Sunday, August 16, 2020

ইসলামি আইন বনাম মুসলমান

  বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

ইসলামি আইন বনাম মুসলমান

(ইসলামি আইন  তথা কুরআন ও সুন্নাহর আইন মানা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্যে ফরজ )

 

প্রতিনিয়ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের ইচ্ছা ও অনিচ্ছায় কিছু না কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। মানুষের বিবেক জ্ঞান বুদ্ধি থাকা সত্বেও শয়তান যেহেতু সব সময় মানুষের পিছনে লেগে থাকে তাই অনেক সময় শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে মানুষ অনেক অপরাধ করে থাকে। মানুষ যাতে সহজ সরল সঠিক পথে চলতে পারে সে জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবি রাসুল প্রেরণসহ আসমানি কিতাব নাযিল করে দিয়েছেন। নবি রাসুলগণ জীবিত থাকাবস্থায় তাঁরা জাতিকে হাতে কলমে অর্থাৎ বাস্তবে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে অন্যায় থেকে বিরত থাকতে হয় আর কিভাবে সৎপথে চলতে হয়। তাঁরা আজ জীবিত নেই কিন্তু রেখে গেছেন আসমানী কিতাব বা আল কুরআন ও রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ। আমরা যেহেতু শেষ নবি হযরত মুহম্মদ সা: এর উম্মত তাই আমরা মুসলমান হিসেবে আল কোরআন ও রাসুল সাঃ এর  অনুসরণ করবো এবং মেনে চলবো। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল আইনের উৎস হচ্ছে আল কোরআন। নবি করিম সা: একদিকে যেমন ছিলেন ধর্ম প্রচারক আবার অন্য দিকে ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্র নায়ক। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র কিভাবে গঠন করতে হয় তার নমূনা বা দৃষ্টান্ত নবি সা: এই পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আল কোরআনের চেয়ে উত্তম সংবিধান বা আইন শাস্ত্র পৃথিবীতে আর নেই।

ইসলামি আইনের তিনটি পর্যায় আছে। এই তিনটি পর্যায় যে মানবে না বা অস্বীকার করবে সে মুসলমান হয়েও কাফের বলে গণ্য হবে। পর্যায় তিনটি হচ্ছেঃ

(১)  পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআনকে সংবিধান বা ইসলামি আইন গ্রন্থ হিসেবে মেনে নিতে হবে।

(২)  কুরআন ও সুন্নাহর আইন  দিয়ে বিচারের রায় দিতে হবেঃ

(৩) কুরআন ও সুন্নাহর আইনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে।

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনাঃ

(১) পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলমানদের সংবিধান বা ইসলামি আইন গ্রন্থ হবে আল কুরআনঃ

মুসলমানদের ইসলামি আইনের মূল আইন শাস্ত্র হচ্ছে আল-কুরআন। ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিসহ সব ধরনের নিয়ম নীতি, আইন কানুন কুরআনে লিপিবদ্ধ আছে। কুরআন ও সুন্নাহর আইন ব্যতীত অন্য কোনো মানব রচিত আইন গ্রহণ করা যাবে না। কুরআন ও সুন্নাহর আইন মেনে চলা একজন মুসলমানের জন্যে ফরজ। কিন্তু ইসলামি আইন বিষয়ক কুরআনের আয়াত ও হাদিস এক শ্রেণির মুসলমান সব সময় এড়িয়ে চলে। ইসলামি আইন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের পক্ষে তাদেরকে কথা বলতে দেখা যায় না। তবে কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে তাহলে তাকে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর সকল আইন বা মতবাদ একবাক্যে মেনে নিতে নিতে হবে। এখানে কোনো যুক্তি বা তর্ক বিতর্ক চলবে না। মুসলমানদের সকল আইনের উৎস আল-কুরআন ও রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ। যা মেনে নেয়া মুসলমানদের জন্যে ফরজ। একটা কথা মনে রাখতে হবে ইসলামি আইনের বাস্তবায়ন ছাড়া ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা কখনই সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

‘হে ঈমানদারগন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২০৮)।

আল্লাহ বলেন,

“তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিফল হতে পারে? আর কিয়ামতের দিন তাদের কঠিন আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন।” (সুরা: বাকারা, আয়াত: ৮৫)।

আমাদের দেশে মুসলমানদের মধ্যে অনেক দল-উপদল ও বিভিন্ন তরিকার লোক আছে। প্রত্যেকেই দেখা যায়, তারা ইসলামের এক একটা অংশ নিয়ে ধর্ম পালন করছে। তবে ইসলামি আইন বিষয় নিয়ে এরা কেউ কথা বলে না। অর্থাৎ ইসলামের এই ফরজ ইবাদতকে তারা আলাদা করে রেখে দিয়েছে। তাহলে এরা কিভাবে ইসলামে পুরোপরি প্রবেশ করার দাবী করে? ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করতে চাইলে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে মেনে নিতে হবে। নইলে সে মুসলমান হয়েও কাফেরে পরিনত হবে।

মুসলমানদের সংবিধান যে কুরআন তার দলিল নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

(ক) আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি পূর্ণ কোরআন শরীফ পরম সত্যতার সাথে এ জন্যেই নাযিল করেছি যে, তুমি সে অনুযায়ী মানুষের উপর আল্লাহর প্রদর্শিত পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং বিচার ফায়সালা করবে।(কোরআনকে যারা এ কাজে ব্যবহার করতে চায় নি তারা এ মহান আমানতের খিয়ানত করে) তুমি এ খিয়ানতকারীদের সাহায্য পক্ষ সমর্থনকারী হয়ো না। (নিসা:১০৫)।

(খ) আল্লাহ বলেন, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো, তাদের মনের খেয়াল খুশী ও ধারনা বাসনা অনুসরন করো না।( মায়েদা:৪৯)।

(গ)  আল্লাহ বলেন, তুমি কি জান না যে, আকাশ ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহর। (বাকারাঃ১০৭)।

(ঘ)  “হুকুম বা বিধান একমাত্র আল্লাহরই”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪০] তিনি আরও বলেন,

(ঙ) “তারা কি তবে জাহেলিয়াতের বিধান চায়? দৃঢ়-বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা আর কে হতে পারে?” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫০]।

(চ) “আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি সহকারে পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব (বিধি-বিধান) ও মানদণ্ড পাঠিয়েছি যাতে লোকেরা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর আমি লৌহ অবতীর্ণ করেছি যাতে প্রচণ্ড শক্তি ও মানবমণ্ডলীর জন্য বিবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর এর উদ্দেশ্য হচ্ছে,আল্লাহ্ জেনে নেবেন,কে গায়েবকে আশ্রয় করে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহাশক্তিধর ও মহা পরাক্রান্ত।” (সূরা হাদীদ : ২৫)।

(ছ) নবি (সাঃ) বলেন, আল্লাহর কোরআন- আল্লাহর দেয়া বিধানই বাঁচবার একমাত্র উপায়। তাতে অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস আছে, ভবিষ্যতের  মানব বংশের অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে তোমাদের পারস্পরিক বিষয় সম্পর্কীয় রাষ্ট্রীয় আইন কানুন ও তাতে রয়েছে। বস্তুতঃ উহা এক চূড়ান্ত বিধান, উহা কোন বাজে জিনিস নহে। (তিরমিজি)

(জ) রাসুল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই বিধান অনুসারে জীবন যাপন করবে, সে উহার প্রতিফল লাভ করবে।যে উহার অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তার শাসন সুবিচার পূর্ণ হবে এবং যে উহাকে দৃঢ় রুপে আকড়িয়ে ধরবে সে সঠিক এবং সত্যিকার কল্যাণের পথে পরিচালিত হতে পারবে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহই হলেন বিধান-দাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই বিধান নিতে হবে”। (আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪৯৫৫; নাসাঈ, (৮/২২৬); বায়হাকি (১০/১৪৫) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত)।

(২) কুরআন ও সুন্নাহর আইন  দিয়ে বিচারের রায় দিতে হবেঃ

মানব রচিত আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করা বা কোনো অপরাধের শাস্তির রায় দেয়া মুসলিম বিচারকদের জন্যে সম্পূর্ন নিষেধ। যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত আইনে বিচারের রায় দেয় তারা মুসলমান হয়েও কাফের, জালেম ও ফাসেক। এরা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।আল্লাহ বলেন,

(ক) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফয়সালা ও শাসনকার্য পরিচালনা করেনি,তারা কাফের।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৪)।

(খ) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা জালেম।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৫)।

(গ) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা ফাসেক (পাপাচারী)।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৭)।

(ঘ) “(হে নবী!) অতএব,আল্লাহ্ তায়ালা যা নাযিল করেছেন,তার ভিত্তিতে আপনি তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করুন এবং আপনার নিকট যে সত্যের আগমন ঘটেছে,তার পরিবর্তে তাদের প্রবৃত্তির (দাবীর) অনুসরণ করবেন না।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৮)।

(ঙ) “তারা কি জাহেলীয়াতের (মূর্খতাজাত) বিচার-ফয়সালা পেতে চায়? প্রত্যয়ের অধিকারী লোকদের জন্য বিচার-ফয়সালা প্রদানের প্রশ্নে আল্লাহর চেয়ে কে অধিকতর উত্তম হতে পারে?” (সূরা মায়েদাহ্ : ৫০)।

(চ) “হে রাসূল! তাদের বলে দিন:) আর তোমরা এ বিষয়ে (আল্লাহর অভিভাবকত্ব সম্বন্ধে) যে মতভেদই করো না কেনো, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছেই সোপর্দ। তিনিই আল্লাহ্-আমার প্রতিপালক; আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তাঁরই অভিমুখী হই।” (সূরা শুরা : ১০)।

(ছ) “হে ঈমানদারগণ! ন্যায়কে আশ্রয় করে আল্লাহর জন্য সাক্ষী হিসাবে দণ্ডায়মান হয়ে যাও এমনকি যদি তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা ও ঘনিষ্ঠ জনদের বিরুদ্ধেও হয়; সে ব্যক্তি ধনীই হোক বা গরীব হোক তাদের উভয়ের (বিরোধে লিপ্ত পক্ষদ্বয়ের) জন্য আল্লাহ্ই অধিকতর ঘনিষ্ঠ। অতএব,ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখার ব্যাপারে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তোমরা যদি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও,তা হলে (জেনে রাখ) তোমরা যা কিছু করছ অবশ্যই আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অবহিত।” (সূরা নিসা : ১৩৫)।

(জ) “(হে নবী!) অবশ্যই আমি সত্য সহকারে আপনার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যাতে আল্লাহ্ আপনাকে যা প্রদর্শন করেছেন তার সাহায্যে লোকদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করেন। আর আপনি খেয়ানতকারীদের (অন্যায়কারীদের) সপক্ষে বিতর্ককারী হবেন না।” (সূরা নিসা : ১০৫)।

(ঞ) “হে দাউদ! নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে ধরণির বুকে (আমার) প্রতিনিধি বানিয়েছি,অতএব, সত্যতা সহকারে লোকদের মাঝে বিচার-ফয়সালা কর।” (সূরা সাদ : ২৬)।

(ট)  আবদুর রাহমান ইবনু আবূ বাকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

তিনি বলেন, উবাইদুল্লাহ ইবনু আবূ বাক্‌রা একজন বিচারক ছিলেন। আমার আব্বা তাকে লিখে পাঠালেন, তুমি উত্তেজিত অবস্থায় কখনো দুই পক্ষের মধ্যে বিচারকার্য সমাধা করবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আমি বলতে শুনেছিঃ বিচারক রাগের অবস্থায় যেনো দুই পক্ষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা না করে। (সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ- (২৩১৬), নাসা-ঈ, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-১৩৩৪)।

এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ বলেছেন। আবূ বাকরা (রাঃ)-এর নাম নুফাই।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(ঠ) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন দু’জন লোক (দু’টো পক্ষ) কোন মোকদ্দমা তোমার কাছে আনবে তখন দ্বিতীয় ব্যক্তির (অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য) না শোনা পর্যন্ত প্রথম ব্যক্তির (অভিযোগকারীর) অনূকূলে কোন ফায়সালাহ দেবে না। এ নীতি ধরে ফায়সালাহ করলে তুমি ফায়সালা কিভাবে করতে হয় তার সঠিক ধারা জানতে পারবে।

‘আলী (রাঃ)বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপদেশ দানের পর হতে আমি বরাবর ক্বাযীর দায়িত্ব সম্পাদন করেছি।

বুলগুল মারাম, হাদিস নং-১৩৮৮, আবূ দাউদ ৩৫৮২, তিরমিযী ১৩৩১, আহমাদ ৬৬৮, ১১৫৯, ১৩৪৪। শাইখ আলবানী ইরওয়াউল গালীল ৮/২২৬ গ্রন্থে বলেন, এর সনদ দুর্বল আবার সহীহ তিরমিযীতে ১৩৩১ হাসান বলেছেন। আহমাদ শাকের মুসনাদ আহমাদ ২/২৮৯ গ্রন্থে এর সনদকে সহীহ বলেছেন, ইবনু উসাইমীন তাঁর শারহুল মুমতি ১৫/৩৫৩ গ্রন্থে বলেন,এ হাদীস সম্পর্কে কিছু মন্তব্য রয়েছে কেউ কেউ একে হাসান বলেছেন। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়:

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কোন খিয়ানাতকারী, খিয়ানাতকারিনীর ও কোন হিংসুকের সাক্ষ্য তার মুসলিম ভাইয়ের বিপক্ষে এবং কোন চাকরের সাক্ষ্য তার মালিকেরে পরিবারের পক্ষে গ্রহন করা জায়িয হবে না। (আবূ দাউদ ৩৬০০, আহমাদ ৬৮৬০, ৬৯০১, বুলগুল মারাম, হাদিস নং-১৪০১। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস।

আবু বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকে বড় পাপ বলে গন্য করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করবো না? এ কথাটি তিনি বারবার বললেন। সকলে বললেন, হে আল্লহর রাসুল! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা এবং পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। তিনি হেলান দিয়ে বসেছিলেন, এবার সোজা হয়ে বসলেন। তিনি কথাগুলো বারবার বলতেই থাকলেন; এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আর যদি তিনি না বলতেন।(বুখারী ২৬৫৪, ৬২৭৩, ৬৯১৯, মুসলিম ৮৭, তিরমিযী ১৯০১, ২৩০১, আহমাদ ১৯৮৭২, ১৯৮৮১, বুলগুল মারাম, হাদিস নং-১৪০৪। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

আবূ উমামাহ হারিসী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি স্বীয় মিথ্যা ক্বসমের মাধ্যমে মুসলিমের প্রাপ্য অধিকার আত্মসাৎ করবে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দিবেন। আর তার জন্য জান্নাতকে নিষিদ্ধ করে দেবেন। কোন এক ব্যক্তি তাঁকে বললো, হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি (যুলুম করে আত্মসাৎ করার) বস্তুটি তুচ্ছ হয়? উত্তরে তিনি বললেন, যদিও বাবলা গাছের একটি শাখা হয়।  (বুলগুলমারাম, হাদিস নং-১৪১০,মুসলিম ১৩৭, নাসায়ী ৫৪১৯, আবু দাউদ ২৩২৪।)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

দুই প্রকারের বিচারক জাহান্নামি হবেঃ

বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ক্বাযী (বিচারক) তিন প্রকারের, তার মধ্যে দু’ প্রকার ক্বাযী জাহান্নামী আর এক প্রকার জান্নাতী। যে ক্বাযী সত্য উপলব্ধি করবে এবং তদনুযায়ী ফায়সালাহ করবে সে জান্নাতবাসী হবে, আর এক ক্বাযী সে সত্য উপলব্ধি করবে কিন্তু তদনুযায়ী ফায়সালাহ করবে না, অন্যায়ের ভিত্তিতে ফায়সালাহ করবে সে জাহান্নামী হবে।আর এক ক্বাযী সত্য উপলব্ধি করতে পারবে না, অথচ অজ্ঞতার ভিত্তিতে লোকের জন্য ফায়সালাহ প্রদান করবে সে জাহান্নামী হবে।(তার নীতিভ্রষ্টতা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে)। (আবূ দাউদ ৩৫৭৩, তিরমিযী ১৩২২, ইবনু মাজাহ ২৩১৫, বুলগুল মারাম, হাদিস নং-১৩৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামি আইনের উৎস হচ্ছে চারটি। যথা:

(ক) কুরআন,

(ক) হাদিস,

(গ) ইজমা ও

(ঘ) কিয়াস।

উল্লেখিত চারটি পন্থায় মুসলিম নেতৃবৃন্দকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন করতে হবে। কোনো মানবরচিত আইনে রাষ্ট্র শাসন করা যাবে না। যে সকল নামধারী মুসলমান নেতৃবৃন্দ কুরআনের আইন বাদ দিয়ে মানুষের তৈরী আইন অনুসরণ করে ও বাস্তবায়ন করে এবং তাদেরকে যারা সমর্থন করে বা মানব রচিত আইন বাস্তবায়নে ভোট দেয় তারা সকলেই, কাফের, ফাসেক ও জালেম এবং শেষ পরিনতি জাহান্নাম।

আমরা এখন আলোচনা করব, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অপরাধ ও অপরাধের ইসলামি আইনে ও মানবরচিত আইনে শাস্তি সম্পর্কে। মানবরচিত আইনকে সমর্থন দিলে মুসলমান কিভাবে বেইমান, মোনাফেক, নাস্তিক ও মুরতাদ তথা আল্লাহদ্রোহী হয়ে যায় তা জানতে পারবো। যদিও এইসব মুসলিম সালাত আদায় করে, সাওম পালন করে, দান খয়রাত করে, মাথায় টুপি রাখে ও হজ্জ পালন করে।

কুরআন হাদিস বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, প্রত্যেকটি অপরাধের তিনটি করে দিক আছেঃ

(ক) প্রথমতঃ অপরাধ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

এরপরও যদি কেহ অপরাধ করেই ফেলে তাহলে তার শাস্তি হচ্ছে ২টি। যথা:

(খ) ইহকালীন বা শরিয়াহ আইনে শাস্তি এবং

(গ) পরকালীন শাস্তি।

ইবনু ‘‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ক্বিয়ামাতের দিন নিহত ব্যক্তি নিজ হাতে তার হত্যাকারীকে তার কপালের চুল ও মাথা ধরে নিয়ে আসবে। তার ঘাড়ের কর্তিত রগসমূহ হতে রক্ত বের হতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! এ লোক আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তার হত্যাকারীকে নিয়ে আরশের নিকট পৌছে যাবে। ‘আমর ইবনু দীনার বলেন, লোকেরা ইবনু ‘‘আব্বাস (রাঃ) এর নিকট (হত্যাকারীর) তাওবার বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন (অনুবাদ) : “কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু’মিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন” – (সূরা আন –নিসা ৯৩)। তিনি বলেন, এ আয়াত মানসূখও হয়নি বা তার বিধান পরিবর্তিতও হয়নি। অতএব তার আর তাওবা কিসের।

(সহীহ : মিশকাত তাহক্বীক্ব সানী (৩৪৬৫), তালীকুর রাগীব (৩/২০৩, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-৩০২৯)।

আবূ ‘ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান (গারীব)। কেউ কেউ এ হাদীসটি ‘আমর ইবনু দীনার হতে, তিনি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে এই সূত্রে একই রকম বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তা মারফূ হিসেবে নয়।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

পরকালীন শাস্তি থেকে নিস্তার পেতে ইসলামের বিধান হচ্ছে, সেই অপরাধ দ্বিতীয়বার আর কোনো দিন সে করবে না,  এ মর্মে খুবই অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করা। তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার মনের গতি বিধি লক্ষ্য করে ইচ্ছে করলে মাফ করেও দিতে পারেন।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের এমন কিছু মাওলানা, মুফতি, মুহাদ্দিস, মসজিদের ইমাম- খতিব, কথিত পির-আউলিয়া ও ইসলামিক বক্তা কিংবা বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আছেন যারা তাদের বক্তব্যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সংঘটিত হওয়া অপরাধগুলোর পরকালীন ও নিষেধমূলক কুরআন হাদিসগুলোই বলেন কিন্তু শরিয়াহ আইনে  ইহকালীন শাস্তির কথা কাউকে বলতে শোনা যায় না। উক্ত ব্যক্তিগণ যদি শরিয়াহ আইনমূলক কুরআন-হাদিসগুলো বাস্তবায়নের জন্যে কথা বলতেন তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ বলতে কিছু থাকতো না। আসলে অনেক মুসলিম নেতা কর্মী ও মাওলানারা কুরআনের কিছু আয়াত মানে আর কিছু আয়াত মানে না। এজন্য কিয়ামতে এদেরকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করা হবে।

আল্লাহ বলেন:

(ক) “তোমরাকি কোরআনের কোন কোন অংশ (আয়াত) মানো আর কোন কোন অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্য থেকে এরুপ কাজ করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বে-খবর নন”। (বাকারা-৮৫)।

(খ) “হে নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না কোন কোন লোকনিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরত্ব থাকবে না।তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতিদানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।” (কাহাফঃ ১০৩-১০৫)।

(গ) “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করতে চাইবে, তার থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না। আখেরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)।

(ঘ) নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন: হযরত হারিসুল আশয়ারী (রঃ)হতে বর্ণিত। নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি (১) জামায়াত বদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) তার আদেশ মেনে চলব (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, যে ব্যক্তি ইসলামি সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত দূরে সরে গেল, সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল, তবে সে যদি সংগঠনে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের নিয়ম নীতির দিকে (লোকদের) আহবান জানায় সে জাহান্নামী। যদিও সে সাওম পালন করে ,সালাত আদায় করে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে।(মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)।

উক্ত হাদিস হতে পাঁচটি বিষয় জানা যায়-

(ক)  জামায়াতবদ্ধ হবে।

(খ)  নেতার কথা মন দিয়ে শুনবে।

(গ)  তার আদেশ মেনে চলবে।

(ঘ)  আলাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করে চলবে।

(ঙ)  আলাহর পথে জিহাদ করবে।

যে ব্যক্তি ইসলামি সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত, পরিমাণ দুরে সরে গেল, সে তার নিজ গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল; তবে সে যদি সংগঠনে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে তবে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের নিয়ম নীতির দিকে মানুষকে আহবান জানায় সে জাহান্নামি। যদিও মুসলমান বলে দাবী করে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী)

হাদীসের গুরুত্বঃ

এখানে ইসলামের এমন পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা বাদ দিলে ইসলামী সমাজের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। ইসলামের যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব নয়।

 ব্যাখ্যাঃ

হাদীসটির শুরুতেই রাসূল (সা:) আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে এ আদেশ দিয়েছেন।

