বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পির-মুরিদ ও বিদআতিরা যেসব কারণে জাহান্নামি
(পর্ব-৫)
যেসব আমলের কারণে মুসলমান মুশরেকে পরিনত হয়
রব
ও ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সহিত আর কাউকে শরীক সাব্যস্ত করার নামই শিরক ৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে
উলুহিয়াত তথা ইলাহ হিসাবে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়৷ যেমন আল্লাহর সাথে অন্য কারো
নিকট দোয়া করা কিংবা বিভিন্ন প্রকার ইবাদাত যেমন, যবেহ, মান্নাত, ভয়, আশা, মহব্বত
ইত্যাদির কোন কিছু গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা৷ এটা সবচেয়ে বড় গুনাহ।
শিরক
দুই প্রকার। যথা- (১) বড় শিরক বা শিরকে আকবর ও (২) ছোট শিরক বা শিরকে আসগর।
শিরক সম্পর্কে কুরআনের আয়াতঃ
(ক) শিরক সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র
কুরআনে বলেন- ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করো না। নিশ্চিত জেনে রেখো শিরক হচ্ছে অতি বড় জুলুম।’
(লুকমান ১৩)।
(খ) ‘নিশ্চয় জেনো, আল্লাহর সঙ্গে শরীক
বানানোর যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ
করে দেবেন। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে, সে তো উদ্ভাবন করে নিয়েছে এক
গুরুতর মিথ্যা।’ (নিসা ৪৮)।
(গ) ‘আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ। সন্তানাদি
থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আসমান ও যমিনে যা কিছু আছে সবই তো তাঁর।’ (নিসা ১৭১)।
(ঘ) ‘যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকেও ডাকে।
তার সমর্থনে তার হাতে কোন দলিল প্রমাণ নেই। তার হিসাব-নিকাশ হবে আল্লাহর নিকট। এ ধরনের
কাফেররা কিছুতেই কল্যাণ ও সফলতা লাভ করতে পারে না।’ (মুমিনুন ১১৭)।
(ঙ) ‘লোকেরা তাঁর কতিপয় বান্দাকে তাঁর
অংশ মনে করে নিয়েছে। প্রকৃত কথা এই যে, মানুষ সুস্পষ্টরূপে অকৃতজ্ঞ।’ (যুখরুফ ১৫)।
(চ) ‘তিনি তো আসমান ও যমিনের উদ্ভাবক।
কি করে তাঁর সন্তান হতে পারে অথচ তার তো জীবন সঙ্গিনিই কেউ নেই? তিনি সব জিনিস সৃষ্টি
করেছেন।’ (আনআম ১০১)
(ছ) ‘তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব ও
ইবাদত করো। আর অন্য কোন কিছুকেই তাঁর সঙ্গে শরীক করো না।’ (নিসা ৩৬)।
(জ) ‘অতএব যে ব্যক্তি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাত
লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে সে যেন নিষ্ঠার সঙ্গে সৎকর্ম সম্পাদন করতে থাকে আর তার রবের
দাসত্ব, ইবাদ-বন্দেগিতে যেন অপর কাউকেও শরীক না করে।’ (কাহাফ ১১০)।
(ঝ) ‘’বল, হে আসমানি কেতাবের অনুসারীগণ,
আসো ঐ কালিমার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে গুরুত্ব রাখে; আর তাহোলঃ আমরা কেউ আল্লাহ্
ছাড়া আর করো উপাসনা করবোনা। এবং আল্লাহ্র সাথে কোন কিছু শরীক করবোনা। আর আল্লাহ্ ছাড়া
পরস্পর একে অপরকে রব মানবোনা। একথা না মেনে যদি তারা পিছটান দেয় তাহলে বল যে, তোমরা
সাক্ষী থাকো যে আমরা মুসলমান’’-
(আল
ইমরান/৬৪)।
(ঞ) ‘’ তাদের মধ্যে বেশীরভাগই ইমান থাকতেও
মুশরিক ছিল’’-(ইউসুফ/১০৬)।
(ট) আল্লাহ্ বলেনঃ ‘’এবং আল্লাহ্র সাথে
অংশীদার সাভ্যাস্ত করেছে যাতে তাঁর রাস্তা থেকে বিপথগামী হয়ে যায়, বল যে, তুমি তোমার
কুফরির মাধ্যমে একটু সুখবোধ করো, তুমি অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দা হবে’’-( জুমর/৭৫)।
(ঠ) ‘’এরা দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে; এদিকেও
নয় ওদিকেও নয়। বস্তুতঃ যাকে আল্লাহ গোমরাহ করে দেন, তুমি তাদের জন্য কোন পথই পাবে
না কোথাও’’-(আন নিসা/১৪৩)।
(ড) আল্লাহ্ বলেনঃ ‘’যখন তারা সালাতে দাঁড়ায়
অলসতা নিয়ে দাঁড়ায় ( অথচ) মানুষকে দেখায়। এবং তারা আল্লাহকে খুব কমি স্মরন করে’’-(
আন্নিসা/১৪২)।
লোক দেখানো সালাত আদায় করা
শিরকঃ
(ঢ) ‘’ঐ মুসল্লিদের জন্যে ধ্বংস যারা তাদের
সালাত ভুলে থাকে, যারা লোক দেখানো সালাত আদায় করে’-(আল মাঊন/৪-৬)।
শিরক সম্পর্কে হাদীস :
মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
(ক) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) আমাকে ১০টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, (১) আল্লাহর সাথে কাউকে
শরীক করবে না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা জ্বালিয়ে দেওয়া হয় (২) তুমি তোমার পিতা-মাতার
অবাধ্য হবে না। যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল-সম্পদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন
(৩) ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো ফরয ছালাত ত্যাগ করবে না। তার পক্ষে আল্লাহর যিম্মাদারী উঠে
যাবে (৪) কখনোই মাদক সেবন করবে না। কেননা এটিই হল সকল অশ্লীলতার মূল (৫) সর্বদা গোনাহ
থেকে দূরে থাকবে। কেননা গোনাহের মাধ্যমে আল্লাহর ক্রোধ আপতিত হয় (৬) সাবধান! জিহাদের
ময়দান হতে পলায়ন করবে না। যদিও সকল লোক ধ্বংস হয়ে যায়। (৭) যদি কোথাও মহামারী দেখা
দেয়, এমতাবস্থায় তুমি যদি সেখানে থাক, তাহলে তুমি সেখানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করবে (মৃত্যুর
ভয়ে পালাবে না)। (৮) তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী তোমার পরিবারের জন্য ব্যয় করবে (অযথা কৃপণতা
করে তাদের কষ্ট দিবে না)। (৯) তাদের উপর থেকে শাসনের লাঠি তুলে নিবে না এবং (১০) তাদেরকে
সর্বদা আল্লাহর ভয় দেখাবে’ (আহমাদ, মিশকাত হা/৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
এক
ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর
রাসূল! আল্লাহর নিকটে কোন গোনাহটি সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, আল্লাহর কোন সমকক্ষ সাব্যস্ত
করা। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লোকটি বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তোমার সন্তানকে
হত্যা করা এই ভয়ে যে, সে তোমার সাথে খাবে (অর্থাৎ দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করা)।
সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে তোমার ব্যভিচারে লিপ্ত
হওয়া’। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একথারই সত্যায়ন করে আল্লাহ পাক
(নেক্কার লোকদের প্রশংসায় আয়াত নাযিল করেন, ‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে
আহ্বান করে না এবং যারা অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে না যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন এবং
যারা ব্যভিচার করে না’ (ফুরক্বান ৬৮; বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯)। হাদিসের মানঃ
সহিহ হাদিস।
(গ) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর
ইবনুল ‘আছ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন যে, ‘কাবীরা গোনাহসমূহ হল- (১) আল্লাহর
সাথে শরীক করা (২) পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া (৩) মানুষ হত্যা করা এবং (৪) মিথ্যা শপথ
করা’ (বুখারী হা/৬৬৭৫)। কিন্তু আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় ‘মিথ্যা শপথ’-এর বদলে ‘মিথ্যা
সাক্ষ্য’ শব্দ এসেছে (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(ঘ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে
বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় হতে দূরে থাকবে।
ছাহাবীগণ বললেন, সেগুলি কী? আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,
(১) আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করা (২) জাদু করা (৩) অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করা,
যা আল্লাহ হারাম করেছেন (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল (অন্যায়ভাবে) ভক্ষণ করা (৬)
জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরলা নির্দোষ মুমিন মহিলাদের নামে ব্যভিচারের
অপবাদ দেওয়া’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(ঙ) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যতদিন
তুমি আমাকে ডাকবে এবং আমার নিকট ক্ষমার আশা রাখবে আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা
যাই হোক না কেন। আমি কারো পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্তও
পৌঁছে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি ক্ষমা করার
ব্যাপারে কারও পরওয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার
দরবারে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কোন শরীক না করে আমার সামনে আস, আমি পৃথিবী পরিমাণ
ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব’ (তিরমিযী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/২৩৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ
হাদিস
(চ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে
বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘অশুভ বা কুলক্ষণ ফল গ্রহণ করা শির্কী কাজ।
কথাটি তিনি তিনবার বললেন (আবূদাঊদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫৮৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৮ম
খণ্ড হা/৪৩৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
(ছ) আবূ হুরায়রাহ (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি অংশীদারদের অংশীদারিত্ব
হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন কাজ করে আর ঐ কাজে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে
আমি ঐ অংশীদারকেও অংশীদারীকে প্রত্যাখ্যান করি’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘আমি ঐ ব্যক্তির
কর্ম হতে মুক্ত’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩১৫ বঙ্গানুবাদ ৯ম খণ্ড হা/৫০৮৪)। হাদিসের মানঃ
সহিহ হাদিস
(জ) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের নিকট আসলেন। এমতাবস্থায় আমরা দাজ্জাল সম্পর্কে
পরস্পর আলোচনা করছিলাম। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আমি কি তোমাদের
এমন বিষয়ে সংবাদ দিব না? যে বিষয়টি আমার কাছে দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর? ছাহাবীগণ বললেন,
জ্বি হাঁ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তা হচ্ছে গোপন শির্ক ।
(আর এর উদাহরণ হচ্ছে) একজন মানুষ ছালাতে দাঁড়িয়ে এই খেয়ালে ছালাত আদায় করে যে, কোন
মানুষ তার ছালাত আদায় করা দেখছে’ (ইবনু মাজাহ, সনদ হাসান, মিশকাত হা/৫৩৩৩; বঙ্গানুবাদ
মিশকাত ৯ম খণ্ড হা/৫১০১)। আলবানী হাদীছটি ছহীহ বলেছেন।
মানুষের
প্রশংসা এবং সম্মান অর্জনের জন্য কোন আমল করা। অথবা কেবলমাত্র পার্থিব কোন স্বার্থের
জন্য কাজ করা, যা মানুষের খুলুছিয়াত এবং তাওহীদকে কলুষিত করে। লোক দেখানো, সুনাম অর্জন,
নেতৃত্ব দান, দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধার ইত্যাদি বিষয়গুলোর কোন একটি আল্লাহর ইবাদতের দ্বারা
আশা করা শিরক। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
উল্লেখিত কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা জানতে পারলাম যে, শিরক একটা মারাত্মক
কবিরাহ গুণাহ, যে গুণাহ আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্য যেকোনো পাপ তিনি
ক্ষমা করে দিতে পারেন। কি কি কাজ বা আমল করলে
একজন মুসলমান শিরক করার কারণে মুশরেকে পরিনত হয় তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, শিরকমূলক আকিদাহগুলো যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন আলেম তাদের ওয়াজ ও লেখনির মাধ্যমে
মুসলমানকে জানিয়ে দিয়ে আসছে বা সতর্ক করে আসছে। এরপরও এক শ্রেণির মুসলমান জেনে শুনে
শিরকমূলক আমল নিজেরাও করছে আবার তাদের অনুসারীদেরকেও করাচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের বিভিন্ন
পিরের দরবার, তাবলীগ জামাতসহ লক্ষ লক্ষ বিদআতি মুসলমান। আমি এখানে পূনরায় শিরকমূলক
কাজগুলো কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক আলোচনা করছি যাতে সকলে বুঝতে পারে এবং শিরক থেকে
বিরত থাকে। এরপরও যারা মানবে না তাদের স্থান নিশ্চিত জাহান্নামে।
কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে বিভিন্ন প্রকার শিরকের বিস্তারিত আলোচনাঃ
(পির মুরিদ ও বিদআতিরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে ওতোপ্রতোভাবে এইসব শিরকের
সাথে জড়িত)
বড় শিরক বা শিরকে আকবরঃ
(১) আহবানের শিরক: আহ্বানের শিরক বলতে মানুষের ক্ষমতার
বাইরে এমন কোনো পার্থিব লাভের আশায় অথবা কোনো পার্থিব ক্ষতি হতে রক্ষা পাবার উদ্দেশে
আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আহ্বান করা বুঝায়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
মসজিদসমূহ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে ডাকার পাশাপাশি
অন্য কাউকে ডেকো না’’। (জিন : ১৮)
যারা
আল্লাহ্ তা’আলাকে গর্ব করে ডাকছে না তাদেরকে তিনি জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমাদের
প্রভু বলেন: তোমরা আমাকে সরাসরি ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। নিশ্চয়ই যারা অহঙ্কার
করে আমার ইবাদাত (দো’আ বা আহবান) হতে বিমুখ হবে তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে
প্রবেশ করবে’’। (মু’মিন/গাফির : ৬০)
আল্লাহ্
তা’আলা ভিন্ন অন্য কাউকে ডাকা হলেও তারা কখনো কারোর ডাকে সাড়া দিবে না। বরং তাদেরকে
ডাকা সর্বদা ব্যর্থ ও নিষ্ফল হতে বাধ্য।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘সত্যিকারের
একক ডাক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য। যারা তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে আহবান করে তাদের
আহবানে ওরা কখনো কোন সাড়া দিবে না। তারা ওব্যক্তির ন্যায় যে মুখে পানি পৌঁছুবে বলে
হস্তদ্বয় সম্প্রসারিত করেছে। অথচ সে পানি কখনো তার মুখে পৌঁছুবার নয়। বস্ত্তত কাফিরদের
ডাক ব্যর্থ ও নিষ্ফল হতে বাধ্য’’। (রা’দ : ১৪)
যারা
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কাউকে ডাকে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা ভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত
বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘সে
ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে? যে আল্লাহ্ তা’আলার পরিবর্তে এমন ব্যক্তি
বা বস্ত্তকে ডাকে যা কস্মিনকালেও (কিয়ামত পর্যন্ত) তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা
ওদের প্রার্থনা সম্পর্কে কখনো অবহিত নয়’’। (আহ্কাফ : ৫)
ইব্রাহীম
(আ.) মুশরিকদেরকে এবং তারা যাদেরকে ডাকতো তাদেরকেও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকে ডাকেন। যাঁকে ডাকলে কখনো সে ডাক ব্যর্থ হয় না।
তিনি বলেন:
‘‘আমি
তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া যাদেরকে ডাকছো সকলকে প্রত্যাখ্যান করছি। আমি
শুধু আমার প্রভুকে ডাকছি। আশা করি, আমার প্রভুকে ডেকে আমি কখনো ব্যর্থ হবো না’’। (মারইয়াম:
৪৮)।
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই সকল লাভ-ক্ষতির মালিক। অন্য কেউ নয়। তিনি ইচ্ছে না করলে কেউ কারোর
লাভ বা ক্ষতি করতে পারে না। আর সকল কল্যাণাকল্যাণও কিন্তু মানব সাধ্যের আওতাধীন নয়।
বরং তার অনেকটুকুই মানব সাধ্যাতীত। সুতরাং সকল ব্যাপারে তাঁকেই ডাকতে হবে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আর
তুমি আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া এমন কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ডাকো না যা তোমার কোন উপকার
বা ক্ষতি করতে পারবে না। এমন করলে সত্যিই তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি আল্ল¬াহ্
তা’আলা তোমাকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন করেন তাহলে তিনিই একমাত্র তোমাকে তা থেকে উদ্ধার
করতে পারেন। আর যদি তিনি তোমার কোন কল্যাণ করতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের গতিরোধ করার
সাধ্য কারোরই নেই। তিনি নিজ বান্দাহ্দের মধ্য থেকে যাকে চান অনুগ্রহ করেন। তিনি অত্যন্ত
ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়ালু’’। (ইউনুস : ১০৬-১০৭)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘হে
নবী তুমি বলে দাও: তোমরা যাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার পরিবর্তে পূজ্য মনে করো তাদেরকে ডাকো।
তারা আকাশ ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়। এতদুভয়ে তাদের কোন অংশীদারিত্বও নেই
এবং তাদের কেউ তাঁর সহায়কও নয়। তাঁর নিকট একমাত্র অনুমতিপ্রাপ্তদেরই কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ
হতে পারে’’। (সাবা : ২২-২৩)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘তামরা
আল্লাহ্ তা’আলার পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা (খেজুরের আঁটির আবরণ পরিমাণ) সামান্য কিছুরও
মালিক নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা কিছুতেই শুনতে পাবে না। আর শুনতে পাচ্ছে বলে মেনে
নিলেও তারা তো তোমাদের ডাকে কখনো সাড়া দিবে না। কিয়ামতের দিবসে তারা তোমাদের শির্ককে
অস্বীকার করবে। আমার মতো সর্বজ্ঞের ন্যায় কেউই তোমাকে সঠিক সংবাদ দিতে পারবে না’’।
(ফাতির : ১৩-১৪)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আববাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
একদা
রাসূল (সা.) আমাকে কিছু মূল্যবান বাণী শুনিয়েছেন যার কিয়দাংশ নিম্নরূপ:
‘‘কিছু
চাইলে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই চাইবে। কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই কামনা করবে। জেনে রেখো, পুরো বিশ্ববাসী একত্রিত হয়েও যদি তোমার
কোন কল্যাণ করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই কল্যাণ করতে পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
আর তারা সকল একত্রিত হয়েও যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই ক্ষতি করতে
পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬)
এ
হচ্ছে মানব সাধ্যাধীন কল্যাণাকল্যাণ সম্পর্কে। তাহলে যা মানব সাধ্যাতীত তা একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়া কখনো ঘটবে কি? কখনোই নয়।
আল্লাহ্
তা’আলাকে ডাকা বা তাঁর নিকট দো’আ করা যে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত তা আমাদের প্রিয় নবী হযরত
মুহাম্মাদ (সা.) অসংখ্য হাদীসে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ্
তা’আলা প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে এসে সকল মানুষকে দো’আর জন্য আহবান
করে থাকেন।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে বলতে থাকেন, কে আছে যে
আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। কে আছে যে আমার কাছে কিছু চাবে আমি তাকে তা দান
করবো। কে আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো’’। (বুখারী, হাদীস ১১৪৫
মুসলিম, হাদীস ৭৫৮ আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৫ তির্মিযী, হাদীস ৩৪৯৮ মালিক, হাদীস ৩০)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলার নিকট দো’আর চাইতেও সম্মানিত কোন বস্ত্ত নেই’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭০ ইবনু মাজাহ্,
হাদীস ৩৮৯৭ ইবনু হিব্বান/ইহসান, হাদীস ৮৬৭)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলাকে ডাকে না তার উপর তিনি রাগান্বিত হন’’। (আদাবুল্ মুফ্রাদ,
হাদীস ৬৫৮ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৮৯৫)
নু’মান বিন্ বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল
(সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘দো’আই
হচ্ছে ইবাদাত’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭২ আবু দাউদ, হাদীস ১৪৭৯ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৮৯৬
ইবনু হিব্বান/ইহ্সান, হাদীস ৮৮৭)
সুতরাং
এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম
শির্ক বৈ কি।
এমন
তো নয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা কোন মাধ্যম ছাড়া কারোর ডাকে সাড়া দেন না। বরং তিনি যখনই কোন
বান্দাহ্ তাঁকে একান্তভাবে ডাকে, সাথে সাথেই তিনি তার ডাকে সাড়া দেন।
তিনি
বলেন:
‘‘যখন
আমার বান্দাহরা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তখন আপনি তাদেরকে বলুনঃ নিশ্চয়ই
আমি (আল্লাহ্ তা’আলা) অতি সন্নিকটে। কোন আহবানকারী যখনই আমাকে আহবান করে তখনই আমি তার
আহবানে সাড়া দেই। অতএব তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার উপর ঈমান আনে। তাহলেই
তারা সঠিক পথের সন্ধান পাবে’’। (বাক্বারাহ্ : ১৮৬)
কবরবাসী
কোন ওলী বা বুযুর্গ কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে এমন বিশ্বাস করে তাদেরকে ডাকাও
কিন্তু এ জাতীয় শির্কের অন্তর্ভুক্ত। এমন ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের গন্ডী থেকে বের
হয়ে যাবে। যদিও সে আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত ইবাদাতগুযার বান্দাহ্ হোক না কেন। কারণ,
মক্কার কাফিররাও তো আল্লাহ্ তা’আলাকে স্বীকার করতো এবং তাঁর ইবাদাত করতো। কিন্তু শির্কের
কারণেই তাদের এ ইবাদাত কোন কাজে আসেনি। তাই তারা অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে।
আল্লাহ্ তা’আলা মক্কার কাফিরদের সম্পর্কে বলেন:
‘‘আপনি
যদি কাফিরদেরকে জিজ্ঞাসা করেন: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই
বলবেঃ আল্লাহ্ তা’আলাই সৃষ্টি করেছেন। আপনি বলুন: তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছো যে, আল্লাহ্
তা’আলা আমার কোন অনিষ্ট করতে চাইলে তোমাদের উপাস্যরা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে?
বা আল্লাহ্ তা’আলা আমার প্রতি কোন অনুগ্রহ করতে চাইলে ওরা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে?
আপনি বলুন: আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। ভরসাকারীদেরকে তাঁর উপরই ভরসা করতে হবে’’।
(যুমার : ৩৮)
মক্কার
কাফিররা আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতকে মৌলিক মনে করতো। তবে তারা মূর্তিপূজা করতো একমাত্র
তাঁরই নৈকট্য লাভের জন্য।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘জেনে
রেখো, অবিমিশ্র আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য। আর যারা আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত
অন্য কাউকে অভিভাবক বা সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা বলে: আমরা তো এদের পূজা
এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। তারা যে বিষয়
নিয়ে এখন নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন সে বিষয়ের
সঠিক ফায়সালা দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা কাফির ও মিথ্যাবাদীকে সঠিক পথে পরিচালিত
করেন না’’। (যুমার : ৩)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তারা
আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত এমন ব্যক্তি বা বস্ত্তসমূহের ইবাদাত করে যা তাদের কোন লাভ বা
ক্ষতি করতে পারে না। তারা বলে: এরা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে।
আপনি বলে দিন: তোমরা কি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলে তাঁর অজানা কোন কিছু
জানিয়ে দিচ্ছো? তিনি পবিত্র এবং তিনি তাদের শির্ক হতে অনেক ঊর্ধ্বে’’। (ইউনুস : ১৮)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তারা
কি আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকে সুপারিশকারী বানিয়ে নিয়েছে? আপনি বলে দিন:
তোমরা কি কাউকে সুপারিশকারী বানিয়ে নিয়েছো? অথচ তারা এ ব্যাপারে কোন ক্ষমতাই রাখে না
এবং কিছুই বুঝে না। আপনি বলে দিন: যাবতীয় সুপারিশ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য তথা
তাঁরই ইখতিয়ারে। অন্য কারোর ইখতিয়ারে নয়। আকাশ ও ভূমন্ডলের সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই।
পরিশেষে তাঁর নিকটই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’’। (যুমার : ৪৩-৪৪)
কবর
পূজারীদের অনেকেই মনে মনে এমন ধারণা পোষণ করে থাকবেন যে, মক্কার কাফির ও মুশ্রিকরা
নিজ মূর্তিদের ব্যাপারে এমন মনে করতো যে, তাদের মূর্তিরা স্পেশালভাবে এমন কিছু ক্ষমতার
মালিক যা আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে কখনোই দেননি। বরং তাদের এ সকল ক্ষমতা একান্তভাবেই
তাদের নিজস্ব। আর আমরা আমাদের পীর-বুযুর্গদের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করছি তা এর সম্পূর্ণ
বিপরীত। আমরা মনে করছি যে, আমাদের পীর-বুযুর্গদের সকল ক্ষমতা একান্ত আল্লাহ্ প্রদত্ত।
আল্লাহ্ তা’আলা নিজ দয়ায় তাঁর ওলীদেরকে এ সকল ক্ষমতা দিয়েছেন। তা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব
নয়।
মূলতঃ
তাদের এ ধারণা একেবারেই বাস্তববর্জিত। কারণ, মক্কার কাফির- মুশ্রিকদের ধারণাও হুবহু
এমন ছিলো। বিন্দুমাত্রও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তারাও তাদের মূর্তিদের ক্ষমতাগুলোকে
একান্তভাবেই আল্লাহ্ প্রদত্ত বলে মনে করতো। একেবারেই তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বলে কখনোই
মনে করতো না।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আব্বাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘মুশরিকরা
বলতো: (হে প্রভু!) আপনার ডাকে আমি সর্বদা উপস্থিত এবং আপনার আনুগত্যে আমি একান্তভাবেই
বাধ্য। আপনার কোন শরীক নেই। তখন রাসূল (সা.) বলতেন: হায়! তোমাদের কপাল পোড়া। এতটুকুই
যথেষ্ট। এতটুকুই যথেষ্ট। আর একটুও বাড়িয়ে বলো না। তারপরও তারা বলতো: তবে হে আল্লাহ্!
আপনার এমন শরীক রয়েছে যার মালিক আপনি এবং সে যা কিছুর মালিক সেগুলোও আপনার। তার নিজস্ব
কিছুই নেই। তারা এ বাক্যগুলো বলতো এবং ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করতো’’। (মুসলিম, হাদীস ১১৮৫)
(২) ফরিয়াদের শিরক: ফরিয়াদের শির্ক বলতে নিতান্ত অসহায়
অবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্য কাউকে সাহায্যের জন্য আহবান করাকে বুঝানো হয়। যে
ধরনের সাহায্য সাধারণত একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ করতে সক্ষম নয়। যেমন:
রোগ নিরাময় বা নৌকোডুবি থেকে উদ্ধার ইত্যাদি।
এ
জাতীয় ফরিয়াদ গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয়
করা জঘন্যতম শির্ক।
যে
কোন সঙ্কট মুহূর্তে সাহায্যের জন্য ফরিয়াদ করা হলে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই সে ফরিয়াদ
শুনে থাকেন এবং তদনুযায়ী বান্দাহ্কে তিনি সাহায্য করেন। অন্য কেউ নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘স্মরণ
করো সেই সংকট মুহূর্তের কথা যখন তোমরা নিজ প্রভুর নিকট কাতর স্বরে প্রার্থনা করেছিলে
তখন তিনি তোমাদের সেই প্রার্থনা কবুল করেছিলেন’’। (আনফাল্ : ৯)
মক্কার
কাফিররা সংকট মুহূর্তে নিজ মূর্তিদের কথা ভুলে গিয়ে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই
ফরিয়াদ করতো। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে সেই সংকট থেকে উদ্ধার করতেন। এরপর তারা আবারো
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভুলে গিয়ে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে,
বর্তমান যুগের কবর বা পীর পূজারীরা আরো অধঃপতনে পৌঁছেছে। তারা সংকট মুহূর্তেও আল্লাহ্
তা’আলাকে ভুলে গিয়ে নিজ পীরদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকে।
আল্লাহ্ তা’আলা মক্কার কাফিরদের সম্পর্কে বলেন:
‘‘তারা
যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকে ডাকে। অন্য কাউকে
নয়। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে পানি থেকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছে দেন তখন তারা আবারো তাঁর
সাথে শির্কে লিপ্ত হয়’’। (আনকাবূত: ৬৫)
তিনি আরো বলেন:
‘‘আপনি
ওদেরকে বলুন: তোমরাই বলো! আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন শাস্তি অথবা কিয়ামত এসে গেলে
তোমরা কি তখন আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবে? তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে অবশ্যই
সঠিক উত্তর দিবে। সত্যিই তোমরা তখন অন্য কাউকে ডাকবেনা। বরং তখন তোমরা ডাকবে একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাকে। তখন তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। আর তখন তোমরা
অন্যকে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে শরীক করা ভুলে যাবে’’। (আন্’আম : ৪০-৪১)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘সমুদ্রে
থাকাকালীন যখন তোমরা কোন বিপদে পড়ো তখন আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য সকল শরীক তোমাদের
মন থেকে উধাও হয়ে যায়। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছে
দেন তখন তোমরা আবারো তাঁর প্রতি বিমুখ হয়ে যাও। সত্যিই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ’’। (ইস্রা/বানী
ইস্রাঈল : ৬৭)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমরা
যে সকল নিয়ামত ভোগ করছো তা সবই আল্লাহ্ তা’আলার নিকট হতে। অতঃপর যখন তোমরা দুঃখ দীনতার
সম্মুখীন হও তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুলভাবে ডাকো। অতঃপর যখন তিনি তোমাদের দুঃখ দুর্দশা
দূর করে দেন তখন আবারো তোমাদের একদল নিজ প্রতিপালকের সঙ্গে শির্কে লিপ্ত হয়ে যায়’’।
(নাহ্ল : ৫৩-৫৪)
আল্লাহ্
তা’আলা এ জাতীয় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে জাহান্নামী বলেছেন। তিনি বলেন:
‘‘মানুষকে
যখন দুঃখ দুর্দশা পেয়ে বসে তখন সে একনিষ্ঠভাবে তার প্রভুকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি ওর
প্রতি কোন অনুগ্রহ করেন তখন সে ইতিপূর্বে আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করার কথা ভুলে গিয়ে
তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে অন্যদেরকে তাঁর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। (হে রাসূল!)
