Search This Blog

Friday, August 26, 2022

যেসব কাজে ফেরেশ্তাগণ দোয়া ও অভিশাপ দেয়

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

যেসব কাজে

ফেরেশ্তাগণ দোয়া ও অভিশাপ দেয়

ভূমিকাঃ ফেরেশতা যার আরবি প্রতিশব্দ ملاءكة‎‎ এবং ইংরেজী প্রতিশব্দ 'অ্যান্জেল'। ইসলামের আকিদা অনুসারে স্বর্গীয় দূত। আরবিতে ফেরেশতাদের একবচনে মালাইক ও বহুবচনে মালাক বলে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা মানুষ ও অন্যন্য প্রাণীকূলের ন্যায় মহান আল্লাহর আরেক সৃষ্টি। তারা দিনরাত ক্লান্ত না হয়ে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করেন এবং মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহর অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।

আল্লাহর হুকুমে তারা সর্বক্ষণ সৃষ্টজীবের সেবায় নিয়োজিত। কা‘ব আল-আহবার (রাঃ) বলেন, যদি আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে মানুষকে হেফাযত না করতেন, তাহ’লে এ পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারত না। ইতিপূর্বে এখানে বসবাসকারী জিনেরা তাদের ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে যেতো (ইবনু কাছীর)।

ফেরেশ্তাদের প্রতি ঈমান আনা

ঈমানের রুকন ৬টি। সেগুলি হচ্ছে, আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীর প্রতি ঈমান, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান, আখেরাতের প্রতি ঈমান এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান। কুরআনুল কারীম এবং সহীহ হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী উক্ত রুকনসমূহের প্রত্যেকটির প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণ হবে না। যে ব্যক্তি এগুলির কোনো একটিকে অস্বীকার করবে, সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“রাসূলের নিকট তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যে অহি অবতীর্ণ হয়েছে, তাকে তিনি এবং মুমিনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা সবাই ঈমান এনেছেন আল্লাহ্‌র প্রতি, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীর প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি। (তাঁরা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন তারতম্য করি না। তাঁরা বলে, আমরা শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং আপনারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে”। (বাক্বারাহ ২৮৫)।

তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

“ঈমান হচ্ছে, আল্লাহ্‌র প্রতি, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীর প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা” (মুসলিম)।

পুরো হাদীসটি নিম্নরূপঃ

আবূ বকর ইবনু আবী শাইবাহ ও জুহায়র.....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকেদের নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় একজন লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! ঈমান কি? তিনি বললেন, ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ, তার ফেরেশতাকুল, তার (নাযিলকৃত) কিতাব, (আখিরাত) তার সাথে সাক্ষাৎ ও তার রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখবে এবং পুনরুত্থান দিবসের উপরও ঈমান আনবে। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! ইসলাম কি? তিনি বললেন, ইসলাম এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদাত করতে থাকবে, কিন্তু তার সাথে কাউকে শারীক করবে না, ফরযকৃত সালাত কায়িম করবে, নির্ধারিত ফরয যাকাত আদায় করবে এবং রমযানের সওম পালন করবে। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! ইহসান কি? তিনি বললেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে যেন তাকে দেখছো; যদি তাকে না দেখো তা হলে তিনি তোমাকে দেখছেন (বলে অনুভব করবে)।

সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশি কিছু জানেন না। তবে আমি তোমাকে তার (কিয়ামতের) কিছু নিদর্শন বলে দিচ্ছিঃ যখন দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে এটা তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। আর যখন বস্ত্রহীন, জুতাহীন (ব্যক্তি) জনগণের নেতা হবে, এটাও তার একটি নিদর্শন। আর মেষ শাবক ও ছাগলের রাখালরা যখন সুউচ্চ দালানকোঠা নিয়ে পরস্পর গর্ব করবে, এটাও তার একটি নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে যে পাঁচটি জিনিসের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ রাখেন, কিয়ামতের জ্ঞান তারই অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নবর্ণিত আয়াত তিলাওয়াত করলেন, "আল্লাহর নিকটই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে, আর তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং মাতৃগর্ভে কি আছে তা তিনিই জানেন। কোন প্রাণীই আগামীকাল কী উপার্জন করবে তা জানে না এবং কোন জমিনে সে মৃত্যুবরণ করবে তাও জানে না। বস্তুতঃ আল্লাহই সব জানেন এবং তিনি সব বিষয়ই অবগত"- (সূরাহ লুকমান ৩১ : ৩৪)।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি চলে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, লোকটিকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনো। তারা তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গেলেন। কিন্তু কাউকে পেলেন না। তারপর রাসূলুল্লাহ বললেন, ইনি জিবরীল (আঃ), লোকেদের দীন শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছিলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫, ৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯, ১০,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০, ৪৭৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যারা  ফেরেশ্তাদের শত্রু তাদের শত্রু আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং

আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিব্রীল ও মীকাঈলের শত্রু হয়, নিশ্চয় আল্লাহ সেসব কাফেরদের শত্রু”। (বাক্বারাহ ৯৮)।

ফেরেশ্তাদের কাজ

মানুষের উদ্দেশে বার্তাবহনঃ

আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী-রাসুলদের নিকট অহি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন জিব্রাঈল (আ.)-কে ।

ফেরেশতাদের সরদার জিব্রীল (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি নিয়ে নবীদের অন্তরে নিক্ষেপ করেন।

আল্লাহ বলেন, “তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছে স্বীয় নির্দেশে রূহ-ওহীসহ ফিরিশতা- পাঠান এ বলে যে, তোমরা সতর্ক কর, নিশ্চয় আমি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই; কাজেই তোমরা আমার ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন কর”। (নাহল ২)।

তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের নিকট নানা অহি নিয়ে আগমন করতেন।

আল্লাহ বলেন, “বলুন, আপনার রবের কাছ থেকে রূহুল-কুদুস (জিবরীল) যথাযথ ভাবে একে নাযিল করেছেন, যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুদৃঢ় করার জন্য এবং হিদায়াত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ”। (নাহল ১০২)।

তিনি আরো বলেন, “(হে নবী!) বল, যে জিবরীলের শত্রু হবে সে জেনে রাখুক, সে (জিবরীল) তো আল্লাহর নির্দেশক্রমে তোমার হৃদয়ে কুরআন পৌঁছে দেয়, যা তার পূর্ববর্তী কিতাব (ধর্মগ্রন্থ)সমূহের সমর্থক এবং বিশ্বাসীদের জন্য যা পথ প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা”। (বাক্বারাহ ৯৭)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় এই কুরআন রাব্বুল আলামিনের পক্ষ হতে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা (জিব্রাঈল) তা নিয়ে অবতরণ করেছে।’ (সুরা শুআরা: ১৯২-৯৩)

তাই জিব্রীলকে অস্বীকার করলে শেষ নবী (ছাঃ) ও কুরআন-হাদীছকে অস্বীকার করতে হবে। যা মানুষের আত্মিক জাগরণ ও বৈষয়িক উন্নয়নের মূল উৎস।

বৃষ্টি ও খাদ্য উৎপাদনঃ

এ কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন হযরত মিকাঈল (আ.)। তিনি আল্লাহর আদেশে বাতাসের মাধ্যমে মেঘমালা সঞ্চালন করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে তা বর্ষণ করেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) জিব্রাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, মিকাঈল কোন দায়িত্বে নিয়োজিত? তখন জিব্রাঈল (আ.) বলেন, তিনি বৃষ্টি, উদ্ভিদ বিষয়ক দায়িত্বে রয়েছেন।’ (ফাতহুল বারি: ৬/৩৫৫)।

কেয়ামতের সময় শিঙায় ফুৎকারঃ

পৃথিবীর বয়সসীমা এক দিন ফুরিয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে মানব সভ্যতার কাল। কেয়ামত সংঘটিত হবে। কেয়ামতের সেই মহাপ্রলয় শুরু হবে ইস্রাফিল (আ.)-এর ফুতকারের মাধ্যমেই। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘শিঙায় ফুৎকার দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা প্রথম দিন থেকেই শিঙা নিয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। ভীতসন্ত্রন্ত অবস্থায় আরশের দিকে লক্ষ রাখছেন। কখন তাকে আদেশ দেওয়া হবে। আদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি এমনভাবে তাকিয়ে আছেন, তার চোখ দুটো যেন দুটো ঘূর্ণায়মান নক্ষত্র গোলক।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৬৭৬)।

ফেরেশতা ইস্রাফীলকে অস্বীকার করলে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করতে হবে। যা অবশ্যই ঘটবে।

আল্লাহ বলেন, “সেদিন তারা কবর থেকে বের হবে দ্রুতবেগে, মনে হবে তারা কোন লক্ষ্যস্থলের দিকে ধাবিত হচ্ছে”। (মা‘আরেজ ৪৩)।

তিনি আরো বলেন, “অপমানে অবনমিত নেত্ৰে। সেদিন তারা কবর হতে বের হবে, মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল”। (ক্বামার ৭)।

প্রতিদিন আমাদের নিদ্রা ও জাগরণে সংঘটিত হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছাতেই আমরা ঘুমিয়ে যাই এবং তাঁর ইচ্ছাতেই ঘুম থেকে জেগে উঠি। আর এটাই হ’ল পুনরুত্থান। মৃত্যুর পর যেটা ক্বিয়ামতের দিন সংঘটিত হবে চিরস্থায়ীভাবে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) তাহাজ্জুদের সময় ঘুম থেকে উঠে দো‘আ পড়তেন পাঠ করতেন।

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রে তাহাজ্জুদের জন্যে দাঁড়িয়ে প্রথমতঃ এ দু’আ পাঠ করতেন,

“আল্ল-হুম্মা রব্বা জিবরীলা ওয়া মীকাঈলা, ওয়া ইসরা-ফীলা, ফাত্বিরাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি, ’আ-লিমাল গয়বি ওয়াশ্ শাহা-দাতি, আনতা তাহকুমু বায়না ’ইবা-দিকা ফীমা কা-নূ ফীহি ইয়াখতালিফূন, ইহদিনী লিমাখতুলিফা ফীহি মিনাল হকক্বি বিইযনিকা, ইন্নাকা তাহদী মান তাশা-উ ইলা- সিরাত্বিম মুসতাক্বীম।’’

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের রব, হে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা, হে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জ্ঞানের অধিকারী! তুমিই তোমার বান্দাদের মতপার্থক্য ফায়সালা করে দিবে। হে আল্লাহ! সত্যের সম্পর্কে যে ইখতিলাফ করা হচ্ছে, এ সম্পর্কে আমাকে সরল সঠিক পথ দেখাও। কারণ তুমি যাকে চাও, সরল পথ দেখাও।’’ (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২১২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রাণিকুলের রুহ কবজঃ

প্রতিটি প্রাণীর রুহ কবজ করার জন্য আল্লাহ দায়িত্ব প্রদান করেন মালাকুল মাউত ফেরশতাকে। আল্লাহর আদেশে তিনিই প্রতিটি প্রাণীর প্রাণ হরণ করেন।

ফেরেশতা মালাকুল মাউতকে অস্বীকার করলে মৃত্যুকে অস্বীকার করতে হবে। অথচ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ।

আল্লাহ বলেন, “বলুন, তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। তারপর তোমাদের রবের কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হব ”। (আস সাজদাহ-১১)।

তিনি আরো বলেন, “আর তিনি তাঁর বান্দাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকারী এবং তিনি তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হেফাযতকারীদেরকে। অবশেষে তোমাদের কারও যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমাদের রাসূল (ফিরিশতা) গণ তার মৃত্যু ঘটায় এবং তারা কোন ক্রটি করে না।

তারপর তাদেরকে প্রকৃত রব আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে। জেনে রাখুন, হুকুম তো তারই এবং তিনি সবচেয়ে দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী”। (আন‘আম ৬১-৬২)।

আমলনামা লিপিবদ্ধকরণঃ

আল্লাহ মানুষের আমলনামা সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত। প্রত্যেক মানুষের হেফাযত ও আমলনামা সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। কেয়ামতের দিন যেন বান্দা আপন কর্মকে অস্বীকার না করতে পারে এর প্রমাণ হিসেবে দুই ফেরেশতার মাধ্যমে বান্দার প্রতিটি আমল লিপিবদ্ধ করেন। সর্বদা ডান ও বাম পাশে তারা উপস্থিত থেকে বান্দার ভালো-মন্দের কাজ লিপিবদ্ধ করেন।

আল্লাহ বলেন, “কর্ম লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাদ্বয় লিপিবদ্ধ করে একজন ডানদিকে এবং একজন বামদিকে বসা থাকেন। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে লেখার জন্য সদাপ্রস্তুত”। (সুরা কাফ: ১৭-১৮)।

যে ফেরেশতা ডানে অবস্থান করেন তিনি মানুষের ছওয়াব লিখেন। আর যে বামে অবস্থান করেন তিনি পাপ লিখেন। এর অর্থ ফেরেশতা মানুষের সাথে সর্বদা অবস্থান করে। (ছহীহাহ হা/১২০৯)।

মানুষের রক্ষণাবেক্ষণঃ

মহান আল্লাহ প্রত্যেক বান্দার হেফাজতে কিছু ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। তারা আল্লাহর হুকুমে তাঁরই মর্জিমতো মানুষকে নানা বিপদ-আপদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। অর্থাৎ তারা বান্দার প্রহরী হয়ে কাজ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেকের সামনে-পেছনে এমন প্রহরী (ফেরেশতা) নিযুক্ত আছে, যারা আল্লাহর নির্দেশে পালাক্রমে তার হেফাজত করে।’ (সুরা রাদ ১৩/১১)।

সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, একজন ব্যক্তিকে দিনে ও রাতে কমপক্ষে চারজন করে ফেরেশতা পাহারা দেয়। যাদের দু’জন ডানে ও বামে মানুষের আমলনামা লিখে, অপর দু’জন মানুষের পিছনে ও সামনে থেকে পাহারা দিয়ে থাকে।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মালাকগণ পালা বদল করে তোমাদের মাঝে আগমন করেন; একদল দিনে, একদল রাতে। ‘আসর ও ফজরের সালাতে উভয় দল একত্র হন। অতঃপর তোমাদের মাঝে রাত যাপনকারী দলটি উঠে যান। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কোন্ অবস্থায় রেখে আসলে? অবশ্য তিনি নিজেই তাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবত। উত্তরে তাঁরা বলেন, আমরা তাদের সালাতে রেখে এসেছি, আর আমরা যখন তাদের নিকট গিয়েছিলাম তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৫৫, ৩২২৩, ৭৪২৯, ৭৪৮৬; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৩১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৩২, আহমাদ ১০৩১৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫২৮, আল-মুসনাদ ৯৪১০, ১৭/১৫৪; ছহীহ ইবনে খুযায়মা ৩২২, ১/১৬৫; আল-ইহসান ফি তাক্বরীব, ছহীহ ইবনে হিববান ২০৬১, ৫/৪০৯-৪০১০; ছহীহুল জামে‘ ৮০১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ মনে করে রাকীব ও আতীদ দুইজন ফেরেশতার নাম যা সঠিক নয় (ড. ওমর সুলায়মান, আলামুল মালায়েকাতিল আবরার, ১২ পৃ.)