(ক) জামায়াত বদ্ধ হওয়াঃ মূল শব্দ অর্থ হচ্ছে বিক্ষিপ্ত কোন বস্তুকে একত্রিত করা। এ থেকে অর্থ দল, জামায়াত ও  সংগঠন।

অর্থ-“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকতেই হবে যারা মানবজাতিকে কল্যানের পথে ডাকবে। (আল ইমরান-১০৪)

কুরআনের ভাষায়  সংগঠনঃ

(খ) “তোমরা সংঘবদ্ধ ভাবে আলাহর রজ্জুকে আকড়ে ধর ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।” (আল ইমরান-১০৩)

(গ) “আর যে ব্যক্তি আলাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারন করবে সে অবশ্যই সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শিত হবে। (আল ইমরান-১০১)।

(ঘ) “আলাহ তায়ালা তো সেই সব লোকদেরকে ভালবাসেন যারা তার পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসা ঢালা প্রাচীর।” (সফ-৪)।

(ঙ)  “তোমরা সেসব লোকের মতো হয়োনা যারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নির্দেশ পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” ( আল ইমরান-১০৫)।

আল্লাহর আইন অনুসারে না চলার কয়েকটি পর্যায় হতে পারেঃ

(ক)  আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনে বিচার-ফয়সালা পরিচালনা জায়েয মনে করা।

(খ)  আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কোন আইন দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা উত্তম মনে করা।

(গ) আল্লাহর আইন ও অন্য কোন আইন শাসনকার্য ও বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের মনে করা।

(ঘ)  আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য কোন আইন প্রতিষ্ঠা করা।

উপরোক্ত যে কোনো একটি কেউ বিশ্বাস করলে সে সর্বসম্মতভাবে কাফের হয়ে যাবে (এর জন্য দেখুনঃ শাইখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলে শাইখ প্রণিত গ্রন্থঃ 'তাহকীমুল কাওয়ানীন')।

ইসলামি দন্ডবিধির  চারটি  ধারাঃ  যথাঃ

(১)  কিসাস ও জিনায়াত।

(২)  হুদুদ বা হদ্দ।

(৩)  তাযীর।

(৪) মুখালাফাত।

বিস্তারিত আলোচনাঃ

(১)  কিসাস ও জিনায়াতঃ (মানব হত্যা ও জখম সম্পর্কে)

কিসাসঃ শাব্দিক অর্থ হল অনুরূপ করা বা সমান করা। শরীআতের পরিভাষায়, “হত্যা বা জখমের ক্ষেত্রে অনুরূপতা নীতিভিত্তিক ন্যায়বিচারকে কিসাস বলে”। কাজেই চোখের বদল চোখ, নাকের বদলে নাক, এবং হত্যার বদলা হত্যা এটাই হল কিসাস।

আল্লাহ বলেন,

আর আমরা তাদের উপর তাতে অত্যাবশ্যক করে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ যখম। তারপর কেউ তা ক্ষমা করলে তা তার জন্য কাফফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম। (সূরা মায়িদাঃ ৪৫)।

খুনের বদলা খুন সম্পর্কে হাদিসসমূহঃ

(১) খুনের বদলে খুনঃ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একটি বালিকা গহনা পরে বাড়ীর বাইরে গেলে একজন ইয়াহুদী তাকে ধরে নিয়ে পাথর দ্বারা আঘাত করে তার মাথা থেতলিয়ে দেয় এবং তার গহনা ছিনিয়ে নেয়। তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আনা হয়। সে মুহুর্তেও তার মধ্যে জীবনের স্পন্দন অবশিষ্ট ছিল। তিনি প্রশ্ন করেনঃ কে তোমাকে হত্যা করেছে, অমুক লোক কি? সে মাথার ইশারায় বলল, না। তিনি আবার প্রশ্ন করেন। তাহলে কি অমুক লোক। এভাবে তিনি নাম উচ্চারণ করতে করতে বললেনঃ অমুক ইয়াহুদী? সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, তাকে ধরে আনা হলে সে ঘটনার স্বীকারোক্তি করল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশে তার মাথা দুই পাথরের মাঝে রেখে থেঁতলিয়ে দেওয়া হল।

(বুখারী ২৪১৩, ২৭৪৬, ৬৮৭৬, ৬৮৭৭, মুসলিম ১৬৭২, তিরমিয়ী ১৩৯৪, নাসায়ী ৪৭৪০, ৪৭৪১, আর দাউদ ৪৫২৭,৪৫২৮, ৪৫২৯, ইবন মাজাহ ২৬৬৫, ২৬৬৬; আহমাদ ১২২৫৬, ১২৩৩০, দারেমী ২৩৫৫ ।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(২) কিয়ামাতের দিবসে মানুষের সবার আগে খুনের বিচার করা হবেঃ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কিয়ামাতের দিবসে মানুষের হক্ব প্রসঙ্গে সবার আগে খুনের বিচার করা হবে।

(বুখারী ৬৮৬৪, মুসলিম ১৬৭৮,তিরমিযী ১৩৯৬, ১৩৯৭, নাসায়ী ৩৯৯১,৩৯৯২, ইবনু মাজাহ ২৬১৫, ২৬১৭,আহমাদ ৩৬৬৫, ৪১৮৮, ৪২০১।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৩) ছেলেকে খুনের অপরাধে বাবাকে হত্যা করা যাবে নাঃ

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ও ইবনু আব্বাস (রাঃ)  থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি ছেলেকে খুনের অপরাধে বাবাকে হত্যা করা যাবে না। সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ- (২৬৬২), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪০০, ১৪০১। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৪) যিম্মাদারীকে খুন করলে সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবে নাঃ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সাবধান! যে লোক সন্ধি-চুক্তি করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যিম্মা (নিরাপত্তা) নিয়েছে তাকে যে লোক খুন করল সে আল্রাহ তা‘আলার যিম্মাদারীকে ছিন্ন করল। সে জান্নাতের সুগন্ধটুকুও লাভ করবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ সত্তর বছরের দুরত্ব (পথ) হতেও পাওয়া যায়। সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ- (২৬৮৭), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪০৩।

আবূ বাকরা (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ বলেছেন। আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে একাধিক সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৫) অনিচ্ছকৃত হত্যাঃ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আমলে এক লোক নিহত হল। তিনি খুনীকে মৃত ব্যক্তির অভিভাবকদের নিকট সোপর্দ করে দিলেন। খুনী ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ! তাকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মৃত ব্যক্তির অভিভাবকদের) বললেনঃ যদি সে সত্য কথা বলে থাকে এবং এ অবস্থায় তুমি তাকে হত্যা কর তবে তুমি জাহান্নামে যাবে। এ কথার ফলে সে খুনীকে মুক্ত করে দিল। সে চামড়ার রশি দ্বারা পিছন দিক থেকে বাঁধা ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, সে রশি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বেরিয়ে গেল। এরপর হতে তার ডাকনাম হয়ে যায় রশিওয়ালা। সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ- (২৬৯০), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪০৭।

এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ বলেছেন। নিসআতুনঃ রশি

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

 (৬) কাফিরের পরিবর্তে কোন মু’মিনকে (কিসাসস্বরূপ) হত্যা করা যাবে নাঃ

আবূ জুহাইফা (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি আলী (রাঃ)-কে বললাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের নিকট সাদা কাগজে কালো কিছু লেখা (কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা) আছি কি যা আল্লাহ তা‘আলার গ্রন্থে নেই? তিনি উত্তরে বললেন, সেই মহান সত্তার শপথ, যিনি শস্য আবির্ভুত করেছেন এবং প্রাণের সৃষ্টি করেছেন! আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদ প্রসঙ্গে একজন মানুষকে যে বিশেষ জ্ঞান দিয়েছেন এবং এই সহীফার মধ্যে যা কিছু আছে তার বেশি কিছু আমি জানি না। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম, সহীফার মধ্যে কি আছে? তিনি বললেন, তাতে রক্তপণ এবং দাসমুক্তি সম্পর্কিত বিধান আছে। তাতে আরো আছে, কাফিরের পরিবর্তে কোন মু’মিনকে (কিসাসস্বরূপ) হত্যা করা যাবে না। সহীহ্, ইবনু মা-জাহ- (২৬৫৮), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪১২।

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে । আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ বলেছেন। এই হাদীস মোতাবেক একদল বিশেষজ্ঞ আলিম আমল করেছেন। সুফিয়ান সাওরী, মালিক ইবনু আনাস, শাফিঈ, আহ্‌মাদ ও ইসহাক (রাঃ) বলেছেন, কাফিরকে খুনের অপরাধে মুসলমানকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা যাবে না। অন্য এক দল বলেছেন, চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের কোন কাফিরকে খুন করার দায়ে মুসলমানকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা বৈধ। কিন্তু প্রথম মতই অনেক বেশি সহীহ্। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৭) জখমের জন্যও রয়েছে কিসাসঃ

ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

একজন লোক তার দাঁত দিয়ে অন্য একজনের হাত কামড়ে ধরে। ঐ লোক তার হাতকে টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার ফলে প্রথম লোকটির সামনে দু’টি দাঁত উপড়ে যায়। তারা দু’জনেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট অভিযোগ উত্থাপন করলে তিনি বললেনঃ তোমাদের কোন লোক কি উটের মত দাঁত দিয়ে তার ভাইকে কামড় দেয়? তোমার কোন দিয়াত প্রাপ্য নেই। অনন্তর মহান আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ “জখমের জন্যও রয়েছে কিসাস” (সূরাঃ মাইদা-৪৫)।

সহীহ্‌, নাসা-ঈ, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪১৬।

ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা ও সালামা ইবনু উমাইয়্যা (রাঃ) হতেও এ অনচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছ। তারা দু’জন সহোদর ভাই। ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্ বলেছেন। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

 (৮) কোনো জখম আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত জখমী লোকের পক্ষে কোন বদলা আদায়ের ফয়সালা দিতে নিষেধ করেছেনঃ

শুআইব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ কোন এক লোক অন্য এক লোকের হাঁটুতে শিং দ্বারা আঘাত করে । সে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে বললোঃ আমার বদলা নিয়ে দিন। তিনি বললেনঃ তুমি ক্ষত সেরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। লোকটি কিন্তু (সেরে যাওয়ার আগেই) আবার এসে বললোঃ আমার জখমের মূল্য বা খেসারত আদায় করে দিন। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার খেসারত আদায় করে দেন। তারপর লোকটি এসে বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো খোড়া হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম তুমি তা মাননি। ফলে আল্লাহ তোমাকে (তাঁর রহমাত হতে) দূর করে দিয়েছেন এবং তোমার খোড়াত্ব বাতিল হয়ে গেছে। (দিয়াত আদায়ের যোগ্য রাখেননি)। এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন জখম আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত জখমী লোকের পক্ষে কোন বদলা আদায়ের ফয়সালা দিতে নিষেধ করেছেন।

(আহমাদ ২১৭, দারাকুতনী ৩/৮৮ এর সনদে ইরসালের দোষ থাকলেও তা ক্ষতিকর নয়, কেননা অনেকগুলো শাহেদ থাকার কারণে এটি সহীহর পর্যায়ভুক্ত। ইমাম সনআনী বলেন, এর সমার্থক হাদীস থাকার কারণে এটিকে শক্তিশালী করেছে। ইবনু তুর্কমান বলেন, ৮৬৭, অনেক সনদে বর্ণিত বলে একে অপরকে শক্তিশালী করেছে।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

জিনায়াত: জিনায়াত হচ্ছে “ব্যক্তির অধিকার এবং ক্ষমা করারও অধিকারী”। মূলতঃ হত্যাকান্ড সংক্রান্ত ঘটনাগুলো হতে পারে তা বেআইনীভাবে কিংবা দূর্ঘটনাবশতঃ, এবং নিহত ব্যক্তির স্বজন বা পরিবারের দিয়তের বিনিময়ে ক্ষমা করার অধিকার এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ স্বরূপঃ

(ক) যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে খুন করে তার ক্ষেত্রে দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ যার মধ্যে ৪০টি হতে হবে গর্ভবতী।

(খ) যদি কোন ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে খুন করে সেক্ষেত্রে তার দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ।

ইমাম আন-নাসায়ী তার বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করেন যে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য দিয়ত রয়েছে, যেমন চোখের জন্য রক্ত পণ হচ্ছে ৫০টি উটের সমপরিমাণ।

হাদিসসমূহঃ

(১)  নিহতের ওয়ারিসগণ চাইলে হত্যাও করতে পারে ক্ষমাও করতে পারেঃ

 (ক)  আমর ইবনু শুআইব (রহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও দাদার সূত্রে থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে কোন ব্যক্তিকে খুন করবে তাকে নিহতের ওয়ারিসগণের নিকট সোপর্দ করা হবে। তারা চাইলে তাকে হত্যাও করতে পারে অথবা রক্তপণও আদায় করতে পারে। রক্তপণের পরিমাণ তিন বছরের ত্রিশটি উষ্ট্রী, চার বছরের ত্রিশটি উট এবং চল্লিশটি গাভিন উষ্ট্রী হতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনরকম সমাধান হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। রক্তপণকে কঠোর করার জন্য এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। (হাসান, ইবনু মা-জাহ, হাদিস নং-২৬২৬, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-১৩৮৭)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান গারীব বলেছেন। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস

(খ)  আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মক্কা-বিজয় দান করলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও গুনগান করার পর বললেনঃ যার আপন কেউ নিহত হয়েছে সে দু’টি বিকল্পের মধ্যে একটি গ্রহণ করতে পারে। সে চাইলে খুনীকে ক্ষমাও করতে পারে অথবা তাকে হত্যাও করতে পারে।

সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ (২৬২৪), জামে আত তিরিমিজি, হাদিস নং-

ওয়াইল ইবনু হুজর, আনাস ও আবূ শুরাইহ খুয়াইলিদ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(২) হাড় দেখা যায় এরূপ জখমের জন্যে রক্তপণের পরিমাণ হবে পাঁচটি করে উটঃ

আমর ইবনু শুআইব (রহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও দাদার সূত্র থেকে বর্ণিতঃ

আমর ইবনু শুআইব (রহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মূযিহার (হাড় দেখা যায় এরূপ জখমের) রক্তপণের পরিমাণ হবে পাঁচটি করে উট।

(হাসান সহীহ্‌, ইবনু মা-জাহ- হাদিস নং-২৬৫৫, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-১৩৯০)

এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ বলেছেন। এ হাদীস মোতাবেক আলিমগণ আমল করেছেন। এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন সুফিয়ান সাওরী, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকও। তারা বলেন, মূযিহার (হাড় বের হয়ে যাওয়া জখমের) রক্তপণের পরিমাণ হবে পাঁচটি করে উট। হাদিসের মানঃ হাসান সহিহ

(৩) একেকটি আঙ্গুলের জন্য রক্তপণের পরিমাণ হবে দশটি করে উটঃ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ হাত ও পায়ের আঙ্গুলসমূহের একই পরিমাণ রক্তপণ ধার্য হবে। একেকটি আঙ্গুলের জন্য রক্তপণের পরিমাণ হবে দশটি করে উট।

(সহীহ্‌, ইরওয়া-হাদিস নং-২২৭১, জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং-১৩৯১)

আবূ মূসা ও আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। এই সূত্রে ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্‌ গারীব বলেছেন। এ হাদীস মোতাবেক একদল আলিম আমল করেছেন। একইরকম কথা বলেছেন (প্রতিটি আঙ্গুলের রক্তপণ দশটি উট) সুফিয়ান সাওরী, শাফিঈ, আহমাদ এবং ইসহাকও। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৪) পাথর মেরে গর্ভবতী  মহিলাকে হত্যার দিয়াত আদায়ঃ

(ক)  আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

হুযাইল গোত্রের দু'জন মহিলা উভয়ে মারামারি করেছিল। তাদের একজন অন্যজনের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পাথর গিয়ে তার পেটে লাগে। সে ছিল গর্ভবতী। ফলে তার পেটের বাচ্চাকে সে হত্যা করে। তারপর তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট অভিযোগ দায়ের করে। তিনি ফয়সালা দেন যে, এর পেটের সন্তানের বদলে একটি পূর্ণ দাস অথবা দাসী দিতে হবে। আর নিহত মেয়েটির জন্য হত্যাকারিণীর আসাবাগণের (অভিভাবকদের) উপর দিয়াত (একশত উট) দেয়ার নির্দেশ দেন এবং এ দিয়াতের ওয়ারিসদের মধ্যে নিহত মহিলার সন্তান ও তাদের সঙ্গে অন্য যারা অংশীদার রয়েছে তাদের শামিল করেন। এরূপ ফায়সালার জন্য হামাল বিন নাবিগাহ আল-হুযালী বললঃ হে আল্লাহর রসূল! এমন সন্তানের জন্য আমার উপর জরিমানা কেন হবে, যে পান করেনি, খাদ্য খায়নি, কথা বলেনি এবং কান্নাকাটিও করেনি। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছন্দযুক্ত কথার জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ এ তো (দেখছি) গণকদের ভাই।

(বুখারী ৫৭৫৮, ৫৭৬০, ৬৭৪০, ৬৯০৪, মুসলিম ১৬৮১, তিরমিয়ী ১৪১০, ২১:১১, নাসায়ী ৪৮১৭, ৪৮১৯, আর দাউদ ৪৫৭৬, ইবনু মাজাহ ২৬৩৯, আহমাদ ৭১৭৬, ৭৬৪৬, ২৭২১২, মালেক ১৬০৮, ১৬০৯, দারেমী ২৩৮২। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিসহাদিস

(খ) মুগীরা ইবনু শুবা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

দু’জন স্ত্রীলোক একে অপরের সতীন ছিল। তাদের মধ্যে একে অন্যের উপর পাথর অথবা তাঁবুর খুঁটি ছুঁড়ে মারে। ফলে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ভ্রুণের রক্তপণ হিসেবে একটি যুবক অর্থ্যাৎ গোলাম অথবা বাঁদী প্রদানের ফায়সালা দেন। তিনি ঐ মহিলাটির পিতার বংশের লোকদের উপর তা পরিশোধের দায় অর্পণ করেন। সহীহ্, ইরওয়া (২৬০৬), নাসা-ঈ, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪১১।

উপরোক্ত হাদীসের মত হাসান-যাইদ ইবনু হুবাব হতে, তিনি সুফিয়ান হতে, তিনি মানসূর (রহঃ) –এর সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ্ বলেছেন। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৫) কান কাটার ফলে দিয়াত আদায়ঃ

ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

গরীব লোকেদের কোন এক ছেলে ধনী লোকদের কোন এক বালকের কান কেটে ফেলে। তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটে বিচার প্রার্থী হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের জন্য কোন দিয়াত দেয়ার ব্যবস্থা করেননি। (তাদের পক্ষে ক্ষতিপূরণ সম্ভব ছিল না বলে)।  (আর দাউদ ৪৫৯০, নাসায়ী ৪৭৫১, নাসায়ী ৪৭৫১, দারেমী ২৩৬৮।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৬) দিয়াতের হিসাবঃ

দাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়ামান প্রদেশের অধিবাসীবৃন্দকে লিখেছিলেন ঐ হাদীসে (ঐ পত্রে) এটাও লিখেছিলেন- এটা নিশ্চিত যে, কেউ যদি কোন মুমিন মুসলিমকে বিনা অপরাধে হত্যা করে এবং ঐ হত্যা প্রমাণিত হয় তবে তাতে প্রাণদন্ড হবে; কিন্তু নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ যদি অন্য কোনভাবে (ক্ষমা করতে বা ক্ষতিপূরণ নিতে) রাজি হয় তবে তার প্রাণদন্ড হবে না। প্রাণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে একশত উট দেয়া হবে। নাক যদি সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয় তবে তাতে একশত উট দেয়া হবে; জিহ্বা কেটে ফেলা হলে পূর্ণ দিয়াত (১০০ উট) দেয়া হবে; উভয় ঠোঁট কেটে ফেলা হলে পূর্ণ দিয়াত দিতে হবে; পুরুষাঙ্গ কাটা হলে পূর্ণ খেসারত (১০০ উট) দেয়া হবে; উভয় অন্ডকোষ নষ্ট করা হলে পূর্ণ দিয়াত লাগবে; এবং মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেললে পূর্ণ দিয়াত লাগবে। (একটা অন্ডকোষের জন্য ৫০ টি উট দেয়া।) উভয় চক্ষু নষ্ট করা হলে একশত উট দেয়া হবে।

তারপর এক পায়ের জন্য অর্ধেক এবং অর্ধেক মাথার আঘাত প্রাপ্ত হলে এক তৃতীয়াংশ দিয়াত দিতে হবে; পেটে কিছু বিদ্ধ করা হলে (যদি পেটের ভিতরে গিয়ে পৌছে) তবে এক তৃতীয়াংশ দিয়েত দিতে হবে, হাত পায়ের আঙ্গুলগুলোর যে কোন ১ টির জন্য ১০টি উট, একটি দাতের জন্য ৫টি উট, যে আঘাতের ফলে মাথা ও মুখ ছাড়া হাড় ঠেলে উঠে বা অন্য কোন কারণে দৃশ্যমান হয়ে উঠে তাতে ৫টি উট দেয়া হবে।

তারপর এটাও নিশ্চিত যে, (কোন পুরুষ কোন রমণীকে হত্যা করে তবে) নিহত স্ত্রীলোকের কারণে হত্যাকারী অপরাধী পুরুষকে হত্যা করা হবে। হত্যাকারীর যদি স্বর্ণমুদ্রা থাকে তবে সে একহাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) নিহতের ওয়ারিসকে প্রদান করবে।

হাদীসটি আবু দাউদ তার মুরসাল সনদের হাদীসগুলোর মধ্যে রিওয়ায়াত করেছেন। নাসাঈ, ইবনু খুযাইমাহ, ইবনুল হিব্বান, আহমদ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর সহীহ হওয়া প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ রয়েছে। (মুরসাল সনদ প্রসঙ্গে এরূপ অভিমত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাদীসটি ফুকাহাগণের নিকটে স্বীকৃতি লাভ করেছে ও এ হাদীসের উপর আমল হয়ে আসছে।)

ইমাম শওক্বানী তাঁর আস সাইলুল জাররার ৪/৪৪৩ গ্রন্থে বলেন, ইমামগণ তাকে গ্রহণকরেছেন। শাইখ আলবানী যঈফ নাসায়ী ৪৮৬৮ গ্রন্থে একে যঈফ উল্লেখ করে বলেন, এর অধিকাংশের শাহিদ রয়েছে। আর তিনি তাখরীজ মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৪২১ গ্রন্থে বলেন, এর সনদেঃ সনদটি মুরসালের দোষে দুষ্ট। ইবনু উসাইমীন তাঁর শরহে বুলুগুল মারাম ৫/২৬১ গ্রন্থে বলেন, হাদীসটি মুরসাল। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৭) হাড় দৃশ্যমান হয়ে উঠে তার দিয়াত (খেসারত) পাঁচটি উট দিতে হবেঃ