তুমি বলে দাও: আরো কিছু দিন কুফরীর মজা ভোগ করো। নিশ্চয়ই তুমি জাহান্নামীদের অন্যতম’’।
(যুমার : ৮)।
পীর
বা কবর পূজারীরা যতই নিজ ওলী বা বুযুর্গদের নিকট ফরিয়াদ করুকনা কেন, যতই তাদের পূজা
অর্চনা করুকনা কেন তারা এতটুকুও নিজ ভক্তদের দুর্দশা ঘুচাতে পারবে না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
বলে দিন: তোমরা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া যাদেরকে পূজ্য বানিয়েছো তাদেরকে ডাকো। দেখবে, তারা
তোমাদের কোন দুঃখ দুর্দশা দূর করতে পারবে না। এমনকি সামান্যটুকু পরিবর্তনও নয়’’। (ইস্রা/বানী
ইস্রাঈল : ৫৬)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘মূর্তীদের
উপাসনা করাই উত্তম না সেই সত্তার উপাসনা যিনি আর্তের ডাকে সাড়া দেন, বিপদ-আপদ দূরীভূত
করেন এবং যিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি বানিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলার সমকক্ষ অন্য
কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো’’। (নাম্ল : ৬২)
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই সকল সমস্যা সমাধান করতে পারেন। তা যাই হোকনা কেন এবং যে পর্যায়েরই
হোকনা কেন।
আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘(আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর বান্দাহ্দেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন) হে আমার বান্দাহরা! তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট।
শুধু সেই ব্যক্তিই হিদায়াতপ্রাপ্ত যাকে আমি হিদায়াত দেবো। অতএব তোমরা আমার নিকটই হিদায়াত
চাও। আমি তোমাদেরকে হিদায়াত দেবো। হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই ক্ষুধার্ত। শুধু
সেই ব্যক্তিই আহারকারী যাকে আমি আহার দেবো। অতএব তোমরা আমার নিকটই আহার চাও। আমি তোমাদেরকে
আহার দেবো। হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই বিবস্ত্র। শুধু সেই ব্যক্তিই আবৃত যাকে
আমি আবরণ দেবো। অতএব তোমরা আমার নিকটই আবরণ চাও। আমি তোমাদেরকে আবরণ দেবো। হে আমার
বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই রাতদিন গুনাহ্ করছো। আর আমি সকল গুনাহ্ ক্ষমাকারী। অতএব তোমরা
আমার নিকটই ক্ষমা চাও। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো’’। (মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭)
(৩) আশ্রয়ের শিরক: আশ্রয়ের শির্ক বলতে যে কোন অনিষ্টকর
বস্ত্ত বা ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর
শরণাপন্ন হওয়াকেই বুঝানো হয়।
আল্লাহ্
তা’আলার নিকট এ জাতীয় কোন আশ্রয় কামনা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা তিনি ছাড়া অন্য
কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক। তবে যে আশ্রয় মানব সাধ্যাধীন তা সক্ষম যে কারোর
নিকট চাওয়া যেতে পারে। তবুও এ ব্যাপারে কারোর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া ছোট শির্কের
অন্তর্ভুক্ত।
শয়তানের
অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নিকটই আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন:
‘‘যদি
শয়তান তোমাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে প্ররোচিত করতে চায় তাহলে তুমি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই
আশ্রয় চাবে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ’’। (ফুস্সিলাত/হা-মীম আসসাজদাহ্ : ৩৬)
তিনি আরো বলেন:
‘‘আর
আপনি বলুন: হে আমার প্রভু! আমি শয়তানের প্ররোচনা হতে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি
এবং আপনার নিকটই আশ্রয় প্রার্থনা করি তাদের উপস্থিতি হতে’’। (মু’মিনূন : ৯৭-৯৮)
মানব
শত্রুর অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও একমাত্র তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনার জন্য আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর নবীকে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন:
‘‘অতএব
আপনি (ওদের শত্রুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই শরণাপন্ন হোন।
তিনিই তো সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’’। (গাফির/মু’মিন : ৫৬)।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীকে আরো ব্যাপকভাবে তাঁর আশ্রয় চাওয়া শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন:
‘‘আপনি
বলুন: আমি আশ্রয় চাচ্ছি প্রভাতের প্রভুর তাঁর সকল সৃষ্টি, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত, গ্রন্থিতে
ফুৎকারকারিনী নারী এবং হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট থেকে’’। (ফালাক্ব : ১-৫)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘আপনি
বলুন: আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানবের প্রভু, মালিক ও উপাস্যের আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার
অনিষ্ট থেকে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানব অন্তরে। চাই সে জিন হোক অথবা মানুষ’’। (নাস :
১-৬)।
আল্লাহ্
তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর আশ্রয় চাইলে তাতে তারা তাদের অনিষ্ট কখনো বন্ধ করেনা বরং
তারা আরো হঠকারী, অনিষ্টকারী ও গুনাহ্গার হয় এবং আশ্রয় অনুসন্ধানীরা আরো বিপথগামী ও
পথভ্রান্ত হয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আর
কিছু সংখ্যক মানুষ কতক জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করতো। তাতে করে তারা জিনদের আত্মম্ভরিতা
আরো বাড়িয়ে দেয়’’। (জিন : ৬)।
জিনদের
আশ্রয় কামনাকারী মুশ্রিক বা জাহান্নামী হলেও তারা আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছায় মানুষের কিছুনা
কিছু উপকার করতে অবশ্যই সক্ষম। সুতরাং তাদের থেকে উপকার পাওয়া যাচ্ছে বলে তাদের আশ্রয়
কামনা করা কখনোই জায়েয হবেনা। শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তি কর্তৃক উপকৃত
হওয়া তা জায়েয বা হালাল হওয়া প্রমাণ করেনা। এমনও অনেক বস্ত্ত বা কর্ম রয়েছে যা হারাম
বা না জায়েয হওয়া সত্ত্বেও তা কর্তৃক মানুষ কিছু না কিছু উপকৃত হয়ে থাকে। যেমন: ব্যভিচার,
সুদ, ঘুষ ইত্যাদি।
উল্লেখ্য
যে, কোর’আন ও হাদীসে অজ্ঞ বা অপরিপক্ব পীর ফকিররা যে কোন সমস্যার সমাধানে সাধারণত জিনদের
আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
মানুষরা
যে জিন জাতি কর্তৃক কখনো কখনো উপকৃত হতে পারে তা আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে
সুন্দরভাবে বর্ণনা করেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘হে মোহাম্মাদ! স্মরণ করুন সে দিনকে যে দিন আল্লাহ্
তা’আলা কাফির ও জিন শয়তানদেরকে একত্রিত করে বলবেন: হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা বহু মানুষকে
গুমরাহ্ করেছো। তখন তাদের কাফির অনুসারীরা বলবে: হে আমাদের প্রভু! আমরা একে অপরের মাধ্যমে
প্রচুর লাভবান হয়েছি। এভাবেই আমরা আমাদের নির্ধারিত জীবন অতিবাহিত করেছি। আল্লাহ্ তা’আলা
বলবেন: জাহান্নামই হচ্ছে তোমাদের বাসস্থান। সেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে। তবে আল্লাহ্
তা’আলা যাকে মুক্তি দিতে চাইবেন সেই একমাত্র মুক্তি পাবে। অন্যরা নয়। নিশ্চয়ই তোমাদের
প্রভু সুকৌশলী এবং অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়’’। (আন্’আম : ১২৮)।
আমাদের
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বিশেষ প্রয়োজনে সকলকে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার আশ্রয় চাওয়া
শিখিয়েছেন। অন্য কারোর নয়।
খাওলা
বিন্তে হাকীম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন জায়গায় অবস্থান করে বলবেঃ আল্লাহ্ তা’আলার পরিপূর্ণ বাণীর আশ্রয় চাচ্ছি
তাঁর সকল সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে। তাহলে উক্ত স্থান ত্যাগ করা পর্যন্ত কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তি
তার এতটুকুও ক্ষতি করতে পারবে না’’। (মুসলিম, হাদীস ২৭০৮ তিরমিযী, হাদীস ৩৪৩৭)।
(৫) সালাতের শিরক: রুকু, সিজ্দাহ্, সাওয়াবের আশায় কোন
ব্যক্তি বা বস্ত্তর সামনে বিনম্রভাবে দাঁড়ানো বা নামাযের শির্ক বলতে একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য এ সকল গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতগুলো ব্যয় করাকে বুঝানো হয়।
এ
ইবাদাতগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই করতে হয়। অন্য কারোর জন্য নয়। আল্লাহ্ তা’আলা
বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমারা রুকূ, সিজ্দাহ্, তোমাদের প্রভুর ইবাদাত এবং সৎকর্ম সম্পাদন করো।
যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’। (হাজ্জ: ৭৭)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তোমরা
সিজদাহ্ করোনা সূর্য বা চন্দ্রকে। বরং সিজদাহ্ করো সে আল্লাহ্ তা’আলাকে যিনি সৃষ্টি
করেছেন ওগুলোকে। যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করতে চাও’’। (ফুসসিলাত/হা-মীম আস্
সাজদাহ্ : ৩৭)।
কাইস্
বিন্ সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি ইয়েমেনের ‘‘হীরা’’ নামক এলাকায় গিয়ে দেখতে
পেলাম, সে এলাকার লোকেরা নিজ প্রশাসককে সিজ্দা করে। তখন আমি মনে মনে ভাবলাম, এ জাতীয়
সিজ্দাহ্’র উপযুক্ত একমাত্র রাসূলই (সা.) হতে পারে। অন্য কেউ নয়। তাই আমি মদীনায় এসে
রাসূল (সা.) কে ঘটনাটি এবং আমার মনের ভাবটুকু জানালে তিনি বললেন:
‘‘বলো!
তুমি আমার ইন্তিকালের পর আমার কবরের পাশ দিয়ে গেলে আমার কবরটিকে সিজ্দাহ্ করবে কি?
আমি বললাম: না, তিনি বললেন: তাহলে এখনও করোনা। আমি যদি কাউকে কারোর জন্য সিজ্দাহ্ করতে
আদেশ করতাম তাহলে মহিলাদেরকে নিজ স্বামীদের জন্য সিজ্দাহ্ করতে আদেশ করতাম। কারণ, আল্লাহ্
তা’আলা পুরুষদেরকে নিজ স্ত্রীদের উপর প্রচুর অধিকার দিয়েছেন’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২১৪০)।
আল্লাহ্ তা’আলা নামায ও সুদীর্ঘ বিনম্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পর্কে বলেন:
‘‘তোমরা
নামাযসমূহ বিশেষভাবে মধ্যবর্তী নামায (’আসর) সময় মতো আদায় করো এবং বিনীতভাবে একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যেই দাঁড়াও। অন্য কারোর উদ্দেশ্যে নয়’’। (বাক্বারাহ্ : ২৩৮)।
মু’আবিয়াহ্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
‘‘যে
ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট যে, মানুষ তার জন্য মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকুক তাহলে
সে যেন নিজ বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৭৫৫)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আপনি
বলে দিন: আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণকালের সকল নেক আমল সারা জাহানের
প্রভু একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এরই জন্যে আদিষ্ট হয়েছি
এবং আমিই আমার উম্মতের সর্বপ্রথম মুসলমান’’। (আন্’আম : ১৬২-১৬৩)।
তিনি
আরো বলেন:
‘‘অতএব
তোমার প্রভুর জন্য নামায পড়ো এবং কুরবানী করো’’। (কাউসার : ২)।
(৬) তাওয়াফের শিরক: তাওয়াফের শির্ক বলতে একমাত্র কা’বা
শরীফ ব্যতীত অন্য কোন বস্ত্তর তাওয়াফ করাকে বুঝানো হয়।
সাওয়াবের
আশায় কোন বস্ত্তর চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলার
মর্জি ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক। অতএব তা শরীয়ত সমর্থিত হতে হবে।
ইচ্ছে করলেই কোন মাজার তাওয়াফ করা যাবেনা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
যেন প্রাচীন গৃহ (কা’বা শরীফ) তাওয়াফ করে’’। (হাজ্জ : ২৯)।
তিনি
আরো বলেন:
‘‘আমি
ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিমাস্ সালাম) থেকে এ বলে অঙ্গীকার নিয়েছি যে, তোমরা আমার ঘরকে
তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী এবং রুকু ও সিজ্দাহ্কারীদের জন্যে সর্বদা পবিত্র রাখো’’।
(বাক্বারাহ্ : ১২৫)।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কিয়ামত
সংঘটিত হবেনা যতক্ষণ না দাউস্ গোত্রের মহিলারা পাছা নাচিয়ে যুল্খালাসা নামক মূর্তির
তাওয়াফ করবে’’।
(বুখারী,
হাদীস ৭১১৬ মুসলিম, হাদীস ২৯০৬ বাগাওয়ী, হাদীস ৪২৮৫ ইবনু হিব্বান, হাদীস ৬৭১৪ আব্দুর
রাযযাক, হাদীস ২০৭৯৫)।
(৭) তাওবার শিরক: তাওবার শির্ক বলতে আল্লাহ্ তা’আলা
ব্যতীত অন্য কারোর নিকট তাওবা করাকে বুঝানো হয়।
কোন
অপকর্ম বা গুনাহ্ থেকে খাঁটি তাওবা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলা
ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই তাওবা করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’।
(নূর : ৩১)।
সকল
গুনাহ্ ক্ষমা করার মালিক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। অন্য কেউ নয়। সুতরাং একমাত্র তাঁর
কাছেই কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। অন্য কারোর নিকট নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘কমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই গুনাহ্ মাফ করতে পারেন’’। (আ’লে-ইমরান : ১৩৫)।
(৮) জবাইয়ের শিরক: জবাইয়ের শির্ক বলতে একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর নৈকট্য লাভের জন্য যে কোন পশু জবাই করাকে বুঝানো হয়। চাই
তা আল্লাহ্ তা’আলা’র নামেই জবাই করা হোক বা অন্য কারোর নামে। চাই তা নবী, ওলী, বুযুর্গ
বা জিনের নামেই হোক বা অন্য কারোর নামে।
সাওয়াবের
আশায় কোন পশু জবাই করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর
জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
বলে দিন: আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণকালের সকল নেক আমল সারা জাহানের
প্রভু একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এরই জন্যে আদিষ্ট হয়েছি
এবং আমিই আমার উম্মতের সর্বপ্রথম মুসলমান’’। (আন্’আম : ১৬২-১৬৩)।
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘সুতরাং
আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন ও কুরবানি করুন’’। (কাউসার : ২)
’আলী
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা লা’নত (নিজ রহমত হতে বঞ্চিত) করেন সে ব্যক্তিকে যে তিনি ব্যতীত অন্য কারোর জন্য
পশু জবেহ্ করে’’। (মুসলিম, হাদীস ১৯৭৮)।
সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি জান্নাতে গিয়েছে একটি মাছির জন্যে। আর অন্য জন জাহান্নামে। শ্রোতারা বললো:
তা কিভাবে? তিনি বললেন: একদা দু’ ব্যক্তি কোন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের
ছিলো একটি মূর্তি। যাকে কিছু না দিয়ে তথা দিয়ে অতিক্রম করা ছিলো যে কোন ব্যক্তির জন্য
দুষ্কর। অতএব তারা এদের একজনকে বললো: মূর্তির জন্য কিছু পেশ করো। সে বললো: আমার কাছে
দেয়ার মতো কিছুই নেই। তারা বললো: একটি মাছি হলেও পেশ করো। অতএব সে একটি মাছি পেশ করলে
তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তাতে করে শির্ক করার দরুন সে জাহান্নামী হয়ে গেলো। তেমনিভাবে তারা
অন্য জনকে বললো: মূর্তির জন্য কিছু পেশ করো। সে বললো: আমি আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্য
কারোর জন্য কোন নজরানা পেশ করতে পারবোনা। তাতে করে তারা ওকে হত্যা করলো এবং সে জান্নাতী
হলো’’। (আহমাদ/যুহদ : ১৫)।
এ
জাতীয় কুরবানির গোস্ত খাওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
তিনি তোমাদের উপর হারাম করে দিয়েছেন মৃত পশু, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোস্ত এবং যা
আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারোর নামে জবেহ্ করা হয়েছে’’। (বাকারাহ্ : ১৭৩)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘যে
পশু আল্লাহ্ তা’আলার নামে জবাই করা হয়নি (বরং তা জবাই করা হয়েছে অন্য কারোর নামে অথবা
এমনিতেই মরে গেছে) তা হতে তোমরা এতটুকুও খেয়োনা। কারণ, তা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্যতার
শামিল। শয়তানরা নিশ্চয়ই তাদের অনুগতদের পরামর্শ দিয়ে থাকে তোমাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত
হওয়ার জন্যে। তোমরা তাদের আনুগত্য করলে নিঃসন্দেহে মুশরিক হয়ে যাবে’’। (আন্’আম : ১২১)
যেখানে
বিদ্আত বা শির্কের চর্চা হয় যেমন: বর্তমান যুগের মাযারসমূহ সেখানে কোন পশু জবাই করা
এমনকি তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নাম উচ্চারণ করে জবাই করা হলেও তা করা বৈধ নয়। বরং
তা মারাত্মক একটি গুনাহ্’র কাজ।
সাবিত বিন্ যাহ্হাক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর যুগে বুওয়ানা নামক স্থানে একটি উট কুরবানি করবে বলে মানত করেছে।
রাসূল (সা.) কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন: ওখানে কোন মূর্তি পূজা করা
হতো কি? সাহাবারা বললেন: না। তিনি বললেন: সেখানে কোন মেলা জমতো কি? সাহাবারা বললেন:
না। রাসূল (সা.) মানতকারীকে বললেন: তুমি মানত পুরা করে নাও। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলার
অবাধ্যতা বা মানুষের মালিকানা বহির্ভূত বস্ত্তর মানত পুরা করতে হয় না’’। (আবু দাউদ,
হাদীস ৩৩১৩ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ২১৬১)
তবে
এ সকল স্থানে কেউ অজ্ঞতাবশতঃ কোন কিছু মানত করে থাকলে মানত পুরা না করে শুধুমাত্র কসমের
কাফ্ফারা আদায় করবে।
’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ
করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য (ইবাদাত) করবে বলে মানত করেছে সে যেন তাঁর আনুগত্য
করে তথা মানত পুরা করে নেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্যতা তথা গুনাহ্’র কাজ
করবে বলে মানত করেছে সে যেন তাঁর অবাধ্য না হয় তথা মানত পুরা না করে’’। (আবু দাউদ,
হাদীস ৩২৮৯ তিরমিযী, হাদীস ১৫২৬ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ২১৫৬)।
’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আরো বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কোন
গুনাহ্’র ব্যাপারে মানত করা চলবেনা। তবে কেউ অজ্ঞতাবশতঃ এ জাতীয় মানত করে ফেললে উহার
কাফ্ফারা কসমের কাফ্ফারা হিসেবে দিতে হবে’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩২৯০, ৩২৯২ তিরমিযী,
হাদীস ১৫২৪, ১৫২৫ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ২১৫৫)।
(৯) মানতের শিরক: মানতের শির্ক বলতে একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য কোন কিছু মানত করাকে বুঝানো হয়।
যে
কোন উদ্দেশ্য সফলের জন্য কোন কিছু মানত করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত। যা আল্লাহ্ তা’আলা
ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর নেক বান্দাহদের গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
‘‘তাদের
বৈশিষ্ট্য হলো: তারা তাদের মানত পূরা করে’’। (ইন্সান/দাহর : ৭)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তারা যেন তাদের মানত পুরা করে নেয়’’। (হাজ্জ : ২৯)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তোমরা
যা ব্যয় করো বা মানত করো তা অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা জানেন’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭০)
উক্ত
আয়াতসমূহের প্রথম আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মানত পুরা করার কারণে তাঁর নেক বান্দাহ্দের
প্রশংসা করেছেন। আর কারোর প্রশংসা শুধুমাত্র আবশ্যকীয় বা পছন্দনীয় কাজ সম্পাদন অথবা
নিষিদ্ধ কাজ বর্জনের কারণেই হয়ে থাকে। দ্বিতীয় আয়াতে মানত পুরা করার আদেশ দেয়া হয়েছে।
আর আল্লাহ্ তা’আলা বা তদীয় রাসূল (সা.) এর আদেশ মান্য করার নামই তো হচ্ছে ইবাদাত। তৃতীয়
আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মানত সম্পর্কে অবগত আছেন এবং উহার প্রতিদান দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন।
ইহা যে কোন মানত ইবাদাত হওয়াই প্রমাণ করে। আর এ কথা সবারই জানা যে, ইবাদাত বলতেই তা
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য কারোর জন্য নয়। অন্য কারোর জন্য সামান্যটুকু
ইবাদাত ব্যয় করার নামই তো শির্ক। অতএব কারোর জন্য কোন কিছু মানত করা সত্যিই শির্ক।
এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বর্তমান
যুগে যারা ওলী-বুযুর্গদের কবরের জন্য নিয়ত বা মানত করে যাচ্ছে তাদের ও মক্কার মুশ্রিকদের
মধ্যে সামান্যটুকুও ব্যবধান নেই।
আল্লাহ্ তা’আলা মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন:
‘‘মুশ্রিকরা
আল্লাহ্ তা’আলার দেয়া শস্য ও পশু সম্পদের একাংশ তাঁর জন্যই নির্ধারিত করছে এবং তাদের
ধারণানুযায়ী বলছে: এ অংশ আল্লাহ্ তা’আলার জন্য আর এ অংশ আমাদের শরীকদের। তবে তাদের
শরীকদের অংশ কখনো আল্লাহ্ তা’আলার নিকট পৌঁছেনা। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ তা’আলার অংশ তাদের
শরীকদের নিকট পৌঁছে যায়। এদের ফায়সালা কতোই না নিকৃষ্ট’’। (আন্’আম : ১৩৬)
মূলতঃ
মানত দু’ প্রকার: কোন উদ্দেশ্য হাসিলের শর্ত ছাড়াই এমনিতেই আল্লাহ্ তা’আলার জন্য কোন
ইবাদাত মানত করা। আর অন্যটি হচ্ছে কোন উদ্দেশ্য হাসিলের শর্তে আল্লাহ্ তা’আলার জন্য
কোন কিছু মানত করা। এ দু’য়ের মধ্যে প্রথমটিই প্রশংসনীয়। আর এ ধরনের মানত পুরা করাই
নেককারদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়টি নয়। বরং তা খুবই নিন্দনীয়। তাই তো রাসূল
(সা.) এ জাতীয় মানত করতে নিষেধ করেছেন। তবে এরপরও কেউ এ ধরনের মানত করে ফেললে সে তা
পুরা করতে অবশ্যই বাধ্য।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
মানত করো না। কারণ, মানত কারোর ভাগ্যলিপিকে এতটুকুও পরিবর্তন করতে পারে না। বরং মানতের
মাধ্যমে কৃপণের পকেট থেকে কিছু বের করে নেয়া হয়। (যা সে এমনিতেই আদায় করতো না’’।)
(মুসলিম, হাদীস ১৬৪০)।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: মানতের মাধ্যমে আদম সন্তান এমন কিছু অর্জন করতে পারে না যা আমি তার জন্য
ইতিপূর্বে বরাদ্দ করিনি। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণের পকেট থেকে কিছু বের করে আনা হয়।
কারণ, সে মানতের মাধ্যমেই আমাকে এমন কিছু দেয় যা সে কার্পণ্যের কারণে ইতিপূর্বে আমাকে
দেয়নি’’। (আহমাদ্ ২/২৪২)।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘মানত
দু’ প্রকার। তার মধ্যে যা হবে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য তার কাফ্ফারা হবে শুধু
তা পুরা করা। আর যা হবে শয়তানের জন্য তথা শরীয়ত বিরোধী তা কখনোই পুরা করতে হবে না।
তবে সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কসমের কাফফারা দিতে হবে’’। (ইবনুল জারূদ্/মুন্তাক্বা,
হাদীস ৯৩৫ বায়হাক্বী ১০/৭২)।
(১০) আনুগত্যের শির্ক - ১
আনুগত্যের
শির্ক বলতে বিনা ভাবনায় তথা শরীয়তের গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ ছাড়াই হালাল, হারাম, জায়েয,
নাজায়েযের ব্যাপারে আলেম, বুযুর্গ বা উপরস্থ কারোর সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে সন্তুষ্টচিত্তে
মেনে নেয়াকে বুঝানো হয়।
এ
জাতীয় আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয়
করা জঘন্যতম শির্ক।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
আল্লাহ্ তা’আলাকে ছেড়ে নিজেদের আলিম, ধর্ম যাজক ও মার্ইয়ামের পুত্র মাসীহ্ (’ঈসা)
(আ.) কে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে শুধু এতটুকুই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলারই ইবাদাত করবে। তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোন মা’বূদ নেই। তিনি তাদের শির্ক
