯১, সহীহুল বুখারী ৭০৫৬, ১৮, ৩৮৯২, ৩৮৯৩, ৩৯৯৯, ৪৮৯৪, ৬৭৮৪, ৬৮০১৬৮৭৩৩, ৭১৯৯, ৭২১৩, ৭৪৬৮, মুসলিম ১৭০৯, তিরমিযী ১৪৩৯, নাসায়ী ৪১৪৯, ৪১৫১৪, ৪১৫২, ৪১৫৩, ৪১৫৪, ৪১৬১, ৪১৬২, ৪১৭৮, ৪২১০, ৫০০২, ইবনু মাজাহ ২৬০০, ২৮৬৬, আহমাদ ৪৩৮৮, ১৫২২৬, ২২১৬০, ২২১৯২, ২২২০৯, ২২২১৮, ২২২৪৮, ২২২৬৩)।
উক্ববাহ বিন আমের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত,
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট (বাইআত করার উদ্দেশ্যে) ১০ জন লোক উপস্থিত হল। তিনি ন’জনের নিকট থেকে বাইয়াত নিলেন। আর মাত্র একজন লোকের নিকট হতে বাইআত নিলেন না। সকলে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি ন’জনের বাইআত গ্রহণ করলেন, কিন্তু এর করলেন না কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘ওর দেহে কবচ রয়েছে তাই।’’ অতঃপর সে নিজ হাতে তা ছিঁড়ে ফেলল। সুতরাং তার নিকট থেকেও বাইআত নিলেন এবং বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি কবচ লটকায়, সে ব্যক্তি শিরক করে।’’ (আহমাদ ১৭৪২২, হাকেম, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪৯; গ্রন্থঃ হাদীস সম্ভার-৩৭৯৩; পাবলিশারঃ ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী।
হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছি শ্রবণ ও আনুগত্যের ব্যাপারে এবং এটা স্বাভাবিক অবস্থা, কঠিন অবস্থা, আগ্রহ ও অনাগ্রহ সর্বাবস্থার জন্য প্রযোজ্য। আমরা আরো বাইয়াত গ্রহণ করেছি যে, যে কোন ব্যাপারে আমীরের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবো না এবং সর্বাবস্থায় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো এ ব্যাপারে কোন তিরস্কার কারীর তিরস্কারকে পরোয়া করবো না।
(নাসায়ী )
রাসুল সাঃ এর নিকট বায়াতঃ
উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে কোন এক সমাবেশে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমরা এই কথার উপর আমার নিকট বাই’আত করঃ আল্লাহ তা‘আলার সাথে তোমরা কোন অংশীদার স্থাপন করবে না, চুরি করবে না এবং যিনা-ব্যভিচার করবেনা। তারপর তিনি বাই’আত বিষয়ক পূর্ণ আয়াত তাদেরকে তিলাওয়াত করে শুনালেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমাদের যে লোক এই বাই’আত পূর্ণ করবে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট রয়েছে তার জন্য পুরষ্কার। আর কোন মানুষ এর কোন একটি অপরাধে জড়িয়ে পড়লে এবং এর জন্য তাকে শাস্তিও প্রদান করা হলে তাতে তার গুণাহের কাফফারা হয়ে যাবে। আর কোন মানুষ এর কোন একটি অপকর্ম করে বসলে এবং আল্লাহ তা‘আলা সেটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দিলে তার প্রসঙ্গটি আল্লাহ তা‘আলার উপর ন্যস্ত। তাকে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে শাস্তিও দিতে পারেন আবার মাফও করে দিতে পারেন। (সহীহ্, ইরওয়া- ২৩৩৪, নাসা-ঈ, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪৩৯।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তিন রকম লোকের সাথে আল্লাহ তায়ালা ক্বিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা’আলা কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। (এক) ঐ ব্যক্তি, যে জনশুন্য ময়দানে অতিরিক্ত পানির মালিক কিন্তু মুসাফিরকে তা থেকে পান করতে দেয় না। (দুই) সে ব্যক্তি যে আসরের পর অন্য লোকের কাছে দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয় করতে গিয়ে এমন ক্বসম খায় যে, আল্লাহর শপথ! এটার এত দাম হয়েছে। ক্রেতা সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে সে জিনিস কিনে নেয়। অথচ সে জিনিসের এত দাম হয়নি। (তিন) ঐ ব্যক্তি যে একমাত্র দুনিয়ার স্বার্থে ইমামের বায়’আত গ্রহন করে। (বাদশাহ) ঐ লোকের মনের বাসনা পুর্ন করলে সে তার বায়’আত পুর্ন করে। আর যদি তা না হয়, তাহলে বায়’আত ভঙ্গ করে।
(বুলগুলমরাম, হাদিস নং-১৪১৪, বুখারী ২৩৫৮, ২৩৬৯, ২৬৭২, ৭৪৪৬, মুসলিম ১০৮, তিরমিযী ১৫৯৫, ইবনু মাজাহ ২৮৭০, আহমাদ ৭৩৯৩, ৯৮৬৬।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
পৃথিবীতে যতো পির ও ভন্ড অলি আছে, এরা সব সময় মুরিদকে বুঝায় যে, তাদের নিকট বাইয়াত করা ফরজ। এখানেও এরা কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা করেছে। আমি অপব্যাখ্যাগুলো তুলে না ধরে আসলে কার নিকট বাইয়াত করতে হয় সেটুকু আলোচনা করছি।
বাইআত করতে হয় শুধুমাত্র মুসলিম শাসকের হাতে। আহলে হিল্ল ও আকদ তাঁর হাতে বাইআত করবেন। আহলে হিল্ল ও আকদ হচ্ছে- আলেম সমাজ, সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করার মাধ্যমে তাঁর কর্তৃত্ব সাব্যস্ত হবে। সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করতে হবে না। বরং তারা তার আনুগত্য করবে যতক্ষণ না সেটা গুনাহর আওতায় না পড়ে।
আল-মাজেরি বলেন:
“যারা আহলে হিল্ল ওয়াল আকদ শুধু তারা ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করলে যথেষ্ট; সর্বসাধারণের বাইআত করা ওয়াজিব নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে সশরীরে তার কাছে হাযির হয়ে হাতে হাত রাখতে হবে এটা জরুরী নয়। বরং প্রত্যেকে তার আনুগত্য করবে, তার কথা মেনে চলবে, তার বিরোধিতা করবে না, তার বিপক্ষে যাবে না।”[ফাতহুল বারী থেকে সংকলিত]
ইমাম নববী ‘শরহে সহিহ মুসলিম’ গ্রন্থে বলেন:
বাইআতের ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে, বাইআত শুদ্ধ হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাইআত করতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। আহলে হিল্ল ওয়াল আকদের প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাইআত করতে হবে সেটাও শর্ত নয়। বরং শর্ত হচ্ছে- আলেমসমাজ, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে যাদেরকে একত্রিত করা সম্ভব হয় তাদের বাইআত করা...। প্রত্যেক ব্যক্তিকে ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এসে হাতে হাত রেখে বাইআত করতে হবে এমনটি ওয়াজিব নয়। বরং সকলের উপর ওয়াজিব হচ্ছে- রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ মেনে চলা, তার বিরোধিতা না করা, বিদ্রোহী না হওয়া।” ।
যেসব হাদিসে বাইআতের কথা এসেছে সেখানে বাইআত দ্বারা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা উদ্দেশ্য। যেমন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল কিন্তু তার গর্দানে বাইআত নেই সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” [সহিহ মুসলিম (১৮৫১)]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
“যে ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করেছে, হাত দিয়ে ও অন্তর থেকে তার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে সে যেন যথাসম্ভব সে রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য করে। যদি কোন লোক এ রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে টানাটানি করতে আসে তখন তোমরা সে লোকের গর্দান ফেলে দাও।”[সহিহ মুসলিম (১৮৪৪)] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যদি দুইজন খলিফার হাতে বাইআত করা হয় তখন শেষের জনকে হত্যা কর” [সহিহ মুসলিম (১৮৫৩)] এ হাদিসগুলো প্রত্যেকটি রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা সংক্রান্ত; এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন দলের হাতে বাইআত করা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শাইখ সালেহ আল-ফাওযান বলেন: বাইআত শুধুমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে করতে হবে। এ ছাড়া যত বাইআত আছে এগুলো বিদআত। এ বাইআতগুলো অনৈক্যের কারণ। একই দেশের একই রাজ্যের মুসলমানদের উপর আবশ্যকীয় হলো একজন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা। একাধিক বাইআত করা নাজায়েয।[আল-মুনতাকা মিন ফাতাওয়াস শাইখ সালেহ আল-ফাওযান ১/৩৬৭]
রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করার পদ্ধতি:
পুরুষের বাইআত করার পদ্ধতি হবে মৌখিকভাবে ও কর্মের মাধ্যমে অর্থাৎ মুসাফাহা করে। আর নারীদের ক্ষেত্রে শুধু মৌখিকভাবে। এ পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সাহাবায়ে কেরামের বাইআতের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আয়েশা (রাঃ) এর উক্তি হচ্ছে- “না, আল্লাহর শপথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত কখনো কোন নারীর হাতকে স্পর্শ করেনি। তিনি তাদেরকে মৌখিকভাবে বাইআত করাতেন।” [সহিহ বুখারী (৫২৮৮) সহিহ মুসলিম (১৮৬৬)]
ইমমা নববী (রহঃ) হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন:
এ হাদিসে মহিলাদের হাত না ধরে মৌখিকভাবে বাইআত করানোর দলিল রয়েছে এবং পুরুষের হাত ধরে ও মৌখিকভাবে বাইআত করানোর দলিল রয়েছে।”
উল্লেখিত তথ্যের আলোকে এটাই প্রতীয়মান যে, শুধু নির্দিষ্ট সংখ্যক কোনো পির-অলির নিকট বায়াত গ্রহন করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। রাষ্ট্র প্রধান কিংবা তার প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কারো নিকট বায়াত করা হারাম।
মাজারে গিয়ে মাথা নত করা
যাবে কিনা?
