Search This Blog

Wednesday, December 16, 2020

কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-১১)

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর

(পর্ব-১১)

(এই পর্বে সাম্প্রতিক উত্থাপিত ২৪১টি প্রশ্নোত্তর সংযোজন করা হয়েছে)

(July-December-2020)

প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন (১) : ধর্ষণের বিচার চেয়ে নারীরা যে রাস্তায় নামছে, এটা কি ইসলামে জায়েজ আছে?

উত্তর:

উত্তর দেয়ার পূর্বে বলতে চাই, আমি জানি, যদিও এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা নারীবাদী, সেক্যুলার ও তথাকথিত বিকৃত গণতন্ত্র পূজারীদের ভালো লাগবে না তবুও ইসলাম ও বাস্তবতার আলোকে সত্য কথা তুলে ধরা আবশ্যক মনে করি।

যাহোক, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের জন্য দীন, চরিত্র ও সম্ভ্রম রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত ও নিরাপদ পন্থা হল, বাড়িতে অবস্থান করা এবং বাইরে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা না করা। যেমনটি মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

 “আর তোমরা (নারীরা) তোমাদের ঘরে অবস্থান করবে; মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।” (সূরা আহযাব: ৩৩)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

“হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও বিশ্বাসীদের রমণীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের (মুখমণ্ডলের) উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে; ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।” (সূরা আহযাব: ৫৯)

উক্ত আয়াতে جَلاَبِيْبُ শব্দটি جِلْبَ এর বহুবচন। তা এমন বড় চাদরকে বলা হয়, যাতে পুরো শরীর ঢেকে যায়।

আর নিজের উপর চাদর টেনে নেওয়ার অর্থ: চেহারার উপর এমন ভাবে ঘোমটা নেওয়া যাতে চেহারার অধিকাংশ ঢেকে যায় এবং চক্ষু নিচু করে চলাতে রাস্তাও দেখা যায়।

এটা পর্দার হিকমত, যৌক্তিকতা ও উপকারিতার বর্ণনা যে, তার দ্বারা একজন ভদ্র ও লজ্জাশীলা মহিলা এবং নির্লজ্জ ও অসতী মহিলার পরিচয় লাভ হয়। পর্দা করা দেখে বোঝা যাবে যে, এটা ভাল ঘরের মহিলা; যাকে টিপ্পনী কাটার ক্ষমতা কারোর হবে না। আর তার বিপরীত বেপর্দা মহিলা লম্পটদের চোখের তৃপ্তিকর খোরাক এবং কামুক যুবকদের যৌন বাসনার কেন্দ্রস্থল। [তাফসিরে আহসানুল বায়ান]

তবে ইসলামে নারীদেরকে জীবনের একান্ত জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয় কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে। যেমন:

 ১. বাইরে বের হওয়ার সময় পূর্ণ হিজাব পরিধান করা এবং নিজেকে ফেতনা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা।

 ২) নিজের শরীর, পোশাক ও সাজ-সজ্জার সৌন্দর্য পর পুরুষের সামনে প্রকাশ না করা।

 ৩. বাইরে যাওয়ার সময় আতর-সুগন্ধি ব্যবহার না করা।

 ৪) পরপুরুষের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা এবং তাদের সাথে বিনা দরকারে কথা না বলা।

 ৫) স্বামী বা মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ছাড়া দূরে কোথাও না যাওয়া।

 ৬) কোন পরপুরুষের সাথে লোকচক্ষুর আড়ালে না যাওয়া।

 ৭) সার্বিক নিরাপত্তা থাকা ইত্যাদি।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ইত্যাদির নামে আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক-যুবতিরা একাকার হয়ে, নারী-পুরুষ একসাথে হৈহুল্লোড় ও ঘেঁষাঘেঁষি করে, পর্দা ও লজ্জাশীলতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাস্তায় মিছিল-মিটিং করছে, শ্লোগান দিচ্ছে এবং পুলিশ বাহিনীর সাথে হাতাহাতি, ধ্বস্তাধ্বস্তি ও মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে।

মারামারি ও দৌড়াদৌড়ির সময় তারা পরপুরুষদের সামনে অনাবৃত হচ্ছে এবং মিডিয়ার সামনে তাদের ইজ্জত-সম্মান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অনেক সময় সুযোগ সন্ধানী ধর্ষক ও লম্পট পুরুষরা এসব পরিস্থিতিতেও নানা অনৈতিক কাজের সুযোগ নিচ্ছে এবং সুযোগ পেলেই তাদের শ্লীলতাহানী ঘটাতেও ত্রুটি করছে না। অর্থাৎ ধর্ষণের বিচার চাইতে এসে আবারও ধর্ষণের শিকার! এই হল বাস্তব পরিস্থিতি।

সুতরাং এমন ফিতনা বিক্ষুব্ধ ও অনিরাপদ পরিস্থিতিতে এসব মিছিল-মিটিং এ নারীদের অংশ গ্রহণ ইসলামের দৃষ্টিতে কিভাবে গ্রহনযোগ্য হতে পারে? আল্লাহ ক্ষমা করুন।

লজ্জাজনক ব্যাপার হল, এ সকল প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশে একশ্রেণীর নারীর উদ্ভট ও নোংরা পোশাক, নির্লজ্জ আচরণ ও কার্যক্রম দেখে মনে হয় এরা ধর্ষণ বন্ধ নয় বরং ধর্ষণকে উশকে দেয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছে। আরও দেখা যাচ্ছে, এ সব আন্দোলনের নামে তথাকথিত গার্ল ফ্রেন্ড ও বয় ফ্রেন্ডরা অবাধে রাত-দিন যখন যেখানে মনে চাচ্ছে তখন সেখানে ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করছে।

হয়ত আমাদের এ সকল আল্লাহর নাফরমানি মূলক কার্যক্রমই আল্লাহর গজব হিসেবে ধর্ষণ রূপী মহামারী নেমে আসার অন্যতম কারণ।

আমরা মনে করি, ধর্ষণের বহু কারণ আছে। তন্মধ্যে অন্যতম হল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ ইসলামের বিধিবিধান ও অনুশাসন থেকে দুরে সরে যাওয়া, আল্লাহর ভয় ও দ্বীনদারিকে অবজ্ঞা করা, বিশেষ করে ইসলাম নারীদের প্রতি যে সকল নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো অনুসরণ না করা। আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন করার কারণে নারীরা পদেপদে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ইজ্জত হারা হচ্ছে এবং ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটি আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে যাওয়ার অন্যতম একটি ফল।

সুতরাং আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন করে, পর্দাকে জলাঞ্জলি দিয়ে যতই মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, বিক্ষোভ করা হোক না কেন কখনোই ধর্ষণ বন্ধ হবে না।

শুধু আইন করেও ধর্ষণ ঠেকানো যাবে না। যদি তাই হত, তাহলে আমেরিকার মত দেশ পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ধর্ষক দেশে পরিণত হতো না বা বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলো নারী ধর্ষণে শীর্ষে অবস্থান করতো না।

বরং ধর্ষণ থেকে বাঁচতে করণীয় হল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ মহান আল্লাহর পথে ফিরে আসা, পাপাচার ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে আল্লাহর নিকট তওবা করা, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণ করা এবং ধর্ষণ, অন্যায়-অকর্ম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা। এর পাশাপাশি যার যার অবস্থান থেকে যথাসাধ্য ধর্ষণ বিরোধী ও সচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালানো, নেটে লিখালিখি করা, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানানো এবং আইনগত ভাবে ও শরিয়ত সম্মত উপায়ে প্রতিবাদ জানানোর জন্য অন্যান্য যে সকল পন্থা আছে সেগুলো প্রয়োগ করা। সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহ শিক্ষা নিষিদ্ধ, কর্ম ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ, জিনা-ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের আইন বাস্তবায়ন সহ ধর্ষণের সকল কারণ চিহ্নিত করে সেগুলোর ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী-দাওয়া তুলে ধরা।

তাহলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই প্রতিশ্রুত নিরাপত্তা দান করবেন, নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষা পাবে এবং সর্বোপরি দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন (২) : আমি অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী ছিলাম। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে বর্তমানে বড় আকারে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমি কি যাকাতের হকদার হব? যদি হই তবে যাকাতের টাকা দিয়ে সরাসরি ঋণ পরিশোধ না করে তা দিয়ে ব্যবসা করে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করা যাবে কি?

উত্তর : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যাকাতের হকদার (তওবা ৯/৬০)। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি হ’ল ঐ ব্যক্তি, যার জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে। তবে এমন অতিরিক্ত সম্পদ নেই যা দ্বারা সে ঋণ পরিশোধ করতে পারে (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩৯২; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ২৩/৩২১)। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যাকাত গ্রহণের পর তার সর্বপ্রথম কর্তব্য হ’ল ঋণ পরিশোধ করা। কেননা যেকোন সময় তার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। এমনকি কতিপয় বিদ্বান অভাবী ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যেন ঋণ ব্যতীত অন্য খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় না করে, সেজন্য ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সরাসরি যাকাত না দিয়ে তাকে জানিয়ে সরাসরি ঋণদাতাকে প্রদান করার কথা বলেছেন (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ৩১/১২৫)। সুতরাং উক্ত অর্থ দিয়ে ব্যবসা করা যাবে না, যদিও তা ঋণ পরিশোধের নিয়তে হয়। তাছাড়া ব্যবসায় ক্ষতিরও সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে অপাত্রে যাকাতের অর্থ নিঃশেষ হ’লে সে পাপী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৯/৪০৩-৪০৪; উছায়মীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ)।

প্রশ্ন (৩) : করোনার কারণে ময়দানে বা মসজিদে ঈদের ছালাত আদায় করা না গেলে বাড়িতে একাকী বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তা আদায় করা যাবে কি?

উত্তর : বিশেষ কারণবশতঃ বাড়িতে একাকী বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অতিরিক্ত ১২ তাকবীরসহ ঈদের ছালাত আদায় করা যাবে (বুখারী ‘ঈদায়নের ছালাত’ অধ্যায়-১৩, ২৫ অনুচ্ছেদ)। তবে একাকী ছালাতে খুৎবা দিবে না। আর জামা‘আতের সাথে আদায় করলে এবং খুৎবা দেওয়ার উপযুক্ত কেউ থাকলে তিনি খুৎবা দিবেন। কারণ ঈদের ছালাতে খুৎবা দেওয়া ও শোনা সুন্নাত, যদিও জুম‘আতে খুৎবা দেওয়া ও শোনা ওয়াজিব। তবে যদি কেউ আদায় করতে না পারে তবে ক্বাযা করতে হবে না। কেননা এটি ফরযে কেফায়াহ (ইবনু কুদামা, মুগনী ২/২৮৯; মুগনিউল মুহতাজ ১/৫৮৯; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ২০৫ পৃ.)।

প্রশ্ন (৪) : রাসূল (ছাঃ) কুষ্ঠ রোগীর হাত ধরে একত্রে খেয়েছেন মর্মে কোন হাদীছ আছে কি? সেটা ছহীহ হ’লে অন্যান্য হাদীছের সাথে এর সমন্বয় কি হবে?

উত্তর : উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ। আর তা হ’ল- জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একজন কুষ্ঠ রোগীর হাত ধরে তাকে নিজের সাথে একই পাত্রে খাওয়াতে বসান। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহর নামে এবং (সব ব্যাপারে) তাঁর উপর আস্থা ও ভরসা সহকারে খাও (তিরমিযী হা/১৮১৭; আবূদাউদ হা/৩৯২৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৪২; মিশকাত হা/৪৫৮৫)। উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটিকে ইমাম তিরমিযী, আলবানী, আরনাউত্বসহ সকল মুহাক্কিক যঈফ বলেছেন (যঈফাহ হা/১১৪৪; যঈফুল জামে‘ হা/৪১৯৫)। তাছাড়া এটি সরাসরি ছহীহ হাদীছের বিরোধী। কারণ রাসূল বলেন, ‘তোমরা কুষ্ঠরোগী হ’তে এমনভাবে পলায়ন কর, যেভাবে তোমরা সিংহ থেকে পলায়ন কর’ (বুখারী হা/৫৭০৭; মিশকাত হা/৪৫৭৭)। রাসূল (ছাঃ) একবার ছাক্বীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের সাথে জনৈক কুষ্ঠ রোগীর হাতে হাত রেখে বায়‘আত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বরং তিনি লোক পাঠিয়ে বলে দেন, আমরা তোমার বায়‘আত নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও’ (মুসলিম হা/২২৩১; মিশকাত হা/৪৫৮১)। অতএব উক্ত যঈফ হাদীছের আলোকে ছোঁয়াচে রোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বরং ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব রয়েছে; তবে সেটি কেবল আল্লাহর হুকুমেই সংক্রমিত হয়। এটাই হ’ল সঠিক আক্বীদা। সুতরাং যথাযথভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং করোনা আক্রান্তদের পাশে সাধ্যমত দাঁড়াতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার রবের প্রতি বিনয়ী হয়ে ও দৃঢ় ঈমান রেখে বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াও (ছহীহাহ হা/২৮৭৭)।

প্রশ্ন (৫) : ফরয গোসলের সঠিক নিয়ম না মেনে কেবল তিনবার পুরো শরীর ধৌত করলে কি গোসলের ফরযিয়াত আদায় হয়ে যাবে?

উত্তর : পবিত্রতা অর্জনের নিয়তে পুরো দেহ পানি দ্বারা ধৌত করলেও গোসলের ফরযিয়াত আদায় হয়ে যাবে (ঊছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/২২৫; আশ-শারহুল মুমতে‘ ১/৩৬২)। আল্লাহ বলেন, আর যদি তোমরা নাপাক হয়ে যাও, তাহ’লে গোসল কর (মায়েদাহ ৫/৬)। তবে সেক্ষেত্রে নিয়ত করা ফরয। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সকল সৎকর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল (বুখারী হা/১)।

প্রশ্ন (৬) : মৃতব্যক্তির কবরে কয়েকজন মিলে হাত তুলে দো‘আ করা যাবে কি?

উত্তর : মৃতব্যক্তির দাফনের পর কবরস্থানে দাঁড়িয়ে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দো‘আ করার কোন দলীল নেই। অতএব এরূপ আমল বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত (বিন বায, ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব ১৪/১৩৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/২০৪, ১৩/৩৪০; উছায়মীন, ফাতাওয়াল জানায়েয ২৬৬ পৃ.)। সম্মিলিতভাবে মৃত ব্যক্তির জন্য দো‘আ করার জন্য জানাযা ব্যতীত অন্য কোন অনুষ্ঠান নেই। যেহেতু মৃতব্যক্তির কবরে গিয়ে সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দো‘আ করা হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেহেতু মৃতব্যক্তির মাগফেরাতের জন্য সকলে পৃথক পৃথক ভাবে দো‘আ করতে হবে।

প্রশ্ন (৭) : সালাম ফিরানোর পর ইমাম বা মুক্তাদী কোন দো‘আ না পড়েই কি উঠে যেতে পারবে?

উত্তর : সালাম ফিরানোর পর ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য মুছাল্লায় বসে দো‘আ ও যিকির করা সুন্নাত। কারণ এ সময়ে ফেরেশতাগণ দো‘আ পাঠরত মুছল্লীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, মুছল্লী ছালাত শেষে যতক্ষণ স্বীয় স্থানে বসে তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করে, ততক্ষণ ফেরেশতামন্ডলী তার জন্য দো‘আ করতে থাকে এই মর্মে যে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা কর ও তার উপর রহম কর (বুখারী হা/৪৪৫, মুসলিম হা/৬৪৯; মিশকাত হা/৭০২)। তবে কেউ যদি ওযরের কারণে যিকির-আযকার সংক্ষিপ্ত করতে চায় তবে কমপক্ষে তিনি ‘আল্ল-হুম্মা আনতাস সালা-মু ওয়া মিনকাস সালা-মু, তাবা-রক্তা ইয়া যাল জালা-লি ওয়াল ইকরা-ম’ বলে উঠে যাবেন (বুখারী হা/৮৪৯; মুসলিম হা/৫৯২; মিশকাত হা/৯৬০)।

প্রশ্ন (৮) : আমার এক বোন নাবালেগ অবস্থা থেকেই ধর্মান্তরিত হিন্দু। কিন্তু আমি ও আমার পিতা জন্মগতভাবে মুসলিম। কিছুদিন পূর্বে পিতা মারা গেছেন। এক্ষণে আমার বোন কি পিতার সম্পদের অংশ পাবে? তার সাথে আমার কেমন ব্যবহার করা উচিৎ?

উত্তর : উক্ত বোন পিতার সম্পদে ওয়ারিছ হবে না। কারণ সে এখন অমুসলিম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, মুসলিম কোন কাফেরের ওয়ারেছ হবে না এবং কাফের কোন মুসলিমের ওয়ারেছ হবে না’ (বুখারী হা/৬৭৬৮; মুসলিম হা/১৬১৪; মিশকাত হা/৩০৪৩)। তবে যেহেতু উক্ত বোন নাবালক অবস্থায় হিন্দু হয়েছে সেহেতু তাকে বুঝিয়ে ইসলামের দিকে আহবান করতে হবে। বিভিন্ন উপায়ে বা সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে (তওবাহ ৯/৬০)। তাছাড়া বোন হিসাবে তার সাথে সর্বদা সদাচরণ করবে (মুমতাহিনা ৮)।

প্রশ্ন (৯) : পুরুষের জন্য নারীদের মত নকশাদার চাদর পরিধান করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : পুরুষেরা নারীদের মত এবং নারীরা পুরুষদের মত পোষাক পরবে না। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা পুরুষের সাথে মহিলার এবং মহিলার সাথে পুরুষের সাদৃশ্য পোষণকারীকে অভিসম্পাত করেছেন’ (বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৯)। তবে সাধারণভাবে নকশাদার পোষাক পরা যাবে। পুরুষদের জন্য নকশাদার চাদর পরিধান দোষের নয়। কারণ নকশা সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত, যা গ্রহণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর (আ‘রাফ ৭/৩১)। তবে তাতে যেন বাহুল্য না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়া ছালাতের সময় অধিক নকশাদার, ছবিযুক্ত বা লেখাযুক্ত পোষাক পরা যাবে না, যা মুছল্লীর মনোযোগ বিঘ্নিত করে (বুখারী হা/৩৭৩; মিশকাত হা/৭৫৭)। উল্লেখ্য যে, নকশা যদি রেশমের সুতার হয়, তবে তা সামান্য অংশ বা চার আঙ্গুলের বেশী জায়গায় হওয়া যাবে না (মুসলিম হা/২০৬৯; মিশকাত হা/৪৩২৪, নববী, শরহ মুসলিম উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।

প্রশ্ন (১০) : সকল মানুষকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য ঐক্যবদ্ধ করা অথবা নিজেকে সংশোধন করা কোনটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর : নিজেকে সংশোধন করা, দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া এবং দ্বীনকে শক্তিশালী করার জন্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা কোনটির গুরুত্বই কম নয়। তবে প্রত্যেক আদম সন্তানের প্রাথমিক ও মৌলিক দায়িত্ব হ’ল নিজের আমল সংশোধন করাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয়ই সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে পরিশুদ্ধ হয় (আ‘লা ৮৭/১৪)। যারা নিজেদের সংশোধন না করে মানুষকে দাওয়াত দেয় তাদের পরিণতি বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না? আল্লাহর নিকটে বড় ক্রোধের বিষয় এই যে, তোমরা বল এমন কথা যা তোমরা কর না? (ছফ  ৬১/২-৩)। সুতরাং প্রথমে নিজেকে সংশোধন করতে হবে এবং অপরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। অতঃপর দ্বীনকে শক্তিশালী করার জন্য এবং দ্বীনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য হকপন্থী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগন! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষা কর’ (তাহরীম ৬৬/৬)। তিনি তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘তুমি বল, এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে’ (ইউসুফ ১২/১০৮)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে লড়াই করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)।

প্রশ্ন (১১) : বর্তমানে মোবাইল সাধারণত মন্দ কাজেই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষণে মোবাইল পণ্য ব্যবসা ও মোবাইল সার্ভিসিং পেশা হিসাবে হালাল হবে কি?

উত্তর : উক্ত পেশা হালাল। কারণ এই পণ্যগুলো মৌলিকভাবে হালাল। এগুলোর ভালো-মন্দ নির্ভর করে ব্যবহারকারীর তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির উপর। এক্ষণে ব্যবহারকারীগণ যদি অন্যায় কাজে ব্যবহার করেন তবে পাপ তাদের উপরেই বর্তাবে, বিক্রেতার উপর নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না’ (আন‘আম ৬/১৬৪)।

প্রশ্ন (১২) : আমাদের মসজিদের ইমাম আহলেহাদীছ হওয়ায় মুনাজাত করতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি চাকুরীচ্যুত হন। কিন্তু মসজিদের জমিটি ইমামের বড় ভাই ও অন্য একজনের ব্যক্তি মালিকানাধীন। এক্ষণে মসজিদ কমিটি জমিটি মসজিদের নামে লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু পরিবারের আশংকা জমি লিখে দিলে তাদেরকে সেখানে আর ছালাতই আদায় করতে দেয়া হবে না। এক্ষণে তাদের করণীয় কি?

উত্তর : মসজিদের জন্য দানকৃত জমি মসজিদকে দিয়ে দিতে হবে। কারণ দানকৃত জিনিস ফেরৎ নেয়া যায় না (বুখারী হা/২৬২১; মিশকাত হা/৩০১৮)। তবে লিখিত দলীল করার সময় শিরক ও বিদ‘আত পরিত্যাগের কঠোর শর্ত উল্লেখ পূর্বক দান করা যেতে পারে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য বিদ‘আত দূরীকরণেও সহায়ক হবে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ৬/৩৬০)। উল্লেখ্য যে, ফরয ছালাতান্তে দলবদ্ধ মুনাজাত এবং ফরয ছালাত শেষে সালাম ফিরানোর পরে ইমামের সরবে দো‘আ পাঠ ও মুক্তাদীদের সরবে ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলার প্রচলিত প্রথাটি দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম হ’তে এর পক্ষে ছহীহ বা যঈফ সনদে কোন দলীল নেই (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২২/৫১৯)।

প্রশ্ন (১৩) : জনৈক আলেম লিখেছেন কোন বিষয়ে ছহীহ হাদীছ পাওয়া গেলে এবং তা কোন হাসান হাদীছের বিপরীত হ’লে হাসান হাদীছ আমলযোগ্য হবে না। একথা সঠিক কি?

উত্তর : ছহীহ ও হাসান সনদে বর্ণিত হাদীছদ্বয় পরস্পর বিরোধী হ’লে সমন্বয় সাধন করতে হবে। যদি সমন্বয় করা সম্ভব না হয় তাহ’লে ছহীহ সনদে বর্ণিত হাদীছকে প্রাধান্য দিতে হবে (নববী, আত-তাকরীব ওয়াত-তায়সীর ২৯ পৃ., হাফেয ইবনু হাজার, নুযহাতুন নযর ৭৮, ২১০ পৃ.)। তবে সাধারণতঃ রাসূল (ছাঃ) থেকে ছহীহ সূত্রে প্রমাণিত কোন হাদীছ এমন পরস্পর বিরোধী হয় না, যা সমন্বয় করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন (১৪) : অমুসলিমদের কাছ থেকে কুরবানীর পশু ক্রয় করা যাবে কি? এটা কবুলযোগ্য হবে কি?

উত্তর : হালাল প্রাণী অমুসলিমদের থেকে ক্রয় করাতে কোন দোষ নেই। আর কুরবানী হিসাবে কবুল হ’তেও কোন সমস্যা নেই। কারণ আল্লাহ যে সকল প্রাণী হালাল করেছেন তা খাওয়া হালাল সেটি যেখানেই লালিত-পালিত হোক না কেন (মায়েদাহ ৫/৫)।

প্রশ্ন (১৫) : শেষ বৈঠকে পড়ার জন্য দরূদে ইব্রাহীমী ব্যতীত অন্য কোন দরূদ আছে কি?

উত্তর : হাদীছে বিভিন্ন শব্দে ছহীহ সনদে ৭টি দরূদ বর্ণিত হয়েছে (আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন্নবী, ১৬৫-১৬৮ পৃ.)। তাশাহ্হুদে এর যেকোন একটি পাঠ করলে ছালাত আদায় হয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে দরূদে ইবরাহীমী পাঠ করাই সর্বোত্তম (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২২/৪৫৪-৪৫৮; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/২০২-২০৪; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৫/৩৯৯-৪০০)।

প্রশ্ন (১৬) : রোগ-বালাই থেকে বাঁচার জন্য মাস্ক পরিধান কি তাবীযের উপর নির্ভরশীলতার সাথে তুলনীয় নয়? এটা শিরকের পর্যায়ভুক্ত হবে কি?

উত্তর : তাবীযের সাথে মাস্কের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ তাবীয ঝুলিয়ে তার উপরই ভরসা করা হয়। আর মাস্ক পরে ভাইরাসকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। কারণ ভাইরাস সাধারণত মুখ ও নাক দিয়ে প্রবেশ করে। এদের ঠেকাতেই মাস্ক ব্যবহার করা। আর শরী‘আতে সতর্কতা ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে (মুসলিম হা/২২৩১; মিশকাত হা/৪৫৮১)। অতএব এতে শিরকের কোন বিষয় নেই।

প্রশ্ন (১৭) : জমি বন্ধক নেওয়া বা দেওয়ার ব্যাপারে শরী‘আতের বিধান কি?

উত্তর : লাভ ভোগ করার প্রচলিত নিয়মে বন্ধক রাখা যাবে না। কারণ ঋণের বিনিময়ে লাভ ভোগ করা সূদ (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৪/২৫০; আল-মুদাওয়ান্নাহ ৪/১৪৯; ছালেহ ফাওযান, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২/৫০৫; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৪/১৭৬-৭৭)। ছাহাবীগণ এমন ঋণ নিষেধ করতেন, যা লাভ নিয়ে আসে (বায়হাক্বী ৩/৩৪৯-৩৫০; ইরওয়াউল গালীল হা/১৩৯৭)। তবে অর্থের বিনিময়ে জমি ভাড়া (লীজ) দেয়া বা নেয়া জায়েয (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৭৪ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, ১৩ অনুচ্ছেদ)।

প্রশ্ন (১৮) : আমি মোটা অংকের অর্থ অন্য একজনকে হাদিয়া হিসাবে দিয়েছি এবং চেক দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তিনি এখনো আমার একাউন্ট থেকে তা উত্তোলন করেননি। এক্ষণে উক্ত অর্থের যাকাত আমাকে দিতে হবে কি?

উত্তর : যেহেতু চেক প্রদান করা হয়ে গেছে সেহেতু দাতাকে যাকাত দিতে হবে না। বরং যে হাদিয়াপ্রাপ্ত হয়েছে যদি তার সম্পদ নেছাব পরিমাণ হয় এবং তার উপর এক বছর অতিক্রান্ত হয়, তাহ’লে সে-ই যাকাত প্রদান করবে (তিরমিযী হা/৬৩১; মিশকাত হা/১৭৮৭; ইরওয়া হা/৭৮৭; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব)। এক্ষেত্রে গ্রহীতার কর্তব্য হ’ল, দ্রুত অর্থ উত্তোলন করে নিজের যিম্মায় নেয়া এবং হিসাব করে যাকাত আদায় করা।

প্রশ্ন (১৯) : করোনাকালে ইহরাম অবস্থায় মাস্ক পরিধান করা যাবে কি?

উত্তর : ইহরাম অবস্থায় মুখমন্ডল আবৃত করা সিদ্ধ নয় (বুখারী হা/১৫৪২; মুসলিম হা/১১৭৭; মিশকাত হা/২৬৭৮; ইরওয়া হা/১০২২)। তবে সাময়িকভাবে বিশেষ শারঈ ওযর বশত বা ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধে ইহরাম অবস্থাতেও মাস্ক পরিধান করা যাবে (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/১৩০-৩১)।

প্রশ্ন (২০) : ফরয গোসলের পূর্বে কৃত ওযূতে ছালাত আদায় করা যাবে কি?

উত্তর : গোসলের পূর্বে ওযূ করলে এবং এর মধ্যে ওযূ নষ্ট না হ’লে উক্ত ওযূতে ছালাত আদায় জায়েয হবে। আর এটাই ফরয গোসলের সঠিক পদ্ধতি (বুখারী হা/২৪৮, মিশকাত হা/৪৩৫, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ৬৪ পৃ.)।

প্রশ্ন (২১) : আমার বিবাহের জন্য যে পাত্রী ঠিক করা হয়েছে তার পিতা পূর্বে সূদী কারবারের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে নেই। এমন পরিবারে বিবাহ করা শরী‘আতসম্মত হবে কি?

উত্তর : মেয়ে সৎ, ধার্মিক ও তাক্বওয়াশীল হ’লে বিবাহে কোন বাধা নেই। কেননা একের পাপ অন্যে বহন করে না। তাছাড়া বর্তমানে উক্ত ব্যক্তি সূদের সাথে জড়িতও নয় (আন‘আম ৬/১৬৪; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৮/৪৫)। সুতরাং ঐ পরিবারে বিবাহ করায় কোন বাধা নেই।

প্রশ্ন (২২) : চার কালেমা মুখস্থ না থাকলে কেউ মুসলিম থাকে না। কথাটির সত্যতা জানতে চাই। উক্ত চার কালেমা কি কি?

উত্তর : মুসলিম হওয়ার জন্য চার কালেমা মুখস্থ করা শর্ত নয়; বরং চার কালেমার বিষয়বস্ত্তর উপর ঈমান আনা ও তার উপর আমল করা শর্ত। উল্লেখ্য যে, চার কালেমা হ’ল, আল্লাহর তাওহীদের সাক্ষ্য যুক্ত কিছু বাক্য, যেগুলোকে পরবর্তী বিদ্বানগণ কুরআন ও হাদীছ থেকে গ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছেন। যেমন- (১) কালেমা ত্বাইয়েবা তথা لا إله إلا الله, যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালেমা (ইবরাহীম ২৪ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র; ঊছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১/৭৯)। (২) কালেমা শাহাদাত, যা দ্বারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল উভয়ের প্রতি ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান করা হয়- أشهد أن لا اله الا الله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪)। এছাড়াও রয়েছে কালেমা তাওহীদ, কালেমা তামজীদ প্রভৃতি, যেগুলি ইজতিহাদ ভিত্তিক (আরবী ক্বায়েদা ১ম ভাগ, ২৩ পৃ.)।

প্রশ্ন (২৩) : আমার এক মামাকে ৫০,০০০/- টাকা ধার দিয়েছি। কিন্তু বর্তমানে তিনি এমন ঋণগ্রস্থ যে আমার সেই টাকাগুলো আর ফেরত দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন হ’ল- এ বছর আমার যাকাতের কিছু অর্থ যেমন ১০,০০০/- টাকা তাকে না জানিয়ে কেটে রেখে বাকী টাকাগুলো পরের বছরগুলোতে যাকাতের অর্থ থেকে একই ভাবে কেটে রেখে তার ঋণ আদায় করে নিতে পারব কি?

উত্তর : এভাবে ঋণগ্রহীতাকে না জানিয়ে তার নামে যাকাত বাবদ অর্থ কর্তন করা যাবে না (নববী, আল-মাজমূ‘ ৬/২১০; আল মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৩/৩০০)। বরং এক্ষেত্রে দু’টি করণীয় হ’তে পারে। ১. ঋণগ্রহীতা যাকাতের হকদার হ’লে তাকে যাকাতের সম্পদ থেকে অর্থ প্রদান করবে, যা দ্বারা তিনি ঋণ পরিশোধ করবেন। ২. ঋণ পরিশোধে অক্ষম হ’লে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারে বা আরও অবকাশ দিতে পারে। কারণ আল্লাহ বলেন, তবে যদি ঋণগ্রহীতা অভাবগ্রস্ত হয়, তাহ’লে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি তোমরা ওটা দান করে দাও (অর্থাৎ তাকে ক্ষমা করে দাও), তবে সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ (বাক্বারাহ ২/২৮০)।

প্রশ্ন (২৪) : ছালাতে কোন রাক‘আতে সিজদার সংখ্যা ১টি না ২টি হ’ল এমন সন্দেহ হ’লে করণীয় কি?

উত্তর : ছালাতরত অবস্থায় কোন রাক‘আতে যদি একটি সিজদা হয়েছে বলে প্রবল ধারণা হয়, তবে সালামের পূর্বে আরেকটি সিজদা দিবে এবং সহো সিজদা দিবে। আর ছালাতের পর এমন সন্দেহ হ’লে মসজিদে থাকা অবস্থায় সিজদাটি ক্বাযা আদায় করে নিবে। আর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হ’লে তা আর ক্বাযা করতে হবে না (বুখারী হা/৪০১; মুসলিম হা/ ৫৭১; বাহূতী, শারহু মুনতাহাল ইবাদাত ১/২৩৫; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৩০; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৩/৩৮৪)।

প্রশ্ন (২৫) : একদল মানুষ জুম‘আর জন্য মসজিদে এসে জামা‘আতে শরীক হ’তে পারেনি। এক্ষণে তারা দুই রাক‘আত না চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে?

উত্তর : একাকী হোক বা একাধিক ব্যক্তি হোক জুম‘আর ছালাত ছুটে গেলে তারা যোহরের চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে (তিরমিযী হা/৫২৪; নববী, আল-মাজমূ‘ ৪/৫৫৮)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর এক রাক‘আত পেয়ে যাবে, সে জুম‘আ পেয়ে গেল। সে যেন আরেক রাক‘আত মিলিয়ে নেয়। আর যে ব্যক্তি এক রাক‘আত পেল না সে যেন চার রাক‘আত যোহর পড়ে নেয় (দারাকুৎনী হা/১৬২২; নাসাঈ হা/৫৫৭; ইরওয়া হা/৬২২)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, যদি তুমি জুম‘আর এক রাক‘আত পাও, তবে তার সাথে আরেক রাক‘আত যোগ কর। আর যদি রুকূ না পাও, তাহ’লে চার রাক‘আত (যোহরের ছালাত) আদায় কর (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী ৩/২০৪; ত্বাবারাণী কাবীর, সনদ ছহীহ; ইরওয়া ৩/৮২, তামামুল মিন্নাহ ৩৪০ পৃ.)। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে জমহূর বিদ্বান ঐক্যমত পোষণ করেছেন (তিরমিযী হা/৫২৪-এর আলোচনা; নববী, আল-মাজমূ‘ ৪/৫৫৮)।

প্রশ্ন (২৬) : সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ কি কেবল ইমামই বলবে না মুক্তাদীও বলবে?

উত্তর : ইমাম ও মুক্তাদী উভয়েই ‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’ ও ‘আল্লা-হুম্মা রববানা লাকাল হামদ...’ বলবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখছ’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাকে অনুসরণ করার জন্য (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৩৯)। অত্র হাদীছদ্বয় প্রমাণ করে যে, ইমাম ও মুক্তাদী সকলেই ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতে পারে (বিস্তারিত দ্রঃ মির‘আত ৩/১৮৯ ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ)। অবশ্য শায়খ ঊছায়মীন ও বিন বাযসহ কতিপয় বিদ্বানের অভিমত হ’ল ইমাম ‘সামি‘আল্লাহ’ এবং ‘রববানা....’ ঊভয়টি বলবে। আর মুক্তাদী কেবল ‘রববানা লাকাল হামদ’ বললেই যথেষ্ট হবে (ঊছায়মীন, লিকাউল বাবিল মাফতুহ ৩২০/১; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৭/৯৩-৯৪)। তবে উভয়ের জন্য দু’টি বাক্য বলার বিষয়টিই ছহীহ হাদীছের অধিক নিকটবর্তী (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬২; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন্নবী ১৩৫ পৃ.; ছালাতুর রাসূল ১০৫ পৃ.)।

প্রশ্ন (২৭) : আমার ১০ লক্ষ টাকা ঋণ আছে। কিন্তু এখন তা শোধ করতে চাই না। এক্ষণে যাকাত বের করার সময় মূলধন থেকে উক্ত ঋণের টাকা হিসাবের বাইরে রাখতে হবে কি?

উত্তর : ঋণের টাকা হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। কারণ সে তা দ্বারা লাভবান হচ্ছে। অতএব মোট সম্পদ হিসাব করেই যাকাত দিতে হবে (বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৪/৫১; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৮/২৪; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৯/১৮৯)। এক্ষণে যাদের ঋণ আছে তাদের কর্তব্য হ’ল প্রথমে ঋণ পরিশোধ করবে, এরপর হিসাব করে যাকাত দিবে। ওছমান (রাঃ) জুম‘আর খুৎবায় বলেন, ‘এটি (রামাযান) যাকাতের মাস। অতএব যদি কারো উপর ঋণ থাকে তাহ’লে সে যেন প্রথমে ঋণ পরিশোধ করে। এরপর অবশিষ্ট সম্পদ নিছাব পরিমাণ হ’লে সে তার যাকাত আদায় করবে’ (মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৮৭৩; আলবানী, সনদ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল হা/৭৮৯)।

প্রশ্ন (২৮) : ফাতেমা (রাঃ)-কে কি হত্যা করা হয়েছিল? নাকি তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন?

উত্তর : ফাতেমা (রাঃ)-কে হত্যা করা হয়নি; বরং তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ছয় মাস পরে মারা যান (বুখারী হা/৩০৯৩; মুসলিম হা/১৭৫৯)। ১১ হিজরীর ৩রা রামাযান মঙ্গলবার রাতে ৩০ অথবা ৩৫ বছর বয়সে ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন (আল-বিদায়াহ ৫/২৬৭-৭০, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৯৫-১১১, দ্রঃ সীরাতুর রাসূল ৭৯ পৃ.)। ঐতিহাসিক মাদায়েনী বলেন, ফাতেমা (রাঃ) ১১ হিজরীর তৃতীয় রামাযান সোমবারে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ২৫-২৯ বছর হয়েছিল। বাকী‘ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল (আব্দুর সাত্তার শায়খ, ফাতিমাতুয যাহরা (দারুল কলম), ৩৫২, ৩৫৭-৩৫৮ পৃ.)। হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে তাঁর স্বামী হযরত আলী (রাঃ) গোসল দিয়েছিলেন (বায়হাক্বী ৩/৩৯৭, দারাকুৎনী হা/১৮৩৩, সনদ হাসান, দ্রঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ১২০-২১ পৃ.)। উল্লেখ্য যে, শী‘আদের গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় যে, হযরত ওমর (রাঃ)-এর নির্দেশনায় কুনফুয ফাতেমা (রাঃ)-কে আঘাত করেছিল। ফলে তাঁর গর্ভপাত ঘটে এবং পরবর্তীতে সেই আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (বিহারুল আনওয়ার ৪৩/১৭০)। এই ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। স্বীকৃত কোন ইতিহাস গ্রন্থে এর বিন্দুমাত্র উল্লেখ পাওয়া যায় না।

প্রশ্ন (২৯) : আমাদের এলাকা সহ আশপাশের কোথাও কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। এমতাবস্থায় নিজ অবস্থানস্থল থেকে মহামারী কত দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে জামা‘আত পরিত্যাগ করে বাড়িতে ছালাত আদায় করা বৈধ হবে?

উত্তর : দূরত্ব নির্ধারণ নয়, বরং প্রবল ধারণার ভিত্তিতে যদি দেখা যায় যে, এলাকার পরিস্থিতি অনুযায়ী মসজিদে আগত মুছল্লীদের মধ্যে কোন ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে মসজিদে না গিয়ে বাড়িতে ছালাত আদায় করা যাবে। আর তদ্রূপ না হ’লে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মুওয়াযযিনের আযান শুনেছে এবং কোন ওযর বা অসুবিধা তাকে তার অনুসরণ করতে বাধা দেয়নি, তার আদায়কৃত ছালাত আল্লাহ কবুল করবেন না (আবূদাউদ হা/৫৫১; মিশকাত হা/১০৭৭; ছহীহুত তারগীব হা/৪২৬)। ভয়-ভীতি বা অসুস্থতা ও মহামারী ছড়িয়ে পড়া একটি বড় ওযর। সেজন্য ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে বাড়িতে ছালাত আদায় করা যাবে, দূরত্ব কোন বিষয় নয় (বাহুতী, কাশশাফুল কেনা‘ ৪/১৬, ১/৪৯৮; আব্দুল মুহসিন আল আববাদ, শরহ আবূদাঊদ ৬/২৭৫)।

প্রশ্ন (৩০) : বিসমিল্লাহ না লিখে ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি’ বা ৭৮৬ ইত্যাদি লেখা জায়েয হবে কি?

উত্তর : বিসমিল্লাহ বলেই শুরু করতে হবে। আর ‘বিসমিল্লাহ’র পরিবর্তে ৭৮৬ সংখ্যা লেখা যাবে না। কেননা আরবী হরফসমূহের আবজাদী তথা সংখ্যাতাত্ত্বিক গণনা পদ্ধতিতে ‘বিসমিল্লাহ্’-এর ১৯টি হরফের মান যোগ করে ৭৮৬ বানানো হয়েছে, যা নিছক কপোলকল্পিত। আর তা কখনোই ‘বিসমিল্লাহ্’-এর বিকল্প নয়। মূলতঃ ‘বিসমিল্লাহ’ কুরআনের আয়াতাংশ (নমল ২৭/৩০) এবং আল্লাহ প্রদত্ত একটি ইবাদতের শব্দ। আল্লাহর সাহায্য কামনা করে সকল শুভ কাজে ‘বিসমিল্লাহ’ ব্যবহার করা অন্যতম ইবাদত। সুতরাং ‘বিসমিল্লাহ্’-র পরিবর্তে ৭৮৬ ব্যবহার করলে তা ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না এবং তাতে কোন নেকী হবে না। একইভাবে অনুবাদ লিখলেও হবে না। কেননা ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এরূপ কোন রীতি নেই। সর্বোপরি এটি কুরআনের আয়াত মনে করে পড়লে প্রতি হরফে ১০ নেকী লাভ হবে। কিন্তু অনুবাদ পড়লে তা হবে না।

যদি বলা হয়, এর দ্বারা ‘বিসমিল্লাহ’-কে যত্রতত্র অমর্যাদাকর ব্যবহার থেকে রক্ষা করা যায়, সেটি ভুল হবে। বরং ‘বিসমিল্লাহ’ বলেই এর মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। অস্পষ্ট সংকেতে লেখায় বরং এর প্রতি অসম্মান করা হবে। আর কোথাও অমর্যাদার আশংকা থাকলে মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট। লেখার প্রয়োজন নেই। যেমনভাবে ইমাম বুখারী (রহ.) ছহীহ বুখারীর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখেননি।

প্রশ্ন (৩১) : কোন পুরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হ’লে তার কাছ থেকে ‘খোলা’ করে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে কি?