হতে একেবারেই পূতপবিত্র’’। (তাওবাহ্: ৩১)।
’আদি’ বিন্ হাতিম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমি
নবী (সা.) এর দরবারে গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ঝুলিয়ে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে ডেকে বলেন:
হে ’আদি’! এ মূর্তিটি (ক্রুশ) গলা থেকে ফেলে দাও। তখন আমি তাঁকে উক্ত আয়াতটি পড়তে শুনেছি।
’আদি’ বলেন: মূলতঃ খ্রিষ্টানরা কখনো তাদের আলিমদের উপাসনা করতো না। তবে তারা হালাল
ও হারামের ব্যাপারে বিনা প্রমাণে আলিমদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতো। আর এটিই হচ্ছে আলিমদেরকে
প্রভু মানার অর্থ তথা আনুগত্যের শির্ক’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩০৯৫)।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘যে
পশু একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নামে জবাই করা হয়নি (বরং তা জবাই করা হয়েছে অন্য কারোর
নামে অথবা এমনিতেই মরে গেছে) তা হতে তোমরা এতটুকুও খেয়ো না। কারণ, তা আল্লাহ্ তা’আলার
অবাধ্যতার শামিল। শয়তানরা নিশ্চয়ই তাদের অনুগতদের কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে তোমাদের সঙ্গে
বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্যে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মুশ্রিক
হয়ে যাবে। (আন’আম : ১২১)।
ইসলাম
বিরোধী কালা কানুনের আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসকদের বিচার-মীমাংসা সন্তুষ্টচিত্তে
মেনে নেয়া এ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। যেমন: সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার বা মদ জাতীয় হারাম বস্ত্তকে
হালাল করার নীতি। পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ওয়ারিসি সম্পত্তির সমবন্টন বা পর্দাহীনতার
নীতি। বহুবিবাহের মতো হালাল বস্ত্তকে হারাম করার নীতি। এ সকল ব্যাপারে প্রশাসকদের অকুন্ঠ
আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে হারাম ও একান্ত শির্ক। কারণ, মানব জীবনের প্রতিটি শাখায় তথা যে
কোন সমস্যায় কোর’আন ও হাদীসের সঠিক সিদ্ধান্ত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়াই সকল মোসলমানের
একান্ত কর্তব্য। আর এটিই হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার গোলামী ও একত্ববাদের একান্ত দাবি। কেননা,
আইন রচনার সার্বিক অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘জেনে
রাখো, সকল সৃষ্টি তাঁরই এবং হুকুমের অধিকারীও একমাত্র তিনি। তিনিই হুকুম দাতা এবং তাঁর
হুকুমই একান্তভাবে প্রযোজ্য’’। (আ’রাফ : ৫৪)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তোমরা
যে কোন বিষয়েই মতভেদ করো না কেন উহার মীমাংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই দিবেন’’। (শূরা
: ১০)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমাদের
মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে উহার মীমাংসার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয়
রাসূলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করো। যদি তোমরা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালের প্রতি
দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটিই হচ্ছে তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর পরিসমাপ্তি’’।
(নিসা’ : ৫৯)
উক্ত
আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার আইনানুযায়ী বিচারকার্য
পরিচালনা করা শুধু ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই নয় বরং তা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত এবং
তা সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা’আলার অধিকার বাস্তবায়ন ও নিজ আক্বীদা-বিশ্বাস সুরক্ষণের
শামিল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানব রচিত বিধি-বিধানের আলোকে সকল বিচার-ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে
মেনে নিচ্ছে পরোক্ষভাবে সে যেন এ বিধান রচয়িতাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার হিসেবে
গ্রহণ করছে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তাদের
কি এমন কোন (আল্লাহ্’র অংশীদার) দেবতাও রয়েছে যারা আল্লাহ্ তা’আলার অনুমোদন ছাড়া তাদের
জন্য বিধি-বিধান রচনা করে’’। (শূরা : ২১)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমরা
যদি তাদের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মুশরিক হয়ে যাবে’’। (আন’আম : ১২১)
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে মানব রচিত আইন গ্রহণকারীদেরকে ঈমানশূন্য তথা কাফির বলে
ঘোষণা দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
কি ওদের ব্যাপারে অবগত নন? যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাব ও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের
উপর ঈমান এনেছে বলে ধারণা পোষণ করছে। অথচ তারা তাগূতের (আল্লাহ্ বিরোধী যে কোন শক্তি)
ফায়সালা কামনা করে। বস্ত্ততঃ তাদেরকে ওদের বিরুদ্ধাচরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। শয়তান চায়
ওদেরকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করতে। ... অতএব আপনার প্রতিপালকের কসম! তারা কখনো ঈমানদার
হতে পারে না যতক্ষণ না তারা আপনাকে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক বানিয়ে নেয় এবং
আপনার সকল ফায়সালা নিঃসঙ্কোচে তথা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়’’। (নিসা’ : ৬০-৬৫)
অতএব
যারা নিয়ত মানব রচিত বিধি-বিধান বাস্তবায়নের আহবান করছে পরোক্ষভাবে তারা বিধি-বিধান
রচনা ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে অন্যকে আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার বানাচ্ছে। আর যারা আল্লাহ্
তা’আলার বিধান ছাড়া অন্য বিধানের আলোকে বিচারকার্য পরিচালনা করছে তারা নিশ্চিতভাবেই
কাফির। চাই তারা উক্ত বিধানকে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান চাইতে উত্তম, সম পর্যায়ের বা আল্লাহ্
তা’আলার বিধান এর পাশাপাশি এটাও চলবে বলে ধারণা করুকনা কেন। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন
মাজীদের উক্ত আয়াতে বলেছেন: তারা ঈমান আছে বলে ধারণা পোষণ করে। বাস্তবে তারা ঈমানদার
নয়। দ্বিতীয়তঃ তারা তাগূতকে বিচারক মানে ; অথচ তার বিরুদ্ধাচরণ ঈমানের অঙ্গ।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘অতএব
যে ব্যক্তি তাগূতকে অবিশ্বাস এবং আল্লাহ্ তা’আলাকে বিশ্বাস করে সেই প্রকৃতপক্ষে মজবুত
রশি আঁকড়ে ধরলো। অর্থাৎ ঈমানদার হলো’’। (বাক্বারাহ্ : ২৫৬)
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাঁর বিধান বিমুখতাকে মুনাফিকের আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন:
‘‘যখন
তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার বিধান ও রাসূল (সা.) এর প্রতি আহবান করা হয় তখন আপনি মুনাফিকদেরকে
আপনার প্রতি বিমুখ হতে দেখবেন’’। (নিসা’ : ৬১)।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর বিধান ছাড়া অন্য বিধানকে জাহিলী (বর্বর) যুগের বিধান বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন:
‘‘তারা
কি জাহিলী যুগের বিধান চাচ্ছে? দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার বিধান চাইতে সুন্দর
বিধান আর কে দিতে পারে?’’ (মা’য়িদাহ্ : ৫০)।
ইব্নে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহু) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা উক্ত আয়াতে সে ব্যক্তিকে দোষারোপ করছেন যে ব্যক্তি সার্বিক কল্যাণময় আললাহ্
তা’আলার বিধান ছেড়ে মানব রচিত বিধি-বিধানের পেছনে পড়েছে। যেমনিভাবে জাহিলী যুগের লোকেরা
ভ্রষ্টতা ও মূর্খতার মাধ্যমে এবং তাতার্রা চেঙ্গিজ খান রচিত ‘‘ইয়াসিক’’ নামক সংবিধানের
মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করতো। যা ছিলো ইহুদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের সংবিধানসমূহ
থেকে বিশেষভাবে চয়িত। তাতে চেঙ্গিজ খানের ব্যক্তিগত মতামতও ছিল। ধীরে ধীরে তার সন্তানরা
এ সংবিধানকে জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছে। যার গুরুত্ব তাদের নিকট কোর’আন ও হাদীসের
চাইতেও বেশি। যে এমন করলো সে কাফির হয়ে গেলো। তার সাথে যুদ্ধ করা সবার উপর ওয়াজিব যতক্ষণনা
সে আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর বিধানের দিকে ফিরে আসে। বর্তমান যুগে অধিকাংশ
রাষ্ট্রে মানব রচিত যে সংবিধান চলছে তা অনেকাংশে তাতারদের সংবিধানেরই সমতুল্য’’। (আল্
ইরশাদ্ : ১০২-১০৩)।
যে
কোন মুফতি সাহেবের ফতোয়া কোর’আন ও হাদীসের বিপরীত জেনেও নিজের মন মতো হওয়ার দরুন তা
মেনে নেয়া এ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। সঠিক নিয়ম হচ্ছে, কোন গবেষকের কথা কোর’আন ও হাদীসের
সঠিক প্রমাণভিত্তিক হলে তা মেনে নেয়া। নতুবা নয়।
ইমামগণ
এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূল (সা.) ছাড়া সবার কথাই গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য হতে পারে। এ জন্য
তাঁরা সবাইকে কোর’আন ও হাদীসের সঠিক প্রমাণ ছাড়া কারোর কথা অন্ধভাবে মেনে নিতে নিষেধ
করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি (কোর’আন ও হাদীসের) দলীল সম্পর্কে অবগত নয় (যে কোর’আন ও হাদীসের উপর ভিত্তি
করে আমি ফতোয়া দিয়েছি) তার জন্য আমার কথানুযায়ী ফতোয়া দেয়া হারাম’’। (শা’রানী/মীযান,
ফুতূহাতি মাক্কিয়্যাহ্, দিরাসাতুল্ লাবীব : ৯০ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৭)
তিনি আরো বলেন:
‘‘যখন
তোমরা দেখবে আমার কথা কোর’আন ও হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী তখন তোমরা কোর’আন ও হাদীসের
উপর আমল করবে এবং আমার কথা দেয়ালে ছুঁড়ে মারবে’’। (শা’রানী/মীযান ১/৫৭ সাবীলুর্ রাসূল
: ৯৭-৯৮)।
জনৈক
ব্যক্তি ‘‘দানিয়াল’’ (কেউ কেউ তাঁকে নবী মনে করেন) এর কিতাব নিয়ে কূফায় প্রবেশ করলে
ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) তাকে হত্যা করতে চেয়েছেন এবং তিনি তাকে উদ্দেশ্য
করে বলেন:
‘‘কোর’আন
ও হাদীস ছাড়া অন্য কিতাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি?’’ (শা’রানী/মীযান, হাক্বীক্বাতুল্
ফিক্বহ্, সাবীলুর্ রাসূল : ৯৯)
তিনি আরো বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) ও সাহাবাদের বাণী সদা শিরোধার্য। তবে তাবেয়ীনদের বাণী তেমন নয়। কারণ, তারাও পুরুষ
আমরাও পুরুষ। অর্থাৎ আমরা সবাই একই পর্যায়ের। সুতরাং প্রত্যেকেরই গবেষণার অধিকার রয়েছে’’।
(যাফারুল্ আমানী : ১৮২ আল্ ইর্শাদ্ : ৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৮)।
ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে আরো বলা হয়:
’’ইমাম
আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো: আপনার ফতোয়া যদি কোর’আনের বিপরীত
বলে সাব্যস্ত হয় তখন আমাদের কি করতে হবে? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া ছেড়ে দিয়ে তখন কোর’আনকে
মানবে। বলা হলো: আপনার ফতোয়া যদি হাদীসের বিপরীত সাব্যস্ত হয়? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া
ছেড়ে দিয়ে তখন হাদীসকে মানবে। বলা হলো: আপনার ফতোয়া যদি সাহাবাদের বাণীর বিপরীত সাব্যস্ত
হয়? তিনি বললেন: আমার ফতোয়া ছেড়ে দিয়ে তখন সাহাবাদের বাণী অনুসরণ করবে’’। (রাওযাতুল্
’উলামা, ’ইক্ব্দুল্ জীদ্ : ৫৪ সাবীলুর্ রাসূল : ৯৭)।
ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) আরো বলেন:
‘‘তুমি
আমি আবু হানীফা এবং মালিক এমনকি অন্য যে কারোর অন্ধ অনুসরণ করোনা। বরং তারা যেভাবে
হুকুম-আহ্কাম সরাসরি কোর’আন ও হাদীস থেকে সংগ্রহ করেছে তোমরাও সেভাবে সংগ্রহ করো’’।
(শা’রানী/মীযান, ’হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, ত’ুহ্ফাতুল্ আখ্ইয়ার্ : ৪ সাবীলুর্ রাসূল
: ৯৯)।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘‘আমাদের
সকলের মত গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য হতে পারে তবে রাসূল (সা.) এর মত অনুরূপ নয়। বরং তা সদা
গ্রাহ্য। কারণ, তা ওহি তথা ঐশী বাণী’’। (ইক্ব্দুল্ জীদ্, আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির
২/৯৬ ইর্শাদুস্ সালিক ১/২২৭ আল্ ইর্শাদ্ : ৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ১০১)
তিনি আরো বলেন:
‘‘আমি
মানুষ। সুতরাং আমার কথা কখনো শুদ্ধ হবে। আবার কখনো অশুদ্ধ হবে। তাই তোমরা আমার কথায়
গবেষণা করে যা কোর’আন ও হাদীসের অনুরূপ পাবে তাই মেনে নিবে। অন্যথায় তা প্রত্যাখ্যান
করবে’’।
(জাল্বুল্
মান্ফা’আহ্, ’হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, জামি’উ বায়ানিল্ ’ইল্মি ওয়া ফায্লিহী ২/৩৩ আল্
ইহ্কাম ফী উসূলিল্ আহ্কাম ৬/১৪৯ ঈক্বাযুল্ হিমাম ৭২ আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির
২/৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ১০১-১০২)।
ইমাম শাফি’য়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোর’আন ও হাদীসের কোন প্রমাণ ছাড়া জ্ঞানার্জন করে সে ওব্যক্তির ন্যায় যে রাত্রি
বেলায় কাঠ কেটে বোঝা বেঁধে বাড়ি রওয়ানা করলো অথচ তাতে সাপ রয়েছে যা তাকে দংশন করছে।
কিন্তু তার তাতে কোন খবরই নেই’’। (ই’লামুল্ মুওয়াক্বক্বি’য়ীন, সাবীলুর্ রাসূল : ১০১)।
ইমাম আবু হানীফা এবং শাফি’য়ী (রাহিমাহুমাল্লাহ) আরো বলেন:
‘‘কোন
হাদীস বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে তা আমার মায্হাব বলে মনে করবে। জেনে রাখো, আমার কোন সিদ্ধান্ত
হাদীসের বিপরীত প্রমাণিত হলে তখন হাদীস অনুযায়ী আমল করবে এবং আমার কথা দেয়ালে ছুঁড়ে
মারবে’’। (ইক্ব্দুল্ জীদ্, আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ রাদ্দুল্ মুহ্তার
১/৪৬ রাস্মুল্ মুফ্তী : ১/৪ ঈক্বাযুল্ হিমাম : ৫২, ১০৭ দিরাসাতুল্ লাবীব : ৯১ সাবীলুর্
রাসূল : ১০১)
ইমাম শাফি’য়ী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন:
‘‘আমি
যদি এমন কোন কথা বলে থাকি যা নবী (সা.) এর কথার বিপরীত তখন নবী (সা.) এর বিশুদ্ধ হাদীস
অনুসরণ করাই সর্বোত্তম। অতএব তখন আমার অন্ধ অনুসরণ করবে না’’। (ইক্ব্দুল্ জীদ্, ই’লামুল্
মুওয়াক্বক্বি’য়ীন ২/২৬১ ঈক্বাযুল্ হিমাম ১০০, ১০৩ সাবীলুর্ রাসূল : ১০০)
তিনি আরো বলেন:
‘‘সকল
আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূল (সা.) এর হাদীস যখন কারোর নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায়
তখন অন্য কারোর কথার কারণে তা প্রত্যাখ্যান করার কোন অধিকার সে ব্যক্তির আর থাকে না’’।
(হাক্বীক্বাতুল্ ফিক্বহ্, শা’রানী/মীযান, তাইসীর : ৪৬১)।
(১০) আনুগত্যের শির্ক - ২
ইমাম আহমাদ্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘‘তুমি
আমি আহমাদ্, ইমাম মালিক, শাফি’য়ী, আওযা’য়ী, সাওরী এমনকি কারোর অন্ধ অনুসরণ করো না।
বরং তুমি ওখান থেকেই জ্ঞান আহরণ করো যেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন এ সকল ইমামরা’’।
(ইক্ব্দুল্ জীদ্, ইবনুল্ জাওযী/মানাক্বিবুল্ ইমামি আহমাদ্ : ১৯২ ঈক্বাযুল্ হিমাম ১১৩
আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ দিরাসাতুল্ লাবীব : ৯৩ সাবীলুর্ রাসূল : ১০০)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর কথার পাশাপাশি আর কারোর কথা বলার কোন অধিকার থাকে না’’।
(ইক্ব্দুল্
জীদ্, আল্ ইয়াওয়াক্বীতু ওয়াল্ জাওয়াহির ২/৯৬ সাবীলুর্ রাসূল : ১০০)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমার
গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকে এদের (ইমামদের) কারোর হাতে সোপর্দ করো না। বরং তুমি রাসূল (সা.)
ও তাঁর সাহাবাদের কথানুযায়ী চলবে। তবে তাবি’য়ীনদের কথা মানার ব্যাপারে তুমি সম্পূর্ণরূপে
স্বাধীন’’।
(ই’লামুল্
মুওয়াক্বক্বি’য়ীন, সাবীলুর্ রাসূল : ১০০)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘আশ্চর্য
হয় ওদের জন্য যারা হাদীসের বর্ণনধারার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত। এতদসত্ত্বেও
তারা তা না মেনে সুফ্ইয়ান (সাওরী) (রাহিমাহুল্লাহ) এর একান্ত ব্যক্তিগত মতামত গ্রহণ
করে। অথচ আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ রাসূল (সা.) এর আদেশ অমান্যকারীদের এ মর্মে সতর্ক
থাকা উচিত যে, তাদের উপর নেমে আসবে বিপর্যয় বা আপতিত হবে কঠিন শাস্তি’’। (আল্ ইর্শাদ্
: ৯৭ তাইসীর : ৪৬১)।
ইমাম আহমাদ্ (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেন:
‘‘উক্ত
আয়াতে ফিৎনাহ্ বলতে শির্ককেই বুঝানো হয়েছে। সম্ভবত এটাই বুঝানো হচ্ছে যে, যখন কোন ব্যক্তি
রাসূল (সা.) এর কোন কথা প্রত্যাখ্যান করে তখন তার অন্তরে কিছুটা বক্রতা সৃষ্টি হয়।
এমনকি ধীরে ধীরে তার অন্তর সম্পূর্ণরূপে বক্র হয়ে যায়। এতেই তার ধ্বংস অনিবার্য’’।
(তাইসীরুল্ ’আযীযিল্ হামীদ : ৪৬২)।
তিনি উক্ত আয়াতের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় আরো বলেন:
‘‘তুমি
জানো কি? উক্ত আয়াতে ফিৎনাহ্ বলতে কি বুঝানো হয়েছে। তিনি বলেন: উক্ত আয়াতে ফিৎনাহ্
বলতে কুফরীকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ ফিৎনাহ্ (কুফরী) হত্যা
অপেক্ষা গুরুতর’’। (বাক্বারাহ্ : ২১৭) (তাইসীরুল্ ’আযীযিল্ হামীদ: ৪৬২)
ইমাম
আহমাদ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) ওদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন যারা হাদীসকে বিশুদ্ধ জেনেও সুফ্ইয়ান
(সাওরী) (রাহিমাহুল্লাহ্) বা অন্যান্য ইমামগণের অন্ধ অনুসরণ করে।
তারা
কখনো কখনো এ বলে হাদীস মানতে অক্ষমতা প্রকাশ করে যে, হাদীস মানা না মানা গবেষণা সংক্রান্ত
ব্যাপার। আর গবেষণার দরোজা বহু পূর্বেই বন্ধ হয়ে গেছে অথবা আমার ইমাম আমার চাইতে এ
সম্পর্কে ভাল জানেন। তিনি জেনে শুনেই এ হাদীস গ্রহণ করেননি। সুতরাং এ ব্যাপারে ভাবনা
বা গবেষণার কোন প্রয়োজন নেই অথবা গবেষণার দরোজা এখনো বন্ধ হয়নি। তবে গবেষণার জন্য এমন
অনেকগুলো শর্ত রয়েছে যা এ যুগে কারোরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছেনা। যেমন: গবেষক কোর’আন ও
হাদীসে বিশেষজ্ঞ হওয়া এবং উহার নাসিখ (রহিতকারী) মান্সূখ (রহিত) সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে
অবগত হওয়া ; হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধ জানা ; শব্দ ও বাক্যের ইঙ্গিত, অভিব্যক্তি ও বাচনভঙ্গি
সম্পর্কে সুপন্ডিত হওয়া ; আরবী ভাষা, নাহু (ব্যাকরণ), উসূল (ফিকাহ্ শাস্ত্রের মৌলিক
প্রমাণ সংক্রান্ত জ্ঞান) ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখা। আরো এমন
অনেকগুলো শর্ত বলা হয় যা যা আবু বকর ও ’উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এর মধ্যে পাওয়া যাওয়াও
হয়তো বা অসম্ভব।
উক্ত
শর্তসমূহ সঠিক বলে মেনে নিলেও তা শুধু ইমাম আবু হানীফা, মালিক, শাফি’য়ী ও আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহু)
এর মতো প্রথম পর্যায়ের বা মহা গবেষকদের ক্ষেত্রে মেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ওগুলোকে
সরাসরি কোর’আন ও হাদীস মোতাবেক আমল করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে শর্ত হিসেবে মেনে নেয়া
হলে তা হবে সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা’আলা, তদীয় রাসূল ও ইমামগণের উপর মারাত্মক অপবাদ।
বরং একজন মু’মিন হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তির উপর ফরয এই যে, যখনই কোর’আনের কোন আয়াত অথবা
রাসূল (সা.) এর বিশুদ্ধ কোন হাদীস তার কর্ণকুহরে পৌঁছুবে এবং সে তা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম
হবে তখনই সে তা নিঃসঙ্কোচে মেনে নিবে। তা যে কোন বিষয়েই হোকনা কেন এবং উহার বিপরীতে
যে কেউই মত ব্যক্ত করুকনা কেন। ইহাই মহামহিম আল্লাহ্ তা’আলা এবং তদীয় রাসূল মুহাম্মাদ
(সা.) এর একান্ত নির্দেশ এবং সকল আলিম এ ব্যাপারে একমত।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
নিজ প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিধানের অনুসরণ করো। তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে অনুসরণীয়
বন্ধু বা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না। তবে তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো’’। (আ’রাফ
: ৩)
সকল
হিদায়াত একমাত্র রাসূল (সা.) এর আনুগত্যে। অন্য কারোর আনুগত্যে নয়। সে যত বড়ই হোক না
কেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘যদি
তোমরা তাঁর (আল্লাহ্) রাসূলের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা সত্যিকারার্থে হিদায়াতপ্রাপ্ত
হবে। রাসূলের কর্তব্যই তো হচ্ছে সকলের নিকট আল্লাহ্ তা’আলার সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া’’।
(নূর : ৫৪)
উক্ত
আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূলের আনুগত্যে হিদায়াত রয়েছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু
মাযহাবীরা তাতে হিদায়াত দেখতে পাচ্ছে না। বরং তাদের অধিকাংশের ধারণা, রাসূল (সা.) এর
হাদীস সরাসরি অবলম্বনে সমূহ গোমরাহির নিশ্চিত সম্ভাবনা এবং একান্তভাবে মাযহাব অনুসরণে
সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাইতো তারা নির্দিষ্ট কোন মাযহাব পরিত্যাগ করাকে মারাত্মক
অপরাধ ও চরম গোমরাহির কারণ বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
ইমাম
আহমাদ্ (রাহিমাহুল্লাহ) এর উপরোল্লিখিত বাণীতে এ কথাও সুস্পষ্ট যে, কারোর নিকট রাসূল
(সা.) এর সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছা পর্যন্ত ততক্ষণ কোন ইমামের অন্ধ অনুসরণ (তাক্বলীদ) সত্যিকারার্থে
দোষনীয় নয়। বরং দোষনীয় হচ্ছে কারোর নিকট রাসূল (সা.) এর সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছার পরও পূর্ব
ভুল সিদ্ধান্তের উপর অটল ও অবিচল থাকা। দোষনীয় হচ্ছে ফিকাহ্’র কিতাবসমূহ জীবন চালনার
জন্যে সম্পূর্ণরূপে যথেষ্ট মনে করে কোর’আন ও হাদীসের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা।
অনেক
ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোর’আন ও হাদীস অধ্যয়ন করা হলেও তা একমাত্র বরকত হাসিল অথবা মাযহাবী
অপতৎপরতা দৃঢ়তর করা তথা কোর’আন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা দেয়ার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। একান্ত
শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়। শুধুমাত্র চাকুরির জন্যে। শরীয়ত শেখার জন্যে নয়। তাদের
সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে, নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর অন্তর্ভুক্ত তারাইতো
নয়? না অন্য কেউ।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আমি
আমার পক্ষ থেকে আপনাকে কোর’আন মাজীদ দিয়েছি উপদেশ স্বরূপ। যে ব্যক্তি তা হতে বিমুখ
হবে সে কিয়ামতের দিন গুনাহ্’র মহা বোঝা বহন করবে। এমনকি সে স্থায়ী শাস্তির সম্মুখীনও
হবে এবং এ বোঝা তার জন্য দুঃখ ও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে’’। (ত্বা-হা: ৯৯-১০১)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন-যাপন হবে কঠিন ও সংকুচিত এবং কিয়ামতের দিন আমি
তাকে উঠাবো অন্ধ রূপে। তখন সে বলবে: হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে কেন অন্ধ করে উঠালেন?
আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: এ ভাবেই। কারণ, দুনিয়াতে তোমার
নিকট আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী এসেছিলো তখন তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। সে ভাবেই আজ তোমাকে
ভুলে যাওয়া হলো। এ ভাবেই আমি হঠকারী ও প্রভুর নিদর্শনে অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
নিশ্চয়ই পরকালের শাস্তি কঠিন ও চিরস্থায়ী’’। (ত্বা-হা : ১২৪-১২৭)।
’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আববাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কেই
বলেন:
’’অচিরেই
তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হবে। আমি বলছি: রাসূল (সা.) বলেছেন। অথচ তোমরা বলছো:
আবু বক্র (রা.) বলেছেন, ’উমর (রা.) বলেছেন’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৭)।
শায়েখ
আব্দুর রহমান বিন্ হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) প্রতিটি মুসলমানের সঠিক কর্তব্য সম্পর্কে
বলেন:
‘‘প্রতিটি
ব্যক্তির কর্তব্য এই যে, যখন তার নিকট কোর’আন ও হাদীসের সঠিক প্রমাণ পৌঁছুবে এবং সে
তা বুঝতে সক্ষম হবে তখন সে আর সামনে পা বাড়াবেনা বরং তা নিঃসঙ্কোচে মেনে নিবে। এর বিরোধিতায়
যে কোন ব্যক্তিই মত পোষণ করুকনা কেন’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৭)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘প্রত্যেক
নিজ হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির কর্তব্য এই যে, যখন সে কিতাব পড়ে কোন আলিমের মতামত জানবে
তখন তা কোর’আন ও হাদীসের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিবে। কারণ, যে কোন গবেষক বা তার অনুসারীরা
যখনই কোন মাস্আলা উল্লেখ করেন সাথে সাথে তার প্রমাণও উল্লেখ করে থাকেন। সুতরাং আমাদের
সক্ষমদের কর্তব্য, প্রতিটি মাস্আলার সঠিক দৃষ্টিকোণ জেনে নেয়া। কারণ, যে কোন মাস্আলার
সঠিক দৃষ্টিকোণ সবেমাত্র একটি। দু’টো বা ততোধিক নয়। তবে ইমামগণ সর্বাবস্থায় গবেষণার
সাওয়াবের অধিকারী হবেন। চাই তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হোন বা নাই হোন। অতএব, ইনসাফ
অন্বেষী ব্যক্তি সে, যে গবেষকদের মতামতে গভীর দৃষ্টি আরোপ করে কোর’আন ও হাদীস সম্মত
সঠিক মত জেনে নিবে এবং জানবে কোন্ আলিমের মত নিখুঁত প্রমাণভিত্তিক তাহলে সে তা মেনে
নিবে। এভাবেই ক্ষণকালের মধ্যে তার নিকট পরীক্ষিত এক ধর্মীয় জ্ঞানভান্ডার সঞ্চিত হবে’’।
(আল্ ইরশাদ্ : ৯৭)
আব্দুর রহমান বিন্ হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহ্’র বাণী:
‘‘তোমরা
যদি তাদের আনুগত্য করো তাহলে তোমরা নিশ্চিতভাবে মুশ্রিক হয়ে যাবে’’। (আন্’আম : ১২১)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন:
‘‘এ
জাতীয় শির্কে মায্হাব অনুসারীদের অনেকেই লিপ্ত। কারণ, তারা নিজ ইমামের মত পরিপন্থী
কোন প্রমাণ গ্রহণ করেনা যতই তা বিশুদ্ধ প্রমাণিত হোকনা কেন। তাদের কট্টরপন্থীরাতো এমনও
বিশ্বাস করে যে, ইমাম সাহেবের মত পরিপন্থী কোন প্রমাণ গ্রহণ করা মাকরূহ বা হারাম। এমতাবস্থায়
বিপর্যয় আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তারা এমনও বলে থাকে যে, ইমাম সাহেব দলীল সম্পর্কে
আমাদের চাইতে কম অবগত ছিলেন না’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৭-৯৮)।
শায়েখ মোহাম্মদ বিন্ আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘‘পঞ্চম
মাস্আলা এই যে, অবস্থার পরিবর্তন এতটুকু পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, অনেকেই বুযুর্গদের উপাসনাকে
উৎকৃষ্ট আমল বলে মনে করছে। এমনকি উহাকে বিলায়াত (বুযুর্গী) বলতে এতটুকুও সঙ্কোচ করছেনা।
অনুরূপভাবে আলিমদের উপাসনাকে ইল্ম তথা ফিক্হ বলা হচ্ছে। ধীরে ধীরে অবস্থার এতখানি অবনতি
ঘটেছে যে, বুযুর্গ নামধারী ভন্ডদের এবং আলিম নামধারী মূর্খদের পূজা শুরু হয়েছে’’।
(আল্ ইরশাদ্ : ৯৮)।
অতএব
মৃত ব্যক্তিদের ওয়াসীলা গ্রহণ, যে কোন সমস্যার সমাধান কল্পে তাদেরকে আহবান, সূফীদের
পথ ও মত অনুসরণ, জন্মোৎসব উদ্যাপন এ জাতীয় সকল ভ্রষ্টতা, বিদ্’আত ও কুসংস্কারের ক্ষেত্রে
ভ্রষ্ট আলিমদের অনুসরণ তাদেরকে প্রভু মানার শামিল। ভ্রষ্ট আলিমরা ইসলাম ধর্মে এমন কিছু
কর্মকান্ড আবিষ্কার করেছে যার লেশমাত্রও কোর’আন বা হাদীসে খুঁজে পাওয়া যায়না। পরিশেষে
ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, বিদ্’আতকে ধর্ম পালনের মূল মানদন্ড বলে বিবেচনা
করা হচ্ছে। যা পালন না করলে সে ব্যক্তিকে ধর্ম ত্যাগী বা আলিম-বুযুর্গদের চরম শত্রু
ভাবা হচ্ছে।
গবেষক
ইমামদের ভুল গবেষণা মানা যদি নাজায়েয হয়ে থাকে অথচ তারা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য একটি
সাওয়াব পাচ্ছেন তাহলে আক্বীদার বিষয়ে (যাতে গবেষণার সামান্যটুকুও অবকাশ নেই) ভ্রষ্ট
আলিমদের অনুসরণ কিভাবে জায়েয হতে পারে। মূলতঃ ব্যাপারটি এমন যেমনটি আল্লাহ্ তা’আলা
কোর’আন মাজীদের মধ্যে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আমি
মানুষকে বুঝানোর জন্যে এ কোর’আন মাজীদে সর্ব প্রকারের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি। আপনি
যদি তাদের সম্মুখে কোন নিদর্শন উপস্থিত করেন তখন কাফিররা নিশ্চয়ই বলবে: তোমরা অবশ্যই
মিথ্যাশ্রয়ী। এভাবেই আল্লাহ্ তা’আলা মূর্খদের অন্তরে মোহর মেরে দেন। অতএব আপনি ধৈর্যধারণ
করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলার প্রতিশ্রুতি সত্য। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকুন যে, অবিশ্বাসীরা
যেন আপনাকে বিচলিত করতে না পারে’’। (রূম : ৫৮-৬০)
সর্ব
বিষয়ে আলিমদের কট্টর অন্ধ অনুসারীদের পাশাপাশি আরেকটি দল রয়েছে যারা সবার উপর গবেষণা
ওয়াজিব বলে মনে করে। যদিও সে গন্ডমূর্খ হোকনা কেন। তারা ফিক্হের কিতাব পড়া হারাম মনে
করে। তারা চায় মূর্খরাও যেন কোর’আন ও হাদীস থেকে মাস্আলা বের করে নেয়। এটি চরম কট্টরতা
বৈ কি? ভয়ঙ্করতার বিবেচনায় এরাও প্রথমোক্তদের চাইতে কম নয়। অতএব, এ ক্ষেত্রে মধ্যম
পন্থা অনুসরণ করাই সর্বোত্তম। অর্থাৎ আমরা গবেষকদের অন্ধ অনুসরণও করবোনা আবার তাদের
কোর’আন-হাদীস সম্মত জ্ঞানগর্ব আলোচনাও প্রত্যাখ্যান করবোনা। বরং আমরা তাদের গবেষণা
গভীরভাবে অধ্যয়ন করে কোর’আন ও হাদীস বুঝার সঠিক পথ খুঁজে পেতে পারি।
(১১) ভালোবাসার শির্ক - ১
ভালোবাসার
শির্ক বলতে দুনিয়ার কাউকে এমনভাবে ভালোবাসাকে বুঝানো হয় যাতে তার আদেশ-নিষেধকে আল্লাহ্
তা’আলার আদেশ-নিষেধের উপর প্রাধান্য দেয়া অথবা সমপর্যায়ের মনে করা হবে। তাতে অভূতপূর্ব
সম্মান, অধীনতা ও আনুগত্যের সংমিশ্রণ থাকে।
কোর’আন
ও হাদীসের দৃষ্টিকোণে এ জাতীয় ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য
কারোর জন্য নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
‘‘মানবমন্ডলীর
অনেকেই এমন যে, তারা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্যকে শরীক করে। তারা ওদেরকে এমনভাবে ভালোবাসে
যেমন ভালোবাসে আল্লাহ্ তা’আলাকে । তবে ঈমানদার ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই সর্বাধিক
ভালোবাসে। জালিমরা যদি শাস্তি অবলোকন করে বুঝতো যে, সমুদয় শক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই
জন্য এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর’’। (বাক্বারাহ: ১৬৫)
স্বাভাবিক
ভালোবাসা যা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য না হয়ে অন্য কারোর জন্যও হতে পারে তা তিন
প্রকার:
ক. প্রকৃতিগত ভালোবাসা। যেমন: আহারের জন্য
ক্ষুধার্তের ভালোবাসা।
খ. স্নেহ জাতীয় ভালোবাসা। যেমন: সন্তানের
জন্য পিতার ভালোবাসা।
গ. আসক্তিগত ভালোবাসা। যেমন: স্বামীর জন্য
স্ত্রীর ভালোবাসা।
তবে
এ সকল ভালোবাসাকে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসার উপর কোনভাবেই প্রাধান্য দেয়া যাবে না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি বলুন: যদি তোমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, স্ত্রী, গোত্র-গোষ্ঠী, অর্জিত ধন-সম্পদ
আর ঐ ব্যবসা যার অবনতির তোমরা আশঙ্কা করছো এবং পছন্দসই গৃহসমূহ তোমাদের নিকট আল্লাহ্
তা’আলা ও তদীয় রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে তোমরা
অচিরেই আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তির অপেক্ষা করতে থাকো। বস্ত্ততঃ আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর আদেশ
অমান্যকারীদের সুপথ প্রদর্শন করেন না’’। (তাওবা: ২৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার নিদর্শনসমূহ:
কারোর
মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা বিদ্যমান আছে কিনা তা বুঝার কয়েকটি নিদর্শন বা উপায়
রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:
(ক) আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছাকে নিজ ইচ্ছার
উপর প্রধান্য দেয়া।
(খ) সকল বিষয়ে রাসূল (সা.) আনীত বিধি-বিধান
মেনে চলা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি বলে দিন: যদি তোমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে সত্যিকারার্থে ভালোবেসে থাকো তাহলে
তোমরা আমার অনুসরণ করো। তখনই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ
ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ্ তা’আলা সত্যিই ক্ষমাশীল ও দয়ালু’’। (আল-ইম্রান: ৩১)
(গ) সকল ঈমানদারের প্রতি দয়াবান ও অনুগ্রহশীল
হওয়া।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
’’যে
সকল মু’মিন আপনাকে অনুসরণ করে তাদের প্রতি আপনি বিনয়ী হোন’’। (শু’আরা’ : ২১৫)
আল্লাহ্
তা’আলা সাহাবাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
‘‘মুহাম্মাদ
(সা.) আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত রাসূল। আর তাঁর সহচরগণ কাফিরদের প্রতি খুবই কঠোর। তবে
তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত দয়াবান’’। (ফাত্হ্ : ২৯)
(ঘ) কাফিরদের প্রতি কঠোর হওয়া।
আল্লাহ্ তা’আলা নবী (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
’’হে
নবী! আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি খুব কঠোর হোন’’।
(তাহ্রীম : ৯)
(ঙ) আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত দ্বীনকে দুনিয়ার
বুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মুখ, হাত, জান ও মালের মাধ্যমে তথা সার্বিকভাবে আল্লাহ্’র
রাস্তায় জিহাদ করা।
(চ) আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা
করার ক্ষেত্রে কারোর গাল-মন্দ তথা তিরস্কারকে পরোয়া না করা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমাদের কেউ স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করলে (তাতে ইসলামের কোন ক্ষতি হবেনা।) কারণ,
আল্লাহ্ তা’আলা সত্বরই তাদের স্থলে এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন
এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি দয়াশীল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে।
আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না’’। (মায়িদাহ্
: ৫৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার উপায়:
যে
যে কাজ করলে কারোর অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যায় তা নিম্নরূপ:
১. অর্থ বুঝে মনোযোগ সহকারে কোর’আন মাজীদ
তিলাওয়াত করা।
২. বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা।
৩. অন্তরে, কথায় ও কাজে সর্বদা আল্লাহ্
তা’আলাকে স্মরণ করা।
৪. নিজের পছন্দ ও আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দ
পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হলে আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দকে নিজের পছন্দের উপর সর্বাধিক প্রাধান্য
দেয়া।
৫. আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলীর মাহাত্ম্য,
তাৎপর্য ও সুফল নিয়ে গবেষণা করা।
৬. প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তথা আল্লাহ্ তা’আলার
সকল নিয়ামত নিয়ে সর্বদা ভাবতে থাকা।
৭. আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি সর্বদা বিনয়ী
ও মুখাপেক্ষী থাকা।
৮. রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদের
নামায, কোর’আন তিলাওয়াত ও তাওবা-ইস্তিগ্ফার করা।
৯. নেক্কার ও আল্লাহ্প্রেমীদের সাথে উঠাবসা
করা।
১০. আল্লাহ্ তা’আলা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়
এমন সকল কর্মকান্ড থেকে সর্বদা বিরত থাকা।
আল্লাহ্
তা’আলার ভালোবাসা পাওয়ার উপায়:
আল্লাহ্
তা’আলার ভালোবাসা পেতে হলে পারস্পরিক যে কোন সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই
হতে হবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।
মু’আয বিন্ জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: আমার কর্তব্য ওদেরকে ভালোবাসা যারা আমার জন্য অন্যকে ভালোবাসে, আমার জন্য
অন্যের সাথে উঠে-বসে, আমার জন্য অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং আমারই জন্য কাউকে দান
করে’’। (ইবনু হিব্বান/মাওয়ারিদ, হাদীস ২৫১০ বাগাওয়ী, হাদীস ৩৪৬৩ কোযায়ী, হাদীস ১৪৪৯,
১৪৫০)।
মু’আয বিন্ আনাস্ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ
করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই কাউকে কোন কিছু দিলো এবং একমাত্র তাঁরই জন্য কাউকে কোন
কিছু থেকে বঞ্চিত করলো। তাঁর জন্যই কাউকে ভালোবাসলো এবং একমাত্র তাঁরই জন্য কারোর সঙ্গে
শত্রুতা পোষণ করলো। তাঁরই জন্য নিজ অধীনস্থ কোন মেয়েকে কারোর নিকট বিবাহ্ দিলো তাহলে
তার ঈমান তখনই সত্যিকারার্থে পরিপূর্ণ হলো’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৫২১)।
আল্লাহ্
তা’আলাকে ভালোবাসার পাশাপাশি তদীয় রাসূল (সা.) কেও ভালোবাসতে হবে। কারণ, এতদুভয়ের ভালোবাসা
অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাসূল (সা.) কে ভালোবাসা সত্যিকার ঈমানদারের পরিচয়। আর রাসূল
(সা.) কে ভালোবাসা মানে সর্ব কাজে তাঁর আনীত বিধানকে অনুসরণ করা।
আনাস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তিনটি
বস্ত্ত কারোর মধ্যে বিদ্যমান থাকলে সে সত্যিকারার্থে ঈমানের মজা পাবে। আল্লাহ্ তা’আলা
ও তদীয় রাসূল (সা.) তার নিকট অন্যান্যের চাইতে বেশি প্রিয় হলে, কাউকে একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলার জন্যই ভালোবাসলে এবং দ্বিতীয়বার কাফির হয়ে যাওয়া তার নিকট সে রকম অপছন্দনীয়
হলে যে রকম জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়’’। (বুখারী, হাদীস
১৬, ২১, ৬৯৪১ মুসলিম, হাদীস ৪৩ তিরমিযী, হাদীস ২৬২৪)।
রাসূল (সা.) আরো বলেন:
‘‘তোমাদের
কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ পিতা ও সন্তান এমনকি দুনিয়ার সকল
মানুষ হতে সর্বাধিক প্রিয় না হই’’। (বুখারী, হাদীস ১৫ মুসলিম, হাদীস ৪৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসা দু’ ধরনের:
(১) যা ফরয বা বাধ্যতামূলক। আর তা হচ্ছে:
আল্লাহ্ তা’আলা যে কাজগুলো মানুষের জন্য ফরয বা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন সেগুলোকে ভালোবাসা
এবং তিনি যে কাজগুলোকে হারাম করে দিয়েছেন সেগুলোকে অপছন্দ করা। তদীয় রাসূল (সা.) কে
ভালোবাসা যিনি তাঁর পক্ষ থেকে সকল আদেশ-নিষেধ তাঁর বান্দাহ্দের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর আনীত সকল বিধি-বিধানকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। সকল নবী-রাসূল ও মু’মিনদেরকে
ভালোবাসা এবং সকল কাফির ও ফাজির (নিঃশঙ্ক পাপী) কে অপছন্দ করা।
(২) যা উপরস্থ বা আল্লাহ্ তা’আলার অতি
নিকটবর্তীদের পর্যায়। আর তা হচ্ছে: আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দনীয় সকল নফল কাজগুলোকে ভালোবাসা
এবং তাঁর অপছন্দনীয় সকল মাকরূহ্ কাজগুলোকে অপছন্দ করা। এমনকি তাঁর সকল ধরনের কঠিন ফায়সালাগুলোকেও
সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া।
যেমন
কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসে তাকেও সে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে
ভালোবাসতে হয়। তেমনিভাবে সে যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে অপছন্দ করে তাকেও সে বস্ত্ত বা
ব্যক্তিকে অপছন্দ করতে হয়। নতুবা তার ভালোবাসা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। ঠিক একইভাবে
কেউ আল্লাহ্ তা’আলাকে সত্যিকারার্থে ভালোবাসলে তিনি যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসেন
অথবা অপছন্দ করেন তাকেও সে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসতে বা অপছন্দ করতে হবে। নতুবা
তার আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার দাবি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা
কোর’আন মাজীদের মধ্যে এবং তদীয় রাসূল (সা.) হাদীসের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বন্ধু-শত্রু,
পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমাদের
বন্ধুতো আল্লাহ্ তা’আলা, তদীয় রাসূল (সা.) ও মু’মিনরা। যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত
দেয় এবং সর্বদা আল্লাহ্ তা’আলার সামনে বিনয়ী থাকে’’। (মা’য়িদাহ্ : ৫৫)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘মু’মিন
পুরুষ ও মহিলা একে অপরের বন্ধু’’। (তাওবাহ্ : ৭১)
তিনি আরো বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি তাদের সাথে
বন্ধুত্ব করছো অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা অস্বীকার করছে। রাসূল (সা.)
এবং তোমাদেরকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছে। এ কারণে যে তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্
তা’আলার উপর ঈমান এনেছো। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদ এবং আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য
বের হয়ে থাকো তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছো? আমি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য
সব কিছুই জানি। তোমাদের যে কেউই উক্ত কাজ করে সে অবশ্যই সঠিক পথ হতে বিচ্যুত’’। (মুম্তা’হিনাহ্
: ১)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা মু’মিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহ্
তা’আলাকে তোমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও?’’ (নিসা’ : ১৪৪)।
তিনি আরো বলেন:
‘‘মু’মিনরা
যেন মু’মিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি এমন করবে আল্লাহ্
তা’আলার সাথে তার কোন সম্পর্কই থাকবে না। তবে তা যদি ভয়ের কারণে আত্মরক্ষামূলক হয়ে
থাকে তাহলে তাতে কোন অসুবিধে নেই। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে নিজের ভয় দেখাচ্ছেন। তাঁর
নিকটই সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’। (আ-লু ’ইম্রান : ২৮)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা। তারা একে অপরের বন্ধু।
তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি ইহুদী ও খ্রীস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করবে নিশ্চয়ই সে
তাদেরই অন্তর্ভুক্ত, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাআলা অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ দেখান না।
(সূরা মা’য়িদাহ্ : ৫১)
তিনি আরো বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতৃ ও ভ্রাতাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা যদি তারা ঈমানের
মুকাবিলায় কুফ্রকে পছন্দ করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা ওদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে তারা
অবশ্যই বড় যালিম’’। (তাওবাহ্ : ২৩)
তিনি আরো বলেন:
‘‘আপনি
আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবেন না যে তারা আল্লাহ্ তা’আলা
ও তদীয় রাসূল (সা.) এর বিধান লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসবে। যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র,
ভ্রাতা বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হোকনা কেন। এদের অন্তরেই আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানকে সুদৃঢ় করেছেন
এবং নিজ সহযোগিতায় তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। পরকালে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হবে হরেক রকমের নদ-নদী। তারা সেখানে সর্বদা থাকবে। আল্লাহ্ তা’আলা
তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহ্’র দলভুক্ত। আর জেনে
রাখো, আল্লাহ্’র দলই সর্বদা নিশ্চিত সফলকাম’’। (মুজাদালাহ্ : ২২)।
(১১) ভালোবাসার শির্ক - ২
কাফিরদের
সাথে বন্ধুত্ব করা ইহুদীদের চরিত্র। মুসলমানদের চরিত্র নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
ইহুদীদের অনেককে দেখবেন যে, তারা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করছে। তাদের এ বন্ধুত্ব কতই
না নিকৃষ্ট। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলে, তারা চিরকাল
আযাবে থাকবে’’। (মা’য়িদাহ্ : ৮০)।
কাফিরদের
সাথে বন্ধুত্ব দুনিয়ার সকল অঘটনের মূল। তাতে মুসলমানদের বিন্দু মাত্রও কোন ফায়দা নেই।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘যারা
কাফির তারা একে অপরের বন্ধু। তোমরা যদি উপরোক্ত বিধান কার্যকর না করো তথা মুসলমানদের
সাথে বন্ধুত্ব না করে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করো তাহলে দুনিয়াতে শুরু হবে কঠিন ফিৎনা
ও মহাবিপর্যয়’’। (আনফাল : ৭৩)
কাফিরদের
সাথে যতই বন্ধুত্ব করা হোকনা কেন তারা তাতে কখনোই সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না মুসলমানরা
তাদের ন্যায় কাফির হয়ে যায়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘ইহুদী
ও খ্রিস্টানরা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ
করেন’’। (বাক্বারাহ্ : ১২০)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তাদের
মনে চায়, তোমরাও যেন তাদের মতো কাফির হয়ে যাও। তা হলে তোমরা সবাই একই রকম হয়ে যাবে।
অতএব তোমরা তাদেরকে কখনো বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না’’। (নিসা’ : ৮৯)
তিনি আরো বলেন:
‘‘কাফিররা
তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতেই থাকবে যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের ধর্ম থেকে ফেরাতে
পারে যদি তাদের পক্ষে তা করা সম্ভবপর হয়’’। (বাক্বারাহ্ : ২১৭)
কাফিরদের
প্রতি যে কোন ধরনের দুর্বলতা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
যালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না। অন্যথায় তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। তখন
আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া তোমাদের কেউ সহায় হবে না। অতএব তোমাদেরকে তখন কোন সাহায্যই করা
হবে না’’। (হূদ : ১১৩)
কাফিরদের
প্রতি ঝুঁকে পড়া অনেক ধরনেরই হয়ে থাকে যার কিয়দংশ নিম্নরূপ:
(১) তাদের
সাথে সাধারণ বন্ধুত্ব করা।
(২) তাদের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব করা।
(৩) তাদের
প্রতি সামান্যটুকুও দুর্বলতা দেখানো।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
’’আমি
আপনাকে অবিচল না রাখলে আপনি তাদের প্রতি প্রায় কিছুটা ঝুঁকেই পড়ছিলেন। আপনি তাদের প্রতি
কিছুটা ঝুঁকে পড়লে আমি অবশ্যই আপনাকে ইহকাল ও পরকালে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাতাম।
তখন আপনি আমার বিপক্ষে কোন সাহায্যকারী পেতেন না’’।
(ইসরা’/বানী
ইস্রা’ঈল : ৭৪-৭৫)া
(৪) তাদের প্রতি যে কোন ধরনের নমনীয়তা দেখানো।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারাতো
চায়, আপনি তাদের প্রতি একটু নমনীয় হোন তাহলে তারাও আপনার প্রতি নমনীয় হবে’’। (ক্বলম
: ৯)
(৫) যে কোন ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা।
‘‘যার
অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনযোগী করে দিয়েছি এবং যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে ও কার্যকলাপে
সীমাতিক্রম করে আপনি কখনো তার আনুগত্য করবেন না’’। (কাহফ : ২৮)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা যদি কাফিরদের আনুগত্য করো তাহলে তারা তোমাদেরকে মুরতাদ বানিয়ে ছাড়বে।
অতঃপর তোমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’’। (আলে-ইমরান : ১৪৯)
(৬) তাদেরকে কাছে বসানো।
(৭) কোন কাজে তাদের পরামর্শ নেয়া।
(৮) তাদেরকে
মুসলমানদের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে খাটানো।
(৯) তাদেরকে
মুসলমানদের ভেদজ্ঞাতা তথা প্রাইভেট সেক্রেটারী বানানো।
(১০) তাদের সাথে উঠা-বসা, বন্ধুসুলভ সাক্ষাৎ
করা ইত্যাদি।
(১১) তাদেরকে দেখে খুশি প্রকাশ করা বা তাদের সাথে হাস্যোজ্জল
মুখে সাক্ষাৎ করা।
(১২) তাদেরকে
যে কোন ধরনের সম্মান করা।
(১৩) তাদেরকে আমানতদার মনে করা।
(১৪) তাদেরকে যে কোন কাজে সহযোগিতা করা।
(১৫) তাদেরকে
যে কোন দুনিয়াবি কাজে নসীহত করা।
(১৬) তাদের মতামত অনুসরণ করা।
(১৭) তাদের সাথে চলাফেরা করা।
(১৮) তাদের যে কোন কাজে সন্তুষ্ট থাকা।
(১৯) তাদের সাথে যে কোন ধরনের সাদৃশ্য বজায়
রাখা।
(২০) তাদেরকে যে কোন সম্মানসূচক শব্দে সম্বোধন করা।
(২১) তাদের সাথে বা তাদের এলাকায় বসবাস করা।
সামুরাহ্
বিন্ জুন্দুব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন মুশ্রিকের সাথে উঠেবসে এবং তার সাথে বসবাস করে সে তার মতোই মুশ্রিক বলে
গণ্য’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৭)।
জারীর বিন্ ’আব্দুল্লাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ
করেন:
‘‘যে
সকল মুসলমান মুশ্রিকদের মাঝে বসবাস করে আমার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই’’। (আবু দাউদ,
হাদীস ২৬৪৫)।
(২২) তাদেরকে সালাম দেয়া। রাসূল (সা.) ইরশাদ
করেন:
‘‘তোমরা
ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে সালাম দিবে না। বরং তোমারা তাদের কাউকে বড় রাস্তায় পেলে তাকে
সংকীর্ণ পথে চলতে বাধ্য করবে’’। (মুসলিম, হাদীস ২১৬৭)।
আল্লাহ্
তা’আলা উক্ত ব্যাপারে ইব্রাহীম (আ.) এর আদর্শ অনুসরণ করার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়কে
আহবান করেছেন:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের
মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ ; তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমরা এবং আল্লাহ্’র পরিবর্তে
তোমরা যে মূর্তিসমূহের ইবাদাত করছো তা হতে আমরা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত পবিত্র। তোমাদেরকে
আমরা অস্বীকার করছি এবং আজ হতে চিরকালের জন্য আমাদের ও তোমাদের মাঝে বলবৎ থাকবে শত্রুতা
ও বিদ্বেষ যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান আনো’’। (মুমতাহিনাহ্ : ৪)।
রাসূল (সা.) কে ভালোবাসাও দু’ ধরনের:
(১) যা ফরয বা বাধ্যতামূলক। আর তা হচ্ছেঃ
তাঁর আনীত সকল বিধি-বিধানকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া। আল্লাহ্ তা’আলাকে পাওয়ার জন্যে
একমাত্র তাঁরই পথকে অনুসরণ করা। তাঁর সকল বাণীকে সত্য মনে করা, তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ
মেনে চলা এবং তাঁর আনীত দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা
চালানো। তাঁর আদর্শ বিরোধীদের সাথে প্রয়োজন ও সাধ্যানুযায়ী যুদ্ধ করা।
(২) যা প্রশংসনীয় ও রাসূলপ্রেমীদের কাজ।
আর তা হচ্ছেঃ চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, নফল-মুস্তাহাব ইত্যাদি
তথা তাঁর সকল শিষ্টাচার ও উন্নত চরিত্রের ব্যাপারে তাঁর সার্বিক অনুসরণ করা। তাঁর জীবনী
নিয়ে গবেষণা করা। তাঁর নাম শুনলে হৃদয় ভক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়া। তাঁর উপর বেশি বেশি
দরূদ পাঠ করা। তাঁর বাণী শুনতে ভালো লাগা। তাঁর বাণীকে অন্য সকলের বাণীর উপর প্রাধান্য
দেয়া। দুনিয়ার ব্যাপারে স্বল্পতে তুষ্টি এবং আখিরাতের প্রতি অধিক অনুরাগী হওয়া।
পক্ষান্তরে
যারা রাসূল (সা.) এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বশতঃ মিলাদুন্নাবী পালনের মতো বিদ্’আত এবং কঠিন
মুহূর্তে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য রাসূলকে আহবানের মতো শির্ক করে তারা মুখে রাসূলপ্রেমের
ঠুন্কো দাবিদার হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা চরম মিথ্যাবাদী।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তাদের
উক্তি: আমরা আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূলের উপর ঈমান এনেছি এবং তাদের আনুগত্য স্বীকার
করেছি। অথচ তাদের একদল কিছুক্ষণ পর এ প্রতিজ্ঞা থেকে সরে দাঁড়ায়। বস্ত্ততঃ এরা মু’মিন
নয়। কারণ, রাসূল (সা.) এ কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন অথচ তারা তাই করছে’’। (নূর : ৪৭)।
ঈমানের
সত্যিকার মজা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) কে ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তিনটি
জিনিস যার মধ্যে থাকবে সে সত্যিকারার্থে ঈমানের মজা পাবে। যার নিকট আল্লাহ্ তা’আলা
ও তদীয় রাসূল (সা.) সর্বাধিক প্রিয় হবে। যে ব্যক্তি কাউকে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার
জন্যই ভালোবাসবে। যে ব্যক্তি মুরতাদ্ হওয়া অপছন্দ করবে যেমনিভাবে অপছন্দ করে জাহান্নামে
নিক্ষিপ্ত হওয়া’’। (বুখারী, হাদীস ১৬, ২১, ৬৯৪১ মুসলিম, হাদীস ৪৩ তিরমিযী, হাদীস ২৬২৪)।
(১২) ভয়ের শির্কঃ
ভয়ের
শির্ক বলতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতিরেকে কেউ কারোর পক্ষে অপ্রকাশ্যভাবে দুনিয়া
বা আখিরাত সংক্রান্ত যে কোন ক্ষতি সংঘটন করতে পারে বলে অন্ধ বিশ্বাস করে তাকে ভয় পাওয়াকে
বুঝানো হয়।
এ
ধরণের ভয় একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য কারোর জন্য নয়।
ভয়
বলতে কোন খারাপ আলামত পরিলক্ষণ করে অপ্রীতিকর কোন কিছুর আশঙ্কা করাকে বুঝানো হয়। ভয়
সাধারণত তিন প্রকার:
ক. অদৃশ্যের ভয়:
অদৃশ্যের
ভয় বলতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া কোন মূর্তি, মৃত ব্যক্তি বা অদেখা কোন জিন বা
মানবের অনিষ্টতা থেকে ভয় পাওয়াকে বুঝানো হয়।
এ
জাতীয় ভয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।
ইব্রাহীম
(আ.) এর উম্মতরা তাঁকে সে যুগের মূর্তির ভয় দেখিয়েছিলো। কিন্তু তিনি ভয়ের সে অমূলক
সম্ভাবনার কথা দৃঢ়ভাবে উড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ তা’আলা সে কথাই কোর’আন মাজীদে সুন্দরভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
‘‘তোমাদের
মূর্তিদেরকে আমি ভয় করিনা। তবে আমার প্রভু যাই চান তাই ঘটবে। প্রতিটি বস্ত্ত সম্পর্কে
আমার প্রভু সম্যক জ্ঞান রাখেন। এর পরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? আর আমি তোমাদের
মূর্তিদেরকে ভয় করবোই বা কেন? অথচ তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করতে ভয় পাওনা।
যদিও আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তোমাদের নিকট কোন প্রমাণ নেই। আমাদের মধ্যে
কে কতটুকু নিরাপত্তার অধিক উপযোগী জানা থাকলে অতিসত্বর তোমরা বলো’’। (আন্’আম : ৮০-৮১)।
হূদ (আ.) এর উম্মতরাও তাঁকে সে যুগের মূর্তিদের ভয় দেখিয়েছিলো। তারা বলেছিলো:
‘‘আমাদের
ধারণা, আমাদের কোন দেবতা তোমার ক্ষতি করেছে। হূদ (আ.) বললেন: আমি আল্লাহ্ তা’আলাকে
সাক্ষী রেখে বলছি এবং তোমরাও সাক্ষী থাকো যে, আমি তোমাদের দেবতা থেকে সম্পূর্ণরূপে
মুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অনন্তর তোমরা সবাই সদলবলে আমার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র চালিয়ে
যাও। আমাকে এতটুকুও অবকাশ দিও না’’। (হূদ : ৫৪-৫৫)।
মক্কার
কাফিররাও রাসূল (সা.) কে নিজ দেবতাদের ভয় দেখিয়েছিলো।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
আপনাকে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্যদের ভয় দেখায়’’। (যুমার : ৩৬)
বর্তমান
যুগের কবর পূজারীরাও তাওহীদ পন্থীদেরকে এ জাতীয় ভয় দেখিয়ে থাকে। যখন তাদেরকে কবর পূজা
ছেড়ে এক আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে বলা হয় তখন তারা বলে: কবরে শায়িত বুযুর্গের সাথে
বেয়াদবি করোনা। অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের অনেকেরই অবস্থা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে
যে, আল্লাহ্ তা’আলার নামে মিথ্যা কসম খেতে সত্যিই তারা কোন দ্বিধাবোধ করেনা। অথচ জীবিত
বা মৃত পীরের নামে মিথ্যা কসম খেতে তারা প্রচুর দ্বিধাবোধ করে। তাদের মধ্যকার কেউ অন্যের
উপর যুলুম করে আল্লাহ্ তা’আলার নামে আশ্রয় চাইলে তাকে কোন আশ্রয় দেয়া হয় না। কিন্তু
কোন পীর বা কবরের নামে আশ্রয় চাওয়া হলে তার প্রতি কটু দৃষ্টিতেও কেউ তাকাতে সাহস পায়না।
অথচ এ জাতীয় ভয় একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই করতে হবে। অন্য কাউকে নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
কি ওদেরকে ভয় পাচ্ছো? অথচ তোমাদের উচিৎ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় পাওয়া যদি তোমরা
সত্যিকার ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (তাওবাহ্ : ১৩)।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
এ শয়তান ; যে নিয়ত তোমাদেরকে নিজ বন্ধুদের ভয় দেখিয়ে থাকে। তোমরা ওদেরকে ভয় করোনা।
শুধু আমাকেই ভয় করো যদি তোমরা ঈমানের দাবিদার হয়ে থাকো’’। (আলে-ইমরান : ১৭৫)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তাদেরকে
ভয় করোনা। শুধু আমাকেই ভয় করো’’। (মায়িদাহ্ : ৩)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমরা
শুধু আমাকেই ভয় করো। অন্যকে নয়’’। (বাক্বারাহ্ : ৪০)
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মসজিদ আবাদকারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
‘‘মসজিদগুলো
আবাদ করবে শুধু ওরাই যারা আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালের প্রতি সত্যিকার ঈমান এনেছে এবং
নিয়মিত নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়। উপরন্তু তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া
অন্য কাউকে ভয় পায়না ; বস্ত্ততঃ এদের ব্যাপারেই হিদায়াত প্রাপ্তির আশা করা যায়’’।
(তাওবাহ্ : ১৮)
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় পাওয়া সর্ব যুগের নবী-রাসূলগণের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় করতো। অন্য কাউকে নয়’’। (আহযাব : ৩৯)
এ
জাতীয় ভয় ধার্মিকতার মেরুদন্ড। যা অন্যের জন্য ব্যয় করা বড় শির্ক।
খ. কোন মানুষের ভয়:
মানুষের
ভয় বলতে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির ভয়ে যে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয়াকে বুঝানো হয়। যেমন:
কাউকে সৎ কাজের আদেশ অথবা অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে গিয়ে অথবা আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ
করতে গিয়ে মানুষকে ভয় পাওয়া। এ জাতীয় ভয় শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও ছোট শির্ক।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘এরা
ওরা যাদেরকে অন্যরা এ বলে ভয় দেখিয়েছে যে, সত্যিই শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে।
অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় করো। এতে ওদের ঈমান আরো বেড়ে যায়। বরং তারা বলে: আল্লাহ্ তা’আলাই
আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ দায়িত্বশীল। অতঃপর তারা যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে অথচ তাদের কোন ক্ষতি হয়নি।
আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টিই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল। নিশ্চয়ই
এ শয়তান। যে নিয়মিত তোমাদেরকে ওর অনুগতদের ভয় দেখিয়ে থাকে। অতএব তোমরা ওদেরকে ভয় করোনা।
শুধু আমাকেই ভয় করো যদি তোমরা ঈমানের দাবিদার হও’’। (আল-ইমরান : ১৭৩-১৭৫)
উক্ত ভয় সম্পর্কে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘সাবধান!
মানুষের ভয় যেন তোমাদের কাউকে কোথাও সত্য কথা বলা থেকে বিরত না রাখে’’। (ইবনু মাজাহ,
হাদীস ৪০৭৯)।
রাসূল (সা.) আরো বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা কিয়ামতের দিন বান্দাহকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করবেন: যখন তুমি তোমার সামনে
কাউকে অপকর্ম করতে দেখলে তখন তুমি তাকে বাধা দিলে না কেন? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাহ্কে
তার কৈফিয়ত শিখিয়ে দিলে সে বলবে: হে আমার প্রভু! আমি তো আপনার রহমতের আশা করেছিলাম
ঠিকই তবে অপকর্ম প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে ভয় পেয়েছিলাম’’।
(ইব্নু
মাজাহ্, হাদীস ৪০৮৯ ইবনু হিব্বান, হাদীস ১৮৪৫)
গ.
আল্লাহ্ তা’আলার আযাবের ভয়:
মু’মিন
বলতেই তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলার কঠিন আযাবের ভয় পেতে হবে। এ জাতীয় ভয় কারোর মধ্যে
না থাকলে কখনোই তার পক্ষে কোন গুনাহ্’র কাজ থেকে বাঁচা সম্ভবপর নয়। এ জাতীয় ভয় ইহ্সানের
অন্তর্ভুক্ত।
কোর’আন
ও হাদীস এ জাতীয় ভয় প্রদর্শনে পরিপূর্ণ। তবে শুধু ভয় প্রদর্শনই নয় বরং পাশাপাশি এর
উপকারিতাও বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলার জমিনে অধিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র অধিকার ওদের যারা কিয়ামতের দিন আমার সামনে উপস্থিতির
ভয় পায় এবং আমার কঠিন শাস্তিরও’’। (ইব্রাহীম : ১৪)
তিনি আরো বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার সামনে উপস্থিতির ভয় পায় তার জন্যই রয়েছে দু’টি
জান্নাত’’। (রাহ্মান : ৪৬)
তিনি আরো বলেন:
‘‘জান্নাতীরা
তখন বলবে: আমরা ইতিপূর্বে দুনিয়াতেও পরিবার-পরিজনের সাথে থাকাবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলার
ভয়ে শংকিত ছিলাম। (ত্বূর : ২৬)
আল্লাহ্ তা’আলা তার নেককার বান্দাহ্দের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
‘‘তারা
মানত পুরো করে এবং সে দিনকে (কিয়ামতের দিন) ভয় পায় যে দিনের ভয়াবহতা হবে খুবই ব্যাপক’’।
(দাহর : ৭)
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই সাধারণত দ্রুত কল্যাণমুখী হয়ে থাকে। অন্যরা
নয়। আর শুধুমাত্র গুনাহ্’র কারণেই যে আল্লাহ্ তা’আলার আযাবকে ভয় করতে হবে তাও কিন্তু
সর্বশেষ কথা নয়। বরং সত্যিকার মুসলমানের কাজ হলো, প্রচুর নেক আমল করেও তা আল্লাহ্ তা’আলার
দরবারে কবুল ও মকবুল না হওয়ার আশঙ্কা করা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘নিঃসন্দেহে
যারা নিজ প্রভুর ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা নিজ প্রভুর নিদর্শনাবলীতে বিশ্বাসী, যারা নিজ
প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করেনা এবং যারা নিজ প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন করবে বলে যা দান
করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে শুধু তারাই কেবল দ্রুত সম্পাদন করে থাকে পুণ্যকর্মসমূহ
এবং তারাই উহার প্রতি সত্যিকার অগ্রগামী’’। (মু’মিনূন : ৫৭-৬১)
’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) বলেন:
‘‘আমি
রাসূল (সা.) কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, এরা কি মদ্যপায়ী চোর তস্কর?
নতুবা তারা আল্লাহ্ তা’আলার রাস্তায় দান করেও ভয় পাবে কেন? তিনি বললেন: না, এমন নয়
হে সিদ্দীকের মেয়ে! বরং এরা রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং সাদাকা করে। এর পরও তা আল্লাহ্
তা’আলার দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে শঙ্কিত’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩১৭৫)
ঘ. স্বাভাবিক ভয়:
স্বাভাবিক
ভয় বলতে সহজাত ভয়কে বুঝানো হয়। যেমন: শত্রু, সিংহ ইত্যাদি দেখে ভয় পাওয়া। এ ভীতি দোষনীয়
নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আ.) সম্পর্কে বলেন:
‘‘ভীত
সতর্কাবস্থায় সে (মূসা (আ.)) মিসর থেকে বেরিয়ে পড়লো’’। (ক্বাসাস : ২১)
তবে
আল্লাহ্ভীতি হতে হবে আশা ও ভালোবাসা মিশ্রিত। যাতে অতি ভয় কাউকে আল্লাহ্ তা’আলার রহ্মত
থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ এবং অতি আশা কাউকে আল্লাহ্ তা’আলার পাকড়াও থেকে সম্পূর্ণরূপে
নিরাপদ ভাবতে উৎসাহিত না করে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘একমাত্র
পথভ্রষ্টরাই নিজ প্রভুর করুণা থেকে নিরাশ হয়ে থাকে’’। (হিজর : ৫৬)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তোমরা
আল্লাহ্ তা’আলার করুণা থেকে কখনোই নিরাশ হয়ো না। কারণ, একমাত্র কাফিররাই আল্লাহ্ তা’আলার
করুণা থেকে নিরাশ হয়ে থাকে’’। (ইউসুফ : ৮৭)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তারা
কি নিজেদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার সূক্ষ্ম পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করে? বস্ত্ততঃ একমাত্র
ক্ষতিগ্রস্তরাই আল্লাহ্ তা’আলার পাকড়াও থেকে নিঃশঙ্ক হতে পারে’’। (আ’রাফ : ৯৯)
ইসমাঈল বিন রাফি’ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলার সূক্ষ্ম পাকড়াও থেকে নির্ভয় হওয়ার মানে এও যে, বান্দাহ্ গুনাহ্ করতে থাকবে
এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমার আশা করবে’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৮০)
হাসান (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
‘‘যাকে
আল্লাহ্ তা’আলা অঢেল সম্পদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন অতঃপর সে বুঝতে পারেনি যে, তা
দিয়ে তাকে সূক্ষ্ম পরীক্ষার সম্মুখীন করা হচ্ছে তাহলে বাস্তবার্থে সে চরম বোকা। আর
যাকে আল্লাহ্ তা’আলা আর্থিক সংকটে ফেলেছেন অতঃপর সে বুঝতে পারেনি যে, সকল ধরনের সুখ
ও স্বাচ্ছন্দ্য পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনের তাগিদে তারই জন্য এবং তারই কল্যাণে সংরক্ষণ
করা হচ্ছে তাহলে সেও চরম বোকা’’। (তাইসীরুল্ আযীযিল্ হামীদ : ৪২৬)
আশা
ও ভয়ের সংমিশ্রণকেই ঈমান বলা হয়। নবী ও রাসূলদের ঈমান এ পর্যায়েরই ছিল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
(নবী ও রাসূলরা) সৎকর্মে দৌড়ে আসতো এবং আমাকে ডাকতো আশা ও ভয়ের মাঝে। তেমনিভাবে তারা
ছিলো আমার নিকট সুবিনীত’’। (আম্বিয়া : ৯০)
তিনি আরো বলেন:
‘‘তারা
যাদেরকে ডাকে তারাই তো নিজ প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করে বেড়ায়। এ প্রতিযোগিতায়
যে, কে কতটুকু আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং তারা আল্লাহ্ তা’আলার দয়া
কামনা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় পায়। আপনার প্রতিপালকের শাস্তি সত্যিই ভয়াবহ’’। (ইস্রা/বানী
ইস্রাঈল : ৫৭)
আশা
ও ভয়ের সংমিশ্রণ সত্যিকারার্থে যে কোন আল্লাহ্’র বান্দাহ্কে পুণ্য কর্ম সম্পাদন, গুনাহ্
থেকে পরিত্রাণ ও তাওবা করণে বিপুল সহায়তা করে থাকে। কারণ, যে কোন পুণ্য কর্ম সম্পাদন
একমাত্র সাওয়াবের আশায় এবং যে কোন পাপ থেকে পরিত্রাণ একমাত্র শাস্তির ভয়েই সম্ভব। শুধু
ভয় বা নৈরাশ্য মানুষকে নেক কাজ থেকে নিরুৎসাহী এবং শুধু নির্ভয়তা বা নিরাপত্তাবোধ মানুষকে
গুনাহ্ করতে সুদূর অনুপ্রাণিত করে।
উক্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই আলিমরা বলে থাকেন:
‘‘যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসায় তাঁর
ইবাদাত করে সে সূফী। যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে তাঁর ইবাদাত করে সে হারুরী
বা খারিজী। যে ব্যক্তি নিরেট আশায় আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করে সে মুরজি। আর যে ব্যক্তি
আশা, ভয় ও ভালোবাসার সংমিশ্রণে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করে সেই সত্যিকার মু’মিন’’।
(আল্ ইরশাদ্ : ৮০)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় পাওয়ার উপায়:
তিনটি
জিনিসের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলার সত্যিকার ভয় সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে জিনিসগুলো
নিম্নরূপ:
১. পাপ ও পাপের অপকার সম্পর্কে অবগত হওয়া।
২. পাপের শাস্তি অনিবার্য বলে বিশ্বাস
করা।
৩. পাপের পর তাওবা করা সম্ভবপর নাও হতে
পারে তা বিশ্বাস করা।
কারোর
মধ্যে এ তিনটি বস্ত্তর সম্মিলন ঘটলে সে কোন গুনাহ্’র আগপর একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই
ভয় করতে শিখবে।
মানুষ
যতই গুনাহ্ করুক না কেন তবুও সে কখনো আল্লাহ্ তা’আলার রহ্মত হতে নিরাশ হতে পারে না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
আমার বান্দাহ্দেরকে এ বাণী পৌঁছিয়ে দিন যে, হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা যারা গুনাহ্’র
মাধ্যমে নিজেদের প্রতি অধিক অত্যাচার- অবিচার করেছো আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ থেকে কখনো
নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই
তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তোমরা নিজ প্রতিপালক অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ
করো শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার বহু পূর্বে। জেনে রাখো, এরপর কিন্তু তোমাদেরকে আর সাহায্য
করা হবে না’’। (যুমার : ৫৩-৫৪)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ (রা.) বলেন:
‘‘সর্ববৃহৎ
পাপ হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করা, তাঁর শাস্তি থেকে নিজকে নিরাপদ ভাবা
এবং তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া’’। (’আব্দুর রায্যাক, হাদীস ১৯৭০১)
তবে
সঠিক নিয়ম হচ্ছে, সুস্থতার সময় আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় পাওয়া এবং অসুস্থতা বা মৃত্যুর
সময় আল্লাহ্ তা’আলার রহমতের আশা করা।
(১৩) তাওয়াক্কুল বা ভরসার শির্কঃ
তাওয়াক্কুল
বা ভরসার শির্ক বলতে মানুষের অসাধ্য ব্যাপারসমূহ সমাধানে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া
অন্য কারোর উপর ভরসা করাকে বুঝানো হয়। যেমন: রিযিক দান, সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদি। কারণ,
আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা
মারাত্মক শির্ক।
তবে
আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত না করে তাঁর উপর যে কোন বিষয়ে ভরসা করাও কিন্তু অমূলক।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘সুতরাং
আপনি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করুন এবং তাঁর উপর ভরসা করুন। আপনার প্রভু কিন্তু আপনাদের
কর্ম থেকে গাফিল নন’’। (হূদ: ১২৩)
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাওয়াক্কুলকে ঈমানের শর্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
‘‘তোমরা
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই ভরসা করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (মায়িদাহ্ :
২৩)
অন্য
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাওয়াক্কুলকে ইসলামের শর্ত বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
‘‘মূসা
(আ.) আরো বললেন: হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহ্ তা’আলার উপর ঈমান এনে থাকো তাহলে
তাঁরই উপর ভরসা করো যদি তোমরা নিজকে মুসলিম বলে দাবি করো’’। (ইউনুস : ৮৪)
কোর’আন
মাজীদের আরেকটি আয়াতে তাওয়াক্কুলকে মু’মিনদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
মু’মিন ওরা যাদের সম্মুখে মহান আল্লাহ্ তা’আলার নাম উচ্চারিত হলে তাদের অন্তরাত্মা
কেঁপে উঠে। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহ্ তা’আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান
বৃদ্ধি পায় এবং তারা সকল বিষয়ে নিজ প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’’। (আনফাল : ২)
ইমাম ইব্নুল ক্বায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে
বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা উক্ত আয়াতে তাওয়াক্কুলকে ঈমানের শর্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাহলে বুঝা গেলো,
তাওয়াক্কুল না থাকলে ঈমান থাকে না। আর যখনই ঈমান শক্তিশালী হবে তাওয়াক্কুলও শক্তিশালী
হবে এবং যখনই ঈমান দুর্বল হবে তাওয়াক্কুলও দুর্বল হয়ে যাবে। তাহলে বুঝা গেলো, তাওয়াক্কুলের
দুর্বলতা নিঃসন্দেহে ঈমান দুর্বল হওয়া প্রমাণ করে। আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আনের কয়েকটি
আয়াতে তাওয়াক্কুল ও ইবাদাত, তাওয়াক্কুল ও ঈমান, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ্ভীরুতা, তাওয়াক্কুল
ও ইসলাম, তাওয়াক্কুল ও হিদায়াতকে একত্রে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে,
তাওয়াক্কুল বস্ত্তটি ঈমান ও ইহ্সানের সকল পর্যায় এবং ইসলামের সকল কর্মকান্ডের মূল উৎস।
আরো প্রতীয়মান হয় যে, এগুলোর সাথে তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক এমন যেমন শরীরের সাথে মাথার
সম্পর্ক। যেমনিভাবে শরীর ছাড়া মাথার অবস্থান অকল্পনীয় তেমনিভাবে তাওয়াক্কুল ছাড়াও এগুলোর
উপস্থিতি সত্যিই অকল্পনীয়’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯১-৯২)
তাওয়াক্কুল বা ভরসার প্রকারভেদ:
আল্লাহ্
তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করা তিন প্রকার। যা নিম্নরূপ:
১. সৃষ্টির অসাধ্য এমন কোন ব্যাপারে স্রষ্টা
ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করা। যেমন: বিজয়, রক্ষণ, রিযিক বা সুপারিশ ইত্যাদির ব্যাপারে
মৃত বা অনুপস্থিত কোন ব্যক্তির উপর ভরসা করা। এটি বড় শির্ক।
২. মানুষের সাধ্যাধীন এমন কোন বাহ্যিক
ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি, গভর্ণর বা সক্ষম কারোর উপর সম্পূর্ণরূপে ভরসা করা। যেমন: দান,
সাদাকা বা বাহ্যিক সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদির ব্যাপারে উপরোক্ত কারোর উপর ভরসা করা। এটি
ছোট শির্ক।
৩. কোন কর্ম সম্পাদনে নিজ প্রতিনিধির
উপর নির্ভরশীল হওয়া। যেমন: ক্রয়, বিক্রয় ইত্যাদির ব্যাপারে। এটি জায়েয। তবে এ সকল প্রতিনিধির
উপরও সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। বরং এ জাতীয় কর্মসমূহ সহজ করণে সত্যিকারার্থে
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ, প্রতিনিধি বলতেই তা মাধ্যম
মাত্র এবং এ মাধ্যম ক্রিয়াশীল করতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই সক্ষম। অন্য কেউ নয়।
তবে
এ কথা একান্তভাবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা করা বৈষয়িক উপকরণ গ্রহণ
করার মোটেও পরিপন্থী নয়। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা প্রতিটি বস্ত্ত বা ব্যাপারকে যে কোন
উপকরণ বা মাধ্যম নির্ভরশীল করেছেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি
মাধ্যম ও উপকরণ গ্রহণ করতে আদেশ দিয়েছেন। অতএব উপকরণ বা মাধ্যম গ্রহণ করাও ইবাদাত।
যেমনিভাবে আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করাও একটি ইবাদাত। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা
উপকরণ গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। আর আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ পালনের নামই তো ইবাদাত।
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা নিজ সতর্কতা অবলম্বন করো’’। (নিসা : ৭১)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তোমরা
কাফিরদের মোকাবিলায় যথাসাধ্য শক্তি সঞ্চয় করো’’। (আনফাল : ৬০)
তিনি আরো বলেন:
‘‘নামায
শেষ হলেই তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ তথা রিযিক অনুসন্ধান
করো’’। (জুমু’আহ্ : ১০)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘শক্তিশালী
মু’মিন দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা অনেক ভালো এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট অধিক পছন্দনীয়। তবে
উভয়ের মধ্যে কম ও বেশি কল্যাণ রয়েছে। যা তোমার উপকারে আসবে তা করতে সর্বদা উৎসাহী থাকো
এবং আল্লাহ্’র সাহায্য কামনা করো। অক্ষমের ন্যায় বসে থেকো না। কোন অঘটন ঘটলে এ কথা
বলবেনা যে, যদি এমন করতাম তাহলে এমন এমন হতো। বরং বলবে: আল্লাহ্ তা’আলা ইহা আমার ভাগ্যে
রেখেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কারণ, ‘‘যদি’’ শব্দটি শয়তানের শয়তানীর দরোজা
খুলে দেয়’’। (মুসলিম, হাদীস ২৬৬৪)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমি উটটি বেঁধে তাওয়াক্কুল করবো নাকি না বেঁধেই
তাওয়াক্কুল করবো? তিনি বললেন: বেঁধেই তাওয়াক্কুল করো। না বেঁধে নয়’’। (তিরমিযী, হাদীস
২৫১৭)
’উমর
বিন্ খাত্তাব (রা.) এর সঙ্গে ইয়েমেনের কিছু সংখ্যক লোকের সাক্ষাৎ হলে তিনি তাদেরকে
বলেন:
‘‘তোমরা
কারা? তারা বললো: আমরা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল। তিনি বললেন: না, বরং
তোমরা অসদুপায়ে মানুষের সম্পদ ভক্ষণকারী। আল্লাহ্ তা’আলার উপর সত্যিকার নির্ভরশীল সে
ব্যক্তি যে জমিনে বীজ বপন করে তাঁরই উপর ভরসা করে’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৪)
ইমাম
আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, জনৈক ব্যক্তি উপার্জন না করে বসে আছে এবং
বলছে: আমি আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করেছি। তখন তিনি বলেন:
‘‘প্রত্যেকেরই
উচিত আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করা। তবে এর পাশাপাশি নিজকে উপার্জনে অভ্যস্ত
করতে হবে। কারণ, সকল নবীগণ পয়সার বিনিময়ে কাজ করেছেন। এমনকি আমাদের নবী মুহাম্মাদ
(সা.) , আবু বকর, ’উমরও। তাঁরা আল্লাহ্ তা’আলার রিযিকের আশায় বসে থাকেননি। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ তথা রিযিক অনুসন্ধান
করো’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৪)
এ ব্যাপারে জনৈক আলিম সত্যই বলেছেন। তিনি বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি রোজগার বা উপকরণ অবলম্বনের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করলো সে যেন রাসূল (সা.) এর
হাদীস নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো। আর যে ব্যক্তি তাওয়াক্কুল নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো সে যেন ঈমান
নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৩)
ইমাম
ইবনে রাজাব (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: মানবকর্ম বলতেই তা সর্বসাকুল্যে তিনটি প্রকারের
যে কোন একটি প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যা নিম্নরূপ:
১. ইবাদাতঃ যা সম্পাদন করতে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাহ্দেরকে
আদেশ করেছেন এবং যা বান্দাহ্’র জন্য পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের
কারণ হবে। তা বিনা ভেদাভেদে প্রত্যেককে অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে আল্লাহ্
তা’আলার উপর ভরসা ও তাঁর সহযোগিতা কামনা করা একান্ত কর্তব্য। কারণ, একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলাই বান্দাহ্কে সৎ কাজ করতে এবং অসৎ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করে থাকেন।
আল্লাহ্ তা’আলা যা ইচ্ছে করেন তাই ঘটে থাকে এবং তিনি যা ইচ্ছে করেন না তা কখনোই ঘটে
না। তাই যে ব্যক্তি ইবাদাত করতে গাফিলতি করবে সে দুনিয়া ও আখিরাতে অবশ্যই শাস্তির সম্মুখীন
হবে।
ইউসুফ
বিন্ আস্বাত (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
‘‘এমন
ব্যক্তির ন্যায় আমল করবে পরকালে নিষ্কৃতির জন্য যার একমাত্র আমলই ভরসা এবং এমন ব্যক্তির
ন্যায় তাওয়াক্কুল করবে যে কেবল ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে বলে বিশ্বাস করে’’। (আল্ ইরশাদ্
: ৯৩)
২. প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সর্বদা
যা করে থাকে এবং যা সম্পাদন করতে মানুষ আদিষ্ট ও একান্তভাবে বাধ্যঃ যেমন: খিদে লাগলে ভক্ষণ, পিপাসা লাগলে
পান, সূর্যের তাপে ছায়া ও ঠান্ডায় তাপ গ্রহণ ইত্যাদি। এ সকল কর্ম সম্পাদন করা বান্দাহ্’র
উপর ওয়াজিব। যে ব্যক্তি এগুলো করতে সক্ষম অথচ সে অবহেলা বশতঃ তা না করে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে সে ব্যক্তি অবশ্যই অপরাধী এবং পরকালে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। তবে আল্লাহ্ তা’আলা
কোন কোন ব্যক্তিকে এমন কিছু ক্ষমতা দিয়ে থাকেন যা অন্যের নেই। সুতরাং সে তার সাধ্যানুযায়ী
ব্যতিক্রম কিছু করলে তাতে কোন অসুবিধে নেই। এ কারণেই রাসূল (সা.) একটানা রোযা রাখতেন।
কিন্তু তিনি সাহাবাদেরকে তা করতে নিষেধ করতেন এবং বলতেন:
‘‘আমি
তোমাদের মতো নই। আমাকে আল্লাহ্ তা’আলা খাওয়ান ও পান করান’’। (বুখারী, হাদীস ১৯৬৪ মুসলিম,
হাদীস ১১০৫)
পূর্ববর্তীদের
অনেকেই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে পারতেন। তাতে এতটুকুও তাদের ইবাদাতের ক্ষতি হতো না।
কিন্তু যে ব্যক্তি না খেলে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইবাদাত করতে কষ্ট হয় তার জন্য না খাওয়া
সত্যিই দোষনীয়।
৩. প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অধিকাংশ
সময় যা করে থাকে এবং যা করতে মানুষ একান্তভাবে বাধ্য নয়ঃ যেমন: বিবাহ-শাদি ইত্যাদি। অতএব কারোর
এ সবের একেবারেই প্রয়োজন নেই বলে কেউ তা না করলে সে এ জন্য গুনাহ্গার হবে না।
যে
কোন ব্যাপারে বান্দাহ্’র জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট। তাই তাঁর উপরই ভরসা
করতে হবে। অন্য কারোর উপর নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘হে
নবী! আপনি ও আপনার অনুসারীদের জন্য সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট’’।
(আন্ফাল : ৬৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘কাফিররা
যদি আপনাকে প্রতারিত করতে চায় তাহলে আপনার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট। একমাত্র
তিনিই আপনাকে নিজ সাহায্য (ফিরিশতা) ও মু’মিনদের দিয়ে শক্তিশালী করেছেন’’। (আনফাল
: ৬২)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করবে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে যে কোন সংকট থেকে উদ্ধার করবেন
এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দিবেন। আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার
উপরই ভরসা করবে তখন তিনিই হবেন তার জন্য একান্ত যথেষ্ট’’। (ত্বালাক্ব : ৩)
উক্ত
আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাওয়াক্কুলকে যে কোন কার্যসিদ্ধির অনেকগুলো মাধ্যমের একটি সবিশেষ
ও সর্বপ্রধান মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও তা কিন্তু একেবারেই সর্বেসর্বা
নয়। বরং এর পাশাপাশি অন্য মাধ্যমও গ্রহণ করতে হবে। যেমনিভাবে আল্লাহভীতিও কার্যসিদ্ধির
গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। তবে যখন সকল মাধ্যম চরমভাবে ব্যর্থ হবে তখন একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলার উপর খাঁটি তাওয়াক্কুলই কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হবে।
’উমর
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
‘‘তোমরা
যদি আল্লাহ্ তা’আলার উপর সত্যিকারার্থে ভরসা করতে তাহলে তিনি তোমাদেরকে রিযিক দিতেন
যেমনিভাবে তিনি রিযিক দিয়ে থাকেন পাখীদেরকে। পাখীরা ভোর বেলায় খালি পেটে বাসা থেকে
বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৩৯)
(১৪) সুপারিশের
শির্কঃ
সুপারিশের
শির্ক বলতে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট পরকালের সার্বিক মুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য
কোন সুপারিশ কামনা করাকে বুঝানো হয়।
এ
জাতীয় সুপারিশের অনুমতি বা মঞ্জুরির চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার হাতে। অতএব তিনি
ছাড়া অন্য কারোর নিকট তা কামনা করা মারাত্মক শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি বলে দিন: যাবতীয় সুপারিশ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য তথা তাঁরই ইখতিয়ারে।
অন্য কারোর ইখতিয়ারে নয়’’। (যুমার : ৪৪)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তিনি
ছাড়া তোমাদের জন্য কোন অভিভাবকও নেই এবং সুপারিশকারীও। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে
না?’’ (সাজদাহ্ : ৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনি
ছাড়া তাদের না কোন সাহায্যকারী থাকবে না কোন সুপারিশকারী। এতে করে হয়তোবা তারা আল্লাহ্
তা’আলাকে ভয় করবে’’। (আন্’আম : ৫১)
কিয়ামতের
দিন কেউ কারোর জন্য সুপারিশ করতে চাইলে তাকে সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি নিতে
হবে।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘কে
আছে এমন যে আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট কারোর জন্য সুপারিশ করতে পারে?’’
