Search This Blog

Friday, March 20, 2020

কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ছালাত।


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম 
কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ছালাত

আল্লাহ বলেন,
‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’ (ত্বোয়া-হা ২০/১৪)।
সম্মানিত মুছল্লী !
অনুধাবন করুন আপনার প্রভুর বাণী- ‘সফলকাম হবে সেই সব মুমিন যারা ছালাতে রত থাকে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে’।[1] অতএব গভীরভাবে চিন্তা করুন! আপনার প্রভু আল্লাহ কিজন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন? মনে রাখবেন তিনি আপনাকে বিনা প্রয়োজনে সৃষ্টি করেননি। তাঁর সৃষ্ট এ সুন্দর সৃষ্টি জগতকে সুন্দরভাবে আবাদ করার দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই তিনি আপনাকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কে এখানে কত বেশী সুন্দর আমল করে এবং তার সৃষ্টিকর্তার হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তা পরীক্ষার জন্য আল্লাহ মউত ও হায়াতকে সৃষ্টি করেছেন।[2] আপনার হাত-পা, চক্ষু-কর্ণ, নাসিকা-জিহবা সর্বোপরি যে মূল্যবান জ্ঞান-সম্পদ এবং ভাষা ও চিন্তাশক্তির নে‘মত দান করে আপনাকে আপনার প্রভু এ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তার যথার্থ ব্যবহার আপনি করেছেন কি-না, তার কড়ায়-গন্ডায় হিসাব আপনাকে আপনার সৃষ্টিকর্তার নিকটে দিতে হবে।[3]
কেউ আপনার উপকার করলে আপনি তার নিকটে চির কৃতজ্ঞ থাকেন। সর্বপ্রদাতা আল্লাহর নিকটে আপনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কি? একবার ভেবে দেখুন দুনিয়ার সকল সম্পদের বিনিময়ে কি আপনি আপনার ঐ সুন্দর দু’টি চক্ষুর ঋণ শোধ করতে পারবেন? পারবেন কি আপনার দু’টি হাতের, পায়ের, কানের বা জিহবার যথাযথ মূল্য দিতে? আপনার হৃৎপিন্ডে যে প্রাণবায়ুর অবস্থান, সেটি কার হুকুমে সেখানে এসেছে ও কার হুকুমে সেখানে রয়েছে? আবার কার হুকুমে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে? [4] সেটির আকার-আকৃতিই বা কি, তা কি কখনও আপনি দেখতে পেয়েছেন? শুধু কি তাই? আপনার পুরো দেহযন্ত্রটাই যে এক অলৌকিক সৃষ্টির অপরূপ সমাহার। যার কোন একটি তুচ্ছ অঙ্গের মূল্য দুনিয়ার সবকিছু দিয়েও কি সম্ভব?
অতএব আসুন! সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি মন খুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাঁর প্রেরিত মহান ফেরেশতা জিব্রীলের মাধ্যমে শিখানো ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রদর্শিত পদ্ধতিতে ‘ছালাত’ আদায়ে রত হই।[5] স্বীয় প্রভুর নিকটে আনুগত্যের মস্তক অবনত করি।
হে মুছল্লী!
ছালাতের নিরিবিলি আলাপের সময় আপনি আপনার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকটে হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিন।[6] ছালাত শেষ করার আগেই আপনার সকল প্রার্থনা নিবেদন করুন। সিজদায় লুটিয়ে পড়ে চোখের পানি ফেলুন। আল্লাহ আপনার হৃদয়ের কথা জানেন। আপনার চোখের ভাষা বুঝেন। ঐ শুনুন পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর আকুল প্রার্থনা- ‘প্রভু হে! নিশ্চয়ই আপনি জানেন যা কিছু আমরা হৃদয়ে লুকিয়ে রাখি ও যা কিছু আমরা মুখে প্রকাশ করি। আল্লাহর নিকটে যমীন ও আসমানের কোন কিছুই গোপন থাকেনা’।[7] অতএব ভীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও গভীর আস্থা নিয়ে বুকে জোড়হাত বেঁধে বিনীতভাবে আপনার মনিবের সামনে দাঁড়িয়ে যান। দু’হাত উঁচু করে রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করুন। অতঃপর তাকবীরের মাধ্যমে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করুন। যাবতীয় গর্ব ও অহংকার চূর্ণ করে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সম্মুখে রুকূতে মাথা ঝুঁকিয়ে দিন। তারপর সিজদায় গিয়ে মাটিতে মাথা লুটিয়ে দিন। সর্বদা স্মরণ রাখুন তাঁর অমোঘ বাণী- ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে আমি তোমাদেরকে অবশ্যই বেশী করে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’। [8] তিনি বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য অন্তরকে খালি করে নাও। আমি তোমার হৃদয়কে সচ্ছলতা দ্বারা পূর্ণ করে দেব এবং তোমার অভাব দূর করে দেব। কিন্তু যদি তুমি সেটা না কর, তাহ’লে আমি তোমার দু’হাতকে (দুনিয়াবী) ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব মিটাবো না’।[9]
অতএব আসুন! আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান ‘ছালাতে’ রত হই ‘তাকবীরে তাহরীমা’-র মাধ্যমে দুনিয়ার সবকিছুকে হারাম করে একনিষ্ঠভাবে বিনম্রচিত্তে বিগলিত হৃদয়ে!!
* মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬০ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘নবুঅতের নিদর্শনসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৫; ১০ম নববী বর্ষে ইয়ামনের ঝাড়-ফুঁককারী কবিরাজ যেমাদ আযদী মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কথিত জিন ছাড়ানোর তদবীর করতে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে উপরোক্ত খুৎবা শুনে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন।
দলীলের উৎসঃ
[1]. قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ فِي صَلاَتِهِمْ خَاشِعُوْن َ(সূরা মু’মিনূন ২৩/১-২।)
[2] .اَلَّذِىْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً (মুলক ৬৭/২।)
[3] . فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَهُ ، وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَهُ (যিলযাল ৯৯/৭-৮।)
[4] وَ يَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الرُّوْحِ قُلِ الرُّوْحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّيْ وَمَا أُوْتِيْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيْلاً (বনু ইসরাঈল ১৭/৮৫।
[5] . صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ বুখারী (দিল্লী) ‘আযান’ অধ্যায়-২, ১/৮৮ পৃঃ, হা/৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬; মিশকাত-আলবানী (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ, ১৪০৫হি:/১৯৮৫খৃ:) হাদীছ সংখ্যা/৬৮৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দেরীতে আযান’ অনুচ্ছেদ-৬।
[6] . إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا صَلَّى يُنَاجِيْ رَبَّهُ... ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ যখন ছালাত আদায় করে, তখন সে তার প্রভুর সঙ্গে মুনাজাত করে’ অর্থাৎ গোপনে আলাপ করে’। -বুখারী হা/৫৩১, ১/৭৬ পৃঃ; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭১০ ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭; আহমাদ, মিশকাত হা/৮৫৬ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[7] . رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِيْ وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ (ইবরাহীম ১৪/৩৮।)
[8] . لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِيْ لَشَدِيْدٌ (ইবরাহীম ১৪/৭।)
[9] . হাদীছে কুদসী; আহমাদ, তিরমিযী হা/২৪৬৬; ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; ঐ, মিশকাত হা/৫১৭২ ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-২৬, পরিচ্ছেদ-২; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৫৯।
ছালাতের বিস্তারিত নিয়ম-কানূন
ছালাতের বিস্তারিত নিয়ম-কানূন বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তবে নিম্নের হাদীছটিতে অধিকাংশ বিধান একত্রে পাওয়া যায় বিধায় আমরা এটিকে অনুবাদ করে দিলাম।
‘হযরত আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) একদিন দশজন ছাহাবীকে বললেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত সম্পর্কে আপনাদের চাইতে অধিক অবগত। তাঁরা বললেন, তাহ’লে বলুন। তখন তিনি বলতে শুরু করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ছালাতে দাঁড়াতেন, তখন
(১) দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে তাকবীর বলতেন। অতঃপর ক্বিরাআত করতেন। অতঃপর তাকবীর দিয়ে
(২) দু’হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে রুকুতে যেতেন। এসময় দু’হাত হাঁটুর উপর রাখতেন এবং মাথা ও পিঠ সোজা রাখতেন। অতঃপর সামি‘আল্লা-হু লেমান হামিদাহ বলে রুকূ থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময়
(৩) দু’হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। অতঃপর তাকবীর দিয়ে সিজদায় গিয়ে দু’হাত দু’পাঁজর থেকে ফাঁক রাখতেন এবং দু’পায়ের আঙ্গুলগুলি খোলা রাখতেন (‘ক্বিবলার দিকে মুড়ে রাখতেন’ -বুখারী হা/৮২৮; ঐ, মিশকাত হা/৭৯২)।
অতঃপর উঠতেন ও বাম পায়ের পাতার উপর সোজা হয়ে বসতেন, যতক্ষণ না প্রত্যেক হাড় স্ব স্ব স্থানে ঠিকমত বসে যায়। অতঃপর দাঁড়াতেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাক‘আতেও এরূপ করতেন। অতঃপর যখন দ্বিতীয় রাক‘আত শেষে (তৃতীয় রাক‘আতের জন্য) উঠতেন, তখন তাকবীর দিয়ে দাঁড়িয়ে (৪) দু’হাত কাঁধ বরাবর এমনভাবে উঠাতেন, যেমনভাবে তাকবীরে তাহরীমার সময় উঠিয়েছিলেন। এভাবে তিনি অবশিষ্ট ছালাতে করতেন। অবশেষে যখন শেষ সিজদায় পৌঁছতেন, যার পরে সালাম ফিরাতে হয়, তখন বাম পা ডান দিকে বাড়িয়ে দিতেন ও বাম নিতম্বের উপর বসতেন (قَعَدَ مُتَوَرِّكًا)। অতঃপর সালাম ফিরাতেন’। এ বর্ণনা শোনার পর উপস্থিত দশজন ছাহাবীর সকলে বলে উঠলেন ‘ছাদাক্বতা’ (صَدَقْتَ), ‘আপনি সত্য বলেছেন’। এভাবেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন’।[1]
দলীলের উৎসঃ
 [1] . আবুদাঊদ হা/৭৩০ ‘হাদীছ ছহীহ’; দারেমী, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি; ঐ, মিশকাত হা/৮০১ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০; বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ৫ম মুদ্রণ ১৯৮৭) হা/৭৪৫ (১২), ১/৩৪০ পৃঃ।
ছালাতের বিস্তারিত আলোচনাঃ
১. জায়নামাজের কোনো দোয়া নেইঃ  প্রচলিত ছালাত শিক্ষার বইগুলোতে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে “ইন্নি ওয়াজ্জাহ তু ওয়াজ্ হিয়া লিল্লাজি, ফাত্বরস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল্ আরদ্বঅ হানি-ফাওঁ ওয়ামা-আনা মিনাল মুশরিকী-ন” এই দোয়াটি পড়া হয়। এই দোয়াটি কোরআনের একটি আয়াত। আসলে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে এই দোয়াটি পড়ার কোনো দলীল নেই। মূলত এই দোয়াটি এক প্রকার ছানা। বুকে হাত বাঁধার পর সাধারনত যে ছানা পড়া হয় তার পরিবর্তে এই দোয়াটি পড়া যাবে।
জায়নামাজে দাঁড়িয়ে হাদিসে বর্ণিত কোনো দোয়া নেই।
১. নিয়তঃ
‘নিয়ত’ অর্থ ‘সংকল্প’। ছালাতের শুরুতে নিয়ত করা অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَاتِ وَ إِنَّمَا لِكُلٍّ امْرِءٍ مَّا نَوَى... ‘সকল কাজ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই-ই পাবে, যার জন্য সে নিয়ত করবে’....। [2] অতএব ছালাতের জন্য ওযূ করে পবিত্র হয়ে পরিচ্ছন্ন পোষাক ও দেহ-মন নিয়ে কা‘বা গৃহ পানে মুখ ফিরিয়ে মনে মনে ছালাতের দৃঢ় সংকল্প করে স্বীয় প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় তাঁর সম্মুখে বিনম্রচিত্তে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। মুখে নিয়ত পাঠের প্রচলিত রেওয়াজটি দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতে এর কোন স্থান নেই। অনেকে ছালাত শুরুর আগেই জায়নামাযের দো‘আ মনে করে ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু...’ পড়েন। এই রেওয়াজটি সুন্নাতের বরখেলাফ। মূলতঃ জায়নামাযের দো‘আ বলে কিছু নেই।
দলীলের উৎসঃ
[2] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ; ছহীহ বুখারী ও মিশকাত -এর ১ম হাদীছ।
২. তাকবীরে তাহরীমা ও বুকে হাত বাঁধাঃ
দুই হাতের আংগুল সমূহ ক্বিবলামুখী খাড়াভাবে কাঁধ অথবা কান পর্যন্ত উঠিয়ে দুনিয়াবী সবকিছুকে হারাম করে দিয়ে স্বীয় প্রভুর মহত্ত্ব ঘোষণা করে বলবে ‘আল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)। অতঃপর বাম হাতের উপরে ডান হাত বুকের উপরে বেঁধে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সম্মুখে নিবেদিত চিত্তে সিজদার স্থান বরাবর দৃষ্টি রেখে [3] দন্ডায়মান হবে। আল্লাহ বলেন, وَقُوْمُوْا ِللهِ قَانِتِيْنَ- ‘আর তোমরা আল্লাহর জন্য নিবিষ্টচিত্তে দাঁড়িয়ে যাও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)। হাত বাঁধার সময় দুই কানের লতি বরাবর দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী উঠানোর হাদীছ যঈফ। [4] ছালাতে দাঁড়ানোর সময় তাকবীরে তাহরীমার পর বুকে হাত বাঁধা সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদীছগুলির কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন,
‘লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ত যেন তারা ছালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে, ছাহাবী সাহল বিন সা‘দ এই আদেশটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত করতেন বলেই আমি জানি’।[5]
‘যেরা‘ (ذِرَاعٌ) অর্থ কনুই থেকে মধ্যমা আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত দীর্ঘ হাত’ (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। একথা স্পষ্ট যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখলে তা বুকের উপরেই চলে আসে। নিম্নোক্ত রেওয়ায়াত সমূহে পরিষ্কারভাবে যার ব্যাখ্যা এসেছে। যেমন-
২. ছাহাবী হুলব আত-ত্বাঈ (রাঃ) বলেন,
 ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বাম হাতের জোড়ের (কব্জির) উপরে ডান হাতের জোড় বুকের উপরে রাখতে দেখেছি’।[6]
৩. ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বলেন,
 ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপরে রাখলেন’। [7]
উপরোক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহে ‘বুকের উপরে হাত বাঁধা’ সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। ইমাম শাওকানী বলেন, ‘হাত বাঁধা বিষয়ে ছহীহ ইবনু খুযায়মাতে ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের চাইতে বিশুদ্ধতম কোন হাদীছ আর নেই’।[8] উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন ছাহাবী ও ২ জন তাবেঈ থেকে মোট ২০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এর বিপরীত কিছুই বর্ণিত হয়নি এবং এটাই জমহূর ছাহাবা ও তাবেঈনের অনুসৃত পদ্ধতি।[9]
এক্ষণে ‘নাভির নীচে হাত বাঁধা’ সম্পর্কে আহমাদ, আবুদাঊদ, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে চারজন ছাহাবী ও দু’জন তাবেঈ থেকে যে চারটি হাদীছ ও দু’টি ‘আছার’ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে মুহাদ্দেছীনের বক্তব্য হ’ল- ‘(যঈফ হওয়ার কারণে) এগুলির একটিও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়’।[10]
প্রকাশ থাকে যে, ছালাতে দাঁড়িয়ে মেয়েদের জন্য বুকে হাত ও পুরুষের জন্য নাভীর নীচে হাত বাঁধার যে রেওয়াজ চালু আছে, হাদীছে বা আছারে এর কোন প্রমাণ নেই। [11] বরং এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, ছালাতের মধ্যকার ফরয ও সুন্নাত সমূহ মুসলিম নারী ও পুরুষ সকলে একই নিয়মে আদায় করবে।[12]
বুকে হাত বাঁধার তাৎপর্য : ত্বীবী বলেন, ‘হৃৎপিন্ডের উপরে বুকে হাত বাঁধার মধ্যে হুঁশিয়ারী রয়েছে এ বিষয়ে যে, বান্দা তার মহা পরাক্রান্ত মালিকের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে হাতের উপর হাত রেখে মাথা নিচু করে পূর্ণ আদব ও আনুগত্য সহকারে, যা কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না’।[13]
দলীলের উৎসঃ
[3] . হাকেম, বায়হাক্বী, আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী (বৈরূত : ১৪০৩/১৯৮৩) পৃঃ ৬৯; ইরওয়া হা/৩৫৪-এর শেষে দ্রষ্টব্য।
[4] . আবুদাঊদ হা/৭৩৭।
[5] . বুখারী (দিল্লী ছাপা) ১/১০২ পৃঃ, হা/৭৪০, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৮৭; ঐ, মিশকাত হা/৭৯৮, ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০। উল্লেখ্য যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন (১৯৯১), আধুনিক প্রকাশনী (১৯৮৮) প্রভৃতি বাংলাদেশের একাধিক সরকারী ও বেসরকারী প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক অনুদিত ও প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ বুখারী শরীফে উপরোক্ত হাদীছটির অনুবাদে ‘ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপরে’ -লেখা হয়েছে। এখানে অনুবাদের মধ্যে ‘কব্জি’ কথাটি যোগ করার পিছনে কি কারণ রয়েছে বিদগ্ধ অনুবাদক ও প্রকাশকগণই তা বলতে পারবেন। তবে হাদীছের অনুবাদে এভাবে কমবেশী করা ভয়ংকর গর্হিত কাজ বলেই সকলে জানেন।
[6] . আহমাদ হা/২২৬১০, সনদ হাসান, আলবানী, আহকামুল জানায়েয, মাসআলা নং-৭৬, ১১৮ পৃঃ; তিরমিযী (তুহফা সহ, কায়রো : ১৪০৭/১৯৮৭) হা/২৫২, ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১৮৭, ২/৮১, ৯০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৯।
[7] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৭৯; আবুদাঊদ হা/৭৫৫, ইবনু মাস‘ঊদ হ’তে; ঐ, হা/৭৫৯, ত্বাঊস বিন কায়সান হ’তে; ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, ‘ছালাতে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা’ অনুচ্ছেদ-১২০।
[8] . নায়লুল আওত্বার ৩/২৫।
[9] . নায়লুল আওত্বার ৩/২২; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : ১৪১২/১৯৯২) ১/১০৯।
[10] . মির‘আতুল মাফাতীহ (দিল্লী: ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৫/১৯৯৫) ৩/৬৩; তুহফাতুল আহওয়াযী ২/৮৯ ।
[11] . মির‘আত (লাহোর ১ম সংস্করণ, ১৩৮০/১৯৬১) ১/৫৫৮; ঐ, ৩/৬৩; তুহফা ২/৮৩ ।
[12] . মির‘আত ৩/৫৯ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৯; নায়লুল আওত্বার ৩/১৯ ।
[13] . মির‘আত ৩/৫৯ পৃঃ, হা/৮০৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
৩. ছানাঃ
‘ছানা’ (الثناء) অর্থ ‘প্রশংসা’। এটা মূলতঃ ‘দো‘আয়ে ইস্তেফতা-হ’ (دعاء الاستفتاح) বা ছালাত শুরুর দো‘আ। বুকে জোড় হাত বেঁধে সিজদার স্থানে দৃষ্টি রেখে বিনম্রচিত্তে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে মুছল্লী তার সর্বোত্তম ইবাদতের শুভ সূচনা করবে। (বুখারী হা/৭৪৪, ১/১০২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭০৮, ২/১০৩ পৃঃ); মিশকাত হা/৮১২, পৃঃ ৭৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৫৬, ২/২৬৬ পৃঃ।)
ছানা
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা বা-‘এদ বায়নী ওয়া বায়না খাত্বা-ইয়া-ইয়া, কামা বা-‘আদতা বায়নাল মাশরিক্বি ওয়াল মাগরিবি। আল্লা-হুম্মা নাকক্বিনী মিনাল খাত্বা-ইয়া, কামা ইউনাকক্বাছ ছাওবুল আব্ইয়াযু মিনাদ দানাসি। আল্লা-হুম্মাগসিল খাত্বা-ইয়া-ইয়া বিল মা-য়ি ওয়াছ ছালজি ওয়াল বারাদি’।
অনুবাদঃ হে আল্লাহ! আপনি আমার ও আমার গোনাহ সমূহের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন, যেমন দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে পরিচ্ছন্ন করুন গোনাহ সমূহ হতে, যেমন পরিচ্ছন্ন করা হয় সাদা কাপড় ময়লা হতে। হে আল্লাহ! আপনি আমার গুনাহ সমূহকে ধুয়ে ছাফ করে দিন পানি দ্বারা, বরফ দ্বারা ও শিশির দ্বারা’। একে ‘ছানা’ বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ বলা হয়। ছানার জন্য অন্য দো‘আও রয়েছে। তবে এই দো‘আটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ।
ছানা সম্পর্কে আরো দোয়া জানতে চাইলে নীচে গিয়ে ১নং এ ক্লিক করুন।
৪. বিসমিল্লাহ ও সুরা ফাতিহা পাঠঃ
ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পাঠ শেষে ‘আ‘ঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্ব-নির রজীম মিন হামযিহী ওয়া নাফখিহী ওয়া নাফছিহী’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নীরবে পড়বে। অতঃপর সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে। প্রকাশ থাকে যে, ‘আঊযুবিল্লাহ’ কেবল ১ম রাক‘আতে পড়বে, বাকী রাক‘আতগুলিতে নয়।[14] অমনিভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ সূরায়ে ফাতিহার অংশ হওয়ার পক্ষে যেমন কোন ছহীহ দলীল নেই, [15] তেমনি ‘জেহরী’ ছালাতে ‘বিসমিল্লাহ’ সরবে পড়ার পক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নেই।[16] বরং এটি দুই সূরার মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে পঠিত হয়’ (কুরতুবী)।[17]
ইমাম কুরতুবী বলেন যে, সকল কথার মধ্যে সঠিক কথা হ’ল ইমাম মালেকের কথা যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরা ফাতিহার অংশ নয়’। যেমন ‘কুরআন’ খবরে ওয়াহেদ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং তা প্রতিষ্ঠিত হয় অবিরত ধারায় অকাট্ট বর্ণনা সমূহের মাধ্যমে, যাতে কোন মতভেদ থাকে না। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, এটি সূরা ফাতিহার অংশ না হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এতে মতভেদ রয়েছে। আর কুরআনে কোন মতভেদ থাকে না। বরং ছহীহ-শুদ্ধ বর্ণনা সমূহ যাতে কোন আপত্তি নেই, একথা প্রমাণ করে যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরা ফাতিহার অংশ নয়’। এটি সূরা নমলের ৩০তম আয়াত মাত্র। এ বিষয়ে ছহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য’। [18]
(১) আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন,
অর্থ : আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছি। কিন্তু তাঁদের কাউকে ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে পড়তে শুনিনি’। [19]
(২) দারাকুৎনী বলেন, ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে বলার বিষয়ে কোন হাদীছ ‘ছহীহ’ প্রমাণিত হয়নি। [20]
(৩) তবে ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে সবল-দুর্বল মিলে প্রায় ১৪টি হাদীছের প্রতি লক্ষ্য রেখে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হয়তোবা কখনো কখনো ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে বলে থাকবেন। তবে অধিকাংশ সময় তিনি চুপে চুপেই পড়তেন। এটা নিশ্চিত যে, তিনি সর্বদা জোরে পড়তেন না। যদি তাই পড়তেন, তাহ’লে ছাহাবায়ে কেরাম, খুলাফায়ে রাশেদ্বীন, শহরবাসী ও সাধারণ মুছল্লীদের নিকটে বিষয়টি গোপন থাকত না’।.... অতঃপর বর্ণিত হাদীছগুলি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলির মধ্যে যেগুলি ছহীহ, সেগুলির বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং স্পষ্টগুলি ছহীহ নয়’।[21]
দলীলের উৎসঃ
[14] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১১২ পৃঃ ; নায়ল ৩/৩৬-৩৯ পৃঃ।
[15] . নায়লুল আওত্বার ৩/৫২ পৃঃ। বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : নায়ল ৩/৩৯-৫২।
[16] . নায়লুল আওত্বার ৩/৪৬ পৃঃ।
[17] . আবুদাঊদ হা/৭৮৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১২৫।
[18] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৩ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; তাফসীরে কুরতুবী মুক্বাদ্দামা, ‘বিসমিল্লাহ’ অংশ দ্রষ্টব্য।
[19] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা (বৈরূত : ১৩৯১/১৯৭১), হা/৪৯৪-৯৬; আহমাদ, মুসলিম, নায়ল ৩/৩৯; দারাকুৎনী হা/১১৮৬-৯৫; হাদীছ ছহীহ।
[20] . নায়লুল আওত্বার ৩/৪৬ পৃঃ ।
[21] . যা-দুল মা‘আ-দ ১/১৯৯-২০০ পৃঃ ; নায়ল ৩/৪৭ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০২ পৃঃ।
৫. (ক ও খ) সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার দলীল সমূহ ও বিরোধীদের দলীলসমূহ ও তার জওয়াবঃ
৫. (ক) সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার দলীল সমূহ-
ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য সকল প্রকার ছালাতে প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। প্রধান দলীল সমূহ :
(১) হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, (‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’। [22]
(২) ছালাতে ভুলকারী জনৈক ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অতঃপর তুমি ‘উম্মুল কুরআন’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পড়বে এবং যেটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন কুরআন থেকে পাঠ করবে’...। [23]
(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আদিষ্ট হয়েছিলাম যেন আমরা সূরায়ে ফাতিহা পড়ি এবং (কুরআন থেকে) যা সহজ মনে হয় (তা পড়ি)’।[24]
(৪) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে নির্দেশ দেন যেন আমি এই কথা ঘোষণা করে দেই যে, ছালাত সিদ্ধ নয় সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। অতঃপর অতিরিক্ত কিছু’।[25] এখানে প্রথমে সূরায়ে ফাতিহা, অতঃপর কুরআন থেকে যা সহজ মনে হয়, সেখান থেকে অতিরিক্ত কিছু পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(৫) আল্লাহ বলেন, (‘ওয়া এযা কুরিয়াল কুরআ-নু ফাসতামি‘ঊ লাহূ ওয়া আনছিতূ’)। অর্থ : ‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর ও চুপ থাক’... (আ‘রাফ ৭/২০৪)।
আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা কি ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে না। বরং কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পাঠ করবে’।[26]
(৬) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করল, যার মধ্যে ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করল না, তার ঐ ছালাত বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, অপূর্ণাঙ্গ’...। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) -কে বলা হ’ল, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি, তখন কিভাবে পড়ব? তিনি বললেন, إقْرَأْ بِهَا فِيْ نَفْسِكَ (ইক্বরা’ বিহা ফী নাফসিকা) ‘তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। তাছাড়া উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অর্ধেক করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে وَلِعَبْدِيْ مَا سَأَلَ ‘আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’।[27] ইমাম ও মুক্তাদী উভয়েই আল্লাহর বান্দা। অতএব উভয়ে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর সর্বোত্তম হেদায়াত প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ আমাদেরকে যেদিকে পথনির্দেশ দান করেছেন।
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১ম ভাগে আলহামদু... থেকে প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং ২য় ভাগে ইহ্দিনাছ... থেকে শেষের তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনা এবং ইইয়াকা না‘বুদু...-কে মধ্যবর্তী আয়াত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিভক্ত। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ-কে শামিল করা হয়নি। ফলে অত্র হাদীছ অনুযায়ী বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ নয়।
‘খিদাজ’ (خِدَاجٌ) অর্থ : সময় আসার পূর্বেই যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, যদিও সে পূর্ণাংগ হয় (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আরবরা ঐ বাচ্চাকে ‘খিদাজ’ বলে, যা রক্তপিন্ড আকারে অসময়ে গর্ভচ্যুত হয় ও যার আকৃতি চেনা যায় না’। আবু ওবায়েদ বলেন, ‘খিদাজ’ হ’ল গর্ভচ্যুত মৃত সন্তান, যা কাজে আসে না’। [28] অতএব সূরায়ে ফাতিহা বিহীন ছালাত প্রাণহীন অপূর্ণাংগ বাচ্চার ন্যায়, যা কোন কাজে লাগে না।
(৭) হযরত ওবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, আমরা একদা ফজরের জামা‘আতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাত রত ছিলাম। এমন সময় মুক্তাদীদের কেউ সরবে কিছু পাঠ করলে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ক্বিরাআত কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সালাম ফিরানোর পরে তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু পড়ে থাকবে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এরূপ করো না কেবল সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। কেননা ছালাত সিদ্ধ হয় না যে ব্যক্তি ওটা পাঠ করে না’।[29]
ঘটনা এই যে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাথে অনেকে ইমামের পিছনে সরবে ক্বিরাআত করত। অনেকে প্রয়োজনীয় কথাও বলত। তাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন ঘটতো। তাছাড়া মুশরিকরাও রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন পাঠের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে শিস দিত ও হাততালি দিয়ে বিঘ্ন ঘটাতো। সেকারণ উপরোক্ত আয়াত (আ‘রাফ ৭/২০৪) নাযিলের মাধ্যমে সকলকে কুরআন পাঠের সময় চুপ থাকতে ও তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে আদেশ করা হয়েছে।[30] এই নির্দেশ ছালাতের মধ্যে ও বাইরে সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। অতঃপর পূর্বোক্ত উবাদাহ, আবু হুরায়রা ও আনাস (রাঃ) প্রমুখ বর্ণিত হাদীছ সমূহের মাধ্যমে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা নীরবে পড়তে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্য কোন সূরা নয়।
অতএব উক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহ পূর্বোক্ত কুরআনী আয়াতের (আ‘রাফ ৭/২০৪) ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে, বিরোধী হিসাবে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট, তাঁর নিজের পক্ষ থেকে নয়। অতএব অহি-র বিধান অনুসরণে সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।
৫. (খ) বিরোধীদের দলীলসমূহ ও তার জওয়াব
ইমামের পিছনে জেহরী বা সের্রী কোন প্রকার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা যাবে না -এই মর্মে যাঁরা অভিমত পোষণ করেন, তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) সূরা আ‘রাফ ২০৪ আয়াতে ক্বিরাআতের সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে বলা হয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন সূরাকে ‘খাছ’ করা হয়নি। এক্ষণে হাদীছ দ্বারা সূরায়ে ফাতিহাকে খাছ করলে তা কুরআনী আয়াতকে ‘মনসূখ’ বা হুকুম রহিত করার শামিল হবে। অথচ ‘হাদীছ দ্বারা কুরআনী হুকুমকে মানসূখ করা যায় না’। [31]
জবাব : এখানে ‘মনসূখ’ হবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং হাদীছে ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মধ্য থেকে উম্মুল কুরআনকে ‘খাছ’ করা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)। যেমন কুরআনে সকল উম্মতকে লক্ষ্য করে ‘মীরাছ’ বণ্টনের সাধারণ আদেশ দেওয়া হয়েছে (নিসা ৪/৭,১১)। কিন্তু হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানগণ পাবেন না বলে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[32]
মূলতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটেছিল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী হিসাবে[33] এবং ঐ ব্যাখ্যাও ছিল সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট।[34] অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করা ‘অহিয়ে গায়ের মাতলু’ বা আল্লাহর অনাবৃত্ত অহি-কে প্রত্যাখ্যান করার শামিল হবে।
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক জেহরী ছালাতে সালাম ফিরিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এইমাত্র আমার সাথে কুরআন পাঠ করেছ? একজন বলল, জি-হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাই বলি, مَا لِيْ أُنَازِعُ القُرْآنَ ‘আমার ক্বিরাআতে কেন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে’? রাবী বলেন, ‘এরপর থেকে লোকেরা জেহরী ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হ’ল’।[35]
জবাব : হাদীছের বক্তব্যে বুঝা যায় যে, মুক্তাদীগণের মধ্যে কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাথে সরবে ক্বিরাআত করেছিলেন। যার জন্য ইমাম হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিপূর্বে আনাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দু’টিতে নীরবে পড়ার কথা এসেছে, যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘জেহরী ছালাতে মুক্তাদী এমনভাবে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে, যাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়’।[36] অতএব নীরবে ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পড়লে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ্য যে, হাদীছের শেষাংশে ‘অতঃপর লোকেরা ক্বিরাআত থেকে বিরত হ’ল’ কথাটি ‘মুদরাজ’ (مدرج), যা সনদভুক্ত অন্যতম বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী কর্তৃক সংযুক্ত। শিষ্য সুফিয়ান বিন ‘উয়ায়না বলেন, যুহরী (এ বিষয়ে) এমন কথা বলেছেন, যা আমি কখনো শুনিনি’। [37]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ইমাম নিযুক্ত হন তাকে অনুসরণ করার জন্য। তিনি যখন তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বল। তিনি যখন ক্বিরাআত করেন, তখন তোমরা চুপ থাক’। [38]
জবাব : উক্ত হাদীছে ‘আম’ ভাবে ক্বিরাআতের সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে। কুরআনেও অনুরূপ নির্দেশ এসেছে (আ‘রাফ ৭/২০৪)। একই রাবীর (আবু হুরায়রা) ইতিপূর্বেকার বর্ণনায় এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে সূরায়ে ফাতিহাকে ‘খাছ’ ভাবে চুপে চুপে পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করলে উভয় ছহীহ হাদীছের উপরে আমল করা সম্ভব হয়।
(৪) হযরত জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের ক্বিরাআত তার জন্য ক্বিরাআত হবে’।[39]
জবাব : (ক) ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, যতগুলি সূত্র থেকে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে সকল সূত্রই দোষযুক্ত। সেকারণ ‘হাদীছটি সকল বিদ্বানের নিকটে সর্বসম্মতভাবে যঈফ ।[40]
(খ) অত্র হাদীছে ‘ক্বিরাআত’ কথাটি ‘আম’। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহা পাঠের নির্দেশটি ‘খাছ’। অতএব অন্য সব সূরা বাদ দিয়ে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
(৫) (‘লা ছালা-তা ইল্লা বি ফা-তিহাতিল কিতাব’) বা ‘সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত ছালাত নয়’ [41] অর্থ ‘ছালাত পূর্ণাংগ নয়’ (لاَ صَلاَةَ بِالكَمَالِ) । যেমন অন্য হাদীছে রয়েছে, (‘লা ঈমা-না লিমান লা আমা-নাতা লাহূ, ওয়ালা দ্বীনা লিমান লা ‘আহ্দা লাহূ’) ‘ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানত নেই এবং ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই’[42] অর্থ ঐ ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ নয়, বরং ত্রুটিপূর্ণ।
জবাব : (ক) কুতুবে সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত উপরোক্ত মর্মের প্রসিদ্ধ হাদীছটি একই রাবী হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে দারাকুৎনীতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যার মধ্যে মুছল্লী সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’।[43] অতএব উক্ত হাদীছে ‘ছালাত নয়’ অর্থ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’।
(খ) অনুরূপভাবে’ ‘খিদাজ’ বা ত্রুটিপূর্ণ- এর ব্যাখ্যায় ইবনু খুযায়মা স্বীয় ‘ছহীহ’ গ্রন্থে ‘ছালাত’ অধ্যায়ে ৯৫ নং দীর্ঘ অনুচ্ছেদ রচনা করেন এভাবে যে,
‘ঐ ‘খিদাজ’-এর আলোচনা যে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) অত্র হাদীছে হুঁশিয়ার করেছেন যে, ঐ ত্রুটি থাকলে ছালাত সিদ্ধ হবে না। কেননা ত্রুটি দু’প্রকারেরঃ এক- যা থাকলে ছালাত সিদ্ধ হয় না। দুই- যা থাকলেও ছালাত সিদ্ধ হয়। পুনরায় পড়তে হয় না। এই ত্রুটি হ’লে ‘সিজদায়ে সহো’ দিতে হয় না। অথচ ছালাত সিদ্ধ হয়ে যায়’।
অতঃপর তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর হাদীছ উদ্ধৃত করেন যে, ছালাত সিদ্ধ নয়, যাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা হয় না’.....। [44]
এক্ষণে ‘লা ছালা-তা বা ‘ছালাত নয়’-এর অর্থ যখন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘লা তুজযিউ’ অর্থাৎ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’ বলে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তখন সেখানে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। অতএব ‘খিদাজ’ অর্থ ‘অপূর্ণাঙ্গ’ করাটা অন্যায়। বরং এটি ‘ক্রটিপূর্ণ’। আর ত্রুটিপূর্ণ ছালাত প্রকৃত অর্থে কোন ছালাত নয়।
অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ, অধিকাংশ ছাহাবী ও তাবেঈন এবং ইমাম মালেক, শাফেঈ ও আহমাদ সহ অধিকাংশ মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত ও নিয়মিত আমলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সর্বাবস্থায় সকল ছালাতে সূরায়ে ফাতেহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য। নইলে অহেতুক যিদ কিংবা ব্যক্তি ও দলপূজার পরিণামে সারা জীবন ছালাত আদায় করেও ক্বিয়ামতের দিন স্রেফ আফসোস ব্যতীত কিছুই জুটবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে ও সকলে আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক সমূহ ছিন্ন হবে’। ‘যেদিন অনুসারীগণ বলবে, যদি আমাদের আরেকবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন আজ তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমনিভাবে আল্লাহ সেদিন তাদের সকল আমলকে তাদের জন্য ‘আফসোস’ হিসাবে দেখাবেন। অথচ তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৬-৬৭)।
দলীলের উৎসঃ
[22] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২২ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; কুতুবে সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে উক্ত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।
[23] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৮০৪; আবুদাঊদ হা/৮৫৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১৪৯।
24] . আবুদাঊদ হা/৮১৮।
[25] . আবুদাঊদ হা/৮২০।
 [26] . বুখারী, জুয্উল ক্বিরাআত; ত্বাবারাণী আওসাত্ব, বায়হাক্বী, ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৮৪৪; হাদীছ ছহীহ- আরনাঊত্ব; তুহফাতুল আহওয়াযী, ‘ইমামের পিছনে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-২২৯, হা/৩১০-এর ভাষ্য (فالطريقان محفوظان) , ২/২২৮ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ২/৬৭ পৃঃ, ‘মুক্তাদীর ক্বিরাআত ও চুপ থাকা’ অনুচ্ছেদ।
[27] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৩, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; নায়ল ৩/৫১-৫২।
[28] . তিরমিযী (তুহফা সহ) হা/২৪৭-এর ভাষ্য ২/৬১ পৃঃ; আবুদাঊদ (আওন সহ) হা/৮০৬-এর ভাষ্য, ৩/৩৮ পৃঃ ।
