বিসমিল্লাহির
রাহমানির রাহিম
পির-মুরিদ ও বিদআতিরা যেসব কারণে জাহান্নামি
(পর্ব-৬)
মুনাফিক মুসলমানদের মুনাফিকীকরণ ও তাদের রাজত্ব
মুসলিম রাষ্ট্র
প্রধান বা শাসকের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আমি তাদেরকে পৃথিবীতে (রাজ)
ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ দিবে
ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর আয়ত্তে। (সুরা হজ্জ-আয়াত
নং-৪১)।
কথা ছিল মুসলিম নেতাগন রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতায় গেলে তারা উল্লেখিত চারটি বিষয় সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু সেই
প্রতিশ্রুতি মুসলিম শাসকগণ রাখেনি বা রাখছে না।
বুরায়দা (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা মুনাফিক মানুষকে নেতা হিসাবে গ্রহণ কর না। যদি
নেতা মুনাফিক হয়, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে অসন্তুষ্ট করলে। অন্য বর্ণনায় আছে
যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যুক মুনাফিক ব্যক্তিকে বলে, হে আমার নেতা! তখন সে তার প্রতিপালককে
রাগান্বিত করল’ (আবুদাঊদ হা/৪৯৭৭; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস।
আবু হুরায়রা
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা
বলবেন না। তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদের জন্য
রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। (১) বৃদ্ধ ব্যভিচারকারী (২) মিথ্যুক শাসক (৩) অহংকারী গরীব’
(মুসলিম হা/১০৭; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪২১০; মিশকাত হা/৫১০৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস।
বর্তমানে পৃথিবীর মোট রাষ্ট্র
সংখ্যা- ২২৮টি, পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্র- ১৯৫ টি, পৃথিবীতে মোট মুসলিম রাষ্ট্র সংখ্যা-
৬৫টি, OIC ভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্র সংখ্যা- ৫৭ টি, পৃথিবীর মুসলিম জনসংখ্যা- ১৪২ কোটি
(প্রায়)।
কোন্ কোন্ মুসলিম রাষ্ট্র ইসলামি বিধি বিধান মেনে চলে?
গবেষণা রিপোর্ট কি বলে?
১০ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে কালের
কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিতঃ
ইসলামী বিধান অনুসরণে শীর্ষে
আয়ারল্যান্ড, ১৩১ নম্বরে আছে সৌদি আরব।
ইসলামী বিধান মেনে চলার দিক
থেকে অনেক মুসলিম দেশকে পেছনে ফেলে অদ্ভুতভাবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে ইউরোপের দেশ
আয়ারল্যাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য
বিভাগের প্রফেসর হুসেইন আসকারি সম্প্রতি ইসলামের বিধান মেনে চলার ব্যাপারে গবেষণাকর্ম
সম্পন্ন করেছেন। সেই গবেষণায় তিনি দেখার চেষ্টা করেছেন, বিশ্বের কোন দেশগুলোতে দৈনন্দিন
জীবনে ইসলামী বিধান মেনে চলা হয়।
গবেষণার নমুনায় দু’শ আটটি
দেশ ছিল। সেসব দেশের মধ্যে কারা কতটা রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজের মধ্যে ইসলামী বিধান
মেনে চলে, সেসব বিবেচনা করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে,
ইসলামি রীতি মেনে চলা দেশের তালিকার শীর্ষে ইসলামী কোনো দেশের নাম নেই। এমনকি তালিকার
৩৩ নম্বরে রয়েছে মালয়েশিয়া এবং কুয়েত রয়েছে ৪৮ এ।
গবেষক হুসেইন আসকারি বলেন,
মুসলিম দেশগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইসলামী আইন ব্যবহার করে। এমন অনেক দেশ আছে;
যেগুলো ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। তবে সেখানকার সমাজে ইসলামী আইন মেনে চলা হয় না,
দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, এমনকি ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে সেখানে।
গবেষণার ফলাফলে দেখানো হয়েছে,
সমাজে ইসলামী বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য,
নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও বেলজিয়াম তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন ৬৪ নম্বরে এবং সৌদি আরব রয়েছে একশ ৩১ নম্বরে।
অন্যদিকে তথাকথিত ইসলামী
দেশগুলোতে মুসলমানরা সালাত আদায় করেন, সাওম পালন, কুরআন-হাদিস পড়েন, নারীরা পর্দা মেনে
চলে, দাড়ি রাখার সংখ্যা বেশি, ইসলামী পোষাক নিয়ে সচেতন; তবে সমাজে দুর্নীতি আর পেশাগত
জীবনে অসদুপায় অবলম্বনের নজির চতুর্দিকে।
এর আগে ২০১০ সালেও এক গবেষণায়
ইসলামী বিধান মেনে চলা দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে ইসলামী রাষ্টের নাম ছিল না। ওই গবেষণায়
নিউজিল্যান্ড, লাক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা,
যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নেদারল্যান্ড ছিল তালিকার শীর্ষে।
আগে থেকে আমরা জানতাম যে,
সৌদি আরব, ইরান, কুয়েতে হয়তো ইসলামি শরিয়াহ আইন ১০০% চালু আছে।কিন্তু বাস্তবে তা নেই।
এইসব দেশসহ আরো মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশগুলোতে সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, লটারী, অপহরণ,
গুম, খুন, দুর্নীতি, যিনা/ব্যভিচার ও অস্ত্রবাজিসহ সকল প্রকার অনৈসলামিক কর্মকান্ড
চালু আছে। ৬৫টি মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাষ্ট্রের কোথাও ১০০% ইসলামি আইন বা বিচার ব্যবস্থা
চালু নেই। অথচ আল্লাহ তায়লা তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিয়েছেন সৎ কাজের আদেশ দিতে ও অসৎ
বা অন্যায়মূলক কাজে বাঁধা দিতে কিন্তু এইসব রাষ্ট্র প্রধানরা ক্ষমতা পেয়ে আল্লাহর আইন
বাদ দিয়ে তারা মানব রচিত আইন তৈরী করে সেই মোতাবেক রাষ্ট্র বা শাসন কাজ চালিয়ে আল্লাহর
সাথে ওয়াদা ভঙ্গ বা মুনাফিকীকরণ করে আসছেন। এরা যেহেতু আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য, তাই
এরা এক প্রকোর নাফরমান।
মূলত বিশ্ব মুনাফেক মুসলমান
রাজনৈতিক নেতাগণ ও ধর্মীয় গুরু যেমন, বিভিন্ন পির/অলি ইত্যাদি এবং তাদের অনুসারীদের
মুনাফিকীকরণ এর জন্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসলামি অনুশাসন বা ইসলামি আইন বা বিচার ব্যবস্থা
কিংবা ইসলামি বিধি বিধান কায়েম করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা: আলোচনার
মূল বিষয় হচ্ছে মুনাফেক মুসলমানদের মুনাফিকীকরণ। পৃথিবীর মোট মুসলমানদের প্রায় ৯৭%
মুসলমান কথা-বার্তায়, কাজে-কর্মে, ইবাদত-বন্দেগীসহ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মুনাফিকীকরণ
করে আসছে। হয়তো আপনি বলবেন, অমুক হুজুর, অমুক নেতা, অমুক পির-অলি এতো স্বচ্ছ ইমানদার
তারা কিভাবে মুনাফেক হয়? আমি বলব হ্যাঁ তাদের
মধ্যেও মুনাফিকী স্বভাব আছে। আপনারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
মুনাফিক মুসলমান
মুনাফিক!
‘নিফাক’ ও ‘মুনাফিক’ আরবি
দুটি শব্দ। ‘নিফাক’ অর্থ কপটতা এবং ‘মুনাফিক’ অর্থ কপট ব্যক্তি - যার অন্তরে এক, বাহিরে
আরেক।
ইসলামী পরিভাষায় ‘নিফাক’
এর অর্থ হলো, অন্তরে কুফরি গোপন রেখে মুখে ঈমানের কথা বলা এবং লোক দেখানোর জন্য বিভিন্ন
ইসলামি ইবাদত পালন করা ও মুসলমানদের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। যে ব্যক্তি এরূপ
করে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘মুনাফিক’ বলা হয়।
হুযাইফাহ
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন নিফাক বস্তুত নবী
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর যুগে ছিল। আর এখন হল তা ঈমান গ্রহণের পর কুফরী।(বুখারী-৭১১৪,
আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
নিফাক মূলত
দুই প্রকারঃ
১. নিফাকে ইতিকাদি (বিশ্বাসগত নিফাক)।
২. নিফাকে আমলী (আমল-ইবাদতগত
নিফাক)।
বিশ্বাসগত নিফাক কুফরের চেয়েও
মারাত্মক। কারণ মুনাফিক ব্যক্তি বাহ্যত ইসলামের কাজ করে মুসলিম সমাজকে প্রতারিত করে
এবং তাদের কাছ থেকে আইনগত আর্থিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আর শত্রুর গুপ্তচর
হিসাবে কাজ করে এবং মুসলমানদের গোপন বিষয়ের ব্যাপারে দুশমনদের অবহিত করে দেয়। প্রকাশ্য
শত্রু থেকে আত্মরক্ষা করা সহজ কিন্তু গোপন শত্রুর চক্রান্ত থেকে বাঁচা খুবই দুঃষ্কর।
এই মুনাফিক সম্প্রদায়ের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুযায়ী
মুনাফিক মুসলমানদের পরিচয়ঃ
আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার
৮ থেকে ২০ পর্যন্ত মোট ১৩টি আয়াত মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন।
তা ছাড়া বিভিন্ন সুরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন। বিস্তারিত নিম্নে
আলোচনা করা হলো।
প্রথম মুনাফিক মুসলমানের উৎপত্তিঃ
যায়দ ইব্নু
আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা কোন এক সফরে
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে বের হলাম। সফরে এক কঠিন অবস্থা লোকেদেরকে
গ্রাস করে নিল। তখন ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু উবাই তার সাথী-সঙ্গীদেরকে বলল, “আল্লাহ্র রাসূলের
সহচরদের জন্য তোমরা ব্যয় করবে না যতক্ষণ তারা সরে পড়ে যারা তার আশে পাশে আছে।” সে এও
বলল, “আমরা মাদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল লোকেরা দুর্বল লোকদের বহিষ্কৃত
করবেই।” (এ কথা শুনে) আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এলাম এবং
তাঁকে এ সম্পর্কে জানালাম। তখন তিনি ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু উবাইকে ডেকে পাঠালেন। সে অতি
জোর দিয়ে কসম খেয়ে বলল, এ কথা সে বলেনি। তখন লোকেরা বলল, যায়দ রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। তাদের এ কথায় আমার খুব দুঃখ হল। শেষ
পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলা আমার সত্যতার পক্ষে আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ “যখন মুনাফিকরা তোমার
কাছে আসে।” এরপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ডাকলেন, যাতে তিনি
তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, “কিন্তু তারা তাদের মাথা ফিরিয়ে নিল।” আল্লাহ্র
বানীঃ “দেয়ালে ঠেস লাগানো কাঠ সদৃশ”- (সুরাহ মুনাফিকুন ৬৩/৪) (বুখারী পর্ব ৬৫ অধ্যায়
৩ হাদীস নং ৪৯০৩; মুসলিম ৫০ হাঃ ২৭৭২,আল লু'লু ওয়াল মারজান -১৭৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস।
মুনাফিক মুসলমানের প্রধান প্রধান
চিহ্ন বা আলামত বা স্বভাবসমূহঃ
(ক)
আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, মুনাফিকের চিহ্ন তিনটিঃ
(১) যখন কথা বলে মিথ্যা বলে;
(২) যখন অঙ্গীকার করে ভঙ্গ
করে এবং
(৩) আমানত রাখা হলে খিয়ানাত
করে। মুসলিমের বর্ণনায় এটাও রয়েছে যে, ‘যদিও সে ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে এবং
মনে করে যে, সে মুসলমান’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯, বুখারী-তাওহীদ প্রকাশনী,
২৬৮২, ২৭৪৯,৬০৯৫; মুসলিম ১/২৫ হাঃ ৫৯, আহমাদ ৯১৬২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ
৩২) । হাদিসের মানঃ সহিহ।
(খ)
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযি.) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব
থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়।
(১) আমানত রাখা হলে খিয়ানত
করে;
(২) কথা বললে মিথ্যা বলে;
(৩) অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে;
এবং
(৪) বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে
গালাগালি দেয়। শু‘বা আ‘মাশ (রহ.) থেকে হাদীস বর্ণনায় সুফইয়ান (রহ.)-এর অনুসরণ করেছেন।
(বুখারী-তাওহীদ প্রকাশনী, ২৪৫৯, ৩১৭৮; মুসলিম ১/২৫ হাঃ ৫৮, আহমাদ ৬৭৮২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ
৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৩), হাদিসের মানঃ
সহিহ (Sahih)।
উল্লেখিত হাদিসদ্বয়
হতে আমরা জানতে পারলাম যে, মুনাফেকদের প্রধান চিহ্ন হচ্ছে ৪টিঃ
১. আমানত রাখা হলে খিয়ানত
করে;
২. কথা বললে মিথ্যে বলে;
৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে;
এবং
৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে
গালাগালি দেয়।
হুযাইফাহ ইব্নু
ইয়ামান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, বর্তমান কালের
মুনাফিকরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কালের মুনাফিকদের চেয়েও জঘন্য।
কেননা, সে কালে তারা (মুনাফিকী) করত গোপনে আর আজ করে প্রকাশ্যে। (বুখারী-৭১১৩, আধুনিক
প্রকাশনী- ৬৬১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬২৮)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুসারে বিস্তারিত আলোচনাঃ
(১) আমানত রাখা হলে খিয়ানত করেঃ
মুনাফিকদের অন্যতম একটি চরিত্র হচ্ছে আমানতের খিয়ানত করাঃ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকদের চারটি স্বভাবের অন্যতম।
(বুখারী হা/৩৩, মুসলিম হা/২১৯)।
আমানত শব্দটি খেয়ানত শব্দের
বিপরীত। আমানতের হেফাযত করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমানতের খেয়ানত করা মুনাফেকের
লক্ষণ। আখেরী যামানায় আমানতের খেয়ানত ব্যাপাকভাবে দেখা দিবে। অযোগ্য লোককে কোন কাজের
দায়িত্ব দেয়াও আমানতের খেয়ানতের অন্তর্ভূক্ত। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে নবীজীকে
এই বলে প্রশ্ন করলো যে, কিয়ামত কখন হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর
কথা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছু লোক মন্তব্য করলোঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
লোকটির এই প্রশ্নকে অপছন্দ করেছেন। আবার কিছু লোক বললোঃ তিনি তাঁর কথা শুনতেই পান নি।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচনা শেষে বললেনঃ প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে
বললোঃ এই তো আমি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
‘‘যখন আমানতের খেয়ানত হবে
তখন কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে বলে মনে করবে। লোকটি আবার প্রশ্ন করলোঃ কিভাবে আমানতের
খেয়ানত করা হবে? নবীজী বললেনঃ যখন অযোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা
করতে থাকো’’। বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুর রিকাক।
আখেরী যামানায় যখন আমানতদারের
সংখ্যা কমে যাবে তখন বলা হবে অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। লোকেরা একথা শুনে
তার প্রশংসা করবে এবং বলবেঃ সে কতই না বুদ্ধিমান! সে কতই না মজবুত ঈমানের অধিকারী!
অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই।(বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।)
মুমিন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হলো সে আমানতদার হয়। মুমিনের কাছে জীবনের সর্বাপেক্ষা সম্পদ হলো আমানতদারী। আমানতদারী
একজন মুমিনের নিদর্শন। এ কারণে মুমিন নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে হলেও আমানতদারী
রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়।
আমানতদারীর গুরুত্ব বর্ণনা
করতে গিয়ে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিয়েছেন, আমানত তার
হকদারকে প্রত্যাবর্তন করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন
ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দিচ্ছেন তা কত উত্কৃষ্ট আল্লাহ
সর্বশ্রোতা আল্লাহ সর্বস্রষ্টা।’ (সূরা নিসা : ৪৮)।
উল্লেখিত আয়াতে আমানতের বিষয়ে
বর্ণনা করতে গিয়ে একদিকে যেমন হকদারের হক প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে
বিচারকের বিচারকার্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করতে বলা হয়েছে।
এ থেকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়, আমানতদারী শুধু হকদারকে হক বুঝিয়ে দেওয়ার
মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে
পালন করাটাও আমানতদারী। আর এই দায়িত্ব অর্পণ যেমনিভাবে বান্দার পক্ষ থেকে অন্য বান্দার
ওপর হতে পারে আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতিও হতে পারে। যেমন আল্লাহ মানুষকে
সুস্থ বিবেক, হাত, পা, চক্ষুসহ যত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করেছেন সেগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহারেরও
নির্দেশ দিয়েছেন। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ-প্রদত্ত এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহর নির্দেশের
বাইরে, পছন্দের বাইরে কোনোভাবে ব্যবহার করে তবে সে কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারীদের দলভুক্ত
হয়ে উঠবে।
আল কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
‘চোখসমূহের খেয়ানত এবং অন্তরসমূহ যা গোপনে রাখে তা তিনি (আল্লাহ জানেন)।’ (সূরা মুমিন
: ১৯)।
ওই আয়াতে চোখের অপব্যবহারকে
খেয়ানত বলা হয়েছে। চোখের দ্বারা খেয়ানত বলতে চোখ দ্বারা এমন সব কিছু দেখা যা দেখলে
আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেটাই চোখের খেয়ানত, অনুরূপভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিষয়টাও
একইভাবে প্রমাণিত হলো। যেমন হাত দিয়ে কারও প্রতি জুলুম করা, চুরি করা, ডাকাতি করা ইত্যাদি
হাতের খেয়ানত। মুখ দিয়ে কাউকে গালি দেওয়া, মিথ্যা বলা, গিবত করা ইত্যাদি মুখের খেয়ানত।
আল্লাহর পছন্দের বাইরে কোনো নাফরমানির কাজে ব্যয় করাটা সময়ের খেয়ানত। আবার কেউ যদি
কারও সঙ্গে কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য কারও সঙ্গে কোনো চাকরিতে চুক্তিবদ্ধ হয় আর ওই
চাকরিজীবী যদি ওই চুক্তিবদ্ধ সময়ের মাঝে কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি না নিয়ে অন্য কোথাও
সময় ব্যয় করে তাও হবে বড় ধরনের শুধু খেয়ানতই নয় বরং ধোঁকাবাজির শামিল। সে ক্ষেত্রে
ওই ব্যক্তি একই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা করা, ধোঁকা দেওয়া, সময়ের খেয়ানত করার গুনায় লিপ্ত
হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আমানতদার। তাঁর কাছে শুধু মুসলিমরাই
সম্পদ আমানত রাখেনি বরং অমুসলিম অবিশ্বাসীরাও তার কাছে আমানত রাখতেন।
তিনি শুধু মানুষের সম্পদের
আমানতদারই ছিলেন না তিনি ছিলেন আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থারও আমানতদার। তাইতো তিনি
আল-আমিন বা বিশ্বাসী।
অন্যদিকে আমানতের খেয়ানত
করা মুনাফেকের অন্যতম চরিত্র। কোনো ব্যক্তি যদি কারো আমানতের খেয়ানত করে তবে সে ঈমানহীন
হয়ে পড়ে। এ কারণেই আমানতের খেয়ানত করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বর্তমান সময়ে আমানতের খেয়ানত
মহামারী আকারে বেড়ে চলেছে। এ খেয়ানত মানুষকে মুনাফেকে পরিণত করছে। মুনাফেকদের ব্যাপারে
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘হে নবি! কাফির ও মুনাফিকদের
বিরুদ্ধে জেহাদ করুন এবং তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন করুন। আর তাদের পরিণতি হচ্ছে
জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। (সুরা তাওবা : আয়াত ৭৩)।
আল্লাহ তাআলা আমানতের খেয়ানতকারী
মুনাফিকদের পরকালীন অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের
সর্বনিম্ন স্থানে অবস্থান করবে। (সুরা নিসা : আয়াত ১৪৫)
আমানতের হেফাজত করতে আল্লাহ
তাআলা কুরআন এবং হাদিসে মুমিন বান্দার জন্য নসিহত পেশ করা হয়েছে। এ চরিত্রের লোকদের
ব্যাপারে কুরআন এবং হাদিসে এসেছে মারাত্মক সতর্কতা। যারা আমানতের খেয়ানতকারীর চরিত্রে
অভ্যস্ত তাদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা-
'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের
আদেশ দিচ্ছেন আমানতগুলো তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে।' (সুরা নিসা : আয়াত ৫৮)।
আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ!
তোমরা জেনে-শুনে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে এবং নিজেদের পারস্পরিক আমানতের খেয়ানত করোনা
(আনফাল ২৭)।
যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে
সতর্ক থাকে তারাই প্রকৃত মুমিন (মুমিনুন ৮)।
হুযাইফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু
কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট
দু’টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। একটি তো আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং দ্বিতীয়টির জন্য অপেক্ষায়
রয়েছি। তিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, আমানত মানুষের অন্তরের অন্তঃস্তলে অবতীর্ণ
হয়েছে। অতঃপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর তারা কুরআন থেকে জ্ঞানার্জন করেছে। তারপর
তারা নবির হাদিস থেকেও জ্ঞানার্জন করেছে। এরপর আমাদেরকে আমানত তুলে নেওয়া সম্পর্কে
বর্ণনা করেছেন, মানুষ এক ঘুম ঘুমানোর পর তার অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া হবে। তখন
একটি বিন্দুর মত তার চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। পুনরায় মানুষ এক ঘুম ঘুমাবে। আবারো তার অন্তর
থেকে আমানত উঠিয়ে নেওয়া হবে। তখন জ্বলন্ত আগুন গড়িয়ে তোমার পায়ে পড়লে যেমন একটা ফোস্কা
পড়ে কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায় তার মত চিহ্ন থাকবে। তুমি তাকে ফোলা দেখবে; কিন্তু বাস্তবে
তাতে কিছুই থাকবে না।’’ অতঃপর (উদাহরণস্বরূপ) তিনি একটি কাঁকর নিয়ে নিজ পায়ে গড়িয়ে
দিলেন। (তারপর বলতে লাগলেন,) সে সময় লোকেরা বেচা-কেনা করবে কিন্তু প্রায় কেউই আমানত
আদায় করবে না। এমনকি লোকে বলাবলি করবে যে, অমুক বংশে একজন আমানতদার লোক আছে। এমনকি
(দুনিয়াদার) ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করা হবে, সে কতই না অদম্য! সে কতই না বিচক্ষণ!