(বাক্বারাহ্ : ২৫৫)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলার অনুমতি ছাড়া সে দিন কোন সুপারিশকারী থাকবে না’’। (ইউনুস : ৩)
সুপারিশ
তো দূরের কথা সে দিন তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ কোন কথাই বলার অধিকার রাখবে না। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘সে
দিন কোন ব্যক্তি তাঁর (আল্লাহ্ তা’আলার) অনুমতি ছাড়া কথাও বলতে পারবে না’’। (হূদ :
১০৫)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘সে
দিন দয়াময় প্রভুর অনুমতি ছাড়া কেউ কোন কথা বলতে পারবে না’’। (নাবা : ৩৮)
সে
দিন কেউ আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে সুপারিশ করার অনুমতি পেলেও সে নিজ ইচ্ছানুযায়ী যে
কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবে না। বরং সে এমন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবে
যার উপর আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘ফিরিশতাগণ
শুধু ওদের জন্যই সুপারিশ করবে যাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট’’। (আম্বিয়া : ২৮)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আকাশে
অনেক ফিরিশ্তা এমন রয়েছে যাদের সুপারিশ কোন কাজে আসবে না যতক্ষণ না আল্লাহ্ তা’আলা
সুপারিশের অনুমতি দিবেন যাকে ইচ্ছা তাকে এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তার জন্য’’। (নাজম
: ২৬)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘সে
দিন কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। তবে শুধু ওর সুপারিশই ফলপ্রসূ হবে যাকে দয়াময় প্রভু
সুপারিশের অনুমতি দিবেন এবং যার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা সুপারিশ করা পছন্দ করবেন’’। (ত্বাহা
: ১০৯)
এমনকি
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) ও সে দিন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সুপারিশের অনুমতি
চাবেন। অতঃপর তাঁকে সুপারিশের অনুমতি দেয়া হবে এবং সাথে সাথে তাঁর জন্য সুপারিশের গন্ডিও
ঠিক করে দেয়া হবে। অতএব আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি ছাড়া এবং তাঁর নির্ধারিত গন্ডির বাইরে
সে দিন তিনিও কারোর জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘জান্নাতীদেরকে
জান্নাতে ঢুকার পূর্বে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হবে। তখন তারা নবীদের সুপারিশ কামনা করলে
কেউ তাতে রাজি হবেন না। পরিশেষে তারা রাসূল (সা.) এর নিকট আসবে। রাসূল (সা.) বলেন:
তখন আমি আমার প্রভুর নিকট অনুমতি চাইলে আমাকে অনুমতি দেয়া হবে। প্রভুকে দেখেই আমি সিজদাহে
পড়ে যাবো। তিনি আমাকে যতক্ষণ ইচ্ছা সিজদাহরত অবস্থায় রাখবেন। অতঃপর আমাকে বলা হবে,
মাথা উঠাও। তুমি যা চাও তা দেয়া হবে। যা বলো শুনা হবে। যা সুপারিশ করো তা গ্রহণ করা
হবে। অতঃপর আমি মাথা উঠাবো। তখন আমি প্রভুর প্রশংসা করবো যা তখন তিনি আমাকে শিখিয়ে
দেবেন। এরপর আমি সুপারিশ করবো। তখন আমার সুপারিশের গন্ডি ঠিক করে দেয়া হবে। তখন আমি
শুধু তাদেরকেই জান্নাতে প্রবেশ করাবো। পুনরায় আমি তাঁর নিকট ফিরে আসবো এবং আমি তাঁকে
দেখা মাত্রই সিজদাহে পড়ে যাবো। অতঃপর আমি সুপারিশ করলে আমার সুপারিশের গন্ডি ঠিক করে
দেয়া হবে। তখন আমি শুধু তাদেরকেই জান্নাতে প্রবেশ করাবো। এভাবে তৃতীয়বার। চতুর্থবার
আমি ফিরে এসে বলবো, এখন শুধু জাহান্নামে ওব্যক্তিই রয়েছে যাকে কুর’আন মাজীদ আটকে রেখেছে।
অর্থাৎ যাদের জন্য চিরতরে জাহান্নামে থাকা নির্ধারণ করা হয়েছে’’। (বুখারী, হাদীস ৪৪৭৬,
৬৫৬৫, ৭৪১০, ৭৪৪০)।
তবে
বিশেষভাবে জানার বিষয় এইযে, আল্লাহ্ তা’আলা শুধুমাত্র খাঁটি তাওহীদপন্থীদের জন্যই সুপারিশের
অনুমতি দিবেন। অন্য কারোর জন্য নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন:
‘‘ফলে
সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না’’। (মুদ্দাস্সির : ৪৮)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল!
কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ পাওয়ার ভাগ্য কার হবে? তিনি বললেন:
‘‘হে
আবু হুরাইরাহ্! পূর্ব থেকেই তোমার সম্পর্কে আমার এ ধারণা ছিল যে, তোমার আগে এ সম্পর্কে
আর কেউ প্রশ্ন করবে না। কারণ, আমি তোমাকে সর্বদা হাদীসলোভী দেখছি। কিয়ামতের দিন আমার
সুপারিশ পাওয়ার ভাগ্য ওব্যক্তির হবে যে খাঁটি অন্তঃকরণে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া কোন মা’বুদ
নেই বলে স্বীকার করবে’’। (বুখারী, হাদীস ৯৯, ৬৫৭০)
’আউফ্
বিন্ মালিক্ আশ্জা’য়ী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘জিব্রীল
(আ.) আমার প্রভুর প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে দু’টি ব্যাপারের যে কোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা
দিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা আমার আধা উম্মাতকে জান্নাতে দিবেন নাকি আমি এর পরিবর্তে আমার
সকল উম্মাতের জন্য সুপারিশ করবো। অতঃপর আমি সুপারিশের ব্যাপারটিই গ্রহণ করলাম। আর এ
সুপারিশটুকু এমন সকল ব্যক্তির ভাগ্যে জুটবে যারা শির্কমুক্ত অবস্থায় ইন্তিকাল করবে’’।
(তিরমিযী, হাদীস ২৪৪১)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘প্রত্যেক
নবীর জন্য একটি কবুল দো’আ বরাদ্দ রয়েছে এবং প্রত্যেক নবী তা দ্রুত (দুনিয়াতেই) করে
ফেলেছেন। তবে আমি আমার দো’আটি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের জন্য সুপারিশ হিসেবে সংরক্ষণ
করেছি। আল্লাহ্ চানতো তা এমন সকল ব্যক্তির ভাগ্যে জুটবে যারা শির্কমুক্ত অবস্থায় ইন্তিকাল
করবে’’। (মুসলিম, হাদীস ১৯৯ তিরমিযী, হাদীস ৩৬০২ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪৩৮৩)
উক্ত
হাদীসদ্বয় এটিই প্রমাণ করে যে, পরকালে তাওহীদপন্থীদের জন্য রাসূল (সা.) এর সুপারিশ
দো’আ বা আবেদন জাতীয় হবে। দুনিয়ার সুপারিশকারীদের সুপারিশের অনুরূপ নয়। দুনিয়ার কোন
সুপারিশকারী সাধারণত এমন ব্যক্তির নিকট সুপারিশ করে থাকে যে ব্যক্তি সুপারিশকারীর নিকট
কোন ধরণের অনুগ্রহভোগী অথবা তার উপর সুপারিশকারীর কোন কর্তৃত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ্ তা’আলার
উপর কারোর কোন অনুগ্রহ বা কর্তৃত্ব নেই।
মূলতঃ
আল্লাহ্ তা’আলা ফিরিশ্তা, নবী বা ওলীগণকে সুপারিশের অনুমতি দিয়ে তাঁদেরকে সম্মানিত
করবেন। ব্যাপারটা এমন যে, আল্লাহ্ তা’আলা নিজ অনুগ্রহে কিছু গুনাহ্গারকে ক্ষমা করে
তাদেরকে জান্নাত দিতে চান। কিন্তু তিনি তাদেরকে সরাসরি জান্নাতে না পাঠিয়ে তাদেরকে
ক্ষমা করা ও জান্নাতে পাঠানোর ব্যাপারে নিজ ফিরিশ্তা, নবী বা ওলীগণকে সুপারিশের অনুমতি
দিয়ে তাঁদেরকে সম্মানিত করবেন। সুতরাং সুপারিশকারীরা সুপারিশের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলার
নিশ্চিত ফায়সালার সামান্যটুকুও পরিবর্তন করতে পারবেনা।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তিনি
নিজ ফায়সালায় কাউকে শরীক করেন না’’। (কাহফ : ২৬)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা এককভাবে ফায়সালা করেন। তাঁর ফায়সালা দ্বিতীয়বার পর্যালোচনা করার অধিকার কারোর
থাকে না। তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’’। (রা’দ্ : ৪১)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘(হে
মুহাম্মাদ (সা.)!) আপনি ওদেরকে বলে দিন: আল্লাহ্ তা’আলা যদি ঈসা (আ.) ও তাঁর মা এবং
দুনিয়ার সবাইকে ধ্বংস করে দিতে চান তাহলে কে আছে এমন যে তাঁদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার হাত
থেকে রক্ষা করতে পারে?’’ (মায়িদাহ্ : ১৭)
(১৫) হিদায়াতের শির্কঃ
হিদায়াতের
শির্ক বলতে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ কাউকে হিদায়াত দিতে পারে এমন বিশ্বাস করা
অথবা এ বিশ্বাসে কারোর নিকট হিদায়াত কামনা করাকে বুঝানো হয়।
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছে ছাড়া কেউ কাউকে ইচ্ছে করলেই সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে না।
এমনকি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও নিজ ইচ্ছায় কাউকে হিদায়াত দিতে পারেননি।
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যাকে চান হিদায়াত দিতে পারেন। অন্য কেউ নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘তাদেরকে
সুপথে আনার দায়িত্ব আপনার উপর নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলা যাকে চান সৎপথে পরিচালিত করেন’’।
(বাক্বারাহ্ : ২৭২)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আপনি
যতই চান না কেন অধিকাংশ লোকই মু’মিন হওয়ার নয়’’। (ইউসুফ : ১০৩)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘আপনি
যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারেন না। তবে আল্লাহ্ তা’আলা যাকে ইচ্ছে
করেন তাকেই সৎপথে আনয়ন করেন। তিনি হিদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে ভালই জানেন’’। (ক্বাসাস্
: ৫৬)
আবু
যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘(আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর বান্দাহ্দেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন) হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট।
শুধু সেই ব্যক্তিই হিদায়াতপ্রাপ্ত যাকে আমি হিদায়াত দেবো। অতএব তোমরা আমার নিকট হিদায়াত
চাও। আমি তোমাদেরকে হিদায়াত দেবো’’। (মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭)
মুসাইয়াব
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
রাসূল
(সা.) এর চাচা আবু তালিব যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তিনি [রাসূল (সা.)] তার (আবু তালিব)
নিকট এসে দেখতে পেলেন, আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ্ বিন্ আবু উমাইয়া তার নিকট বসা। তখন রাসূল
(সা.) তাঁর চাচাকে বললেন: হে চাচা! আপনি বলুন: আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তাহলে
আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ ব্যাপারে আপনার জন্য সাক্ষী দেবো। আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ্
বললো: হে আবু তালিব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করছো? এভাবে রাসূল (সা.)
তাকে কালিমা পাঠ করাতে চাচ্ছিলেন। আর ওরা সে কথাই বার বার বলছিলো। পরিশেষে আবু তালিব
আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম নিয়েই ইন্তিকাল করলো এবং কালিমা উচ্চারণ করতে অস্বীকার করলো।
এরপরও রাসূল (সা.) বললেন: আল্লাহ্’র কসম! আমি আপনার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমা
প্রার্থনা করবো যতক্ষণনা তিনি আমাকে নিষেধ করেন। অতঃপর তার সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হলো:
‘‘নবী ও অন্যান্য সকল মু’মিনদের জন্য জায়িয নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার
নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয়-স্বজনই বা হোকনা কেন এ কথা সুস্পষ্ট হওয়ার
পর যে, তারা সত্যিকার জাহান্নামী’’। আরো নাযিল হলোঃ ‘‘আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই
তাকে সৎপথে আনতে পারেন না। তবে আল্লাহ্ তা’আলা যাকে ইচ্ছে করেন তাকেই সৎপথে আনয়ন করেন’’।
(তাওবা:
১১৩) এবং (ক্বাসাস্ : ৫৬) (বুখারী, হাদীস ১৩৬০, ৩৮৮৪, ৪৬৭৫, ৪৭৭২, ৬৬৮১ মুসলিম, হাদীস
২৪)
(১৬) সাহায্য প্রার্থনার শির্কঃ
সাহায্য
প্রার্থনার শির্ক বলতে মানুষের সাধ্যের বাইরে এমন কোন সাহায্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা
ছাড়া অন্য কারোর নিকট কামনা করাকে বুঝানো হয়।
এ
জাতীয় সাহায্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই কামনা করতে হয়। অন্য কারোর নিকট নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা মানুষকে প্রতি নামাযে এ বাক্যটি বলতে শিখিয়েছেন:
‘‘আমরা
আপনারই ইবাদাত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’’। (ফাতি’হা : ৫)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল (সা.) আমাকে কিছু মূল্যবান বাণী
শুনিয়েছেন যার কিয়দাংশ নিম্নরূপ:
‘‘কিছু
চাইলে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’লার নিকটই চাইবে। কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই কামনা করবে। জেনে রেখো, পুরো বিশ্ববাসী একত্রিত হয়েও যদি তোমার
কোন কল্যাণ করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই কল্যাণ করতে পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
আর তারা সবাই একত্রিত হয়েও যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই ক্ষতি
করতে পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬)
(১৭) কবর পূজার শির্কঃ
কবর
পূজার শির্ক বলতে কবরে শায়িত কোন ওলী বা বুযুর্গের জন্য যে কোন ধরনের ইবাদাত সম্পাদন
বা ব্যয় করাকে বুঝানো হয়।
বর্তমান
যুগের মাযারকে শির্কের কুঞ্জ বা আড্ডা বলা যেতে পারে। এমন কোন শির্ক নেই যা কোন না
কোন মাযারকে কেন্দ্র করে অনুশীলিত হচ্ছে না। আহবান, ফরিয়াদ, আশ্রয়, আশা, রুকু, সিজদাহ্,
বিনম্রভাবে কবরের সামনে দাঁড়ানো, তাওয়াফ, তাওবা, জবাই, মানত, আনুগত্য, ভয়, ভালোবাসা,
তাওয়াক্কুল, সুপারিশ ও হিদায়াত কামনা করার মত বড় বড় শির্ক যে কোন কবরের পার্শ্বে নির্বিঘ্নে
চর্চা করা হচ্ছে।
এ
সবের মূলে সর্বদা একটি কারণই কাজ করে চলছে। আর তা হলো: ওলী-বুযুর্গদের ব্যাপারে অমূলক
বাড়াবাড়ি। এ জাতীয় বাড়াবাড়ির কারণে যেমনিভাবে ধ্বংস হয়েছে নূহ (আ.) এর উম্মতরা তেমনিভাবে
ধ্বংস হয়েছে ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা।
এ
কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা ওদেরকে ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করে
দিয়েছেন।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
বলে দিন: হে ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা! তোমরা ধর্মীয় ব্যাপারে অমূলক সীমালংঘন করো না এবং
ওসব লোকদের ভিত্তিহীন কল্পনার অনুসারী হয়ো না যারা অতীতে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং
আরো বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে। বস্ত্ততঃ তারা সরল পথ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছে’’।
(মায়িদাহ্ : ৭৭)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি আল্লাহ্ তা’আলার বাণী:
‘‘তারা
বলেছে: তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে ; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ্,
সুওয়া’, ইয়াগুস্, ইয়াঊক্ ও নাসর্কে’’। (নূহ্ : ২৩)
উক্ত
আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন:
‘‘যে
মূর্তিগুলোর প্রচলন নূহ্ (আ.) এর সম্প্রদায়ে ছিলো তা এখন আরবদের নিকট। দাউমাতুল্ জান্দাল্
এলাকায় কাল্ব সম্প্রদায় ওয়াদ্দকে পূজা করতো। হুযাইল্ সম্প্রদায় সুওয়া’কে। মুরাদ্ সম্প্রদায়
ইয়াগুস্কে। সাবাদের নিকটবর্তী এলাকা জাউফের ‘‘বানী গোত্বাইফ্’’ গোত্ররাও ইয়াগুসেরই
পূজা করতো। হাম্দান সম্প্রদায় ইয়াউক্কে। জুল্ কালা’ এর বংশধর হিম্য়ার সম্প্রদায় নাস্রকে।
এ সবগুলো ছিল নূহ্ (আ.) এর সম্প্রদায়ের ওলী-বুযুর্গদের নাম। যখন তারা মৃত্যুবরণ করলো
তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে এ মর্মে বুদ্ধি দিলো যে, তোমরা ওদের বৈঠকখানায় ওদের প্রতিমূর্তি
বানিয়ে সম্মানের সাথে বসিয়ে দাও। অতঃপর তারা তাই করলো। কিন্তু তখনো ওদের পূজা শুরু
হয়নি। তবে এ প্রজন্ম যখন নিঃশেষ হয়ে গেলো এবং ধর্মীয় জ্ঞানের বিলুপ্তি ঘটলো তখনই এ
প্রতিমূর্তিগুলোর পূজা শুরু হলো’’। (বুখারী, হাদীস ৪৯২০)
শুধু
বুযুর্গদের ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি নয় বরং রাসূল (সা.) নিজ ব্যাপারেও কোন বাড়াবাড়ি করতে
উম্মতদেরকে সুদৃঢ় কন্ঠে নিষেধ করেছেন।
রাসূল
(সা.) এর প্রতি সত্যিকার সম্মান:
’উমর
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন:
‘‘তোমরা
আমার প্রশংসা করতে গিয়ে কখনো বাড়াবাড়ি করো না যেমনিভাবে বাড়াবাড়ি করেছে খ্রিষ্টানরা
’ঈসা বিন্ মার্য়াম্ (আ.) এর ব্যাপারে। আমি কেবল আল্লাহ্ তা’আলার বান্দাহ্। সুতরাং তোমরা
আমার সম্পর্কে বলবে: তিনি আল্লাহ্ তা’আলার বান্দাহ্ এবং তদীয় রাসূল’’। (বুখারী, হাদীস
৩৪৪৫, ৬৮৩০)
রাসূল
(সা.) কে অমূলক বেশি সম্মান দিতে যাওয়ার কারণেই বহু শির্কের উদ্ভাবন হয়। এ অমূলক সম্মান
হেতুই যে কোন সমস্যায় তাঁকে আহবান করা হয়, তাঁর নিকট ফরিয়াদ করা হয়, তাঁর জন্য মানত
মানা হয়, তাঁর কবরের চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করা হয় এবং তিনি গায়েব জানেন ও তাঁর হাতে
সর্বময় ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
সত্যিকারার্থে
এটি সম্মান নয় বরং তা কুফরী বৈ কি? মূলতঃ রাসূল (সা.) কে তিন ভাবে সম্মান করা যায়।
তা নিম্নরূপ:
ক. অন্তর দিয়ে সম্মান করাঃ আর তা হচ্ছে মুহাম্মাদ (সা.) কে আল্লাহ্
তা’আলার বান্দাহ্ ও তদীয় রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করার আওতাধীন এবং তা কেবল রাসূল (সা.)
এর ভালোবাসাকে নিজ সত্তা, মাতা, পিতা, সন্তান ও সকল মানুষের ভালোবাসার উপর প্রাধান্য
দেয়ার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়ে থাকে।
তবে
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, বাহ্যিক এমন দু’টি কর্ম রয়েছে যা কারোর অন্তরে সত্যিকারার্থে
রাসূল (সা.) এর জন্য এ জাতীয় ভালোবাসা বিদ্যমান রয়েছে কি না তা প্রমাণ করে। কর্ম দু’টি
নিম্নরূপ:
১. খাঁটি তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়া। কারণ,
রাসূল (সা.) সার্বিকভাবে শির্কের সকল পথ, মত ও মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং রাসূল
(সা.) এর সম্মান কখনো শির্কের মাধ্যমে হতে পারে না।
২. সর্ব ক্ষেত্রে তাঁরই অনুসরণ করা। অতএব
সর্ব বিষয়ে তাঁর কথাই গ্রহণযোগ্য হবে। অন্য কারোর কথা নয়। যেমনিভাবে সকল ইবাদাত একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হয় তেমনিভাবে সকল প্রকারের অনুসরণ একমাত্র তাঁরই রাসূলের
জন্য হতে হবে।
খ. মুখ দিয়ে সম্মান করাঃ আর তা কোন রকম বাড়াবাড়ি ছাড়া রাসূল
(সা.) এর যথোপযুক্ত প্রশংসা করার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়ে থাকে।
গ. অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে সম্মান
করাঃ আর তা রাসূল
(সা.) এর সমূহ আনুগত্য বাস্তব কর্মে পরিণত করার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়ে থাকে।
মোটকথা,
রাসূল (সা.) এর কার্যত সম্মান তাঁর বিশুদ্ধ বাণীর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস স্থাপন করা,
তাঁর আদেশ-নিষেধ মান্য করা, তাঁরই জন্যে কাউকে ভালোবাসা বা কারোর সাথে শত্রুতা পোষণ
করা, যে কোন ব্যাপারে তাঁরই ফায়সালাকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়ার মাধ্যমেই সুসংঘটিত
হয়ে থাকে।
অমূলক
বাড়াবাড়ি শরীয়তের দৃষ্টিতে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। চাই তা ইবাদাতের ক্ষেত্রেই হোক বা
আক্বীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘হে
মানুষ সকল! তোমরা ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, তোমাদের পূর্বেকার সকল উম্মাত
শুধু এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩০৮৫ ইবনু হিববান্, হাদীস ১০১১)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাস্’ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘সীমা
লঙ্ঘনকারীরা ধ্বংস হোক! রাসূল (সা.) এ বাক্যটি তিন বার উচ্চারণ করেন’’। (মুসলিম, হাদীস
২৬৭০ আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৮)
ওলী-বুযুর্গদের
ব্যাপারে বেশি বাড়াবাড়ি করার কারণেই প্রথমে তাদের কবরের উপর ঘর বা মসজিদ তৈরি করা হয়।
অতঃপর সে কবরের জন্য সিজদা করা হয়, মানত করা হয় এমনকি উহাকে নামায ও দো’আ কবুল হওয়ার
বিশেষ স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়, তাতে শায়িত ব্যক্তির নামে কসম খাওয়া হয়, তার নিকট
ফরিয়াদ করা হয়, তাকে আল্লাহ্ তা’আলার চাইতেও বেশি ভয় করা হয়, তার নিকট যে কোন সমস্যার
সমাধান চাওয়া হয়, তার নিকট অতি বিনয়ের সঙ্গে এমনভাবে কান্নাকাটি করা হয় যা আল্লাহ্
তা’আলার ঘর মসজিদেও করা হয় না এমনকি পরিশেষে তা খাদিম নামের কিছু সংখ্যক মানুষের আড্ডা
হয়ে যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কবরের উপর মসজিদ
নির্মাণকারীকে আল্লাহ্ তা’আলার সর্ব নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: উম্মে হাবীবাহ্ ও উম্মে সালামাহ্ (রা.)
ইথিওপিয়ায় একটি গির্জা দেখেছিলো যাতে অনেকগুলো ছবি টাঙ্গানো রয়েছে। তারা তা রাসূল
(সা.) কে জানালে তিনি বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
ওরা তাদের মধ্যে কোন ওলী-বুযুর্গ ইন্তিকাল করলে তারা ওর কবরের উপর মসজিদ বানিয়ে নেয়
এবং এ জাতীয় ছবিসমূহ টাঙ্গিয়ে রাখে। ওরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সর্ব নিকৃষ্ট
সৃষ্টি হিসেবে সাব্যস্ত হবে’’। (বুখারী, হাদীস ৪২৭, ৪৩৪, ১৩৪১, ৩৮৭৩ মুসলিম, হাদীস
৫২৮ ইবনু খুযাইমাহ্, হাদীস ৭৯০)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাস্ঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘সর্ব
নিকৃষ্ট মানুষ ওরা যারা জীবিত থাকতেই কিয়ামত এসে গেলো এবং ওরা যারা কবরের উপর মসজিদ
নির্মাণ করলো’’।
(ইবনু
খুযাইমাহ্, হাদীস ৭৮৯ ইবনু হিববান/ইহ্সান, হাদীস ৬৮০৮ ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস ১০৪১৩
বায্যার/কাশ্ফুল আস্তার, হাদীস ৩৪২০)
নবী
(সা.) কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকারী ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে লা’নত (অভিশাপ) দিয়েছেন।
’আয়েশা
ও ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন:
‘‘যখন
রাসূল (সা.) মৃত্যু শয্যায় তখন তিনি চাদর দিয়ে নিজ মুখমন্ডল ঢেকে ফেললেন। অতঃপর যখন
তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচিছলো তখন তিনি চেহারা খুলে বললেন: ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের উপর
আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত ; তারা নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিলো। এ কথা বলে নবী (সা.)
নিজ উম্মতকে সে কাজ না করতে সতর্ক করে দিলেন’’। (বুখারী, হাদীস ৪৩৫, ৪৩৬, ৩৪৫৩, ৩৪৫৪,
৪৪৪৩, ৪৪৪৪ মুসলিম, হাদীস ৫৩১)
নবী
(সা.) কবরের উপর মসজিদ বানানোর ব্যাপারে শুধু লা’নত ও নিন্দা করেই ক্ষান্ত হননি বরং
তিনি তা করতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধও করেছেন।
জুন্দাব্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি নবী (সা.) কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন:
‘‘তোমাদের
পূর্বেকার লোকেরা নিজ নবী ও ওলী-বুযুর্গদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিতো। সাবধান! তোমরা
কবরকে মসজিদ বানিওনা। আমি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করছি’’। (মুসলিম, হাদীস
৫৩২)
শুধু
কবরের উপর মসজিদ বানানোই নয় বরং রাসূল (সা.) কবরের উপর বসতে বা উহার দিকে ফিরে নামায
পড়তেও নিষেধ করেছেন।
আবু
মার্সাদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
কবরের উপর বসো না এবং উহার দিকে ফিরে নামাযও পড়ো না’’। (মুসলিম, হাদীস ৯৭২ আবু দাউদ,
হাদীস ৩২২৯ ইবনু খুযাইমাহ্, হাদীস ৭৯৩)
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘নবী
(সা.) কবরস্থানে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন’’।
(ইবনু
হিববান, হাদীস ৩৪৫ আবু ইয়া’লা, হাদীস ২৮৮৮ বাযযার/কাশফুল আস্তার, হাদীস ৪৪১, ৪৪২)
রাসূল
(সা.) শুধু কবরের উপর ঘর বানাতে নিষেধ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি কবরকে পাকা করতে
এবং কবরের সাথে যে কোন বস্ত্ত সংযোজন করতেও কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) কবর পাকা করতে, উহার উপর বসতে, ঘর বানাতে এমনকি উহার সাথে কোন জিনিস সংযোজন করতেও
নিষেধ করেছেন’’।
(মুসলিম,
হাদীস ৯৭০ আবু দাউদ, হাদীস ৩২২৫, ৩২২৬ আব্দুর রায্যাক, হাদীস ৬৪৮৮ ইবনু হিববান/ইহসান,
হাদীস ৩১৫৩, ৩১৫৫)
কবরের
প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা যাতে মানুষের অন্তরে গেঁথে না যায় এবং রাসূলে আক্রাম (সা.)