[29] . তিরমিযী (তুহফা সহ) হা/৩১০; মিশকাত হা/৮৫৪, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; আহমাদ হা/২২৭৯৮, সনদ হাসান -আরনাঊত্ব; হাকেম ১/২৩৮, হা/৮৬৯। আলবানী অত্র হাদীছ দ্বারা জেহরী ছালাতে মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করাকে ‘জায়েয’ বলেছেন, কিন্তু ‘ওয়াজিব’ বলেন নি (দ্র: মিশকাত হা/৮৫৪-এর টীকা) । পরবর্তীতে উক্ত হাদীছকে যঈফ বলেছেন (আবুদাঊদ হা/৮২৩)। এমনকি তিনি অন্যত্র জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ ‘মনসূখ’ বলেছেন (ছিফাত ৭৯-৮১)। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী ‘জেহরী ও সের্রী সকল ছালাতে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব’ বলে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (বুখারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৯৫)।
[30] . কুরতুবী, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য, ৭/৩৫৪ পৃঃ।
[31] . নূরুল আনওয়ার ২১৩-১৪ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৭ পৃঃ।
[32] . যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমরা আপনাকে দিয়েছি সাতটি আয়াত (সূরা ফাতিহা), যা পুন: পুন: পঠিত হয় এবং মহান কুরআন’ (হিজর ১৫/৮৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীগণ! কোন উত্তরাধিকারী রাখি না। যা কিছু আমরা রেখে যাই, সবই ছাদাক্বা’। =কানযুল উম্মাল হা/৩৫৬০০; নাসাঈ কুবরা হা/৬৩০৯; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৭৬ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-১০।
[33] . নাহল ১৬/৪৪, ৬৪।
[34] . নাজম ৫৩/৩-৪ وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى, ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ
[35] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী , মিশকাত হা/৮৫৫, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[36] . হুজ্জাতুল্লা-হিল বা-লিগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ ১৩৫৫/১৯৩৬), ২/৯ পৃঃ।
[37] . আবুদাঊদ হা/৮২৭; আওনুল মা‘বূদ হা/৮১১-১২, অনুচ্ছেদ-১৩৫; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৫।
[38] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৮৫৭।
[39] . ইবনু মাজাহ হা/৮৫০; দারাকুৎনী হা/১২২০; বায়হাক্বী ২/১৫৯-৬০ পৃঃ; হাদীছ যঈফ।
[40] . ফাৎহুল বারী ২/২৮৩ পৃঃ, হা/৭৫৬ -এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; নায়লুল আওত্বার ৩/৭০ পৃঃ। আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। অতঃপর ব্যাখ্যায় বলেন যে, হাদীছটির কোন সূত্র দুর্বলতা (ضعف) হ’তে মুক্ত নয়। তবে দুর্বল সূত্র সমূহের সমষ্টি সাক্ষ্য দেয় যে, এর কিছু ভিত্তি আছে (أن للحديث أصلا) (ইরওয়া হা/৫০০, ২/২৭৭)। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যই ইঙ্গিত দেয় যে, হাদীছটি আসলেই যঈফ, যা অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ সর্বসম্মত ভাবে বলেছেন।
[41] . ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, সৈয়ূত্বী, আল-জামে‘উল কাবীর হা/১১৯৪; আলবানী, তামামুল মিন্নাহ পৃঃ ৩২৯।
[42] . বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৩৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, সনদ জাইয়িদ।
[43] . দারাকুৎনী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ ১৪১৭/১৯৯৬) হা/১২১২, ১/৩১৯ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
[44] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৯০, ১/২৪৭-৪৮ পৃঃ সনদ ছহীহ। أجزأ الشيئ فلانا اي كفاه অর্থাৎ ‘এটি তার জন্য যথেষ্ট হয়েছে’ ; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ১১৯-২০ পৃঃ।
৫. (গ) রুকূ পেলে রাক‘আত না পাওয়া
ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহা ব্যতীত কেবলমাত্র রুকূ পেলেই রাক‘আত পাওয়া হবে না। এমতাবস্থায় তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। তবে জমহূর বিদ্বানগণের অভিমত হ’ল এই যে, রুকূ পেলে রাক‘আত পাবে। সূরায়ে ফাতেহা পড়তে পারুক বা না পারুক’। তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ছালাতের এক রাক‘আত পেল, সে ব্যক্তি পূর্ণ ছালাত পেল’।[45]
জবাব : জমহূর বিদ্বানগণ এখানে ‘রাক‘আত’ অর্থ ‘রুকূ’ করেছেন। ইমাম বুখারী বলেন যে, এখানে রাক‘আত বলা হয়েছে। রুকূ, সিজদা বা তাশাহহুদ বলা হয়নি’ (অথচ সবগুলো মিলেই রাক‘আত হয়) (‘আওনুল মা‘বূদ ৩/১৫২)। শামসুল হক আযীমাবাদী বলেন, ‘এখানে কোন কারণ ছাড়াই রাক‘আত অর্থ রুকূ করা হয়েছে যা ঠিক নয়’। যেমন ছহীহ মুসলিমে বারা বিন আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে ‘ক্বিয়াম ও সিজদার বিপরীতে রাক‘আত শব্দ এসেছে। সেখানে রাক‘আত অর্থ রুকূ করা হয়েছে। [46] ‘আব্দুর রহমান সা‘দীও তাই বলেন’ (আল-মুখতারাত, পৃঃ ৪৪) ।
(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর ছালাতের শেষ রাক‘আতে রুকূ পেল, সে যেন আরেক রাক‘আত যোগ করে নেয়। কিন্তু যে ব্যক্তি শেষ রাক‘আতে রুকূ পেল না, সে যেন যোহরের চার রাক‘আত পড়ে।[47]
জবাব : দারাকুৎনী বর্ণিত অত্র হাদীছটি ‘যঈফ’।[48]
(৩) আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে একটি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে। তিনি একাকী রুকূ অবস্থায় পিছন থেকে কাতারে প্রবেশ করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, আল্লাহ তোমার আগ্রহ বৃদ্ধি করুন। তবে আর কখনো এরূপ করো না’।[49]
জবাব : ইবনু হাযম আন্দালুসী ও ইমাম শাওকানী বলেন, এ হাদীছের মধ্যে জমহূরের মতের পক্ষে কোন দলীল নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) তাকে যেমন ঐ রাক‘আত পুনরায় পড়তে বলেননি, তেমনি ঐ ছাহাবী ঐ রাক‘আতটি গণনা করেছিলেন কি-না, সেকথাও বর্ণিত হয়নি।[50]
অন্যান্য বিদ্বানগণ জমহূরের মতের বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, শুধুমাত্র রুকূ পেলেই রাক‘আত পাওয়া হবে না। কেননা সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। যা পরিত্যাগ করলে ছালাত বাতিল হবে ও পুনরায় পড়তে হবে।[51] যেমন ক্বিয়াম, রুকূ, সিজদা ইত্যাদি ফরয, যার কোন একটি বাদ দিলে ছালাত বাতিল হবে ও পুনরায় নতুনভাবে পড়তে হবে।
এক্ষণে যে ব্যক্তি কেবল রুকূ পেল, সে ব্যক্তি ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহার দু’টি ফরয তরক করল। অতএব তার ঐ রাক‘আত গণ্য হবে না। বরং তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। অবশ্য ছালাতে যোগদান করার নেকী তিনি পুরোপুরি পেয়ে যাবেন।
এদের দলীলসমূহ নিম্নরূপ:
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ইক্বামত শুনে তোমরা দৌড়ে যেয়ো না। বরং স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাও। তোমাদের জন্য স্থিরতা অবলম্বন করা আবশ্যক। অতঃপর তোমরা জামা‘আতে ছালাতের যতটুকু পাও, ততটুকু আদায় কর এবং যেটুকু ছুটে যায় সেটুকু পূর্ণ কর’।[52] ইমাম বুখারী বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তি কেবল রুকূ পেয়েছে। কিন্তু ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতেহার দু’টি ফরয পায়নি। অতএব তাকে শেষে এক রাক‘আত যোগ করে ঐ ছুটে যাওয়া ফরয দু’টি পূর্ণ করতে হবে’। [53]
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক একটি ‘মওকূফ’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তোমার জন্য যথেষ্ট হবে না যদি না তুমি ইমামকে দাঁড়ানো অবস্থায় পাও’।[54] হাফেয ইবনু হাজার বলেন, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রুকূ পেলে রাক‘আত না পাওয়ার বিষয়টিই প্রসিদ্ধ।[55]
(৩) তাবেঈ বিদ্বান মুজাহিদ বলেন, সূরায়ে ফাতিহা পড়তে ভুলে গেলে সে রাক‘আত গণনা করা হ’ত না [56]
ইবনু হাযম বলেন, রাক‘আত পূর্ণ হওয়ার জন্য তার উপরে অবশ্য করণীয় হ’ল ক্বিয়াম ও ক্বিরাআত করা। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, রাক‘আত ও অন্য কোন রুকন ছুটে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে ইমামের সাথে যোগদানের সময় কোন রাক‘আত ছুটে গেলে তা যেমন পরে আদায় করতে হয়, অনুরূপভাবে সূরায়ে ফাতিহা ছুটে গেলে সেটাও পরে আদায় করতে হবে। কেননা ওটাও অন্যতম রুকন, যা আদায় করা ফরয। এক্ষণে ‘সূরায়ে ফাতিহা ছুটে গেলেও ছালাত হয়ে যাবে’ বলে যদি দাবী করা হয়, তবে তার জন্য স্পষ্ট ও ছহীহ দলীল প্রয়োজন হবে। অথচ তা পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, কেউ কেউ আগ বেড়ে এ বিষয়ে ইজমা-এর দাবী করেছেন। ঐ ব্যক্তি ঐ বিষয়ে মিথ্যাবাদী। কেননা আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সূরায়ে ফাতিহা পড়তে না পারলে ঐ রাক‘আত গণনা করতেন না’। অমনিভাব যায়েদ বিন ওয়াহাব থেকেও বর্ণিত হয়েছে। [57]
ইমাম শাওকানী বলেন, ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য সর্বাবস্থায় প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ‘ফরয’। বরং এটি ছালাত সিদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত। অতএব যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, এটা ছাড়াই ছালাত সিদ্ধ হবে, তাকে এমন স্পষ্ট দলীল পেশ করতে হবে, যা পূর্বে বর্ণিত না সূচক ‘আম’ দলীলগুলিকে ‘খাছ’ করতে পারে’। [58]
উপসংহার : উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র রুকূ পেলে রাক‘আত হবেনা। বরং তাকে আরেক রাক‘আত যোগ করে পড়তে হবে। এটা বলা যেতে পারে যে, যেখানে রুকূ পেলে রাক‘আত পাওয়ার স্পষ্ট দলীল নেই এবং যেখানে আরেক রাক‘আত যোগ করার ব্যাপারে ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে, সেখানে অন্য কারো বক্তব্য তালাশ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এরপরেও ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম শাওকানী ও তাঁদের সমমনা বিদ্বানগণকে বাদ দিলে জমহূর বিদ্বানগণ বলতে আর কাদের বুঝানো হবে, সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়।
* বিষয়টি নিয়ে মতভেদ আছে এবং আমাদের দেশের অধিকাংশ সহীহ আলেম মনে করেন যে, যদি কোন ব্যাক্তি রুকু পেল তবে সে ঐ রাকাত পেল, আল্লাহই ভালো জানেন ।
দলীলের উৎসঃ
[46] . মুসলিম হা/১০৮৫, ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮; আবুদাঊদ (আওন সহ), অনুচ্ছেদ-১৫২, হা/৮৭৫, ৩/১৪৫ পৃঃ।
[47] . দারাকুৎনী হা/১৫৮৭ ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর এক রাক‘আত পেল কিংবা পেল না’ অনুচ্ছেদ।
 [48] . দারাকুৎনী হা/১৫৮৭; হাদীছ ‘যঈফ’, টীকা দ্র:।
[49] . আবুদাঊদ (‘আওন সহ) হা/৬৬৯-৭০; আবুদাঊদ হা/৬৮৩-৮৪, অনুচ্ছেদ-১০১।
[50] . ‘আওনুল মা‘বূদ ৩/১৪৬ পৃঃ, হা/৮৭৫ -এর ব্যাখ্যা।
[51] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা (বৈরূত: ১৩৯১/১৯৭১; ১ম সংস্করণ, তাহক্বীক্ব: ড. মুহাম্মাদ মুছতফা আল-আ‘যামী), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ- ৯৩ ও ৯৪, ১/২৪৬-৪৭ পৃঃ।
[52] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৬, ‘আযান দেরীতে দেওয়া’ অনুচ্ছেদ-৬।
[53] . বুখারী, জুয্উল ক্বিরাআত, মাসআলা-১০৬, পৃঃ ৪৬; ‘আওনুল মা‘বূদ হা/৮৭৫-এর ব্যাখ্যা ৩/১৫২ পৃঃ।
[54] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৯-এর আলোচনার শেষে দ্রষ্টব্য।
[55] . শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৩/৬৯।
[56] . বুখারী, জুয্উল ক্বিরাআত, হা/২৮, পৃঃ ১৩।
[57] . নায়লুল আওত্বার ৩/৬৯ পৃঃ।
[58] . নায়লুল আওত্বার ৩/৬৭-৬৮ পৃঃ।
ক্বিরাআতের আদব
(১) সূরায়ে ফাতিহার প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করা সুন্নাত।[59] অমনিভাবে ক্বিরাআত সুন্দর আওয়াযে পড়ার নির্দেশ রয়েছে।[60] কিন্তু গানের সুরে পড়া যাবে না।[61] কোনরূপ ‘তাকাল্লুফ’ বা ভান করা যারে না। বরং স্বাভাবিক সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করাই শরী‘আতে পসন্দনীয়। ‘ছানা’ পড়ার জন্য ক্বিরাআতের শুরুতে ‘সাকতা’ করা অর্থাৎ সামান্য বিরতি দেওয়া সুন্নাত।[62] ১ম রাক‘আতের ক্বিরাআত কিছুটা দীর্ঘ হওয়া বাঞ্ছনীয়। [63] অমনিভাবে কুরআনের শুরুর দিক থেকে শেষের দিকে ক্বিরাআত করা ভাল। তবে আগপিছ হ’লে দোষ নেই। এমনকি একই সূরা পরপর দুই রাক‘আতে পড়া চলে।[64]
(২) জেহরী ছালাতে প্রথম দু’রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠের পর ইমাম হ’লে যেকোন সূরা পাঠ করবে। আর মুক্তাদী হ’লে সূরা ফাতিহা পড়ার পর [65] আর কিছুই না পড়ে কেবল ইমামের ক্বিরাআত মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তবে যোহর ও আছরের ছালাতে ইমাম-মুক্তাদী সকলে সূরায়ে ফাতিহা সহ অন্য সূরা পড়বে এবং ৩য় ও ৪র্থ রাক‘আতে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়বে। যেমন আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যোহরের প্রথম দু’রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা ও অন্য দু’টি সূরা পড়তেন এবং শেষের দু’রাক‘আতে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়তেন। ... অনুরূপ করতেন আছরে ...’।[66] শেষের দু’রাক‘আতেও কোন কোন ছাহাবী সূরা মিলাতেন বলে জানা যায়।[67]
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকল ছালাতে সময় ও সুযোগ মত ক্বিরাআত দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত করতেন। তিনি
(ক) ফজরের ১ম রাক‘আতে অধিকাংশ সময় ক্বিরাআত দীর্ঘ করতেন এবং ‘ক্বাফ’ হ’তে ‘মুরসালাত’ পর্যন্ত ‘দীর্ঘ বিস্তৃত’ (طوال المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন। কখনো ‘নাবা’ হ’তে ‘লাইল’ পর্যন্ত ‘মধ্যম বিস্তৃত’ (أوساط المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে এবং কখনো ‘যোহা’ হ’তে ‘নাস’ পর্যন্ত ‘স্বল্প বিস্তৃত’ (قصار المفصَّل) সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন [68]
(খ) তিনি যোহর ও আছরের প্রথম দু’রাক‘আত দীর্ঘ করতেন এবং শেষের দু’রাক‘আত সংক্ষেপ করতেন। তিনি মাগরিবের ছালাতে ‘স্বল্প বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে, এশার ছালাতে ‘মধ্যম বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে এবং ফজরের ছালাতে ‘দীর্ঘ বিস্তৃত’ সূরা সমূহ হ’তে পাঠ করতেন। কখনো এর বিপরীত করতেন।
(গ) কখনো তিনি একই রাক‘আতে পরপর দু’টি বা ততোধিক সূরা পড়েছেন
(ঘ) কখনো একই সূরা পরপর দু’রাক‘আতে পড়েছেন
(ঙ) তিনি ফজরের দু’রাক‘আতে কখনো সূরা কাফেরূণ ও ইখলাছ এবং কখনো ফালাক্ব ও নাস পাঠ করেছেন
(চ) ১ম রাক‘আতে তিনি ক্বিরাআত দীর্ঘ এবং ২য় রাক‘আতে সংক্ষেপ করতেন। তবে কখনো কখনো ব্যতিক্রম হ’ত
(ছ) তিনি ছালাতের প্রতি ক্বিরাআতের শুরুতে সূরা ইখলাছ পাঠকারীর প্রশংসা করেছেন
(জ) তিনি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন যে, এর কমে হ’লে সে কুরআনের কিছুই বুঝবে না
(ঝ) তাঁর রাক‘আত, ক্বিরাআত ও সিজদা সর্বদা প্রথম থেকে শেষের দিকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত হ’ত। [69]
দলীলের উৎসঃ
[59] .দারাকুৎনী হা/১১৭৮, তিরমিযী, মিশকাত হা/২২০৫ ‘কুরআনের ফযীলত’ অধ্যায়-৮, ‘তেলাওয়াতের আদব’ অনুচ্ছেদ-১ ; নায়ল ৩/৪৯-৫০ পৃঃ।
[60] . আহমাদ, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মিশকাত হা/২১৯৯, ২২০৮।
[61] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২১৯২।
[62] . নাসাঈ হা/৮৯৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮১২, অনুচ্ছেদ-১১। দুই সাকতা সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৮১৮)।
[63] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৮ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; নায়ল ৩/৭৬।
[64] . বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি; নায়লুল আওত্বার ৩/৮০-৮২ পৃঃ ‘প্রতি রাক‘আতে দু’টি সূরা পড়া ও তারতীব‘ অনুচ্ছেদ; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৮৬২, অনুচ্ছেদ-১২।
[65] . ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩ ‘ছালাতে দাঁড়ানো’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-১১।
[66] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৮, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; নায়ল ৩/৭৬, ৪/২৪ পৃঃ।
[67] . মুওয়াত্ত্বা হা/২৬০; মির‘আত ১/৬০০ পৃঃ ; ঐ, ৩/১৩১ পৃঃ।
[68] . (১) কুরআনের প্রথম দিকের ৭টি বড় সূরাকে ‘দীর্ঘ সপ্তক’ (السبع الطوال) বলা হয়। সেগুলি হ’ল যথাক্রমে সূরা বাক্বারাহ, আলে ইমরান, নিসা, মায়েদাহ, আন‘আম, আ‘রাফ ও তওবাহ। কোন কোন বিদ্বান আনফাল ও তওবাহকে একত্রে একটি সূরা হিসাবে গণ্য করেছেন (২) ক্বাফ হ’তে মুরসালাত পর্যন্ত ২৮টি সূরাকে ‘দীর্ঘ বিস্তৃত’ (طوال المفصَّل), (৩) ‘নাবা’ হ’তে ‘লাইল’ পর্যন্ত ১৫টি সূরাকে ‘মধ্যম বিস্তৃত’ (أوساط المفصَّل), এবং (৪) ‘যোহা’ হ’তে ‘নাস’ পর্যন্ত ২২টি সূরাকে ‘স্বল্প বিস্তৃত’ (قصار المفصَّل) সূরা বলা হয়। বাকী গুলিকে সাধারণ সূরা হিসাবে গণ্য করা হয়।
[69] . মুসলিম, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮৪২, ৮৪৮; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৮, ৮২৯, ৮৫৩; আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী পৃঃ ৮৯-১০২, ১৩৭
৬. সশব্দে আমীন
জেহরী ছালাতে ইমামের সূরায়ে ফাতিহা পাঠ শেষে ইমাম-মুক্তাদী সকলে সরবে ‘আমীন’ বলবে। ইমামের আগে নয় বরং ইমামের ‘আমীন’ বলার সাথে সাথে মুক্তাদীর ‘আমীন’ বলা ভাল। তাতে ইমামের পিছে পিছে মুক্তাদীর সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা সম্ভব হয় এবং ইমাম, মুক্তাদী ও ফেরেশতাদের ‘আমীন’ সম্মিলিতভাবে হয়। যেমন এরশাদ হয়েছে,
কুতুবে সিত্তাহ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছগুলির সারকথা হ’ল এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন ইমাম ‘আমীন’ বলে কিংবা ‘ওয়ালায্ যা-ল্লীন’ পাঠ শেষ করে, তখন তোমরা সকলে ‘আমীন’ বল। কেননা যার ‘আমীন’ আসমানে ফেরেশতাদের ‘আমীন’-এর সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করা হবে’। [70] ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘গায়রিল মাগযূবে ‘আলাইহিম ওয়ালায্ যা-ল্লীন’ বলার পরে তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে আমীন বলতে শুনলাম’। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে। [71]
‘আমীন’ অর্থ : اَللَّهُمَّ اسْتَجِبْ ‘হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর’। ‘আমীন’ (آمِيْن)-এর আলিফ -এর উপরে ‘মাদ্দ’ বা ‘খাড়া যবর’ দুটিই পড়া জায়েয আছে। [72] নাফে‘ বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) কখনো ‘আমীন’ বলা ছাড়তেন না এবং তিনি এব্যাপারে সবাইকে উৎসাহ দিতেন’। আত্বা বলেন, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) সরবে ‘আমীন’ বলতেন। তাঁর সাথে মুক্তাদীদের ‘আমীন’-এর আওয়াযে মসজিদ গুঞ্জরিত হয়ে উঠত’ (حَتَّى إِنَّ لِلْمَسْجِدِ لَلَجَّةً)।[73]
এক্ষণে যদি কোন ইমাম ‘আমীন’ না বলেন, কিংবা নীরবে বলেন, তবুও মুক্তাদী সরবে ‘আমীন’ বলবেন।[74] অনুরূপভাবে যদি কেউ জেহরী ছালাতে ‘আমীন’ বলার সময় জামা‘আতে যোগদান করেন, তবে তিনি প্রথমে সরবে ‘আমীন’ বলে নিবেন ও পরে নীরবে সূরায়ে ফাতিহা পড়বেন। ইমাম ঐ সময় পরবর্তী ক্বিরাআত শুরু করা থেকে কিছু সময় বিরতি দিবেন। যাতে সূরা ফাতিহা ও পরবর্তী আমীন ও ক্বিরাআতের মধ্যে পার্থক্য বুঝা যায়। উল্লেখ্য যে, এ সময় মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ করা এবং সেই সময় পরিমাণ ইমামের চুপ থাকার কোন দলীল নেই।[75] ‘আমীন’ শুনে কারু গোস্বা হওয়া উচিৎ নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,
‘ইহুদীরা তোমাদের সবচেয়ে বেশী হিংসা করে তোমাদের ‘সালাম’ ও ‘আমীন’ -এর কারণে’। [76] কারণ এই সাথে ফেরেশতারাও ‘আমীন’ বলেন। ফলে তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ‘আমীন’ বলার পক্ষে ১৭টি হাদীছ এসেছে।[77] যার মধ্যে ‘আমীন’ আস্তে বলার পক্ষে শো‘বা থেকে একটি রেওয়ায়াত আহমাদ ও দারাকুৎনীতে এসেছে أو أَخْفَي بِهَا صَوْتَهُ خَفَضَ বলে। যার অর্থ ‘আমীন’ বলার সময় রাসূল (ছাঃ)-এর আওয়ায নিম্নস্বরে হ’ত’। একই রেওয়ায়াত সুফিয়ান ছাওরী থেকে এসেছে رَفَعَ بِهَا صَوْتَهُ বলে। যার অর্থ- ‘তাঁর আওয়ায উচ্চৈঃস্বরে হ’ত’। হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণের নিকটে শো‘বা থেকে বর্ণিত নিম্নস্বরে ‘আমীন’ বলার হাদীছটি ‘মুযত্বারিব’ (مضطرب)। অর্থাৎ যার সনদ ও মতনে নাম ও শব্দগত ভুল থাকার কারণে ‘যঈফ’। পক্ষান্তরে সুফিয়ান ছওরী (রাঃ) বর্ণিত সরবে আমীন বলার হাদীছটি এসব ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়ার কারণে ‘ছহীহ’।[78] অতএব বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে বর্ণিত জেহরী ছালাতে সশব্দে ‘আমীন’ বলার বিশুদ্ধ সুন্নাতের উপরে আমল করাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য। তাছাড়া ইমামের সশব্দে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ শেষে ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনার সাথে মুক্তাদীগণের নীরবে সমর্থন দান কিছুটা বিসদৃশ বৈ-কি!
দলীলের উৎসঃ
[70] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৫, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; মুওয়াত্ত্বা (মুলতান, পাকিস্তান ১৪০৭/১৯৮৬) হা/৪৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়, পৃঃ ৫২।
[71] . দারাকুৎনী হা/১২৫৩-৫৫, ৫৭, ৫৯; আবুদাঊদ, তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৮৪৫।
[72] . মুনযেরী, ছহীহ আত-তারগীব হা/৫১১, হাশিয়া আলবানী, ১/২৭৮ পৃঃ ।
[73] . বুখারী তা‘লীক্ব ১/১০৭ পৃঃ, হা/৭৮০; ফাৎহুল বারী হা/৭৮০-৮১ ‘সশব্দে আমীন বলা’ অনুচ্ছেদ-১১১।
[74] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৫৭৫, অনুচ্ছেদ-১৩৯।
[75] . তিরমিযী, আবুদাঊদ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৮১৮ -এর টীকা-আলবানী, ‘তাকবীরের পর যা পড়তে হয়’ অনুচ্ছেদ-১১; দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী ৭ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০৪, প্রশ্নোত্তর: ৪০/৪০০, পৃঃ ৫৫-৫৬ ।
[76] . আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/৮৫৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫১২।
[77] . আর-রাওযাতুন নাদিইয়াহ ১/২৭১।
[78] . দারাকুৎনী হা/১২৫৬-এর ভাষ্য, আর-রাওযাতুন নাদিইয়াহ ১/২৭২; নায়লুল আওত্বার ৩/৭৫।
৭. রুকূ
‘রুকূ’ অর্থ ‘মাথা ঝুঁকানো’ (الإنحناء)। পারিভাষিক অর্থ, শারঈ তরীকায় আল্লাহর সম্মুখে মাথা ঝুঁকানো’। ক্বিরাআত শেষে মহাপ্রভু আল্লাহর সম্মুখে সশ্রদ্ধচিত্তে মাথা ও পিঠ ঝুঁকিয়ে রুকূতে যেতে হয়। রুকূতে যাওয়ার সময় ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে তাকবীরের সাথে দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত সোজাভাবে উঠাবে। অতঃপর দুই হাতের আঙ্গুল খোলা রেখে দুই হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে রুকূ করবে। রুকূর সময় পিঠ ও মাথা সোজা ও সমান্তরাল রাখবে। হাঁটু ও কনুই সোজা থাকবে। অতঃপর সিজদার স্থান বরাবর নযর স্থির রেখে[79] সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা ও নিজের ক্ষমা প্রার্থনায় মনোনিবেশ করে দো‘আ পড়তে থাকবে। রুকূ ও সিজদার জন্য হাদীছে অনেকগুলি দো‘আ এসেছে। তন্মধ্যে রুকূর জন্য سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمِ (সুবহা-না রব্বিয়াল ‘আযীম) ‘মহা পবিত্র আমার প্রতিপালক যিনি মহান’ এবং সিজদার জন্য سُبْحَانَ رَبِّىَ الْأَعْلَى ( সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা) ‘মহা পবিত্র আমার প্রতিপালক যিনি সর্বোচ্চ’[80] সর্বাধিক প্রচলিত। এ দু’টি দো‘আ তিনবার পড়বে। বেশির কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট নেই। [81] ঊর্ধ্বে দশবার পড়ার হাদীছ ‘যঈফ’।[82] তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জীবনের শেষদিকে এসে রুকূ ও সিজদাতে এমনকি ছালাতের বাইরে অধিকাংশ সময় নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তেন।-
 (সুবহ-নাকা আল্লা-হুম্মা রব্বানা ওয়া বিহাম্দিকা, আল্লা-হুম্মাগ্ফিরলী) ‘হে আল্লাহ হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার প্রশংসার সাথে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন! [83]
উল্লেখিত দোয়া ছাড়াও হাদিসে বর্ণিত আরো অনেক দোয়া আছে। দোয়াগুলো ইমাম ধীরস্থিরভাবে ছালাত আদায় করলে যতটুকু দোয়া পড়া যায় পড়বেন। না হলে একাকী ছালাত আদায়কালে দোয়াগুলো পড়বেন।
রুকুর আরো দোয়া জানতে চাইলে নীচে গিয়ে ১নং এ  ক্লিক করুন।
দলীলের উৎসঃ
[79] . বায়হাক্বী, হাকেম, ছিফাত ৬৯ পৃঃ।
[80] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৮৮১।
 [81] . আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৮৮৫; ইবনু মাজাহ হা/৮৮৮; আলবানী, ছিফাত, ১১৩ পৃঃ, ‘রুকূর দো‘আ সমূহ’ অনুচ্ছেদ, টীকা-২ ও ৩।
[82] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮৮০, ৮৮৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রুকূ‘ অনুচ্ছেদ-১৩।
[83] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৭১; নায়লুল আওত্বার ৩/১০৬।
৮. ক্বওমা
রুকূ থেকে উঠে সুস্থির হয়ে দাঁড়ানোকে ‘ক্বওমা’ বলে। ‘ক্বওমা’র সময় দু’হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও ইমাম-মুক্তাদী সকলে বলবে, সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ) অর্থাৎ ‘আল্লাহ শোনেন তার কথা যে তাঁর প্রশংসা করে’। অতঃপর বলবে (রববানা ওয়া লাকাল হাম্দ) অথবা (রববানা লাকাল হাম্দ) অথবা (আল্লা-হুম্মা রববানা লাকাল হাম্দ) ‘হে আল্লাহ হে আমাদের প্রভু! আপনার জন্যই যাবতীয় প্রশংসা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যার কথা ফেরেশতাদের কথার সঙ্গে মিলে যাবে তার বিগত দিনের সকল গোনাহ মাফ করা হবে।[84] অথবা বলবে, (রববানা ওয়া লাকাল হাম্দ হাম্দান কাছীরান ত্বাইয়েবাম মুবা-রাকান ফীহি) ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার জন্য অগণিত প্রশংসা, যা পবিত্র ও বরকতময়’। দো‘আটির ফযীলত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘আমি ৩০-এর অধিক ফেরেশতাকে দেখলাম যে, তারা প্রতিযোগিতা করছে কে এই দো‘আ পাঠকারীর নেকী আগে লিখবে’।[85]
ক্বওমার অন্যান্য দো‘আ সমূহ :
1- رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُّبَارَكًا فِيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى- (مالك والبخاري وابوداؤد)-
2- اَللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَمِلْءَ الْأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ- (مسلم، صفة صلاة النبى  117-119)-
উল্লেখ্য যে, ‘ইয়া রববী লাকাল হামদু কামা ইয়াম্বাগী লিজালা-লি ওয়াজহিকা ওয়া লি ‘আযীমি সুলত্বা-নিকা’ বলে এই সময়ে যে দো‘আ প্রচলিত আছে, তার সনদ যঈফ। [86]
ক্বওমাতে রুকূর ন্যায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দো‘আ পড়তে হয়। কেননা ‘ক্বওমার সময় সুস্থির হয়ে না দাঁড়ালে এবং সিজদা থেকে উঠে সুস্থির ভাবে না বসলে ছালাত সিদ্ধ হবে না।[87] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
‘ঐ ব্যক্তির ছালাত যথার্থ হবে না, যতক্ষণ না সে রুকূ ও সিজদাতে তার পিঠ সোজা রাখে’।[88]
জ্ঞাতব্য : ক্বওমার সময় অনেকে হাত কিছুক্ষণ খাড়াভাবে ধরে রাখেন। কেউ পুনরায় বুকে হাত বাঁধেন। যা ঠিক নয়। এ বিষয়ে ছহীহ হাদীছ সমূহ নিম্নরূপ:
(১) বিখ্যাত ছাহাবী আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) যিনি ১০ জন ছাহাবীর সম্মুখে রাসূলের (ছাঃ) ছালাতের নমুনা প্রদর্শন করে সত্যায়ন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়েছে-
‘তিনি রুকূ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন এমনভাবে যে, মেরুদন্ডের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে আসে’। [89]
(২) ছালাতে ভুলকারী (مسيئ الصلاة) জনৈক ব্যক্তিকে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক হাতে-কলমে ছালাত শিখানোর প্রসিদ্ধ হাদীছে এসেছে ‘যতক্ষণ না অস্থি সমূহ স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসে’।[90] ওয়ায়েল বিন হুজ্র ও সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বর্ণিত ‘ছালাতে বাম হাতের উপরে ডান হাত রাখার ‘আম’ হাদীছের[91] উপরে ভিত্তি করে রুকূর আগে ও পরে ক্বওমা-র সময় বুকে হাত বাঁধার কথা বলা হয়।[92] কিন্তু উপরোক্ত হাদীছগুলি রুকূ পরবর্তী ‘ক্বওমা’র অবস্থা সম্পর্কে ‘খাছ’ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বুকে হাত বাঁধার বিষয়টি হাতের স্বাভাবিক অবস্থার পরিপন্থী। এক্ষণে শিরদাঁড়া সহ দেহের অন্যান্য অস্থি সমূহকে স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসতে গেলে ক্বওমার সময় হাতকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেওয়াটাই ছহীহ হাদীছ সমূহের যথাযথ অনুসরণ বলে অনুমিত হয়। [93] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
দলীলের উৎসঃ
[84] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৭৪-৭৭; বুখারী হা/৭৩২-৩৫, ৭৩৮; মুসলিম হা/৮৬৮, ৯০৪, ৯১৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়; ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, ১১৭-১৯ পৃঃ।
[85] . বুখারী, মিশকাত হা/৮৭৭, ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ-১৩।
[86] . ইবনু মাজাহ হা/৩৮০১; যঈফুল জামে‘ হা/১৮৭৭।
[87] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৯০ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১২১।
[88] . আবুদাঊদ, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/৮৭৮, আবু মাস‘ঊদ আনছারী (রাঃ) হ’তে; নায়ল ৩/১১৩-১৪ পৃঃ।
[89] . বুখারী, মিশকাত হা/৭৯২।
[90] . তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮০৪।
[91] . মুসলিম, বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৭,৭৯৮।
[92] . দারুল ইফতা, মাজমূ‘আ রাসা-ইল ফিছ ছালাত (রিয়াদ: ১৪০৫ হিঃ), পৃঃ ১৩৪-৩৯; বদীউদ্দীন শাহ রাশেদী সিন্ধী, যিয়াদাতুল খুশূ‘ (কুয়েত, ১৪০৬/১৯৮৬), পৃঃ ১-৩৮।
[93] . বিস্তারিত দেখুন : আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, পৃঃ ১২০ টীকা, ‘ক্বওমা দীর্ঘ করা’ অনুচ্ছেদ; আলবানী, মিশকাত হা/৮০৪ টীকা, ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০; মুহিববুল্লাহ শাহ রাশেদী সিন্ধী, নায়লুল আমানী (করাচী তাবি) পৃঃ ১-৪২; মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ডিসেম্বর’ ৯৮, ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা, পৃঃ ৫০-৫১।
৯. রাফ‘উল ইয়াদায়েন
এর অর্থ- দু’হাত উঁচু করা। এটি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণের অন্যতম নিদর্শন।[94] রুকূ থেকে উঠে ক্বওমাতে দাঁড়িয়ে দু’হাত ক্বিবলামুখী স্বাভাবিকভাবে কাঁধ বা কান বরাবর উঁচু করে তিন বা চার রাক‘আত বিশিষ্ট ছালাতে মোট চারস্থানে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করতে হয়।
(১) তাকবীরে তাহরীমার সময়
(২) রুকূতে যাওয়ার সময়
(৩) রুকূ থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময় এবং
(৪) ৩য় রাক‘আতে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধার সময়। এমনিভাবে প্রতি তাশাহ্হুদের বৈঠকের পর উঠে দাঁড়াবার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতে হয়।
রুকূতে যাওয়া ও রুকূ হ’তে ওঠার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করা সম্পর্কে চার খলীফা সহ প্রায় ২৫ জন ছাহাবী থেকে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহ রয়েছে। একটি হিসাব মতে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছের রাবী সংখ্যা ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’[95] সহ অন্যূন ৫০ জন ছাহাবী[96] এবং সর্বমোট ছহীহ হাদীছ ও আছারের সংখ্যা অন্যূন চার শত। [97] ইমাম সুয়ূত্বী ও আলবানী প্রমুখ বিদ্বানগণ ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ -এর হাদীছকে ‘মুতাওয়াতির’ (যা ব্যাপকভাবে ও অবিরত ধারায় বর্ণিত) পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন।[98] ইমাম বুখারী বলেন,
অর্থাৎ কোন ছাহাবী রাফ‘উল ইয়াদায়েন তরক করেছেন বলে প্রমাণিত হয়নি। তিনি আরও বলেন ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছ সমূহের সনদের চেয়ে বিশুদ্ধতম সনদ আর নেই’। [99] রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে প্রসিদ্ধতম হাদীছ সমূহের কয়েকটি নিম্নরূপঃ
(১) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের শুরুতে, রুকূতে যাওয়াকালীন ও রুকূ হ’তে ওঠাকালীন সময়ে..... এবং ২য় রাক‘আত থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করতেন’। [100] হাদীছটি বায়হাক্বীতে বর্ধিতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘এভাবেই তাঁর ছালাত জারি ছিল, যতদিন না তিনি আল্লাহর সাথে মিলিত হন’। অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি রাফ‘উল ইয়াদায়েন সহ ছালাত আদায় করেছেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদ্বীনী বলেন, এই হাদীছ আমার নিকটে সমস্ত উম্মতের উপরে ‘হুজ্জাত’ বা দলীল স্বরূপ (حُجَّةٌ عَلَي الْخَلْقِ)। যে ব্যক্তি এটা শুনবে, তার উপরেই এটা আমল করা কর্তব্য হবে। হাসান বছরী ও হামীদ বিন হেলাল বলেন, সকল ছাহাবী উক্ত তিন স্থানে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন’। [101]
(২) মালিক ইবনুল হুওয়াইরিছ (রাঃ) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ছালাতের জন্য ‘তাকবীরে তাহরীমা’ দিতেন, তখন হাত দু’টি স্বীয় দুই কান পর্যন্ত উঠাতেন। অতঃপর রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হ’তে উঠার সময় তিনি অনুরূপ করতেন এবং ‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’ বলতেন’।[102]
উল্লেখ্য যে, শত শত ছহীহ হাদীছের বিপরীতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত বাকী সময়ে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ না করার পক্ষে প্রধানতঃ যে চারটি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে, তার সবগুলিই ‘যঈফ’। তন্মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। যেমন আলক্বামা বলেন যে, একদা ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) আমাদেরকে বলেন,
‘আমি কি তোমাদের নিকটে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত আদায় করব না? এই বলে তিনি ছালাত আদায় করেন। কিন্তু তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার ব্যতীত অন্য সময় আর রাফ‘উল ইয়াদায়েন করলেন না’।[103] উক্ত হাদীছ সম্পর্কে ইবনু হিববান বলেন,
‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ না করার পক্ষে কূফাবাসীদের এটিই সবচেয়ে বড় দলীল হ’লেও এটিই সবচেয়ে দুর্বলতম দলীল, যার উপরে নির্ভর করা হয়েছে। কেননা এর মধ্যে এমন সব বিষয় রয়েছে, যা একে বাতিল গণ্য করে’।[104]
শায়খ আলবানী বলেন, হাদীছটিকে ছহীহ মেনে নিলেও তা ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ -এর পক্ষে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহের বিপরীতে পেশ করা যাবে না। কেননা ‘এটি না-বোধক এবং ঐগুলি হাঁ-বোধক। ইলমে হাদীছ-এর মূলনীতি অনুযায়ী হাঁ-বোধক হাদীছ না-বোধক হাদীছের উপর অগ্রাধিকার যোগ্য’।[105]
শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী বলেন, ‘যে মুছল্লী রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে, ঐ মুছল্লী আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ মুছল্লীর চাইতে, যে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে না। কেননা রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এর হাদীছ সংখ্যায় বেশী ও অধিকতর মযবুত’।[106]
রাফ‘উল ইয়াদায়নের ফযীলতঃ
রাফ‘উল ইয়াদায়েন হ’ল আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের অন্যতম নিদর্শন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন হ’ল ছালাতের সৌন্দর্য।’ রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হ’তে ওঠার সময় কেউ রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করলে তিনি তাকে ছোট পাথর ছুঁড়ে মারতেন।[107] উক্ববাহ বিন ‘আমের (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক রাফ‘উল ইয়াদায়েন-এ ১০টি করে নেকী আছে। [108] যদি কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের মহববতে একটি নেকীর কাজ করেন, আল্লাহ বলেন, আমি তার নেকী ১০ থেকে ৭০০ গুণে বর্ধিত করি।[109] শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ হ’ল فعل تعظيمي বা সম্মান সূচক কম,র্ যা মুছল্লীকে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার ব্যাপারে ও ছালাতে তন্ময় হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়’। [110]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদা থেকে উঠে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন না’।[111] ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, ইমাম আহমাদ -এর অধিকাংশ বর্ণনাও একথা প্রমাণ করে যে, তিনি সিজদাকালে রাফ‘উল ইয়াদায়েন -এর সর্মথক ছিলেন না’।[112] শায়খ আলবানী সিজদায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন বলে যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন,[113] তার অর্থ রুকূর ন্যায় রাফ‘উল ইয়াদায়েন নয়। বরং সাধারণভাবে সিজদা থেকে হাত উঠানো বুঝানো হয়েছে বলে অনুমিত হয়। ইমাম আহমাদ বলেন, রাসূল (ছাঃ) দুই সিজদার মাঝে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন না’।[114]
সুধী পাঠক! মাত্র কয়েকটি বর্ণনা এখানে উল্লেখ করা হল। তবে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীছের সংখ্যা অনেক।(বুখারী হা/৭৩৫, ৭৩৬, ৭৩৭, ৭৩৮, ৭৩৯= ৫টি; ছহীহ মুসলিম হা/৮৮৭, ৮৮৮, ৮৮৯, ৮৯০, ৮৯১= ৫টি; আবুদাঊদ হা/৭২১, ৭২২, ৭২৩, ৭২৫, ৭২৬, ৭২৮, ৭২৯, ৭৩০, ৭৪১, ৭৪২, ৭৪৩, ৭৪৪, ৭৪৫, ৭৪৬, ৭৪৭,, ৭৬১= ১৬টি; নাসাঈ হা/৮৭৬, ৮৭৭, ৮৭৮, ৮৭৯, ৮৮০, ৮৮১, ৮৮৯, ১০২৪, ১০২৫, ১০২৫৫, ১০৫৬, ১০৫৭, ১০৫৯= ১৩টি; ইবনু মাজাহ হা/৮৫৮, ৮৫৯, ৮৬০, ৮৬১, ৮৬২, ৮৬৩, ৮৬৮= ১১টি; তিরমিযী হা/২৫৫। শুধু ‘কুতুবে সিত্তাহ্র’ মধ্যেই প্রায় ৫১টি হাদীছ এসেছে।) উল্লেখিত দলীলসমূহে ১০২টি হাদিসের কথা বলা হয়েছে।
রুকূতে যাওয়া ও রুকূ হতে উঠার সময় ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ করা সম্পর্কে চার খলীফাসহ প্রায় ২৫ জন ছাহাবী থেকে বর্ণিত ছহীহ হাদীছ রয়েছে। একটি হিসাব মতে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছের রাবী সংখ্যা ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ সহ অন্যূন ৫০ জন ছাহাবী। (ফাৎহুল বারী ২/২৫৮ পৃঃ, হা/৭৩৭-এর ব্যাখ্যা, ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৪।)
এবং সর্বমোট ছহীহ হাদীছ ও আছারের সংখ্যা অন্যূন চার শত। (মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী (৭২৯-৮১৭ হিঃ), সিফরুস সা‘আদাত (লাহোর : ১৩০২ হিঃ, ফার্সী থেকে উর্দূ), ১৫ পৃঃ; গৃহীতঃ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃঃ ১০৮।)
