বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কুরআন তেলাওয়াতের আদব সমূহ
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এলেন। আমরা তখন কুরআন তিলাওয়াত
করছিলাম। এ পাঠের মধ্যে ’আরব অনারব সবই ছিল (যারা কুরআন পাঠে ঠিক মতো উচ্চারণ করতে
পারছিল না) তারপরও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ পড়ে যাও। প্রত্যেকেই
ভাল পড়ছো। (মনে রাখবে) অচিরেই এমন কতক দল আসবে যারা ঠিক মতো কুরআন পাঠ করবে, যেভাবে
তীর সোজা রাখা হয়। তারা (দুনিয়াতেই) তাড়াতাড়ি এর ফল চাইবে। আখিরাতের জন্য অপেক্ষা করবে
না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২০৬, সুনান আবূ দাঊদ
৮৩০, আহমাদ ১৫২৭৩, শু‘আবূল ঈমান, ২৩৯৯, সহীহাহ্ ২৫৯, সহীহ আল জামি‘ ১১৬৭)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
পরকালীন জীবনে স্থায়ী আবাস নির্ধারিত হয় ইহকালীন জীবনের ইবাদত তথা সৎ আমলের মাধ্যমে।
ইবাদতের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত অন্যতম। কুরআন তেলাওয়াতের শিষ্টাচার সম্পর্কে ইসলামে
বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে। যেগুলি পালন করলে যথাযথ ছওয়াব লাভ হয়। আর এগুলির অভাবে কোন
ক্ষেত্রে ছওয়াব বিনষ্ট হয়। নিম্নে কুরআন তেলাওয়াতের আদবগুলি উল্লেখ করা হ’ল।–
কুরআন তেলাওয়াতের আদব সমূহ
কুরআন তেলাওয়াতের আদব সমূহ দু’ভাগে ভাগ করা
যায়।
(ক) বাতেনী
বা অপ্রকাশ্য আদব ও
(খ)
যাহেরী বা প্রকাশ্য আদব।
অপ্রকাশ্য আদব বলতে যা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট
বাহ্যিকভাবে যা দেখা যায় না। প্রকাশ্য আদব বলতে বুঝায় যা বাস্তবে দেখা যায়।
(ক) বাতেনী বা অপ্রকাশ্য আদব
সমূহঃ
(১) খালেছ অন্তরে তেলাওয়াত করাঃ
কুরআন তেলাওয়াত ইবাদত। যার ভিত্তি ইখলাছের
উপরে প্রতিষ্ঠিত। ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা না থাকলে তা বাতিল হবে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন, ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া
হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। (আল-বায়্যিনাহ ৯৮/৫)।
মূলতঃ আমল বিশুদ্ধ ও কবুল হয় আমলকারীর নিয়তের
উপরে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই কর্মফল নিয়তের উপরে নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির
জন্য তাই হবে, যার সে নিয়ত করবে’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৮২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৯০৭, মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ১, সুনান আততিরমিযী ১৬৩৭, সুনান আননাসায়ী ৭৫, সুনান আবূ দাঊদ ২২০১,
সুনান ইবনু মাজাহ্ ৪২২৭, আহমাদ ১৬৯, ৩০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২) আল্লাহর কালামের যথাযোগ্য সম্মান
করাঃ
তেলাওয়াতকারী ও শ্রোতা উভয়ের চিন্তা করা উচিত
যে, এটা আল্লাহর বাণী। যা জিব্রীল (আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল করা হয়েছে।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে ছাহাবায়ে কেরাম শিখেছেন। যখন মানুষ একে আল্লাহর কালাম
হিসাবে মনে মনে ভাববে তখন তার অন্তর ভীত হবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সন্ত্রস্ত হবে। আর তার
দেহ-মনে আল্লাহর ভয়, তাঁর সম্মান ও মহত্ত্ব প্রভাব বিস্তার করবে।
(৩) মনোযোগ সহকারে তেলাওয়াত করাঃ
কুরআন তেলাওয়াতকালে মন থেকে অন্য সকল চিন্তা
দূরে রাখতে হবে। উদাসীনতা পরিহার করে তেলাওয়াত করতে হবে। ক্বারীকে চিন্তা করতে হবে
যে, সে তার প্রতিপালকের সামনে আছে এবং তাঁর বাণী তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর সাথে কথা
বলছে। আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাছিল করার চেষ্টা করবে। এতে তার
মধ্যে একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা বৃদ্ধি পাবে।
জুনদুব ইবনু ’আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মনের আকর্ষণ থাকা পর্যন্ত
কুরআন পড়বে। মনের ভাব পরিবর্তিত হলে অর্থাৎ- আগ্রহ কমে গেলে তা ছেড়ে উঠে যাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৯০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৫০৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৬৭, সহীহাহ্ ৩৯৯৩,
দারিমী ৪৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৪) আয়াত অনুধাবনের চেষ্টা করাঃ
তেলাওয়াতকৃত আয়াতের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের
চেষ্টা করা উচিত। কেননা এসব আল্লাহর নির্দেশ। যার অর্থ বুঝে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে
তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা যরূরী। আর তেলাওয়াকারীকে চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ
এ কুরআনে বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করেছেন। সেজন্য আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে
যথাযথভাবে বুঝে তা প্রতিপালন করা আবশ্যক। আর আদেশ-নিষেধ অনুধাবন করা কুরআন তেলাওয়াতের
অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি
নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’
(সুরা ছোয়াদ ৩৮/২৯)।
তিনি আরো
বলেন, ‘তবে কি তারা কুরআন গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ’? (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
(৫) আয়াতের সাথে প্রভাবিত হওয়াঃ
প্রত্যেকটি আয়াতের প্রেক্ষাপট ও সংশ্লিষ্ট
বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। সেই সাথে আল্লাহ গুণাবলী ও নামসমূহ এবং তাঁর কার্যাবলী
সম্পর্কে গবেষণা করলে তাঁর মহত্ত্ব অবহিত হওয়া যাবে। অনুরূপভাবে নবী-রাসূলগণের ঘটনাবলী
সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যে, কিভাবে তাঁদেরকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা হয়েছিল, তাঁদেরকে
কষ্ট দেওয়া হয়েছিল, মুত্তাক্বীদের কি হয়েছিল। আর এসব থেকে উপদেশ গ্রহণ করা। নবী-রাসূলগণকে
মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী ও আল্লাহর অবাধ্যদেরকে কিভাবে দুনিয়াতে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং পরকালে
তাদের জন্য কি শাস্তি রয়েছে, সে বিষয়ে চিন্তা করা।
(খ) প্রকাশ্য আদব সমূহঃ
(১) পবিত্রতা অর্জন করাঃ
পবিত্র অবস্থায় তথা ওযূ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত
করা উত্তম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ওযূ ব্যতীত আমি আল্লাহর নাম নেয়া অপছন্দ করি অথবা তিনি
বললেন, পবিত্রাবস্থায় ব্যতীত’।
মূল হাদিসঃ
মুহাজির ইবনু কুনফুয (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) তখন প্রস্রাব করছিলেন। তিনি তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু তিনি (প্রস্রাবের
পর) যে পর্যন্ত না উযূ করলেন তার সালামের কোন উত্তর দিলেন না। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজর পেশ করে বললেন, উযূ না করে আমি আল্লাহর নাম নেয়া পছন্দ করিনি
(এ কারণেই তোমার সালামের উত্তর দেইনি)। (মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ৪৬৭, সুনান আবূ দাঊদ ১৭, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ৮৩৪, সুনান আননাসাঈ ৩৮)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
আর কুরআন তেলাওয়াত যিকরের অন্তর্ভুক্ত। তবে