উত্তর : যদি মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পুরুষের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা নেই, তাহ’লে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাইতে পারে বা খোলা করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কারণ বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হ’ল সন্তান লাভ করা। আর সন্তান জন্মের সক্ষমতা না থাকা স্বামীর একটি দোষ। যে কারণে স্ত্রী খোলা করে বিচ্ছিন্ন হ’তে পারে (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ৫/১৬৬; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/২২০)। স্মর্তব্য যে, শারঈ ওযর ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাইতে পারে না। কোন কারণ ছাড়াই যদি কেউ স্বামীর কাছে তালাক চায়, তাহ’লে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না (আবূদাঊদ হা/২২২৬; মিশকাত হা/৩২৭৯; ছহীহুত তারগীব হা/২০১৮)। অন্য বর্ণনায় বিনা কারণে তালাকপ্রার্থী নারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে (তিরমিযী হা/১১৮৬; মিশকাত হা/৩২৯০; ছহীহাহ হা/৬৩২)। অতএব এমতাবস্থায় নারী চাইলে ধৈর্য সহকারে স্বামীর সংসারে থাকতে পারে অথবা খোলা করে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র বিবাহ করতে পারে।

প্রশ্ন (৩২) : আমাদের সমিতি থেকে কয়েক লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ফ্যান ক্রয়ের জন্য কোম্পানীতে অগ্রিম টাকা জমা দেয়া হয়। অতঃপর করোনা পরিস্থিতির কারণে তারা সময়মত তা ডেলিভারী না দিয়ে অন্যত্র বিক্রয় করে দেয়। এখন তারা মাল না থাকায় পূর্বে গৃহীত প্রত্যেক ফ্যানের সাথে অতিরিক্ত ১০০ টাকা করে লাভ দিয়ে অগ্রিম প্রদত্ত টাকা ফেরত দিতে চাচ্ছে। উক্ত লভ্যাংশ সহ টাকা নেওয়া যাবে কি? এটা টাকার বিনিময়ে অধিক টাকা নেওয়ার নামান্তর হবে কি?

উত্তর : এভাবে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা জায়েয হবে না। কেননা এতে টাকার বিনিময়ে অধিক টাকা নেওয়া হচ্ছে। বরং এর পরিবর্তে যদি কোম্পানীটি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে লভ্যাংশ প্রদান করে তবে তা জায়েয হবে, যা ‘মুযারাবাহ’ হিসাবে গণ্য হবে বলে (দারাকুৎনী হা/৩০৭৭; মুওয়াত্ত্বা হা/২৫৩৫; ইরওয়াউল গালীল হা/১৪৭২, ৫/২৯২ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৮৯৫, মওকূফ ছহীহ)।

প্রশ্ন (৩৩) : ঋণ গ্রহণ করে কুরবানী দেওয়া যাবে কি?

উত্তর : ঋণ করে কুরবানী করা জায়েয। যদি উক্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৬/৩০৫; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১/৩৭)।

প্রশ্ন (৩৪) : জনৈক ইসলামবিদ্বেষী লেখক লিখেছেন, রাসূল (ছাঃ) মানুষের কথায় সন্দেহ করে তার সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ও খলীফা আবুবকরের মত মানুষের সন্তান আয়েশার প্রতি যে আচরণ করেছেন তা কি নবীসুলভ বা অনুকরণীয়? অহী যদি না আসতো তবে কি আয়েশা বঞ্চনার শিকার হ’তেন না? বর্তমানে তো অহী আসবে না। তাহ’লে একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যদি উক্ত ঘটনার অবতারণা হয়, তবে সে কি করবে? তার জন্য নবী (ছাঃ) কী আদর্শ রেখে গেছেন? একজন মানুষ হিসাবে কী রাস্তা দেখিয়ে গেলেন? নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সে কি তার স্ত্রীকে তালাক দেবে না? এভাবেই কি তালাকের অভিশাপ সমাজকে কলুষিত করছে না? উক্ত প্রশ্নের জবাব কি?

উত্তর : উক্ত প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জঘন্য ও অজ্ঞতাপ্রসূত। যারা এমন বিশ্বাস রাখবে তারা কাফের হয়ে যাবে (ইবনুল ‘আরাবী, ‘আরেযাতুল আহওয়াযী ১১/৫২)। রাসূল (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি সন্দেহের বশে নয়, বরং মুনাফিকদের অপপ্রচার দেখে এবং কিছু ছাহাবীর পরামর্শে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অহী প্রাপ্তির মাধ্যমেই তাঁর পবিত্রতার বিষয়টি নিশ্চিত হোক (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৮/৪৮০)। এজন্য রাসূল (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছিলেন, হে আয়েশা! তোমার সম্পর্কে এ ধরনের কথা আমার কাছে পেঁŠছেছে। তুমি নির্দোষ হ’লে আল্লাহ অবশ্যই তোমার নির্দোষিতা ঘোষণা করবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহে জড়িয়ে গিয়ে থাক, তাহ’লে আল্লাহর কাছে তওবা ও ইস্তিগফার কর। কেননা বান্দা নিজের পাপ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তওবা কবুল করেন (বুখারী হা/২৬৬১; মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬২)। আর রাসূল (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীর ব্যাপারে সন্দেহ করেননি বলেই আলী ও বারীরা (রাঃ)-এর সাথে পরামর্শ শেষে খুৎবায় দাঁড়িয়ে বলেন, আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে যে লোক আমাকে জ্বালাতন করেছে, তার মুকাবিলায় কে প্রতিকার করবে? আল্লাহর কসম, আমি তো আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানি না। আর এমন ব্যক্তিকে জড়িয়ে তারা কথা তুলেছে, যার সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু আমি জানি না। আর সে তো আমার সাথে ছাড়া আমার ঘরে কখনও প্রবেশ করত না (বুখারী হা/২৬৬১; মুসলিম হা/১৬৯৫)। দুঃখজনক হ’ল, নবী বিদ্বেষীরা এমন রাসূলের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয় যে রাসূল কখনো স্ত্রীদের প্রহার কিংবা গালি-গালাজ পর্যন্ত করেননি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) এক জিহাদের ময়দান ব্যতীত নিজ হাত দিয়ে কাউকে মারেননি, এমনকি তাঁর স্ত্রী ও খাদেমদেরকেও না (মুসলিম হা/২৩২৮; মিশকাত হা/৫৮১৮)।

প্রশ্ন (৩৫) : পিতা-মাতার নিকট মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়ে দান

উত্তর : মিথ্যা বলে পিতা-মাতার নিকট থেকে টাকা নিয়ে দান করা জায়েয নয়। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি মিথ্যুক বলেই গণ্য হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮২৪)। তবে পিতা-মাতাকে না বলে বৈধ উদ্দেশ্যে তাদের সম্পদ হ’তে সামান্য কিছু দান করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মহিলা যদি (স্বামীর অনুমতি ছাড়াই) তার বাড়ীর কিছু সম্পদ দান করে এবং এতে সম্পদ ধ্বংস করা উদ্দেশ্য না থাকে, তাহ’লে দান করার কারণে মহিলার নেকী হবে আর উপার্জন করার কারণে স্বামীরও নেকী হবে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৪৭)। অত্র হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন ছেলে পিতাকে না বলে হক পথে কিছু দান করলে উভয়ের নেকী হবে। যদি পিতা তাতে সন্তুষ্ট থাকে।

প্রশ্ন (৩৬) : ভ্যানিলা এসেন্সযুক্ত খাবার খাওয়া হালাল হবে কি?

উত্তর : ভ্যানিলা এসেন্সযুক্ত খাবার খাওয়া হালাল। তবে বাজারে প্রাপ্ত ভ্যানিলায় যদি অধিক পরিমাণে এ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে তা হারাম’ (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৮/৩৩৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৩/৫৪, ২২/১৪৪)। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে যদি এমন সামান্য পরিমাণ এ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, যা মাদকতা আনে না; তাহ’লে তা জায়েয (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৩/৫৪; উছায়মীন, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১২/৩৭০)।

প্রশ্ন (৩৭) : ছালাত শেষে সালাম ফিরানোর সময় দৃষ্টি কোন দিকে রাখতে হবে?

উত্তর : সালাম ফিরানোর সময় মুছল্লী স্বাভাবিক ভাবে ডানে বা বামে দৃষ্টিপাত করে সালাম ফিরাবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত আদায়কারী তার ডানে এবং বামে থাকা ভাইদেরকে সালাম প্রদান করবে (মুসলিম হা/৪৩১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০১৯)। অতএব সালাম ফিরানোর সময় ডানে এবং বামে থাকা ভাইদেরকে সালাম প্রদানের নিয়ত করবে। আর যদি একাকী ছালাত আদায় করে, তাহ’লে ডানে ও বামে থাকা ফেরেশতাদের সালাম প্রদানের নিয়ত করবে (নববী, আল-মাজমূ‘ ৩/৪৫৬, ৪৬২; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১/৩২৬, ৩২৭; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৩/২০৮)।

প্রশ্ন (৩৮) : মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমাকে জাহাযে কখনো ১ বছর বা তারও বেশী একটানা জাহাযে অবস্থান করতে হয়। জাহাযও বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে চলমান থাকে। এমতাবস্থায় ছালাত জমা ও ক্বছর করা এবং সুন্নাত ছালাত পরিত্যাগ করার ব্যাপারে শরী‘আতের বিধান কি?

উত্তর : এমতাবস্থায় ছালাত কছর করা যাবে। তবে ছালাত জমা‘ তাকদীম বা তাখীর তখনই করা উত্তম হবে যখন যথা সময়ে ছালাত আদায়ের সুযোগ পাবে না। কারণ আল্লাহ ছালাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন (নিসা ৪/১০৩; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৪/৩৭০; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১২/২৮১-২৮২)। সামুদ্রিক সফরে এক বছর অবস্থান করলেও ছালাত কছর করতে পারবে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, আলেমগণ এই বিষয়ে একমত যে, যতদিন পর্যন্ত ইকামত বা নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত না নিবে, ততদিন একজন মুসাফির কছর আদায় করবে। যদিও এভাবে বহু বছর কেটে যায় (তিরমিযী হা/৫৪৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) আযারবাইজান সফরে গেলে পুরো বরফের মৌসুম সেখানে আটকে যান ও ছয় মাস যাবৎ কছর করেন (বায়হাক্বী ৩/১৫২ পৃঃ; ইরওয়া হা/৫৭৭, সনদ ছহীহ)। অনুরূপভাবে হযরত আনাস (রাঃ) শাম বা সিরিয়া সফরে গিয়ে দু’বছর সেখানে থাকেন ও কছর করেন (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৮৬ পৃ.; মিরক্বাত ৩/২১১ পৃঃ)। সুতরাং স্থায়ী মুসাফির যেমন জাহায, বিমান, ট্রেন, বাস ইত্যাদির চালক ও কর্মচারীগণ সফর অবস্থায় সর্বদা ছালাতে কছর করতে পারেন (ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ১৮৭ পৃঃ)। তবে মনে রাখতে হবে যে, ক্বছর করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং অধিকাংশ ছাহাবী সর্বদা ক্বছরকেই অগ্রাধিকার দিতেন (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১২)।

প্রশ্ন (৩৯) : ইমাম মাহদী আসার ব্যাপারে নিশ্চিত হ’লে মুমিনদের জন্য করণীয় কি?

উত্তর :  ইমাম মাহদীর আগমনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সহজসাধ্য নয়। তবে বিভিন্ন আলামত দেখে প্রকৃত মুমিনরা অনুধাবন করতে পারবেন। যেমন তাঁর আগমনের অন্যতম আলামত হ’ল, তিনি এমন এক সময়ে দুনিয়ায় আগমন করবেন যখন সমগ্র দুনিয়া অন্যায় ও অত্যাচারে ভরে যাবে। অতঃপর তিনি এক রাতেই ন্যায় ও ইনছাফে ভরে দিবেন (আবুদাউদ হা/৪২৮৫; ছহীহাহ হা/১৫২৯)। তিনি একাধারে সাত বছর শাসনকার্য চালাবেন, সম্পদের সঠিক বণ্টন করবেন। ঘন ঘন বৃষ্টি বর্ষণ হবে। ফলে বৃক্ষ-তরুলতায় পৃথিবী ভরে যাবে এবং গবাদিপশুর প্রাচুর্য বৃদ্ধি পাবে। মুসলিম উম্মাহ উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে (ছহীহাহ হা/৭১১)। তিনি যখনই আগমন করবেন তখন মুমিনদের আবশ্যিক কর্তব্য হবে আমীর বা নেতা হিসাবে তাঁর যথাযথভাবে অনুসরণ করা। এমনকি স্বয়ং ঈসা (আঃ)-ও তাঁর ইমামতিতেই ছালাত আদায় করবেন (মুসলিম হা/১৫৬; ছহীহাহ হা/২২৩৬; মিশকাত হা/৫৫০৭)।

প্রশ্ন (৪০) : অমুসলিমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা যাবে কি? তার মৃত্যুতে ইন্নালিল্লাহ বলা বা তার জন্য প্রার্থনা করা কিংবা ‘ওপারে ভাল থাকবেন’ জাতীয় বাক্য বলা জায়েয কি?

উত্তর : কোন অমুসলিমের মৃত্যুতে প্রয়োজনে তার নিকট আত্মীয়-স্বজনের নিকট শোক প্রকাশ করা যাবে বা তাদেরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়া যাবে। তাদের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে ‘ইন্নালিল্ল¬াহ..’ বলাতেও কোন বাধা নেই। কেননা এগুলি স্বাভাবিক মানবীয় সদাচরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত (মুমতাহিনা ৬০/৮, ইবনু কুদামা ২/৪১০; মুগনিউল মুহতাজ ২/৪২; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব)। তবে তাদের জন্য কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা বা রহমতের দো‘আ করা সিদ্ধ নয় (তওবা ৯/৮৪; নববী, আল-মাজমু‘ ৫/১১৯; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘ ফাতাওয়া ১২/৪৮৯)। কেননা যে ব্যক্তি ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেনি, সে নিশ্চিতভাবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী (বাইয়েনাহ ৯৮/৬; মুসলিম হা/১৫৩)। আল্ল¬াহ বলেন, ‘মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সঙ্গত নয়; যদিও তারা নিজেদের আত্মীয় হয়, তাদের কাছে একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (তওবা ৯/১১৩)। এজন্য রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর মৃত মায়ের জন্যও ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়েছিল (মুসলিম হা/৯৭৬)। অতএব কোন অমুসলিমের মৃত্যুতে ‘ওপারে ভাল থাকবেন’ বা ‘শান্তিতে বিশ্রাম নিন’ (RIP) ইত্যাদি প্রার্থনাসূচক বাক্য বলা নিষিদ্ধ। 

প্রশ্ন (৪১) : ছাহাবী মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) কি তাঁর পরিবারের জন্য মহামারীর আক্রমণ প্রার্থনা করেছিলেন?

উত্তর : ছাহাবী মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) তাঁর পরিবারের জন্য মহামারীকে রহমত হিসাবে কামনা করেছিলেন। আর এতে তাঁর দুই স্ত্রী ও পুত্রসহ তিনি নিজে মারা যান। হাদীছে এসেছে, সেনাপতি আবু ওবায়দাহ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর সেনাপতি হন রাসূল (ছাঃ)-এর আরেক প্রিয় ছাহাবী মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)। সবাই তখন প্লে¬গের আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত। নতুন সেনাপতি হবার পর মু‘আয (রাঃ) একটি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, এই প্লেগ আল্ল¬াহর পক্ষ থেকে কোন মুছীবত নয় বরং إِنَّهَا رَحْمَةُ رَبِّكُمْ وَدَعْوَةُ نَبِيِّكُمْ، وَقَبْضُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْاللَّهُمَّ أَدْخِلْ عَلَى آلِ مُعَاذٍ نَصِيبَهُمْ مِنْ هَذِهِ الرَّحْمَةِ ‘এটা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে রহমত এবং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দো‘আর ফল। এতে ইতিপূর্বে বহু সৎকর্মশীলের জীবন নাশ হয়েছে। হে আল্লাহ! এটি মু‘আযের পরিবারেও পাঠান। যাতে আমরাও এ রহমতের একটি অংশ পাই। দো’আ শেষে ঘরে ফিরে দেখলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্র আব্দুর রহমান প্লে¬গাক্রান্ত হয়ে গেছেন। ছেলে তার পিতাকে সান্ত্বনা দিয়ে কুরআনের ভাষায় বলেন, ‘সত্য সেটাই যা তোমার পালনকর্তার নিকট থেকে আসে। অতএব তুমি অবশ্যই সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (বাকারাহ ২/১৪৭)। পুত্রের সান্ত্বনার জবাব পিতাও দেন কুরআনের ভাষায়- ‘ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবে’ (আছ-ছাফফাত ৩৭/১০২)।

কিছু দিনের মধ্যে তাঁর প্রিয় পুত্রটি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর দুই স্ত্রীও মারা যান। অবশেষে তাঁর হাতের একটি আঙ্গুলে ফোঁড়া বের হয়। এটা দেখে মু‘আয (রাঃ) খুবই খুশী হন এবং বলেন, দুনিয়ার সকল সম্পদ এটির তুলনায় মূল্যহীন। অল্পদিনের মধ্যে তিনিও প্লে¬গে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (আহমাদ হা/২২১৩৮; ছহীহুত তারগীব হা/১৪০২)। স্মর্তব্য যে, এই প্রার্থনা তাঁর ব্যক্তিগত ইজতিহাদ ছিল। তাছাড়া তিনি জীবন থেকে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই প্রার্থনা করেননি। বরং মহামারীতে মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেছিলেন। কারণ নিজের বিরুদ্ধে দো‘আ করা নিষিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের, তোমাদের সন্তান-সন্ততির এবং তোমাদের সম্পদের ব্যাপারে বদদো‘আ করো না (মুসলিম হা/৩০০৯; মিশকাত হা/২২২৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা নিজের জন্য যা কল্যাণকর, শুধু সেটাই চাও। কেননা তোমরা যা বল তার জন্য ফেরেশতাগণ আমীন, আমীন বলতে থাকেন (মুসলিম হা/৯২০; মিশকাত হা/১৬১৯)।

প্রশ্ন (৪২) : বর্তমানে বাংলাদেশে ‘রেডিয়াম ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি কোম্পানী ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগে’র আহবান জানাচ্ছে। তাদের নিয়ম অনুযায়ী ১০ ইউএস ডলার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এর বিনিময়ে তারা ‘রিপটন কয়েন’ নামে দুইশ’ কয়েন দিচ্ছে। যেটা একদিনে দেওয়া হয় না। বরং ন্যূনতম ছয় মাসে মাইনিং হিসাবে প্রতিদিন ১/২টা করে ছয় মাসের মধ্যে প্রদান করা হয়। তাদের দাবী অনুযায়ী আগামী ৬ মাসের মধ্যে এর রেট একটা উচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে। আনুমানিক প্রতি কয়েন ১০ ডলার থেকে ১০০ ডলার হ’তে পারে। দ্বিতীয়তঃ তাদের সাথে কাজ করলে অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তিকে রেফার করলে কোম্পানির পক্ষ থেকে ঐ ব্যক্তির বিনিয়োগের ৫% হারে মুনাফা প্রদান করবে। কিন্তু বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের কোন কমতি হবে না। এইভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের বিনিময়ে তারা আরো পারসেন্টেজ লাভের ব্যবস্থা রাখছে। আবার এই কারেন্সির বিনিময় মূল্য রয়েছে এবং তারা বলছে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে ভার্চুয়াল কারেন্সির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হবে। ইতিপূর্বে ‘বিটকয়েন’ নামে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি বাযারে এসেছিল ২০০৯ সালে। তখন তার মূল্য ছিল ৮/৯ টাকা। বর্তমানে ২০২০ সালে সেই কয়েনের মূল্য ৮ লক্ষ টাকা (১৩১১৯ সিঙ্গাপুরী ডলার)। ঠিক তেমনি ‘রিপটন কয়েন থেকে আয় আসবে বলে দাবী করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো অধিক মুনাফা লাভের আশায় এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা যাবে কি? বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।          

উত্তর : ‘বিটকয়েন  হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা একধরনের সাংকেতিক মুদ্রা। এর নিজস্ব কোন মূল্যমান নেই। বাস্তব কোন রূপ নেই। এর অস্তিত্ব কেবল ইন্টারনেটে। এজন্য একে ডিজিটাল, ভার্চুয়াল বা অনলাইন কারেন্সিও বলা হয়। বর্তমানে বিটকয়েনের অনুরূপ প্রশ্নোল্লেখিত রিপটনসহ বিভিন্ন নামে হাযারো সাংকেতিক মুদ্রার আবির্ভাব ঘটেছে। এর লেনদেনের জন্য কোন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না। ফলে এর কোন আইনসঙ্গত ভিত্তি নেই, কোন জওয়াবদিহিতাও নেই। প্রকৃত মুদ্রার বৈশিষ্ট্যও এতে নেই। ফলে এই মুদ্রার লেনদেন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নিষিদ্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটকয়েন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এর মূল্য প্রধানত ফটকামূলক লেনদেন থেকে প্রাপ্ত। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিপরীতে এর দর মারাত্মক ওঠানামা করে। যেহেতু গোটা বিষয়টি অজ্ঞাত, অনিশ্চয়তাপূর্ণ ও প্রতারণার ঝুঁকিপূর্ণ, অতএব এরূপ অনিয়মিত ও অপ্রকৃত মুদ্রার আদান-প্রদানে জড়িত হওয়া জায়েয নয়।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘হাছাহ’ ও ‘গারার’ ব্যবসা হতে নিষেধ  করেছেন’  ( আহমাদ  হা/৭৪০৫; বায়হাক্বী হা/১০৩৯০, সনদ ছহীহ)। ‘হাছাহ’ ব্যবসা বলতে যখন বিক্রেতা ক্রেতার কাছে কাপড় বিক্রির সময় বলে, ‘আমি আপনার কাছে তা-ই বিক্রি করব যার উপর আমার ছোড়া পাথরটি পড়বে’। অথবা ‘আমি আপনাকে সেই জমিই বিক্রি করব যার উপর আমার ছোড়া পাথরটি পড়বে’। অর্থাৎ কোন দ্রব্যটি বিক্রি করা হচ্ছে তা জ্ঞাত নয়। ফলে এটি নিষিদ্ধ। আর ‘গারার’ হল যা অনিশ্চিত বা অনুমাননির্ভর। অর্থাৎ হতেও পারে, নাও হতে পারে। যেমন পানির মাছ বিক্রি করা, গরুর বাঁটের দুধ বিক্রি করা কিংবা গর্ভবতী পশুর গর্ভে যা আছে তা বিক্রি করা ইত্যাদি। এটি নিষিদ্ধ। কারণ এতে ‘গারার’ বা প্রতারণার ঝুঁকি রয়েছে।

সুতরাং যেহেতু এটি পরিষ্কার যে, ডিজিটাল কারেন্সি একটি অজ্ঞাত উৎস হ’তে এবং অকর্তৃত্বশালী পক্ষ হ’তে প্রচলন করা হয়; আর এতে গারার বা অস্পষ্টতা রয়েছে এবং সেই সাথে ফটকামূলক লেনদেনের কারণে এতে জুয়ারও সম্পর্ক রয়েছে, সেহেতু এর ক্রয়-বিক্রয় বা এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়া বৈধ নয়। তুরস্কের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আরব আমিরাত, মিসর ও ফিলিস্তীনের কেন্দ্রীয় ফৎওয়া বিভাগ, দারুল উলূম দেওবন্দের ফৎওয়া বিভাগসহ বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে ক্রিপ্টো কারেন্সিকে নাজায়েয ফৎওয়া দিয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট। এর মধ্যবর্তী বিষয়সমূহ অস্পষ্ট, যা অনেক মানুষ জানে না। অতএব যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ বস্ত্তসমূহ থেকে বেঁচে থাকবে, সে ব্যক্তি তার দ্বীন ও সম্মানকে পবিত্র রাখল। আর যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ কাজে লিপ্ত হ’ল, সে হারামে পতিত হল’ (বুখারী হা/২০৫১; মুসলিম হা/১৫৯৯; মিশকাত হা/২৭৬২)।

প্রশ্ন (৪৩) : ছালাত চলা অবস্থায় ইমামের পিছনে জায়গা না থাকলে ইমামের সাথে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা যাবে কি?

উত্তর : জায়গার সংকীর্ণতার কারণে ইমামের পার্শ্বে তার ডানে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা যাবে। তবে এটা মুছল্লীর জন্য প্রথম কাতার হবে না। কেননা ইমামের পিছনের কাতার হ’ল ছালাতের প্রথম কাতার (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/৪৬)।

প্রশ্ন (৪৪) : মালয়েশিয়া ভিত্তিক ডিএক্সএন কোম্পানী যে ব্যবসা করছে তার বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : ডিএক্সএন মূলতঃ অসাধু এমএলএম ব্যবসা চালাচ্ছে। নানা আকর্ষণীয় প্যাকেজ দেখিয়ে তারা সদস্য ভর্তি করে এবং প্রায় বিনা পরিশ্রমে মোটা অংক লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়। এদের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া মোটেই বৈধ হবে না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জিজিএন, ডেসটিনি, নিউওয়ে, যুবক, এ্যাপটেক, ইউনিপেটু ইত্যাদি প্রতারক কোম্পানী সমূহের মত ডিএক্সএন বিশ্বের বেকার তরুণদের কাজে লাগিয়ে ও তাদের পণ্য কিনে আকাশ-কুসুম লাভের প্রলোভন দেখিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। মূলতঃ তারা মানুষের সস্তা আবেগকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পেতেছে। তাই এদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক (দ্র. মাসিক আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ২০০৮, প্রশ্নোত্তর  ২/৮২)।

প্রশ্ন (৪৫) : একই ইমাম একাধিক স্থানে ঈদের জামা‘আতে ইমামতি করতে পারবে কি?

উত্তর : বিশেষ প্রয়োজনে একই ইমাম একাধিক স্থানে ঈদের ছালাতে ইমামতি করতে পারেন। ত্বালক বিন আলী (রাঃ) এক রাতে দুই জায়গায় তারাবীহর ছালাতে ইমামতি করেছিলেন (আবূদাঊদ হা/১৪৩৯; বায়হাক্বী সুনানুল কুবরা, হা/৪৬২২; আইনী, শরহ আবূদাঊদ ৫/৩৫০)।

প্রশ্ন (৪৬) : এশার ফরয ছালাতের পর চার রাক‘আত নফল ছালাত আদায়ের কোন বিধান আছে কি?

উত্তর : এশার ছালাতের পরে দু’রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা আদায় করবে (বুখারী হা/১১৬৫; মুসলিম হা/৭২৮; মিশকাত হা/১১৫৯)। এরপরে বাড়িতে গিয়ে কেউ চাইলে চার রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতে পারে (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ২/৯৬)। উল্লেখ্য যে, এই চার রাক‘আত ছালাত বিশেষ কোন ছালাত নয় এবং এশার ছালাতের সাথেও সংশ্লিষ্ট নয়। বরং এটি তাহাজ্জুদের ছালাতের অংশ হিসাবে গণ্য (ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী ২/৯৬)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি আমার খালা নবী করীম (ছাঃ)-এর সহধর্মিনী মায়মূনা (রাঃ)-এর ঘরে এক রাতে ছিলাম। নবী করীম (ছাঃ)ও সেই রাতে সেখানে ছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) জামা‘আতে এশার ছালাত আদায় করে তাঁর ঘরে চলে আসলেন এবং চার রাক‘আত ছালাত আদায় করে শুয়ে পড়লেন (বুখারী হা/১১৭; মুসলিম হা/৯০১)। উল্লেখ্য যে, উক্ত চার রাক‘আত ছালাতের ফযীলতে বলা হয়েছে যে, তা ক্বদর রাতের ছালাত আদায়ের সমতুল্য (ইবনু আবী শায়বাহ হা/৭৩৫১-৭৩৫৭; মারওয়াযী, মুখতাছার ক্বিয়ামুল লাইল হা/১৯২)। উক্ত মর্মে বর্ণিত মারফূ‘ হাদীছগুলোর সবই অত্যন্ত দুর্বল। তবে প্রায় একই মর্মে ছহীহ সূত্রে বেশ কিছু মওকূফ হাদীছ বর্ণিত হওয়ায় আলবানী (রহঃ) বলেন, এই আমলের ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনাটি মারফূ‘র পর্যায়ভুক্ত (যঈফাহ হা/৫০৬০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

প্রশ্ন (৪৭) : আয়না দেখার বিশেষ কোন দো‘আ আছে কি?

উত্তর : আয়না দেখার বিশেষ দো‘আ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলির কোনটি জাল এবং কোনটি খুবই দুর্বল (ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াউম ওয়াল লাইল হা/১৬৩-১৬৪; ইরওয়া ১/১১৫)। তবে (আয়না দেখা সহ) সাধারণভাবে যেকোন সময় নিজের সুন্দর অবয়বের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ও সুন্দর চরিত্রের প্রার্থনা করে এই দো‘আটি পাঠ করা যায়- ‘আল্লহুম্মা কামা হাস্সানতা খালক্বী ফা-আহসিন খুলুক্বী’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি যেমন আমার অবয়ব সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চরিত্র সুন্দর করে দাও’ (ইবনু হিববান হা/৯৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩০৭; ইরওয়া হা/৭৪)।

প্রশ্ন (৪৮) : ১০ই মুহাররমকে বিশেষ ফযীলত মনে করে উক্ত দিনে বিবাহের দিন ধার্য করা যাবে কি?

উত্তর : বিশেষ ফযীলত মনে করে উক্ত দিবসে বিবাহের দিন ধার্য করা যাবে না। কেননা ১০ই মুহাররমে নাজাতে মূসার শুকরিয়ার নিয়তে দু’টি নফল ছিয়াম পালন ব্যতীত এ মাসে অন্য কিছুই করণীয় নেই। যার দ্বারা বিগত এক বছরের (ছগীরা) গোনাহ সমূহ মাফ করা হয় (মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ)। এদিনকে শুভ দিন বা ফযীলতপূর্ণ দিন মনে করে বিবাহের দিন ধার্য করার পক্ষে শরী‘আতের কোন নির্দেশ নেই। এ ধরনের চিন্তাগুলি বিদ‘আতী আক্বীদা সমূহ থেকে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করছে মাত্র।

প্রশ্ন (৪৯) : কবরস্থানে জুতা পরিধান করে প্রবেশ করা যাবে কি? কবরে জুতার স্পর্শ লাগলে গোনাহ হবে কি?           

উত্তর : জুতা পায়ে দিয়ে কবরস্থানে যাওয়া নাজায়েয নয় (বুখারী হা/১৩৭৪, মুসলিম হা/২৮৭০, মিশকাত হা/১২৬)। তবে জমহূর বিদ্বানগণ বিনা প্রয়োজনে কবরস্থানে জুতা পরিধান করাকে সুন্নাতের খেলাফ বলেছেন এবং ময়লা-আবর্জনা না থাকলে পারতপক্ষে জুতা খুলে প্রবেশ করাই উত্তম বলেছেন (ইবনু কুদামা, মুগনী ২/২২৪; ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৩/২০৬; শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৪/১০৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৯/১২৩-১২৪; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৭/২০২)। কেননা রাসূল (ছাঃ) একজন লোককে সিবতী জুতা পরে কবরস্থানে চলতে দেখে বললেন, হে সিবতী জুতাওয়ালা! তোমার ধ্বংস হোক। তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল। লোকটি রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে দেখে রাগ বুঝতে পেরে জুতা খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল (আবূদাঊদ হা/৩২৩০; আহমাদ হা/২০৮০৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯১৩)। যদিও উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ত্বাহাভী, ইবনু হাযম ও খাত্ত্বাবী বলেন, হাদীছটি নিষেধাজ্ঞার অর্থে নয়, বরং জুতায় অপবিত্রতা লেগে থাকলে কিংবা বিশেষ করে সিবতী জুতার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। কেননা এই জুতা সাধারণতঃ বিলাসী লোকদের পরিধেয়, যাতে অহংকারের প্রকাশ ঘটে। আর কবরস্থানে বিনয় ও তাক্বওয়ার লেবাস পরিধানই কাম্য (খাত্ত্বাবী, মা‘আলিমুস সুনান ১/৩১৭; মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৪/১৩১-১৩২)।

প্রশ্ন (৫০) : একটি অনলাইন শপ থেকে ১০ হাযার টাকায় একটা দ্রব্য ৫০% ডিসকাউন্টে তথা ৫ হাযার টাকায় ক্রয় করার পর কোম্পানী স্টক না থাকায় তাদের কোম্পানীর নীতি অনুযায়ী পুরো ১০ হাযার টাকা ফেরৎ দিয়েছে। এক্ষণে অতিরিক্ত পাওয়া অর্থ গ্রহণ করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : উক্ত অর্থ কোম্পানীর পলিসি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয। তবে সাবধান থাকতে হবে যে, সাধারণভাবে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক থাকলে তাদের হাদিয়া গ্রহণ করা সূদ হিসাবে গণ্য। আবূ বুরদাহ (রহঃ) বলেন, আমি মদীনায় গেলাম। আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হ’ল। তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাদের এখানে আসবে না? তোমাকে আমি খেজুর ও ছাতু খেতে দেব এবং একটি (মর্যাদাপূর্ণ) ঘরে থাকতে দেব। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি এমন স্থানে (ইরাক) বসবাস কর, যেখানে সূদের কারবার অত্যন্ত ব্যাপক। যখন কোন মানুষের নিকট তোমার কোন প্রাপ্য থাকে আর সেই মানুষটি যদি তোমাকে কিছু ঘাস, খড় অথবা খড়ের ন্যায় নগণ্য বস্তুও হাদিয়া দেয়, তুমি তা গ্রহণ করো না, কেননা তা সূদের অন্তর্ভুক্ত (বুখারী হা/৩৮১৪; মিশকাত হা/২৮৩৩)। উল্লেখ যে, বর্তমানে বাযার সৃষ্টি করার জন্য এসব কোম্পানি চটকদার অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অতএব এদের সাথে লেনদেনে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

প্রশ্ন (৫১) : রাসূল (ছাঃ) মি‘রাজের রাত্রিতে জাহান্নামীদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রশ্ন হল- এখনও তো ক্বিয়ামত শুরু হয়নি। তাহলে রাসূল (ছাঃ)-কে এসব দৃশ্য কিভাবে দেখানো হল?

উত্তর : কোন বান্দা কি পাপ করবে এবং তার জন্য কি শাস্তি ভোগ করবে সবই আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। সেকারণ তিনি তাদের ভোগকৃত শাস্তি অগ্রিম প্রদর্শন করতেও সক্ষম, যা রাসূল (ছাঃ)-কে মি‘রাজে বা বিভিন্ন সময়ে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে জান্নাতের সুখ এবং জাহান্নাম ও কবরের শাস্তি তথা অদৃশ্যের বিষয় অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অতএব এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে যেভাবে সংবাদ দিয়েছেন সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে, যা ঈমানের অংশ (উছায়মীন, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২/৫৩)। 

প্রশ্ন (৫২) : ২য় বিবাহ করার পর থেকে দীর্ঘ ১৭-১৮ বছর যাবৎ পিতা আমার ও আমার মায়ের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না। বর্তমানে আমার চাচা-ফুফুরা আমাদেরকে বসতভিটা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি? এরূপ পিতার পরকালীন শাস্তি কি?

উত্তর : পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল (নিসা ৪/৩৪)। সেকারণ পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করার দায়িত্ব পিতার। এ দায়িত্ব পালন না করলে তিনি পাপী হবেন এবং তওবা না করলে যুলুমের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তির ভাগিদার হবেন (নিসা ৪/৩৪, বুখারী হা/৭১৩৮; মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫)। তবে পিতার সাথে যথাসম্ভব সম্পর্ক রাখতে হবে এবং সদাচরণ করতে হবে। সাথে সাথে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বংশীয় অভিভাবক বা সমাজের দায়িত্বশীলদের সহযোগিতায় ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর পিতার বসতভিটা থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। কারণ বসতবাড়ী পিতার সম্পদ। আর পিতার সম্পদের উত্তরাধিকারী সন্তানেরা। সুতরাং চাচা-ফুফুদের অধিকার নেই তাড়িয়ে দেয়ার। পেশী শক্তির বলে তাড়িয়ে দিলে বা সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলে ক্বিয়ামতের দিন নেকী দিয়ে পরিশোধ করতে হবে বা পাওনাদারের পাপ গ্রহণ করতে হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১২৭)। তবে সন্তানদের উচিত অধিকার বঞ্চিত হ’লেও সর্বাবস্থায় পিতার আনুগত্য করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, যদিও তারা তোমাকে তোমার সম্পদ থেকে ও কেবল তোমার জন্য নির্দিষ্ট সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে’ (মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭৯৫৬; মু‘জামুল কাবীর হা/১৫৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৬৯)। আর নিঃসন্দেহে সন্তানদের উপর যুলুমের শাস্তি পিতা দুনিয়া ও আখেরাতে পাবেন। যুলুমের শাস্তি থেকে কেউ রেহাই পাবে না (ফুছছিলাত ৪১/৪৬)।

প্রশ্ন (৫৩) : বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন মাধ্যমে একে অপরকে লিখিতভাবে দো‘আ করা হয় এবং তার জবাব দেওয়া হয়। এভাবে পরস্পরের জন্য দো‘আ করলে নেকী হবে কি?

উত্তর : লিখিত আকারে একে অপরের জন্য দোআ করা যায়। তবে লেখার সময় দোআ করার নিয়ত থাকতে হবে। আর অনুপস্থিত কারো জন্য দোআ করা নেকীর কাজ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘একজন মুসলিম তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোআ করলে তা কবুল হয়। তার মাথার নিকটে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে, যখন সে তার ভাইয়ের জন্য দোআ করে তখন নিয়োজিত ফেরেশতা বলে আমীন এবং তোমার জন্যও অনুরূপ’ (মুসলিম হা/২৭৩৩; মিশকাত হা/২২২৮)। অতএব লিখিত দোআ করলে নেকী না হওয়ার কোন কারণ নেই।

প্রশ্ন (৫৪) : ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইয়ে জানাযার ছালাত ৫-৯ তাকবীরেও পড়া যায় বলা হয়েছে। এক্ষণে চারের অধিক তাকবীরে কীভাবে ছালাত আদায় করব?

উত্তর : রাসূল (ছাঃ)-এর সবশেষ আমল ছিল তিনি চার তাকবীরে নাজাশীর জানাযার ছালাত আদায় করেছিলেন। আর এর উপরই প্রসিদ্ধ ইমামগণের অভিমত (আল-মাওসূআতুল ফিক্বহিয়া ১৩/২১১)। ইবনু কুদামা বলেন, জানাযার ছালাতের ক্ষেত্রে সুন্নাত হ’ল তা চার তাকবীরে আদায় করা, কম বা বেশী না করা (আল-মুগনী ৪/৪২৬)। তবে পাঁচ তাকবীরেও পড়া যায়। কারণ রাসূল (ছাঃ) পড়েছেন (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৭/৮২)। এক্ষণে কেউ যদি পাঁচ বা সাত অথবা নয় তাকবীরে জানাযার ছালাত আদায় করতে চায় তারা প্রতি তাকবীরের পর মাইয়েতের জন্য হাদীছে বর্ণিত অতিরিক্ত দো‘আগুলো পাঠ করতে পারে এবং সবশেষে সালাম ফিরিয়ে ছালাত শেষ করবে (হাকেম হা/১৩২৮; আবুদাউদ হা/৩২০২; আহমাদ হা/১৬৬১; আলবানী, আহকামুল জানায়েয ১২৫ পৃ:)। তবে সমাজে চার তাকবীর প্রসিদ্ধ হওয়ায় এর উপরই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ।

প্রশ্ন (৫৫) : আমার পিতা ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে আমাকে চাকুরী নিয়ে দিয়েছেন। এক্ষণে আমার জন্য উক্ত চাকুরীর বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালানো জায়েয হচ্ছে কি?

উত্তর : ঘুষ নেওয়া ও দেওয়া দু’টিই হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কে লা‘নত করেছেন (আবুদাঊদ, তিরমিযী, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৩৭৫৩)। তাই ঘুষ দিয়ে চাকরী নেওয়া জায়েয নয়। এতে একদিকে ঘুষ প্রদানের কবীরা গুনাহ হয়, অন্যদিকে ঘুষদাতা অযোগ্য হ’লে অন্য চাকরী প্রার্থীর হক নষ্ট করারও গুনাহ হয়। এক্ষণে যদি ঐ ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে চাকরীর যোগ্য বিবেচিত হয় এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে সেক্ষেত্রে তার বেতন হালাল হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তবে তাকে ঘুষ প্রদানের জন্য তওবা ও এস্তেগফার করতে হবে।

আর যদি সে তার কর্মক্ষেত্রে অযোগ্য হয় এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহ’লে তার জন্য ঐ চাকরীতে থাকা এবং বেতন নেয়া বৈধ হবে না, বরং তার উপার্জন হারাম হয়ে যাবে (বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৯/৩১-৩২)। এক্ষেত্রে তাঁর উচিৎ হবে, খালেছ নিয়তে তওবা করা এবং উত্তম রিযিক অনুসন্ধান করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। কেননা কোন ব্যক্তিই তার জন্য নির্ধারিত রিযিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না, যদিও তার রিযিক প্রাপ্তিতে কিছুটা বিলম্ব হয়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। যা হালাল তা গ্রহণ কর এবং যা হারাম তা বর্জন কর (ইবনু মাজাহ হা/২১৪৪; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৪২)।

প্রশ্ন (৫৬) : বাদ্যযন্ত্র ছাড়া যেকোন গান গাওয়া শরী‘আত সম্মত কি?

উত্তর : গানের কথা শিরক-বিদ‘আত ও অশ্লীলতা মুক্ত এবং সুন্দর অর্থবোধক হ’লে বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গাওয়া যাবে। নবী করীম (ছাঃ) কবি হাস্সান বিন ছাবিত (রাঃ)-কে বলেছিলেন, ‘হে হাস্সান! তুমি আমার পক্ষ থেকে কাফেরদের প্রতি ছন্দাকারে জবাব দাও’। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি হাস্সানকে কাফেরদের প্রত্যুত্তর করার জন্য জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাকে শক্তিশালী কর’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৭৮৯, ৪৭৯৩, ৪৮০৫ ‘বক্তৃতা প্রদান ও কবিতা-গান বলা’ অনুচ্ছেদ)। হাস্সান বিন ছাবিতের কবিতা আবৃত্তির জন্য মসজিদে একটি মিম্বর নির্মাণ করা হয়েছিল (তিরমিযী, ফাৎহুলবারী, ১/৫৪৮ পৃঃ ‘মসজিদে কবিতা আবৃত্তি’ অনুচ্ছেদ)। অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রশংসা এবং বাতিলের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে ইসলামী জাগরণী গাওয়া বা প্রচার করায় কোন বাধা নেই (আব্দুল্লাহ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৪৩৭; ফাতাওয়া ইসলামিয়াহ ৪/৩৮৯, ৫৩২-৩৩)।

প্রশ্ন (৫৭) : কোন নারীকে বিবাহিতা অবস্থায় নিজের জন্য আগাম বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া জায়েয হবে কি?