খালেস
তাওহিদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামে শিরকের পাশাপাশি শিরক প্রবেশের দরজা-জানালাও চিরতরের
জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একারণে কবর সংক্রান্ত যে সব বিষয় রাসূলুল্লাহ ﷺ
শিক্ষা দিয়েছেন (যথা যিয়ারত, সালাম ও দুআ) সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছু করার বিন্দুমাত্র
অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কবর-মাজারকে সম্মানসূচক সিজদা করা, গিলাফ চড়ানো,
চুমু খাওয়া, তাতে বাতি জ্বালানো, তার সামনে মাথা নোয়ানো-এগুলো বড় গুনাহ ও শিরকী কাজ।
এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসে অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি দলীল রেফারেন্সসহ
পেশ করা হল।
(১) কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন- নিশ্চয়ই
সিজদার স্থানসমূহের মালিক আল্লাহ তাআলা। অতএব তোমরা তার সাথে কারো ইবাদত করো না। (সূরা
জিন ১৮)
এ
আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে জুবায়ের, আতা,তলক ইবনে হাবীব প্রমুখ
মুফাসসিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতের সিজদার স্থানসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য সিজদার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
অর্থাৎ এগুলোর মালিক আল্লাহ। অতএব এগুলো দ্বারা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করো না।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৬৭৬; তাফসীরে কুরতুবী ১৯/১৪; তাফসীরে রুহুল মাআনী ২৯/৯১)
(২) সহীহ বুখারির হাদিসে এসেছে, রাসূল ﷺ বলেছেন,
ইহুদী
ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত হোক। কারণ, তারা নিজেদের নাবীগণের কবরকে সিজদার স্থানে
পরিণত করেছে। (সহীহ বুখারী ১৩০৭)
(৩) সহীহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে,
হযরত
জুনদুব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ মৃত্যুর পূর্বে পাঁচটি বিষয় বলেছিলেন, [এর মাঝে]…বলেন,
তোমাদের পূর্ববর্তী কত উম্মত স্বীয় নবী ও বুজুর্গদের কবরকে সেজদার স্থান বানিয়েছে।
সাবধান! তোমরা কবরকে সেজদার স্থান বানিও না। আমি তোমাদের তা হতে বারণ করছি। (সহীহ মুসলিম
৫৩২)।
কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস
করা যাবে কিনা?
কবরের
উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা নাজায়েয ও নিন্দনীয় কাজ। এ কাজের দ্বারা কবরবাসীকে অপমান
করা হয়। এমনকি কবরের উপর বসাও অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়বে না এবং কবরের
উপর বসবে না। ” (মুসলিম, হা/ ২১২২)
ইবনু
তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন, ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত
যে, কবরের উপর মসজিদ,বাড়ি-ঘর ইত্যাদি করা যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে নিষেধ করে গিয়েছেন ।(মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/১৯৪-৯৫ )
তবে
যদি একান্ত কোনো কারণে বাড়ি-ঘর করতে হয় আর কবর অল্প-পুরোনো বা নূতন হয় তাহলে লাশ উঠিয়ে
অন্যত্র কবর স্থানান্তর করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি কবর অনেক পুরাতন হয় তাহলে সেখানে
মাটির নিচে পুঁতে রেখে সমান করার মাধ্যমে কবর মিটিয়ে দিয়ে উপরে বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন।
(ফাতহুল কাদীর ২/১০১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ২/৪৭১; আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া
২/১৭৫; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/১৯৪-৯৫)।
আজমীর শরীফ ও মাযারে
শিরনির মান্নত করা কতোটুকু জায়েজ?
আজমীর
শরীফ ও যেকোনো মাযারে গিয়ে শিরনির মান্নত করলে সে মান্নত হবে না; বরং এমন নিয়ত করা
গুনাহ হয়েছে। কারণ কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হলে মাযারে যাওয়ার নিয়ত করা, সেখানে শিরনি
দেওয়া ইত্যাদি শিরক ও কঠোর গুনাহর কাজ। মান্নত শুধু আল্লাহ তাআলার নামেই করা যায়।
কোনো মাযার বা পীরের নামে মান্নত করা শিরক। তাই কেউ এমন নিয়ত করলেও তা পালন করা থেকে
বিরত থাকা জরুরি। উপরন্তু উক্ত নিয়তের কারণে তওবা-ইস্তেগফার করা জরুরি।
-সহীহ
বুখারী ২/৯৯১; আলমুহীতুল বুরহানী ৬/৩৫২; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৮; বাদায়েউস সানায়ে
৪/২২৬; ফাতহুল কাদীর ৪/৩৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৩৯।
পীর-ওলি ও মাজারের নামে
মানতকৃত পশু খাওয়া যাবে কি?
যাবে
না। কেননা, গায়রুল্লাহর নামে মানতকৃত পশু যদি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে যবাই
করা হয়, তবুও তা হারাম হয়। (আল বাহ্রুর রায়েক ৮/১৯২ রাদ্দুল মুহতার ৬/৩০৯ কিফায়াতুল
মুফতী ১/২১৬)।
মাজারে বাতি প্রজ্বলন ও কবরকে
সেজদা করা যাবে কিনাঃ
“হযরত
ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর নবী সাঃ অভিশম্পাত করেছেন (বেপর্দা) কবর যিয়ারতকারীনী
মহিলাদের উপর, এবং সেসব লোকদের উপর যারা কবরকে মসজিদ বানায় (কবরকে সেজদা করে) এবং সেখানে
বাতি প্রজ্জ্বলিত করে। (জামি তিরমীযী-২/১৩৬)।
গাইরুল্লাহকে সেজদা করা যাবে
কিনাঃ
হযরত
মুআজ বিন জাবাল রাঃ থেতে বর্ণিত। তিনি সিরিয়া গেলে সেখানকার খৃষ্টান অধিবাসী কর্তৃক
পোপ ও পাদ্রীদেরকে সেজদা করতে দেখলেন। হযরত মুআজ রাঃ বলেন, আমি তাদেরকে বললামঃ তোমরা
কেন এমন কর? তারা উত্তরে বলল, এটাতো আমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অভিবাদন [ভক্তি ও সম্মান
প্রকাশের মাধ্যম] ছিল। আমি [মুআজ] বললাম, তাহলে আমরা স্বীয় নবীকে এর প্রকারের ভক্তি
প্রকাশের অধিক অধিকার রাখি। [সিরিয়া হতে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত মুআজ রাঃ রাসূল সাঃ
এর নিকট তাঁকে সেজদা করার অনুমতি চাইলে] তিনি ইরশাদ করেন, এরা [খৃষ্টানরা] স্বীয় নবীদের
উপর মিথ্যারোপ করছে [যে তাদের অভিবাদন সেজদা ছিল।]। যেমন ওরা নিজেদের আসমানী কিতাবে
বিকৃতি সাধন করেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের মনগড়া অভিবাদনের চাইতে অতি উত্তম অভিবাদন
সালাম আমাদের দান করেছেন। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৪০৪, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস
নং-৭২৯৪, মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাইন, হাদীস নং-৭৩২৫}
হযরত
জুনদুব রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ মৃত্যুর পূর্বে পাঁচটি বিষয় বলেছিলেন,
[এর মাঝে]…… বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী কত উম্মত স্বীয় নবী ও বুজুর্গদের কবরকে সেজদার
স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সেজদার স্থান বানিও না। আমি তোমাদের তা হতে বারণ
করছি। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৩২}
হযরত
আতা বিন ইয়াসার রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ! আমার কবরকে
প্রতিমার ন্যায় ইবাদতের বস্তু বানিও না। আল্লাহর গজব সেসব লোকের উপর কঠোর আকার ধারণ
করেছে, যারা তাদের নবীদের কবরকে সেজদার স্থল বানিয়েছে। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৫৭০,
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৭৩৫৮}
নারী পুরুষের একত্র হওয়া
বা সাক্ষাৎ করা যাবে কিনাঃ
হে
নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও [ইহুদী খৃষ্টান)। তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় পাও
তবে আকর্ষণধর্মী ভঙ্গিতে কথা বলনা, যাতে যাদের মাঝে যৌনলিপ্সা আছে তারা তোমাদের প্রতি
আকৃষ্ট হয়। বরং তোমরা স্বাভাবিক কথা বল। এবং তোমরা অবস্থান কর স্বীয় বসবাসের গৃহে,
জাহেলী যুগের মেয়েদের মত নিজেদের প্রকাশ করো না। {সূরা আহযাব-৩২}
অর্থ
: আর তোমরা তাঁর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের কাছে
কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাঁদের অন্তরের জন্য
অধিকতর পবিত্রতার কারণ। {সূরা আহযাব-৫৩}
বিখ্যাত
তাফসীরবিদ ইমাম কুরতুবী রাহ. উক্ত আয়াতের আলোচনায় বলেন, উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের কাছে কোনো প্রয়োজনে পর্দার আড়াল থেকে
কিছু চাওয়া বা কোনো মাসআলা জিজ্ঞাসা করার অনুমতি দিয়েছেন। সাধারণ নারীরাও উপরোক্ত হুকুমের
অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/১৪৬)
নবী
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীগণ হলেন সকল মুমিনের মা। অথচ তাঁদের
সাথেই লেনদেন বা কথা-বার্তা বলতে হলে পর্দার আড়াল থেকে করতে বলা হয়েছে। তাহলে অন্যান্য
সাধারণ বেগানা নারীদের ক্ষেত্রে হুকুমটি কত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত তা তো সহজেই অনুমেয়।
রাসূল
সাঃ ইরশাদ করেন, চোখের জিনা হল [হারাম] দৃষ্টিপাত। কর্ণদ্বয়ের জিনা হল, [গায়রে মাহরামের
যৌন উদ্দীপক] কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শোনা। জিহবার জিনা হল, [গায়রে মাহরামের সাথে সুড়সুড়িমূলক]
কথোপকথন। হাতের জিনা হল, [গায়রে মাহরামকে] ধরা বা স্পর্শকরণ। পায়ের জিনা হল, [খারাপ
উদ্দেশ্যে] চলা। অন্তর চায় এবং কামনা করে আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবে রূপ দেয় [যদি
জিনা করে] এবং মিথ্যা পরিণত করে [যদি অন্তরের চাওয়া অনুপাতে জিনা না করে]। {সহীহ মুসলিম,
হাদীস নং-২৬৫৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৯৩২}
কবর ঘিরে উরস করা যাবে কিনাঃ
“তোমরা
স্বীয় ঘরকে কবর বানিয়োনা। (অর্থাৎ কবরের ন্যায় ইবাদত-নামায, তেলাওয়াত ও যিকির ইত্যাদি
বিহীন করনা।) এবং আমার কবরে উৎসব করোনা।(অর্থাৎ বার্ষিক, মাসিক বা সাপ্তাহিক কোন আসরের
আয়োজন করনা। তবে হ্যাঁ আমার উপর দুরূদ পাঠ কর। নিশ্চয় তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের
দরূদ আমার নিকট পৌঁছে থাকে।(আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতারা পৌঁছিয়ে দেন।)” (সুনানে আবু দাউদ:
হাদিস নং-২০৪৪/৪০)
এখানে
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- রাসূলে সাঃ নিজ রওযা মুবারকে উৎসব (উরস) পালন করতে বারণ করেছেন।
তাহলে অন্য কে আর এমন আছে যার কবরে তা বৈধ হবে?
হাদিসের
বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা মুনাভী রহঃ এই হাদিসের ব্যাক্ষা করতে গিয়ে বলেন-
“এ
হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, সাধারণ মানুষ যারা বছরের কোন নির্দিষ্ট মাসে বা দিনে (উরসের
নামে) ওলীদের মাযারে একত্রিত হয় এবং বলে-আজ পীর সাহেবের জন্ম বার্ষিকী (মৃত্যু বার্ষিকী),
সেখানে তারা পানাহারেরও আয়োজন করে, আবার নাচ গানেরও ব্যবস্থা করে থাকে, এ সবগুলিই শরীয়ত
পরিপন্থী ও গর্হিত কাজ। এ সব কাজ প্রশাসনের প্রতিরোধ করা জরুরী। (আউনুল মা’বুদ-৬/২৩)
পা ছুয়ে সালাম (কদমবুচি
) বৈধ কিনা?