আমর ইবনু শু’আইব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যে সকল আঘাতের ফলে হাড় দৃশ্যমান হয়ে উঠে তার দিয়াত (খেসারত) পাঁচটি উট দিতে হবে। সবগুলো আঙ্গুলের দিয়াত দশটি করে উট।

আবূ দাউদ ৪৫৬৬, তিরমিযী ১৩৯০, নাসায়ী ৪৮৫২, ইবনু মাজাহ ২৬৫৫, আহমাদ ৬৬৪৩, ৬৭৩৩, ৬৯৭৩, দারেমী ২৩৭২। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস

(৮) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পক্ষ হতে একশ’ উট রক্তপণ বাবদ আদায় করে দিলেনঃ

সাহ্‌ল ইব্‌নু হাসমা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিইনি ও তাঁর কওমের কতক বড় বড় ব্যক্তি বর্ণনা করেন যে, ‘আব্দুল্লাহ্ ইব্‌নু সাহ্‌ল ও মুহাইয়াসা ক্ষুধার্ত হয়ে খায়বারে আসেন। একদা মুহাইয়াসা জানতে পারেন যে, ‘আব্দুল্লাহ্‌ নিহত হয়েছে এবং তাঁর লাশ একটা গরতে অথবা কূপে ফেলে দেয়া হয়েছে। তখন তিনি ইয়াহূদীদের কাছে এসে বললেন, আল্লাহ্‌র শপথ! নিঃসন্দেহে তোমরাই তাকে মেরে ফেলেছ। তারা বলল, আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি, আমরা তাকে হত্যা করিনি। তারপর তিনি তার কওমের কাছে এসে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। পরে তিনি, তার বড় ভাই হওয়াইয়াসা এবং ‘আবদুর রহমান ইবনু সাহ্‌ল আসলেন। মুহাইয়াসা, যিনি খায়বারে ছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকত এ ঘটনা বলার জন্য এগিয়ে গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ বড়কে কথা বলতে দাও, বড়কে কথা বলতে দাও। এ দ্বারা তিনি উদ্দেশ্য করলেন বয়সে বড়কে। তখন হুওয়াইয়াসা প্রথমে ঘটনা বর্ণনা করলেন। এরপর কথা বললেন, মুহাইয়াসা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হয় তারা তোমাদের মৃত সাথীর রক্তপণ আদায় করবে, না হয় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কাছে এ ব্যাপারে পত্র লিখলেন। জবাবে লেখা হল যে, আমরা তাকে হত্যা করিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুওয়াইয়াসা, মুহাইয়াসা ও ‘আবদুর রহমানকে বললেন, তোমরা কি কসম করে বলতে পারবে? তাহলে তোমরা তোমাদের সঙ্গীর রক্তপণের অধিকারী হবে। তারা বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে ইয়াহূদীরা কি তোমাদের সামনে কসম করবে? তাঁরা বলল, এরা তো মুসলমান না। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পক্ষ হতে একশ’ উট রক্তপণ বাবদ আদায় করে দিলেন। অবশেষে উটগুলোকে ঘরে ঢুকানো হল। সাহ্‌ল বলেন, ওগুলো থেকে একটা উট আমাকে লাথি মেরেছিল।

(বুখারী ২৭০২, ৩১৭৩, ৬১৪২,৬৮৯৮, ৭১৯২, মুসলিম ১৬৬৯, তিরমিযী ১৪২২, নাসায়ী ৪৭১৩, ৪৭১৪, ৪৭১৫, আবূ দাউদ ৪৫২০, ৪৫২১, ইবনু মাজাহ ২৬৭৭।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

হত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাঃ (ইসলামি আইন ও মানব রচিত আইন)-

মানব হত্যা সম্পর্কে ইসলাম তথা আল্লাহ তায়ালা ও নবি করিম (সঃ) কী বলেছেন,তার শাস্তি কী হবে কিংবা বিচারিক কার্যক্রম কি হবে তার বিধান বা আইন তৈরি করা আছে।নবি করিম (সাঃ) একদিকে যেমন ছিলেন ধর্ম প্রচারক অন্য দিকে তেমনি ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্র নায়ক, একজন সফল রাজনীতিবীদ।তিনিই একমাত্র একজন সফল রাষ্ট্রপতি যিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সকল আইন কানুন তৈরি করে রেখে গেছেন। আমরা মুসলমান, আমরা নবি করিম (সাঃ) এর অনুসারি। আমরা তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল। তাঁর তৈরিকৃত সকল আইন কানুন বা নিয়ম নীতি বা আদর্শ আমরা মেনে চলব। অন্য কোনো ব্যক্তির আদর্শ আমরা মানবো না। এখন আসি খুন বা হত্যা সম্পর্কে ইসলাম কি আইন তৈরী করেছে আর বাংলাদেশের মুসলিম রাজনীতিবীদরা সংসদে বসে কি আইন তৈরী করেছে, যাদেরকে আমরা ভোট দিয়ে সংসদে প্রেরণ করেছি, সে সম্পর্কে জেনে নেই।

মহান আল্লাহ তাআলার নিকট শিরকের পরে সবচেয়ে গর্হিত ও মন্দকাজ হত্যা বা কতল। পৃথিবীর ইতিহাসে হত্যাই প্রথম পাপ। হাবীল ও কাবীলের ঘটনা এক্ষেত্রে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। হত্যা বলতে কোন কিছুর আঘাতে, অস্ত্রের সাহায্যে, পাথর নিক্ষেপে, বিষপ্রয়োগে বা অন্য কোন উপায়ে মানুষের প্রাণনাশ করাকে বুঝায়। মানব হত্যা একটি মানবতা বিধ্বংসী জঘন্যতম অপরাধ। যখন কেউ তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এ অপরাধ করল সে যেন গোটা মানবতার বিরুদ্ধে এ অপরাধ করল। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘একজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেমন গোটা মানব জাতির জীবন বাঁচানোর সমতুল্য, ঠিক তেমনি কোন মানুষের জীবন সংহার করা গোটামানব জাতিকে ধ্বংস করার সমতুল্য।’ [আল-কুরআন- ৫:৩২]

উপরোক্ত আয়াতে কারিমার তাৎপর্য পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, হত্যা কতটা মন্দ, গর্হিত, বিবেক বর্জিত ও জঘন্য। যদিও প্রাণনাশের বিনিময়ে দিয়াত বা রক্তমূল্যের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের জন্য ইসলাম সংশোধনের ব্যবস্থা রেখেছে, কিংবা কিসাসের মাধ্যমে প্রতিশোধের সুযোগ রয়েছে, তা সত্ত্বেও জীবনের বা প্রাণের মূল্য কি আর দেওয়া হয়? রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, “কোন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চাইতে  দুনিয়াটা ধ্বংস হয়ে যাওয়াই আল্লাহর নিকট অধিকতর সহজ।” মুমিনের জীবনের মূল্য আল্লাহর নিকট অত্যাধিক। এ পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের চেয়ে আল্লাহর নিকট মুমিনের মূল্য বেশি। এ ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা. এর উপরোক্ত বানীটিই প্রণিধান যোগ্য। যে জিনিসের মূল্য বেশি তার হারানোর বেদনাও ততবেশি। আর অন্যায়ভাবে কেউ যদি কারো প্রাণনাশ করে তবে তার জন্য রয়েছে কড়া শাস্তির হুশিয়ারি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

“যে কোন লোক কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার প্রতিফল হচ্ছে জাহান্নাম। সে চিরকালই সেখানে থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রদ্ধ হন এবং তার প্রতি অভিশাপ করেন। উপরন্তু তিনি তার জন্য কঠিন আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [আল কুরআন- ৪:৯৩]

হত্যার ধরণ ও প্রকৃতির আলোকে ইসলামী আইনে হত্যাকে পাঁচ প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ও ধরণের আলোকে হত্যার প্রকারভেদসমূহ নিম্নরূপ :

১. ইচ্ছাকৃত হত্যা

২. প্রায় ইচ্ছামূলক হত্যা

৩. ভুলবশত হত্যা

৪. প্রায় ভুলবশত হত্যা

৫. কারণবশত হত্যা

১.ইচ্ছাকৃত হত্যা : কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে যখন এমন কাজ করে যার দ্বারা অন্য ব্যক্তির পাণনাশ হয়, তখন তার সে কাজকে ‘ইচ্ছাকৃত হত্যা’ বলা হয় এবং এর জন্য কিসাসের বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, কিসাস আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পদাংক অনুসরণ করা, সমান বদলা গ্রহণ করা, সাদৃশ্য বজায় রাখা, অনুরূপ করা। ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় অপরাধীকে তার অপরাধ সদৃশ শাস্তি প্রদানকে কিসাস বলা হয়। যেমন হত্যার বদলায় হত্যা করা, যখমের বদলায় যখম করা। কিসাস সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা, “হে মুমিগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের পরিবর্তে ক্রীতদাস, এবং নারীর পরিবর্তে নারী। (নিহত ব্যাক্তির) তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু ক্ষমা করে দেয়া হলে ন্যায়নীতির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার দিয়ত আদায় করা বিধেয়। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সহজীকরণ ও রহমত বিশেষ।” [আল কুরআন- ২:১৭৮]

আরো বলা হচ্ছে, “তাদের জন্য আমরা তাতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখম সমূহের বদলে অনুরূপ যখন। আর যে ক্ষমা করে দেয়, তা তার পাপের জন্য কাফফারা হবে।” [আল কুরআন- ৫:৩৪]

কুরআনের অন্য জায়গায় রয়েছে, “কেউ অন্যায় ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি। কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে। সে তো সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে।” [আল কুরআন- ১৭:৩৩]

রাসুলুল্লাহ সা.-ও অনুরূপ কথা বলেছেন, “যার কোন ব্যক্তি নিহত হবে, তার দু’টি ইখতিয়ার রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে রক্তমূল্যও নিতে পারবে, ইচ্ছা করলে কিসাসও গ্রহণ করতে পারবে।” [সহিহ বুখারি-কিতাবুত দিয়াত : হা. ৬৪৮৬, আবু দাউদ-কিতাবুদ দিয়াত : হা. ৪৫০৫]

২. প্রায় ইচ্ছামূলক হত্যা : যে ধরণের বস্তু দ্বারা সাধারণত হত্যা সংঘটিত হয় না; সেই ধরণের কোন বস্তুর দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হলে সে হত্যাকে ‘প্রায় ইচ্ছামূলক হত্যা’ বলা হয় এবং এর জন্য দিয়াতের বিধান প্রযোজ্য হবে।

ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে, দেহ কাটেনা বা দেহে বিদ্ধ হয় না- এধরণের কোন বস্তু দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা সংঘটিত হলে তাকে ‘প্রায় ইচ্ছামূলক হত্যা’ বলে। যেমন সাম্প্রতিককালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ড. তাহের হত্যা মামলা। পক্ষান্তরে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ রহ. এর মতে যে সব বস্তু দ্বারা সাধারণত হত্যা করা যায় না- এধরণের বস্তু (যেমন- ক্ষুদ্র পাথর, ক্ষুদ্র লাঠি, চাবুক, কলম ইত্যাদি) দ্বারা হত্যা সংঘটিত হলে তাকে ‘প্রায় ইচ্ছামূলক হত্যা’ বলে। এ প্রকারের হত্যার ক্ষেত্রে যেহেতু হত্যাকারীর হত্যা করার ইচ্ছা ছিল কিনাÑ এব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, তাই এধরণের হত্যার বেলায় কিসাসের বিধান প্রযোজ্য হবে না। তবে যদি হত্যাকারীর ইচ্ছা, (গধৎং জবধ) বা দুষ্ট মানসিকতা প্রমাণিত হয় তবে কিসাসের বিধান প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে বা দিয়াতের কঠোর বিধান প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে দিয়াত বাধ্যতামূলক হবার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাফফারার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু অগ্রগণ্য মত হল কাফফারা ওয়াজিব হবে।

৩. ভুলবশত হত্যা : নিষিদ্ধ নয়, এমন কোন কাজ করার সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে ভুলবশত হত্যা সংঘটিত হলে তাকে ‘ভুলবশত হত্যা’ বলা হয় এবং এর জন্য দিয়াত ও কাফফারা ওয়াজিব হবে।

এ ভুল কয়েকভাবে হতে পারে। ক. কর্তার ধারণার মধ্যে, খ. কাজের মধ্যে এবং গ. ধারণা ও কাজ উভয়ের মধ্যে হতে পারে।

(ক) কর্তার ধারণায় ভুলঃ  যেমন, শিকারী ব্যক্তি কোন মানুষকে শিকারের পশু মনে করে তার প্রতি তীর বা গুলি নিক্ষেপ করল, পরে দেখা গেল যে, সে মানুষ, শিকারের প্রার্থী নয়। অনুরূপ ভাবে কোন মানুষকে শত্র“ সৈন্য মনে করে তীর নিক্ষেপ করল, পরে দেখা গেল যে, সে শত্র“ সৈন্য নয়। এক্ষেত্রে অপরাধীর কাজের মধ্যে ভুল হয়নি; কারণ সে যা মারতে চেয়েছে তাই মেরেছে; বরং ভুল হয়েছে তার ধারণা বা অনুমানের মধ্যে।

(খ) কর্তার কাজের ভুলঃ যেমন, এক শিকারী একটি হরিণের প্রতি গুলি ছুড়ল; কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা ঝোপের মধ্যে অন্য কোন কাজে রত মানুষের দেহে বিদ্ধ হল এবং এর ফলে সে মারা গেল। অনুরূপভাবে শত্র“ সৈন্যকে টার্গেট করে তীর মারল বা গুলি ছুঁড়ল, কিন্তু তীর বা গুলিটি লক্ষচ্যুত হয়ে অপর কোন ব্যক্তির উপর আঘাত করল এবং এর ফলে সে মারা গেল।

(গ)  ধারণা ও কাজঃ উভয়ে ভুল : যেমন- শিকারী ব্যক্তি কোন মানুষকে শিকারের পশু মনে করে তার প্রতি তীর বা গুলি নিক্ষেপ করল; কিন্তু তা লক্ষভ্রষ্ট হয়ে অপর ব্যক্তির দেহে বিদ্ধ হল এবং এর ফলে সে মারা গেল। এ ক্ষেত্রে সে মানুষকে শিকারের পশু মনে করে নিজের অনুমানে ভুল করেছে এবং যার প্রতি তীর বা গুলি নিক্ষেপ করেছে তা তার পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির শরীরে গিয়ে লাগায় সে কাজেও ভুল করেছে।

(৪) প্রায় ভুলবশত হত্যা : কোন ব্যক্তির কোন কাজের দ্বারা হত্যা সংঘটিত হলে তাকে ‘প্রায় ভুলবশত হত্যা’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধীর কোন ধরনের সংকল্প ছাড়াই হত্যা সংঘটিত হয় বলে একে ‘প্রায় ভুলবশত হত্যা’ নামে অভিহিত করা হয়। যেমন, কোন ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় পার্শ্ব পরিবর্তন করার সময় অপর ব্যক্তির ওপর ঘটনাক্রমে উল্টে পড়ল এবং এর ফলে ব্যক্তিটি মারা গেল। এ প্রকারের হত্যা যেহেতু একদিকে অপরাধীর অসতর্কতার কারণেই সংঘটিত হয়েছে, তাই এটা ভুলবশত হত্যার মধ্যে গণ্য হবে এবং এজন্য দিয়ত ওয়াজিব হবে। অপরদিকে যেহেতু অপরাধীর কর্ম ও হত্যার মধ্যে সরাসরি কারণ এর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে তাই এজন্য কাফফারা ও ওয়াজিব হবে।

[আসসাপখসী, আল মাবসুত : খ. ২৬, পৃ. ৬৬, ১০৪]

(৫) কারণবশত হত্যা : কোন ব্যক্তির প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাব জনিত কাজের ফলে অন্য ব্যক্তির প্রাণনাশ হলে তাকে ‘কারণজনিত হত্যা’ বলা হয়। যেমন, কোন ব্যক্তি যাতায়াতের রাস্তার পার্শ্বে গর্ত খনন করল এবং তাতে কোন পথচারী পড়ে গিয়ে মারা গেল অথবা কেউ পথের পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড পাথর রাখল এবং তার সাথে পথচারী ধাক্কা খেয়ে মারা গেল। এ প্রকারের হত্যায় অপরাধী সরাসারি হত্যাকান্ড সংঘটিত করেনা; বরং তার দ্বারা সংঘটিত কোন কাজই হত্যাকান্ডের কারণ হয়। এখানে অপরাধী যে কাজটি করে তা তার জন্য বৈধ; তবে তিনি তার কর্ম সম্পাদনে সীমা লংঘন করেছেন এবং অসতর্কতার পরিচয় দিয়েছে; যার ফলে তার কর্মটি হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রকারের হত্যার মৃত্যুদণ্ড হবে না এবং কাফফারাও ওয়াজিব হবে না। তবে দিয়াত ওয়াজিব হবে।

ইসলামী আইনে হত্যার বদলা মৃত্যুদণ্ড ওয়াজিব ইওয়ার শর্তাবলী : হত্যার বদলা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বা ওয়াজিব হওয়ার কতিপয় শর্ত রয়েছে। এগুলো পাওয়া গেলে হত্যার কিসাস স্বরূপ মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক হবে। এগুলোর কয়েকটি হত্যাকারীর সাথে, আর কয়েকটি নিহত ব্যক্তির সাথে, আর কয়েকটি মৃত্যুদণ্ড দাবীকারীদের সাথে, আর কতিপয় হত্যাকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট।

হত্যাকারীর সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী :

(ক) হত্যাকারী মুকাল্লাফ (বালিগ ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন) হওয়া।

(খ) হত্যাকারী মুসলিম বা ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী অমুসলিম নাগরিক হওয়া।

(গ) হত্যাকারী সন্দেহমুক্ত হত্যার অভিপ্রায় থাকা।

নিহত ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী :

(ক) নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর সন্তান বা অধঃস্তন ব্যক্তি না হওয়া।

(খ) নিহত ব্যক্তি মাসূমুদ্দাম হওয়া। সে যদি অন্য কোন অপরাধে (যেমন হত্যা, ধর্মত্যাগ ও ব্যভিচার প্রভৃতি) হত্যা দন্ডে দন্ডিত হয় কিংবা রাষ্ট্রে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অমুসলিম (হারাবি) হয় তাহলে হত্যাকারীর মৃত্যুদন্ড হবে না।

(গ) নিহত  ব্যক্তি ও হত্যাকারীর মধ্যে শ্রেণী ও অবস্থাগত পার্থক্য না থাকা।

কিসাসের দাবীদারদের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী :

(ক) কিসাসের দাবীদার বিদ্যমান থাকা,

(খ) রক্তের দাবীদারদের শারীরিক ও মানসিক পূর্ণ উপযুক্ততা থাকা।

(গ) নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছদের পক্ষ থেকে কিসাসের দাবী থাকা । রাসুল সা.

বলেছেন, “ইচ্ছাকৃত হত্যা অবশ্যই সদৃশ বদলা গ্রহণযোগ্য। তবে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছরা ক্ষমা করে দিলে ভিন্ন কথা।” [দারুকুতনী, আস সুনান : হা. ৪৫]

(ঘ) নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছদের সকলেই উপস্থিত থাকা ।

(ঙ) কিসাসের দাবীদার হত্যা কারীর সন্তান কিংবা তার অধঃস্তন ব্যক্তি না হওয়া।

হত্যাকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী :

(ক) হত্যাকান্ড সরাসরি হওয়া।

(খ) হত্যা সীমা লঙ্ঘনমূলক হওয়া।

(গ) হত্যা ইসলামী রাষ্ট্রে সংঘটিত হওয়া।

মানব রচিত আইনে হত্যার শাস্তি :

দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ২৯৯ থেকে ৩১১ পর্যন্ত মানব দেহ সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ ও এর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে তা আলোকপাত করা হল।

ধারা- ২৯৯ : দন্ডনীয় নরহত্যা: যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে অথবা এমন শারীরিক ক্ষতি করে,যার ফলে সে মারা যায় অথবা তার জানা থাকে যে, উক্ত আঘাতের ফলে মৃত্যু অবধারিত সে ব্যক্তি নরহত্যার দন্ডনীয় অপরাধ করল। যেমন-

(ক). ক নামক ব্যক্তি ঙ নামক ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি গর্ত খুড়ল এবং এর উপরিভাগে কিছু ঘাসের চাবড়া ফেলে রাখল যাতে সে উক্ত গর্ত লক্ষ্য না করে এবং ঐ গর্তে পতিত হয়। ঙ নামক ব্যক্তি উক্ত গর্তে পতিত হল এবং নিহত হল। অতএব, ক নামক ব্যক্তি নরহত্যার শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হল।

(খ). ক জানে যে, ঙ ঝোপের আড়ালে আছে যা খ জানে না। তা সত্ত্বেও সে খ কে প্ররোচিত করল যেন ঝোপের মধ্যে গুলি করে যাতে করে ঙ-র মৃত্যু ঘটে। খ গুলি ছুড়ল এবং ঙ মারা গেল। এক্ষেত্রে খ কোন অপরাধের দায়ে দোষী হবে না। কিন্তু ক নর হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে।

(গ). ক একটি মুরগিকে গুলি করল হত্যা করে চুরি করার উদ্দেশ্যে কিন্তু মুরগির পরিবর্তে খ নিহত হল। কেননা খ ঝোপের আড়ালে ছিল যা ক জানত না। যদি এখানে ক আইনবিরোধী কাজ করেছে তবুও সে নরহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে না। কেননা খ কে হত্যা তার কোন উদ্দেশ্য ছিল না বা তার মৃত্যু ঘটতে পারে এমন কোন কাজ করা তার উদ্দেশ্য ছিল না।

ধারা- ৩০০ : খুন :

নরহত্যা খুন হিসেবে বিবেচিত হবে যদি মৃত্যু সংঘটন করা হয় মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যেই অথবা

দ্বিতীয়ত : শারীরিকভাবে এমন যখম করা হয় অপরাধী জানে যে, ঐ যখমে তার মৃত্যু ঘটবে। অথবা

তৃতীয়ত : শারীরিকভাবে এমন যখম করা হয় যে যখমের ফলে স্বাভাবিক কারণ হয় মৃত্যু বা মৃত্যুর জন্য ঐ যখমই যথেষ্টে, অথবা