উত্তর : কোন বিবাহিতা নারীকে আগাম বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া হারাম। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যে সকল নারীকে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে বিবাহিতা নারী (নিসা ৪/২৪; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ১৯/১৯১)। এমনকি বিবাহিতা কোন নারীর সংসার ভেঙ্গে যায়, এমন কোন কাজ করা যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা দাসকে তার মনিবের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় (আবুদাউদ হা/২১৭৫; মিশকাত হা/৩২৬২; ছহীহুত তারগীব হা/২০১৪)। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানোর চেষ্টা করা কবীরা গুনাহ, যা শয়তানের কাজ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ইবলীস পানির উপর তার আরশ স্থাপন করে তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হয় সেই, যে সর্বাধিক ফিৎনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে বলে, তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণই করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত আমি তাকে ছেড়ে দেইনি। অতঃপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যাঁ, তুমি একটি বড় কাজ করেছ। বর্ণনাকারী আ‘মাশ বলেন, আমার মনে হয়, তিনি বলেছেন, অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে (মুসলিম হা/২৮১৩; মিশকাত হা/৭১)।

প্রশ্ন (৫৮) : আমি বড় ভাইয়ের টাইলসের ব্যবসায় বেশ কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছি এই শর্তে যে, ব্যবসায় তার লাভ যাই হৌক না কেন প্রতি লাখে প্রতি মাসে তিনি আমাকে দুই হাযার টাকা লাভ দিবেন। এরূপ চুক্তি শরী‘আত সম্মত কি?

উত্তর : এরূপ চুক্তি শরী‘আত সম্মত নয়। কারণ হাদীছ মোতাবেক ‘মুযারাবা’ পদ্ধতিতে ব্যবসা করা যায়। যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ব্যবসার জন্য অর্থ প্রদান করবে। আর লাভ-ক্ষতি নির্দিষ্ট হারে উভয়ের মাঝে বণ্টিত হবে। উভয়ের সম্মতিতে এরূপ ব্যবসা বৈধ (নিসা ২৯; ইরওয়া হা/১৪৭০-৭২ ‘মুযারাবা’ অধ্যায় ৫/২৯০-৯৪ পৃঃ)। কিন্তু লাভ হোক বা ক্ষতি হোক সর্বাবস্থায় নির্দিষ্ট হারে লাভ দিতে হবে এমন চুক্তি শরী‘আত সম্মত নয়।

প্রশ্ন (৫৯) : সপ্তম দিনে শিশুর আক্বীক্বার পশু যবেহ করার পূর্বে কি মাথা মুন্ডন করা যাবে?

উত্তর : সুন্নাত হ’ল সপ্তম দিনে শিশুর জন্য আক্বীক্বা দেওয়ার পরে তার মাথা মুন্ডন করা। সপ্তম দিনে শিশুর নাম রাখবে, এরপর আক্বীক্বা করবে, এরপর মাথা ন্যাড়া করবে এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য ছাদাক্বা করবে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৬/১০৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১০/১৫; বিস্তারিত ‘মাসায়েলে কুরবানী ও আক্বীক্বা’ বই দ্রঃ)। তবে অনেক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে প্রচুর চুল নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। উক্ত চুল যদি শিশুর জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে তবে সপ্তম দিনের পূর্বেও মাথা মুন্ডন করা যাবে (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৫/২১৫)।

প্রশ্ন (৬০) : মোবাইলে কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণকালে সিজদায়ে তেলাওয়াতের আয়াতসমূহ আসলে করণীয় কি?

উত্তর : মোবাইল বা যেকোন মাধ্যমে সিজদার আয়াত শ্রবণ করলে সিজদা দেওয়া উত্তম। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করতেন এবং আমরা তাঁর নিকট থাকতাম, তখন তিনি সিজদা করতেন এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে সিজদা করতাম। এতে কখনও এত ভিড় হ’ত যে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সিজদা করার জন্য কপাল রাখার জায়গা পেত না (বুখারী হা/১০৭৬; মিশকাত হা/১০২৫)। তবে এটি ওয়াজিব নয়। কেননা যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা না করলে রাসূল (ছাঃ)ও সিজদা দেননি (আবূদাউদ হা/১৪০৪; তিরমিযী হা/৫৭৬; দারেমী হা/১৪৭২, সনদ ছহীহ)।

প্রশ্ন (৬১) : ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন মর্মে যে বর্ণনাটি এসেছে সেটি কি ছহীহ?

উত্তর : উক্ত মর্মে বর্ণিত আছারটি ছহীহ (ছহীহুত তারগীব হা/৩৪৯; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/২১১৯)। তবে এটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ইজতিহাদ। যা কোন কারণবশতঃ হয়ে থাকবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিয়ো না। আর যখন তারা বাইরে বের হবে, তখন অবশ্যই যেন সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকে’ (বুখারী হা/৯০০; মুসলিম হা/৪৪২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৪৫৭; ইবনু কাছীর ৬/৪০৯; ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ২/৩৪৯)।

প্রশ্ন (৬২) : আমার একটি জমি আছে যেটি মসজিদসহ একটি মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য দান করতে চাই। তবে আমার বসবাসের জন্য কোন জমি না থাকায় উক্ত কমপ্লেক্সের নির্দিষ্ট একটি অংশকে আমি বসতবাড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে চাই, যা দানপত্রের শর্তে উল্লেখ থাকবে। এক্ষেত্রে শারঈ কোন বাধা আছে কি?

উত্তর : এমন শর্তে দান করায় কোন বাধা নেই। এক্ষেত্রে বসবাসের জন্য অংশটুকু বা তার মূল্য বাদে অবশিষ্ট অংশ দান হিসাবে গণ্য হবে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৫/১২০-২২)।

প্রশ্ন (৬৩) : যাকাতের অর্থ কর্যে হাসানা বা সূদমুক্ত ঋণ প্রকল্পে ব্যয় করা যাবে কি?

উত্তর : যাকাতের অর্থ যাকাতের নির্দিষ্ট খাতেই বণ্টন করতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এর জন্য নির্দিষ্ট খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন (তওবাহ ৯/৬০)। আল্লাহ তা‘আলা যাকাতকে গরীবের হক বা অধিকার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এটি ঋণ হিসাবে উল্লেখ করেননি (যারিয়াত ৫১/১৯; মুজাদালা ৫৮/২৪-২৫)। অপরদিকে করযে হাসানাহ একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টিসহ প্রভূত কল্যাণ লাভ করা যায়। যা নিজের মূল সম্পদ থেকে দিতে হয় (হাদীদ ৫৭/১১,১৮; তাগাবুন ৬৪/১৭; মায়েদাহ ৫/১২; ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৪/১৮৩-৮৪; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৫/২৪-২৬)। সুতরাং যাকাতের অর্থ অনুরূপ কোন ঋণ প্রকল্পে ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন (৬৪) : এ বছর যারা হজ্জের নিয়ত করেছিলেন, হজ্জ স্থগিত হওয়ার কারণে তাদেরকে কি আগামী বছর হজ্জে যাওয়ার নিয়ত করা যরূরী, না যেকোন সময় করলেই হবে? যদি কেউ আগামী বছর হজ্জের নিয়তের পর হজ্জের পূর্বেই মারা যান, তবে কি তিনি হজ্জের ছওয়াব পাবেন?

উত্তর : পরিস্থিতির কারণে যারা এ বছর হজ্জে যেতে পারছেন না, তাদের জন্য আগামী বছরই হজ্জে যাওয়ার নিয়ত করা যরূরী। কেননা হজ্জ ফরয হওয়ার পর তা যতদ্রুত সম্ভব আদায় করাই কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্জের সংকল্প করে, সে যেন তা দ্রুত সম্পন্ন করে’ (আবুদাঊদ হা/১৭৩২, মিশকাত হা/২৫২৩ ‘মানাসিক’ অধ্যায়)। আর কেউ যদি নিয়ত করার পর পরবর্তী হজ্জ আসার পূর্বে মারা যান তাহ’লে নিয়তের কারণে তিনি হজ্জের ছওয়াব পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ (বুখারী হা/৭৫০১; মিশকাত হা/২৩৭৪)। তবে হজ্জ পালনকারী হিসাবে গণ্য হবেন না। কিন্তু তিনি যদি হজ্জের সফরে বের হয়ে পথিমধ্যে মারা যান, তবে হজ্জ পালনকারীর মর্যাদা পেয়ে যাবেন। আল্লাহ বলেন, আর যে ব্যক্তি তার ঘর থেকে বের হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করার উদ্দেশ্যে, অতঃপর মৃত্যু তাকে গ্রাস করে। তার প্রতিদানের ভার আল্লাহর উপর ন্যস্ত হয়েছে, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময় (নিসা ৪/১০০)।

প্রশ্ন (৬৫) : কোন পশু সুস্থ হ’লে ছাদাক্বা করার মানত করা হয়েছে। এক্ষণে সেই পশু দিয়ে কুরবানী করা যাবে কি? কিংবা আইয়ামের তাশরীকের দিনগুলোতে এটি যবেহ করা যাবে?

উত্তর : মানত ও কুরবানী দু’টি পৃথক ইবাদত। মানত ওয়াজিব, কুরবানী সুন্নাত। এছাড়া মানতের পশু ছাদাক্বার জন্য নির্ধারিত এবং সেই পশুর পুরোটাই ছাদাক্বা করতে হয়। সুতরাং উক্ত পশু কুরবানীর জন্য নির্ধারণ করা যাবে না। অতএব যদি সামর্থ্য থাকে তবে ভিন্ন পশু দিয়ে কুরবানী করবে নতুবা করবে না। আর উক্ত পশুটিকে কুরবানীর দিনসহ আইয়ামের তাশরীকের যে কোন দিন যবেহ করা যাবে, তবে তা কুরবানী হিসাবে গণ্য হবে না (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ২৪/৪০৯)।

প্রশ্ন (৬৬) : কাউকে বিভিন্ন ভাবে উপকার করা সত্ত্বেও সে যদি বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে অকৃতজ্ঞ আচরণ করে, তবে ক্রোধবশত তাকে প্রদত্ত সুবিধাদি কেড়ে নেওয়া উচিৎ হবে কি?

উত্তর : বিষয়টি পরিস্থিতি ও অপরাধের উপর নির্ভর করবে। তবে সাধারণভাবে কৃত অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে কাউকে প্রদত্ত সুবিধা কেড়ে নেওয়া উচিৎ নয়। যেমনভাবে আয়েশা (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যেনার অপবাদ দেওয়া হ’লে তাতে মিসত্বাহ বিন আছাছাহ যোগ দেন। এতে আবুবকর (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে তাকে কোন ধরনের সহযোগিতা না করার অঙ্গীকার করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন ‘তোমাদের মধ্যে যারা সম্পদ ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন শপথ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্তদেরকে এবং আল্লাহর পথে যারা গৃহত্যাগ করেছে, তাদেরকে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদের মার্জনা করে দেয় ও দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যায়। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (নূর ২৪/২৪; বুখারী হা/২৬৬১; মুসলিম হা/২৭৭০)। তাছাড়া যে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে তা দানের শামিল। আর দান ফিরিয়ে নেওয়া নিজ বমন খাওয়ার সমতুল্য, যা হারাম (আবূদাঊদ হা/৩৫৩৯; মিশকাত হা/৩০২১; ছহীহাহ হা/১৬৯৯)। অপরদিকে প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক আখেরাতে নিজ কৃতকর্মের জন্য শাস্তি ভোগ করবে এবং দুনিয়াতে সে ধিকৃত হবে।

প্রশ্ন (৬৭) : আমের মুকুল বের হওয়ার পূর্বে বাগানের ফল বিক্রি করা জায়েয হবে কি? কেউ যদি ফল আসার পূর্বেই গোটা বাগান ক্রয় করে, তবে তা সিদ্ধ হবে কি-না?

উত্তর : মুকুল আসার পূর্বে ফল বিক্রি করা জায়েয হবে না। কারণ জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) ফল পরিপক্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এবং কয়েক বছরের মেয়াদে কোন গাছের বা বাগানের ফল বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন (বুখারী হা/২১৯৪-৯৬; মুসলিম হা/১৫৩৬; মিশকাত হা/২৮৪১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৯৩২)। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘বলতো, আল্লাহ তা‘আলা যদি ফল নষ্ট করে দেন, তবে কিসের বিনিময়ে তোমার ভাইয়ের মাল গ্রহণ করবে’? (বুখারী হা/২২০৮; মুসলিম হা/১৫৫৫)। অতএব এরূপ অস্পষ্ট ও একপাক্ষিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত ক্রয়-বিক্রয় জায়েয নয়। বরং গাছের আম ‘মুযারাবা’ অংশীদারী চুক্তিতে বর্গা দিতে পারে (মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/২৫৩৪-৩৫; ইরওয়া ৫/২৯২, হা/১৪৬৯-এর আলোচনা ‘মুযারাবা’ অনুচ্ছেদ)। অর্থাৎ জমির মালিক ও ফলের ক্রেতার মধ্যে লাভ-লোকসান অংশীদারী ভিত্তিতে ব্যবসায়িক চুক্তি হ’তে পারে।

দ্বিতীয়তঃ ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম ও শায়খ উছায়মীনসহ একদল বিদ্বানের মতে, গাছে মুকুল আসার পূর্বেই যদি বাগান ভাড়া দেওয়া হয়, তবে তা জায়েয। তাদের বক্তব্য, এটিই ওমর (রাঃ)-এর অভিমত এবং এ ব্যাপারে কোন ছাহাবী তাঁর বিরোধিতা করেননি (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩০/১৫১-১৫২; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ৬/২০৩-২০৮; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৮৪-৮৫)। যেমন ওমর (রাঃ)-এর নিকট একজন ইয়াতীম ছিল। তিনি তার সম্পদগুলো তিন বছরের জন্য ভাড়া দিয়ে দেন (ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৩২৫৮, ২৩৭২১, সনদ ছহীহ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, উসায়েদ বিন হুযায়ের মারা গেলে তার কিছু ঋণ ছিল। তখন ওমর (রাঃ) তার বাগানটি দু’বছরের জন্য ভাড়া দিয়ে তার ঋণ পরিশোধ করেন (ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৩২৬০, ২৩৭২৩, সনদ যঈফ)। আর ‘কয়েক বছরের জন্য গাছ বা বাগান বিক্রয় নিষিদ্ধ’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটির জওয়াবে বিদ্বানগণ বলেন, বাগানের ক্রেতা যদি গাছের দেখাশুনা, পানি সেচ থেকে শুরু করে সার্বিক দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে, তবে এটা হাদীছের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না। কেননা এটি জমি ভাড়া দেয়ার মতই (উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/৮৩-৮৪)। এজন্য ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, বাগান ভাড়া নেওয়া জমি ভাড়া নেওয়ার মতই। কারণ বাগান চাষাবাদ করে ফল ফলানো হয়, যেমন জমি চাষ করে ফসল ফলানো হয়। সুতরাং দুনিয়ায় যদি কোন বিশুদ্ধ ক্বিয়াস থাকে তাহ’লে এটি সেটি (আহকামু আহলিয যিম্মাহ ১/২৬৩-৬৪)।

প্রশ্ন (৬৮) : হজ্জকারী ব্যক্তি হজ্জের দো‘আসমূহ সঠিকভাবে পড়তে না পারলে তার হজ্জ কবুল হবে কি?

উত্তর : হজ্জ হয়ে যাবে। তবে নেকীতে ঘাটতি হবে (আহমাদ হা/১৮৯১৪, ছহীহুল জামে‘ হা/১৬২৬)। সেকারণ হজ্জে গমনের পূর্বে প্রয়োজনীয় দো‘আগুলো গুরুত্বের সাথে মুখস্থ করা যরূরী।

প্রশ্ন (৬৯) : সদ্যপ্রসূত শিশুকে কোলে নিলে শরীর বা কাপড় কি নাপাক হয়ে যায়?

উত্তর : সদ্যজাত শিশুর শরীরে লেগে থাকা পানি পবিত্র। অতএব তার দেহে ও মাথায় থাকা পানি কাপড়ে লেগে গেলে কাপড় অপবিত্র হবে না। তবে সতর্কতাস্বরূপ ধুয়ে নেয়াই উত্তম (ঊছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/২১৪; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিইয়াহ ৪২/১১৫)।

প্রশ্ন (৭০) : জনৈক ব্যক্তির প্রথমা স্ত্রীর দু’সন্তান ও দ্বিতীয় স্ত্রীর সাত সন্তান। প্রথমা স্ত্রীর বড় ছেলের পাঁচ সন্তান ও ছোট ছেলে নিঃসন্তান। প্রথমা স্ত্রীর বড় ছেলে মারা গেছে এবং তার দুই ছেলে আছে। এক্ষণে প্রথমা স্ত্রীর ছোট ছেলে মারা গেলে বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা সম্পত্তির ওয়ারিছ হবে, নাকি আপন ভাতিজারা ওয়ারিছ হবে?

উত্তর : ব্যক্তির আপন ভাই ও বোন না থাকায় বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা ফারায়েয বণ্টনের পর আছাবা হিসাবে সম্পত্তির ওয়ারিছ হবে। বৈমাত্রেয় ভাইয়ের বর্তমানে আপন ভাতিজারা ওয়ারিছ হবে না। কারণ বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা ভাতিজাদের তুলনায় নিকটতম। তবে ব্যক্তি চাইলে ভাতিজাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সম্পদ অছিয়ত করে দিতে পারেন। বরং তাদের জন্য অছিয়ত করা মুস্তাহাব। এক্ষেত্রে লিখিতভাবেও অছিয়ত করতে পারেন (বাক্বারা ২/১৮০; বুখারী হা/৫৬৬৮; মুসলিম হা/১৬২৮; মিশকাত হা/৩০৭১)।

প্রশ্ন (৭১) : সন্তানের আক্বীক্বা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কেউ দিতে পারবে কি?

উত্তর : পিতাই সন্তানের আক্বীক্বার জন্য মূল দায়িত্বশীল। তবে সামর্থ্য না থাকলে বা কষ্টকর হ’লে পিতার সম্মতিক্রমে আত্মীয়-স্বজন বা অন্যেরাও শিশুর আক্বীক্বা দিতে পারে (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৯/৫৯৫; তোহফাতুল আহওয়াযী ৫/৯৫)। রাসূল (ছাঃ) তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইনের আক্বীক্বা করেছিলেন (আবূদাঊদ হা/২৮৪৮; মিশকাত হা/৪১৫৫; ইরওয়া হা/১১৬৪)।

প্রশ্ন (৭২) : ঘুমের মধ্যে মন্দ স্বপ্ন দেখি ও ভয় পাই। মাঝে মধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এসব থেকে বাঁচার জন্য করণীয় কি?

উত্তর : মন্দ স্বপ্ন দেখলে করণীয় হ’ল; ১. ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে বাম দিকে ৩ বার থুক মারা, ২. তিন বার আ‘ঊযুবিল্লা-হি মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম বলা ৩. পার্শ্ব পরিবর্তন করা এবং এই খারাপ স্বপ্নের কথা কারো নিকটে প্রকাশ না করা (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬১২-১৪)। এরপরেও যদি ভয় দূর না হয়, তাহ’লে উঠে ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে (বুখারী হা/৭০১৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৯০৬; ছহীহাহ হা/১৩৪১; মিশকাত হা/৪৬১৪)। এছাড়া মন্দ স্বপ্ন থেকে বাঁচার জন্য শোয়ার পূর্বে ভালভাবে ওযূ করবে, আয়াতুল কুরসী পড়বে, সূরা নাস, ফালাক, ইখলাছ পড়ে ফু দিয়ে নিজের সারা শরীর তিনবার বুলাবে এবং শয়তানের কাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে দো‘আসমূহ পড়বে (বুখারী হা/২৪৭, ২৩১১, ৫০১৬; আবূদাঊদ হা/৩৮৯৩)।

প্রশ্ন (৭৩) : হিন্দুদের সম্পত্তি মুসলমানদের নামে রেকর্ড হয়েছে। ঐসব হিন্দু মালিকরা কোথায় আছে তাও জানা নেই। এরূপ সম্পদের ক্ষেত্রে করণীয় কি?

উত্তর : যদি সাধারণভাবে নিয়মমাফিক (এনিমি/ভেস্টেড প্রোপার্টি এ্যাক্ট মোতাবেক) মুসলমানদের নামে রেকর্ড করা হয়ে থাকে তাহ’লে যাদের নামে রেকর্ড হয়েছে তারা ভোগ করবে। তবে যদি কোন হিন্দুর প্রতি অন্যায় করে নিজেদের নামে রেকর্ড করা হয়ে থাকে তাহ’লে অবশ্যই সেটি যুলুম হয়েছে। সেজন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। আর যদি হিন্দুদের আত্মীয়-স্বজন খুঁজে পাওয়া যায় তাহ’লে তাদের নিকট উক্ত সম্পদ ফিরিয়ে দিবে। কারণ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যে কারো সম্পদ যুলুম করে ভোগ করা হারাম (বাক্বারা ২/২৭৯; ইমাম শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ৪/২৮৪; ফাৎহুল বারী ৫/৩৪১)।

প্রশ্ন (৭৪) : আমার পিতা ২০১২ সালে সঊদী আরবে মৃত্যুবরণ করলে সেখানেই কবরস্থ হন। এখন তার কবরের অংশবিশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা যাবে কি?

উত্তর : শারঈ প্রয়োজন ব্যতীত কবর স্থানান্তর করা জায়েয নয় (বুখারী হা/১৩৫১-৪২; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/৩০৩; নববী, আল-মাজমূ‘ ৫/২৭৩)। প্রশ্নানুযায়ী কবর স্থানান্তরের পেছনে শারঈ কোন ওযর আছে বলে মনে হয় না। এক্ষণে যদি এতে দুনিয়াবী উদ্দেশ্য থাকে, তবে একাজ থেকে বিরত থাকা যরূরী।

প্রশ্ন (৭৫) : কোন ব্যক্তি সূদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছে না। এক্ষণে তার কোন আত্মীয় বা ছেলেমেয়ে যদি উক্ত ঋণ পরিশোধ করে দেয় তবে ঋণ শোধকারী না ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তি গুনাহগার হবে?

উত্তর : এক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারীই এককভাবে গুনাহগার হবে, আত্মীয়রা নয়। কারণ আল্লাহ বলেন, ‘একের পাপের বোঝা অন্যে বইবে না’ (আন‘আম ৬/১৬৪)। আর আত্মীয়-স্বজনদের কর্তব্য হবে ভবিষ্যতে উক্ত ব্যক্তি যেন সূদের সাথে জড়িত না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। কারণ সূদ পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধ। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যারা সূদ খায়, সূদ দেয়, সূদের হিসাব লেখে এবং সূদের সাক্ষ্য দেয়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উপর লা‘নত করেছেন এবং বলেছেন, অপরাধের ক্ষেত্রে এরা সকলেই সমান’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮০৭)।

প্রশ্ন (৭৬) : সম্প্রতি তুরষ্কে আয়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তর নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এভাবে কোন গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : আয়া সোফিয়া ৫৩৭ খৃষ্টাব্দে বাইজান্টাইন সম্রাট কর্তৃক নির্মিত গির্জা, যেটি সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৪৫৩ সালে ওছমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ ইস্তাম্বুল বিজয়কালে এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। এটি কোন অন্যায় বা স্বেচ্ছাচারিতামূলক সিদ্ধান্ত ছিল না। কেননা বিজিত এলাকায় অমুসলিমদের কোন উপাসনালয়কে মসজিদে রূপান্তরের জন্য ইসলামী শরী‘আতের আলোকে যেসব নীতিমালা ওলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন, তা এখানে পূর্ণভাবে অনুসৃত হয়েছে। যেমন: (ক) যদি বিজিত এলাকাটি সন্ধির মাধ্যমে অধিকৃত হয়, তবে সন্ধিচুক্তি অনুসারে তার হুকুম নির্ধারিত হবে। (খ) আর যদি সরাসরি দখলীকৃত ভূখন্ড হয়, তবে সেটা শাসকের ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। হয় তিনি উপাসনালয়কে মসজিদে পরিণত করবেন, নতুবা মাছলাহাত বা কল্যাণ বিবেচনায় অমুসলিমদের জন্য ছেড়ে দিবেন (ইবনু তায়মিয়া, মাসাআলাতুন ফিল কানাইস, ১২২-১২৩; ইবনুল কাইয়িম, আহকামু আহলিয যিম্মাহ ৩/১১৯০-৯২)। যেহেতু ওছমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ যুদ্ধের মাধ্যমেই ইস্তাম্বুল জয় করেছিলেন। অতএব তাঁর জন্য আয়া সোফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করায় কোন বাধা ছিল না। তদুপরি তিনি গির্জাটি সরাসরি মসজিদে পরিণত না করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে সেটি ক্রয় করে নিয়েছিলেন। এমনকি সেখানে রাষ্ট্রের বায়তুল মাল থেকেও কোন অর্থ নেননি; বরং নিজ সম্পদ থেকে ক্রয় করে মসজিদটিকে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। যার দলীলপত্র তুর্কী রাষ্ট্রীয় মহাফেযখানায় অদ্যাবধি সংরক্ষিত রয়েছে (দ্র. আল-জাযীরা নিউজ, কাতার, ১০.০৭.২০)।   

প্রশ্ন (৭৭) : সম্প্রতি এক লঞ্চডুবিতে অনেক লোক মারা গেছেন। এক্ষেত্রে তাদের জন্য আমভাবে শাহাদতের দো‘আ করা যাবে, নাকি শর্তযুক্তভাবে দো‘আ করতে হবে? কেননা তাদের মধ্যে অনেকে শিরক-বিদ‘আতে যুক্ত থাকতে পারে।

উত্তর : পাবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করেছেন (বুখারী হা/৬৫৩; মুসলিম হা/১৯১৫; মিশকাত হা/১৫৪৬)। তবে নিঃসন্দেহে এই মর্যাদা পেতে গেলে তাঁকে শিরক-বিদ‘আতমুক্ত ও বিশুদ্ধ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলিম হ’তে হবে (মিরক্বাত হা/৩৮৩৯-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ)। উল্লেখ্য যে, এরূপ ক্ষেত্রে তাদের জন্য দো‘আ করার সময় মুসলিম বা মুমিনদেরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করে দো‘আ করতে হবে। কারণ কাফির ও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা জায়েয নয় (তওবা ১১৩; নববী, আল-মাজমূ‘ ৫/১৪৪)। আর সুধারণার ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আমভাবে দো‘আ করলে সমস্যা নেই।

প্রশ্ন (৭৮) : সমকামিতায় লিপ্ত না থাকলেও পশ্চিমা উদারতাবাদে বিশ্বাসী কিছু ব্যক্তি সমকামীদেরকে জিনগত ত্রুটিযুক্ত হিসাবে ধারণা করে তাদের সমকামিতার অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে কথা বলে। ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে এদের হুকুম কী?

উত্তর : সমকামিতা জিনগত বা মানসিক কোন সমস্যা নয়। বরং আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলো সর্বশেষ গবেষণায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, সমকামিতার পিছনে জিনগত কোন প্রভাব নেই (দ্র. উইকলি ন্যাচার সাইন্টিফিক জার্নাল, লন্ডন, ২৯শে আগস্ট ২০১৯)। বরং এটি চারিত্রিক সমস্যা। সুতরাং সমকামিতা প্রাকৃতিক বলে হালকা করে দেখা এবং পশ্চিমাদের অনুকরণে সমকামিতাকে স্বীকৃতি প্রদান করা গর্হিত অপরাধ। একজন মুসলিমের পক্ষে কখনও এমন কোন অপরাধের পক্ষে অবস্থান নেয়া সম্ভব নয়, যাকে ইসলামী শরী‘আত নিকৃষ্ট কবীরা গুনাহ বলে ঘোষণা করেছে। সমকামিতা এমন ঘৃণ্যতম অপরাধ, যার কারণে বিগত যুগে আল্লাহ তা‘আলা কওমে লূতকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (আ‘রাফ ৭/৮০-৮৪; হিজর ১৫/৭২-৭৬)। ইসলামে সমকামিতার শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা যাকে লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মত পুরুষে পুরুষে অপকর্ম করতে দেখবে তাদের উভয়কে হত্যা কর (তিরমিযী হা/১৪৫৬; আবূদাঊদ হা/৪৪৬২; মিশকাত হা/৩৫৭৫)। তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কওমে লূতের ন্যায় অপকর্মকারীদের প্রতি লা‘নত করেছেন, তিনি একথাটি তিনবার বলেন (আহমাদ হা/২৯১৫; ছহীহাহ হা/৩৪৬২)। সুতরাং যারা সরাসরি সমকামিতায় জড়িত না থেকেও তথাকথিত উদারতাবাদের নামে এই অপরাধকে স্বীকৃতি দেবে, তারাও সমান পাপী। তবে এদের শাস্তি ভিন্ন। ইসলামী আদালত তাদের পাপের মাত্রা অনুযায়ী তা‘যীর বা শাস্তি নির্ধারণ করবে।

প্রশ্ন (৭৯) : হিন্দুরা ‘তুলসী’ গাছের পূজা করে থাকে। এক্ষণে উক্ত গাছ ঔষধের প্রয়োজনে মুসলমানরা ব্যবহার করতে পারবে কি?

উত্তর : হিন্দুদের তুলসী গাছ পূজার কারণে তা মুসলমানদের জন্য ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা এবং ঔষধের প্রয়োজনে বাড়ীতে লাগানো শরী‘আত পরীপন্থী নয়। কেননা আল্লাহ পাক বলেন, ‘আল্লাহ পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তোমাদের কল্যাণের জন্য’ (বাক্বারাহ ২/২৯)। তবে কারো যদি এরূপ বিশ্বাস থাকে যে, ‘তুলসী গাছ’ হিন্দুদের উপাস্য হওয়ায় মর্যাদাবান, তাহ’লে তা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে।

প্রশ্ন (৮০) : জুম‘আ বা বিভিন্ন খুৎবায় পঠিত ‘খুৎবাতুল হাজতে’র শব্দগুলি কি সুনির্দিষ্ট? জুম‘আতে এবং বিবাহে খুৎবাতুল হাজত পাঠের হুকুম কি? যে কোন বক্তব্য ও লেখনীর শুরুতে খুৎবাতুল হাজত কি যরূরী?

উত্তর : খুৎবাতুল হাজত রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে নির্দিষ্ট কিছু শব্দে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের দু’টি তাশাহহুদ শিখাতেন একটি ছালাতে পড়ার জন্য, অপরটি খুৎবাতুল হাজতের জন্য (তিরমিযী হা/১১০৫; মিশকাত হা/৩১৪৯, সনদ ছহীহ)। বিবাহকালে ‘খুৎবাতুল হাজত’ বা বিবাহের খুৎবা পাঠ করা সুন্নাত। তবে জুম‘আয় খুৎবাতুল হাজত পাঠ করা ওয়াজিব। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যেসব খুৎবায় (বক্তৃতায়) তাশাহহুদ পাঠ করা হয় না তা পঙ্গু হাতের সমতুল্য’ (আবূদাঊদ হা/৪৮৪১; মিশকাত হা/৩১৫০; ছহীহাহ হা/১৬৯)। এক্ষণে লেখনী বা সাধারণ বক্তব্যের পূর্বে খুৎবাতুল হাজত পাঠ করা যরূরী নয়। সেজন্য ইমাম বুখারীসহ অধিকাংশ মুহাদ্দিছ তাঁদের সংকলিত হাদীছ গ্রন্থসমূহে খুৎবাতুল হাজত লেখেননি। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে লেখা পত্রে খুৎবাতুল হাজত লেখেননি। অতএব বিবাহে এটি পাঠ করা সুন্নাত, জুম‘আয় ওয়াজিব ও সাধারণ অবস্থায় মুস্তাহাব (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ১৮/২৮৭; ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৯/১, ৭/২২০; আলবানী, খুৎবাতুল হাজাত ১/৩৫-৪২)। উল্লেখ্য যে, খুৎবার মূল বিষয়বস্ত্ত তথা হামদ-ছানা ও দরূদ পাঠ অক্ষুণ্ণ রেখে ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন আলংকারিক বাক্যে খুৎবা পাঠ করে থাকেন। এতে দোষের কিছু নেই।

প্রশ্ন (৮১) : কবর সংরক্ষণের জন্য কবরের চার পার্শ্বে প্রাচীর দেয়া কি নিষিদ্ধ?

উত্তর : গোরস্থানের সীমানা প্রাচীর থাকলে ব্যক্তিবিশেষের কবরকে কেন্দ্র করে চারপার্শ্বে প্রাচীর দেওয়া যাবে না (আলবানী, তাহযীরুস সাজেদ ৮৯ পৃ.)। তবে কবরস্থানে সীমানা প্রাচীর না থাকলে কিংবা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কবরের চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা যাবে বা প্রাচীর দেওয়া যাবে (ফাতাওয়া মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ৩/২১১-১২)। উল্লেখ্য যে, কবরের উপর কোন ধরনের ভবন নির্মাণ করা যাবে না। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) কবরকে পাকা করতে, তার উপরে ঘর নির্মাণ করতে, তার উপরে বসতে ও নাম লিখে রাখতে নিষেধ করছেন’ (মুসলিম হা/৯৭০; মিশকাত হা/১৬৭০)। এছাড়া কবরে নামফলক লিখে রাখা, ভক্তিমূলক বক্তব্য লিখে রাখা, কবরকে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত করা ইত্যাদি খৃষ্টানদের সংস্কৃতি, যা পরিত্যাজ্য।

প্রশ্ন (৮২) : শী‘আদের তা‘যিয়া মিছিলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই। কখন ও কোথায় এই মিছিলের সূচনা হয়েছিল?

উত্তর : বাগদাদের আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুক্বতাদিরের শাসনামলে (৩৩৪-৩৬৩ হি./৯৪৬-৯৭৪ খৃ.) তাঁর শক্তিশালী শী‘আ আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে মু‘ইযযুদ্দৌলা হযরত হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদত বার্ষিকী স্মরণে ৩৫২ হিজরীর ১০ই মুহাররমকে ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন। তিনি মহিলাদের শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহরে ও গ্রামে সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারী হ’লে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে (আশূরায়ে মুহাররম পৃ. ১৬-১৭)।

আর তা‘যিয়া হ’ল আরবী তা‘যিয়া (التَّعْزِيَةُ) শব্দের প্রতিরূপ। এর অর্থ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বা যে কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দেওয়া ও তার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা। কিন্তু ৬১ হিজরীতে হোসায়েন (রাঃ) কারবালায় শহীদ হওয়ার পর থেকে ৩৫২ হিজরী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের কোথাও এদিনটিকে শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়নি। সুতরাং এই দিনে শোক পালন করা একটি নবাবিষ্কৃত রীতি। তাছাড়া মৃত ব্যক্তির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে তিনদিন শোক প্রকাশ করা যায়; এর বেশী নয় (বুখারী হা/১২৮০; মুসলিম হা/১৪৮৬)। এর সাথে যোগ হয়েছে তা‘যিয়া মিছিলের বিদ‘আতী অনুষ্ঠান, যা কিনা স্বয়ং শী‘আদের আঁতুড়ভূমি ইরানেও প্রচলিত নয়। এই রেওয়াজ কেবল ভারত উপমহাদেশে দেখা যায়। মোগল বাদশাহ আকবরের সময় আগ্রা দূর্গ থেকে তা‘যিয়া মিছিল বের হ’ত। এতে অন্যান্য রেওয়াজের সাথে শোকের চিহ্ন হিসাবে হুসায়েন (রাঃ)-এর সমাধির প্রতিকৃতি বহন করা হয় এবং মিছিল শেষে সেই প্রতিকৃতি হিন্দুয়ানী প্রথার অনুকরণে নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়। সুন্নী মুসলমানরা এমনকি অনেক সময় হিন্দুরাও এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। শোকের চেয়ে এতে উৎসবই প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে মোগল সুবেদার শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯খ্রি.)-এর আমলে শী‘আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত তখন থেকেই এদেশে তা‘যিয়া মিছিলের প্রচলন হয় (বাংলাপিডিয়া)। এ অঞ্চলের পরবর্তী শাসক ও নবাবেরাও শী‘আ  ছিলেন।  ফলে  এদেশের  মুসলমানদের জীবনাচরণে শী‘আ প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বস্ত্ততঃ শোক দিবস পালন কিংবা তা‘যিয়া মিছিল অনুষ্ঠানের কোন ভিত্তি ইসলামে নেই, যা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

প্রশ্ন (৮৩) : ওয়াক্তিয়া মসজিদ, জামে মসজিদ এবং গৃহাভ্যন্তরে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ে ছওয়াবের তারতম্য হবে কি?

উত্তর : বাড়িতে জামা‘আতে ছালাত আদায় অপেক্ষা ওয়াক্তিয়া মসজিদে ছালাত আদায়ে অধিক ছওয়াব রয়েছে (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ২/১৩৫; মিরকাত ২/৫৯৪)। কেননা প্রথমতঃ রাসূল (ছাঃ) মসজিদেই জামাআ‘তে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যা ওয়াজিব (বুখারী হা/৬৪৪; মুসলিম হা/৬৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৭৯৩)। তাছাড়া ইবনু মাসঊদের হাদীছে বলা হয়েছে, যেখান থেকে আযান দেওয়া হয় (মুসলিম হা/৬৫৪; মিশকাত হা/১০৭২)। আর আযান মসজিদ থেকেই দেওয়া হয়। কোন বাড়ি বা দোকান থেকে নয়। দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ) মসজিদে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ে অধিকতর ছওয়াব প্রাপ্তির কথা বলেছেন (বুখারী হা/৬৪৭; মিশকাত হা/৭০২)। তৃতীয়তঃ হাদীছে মসজিদে হেঁটে গেলে বহুগুণ ছওয়াবের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এমনকি পূর্ণ হজ্জ ও ওমরাহর নেকীর কথাও এসেছে (আবুদাউদ হা/৫৫৮; মিশকাত হা/৭২৮)। আর ওয়াক্তিয়া মসজিদ অপেক্ষা জুম‘আ মসজিদে মুছল্লী সংখ্যা বেশী হ’লে সেখানেও ছওয়াবের তারতম্য রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দু’জনে জামা‘আতে ছালাত আদায় করা উত্তম একাকী ছালাত আদায়ের চেয়ে। বহুসংখ্যক লোকের জামা‘আতে ছালাত আদায় করা উত্তম দু’জনে ছালাত আদায় করার চেয়ে উত্তম। আর এটা আল্লাহর নিকট অতীব প্রিয়’ (আবুদাউদ হা/৫৫৪; মিশকাত হা/১০৬৬; ছহীহুত তারগীব হা/৪১১)। তবে কেউ শারঈ ওযরের কারণে বাড়িতে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করলে মসজিদে ছালাত আদায়ের সমতুল্য ছওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ (ওছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৪/৩২৩)। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ রোগে অসুস্থ হ’লে অথবা সফরে থাকলে তার আমলনামায় তা-ই লেখা হয়, যা সে সুস্থ অবস্থায় বা বাড়ীতে থাকলে লেখা হ’ত’ (বুখারী হা/২৯৯৬; মিশকাত হা/১৫৪৪)।

প্রশ্ন (৮৪) : শরী‘আতে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মাকরূহ প্রভৃতি পরিভাষা কি গ্রহণযোগ্য? এসকল বিধানের হুকুম ও তারতম্য সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : ফরয এবং ওয়াজিব অর্থ ও হুকুমের দিক থেকে কাছাকাছি পরিভাষা। শরীআ‘তের দৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিধানগুলিকে ফরয ও ওয়াজিব দ্বারা নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ এমন বিধান যা পালনে ছওয়াব পাওয়া যায় এবং পরিত্যাগে শাস্তি পেতে হয়। তবে উভয়ের মধ্যে ব্যবহারিক পার্থক্য হ’ল, ফরয বিধানসমূহ ওয়াজিবের তুলনায় কিছুটা বেশী গুরুত্ব বহন করে (ইবনু তায়মিয়াহ, আল-মুসওয়াদ্দাহ ফী উছূলিল ফিক্বহ পৃ. ৫০; আব্দুল করীম যায়দান, আল-ওয়াজীয ফী উছূলিল ফিক্বহ পৃ. ৩১-৩২)। যেমন হজ্জের কোন ফরয ছুটে গেলে পুনরায় হজ্জ করতে হয়। কিন্তু ওয়াজিব ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল হয় না; বরং কাফফারা দিলে হজ্জ আদায় হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ছালাতের কোন ফরয ছুটে গেলে তা পুনরায় আদায় করতে হয়। কিন্তু কোন ওয়াজিব ছুটে গেলে সহো সিজদা দিলেই তা সম্পন্ন হয়ে যায় (ইবনু হাজার হায়তামী, আল-ফাতাওয়াল হাদীছিয়াহ ১/১৫৭)।

ফরয ও ওয়াজিব ব্যতীত অন্যান্য ইবাদতসমূহ পালন করলে ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং যা পরিহারে ব্যক্তি পাপী হবে না; কিন্তু নিন্দাযোগ্য হবে। এগুলোর মধ্যে আবার গুরুত্বের কিছু তারতম্য রয়েছে। যেমন যে সকল ইবাদত রাসূল (ছাঃ) প্রায় নিয়মিতই করতেন ও করার জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন সেগুলো সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। উদাহরণ স্বরূপ ঈদায়েনের ছালাত, দিনে-রাতে বারো রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ, বিতরের ছালাত ইত্যাদি। আর যে সকল আমল রাসূল (ছাঃ) কখনও করেছেন, কখনও ছেড়েছেন; কিন্তু বিশেষ গুরুত্বারোপ করেননি, সেগুলো সুন্নাতে যায়েদাহ বা গায়ের মুওয়াক্কাদাহ। তবে এ সকল আমল অনেক ফযীলতপূর্ণ। যেমন আছরের পূর্বে দুই বা চার রাক‘আত ছালাত আদায় করা। আযান ও ইক্বামতের মাঝে দু’রাক‘আত ছালাত, মাগরিবের আযানের পরে ও জামা‘আতের পূর্বে দু‘রাক‘আত ছালাত আদায় করা ইত্যাদি। এগুলোকে মুস্তাহাবও বলা হয়। আবার শরী‘আত যে কাজটি করা বা না করার ইখতিয়ার দিয়েছে সেটি মুবাহ, জায়েয বা হালাল। একে মানদুবও বলা হয় (আব্দুল করীম যায়দান, আল-ওয়াজীয ফী উছূলিল ফিক্বহ পৃ. ৩৯)। আবার কতগুলো আমল আছে, যা হারাম অর্থাৎ করলে শাস্তি রয়েছে এবং পরিহার করলে ছওয়াব পাওয়া যায়। যেমন মিথ্যা বলা, অযথা তর্ক করা ইত্যাদি (আবুদাউদ হা/৪৮০০; ছহীহুত তারগীব হা/২৬৪৮)। আবার কিছু আমল হারাম নয়; তবে রাসূল (ছাঃ) অপসন্দ করেছেন। এগুলোকে মাকরূহ বলা হয়। যেমন ঠেস বা হেলান দিয়ে বসে খাওয়া (বুখারী হা/৫৩৯৮; মিশকাত হা/৪১৬৮; আল-ওয়াযেহ ফী উছুলিল ফিক্বহ ৩৪ পৃ.)।

প্রশ্ন (৮৫) : সূর্য হেলে যাওয়ার পরপরই যে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করা হয় হাদীছের পরিভাষায় ঐ ছালাতের নাম কি? এই ছালাত আদায় করলে যোহরের পূর্বের চার রাক‘আত সুন্নাত ছালাতের হক আদায় হয়ে যাবে কি?