পা
ছুঁয়ে সালাম করা, কদমবুসি করা বা পায়ে চুমু খাওয়া, পদধূলি নেওয়া – এ সবগুলো হচ্ছে মুশরেক
জাতি হিন্দুদের অনুকরণে নিকৃষ্ট বিদআ’ত। মূলত কবর মাযার পূজারী আর পীর পূজারীরা মুসলমানদের
মাঝে এই কুপ্রথা ঢুকিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই বেদাতীরা কবর মাযার ও তাদের পীর
বুজুর্গদেরকে সেজদাহ পর্যন্ত করে (নাউযুবিল্লাহ), সুতরাং পা ছুঁয়ে সালাম করা এদের কাছে
কোন ব্যাপারই না। আফসোস ! আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু বা কাফেরকে দেখলামনা মুসলমানদের কোনো
কিছু অনুকরণ করতে। মুসলমান জাতি কেনো হিন্দুয়ানি কালচার ফলো করার জন্য এতো দিওয়ানা
হবে? বিঃ দ্রঃ পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলেমাথা কোনো মানুষের সামনে ঝুঁকানো হয়, যা শিরক।
মুসলমানদের মাথা শুধুমাত্র এক আল্লাহর সামনেই নত হয় – নামাযের রুকু ও সিজদাতে, অন্য
কারো জন্য না। সমস্যা হচ্ছে, সমাজের অজ্ঞ লোকদেরকে নিয়ে – জানেনা ইসলাম একফোটা, ক্বুরান
হাদীস না জেনেই বড় বড় ফতোয়া ছাড়ে আর নিরিহ বউদেরকে বাধ্য করে এই হারাম কাজ করার জন্য।
দেবদাস মার্কা স্বামী খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকে – তার বউকে হারাম কাজে বাধ্য করা হচ্ছে,
বাঁধা না দিয়ে বোবা শয়তান সেজে বসে থাকে। মোস্ট প্রবাবলি, এই ধরণের লোকগুলো মানুষকে
খুশি করার জন্য নিজেও শ্বশুড়বাড়ি গিয়ে পায়ের ধূলা নেওয়ার জন্য অন্যের পায়ের উপর হুমড়ি
খেয়ে পড়ে। এদেরকে ইসলাম শেখানো জরুরী, এদের মূর্খতার কারণে পুরো সমাজে বিপর্যয় দেখা
যাচ্ছে, নিজে ইসলাম জানেনা – অন্যদের ইসলাম পালনে বাঁধা সৃষ্টি করে। সমাজের লোকেরা
পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে যদি আযাব আসে, সেটা কিন্তু ভালো-মন্দ সবাইকে স্পর্শ করে। তাই
আমাদের মুসলমানদেরকে জমীন থেকে শিরক ও বেদাত উৎখাত করার জন্য ক্বুরান ও সুন্নাতের দাওয়াত
ও তাবলীগে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। যেই প্রসংগে কথাগুলো বলাঃ শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি আশা
করলেই যে সব আশা পূরণ করতে হবে এমন না, হারাম কাজে তাদের কেন, স্বামীর আদেশও মান্য
করা যাবেনা। ইসলামের বিধান হচ্ছেঃ জায়েজ কাজে স্বামীর আনুগত্য করতে হবে, যদিও সেটা
কোনো স্ত্রীর ভালো না লাগে বা সে ঐ বিষয়ের সাথে একমত না হয়। কিন্তু, স্বামী যদি এমন
কোনো কথা বলে, যা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত তাহলে সেটা মানা যাবেনা। আজকাল অনেক মুসলিম(!)
পুরুষ তার স্ত্রী পর্দা করুক পছন্দ করেনা, এই ব্যাপারে স্বামীর অনুগত্য করা চলবেনা।
এ প্রসংগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “খালিক (সৃষ্টিকর্তার)
অবাধ্য হয়ে কোনো মাখলুকের (সৃষ্টির) আনুগত্য নেই।” মুসনাদে আহমাদ ও হাকিম। আর কেউ যদি
মানুষকে খুশি করার জন্য আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তাহলে তার পরিণতি সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মানুষকে সন্তুষ্ট করার আল্লাহ তাআ’লাকে অসন্তুষ্ট
করে, তাহলে আল্লাহ তাআ’লা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। পরিণতিতে আল্লাহ তাআ’লাকে অসন্তুষ্ট
করিয়া যাদেরকে সে সন্তুষ্ট করিয়াছিল, তারাও অসন্তুষ্ট হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে
সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে মানুষকে অসন্তুষ্ট করে, আল্লাহ তাআ’লা তার প্রতি সন্তুষ্ট
হন এবং আল্লাহ তাআ’লাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে যাহাদেরকে সে অসন্তুষ্ট করেছিলো, তাদেরকেও
আল্লাহ তাআ’লা সন্তুষ্ট করেন। সেই সব অসন্তুষ্ট লোকদের দৃষ্টিতে আল্লাহ তাআ’লা তাকে
উত্তম করে দেন, সেইব্যাক্তির কথা ও কাজকে তাহাদের দৃষ্টিতে শোভণীয় করে দেন।” [সুনানে
আত-তিরমিযী]
পা
ধরে সালাম বা কদমবুসি করা শরী‘আত সম্মত নয়। আনাস (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি এসে বলল,
হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যখন তার কোন ভাই বা বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত
করবে, তখন সে কি মাথা ঝুঁকাবে বা তাকে জড়িয়ে ধরবে বা চুমু খাবে? তিনি বললেন, না। লোকটি
বলল, তাহ’লে কি কেবল হাত ধরবে ও মুছাফাহা করবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ’ (তিরমিযী,
মিশকাত হা/৪৬৮০ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, মুছাফাহা ও মু‘আনাক্বা অনুচ্ছেদ-৩)। কদমবুসি সম্পর্কে
বর্ণিত হাদীছ যঈফ (আদাবুল মুফা্যদ হা/৯৭৫-৭৬; ঐ, ইফাবা হা/৯৮৭-৮৮)।
প্রসঙ্গঃ পির-অলিদের শাফায়েত
বা সুপারিশঃ
পিরগণ
বলেন যে, তারা কিয়ামতে মুরিদের হাত ধরে বেহেশতে নিয়ে যাবে। আসলে তাদের এ ক্ষমতা কি
আছে?
পীরগণ
বলেন তারা মুরীদদেরকে হাত ধরে বেহেশতে নিয়ে যাবেন বা পীরগণের সুপারিশে মুরীদরা বেহেশতে
যাবে! কিন্তু আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন,
“আর
সেদিনের ভয় করো, যখন কেউ কারো সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও
কবুল হবে না; কারো কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ নেওয়া হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে
না”। (বাক্বারা ২:৪৮)
আল্লাহ
তায়ালা বলেছেন, অর্থাৎ, আজকে (কিয়ামতের দিন) তোমাদের কেউ কাউকে উপকার কিংবা ক্ষতি করতে
পারবে না। আর আমি অপরাধীদেরকে বলব-জাহান্নামের আগুনের স্বাদ গ্রহণ কর দুনিয়ায় যাকে
তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। (সুরা সাবা: ৪২)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থাৎ,
সেটি এমন দিন যেদিন কোন নিকটতম প্রিয়জনও কোন নিকটতম প্রিয়জনের কাজে আসবে না। আর তাদেরকে
সাহায্যও করা হবে না। (সুরা দুখান:৪১)
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থাৎ,
সেদিন এমন একটি দিন যখন কারও জন্য কোন কিছু করার সাধ্য থাকবে না। ফায়সালার ভার সেদিন
একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতেই থাকবে। (সুরা ইনফিতার :১৯)।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “হে কুরাইশদল! তোমরা আল্লাহর নিকট নিজেদেরকে
বাঁচিয়ে নাও, আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর নিকট কোন উপকার করতে পারব না। হে বানী
আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হে (চাচা) আব্বাস
বিন আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহর দরবারে আপনার কোন কাজে আসব না। হে আল্লাহর রসূলের
ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আপনার জন্য আল্লাহর দরবারে কোন উপকারে আসব না। হে আল্লাহর রসূলের
বেটী ফাতেমা! আমার কাছে যে ধন-সম্পদ চাইবে চেয়ে নাও, আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোন উপকার
করতে পারব না।” (বুখারী ২৭৫৩, মুসলিম ৫২৫নং)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
এর
পরেও পীরগণ কিভাবে বলেন, তারা মুরীদদের জন্য সুপারিশ করবেন? তাদেরকে হাত ধরে বেহেশতে
নিয়ে যাবেন? আল্লাহ কি তাদেরকে পৃথিবী থেকেই জান্নাতের সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন?
হাত ধরে বেহেশতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তারা কি আল্লাহ’কে মিথ্যাবাদী (আল্লাহ ক্ষমা
করুন) প্রতিপন্ন করছেন না?