চতুর্থত : যদি যখমকারী ব্যক্তি জানে যে, এটা এমনটাই আসন্ন হুমকি স্বরূপ যে, এর ফলে অতি অবশ্যই সকল উপায়ে মৃত্যু ঘটবে অথবা ঐ শারীরিক ক্ষতি মৃত্যু সংঘটনের জন্য এতটাই অনুকুল যে, কোন রকম ঝুঁকি ছাড়াই মৃত্যু অবধারিত। যেমন, ক নামক ব্যক্তি ঙ- কে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করল। এর ফলে ঙ মারা গেল। ক খুন করল। অথবা ক কোনরকম কারণ ছাড়াই  গোলাভর্তি কামান ছুড়ল জনতার উদ্দেশ্যে এবং তাদের হত্যা করল। ক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত যদিও তার ইচ্ছা ছিলনা ঙ- কে হত্যা করা।

ধারা- ৩০২ :

খুনের শাস্তি : যে ব্যক্তি খুন করবে তার শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড, অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সাথে জরিমানা ও হতে পারে।

ধারা- ৩০৩ :

যে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হওয়ার পরে খুন করে সে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হবে।

ধারা- ৩০৪ :

খুন হয়নি বা খুনের পর্যায়ে পড়েনা এমন নরহত্যার শাস্তি : যে ব্যক্তি এমন নরহত্যা করল যা খুনের পর্যায়ে পড়ে না, সে যাবজ্জীবন কারা দন্ডে দন্ডিত হবে অথবা দশ বছর পর্যন্ত সাজা ভোগ করবে এবং সাথে জরিমানা হবে। যে ব্যক্তি দ্বারা মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে সে কাজের উদ্দেশ্য যদি মৃত্যু হয় অথবা এমন শারীরিক আঘাত যার ফলে মৃত্যু হয়, তাহলে উপরোক্ত শাস্তি। আর যদি জেনে শুনে এমন কাজ করে যদ্বারা মৃত্যু সংঘটিত হয় কিন্তু এরূপ ইচ্ছা ছিল না অথবা এমন শারীরিক ক্ষতি যার ফলে মৃত্যু সংঘটিত হয় তাহলে তিনি দশ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই প্রযোজ্য হবে।

ধারা-৩০৪ ক :

জনপথে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে বা কোন যানে আরোহণ করে মৃত্যু সংঘটন : যে ব্যক্তি বেপরোয়া অথবা অবহেলা করে কারো মৃত্যু ঘটায় যা দন্ডনীয় নরহত্যার পর্যায়ে পড়ে, সে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হবে অথবা জরিমানাসহ উভয়ই হবে তার শাস্তি। আর যা দন্ডনীয় নর হত্যার পর্যায়ে পড়ে না তার জন্য সে তিন বছর পর্যন্ত যেকোন প্রকারের (সশ্রম বা বিনাশ্রম) কারাদন্ডে দন্ডিত হবে অথবা জরিমানা অথবা জেল-জরিমানা উভয়ই হবে। [ধারা-৩০৪ খ]

ইসলামি আইন ও মানব রচিত আইনের পার্থক্য

(ক) ইসলামী আইনে হত্যার বদলা হিসাবে হত্যার বিধান নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছদের ওপর ন্যাস্ত।

(খ) ইসলামী আইনে কেবল কেসাস বা অনুরূপ শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে।

(গ) ইসলামী আইনে ক্ষমা করার অধিকার নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে দেয়া হয়েছে।

(ঘ) ইসলামী আইনে স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কেও কেসাস বা দিয়ত মাফ করে দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। এটা বান্দার হক।

(ঘ) স্বয়ং আল্লাহও তা ক্ষমা করেন না, একমাত্র খালেছ দিলে তওবা ব্যতীত।

(ক) মানব রচিত আইনে রাষ্ট্রে মানোনীত ব্যক্তির নিকট সমর্পিত।

(খ) প্রচলিত আইনে খুনের বদলা খুনের বিধানের সাথে বিকল্প বিধান হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

(গ) প্রচলিত আইনে বিচারকের হাতে ন্যাস্ত।

(ঘ) আমাদের সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোন দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যেকোন দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’

(২) হুদুদ বা হদ্দঃ হুদুদ অর্থ নির্দষ্ট বা সীমারেখা। শরীআতে কিছু কিছু কাজের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তির উল্লেখ আছে। এগুলোকে হুদুদ বলে। যথা-

(ক) অবিবাহিত ব্যভিচারীকে ১০০টি বেত্রাঘাত করা, বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম করে হত্যা করা। [সূরা নূর : ২, বুখারী ও মুসলিম]

(খ) কারোও উপর ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আরোপকারীকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা। [সূরা নূর : ৪]

(গ) পেশাদার চুরি ঠেকাতে চোরের হাত কেটে দেওয়া। [সূরা মায়িদা : ৩৮]

(ঘ) ডাকাতি, সন্ত্রাস কিংবা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা/ বিদ্রোহ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা বা শূলে চড়ানো বা বিপরীত দিক থেকে হাত পা কেটে দেওয়া কিংবা দেশান্তরিত করা। [সূরা মায়িদা : ৩৩]

(ঙ) মদ্যপানকারীকে ৪০/৮০ টি বেত্রাঘাত করা। [বুখারী]

(চ) মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম পরিত্যাগকারী ব্যক্তিকে ক্বতল করা। [বুখারী]

(গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সালাত পরিত্যাগকারীকেও অসংখ্য আলিম মুরতাদ গণ্য করেন।)

নবী (সঃ) বলেন- “একটি হদ জারী করা দুনিয়াবাসীর জন্য ৪০ দিনের কল্যাণকর বৃষ্টির চাইতেও কল্যাণকর।” [নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ]

(৩)  তাযীরঃ এটি হচ্ছে “সমাজের অধিকার”। যা কিছু সমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত, যেমন- রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেচাঁমেচি করা বা রাস্তায় আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি। রাষ্ট্রের অভিজ্ঞ আলিম ফকীহরা বসে বিভিন্ন অপরাধের সংজ্ঞা এবং শাস্তি নির্ধারণ করবেন।

আবূ বুরদা ইবনু নিয়ার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত হাদ্দের অন্তর্ভুক্ত কোন অন্যায় ছাড়া (অন্য অন্যায়ের শাস্তি হিসেবে) দশটির বেশি বেত্রাঘাত প্রদান করা যাবে না। (সহীহ্, ইবনু মা-জাহ (২৬০১), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪৬৩)।

কিন্তু কিসাস হুদুদের ক্ষেত্রে তাযীরের মত এই শিথিলতার কোন অবকাশ নেই।

রাসূল (সঃ) বলেছেন-

”কিয়ামতের দিন একজন শাসককে আনা হবে৷ সে হদের মধ্যে বেত্রাঘাতের সংখ্যা এক ঘা কমিয়ে দিয়েছিল৷ জিজ্ঞেস করা হবে, এ কাজ তুমি কেন করেছিলে? জবাব দেবে, আপনার বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়ে৷ আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাহলে তাদের ব্যাপারে তুমি আমার চেয়ে বেশী অনুগ্রহশীল ছিলে? তারপর হুকুম হবে, নিয়ে যাও একে দোজখে। আর একজন শাসককে আনা হবে৷ সে বেত্রাঘাতের সংখ্যা ১টি বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি এ কাজ করেছিলে কেন? সে জবাব দেবে, যাতে লোকেরা আপনার নাফরমানি করা থেকে বিরত থাকে৷ আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা, তাদের ব্যাপারে তুমি তাহলে আমার চেয়ে বেশী বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিলে? তারপর হুকুম হবে, নিয়ে যাও একে দোজখে।” [তাফসীরে কবীর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২২৫ পৃষ্ঠা]।

(৪) মুখালাফাত: এটি হচ্ছে “রাষ্ট্রের অধিকার”। এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত বিষয়ে রাষ্ট্র নিজেই নিয়ম/ আইন তৈরী করে থাকে। যেমন- রাস্তায় গাড়ির গতিসীমা অতিক্রম, যেখানে গাড়ি রাখার নিয়ম নেই সেখানে রাখা ইত্যাদি।

ইসলামি আইনে কতিপয় অপরাধের শাস্তির বিধানঃ

হদ্দ বা হুদুদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাঃ

হদ্দ ইসলামি আইনের একটি পরিভাষা, যা সুনিদিষ্ট কতিপয় অপরাধ ও সেগুলোর জন্য নির্ধারিত শাস্তিকে বুঝায়।

আল্লাহর অধিকার লংঘনের দায়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যে শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, শরিয়তের পরিভাষায় তাকে হদ্দ বলে।

একটি রাষ্ট্র বা সমাজ কিভাবে চলবে এবং কেহ অপরাধ করলে তার ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি কী হবে তার সব নিয়ম কানুন বা আইন কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন। নবি করিম (সাঃ) একজন সফল রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে কোরআনের আইন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গেছেন, যেনো আমরা মুসলমানরা সেই অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারি।

যে লোকের উপর হদ্দ বাধ্যকর হয় নাঃ

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তিন প্রকার লোক হতে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে (শাস্তি থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে) ঘুমিয়ে থাকা লোক জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত; শিশু বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং নিষ্ক্রিয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের জ্ঞান না আসা পর্যন্ত। (সহীহ্, ইবনু মা-জাহ (২০৪১, ২০৪২), জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪২৩।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

ইসলামি আইনে হদ্দের প্রকারভেদঃ

শাস্তির অর্থে হদ্দ কয়েক প্রকার। যেমন:

(ক) মৃত্যুদন্ড

(খ) বেত্রাঘাত করা

(গ) শূলীবিদ্দ করা

(ঘ) তরবারির দ্বারা শিরচ্ছেদ করা

(ঙ) পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা

যেমনঃ যিনা বা ধর্ষণের অপরাধে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ড পাথর নিক্ষেপে, ডাকাতির অপরাধে মৃত্যুদন্ড শূলীবিদ্দ করে বা তরবারির আঘাতে এবং ধর্মত্যাগ এর অপরাধে মৃত্যুদন্ড তরবারির আঘাতে শিরচ্ছেদ করে কার্যকর করা হয়। হাত কাটার শাস্তি কেবল চুরির অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপের শাস্তি আশি বেত্রাঘাত , অবিবাহিত যিনাকারীর শাস্তি একশ বেত্রাঘাত এবং মদ্যপের শাস্তি আশি বেত্রাঘাত। ডাকাতির অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধের ধরণ ও তীব্রতার বিবেচনায়  মৃত্যুদন্ড ব্যতীত বিপরীত দিক থেকে হস্তপদ কর্তন ও নির্বাসন দন্ড অনুমোদন করা হয়েছে। ফকিহগণের মতে, কারাদন্ডের মাধ্যমেও নির্বাসন দন্ড কার্যকর করা যেতে পারে।

উল্লেখিত আল্লাহর আইন বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও কার্যকর নেই। অথচ বাংলাদেশের শাসকগণ সকলেই মুসলমান। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আল্লাহর আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সংসদে মানব রচিত আইন পাশ করে নিয়েছে।

ইসলামি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকারভেদঃ

(ক) যিনা বা ব্যভিচার,

(খ) যিনা এর উপর মিথ্যা অপবাদ,

(গ) চুরি,

(ঘ) ডাকাতি,

(ঙ) মাদক গ্রহণ,

(চ) ইসলাম ধর্ম ত্যাগ,

(ছ) ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। (বাদায়ে উস সানায়ে, ৭ম খন্ড)।

(জ) সালাত পরিত্যাগকারীকেও অসংখ্য আলিম মুরতাদ গণ্য করেন।

(তথ্য সূত্রঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত- অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল)।

(৩) ইসলামি আইনে শাস্তি কার্যকর করতে হবেঃ

ইসলামি আইনে যেসব বিষয়ে বিচার ও শাস্তি কার্যকর করতে হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

(ক) যিনা বা ব্যভিচারঃ যিনা বা ব্যভিচার ও ধর্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

(যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণ বনাম ইসলামি আইন)

(খ) যিনা এর উপর  মিথ্যা অপবাদঃ

ইসলামি আইনে শাস্তিঃ

(ক) আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘যারা সতী-সাধ্বী কোন মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলো; অথচ চারজন সাক্ষীর মাধ্যমে তা প্রমাণিত করতে পারেনি তা হলে তোমরা ওদেরকে আশিটি করে বেত্রাঘাত করো, কারোর ব্যাপারে তাদের সাক্ষ্য আর কখনো গ্রহণ করো না এবং তারাই তো সত্যিকার ফাসিক। তবে যারা এরপর তাওবা করে নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় (তারা সত্যিই অপরাধমুক্ত)। কারণ, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’’। (নূর : ৪-৫)

(খ) তিনি আরো বলেন,

‘‘যারা নিজ স্ত্রীদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলো অথচ তাদের সপক্ষে তারা ব্যতীত অন্য কোন সাক্ষী নেই তা হলে তাদের প্রত্যেককে চার চার বার এ বলে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, সে নিশ্চয়ই সত্যবাদী। পঞ্চমবার সে এ কথা বলবে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পতিত হোক সে যদি এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে। তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে সে এ ব্যাপারে চার চার বার সাক্ষ্য দিলে যে, তার স্বামী নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। পঞ্চমবার সে এ কথা বলবে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার গযব পতিত হোক যদি তার স্বামী এ ব্যাপারে সত্যবাদী হয়ে থাকে’’। (নূর : ৬-৯)

(গ) আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘‘তোমরা ব্যাপারটিকে তুচ্ছ মনে করছো; অথচ তা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট খুবই গুরুতর অপরাধ’’। (নূর : ১৫)

(ঘ)  আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, যখন কুরআনে আমার উপর আরোপিত অপবাদ হতে মুক্তি সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মিম্বারে উঠে দাঁড়ালেন ও এর উল্লেখ করলেন এবং কুরআনের আয়াত পাঠ করে শুনালেন, তারপর মিম্বার হতে অবতরণ করলেন, এবং দুজন পুরুষ (হাসসান ইবনু সাবিত, মিসতাহ ইবনু আসাসা) ও একজন স্ত্রীলোক (হামনা বিনতু জাহাশ) কে আশিটি করে বেত্রাঘাত করতে আদেশ করেন। অতএব তাদেরকে সে পরিমাণ বেত্রাঘাত করা হয়’’।

আবু দাউদ ৪৪৭৪, ইবনু মাজাহ ২৫৬৭, আহমাদ ২৬৫৩১। শাইখ আলবানী সহীহ ইবনু মাজাহ ২০৯৭, সহীহ তিরমিযী ৩১৮১, সহীহ আবু দাউদ ৪৪৭৪ গ্রন্থত্রয়ে হাসান বলেছেন, তবে তাখরীজ মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৫১২ এর মধ্যে বলেন, ইবনু ইসহাক আন আন করে বর্ণনা করেছেন, যিনি মুদাল্লিস। ইমাম শওকানী তার নাইলুল আওত্বার ৭/৮২ গ্রন্থে বলেন, এর সানাদে মুহাম্মাদ বিন ইসহাক রয়েছে। সে আন আন করে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তার তাদলীস ও আন আন এর কারণে এটি দলিল হিসেবে গৃহীত হবে না। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস।

(ঙ) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা সাত প্রকার ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে দূরে থাক।’’ লোকেরা বলল, ‘সেগুলো কী কী? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, (১) ‘‘আল্লাহর সাথে শিরক করা। (২) যাদু করা। (৩) অন্যায়ভাবে এমন জীবন হত্যা করা, যাকে আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন। (৪) সূদ খাওয়া। (৫) এতীমের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা। (৬) ধর্মযুদ্ধ কালীন সময়ে (রণক্ষেত্র) থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন ক’রে পলায়ন করা। (৭) সতী-সাধ্বী উদাসীনা মু’মিন নারীদের চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করা।’’

(সহীহুল বুখারী ২৭৬৭, ২৭৬৬, ৫৭৬৪, ৬৮৫৭, মুসলিম ৮৯, নাসায়ী ৩৬৭১, আবূ দাউদ ২৮৭৪)

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(চ) আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

হিলাল বিন্ উমাইয়াহ্ (রাঃ) শারীক বিন্ সা’হ্মা’ (রাঃ) কে তার স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করেছে বলে অপবাদ দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

‘‘সাক্ষী-প্রমাণ দিবে। নতুবা তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হবে’’। (বুখারী ২৬৭১)

মিথ্যে অপবাদকারী বা স্বাক্ষীর শেষ পরিনতিঃ

(ক) আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘নিশ্চয়ই যারা সতী-সাধ্বী সরলমনা মু’মিন মহিলাদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য (আখিরাতে) রয়েছে মহা শাস্তি’’। (নূর : ২৩)

(খ) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি ভুল কিংবা গোনাহ করে, অতঃপর কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর অপবাদ আরোপ করে, সে নিজের মাথায় বহন করে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য গোনাহ।' (সুরা নিসা, আয়াত ১১২)।

(গ) মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন শরিফে ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পরস্পরের গিবতে লিপ্ত না হয়। তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ কর? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। (সুরা হুজুরাত, আয়াত ১২)।

(গ)  মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান শিরক সমতুল্য গুনাহ:

“একবার রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে বসে ছিলেন এ অবস্থায় তিনি সাহাবাদের বললেন, বড় গোনাহ সম্পর্কে কি আমি তোমাদের বলব? সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ বলুন। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত হল কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা তথা শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা। অতঃপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া (একথা তিনবার বললেন)। [সহীহ বুখারী: ২৬৫৪]

(ঘ) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে নাঃ

“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মুর্খতা পরিত্যাগ করতে পারলনা, তার রোযা রেখে শুধুমাত্র পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” [সহীহ বুখারী:৬০৫৭]

(ঙ) মিথ্যা অপবাদকারী হতভাগা:

“তোমরা কি জান গরীব কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” [সুনান আত তিরমিজি- ২৪১৮]

(চ) বানোয়াট অভিযোগকারীর স্থান জাহান্নাম:

“যে ব্যক্তি কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন বানোয়াট অভিযোগ আনল, সেযেন নিজেই নিজের স্থান জাহান্নামে করে নিল।” [সহীহ বুখারী:৩৫০৮]

(ছ) মিথ্যা রটনাকারীর উপর আল্লাহর গযব:

“নিশ্চয় যারা গো বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে গযব ও লাঞ্ছনা। আর এভাবে আমি মিথ্যা রটনাকারীদের প্রতিফল দেই।” [সূরা আল আরাফ:১৫২]

(জ) মিথ্যা রটনাকারী ব্যর্থ হয়:

“আর যে ব্যক্তি মিথ্যা আরোপ করে, সে-ই ব্যর্থ হয়।” [সূরা তাহা :৬১]

(ঝ) অপবাদ ক্ষণস্থায়ী :

 “দেখ, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজদের উপর, তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল।” [আনআম : ২৪]

মানব রচিত আইনে শাস্তির বিধানঃ

ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামালার শাস্তির বিধান রয়ছে। ২৫০ ধারা অনুযায়ী, “ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামীকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানীমূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ  দিতে পারেন”।

দণ্ডবিধির ২০৯ ধারা মতে, “মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড সহ অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবে”। আবার ২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তি বলা হয়েছে, “যদি কোন ব্যক্তি কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করে তবে মামলা দায়ের কারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে”।

দণ্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে।

দণ্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা আছে, “যদি কোন ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান বলে আইনত: বাধ্য হয়ে বা কোন  বিষয়ে কোন ঘোষণা করার জন্য আইনবলে বাধ্য হয়ে এরূপ কোন বিবৃতি প্রদান করে, যা মিথ্যা এবং যা সে  মিথ্যা বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তা হলে উক্ত ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বলে পরিগনিত হবে”। কোন বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোন ভাবে দেওয়া হোক না কেন তা এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “যদি কোন ব্যক্তি কোন বিচার বিভাগীয় মোকদ্দমায় কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে  সেই ব্যক্তির যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ড-যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে- দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে,  যদি অন্য কোন মামলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।

মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য মৃত্যুদণ্ড শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ১৯৪ ধারা অনুযায়ী, “ যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য  দেওয়া বা উদ্ভাবন করা যার উপর ভিত্তি করে নির্দোষ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে, যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া যাবে”।

 (গ) চুরিঃ

যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তির দখল হইতে কোন অস্থাবর সম্পত্তির উক্ত ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে অসাধুভাবে গ্রহণ করবার অভিপ্রায়ে অনুরূপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে উক্ত সম্পত্তি স্থানান্তর করে, সেই ব্যক্তি চুরি করে বলে গণ্য হবে।

ইসলামি আইনে চুরির শাস্তিঃ

(ক) আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কোন চোরের হাত চার ভাগের এক ভাগ দিনার বা তার অধিক পরিমাণ মাল চুরি ছাড়া কাটা যাবে না।

বুখারীতে এভাবে আছে, এক চতুর্থাংশ দীনার বা তার অধিক চুরির কারণে হাত কাটা যাবে। আহমাদে আছে এক চতুর্থাংশ দীনারের চুরির কারণে হাত কাটো, এর কমে হাত কেটো না।

(বুখারী ৬৭৮৯, ৬৭৯০, ৬৭৯১, মুসলিম ১৬৮৪, তিরমিযী ১৪৪৫, নাসায়ী ৪৯১৪, ৪৯১৫, আবু দাউদ ৪৩৮৩, ৪৩৮৪, ইবনু মাজাহ ২৫৮৫, আহমাদ ২৩৫৫৮, ২৩৯৯৪, ২৪২০৪, মালেক ১৫৫৭, দারেমী ২৩০০।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(খ) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিন দিরহাম মূল্যের ঢালের চুরিতে হাত কেটেছিলেন।  (বুখারী ৬৭৯৬, ৬৭৯৭, ৬৭৯৮, মুসলিম ১৬৮৯, তিরমিযী ১৪৪৬, নাসায়ী ৪৯০৬, ৪৯০৭, ৪৯০৮, আবু দাউদ ৪৩৮৫, ইবনু মাজাহ ২৫৮৪, আহমাদ ৪৪৮৯, ৫১৩৫, মালেক ১৫৭২, দারেমী ২৩০১।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(গ) আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হয় চোরের উপর যে একটি ডিম চুরি করেছে। তাতে তার হাত কাটা গেছে বা একটি দড়ি চুরি করেছে যার ফলে তার হাত কাটা গেছে।  (বুখারী ৬৭৮৩, মুসলিম ১৬৮৭, নাসায়ী ৪৮৭৩, ইবনু মাজাহ ২৫৮৮, আহমাদ ৭৩৮৮।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঘ)  জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক চোরকে ধরে আনা হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ করলেন, তার (ডান) হাত কেটে দাও। সুতরাং তার হাত কেটে ফেলা হলো। পরে পুনরায় চুরির দায়ে তাকে দ্বিতীয়বার আনা হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তার (বাম) পা কেটে দাও। সুতরাং তার পা কেটে ফেলা হলো। এরপর পুনরায় তৃতীয়বার তাকে চুরির অপরাধে আনা হলো। এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ দিলেন, তার (বাম) হাত কেটে দাও। সুতরাং তার হাত কেটে ফেলা হলো। পরে চতুর্থবার তাকে চুরির অপরাধে আনা হলো। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ দিলেন, তার (ডান) পাও কেটে দাও। সুতরাং তার পাও কেটে ফেলা হলো। তারপর পঞ্চমবার তাকে চুরির অপরাধে উপস্থিত করা হলো। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবার তাকে হত্যার হুকুম দিলেন। সুতরাং আমরা তাকে টেনে নিয়ে এসে একটি কূপের মধ্যে ফেলে দিলাম এবং তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করলাম।(মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৩৬০৩, আবূ দাঊদ ৪৪১০, নাসায়ী ৪০৭, ৪৯৭৮। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