ওযূ ছাড়াও কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে। আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর করতেন’।
মূল হাদিসঃ
আয়িশাহ্ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাবস্থায় মহামহিয়ান আল্লাহর জিকির করতেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৭১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৭৩, সুনান আততিরমিযী ৩৩৮৪; ছহীহাহ ৪০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
তাই ওযূ ছাড়াও তেলাওয়াত করা যাবে। কিন্তু ওযূ
অবস্থায় তেলাওয়াত করা উত্তম।
(২) মিসওয়াক করাঃ
তেলাওয়াতের পূর্বে মিসওয়াক করে মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন
রাখা।
আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, তোমাদের মুখ হল কুরআনের রাস্তা। অতএব তোমরা দাঁতন করে তা পবিত্র ও সুগন্ধযুক্ত
করো। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৯১, ছহীহাহ ১২১৩)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলী (রাঃ) বলেন, ‘আমাদেরকে
মিসওয়াক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই বান্দা যখন ছালাতে দাঁড়ায়, তখন
একজন ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে থাকেন এবং নিকটবর্তী হন।
এভাবে তিনি শুনতে থাকেন এবং নিকটবর্তী হ’তে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ মুছল্লীর মুখের
উপরে রাখেন। অতঃপর যখনই সে কোন আয়াত তেলাওয়াত করে তখন তা ফেরেশতার পেটে চলে যায়’। (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৩৭; ছহীহাহ হা/১২১৩)।
অন্যত্র এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘অতএব তোমরা কুরআনের জন্য তোমাদের মুখকে পবিত্র
কর’। (ছহীহাহ হা/১২১৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/২১৫)।
(৩) ক্বিবলামুখী হওয়াঃ
তেলাওয়াতকারীর জন্য মুস্তাহাব হচ্ছে ছালাতের
বাইরে কিবলামুখী হওয়া। শিক্ষকের সামনে আদব সহকারে বসার ন্যায় বিনম্র হয়ে বসে তেলাওয়াত
করা উত্তম। তবে দাঁড়িয়ে, বসে বা কাত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করলেও তা জায়েয হবে। যেমন আল্লাহ
বলেন, দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে
স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা!
তুমি এগুলিকে অনর্থক সৃষ্টি করনি। মহা পবিত্র তুমি। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের
আযাব থেকে বাঁচাও। (সুরা আলে ইমরান ৩/১৯১)!
আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমার কোলে
হেলান দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েয অবস্থায় ছিলাম’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৪৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
২৯৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৮০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩০১, মুসান্নাফ ‘আবদুর
রাযযাক ১২৫২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৯৮, আহমাদ ২৪৮৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৪) তেলাওয়াতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ
পাঠ করাঃ
তেলাওয়াতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ পাঠ করা। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন, ‘যখন তুমি কুরআন তেলাওয়াত কর, তখন (শুরুতে) বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহর
আশ্রয় প্রার্থনা কর’। (সুরা নাহল ১৬/৯৮)।
এজন্য কোন বিদ্বান ‘আঊযুবিল্লাহ’ পাঠ করাকে
ওয়াজিব এবং জমহূর বিদ্বান মুস্তাহাব বলেছেন।
(৫) তেলাওয়াতের শুরুতে বিসমিল্লাহ
বলাঃ
তেলাওয়াতের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নাত।
শায়খ ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, ছালাতে ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পড়া, বিসমিল্লাহ ও আঊযুবিল্লাহ
বলা এবং আমীন বলা সুন্নাত। (শরহুল মুমতে‘ ৩/৩৩০ পৃঃ)।
সুতরাং বিসমিল্লাহ বলা ছালাতের মধ্যে যখন ওয়াজিব
নয়, সুন্নাত, তখন তা ছালাতের বাইরেও সুন্নাত, ওয়াজিব নয়।
শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন, সূরা ফাতিহা অথবা
অন্য সূরা তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ পড়া ছালাতের ভিতরে ও বাইরে সুন্নাত, ওয়াজিব
নয়। এটাই সঠিক কথা।
অতএব যদি কেউ তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ
ছেড়ে দেয়, তবুও তার তেলাওয়াত সিদ্ধ হবে। কিন্তু সুন্নাত পরিত্যাগ করা হবে। এজন্য তেলাওয়াতের
ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ পড়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(৬) গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহ আয়াতের
পুনরাবৃত্তিঃ
গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের
জন্য বারবার একই আয়াত তেলাওয়াত করা যায়। আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (এক
রাত্রে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাতে ভোর পর্যন্ত
দাঁড়িয়ে একটি মাত্র আয়াত পড়তে থাকলেন, আয়াতটি এই
“ইন তু’আযযিব হুম ফায়িন্নাহুম ’ইবা-দুকা ওয়া
ইন তাগফির লাহুম ফায়িন্নাকা আন্তাল ’আযীযুল হাকীম”
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! যদি তুমি তাদেরকে আযাব
দাও তাহলে তারা তোমার বান্দা। আর যদি তুমি তাদেরকে মাফ করো, তাহলে তুমি সবচেয়ে শক্তিশালী
ও প্রজ্ঞাময়”- (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫: ১১৮)। (মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ১২০৫, সুনান আননাসায়ী ১০১০, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১৩৫০)। হাদিসের মানঃ
হাসান (Hasan)।
(৭) বিনম্রভাবে তেলাওয়াত করাঃ
বিনম্রভাবে বা কান্না জড়িত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত
করা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়চিত্ততা
আরও বৃদ্ধি পায়’। (সুরা বনু ইসরাঈল ১৭/১০৯)।
মুত্বররিফ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু শিখখীর (রহঃ)
নিজের পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
নিকট আসলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি সালাত আদায়
করতেছিলেন এবং তাঁর ভিতর থেকে টগবগে আওয়াজ হচ্ছিল যেমন ডেগের ফুটন্ত পানির টগবগ আওয়াজ
হয়। অর্থাৎ তিনি কান্নাকাটি করছিলেন।
আর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাত আদায় করতে দেখছি। এমতাবস্থায় তাঁর সিনার মধ্যে চাক্কির
আওয়াজের ন্যায় কান্নার আওয়াজ থাকত। (মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ১০০০, সুনানআবূ দাঊদ ৯০৪, সুনান আননাসায়ী ১২১৪, সহীহ আত্ তারগীব ৫৪৪, আহমাদ
১৬৩১২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
(৮) রহমতের আয়াত আসলে তা চাওয়া এবং
আযাবের আয়াত আসলে তা হতে পানাহ চাওয়াঃ
কুরআন তেলাওয়াতকালে রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহর
নিকটে তাঁর রহমত প্রার্থনা করা এবং আযাবের আয়াত আসলে তা থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা
করা কর্তব্য।
হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘আমি এক রাত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে
ছালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি
একশত আয়াত পরিমাণ তেলাওয়াত করে রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন,
আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু’শত আয়াত পরিমাণ তেলাওয়াত করে রুকুতে যাবেন, কিন্তু
তিনি তেলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরা এক রাক‘আতেই
তেলাওয়াত করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং সূরা নিসা শুরু
করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন। তারপর সূরা আলে ইমরানও শুরু করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন।
তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। যদি তিনি এমন কোন আয়াত তেলাওয়াত করে ফেলতেন যাতে কোন
তাসবীহ রয়েছে তবে তাসবীহ পাঠ করতেন, যদি কোন যাঞ্ছা করার আয়াত তেলাওয়াত করতেন তখন যাঞ্ছা
করতেন। যদি কোন বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন আশ্রয়
প্রার্থনা করতেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৯৯,
আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৭২, সুনান আবূদাঊদ ৮১৫; সুনান আননাসাঈ ১৬৬৪, ইসলামী ফাউন্ডেশন
১৬৮৪, ইসলামীক সেন্টার ১৬৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
(৯) তেলাওয়াতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী
বস্ত্ত দূরে রাখাঃ
কুরআন তেলাওয়াতের সময় তেলাওয়াতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী
যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। যেমন হাসাহাসি, খেলাধূলা, হাতে অনর্থক
কাজ করা, বিনা প্রয়োজনে এদিক-সেদিক তাকানো, মোবাইল টেপা অন্যের সাথে অনর্থক কথা বলা,
তেলাওয়াতের মাঝে লোকের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে তেলাওয়াত বন্ধ করে দেওয়া এবং অযথা বিভিন্ন
বিষয়ে চিন্তা করা ইত্যাদি।
(১০) হাই তোলার সময় তেলাওয়াত বন্ধ
রাখাঃ
হাই তোলার সময়ে তেলাওয়াত বন্ধ রাখা কর্তব্য।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, ‘যখন তুমি হাই তোল তেলাওয়াত অবস্থায়, তখন তুমি ক্বিরাআত থেকে বিরত
থাক কুরআনের সম্মানে, যতক্ষণ না তোমার হাই চলে যায়’। (মুহাম্মাদ
ছাফা শায়খ ইবরাহীম হাক্বী, উলূমুল কুরআন মিন খিলালে মুক্বাদ্দামাতিত তাফাসীর, ২য় খন্ড,
(বৈরূত: মুআসসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫হিঃ/২০০৪খ্রিঃ), পৃঃ ১৯৭)।
নাফি’ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু উমার
(রাঃ) যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন কুরআন তিলাওয়াত হতে অবসর না হয়ে কোন কথা বলতেন
না। একদা আমি সূরাহ আল-বাকারাহ পাঠরত অবস্থায় তাঁকে পেলাম। পড়তে পড়তে এক স্থানে তিনি
পৌঁছলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি জান, কী ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে? আমি বললাম,
না। তিনি তখন বললেন, অমুক অমুক ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর আবার পাঠে অগ্রসর
হলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৫২৬, ৪৫২৭, আধুনিক
প্রকাশনীঃ ৪১৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪১৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(১১) সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াত করাঃ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন নবীর সুর করে কুরআন পড়াকে
আল্লাহ তা’আলা যতটা কান পেতে শোনেন আর কোন কথাকে এতো কান পেতে শোনেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৯২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০২৩, ৫০২৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭৩০,
আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯২, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৭৩, সুনান আননাসায়ী ১০১৭, আহমাদ ৭৬৭০,
দারিমী ১৫২৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৪২৮, শু‘আবূল ঈমান ১৯৫৬, সহীহ ইবনু হিব্বান
৭৫১, সহীহ আত্ তারগীব ১৪৪৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৫৪)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih।
এজন্য সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতে রাসূল
(ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বারা ইবনু
’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
‘তোমাদের মিষ্টি স্বর দিয়ে কুরআনকে সুন্দর করো।’ (মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৯৯, সুনান আবূ দাঊদ ১৪৬৮, সুনান আননাসায়ী ১০১৫, সুনান ইবনু মাজাহ
১৩৪২, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৭৩৭, আহমাদ ১৮৪৯৪, দারিমী ৩৫৪৩, মুসতাদারাক লিল হাকিম ২০৯৮,
সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২৪২৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৪৯, সহীহ আত্ তারগীব ১৪৪৯)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
তিনি আরো
বলেন, ‘তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে
সেŠন্দর্যমন্ডিত কর। কারণ সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়’। (দারিমী ৩৫৪৪; ছহীহাহ ৭৭১; ছহীহুল জামে‘ ৩১৪৫)।
সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করা কুরআনের সৌন্দর্য।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সুন্দর আওয়াজ (কণ্ঠস্বর) কুরআনের সৌন্দর্য’। (ছহীহুল জামে‘ ৩১৪৪; ছহীহাহ ১৮১৫)।
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ)
বলেন, জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের মধ্যে সুকন্ঠে কুরআন তিলাওয়াতকারী
সেই ব্যক্তি যার তিলাওয়াত শুনে তোমাদের ধারণা হয় যে, সে আল্লাহ্র ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।
(সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৩৯; ছহীহুল জামে‘ ২২০২; ছহীহ আত-তারগীব
১৪৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
উল্লেখ্য, গানের সুরে ও বাজনার তালে তালে কুরআন
তেলাওয়াত করা যাবে না।
(১২) মনের আকর্ষণ থাকা পর্যন্ত কুরআন
পড়াঃ
জুনদুব ইবনু ’আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মনের আকর্ষণ থাকা পর্যন্ত
কুরআন পড়বে। মনের ভাব পরিবর্তিত হলে অর্থাৎ- আগ্রহ কমে গেলে তা ছেড়ে উঠে যাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৯০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৫০৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৬৭, সহীহাহ্ ৩৯৯৩,
দারিমী ৪৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(১৩) কুরআন মাজীদ বারবার তিলাওয়াত
করে স্মরণ রাখতে হবেঃ
(ক) ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত
যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্তরে কুরআন গেঁথে
(মুখস্থ) রাখে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ মালিকের ন্যায়, যে উট বেঁধে রাখে। যদি সে উট বেঁধে
রাখে, তবে সে উট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু যদি সে বাঁধন খুলে দেয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৩১,
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭২৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৮৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
২১৮৯, মুয়াত্ত্বা মালিক ৬৯০, আহমাদ ৫৯২৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪০৫১, শু‘আবূল