আল্লাহ
আমাদেরকে ভ্রান্ত পথ থেকে সরল সঠিক পথে আসার তওফীক দান করুন। আমিন।
আল্লাহর সাথে মিশে যাওয়া:
একটি হাদিসের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার-
ইসলামে
তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম। যার অর্থ হলো: এক ইলাহের সার্বভৌমত্ব ও এক ইলাহের বিধান
মেনে নেওয়া। উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত ও আসমা ওয়াস সীফাত সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ (সুব)
এর একাত্ব বজায় রাখা। কিন্তু পীর-সূফীদের পরিভাষায় তাওহীদ মানে হলো ‘আল্লাহর সাথে
একাকার হয়ে যাওয়া’। অর্থাৎ বান্দা ইবাদত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যেখন
বান্দা ও আল্লাহর মাঝে কোন পার্থক্য থাকে না । চিনি যেভাবে পানির সঙ্গে মিশে যায় সেভাবে
আল্লাহওয়ালাগণ আল্লাহর সঙ্গে মিশে যান । এরা তাদের এই মতের সপক্ষে নিম্নের হাদীসটিকে
প্রমাণ স্বরূপ পেশ করে থাকে:
অর্থ:
“আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা
বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা রাখবে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি
। আমার বান্দা আমি তার উপর যা ফরয করেছি তার চেয়ে আমার কাছে বেশী প্রিয় কোন ইবাদত
দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জণ করতে পারে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার
নৈকট্য অর্জণ করতে থাকে, এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই
যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে
সবকিছু দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা
দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান
করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অব্যশই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি যে কোন
কাজ করতে চাইলে এটাতে কোন রকম দ্বিধা সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা সংকোচ মু’মিন বান্দার
প্রাণ হরণে করি। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার কষ্ট অপসন্দ করি।” (সহীহ বুখারী
৬৫০২)
এই
হাদীস দ্বারা দলীল দিয়েই ভারত বর্ষের প্রসিদ্ধ সুফীবাদী তাফসীর ‘তাফসীরে মাযহারী’
তে বলা হয়েছে:
অর্থ:
“আল্লাহ (সুব:) কোন কোন মানুষের অন্তরের মধ্যে তার জাতি (সত্ত্বাগত) মুহাব্বত তৈরী
করে দেন ফলে সে সত্ত্বাগতভাবে আল্লাহর সাথে মিশে যায়।”(‘তাফসীরে মাযহারী’ প্রথম খন্ড
৫০ পৃষ্ঠায় إِنِّي أَعْلَمُ
مَا لَا
تَعْلَمُونَ আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য।)
সূফীদের
সকল তরীকার লোকদের কাছেই এ আক্বীদাহ ও বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য। এ আক্বীদার প্রথম প্রবক্তা
ও প্রতিষ্ঠাতা ‘মানসূর হাল্লাজ’ নামক এক ভন্ড সূফীকে বলা হয়ে থাকে। তিনিই সর্বপ্রথম
এ আক্বীদাহ প্রকাশ করেন। এবং তিনি اَنَا الحَقُّ
‘আমিই আল্লাহ’ বলে যিকির করা শুরু করেন। তাছাড়া তিনি আরও কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন
যা থেকে তার এই আক্বীদাহর চুড়ান্ত ব্যাখ্যা জানা যায়। কবিতাগুলো এই:
অর্থ:
আমিই হক্ব (আল্লাহ)। হক্ব হক্বের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য
নেই।
অর্থ:
নিঃসন্দেহে আমিই তুমি, তোমার পবিত্রতা সেতো আমারই পবিত্রতা, তোমার তাওহীদ সেতো আমারই
তাওহীদ, তোমার অবাধ্যতা সেতো আমারই অবাধ্যতা।
অর্থ:
“আমি যাকে চাই সেতো আমিই। আমরা দু’টো রুহ (প্রাণ) একই দেহে প্রবেশ করেছি।”
অর্থ:
তোমার রুহটা আমার রুহের সঙ্গে মিশে গেছে যেমনিভাবে শরাব স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিশে যায়।
তাই তোমাকে কোন বিপদ-আপদ স্পর্শ করলে আমাকেই স্পর্শ করে। তুমি আর আমি সর্বাবস্থায়
একই । ( মুহাব্বাতুর রাসূল বাইনাল ইত্তিবায়ে ওয়াল ইবতিদায়ে ১ম খন্ড ২১১পৃষ্ঠা।)
এভাবে
‘মানসূর হাল্লাজ’ এই জঘন্য শিরকি আক্বিদার গোড়াপত্তণ করেন। পরবর্তীতে সূফীদের শায়খে
আকবার ‘মহিউদ্দীন ইবনে আরাবী’ এই আক্বীদাকে আরও সম্প্রসারণ করে ‘ওয়াহদাতুল অজুদ’ এর
আক্বীদাহ মুসলিম জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেন। যার সারকথা হলো, ‘বান্দা এবং আল্লাহর অস্তিত্ব
এক।’
বর্তমান
পীর-সূফীদেরও একই আক্বীদাহ। যেমন: চরমোনাইয়ের পীর সাহেব বলেন: ‘মানছুর হাল্লাজ যখন
আল্লাহ পাকের এশকের জোশে দেওয়ানা হইতেন, তখন তিনি এই শের পড়িতেন:
ওগো
আমার মা’শুক মাওলা! আপনি আপন কুদরাতী নজরে আমার দিকে চাহিয়া দেখুন। আমি এখন আমি নাই।
আমি আপনি হইয়াছি আর আপনি আমি হইয়াছেন। আমি হইয়াছি তন্, আপনি হইয়াছেন জান। আমি শরীর
আপনি প্রাণ। এরপর আর কেহ বলিতে পারে না যে, আমি একজন আপনি আর একজন। বরং আমি ও আপনি
এক হইয়া গিয়াছি, অর্থাৎ আমি আপনার জামালের খুশীর মধ্যে ডুবিয়া গিয়াছি, আমার অজুদ
ফানা হইয়া গিয়াছে এবং আমার রূহ আপনার নূরের সাথে মিশিয়া গিয়াছে। আমার আমিও যখন
লয় হইয়া গিয়াছে, তখন আমি আর কোথায় আছি? আমি নাই। আপনিই ছিলেন, আপনিই আছেন, আপনিই
থাকিবেন। আপনিতো আপনি, আমিও আপনি। আমি বলিতে আর কিছুই নাই।” (‘আশেক মাশুক বা ইশকে ইলাহী’
সৈয়দ মোহাম্মদ এসহাক রচিত, পৃষ্ঠা নং ৪২।)
অথচ
এটি একটি মারাত্মক শিরকী আক্বিদাহ। কেননা আল্লাহ হচ্ছেন খালেক বা সৃষ্টিকর্তা। মানুষ
হলো মাখলূক বা সৃষ্টি। সৃষ্ট্রা ও সৃষ্টির মধ্যে একাকার করে দেওয়া এটা হিন্দুদের আকিদাহ
। তাদের বিশ্বাস, স্রষ্টার কোন স্বতন্ত্র অস্ত্মিত্ব নেই, সৃষ্টির সবকিছুর মধ্যেই তিনি
বিরাজমান। এজন্য তারা বলে থাকে ‘সবকিছুই ঈশ্বর’ তাদের পরিচয়ও হলো ‘সর্বেশ্বরবাদী’
। অথচ মুসলিমদের আক্বিদাহ হলো ‘সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি’। তবে আল্লাহ নয়। মনসূর হাল্লাজের
এই ভ্রান্ত আকিদার কারণে বাগদাদের তৎকালিন সমস্ত আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাকে হত্যা
করা হয়। আর বাগদাদ তখন ছিল বাগদাদ! অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞানের প্রাণ কেন্দ্র । এমতাবস্থায়
সমস্ত ওলামায়ে কেরামদের কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া ফাতওয়াকে উপেক্ষা
করে মানসুর হাল্লাজকে আল্লাহর অলী বলে আক্বিদাহ পোষণ করা মূলত: ইসলামী শরিয়াহ ও আলেম
ওলামাদের সর্বসম্মত রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করার শামিল । তাছাড়া পীর-সূফীদের
এই মহান গুরু মানসুর হাল্লাজ সম্পর্কে ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণ কিতাব ইমাম ইবনে
কাসীর রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে বলা হয়েছে:
অর্থ:
“খতীবে বাগদাদী বলেন: ফুকাহায়ে কেরামদের অনেকেই বলেছেন যে, হাল্লাজকে কতল করার ব্যাপারে
ওলামাদের ইজমা হয়েছিল এবং কাফের হিসেবেই তাকে কতল করা হয়েছে । সে ছিল কাফের, মিথ্যাবাদী
।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১১খন্ড ১১৫পৃষ্ঠা।)
এর
পর ইবনে কাসির (র:) হাল্লাজের কিছু ভন্ডামি উল্লেখ করেছেন । যার দ্বারা এর স্পষ্ট হয়ে
যায় যে হাল্লাজ কোন আল্লাহওয়ালা ছিল না । বরং সে ছিল প্রতারক। তাই যারা মনসুর হাল্লাজকে
অনুসরণ করছেন তাদের ভেবে দেখা উচিত । বিশেষ করে বিদায় নিহায়ার ১১খন্ডে উল্লেখিত মানসুর
হাল্লাজের জীবনি সকলের পড়া উচিত ।
সূফীদের
দলীল হিসাবে পেশ করা আবূ হুরাইরা (রা:) এর উপরোক্ত হাদীসটির জবাবে আমরা বলবো: ঐ হাদীসে
মূলত আল্লাহর নুসরাত-সাহায্যের কথা বল হয়েছে। আল্লাহর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার কথা
বলা হয়নি। হাদীসের শেষ অংশে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘সে যদি আমার
কাছে কোন কিছু সাওয়াল করে, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি । আর যদি সে আমার কাছে
আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই ।’ স্বত্তাগতভাবেই যদি আল্লাহ সঙ্গে মিশে
যায় তাহলে আবার আল্লাহর কাছে সাওয়াল করা বা আশ্রয় চাওয়ার প্রয়োজন কি? মূলত: এ
জাতীয় বাক্যগুলো সাহায্য-সহানুভূতি করার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন প্রধানমন্ত্রী
কাউকে বললো, যাও! অমুক কাজটা তুমি করো আমি তোমার সঙ্গে আছি। এর অর্থ হলো আমার সাহায্য-সহানুভূতি
তোমার সঙ্গে থাকবে। এর মানে এই নয় যে, প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে স্বত্তাগতভাবে মিশে
যায়। এ বিষয়টি একটি সাধারণ লোকেও বুঝে । কিন্তু সূফিবাদীরা নিজেদের ভ্রান্ত মতের
স্বপক্ষে হাদীসটিকে অপব্যবহার করে থাকে ।
পির-সুফিগণ কি আল্লাহর
অলী?
যে
ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ
করে সেই আল্লাহর অলী।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
‘‘মনে
রেখো যে, আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নেই। আর তারা বিষন্নও হবেনা। তারা হচ্ছে সেই সমস্ত
লোক যারা ঈমান এনেছে এবং পরহেজগারিতা অবলম্বন করে থাকে। তাদের জন্যে সুসংবাদ রয়েছে
পার্থিব জীবনে এবং পরকালেও’’। (সূরা ইউনূসঃ ৬২-৬৪) এই আয়াতে আল্লাহর অলীর সংজ্ঞা ও
পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ
‘‘আল্লাহই
হচ্ছেন ঈমানদারদের অলী (বন্ধু)। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর
যারা কাফের তাদের বন্ধু হচ্ছে তাগুত (শয়তান) তারা তাদেরকে আলো হতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে
যায়’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৭) ।
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ
‘‘আল্লাহ,
তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণই হচ্ছেন তোমাদের অলী (বন্ধু)। যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত
দেয় এবং রুকু করে। আর যে আল্লাহ্ তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে,
(তারাই আল্লাহর দলভুক্ত) নিশ্চয়ই আল্লাহর দল বিজয়ী’’। (সূরা মায়িদাঃ ৫৫-৫৬)
এই
আয়াতে আল্লাহর অলীর সংজ্ঞা ও পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পুরোপুরি
অনুসারীর হতে যদি আল্লাহ কারামাত বা অলৌকিক কিছু বের করেন তবে তিনি আল্লাহর অলী হিসেবে
গণ্য হবেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
‘‘অমুকের
পিতার সন্তানেরা আমার বন্ধু নয়। মুত্তাকীরাই কেবল আমার বন্ধু’’।[1]
হাসান
(রাঃ) বলেনঃ একদল লোক আল্লাহর ভালবাসা প্রকাশ করলে আল্লাহ্ তাদেরকে এই আয়াত দ্বারা
পরীক্ষা করলেন।
আল্লাহ বলেন,
‘‘হে
নবী! আপনি বলে দিনঃ তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তাহলে আমার অনুসরণ করো। তবেই আল্লাহ্
তোমাদেরকে ভালবাসবেন’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)
ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ
যখন তুমি দেখবে কোন লোক পানির উপর দিয়ে হাঁটছে অথবা শূণ্যে উড়ছে তখন তুমি তাকে অলী
হিসেবে বিশ্বাস কর না কিংবা তার দ্বারা প্রতারিত হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা জেনে নিবে
সে রাসূলের অনুসরণ করে কি না। ইমাম শাফেয়ীর কথাটি ভন্ড অলী ও সঠিক অলী চেনার গুরুত্বপূর্ণ
একটি মাপকাঠি। বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আদাব।
রাসুল সাঃ বলেন,
“যে
ব্যক্তি আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য
অর্জন বা ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালবাসি যে কাজ
আমি ফরয করেছি। (ফরয কাজ পালন করাই আমার নৈকট্যে অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে প্রিয়
কাজ)। এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়তের পথে অগ্রসর হতে
থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত
হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়, আমি তার দর্শনেন্দ্রিয় হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি
তার হাত হয়ে যাই, যদ্দ্বারা সে ধরে বা আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যদ্দ্বারা
সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি।
সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।” (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক, নং ৬৫০২।)
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে
আল্লাহর অলি হওয়ার জন্যে যেসব শর্ত প্রযোজ্য তাহলোঃ
(১)
ঈমানদার হতে হবে।
(২)
পরহেজগার হতে হবে।
(৩)
সালাত কায়েম করতে হবে।
(৪)
যাকাত প্রদান করতে হবে।
(৫) রুকু করতে হবে।
(৬)
আল্লাহ্ তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
(৭)
মুত্তাকী হতে হবে।
(৮)
রাসুল সাঃ এর প্রতি আনুগত্যশীল হতে হবে বা রাসুল সাঃ এর অনুসারী হতে হবে।
(৯)
সকল ফরজ কাজ পালন করতে হবে।
(১০)
সকল নফল ইবাদত পালন করতে হবে।
প্রিয়
পাঠকঃ এই সব গুণাবলী বা শর্তাবলী বর্তমান পির বা সুফি ও তাদের মুরিদ কিংবা আশেকে রাসুলদের
মধ্যে কি আছে?