ইমামের কাছে আনার পূর্বেই চোরকে ক্ষমা করা জায়েযঃ

সাফওয়ান ইবনু উমাইয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেছিলেন – যখন তিনি (সাফওয়ান) তার এক চাদর চুরির ব্যাপারে হাত কাটার আদেশ দেয়ার পর সুপারিশ করেছিলেন – কেন তুমি তাকে (চোরকে) আমার কাছে আনার আগেই এ সুপারিশ করনি। [

(নাসায়ী ৪৮৭৮, ৪৮৭৯, ৪৮৮৩, ইবনু মাজাহ ২৫৯৫, আহমাদ ১৪৮৭৯, ২৭০৯০, ২৭০৯৭, বুলগুলমারাম, হাদিস নং-১২৩৮। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

আমানত আত্মসাৎকারী, লুটেরা এবং ছিনতাইকারীর শাস্তিঃ

কারোর নিকট কোন কিছু আমানত রাখার পর সে তা আত্মসাৎ করলে এবং কেউ কারোর কোন সম্পদ লুট অথবা ছিনতাই করে ধরা পড়লে চোর হিসেবে তার হাত খানা কাটা হবে না। পকেটমারের বিধানও তাই। তবে তারা কখনোই শাস্তি পাওয়া থেকে একেবারেই ছাড় পাবে না। এদের বিধান হত্যাকারীর বিধানাধীন উল্লেখ করা হয়েছে।

(ক)  জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘আমানত আত্মসাৎকারী, লুটেরা এবং ছিনতাইকারীর হাতও কাটা হবে না’’।

(আবূ দাউদ ৪৩৯১, ৪৩৯২, ৪৩৯৩; তিরমিযী ১৪৪৮; ইব্নু মাজাহ্ ২৬৪০, ২৬৪১; ইব্নু হিববান ১৫০২ নাসায়ী ৮/৮৮; আহমাদ ৩/৩৮০)

(খ) কেউ কারোর কোন ফলগাছের ফল গাছ থেকে ছিঁড়ে খেয়ে ধরা পড়লে তার হাতও কাটা হবে না। এমনকি তাকে কোন কিছুই দিতে হবে না। আর যদি সে কিছু সাথে নিয়ে যায় তখন তাকে জরিমানাও দিতে হবে এবং যথোচিত শাস্তিও ভোগ করতে হবে। আর যদি গাছ থেকে ফল পেড়ে নির্দিষ্ট কোথাও শুকাতে দেয়া হয় এবং সেখান থেকেই কেউ চুরি করলো তখন তা হাত কাটার সমপরিমাণ হলে তার হাতও কেটে দেয়া হবে।

রা’ফি’ বিন্ খাদীজ ও আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘কেউ কারোর ফলগাছের ফল গাছ থেকে ছিঁড়ে খেলে অথবা কারোর খেজুর গাছের মাথি-মজ্জা খেয়ে ফেললে তার হাতও কাটা হবে না’’। (আবূ দাউদ ৪৩৮৮; তিরমিযী ১৪৪৯; ইব্নু মাজাহ্ ২৬৪২, ২৬৪৩; ইব্নু হিববান ১৫০৫ নাসায়ী ৮/৮৮; আহমাদ ৩/৪৬৩)।

(গ) আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গাছের ফল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:

‘‘কেউ প্রয়োজনের খাতিরে সাথে কিছু না নিয়ে (কারোর কোন ফলগাছের ফল) শুধু খেলে তাকে এর জরিমানা স্বরূপ কিছুই দিতে হবে না। আর যে শুধু খায়নি বরং সাথে কিছু নিয়ে গেলো তাকে ডবল জরিমানা দিতে হবে এবং যথোচিত শাস্তিও ভোগ করতে হবে। আর যে ফল শুকানোর জায়গা থেকে চুরি করলো এবং তা ছিলো একটি ঢালের সমমূল্য তখন তার হাত খানা কেটে দেয়া হবে। আর যে এর কম চুরি করলো তাকে ডবল জরিমানা দিতে হবে এবং যথোচিত শাস্তিও ভোগ করতে হবে’’। (আবূ দাউদ ৪৩৯০; ইব্নু মাজাহ্ ২৬৪৫ নাসায়ী ৮/৮৫; হা’কিম ৪/৩৮০)

(ঘ) কেউ কারোর কাছ থেকে কোন কিছু ধার নিয়ে তা অস্বীকার করলে এবং তা তার অভ্যাসে পরিণত হলে এমনকি বস্ত্তটি হাত কাটার সমপরিমাণ হলে তার হাত খানা কেটে দেয়া হবে।

‘আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

‘‘জনৈকা মাখ্জূমী মহিলা মানুষ থেকে আসবাবপত্র ধার নিয়ে তা অস্বীকার করতো তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত খানা কাটতে আদেশ করলেন’’। (মুসলিম ১৬৮৮; আবূ দাউদ ৪৩৭৪, ৪৩৯৫, ৪৩৯৬, ৪৩৯৭)। তবে কোন কোন বর্ণনায় তার চুরির কথাও উল্লেখ করা হয়।

(ঙ) কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তির কোন কিছু চুরি করলে এবং তা হাত কাটা সমপরিমাণ হলে তার হাত খানা কেটে দেয়া হবে।

স্বাফ্ওয়ান বিন্ উমাইয়াহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

‘‘আমি একদা মসজিদে ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন আমার গায়ে একটি চাদর ছিলো ত্রিশ দিরহামের। ইতিমধ্যে জনৈক ব্যক্তি এসে চাদরটি আমার থেকে ছিনিয়ে নিলো। লোকটিকে ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট নিয়ে আসা হলে তিনি তার হাত খানা কেটে ফেলতে বলেন’’।

(আবূ দাউদ ৪৩৯৪; ইব্নু মাজাহ্ ২৬৪৪ নাসায়ী ৮/৬৯; আহমাদ ৬/৪৬৬; হা’কিম ৪/৩৮০ ইব্নুল জারূদ্, হাদীস ৮২৮)।

হাদ্দ এর আওতাধীন অপরাধের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা নিষেধঃ

আইশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

মাখযূম বংশের একজন মহিলার চুরির ঘটনা কুরাইশদেরকে চিন্তিত করে তুলে। তারা একে অপরের সাথে বলাবলি করল, এ ব্যাপারটি নিয়ে কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে আলোচনা করতে পারে? তারা বলল, এ বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলার সাহস উসামা ইবনু যাইদ ছাড়া আর কারো নেই। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খুবই প্রিয়। উসামা (রাঃ) তাঁর সাথে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত শাস্তিসমূহের অন্তর্ভূক্ত একটি শাস্তি প্রসঙ্গে তুমি সুপারিশ করছ? তারপর তিনি দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন এবং বলেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো একারণে ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোন ধনী-মর্যাদাশালী লোক চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত এবং তাদের মাঝে কোন দুর্বল প্রকৃতির লোক চুরি করলে তার উপর শাস্তি কার্যকর করত। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।

(সহীহুল বুখারী ২৬৪৮, ৩৪৭৫, ৩৭৩৩, ৪৩০৪, ৬৭৮৭, ৬৭৮৮, ৬৮০০, মুসলিম ১৬৮৮, তিরমিযী ১৪৩০, নাসায়ী ৪৮৯৫, ৪৮৯৭-৪৯০৩, আবূ দাউদ ৪৩৭৩, ইবনু মাজাহ ২৫৪৭, আহমাদ ২২৯৬৮, ২৪৭৬৯, দারেমী ২৩০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

মানব রচিত আইনে চুরির শাস্তিঃ

শাস্তিঃ খোলা স্থান  থেকে চুরি হলে দঃবিঃ ৩৭৯ ধারা মোতাবেক শাস্তি হবে। আবদ্ধ স্থান থেকে চুরি হলে দঃবিঃ আইনের ৩৮০ ধারা মোতাবেক শাস্তি হবে। চাকর কর্তৃক চুরি হলে দঃবিঃ আইনের ৩৮১ ধারা মোতাবেক শাস্তি হবে।

বর্ণনাঃ

ধারা ৩৭০ বাসগৃহ ইত্যাদিতে চুরি

যে ব্যক্তি, মনুষ্য বসবাস বা সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয় এইরূপ অট্টালিকা, তাঁবু বা জাহাজে চুরি অনুষ্ঠান করে, সেই ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদন্ডে-যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে- দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবে।

ধারা ৩৭৯ চুরির শাস্তি

যে ব্যক্তি চুরি করে, সেই ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদন্ডে-যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবে।

অনেকেই রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় সম্পদ চুরি করতে একটুও দ্বিধা করে না। তাদের ধারণা, সবাই তো করে যাচ্ছে তাই আমিও করলাম। এতে অসুবিধে কোথায়? মূলত এ ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, জাতীয় সম্পদ বলতে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সম্পদকেই বুঝানো হয়। সুতরাং এর সাথে বহু লোকের অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষভাবে তাতে রয়েছে গরিব, দু:খী, ইয়াতীম, অনাথ ও বিধবাদের অধিকার। তাই ব্যক্তি সম্পদের তুলনায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি এবং এর চুরিও খুবই মারাত্মক।

আবার কেউ কেউ কোন কাফিরের সম্পদ চুরি করতে এতটুকুও দ্বিধা করে না। তাদের ধারণা, কাফিরের সম্পদ আত্মসাৎ করা একেবারেই জায়িয। মূলত এরূপ ধারণাও সম্পূর্ণটাই ভুল। বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন সকল কাফিরের সম্পদই হালাল যাদের সঙ্গে এখনো মুসলিমদের যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান। মুসলিম এলাকায় বসবাসরত কাফির ও নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কাফির এদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

কেউ কেউ তো আবার অন্যের ঘরে মেহমান হয়ে তার আসবাবপত্র চুরি করে। কেউ কেউ আবার ঠিক এরই উল্টো। সে তার মেহমানের টাকাকড়ি বা আসবাবপত্র চুরি করে। এ সবই নিকৃষ্ট চুরি।

আবার কোন কোন পুরুষ বা মহিলা তো এমন যে, সে কোন না কোন দোকানে ঢুকলো পণ্য খরিদের জন্য গাহক বেশে অথচ বের হলো চোর হয়ে।

কেউ শয়তানের ধোঁকায় চুরি করে ফেললে তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট খাঁটি তাওবা করে চুরিত বস্ত্তটি উহার মালিককে ফেরৎ দিতে হবে। চাই সে তা প্রকাশ্যে দিক অথবা অপ্রকাশ্যে। সরাসরি দিক অথবা কোন মাধ্যম ধরে। যদি অনেক খোঁজাখুঁজির পরও উহার মালিক বা তার ওয়ারিশকে পাওয়া না যায় তা হলে সে যেন বস্ত্তটি অথবা বস্ত্তটির সমপরিমাণ টাকা মালিকের নামে সাদাকা করে দেয়। যার সাওয়াব মালিকই পাবে। সে নয়।

(ঘ) ডাকাতি,

ইসলামি আইনে ডাকাতির শাস্তিঃ

ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। কারণ চুরি হয় গোপনে। আর ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এদের শাস্তি হলো হত্যা, শূলে চড়ানো, হাত-পা কেটে ফেলা ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৩১৩)।

ইসলামি আইনে সন্ত্রাস, অপহরণ, দস্যুতা ও লুন্ঠন এর শাস্তিঃ

সন্ত্রাস, দস্যুতা, ছিনতাই, লুন্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি কবীরা গুনাহ্গুলোর অন্যতম। চাই সেগুলোর পাশাপাশি কাউকে হত্যা করা হোক অথবা নাই হোক। কারণ, তারা যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী। তবে সেগুলোর পাশাপাশি কাউকে হত্যা করা হলে অবশ্যই হত্যাকারীদেরকে হত্যা করতে হবে। আর সেগুলোর পাশাপাশি কাউকে হত্যা করা না হলে সে অঘটনগুলো সম্পাদনকারীদেরকে চারটি শাস্তির যে কোন একটি শাস্তি দিতে হবে। হত্যা করতে হবে অথবা ফাঁসী দিতে হবে অথবা এক দিকের হাত এবং অপর দিকের পা কেটে ফেলতে হবে অথবা অন্য এলাকার জেলে বন্দী করে রাখতে হবে যতক্ষণ না তারা খাঁটি তাওবা করে নেয়। এমনকি তারা শুধুমাত্র একজনকেই হত্যা করার ব্যাপারে কয়েকজন অংশ গ্রহণ করলেও তাদের সকলকেই হত্যা করা হবে। যদি তারা সরাসরি উক্ত হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘যারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যুদ্ধ কিংবা প্রকাশ্য শত্রুতা পোষণ করে অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিধি-বিধানের উপর হঠকারিতা দেখায় এবং (হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, অপহরণ ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে) ভূ-পৃষ্ঠে অশান্তি ও ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসী দেয়া হবে অথবা এক দিকের হাত এবং অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে অথবা অন্য এলাকার জেলে বন্দী করে রাখা হবে যতক্ষণ না তারা খাঁটি তাওবা করে নেয়। এ হচ্ছে তাদের জন্য ইহলোকের ভীষণ অপমান এবং পরকালেও তাদের জন্য ভীষণ শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে তোমরা তাদেরকে গ্রেফতার করার পূর্বে যদি তারা স্বেচ্ছায় তাওবা করে নেয় তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু’’। (মা’য়িদাহ্ : ৩৩)

তবে মানুষের হৃত অধিকার তাদেরকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

‘‘জনৈক যুবককে চুপিসারে হত্যা করা হলে ’উমর (রাঃ) বললেন: পুরো সান্‘আবাসীরাও (বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী) যদি উক্ত যুবককে হত্যা করায় অংশ গ্রহণ করতো তা হলে আমি তাদের সকলকেই ওর পরিবর্তে হত্যা করতাম। তাদেরকে আমি কখনোই এমনিতেই ছেড়ে দিতাম না’’। (বুখারী ৬৮৯৬)

যুলুম, অত্যাচার ও কারোর উপর অন্যায়মূলক আক্রমণঃ

কারোর জন্য অন্যের উপর যে কোনভাবে যুলুম, অত্যাচার অথবা অন্যায় মূলক আক্রমণ হারাম ও কবীরা গুনাহ্। কাউকে মারা, হত্যা করা, আহত করা, গালি দেয়া, অভিসম্পাত করা, ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া, দুর্বলের উপর হাত উঠানো চাই সে হোক নিজের কাজের ছেলে কিংবা নিজের কাজের মেয়ে অথবা নিজ স্ত্রী-সন্তান; তেমনিভাবে জোর করে কারোর কোন অধিকার হরণ ইত্যাদি ইত্যাদি যুলুমেরই অন্তর্গত।

যুলুম পারস্পরিক বন্ধুত্ব বিনষ্ট করে। আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বৈরিতা সৃষ্টি করে। মানুষের মাঝে হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয় এবং এরই কারণে ধনী ও গরীবের মাঝে ধীরে ধীরে ঘৃণা ও শত্রুতা জেগে উঠে। তখন উভয় পক্ষই দুনিয়ার বুকে অশান্তি নিয়েই জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।

আল্লাহ্ তা‘আলা যালিমদের জন্য জাহান্নামে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। যা তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘আমি যালিমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানি। যা তাদের মুখমন্ডল পুড়িয়ে দিবে। এটা কতই না নিকৃষ্ট পানীয় এবং সে জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়’’। (কাহ্ফ : ২৯)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:

’’অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল!’’ (শু‘আরা’ : ২২৭)

আবূ যর গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘হে আমার বান্দাহ্রা! নিশ্চয়ই আমি আমার উপর যুলুম হারাম করে দিয়েছি অতএব তোমাদের উপরও তা হারাম। সুতরাং তোমরা পরস্পর যুলুম করো না’’। (মুসলিম ২৫৭৭)

কেউ কেউ কোন যালিমকে অনায়াসে মানুষের উপর যুলুম করতে দেখলে এ কথা ভাবে যে, হয়তো বা সে ছাড় পেয়ে গেলো। তাকে আর কোন শাস্তিই দেয়া হবে না। না, ব্যাপারটা কখনোই এমন হতে পারে না। বরং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে কিয়ামতের দিনের কঠিন শাস্তির অপেক্ষায় রেখেছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘তুমি কখনো মনে করো না যে, যালিমরা যা করে যাচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা সে ব্যাপারে গাফিল। বরং তিনি তাদেরকে সুযোগ দিচ্ছেন কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। যে দিন সবার চক্ষু হবে স্থির বিস্ফারিত। সে দিন তারা ভীত-বিহবল হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছুটোছুটি করবে। তাদের চক্ষু এতটুকুর জন্যও নিজের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে একেবারেই আশা শূন্য’’। (ইব্রাহীম : ৪২-৪৩)

কারোর মধ্যে বিনয় ও নম্রতা না থাকলেই সে কারোর উপর উদ্যত ও আক্রমণাত্মক হতে পারে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা সকলকে বিনয়ী ও নম্র হতে আদেশ করেন।

’ইয়ায বিন্ ’হিমার মুজাশি’য়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন:

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা এ মর্মে আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা নম্র ও বিনয়ী হও; যাতে করে একের অন্যের উপর গর্ব করার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এবং একের অন্যের উপর অত্যাচার বা আক্রমণাত্মক আচরণ করার সুযোগ না আসে’’। (মুসলিম ২৮৬৫)

আবূ মাস্’ঊদ্ আন্সারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

’’আমি আমার একটি গোলামকে মারছিলাম এমতাবস্থায় পেছন থেকে শুনতে পেলাম, কে যেন আমাকে বড় আওয়াজে বলছে: শুনো, হে আবূ মাস্’ঊদ্! তুমি এর উপর যতটুকু ক্ষমতাশীল তার চাইতেও অনেক বেশি ক্ষমতাশীল আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার উপর। অতঃপর আমি (পেছনে) তাকিয়ে দেখি, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতএব আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! একে আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য স্বাধীন করে দিলাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি যদি এমন না করতে তা হলে তোমাকে জাহান্নামের অগ্নি স্পর্শ করতো অথবা পুড়িয়ে দিতো’’।

(মুসলিম ১৬৫৯)

হিশাম বিন্ ’হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ওদেরকে শাস্তি দিবেন যারা দুনিয়াতে মানুষকে (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেয়’’। (মুসলিম ২৬১৩)

আল্লাহ্ তা‘আলা অত্যাচারী ও কারোর উপর অন্যায় মূলক আক্রমণকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। উপরন্তু আখিরাতের শাস্তি তো তার জন্য প্রস্ত্তত আছেই।

আবূ বাক্রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘দু’টি গুনাহ্ ছাড়া এমন কোন গুনাহ্ নেই যে গুনাহ্গারের শাস্তি আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেওয়াই উচিৎ; উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ্ দু’টি হচ্ছে, অত্যাচার তথা কারোর উপর অন্যায় মূলক আক্রমণ এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী’’।

(আবূ দাউদ ৪৯০২; তিরমিযী ২৫১১; ইব্নু মাজাহ্ ৪২৮৬; ইব্নু হিববান ৪৫৫, ৪৫৬ বায্যার, হাদীস ৩৬৯৩; আহমাদ ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪)

মানুষকে অযথা শাস্তি দেয়া কিংবা প্রহার করাঃ

মানুষকে অযথা শাস্তি দেয়া কিংবা প্রহার করা আরেকটি কবীরা গুনাহ্ ও হারাম।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘দু’ জাতীয় মানুষ এমন রয়েছে যারা জাহান্নামী। তবে আমি তাদেরকে এখনো দেখিনি। তাদের মধ্যে এক জাতীয় মানুষ এমন যে, তাদের হাতে থাকবে লাঠি যা দেখতে গাভীর লেজের ন্যায়। এগুলো দিয়ে তারা অযথা মানুষকে প্রহার করবে’’। (মুসলিম ২১২৮)

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘এ উম্মতের মধ্যে শেষ যুগে এমন কিছু লোক পরিলক্ষিত হবে যাদের সাথে থাকবে লাঠি যা দেখতে গাভীর লেজের ন্যায়। তারা সকালে বের হবে আল্লাহ্ তা‘আলার অসন্তুষ্টি নিয়ে এবং বিকেলে ফিরবে আল্লাহ্ তা‘আলার ক্রোধ নিয়ে’’। (আহমাদ ৫/২৫০; ’হা’কিম ৪/৪৩৬ ত্বাবারানী, হাদীস ৮০০০)।

মানব রচিত আইনে ডাকাতির শাস্তিঃ

দন্ডবিধি অনুযায়ী "ডাকাতি" (সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধান)

ধারা ৩৯১ ডাকাতিঃ

যেক্ষেত্রে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি মিলিত ভাবে কোন দস্যুতা অনুষ্ঠান করে বা করিবার উদ্যোগ করে কিংবা যেক্ষেত্রে মিলিত ভাবে দস্যুতাকারী বা অনুষ্ঠান করিবার উদ্যোগকারী ব্যক্তিগণের এবং উপস্থিত ও অনুরূপ দস্যুতা অনুষ্ঠানে বা উহার উদ্যোগে সাহায্যকারী ব্যক্তিগণের মোট সংখ্যা ৫ (পাঁচ) বা ততোধিক হয়, সেইক্ষেত্রে অনুরূপ অনুষ্ঠানকারী প্রত্যেক ব্যক্তি ‘ডাকাতি’ করে বলিয়া গণ্য হইবে।