শুক্রবিন্দুকে জরায়ুতে সংরক্ষণঃ

শুক্রবিন্দু হলো মানবজন্মের প্রধান উপকরণ। আল্লাহ তায়ালা আপন কুদরতে মায়ের জরায়ুতে তাকে সংরক্ষণ করেন। বিশেষ সময়ে সেই শুক্রাণু যখন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়, কিছু আদেশ দিয়ে আল্লাহ তার নিকট ফেরেশতা পাঠান।

রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত,

যায়দ ইবনু ওয়াহব (রহ.) হতে বর্ণিত। ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, সত্যবাদী হিসেবে গৃহীত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান নিজ নিজ মায়ের পেটে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে অবস্থান করে, অতঃপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়। ঐভাবে চল্লিশ দিন অবস্থান করে। অতঃপর তা গোশতপিন্ডে পরিণত হয়ে (আগের মত চল্লিশ দিন) থাকে। অতঃপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। আর তাঁকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। তাঁকে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়, তার ‘আমল, তার রিয্ক, তার আয়ু এবং সে কি পাপী হবে না নেককার হবে। অতঃপর তার মধ্যে আত্মা ফুঁকে দেয়া হয়। কাজেই তোমাদের কোন ব্যক্তি ‘আমল করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার এবং জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত পার্থক্য থাকে। এমন সময় তার ‘আমলনামা তার উপর জয়ী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীর মত আমল করে। আর একজন ‘আমল করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছে যে, তার এবং জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত তফাৎ থাকে, এমন সময় তার ‘আমলনামা তার উপর জয়ী হয়। ফলে সে জান্নাতবাসীর মত ‘আমল করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩২০৮, ৩৩৩২, ৬৫৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৮২, আহমাদ ৩৬২৪, ৩৬১৭, ৩৯২৪, ৪০৮০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৭০৮, সুনান ইবনু মাজাহ ৭৬, সুনান আত তিরমিযী ২১৩৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১৭৪, যিললুল জান্নাহ ১৭৫, ১৭৬, ইরওয়াহ ২১৪৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৯৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ বলেন, “তিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য আট প্রকার পশু অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তোমাদের মাতৃগর্ভের তিন প্রকার অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেন। তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক, সার্বভৌমত্ব তাঁরই, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। অতএব তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলেছ?”। (যুমার ৬)।

পাহাড়ের জন্য নিয়োজিতঃ

জমিনের ভারসম্য বজায় রেখেছে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের স্থিতি ও ভারসম্য বজায় রাখার জন্য আল্লাহ পৃথক ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে এর প্রমাণ মেলে। দ্বীনের দাওয়াত সংক্রান্ত বিশেষ এক ঘটনা বর্ণনাকালে রাসুল (সা.) বলেন,

‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, একবার তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজেস করলেন, উহুদের দিনের চেয়ে কঠিন কোন দিন কি আপনার উপর এসেছিল? তিনি বললেন, আমি তোমার ক্বওম হতে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তা তো হয়েছি। তাদের হতে অধিক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, আকাবার দিন যখন আমি নিজেকে ইবনু ‘আবদে ইয়ালীল ইবনে ‘আবদে কলালের নিকট পেশ করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, সে তার জবাব দেয়নি। তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, কারনুস সাআলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা দূর হয়নি। তখন আমি মাথা উপরে উঠালাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সে দিকে তাকালাম। তার মধ্যে ছিলেন জিব্রাঈল (আঃ)। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আপনার ক্বওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা উত্তরে যা বলেছে তা সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাঁকে হুকুম দিতে পারেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহলে আমি তাদের উপর আখশাবাইনকে চাপিয়ে দিব। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বরং আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন যারা এক আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে আর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩২৩১, ৭৩৮৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৯১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিশেষ ইবাদতে নিয়োজিতঃ

ফেরেশতারা সদা আল্লাহর হুকুমের অনুগত। তবুও আল্লাহ কোনো কোনো ফেরেশতাকে বিশেষ কোনো ইবাদতে নিয়োজিত করে রেখেছেন। বিষয়টি নিচের হাদিস থেকে জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

 আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি (অদৃশ্য জগতের) যা দেখি তোমরা তা দেখ না, আর আমি যা শুনতে পাই তোমরা তা শুনতে পাও না। আসমান তো চড়চড় শব্দ করছে, আর সে এই শব্দ করার যোগ্য। তাতে এমন চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও নেই যেখানে কোন ফিরিশতা আল্লাহ্ তা’আলার জন্যে অবনত মস্তকে সাজদায় পড়ে না আছে। আল্লাহর শপথ! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তোমরা খুব কমই হাসতে, বেশি কাঁদতে এবং বিছানায় স্ত্রীদের উপভোগ করতে না, বাড়ী-ঘর ছেড়ে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়তে, আল্লাহ তা’আলার সামনে কাকুতি-মিনতি করতে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩১২, সুনান ইবনু মাজাহ ৪১৯০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

এছাড়া নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কোটি কোটি ফেরেশতা আল্লাহর হুকুমে সর্বদা সৃষ্টি জগতের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন ও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। যারা কখনোই আল্লাহর অবাধ্যতা করে না।

আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদেশপ্ৰাপ্ত হয় তা-ই করে”। (তাহরীম ৬)।

সর্বোপরি প্রত্যেক মানুষের প্রতি মুহূর্তের নিরাপত্তার জন্য একজন ফেরেশতাকে সার্বক্ষণিক প্রহরী হিসাবে নিয়োজিত রাখা হয়েছে।

আল্লা্হ বলেন, “প্রত্যেক জীবের জন্য একজন সংরক্ষক রয়েছে”। (ত্বারেক ৪)।

অর্থাৎ, প্রত্যেক জীবের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে ফিরিশতা নিযুক্ত আছেন। যাঁরা তার নেকী-বদী লিপিবদ্ধ করে থাকেন। কোন কোন আলেম বলেন, তা হল মানুষের হিফাযতকারী ফিরিশতা; যেমন সূরা রা’দের ১১নং আয়াত থেকে জানা যায় যে, মানুষের হিফাযতের জন্যেও তার সামনে-পিছনে ফিরিশতা মোতায়েন থাকেন; যেমন তার কথা ও কাজ নোট করার জন্য ফিরিশতা নিযুক্ত আছেন।

এক দল ফিরিস্তা, যাঁরা দোয়া পাঠ বা জিকিরকারীদের খুঁজে বেড়ান

আল্লাহ বলেন,

“তুমি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখ, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে থাকে এবং তুমি তাদের নিকট হতে স্বীয় দৃষ্টি ফিরায়ো না।” (সূরা কাহাফ ২৮ আয়াত)।

রাসুল (সাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর কিছু ফেরেশতা আছেন, যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে-ফিরে আহলে যিকির খুঁজতে থাকেন। অতঃপর যখন কোন সম্প্রদায়কে আল্লাহর যিকিররত অবস্থায় পেয়ে যান, তখন তাঁরা একে অপরকে আহ্বান করে বলতে থাকেন, ‘এস তোমাদের প্রয়োজনের দিকে।’ সুতরাং তাঁরা (সেখানে উপস্থিত হয়ে) তাদেরকে নিজেদের ডানা দ্বারা নিচের আসমান পর্যন্ত বেষ্টিত করে ফেলেন। অতঃপর তাঁদেরকে তাঁদের প্রতিপালক জানা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমার বান্দারা কি বলছে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছে, আপনার মহত্ত্ব বর্ণনা করছে, আপনার প্রশংসা ও গৌরব বয়ান করছে।’ আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি আমাকে দেখেছে?’

ফেরেশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! তারা আপনাকে দেখেনি।’ আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা আমাকে দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘যদি তারা আপনাকে দেখত, তাহলে আরও বেশী বেশী ইবাদত, গৌরব বর্ণনা ও তসবীহ করত।’ আল্লাহ বলেন, ‘ কি চায় তারা?’ ফিরিশতারা বলেন, ‘তারা আপনার কাছে জান্নাত  চায়।’ আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি জান্নাত দেখেছে?’ ফিরিশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা তা দেখেনি।’ আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা তা দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা তা দেখলে তার জন্য আরও বেশী আগ্রহান্বিত হত। আরও বেশী বেশী তা প্রার্থনা করত। তাদের চাহিদা আরও বড় হত।’ আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি থেকে পানাহ চায়?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা জাহান্নাম থেকে পানাহ চায়।’

আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি জাহান্নাম দেখেছে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘জী না, আল্লাহর কসম! হে প্রতিপালক! তারা তা দেখেনি।’ আল্লাহ বলেন, ‘ কি হত, যদি তারা তা দেখত?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘তারা তা দেখলে বেশী বেশী করে তা হতে পলায়ন করত। বেশী বেশী ভয় করত।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি তাদেরকে মাফ করে দিলাম।’ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে একজন বলেন, ‘কিন্তু ওদের মধ্যে অমুক ওদের দলভুক্ত নয়। সে আসলে নিজের কোন প্রয়োজনে সেখানে এসেছে।’ আল্লাহ বলেন, ‘(আমি তাকেও মাফ করে দিলাম! কারণ,) তারা হল এমন সম্প্রদায়, যাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত (হতভাগা) থাকে না।”

মুসলিমের আবূ হুরাইরা কর্তৃক এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অবশ্যই আল্লাহর অতিরিক্তি কিছু ভ্রাম্যমান ফেরেশতা আছেন, যারা জিকিরের মজলিস খুঁজতে থাকেন। অতঃপর যখন কোন এমন মজলিস পেয়ে যান, যাতে আল্লাহর যিকির হয়, তখন তাঁরা সেখানে বসে যান। তাঁরা পরস্পরকে ডানা দিয়ে ঢেকে নেন। পরিশেষে তাঁদের ও নিচের আসমানের মধ্যবর্তী জায়গা পরিপূর্ণ করে দেন। অতঃপর লোকেরা মজলিস ত্যাগ করলে তাঁরা আসমানে উঠেন। তখন আল্লাহ আয্যা অজাল্ল অধিক জানা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কোথা থেকে এলে?’ তাঁরা বলেন, ‘আমরা পৃথিবী থেকে আপনার এমন কতকগুলি বান্দার নিকট থেকে এলাম, যারা আপনার তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ পড়ে এবং আপনার নিকট প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কি প্রার্থনা করে?’ তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আপনার জান্নাত প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জান্নাত দেখেছে?’