সে কতই না বুদ্ধিমান! অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও থাকবে না।’’ (হুযাইফা
বলেন,) ইতোপূর্বে আমার উপর এমন যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে, যখন কারো সাথে বেচাকেনা করতে
কোন পরোয়া করতাম না। কারণ সে মুসলিম হলে তার দ্বীন তাকে আমার (খিয়ানত থেকে) বিরত রাখবে।
আর খ্রিষ্টান অথবা ইয়াহূদী হলে তার শাসকই আমার হক ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা
হচ্ছে এই যে, আমি অমুক অমুক ছাড়া বেচা-কেনা করতে প্রস্তুত নই। [বুখারি৬৪৯৭, ৭০৮৬, ৭২৭৬,
মুসলিম ১৪৩, তিরমিযি ২১৭৯, ইবন মাজাহ ৪০৫৩, আহমদ ২২৭৪৪]।
আমানতের খেয়ানত করা একটি
মারাত্মক কবিরা গুণাহ। এ প্রকৃতির মুনাফিকরা জাহান্নামে বাস করবে।
(২) কথা বললে মিথ্যে বলেঃ
মুনাফিক মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিথ্যে বলাঃ
প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো না
কোনোভাবে মিথ্যের সহিত জড়িত। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে মসজিদের খাদেম পর্যন্ত দেখা
যায় তাদের কথা বার্তা বা ওয়াজ মাহফিলে বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যে গল্প বা কাহিনী কিংবা
মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে থাকে। অনেকে কৌতুক কিংবা হাসির ছলেও মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু মিথ্যে
বলার কতো যে ভয়ংকর শাস্তি তা যদি মুসলমান সঠিকভাবে অনুধাবন করতো তাহলে কখনই সত্য ছাড়া
মিথ্যের কল্পনাও করতো না।
মিথ্যা বলা অশোভনীয় ও অত্যন্ত
ঘৃণিত কাজ। চারিত্রিক স্খলনের কারণে অনেকে মিথ্যায় জড়িয়ে যায়। মনুষ্যত্ববোধ ও রুচিশীলতা
লোপ পেলেও অনেকে মিথ্যার বেসাতি তৈরি করে। কিন্তু সুস্থ ও সঠিক মন-মস্তিষ্ক কোনোক্রমেই
মিথ্যা সমর্থন দিতে পারে না।
মিথ্যা ভয়াবহ গুনাহ। মিথ্যা
থেকে বেঁচে থাকতে ইসলাম দৃঢ়ভাবে সতর্ক করেছে।
ইসলামে মিথ্যার সামান্যতম
আশ্রয় বা সুযোগ নেই। কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, এটা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম
ও গর্হিত। মিথ্যাবাদীর পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে খুবই নিন্দনীয়। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি
ক্ষেত্রে ও মৌলিক স্বার্থে মিথ্যা বলার অবকাশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
‘মিথ্যা তো তারাই বানায়, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই
মিথ্যুক। ’ (সুরা নাহাল, আয়াত: ১০৫)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত
হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুনাফেকদের নিদর্শন তিনটি : কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি
ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৩৩, মুসলিম, হাদিস নং : ৫৯)।
মুসলিম মনীষীরা বলেছেন, সবচেয়ে
বড় মিথ্যা হলো আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর ওপর মিথ্যারোপ করা। এর শাস্তি অত্যন্ত
ভয়াবহ। কেউ কেউ এ জাতীয় মিথ্যুককে কাফের পর্যন্ত বলেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের
জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম,
আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে
না। ’ (সুরা নাহাল, আয়াত : ১১৬)।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার ওপর মিথ্যা বলবে না, যে আমার ওপর মিথ্যা বলবে, সে যেন
জাহান্নামে প্রবেশ করে। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ১০৬)।
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন,
‘এর অর্থ হচ্ছে যে রাসূল সা. এর ওপর মিথ্যা বলবে সে যেন নিজ স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম
বানিয়ে নেয়। ’ (তারিকুল হিজরাতাইন : ১৬৯)।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান
হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ
করবে না। তোমরা ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার নিকটতর। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৮)
হাফস ইবন আসেম থেকে বর্ণিত
হাদিসে রাসুল (সা.) বলেনে, ‘ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা
শুনবে তাই বলবে। ’ (মুসলিম : ৫)।
ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এ
সব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, যা যা শোনা যায় তার সব কিছু বলা নিষেধ। কারণ, প্রতিনিয়ত
সত্য-মিথ্যা অনেক কিছুই শোনা যায়, অতএব যে ব্যক্তি সব কিছু বলে বেড়াবে—তার দ্বারা
মিথ্যা প্রচারিত হওয়াই স্বাভাবিক, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আর এটাই
হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যার জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দখল নেই। হ্যাঁ, গোনাহগার হওয়ার ইচ্ছা
শর্ত। আল্লাই ভাল জানেন। ’ (শরহু মুসলিম : ১/৭৫)।
মযাক করে হলেও মিথ্যে বলা নিষেধঃ
আবু উমামা
বাহেলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি ঘর নিয়ে দেয়ার জন্য
যামীন, যে তর্ক পরিহার করে হক হলেও। আর একটি ঘর জান্নাতের মাঝামাঝিতে নিয়ে দেয়ার জন্য
যামীন, যে মিথ্যা পরিহার করে মযাক করে হলেও এবং আরও একটি ঘর জান্নাতের সর্বোচ্চে নিয়ে
দেয়ার জন্য যিম্মাদার, যে তার চরিত্রকে সুন্দর করবে’ (আবুদাঊদ হা/৪৮০০; বায়াহাক্বী,
আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
হাসানোর জন্যে মিথ্যে কথা বললে তার ধ্বংস নিশ্চিতঃ
বাহয ইবনু
হাকীম তার পিতা থেকে বর্ণিতঃ
তার দাদা বলেন, আমি রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত
যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস’ (তিরমিযী
হা/২৩১৫; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪২০৯; মিশকাত হা/৪৮৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সত্য কথা বললে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ তাকে ভালবাসেঃ
আব্দুর রহমান
ইবনু হারিছ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, ‘আমরা একদা নবী
করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকটে ছিলাম। তিনি ওযূর পানি নিয়ে ডাকলেন।
তিনি তাতে হাত ডুবালেন এবং ওযূ করলেন। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম এবং তাঁর নিকট হতে অঞ্জলী
ভরে ওযূর পানি নিলাম। তিনি বললেন, তোমরা এ কাজ করতে উৎসাহিত হলে কেন? আমরা বললাম, এটা
হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা। তিনি বললেন, তোমরা যদি চাও যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
তোমাদেরকে ভালবাসবেন তাহলে তোমাদের নিকট আমানত রাখা হলে, তা প্রদান কর। কথা বললে, সত্য
বল। তোমাদের প্রতিবেশীর সাথে ভাল আচরণ কর’ (ত্বাবারাণী, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৮০)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সত্য কথা বললে দুনিয়ায় তার কোনো সমস্যা নেইঃ
আব্দুল্লাহ
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন তোমার মাঝে চারটি জিনিস থাকবে, তখন দুনিয়ার সবকিছু হারিয়ে
গেলেও তোমার কোন সমস্যা নেই। (১) আমানত রক্ষা করা (২) সত্য কথা বলা (৩) সুন্দর চরিত্র
(৪) বৈধ রুযী’ (আহমাদ, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মিথ্যা সন্দেহ ও অশান্তির নামঃ
হাসান ইবনু
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে অবগত হয়েছি, তিনি বলেছেন, ‘তুমি সন্দেহযুক্ত কথা ও কর্ম ছেড়ে
যাতে সন্দেহ নেই সে দিকে ফিরে যাও। নিশ্চয়ই সত্য প্রশান্তির নাম এবং মিথ্যা সন্দেহ
ও অশান্তির নাম’ (তিরমিযী, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সত্য কথার অধিকারী ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম মানুষঃ
আব্দুল্লাহ
ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলা হল, সবচেয়ে ভাল মানুষ কে? তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক হিংসা-বিদ্বেষ
মুক্ত অন্তরের অধিকারী এবং সত্য কথার অধিকারী ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম মানুষ’। ছাহাবীগণ
বললেন, আমরা সত্য কথার অধিকারী জানি। কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত অন্তর কি জিনিস তা
জানি না। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি স্বচ্ছ ও পরহেযগার। যার মধ্যে (১) পাপ নেই, পাপ হলেই
ক্ষমা চায় (২) সীমালংঘন নেই (৩) খিয়ানত নেই (৪) হিংসা নেই (ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬)। হাদিসের
মানঃ সহিহ হাদিস।
মিথ্যে ও পাপ উভয়ে জাহান্নামে যাবেঃ
আবুবকর ছিদ্দীক
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা সত্য গ্রহণ কর। সত্য নেকীর সাথে রয়েছে। আর উভয়টি
জান্নাতে যাবে। আর মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপের সাথে রয়েছে। উভয়ই জাহান্নামে
যাবে’ (ইবনু হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মিথ্যে ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেঃ
আবুবকর ছিদ্দীক
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা
থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই মিথ্যা ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে’ (বায়হাক্বী কুবরা হা/২০৬১৫)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
কাউকে কিছু দিতে চেয়ে না দিলে সে মিথ্যেবাদী বলে গণ্য হবেঃ
আবু হুরায়রা
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে তার বাচ্চাকে বলল, আসো নাও। অতঃপর তাকে কিছু দিল না।
সে একজন মিথ্যুক মহিলা’ (আহমাদ হা/৯৮৩৫; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪২০৭)। হাদিসের মানঃ
সহিহ হাদিস।
কাউকে কিছু দিতে চেয়ে না দিলে সে মিথ্যেবাদী বলে গণ্য হবেঃ
আব্দুল্লাহ
ইবনু আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদা আমার মা
আমাকে ডাকলেন, তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের বাড়িতে বসেছিলেন,
সে বলল, আস তোমাকে কিছু দিব। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে বললেন,
তুমি তাকে কি দিবে? সে বলল, আমি তাকে খেজুর দিব। তিনি বললেন, মনে রেখ, তুমি যদি তাকে
কিছু না দাও, তাহলে তুমি একজন মিথ্যুক মহিলা বলে লেখা হবে’ (বায়হাক্বী, আত-তারগীব ওয়াত
তারহীব হা/৪২০৮; মিশকাত হা/৪৮৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
যারা মিথ্যে কথা বলে পরকালে তাদের জিহবা হবে আগুনেরঃ
আম্মার ইবনু
ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যার দুনিয়াতে দু’টি মুখ হবে, ক্বিয়ামতের মাঠে তার মুখে
আগুনের দু’টি জিহ্বা হবে’ (আবুদাঊদ হা/৪৮৭৩; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪২১৫)। পরকালে
আগুনের জিহ্বা হবে তাদের, যারা মানুষের সাথে মিথ্যা কথা বলে, চোগলখুরী করে ও পরনিন্দা
করে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মিথ্যে কসম করা কবিরা গোনাহঃ
আব্দুল্লাহ
ইবনু আমর (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেন, ‘বড় বড় কবীরা
গোনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা
এবং মিথ্যা কসম করা’ (বুখারী)। কিন্তু আনাসের বর্ণনায় ‘মিথ্যা কসম’-এর পরিবর্তে ‘মিথ্যা
সাক্ষ্য’ শব্দ রয়েছে (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সত্য কথা বললে রাসুল সাঃ জান্নাতের যামিন হবেনঃ
উবাদাহ বিন
ছামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের পক্ষ হতে আমাকে ছয়টি বিষয়ের
জামানত দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের যামিন হব। (১) তোমরা যখন কথাবার্তা বল, তখন
সত্য বলবে। (২) যখন ওয়াদা কর, তা পূর্ণ করবে। (৩) যখন তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়,
তা আদায় করবে। (৪) নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে। (৫) স্বীয় দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে
এবং (৬) স্বীয় হস্তকে (অন্যায় কাজ হতে) বিরত রাখবে’ (আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৪৮৭০,
সনদ হাসান)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
সর্বদা মিথ্যে কথা বলা ব্যক্তি আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে নেয়া হয়ঃ
আব্দুল্লাহ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য একটি পুণ্যময় কাজ। আর পুণ্য জান্নাতের পথ
দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাকে আল্লাহর খাতায় সত্যনিষ্ঠ বলে লিখে
নেয়া হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা হচ্ছে পাপকাজ। পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি
সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে
নেয়া হয়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত বাংলা ৯ম খণ্ড হা/৪৬১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া বড় কবিরা গুণাহঃ
আবূ বাক্রাহ
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আমি কি তোমাদের সব থেকে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব
না? আমরা বললাম: অবশ্যই সতর্ক করবেন, হে আল্লাহ্র রসূল! তিনি বললেনঃআল্লাহ্র সঙ্গে
কোন কিছুকে অংশীদার গণ্য করা, পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান
দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসলেন এবং বললেনঃমিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য
দেয়া, দু’বার করে বললেন এবং ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন
না। (সহিহ বুখারী, ৫৯৭৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৮)। হাদিসের
মানঃ সহিহ হাদিস।
আনাস ইবনু
মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাবীরা গুনাহ্র কথা উল্লেখ করলেন অথবা তাঁকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহ্র সঙ্গে শারীক করা, মানুষ হত্যা করা ও মা-বাপের
নাফরমানী করা। তারপর তিনি বললেনঃ আমি কি তোমাদের কবীরা গুনাহ্র অন্যতম গুনাহ হতে সতর্ক
করবো না? পরে বললেনঃ মিথ্যা কথা বলা, অথবা বলেছেনঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
শু'বাহ (রহঃ) বলেন, আমার
বেশি ধারণা হয় যে, তিনি বলেছেনঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।( সহিহ বুখারী, ৫৯৭৭, আধুনিক প্রকাশনী-
৫৫৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যে বলা বৈধঃ
এক. যুদ্ধে মিথ্যা বলা বৈধ।
দুই. দু’পক্ষের মাঝে সমঝোতা করার জন্যে মিথ্যা
বলা বৈধ।
তিন. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও মিল তৈরির
করার জন্যেও মিথ্যা বলা বৈধ।
উম্মে কুলসুম (রা.) বলেন,
আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য ভালো
কথার আদান-প্রদানকালে মিথ্যা বলে—সে মিথ্যুক নয়। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ২৫৪৬; মুসলিম,
হাদিস নং : ২৬০৫)।
আসমা বিনতে ইয়াজিদ বলেন,
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন জায়গা ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার
জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং দু’জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা
বৈধ। (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৯৩৯; সহিহ আল-জামে : ৭৭২৩)।
মিথ্যে বলার শেষ পরিনতিঃ
সভ্য পৃথিবীতে মিথ্যা কেউ
পছন্দ করেনা। হাল-জমানায় মিথ্যার ধরন ও উপকরণে এসেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু মিথ্যার
অসারতা ও পরিণাম একদিন ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে। পৃথিবীতে যেমন অনিবার্য ক্ষতি রয়েছে
তেমনি আখেরাতেও রয়েছে কঠিন শাস্তি। পবিত্র কোরআন-হাদিসে তা বিবৃত হয়েছে।
মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতা সৃষ্টি হয়ঃ
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুতরাং
পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক (দ্বিমুখিতা) রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা
তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা
যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে। (সুরা তওবা, আয়অত : ৭৭)।
মিথ্যা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়ঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)
থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ।
আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে
নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, একসময় আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে পরিগণিত
হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা
বলতে থাকে, আল্লাহর নিকট একসময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়। (বুখারি, হাদিস নং: ৫৭৪৩;
মুসলিম, হাদিস নং: ২৬০৭)
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ শায়খ
সানআনি বলেন, ‘হাদিসে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, বান্দা সত্য বললে সত্যবাদিতা তার একটি
আলামত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বান্দা মিথ্যা বললে মিথ্যা বলা তার অভ্যাস ও আলামতে পরিণত
হয়। সত্যবাদিতা ব্যক্তিকে জান্নাতে নিয়ে যায় আর মিথ্যা ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
অধিকন্তু সত্যবাদীর কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে ও তা মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা
পায় আর মিথ্যুকদের কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে না এবং মানুষের নিকট তা গ্রহণযোগ্যতাও
পায় না। ’ (সুবুলুস সালাম : ২/৬৮৭)।
মিথ্যুকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়ঃ
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন,
যেসব কারণে ফতোয়া, সাক্ষ্য ও বর্ণনা গ্রহণযোগ্যতা
হারায়, তার মধ্যে মিথ্যা অন্যতম। মিথ্যা মানুষের মুখের কার্যকারিতাই নষ্ট করে দেয়।
যেমনিভাবে অন্ধ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং বধির ব্যক্তির শোনার
সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মুখ একটি অঙ্গের ন্যায়, যখন তা মিথ্যা বলা আরম্ভ করবে
তখন তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। বরং মানুষের ক্ষতির মূল কারণই হচ্ছে মিথ্যা জবান।
(আলামুল মুয়াক্কিঈন : ১/৯৫)।
মিথ্যার কারণে চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়ঃ
দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতেই
চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ
করে কেয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে। ’ (জুমার, আয়াত : ৬০)।
যারা মিথ্যা কথা বলবে, কিয়ামতে লোহার সাঁড়াশি দ্বারা তার গাল চিরে ফেলা
হবেঃ
সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ)
হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অভ্যাস ছিল তিনি
ফজরের ছালাত শেষে প্রায় আমাদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের কেউ
আজ রাত্রে কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? বর্ণনাকারী বলেন, আমাদের কেউ স্বপ্ন দেখে থাকলে সে
তাঁর নিকট বলত। আর তিনি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক তার তা’বীর বর্ণনা করতেন। যথারীতি একদিন
সকালে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ (আজ রাত্রে) কোন স্বপ্ন দেখেছে কি? আমরা বললাম, না।
তখন তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি। আজ রাত্রে দুই ব্যক্তি আমার নিকট আসল এবং তারা
উভয়ে আমার হাত ধরে একটি পবিত্র ভূমির দিকে (সম্ভবত তা শাম বা সিরিয়ার দিকে) নিয়ে গেল।
দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে আর অপর এক ব্যক্তি লোহার সাঁড়াশি হাতে দাঁড়ানো। সে তা উক্ত
বসা ব্যক্তির গালের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং তা দ্বারা চিরে গর্দানের পিছন পর্যন্ত নিয়ে
যায়। অতঃপর তার দ্বিতীয় গালের সাথে অনুরূপ ব্যবহার করে। ইত্যবসরে প্রথম গালটি ভাল হয়ে
যায়। আবার সে (প্রথমে যেভাবে চিরেছিল) পুনরায় তাই করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি?
তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। সম্মুখের দিকে চললাম।
অবশেষে আমরা এমন এক ব্যক্তির
কাছে এসে পৌঁছলাম, যে ঘাড়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে, আর অপর এক ব্যক্তি একখানা ভারী
পাথর নিয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার আঘাতে শায়িত ব্যক্তির মাথা চুর্ণ-বিচুর্ণ
করছে। যখনই সে পাথরটি নিক্ষেপ করে (মাথা চুর্ণ-বিচুর্ণ করে) তা গড়িয়ে দূরে চলে যায়,
তখনই সে লোকটি পুনরায় পাথরটি তুলে আনতে যায় সে ফিরে আসার পূর্বে ঐ ব্যক্তির মাথাটি
পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যায় এবং পুনরায় সে তা দ্বারা তাকে আঘাত করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
এটা কি? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম। অবশেষে একটি গর্তের
নিকট এসে পৌঁছলাম, যা তন্দুরের মত ছিল। তার উপর অংশ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশটি
ছিল প্রশস্ত। তার তলদেশে আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা যখন উপরের দিকে
উঠত, তখন তার ভিতরে যারা রয়েছে তারাও উপরে উঠে আসত এবং উক্ত গর্ত হতে বাইরে পড়ে যাওয়ার
উপক্রম হত আর যখন অগ্নিশিখা কিছুটা শিথিল হত, তখন তারাও পুনরায় ভিতরের দিকে চলে যেত।
তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? তারা উভয়ে বলল,
সামনে চলুন, সুতরাং সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম এবং একটি রক্তের নহরের নিকট এসে পৌঁছলাম।
দেখলাম, তার মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং নহরের তীরে একজন লোক দণ্ডায়মান।
আর তার সম্মুখে রয়েছে প্রস্তরখণ্ড। নহরের ভিতরের লোকটি যখন তা থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে
কিনারার দিকে অগ্রসর হতে চায়, তখন তীরে দাঁড়ানো লোকটি ঐ লোকটির মুখ লক্ষ্য করে পাথর
নিক্ষেপ করে এবং সে লোকটিকে ঐ স্থানে ফিরিয়ে দেয় যেখানে সে ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
এটা কি? সঙ্গীদ্বয় বলল, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে শ্যামল সুশোভিত একটি বাগানে
পৌঁছলাম। বাগানে ছিল একটি বিরাট বৃক্ষ। আর উক্ত বৃক্ষটির গোড়ায় উপবিষ্ট ছিলেন, একজন
বৃদ্ধ লোক এবং বিপুল সংখ্যক বালক। এ বৃক্ষটির সন্নিকটে আরেক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম,
যার সম্মুখে রয়েছে আগুন, যাকে সে প্রজ্বলিত করছে। এরপর আমার সঙ্গীদ্বয় আমাকে ঐ বৃক্ষের
উপরে আরোহণ করালো এবং সেখানে তারা আমাকে বৃক্ষরাজির মাঝখানে এমন একখানা গৃহে প্রবেশ
করালো যে, এরূপ সুন্দর ও মনোরম ঘর আমি আর কখনো দেখিনি। তার মধ্যে ছিল কতিপয় বৃদ্ধ,
যুবক, নারী ও বালক। অনন্তর তারা উভয়ে আমাকে সে ঘর হতে বের করে বৃক্ষের আরও উপরে চড়ালো
এবং এমন একখানা গৃহে প্রবেশ করালো যা প্রথমটি হতে সমধিক সুন্দর ও উত্তম। তাতেও দেখলাম,
কতিপয় বৃদ্ধ ও যুবক। অনন্তর আমি উক্ত সঙ্গীদ্বয়কে বললাম, আপনারা উভয়েই তো আমাকে আজ
সারা রাতে অনেক কিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। এখন বলেন, আমি যা কিছু দেখেছি তার তাৎপর্য
কি? তারা উভয়ে বলল, হ্যাঁ, (আমরা তা জানাবো)। ঐ যে এক ব্যক্তিকে দেখেছেন সাঁড়াশি দ্বারা
যার গাল চিরা হচ্ছে, সে মিথ্যাবাদী, সে মিথ্যা বলত এবং তার নিকট হতে মিথ্যা রটানো হত।
এমনকি তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। অতএব তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণ করা হবে, যা
আপনি দেখেছেন। আর যে ব্যক্তির মস্তক পাথর মেরে ঘায়েল করতে দেখেছেন, সে ঐ ব্যক্তি, আল্লাহ
তা‘আলা যাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু সে কুরআন হতে গাফেল হয়ে রাত্রে ঘুমাতো
এবং দিনেও তার নির্দেশ মোতাবেক আমল করত না। সুতরাং তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণই
করা হবে, যা আপনি দেখেছেন। আর (আগুনের) তন্দুরে যাদেরকে দেখেছেন, তারা হল যেনাকারী
(নারী-পুরুষ)। আর ঐ ব্যক্তি যাকে (রক্তের) নহরে দেখেছেন, সে হল সুদখোর। আর ঐ বৃদ্ধ
ব্যক্তি যাকে একটি বৃক্ষের গোড়ায় উপবিষ্ট দেখেছেন, তিনি হলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর
চতুস্পার্শ্বের শিশুরা হল মানুষের সন্তানাদি। আর যে লোকটিকে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করতে
দেখেছেন, সে হল দোযখের দারোগা মালেক। আর প্রথম যে ঘরটিতে আপনি প্রবেশ করেছিলেন, তা
(জান্নাতের মধ্যে) সর্বসাধারণ মুমিনদের গৃহ। আর যে ঘর যে পরে দেখেছেন, তা শহীদদের ঘর।
আর আমি হলাম, জিব্রাঈল এবং ইনি হলেন মীকাঈল। এবার আপনি মাথা উপরের দিকে তুলে দেখুন।
তখন আমি মাথাটি তুলে দেখলাম, যেন আমার মাথার উপরে মেঘের মত কোন একটি জিনিস রয়েছে। অপর
এক বর্ণনায় আছে, একের পর এক স্তরবিশিষ্ট সাদা মেঘের মত কোন জিনিস দেখলাম। তাঁরা বললেন,
তা আপনারই বাসস্থান। আমি বললাম, আমাকে সুযোগ দিন আমি আমার ঘরে প্রবেশ করি। তারা বললেন,
এখনও আপনার হায়াত বাকী আছে, যা আপনি এখনো পূর্ণ করেননি। আপনার যখন নির্দিষ্ট হায়াত
পূর্ণ হবে, তখন আপনি আপনার বাসস্থানে প্রবেশ করবেন’ (বুখারী, বাংলা মিশকাত হা/৪৪১৬)।
এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যারা মিথ্যা কথা বলবে, লোহার সাঁড়াশি দ্বারা তার গাল
চিরে ফেলা হবে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
মিথ্যে সাক্ষ্য ও অপবাদ-এর পরিণামঃ
আল্লাহ তায়ালা মানুষের দুনিয়া
ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিতকরণে দিয়েছেন ইসলামী জীবনবিধান। এ বিধানের মূল লক্ষ্য মানুষকে
সত্যিকারে আল্লাহর বান্দা তৈরি করা। সে জন্য ইসলাম মানুষকে তার জীবনে বেশ কিছু বিধিবিধান
মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে এবং কিছু কাজ থেকে সর্বাবস্থায় বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ
প্রদান করেছে। মানবজীবনে অপরিহার্যভাবে দূরে থাকার ব্যাপারে যে নির্দেশ এসেছে তন্মধ্যে
কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা এবং অপবাদ দেয়া অন্যতম। এ দু‘টিকে কবীরা গুনাহর
এর অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। কোন ইমানদার ব্যক্তি এ ধরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে
না। ইমানদারদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না । আলকুরআনে বলা হয়েছে,
“আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য
হয় না এবং যখন তারা অনর্থক কথা-কর্মের পাশ দিয়ে চলে তখন সসম্মানে চলে যায়।” [সূরা আলফুরকান:৭২]
যুগ যুগ ধরে প্রকৃত ইমানদারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়া হয়েছে। আলকুরআনে
এসেছে,
“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক
নবীর শত্রু করেছি মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে, তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে
অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথার কুমন্ত্রণা দেয় এবং তোমার রব যদি চাইতেন, তবে তারা তা করত
না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তারা যে মিথ্যা রটায়, তা ত্যাগ কর।” [ আনআম ১১২] আজকে আমাদের
সমাজে নানাভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। একজন অপরজনকে ঘায়েল
করার জন্য এ দু‘টি মানবতাবিরোধী কাজ অহরহ চলছে। মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদের মাধ্যমে হয়ত
সাময়িক লাভবান বা আনন্দিত হওয়া যায়, কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণাম দুনিয়াতে যেমনি রয়েছে,
তেমনিভাবে আখেরাতেও রয়েছে কঠিন শাস্তি। এসব থেকে বিরত থাকতে আলকুরআনে নির্দেশ দিয়ে
বলা হয়েছে,
“সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা
থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর।” [সূরা হাজ্জ:৩০]
মানুষের ব্যক্তি ও সামষ্টিক
জীবনে মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়ার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। তাকে জীবনের সকল পর্যায়ে
বিপর্যস্থ ও সমস্যাগ্রস্থ করতে এ দু‘টি পাপই যথেষ্ট- যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবেতিহাসের
পরিক্রমায় এ সত্যটিই বার বার আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে, প্রমাণিত হয়েছে নানাভাবে।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত বহুজাতি জ্ঞান-গরিমা, সম্পদ-সমৃদ্ধি, কৃষ্টি-কালচারে আকাশচুম্বি
সফলতা অর্জন করার পরও এই একটি কারণে তারা সমূলে ধ্বংস হয়েছে। কুরআন কারীমে আদ ও সামূদ
জাতিসহ অনেক জাতিগোষ্ঠীর বিপর্যয় ও ধ্বংসের সংবাদ আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে।
এ পর্যায়ে ইসলামী শরীয়াতের
দৃষ্টিতে মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়ার অপরাধের মাত্রা এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে
কয়েকটি পরিণাম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
(ক) মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান শিরক সমতুল্য গুনাহঃ
শিরক সবচেয়ে বড় ও কঠিন গুনাহ।
আল্লাহ তায়ালা শিরক ছাড়া সব ধরণের গুণাহ ক্ষমা করবেন। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এমন বড় গুনাহের
কাজ, যা শিরকের গুনাহের সমতুল্য। হাদীসে এসেছে,
“একবার রাসূল সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে বসে ছিলেন এ অবস্থায় তিনি সাহাবাদের বললেন, বড় গোনাহ
সম্পর্কে কি আমি তোমাদের বলব? সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ বলুন। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত হল কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা
তথা শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা। অতঃপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা সাক্ষী
দেওয়া (একথা তিনবার বললেন)। [সহীহ বুখারী: ২৬৫৪]।
(খ) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে নাঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে
তার জীবনের মুক্তি ও কল্যাণলাভের সকল পথ চিররুদ্ধ করে দেয়া হয়। দুনিয়ার জীবনে কোন বিচারকাজে
তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না। আখিরাতের জীবনের জন্য তার ভাল কোন আমল আল্লাহর নিকট কবুল
হবে না। এ বিষয়ে রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও
কাজ এবং মুর্খতা পরিত্যাগ করতে পারলনা, তার রোযা রেখে শুধুমাত্র পানাহার বর্জনে আল্লাহর
কোন প্রয়োজন নেই।” [সহীহ বুখারী:৬০৫৭]।
(গ) মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবীরাহ গুনাহঃ
মানবজীবনের দুনিয়ার শান্তি
এবং আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণলাভের জন্য কবীরা গুনাহ পরিত্যাগ করা অপরিহার্য। কেউ যদি
মিথ্যা সাক্ষী দেয় তবে তা হবে কবীরা গুনাহ। তাওবাহ করা ছাড়া তার উপায় নেই। ইচ্ছাকৃত
কবীরাগুনাহকারী ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারে না। হাদীসে এসেছে,
“আনাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে
বর্ণিত। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
করা হলো । উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা তথা শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী
করা, মানুষ হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া।” [সহীহ বুখারী:২৬৫৩]।
(ঘ) মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়া বড় যুলূমঃ
কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য
প্রদান করা ও অপবাদ রটনার মাধ্যমে ব্যক্তির উপর যুলুম করা হয়। আর যুলুমের কারণে সমাজ
ও রাষ্ট্রে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়। এ বিপর্যয় কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির উপর আসে
না, বরং সকেলই এর ভুক্তভুগি হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
মুসলমানদেরকে মজলুমের বদ দু‘আ থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। কারণ
আল্লাহ তায়ালা মজলুমের দু‘আ কখনও ফেরত দেন না। কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর তোমরা ভয় কর ফিতনাকে
যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু যালিমদের উপরই আপতিত হবে না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয়
আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।” [ সূরা আনফাল : ২৫]।
(ঙ) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ও গ্রহণকারী উভয়ে সমান অপরাধীঃ
মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা তার সাক্ষ্য
দেয়ার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছে, আর সে অপরাধ যে গ্রহণ করেছে সেও সমান অপরাধী হিসাবে
বিবেচিত হবে। কারণ মিথ্যা সাক্ষ্য বিচারের নামে প্রতারণার নামান্তর। এখানে সাক্ষ্যদাতা
ও বিচারক উভয়েই প্রতারণা ও জুলুমের দায়ে দোষী বিবেচিত হবে। ইবনে হাজর রা. বলেন,
“মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ও গ্রহণকারী
উভয় সমান অপরাধী ও তারা কাবীরাগুনাহকারী হিসাবে সাব্যস্ত হবে।”
(চ) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ও গ্রহণকারী খেয়ানতকারী হিসাবে অভিযুক্তঃ
একজন মুসলমানের ঈমানের প্রধান
দাবি ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির সকল আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা। যারা বিচার শালিস করে থাকেন
তাদের ওপর এক বিরাট আমানতের দায়িত্ব থাকে। জেনে শুনে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান ও গ্রহণের
মাধ্যমে উভয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে আমানতের খেয়ানত করে থাকে। কেননা কুরআনে এসেছে,
“নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি
যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ
তোমাকে দেখিয়েছেন। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না”। [ সূরা আননিসা:১০৫]
আর খেয়ানতকারীর শাস্তি ভয়াবহ হবে।
(ছ) মিথ্যা অপবাদকারী হতভাগাঃ
মিথ্যা অপবাদকারী সাময়িক
আনন্দ, কোন প্রাচুর্য পেলে বা তার কোন পদোন্নতি হলেও মিথ্যা অপবাদকারীর চেয়ে হতভাগা
আর কেহ নেই। সে দুনিয়াতে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং আখিরাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সকল অপরাধের
বোঝা বহন করবে এবং এক পর্যায়ে নি:স্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আবু হুরায়রা
রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা কি জান গরীব কে? সাহাবীগণ
বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের
মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি
দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত
করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল
নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” [সুনান আততিরমীযি: ২৪১৮]
(জ) বানোয়াট অভিযোগকারীর স্থান জাহান্নামঃ
কেউ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির
বিরুদ্ধে কোন বানোয়াট অভিযোগ আনলে তা অভিযোগকারীর জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
আবু যার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
“যে ব্যক্তি কোন গোষ্ঠীর
বিরুদ্ধে কোন বানোয়াট অভিযোগ আনল, সেযেন নিজেই নিজের স্থান জাহান্নামে করে নিল।” [সহীহ
বুখারী:৩৫০৮]
(ঝ) মিথ্যা রটনাকারীর উপর আল্লাহর গযবঃ
কোন ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে
মিথ্যা কথা বললে সে নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর অন্যের ব্যাপারে বললে সে অনেককে ক্ষতিগ্রস্থ
করে এবং নিজেও তার শিকার হয়। এটি মহাপাপ। তাই মিথ্যা রটনাকারীর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে
গযব অনিবার্য হয়ে যায়। আলকুরআনে বলা হয়েছে,
“নিশ্চয় যারা গো বাছুরকে
(উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ
থেকে গযব ও লাঞ্ছনা। আর এভাবে আমি মিথ্যা রটনাকারীদের প্রতিফল দেই।” [সূরা আলআরাফ:১৫২]
(ঞ) মিথ্যা রটনাকারী ব্যর্থ হয়ঃ
মিথ্যা কখনও সত্যে পরিণত
হয় না। মিথ্যা আরোপ করে সাময়িক সাফল্য পাওয়া গেলেও চূড়ান্তভাবে সফল হওয়া যায় না, মিথ্যা
অপবাদ দিয়ে সাময়িকভাবে কাওকে হেয় করা যায় বা কাওকে পাকড়াও করা যায়। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা
অপবাদ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “আর যে ব্যক্তি মিথ্যা আরোপ করে, সে-ই
ব্যর্থ হয়।” [সূরা তাহা :৬১]।
(ট) অপবাদ ক্ষণস্থায়ীঃ
মানুষের জীবন দুনিয়াতেই শেষ
নয়। আখিরাতের অনন্ত জীবনই মানুষের প্রকৃত বা আসল জীবন। সেখানেই তাকে চিরকাল অবস্থান
করতে হবে। সত্য চিরস্থায়ী। আর অপবাদ সবসময় ক্ষণস্থায়ী, এর স্থায়িত্ব একান্তই সাময়িক।
পরিণতি অত্যস্ত ভয়াবহ। আলকুরআনে বলা হয়েছে,
“দেখ, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজদের উপর, তারা
যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল।” [আনআম : ২৪]
(ঠ) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়ঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য এবং অপবাদ
কোন সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠালাভ করলে সেখানে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা
যায় না। সামাজিক অনুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য।
(ড) সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য এবং অপবাদ
কোন সমাজে ব্যাপকভিত্তি পেলে সেখানের সামাজিক শৃঙ্খলা দ্রুত বিনষ্ট হয়। সমাজের সর্বত্র
অশান্তি বিরাজ করে। পারস্পরিক কলহ বিবাদ বেড়ে যায়। ফলে সমন্বিত কোন কল্যাণকাজের উদ্যোগ
গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। সমাজ ও রাষ্ট্রের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ায় বহি:শত্রুর আক্রমণ সহজতর
হয়।
(ঢ) সামাজিক ঐক্য ও সংহতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য এবং অপবাদ-এর
কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসরতদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতার জন্ম নেয়। ফলে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে
কোন ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।
(ণ) রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়ঃ
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিবাসীরা
যখন পারস্পরিক বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং একে অন্যকে অপবাদ দেয়া শুরু করে, তখন
সেখানে কোন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা আস্থাহীনতা কোন কল্যাণকর
উদ্যোগকেই সফল হতে দেয় না। একে অন্যে কাদা ছোঁড়াছুড়িতে ব্যস্ত থাকে।
ইসলামে বিশ্বাসী সকল মানুষের
জন্য উপরে বর্ণিত অতি গর্হিত এবং সভ্যতা ও মানবতা বিরোধী পাপাচার থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
সমাজ ও রাষ্ট্রে কল্যাণ নিশ্চিতকরণে এই অপরাধমুক্ত হওয়া জরুরী। বিশ্বমানবতাকে অনিবার্য
ধ্বংসের হাত হতে বাঁচানোর একমাত্র রক্ষাকবচ। এটি মানবচরিত্রের সকল ভালগুণাবলী বিনষ্টকারী।
মানবসমাজে শান্তি ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। পক্ষান্তরে পৃথিবীর সকল
বিপর্যয়ের নিয়ামক। মানুষে মানুষে সবধরণের অন্যায় ও জুলুম পরিচালনার মূল কারণ। আজকের
সমাজে যারা মিথ্যা সাক্ষ্য ও অপবাদ দেয়ার মত জঘন্য কাজে সম্পৃক্ত তাদেরকে সতর্ক হওয়া
এবং এ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা অনেক জাতিতে তাদের এ দুটি কুকর্মের কারণে
ধ্বংস করে দিয়েছেন।
আল্লাহতায়ালা বলেন,
“তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, আমি তাদের পূর্বে কত প্রজন্মকে
ধ্বংস করেছি, নিশ্চয় যারা তাদের কাছে ফিরে আসবে না।” [সূরা ইয়াছিন : ৩১] আমরা যারা
এসব অন্যায় কাজ হতে দেখছি তাদেরকেও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য
ও মিথ্যা অপবাদ দেয়ার মত জঘন্য কাজে সম্পৃক্ত তাদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য
সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাবে হবে।
(৩) অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করেঃ
মুনাফিক মুসলমানদের আরেকটি
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদা কিংবা অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করেঃ
প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা বা
ওয়াদা পালন করা মানব জীবনের একটি মহত্তম গুণ। সংসার জীবনে কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে প্রতিশ্রুতি
রক্ষা, ওয়াদা পালন করা কঠিনতম সর্বোত্কৃষ্ট কাজ। সংসার, সমাজ জীবনে যারা এই গুণের
মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন,তারাই মানুষের কাছে আদরণীয়,সম্মানিত ব্যক্তি। মনে
রাখতে হবে অপরের সাথে ওয়াদা করা, প্রতিশ্রুতি দেয়া, শপথ সংকল্প বা বিভিন্ন ধরনের
চুক্তি এবং অঙ্গীকার পালন করা ঈমানের একটি অঙ্গ। যে কোন ধর্মে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি
পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। দুনিয়ার সবাই ওয়াদা পালনকারী ব্যাক্তিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে
থাকে। তাকে সম্মান করে এবং মান্যও করে। ইসলামেও এর ব্যাতিক্রম নয়। ইসলামে ওয়াদার
গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে ইসলামে ভৎসনা করে, এমনকি ওয়াদা ভঙ্গকারীকে
মুনাফিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি হলো:
সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যে মৌখিক বা লিখিত চুক্তি বা অঙ্গীকার
করা। ওয়াদা একটি আরবী শব্দ, “আ’হদ” শব্দ হতে নির্গত। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: অঙ্গীকার,
চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা জঘন্য অপরাধ।
এ কথা জেনেশুনেও আমরা সজ্ঞানে অহরহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছি। প্রতিশ্রুতি দিয়ে
প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা যেন আজকাল আমাদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামি পরিভাষায়: কোনো লোকের
সঙ্গে অপর কোনো ব্যক্তি অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা পালন করার নাম ওয়াদা।
জীবনে প্রতিনিয়ত চলার পথে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি পেয়েও থাকি। ইসলাম এসব প্রতিশ্রুতি
পালন করার জোরালো তাকিদ করেছে। আল্লাহ ওয়াদা পালনকারীকে ভালোবাসেন। প্রতিশ্রুতি পালন
করা আল্লাহর একটা অন্যতম গুন।
আল্লাহ নিজে প্রতিশ্রুতি
পালন সম্পর্কে আল কুরআনে ইরশাদ করেন : স্মরণ রাখিও যে, আল্লাহরই সত্বাধীন রহিয়াছে
যাহা কিছু আসমান সমূহে এবং যমীনে আছে। স্মরণ রাখিও যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কিন্তু
অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে না। (সূরা ইউনুস-৫৫)
আল কুরআনের অন্য এক জায়গায়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : ও মুমিনেরা তোমরা কেন বল যা তোমরা তা করনা? আল্লাহর কাছে
সবচেয়ে ঘৃন্য সে ব্যক্তি, যে নিজে যা বলে কিন্তু সে তা করেনা। (সুরা সফ-২/৩)
প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষমতা
থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালন করতে ধর্মীয় কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে
তা পূরণ করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে
পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা সম্পর্কে অবহিত
করে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন
ও আমানতদারী মানুষের কল্যাণমুখী গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তা সত্যবাদিতার অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ। আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির পরিচয় ও গুণাবলীর কথা
উল্লেখ করে ইরশাদ করেন:
“এবং যারা নিজেদের আমানত
ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে” (সূরা মুমিনুন-৮)
নেক বান্দা ও নেক আমলের আলোচনা
প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
“এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তারা
পূর্ণ করে।” (সূরা বাকারা-১৭৭)
ইসলামে প্রতিশ্রুতি পালন
বাধ্যতামূলক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন :
“এবং তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন
করবে, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪)।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার
সঙ্গে করা ওয়াদা তোমরা পূর্ণ কর। আমিও তোমাদের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ করব। আর আমাকেই
ভয় কর।’ (সূরা বাকারা : ৪০)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা
আল্লাহ এবং পরস্পরের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ কর। আর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কৃত ওয়াদা
ভঙ্গ কর না।’ (সূরা নাহল : ৯১)।
নবী-রসুলরা ছিলেন ওয়াদা রক্ষাকারী
সত্যনিষ্ঠ মহামানব। হজরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ কিতাবে স্মরণ
কর ইসমাইলের কথা। সে ছিল ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ নবী এবং রসুল।’ (সূরা মারয়াম :
৫৪)।
আবদুল্লাহ ইবনে হাসমা (রা.)