এর কবর এলাকা যাতে মেলা বা ঈদগাহে রূপান্তরিত না হয় সে জন্য রাসূল (সা.) তাঁর কবরের
নিকট গিয়ে তাঁকে সালাম করার আদেশ দেননি। বরং তিনি এর বিপরীতে তাঁর কবরের নিকট গিয়ে
তাঁকে সালাম করার প্রতি নিজ উম্মতদেরকে অনুৎসাহিত করেছেন। সুতরাং যে কোন মুসলমান যে
কোন স্থান হতে তাঁর নিকট সালাত ও সালাম পাঠাতে পারে। অতএব তাঁর কবরের নিকট গিয়ে তাঁকে
সালাম দেয়ার মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
নিজেদের ঘর গুলোকে কবর বানিও না। বরং তোমরা তাতে নফল নামায, কোর’আন তিলাওয়াত ও দো’আ
ইত্যাদি করিও এবং আমার কবরকে মেলা বানিও না। তাতে বার বার নির্দিষ্ট সময়ে আসার অভ্যাস
করো না। বরং তোমরা সর্বদা আমার উপর সালাত ও সালাম পাঠিও। কারণ, তোমাদের সালাত ও সালাম
আমার নিকট অবশ্যই পৌঁছুবে। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২০৪২ আহমাদ
: ২/৩৬৭)
আউস্
বিন্ আউস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘সর্বোৎকৃষ্ট
দিন জুমার দিন। এ দিন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ দিনই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এ দিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে এবং এ দিনই সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব তোমরা এ দিন আমার
নিকট বেশি বেশি সালাত ও সালাম পাঠিও। কারণ, নিশ্চয়ই তোমাদের সালাত ও সালাম আমার নিকট
পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। সাহাবারা বললেন: কিভাবে আপনার নিকট আমাদের সালাত ও সালাম পৌঁছিয়ে
দেয়া হবে? অথচ আপনি তখন মাটি হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবেন। রাসূল (সা.) বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্
তা’আলা মাটির উপর নবীদের শরীর হারাম করে দিয়েছেন’’। (আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৭, ১৫৩১ ইবনু
হিববান/ইহসান, হাদীস ৯০৭ ইবনু খুযাইমাহ্, হাদীস ১৭৩৩)
এ
যদি হয় রাসূল (সা.) এর কবরের অবস্থা। যেখানে যিয়ারাতের উদ্দেশ্যে বার বার যাওয়ার অভ্যাস
করা যাবে না। যাতে করে তা মেলাক্ষেত্রে রূপান্তরিত না হয়ে যায়। তাহলে নিয়মিতভাবে প্রতি
বছর ওলী-বুযুর্গদের কবরের উপর উরস ও দো’আভোজ উদ্যাপন কিভাবে জায়িয হতে পারে? যা সরাসরি
মেলা হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই এবং যাতে ঈদের চাইতেও অনেক বেশি খুশি প্রকাশ করা হয়।
অতএব কোন্ যুক্তিতে উরস মাহফিল অভিমুখে মানতের গরু ছাগল নিয়ে মাযারভক্তদের শোভাযাত্রা
বড় শির্ক না হয়ে তা জায়িয বরং সাওয়াবের কাজ হতে পারে? অথচ রাসূল (সা.) তিনটি মসজিদ
ছাড়া অন্য কোথাও সাওয়াবের নিয়্যাতে ভ্রমণ করা হারাম করে দিয়েছেন।
আবু
সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তিনটি
মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও সাওয়াবের নিয়্যাতে সফর করা যাবে না। সে মসজিদগুলো হলোঃ হারাম
(মক্কা) শরীফ, মসজিদে আক্সা এবং মসজিদে নববী’’। (বুখারী, হাদীস ১১৯৭, ১৯৯৫ মুসলিম,
হাদীস ৮২৭ তিরমিযী, হাদীস ৩২৬)
বাস্রা
বিন্ আবী বাস্রা গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি আবু হুরাইরাহ্ (রা.) কে তূর পাহাড় থেকে
আসতে দেখে বললেন:
‘‘আমি
আপনাকে তূর পাহাড়ের দিকে যাওয়ার পূর্বে দেখতে পেলে অবশ্যই সে দিকে যেতে দিতাম না। কারণ,
আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি: সাওয়াবের নিয়্যাতে তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর
করা যাবে না। সে মসজিদগুলো হলো: মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা’’। (মালিক
: ১/১০৮-১০৯ আহমাদ : ৬/৭ ’হুমাইদী, হাদীস ৯৪৪)
মোটকথা,
ওলী-বুযুর্গদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা সমূহ ধ্বংসের মূল। সুতরাং যে কোন ধরণের বাড়াবাড়ি
ওদের ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।
নবী-ওলীদের
নিদর্শনসমূহ অনুসন্ধান করে তা নিয়ে ব্যস্ত হওয়াও তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির শামিল। সুতরাং
তাও শরীয়তের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।
নাফি’
(রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) এর মৃত্যুর পর রিদ্ওয়ান বৃক্ষের (যে গাছের নীচে রাসূল (সা.) সাহাবাদেরকে ষষ্ঠ
হিজরী সনে মক্কার কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধের বায়’আত করেন) নীচে এসে অনেকেই নামায পড়া শুরু
করলো। তা শুনে ’উমর (রা.) কঠোর ভাষায় উহার নিন্দা করলেন এবং উক্ত গাছটি কেটে ফেললেন’’।
(ইবনু আবী শাইবাহ্, হাদীস ৭৫৪৫ আল্-মুন্তাযিম ৩/২৭২)
মা’রুর
বিন্ সুওয়াইদ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা আমি ’উমর (রা.) এর সাথে
মক্কার পথে ফজরের নামায আদায় করলাম। অতঃপর তিনি দেখলেন অনেকেই এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: এরা কোথায় যাচ্ছে। উত্তরে বলা হলো: রাসূল (সা.) যেখানে নামায
পড়েছেন ওখানে নামায পড়ার জন্যে। তখন তিনি বললেন:
‘‘তোমাদের
পূর্বেকার লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। তারা নিজ নবীদের নিদর্শনসমূহ খুঁজে
বেড়াতো এবং উহার উপর গির্জা বা ইবাদাতখানা বানিয়ে নিতো। অতএব এ মসজিদগুলোতে থাকাবস্থায়
নামাযের সময় হলে তোমরা তাতে নামায পড়ে নিবে। নতুবা তা অতিক্রম করে যাবে। বিশেষ সাওয়াবের
নিয়্যাতে তাতে নামায পড়তে আসবে না’’। (ইবনু আবী শাইবাহ্ : ২/৩৭৬)
আবুল
’আলিয়াহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘যখন
আমরা তুস্তার্ জয় করলাম তখন আমরা হুর্মুযের খাজাঞ্চিখানায় একটি খাট পেলাম। তাতে একটি
মৃত মানুষ শায়িত এবং তার মাথার পার্শ্বে একখানা কেতাব রাখা আছে। আমরা কেতাবখানা ’উমর
(রা.) এর নিকট নিয়ে আসলে তিনি কা’ব (রা.) কে ডেকে তা আরবী করে নেন। আরবদের মধ্যে আমিই
সর্বপ্রথম তা পড়লাম। যেভাবে আমরা কোর’আন মাজীদ পড়ি সেভাবেই পড়লাম। বর্ণনাকারী বলেন:
আমি আবুল্ ’আলিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম: তাতে কি লেখা ছিলো? তিনি বললেন: তোমাদের জীবন যাপন,
কর্মকান্ড, কথার ধ্বনি ও ভবিষ্যতে যা ঘটবে সে সম্পর্কেই আলোচনা ছিলো। বর্ণনাকারী বললো:
সে মৃত লোকটাকে আপনারা কি করলেন? তিনি বললেন: আমরা দিনের বেলায় বিক্ষিপ্তভাবে তার জন্য
তেরোটি কবর খনন করলাম। রাত্র হলে আমরা তাকে কোন একটিতে দাফন করে কবরগুলো সমান করে দেই।
যাতে কেউ বুঝতে না পারে তাকে কোথায় দাফন করা হলো। যাতে তারা পুনরায় তাকে কবর থেকে উঠিয়ে
না ফেলতে পারে। বর্ণনাকারী বললো: তারা সে ব্যক্তি থেকে কি আশা করতো? তিনি বললেন: (তাদের
ধারণা) যখন তাদের এলাকায় কখনো অনাবৃষ্টি দেখা দিতো তখন তারা তাকে খাট সহ বাইরে নিয়ে
আসতো এবং তখনই বৃষ্টি হতো। বর্ণনাকারী বললো: আপনাদের ধারণা মতে সে কে হতে পারে? তিনি
বললেন: লোক মুখে শুনা যায়, তিনি ছিলেন দানিয়াল নবী। বর্ণনাকারী বললো: কতদিন থেকে আপনারা
তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেলেন? তিনি বললেন: তিন শত বছর থেকে। বর্ণনাকারী বললো: তাঁর
শরীরের কোন অংশের পরিবর্তন হয়নি কি? তিনি বললেন: না। তবে শুধু ঘাড়ের কয়েকটি চুলের সামান্যটুকু
পরিবর্তন দেখা গেলো। কারণ, মাটি নবীদের শরীর খেতে পারে না। (আল্ বিদায়া ওয়ান্ নিহায়াহ্
: ২/৪০ আম্ওয়াল্/আবু ’উবাইদ্ : ৮৭৭ ফুতূহুল্ বুল্দান্ : ৩৭১)
কোন
কবরকে পূজা করা হলে শরীয়তের পরিভাষায় তা মূর্তিপূজা হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণেই রাসূল
(সা.) তাঁর কবরকে ভবিষ্যতে কেউ যেন মূর্তি বানিয়ে না নেয় সে জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট
করুণ কন্ঠে ফরিয়াদ করেন।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী কারীম (সা.) আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ দো’আ
প্রার্থনা করেন:
‘‘হে
আল্লাহ্! আপনি আমার কবরকে মূর্তি বানাবেন না। ভবিষ্যতে যার পূজা করা হবে। আল্লাহ্ তা’আলার
লা’নত এমন সম্প্রদায়ের উপর যারা নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিলো’’। (আহমাদ : ২/২৪৬
আবু নু’আঈম্ : ৭/৩১৭)
বর্তমান
যুগের কবর পূজারী ও মাযারের খাদিমদের সাথে ইব্রাহীম ও মূসা (আলাইহিমাস্ সালাম) এর যুগের
মূর্তি পূজারীদের কতইনা সুন্দর মিল রয়েছে।
ইব্রাহীম
(আ.) তাঁর যুগের মূর্তি পূজারীদেরকে বললেন:
‘‘এ
মূর্তিগুলো কি যে ; তোমরা তাদের নিকট পূজার জন্য নিয়মিত অবস্থান করছো’’। (আম্বিয়া
: ৫২)
মূসা
(আ.) এর যুগের মূর্তি পূজারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আমি
বনী ইস্রাঈলকে সমুদ্র পার করে দিলে তাদের সঙ্গে মূর্তির নিকট নিয়মিত অবস্থানকারী এক
দল পূজারীর সাথে সাক্ষাৎ হয়’’। (আ’রাফ : ১৩৮)
কবর
পূজারীদের অনেকেরই ধারণা এই যে, যারা একবার আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর উপর
ঈমান এনেছে তাদের মধ্যে কখনো কোন শির্ক পাওয়া যেতে পারে না। মুশরিক শুধু রাসূল (সা.)
এর যুগেই ছিল। যারা তাঁর ইসলাম প্রচারে সর্বদা বাধা প্রদান করতো। অন্যদিকে যে ব্যক্তি
একবার আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর উপর ঈমান এনেছে সে কি করে মুশরিক হতে পারে?
তা কখনোই সম্ভব নয়।
তাদের
এ ধারণা সম্পূর্ণরূপেই ভুল প্রমাণিত। কারণ, রাসূল (সা.) হাদীসের মধ্যে এর সম্পূর্ণ
বিপরীত মত পোষণ করেছেন। শুধু এতটুকুতেই তিনি ক্ষান্ত হননি বরং তিনি এ উম্মতের মধ্যে
মূর্তি পূজাও যে চালু হবে তা সত্যিকারভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
সাউবান
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কিয়ামত
কায়েম হবেনা যতক্ষণনা আমার উম্মতের কয়েকটি গোত্র মুশরিকদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা এবং
মূর্তি পূজা শুরু করবে’’।
(আবু
দাউদ, হাদীস ৪২৫২ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪০২৩ বাগাওয়ী, হাদীস ৪০১৫)
শুধু
এতটুকুতেই ক্ষান্ত নয় বরং রাসূল (সা.) এর উম্মতরা ছোট-বড় প্রতিটি কাজে ইহুদী, খ্রিষ্টান
ও অগ্নিপূজকদের হুবহু অনুসারী হবে।
আবু
সাঈদ খুদ্রী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসারী হবে। হাত হাত বিঘত বিঘত তথা হুবহু অবিকলভাবে।
এমনকি তারা যদি কোন গুইসাপ গর্তে ঢুকে পড়ে তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকে পড়বে। আমরা (সাহাবাগণ)
বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল! তারা কি ইহুদী ও খ্রিষ্টান? তিনি বললেন: তারা নয় তো আর
কারা?’’
(বুখারী,
হাদীস ৩৪৫৬, ৭৩২০ মুসলিম, হাদীস ২৬৬৯ ত্বায়ালিসী, হাদীস ২১৭৮)
এরই
পাশাপাশি কোর’আন ও হাদীসে অপরিপক্ক কিছু আলিম সমাজ, রাজা-বাদশাহ, আমীর-উমারা বিপুল
সংখ্যক জনসাধারণকে পথভ্রষ্ট করার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তারা এতটুকুও আল্লাহ্ তা’আলাকে
ভয় পাচ্ছে না। এদেরই সম্পর্কে রাসূল (সা.) বহু পূর্বে সত্য ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
সাউবান
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আমি আমার উম্মতের ব্যাপারে পথভ্রষ্টকারী ইমাম বা নেতাদের ভয় পাচ্ছি। যারা প্রতিনিয়ত
জনসাধারণকে গোমরাহ্ করবে’’।
(আবু
দাউদ, হাদীস ৪২৫২ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪০২৩ বাগাওয়ী, হাদীস ৪০১৫)
এতদ্সত্ত্বেও
একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা ও সর্ববস্থায় সত্যের উপর অটল ও অবিচল থাকবে। কারোর অসহযোগিতা
বা অসহনশীলতা তাদের কোনরূপ ক্ষতি করতে পারবেনা।
সাউবান,
মু’আবিয়া ও মুগীরা বিন্ শো’বা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘সর্বদা
আমার একদল উম্মত সত্যবিজয়ী এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। কারোর অসহযোগিতা বা বিরোধিতা তাদের
কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিয়ামত আসা পর্যন্ত তারা এ অবস্থায়ই থাকবে’’।
(বুখারী,
হাদীস ৩৬৪০, ৩৬৪১ মুসলিম, হাদীস ১৯২০, ১৯২১, ১০৩৭ আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫২ ইবনু মাজাহ্,
হাদীস ৪০২৩ বাগাওয়ী, হাদীস ৪০১৫)
(১৮) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ঘর মসজিদ ছাড়াও অন্য
কোন মাজার বা কবরে অবস্থান তথা সেখানকার খাদিম হওয়া যায় এমন মনে করার শির্কঃ
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে সাওয়াবের নিয়্যাতে একমাত্র তাঁর ঘর মসজিদে অবস্থান তথা
ই’তিকাফ করার অনুমতি দিয়েছেন। অন্য কোথাও নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আমি
ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিমাস্ সালাম) থেকে এ বলে অঙ্গীকার নিয়েছি যে, তোমরা আমার ঘরকে
তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী এবং রুকু ও সিজ্দাহ্কারীদের জন্যে পবিত্র রাখো’’। (বাক্বারাহ্
: ১২৫)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমাদের
কারোর জন্য জ্বলন্ত কয়লার উপর বসা খুবই উত্তম কোন কবরের উপর বসার চাইতে। যদিও জ্বলন্ত
কয়লার উপর বসলে তার কাপড় জ্বলে শেষ পর্যন্ত তার শরীরের চামড়াও জ্বলে যাবে তবুও’’।
(মুসলিম, হাদীস ৯৭১)
কবরের
খাদিমরা সরাসরি কবরের উপর না বসে থাকলেও কবরের উপর বসার ন্যায়ই। কারণ, কবরের পাশেই
তাদের অবস্থান এবং কবরকে নিয়েই তাদের সকল ব্যস্থতা। সুতরাং উক্ত হাদীস তাদের ব্যাপারে
প্রযোজ্য হওয়া একেবারেই অবাঞ্ছিত নয়।
(১৯) আল্লাহ্ তা’আলা সর্ব
জায়গায় অথবা সকল মু’মিনের অন্তরে অথবা সকল বস্ত্তর মধ্যে লুক্কায়িত রয়েছেন এমন মনে
করার শির্কঃ
আল্লাহ্
তা’আলা সর্ব জায়গায় রয়েছেন অথবা সকল মু’মিনের অন্তরে অথবা সকল বস্ত্তর মধ্যে লুক্কায়িত
রয়েছেন বলে ধারণা করা এটাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা একের অধিক। আর এটিই হচ্ছে
আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদে অস্বীকৃতি তথা তাঁর একক সত্তায় শির্ক।
মূলতঃ
আল্লাহ্ তা’আলা (নিজ সত্তা নিয়ে) সব কিছুর উপরে বিশেষভাবে ’আরশে ’আজীমের উপর যেভাবে
থাকার ওভাবেই রয়েছেন। অন্য কোথাও নয়। তিনি ’আরশে ’আজীমের উপর থেকেই সর্বস্থানের সর্বকিছু
দেখেন, জানেন ও শুনেন।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
কি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত যে, আকাশের উপর যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমি ধ্বসিয়ে
দিবেননা? অতঃপর ভূমি আকস্মিকভাবে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা কি
এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত যে, আকাশের উপর যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর কঙ্করবর্ষী ঝড়-ঝঞ্ঝা
প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা অবশ্যই বুঝতে পারবে কেমন ছিলো আমার সতর্কবাণী’’। (মুলক
: ১৬-১৭)।
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘ফিরিশতা
ও জিব্রীল আল্লাহ্ তা’আলার দিকে ঊর্ধ্বগামী হবে’’।
(মা’আরিজ
: ৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তাঁর
দিকেই পবিত্র বাণীসমূহ আরোহণ করে’’। (ফাতির : ১০)
আল্লাহ্
তা’আলা ’ঈসা (আ.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আমি আপনাকে নিরাপদভাবে আমার দিকে উত্তোলন করবো’’। (আ’লু ’ইমরান : ৫৫)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
তোমাদের প্রভু আল্লাহ্ তা’আলা। যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর
তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর অবস্থান করেন’’। (আ’রাফ : ৫৪ ইউনুস : ৩)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনিই
আল্লাহ্ যিনি আকাশমন্ডলীকে স্থাপন করেছেন স্তম্ভ বিহীন। যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো। অতঃপর
তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর অবস্থান করেন’’। (রা’দ : ২)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘দয়াময়
প্রভু ’আরশে ’আজীমের উপর অবস্থান করেন’’। (ত্বা-হা)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘যিনি
(আল্লাহ্) আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর
তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর অবস্থান করেন। তিনি দয়াময়। অতএব তাঁর সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তিকেই
জিজ্ঞাসা করে দেখো’’। (ফুরকান : ৫৯)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনিই
আল্লাহ্ যিনি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।
অতঃপর তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর অবস্থান করেন’’। (সাজ্দাহ্ : ৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনিই
(আল্লাহ্) আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর
অবস্থান করেন’’। (’হাদীদ : ৪)
এ
’আরশে ’আজীম থেকে নেমেই আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে
এসে সকল মানুষকে তাঁর নিকট প্রার্থনা করার জন্য আহবান করে থাকেন। তবে এমন নয় যে, তিনি
প্রথম আকাশে নেমে আসলে তিনি ’আরশের নীচে চলে আসেন। তখন তিনি ’আরশের উপর থাকেননা। বরং
তিনি কিভাবে নিম্নাকাশে আসেন তা তিনিই ভালো জানেন। আমাদের তা জানা নেই।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে এসে বলতে থাকেন: তোমরা কে আছো আমাকে
ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। তোমরা কে আছো আমার কাছে কিছু চাবে আমি তাকে তা দান করবো।
তোমরা কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো’’।
(বুখারী,
হাদীস ১১৪৫ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮ আবু দাউদ, হাদীস ১৩১৫ তির্মিযী, হাদীস ৩৪৯৮ মালিক, হাদীস
৩০)
মু’আবিয়া
বিন্ ’হাকাম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমার
একটি দাসী ছিলো। উহুদ ও জাওয়ানিয়া এলাকাদ্বয়ের আশপাশে ছাগল চরাতো। একদা আমি দেখতে পেলাম,
ছাগলপালের একটি ছাগল নেই। নেকড়ে তা খেয়ে ফেলেছে। আর আমি একজন মানুষ। কোন কিছু বিনষ্ট
হলে অন্যের ন্যায় আমিও ব্যথিত হই। তাই আমি দাসীর উপর রাগান্বিত হয়ে তাকে একটি থাপ্পড়
মেরে দিলাম। অতঃপর তা রাসূল (সা.) এর নিকট বর্ণনা করলে তিনি ব্যাপারটিকে মারাত্মক ভাবলেন।
আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমি কি ওকে স্বাধীন করে দেবো? তিনি বললেন: ওকে আমার
নিকট নিয়ে এসো। অতঃপর আমি ওকে তাঁর নিকট নিয়ে আসলাম। তিনি ওকে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা
কোথায়? সে বললো: আকাশে। তিনি বললেন: আমি কে? সে বললো: আপনি আল্লাহ্’র রাসূল। রাসূল
(সা.) বললেন: ওকে স্বাধীন করে দাও। কারণ, সে ঈমানদার’’। (মুসলিম, হাদীস ৫৩৭)
রাসূল
(সা.) দাসীটিকে আল্লাহ্ তা’আলা কোথায় আছেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি আকাশে আছেন বলার পর
তাকে ঈমানদার বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অতএব আমাদের ভাবা দরকার। আমরাও কি সে বিশ্বাসে
বিশ্বাসী। আমারা রাসূল (সা.) এর পক্ষ থেকে ঈমানের সার্টিফিকেট পাচ্ছি কি না।
রাসূল
(সা.) আরো বলেন:
‘‘তোমরা
কি আমাকে বিশ্বাস করোনা? অথচ আকাশে যিনি আছেন তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন’’। (বুখারী,
হাদীস ৪৩৫১ মুসলিম, হাদীস ১০৬৪)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘ও
সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে (সহবাসের জন্য) বিছানার দিকে
ডাকলে সে যদি তার ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে যে সত্তা আকাশে আছেন তিনি ওর উপর অসন্তুষ্ট
হন যতক্ষণনা তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট হয়’’। (মুসলিম, হাদীস ১৪৩৬)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমারা
বিশ্ববাসীর উপর দয়া করো তাহলে আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর দয়া করবেন’’। (তিরমিযী,
হাদীস ১৯২৪)
যায়নাব
বিন্ত জাহশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) রাসূল (সা.) এর অন্যন্য স্ত্রীদের উপর গর্ব করে বলতেন:
‘‘তোমাদেরকে
তোমাদের পরিবারবর্গ বিবাহ্ দিয়েছে। আর আমাকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা সপ্তাকাশের উপর থেকে
বিবাহ্ দিয়েছেন’’। (বুখারী, হাদীস ৭৪২০ তিরমিযী, হাদীস ৩২১৩)
মি’রাজের
হাদীস তো সবারই জানা। এ ছাড়া কয়েক ডজন হাদীসও একই বক্তব্য উপস্থাপন করছে। এমনকি সাহাবায়ে
কিরাম এবং তাবিয়ীনদেরও এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে।
পরবর্তী
আলিমদের মধ্য থেকে ইমাম আবু হানীফা, ইবনু জুরাইজ, আওযায়ী, মুক্বাতিল, সুফ্ইয়ান সাওরী,
ইমাম মালিক, লাইস্ বিন্ সা’দ, সালাম বিন্ আবী মুত্বী’, হাম্মাদ বিন্ সালামাহ্, আব্দুল
আযীয বিন্ আল-মা’জিশূন, হাম্মাদ বিন্ যায়েদ, ইবনু আবী লাইলা, জা’ফর সাদিক, সালাম বসরী,
ক্বাযী শরীক, মুহাম্মাদ বিন্ ইস্’হাক্ব, মিস্’আর বিন্ কিদাম, জারীর আয-যাববী, আব্দুল্লাহ্
বিন্ আল-মুবারাক, ফুযাইল বিন্ ’ইয়ায, হুশাইম বিন্ বাশীর, নূহ্ আল-জা’মি’, আববাদ বিন্
আল-’আওয়াম, ক্বাযী আবু ইউসুফ, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ইদ্রীস, মুহাম্মাদ বিন্ হাসান, বুকাইর
বিন্ জা’ফর, বিশর বিন্ ’উমর, ইয়া’হয়া আল-ক্বাত্ত্বান, মানসূর বিন্ ’আম্মার, আবু নু’আইম
আল-বালখী, আবু মু’আয আল-বালখী, সুফ্ইয়ান বিন্ ’উয়াইনাহ্, আবু বকর বিন্ ’আইয়াশ, ’আলী
বিন্ ’আসিম, ইয়াযীদ বিন্ হা’রূন, সা’য়ীদ বিন্ ’আ’মির আয-যাবা’য়ী, ওয়াকী’ বিন্ আল-জাররাহ্,
’আব্দুর রহ্মান বিন্ মাহ্দী, ওয়াহাব বিন্ জারীর, আসমা’য়ী, খালীল বিন্ আহমাদ, ফাররা’,
খুরাইবী, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ আবী জা’ফর আর-রাযী, নাযার বিন্ মু’হাম্মাদ আল-মারওয়াযী,
ইমাম শাফি’য়ী, ক্বা’নাবী, ’আফফান, ’আ’সিম বিন্ ’আলী, ’হুমাইদী, ইয়াহয়া বিন্ ইয়াহয়া
নীসাবূরী, হিশাম বিন্ ’উবাইদুল্লাহ্ আর-রাযী, ’আব্দুল মালিক বিন্ আল-মা’জিশূন, মু’হাম্মাদ
বিন্ মুস’আব আল-’আ’বিদ, সুনাইদ বিন্ দাঊদ আল-মিসসীসী, নু’আইম বিন্ ’হাম্মাদ আল-খুযা’য়ী,
বিশর আল-’হাফী, আবু ’উবাইদ আল-ক্বা’সিম বিন্ সাল্লা’ম, আহমাদ বিন্ নাস্র আল-খুযা’য়ী,
মাক্কী বিন্ ইব্রা’হীম, ক্বুতাইবাহ্ বিন্ সা’ঈদ, আবু মু’আম্মার আল-ক্বাত্বী’য়ী, ইয়াহ্য়া
বিন্ মু’ঈন, ’আলী বিন্ আল-মাদীনী, ইমাম আহমাদ বিন্ ’হাম্বাল, ইস্’হাক্ব বিন্ রা’হূয়াহ্,
আবু ’আব্দিল্লাহ্ ইবনুল আ’রাবী, আবু জা’ফর আন-নুফাইলী, ’ঈশী, হিশা’ম বিন্ ’আম্মার,
যুন্নূন আল-মাস্রী, আবু সাউর, মুযানী, যুহলী, ইমাম বুখারী, আবু যুর’আহ্ আর-রাযী, আবু
হা’তিম আর-রাযী, ইয়াহয়া বিন্ মু’আয আর-রাযী, আহমাদ বিন্ সিনান, মুহাম্মাদ বিন্ আস্লাম
ত্বূসী, আব্দুল ওয়াহহাব আল-ওয়াররাক্ব, ’হারব আল-কিরমানী, ’উসমান বিন্ সা’ঈদ আদ-দা’রামী,
আবু মুহাম্মাদ আদ-দা’রামী, আহমাদ বিন্ ফুরা’ত আর-রাযী, আবু ইস্হাক্ব আল-জূযেজানী, ইমাম
মুসলিম, ক্বাযী সা’লিহ্ বিন্ ইমাম আহমাদ, হা’ফিয আবু আব্দুর রহমান বিন্ ইমাম আহমাদ,
হাম্বাল বিন্ ইসহাক্ব, আবু উমাইয়াহ্ আত্ব-ত্বারসূসী, বাক্বী বিন্ মিখলাদ, ক্বাযী ইসমা’ঈল,
হা’ফিয ইয়া’ক্বূব আল-ফাসাওয়ী, হা’ফিয ইবনু আবী খাইসামাহ্, আবু যুর’আ আদ-দামেশক্বী,
ইবনু নাসার আল-মারওয়াযী, ইবনু ক্বুতাইবাহ্, ইবনু আবী ’আসিম, আবু ’ঈসা আত-তিরমিযী, ইবনু