পিরের
দরবারে গেলে আমরা কি দেখতে পাই? তাদের বানানো ইবাদত আর রাসুল সাঃ এর দেখানো ইবাদতের
সাথে কি কোনো মিল পাওয়া যায়? এসব বিষয়ে দ্বিতীয় পর্বে আমরা বিশদ দেখতে পাবো।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরাঃ
পির বা সুফিগণ যখন দেখতে পেলো যে, পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ কুরআন ও হাদিসের কোথাও নেই
আবার সহিহ আকিদাহপন্থী আলেমগণ যখন এতদবিষয়ে লেখা লেখি করতে লাগলেন বা গণসচেতনতা বাড়াতে
লাগলেন তখন এইসব পির বা সুফিগণ কুরআন ও হাদিস থেকে অলি সংক্রান্ত দলিলগুলোর অপব্যাখ্যা
করে বলতে লাগলেন যে, পির বা সুফি কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যদি ধরেও নেয়া যায় তাহলে
উপরোক্ত ১০টি শর্তাবলী তাদের মধ্যে কি আছে? এসবের মধ্যে আজকে ৮ নং শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা
করবো, যার মধ্যে সব কিছুই আছে।
পির বা সুফিগণ কি রাসুল
সাঃ এর প্রতি আনুগত্যশীল বা অনুসারী?
সুফীবাদের
কথা হচ্ছে, চোখ বন্ধ করে এবং বিনা শর্তে সুফী তরীকার পীর বা শায়েখের আনুগত্য করতে হবে
এবং মুরীদদেরকে তাদের সামনে পাপ করে থাকলে তা স্বীকার করতে হবে। ভক্তরা পীরের হাতে
সেরকম আটকা থাকবে যেমন গোসল দাতার হাতে মৃত ব্যক্তি।
পীরের আত্মার সাথে মুরীদের
আত্মার সম্পর্ক তৈরী করাঃ
সুফীদের
কথা হচ্ছে শত শত বই-পুস্তক পাঠ করে কোন মুমিন সঠিক পথে চলতে পারবে না। পীর বা শায়েখের
অন্তরের সাথে মুরীদের অন্তর যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দ্বীনি ইলম ও আমলে পরিপক্ক হওয়া
যাবে না।
এখানে
একটি কথা সুস্পষ্ট যে, পির বা সুফিগণ তারা নিজেরাই রাসুল এর প্রতি আনুগত্যশীল নয় তারা
আবার মুরিদকে বলে তাদের প্রতি আনুগত্যশীল হতে। আসলে আনুগত্য কার করবো, পিরের না রাসুল
সাঃ এর। আসুন ইসলাম কি বলে জেনে নেইঃ
রাসুল
সাঃ এর প্রতি আনুগত্যশীল বা অনুসারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাঁর প্রতিটি আদেশ নিষেধ মেনে
চলা। তিনি যেভাবে নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন ঠিক সেভাবেই অনুসরণ
করা বা মেনে চলা। কিন্তু পিরদের দেখা যায় তারা ইসলামি আইন, বিচার বা দন্ডবিধি, জিহাদ
ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম সংক্রান্ত সকল আদেশ পরিহার করে চলেন। কুরআনের কিছু অংশ মানে
আর কিছু অংশ মানে না। এরুপ যারা করে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি।
আল্লাহ বলেন,
“তোমরা
কি কোরআনের কোন কোন অংশ (আয়াত) মানো আর কোন কোন অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের
মধ্য থেকে এরুপ কাজ করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য
লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী
সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্য কলাপ সম্বন্ধেবে- খবর নন। (বাকারা-৮৫)।
প্রিয় পাঠকঃ
পির-সুফিগণ কি তাহলে রাসুল সাঃ এর আদেশ মেনে চলে?
আসুন আনুগত্য বিষয়ে আল্লাহ
কি বলেন জেনে নেইঃ
(১) সকল প্রশংসা আল্লহ তায়া’লারই উপযোগী–যিনি
সমস্ত বিশ্বের প্রতিপালক, যিনি পরম দয়ালু, অতিশয় করুনাময়, যিনি প্রতিফল দিবসের (অর্থাৎ
কিয়ামাত দিনের) মালিক; আমরা আপনারই ইবাদাত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি।
আমাদিগকে সরল পথ দেখান, সেই সকল লোকদের পথ–যাহাদিগকে আপনি নিয়ামাত দান করিয়াছেন, তাহাদের
পথ নহে–যাহাদের প্রতি আপনার গজব বর্ষিত হইয়াছে, আর না তাহাদের পথ–যাহারা পথভ্রষ্ট হুয়া
গিয়াছে। (সুরা ফাতিহা)
(২) নিশ্চয়, আল্লহ তায়া’লা আমারও রব তোমাদেরও
রব। সুতরাং তাঁহার ইবাদাত কর, ইহাই সরল পথ। (সুরা আল-ইমরনঃ ৫১)
(৩) আপনি বলিয়া দিন, আমার রব আমাকে একটি
সরল পথ দেখাইয়াছেন, ইহা একটি সুদৃঢ় ধর্ম, যাহা ইবরহীমের তরীকা যাহাতে কোন প্রকার বক্রতা
নাই এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। আপনি বলিয়া দিন, নিশ্চয়, আমার নামায
এবং আমার কুরবানী এবং আমার জীবন, আমার মরণ একমাত্র আল্লহর জন্যই, যিনি সমগ্র বিশ্বের
প্রতিপালক, তাঁহার কোন শরীক নাই এবং আমার প্রতি ইহাই আদেশ হইয়াছে এবং আমি সমস্ত অনুগতদের
মধ্যে প্রথম (অনুগত)। (সুরা আনআমঃ ১৬১-১৬৩)
(৪) আপনি বলিয়া দিন, হে মানবসকল, আমি তোমাদের
সকলের প্রতি সেই মহান আল্লহ কতৃক প্রেরিত রসূল, যাহার পূর্ণ আধিপত্য রহিয়াছে আসমানসমূহে
এবং যমীনে, যিনি ব্যতীত কেহই ইবাদাতের যোগ্য নহে, তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনি মৃত্যু
ঘটান, অতএব তোমরা আল্লহ তায়া’লার প্রতি ঈমান আন এবং তাঁহার প্রেরিত নবীয়ে-উম্মীর প্রতিও–যিনি
স্বয়ং আল্লহ তায়া’লার প্রতি এবং তাঁহার নির্দেশাবলীর প্রতি ঈমান রাখেন এবং তাঁহার অনুসরণ
কর, যেন তোমরা সৎপথ প্রাপ্ত হও। (সূরা আ’রাফঃ ১৫৮)
(৫) আর আমি পয়গম্বরগণকে বিশেষ করিয়া এইজন্য
প্রেরণ করিয়াছি, যেন আল্লহর আদেশে তাঁহাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তাহারা নিজেদের
নফসের উপর জুলুম করিবার পর আপনার নিকট উপস্থিত হইত এবং আল্লহর নিকট ক্ষমা চাহিত, আর
রসূলও তাহাদের জন্য আল্লহর নিকট ক্ষমা চাহিতেন, তবে অবশ্যই তাহারা আল্লহকে তওবা কবুলকারী,
করুণাময় পাইত। (সূরা নিসাঃ ৬৪)
(৬) হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লহ তায়া’লা
ও তাঁহার রসূলের আদেশ পালন কর, আর সেই আদেশ পালনে বিমুখ হইও না, অথচ তোমরা তো শ্রবণ
করিয়াই থাক (সূরা আনফালঃ ২০)
(৭) আর তোমরা আল্লহ ও তাঁহার রসুলের আদেশ
পালন কর, যাহাতে তোমাদের উপর রহম করা হয় (সূরা আল-ইমরনঃ ১৩২)
(৮) আর তোমরা আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের
আদেশ পালন করিতে থাক এবং আপোষে বিবাদ করিবে না, অন্যথায় সাহসহারা হইয়া পড়িবে এবং তোমাদের
প্রভাব বিনষ্ট হইয়া যাইবে, আর ধৈর্য ধারণ করিবে; নিশ্চয় আল্লহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
(সূরা আনফালঃ ৪২)
(৯) হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লহ ও রসূলের
আনুগত্য কর এবং তোমাদের যারা উপরস্থ তাহাদেরও।
অনন্তর যদি তোমরা কোন বিষয়ে পরস্পর দ্বিমত হও তবে সেই বিষয়কে আল্লহ ও তাঁহার রসূলের
উপর হাওয়ালা করিয়া দাও, যদি তোমরা আল্লহ তায়া’লার প্রতি ও কিয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান
রাখ। এই বিষয়গুলি উত্তম এবং পরিণামও খুব ভাল। (সূরা নিসাঃ ৫৯)
(১০) ঈমানদারদের কথা তো ইহাই, যখন তাহাদিগকে
আল্লহ ও তাঁহার রসূলের দিকে আহবান করা হয় তাহাদের মিমাংসার জন্য তখন তাহারা বলিয়া দেয়–আমরা
শুনিলাম এবং আদেশ মানিয়া লইলাম, আর এরূপ লোকেরাই সফলকাম হইবে। আর এ ব্যক্তি আল্লহ ও
তাঁহার রসূলের কথা মান্য করে এবং আল্লহকে ভয় করে এবং তাঁহার বিরূদ্ধাচরণ হইতে বিরত
থাকে, এইরূপ লোকেরাই সফলকাম হইবে (সূরা নূরঃ ৫১-৫২)
(১১) আপনি বলিয়া দিন, আল্লহর আনুগত্য কর
এবং রসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরাও তবে জানিয়া রাখ যে, তাঁহার (রসূলের)
উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তোমরা
দায়ী। আর যদি তোমরা তাঁহার অনুগত থাক, তবে সুপথপ্রাপ্ত হইবে, আর রসুলের দায়িত্ব কেবল
সুস্পষ্টভাবে পৌঁছাইয়া দেওয়া। তোমাদের মধ্যে যাহারা ঈমান আনিবে এবং সৎকার্যসমুহ করিবে,
আল্লহ ওয়াদা দিতেছেন যে, তাহাদিগকে পৃথিবীর রাজত্ব দান করিবেন, যেমন তাহাদের পূর্ববর্তীদিগকে
রাজত্ব দিয়াছিলেন এবং তিনি তাহাদের জন্য যে দ্বীনকে পছন্দ করিয়াছেন উহাকে তাহাদের জন্য
শক্তিশালী করিয়া দিবেন। আর তাহাদের এই ভয়-ভীতির পর উহাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করিয়া
দিবেন, তবে এই শর্তে যে, তাহারা আমার ইবাদাত করিতে থাকে আমার প্রতি কোন প্রকার অংশী
স্থির না করে, আর যাহারা ইহার পরও না-শোকরী করিবে, তবে তো তাহারাই নাফরমান। আর নামাযের
পাবন্দী কর এবং যাকাত প্রদান কর, আর রসূলের আনুগত্য কর যেন তোমাদের প্রতি রহম করা যাইতে
পারে। (সূরা নূরঃ ৫৪-৫৬)।
(১২) হে ঈমানদারগণ, আল্লহ তায়া’লাকে ভয় কর
এবং সুসঙ্গত কথা বল, আল্লহ তায়া’লা তোমাদের আ’মালসমূহ কবুল করিবেন এবং তোমাদের গুনাহসমুহকে
মাফ করিয়া দিবেন; আর যে ব্যক্তি আল্লহ তায়া’লা ও রসূলের আনুগত্য করিবে সে মহান সফলতা
লাভ করিবে। (সূরা আহযাবঃ ৭১)
(১৩) হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লহ তায়া’লা
ও রসূলের আদেশ মান্য কর, যখন তিনি (রসূল) তোমাদিগকে তোমাদের জীবন-সঞ্চারক বস্তুর দিকে