এ জন্য ইমাম সুয়ূত্বী, আলবানীসহ প্রমুখ বিদ্বান ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’-এর হাদীছকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে স্বীকৃতি দান করেছেন। (তুহফাতুল আহওয়াযী ২/১০০, ১০৬ পৃঃ; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ১২৮।)
যতো প্রকার ইবাদত আছে তার মধ্যে ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ এর বর্ণিত হাদিস সংখ্যা সর্বাধিক। যারা ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন” করেন না তারা হাদিস অস্বীকারকারী চিহ্নিত বিদআতী মুছল্লী। এরা প্রকৃত মুসলমান নয়। হাদিস অমান্যকারী হিসেবে এদের স্থান হবে জাহান্নামে। ফালিল্লা-হিল হামদ।
দলীলের উৎসঃ
[94] . নায়লুল আওত্বার ৩/১৯ পৃঃ।
[95] . ‘আশারায়ে মুবাশ্‌শারাহ’ অর্থাৎ স্ব স্ব জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দশজন ছাহাবী। তাঁরা হলেন : ১.আবুবকর ছিদ্দীক্ব ‘আব্দুল্লাহ বিন ‘উছমান আবু কুহাফা (মৃঃ ১৩ হিঃ বয়স ৬৩ বৎসর)। ২. ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (মৃঃ ২৩ হিঃ বয়স ৬০) ৩. ‘উছমান ইবনু ‘আফফান (মৃঃ ৩৫ হিঃ বয়স অন্যূন ৮৩) ৪. ‘আলী ইবনু আবী ত্বালিব (মৃঃ ৪০ হিঃ বয়স ৬০) ৫. আবু ‘উবায়দাহ ‘আমের বিন ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (মৃঃ ১৮ হিঃ বয়স ৫৮) ৬. ‘আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (মৃঃ ৩২ হিঃ বয়স ৭৫) ৭. ত্বাল্হা বিন ‘উবায়দুল্লাহ (মৃঃ ৩৬ হিঃ বয়স ৬২) ৮. যোবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (মৃঃ ৩৬ হিঃ বয়স ৭৫) ৯. সা‘ঈদ বিন যায়েদ বিন ‘আমর (মৃঃ ৫১ হিঃ বয়স ৭১) ১০. সা‘দ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ (মৃঃ ৫৫ হিঃ বয়স ৮২) রাযিয়াল্লা-হু ‘আনহুম।
[96] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৭ পৃঃ ; ফাৎহুল বারী ২/২৫৮ পৃঃ, হা/৭৩৭-এর ব্যাখ্যা, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৮৪।
[97] . মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী (৭২৯-৮১৭ হিঃ), সিফরুস সা‘আদাত (লাহোর : ১৩০২ হিঃ, ফার্সী থেকে উর্দূ), ১৫ পৃঃ।
[98] . তুহফাতুল আহওয়াযী ২/১০০, ১০৬ পৃঃ; আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী পৃঃ ১০৯।
[99] . ফাৎহুল বারী ২/২৫৭ পৃঃ, হা/৭৩৬-এর ব্যাখ্যা, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৮৪।
[100] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৩-৯৪ ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০।
[101] . বায়হাক্বী, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/৮১৩, ‘মুরসাল হাসান’ ২/৪৭২ পৃঃ; মুওয়াত্ত্বা মালেক ‘ছালাত শুরু’ অনুচ্ছেদ; ‘মুরসাল ছহীহ’, মিশকাত হা/৮০৮; নায়লুল আওত্বার ৩/১২-১৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৮।
[102] . মুসলিম হা/৮৬৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[103] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮০৯, ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০।
[104] . নায়লুল আওত্বার ৩/১৪ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৮।
[105] . মিশকাত হা/৮০৯-এর টীকা (আলবানী) ১/২৫৪ পৃঃ।
[106] . হুজ্জাতুল্লা-হিল বালিগাহ ২/১০ পৃঃ।
[107] . নায়লুল আওত্বার ৩/১২; ফাৎহুল বারী ২/২৫৭।
[108] . নায়লুল আওত্বার ৩/১২; ছিফাত ১০৯।
[109] . বুখারী, মুসলিম, ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬; মিশকাত হা/৪৪।
[110] . হুজ্জাতুল্লা-হিল বালিগাহ ২/১০ পৃঃ।
[111] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৬৯৪।
[112] . মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, (মদীনা ত্বাইয়েবাহ : ১৪০৬/১৯৮৬, ১ম সংস্করণ) মাসআলা-৩২০।
[113] . আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী ১২১ পৃঃ।
[114] . ইবনুল ক্বাইয়িম, বাদায়ে‘উল ফাওয়ায়েদ ৩/৮৯-৯০; মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, মাসআলা-৩২০, ১/২৩৬ পৃঃ।
রুকূ-সিজদার আদব
বারা’ বিন আযেব (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রুকূ, সিজদা, দুই সিজদার মধ্যকার বৈঠক এবং রুকূ পরবর্তী ক্বওমা-র স্থিতিকাল প্রায় সমান হ’ত। [115] আনাস (রাঃ) বলেন, এগুলি এত দীর্ঘ হ’ত যে, মুক্তাদীগণের কেউ কেউ ধারণা করত যে, রাসূল (ছাঃ) হয়তোবা ছালাতের কথা ভুলে গেছেন’।[116]
দলীলের উৎসঃ
[115]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৬৯, ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ-১৩।
[116]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ইরওয়াউল গালীল হা/৩০৭।
১০. সিজদা
‘সিজদা’ অর্থ চেহারা মাটিতে রাখা। পারিভাষিক অর্থ, আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে বিনম্রচিত্তে চেহারা মাটিতে রাখা’। রুকূ হ’তে উঠে ক্বওমার দো‘আ শেষে ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে আল্লাহর নিকটে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে এবং সিজদার দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। নাক সহ কপাল, দু’হাত, দু’হাঁটু ও দু’পায়ের আংগুল সমূহের অগ্রভাগ সহ মোট ৭টি অঙ্গ মাটিতে লাগিয়ে সিজদা করবে।[117] সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে দু’হাত মাটিতে রাখবে। কেননা এ বিষয়ে আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ হাদীছটি ‘ছহীহ’।[118] কিন্তু ওয়ায়েল বিন হুজ্র (রাঃ) বর্ণিত আগে হাঁটু রাখার হাদীছটি ‘যঈফ’।[119] সিজদার সময় হাত দু’খানা ক্বিবলামুখী করে [120] মাথার দু’পাশে কাঁধ বা কান বরাবর[121] মাটিতে স্বাভাবিকভাবে রাখবে[122] এবং কনুই ও বগল ফাঁকা রাখবে। [123] হাঁটু বা মাটিতে ঠেস দিবে না।[124] সিজদায় দুই কনুই উঁচু রাখবে এবং কোনভাবেই দু’হাত কুকুরের মত মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া যাবে না।[125]
সিজদা এমন (লম্বা) হবে, যাতে বুকের নীচ দিয়ে একটা বকরীর বাচ্চা যাওয়ার মত ফাঁকা থাকে।[126] সহজ হিসাবে প্রত্যেক মুছল্লী নিজ হাঁটু হ’তে নিজ হাতের দেড় হাত দূরে সিজদা দিলে ঠিক হ’তে পারে। সিজদা হ’তে উঠে বাম পায়ের পাতার উপরে বসবে এবং ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে ও আঙ্গুলগুলি ক্বিবলামুখী রাখবে।[127]
অতঃপর বৈঠকের দো‘আ পাঠ শেষে তাকবীর বলে দ্বিতীয় সিজদায় যাবে। অনেক মহিলা সিজদায় গিয়ে মাটিতে নিতম্ব রাখেন। এই মর্মে ‘মারাসীলে আবুদাঊদে’ বর্ণিত হাদীছটি নিতান্তই ‘যঈফ’।[128] এর ফলে সিজদার সুন্নাতী তরীকা বিনষ্ট হয়। সিজদা হ’ল ছালাতের অন্যতম প্রধান ‘রুকন’। সিজদা নষ্ট হ’লে ছালাত বিনষ্ট হবে। অতএব এই বদভ্যাস এখনই পরিত্যাজ্য।
সিজদা হ’ল দো‘আ কবুলের সর্বোত্তম সময়। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
‘বান্দা স্বীয় প্রভুর সর্বাধিক নিকটে পৌঁছে যায়, যখন সে সিজদায় রত হয়। অতএব তোমরা ঐ সময় বেশী বেশী প্রার্থনা কর’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা প্রার্থনায় সাধ্যমত চেষ্টা কর। আশা করা যায়, তোমাদের দো‘আ কবুল করা হবে’।[129] রুকূ ও সিজদাতে কমপক্ষে তিনবার তাসবীহ পাঠ করবে।[130] দশবার দো‘আ পাঠের যে হাদীছ এসেছে, তা যঈফ। [131]
দুই সিজদার মধ্যেকার সংক্ষিপ্ত বৈঠকে হাতের আঙ্গুলগুলি দুই হাঁটুর মাথার দিকে স্বাভাবিকভাবে ক্বিবলামুখী ছড়ানো থাকবে। [132]
সিজদার সময়ঃ
রাসুল (সাঃ) বলেন, সিজদায় সাধ্যমত দোয়া করার চেষ্টা করো। আশা করা যায় তোমার দোয়া কবুল করা হবে। (সহীহ মুসলিম-হা/৪৯০, ৮০৯, ৮১২ দা.ফা)
(খ) ইবনু আব্বাস (রা;) বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন,“তোমরা সিজদায় বেশী বেশী দোয়া করো, কেননা সিজদাহ হচ্ছে দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়”।(সহিহ মুসলিম,হাদিস নং-১১০২, মিশকাত, হাদিস নং-৮৭৩)।
(গ) অন্য বর্ণনায় রয়েছে, মানুষ সিজদাহ অবস্থায় তার প্রতিপালকের সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হয়। অতএব তোমরা সিজদায় বেশী বেশী দোয়া করো। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং-১১১১, মিশকাত, হাদিস নং-৮৯৪।
সিজদার দোয়াঃ
সিজদায় প্রথমে পাঠ করবো- “সুবহানা রব্বিয়াল ‘আলা”
অর্থঃ আমার মহান সুউচ্চ প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করছি। (তিনবার) [সহীহ আত তিরমিযী ১/৮৩]।
সিজদার অতিরিক্ত দোয়াসমূহ জানতে নীচে গিয়ে ১নং এ ক্লিক করুনঃ
দলীলের উৎসঃ
[117] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৮৭, ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।
[118] . আবুদাঊদ হা/৮৪০; ঐ, মিশকাত হা/৮৯৯ অনুচ্ছেদ-১৪।
[119] . আবুদাঊদ হা/৮৩৮; ঐ, মিশকাত হা/৮৯৮ অনুচ্ছেদ-১৪, টীকা, পৃঃ ১/২৮২; মির‘আত ৩/২১৭-১৮; ইরওয়া হা/৩৫৭।
[120] . ‘কেননা দুই হাতও সিজদা করে যেমন মুখমন্ডল সিজদা করে থাকে’। -মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/৯০৫ ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।
[121] . ফিক্বহুস্ সুন্নাহ ১/১২৩; আবুদাঊদ, তিরমিযী, নায়লুল আওত্বার ৩/১২১।
[122] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/৭৯২ অনুচ্ছেদ-১০, হা/৮৮৮ অনুচ্ছেদ-১৪।
[123] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৯১ অনুচ্ছেদ-১৪।
[124] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৮০১।
[125] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৮৮ ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।
[126] . মুসলিম, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৮৯০।
[127] . বুখারী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৭৯২, ৮০১।
[128] . সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম হা/২৮২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ‘সিজদার অঙ্গ সমূহ’ অধ্যায়, ১/৩৭৩ পৃঃ ; যঈফুল জামে‘ হা/৬৪৩; সিলসিলা যঈফাহ হা/২৬৫২।
[129] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৪, অনুচ্ছেদ-১৪, হা/৮৭৩, অনুচ্ছেদ-১৩; নায়ল ৩/১০৯; মির‘আত ১/৬৩৫; ঐ, ৩/২২১-২২।
[130] . ইবনু মাজাহ হা/৮৮৮; আহমাদ, আবুদাঊদ, প্রভৃতি, ছিফাত পৃঃ ১১৩, ১২৭।
[131] . আবুদাঊদ হা/৮৮৮; নাসাঈ, মিশকাত হা/৮৮৩।
[132] . নাসাঈ, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১২৬।
দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠকের দো‘আ
দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠকের দো‘আঃ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাগ্ফিরলী ওয়ারহামনী ওয়াজ্বুরনী ওয়াহদিনী ওয়া ‘আ-ফেনী ওয়ারঝুক্বনী ।
অনুবাদ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার উপরে রহম করুন, আমার অবস্থার সংশোধন করুন, আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, আমাকে সুস্থতা দান করুন ও আমাকে রূযী দান করুন’।
অথবা কমপক্ষে ২ বার বলবে ‘রব্বিগফিরলী’ (হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর)। [133] অতঃপর ২য় সিজদা করবে ও দো‘আ পড়বে।
দলীলের উৎসঃ
[133] . ইবনু মাজাহ হা/৮৯৭; নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৯০১, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সিজদা ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।
জালসায়ে ইস্তেরা-হাত
২য় ও ৪র্থ রাক‘আতে দাঁড়াবার প্রাক্কালে সিজদা থেকে উঠে সামান্য সময়ের জন্য স্থির হয়ে বসা সুন্নাত। একে ‘জালসায়ে ইস্তেরা-হাত’ বা স্বস্তির বৈঠক বলে। যেমন হাদীছে এসেছে,
অর্থাৎ ‘ছালাতের মধ্যে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেজোড় রাক‘আতে পৌঁছতেন, তখন দাঁড়াতেন না যতক্ষণ না সুস্থির হয়ে বসতেন’। [134] একই রাবীর অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্বিতীয় সিজদা হ’তে মাথা উঠাতেন তখন বসতেন এবং মাটির উপরে (দু’হাতে) ভর দিতেন। অতঃপর দাঁড়াতেন’। [135]
‘হাতের উপরে ভর না দিয়ে তীরের মত সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন’ বলে ‘ত্বাবারাণী কাবীরে’ বর্ণিত হাদীছটি ‘মওযূ’ বা জাল এবং উক্ত মর্মে বর্ণিত সকল হাদীছই ‘যঈফ’। [136]
ইসহাক্ব বিন রাহ্ওয়াইহ বলেন, যুবক হৌক বা বৃদ্ধ হৌক রাসূল (ছাঃ) থেকে এ সুন্নাত জারি আছে যে, তিনি প্রথমে মাটিতে দু’হাতে ভর দিতেন। অতঃপর দাঁড়াতেন। দশজন ছাহাবী কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে সত্যায়ন প্রাপ্ত আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) প্রদর্শিত ছালাতের প্রসিদ্ধ হাদীছেও এর স্পষ্ট দলীল রয়েছে। [137]
দলীলের উৎসঃ
[134] . বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৬, অনুচ্ছেদ-১০; নায়ল ৩/১৩৮।
[135] . বুখারী, ফাৎহ সহ হা/৮২৪, ‘ওঠার সময় কিভাবে মাটির উপরে ভর দেবে’ অনুচ্ছেদ-১৪৩, ‘আযান’ অধ্যায়-১৩, ২/৩৫৩-৫৪ পৃঃ।
[136] . ছিফাত, ১৩৭ পৃঃ ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬২, ৯২৯, ৯৬৭; নায়ল ৩/১৩৮-১৩৯।
[137] . বুখারী, ছিফাত, পৃঃ ১৩৬-৩৭ টীকা; তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮০১; ইরওয়া হা/৩০৫, ৩৬২; ২/১৩, ৮২-৮৩ পৃঃ।
সিজদার ফযীলত
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে, আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লেখেন ও তার একটি পাপ দূর করে দেন এবং তার মর্যাদার স্তর একটি বৃদ্ধি করে দেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী সিজদা কর’।[138]
(২) ক্বিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈমানদারগণকে চিনবেন তাদের সিজদার স্থান ও ওযূর অঙ্গ সমূহের ঔজ্জ্বল্য দেখে’। [139]
(৩) আল্লাহ জাহান্নামবাসীদের মধ্য থেকে কিছু লোকের উপরে অনুগ্রহ করবেন এবং ফেরেশতাদের বলবেন, যাও ঐসব লোকদের বের করে নিয়ে এসো, যারা আল্লাহর ইবাদত করেছে। অতঃপর ফেরেশতাগণ তাদের সিজদার চিহ্ন দেখে চিনে নিবেন ও বের করে আনবেন। বনু আদমের সর্বাঙ্গ আগুনে খেয়ে নিবে, সিজদার চিহ্ন ব্যতীত। কেননা আল্লাহ পাক জাহান্নামের উপরে হারাম করেছেন সিজদার চিহ্ন খেয়ে ফেলতে’।[140]
দলীলের উৎসঃ
[138] . ইবনু মাজাহ হা/১৪২৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-২০১।
[139] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৯০ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩; মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৮; আহমাদ হা/১৭৭২৯, ছিফাত, ১৩১ পৃঃ।
[140] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫৮১ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪; ছিফাত, ১৩১ পৃঃ।
১১. শেষ বৈঠক
যে বৈঠকের শেষে সালাম ফিরাতে হয়, তাকে শেষ বৈঠক বলে। এটি ফরয, যা না করলে ছালাত বাতিল হয়। তবে ১ম বৈঠকটি ওয়াজিব, যা ভুলক্রমে না করলে সিজদায়ে সহো ওয়াজিব হয়। ২য় রাক‘আত শেষে বৈঠকে বসবে। যদি ১ম বৈঠক হয়, তবে কেবল ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ে ৩য় রাক‘আতের জন্য উঠে যাবে। [141] আর যদি শেষ বৈঠক হয়, তবে ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ার পরে দরূদ, দো‘আয়ে মাছূরাহ এবং সম্ভব হ’লে অন্য দো‘আ পড়বে।[142] ১ম বৈঠকে বাম পা পেতে তার উপরে বসবে ও শেষ বৈঠকে ডান পায়ের তলা দিয়ে বাম পায়ের অগ্রভাগ বের করে দিয়ে বাম নিতম্বের উপরে বসবে ও ডান পায়ের পাতা খাড়া রাখবে। এই সময় ডান পায়ের আঙ্গুলী সমূহের অগ্রভাগ ক্বিবলামুখী থাকবে।[143] জোড়-বেজোড় যেকোন ছালাতের সালামের বৈঠকে নারী-পুরুষ সকলকে এভাবেই বাম নিতম্বের উপর বসতে হয়। একে ‘তাওয়ার্রুক’ (التورك) বলা হয়।[144]
বৈঠকের সময় বাম হাতের আঙ্গুলগুলো বাম হাঁটুর প্রান্ত বরাবর ক্বিবলামুখী ও স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে[145] এবং ডান হাত ৫৩ -এর ন্যায় মুষ্টিবদ্ধ থাকবে ও শাহাদাত অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করবে।[146] বৈঠকের শুরু থেকে সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ইশারা করতে থাকবে।[147] ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৯০৪-৯৪ খৃ:) বলেন, আঙ্গুল ইশারার মাধ্যমে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেওয়া হয়।[148] দো‘আ পাঠের সময় আকাশের দিকে তাকানো নিষেধ।[149] ইশারার সময় আঙ্গুল দ্রুত নাড়ানো যাবে না, যা পাশের মুছল্লীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়’। [150] ‘আশহাদু’ বলার সময় আঙ্গুল উঠাবে ও ইল্লাল্লা-হ’ বলার পর আঙ্গুল নামাবে’ বলে যে কথা চালু আছে তার কোন ভিত্তি নেই।[151] মুছল্লীর নযর ইশারার বাইরে যাবে না। [152] এই সময় নিম্নোক্ত দো‘আসমূহ পড়বে-
(ক) তাশাহহুদ* (আত্তাহিইয়া-তু) :
নবীকে সম্বোধন:
তাশাহহুদ সম্পর্কিত সকল ছহীহ মরফূ হাদীছে রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন সূচক ‘আইয়ুহান্নাবী’ শব্দ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ কতিপয় ছাহাবী ‘আইয়ুহান্নাবী’-এর পরিবর্তে ‘আলান্নাবী’ বলতে থাকেন। যেমন বুখারী ‘ইস্তীযা-ন’ অধ্যায়ে এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। অথচ সকল ছাহাবী, তাবেঈন, মুহাদ্দেছীন, ফুক্বাহা পূর্বের ন্যায় ‘আইয়ুহান্নাবী’ পড়েছেন। এই মতভেদের কারণ হ’ল এই যে, রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁকে সম্বোধন করে ‘আইয়ুহান্নাবী’ বলা গেলেও তাঁর মৃত্যুর পরে তো আর তাঁকে ঐভাবে সম্বোধন করা যায় না। কেননা সরাসরি এরূপ গায়েবী সম্বোধন কেবল আল্লাহকেই করা যায়। মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এভাবে সম্বোধন করলে তাঁকে আল্লাহ সাব্যস্ত করা হয়ে যায়। সেকারণ কিছু সংখ্যক ছাহাবী ‘আলান্নাবী’ অর্থাৎ ‘নবীর উপরে’ বলতে থাকেন।
পক্ষান্তরে অন্য সকল ছাহাবী পূর্বের ন্যায় ‘আইয়ুহান্নাবী’ বলতে থাকেন। ত্বীবী (মৃ: ৭৪৩ হিঃ) বলেন, এটা এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁদেরকে উক্ত শব্দেই ‘তাশাহহুদ’ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার কোন অংশ তাঁর মৃত্যুর পরে পরিবর্তন করতে বলে যাননি। অতএব ছাহাবায়ে কেরাম উক্ত শব্দ পরিবর্তনে রাযী হননি। ছাহেবে মির‘আত বলেন, জীবিত-মৃত কিংবা উপস্থিতি-অনুপস্থিতির বিষয়টি ধর্তব্য নয়। কেননা স্বীয় জীবদ্দশায়ও তিনি বহু সময় ছাহাবীদের থেকে দূরে সফরে বা জিহাদের ময়দানে থাকতেন। তবুও তারা তাশাহহুদে নবীকে উক্ত সম্বোধন করে ‘আইয়ুহান্নাবী’ বলতেন। তারা তাঁর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে উক্ত সম্বোধনে কোন হেরফের করতেন না। তাছাড়া বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ‘খাছ’ বিষয়াবলীর (من خصائصه) অন্তর্ভুক্ত। এটা স্রেফ তাশাহহুদের মধ্যেই পড়া যাবে, অন্য সময় নয়।
উল্লেখ্য যে, এই সম্বোধনের মধ্যে কবর পূজারীদের জন্য কোন সুযোগ নেই। তারা এই হাদীছের দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বত্র হাযির-নাযির প্রমাণ করতে চায় [153] ও মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য তাঁকে ‘অসীলা’ হিসাবে গ্রহণ করতে চায়। এটা পরিষ্কারভাবে ‘শিরকে আকবর’ বা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
এরপর দরূদ পাঠ করবে।
(খ) দরূদ :
জ্ঞাতব্য : দরূদে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারকে ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর ফলে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর পরিবারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে বলে মনে হ’লেও প্রকৃত অর্থে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) স্বয়ং ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর এবং মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ও সর্বশেষ রাসূল। পিতা ইবরাহীমের সাথে সন্তান হিসাবে তাঁর তুলনা মোটেই অমর্যাদাকর নয়। দ্বিতীয়ত: ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশে হাযার হাযার নবী ছিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিবারবর্গের মধ্যে কোন নবী না থাকা সত্ত্বেও তাঁদেরকে অগণিত নবী-রাসূল সমৃদ্ধ মহা সম্মানিত ইবরাহীমী বংশের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিবারের মর্যাদা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি করা হয়েছে।[154]
দরূদ -এর ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপরে দশটি রহমত নাযিল করেন। তার আমলনামা হ’তে দশটি গুনাহ ঝরে পড়ে ও তার সম্মানের স্তর আল্লাহর নিকটে দশগুণ বৃদ্ধি পায়’।[155]
অতঃপর নিম্নের দো‘আ পাঠ করবে, যা ‘দো‘আয়ে মাছূরাহ’ নামে পরিচিত। এতদ্ব্যতীত জানা মত অন্যান্য দো‘আ পড়বে। এই সময় কুরআনী দো‘আও পড়া যাবে।
(গ) দো‘আয়ে মাছূরাহঃ[156) আল্ল-হুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আযাবি জাহান্নামা, ওয়া আউজুবিকা মিন আযা-বিল ক্ববরি, ওয়া আউজুবিকা মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ দাজ্জ-লি, ওয়া আউজুবিকা মিন ফিতনাতিল মাহ্ইয়া ওয়াল মামা-ত, আল্ল-হুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল মা’ছামি ওয়া মিনাল মাগরামি।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট জাহান্নামের আজব হতে আশ্রয় চাই, কবরের আযাব হতে আশ্রয় চাই, আশ্রয় চাই কানা দাঝঝালের পরীক্ষা ফিতনা থেকে। তোমার নিকট আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা হতে এবং তোমার নিকট আশ্রয় চাই পাপ ও ঋণের বোঝা হতে।’ (বুখারি-হা/৮৩২ দা.ফা/তাওহীদ, হা/৭৯৪ ই.ফা.বা , মুসলিম, মিশকাত)।

এরপর অন্যান্য দো‘আসমূহ পড়তে পারে।
তাশাহহুদের শেষে নিম্নোক্ত দো‘আটি পাঠ করার জন্য বিশেষভাবে তাকীদ এসেছে -
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন্ ‘আযা-বি জাহান্নামা ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন্ ‘আযা-বিল ক্বাব্রে, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন্ ফিৎনাতিল মাসীহিদ্ দাজ্জা-লি, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন ফিৎনাতিল মাহ্ইয়া ওয়াল মামা-তি।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় ভিক্ষা করছি জাহান্নামের আযাব হ’তে, কবরের আযাব হ’তে, দাজ্জালের ফিৎনা হ’তে এবং জীবন ও মৃত্যুকালীন ফিৎনা হ’তে’। [157]
তাশাহ্হুদ ও সালামের মধ্যেকার দো‘আ সমূহের শেষে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিম্নের দো‘আ পড়তেন :
(১) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাগফিরলী মা ক্বাদ্দামতু অমা আখখারতু, অমা আসরারতু অমা আ‘লানতু, অমা আসরাফতু, অমা আনতা আ‘লামু বিহী মিন্নী; আনতাল মুক্বাদ্দিমু ওয়া আনতাল মুআখখিরু, লা ইলা-হা ইল্লা আনতা’ ।
অনুবাদ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার পূর্বাপর গোপন ও প্রকাশ্য সকল গোনাহ মাফ কর (এবং মাফ কর ঐসব গোনাহ) যাতে আমি বাড়াবাড়ি করেছি এবং ঐসব গোনাহ যে বিষয়ে তুমি আমার চাইতে বেশী জানো। তুমি অগ্র-পশ্চাতের মালিক। তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’।[158]
(২) ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিনান্না-র’ (হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি)।[159]
তাশাহ্হুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ে দো‘আ বিষয়ে জ্ঞাতব্য:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাশাহ্হুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন দো‘আ পড়তেন।[160] ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত তাশাহহুদে (অর্থাৎ আত্তাহিইয়াতু)-এর শেষে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘অতঃপর দো‘আ সমূহের মধ্যে যে দো‘আ সে পসন্দ করে, তা করবে’।[161] এ কথার ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের মধ্যে একদল বলেছেন, এ সময় গোনাহ নেই এবং আদবের খেলাফ নয়, দুনিয়া ও আখেরাতের এমন সকল প্রকার দো‘আ করা যাবে। পক্ষান্তরে অন্যদল বলেছেন, কুরআন-হাদীছে বর্ণিত দো‘আ সমূহের মাধ্যমেই কেবল প্রার্থনা করতে হবে। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমাদের এই ছালাতে মানুষের সাধারণ কথা-বার্তা বলা চলে না। এটি কেবল তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন পাঠ মাত্র’।[162]
বর্ণিত উভয় হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য এটাই হ’তে পারে যে, অন্যের উদ্দেশ্যে নয় এবং আদবের খেলাফ নয়, আল্লাহর নিকট এমন সকল দো‘আ করা যাবে। তবে ছালাতের পুরা অনুষ্ঠানটিই যেহেতু আরবী ভাষায়, সেহেতু অনারবদের জন্য নিজেদের তৈরী করা আরবীতে প্রার্থনা করা নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত: সর্বাবস্থায় সকলের জন্য হাদীছের দো‘আ পাঠ করাই উত্তম। কিন্তু যখন দো‘আ জানা থাকে না, তখন তার জন্য সবচেয়ে উত্তম হবে প্রচলিত দো‘আয়ে মাছূরাহ (আল্লা-হুম্মা ইন্নী যালামতু...) শেষে নিম্নের দো‘আটির ন্যায় যে কোন একটি সারগর্ভ দো‘আ পাঠ করা, যা দুনিয়া ও আখেরাতের সকল প্রয়োজনকে শামিল করে। আনাস (রাঃ) বলেন, এ দো‘আটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় পড়তেন।-
আল্লা-হুম্মা রববানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র’ । অথবা আল্লা-হুম্মা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া ..।
‘হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতে মঙ্গল দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’। [163] এ সময় দুনিয়াবী চাহিদার বিষয়গুলি নিয়তের মধ্যে শামিল করবে। কেননা আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন ও তার হৃদয়ের কান্না শোনেন’।[164] দো‘আর সময় নির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে নাম না করাই ভাল। কেননা ভবিষ্যতে বান্দার কিসে মঙ্গল আছে, সেটা আল্লাহ ভাল জানেন।[165]
(ঘ) সালাম : দো‘আয়ে মাছূরাহ ও অন্যান্য দো‘আ শেষে ডাইনে ও বামে ‘আস্সালা-মু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লা-হ’ বলবে।[166] কেবল ডাইনে সালামের শেষদিকে ‘ওয়া বারাকা-তুহূ’ বৃদ্ধি করা যাবে। [167] দু’দিকে নয়।[168] অতঃপর একবার সরবে ‘আল্লা-হু আকবার’[169] এবং তিনবার ‘আসতাগ্ফিরুল্লা-হ’ ও একবার‘আল্লা-হুম্মা আনতাস সালা-মু ওয়া মিনকাস সালা-মু, তাবা-রক্তা ইয়া যাল জালা-লে ওয়াল ইকরা-ম’ বলবে। এটুকু পড়েই উঠে যেতে পারে।[170] অতঃপর ডাইনে অথবা বামে ঘুরে সরাসরি মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে বসবে। [171] ডান দিক দিয়ে ফেরার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো পড়েছেন, رَبِّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ ‘রবেব ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাব‘আছু ইবা-দাকা’ (হে আমার প্রতিপালক! তোমার আযাব হ’তে আমাকে বাঁচাও! যেদিন তোমার বান্দাদের তুমি পুনরুত্থান ঘটাবে)।[172]  

তাশাহ্হুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ের অতিরিক্ত  দোয়া জানতে নীচে গিয়ে ১নং এ
ক্লিক করুন।
দলীলের উৎসঃ
[141] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১২৯; আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/৯১৫, ‘তাশাহহুদ’ অনুচ্ছেদ-১৫।
 [142] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১২৯; মির‘আত ১/৭০৪; ঐ, পৃঃ ৩/২৯৪-৯৫, হা/৯৪৭, ৯৪৯।
[143] . বুখারী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৭৯২,৮০১; নায়ল ৩/১৪৩-৪৫ ‘তাশাহহুদে বসার নিয়ম’ অনুচ্ছেদ।
 [144] . ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৮৬২,৬৭,৭৩; বুখারী হা/৮২৮, আবুদাঊদ হা/৭৩০; ঐ, মিশকাত হা/৭৯১, ৮০১।
[145] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯০৭ ‘তাশাহহুদ’ অনুচ্ছেদ-১৫।
[146] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯০৬, ৯০৮। ৫৩ -এর ন্যায় অর্থ কনিষ্ঠা, অনামিকা ও মধ্যমা অঙ্গুলী মুষ্টিবদ্ধ করা ও বৃদ্ধাঙ্গুলীকে তাদের সাথে মিলানো এবং শাহাদাত অঙ্গুলীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া।
 [147] . মির‘আত ৩/২২৯; আলবানী, মিশকাত হা/৯০৬ -এর টীকা।
[148] . মির‘আত ৩/২২৯ পৃঃ।
[149] . নাসাঈ হা/১২৭৬; মুসলিম, মিশকাত হা/৯৮৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-১৯।
[150] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৫৭ ‘সতর’ অনুচ্ছেদ-৮ ; মির‘আত হা/৭৬৩, ১/৬৬৯ পৃঃ, ঐ, ২/৪৭৩ পৃঃ।
 [151] . আলবানী, মিশকাত হা/৯০৬-এর টীকা-২ দ্রষ্টব্য; ঐ, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, পৃঃ ১৪০; মির‘আত ৩/২২৯।
[152] . আহমাদ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৯১৭, ৯১১; আবুদাঊদ হা/৯৯০; নাসাঈ হা/১২৭৫; মিশকাত হা/৯১২।
* ক্বাযী ‘আয়ায (৪৭৬-৫৪৪ হিঃ) বলেন, আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য এবং শেষনবীর রিসালাতের সাক্ষ্য শামিল থাকায় অন্য দো‘আ সমূহের উপর প্রাধান্যের কারণে যিকরের এই বিশেষ অনুষ্ঠানটিকে সামষ্টিক ভাবে তাশাহহুদ বলা হয়’। -মির‘আত ৩/২২৭।
[153] . মির‘আত ১/৬৬৪-৬৫; ঐ, ৩/২৩৩-৩৪, হা/৯১৫ -এর ভাষ্য দ্রঃ।
[154] . মির‘আত ১/৬৭৮-৬৮০; ঐ, ৩/২৫৩-৫৫।
 [155] . নাসাঈ, মিশকাত হা/৯২২, ‘নবীর উপরে দরূদ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৬।
 [156] . ‘মাছূরাহ’ অর্থ ‘হাদীছে বর্ণিত’। সেই হিসাবে হাদীছে বর্ণিত সকল দো‘আই মাছূরাহ। কেবলমাত্র অত্র দো‘আটি নয়। তবে এ দো‘আটিই এদেশে ‘দো‘আয়ে মাছূরাহ’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। -লেখক।
 [157] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪০-৪১।
[158] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮১৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘তাকবীরের পরে কি পড়তে হয়’ অনুচ্ছেদ-১১।
[159] . আবুদাঊদ হা/৭৯৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১২৮; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৮৬৫।
[160] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮১৩ ‘তাকবীরের পর যা পড়তে হয়’ অনুচ্ছেদ-১১; নববী, রিয়াযুছ ছালেহীন ‘যিকর’ অধ্যায় হা/১৪২৪।
[161] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯০৯; মির‘আত হা/৯১৫, ৩/২৩৫।
[162] . মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৯৭৮ ‘ছালাতের মাঝে যে সকল কাজ অসিদ্ধ এবং যা সিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ-১৯ ; মির‘আত হা/৯৮৫, ৩/৩৩৯-৪০ পৃঃ।
[163] . বুখারী হা/৪৫২২, ৬৩৮৯; বাক্বারাহ ২/২০১; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪৮৭ ‘দো‘আসমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘সারগর্ভ দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-৯।
 [164] . আলে ইমরান ৩/১১৯, ৩৮; ইবরাহীম ১৪/৩৯; গাফির/মুমিন ৪০/১৯।
[165] . বাক্বারাহ ২/২১৬।
[166] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৯৫০, ‘তাশাহহুদে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৭।
[167] . আবুদাঊদ, ইবনু খুযায়মা, ছিফাত, পৃঃ ১৬৮।
[168] . আলবানী, তামামুল মিন্নাহ ১৭১ পৃঃ।
[169] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯৫৯; বুখারী ফাৎহসহ হা/৮৪১-৪২।
[170] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৬০, ‘ছালাত পরবর্তী যিকর’ অনুচ্ছেদ-১৮।
[171] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪৪-৪৬; মির‘আত হা/৯৫১-৫৪ -এর ব্যাখ্যা, ৩/৩০০-০৪।
[172] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪৭ ‘তাশাহহুদে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৭।
ছালাত পরবর্তী যিকরসমূহ
ছালাম ফিরানোর পর ইমামের সাথে থাকলে সম্মিলিত মোনাজাত না করে কিংবা একাকী ছালাত আদায় করলে তাড়াহুড়ো করে উঠে না গিয়ে হাদিসে বর্ণিত বেশ কিছু দোয়া আছে যেগুলো আমরা আমল করবো। 
ছালাত শেষে ছালাম ফিরানোর পর রাসুল সাঃ যেসমস্ত দোয়ার আমল করতেন তা জানতে নীচে গিয়ে ২ নং এ ক্লিক করুন।
                                                        মুনাজাত (المناجاة)
‘মুনাজাত’ অর্থ ‘পরস্পরে গোপনে কথা বলা’ (আল-মুনজিদ প্রভৃতি)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কেউ যখন ছালাতে রত থাকে, তখন সে তার প্রভুর সাথে ‘মুনাজাত’ করে অর্থাৎ গোপনে কথা বলে’।[198] তাই ছালাত কোন ধ্যান (Meditation) নয়, বরং আল্লাহর কাছে বান্দার সরাসরি ক্ষমা চাওয়া ও প্রার্থনা নিবেদনের নাম। দুনিয়ার কাউকে যা বলা যায় না, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে বান্দা তাই-ই বলে। আল্লাহ স্বীয় বান্দার চোখের ভাষা বুঝেন ও হৃদয়ের কান্না শোনেন।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’ (মুমিন/গাফির ৪০/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ ‘দো‘আ হ’ল ইবাদত’।[199] অতএব দো‘আর পদ্ধতি সুন্নাত মোতাবেক হ’তে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন পদ্ধতিতে দো‘আ করেছেন, আমাদেরকে সেটা দেখতে হবে। তিনি যেভাবে প্রার্থনা করেছেন, আমাদেরকে সেভাবেই প্রার্থনা করতে হবে। তাঁর রেখে যাওয়া পদ্ধতি ছেড়ে অন্য পদ্ধতিতে দো‘আ করলে তা কবুল হওয়ার বদলে গোনাহ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী থাকবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের মধ্যেই দো‘আ করেছেন। তাকবীরে তাহরীমার পর থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত সময়কাল হ’ল ছালাতের সময়কাল। [200] ছালাতের এই নিরিবিলি সময়ে বান্দা স্বীয় প্রভুর সাথে ‘মুনাজাত’ করে। ‘ছালাত’ অর্থ দো‘আ, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি। ‘ছানা’ হ’তে সালাম ফিরানোর আগ পর্যন্ত ছালাতের সর্বত্র কেবল দো‘আ আর দো‘আ। অর্থ বুঝে পড়লে উক্ত দো‘আগুলির বাইরে বান্দার আর তেমন কিছুই চাওয়ার থাকে না। তবুও সালাম ফিরানোর পরে একাকী দো‘আ করার প্রশস্ত সুযোগ রয়েছে। তখন ইচ্ছামত যেকোন ভাষায় যেকোন বৈধ দো‘আ করা যায়। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, এই দো‘আ دبر الصلاة বা ছালাত শেষের দো‘আ নয়, বরং তাসবীহ-তাহলীলের মাধ্যমে عبادة ثانية বা দ্বিতীয় ইবাদত শেষের দো‘আ হিসাবে গণ্য হবে। কেননা মুছল্লী যতক্ষণ ছালাতের মধ্যে থাকে, ততক্ষণ সে তার প্রভুর সাথে গোপনে কথা বলে বা মুনাজাত করে। কিন্তু যখনই সালাম ফিরায়, তখনই সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। [201]
ছালাতে দো‘আর স্থান সমূহ :
(১) ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতা-হ, যা ‘আল্লা-হুম্মা বা-‘এদ বায়নী’ দিয়ে শুরু হয় (২) শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল সূরায়ে ফাতিহার মধ্যে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও‘ইহ্দিনাছ ছিরা-ত্বাল মুস্তাকীম’(৩) রুকূতে ‘সুবহা-নাকা আল্লা-হুম্মা...’। (৪) রুকূ হ’তে উঠার পর ক্বওমার দো‘আ ‘রববানা ওয়া লাকাল হাম্দ হাম্দান কাছীরান’... বা অন্য দো‘আ সমূহ। (৫) সিজদাতেও ‘সুবহা-নাকা আল্লা-হুম্মা’... বা অন্য দো‘আ সমূহ। (৬) দুই সিজদার মাঝে বসে ‘আল্লা-হুম্মাগ্ফিরলী...’ বলে ৬টি বিষয়ের প্রার্থনা। (৭) শেষ বৈঠকে তাশাহ্হুদের পরে ও সালাম ফিরানোর পূর্বে দো‘আয়ে মাছূরাহ সহ বিভিন্ন দো‘আ পড়া। এ ছাড়াও রয়েছে (৮) ক্বওমাতে দাঁড়িয়ে দো‘আয়ে কুনূতের মাধ্যমে দীর্ঘ দো‘আ করার সুযোগ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সিজদার সময় বান্দা তার প্রভুর সর্বাধিক নিকটে পৌঁছে যায়। অতএব ঐ সময় তোমরা সাধ্যমত বেশী বেশী দো‘আ কর।[202] অন্য হাদীছে এসেছে যে, তিনি শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ ও সালামের মধ্যবর্তী সময়ে বেশী বেশী দো‘আ করতেন। [203] সালাম ফিরানোর পরে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ‘মুনাজাত’ বা গোপন আলাপের সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব সালাম ফিরানোর আগেই যাবতীয় দো‘আ শেষ করা উচিৎ, সালাম ফিরানোর পরে নয়। এক্ষণে যদি কেউ মুছল্লীদের নিকটে কোন ব্যাপারে বিশেষভাবে দো‘আ চান, তবে তিনি আগেই সেটা নিজে অথবা ইমামের মাধ্যমে সকলকে অবহিত করবেন। যাতে মুছল্লীগণ স্ব স্ব দো‘আর নিয়তের মধ্যে তাকেও শামিল করতে পারেন।
দলীলের উৎসঃ
[198] . বুখারী (দিল্লী ছাপা) ১/৭৬ পৃঃ; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭১০, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭ ; إِنَّ الْمُصَلِّى يُنَاجِى رَبَّهُ আহমাদ, মিশকাত হা/৮৫৬ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[199] . আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/২২৩০ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ২য় পরিচ্ছেদ।
[200] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১২ ‘ত্বাহারৎ’ অধ্যায়-৩, ‘যা ওযূ ওয়াজিব করে’ অনুচ্ছেদ-১, পরিচ্ছেদ-২।
[201] . যা-দুল মা‘আ-দ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৯তম সংস্করণ ১৯৯৬), ১/২৫০।
[202] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৪ ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪ ; নায়ল ৩/১০৯ পৃঃ।
[203] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮১৩ ‘তাকবীরের পর যা পড়তে হয়’ অনুচ্ছেদ-১১।
ফরয ছালাত বাদে সম্মিলিত দো‘আ
ফরয ছালাত শেষে সালাম ফিরানোর পরে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে ইমামের সরবে দো‘আ পাঠ ও মুক্তাদীদের সশব্দে ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলার প্রচলিত প্রথাটি দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন সৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম হ’তে এর পক্ষে ছহীহ বা যঈফ সনদে কোন দলীল নেই। বলা আবশ্যক যে, আজও মক্কা-মদ্বীনার দুই হারাম-এর মসজিদে উক্ত প্রথার কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রচলিত সম্মিলিত দো‘আর ক্ষতিকর দিক সমূহ :
(১) এটি সুন্নাত বিরোধী আমল। অতএব তা যত মিষ্ট ও সুন্দর মনে হৌক না কেন সূরায়ে কাহ্ফ-এর ১০৩-৪ নং আয়াতের মর্ম অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
(২) এর ফলে মুছল্লী স্বীয় ছালাতের চাইতে ছালাতের বাইরের বিষয় অর্থাৎ প্রচলিত ‘মোনাজাত’কেই বেশী গুরুত্ব দেয়। আর এজন্যেই বর্তমানে মানুষ ফরয ছালাতের চাইতে মোনাজাতকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ‘আখেরী মুনাজাত’ নামক বিদ‘আতী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেশী আগ্রহ বোধ করছে ও দলে দলে সেখানে ভিড় জমাচ্ছে।
(৩) এর মন্দ পরিণতিতে একজন মুছল্লী সারা জীবন ছালাত আদায় করেও কোন কিছুর অর্থ শিখে না। বরং ছালাত শেষে ইমামের মুনাজাতের মুখাপেক্ষী থাকে।
(৪) ইমাম আরবী মোনাজাতে কী বললেন সে কিছুই বুঝতে পারে না। ওদিকে নিজেও কিছু বলতে পারে না। এর পূর্বে ছালাতের মধ্যে সে যে দো‘আগুলো পড়েছে, অর্থ না জানার কারণে সেখানেও সে অন্তর ঢেলে দিতে পারেনি। ফলে জীবনভর ঐ মুছল্লীর অবস্থা থাকে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’।
(৫) মুছল্লীর মনের কথা ইমাম ছাহেবের অজানা থাকার ফলে মুছল্লীর কেবল ‘আমীন’ বলাই সার হয়।