তাঁরা বলেন, ‘না, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জান্নাত দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘তারা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে।’ তিনি বলেন, ‘তারা আমার নিকট কি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে?’ তাঁরা বলেন, ‘আপনার জাহান্নাম থেকে, হে প্রতিপালক!’ তিনি বলেন, ‘তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে?’ তাঁরা বলেন, ‘না।’ তিনি বলেন, ‘কেমন হত, যদি তারা আমার জাহান্নাম দেখত?’ তাঁরা বলেন, ‘আর তারা আপনার নিকট ক্ষমা চায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম, তারা যা প্রার্থনা করে তা দান করলাম এবং যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তা থেকে আশ্রয় দিলাম।’ তাঁরা বলেন, ‘হে প্রতিপালক! ওদের মধ্যে অমুক পাপী বান্দা এমনি পার হতে গিয়ে তাদের সাথে বসে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাকেও ক্ষমা করে দিলাম! কারণ তারা সেই সম্প্রদায়, তাদের সাথে যে বসে সেও বঞ্চিত হয় না।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৪০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৭৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৮৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২৬৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৬০০, সহীহ আত্ তারগীব ১৫০২, আহমাদ ৭৩৭৬, ৮৪৮৯, ৮৭৪৯, রিয়াযুস সালেহীন-১/১৪৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফেরেশ্তাদের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ

ফেরেশতা আল্লাহর বিস্ময়কর এক সৃষ্টি। আল্লাহ সৃষ্টিজগতে নানা কাজে ফেরেশতাদের নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে তাঁদের আল্লাহর বিশেষ বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী ও নির্দেশনা তাঁর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসুলদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেন ফেরেশতারা।

সে হিসেবে নবী-রাসুলদের সঙ্গে ফেরেশতাদের সাক্ষাৎ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু নবী না হয়েও অনেকেই ফেরেশতার সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে যেমন পুণ্যবান মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে পাপিষ্ঠরাও। যেমন—সারা, মারিয়াম, মুসা (আ.)-এর মা ও লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা। এ ছাড়া মৃত্যুর সময় প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর ফেরেশতাকে দেখতে পায়। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বলে আল্লাহ আমাদের প্রভু; অতঃপর তারা অটল থাকে। তাদের কাছে (মৃত্যুর সময়) ফেরেশতা এসে বলে, তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো—যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল।  (সুরা:  ফুসসিলাত, আয়াত: ৩০)।

পাপীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘যেদিন (মৃত্যুর সময়) তারা ফেরেশতাদের দেখবে, (সেদিন বলা হবে) আজ অপরাধীদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। (সুরা: ফোরকান, আয়াত: ২২)।

মানুষ ও ফেরেশতার সাক্ষাতের কয়েকটি ঘটনা

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনায় নবী-রাসুল নন এমন মানুষ ও ফেরেশতার সাক্ষাতের যেসব ঘটনা পাওয়া যায় তার কয়েকটি হলো,

(এক) মারিয়াম (আ.) : ঈসা (আ.)-এর মা মারিয়াম (আ.) পুরুষরূপে একজন ফেরেশতার সাক্ষাৎ পান। যিনি তাঁকে সন্তান লাভের সুসংবাদ দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তার কাছে আমার রুহকে (জিবরাঈল) প্রেরণ করলাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারিয়াম বলল, যদি তুমি আল্লাহকে ভয় করো, তবে আমি তোমার কাছ থেকে দয়াময়ের কাছে আশ্রয় চাইছি। (সুরা: মারিয়াম, আয়াত: ১৭-১৮)।

(দুই) সারা (আ.) : ইবরাহিম (আ.)-এর স্ত্রী সারা (আ.)ও ফেরেশতার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। কোরআনে সেই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের এবং ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলল, কী আশ্চর্য! আমি সন্তান জন্ম দেব, আমি বৃদ্ধা আর এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! এটি অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার। তারা (ফেরেশতারা) বলল, ‘আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের ওপর রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসা ও সম্মানের অধিকারী। ’ (সুরা: হুদ, আয়াত: ৭১-৭৩)।

(তিন) লুত (আ.)-এর জাতি: লুত (আ.)-এর জাতি বিকৃত যৌনচর্চায় অভ্যস্ত ছিল। সমকামিতার মতো ব্যাধি সে সমাজে বিস্তার লাভ করে। লুত (আ.) তাদের এই বিকৃত মানসিকতা ও ভয়াবহ পাপ থেকে বেঁচে থাকার আহ্বান জানায়। কিন্তু ক্রমেই তাদের অবাধ্যতা বাড়তে থাকে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করার জন্য একদল ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তারা সুদর্শন পুরুষের আকৃতিতে আসে। ফলে তারা আগত ফেরেশতাদের ওপর হামলে পড়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা লুতের কাছে এলো, তখন তাদের আগমনে সে বিষণ্ন হলো। নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করল এবং বলল, এটি একটি নিদারুণ দিন। তার সম্প্রদায় তার কাছে উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো এবং তারা আগে থেকে কুকর্মে লিপ্ত ছিল। সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! এরা আমার কন্যা, তোমাদের জন্য তারা পবিত্র। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। আমার মেহমানের ব্যাপারে আমাকে হেয় কোরো না। তোমাদের মধ্যে কি কোনো ভালো মানুষ নেই?’ (সুরা: হুদ, আয়াত: ৭৭-৭৮)।

(চার) মুসা (আ.)-এর মা: আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-এর মায়ের প্রতি ওহি অবতীর্ণ করেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমার মায়ের প্রতি ওহি অবতীর্ণ করলাম, যা অবতীর্ণ করার। ’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৩৮) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের অর্থ এভাবে করেছেন, ‘আমি ওহি অবতীর্ণ করলাম, যেমন নবীদের প্রতি করেছিলাম।  (আবদুল্লাহ জাবের, আহলুলহাদিদ ডটকম, প্রকাশ : ২৬ মে ২০১২)।

এই ব্যাখ্যা ও সুরা কাসাসের বর্ণনা থেকে অনুমান হয়, মুসা (আ.)-এর মায়ের সঙ্গে হয়তো ফেরেশতাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

(পাঁচ) সুলাইমান (আ.)-এর রাজ্যের অধিবাসী: আল্লাহ সুলায়মান (আ.)-এর রাজ্যের অধিবাসীদের পরীক্ষার জন্য হারুত ও মারুত নামে দুজন ফেরেশতা পাঠান। মানুষের আকৃতিতে তারা সেখানে অবস্থান করে। কোরআনে সেই ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সুলাইমানের রাজ্যে শয়তানরা যা পাঠ করত, তারা তার অনুসরণ করে। সুলাইমান কুফরি করেনি; বরং শয়তানরাই কুফরি করেছে। তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত এবং যা বাবেল শহরে হারুত-মারুত ফেরেশতাদ্বয়ের ওপর অবতীর্ণ হতো। তারা দুজন কাউকে এই কথা না বলে কিছু শেখাত না যে আমরা পরীক্ষাস্বরূপ। সুতরাং তুমি কুফরি কোরো না।  (সুরা: বাকারা, আয়াত : ১০২)।

(ছয়) সাহাবিদের মজলিস: সাহাবিদের উপস্থিতিতে রাসুল (সা.)-এর কাছে মুসাফিরের বেশে জিবরাঈল (আ.) আসেন এবং তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। রাসুল (সা.) তার উত্তর দেন। তিনি বলে যাওয়ার পর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইনি জিবরাঈল। তিনি তোমাদের দ্বিন শেখাতে এসেছিলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫, ৭,  আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯, ১০,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০, ৪৭৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(সাত) বনি ইসরাইলের তিন ব্যক্তি:  আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, বানী ইসরাইলের মধ্যে তিনজন লোক ছিল। একজন শ্বেতরোগী, একজন মাথায় টাকওয়ালা আর একজন অন্ধ। মহান আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। কাজেই, তিনি তাদের নিকট একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে শ্বেত রোগীটির নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট কোন্ জিনিস অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, সুন্দর রং ও সুন্দর চামড়া। কেননা, মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীরের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে তার রোগ সেরে গেল। তাকে সুন্দর রং এবং সুন্দর চামড়া দান করা হল। অতঃপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ ধরনের সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, ’উট’ অথবা সে বলল, ’গরু’। এ ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়েছে যে শ্বেতরোগী না টাকওয়ালা দু’জনের একজন বলেছিল ’উট’ আর অপরজন বলেছিল ’গরু’। অতএব তাকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী উটনী দেয়া হল। তখন ফিরশতা বললেন, ’’এতে তোমার জন্য বরকত হোক।’’

বর্ণনাকারী বলেন, ফেরেশতা টাকওয়ালার নিকট গেলেন এবং বললেন, তোমার নিকট কী জিনিস পছন্দনীয়? সে বলল, সুন্দর চুল এবং আমার হতে যেন এ রোগ চলে যায়। মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। বর্ণনাকারী বলেন, ফেরেশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ মাথার টাক চলে গেল। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হল। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, ’গরু’। অতঃপর তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দান করলেন। এবং ফেরেশতা দু’আ করলেন, এতে তোমাকে বরকত দান করা হোক। অতঃপর ফেরেশতা অন্ধের নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ জিনিস তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, আল্লাহ্ যেন আমার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন, যাতে আমি মানুষকে দেখতে পারি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তখন ফেরেশতা তার চোখের উপর হাত ফিরিয়ে দিলেন, তৎক্ষণাৎ আল্লাহ্ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল ’ছাগল’। তখন তিনি তাকে একটি গর্ভবতী ছাগী দিলেন। উপরে উল্লেখিত লোকদের পশুগুলো বাচ্চা দিল। ফলে একজনের উটে ময়দান ভরে গেল, অপরজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেল এবং আর একজনের ছাগলে উপত্যকা ভরে গেল।

অতঃপর ঐ ফেরেশতা তাঁর পূর্ববর্তী আকৃতি প্রকৃতি ধারণ করে শ্বেতরোগীর নিকট এসে বললেন, আমি একজন নিঃস্ব ব্যক্তি। আমার সফরের সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ আমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছার আল্লাহ্ ব্যতীত কোন উপায় নেই। আমি তোমার নিকট ঐ সত্তার নামে একটি উট চাচ্ছি, যিনি তোমাকে সুন্দর রং, কোমল চামড়া এবং সম্পদ দান করেছেন। আমি এর উপর সাওয়ার হয়ে আমার গন্তব্যে পৌঁছাব। তখন লোকটি তাকে বলল, আমার উপর বহু দায়িত্ব রয়েছে। তখন ফেরেশতা তাকে বললেন, সম্ভবত আমি তোমাকে চিনি। তুমি কি এক সময় শ্বেতরোগী ছিলে না? মানুষ তোমাকে ঘৃণা করত। তুমি কি ফকীর ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তোমাকে দান করেছেন। তখন সে বলল, আমি তো এ সম্পদ আমার পূর্বপুরুষ হতে ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছি। ফেরেশতা বললেন, তুমি যদি মিথ্যাচারী হও, তবে আল্লাহ্ তোমাকে সেরূপ করে দিন, যেমন তুমি ছিলে। অতঃপর ফেরেশতা মাথায় টাকওয়ালার নিকট তাঁর সেই বেশভূষা ও আকৃতিতে গেলেন এবং তাকে ঠিক তেমনই বললেন, যেরূপ তিনি শ্বেত রোগীকে বলেছিলেন। এও তাকে ঠিক অনুরূপ জবাব দিল যেমন জবাব দিয়েছিল শ্বেতরোগী।

তখন ফেরেশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যাচারী হও, তবে আল্লাহ্ তোমাকে তেমন অবস্থায় করে দিন, যেমন তুমি ছিলে। শেষে ফেরেশতা অন্ধ লোকটির নিকট তাঁর আকৃতিতে আসলেন এবং বললেন, আমি একজন নিঃস্ব লোক, মুসাফির মানুষ; আমার সফরের সকল সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ বাড়ি পৌঁছার ব্যাপারে আল্লাহ্ ব্যতীত কোন গতি নেই। তাই আমি তোমার নিকট সেই সত্তার নামে একটি ছাগী প্রার্থনা করছি যিনি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন আর আমি এ ছাগীটি নিয়ে আমার এ সফরে বাড়ি পৌঁছতে পারব। সে বলল, প্রকৃতপক্ষেই আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ্ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি ফকীর ছিলাম। আল্লাহ্ আমাকে সম্পদশালী করেছেন। এখন তুমি যা চাও নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম। আল্লাহর জন্য তুমি যা কিছু নিবে, তার জন্যে আজ আমি তোমার নিকট কোন প্রশংসাই দাবী করব না। তখন ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তুমি রেখে দাও। তোমাদের তিন জনের পরীক্ষা নেয়া হল মাত্র। আল্লাহ্ তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তোমার সাথীদ্বয়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৬৪, ৬৬৫৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৬৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(আট) আল্লাহর জন্য সম্পর্ক রক্ষাকারী: ’আবদুল আ’লা ইবনু হাম্মাদ (রহঃ).....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এক ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য অন্য এক গ্রামে গেল। আল্লাহ তা’আলা তার জন্য পথিমধ্যে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করলেন। সে ব্যক্তি যখন ফেরেশতার কাছে পৌছল, তখন ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছো? সে বলল, আমি এ গ্রামে আমার এক ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য যেতে চাই। ফেরেশতা বললেন, তার কাছে কি তোমার কোন অবদান আছে, যা তুমি আরো প্রবৃদ্ধি করতে চাও? সে বলল, না। আমি তো শুধু আল্লাহর জন্যই তাকে ভালবাসি। ফেরেশতা বললেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে (তার দূত হয়ে) তোমার কাছে অবহিত করার জন্য এসেছি যে, আল্লাহ তোমাকে ভালবাসেন, যেমন তুমি তোমার ভাইকে তারই সম্ভষ্টি অর্জনের জন্য ভালবেসেছ। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৪৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩১৬, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফেরেশতারা কি শুধু মানুষের আকৃতিতে আসে?

আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের যেকোনো আকৃতি ধারণের শক্তি দিয়েছেন। তাই ফেরেশতারা শুধু মানবাকৃতিতেই দেখা দেয় না; বরং কখনো কখনো ভিন্ন আকৃতিতেও আসে। উসাইদ বিন হুদাইর (রা.) সুরা বাকারা বা সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলেন। এমন সময় তাঁর ঘোড়াটি কয়েকবার ডেকে ওঠে। তিনি বের হয়ে আকাশের দিকে তাকালে আলোর প্রদীপ বা মেঘমালার ভেতর প্রদীপ দেখতে পান। এই ঘটনা তিনি রাসুল (সা.)-কে বললে তিনি আবারও তাঁকে তিলাওয়াত করতে বলেন এবং আসমানের দিকে তাকালে তিনি মেঘমালার ভেতর প্রদীপ সদৃশ বস্তু দেখতে পান। এরপর তিনি বলেন, ‘তারা একদল ফেরেশতা। তোমার তিলাওয়াতের আওয়াজ শোনার জন্য (পৃথিবীর) নিকটবর্তী হয়েছে। যদি তুমি সকাল পর্যন্ত তিলাওয়াত করতে, তবে তারা সকাল পর্যন্ত অবস্থান করত এবং মানুষ তাদের দেখতে পেত। ’ (আল ইসাবা : ৪/৪৮২)।

ফেরেশতারা কেন পুরুষরূপে হাজির হোন

ফেরেশতারা লিঙ্গ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তাদের নারী বা পুরুষ বানাননি। তবে কোরআন ও হাদিসের বর্ণনায় মানুষ ও ফেরেশতার সাক্ষাতের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে ফেরেশতাদের পুরুষের রূপ ধারণ করতে দেখা যায়। পবিত্র কোরআনেও তাদের ব্যাপারে পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর কারণ কী? মুফাসসিররা এর উত্তরে বলেন, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিভিন্ন কাফির ও মুশরিক সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা। আল্লাহ তাদের বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত করার জন্য পুরুষরূপে তাদের প্রেরণ করেন। পবিত্র কোরআনেও তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রতিবাদে বলা হয়েছে, ‘তারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা প্রতিপন্ন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর বান্দা। তারা কি তাদের সৃষ্টির সময় উপস্থিত ছিল? অতি শিগগিরই তাদের সাক্ষ্য লিখে রাখা হবে এবং তারা জিজ্ঞাসিত হবে। ’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত: ১৯)।

ফেরেশ্তাদের সংখ্যা

ফেরেশতাদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তাআলাই অবগত আছেন। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আপনার প্রতিপালকের বাহিনী (ফেরেশতা) সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (সূরা মুদ্দাসসির, ৭৪ : ৩১)।

ফেরেশ্তাদের দোয়া ও অভিশাপ

মানবজাতির প্রতি ফেরেশ্তাদের দোয়া

ফেরেশতাগণ আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি। তারা সব সময় আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন করে থাকেন। তারা নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছুই বলেন না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হ’তে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতামন্ডলী, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে’। (তাহরীম ৬)।

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, ফেরেশতামন্ডলী বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের জন্য দো‘আ করে থাকেন। এ সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপিত হ’ল।-

(১) মুমিন ও তাদের সৎ আত্মীয়দের জন্যঃ

কিছু এমন সৌভাগ্যবান লোক আছে, যাদের জন্য সম্মানিত ফেরেশতাগণ দো‘আ করে থাকেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ বহনে রত এবং যারা তার চতুষ্পার্শ্বে ঘিরে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের রব! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তওবা করে এবং তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হ’তে রক্ষা কর। হে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় এবং তুমি তাদেরকে শাস্তি হ’তে রক্ষা কর। সেদিন তুমি যাকে শাস্তি হ’তে রক্ষা করবে, তাকে তো অনুগ্রহই করবে, এটাই তো মহা সাফল্য’। (গাফের/মুমিন ৭-৯)।

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ফেরেশতাগণের দরূদঃ

ফেরেশতাগণ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করেন ও তাঁর জন্য দো‘আ করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। (আহযাব ৫৬)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠকারীর জন্যঃ

যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তাদের জন্য দো‘আ করেন।

(ক) আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর সত্তর বার দয়া করেন ও তার ফেরেশতাগণ তার জন্য সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতএব বান্দারা অল্প দরূদ পাঠ করুক বা অধিক দরূদ পাঠ করুক (এটা তার ব্যাপার)’। (আল-মুসনাদ হা/৬৬০৫, ১০/১০৬-১০৭, হাদীছ হাসান। দ্র: আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ২/৪৯৭; মাযমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১৬০; আল-কাউলুল বাদী, ১৫৩ পৃঃ)।

(খ) আমের ইবনু রবীআ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন কোন মুসলিম ব্যাক্তি আমার প্রতি দুরূদ পাঠ করে এবং যতক্ষণ সে আমার প্রতি দুরূদ পাঠরত থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য দুআ করতে থাকেন। অতএব বান্দা চাইলে তার পরিমাণ (দরূদ পাঠ) কমাতেও পারে বা বাড়াতেও পারে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৯০৭)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৩) ওযূ অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তিঃ

যেসব সৌভাগ্যবান মানুষের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দো‘আ করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হ’লেন ওযূ অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে,

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের এই শরীরকে পবিত্র রাখ। আল্লাহ তোমাদেরকে পবিত্র করবেন। যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (ওযূ অবস্থায়) রাত অতিবাহিত করবে, অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সঙ্গে রাত অতিবাহিত করবেন। রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই সে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় (ওযূ অবস্থায়) ঘুমিয়েছে’। (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১মখন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪০১), পৃঃ ৪০৮-৪০৯; হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী হাদীছটিকে জাইয়িদ বলেছেন। দ্রঃ ফাতহুল বারী, ১১তম খন্ড (সঊদী আরব: রিয়াসাতু ইদারাতিল বুহুছিল ইলমিয়্যাহ), পৃঃ ১০৯)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে ওযূ অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হ’লেও ফেরেশতা তার জন্য দো‘আ করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (ওযূ অবস্থায়) ঘুমায় তার সঙ্গে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকেন, সে ঘুম থেকে জাগ্রত হ’লে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! তোমার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছে’। (আমীল আলাউদ্দীন ফারেসী, আল-ইহসান ফী তাক্বরীবি ছহীহ ইবনে হিববান, ৩য় খন্ড (বৈরুত: মুয়াস্সাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ৩২৮-২২৯; হাদীছ ছহীহ। দ্রঃ ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১ম খন্ড (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মাআরিফ, ১৪০৯ হিঃ) পৃঃ ৩১৭)।

(৪) ছালাতের জন্য অপেক্ষারত মুছল্লীবৃন্দঃ

ওযূ অবস্থায় ছালাতের জন্য অপেক্ষারত মুছল্লীদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। হাদীছে এসেছে,

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত তার সালাত আদায়ের স্থানে (জায়নামাযে) বসে থাকে ততক্ষণ মালায়িকাহ্ (ফিরিশতাগণ) তার জন্য দু‘আ করতে থাকেন। তার অযু নষ্ট হওয়া অথবা উঠে চলে যাওয়া পর্যন্ত মালায়িকাহ্ এই বলে দু‘আ করতে থাকেনঃ ‘হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ! তার প্রতি রহম করুন।’ (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৬৯-৪৭১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৪৫, ১৭৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৩৯২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) প্রথম কাতারের মুছল্লীবৃন্দঃ

প্রথম কাতারের মুছল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দো‘আ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

(ক) আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নিজ ফিরিশতাগণের নিকট প্রথম সারিতে সালাত পড়ুয়াদের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফিরিশতাগণও তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করেন। সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় সারির সালাত পড়ুয়াদের মর্যাদাও কি একই রকম? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নিজ ফিরিশতাগণের নিকট প্রথম সারিতে সালাত পড়ুয়াদের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফিরিশতাগণও তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করেন। সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় সারির সালাত পড়ুয়াদের মর্যাদাও কি একই রকম? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হ্যাঁ। দ্বিতীয় সারির সালাত পড়ুয়াদের মর্যাদাও একই রকম। (আহমদ ২১২৩৩, আল-ইহসান ফী তাক্বরীবি ছহীহ ইবনে হিববান, ৫ম খন্ড, পৃঃ ৫৩০-৫৩১; হাদীছ ছহীহ, দ্রঃ ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৩৯)।

(খ) বারা’আ ইবনু আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সোজা করো, তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ বিক্ষিপ্ত হবে না।”তিনি বলেন, তিনি আরও বলতেন: “আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ প্রথম কাতার অথবা, প্রথম কাতারসমূহের উপর রহমত বর্ষণ করেন”। (সুনান আদ-দারেমী, ১২৯৬, সুনান ইবনু মাজাহ ৯৯৭, সহীহ ইবনু হিব্বান  ২১৫৭, ২১৬১; মাওয়ারিদুয যাম’আন ৩৮৬, নাসায়ী ৮১১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৬৬৪, আহমাদ ১৮০৪৫, ১৮১৪২, ১৮১৪৭, ১৮১৬৬, ১৮১৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইবরাহীম ইবনু আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ প্রথম কাতারের লোকেদের উপর রহমত নাযিল করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৯৯৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(ঘ) উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে ফজরের সালাত আদায় করার পর বললেনঃ অমুক হাযির আছেন কি? সাহাবীগণ বললেনঃ না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ দুই ওয়াক্ত (ফজর ও ‘ইশা) সালাতই মুনাফিকদের জন্য বেশি ভারী হয়ে থাকে। তোমরা যদি এই দুই ওয়াক্ত সালাতে কি পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে তা জানতে, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তোমরা অবশ্যই এতে শামিল হতে। জামা‘আতের প্রথম কাতার মালায়িকাহর (ফিরিশতাদের) কাতারের সমতুল্য। তোমরা যদি এর ফাযীলাত সম্পর্কে জানতে, তাহলে অবশ্যই তোমরা এজন্য প্রতিযোগিতা করতে। নিশ্চয় দু’জনের জামা‘আত একাকী সালাত আদায়ের চেয়ে উত্তম। তিনজনের জামা‘আত দু’জনের জামা‘আতের চেয়ে উত্তম। জামা‘আতে লোক সংখ্যা যত বেশী হবে মহান আল্লাহর নিকট তা ততই বেশি পছন্দনীয়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৫৫৪, নাসায়ী ৮৪২, দারিমী ১২৬৯, আহমাদ (৫/১৪০)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(ঙ) জাবির ইবনু সামুরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মালায়িকাহ্ (ফিরিশতাগণ) যেরূপ তাদের প্রতিপালকের নিকট কাতারবদ্ধ হয়ে থাকে তোমরা কি সেরূপ কাতারবদ্ধ হবে না? আমরা বললাম, মালায়িকাহ্ তাদের প্রতিপালকের নিকট কিরূপে কাতারবদ্ধ হয়? তিনি বলেন, সর্বাগ্রে তারা প্রথম কাতার পূর্ণ করে, তারপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তী কাতারগুলো এবং তারা কাতারে পরস্পর মিলে মিলে দাঁড়ায়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৬৬১, নাসায়ী ৯৯২), আহমাদ (৫/১০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৬) কাতারের ডান পার্শ্বের মুছল্লীবৃন্দঃ

কাতারের ডান পার্শ্বের মুছল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতামন্ডলী দো‘আ করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়া করেন ও ফেরেশতামন্ডলী দো‘আ করেন ডান পার্শ্বে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের উপর’। (আল-ইহসান ফী তাক্বরীবি ছহীহ ইবনে হিববান, ৫ম খন্ড, পৃঃ ৫৩৩-৫৩৪; সুনানু আবী দাঊদ আওনুল মাবুদসহ, ২য় খন্ড (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হিঃ), পৃঃ ২৬৩; হাদীছ হাসান, দ্রঃ ছহীহ আবু দাউদ হা/৬৮০)।

 আল-বারাআ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত পড়তাম তখন (কাতারের) ডান দিকে দাঁড়াতে পছন্দ করতাম। (সুনান ইবনু মাজাহ ১০০৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৫২৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭০৯, নাসায়ী ৮২২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৬১৫, আহমাদ ১৮০৮২, ১৮৩৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৭) কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুছল্লীবৃন্দঃ

কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুছল্লীবৃন্দের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়া করেন এবং ফেরেশতামন্ডলী দো‘আ করেন, যারা একে অপরের সাথে মিলে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে’। (ছহীহ ইবনে হিববান ৫/৫৩৬ পৃঃ; হাদীছ হাসান, ছহীহ। দ্রঃ ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫০১, ১/২৭২ পৃঃ)।

আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যারা কাতারগুলো মিলিয়ে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ এবং তার ফেরেশতাগণ রহমত বর্ষণ করেন। যে ব্যাক্তি কাতারের ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ৯৯৫, আহমাদ ২৪০৬৬)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ কারণে ছাহাবীগণ জামা‘আতে ছালাত আদায়কালীন পরস্পর মিলিত হয়ে দাঁড়ানোতে গুরুত্ব দিতেন। বিশিষ্ট ছাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন,

অর্থাৎ ‘আমাদের সবাই ছালাতে একে অপরের কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাতাম’। (ছহীহ বুখারী ফাতহুল বারী সহ, ২য় খন্ড (সঊদী আরব: রিয়াসাতু ইদারাতিল বুহুছিল ইলমিয়্যাহ তাবি), পৃঃ ২১১)।

রাসূল (ছাঃ) ছালাত আরম্ভের পূর্বে মুছল্লীদের দিকে তাকিয়ে বলতেন,

‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর তিনবার বলতেন। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কাতারকে সোজা কর, অন্যথা আল্লাহ তোমাদের অন্তরের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি করবেন’। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩১)।