আহবা্ন করেন, আর জানিয়া রাখ যে, আল্লহ তায়া’লা মানুষ ও তাহার অন্তরের মাঝে অন্তরায়
হইয়া যান এবং নিঃসন্দেহে তোমাদের সকলকে আল্লহ তায়া’লারই সমীপে সমবেত হইতে হইবে। (সূরা
আনফালঃ ২৪)
(১৪) আপনি বলিয়া দিন, তোমরা অনুসরণ কর আল্লহ
তায়া’লা ও রসূলের। অতঃপর যদি তাহারা ফিরিয়া যায় তবে (শুনিয়া রাখুক) আল্লহ তায়া’লা কাফেরদিগকে
ভালবাসেন না। (সূরা আল-ইমরনঃ ৩২)
(১৫) যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করিয়াছে সে তো আল্লহ তায়া’লারই
আনুগত্য করিল, আর যে বিমুখ থাকে, তবে আমি তো আপনাকে তাহাদের প্রতি রক্ষক রূপে প্রেরণ
করি নাই। (সূরা নিসাঃ ৮০)
(১৬) আর যে ব্যক্তি আল্লহ তায়া’লা ও রসূলের
অনুগত হয়, তবে এইরূপ ব্যক্তিগণও সেই মহান ব্যক্তিগণের সহচর হইবেন যাহাদের প্রতি আল্লহ
তায়া’লা আনুগ্রহ করিয়াছেন, অর্থাৎ নবীগণ এবং সিদ্দীকগণ এবং শহীদগণ এবং নেককারগণ। আর
এই মহাপুরুষগণ অতি উত্তম সহচর। ইহা আনুগ্রহ আল্লহ তায়া’লার পক্ষ হইতে এবং সর্বজ্ঞ হিসেবে
আল্লহই যথেষ্ট। (সূরা নিসাঃ ৬৯-৭০)
(১৭) আর যে ব্যক্তি আল্লহ এবং তাঁহার রসূলের
পূর্ণ আনুগত্য করিবে আল্লহ তাহাকে এইরূপ বেহেশতসমূহে প্রবেশ করাইবেন যাহার তলদেশে নহরসমূহ
বহিতে থাকিবে, তাহারা অনন্তকাল উহাতে অবস্থান করিবে; আর ইহা বিরাট সফলতা। আর যে ব্যক্তি
আল্লহ ও তাঁহার রসূলের কথা অমান্য করিবে এবং সম্পূর্ণরূপেই তাঁহার বিধানসমূহ লঘংন করিয়া
চলিবে, আল্লহ তায়া’লা তাহাকে অগ্নিতে প্রবেশ করাইয়া দিবেন, এইরূপে যে সে উহাতে অনন্তকাল
থাকিবে এবং তাহার এইরূপ শাস্তি হইবে যাহাতে লাঞ্চনাও রহিয়াছে। (সূরা নিসাঃ ১৩-১৪)
(১৮) তাহারা আপনার নিকট গনীমতসমূহের বিধান
জিজ্ঞাসা করেতেছে। আপনি বলিয়া দিন, এই গনীমতসমূহ আল্লহ তায়া’লা ও রসূলের জন্য, অতএব
তোমরা আল্লহ তায়া’লাকে ভয় কর এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের সংশোধন কর, আর আল্লহ
ও রসূলের অনুসরণ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও। নিশ্চয় ঈমানদারগণ তো এইরূপ হয় যে, যখন
(তাহাদের সম্মুখে) আল্লহ তায়া’লার নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাহাদের অন্তরসমূহ ভীত হইয়া
পড়ে, আর যখন তাহাদিগকে আল্লহ তায়া’লার আয়াতসমূহ পড়িয়া শুনান হয় তখন সেই আয়াত তাহাদের
ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করিয়া দেয়, আর তাহারা নিজেদের পরওয়ারদিগারের উপর নির্ভর করে, যাহারা
নামাযের পাবন্দী করে এবং আমি যাহা কিছু তাহাদিগকে দিয়াছি উহা হইতে ব্যয় করে। ইহারাই
সত্যিকার ঈমানদার; ইহাদের জন্য রহিয়াছে উচ্চ পদসমূহ তাহাদের রবের নিকট, আর ক্ষমা ও
সম্মানজনক রিযিক। (সূরা আনফালঃ ১-৩)
(১৯) আর ঈমানদার পুরুষগণ ও ঈমানদার নারীগণ
পরস্পর একে অপরের বন্ধু। তাহারা সৎ বিষয়ে আদেশ করে এবং অসৎ বিষয় হইতে বারণ করে, আর
নামাযের পাবন্দী করে এবং যাকাত প্রদান করে, আল্লহ তায়া’লা ও তাঁহার রসূলের আদেশ মানিয়া
চলে; এই সমস্ত লোকের প্রতি আল্লহ তায়া’লা অবশ্যই রহমত বর্ষণ করিবেন। নিঃসন্দেহে আল্লহ
তায়া’লা অতিশয় ক্ষমতাবান, হিকমাতওয়ালা। (সূরা তওবাহঃ ৭১)
(২০) আপনি বলিয়া দিন, যদি তোমরা আল্লাহ
তায়া’লার সঙ্গে ভালবাসা রাখ তবে তোমরা আমার অনুসরণ কর, আল্লহ তায়া’লা তোমাদিগকে ভালবাসিবেন
এবং তোমাদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। আল্লহ তায়া’লা খুব ক্ষমাশীল, বড় করুণাময়।
(সূরা আল-ইমরনঃ ৩১)
(২১) আল্লহ তায়া’লার রসূলের মধ্যে এক উত্তম
আদর্শ রহিয়াছে তোমাদের জন্য, অর্থাৎ সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লহ তায়া’লা ও শেষ দিবস
হইতে ভয় রাখে এবং অধিক পরিমাণে আল্লহ তায়া’লা যিকির করে। (সূরা আহ’যাবঃ ২১)
(২২) আর রসূল তোমাদিগকে যাহা দান করেন তাহা
গ্রহণ কর আর যাহা হইতে তোমাদিগকে নিষেধ করেন তাহা হইতে বিরত থাক। (সূরা হাশরঃ ৭)
হাদিস হতেঃ
(১) আবূ মূসা (রাঃ) নবী করীম
(ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন
যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার ও আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হ’ল এমন
যে, এক লোক কোন এক কওমের নিকট এসে বলল, হে কওম! আমি নিজের চোখে সেনাবাহিনীকে দেখে এসেছি।
আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী। কাজেই তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কর। কওমের কিছু লোক তার কথা
মেনে নিল, সুতরাং রাতের প্রথম প্রহরে তারা সে জায়গা ছেড়ে রওনা হ’ল এবং একটি নিরাপদ
জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ফলে তারা রক্ষা পেল। তাদের মধ্যকার আর এক দল লোক তার কথা মিথ্যা
মনে করল, ফলে তারা নিজেদের জায়গাতেই রয়ে গেল। সকাল বেলায় শুত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ
করল ও তাদের ধ্বংস করে দিল এবং তাদের মূল উৎপাটিত করে দিল। এটা হ’ল তাদের উদাহরণ যারা
আমার আনুগত্য করে এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে। আর যারা আমার কথা অমান্য করে
তাদের দৃষ্টান্ত হ’ল, আমি যে সত্য (বাণী) নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা’। বুখারী
হা/৭২৮৩।
(২) হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে কুরআন পাঠকারীগণ! তোমরা (কুরআন ও সুন্নাহর উপর)
সুদৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই তোমরা অনেক পশ্চাতে পড়ে আছ। আর যদি তোমরা ডান দিকের কিংবা বাম দিকের
পথ অনুসরণ কর, তাহ’লে তোমরা সঠিক পথ হ’তে বহু দূরে সরে পড়বে’। বুখারী হা/৭২৮২।
(৩) বেলাল বিন সা‘আদ বলেন, তিনটি বিষয় কোন আমলে পাওয়া গেলে তা
গ্রহণ করা হবে না। তাহ’ল শিরকী ও কুফরী (কাজ) এবং নিজের রায় মত চলা (নিজের ইচ্ছা মত
আমল করা)। আমি বললাম, হে আবূ ওমর! রায় কি জিনিস? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল
(ছাঃ)-এর সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে নিজের ইচ্ছামত বলা এবং আমল করা। আল-হারুবী, যাম্মুল কালাম
ওয়া আহলিহি, ২/২৫৯-৬০।
(৪) অকী‘ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি হাদীছ যেভাবে এসেছে সেভাবে
অন্বেষণ করে, তাহ’লে জানবে সে সুন্নাতের অনুসারী। আর যে ব্যক্তি হাদীছ অন্বেষণ করবে
তার রায়কে (মতকে) শক্তিশালী করার জন্য তাহ’লে জানবে সে বিদ‘আতী। আল-হারুবী, যাম্মুল
কালাম ওয়া আহলিহি, ২/২৬৯-৭০।
(৫) কুরআন-সুন্নাহর অনুসারীদের জন্য সুসংবাদ
রয়েছে। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ইসলাম শুরু হয়েছিল গুটিকতক লোকের মাধ্যমে, আবার
সেই অবস্থা প্রাপ্ত হবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য (যারা কুরআন-সুন্নাহ
অনুযায়ী আমল করে)। মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৯।
(৬) ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আমর
আস-সুলামী ও হুজর ইবনু হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
একদা
আমরা আল-ইরবাদ ইবনু সারিয়াহ (রাঃ)-এর নিকট আসলাম। যাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে
তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত : “তাদেরও কোন অপরাধ নেই যারা তোমার নিকট বাহনের জন্য এলে তুমি
বলেছিলে : আমি তোমাদের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করতে পারছি না” (সূরাহ আত-তাওবাহ
: ৯২)। আমরা সালাম দিয়ে বললাম, আমরা আপনাকে দেখতে, আপনার অসুস্থতার খবর নিতে এবং আপনার
কাছ থেকে কিছু অর্জন করতে এসেছি। আল-ইরবাদ (রাঃ) বললেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সলাত আদায় করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে
আমাদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো
বিগলিত হলো। তখন এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এ যেন কারো বিদায়ী ভাষণ! অতএব
আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? তিনি বলেনঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, শ্রবণ ও আনুগত্যের
উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে
জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং
আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাহ্গণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে।
সাবধান! (ধর্মে) প্রতিটি নবাবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কার হলো বিদ’আত