(৬) ইমাম ছাহেবের দীর্ঘক্ষণ ধরে আরবী-উর্দূ-বাংলায় বা অন্য ভাষায় করুণ সুরের মোনাজাতের মাধ্যমে শ্রোতা ও মুছল্লীদের মন জয় করা অন্যতম উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ফলে ‘রিয়া’ ও ‘শ্রুতি’-র কবীরা গোনাহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ‘রিয়া’-কে হাদীছে الشرك الأصغر বা ‘ছোট শিরক’ বলা হয়েছে। [204]  যার ফলে ইমাম ছাহেবের সমস্ত নেকী বরবাদ হয়ে যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হ’তে পারে।
ছালাতে হাত তুলে সম্মিলিত দো‘আ :
(১) ‘ইস্তিসক্বা’ অর্থাৎ বৃষ্টি প্রার্থনার ছালাতে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দু’হাত তুলে দো‘আ করবে। এতদ্ব্যতীত
(২) ‘কুনূতে নাযেলাহ’ ও ‘কুনূতে বিতরে’ও করবে।
একাকী দু’হাত তুলে দো‘আ :
ছালাতের বাইরে যে কোন সময়ে বান্দা তার প্রভুর নিকটে যে কোন ভাষায় দো‘আ করবে। তবে হাদীছের দো‘আই উত্তম। বান্দা হাত তুলে একাকী নিরিবিলি কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহ তার হাত খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জা বোধ করেন।[205] খোলা দু’হস্ততালু একত্রিত করে চেহারা বরাবর সামনে রেখে দো‘আ করবে।[206] দো‘আ শেষে মুখ মাসাহ করার হাদীছ যঈফ। [207] বরং উঠানো অবস্থায় দো‘আ শেষে হাত ছেড়ে দিবে।
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের জন্য আল্লাহর নিকট হাত উঠিয়ে একাকী কেঁদে কেঁদে দো‘আ করেছেন।[208]
(২) বদরের যুদ্ধের দিন তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে আল্লাহর নিকটে একাকী হাত তুলে কাতর কণ্ঠে দো‘আ করেছিলেন। [209]
(৩) বনু জাযীমা গোত্রের কিছু লোক ভুলক্রমে নিহত হওয়ায় মর্মাহত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাকী দু’বার হাত উঠিয়ে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চেয়েছিলেন।[210]
(৪) আওত্বাস যুদ্ধে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর নিহত ভাতিজা দলনেতা আবু ‘আমের আশ‘আরী (রাঃ)-এর জন্য ওযূ করে দু’হাত তুলে একাকী দো‘আ করেছিলেন।[211]
(৫) তিনি দাওস কওমের হেদায়াতের জন্য ক্বিবলামুখী হয়ে একাকী দু’হাত তুলে দো‘আ করেছেন।[212]
এতদ্ব্যতীত
(৬) হজ্জ ও ওমরাহ কালে সাঈ করার সময় ‘ছাফা’ পাহাড়ে উঠে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে দু’হাত তুলে দো‘আ করা।[213]
(৭) আরাফার ময়দানে একাকী দু’হাত তুলে দো‘আ করা।[214]
(৮) ১ম ও ২য় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর একটু দূরে সরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত তুলে দো‘আ করা। [215]
(৯) মুসাফির অবস্থায় হাত তুলে দো‘আ করা।[216]
তাছাড়া জুম‘আ ও ঈদায়েনের খুৎবায় বা অন্যান্য সভা ও সম্মেলনে একজন দো‘আ করলে অন্যেরা (দু’হাত তোলা ছাড়াই) কেবল ‘আমীন’ বলবেন। [217] এমনকি একজন দো‘আ করলে অন্যজন সেই সাথে ‘আমীন’ বলতে পারেন।
উল্লেখ্য যে, দো‘আর জন্য সর্বদা ওযূ করা, ক্বিবলামুখী হওয়া এবং দু’হাত তোলা শর্ত নয়। বরং বান্দা যে কোন সময় যে কোন অবস্থায় আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করবে। যেমন খানাপিনা, পেশাব-পায়খানা, বাড়ীতে ও সফরে সর্বদা বিভিন্ন দো‘আ করা হয়ে থাকে। আর আল্লাহ যে কোন সময় যে কোন অবস্থায় তাঁকে আহবান করার জন্য বান্দার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।[218]
কুরআনী দো‘আ :
রুকূ ও সিজদাতে কুরআনী দো‘আ পড়া নিষেধ আছে।[219] তবে মর্ম ঠিক রেখে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনে পড়া যাবে। যেমন রববানা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া ... (বাক্বারাহ ২/২০১)-এর স্থলে আল্লা-হুম্মা রববানা আ-তিনা অথবা আল্লা-হুম্মা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া ...বলা। [220]  অবশ্য শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পরে সালাম ফিরানোর পূর্বে কুরআনী দো‘আ সহ ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সকল প্রকারের দো‘আ পাঠ করা যাবে।
দলীলের উৎসঃ
[204] . আহমাদ, মিশকাত হা/৫৩৩৪ ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-২৬, ‘লোক দেখানো ও শুনানো’ অনুচ্ছেদ-৫।
[205] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২২৪৪, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯।
[206] . আবুদাঊদ হা/১৪৮৬-৮৭, ৮৯; ঐ, মিশকাত হা/২২৫৬।
[207] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২২৪৩, ৪৫, ২২৫৫ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯; আলবানী বলেন, দো‘আর পরে দু’হাত মুখে মোছা সম্পর্কে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। মিশকাত, হাশিয়া ২/৬৯৬ পৃঃ; ইরওয়া হা/৪৩৩-৩৪, ২/১৭৮-৮২ পৃঃ।
[208] . মুসলিম হা/৪৯৯, ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘উম্মতের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দো‘আ করা’ অনুচ্ছেদ-৮৭।
[209] . মুসলিম হা/৪৫৮৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়-৩২, অনুচ্ছেদ-১৮, ‘বদরের যুদ্ধে ফেরেশতাগণের দ্বারা সাহায্য প্রদান’।
[210] . বুখারী, মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯, অনুচ্ছেদ-৫; বুখারী হা/৪৩৩৯ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৮০, ‘দো‘আয় হাত উঁচু করা’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[211] . এটি ছিল ৮ম হিজরীতে সংঘটিত ‘হোনায়েন’ যুদ্ধের পরপরই। বুখারী হা/৪৩২৩, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ সমূহ’ অধ্যায়-৬৪, ‘আওত্বাস যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ-৫৬।
[212] . বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬১১; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৬।
[213] . আবুদাঊদ হা/১৮৭২; মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫।
[214] . নাসাঈ হা/৩০১১।
[215] . বুখারী হা/১৭৫১-৫৩, ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, ‘জামরায় কংকর নিক্ষেপ ও হাত উঁচু করে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৩৯-৪২।
[216] . মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬০।
[217] . ছহীহ আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৬১; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৮/২৩০-৩১; ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম পৃঃ ৩৯২।
[218] . বাক্বারাহ ২/১৮৬, মুমিন/গাফের ৪০/৬০; বুখারী ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৮০, অনুচ্ছেদ-২৪, ২৫ ও অন্যান্য অনুচ্ছেদ সমূহ।
[219] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৭৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ-১৩ ; নায়ল ৩/১০৯ পৃঃ।
[220] . বুখারী হা/৪৫২২; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪৮৭, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘সারগর্ভ দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-৯।
সুন্নাত-নফলের বিবরণ
(ক) ফরয ব্যতীত সকল ছালাতই নফল বা অতিরিক্ত। তবে যেসব নফল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত পড়তেন বা পড়তে তাকীদ করতেন, সেগুলিকে ফিক্বহী পরিভাষায় ‘সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ’ বা ‘সুন্নাতে রাতেবাহ’ বলা হয়। যেমন ফরয ছালাত সমূহের আগে-পিছের সুন্নাত সমূহ। এই সুন্নাতগুলি কবাযা হ’লে তা আদায় করতে হয়। যেমন যোহরের প্রথম দু’রাক‘আত বা চার রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা যোহর ছালাত আদায়ের পরে পড়তে হয় এবং ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা ফজরের ছালাতের পরেই পড়তে হয়। [221] এজন্য তাকে বেলা ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়না।
২য় প্রকার সুন্নাত হ’ল ‘গায়ের মুওয়াক্কাদাহ’, যা আদায় করা সুন্নাত এবং যা করলে নেকী আছে, কিন্তু তাকীদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘দুই আযানের মধ্যে’ অর্থাৎ আযান ও এক্বামতের মাঝে ছালাত রয়েছে (২ বার)। তৃতীয়বারে বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’।[222] যেমন আছরের পূর্বে দুই বা চার রাক‘আত সুন্নাত, মাগরিব ও এশার পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত।[223] তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাগরিবের ব্যাপারে বিশেষভাবে বলেন, ‘তোমরা মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দু’রাক‘আত পড় (২ বার)। তৃতীয়বারে বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’। [224]
এর দ্বারা নফল ছালাতের নেকী যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মুছল্লী বৃদ্ধি পায়। যাতে জামা‘আতের নেকী বেশী হয়। [225]
(খ) ফরয ও সুন্নাতের জন্য স্থান পরিবর্তন ও কিছুক্ষণ দেরী করে উভয় ছালাতের মাঝে পাথর্ক্য করা উচিৎ।[226]
(গ) সুন্নাত বা নফল ছালাত সমূহ মসজিদের চেয়ে বাড়ীতে পড়া উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, বাড়ীতে নফল ছালাত অধিক উত্তম আমার এই মসজিদে ছালাত আদায়ের চাইতে; ফরয ছালাত ব্যতীত’।[227] অন্য হাদীছে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের বাড়ীতে কিছু ছালাত (অর্থাৎ সুন্নাত-নফল) আদায় কর এবং ওটাকে কবরে পরিণত করো না’।[228]
ইমাম নববী বলেন, বাড়ীতে নফল ছালাত আদায়ে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্য এটা হ’তে পারে যে, সেটা গোপনে হয় এবং ‘রিয়া’ মুক্ত হয়, বাড়ীতে বরকত হয়, আল্লাহর রহমত এবং ফেরেশতা মন্ডলী নাযিল হয় ও শয়তান পালিয়ে যায়।[229]
(ঘ) সাধারণ নফল ছালাতের জন্য কোন রাক‘আত নির্দিষ্ট নেই; যত খুশী পড়া যায়।[230] তবে রাতের বিশেষ নফল অর্থাৎ তারাবীহ বা তাহাজ্জুদের ছালাত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ১১ রাক‘আতের ঊর্ধ্বে পড়েননি।[231]
(ঙ) একই নফল ছালাত কিছু অংশ দাঁড়িয়ে ও কিছু অংশ বসে পড়া যায়।[232]
(চ) ফজরের সুন্নাত পড়ার পরে ডান কাতে স্বল্পক্ষণ শুতে হয়।[233]
সুন্নাত ও নফলের ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
(১) ‘যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। যোহরের পূর্বে চার, পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পরে দুই ও ফজরের পূর্বে দুই’।[234] ইবনে ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে যোহরের পূর্বে দু‘রাক‘আত সহ সর্বমোট দশ রাক‘আতের নিয়মিত আমলের কথা এসেছে।[235]
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
... ‘ক্বিয়ামতের দিন (মীযানের পাল্লায়) ফরয ইবাদতের কমতি হ’লে প্রতিপালক আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না। তখন নফল দিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার অন্যান্য সকল আমল সম্পর্কেও অনুরূপ করা হবে’ (যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদিতে)। [236]
তিনি বলেন, তোমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রির ন্যায় ঘনঘোর ফিৎনা সমূহে পতিত হবার আগেই নেক আমল সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবিত হও। যখন লোকেরা মুমিন অবস্থায় সকালে উঠবে ও কাফের অবস্থায় সন্ধ্যা করবে এবং মুমিন অবস্থায় সন্ধ্যা করবে ও কাফির অবস্থায় সকালে উঠবে। সে দুনিয়াবী স্বার্থের বিনিময়ে তার দ্বীনকে বিক্রি করবে’। [237] অর্থাৎ চারিদিকে অন্যায় ছেয়ে যাবে। সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হবে। নেক কাজের পথও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন আজকাল শিরক ও বিদ‘আতযুক্ত আমলকে নেক আমল বলা হচ্ছে। পক্ষান্তরে ছহীহ সুন্নাহভিত্তিক আমলকে বাতিল বলা হচ্ছে।
(৩) খাদেম রবী‘আহ বিন কা‘ব একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দাবী করেন যে, আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি বেশী বেশী সিজদার মাধ্যমে আমাকে সাহায্য কর’। অনুরূপ একটি প্রশ্নে আরেক খাদেম ছাওবানকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তুমি অধিকহারে সিজদা কর। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রতিটি সিজদার মাধ্যমে আল্লাহ তোমার সম্মানের স্তর একটি করে বৃদ্ধি করবেন ও তোমার থেকে একটি করে গোনাহ দূর করে দিবেন। [238]
দলীলের উৎসঃ
[221] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৪৩; আবুদাঊদ হা/১২৬৫-৬৭; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১০৪৪ ‘ছালাতের নিষিদ্ধ সময় সমূহ’ অনুচ্ছেদ-২২।
[222] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৬২ ‘আযানের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৫।
[223] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১১৭১-৭২; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৬৫, ১১৭৯-৮০; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৬২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪২-৪৩।
[224] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৬৫ ‘সুন্নাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।
[225] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০৬৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘জামা‘আত ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[226] . আবুদাঊদ হা/১০০৬, ‘ফরয ছালাতের স্থানে নফল আদায়কারী মুছল্লী সম্পর্কে’
 অনুচ্ছেদ-১৯৫।
[227] . আবুদাঊদ হা/১০৪৪; মিশকাত হা/১৩০০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[228] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭১৪, ১২৯৫, অনুচ্ছেদ-৭ ও ১৭; আবুদাঊদ হা/১০৪৩।
[229] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৬ পৃঃ।
[230] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৭ পৃঃ; ইরওয়া হা/৪৫৭, ২/২০৯ পৃঃ; আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইরওয়া হা/৪৬৯-৭০।
[231] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ইরওয়া ২/১৯১ পৃঃ।
[232] . মুসলিম, সুনান, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৭ পৃঃ।
[233] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১১৮৮, ১২০৬ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১; 
মির‘আত ৪/১৬৮, ১৯১ পৃঃ।
[234] . তিরমিযী, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৫৯ ‘সুন্নাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।
[235] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৬০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪০-৪১ পৃঃ।
[236] . আবুদাঊদ হা/৮৬৪-৬৬; তিরমিযী, নাসাঈ, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩৩০, ‘ছালাতুত 
তাসবীহ’ অনুচ্ছেদ-৪০।
[237] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৮৩ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়-২৭, পরিচ্ছেদ-১।
[238] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৬-৯৭, ‘সিজদার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।
মাসবূকের ছালাত
কেউ ইমামের সাথে ছালাতের কিছু অংশ পেলে তাকে ‘মাসবূক্ব’ বলে। মুছল্লী ইমামকে যে অবস্থায় পাবে, সে অবস্থায় ছালাতে যোগদান করবে। [239] ইমামের সাথে যে অংশটুকু পাবে, ওটুকুই তার ছালাতের প্রথম অংশ হিসাবে গণ্য হবে। রুকূ অবস্থায় পেলে স্রেফ সূরায়ে ফাতিহা পড়ে রুকূতে শরীক হবে। ‘ছানা’ পড়তে হবে না। সূরায়ে ফাতিহা পড়তে না পারলে রাক‘আত গণনা করা হবে না। মুসাফির কোন মুক্বীমের ইক্বতিদা করলে পুরা ছালাত আদায় করবে। অতএব রুকূ, সিজদা, বৈঠক যে অবস্থায় ইমামকে পাওয়া যাবে, সেই অবস্থায় জামা‘আতে যোগদান করবে। তাতে সে জামা‘আতের পূর্ণ নেকী পেয়ে যাবে। [240] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
 ‘ছালাতের যে অংশটুকু তোমরা পাও সেটুকু আদায় কর এবং যেটুকু বাদ পড়ে, সেটুকু পূর্ণ কর’। [241]
দলীলের উৎসঃ
[239]. তিরমিযী হা/৫৯১, মিশকাত হা/১১৪২ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘মুক্তাদীর করণীয় এবং মাসবূকের
 হুকুম’ অনুচ্ছেদ-২৮, পরিচ্ছেদ-২; ছহীহুল জামে‘ হা/২৬১।
[240]. আবুদাঊদ হা/৫৬৪; ঐ, মিশকাত হা/১১৪৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘মুক্তাদীর করণীয় এবং 
মাসবূকের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-২৮।
[241]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৬ ‘দেরীতে আযান’ অনুচ্ছেদ-৬; নায়ল ৪/৪৪-৪৬।
ক্বাযা ছালাত
ক্বাযা ছালাত দ্রুত ও ধারাবাহিকভাবে এক্বামত সহ আদায় করা বাঞ্ছনীয়।[242] খন্দকের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ মাগরিবের পরে যোহর থেকে এশা পর্যন্ত চার ওয়াক্তের ক্বাযা ছালাত এক আযান ও চারটি পৃথক এক্বামতে পরপর জামা‘আত সহকারে আদায় করেন। [243] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘কেউ ভুলে গেলে অথবা ঘুমিয়ে গেলে তার কাফফারা হ’ল ঘুম ভাঙলে অথবা স্মরণে আসার সাথে সাথে ক্বাযা ছালাত আদায় করা’। [244]
‘উমরী ক্বাযা’ অর্থাৎ বিগত বা অতীত জীবনের ক্বাযা ছালাত সমূহ বর্তমানে নিয়মিত ফরয ছালাতের সাথে যুক্ত করে ক্বাযা হিসাবে আদায় করা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা’।[245] কেননা ইসলাম তার পূর্বেকার সবকিছুকে ধ্বসিয়ে দেয়[246] এবং খালেছভাবে তওবা করলে আল্লাহ তাঁর বান্দার বিগত সকল গোনাহ মাফ করে দেন। [247] অতএব এমতাবস্থায় উচিৎ হবে, বেশী বেশী নফল ইবাদত করা। কেননা ফরয ইবাদতের ঘাটতি হ’লে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর হুকুমে নফল ইবাদতের নেকী দ্বারা তা পূর্ণ করা হবে।[248]
দলীলের উৎসঃ
[242] . মুসলিম হা/১৫৬০/৬৮০ ‘মসজিদসমূহ’ অধ্যায়-৫ ‘ক্বাযা ছালাত দ্রুত আদায় করা মুস্তাহাব’ অনুচ্ছেদ-৫৫।
[243] . নাসাঈ হা/৬৬২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৯১ পৃঃ; নায়ল ২/৯০ পৃঃ।
[244] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৩-০৪ ‘আগেভাগে ছালাত আদায়’ অনুচ্ছেদ-২; মুসলিম, মিশকাত হা/৬৮৪, ‘দেরীতে আযান’ অনুচ্ছেদ-৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৮২, ২০৫।
[245] . আলোচনা দ্রষ্টব্য: আলবানী-মিশকাত হা/৬০৩, টীকা-২।
[246] . মুসলিম, মিশকাত হা/২৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[247] . আল-ফুরক্বান ২৫/৭১; যুমার ৩৯/৫৩।
[248] . আবুদাঊদ হা/৮৬৪-৬৬; তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৩০, ‘ছালাতুত তাসবীহ’ অনুচ্ছেদ-৪০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২০৫।
১. পরিবহনে ছালাত
পরিবহনে কিংবা ভীতিকর অবস্থায় ক্বিবলামুখী না হ’লেও চলবে।[1] অবশ্য পরিবহনে ক্বিবলামুখী হয়ে ছালাত শুরু করা বাঞ্ছনীয়।[2] যখন পরিবহনে রুকূ-সিজদা করা অসুবিধা মনে হবে, তখন কেবল তাকবীর দিয়ে ও মাথার ইশারায় ছালাত আদায় করবে। সিজদার সময় মাথা রুকূর চেয়ে কিছুটা বেশী নীচু করবে।[3] যখন ক্বিবলা ঠিক করা অসম্ভব বিবেচিত হবে, কিংবা সন্দেহে পতিত হবে, তখন নিশ্চিত ধারণার ভিত্তিতে ক্বিবলার নিয়তে একদিকে ফিরে সামনে সুৎরা রেখে ছালাত আদায় করবে।[4] নৌকায় দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে, যদি ডুবে যাওয়ার ভয় না থাকে।[5] এ সময় বা অন্য যে কোন সময় কষ্টকর দাঁড়ানোর জন্য কিছুতে ঠেস দেওয়া যাবে। [6]
দলীলের উৎসঃ
[1] . বাক্বারাহ ২/২৩৮; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ইরওয়া হা/৫৮৮; ইবনু মাজাহ হা/১০২০; নায়ল ২/২৪৯।
[2] . আবুদাঊদ হা/১২২৪-২৮; নায়ল ২/২৯১ পৃঃ।
[3] . আবুদাঊদ হা/১২২৭; বায়হাক্বী, আহমাদ, তিরমিযী, ছিফাত ৫৫-৫৬ পৃঃ।
[4] . দারাকুৎনী, হাকেম, বায়হাক্বী, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, ইরওয়া হা/২৯১।
[5] . বাযযার, দারাকুৎনী, হাকেম, ছিফাত, পৃঃ ৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৭৭; নায়ল ৪/১১২।
[6] . আবুদাঊদ, হাকেম, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩১৯; ইরওয়া হা/৩৮৩।
২. রোগীর ছালাত
পীড়িতাবস্থায় দাঁড়াতে অক্ষম হলে কিংবা রোগবৃদ্ধির আশংকা থাকলে বসে, শুয়ে বা কাত হয়ে ছালাত আদায় করবে।[7] সিজদার জন্য সামনে বালিশ, টুল বা উঁচু কিছু নেওয়া যাবে না। যদি মাটিতে সিজদা করা অসম্ভব হয়, তাহ’লে ইশারায় ছালাত আদায় করবে। সিজদার সময় রুকূর চেয়ে মাথা কিছুটা বেশী নীচু করবে।[8] জানা আবশ্যক যে, শারঈ ওযর ব্যতীত ‘বসা মুছল্লী দাঁড়ানো মুছল্লীর অর্ধেক নেকী পেয়ে থাকেন’।[9]
দলীলের উৎসঃ
[7]. বুখারী, মিশকাত হা/১২৪৮ ‘কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন’ অনুচ্ছেদ-৩৪; সুনান, নায়ল ‘রোগীর ছালাত’ অনুচ্ছেদ, ৪/১১০ পৃঃ।
[8]. ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৩।
[9]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২৪৯, ১২৫২, ‘কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন’ অনুচ্ছেদ-৩৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৯৮ ‘রাতের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
৩. সুতরার বিবরণ
মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে যাওয়া নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রমকারী যদি জানত যে, এতে তার কত বড় পাপ রয়েছে, তাহ’লে তার জন্য সেখানে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ বছর দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম হ’ত অতিক্রম করে চলে যাওয়ার চাইতে।[10] ইমাম ও সুৎরার মধ্য দিয়ে অতিক্রমকারীকে হাদীছে ‘শয়তান’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।[11] এজন্য কিবলার দিকে লাঠি, দেওয়াল, মানুষ বা যেকোন বস্ত্ত দ্বারা মুছল্লীর সম্মুখে সুৎরা বা আড়াল করতে হয়।[12] তবে জামা‘আত চলা অবস্থায় অনিবার্য কারণে মুক্তাদীদের কাতারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা জায়েয আছে।[13] সিজদার স্থান থেকে সুৎরার মধ্যে একটি বকরী যাওয়ার মত ফাঁকা রাখা আবশ্যক।[14] অতএব মসজিদে বা খোলা স্থানে মুছল্লীর সিজদার স্থান হ’তে একটি বকরী যাওয়ার মত দূরত্ব রেখে অতিক্রম করা যেতে পারে। তবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাই উত্তম। উল্লেখ্য যে, সুৎরা না পেলে সম্মুখে রেখা টানার হাদীছ ‘যঈফ’। [15] আজকাল বিভিন্ন মসজিদে সুৎরা বানিয়ে রাখা হয়। যা মুছল্লীর সামনে রেখে যাতায়াত করা হয়। এটি সামনে দিয়ে যাবার শামিল এবং শরী‘আতে এর কোন প্রমাণ নেই।
দলীলের উৎসঃ
[10] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৭৬, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সুৎরা’ অনুচ্ছেদ-৯।
[11] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৭।
[12] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৩,৭৭৯,৭৭৭ ‘সুৎরা’ অনুচ্ছেদ-৯।
[13] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৮০।
[14] . বুখারী হা/৪৯৬; মুসলিম হা/১১৩৪; ছিফাত, পৃঃ ৬২।
[15] . আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৭৮১।
৪. যাদের ইমামতি সিদ্ধ
(১) বুঝদার বালক
(২) অন্ধ ব্যক্তি
(৩) বসা ব্যক্তির ইমামত দাঁড়ানো ব্যক্তির জন্য
(৪) দাঁড়ানো ব্যক্তির ইমামত বসা ব্যক্তির জন্য
(৫) নফল আদায়কারীর ইমামত ফরয আদায়কারীর জন্য
(৬) ফরয আদায়কারীর ইমামত নফল আদায়কারীর জন্য
(৭) তায়াম্মুমকারীর ইমামত ওযূকারীর জন্য
(৮) ওযূকারীর ইমামত তায়াম্মুমকারীর জন্য
(৯) মুক্বীমের ইমামত মুসাফিরের জন্য
(১০) মুসাফিরের ইমামত মুক্বীমের জন্য।[16]
[16] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭৬ পৃঃ।
৫. ফাসিক ও বিদ‘আতীর ইমামত
ফাসিক ও বিদ‘আতীর পিছনে ছালাত আদায় করা মাকরূহ।[17] তবে বাধ্যগত অবস্থায় জায়েয আছে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন,‘ইমামগণ তোমাদের ছালাতে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এক্ষণে তারা সঠিকভাবে ছালাত আদায় করালে তোমাদের জন্য নেকী রয়েছে। আর তারা ভুল করলে তোমাদের জন্য রয়েছে নেকী, কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে গোনাহ’। [18] এ বিষয়ে মহান খলীফা ওছমান (রাঃ)-কে বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহে অবরুদ্ধ অবস্থায় জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘মানুষের শ্রেষ্ঠ আমল হ’ল ছালাত। অতএব যখন তারা ভাল কাজ করে, তখন তুমি তাদের সাথী হও। আর যখন তারা মন্দ কাজ করে, তখন তুমি তাদের মন্দ কাজ থেকে দূরে থাক’। হাসান বছরীকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, صَلِّ و عليه بِدْعَتُهُ ‘তুমি তার পিছনে ছালাত আদায় কর। আর বিদ‘আতের গোনাহ বিদ‘আতীর উপরে বর্তাবে’। যুহরী বলেন, বাধ্যগত অবস্থায় ব্যতীত আমরা এটা জায়েয মনে করতাম না’।[19] আল্লাহ বলেন,‘তোমরা রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর’(বাক্বারাহ ২/৪৩)। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন যে, তিন ব্যক্তির ছালাত কবুল হয়না। তার মধ্যে একজন হ’ল ঐ ইমাম, যাকে মুছল্লীরা পসন্দ করে না’। [20]
সুন্নাত অমান্যকারী ব্যক্তিকে ইমাম বানানো যাবে না। এমনকি ফাসিক ও বিদ‘আতী কোন লোককে মসজিদ কমিটির সভাপতি বা সদস্য করা যাবে না। কেননা এতে তাকে সম্মান দেখনো হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ‘মুনকার’ কিছু দেখলে তা যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে। নইলে যবান দিয়ে। নইলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। আর এটা হ’ল দুর্বলতম ঈমান।[21]
দলীলের উৎসঃ
[17] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭৭ পৃঃ; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৭৪৭, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[18] . বুখারী, মিশকাত হা/১১৩৩, ‘ইমামের কর্তব্য’ অনুচ্ছেদ-২৭।
[19] . বুখারী হা/৬৯৫-৯৬ (ফাৎহুল বারী সহ), ‘আযান’ অধ্যায়-১০, ‘বিদ‘আতী ও ফিৎনা গ্রস্তের ইমামতি’ অনুচ্ছেদ-৫৬, ২/২২০-২৩।
[20] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১১২২-২৩, ১১২৮, সনদ হাসান, ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬।
[21] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৭, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’ অনুচ্ছেদ-২২।
৬. মহিলাদের ছালাত ও ইমামত
(ক) পুরুষ ও মহিলাদের ছালাতের মধ্যে পদ্ধতিগত কোন পার্থক্য নেই। ছালাতে নারীরা পুরুষের অনুগামী।[22] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নারী-পুরুষ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা সেভাবে ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখছ’।[23] মসজিদে নববীতে নারী-পুরুষ সকলে তাঁর পিছনে একই নিয়মে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ও জুম‘আ আদায় করেছেন।[24]
(খ) তবে মসজিদে পুরুষের জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ও জুম‘আ আদায় করা তাদের জন্য ফরয নয়। [25] অবশ্য মসজিদে যেতে তাদেরকে বাধা দেওয়াও যাবে না। এ সময় তারা সুগন্ধি মেখে (বা সৌন্দর্য প্রদর্শন করে) মসজিদে জামা‘আতে যেতে পারবে না।[26] মহিলাদের জন্য বাড়ীতে গৃহকোণে নিভৃতে একাকী বা জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করা উত্তম।[27]
(গ) মহিলাগণ (নিম্নস্বরে) আযান ও ইক্বামত দিবেন এবং মহিলা জামা‘আতের প্রথম কাতারের মধ্যস্থলে সমান্তরালভাবে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবেন।[28] ফরয ও তারাবীহর জামা‘আতে তাদের ইমামতি করার স্পষ্ট দলীল রয়েছে।[29] মা আয়েশা (রাঃ) ও উম্মে সালামাহ (রাঃ) প্রমুখ মহিলাদের জামা‘আতে ইমামতি করতেন। [30] বদর যুদ্ধের সময় উম্মে ওয়ারাক্বাহ (রাঃ)-কে তার পরিবারের ইমামতি করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তার জন্য একজন বৃদ্ধ মুওয়াযযিন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।[31] অন্য বর্ণনায় খাছভাবে এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) তাকে তার পরিবারের মহিলাদের ইমামতির অনুমতি দিয়েছিলেন’।[32]
(ঘ) মহিলারা পুরুষদের ইমামতি করতে পারবে না।[33] কেননা আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪)। তাছাড়া এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশ নেই এবং তাঁর ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এর কোন নযীর বা প্রচলন নেই। আর এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের সময় যা দ্বীন ছিল না, পরে তা দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে না।[34]
দলীলের উৎসঃ
[22] . মির‘আত ৩/৫৯; নায়ল ৩/১৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৯।
[23] . বুখারী, মিশকাত হা/৬৮৩ ‘দেরীতে আযান’ অনুচ্ছেদ-৬।
[24] . বুখারী, মিশকাত হা/৯৪৮ ‘তাশাহহুদে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৭; মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৯ ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫।
[25] . আবুদাঊদ হা/৫৬৭, ৫৭০; আহমাদ হা/২৭১৩৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭১।
[26] . আবুদাঊদ হা/৫৬৫; মুসলিম, মিশকাত হা/১০৫৯-৬১ ‘জামা‘আতে ছালাত ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭১।
[27] . আবুদাঊদ হা/৫৬৭, ৫৭০; মিশকাত হা/১০৬২-৬৩।
[28] . ভূপালী, আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ (ছান‘আ, ইয়ামন : ১৪১১/১৯৯১) ১/৩২২ পৃঃ।
[29] . আবুদাঊদ হা/৫৯১, দারাকুৎনী প্রভৃতি ইরওয়া হা/৪৯৩; নায়ল ৪/৬৩।
[30] . বায়হাক্বী, ১/৪০৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৯১, ১৭৭।
[31] . আবুদাঊদ হা/৫৯১-৯২; ছহীহ ইবনু খুযায়মা, আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩২২; নায়ল ৪/৬৩ ; ইরওয়া হা/৪৯৩।
[32] . দারাকুৎনী হা/১০৭১, সনদ যঈফ।
[33] . আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩১২।
[34] . আহমাদ, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/১৬৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-৫।
৭. অন্ধ, গোলাম ও বালকদের ইমামত
(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)-কে দু’বার মদ্বীনার ইমামতির দায়িত্ব দেন।[35] অন্ধ ছাহাবী উৎবান বিন মালেক (রাঃ) তার কওমের ইমামতি করতেন। [36]
 (খ) আবু হুযায়ফা (রাঃ)-এর গোলাম সালেম ক্বোবা-র ‘আছবাহ (العصبة) নামক স্থানে হিজরতের পূর্বে মুসলমানদের ইমামতি করতেন। ওমর ও আবু সালামা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী তার মুক্তাদী হ’তেন।[37] হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর গোলাম আবু ‘আমর মুক্ত হওয়ার পূর্বে লোকদের ইমামতি করতেন (মুসনাদে শাফেঈ)।
(গ) ‘আমর বিন সালামাহ বিন ক্বায়েস (রাঃ) ভাল ক্বারী হওয়ার কারণে ৬, ৭ বা ৮ বছর বয়সে ইমামতি করেছেন।[38]
দলীলের উৎসঃ
[35] . আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৫৯৫; মিশকাত হা/১১২১ ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬।
[36] . বুখারী, নাসাঈ, নায়লুল আওত্বার ৪/৫৭-৫৮, ‘অন্ধের ইমামত’ অনুচ্ছেদ।
[37] . বুখারী, মিশকাত হা/১১২৭ ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬; নায়লুল আওত্বার ৪/৫৯।
[38] . আহমাদ, আবুদাঊদ, নাসাঈ প্রভৃতি; নায়ল ৪/৬৩; বুখারী, মিশকাত হা/১১২৬।
৮. ইমামতের হকদার
(১) বালক বা কিশোর হলেও ক্বিরাআতে পারদর্শী ব্যক্তিই ইমামতির প্রথম হকদার। (২) ইলমে হাদীছে পারদর্শী ও সুন্নাতের পাবন্দ ব্যক্তি। (৩) সেদিকে সমান হ’লে বয়সে যিনি বড় তিনিই ইমাম হবেন।[39]
দলীলের উৎসঃ
[39] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১১৭; বুখারী, মিশকাত হা/১১২৬।
৯. ইমামের অনুসরণ
ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ ‘ইমাম নিযুক্ত করা হয়, কেবল তাঁকে অনুসরণ করার জন্য’।[40] ইমামের পিছে পিছে মুক্তাদী তাকবীর, রুকূ, সিজদা, ক্বিয়াম ও সালাম ফিরাবে। [41] বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদায় গিয়ে মাটিতে চেহারা না রাখা পর্যন্ত আমাদের কেউ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পিঠ ঝুঁকাতো না।[42] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুক্তাদী যদি ইমামের আগে মাথা উঠায় (অর্থাৎ রুকূ-সিজদা থেকে বা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়), তবে (ক্বিয়ামতের দিন) তার মাথা হবে গাধার মাথা’ (অর্থাৎ তার ছালাত কবুল হবে না)। [43]
ইমামের অনুসরণ হবে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার জন্য। যেমন তাকবীর, রুকূ, ক্বিয়াম, সুজূদ, সালাম ইত্যাদি সময়ে। এর অর্থ এটা নয় যে, ইমাম সুন্নাত তরক করলে মুক্তাদীকেও সুন্নাত তরক করতে হবে। অতএব ইমাম বুকে হাত না বাঁধলে বা সশব্দে আমীন না বললে বা রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করলেও মুক্তাদী ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী সেগুলি আমল করবেন। এর ফলে তিনি সুন্নাত অনুসরণের নেকী পাবেন। ওযরের কারণে ইমাম বা কোন মুক্তাদী বসে পড়তে পারেন। কিন্তু অন্যেরা দাঁড়িয়ে পড়বেন।[44] ইমাম অবশ্যই প্রথম রাক‘আত তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ করবেন। ওযূ টুটে গেলে তিনি তাঁর পিছন থেকে একজনকে ইমামতি দিয়ে বেরিয়ে যাবেন। ইমাম যদি ভুলবশত: নাপাক অবস্থায় ইমামতি করে থাকেন, তাহ’লে জামা‘আত শেষে পাক হয়ে তিনি তা পুনরায় পড়বেন। কিন্তু মুক্তাদীদের পুনরায় পড়তে হবে না।[45]
দলীলের উৎসঃ
[40] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৩৯ ‘মুক্তাদীর কর্তব্য ও মাসবূকের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-২৮।
[41] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১৩৭।
[42] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৩৬।
[43] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৪১, ১১৩৮।
[44]. বুখারী, মিশকাত হা/১১৩৯; মির‘আত ৪/৮৯।১৪৬ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)
[45] ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৮০।
১০. মুসাফিরের ইমামত
ইমাম ক্বছর করলে মুক্বীম পুরা পড়বেন এবং ইমাম পুরা পড়লে মুসাফির পুরা পড়বেন। যদিও কিছু অংশ পান।[46] কেউ কোথাও গেলে সেই এলাকার লোকই ইমামতি করবেন।[47] তবে তাদের অনুমতিক্রমে তিনি ইমামতি করতে পারবেন। [48]
দলীলের উৎসঃ
[46] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭৭।
[47] . মুসলিম, আবুদাঊদ হা/৫৯৬; মিশকাত হা/১১২০।
[48] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১১৭, ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬।
১১. জামা‘আত ও কাতার
(ক) দু’জন মুছল্লী হলে জামা‘আত হবে। ইমাম বামে ও মুক্তাদী ডাইনে দাঁড়াবে।[49] তিনজন মুছল্লী হলে ইমাম সম্মুখে এবং দু’জন মুক্তাদী পিছনে দাঁড়াবে।[50] তবে বিশেষ কারণে ইমামের দু’পাশে দু’জন সমান্তরালভাবে দাঁড়াতে পারেন। তার বেশী হ’লে অবশ্যই পিছনে কাতার দিবেন।[51] সামনের কাতারে পুরুষগণ ও পিছনের কাতারে মহিলাগণ দাঁড়াবেন। [52] পুরুষ সকলের ইমাম হবেন। কিন্তু নারী কখনো পুরুষের ইমাম হবেন না। নারী ও পুরুষ কখনোই পাশাপাশি দাঁড়াবেন না। দু’জন বয়স্ক পুরুষ, একটি বালক ও একজন মহিলা মুছল্লী হ’লে বয়স্ক একজন পুরুষ ইমাম হবেন। তাঁর পিছনে উক্ত পুরুষ ও বালকটি এবং সকলের পিছনে মহিলা একাকী দাঁড়াবেন। আর যদি দু’জন পুরুষ ও একজন মহিলা হন, তাহ’লে ইমামের ডাইনে পুরুষ মুক্তাদী দাঁড়াবেন এবং পিছনে মহিলা একাকী দাঁড়াবেন। [53] একজন পুরুষ ও একজন মহিলা হ’লে সামনে পুরুষ ও পিছনে মাহিলা দাঁড়াবেন। ইমামকে মধ্যবর্তী ধরে কাতার ডাইনে ও বামে সমান করতে হবে। তবে ডাইনে সামান্য বৃদ্ধি হবে। কিন্তু কোনক্রমেই ডান প্রান্ত থেকে বা মসজিদের উত্তর দেওয়াল থেকে ২য় ও পরবর্তী কাতার সমূহ শুরু করা যাবে না। প্রয়োজনে ইমাম উঁচুতে ও মুক্তাদীগণ নীচে দাঁড়াতে পারেন।[54] ইমামের আওয়ায পৌঁছলে এবং ইক্তেদা সম্ভব হ’লে ইবনু হাজার বলেন, ইমাম নীচে থাকুন বা উপরে থাকুন ছালাত আদায় করা জায়েয।[55] তবে ইমামের নীচে থাকাই উত্তম। এক ব্যক্তি দ্বিতীয়বার জামা‘আতে ইমাম বা মুক্তাদী হিসাবে যোগদান করতে পারেন। তখন দ্বিতীয়টি তার জন্য নফল হবে। [56] ইমাম অতি দীর্ঘ করলে কিংবা অন্য কোন বাধ্যগত কারণে মুক্তাদী সালাম ফিরিয়ে জামা‘আত ত্যাগ করে একাকী শুরু থেকে ছালাত আদায় করতে পারবেন।[57]
(খ) কাতার সোজা করা
সম্মুখের কাতারগুলি আগে পূর্ণ করতে হবে।[58] কেননা ফেরেশতাগণ আল্লাহর সম্মুখে এভাবেই কাতার দিয়ে থাকেন। [59] কাতার সোজা করতে হবে এবং কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলাতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘তোমরা কাতার সোজা কর, কেননা কাতার সোজা করা ছালাত প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত’। [60] আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের শুরুতে আমাদের কাঁধগুলিতে হাত দিয়ে পরস্পরে মিলিয়ে দিতেন এবং বলতেন, اسْتَوُوا وَلاَ تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ ‘তোমরা কাতার সোজা কর, বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ো না। তাতে তোমাদের অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যাবে’।[61] আনাস (রাঃ) বলেন,‘আমাদের মধ্য থেকে একজন পরস্পরের কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলিয়ে দিতেন’। ছাহাবী নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন,‘অতঃপর দেখলাম যে, একজন ব্যক্তি মুছল্লীদের পরস্পরের কাঁধে কাঁধ, হাঁটুতে হাঁটু ও গোড়ালিতে গোড়ালি মিলিয়ে দিচ্ছেন’।[62] যার ভিত্তিতে ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে-‘ছালাতের কাতারে কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো অনুচ্ছেদ’। [63]
এখানে পা মিলানো অর্থ পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দেওয়া। যাতে কোনরূপ ফাঁক না থাকে এবং কাতারও সোজা হয়। বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে أَقِيْمُوْا صُفُوْفَكُمْ وَ تَرَاصُّوْا ‘তোমরা কাতার সোজা কর এবং পরস্পরে ভালভাবে (কাঁধ ও পা) মিলাও’।[64] আবুদাঊদের অন্য বর্ণনায় এসেছে, حَاذُوْا بَيْنَ الْمَنَاكِبِ وَسُدُّوا الْخَلَلَ... وَلاَ تَذَرُوْا فُرُجَاتٍ لِلشَّيْطَانِ ‘কাঁধগুলি সমান কর ও ফাঁক বন্ধ কর এবং শয়তানের জন্য কোন জায়গা খালি ছেড়োনা’। ‘কেননা আমি দেখি যে, শয়তান ছোট কালো বকরীর ন্যায় (كأَنَّها الْحَذَفُ) তোমাদের মাঝে ঢুকে পড়ে’। [65] ইবনু হাজার বলেন, নু‘মান বিন বাশীরের বর্ণনার শেষাংশে كَعْبَه بكَعْبِه ‘গোড়ালির সাথে গোড়ালি’ কথাটি এসেছে। এর দ্বারা পায়ের পার্শ্ব বুঝানো হয়েছে, পায়ের পিছন অংশ নয়, যেমন অনেকে ধারণা করেন’।[66] এখানে মুখ্য বিষয় হ’ল দু’টি: কাতার সোজা করা ও ফাঁক বন্ধ করা। অতএব পায়ের সম্মুখভাগ সমান্তরাল রেখে পাশাপাশি মিলানোই উত্তম।