উত্তর : আব্দুল্লাহ ইবনুস সায়িব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূর্য ঢলার পর হ’তে যোহরের পূর্ব পর্যন্ত ৪ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন এবং বলতেন, এ সময় আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয়। আমার একান্ত ইচ্ছা, এ সময় আমার কোন সৎকর্ম আল্লাহর দরবারে পৌছুক (তিরমিযী হা/৪৭৮; আহমাদ হা/২৩৫৯৭; মিশকাত হা/১১৬৯)। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে এই ছালাত ছিল যোহরের পূর্বের চার রাকাআত ছালাত (মানাভী, ফায়যুল ক্বাদীর ১/৪৬৭)। তবে ইবনুল ক্বাইয়িম ও ইরাক্বীসহ কতিপয় বিদ্বানের মতে এটি স্বতন্ত্র ছালাত, যাকে ‘সুন্নাতুয যাওয়াল’ বা সূর্য ঢলে পড়ার ছালাত বলা হয়। এটি যোহরের ছালাতের পূর্বের চার রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ নয় (ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ১/২৯৮-৯৯; মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/১৪৬)।

প্রশ্ন (৮৬) : কুরআন বুঝে পড়া ও না বুঝে পড়ার মধ্যে ছওয়াবের কোন পার্থক্য আছে কি?

উত্তর : কুরআন তেলাওয়াত বুঝে করুক বা না বুঝে করুক প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি নেকী রয়েছে (তিরমিযী হা/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭)। তবে বুঝে পাঠ করলে অতিরিক্ত ছওয়াব পাওয়া যাবে। কেননা কুরআন তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হ’ল উপদেশ গ্রহণ করা, যার জন্য কুরআন বুঝা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। তিনি আরও বলেন, তবে কি তারা কুরআন গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। ছাহাবায়ে কেরাম কুরআনের দশটি আয়াত শুনলে তা না বুঝে আর দশটি আয়াতের দিকে অগ্রসর হতেন না (বায়হাক্বী হা/৫৪৯৫, ৩/১১৯; হাকেম হা/২০৪৭, ১/৭৪৩)। তাছাড়া যারা কুরআন বুঝেনা তাদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, আর তাদের মধ্যে একদল নিরক্ষর ব্যক্তি রয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না কেবল একটা ধারণা ব্যতীত। তারা স্রেফ কল্পনা করে মাত্র (বাক্বারা ২/৭৮)। সুতরাং কুরআন না বুঝে তেলাওয়াত করলে ছওয়াব পাওয়া যাবে। তবে বুঝে পড়া, অনুধাবন করা ও তদনুযায়ী আমল করাই কুরআন তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য ও অধিক ছওয়াবের কারণ। সুতরাং প্রত্যেক মুসলামানের উচিৎ সাধ্যমত কুরআন বুঝে ও অনুধাবন করে পড়া এবং তদনুযায়ী আমল করা (ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘দাহ ১/১৮৭; উছায়মীন, ফাতাওয়া নুরুন আলাদ-দারব ৪৭)। এজন্য পাঠ করুন : হাফাবা প্রকাশিত ‘কুরআন অনুধাবন’ বই।

প্রশ্ন (৮৭) : খুনছা তথা হিজড়া ছাগল বা গরু দ্বারা কুরবানী করা যাবে কি?

উত্তর : হিজড়া গরু বা ছাগল দ্বারা কুরবানী করা যাবে, যদি তার দ্বারা গোশত দূষিত বা দুর্গন্ধযুক্ত না হয়। রাসূল (ছাঃ) কুরবানীর প্রাণীর যে সকল দোষ বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে হিজড়া অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, হিজড়া পশু দ্বারা কুরবানী হবে (হাত্তাব আল-মালেকী, মাওয়াহিবুল জালীল ৪/৩৬৪)। সাধারণতঃ মানুষ, গরু ও উটের মধ্যে হিজড়া হয়। অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে হয় বলে জানা যায় না।

প্রশ্ন (৮৮) : কনস্টান্টিনোপল সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) কোন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কি? ওছমানীয় খলীফাগণ আমাদের জানা মতে মন্দ আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। এক্ষণে তাদের একজনকে রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়নকারী হিসাবে গণ্য করা যাবে কি?

উত্তর : রাসূল (ছাঃ) কনস্টান্টিনোপল তথা বর্তমান ইস্তাম্বুল বিজয়ের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর পাশে বসে লিখতাম। একদিন তাকে প্রশ্ন করা হল দুই নগরীর মধ্যে কোনটি প্রথম বিজিত হবে, কনস্টানটিনোপল, না রোম? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হিরাকল (হিরাক্লিয়াস)-এর শহর (কনস্টান্টিনোপল) (দারেমী হা/৪৮৬; আহমাদ হা/৬৬৪৫; ছহীহাহ হা/৪)। যা ওছমানীয় খলীফা মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ (৮৫৫-৮৮৬ হি.)-এর হাতে প্রথম বিজিত হয়। দ্বিতীয় নগরী তথা রোম আল্লাহর ইচ্ছায় ক্বিয়ামতের পূর্বে বিজিত হবে (ছহীহাহ হা/৪-এর আলোচনা)। রাসূল (ছাঃ) কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফযীলতও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বপ্রথম যে দলটি নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তারা যেন জান্নাতকে অবধারিত করে ফেলল। উম্মে হারাম (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে হব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের প্রথম যে দলটি রোমকদের রাজধানী আক্রমণ করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। তিনি বললেন, আমি কি তাদের মধ্যে হব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না’ (বুখারী হা/২৯২৪; ছহীহাহ হা/২৬৮)।

ওছমানীয় খলীফাদের আক্বীদা মন্দ ছিল বলে ধারণা করার কোন যুক্তি নেই। বরং ছূফীবাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ গোঁড়া ছূফীদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং উদার মনা ছিলেন। তিনি আলেমদের সম্মান করতেন এবং আলেমদের ন্যায় পোষাক পরিধান করতেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করেন।

হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হি.) সিরিয়ার গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে মু‘আবিয়া (রাঃ) ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে প্রথম সমুদ্র অভিযান করেন। অতঃপর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত কালে (৪১-৬০ হি.) ৫২ হিজরী সনে ইয়াযীদের নেতৃত্বে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে প্রথম যুদ্ধাভিযান প্রেরিত হয়। ইবনু কাছীর বলেন, ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে পরিচালিত উক্ত অভিযানে স্বয়ং হুসায়েন (রাঃ) অংশ গ্রহণ করেন। এতদ্ব্যতীত যোগদান করেছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আবু আইয়ূব আনছারী প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণ (দ্র. হাফাবা প্রকাশিত ‘আশূরায়ে মুহাররম’ বই)।

উল্লেখ্য যে, ‘অবশ্যই তোমরা কনস্টান্টিনোপল জয় করবে। এর আমীর ও সৈন্যরা কতইনা সৌভাগ্যবান!’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটির সনদ যঈফ (যঈফাহ হা/৮৭৮)।

প্রশ্ন (৮৯) : ব্যাঙের পেশাব কাপড়ে লাগলে তাতে ছালাত আদায় করা যাবে কি?

উত্তর : ব্যাঙের পেশাব নাপাক। কারণ যেসব প্রাণীর গোশত হারাম তার পেশাবও হারাম। অতএব ব্যাঙের পেশাব কাপড়ে লাগলে তা ধুয়ে ছাফ করতে হবে (ইবনু হাজার হায়তামী, তোহফাতুল মুহতাজ ১/৩১৭)।

প্রশ্ন (৯০) : পিতা-মাতা মারা গেলে মাথা মুন্ডন করার হুকুম কি? এ বিষয়ে আবুদাউদের হা/৪১৯২-এর ব্যাখ্যা জানতে চাই। 

উত্তর : হাদীছটি হ’ল, আব্দুল্লাহ বিন জা‘ফর (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) জা‘ফরের সন্তানদেরকে (জা‘ফর -এর শাহাদাতের জন্য) শোক প্রকাশের জন্য তিনদিন সময় দিলেন। অতঃপর তিনি তাদের কাছে এলেন এবং বললেন, আজকের পর থেকে তোমরা আর আমার ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করবে না। অতঃপর বললেন, আমার ভাইয়ের সন্তানদের আমার কাছে ডেকে আনো। সেমতে আমাদেরকে আনা হ’ল। যেন আমরা কতকগুলি পাখির ছানা। অতঃপর তিনি বললেন, নাপিত ডেকে আনো। অতঃপর নাপিত এসে আমাদের মাথা মুন্ডন করে দিল (আবুদাউদ হা/৪১৯২; আহমাদ হা/১৭৫০; মিশকাত হা/৪৪৬৩, সনদ ছহীহ)।

উক্ত হাদীছের ফলে কারো কারো ধারণা পিতা-মাতা মারা গেলে তিনদিন পরে মাথা মুন্ডন করা কর্তব্য। কিন্তু এই ধারণা ভুল। কেননা উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণ বলেন, জা‘ফর (রাঃ)-এর শিশু সন্তানরা যাতে শোকে নিজেদের দেহ ও চুল কালিমালিপ্ত না করে সেজন্য রাসূল (ছাঃ) তাদের মাথা ন্যাড়া করে দিতে বলেন (উছায়মীন, শারহু রিয়াযিছ ছালেহীন হা/১৬৪০-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। তাছাড়া তাদের মা স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস দশদিন শোকগ্রস্ত থাকার কারণে হয়ত সন্তানদের চুল পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবে না। এই আশঙ্কায় রাসূল (ছাঃ) তাদের মাথা মুন্ডন করে দেন (আউনুল মা‘বুদ ১১/১৬৪; মিরক্বাত ৭/২৮৩৪)।

উল্লেখ্য যে, কারো মৃত্যুতে শোকের নিদর্শন হিসাবে মাথা মুন্ডন করা হারাম। যেটি হিন্দুদের মধ্যে চালু আছে। আবু বুরদাহ (রহঃ) বলেন, ছাহাবী আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার মাথা তার পরিবারের এক মহিলার কোলে ছিল। মহিলাটি চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু তিনি তাকে থামাতে পারছিলেন না। অতঃপর যখন তাঁর জ্ঞান ফিরল তখন তিনি বললেন, আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রাখি না, যাদের থেকে রাসূল (ছাঃ) সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। যে সব নারী (মৃতের শোকে) উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করে, মাথার চুল ছিঁড়ে, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে, রাসূল (ছাঃ) তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন (বুখারী হা/১২৯৬; মুসলিম হা/১০৪; আলবানী, আহকামুল জানায়েয ৩০ পৃ.)।

প্রশ্ন (৯১) : যদি কোন মৃত ব্যক্তির পোস্ট মর্টেম করার কারণে বা পুড়ে যাওয়ার কারণে লাশের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে যায় তাহ’লে উক্ত লাশকে গোসল দেওয়ার বিধান কি?

উত্তর : মৃতকে গোসল দেওয়া ওয়াজিব। এক্ষণে গোসল দেওয়ার সময় হাত দ্বারা স্পর্শ করার কারণে শরীর ঝলসানো চামড়া খসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে কেবল মাইয়েতের দেহে পানি ঢেলে দেবে। এতেও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে তায়াম্মুম করাবে (নববী, আল-মাজমূ‘ ৫/১৭৮; হায়তামী, তোহফাতুল মুহতাজ ৩/১৮৪)। আর লাশ যদি এর থেকেও বেশী স্পর্শকাতর বা ভয়াবহ হয়, তাহলে গোসল ও তায়াম্মুম ছাড়াই কাফন-দাফন সম্পন্ন করবে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ২/১১৯)।

প্রশ্ন (৯২) : শীষ (আঃ)-এর সম্পর্ক জানতে চাই। তিনি কি ভারতে মারা যান?

উত্তর : হযরত শীছ (আঃ) আদম (আঃ)-এর তৃতীয় পুত্র সন্তান। হাবীলের মৃত্যুর পর আল্লাহ তা‘আলা শীছ (আঃ)-কে (যমজের বদলে) একক সন্তান হিসাবে দান করেন। সেজন্য তার নাম রাখা হয় শীছ। অর্থ আল্লাহর দান। তাঁর বংশধারায় আজকের পৃথিবীর সকল মানুষ বলে একদল বিদ্বান মত পোষণ করেন (ইবনু কাছীর, আল-বেদায়াহ ১/১০৯; ইবনুল আছীর, আল কামেল ফীত তারীখ ১/১৭)। শেষ জীবনে শীছ (আঃ) রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে পুত্র আনূশকে ডেকে তিনি অছিয়ত করেন। অতঃপর মক্কাতেই ৯১২ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর আবু কুবায়েস পাহাড়ের গুহায় স্বীয় পিতা-মাতার পাশেই তাঁকে দাফন করা হয় (ইবনুল আছীর, আল কামেল ফিত-তারীখ ১/১৭)। উল্লেখ্য যে, একদল লোক ভুয়া ভিডিও তৈরী করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, শীছ (আঃ)-এর কবর ভারতে রয়েছে, যা সর্বৈব মিথ্যা।

প্রশ্ন (৯৩) : গৃহপালিত পশু-পাখি যেমন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর পায়ের নখ বা ক্ষুর খাওয়া জায়েয হবে কি?

উত্তর : এগুলো হালাল প্রাণী। মানুষের যা রুচি হবে তা খাবে এতে কোন দোষ নেই (মায়েদাহ ৫/৮৮)।

প্রশ্ন (৯৪) : দ্বিতীয় বিবাহ করার কারণে আমার মা আমার পিতাকে তালাক দেন। বর্তমানে আমি মায়ের সাথে থাকি এবং তাকে দেখাশোনা করি। এক্ষণে আমি সামর্থ্যবান হই বা না হই, পিতাকে দেখাশোনা করার কোন দায়িত্ব আমার আছে কি?     

উত্তর : পিতা-মাতা যে অবস্থানেই থাকুক সন্তানের দায়িত্ব হ’ল তার খোঁজ-খবর নেওয়া ও সামর্থ্য থাকলে আর্থিক সহায়তা করা। এমনকি তারা অমুসলিম হলেও দুনিয়াতে তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ বলেন, পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে বসবাস করবে’ (লোকমান ৩১/১৫)। রাসূল (ছাঃ) আসমা (রাঃ)-কে তার অমুসলিম মায়ের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী হা/৩১৮৩, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯১৩)। এছাড়া আবু হুরায়রা (রাঃ) তার মুশরিক মাতার সাথেই বসবাস করতেন (মুসলিম হা/২৪৯১, মিশকাত হা/৫৮৯৫ ‘মু‘জেযা’ অনুচ্ছেদ)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, যদিও তারা তোমাকে তোমার সম্পদ থেকে এবং তোমার সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে’ (ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৭৯৫৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৬৯)। অতএব সাধ্যমত পিতার খোঁজ-খবর নিবে এবং সামর্থ্য থাকলে তার জন্য ব্যয় করবে।

প্রশ্ন (৯৫) : বাজার থেকে গোশত ক্রয়ের সময় পশুটি জীবিত ছিল কি না, যবেহের ক্ষেত্রে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছিল কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন থেকে যায়। এক্ষণে এরূপ সন্দেহপূর্ণ গোশত ক্রয় পরিহার করতে হবে কি?

উত্তর : কোন মুসলিম ব্যক্তি পশু যবেহ করলে সুধারণা রাখতে হবে এবং অযথা সন্দেহ পরিহার করতে হবে। আর বিসমিল্লাহ বলে খাবে (নববী, আল-মাজমূ‘ ৮/৪০৫; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২২/৩৬৫)। কারণ একদা মদীনার গ্রামাঞ্চলের নওমুসলিমরা মদীনা শহরে গোশত বিক্রি করতে আসলে এবং ছাহাবীগণ বিসমিল্লাহ বলা হয়েছে কিনা সন্দেহ করলে রাসূল (ছাঃ) তাদের যবেহ করা পশুর গোশ্ত বিসমিল্লাহ বলে খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী হা/৭৩৯৮; মিশকাত হা/৪০৬৯)। তবে যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোন অমুসলিম তা যবেহ করেছে, তবে তা খাওয়া যাবে না।

প্রশ্ন (৯৬) : তাওহীদকে কে প্রথম তিন ভাগে বিভক্ত করেন? এই প্রকরণের দলীল কি?

উত্তর : ইবনু জারীর ত্বাবারী (মৃ. ৩১০হি.), ইবনু বাত্ত্বা (মৃ. ৩৮৭হি.) ও ইবনু মানদাহ (মৃ. ৩৯৫হি.) প্রমুখ বিদ্বান সর্বপ্রথম অধিকতর বোধগম্যতার জন্য ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে তাওহীদকে একাধিক ভাগে বিভক্ত করেন। অতঃপর ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) ও ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) তাওহীদকে দুইভাগে ভাগ করেন, যা তিন প্রকার তাওহীদকেই শামিল করে (ইবনু বাত্ত্বা, আল-ইবানাহ ২/১৭২-৭৩; ইবনু মানদাহ, আত-তাওহীদ ১/৩৩; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ১৫/১৬৪)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অসংখ্য দলীল দ্বারা এই ভাগগুলি প্রমাণিত। যেমন সূরা ফাতিহার মধ্যেই এই তিনটি প্রকারের দলীল রয়েছে। তাওহীদকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপলব্ধির জন্য এই ভাগগুলি খুবই যথার্থ, যার কোনটিই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

উদাহরণস্বরূপ : (১) তাওহীদে রুবূবিয়াত তথা রব ও সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহর একত্বের দলীল হ’ল- আল্লাহ বলেন, ‘যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, কে তাদের সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ’। এরপরেও তারা কোথায় ঘুরছে? (যুখরুফ ৪৩/৮৭)। (২) তাওহীদে উলূহিয়াত বা একমাত্র মা‘বূদ হিসাবে আল্লাহর ইবাদতের দলীল হ’ল- আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তুমি জেনে রাখ যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার ও মুমিন নর-নারীদের জন্য। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ভালভাবেই জানেন তোমাদের চলাফেরা ও আশ্রয় সম্পর্কে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। (৩) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত তথা নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্বের দলীল হ’ল- আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন’ (শূরা ৪২/১১)। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি জানেন যা কিছু তাদের সম্মুখে ও পিছনে আছে। আর তারা তাঁকে জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত্ব করতে পারে না’ (ত্বোয়াহা ২০/১১০)।

সুতরাং তাওহীদের প্রকারভেদ কোন নতুন আবিষ্কার নয়; বরং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকেই গৃহীত (শানক্বীত্বী, তাফসীর আযওয়াউল বায়ান ৩/১৭-১৯; দ্র. আব্দুর রাযযাক আল-বদর, আল-ক্বাওলুস সাদীদ ফী রাদ্দে ‘আলা মান আনকারা তাক্বসীমাত-তাওহীদ)।

প্রশ্ন (৯৭) : ‘সত্য কথাই তিতা’। হাদীছটি কি ছহীহ?

উত্তরঃ এ মর্মে কোন হাদীছ পাওয়া যায় না। তাছাড়া সব সত্য কথাই তিতা এমন কথাও সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সত্য কথা বল যদিও তা তিতা হয়’ (আহমাদ, মিশকাত হা/৫২৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৬৬)।

প্রশ্ন (৯৮) : মহিলারা কুরবানীর পশু যবেহ করতে পারে কি?

উত্তর : মহিলারা কুরবানীর পশু সহ যেকোন পশু যবেহ করতে পারে। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, তার একটি  ছাগল ‘সালআ’ নামক চারণক্ষেত্রে ছিল। তাঁর এক দাসী ছাগলটিকে মরণাপন্ন দেখে পাথর দ্বারা যবেহ করে দেয়। বিষয়টি তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি ছাগলটি খাওয়ার নির্দেশ দেন (বুখারী, মিশকাত হা/৪০৭২)।

প্রশ্ন (৯৯) : বিশেষ কারণবশত সপ্তম দিনের পূর্বে সন্তানের আক্বীক্বা দেওয়া যাবে কি?

উত্তর : শিশু জন্মের সপ্তম দিনে আক্বীক্বা দেওয়াই সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক শিশু তার আক্বীক্বার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবেহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়’ (আবুদাউদ হা/২৮৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৩১৬৫; মিশকাত হা/৪১৫৩)। রাসূল (ছাঃ) তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইনের আক্বীক্বাও সপ্তম দিনে করেছিলেন (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৩১১, সনদ হাসান)। অতএব সক্ষম ব্যক্তি সপ্তম দিনেই আক্বীক্বা করবে। ইবনুল ক্বাইয়িম, উছায়মীনসহ এক দল বিদ্বানের মতে, বিশেষ শারঈ ওযর থাকলে সপ্তম দিনের পূর্বে অথবা পরেও আক্বীক্বা দিতে পারে (নববী, আল-মাজমূ‘ ৮/৪৩১; ইবনুল ক্বাইয়িম, তোহফাতুল মাওদুদ ৬৩ পৃ.; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৫/২২৯; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৪৪৫-৪৪৬)।

প্রশ্ন (১০০) : ‘আমরা সত্বর তোমার উপর নাযিল করব ভারী কিছু বিষয়’-আয়াতটির ব্যাখ্যা কি? অনেকে এ আয়াত দ্বারা ইক্বামতে দ্বীন বুঝাতে চান। এটা সঠিক কি?

উত্তর : উক্ত আয়াতে ‘ভারী কিছু বিষয়’-এর অর্থ পূর্ণ কুরআন ও ইসলাম (কুরতুবী)। ক্বাতাদাহ বলেন, ‘আল্লাহর কসম! ভারী হ’ল এর ফরয সমূহ এবং দন্ডবিধি সমূহ’। মুজাহিদ বলেন, ‘এর হালাল ও হারাম সমূহ’। মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল-কুরাযী বলেন, ‘মুনাফিক ও কাফিরদের জন্য ভারী’ (কুরতুবী)। তবে ঈমানদারগণের জন্য ইসলামের বিধান পালন কখনোই ভারী নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে। আর তা অবশ্যই কঠিন কাজ, বিনীত বান্দাদের জন্য ব্যতীত’ (বাক্বারাহ ২/৪৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই এ দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি এতে কঠোরতা আরোপ করবে, সে পরাভূত হবে। অতএব তোমরা সঠিক পথে থাক এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর ও মানুষকে সুসংবাদ প্রদান কর’ (বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ছালাত ও ইবাদতের মাধ্যমে মানুষের মন-মানসিকতাকে আগেই প্রস্ত্তত করে নিতে হয়। এগুলি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ট্রেনিং কোর্স’ নয়। যেমনটি আধুনিক কালের অনেক রাজনৈতিক মুফাসসির ধারণা করে থাকেন (আবুল আ‘লা মওদূদী, খুত্ববাত (দিল্লী-৬ : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, ১৯৮৭ খৃ.) ৩২০ পৃ.)। বরং ইসলামী রাষ্ট্র থাক বা না থাক, ইসলামী ইবাদত সমূহ সর্বাবস্থায় ফরয। আর ‘ট্রেনিং কোর্স’ হয় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য।

অত্র আয়াত ইসলামের সূচনাকালে মক্কায় নাযিল হয়েছে। অতঃপর ধীরে ধীরে তেইশ বছরে গিয়ে মদীনায় ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বড় বোঝা বহন করার জন্য বড় হৃদয়ের দৃঢ়চিত্ত মানুষ আবশ্যক। আর সেজন্য সর্বাগ্রে নিশুতি রাতে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তার প্রতি একান্তভাবে নির্ভরশীল হওয়া ও আধ্যাত্মিক চেতনা সম্পন্ন হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। হাদীছে ছালাতকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত এবং ইসলামের খুঁটি বলা হয়েছে (তিরমিযী হা/২৬১৬; মিশকাত হা/২৯; ছহীহাহ হা/১১২২)। সমাজের পুঞ্জিভূত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা দুর্বলচিত্ত ও সুবিধাবাদী লোকদের মাধ্যমে কখনো সম্ভব নয়। বস্ত্ততঃ ইসলাম হ’ল আল্লাহ প্রেরিত ‘স্পষ্ট ও স্বচ্ছ দ্বীন’ (আহমাদ হা/১৫১৯৫; মিশকাত হা/১৭৭; ইরওয়া হা/১৫৮৯)। একে বাস্তবায়নের জন্য স্বচ্ছ হৃদয়ের মুমিন আবশ্যক। যে সাহসের সাথে সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারে। নইলে সে ধ্বংস হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে স্পষ্ট দ্বীনের উপর ছেড়ে যাচ্ছি। যার রাত্রি হ’ল দিনের মত। আমার পরে এ থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে ধ্বংস হবে’ (ইবনু মাজাহ হা/৪৩; হাকেম হা/৩৩১; আহমাদ হা/১৭১৮২; ছহীহাহ/৯৩৭)। অতএব উক্ত আয়াত থেকে ইক্বামতে দ্বীন অর্থ গ্রহণ করা সঠিক হবে না।

প্রশ্ন (১০১) : দুই সিজদার মাঝে পড়ার জন্য প্রচলিত দো‘আটি ছাড়া আর কোন দো‘আ আছে কি?

উত্তর : দুই সিজদার মাঝে প্রচলিত দো‘আটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। যেমন কোন কোন হাদীছে কেবল ‘রাবিবগ ফিরলী, রাবিবগ ফিরলী’ (আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও) অংশটুকু এসেছে (আবুদাউদ হা/৮৫০, ৮৭৪; ইবনু মাজাহ হা/৮৯৭, ৮৯৮ ; মিশকাত হা/১২০০; ইরওয়া হা/৩৩৫, সনদ ছহীহ)। আবার কোন হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) পাঁচটি বিষয় প্রার্থনা করতেন (আবুদাউদ হা/৮৫০; মিশকাত হা/৯০০, সনদ ছহীহ)। আবার কোন হাদীছে এসেছে, তিনি দুই সিজদার মাঝে সাতটি বিষয় প্রার্থনা করতেন (ইবনু মাজাহ হা/৮৯৮; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন্নবী ১৫৩ পৃ.)। সেজন্য ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, হাদীছে বিভিন্ন শব্দযোগে মোট সাতটি বিষয় প্রার্থনা করা হয়েছে। যার সবগুলি একত্রে পাঠ করা উত্তম (নববী, আল-মাজমূ‘ ৩/৪৩৭)। উক্ত সাতটি বিষয় হ’ল- ‘আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়ারহাম্নী ওয়াহ্দিনী ওয়া ‘আ-ফিনী ওয়ারযুকনী ওয়ারফা‘নী’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার উপর রহম করুন, আমার অবস্থার সংশোধন করুন, আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, আমাকে সুস্থতা দান করুন ও আমাকে রূযী দান করুন, আমার মর্যাদা উন্নীত করুন’ (ইবনু মাজাহ হা/৮৯৮)।

প্রশ্ন (১০২) : তাহাজ্জুদ ছালাত কি ঘুম থেকে উঠে আদায় করা শর্ত? না রাতের যেকোন সময় পড়লেই তা তাহাজ্জুদ হিসাবে গণ্য হবে?

উত্তর : এশার ছালাতের পরই তাহাজ্জুদের ছালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায় এবং ফজর উদয় হ’লে শেষ হয়ে যায় (মুসলিম হা/৭৩৬; মিশকাত হা/১১৮৮; ইবনুল মুনযির, আল-ইজমা‘ ৫০ পৃ.; আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান ২৬ পৃ.; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ৩৪/১১৯)। তবে তাহাজ্জুদের ছালাতের মূল সময় হ’ল রাত্রির তৃতীয় প্রহর (বুখারী হা/৩৪২০; মুসলিম হা/১১৫৯; মিশকাত হা/১২২৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ছালাত আদায় কর এমন সময় যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে’ (তিরমিযী হা/২৪৮৫)। যেসময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ডেকে ডেকে বলেন, কে আছ আমাকে আহবানকারী, আমি তার আহবানে সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে যাঞ্ছাকারী, আমি তাকে দান করব। কে আছ আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করব’। এভাবে বলতে থাকেন যতক্ষণ না ফজরের আলো স্পষ্ট হয়’ (মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩)। তাহাজ্জুদ বা বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে ‘উবাদাহ বিন ছামিত, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস প্রমুখ ছাহাবীগণ ফজর ছালাতের আগে তা আদায় করে নিতেন (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৮৩)।

প্রশ্ন (১০৩) : তাবীয ঝুলানো, হাড়ি পড়া ইত্যাদি কুফরী বস্ত্ত যে ঘরে ঝুলানো থাকে সেখানে ছালাত পড়লে কবুল হবে কি?

উত্তর : তাবীয ঝুলানো শিরক। তাবীয থাকার কারণে রাসূল (ছাঃ) এক ছাহাবীর বায়‘আত নেননি। সে তা কেটে ফেলে দিলে তিনি তার বায়‘আত গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয লটকালো সে শিরক করল’ (আহমাদ হা/১৬৯৬৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৯৪; ছহীহাহ হা/৪৯২)। অন্য হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকালো, তাকে তার উপরই নির্ভরশীল করে দেয়া হয়’ (তিরমিযী হা/২০৭২; মিশকাত হা/৪৫৫৬; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪৫৬)। আর ঘরে তাবীয, হাড়ি বা অন্য কিছু ঝুলানোর কারণে গুনাহ হ’লেও সেখানে ছালাত আদায় করলে ছালাত আদায়  হয়ে  যাবে  (ফাতাওয়া  লাজনা  দায়েমাহ ৬/১৭৯, ৫/৩৭৭; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১২/৩৬০)।

প্রশ্ন (১০৪) : আমার বন্ধু নৌবাহিনীতে চাকুরী করে। সেখানে সব দ্বীনী বিধান পালন করা গেলেও দাড়ি রাখা যায় না। রাখলে ছেটে রাখতে হয়। এক্ষণে তার করণীয় কি?

উত্তর : দাড়ি রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা কর এবং দাড়িকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও। আর গোঁফ ছোট কর (বুখারী হা/৫৮৯২; মুসলিম হা২৫৯; মিশকাত হা/৪৪২১)। আর দাড়ি কাটা বা ছাঁটার পক্ষে কোন দলীল নেই; বরং এটি রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শের পরিপন্থী।

এক্ষণে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করতে হবে এবং তাদেরকে বোঝানোর সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে।  কোনভাবেই সম্ভব না হ’লে যতটুকু সুযোগ রয়েছে ততটুকু রেখেই ইসলামের বিধান পালন করবে (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী হা/৫৮৯২-৯৩-এর আলোচনা, ১০/৩৪৯-৫১; ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার ৪/৩১৭)।

প্রশ্ন (১০৫) : জনৈক নারী এক ছেলে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। কিছুদিন পর ছেলেও মারা যায়। বর্তমানে তার স্বামী ও এক ভাই জীবিত আছে। তাদের সম্পদ কিভাবে বণ্টিত হবে?  

উত্তর : প্রথমতঃ সম্পদ স্বামী ও ছেলের মাঝে বণ্টিত হবে। অর্থাৎ স্বামী এক-চতুর্থাংশ পাবেন এবং ছেলে আছাবা হিসাবে পুরো সম্পদ পেয়ে যাবে (নিসা ৪/১২)। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘অংশীদারদের নির্ধারিত প্রাপ্য অংশ দিয়ে দাও। অতঃপর যা অবশিষ্ট থাকে তা (আছাবা হিসাবে) নিকটতম পুরুষ লোকের প্রাপ্য’ (বুখারী হা/৬৭৩২; মুসলিম হা/১৬১৫; মিশকাত হা/৩০৪২)। এক্ষণে ছেলে মারা যাওয়ার কারণে পিতা আছাবা হিসাবে পুরো সম্পদ পাবেন (নিসা ৪/১১; ইবনুল মুফলেহ. আল-মুবদে‘ ফী শারহিল মুকনে‘ ৫/৩২২)। আর উক্ত মহিলার ভাই কোন সম্পদ পাবে না।

প্রশ্ন (১০৬) : অবাধ্য স্ত্রীর ছালাত কবুল হবে কি?

উত্তর : অবাধ্য স্ত্রীর ছালাত কবুল হবে না মর্মে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, দু’জন ব্যক্তির ছালাত তার মাথা অতিক্রম করবে না (কবুল হবে না)। (১) যে দাস তার মালিক হ’তে পলায়ন করেছে যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। (২) অবাধ্য স্ত্রী যতক্ষণ না সে আনুগত্যে ফিরে আসে (হাকেম হা/৭২৩০; ছহীহাহ হা/২৮৮; ছহীহুত তারগীব হা/১৮৮৮)। তবে সে যদি তওবা করে আবার আনুগত্য ফিরে আসে, তাহ’লে কবুল হবে। অতএব শারঈ ওযর ব্যতীত স্বামীর আনুগত্য অবশ্যই করতে হবে। অন্যথায় যেমন ইবাদত কবুল হবে না, তেমনি ফেরেশতারা লা‘নত করবে (বুখারী হা/৩২৩৭; মুসলিম হা/১৪৩৬; মিশকাত হা/৩২৪৬)।

প্রশ্ন (১০৭) : রাসূল (ছাঃ) ইশরাক বা ছালাতুয যোহা কত রাক‘আত আদায় করেছেন?

উত্তর : সূর্যোদয়ের পরপরই প্রথম প্রহরের শুরুতে পড়লে একে ‘ছালাতুল ইশরাক্ব’ বলা হয় এবং কিছু পরে দ্বিপ্রহরের পূর্বে পড়লে তাকে ‘ছালাতুয যোহা’ বা চাশতের ছালাত বলা হয়। ইশরাক, যোহা, আউয়াবীন সবই একই ছালাত। এই ছালাত বাড়ীতে পড়া ‘মুস্তাহাব’। এটি সর্বদা পড়া এবং আবশ্যিক গণ্য করা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কখনও পড়তেন, কখনও ছাড়তেন। চাশতের ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা ২, ৪, ৮, ১২ পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরাতে হয়। উল্লেখ্য যে, দুপুরের পূর্বের এই ছালাতকেই ‘ছালাতুল আউওয়াবীন’ বলে। মাগরিবের পরের ছয়, বিশ বা যে কোন পরিমাণ নফল ছালাতকে আউওয়াবীন বলার হাদীছগুলি যঈফ (দ্র. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ‘ইশরাক্ব ও চাশতের ছালাত’ অধ্যায়)।

প্রশ্ন (১০৮) : কন্যার সম্মতি ব্যতীত পিতা এককভাবে বিবাহ দিতে পারবেন কি?

উত্তর : সাবালিকা মেয়ের সম্মতি ব্যতীত পিতা তাকে এককভাবে বিবাহ দিতে পারেন না। খানসা বিনতে খিযামের আপত্তির কারণে রাসূল (ছাঃ) তার পিতার দেওয়া বিবাহ বাতিল করে দেন এবং পরে তিনি আবু লুবাবাহ ইবনুল মুনযিরের সাথে বিবাহিতা হন (বুখারী হা/৬৯৪৫; মিশকাত হা/৩১২৮, ইবনু মাজাহ হা/১৮৭৩)। তবে কন্যার কর্তব্য পিতার সম্মতিকে গুরুত্ব দেওয়া। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, যেকোন মহিলা তার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল (আবুদাঊদ হা/২০৮৩ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩১৩১ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)।  

তবে মেয়ে যদি কুমারী হয় এবং তাকে বিয়ের কথা জানানোর পর যদি সে চুপ থাকে, তাহ’লে চুপ থাকাটাই তার সম্মতি হিসাবে গণ্য হবে। আর বিধবা হ’লে মুখে স্পষ্ট সম্মতি নিতে হবে (মুসলিম হা/১৪২১; মিশকাত হা/৩১২৭)।

প্রশ্ন (১০৯) : জনৈক পীর ছাহেব ছালাতে একাগ্রতার জন্য চোখ বন্ধ করে কলবের দিকে খেয়াল রেখে ছালাত আদায় করতে বলেছেন। এ পন্থা অবলম্বন করা যাবে কি?

উত্তর : উক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। কেননা ছালাতে একাগ্রতা আনার নামে চোখ বন্ধ রাখা মাকরূহ (ছালেহ আল-ফাওযান, আল-মুনতাক্বা ৪৯/৩২; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৭/১০৪ -০৫)। বরং ছালাতের মধ্যে সিজদার স্থানের দিকে এবং তাশাহহুদের সময় আঙ্গুলের ইশারার দিকে দৃষ্টি রাখাই হাদীছ সম্মত (হাকেম হা/১৭৬১; আবুদাঊদ হা/৯৯০, মিশকাত হা/৯১২)।

প্রশ্ন (১১০) : সামাজিক মাধ্যমে মৃত্যু সংবাদ জানানো এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দো‘আ চাওয়া শরী‘আতসম্মত কি?

উত্তর : এভাবে মৃত্যু সংবাদ জানানো জায়েয। হাবশার সম্রাট নাজাশী মৃত্যুবরণ করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মৃত্যু সংবাদ মুসলমানদের জানিয়ে দেন এবং মুসলিম হওয়ার কারণে তার জানাযার ছালাত আদায় করেন’ (বুখারী হা/১৩২৭)। উল্লেখ্য যে, মসজিদের মাইকে বা বাযারে কারু মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা জায়েয নয়। তাছাড়া মসজিদের বোর্ডে কারু মৃত্যু সংবাদ লিখে প্রকাশ করাও জায়েয নয়। কেবল জানাযার জন্য পরস্পরকে অবহিত করা জায়েয (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৯/১৪২)।

প্রশ্ন (১১১) : ১৯৪৫ সালে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়। আমার ভগ্নিপতি ৫০০/= মোহরানা নির্ধারণ করে বিবাহ সম্পন্ন করে। কিন্তু তখন সে মোহরানা পরিশোধ করেনি। পরবর্তীতে আমার বোন এক পুত্র সন্তান রেখে মারা যায়। ঐ ছেলেও ৫ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান রেখে মারা যায়। এক্ষণে ঐ মোহরানা পরিশোধ করতে চাইলে তার মূল্যমান বর্তমান হিসাবে হবে না-কি পূর্বনির্ধারিত ৫০০/- টাকা দিলেই যথেষ্ট হবে? এছাড়া ঐ অর্থের হকদার কে হবে?

উত্তর : বকেয়া মোহর স্ত্রীর জন্য স্বামীর ঋণস্বরূপ। তাই স্ত্রী মারা গেলেও তাকে মোহরানা প্রদান করতে হবে। আর প্রাপ্ত অর্থ ওয়ারিছরা মীরাছের বিধান অনুপাতে পাবেন (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৮/১৬; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৯/৮৬)। এক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত মোহরানা পরিশোধ করবে (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, মাসআলা ক্রমিক ৩২৬১, ৪/২৩৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, সে ব্যক্তিই উত্তম যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে উত্তম (বুখারী হা/২৩৯২; মুসলিম হা/১৬০০; মিশকাত হা/২৯০৫)।

প্রশ্ন (১১২) : যে ব্যক্তি রাত্রে শয়নকালে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে, সে সকালে নিষ্পাপ হয়ে জেগে উঠে। উক্ত হাদীছ কি ছহীহ?

উত্তর : হাদীছটি জাল (মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৬২২৪, যঈফুল জামে‘ হা/৫৭৮৭; মওযূ‘আত ১/২৪৭)।

প্রশ্ন (১১৩) : ছালাতরত অবস্থায় মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম শুনলে ‘ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম’ বলতে হবে কি?

উত্তর : বলতে হবে না। রাসূল (ছাঃ) কিংবা ছাহাবীদের থেকে এরূপ বলার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ছালাতের বাইরে শুনলে বলতে হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৯২১)।

প্রশ্ন (১১৪) : ওমরাহ করার পর চুল না কাটলে কাফফারা দিতে হবে কি? এছাড়া মক্কায় চুল না কেটে ৮৫ কি.মি. দূরে জেদ্দায় গিয়ে চুল কাটা যাবে কি?

উত্তর : ওমরা করার পরে চুল ছাটা বা মাথা মুন্ডন করা ওয়াজিব। তার পূর্বে হালাল হওয়া যাবে না। অতএব কেউ যদি ওয়াজিব তরক করে, তাহ’লে তাকে কাফফারা হিসাবে একটি কুরবানী দিতে হবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৩৪২)। আর মক্কায় মাথা মুন্ডন করাই সুন্নাত। তবে দূরবর্তী কোন স্থানে করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে চুল ছেটে ফেলার বা মুন্ডন করার পূর্বে ইহরাম খুলে হালাল হওয়া যাবে না (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ১৭/৫৭)।

প্রশ্ন (১১৫) : দুনিয়া হ’ল আখেরাতের জন্য শস্যক্ষেত্র- মর্মে বর্ণিত হাদীছটি কি ছহীহ?

উত্তর : হাদীছটি জাল ও বানোয়াট (আছ-ছাগানী, আল-মাওযূ‘আত ১/৬৪; ফাত্তানী, তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত ১/১৭৪)। তবে অর্থগতভাবে সঠিক। কেননা আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি পরকালের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য পরকালের ফসল বাড়িয়ে দেই (আশ-শূরা ২০)।

প্রশ্ন (১১৬) : মৃত ব্যক্তির নামে মসজিদে ধনী-গরীব সম্মিলিতভাবে সবাইকে খাওয়ানো যাবে কি?

উত্তর : মৃত ব্যক্তির নামে সকল শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে খাওয়ানোর অনুষ্ঠান করা যাবে না। কারণ মৃত ব্যক্তির নামে যা করা হয় তা হ’ল ছাদাক্বাহ, যা ধনীরা খেতে পারে না (তওবাহ ৯/৬০; তিরমিযী হা/৬৫২)।

প্রশ্ন (১১৭) : নমরূদ মশার কামড়ে মারা গিয়েছিল বলে সমাজে যে ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য?

উত্তর : নমরূদ কিভাবে মারা গেছে সে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীছে কিছু বলা হয়নি। তবে তাফসীর ও ইতিহাসের গ্রন্থ সমূহে পাওয়া যায় যে, মশা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, বাক্বারাহ ২৫৯-এর তাফসীর দ্র., আল-বিদায়াহ ১/১৭২)। তবে এ সবই ইস্রাঈলী বর্ণনা। যে বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আহলে কিতাবদের সত্য বলোনা এবং মিথ্যাও বলোনা। বরং বল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম আল্লাহর উপরে এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে, তার উপর’ (বুখারী হা/৪৪৮৫; মিশকাত হা/১৫৫)।

প্রশ্ন (১১৮) : হজ্জ করতে গিয়ে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে কাফনের কাপড় ক্রয় করা যাবে কি?

উত্তর : অধিক ফযীলতপূর্ণ মনে করে মক্কা থেকে কাফনের কাপড় ক্রয় করে রাখা শরী‘আতসম্মত নয়। এটি দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না’ (নিসা ১৭১)। তবে সাধারণভাবে ইহরামের কাপড় বা যে কোন কাপড়কে কাফনের কাপড় হিসাবে নির্ধারণ করে রাখা যায়। জনৈক ব্যক্তি   রাসূল   (ছাঃ)-এর   নিকট  থেকে  কাফনের  কাপড় বানানোর জন্য একটি চাদর উপহার হিসাবে চেয়ে নেয়। অতঃপর সে মারা গেলে সেটি দ্বারাই তার কাফন হয় (আহমাদ হা/২২৮৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৫৫)।

প্রশ্ন (১১৯) : ছালাতে সূরা ফাতিহার পর সর্বনিম্ন কয়টি আয়াত পাঠ করা আবশ্যক?