ঈমান ১৮১০, সহীহ ইবনু হিববান ৭৬৪, সহীহাহ্ ৩৫৭৭, সহীহ আত্ তারগীব ১৪৪৫, সহীহ আল জামি‘
২৩৭২, আহমাদ ৪৬৬৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৫৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৬১)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahi।
(খ) আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, নবী
সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এটা খুবই খারাপ কথা যে, তোমাদের মধ্যে কেউ
বলবে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং,
তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করতে থাক কেননা, তা মানুষের অন্তর থেকে উটের চেয়েও দ্রুত গতিতে
চলে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৩২, ৫০৩৯;
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
২১৮৮, সুনান আততিরমিযী ২৯৪২, সুনান আননাসায়ী ৯৪৩, আহমাদ ৩৯৬০, দারিমী ২৭৮৭, মু‘জামুল
কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১০৪১৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪০৫৩, শু‘আবূল ঈমান ১৮১২,
সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৬২, সহীহ আত্ তারগীব ১৪৪৬, সহীহ আল জামি‘ ২৮৪৯, আহমাদ ৩৬২০, আধুনিক
প্রকাশনীঃ ৪৬৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(গ) আবূ
মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা
কুরআনের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। আল্লাহর কসম! যাঁর হাতে আমার জীবন! কুরআন বাঁধন ছাড়া উটের
চেয়েও দ্রুত গতিতে দৌড়ে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৫০৩৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭২৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯১, মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ২১৮৭, আহমাদ ১৯৫৬৩, ইবনু আবী শায়বাহ্
৮৫৬৯, শু‘আবূল ঈমান ১৮০৯, সহীহ আত্ তারগীব ১৪৪৭, সহীহ আল জামি‘ ২৯৫৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৬৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(১৪) তারতীল ও তাজবীদসহ তেলাওয়াত
করাঃ
ধীরে-সুস্থে কুরআন তেলাওয়াত করা। আল্লাহ বলেন,
‘আর কুরআন তেলাওয়াত করুন ধীরে-সুস্থে সুন্দরভাবে’। (সুরা মুযযাম্মিল ৭৩/৪)।
(ক)
ক্বাতাদাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-কে নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ’কিরাআত’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কোন কোন ক্ষেত্রে শব্দকে) দীর্ঘায়িত করে পাঠ করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৪৫, ৫০৪৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৬৭২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(খ) ক্বাতাদাহ
(রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনাস (রাঃ)-কে নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
’কিরাআত’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ’কিরাআত’
কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, কোন কোন ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম
দীর্ঘ করতেন। এরপর তিনি ’বিস্মিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং তিনি
বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’বিস্মিল্লাহ্’’ ’আর রহমান’, ’আর রহীম’
পড়ার সময় দীর্ঘায়িত করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৫০৪৬, ৫০৪৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১৯১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ
৪৬৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(গ) ইবনু
জুরায়জ (রহঃ) ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) হতে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ্
(রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বাক্যের মধ্যে পূর্ণ থেমে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি বলতেন, ‘আলহাম্দু
লিল্লা-হি রব্বিল ’আ-লামীন’, এরপর থামতেন। তারপর বলতেন, ’আর্ রহমা-নির রহীম’, তারপর
বিরতি দিতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২০৫, সুনান
আততিরমিযী ২৯২৭, দারাকুত্বনী ১১৯১, মুসতাদারাক লিল হাকিম ২৯১০, শামায়িল ২৭০, ইরওয়া
৩৪৩, সহীহ আল জামি ৫০০০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(১৫) বড় অপবিত্রতায় কুরআন স্পর্শ
না করাঃ
গোসল ফরয হওয়া, হায়েয, নেফাস ইত্যাদি অবস্থায়
কুরআন স্পর্শ না করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ একে স্পর্শ করেনি’।
(সুরা ওয়াকি‘আহ ৫৬/৭৯)। এখানে পবিত্রগণ বলতে ফেরেশতাদের
বুঝানো হয়েছে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ বকর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু
আমর ইবনু হাযম (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
’আমর ইবনু হাযম-এর কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতে এ কথাও লেখা ছিল যে, পবিত্র লোক ছাড়া
যেন কোন ব্যক্তি কুরআন স্পর্শ না করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ৪৬৫, মালিক ৪৬৮, দারাকুত্বনী, সহীহুল জামি ৭৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)
এখানে পবিত্র বলতে জুনুবী বা যার উপরে গোসল
ফরয এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। আর ছোট অপবিত্রতা বা ওযূ ভঙ্গ হয়ে গেলে কুরআন স্পর্শ
করা যাবে এবং দেখে তেলাওয়াত করা যাবে। (তুহফাতুল আহওয়াযী
১/৩৮৭; নায়লুল আওত্বার ১/২৫৯)।
তবে ওযূ করে তেলাওয়াত করা উত্তম।
উল্লেখ্য যে, ফরয গোসলের নাপাকীতে কুরআন আদৌ
স্পর্শ করা যাবে না। তবে মুখস্থ পড়া যাবে। তাছাড়া কুরআন মুদ্রণ, বাইন্ডিং, বহন ইত্যাদি
যরূরী কাজে নিয়োজিত মুসলিম কর্মচারীরা ওযূ ব্যতীত এটি স্পর্শ করতে পারবে। কিন্তু কাফের-মুশরিকরা
তা স্পর্শ করতে পারবে না।
(১৬) তন্দ্রা অবস্থায় তেলাওয়াত না
করাঃ
তন্দ্রাবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত না করা। রাসূল
(ছাঃ) বলেন,
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ যখন রাতে সালাতে দাঁড়ায় এবং কিরাআত পাঠে তার জিহবা
আড়ষ্ট হয়ে আসে (তন্দ্রার কারণে), সে কী বলে তা বুঝেনা, তখন সে শুয়ে পড়বে। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৭২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭২১,
আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৮৭, সুনান আবূ দাঊদ ১৩১১, আহমাদ ২৭৪৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih।
(১৭) কুরআন অনুযায়ী আমল করাঃ
কুরআন অনুযায়ী আমল করা জরুরী। রাসূল (ছাঃ)
বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা এই কিতাবের দ্বারা কতক লোককে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত
করেন এবং কতককে অবনমিত করেন’।
মূল হাদিসঃ
যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ)....আমির ইবনু ওয়াসিলাহ
(রহঃ) থেকে বর্ণিত। নাফি’ ইবনু আবদুল হারিস (রাযিঃ) উসফান নামক স্থানে উমর (রাযিঃ)
এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। উমর (রাযিঃ) তাকে মক্কায় (রাজস্ব আদায়কারী) নিয়োগ করলেন।
অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি প্রাস্তরবাসীদের জন্য কাকে কাজে নিয়োগ করেছ?