এবং প্রতিটি বিদ’আত হলো ভ্রষ্টতা। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৬০৭, হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস।
(৭) ইবনু শিহাব (রহঃ) থেকে
বর্ণিতঃ
আবূ
ইদরীস আল-খাওলানী ‘আয়িযুল্লাহ (রহঃ) তাকে জানিয়েছে, মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-এর সহচর
ইয়াযীদ ইবনু ‘আমীরাহ তাকে জানিয়েছে, তিনি বলেন মু’আয (রাঃ) কোন ওয়াজে বসলেই বলতেন,
আল্লাহ্ মহা ন্যায়বিচারক, সন্দেহকারীরা ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ)
একদিন বলেন, তোমাদের পরবর্তী যুগে ফিত্বনাহ্ সৃষ্টি হবে, তখন প্রচুর সম্পদ থাকবে। মু’মিন,
মুনাফিক, পুরুষ-নারী, ছোট-বুড়ো, স্বাধীন-গোলাম সকলে কুরআন খুলে পাঠ করবে (কিন্তু অর্থ
বুঝবে না)। অচিরেই কেউ বলবে, “লোকদের কি হলো, তারা কেন আমার অনুসরণ করবে না যতক্ষণ
না আমি তাদের জন্য এছাড়া নতুন কিছু প্রবর্তন করতে পারি”। অতএব তোমরা তার এ বিদ’আত হতে
বেঁচে থাকবে। কারণ দ্বীনের মধ্যে যা নতুন প্রবর্তন করা হয় তা গোমরাহী। আমি তোমাদেরকে
জ্ঞানী ব্যক্তিদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সতর্ক করছি। কেননা শয়তান পন্ডিতদের মুখ দিয়ে
গোমরাহী কথা বলায়। আবার মুনাফিকরাও মাঝে মাঝে হক কথা বলে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি মু’আয
(রাঃ)-কে বললাম, আল্লাহ্ আপনার উপর সদয় হোন, জ্ঞানী ব্যক্তি যে পথভ্রষ্টতাপূর্ণ কথা
বলে আর মুনাফিক সত্য কথা বলে এটা আমি কিভাবে বুঝবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, জ্ঞানী ব্যক্তিদের
সেসব ভ্রান্তিপূর্ণ কথা বর্জন করবে যা লোকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং বলবে, এ আবার
কেমন কথা। তবে এসব কথায় তোমরা জ্ঞানীদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে না। কেননা হয়ত জ্ঞানী
ব্যক্তি এসব ভ্রান্তিপূর্ণ কথা থেকে ফিরে আসবে। আর তুমি হক কথা শুনামাত্র তা গ্রহণ
করো, কেননা হকের মধ্যে নূর আছে। ইবনু ইসহাক্ব (রহঃ) যুহরী (রহঃ) সূত্রে বলেন, মু’আয
ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, হ্যাঁ, তুমি যদি জ্ঞানী ব্যক্তির বক্তব্যে সন্দেহ করো, যতক্ষণ
না বলো, তিনি এর দ্বারা কি বুঝাচ্ছেন। সুনানে
আবু দাউদ-হাদিস নং-৪৬১১, হাদিসের মানঃ সহিহ মাওকুফ।
(৮) আবুস সালত (রাঃ) থেকে
বর্ণিতঃ
তিনি
বলেন, একদা এক ব্যক্তি ‘উমার ইবনু ‘আবদুল ‘আযীয (রহঃ)-এর নিকট তাক্বদীর সম্পর্কে জানতে
চেয়ে চিঠি লিখলো। উত্তরে তিনি লিখেন, অতঃপর আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, আল্লাহ্কে ভয়
করো, ভারসাম্যপূর্ণভাবে তাঁর হুকুম মেনে চলো, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর
সুন্নাতের অনুসরণ করো, তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভের ও সংরক্ষিত হওয়ার পর বিদ’আতীদের
বিদ’আত বর্জন করো। সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা তোমার কর্তব্য। কারণ এ সুন্নাত তোমাদের জন্য
আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে রক্ষাকবজ। জেনে রাখো! মানুষ এমন কোন বিদ’আত করেনি যার বিরুদ্ধে
ইতিপূর্বে কোন প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা তার বিরুদ্ধে এমন কোন শিক্ষা নেই যা তার ভ্রান্তি
প্রমাণ করে। কেননা সুন্নাতকে এমন এক ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি সুন্নাতের বিপরীত
সম্বন্ধে অবগত। আর ইবনু ফাসির তার বর্ণনায় “তিনি জানতেন ভুলত্রুটি, অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি
সম্পর্কে” একথাগুলো উল্লেখ করেননি। কাজেই তুমি নিজের জন্য ঐ পথ বেছে নিবে যা তোমার
পূর্ববর্তী মহাপুরুষগণ তাদের নিজেদের জন্য অবলম্বন করেছেন। কারণ তারা যা জানতে পেরেছেন
তার পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতার সঙ্গে বিরত থেকেছেন এবং তারা
দ্বীন সম্পর্কে পারদর্শী ছিলেন, আর যা করতে তারা নিষেধ করেছেন, তা জেনে-শুনেই নিষেধ
করেছেন। তারা দ্বীনের অর্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক জ্ঞানী ছিলেন। আর তোমাদের
মতাদর্শ যদি সঠিক পথ হয় তাহলে তোমরা তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে গেলে। আর যদি তোমরা বলো যে, তারা
দ্বীনের মধ্যে নতুন কথা উদ্ভাবন করেছেন তবে বলো, পূর্ববর্তী লোকেরাই উত্তম ছিলেন এবং
তারা এদের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন। যতটুকু বর্ণনা করার তা তারা বর্ণনা করেছেন, আর যতটুকু
বলার প্রয়োজন তা তারা বলেছেন। এর অতিরিক্ত বা এর কমও বলার নেই। আর এক গোত্র তাদেরকে
উপেক্ষা করে কিছু কমিয়েছে, তারা সঠিক পথ হতে সরে গেছে, আর যারা বাড়িয়েছে তারা সীমালঙ্ঘন
করেছে। আর পূর্ববর্তী মহাপুরুষগণ ছিলেন এর মাঝামাঝি সঠিক পথের অনুসারী। পত্রে তুমি
তাক্বদীরে বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চেয়ে লিখেছো। আল্লাহ্র অনুগ্রহে তুমি এমন ব্যক্তির
নিকট এ বিষয়ে জানতে চেয়েছো যিনি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আমার জানা মতে, তাক্বদীরে বিশ্বাসের
উপর বিদ’আতীদের নবতর মতবাদ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এটা কোন নতুন বিষয় নয়, জাহিলিয়াতের
সময়ও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। অজ্ঞ লোকেরা তখনও তাদের আলোচনা ও কবিতায় এ বিষয়টি উল্লেখ
করতো এবং তাদের ব্যর্থতার জন্য তাক্বদীরকে দায়ী করতো। ইসলাম এসে এ ধারণাকে আরো বদ্ধমূল
করেছে এবং এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক হাদীস উল্লেখ
করেছেন। আর মুসলিমগণ তাঁর নিকট সরাসরি শুনেছে এবং তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে পরস্পর
আলোচনা করেছে। তারা অন্তরে বিশ্বাস রেখে, তাদের রবের অনুগত হয়ে, নিজেদেরকে অক্ষম মনে
করে এ বিশ্বাস স্থাপন করেছে যে, এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহ্র জ্ঞান, কিতাব ও তাক্বদীর
বহির্ভূত। এছাড়া তা আল্লাহ্র আমোঘ কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। আর যদি তোমরা বলো, কেন আল্লাহ্
এ আয়াত নাযিল করেছেন এবং কেন একথা বলেছেন, তবে জেনে রাখো! তারাও কিতাবের ঐসব বিষয় পড়েছেন
যা তোমরা পড়ছো; উপরন্তু তারা সেসব ব্যাখ্যা অবহিত ছিলেন যা তোমরা জানো না। এতদসত্ত্বেও
তারা বলেছেন, সবকিছু আল্লাহ্র কিতাব ও তাক্বদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ যা
নির্ধারণ করেছেন তা অবশ্যই ঘটবে, আল্লাহ্ যা চান তাই হয় এবং যা চান না তা হয় না। লাভ
বা ক্ষতি কোন কিছুই আমরা নিজেদের জন্য করতে সক্ষম নই। অতঃপর তারা ভালো কাজের প্রতি
উৎসাহী ও খারাপ কাজের ব্যাপারে সাবধান হয়েছেন। সুনানে আবু দাউদ-হাদিস নং-৪৬১২, হাদিসের মানঃ সহিহ মাকতু।
পির-সুফিগণ কি উলিল আমর?
পির-সুফিগণ
তাদের বইসহ বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে বলেন থাকেন যে, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত অনুযায়ী তারাই
নাকি উলিল আমর। মুরিদকে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন যে, এজন্যেই তাদের আনুগত্য
করতে হবে। যারা আনুগত্য করবে না তারা জাহান্নামি। আসলে কি তাই? আসুন উলিল আমর সম্পর্কে
জেনে নেই।
আল
কোর’আনের সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে –
“হে
বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর। রাসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য কর। এরপর যদি তোমাদের
মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট ফিরে যাবে; যদি তোমরা আল্লাহ
ও আখিরাতকে বিশ্বাস কর। এটাই তোমাদের জন্যে সুন্দর ও উত্তম উপায়”। [সূরা ৪/নিসা – ৫৯]
এ
আয়াতটি অনুবাদ করার সময় অনেকেই ‘উলিল আমরের’ অর্থ করেন –‘নেতা’। কিন্তু উলিল আমরের
অর্থ যদি “নেতা” করা হয়, তাহলে কোর’আনের অন্য একটি আয়াতের সাথে বৈপরীত্য তৈরি হয়। কেননা,
কেয়ামতের দিন জাহান্নামীরা আল্লাহর নিকট অভিযোগ করে বলবে–“আমরা আমাদের নেতার আনুগত্য
করেছিলাম বলে তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে।”
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের
বা মুরব্বীদের কথা মেনে নিয়েছিলাম, তাই তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল”। [সূরা ৩৩/আহযাব
– ৬৭]
তাহলে এখানে উলিল আমরের সঠিক অর্থ কি হবে?