পুরুষ ও মহিলা মুছল্লী স্ব স্ব কাতারে দু’পা স্বাভাবিক ফাঁক করে দাঁড়াবেন। যাতে পায়ের মাঝখানে নিজের জুতা জোড়া রাখা যায়। [67] দেহের ভারসাম্যের অধিক পা ফাঁক করবেন না। মহিলা মুছল্লী তার দুই গোড়ালি একত্রিত করে দাঁড়াবেন না। এগুলি স্রেফ কুসংস্কার মাত্র। পরস্পরে কাঁধ, হাঁটু ও গোড়ালি মিলানোর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে বানোয়াট যুক্তিতে নিয়মিতভাবে পরস্পরে পা ফাঁক করে কাতার দাঁড়ানোর মধ্যে কোন নেকী নেই, স্রেফ গোনাহ রয়েছে। এই বাতিল রেওয়াজ থেকে দ্রুত তওবা করে পায়ে পা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই ভাই হয়ে কাতার দাঁড়ানো কর্তব্য।
উল্লেখ্য যে, দুই পিলারের মাঝখানে কাতার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।[68]
(গ) ১ম কাতারের নেকী :
১ম কাতারে নেকী বেশী। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যদি লোকেরা জানতো ১ম কাতারে কি নেকী আছে, তাহ’লে তারা লটারী করত। [69] তিনি বলেন, ‘প্রথম কাতার হ’ল ফেরেশতাদের কাতারের ন্যায়। যদি তোমরা জানতে এর ফযীলত কত বেশী, তাহ’লে তোমরা এখানে আসার জন্য অতি ব্যস্ত হয়ে উঠতে’।[70] অবশ্য ১ম কাতারে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ ইমামের নিকটবর্তী থাকবেন, অতঃপর মর্যাদা অনুযায়ী অন্যান্যগণ। এ সময় মসজিদে বাজারের মত শোরগোল করা নিষেধ (إِيَّاكُمْ وَهَيْشَاتِ الأَسْوَاقِ)। [71]
(ঘ) একাকী কাতারের পিছনে না দাঁড়ানো :
কাতারের পিছনে একাকী দাঁড়াবে না। কেননা অনুরূপভাবে ছালাত আদায়ের কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে পুনরায় ছালাত আদায় করতে বলেন।[72] তবে সামনের কাতারে জায়গা না থাকলে বাধ্যগত অবস্থায় পিছনে একাকী দাঁড়ানো জায়েয আছে। [73]
দলীলের উৎসঃ
[49] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১০৬, ‘দাঁড়ানোর স্থান’ অনুচ্ছেদ-২৫; আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩০৮।
[50] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১০৭, অনু-২৫।
[51] . নাসাঈ হা/১০২৯; আবুদাঊদ হা/৬১৩।
[52] . মুসলিম, মিশকাত হা/১০৯২; আবুদাঊদ হা/৬৭৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৮।
[53] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১০৮, ১১০৯, অনুচ্ছেদ-২৫; আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩০৮।
[54] . আবুদাঊদ হা/৫৯৭, অনুচ্ছেদ-৬৭।
[55] . ‘আওনুল মা‘বূদ হা/৫৮৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭৯-৮০।
[56] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৭৮।
[57] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৩৩ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; মির‘আত ৪/১৩৯।
[58] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১০৯৪, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[59] . আবুদাঊদ হা/৬৬১ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৪।
[60] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৮৭, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[61] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৮৮, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[62] . আবুদাঊদ হা/৬৬২ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৪।
[63] . বুখারী হা/৭২৫, ফৎহুল বারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৭৬।
[64] . বুখারী হা/৭১৯, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৭২; ঐ, মিশকাত হা/১০৮৬ ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪; মির‘আত ৪/৪।
[65] . আবুদাঊদ হা/৬৬৬-৬৭; মিশকাত হা/১১০২, ১০৯৩, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[66] . আবুদাঊদ হা/৬৬২; বুখারী হা/৭২৫; ফাৎহুল বারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, ‘কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা মিলানো’ অনুচ্ছেদ-৭৬, ২/২৪৭ পৃঃ।
 [67] . আবুদাঊদ হা/৬৫৪-৫৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯০।
[68] . আবুদাঊদ হা/৬৭৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৯৫।
[69] . বুখারী হা/৭২১ (ফাৎহুল বারী সহ), মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬২৮, ‘ছালাতের ফযীলতসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৩।
[70] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০৬৬ ‘জামা‘আত ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[71] . মুসলিম, মিশকাত হা/১০৮৮-৮৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[72] . আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১১০৫ ‘কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ-২৪।
[73] . বাক্বারাহ ২/২৮৬, তাগাবুন ৬৪/১৬; নায়ল ৪/৯২-৯৩ পৃঃ।
                                              ১২. আঙ্গুলে তাসবীহ গণনা করা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা তাসবীহ সমূহ আঙ্গুলে গণনা কর। কেননা আঙ্গুল সমূহ ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে এবং তারা কথা বলবে’।[74] দানা বা কংকর দিয়ে তাসবীহ গণনার হাদীছটি যঈফ [75] এবং ‘তাসবীহ মালায় গণনাকারী ব্যক্তি কতই না সুন্দর’ (نِعْمَ الْمُذَكِّرُ السُّبْحَةَ) মর্মে বর্ণিত মরফূ হাদীছটি মওযূ বা জাল।[76] অতএব প্রচলিত তাসবীহ মালায় বা অন্য কিছু দ্বারা তাসবীহ গণনা করা সুন্নাত বিরোধী আমল। তাছাড়া এতে ‘রিয়া’ অর্থাৎ লোক দেখানোর সম্ভাবনা বেশী থাকে। আর ‘রিয়া’ হ’ল ছোট শিরক’।[77] ফলে তাসবীহ পাঠের সকল নেকী বরবাদ হবার সম্ভাবনা থাকবে।
তাসবীহ দু’হাতে বা বাম হাতে নয়। বরং ডান হাতে গণনা করতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খানাপিনাসহ সকল শুভ ও পবিত্র কাজ ডান হাতে করতেন এবং পায়খানা-পেশাব ও অন্যান্য কাজ বামহাতে করতেন।[78] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ডান হাতে তাসবীহ গণনা করতে দেখেছি।[79] আর এটা স্বত:সিদ্ধ কথা যে, ডান হাতের গণনা কড়ে আঙ্গুল দিয়ে শুরু করতে হয়, বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে নয়। কেননা ডান হাতের ডান পাশ কড়ে আঙ্গুল দিয়েই শুরু হয়েছে এবং এ আঙ্গুল দিয়ে গণনা শুরু করাটাই সহজ ও স্বভাবগত।
দলীলের উৎসঃ
[74] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২৩১৬ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, অনুচ্ছেদ-৩।
[75] . আবুদাঊদ হা/১৫০০, ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, ‘কংকর দ্বারা তাসবীহ গণনা’ অনুচ্ছেদ-৩৫৯; মিশকাত হা/২৩১১।
[76] . মুসনাদে দায়লামী; যঈফাহ হা/৮৩।
[77] . আহমাদ, মিশকাত হা/৫৩৩৪ ‘ ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-২৬, ‘লোক দেখানো ও শুনানো’ অনুচ্ছেদ-৫; ছহীহাহ হা/৯৫১।
[78] . আবুদাঊদ হা/৩২-৩৩; ঐ, মিশকাত হা/৩৪৮, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩।
[79] . বায়হাক্বী ২/১৮৭; আবুদাঊদ হা/১৫০২ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-৩৫৯।
১৩. আয়াত সমূহের জওয়াব
(১) সূরা আ‘লা-তে ‘সাব্বিহিস্মা রব্বিকাল আ‘লা’-এর জওয়াবে ‘সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা’ (মহাপবিত্র আমার প্রতিপালক, যিনি সর্বোচ্চ)। [80]
(২) সূরা ক্বিয়ামাহ-এর শেষ আয়াতের জওয়াবে ‘সুবহা-নাকা ফা বালা’ (মহাপবিত্র আপনি! অতঃপর হাঁ, আপনিই মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন)। [81]
(৩) সূরা গাশিয়া-র শেষে ‘আল্লা-হুম্মা হা-সিবনী হিসা-বাঁই ইয়াসীরা’ বলে প্রার্থনা করা (অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি সহজভাবে আমার হিসাব গ্রহণ কর’)। [82] হাদীছে নির্দিষ্ট কোন সূরার নাম বলা হয়নি। তবে অর্থের বিবেচনায় এখানে অত্র দো‘আ পাঠ করা হয়ে থাকে। অন্য আয়াতে ‘হিসাব’-এর বিবরণ আসলে সেখানেও এ দো‘আ পড়া যাবে।
(৪) সূরা রহমান-য়ে ‘ফাবে আইয়ে আ-লা-য়ে রাব্বিকুমা তুকাযযিবা-ন’-এর জওয়াবে ‘লা বেশাইয়িম মিন নি‘আমিকা রব্বানা নুকাযযিবু ফালাকাল হাম্দ’ (হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার কোন একটি নে‘মতকেও আমরা অস্বীকার করি না। অতঃপর তোমার জন্যই সকল প্রশংসা)।[83]
উল্লেখ্য যে, (ক) সূরা তীন-এর শেষে ‘বালা ওয়া আনা ‘আলা যা-লিকা মিনাশ শা-হেদ্বীন’ এবং (খ) সূরায়ে মুরসালাত-এর শেষে ‘আ-মান্না বিল্লাহ’ বলার হাদীছ ‘যঈফ’।[84] (গ) সূরা বাক্বারাহর শেষে ‘আমীন’ বলার হাদীছ ‘যঈফ’। [85] (ঘ) সূরা মুল্কের শেষে দো‘আ পাঠের কোন ভিত্তি নেই।
মিশকাত-এর ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ছালাতের মধ্যে হৌক বা বাইরে হৌক, পাঠকারীর জন্য উপরোক্ত আয়াত সমূহের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। যা বর্ণিত হাদীছ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু শ্রোতা বা মুক্তাদীর জন্য উপরোক্ত আয়াত সমূহের জওয়াব দেওয়ার প্রমাণে স্পষ্ট কোন মরফূ হাদীছ আমি অবগত নই। তবে আয়াত গুলিতে প্রশ্ন রয়েছে। সেকারণ জওয়াবের মুখাপেক্ষী। কাজেই পাঠকারী ও শ্রোতা উভয়ের জন্য উত্তর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। [86] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, বক্তব্যটি মুৎলাক্ব অর্থাৎ সাধারণ ভাবে এসেছে। অতএব তা ছালাত ও ছালাতের বাইরে এবং ফরয ও নফল সব ছালাতকে শামিল করে। তিনি ‘মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা’র বরাতে একটি ‘আছার’ উদ্ধৃত করেন এই মর্মে যে, ছাহাবী আবু মূসা আশ‘আরী ও মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) ফরয ছালাতে উক্ত জওয়াব দিতেন। ওমর ও আলী (রাঃ) সাধারণভাবে সকল অবস্থায় জওয়াব দিতেন। [87]
দলীলের উৎসঃ
[80] . আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৮৮৩, মিশকাত হা/৮৫৯ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[81] . বায়হাক্বী, আবুদাঊদ হা/৮৮৪, ‘ছালাতে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৫৪; হাদীছ ছহীহ।
[82] . আহমাদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/৫৫৬২ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হিসাব ও মীযান’ অনুচ্ছেদ-৩, হাদীছ হাসান।
[83] . তিরমিযী হা/৩৫২২; মিশকাত হা/৮৬১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৫০।
 [84] . আবুদাঊদ হা/৮৮৭, মিশকাত হা/৮৬০, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; হাদীছ যঈফ।
[85] . তাফসীর ইবনে জারীর হা/৬৫৪১, তাহক্বীক্ব তাফসীর ইবনে কাছীর।
[86] . মির‘আত (বেনারস, ভারত ১৪১৫/১৯৯৫) ৩/১৭৫ পৃঃ।
[87] . আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, পৃঃ ৮৬ হাশিয়া।

১৪. সিজদায়ে সহো
ছালাতে ভুলক্রমে কোন ‘ওয়াজিব’ তরক হয়ে গেলে শেষ বৈঠকের তাশাহহুদ শেষে সালাম ফিরানোর পূর্বে ‘সিজদায়ে সহো’ দিতে হয়। রাক‘আতের গণনায় ভুল হলে বা সন্দেহ হ’লে বা কম বেশী হয়ে গেলে বা ১ম বৈঠকে না বসে দাঁড়িয়ে গেলে ইত্যাদি কারণে এবং মুক্তাদীগণের মাধ্যমে ভুল সংশোধিত হ’লে ‘সিজদায়ে সহো’ আবশ্যক হয়। শাওকানী বলেন, ওয়াজিব তরক হলে ‘সিজদায়ে সহো’ ওয়াজিব হবে এবং সুন্নাত তরক হলে ‘সিজদায়ে সহো’ সুন্নাত হবে।[88] অতএব ছালাতে ক্বিরাআত ভুল হ’লে বা সের্রী ছালাতে ভুলবশত ক্বিরাআত জোরে বা তার বিপরীত হয়ে গেলে সহো সিজদার প্রয়োজন নেই।
নিয়ম : (১) যদি ইমাম ছালাতরত অবস্থায় নিজের ভুল সম্পর্কে নিশ্চিত হন কিংবা সরবে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলার মাধ্যমে লোকমা দিয়ে মুক্তাদীগণ ভুল ধরিয়ে দেন, তবে তিনি শেষ বৈঠকের তাশাহ্হুদ শেষে তাকবীর দিয়ে পরপর দু’টি ‘সিজদায়ে সহো’ দিবেন। অতঃপর সালাম ফিরাবেন।[89]
(২) যদি রাক‘আত বেশী পড়ে সালাম ফিরিয়ে দেন, অতঃপর ভুল ধরা পড়ে, তখন (পূর্বের ন্যায় বসে) তাকবীর দিয়ে ‘সিজদায়ে সহো’ করে সালাম ফিরাবেন। [90]
(৩) যদি রাক‘আত কম করে সালাম ফিরিয়ে দেন। তখন তাকবীর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাকী ছালাত আদায় করবেন ও সালাম ফিরাবেন। অতঃপর (তাকবীর সহ) দু’টি ‘সিজদায়ে সহো’ দিয়ে পুনরায় সালাম ফিরাবেন।[91]
(৪) ছালাতের কমবেশী যাই-ই হৌক সালামের আগে বা পরে দু’টি ‘সিজদায়ে সহো’ দিবেন।[92]
মোট কথা ‘সিজদায়ে সহো’ সালামের পূর্বে ও পরে দু’ভাবেই জায়েয আছে। কিন্তু তাশাহহুদ শেষে কেবল ডাইনে একটি সালাম দিয়ে দু’টি ‘সিজদায়ে সহো’ করে পুনরায় তাশাহ্হুদ ও দরূদ পড়ে দু’দিকে সালাম ফিরানোর প্রচলিত প্রথার কোন ভিত্তি নেই।[93] সিজদায়ে সহো-র পরে ‘তাশাহ্হুদ’ পড়ার বিষয়ে ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) হ’তে যে হাদীছটি এসেছে, সেটি ‘যঈফ’।[94] তাছাড়া একই রাবী কর্তৃক বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের ছহীহ হাদীছের বিরোধী। কেননা সেখানে তাশাহ্হুদের কথা নেই।[95]
ইমামের ভুল হ’লে পুরুষ মুক্তাদী সরবে ‘সুবহা-নাল্লা-হ’ বলে এবং মহিলা মুক্তাদী হাতের পিঠে হাত মেরে শব্দ করে ‘লোকমা’ দিবে (কুরতুবী)। [96] অর্থাৎ ভুল স্মরণ করিয়ে দিবে। এখানে নারী ও পুরুষের লোকমা দানের পৃথক পদ্ধতির কারণ হ’ল এই যে, নারীর কণ্ঠস্বরটাও লজ্জার অন্তর্ভুক্ত (لِأَنَّ صَوْتَهُنَّ عَوْرَةٌ)। যা প্রকাশ পেলে পুরুষের মধ্যে ফিৎনার সৃষ্টি হ’তে পারে। বস্ত্তত: একারণেই নারীদের উচ্চকণ্ঠে আযান দিতে নিষেধ করা হয়েছে।[97]
দলীলের উৎসঃ
[88] . শাওকানী, আস-সায়লুল জাররা-র (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/২৭৪ পৃঃ।
[89] . মুসলিম, মিশকাত হা/১০১৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৮ ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-২০।
[90] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-২০।
[91] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৭ ; মুসলিম, মিশকাত হা/১০২১।
 [92] . মুসলিম হা/১২৮৭ (৫৭২), ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-১৯; নায়লুল আওত্বার ৩/৪১১ পৃঃ।
[93] . মির‘আতুল মাফাতীহ ২/৩২-৩৩ পৃঃ ; ঐ, ৩/৪০৭, হা/১০২৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[94] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইরওয়াউল গালীল হা/৪০৩, ২/১২৮-২৯ পৃঃ।
[95] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০১৭ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সহো’ অনুচ্ছেদ-২০।
[96] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯৮৮ ‘ছালাতে সিদ্ধ ও অসিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯; মির‘আত ৩/৩৫৭।
[97] . মির‘আত ৩/৩৫৭-৫৮; اَلْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১০৯ ‘বিবাহ’ অধ্যায়-১৩; فَلاَ تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ... আহযাব ৩৩/৩২।
১৫. সিজদায়ে তেলাওয়াত
পবিত্র কুরআনে এমন কতকগুলি আয়াত রয়েছে, যেগুলি তেলাওয়াত করলে বা শুনলে মুমিন পাঠক ও শ্রোতা সকলকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি সিজদা করতে হয়। এই সিজদা যেহেতু ছালাত নয়, সে কারণে এর জন্য ওযূ বা ক্বিবলা শর্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মুশরিকরাও একবার সিজদা দিয়েছিল। এক স্থানে দীর্ঘক্ষণ থাকলে এ সিজদা সঙ্গে সঙ্গে না করে কিছু পরেও করা যায়। স্থান পরিবর্তন হ’লে আর সিজদা করতে হয় না, ক্বাযাও আদায় করতে হয় না। জেহরী বা সের্রী ছালাতে তেলাওয়াত করলেও এ সিজদা দিতে হয়। একই আয়াত বারবার পড়লে তেলাওয়াত শেষে একবার সিজদা দিলেই যথেষ্ট হবে। গাড়ীতে চলা অবস্থায় সিজদার আয়াত পড়লে বা শুনলে ইশারায় বা নিজের হাতের উপরে সিজদা করবে। এই সিজদা ফরয নয়। করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই।
নিয়ম : প্রথমে তাকবীর দিয়ে সিজদায় যাবে। অতঃপর দো‘আ পড়বে এবং পুনরায় তাকবীর দিয়ে মাথা উঠাবে।[98] সিজদা মাত্র একটি হবে। এতে তাশাহহুদ নেই, সালামও নেই।[99]
ফযীলত : সিজদার আয়াত শুনে বনু আদম সিজদায় চলে গেলে শয়তান কাঁদতে থাকে আর বলে যে, হায়! বনু আদমকে সিজদার আদেশ দিলে সে সিজদা করল ও জান্নাতী হ’ল। আর আমাকে সিজদার আদেশ দিলে আমি অবাধ্যতা করলাম ও জাহান্নামী হ’লাম।[100] একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরায়ে নাজম তেলাওয়াত শেষে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করলে ঐ সময় কা‘বা চত্বরে উপস্থিত মুশরিক কুরায়েশরা সবাই সিজদায় পড়ে যায়। কিন্তু একজন বৃদ্ধ কুরায়েশ নেতা একমুঠো মাটি কপালে ঠেকিয়ে বলে যে, আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে পরে কাফের অবস্থায় নিহত হ’তে দেখেছি। [101] এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বাকী যারা ঐদিন সিজদা করেছিল, পরবর্তীতে তারা সবাই ইসলাম কবুলের সৌভাগ্য লাভ করেন।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের দো‘আ : অন্যান্য সিজদার ন্যায় ‘সুবহা-না রবিবয়াল আ‘লা’ বলা যাবে। তবে আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে একটি খাছ দো‘আ বর্ণিত হয়েছে, যা তিনি রাত্রির ছালাতে সিজদায়ে তেলাওয়াতে পাঠ করতেন। যেমন-
‘সাজাদা ওয়াজ্হিয়া লিল্লাযী খালাক্বাহূ ওয়া শাক্ক্বা সাম‘আহূ ওয়া বাছারাহূ বেহাওলিহী ওয়া কুওয়াতিহী; ফাতাবা-রাকাল্লা-হু আহসানুল খা-লেক্বীন ।
অর্থ : আমার চেহারা সিজদা করছে সেই মহান সত্তার জন্য যিনি একে সৃষ্টি করেছেন এবং স্বীয় ক্ষমতা ও শক্তি বলে এতে কর্ণ ও চক্ষু সন্নিবেশ করেছেন। অতএব মহাপবিত্র আল্লাহ যিনি সুন্দরতম সৃষ্টিকর্তা (মুমিনূন ২৩/১৪)।[102]
পবিত্র কুরআনে সিজদার আয়াত সমূহ ১৫টি।[103] যা নিম্নরূপ : [104]
আ‘রাফ ২০৬, রা‘দ ১৫, নাহ্ল ৫০, ইস্রা/বনু ইস্রাঈল ১০৯, মারিয়াম ৫৮, হজ্জ ১৮, ৭৭, ফুরক্বান ৬০, নমল ২৬, সাজদাহ ১৫, ছোয়াদ ২৪, ফুছসালাত/হামীম সাজদাহ ৩৮, নাজম ৬২, ইনশিক্বাক্ব ২১, ‘আলাক্ব ১৯।
দলীলের উৎসঃ
[98] . মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৫৯৩০; বায়হাক্বী ২/৩২৫, সনদ ছহীহ; আলবানী, তামামুল মিন্নাহ ২৬৯ পৃঃ।
[99] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৪।
 [100] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৫; আহমাদ, ইবনু মাজাহ, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৪ পৃঃ।
[101] . ছহীহ বুখারীতে বর্ধিতভাবে এসেছে যে, ঐ ব্যক্তি ছিল উমাইয়া বিন খালাফ। -বুখারী, মিশকাত হা/১০২৩; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৩৭ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘সিজদায়ে তেলাওয়াত’ অনুচ্ছেদ-২১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৪-৬৭।
[102] . হাকেম ১/২২০ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৭; মির‘আত ৩/৪৪৭; নায়ল ৩/৩৯৮।
[103] . দারাকুৎনী হা/১৫০৭; আহমাদ হা/১৭৪৪৮; হাকেম ২/৩৯০-৯১ ‘তাফসীর সূরা হজ্জ’; মির‘আত ৩/৪৪০-৪৩; নায়ল ৩/৩৮৬-৯১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৫; তামামুল মিন্নাহ, ২৭০ পৃঃ।
[104] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৫-৬৬ পৃঃ।
১৬. সিজদায়ে শোকর
কোন খুশীর ব্যাপার ঘটলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সিজদায় পড়ে যেতেন।[105] সিজদায়ে তেলাওয়াতের ন্যায় এখানেও একটি সিজদা হবে এবং এই সিজদাতেও ওযূ বা ক্বিবলা শর্ত নয়। হাদীছে তাকবীর দেওয়ার স্পষ্ট বক্তব্য নেই। তবে সম্ভবতঃ অন্যান্য সিজদার উপরে ভিত্তি করে ছাহেবে ‘বাহরুর রায়েক্ব’ তাকবীর দেওয়ার কথা বলেছেন।[106]
দলীলের উৎসঃ
[105] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৪৯৪ ‘সিজদায়ে শুক্র’ অনুচ্ছেদ-৫১।
[106] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৮ পৃঃ।
১৭. ছালাত বিষয়ে অন্যান্য জ্ঞাতব্য
(১) মসজিদে প্রবেশের দো‘আ : প্রথমে ডান পা রেখে বলবে,      
(আল্লা-হুম্মাফ্তাহ্লী আবওয়া-বা রহমাতিকা) ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য তোমার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দাও’।[107] অন্য বর্ণনায় শুরুতে দরূদ পাঠের কথা বলা হয়েছে। যেমন, اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّسَلِّمْ (আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া সাল্লিম) ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর’।[108] ইমাম নববী বলেন, বাড়ীতে প্রবেশকালে সেখানে লোক থাক বা না থাক, যেভাবে সালাম দেওয়া মুস্তাহাব (নূর ২৪/২৭, ৬১), তেমনিভাবে মসজিদে মুছল্লী থাক বা না থাক, সালাম দিয়ে প্রবেশ করা মুস্তাহাব। [109]
(২) মসজিদ থেকে বের হওয়ার দো‘আ : প্রথমে বাম পা রেখে বলবে,
 (আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা মিন ফাযলিকা) ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি’।[110] অন্য বর্ণনায় শুরুতে দরূদ পাঠের কথা বলা হয়েছে। যেমন, اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّسَلِّمْ (আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া সাল্লিম) ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর’।[111]
(৩) যখন খাদ্য হাযির হবে, ওদিকে জামা‘আতের এক্বামত হবে, তখন প্রথমে খাওয়া সেরে নিতে পারবে।[112]
(৪) জামা‘আতে ছালাত দীর্ঘায়িত করা উচিৎ নয়। কেননা সেখানে কোন রোগী, দুর্বল ও বয়স্ক ব্যক্তি বা যরূরী কাজে ব্যস্ত ব্যক্তি থাকতে পারেন। তবে একাকী যত খুশী দীর্ঘ করা যাবে।[113] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জামা‘আত অবস্থায় কোন শিশুর কান্না শুনলে ছালাত সংক্ষেপ করতেন। যাতে বাচ্চার মা সমস্যায় না পড়ে।[114] অতএব জামা‘আত চলাকালে লোডশেডিং বা অনুরূপ হঠাৎ কোন সমস্যা দেখা দিলে ইমাম ছালাত সংক্ষেপ করবেন।
(৫) ফরয বা সুন্নাত-নফল পড়া অবস্থায় প্রয়োজনে ক্বিবলার দিকের দরজা খুলে দেওয়া যাবে’।[115] অতএব যরূরী প্রয়োজনে (ডাইনে-বামে না তাকিয়ে) সম্মুখ দিকের বিদ্যুতের সুইচ অন বা অফ করার মত ছোট-খাট কাজ করা যাবে।
(৬) ওযূ করে ছালাতের জন্য মসজিদে যাওয়া অবস্থায় (সম্মুখ দিয়ে হউক বা পিছন দিক দিয়ে হৌক) দু’হাতের আঙ্গুল পরস্পরের মধ্যে ঢুকানো অর্থাৎ ‘তাশবীক’ করা যাবেনা’। কেননা সে তখন ছালাতের মধ্যে থাকে। অথচ এতে ছালাতের প্রতি অনীহা প্রকাশ পায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একে শয়তানী কাজ বলে অভিহিত করেছেন।[116] ছালাতের মধ্যে আঙ্গুল মটকানো যাবে না। [117] তাছাড়া ছালাতে হাস্য করা, নাক-মুখ চুলকানো, বারবার কাপড় গুছানো বা ঘুমানো সবই অমনোযোগিতার পর্যায়ে পড়ে।
(৭) ছালাত অবস্থায় পুরুষের জন্য জামার হাতা সমূহ বা কাপড় গুটিয়ে রাখা যাবে না। বরং খোলামেলা ছেড়ে দিতে হবে।[118] তবে পুরুষের কাপড় ছালাত ও ছালাতের বাইরে সর্বদা টাখনুর উপরে রাখতে হবে।[119] কেননা টাখনুর নীচে যতটুকু যাবে, ততটুকু জাহান্নামে পুড়বে’। [120]
(৮) ছালাত অবস্থায় কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো[121] কিংবা আসমানের দিকে বা ডানে-বাঁয়ে তাকানো নিষেধ। [122]
(৯) সিজদার স্থান একবার ছাফ করা যাবে।[123] সেখানে প্রচন্ড গরম থাকলে বা অন্য কোন সমস্যা থাকলে পরিহিত কাপড়ের একাংশ বিছিয়ে বা অন্য কিছু রেখে তার উপর সিজদা করা যাবে।[124]
(১০) অনেকে দু’হাঁটুর উপর অথবা মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর ভর করে সিজদা থেকে উঠে দাঁড়ান। এটা ঠিক নয়। কেননা এর দ্বারা মাটিতে পুরা ভর করা যায় না। ইবনু ওমরের হাদীছে كَانَ يَعْجِنُ শব্দ এসেছে। যার অর্থ আটার খামীর যেমন হাতের পুরা চাপ দিয়ে করতে হয়, অনুরূপভাবে মাটিতে হাতের পুরা চাপ দিয়ে উঠতে হয়। [125]
(১১) হাই উঠলে ‘হা’ করে শব্দ করা যাবে না। তাতে শয়তান হাসে অথবা মুখে ঢুকে পড়ে। এ সময় মুখে হাত দিয়ে চেপে রাখতে হবে। [126] কারণ এতে ছালাতে ক্লান্তি প্রকাশ পায়। একইভাবে হাঁচি-কাশির শব্দ চেপে রাখতে হবে। কেননা তা অন্যের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়।
(১২) ছালাতরত অবস্থায় সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রাণী মারা যাবে।[127] এ অবস্থায় চোর ধরার জন্য ছালাত ছেড়ে দেওয়া যাবে।[128]
(১৩) হাঁচি এলে ‘আলহাম্দুলিল্লা-হ’ বলা যাবে।[129] তবে হাঁচির জওয়াব দেওয়া যাবে না।[130] মুখে সালামের জওয়াব দেওয়া যাবে না। তবে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় জওয়াব দেওয়া যাবে। [131]
(১৪) বাচ্চা কোলে নিয়েও ছালাত আদায় করা যাবে।[132]
(১৫) কবরের দিকে ফিরে ছালাত আদায় করা যাবে না এবং কবরের উপরে বসা যাবে না।[133] যে কবরে পূজা হয় এবং কবরবাসীর কাছে কিছু চাওয়া হয়, তার পাশে মসজিদ থাকলে সেখানে ছালাত আদায় করা যাবে না।
(১৬) মুছল্লীদের নিকটে আওয়ায পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ইমামের তাকবীরের পিছে পিছে ‘মুকাবিবর’ উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দিতে পারবে। অসুস্থ রাসূল (ছাঃ)-এর তাকবীরের পিছে পিছে আবুবকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ‘মুকাবিবর’।[134]
(১৭) যে সব ছালাতের শেষে সুন্নাত নেই, অর্থাৎ ফজর ও আছরের শেষে মুছল্লীদের দিকে ফিরে বসা এবং অন্য সময় না বসা, একইভাবে কেবল ফরয ছালাতে ইমামের পাগড়ী মাথায় দেওয়া এবং সালাম ফিরানোর পরে তা খুলে রাখা, সম্পূর্ণরূপে সুন্নাত পরিপন্থী কাজ।
(১৮) পোষাক, টুপী ও পাগড়ীতে অমুসলিমদের এবং শিরক ও বিদ‘আতপন্থীদের অনুকরণ করা নিষেধ।[135]
(১৯) মেয়েদের পুরুষালী পোষাক এবং পুরুষদের মেয়েলী পোষাক পরা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসব লোককে ঘর থেকে বের করে দিতে বলেছেন। [136]
(২০) ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে ছালাত শুরু করতে হবে।[137] ‘নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া’... বলে মুখে নিয়ত পাঠের মাধ্যমে ছালাত শুরু করা বিদ‘আত। যারা একে ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বলেন, তাদের জবাবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইবাদতের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ‘সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। আর ‘সকল ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[138]
(২১) তাকবীর দ্বারা ছালাত শুরু হয় এবং সালাম দ্বারা শেষ হয়।[139] অনুরূপভাবে ছালাতে প্রবেশকালে তাকবীর দিয়ে বাম হাতের উপর ডান হাত বুকে বাঁধতে হয়’।[140] বুকে হাত বাঁধা ব্যতীত অন্যভাবে ছালাত আদায় করা হয় ভিত্তিহীন, না হয় যঈফ।[141]
(২২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাতের মধ্যে তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন : (১) মোরগের মত ঠোকর দিয়ে দ্রুত ছালাত আদায় করা (২) বানর বা কুকুরের মত চার হাত-পা একত্র করে বসা (৩) শৃগালের মত এদিক-ওদিক তাকানো।[142]
(২৩) ছালাতের সময় নকশা করা পোষাক পরিধান করা উচিৎ নয়, যা নিজের বা অন্য মুছল্লীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।[143] মুছাল্লা বা জায়নামাযের ব্যাপারেও একই কথা বলা যেতে পারে। ডান, বাম বা সম্মুখ থেকে ছবিযুক্ত সবকিছু দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে ফেলতে হবে। [144]
(২৪) ‘বাচ্চাদের মসজিদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখো’ বলে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তা যঈফ।[145] একইভাবে বাচ্চাদের পৃথকভাবে পিছনের কাতারে দাঁড়ানোর হাদীছও যঈফ।[146]
(২৫) ‘যে ব্যক্তি ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করবে, তার ছালাত বিনষ্ট হবে’ এবং ‘যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে, তার মুখ আগুন দিয়ে ভরে দেওয়া হবে’ বলে যেসব হাদীছ প্রচলিত আছে, তা ‘মওযূ’ বা জাল[147] এবং মাটি দিয়ে ভরে দেওয়ার হাদীছ ‘মওকূফ’ ও যঈফ। [148]
(২৬) ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কথা বলার আগেই ছয় রাক‘আত (নফল) ছালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পঞ্চাশ বছরের গোনাহ মাফ হবে’। ‘যে ব্যক্তি ঐ ছয় রাক‘আতের মধ্যে কোন মন্দ কথা বলবে না, সে ব্যক্তি বারো বছরের ইবাদতের সমান নেকী পাবে’। ‘মাগরিব ও এশার মধ্যে যে ব্যক্তি বিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করবেন’ মর্মে বর্ণিত হাদীছ সমূহ অত্যন্ত যঈফ।[149] মাগরিব হ’তে এশার মধ্যে পঠিত নফল ছালাত সমূহকে ‘ছালাতুল আউওয়াবীন’ বলার হাদীছটিও যঈফ।[150] বরং ছালাতুয যোহাকেই রাসূল (ছাঃ) ‘ছালাতুল আউয়াবীন’ বলেছেন’।[151]
(২৭) সারা রাত্রি ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে না।[152] আল্লাহ বলেন, ‘তুমি রাত্রিতে ছালাত আদায় কর কিছু অংশ বাদ দিয়ে’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৪)। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কদাচিৎ পুরা রাত্রি জাগরণ করেছেন।[153] তিনি কখনো একরাতে কুরআন খতম করেননি।[154] এক্ষণে ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ/৬৯৯-৭৬৭ খৃঃ) একরাতে কুরআন খতম করতেন ও তাতে এক হাযার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’। ‘তিনি যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানে সাত হাযার বার কুরআন খতম করেন’। ‘তিনি একটানা ৪০ বছর এশার ওযূতে ফজরের ছালাত আদায় করেছেন’ এবং ‘প্রতি রাক‘আতে কুরআন খতম করেছেন[155] ইত্যাদি যেসব কথা প্রচারিত হয়েছে, তা স্রেফ অতিভক্তির বাড়াবাড়ি ও ইমামের নামে মিথ্যা অপবাদ মাত্র।[156]
(২৮) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সবচেয়ে বড় চোর হ’ল ‘ছালাত চোর’। সে হ’ল ঐ ব্যক্তি যে ছালাতে রুকূ ও সিজদা পূর্ণ করে না’। [157] তিনি বলেন, যদি সে ঐ অবস্থায় মারা যায়, তবে সে ‘মুহাম্মাদী মিল্লাতের বহির্ভূত (مَاتَ عَلَى غَيْرِ مِلَّةِ مُحَمَّدٍ) হিসাবে মৃত্যুবরণ করবে’।[158]
(২৯) ফরয ও নফলের মধ্যে কথা বলা বা বের হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে পার্থক্য করা উচিৎ।[159] অমনিভাবে ফরয ছালাত আদায়ের স্থান হ’তে কিছুটা সরে গিয়ে সুন্নাত-নফল ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব।[160] ইমাম বুখারী ও ইমাম বাগাভী বলেন, এর দ্বারা ইবাদতের স্থানের সংখ্যা বেশী হয় এবং সিজদার স্থান সমূহ আল্লাহর নিকটে সাক্ষী হয়। যেমন সূরায়ে যিলযালের ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘ক্বিয়ামতের দিন যমীন নিজেই আল্লাহর হুকুমে (তার উপরে কৃত বান্দার আমল সম্পর্কে) খবর দিবে’। অনুরূপভাবে সূরা দুখান ২৯ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে যে, কোন মুমিন মারা গেলে তার সিজদার স্থান সমূহ কাঁদতে থাকে এবং তার সৎকর্ম সমূহ আসমানে উঠানো হয়। কিন্তু আসমান ও যমীন কোন কাফেরের জন্য কাঁদবেনা। [161] কারণ ওরা কখনো আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাটিতে সিজদা করেনি।
(৩০) চোখে দেখা বা কানে শোনার মাধ্যমে যদি ইমামের ইক্বতিদা করা সম্ভব হয়, তবে কাছাকাছি হ’লে তাঁর ইক্বতিদা করা জায়েয। যদিও সেটা মসজিদের বাইরে হয় কিংবা উভয়ের মধ্যে কোন দেওয়াল, রাস্তা বা অনুরূপ কোন প্রতিবন্ধক থাকে।[162]
(৩১) ছালাতের মধ্যে আরবী ব্যতীত অন্য ভাষায় ক্বিরাআত ও তাসবীহ পাঠ করা যাবে না। মুখস্থ না থাকায় যদি কেউ কুরআনের কিছুই পড়তে না পারে অথবা অনারব হওয়ার কারণে কুরআন না জানে, তখন সে কেবল সুবহানাল্লাহ, ওয়াল-হামদুলিল্লাহ, অলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, অলা হাওলা অলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলবে। ঐসঙ্গে এ দো‘আও করতে পারবে, আল্লা-হুম্মারহামনী, ওয়া ‘আফেনী, ওয়াহদেনী, ওয়ারঝুক্বনী (হে আল্লাহ! আমাকে অনুগ্রহ কর, আমাকে সুস্থতা দাও, আমাকে সঠিক পথ দেখাও এবং আমাকে রূযী দাও!)।[163] তবে এটি স্রেফ একবার অথবা সাময়িক কালের জন্য। কেননা সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত ছালাত সিদ্ধ হয় না।[164]
দলীলের উৎসঃ
[107] . হাকেম ১/২১৮; মুসলিম, মিশকাত হা/৭০৩, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[108] . আবুদাঊদ হা/৪৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৭৭২-৭৩; বায়হাক্বী ২/৪৪২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৭৮।
[109] . আল-আযকার (বৈরূত : ১৪১৪/১৯৯৪) ১/২৫৮।
[110] . হাকেম ১/২১৮; মুসলিম, মিশকাত হা/৭০৩ ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[111] . আবুদাঊদ হা/৪৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৭৭৩; বায়হাক্বী ২/৪৪২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৭৮।
[112] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১০৫৬, ‘জামা‘আত ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[113] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৩১, ১১৩৪ ‘ইমামের কর্তব্য সমূহ’ অনুচ্ছেদ-২৭।
[114] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/১১২৯-৩০।
 [115] . বুখারী হা/৭৫৩, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৯৪; আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০০৫ ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্মসমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[116] . আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৯৯৪; মির‘আত হা/১০০১, ৩/৩৬৫ পৃঃ।
[117] . মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ইরওয়া হা/৩৭৮-এর শেষে দ্রষ্টব্য।
[118] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৮৭, ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪; ছিফাত পৃ: ১২৫।
[119] . আবুদাঊদ হা/৬৩৭ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, ‘ছালাতে কাপড় ঝুলানো’ অনুচ্ছেদ-৮৩।
[120] . বুখারী, মিশকাত হা/৪৩১৪ ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২।
[121] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯৮১, অনুচ্ছেদ-১৯; মির‘আত ৩/৩৪৮-৪৯ পৃঃ।
 [122] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/৯৮২-৮৩, ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[123] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯৮০ ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[124] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মির‘আত ৩/৩৯১; আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০১১, অনুচ্ছেদ-১৯।
 [125] . ছিফাত পৃঃ ১৩৭; ছহীহাহ হা/২৬৭৪; যঈফাহ হা/৯৬৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[126] . বুখারী, মিশকাত হা/৯৮৬; মুসলিম, মিশকাত হা/৯৮৫, অনুচ্ছেদ-১৯; মুসলিম, মিশকাত হা/৪৭৩৭ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলা’ অনুচ্ছেদ-৬।
[127] . আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১০০৪, ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[128] . বুখারী হা/১২১১, অধ্যায়-২১, অনুচ্ছেদ-১১।
[129] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৯৯২, অনুচ্ছেদ-১৯।
[130] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৭৮, অনুচ্ছেদ-১৯।
[131] . তিরমিযী, মিশকাত হা/৯৯১; মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১০১৩, অনুচ্ছেদ-১৯।
[132] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯৮৪ ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[133] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৯৮-৯৯, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, ‘মৃতের দাফন’ অনুচ্ছেদ-৬।
[134] . মুসলিম, নাসাঈ হা/১২৪০; আবুদাঊদ, আহমাদ, ইবনু মাজাহ, ছিফাত, ৬৭ পৃঃ।
 [135] . মুসলিম, মিশকাত হা/৪৩২৭; আহমাদ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৩৪৭, ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২।
[136] . বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৮, ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২।
[137] . মুসলিম, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৭৯১, ৮০১, ৩১২; ছিফাত, ৬৬ পৃঃ।
[138] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-২ নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়নের ছালাত’ অধ্যায়, ‘কিভাবে খুৎবা দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৭৮৫।
 [139] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৩১২ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, ‘যা ওযূ ওয়াজিব করে’ অনুচ্ছেদ-১; ইরওয়া হা/৩০১।
[140] . বুখারী, মিশকাত হা/৭৯৮, ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০; আবুদাঊদ হা/৭৫৫, ৭৫৯, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ১২১ অনুচ্ছেদ।
 [141] . আলবানী, হাশিয়া ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, ৬৯ পৃঃ।
[142] . আহমাদ, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৫৩; ছিফাত পৃঃ ৭০, ১১২।
[143] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭৫৭, ‘সতর’ অনুচ্ছেদ-৮; ঐ, হা/৯৮২, অনুচ্ছেদ-১৯; ইরওয়া হা/৩৭৬।
[144] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/৭৫৭-৫৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘সতর’ অনুচ্ছেদ-৮।
[145] . ইবনু মাজাহ হা/৭৫০, ‘মসজিদ ও জামা‘আত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৫; ছিফাতু ছালা-তিন্নবী হাশিয়া, ৮৩ পৃঃ ।
[146] . আবুদাঊদ হা/৬৭৭; ঐ, মিশকাত হা/১১১৫ ‘দাঁড়ানোর স্থান’ অনুচ্ছেদ-২৫।
[147] . আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬৮-৬৯।
[148] . মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৩, পৃ: ২/২৮১।
 [149] . সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬৭-৪৬৯; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১১৭৩-৭৪ ‘সুন্নাত ছালাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ ৩০।
[150] . সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬১৭।
[151] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩১২ ‘ছালাতুয যোহা’ অনুচ্ছেদ-৩৮।
[152] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ
[153] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; আহমাদ হা/২১০৯১; নাসাঈ হা/১৬৩৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৫৪ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ফযীলতসমূহ’ অনুচ্ছেদ-১।
[154] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[155] . মুক্বাদ্দামা শরহ বেক্বায়াহ পৃঃ ৩৬-৩৭, হানাফী ফিক্বহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘শরহ বেক্বায়াহ’র ভূমিকা মুক্বাদ্দামা ‘উমদাতুর রি‘আয়াহ (মোট পৃঃ সংখ্যা ৪-৪৬)। লেখক: আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-৮৬ খৃ:)। প্রকাশক: মাকতাবা থানবী, দেউবন্দ, ভারত, তাবি’। আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই, যখন দেখি যে, বিজ্ঞ লেখক এসব ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনীর পক্ষে জোরালো যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। পূর্বসূরীগণ এভাবে উত্তরসূরীদের জন্য কত কিছুই না ছেড়ে গেছেন। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন-আমীন!