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবুওয়তের আগে আমি রসুল (সা.) থেকে কিছু দ্রব্য ক্রয় করি এবং
বলি আপনি এখানে দাঁড়ান আমি টাকা নিয়ে আসছি। বাড়িতে গিয়ে আমি রসুল (সা.)-এর কথা ভুলে
গেলাম। তিন দিন পর মনে হওয়া মাত্রই ওই স্থানে গিয়ে দেখি হুজুর (সা.) দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি আমাকে দেখে শুধু বললেন, তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললে। আমি তিন দিন পর্যন্ত
তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯৬)।
পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে
ওয়াদা রক্ষাকারীর প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত
মোত্তাকীরা যখন ওয়াদা করে, তখন তা রক্ষা করে।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)।
‘হ্যাঁ! কেউ যদি ওয়াদা রক্ষা
করে এবং আল্লাহকে ভয় করে, তবে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ এমন খোদাভিরুদের ভালোবাসেন।’
(সূরা আলে ইমরান : ৭৬)।
ওয়াদা রক্ষা না করা কবিরা
গুনাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়াদা রক্ষা না করার অপরাধে আমি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে
অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত করেছি। আর তাদের অন্তরগুলোকে করে দিয়েছি কঠিন।’ (সূরা মায়েদা
: ১৩।)
‘তিনি তাদের অন্তরে মুনাফিকি
স্থায়ী করে দিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার দিন পর্যন্ত। কারণ তারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত
ওয়াদা রক্ষা করেনি বরং মিথ্যাচার করেছে।’ (সূরা তাওবা : ৭৭)।
জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত
আমরা একে অন্যকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এসব প্রতিশ্রুতি এবং ওয়াদা রক্ষা করা একান্ত
কর্তব্য। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রেও ওয়াদা রক্ষা অপরিহার্য।
এ ব্যাপারে সামন্যতম শৈথিল্য প্রদর্শনও দুনিয়া-আখিরাতে বিপদের কারণ হতে পারে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা
ওয়াদা রক্ষা কর। ওয়াদা রক্ষার ব্যাপারে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল
: ৩৩)।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত,
রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল
অতঃপর তা রক্ষা করল না।’ (মু’জামুল আওসাত : ৩৬৪৮, তারিখে দিমাশক : ৫৬১১৯)।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে
বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমীরের (শাসকের) আনুগত্যের
অবাধ্য হলো এবং মুসলিম জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, এমতাবস্থায় সে মারা গেলে তার
মৃত্যু জাহিলিয়্যাত যুগের উপর হবে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকার নিচে যুদ্ধ করে যার হক
বা বাতিল হওয়া সম্পর্কে অজানা; বরং সে যেন দলীয় ক্রোধের বশীভূত হয়ে অথবা দলীয় স্বার্থ
রক্ষায় লোকেদেরকে আহবান করে কিংবা দলীয় প্রেরণায় মদদ জোগায়। এমতাবস্থায় সে মারা গেলে
জাহিলিয়্যাতের উপরই মৃত্যুবরণ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মাতের বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন
করল এবং ভালো-মন্দ সকলকে নির্বিচারে আক্রমণ করতে লাগল। এমনকি তাত্থেকে আমার উম্মাতের
কোনো মু’মিনেরও পরোয়া করল না এবং আশ্রিত তথা নিরাপত্তায় অধিকারী ব্যক্তির সাথে যে অঙ্গীকার
রয়েছে, তার চুক্তিও পূরণ করল না, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তার সাথে আমার
কোনই সম্পর্ক নেই।
সহীহ : মুসলিম ১৮৪৮, নাসায়ী
৪১১৪, ইবনু মাজাহ ৩৯৪৮, আহমাদ ৮০৬১, সহীহাহ্ ৪৩৩, সহীহ আল জামি‘ ৬২৩৩, মিশকাতুল মাসাবিহ
(মিশকাত), ৩৬৬৯।
অঙ্গীকার ভঙ্গকারীর শাস্তিঃ
অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ
করা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্ব বর্ণনা এসেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ
করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৪)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা
বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১)।
আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর
অঙ্গীকার পূরণ করো।’ (আল-আনআম, আয়াত: ১৫২)।
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন
লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। ’ (সুরা
রাদ, আয়াত: ২০)।
মহান আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ
করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো। ’ (সুরা নাহল, আয়াত:
৯১)।
(ক) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হারাম ও
মুনাফেকিঃ
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার
মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না,
তার মধ্যে দ্বীন নেই। ’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ১৫)।
তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের
নিদর্শন তিনটি: কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে চারটি। চতুর্থটি হলো যখন বিবাদ করে, গালাগাল করে। ’ (বুখারি, মুসলিম,
মিশকাত, ১৭ পৃষ্ঠা)।
হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান
হয়, অঙ্গীকার পূরণের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক আছে। যার ঈমানের ঘাটতি রয়েছে, সেই অঙ্গীকার
ভঙ্গ করে। আর এর ফলে আল্লাহ তাআলা শত্রুদের তাদের ওপর প্রবল ও শক্তিশালী করে দেন।
(খ) আল্লাহ তাআলা তার বিরুদ্ধে
বাদী হবেনঃ
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু
আনহু হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা
করেছেন যে, কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো । এক ব্যক্তি,
যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করলো । আরেক ব্যক্তি, যে কোন আযাদ মানুষকে বিক্রি
করে তার মূল্য ভোগ করলো । আরেক ব্যক্তি, যে কোন মজুর নিয়োগ করে তার হতে পুরো কাজ আদায়
করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না । -[বুখারীঃ ২২২৭]
(গ) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহঃ
মহানবী (সা.) বলেছেন, যে
ব্যক্তি কোনো নেতার আনুগত্যের অঙ্গীকার করে, তার উচিত সাধ্যমতো তার আনুগত্য করা (মুসলিম)।
তাই কাউকে বৈধ কোনো কিছুর প্রতিশ্রুতি দিলে বা অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করা আবশ্যক।
(৪) বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে
গালাগালি দেয়ঃ
মুনাফিকদের আরেকটি অন্যতম
চরিত্র হচ্ছে ঝগড়া বা বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেঃ
অন্যকে গালি দেওয়া বা অশ্রাব্য
ভাষায় কথা বলা কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না। মুমিন তো ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেও
মার্জিত ভাষায়, ভদ্র ও সংযতভাবে শোকজ করে। কিন্তু কিছু মানুষ রাগান্বিত হলে অন্যকে
অশ্লীল ও শ্রুতিকটু বাক্যবাণে নাজেহাল করে। অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে।
আমরা সাধারণত পান থেকে চুন
খসলেই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে বসি। অন্যকে দোষারোপ করি, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল
করি। এ ধরনের কাজ একজন মুমিনের জন্য কখনো শোভা পায় না।
হাদিসে এসেছে-
আব্দুল্লাহ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি ভর্ৎসনাকারী, অভিসম্পাৎকারী,
অশ্লীল গালমন্দকারী ও নির্লজ্জ হতে পারে না’ (তিরমিযী, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৪৮৪৭;
বাংলা মিশকাত হা/৪৬৩৪, সনদ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যকে
গালি দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। আর তা যদি হয় বিনা অপরাধে, তাহলে তা আরো জঘন্য অপরাধ। পবিত্র
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা
অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৮)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ
করেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি [আল্লাহর অবাধ্য আচরণ] এবং তার সঙ্গে লড়াই ঝগড়া
করা কুফরি’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৪৫, ৭০৭৬; তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৩)। তাই আমাদের উচিত
মানুষের সঙ্গে মার্জিত ভাষায় কথা বলা, ঝগড়া এড়িয়ে চলা। কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও নিজেকে
সংযত রাখা। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাগিবতণ্ডায় লিপ্ত হলে তা লড়াই ঝগড়ায় গড়ানো স্বাভাবিক।
কিন্তু হাদিসে এ ধরনের ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে।
অনেকে আবার সাধারণ বিষয়েও
মা-বাবা তুলে গালি দিয়ে বসে। কিছু কিছু পেশায় এ ধরনের শব্দ ব্যবহার না করলে নাকি অধস্তনদের
কন্ট্রোলে রাখা যায় না। তারা তাদের অধীনদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলার সময়ও সঙ্গে কিছু
অশ্লীল গালি জুড়ে দেয়। অথচ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে গালি দেওয়া জঘন্য অপরাধ।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের মা-বাবাকে অভিশাপ করা।’
জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের মা-বাবাকে কিভাবে অভিশাপ করে?’ তিনি
বললেন, ‘যখন সে অন্যের বাবাকে গালাগাল করে, তখন সে নিজের বাবাকেও গালাগাল করে থাকে।
আর যে অন্যের মাকে গালি দেয়, বিনিময়ে সে তার মাকেও গালি দেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৭৩,
তিরমিজি, হাদিস : ১৯০২)।
আমাদের উচিত কারো সঙ্গে এমন
ব্যবহার করে ফেললে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। কারণ মানুষের সঙ্গে অশোভনীয় আচরণ করা
ও তার সম্মানহানি করা জুলুম। কঠিন কেয়ামতের দিন ক্ষুদ্র একটি জুলুমও মানুষকে জাহান্নামের
দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন,
‘যে ব্যক্তি তার (কোনো মুসলিম) ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করেছে অথবা কোনো বিষয়ে জুলুম করেছে,
সে যেন আজই (দুনিয়াতে) তার কাছে (ক্ষমা চেয়ে) হালাল করে নেয়—ওই দিন আসার আগে, যেদিন
দিনার ও দিরহাম কিছুই থাকবে না। তার যদি কোনো নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুমের পরিমাণ
অনুযায়ী তা থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি তার কোনো নেকি না থাকে, তবে তার সঙ্গীর পাপরাশি
তার (জালেমের) ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস:
৯৩৩২)।
তাই আমাদের সবার উচিত এ ধরনের
অশ্লীল কাজ ত্যাগ করে মহান আল্লাহর দরবারে তওবা করা। মানুষকে সম্মান করা। সে যে-ই হোক,
ছোট হোক কিংবা বড়। সবার সঙ্গেই মার্জিত আচরণ করা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সঃ)-কে
গালি দিলে কেউ মুসলিম থাকবে কি?
আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সঃ)-এর
বিরুদ্ধে কোন কুমন্তব্য করা, গালি প্রয়োগ করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা কটাক্ষ করা বড় কুফরী।
মহান আল্লাহ বলেন,
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে
কষ্ট দেয়, আল্লাহ তো তাদেরকে ইহলোকে ও পরলোকে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক
শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।” (আহযাবঃ ৫৭)।
তিনি আরও বলেন, “তাদের মধ্যে
এমন কতিপয় লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, ‘সে প্রত্যেক কথায় কর্ণপাত ক’রে থাকে।’
তুমি বলে দাও, ‘সে কর্ণপাত তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। সে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনায়ন
করে এবং মু’মিনদের(কথাকে) বিশ্বাস করে। আর সে তোমাদের মধ্যে বিশ্বাসী লোকেদের জন্য
করুণাস্বরূপ। যারা আল্লাহ্র রাসুলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’
(তাওবাহঃ ৬১)
মা-বাবা তুলে গালাগাল জঘন্য গুনাহঃ
গালাগাল বা শব্দবোমা, যে
নামেই ব্যাখ্যা করি, এটি মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু কিছু কিছু পরিবেশে এটিকে মন্দ
ভাবা হয় না। যেমন, কর্মচারীদের কন্ট্রোলে রাখার জন্য নাকি গালি দিতেই হয়। এমন অনেক
ডিমার্টমেন্ট আছে, যেখানে গালি দেওয়া ছাড়া কথাই যেন পূর্ণ হয় না।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো,
তারা যে অশ্লীল গালিগুলো দেয়, তার বেশির ভাগই হয় মা-বাবা তুলে। যা কোনোভাবেই কাম্য
নয়। কিন্তু তাদের পরিভাষায় এটা নাকি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কাছের বন্ধুকে, বিশ্বস্ত
কর্মচারীকে তাঁরা এ ধরনের গালি দেওয়া ছাড়া কথাই বলতে পারেন না।
আবদুল্লাহ
ইবনু ‘আম্র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো নিজের পিতা-মাতাকে
লা’নত করা। জিজ্ঞেস করা হলো: হে আল্লাহ্র রসূল! আপন পিতা-মাতাকে কোন লোক কীভাবে লা’নত
করতে পারে? তিনি বললেনঃসে অন্যের পিতাকে গালি দেয়, তখন সে তার পিতাকে গালি দেয় এবং
সে অন্যের মাকে গালি দেয়, তখন সে তার মাকে গালি দেয়।[ সহিহ বুখারী, ৫৯৭৩, মুসলিম ১/৩৮,
হাঃ ৯০, আহমাদ ৬৫৪০] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৫)। হাদিসের মানঃ
সহিহ
তাই দুষ্টুমির ছলেও কাউকে
গালি দিয়ে কথা বলা উচিত নয়। কাউকে কন্ট্রোল করার জন্য বাজে ব্যবহার করতে হবে, এটা আমাদের
বানানো নীতি। এটি আমাদের ব্যক্তিত্বকে খাটো করে দেয়। কোনো মুমিন এ ধরনের পথ অবলম্বন
করতে পারে না। কারণ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি। আর তার
সঙ্গে লড়াই, ঝগড়া করা কুফুরি। (বুখারি, হাদিস : ৬০৪৫)।
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,
মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপদাতা, অশ্লীলভাষী ও গালাগালকারী হয় না। (তিরমিজি, হাদিস
: ২০৪৩)।
ইদানীং অনেকে বিকৃত মস্তিষ্কের
এক গায়কের গালি সংবলিত গান নিয়ে ভীষণ ট্রলে মজে আছেন। অনেক সময়, দুষ্টুমির ছলে বিভিন্ন
জায়গায় নিজেরাই এই অশ্লীল গানগুলো গাইতে শুরু করেন। আবার সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও
ছড়িয়ে দেন। এটা জঘন্য অপরাধ। কারণ এর মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তাতে উসকানি
দিচ্ছে ভাইরাল হওয়ার উন্মাদনা নামক একটি ভাইরাস।
যারা এই ধরনের উন্মাদনায়
সমাজে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। পবিত্র কোরআনে
ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা পছন্দ করে যে মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্য
দুনিয়া ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি; আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। (সুরা
: নূর, আয়াত : ১৯)।
তা ছাড়া এভাবে অশ্লীলতা ছড়ানোর
কারণে যত মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হবে, এ ধরনের অশ্লীল গালি শিখবে, গানে গানে তার
চর্চা করবে, সবার গুনাহের সমপরিমাণ অংশ যিনি ছড়িয়েছেন, তার কাঁধে আসবে।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি মানুষকে নেক কাজের দাওয়াত দেবে, সে ওই লোকদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; যারা
তার দাওয়াত পেয়ে নেক কাজ করবে অথচ তাদের সওয়াবের সামান্যও হ্রাস পাবে না। অনুরূপভাবে
যে ব্যক্তি মানুষকে গুনাহের কাজের দাওয়াত দেবে সে ওই লোকদের সমপরিমাণ গুনাহ পাবে, যারা
তার দাওয়াত পেয়ে গুনাহের কাজ করবে। অথচ তাদের গুনাহ হ্রাস পাবে না।’ (মুসলিম, হাদিস
: ৬৯৮০)।
তাই আমাদের উচিত, অশ্লীল
গালাগালসহ সব অশ্লীল জিনিস ত্যাগ করা। মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করা। এবং অশ্লীলতা ছড়ানো
থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন।
কাউকে 'হারামজাদা' বলে গালি দেয়া কবিরা গোনাহঃ
'হারামজাদা' শব্দটি আমাদের
মাঝে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। আমরা অনেকেই হয়তো না জেনে বা দুষ্টুমি করে অপরকে 'হারামজাদা'বলে
ফেলি।
অনেক সময় বাবা মাও ঠাট্টা-মশকারা
করে তার সন্তানের ক্ষেত্রে এ কুৎসিত শব্দটি প্রয়োগ করে ফেলেন।
(ক) কিন্তু যদি জানতাম এটি কত ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক
গালি তাহলে হয়তো কখনোই কাউকে বলতাম না।
(খ) আর বললেও যাকে বলা হত সে সহ্য করে নিতে পারত
না। কারণ,আপনি কি জানেন 'হারামজাদা' মানে কী?
'হারামজাদা'মানে অবৈধ বা
জারজ সন্তান।
যিনা বা ব্যভিচারের মত মারাত্মক
পাপ কাজের ফলে যে সন্তান জন্ম নেয় তাকে ফার্সি ভাষায় 'হারামজাদা' বা অবৈধ সন্তান বলা
হয়।
আফসোস! বর্তমান সমাজে আমরাও
এ নোংরা ও জঘন্য শব্দটি যার তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দিচ্ছি।
অথচ,বাস্তবে কেউ জারজ হলেও
তাকে জারজ বলে গালি দেয়া হারাম।
সুতরাং কেউ যদি প্রকৃতপক্ষে
জারজ না হয়ে থাকে আর আমরা তাকে জারজ বলে গালি দেই তাহলে তো দ্বিগুণ গুনাহ হবে।
(ক) গালি
দেওয়ার গুনাহ এবং
(খ) অপবাদের
গুনাহ।
আর উভয়টাই কবিরা বা মারাত্মক
গুনাহ। তাছাড়া অপরকে গালি দেয়া মানে তার হক নষ্ট করা বা তার মান সম্মানে আঘাত হানা।
আর এ গুনাহ আল্লাহ তা'আলা
ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না ঐ বান্দা ক্ষমা করে। তাই সাবধান।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“আর যারা মুমিন নরনারীদের
কষ্ট দেয় এমন কোনো কাজের জন্য যা তারা করেনি তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।”
[সূরা আহযাব; আয়াত-৫৮]
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
‘মুসলমানকে গালি দেয়া পাপাচার
আর হত্যা করা কুফরি।’ [বুখারী: ৪৮ শামেলা]
হযরত বিলাল (রা:) ছিলেন হাবশী
বংশের। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কালো।একদা আবু যর (রা:) কোনো কারণে তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে
তাকে বলেছিলেন, “হে কালো মহিলার ছেলে"।
তিনি এ কথা সহ্য করতে না
পেরে রাসূল (সা:) এর দরবারে আবু যর (রা:) এর নামে নালিশ করেন।
রাসূল (সা:) ধমক দিয়ে তাঁকে
বললেন,
হে আবু যর! তোমার মাঝে এখনও
জাহেলিয়াতের বর্বরতা রয়ে গেছে [মুসলিম: ৪৪০৩ শামেলা]।
যুগকে গালি দেয়া সম্পর্কে জাহিলদের কথাঃ
আর কালই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস
করে (সূরা জাছিয়া ৪৫:২৪)।
ব্যাখ্যা: নাস্তিকরা(الدهرية) ঘটমান অবস্থাকে যুগের সাথে
সম্পৃক্ত করে। জাহিলদের নিকট কোন বিষয় অপছন্দ হলে তারা সেটাকে যুগের দিকে সম্পৃক্ত
করে। আর পছন্দ না হওয়ার কারণে যুগকে তিরস্কার করে, অথচ সকল বিষয়-বস্তু মহান স্রষ্টার
দিকেই সম্পৃক্ত করা আবশ্যক। আর যুগ হলো সময়, যা মহান আল্লাহর সৃষ্টি সমূহের অন্তর্ভুক্ত।
আর যুগের কোন পরিবর্তন নেই। চলমান অবস্থাকে যারা যুগের সাথে সম্পৃক্ত করে আল্লাহ তা‘আলা
তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন,
আর তারা বলে, ‘দুনিয়ার জীবনই
আমাদের একমাত্র জীবন। আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই। আর কালই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস করে (সূরা
জাছিয়া ৪৫:২৪)।
আর গালির মাধ্যমে আখেরাত
ও পুনরুত্থানকে অস্বীকার হয়। (نَمُوتُ
وَنَحْيَا)
আমরা মরবো ও জীবিত হবো। অর্থাৎ মানুষ মরে ও জীবিত থাকে। আর জাহিলরা বলে, দয়াকে উঠিয়ে
নেয়া হয়েছে আর জমিনকে গ্রাস করা হয়েছে। আর তারা বলে, এটাই জীবনের স্বভাব। (وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ) যুগই আমাদের ধ্বংস করে
দিল। জাহিলরা ধ্বংস হওয়াকে যুগের সাথে সম্পৃক্ত করে তাই দিন-রাত্রির অতিক্রম তাদের
নিকট মৃত্যুর কারণ বলে গণ্য হয়। এখানে কোন নির্দিষ্ট কাল এবং নির্দিষ্ট ফেরেশতাও নেই
যে, যুগের সময় শেষ হলে প্রাণ হরণ করবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগকে
গালি দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
তোমরা যুগকে গালি দিও না।
কেননা আল্লাহ তা‘আলাই যুগ।[1]
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাই যুগের
স্রষ্টা। আর যুগের মাঝে যা কিছু বিরাজমান তা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত। হাদীছে
কুদছিতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়।
তারা যুগকে গালি দেয়; অথচ আমিই যুগ। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা; রাত ও দিন আমিই পরিবর্তন
করি।[2]
আর যুগকে গালি দেয়া হলে মূলতঃ
যুগের স্রষ্টা মহান আল্লাহকেই গালি দেয়া হয়। এভাবেই আদম সন্তান পবিত্র মহান রবকে কষ্ট
দেয়। কেননা, যুগের তিরস্কার আল্লাহর উপর আরোপিত হয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলাই সকল বিষয়ের
পরিবর্তনকারী আর সময়, বিপদাপদ এবং সবকিছু নির্ধারণকারী। যুগ মহান আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্টি।
গালি ও তিরস্কার থেকে বিরত থাকা মুসলিমদের উপর আবশ্যক। মুসলিমরা কোন বিপদের সম্মুখ
হলে তারা নিজেদের ব্যাপারে ভেবে দেখবে আর তাদের পাপকে তারা স্বীকার করে নেবে। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত
আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃত কর্মেরই ফল। আর তোমাদের অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন (সূরা
শুরা ৪২:৩০)। মানুষের উচিত নিজেদেরকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করা, যুগকে নয়।
[1]. ইমাম বুখারী কিতাবুল
আদাবে ছ্বহীহ সূত্রে باب
لا
تسبوا
الدهر
নামক পরিচ্ছেদ বর্ণনা করেছেন। ছ্বহীহ মুসলিম হা/২২৪৬।
[2] . ছ্বহীহ বুখারী হা/
৪৮২৬, ৬১৮১,৭৪৯১ ছ্বহীহ মুসলিম হা/ ২২৪৬।
কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুসারে মুনাফিকদের অন্যান্য চরিত্রসমূহঃ
কুরআনে করীম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের অসংখ্য জায়গায় মুনাফিকদের আলোচনা এসেছে। তাতে তাদের চরিত্র
ও কর্মতৎপরতা আলোচনা করা হয়েছে। আর মুমিনদেরকে তাদের থেকে সতর্ক করা হয়েছে যাতে তাদের
চরিত্র মুমিনরা অবলম্বন না করে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাদের নামে একটি সুরাও নাযিল করেন।
মুনাফিকদের চরিত্র:
(১) রাসুল সাঃ এর নীতি গ্রহণ করতে ইতস্তত করাঃ
‘তাদেরকে যখন বলা হয় যে,
আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেইদিকে এসো ও রাসূলের নীতি গ্রহণ কর, তখন এ মুনাফিকদেরকে আপনি
দেখতে পাবেন যে, তারা আপনার নিকট আসতে ইতস্তত করছে ও পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।’ (নিসা
৬১)।
(২) মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যধিগ্রস্তঃ
মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও
ব্যধিগ্রস্ত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক
এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার
নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে
ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না। তাদের তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি, আর
আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ
আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন। আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা
সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।’ (সূরা: বাকারা,
আয়াত : ৮-১২)।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, সন্দেহ, সংশয় ও প্রবৃত্তির ব্যাধি তাদের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে, ফলে তাদের
অন্তর বা আত্মা ধ্বংস হয়ে গেছে। আর তাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও নিয়তের ওপর খারাপ ও নগ্ন
মানসিকতা প্রাধান্য বিস্তার করছে। ফলে তাদের অন্তর একদম হালাক বা ধ্বংসের উপক্রম। বিজ্ঞ
ডাক্তাররাও এখন তার চিকিৎসা দিতে অক্ষম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে
ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।”
(৩) মুনাফিকদের অন্তরে অধিক লোভ-লালসাঃ
মুনাফিকরা অধিক লোভী হয়ে
থাকে। যার কারণে তারা পার্থিব জগতকে বেশি ভালোবাসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে নবীÑপতিœগণ, তোমরা অন্য
কোনো নারীর মতো নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে
কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা
বলবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩২]।
অর্থাৎ যে ব্যক্তির অন্তরে
ঈমান দুর্বল থাকে, সে তার দুর্বলতার কারণে লোভী হয়ে থাকে। আর সে তার ঈমানের দুর্বলতার
কারণে ইসলাম বিষয়ে সন্দেহ পোষণকারী একজন মুনাফিক। যার ফলে সে আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া
বিধানকে গুরুত্বহীন মনে করে এবং হালকা করে দেখে। আর অন্যায় অশ্লীল কাজ করাকে কোনো অন্যায়
মনে করে না।[১]
(৪) মুনাফিকরা অহংকারী ও দাম্ভিকঃ
মুনাফিকরা কখনই তাদের নিজেদের
দোষত্রুটি নিজেরা দেখতে পায় না। তাই তারা নিজেদের অনেক বড় মনে করে। কারো কোনো উপদেশ
তারা গ্রহণ করে না, তারা মনে করে তাদের চাইতে বড় আর কে হতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা তাদের
অহংকারী স্বভাবের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস,
আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি
তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে।” [সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত: ৫]
এ আয়াতে অভিশপ্ত মুনাফিকদের
বিষয়ে সংবাদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের
জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে,
অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে”।
অর্থাৎ তাদের যা পালন করতে
বলা হলো, অহংকার ও অহমিকা বশত বা নিকৃষ্ট মনে করে তারা তা পালন করা হতে বিরত থাকে।
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তি দিয়ে বলেন,
“তুমি তাদের জন্য ক্ষমা কর
অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই
আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না।” [সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত: ৬]
(৫) মুনাফিকদের চরিত্র হলো, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ
করাঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের
বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলি জানিয়ে দেবে। বল, ‘তোমরা
উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত:
৬৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা
সব সময় এ আশংকা করত যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে যা আছে, তা মুমিনদের নিকট একটি
সূরা নাযিল করে জানিয়ে দিবেন। তাদের এ আশংকার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল
করেন। কারো মতে, আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলের ওপর এ আয়াত নাযিল করেন, কারণ, মুনাফিকরা
যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো দোষ বর্ণনা, তার বা মুসলিমদের কোনো
কর্মের সমালোচনা করত, তখন তারা নিজেরা বলাবলি করত, আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় প্রকাশ
করে না দেয়। তাদের কথার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন, আপনি তাদের ধমক
ও হুমকি দিয়ে বলুন, ﴿ٱسۡتَهۡزِءُوٓاْ
إِنَّ
ٱللَّهَ
مُخۡرِجٞ
مَّا
تَحۡذَرُونَ﴾
“তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ”।
(৬) মুমিনদের সাথে বিদ্রূপঃ
মুনাফিকরা মুমিনদের সাথে
বিদ্রূপ করত। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা মুমিনদের সাথে প্রকাশ করত
যে, তারা ঈমানদার আবার যখন তারা তাদের কাফির বন্ধুদের সাথে মিলিত হত, তখন তারা তাদের
সাথে ছির অন্তরঙ্গ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর যখন তারা মুমিনদের সাথে
মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত
হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের
প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন।” [সূরা
আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৪, ১৫]।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, মুনাফিকদের দু’টি চেহারা: একটি চেহারা দ্বারা তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাত করত,
আর আরেকটি চেহারা দ্বারা তারা তাদের মুনাফিক (কাফের) ভাইদের সাথে সাক্ষাত করত। তাদের
দু’টি মুখ থাকত, একটি দ্বারা তারা মুসলিমদের সাতে মিলিত হত, আর অপর চেহারা তাদের অন্তরে
লুকায়িত গোপন তথ্য সম্পর্কে সংবাদ দিত।
তারা কিতাব ও সুন্নাহ এবং
উভয়ের অনুসারীদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে ফিরে যায় এবং তারা তাদের নিকট যা আছে তার
ওপর সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল কৃত ওহীর বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকে
অস্বীকার করত। তারা মনে করত, তারাই বড় জ্ঞানী। হে রাসূল আপনি তাদের বলে দিন, তাদের
জ্ঞান যতই থাকুক না কেন, তা তাদের কোনো উপকারে আসে না, বরং তা তাদের অন্যায় অনাচারকে
আরো বৃদ্ধি করে। আর আপনি কখনোই তাদের ওহীর প্রতি আনুগত্য করতে দেখবেন না। তাদের আপনি
দেখবেন ওহীর প্রতি বিদ্রূপ কারী। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাদের বিদ্রূপের বদলা
দেবেন। ﴿ٱللَّهُ
يَسۡتَهۡزِئُ
بِهِمۡ
وَيَمُدُّهُمۡ
فِي
طُغۡيَٰنِهِمۡ
يَعۡمَهُونَ﴾
“আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ
দেন।” তারা তাদের কু-কর্মে আনন্দ ভোগ করতে থাকবে।
(৭) মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করা হতে বিরত রাখাঃ
মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর
রাখে খরচ করাকে অনর্থক মনে করে। তাই তারা মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করতে নিষেধ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তারাই বলে, যারা আল্লাহর
রাসূলের কাছে আছে তোমরা তাদের জন্য খরচ করো না, যতক্ষণ না তারা সরে যায়। আর আসমানসমূহ
ও যমিনের ধনÑভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না। [সূরা আল মুনাফিকূন,
আয়াত: ৭]
যায়েদ ইবন আরকাম রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত,
“আমি একদা একটি যুদ্ধে আব্দুল্লাহ
ইবন উবাই কে বলতে শুনি সে বলে, তোমরা মুহাম্মদের আশ পাশে যে সব মুমিনরা রয়েছে, তাদের
জন্য খরচ করো না, যাতে তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়। আর যদি তারা মদিনায় ফিরে আসে তাহলে
মদিনার সম্মানী লোকেরা এ সব নিকৃষ্ট লোকদের বহিষ্কার করবে। আমি বিষয়টি আমার চাচা অথবা
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললে, তারা বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
নিকট আলোচনা করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে আমি
তাকে বিস্তারিত বিষয়টি জানালাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ
ইবন উবাই ও তার সাথীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, তারা শপথ করে বলল, আমরা এ ধরনের কোনো কথা
বলি নাই। তাদের কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা বিশ্বাস করল,
আর আমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরপর আমি এত চিন্তিত হলাম ইতোপূর্বে আর কোনো দিন আমি
এত চিন্তিত হই নাই। আমি লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকতাম। লজ্জায় ঘর থেকে বের হতাম না। তখন
আমার চাচা আমাকে বলল, আমরা কখনো চাইছিলাম না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
তোমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করুক বা তোমাকে অস্বীকার করুক। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত-
“যখন তোমার কাছে মুনফিকরা
আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন
যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যবাদী”
নাযিল করেন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে
এ আয়াত পাঠ করে শোনান এবং বলেন, হে যায়েদ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত
করেন।”
(৮) মুনাফিকদের মূর্খতা ও মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করাঃ
মুনাফিকরা নিজেরা মূর্খ এ
জিনিষটি তাদের চোখে ধরা পড়তো না। কিন্তু তারা মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করত। এ কারণেই
তাদের যখন মুমিনদের ন্যায় ঈমান আনার জন্য বলা হত, তখন তারা বলত, মুমিনরা-তো বুঝে না,
তারা মূর্খ, তাই তারা ঈমান এনেছে। আমরাতো মূর্খ নই, আমরা শিক্ষিত আমরা কেন ঈমান আনব?
আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়ে বলেন,
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়,
‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা
ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না”। [সূরা আল-বাকারা,
আয়াত: ১৩]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, যারা কুরআন ও হাদীসের আনুগত্য করে তারা তাদের নিকট নির্বোধ, বোকা। তাদের জ্ঞান
বুদ্ধি বলতে কিছুই নাই। আর যারা ইসলামী শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চায়
তারা তাদের নিকট সেই গাধার মত যে বোঝা বহন করে। তার কিতাব বা ব্যবসায়ীর মালামাল দ্বারা
তার কোনো লাভ হয় না। সে নিজে কোনো প্রকার উপকার লাভ করতে পারে না। আর যারা আল্লাহর
ওপর ঈমান আনে এবং তার আদেশের আনুগত্য করে তারা হলো, তাদের নিকট নির্বোধ, মূর্খ। তাই
তারা তাদের মজলিশে তার উপস্থিতিকে অপছন্দ করত ও তার দ্বারা তারা তাদের অযাত্রা হতো
বলে বিশ্বাস করত।[২]
(৯) কাফিরদের সাথে তাদের বন্ধুত্বঃ
মুনাফিকরা কাফিরদেরকে তাদের
বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। মুমিনদের তারা কখনোই তাদের বন্ধু বানাত না। তারা মনে করত কাফিরদের
সাথে বন্ধুত্ব করলে তারা ইজ্জত সম্মানের অধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও
যে, নিশ্চয় তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। যারা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে
বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান চায়? অথচ যাবতীয় সম্মান আল্লাহর”।
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৩৮, ১৩৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ
তা‘আলা তার নবীকে বলেন, হে মুহাম্মদ! بَشِّرِ
ٱلۡمُنَٰفِقِينَ
তুমি ঐ সব মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও, যে সব মুনাফিকরা আমার দীন অস্বীকারকারী ও বেঈমানদের
সাথে বন্ধুত্ব করে অর্থাৎ মুমিনদের বাদ দিয়ে তারা কাফিরদের তাদের সহযোগী ও বন্ধুরূপে
গ্রহণ করে, তারা কি আমার ওপর অবিশ্বাসী বেঈমানদের সাথে বন্ধুত্ব করার মাধ্যমে তাদের
নিকট থেকে শক্তি, সামর্থ্য, সম্মান ও সাহায্য তালাশ করে?। তারা কি জানে না? ইজ্জত,
সম্মান, শক্তি সামর্থ্য-তো সবই আল্লাহর জন্য। “তারা কি তাদের কাছে সম্মান চায়?” অর্থাৎ
তারা কি তাদের নিকট ইজ্জত তালাশ করে? আর যারা নিকৃষ্ট ও সংখ্যালঘু কাফিরদের থেকে সম্মান
পাওয়ার আশায় তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কেন মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে না?
তারা যদি মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করত, তাহলে তারা ইজ্জত, সম্মান ও সহযোগিতা আল্লাহর
নিকটই তালাশ করত। কারণ, ইজ্জত সম্মানের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ। যাবতীয় ইজ্জত সম্মান
কেবলই আল্লাহর। আল্লাহ বলেন, “যাবতীয় সম্মান আল্লাহর” তিনি যাকে চান ইজ্জত দেন, আর
যাকে চান বে-ইজ্জত করেন।[৩]
(১০) তারা মুমিনদের পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকেঃ
মুনাফিকরা সব সময় পিছনে থাকত,
কারণ, তারা অপেক্ষা করত, যদি বিজয় মুমিনদের হয়, তাহলে তারা মুমিনদের সাথে মিলে যায়
আর যদি বিজয় কাফিরদের হয়, তখন কাফিরদের পক্ষে চলে যায়। তাদের এ ধরনের অপকর্মের বর্ণনা
দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“যারা তোমাদের ব্যাপারে
(অকল্যাণের) অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয়, তবে তারা
বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে,
‘আমরা কি তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করি নি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করি নি’?
সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ কখনো মুমিনদের বিপক্ষে
কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪১]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ
তা‘আলা বলেন, হে মুমিনগণ! যারা তোমাদের পরিণতি জানার জন্য অপেক্ষা করে। “যদি আল্লাহর
পক্ষ হতে তোমাদের বিজয় হয়।” অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যদি তোমাদের দুশমনদের ওপর তোমাদের
বিজয় দান করে এবং তোমরা গণিমতের মাল লাভ কর, তখন তারা তোমাদের বলবে,আমরা কি তোমাদের
সাথে যুদ্ধ করি নি এবং তোমাদের সাথে লড়াই করি নি? তোমরা আমাদেরকে গণিমতের মাল হতে আমাদের
ভাগ দিয়ে দাও! কারণ, আমরা তোমাদের সাথে যুদ্ধে শরিক ছিলাম। অথচ তারা তাদের সাথে যুদ্ধে
শরিক ছিল না তারা জান প্রাণ চেষ্টা করত পরাজয় যাতে মুমিনদের ললাটে থাকে। আর যদি বিজয়
তোমাদের কাফির দুশমনদের হয়ে থাকে এবং তারা তোমাদের থেকে ধন-সম্পদ লাভ করে, তখন এসব
মুনাফিকরা কাফিরদের গিয়ে বলবে, أَلَمۡ
نَسۡتَحۡوِذۡ
عَلَيۡكُمۡ
আমরা কি তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করি নি? যার ফলে তোমরা মুমিনদের ওপর বিজয় লাভ
করছ! তাদেরকে আমরা তোমাদের ওপর আক্রমণ করা হতে বাধা দিতাম। আর তাদের আমরা বিভিন্নভাবে
অপমান, অপদস্থ করতাম। যার ফলে তারা তোমাদের আক্রমণ করা হতে বিরত থাকে এবং যুদ্ধের ময়দান
থেকে পলায়ন করে। আর এ সুযোগে তোমরা তোমাদের দুশমনদের ওপর বিজয় লাভ কর। আল্লাহ তা‘আলাই
তোমাদের মাঝে ও মুনাফিকদের মাঝে কিয়ামতের দিন ফায়সালা করবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মুমিন
ও মুনাফিকদের মাঝে কিয়ামতের দিন ফায়সালা করবেন। যারা ঈমানদার তাদের আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত
দান করবেন, আর যারা মুনাফিক তাদের তিনি কাফির বন্ধুদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।[৪]
(১১) মুনাফিকদের চরিত্র হলো, আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়া ও ইবাদতে অলসতা করাঃ
মুনাফিকরা তাদের ধারণা অনুযায়ী
আল্লাহকে ধোঁকা দেয় এবং সালাতে তারা অলসতা করে। তাদের সালাত হলো, লোক দেখানো। তারা
আল্লাহর ভয়ে ইবাদত করে না। তারা ইবাদত করে মানুষের ভয়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে
ধোঁকা দেয়। অথচ তিনি তাদের ধোঁকা (-এর জবাব) দান কারী। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায়
তখন অলস-ভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায় এবং তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে।” [সূরা
আন-নিসা, আয়াত: ১৪২]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা
তাদের ধারণা অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দেয়। কারণ, তাদের নিফাকই তাদের জান-মাল
ও ধন-সম্পদকে মুমিনদের হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। মুখে ইসলাম ও ঈমান প্রকাশ করার কারণে,
আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়। অথচ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের
অন্তরে তারা যে কুফুরকে লুকিয়ে রাখছেন তা জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ
করতে না করেন। এর দ্বারা তিনি দুনিয়াতে তাদের সুযোগ দেন। আর যখন কিয়ামতের দিন আসবে,
তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে এর বদলা নিবেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তারা অন্তরে
যে কুফরকে গোপন করত তার বিনিময়ে তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
“আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন অলস-ভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায়” মুনাফিকরা আল্লাহ
তা‘আলা যে সব নেক আমল ও ইবাদত বন্দেগী মুমিনদের ওপর ফরয করেছেন, তার কোনো একটি নেক
আমল মুনাফিকরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে না। কারণ, কীভাবে করবে তারা তো
আখিরাত, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম কোনো কিছুই বিশ্বাস করে না। তারা প্রকাশ্যে যে সব
আমল করে থাকে তা কেবলই নিজেদের রক্ষা করার জন্যই করে থাকে অথবা মুমিনদের থেকে বাঁচার
জন্য করে থাকে। যাতে তারা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে না পারে এবং তাদের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে
নিতে না পারে। তাই তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন অলসতা করে দাঁড়ায়। সালাতে দাঁড়িয়ে তারা
এদিক সেদিক তাকায় এবং নড়াচড়া করে। সালাতে উপস্থিত হয়ে তারা মুমিনদের দেখায় যে, আমরা
তোমাদের অন্তর্ভুক্ত অথচ তারা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, তারা সালাত আদায় করা
যে ফরয বা ওয়াজিব তাতে বিশ্বাস করে না। তাই তাদের সালাত হলো, লোক দেখানো সালাত, আল্লাহকে
সন্তুষ্টি করার সালাত নয়।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী “এবং
তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে।” এখানে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি তারা আল্লাহর
যিকির কম করে বেশি করে না? উত্তরে বলা হবে, এখানে তুমি আয়াতের অর্থ যা বুঝেছ, তা বাস্তবতার
সম্পূর্ণ বিপরীত। আয়াতের অর্থ হলো, তারা একমাত্র লোক দেখানোর জন্যই আল্লাহর যিকির করে,
যাতে তারা তাদের নিজেদের থেকে হত্যা, জেল ও মালামাল ক্রোক করাকে প্রতিহত করতে পারে।
তাদের যিকির আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করা বা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য নয়। এ
কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কম বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, তারা তাদের যিকির দ্বারা আল্লাহর
সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও সাওয়াব লাভ করাকে উদ্দেশ্য বানায়নি। সুতরাং তাদের আমল যতই বেশি
হোক না কেন তা বাস্তবে মরীচিকার মতোই। যা বাহ্যিক দিক দিয়ে দেখতে পানি বলে মনে হয় কিন্তু
বাস্তবে তা পানি নয়।[৫]
(১২) দ্বিমুখী নীতি ও সিদ্ধান্ত হীনতাঃ
মুনাফিকরা দ্বৈতনীতির হয়ে
থাকে। তাদের বাহ্যিক এক রকম আবার ভিতর আরেক রকম। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলে তখন তারা
যেন পাক্কা ঈমানদার, আবার যখন কাফিরদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা কাট্টা কাফির। তাদের
এ দ্বি-মুখী নীতির কারণে তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। সবার কাছেই তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত
হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে বলেন,
“তারা এর মধ্যে দোদুল্যমান,
না এদের দিকে আর না ওদের দিকে। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনো তার জন্য কোনো
পথ পাবে না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪৩]।
অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের দীনের
ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। তারা সঠিকভাবে কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারে না।
তারা বুঝে শুনে মুমিনদের সাথেও নয় আবার না বুঝে কাফিরদের সাথেও নয়; বরং তারা উভয়ের
মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে।[৬]
আব্দুল্লাহ উমার রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“মুনাফিকদের উপমা ছাগলের
পালের মাঝে দড়ি ছাড়া বকরীর মত। একবার এটিকে গুঁতা দেয় আবার এটিকে গুঁতা দেয়।[৭]
ইমাম নববী রহ. বলেন, العائرة শব্দের “সিদ্ধান্তহীন লোক,
সে জানেনা দু’টির কোনোটির পিছু নিবে। আর تعير
“ঘুরাঘুরি করা, ছুটাছুটি করা।[৮] মুনাফিকরাও অনুরূপ। তারা সর্বদা সিদ্ধান্ত হীনতায়
ভুগতে থাকে। তাদের চিন্তা ও পেরেশানির কোনো অন্ত নাই। দুনিয়াতে এটি তাদের জন্য বড় ধরনের
আযাব। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এ ধরনের ‘আযাব থেকে হেফাযত করুন।
(১৩) মুমিনদের ধোঁকা দেওয়াঃ
মুনাফিকরা মনে করে তারা আল্লাহ
তা‘আলা ও মুমিনদের ধোঁকা দিয়ে থাকে, প্রকৃত পক্ষে তারা কাউকেই ধোঁকা দেয় না। তারা নিজেরাই
তাদের নিজেদের ধোঁকা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তারা আল্লাহকে এবং যারা
ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে (বলে মনে করে)। অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে
এবং তারা তা অনুধাবন করে না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: মুনাফিকরা
তাদের রব ও মুমিনদের ধোঁকা দিত। তারা তাদের মুখে প্রকাশ করত যে, আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস
করি, কিন্তু তাদের অন্তরে তারা অবিশ্বাস, অস্বীকার ও সন্দেহ-সংশয়কে গোপন করত, যাতে
তারা তাদের জন্য অবধারিত শাস্তি- হত্যা, বন্দি করা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান ইত্যাদি
হতে মুক্তি পায়। তারা মুখের ঈমান ও স্বীকার করাকে নিজেদের বাঁচার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
করত। অন্যথায় তাদের ওপর ঐ শাস্তি বর্তাবে যা অস্বীকারকারী কাফিরদের ওপর বর্তায়। আর
এটাই হলো, মুমিনদের ও তাদের রবকে ধোঁকা দেওয়া।[৯]
(১৪) গাইরুল্লাহর নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়াঃ
মুনাফিকদের অন্যতম স্বভাব
হলো, তারা বিচার ফায়সালার জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট
যেত না। তারা তাদের কাফির বন্ধুদের নিকট বিচার ফায়সালার জন্য যেত। যাতে তারা তাদের
প্রতিপক্ষকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষম হয়। কারণ, তারা জানতো যদি ন্যায় বিচার
করা হয়, তখন ফায়সালা তাদের বিপক্ষে যাবে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
কখনোই ন্যায় বিচার ও ইনসাফের বাহিরে যেতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তুমি কি তাদেরকে দেখ নি,
যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার ওপর, যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি
এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত
করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আস যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের
দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে।” [সূরা আন-নিসা,
আয়াত: ৬০, ৬১]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, যখন মুনাফিকদের আল্লাহ তা‘আলার সুস্পষ্ট ওহীর বিধান, আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের দিকে বিচার ফায়সালার জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তারা পলায়ন
করে এবং তুমি তাদের দেখতে পাবে, তারা এ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ। আর যখন তুমি তাদের বাস্তবতা
সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তুমি দেখতে পাবে তাদের মধ্যে ও বাস্তবতার মধ্যে বিশাল তফাৎ।
তারা কোনো ভাবেই আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ ওহীর আনুগত্য করে না।[১০]
(১৫) মুমিনদের মাঝে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করাঃ
মুনাফিকরা চেষ্টা করে কীভাবে
মুমিনদের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করা যায়। তারা সব সময় মুমিনদের মাঝে অনৈক্য, মতবিরোধ ও
ইখতেলাফ লাগিয়ে রাখে। তারা একজনের কথা আরেক জনের নিকট গিয়ে বলে। চোগলখোরি করে বেড়ায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“যদি তারা তোমাদের সাথে বের
হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের
মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী,
আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৪৭]
অর্থাৎ যদি তারা তোমাদের
সাথে যুদ্ধে বের হত, তবে তারা তোমাদের ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকারে আসত না। কারণ, তোমাদের
মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত। কারণ, তারা হলো, কাপুরুষ ও অপদস্থ সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে
যুদ্ধ করা ও কাফিরদের মোকাবেলা করার মত কোনো সাহস তাদের নাই। আর তারা তোমাদের মাঝে
ছুটোছুটি করত, একবার এদিক যেত, আবার ওদিক যেত, একজনের কথা আরেক জনের নিকট গিয়ে বলত,
চোগলখোরি করত, বিদ্বেষ চড়াত এবং তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে থাকত যা তোমাদের
জন্য অকল্যাণ ও অশান্তি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনত না। وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ
لَهُمۡۗ
আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে এমন লোক, যারা তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী, অর্থাৎ তাদের আনুগত্যকারী,
তাদের কথাকে পছন্দকারী ও তাদের হিতাকাংখি। যদিও তারা তাদের প্রকৃত অবস্থা ও অবস্থান
সম্পর্কে তারা অবগত নয়। ফলে এ সব অপকর্মের কারণে মুমিনদের মাঝে বড় ধরনের ফ্যাসাদ ও
বিবাদ তৈরি হতে পারে। যা তোমাদের পরাজয়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালান করবে।[১১]
(১৬) মিথ্যে শপথ করা, কাপুরুষতা ও ভীরুতাঃ
মুনাফিকরা অধিক হারে মিথ্যা
শপথ করে। তাদের যখন কোনো অপকর্মের জন্য জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তারা তা সাথে সাথে অস্বীকার
করে এবং তারা তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা শপথ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তারা আল্লাহর কসম করে
যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তারা এমন
কওম যারা ভীত হয়। যদি তারা কোনো আশ্রয়স্থল, বা কোনো গুহা অথবা লুকিয়ে থাকার কোনো প্রবেশস্থল
পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫৬, ৫৭]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ
তা‘আলা এ আয়াতে মুনাফিকদের আকুতি, তাদের হৈ-চৈ ও তৎপরতা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে বলেন,
وَيَحۡلِفُونَ
بِٱللَّهِ
إِنَّهُمۡ
لَمِنكُمۡ
আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন কসম করে বলে যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ বাস্তবতা
হলো, وَمَا
هُم
مِّنكُمۡ
তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং وَلَٰكِنَّهُمۡ
قَوۡمٞ
يَفۡرَقُونَ
তারা হলো এমন এক সম্প্রদায় যারা ভীরু। আর মুমীনরা হলো সাহসী বীর, তারা কখনোই ভয় পায়
না। তাদের ভয়ই তাদেরকে শপথ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
لَوۡ
يَجِدُونَ
مَلۡجَا
যদি তারা কোনো আশ্রয়স্থল, বা مَغَٰرَٰتٍ
কিল্লা পেত যেখানে গিয়ে তারা আত্মরক্ষা করতে পারত, বা مُدَّخَلٗا কোনো পাহাড়ের গুহা
অথবা যমিনে লুকিয়ে থাকার কোনো প্রবেশস্থল বা গর্ত পেত, তবে তারা সেদিকেই দৌড়ে পালাত।
তারা কখনোই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত না। আল্লাহ বলেন, لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ অর্থাৎ তারা তোমাদের
রেখে সে আশ্রয়স্থলের দিকে দৌড়ে পালাত। কারণ, তারা যে তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তা তোমাদের
ভালোবাসায় নয় বরং বাধ্য হয়ে। বাস্তবে তারা চায় যে, যদি তোমাদের সাথে না মিলে থাকতে
পারত! কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনের জন্য আলাদা বিধান থাকে। অর্থাৎ তাদের বিষয়ে
সব কিছু জানার পরও তোমরা যে তাদের সাথে যুদ্ধ কর না বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ
নাও না, তা একটি বৃহত্তর স্বার্থের দিক বিবেচনা ও একটি বিশেষ প্রয়োজনকে সামনে রেখে।
অন্যথায় তাদের অপরাধ কাফির ও মুশরিকদের চেয়েও মারাত্মক। এ কারণে তারা সব সময় দুশ্চিন্তা,
সিদ্ধান্তহীনতা ও পেরেশানিতে থাকে। আর ইসলাম ও মুসলিমরা সব সময় ইজ্জত, সম্মান ও মর্যাদা
নিয়ে বসবাস করে থাকেন। আর যখনই মুসলিমরা খুশি হয়, তা তাদের বিরক্তির কারণ হয়। তারা
সব সময় পছন্দ করে, যাতে তোমাদের সাথে মিলতে না হয়। তাই আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ যদি তারা
কোনো আশ্রয়স্থল, বা কোনো গুহা অথবা লুকিয়ে থাকার কোনো প্রবেশস্থল পেত, তবে তারা সেদিকেই
দৌড়ে পালাত।[১২]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
“আর যখন তুমি তাদের দিকে
তাকিয়ে দেখবে, তখন তাদের শরীর তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে, তুমি তাদের
কথা (আগ্রহ নিয়ে) শুনবে। তারা দেওয়ালে ঠেস দেওয়া কাঠের মতোই। তারা মনে করে প্রতিটি
আওয়াজই তাদের বিরুদ্ধে। এরাই শত্রু, অতএব এদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস
করুন। তারা কীভাবে সত্য থেকে ফিরে যাচ্ছে। [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৪]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, দেহের দিক দিয়ে তারা খুব সুন্দর, মুখের দিক দিয়ে তারা খুব সাহিত্যিক, কথার দিক
দিয়ে তার খুব ভদ্র, অন্তরের দিক দিয়ে তারা সর্বাধিক খবিস নাপাক ও মনের দিক দিয়ে খুবই
দুর্বল। তারা খাড়া কাঠের মত খাড়া করা, যাতে কোনো ফল নাই। গাছগুলোকে জড়ের থেকে উপড়ে
ফেলা হয়েছে, ফলে সে গুলো একটি দালানের সাথে খাড়া করে রাখা হয়েছে, যাতে পথচারীরা পা
পৃষ্ট না করে।[১৩]
(১৭) তারা যা করে নি তার ওপর তাদের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করতঃ
মুনাফিকরা যে কাজ করে না
তার ওপর তাদের কোনো ভৎসনা মানতে রাজি না। এমনটি তারা কাজ না করে সে কাজের প্রশংসা শুনতে
চায়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবান্তর চাহিদার নিন্দা করে বলেন,
“যারা তাদের কৃতকর্মের প্রতি
খুশী হয় এবং যা তারা করে নি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে পছন্দ করে, তুমি তাদেরকে আযাব থেকে
মুক্ত মনে করো না। আর তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত:
১৮৮]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত,
“মুনাফিকদের একটি জামা‘আত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
যখন কোনো যুদ্ধে বের হত, তখন তারা যুদ্ধে যাওয়া হতে বিরত থাকতো। আর তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গিয়ে আত্ম-তৃপ্তিতে ভুগত। আর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যুদ্ধ হতে ফিরে আসতো, তখন তারা তার নিকট গিয়ে মিথ্যা
অজুহাত দাঁড় করিয়ে অপারগতা প্রকাশ করত এবং তারা মিথ্যা শপথ করত। আর তারা পছন্দ করত,
যাতে তারা যে যুদ্ধে যায়নি তার জন্য যেন তাদের প্রশংসা করা হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা
এ আয়াত নাযিল করেন, “যারা তাদের কৃতকর্মের
প্রতি খুশী হয় এবং যা তারা করে নি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে পছন্দ করে...।[১৪]
(১৮) মুনাফিকরা নেক আমলসমূহের দুর্নাম করতঃ