ধারা ৩৯২ দস্যুতার শাস্তিঃ

যে ব্যক্তি দস্যুতা করে, সেই ব্যক্তি সশ্রম কারাদন্ডে- যাহার মেয়াদ দশ বছর হইতে পারে দন্ডিত হইবে, তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবে এবং যদি রাজপথে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে দস্যুতা অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে উক্ত কারাদন্ড চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হইতে পারিবে।

ধারা ৩৯৫ ডাকাতির শাস্তিঃ

যে ব্যক্তি ডাকাতি করে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা সশ্রম কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হইতে পারে-দন্ডিত হইবে, এবং তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হইবে।

ধারা ৩৯৬ খুন সহকারে ডাকাতিঃ

পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি যাহারা মিলিতভাবে ডাকাতি করিতেছে, তাহাদের যেকোন একজন অনুরূপভাবে ডাকাতি করা কালে খুন করিলে উক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা সশ্রম কারাদন্ডে- যাহার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হইতে পারে- দন্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবে।

(ঙ) মাদক গ্রহণঃ

মদ এমন একটি বস্তু যা বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর বিবেক আচ্ছন্ন হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এজন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, মদ হচ্ছে সকল অশ্লীল কর্মের মূল। উল্লেখ্য যে, মদ কোন নির্ধারিত বস্তুর নাম নয়। যেসব বস্তু বেশী পরিমাণ খেলে বিবেকের ক্ষতি হয় তার অল্প বস্তুও মদ।

মদ পানকারী বা নেশাদার দ্রব্য গ্রহণকারীকে প্রথমতঃ বিরত থাকার নির্দেশ এরপরও গ্রহণ করলে পরকালে তার কী শাস্তি হবে তার বিবরণঃ

(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কর্ম। অতএব তোমরা এগুলি থেকে বেঁচে থাক। যাতে তোমরা কল্যাণ প্রাপ্ত হও। শয়তান তোমাদের মাঝে মদ ও জুয়ার মাধ্যমে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করতে চায় এবং আল্লাহর যিক্র ও ছালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে চায়। তাহলে কি তোমরা বিরত থাকবে’? (মায়িদাহ ৯০-৯১)।

লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। তুমি বল: উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং উপকারও আছে মানুষের জন্য, তবে এদের পাপ উপকারের চেয়ে অধিক। [সূরা বাকারা-২১৯]

(খ) হে মুমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার এবং যদি তোমরা মুসাফির না হও তবে অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর। আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অথবা তোমরা নারী সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম কর সুতরাং মাসেহ কর তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত, নিশ্চয় আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল। (সুরা নিসা-৪৩)।

(গ)  ওছমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা নেশাদার দ্রব্য থেকে বেঁচে থাক। কেননা নেশাদার দ্রব্য হচ্ছে অশ্লীল কর্মের মূল। যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য থেকে বেঁচে থাকে না তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নাফরমানী করার কারণে সে শাস্তির হক্বদার হয়’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তার সীমালঙ্ঘন করে, আল্লাহ তাকে এমন আগুনে প্রবেশ করাবেন যেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি’ (নিসা ১৪; নাসাঈ, হাদীছ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(ঘ)  ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সব নেশাদার দ্রব্য মদ আর সব ধরনের মদ হারাম। যে ব্যক্তি সর্বদা নেশাদার দ্রব্য পান করে তওবা বিহীন অবস্থায় মারা যাবে সে পরকালে সুস্বাদু পানীয় পান করতে পাবে না’ (মুসলিম ২/১৬৭ পৃঃ, ‘মদ্যপান’ অধ্যায়, ‘সকল নেশাদার দ্রব্য হারাম’ অনুচ্ছেদে, মিশকাত হা/৩৬৩৮; বাংলা মিশকাত ৭ম খণ্ড, হা/৩৪৭২ ‘হুদূদ’ অধ্যায়)।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(ঙ) জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে- নেশাদার দ্রব্য পানকারীদের আল্লাহ “ত্বিনাতে খাবাল” পান করাবেন। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! ‘ত্বিনাতে খাবাল’ কি জিনিস? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, জাহান্নামীদের শরীর হতে গলে পড়া রক্তপুজ মিশ্রিত অত্যন্ত গরম তরল পদার্থ’ (মুসলিম ২/১৬৭ পৃঃ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(চ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সর্বদা নেশাদার দ্রব্য পান কারী মূর্তিপূজকের ন্যায় অপরাধী’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৫, হাদীছ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ছ) আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সর্বদা নেশাদার দ্রব্য পানকারী জান্নাতে যাবে না’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৬, হাদীছ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(জ) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়া ও লটারীতে অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদানকারী এবং সর্বদা মদপানকারী জান্নাতে যাবে না’ (দারেমী, মিশকাত হা/৩৬৫৩; বাংলা মিশকাত ৭ম খণ্ড, হা/৩৪৮৬ ‘শাস্তি’ অধ্যায়)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঝ) আম্মার ইবনু ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষ কখনো জান্নাতে যাবে না। (১) যে ব্যক্তি তার পরিবারে বেহায়াপনার সুযোগ দেয়। (২) পুরুষের বেশধারী নারী। (৩) নিয়মিত নেশাদার দ্রব্য পানকারী’ (তাবরাণী, তারগীব হা/৩৩৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঞ) ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন। (১) সর্বদা মদপানকারী, (২) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও (৩) পরিবারে বেপর্দার সুযোগ দানকারী (দায়ূছ)’ (নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৬৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(ট) আবূ মূসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে না। (১) সর্বদা নেশাদার দ্রব্য পানকারী। (২) আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী। (৩) যাদুকে বিশ্বাসকারী’ (আহমাদ, মিশকাত, হাদীছ ছহীহ হা/৩৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঠ)  আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। যদি তওবাহ করে তাহলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। আবার নেশাদার দ্রব্য পান করলে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। আর যদি তওবা করে তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। আবার যদি নেশাদার দ্রব্য পান করে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। এ অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে যাবে। তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। লোকটি যদি চতুর্থবার মদ পান করে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামাতের দিন ‘রাদাগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। ছাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! ‘রাদাগাতু খাবাল’ কী? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আগুনের তাপে জাহান্নামীদের শরীর হতে গলে পড়া রক্তপূজ মিশ্রিত গরম তরল পদার্থ’ (ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/ ২৭৩৮, হাদীছ ছহীহ)।

মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর লোকের প্রতি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অভিশাপ করেছেন। (১) যে লোক মদের নির্যাস বের করে (২) প্রস্তুতকারক (৩) মদপানকারী (৪) যে পান করায় (৫) আমদানীকারক (৬) যার জন্য আমদানী করা হয় (৭) বিক্রেতা (৮) ক্রেতা (৯) সরবরাহকারী এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী’ (তিরমিযী, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/২৭৭৬; বঙ্গানুবাদ ৬ষ্ঠ খণ্ড, হা/ ২৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ড) আবু মালিক আশ’আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার কিছু উম্মত মদ পান করবে এবং তার নাম রাখবে ভিন্ন। তাদের নেতাদেরকে গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সম্মান করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ভুমিকম্পের মাধ্যমে মাটিতেই ধসিয়ে দিবেন। আর তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করবেন’ (বুখারী, ইবনে মাজাহ হা/৪০২০)। এ হাদীছ দ্বারা বুঝা গেল মানুষ মদ্যপান করবে, তবে মদের নাম অন্য হবে। আর নেতা ও দায়িত্বশীলদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা। এদের চরিত্র হবে নোংরা, এদের প্রিয় কাজ হবে অশ্লীলতা। তাদের স্বভাব ও কৃষ্টি-কালচার হবে শূকর ও বানরের ন্যায়। এরা স্বপরিবারে পাশ্চাত্যদের স্বভাব চরিত্র গ্রহণ করবে। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ঢ) মু’আয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘ইসলামের সূচনা বা রাজত্ব শুরু হয়েছে নবী ও দয়া দ্বারা। তারপর রাজত্ব আসবে খেলাফত ও রহমত দ্বারা, তারপর আসবে অত্যাচারী শাসকদের যুগ। তারপর আসবে কঠোরতা, উচ্ছৃংখলতা, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর যুগ। এসব অত্যাচারী শাসকেরা রেশমী কাপড় পরিধান করা, অবৈধভাবে নারীদের লজ্জাস্থান উপভোগ করা এবং মদ পান করাকে হালাল মনে করবে। এরপরও তাদের প্রচুর রুযী দেয়া হবে। দুনিয়াবী যে কোন কাজে তাদের সাহায্য করা হবে। অবশেষে এ পাপের মধ্যে লিপ্ত থেকে আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে’ (বায়হাক্বী, বাংলা মিশকাত হা/৫১৪৩, হাদীছ ছহীহ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ণ) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, ক্বিয়ামতের আলামত সমূহের মধ্যে রয়েছে (১) বিদ্যা উঠে যাবে (২) মূর্খতা বেড়ে যাবে (৩) ব্যাভিচার বেশি হবে (৪) মদপান বৃদ্ধি পাবে (৫) পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে (৬) নারীর সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে। এমনকি একজন পুরুষ ৫০ জন মহিলার পরিচালক হবে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘বিদ্যা কমে যাবে এবং মূর্খতা প্রকাশ পাবে’ (বুখারী, মুসলিম মিশকাত হা/৫২০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ত) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন আমার উম্মত নেশাদার দ্রব্য পান করবে, গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হবে এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হবে তখন অবশ্যই তিনটি ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে- (১) বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ধসে যাবে (২) উপর থেকে অথবা কোন জাতির পক্ষ থেকে যুলুম অত্যাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে (৩) অনেকের পাপের দরুণ আকার-আকৃতি বিকৃত করা হবে। আর এ গযবের মূল কারণ তিনটি। (ক) মদ পান করা (খ) নায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হওয়া

(থ) আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমার দোস্ত আমাকে অছিয়ত করেছেন, ‘নেশাদার দ্রব্য পান কর না। নিশ্চয়ই তা সব ধরনের অন্যায়ের চাবী’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(দ) ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঐ বস্তু যা বিবেকের ক্ষতি করে সেসবই মদ। আর সব ধরনের মদই হারাম’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ধ) জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে বস্তু বেশী পরিমাণ খেলে বিবেকের ক্ষতি হয়, তার কমও হারাম’ (ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(ন) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নেশাদার দ্রব্য এবং তার মূল্য হারাম করেছেন। মৃতপ্রাণী ও তার মূল্য হারাম করেছেন। শূকর ও তার মূল্য হারাম করেছেন’ (আবুদাউদ হা/৩৪৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(প)  আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নেশাদার দ্রব্য পানকারী জান্নাতে যাবে না। পিতামাতার অবাধ্য ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। খোটা দানকারী জান্নাতে যাবে না’ (তারগীব হা/২৩৬৩)।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(ফ)  আব্দুল্লাহ ইবনু আমর থেকে বর্ণিতঃ

‘যে ব্যক্তি মদ পান করবে আল্লাহ তার উপর ৪০ দিন সন্তুষ্ট হবেন না’ (আহমাদ হা/২৭৬৪৪; তারগীব হা/৩৪১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

ইসলামি আইনে মদ পানকারী বা নেশাদার দ্রব্য গ্রহণকারীর দুনিয়ায় শাস্তিঃ

(ক)  আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

মদ পানকারী এ ব্যক্তিকে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটে নিয়ে আসা হলো। তিনি তাকে দু’খানা ছড়ি (এক যোগে ধরে তার) দ্বারা চল্লিশের মত কোড়া মারলেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ ১ম খলিফা আবু বাকর (রাঃ) এরূপ কোড়া মেরেছেন, উমার (রাঃ) তার খিলাফতকালে এ ব্যাপারে লোকদের সাথে পরামর্শ করলেন। আবদুর রহমান ইবনু আওফ বলেনঃ সর্বাপেক্ষা হালকা শাস্তি হচ্ছে আশি (কোড়া)। ‘উমার (রাঃ) ঐ (৮০-র) আদেশই জারি করলেন।

বুখারী ৬৭৭৩, ৬৭৭৬, মুসলিম ১৭০৬, তিরমিযী ১৪৪৩, আবু দাউদ ৪৪৭৯, ইবনু মাজাহ ২৫৭০, আহমাদ ১১৭২৯, ১২৩৯৪, ১২৪৪৪, দারেমী ২৩১১। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(খ) মু’আবিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ পানকারী প্রসঙ্গে বলেনঃ যখন তা পান করবে তখন তাকে কোড়া মারো, তারপর পান করলে কোড়া মারো, তারপর ৩য় বার পান করলেও তাকে কোড়া মারো, তারপর ৪র্থ বার মদ পান করলে তার গর্দান কেটে দাও। (তিরমিযী ১৪৪, আবু দাউদ ৪৪৮২, ইবনু মাজাহ ২৫৭৩, আহমাদ ১৬৪০৫, ১৬৪১৭, ১৬৪২৭।) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(গ) মুআবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে লোক সুরা পান করে তাকে চাবুক পেটা কর। যদি সে লোক চতুর্থবার সুরাপানে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে মেরে ফেল।

সহীহ্, ইবনু মা-জাহ (২৫৭২, ২৫৭৩, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪৪৪)

(আবূ হুরাইরা, শারীদ, শুরাহবিল ইবনু আওস, জারীর, আবুর রামদা আল-বালাবী ও আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা বলেন, মু‘আবিয়ার হাদিসটি অনুরূপভাবে সাওরী বর্ণনা করেছেন আসিম হতে, তিনি আবূ সালিহ হতে, তিনি মু‘আবিয়া হতে, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে। ইবনু জুরাইজ এবং আমর বর্ণনা করেছেন সুহাইল ইবনু আবী সালিহ হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি আবূ হুরাইরা হতে, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে একই বিষয়ে আবূ সালিহ কর্তৃক মু’আবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত এই হাদীসটি অত্যাধিক সহীহ্। আবূ ঈসা বলেন, আমি ইমাম বুখারী (রহঃ) -কে একথা বলতে শুনেছি। তিনি আরো বলেছেন, পূর্বে মদ পানকারীকে মেরে ফেলার হুকুম ছিল। পরে সেটাকে বাতিল করা হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক-মুহাম্মাদ ইবনু মুনকাদিরের সূত্রে, তিনি জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) -এর সূত্রে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “যে লোক মাদকদ্রব্য সেবন করে সে লোককে চাবুক পেটা কর। যদি সে লোক চতুর্থবার তা সেবন করে তাহলে তাকে মেরে ফেল।” জাবির (রাঃ) বলেন, তারপর একজন লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আনা হল সে লোক চতুর্থবার সুরা পান করেছিল। তাকে তিনি বেত্রাঘাত করলেন কিন্তু হত্যা করেননি। ইমাম যুহরীও কাবীসা ইবনু যুয়াইব (রাঃ) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট হতে একই কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি (কাবীসা) বলেছেন, প্রথমে হত্যার হুকুম ছিল, পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়েছে।

অভিজ্ঞ আলিমগণ এরূপ আমল করেছেন। আমরা এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনরকম দ্বিমত দেখতে পাইনি। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ একমত যে, মদ্য পানকারীকে মেরে ফেলা যাবে না। তাছাড়া এই বক্তব্যকে অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস আরো বেশি মজবুত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যে লোক এরকম সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোন প্রভু নেই এবং আমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল’ -তার রক্তপাত (হত্যা) করা বৈধ হবেনা। তবে এ ধরণের তিন প্রকার মানুষকে হত্যা করা যাবেঃ কোন মানুষের হত্যাকারী, বিবাহিত যিনাকারী এবং নিজের দ্বীন পরিত্যাগকারী (মুরতাদ)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

মদ দিয়ে চিকিৎসা করা হারামঃ

(ক)  উম্মু সালামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমাদের রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা আল্লাহ তার হারামকৃত বস্তুর মধ্যে করেননি। আত্-তালখীসুল হাবীর ৪/১৩৯৭, আল মুহাযযিব (৮/৩৯৬৬), মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৫/৮৯) শাকীক বিন সালাম থেকে, বুলগুলমারাম, হাদিস নং-১২৫১।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(খ) ওয়ায়িল আল হাযরামী থেকে বর্ণিতঃ

তারিক ইবনু সুওয়াইদ (রাঃ) মদ দিয়ে ওষুধ তৈরী করা প্রসঙ্গে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করেছিলেন, উত্তরে তিনি বলেন, ওটাতো ওষুধ নয় বরং তা ব্যাধি।

(মুসলিম ১৯৮৪, তিরমিযী ২০৪৬, আবূ দাঊদ ৩৮৭৩, আহমাদ ১৮৩১০, ১৮৩৮০, ২৬৫৯৬, বুলগুলমারাম, হাদিস নং-১২৫২। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

মানব রচিত আইনে মদ পানের বৈধতা বা লাইসেন্স প্রদানঃ

২৪ মে ২০১৫ তারিখে “যুগান্তর পত্রিকায়” প্রকাশিত এক তথ্য মতে, সারা দেশে মদের বার রয়েছে ১১৮টি। এর মধ্যে ক্লাব-বার ২৮টি। এসব ক্লাব-বারের বেশিরভাগই আবার ঢাকায়। রাজধানীতে ক্লাব বারের সংখ্যা ১৭টি। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে।

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে (০৮.৫১ PM Bdst) bdnews24.com  এ প্রকাশিত  এক তথ্য মতে জানা যায়, ঢাকায় ৬০টি ক্যাসিনো আছে। এছাড়া অনেক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত যে, ক্যাসিনোর সংখ্যা কেউ বলছে ৬০টি, কেউ ১৫০টি, কেউ ৬০০টি।

১৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে “দৈনিক সংগ্রাম” পত্রিকায় প্রকাশিত-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) হিসেবে রাজধানীতে বৈধ মদের বার ৫০ থেকে ৬০টি এবং সিসা বার বা সিসা লাউঞ্জ রয়েছে ১০৫টি। অনেক বারের আইনি ভিত্তি থাকলেও সেখানে যে মদ বা সিসা বিক্রি হয় তার বেশির ভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। নতুন বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের টার্গেট হচ্ছে এসব বার। এরই মধ্যে শতাধিক বারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তালিকা ধরে শিগগিরই অভিযানে নামছে সংস্থাটি।

১৯ জুন ২০১৮ তারিখে “দৈনিক যুগান্তর” পত্রিকায় প্রকাশিত, বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত বারের সংখ্যা মাত্র ৯৬টি।

২৬ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে “শেয়ার বিজনেস” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত- দেশে বর্তমানে মদপানের অনুমতি রয়েছে ১৪২২৩ জনের। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ৮১০০ জনের। আর অনুমতিপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ৭২৩ জন। জেলা শহরের চেয়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে কোমল পানীয় মদ পানকারী বেশি। কোনো কোনো জেলায় দেখা গেছে, ৫০ জনেরও নিচে মদ পানকারীর পারমিট রয়েছে।

যেভাবে মদপানের পারমিট বা লাইসেন্স করতে হয়ঃ

বংলাদেশে মদপানের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকারের যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়োগ প্রাপ্ত সেটি হল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর/Narcotics Control Department. ঠিকানা: ৪৪১, তেজগাও শিল্পাঞ্চল। ঢাকা- ১২০৮।

লাইসেন্সর জন্য  নির্দিষ্ট ফরম পুরন করে এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি সহকারে জমাদান সাপেক্ষে পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয়।

নির্ধারিত পারমিট ফিঃ

(ক)  বিদেশী মদ/ ফরেন লিকিওর এর জন্য---- ২,০০০ টাকা

(খ) দেশী মদের জন্য-----------------------------৮০ টাকা

আনুষাঙ্গিক কাগজপত্রঃ

আবদনটির যৌক্তিকতা প্রমানে ডাক্তারি সার্টিফিকেট।

প্রিয় পাঠকঃ আমাদের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশে মদ পান আইনীগতভাবে সম্পূর্ণ জায়েজ। মদের বারের সংখ্যা  ও মদ পানকারীর লাইসেন্স সংখ্যা সরকারি হিসেবে যাই থাকুক, আপনি খকন কোথায় মদ খেতে চান সেখানেই হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। শুধু মদই না যেকোনো নেশা জাতীয় দ্রব্য হাতের নাগালেই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে মদের লাইসেন্স দেয়ার প্রথম উদ্যোক্তা কে?

০৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে “বাংলা ট্রিবিউন” পত্রিকায় প্রকাশিত-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এসে মদ, জুয়া, রেস খেলা বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, জিয়াউর রহমানসহ তারাই মদের লাইসেন্স চালু করে।’

মুসলিম সমাজে বা রাষ্ট্রে মদের প্রচলন কারা করলো? কেনই বা করলো? আসুন গোপনীয় মূল রহস্য জেনে নেইঃ

ফ্রাঞ্চের জনৈক বিশিষ্ট পন্ডিত হেনরী তাঁ গ্রন্থ “ খাওয়াতির মাওয়ানিহ ফিল ইসলাম” এ লিখেছেন,“ প্রাচ্যবাসীকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র এবং মুসলমানদেরকে খতম করার জন্য এই মদই ছিল অব্যর্থ তলোয়ার। আমরা আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত আমাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্ত আমাদের ব্যবহৃত অস্ত্রে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় নি।ফলে তাদের বংশ বেড়েই চলছে।এরা যদি আমাদের এ উপঢৌকন গ্রহণ করে নিতো; যে ভাবেই তাদের একটি বিশ্বাস বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী গ্রহণ করে নিয়েছে তাহলে তারাও আমাদের কাছে পদানত ও অপদস্ত হয়ে যেত।আজ যাদের ঘরে আমাদের সরবরাহকৃত মদের প্রবাহ বইছে,তারা আমাদের কাছে এতই নিকৃষ্ট ও পদদলিত হয়ে গেছে যে, তারা তাদের মাথাটি পর্যন্ত তুলতে পারছে না।

(সূত্র: অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল। প্রকাশক-ইসলামিক  ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশকাল-মে ২০০৬।

(চ) ইসলাম ধর্ম ত্যাগী বা মুরতাদঃ

মুরতাদ বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যে প্রথমে মুসলমান ছিল। তারপর ইসলামের যে কোন জরূরিয়্যাতে দ্বীন অস্বিকার করে কাফের হয়ে গেছে। উক্ত ব্যক্তির নাম মুরতাদ। আর যে ব্যক্তি মুরতাদ সে কাফেরও হয়ে যায়। এখানে একটি বিষয় বুঝে রাখতে হবে যে, কাফের মানেই মুরতাদ নয়। কিন্তু মুরতাদ মানেই কাফের।

যদি কোন মুসলিম মুরতাদ হয়ে যায় এবং মুরতাদের সকল শর্ত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় (সুস্থ- মস্তিস্ক, বালেগ, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়া) তাহলে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হবে এবং ইমাম তথা মুসলমানদের শাসক অথবা তাঁর প্রতিনিধি যেমন বিচারক তাকে হত্যা করবে। তাকে গোসল করানো হবে না, তার জানাযা-নামায পড়ানো হবে না এবং তাকে মুসলমানদের গোরস্থানে দাফন করা হবে না।

(ক)  “তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাকারা: ২:২১৭)।

(খ) “যারা একবার মুসলমান হয়ে পরে কাফের হয়ে গেছে, তারপর পুনরায় মুসলমান হয়েছে এবং আবারো কাফের হয়ে গেছে এবং দিন দিন কুফুরীর পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে, আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না, সঠিক পথও দেখাবেন না।” (সূরা নিসা: ৪:১৩৭)

(গ) “যদি এরা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে তুমি বলো– আমি এবং আমার অনুসরণকারীগণ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছি; অতঃপর যারা কিতাবপ্রাপ্ত এবং যারা (কিতাব না পেয়ে) মূর্খ (থেকে গেছে), তাদের জিজ্ঞেস করো– তোমরা কি সবাই আত্মসমর্পণ করছো? তখন তারা যদি আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেয় তাহলে তো তারা সঠিক পথ পেয়েই গেলো; আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে কেবল (আমার কথা) পৌঁছে দেয়া। আল্লাহ (নিজেই) তাঁর বান্দাদের (কর্মকাণ্ড) পর্যবেক্ষণ করছেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩:২০)।

(ঘ) “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আর ভূপৃষ্ঠে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা এক দিকের হাত ও অপর দিকের পা কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে; এটা তো দুনিয়ায় তাদের জন্য ভীষণ অপমানজনক ব্যাপার, আর আখিরাতেও তাদের জন্য ভীষণ শাস্তি রয়েছে।” (সূরা মায়েদা: ৫:৩৩)।

(ঙ) ইব্নু ‘উমর (রাঃ) যুহ্রী ও ইব্রাহীম (রহঃ) বলেন, ধর্মত্যাগী নারীকে হত্যা করা হবে এবং তার থেকে তওবা আহবান করা হবে। আল্লাহ্ বলেনঃ ঈমান আনার পর যে সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে আল্লাহ্ কিভাবে সৎ পথের নির্দেশ দেবেন...... এরাই তারা যারা পথভ্রষ্ট পর্যন্ত। (সূরা আল ‘ইমরান ৩/৮৬-৯০)।

(চ) আল্লাহ্র বাণীঃ যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমরা যদি তাদের দল বিশেষের আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদেরকে ঈমানের পর আবার সত্য প্রত্যাখ্যানকারীতে পরিণত করবে - (সূরা আল ‘ইমরান ৩/১০০)।

(ছ) আল্লাহ্ বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে আল্লাহ্ এমন এক জাতি আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন ও যারা তাঁকে ভালবাসবে - (সূরা আল-মায়িদা ৫/৫৪)।

(জ) আল্লাহ্ বলেনঃ যারা সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য হৃদয় খুলে রাখে তাদের উপর পতিত হয় আল্লাহ্র গযব এবং তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি। তা এজন্য যে, তারা ইহ জীবনকে পর জীবনের উপর প্রাধান্য দেয়- (সূরা নাহল ১৬/১০৬-১০৭)।

(ঝ) অবশ্যই তোমার প্রতিপালক তাদের জন্য যারা নির্যাতিত হবার পর দেশ ত্যাগ করে পরে জিহাদ করে এবং ধৈর্য ধারণ করে তোমার প্রতিপালক এসবের পর তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু - (সূরা নাহল ১৬/১১০)।

(ঞ) ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না।’ আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)।

(ট) আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দু’জনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দু’জন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।

বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)

(ঠ) যখন উমর রা. এর নিকট ‘তুসতার’ নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)।

যারা ফরযসমূহ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং যাদেরকে ধর্মত্যাগের অপরাধে অপরাধী করা হয়েছে তাদেরকে হত্যা করাঃ

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, যখন নবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যু হল এবং আবূ বকর (রাঃ) খলীফা হলেন আর আরবের যারা কাফির হল, তখন ‘উমর (রাঃ) বললেন, হে আবূ বকর! আপনি কিভাবে লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন? অথচ নবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই) বলবে। আর যে কেউ ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, যথার্থ কারণ না থাকলে সে তার জান-মাল আমার হাত থেকে রক্ষা করে নেয়। আর তার হিসাব আল্লাহ্র দায়িত্বে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৬৯২৪,আধুনিক প্রকাশনী-৬৪৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪৫৬), হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(খ) আবূ বক্‌র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহ্‌র কসম! যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমি যুদ্ধ করব। কেননা, যাকাত হল মালের হক। আল্লাহ্‌র কসম! যদি তারা একটি বক্‌রির বাচ্চাও না দেয় যা তারা রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে দিত, তাহলে তা না দেয়ার কারণে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। ‘উমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহ্‌র কসম! আমি বুঝতে পারলাম যে, এটা আর কিছু নয় এবং আল্লাহ্‌ আবূ বকর (রাঃ)-এর বক্ষ যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। পরে আমি বুঝতে পারলাম যে, (আবূ বকর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন) এটি-ই হক।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৬৯২৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪৫৬), হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

মুরতাদকে প্রথমে তওবা করার আহবান করতে হবেঃ

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। ওহুদ যুদ্ধে এক মহিলা মুরতাদ হয়ে যায়,তখন রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন,তাকে তওবা করানো হোক,আর যদি তওবা না করে,তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। {সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১২১, সুনানে বায়হাকী কুবরা,হাদীস নং-১৬৬৪৫,মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক,হাদীস নং-১৮৭২৫,মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস নং-২৯৬০৭} ।

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। উম্মে মারওয়ান নামের এক মহিলা মুরতাদ হয়ে গেলে রাসূল সাঃ আদেশ দেন যে,তার কাছে ইসলাম পেশ করতে,যদি সে ফিরে আসে তাহলে ভাল, নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। {সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী,হাদীস নং-১৬৬৪৩,সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১২২}।

মানব রচিত আইনে ধর্মত্যাগী বা  মুরতাদের শাস্তিঃ

 মানব রচিত আইনে ধর্মত্যাগী বা  মুরতাদের শাস্তির কোনো আইন তৈরী করা নেই। তবে ধর্ম অবমাননার ফৌজদারী আইন আছে যা নিম্নরুপঃ ইহা সকল ধর্মের জন্যে-

ধর্মের অবমাননাঃ

প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত৷ বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারার আইনে এ সংক্রান্ত অপরাধ এবং শাস্তির বিধান আছে৷ মোটা দাগে এই অপরাধগুলো হলো:

২৯৫–কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্মবোধে অবমাননা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উপসানলয়ের ক্ষতি সাধন বা অপবিত্র করা৷

২৯৫ (ক)–কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে উক্ত যে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজ৷

২৯৬–ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি৷

২৯৭– সমাধিস্থান ইত্যাদিতে অনধিকার প্রবেশ৷

২৯৮–ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করার উদ্দেশে শব্দ উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি৷

এ সব অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচচ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান আছে৷ অ্যাডভোকেট শ. ম রেজাউল করিম বলেন, ‘‘এই আইন সব ধর্মের জন্য৷ এই আইনের সুবিধা সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিতে পারবে৷ আর যে কোনো ধর্মের অবমাননাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কোনো বিশেষ ধর্মের জন্য বা একক কোনো ধর্মকে সুরক্ষা দিতে এই আইন নয়৷''

এর বাইরেও বিতর্কিত তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ এই আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে৷

(ছ) ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহঃ

“তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৩)। “তাদেরকে (দীনের শত্রুদের) যেখানেই পাও তাদের সাথে যুদ্ধ করো।

যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও। কেননা মানব হত্যা যদিও খারাপ কাজ, তবে ফিতনা সৃষ্টি মানবহত্যার চেয়েও খারাপ। –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯১)।

‘‘আমি (আবূ মুতী) বললাম, কোনো মানুষ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে থাকেন। তখন কিছু মানুষ তার অনুগামী হয়। তখন তারা জামা‘আতের (রাষ্ট্র ও সমাজের) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এদের বিষয়ে আপনি কি বলেন? আপনি কি এরূপ কর্মের স্বীকৃতি দেন? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘‘না’’। আমি বললাম, কেন? মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল () তো ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এতো একটি জরুরী ফরয। তিনি বলেন: তা ঠিক; তবে তারা এভাবে ন্যায়ের চেয়ে অন্যায়-ফাসাদ বেশি করে; কারণ তারা রক্তপাত করে, মানুষের ধন-সম্পদ ও সম্ভ্রম নষ্ট করার কঠিন হারামে নিপতিত হয়, ধনসম্পদ লুটপাট করে। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘মু’মিনদের দু‘দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করবে; আর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে যারা বিদ্রোহ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে...।’’ আমি বললাম: তাহলে কি আমি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করব? তিনি বলেন: হ্যাঁ। তুমি আদেশ ও নিষেধ করবে। যদি গ্রহণ করে তবে ভাল। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তাহলে তুমি ন্যায়পন্থী দলের (রাষ্ট্র ও সমাজের) সাথে থাকবে, যদিও রাষ্ট্রপ্রধান জালিম হয়। কারণ রাসূলুল্লাহ () বলেছেন: জালিমের জুলম ও ন্যায়পরায়ণের ইনসাফ কোনোটিই তোমাদের ক্ষতি করবে না। তোমরা তোমাদের পুরস্কার লাভ করবে এবং তারা তাদের শাস্তি পাবে।... কাজেই তুমি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে বিদ্রোহের কারণে, কাফির হওয়ার কারণে নয়। আর ন্যায়পন্থী জনগোষ্ঠী (মূল সমাজ) ও জালিম শাসকের সাথে থাকবে, কিন্তু বিদ্রোহীদের সাথে থাকবে না।’’ (ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৫, ৫২।)

ইসলামি আইনে কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর দেয়া বিধানকে অস্বীকার করে বা ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেহ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাকে মৃত্যু দন্ড দিতে হবে।

মানব রচিত আইনেও অপরাধের ধরণ অনুযায়ী যাবজ্জীবন বা মৃত্যু দন্ডের বিধান আছে। এতএব ফেতনা ফ্যাসাদ দূরীভুত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যবস্থা ইসলামি রাষ্ট্র করবে কোনো সাধারণ জনগণ নয়। যেহেতু আমাদের দেশ ইসলামি রাষ্ট্র নয় তাই এক মুসলিম আরেক মুসলিমের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই অস্ত্র ধারণ করে নতুন ফ্যাসাদ সুষ্টি করা যাবে না। এরুপ করতে ইসলামে নিষেধ আছে।

মানব রচিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও তার শাস্তির বিধানঃ

বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির ১২১ ধারা থেকে ১২৬ ধারা পর্যন্ত রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের প্রকৃতি ও শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞা দেওয়া আছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোন ব্যক্তি উচ্চারিত বা লিখিত কথা বা উক্তি দ্বারা, কিংবা চিহ্নাদি দ্বারা, কিংবা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কিংবা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশ বা আইনানুসারে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার চেষ্টা করে কিংবা বৈরিতা উদ্রেগ করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা যে কোন কম মেয়াদের কারাদণ্ডে যার সঙ্গে জরিমানা যুক্ত করা যাবে, কিংবা ৩ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তৎসহ তাকে জরিমানায়ও দণ্ডিত করা যাবে।’ দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা যুদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ বা যুদ্ধ ঘোষণায় সহায়তা করলে সেই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ১২১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ১২১ ধারায় দণ্ডিত অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্র করলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ১২২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করলে সেই ব্যক্তিও যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ ১২৩ ধারায় এ ধরনের অপরাধ সুগম করার অভিপ্রায়ে ষড়যন্ত্র গোপন করলে ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবে। দণ্ডবিধির ১২৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সৃষ্টির নিন্দা করা ও উহার সার্বভৌমত্ব বিলোপ সমর্থন করলে বা সেই মর্মে প্রচারণা চালালে দশ বৎসর পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।’ দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগে বাধ্য করা বা বাধাদান করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতি, গর্ভনর প্রমুখ ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে সেই ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’ ১২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ কোন এশীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেষ্টা করলে সেই ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।’ ১২৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান কোন শক্তির রাষ্ট্রীয় এলাকার ওপর হামলা বা লুণ্ঠন অনুষ্ঠান করলে উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

আরো কিছু শাস্তিঃ

 চাঁদাবাজির শাস্তিঃ

চাঁদাবাজি আরেকটি মারাত্মক অপরাধ। কোন প্রভাবশালী চক্র কর্তৃক জোর পূর্বক কাউকে কোথাও নিজ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অথবা নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে বাধ্য করাকে সাধারণত চাঁদাবাজি বলা হয়। দস্যুতার সাথে এর খুবই মিল। চাঁদা উত্তোলনকারী, চাঁদা লেখক ও চাঁদা গ্রহণকারী সবাই উক্ত গুনাহ্’র সমান অংশীদার। এরা যালিমের সহযোগী অথবা সরাসরি যালিম।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

‘‘শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধেই (শাস্তির) ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ আচরণ করে বেড়ায়। বস্ত্তত: এদের জন্যই রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি’’। (শূরা’ : ৪২)

তিনি আরো বলেন:

’’তোমরা যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না তথা তাদেরকে যুলুমের সহযোগিতা করো না। অন্যথায় তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। আর তখন আল্লাহ্ ছাড়া কেউ তোমাদের সহায় হবে না। অতএব তখন তোমাদেরকে কোন সাহায্যই করা হবে না’’। (হূদ্ : ১১৩)

জা’বির বিন্ ‘আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

‘‘কারোর উপর অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকো। কারণ, এ অত্যাচার কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকার রূপেই দেখা দিবে’’। (মুসলিম ২৫৭৮)

ইসলামি আইনে যাদুকরকে হত্যা করার বিধানঃ

বাজালাহ ইবনু আবাদাহ থেকে বর্ণিতঃ

ওমর (রাঃ) মুসলিম গভর্নরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় বলেছিলেন, ‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা কর’ (বুখারী, বায়হাক্বী, আল-কাবায়ির ২৬ পৃঃ)।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

পৃথিবীতে  ফেতনা-ফ্যাসাদ বা অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর শাস্তিঃ

যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (মায়েদা ৬ : ৩৩)।

“তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৩)।

“তাদেরকে (দীনের শত্রুদের) যেখানেই পাও তাদের সাথে যুদ্ধ করো। যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও। কেননা মানব হত্যা যদিও খারাপ কাজ, তবে ফিতনা সৃষ্টি মানবহত্যার চেয়েও খারাপ। –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯১)।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আত্মসাৎকারী, লুণ্ঠনকারী ও ছিনতাইকারীর ব্যাপারে হাত কেটে ফেলার দণ্ড নেই।

(সহীহ্, ইবনু মা-জাহ, হাদিস নং- ২৫৮৯, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪৪৮) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ গাছের ফল ও গাছের মজ্জা (তাল, খেজুর, নারিকেল ইত্যাদি গাছের মাথার নরম ও কচি অংশ) চুরির দায়ে হাত কাটার বিধান নেই।

(সহীহ্, ইবনু মা-জাহ, হাদিস নং-২৫৯৩, জামে আত তিরমিজি, হাদিস নং-১৪৪৯)

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

অনুমতি ছাড়া কেহ উঁকি মারলে তার শাস্তিঃ

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন আবুল কাসিম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যদি কোন লোক কোন অনুমতি ছাড়াই তোমার দিকে উঁকি মারে আর তুমি তাকে কাঁকর ছুঁড়ে মার ও তার চক্ষু নষ্ট করে ফেল তবে তোমার কোন দোষ হবে না।

আহমাদ ও নাসায়ীর শব্দে রয়েছে, এর জন্য কোন দিয়াত বা কিসাস নেই। ইবনু হিব্বান এ বর্ধিত অংশকে সহীহ বলেছেন। [১৩০৬]

 [১৩০৬] বুখারী ৬৮৮৮, ৬৯০২, ২১৫৮, নাসায়ী ৪৮৬১, মুসলিম ২১৫৮ আবূ দাঊদ ৫১৭২ আহমাদ ৭৫৬১। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধে কেহ কটুক্তি করলে তার শাস্তির বিধানঃ

“অবশ্য তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে আর যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। আর আমি বিধানসমূহে জ্ঞানী লোকদের জন্যে সর্বস্তরে র্বণনা করে থাকি। আর যদি ভঙ্গ করে তারা তাদের শপথ প্রতিশ্রুতির পর এবং বিদ্রুপ করে তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে, তবে কুফর প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ, এদের কেন শপথ নেই যাতে তারা ফিরে আসে। তোমরা কি সেই দলের সাথে যুদ্ধ করবে না; যারা ভঙ্গ করেছে নিজেদের শপথ এবং সঙ্কল্প নিয়েছে রসূলকে বহিস্কারের? আর এরাই প্রথম তোমাদের সাথে বিবাদের সূত্রপাত করেছে। তোমরা কি তাদের ভয় কর? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও। {সূরা তওবা-১১-১৩}।

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ এ আয়াতের দ্বারা দলিল দিয়ে বলেন- যে ব্যক্তি ইসলাম বা কুরআনের বিরুদ্ধে খারাপ মন্তব্য করে, অথবা রাসূল সাঃ এর ব্যাপারে মন্দ কথা বলে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে। {মাহাসিনুত তাওয়ীল-৫/১৪২}

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

কোন এক অন্ধ সাহাবীর একটা সন্তানের মাতা দাসী ছিল, সে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে গালি দিত এবং তাঁর প্রসঙ্গে অশোভনীয় মন্তব্য করত। সাহাবী তাকে নিষেধ করতেন কিন্তু সে বিরত হত না। এক রাত্রে অন্ধ সাহাবী (তার এরূপ দূর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে) কুড়ালি জাতীয় এক অস্ত্র দিয়ে ঐ দাসীর পেটে বসিয়ে দেন ও তার উপর বসে যান ও তাকে হত্যা করে ফেললেন। এ সংবাদ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটে পৌঁছালে তিনি বলেনঃ তোমরা সাক্ষী থাক, এ খুন বাতিল এ জন্য কোন খেসারত দিতে হবে না। আবূ দাঊদ ৪৩৬১, নাসায়ী ৪০৭০, বিুলগুলমারাম, হাদিস নং-১২০৪। হাদিসের মানঃ হাসান হাদিস।

রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধে কেহ অবস্থান নিলে তার শাস্তিঃ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, এমন মুসলমানের রক্ত হালাল নয়, যে সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তবে তিন শ্রেণীর মানুষকে হত্যা করতে হয়। (১) এমন মানুষ যে বিবাহ করার পর যেনা করল। তাকে রজম করতে হবে। (২) এমন ব্যক্তি যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে অবস্থান করল, তাকে হত্যা করা হবে, না হয় শূলী দেওয়া হবে, না হয় যমীন হতে নির্বাসন করা হবে। (৩) এমন ব্যক্তি যে কাউকে হত্যা করল, তাকে হত্যা করা হবে’ (আবুদাঊদ হা/৪৩৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

কিভাবে ইসলামি আইন  পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হবে?

ইসলামি আইন বা ইসলামি দন্ডবিধি বা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কায়েম বা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে শুধু দোয়া, জিকির, ওয়াজ-মাহফিল, দরবার ও তাসবিহ দানার মধ্যে নিমজ্জিত থাকলে আল্লাহতায়ালার বিধান কোনো দিন কায়েম হবে না। আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র নয়। আমাদের রাষ্ট্র চলে মানব রচিত প্রচলিত আইনে। এই মানব রচিত আইন বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ইসলামি আইন কার্যকর করা সম্ভব নয়। কারণ গণতান্ত্রিক ধারায় আমাদের দেশে জনগণ ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন, যারা নির্বাচিক হোন তারা ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নির্বাচিত হোন না। সংসদে গিয়ে তারা মানব রচিত আইন প্রনয়ণ করেন এবং সেই মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। তাই রাষ্ট্রে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠিত হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে জনগণ তথা ভোটারদের উপর। এই ভোটারদের মধ্যে ৮০% ভোটার আছে যারা মুসলমান। আবার তাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা মুফতি, মুহাদ্দিস, হাফেজ, ইমাম, মুয়াজ্জিন, পির-অলি, রাসুল সাঃ এর আওলাদ, ইসলামি বক্তা, মাদ্রাসার প্রিন্সপ্যালসহ বিখ্যাত-প্রখ্যাত আলেম সমাজ। ওহে মুসলমান আপনি যাকে ভোট দিলেন তিনি সংসদে গিয়ে এমন আইন পাশ করলো যা আল্লাহর বিধানের বিপক্ষে। আপনার জিন্দিগীর ইবাদত ও আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হবে তো? একদিকে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর বিপক্ষে স্বাক্ষী রেখে অবস্থান নিচ্ছেন অপর দিকে দরবার খুলে বসে বলছেন আপনি রাসুল সাঃ এর আওলাদ। আপনি কিসের মুসলমান?

আপনি কিসের দাওয়াতি কাজ করেন, আপনি কিসের দাঈ?