আবূ মাস্‘ঊদ আল আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের সময় আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেনঃ সোজা হয়ে দাঁড়াও, সামনে পিছনে হয়ে দাঁড়িও না। অন্যথায় তোমাদের অন্তরে বিভেদ সৃষ্টি হবে। আর তোমাদের যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী, তারা আমার নিকট দাঁড়াবে। তারপর সমস্ত লোক যারা তাদের নিকটবর্তী (মানের), তারপর ঐসব লোক যারা তাদের নিকটবর্তী হবে। আবূ মাস্‘ঊদ (রাঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, আজকাল তোমাদের মাঝে বড় মতভেদ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ১০৮৮, মুসলিম ৪৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূল কাসিম আল-জাদালী সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত লোকদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনবার বললেনঃ তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সোজা কর। আল্লাহর শপথ! অবশ্যই তোমরা তোমাদের কাতারসমূহ সোজা করে দাড়াঁও। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে মতানৈক্য সৃষ্টি করে দিবেন। বর্ণনাকারী নু’মান (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি এক লোককে দেখলাম, সে তার সঙ্গীর কাঁধের সাথে নিজের কাঁধ, তার হাঁটুর সাথে নিজের হাঁটু এবং তার গোড়ালির সাথে নিজের গোড়ালী মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৬৬২, আহমাদ (৪/২৭৬), ইবনু খুযাইমাহ (১৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা তোমাদের কাতার সোজা করে নাও। কেননা, আমি আমার পিছন হতেও তোমাদের দেখতে পাই। আনাস (রাযি.) বলেন আমাদের প্রত্যেকেই তার পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাতাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৭২৫,৭১৮, আধুনিক প্রকাশনী ৬৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা সালাতের ইক্বামাত(ইকামত/একামত) দেয়া হলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে চেহারা ফিরালেন এবং বললেন, নিজ নিজ কাতার সোজা করো এবং পরস্পর গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়াও! নিশ্চয় আমি আমার পেছনের দিক হতেও তোমাদেরকে দেখতে পাই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ১০৮৬,  বুখারী ৭১৮, ৭১৯, মুসলিম ৪৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমরা সালাতের কাতার সোজা রাখবে। কাঁধকে সমান করো। কাতারের খালি স্থান পুরা করো। নিজেদের ভাইদের হাতে নরম থাকবে। কাতারের মধ্যে শায়ত্বন (শয়তান) দাঁড়াবার কোন খালি স্থান ছেড়ে দেবে না। যে লোক কাতার মিশিয়ে রাখবে আল্লাহ তা‘আলা (তাঁর রহমতের সাথে) তাকে মিলিয়ে রাখবেন। আর যে লোক কাতার ভেঙ্গে দাঁড়াবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার রহমত থেকে কেটে দেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ১১০২, আবূ দাঊদ ৬৬৬, সহীহ আত্ তারগীব ৪৯৫, আহমাদ ৫৭২৪, সহীহাহ্ ৭৪৩, সহীহ আল জামি‘ ১১৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৮) ইমামের সূরা ফাতিহা শেষে আমীন পাঠকারীবৃন্দঃ

ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ শেষ করলে আমীন বলা শরী‘আত সম্মত। এ সময় ফেরেশতামন্ডলীও আমীন বলে থাকেন। ইমাম ও মুছল্লীদের আমীন এবং ফেরেশতাদের আমীন মিলে গেলে গোনাহ মাফ হয়। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

(ক)  আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“যখন ইমাম সাহেব “আমীন” বলবেন তখন তোমরাও “আমীন” বলবে। কারণ, যার “আমীন” বলা ফিরিশতাগণের “আমীন” বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে”। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), হাদীস নং ৭৮০, ৭৮১, ৬৪০২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪১০; আবু দাউদ, ৯৩৬; তিরমিযী ২৩২, আহমাদ ৮২৪৭, আধুনিক প্রকাশনী ৭৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  অন্য বর্ণনায় রয়েছে,

“যখন ইমাম সাহেব غَيْرِ المَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ বলবেন তখন তোমরা “আমীন” বলবে। কারণ, যার “আমীন” বলা ফিরিশতাগণের “আমীন” বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৮২, ৪৪৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪১০; আবু দাউদ, হাদীস নং ৯৩৫, আধুনিক প্রকাশনী ৭৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উপরোক্ত হাদীছদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম সূরা ফাতিহা সমাপ্ত করার পর ফেরেশতাগণ সমবেত মুছল্লীদের জন্য আমীন বলে আল্লাহর সমীপে সুপারিশ করে থাকেন, যার অর্থ হ’ল, হে আল্লাহ! আপনি ইমাম ও মুছল্লীদের সূরা ফাতিহায় বর্ণিত দো‘আ সমূহ কবুল করুন। কারণ আমীন অর্থ হ’ল আপনি কবুল করুন’। (ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৬২)।

(৯) ছালাত শেষে ওযূসহ স্বস্থানে অবস্থানকারীবৃন্দঃ

ছালাত শেষে ওযূসহ যেসব মুছল্লী স্বীয় স্থানে বসে থাকে তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে এবং যতক্ষণ সালাত তাকে আটক রাখে, ততক্ষণ সে সালাতের মধ্যে থাকে। তোমাদের কেউ যে মজলিসে সালাত পড়েছে তাতে যতক্ষণ সে অবস্থান করে ততক্ষণ ফেরেশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকেন। তারা বলেন, হে আল্লাহ্! তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ্! তাকে অনুগ্রহ করুন। হে আল্লাহ্! তার তওবা কবূল করুন। যতক্ষণ না তার উযূ  ছুটে যায়, যতক্ষণ না সে কাউকে কষ্ট দেয় (ততক্ষণ এ দুআ চলতে থাকে)। (সুনান ইবনু মাজাহ ৭৯৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৩০, ৪৯১; নাসায়ী ১৪৩০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১০৪৬, মুওয়াত্ত্বা মালিক ২৪৩, সহীহ তারগীব ৪৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মাগরিবের সালাত পড়লাম। তারপর যার চলে যাওয়ার চলে গেলেন এবং যার থেকে যাওয়ার থেকে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত দ্রুতবেগে এলেন যে, তাঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হতে লাগলো। তিনি তাঁর দু হাঁটুর উপর ভর করে বসে বলেনঃ তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক আসমানের একটি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের নিকট তোমাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলছেনঃ তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখো, তারা এক ফরয আদায়ের পর পরবর্তী ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৮০১, আহমাদ ৬৭১১-১২, ৬৯০৭, সহীহ তারগীব ৪৪৫, সহীহাহ ৬৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন মুসলিম ব্যাক্তি যতক্ষণ মসজিদে সালাত ও যিকিরে রত থাকে ততক্ষণ আল্লাহ তার প্রতি এতটা আনন্দিত হন, প্রবাসী ব্যাক্তি তার পরিবারে ফিরে এলে তারা তাকে পেয়ে যেরূপ আনন্দিত হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ৮০০, আহমাদ ৮০০৪, ৮১৫০, ৮২৮২, ৯৫৩১. সহীহ তারগীব ৩২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মাগরিবের সালাত পড়লাম। তারপর যার চলে যাওয়ার চলে গেলেন এবং যার থেকে যাওয়ার থেকে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত দ্রুতবেগে এলেন যে, তাঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হতে লাগলো। তিনি তাঁর দু হাঁটুর উপর ভর করে বসে বলেনঃ তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক আসমানের একটি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের নিকট তোমাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলছেনঃ তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখো, তারা এক ফরয আদায়ের পর পরবর্তী ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৮০১, আহমাদ ৬৭১১-১২, ৬৯০৭, সহীহ তারগীব ৪৪৫, সহীহাহ ৬৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে আদায় করে, তারপর সূর্য উঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহ তা’আলার যিকর করে, তারপর দুই রাকাআত নামায আদায় করে- তার জন্য একটি হাজ্জ ও একটি উমরার সাওয়াব রয়েছে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পূর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণ (হাজ্জ ও উমরার সাওয়াব)। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৫৮৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৭১, তা’লীকুর রাগীব- (১/১৬৪, ১৬৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(১০) জামা‘আতে ফজর ও আছর ছালাত আদায়কারীর জন্যঃ

যারা ফজর ও আছর ছালাত জামা‘আতে আদায় করে, তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মালাকগণ পালা বদল করে তোমাদের মাঝে আগমন করেন; একদল দিনে, একদল রাতে। ‘আসর ও ফজরের সালাতে উভয় দল একত্র হন। অতঃপর তোমাদের মাঝে রাত যাপনকারী দলটি উঠে যান। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কোন্ অবস্থায় রেখে আসলে? অবশ্য তিনি নিজেই তাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবত। উত্তরে তাঁরা বলেন, আমরা তাদের সালাতে রেখে এসেছি, আর আমরা যখন তাদের নিকট গিয়েছিলাম তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৫৫, ৩২২৩, ৭৪২৯, ৭৪৮৬; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৩১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৩২, আহমাদ ১০৩১৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫২৮, আল-মুসনাদ ৯৪১০, ১৭/১৫৪; ছহীহ ইবনে খুযায়মা ৩২২, ১/১৬৫; আল-ইহসান ফি তাক্বরীব, ছহীহ ইবনে হিববান ২০৬১, ৫/৪০৯-৪০১০; ছহীহুল জামে‘ ৮০১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১১) মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণের জন্য প্রার্থনাকারীঃ

ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ).....সাফওয়ান ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু সাফওয়ান (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সিরিয়াতে আবু দারদা (রাযিঃ) এর ঘরে গেলাম। আমি তাকে ঘরে পেলাম না; বরং সেখানে উম্মু দারদাকে পেলাম। তিনি বললেন, আপনি কি এ বছর হজ্জ পালন করবেন? আমি বললাম, জি হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর নিকট আমাদের কল্যাণের জন্যে দু’আ করবেন। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ একজন মুসলিম বান্দা তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দুআ করলে তা কবুল হয়। তার মাথার নিকটে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকেন, যখন সে তার ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করে তখন নিয়োজিত ফেরেশতা বলে থাকে "আমীন এবং তোমার জন্যও অবিকল তাই"। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৮২২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৬৮০, ইসলামিক সেন্টার ৬৭৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মুসলিম তার কোন মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দু’আ করলে ওই দু’আ কবূল করা হয়। দু’আকারীর মাথার পাশে একজন মালাক (ফেরেশতা) নিয়োজিত থাকেন। যখন সে তার ভাইয়ের জন্য (কল্যাণের) দু’আ করে; সে নিযুক্ত মালাক সাথে সাথে বলেন ’আমীন’ এবং তোমার জন্যও অনুরূপ হোক। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২২৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫৩৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬৪৩১, সহীহ আল জামি‘ ৬২৩৫। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ফেরেশতাদের দো‘আ পাওয়ার প্রত্যাশায় অতীত যামানার মনীষীগণ অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য দো‘আ করাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন।

কুরআন মাজীদে সেই মুমিনদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা অতীত মুমিনদের জন্য দো‘আ করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকের ক্ষমা করুন এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি দয়ালু ও পরম করুণাময়”। (হাশর ১০)।

(১২) কল্যাণের পথে ব্যয়কারীদের জন্যঃ

সেসকল লোক যারা কল্যাণের পথে ব্যয় করে থাকেন, তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। নিম্নের হাদীছ তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

কাসিম ইবনু যাকারিয়্যা (রহঃ)....আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক বান্দা যখন সকালে ওঠে দু’জন মালাক (ফেরেশতা) অবতীর্ণ হন। তাদের জনৈক বলেন, “হে আল্লাহ খরচকারীর ধন আরো বাড়িয়ে দাও" এবং দ্বিতীয়জন বলেন, “হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দাও।” (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২০৫, ইসলামীক সেন্টার ২২০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এই হাদীছে নবী (ছাঃ) তাঁর উম্মতকে এ সংবাদ দিয়েছেন যে, ভাল পথে ব্যয়কারীর জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন যে, আল্লাহ তাদের খরচকৃত সম্পদের প্রতিদান দান করুন।

মোল্লা আলী কারী (রহঃ) এ হাদীছের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ফেরেশতাদের দো‘আয় যে (خلف) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এর অর্থ হ’ল মহাপুরস্কার। (মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ, ৪র্থখন্ড (মক্কা: আল মাকতাবাতুত তিজারিয়্যাহ, তাবি), পৃঃ ৩৬৬)।

হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) এ হাদীছের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চমৎকার কথা বলেছেন যে, ফেরেশতাদের দো‘আয় সৎপথে ব্যয় করার পুরস্কার নির্দিষ্ট নয়। কেননা এর তাৎপর্য হ’ল যাতে করে এতে সম্পদ, ছওয়াব ও অন্যান্য জিনিসও শামিল হয়। সৎপথে ব্যয়কারীদের অনেকেই উক্ত সম্পদ ব্যয়ের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বেই ইন্তিকাল করেন এবং প্রতিদান নেকীর আকারে পরকালে অবধারিত হয়। অথবা উক্ত খরচের বিনিময় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। (ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী, ৩য় খন্ড (সঊদী আরব: রিয়াসাতু ইদারাত, তাবি), পৃঃ ২০৫)।

আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

‘প্রতিদিন সূর্য উদয়ের সময় তার দুই পার্শ্বে দুই ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে, হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের দিকে অগ্রসর হও। পরিতৃপ্তকারী অল্প সম্পদ, উদাসীন ব্যক্তির অধিক সম্পদ হ’তে উত্তম। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়। অনুরূপ সূর্যাস্তের সময় তার পার্শ্বে দুই ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়। (আল-মুসনাদ ৫/১৯৭; আল-ইহসান ফি তাকরিব ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৩২৯, ৮/১২১-১২২; আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহায়ন ২/৪৪৫, হাদীছ ছহীহ। দ্রঃ সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৪৪; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৪৫৬)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

‘জান্নাতে দরজার পার্শ্বে এর ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন, যে ব্যক্তি আজ ঋণ (আল্লাহর রাস্তায় দান করবে) দিবে, তার প্রতিদান পাবে আগামীকাল (ক্বিয়ামত দিবসে)। আর অন্য দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও’। (আল-মুসনাদ ২/৩০৫-৩০৬; আল-ইহসান ফী তাকরীব ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৩৩৩, ৮/১২৪; সিলাসিলা ছহীহাহ হা/৯২০)।