[156] . আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন নবী পৃঃ ১০১ টীকা দ্রষ্টব্য।
[157] . আহমাদ, মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/৮৮৫-৮৬ ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ-১৩; ছিফাত, ১১২ পৃঃ।
 [158] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৬৬৫; ও অন্যান্য; ছিফাত পৃঃ ১১২।
[159] . মুসলিম, আবুদাঊদ, নায়লুল আওত্বার ৪/১১০; ছহীহুল জামে’ হা/৭৪৭৮।
[160] . আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ হা/১৪২৭, মিশকাত হা/৯৫৩ ‘তাশাহহুদে দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-১৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৭২৭।
[161] . কুরতুবী, ইবনু কাছীর, শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৪/১১০, ‘ফরয ছালাতের স্থান থেকে সরে গিয়ে নফল ছালাত আদায় করা’ অনুচ্ছেদ। আল্লাহ বলেন, (১)يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا، بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا- -যিলযাল ৯৯/৪-৫; (২) فَمَا بَكَتْ عَلَيْهِمُ السَّمَاءُ وَالأرْضُ وَمَا كَانُوا مُنْظَرِينَ- -দুখান ৪৪/২৯।
[162] . বুখারী হা/৭২৯ ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৮০; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১১১৪, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দাঁড়ানোর স্থান’ অনুচ্ছেদ-২৫।
 [163] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৭৮ ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯; আবুদাঊদ হা/৮৩২ ‘নিরক্ষর ও অনারব ব্যক্তির জন্য ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১৩৯; নাসাঈ হা/৯২৪; ঐ, মিশকাত হা/৮৫৮ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১; শাওকানী, আসসায়লুল জার্রার (বৈরূত : তাবি) ১/২২১, ‘আরবী ভাষায় কষ্ট হ’লে অন্য ভাষায় পড়া’ প্রসঙ্গে; মির‘আত হা/৮৬৫, ৩/১৭২-৭৩ পৃঃ।
[164] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২২ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
১. বিতর ছালাত
বিতর ছালাত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ।[1] যা এশার ফরয ছালাতের পর হ’তে ফজর পর্যন্ত সুন্নাত ও নফল ছালাত সমূহের শেষে আদায় করতে হয়।[2] বিতর ছালাত খুবই ফযীলতপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে বা সফরে কোন অবস্থায় বিতর ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পরিত্যাগ করতেন না।[3]
‘বিতর’ অর্থ বেজোড়। যা মূলতঃ এক রাক‘আত। কেননা এক রাক‘আত যোগ না করলে কোন ছালাতই বেজোড় হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘রাতের নফল ছালাত দুই দুই (مَثْنَى مَثْنَى)। অতঃপর যখন তোমাদের কেউ ফজর হয়ে যাবার আশংকা করবে, তখন সে যেন এক রাক‘আত পড়ে নেয়। যা তার পূর্বেকার সকল নফল ছালাতকে বিতরে পরিণত করবে’।[4] অন্য হাদীছে তিনি বলেন, اَلْوِتْرُ رَكْعَةٌ مِّنْ آخِرِ اللَّيْلِ ‘বিতর রাত্রির শেষে এক রাক‘আত মাত্র’।[5] আয়েশা (রাঃ) বলেন, وَكَانَ يُوْتِرُ بِوَاحِدَةٍ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক রাক‘আত দ্বারা বিতর করতেন’। [6]
রাতের নফল ছালাত সহ বিতর ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাক‘আত পর্যন্ত (وَلاَ بِأَكْثَرَ مِنْ ثَلاَثَ عَشْرَةَ) পড়া যায় এবং তা প্রথম রাত্রি, মধ্য রাত্রি, ও শেষ রাত্রি সকল সময় পড়া চলে।[7] যদি কেউ বিতর পড়তে ভুলে যায় অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে স্মরণ হ’লে কিংবা রাতে বা সকালে ঘুম হ’তে জেগে উঠার পরে সুযোগ মত তা আদায় করবে।[8] অন্যান্য সুন্নাত-নফলের ন্যায় বিতরের ক্বাযাও আদায় করা যাবে।[9] তিন রাক‘আত বিতর একটানা ও এক সালামে পড়াই উত্তম।[10] ৫ রাক‘আত বিতরে একটানা পাঁচ রাক‘আত শেষে বৈঠক ও সালাম সহ বিতর করবে। [11] সাত ও নয় রাক‘আত বিতরে ছয় ও আট রাক‘আতে প্রথম বৈঠক করবে। অতঃপর সপ্তম ও নবম রাক‘আতে শেষ বৈঠক করে সালাম ফিরাবে।[12]
চার খলীফাসহ অধিকাংশ ছাহাবী, তাবেঈ ও মুজতাহিদ ইমামগণ এক রাক‘আত বিতরে অভ্যস্ত ছিলেন।[13] অতএব ‘এক রাক‘আত বিতর সঠিক নয় এবং এক রাক‘আতে কোন ছালাত হয় না’। ‘বিতর তিন রাক‘আতে সীমাবদ্ধ’। ‘বিতর ছালাত মাগরিবের ছালাতের ন্যায়’। ‘তিন রাক‘আত বিতরের উপরে উম্মতের ইজমা হয়েছে’ বলে যেসব কথা সমাজে চালু আছে, শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই’।[14] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা মাগরিবের ছালাতের ন্যায় (মাঝখানে বৈঠক করে) বিতর আদায় করো না’।[15] উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতরের ১ম রাক‘আতে সূরা আ‘লা, ২য় রাক‘আতে সূরা কাফেরূণ ও ৩য় রাক‘আতে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। ঐ সাথে ফালাক্ব ও নাস পড়ার কথাও এসেছে।[16] এসময় তিনি শেষ রাক‘আতে ব্যতীত সালাম ফিরাতেন না (وَلاَ يُسَلِّمُ إِلاَّ فِي آخِرِهِنَّ)। [17]
কুনূত (القنوت) :
‘ কুনূত’ অর্থ বিনম্র আনুগত্য। কুনূত দু’প্রকার। কুনূতে রাতেবাহ ও কুনূতে নাযেলাহ। প্রথমটি বিতর ছালাতের শেষ রাক‘আতে পড়তে হয়। দ্বিতীয়টি বিপদাপদ ও বিশেষ কোন যরূরী কারণে ফরয ছালাতের শেষ রাক‘আতে পড়তে হয়। বিতরের কুনূতের জন্য হাদীছে বিশেষ দো‘আ বর্ণিত হয়েছে।[18] বিতরের কুনূত সারা বছর পড়া চলে।[19] তবে মাঝে মধ্যে ছেড়ে দেওয়া ভাল। কেননা বিতরের জন্য কুনূত ওয়াজিব নয়। [20] দো‘আয়ে কুনূত রুকূর আগে ও পরে[21] দু’ভাবেই পড়া জায়েয আছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে,
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কারো বিরুদ্ধে বা কারো পক্ষে দো‘আ করতেন, তখন রুকূর পরে কুনূত পড়তেন...।[22] ইমাম বায়হাক্বী বলেন,
‘রুকূর পরে কুনূতের রাবীগণ সংখ্যায় অধিক ও অধিকতর স্মৃতিসম্পন্ন এবং এর উপরেই খুলাফায়ে রাশেদ্বীন আমল করেছেন’। [23] হযরত ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, আনাস, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী থেকে বিতরের কুনূতে বুক বরাবর হাত উঠিয়ে দো‘আ করা প্রমাণিত আছে।[24] কুনূত পড়ার জন্য রুকূর পূর্বে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায় দু’হাত উঠানো ও পুনরায় বাঁধার প্রচলিত প্রথার কোন বিশুদ্ধ দলীল নেই।[25] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, বিতরের কুনূত রুকূর পরে হবে, না পূর্বে হবে এবং এই সময় দো‘আ করার জন্য হাত উঠানো যাবে কি-না। তিনি বললেন, বিতরের কুনূত হবে রুকূর পরে এবং এই সময় হাত উঠিয়ে দো‘আ করবে।[26] ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) বলেন, বিতরের কুনূতের সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে বুক বরাবর উঁচু থাকবে। ইমাম ত্বাহাবী ও ইমাম কার্খীও এটাকে পসন্দ করেছেন।[27] এই সময় মুক্তাদীগণ ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন।[28]
দো‘আয়ে কুনূত (دعاء قنوت الوتر) :
হাসান বিন আলী (রাঃ) বলেন যে, বিতরের কুনূতে বলার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে নিম্নোক্ত দো‘আ শিখিয়েছেন।-
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদায়তা, ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফায়তা, ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লায়তা, ওয়া বা-রিকলী ফীমা ‘আ‘ত্বায়তা, ওয়া ক্বিনী শাররা মা ক্বাযায়তা; ফাইন্নাকা তাক্বযী ওয়া লা ইয়ুক্বযা ‘আলায়কা, ইন্নাহূ লা ইয়াযিল্লু মাঁও ওয়া-লায়তা, ওয়া লা ইয়া‘ইযঝু মান্ ‘আ-দায়তা, তাবা-রকতা রব্বানা ওয়া তা‘আ-লায়তা, ওয়া ছাল্লাল্লা-হু ‘আলান্ নাবী’ ।[29]
জামা‘আতে ইমাম ছাহেব ক্রিয়াপদের শেষে একবচন...‘নী’-এর স্থলে বহুবচন.... ‘না’ বলতে পারেন।[30]
অনুবাদ : হে আল্লাহ! তুমি যাদেরকে সুপথ দেখিয়েছ, আমাকে তাদের মধ্যে গণ্য করে সুপথ দেখাও। যাদেরকে তুমি মাফ করেছ, আমাকে তাদের মধ্যে গণ্য করে মাফ করে দাও। তুমি যাদের অভিভাবক হয়েছ, তাদের মধ্যে গণ্য করে আমার অভিভাবক হয়ে যাও। তুমি আমাকে যা দান করেছ, তাতে বরকত দাও। তুমি যে ফায়ছালা করে রেখেছ, তার অনিষ্ট হ’তে আমাকে বাঁচাও। কেননা তুমি সিদ্ধান্ত দিয়ে থাক, তোমার বিরুদ্ধে কেউ সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তুমি যার সাথে বন্ধুত্ব রাখ, সে কোনদিন অপমানিত হয় না। আর তুমি যার সাথে দুশমনী কর, সে কোনদিন সম্মানিত হ’তে পারে না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি বরকতময় ও সর্বোচ্চ। আল্লাহ তাঁর নবীর উপরে রহমত বর্ষণ করুন’।
দো‘আয়ে কুনূত শেষে মুছল্লী ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সিজদায় যাবে।[31] কুনূতে কেবল দু’হাত উঁচু করবে। মুখে হাত বুলানোর হাদীছ যঈফ।[32] বিতর শেষে তিনবার সরবে ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’শেষদিকে দীর্ঘ টানে বলবে’।[33] অতঃপর ইচ্ছা করলে বসেই সংক্ষেপে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবে এবং সেখানে প্রথম রাক‘আতে সূরা যিলযাল ও দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা কাফেরূণ পাঠ করবে।[34]
উল্লেখ্য যে, اَللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِيْنُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ আল্লা-হুম্মা ইন্না নাস্তা‘ঈনুকা ওয়া নাস্তাগফিরুকা...’ বলে বিতরে যে কুনূত পড়া হয়, সেটার হাদীছ ‘মুরসাল’ বা যঈফ।[35] অধিকন্তু এটি কুনূতে নাযেলাহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, কুনূতে রাতেবাহ হিসাবে নয়।[36] অতএব বিতরের কুনূতের জন্য উপরে বর্ণিত দো‘আটিই সর্বোত্তম। [37]
ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) থেকে কুনূতের জন্য এর চেয়ে কোন উত্তম দো‘আ আমরা জানতে পারিনি’।[38]
কুনূতে নাযেলাহ (قنوت النازلة) :
যুদ্ধ, শত্রুর আক্রমণ প্রভৃতি বিপদের সময় অথবা কারুর জন্য বিশেষ কল্যাণ কামনায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে বিশেষভাবে এই দো‘আ পাঠ করতে হয়। ‘কুনূতে নাযেলাহ’ ফজর ছালাতে অথবা সব ওয়াক্তে ফরয ছালাতের শেষ রাক‘আতে রুকূর পরে দাঁড়িয়ে ‘রববানা লাকাল হাম্দ’ বলার পরে দু’হাত উঠিয়ে সরবে পড়তে হয়। [39] কুনূতে নাযেলাহর জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে নির্দিষ্ট কোন দো‘আ বর্ণিত হয়নি। অবস্থা বিবেচনা করে ইমাম আরবীতে[40] দো‘আ পড়বেন ও মুক্তাদীগণ ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলবেন। [41] রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বা শক্তির বিরুদ্ধে এমনকি এক মাস যাবৎ একটানা বিভিন্নভাবে দো‘আ করেছেন।[42] তবে হযরত ওমর (রাঃ) থেকে এ বিষয়ে একটি দো‘আ বর্ণিত হয়েছে। যা তিনি ফজরের ছালাতে পাঠ করতেন এবং যা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে দৈনিক পাঁচবার ছালাতে পাঠ করা যেতে পারে। যেমন-
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাগফির লানা ওয়া লিল মু’মিনীনা ওয়াল মু‘মিনা-তি ওয়াল মুসলিমীনা ওয়াল মুসলিমা-তি, ওয়া আল্লিফ বায়না কুলূবিহিম, ওয়া আছলিহ যা-তা বায়নিহিম, ওয়ানছুরহুম ‘আলা ‘আদুউবিকা ওয়া ‘আদুউবিহিম। আল্লা-হুম্মাল‘আনিল কাফারাতাল্লাযীনা ইয়াছুদ্দূনা ‘আন সাবীলিকা ওয়া ইয়ুকাযযিবূনা রুসুলাকা ওয়া ইয়ুক্বা-তিলূনা আউলিয়া-আকা। আল্লা-হুম্মা খা-লিফ বায়না কালিমাতিহিম ওয়া ঝালঝিল আক্বদা-মাহুম ওয়া আনঝিল বিহিম বা’সাকাল্লাযী লা তারুদ্দুহূ ‘আনিল ক্বাউমিল মুজরিমীন।
অনুবাদ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এবং সকল মুমিন-মুসলিম নর-নারীকে ক্ষমা করুন। আপনি তাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিন ও তাদের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসা করে দিন। আপনি তাদেরকে আপনার ও তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন। হে আল্লাহ! আপনি কাফেরদের উপরে লা‘নত করুন। যারা আপনার রাস্তা বন্ধ করে, আপনার প্রেরিত রাসূলগণকে অবিশ্বাস করে ও আপনার বন্ধুদের সাথে লড়াই করে। হে আল্লাহ! আপনি তাদের দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে দিন ও তাদের পদসমূহ টলিয়ে দিন এবং আপনি তাদের মধ্যে আপনার প্রতিশোধকে নামিয়ে দিন, যা পাপাচারী সম্প্রদায় থেকে আপনি ফিরিয়ে নেন না’।[43]
অতঃপর প্রথমবার বিসমিল্লাহ... সহ ইন্না নাস্তা‘ঈনুকা .... এবং দ্বিতীয়বার বিসমিল্লাহ... সহ ইন্না না‘বুদুকা ...বর্ণিত আছে।[44]
উল্লেখ্য যে, উক্ত ‘কুনূতে নাযেলাহ’ থেকে মধ্যম অংশটুকু অর্থাৎ ইন্না নাস্তা‘ঈনুকা ... নিয়ে সেটাকে ‘কুনূতে বিতর’ হিসাবে চালু করা হয়েছে, যা নিতান্তই ভুল। আলবানী বলেন যে, এই দো‘আটি ওমর (রাঃ) ফজরের ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ হিসাবে পড়তেন। এটাকে তিনি বিতরের কুনূতে পড়েছেন বলে আমি জানতে পারিনি।[45]
দলীলের উৎসঃ
[1] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৩; নাসাঈ হা/১৬৭৬; মির‘আত ২/২০৭; ঐ, ৪/২৭৩-৭৪; শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লা-হিল বা-লিগাহ ২/১৭।
 [2] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৯২-৯৩।
[3] . ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আ-দ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৯ সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) ১/৪৫৬।
[4] . عَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَلاَةِ اللَّيْلِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صَلاَةُ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى، فَإِذَا خَشِيَ أَحَدُكُمُ الصُّبْحَ صَلَّى رَكْعَةً وَاحِدَةً تُوتِرُ لَهُ مَا قَدْ صَلَّى- বুখারী (ফাৎহ সহ) হা/৯৯০ ‘বিতর’ অধ্যায়-১৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[5] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৫।
[6] . ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৮৫।
[7] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৫; আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৬৩-৬৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৬১।
[8] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ মিশকাত হা/১২৬৮, ১২৭৯; নায়ল ৩/২৯৪, ৩১৭-১৯, মির‘আত ৪/২৭৯।
[9] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮; নায়লুল আওত্বার ৩/৩১৮-১৯।
[10] . মির‘আত ৪/২৭৪; হাকেম ১/৩০৪ পৃঃ।
[11] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৬; মির‘আত ৪/২৬২।
[12] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭; বায়হাক্বী ৩/৩০; মির‘আত ৪/২৬৪-৬৫।
 [13] . নায়লুল আওত্বার ৩/২৯৬; মির‘আত ৪/২৫৯।
 [14] . মিরক্বাত ৩/১৬০-৬১, ১৭০; মির‘আত হা/১২৬২, ১২৬৪, ১২৭৩ -এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্যঃ ৪/২৬০-৬২, ২৭৫।
[15] . দারাকুৎনী হা/১৬৩৪-৩৫; সনদ ছহীহ।
[16] . হাকেম ১/৩০৫, আবুদাঊদ, দারেমী, মিশকাত হা/১২৬৯, ১২৭২।
[17] . নাসাঈ হা/১৭০১, ‘ক্বিয়ামুল লাইল’ অধ্যায়-২০, অনুচ্ছেদ-৩৭; মির‘আত ৪/২৬০।
[18] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৭৩।
[19] . প্রাগুক্ত, মিশকাত হা/১২৭৩; মির‘আত ৪/২৮৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৬।
[20] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১২৯১-৯২ ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ-৩৬; মির‘আত ৪/৩০৮।
[21] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৮৯; ইবনু মাজাহ হা/১১৮৩-৮৪, মিশকাত হা/১২৯৪; মির‘আত ৪/২৮৬-৮৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৭; আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান পৃঃ ২৩।
[22] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৮৮।
[23] . বায়হাক্বী ২/২০৮; তুহফাতুল আহওয়াযী (কায়রো : ১৪০৭/১৯৮৭) হা/৪৬৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ২/৫৬৬ পৃঃ।
 [24] . বায়হাক্বী ২/২১১-১২; মির‘আত ৪/৩০০; তুহফা ২/৫৬৭।
 [25] . ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৭; মির‘আত ৪/২৯৯, ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ-৩৬।
 [26] . তুহফা ২/৫৬৬; মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, মাসআলা নং ৪১৭-২১।
[27] . মির‘আত ৪/৩০০ পৃঃ।
 [28] . মির‘আত ৪/৩০৭; ছিফাত ১৫৯ পৃঃ; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৯০।
[29] . সুনানু আরবা‘আহ, দারেমী, মিশকাত হা/১২৭৩ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; ইরওয়া হা/৪২৯, ২/১৭২। উল্লেখ্য যে, কুনূতে বর্ণিত উপরোক্ত দো‘আর শেষে ‘দরূদ’ অংশটি আলবানী ‘যঈফ’ বলেছেন। তবে ইবনু মাসঊদ, আবু মূসা, ইবনু আববাস, বারা, আনাস প্রমুখ ছাহাবী থেকে বিতরের কুনূত শেষে রাসূলের উপর দরূদ পাঠ করা প্রমাণিত হওয়ায় তিনি তা পাঠ করা জায়েয হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন -ইরওয়া ২/১৭৭, তামামুল মিন্নাহ ২৪৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৭)। ছাহেবে মির‘আত বলেন, ইবনু আবী আছেম ও ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, ইবনু হিববান বর্ণিত কুনূতে وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنَتُوْبُ إِلَيْكَ -এসেছে (মির‘আত ৪/২৮৫)। তবে সেটি বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি। সেকারণ আমরা এটা ‘মতন’ থেকে বাদ দিলাম।
তবে দো‘আয়ে কুনূতের শেষে ইস্তেগফার সহ যেকোন দো‘আ পাঠের ব্যাপারে অধিকাংশ বিদ্বান মত প্রকাশ করেছেন। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুনূতে কখনো একটি নির্দিষ্ট দো‘আ পড়তেন না, বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দো‘আ পড়েছেন (দ্রঃ আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ আবুদাঊদ, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/১২৭৬; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ২৩/১১০-১১; মির‘আত ৪/২৮৫; লাজনা দায়েমাহ, ফৎওয়া নং ১৮০৬৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া উছায়মীন, ফৎওয়া নং ৭৭৮-৭৯)। তাছাড়া যেকোন দো‘আর শুরুতে হাম্দ ও দরূদ পাঠের বিষয়ে ছহীহ হাদীছে বিশেষ নির্দেশ রয়েছে (আহমাদ, আবুদাঊদ হা/১৪৮১; ছিফাত পৃঃ ১৬২)। অতএব আমরা ‘ইস্তেগফার’ সহ যেকোন দো‘আ ও ‘দরূদ’ দো‘আয়ে কুনূতের শেষে পড়তে পারি।
[30] . আহমাদ, ইরওয়া হা/৪২৯; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭২২; শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, প্রশ্নোত্তর সংখ্যা : ২৯০, ৪/২৯৫ পৃঃ।
 [31] . আহমাদ, নাসাঈ হা/১০৭৪; আলবানী, ছিফাতু ছালা-তিন্নবী, ১৬০ পৃঃ।
[32] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৭; যঈফ আবুদাঊদ হা/১৪৮৫; বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২২৫৫ -এর টীকা; ইরওয়াউল গালীল হা/৪৩৩-৩৪, ২/১৮১ পৃঃ।
 [33] . নাসাঈ হা/১৬৯৯ সনদ ছহীহ।
[34] . আহমাদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৮৪, ৮৫, ৮৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৯৩।
[35] . মারাসীলে আবুদাঊদ হা/৮৯; বায়হাক্বী ২/২১০; মিরক্বাত ৩/১৭৩-৭৪; মির‘আত ৪/২৮৫।
[36] . ইরওয়া হা/৪২৮-এর শেষে, ২/১৭২ পৃঃ।
[37] . মির‘আত হা/১২৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৪/২৮৫ পৃঃ।
[38] . তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৪৬৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ২/৫৬৪ পৃঃ; বায়হাক্বী ২/২১০-১১।
[39] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৮৮-৯০; ছিফাত ১৫৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৮-৪৯।
[40] . মুসলিম, মিশকাত হা/৯৭৮, ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯; মির‘আত হা/৯৮৫-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ৩/৩৪২ পৃঃ; শাওকানী, আসসায়লুল জার্রার ১/২২১।
[41] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৯০; মির‘আত ৪/৩০৭; ছিফাত ১৫৯ পৃঃ।
[42] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৮৮-৯১।
[43] . বায়হাক্বী ২/২১০-১১। বায়হাক্বী অত্র হাদীছকে ‘ছহীহ মওছূল’ বলেছেন।
[44] . বায়হাক্বী ২/২১১ পৃঃ।
[45] . ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৮, ২/১৭২ পৃঃ।
২. তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ
রাত্রির বিশেষ নফল ছালাত তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নামে পরিচিত। রামাযানে এশার পর প্রথম রাতে পড়লে তাকে ‘তারাবীহ’ এবং রামাযান ও অন্যান্য সময়ে শেষরাতে পড়লে তাকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয়।
তারাবীহ : মূল ধাতু رَاحَةٌ (রা-হাতুন) অর্থ : প্রশান্তি। অন্যতম ধাতু رَوْحٌ (রাওহুন) অর্থ : সন্ধ্যারাতে কোন কাজ করা। সেখান থেকে ترويحة (তারবীহাতুন) অর্থ : সন্ধ্যারাতের প্রশান্তি বা প্রশান্তির বৈঠক; যা রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাতে প্রতি চার রাক‘আত শেষে করা হয়ে থাকে। বহুবচনে (التراويح) ‘তারা-বীহ’ অর্থ : প্রশান্তির বৈঠকসমূহ (আল-মুনজিদ)
তাহাজ্জুদ : মূল ধাতু هُجُوْدٌ (হুজূদুন) অর্থ : রাতে ঘুমানো বা ঘুম থেকে উঠা। সেখান থেকে تَهَجُّدٌ (তাহাজ্জুদুন) পারিভাষিক অর্থে রাত্রিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা বা রাত্রি জেগে ছালাত আদায় করা (আল-মুনজিদ)।
উল্লেখ্য যে, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামে রামাযান, ক্বিয়ামুল লায়েল সবকিছুকে এক কথায় ‘ছালাতুল লায়েল’ বা ‘রাত্রির নফল ছালাত’ বলা হয়। রামাযানে রাতের প্রথমাংশে যখন জামা‘আত সহ এই নফল ছালাতের প্রচলন হয়, তখন প্রতি চার রাক‘আত অন্তর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হ’ত। সেখান থেকে ‘তারাবীহ’ নামকরণ হয় (ফাৎহুল বারী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব)। এই নামকরণের মধ্যেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যে, তারাবীহ প্রথম রাতে একাকী অথবা জামা‘আত সহ এবং তাহাজ্জুদ শেষরাতে একাকী পড়তে হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযানের রাতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টিই পড়েছেন মর্মে ছহীহ বা যঈফ সনদে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না’। [1]
রাত্রির ছালাতের ফযীলত : রাত্রির ছালাত বা ‘ছালাতুল লায়েল’ নফল হ’লেও তা খুবই ফযীলতপূর্ণ। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাত্রির (নফল) ছালাত’।[2] তিনি আরও বলেন,
‘আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব? কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? এভাবে তিনি ফজর স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত আহবান করেন’। [3]
তারাবীহর জামা‘আত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসের ২৩, ২৫ ও ২৭ তিন রাত্রি মসজিদে জামা‘আতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করেছেন। প্রথম দিন রাত্রির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, দ্বিতীয় দিন অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত এবং তৃতীয় দিন নিজের স্ত্রী-পরিবার ও মুছল্লীদের নিয়ে সাহারীর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ছালাত আদায় করেন। [4] পরের রাতে মুছল্লীগণ তাঁর কক্ষের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি যে, এটি তোমাদের উপর ফরয হয়ে যায় কি-না (خَشِيْتُ أَنْ يُّكْتَبَ عَلَيْكُمْ)। আর যদি ফরয হয়ে যায়, তাহ’লে তোমরা তা আদায় করতে পারবে না’...। [5]
তারাবীহর ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[6]
তারাবীহর জামা‘আত ঈদের জামা‘আতের ন্যায় :
ইমাম শাফেঈ, আবু হানীফা, আহমাদ ও কিছু মালেকী বিদ্বান এবং অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন, তারাবীহর ছালাত জামা‘আতে পড়া উত্তম, যা ওমর (রাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম চালু করে গেছেন এবং এর উপরেই মুসলমানদের আমল জারি আছে। কেননা এটি ইসলামের প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহের (لأنه من الشعائر الظاهرة) অন্তর্ভুক্ত। যা ঈদায়নের ছালাতের সাথে সামঞ্জস্যশীল’।[7]
রাক‘আত সংখ্যা : রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে রাত্রির এই বিশেষ নফল ছালাত তিন রাক‘আত বিতরসহ ১১ রাক‘আত ছহীহ সূত্র সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন,
অর্থ : রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির ছালাত এগার রাক‘আতের বেশী আদায় করেননি। তিনি প্রথমে (২+২) [8] চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়েন।[9]
বন্ধ হওয়ার পরে পুনরায় জামা‘আত চালু : সম্ভবত: নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খেলাফতের উপরে আপতিত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে ১ম খলীফা হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত খেলাফতকালে (১১-১৩ হিঃ) তারাবীহর জামা‘আত পুনরায় চালু করা সম্ভবপর হয়নি। ২য় খলীফা হযরত ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় যুগে (১৩-২৩ হিঃ) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে এবং বহু সংখ্যক মুছল্লীকে মসজিদে বিক্ষিপ্তভাবে উক্ত ছালাত আদায় করতে দেখে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সুন্নাত অনুসরণ করে তাঁর খেলাফতের ২য় বর্ষে ১৪ হিজরী সনে মসজিদে নববীতে ১১ রাক‘আতে তারাবীহর জামা‘আত পুনরায় চালু করেন।[10] যেমন সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন,
‘খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হযরত উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীম দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে ১১ রাক‘আত ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায়ের নির্দেশ প্রদান করেন। এই ছালাত(إلي فُرُوْعِ الْفَجْرِ) ফজরের প্রাক্কাল (সাহারীর পূর্ব) পর্যন্ত দীর্ঘ হ’ত’।[11]
বিশ রাক‘আত তারাবীহ : প্রকাশ থাকে যে, উক্ত রেওয়ায়াতের পরে ইয়াযীদ বিন রূমান থেকে ‘ওমরের যামানায় ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়া হ’ত’ বলে যে বর্ণনা এসেছে, তা ‘যঈফ’ এবং ২০ রাক‘আত সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে ‘মরফূ’ সূত্রে যে বর্ণনা এসেছে, তা ‘মওযূ’ বা জাল।[12] এতদ্ব্যতীত ২০ রাক‘আত তারাবীহ সম্পর্কে কয়েকটি ‘আছার’ এসেছে, যার সবগুলিই ‘যঈফ’।[13] ২০ রাক‘আত তারাবীহর উপরে ওমরের যামানায় ছাহাবীগণের মধ্যে ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত হয়েছে বলে যে দাবী করা হয়, তা একেবারেই ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা (بَاطِلَةٌ جِدًّا) মাত্র। [14] তিরমিযীর ভাষ্যকার খ্যাতনামা ভারতীয় হানাফী মনীষী দারুল উলূম দেউবন্দ-এর তৎকালীন সময়ের মুহতামিম (অধ্যক্ষ) আনোয়ার শাহ কাষ্মীরী (১২৯২-১৩৫২/১৮৭৫-১৯৩৩ খৃঃ) বলেন, একথা না মেনে উপায় নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তারাবীহ ৮ রাক‘আত ছিল। [15]
এটা স্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদ্বীন থেকে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর অন্য কোন স্ত্রী ও ছাহাবী থেকে ১১ বা ১৩ রাক‘আতের ঊর্ধ্বে তারাবীহ বা তাহাজ্জুদের কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ নেই।[16] বর্ধিত রাক‘আত সমূহ পরবর্তীকালে সৃষ্ট। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির ছালাত ১১ বা ১৩ রাক‘আত আদায় করতেন। পরবর্তীকালে মদ্বীনার লোকেরা দীর্ঘ ক্বিয়ামে দুর্বলতা বোধ করে। ফলে তারা রাক‘আত সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে, যা ৩৯ রাক‘আত পর্যন্ত পৌঁছে যায়’।[17] অথচ বাস্তব কথা এই যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যেমন দীর্ঘ ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতের মাধ্যমে তিন রাত জামা‘আতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করেছেন, তেমনি সংক্ষিপ্ত ক্বিয়ামেও তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করেছেন। যা সময় বিশেষে ৯, ৭ ও ৫ রাক‘আত হ’ত। কিন্তু তা কখনো ১১ বা ১৩ -এর ঊর্ধ্বে প্রমাণিত হয়নি।[18] তিনি ছিলেন ‘সৃষ্টিজগতের প্রতি রহমত স্বরূপ’ (আম্বিয়া ২১/১০৭) এবং বেশী না পড়াটা ছিল উম্মতের প্রতি তাঁর অন্যতম রহমত।
শৈথিল্যবাদ : অনেক বিদ্বান উদারতার নামে ‘বিষয়টি প্রশস্ত’ (الأمر واسع) বলে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন এবং ২৩ রাক‘আত পড়েন ও বলেন শত রাক‘আতের বেশীও পড়া যাবে, যদি কেউ ইচ্ছা করে। দলীল হিসাবে ইবনু ওমর (রাঃ) বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীছটি পেশ করেন যে, ‘রাত্রির ছালাত দুই দুই (مَثْنَى مَثْنَى) করে। অতঃপর ফজর হয়ে যাবার আশংকা হ’লে এক রাক‘আত পড়। তাতে পিছনের সব ছালাত বিতরে (বেজোড়ে) পরিণত হবে’।[19] অত্র হাদীছে যেহেতু রাক‘আতের কোন সংখ্যাসীমা নেই এবং রাসূল (ছাঃ)-এর কথা তাঁর কাজের উপর অগ্রাধিকারযোগ্য, অতএব যত রাক‘আত খুশী পড়া যাবে। তবে তারা সবাই একথা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১১ রাক‘আত পড়েছেন এবং সেটা পড়াই উত্তম। অথচ উক্ত হাদীছের অর্থ হ’ল, রাত্রির নফল ছালাত (দিনের ন্যায়) চার-চার নয়, বরং দুই-দুই রাক‘আত করে। [20] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা ছালাত
আদায় কর, যেভাবে আমাকে ছালাত আদায় করতে দেখছ’।[21] এ কথার মধ্যে তাঁর ছালাতের ধরন ও রাক‘আত সংখ্যা সবই গণ্য। তাঁর উপরোক্ত কথার ব্যাখ্যা হ’ল তাঁর কর্ম, অর্থাৎ ১১ রাক‘আত ছালাত। অতএব ইবাদত বিষয়ে তাঁর কথা ও কর্মে বৈপরীত্য ছিল, এরূপ ধারণা নিতান্তই অবাস্তব।
এক্ষণে যখন সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ১১ রাক‘আত পড়তেন এবং কখনো এর ঊর্ধ্বে পড়েননি এবং এটা পড়াই উত্তম, তখন তারা কেন ১১ রাক‘আতের উপর আমলের ব্যাপারে একমত হ’তে পারেন না? কেন তারা শতাধিক রাক‘আত পড়ার ব্যাপারে উদারতা দেখিয়ে ফের ২৩ রাক‘আতে সীমাবদ্ধ থাকেন? এটা উম্মতকে ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখার নামান্তর বৈ-কি!
এক্ষণে যদি কেউ রাতে অধিক ইবাদত করতে চান এবং কুরআন অধিক মুখস্থ না থাকে, তাহ’লে দীর্ঘ রুকূ ও সুজূদ সহ ১১ রাক‘আত তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ শেষ করে দীর্ঘক্ষণ ধরে তাসবীহ ও কুরআন তিলাওয়াতে রত থাকতে পারেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও অধিক ছওয়াবের কাজ। এছাড়াও রয়েছে যেকোন সাধারণ নফল ছালাত আদায়ের সুযোগ। যেমন ছালাতুল হাজত, ছালাতুত তাওবাহ, তাহিইয়াতুল ওযূ, তাহিইয়াতুল মাসজিদ ইত্যাদি।
অতএব রাতের নফল ছালাত ১১ বা ১৩ রাক‘আতই সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সর্বোত্তম। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরিয়ে আট রাক‘আত তারাবীহ শেষে কখনও এক, কখনও তিন, কখনও পাঁচ রাক‘আত বিতর এক সালামে পড়তেন। [22] জেনে রাখা ভাল যে, রাক‘আত গণনার চেয়ে ছালাতের খুশূ-খুযূ ও দীর্ঘ সময় ক্বিয়াম, কু‘ঊদ, রুকূ, সুজূদ অধিক যরূরী। যা আজকের মুসলিম সমাজে প্রায় লোপ পেতে বসেছে। ফলে রাত্রির নিভৃত ছালাতের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
জামা‘আতে তারাবীহ কি বিদ‘আত?
রামাযানের প্রতি রাতে নিয়মিত জামা‘আতে তারাবীহ পড়াকে অনেকে বিদ‘আত মনে করেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাত্র তিনদিন জামা‘আতে তারাবীহ পড়েছিলেন [23] এবং ওমর ফারূক (রাঃ) নিয়মিত জামা‘আতে তারাবীহ চালু করার পরে একে ‘সুন্দর বিদ‘আত’(نِعْمَتِ الْبِدْعَةُ هٰذِهِ) বলেছিলেন।[24] এর জবাব এই যে, ওমর ফারূক (রাঃ) এটিকে আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত বলেছিলেন, শারঈ অর্থে নয়। কেননা শারঈ বিদ‘আত সর্বতোভাবেই ভ্রষ্টতা। যার পরিণাম জাহান্নাম। তিনি এজন্য বিদ‘আত বলেন যে, এটিকে রাসূল (ছাঃ) কায়েম করার পরে ফরয হওয়ার আশংকায় পরিত্যাগ করেন।[25] আবুবকর (রাঃ) পুনরায় চালু করেননি। অতঃপর দীর্ঘ বিরতির পরে চালু হওয়ায় বাহ্যিক কারণে তিনি এটাকে ‘কতই না সুন্দর বিদ‘আত’ অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)-এর পরে পুনঃপ্রচলন বলে প্রশংসা করেন।[26]
এক নযরে রাতের নফল ছালাতের নিয়ম সমূহ :
(১) ১১ রাক‘আত : দুই দুই করে ৮ রাক‘আত। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়ে শেষ বৈঠক করবে।[27] রামাযান ও অন্য সময়ে এটা ছিল রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) -এর অধিকাংশ রাতের আমল।
(২) ১১ রাক‘আত : দুই দুই করে মোট ১০ রাক‘আত। অতঃপর এক রাক‘আত বিতর।[28]
(৩) ১৩ রাক‘আত : দুই দুই করে ৮ রাক‘আত। অতঃপর একটানা পাঁচ রাক‘আত বিতর। অথবা দুই দুই করে ১০ রাক‘আত, অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর। অথবা দুই দুই করে ১২ রাক‘আত, অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর।[29]
(৪) ৯ রাক‘আত : একটানা ৮ রাক‘আত পড়ে প্রথম বৈঠক ও নবম রাক‘আতে শেষ বৈঠক। অথবা দুই দুই করে ৬ রাক‘আত। অতঃপর তিন রাক‘আত বিতর। অথবা দুই দুই করে ৮ রাক‘আত। অতঃপর ১ রাক‘আত বিতর।[30]
(৫) ৭ রাক‘আত : একটানা ৬ রাক‘আত পড়ে প্রথম বৈঠক ও সপ্তম রাক‘আতে শেষ বৈঠক। অথবা দুই দুই করে ৪ রাক‘আত। অতঃপর ৩ রাক‘আত বিতর। অথবা দুই দুই করে ৬ রাক‘আত। অতঃপর এক রাক‘আত বিতর।[31]
(৬) ৫ রাক‘আত : একটানা ৫ রাক‘আত বিতর অথবা দুই দুই করে ৪ রাক‘আত। অতঃপর এক রাক‘আত বিতর।[32]
ইমাম মুহাম্মাদ বিন নছর আল-মারওয়াযী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে একটানা একাধিক রাক‘আত বিতর পড়ার প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু দুই দুই রাক‘আত পড়ে সালাম ফিরানো ও শেষে এক রাক‘আত-এর মাধ্যমে বিতর করাকেই আমরা উত্তম মনে করি। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক প্রশ্নকারীকে এধরনের জবাবই দিয়েছিলেন যে, ‘রাতের ছালাত দুই দুই। অতঃপর যখন তুমি ফজর হয়ে যাবার আশংকা করবে, তখন এক রাক‘আত পড়ে নাও, যা তোমার পিছনের সব ছালাতকে বিতরে পরিণত করবে’। [33]
উপরের ৬টি নিয়মের মধ্যে প্রথমটি কেবল তিনি তারাবীহ ও তাহাজ্জুদে পড়েছেন। বাকীগুলি বিভিন্ন সময় তাহাজ্জুদে পড়েছেন। বৃদ্ধাবস্থায় কিংবা সময় কম থাকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো কখনো কমসংখ্যক রাক‘আতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। উম্মতের জন্য এটি বিশেষ অনুগ্রহ বটে। বৃদ্ধকালে ভারী হয়ে যাওয়ায় তিনি অধিকাংশ (রাতের নফল) ছালাত বসে বসে পড়তেন।[34]
এক্ষণে ২৩, ২৫ ও ২৭শে রামাযানের যে বেজোড় তিন রাত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জামা‘আত সহ তারাবীহ পড়েছিলেন, সে তিন রাত কত রাক‘আত পড়েছিলেন? জবাব এই যে, সেটা ছিল আট রাক‘আত তারাবীহ ও বাকীটা বিতর। যেমন হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিয়ে রামাযানে ছালাত আদায় করলেন আট রাক‘আত এবং বিতর পড়লেন।[35]
জাবের (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছে বিতরের রাক‘আত সংখ্যা বলা হয়নি। কিন্তু আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের শেষে স্পষ্টভাবে তিন রাক‘আত বিতরের কথা এসেছে, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।[36] অতএব ৮+৩=১১ রাক‘আত তারাবীহ জামা‘আত সহকারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত হিসাবে সাব্যস্ত হয়। হযরত ওমর (রাঃ) সেটাই পুনরায় চালু করেছিলেন। তিনি মোর্দা সুন্নাত যেন্দা করেছিলেন। তিনি ‘সুন্নাতে হাসানাহ’ করেছিলেন, ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ করেননি। কেননা শারঈ বিদ‘আত সবটুকু ভ্রষ্টতা। সেখানে ভাল-মন্দ ভাগ নেই। বরং শারঈ বিদ‘আতকে ‘হাসানাহ’ ও ‘সাইয়েআহ’ দু’ভাগে ভাগ করাটাই আরেকটি বিদ‘আত। আল্লাহ আমাদেরকে বিদ‘আত হ’তে রক্ষা করুন!