মুনাফিকরা মুসলিমদের ভালো
কাজগুলোকে মানুষের সামনে খারাপ করে তুলে ধরত। যতই ভালো কাজই হোক না কেন তাতে মুনাফিকরা
তাদের স্বার্থ খুঁজত। যদি তাদের স্বার্থ হাসিল হত তখন তারা চুপ থাকতো আর যখন তাদের
হীন স্বার্থ হাসিল না হত তখন তারা বদনাম করা আরম্ভ করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তাদের মধ্যে কেউ আছে,
যে সদকা বিষয়ে তোমাকে দোষারোপ করে। তবে যদি তাদেরকে তা থেকে দেওয়া হয়, তারা সন্তুষ্ট
থাকে, আর যদি তা থেকে দেওয়া না হয়, তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত:
৫৮][১৫]
আয়াতের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, মুনাফিকদের
একটি জামা‘আত আছে, যখন তুমি সদকা বণ্টন কর, তখন তারা সদকা বিষয়ে তোমাকে দোষারোপ করে
অর্থাৎ তোমার ওপর দোষ চাপায় ও তোমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে এবং তুমি যে
বণ্টন করেছ, সে বিষয়ে তারা তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়। মূলত: তারাই দোষী ও মিথ্যুক। তারা
দীনের কারণে কোনো কিছুকে অপছন্দ করে না, তারা অপছন্দ করে নিজেদের স্বার্থের জন্য। এ
কারণে যদি তাদেরকে যাকাত দেওয়া হয়, তারা সন্তুষ্ট থাকে, আর যদি তা থেকে তাদের দেওয়া
না হয়, তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
“যারা দোষারোপ করে সদকার
ব্যাপারে মুমিনদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছা দানকারীদেরকে এবং তাদেরকে যারা তাদের পরিশ্রম
ছাড়া কিছুই পায় না। অতঃপর তারা তাদেরকে নিয়ে উপহাস করে, আল্লাহও তাদেরকে নিয়ে উপহাস
করেন এবং তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭৯]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
“আমাদেরকে যখন সদকা করার
জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো, তখন আমরা বাড়ী থেকে বহন করে সদকার মালামাল নিয়ে আসতাম। সামর্থ্য
অনুযায়ী কেউ বেশি নিয়ে আসত, আবার কেউ কম নিয়ে আসত। আবু আকীল অর্ধ সা নিয়ে আসল আর অপর
এক ব্যক্তি তার চেয়ে কিছু বেশি নিয়ে আসল। তখন মুনাফিকরা বলল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ
সদকার প্রতি মুখাপেক্ষী নন, আর দ্বিতীয় লোকটি যে একটু বেশি নিয়ে আসছে, তার সম্পর্কে
বলল, সে তা কেবলই লোক দেখানোর জন্যই করছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার প্রেক্ষাপটে
এ আয়াত নাযিল করেন- “যারা দোষারোপ করে সদকার ব্যাপারে মুমিনদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছা
দানকারীদেরকে এবং তাদেরকে যারা তাদের পরিশ্রম ছাড়া কিছুই পায় না।”...[১৬]
সব সময় তাদের বাড়াবাড়ি এবং
তাদের অনাচার থেকে কেউ নিরাপদে থাকে না। এমনকি যারা সদকা করে তারাও তাদের অনাচার থেকে
নিরাপদ নয়। যদি তাদের কেউ অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে আসে, তখন তারা বলে, এ তো লোক দেখানোর
জন্য নিয়ে আসছে। আর যদি সামান্য নিয়ে আসে, তখন তারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা তার সদকার প্রতি
মুখাপেক্ষী নয়।[১৭]
(১৯) তারা নিম্নমান ও অপারগ লোকদের প্রতি সন্তুষ্টিঃ
মুনাফিকরা অপারগ মা’জুর লোকদের
সাথে থাকতে পছন্দ করে। যারা ওযরের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারে না, তারা তাদের সাথে
থাকাকে তাদের জন্য নিরাপদ মনে করে। তাই তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
নিকট এসে বিভিন্ন ধরনের ওজর পেশ করে। যাতে তাদের যুদ্ধে যেতে না হয়। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
“আর যখন কোনো সূরা এ মর্মে
নাযিল করা হয় যে, ‘তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর রাসূলের সাথে জিহাদ কর’, তখন
তাদের সামর্থ্য বান লোকেরা তোমার কাছে অনুমতি চায় এবং বলে, ‘আমাদেরকে ছেড়ে দাও, আমরা
বসে থাকা লোকদের সাথে থাকব”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮৬]
আল্লাহ তা‘আলা যারা শক্তি
সামর্থ্য ও সব ধরনের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও জিহাদে শরীক হয় না এবং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে, আল্লাহ তা‘আলা
তাদের নিন্দা ও দোষারোপ করেন। তারা বলে, ‘আমাদেরকে ছেড়ে দাও, আমরা বসে থাকা লোকদের
সাথে থাকব’ তারা তাদের নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করতে কার্পণ্য করে না। সৈন্য দলেরা যুদ্ধে
বের হলেও, তারা নারীদের সাথে ঘরে বসে থাকতেও লজ্জা করে না। যখন যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন
তারা খুবই দুর্বল। আর যখন তারা বেঁচে যায় তখন অতি কথন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্য
এক আয়াতে বলেন,
“তোমাদের ব্যাপারে (সাহায্য
প্রদান ও বিজয় কামনায়) কৃপণতার কারণে। অতঃপর যখন ভীতি আসে তখন তুমি তাদের দেখবে মৃত্যুভয়ে
তারা মূর্ছিত ব্যক্তির ন্যায় চক্ষু উল্টিয়ে তোমার দিকে তাকায়। অতঃপর যখন ভীতি চলে যায়
তখন তারা সম্পদের লোভে কৃপণ হয়ে শাণিত ভাষায় তোমাদের বিদ্ধ করে। এরা ঈমান আনেনি। ফলে
আল্লাহ তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।” [সূরা আল-আহযাব,
আয়াত: ১৯] যুদ্ধের বাইরে তারা অতি কথন করে এবং তাদের গলাবাজির আর অন্ত থাকে না; কিন্তু
যুদ্ধের ময়দানে তার সর্বাধিক দুর্বল ও কাপুরুষ।[১৮]
(২০) মুনাফিকরা খারাপ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করেঃ
মুনাফিকরা মানুষকে খারাপ
ও মন্দ কাজের দিকে আহ্বান করে। ভালো কাজের দিকে ডাকে না। পক্ষান্তরে মুমিনরা তাদের
সম্পূর্ণ বিপরীত, তারা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক
নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের আদেশ দেয়, আর ভাল কাজ থেকে নিষেধ করে, তারা
নিজদের হাতগুলোকে সঙ্কুচিত করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে
ভুলে গিয়েছেন, নিশ্চয় মুনাফিকরা হচ্ছে ফাসিক।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৭]
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের
অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তারা মুমিনদের বিপরীত গুণের অধিকারী। কারণ, মুমিনরা মানুষকে
ভালো কাজের আদেশ দেয়, আর খারাপ কাজ হতে বারণ করে। পক্ষান্তরে মুনাফিকরা খারাপ কাজের
আদেশ দেয় এবং ভালো কাজ হতে নিষেধ করে। আর আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা হতে তারা তাদের
হাত-দ্বয় গুটিয়ে রাখে। তারা আল্লাহর স্মরণকে ভুলে যায়, আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে সে
ব্যক্তির আচরণ করেন, যে তাদের ভুলে যান। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন, তাদের
বলা হবে আজকের দিন আমরা তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমনটি তোমরা আজকের দিনের সাক্ষাতের দিনটি
ভুলে গিয়েছিলে, নিশ্চয় মুনাফিকরা হলো, সত্যের পথ হতে বিচ্যুত, আর গোমরাহীর পথে পরিবেষ্টিত।[১৯]
(২১) জিহাদকে অপছন্দ করা ও জিহাদ হতে বিরত থাকাঃ
মুনাফিকরা জিহাদকে অপছন্দ
করে। তারা কখনোই আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে চায় না। এ কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে জিহাদ
হতে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“পিছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর
রাসূলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে খুশি হলো, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না। বল, ‘জাহান্নামের
আগুন অধিকতর গরম, যদি তারা বুঝত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮১]
তাবুকের যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সাথে যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি সে সব মুনাফিকদের
সমালোচনা করে বলেন, তারা তাদের গৃহাভ্যন্তরে বসে থাকাকে পছন্দ করে এবং আর আল্লাহর রাস্তায়
জান মাল দিয়ে জিহাদ করতে অপছন্দ করে। আর তারা একে অপরকে বলে, ﴿لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ﴾ তোমরা গরমের মধ্যে
বের হয়ো না। অর্থাৎ তাবুকের যুদ্ধের অভিযান ছিল উত্তপ্ত গরমের মৌসুমে এবং ফসল কাটার
উপযুক্ত সময়। এ কারণেই মুনাফিকরা বলে তোমরা গরমের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ো না। আল্লাহ
তা‘আলা তার স্বীয় রাসূল কে বলেন, আপনি তাদের বলুন, “তোমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশের বিরোধিতা করার মাধ্যমে জাহান্নামের যে পরিণতির দিকে যাচ্ছ,
তা দুনিয়ার এ গরমের চেয়ে আরো বেশি উত্তপ্ত। যদি তোমরা বুঝতে পারতে”।[২০]
সুতরাং তোমাদের জন্য জাহান্নামের
আগুনের চেয়ে দুনিয়ার গরম অনেক সহনীয়। কিন্তু তোমরা এখন তা বুঝতে পারছ না।
(২২) অপমান ও অপদস্থের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়াঃ
মুনাফিকরা যুদ্ধ হতে বিরত থাকার জন্য অপমানিত হবে
তবুও তারা যুদ্ধে যাবে না। তাদের নিকট মান-সম্মান ও ইজ্জতের কোনো দাম নাই। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
“আর স্মরণ কর, যখন মুনাফিকরা
ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা বলছিল, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন
তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যখন তাদের একদল বলেছিল, “হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তোমাদের
কোনো স্থান নেই, তাই তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল নবীর কাছে অনুমতি চেয়ে বলছিল, আমাদের
বাড়িÑঘর অরক্ষিত, অথচ সেগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।”
[সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ১২, ১৩]
(২৩) মুমিনদের থেকে পিছে হটাঃ
মুনাফিকদের চরিত্র হলো, তারা
সব সময় পিছু হটে থাকে। তারা কোনো ভালো কাজের পিছনে থাকে। সালাতে তারা সবার পিছনে আসে
এবং পিছনের কাতারে দাঁড়ায়। রাসূল সা. এর তালীমের মজলিশে তারা পিছনে থাকে। জিহাদে বের
হলে তারা মুমিনদের পিছনে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ
এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে। সুতরাং তোমাদের কোনো বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ
আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত:
৭২]
আয়াতের ব্যাখ্যা: এ আয়াতে
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের গুণাগুণ ও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন, আল্লাহ
তা‘আলা তাদের মুমিন বলে সম্বোধন করেন এবং বলেন, হে মুমিনগণ! কিছু লোক আছে যারা তোমাদের
অন্তর্ভুক্ত ও তোমাদের সম্প্রদায়ের। আর তারা তোমাদেরই সাদৃশ্য। তারা মানুষের মধ্যে
প্রকাশ করে যে, আমরা তোমাদের দাওয়াত ও ধর্মের অনুসারী অথচ তারা এ দাওয়াত ও ইসলাম ধর্মের
অনুসারী নয়, সত্যিকার অর্থে তারা হলো মুনাফিক। যার ফলে তোমাদের শত্রুদের সাথে জিহাদ
ও তাদের সাথে লড়াই করতে তারা বিলম্ব করে। তোমরা মুমিনগণ ঘর থেকে বের হলেও তারা ঘর থেকে
বের হয় না। فَإِنۡ
أَصَٰبَتۡكُم
مُّصِيبَة
যদি তোমাদের কোনো মুসীবত তথা পরাজয় নেমে আসে অথবা তোমাদের কেউ আহত বা শহীদ হয়, তখন
তারা বলে, আল্লাহ আমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না। কারণ,
যদি আমি তাদের সাথে উপস্থিত থাকতাম, তবে আমিও আক্রান্ত হতাম; আহত বা নিহত হতাম। তারা
যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকাতে খুশি ও আনন্দ যোগায়। কারণ, সে তো মুনাফিক। আল্লাহর
রাস্তায় আক্রান্ত হলে বা শহীদ হলে যে সব সাওয়াব ও বিনিময়ের ঘোষণা আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন
সে বিষয়ে সে বিশ্বাস করে না, বরং সন্দেহ পোষণকারী। সে কখনোই সাওয়াবের আশা করে না এবং
আল্লাহর আযাবকে ভয় করে না।[২১]
(২৪) জিহাদ থেকে বিরত থাকতে অনুমতি চাওয়াঃ
মুনাফিকরা জিহাদে অংশ গ্রহণ
করাকে অপছন্দ করে। তার জন্য তারা রাসূল সা. এর দরবারে এসে বিভিন্ন ধরনের অহেতুক অজুহাত
দাড় করায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ
বলে, ‘আমাকে অনুমতি দিন এবং আমাকে ফিতনায় ফেলবেন না’। শুনে রাখ, তারা ফিতনাতেই পড়ে
আছে। আর নিশ্চয় জাহান্নাম কাফিরদের বেষ্টনকারী।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৪৯]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আর মুনাফিকদের
মধ্যে থেকে কেউ কেউ তোমাকে বলবে হে মুহাম্মদ! ‘আমাকে ঘরে বসে থাকতে অনুমতি দিন আমি
যুদ্ধে তোমাদের সাথে শরিক হবো না। তুমি যদি আমাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য কর, আমি আমার বিষয়ে
আশংকা করছি যে, রুমের সুন্দর সুন্দর রমণীদের কারণে আমি ফিতনায় আক্রান্ত হতে পারি। সুতরাং
তুমি আমাকে ফিতনায় ফেলবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
শুনে রাখ, তারা তাদের এ কথার কারণেই ফিতনাতেই পড়ে আছে।[২২]
(২৫) জিহাদে না গিয়ে বিভিন্ন ওজুহাত দাঁড় করানোঃ
রাসূল সা. যখন জিহাদ থেকে
ফিরে আসতো, তখন মুনাফিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বিভিন্ন
ধরনের অজুহাত দাঁড় করান এবং নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
“তারা তোমাদের নিকট ওযর পেশ
করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাবে। বল, ‘তোমরা ওযর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো
বিশ্বাস করব না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তোমাদের
আমল দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের
পরিজ্ঞাতার নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে”।
[সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৯৪]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ
তা‘আলা মুনাফিকদের বিষয়ে সংবাদ দেন যে, তারা যখন মদিনা ফিরে আসবে তখন তারা তোমাদের
নিকট ওজর পেশ করবে। আল্লাহ বলেন, বল, ‘তোমরা
ওজর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর ও
অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ দেখবেন এবং
তাঁর রাসূলও। অর্থাৎ তোমাদের আমলসমূহ আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের সম্মুখে প্রকাশ
করে দেবেন। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের পরিজ্ঞাতার নিকট।فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ অতঃপর তিনি তোমাদেরকে
জানিয়ে দেবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে’। অর্থাৎ তোমাদের খারাপ আমল ও ভালো আমল
সম্পর্কে অবগত করবে আর তোমাদের তার ওপর বিনিময় দিবেন।[২৩]
(২৬) মানুষের থেকে আত্ম-গোপন করাঃ
মুনাফিকরা মাথা লুকাত এবং
নিজেদের সব সময় আড়াল করে রাখতো। কারণ, তাদের মনে সব সময় আতংক থাকতো। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
“তারা মানুষের কাছ থেকে লুকাতে
চায়, আর আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে চায় না। অথচ তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে
এমন কথার পরিকল্পনা করে যা তিনি পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন
করে আছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৮]
আয়াতের ব্যাখ্যা: আল্লাহ
তা‘আলা মুনাফিকদের আমলের নিন্দা করে বলেন, তারা তাদের খারাপীগুলো মানুষের থেকে গোপন
করে, যাতে তারা তাদের খারাপ না বলে, অথচ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের চরিত্রগুলো প্রকাশ করে
দেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোপন বিষয় ও তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে কি আছে, সে সম্পর্কে
জানেন। এ কারণেই তিনি বলেন, অথচ তিনি তাদের সাথেই থাকেন যখন তারা রাতে এমন কথার পরিকল্পনা
করে যা তিনি পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তারা যা করে তা পরিবেষ্টন করে আছেন। এটি তাদের
হুমকি ও ধমক আল্লাহর পক্ষ হতে।[২৪]
(২৭) মুমিনদের মুসিবতে খুশি হওয়াঃ
মুমিনরা যখন কোনো মুসীবতে
পতিত হয়, তখন মুনাফিকরা খুব খুশি হয়। তারা সব সময় মুমিনদের ক্ষতি কামনা করে এবং তাদের
মুসিবতের অপেক্ষায় থাকে। কারণ, তারা তাদের অন্তরে মুমিনদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের
ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি
করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ
পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য
আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাস
এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা
তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত
হয়, তোমাদের ওপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ
অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত। যদি তোমাদেরকে কোনো কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন
তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়। আর যদি তোমরা
ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না।
নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৮-১২০]।
আয়াতের সারমর্ম: আল্লাহ তা‘আলা
তার মুমিন বান্দাদেরকে মুনাফিকদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। অর্থাৎ
আল্লাহ মুনাফিকদের অন্তরে কি আছে এবং তারা তাদের শত্রুদের জন্য কি গোপন করেন, তা জানিয়ে
দেন। মুনাফিকরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী কখনোই মুমিনদের বন্ধু বানাবে না। তারা সব সময় তাদের
বিরোধিতা ও ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। মুমিনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকবে। আর তারা
মুমিনদের কষ্টের কারণ হয় বা তাদের কোন মুসিবত হয় এমন কাজই করতে থাকবে।[২৫]
(২৮) যখন আমানত রাখা হয় খিয়ানত করে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, আর যখন প্রতিশ্রুতি
দেয়, তা ভঙ্গ করে আর যখন ঝগড়া করে অকাট্য ভাষায় গাল-মন্দ করেঃ
মুনাফিকদের কিছু মৌলিক গুণ
আছে, যেগুলো একটি সমাজ, দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এ সব গুণগুলো থেকে বেঁচে
থাকা আমাদের সকলের জন্য একান্ত অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তাদের মধ্যে কতক আল্লাহর
সাথে অঙ্গীকার করে যে, যদি আল্লাহ তার স্বীয় অনুগ্রহে আমাদের দান করেন, আমরা অবশ্যই
দান-খয়রাত করব এবং অবশ্যই আমরা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে তাঁর
অনুগ্রহ দান করলেন, তারা তাতে কার্পণ্য করল এবং বিমুখ হয়ে ফিরে গেল। সুতরাং, পরিণামে
তিনি তাদের অন্তরে নিফাক রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে,
তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে।”
[সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭৫-৭৭]
আয়াতের সারমর্ম: আয়াতে আল্লাহ
তা‘আলা বলেন, মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, যদি আল্লাহ তা‘আলা তার
করুণা দ্বারা তাদের ধন-সম্পদ ও অর্থ বিত্ত দান করেন, তবে সে আল্লাহর রাহে খরচ করবে।
আর সে নেককার লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের যখন ধন-সম্পদ দেওয়া হলো, তারা
তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। তারা যে সদকা করার দাবি করছিল তা পূরণ করে নি। আল্লাহ
তা‘আলা তাদের এ অপকর্মের শাস্তি স্বরূপ তাদের অন্তরে নিফাক ঢেলে দেন। যেদিন তারা আল্লাহর
সাথে সাক্ষাত করবে অর্থাৎ কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তা তাদের অন্তরে স্থায়ী হবে। আমরা আল্লাহর
নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি এ ধরনের নিফাক হতে।[২৬]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন
আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন
নয়। তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে (বলে মনে করে) অথচ তারা
নিজেদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, মুনাফিকদের বড় পুঁজি হলো, ধোঁকা দেওয়া ও প্রতারণা করা। তাদের সম্পদ হলো, মিথ্যা
ও খিয়ানত। তাদের মধ্যে দুনিয়ার জীবনের ওপর যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। উভয় দল, তাদের প্রতি
সন্তুষ্ট এবং তারা নিরাপদ। “তারা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোঁকা দেয় এবং যারা আল্লাহর ওপর ঈমান
আনছে তাদের ধোঁকা দেয়, মূলতঃ তারা তাদের নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয় কিন্তু তারা তা অনুধাবন
করে না।”[২৭]
আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“চারটি গুণ যার মধ্যে একত্র
হবে, সে সত্যিকার মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ তিনটি গুনের যে কোনো একটি থাকবে সে যতদিন
পর্যন্ত তা পরিহার না করবে তার মধ্যে নেফাকের একটি গুণ অবশিষ্ট থাকল। যখন কথা বলে মিথ্যা
বলে। আর যখন কোনো বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা লঙ্ঘন করে, আর যখন ওয়াদা করে তা খিলাফ
করে, যখন ঝগড়া-বিবাদ করে, সে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করে।[২৮]
ইমাম নববী রহ. বলেন, এক দল
আলেম এ হাদীসটিকে জটিল বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, এখানে যে কটি গুণের কথা বলা হয়েছে,
তা একজন সত্যিকার মুসলিম যার মধ্যে কোনো সন্দেহ বা সংশয় নাই তার মধ্যেও পাওয়া যেতে
পারে। যেমন, ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের ভাইদের মধ্যেও এ ধরনের গুণ পাওয়া গিয়েছিল। অনুরূপভাবে
আমাদের আলেম, ওলামা, পূর্বসূরি ও মনীষীদের মধ্য হতে অনেকের মধ্যে এসব গুণ বা এর কোনো
একটি পাওয়া যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তাই বলে তারাতো মুনাফিক নয়। এর সমাধানে ইমাম নববী
বলেন, আলহামদু লিল্লাহ এ হাদীসে তেমন কোনো অসুবিধা নাই। তবে আলেমগণ হাদীসের বিভিন্ন
অর্থ বর্ণনা করেন, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আলেমগণ যা বলেছেন, তা হলো, মূলতঃ এ চরিত্রগুলো
হলো, নেফাকের চরিত্র। যাদের মধ্যে এ সব চরিত্র থাকবে সে মুনাফিকদের সাদৃশ্য হবে, তাদের
চরিত্রে চরিত্রবান হবে। কারণ, নিফাক হলো, তার ভিতরে যা আছে, তার বিপরীতটিকে প্রকাশ
করা। যার মধ্যে উল্লেখিত চরিত্র গুলো পাওয়া যাবে, তার ক্ষেত্রে নেফাকের অর্থটিও প্রযোজ্য।
সে যাকে ওয়াদা দিয়েছে, যার সাথে মিথ্যা কথা বলছে, যার আমানতের খিয়ানত করছে এবং যার
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে, তার ব্যাপারে সে অবশ্যই মুনাফেকি করছে। তার সাথে সে অবশ্যই
বাস্তবতাকে গোপন করছে। এ অর্থে লোকটি অবশ্যই মুনাফিক। কিন্তু সে ইসলামের ক্ষেত্রে মুনাফিক