(১৩) সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্যঃ

যারা ছিয়াম রাখার নিয়তে সাহরী খায় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন।

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য দয়া করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন’। (মুসনাদ আহমদ ১১৮৭, আল-ইহসান ফি তাকরীব ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৪৬৭, ৮/২৪৬, হাদীছ ছহীহ। দ্রঃ ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৫১৯; সিলাসিলা ছহীহাহ হা/১৬৫৪)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সাহরী খাওয়াতে বরকত রয়েছে, সাহরী কখনো ছাড়বে না যদিও এক ঢোক পানি পান করেও হয়। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সাহরী গ্রহণকারীদের উপর দয়া করেন এবং তাদের জন্য ফেরেশতাগণ ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন’। (আল-মুসনাদ হা/১০৬৬৪; সিলাসিলা ছহীহাহ হা/৩৪০৯)।

(১৪) রোগী দর্শনকারীর জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনাঃ

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু “আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এক মুসলিমের অধিকার অপর মুসলিমের উপর পাঁচটিঃ সালামের জবাব দেওয়া, রুগীকে দেখতে যাওয়া, জানাযার সঙ্গে যাওয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচলে তার জবাব দেওয়া।’’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২৪০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৬২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৭৩৭, নাসায়ী ১৯৩৮, সুনান আবূ দাউদ ৫০৩০, সুনান ইবনু মাজাহ ১৪৩৫, আহমাদ , ১০৫৮৩, ২৭৫১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪৬৫, ইসলামিক সেন্টার ৫৪৮৭)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যারা কোন মুসলিম রোগীকে দেখতে যায় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

আলী রাদিয়াল্লাহু ’আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ’’যে কোন মুসলিম অন্য কোন (অসুস্থ) মুসলিমকে সকাল বেলায় কুশল জিজ্ঞাসা করতে যাবে, তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশ্তা কল্যাণ কামনা করবেন। আর যদি সে সন্ধ্যা বেলায় তাকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে যায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশ্তা তার মঙ্গল কামনা করে। আর তার জন্য জান্নাতের মধ্যে পাড়া ফল নির্ধারিত হবে। (রিয়াযুস স্বা-লিহীন (রিয়াদুস সালেহীন) ৯০৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৯৯, মুসলিম ২৫৬৮, তিরমিযী ৯৬৭, আহমাদ ২১৮৬৮, ২১৮৮৪, ২১৮৯৮, ২১৯১৬, ২১৯৩৩, ২১৯৩৮,আল-মুসনাদ ৮১৫, আল-ইহসান ফী তাকরীব ছহীহ ইবনে হিববান ২৯৫৮, ৭/২২৪-২২৫, সিলাসিলা ছহীহাহ ১৩৬৭)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্য একটি হাদীছে এসেছে,

আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে গেল তার সাথে সত্তর হাযার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় কোন রোগীকে দেখতে গেল, তার সাথে সত্তর হাযার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়’। (আল-মুসনাদ হা/৯২৮, হাদীছ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭৬৭)।

রোগী দেখতে যাওয়ার ছওয়াব সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখিত হ’ল-

জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোগী দেখতে গেল, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে আচ্ছন্ন থাকল এবং যখন সে রোগীর কাছে বসে তখন সে রহমতের ভিতরে ডুবে থাকে’। (আল-মুসনাদ হা/৩০১৮, হাদীছ ছহীহ,ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৪৭৭)।

মোল্লা আলী কারী এ হাদীছটির ব্যাখ্যায় বলেন, রোগী দেখার নিয়তে নিজ বাড়ী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর রহমতে প্রবেশ করে থাকে। فَإِذَا جَلَسَ اِغْتَمَسَ যখন সে রোগীর কাছে বসে, তখন সে আল্লাহর রহমতে ডুবে যায়। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, اِغْتَمَسَ فِيْهَا রহমতের মাঝে সে ডুবে হাবুডুবু খেতে থাকে। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/৫২)।

রোগী দর্শনের জন্য যাওয়ার সময়ই শুধু রহমতে আচ্ছন্ন হয় না বরং বাড়ীতে ফেরার সময়ও তাকে আল্লাহ রহমত দ্বারা আচ্ছন্ন করেন। উপরোল্লেখিত হাদীছের শব্দ, ফেরা পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে প্রবেশ করে তা প্রমাণ করে। এছাড়া আরও একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন সে রোগীর কাছ থেকে রওয়ানা হয় তখনও আল্লাহর রহমত তাকে ঢেকে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত যেখান থেকে সে এসেছে, সেখানে ফিরে না আসে’। (মাজমাঊয যাওয়ায়েদ ২/২৯৭)।

রোগীর সেবা-শুশ্ৰুষার মর্যাদা

আবু বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ)....রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আযাদকৃত গোলাম সাওবান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন রোগীর সেবা করে, সে খুরফাতুল জান্নাতে রত থাকে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! খুরফাতুল জান্নাত কী? তিনি বললেন, এর ফল-ফলাদি সংগ্রহ করা। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৪৮, ৬৪৪৫, ৬৪৪৬, ৬৪৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৮, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৯৬৭, আহমাদ ২১৮৬৮, ২১৮৮৪, ২১৮৯৮, ২১৯১৬, ২১৯৩৩, ২১৯৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩২০, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পক্ষান্তরে রোগীর দেখাশুনা না করলে শাস্তি পেতে হবে। এমর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

 মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম ইবনু মাইমুন (রহঃ).....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিনে বলবেন, হে আদম সন্তান আমি অসুস্থ হয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমার সেবা-শুশ্রুষা করনি। সে বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমার সেবা শুশ্রুষা করব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, আর তুমি তার সেবা করনি, তুমি কি জানতে না যে, তুমি তার সেবা-শুশ্রুষা করলে আমাকে তার কাছেই পেতে। হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খেতে দাওনি। সে (বান্দা) বলবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমাকে আহার করাতে পারি? তুমি তো সারা জাহানের প্রতিপালক।

তিনি (আল্লাহ) বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে আহার চেয়েছিল? তুমি তাকে খেতে দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে আহার করাতে তাহলে তা অবশ্যই আমার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে পানীয় চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। সে (বান্দা) বলবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমাকে পান করাব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক। তিনি (আল্লাহ) বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানীয় চেয়েছিল, তুমি তাকে পান করাওনি। যদি তুমি তাকে পান করাতে, তবে তা আমার কাছে পেয়ে যেতে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৯, আহমাদ ৮৯৮৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩২২, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৭১)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট উক্তির উপর ফেরেশতাদের আমীন বলা

রোগী ও মৃত ব্যক্তির নিকট যা বলা হয় তা কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন।

 আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বাহ ও আবূ কুরায়ব (রহঃ).....উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমরা পীড়িত ব্যক্তি অথবা মৃত ব্যক্তির নিকট হাজির হও তখন তার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য কর। কেননা তোমরা যেরূপ বল তার ওপর মালাকগণ (ফেরেশতামণ্ডলী) আমীন বলেন। উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) বলেন, এরপর যখন আবূ সালামাহ ইনতিকাল করলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আবূ সালামাহ্ (রাযিঃ) ইনতিকাল করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "তুমি বল, হে আল্লাহ আমাকে ও তাকে ক্ষমা কর এবং তার পরে আমাকে উত্তম পরিণাম দান কর" উম্মু সালামাহ (রাযিঃ) বলেন, অতঃপর আমি তা বললাম। আল্লাহ আমাকে তার (আবূ সালামাহ-এর) চেয়ে উত্তম প্রতিদান হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দান করলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২০১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯১৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৬১৭, মুসলিম ৯১৯, সুনান আত্ তিরমিযী ৯৭৭, সুনান আবূ দাঊদ ৩১১৫, নাসায়ী ১৮২৫, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১৪৪৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৬০৬৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ১০৮৪৭, আহমাদ ২৬৪৯৭, ইবনু হিব্বান ৩০০৫, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৬৭৫৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭১২৪, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১৪৬১, সহীহ আত্ তারগীব ৩৪৮৯, সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৪৯১, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৯৯৮, ইসলামীক সেন্টার ২০০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর নিকটে গেলে আল্লাহ তা‘আলার নিকটে তার রোগ মুক্তির জন্য দো‘আ কর এবং মৃত ব্যক্তির নিকট গেলে তার ক্ষমার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করবে। অনুরূপ যে জায়গায় যাও নিজের জন্য ভাল কথাই বলবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/৮৪)।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এই হাদীছে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে যে, এ ধরনের স্থানে যেন উত্তম কথা বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলার নিকট রোগী বা মৃতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং তার প্রতি যেন মেহেরবানী, সহজ ও নরম ব্যবহার করা হয়, সেজন্য দো‘আ করা হয় তা কবুল হওয়ার জন্য তারা আমীন বলে থাকেন। (শারহ নববী ৬/২২২)।

(১৫) সৎকাজের শিক্ষা প্রদানকারীর জন্যঃ

ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো ব্যাপারে হিংসা করা ঠিক নয়। প্রথম ব্যক্তি- যাকে আল্লাহ তা’আলা সম্পদ দান করেছেন, সাথে সাথে তা সত্যের পথে (ফী সাবীলিল্লাহ) বা সৎকার্যে ব্যয় করার জন্য তাকে তাওফীক্বও দিয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি- যাকে আল্লাহ তা’আলা হিকমাহ্, অর্থাৎ- জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং সে এ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগায় এবং (লোকদেরকে) তা শিখায়।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)  ২০২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩, ১৪০৯,৭১৪১,৭৩১৬; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৭৮১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮১৬, আহমাদ ৩৪৫১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ যখন মারা যায় তখন তার ’আমল বন্ধ (নিঃশেষ) হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি ’আমলের সাওয়াব (অব্যাহত থাকে): (১) সদাক্বায়ি জারিয়াহ্, (২) জ্ঞান- যা থেকে মানুষ উপকৃত হতে থাকে এবং (৩) সুসন্তান- যে তার (পিতা-মাতার) জন্য দু’আ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২০৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪১১৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৩১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যারা মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা দেয় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন। যেমন-

আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে দুই ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হ’ল, যাদের একজন আলেম, অপরজন আবেদ (ইবাদতকারী)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আবেদের তুলনায় আলেমের মর্যাদা হ’ল যেমন তোমাদের সর্বনিম্ন লোকের তুলনায় আমার মর্যাদা’। (জামে তিরমিযী হা/২৬০৯, হাদীছ ছহীহ, ছহীহ সুনানে তিরমিযী ২/৩৪৩)।

তারপর রাসূল (ছাঃ) বললেন,

‘নিশ্চয়ই মানুষকে ভাল কথা শিক্ষাদানকারীর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে থাকেন এবং ফেরেশতাগণ, আসমান ও যমীনের অধিবাসীরা এমনকি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মৎসও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে’। (প্রাগুক্ত)।

হাদীছে মানুষকে উত্তম কথা শিক্ষা দেওয়ার অর্থ সম্পর্কে মোল্লা আলী কারী (রাঃ) বলেন, সেটা এমন শিক্ষা যার সাথে মানুষের মুক্তি জড়িত। রাসূল (ছাঃ) প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ক্ষমার উল্লেখ করেননি; বরং مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ অর্থাৎ মানুষের উত্তম শিক্ষা দাতার কথা বলেছেন। যেন এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমার উপযুক্ত ঐ শিক্ষক যিনি মানুষকে কল্যাণের পথে পেঁŠছার জন্য ইলম শিক্ষা দান করে থাকেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ ১/৪৭৩)।

(১৬) সুরা হাশরের শেষ তিনটি আয়াত তেলাওয়াত করলে ৭০ হাজার ফেরেশ্তা তার জন্যে দোয়া করতে থাকবেঃ (হাদিসটি জঈফ)

মাকিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সকালে উপস্থিত হয়ে তিনবার "আউযু বিল্লাহিস সামীঈল আলীমি মিনাশ শাইতানির রাজীম" তারপর সুরা আল হাশরের শেষের তিন আয়াত পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সত্তর হাজার ফিরিশতা নিয়োজিত করবেন। তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দু’আ করতে থাকবেন। সে ঐ দিন ইন্তেকাল করলে তার শহীদী মৃত্যু হবে। যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এরূপ পাঠ করবে, সেও একই রকম গৌরবের অধিকারী হবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯২২, যঈফ, তা’লীকুর রাগীব (২/২২৫)।হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

মানব জাতির প্রতি ফেরেশতাদের অভিশাপ

ফেরেশতামন্ডলী মানুষের উত্তম গুণাবলীর কারণে যেমন তাদের জন্য দো‘আ করেন, তেমনি মানুষের ঘৃণ্য দোষ, অসৎ কাজ ও অপকর্মের কারণে তাদের জন্য বদদো‘আ করেন বা অভিসম্পাত করেন। যাদের জন্য ফিরিশতাগণ বদদো‘আ করেন, তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করা হ’ল।-