উল্লেখ্য যে, হাদীছে বিতর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘যখন তুমি ফজর হয়ে যাবার আশংকা করবে, তখন এক রাক‘আত পড়ে নাও। তাহ’লে পিছনের ছালাত গুলি বিতরে পরিণত হবে’।[37] এতে বুঝা যায় যে, একটানা বা দুই দুই করে পড়লেও সেটা শেষের এক রাক‘আতের মাধ্যমে বিতরে পরিণত হবে। [38] আর একারণেই ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ১৩, ১১, ৯, ৭, ৫, ৩, ও ১ রাক‘আত বিতর প্রমাণিত আছে। তবে সবচেয়ে বিশুদ্ধতর হ’ল এক রাক‘আত।[39] অর্থাৎ তারাবীহ ও বিতর পৃথক নয়। বরং শেষে এক রাক‘আত যোগ করলে সবটাকেই ‘বিতর’ বলা যায় ও সবটাকেই ‘ছালাতুল লায়েল’ বা ‘রাতের ছালাত’ বলা যায়।
রাত্রির ছালাত সম্পর্কে জ্ঞাতব্য
(১) শেষ রাতে তাহাজ্জুদে উঠে প্রথমে হালকাভাবে দু’রাক‘আত পড়বে। অতঃপর বাকী ছালাত পড়বে।[40] (২) যদি কেউ প্রথম রাতে এশার পরে বিতর পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে শেষ রাতে উঠে দু’রাক‘আত করে তাহাজ্জুদ পড়বে। শেষে আর বিতর পড়তে হবে না। কেননা এক রাতে দুই বিতর চলে না।[41] (৩) বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে সকালে অথবা যখন স্মরণ বা সুযোগ হবে, তখন পড়বে’। [42] এটি ‘মুবাহ’ (ইচ্ছাধীন, বাধ্যতামূলক নয়)।[43] (৪) তাহাজ্জুদ বা বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে ‘উবাদাহ বিন ছামিত, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস প্রমুখ ছাহাবীগণ ফজর ছালাতের আগে তা আদায় করে নিতেন। [44] (৫) বিতর পড়ে শুয়ে গেলে এবং ঘুম অথবা ব্যথার আধিক্যের কারণে তাহাজ্জুদ পড়তে না পারলে রাসূল (ছাঃ) দিনের বেলায় (সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে) ১২ রাক‘আত পড়েছেন (তন্মধ্যে তাহাজ্জুদের ৮ রাক‘আত ও ছালাতুয যোহা ৪ রাক‘আত)। [45] (৬) যদি কেউ আগ রাতে বিতরের পর দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে এবং শেষরাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে সক্ষম না হয়, তাহ’লে উক্ত দু’রাক‘আত তার জন্য যথেষ্ট হবে’।[46] (৭) ‘যদি কেউ তাহাজ্জুদের নিয়তে শুয়ে গেলেও উঠতে না পারে, তাহ’লে সে উত্তম নিয়তের কারণে পূর্ণ নেকী পাবে এবং উক্ত ঘুম তার জন্য ছাদাক্বা হবে’।[47] ‘যদি কেউ পীড়িত হয় বা সফরে থাকে, তাহ’লে বাড়ীতে সুস্থ অবস্থায় সে যে নেক আমল করত, সেইরূপ ছওয়াব তার জন্য লেখা হবে’।[48] আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে অব্যাহত পুরস্কার’। [49] (৮) রাতের নফল ছালাত নিয়মিত আদায় করা উচিৎ। কেননা ‘যেকোন নেক আমল তা যত কমই হৌক, নিয়মিত করাই আল্লাহর নিকট অধিক পসন্দনীয়’।[50] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি ঐ ব্যক্তির মত হয়ো না, যে রাতের নফল ছালাতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়েছে’।[51] তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ ঐ স্বামী-স্ত্রীর উপর রহম করুন, যারা তাহাজ্জুদে ওঠার জন্য পরস্পরের মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়, যদি একজন আপত্তি করে’।[52] (৯) তাহাজ্জুদের ক্বিরাআত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো সশব্দে কখনো নিঃশব্দে পড়েছেন।[53] তিনি বলেন, সরবে ও নীরবে পাঠকারী প্রকাশ্যে ও গোপনে ছাদাক্বাকারীর ন্যায়।[54] তিনি আবুবকর (রাঃ)-কে কিছুটা জোরে এবং ওমর (রাঃ)-কে কিছুটা আস্তে ক্বিরাআত করার উপদেশ দেন।[55] (১০) তারাবীহর জন্য নির্দিষ্ট কোন দো‘আ নেই। তবে শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে পড়ার জন্য আয়েশা (রাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিশেষ একটি দো‘আ শিক্ষা দিয়েছিলেন। সেটি হ’ল, اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْআল্লা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউভুন তোহেববুল ‘আফ্ওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’ (হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমা করতে ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর)। [56] (১১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা মনের প্রফুল্লতা নিয়ে ছালাত আদায় কর এবং সাধ্যমত নেক আমল কর, বিরক্তি বোধ না করা পর্যন্ত’।[57] (১২) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি জানিনা যে, আল্লাহর নবী (ছাঃ) কখনো এক রাত্রিতে সমস্ত কুরআন খতম করেছেন কিংবা ফজর অবধি সারা রাত্রি ব্যাপী (নফল) ছালাত আদায় করেছেন।[58]
তাহাজ্জুদে উঠে দো‘আ ( ما يقول إذا قام من الليل) :
(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ রাত্রে জাগ্রত হয় ও নিম্নের দো‘আ পাঠ করে এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, তা কবুল করা হয়। আর যদি সে ওযূ করে এবং ছালাত আদায় করে, সেই ছালাত কবুল করা হয়’। দো‘আটি হ’ল :
উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু; লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াল হামদু লিল্লা-হি ওয়ালা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার; ওয়ালা হাওলা ওয়ালা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ। অতঃপর বলবে, ‘রবিবগফির্লী’ (প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর)। অথবা অন্য প্রার্থনা করবে।
অনুবাদ : আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর জন্যই সকল রাজত্ব ও তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা এবং তিনিই সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী। মহা পবিত্র আল্লাহ। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। নেই কোন ক্ষমতা নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত’। [59] এছাড়া অন্যান্য দো‘আও পড়তেন।[60]
(খ) স্ত্রী মায়মূনা (রাঃ)-এর ঘরে তাহাজ্জুদের ছালাতে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৯০ আয়াত (إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ... لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ) থেকে সূরার শেষ অর্থাৎ ২০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করেন’ (বু: মু:)। একবার সফরে রাতে ঘুম থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা আলে ইমরান ১৯১-৯৪ আয়াত (رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً..... إِنَّكَ لاَ تُخْلِفُ الْمِيْعَادَ) পাঠ করেছেন (নাসাঈ)। একবার তিনি (গুরুত্ব বিবেচনা করে) সূরা মায়েদাহ ১১৮ আয়াতটি (إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ) দিয়ে পুরা তাহাজ্জুদের ছালাত শেষ করেন’ (নাসাঈ)। [61]
(গ) তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন ‘ছানা’ পড়েছেন।[62] তন্মধ্য হ’তে যে কোন ‘ছানা’ পড়া চলে। তবে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাতে যখন তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন, তখন তাকবীরে তাহরীমার পর নিম্নের দো‘আটি পড়তেন-
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা লাকাল হামদু আনতা ক্বাইয়িমুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি ওয়া মান ফীহিন্না, ওয়ালাকাল হামদু আনতা নূরুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি ওয়া মান ফীহিন্না, ওয়ালাকাল হামদু আনতা মালিকুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি ওয়া মান ফীহিন্না; ওয়া লাকাল হামদু, আনতাল হাক্কু, ওয়া ওয়া‘দুকা হাক্কুন, ওয়া লিক্বা-উকা হাক্কুন, ওয়া ক্বাওলুকা হাক্কুন; ওয়া ‘আযা-বুল ক্বাবরে হাক্কুন, ওয়াল জান্নাতু হাক্কুন, ওয়ান্না-রু হাক্কুন; ওয়ান নাবিইয়ূনা হাক্কুন, ওয়া মুহাম্মাদুন হাক্কুন, ওয়াস সা-‘আতু হাক্কুন। আল্লা-হুম্মা লাকা আসলামতু ওয়া বিকা আ-মানতু, ওয়া ‘আলাইকা তাওয়াক্কালতু, ওয়া ইলাইকা আনাবতু, ওয়া বিকা খা-ছামতু, ওয়া ইলাইকা হা-কামতু, ফাগফিরলী মা ক্বাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু, ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ‘লানতু, ওয়া মা আনতা আ‘লামু বিহী মিন্নী; আনতাল মুক্বাদ্দিমু ওয়া আনতাল মুওয়াখখিরু, লা ইলা-হা ইল্লা আনতা, ওয়া লা ইলা-হা গাইরুকা।
অর্থঃ
‘হে আল্লাহ! তোমার জন্য যাবতীয় প্রশংসা, তুমি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এ সবের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর ধারক। তোমারই জন্য সমস্ত প্রশংসা, তুমি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এ সবের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর জ্যোতি। তোমারই জন্য সমস্ত প্রশংসা, তুমি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এ সবের মধ্যে যা আছে সবকিছুর বাদশাহ। তোমারই জন্য সমস্ত প্রশংসা, তুমিই সত্য, তোমার ওয়াদা সত্য, তোমার সাক্ষাত লাভ সত্য, তোমার বাণী সত্য, কবর আযাব সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মাদ সত্য এবং ক্বিয়ামত সত্য। হে আল্লাহ! আমি তোমারই নিকট আত্মসমর্পণ করি, তোমারই উপর ভরসা করি ও তোমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। আমি তোমার জন্যই ঝগড়া করি এবং তোমার কাছেই ফায়ছালা পেশ করি। অতএব তুমি আমার পূর্বাপর, গোপন ও প্রকাশ্য সকল অপরাধ ক্ষমা কর। তুমি অগ্র ও পশ্চাতের মালিক। তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং তুমি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই।[63]
দলীলের উৎসঃ
[1] . মির‘আত ৪/৩১১ পৃঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[2] . মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।
[3] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২২৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩; মুসলিম হা/১৭৭৩।
[4] . আবুদাঊদ, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/১২৯৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[5] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৯৫ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[6] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৯৬ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[7] . শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ‘তারাবীহর ছালাত’ অনুচ্ছেদ, ৩/৩২১।
[8] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৮৮ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[9] . (১) বুখারী ১/১৫৪ পৃঃ, হা/১১৪৭; (২) মুসলিম ১/২৫৪ পৃঃ, হা/১৭২৩; (৩) তিরমিযী হা/৪৩৯; (৪) আবুদাঊদ হা/১৩৪১; (৫) নাসাঈ হা/১৬৯৭; (৬) মুওয়াত্ত্বা, পৃঃ ৭৪, হা/২৬৩; (৭) আহমাদ হা/২৪৮০১; (৮) ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১১৬৬; (৯) বুলূগুল মারাম হা/৩৬৭; (১০) তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৪৩৭; (১১) বায়হাক্বী ২/৪৯৬ পৃঃ, হা/৪৩৯০; (১২) ইরওয়াউল গালীল হা/৪৪৫-এর ভাষ্য, ২/১৯১-১৯২; (১৩) মির‘আতুল মাফাতীহ হা/১৩০৬-এর ভাষ্য, ৪/৩২০-২১।
[10] . মির‘আত ২/২৩২ পৃঃ; ঐ, ৪/৩১৫-১৬ ও ৩২৬ পৃঃ।
[11] . (১) মুওয়াত্ত্বা (মুলতান, পাকিস্তান: ১৪০৭/১৯৮৬) ৭১ পৃঃ, ‘রামাযানে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ; মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৩০২ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭; মির‘আত হা/১৩১০, ৪/৩২৯-৩০, ৩১৫ পৃঃ; (২) বায়হাক্বী ২/৪৯৬, হা/৪৩৯২; (৩) মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ (বোম্বাই, ১৩৯৯/১৯৭৯) ২/৩৯১ পৃঃ, হা/৭৭৫৩; (৪) ত্বাহাভী শরহ মা‘আনিল আছার হা/১৬১০।
[12] . আলবানী, হাশিয়া মিশকাত হা/১৩০২, ১/৪০৮ পৃঃ; ইরওয়া হা/৪৪৬, ৪৪৫, ২/১৯৩, ১৯১ পৃ:।
[13] . তারাবীহর রাক‘আত বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মির‘আত হা/১৩১০ -এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৪/৩২৯-৩৫ পৃঃ; ইরওয়া হা/৪৪৬-এর আলোচনা দ্রঃ ২/১৯৩ পৃঃ।
[14] . তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৮০৩-এর আলোচনা দ্রঃ ৩/৫৩১ পৃঃ; মির‘আত ৪/৩৩৫।
[15] . كَانَتْ ثَمَانِيَةَ رَكْعَاتٍ) r (وَلاَ مَنَاصَ مِنْ تَسْلِيْمٍ أَنَّ تَرَاوِيْحَهُ আল-‘আরফুশ শাযী শরহ তিরমিযী হা/৮০৬-এর আলোচনা, দ্রঃ ২/২০৮ পৃঃ; মির‘আত ৪/৩২১।
[16] . মুওয়াত্ত্বা, ৭১ পৃঃ, টীকা-৮ দ্রষ্টব্য।
[17] . ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া (মক্কা: আননাহযাতুল হাদীছাহ ১৪০৪/১৯৮৪), ২৩/১১৩।
[18] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৮৮ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৬৪ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫, আয়েশা (রাঃ) হ’তে; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৯৫, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে।
 [19] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[20] . কেননা অত্র হাদীছের রাবী ইবনু ওমর (রাঃ) দিনের নফল ছালাত এক সালামে চার রাক‘আত করে পড়তেন। -মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৬৬৯৮, ২/২৭৪, সনদ ছহীহ, আলবানী, তামামুল মিন্নাহ পৃঃ ২৪০; বায়হাক্বী, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আ-ছা-র হা/১৪৩১, ৪/১৯২। ছহীহ বুখারীর বর্ণনায় (হা/৯৯০) এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুৎবা দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, রাত্রির ছালাত কিভাবে পড়তে হবে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দুই দুই করে। ভাষ্যকার ইবনু হাজার বলেন, জবাবে এটা স্পষ্ট হয় যে, ঐ ব্যক্তি রাক‘আত সংখ্যা অথবা (চার রাক‘আত) পৃথকভাবে না মিলিয়ে পড়তে হবে, সেকথা জিজ্ঞেস করেছিল’ (ফাৎহুল বারী হা/৯৯০ ‘বিতর’ অধ্যায়-১৪, ২/৫৫৫-৫৬; মির‘আত ৪/২৫৬)।
 [21] . বুখারী হা/৬৩১; ঐ, মিশকাত হা/৬৮৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দেরীতে আযান’ অনুচ্ছেদ-৬।
[22] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৬৪-৬৫ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
 [23] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৯৮ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[24] . বুখারী হা/২০১০; ঐ, মিশকাত হা/১৩০১ অনুচ্ছেদ-৩৭; মির‘আত হা/১৩০৯, ৪/৩২৬-২৭।
[25] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৯৫ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭; আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৯৮।
[26] . মির‘আত ২/২৩২ পৃঃ; ঐ, ৪/৩২৭।
[27] . বুখারী হা/১১৪৭; মুসলিম হা/১৭২৩ ও অন্যান্য।
[28] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৮৮ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[29] . মুসলিম, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৫৬, ১২৬৪ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; মুসলিম, মিশকাত হা/১১৯৭, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[30] . মুসলিম, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৫৭, ১২৬৪ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; মুসলিম, মিশকাত হা/১১৯৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৫৪, ১২৬৫।
[31] . আবুদাঊদ হা/১৩৪২; ঐ, মিশকাত হা/১২৬৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪।
[32] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৬৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪।
[33] . বুখারী হা/৪৭২-৭৩, ৯৯০; মুসলিম হা/১৭৫১; মিশকাত হা/১২৫৪, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[34] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৯৮, ‘রাতের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[35] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১০৭০ ‘সনদ হাসান’ ২/১৩৮ পৃঃ; আলবানী, ছালাতুত তারাবীহ হা/৯, ২১ পৃঃ; মির‘আত ৪/৩২০।
[36] . দ্র: টীকা ৭৯৩; বুখারী হা/১১৪৭; মুসলিম হা/১৭২৩ প্রভৃতি।
[37] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫৪, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[38] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪৫-৪৬ পৃঃ।
[39] . মুস্তাদরাক হাকেম ১/৩০৬।
[40] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১৯৩-৯৪, ৯৭, ‘রাতের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[41] . আবুদাঊদ, নাসাঈ প্রভৃতি (لاَ وِتْرَانِ فِىْ لَيْلَةٍ) নায়ল, ‘বিতর’ অধ্যায় ৩/৩১৪-১৭ পৃঃ; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫৬৭।
[42] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৬৮, ১২৭৯ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৬২-৬৩; মির‘আত ৪/২৭৯।
[43] . নায়লুল আওত্বার ৩/৩১৭-১৯।
[44] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৮৩।
[45] . মির‘আত ৪/২৬৬; মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
[46] . দারেমী, মিশকাত হা/১২৮৬; ছহীহাহ হা/১৯৯৩।
[47] . নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইরওয়া হা/৪৫৪।
[48] . বুখারী, মিশকাত হা/১৫৪৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-১।
[49] . হা-মীম সাজদাহ ৪১/৮, তীন ৯৫/৬।
[50] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৪২, ‘কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন’ অনুচ্ছেদ-৩৪।
[51] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৩৪, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।
[52] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৩০, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।
[53] . আবুদাঊদ হা/২২৬; তিরমিযী হা/৪৪৯; মিশকাত হা/১২০২-০৩, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[54] . নাসাঈ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২২০২, ‘কুরআনের ফাযায়েল’ অধ্যায়-৮, অনুচ্ছেদ-১।
[55] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১২০৪, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[56] . আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘ক্বদরের রাত্রি’ অনুচ্ছেদ-৮।
[57] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৪৩-৪৪ ‘কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন’ অনুচ্ছেদ-৩৪।
[58] . মুসলিম, মিশকাত হা/১২৫৭, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ-৩৫।
 [59] . বুখারী, মিশকাত হা/১২১৩ ‘রাত্রিতে উঠে তাহাজ্জুদে কি বলবে’ অনুচ্ছেদ-৩২।
[60] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৯৫; আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২০০, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[61] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৯৫; নাসাঈ, মিশকাত হা/১২০৯; নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২০৫, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১; আহমাদ হা/২১৩৬৬; মির‘আত ৪/১৯১।
[62] . মুসলিম, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১২১২, ১৪, ১৭; নাসাঈ হা/১৬১৭ ইত্যাদি।
[63] . আবুদাঊদ হা/৭৭২; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১১৫১-৫২; বুখারী হা/৬৩১৭; মুসলিম হা/১৮০৮; মিশকাত -আলবানী, হা/১২১১ ‘রাত্রিতে উঠে তাহাজ্জুদে কি বলবে’ অনুচ্ছেদ-৩২; মির‘আত হা/১২১৮।
৩. সফরের ছালাত (الصلاة في السفر)
সফর অথবা ভীতির সময়ে ছালাতে ‘ক্বছর’ করার অনুমতি রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন-
অর্থ : ‘যখন তোমরা সফর কর, তখন তোমাদের ছালাতে ‘ক্বছর’ করায় কোন দোষ নেই। যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে উত্যক্ত করবে। নিশ্চয়ই কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (নিসা ৪/১০১)।
‘ক্বছর’ অর্থ কমানো। পারিভাষিক অর্থে : চার রাক‘আত বিশিষ্ট ছালাত দু’রাক‘আত করে পড়াকে ‘ক্বছর’ বলে। মক্কা বিজয়ের সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বছরের সাথে ছালাত আদায় করেন।[1] শান্তিপূর্ণ সফরে ক্বছর করতে হবে কি-না এ সম্পর্কে ওমর ফারূক (রাঃ)-এর এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللهُ بِهَا عَلَيْكُمْ فَاقْبَلُوْا صَدَقَتَهُ-‘আল্লাহ এটিকে তোমাদের জন্য ছাদাক্বা (উপঢৌকন) হিসাবে প্রদান করেছেন। অতএব তোমরা তা গ্রহণ কর’।[2] সফর অবশ্যই আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের সফর হ’তে হবে, গোনাহের সফর নয়’। [3]
সফরের দূরত্ব (مسافة السفر) :
সফরের দূরত্বের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে এক মাইল হ’তে ৪৮ মাইলের বিশ প্রকার বক্তব্য রয়েছে।[4] পবিত্র কুরআনে দূরত্বের কোন ব্যাখ্যা নেই। কেবল সফরের কথা আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকেও এর কোন সীমা নির্দেশ করা হয়নি। [5] অতএব সফর হিসাবে গণ্য করা যায়, এরূপ সফরে বের হ’লে নিজ বাসস্থান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর গেলেই ‘ক্বছর’ করা যায়। কোন কোন বিদ্বানের নিকটে সফরের নিয়ত করলে ঘর থেকেই ‘ক্বছর’ শুরু করা যায়। তবে ইবনুল মুনযির বলেন যে, সফরের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদ্বীনা শহর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পূর্বে ‘ক্বছর’ করেছেন বলে আমি জানতে পারিনি’। তিনি বলেন, বিদ্বানগণ একমত হয়েছেন যে, সফরের নিয়তে বের হয়ে নিজ গ্রাম (বা মহল্লার) বাড়ীসমূহ অতিক্রম করলেই তিনি ক্বছর করতে পারেন।[6]
আমরা মনে করি যে, মতভেদ এড়ানোর জন্য ঘর থেকেই দু’ওয়াক্তের ফরয ছালাত ক্বছর ও সুন্নাত ছাড়াই পৃথক দুই এক্বামতের মাধ্যমে জমা করে সফরে বের হওয়া ভাল। তাবূকের অভিযানে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ এটা করেছিলেন।[7]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৯ দিন (মক্কা বিজয় অথবা তাবূক অভিযানে) অবস্থানকালে ‘ক্বছর’ করেছেন। আমরাও তাই করি। তার বেশী হ’লে পুরা করি।[8] যদি কারু সফরের মেয়াদ নির্দিষ্ট থাকে, তথাপি তিনি ‘ক্বছর’ করবেন, যতক্ষণ না তিনি সেখানে স্থায়ী বসবাসের সংকল্প করেন।[9] সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় ১৯ দিনের বেশী হ’লেও ‘ক্বছর’ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবূক অভিযানের সময় সেখানে ২০ দিন যাবৎ ‘ক্বছর’ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) আযারবাইজান সফরে গেলে পুরা বরফের মৌসুমে সেখানে আটকে যান ও ছ’মাস যাবৎ ক্বছরের সাথে ছালাত আদায় করেন। অনুরূপভাবে হযরত আনাস (রাঃ) শাম বা সিরিয়া সফরে এসে দু’বছর সেখানে থাকেন ও ক্বছর করেন। [10]
অতএব স্থায়ী মুসাফির যেমন জাহায, বিমান, ট্রেন, বাস ইত্যাদির চালক ও কর্মচারীগণ সফর অবস্থায় সর্বদা ছালাতে ক্বছর করতে পারেন এবং তারা দু’ওয়াক্তের ছালাত জমা ও ক্বছর করতে পারেন।
মোটকথা ভীতি ও সফর অবস্থায় ‘ক্বছর’ করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সফরে সর্বদা ক্বছর করতেন। হযরত ওমর, আলী, ইবনু মাসঊদ, ইবনু আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ সফরে ক্বছর করাকেই অগ্রাধিকার দিতেন।[11] হযরত ওছমান ও হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রথম দিকে ক্বছর করতেন ও পরে পুরা পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) জামা‘আতে পুরা পড়তেন ও একাকী ক্বছর করতেন।[12] কেননা আল্লাহ বলেন, ‘সফর অবস্থায় ছালাতে ‘ক্বছর’ করলে তোমাদের জন্য কোন গোনাহ নেই’ (নিসা ৪/ ১০১)।
ছালাত জমা ও ক্বছর করা
সফরে থাকা অবস্থায় যোহর-আছর (২+২=৪ রাক‘আত) ও মাগরিব-এশা (৩+২=৫ রাক‘আত) পৃথক এক্বামতের মাধ্যমে সুন্নাত ও নফল ছাড়াই জমা ও ক্বছর করে তাক্বদীম ও তাখীর দু’ভাবে পড়ার নিয়ম রয়েছে।[13] অর্থাৎ শেষের ওয়াক্তের ছালাত আগের ওয়াক্তের সাথে ‘তাক্বদীম’ করে অথবা আগের ওয়াক্তের ছালাত শেষের ওয়াক্তের সাথে ‘তাখীর’ করে একত্রে পড়বে।[14]
ভীতি ও ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াও অন্য কোন বিশেষ শারঈ ওযর বশতঃ মুক্বীম অবস্থায়ও দু’ওয়াক্তের ছালাত ক্বছর ও সুন্নাত ছাড়াই একত্রে জমা করে পড়া যায়। যেমন যোহর ও আছর পৃথক এক্বামতের মাধ্যমে ৪+৪=৮ (ثَمَانِيًا) এবং মাগরিব ও এশা অনুরূপভাবে ৩+৪=৭ (سَبْعًا) রাক‘আত। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, এটা কেন? তিনি বললেন, যাতে উম্মতের কষ্ট না হয়’।[15]
ইস্তেহাযা বা প্রদর রোগগ্রস্ত মহিলা ও বহুমূত্রের রোগী বা অন্যান্য কঠিন রোগী, বাবুর্চী এবং কর্মব্যস্ত ভাই-বোনেরা মাঝে-মধ্যে বিশেষ ওযর বশতঃ সাময়িকভাবে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন।[16]
হজ্জের সফরে আরাফাতের ময়দানে কোনরূপ সুন্নাত-নফল ছাড়াই যোহর ও আছর একত্রে (২+২) যোহরের আউয়াল ওয়াক্তে পৃথক এক্বামতে ‘জমা তাক্বদীম’ করে এবং মুযদালিফায় মাগরিব ও এশা একত্রে (৩+২) এশার সময় পৃথক এক্বামতে ‘জমা তাখীর’ করে জামা‘আতের সাথে অথবা একাকী পড়তে হয়। [17]
সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত সমূহ পড়তেন না। [18]
অবশ্য বিতর, তাহাজ্জুদ ও ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ছাড়তেন না। [19]
তবে সাধারণ নফল ছালাত যেমন তাহিইয়াতুল ওযূ, তাহিইয়াতুল মাসজিদ ইত্যাদি আদায়ে তিনি কাউকে নিষেধ করতেন না। [20]
দলীলের উৎসঃ
[1] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৬ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।
[2] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৩৫ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।
[3] . মির‘আত ৪/৩৮১।
[4] . শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৪/১২২ পৃঃ; আলোচনা দ্রষ্টব্য, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৬৩।
[5] . ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ (বৈরুত: ১৪১৬/১৯৯৬) ১/৪৬৩ পৃঃ।
[6] . নায়লুল আওত্বার ৪/১২৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩।
 [7] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৪৪ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।
[8] . বুখারী ১/১৪৭, হা/৪২৯৮; ঐ, মিশকাত হা/১৩৩৭।
[9] . সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩।
[10] . মিরক্বাত ৩/২২১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৩-১৪।
[11] . ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১২।
[12] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪৭-৪৮ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।
[13] . বুখারী, মিশকাত হা/১৩৩৯; আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৪৪।
[14] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৫।
[15] .(أَرَادَ أَنْ لاَ يُحْرِجَ أُمَّتَهُ) বুখারী হা/১১৭৪ ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়-১৯, অনুচ্ছেদ-৩০; মুসলিম হা/১৬৩৩-৩৪; নায়লুল আওত্বার ৪/১৩৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৮।
[16] . নায়লুল আওত্বার ৪/১৩৬-৪০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৭-১৮।
[17] . বুখারী, মিশকাত হা/২৬১৭, ২৬০৭ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘আরাফা ও মুযদালিফা থেকে প্রত্যাবর্তন’ অনুচ্ছেদ-৫; আহমাদ, মুসলিম, নাসাঈ, নায়ল ৪/১৪০।
[18] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৮ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১৬।
[19] . ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ৩/৪৫৭ পৃঃ।
[20] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪০; বুখারী হা/১১৫৯; নায়ল ৪/১৪২; যা-দুল মা‘আদ ১/৪৫৬।
৪. জুম‘আর ছালাত (صلاة الجمعة)
সূচনা : ১ম হিজরীতে জুম‘আ ফরয হয় এবং হিজরতকালে ক্বোবা ও মদ্বীনার মধ্যবর্তী বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رانوناء) উপত্যকায় সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুম‘আর ছালাত আদায় করেন।[1] যাতে একশত মুছল্লী শরীক ছিলেন।[2] তবে হিজরতের পূর্বে মদ্বীনার আনছারগণ আপোষে পরামর্শক্রমে ইহুদী ও নাছারাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনের বিপরীতে নিজেদের জন্য একটি ইবাদতের দিন ধার্য করেন ও সেমতে আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মদ্বীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের নাক্বী‘উল খাযেমাত (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত চালু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুছল্লী যোগদান করেন।[3] অতঃপর হিজরতের পর জুম‘আ ফরয করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জুম‘আর এই দিনটি প্রথমে ইয়াহূদ-নাছারাদের উপরে ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ বিষয়ে মতভেদ করে। তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই দিনের প্রতি (অহীর মাধ্যমে) হেদায়াত দান করেন। এক্ষণে সকল মানুষ আমাদের পশ্চাদানুসারী। ইহুদীরা পরের দিন (শনিবার) এবং নাছারারা তার পরের দিন (রবিবার)...। [4] যেহেতু আল্লাহ শনিবারে কিছু সৃষ্টি করেননি এবং আরশে স্বীয় আসনে সমুন্নত হন, সেহেতু ইহুদীরা এদিনকে তাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে বেছে নেয়। যেহেতু আল্লাহ রবিবারে সৃষ্টির সূচনা করেন, সেহেতু নাছারাগণ এ দিনটিকে পসন্দ করে। এভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশের উপর নিজেদের যুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। পক্ষান্তরে জুম‘আর দিনে সকল সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন হয় এবং সর্বশেষ সৃষ্টি হিসাবে আদমকে পয়দা করা হয়। তাই এ দিনটি হ’ল সকল দিনের সেরা। এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে নির্ধারিত হওয়ায় বিগত সকল উম্মতের উপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। [5] কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আযানের আওয়ায শুনে বিগলিত হৃদয়ে বলতেন, ‘আল্লাহ রহম করুন আস‘আদ বিন যুরারাহর উপর, সেই-ই প্রথম আমাদের নিয়ে জুম‘আর ছালাত কায়েম করে রাসূল (ছাঃ)-এর মক্কা থেকে আগমনের পূর্বে। [6]
শহরে হৌক বা গ্রামে হৌক জুম‘আর ছালাত প্রত্যেক বয়স্ক পুরুষ ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের উপরে জামা‘আত সহ আদায় করা ‘ফরযে আয়েন’।[7] তবে গোলাম, রোগী, মুসাফির, শিশু ও মহিলাদের উপরে জুম‘আ ফরয নয়। [8] বাহরায়েন বাসীর প্রতি এক লিখিত ফরমানে খলীফা ওমর (রাঃ) বলেন, جَمِّعُوْا حَيْثُمَا كُنْتُمْ ‘তোমরা যেখানেই থাক, জুম‘আ আদায় কর’।[9] অতএব দু’জন মুসলমান কোন স্থানে থাকলেও তারা একত্রে জুম‘আ আদায় করবে।[10] একজনে খুৎবা দিবে। যদি খুৎবা দিতে অপারগ হয়, তাহ’লে দু’জনে একত্রে জুম‘আর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। [11] কারাবন্দী অবস্থায় অনুমতি পেলে করবে, নইলে করবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)।
গুরুত্ব (أهمية الجمعة) :
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! জুম‘আর দিনকে আল্লাহ তোমাদের জন্য (সাপ্তাহিক) ঈদের দিন হিসাবে নির্ধারণ করেছেন (جَعَلَهُ اللهُ عِيْدًا)। তোমরা এদিন মিসওয়াক কর, গোসল কর ও সুগন্ধি লাগাও’।[12] (২) অতএব জুম‘আর দিন সুন্দরভাবে গোসল করে সাধ্যমত উত্তম পোষাক ও সুগন্ধি লাগিয়ে আগেভাগে মসজিদে যাবে।[13] (৩) মসজিদে প্রবেশ করে সামনের কাতারের দিকে এগিয়ে যাবে[14] এবং বসার পূর্বে প্রথমে দু’রাক‘আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ আদায় করবে। [15] দুনিয়ার সকল গৃহের ঊর্ধ্বে আল্লাহর গৃহের সম্মান। তাই এ গৃহে প্রবেশ করে বসার পূর্বেই আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের সিজদা করতে হয়। আল্লাহ সবচাইতে খুশী হন বান্দা যখন সিজদা করে। কিন্তু যারা সিজদা না করেই বসে পড়ে, তারা আল্লাহ ও আল্লাহর গৃহের প্রতি অসম্মান করে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা করে। (৪) অতঃপর খত্বীব মিম্বরে বসার আগ পর্যন্ত যত রাক‘আত খুশী নফল ছালাতে মগ্ন থাকবে। [16] (৫) এরপর চুপচাপ মনোযোগ সহকারে খুৎবা শুনবে।[17] (৬) খুৎবা চলা অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করলে কেবল দু’রাক‘আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ সংক্ষেপে আদায় করে বসে পড়বে।[18] (৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জুম‘আ থেকে অলসতাকারীদের ঘর জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।[19] (৮) তিনি বলেন, জুম‘আ পরিত্যাগকারীদের হৃদয়ে আল্লাহ মোহর মেরে দেন। অতঃপর তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’।[20] (৯) তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি অবহেলা ভরে পরপর তিন জুম‘আ পরিত্যাগ করল, সে ব্যক্তি ইসলামকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল’।[21] (১০) অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি বিনা ওযরে তিন জুম‘আ পরিত্যাগ করল, সে ব্যক্তি ‘মুনাফিক’।[22]
ফযীলত (فضل يوم الجمعة) :
(১) জুম‘আর দিন হ’ল ‘দিন সমূহের সেরা’ (سيد الأيام)। এদিন আল্লাহর নিকটে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিনের চাইতেও মহিমান্বিত। এইদিন নিকটবর্তী ফেরেশতাগণ, আকাশ, পৃথিবী, বায়ু, পাহাড়, সমুদ্র সবই ক্বিয়ামত হবার ভয়ে ভীত থাকে’।[23]
(২) জুম‘আর রাতে বা দিনে কোন মুসলিম মারা গেলে আল্লাহ তাকে কবরের ফিৎনা হ’তে বাঁচিয়ে দেন’।[24]
(৩) এইদিন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়। এইদিন তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় ও এইদিন তাঁকে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এদিনে তাঁর তওবা কবুল হয় এবং এদিনেই তাঁর মৃত্যু হয়। এইদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে ও ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।
(৪) এদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে বেশী বেশী দরূদ পাঠ করতে হয়।[25]
(৫) এই দিন ইমামের মিম্বরে বসা হ’তে জামা‘আতে ছালাত শেষে সালাম ফিরানো পর্যন্ত সময়ের মধ্যে[26] এমন একটি সংক্ষিপ্ত সময় (سَاعَةٌ خَفِيْفَةٌ) রয়েছে, যখন বান্দার যেকোন সঙ্গত প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন।[27] দো‘আ কবুলের এই সময়টির মর্যাদা লায়লাতুল ক্বদরের ন্যায় বলে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জুম‘আর সমস্ত দিনটিই ইবাদতের দিন। অন্য হাদীছের [28] বক্তব্য অনুযায়ী ঐদিন আছর ছালাতের পর হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দো‘আ কবুলের সময়কাল প্রলম্বিত। অতএব জুম‘আর সারাটা দিন দো‘আ-দরূদ, তাসবীহ-তেলাওয়াত ও ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া উচিৎ।[29] এই সময় খত্বীব স্বীয় খুৎবায় এবং ইমাম ও মুক্তাদীগণ স্ব স্ব সিজদায় ও শেষ বৈঠকে তাশাহ্হুদ ও দরূদের পরে সালামের পূর্বে আল্লাহর নিকটে প্রাণ খুলে দো‘আ করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই সময়ে বেশী বেশী দো‘আ করতেন।[30]
(৬) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন গোসল করে সুগন্ধি মেখে মসজিদে এল ও সাধ্যমত নফল ছালাত আদায় করল। অতঃপর চুপচাপ ইমামের খুৎবা শ্রবণ করল ও জামা‘আতে ছালাত আদায় করল, তার পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত এবং আরও তিনদিনের গোনাহ মাফ করা হয়’।[31]
(৭) তিনি আরও বলেন, ‘জুম‘আর দিন ফেরেশতাগণ মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন ও মুছল্লীদের নেকী লিখতে থাকেন। এদিন সকাল সকাল যারা আসে, তারা উট কুরবানীর সমান নেকী পায়। তার পরবর্তীগণ গরু কুরবানীর, তার পরবর্তীগণ ছাগল কুরবানীর, তার পরবর্তীগণ মুরগী কুরবানীর ও তার পরবর্তীগণ ডিম কুরবানীর সমান নেকী পায়। অতঃপর খত্বীব দাঁড়িয়ে গেলে ফেরেশতাগণ দফতর গুটিয়ে ফেলেন ও খুৎবা শুনতে থাকেন’।[32]
(৮) তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন ভালভাবে গোসল করে। অতঃপর সকাল সকাল মসজিদে যায় পায়ে হেঁটে, গাড়ীতে নয় এবং আগে ভাগে নফল ছালাত শেষে ইমামের কাছাকাছি বসে ও মনোযোগ দিয়ে খুৎবার শুরু থেকে শুনে এবং অনর্থক কিছু করে না, তার প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের ছিয়াম ও ক্বিয়ামের অর্থাৎ দিনের ছিয়াম ও রাতের বেলায় নফল ছালাতের সমান নেকী হয়’।[33]
জুম‘আর আযান (أذان الجمعة) :
খত্বীব ছাহেব মিম্বরে বসার পরে মুওয়ায্যিন জুম‘আর আযান দিবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর যুগে এবং ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথমার্ধ্বে এই নিয়ম চালু ছিল। অতঃপর মুসলমানের সংখ্যা ও নগরীর ব্যস্ততা বেড়ে গেলে হযরত ওছমান (রাঃ) জুম‘আর পূর্বে মসজিদে নববী থেকে দূরে ‘যাওরা’ (زوراء) বাজারে একটি বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে লোকদের আগাম হুঁশিয়ার করার জন্য পৃথক একটি আযানের নির্দেশ দেন।[34] খলীফার এই হুকুম ছিল স্থানিক প্রয়োজনের কারণে একটি সাময়িক নির্দেশ মাত্র। সেকারণ মক্কা, কূফা ও বছরা সহ ইসলামী খেলাফতের বহু গুরুত্বপূর্ণ শহরে এ আযান তখন চালু হয়নি। হযরত ওছমান (রাঃ) এটাকে সর্বত্র চালু করার প্রয়োজন মনে করেননি বা উম্মতকে বাধ্য করেননি। তাই সর্বদা সর্বত্র এই নিয়ম চালু করার পিছনে কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আচরিত সুন্নাতের অনুসরণই সকল মুমিনের কর্তব্য।
ডাক আযান :
ওমর ইবনু আলী আল-ফাকেহানী (৬৫৪-৭৩৪/১২৫৬-১৩৩৪ খৃঃ) বলেন যে, ডাক আযান প্রথম বছরায় চালু করেন যিয়াদ এবং মক্কায় চালু করেন হাজ্জাজ। আর আমার কাছে এখন খবর পৌঁছেছে যে, নিকট মাগরিবে অর্থাৎ আফ্রিকার তিউনিস ও আলজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের লোকদের নিকট অদ্যাবধি কোন আযান নেই মূল এক আযান ব্যতীত’।[35] হযরত আলী (রাঃ)-এর (৩৫-৪০ হিঃ) রাজধানী কূফাতেও এই আযান চালু ছিল না। [36] ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, উমাইয়া খলীফা হেশাম বিন আব্দুল মালেক (১০৫-২৫/৭২৪-৭৪৩ খৃঃ) সর্বপ্রথম ওছমানী আযানকে ‘যাওরা’ বাজার থেকে এনে মদ্বীনার মসজিদে চালু করেন।[37] ইবনুল হাজ্জ মালেকী বলেন, অতঃপর হেশাম খুৎবাকালীন মূল আযানকে মসজিদের মিনার থেকে নামিয়ে ইমামের সম্মুখে নিয়ে আসলেন’।[38] ফলে বর্তমানে খুৎবার প্রায় আধা ঘণ্টা পূর্বে ‘ডাক আযান’ হচ্ছে মিনারে বা মাইকে। অতঃপর খুৎবার মূল আযান বা কথিত ‘ছানী আযান’ হচ্ছে মিম্বরের সম্মুখে বা মসজিদের দরজার বাইরে।[39]
এইভাবে হাজ্জাজী ও হেশামী আযান সর্বত্র চালু হয়েছে। অথচ জুম‘আর সুন্নাতী আযান ছিল একটি। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, খত্বীব মিম্বরে বসার পরে সম্মুখ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যে আযান দেওয়া হয় (এবং যা ইসলামের স্বর্ণযুগে চালু ছিল), এটাই সঠিক। এর বাইরে মিম্বরের নিকটে খত্বীবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আযান দেওয়া বিষয়ে একটি বর্ণও প্রমাণিত নয়’।[40] অতএব আমাদের উচিৎ হবে সেই হারানো সুন্নাত যেন্দা করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ- ‘তোমাদের পরে এমন একটা কষ্টকর সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[41] তাছাড়া বর্তমানে মাইক, ঘড়ি, মোবাইল ইত্যাদির যুগে ওছমানী আযানের প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
খুৎবা (خطبة الجمعة) :
জুম‘আর জন্য দু’টি খুৎবা দেওয়া সুন্নাত, যার মাঝখানে বসতে হয়।[42] ইমাম মিম্বরে বসার সময় মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে সালাম দিবেন।[43] আবুবকর ও ওমর (রাঃ) এটি নিয়মিত করতেন। আবু হানীফা ও মালেক (রহঃ) প্রমুখ মসজিদে প্রবেশকালে সালাম করাকেই যথেষ্ট বলেছেন।[44] খত্বীব হাতে লাঠি নিবেন। [45] নিতান্ত কষ্টদায়ক না হ’লে সর্বদা দাঁড়িয়ে খুৎবা দিবেন। ১ম খুৎবায় হাম্দ, দরূদ ও ক্বিরাআত ছাড়াও সকলকে নছীহত করবেন, অতঃপর বসবেন। দ্বিতীয় খুৎবায় হাম্দ ও দরূদ সহ সকল মুসলমানের জন্য দো‘আ করবেন।[46] প্রয়োজনে এই সময়ও কিছু নছীহত করা যায়।[47] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) হাম্দ, দরূদ ও নছীহত তিনটি বিষয়কে খুৎবার জন্য ‘ওয়াজিব’ বলেছেন। যাতে কুরআন থেকে একটি আয়াত হ’লেও পাঠ করতে হবে। এতদ্ব্যতীত সূরায়ে ক্বাফ-এর প্রথমাংশ বা অন্য কিছু আয়াত তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব।[48] খুৎবা আখেরাত মুখী, সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ হওয়া বাঞ্ছনীয়। [49] তবে দীর্ঘ হওয়াও জায়েয আছে।[50] খুৎবার সময় কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সংক্ষিপ্তভাবে দু’রাক‘আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ ছালাত পড়ে বসবেন’।[51]
মাতৃভাষায় খুৎবা দান
খুৎবা মাতৃভাষায় এবং অধিকাংশ মুছল্লীদের বোধগম্য ভাষায় হওয়া যরূরী। কেননা খুৎবা অর্থ ভাষণ, যা শ্রোতাদের বোধগম্য ভাষায় হওয়াই স্বাভাবিক। আল্লাহ বলেন,‘আমরা সকল রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষা-ভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তিনি তাদেরকে (আল্লাহর দ্বীন) ব্যাখ্যা করে দেন’ (ইবরাহীম ১৪/৪)। অতঃপর আমাদের রাসূল (ছাঃ)-কে খাছ করে বলা হচ্ছে, ‘আর আমরা আপনার নিকটে ‘যিকর’ (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের নিকট ঐসব বিষয়ে ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহ্ল ১৬/৪৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সময়ের চাহিদা অনুযায়ী খুৎবা দিতেন। নবী আর আসবেন না। তাই রাসূলের ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে[52] প্রত্যেক আলেম ও খত্বীবের উচিৎ মুছল্লীদের নিজস্ব ভাষায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধান সমূহ খুৎবায় ব্যাখ্যা করে শুনানো। নইলে খুৎবার উদ্দেশ্য বিনষ্ট হবে।
হযরত জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, খুৎবার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দু’চোখ উত্তেজনায় লাল হয়ে যেত। গলার স্বর উঁচু হ’ত ও ক্রোধ ভীষণ হ’ত। যেন তিনি কোন সৈন্যদলকে হুঁশিয়ার করছেন’।[53] ছাহেবে মির‘আত বলেন, ‘অবস্থা অনুযায়ী এবং মুছল্লীদের বোধগম্য ভাষায় খুৎবা দেওয়ার ব্যাপারে জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীছটিই হ’ল প্রথম দলীল’।[54] মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাতৃভাষায় খুৎবা দিতেন। তাঁর ও তাঁর ছাহাবীগণের মাতৃভাষা ছিল আরবী। তিনি ছিলেন বিশ্বনবী। তাই বিশ্বের সকল ভাষাভাষী তাঁর উম্মতকে স্ব স্ব মাতৃভাষায় খুৎবা দানের মাধ্যমে কুরআন ও হাদীছ ব্যাখ্যা করে দিতে হবে, যা অবশ্য পালনীয়।
যদি বলা হয় যে, রাসূল (ছাঃ) আরবী ভাষায় খুৎবা দিতেন, অতএব আমাদেরও কেবল আরবীতে খুৎবা দিতে হবে, তাহ’লে তো বলা হবে যে, তিনি যেহেতু সর্বক্ষণ আরবী ভাষায় কথা বলতেন, অতএব আমাদেরকেও মাতৃভাষা ছেড়ে সর্বক্ষণ আরবীতে কথা বলতে হবে। আরবী ব্যতীত অন্য ভাষা বলা যদি নিষিদ্ধ হয়, তাহ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ)-কে ইহুদীদের হিব্রু ভাষা শিখতে বললেন কেন? যা তিনি ১৫ দিনেই শিখে ফেলেন ও উক্ত ভাষায় রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে পত্র পঠন, লিখন ও দোভাষীর কাজ করেন। [55]
নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ) বলেন, শ্রোতামন্ডলীকে জান্নাতের প্রতি উৎসাহ দান ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করাই ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খুৎবার নিয়মিত উদ্দেশ্য। এটাই হ’ল খুৎবার প্রকৃত রূহ এবং এজন্যই খুৎবার প্রচলন হয়েছে’।[56]