উত্তর : ছালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৮২২)। আর সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পড়া সুন্নাতে মু্ওয়াক্কাদাহ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৮)। অতএব কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করলেও ছালাত হয়ে যাবে (বুখারী হা/৭৭২)। আর সূরা ফাতিহার সাথে সর্বনিম্ন যেকোন একটি আয়াত পাঠ করলেও যথেষ্ট হবে। যেমন আয়াতুল কুরসী। তবে স্মর্তব্য যে, আয়াতটি অসম্পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক হ’লে তা পড়া উচিৎ নয় (বাহূতী, কাশ্শাফুল ক্বিনা‘ ১/৩৪২)। যেমন- مدهامتان ‘(জান্নাতের) ঘন সবুজ দু’টি বাগান’ (আর-রহমান ৫৫/৬৪)।

প্রশ্ন (১২০) : ক্বিবলা নির্ণায়ক আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে কোন মসজিদের ক্বিবলা যদি ভুল প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে করণীয় কি?

উত্তর : যে মসজিদের ক্বিবলা ভুল প্রমাণিত হ’লে সেদিকে ফিরে ছালাত আদায় করা যাবেনা। এমতাবস্থায় মসজিদের মধ্যে কাতার ক্বিবলামুখী করে ঠিক করে নিতে হবে। অথবা সম্ভব হ’লে মসজিদ পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে ক্বিবলা ঠিক করতে হবে (বাক্বারাহ ২/১৪৪; উছায়মীন, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১২/৪১৫-১৭)।

প্রশ্ন (১২১) : গোসলখানা ও টয়লেট একত্রে থাকলে সেখানে ওযূ করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : গোসলখানা ও টয়লেট একত্রে থাকলেও যদি ওযূ করার স্থানে অপবিত্র বস্ত্ত ছড়িয়ে না থাকে, তাহ’লে সেখানে ওযূ করায় শরী‘আতে কোন বাধা নেই (ফাতওয়া লাজনা-দায়েমাহ ৫/৮৫; মাজমূ‘ ফাতাওয়া উছায়মীন ১২/৩৬৯)।

প্রশ্ন (১২২) : ছালাতে কাতার সোজা করা এবং কাতারের ধারাবাহিকতা তথা ইত্তিছালুছ ছফূফ বজায় রাখার বিধান ও হুকুম সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : ছালাতে কাতার সোজা করা ওয়াজিব (উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/৩, ৭/৩-১৩)। রাসূল (ছাঃ) একাধিক হাদীছে কাতার সোজা করার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারী হা/৭২৩; মুসলিম হা/৪৩৩; মিশকাত হা/১০৮৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমার নিকটে তোমাদের সবচাইতে অপসন্দনীয় বিষয় হ’ল কাতার বাঁকা করা’ (বুখারী হা/৭২৪)। অনুরূপভাবে একটি কাতারের সাথে আরেকটি কাতার মিলিয়ে দাঁড়ানোও ওয়াজিব (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমুউল ফাতাওয়া ২০/৫৫৯, ২৩/৩৯৬, ২৩/৪০৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কাঁধগুলি সমান কর ও ফাঁক বন্ধ কর এবং শয়তানের জন্য কোন জায়গা খালি ছেড়োনা’। ‘কেননা আমি দেখি যে, শয়তান ছোট কালো বকরীর ন্যায়(كأَنَّها الْحَذَفُ) তোমাদের মাঝে ঢুকে পড়ে’ (আবুদাউদ হা/৬৬৭; মিশকাত হা/১০৯৩; ছহীহুত তারগীব হা/৪৯৫)। তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায়, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তাঁর রহমতে মিলিয়ে দেন, আর যে ব্যক্তি কাতার বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহ তা‘আলা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন (আবুদাউদ হা/৬৬৬; ছহীহুত তারগীব হা/৪৯৫)। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, জামা‘আতে ইমামের ইকতেদা করার জন্য দু’টি শর্ত; তাকবীর শ্রবণ করা ও কাতারের সাথে কাতার মিলিয়ে রাখা। অবশ্য কেউ কেউ ইমামকে দেখতে পাওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন, যা সঠিক নয়। অতএব যদি কাতার দীর্ঘায়িত হয়ে মসজিদের বাইরে চলে আসে, তবে তাতে যুক্ত হয়ে দোকান বা বাযার থেকে ইমামের অনুসরণ করায় কোন বাধা নেই’ (আশ-শারহুল মুমতে‘

প্রশ্ন (১২৩) : সূরা আহযাবের ৫২ আয়াতে এসেছে ‘এরপর তোমার জন্য কোন নারী বৈধ নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ বৈধ নয় যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে’। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তো এরপরেও বিবাহ করেছেন। এর ব্যাখ্যা কি?

উত্তর : উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন বিবাহ করেননি (ইবনু কাছীর ৬/৩৯৬; তাফসীর ঐ আয়াত দ্রঃ)। তবে ইবনু আববাস (রাঃ)-সহ বিশিষ্ট মুফাস্সিরগণের মতে, উক্ত আয়াতটির হুকুম মানসূখ হয়ে গেছে পূর্ববর্তী ৫১ আয়াত দ্বারা। কেননা উম্মে সালামাহ ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয়নি সব মহিলাকে তার জন্য হালাল করা ব্যতীত (তিরমিযী হা/৩২১৬ প্রভৃতি; ছহীহাহ হা/৩২২৪)।

প্রশ্ন (১২৪) : জনৈক ব্যক্তি ডাক বিভাগে কাজ করে। তার অনেক কাজের মধ্যে একটি কাজ হ’ল সূদভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের হিসাব রাখা এবং গ্রাহক মারা গেলে তার স্বজনরা কতটাকা সূদ পাবে তার হিসাব রাখা। তার চাকুরী জায়েয হবে কি?

উত্তর : ডাক বিভাগ কোন সূদী প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় এতে চাকুরী করা হালাল। তবে যে বিভাগটি সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত কাজ করে সেখানে কাজ করা নিষিদ্ধ। কেননা সরাসরি সূদী লেনদেন বা হিসাবাদির সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এমন কোন কর্মে নিযুক্ত হওয়া হারাম (আলে ইমরান ১৩০; বুখারী হা/২০৮৬)। সুতরাং অন্য কোন বিভাগে যাওয়ার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে, নতুবা সেখানে চাকুরী করা জায়েয হবে না।

প্রশ্ন (১২৫) : একই পাপ বারবার করছি আর তওবা করছি। কিন্তু কোনক্রমেই ছাড়তে পারছি না। এক্ষণে আমার করণীয় কি?

উত্তর : একই পাপ একাধিক বার করা জঘন্য অন্যায়। এতে এক সময় ব্যক্তি পাপের অনুভূতিশূন্য হয়ে যায় এবং তওবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকবে এবং প্রতিমুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করবে ও তওবা-ইস্তিগফার করবে। যদি খালেছ নিয়তে তওবা করে তবে তা কবুলযোগ্য হবে ইনশাআল্লাহ। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘এক বান্দা গোনাহ করল। তারপর সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো গোনাহ করে ফেলেছি। তাই আমার গোনাহ মাফ করে দাও। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দা কি একথা জেনেছে যে, তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি গোনাহ মাফ করেন এবং এর কারণে শাস্তিও দেন? (সে যদি জেনে-বুঝে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে) তাহ’লে আমার বান্দাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। তারপর সে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কিছুকাল বিরত থাকার পর আবার গুনাহে লিপ্ত হ’ল এবং একইভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করল। তখন আল্লাহ একই জবাব দিয়ে আবারো তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তার কিছুদিন পর তৃতীয়বারের মত গোনাহ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ রাববুল আলামীন সেবারও তার জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলেন’ (বুখারী হা/৭৫০৭; মুসলিম হা/২৭৫৭; মিশকাত হা/২৩৩৩)।

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন, বান্দা যদি একশ’ বার বা হাযার বার বা তার চেয়ে বেশীবারও পাপ করে আর প্রত্যেকবার তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ (নববী, শরহ মুসলিম হা/২৭৫৭, ১৭/৭৫; ফাৎহুল বারী ১৩/৪৭২)। অতএব নিরাশ না হয়ে পুনরায় পাপ না করার দৃঢ় ইচ্ছার সাথে তওবা করতে হবে। সাথে সাথে সৎ ও নেককার মানুষদের সাথে উঠা-বসা করবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে ডাকে তাঁর দীদার লাভের কামনায় এবং তুমি তাদের থেকে তোমার দু’চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়’ (কাহফ ১৮/২৮)।

প্রশ্ন (১২৬) : মূসা (আঃ) মালাকুল মউতকে থাপ্পড় মেরে তার এক চোখ কানা করে দিয়েছিলেন- এর ব্যাখ্যা কি?

উত্তর : মালাকুল মউত মূসা (আঃ)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তাকে থাপ্পড় মেরে চোখ নষ্ট করে দেন মর্মে ঘটনাটি ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। হাদীছটি নিম্নরূপ :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, মালাকুল মউত মূসা (আঃ)-এর নিকট আসেন তাঁর জান কবয করার জন্য। তখন তিনি তাকে থাপ্পড় মারেন। ফলে তার চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তখন মালাকুল মউত তার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যান এবং বলেন, আপনি আমাকে এমন এক বান্দার নিকট পাঠিয়েছেন, যিনি মরতে চান না। আল্লাহ তার চোখ ফিরিয়ে দেন এবং বলেন, তুমি পুনরায় যাও এবং তাকে বল, আপনি কতদিন বাঁচতে চান? অতঃপর তুমি একটি ষাঁড়ের দেহে হাত রেখে বলবে, এর মধ্যে যত লোম আছে ততদিন আপনার হায়াত বৃদ্ধি করা হবে। তিনি বললেন, অতঃপর কি হবে? তিনি বললেন, আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। তখন মূসা বললেন, তাহ’লে এখুনি হৌক। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে একটি ঢিল ছোঁড়ার দূরত্বে নিয়ে যাও। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! যদি আমি সেখানে থাকতাম, তাহ’লে আমি তোমাদেরকে রাস্তার ধারে সেই লাল ঢিবির স্থানটি দেখিয়ে দিতাম’ (বুখারী হা/৩৪০৭; মুসলিম হা/২৩৭২; মিশকাত হা/৫৭১৩)।

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু খুযায়মাহ (রহঃ) বলেন, অনেক বিদ‘আতী ব্যক্তি এই হাদীছকে অস্বীকার করে। তারা বলে, মূসা (আঃ) যদি তাকে চিনে থাকেন, তাহ’লে তিনি তাকে হীন গণ্য করেছেন। আর যদি না চিনে থাকেন, তাহ’লে তার ক্বিছাছ নেওয়া হ’ল না কেন? এর উত্তর এই যে, আল্লাহ ঐ সময় মূসার রূহ কবয করার জন্য পাঠাননি, বরং তাকে পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আর মূসা মালাকুল মউতকে থাপ্পড় মেরেছিলেন এজন্য যে, তিনি মনুষ্যবেশে বিনা অনুমতিতে তার গৃহে প্রবেশ করেছিলেন। যেভাবে দু’জন ফেরেশতা ইব্রাহীম (আঃ) ও লূত (আঃ)-এর বাড়ীতে এসেছিলেন অচেনা মানুষের বেশ ধরে। ফলে ইব্রাহীম (আঃ) তাদের আপ্যায়নের জন্য বাছুরের ভুনা গোশত নিয়ে আসেন (যারিয়াত ৫১/২৪-২৮)। আর লূত (আঃ) তাদের উপর নিজের সমকামী সম্প্রদায়ের হাতে ইয্যত হারানোর ভয় পেয়েছিলেন (হূদ ১১/৮০-৮১)। আর বিদ‘আতীদের দাবী অনুযায়ী একজন ফেরেশতা কিভাবে মানুষের কাছ থেকে ক্বিছাছ নিতে পারেন? অন্য বিদ্বানগণ বলেন, মালাকুল মউত তাকে এখতিয়ার না দিয়ে জান কবয করতে উদ্যত হওয়ায় মূসা (আঃ) তাকে থাপ্পড় মারেন। কেননা নবী-রাসূলগণকে মৃত্যুর আগে এখতিয়ার দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) স্বীয় মৃত্যুকালে বলেন, ‘কোন নবীই মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না তাঁকে (দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্য থেকে) একটিকে বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয়’ (বুখারী হা/৪৪৩৫; মুসলিম হা/২৪৪৪; মিশকাত হা/৫৯৬৪)। কিন্তু মালাকুল মউত মূসা (আঃ)-কে সে এখতিয়ার নেওয়ার সুযোগ দেননি (ফাৎহুল বারী হা/৩৪০৭-এর আলোচনা, ৬/৪৪২ পৃ.)।     

ইমাম কুরতুবী বলেন, মালাকুল মউত অচেনা মানুষের বেশ ধরে তাঁর ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। সেকারণ মূসা (আঃ) তাকে থাপ্পড় মারেন। এটাই হ’ল সুন্দর ব্যাখ্যা (কুরতুবী, তাফসীর মায়েদাহ ২১ আয়াত, ৬/১৩২)। সর্বোপরি ফেরেশতা অদৃশ্য সত্তা। তাকে থাপ্পড় মারা কোন মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়; যদি না তিনি মনুষ্যবেশে আগমন করেন। সর্বোপরি বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়াও অপ্রয়োজনীয়। কেননা লৌকিক জ্ঞান দিয়ে কোন অলৌকিক বিষয়কে ব্যাখ্যা করা মানুষের সাধ্যাতীত। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

প্রশ্ন (১২৭) : স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর জান্নাত-মর্মে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়েছে কি?

উত্তর : উক্ত মর্মে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি। তবে স্ত্রীর নিকট স্বামী অনেক মর্যাদাশীল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) সর্বদা স্বামীর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। জনৈক মহিলা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে কথা বলা সম্পন্ন করলে তিনি তাকে বললেন, ‘হে অমুক মহিলা! তোমার স্বামী আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ আছে। তিনি বললেন, তুমি তার জন্য কেমন? সে বলল, আমি তার আনুগত্য ও খেদমতে কমতি করি না। তবে যেটা করতে অসমর্থ হই তা ব্যতীত। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, তুমি খেয়াল রেখ যে, তুমি তার হৃদয়ের কোথায় অবস্থান করছ? কেননা সে তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম (আহমাদ হা/১৯০২৫; ছহীহাহ হা/২৬১২)।

অন্যত্র এসেছে, মু‘আয (রাঃ) সিরিয়া থেকে ফিরে এসে নবী করীম (ছাঃ)-কে সিজদা করেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বলেন, হে মু‘আয! এ কী? তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গিয়ে দেখতে পাই যে, তথাকার লোকেরা তাদের ধর্মীয় নেতা ও শাসকদেরকে সিজদা করে। তাই আমি মনে মনে আশা পোষণ করলাম যে, আমি আপনার সামনে তাই করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তা করো না। কেননা আমি যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহ’লে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করতে। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! স্ত্রী তার স্বামীর হক আদায় না করা পর্যন্ত তার প্রভুর হক আদায় করতে সক্ষম হবে না (ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫২৯৫)।

প্রশ্ন (১২৮) : অভিভাবকদের মত হ’ল, চাকুরী না পেলে বিবাহ নয়। অন্য দিকে চাকুরী পেতে পেতে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় বা বহু পাপের সাথে জড়িয়ে পড়তে হয়। এক্ষণে গোপনে বিবাহ করা কি জায়েয? বিবাহের সংবাদ ঘোষণা করা কি যরূরী? গোপন রাখলে গুনাহগার হ’তে হবে কি?

উত্তর : বিবাহের ঘোষণা দেওয়া ও প্রচার করা যরূরী (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/১০২; ঊছায়মীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা বিবাহের সংবাদ প্রচার কর, তোমরা বিবাহের সংবাদ প্রচার কর। কেননা এটি এমন সম্বন্ধ, যা ব্যভিচার নয় (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫২৯; ছহীহাহ হা/১৪৬৩)। তবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মেয়ের পিতা ও দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিবাহ হ’লেই বিবাহ সিদ্ধ হবে। কারণ বিবাহের জন্য এই তিনটি বিষয় আবশ্যিক (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৭৫; ইরওয়া হা/১৮৬০, সনদ ছহীহ)। স্মর্তব্য যে, গোপন বিবাহের নামে যদি কেউ প্রচলিত কোর্ট ম্যারেজ করে বা মেয়ের ওলী ব্যতীত বিবাহ হয়, তবে তা বাতিল হবে (তিরমিযী হা/১১০২ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩১৩১)।

প্রশ্ন (১২৯) : তাহাজ্জুদ সহ যেকোন নফল ছালাত স্ত্রীর সাথে জামা‘আতের সাথে আদায় করা যাবে কি?

উত্তর : তাহাজ্জুদ সহ যেকোন নফল ছালাত স্ত্রীর সাথে জামা‘আতের সাথে আদায় করা যাবে। তবে স্ত্রী পিছনে দাঁড়াবে। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, একবার আমাদের ঘরে আমি ও একটি ইয়াতীম ছেলে (অর্থাৎ আমার ভাই) নবী করীম (ছাঃ)-এর পিছনে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করলাম। আর আমার মা উম্মে সুলাইম (রাঃ) আমাদের পিছনে দাঁড়ালেন (বুখারী হা/৭২৭; মিশকাত হা/১১০৮)। তবে এটি নিয়মিত করা উচিৎ হবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) এমন আমল মাঝে-মধ্যে করেছেন (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৩/৪১৪; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ-দারব)।

প্রশ্ন (১৩০) : কুরবানীর গোশত তিনভাগ করার ব্যাপারে শারঈ নির্দেশনা আছে। কিন্তু আক্বীক্বা বা সাধারণভাবে পশু যবেহ করলেও তিনভাগ করতে হবে কি?

উত্তর : কুরবানীর গোশতের ন্যায় আক্বীক্বার গোশতও তিনভাগ করা উত্তম। তবে কেউ যদি মনে করে পুরো গোশত রান্না করে নিজে ও আত্মীয়-স্বজন মিলে খাবে, তাতেও কোন দোষ নেই। ইবনু জুরাইজ বলেন, আক্বীক্বার গোশত রান্না করে নিজে খাবে, প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের খাওয়াবে। এখান থেকে কোন কিছু ছাদাক্বা করার প্রয়োজন নেই (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৯/৩৬৬; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব)।

প্রশ্ন (১৩১) : আমি ছালাতে গিয়ে দেখি ইমাম রুকূ অবস্থায়। ছালাতে অংশগ্রহণ করেই সূরা ফাতিহা পাঠ করা শুরু করি। এরই মধ্যে ইমাম রুকূ থেকে উঠে যান। আমি সেটিকে রাক‘আত ধরে ছালাত সম্পন্ন করি।

উত্তর : রুকূ না পাওয়ার কারণে সে রাক‘আত পায়নি। এক্ষণে ঐ ব্যক্তিকে উক্ত ওয়াক্তের ফরয ছালাত পুনরায় আদায় করতে হবে। কারণ সে ওয়াক্তের মধ্যে সেই ছালাতের বাকী অংশ আদায় করেনি। কারো যদি এক রাক‘আত ছালাত ছুটে যায় এবং সালাম ফিরিয়ে নেয় আর ওয়াক্তের মধ্যে মনে হয় তাহ’লে যে রাক‘আত বা রুকন ছুটেছে তা আদায় করে সহো সিজদা দিয়ে সালাম ফিরালেই যথেষ্ট হবে। আর যদি ছুটে যাওয়া রাক‘আত বা রুকনের বিষয়ে ওয়াক্তের পরে স্মরণ হয় তাহ’লে উক্ত ওয়াক্তের ফরয ছালাত সম্পূর্ণ আদায় করতে হবে (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/১১৪, ১/৬৯৩; শায়খ উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৪/১৭; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৯৩৬ পৃ.)।

প্রশ্ন (১৩২) : ঈদায়নের ছালাতের ২য় রাক‘আতে উঠে বুকে হাত বেঁধে পাঁচ তাকবীর দিতে হবে না-কি তাকবীর শেষে হাত বাঁধবে?

উত্তর : ছালাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হাত বুকে রাখতে হবে। কারণ এটিই ছালাতের মৌলিক অবস্থান। সাহ্ল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, ‘লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ত যেন তারা ছালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে, ছাহাবী সাহ্ল বিন সা‘দ এই আদেশটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত করতেন বলেই আমি জানি’ (বুখারী (দিল্লী ছাপা) ১/১০২ পৃ., হা/৭৪০)। ওয়ায়েল ইবনু হুজর বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপরে রাখলেন’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৭৯)। সুতরাং সিজদা থেকে দাঁড়িয়ে প্রথমে বুকে হাত বাঁধবে। অতঃপর প্রতি তাকবীরে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও বাম হাতের উপর ডান হাত বুকে বাঁধবে।

প্রশ্ন (১৩৩) : আমাদের কারখানায় বিদেশী নারীদের নানা ডিজাইনের শরী‘আত বিরোধী পোষাক বানাতে হয়। এটা জায়েয হবে কি?

উত্তর : অশ্লীলতা প্রকাশ করে এমন পোশাক বানানো থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে অন্যায় কাজে সহায়তা করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গোনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা কর না’ (মায়েদাহ ৫/২)। শালীন পোষাক যেমন নিজে পরবে, তেমনি অন্যকে পরতে সহযোগিতা করবে। আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! আমরা তোমাদের উপর পোষাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি বেশভূষার উপকরণ সমূহ। তবে আল্লাহভীতির পোষাকই সর্বোত্তম (আ‘রাফ ৭/২৬)।

প্রশ্ন (১৩৪) : নারীদের জন্য বাইরে পরা নিষিদ্ধ পোষাক যেমন গেঞ্জি, স্কার্ট ইত্যদি গৃহাভ্যন্তরে পরা জায়েয হবে কি?

উত্তর : এসব পোষাক গৃহাভ্যন্তরে কেবল স্বামীর সামনে পরা জায়েয। সন্তান ও অন্যান্য মাহরামের সামনে নয়। কেননা নারীর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য প্রকাশকারী পোষাক কেবল স্বামী ব্যতীত অন্যের সামনে পরিধান করা নিষিদ্ধ (উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২/৮২৫, ১২/২১৭; ছালেহ ফাউযান, আল-মুনতাক্বা ৩/১৭০)।

প্রশ্ন (১৩৫) : কোন স্থানে ব্যথা হ’লে কি কি দো‘আ পাঠ করতে হয়?

উত্তর : শরীরের কোন স্থানে ব্যথা হ’লে সেখানে হাত রেখে তিনবার বিসমিল্লাহ বলে নিম্নের দো‘আটি সাতবার পাঠ করবেন- আ‘ঊযু বি‘ইযযাতিল্লা-হি ওয়া ক্বুদরাতিহি মিন শার্রি মা আজিদু ওয়া উহা-যিরু’ (আমি যে ব্যথা ভোগ করছি ও যে ভয়ের আশংকা করছি, তার অনিষ্ট হ’তে আমি আল্লাহর সম্মান ও শক্তির আশ্রয় প্রার্থনা করছি)’। রাবী ওছমান বিন আবুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, আমি এটা করি এবং আল্লাহ আমার দেহের বেদনা দূর করে দেন (মুসলিম হা/২২০২; মিশকাত হা/১৫৩৩)। এছাড়া সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়ে দু’হাতে ফুঁক দিয়ে রোগী নিজে অথবা তার হাত ধরে অন্য কেউ যতদূর সম্ভব সারা দেহে বুলাবে (বুখারী হা/৪৪৩৯; মুসলিম হা/২১৯২; মিশকাত হা/১৫৩২; দ্র. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) সংশ্লিষ্ট অধ্যায়)।

প্রশ্ন (১৩৬) : বিবাহ হারাম এমন ব্যক্তিদের সামনে পর্দা করা আবশ্যক নয়। এক্ষণে বোন জীবিত থাকা অবস্থায় দুলাভাইয়ের সামনে পর্দা না করলে গোনাহ হবে কি?

উত্তর : শ্যালিকা অবশ্যই দুলাভাই থেকে শারঈ পর্দা করবে। অন্যথায় গুনাহগার হবে। কেননা মাহরাম প্রথমত দুই প্রকার। স্থায়ী ও অস্থায়ী। অস্থায়ী মাহরাম আবার দুই প্রকার। ১. যাদের সাথে বিবাহ চির দিনের জন্য হারাম যেমন শাশুড়ী। ২. যাদের সাথে স্ত্রীর কারণে অস্থায়ীভাবে বিবাহ হারাম যেমন শ্যালিকা, খালা শাশুড়ী, ফুফু শাশুড়ী ইত্যাদি। সুতরাং যারা স্ত্রীর কারণে অস্থায়ীভাবে হারাম তাদেরকেও যথারীতি শারঈ পর্দা করতে হবে (ফাতাওয়াল মারআতিল ইসলামিয়াহ ১/৪২২-২৩;  বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২০/২৮৯; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৭/৩৬)।

প্রশ্ন (১৩৭) : আমি একজন ড্রাইভার। মালিক বাযার করার পর টাকা বেঁচে যায়। তিনি কখনো বকেয়া টাকা ফেরৎ চান না। তাই আমিও ফেরৎ দেই না। এই টাকা আমার জন্য হালাল হবে কি?

উত্তর : মালিকের অজ্ঞাতসারে বা তাকে না জানিয়ে উক্ত টাকা গ্রহণ করা হালাল হবে না। কারণ মালিক এ ব্যাপারে তাকে অনুমতিও দেননি। অতএব যত টাকা বাঁচবে মালিকের হাতে তুলে দিতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরৎ দাও এবং যে তোমার খেয়ানত করেছে, তুমি তার খেয়ানত করো না’ (তিরমিযী হা/১২৬৪; মিশকাত হা/২৯৩৪; ছহীহাহ হা/৪২৩)।

প্রশ্ন (১৩৮) : পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম যেনা-ব্যভিচার কখন ঘটে?

উত্তর : এ মর্মে কুরআন বা হাদীছে কোনরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে সূরা আহযাব ৩৩ আয়াত ‘প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না’-এর ব্যাখ্যায় মুফাসি্সরগণ বলেন, এটি আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ের। কেউ বলেন, নূহ ও ইদরীস (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ের এবং কেউ বলেছেন, ঈসা ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনা (তাফসীর ত্বাবারী, ইবনু কাছীর)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

প্রশ্ন (১৩৯) : রাসূল (ছাঃ) পড়া-লেখা না শিখে মারা যাননি মর্মে বর্ণিত হাদীছটির বিশুদ্ধতা জানতে চাই।

উত্তর :ما مات رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى قرأ وكتب ‘রাসূল (ছাঃ) পড়া-লেখা না শিখে মারা যাননি’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল (যঈফাহ হা/৩৪৩)। তাছাড়া পবিত্র কুরআনেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে উম্মী বা নিরক্ষর হিসাবে অভিহিত করেছেন (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি তো এর আগে কোন বই পড়নি এবং স্বহস্তে কোন লেখাও লেখনি, যাতে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতে পারে’ (আনকাবূত ২৯/৪৮; বিস্তারিত দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৮০৬ পৃ.)।

প্রশ্ন (১৪০) : ছালাতের মধ্যে কোন রাক‘আত কম-বেশী হওয়া বা অন্য কোন ভুল করার পর সহো দা দিতে ভুলে গেলে পরবর্তীতে তা কিভাবে আদায় করতে হবে?

উত্তর : ছালাতের মধ্যে কোন ফরয রুকন যেমন রুকূ, সিজদা বা রাক‘আত কমে গেলে এবং ওয়াক্তের মধ্যে স্মরণ হ’লে বাকী অংশ আদায় করে সহো সিজদা দিতে হবে। পরে স্মরণ হ’লে পুরো ছালাত আদায় করতে হবে (নববী, আল মাজমূ‘ ৪/৭৭, ৪/১২৫; ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/১১৪, ১/৬৯৩; শায়খ উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৪/১৭; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৯৩৬ পৃ.)। ছালাতের কোন ফরয রুকন বেশী হয়ে গেলে যেমন রাক‘আত বেড়ে গেলে সহো সিজদা দিতে হবে। এই সহো সিজদা দিতে ভুলে গেলে এবং মসজিদের মধ্যে স্মরণ হ’লে সহো সিজদা দিয়ে সালাম ফিরাবে। আর ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর স্মরণ হ’লে সহো সিজদা রহিত হয়ে যাবে (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ২/২৮; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৩/৩৯৭)। তবে যখনই স্মরণ হবে তখনই সহো সিজদা দেওয়া ভালো এবং নিরাপদ (ইবনু তায়মিয়াহ, আল ইখতিয়ারাত ৯৪ পৃ.; বিন বায, ফাতাওয়া নুরুন আলাদ-দারব)। আর ছালাতের ওয়াজিব যেমন প্রথম তাশাহুদ ইত্যাদি ছুটে যাওয়ার কারণে ওয়াজিব হওয়া সহো সিজদা দিতে ভুলে গেলে এবং মসজিদে থাকা অবস্থায় তা স্মরণ হ’লে সহো সিজদা দিবে। আর দেরীতে স্মরণ হ’লে সহো সিজদা রহিত হয়ে যাবে (নববী, আল মাজমূ‘ ৪/১২৫)।

প্রশ্ন (১৪১) : আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে কেবল এক জন এমএ পর্যন্ত পড়াশুনা করে ভালো বেতনে চাকুরী পেয়েছে। যে পড়াশুনা করতে আমাদের চেয়ে ভাইয়ের পিছনে ৬-৭ লক্ষ টাকা বেশী খরচ হয়েছে। এক্ষণে আমি আমার পিতা বা চাকুরীজীবী ভাইয়ের কাছে ইনছাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অর্থ চাইতে পারি কি? আর কি পরিমাণ দাবী করা ন্যায়সঙ্গত হবে?

উত্তর : উক্ত কারণে পিতা বা ভাইয়ের নিকট থেকে টাকা দাবী করার শারঈ কোন অধিকার নেই। কারণ শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর এটা পূরণ করতে সন্তানদের মাঝে তারতম্য হওয়া স্বাভাবিক। তবে উক্ত চাকুরীজীবী ভাইয়ের উচিৎ হবে, অন্যান্য ভাই-বোনের প্রতি ইহসান করা।

উল্লেখ্য যে, কোন সন্তানের জন্য বাড়তি সম্পদ প্রদানের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক- যদি পিতা সন্তানদের কোন সম্পদ হেবা বা দান করতে চান, তাহ’লে সকল সন্তানকে সমানভাবে দিতে হবে। আর মেয়েদেরকে ছেলেদের অর্ধেক দিতে হবে। তবে কাউকে বেশী দিতে চাইলে অন্য শরীকদের সম্মতি থাকতে হবে, যাতে তাদের মাঝে পক্ষপাতিত্ব ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি না হয়। দুই- বিষয়টি যদি সাধারণ ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হয়, তাহ’লে কম-বেশীতে বাধা নেই। যেমন দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে মেডিকেল কলেজে পড়ে যার খরচ অনেক বেশী। অপরদিকে আরেক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যার খরচ অনেক কম। অনুরূপভাবে কোন অসুস্থ, প্রতিবন্ধী বা অভাবী সন্তানের জন্য অতিরিক্ত খরচ করা ইত্যাদি। এরূপ খরচের ক্ষেত্রে কমবেশী করাতে কোন দোষ নেই (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৫/৩৮৯, ৬/৫৩; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩৪/১০৫; উছায়মীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ২/৬৩)। উল্লেখ্য যে, ‘যদি তুমি দানের ক্ষেত্রে কাউকে প্রাধান্য দিতে চাও তাহ’লে মেয়েদের প্রাধান্য দিবে’- মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (যঈফাহ হা/৩৪০)।

প্রশ্ন (১৪২) : আমার আপন বড় ভাই জালিয়াতি করে আমার সব জমি দখল করে নিয়েছে। পিতা-মাতাও মারা গেছেন। এক্ষণে আমি তার বিরুদ্ধে যেকোন পদক্ষেপ নিতে পারি কি?

উত্তর : বৈধ পন্থায় তার বিরুদ্ধে যে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ইসলামী আইন অনুযায়ী কেউ শরীককে ফাঁকি দিয়ে থাকলে অবশ্যই তা ফেরৎ দিতে বাধ্য। সুতরাং প্রথমতঃ আত্মীয়-স্বজনের সহায়তা নিয়ে প্রাপ্য অংশ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যদি স্থানীয়ভাবে সমাধান না হয়, তবে আদালতের সহায়তা নিবে। স্মর্তব্য যে, নিজের বৈধ অধিকার আদায়ের জন্য রাসূল (ছাঃ) জোর তাকীদ দিয়েছেন। যেমন জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্র রাসূল! যদি কেউ আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়, তবে আমি কি করব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি তাকে তোমার সম্পদ নিতে দিবে না। লোকটি বলল, যদি সে আমার সাথে এ নিয়ে লড়াই করে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমিও তার সাথে লড়াই করবে। লোকটি বলল, যদি সে আমাকে হত্যা করে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে তুমি শহীদ বলে গণ্য হবে। লোকটি বলল, আর যদি আমি তাকে হত্যা করি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে সে জাহান্নামী (মুসলিম হা/১৪০; মিশকাত হা/৩৫১৩)। সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও যদি দখলে না নিতে পারে, তাহ’লে এর প্রতিদান আল্লাহ্র নিকট চাইতে হবে। কেননা শেষ বিচারের দিন যালেমের নেকী মাযলূমকে প্রদান করা হবে এবং মাযলূমের পাপ যালেমের আমলনামায় যুক্ত করা হবে (মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭)।

প্রশ্ন (১৪৩) : দুর্গন্ধ দূর করার জন্য নারীরা এ্যালকোহলযুক্ত পারফিউম ঘরে বা বাইরে ব্যবহার করতে পারবে কি?

উত্তর : প্রথমতঃ নারীরা ঘরের বাইরে কোন ধরনের পারফিউম বা সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবে না। বরং এরূপ নারীকে যেনাকার বলা হয়েছে (নাসাঈ হা/৫১২৬; মিশকাত হা/১০৬৫)। তবে বাড়িতে স্বামীর সামনে ব্যবহার করতে পারবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, পুরুষের জন্য সুগন্ধি যাতে রং নেই এবং নারীর জন্য রং যাতে সুগন্ধি নেই। রাবী সাঈদ বিন আবু ‘আরূবাহ বলেন, আমি মনে করি যে, এর দ্বারা তারা অর্থ নিতেন, যখন নারী বাইরে যাবে। কিন্তু যখন সে তার স্বামীর কাছে থাকবে, তখন যা খুশী সুগন্ধি লাগাবে’ (আবুদাঊদ হা/৪০৪৮; মিশকাত হা/৪৩৫৪)। 

দ্বিতীয়তঃ দুর্গন্ধনাশক স্প্রে বা পারফিউম যাতে অধিক মাত্রায় এ্যালকোহল রয়েছে, তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ যা মাদকতা আনে তা খাওয়া, পান করা, ক্রয়-বিক্রয়  করা সবই হারাম (তিরমিযী হা/১২৯৫; মিশকাত হা/২৭৭৬, সনদ ছহীহ; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৮/৩৩৭)। তবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে যদি মাদকতা না আনে এমন সামান্য পরিমাণ এ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, তবে তা জায়েয (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৩/৫৪; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া নং ২৮৭; ১২/৩৭০)।

প্রশ্ন (১৪৪) : কাবিননামা রেজিস্ট্রারে আমার অজান্তেই কাযী ছাহেব তাকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে আমার স্ত্রী কিছু না জানিয়েই হঠাৎ আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এক্ষণে আমি গ্রহণ না করলে এর কার্যকারিতা আছে কি?

উত্তর : স্বামীর শারঈ কোন দোষের কারণে স্বামী থেকে স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রথমতঃ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে তা সংঘটিত হবে। আর যদি স্বামী গ্রহণ না করে তবে সামাজিকভাবে বা আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি কার্যকর হবে। ‘খোলা’ তথা বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নারীর পক্ষ থেকে স্বামীকে মোহরানা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, যদি তা তাকে পূর্ণভাবে দিয়ে থাকে। এটি তালাক নয় বরং বিচ্ছেদ (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৮/১৮১; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/২৮৯-৯০)। এক্ষণে যদি তারা নতুনভাবে সংসার করতে চায়, তাহ’লে স্ত্রী এক তোহর ইদ্দত পালন শেষে উভয়ে নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে পারবে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩৩/১৫৩; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/৪৫০-৪৭০)।

প্রশ্ন (১৪৫) : প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলোর কাজে শরীক হওয়ার নিয়তে অর্থ দান করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক দল জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত থাকে, তবে তাদেরকে বৈধ কাজে আর্থিক সহযোগিতা করা যাবে। তবে গণতন্ত্র বা কোন বাতিল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাতে অর্থ দান করা যাবে না। কারণ আল্লাহ বলেন, ‘নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গোনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা কর না’ (মায়েদাহ ৫/২)।

প্রশ্ন (১৪৬) : সন্তান হাদীছের সনদ জানতে চাইলে পিতা বিব্রত হয়ে তার ব্যাপারে বদদো‘আ করেছেন যে, তুমি কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ কর। এরূপ দো‘আ কি কবুল হবে? সন্তানের জন্য এক্ষেত্রে করণীয় কি?

উত্তর : অন্যায়ভাবে কৃত এরূপ বদদো‘আ কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি আল্লাহ মানুষের প্রতি দ্রুত অনিষ্ট করতেন, যেমন তারা দ্রুত কল্যাণ চায়, তাহ’লে তাদের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যেত’ (ইউনুস ১০/১১)। এর তাফসীরে ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, রাগান্বিত অবস্থায় কেউ নিজের, সন্তানের বা সম্পদের বিরুদ্ধে দো‘আ করলে আল্লাহ তার বিশেষ রহমতে অবকাশ দেন (তাফসীরে ইবনু কাছীর ২/৫৫৪, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য যে, পিতার জন্য কখনও উচিৎ হবে না এমন বদদো‘আ করা। কেননা পিতা-মাতার দো‘আ কবুলযোগ্য তা ভালো হোক বা খারাপ হোক (আহমাদ হা/১০৭১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩১)। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) সন্তানদের বিরুদ্ধে দো‘আ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, নিজেদের সন্তান-সন্ততির বিরুদ্ধে, নিজেদের ধন-সম্পদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করো না। (কেননা হয়তো এমন হ’তে পারে যে,) তোমরা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এমন একটি সময় পেয়ে বস, যখন আল্লাহ্র কাছে যা প্রার্থনা করবে, তোমাদের জন্য তা কবুল করে নেবেন (মুসলিম হা/৩০০৯; মিশকাত হা/২২২৯)। অপরদিকে সন্তানেরও উচিৎ হবে, পিতা-মাতার সাথে বাকচারিতায় সর্বোচ্চ ভদ্রতা ও নম্রতা অবলম্বন করা এবং পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হয়, এমন কাজ করে ফেললে বিনয়াবনতচিত্তে ক্ষমা চেয়ে নেয়া।

প্রশ্ন (১৪৭) : কম্পিউটারের দোকানে মাঝে মাঝেই আমাদের জমি বন্ধকের চুক্তিপত্র লিখতে হয়। এটা কম্পোজ করে দিলে কি আমাকে গোনাহের ভাগিদার হ’তে হবে?

উত্তর : লাভ ভোগ করার প্রচলিত নিয়মে বন্ধক রাখা হারাম। কারণ ঋণের বিনিময়ে লাভ ভোগ করা সূদের অন্তর্ভুক্ত (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৪/২৫০; আল-মুদাওয়ানাহ ৪/১৪৯; ছালেহ ফাওযান, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২/৫০৫; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৪/১৭৬-৭৭)। ছাহাবীগণ এমন ঋণদান নিষেধ করতেন, যা লাভ নিয়ে আসে (বায়হাক্বী ৩/৩৪৯-৩৫০; ইরওয়াউল গালীল হা/১৩৯৭)। অতএব এধরনের হারাম কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গোনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)।

প্রশ্ন (১৪৮) : আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে রাসূল (ছাঃ) নিরুৎসাহিত করেছেন কি? করে থাকলে এর তাৎপর্য কি?

উত্তর : لا تنكحوا القرابة القريبة... ‘আত্মীয়রা আত্মীয়দের বিবাহ করো না...’- মর্মে বর্ণিত কথাটি হাদীছ নয়। সম্ভবতঃ গাযালী তাঁর এহইয়াউল উলূম-এর মধ্যে (২/৪১) এটিকে হাদীছ সমষ্টির মধ্যে উল্লেখ করায় অনেকে ধোঁকা খেয়েছেন। আসলে হাদীছ হিসাবে এর কোন ভিত্তি নেই (যঈফাহ হা/৫৩৬৫)। তাছাড়া এটি কুরআন ও রাসূল (ছাঃ)-এর নীতিবিরোধী। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আমরা তোমার জন্য হালাল করেছি ঐসব স্ত্রীদের। যাদেরকে তুমি মোহর দিয়েছ এবং ঐসব দাসীদের, যাদেরকে আল্লাহ তোমার জন্য গণীমত হিসাবে প্রদান করেছেন। আর তোমার চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন ও খালাতো বোনকে, যারা তোমার সাথে হিজরত করেছে (আহযাব ৩৩/৫০)। আর রাসূল (ছাঃ) তার মেয়ে ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহ দেন আপন চাচাতো ভাই আলী (রাঃ)-এর সাথে। অপর দুই মেয়ের বিবাহ দেন আপন চাচা আবু লাহাবের দুই ছেলের সাথে। তিনি নিজেও উম্মে সালামা, আয়েশা, উম্মে হাবীবাসহ অনেক কুরাইশ বংশীয়া আত্মীয়াকে বিবাহ করেন।

প্রশ্ন (১৪৯) : বিবাহিতা মেয়ের পিতা-মাতা অসুস্থ এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। স্বামীর পক্ষে শ্বশুরবাড়ীতে সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষণে উক্ত নারী চাকুরী করে পিতা-মাতাকে সহযোগিতা করতে পারবে কি?

উত্তর : গৃহই মহিলাদের মূল কর্মক্ষেত্র (আহযাব ৩৩)। তবে বিশেষ প্রয়োজনে নারীরা বাইরে চাকুরী করতে পারে। সেজন্য পৃথক কর্মস্থল থাকা যরূরী। সুতরাং নিরাপদ পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতিক্রমে নারীদের চাকুরী করাতে শরী‘আতে বাধা নেই। সেই সাথে উত্তম রিযিকের জন্য আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করবে (ফাতাওয়া ইবনু জিবরীন ২২/১; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৪/৩০৭-৩০৯, ২৮/১০৩; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৭/২৩৭)।

প্রশ্ন (১৫০) : বিভিন্ন কোম্পানী ডাক্তারদের যেসব ঔষধের স্যাম্পল দেয়, সেগুলো গরীব মানুষদের দান করা অথবা তা ঔষধের দোকানে বিক্রি করে উক্ত অর্থ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা জায়েয হবে কি?

হবে। বরং নিজে ভোগ না করে জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দেওয়াই নিরাপদ। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোম্পানীর ঔষধ রোগীদেরকে লিখে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করতেই উক্ত হাদিয়া প্রদান করা হয়ে থাকে, যা একপ্রকার ঘুষ (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ ২৩/৫৭০)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘুষখোর ও ঘুষ প্রদানকারীকে অভিসম্পাত করেছেন (তিরমিযী হা/১৩৩৬; মিশকাত হা/৩৭৫৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/২২১১)।

প্রশ্ন (১৫১) : জনৈকা নারী তার স্বামীর সাথে সংসার করতে অনীহা পোষণ করে। তার ‘খোলা’ তালাক চাওয়ার প্রেক্ষিতে স্বামী সামাজিকভাবে তিন তালাক প্রদান করে। কিন্তু স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, যা কেউ জানত না। এক্ষণে উক্ত তালাক কি কার্যকর হয়েছে?