(১) ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে খারাপ মন্তব্যকারীঃ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে গাল-মন্দ করতে নিষেধ করেছেন।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ সওয়াব হবে না। জারীর ‘আবদুল্লাহ ইবনু দাউদ, আবূ মু‘আবিয়াহ ও মুহাযির (রহ.) আ‘মাশ (রহ.) হতে হাদীস বর্ণনায় শুবা (রহ.)-এর অনুসরণ করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৬৭৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৩৮১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৩৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৪০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 উসমান ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ).....আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও আবদুর রহমান ইবনু ’আওফ (রাযিঃ) এর মাঝে (অপ্রীতিকর) একটা কিছু ঘটেছিল। তখন খালিদ (রাযিঃ) তাকে গাল-মন্দ করেন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা আমার সাহাবীদের কাউকে গাল-মন্দ করবে না। কারণ, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বতের সমতুল্য স্বর্ণ খরচ করে তবুও তাদের এক মুদ অথবা অর্ধ মুদের ন্যায় হবে না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৩৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৫৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৩০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যাদেরকে ফেরেশতাগণ অভিশাপ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হ’ল ঐ সকল লোক যারা ছাহাবীদেরকে গালি দেয়।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ছাহাবীদেরকে গালি দিল তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা ও সকল মানুষের অভিশাপ’। (আবুল কাসিম তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১২৭০৯, ১২/১১০-১১১, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৩৪০, ৫/৮৮৬-৮৮৭, ছহীহ জামেউছ ছাগীর হা/৬১৬১, ৫/২৯৯, ত্বাবারানী/কবীর ১২৭০৯ সা’হীহুল্ জামি, হাদীস ৫২৮৫)। হাদিসের মান: হাসান।

এ হাদীছের ব্যাখ্যায় আল্লামা মানাবী (রহঃ) বলেন, سبهم অর্থ- যে তাদেরকে গালি দিল আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৎলোকদের দল থেকে বের করে দেন এবং সৃষ্টজীব তাদের জন্য বদ দো‘আ করে থাকে। (ফায়যুল কাদীর ৬/১৪৬-১৪৭)।

(২) মদীনায় বিদ‘আতের প্রচলনকারীঃ

যে সমস্ত অধম ব্যক্তিদেরকে ফেরেশতাগণ অভিশাপ করে থাকেন, তাদের এক প্রকার হ’ল যারা মদীনাতে বিদ‘আতে লিপ্ত অথবা বিদ‘আতকারীকে আশ্রয় দিবে।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদিনা এখান হতে ওখান পর্যন্ত হারাম (রূপে গণ্য)। সুতরাং তার গাছ কাটা যাবে না এবং এখানে কোন ধরনের অঘটন (বিদ‘আত, অত্যাচার ইত্যাদি) ঘটানো যাবে না। যদি কেউ এখানে কোন অঘটন ঘটায় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ্র এবং ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লা’নত (অভিশাপ)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৬৭, ৭৩০৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩২১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৬৬, ৩৬৮৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৭০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) মদীনাবাসীর উপর অত্যাচারকারী অথবা তাদেরকে ভয় প্রদর্শনকারীঃ

যারা রাসূল (ছাঃ)-এর শহর মদীনার উপর অত্যাচার করে এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে ভয় প্রদর্শন করে তাদেরকে ফেরেশতাগণ অভিশাপ করে থাকেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদীনাবাসীকে ভয় দেখাল, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাকে ভয় দেখান। আর তার উপর আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত দিবসে তার ফরয ও নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করবেন না’। (আল-মুসনাদ হা/১৫৯৬৪, ১৫৯৬২; কিতাব সুনানুল কুবরা, ৪২৬৫, ১, ২/৪৮৩, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৬৬৩১, ৭/১৪৩; সিলসিলা ছহীহা হা/২৩০৪)।

(৪) মুসলমানদের সাথে অঙ্গীকার ও সন্ধি ভঙ্গকারীঃ

অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্ব বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৪)।

অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো।  (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১)।

আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো। (আল-আনআম, আয়াত: ১৫২)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।  (সুরা রাদ, আয়াত: ২০)।

মহান আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো। (সুরা নাহল, আয়াত: ৯১)।

যারা মুসলমানদের সাথে কৃত সন্ধি ও চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের জন্য ফেরেশতাগণ বদদো‘আ করেন।

আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

‘সকল মুসলমানদের সন্ধি ও চুক্তি এক। সবচেয়ে নিচু শ্রেণীর একজন মুসলমান সন্ধি ও চুক্তি করতে পারে। যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও চুক্তিকে ভঙ্গ করবে তার উপর আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতাকুল ও সকল মুসলমানের অভিশাপ। ক্বিয়ামত দিবসে তার ফরয, নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করা হবে না’। (ছহীহ বুখারী হা/২৯৪৩, ছহীহ মুসলিম হা/৪৬৭, (১৩৭০) ৪৬৮, ৯৯৫-৯৯৯)।

দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে মুসলমানরা সন্ধি ও অঙ্গীকার বাতিল করার জন্য কত রকম বাহনাই না করে থাকে। অনেকে এমনও আছে যারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কারো সাথে লেন-দেন চুক্তি করার পর নিজের স্বার্থের বিপরীত দেখলেই তা বাতিল করে দেয় এবং বলে আমাদের এই চুক্তি করার কোন এখতিয়ারই নেই। কোন পিতা যদি কারো সাথে কোন চুক্তি করে বসে আর ছেলে যদি তা নিজের জন্য সুবিধাজনক মনে না করে তবে ছেলে বলে যে, পিতা বহুদিন পূর্বে কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। দোকান বা ফ্যাক্টরীতে যাওয়া আসা শুধু বরকতের জন্যই, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন-দেনের সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই।

আর ছেলে যদি কোন চুক্তি করে এবং তা যদি পিতা বাতিল করতে চায়, তবে সে যুক্তি পেশ করে যে, ব্যবসা তো আমার, এধরনের চুক্তি করা তার এখতিয়ার বহির্ভূত।

নিজেকে যারা বুদ্ধিমান ও পন্ডিত মনে করে তাদের আয়াতের প্রতি খেয়াল করা উচিত- ‘তারা আল্লাহ ও ঈমানদারকে ধোঁকা দেয় প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই ধোঁকাতে পতিত হয়ে থাকে কিন্তু তারা বুঝতে সক্ষম হয় না’ (বাক্বারাহ ৯)।

(৫) সৎ কাজে, দান-খয়রাতে বাঁধা প্রদানকারীঃ

যারা স্বীয় সম্পদ সৎপথে ব্যয় করে না তাদের জন্য ফেরেশতাগণ বদ দো‘আ করে থাকেন। বিভিন্ন হাদীছে নবী (ছাঃ) তার উম্মতকে এ ব্যাপারে সাবধান করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীছ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-

কাসিম ইবনু যাকারিয়্যা (রহঃ)....আবূ হুরায়রাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক বান্দা যখন সকালে ওঠে দু’জন মালাক (ফেরেশতা) অবতীর্ণ হন। তাদের জনৈক বলেন, “হে আল্লাহ খরচকারীর ধন আরো বাড়িয়ে দাও" এবং দ্বিতীয়জন বলেন, “হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দাও।” (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২২০৫, ইসলামীক সেন্টার ২২০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, সম্পদ ব্যয় না করার কারণে ধ্বংসের মর্ম হ’ল, সৎ পথে যে সম্পদ খরচ না করা হয় তাই ধ্বংস হওয়া বা সম্পদশালী নিজেই ধ্বংস হওয়া। আর সম্পদশালীর ধ্বংস হওয়ার অর্থ হ’ল, তার অন্যান্য বাজে কর্মে এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া যেন সে আর সৎকর্মের দিকে কোন ভ্রূক্ষেপই করতে পারে না। (ফাতহুল বারী ৩/৩০৫)।

আবুদ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দিন সূর্য উদয়ের সময় তার দুই পার্শ্বে দুই ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়, তারা উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকেন, হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে অগ্রসর হও, পরিতৃপ্তকারী অল্প সম্পদ উদাসীনকারী অধিক সম্পদ হ’তে উত্তম। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়। আর সূর্যাস্তের সময় তার উভয় পার্শ্বে দুই ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়’। (মুসনাদে আহমাদ হা/২০৭২৮; সিলসিলা ছহীহা হা/৪৪৪)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই একজন ফেরেশতা জান্নাতের এক দরজার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে বলেন, যে ব্যক্তি আজ ঋণ (আল্লাহর রাস্তায় দান করবে) দিবে, তার প্রতিদান পাবে আগামীকাল (ক্বিয়ামত দিবসে)। আর অন্য দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও’। (আল-মুসনাদ হা/৭৭০৯, ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৩৩৩, ৮/১২৪; সিলসিলাহ ছহীহহা হা/৯২০)।

(৬) তিন প্রকার লোকের জন্য জিবরাঈল (আঃ)-এর বদ দো‘আঃ

তিন শ্রেণীর লোকের জন্য জিবরাঈল (আঃ) বদদো‘আ করেছেন ও তার সমর্থনে রাসূল (ছাঃ) আমীন বলেছেন। তারা হ’ল-

(ক) যে সকল লোক রামাযান মাস পাওয়ার পরেও নিজের গোনাহ ক্ষমা করাতে পারল না।

(খ) যারা পিতা-মাতাকে জীবিতাবস্থায় পাওয়ার পর তাদের সাথে সদ্ব্যহার করে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পেল না।

(গ) যাদের সামনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নাম উচ্চারিত হওয়ার পরও তাঁর উপর দরূদ পড়ে না।

এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদীছ প্রনিধানযোগ্য-

মালেক বিন হুয়াইরিস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে উঠেন, প্রথম সিঁড়িতে উঠে আমীন বলেন। অতঃপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেন, আমীন। অতঃপর তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেন, আমীন। অতঃপর বললেন, আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! যে ব্যক্তি রামাযান মাসে উপনীত হওয়ার পরও তার জীবনের গোনাহকে ক্ষমা করাতে পারল না, আল্লাহ তাকে রহমত থেকে দূর করুন। আমি তা শুনে বললাম, আমীন। তারপর বলেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে অথবা তাদের একজনকে পেল, অথচ (তাদের সাথে সদ্ব্যহার না করে) জাহান্নামে প্রবেশ করল, আল্লাহ তা‘আলা তাকেও তাঁর রহমত থেকে দূর করুন। আমি বললাম, আমীন। অতঃপর বললেন, যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হওয়ার পর আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না, সেও আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে দূর হোক। আমিও তাতে বললাম, আমীন’। (ছহীহ ইবনু হিববান, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩০৮, হা/৪১০, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৩০৪, হা/৯০৯,  আল ইহসান ফি তাকরিব সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস নং ৪০৯, ২/১৪০, ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৯৬,  মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস নং: ১৭৩১৭, মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৭২৫৬, শায়ক শুয়াইব আরনাউত লিখেন হাদীসটি সহীহ)।

 

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি প্রথম সিঁড়িতে উঠার সময় জিবরীল (আঃ) এসে বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা বা তাদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পাওয়ার পরও (তাদের সাথে সদ্ব্যহার করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না, সে দূর হোক। তিনি বলেন, তখন আমি বললাম, আমীন। যাদের সামনে আপনার নাম উল্লেখ করার পরও দরূদ পাঠ করল না, সে দূর হোক। তাতে আমি বললাম, আমীন। তিনি বলেন, যারা রামাযান মাসে উপনীত হওয়ার পরও তার জীবনের গোনাহ ক্ষমা করাতে পারল না, সেও আল্লাহর রহমত হ’তে দূর হোক, তাতেও আমি বললাম, আমীন’। (ছহীহ তারগীব হা/৯৯৫)।

(৭) মুসলমানদের প্রতি সন্ত্রাসী হামলাকারীঃ

যারা মুসলমানদের উপর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায় তাদের জন্য ফেরেশতাগণ অভিশাপ করে থাকেন। হাদীছে এসেছে,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি লৌহবর্ম দ্বারা ইশারা করল, অতঃপর তা হাত হতে ফেলে না দেয়া পর্যন্ত মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) তাকে অভিশাপ দিতে থাকে। যদিও লোকটি তার আপন ভাই হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫১৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬১৬,সহীহ আল জামি‘ ৬০৩৪, সহীহ আত্ তারগীব ২৮১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪২৮, ইসলামিক সেন্টার ৬৪৭৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মাঝে কেউ যেন তার ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত না করে। কেননা, সে হয়তো জানে না শায়ত্বন তার এই হাতিয়ার দ্বারা তার ওপর আঘাত করিয়ে ক্ষতিসাধন করতে পারে, ফলে সে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫১৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭০৭২,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬১৭, আহমাদ ৮২১২, সহীহ আল জামি‘ ৭৭১৬, সহীহ আত্ তারগীব ২৮০৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ এবং আবূল আহওয়াস মুহাম্মাদ ইবনু হাইয়্যান (রহঃ)....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়, আর যে ব্যক্তি আমাদের ধোকা দিবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫২০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৮৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১, নাসায়ী ৪১০০, সুনান আত তিরমিযী ১৪৫৯, সুনান ইবনু মাজাহ ২৫৭৫, আহমাদ ৯৩৯৬, সহীহ আল জামি ৬২১৭, সহীহ আত্ তারগীব ১৭৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ১৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সালামাহ্ ইবনুল আক্ওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের ওপর যে তরবারি উঠাল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫২১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯৯, আহমাদ ১৬৫০০, সহীহ আল জামি ৬২৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৮) ইসলামী আইন প্রয়োগে বাধা প্রদানকারীঃ

ইসলামী দন্ডবিধি প্রয়োগে বাধা প্রদানকারীর উপর ফেরেশতাগণ অভিশাপ করে থাকেন। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি অজান্তে হত্যা হ’ল বা পাথর, চাবুক বা লাঠি নিক্ষেপের কারণে মারা গেল, তবে এর জন্য ভুল করে হত্যার দিয়্যাত দিতে হবে। কিন্তু যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হবে তাতে দন্ডবিধি প্রয়োগ হবে এবং যে ব্যক্তি এ দন্ডবিধি প্রয়োগে বাধা দান করবে তার উপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তা‘আলা তার ফরয, নফল কোন ইবাদতই গ্রহণ করবেন না’। (নাসাঈ হা/৪৭০৮; ইবনু মাজাহ, হা/২৬২৫; হাদীছ ছহীহ; ছহীহ সুনানে আবূ দাউদ ৩/৮৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৫১)।