নয় যে, মুখে ইসলাম প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরকে লালন করল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তার বাণী দ্বারা এ কথা বলেননি যে, সে খাঁটি মুনাফিক ও চির জাহান্নামী হবে
এবং জাহান্নামের নিম্নস্তরে তার অবস্থান হবে। এ অর্থটিই বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ
আমাদের বোঝার তাওফীক দান করুন।
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের বাণী:
“সে খালেস মুনাফিক” এ কথার
অর্থ হলো, এ চরিত্রগুলোর কারণে লোকটি মুনাফিকদের সাথে অধিক সাদৃশ্য রাখে। আবার আরো
কতক আলেম বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী ঐ লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
যার মধ্যে এ চরিত্রগুলো প্রাধান্য বিস্তার করছে। আর যার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে
নি তবে মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়, সে এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত নয়। মুহাদ্দিসগণ হাদীসের এ
অর্থটিকেই গ্রহণ করেছেন।[২৯]
(২৯) সময় মত সালাত আদায় না করাঃ
মুনাফিকরা সময় মত সালাত আদায়
করে না। জামা‘আতে ঠিক মত হাজির হয় না। তারা সালাতের জামা‘আত কায়েম হওয়ার শেষ সময় আসে
আবার সর্বাগ্রে চলে যায়।
আলা ইবন আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত,
“একদিন তিনি বছরায় আনাস ইবন
মালেকের বাড়ীতে প্রবেশ করেন। আর আনাস ইবন মালেক তখন যোহরের সালাত আদায় করে বাড়ীতে ফিরেন।
তার ঘর ছিল মসজিদের একেবারে পাশেই। আলা ইবন আব্দুর রহমান বলেন, আমরা তার নিকট প্রবেশ
করলে, তিনি আমাদের বলেন, তোমরা কি আসরের সালাত আদায় করছ? আমরা তাকে বললাম, আমরাতো কেবল
যোহরের সালাত আদায় করে ফিরলাম। তখন তিনি বললেন, তাহলে তোমরা আসরের সালাত আদায় কর। তারপর
আমরা দাঁড়ালাম এবং আসরের সালাত আদায় করলাম। আমরা সালাতের সালাম ফিরাইলে তিনি বলেন,
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি মুনাফিকদের সালাত হলো, তারা
বসে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর সূর্য যখন শয়তানের দু’টি শিংয়ের মাঝে অবস্থান
করে, তখন তারা তাড়াহুড়া করে সালাতে দাঁড়ায়, কাকের ঠোকরের মতো চার রাকাত সালাত আদায়
করে, তাতে আল্লাহর যিকির বা স্মরণ খুব কমই করা হয়ে থাকে।[৩০]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, তারা সালাতকে প্রথম ওয়াক্তে আদায় করে না। সালাতকে একদম শেষ ওয়াক্তে নিয়ে যায়,
যখন সালাতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তারা ফজর আদায় করে সূর্য উদয়ের সময়, আসর
আদায় করে সূর্যাস্তের সময়। আর তারা সালাত আদায় করে কাকের ঠোকরের মত করে। তাদের সালাত
হলো, দেহের সালাত, তাদের সালাত অন্তরের সালাত নয়। তারা সালাতের মধ্যে শিয়ালের মত এদিক
সেদিক তাকায়।[৩১]
(৩০) জামা‘আতে সালাত আদায় করা হতে বিরত থাকাঃ
মুনাফিকরা জামা‘আতে সালাত
আদায় হতে বিরত থাকে। তাদের নিকট জামা‘আতে সালাত আদায় করা অতীব কঠিন কাজ। তাই মুমীনদের
উচিত, তারা যেন জামা‘আতে সালাত আদায় করবে।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে,
কিয়ামতের দিন সে একজন মুসলিম হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে, সে যেন পাঁচ ওয়াক্ত
সালাতসমূহের জন্য আহ্বান করা হলে, তা যথাযথ সংরক্ষণ করে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের
নবীর জন্য হেদায়েতের বিধান চালু করেন। আর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হলো, হিদায়েতেরই বিধান।
তোমরা যদি তোমাদের সালাতসমূহকে ঘরে আদায় কর, যেমনটি এ পশ্চাৎপদ লোকটি করে থাকে, তবে
তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নতকে ছেড়ে দিলে। আর যখন তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাতকে ছেড়ে
দেবে তখন তোমরা গোমরাহ ও ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে কোনো ব্যক্তিই হোক না কেন, সে যখন ভালোভাবে
অযু করবে, তারপর মসজিদসমূহ থেকে কোনো একটি মসজিদের দিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা করে, আল্লাহ
তা‘আলা তার প্রতিটি কদমে কদমে নেকি লিপিবদ্ধ করেন, তার মর্যাদাকে এক ধাপ করে বৃদ্ধি
করেন এবং একটি করে গুনাহ ক্ষমা করেন। আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
যুগে দেখেছি একমাত্র প্রসিদ্ধ মুনাফিক ছাড়া আর কেউ সালাত হতে বিরত থাকতো না। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমরা আরো দেখেছি, এক লোককে দুইজন মানুষের কাঁধে
ভর করে সালাতের কাতারে উপস্থিত করা হত।[৩২]
আল্লামা সুমনি রহ. বলেন,
এখানে মুনাফিক দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ মুনাফিক নয় যারা কুফুরকে গোপন করে এবং ইসলাম প্রকাশ
করে। যদি তাই হয়, তাহলে জামা‘আতে সালাত আদায় করা ফরয হয়ে যাবে। কারণ, যে কুফুরকে গোপন
করে সে অবশ্যই কাফির।”[৩৩]
(৩১) অশ্লীল কথা বলা ও বেশি কথা বলাঃ
মুনাফিকদের স্বভাব হলো, তারা
কথায় কথায় মানুষকে গালি দেয়, লজ্জা দেয়। যে কথা লোক সমাজে বলা উচিত নয়, ঐ ধরনের অশ্লীল
ফাহেশা কথা বলাবলি করত এবং তারা তাদের মজলিশে হাসাহাসি করত।
আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“লজ্জা ও কথা কম বলা, ঈমানের
দু’টি শাখা আর অশ্লীলতা ও অতিকথন নেফাকের দু’টি শাখা।[৩৪]
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, হাদীসে
الْعِىُّ
শব্দটির অর্থ হলো, কম কথা বলা আর الَبذَاءُ
শব্দের অর্থ হলো, অশ্লীল কথা বলা আর البيان
অর্থ হলো অধিক কথা বলা। যেমন, বক্তা বা ওয়ায়েজরা মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য ও তাদের
প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে এমন এমন কথা বলে যা আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করে না।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, মুনাফিকদের অবস্থা মুসলিমদের মধ্যে অচল মুদ্রার মত। যা অনেক মানুষই তাদের অভিজ্ঞতা
না থাকার কারণে গ্রহণ করে থাকে। আর যারা অভিজ্ঞ ও যোগ্যতা সম্পন্ন তারা অবশ্যই বুঝতে
পারে এটি কি আসল মুদ্রা না নকল মুদ্রা। আর এ ধরনের অভিজ্ঞ লোকের সংখ্যা সমাজে কমই হয়ে
থাকে। দীনের জন্য এ ধরনের লোকের চাইতে ক্ষতি আর কিছুই হতে পারে না। এ সব লোকেরা দীন
ও ধর্মকে স্ব-মুলে উৎখাত করে ফেলে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে তাদের অবস্থাকে
পরিষ্কার করেন ও চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেন। একাধিক বার তাদের অবস্থান, বৈশিষ্ট্য ও আলোচনা
তুলে ধরেন এবং তাদের ক্ষতি উম্মতকে থেকে সতর্ক করেন। এ উম্মতকে বার বার তাদের কারণে
মাশুল দেওয়া এবং তাদের কারণেই এ উম্মতের ওপর বড় বড় মুসিবত নেমে আসায়, তাদের সম্পর্কে
ভালোভাবে জানার প্রয়োজন তীব্রভাবে দেখা দেয়। তাদের কথা শোনা হতে বেঁচে থাকা, তাদের
এবং সাথে সম্পর্ক রাখা হতে দুরে থাকা উম্মতের ওপর ফরয হয়ে গেছে। তারা কত পথিককেই না
তাদের গন্তব্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! তাদেরকে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে গোমরাহি ও
ভ্রষ্ট পথে নিয়ে গেছে। তারা কত মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করছে! আর কত
মানুষকে তারা আশাহত করছে। তারা মানুষকে ওয়াদা দিয়ে প্রতারণা করছে এবং মানুষকে ধ্বংস
ও হালাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে।[৩৫]
(৩২) গান শ্রবণ করাঃ
গান-বাজনা হলো মুনাফিকদের
একটি অন্যতম কু অভ্যাস, যা একজন মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে সম্পূর্ণ গাফেল করে দেয়।
আর এ গান বাজনাই ছিল মুনাফিকদের নিত্য দিনের সাথী। তারা সব সময় গান বাজনা শ্রবণ করে
সময় নষ্ট করত। বর্তমান সময়ে এ ব্যধিটি মুসলিম যুবকদের মধ্যেও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুনাফিকদের এ ঘৃণিত স্বভাব থেকে আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু বলেন,“গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে। [৩৬]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ.
বলেন, মনে রাখতে হবে, নিফাকের মুল ভিত্তি হলো, একজন মানুষের বাহ্যিক দিকটি তার অন্তরের
অবস্থার বিপরীত হওয়া। একজন গায়ক তার দুই অবস্থা হতে পারে, সে তার গানে কারো চরিত্রকে
হনন করে, ফলে সে ফাজির। অথবা সে মিথ্যা গুণগান করে তাহলে সে মুনাফিক। একজন গায়ক সে
দেখায় যে, তার মধ্যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি আগ্রহ আছে কিন্তু তার অন্তর নফসের খায়েশাতে
ভরপুর। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যে সব গান বাজনা বাদ্য যন্ত্র ও অনর্থক গলাবাজিকে অপছন্দ
করে, তার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট। তার অন্তর এসব দ্বারাই সব সময় ভর্তি। আল্লাহ ও আল্লাহর
রাসূল যা পছন্দ করে এবং যা অপছন্দ করে তা থেকে তার অন্তর একে বারেই খালি ও বিরান। তাদের
এ চরিত্র নিফাক বৈ আর কিছুই না।... এ ছাড়াও নিফাকের আলামত হলো, আল্লাহর যিকির কম করা,
সালাত আদায়ে অলসতা করা এবং সালাতে কাকের ঠোকরের মত ঠোকর দেওয়া। আর অভিজ্ঞতা হলো, যারা
গান করে তাদের খুব কম লোকই আছে যাদের মধ্যে এ চরিত্রগুলো পাওয়া যাবে না। গায়করা সাধারণত
সালাতে অমনোযোগী ও আল্লাহর যিকির হতে গাফেল হয়ে থাকে। এ ছাড়াও নিফাকের ভিত্তিই হলো,
মিথ্যার ওপর আর গান হলো সবচেয়ে অধিক মিথ্যাচার। গানে অসুন্দরকে সুন্দর ও খারাপকে ভালো
করে দেখায় আর সুন্দরকে বিশ্রী আর ভালোকে মন্দ করে দেখায়। আর এই হলো আসল নিফাক বা কপটতা।
আরো বলা যায়, নিফাক হলো ধোঁকা, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার আর গানের ভিত্তিই হলো এ সবের ওপর
প্রতিষ্ঠিত।[৩৭]
(৩৩) মুনাফিকরা শয়তানের সাথে থাকেঃ
‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়,
অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান
আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না। আর
তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের
সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের
সাথে) উপহাস করি মাত্র বরং আল্লাহই তাদের সাথে উপহাস করেন। আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন
যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে। তারা সে সমস্ত লোক, যারা
হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি
এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত : ১৩-১৬)।
দলিলের উৎসঃ
[1] জামেউল বয়ান ২০/২৫৮।
[২] মাদারেজুস
সালেহীন ১/৩৫০।
[৩] জামেউল বায়ান ৯/৩১৯
[৪] জামেয়ুল বায়ান ৯/৩২৪
[৫] জামেউল
বায়ান ৫/৩২৯।
[৬] জামেউল
বায়ান ৯/৩৩৩।
[৭] সহীহ মুসলিম,
হাদীস নং ২৭৮৪।
[৮] শরহে নববী ১৭/১২৮।
[৯] জামেউল বায়ান ১/২৭২।
[১০] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৩।
[১১] তাফসীরুল কুরআন আল-আযীম ৪/১৬০।
[১২] তাফসীরুল কুরআন আল আজীম ৪/১৬৩।
[১৩] মাদারেজুস
সালেকীন ১/৩৫৪।
[১৪] সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ৪৫৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৭৭।
[১৫] তাফসীরুল
কুরআন আল-আযীম ১৮২/২।
[১৬] সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ৪৬৬৮) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৮)
[১৭] তাফসীরুল
কুরআন আল-আযীম ৪/১৮৪।
[১৮] তাফসীরুল কুরআন আল-আযীম ৪/১৯২।
[১৯] তাফসীরুল
কুরআন আল আযীম ৪/১৭৩।
[২০] তাফসীরুল
কুরআন আল আযীম ৪/১৭৯।
[২১] জামেউল বায়ান ৮/৫৩৮।
[২২] তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৪/১৬১।
[২৩] তাফসীরুল
কুরআন আল আযীম ৪/২০১।
[২৪] তাফসীরুল
কুরআন আল আযীম ৪/৪০৭।
[২৫] তাফসীরুল
কুরআনীল আযীম ২/১০৬।
[২৬] তাফসীরুল
কুরআন আল আযীম ৪/৮৩
[২৭] মাদারেজুস
সালেকীন ১/৩৪৯।
[২৮] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
৫৮।
[২৯] শরহে
মুসলিম ২/৪৬-৪৭।
[৩০] সহীহ
মুসলিম, হাদীস নং ৬২২।
[৩১] মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৫৪।
[৩২] সহীহ
মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৪।
[৩৩] দেখুন
‘আওনুল মাবুদ ২/১৭৯।
[৩৪] তিরমিযী,
হাদীস নং ২০২৭। হাকিম হাদীটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[৩৫] তরিকুল
হিজরাতাইন ৬০৩।
[৩৬] শুয়াবুল
ঈমান ১০/২২৩।
[৩৭] ইগাসাতুল নাহকান ১/২৫০।
মুনাফিকদের অন্যান্য কর্মকান্ডসমূহঃ
(১) ইসলামি সংগঠনঃ ইসলামি সংগঠন বা ইসলামি
রাজনীতি করা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্যে ফরজ। এতদ সত্ত্বেও মুনাফিকরা অনৈসলামিক দল গঠন
করে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
(২) মানবরচিত আইনঃ মুনাফিকরা ইসলামি আইন বাদ
দিয়ে মাবনরচিত আইনে রাষ্ট্র শাসন করছে।
(৩) মানবরচিত সংবিধানঃ মুসলমানদের সংবিধান হবে
কুরআন। কিন্তু মুনাফিকরা কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে না নিয়ে তারা মানবরচিত সংবিধান
তৈরী করেছে।
(৪) বিচারিক কাজে মানবরচিত আইন প্রয়োগঃ
যারা আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানবরচিত আইনে বিচার করে তারা কাফের, জালেম ও ফাসেক। মুনাফিক
মুসলমানরা এ কাজও করছে আবার আল্লাহু আল্লাহু জিকিরও করছে।
(৫) পির বনাম ধর্ম ব্যবসাঃ পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ ইসলামে
নেই। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটি ভ্রান্ত মতবাদ। এই ব্যবসায় শিরক, কুফর আর বিদআত ছাড়া আর
কিছু নেই। মুনাফিক মুসলমানরা এই ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত।
(৬) পতিতা ব্যবসার সাথে জড়িতঃ আবাসিক/অনাবাসিক হোটেল,
বিভিন্ন পার্ক, রিসোর্টসহ গোপনীয় অনেক স্থানে দেদারছে চলছে নারীদের দেহ ব্যবসা। এই
ব্যবসার সাথে মুনাফিক মুসলমানরা জড়িত।
(৭) মদ, জুয়া, লটারী, ক্যাসিনো খেলার সাথে জড়িতঃ
মুনাফিক মুসলমানরা এগুলোর সাথে সরাসরি জড়িত।
(৮) ছবি অংকন ও মূর্তি নির্মাণঃ ইসলামে এই ব্যবসা
সম্পূর্ণ হারাম। তা জানা সত্বেও মুনাফিক মুসলমানরা সরাসরি এইসব ব্যবসার সাথে জড়িত।
(৯) কুকুর লালন পালন ও ব্যবসাঃ কুকুরের মূল্য হারাম। যে
ঘরে কুকুর থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেস্তা প্রবেশ করে না। পশু পালন ও ক্ষেত খামার এর পাহাড়া
ব্যতীত বাড়িতে কুকুর লালন পালন করা নিষেধ। এসব জানা সত্ত্বেও মুনাফিক মুসলমানরা ইসলাম
বিরোধী এই কাজগুলোর সাথে জড়িত।
(১০) তাবিজ, জোতিষী, গণক ও যাদু ব্যবসা হারামঃ
মুনাফিক মুসলমানরা এইসব হারাম ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত।
(১১) গায়িকা ভাড়া করা ও গান শিক্ষা দেয়া হারামঃ
মুনাফিক মুসলমানদের এই বিষয়ে কি লিখবো? স্টেজে তার যুবতী মেয়ে অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে নেচে
গেয়ে দর্শক মাতিয়ে তুলল, সামনে বাবা মা বসে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলছে তার মেয়ে পেরেছে।
গান শিক্ষার অনেক বিদ্যায়লয় আছে যেখানে গান শিক্ষা দেয়া হয়। নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের
সম্পর্কে আপনারাই অনেক জানেন। তাদের উপার্জিত এই অর্থ হারাম।
(১২) পর্দাহীনতার প্রচলনঃ মুনাফিক মুসলমানরা পর্দার
বিধান মেনে চলে না। নারী ধর্ষণের ৯০% কারণ নারীর পোশাক। তবে নিতান্ত গরীব মানুষ ছাড়া
অন্যরা ধর্ষণ বা ব্যভিচারকে অন্যায় কিছু মনে করা না। তারা মনে করে জাস্ট ইনজয়।
(১৩) নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে
ভোট প্রদানঃ ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। ইসলামে নিষিদ্ধ
আছে, নারী কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা
দিয়ে মুনাফিক মুসলমানরা নেই কাজটিই করে আসছে।
(১৪) সমকামিতা প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াইঃ
মুনাফিক মুসলমানরা সমকামিতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে দীর্ঘ দিন থেকে কা্জ করে আসছে। যা
ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম।
(১৫) সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, অপহরণ, খুন, ক্ষমতার
অপব্যবহারঃ মুনাফিক মুসলমানরা এসবের সবগুলোর সাথেই জড়িত।
(১৬) ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণাঃ ব্যবসা-বাণিজ্যের
সাথে জড়িত মুসলমানদের ৯৮%-ই মুনাফিক মুসলমান। খাদ্যে ভেজাল দ্রব্য মিশানো, ওজনে কম
দেয়া, ফরমালিন মিশানো, খাদ্যদ্রব্য মজুত করে দাম বৃদ্ধি করা, মিথ্যে কথা বলে পণ্য বিক্রিসহ
সব ধরণের প্রতারণার সাথে মুনাফিক মুসলমানরা জড়িত।
প্রিয় মুসলমান
ভাইয়েরাঃ
বর্তমান যুগ হচ্ছে মুনাফিক মুসলমানদের রাজত্ব। তাদের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড এতো বেশী
যে, সেসব নিয়ে লিখলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা হবে। মূলত মুনাফিক মুসলমানদের দুনিয়াবী কয়েক
দিনের স্বার্থের জন্যে ইসলাম আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। কাফের
মুশরেকরা যে পরিমান ইসলামের ক্ষতি করছে তাদের সাথে মুনাফিকরা যোগ দিয়ে পুরো ইসলামকেই
মূলোৎপাটন করছে। এই সব মুনাফিক মুসলমানরা ইসলামের গোপন শত্রু। এদের থেকে সকলকে সাবধানে
ধাকতে হবে। আমাদের সমাজে এরা চিহ্নিত।
মুনাফিকদের পরিনাম বা শাস্তিঃ
(১) কোনো মুনাফিকের জন্য শাফায়াত থাকবে নাঃ
আল্লাহ বলেন: -
“নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে
জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সুপারিশকারী কখনও পাবে না।”
[সুরা: -আন নিসা, আয়াত: -১৪৫]
আল্লাহ মুনাফিক সম্পর্কে
রাসূল সা. কে বলেন: -
"আর তাদের (মুনাফিক)
মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না।
তারা তো আল্লাহর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং রসূলের প্রতিও। বস্তুতঃ তারা নাফরমান
অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে। [সুরা:-আত-তাওবাহ, আয়াত: -৮৪]
রাসূল বলেছেন: -
"অভিশপ্ত সে, যে কোনো
মুমিনের ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে।" [ সহীহ তিরমিজি, হাদিস :
১৯৪০]
সুতরাং কুরআনের এবং সহিহ
হাদিস থেকে জানা যায় যে মুনাফিকের কোন শাফায়াত গ্রহণ করা হবে না আল্লাহর দরবারে।
(২) কোন কাফির এর জন্য শাফায়াত থাকবে নাঃ
আল্লাহ কাফেরকে বলেন: -
“আর যারা কাফের হয়েছে, তাদের
জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে
এবং তাদের থেকে তার শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে এভাবেই শাস্তি
দিয়ে থাকি।” [সূরা:- ফাতির, আয়াত:- ৩৬]
আল্লাহ আরোও বলেন:-
“কাফেররা কি মনে করে যে,
তারা আমার পরিবর্তে আমার বান্দাদেরকে সুপারিশকারী রূপে গ্রহণ করবে? আমি কাফেরদের অভ্যর্থনার
জন্যে জাহান্নামকে প্রস্তুত করে রেখেছি।” [সূরা:- আল কাহফ , আয়াত:- ১০২]
(৩) কোন কুফরিকারী এর জন্যে সুপারিশকারী গ্রহণ হবে নাঃ
আল্লাহ কুফরি কারীদের বলেন:-
“এই দুই বাদী বিবাদী, তারা
তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব যারা কুফরি করে, তাদের জন্যে আগুনের পোশাক
তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।” [সূরা:- আল হাজ্জ, আয়াত:-
১৯]
আল্লাহ আরোও বলেন:-
“যদি সারা পৃথিবী পরিমাণ
স্বর্ণও তার পরিবর্তে দেয়া হয়,তবুও যারা কাফের হয়েছে এবং কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে
তাদের তওবা কবুল করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব! পক্ষান্তরে তাদের
কোনই সুপারিশকারী নেই।” [সূরা:-আল ইমরান আয়াত:- ৯১]
সুতরাং যারা কুফরি করে তাদের
জন্যও শাফায়াতকারী থাকবে না।
(৪) জালেম বা পাপাচারী সম্প্রদায় এদের সুপারিশকারী থাকবে নাঃ
আল্লাহ বলেন: -
“আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে
মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত করেন। পার্থিবজীবনে এবং পরকালে। এবং আল্লাহ জালেমদেরকে পথভ্রষ্ট
করেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা, তা করেন।” [সূরা:- ইব্রাহীম , আয়াত:- ২৭]
আল্লাহ আরোও বলেন: -
“পাপিষ্ঠদের জন্যে কোন বন্ধু
নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” [সুরা: -আল মু-মিন, আয়াত: -১৮]
যারা নিজেদের প্রতি এবং মানুষদের
প্রতি যুলুম- নির্যাতিত এবং অন্যায়- অত্যাচার করেছে তাদের সুপারিশ করা কবুল হবে না।
সুতরাং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম।
(৫) মুনাফিকগণ কাফেরদের বন্ধুরুপে গ্রহণ করায় এরা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি ভোগ
করবেঃ
“যেসব মুনাফিক ঈমানদার লোকদের
বাদ দিয়ে কাফের লোকদেরকে নিজেদের বন্ধু ও সঙ্গীরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে এ সুসংবাদ শুনিয়ে
দিন যে, তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছে। উহারা কি সম্মান লাভের সন্ধানে
তাদের নিকটে যায়? অথচ সম্মানতো একমাত্র আল্লাহরই জন্য।” (নিসা ১৩৮-১৩৯)।
(৬) মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের নিম্ন স্তরেঃ
(ক) ‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে
অবস্থান করবে, আর আপনি তাদের সাহায্যকারী হিসেবে কখনও কাউকে পাবেন না।’ (নিসা ১৪৫)।
(খ) ‘এই মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং কাফেরদের জন্য
আল্লাহতায়ালা দোযখের আগুনের ওয়াদা করেছেন, যাতে তারা চিরদিন থাকবে, ইহাই তাদের উপযুক্ত।
তাদের উপর আল্লাহর অভিসাপ এবং তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী আযাব।’ (তওবা ৬৮)।
(খ) আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবিতাবস্থায় কতক মুনাফিক লোকের অভ্যাস এই ছিল যে, নবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন যুদ্ধের জন্যে বের হতেন তখন তারা পিছনে গা ঢাকা দিয়ে থাকতো
এবং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরূদ্ধে অবস্থান করাতেই তারা
উচ্ছাস প্রকাশ করত। এরপর যখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিরে আসতেন
তখন তারা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে গিয়ে বিভিন্ন অজুহাত
পেশ করত, কসম করত এবং প্রত্যাশা করত যেন তারা প্রশংসিত হয় এমন কার্যের উপর যা তারা
করেনি। তখন অবতীর্ণ হলোঃ “যারা নিজেরা যা করেছে তাতে আনন্দোল্লাস করে এবং যা নিজেরা
করেনি এমন কর্মের জন্য প্রশংসিত হতে পছন্দ করে, তারা ‘আযাব থেকে রেহাই পাবে- আপনি কক্ষনো
এমন মনে করবেন না। তাদের জন্যে আছে কঠিন ‘আযাব”- (সূরাহ্ আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৮৮)। (ই.ফা.