উত্তর : প্রশ্নে বর্ণিত অবস্থায় ‘খোলা’ হয়েছে। যার ইদ্দত মাত্র এক ঋতু। কিন্তু স্ত্রী যেহেতু গর্ভবতী ছিল, সেজন্য তার ইদ্দত হ’ল সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। অতঃপর উভয়ে চাইলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে সংসার করতে পারবে (তালাক ৬৫/৪)। তাছাড়া স্ত্রীকে গর্ভকালীন ও সন্তানকে দুধ পানকালীন সময়ে স্বামীকে তাদের খরচ বহন করতে হবে (মুসলিম হা/১৪৮০; মিশকাত হা/৩৩২৪; ইবনু কুদামাহ,  মুগনী ৮/১৮৬)।

প্রশ্ন (১৫২) : বাধ্যগতভাবে প্রাপ্ত সূদ গরীবদের মাঝে দান না করে ইনকাম ট্যাক্স পরিশোধে ব্যয় করা যাবে কি?

উত্তর : ট্যাক্স হ’ল সরকারী কর। এর সাথে সূদের কোন সম্পর্ক নেই। সূদ সর্বাবস্থায় হারাম। সুতরাং সূদের টাকা দিয়ে ইনকাম ট্যাক্স দেওয়া যাবে না (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৩/৩৬৬)। বরং সূদের টাকা ছওয়াবের প্রত্যাশা না করে যেকোন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করবে (ফাতাওয়া ইসলামিয়া ২/৪০৪-৪১১)।

প্রশ্ন (১৫৩) : আমরা কেবল তিনবোন। ভাই নেই। আমার পিতারা পাঁচ ভাইবোন। আমার পিতা জীবদ্দশায় আমাদের তিন বোনের নামে সমুদয় সম্পদ রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। আমার এক মামা বলেছেন এটা ঠিক হয়নি। তিনি অন্য ওয়ারিছদের হক বঞ্চিত করেছেন। মসজিদের ইমাম ছাহেব বলেছেন, জীবদ্দশায় পিতা সন্তানদের মধ্যে যেকোন সম্পদ সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারেন। এ বিষয়ে সমাধান কি?

উত্তর : যে ব্যক্তির কেবল তিন কন্যা রয়েছে সে সমুদয় সম্পত্তি মেয়েদের নামে লিখে দিতে পারবে না। কারণ একাধিক কন্যা থাকলে তারা সমুদয় সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবে। আর বাকী সম্পত্তি পিতা-মাতা, স্ত্রী বা ভাই ও তাদের অনুপস্থিতিতে ভাতিজারা পাবে (নিসা ৪/১১)। দ্বিতীয়তঃ জীবিত অবস্থায় ওয়ারিছদের মাঝে সমুদয় সম্পদ বণ্টন করা জায়েয। তবে কাউকে বঞ্চিত করে বা বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নয়; বরং কুরআনের বিধান অনুযায়ীই তা বন্টন করতে হবে (মারদাভী, আল-ইনছাফ ৭/১৪২; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৬/৪৬৩)। সুতরাং কুরআনের বিধান অনুযায়ী কেবল মেয়েদের নামে সমুদয় সম্পত্তি লিখে দিয়ে পিতা অন্যদের বঞ্চিত করেছেন। অতএব সম্পত্তি পুনরায় সঠিকভাবে শরীকদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। নতুবা কুরআনী বিধান লংঘনের দায়ে পিতাকে কবরে শাস্তি ভোগ করতে হবে (নিসা ৪/১৪)।

প্রশ্ন (১৫৪) : জনৈক আলেম বলেন, ওযূ করার ক্ষেত্রে কুলি করার সময় গড়গড়া করা যাবে না। এটা সঠিক কি?

উত্তর : কুলি করার সময় গড়গড়া করার ব্যাপারে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি (ইবনু হাজার, তালখীছুল হাবীর ১/২৬৫)। তবে কুলির সময় গড়গড়া করা ওযূর পূর্ণতাকারী হওয়ায় বিদ্বানগণ তা মুস্তাহাব বলেছেন (মুসলিম হা/২৪০; মিশকাত হা/৪০৫; নববী, আল-মাজমূ‘ ১/৩৫৫; ঊছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১/১৭১)।

প্রশ্ন (১৫৫) : মসজিদে দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায় করলে প্রথম জামা‘আতের মত ছওয়াব পাওয়া যাবে কি?

উত্তর :  কোন ওযরের কারণে দ্বিতীয় জামা‘আত করলে বা মসজিদে এসে একাকী ছালাত আদায় করলেও জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ছওয়াব পেয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, কোন ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ করে মসজিদে গিয়ে দেখতে পেল লোকেরা ছালাত আদায় করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ তাকেও জামা‘আতে শামিল হয়ে ছালাত আদায়কারীদের সমান ছওয়াব দান করবেন। অথচ তাদের ছওয়াব থেকে কিছুই কমানো হবে না (আবুদাউদ হা/৫৬৪; মিশকাত হা/১১৪৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৬১৬৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন উত্তমরূপে ওযূ করে ছালাতের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন সে তার ডান পা উঠাতেই মহান আল্লাহ তার জন্য একটি ছওয়াব লিখে দেন। এরপর বাম পা ফেলার সাথে সাথেই মহা সম্মানিত আল্লাহ তার একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেন। এখন তোমাদের ইচ্ছা হ’লে মসজিদের নিকটে থাকবে অথবা দূরে। অতঃপর সে যখন মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করে, তখন তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। যদি জামা‘আত শুরু হয়ে যাওয়ার পর মসজিদে উপস্থিত হয় এবং অবশিষ্ট ছালাতে শামিল হয়ে ছালাতের ছুটে যাওয়া অংশ পূর্ণ করে, তাহ’লেও তাকে অনুরূপ (জামা‘আতে পূর্ণ ছালাত আদায়কারীর সমান ছওয়াব) দেয়া হয়। আর যদি সে (মসজিদে এসে) জামা‘আত সমাপ্ত দেখে একাকী ছালাত আদায় করে নেয়, তবুও তাকে ঐরূপ (ক্ষমা করে) দেয়া হয় (আবুদাউদ হা/৫৬৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩০১)। অতএব প্রথম জামা‘আতে অংশগ্রহণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কোন কারণে দেরী হয়ে গেলে জামা‘আতে বা একাকী ছালাত আদায় করে নিবে। ইনশাআল্লাহ এতে সে জামা‘আতের ছওয়াব পেয়ে যাবে।

প্রশ্ন (১৫৬) : বিবাহের দিন নিজেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার জন্য তাজ বা মুকুট পরা যাবে কি?

উত্তর : বিয়েতে এগুলি পরা জায়েয। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যেন সাজ-সজ্জায় অন্য ধর্মের সংস্কৃতির প্রকাশ না ঘটে এবং অপচয় না হয়। মনে রাখতে হবে যে, ‘আল্লাহভীতির পোশাকই সর্বোত্তম’ (আ‘রাফ ৭/২৬)। 

প্রশ্ন (১৫৭) : জনৈক নারীর স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম। চিকিৎসা নিয়েও সুফল হয়নি। মহিলার পিতা-মাতার বক্তব্য এভাবেই সংসার করতে হবে। তারা অন্যত্র বিবাহ দিতে রাযী নয়। এক্ষণে উক্ত মহিলা স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে নিজে নিজে বিবাহ করতে পারবে কি?

উত্তর : যদি মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, উক্ত ব্যক্তির স্ত্রী মিলনের সক্ষমতা নেই, তাহ’লে স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাইতে পারে বা ‘খোলা’ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে (ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার ৬/১৯৩; মুগনী ৭/৩২৩; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/২০৭)। এমতাবস্থায় নারী চাইলে ধৈর্য সহকারে স্বামীর সংসারে থাকতেও পারে। ‘খোলা’ করে বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। ওলী যদি বিবাহে অন্যায়ভাবে বাধা দেয়, তাহ’লে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শারঈ নিয়মে বিবাহ সম্পন্ন করবে (আবুদাঊদ হা/২০৮৩)। 

প্রশ্ন (১৫৮) : পিতা বা অন্য কারো কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফরে বের হওয়া শরী‘আতসম্মত হবে কি?

উত্তর : এককভাবে কোন কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সফর করা যাবে না। কেননা মাইয়েতের জন্য যেকোন স্থান থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা যায়। এজন্য কবর যিয়ারত শর্ত নয়। তবে অন্য উদ্দেশ্যে সে স্থানে গমনের পর কবর যিয়ারত করলে তাতে কোন দোষ নেই (উছায়মীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৯৬/৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১/৪৩৪)। উল্লেখ্য যে, কবর যিয়ারত করা সুন্নাত। কারণ কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুকে স্মরণ হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়’ (মুসলিম হা/৯৭৬; মিশকাত হা/১৭৬৩)। আর অধিক নেকী বা বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর কোন মসজিদ বা কোন মানুষের কবর যিয়ারতের জন্য সফর করা হারাম। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারতের জন্যও নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, সফরের জন্য বের হবে না তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে ব্যতীত। মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্বছা এবং আমার এই মসজিদ অর্থাৎ মসজিদে নববী’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৩)।

প্রশ্ন (১৫৯) : ওছমানী শাসক আরতুগ্রুল গাযীর চরিত্র অবলম্বনে যে টিভি সিরিয়াল বানানো হয়েছে, বিশ্বব্যাপী তা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু? এটা দেখা জায়েয হবে কি?

উত্তরঃ ওছমানীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ওছমান গাযীর পিতা আরতুগ্রুল গাযী (মৃত্যু ১২৮০খৃ.)-এর উত্থানের কাহিনী সম্বলিত যে কাল্পনিক তুর্কী চিত্রনাট্য বর্তমানে টিভি সিরিয়াল হিসাবে চলছে, তা ইতিহাসের বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলীর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় (মুহাম্মাদ ফরীদ বেক, তারীখুদ দাওলাহ ১/১১৩-১১৬; ড. আলী মুহাম্মাদ ছাল্লাবী, আদ-দাওলাতুল ওছমানিয়া ১/৪০-৯৩, ২০০)। উক্ত ধারাবাহিকে ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধের বিকাশকে গুরুত্ব প্রদান করা হ’লেও বেপর্দা নারী চরিত্র সহ বহু শরী‘আত বিরোধী দৃশ্যপট রয়েছে। এছাড়া আক্বীদাগতভাবে সেখানে ইবনু আরাবী ও তাঁর ভ্রান্ত ছূফীবাদকে তুলে ধরা হয়েছে। যা একই সাথে তাক্বওয়াবিরোধী এবং তাওহীদের স্বচ্ছ আক্বীদা বিনষ্টকারী। অতএব এসব অনুষ্ঠান দেখা থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য। প্রকাশ থাকে যে, নাট্যচিত্রগুলোর বেশীরভাগ অংশই মিথ্যা ও অতিরঞ্জনে ভরপুর। এতে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি সম্পর্কে দর্শকদের ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মানুষের মনোরঞ্জন ও বিনোদনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে এসব ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রসমূহের প্রকৃত গুরুত্ব হারিয়ে যায়। সর্বোপরি যে কোন অভিনয়কর্মকেই তাক্বওয়া ও ইখলাছবিরোধী এবং আল্লাহ্র স্মরণ থেকে গাফেলকারী কাজ হিসাবে অধিকাংশ বিদ্বান অপসন্দ করেছেন। অপরদিকে কুরআনে বর্ণিত কাহিনী ও নবী-রাসূলগণের কাহিনী নিয়ে অভিনয়কর্মকে ওলামায়ে কেরাম হারাম ঘোষণা করেছেন (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৩/২৬৮-৭০; ফাতাওয়া ইসলামিয়া ৩/৭২)।

প্রশ্ন (১৬০) : জনৈক ব্যক্তি বলেন, শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ইবাদত কবূল হবে না। এটা কি ঠিক?

উত্তর : উক্ত বক্তব্য ভিত্তিহীন। ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য এরূপ কোন শর্তারোপ শরী‘আতে করা হয়নি। তবে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’ (মুসলিম হা/১৯১০, মিশকাত হা/৩৮১৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর  কোন হিজরত নেই। তবে জিহাদ ও তার নিয়ত বাকী রইল। অতএব যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা বের হবে’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮)। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে জিহাদের বাসনা ও শহীদী মৃত্যুর কামনা থাকা যরূরী। অবশ্যই সে জিহাদ হ’তে হবে আল্লাহ্র কালেমাকে সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে প্রকৃত জিহাদ (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই)।

প্রশ্ন (১৬১) : জুম‘আর দিন পিতা-মাতার কবর যিয়ারত করা উত্তম। এ কথা সঠিক কি?

উত্তর : উক্ত কথা সঠিক নয়। যেকোন দিন কবর যিয়ারত করা যায় (মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৬৩)। জুম‘আর দিন কবর যিয়ারতের ফযীলত সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৯-৫০; বায়হাক্বী, শো‘আবুল ঈমান মিশকাত হা/১৭৬৮ ‘কবর যিয়ারত’ অনুচ্ছেদ)।

প্রশ্ন (১৬২) : দেওয়াল লিখন দেখা যায়, ‘সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মীলাদুন্নবীর ঈদ’। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? ইসলাম ধর্মে ঈদে মীলাদ বলতে কি কিছু আছে? ইসলামে ঈদ কয়টি?

উত্তর : ইসলামে ঈদ মাত্র দু’টি। ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা (আবূদাঊদ হা/১১৩৪)। ঈদে মীলাদ বলে কোন কিছুই নেই। এটি খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলমানদের ক্রুসেড যুদ্ধের সময় তাদের ‘বড় দিন’ পালনের অনুকরণে ৬২৫ হিজরীতে ইরাকের ‘এরবল’ প্রদেশের গবর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হি.)-এর নির্দেশক্রমে মুসলমানদের মধ্যে চালু হয়। সমস্ত আলেম এর বিরোধিতা করলেও জনৈক সরকারী আলেম এর পক্ষে বই লেখেন। তখন থেকেই এই বিদ‘আতী প্রথা চালু হয়েছে (দ্র. তারীখ ইবনু খাল্লিকান)।

এদেশের বিদ‘আতীরা ঐ সঙ্গে যোগ করেছে ক্বিয়াম ও জশনে জুলূসের প্রথা। তাদের ধারণা মতে মীলাদের মজলিসে রাসূল (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়। সেকারণ তাঁর সম্মানে সবাইকে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নবী সালাম ‘আলায়কা’ বলতে হয়। অতঃপর তাঁর জন্মের খুশীতে মিছিল বের করতে হয়। যাকে ‘জশনে জুলূস’ বলা হয়। বর্তমানে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস একই দিনে অর্থাৎ ১২ই রবীউল আউয়াল তারিখে পালন করা হচ্ছে। এটাও এক জাহেলী কর্মকান্ড। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস কোনটাই সঠিকভাবে বলার উপায় নেই। সর্বাধিক ধারণা মতে তাঁর জন্ম তারিখ ছিল ৯ই রবীউল আউয়াল এবং মৃত্যু তারিখ ছিল ১লা রবীউল আউয়াল (দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৫৬-৫৭ পৃ.; বিস্তারিত দ্র. ‘মীলাদ প্রসঙ্গ’ বই, ৬ষ্ঠ প্রকাশ)।

প্রশ্ন (১৬৩) : সন্তানের ঋণ পরিশোধ করা পিতার জন্য আবশ্যক কি? পরিশোধ না করলে তিনি গোনাহগার হবেন কি? সন্তান পিতার সংসারে থাকা বা না থাকায় বিধানের কোন পরিবর্তন হবে কি?

উত্তর : সন্তানের ঋণ পরিশোধের জন্য পিতা বাধ্য নন। প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান ঋণ করে থাকলে সে নিজেই এর দায়-দায়িত্ব বহন করবে। সন্তান যদি পিতার সংসারেও থাকে, তবুও এর দায়ভার পিতার উপর বর্তাবে না। তবে পিতা ইহসান স্বরূপ অন্য সন্তানদের সম্মতিক্রমে তাকে ঋণ পরিশোধে সহযোগিতা করতে পারেন। আর বিশেষ অবস্থায় যাকাতের সম্পদ থেকেও তিনি সন্তানের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করতে পারেন (নববী, আল-মাজমূ‘ ৬/২২৯; ইবনু কুদামা, মুগনী ২/৪৮২; ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ইখতিয়ারাত ১/৫১৬)।

প্রশ্ন (১৬৪) : হিজড়াদের আক্বীক্বার বিধান কি? হিজড়াদের মীরাছ কিভাবে বণ্টিত হবে?

উত্তর : হিজড়া সন্তান তিন ভাগে বিভক্ত। কেউ পুরুষাঙ্গ বিশিষ্ট। এরূপ সন্তানের জন্য দু’টি ছাগল আক্বীক্বা দিবে। কেউ নারী অঙ্গ বিশিষ্ট। এরূপ সন্তানের জন্য একটি ছাগল আক্বীক্বা দিবে (বায়হাক্বী হা/১২৫১৪; শানক্বীত্বী, শারহু যাদিল মুসতাক্বনে‘ ১৯/১৩৩)। কিছু হিজড়া সন্তান রয়েছে যাদের নারী বা পুরুষ হিসাবে পার্থক্য করা কঠিন। এরূপ সন্তানের আক্বীক্বার ব্যাপারে আল্লামা শানক্বীত্বী বলেন, বিদ্বানগণ এদের নারী হিসাবে গণ্য করে একটি ছাগল আক্বীক্বা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন (শারহু যাদিল মুসতাক্বনে‘ ২৭/১৩০)। অনুরূপভাবে এদের মীরাছের ব্যাপারেও মতপার্থক্য রয়েছে। তাদের মধ্যে নারী বা পুরুষালী বৈশিষ্ট্য কোনটা স্পষ্ট না হ’লে ইমাম মালেকসহ একদল বিদ্বানের মতে, তাদেরকে মীরাছের ক্ষেত্রে মুতাওয়াস্সিত বা মধ্যবর্তী ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ তারা একইসাথে পুরুষের মীরাছের অর্ধেক এবং নারীর মীরাছের অর্ধেক পাবে (ইসলাম ওয়েব ফৎওয়া ক্রমিক ৪৬৭২৪)।

প্রশ্ন (১৬৫) : জনৈক ব্যক্তি প্রতি বছর গরীব লোকদের ইফতার করানোর নিয়তে তিন বিঘা জমি ওয়াকফ করেন। তিনি মারা গেছেন। এক্ষণে ইফতার করানোর পর অতিরিক্ত টাকা মসজিদ, মাদ্রাসা ও ঈদগাহে দান করা যাবে কি?

উত্তর : ইফতার করানো অধিক ছওয়াবের কাজ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছায়েমকে ইফতার করাবে, তার জন্য ঐ ছায়েমদের অনুরূপ ছওয়াব রয়েছে। অথচ তাদের ছওয়াবে কোন কমতি করা হবে না’ (তিরমিযী হা/৮০৭; ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬; মিশকাত হা/১৯৯২)। সেজন্য উক্ত ব্যক্তির নিয়ত মোতাবেক উক্ত ওয়াকফের সম্পদ কেবল গরীবদেরকে ইফতারের জন্যই বরাদ্দ রাখা উচিৎ। কেননা ওয়াক্ফের সম্পদ দাতার নিয়তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ৪৪/১১৯; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৯/৫৬০-৬১)। তবে কোন শারঈ ওযর থাকলে বা পরিবর্তনকৃত খাতটি ওয়াকফকৃত খাতের সমকক্ষ বা তার চাইতে উত্তম হ’লে এবং তাতে সামাজিক কল্যাণ থাকলে ওয়াকফের খাত পরিবর্তন করা যাবে বলে ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম ও শায়খ উছায়মীনসহ কতিপয় বিদ্বান অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন এক মসজিদের অতিরিক্ত সম্পদ আরেক মসজিদে, এক মাদ্রাসার অতিরিক্ত সম্পদ আরেক মাদ্রাসা বা ঈদগাহে ব্যয় করা ইত্যাদি (ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৪২৯; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ৩/২২৭; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৯/৫৬০-৬১)।

প্রশ্ন (১৬৬) : ইমামের খুৎবা চলাকালীন কোন ফযীলতপূর্ণ বা বিস্ময়কর বর্ণনা শুনলে সরবে ‘সুবহানাল্লাহ’ বা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করা যাবে কি?

উত্তর : খুৎবা চলাকালে খতীবের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপরোক্ত দো‘আ সমূহ পাঠ করায় কোন বাধা নেই। যেমন খুৎবার সময় ইমাম দো‘আ করলে, রাসূল (ছাঃ)-এর নাম নিলে, আল্লাহ প্রদত্ত বড় কোন নে‘মত অথবা কোন আমলে প্রভূত ফযীলত ইত্যাদি বর্ণনা করলে প্রত্যুত্তরে এমন স্বরে আমীন বলা বা তাসবীহ পাঠ করা। যা অন্য মুছল্লীদের শ্রবণে বিঘ্ন ঘটাবে না (শায়খ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩০/২৪৩)।

ছাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তারা এমন কিছু শুনলে তাকবীর বা তাসবীহ পাঠ করতেন। একদিন রাসূল (ছাঃ) বলেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম। আমি আশা করি, তোমরা সমস্ত জান্নাতবাসীর এক-তৃতীয়াংশ হবে। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, আমরা এ কথা শুনে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলাম। তিনি আবার বললেন, আমি আশা করি তোমরা সমস্ত জান্নাতীদের অর্ধেক হবে। এ কথা শুনে আমরা আবারও ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিলাম (বুখারী হা/৩৩৪৮; মিশকাত হা/৫৫৪১)। এমনকি ছালাতরত অবস্থাতে রাসূল (ছাঃ) যখন আল্লাহর বড়ত্ব বিষয়ক আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতেন। যখন প্রার্থনামূলক আয়াত আসত, তখন প্রার্থনা করতেন। জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত আসলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন (মুসলিম হা/৭৭২)। মুছল্লীদের জন্যও অনুরূপ পাঠ করা মুস্তাহাব (শরহ নববী)। অতএব খুৎবার সময় মুছল্লীদের জন্য এরূপ বলায় কোন বাধা নেই। তবে এ সময় মুছল্লীদের মধ্যে পারস্পরিক বাক্যালাপ নিষিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জুম‘আর দিন ইমাম খুৎবা দেওয়ার সময় তুমি যদি তোমার সাথীকে বল ‘চুপ থাক’, তাহ’লে তুমি অনর্থক কথা বললে (বুখারী হা/৯৩৪; মুসলিম হা/৮৫১; মিশকাত হা/১৩৮৫)।

প্রশ্ন (১৬৭) : মায়ের চাচাতো বোনকে বিয়ে করা যাবে কি? দলীলসহ জানতে চাই।

উত্তর : মায়ের চাচাতো বোন মাহরাম নয়। সেজন্য তাকে বিবাহ করায় শরী‘আতে কোন বাধা নেই। আল্লাহ তা‘আলা যে সকল নারীকে মাহরাম হিসাবে বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে মায়ের চাচাতো বোন নেই (নিসা ৪/২৩)। এর পরই আল্লাহ বলেন, এদের ব্যতীত তোমাদের জন্য সকল নারী হালাল করা হয়েছে এই শর্তে যে, তোমরা তাদেরকে মালের বিনিময়ে কামনা করবে বিবাহের উদ্দেশ্যে, ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে নয় (নিসা ৪/২৪)। শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, পিতা-মাতার চাচাতো বোনেরা ব্যক্তির চাচাতো বোনের ন্যায়। সুতরাং আপন চাচাতো বা মামাতো বোনকে বিবাহে যেমন কোন বাধা নেই, তেমনি পিতা-মাতার চাচাতো বা মামাতো বোনকেও বিবাহে কোন দোষ নেই (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয, ফাতাওয়া ইসলামিয়া ৩/১৩১; আমীন বিন ইয়াহ্ইয়া, আল-ফাতাওয়াল জামে‘আহ লিল মারা’তিল মুসলিমাহ ২/৫৯৬)।

প্রশ্ন (১৬৮) : টিকিট কেটে পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা যাবে কি?

উত্তর : প্রচলিত নিয়মে টিকিট কেটে মাছ শিকার শরী‘আতসম্মত নয়। কেননা এতে ধোঁকার সম্ভাবনা থাকে। যা নিষিদ্ধ বাই‘য়ে গারারের অন্তর্ভুক্ত। আর বাই‘য়ে গারার হ’ল এমন পরিমাণ বা এমন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যা বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউ জানে না (নববী, শারহু মুসলিম ১০/১৫৬; ইবনু হাযম, মুহাল্লা ৮/৩৯৬; ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম ২/১৮; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৯/২৭৭)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) পাথর খন্ড নিক্ষেপের মাধ্যমে কেনা-বেচা ও প্রতারণা মূলক ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ করেছেন (মুসলিম হা/১৫১৩; মিশকাত হা/২৮৫৪)। সুতরাং প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে পুকুরে সাধারণ এন্ট্রি ফী নির্ধারণ করে মাছ ধরার ব্যবস্থা করা হ’লে তা জায়েয হবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকে যা মাছ পাবে, তা মালিকের নিকট থেকে নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে নেবে। এতে কারো কোন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না।

প্রশ্ন (১৬৯) : ঈদের ছালাতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অতিরিক্ত তাকবীরসমূহ উচ্চারণকালে রাফঊল ইয়াদায়েন করা কি যরূরী?

উত্তর : ঈদের ছালাতে অতিরিক্ত তাকবীরের সময় রাফঊল ইয়াদায়েন করা মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে সকল মাযহাবের বিদ্বানদের ঐক্যমত রয়েছে (আইনী, আল-বেনায়া শারহুল হেদায়া ৩/১১৫; নববী, আল-মাজমূ‘ ৫/২১; ইবনু কুদামাহ, মুগনী ২/২৮৩)। হানাফী বিদ্বান কা‘সানী এ ব্যাপারে ইজমার দাবী করেছেন (বাদায়েঈ ছানায়েঈ ১/২০৭)। কারণ ওয়ায়েল বিন হুজর বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে প্রত্যেক তাকবীরে রাফঊল ইয়াদায়েন করতে দেখেছি (আহমাদ হা/১৮৮৬৮; আবুদাউদ হা/৭২৫; ইরওয়া হা/৬৪১, সনদ হাসান)। হাদীছটি ব্যাপক অর্থবোধক, যা ঈদের ছালাতের তাকবীরকে শামিল করে। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ সকল তাকবীরকে শামিল করে। অর্থাৎ ঈদ ও জানাযার অতিরিক্ত তাকবীরে রাফউল ইয়াদায়েনকেও শামিল করে (মির‘আত ৫/৫৪)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) প্রত্যেক তাকবীরে রাফঊল ইয়াদায়েন করতেন (যাদুল মা‘আদ ১/৪২৭)। অতএব আম হাদীছের সমর্থন ও অধিকাংশ বিদ্বানের ঐক্যমত থাকায় অতিরিক্ত তাকবীরে রাফঊল ইয়াদায়েন করা মুস্তাহাব (মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৪)।

প্রশ্ন (১৭০) : স্ত্রী কি স্বামীর নাম ধরে ডাকতে পারবে?

উত্তর : স্ত্রীর নিকট স্বামী হ’লেন সম্মানের পাত্র। অতএব যেভাবে ডাকলে স্বামী খুশী হবেন সেভাবে ডাকা উচিৎ। তবে স্বামী অসন্তুষ্ট না হ’লে স্ত্রী স্বামীর নাম ধরে ডাকতে পারে। মূলতঃ এগুলো সামাজিক প্রচলনের বিষয়। আরবীয় সমাজে নাম ধরে ডাকাকে অপমানজনক মনে করা হয় না। যেমন যয়নব (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে তাঁর স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর নাম ধরে কথা বলেছিলেন (বুখারী হা/১৪৬২)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, আয়েশা যখন তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট থাক তখন আমি বুঝতে পারি। আমি বললাম, কিভাবে বুঝতে পারেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি যখন আমার উপর খুশী থাক তখন বল, মুহাম্মাদের রব-এর কসম! আর যখন অসন্তুষ্ট থাক তখন বল, ইব্রাহীমের রব-এর কসম! আয়েশা (রাঃ) বললেন, জী হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল! ক্রোধ ব্যতীত আমি কখনই আপনার নাম ছাড়ি না’ (বুখারী হা/৫২২৮; মুসলিম হা/২৪৩৯; মিশকাত হা/৩২৪৫)। ইব্রাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী হাজেরাকে ছেড়ে মক্কা থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন স্ত্রী তাকে পিছন থেকে তাঁর নাম ধরে ডেকে বলেছিলেন, হে ইব্রাহীম আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ (বুখারী হা/৩৩৬৪; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ১/৪০)।

প্রশ্ন (১৭১) : রামাযান মাসে আমি গর্ভবতী থাকায় ছিয়াম পালন থেকে বিরত ছিলাম। এই সুবাদে আমার স্বামী আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিনের বেলা মিলন করে। আমরা এখন অনুতপ্ত আমাদের করণীয় কী?

উত্তর : উভয়কে উক্ত ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে হবে। স্বামী জোর করে মিলন করায় তাকে ক্বাযা ও কাফ্ফারা দু’টিই আদায় করতে হবে (ইবনু মাজাহ হা/২০৪৫; মিশকাত হা/৬২৮৪; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৬/৪০৪)। আর কাফ্ফারা হ’ল, একজন দাস মুক্ত করা অথবা একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন করা অথবা ষাটজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাদ্য বা পোষাক দান করা (মায়েদাহ ৫/৮৯; বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১১, মিশকাত হা/২০০৪ ‘ছওম’ অধ্যায়)। মিসকীনকে খাদ্য দানের ক্ষেত্রে খাবার রান্না করে ষাট জন মিসকীনকে এক ওয়াক্ত খাওয়াবে অথবা প্রত্যেক মিসকীনকে দিন প্রতি অর্ধ ছা‘ তথা সোয়া এক কেজি করে চাউল দান করবে (বুখারী হা/১৮১৬; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৯; আহমাদ হা/১৮১৪৫)।

প্রশ্ন (১৭২) : মসজিদের ডান দিকের পশ্চিমে পৃথক কোন বাড়িতে মহিলারা জুম‘আর ছালাত আদায় করতে পারবে কি?

উত্তর : কোন বাড়ি থেকে মসজিদের ইমামের অনুসরণ করা জায়েয নয়। কারণ সেটা জামা‘আত হিসাবে গণ্য হবে না। জামা‘আতের জন্য একই মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, কাতার মিলে থাকা এবং ইমামের তাকবীর শুনতে পাওয়া ইত্যাদি শর্তগুলো থাকা আবশ্যক (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৩/৪০৭-৪১০; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ৪/২৯৭-৩০০)। তবে বাধ্যতামূলক কোন ওযরবশত বা মসজিদে জায়গা সংকুলান না হ’লে কাতার মিলে থাকার শর্তে এমন বাড়িতে ছালাত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৩/৪০৪; উছায়মীন, মাজমূ‘ফাতাওয়া ১৩/২৮, ৪৫)।

প্রশ্ন (১৭৩) : জুম‘আর দিন ইমাম ছাহেব খুৎবায় উঠে গেলে তাদের নাম ফেরেশতাদের খাতায় উঠে না। এক্ষণে তাদের জুম‘আ হবে কি?

উত্তর : জুম‘আর দিনে কোন মুছল্লী আযানের পর আসলে সে প্রভূত ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। তবে তার জুম‘আ বাতিল হবে না। কারণ জুম‘আর খুৎবা শ্রবণ করা ওয়াজিব হ’লেও এটি ছালাতের জন্য শর্ত নয় (জুম‘আ ৬২/০৯; ইবনুল ‘আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/২৪৯; ফাৎহুল বারী ২/৪১৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর এক রাক‘আত পেল সে জুম‘আর ছালাত পেল’ (নাসাঈ হা/৫৫৭, ১৪২৫)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আপনি জুম‘আর এক রাক‘আত পেলে অপর রাক‘আত মিলিয়ে নিন। তবে রুকূ না পেলে চার রাক‘আত যোহর পড়ুন (বায়হাক্বী, ইরওয়া হা/৬২১)।

প্রশ্ন (১৭৪) : কোন মৃত ব্যক্তির জন্য জান্নাতের উচু মাকাম কামনা করা যাবে কি? কেননা জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম তো রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ?

উত্তর : যেকোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য জান্নাতের উঁচু মাকাম কামনা করা যায়। আর জান্নাতের উঁচু মাকাম হল জান্নাতুল ফেরদাউস। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা যখন আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউস প্রার্থনা করবে। কারণ তা জান্নাতের মধ্যবর্তী এবং সর্বোচ্চ জান্নাত। সেখান থেকেই জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হয় এবং এর ওপরই আল্লাহর আরশ অবস্থিত (বুখারী হা/২৭৯০; মিশকাত হা/৩৭৮৭)। হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ প্রমাণ করে যে, ফেরদাউস সকল জান্নাতের উপরে অবস্থিত। অতএব মুমিনের জন্য জান্নাতের উঁচু মাকাম তথা জান্নাতুল ফেরদাউস প্রার্থনা করা যাবে। তবে ‘মাক্বামে মাহমূদ’ কারো জন্য প্রার্থনা করা যাবে না। কারণ সে স্থানটি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ। আর সেটি জান্নাতের কোন অংশ নয়। বরং শাফা‘আতের স্থান (ইবনুল জাওযী (মৃ. ৫৭৯ হি.), যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর ৩/৪৭)।

প্রশ্ন (১৭৫) : কোন বিজ্ঞ আলেমের নামের পূর্বে ‘আল্লামা’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে কি?

উত্তর : ‘আল্লামা’ শব্দটি আরবী। যেটি আলেম শব্দের ইসমে মুবালাগা। অর্থাৎ বড় জ্ঞানী। যখন কোন আলেমের মাধ্যমে জাতি উপকৃত হয় এবং তার ইলম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে আল্লামা বলা হয়। বিদ্বানদের মধ্যে এর প্রচলন রয়েছে। সুতরাং শব্দটি কোন বিশিষ্ট আলেমের নামের পূর্বে ব্যবহার করা দোষণীয় নয় (আল-ফারাবী, আছ-ছিহাহ ৫/১৯৯০; আর-রাযী, মুখতারুছ ছিহাহ ১/২১৭; আব্দুল কারীম খিযর, শারহুল আরবাঈন ২১৮ পৃ.)। তবে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন লকবটির অপপ্রয়োগ না হয় এবং যে কারো ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত না হয়। 

প্রশ্ন (১৭৬) : অমুসলিম কেউ মারা গেলে ইন্না লিল্লাহ বলা যাবে কি?

উত্তর : অমুসলিমের মৃত্যুতেও ‘ইন্নালিল্লাহ’ বলা যাবে (বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৩৭৫ পৃ:, ১৪/৩৬৪-৬৫)। কারণ প্রতিটি মানুষই আল্লাহর নিকট ফিরে যাবে। তবে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না (তওবা ১১৩; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ৫/১১৯; আল-মাওসূ‘আতুল আক্বদিয়া)।

প্রশ্ন (১৭৭) : আমি যে অফিসে চাকরি করি সেখানে একটি ফান্ড ছিল। দুই বছর হওয়ার পর মালিক পক্ষ থেকে ফান্ডের টাকা চার শতাংশ সূদসহ সবাইকে ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। উক্ত সূদী অর্থের ক্ষেত্রে আমার করণীয় কি?

উত্তর : মালিক পক্ষের নিকট এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এটা এড়িয়ে যেতে হবে। আর প্রাপ্ত অতিরিক্ত চার শতাংশ অর্থ নেকীর আশা ব্যতীত জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে দিতে হবে। কারণ সূদ সর্বাবস্থায় হারাম। আর হারাম সম্পদ ভোগ করা বা ছওয়াবের আশায় দান করা শরী‘আতসম্মত নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন করল, অতঃপর তা থেকে ছাদাক্বা করল, সে তার ছওয়াব পাবে না এবং হারাম উপার্জনের দায় তার উপরেই বর্তাবে (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩২১৬; ছহীহুত তারগীব হা/১৭১৯)।

প্রশ্ন (১৭৮) : ইস্রাঈলী বর্ণনা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিৎ?

উত্তর : ইস্রাঈলী বর্ণনা সম্পর্কে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. কিছু বর্ণনা আছে যেগুলোকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমর্থন করে, সেগুলো বিশ্বাস করা ওয়াজিব। ২. যেসব বর্ণনা ইসলামী আক্বীদা বিরোধী বা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেগুলো মিথ্যা হিসাবে জানা ওয়াজিব। ৩. আর কিছু বর্ণনা রয়েছে যেগুলোর ব্যাপারে কুরআন বা ছহীহ হাদীছে কিছুই বর্ণিত হয়নি, সেগুলোকে সত্য বা মিথ্যা হিসাবে নির্ধারণ না করে চুপ থাকতে হবে (শানক্বীতী, আযওয়াউল বায়ান ৩/৩৪৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা বনী-ইস্রাঈল থেকে যা বর্ণনা কর, তাতে কোন দোষ নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করল অর্থাৎ জাল হাদীছ বর্ণনা করল, সে যেন নিজের ঠিকানা জাহান্নামে করে নিল (বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮)।  তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা আহলে কিতাবদের (বর্ণনা ও ব্যাখ্যাকে) সমর্থনও করো না, মিথ্যাও বলো না। বরং তোমরা তাদের বলবে, ‘আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং যা আমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে তার উপর’ (বাক্বারাহ ২/৩৬; বুখারী হা/৪৪৮৫; মিশকাত হা/১৫৫)।

প্রশ্ন (১৭৯) : ফিদইয়ার টাকা দিয়ে মসজিদের ইমাম ছাহেব নিজের কিতাব ক্রয় করতে পারবেন কি?

উত্তর: ফিদইয়ার টাকা কেবল ফকীর ও মিসকীনদের হক। এক্ষণে মসজিদের ইমাম যদি ফকীর বা মিসকীনদের অন্তর্ভুক্ত হন, তাহ’লে তিনি ফিদইয়ার টাকা দিয়ে কিতাব ক্রয় করতে পারেন, নতুবা তার জন্য এটি জায়েয নয় (বাক্বারাহ ২/১৮৪; ইমাম শাফেঈ, কিতাবুল উম্ম ৭/৬৮)।

প্রশ্ন (১৮০) : ব্যাংক থেকে সূদী ঋণ নিয়ে ব্যবসা করি। এখান থেকে তওবা করার জন্য এখন আমার করণীয় কি?

উত্তর : প্রথমতঃ ঋণ পরিশোধ করে ব্যাংকের সাথে লেনদেন বন্ধ করতে হবে (ছালেহ ফাওযান, আল-মুনতাক্বা ৫/২১০)। কারণ সূদ সর্বাবস্থায় হারাম (বাক্বারাহ ২/২৭৫-২৭৮)। দ্বিতীয়তঃ খালেছ নিয়তে তওবা করতে হবে। আর তওবা কবুলের জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে- (১) একমাত্র আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্যই তওবা করতে হবে। (২) কৃত গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হ’তে হবে। (৩) পুনরায় সে গোনাহে জড়িত না হওয়ার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তওবার জন্য বেশী বেশী পাঠ করতে হবে ‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ুম ওয়া আতূবু ইলাইহে’ (তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৫৩; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ২৯৪ পৃঃ)।

প্রশ্ন (১৮১) : আমি শাড়ীর ব্যবসা করি। এটা কি হিন্দুদের পোষাক? এর ব্যবসা করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : শাড়ীর ব্যবসা করা জায়েয। কারণ এটি কোন ধর্মের নিদর্শন মূলক পোষাক হিসাবে গণ্য নয়। আর যখন কোন পোষাক মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটা আর ধর্মীয় পোষাক থাকে না (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৩০৭; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৪৭-৪৮, ১২/২৯০; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৩/৩০৬-৩১০)। তবে মুসলমানদের পোষাক হ’তে হবে তাক্বওয়ার পোষাক যা পুরা দেহকে আবৃত করে। কারু পক্ষে শাড়ীর মাধ্যমে পূর্ণ পর্দা করা সম্ভব না হ’লে তিনি শাড়ী বর্জন করবেন এবং পূর্ণ দেহ আবৃতকারী ঢিলা ম্যাক্সী পরবেন। কিন্তু শাড়ী পরিধান করা এবং এর ব্যবসা করা দোষের নয়, বরং মৌলিকভাবে জায়েয।

প্রশ্ন (১৮২) : বিবাহের পাত্রীকে বিউটি পার্লারে নিয়ে বা বাড়িতে সাজ-সজ্জা করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করে নারীরা সৌন্দর্য চর্চা করতে পারে। তবে এজন্য প্রচলিত বিউটি পার্লারে যাওয়া সমীচীন নয়। কারণ বিউটি পার্লারে কৃত্রিমভাবে অসুন্দরকে সুন্দর করার মাধ্যমে প্রতারণা করা হয় এবং ভ্রু চিকন করাসহ নানা শরী‘আত বিরোধী কাজ করা হয়। সেজন্য তাক্বওয়াশীল মুসলিম নারীর জন্য বিউটি পার্লারে যাওয়া অনুচিৎ। তবে যদি শরী‘আত বিরোধী কোন কর্মকান্ড না হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে ও ইয্যত-আব্রু হেফাযত রেখে যাওয়া যেতে পারে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৭/১২৪-১৩৩)।

প্রশ্ন (১৮৩) : তাদলীস কি? মুদাল্লিস রাবীর হাদীছ কি গ্রহণযোগ্যতা পায়?

উত্তর : যে হাদীছের রাবী নিজের উস্তাদের নাম উল্লেখ না করে তদূর্ধ্ব কোন শায়খের নামে এরূপভাবে হাদীছ বর্ণনা করেন যেন মনে হয় যে, তিনি সরাসরি হাদীছটি উক্ত শায়খের নিকট থেকে শুনেছেন। অথচ তিনি নিজে তাঁর নিকট থেকে শুনেননি। এইরূপ কর্মকে উছূলে হাদীছের পরিভাষায় ‘তাদলীস’ বলে। আর যিনি এইরূপ করেন তাঁকে ‘মুদাল্লিস’  বলা হয় (যাহাবী, আল-মাওকেযাতু ফী ইলমি মুছত্বালাহিল হাদীছ ১/৪৭-৪৮)। ‘মুদাল্লিস’ রাবীর এককভাবে বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়- যে পর্যন্ত না তিনি কেবলমাত্র ছেক্বাহ রাবী হ’তে তাদলীস করেন বলে সাব্যস্ত হয় অথবা তিনি সেটি নিজে সরাসরি শ্রবণ করেছেন মর্মে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন (ড. মাহমূদ আত-ত্বহহান, তায়সীরু মুছত্বালাহিল হাদীছ ৯৭ পৃ.)।

প্রশ্ন (১৮৪) : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত শো‘আয়েব (আঃ) কি নবী ছিলেন, না একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন?