বিভিন্ন মসজিদে স্রেফ আরবী খুৎবা পাঠের যে প্রচলন রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে খুৎবার উদ্দেশ্য বিরোধী। এটা বুঝতে পেরে বর্তমানে মূল খুৎবার পূর্বে মিম্বরে বসে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার মাধ্যমে যে তৃতীয় আরেকটি খুৎবা চালু করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। কেননা জুম‘আর জন্য নির্ধারিত খুৎবা হ’ল দু’টি, তিনটি নয়। তাছাড়া মূল খুৎবার পূর্বের সময়টি মুছল্লীদের নফল ছালাতের সময়। তাদের ছালাতের সুযোগ নষ্ট করে বক্তৃতা করার অধিকার ইসলাম কোন খত্বীব ছাহেবকে দেয়নি। অতএব সুন্নাতের উপরে আমল করতে চাইলে মূল খুৎবায় দাঁড়িয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে তাদের বোধগম্য ভাষায় নছীহত করতে হবে। খুৎবার সময় কথা বলা নিষেধ। এমনকি অন্যকে ‘চুপ কর’ একথাও বলা চলবে না।[57]
ক্বিরাআত : জুম‘আর ছালাতে ইমাম প্রথম রাক‘আতে সূরায়ে ‘জুম‘আ’ অথবা সূরায়ে ‘আ‘লা’ এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরায়ে ‘মুনা-ফিকূন’ অথবা সূরায়ে ‘গা-শিয়াহ’ পড়বেন। [58] অন্য সূরাও পড়া যাবে।[59] জুম‘আর দিন ফজরের ১ম রাক‘আতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরায়ে ‘সাজদাহ’ ও ২য় রাক‘আতে সূরায়ে ‘দাহর’ পাঠ করতেন।[60]
দো‘আ চাওয়া : মুছল্লীদের নিকটে বিশেষ কোন দো‘আ চাওয়ার থাকলে খত্বীব বা ইমামের মাধ্যমে পূর্বেই সকলকে অবহিত করা উচিৎ। যাতে সবাই উক্ত মুছল্লীর প্রার্থনা অনুযায়ী আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে পারে ও নিজেদের দো‘আর নিয়তের মধ্যে তাকেও শামিল করতে পারে। কেননা সালাম ফিরানোর মাধ্যমে ছালাত শেষ হয়ে যায়। আর ছালাতের মধ্যেই দো‘আ কবুল হয়। বিশেষ করে সিজদার হালতে। কিন্তু সালাম ফিরানোর পর ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ ও ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলার প্রচলিত প্রথাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পরিপন্থী।
দো‘আ কবুলের সময়কাল : বিদ্বানগণ জুম‘আর দিনে দো‘আ কবুলের সঠিক সময়কাল নিয়ে মতভেদ করেছেন। এই মতভেদের ভিত্তি মূলতঃ আমর বিন আওফ (রাঃ) বর্ণিত তিরমিযীর হাদীছ, যেখানে ‘জামা‘আতের শুরু থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত’ সময়কালকে এবং অপরটি আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ, যেখানে ঐ সময়কালকে ‘আছরের ছালাতের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত’ বলা হয়েছে।[61] এবিষয়ে বিদ্বানগণের ৪৩টি মতভেদ উল্লেখিত হয়েছে। [62]
তিরমিযীর ভাষ্যকার আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (রহঃ) বলেন, শেষোক্ত হাদীছের রাবী আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) এখানে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য وَهُوَ يُصَلِّيْ (ছালাতের অবস্থা)- কে يَنْتَظِرُ الصَّلاَةَ (ছালাতের অপেক্ষারত) বলে ব্যাখ্যা করেছেন।[63] এতেই বুঝা যায় যে, তিনি এটা সরাসরি রাসূল (ছাঃ) থেকে শুনেছেন বলে বর্ণনা করেননি। পক্ষান্তরে আমর বিন আওফ (রাঃ) বর্ণিত তিরমিযী ও ইবনু মাজাহর হাদীছটি মরফূ, যা ইমাম বুখারী ও তিরমিযী ‘হাসান’ বলেছেন, সেটি রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য وَهُوَ يُصَلِّيْ (ছালাতরত অবস্থা)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত অপর একটি হাদীছ একে শক্তিশালী করে। যেখানে এই সময়কালকে  ‘খত্বীব মিম্বরে বসা হ’তে ছালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত’ বলা হয়েছে।[64] ইবনুল ‘আরাবী বলেন, এই বক্তব্যটিই অধিকতর সঠিক। কেননা এ সময়ের সম্পূর্ণটাই ছালাতের অবস্থা। এতে হাদীছে বর্ণিত ‘ছালাতরত অবস্থায়’ বক্তব্যের সাথে শব্দগত ও অর্থগত উভয় দিক দিয়ে মিল হয়’। বায়হাক্বী, ইবনুল ‘আরাবী, কুরতুবী, নববী প্রমুখ এ বক্তব্য সর্মথন করেন।[65] অতএব ‘খতীব মিম্বরে বসা হ’তে সালাম ফিরানো পর্যন্ত ছালাতরত অবস্থায়’ দো‘আ কবুলের মতটিই ছহীহ হাদীছের অধিকতর নিকটবর্তী।
ঘুমের প্রতিকার : দো‘আ কবুলের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক মুছল্লী বিশেষ করে খুৎবার সময় ঘুমে ঢুলতে থাকে। ফলে তারা খুৎবার কিছুই উপলব্ধি করতে পারেনা। এজন্য এর প্রতিকার হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন খুৎবার সময় ঘুমে ঢুলতে থাকে, তখন সে যেন তার অবস্থান পরিবর্তন করে’। [66] এ বিষয়ে মুছল্লীদের পরস্পরকে সাহায্য করা উচিৎ।
এহতিয়াত্বী জুম‘আ
এহ্তিয়াত্বী জুম‘আ বা ‘আখেরী যোহর’ নামে জুম‘আর ছালাতের পরে পুনরায় যোহরের চার রাক‘আত একই ওয়াক্তে পড়ার যে রেওয়াজ এদেশে চালু আছে, তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। কেননা জুম‘আর পরে যোহর পড়ার কোন দলীল নেই। তাছাড়া যে ব্যক্তি জুম‘আ পড়ে, তার উপর থেকে যোহরের ফরযিয়াত উঠে যায়। কারণ জুম‘আ হ’ল যোহরের স্থলাভিষিক্ত। এক্ষণে যে ব্যক্তি জুম‘আ আদায়ের পর যোহর পড়ে, তার পক্ষে কুরআন, সুন্নাহ এবং কোন বিদ্বানের সমর্থন নেই।[67] গ্রামে জুম‘আ হবে কি হবে না, এই সন্দেহে পড়ে কিছু লোক দু’টিই পড়ে থাকে।
কোন কোন দেশে জুম‘আর ছালাতের পরপরই পুনরায় যোহরের জামা‘আত দাঁড়িয়ে যায়। ভাবখানা এই যে, জুম‘আ কবুল না হ’লে যোহর তো নিশ্চিত। আর যদি জুম‘আ কবুল হয়, তাহ’লে যোহরটা নফল হবে ও বাড়তি নেকী পাওয়া যাবে। অথচ সন্দেহের ইবাদতে কোন নেকী হয় না। বরং স্থির সংকল্প বা নিয়ত হ’ল নেকী পাওয়ার আবশ্যিক পূর্বশর্ত। [68] এই সন্দেহযুক্ত ছালাত এখুনি পরিত্যাজ্য।[69] নইলে বিদ‘আতী আমলের কারণে গোনাহগার হ’তে হবে।
আব্বাসীয় খলীফাদের আমলে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ভ্রান্ত ফের্কা মু‘তাযিলাগণ এটি চালু করে। যা পরবর্তীকালের কিছু হানাফী আলেমের মাধ্যমে সুন্নীদের অনেকের মধ্যে চালু হয়ে যায়। অথচ জুম‘আ আল্লাহ ফরয করেছেন। আর কোন ফরযে সন্দেহ করা কুফরীর শামিল। অতএব যারা জেনে বুঝে আখেরী যোহরে অভ্যস্ত, তাদের এখুনি তওবা করা উচিৎ ও কেবলমাত্র জুম‘আ আদায় করা কর্তব্য। খোদ হানাফী মাযহাবেও ‘আখেরী যোহর’ না পড়াকে ‘উত্তম’ বলা হয়েছে।[70]
জুম‘আর সুন্নাত (سنن الجمعة) : জুম‘আর পূর্বে নির্দিষ্ট কোন সুনণাত ছালাত নেই। মুছল্লী কেবল ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ দু’রাক‘আত পড়ে বসবে। অতঃপর সময় পেলে খত্বীব মিম্বরে বসার আগ পর্যন্ত যত খুশী নফল ছালাত আদায় করবে। জুম‘আর ছালাতের পরে মসজিদে চার রাক‘আত অথবা বাড়ীতে দু’রাক‘আত সুন্নাত আদায় করবে। তবে মসজিদেও চার বা দুই কিংবা দুই ও চার মোট ছয় রাক‘আত সুন্নাত ও নফল পড়া যায়।[71] ইবনু ওমর (রাঃ) চার রাক‘আত সুন্নাত এক সালামে পড়তেন। তবে দুই সালামেও পড়া যায়।[72] জুম‘আর (খুৎবার) পূর্বে এক সালামে চার রাক‘আত পড়ার হাদীছটি ‘যঈফ’। [73]
জুম‘আ বিষয়ে অন্যান্য জ্ঞাতব্য
(১) বাধ্যগত কারণে জুম‘আ পড়তে অপারগ হ’লে যোহর পড়বে।[74] সফরে থাকলে ক্বছর করবে। মুসাফির একাধিক হ’লে জামা‘আতের সাথে ক্বছর পড়বে।[75]
(২) জুম‘আর ছালাত ইমামের সাথে এক রাক‘আত পেলে বাকী আরেক রাক‘আত যোগ করে পূরা পড়ে নিবে।[76]
(৩) কিন্তু রুকূ না পেলে এবং শেষ বৈঠকে যোগ দিলে চার রাক‘আত পড়বে’।[77] অর্থাৎ জুম‘আর নিয়তে ছালাতে যোগদান করবে এবং যোহর হিসাবে শেষ করবে।[78] ‘এর মাধ্যমে সে জামা‘আতে যোগদানের পূরা নেকী পাবে’। [79] অবশ্য রুকূ পাওয়ার সাথে সাথে তাকে ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতে ফাতিহা পেতে হবে। কেননা ‘সূরা ফাতিহা ব্যতীত ছালাত সিদ্ধ হয় না’।[80] উল্লেখ্য যে, ‘যে ব্যক্তি তাশাহহুদ পেল, সে ব্যক্তি ছালাত পেল’ মর্মে মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ-তে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত আছারটি যঈফ।[81]
(৪) খত্বীব মিম্বরে বসার পর মুছল্লীগণ দ্রুত কাছাকাছি চলে আসবে ও খত্বীবের মুখোমুখি হয়ে বসবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত দূরে বসবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে গেলেও দেরীতে প্রবেশ করবে।[82]
(৫) খুৎবার সময় মুছল্লীদের তিনমাথা হয়ে (الْحَبْوَة) অর্থাৎ দু’পা উঁচু করে দু’হাটুতে মাথা রেখে বসা নিষেধ।[83]
(৬) পিছনে এসে সামনের মুছল্লীদের ডিঙিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। বরং সেখানেই বসে পড়বে।[84]
(৭) জুম‘আ সহ কোন বৈঠকেই কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।[85] তবে সকলকে বলবে, إِفْسَحُوْا ‘আপনারা জায়গা ছেড়ে দিন’।[86]
(৮) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জুম‘আতে তিন ধরনের লোক আসে। (ক) যে ব্যক্তি অনর্থক আসে, সে তাই পায় (খ) যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনার জন্য আসে। আল্লাহ চাইলে তাকে দেন, অথবা না দেন (গ) যে ব্যক্তি নীরবে আসে এবং কারু ঘাড় মটকায় না ও কষ্ট দেয় না, তার জন্য এই জুম‘আ তার পরবর্তী জুম‘আ এমনকি তার পরের তিনদিনের (ছগীরা) গোনাহ সমূহের কাফফারা হয়ে থাকে। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একটি নেকীর কাজ করে, তার জন্য দশগুণ প্রতিদান রয়েছে’ (আন‘আম ৬/১৬০)।[87]
দলীলের উৎসঃ
[1] . মির‘আত ২/২৮৮; ঐ, ৪/৪৫১; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/২১১।
[2] . ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪৯৪; যা-দুল মা‘আ-দ ১/৯৮।
 [3] . ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ সনদ ‘হাসান’। সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪৩৫; যা-দুল মা‘আ-দ ১/৩৬১; নায়ল ৪/১৫৭-৫৮; মির‘আত ৪/৪২০। ১১ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে (জুলাই ৬২০ খৃ:) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে সর্বপ্রথম বায়‘আতকারী ৬ জন যুবকের কনিষ্ঠতম নেতা, যার নেতৃত্বে মদীনায় সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারিত হয় এবং পরবর্তী দু’বছরে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী মক্কায় এসে বায়‘আত গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৪শ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (সেপ্টেম্বর ৬২২) হিজরত সংঘটিত হয় এবং ১ম হিজরী সনেই শাওয়াল মাসে অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ও বাক্বী‘ গোরস্থানে ১ম ছাহাবী হিসাবে কবরস্থ হন =আল-ইছাবাহ, ক্রমিক সংখ্যা ১১১।
[4] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৫৪ ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২; মির‘আত ৪/৪২১ পৃঃ ।
[5] . মির‘আত ৪/৪১৯-২১ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আ‘রাফ ৫৪।
[6] . ইবনু মাজাহ হা/১০৮২ ‘ছালাতে দাঁড়ানো’ অধ্যায়-৫, ‘জুম‘আ ফরয হওয়া’ অনুচ্ছেদ-৭৮; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, ‘গ্রামে জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-২১৬।
[7] . জুম‘আ ৬২/৯; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৫।
[8] . আবুদাঊদ, দারাকুৎনী, মিশকাত হা/১৩৭৭, ১৩৮০ ‘জুম‘আ ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ-৪৩; ইরওয়া হা/৫৯২, ৩/৫৪, ৫৮; আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩৪১ পৃঃ।
[9] . মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৫১০৮; ইরওয়া ৩/৬৬, হা/৫৯৯-এর শেষে; ফাৎহুল বারী হা/৮৯২-এর আলোচনা দ্র: ২/৪৪১, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়-১১, অনুচ্ছেদ-১১।
[10] . নায়লুল আওত্বার ৪/১৫৯-৬১; মির‘আত ২/২৮৮-৮৯; ঐ, ৪/৪৪৯-৫০।
[11] . ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী, আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩৪২ পৃঃ।
[12] . মুওয়াত্ত্বা, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩৯৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সকাল সকাল মসজিদে গমন’ অনুচ্ছেদ-৪৪।
[13] . বুখারী, মিশকাত হা/১৩৮১, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[14] . নাসাঈ হা/৬৬১; আহমাদ, মিশকাত হা/১১০৪; ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৩৯, ৪২।
[15] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭০৪ ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[16] . মুসলিম, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৫৮, ১৩৮৪, ৮৭।
[17] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৮১-৮২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৬।
[18] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১১ ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫; আবুদাঊদ হা/১১১৬।
[19] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৭৮ ‘জুম‘আ ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ-৪৩।
[20] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৭০, অনুচ্ছেদ-৪৩।
[21] . আবু ইয়া‘লা, ছহীহ আত-তারগীব হা/৭৩৩; আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৭১।
[22] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৮৫৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/৭২৬-২৮; মির‘আত ৪/৪৪৬।
[23] . ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩৬৩ ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২।
[24] . আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৬৭ ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২।
[25] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩৬১, ১৩৬৩।
 [26] . মুসলিম, আবুদাঊদ, মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৩৫৬-৫৯ ও ১৩৬১ ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২; তিরমিযী হা/৪৯০-৯১, শরহ আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (বৈরূত ছাপা ১৪০৮/১৯৮৭) ২/৩৬১ ও ৩৬৩-৬৪ পৃঃ।
[27] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৫৭, ‘জুম‘আ অনুচ্ছেদ-৪২।
[28] . তিরমিযী হা/৪৮৯; মিশকাত হা/১৩৬০, ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২।
 [29] . ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ১/৩৮৬।
[30] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৪ ‘সিজদা ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪; ঐ, হা/৮১৩ ‘তাকবীরের পর যা পড়তে হয়’ অনুচ্ছেদ-১১; মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৪২৪/১৭, (বৈরূত ছাপা ১৪০৯/১৯৮৯) পৃঃ ৫৩৭।
[31] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৮১-৮২, পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[32] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৮৪, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[33] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩৮৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৬; মির‘আত ৪/৪৭১।
[34] . বুখারী, মিশকাত হা/১৪০৪ ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫; ফাৎহ ২/৪৫৮। ‘যাওরা বাজার’ বর্তমানে মসজিদে নববীর আঙিনার অন্তর্ভুক্ত।
[35] . মির‘আত ২/৩০৭; ঐ, ৪/৪৯২। উল্লেখ্য যে, যিয়াদ বিন আবীহি ছিলেন মু‘আবিয়া (৪১-৬০/৬৬১-৬৮০ খৃঃ)-এর আমলে বছরার গভর্ণর। অন্যদিকে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের আমলে (৬৫-৮৬/৬৮৫-৭০৫ খৃঃ) তার সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে হেজায, ইরাক, মিসর ও সিরিয়ার কিছু অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ খলীফা (৬৪-৭৩ হিঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (১-৭৩ হিঃ) মক্কায় শহীদ হ’লে হাজ্জাজ (৪০-৯৫/৬৬০-৭১৪ খৃঃ) মক্কার শাসক নিযুক্ত হন।
[36] . তাফসীরে জালালায়েন, ৪৬০ পৃঃ, টীকা ১৯; কুরতুবী ১৮/১০০ পৃঃ, তাফসীর সূরা জুম‘আ, ৯ আয়াত।
[37] . মির‘ক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী ছাপা : তাবি) ৩/২৬৩।
[38] . ‘আওনুল মা‘বূদ শরহ আবুদাঊদ (কায়রো : ১৪০৭/১৯৮৭) ৩/৪৩৩-৩৪ পৃঃ, হা/১০৭৪-৭৫-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[39] . ‘মিম্বরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আযান দেওয়ার রেওয়াজ রাসূলের যামানা থেকে নিয়মিতভাবে (بذلك جرى التوارث) চলে আসছে’ বলে প্রসিদ্ধ হানাফী ফিক্বহ গ্রন্থ ‘হেদায়া’-র লেখক যে দাবী করেছেন, তা একেবারেই বাতিল ও ভিত্তিহীন। দ্রঃ ‘আওনুল মা‘বূদ হা/১০৭৫-এর আলোচনা, ৩/৪৩৪-৩৭।
[40] . ولم يثبت حرف واحد فى الأذان مستقبل الإمام محاذيًا به عند المنبر ‘আওনুল মা‘বূদ ৩/৪৩৭, হা/১০৭৫-এর ব্যাখ্যা, ‘জুম‘আর দিনে আহবান’ অনুচ্ছেদ-২২২।
[41] . ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।
[42] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৫; আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩৪৫।
[43] . ইবনু মাজাহ হা/১১০৯; ছহীহাহ হা/২০৭৬।
[44] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩০; নায়ল ৪/২০১।
[45] . আবুদাঊদ হা/১০৯৬; ইরওয়া হা/৬১৬, ৩/৭৮, ৯৯; নায়ল ৪/২১২।
[46] . জুম‘আ ৬২/১১; মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৫, ১৫, ১৬ ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫; নাসাঈ হা/১৪১৮, ‘২য় খুৎবায় ক্বিরাআত ও যিকর’ অনুচ্ছেদ-৩৫; আহমাদ, ত্বাবারাণী, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৪; মির‘আত ২/৩০৮; ঐ, ৪/৪৯৪, ৫০৮-০৯।
[47] . নাসাঈ হা/১৪১৭-১৮, তিরমিযী হা/৫০৬, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-১১।
[48] . মির‘আত ২/৩০৮, ৩১০; ঐ, ৪/৪৯৪, ৪৯৮-৯৯; মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৯, অনুচ্ছেদ-৪৫।
[49] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৫-০৬ ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫।
[50] . মুসলিম হা/৭২৬৭ (২৮৯২), ‘ফিতান’ অধ্যায়-৫২, অনুচ্ছেদ-৬; মির‘আত ৪/৪৯৬।
[51] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১১; ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫; নায়ল ৪/১৯৩।
[52] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২১২ ‘ইলম’ অধ্যায়-২।
[53] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৭; মির‘আত ২/৩০৯; ঐ, ৪/৪৯৬-৯৭।
[54] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০৫; মির‘আত হা/১৪১৮-এর আলোচনা দ্রঃ, ৪/৪৯৪-৯৫।
 [55] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৫৯ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ-১।
[56] . নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী, আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৩৪৫।
[57] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৮৫ ‘পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সকাল সকাল মসজিদে গমন’ অনুচ্ছেদ-৪৪।
[58] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৩৯-৪০ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[59] . আবুদাঊদ হা/৮১৮, ৮২০, ৮৫৯।
[60] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮৩৮।
[61] . তিরমিযী হা/৪৮৯; ঐ, মিশকাত হা/১৩৬০; তুহফা হা/৪৮৮-৮৯।
[62] . শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৪/১৭২-৭৬।
[63] . তিরমিযী হা/৪৯১; আবুদাঊদ হা/১০৪৬; মুওয়াত্ত্বা, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৫৯ ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২।
[64] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৫৮, ‘জুম‘আ’ অনুচ্ছেদ-৪২।
[65] . আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির, শরহ তিরমিযী ২/৩৬৩-৬৪, হা/৪৯০-৯১।
[66] . তিরমিযী, মিশকাত হা/১৩৯৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[67] . সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৭।
[68] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুক্বাদ্দামা মিশকাত হা/১।
[69] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আহমাদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/২৭৬২, ২৭৭৩ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১।
[70] . দ্রঃ দুর্রে মুখতার ১/৩৬৭; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি; সংশোধনে : দাঊদ রায), ২৫৩ পৃঃ; ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ (দিল্লী : ১৪০৯/১৯৮৮), ১/৫৭৫-৮০।
[71] . মুসলিম, মিশকাত হা/১১৬৬ ‘সুন্নাত ছালাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০; তিরমিযী হা/৫২২-২৩ ‘জুম‘আ’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-২৪; মির‘আত ২/১৪৮; ঐ, ৪/১৪২-৪৩।
[72] . মির‘আত ৪/২৫৭-৫৮।
[73] . ইবনু মাজাহ হা/১১২৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, ‘জুম‘আর পূর্বে ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৯৪।
[74] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৬-২৭।
[75] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৪, ‘সফরে ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪১।
[76] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪১২, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘খুৎবা ও ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫।
[77] . মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, বায়হাক্বী ৩/২০৪; ত্বাবারাণী কাবীর, সনদ ছহীহ; ইরওয়া ৩/৮২।
[78] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৫, টীকা দ্র:।
[79] . বায়হাক্বী, ইরওয়া হা/৬২১; ৩/৮১-৮২।
[80] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২২; আলোচনা দ্রষ্টব্য : ‘সূরা ফাতিহা পাঠ’ অধ্যায়।
[81] . আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/৮২।
[82] . আবুদাঊদ হা/১১০৮; ঐ, মিশকাত হা/১৩৯১, অনুচ্ছেদ-৪৪; তিরমিযী, মিশকাত হা/১৪১৪, অনুচ্ছেদ-৪৫।
[83] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৯৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[84] . আবুদাঊদ হা/১১১৮ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-২৩৮।
[85] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৯৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[86] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৩৮৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৪৪।
[87] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৯৬, অনুচ্ছেদ-৪৪।
৫. ঈদায়নের ছালাত
সূচনা : ঈদায়নের ছালাত ২য় হিজরী সনে চালু হয়।[1] ঈদায়েন হ’ল মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ নির্ধারিত বার্ষিক দু’টি আনন্দ উৎসবের দিন। ঈদায়নের উৎসব হবে পবিত্রতাময় ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ। প্রাক ইসলামী যুগে আরব দেশে অন্যদের অনুকরণে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদ্বীনায় হিজরত করার পরে দেখলেন যে, মদ্বীনাবাসীগণ বছরে দু’দিন খেলাধূলা ও আনন্দ-উৎসব করে। তখন তিনি তাদেরকে বললেন,
‘আল্লাহ তোমাদের ঐ দু’দিনের বদলে দু’টি মহান উৎসবের দিন প্রদান করেছেন ‘ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।[2] দুই ঈদের দিন এবং ঈদুল আযহার পরের তিন দিন ছিয়াম পালন নিষিদ্ধ।[3]
গুরুত্ব : ঈদায়নের ছালাত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ইসলামের প্রকাশ্য ও সেরা নিদর্শন সমূহের অন্যতম। সূর্যোদয়ের পরে সকাল সকাল খোলা ময়দানে গিয়ে ঈদায়নের ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করতে হয়। কেবলমাত্র মাসজিদুল হারামে ঈদায়নের ছালাত সিদ্ধ রাখা হয়েছে বিশালায়তন হওয়ার কারণে এবং মক্কার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের সংকীর্ণতার কারণে।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদ্বীনায় মসজিদে নববী-র বাইরে খোলা ময়দানে নিয়মিতভাবে ঈদায়নের ছালাত আদায় করেছেন এবং নারী-পুরুষ সকল মুসলমানকে ঈদায়নের জামা‘আতে শরীক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।[5]
নিয়মাবলী : ঈদায়নের ছালাতে আযান বা এক্বামত নেই। সকলকে নিয়ে ইমাম প্রথমে জামা‘আতের সাথে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবেন ও পরে খুৎবা দিবেন। খুৎবার সময় হাতে লাঠি রাখবেন। [6] একটি খুৎবা দেওয়াই ছহীহ হাদীছ সম্মত। দুই খুৎবা সম্পর্কে কয়েকটি ‘যঈফ’ হাদীছ রয়েছে। ইমাম নবভী (রহঃ) বলেন, প্রচলিত দুই খুৎবার নিয়মটি মূলতঃ জুম‘আর দুই খুৎবার উপরে ক্বিয়াস করেই চালু হয়েছে। খুৎবা শেষে বসে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার রেওয়াজটিও হাদীছ সম্মত নয়। বরং এটাই প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র একটি খুৎবা দিয়েছেন। যার মধ্যে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, দো‘আ সবই ছিল। [7]
ঈদায়নের জামা‘আতে পুরুষদের পিছনে পর্দার মধ্যে মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় চাদরে আবৃত হয়ে যোগদান করবেন। প্রয়োজনে একজনের চাদরে দু’জন আসবেন। খত্বীব ছাহেব নারী-পুরুষ সকলকে উদ্দেশ্য করে তাদের বোধগম্য ভাষায় কুরআন-হাদীছের ব্যাখ্যাসহ খুৎবা দিবেন। ঋতুবতী মহিলাগণ কেবল খুৎবা শ্রবণ করবেন ও দো‘আয় শরীক হবেন। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন যে, ‘উক্ত হাদীছের শেষে বর্ণিত دَعْوَةُ الْمُسْلِمِيْنَ কথাটি ‘আম’। এর দ্বারা ইমামের খুৎবা, নছীহত ও দো‘আ বুঝানো হয়েছে। কেননা ঈদায়নের ছালাতের পরে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিত দো‘আর প্রমাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে কোন ছহীহ হাদীছ বা ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল বর্ণিত হয়নি’। [8]
জ্ঞাতব্য : (১) বৃষ্টি কিংবা ভীতির কারণে ময়দানে যাওয়া অসম্ভব বিবেচিত হ’লে মসজিদে ঈদের জামা‘আত করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীর পূর্ব দরজার বাইরে ৫০০ গজ দূরে ‘বাত্বহান’ (بَطْحَان) প্রান্তরে ঈদায়নের ছালাত আদায় করতেন এবং একবার মাত্র বৃষ্টির কারণে মসজিদে ছালাত আদায় করেছিলেন। [9] কিন্তু বিনা কারণে বড় মসজিদের দোহাই দিয়ে ময়দান ছেড়ে মসজিদে ঈদের জামা‘আত করা সুন্নাত বিরোধী কাজ। (২) জামা‘আত ছুটে গেলে একাকী বা জামা‘আত সহকারে ঈদের ন্যায় তাকবীর সহ দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে নিবে।[10] (৩) ঈদগাহে আসতে না পারলে বাড়ীতে মেয়েরা সহ সকলকে নিয়ে ঈদগাহের ন্যায় তাকবীর সহকারে জামা‘আতের সাথে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। [11] (৪) জুম‘আ ও ঈদ একই দিনে হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইমাম হিসাবে দু’টিই পড়েছেন। অন্যদের মধ্যে যারা ঈদ পড়েছেন, তাদের জন্য জুম‘আ অপরিহার্য করেননি।[12] অবশ্য দু’টিই আদায় করা যে অধিক ছওয়াবের কারণ, এতে কোন সন্দেহ নেই। (৫) চাঁদ ওঠার খবর পরদিন পূর্বাহ্নে পেলে সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে ঈদের ময়দানে গিয়ে জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় করবে। নইলে পরদিন ঈদ পড়বে।[13]
(৬) মক্কার সাথে মিলিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনের দাবী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা এবং স্রেফ অযৌক্তিক দাবী মাত্র। কেননা আল্লাহ বলেন,‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযান) মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখো ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়ো’। [14] এতে প্রমাণিত হয় যে, সারা দুনিয়ার মানুষ একই সময়ে চাঁদ দেখতে পায় না। আর এটাই স্বাভাবিক। কেননা মক্কায় যখন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায়, ঢাকায় তখন ৩ ঘণ্টা রাত হয়। তখন ঢাকার লোকদের কিভাবে বলা যাবে যে, তোমরা চাঁদ না দেখেও ছিয়াম রাখ বা ঈদ করো? ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার ছিয়াম ও ঈদ মক্কার একদিন পরে চাঁদ দেখে হবে।[15]
অতিরিক্ত তাকবীর সমূহ
ঈদায়নের ছালাতে অতিরিক্ত বারোটি তাকবীর দেওয়া সুন্নাত।[16] যেমন
(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহাতে প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ তাকবীর দিতেন রুকূর দুই তাকবীর ব্যতীত’ [17] এবং ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’।[18]
(২) ‘আমর ইবনু শু‘আইব (রাঃ) তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে,
অনুবাদ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিৎরে ‘তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’ প্রথম রাক‘আতে সাতটি ও শেষ রাক‘আতে পাঁচটি সহ মোট বারোটি (অতিরিক্ত) তাকবীর দিতেন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ছালাতের তাকবীর’ ব্যতীত।[19]
অত্র হাদীছটি সম্পর্কে ছাহেবে তুহফা ও ছাহেবে মির‘আত উভয়ে বলেন, ‘এটা পরিস্কার যে, আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীছটিই এ বিষয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ’।[20]
শায়খ আলবানী (রহঃ) হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী ও তাঁর উসতায আলী ইবনুল মাদ্বীনী হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। আল্লামা নীমভী বলেন, হাদীছটির সনদের মূল কেন্দ্রবিন্দু (مدار) হ’লেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফী। তাঁকে কোন কোন বিদ্বান ‘যঈফ’ বলেছেন। ছাহেবে মির‘আত বলেন, ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, আলী ইবনুল মাদ্বীনী প্রমুখ বিদ্বানগণের ন্যায় হাদীছ শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গের (جهابذة) বক্তব্যের পরে অন্যদের বক্তব্যের প্রতি দৃকপাত না করলেও চলে। মুজতাহিদ ইমামগণ এ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন। ইবনু ‘আদী বলেন, আমর ইবনু শু‘আইব থেকে আব্দুর রহমান আত-ত্বায়েফীর সকল হাদীছ সুদৃঢ় (مسةقيمة)। হাফেয ইরাক্বী বলেন, إسناده صالح ‘অত্র হাদীছের সনদ দলীলযোগ্য’। তিরমিযীর ভাষ্যকার ছাহেবে তুহফা বলেন, ‘সারকথা এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমরের হাদীছটি ‘হাসান’ ও দলীল গ্রহণের যোগ্য এবং একে শক্তিশালী করে ঐ সকল হাদীছ, যেগুলির দিকে তিরমিযী ইঙ্গিত করেছেন’।[21]
(৩) কাছীর বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদায়নের প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে পাঁচ তাকবীর দিতেন’। [22] কাছীর বিন আব্দুল্লাহ বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছ সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী বলেন,
অর্থ : হাদীছটির সনদ ‘হাসান’ এবং এটিই ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে বর্ণিত ‘সর্বাধিক সুন্দর’ রেওয়ায়াত।[23] তিনি আরও বলেন যে, আমি এ সম্পর্কে আমার উস্তায ইমাম বুখারীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
‘ঈদায়নের ছালাতের অতিরিক্ত তাকবীর সম্পর্কে এর চাইতে অধিকতর ছহীহ আর কোন রেওয়ায়াত নেই এবং আমিও সে কথা বলি’। [24]
তাকবীরে তাহরীমা সহ কি-না : ইমাম মালেক ও আহমাদ (রহঃ) তাকবীরে তাহরীমা সহ প্রথম রাক‘আতে সাত তাকবীর বলেন। ইমাম শাফেঈ, আওযাঈ, ইসহাক্ব, ইবনু হাযম প্রমুখ বিদ্বান তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত সাত তাকবীর বলেন। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, ‘এটাই সর্বাধিক স্পষ্ট বরং নির্দিষ্ট যে, ওটা হ’ল তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত’। [25]
কারণ
(১) তাকবীরে তাহরীমা হ’ল ফরয, যা সকল ছালাতে প্রযোজ্য। আর এটি হ’ল সুন্নাত ও অতিরিক্ত, যা কেবল ঈদায়নে প্রযোজ্য।
(২) কূফার গভর্ণর সাঈদ ইবনুল ‘আছ হযরত আবু মূসা আশ‘আরীকে ঈদায়নের তাকবীর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিভাবে দিয়েছেন সেকথা জিজ্ঞেস করেন। [26] নিশ্চয়ই তিনি সেখানে তাকবীরে তাহরীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেননি।
(৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে তাঁর নিজস্ব আমল হিসাবে ৭, ৯, ১১, ১২ ও ১৩ তাকবীরের ‘আছার’ সমূহ ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আলবানী বলেন, তবে তাঁর ১২ তাকবীরের বর্ণনাটিই আমার নিকট অধিকতর ছহীহ’...।[27] তাছাড়া আব্বাসীয় খলীফাগণ ১২ তাকবীরের অনুসারী হওয়ায় বুঝা যায় যে, ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর আমল ১২ তাকবীরের উপরে ছিল। এক্ষণে যদি তাকবীরে তাহরীমা সহ (৮+৫) ১৩ তাকবীর গণনা করা হয়, তাহ’লে পূর্বোক্ত ছহীহ হাদীছ ও অত্র আছারে কোন বিরোধ থাকে না। বরং দু’টির উপরেই আমল করা যায়।
(৪) ছাহাবীর আমলের উপরে রাসূল (ছাঃ)-এর আমল নিঃসন্দেহে অগ্রাধিকারযোগ্য।
(৫) শায়খ আলবানী (রহঃ) উক্ত তাকবীর সমূহকে ঈদায়নের সাথে খাছ ‘অতিরিক্ত তাকবীর’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[28] অতএব এগুলিকে অতিরিক্ত হিসাবেই গণ্য করা উচিৎ এবং তা হবে ক্বিরাআতের পূর্বে, ছানার পূর্বে নয়। কেননা হাদীছে উক্ত তাকবীরগুলিকে ক্বিরাআতের পূর্বে (قبل القراءة) বলা হয়েছে।
(৬) ছানার পরে অতিরিক্ত তাকবীরগুলি দিলে ফরয তাকবীরে তাহরীমা থেকে এগুলিকে পৃথক করা সহজ হয়।
(৭) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে অতিরিক্ত প্রত্যেক তাকবীরের পরে হামদ, ছানা ও দরূদ পাঠ সম্পর্কে যে ‘আছার’ বর্ণিত হয়েছে,[29] সেটি তাঁর নিজস্ব আমল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবী থেকে এরূপ আমলের কোন নযীর নেই।[30]
উপরের আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয় যে, তাকবীরে তাহরীমা, তাকবীরে রুকূ, তাকবীরে ছালাত ইত্যাদি ফরয তাকবীর সমূহ ছাড়াই ১ম রাক‘আতে ৭টি ও ২য় রাক‘আতে ৫টি মোট অতিরিক্ত বারোটি তাকবীর দিতে হবে।
বারো তাকবীরে চার খলীফা :
চার খলীফা ও মদ্বীনার শ্রেষ্ঠ সাত জন তাবেঈ ফক্বীহ ও খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয সহ প্রায় সকল ছাহাবী, তাবেঈ, তিন ইমাম ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ইমামগণ এবং ইমাম আবু হানীফার দুই প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহঃ) বারো তাকবীরের উপরে আমল করতেন। ভারতের দু’জন খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী ও আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী বারো তাকবীরকে সমর্থন করেছেন।[31]
প্রচলিত ছয় তাকবীর : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘ছয় তাকবীরে’ ঈদের ছালাত আদায় করেছেন- মর্মে ছহীহ বা যঈফ কোন স্পষ্ট মরফূ হাদীছ নেই। ‘জানাযার তাকবীরের ন্যায় চার তাকবীর’ বলে মিশকাতে [32] এবং ‘নয় তাকবীর’ বলে মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাতে[33] যে হাদীছ এসেছে, সেটিও মূলতঃ ইবনু মাসঊদের উক্তি। তিনি এটিকে রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে সম্বন্ধিত করেননি। উপরন্তু উক্ত রেওয়ায়াতের সনদ সকলেই ‘যঈফ’ বলেছেন। [34] সুতরাং ইবনু মাসঊদের সঠিক আমল কি ছিল, সে ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যায়। এ বিষয়ে ইমাম বায়হাক্বী বলেন,
অর্থৎ ‘এটি আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-এর ‘ব্যক্তিগত রায়’ মাত্র। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত মরফূ হাদীছ, যার উপরে মুসলমানদের আমল জারি আছে (অর্থাৎ বারো তাকবীর) তার উপরে আমল করাই উত্তম’।[35]
ছয় তাকবীরের তাবীল : ‘জানাযার চার তাকবীরের ন্যায়’[36] বলে ১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা সহ ক্বিরাআতের পূর্বে চার তাকবীর এবং ২য় রাক‘আতে রুকূর তাকবীর সহ ক্বিরাআতের পরে চার তাকবীর বলে ‘তাবীল’ (تأويل) করা হয়েছে। এর মধ্যে তাকবীরে তাহরীমা ও রুকূর ফরয তাকবীর দু’টি বাদ দিলে অতিরিক্ত (৩+৩) ছয়টি তাকবীর হয়। অথচ উক্ত যঈফ হাদীছে কোন তাকবীর বাদ দেওয়ার কথা নেই কিংবা ক্বিরাআতের আগে বা পরে বলে কোন বক্তব্য নেই।
অনুরূপভাবে মুছান্নাফে (বোম্বাই ১৯৭৯, ২/১৭৩) বর্ণিত ‘নয় তাকবীর’ থেকে তাকবীরে তাহরীমা এবং ১ম ও ২য় রাক‘আতের রুকূর তাকবীর দু’টিসহ মোট তিনটি ফরয তাকবীর বাদ দিলে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর হয়। এভাবেই তাবীল করে ছয় তাকবীর করা হয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ছাঃ) কাউকে দেননি।
ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ) বলেন, ‘জানাযার চার তাকবীরে ন্যায়’ মর্মের বর্ণনাটি যদি ‘ছহীহ’ বলে ধরে নেওয়া হয়, [37] তথাপি এর মধ্যে ছয় তাকবীরের পক্ষে কোন দলীল নেই। কারণ তাকবীরে তাহরীমা সহ ১ম রাক‘আতে চার ও রুকূর তাকবীর সহ ২য় রাক‘আতে চার তাকবীর এবং ১ম রাক‘আতে ক্বিরাআতের পূর্বে ও ২য় রাক‘আতে ক্বিরাআতের পরে তাকবীর দিতে হবে বলে কোন কথা সেখানে নেই। বরং এটাই স্পষ্ট যে, দুই রাক‘আতেই জানাযার ছালাতের ন্যায় চারটি করে (অতিরিক্ত) তাকবীর দিতে হবে’।[38]
অথচ এ বিষয়ে ১২ তাকবীরের স্পষ্ট ছহীহ হাদীছের উপরে সকলে আমল করলে সুন্নী মুসলমানেরা অন্ততঃ বৎসরে দু’টি ঈদের খুশীর দিনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছালাত ও ইবাদত করতে পারত। কিন্তু দ্বীনের দোহাই দিয়েই আমরা দ্বীনদারদের বিভক্ত করে রেখেছি। অথচ শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।
ঈদায়নের ছালাতের
১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা ও ছানা পাঠের পর ধীরস্থিরভাবে স্বল্প বিরতি সহ পরপর সাত তাকবীর দিবে। অতঃপর আঊযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ সহ ইমাম সরবে সূরায়ে ফাতিহা ও অন্য সূরা পড়বেন এবং মুক্তাদীগণ চুপে চুপে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পড়বে। অনুরূপভাবে ২য় রাক‘আতে দাঁড়িয়ে ধীরস্থিরভাবে পরপর পাঁচটি তাকবীর দিয়ে কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ সহ সূরায়ে ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে। এ সময় মুক্তাদীগণ চুপে চুপে কেবল সূরা ফাতিহা পড়বে।
প্রথম রাক‘আতে সূরায়ে ক্বাফ অথবা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরায়ে ক্বামার অথবা গা-শিয়াহ পড়বে’। [39] অন্য সূরাও পড়া যাবে।[40] প্রতি তাকবীরে হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে ও বাম হাতের উপর ডান হাত বুকে বাঁধবে। অতিরিক্ত তাকবীর সমূহ বলতে ভুলে গেলে বা গণনায় ভুল হ’লে তা পুনরায় বলতে হয় না বা ‘সিজদায়ে সহো’ লাগে না।[41]
দলীলের উৎসঃ
[1] . মির‘আত ৫/২১; ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম (রিয়াদ : দারুস সালাম ১৪১৪/১৯৯৪), ২৩১-৩২ পৃঃ।
[2] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৪৩৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ঈদায়নের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭।
[3] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২০৪৮ ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬; মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫০; মির‘আত ৬/৬৯।
[4] . মির‘আত ৫/২২-২৩।
[5] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৬।
[6] . আবুদাঊদ হা/১১৪৫, সনদ হাসান; ঐ, মিশকাত হা/১৪৪৪; মির‘আত ৫/৫৮।
[7] . মির‘আত ২/৩৩০-৩৩১; ঐ, ৫/৩১।
[8] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৩১ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭; মির‘আত ২/৩৩১; ঐ, ৫/৩১।
[9] . আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৪৮; সনদ যঈফ; মির‘আত ২/৩২৭; ঐ, ৫/২২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৩৭।
[10] . মির‘আত ৫/৬৪-৬৫।
[11] . বুখারী (ফাৎহ সহ) ২/৫৫০-৫১ পৃঃ, ‘দুই ঈদের ছালাত’ অধ্যায়-১৩, অনুচ্ছেদ-২৫।
[12] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১৬; ঐ, ১/২৩৬; নায়লুল আওত্বার ৪/২৩১।
[13] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৫০; মির‘আত ৫/৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৪১।
[14] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৭০।
[15] . দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, বাংলাদেশ, ৮/৪ সংখ্যা, জানুয়ারী ২০০৫, প্রশ্নোত্তর ১/১২১; ঐ, ১৪/১১ সংখ্যা, আগষ্ট ২০১১, প্রশ্নোত্তর ৩৩/৪৩৩।
[16] . এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন লেখক প্রণীত ‘মাসায়েলে কুরবানী ও আক্বীক্বা’ ৩৪-৪৩ পৃঃ।
[17] . আবুদাঊদ হা/১১৫০; ইবনু মাজাহ হা/১২৮০, সনদ ছহীহ।
[18] . দারাকুৎনী (বৈরূত : ১৪১৭/১৯৯৬) হা/১৭০৪, ১৭১০, সনদ ছহীহ; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৬৩৯-এর ব্যাখ্যা দ্র: ৩/১০৭-০৮; বায়হাক্বী ৩/২৮৭।
[19] . দারাকুৎনী হা/১৭১২, ১৭১৪ ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়, সনদ হাসান; বায়হাক্বী ২/২৮৫ পৃঃ। হাদীছের শেষাংশটি দারাকুৎনী ও বায়হাক্বীতে এসেছে। এতদ্ব্যতীত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে আবুদাঊদ হা/১১৫১ ‘ছহীহ’; ইবনু মাজাহ হা/১২৭৮ ‘হাসান ছহীহ’; আলবানী, ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০২০; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৩।
[20] . তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৮২; মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৫৫ পৃঃ। ইমাম শাওকানী (রহঃ) ঈদায়নের অতিরিক্ত তাকবীর বিষয়ে ১০টি মতভেদ উল্লেখ করে ১২ তাকবীরকেই ‘সর্বাগ্রগণ্য’ (أرجح الأقوال) হিসাবে মন্তব্য করেছেন। দ্রঃ নায়ল ৪/২৫৭ পৃঃ।
[21] . আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ জামে‘ তিরমিযী (মদীনা: মাকতাবা সালাফিইয়াহ ১৩৮৪/১৯৬৪) ৩/৮৫; ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী ২/২৩৮।
[22] . জামে‘ তিরমিযী (দিল্লী : ১৩০৮ হিঃ) ১/৭০ পৃঃ; মিশকাত হা/১৪৪১ ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭; তিরমিযী হা/৫৩৬; ছহীহ তিরমিযী হা/৪৪২; ইবনু মাজাহ হা/১২৭৯; ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/১০৬৪; মির‘আত হা/১৪৫৬, ৫/৪৬-৪৮।
[23] . তিরমিযী (দিল্লী: ১৩০৮ হিঃ), ১/৭০; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/৪৪২, ইবনু মাজাহ (বৈরূত : তাবি) হা/১২৭৯।
[24] . বায়হাক্বী (বৈরূত ছাপা, তাবি) ৩/২৮৬; মির‘আত ২/৩৩৯; ঐ, ৫/৫০-৫১।
[25] . মির‘আত ২/৩৩৮; ঐ, ৫/৪৬।
[26] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৪৪৩ ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭।
[27] . আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/১১২।
[28] . ইরওয়াউল গালীল ৩/১১৩।
[29] . ত্বাবারানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৬৪২, ৩/১১৪।
[30] . বায়হাক্বী ৩/২৯০-৯১; মির‘আত ২/৩৪২; ঐ, ৫/৫৪ পৃঃ।
[31] . মির‘আত’ ২/৩৩৮, ৩৪১; ঐ, ৫/৪৬, ৫২।
[32] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৪৪৩ ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭, হাদীছ যঈফ।
[33] . মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ (বোম্বাই ছাপা: ১৯৭৯), ২/১৭৩ পৃঃ।
[34] . বায়হাক্বী ৩/২৯০; নায়ল ৪/২৫৪, ২৫৬; মির‘আত ৫/৫৭; আলবানী, মিশকাত হা/১৪৪৩।
[35] . বায়হাক্বী ৩/২৯১; মির‘আত ৫/৫১।
[36] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৪৪৩ ‘দুই ঈদের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৪৭।
[37] . যেমন ত্বাহাবী, শরহ মা‘আনিল আছার ৬/২৫ পৃঃ; আলবানী, ছহীহাহ হা/২৯৯৭; আবুদাঊদ হা/১১৫৩; যদিও তাহকীক মিশকাতে (হা/১৪৪৩; বৈরূত : ৩য় সংস্করণ ১৪০৫/১৯৮৫) ও মিশকাতের সর্বশেষ তাহকীকে তিনি ‘যঈফ’ বলেছেন (হেদায়াতুর রুওয়াত ইলা তাখরীজি আহা-দীছিল মাছা-বীহ ওয়াল মিশকাত; দাম্মাম, সঊদী আরব, ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১) হা/১৩৮৮, ২/১২১ পৃঃ।
[38] . ইবনু হাযম, মুহাল্লা (বৈরূত : দারুল ফিকর, তাবি) ৫/৮৪ পৃঃ।
[39] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৪০-৪১ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[40] . আবুদাঊদ হা/৮১৮, ৮২০, ৮৫৯।
[41] . মির‘আত হা/১৪৫৭, ২/৩৪১ পৃঃ; ঐ; হা/১৪৫৫-এর আলোচনা ৫/৫৩-৫৪; ইরওয়া ৩/১১৩।

(সমাপ্ত)
ছালাত সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় জানতে এদের উপর ক্বিলক করুনঃ

'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
 “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

ইসলামের অন্যান্য সকল বিষয় সহিহভাবে জানতে  এর উপর ক্লিক করুনঃ


PLEASE SHARE ON

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...