রাসুল সাঃ এর দাওয়াতি কাজের শেষ লক্ষ্য ছিলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত করা। আপনি তাসবিহর দানা গুণতে গুণতে পরপারে চলে গেলেন আপনি টার্গেটে পৌঁছতে পারলেন না। আপনার দাওয়াতি কাজের মধ্যে সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। অতএব এটা কোনো দাওয়াতি কাজের মধ্যে পড়ে না। যে যাই বলুক, চরমোনাই পির সাহেব সেই উপলব্ধি থেকে তিনি ইসলামি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, শুধু কথায় চিড়ে ভিজে না। যদিও তার দরবার শিরক, কুফর আর বিদআতের কারখানা। হয়তো এক সময় এগুলো তারা সংশোধন করে নিবেন।

আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর বিধিবিধান পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কায়েম করতে চাইলে কয়েকটি পর্যায়ের পর তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। মুসলমানদের মধ্যে অতি ধর্মান্ধ কিছু লোক আছে যারা জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে ইসলাম কায়েম করতে চায়। এটা বর্তমান যুগে কোনো দিনই সম্ভব নয়। আবার অনেকে বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হারাম বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। তারা বলেন, ইসলামে গণতন্ত্র হারাম। বর্তমান যে গণতন্ত্র চালু আছে এটা মুসলমানদের বানানো না। যেসব রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের নিকট থেকে এটা গ্রহণ করা হয়েছে তারা কেহই মুসলমান নয়। বেশ কিছু কুফরী আকিদাহ এই গণতন্ত্রের মধ্যে তারা চালু রেখেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতে। অর্থাৎ সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। এটাই হচ্ছে বর্তমান গনতন্ত্রের মূল স্লোগান। এজন্যেই ইসলামে গণতন্ত্র হারাম।

এখন কথা হচ্ছে বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারায় ভোটা প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচিত না হলে, কোন্ মাধ্যমে ইসলাম কায়েম হবে? আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর বিপক্ষে অবস্থানকারী অনেক আলেমকে এই প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। যারা এই হারাম গণতন্ত্রের বিপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য তাহলে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে ইসলাম কায়েম করা। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। কারণ ইসলাম এই পন্থায় আল্লাহর বিধান কায়েম করে নাই। তাই বলি গণতন্ত্র হারাম হলেও এই পদ্ধতিই অবলম্বন করে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অবলম্বন করে সংসদে যেতে হবে এবং  সকল মাবন রচিত আইন সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল করে আল্লাহ বিধান আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এরপরই গঠিত হবে শূরা বোর্ড।

যাই হোক শূরা বোর্ড পর্যন্ত যেতে চাইলে যে পর্যাগুলো পেরিয়ে যেতে হবে তাহলোঃ

(ক) নিজ ও পরিবারের সদস্যদেরকে আত্মাশুদ্ধি করা। সকল ইবাদত শিরক, কুফর ও বিদআত মুক্ত করা। নিজেকে মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলা। নিজের আখলাক সংশোধন করা, হক্ব আদায় করা, লজ্জা স্থানের হেফাজত করা, আত্ম অহমিকা দূর করা, পর্দার বিধান নিজ পরিবার থেকে চালু করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সকল ইবাদত সহিহভাবে আদায় করা, হালাল উপার্জন করা, হারাম কাজ ত্যাগ করা, নেশা থেকে দূরে থাকা, সুদমুক্ত জীবন গড়া, ইসলামে নিষিদ্ধ কাজগুলো এড়িয়ে চলা এবং কুরআন ও হাদিস বেশী বেশী অধ্যায়ণ করা।

(খ) একটি ইসলামি সংগঠন বা ইসলামি রাজনৈতিক দল গঠন করা। যা করা প্রত্যেক মুসলমানতের জন্যে ফরজ।

 (গ) শিরক, কুফর ও বিদআতমুক্ত সমাজ গঠন এবং আল্লাহর বিধান কায়েমেরে লক্ষ্যে ব্যাপক দাওয়াতি কাজ করা এবং কর্মী সংগ্রহ করা।

(ঘ) ভোটের সময় ভোট প্রদান করা।

কিন্তু এই কাজগুলো করা এতো সহজ নয়। এর সাথে জিহাদ ও শহীদের বিষয় জড়িত। মূলত জিহাদ করতে হবে এবং শহীদ হতে হবে এই ভয়ে খানকা বাবারা দরবার থেকে বের হয় না। বিদআতি আলেমরা এ নিয়ে কথাই বলে না। কখনো তাদের সামনে এসব কথা উঠলে আতংকে পালিয়ে যায়। যাই হোক, “ইসলামি আইন বাস্তবায়নের পদ্ধতি” নামক বই এ এতদবিষয়ে বিস্তারিত লিখবো ইনশাআল্লাহ। দোয়া করবেন। আমিন।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: ইসলামপন্থীদের জন্য বর্তমানের গনতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা বৈধ কি না?

বর্তমান বিশ্বে যে, গনতান্ত্রিক পদ্ধতির চর্চা হচ্ছে, সামগ্রীক ভাবে ইসলাম এটার সাপোর্ট করে না। যদিও এর কিছু দিক ইসলামের সাথে মিলে যায়। যেমন: ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি। কিন্তু সামগ্রীকভাবে এটি ইসলাম বিবর্জিত একটি মতবাদ। পৃথিবীর কোনো ইসলামি বিশেষজ্ঞ এই মতামতের পক্ষে রায় দেন নি।

এমন কি যে সকল ইসলামপন্থী দল গনতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে, তারাও একে মানবরচিত মতবাদ হিসাবেই বিশ্বাস করে।

এখন প্রশ্ন হলো, এমন একটি গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা কতটা যৌক্তিক?

উত্তরঃ

যে ব্যক্তি এ পদ্ধতির অধীনে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে এ জন্যে নির্বাচিত করে যাতে করে এ আইনসভাতে ঢুকে এর বিরোধিতা করা যায়, এ পদ্ধতির বিপক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, সাধ্যানুযায়ী অকল্যাণ ও দুর্নীতি রোধ করা যায় এবং যেনো গোটা ময়দান দুর্নীতিবাজ ও নাস্তিকদের হাতে চলে না যায়, যারা জমিনে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেয়, মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ারসমূহ কল্যাণ নস্যাৎ করে দেয়— তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ইজতিহাদ করার তথা বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

বরং কোনো কোনো আলেম মনে করেন, এ ধরনের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ফরজ।

শাইখ মুহাম্মদ বিন উছাইমীনকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন: আমি মনে করি এ নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়া ফরজ। আমরা যাকে ভাল মনে করি তাকে সহযোগিতা করা ফরজ। কারণ ভাল লোকেরা যদি ঢিলেমি করে তাহলে এ স্থানগুলো কে দখল করবে? খারাপ লোকেরাই দখল করবে কিংবা এমন লোকেরা দখল করবে যাদের কাছে না আছে ভাল; না আছে খারাপ; যারা সুবিধাবাদী। তাই আমাদের উচিত যাকে যোগ্য মনে করি তাকে নির্বাচিত করা।

যদি কেউ বলেন: আমরা যাকে নির্বাচিত করলাম আইনসভার অধিকাংশ সদস্য তার বিপক্ষে।

আমরা জবাবে বলব: কোন অসুবিধা নেই। এই একজনের মধ্যে আল্লাহ বরকত দিতে পারেন। তিনি যদি আইনসভার সামনে হক কথা বলতে পারেন তাহলে অবশ্যই এর প্রভাব থাকবে, প্রভাব থাকতেই হবে। তবে যে ক্ষেত্রে আমাদের কসুর হয় সেটা হচ্ছে- আল্লাহর সাথে বিশ্বস্ত হওয়া। আমরা শুধু বৈষয়িক বিষয়ের উপর নির্ভর করি; আল্লাহর বাণীর দিকে তাকাই না। সুতরাং আপনি যাকে ভাল মনে করেন তাকে নির্বাচিত করুন; এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।

[লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ থেকে সংক্ষেপিত]

সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:

নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দেয়া ও ভোট দেয়া জায়েয আছে কি? উল্লেখ্য, আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনে নয়।

জবাবে তাঁরা বলেন:

যে সরকার আল্লাহর নাযিলকৃত আইন দিয়ে শাসন করে না, শরিয়া আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে না কোন মুসলমানের জন্য সে সরকারে যোগ দেয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে মনোনীত করা জায়েয নয়। তাই এ সরকারের সাথে কাজ করার জন্য কোন মুসলমানের নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে নির্বাচিত করা জায়েয নেই।

তবে কোন মুসলমান যদি এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয় কিংবা অন্যকে নির্বাচিত করে যে, এর মাধ্যমে এ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে, নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে তারা বর্তমান শাসনব্যবস্থার উপর আধিপত্যবিস্তার করার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে সেটা জায়েয। তবে, সে ক্ষেত্রেও যে ব্যক্তি প্রার্থী হবেন তিনি এমন কোন পদ গ্রহণ করতে পারবেন না যা ইসলামী শরিয়ার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান, শাইখ আব্দুল্লাহ কুয়ুদ। [স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র থেকে সংকলিত : ২৩/৪০৬, ৪০৭]

স্থায়ী কমিটিকে আরও জিজ্ঞেস করা হয় যে,

আপনারা জানেন, আমাদের আলজেরিয়াতে “আইনসভার নির্বাচন” অনুষ্ঠিত হয়। কিছু কিছু দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত কায়েমের দিকে আহ্বান করে। আর কিছু কিছু দল আছে যারা ইসলামী হুকুমত চায় না। এখন যে ব্যক্তি এমন কাউকে ভোট দেয় যে প্রার্থী ইসলামী হুকুম চায় না সে ব্যক্তির হুকুম কি হবে; তবে এ ব্যক্তি নামায আদায় করে?

জবাবে তাঁরা বলেন: যে সব দেশে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু নাই সেসব দেশের মুসলমানদের উপর ফরজ ইসলামী হুকুমত ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়োজিত করা এবং যে দল ইসলামী হুকুমত বাস্তবায়ন করবে বলে তারা ধারনা করেন সে দলকে একজোটে সবাই মিলে সহযোগিতা করা। পক্ষান্তরে, যে দল ইসলামী শরিয়া বাস্তবায়ন না করার প্রতি আহ্বান জানায় সে দলকে সহযোগিতা করা নাজায়েয। বরং এ ধরনের সহযোগিতা ব্যক্তিকে কুফরের দিকে ধাবিত করে।

দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:

“আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের মাঝে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী বিধান দিন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, যাতে করে আল্লাহ আপনার প্রতি যা নাযিল করেছেন তারা এর কোন কিছু হতে আপনাকে বিচ্যুত করতে না পারে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু পাপের শাস্তি দিতে চান। নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকেই ফাসেক। তারা কি জাহেলিয়াতের বিধান কামনা করে? যারা (আল্লাহর প্রতি) একীন রাখে তাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কে?”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৯-৫০]

এ কারণে যারা ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে না আল্লাহ তাদেরকে কাফের হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাদের সাথে সহযোগিতা করা থেকে, তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা থেকে সাবধান করেছেন। যদি মুমিনগণ প্রকৃত ঈমানদার হয় তাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন

“হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে তাদেরকে এবং অন্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।”।[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৫৭]

গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি-

শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গুদইয়ান

স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১/৩৭৩)। ফতোয়া নাম্বার: ১০৭১৬৬}।

ইসলামি আইন না মানা ও বাস্তবায়ন না করার শাস্তিঃ

(১) আল্লাহতায়ালা বলেন,

হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহ্র পথ হতে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহ্র পথ হতে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা বিচারদিবসকে ভুলে আছে। -সূরা ছদ (৩৮) : ২৬

(২) আল্লাহতায়ালা রাসুল সাঃ এর আদেশ নিষেধ মানতে বলেছেন,

“রসুল (সঃ) তোমাদের জন্য যা কিছু দেন তা গ্রহণ কর, আর যে জিনিস থেকে বিরত রাখেন (নিষেধ) করেন তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তি দাতা। (হাশর -৭)

(৩) যারা মানবে না তাদের শাস্তিঃ

যারা তাঁর (রাসুলসঃ)  হুকুমের বিরুদ্ধাচারন করে  এ বিষয় তাদের সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য যে, তারা মহাবিপদ গ্রস্ত হবে অথবা যন্ত্রনা দায়ক আযাব তাদেরকে পাকড়াও করবে।  (নূর-৬৩)।

সঠিক পথ প্রদর্শনের পরও যারা বিশ্বাসীদের ব্যতীত অন্য কারও অনুকরন করে এবং মতানৈক্য  ও বিরোধিতা করছে আল্লাহর রাসুল নবি করিম  (সঃ) কে তবু তাদেরকে তিনি তার পছন্দ মতো বিপথে চলতে দেবেন এবং জাহান্নামের অগ্নিতে জ্বালাবেন। (কোরআন-৪:১১৫)।

(৪) যারা কুরআনের অর্ধেক হুকুম মানেঃ

“তোমরা কি কোরআনের কোন কোন অংশ (আয়াত) মানো আর কোন কোন অংশ মানো না? অত:পর যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্য থেকে এরুপ কাজ  করবে – পার্থিব জীবনে প্রকাশ্য লাঞ্চণা ভোগ করা আর কিয়ামতের দিনে ভীষণ শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া তার আর কী সাজা হতে পারে! আর আল্লাহ তো তোমাদের কার্য কলাপ সম্বন্ধেবে- খবর নন। (বাকারা-৮৫)।

(৫) ইসলামি আইন ব্যতীত অন্য আইন গ্রহন করলেঃ

“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করতে চাইবে, তার থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না। আখেরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)।

রাসুল সাঃ বলেন,

(৬)  আবদুল্লাহ্ ইব্নু মাস’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমি হাউজে কাউসারের নিকট তোমাদের আগেই হাজির থাকবো। তোমাদের থেকে কিছু লোককে আমার নিকট পেশ করা হবে। কিন্তু আমি যখন তাদের পান করাতে উদ্যত হবো, তখন তাদেরকে আমার নিকট হতে ছিনিয়ে নেয়া হবে। আমি বলবো, হে রব! এরা তো আমার সাথী। তখন তিনি বলবেন, আপনার পর তারা নতুন (নতুন নতুন ধর্মীয় নিয়ম, যা আপনি করতে বলেননি)  কী ঘটিয়েছে তা আপনি জানেন না। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫৭৩, সহিহ বুখারী-হাদিস নং-৭০৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৭)  সাহ্ল ইব্নু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – কে বলতে শুনেছি যে, আমি হাউজের ধারে তোমাদের আগে হাজির থাকব। যে সেখানে হাজির হবে, সে সেখান থেকে পান করার সুযোগ পাবে। আর যে একবার সে হাউজ থেকে পান করবে সে কখনই পিপাসিত হবে না। অবশ্যই এমন কিছু দল আমার কাছে হাজির হবে যাদের আমি (আমার উম্মাত বলে) চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। কিন্তু এরপরই তাদের ও আমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা দাড় করে দেয়া হবে।

(৮) আবূ হাযিম (রহঃ) বলেন,

আমি হাদীস বর্ণনা করছিলাম, এমন সময় নু’মান ইব্নু আবূ আয়াস আমার নিকট হতে এ হাদীসটি শুনে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সাহ্ল থেকে হাদীসটি এরূপ শুনেছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন সে বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আবূ সা’ঈদ খুদ্রী (রাঃ) - কে এ হাদীসে অতিরিক্ত বলতে শুনেছি যে, নবী (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বলবেনঃ এরা তো আমারই অনুসারী। তখন বলা হবে, আপনি নিশ্চয় জানেন না যে, আপনার পরে এরা দ্বীনের মধ্যে কি পরিবর্তন করেছে (নতুন নতুন ধর্মীয় নিয়ম, যা আপনি করতে বলেন নি) । এ শুনে আমি বলব, যারা আমার পরে পরিবর্তন করেছে, তারা (বিদআতী পির-অলি ও আলেম) দূর হোক, দূর হোক। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫৭৪, সহিহ বুখারী-হাদিস নং-৭০৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(৯) নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন: হযরত হারিসুল আশয়ারী (রঃ)হতে বর্ণিতঃ

নবি করিম সা: ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি (১) জামায়াত বদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) তার আদেশ মেনে চলব (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, যে ব্যক্তি ইসলামি সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘত দূরে সরে গেল, সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল, তবে সে যদি সংগঠনে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের নিয়ম নীতির দিকে (লোকদের) আহবান জানায় সে জাহান্নামী। যদিও সে রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)।

(১০) আবূ হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে। তারা বললেনঃ কে অস্বীকার করবে। তিনি বললেনঃ যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই অস্বীকার করবে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৭২৮০,আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৮৩)।

(১১) জারীর বিন আব্দুল্লাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে সম্প্রদায় যখন বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি থাকে, যার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি তারা তাদেরকে বাধা না দেয় (এবং ঐ পাপাচরণ বন্ধ না করে), তাহলে (তাদের জীবদ্দশাতেই) মহান আল্লাহ তাদেরকে ব্যাপকভাবে তাঁর কোন শাস্তি ভোগ করান।” (আহমাদ ৪/৩৬৪, আবূ দাউদ ৪৩৩৯, ইবনে মাজাহ ৪০০৯, ইবনে হিব্বান, সহীহ আবূ দাউদ ৩৬৪৬। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(১২)  আবূ হুরাইরাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি (কাউকে) সৎপথের দিকে আহবান করবে, সে তার প্রতি আমলকারীদের সমান নেকী পাবে। এটা তাদের নেকীসমূহ থেকে কিছুই কম করবে না। আর যে ব্যক্তি (কাউকে) ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে, তার উপর তার সমস্ত অনুসারীদের গোনাহ চাপবে। এটা তাদের গোনাহ থেকে কিছুই কম করবে না।” (মুসলিম ৬৯৮০ প্রমুখ)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(১৩)  আবূ যায়দ উসামাহইবনে যায়দ ইবনে হারেষাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সেখানে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যাবে এবং সে তার চারিপাশে এমনভাবে ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকির চারিপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামীরা তার কাছে একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, ‘ওহে অমুক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না (আমাদেরকে) সৎ কাজের আদেশ, আর অসৎ কাজে বাধা দান করতে?’ সে বলবে, ‘অবশ্যই। আমি (তোমাদেরকে) সৎকাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু আমি তা নিজে করতাম না এবং অসৎ কাজে বাধা দান করতাম; অথচ আমি নিজেই তা করতাম!” (বুখারী ৩২৬৭, মুসলিম ৭৬৭৪)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(১৪)  আনাস (রাঃ) থেকেবর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “আমি মি’রাজের রাতে এমন একদল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি যারা আগুনের কাঁচি দ্বারা নিজেদের ঠোঁট কাটছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে জিবরীল! ওরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘ওরা আপনার উম্মতের বক্তাদল (বিদআতী পির-অলি ও আলেম); যারা নিজেদের বিস্মৃত হয়ে মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দিত, অথচ ওরা কিতাব (গ্রন্থ) অধ্যয়ন করত, তবে কি ওরা বুঝত না।” (আহমাদ ১২২১১, ১২৮৫৬ প্রভৃতি, ইবনে হিব্বান ৫৩, ত্বাবারানীর আওসাত্ব ২৮৩২, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ১৭৭৩, আবূ য়্যা’লা ৩৯৯২, সহীহ তারগীব ১২৫)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(১৫)  আবূ হুরাইরাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ আছে, সেই সত্তার কসম! এই উম্মতের যে কেউ---ইয়াহুদী হোক বা খ্রিস্টান আমার কথা শুনবে, অতঃপর যা দিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি, তার প্রতি ঈমান আনবে না, সেই জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (মুসলিম ৪০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

(১৬)  আবূ উমামা (রাঃ)থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার উম্মতের দুই শ্রেণির লোক আমার সুপারিশ লাভ করতে পারবে না; (বিবেকহীন) অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা এবং প্রত্যেক সত্যত্যাগী অতিরঞ্জনকারী।” (ত্বাবারানী ৮০০৫, সহীহুল জামে’ ৩৭৯৮ নং)-হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

(১৭)  আবূ হুরাইরা(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ সে জিহাদ করেনি এবং অন্তরে জিহাদ সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনাও করেনি, সে মুনাফিক্বীর একটি শাখায় মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম ৫০৪০, আবূ দাঊদ ২৫০৪ নং)।

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

আল্লাহ বলেন,

 (১৮) যারা ইসলামি আইন বাদ দিয়ে অন্য আইন তথা মানব রচিত আইন মানবে তারা শিরকের মধ্যে গণ্যঃ

অন্য কাউকে যদি আইন প্রদানের মালিক মনে করা হয় তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই রব মানা হয়; যা প্রকাশ্য বড় শির্ক। আর এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন মানবে তাদের সম্পর্কে বলেছেন:

“তারা কি জাহেলিয়াতের আইন চায়? দৃঢ়বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুম-বিধান দাতা আর কে হতে পারে?” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫০]।

এখানে জাহেলিয়্যাতের আইন বলতে আল্লাহ কর্তৃক প্রণীত আইন ছাড়া যাবতীয় আইনকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রণীত আইনের বাইরে যত প্রকার মানব রচিত আইন রয়েছে, তার সবই জাহেলী আইন, যেমন ইংরেজদের রেখে যাওয়া আইন, রোমান আইন ইত্যাদি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ "আল্লাহই হলেন আইনদাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই আইন নিতে হবে"(আবু দাউদ হাদীস নং(৪৯৫৫), নাসায়ী, (৮/২২৬), বায়হাকী (১০/১৪৫) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত)।

(১৯)  ইসলামী আইন বাস্তবায়ন না করা কুফুরী, যা ঈমান নষ্ট করে দেয়ঃ

 আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা কাফির। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৪]

তিনি আরও বলেন,

“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা যালিম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৫]

আরও বলেন,

“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা ফাসেক।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৭]

মূলত আল্লাহর আইন অনুসারে না চলার কয়েকটি পর্যায় হতে পারে:

(ক) আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনে বিচার-ফয়সালা পরিচালনা জায়েয মনে করা।

(খ) আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইন দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা উত্তম মনে করা।

(গ) আল্লাহর আইন ও অন্য কোনো আইন শাসনকার্য ও বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের মনে করা।

(ঘ) আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য কোনো আইন প্রতিষ্ঠা করা।

উপরোক্ত যে কোনো একটি কেউ বিশ্বাস করলে সে সর্বসম্মতভাবে কাফির হয়ে যাবে। (এর জন্য দেখুন: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-শাইখ প্রণিত গ্রন্থ ‘তাহকীমুল কাওয়ানীন’।)

অতএব পির-অলি, বড় পির, রাসুল সাঃ এর আওলাদ, মুফতি, হাফেজ, মুহাদ্দিস, এ নেতা ও নেতা, বড় মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে পরকালে ১০০% কোনো মুক্তি নেই, যদি না আপনি ইসলামি আইন বিষয়ক কুরআন ও হাদিস না মানেন, না প্রচার করেন, না বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“হে নবি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব না  কোন কোন লোক নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত লোক যারা ইহকালের জীবনে ভ্রান্ত পথে চলে এবং মনে করে যে তারা ঠিক পথ ধরেই চলেছে। এরা তারাই, যারা তাদের প্রতিপালক প্রভুর আয়াতগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তার দরবারে প্রত্যাবর্তনের প্রতি অবিশ্বাস পোষন করে। এ জন্যে তাদের সকল আমল নষ্ট হয়ে গেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদের কোনই গুরত্ব থাকবে না। তারা যে কুফরী করেছিলো আর আমার আয়াত  ও রাসুলগণের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তার প্রতি দানে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।” (কাহাফঃ ১০৩-১০৫)।

অন্যান্য Related পর্ব দেখতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ  

  (১) পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ বনাম ইসলাম-(শয়তানের ওহী কার উপর নাযিল হয়?)।  

 (২) পির-অলিদের ভ্রান্ত আক্বিদাহসমূহ।

 লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক
 
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮।)
.................................................................................................................
এক সাথে সকল পর্ব দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন
=========================================

BCSসহ যেকোনো সরকারি-বেসরকারি চাকরি সহজে পেতে BBC  এর উপর ক্লিক করুন।

-----------------------------------------------------
Please Share On

No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...