আল্লাহ তা‘আলা দয়াপরবশ হয়ে এ জাতির উপর দন্ডবিধি নির্ধারণ করেছেন। কেননা এতে রয়েছে মানুষের জীবন (জীবনের নিরাপত্তা)। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘হে বিবেকবান লোক সকল! কিছাছের (ইসলামী দন্ডবিধির) মধ্যে তোমাদের জীবন রয়েছে’। (বাক্বারাহ ১৭৯)।

(৯) স্বামীর বিছানা হ’তে দূরে অবস্থানকারী মহিলাঃ

যে সকল মহিলা তাদের স্বামীর আহবান প্রত্যাখ্যান করতঃ পৃথক বিছানায় রাত্রি যাপন করে তাদের প্রতি ফেরেশতাগণ অভিশাপ করেন। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সঙ্গে একই বিছানায় শোয়ার জন্য ডাকে, আর সে আসতে অস্বীকার করে, তাহলে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতাগণ ঐ মহিলার ওপর লা’নত বর্ষণ করতে থাকে।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫১৯৩, ৩২৩৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৪৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৪৩৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৪৮১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইমাম নববী (রহঃ) অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, শারঈ ওযর ব্যতীত কোন মহিলার জন্য তার স্বামীর বিছানায় থাকতে অস্বীকার করা হারাম। অত্র হাদীছটি একথারই প্রমাণ বহণ করে। (শারহু নববী ১০/৭-৮)।

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দুই প্রকারের লোক যাদের ছালাত তাদের মাথা (থেকে উপরে) অতিক্রম করে না।

(ক) পলাতক গোলাম, যতক্ষণ না তার মালিকের কাছে ফিরে আসে।

(খ) স্বামীর অবাধ্য মহিলা যতক্ষণ না সে তার স্বামীর কাছে ফিরে আসে’। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ ৪/৩১৩; হাদীছ ছহীহ, ছহীহ তারগীব হা/১৮৮৮)।

(১০) যালেম নেতৃবর্গঃ

যে সকল বদনসীব ও বঞ্চিতদের উপর ফেরেশতাগণ অভিশাপ করে থাকেন তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হ’ল ঐ সকল নেতৃবৃন্দ, যারা নাগরিকের অধিকার আদায় করে না। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি এমন একটি হাদীছ বর্ণনা করব যা কেউ বর্ণনা করেনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীর দরজায় দন্ডায়মান ছিলেন আর আমরা ভিতরে ছিলাম। তখন তিনি বলেন, নেতা হবে কুরাইশদের মধ্য হ’তে। নিঃসন্দেহে তোমাদের উপর আমার অধিকার রয়েছে এবং তাদের উপরও তোমাদের অধিকার রয়েছে। যখনই তাদের কাছে অনুগ্রহ চাওয়া হবে, অনুগ্রহ করবে। অঙ্গীকার করা হ’লে পূরণ করতে হবে। বিচার ফায়ছালা করলে ইনসাফ করতে হবে। যে ব্যক্তি এরূপ করবে না তার উপর আল্লাহ, সমস্ত ফেরেশতা ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ’। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১১৮৫৯, হাদীছ ছহীহ ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৮)।

তিনি আরো বলেন, ‘নেতা হবে কুরাইশদের মধ্য হ’তে, যখন অনুগ্রহ কামনা করা হবে তখন যেন তারা অনুগ্রহ করে। অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করবে। বিচারকার্য সম্পাদনে ইনসাফ বজায় রাখবে। তাদের মধ্য হ’তে যে এরূপ করবে না, আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতামন্ডলী ও সমস্ত মানুষের অভিশাপ তার উপর বর্ষিত হবে’। (আল-মুসনাদ হা/১১৮৫৯; হাদীছ ছহীহ সিলসিলা ছহীহা হা/২৮৫৮)।

(১১) কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীঃ

যারা কুফরী অবস্থাতে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের জন্য ফেরেশতাগণ অভিশাপ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে এবং কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের উপর আল্লাহ, ফেরেশত মন্ডলী ও সমগ্র মানবতার অভিশাপ। তারা উক্ত অবস্থায়ই জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করবে। কখনো তাদের আযাব হ্রাস করা হবে না এবং নিষ্কৃতিও দেয়া হবে না’ (বাক্বারাহ ১৬১-১৬২)।

হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যারা কুফরী করেছে এবং সে অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ, ফেরেশতামন্ডলী ও সমগ্র মানবতার অভিশাপ তাদের উপর। এ আযাব ক্বিয়ামত অবধি চলতে থাকবে এবং এ অবস্থাতেই তারা জাহান্নামে নিপতিত হবে। তাদের এই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি কখনো হ্রাস করা হবে না এবং তাদেরকে এ থেকে কখনো অব্যাহতিও দেয়া হবে না; বরং স্থায়ীভাবে এই শাস্তি অনন্তকাল অব্যাহত থাকবে। (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম প্রথম খন্ড, (রিয়াদ: দারুল ফায়হা, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৩ হিঃ), পৃঃ ২১৪)।

আমরা এরূপ কঠিন শাস্তি হ’তে আল্লাহ তা‘আলার কাছে পরিত্রাণ চাই।

(ক) আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের অভিশপ্ত ও শাস্তির যোগ্য হওয়ার জন্য কুফরী অবস্থায় মৃত্যুকে শর্ত করেছেন। হাফেয ইবনুল জাওযী (রহঃ) উক্ত শর্তারোপের অন্তর্নিহিত কারণ প্রসঙ্গে বলেন, মৃত্যু অবস্থায় কুফরীর শর্ত এ জন্যই আরোপ করা হয়েছে যে, কারো ব্যাপারে কুফরীর বিধান আরোপ তার মৃত্যু কুফরীর অবস্থায় হওয়ার কারণেই সাব্যস্ত হবে। (হাফিয ইবনুল জাওযী, যাদূল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর, (বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৪ খৃঃ), পৃঃ ১৬৬)।

এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ রশীদ রেযা বলেছেন, চিরস্থায়ী অভিশাপের শাস্তি প্রাপ্ত হওয়ার জন্য এমন শর্তারোপ করা হয়েছে যে, তার মৃত্যু কুফরের উপর হ’তে হবে। এ ধরনের মানুষের উপর স্থায়ী অভিশাপ হবে এবং এ অবস্থায় কোন প্রকার শাফা‘আত-সুপারিশ অথবা অন্য কোন মাধ্যম তাদের কোন উপকারে আসবে না। (সায়্যিদ মুহাম্মাদ রশীদ রিদা, তাফসীরুল মানার, ২য় খন্ড, (বৈরুত: দারুল মা‘রিফা, ২য় সংস্করণ, তাবি), পৃঃ ৫২-৫৩)।

(খ) ইমাম বাগাবী (রহঃ) বলেন, ইমাম আবু আলিয়া বলেছেন, ঐ সকল লোকদের অভিশাপ ক্বিয়ামতের দিন প্রযোজ্য হবে। কাফেরকে দাঁড় করানো হবে, তারপর তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ দিবেন, অতঃপর ফেরেশতা মন্ডলী, অতঃপর সমগ্র মানবজাতী তাদেরকে অভিশাপ দিবে। (আবু মুহাম্মাদ বাগাবী, মা‘আলিমুত তানযীল, ১ম খন্ড (বৈরুত: দারুল মা‘রিফা, ১ম সংস্করণ, ১৪০৬ হিঃ), পৃঃ ১৩৪)।

(১২) কুফরী মতবাদের অনুসারীঃ

ফেরেশতাগণ যাদের প্রতি অভিশাপ করে থাকেন তাদের অন্যতম হচ্ছে যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে রাসূলকে সত্য জেনে এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও প্রমাণাদি পৌঁছার পরও কুফরী মতবাদ গ্রহণ করে। এ সকল লোকদের সম্পর্কেই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,

‘আল্লাহ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন সে সম্প্রদায়কে যারা ঈমান আনয়নের পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্যদান করার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর কুফরী করে? আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। তারা তো এমনই যাদের শাস্তি হ’ল, তাদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং মানুষ সকলের অভিশাপ। তারা তাতে স্থায়ী হবে, তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে বিরামও দেয়া হবে না। কিন্তু যারা তারপর তওবা করে এবং সংশোধন করে নেয়, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। (আলে ইমরান ৮৬-৮৯)।

হাশরের মাঠে ফিরিশ্তাগণ কি সুপারিশকারী হবে?

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর তোমরা সে দিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। আর কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না। আর তারা সাহায্যও প্রাপ্ত হবে না”। (সুরা বাকারা ২, আয়াত ৪৮)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

 “হে নবী! বিচার দিবস সম্বন্ধে তুমি কী জান? আবার বলছি, বিচার দিবস সম্বন্ধে তুমি কী জান?” এটা সেদিন, যেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করার সামর্থ্য রাখবে না। সেদিন একক কর্তৃত্ব হবে শুধু আল্লাহর।” (সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত: ১৭-১৯)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

“হে নবী! আপনি বলুন, যাবতীয় শাফা‘আত একমাত্র আল্লাহরই এখতিয়ারে। আসমান-যমীনের কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই। অতঃপর তার দিকেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।” (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৪)।

তিনি আরো বলেন,

“তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী নেই। তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?” (সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪)।

তিনি আরো বলেন,

“তিনি ছাড়া তাদের জন্য অন্য কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী নেই”। (সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১)।

তিনি আরো বলেন,

“তবে কি তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে শাফা‘আতকারী গ্রহণ করেছে?” (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৩)।

তিনি আরও বলেন,

তাঁর অনুমতি ছাড়া তো কোনো সুপারিশকারীই হতে পারে না।” (সূরা ইউনুস, আয়াত: ০৩)।

আয়াতগুলো থেকে বাহ্যতঃ বোঝা যাচ্ছে যে, আখেরাতে শাফা’আত বা সুপারিশ কোন কাজে আসবে না। মূলত: ব্যাপারটি এরকম নয়। এ আয়াতের উদ্দেশ্য শুধু কাফের মুশরিক, আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের জন্য কোন শাফা’আত বা সুপারিশ কাজে আসবে না। যেমন পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ যার উপর সন্তুষ্ট নয় তার জন্য তারা সুপারিশ করবে না।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ২৮)।

আল্লাহ কাদের উপর সন্তুষ্ট নয় তা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করে বলেছেন, “আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কুফরতে সন্তুষ্ট নন। (সূরা আয-যুমার: ৭)।

সুতরাং কাফেরদের জন্য কোন সুপারিশ নয়। আর কাফেররাও হাশরের দিন স্বীকৃতি দিবে যে, তাদের জন্য কোন সুপারিশকারী নেই, তারা বলবে “আমাদের তো কোন সুপারিশকারী নেই”। (সূরা আশ-শু'আরা: ১০০)।

তাদের সম্পর্কে আল্লাহ নিজেও বলেছেন, “সুতরাং সুপারিশকারীর সুপারিশ তাদের কোন উপকার দিবে না”। (সূরা আল-মুদাসসির: ৪৮)।

এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যারা কুফরী, শির্কী, নিফাকী অবস্থায় মারা যাবে তাদের জন্য কোন শাফা’আত বা সুপারিশ নেই।

পক্ষান্তরে মুমিনদের জন্য শাফা’আত বা সুপারিশ অবশ্যই হবে। যা কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু তাদের জন্য সুপারিশের ব্যাপারেও শর্ত হচ্ছে,

তন্মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে,

তাদের মধ্যে ঈমান অবশিষ্ট থাকতে হবে। মূলত: এ ঈমানের কারণেই শাফাআত তথা সুপারিশের হকদার হয়েছে। যার সামান্যতম ঈমান আছে তার উপর আল্লাহর সামান্যতম সস্তুষ্টি অবশিষ্ট আছে। সুতরাং যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার জন্য আল্লাহর সামান্যতম সন্তুষ্টি হলেও থাকতে হবে। যদিও অন্য অপরাধের কারণে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারে নি।

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে,

শাফা’আত বা সুপারিশ করার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে অনুমতি থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, “এমন কে আছে যে, তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করে?” (সূরা আল-বাকারাহ: ২৫৫)।

তৃতীয় শর্ত হচ্ছে,

যিনি সুপারিশ করবেন তার উপরও আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, “আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশতা রয়েছে; তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট”। (সূরা আন-নাজম: ২৬)।

অর্থাৎ যিনি সুপারিশ করবেন তার কথা-বার্তা ও সুপারিশ আল্লাহর মনঃপুত হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না”। (সূরা ত্বা-হাঃ ১০৯)।

এ তিনটি শর্ত পাওয়া যাওয়া সাপেক্ষে নবী-রাসূল, শহীদগণ ও নেককার মুমিনগণ শাফা'আত বা সুপারিশ করবেন। যা বহু হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত।

পরিশেষে আমরা যেনো ফেরেশতাগণ যাদের প্রতি অভিশাপ করে থাকেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে দূরে থাকি এবং যেসব গুনাবলী সম্পন্ন মানব জাতির জন্য দো‘আ করে থাকেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হই, আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমিন!

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, বিবিসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

...........................................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস

  বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ঈমান বিষয়ক ৬৯টি সহিহ হাদিস মূল গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) (১) উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্...