৬৭৭৬, ই.সে. ৬৮৩১, সহিহ মুসলিম-৬৯২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(গ) জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
(তিনি বলেন,) রসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন এক ভ্রমণ থেকে প্রত্যাগমন করে মাদীনার সন্নিকটবর্তী
স্থানে পৌঁছলে এমনভাবে প্রচণ্ডবেগে বায়ু প্রবাহিত হয় যে, মনে হচ্ছিল যেন আরোহীকে ধূলায়
ঢেকে ফেলবে। রাবী বলেন, তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ কোন
মুনাফিকের মৃত্যুর কারণে এ বায়ু প্রবাহিত হয়েছে। যখন তিনি মাদীনায় পৌঁছলেন, তখন দেখা
গেল, একজন বড় মুনাফিকের মৃত্যু ঘটেছে। (ই.ফা. ৬৭৮৪, ই.সে. ৬৮৩৯-সহিহ মুসলিম-৬৯৩৪)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মুনাফিকদের সংশোধন হওয়ার সুযোগঃ
আল্লাহতায়ালা বলেন,
“কিন্তু যারা তওবা করে, নিজেদের
অতীত কৃতকর্মের সংশোধন করে ও আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয় এবং আল্লাহর জন্যে ধর্মে বিশুদ্ধ
হয়, তারা বিশ্বাসীদের সঙ্গে থাকবে। আল্লাহও শিগগিরই মুমিনদের মহাপুরস্কার দেবেন।”
(সুরা নিসা, আয়াত: ১৪৬)।
মুনাফিক মুসলমানদের মুকাবেলায় প্রকৃত মুসলমানদের ভূমিকাঃ
মুনাফিকদের ক্ষেত্রে কোন
ঢিলেমি না করা ফরয। তাদের পক্ষ থেকে আগত বিপদকে খাটো করে দেখাও বৈধ নয়। বর্তমানে মুনাফিকরা
তো নবি করিম (ছাঃ)-এর যুগ থেকে বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মুনাফিকরা আজ নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের থেকেও ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেদিন তারা লুকিয়ে ছাপিয়ে মুনাফিকী করত। কিন্তু আজ প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে তা করছে’। (বুখারী হা/৭১১৩।)
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)
নবী করীম (সা.) হতে শুনে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, এ উম্মতের ব্যাপারে এমন সব মুনাফিক
সম্পর্কে আমার আশংকা হয়, যারা কথা বলে সুকৌশলে, আর কাজ করে জুলুমের সঙ্গে। (বায়হাকী)।
তাদের বিষয়ে মুসলমানদের ভূমিকা হবে নিম্নরূপ :
১. তাদের আনুগত্য না করাঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর
এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য কর না। অবশ্যই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (আহযাব ৩৩/১)।
ইমাম তাবারী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে নবী, তুমি
আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য এবং তাঁর প্রতি তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তাঁকে
ভয় কর। আর তাঁকে ভয় কর, তাঁর নির্দেশিত হারাম থেকে দূরে থাকা ও তার সীমালংঘন না করার
মাধ্যমে। আর তুমি ঐ সকল কাফিরের আনুগত্য করবে না যারা তোমাকে বলে, তোমার যেসব ছোট লোক
ঈমানদার অনুসারী আছে তোমার নিকট থেকে তাদের হটিয়ে দাও, যাতে আমরা তোমার কাছে বসতে পারি’।
তুমি ঐ সকল মুনাফিকেরও আনুগত্য করবে না যারা দৃশ্যত তোমার উপর ঈমান রাখে এবং তোমার
কল্যাণ কামনা করে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তোমার, তোমার দ্বীন এবং তোমার ছাহাবীদের ক্ষতি
করতে মোটেও কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তুমি তাদের কোন মতামত গ্রহণ করবে না এবং শুভাকাঙ্খী
মনে করে তাদের কাছে কোন পরামর্শও চাইতে যাবে না। কারণ তারা তোমার শত্রু। ঐ সমস্ত মুনাফিকের
অন্তরে কী লুক্কায়িত আছে আর কী উদ্দেশ্যেই বা তারা বাহ্যত তোমার কল্যাণ কামনা যাহির
করছে তা তাঁর ভাল জানা আছে। তিনি তোমার, তোমার দ্বীনের এবং তোমার ছাহাবীদের সহ সমগ্র
সৃষ্টির ব্যবস্থাপনায় মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী। (জামিউল বায়ান ২০/২০২।)
২. মুনাফিকদের উপেক্ষা করা, ভীতি প্রদর্শন ও উপদেশ দানঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, بَشِّرِ
الْمُنَافِقِيْنَ
بِأَنَّ
لَهُمْ
عَذَاباً
أَلِيْماً
‘তুমি মুনাফিকদের এই সংবাদ জানিয়ে দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’
(নিসা ৪/১৩৮)।
তিনি আরো বলেন,
‘ঐ মুনাফিকরাই তো তারা, যাদের
অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি ওদের এড়িয়ে চল বা উপেক্ষা কর, ওদের উপদেশ
দাও এবং ওদের এমন কথা যা মর্মে গিয়ে পৌঁছে’ (নিসা ৪/৬৩)।
আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে ‘ওরা’
(اولئك)বলতে
মুনাফিকদের বুঝিয়েছেন, ইতিপূর্বে যাদের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, হে রাসূল!
তাগূতের কাছে তাদের বিচার প্রার্থনা করা, তোমার কাছে বিচার প্রার্থনা না করা এবং তোমার
কাছে আসতে বাধা দানে তাদের মনে কী অভিপ্রায় লুকিয়ে ছিল তা আল্লাহ খুব ভাল জানেন। তাদের
মনে তো মুনাফিকী ও বক্রতা লুকিয়ে রয়েছে যদিও তারা শপথ করে বলে, আমরা কেবলই কল্যাণ ও
সম্প্রীতি কামনা করি।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে
বলছেন, ‘তুমি ওদের ছাড় দাও, কায়িক-দৈহিক কোন শাস্তি তুমি ওদের দেবে না। তবে তুমি তাদের
উপর আল্লাহর শাস্তি চেপে বসার এবং তাদের বসতিতে
আল্লাহর মার অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে উপদেশ দাও। তারা আল্লাহ ও তার
রাসূল সম্পর্কে যে সন্দেহের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেজন্য যে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি
তারা হবে সে সম্পর্কে তাদের সতর্ক কর। আর তাদের হুকুম কর আল্লাহকে ভয় করতে এবং আল্লাহ,
আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও শাস্তিকে সত্য বলে মেনে নিতে’। (জামিউল বায়ান
৮/৫১৫।)
৩. মুনাফিকদের সঙ্গে বিতর্কে না জড়ানোঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যারা নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে
পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/১০৭)।
আল্লাহ বলেছেন, হে রাসূল!
যারা নিজেদের সাথে খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের পক্ষ নিয়ে তুমি বিতর্ক করবে
না। বনু উবাইরিক গোত্রের কিছু লোক এই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যাফর গোত্রের তাম‘আহ বা
বশীর ইবনু উবাইরিক এক আনছারীর বর্ম চুরি করে। বর্মের মালিক নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে
অভিযোগ করে এবং তাম‘আহর প্রতি তার সন্দেহের কথা বলে। অনুসন্ধান শুরু হ’লে সে বর্মটি
এক ইহুদীর কাছে গচ্ছিত রাখে। পরে তাম‘আহ, তার ভাই-বেরাদার ও বনু যাফরের আরো কিছু লোক
জোট পাকিয়ে সেই ইহুদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ইহুদীকে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে নিজেকে নির্দোষ
দাবী করে। কিন্তু তাম‘আহর লোকেরা জোরেশোরে বলতে থাকে, এতো শয়তান ইহুদী, সেতো আল্লাহ
ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে। তার কথা কেমন করে বিশ্বাসযোগ্য হ’তে পারে? বরং আমাদের
কথা মেনে নেওয়া উচিত। কেননা আমরা মুসলমান। এ মোকদ্দমার বাহ্যিক ধারাবিবরণীতে প্রভাবিত
হয়ে নবী করীম (ছাঃ) ঐ ইহুদীর বিরুদ্ধে রায় দিতে এবং অভিযোগকারীকে বনু উবাইরিকের বিরুদ্ধে
দোষারোপ করার জন্য সতর্ক করে দিতে প্রায় উদ্যত হয়েছিলেন। এমন সময় উক্ত আয়াত নাযিল হয়
এবং সমস্ত ব্যাপারটির প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয়।
আসলে যে ব্যক্তি অন্যের সাথে
বিশ্বাসঘাতকতা করে সে সবার আগে নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ মন ও মস্তিষ্কের
শক্তিগুলো তার কাছে আমানত হিসাবে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। সে সেগুলোকে অযথা ব্যবহার করে
তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য করে। বিবেক-বুদ্ধিকে দ্বীনের অনুগত না করে বরং আপন
খেয়ালখুশির অনুগত করে সে এভাবে নিজের সাথে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তাই এমন বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ
নিতে নবী করীম (ছাঃ)-কে নিষেধ করা হয়েছে। বস্ত্তত মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা যাদের
স্বভাব এবং এরূপ আত্মসাৎ ও অন্যান্য হারামের মাঝে বিচরণের মাধ্যমে যারা পাপ-পঙ্কিলতার
মাঝে ডুবে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মোটেও ভালবাসেন না এবং পসন্দও করেন না। (জামিউল
বায়ান ৯/১৯০।)
৪. মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে না তোলাঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে মুসলিগণ! তোমরা মুমিন
ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না; তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ত্রুটি
করে না- তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে
বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে
নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও’ (আলে ইমরান
৩/১১৮)।
উক্ত আয়াত কিছু মুসলিম সম্পর্কে
নাযিল হয়েছে। তারা তাদের ইহুদী মুনাফিক বন্ধুদের সঙ্গে গভীর মিতালি রাখত এবং প্রাক
ইসলামী যুগে জাহেলিয়াতের যামানায় যেসব কারণে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ইসলাম
পরবর্তীকালেও তারা তা নির্ভেজালভাবে অটুট রেখেছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে তাদেরকে এমন
বন্ধুত্ব রক্ষা করতে নিষেধ করেন এবং একই সাথে তাদের কোন কাজে ওদের থেকে পরামর্শ নিতেও
নিষেধ করে দেন’। (জামিউল বায়ান ৭/১৪০।)
৫. মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালনা এবং কঠোরতা আরোপঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে নবী! কাফির ও মুনাফিক উভয়ের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তিতে
জিহাদ করো এবং তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন কর। শেষ পর্যন্ত তাদের পরিণতি হচ্ছে
জাহান্নাম, আর তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান।’ (তওবা ৯/৭৩)।
যায়দ ইব্নু সাবিত (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে উহুদ যুদ্ধে যাত্রা করে তাঁর কতিপয় সাথী ফিরে আসলে একদল
লোক বলতে লাগল, আমরা তাদেরকে হত্যা করব, আর অন্য দলটি বলতে লাগলো, না, আমরা তাদেরকে
হত্যা করব না। এ সময়ই (তোমাদের হল কী, তোমরা মুনাফিকদের ব্যাপারে দু’দল হয়ে গেলে?)
(সূরাহ আন-নিসা ৪/৮৮) আয়াতটি নাযিল হয়। (বুখারী পর্ব ২৯, অধ্যায় ১০, হাদীস নং ১৮৮৪;
মুসলিম অধ্যায় ৫০, হাঃ ২৭৭৬, আল লুলু ওয়াল মারজান-১৭৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে এই কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করা যায়।
৬. মুনাফিকদের প্রতি অবজ্ঞা দেখান এবং তাদের নেতা না বানানোঃ
বুরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা মুনাফিক মানুষকে নেতা হিসাবে গ্রহণ কর না। যদি
নেতা মুনাফিক হয়, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে অসন্তুষ্ট করলে। অন্য বর্ণনায় আছে
যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যুক মুনাফিক ব্যক্তিকে বলে, হে আমার নেতা! তখন সে তার প্রতিপালককে
রাগান্বিত করল’ (আবুদাঊদ হা/৪৯৭৭; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৪১৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস।
৭. মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ না করাঃ
আল্লাহ তা‘আরা বলেন,
‘তাদের (মুনাফিকদের) কেউ
মারা গেলে তুমি কখনও তার জানাযার ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না।
নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং পাপাচারী অবস্থাতেই তাদের
মৃত্যু হয়েছে’ (তওবা ৯/৮৪)।
উক্ত আয়াত নাজিলের শানে নুযুলঃ
‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘উমার
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু উবাই
(মুনাফিক সর্দার)-এর মৃত্যু হলে তার পুত্র (যিনি সাহাবী ছিলেন) নাবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেন, আপনার জামাটি আমাকে দান করুন। আমি সেটা দিয়ে
আমার পিতার কাফন পরাতে ইচ্ছে করি। আর আপনি তার জানাযা পড়বেন এবং তার জন্য মাগফিরাত
কামনা করবেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জামাটি তাঁকে দিয়ে দিলেন
এবং বললেনঃ আমাকে খবর দিও, আমি তার জানাযা আদায় করব। তিনি তাঁকে খবর দিলেন। যখন নাবী
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জানাযা আদায়ের ইচ্ছে করলেন, তখন ‘উমার (রাঃ)
তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আল্লাহ্ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা আদায় করতে নিষেধ
করেননি? তিনি বললেনঃ আমাকে তো দু’টির মধ্যে কোন একটি করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্
তা‘আলা বলেছেন, (যার অর্থ) “আপনি তাদের (মুনাফিকদের) জন্য মাগফিরাত কামনা করুন বা মাগফিরাত
কামনা না-ই করুন (একই কথা) আপনি যদি সত্তর বারও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন; কখনো
আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন না” (সূরাহ আত্ তাওবাহ ৯/৮০)। কাজেই তিনি তার জানাযা পড়লেন,
অতঃপর নাযিল হলঃ (যার অর্থ) “তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে আপনি তাদের জানাযা কক্ষণও আদায়
করবেন না” (সূরাহ আত্তাওবাহ ৯/৮৪)। (বুখারী পর্ব ২৩ অধ্যায় ২২ হাদীস নং ১২৬৯; মুসলিম
৫০ হাঃ ২৭৭৪, আল লুলু ওয়াল মারজান-১৭৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
শেষ কথা :
মুনাফিকী একটি প্রাণঘাতী
মানসিক রোগ এবং নিন্দনীয় স্বভাব। নবি করিম (ছাঃ) এহেন স্বভাবের অধিকারীকে বিশ্বাসঘাতক,
আত্মসাৎকারী, মিথ্যুক ও পাপাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা মুনাফিক মনে যা লুকিয়ে
রাখে, বাইরে তার উল্টোটা প্রকাশ করে। সে সত্য বলছে বলে দাবী করে অথচ সে জানে যে সে
মিথ্যুক। সে দাবী করে আমানত রক্ষা করার, অথচ সে ভালই জানে যে সে তা আত্মসাৎকারী। সে
আরও দাবী করে যে, সে অঙ্গীকার পালনে অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। সে তার
প্রতিপক্ষের নামে বানোয়াট সব দোষ বলে বেড়ায় অথচ সে ভাল করেই জানে তার এসব দোষারোপের
মাধ্যমে সে পাপাচারী হচ্ছে। সে মারাত্মক অপরাধ করছে। সুতরাং তার স্বভাব চরিত্রের পুরোটাই
ধোঁকা ও প্রতারণার উপর দন্ডায়মান। এমন যার অবস্থা তার বেলায় বড় মুনাফিক হয়ে যাওয়ার
ভয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা নিফাকে আমালী বা আমলভিত্তিক মুনাফিকী যদিও ঐসব পাপের
অন্তর্ভুক্ত যদ্দরুন বান্দা ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায় না, তবুও যখন তা বান্দার ওপর জেঁকে
বসে এবং তার আচরণকে প্রতারণার জালে আটকে ফেলে এবং তা অনেক্ষণ চলতে থাকে তখন আল্লাহ
তাকে বড় ও আসল মুনাফিকের খাতায় নাম তুলে দিতে পারেন। তার আমলের শাস্তি হিসেবেই তার
অন্তর থেকে ঈমান খারিজ করে সেখানে মুনাফিকীর জায়গা তিনি করে দেন।
পরিবার, সমাজ
ও রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রান্ধ্রে মুনাফিকদের বিচরন। মূলত মুনাফিকরাই এখন সমাজ
ও রাষ্ট্র শাসন করছে। মুনাফিকরা সাধারনত কাফির মুশরিকদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর
অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যায় মুনাফিক মুসলিম রাষ্ট্র নেতাগণ আমেরিকার তাবেদারে
পরিনত হয়েছে। ৫৭টি মুসলিম দেশের ইসলামিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে গঠিত ওআইসি এখন
আমেরিকার হাতের পুতুল। কাশ্মির, মায়ানমার, চীনের উইঘুর ও ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর অন্যান্য
রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খৃষ্টান ও চীনারা নির্বিচারে মুসলিমদের অপহরন,
হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করছে। বিশেষ করে শিশুদের অনেক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হচ্ছে।
জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে। জীবন্ত দেহ থেকে হাত পা কেটে কেটে আলাদা করছে। হাজার হাজার নারী-পুরুষদের
জেলখানায় বন্দী করে অমানবিক অত্যাচার করছে। কিন্তু বিশ্বের মুনাফিক মুসলিম নেতাগণ একটি
টু শব্দ পর্যন্ত করছে না। কোনো প্রতিবাদ করছে না। তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কোনো এ্যাকশন
দেখা যাচ্ছে না। মুনাফিকরা আলোচিত চারটি চরিত্রের মধ্যেই এখন সীমা বদ্ধ নেই। এরা ইসলামের
প্রধান শত্রুদের সাথে আঁতাত করে প্রকৃত ধর্ম প্রাণ মুসলমানদের হত্যা করছে।
এক শ্রেণির
মুনাফিক দরবারে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা নাকি ইসলামের দাওয়াতি কাজ করছে। এইসব ভন্ডরা
শয়তানের তাবেদার। বিশ্ব আজ কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে তাদের নজর নেই।
ওহে মুসলমানঃ এইসব মুনাফিক মুসলমান থেকে আমাদের সাবধানে
থাকতে হবে। সম্মিলিতভাবে তাদের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। তার আগে নিজের মধ্যে মুনাফিকের
বৈশিষ্ট্যাবলী আছে কিনা তা সংশোধন করতে হবে। রাসুল সাঃ যে বলেছেন, ৭৩ দলের মধ্যে ৭২
দল জাহান্নামে যাবে। এরা কারা? আপনারা একটু খেয়াল করুন, জান্নাতে যাওয়ার জন্যে কতোজন
উপযোগী মুসলমান আছে।
আমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করি-
তিনি যেন আমাদের অন্তরের দোষ-ত্রুটিকে সংশোধন করে দেন এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ফিৎনা-ফাসাদ
থেকে আমাদের দূরে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন, আমাদের নবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ)-এর উপর।
(সমাপ্ত)
অন্যান্য Related পর্ব দেখতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
(১) পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ বনাম ইসলাম-(শয়তানের ওহী কার উপর নাযিল হয়?)।
(২) পির-অলিদের ভ্রান্ত আক্বিদাহসমূহ।
(৪) মুখে বলে মুসলমান কর্মকান্ডে সে কাফের।
(৫) যেসব আমলের কারণে মুসলমান মুশরেকে পরিনত হয়।
-----------------------------------------------------
Please Share On
No comments:
Post a Comment