সে বলল- ইবনু আবযা-কে। উমর (রাযিঃ) বললেন, ইবনু আবযা কে? সে (নাফি’) বলল, আমাদের আযাদকৃত
ক্রীতদাসের একজন। উমর (রাযিঃ) বললেন, তুমি একজন ক্রীতদাসকে তাদের জন্য তোমার স্থলাভিষিক্ত
নিয়োগ করেছ? নাফি বললেন- সে (ক্রীতদাসটি) মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কিতাবের একজন
ভাল কারী বা আলিম। আর সে ফারায়িয শাস্ত্রেও অভিজ্ঞ। তখন উমর (রাযিঃ) বললেনঃ তোমাদের
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা এ কিতাব দ্বারা অনেক জাতিকে
মর্যাদায় উন্নীত করেন আর অন্যদের অবনত করেন। অর্থাৎ যারা এ কিতাবের অনুসারী হবে তারা
দুনিয়ায় মর্যাদাবান এবং আখিরাতে জান্নাত লাভ করবে। আর যারা একে অস্বীকার করবে তারা
দুনিয়ায় লাঞ্ছিত পরকালে জাহান্নামে পতিত হবে। (সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ১৭৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮১৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২১১৫,
সুনান ইবনু মাজাহ ২১৮, আহমাদ ২৩২, দারিমী ৩৪০৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৫১২৫,
শু‘আবূল ঈমান ২৪২৮, সহীহাহ্ ২২৩৯, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৭৬৭, ইসলামীক সেন্টার ১৭৭৪)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
অর্থাৎ যারা এর প্রতি পূর্ণাঙ্গ ঈমান আনয়ন
করতঃ তাকে সম্মান করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। (মির‘আত ৪/১৪৯৭)।
কেউ বলেন, যারা ইলম অনুযায়ী আমল করেন তাদের
মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং যারা তা করেন না, তাদেরকে অবনমিত করেন। (মির‘আত ৭/১৮০)।
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘কুরআন হলো তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষের প্রমাণ’।
মূল হাদিসঃ
আবূ মালিক আল আশ্’আরী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাক-পবিত্রতা হলো ঈমানের
অর্ধেক। ‘আলহামদু লিল্লা-হ’ মানুষের ‘আমলের পাল্লাকে ভরে দেয় এবং ‘সুবহানাল্লাহ-হি
ওয়াল হাম্দু লিল্লা-হ’ সাওয়াবে পরিপূর্ণ করে দেয় অথবা বলেছেন, আকাশমণ্ডলী ও জমিনের
মধ্যে যা কিছু আছে তা পরিপূর্ণ করে দেয়। সালাত
হলো নূর বা আলো। দান-খয়রাত (দানকারীর পক্ষে) দলীল। সবর বা ধৈর্য হলো জ্যোতি।
কুরআন হলো তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলীল। প্রত্যেক মানুষ ভোরে ঘুম হতে উঠে নিজের আত্মাকে
তাদের কাজে ক্রয়-বিক্রয় করে- হয় তাকে সে আযাদ করে দেয় অথবা জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।
আর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা¬-হু
আল্লা¬-হু আকবার’ আসমান ও জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে সব পরিপূর্ণ করে দেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৪২২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৩, আহমাদ ৫/৩৪২-৪৩, দারিমী ৬৫৩, সুনান আততিরমিযী ৩৫১৭;
সুনান ইবনু মাজাহ ২৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন, যদি তুমি
কুরআন তেলাওয়াত কর ও সে অনুযায়ী আমল কর, তাহলে তুমি উপকৃত হবে। অন্যথা কুরআন তোমার
বিপক্ষে দলীল হবে। (শরহু মুসলিম ৩/১০২)।
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) কুরআন অনুযায়ী আমল না
করলে কবরে ক্বিয়ামত অবধি শাস্তি হবে বলে উল্লেখ করেছেন।
মূল হাদিসঃ
সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (ফজর) সালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে
বসতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের কেউ গত রাতে কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? (বর্ণনাকারী) বলেন,
কেউ স্বপ্ন, দেখে থাকলে তিনি তা বিবৃত করতেন। তিনি তখন আল্লাহ্র মর্যী মুতাবিক তাবীর
বলতেন। একদা আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন, তোমাদের কেউ কি কোন স্বপ্ন দেখেছ? আমরা বললাম,
জী না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ গত রাতে আমি দেখলাম, আমরা চলতে চলতে
চিৎ হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির পাশে এসে উপস্থিত হলাম, তার মাথার নিকট পাথর হাতে এক ব্যক্তি
দাঁড়িয়ে পাথর দিয়ে তার মাথা চূর্ণ করে দিচ্ছিল। নিক্ষিপ্ত পাথর দূরে গড়িয়ে যাওয়ার ফলে
তা তুলে নিয়ে শায়িত ব্যক্তির নিকট ফিরে আসার পূর্বেই বিচূর্ণ মাথা আগের মত জোড়া লেগে
যাচ্ছিল। সে পুনরায় মাথার উপরে পাথর নিক্ষেপ করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকটি কে? তাঁরা
বললেন, চলুন।
আপনি যার মাথা চূর্ণ করতে দেখলেন, সে এমন ব্যক্তি
যাকে আল্লাহ্ কুরআনের শিক্ষা দান করেছিলেন, কিন্তু রাতের বেলায় সে কুরআন হতে বিরত হয়ে
নিদ্রা যেতো এবং দিনের বেলায় কুরআন অনুযায়ী ‘আমল করতো না। তার সাথে ক্বিয়ামাত (কিয়ামত)
পর্যন্ত এরূপই করা হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
১৩৮৬, ৮৪৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১২৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
আমল বিহীন ক্বারীর উদাহরণ পেশ করে রাসূল (ছাঃ)
বলেন,
আবূ মূসা আশ’আরী (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে, তার দৃষ্টান্ত
হচ্ছে এ লেবুর মত যা সুস্বাদু এবং সুগন্ধযুক্ত। আর যে ব্যক্তি (মু’মিন) কুরআন পাঠ করে
না, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন খেজুরের মত, যা সুগন্ধহীন, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। আর ফাসিক-ফাজির
ব্যক্তি যে কুরআন পাঠ করে, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে রায়হান জাতীয় লতার মত, যার সুগন্ধ আছে,
কিন্তু খেতে বিস্বাদ। আর ঐ ফাসিক যে কুরআন একেবারেই পাঠ করে না, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে
ঐ মাকাল ফলের মত, যা খেতেও বিস্বাদ এবং যার কোন সুগন্ধও নেই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০২০, ৫০৫৯, ৫৪২৭, ৭৫৬০, সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯৭, সুনান আততিরমিযী ২৮৬৫, সুনান
আননাসায়ী ৫০৩৮, সুনান ইবনু মাজাহ ২১৪, আহমাদ ১৯৫৪৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৭০, সহীহ আত্
তারগীব ১৪১৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(১৮) তেলাওয়াতের মাধ্যমে অন্যকে
বিরক্ত না করাঃ
উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করে অন্যকে বিরক্ত
করা উচিত নয়। অনেকে অসুস্থ থাকে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকে, শিক্ষার্থীরা