উত্তর : শো‘আয়েব (আঃ) একজন নবী ছিলেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর তিনি অন্যতম ছিলেন। হযরত শো‘আয়েব (আঃ) হযরত মূসা (আঃ)-এর শ্বশুর ছিলেন। কওমে লূত-এর ধ্বংসের অনতিকাল পরে কওমে মাদইয়ানের প্রতি তিনি প্রেরিত হন (আ‘রাফ ৭/৮৫; হূদ ১১/৮৪)। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি (خطيب الأنبياء) ‘খাত্বীবুল আম্বিয়া’ (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে খ্যাত ছিলেন (আল-বিদায়াহ ১/১৭৩)। আহলে মাদইয়ান-কে পবিত্র কুরআনে কোথাও কোথাও ‘আছহাবুল আইকাহ’ (أصحاب الأيكة) বলা হয়েছে। যার অর্থ ‘জঙ্গলের বাসিন্দাগণ’। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, আহলে মাদইয়ানের উপরে প্রথমে সাতদিন এমন ভীষণ গরম চাপিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা দহন জ্বালায় ছটফট করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা একটি ঘন কালো মেঘমালা পাঠিয়ে দিলেন, যার নীচ দিয়ে শীতল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল। তখন কওমের লোকেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে সেখানে দৌড়ে এল। এভাবে সবাই জমা হবার পর হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হ’ল এবং মেঘমালা হ’তে শুরু হল অগ্নিবৃষ্টি। তাতে মানুষ সব পোকা-মাকড়ের মত পুড়ে ছাই হ’তে লাগল। ইবনু আববাস (রাঃ) ও মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল-কুরাযী বলেন, অতঃপর তাদের উপর নেমে আসে এক বজ্রনিনাদ। যাতে সব মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর শো‘আরা ১৮৯; কুরতুবী, ঐ; নবীদের কাহিনী ১/২৭২-৭৩)।

প্রশ্ন (১৮৫) : ১০০ বছর পূর্বে নির্মিত মসজিদের জমি ওয়াকফকৃত ছিল না। উক্ত জমির ৭ জন উত্তরাধিকারীর মধ্যে ৩ জন জমি ফেরৎ চায়। তাদের এ দাবী শরী‘আতসম্মত কি? মসজিদ কমিটি উক্ত জমি ফেরৎ দিতে বাধ্য কি?

উত্তর : লিখিতভাবে ওয়াকফকৃত না হ’লেও মৌখিকভাবে জায়গাটি ওয়াকফকৃত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে, যেহেতু সুদীর্ঘকাল যাবৎ সেটি মসজিদের জায়গা হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দাতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে দান বা ওয়াকফ না করলে এটি মসজিদের জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হ’ত না। সুতরাং এতদিন পর উত্তরাধিকারীদের পক্ষে এমন দাবী তোলা শরী‘আতসম্মত নয়। তবে যদি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জানা যায় যে, মসজিদের জায়গাটি লিখিত বা মৌখিক কোনভাবেই ওয়াকফ করা হয়নি। বরং জমিটি জোরপূর্বকভাবে দখলকৃত হয়েছে, সেক্ষেত্রে মসজিদ কমিটি উত্তরাধিকারীদের সাথে যে কোন বৈধ শর্তে সমঝোতা করে নিবে। তবে মসজিদের কোন ক্ষতি করা যাবে না।

প্রশ্ন (১৮৬) : শারঈ বিধান অনুযায়ী ব্যভিচারের শাস্তির দাবীর ক্ষেত্রে ৪ জন সাক্ষী প্রয়োজন হয়। কিন্তু যদি ভিডিও ফুটেজ থাকে, তাহ’লে এই একটি সাক্ষ্য থাকলেই কি তা শাস্তির জন্য যথেষ্ট হবে?

উত্তর : ভিডিও ফুটেজ থাকলেও যেনা সাব্যস্ত করার জন্য চারজন পুরুষের সাক্ষ্য আবশ্যক (নিসা ৪/১৫)। কারণ ভিডিও ফুটেজে সহজেই সংযোজন ও বিয়োজন সম্ভব। ফলে একজন নিরপরাধ মানুষ দোষী সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারে। সেজন্য হয় চারজন সাক্ষী থাকতে হবে অথবা নারীকে গর্ভবতী হ’তে হবে অথবা দোষী ব্যক্তিকে যেনার বিষয়টি স্বীকার করতে হবে। কেবল এই তিনটি পন্থায় রাষ্ট্রের পক্ষে যেনার হদ্দ কায়েম করা সম্ভব। মেডিকেল পরীক্ষা, ডিএনএ টেস্ট, ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি বিষয় ব্যক্তির স্বীকারোক্তির সহায়ক। তবে এগুলো সাক্ষীর স্থলাভিষিক্ত হবে না।

উল্লেখ্য যে, চারজন সাক্ষী পাওয়ার বিষয়টি প্রায় অসম্ভব। তবুও তা নির্ধারণের কারণ হ’ল যেনা-ব্যভিচার অত্যন্ত লজ্জাকর ও স্থায়ীভাবে পারিবারিক ও বংশগত সম্মানবিনাশী। এজন্য সহজেই যেন এ ব্যাপারে কেউ কাউকে অপবাদ দিতে না পারে কিংবা বিষয়টি যেন গোপন থাকে, ছড়িয়ে না যায় এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কৃত এই ঘৃণ্য অপরাধ থেকে ব্যক্তি তওবা করে নেয়, সেজন্য এমন বিধান এসেছে (আল-মাওয়ার্দী, আল-হাভী ১৩/২২৬)।

প্রশ্ন (১৮৭) : রাতে বিতর ছালাত পড়তে না পারলে দিনের বেলা তা জোড় সংখ্যায় ক্বাযা আদায় করতে হবে

উত্তর : বিতরের ক্বাযা জোড় সংখ্যায় আদায় করা যায়। কারণ আয়েশা (রাঃ) বলেন, যদি কখনো নবী করীম (ছাঃ) নিদ্রা বা প্রবল ঘুমের চাপের কারণে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করতে না পারতেন, তাহ’লে তিনি দিনে (চাশতের সময়) ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন (মুসলিম হা/৭৪৬; মিশকাত হা/১৫২৭)। এক্ষণে যারা এক রাক‘আত বিতরে অভ্যস্ত তারা দু’রাক‘আত আদায় করবে। যারা তিন রাক‘আতে অভ্যস্ত তারা চার রাক‘আত আদায় করবে। এভাবে যারা এগারতে অভ্যস্ত তারা বারো রাক‘আত আদায় করবে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া ২৩/৯০; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৩০০; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৪/১১৪)। আর কেউ যদি বেজোড় সংখ্যা ঠিক রেখে আদায় করে তাতেও কোন দোষ নেই। কারণ ক্বাযা ছালাতের নিয়ম হ’ল যতটুকু ছুটে যাবে, ততটুকু আদায় করবে। আর যদি কেউ ওযর ছাড়া বিতর ছালাত ত্যাগ করে তাহ’লে ক্বাযা আদায় করা যরূরী নয় (ফাৎহুল বারী ২/৪৮০; ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার ২/১২২-১২৩)।

প্রশ্ন (১৮৮) : আমি দুইবার সন্তান এ্যাবোরশন করেছি। এখন আমি ভুল বুঝে তওবা করেছি। আল্লাহ কি আমার এ গোনাহ মাফ করবেন? এজন্য কোন কাফ্ফারা দিতে হবে কি?

উত্তর : মায়ের জীবননাশের আশংকা বা শারঈ ওযর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তান নষ্ট করা হারাম ও কবীরা গুনাহের কাজ। এক্ষণে সন্তানের বয়স ১২০ দিন হওয়ার পূর্বে যেহেতু প্রাণের সঞ্চার হয় না, সেহেতু ভ্রূণের বয়স ১২০ দিন হওয়ার পূর্বে গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকলে কোন দিয়াত বা কাফ্ফারা লাগবে না। তবে আল্লাহর নিকট খালেছ নিয়তে তওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে। আর যদি সন্তানের বয়স ১২০ দিন অতিক্রম করার পর গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে, তাহ’লে খালেছ তওবার সাথে সাথে দিয়াত বা রক্তপণ এবং কাফফারা দিতে হবে। কারণ ১২০ দিন হ’লে ভ্রূণে প্রাণের সঞ্চার হয় এবং তা মানবসত্ত্বায় রূপ নেয়। এক্ষেত্রে রক্তপণ হ’ল গুর্রাহ বা ৫টি উট বা সমমূল্যের অর্থ, যা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। তবে তারা যদি মাফ করে দেয়, তাহ’লে রক্তপণ লাগবে না। আর কাফ্ফারা হ’ল একজন দাস মুক্ত করা। এতে অক্ষম হ’লে ধারাবাহিকভাবে দু’মাস ছিয়াম পালন করতে হবে (বুখারী হা/৬৯১০; মুসলিম হা/১৬৮১; আল-মুগনী ৮/৩২৭; ফাতাওয়া লাজানা দায়েমাহ ২১/২৫৫, ৩১৬, ৪৩৪-৪৫০)।

প্রশ্ন (১৮৯) : ওযূ করার ক্ষেত্রে সতর ঢাকতে হবে কি?

উত্তর : ওযূ করার জন্য সতর ঢাকা শর্ত নয়। অতএব সতরবিহীন ওযূ করলে ওযূ হয়ে যাবে (বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/১০১; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ৩/১৭৯)। তবে উত্তম হচ্ছে সর্বাবস্থায় সতর ঢেকে রাখা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, স্বীয় স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া সকল মানুষ হ’তে তোমার লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি কেউ (নির্জনে) একাকী থাকে? উত্তরে তিনি বললেন, তখন আল্লাহ্কেই লজ্জা পাওয়া অধিকতর কর্তব্য (তিরমিযী হা/২৭৬৯; মিশকাত হা/৩১১৭)।

প্রশ্ন (১৯০) : লাশের খাটিয়া বহনের সময় বহনকারী পরিবর্তন করা এবং কবরের উপর খেজুর ডাল ও পানি ছিটানো সুন্নাত কি?

উত্তর: এগুলি সুন্নাত বিরোধী কাজ। বিনা প্রয়োজনে বহনকারী পরিবর্তনের কোন বিধান নেই। তবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি কবরের উপরে যে খেজুরের দু’টি কাঁচা চেরা ডাল পুঁতেছিলেন, সেটা ছিল তাঁর জন্য ‘খাছ’। তাঁর বা কোন ছাহাবীর পক্ষ থেকে পরবর্তীতে এমন কোন আমল করার নযীর নেই বুরাইদা আসলামী (রাঃ) ব্যতীত। কেননা তিনি এটার জন্য অছিয়ত করেছিলেন (বুখারী হা/১৩৬১)। অতএব এটা স্পষ্ট যে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নেক আমলের কারণেই কবর আযাব মাফ হ’তে পারে। ফুল দেওয়া বা কাঁচা ডাল পোতার কারণে নয়। কেননা এসবের কোন প্রভাব মাইয়েতের উপর পড়ে না। যেমন আব্দুর রহমান (রাঃ)-এর কবরের উপর তাঁবু খাটানো দেখে ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ওটাকে হটিয়ে ফেল হে বৎস! কেননা ওটা তার আমলের উপরে ছায়া করছে বা বাধা সৃষ্টি করছে (দ্র. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ‘মৃত্যুর পরে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ’ অধ্যায়; ফাৎহুল বারী ১/৩২০; মির‘আত ২/৫২; বিস্তারিত দ্রঃ আলবানী, মিশকাত হা/৩৩৮-এর টীকা ৫)। আর কবরের মাটি দৃঢ় করার জন্য কবরে পানি ছিটিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) তাঁর সর্বশেষ পুত্র ইব্রাহীমকে দাফন করার পর কবরের উপর পানি ছিটিয়ে ছিলেন (ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৬১৪১; মিশকাত হা/১৭০৮; ছহীহাহ হা/৩০৪৫)। তবে পানি ছিটানোর মাধ্যমে মাইয়েত প্রশান্তি পাবে, তার কল্যাণ হবে এরূপ ধারণার কোন ভিত্তি নেই (উছায়মীন, তা‘লীক্ব ‘আলাল কাফী ২/৩৮৯)।

প্রশ্ন (১৯১) : আমাদের এলাকায় প্রচলিত আছে যে, স্বামী বা পরিবারের অভিভাবক ছালাত আদায় না করলে পরিবারের অন্য সদস্য বিশেষত স্ত্রীর ইবাদত কবুল হবে না। একথার সত্যতা আছে কি?

উত্তর : উক্ত কথার কোন ভিত্তি নেই। তবে ছালাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য ফরয। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তির জন্যও ছালাত আদায় ফরয যতক্ষণ ব্যক্তির হিতাহিত জ্ঞান থাকে (বুখারী হা/১১১৭; মিশকাত হা/১২৪৮; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/১২৬, ১৫/২২৯)। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি তোমার পরিবারকে ছালাতের আদেশ দাও এবং তুমি এর উপর অবিচল থাক’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩২)। এর মধ্যে পরিবার প্রধানের প্রতি কঠোর ধমকি রয়েছে। অতএব পরিবার প্রধানের দায়িত্ব হ’ল পরিবারের সকলকে ছালাতে অভ্যস্ত করা। অন্যথায় তাকে অবশ্যই পরকালে কৈফিয়ত দিতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং (ক্বিয়ামতের দিন) প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতঃপর (১) নেতা, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর (২) পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (৩) স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও তার সন্তানদের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (৪) গোলাম তার মনিবের ধন-সম্পদের উপর দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৬৮৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়)।

প্রশ্ন (১৯২) : সুৎরা কি কেবল খোলা মাঠের জন্য নাকি মসজিদের ভিতরেও দিতে হবে?

উত্তর : সুৎরা মসজিদে ও বাইরে সকল স্থানের জন্য প্রযোজ্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করলে যেন সুৎরার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে’ (আবূদাউদ হা/৫৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪১)। সেজন্য নবী করীম (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সুন্নাত ছালাত আদায়ের সময় মসজিদের পিলার ও খুঁটিকে সামনে রেখে ছালাত আদায়ের চেষ্টা করতেন (বুখারী হা/৫০২; মুসলিম হা/৫০৯, ৮৩৭; মিশকাত হা/১১৮০)। ইবনু ওমর (রাঃ) যখন মসজিদে সুৎরার জন্য কোন খুঁটি না পেতেন তখন নাফে‘কে বলতেন তুমি পিঠ ঘুরিয়ে বসো। অতঃপর তিনি ছালাত আদায় করতেন (ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৮৭৮, ২৮৮১; ইবনু কুদামাহ, মুগনী ২/২৮)। ইবনু ওমর (রাঃ) সুৎরা ছাড়া ছালাত আদায় করতেন না (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/২৩৬৮; বিস্তারিত, শায়খ মুহাম্মাদ বিন রিযক রচিত আহকামুস সুৎরা বই)। উল্লেখ্য যে, মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে বলতে তার সিজদার স্থান পর্যন্ত বুঝায়। এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা যাবে না (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৭৭৬)। অনেক বিদ্বানের মতে, দু’হাত বা দুই কাতার পর থেকে অতিক্রম করা যাবে (মির‘আত)।

প্রশ্ন (১৯৩) : জনৈক ব্যক্তি এক মেয়েকে বিবাহ করে। কিছুদিন পরে তার শ্যালিকাকে পসন্দ হয়। এক্ষণে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে শ্যালিকাকে বিবাহ করা যাবে কি?

উত্তর : স্ত্রীকে তিন মাসে তিন তালাক ও তার ইদ্দত শেষে অন্যকে বিয়ে করতে পারে (বাক্বারাহ ২/২২৮)। স্মর্তব্য যে, সমাজে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো সাধারণতঃ পর্দাহীনতার কারণেই ঘটে থাকে। সুতরাং যত কাছের আত্মীয় হৌক না কেন, মাহরাম নয় এমন প্রত্যেক পুরুষের সামনে নারীর জন্য শারঈ পর্দা যরূরী।

প্রশ্ন (১৯৪) : ঈদে মীলাদুন্নবীর নামে যে মিছিল বা জশনে জুলূসের প্রচলন দেশে রয়েছে, তার বিপরীতে একই দিনে যদি সীরাত মাহফিল বা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী আলোচনা সমাবেশ অথবা কোন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, তাতে কি গোনাহ হবে?

উত্তর : ঈদে মীলাদুন্নবী একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আত। তাই এ বিদ‘আত উপলক্ষ্যে যা কিছুই করা হবে, সবই বিদ‘আতী আমল হিসাবে গণ্য হবে (লাজনা দায়েমা, ফৎওয়া ক্রমিক ৫৭২৩)। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী ও তাঁর নির্দেশিত পথ সম্পর্কে জানার জন্য বছরের নির্দিষ্ট কোন দিন নয়, বরং সারা বছরই উন্মুক্ত। এর জন্য বছরের সেই দিনকেই যদি নির্দিষ্ট করা হয় যে দিনটি বিদ‘আতী আমল উদযাপনের জন্য সুপ্রসিদ্ধ, তবে তাও নিঃসন্দেহে বিদ‘আতী আমল হিসাবে গণ্য হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/১৪০)।

প্রশ্ন (১৯৫) : নতুনভাবে ছালাত শুরু করার ক্ষেত্রে যদি কোন সূরা বা দো‘আ মুখস্থ না থাকে তাহ’লে তার জন্য করণীয় কি?

উত্তর : তাকে অন্ততঃ আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ বা আল্লাহুম্মাগফিরলী বলতে হবে। আব্দুল্লাহ বিন ‘আওফা (রাঃ) বলেন, একজন ব্যক্তি এসে রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, আমি কুরআন জানি না। অতএব আমাকে এর স্থলে কিছু শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তুমি বল ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল ‘আলিঈল ‘আযীম। তখন সে বলল, এ তো আল্লাহর জন্য, আমার জন্য কি? তিনি বললেন, তুমি বল আল্লাহুম্মারহামনী ওয়ারযুক্বনী ওয়া আ‘ফিনী ওয়াহদিনী (আবুদাউদ হা/৮৩২, নাসাঈ হা/৯২৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে দুই সিজদার মাঝে ‘রবিবগফিরলী’ বলবে (ইবনু মাজাহ হা/৮৯৭)। তবে এটি স্রেফ সাময়িক কালের জন্য। কেননা সূরা ফাতিহা ব্যতীত ছালাত সিদ্ধ হয় না (বুখারী হা/৭৫৬; মুসলিম হা/৩৯৪)। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় সূরা ও দো‘আ সমূহ শেখার চেষ্টা করতে হবে।

প্রশ্ন (১৯৬) : হায়েয অবস্থায় নারীরা ‘খোলা’ চাইতে পারবে কি?

উত্তর : ‘খোলা’ বা বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়ার জন্য পবিত্র থাকা শর্ত নয়। ঋতুকালে, গর্ভকালে বা এমন তুহরেও ‘খোলা’ করা যাবে যে তুহরে সহবাস করা হয়েছে। কারণ ‘খোলা’ মূলতঃ তালাক নয়; বরং বিচ্ছেদ। স্বামী বা তার পরিবারের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে স্ত্রী ‘খোলা’ করার অধিকার রাখে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ৩৩/২১; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/৪৬৯)। স্মর্তব্য যে, শারঈ ওযর ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাইতে পারে না। কোন কারণ ছাড়াই যদি কেউ স্বামীর কাছে তালাক চায়, তাহ’লে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না (আবুদাঊদ হা/২২২৬; মিশকাত হা/৩২৭৯; ছহীহুত তারগীব হা/২০১৮)। অন্য বর্ণনায় বিনা কারণে তালাকপ্রার্থী নারীকে ‘মুনাফিক’ বলা হয়েছে (তিরমিযী হা/১১৮৬; মিশকাত হা/৩২৯০; ছহীহাহ হা/৬৩২)। অতএব ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার ব্যাপারে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।

প্রশ্ন (১৯৭) : শিশুদের খেলার জন্য পুতুল বা জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি ব্যবহার করা জায়েয হবে কি?

উত্তর : শিশুদের খেলার জন্য অস্থায়ী ভাবে ব্যবহার্য খেলনা পুতুল ব্যবহার করা নাজায়েয নয় (ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৪১৫; ইবনু হাযম, মুহাল্লা মাসআলা নং ১৯১০; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ১২/১২১)। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সম্মুখে পুতুল নিয়ে খেলা করতাম আর আমার কিছু সাথীও আমার সাথে খেলা করত। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রবেশ করতেন তখন তারা আত্মগোপন করত। কিন্তু তিনি তাদেরকে আমার নিকট পাঠিয়ে দিতেন, অতঃপর তারা আমার সাথে খেলত (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩২৪৩)।  নববী বলেন, মেয়েদের খেলনার বিষয়টি স্বতন্ত্র। কারণ এ ব্যাপারে ছাড় রয়েছে। খেলনাটি মানবাকৃতির হৌক বা প্রাণীর আকৃতির হৌক, দেহধারী হৌক বা দেহহীন হৌক, প্রাণীকুলের মধ্যে তার সাদৃশ্য থাক বা না থাক যেমন দু’ডানা ওয়ালা ঘোড়া (ফাৎহুল বারী ১০/৫২৭; তোহফা ৫/৩৫০)। আয়েশা (রাঃ) মাটি দিয়ে নিজ হাতে এই পুতুলগুলো বানিয়েছিলেন। অতএব এভাবে মাটির পুতুল তৈরি করে তাকে কাপড় পরানো ও সেবা-যত্ন করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সন্তান প্রতিপালনের প্রশিক্ষণ নিতে পারে। এতে দোষ নেই। অবশ্য একদল বিদ্বান ছবি ও মূর্তি নিষিদ্ধের আম হাদীছের উপর ভিত্তি করে যাবতীয় আকৃতিবিশিষ্ট খেলনা ব্যবহার করা হারাম বলেছেন (ফাৎওয়াশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ১/১৮০-১৮৩; তুয়াইজিরী, ই‘লানুন নাকীর ৯৭ পৃ:)। তবে আম হাদীছের বিপরীতে খাছ হাদীছ বর্ণিত হওয়ায় ছোট শিশুদের জন্য যেকোন আকৃতির খেলনা ব্যবহার করা জায়েয (ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৫০০; কারযাভী, আল-হালাল ওয়াল হারাম ১০৩-১০৪ পৃ:)। উল্লেখ্য যে, এসব খেলনা কেবল খেলনা হিসাবেই ব্যবহার করা যাবে। শোকেসে বা অন্য কোথাও প্রদর্শনীর জন্য তা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন (১৯৮) : আমি এক লাখ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে ১ বছর জমিতে ফসল ফলিয়ে ফসল ভোগ করলাম। জমির মালিক ১ বছর পর টাকা ফেরত দিলে আমি তার জমি ফেরত দিলাম। উক্ত টাকা ফেরত দেবার সময় জমির মালিক জমি ব্যবহার বাবদ আমাকে এক বা দুই হাযার টাকা কম দেন (বন্ধক নেওয়ার সময় চুক্তি অনুযায়ী)। এই প্রকারের জমি বন্ধক সূদ হবে কি-না? দ্বিতীয়তঃ আমি উক্ত বন্ধক নেওয়া জমি যদি নিজে চাষ না করি বরং জমির মালিককে বা অন্যকে লিজ দেই এবং তার পরিবর্তে বছরে ১২,০০০/- টাকা নেই সেটা সূদ হবে কি-না? (উল্লেখ্য, বর্তমান আমাদের এলাকায় বিষয়টি এমনভাবে প্রচলিত আছে যে, উক্ত বন্ধক নেওয়া জমি মূল মালিককেই চাষ করতে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে তাকে বন্ধক বাবদ প্রাপ্য টাকা থেকে ১২,০০০/- টাকা কম দেওয়া হয়। অর্থাৎ মালিককে এক লাখ টাকার বদলে ৮৮,০০০/- টাকা প্রদান করা হয় এবং জমি চাষাবাদ করতে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে হুকুম কি? বিস্তারিত জানতে চাই।)

উত্তর : প্রচলিত নিয়মে জমি বন্ধক নেওয়া ও দেওয়া ইসলামী শরী‘আতে হারাম। সুতরাং প্রশ্নোল্লেখিত উভয় পদ্ধতির লেনদেন করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ ঋণের বিনিময়ে লাভ ভোগ করা সূদ (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৪/২৫০; আল-মুদাওয়ান্নাহ ৪/১৪৯; ছালেহ ফাওযান, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২/৫০৫; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৪/১৭৬-৭৭)। ছাহাবীগণ এমন ঋণ নিষেধ করতেন, যা লাভ নিয়ে আসে (বায়হাক্বী ৩/৩৪৯-৩৫০; ইরওয়াউল গালীল হা/১৩৯৭)। উল্লেখ্য যে, সাধারণ অবস্থায় জমি ভাড়া (লীজ) দেওয়া ও নেওয়া এবং তাতে চাষাবাদ করা জায়েয (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৭৪, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, ১৩ অনুচ্ছেদ)।

প্রশ্ন (১৯৯) : আমার স্ত্রী চুলে লাল রংয়ের হেয়ার কালার ব্যবহার করে। এটা জায়েয হবে কি?

উত্তর : স্ত্রীর চুল যদি কালো হয়, তবে সেখানে লাল রংয়ের হেয়ার কালার ব্যবহার করা যাবেনা। কেননা কালো চুলই প্রকৃতি সম্মত। যা পরিবর্তন করা নিষিদ্ধ (রূম ৩০)। পক্ষান্তরে  যাদের চুল সাদা বা সাদা-কালো মিশ্রিত, তাদের জন্য কালো ব্যতীত যেকোন রং দ্বারা হেয়ার কালার ব্যবহার করা জায়েয (মুসলিম হা/২১০২; মিশকাত হা/৪৪২৪; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৫/১৬৮)। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে এমন এক ব্যক্তি অতিক্রম করল, যে মেহেদী দ্বারা খিযাব লাগিয়েছিল। তাকে দেখে তিনি বললেন, এটা কতই না চমৎকার! বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আরেক ব্যক্তি অতিক্রম করল সে মেহেদী ও ‘কাতাম’ ঘাস উভয়টি দ্বারা খিযাব করেছিল। তিনি তাকে দেখে বললেন,  এটা তো  আরো  উত্তম।  অতঃপর  আরেক

ব্যক্তি অতিক্রম করল, সে হলুদ রং দ্বারা খিযাব লাগিয়েছিল। তিনি তাকে দেখে বললেন, এটা সর্বাপেক্ষা উত্তম (আবুদাউদ হা/৪২১১; মিশকাত হা/৪৪৫৪, সনদ জাইয়েদ, তবে এর মর্ম ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, আহমাদ হা/২২৩৩৭; ছহীহাহ হা/১২৪৫)। আনাস (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ) মেহেদী ও ‘কাতাম’ ঘাস মিশ্রিত খিযাব লাগিয়েছেন। আর ওমর (রাঃ) নিরেট মেহেদীর খিযাব লাগিয়েছেন (মুসলিম হা/২৩৪১; মিশকাত হা/৪৪৭৮)। কিন্তু সাদা চুলে কালো খিযাব সর্বদা নিষিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবেনা (আবুদাঊদ, নাসাঈ , মিশকাত হা/৪৪৫২)।

একইভাবে ছেলেদের চুলকে খাটো এবং মেয়েদের চুলকে লম্বা রাখতে হবে। এটাই আল্লাহর সৃষ্টিগত রীতি। এর পরিবর্তন করা শয়তানী রীতি (নিসা ৪/১১৯; বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৩১)। যারা কালো চুলকে লাল বা হলুদ করে, সাদা চুল উঠিয়ে ফেলে, চুলে বিভিন্ন উদ্ভট ফ্যাশন করে, হাতে-মুখে উল্কি দেয়, নখ সরু ও লম্বা করে, ভ্রূ কেটে সরু করে, দাড়ি ছেটে স্টাইল করে, দাড়ি মুন্ডন করে, তারা আল্লাহ প্রদত্ত স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বিরুদ্ধাচরণ করে, যা নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন (২০০) : ‘তোমরা কম সম্পদ ও অধিক সন্তান হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ছহীহ কি?

উত্তর : বর্ণনাটি যঈফ (যঈফুল জামে‘ হা/২৬৪১; সিলসিলা যঈফাহ হা/২৫৯২)।

প্রশ্ন (২০১) : আক্বীক্বা ২টি পশুর মধ্যে ১টি পিতার বাসায় এবং অপরটি নানার বাসায় যবেহ করা জায়েয হবে কি?

উত্তর: আক্বীক্বার দু’টি পশু দুই স্থানে যবেহ করা জায়েয। এতে কোন দোষ নেই (হায়তামী, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৪/২৫৭; উছায়মীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৫/২২৮; ছালেহ আল-ফাওযান, আল-মুনতাক্বা ১০/৫০)।

প্রশ্ন (২০২) : ২০১৫ সালে জনৈক ব্যক্তির সাথে আমার বোনের বিবাহ হয়। ঝগড়া-বিবাদ করে একাধিকবার সে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। সর্বশেষ চলে আসার বিশদিন পর সামাজিক ভাবে ও কাযীর উপস্থিতিতে তালাকের কার্যক্রম আরম্ভ করা হয় এবং উভয়পক্ষ সালিসের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক্ষণে উক্ত তালাক কি কার্যকর হয়েছে? এখন আমার বোন অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে পারবে কি?

সালিসী বৈঠকের সিদ্ধান্ত শরী‘আত সম্মত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে খোলা‘ কার্যকর হয়েছে। খোলা‘ তথা বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নারীর পক্ষ থেকে, যা স্বামীকে মোহর বা মোহরের অংশবিশেষ ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয়। এটি তালাক নয় (ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী ৮/১৮১; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩২/২৮৯-৯০; শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৯৫; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/৪৬৭-৭০)। এক্ষণে উক্ত মহিলা এক তোহর ইদ্দত পালন শেষে অন্যত্র বা পূর্ব স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হ’তে পারবে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩৩/১৫৩; আল-ইস্তিযকার ৬/৮২; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/৪৫০-৪৭০)।

প্রশ্ন (২০৩) : তাবীয বেচা-কেনা করা শিরক হবে কি?

উত্তর : তাবীয বেচা-কেনা হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন কোন বস্ত্ত হারাম করেন, তখন তা বিক্রি করাও হারাম’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৯৩৮)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয লটকালো সে শিরক করল’ (আহমাদ হা/১৬৯৬৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৯৪; ছহীহাহ হা/৪৯২)। স্মর্তব্য যে, শিরক করা ও শিরকী কাজে সহযোগিতার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না’ (মায়েদাহ ৫/ ২)।

প্রশ্ন (২০৪) : ধর্ষণ ও যেনা/ব্যভিচারের শাস্তির মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? ধর্ষক অবিবাহিত হ’লেও কি সে মৃত্যুদন্ডের উপযুক্ত?

উত্তর : ধর্ষণের শাস্তি ও যেনা বা ব্যভিচারের শাস্তির মধ্যে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। যেনা বা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার শাস্তি বিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড ও অবিবাহিতদের জন্য একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছর নির্বাসন (নূর ২৪/০২; বুখারী হা/৪৯৬৯; মুসলিম হা/১৬৯১; মিশকাত হা/৩৫৫৫)। আর বিবাহিত ও অবিবাহিত ধর্ষকের জন্য যথাক্রমে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদন্ড ও  একশ’ বেত্রাঘাতের সাথে একদল বিদ্বান মিছলে মোহর তথা উক্ত নারীর সামাজিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ  মোহর জরিমানা  হিসাবে  যুক্ত করেছেন (আবূদাউদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৫৭২; মুওয়াত্তা মালেক হা/১৪, ২/৭৩৪; আল-মুনতাকা শারহুল মুওয়াত্তা ৫/২৬৮-৬৯; ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার ৭/১৪৬)। আর যদি অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয় বা হত্যার উদ্দেশ্যে শারিরীকভাবে আঘাত করা হয় বা হত্যা করা হয়, তাহ’লে সেটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল, যার শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জনপদে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়াবী লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি’ (মায়েদাহ ৫/৩৩)। সেক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী আদালত উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করবে। উল্লেখ্য যে, ধর্ষণের শিকার নারীর কোন শাস্তি হবে না (মিশকাত হা/৩৫৭২, সনদ ছহীহ)। তবে সে যে মূলত ধর্ষণের শিকার হয়েছে সে ব্যাপারে প্রমাণ থাকতে হবে। যেমন চিৎকার করা, প্রশাসনকে অবহিত করা বা নিজেকে হেফাযতের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টার ব্যাপারে কোন প্রমাণ থাকা (আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার ৭/১৪৬)।

প্রশ্ন (২০৫) : আমি আমার পিতার অনুমতি ছাড়াই কাযী অফিসের মাধ্যমে এক ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। পরবর্তীতে উক্ত বিবাহ পরিবার মেনে নিয়েছে। অতঃপর ২০১২ সালে পারিবারিক ঝগড়া হলে রাগের মাথায় আমার স্বামী এক তালাক, দুই তালাক উল্লেখ করে। কিন্তু আমরা এক সাথেই সংসার করতে থাকি। ২০২০ সালে আমার স্বামী মেয়ের সামনে আবারো আমাকে তালাক প্রদান করে। এখন আমরা দুজন দুই স্থানে থাকি। তবে পরস্পরকে খুব ভালোবাসি। আমরা মেয়েসহ আবার এক সাথে থাকতে চাই। এক্ষণে আমাদের করণীয় কী?

উত্তর : প্রত্যেক মুমিন নারীর জন্য অপরিহার্য হ’ল পিতা বা অভিভাবকের অনুমতিক্রমে বিবাহ করা (আবুদাঊদ হা/২০৮৫ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩১৩০-৩১)। তবে যেহেতু উক্ত বিবাহ কাযী অফিসের মাধ্যমে হয়েছে এবং পরিবার মেনে নিয়েছে সেহেতু এটি ‘শিবহে নিকাহ’ হিসাবে বৈধ হয়েছে (ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী ৭/৮; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩২/১০৩)। অতঃপর ২০১২ সালে প্রদত্ত একসাথে দুই তালাক এক তালাক হিসাবে গণ্য হবে। অতঃপর ২০২০ সালে প্রদত্ত তালাকটি ২য় তালাক হিসাবে গণ্য হবে। এক্ষণে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে রাজ‘আত করতে পারবে। আর ইদ্দতের তিন মাস মেয়াদ অতিক্রম করলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে সংসার করতে পারবে। উল্লেখ্য যে, রাজ‘আত করলে বা ইদ্দতকাল শেষে বিবাহ করলে স্বামী আর মাত্র এক তালাকের অধিকারী থাকবে। অর্থাৎ এরপর কোন কারণে এক তালাক দিয়ে দিলে স্ত্রী তার জন্য স্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাবে। ফলে স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হওয়া ও স্বেচ্ছায় তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পূর্বে তার সাথে আর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে না (মাসায়েলে ইমাম আহমাদ ২/৩৩৮, মাসআলা নং ৯৭৫; মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩২/৯৯-১০০)।

প্রশ্ন (২০৬) : বেনামাযী ও বেপর্দা মহিলার রান্না করা খাবার খাওয়া যাবে কি?

উত্তর : বেনামাযী ও বেপর্দা মহিলার রান্না করা খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। রাসূল (ছাঃ) অমুসলিমদের রান্না করা খাবার খেয়েছেন (বুখারী হা/২৬১৭; মুসলিম হা/২১৯০; আহমাদ হা/১৩২২৪; ইরওয়া হা/৩৫)। তবে বেনামাযী ও বেপর্দা নারীকে সাধ্যমত উপদেশ দিতে হবে এবং আল্লাহর পথে আহবান করতে হবে।

প্রশ্ন (২০৭) : কুরআন মুখস্থ করার সময় বারবার সিজদার আয়াত আসলে প্রত্যেকবারই কি সিজদা করতে হবে?

উত্তর : প্রত্যেকবার সিজদা দেওয়া যরূরী নয়। বরং শেষে একবার সিজদা দিলেই যথেষ্ট। তবে একবার পাঠ করলে যখনই পাঠ করবে বা শ্রবণ করবে তখনই সিজদা দেওয়া সুন্নাত। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করতেন এবং আমরা তাঁর নিকট থাকতাম, তখন তিনি সিজদা করতেন এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে সিজদা করতাম। এতে এত ভিড় হ’ত যে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সিজদা করার জন্য কপাল রাখার জায়গা পেত না (বুখারী হা/১০৭৬; মিশকাত হা/১০২৫)। এক স্থানে দীর্ঘক্ষণ থাকলে এ সিজদা সঙ্গে সঙ্গে না করে কিছু পরেও করা যায়। স্থান পরিবর্তন হ’লে আর সিজদা করতে হয় না, ক্বাযাও আদায় করতে হয় না। এই সিজদা করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই (ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ১৫৩-৫৪ পৃ.; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৪ পৃ.)।

প্রশ্ন (২০৮) : জালালুদ্দীন রূমীর আক্বীদা সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : জালালুদ্দীন রূমী (৬০৪-৬৭২ হি.) ভ্রান্ত ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী আধ্যাত্মিক সাধক ও কবি ছিলেন। ‘মসনবী’ তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বর্তমান আফগানিস্তানের বল্খ শহরে জন্মগ্রহণকারী এই ফার্সী কবি আক্বীদাগতভাবে ইবনু আরাবীর ন্যায় হুলূল ও ইত্তেহাদের আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ তার বিশ্বাস ছিল, বান্দার আত্মা আল্লাহর পরমাত্মার মধ্যে প্রবেশ করে সেটি আল্লাহর অংশ হয়ে যায়। আর এই আক্বীদা থেকেই চালু হয়েছে ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’ দর্শন (নাঊযুবিল্লাহ)। একে ‘ওয়াহদাতুল উজূদ’ বা অদ্বৈতবাদী দর্শন বলে। ‘হুলূল’-এর পরবর্তী ধাপ হ’ল ‘ইত্তেহাদ’। যার অর্থ হ’ল আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। অতঃপর স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক হয়ে যাওয়া। এই দর্শনমতে অস্তিত্ব জগতে যা কিছু দৃশ্যমান, তার সবই এক ও অভিন্ন এলাহী সত্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ফলে এই আক্বীদার অনুসারী ছূফীরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য করে না। রূমীর কথা, কর্ম ও জীবন সবই শিরক ও বিদ‘আতে ভরা। তার শিষ্য আফলাকী বলেন, মাওলানাকে (রূমীকে) কেউ সিজদা করলে তিনিও তাকে সিজদা করতেন এমনকি কাফের হ’লেও। একদিন এক ব্যক্তি তাকে সাতবার সিজদা করলে তিনিও তাকে সিজদা করলেন (মানকিবুল আরেফীন ১/৩৩০)। তার বন্ধু তাবরীযী বলেন, কেউ যদি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখতে চায় সে যেন আমাদের মাওলানাকে দেখে...কারণ তার সস্ত্তষ্টিতে জান্নাত রয়েছে এবং তার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। আমাদের মাওলানাই জান্নাতের চাবি (মানকিবুল আরেফীন ১/৪২২)। আফলাকী বলেন, জনৈক মুরীদের মৃত্যুসংবাদ আমাদের মাওলানাকে (রূমীকে) জানানো হ’লে তিনি বলেন, আমাকে মৃত্যুর পূর্বে জানাওনি কেন? যাতে আমি মৃত্যুকে ঠেকাতে পারতাম! (মানাকিবুল আরেফীন ১/৪৯৫)। তার রচিত মসনবী হাযারো মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। তিনি গান-বাজনার তালে তালে নৃত্য সহকারে যিকির করাকে স্রষ্টার কাছে নিবেদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মনে করতেন। তার নিগূঢ় অধ্যাত্মবাদী রচনা বহু মানুষের প্রশংসা পেলেও বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদার বিচারে তা নিরেট শিরক ও বিদ‘আতে পরিপূর্ণ। অতএব একজন সচেতন মুসলমানের জন্য তার কাব্য ও দর্শন থেকে বিরত থাকা আবশ্যক (দ্র. সা‘দুদ্দীন তাফতাযানী, ‘রিসালাতুন ফির রাদ্দি ‘আলা আহলে ওয়াহদাতিল উজূদ’)।

প্রশ্ন (২০৯) : পিতার মৃত্যুর পর একটি ক্লাবের সদস্যরা দাবী করছে যে, জীবদ্দশায় তিনি ক্লাবের জন্য কিছু জমি দান করেছিলেন, কিন্তু দখল দেননি। এ বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এখন ক্লাবের সদস্যরা আইনী লড়াই করে জমিটা পেলে পিতার কবরে শাস্তি হবে কি? শাস্তি থেকে পিতাকে বাঁচানোর জন্য তার দানকৃত জমি ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা আমাদের জন্য জায়েয হবে কি?

উত্তর : ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জনকল্যাণমূলক হ’লে পিতা ছওয়াবের অংশীদার হবেন। সেক্ষেত্রে যদি ক্লাবের সদস্যরা কোন অন্যায় কাজ করে, তাতে তিনি দায়ী হবেন না। কারণ কেউ কারু পাপের বোঝা বহন করবে না (আনআম ৬/১৬৪)।  কিন্তু ক্লাবটি ইসলাম বিরোধী কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হ’লে এবং পিতা জেনে-বুঝে সেখানে জমি দান করে গেলে তিনি কবরে শাস্তির অধিকারী হবেন (মুসলিম হা/১০১৭)। সুতরাং সন্তান বা পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব হবে, ক্লাবের সদস্যদেরকে অন্যায় থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়া এবং পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও দান-ছাদাক্বা করা। কেননা সন্তান ব্যতীত অন্যকে দানকৃত বস্ত্ত ফেরৎযোগ্য নয় (তিরমিযী হা/২১৩২)। অতএব উত্তরাধীকারীদের সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে যেন দানকৃত জমিটি কোন অন্যায় কাজে ব্যবহৃত না হয় এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে, ধর্মীয় কাজে দান করার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে ধর্মের নামে কোন শিরক ও বিদ‘আতী কাজে দান করা না হয়। কেননা ক্বিয়ামতের শেষ বিচারের দিন প্রত্যেককে তার আয় ও ব্যয় উভয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে (তিরমিযী হা/২৪১৭)।

প্রশ্ন (২১০) : আমি একাধিকবার কসম করে তা ভঙ্গ করেছি। এক্ষণে কাফফারা কি একবার দিলেই চলবে না প্রত্যেক কসম ভাঙ্গার জন্য পৃথকভাবে কাফফারা দিতে হবে?

উত্তর : কসম ভঙ্গের কাফফারা একবার দিলেই যথেষ্ট হবে (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৬০৬১; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিইয়া ৩৫/৪৮-৪৮)। তবে কসম ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে হ’লে প্রত্যেক কসমের জন্য আলাদা আলাদা কাফফারা দিতে হবে বলে একদল বিদ্বান মত প্রকাশ করেছেন। যদিও প্রথম মতটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৯/৫১৫)। আর কসমের কাফ্ফারা হ’ল ১০ জন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাদ্য বা পোষাক প্রদান করা অথবা একজন দাস বা দাসীকে মুক্ত করা অথবা তিনদিন ছিয়াম পালন করা (মায়েদাহ ৫/৮৯)। উল্লেখ্য যে, কসমকে নিয়ে খেল-তামাশা করা যাবে না। বরং কসম থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে (মায়েদাহ ৫/৮৯)।

প্রশ্ন (২১১) : ছালাতরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সেটা সৌভাগ্যের মৃত্যু হিসাবে গণ্য হবে কি?