উলিল
আমর [أُو۟لِى
ٱلْأَمْرِ
] দুটি শব্দ–উলিল ও আমর। উলিল শব্দের অর্থ অধিকারীগণ, অভিভাবকগণ, বা, সহযোগীগণ। “আমর”
শব্দটি কোর’আনে অসংখ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ
কোর’আনে
সবচেয়ে বেশি ‘আমর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে “কাজ” অর্থে। মানুষ যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের
সাথে কাজ করার জন্যে ওয়াদাবদ্ধ হয়, তখন সেই কাজের কর্মকর্তাকে উলিল আমর বলা হয়। [সূত্র–কোর’আন,
২৪: ৬২]
‘আমর’
শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হলো ওহী বা আল-কোর’আন। যারা কোর’আনের অধিকারী বা কোর’আনের জ্ঞানে
জ্ঞানী তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়। [সূত্র–কোর’আন, ২১: ৭৩]
‘আমর’
শব্দের তৃতীয় অর্থ হলো ইসলামী শরিয়াহ বা ইসলামী আইন। যারা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ বা বিচারকার্য
পরিচালনা করেন, তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র–কোর’আন,
৪৫: ১৮]
‘আমর’
শব্দের চতুর্থ অর্থ হলো আদেশ। যারা আদেশ করার ক্ষমতা রাখেন, তাদেরকে ‘উলিল আমর’ বলা
হয়। আল্লাহ ও রাসূল (স) এর পর একজন মানুষকে আদেশ করার সর্বাধিক অধিকারী হলেন তার মা
ও বাবা। [সূত্র–কোর’আন, ১৯: ৩২; ৬: ১৫১]
‘আমর’
শব্দের পঞ্চম অর্থ হলো রূহ। রূহের অধিকারী স্বচ্ছ ও সুন্দর হৃদয়কে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।
[সূত্র–কোর’আন, ১৭: ৮৫]
কোনো
ধরণের প্রতিদানের আশা না করে যারা আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকে, তাদেরকেও ‘উলিল আমর’ বলা
হয়। [সূত্র – কোর’আন, ১০: ৭২; ৩: ১০৪]
সমাজের
যে কোনো জ্ঞানী মানুষদেরকেও ‘উলিল আমর’ বলা হয়। [সূত্র–কোর’আন, ৫২: ৩২; ২১: ৭]
সুতরাং,
‘উলিল আমর’ হলো – কোর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানী, সাধারণ জ্ঞানের জ্ঞানী, ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ,
স্বার্থহীন সৎকাজের আদেশকারী, কোনো কাজের দায়িত্বশীল, মাতা-পিতা, শিক্ষক, এবং নিজের
আকল-বুদ্ধি।
অতএব
উল্লেখিত আলোচনায় জানতে পারলাম যে, উলিল আমর বলতে শুধু নেতা বুঝাবে না, কোনো পির-সুফিকেও
বুঝাবে না। বৈধ সব কাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে উলিল আমর বুঝাবে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে
কিয়ামতে জিজ্ঞাসা করা হবেঃ
(১) ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই
তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে
তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জবাবদিহী করবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে
তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের দায়িত্বশীলা, কাজেই
সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল, সে
এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের
দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’’ [বুখারি ২৫৫৮, ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৭৫১, ৫১৮৮,
৫২০০, ৭১৩৮, মুসলিম ১৮২৯, তিরমিযি ১৭০৫, আবু দাউদ ২৯২৮, আহমদ ৪৪৮১, ৫১৪৮, ৫৮৩৫, ৫৮৬৭,
৫৯৯০]
(২) তারপর সেই দিনের কথা মনে কর যেদিন
আমি মানুষের প্রত্যেক দলকে তাদের নেতা সহকারে ডাকব। সেদিন যাদের আমলনামা তাদের ডান
হাতে দেওয়া হবে তারা নিজেদের কার্যকলাপ পাঠ করবে এবং তাদের ওপর সামান্যতম জুলুমও করা
হবে না। সূরা বনী ইসরাইল- ৭১ নম্বর আয়াত।
(৩) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)- এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কিয়ামত
কখন হবে? নবী (সা.) নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজ শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কিয়ামত হওয়ার
ব্যাপারে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, ইয়া রাসুল (সা.)! এই যে, আমি। তিনি জিজ্ঞাসা
করলেন, তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অবশ্য
তেমন দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজও পড়িনি, রোজাও রাখি
নি, তবে আমি নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)- কে ভালবাসি। রাসূল সা. বললেন, যে ব্যক্তি
যাকে ভালোবাসে, সে রোজ কিয়ামতে তার সঙ্গেই থাকবে। আর তুমিও যাকে ভালোবাস তার সঙ্গেই
থাকবে’। তিরমিজী-২৩২৭।
শেষ জামানায় মনগড়া ফতোয়া
আসবে-
উরওয়াহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি
বলেন, ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘আম্র (রাঃ) আমাদের এ দিক দিয়ে হাজ্জে যাচ্ছিলেন। আমি শুনতে
পেলাম, তিনি বলেছেন যে, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সালাম) - কে বলতে শুনেছি,
আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে ইল্ম দান করেছেন, তা হঠাৎ ছিনিয়ে নেবেন না বরং উলামাগণকে তাদের
ইল্মসহ ক্রমশ তুলে নেয়ার মাধ্যমে তা ছিনিয়ে নেবেন। তখন কেবল মূর্খ লোকেরা অবশিষ্ট
থাকবে। তাদের কাছে ফাত্ওয়া চাওয়া হবে। তারা মনগড়া ফাত্ওয়া দেবে। ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট
হবে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। ‘উরওয়াহ (রাঃ) বলেন,আমি এ হাদীসটি নবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সালাম) - এর স্ত্রী ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বললাম। তারপর ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু
আম্র (রাঃ) আবার হজ্জ করতে এলেন। তখন ‘আয়িশা (রাঃ) আমাকে বললেন, হে ভাগ্নে! তুমি
‘আবদুল্লাহ্র কাছে যাও এবং তার থেকে যে হাদীসটি তুমি আমাকে বর্ণনা করেছিলেন, তাঁর
নিকট থেকে যাচাই করে আস। আমি তাঁর নিকট গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে ঠিক সে
রকমই বর্ণনা করলেন, যেরকম আগে বর্ণনা করেছিলেন। আমি ‘আয়িশা (রাঃ) - ’র কাছে ফিরে এসে
তাকে জানালাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং বললেন, আল্লাহ্র কসম! ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু
আম্র (রাঃ) মনে রেখেছে। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮০৯), সহিহ বুখারী,
হাদিস নং-৭৩০৭। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
আমাদের মুক্তির পথ কোনটি?
আল্লাহ
(সুব:) কর্তৃক নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী মানব জাতির মুক্তির পথ কেবল মাত্র একটি। পবিত্র
কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:
অর্থ:
“আর এটিই আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না,
তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ
দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।”(সুরা আনআ’ম ৬:১৫৩)।
এই
আয়াতে আল্লাহ (সুব:) একটি তরীকাকেই অনুসরণ করতে বলেছেন।
আল্লাহ (সুব:) আরো বলেন:
অর্থ:
“আর সঠিক পথ বাতলে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব, এবং পথের মধ্যে কিছু আছে বক্র। আর তিনি
যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে হিদায়াত করতেন।”(সুরা নহল ১৬:৯)।
রাসূলুল্লাহ (সা:) থেকে ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ সর্ম্পকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
অর্থ:
“আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে (সিরাতে মুস্তাকিম বুঝানোর
জন্য) প্রথমে একটি সোজা দাগ দিলেন। আর বললেন এটা হলো আল্লাহর রাস্তা । অতপর ডানে বামে
অনেকগুলো দাগ দিলেন আর বললেন এই রাস্তাগুলো শয়তানের রাস্তা । এ রাস্তাগুলোর প্রতিটি
রাস্তার মুখে মুখে একেকটা শয়তান বসে আছে যারা এ রাস্তার দিকে মানুষদেরকে আহবান করে।
অতপর রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজের কথার প্রমাণে উপরে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটি তেলাওয়াত
করলেন।” (মুসনাদে আহমদ ৪১৪২; নাসায়ী ১১১৭৫; মেশকাত ১৬৬।)
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:
অর্থ:
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন; আমার সকল উম্মতই জান্নাতে
প্রবেশ করবে। তবে যে অস্বীকার করল (সে ব্যতীত)। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া
রাসুলুল্লাহ! অস্বীকার করল কে? রাসূল (সাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে
জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে আমার আনুগত্য করল না সেই অস্বীকার করল (ফলে সে জাহান্নামে
যাবে)। (বুখারী হা/৭২৮০)।
রাসুল সাঃ বলেন,
তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্তুকে মযবূতভাবে ধরে
থাকবে, ততদিন (তোমরা) পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্তু হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর
সুন্নাত’। মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।
উপরোক্ত
আলোচনায় আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের মুক্তির পথ একটাই তাহলো রাসুল সাঃ এর তরীকা মোতাবেক
চলা। এই তরীকার মূল গাইড লাইন হচ্ছে কুরআন ও রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ। কোনো পির-মাশায়েখ
বা সুফিদের তরীকা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের তরীকা মোতাবেক চললে জাহান্নামে যেতে হবে।
অতএব
সার্বিক পর্যালোচনান্তে এটাই প্রমাণিত যে, পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ ইসলামে নেই। এটা তাদের
সম্পূর্ণ বানানো একটি নতুন তরীকা। পির বা সুফিগণ যেসব ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করে তা
কুরআন-হাদিসের কোথাও নেই। এগুলো হচ্ছে কুরআন-হাদিসের বিকৃতরুপ। প্রশ্ন হলো এসব এরা
পায় কোথায়? এর উত্তর উপরে আলোচানা করা হয়েছে যে, শয়তান হচ্ছে এদের প্রভু। এদের দরবারে
যেসব কার্যকলাপ হয় তা দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তাই জেনে শুনে আমরা শয়তানের
তরিকায় চলতে পারি না। আমাদের ইসলামের কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে আমাদের আশে পাশে অনেক
বিজ্ঞ আলেম ব্যক্তি আছেন, তাদের নিকট যাবেন, বুঝে নিবেন।
Related আরো বিষয় জানতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
(১) পির-অলিদের ভ্রান্ত আক্বিদাহসমূহ।
(২) বিদআত কি? বিদআতীদের শেষ ও করুণ পরিনতি।
(৩) যিকির কি? ভন্ডামী যিকির বনাম সহিহ যিকির।সহিহ পথ কোনটি?
(৪) বাংলাদেশে প্রচলিত শির্ক বিদ‘আত ও কুসংস্কারপর্যালোচনা।
No comments:
Post a Comment