অধ্যয়নে মশগূল থাকে এবং কেউবা ছালাতে বা যিকরে রত থাকে; এমতাবস্থায় উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত
করে তাদেরকে বিরক্ত করা অদৌ উচিত নয়। রাসূল (ছাঃ)
বলেন, ‘একজনের কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ অন্যজনের
কানে যেন না পৌঁছে।
মূল হাদিসঃ
ইবনু উমার (রাঃ) এবং ’আবদুল্লাহ ইবনু আনাস
আল-বায়াযী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তারা বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়কারী সালাতরত অবস্থায় তার পরওয়ারদিগারের সাথে
একান্তে আলাপ করে। তাই তার উচিত সে কি আলাপ করে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। অতএব একজনের
কুরআন তিলাওয়াতের শব্দ অন্যজনের কানে যেন না পৌঁছে। (মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ৮৫৬, আহমাদ ৬০৯২, ১৯০৪৪, সহীহাহ্ ১০৬৩, ১৬০৩, ছহীহুল জামে ৯৫১)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
অর্থাৎ ছালাতরত ব্যক্তি, ঘুমন্ত ও অন্য কোন
তেলাওয়াতকারীকে যেন উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেওয়া না হয়।
(মিরকাত ২/৭০২ পৃঃ)।
ইবুন রজব বলেন, মসজিদে ছালাতরত অবস্থায় উচ্চৈঃস্বরে
তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরক্ত না করা। (ইবুন রজব হাম্বলী,
ফাতহুল বারী, ৩/৩৯৮ পৃঃ)।
(১৯) রুকূ-সিজদায় তেলাওয়াত না করাঃ
ছালাতের রুকূ‘-সিজদায় কুরআন তেলাওয়াত করা নিষেধ।
সাঈদ
ইবনু মানসূর, আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ), আবদুল্লাহ ইবনু
আব্বাস (রাযিঃ), হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
(মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন সময়ে) হুজরার পর্দা তুলে দিলেন। লোকেরা এ সময় আবূ বাকরের
পিছনে সালাতের কাতারে দাঁড়ানো ছিল। তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! আর নুবুওয়াতের ধারা অবশিষ্ট
থাকবে না। তবে মুসলিমরা সত্যস্বপ্ন দেখবে অথবা তাদের দেখানো হবে। সাবধান! আমাকে নিষেধ
করা হয়েছে আমি যেন রুকু বা সাজদারত অবস্থায় কুরআন পাঠ না করি। তোমরা রুকু অবস্থায়
মহান প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত বর্ণনা করবে এবং সাজদারত অবস্থায় অধিক দু’আ পড়ার
চেষ্টা করবে, কেননা তোমাদের দু'আ কবুল হওয়ার উপযোগী। হাদীসটি আবূ বকর (রহঃ) حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ سُلَيْمَانَ বলে রিওয়ায়াত করেছেন।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস একাডেমী-৯৬১, ৪৭৯), সুনান আবূ দাউদ
(তাহকিককৃত) ৮৭৬, সুনান ইবনু মাজাহ হ৩৮৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৫৬, ইসলামিক সেন্টারঃ
৯৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
আরো দেখুন,
(সহিহ মুসলিম, হাদিস একাডেমী-৯৬২,
৯৬৩, ৯৬৪, ৯৬৫, ৯৬৬, ৯৬৭, ৯৬৯ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৫৭, ৯৫৮, ৯৫৯, ৯৬০, ৯৬১, ৯৬২,
৯৬৪, ইসলামিক সেন্টারঃ ৯৬৮, ৯৬৯, ৯৭০, ৯৭১,
৯৭২, ৯৭৩, ৯৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(২০) তেলাওয়াতে কষ্ট হলে ধৈর্য ধারণ
করাঃ
কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী না হলে অনেক সময়
তেলাওয়াত করতে কষ্ট হয়। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করে তেলাওয়াত করলে দ্বিগুণ ছওয়াব পাওয়া
যায়।
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, কুরআনের হাফিয পাঠক লিপিকর সম্মানিত মালাকের
মত। খুব কষ্টদায়ক হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কুরআন মাজীদ পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার
পাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৯৩৭, সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ১৭৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৫৪,
সুনান আততিরমিযী ২৯০৪, আহমাদ ২৪৭২১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৫৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৭৩)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
(২১) তিনদিনের কমে কুরআন খতম না
করাঃ
(ক) আবদুল্লাহ্
ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে
বললেন, “এক মাসে কুরআন পাঠ সমাপ্ত কর।’’ আমি বললাম, “আমি এর চেয়ে অধিক করার শক্তি রাখি।’’
তখন নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে সাত দিনে তার পাঠ শেষ করো এবং
এর চেয়ে কম সময়ে পাঠ শেষ করো না।’’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ৫০৫৪, ১১৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৮৫)। হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
(খ) আবদুল্লাহ্ ইবনু ’আমর (রাঃ)
হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় মহিলার সঙ্গে শাদী দেন
এবং প্রায়ই তিনি আমার সম্পর্কে আমার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমার স্ত্রী বলত,
সে কতইনা ভাল মানুষ যে, সে কখনও আমার বিছানায় আসেনি এবং শাদীর পর থেকে আমার সম্পর্কে
খোঁজ খবরও নেয়নি। এ অবস্থা যখন দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলতে থাকল তখন আমার পিতা রাসূলুল্লাহ্
সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার সম্পর্কে জানালেন।
তখন নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার
পিতাকে বললেন, তাকে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করুন। এরপর আমি নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন সওম
পালন কর? আমি উত্তর দিলাম, প্রতিদিন সওম পালন করি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এ অবস্থায়
পূর্ণ কুরআন মাজীদ খতম করতে তোমার কত সময় লাগে? আমি উত্তর দিলাম, প্রত্যেক রাতেই এক
খতম করি। তিনি বললেন, প্রত্যেক মাসে তিনদিন সওম পালন করবে এবং কুরআন এক মাসে এক খতম
দেবে।’’ আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক করার সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহলে প্রতি
সপ্তাহে তিনদিন সওম পালন করবে।
আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক করার শক্তি রাখি।
তিনি বললেন, দু’দিন পর একদিন সওম পালন কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক সামর্থ্য রাখি।
তিনি বললেন, তাহলে সব চেয়ে উত্তম পদ্ধতির সওম পালন কর। তা হল, দাঊদ (আঃ)-এর সওম। তিনি
এক দিন অন্তর একদিন সওম পালন করতেন এবং তুমি প্রতি সাত দিনে একবার কুরআন খতম করো। হায়!
আমি যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেয়া সুবিধা গ্রহণ করতাম!