উত্তর : যারা ইবাদতরত অবস্থায় মারা যায় তারা সৌভাগ্যবান বলে বিভিন্ন হাদীছ প্রমাণ করে। যেমন হাদীছে এসেছে,  রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন আল্লাহ কোন ব্যক্তির ভালো চান, তাকে মানুষের প্রিয়পাত্র করেন। কেউ রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! প্রিয়পাত্র করার অর্থ কী? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘মৃত্যুর আগে তাকে ভালো কাজে লিপ্ত করেন এবং সে অবস্থায় তাকে মৃত্যু দান করেন’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৪২; আহমাদ হা/ ১৭৮১৯; ছহীহাহ হা/১১১৪)। অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন আল্লাহ কোন মানুষের কল্যাণ চান তাকে পবিত্র করেন। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে বান্দাকে পবিত্র করা হয়, রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তার মনে ভালো কাজের উদ্রেক ঘটিয়ে তাকে ভালো কাজে লিপ্ত করা হয় এবং সে অবস্থায় তার জান কবয করা হয় (ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৯০০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৬)। এছাড়াও ইবাদতে লিপ্ত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সে অবস্থায় ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক বান্দা ক্বিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় উত্থিত হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করেছে’ (মুসলিম হা/২৮৭৮)। অতএব নিঃসন্দেহে ইবাদতরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা সৌভাগ্যের আলামত।

প্রশ্ন (২১২) : কারো উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হ’লে সেক্ষেত্রে প্রতিহত করা না ছবর করা উত্তম হবে?

উত্তর: অন্যায় আক্রমণের শিকার হ’লে প্রতিহত করতে হবে। তবে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ধৈর্য্যধারণ করলে উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে উত্তম প্রতিদান লাভ করবে (শূরা ৪২/৩৯-৪৩, ফুছছিলাত ৪১/৩৪)। জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, কেউ এসে আমার মাল জোর করে নিতে চাইলে আমি কি করব? তিনি বললেন, দিবে না। লোকটি বলল, যদি সে আমার সাথে লড়াই করে? তিনি বললেন, তুমিও লড়াই করবে। সে বলল, যদি সে আমাকে হত্যা করে? তিনি বললেন, তুমি শহীদ হবে। সে বলল, যদি আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, তাহ’লে সে জাহান্নামী হবে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫১৩)।

তবে ফিৎনা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লে সে সময় প্রতিশোধ না নিয়ে ধৈর্য্যধারণ করাই উত্তম। যেমন এমতাবস্থায় করণীয় সম্পর্কে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, যদি কেউ আমার ঘরে ঢুকে আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন আমি কি করব? জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, كُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ তুমি আদমের দুই ছেলের মধ্যে উত্তমটির মত হও’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫৭, মেশকাত হা/৫৩৯৯)।

প্রশ্ন (২১৩) : জান্নাতে পুরুষদের জন্য স্ত্রী থাকবে। কিন্তু তারা সেখানে কোন সন্তান জন্ম দিতে পারবে কি?

উত্তর : জান্নাতী নারী-পুরুষ সেখানে যা কামনা করবে তাই পাবে। তাই সন্তান চাইলে সন্তানও পাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মুমিন লোক যদি জান্নাতে সন্তানের আকাঙ্খা করে তাহ’লে সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী গর্ভধারণ করবে ও সন্তান প্রসব করবে এবং সন্তানটি হবে বয়সে যুবক। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মুহূর্তের মধ্যেই এসব হয়ে যাবে’ (তিরমিযী হা/২৫৬৩; ইবনু মাজাহ হা/৪৩৩৮; দারেমী হা/২৮৩৪; আহমাদ হা/১১০৭৮, সনদ ছহীহ)। ইমাম তিরমিযী বলেন, আলিমদের মধ্যে এই বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন, জান্নাতে সম্ভোগ হবে, কিন্তু সন্তান জন্মগ্রহণ করবে না। তাউস, মুজাহিদ ও ইব্রাহীম নাখাঈ প্রমুখ হ’তে এরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, উক্ত হাদীছ প্রসঙ্গে ইসহাক ইবনু ইব্রাহীম বলেন, মুমিন জান্নাতে সন্তানের ইচ্ছা করা মাত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, কিন্তু সে এমন ইচ্ছা করবে না (তিরমিযী হা/২৫৬৩-এর আলোচনা দ্র.)। সেজন্য হাফেয ইবনু কাছীর, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ও একদল বিদ্বান একটি যঈফ হাদীছের উপর ভিত্তি করে বলেন, জান্নাতে জান্নাতীরা সন্তান জন্ম দিবে না (আহমাদ হা/১৬২৫১; ইবনুল ক্বাইয়িম, হাভিল আরওয়াহ ২৩৮ পৃ.; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ২০/৩৫২)। তবে যেহেতু হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী জান্নাতীরা সেখানে যা চাইবে তাই পাবে, তাই এমন বিষয়ে কোন মতবিরোধে পতিত হওয়ার আবশ্যকতা নেই। আল্লাহ বলেন, সেখানে তোমাদের মন যা চাইবে ও তোমরা যা দাবী করবে, সবই পাবে (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩১)।

প্রশ্ন (২১৪) : আমার তিন সন্তান ছোট থেকে বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশুনা করেছে এবং বর্তমানেও বাইরে চাকুরীরত। ছোট সন্তান বাড়িতে থেকে আমার জমি-জমা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু দেখাশুনা ও পরিচালনা করে। আমার বিবেচনায় অন্য সন্তানদের চেয়ে সে আমার সম্পদের বেশী হকদার। এক্ষণে আমি অন্য সন্তানদের সাথে পরামর্শ না করে ছোট সন্তানকে যদি অতিরিক্ত কোন সম্পদ দিতে চাই, সেটা শরী‘আতসম্মত হবে কি?

উত্তর : কোন সন্তান সম্পদ অর্জনে পিতাকে সহায়তা করলে তার পুরস্কার হিসাবে নিজের জীবদ্দশায় তাকে কিছু সম্পদ বেশী দেওয়া যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই হৃদয়ের দুর্বলতা দূর করে ইনছাফের ভিত্তিতে দিতে হবে। কাউকে বঞ্চিত করা বা কারো প্রতি অসন্তুষ্টির ভিত্তিতে নয় (মুহাম্মাদ আলীশ, ফাৎহুল আ‘লিল মালেক ২/১৫৯-১৬০; ফাতাওয়া আশ-শাবকাতুল ইসলামিয়াহ ১২/৩৯৮২; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৬/২৩৬)।

প্রশ্ন (২১৫) : পুরুষেরা নারীদেরকে অথবা নারীরা পুরুষদেরকে শিক্ষাদান করতে পারবে কি?

উত্তর : কোন পুরুষ কোন গায়ের মাহরাম নারীকে নির্জনে পড়াতে পারবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন বেগানা পুরুষ কোন বেগানা নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান করলে সেখানে তৃতীয় জন থাকে শয়তান’ (তিরমিযী হা/১১৭১, মিশকাত হা/৩১১৮)। তবে যদি একত্রিতভাবে শরঈ পর্দা বজায় রেখে পড়ানো হয় এবং তাতে কোন ফেৎনার আশংকা না থাকে, তাহ’লে বাধা নেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাদের দাবীক্রমে তাদের জন্য পৃথক একটি দিন নির্ধারণ করেন, সেখানে তারা জমায়েত হ’ত এবং তিনি তাদেরকে হাদীছ শিক্ষা দিতেন... (বুখারী হা/৭৩১০; মুসলিম হা/২৬৩৩; মিশকাত হা/১৭৫৩ ‘জানায়েয’ অধ্যায়)। অপরদিকে নিরাপদ পরিবেশ থাকলে পূর্ণ পর্দা সহকারে এবং শরী‘আতের বিধি-বিধানসমূহ মেনে নারী পুরুষদেরকে শিক্ষাদান করতে পারে। তবে ফেৎনার আশংকা থাকলে তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মা আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) পর্দার আড়াল থেকে ছাহাবীগণকে জ্ঞানদান করতেন এবং প্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব দিতেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমরা কোন বিষয়ে আটকে গেলে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গিয়ে তার সমাধান নিতাম (তিরমিযী হা/৩৮৮৩)।

প্রশ্ন (২১৬) : ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে চাকুরী করা যাবে কি?

উত্তর : ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে চাকুরী করা যাবে। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা সূদী কর্মকান্ডের অংশ নয়। তবুও যেহেতু তাতে প্রতিষ্ঠানটির প্রচার-প্রচারণার বিষয়টি যুক্ত থাকে, তাই সাধ্যমত সূদবিহীন প্রতিষ্ঠানে চাকরী অন্বেষণ করতে হবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৫/৪৯)।  

প্রশ্ন (২১৭) : যে বিবাহে খরচ কম সে বিবাহে বরকত বেশী। এ হাদীছ সঠিক কি?

উত্তর : উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (বায়হাক্বী শো‘আব হা/৬১৪৬; মিশকাত হা/৩০৯৭; যঈফাহ হা/১১১৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। তবে যে নারীর বিবাহের মোহর কম, সে বিবাহ বরকতপূর্ণ মর্মে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (আহমাদ হা/২৪৫২২; ইরওয়া হা/১৯২৮, সনদ হাসান)। তাছাড়া বিবাহে খরচ কম হওয়া উত্তম বলে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (আবুদাউদ হা/২১১৭)। অতএব বিবাহ ও মোহরানা সকল ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে বিরত থাকা উচিৎ।

প্রশ্ন (২১৮) : জানাযার ছালাতে ক্বিরাআত সশব্দে পাঠ করা যাবে কি? জানাযার প্রথম বা দ্বিতীয় তাকবীর না পেলে মাসবূক ব্যক্তির করণীয় কি?

উত্তর : জানাযার ছালাত সরবে ও নীরবে দু’ভাবেই পড়া যায় (বুখারী ১/১৭৮, হা/১৩৩৫; মুসলিম হা/৯৬৩ (৮৬); মিশকাত হা/১৬৫৪)। ইমাম সরবে পড়লে মুক্তাদীগণ আ‘ঊযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ সহ কেবল সূরা ফাতিহা চুপে চুপে পড়বে এবং পরে দরূদ ও অন্যান্য দো‘আ সমূহ পড়বে। তবে ইমাম নীরবে পড়লে মুক্তাদীগণ সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা (নাসাঈ হা/১৯৮৭, ৮৯) এবং অন্যান্য দো‘আ পড়বে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) একদা জানাযায় সূরা ফাতেহা সরবে পাঠ করেন ও  ছালাত শেষে বলেন, আমি এজন্য এরূপ করলাম যাতে তোমরা অবগত হও যে, এমনটি করা সুন্নাত (বুখারী হা/১৩৩৫; মিশকাত হা/১৬৫৪)। আর মাসবূক যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় তাকবীরে পৌঁছায়, তবে ছালাতের যে অংশটুকু পাবে সেখান থেকেই শুরু করবে। প্রথম তাকবীরে সূরা ফাতিহা পড়বে এবং ধারাবাহিকভাবে যা বাদ পড়বে, সেটুকু ক্বাযা হিসাবে সংক্ষেপে পূর্ণ করে নেবে’ (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৬; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/১৪৯; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৮/৩৯৯)।

প্রশ্ন (২১৯) : দাদী বা নানী তার কোন নাতিকে বা নাতির ছেলেকে সম্পদের কিছু অংশ উপহার হিসাবে দলীল করে দিতে পারবে কি?

উত্তর : এমতাবস্থায় দাদী বা নানী কিছু সম্পদ লিখিতভাবে হেবা করতে পারে। সম্পদের উত্তরাধিকারী না হলে তাদের নামে অছিয়াতও করা যাবে। তবে এক্ষেত্রেও সমতা স্থাপন যরূরী বলে অধিকাংশ বিদ্বান অভিমত ব্যক্ত করেছেন (নববী, রওযাতুত-তালেবীন ৫/৩৭৯; হায়তামী, তুহফাতুল মুহতাজ ৬/৩৬০; মারদাভী, আল-ইনছাফ ৭/১৩৭)। তবে শারঈ প্রয়োজনে কোন নাতি বা নাতনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৬/৫৩; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১১/৪৮)।

প্রশ্ন (২২০) : মসজিদের বারান্দায় মাইকে আযান না দিয়ে ইমামের পাশে মাইকে আযান দেওয়া যাবে কি?

উত্তর : আযান মসজিদের ছাদে, মিনারে বা মসজিদের বাইরে উঁচু স্থান থেকে দেওয়াই সুন্নাত (আবুদাউদ হা/৫১৯; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/১৯৯৫; আহমাদ হা/২২০৮০; মুত্তাফাকুন আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮০)। অবশ্য মাইক ব্যবহারে আযানের শারঈ উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাওয়ায় মসজিদের ভিতর থেকেও আযান দেওয়া যেতে পারে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৬/৭১-৭৩)। তবে মাইকবিহীন মসজিদের ভিতরে আযান দেওয়া যাবে না। কারণ এতে আযানের শারঈ উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।

প্রশ্ন (২২১) : কুরআন তেলাওয়াত করার সময় ১ থেকে ৪ আলিফ পর্যন্ত টানা ভুল হ’লে, কমবেশী হলে, অন্যান্য মাখরাজে ভুল হ’লে গোনাহ হবে কি?

উত্তর : চার আলিফ বা তিন আলিফ মাদ্দের স্থানে এক আলিফ দীর্ঘস্বরে টানলে অর্থ পরিবর্তন হয় না। সেজন্য এতে গুনাহ হবে না, যদিও তাতে তেলাওয়াতের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। তবে মাখরাজের ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। কেননা এতে অর্থ পরিবর্তনের আশংকা থাকে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২২/৪৪৩-৪৪; ইবনুল হাজ্জ, আল মাদখাল ১/৫৩; যায়লাঈ, তাবঈনুল হাক্বায়েক্ব ১/৯০)।

প্রশ্ন (২২২) : ওযূ করার সময় অঙ্গগুলো তিনবারের বেশী বা কম হয়ে গেলে গোনাহগার হ’তে হবে কি?

উত্তর : ওযূ করার সময় অঙ্গগুলো তিনবারের বেশী ধৌত করা হাদীছের ভাষ্যমতে যুলুম, সীমালংঘন ও অবাধ্যতা। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে তাকে ওযূ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ওযূর অঙ্গ সমূহ তিন-তিনবার করে ধৌত করে দেখালেন। আর বললেন, এভাবেই ওযূ করতে হয়। যে ব্যক্তি এর চাইতে বৃদ্ধি করল, সে অন্যায় করল, সীমালঙ্ঘন ও যুলুম করল (নাসাঈ হা/১৪০; ছহীহাহ হা/২৯৮০)। তবে কম-বেশী করলে তাতে ওযূ হয়ে যাবে (নববী, আল-মাজমূ‘ ১/৪৪০; ফাৎহুল বারী ১/২৩৪; নায়লুল আওত্বার ১/২১৮)। উল্লেখ্য যে, হাদীছে তিন বারের কথা বলা হয়েছে, তিন অঞ্জলী নয়। সুতরাং কারো অঙ্গ ধৌত করতে অধিক পানির প্রয়োজন হলে নিতে পারবে এবং তা সীমালংঘন হবে না (নববী, শরহ মুসলিম ৩/১০৯; বিন বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদা-দারব ৫/৪৬) ।

প্রশ্ন (২২৩) : জনৈকা নারী স্বামী মারা যাওয়ার পর তার ছেলের শিক্ষক মসজিদের জনৈক ইমামের সাথে মা-ছেলের সম্পর্ক তৈরী করেছে। তারা একে অপরের সাথে পর্দার মধ্যে থেকে মা-ছেলের মতো কথা বলে এবং উক্ত ইমাম তাকে মা-মণি বলে ডাকে। এভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা জায়েয হবে কি?

উত্তর: উক্ত নারী পর্দার আড়াল থেকে প্রয়োজনীয় কথা বলতে পারে। তবে এভাবে ছেলের মত সম্পর্ক স্থাপন করে বিশেষ যোগাযোগ রাখা সমীচীন নয়। কারণ ইমাম ছাহেব গায়ের মাহরাম হওয়ায় তা অবৈধ সম্পর্কের দিকে ধাবিত করতে পারে। সেজন্য সর্বাবস্থায় নারী-পুরুষের শারঈ পর্দা পালন করা আবশ্যক (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৩)।

প্রশ্ন (২২৪) : গায়ের মাহরাম নারীর সাথে কথপোকথন ও চলাফেরার ক্ষেত্রে কি কি বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক?

উত্তর : গায়ের মাহরাম নারীর সাথে প্রয়োজনে কথা বলা যাবে। কথা বলার সময় উভয়ে দৃষ্টি অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১)। নারী তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখবে (আহযাব ৩৩/৩২-৩৩)। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা বিধেয় (আহযাব ৩৩/৫৩)। নির্জনে কথা বলা যাবে না (তিরমিযী হা/১১৭১; মিশকাত হা/৩১১৮)। সর্বদা আল্লাহভীতি বজায় রাখবে (আ‘রাফ ৭/২৬)।

প্রশ্ন (২২৫) : দ্বীনী ইলম অর্জনকারী ব্যক্তি জান্নাতে নবীগণের সমমর্যাদার অধিকারী হবেন -কথাটি কি সঠিক?

উত্তর : উক্ত মর্মে কোন হাদীছ পাওয়া যায় না। তবে সাধারণভাবে আলেমগণের মর্যাদায় বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, সাধারণ আবেদ ব্যক্তির উপর আলেমের মর্যাদা যেমন নক্ষত্ররাজির উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। আর নিশ্চয়ই আলেমগণ হ’লেন নবীদের ওয়ারিছ (আবুদাউদ হা/৩৬৪১)। নিঃসন্দেহে সেই আলেম হবেন আক্বীদা ও আমলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিখাদ অনুসারী। কেবল আলেম নন, বরং বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের অনুসারী মুমিনগণ অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী হবেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’ল সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।

প্রশ্ন (২২৬) : যেকোন পাপের জন্য ছালাত ব্যতীত সাধারণভাবে সিজদায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে কি? যেভাবে শুকরিয়া আদায়ের জন্য সিজদা করা যায়?

উত্তর : ইস্তিগফারের জন্য ছালাত ব্যতীত কেবল সিজদার বিধান হাদীছে বর্ণিত হয়নি (নববী, আল-মাজমূ‘ ৩/৫৬৫; ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২৩/৯৪)। সুতরাং কেউ পাপ করলে দু’রাক‘আত ছালাত অর্থাৎ ‘ছালাতুত তওবাহ’ আদায় করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অর্থাৎ সিজদায় গিয়ে বা শেষ বৈঠকে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলায়হে’ বলবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, কোন লোক যদি গুনাহ করার পর ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে। অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেন। তারপর তিনি এ আয়াত পড়েন- ‘যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করলে কিংবা নিজের উপর কোন যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে; অতঃপর স্বীয় পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে... (আলে ইমরান ৩/১৩৫; আবুদাঊদ হা/১৫২১; মিশকাত হা/১৩২৪)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে এবং সেখানে একাগ্রতার সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে তাঁর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন’ (আহমাদ হা/২৭৫৮৬, ছহীহাহ হা/৩৩৯৮)। তবে সহো সিজদা, শুকরিয়ার সিজদা ও তেলাওয়াতের সিজদা ছালাত ব্যতীতও করা যায়। উল্লেখ্য যে, কেবল ছালাত আদায় নয়, বরং যে পাপ থেকে সে তওবা করেছে, সেই পাপের পুনরাবৃত্তি না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকবে।

প্রশ্ন (২২৭) : কেউ নবজাতক সন্তানের সুসংবাদ দিলে কী বলে দো‘আ করতে হবে?

উত্তর : ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (তিরমিযী হা/৩৩৮৩; মিশকাত হা/২৩০৬)। এরপর নবাগত সন্তান ও তার ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন দো‘আ করা যায়। যেমন মু‘আবিয়া বিন কুররা (রাঃ) বলেন, ‘আমার সন্তান ইয়াস জন্মগ্রহণ করলে আমি একদল ছাহাবীকে দাওয়াত করে খাওয়াই। তাঁরা দো‘আ করলেন। আমি বললাম, আপনারা দো‘আ করেছেন। আপনারা যে দো‘আ করেছেন আল্লাহ তাতে বরকত দান করুন! আমিও এখন কতগুলি দো‘আ করব, আপনারা ‘আমীন’ বলবেন। রাবী বলেন, আমি নবজাতকের দ্বীনদারী ও জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে তার জন্য অনেক দো‘আ করলাম। রাবী বলেন, আমি সেদিনের দো‘আর বরকত লক্ষ্য করছি (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৫৫, সনদ ছহীহ মাক্বতূ‘)। নবাগত সন্তানের জন্য নিম্নের দো‘আটিও পাঠ করা যায়- ‘জা‘আলাহুল্লাহু মুবারাকান ‘আলায়কা ওয়া ‘আলা উম্মাতে মুহাম্মাদিন (ছাঃ)’ (আল্লাহ নবজাতককে তোমার জন্য এবং উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য বরকত মন্ডিত করুন) (ত্বাবারাণী, আদ-দো‘আ হা/৯৪৫, সনদ ছহীহ)। উল্লেখ্য যে, সমাজে প্রচলিত নবজাতকের জন্য দো‘আ- بَارَكَ اللهُ لَكَ فِي المَوْهُوبِ لَكَ، وَشَكَرْتَ الوَاهِبَ، وبَلَغَ أشُدَّهُ، وَرُزِقْتَ بِرَّه، ‘তোমাকে যা দান করা হয়েছে আল্লাহ তাতে বরকত দিন। তুমি দানকারীর শুকরিয়া আদায় কর, সে তার বয়স পূর্ণ করুক এবং তোমাকে তার পুণ্য প্রদান করা হোক’ (ইবনু আবিদ-দুনিয়া, আল-‘ইয়াল হা/২০১; মুসনাদ ইবনুল জা‘দ হা/১৪৪৮) মর্মে বর্ণিত আছারটি যঈফ (লিসানুল মীযান ৮/৩৫২)। তবে মর্মার্থ সঠিক হওয়ায় বলা যেতে পারে (নববী, আল-আযকার হা/৮৫৩; সালীম হেলালী, ছহীহুল আযকার লিন-নববী ২/৭১৩; ইবনুল ক্বাইয়িম, তোহফাতুল মওলূদ ১/২৯)। এর জওয়াবে সন্তানের সুসংবাদদাতার জন্য নিম্নের দো‘আ পাঠ করা মুস্তাহাব-بَارَكَ اللهُ لَكَ، وبَارَكَ عَلَيْكَ، وجَزَاكَ اللهُ خَيْراً، ورَزَقَكَ اللهُ مِثْلَهُ، وأجْزَلَ ثَوَابَكَ، ‘বারাকাল্লাহ লাকা ওয়া বারাকা ‘আলায়কা ওয়া জাযাকাল্লাহ খায়রান ওয়া রাযাক্বাকাল্লাহ মিছলাহু ওয়া আজ্যালা ছওয়াবাকা’- আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন, আর আপনার ওপর বরকত নাযিল করুন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন, আর আপনাকেও অনুরূপ দান করুন এবং আপনার ছওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করুন (নববী, আল-আযকার হা/৮৫৩; হিছনুল মুসলিম, দো‘আ নং ১৪৫)।

প্রশ্ন (২২৮) : প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সাক্ষাতের সময় সালাম বিনিময় না করে প্রচলিত স্যালুট প্রথা শরী‘আতসম্মত কি?

উত্তর : এটি একটি অনৈসলামী সংস্কৃতি, যা পরিত্যাজ্য (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২৬/৩০৩; তুর্কমানী, আল-লুমা‘ ১/২৮২-২৮৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা ইহূদী-নাছারাদের অনুকরণে সালাম দিয়ো না। কেননা তারা হস্ততালু, মাথা ও ইশারার মাধ্যমে সালাম প্রদান করে থাকে’ (দায়লামী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৭৮৩)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা সালাম প্রদানের ক্ষেত্রে ইহূদী-খৃষ্টানদের অনুকরণ করো না। কেননা ইহূদীরা আঙ্গুল দিয়ে ইশারার মাধ্যমে এবং নাছারারা হস্ততালু দিয়ে ইশারার মাধ্যমে সালাম প্রদান করে’ (তিরমিযী হা/২৬৯৫; মিশকাত হা/৪৬৪৯, সনদ হাসান)। পক্ষান্তরে অভিবাদনের ইসলামী পদ্ধতি হ’ল সাক্ষাতে পরস্পরকে সালাম ও মুছাফাহা করা। এর বাইরে অন্য কোনরূপ আনুষ্ঠানিকতা নেই। সুতরাং সাধ্যমত প্রচলিত প্রথা থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে। তবে বাধ্যগত অবস্থায় আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন ইনশাআল্লাহ (নাহল ১৬/১০৬; তাগাবুন ৬৪/১৬)। সেক্ষেত্রে স্যালুটের সাথে মুখে সালাম উচ্চারণ করা কর্তব্য (তিরমিযী হা/২৬৯৭; নববী, আল-মাজমূ‘ ৪/৫৯৫; ফাৎহুল বারী ১১/১৪; তোহফাতুল আহওয়াযী ৭/৩৯৩)।

প্রশ্ন (২২৯) : দেশে প্রচলিত শেয়ার বাজারের ব্যবসা শরী‘আতসম্মত কি?

উত্তর : বিভিন্ন কারণে প্রচলিত শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা জায়েয নয়। যেমন- (১) ক্রেতার অনেক সময় সম্যক জ্ঞান থাকে না যে কী বস্ত্তর শেয়ার তিনি ক্রয় করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম বস্ত্তর ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছেন (আবুদাঊদ হা/৩৪৮৮)। (২) যে বস্ত্তর শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তা অস্পষ্ট ও অজ্ঞাত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন ক্রয়-বিক্রয়কে ধোঁকা বলেছেন (তিরমিযী হা/১২৩৪; মিশকাত হা/২৮৭০)। (৩) শেয়ার ব্যবসায় পণ্য নিজ আয়ত্বে না নিয়েই ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বস্ত্ত ক্রয়ের পর তা নিজ মালিকানায় নিয়ে আসার পূর্বে বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম, বুলূগুল মারাম হা/৭৮৫)। (৪) শেয়ার ব্যবসায় ফাটকাবাজারীর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ পণ্য দেখে না। অথচ ঘণ্টায় ঘণ্টায় দর উঠা-নামা হয়। তাছাড়া অনেক সময় কোম্পানী প্রকৃত তথ্য গোপন রাখে। কখনো কারখানা তৈরী না করেই বাজারে তার শেয়ার ছাড়া হয় এবং নতুন শেয়ারে অধিক লাভ ধারণা করে সেটিকে লোকেরা অধিক মূল্যে ক্রয় করে। এছাড়াও নিত্যনতুন ছলচাতুরী শেয়ারবাজারে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। (৫) এতে সূদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ শেয়ার ব্যবসা সূদী ঋণের ভিত্তিতে করা হচ্ছে। অতএব শেয়ার ব্যবসা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। উল্লেখ্য যে, যদি সাধারণভাবে কোন শেয়ার ব্যবসা সূদমুক্ত, প্রতারণাবিহীন ও ছলচাতুরীমুক্ত হয়, তাহ’লে তা জায়েয (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৪/২৯৯-৩০০)।

প্রশ্ন (২৩০) : মসজিদে ছালাতের পর অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কৌটা ছাড়া হয়। এটা জায়েয কি? নববী যুগে মসজিদে এরূপ প্রথা চালু ছিল কি?

উত্তর : নববী যুগে এমন প্রথা ছিল না। তবে এভাবে অর্থ সংগ্রহে বাধা নেই। কারণ এটিকে ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয় না। বরং এর মাধ্যমে মুছল্লীদের মধ্যে নিয়মিত দানের উত্তম অভ্যাস তৈরী হয়। এতে দোষের কিছু নেই।

প্রশ্ন (২৩১) : আয়না দেখে হারানো বস্ত্ত বের করার বিষয়টি গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এতে বিশ্বাস করা যাবে কি?

উত্তর : যে ব্যক্তি আয়না চালক অথবা অনুরূপ কোন গণকের নিকট যাবে এবং তার কার্যকলাপকে বিশ্বাস করবে সে কাফের হয়ে যাবে। জাদুর বাস্তবতা আছে। কিন্তু তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা কাফের হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন গায়েব সম্পর্কে সংবাদ দানকারী অথবা জ্যোতিষীর নিকট এসে সে যা বলবে তা বিশ্বাস করবে, সে মুহাম্মাদ-এর প্রতি যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার সাথে কুফরী করল’ (আহমাদ হা/৯৫৩২, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৩৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তার চল্লি¬শ দিনের ছালাত কবূল হবে না’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৫৯৫)। অতএব এসবে বিশ্বাস স্থাপন করা বা এগুলি করে হারানো বস্ত্ত খোঁজা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

প্রশ্ন (২৩২) : কোন কারণবশতঃ বিবাহের অলীমা ইজাব-কবূলের কিছুদিন পরে করা যাবে কি?

উত্তর : বাসর রাতের পর দিন অথবা তিন দিন পর্যন্ত অলীমা করা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর সাথে বাসর রাত যাপন করার পর দিন অলীমা করেছিলেন (বুখারী হা/৫১৭০) এবং তিনি ছাফিয়াহ (রাঃ)-কে বিবাহের পর তিনদিন যাবৎ অলীমা খাইয়েছিলেন (মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৩৮৩৪, হাদীছ ছহীহ)। তবে কারণবশতঃ অলীমার দিন বিলম্বিতও করা যায়। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, সাতদিন বা অনুরূপ দিন পর্যন্ত অলীমা করা যায়। রাসূল (ছাঃ) অলীমার সময়কে এক বা দুই দিনের জন্য খাছ করেননি (বুখারী ১৭/২৬৫)। এর ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, অর্থাৎ তিনি অলীমার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেননি যেদিন অলীমা করাকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব বলা হবে। আর এটি তিনি ‘আম হাদীছ থেকে নিয়েছেন (ফাৎহুল বারী ৯/২৪৩)। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, যখন তোমাদের কাউকে অলীমার দাওয়াত দেয়া হয়, সে যেন তা কবুল করে (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩২১৬)। হাফেয ইবনু হাজার বলেন, উক্ত হাদীছে দিনের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। তাছাড়া ছাহাবী উবাই বিন কা‘বকে সপ্তম দিনে অলীমার দাওয়াত দেওয়া হ’লে তিনি কবুল করেন (ফাৎহুল বারী ৯/২৪৩)। অতএব বিবাহের পর অলীমা যত দ্রুত সম্ভব করাই সুন্নাত, যাতে বিবাহের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।

প্রশ্ন (২৩৩) : আমাদের দেশের মানুষ মসজিদের পাশে কবরস্থ হওয়াকে সৌভাগ্য ও মুছল্লীদের দো‘আ লাভের মাধ্যম হিসাবে গণ্য করে। এটা জায়েয হবে কি?

উত্তর : কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণ করা কোন সৌভাগ্যের বিষয় নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হলে এটি শিরকের কেন্দ্র হয়ে যেতে পারে, যা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা তাদের নবীগণ ও নেক ব্যক্তিগণের কবর সমূহকে মসজিদে পরিণত করেছিল। সাবধান! তোমরা কবর সমূহকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ থেকে কঠোর ভাবে নিষেধ করছি’ (মুসলিম হা/৫৩২; মিশকাত হা/৭১৩)। আর মুছল্লীদের দো‘আ পাওয়ার স্বার্থেও মসজিদের পার্শ্বে কবর দেওয়ার কোন দলীল নেই। কেননা দো‘আ করা হয় আল্লাহর নিকটে। তার জন্য কবরস্থানে যাওয়া শর্ত নয়। তিনি চাইলে যে কোন স্থানেই কবরবাসীর জন্য দো‘আ কবুল করেন। তবে সাধারণ ভাবে মসজিদের পার্শ্বে পৃথক কবরস্থান করায় বাধা নেই।

প্রশ্ন (২৩৪) : কোন বিদ্বানের নিকট থেকে ইলম বা ফৎওয়া গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে শারঈ মানদন্ড কি?

উত্তর : একজন আলেমের মধ্যে ন্যূনতম নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তার নিকট থেকে ইলম অর্জন করা বা ফৎওয়া নেওয়া যাবে। (১) আল্লাহভীরু হওয়া (২) দলীল সহকারে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ অর্জন করা (৩) কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সিদ্ধান্তের কাছে নিরংকুশভাবে আত্মসমর্পণের মানসিকতা থাকা (৪) নবী-রাসূলগণের দাওয়াতী নীতির অনুসারী হওয়া (৫) সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী ফৎওয়া দেওয়া (৬) হিকমত বা প্রজ্ঞা থাকা (৭) হক-এর উপর দৃঢ় থাকা (৮) উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া এবং ইলম অনুযায়ী আমল করা (৯) নিজের বিরুদ্ধে হ’লেও সর্বদা ইনছাফের সাথে হক কথা বলা। (১০) ইখলাছ থাকা প্রভৃতি (দ্র. উছায়মীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ৬৪/১৮)।

প্রশ্ন (২৩৫) : প্রতিদিন বাদ মাগরিব মসজিদে নছীহত করা যাবে কি?

উত্তর : মুছল্লীদের তা‘লীমের উদ্দেশ্যে ছালাতের পর আলোচনা করা জায়েয। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও, একটি আয়াত হ’লেও (বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮)। রাসূল (ছাঃ) বিশেষ করে ফজর ছালাত শেষে আলোচনা করতেন (আবুদাঊদ হা/৪৬০৭ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৬৫)। তিনি ফরয ছালাতের পর ইলমের মজলিসের ফযীলত সম্পর্কে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফরয ছালাতের পর বসে যায় এবং লোকদের দ্বীনের তা‘লীম দেয়, সে ব্যক্তি ঐ আবেদের চাইতে উত্তম যে দিনে ছিয়াম পালন করে ও রাতে ইবাদত করে। যেমন তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের উপর আমার মর্যাদা’ (দারেমী হা/৩৪০; মিশকাত হা/২৫০)।

তবে ওয়ায-নছীহত মুছল্লীদের ধৈর্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তুমি (সপ্তাহে) প্রতি শুক্রবার মানুষকে ওয়ায কর। নইলে দু’বার। আর যদি এর চাইতে অধিক করতে চাও তবে তিনবার। তুমি কুরআনকে মানুষের নিকট বিরক্তিকর করে তুলো না। এতদ্ব্যতীত আমি যেন কখনও তোমাকে না দেখি যে, তুমি লোকদের নিকট পৌঁছবে যখন তারা নিজেদের আলোচনায় মশগুল থাকবে। আর তুমি তাদের কাছে গিয়ে ওয়ায শুরু করে দিবে। তুমি তাদের আলোচনা নষ্ট করে দিবে এবং তা তাদের মধ্যে বিরক্তি উৎপাদন করবে। বরং এ সময় তুমি চুপ থাকবে। অতঃপর যখন তারা তোমাকে চাইবে তখনই কথা বলবে, যতক্ষণ তারা তোমার কথার আকাঙ্ক্ষা করবে’ (বুখারী হা/৬৩৩৭; মিশকাত হা/২৫২)। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) প্রতি বৃহস্পতিবার তা‘লীমী বৈঠক করতেন (বুখারী হা/৭০; মুসলিম হা/২৫৪৮; মিশকাত হা/২০৭)।

প্রশ্ন (২৩৬) : রাসূল (ছাঃ) কে গালিদাতার শাস্তি কি? শাস্তি বাস্তবায়ন করার জন্য দায়িত্বশীল কে? দোষী বলে প্রমাণিত হওয়ার আগেই কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে কি? কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়ে থাকলে তার শাস্তি কি?

উত্তর : শরী‘আতের দৃষ্টিতে রাসূল (ছাঃ) কে গালিদাতা ব্যক্তি হত্যাযোগ্য অপরাধী। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা‘ রয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন (কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ১২ আয়াত ৮/৮২; বিস্তারিত দ্র. ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ), আছ-ছারেমুল মাসলূল ‘আলা শাতিমির রাসূল (ছাঃ)। ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গালি দিত। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী হা/২৫১০; মুসলিম হা/১৮০১)। জনৈকা ইহূদী মহিলা রাসূল (ছাঃ) কে গালি দিত। তখন একজন মুসলিম তাকে হত্যা করলে রাসূল (ছাঃ) তার রক্তমূল্য দেননি (আবুদাউদ হা/৪৩৬২; মিশকাত হা/৩৫৫০; ইরওয়া হা/১২৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ) গালি দিত। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, কে আমার এই শত্রুকে হত্যা করবে? খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, আমি। তখন খালেদ (রাঃ)-কে পাঠানো হয় এবং তিনি তাকে হত্যা করেন (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৫/২৩৭; মুহাল্লা ১২/৪৩৭)। একবার দু’জন মহিলা গানের মাধ্যমে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিন্দা করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৮৬ পৃঃ)। তবে এই হুকুম বাস্তবায়ন করবে দেশের সরকার বা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। এক্ষণে কোন মুসলিম যদি ব্যক্তিগতভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর গালিদাতাকে হত্যা করে ফেলে এবং সেটা আদালতে প্রমাণিত হয়, তাহ’লে আদালত তাকে শাস্তি দিবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) গালিদাতার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন (আবুদাউদ হা/৪৩৬১, ৪৩৬২; মিশকাত হা/৩৫৫০; ইরওয়া হা/১২৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

প্রশ্ন (২৩৭) : জমহূরের মত বলতে কী বোঝায়?

উত্তর : এটি একটি ফিক্বহী পরিভাষা। অর্থ অধিকাংশ। সাধারণ অর্থে, যখন কোন ফিক্বহী মাসআলায় অধিকাংশ ইমাম বা ফক্বীহ একমত পোষণ করেন, তখন সে মতটিকে ‘জমহূর’-এর মত বলা হয়। বিশেষ অর্থে, জমহূর বলতে বুঝানো হয়, এক ইমামের বিপরীতে তিন ইমামের মতামত। অর্থাৎ যখন কোন মাসআলায় চার ইমামের তিন ইমাম একই ফয়ছালা দেন, তখন সে মাসআলাকে জমহূরের মত বলা হয়। আবার যদি কোন মাসআলায় দু’জন ইমাম একমত হন, কিন্তু অপর দু’জন ইমাম ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন; তখন প্রথমোক্ত দুই ইমামের মতকে জমহূরের মত বলা হবে। আবার জমহূর বলতে চার ইমামের ঐক্যমতকেও বুঝানো হয় (আব্দুল কারীম যায়দান, কিতাবু উছূলিদ দা‘ওয়াহ ১/৩৯০-৯৩)। আর কোন মাসআলায় যখন বলা হবে জামাহিরের মত তখন বুঝতে হবে তাতে মুসলিম উম্মাহর ইজমা‘ রয়েছে (আব্দুল্লাহ বিন যায়দান, তাহরীমু নাহবিল আমওয়ালিল মু‘আহিদীন ২১৫ পৃ: ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব ৪/১৪৯)।

প্রশ্ন (২৩৮) : ছালাতের মধ্যে ইমামের তেলাওয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর নাম আসলে দরূদ পাঠ করা যাবে কি?

উত্তর : ছালাতসহ যেকোন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নাম শুনলে তার প্রতি দরূদ পাঠ করা জায়েয (ইবনু আবী শায়বাহ হা/৬০৪১-৪২; হায়তামী, তোহফাতুল মুহতাজ ২/৬৬; আল-মুনতাক্বা শারহুল মুয়াত্তা ১/১৫৪; বিন বায, ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব)। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আদেশ দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। (অতএব) হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর (আহযাব ৩৩/৫৬)। এখানে ছালাতের মধ্যে বা ছালাতের বাইরে নির্দিষ্ট করা হয়নি। উল্লেখ্য যে, এই দরূদ সংক্ষেপে ও নীরবে হতে হবে (আল-মুনতাক্বা শারহুল মুওয়াত্ত্বা ১/১৫৪)।

প্রশ্ন (২৩৯) : দেশে-বিদেশে জীবন বীমা, গাড়ি বীমা, প্রতিষ্ঠান বীমা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী আছে। এরূপ প্রতিষ্ঠান সরাসরি ব্যাংক নয়। এখানে চাকুরী করায় শারঈ কোন বাধা আছে কি?

উত্তর : ইন্স্যুরেন্স বা বীমা কোম্পানীতে চাকুরী করা যাবেনা। কেননা ইন্স্যুরেন্স বা বীমা কোম্পানী প্রচলিত পদ্ধতি শরী‘আতের কয়েকটি মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন- (১) ইন্স্যুরেন্সের মধ্যে সরাসরি সূদ জড়িত, যা হারাম। (২) ইন্স্যুরেন্স পরোক্ষভাবে জুয়ার উপরে প্রতিষ্ঠিত। কেননা এতে যে কোন এক পক্ষ একতরফাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা যুলুমের শিকার হয়। (৩) ইন্স্যুরেন্স অস্পষ্ট ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যার মধ্যে প্রতারণার সুযোগ রয়েছে। আর গারার বা অস্পষ্ট লেনদেন শরীআ‘তে নিষিদ্ধ (মুসলিম হা/১৫১৩ প্রভৃতি)। (৪) নিরাপত্তাদানের মালিক কেবল আল্লাহ। তাই ভরসা করতে হবে কেবল তাঁর উপর। অথচ এখানে ভরসা করা হয় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর উপর। যা ইসলামের মৌলিক আক্বীদা বিরোধী। সুতরাং এরূপ প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা বৈধ হবে না।

প্রশ্ন (২৪০) : ঠোটের নীচের লোম কাটা যাবে কি?

উত্তর : কাটা যাবে না। কেননা বৃদ্ধাবস্থাতেও রাসূল (ছাঃ)-এর ঠোটের নিম্নভাগে উক্ত লোম ছিল। যার কিছু অংশ সাদা ছিল (বুখারী হা/৩৫৪৫-৪৬)।

প্রশ্ন (২৪১) : মুহুরীর পেশা গ্রহণ করা যাবে কি?

উত্তর : মুহুরীর পেশা গ্রহণ করা যায়। তবে তা হ’তে হবে সম্পূর্ণরূপে প্রতারণামুক্ত এবং থাকতে হবে মানুষকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য কর এবং গোনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা কর না’ (মায়েদাহ ৫/২)।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

অন্যান্য পর্বসমূহ দেখতে চাইলে এদের উপর ক্লিক করুনঃ

(১)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০১

(২)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০২

(৩)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০৩

(৪)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০৪

(৫)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০৫

(৬)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর-পর্ব-০৬

(৭)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-০৭)

(৮)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-০৮)

(৯)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-০৯)

(১০)কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-১০)

(১১)  কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নোত্তর (পর্ব-১১)

ইসলামের অন্যান্য বিষয় নিয়ে লিখিত বইসমূহ দেখতে চাইলে  MSHRC এর উপর ক্লিক করুন। (সকল বই কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লিখিত)

MSHRC

===========================================================

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

========================================================

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।

তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)

তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)

নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। [মুসলিম (২৬৭৪)]

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল। (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮।)

====================================================

 (1) BCSসহ যেকোনো সরকারি বেসরকারি চাকরি সহজে পেতে এখানে ক্লিক করুন।

BBC

(2) মজার মজার ইসলামিক গজল ও অন্যান্য বিষয়ের ভিডিও দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন।

GAIBANDHAPEACE TV

====================================================

Please Share On

ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস

  বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস মূল গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) (১) উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্...