এখন আমি দুর্বল বৃদ্ধ হয়ে গেছি।
আবদুল্লাহ্ (রাঃ) প্রত্যেক দিন তার পরিবারের
একজন সদস্যের সামনে কুরআনের সপ্তমাংশ পাঠ করে শোনাতেন। দিবা ভাগে পাঠ করে দেখতেন, তার
স্মরণশক্তি সঠিক আছে কিনা? যা তিনি রাতে পাঠ করবেন তা যেন সহজ হয় এবং যখনই তিনি শারীরিক
শক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা করতেন তখন কয়েক দিন সওম পালন বন্ধ রাখতেন এবং পরবর্তীতে ঐ ক’দিনের
হিসাব করে সওম পালন করতেন। কেননা, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায়
যে নিয়ম পালন করতেন পরে সে নিয়ম ত্যাগ করা অপছন্দ মনে করতেন। আবূ ’আবদুল্লাহ্ বলেন
কেউ তিন দিনে, কেউ পাঁচ দিনে এবং অধিকাংশ লোক সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৫২, ১১৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৬৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(গ) আবদুল্লাহ
ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন পড়েছে, সে কুরআন বুঝেনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২০১, সুনান আততিরমিযী ২৯৪৯, সুনান
ইবনু মাজাহ ১৩৪৭, শু‘আবূল ঈমান ১৯৪১, আবূ দাঊদ ১৩৯৪, আহমাদ ৬৫৩৫, দারিমী ১৫৩৪, সহীহ
ইবনু হিব্বান ৭৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২২) সশব্দে ও নীরবে তেলাওয়াত করাঃ
কুরআন সশব্দে ও নীরবে তেলাওয়াত করা যায়। ক্বারীর
অবস্থা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও সরবে ও কখনো নীরবে পড়া উত্তম।
(ক) আবূ
হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ
তা’আলা কোন বিষয়ের প্রতি ঐরূপ কান লাগিয়ে শুনেন না যেরূপ তিনি নবীর সুমধুর তিলাওয়াত
শুনেন। রাবী বলেন, এর অর্থ সুস্পষ্ট করে আওয়াজের সঙ্গে কুরআন পাঠ করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০২৩, ৫০২৪, ৭৪৮২, ৭৫৪৪; সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯২,, আহমাদ ৭৬৭৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৬৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(খ) উকবাহ্
ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ উচ্চস্বরে কুরআন পড়া প্রকাশ্যে সদকা করার মতো। আর চুপে চুপে কুরআন পড়া চুপে
চুপে সদকা করার মতো। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২০২,
সুনান আবূ দাঊদ ১৩৩৩, সুনান আততিরমিযী ২৯১৯, সুনান আননাসায়ী ২৫৬১, আহমাদ ১৭৩৬৮, সুনানুল
কুবরা লিল বায়হাক্বী ৪৭১২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৪, সহীহ আল জামি‘ ৩১০৫)। হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, নীরবে তেলাওয়াত লৌকিকতামুক্ত।
সুতরাং যে ব্যক্তি লৌকিকতার ভয় করে তার জন্য নীরবে তেলাওয়াত করা উত্তম। আর যদি রিয়ার
আশঙ্কা না করে তাহলে সরবে তেলাওয়াত করা উত্তম। তবে শর্ত হ’ল অন্য মুছল্লী, ঘুমন্ত ব্যক্তি
কিংবা অন্য কাউকে কষ্ট দেওয়া না হয়। অন্যথা নীরবে উত্তম। আর সরবে তেলাওয়াত উত্তম হওয়ার
কারণ হ’ল এরূপ আমল সাধারণত অধিক করা হয়, এতে অন্যেরা উপকৃত হয়, শ্রবণ, শিক্ষা, অনুসরণ
করা এবং এটা দ্বীনের নিদর্শন হওয়ার কারণে। তাছাড়া এতে ক্বারীর অন্তর জাগ্রত হয়, তার
মনোযোগ এর প্রতি নিবদ্ধ হয়, এর প্রতি তার কর্ণ প্রত্যাবর্তিত হয়; এর দ্বারা ক্বারীর
ঘুম দূর হয়, তার উদ্যম বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে ঘুমন্ত ও উদাসীন ব্যক্তি জাগ্রত, সচেতন
ও উৎসাহী হয়। তাই এরূপ নিয়তে সরবে তেলাওয়াত করা উত্তম। (মির‘আত,
৭/২৮৪ পৃঃ)।
(২৩) তেলাওয়াতের সিজদা দেওয়াঃ
তেলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত আসলে সিজদা করা
সুন্নাত। এই সিজদা করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই।
আল-হাসান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু উবাঈদুল্লাহ
ইবনু আবূ ইয়াযীদ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু জুরাইজ (রহ) আমাকে বললেন, হে হাসান!
তোমার দাদা উবাঈদুল্লাহ ইবনু আবূ ইয়াযীদ (রহ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর সূত্রে আমাকে অবহিত
করেন যে, ইবনু আব্বাস(রাঃ) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছিলাম।
তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, আমি গতরাতে স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি একটি
গাছের গোড়ায় সালাত (নামায/নামাজ) পড়ছি এবং তাতে আমি সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করছি।
আমি সিজদা করলাম এবং গাছটিও আমার অনুরূপ সিজদা
করলো। আমি গাছটিকে বলতে শুনলাম, হে আল্লাহ্! এই সিজদার দ্বারা আমার গুনাহ অপসারিত করুন,
আমার জন্য পুরস্কার নির্ধাণে করুন এবং এটাকে আপনার নিকট সঞ্চয় হিসাবে জমা রাখুন। ইবনু
আব্বাস(রাঃ) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিজদার আয়াত তিলাওয়াত
করার পর সিজদা দিতে দেখেছি এবং তাঁকে তাঁর সিজদায় সেই দুআ করতে শুনলাম, গাছটির যে দুআ
ঐ ব্যক্তি তাঁকে অবহিত করেছিল। (সুনান ইবনু মাজাহ ১০৫৩,
সুনান আততিরমিযী ৫৭৯, ৩৪২৪, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১০৩৬, সহীহাহ ২৭১০)। হাদিসের
মানঃ হাসান (Hasan)।
উল্লেখ্য, এই সিজদায় ওযূ বা ক্বিবলা শর্ত নয়।
সিজদা মাত্র একটি হবে। এতে তাশাহ্হুদ নেই, সালামও নেই। (ফিক্বহুস
সুন্নাহ ১/১৬৪)।
(২৪) দীর্ঘ সময় নিয়ে কুরআন খতম না
করাঃ
অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম না করে সাধ্যমত কম
সময়ে কুরআন খতম করা উচিত।
(ক)
আবদুল্লাহ্ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আমাকে বললেন, “এক মাসে কুরআন পাঠ সমাপ্ত কর।’’ আমি বললাম, “আমি এর চেয়ে অধিক করার শক্তি
রাখি।’’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে সাত দিনে তার পাঠ শেষ
করো এবং এর চেয়ে কম সময়ে পাঠ শেষ করো না।’’ (সহীহ বুখারী
(তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৫৪, ১১৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৮৫)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(খ) আবদুল্লাহ্
ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় মহিলার
সঙ্গে শাদী দেন এবং প্রায়ই তিনি আমার সম্পর্কে আমার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন।
আমার স্ত্রী বলত, সে কতইনা ভাল মানুষ যে, সে কখনও আমার বিছানায় আসেনি এবং শাদীর পর
থেকে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবরও নেয়নি। এ অবস্থা যখন দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলতে থাকল তখন
আমার পিতা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার সম্পর্কে জানালেন।
তখন নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার
পিতাকে বললেন, তাকে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করুন। এরপর আমি নবী সাল্লাল্লাহু
’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন সওম
পালন কর? আমি উত্তর দিলাম, প্রতিদিন সওম পালন করি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এ অবস্থায়
পূর্ণ কুরআন মাজীদ খতম করতে তোমার কত সময় লাগে? আমি উত্তর দিলাম, প্রত্যেক রাতেই এক
খতম করি। তিনি বললেন, প্রত্যেক মাসে তিনদিন সওম পালন করবে এবং কুরআন এক মাসে এক খতম
দেবে।’’ আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক করার সামর্থ্য রাখি। তিনি বললেন, তাহলে প্রতি
সপ্তাহে তিনদিন সওম পালন করবে।
আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক করার শক্তি রাখি।
তিনি বললেন, দু’দিন পর একদিন সওম পালন কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে অধিক সামর্থ্য রাখি।
তিনি বললেন, তাহলে সব চেয়ে উত্তম পদ্ধতির সওম পালন কর। তা হল, দাঊদ (আঃ)-এর সওম। তিনি
এক দিন অন্তর একদিন সওম পালন করতেন এবং তুমি প্রতি সাত দিনে একবার কুরআন খতম করো। হায়!
আমি যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেয়া সুবিধা গ্রহণ করতাম!
এখন আমি দুর্বল বৃদ্ধ হয়ে গেছি।
আবদুল্লাহ্ (রাঃ) প্রত্যেক দিন তার পরিবারের
একজন সদস্যের সামনে কুরআনের সপ্তমাংশ পাঠ করে শোনাতেন। দিবা ভাগে পাঠ করে দেখতেন, তার
স্মরণশক্তি সঠিক আছে কিনা? যা তিনি রাতে পাঠ করবেন তা যেন সহজ হয় এবং যখনই তিনি শারীরিক
শক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা করতেন তখন কয়েক দিন সওম পালন বন্ধ রাখতেন এবং পরবর্তীতে ঐ ক’দিনের
হিসাব করে সওম পালন করতেন। কেননা, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায়
যে নিয়ম পালন করতেন পরে সে নিয়ম ত্যাগ করা অপছন্দ মনে করতেন। আবূ ’আবদুল্লাহ্ বলেন
কেউ তিন দিনে, কেউ পাঁচ দিনে এবং অধিকাংশ লোক সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৫২, ১১৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ
৪৬৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(গ) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিন দিনের
কমে কুরআন পড়েছে, সে কুরআন বুঝেনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ২২০১, সুনান আততিরমিযী ২৯৪৯, সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৪৭, শু‘আবূল ঈমান ১৯৪১, আবূ
দাঊদ ১৩৯৪, আহমাদ ৬৫৩৫, দারিমী ১৫৩৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(ঘ)
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, তাকে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি চল্লিশ
দিনে কুরআন পাঠ (শেষ) করবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
২৯৪৭, সুনান আবূ দাউদ ১২৬১, সহীহাহ ১৫১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২৫) ক্বিরাআতে পারদর্শী না হলে
আলেমদের নিকটে পেশ করাঃ
কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী না হ’লে যারা তেলাওয়াতে
দক্ষ তাদের নিকটে পেশ করা এবং ভুল-ত্রুটি থাকলে সংশোধন করে নেওয়া কর্তব্য। যেমন রাসূল
(ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বিশেষ ব্যক্তিদের নিকট থেকে কুরআন শেখার নির্দেশ দেন।
মাসরূক (রহ.) হতে বর্ণিত যে, ‘আবদুল্লাহ ইবনু
আমর (রাঃ)-এর মজলিসে ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর আলোচনা হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন;
তিনি সে ব্যক্তি যাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য শুনার পর হতে
আমি খুব ভালবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআন শিক্ষা কর চারজনের
নিকট থেকে, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (সর্ব প্রথম তিনি এ নামটি বললেন), সালিম- আবূ হুযাইফার
আযাদকৃত গোলাম, মু‘আয ইবনু জাবাল ও উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৮০৮, ৩৭৫৮, ৪৯৯৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৬২২৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৬৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৩৩,
আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
কারণ তারা রাসূলের যুগে কুরআন সংরক্ষণ করেছিলেন।
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর যুগে (সর্বপ্রথম) যে চার ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুরআন হিফয করেছিলেন, তাঁরা
সকলেই ছিলেন আনসারী। (তাঁরা হলেন) উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) আবূ
যায়দ (রাঃ) ও যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ)। কাতাদাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস
করলাম, আবূ যায়দ কে? তিনি বললেন, তিনি আমার চাচাদের একজন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৮১০, ৩৯৯৬, ৫০০৩, ৫০০৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস
একাডেমী) ৬২৩৪-৬২৩৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৬৫, আহমাদ ১৩৯৪৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৫২৮,
ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
অস্পষ্ট আয়াতের অর্থের অনুসরণ করা নিষেধ।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ)
....আয়িশাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
তিলাওয়াত করলেনঃ “তিনিই তোমার প্রতি এ কিতাবকে অবতীর্ণ করেছেন, যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট
মজবুত সাংবিধানিক; এগুলো কিতাবের মূলনীতি আর অন্যগুলো অস্পষ্ট। যাদের হৃদয়ে বক্রতা
রয়েছে, শুধু তারাই ফিতনাহ এবং ভুল ব্যাখ্যার জন্য যা অস্পষ্টতার অনুকরণ করে। মূলতঃ
আল্লাহ ভিন্ন অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না; আর যারা ইলমে সুগভীর তারা বলে, আমরা এতে
বিশ্বাস করি, সবই আমাদের রবের নিকট থেকে সত্য এবং বুদ্ধিমান ছাড়া আর কেউ উপদেশ গ্রহণ
করে না”— (সূরা আ-লি ইমরান ৩ঃ ৭)। তিনি (আয়িশাহ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা সেসব লোকদের দেখতে পাবে যারা অস্পষ্ট আয়াতের অর্থের অনুসরণ
করে, এরাই সে সব ব্যক্তি, যাদের কথা আল্লাহ আলোচনা করেছেন, সুতরাং তোমরা তাদের থেকে
সতর্ক থাক। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৬৮, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ২৬৬৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৩৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
(২৬) আয়াতের মাঝে তেলাওয়াত বন্ধ
করে না দেওয়াঃ
কুরআন তেলাওয়াতকালে আয়াতের মাঝে তেলাওয়াত বন্ধ
করে দেওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহর কালামের উপরে অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।
নাফে‘
(রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
নাফি (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু ’উমার
(রাঃ) যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন কুরআন তিলাওয়াত হতে অবসর না হয়ে কোন কথা বলতেন
না। একদা আমি সূরাহ আল-বাকারাহ পাঠরত অবস্থায় তাঁকে পেলাম। পড়তে পড়তে এক স্থানে তিনি
পৌঁছলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি জান, কী ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে? আমি বললাম,
না। তিনি তখন বললেন, অমুক অমুক ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর আবার পাঠে অগ্রসর
হলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৫২৬, ৪৫২৭, আধুনিক
প্রকাশনীঃ ৪১৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪১৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২৭) কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত না
হওয়াঃ
কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন নিয়ে বিতর্ক করা
কুফরী’। (ছহীহুল জামে‘ হা/৩১০৬)।
তিনি আরো বলেন, ‘পূর্ববর্তী সকল উম্মতই ধ্বংস
হয়েছে যখনই তারা এ ধরনের কাজে জড়িত হয়েছে। তারা কুরআন নিয়ে একে অপরের সাথে বিতর্কে
লিপ্ত হয়েছে। এতে হালাল করা হয়েছে, তাকে হালাল গণ্য কর এবং এতে যা হারাম করা হয়েছে
তাকে হারাম গণ্য কর। আর যা সন্দেহপূর্ণ বা দ্ব্যর্থবোধক তার প্রতি ঈমান রাখ’। (ছহীহুল জামে‘ হা/১৩২২)।
অতএব কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত আদব
বা শিষ্টাচার সমূহ মেনে চলা যরূরী। এর ফলে অশেষ ছওয়াব হাছিল হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে
জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং কুরআন তেলাওয়াত সহ ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফীক্ব
দান করুন-আমীন!
(সমাপ্ত)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক
ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, গুলশান-২,ঢাকা, বাংলাদেশ।
লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন
------------------------------
Please Share On
No comments:
Post a Comment