মা’জাহ্, ইবনু আবী শাইবাহ্, সাহল আত-তুস্তারী, আবু মুসলিম আল-কাজ্জী, যাকারিয়া’ আস-সা’জী,
মুহাম্মাদ বিন্ জারীর, বূশানজী, ইবনু খুযাইমাহ্, ইবনু সুরাইজ, আবু বকর বিন্ আবী দাউদ,
’আমর বিন্ ’উস্মান আল-মাক্কী, সা’লাব, আবু জা’ফর আত-তিরমিযী, আবুল ’আব্বাস আস-সিরা’জ,
হা’ফিয আবু ’আওয়ানাহ্, ইবনু সা’ইদ, ইমাম ত্বা’হাবী, নিফত্বাওয়াইহ্, আবুল ’হাসান আল-আশ’আরী,
’আলী বিন্ ’ঈসা আশ-শিবলী, আবু আহমাদ আল-’আসসাল, আবু বকর আয্যাবা’য়ী, আবুল ক্বাসিম আত্ব-ত্বাবারানী,
ইমাম আবু বকর আল-আ’জুর্রী, হা’ফিয আবুশ্ শাইখ, আবু বকর আল-ইসমা’ঈলী, আযহারী, আবু বকর
বিন্ শা’যা’ন, আবুল ’হাসান বিন্ মাহদী, ইবনু সুফ্ইয়ান, ইবনু বাত্বত্বাহ্, আদ-দারাক্বুত্বনী,
ইবনু মান্দাহ্, ইবনু আবী যায়েদ, খাত্বত্বাবী, ইবনু ফূরাক, ইবনুল বা’ক্বিল্লানী, আবু
আহমাদ আল-ক্বাসসাব, আবু নু’আইম আল-আস্বাহানী, মু’আম্মার বিন্ যিয়া’দ, আবুল-ক্বা’সিম
আল-লা’লাকা’য়ী, ইয়াহয়া বিন্ ’আম্মার, আল-ক্বা’দির বিল্লাহ্, আবু ’উমর আত্বত্বালমান্কী,
আবু ’উস্মান আস-সা’বূনী, মুফ্তী সুলাইম, আবু নাসর আস্সিজ্যী, আবু ’আম্র আদ-দা’নী, ইবনু
আব্দিল বার, ক্বাযী আবু ইয়া’লা, বায়হাক্বী, আবু বকর আল-খাত্বীব, মুফতী নাসর আল-মাক্বদিসী,
ইমামুল ’হারামাইন আল-জুওয়াইনী, সা’দ আয-যানজানী, শাইখুল ইসলাম আব্দুল্লাহ্ আল-আন্সারী,
ইমাম আল-ক্বায়রাওয়ানী, ইবনু আবী কিদ্য়াহ্ আত-তাইমী, ইমাম আল-বাগাওয়ী, আবুল ’হাসান আল-কারজী,
আবুল ক্বাসিম আত-তাইমী, ইবনু মাউহিব, আবু বকর ইবনুল-’আরাবী, আব্দুল্ ক্বাদির আল-জীলি,
শাইখ আবুল বায়ান, ইমাম ক্বুরত্বুবী এবং আরো অন্যান্যরাও এ মত পোষণ করেন।
মানুষের
বিবেকও উক্ত মত সমর্থন করে। কারণ, এ কথা সবারই জানা যে, আল্লাহ্ তা’আলা কোন কিছু সৃষ্টি
করার পূর্বে তিনি একাই ছিলেন। তখন আর কোন কিছুই ছিলোনা। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা সব কিছুই
সৃষ্টি করলেন। এখন আমরা বলবোঃ আল্লাহ্ তা’আলা কি সকল বস্ত্ত নিজ সত্তার ভিতরেই তৈরি
করেছেন। না বাইরে। প্রথম কথা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ, তখন বলতে হবে: আল্লাহ্ তা’আলার
ভিতরেই মানুষ, জিন ও শয়তান রয়েছে। এ ধারণা কুফরি বৈ কি? তাহলে এ কথাই প্রমাণিত হলো
যে, আল্লাহ্ তা’আলা সকল কিছু নিজ সত্তার বাইরেই তৈরি করেছেন। তখন আরেকটি প্রশ্ন জাগে
এই যে, তিনি সব কিছু তৈরি করে তাতে পুনরায় ঢুকেছেন না ঢুকেননি? প্রথম কথা একেবারেই
ঠিক নয়। কারণ, তখন বলতে হবে: আল্লাহ্ তা’আলা ময়লাস্থানেও রয়েছেন। আর তা আল্লাহ্ তা’আলার
শানে বেয়াদবি তথা কুফরি বৈ কি? তাহলে আমরা এখন এ কথায় নিশ্চিত হতে পারি যে, আল্লাহ্
তা’আলা সব কিছু সৃষ্টি করে তিনি সব কিছুর উপরেই রয়েছেন।
(২০) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন নবী-ওলী
অথবা অন্য কোন পীর-বুযুর্গ সব কিছু শুনতে বা দেখতে পান এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই সব কিছু দেখতে বা শুনতে পান। তা যতই ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম হোকনা কেন
এবং যতই তা অদৃশ্য বা অস্পষ্ট হোক না কেন।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘হে
রাসূল (সা.)! তুমি যে কোন অবস্থায়ই থাকোনা কেন অথবা কোর’আন মাজীদের যে কোন আয়াতই পড়োনা
কেন এমনকি তোমরা (নবী ও তাঁর সকল উম্মত) কোন্ কাজ কোন্ সময় করো তা সবই আমি জানি। আকাশ
ও পৃথিবীতে একটি ছোট লাল পিপীলিকা (অণু) সমপরিমাণ অথবা তার থেকেও ক্ষুদ্র বা বড় যে
পরিমাপেরই হোক না কেন কোন বস্ত্তই তোমার প্রভুর অগোচরে নয়। বরং তা সুস্পষ্ট কিতাব তথা
লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (ইউনুস : ৬১)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘কাফিররা
বলে: আমাদের উপর কিয়ামত আসবে না। হে নবী! আপনি ওদেরকে বলে দিন: আমার প্রভুর কসম খেয়ে
বলছি: কিয়ামত অবশ্যই আসবে। তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত। আকাশ ও পৃথিবীতে একটি
ছোট পিপীলিকা সমপরিমাণ অথবা তার থেকেও ক্ষুদ্র বা বড় যে পরিমাপেরই হোকনা কেন কোন বস্ত্তই
তাঁর অগোচরে নয়। বরং তা সুস্পষ্ট কিতাব তথা লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (সাবা
: ৩)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আকাশ ও পৃথিবীর কোন বস্ত্তই লুক্কায়িত নয়’’। (আ’লে-ইমরান : ৫)।
তিনি
আরো বলেন:
’’নিশ্চয়ই
তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল বিষয়ই জানেন’’। (আ’লা : ৭)
আবু
মূসা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমরা
একদা নবী (সা.) এর সাথে সফরে ছিলাম। পথিমধ্যে কিছু লোক উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পড়ছিলো।
তখন রাসূল (সা.) তাদেরকে বললেন: হে মানুষরা! নিজের উপর দয়া করো। নিম্নস্বরে তাকবীর
বলো। কারণ, তোমরা এমন কাউকে ডাকছোনা যে বধির ও অনুপস্থিত তথা তোমাদের থেকে অনেক দূরে।
বরং তোমরা ডাকছো এমন এক সত্তাকে যিনি তোমাদের নিকটেই এবং তিনি সব কিছুই শুনতে পাচ্ছেন।
তিনি তোমাদের সাথেই রয়েছেন’’। (বুখারী, হাদীস ২৯৯২, ৪২০২ মুসলিম, হাদীস ২৭০৪)
অনেক
কোর’আন ও হাদীসে অপরিপক্ক ব্যক্তি উক্ত হাদীস শুনে খুব খুশি হয়ে থাকবেন। কারণ, তাদের
ধারণা, আল্লাহ্ তা’আলা নিজ সত্তা সহ সর্বস্থানেই রয়েছেন। মূলতঃ তাদের এতে খুশি হওয়ার
কোন কারণ নেই। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা এ সকল মূর্খদের সম্পর্কে সর্বদা অবগত রয়েছেন বলে
তিনি বহু পূর্বেই কারোর সাথে তাঁর থাকার সত্যিকারার্থ নিজ কোর’আন মাজীদের মধ্যে সুন্দরভাবে
বাতলিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ্
তা’আলা মূসা ও হারূন (আলাইহিমাস্ সালাম) সম্পর্কে বলেন:
‘‘তিনি
(আল্লাহ্ তা’আলা) বলেন: তোমরা ভয় পেয়োনা। আমিতো তোমাদের সঙ্গেই আছি। আমি তোমাদের সকল
কথা শুনছি ও তোমাদের সকল কাজ অবলোকন করছি’’। (ত্বা-হা : ৪৬)
(২১) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন গাওস,
ক্বুতুব, ওয়াতাদ, আব্দালের এ বিশ্ব পরিচালনায় অথবা উহার কোন কর্মকান্ডে হাত আছে এমন
মনে করার শির্কঃ
যেমন:
বৃষ্টি দেয়া, তুফান বন্ধ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বস্ত্ততঃ
দুনিয়ার সকল বিষয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার হাতেই ন্যস্ত। অন্য
কারোর হাতে নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘তিনিই
আল্লাহ্ যিনি আকাশমন্ডলীকে স্থাপন করেছেন স্তম্ভ বিহীন। যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো। অতঃপর
তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর সমাসীন হন এবং তিনিই চন্দ্র ও সূর্যকে নিয়মানুবর্তী করেন।
ওদের প্রত্যেকেই নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত (নিজ কক্ষপথে) আবর্তন করবে। তিনিই দুনিয়ার সকল
বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন। যাতে তোমরা পরকালে নিজ
প্রভুর সাথে সাক্ষাতে নিশ্চিত হতে পারো’’। (রা’দ : ২)
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
তোমাদের প্রভু আল্লাহ্ তা’আলা। যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর
তিনি নিজ ’আরশে ’আজীমের উপর সমাসীন হন এবং তিনিই দুনিয়ার সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন’’।
(ইউনুস : ৩)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘হে
নবী! আপনি মক্কার কাফিরদেরকে বলুন: তিনি কে? যিনি আকাশ ও জমিন হতে তোমাদেরকে রিযিক
দিয়ে থাকেন। তিনি কে? যিনি কর্ণ ও চক্ষুসমূহের মালিক। তিনি কে? যিনি প্রাণীকে প্রাণহীন
থেকে এবং প্রাণহীনকে প্রাণী থেকে বের করেন। আর তিনি কে? যিনি দুনিয়ার সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ
করেন। তখন তারা অবশ্যই বলবে: তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্ তা’আলা। সুতরাং আপনি তাদেরকে বলুন:
তারপরও তোমরা কেন তাঁকে ভয় পাচ্ছোনা এবং শির্ক থেকে নিবৃত্ত হচ্ছোনা?’’ (ইউনুস : ৩১)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনিই
(আল্লাহ্ তা’আলা) আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত সকল বিষয় পরিচালনা করেন। অতঃপর একদিন সব
কিছুই তাঁর সমীপে সমুত্থিত হবে। যে দিন হবে তোমাদের দুনিয়ার হিসেবে হাজার বছরের সমান’’।
(সাজদাহ্ : ৫)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা বলেন’’ মানুষ আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যুগকে গালি দেয়। অথচ আমিই যুগ নিয়ন্ত্রক।
সকল বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতেই। আমার আদেশেই রাত-দিন সংঘটিত হয়’’।
(বুখারী,
হাদীস ৪৮২৬, ৬১৮১, ৭৪৯১ মুসলিম, হাদীস ২২৪৬ আবু দাউদ, হাদীস ৫২৭৪ আহমাদ : ২/২৩৮ ’হুমাইদী,
হাদীস ১০৯৬ বায়হাক্বী : ৩/৩৬৫ ইবনু হিব্বান/ইহসান, হাদীস ৫৬৮৫ হা’কিম : ২/৪৫৩)
(২২) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন ব্যক্তি
বা দল কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য জীবন বিধান রচনা করতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই মানব জাতির সার্বিক জীবন ব্যবস্থা রচনা করার অধিকার রাখেন। এ কাজের
যোগ্য তিনি ভিন্ন অন্য কেউ নয়।
আমাদের
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ও সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায় কারোর জন্য কোন জীবন বিধান রচনা করে
যাননি। বরং তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যাই বলেছেন তা ওহীর মাধ্যমেই বলেছেন। স্বাধীনভাবে তিনি
কিছুই বলে যাননি।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তিনি
(রাসূল (সা.)) মনগড়া কোন কথা বলেননা। বরং তিনি যাই বলেন তা ওহীর মাধ্যমেই বলেন। যা
তাঁর নিকট প্রেরিত হয়’’। (নাজম : ৩-৪)
আল্লাহ্
তা’আলা বিধান রচনার কর্তৃত্ব কার সে সম্পর্কে বলেন:
‘‘বিধান
দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা শুধুমাত্র
তাঁরই ইবাদাত করবে। আর কারোর নয়। এটিই হলো সরল ও সঠিক ধর্মমত। এরপরও অধিকাংশ মানুষ
এ ব্যাপারে কিছুই অবগত নয়’’। (ইউসুফ : ৪০)
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাঁরই প্রেরিত রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘হে
নবী! আল্লাহ্ তা’আলা আপনার জন্য যা হালাল করেছেন আপনি কেন তা নিজের জন্য হারাম করতে
যাচ্ছেন। আপনি নিজ স্ত্রীদের সন্তুষ্টি কামনা করছেন। তবে আল্লাহ্ তা’আলা পরম ক্ষমাশীল
ও অত্যন্ত দয়ালু’’। (তাহরীম : ১)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমাদের প্রিয় নবী (সা.) জিব্রীল (আ.) কে
একদা বললেন:
‘‘হে
জিবরীল! তোমার অসুবিধে কোথায়? তুমি কেন বেশি বেশি আমার সাথে সাক্ষাৎ করছো না? তখনই
উক্ত আয়াত নাযিল হয় যার অর্থ: আমি আপনার প্রভুর আদেশ ছাড়া আপনার নিকট কোনভাবেই আসতে
পারিনা। আমাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ এবং এ দু’ এর অন্তর্বর্তী যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহ্’র।
আপনার প্রভু কখনো ভুলবার নন। বর্ণনাকারী বলেন: এ হচ্ছে জিব্রীল (আ.) এর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ
(সা.) কে দেয়া উত্তর’’।
[মারইয়াম
: ৬৪ (বুখারী, হাদীস ৩২১৮, ৪৭৩১, ৭৪৫৫]
যখন
জিবরীল (আ.) অথবা মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি ছাড়া বিধান রচনা করার কোন
অধিকার রাখেন না তখন অন্য কেউ বিধান রচনা করার ধৃষ্টতা দেখানো ভ্রষ্টতা বৈ কি?
(২৩) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কেউ কাউকে
ধনী বা গরিব বানাতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই বিশ্বের সকল কিছুর মালিক। অতএব তিনি ইচ্ছা করলেই কেউ ধনী বা গরিব হতে
পারে। অন্য কারোর ইচ্ছায় কেউ ধনী বা গরিব হয় না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আকাশে
ও জমিনে যা কিছুই রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই’’। (বাক্বারাহ্ : ২৮৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তিনিই
আল্লাহ্, যিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য মা’বূদ নেই। তিনিই সব কিছুর মালিক এবং তিনিই পবিত্র’’।
(হাশর : ২৩)
আল্লাহ্
তা’আলা যাকে ইচ্ছা ধনী বানান। আর যাকে ইচ্ছা গরিব বানান। এতে তিনি ভিন্ন অন্য কারোর
সামান্যটুকুও হাত নেই।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা যার জন্য ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং তেমনিভাবে সংকুচিতও’’।
(রা’দ : ২৬)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আপনার প্রভু যার জন্য ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং তেমনিভাবে সংকুচিতও’’।
(ইস্রা’/বানী ইস্রাঈল : ৩০)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘(হে
নবী) আপনি বলে দিন: নিশ্চয়ই আমার প্রভু যার জন্য ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন
এবং তেমনিভাবে সংকুচিতও। তবুও অধিকাংশ লোক এ সম্পর্কে অবগত নয়’’। (সাবা : ৩৬)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘তোমরা
নিজ সন্তানদেরকে দরিদ্রতার ভয়ে হত্যা করোনা। একমাত্র আমিই ওদেরকে এবং তোমাদেরকে রিযিক
দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই ওদেরকে হত্যা করা মহাপাপ’’। (ইস্রা’/বানী ইস্রাঈল : ৩১)
আবু
যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘(আল্লাহ্
তা’আলা নিজ বান্দাহদেরকে বলেন) হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই ক্ষুধার্ত। শুধু সেই
আহারকারী যাকে আমি আহার দেবো। অতএব তোমরা আমার নিকট আহার চাও। আমি তোমাদেরকে আহার দেবো।
হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই বিবস্ত্র। শুধু সেই আবৃত যাকে আমি আবরণ দেবো। অতএব
তোমরা আমার নিকট আবরণ চাও। আমি তোমাদেরকে আবরণ দেবো’’। (মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭)
যতই
দান করা হোক তাতে আল্লাহ্ তা’আলার ধন ভান্ডার এতটুকুও খালি হবে না। এর বিপরীতে মানুষ
যতই দান করবে ততই তার ধন ভান্ডার খালি হতে থাকবে।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা বলেনঃ (হে বান্দাহ্!) তুমি অন্যের উপর ব্যয় করো। আমি তোমার উপর ব্যয় করবো। রাসূল
(সা.) বলেন: আল্লাহ্’র হাত সর্বদা ভর্তি। প্রচুর ব্যয়েও তা খালি হয়ে যায়না। তিনি রাত
ও দিন সকলকে দিচ্ছেন আর দিচ্ছেন। তাঁর দানে কোন বিরতি নেই। রাসূল (সা.) আরো বলেন: তোমরা
কি দেখছোনা যে, আল্লাহ্ তা’আলা আকাশ ও জমিন সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শুধু দিচ্ছেন
আর দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর হাতে যা রয়েছে তা কখনোই শেষ হচ্ছে না’’। (বুখারী, হাদীস ৪৬৮৪,
৭৪১১ মুসলিম, হাদীস ৯৯৩)
আল্লাহ্’র
রাসূল বা অন্য কোন পীর-বুযুর্গ কাউকে ধনী বা গরীব করতে পারেন না।
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি ওদেরকে বলে দিনঃ আমি তোমাদেরকে এ কথা বলছিনা যে, আমার নিকট আল্লাহ্’র ধন
ভান্ডার রয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে আমি ধনী বানিয়ে দেবো। আর এমনো বলছিনা যে, আমি গায়েব
জানি তথা অদৃশ্য জগতের কোন খবর রাখি’’। (আন’আম : ৫০)
(২৪) কিয়ামতের দিন কোন নবী-ওলী অথবা কোন পীর-বুযুর্গ
কাউকে আল্লাহ্ তা’আলার কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে এমন মনে করার শির্কঃ
কিয়ামতের
দিন আল্লাহ্ তা’আলা যাকে চান শাস্তি দিবেন। কোন নবী বা ওলী তাকে আল্লাহ্ তা’আলার হাত
থেকে কোনভাবেই রক্ষা করতে পারবে না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা কাফিরদের জন্য নূহ্ (আ.) ও লূত্ (আ.) এর স্ত্রীদ্বয়ের দৃষ্টান্ত পেশ করেন। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: তারা ছিলো আমার বান্দাহদের দু’ নেককার বান্দাহ্’র অধীন। কিন্তু তারা তাদের
স্বামীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে নূহ্ (আ.) ও লূত্ (আ.) তাদেরকে আল্লাহ্’র শাস্তি
থেকে কোনভাবেই রক্ষা করতে পারলোনা। বরং তাদেরকে বলা হলো: জাহান্নামে প্রবেশকারীদের
সাথে তোমরাও তাতে প্রবেশ করো’’। (তাহরীম : ১০)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘যখন
আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোক্ত কোর’আনের আয়াত নাযিল করেন যার অর্থ: আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে
(আখিরাতের ব্যাপারে) সতর্ক করে দিন। তখন রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে বললেন: হে ক্বুরাইশ্ বংশ!
তোমরা নিজেদেরকে বাঁচাও। আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। হে আব্দে মুনাফের সন্তানরা!
আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। হে ’আব্বাস বিন্ ’আব্দুল মুত্তালিব! আমি আপনার
জন্য কিছুই করতে পারবোনা। হে সাফিয়্যাহ্! (রাসূল (সা.) এর ফুফু) আমি আপনার জন্য কিছুই
করতে পারবোনা। হে ফাতিমাহ্! (রাসূল (সা.) এর ছোট মেয়ে) তুমি আমার সম্পদ থেকে যা চাও
চাইতে পারো। কিন্তু আমি আখিরাতে তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না’’। [শু’আরা : ২১৪
(বুখারী, হাদীস ২৭৫৩, ৪৭৭১ মুসলিম, হাদীস ২০৬]
এমনকি
আল্লাহ্ তা’আলার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা’আলার সর্বপ্রিয় বান্দাহ্ হওয়া সত্ত্বেও
তাঁর সঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা পরকালে কি ব্যবহার করবেন তা নিয়ে তিনি সর্বদা শঙ্কিত ছিলেন।
উম্মুল্
’আলা’ আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘মুহাজিরদেরকে
লটারির মাধ্যমে বন্টন করা হয়েছিলো। আর আমাদের বন্টনে এসেছিলো ’উসমান বিন্ মায্’ঊন
(রা.)। অতএব আমরা তাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসলাম। একদা তার এমন ব্যথা শুরু হলো যে, তাতেই
তার মৃত্যু হয়ে গেলো। মৃত্যুর পর তাকে গোসল ও কাফন দেয়া হলে রাসূল (সা.) আমাদের ঘরে
আসলেন। তখন আমি মৃতকে উদ্দেশ্য করে বললাম: হে আবুস্ সা-য়িব! তোমার উপর আল্লাহ্’র রহমত
বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাকে সম্মানিত করেছেন।
তখন রাসূল (সা.) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তোমাকে কে জানালো যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে
নিশ্চিতভাবে সম্মানিত করেছেন। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল (সা.)! আমার পিতা আপনার
উপর কুরবান হোক! আল্লাহ্ তা’আলা একে সম্মানিত না করলে তিনি আর কাকে সম্মানিত করবেন?
রাসূল (সা.) বললেন: এর মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্’র কসম! আমি নিশ্চয়ই তার কল্যাণই
কামনা করবো। তুমি জেনে রেখো, আমি আল্লাহ্ তা’আলার কসম খেয়ে বলছি: আমি জানিনা অথচ আমি
আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত রাসূল আমি ও তোমাদের সঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন কেমন
আচরণ করবেন। বর্ণনাকারী উম্মুল্ ’আলা’ আন্সারী বললেন: তখনই আমি পণ করলাম যে, আল্লাহ্’র
কসম! এরপর আমি কখনো কারো সম্পর্কে সাফাই গাইবোনা’’। (বুখারী, হাদীস ১২৪৩, ২৬৮৭, ৭০০৩,
৭০১৮)
(২৫) কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কোন
নবী বা ওলী তাঁর হাত থেকে কাউকে ক্ষমা করিয়ে নিতে পারবে এমন মনে করার শির্কঃ
কোন
ব্যক্তি সে আল্লাহ্ তা’আলার যতই নিকটতম বান্দাহ্ হোক না কেন আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত
ইচ্ছা ছাড়া কাউকে তাঁর হাত থেকে ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে না।
আল্লাহ্
তা’আলা রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন বা নাই করুন উভয়ই সমান। আপনি যদি তাদের
জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবুও আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।
তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূলের সাথে কুফরি করেছে। আর আল্লাহ্ তা’আলা
এরূপ অবাধ্য লোকদেরকে কখনো সঠিক পথ দেখান না’’। (তাওবাহ্ : ৮০)
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই বান্দাহ্’র সকল অপরাধ ক্ষমাকারী। তিনি ইচ্ছে করলেই কেউ ক্ষমা পেতে
পারে। অতএব একান্তভাবে তাঁর নিকটই ক্ষমা চাইতে হবে। অন্য কারোর কাছে নয়।
আবু
যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘(আল্লাহ্
তা’আলা নিজ বান্দাহ্দেরকে বলেন) হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা সবাই রাতদিন গুনাহ্ করছো।
আর আমিই সকল গুনাহ্ ক্ষমাকারী। অতএব তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা
করে দেবো’’। (মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭)
(২৬) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন নবী-ওলী
অথবা অন্য কোন পীর-বুযুর্গ গায়েব জানেন এমন মনে করার শির্কঃ
গায়েব
বলতে মানব জাতির বাহ্য বা অবাহ্যেন্দ্রিয়ের আড়ালের কোন বস্ত্তকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ
যা কোন ধরনের মানবেন্দ্রিয় বা মানব তৈরী প্রযুক্তি কর্তৃক উপলব্ধ বা জ্ঞাত হওয়া সম্ভবপর
নয় তাই গায়েব।
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই গায়েব জানেন। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ এতটুকুও গায়েব জানে না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘(হে
নবী) আপনি বলে দিন: আকাশ ও পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে
না এবং তারা এও জানে না যে তারা কখন পুনরুত্থিত হবে’’। (নামল : ৬৫)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘গায়েবের
চাবিকাঠি একমাত্র তাঁরই হাতে। তিনি ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে না। জল ও স্থলের সব কিছুই
তিনি জানেন। কোথাও কোন বৃক্ষ থেকে একটি পাতা ঝরলেও তিনি তা জানেন। এমনকি ভূগর্ভের দানা
বা বীজ এবং সকল শুষ্ক ও তরতাজা বস্ত্তও তাঁর অবগতির বাইরে নয়। বরং সব কিছুই তাঁর সুস্পষ্ট
কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে’’। (আন্’আম : ৫৯)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
কিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই
একমাত্র জানেন গর্ভবতী মহিলার জরায়ুতে কি জন্ম নিতে যাচ্ছে। কেউ জানেনা আগামীকাল সে
কি অর্জন করবে। কেউ জানেনা কোথায় তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা সর্বজ্ঞ
ও সর্ব বিষয়ে অবগত’’। (লোকমান : ৩৪)
তবে
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) হাদীসের মধ্যে আমাদেরকে গায়েব সম্পর্কে যে সংবাদগুলো
দিয়েছেন তা আল্লাহ্ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তিনি নিজ পক্ষ
থেকে গায়েবের কোন সংবাদ দেননি এবং কখনো তিনি গায়েব জানতেন না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি তাদেরকে বলে দিন: আমি তোমাদেরকে এ কথা বলছি না যে, আমার নিকট আল্লাহ্’র
ধন ভান্ডার রয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে আমি ধনী বানিয়ে দেবো। আর এমনো বলছি না যে, আমি গায়েব
জানি তথা অদৃশ্য জগতের কোন খবর রাখি’’। (আন’আম : ৫০)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘(হে
নবী!) আপনি বলে দিন: আমার ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, মঙ্গল-অমঙ্গল ইত্যাদির ব্যাপারে আমার
কোন হাত নেই। বরং আল্লাহ্ তা’আলা যাই ইচ্ছে করেন তাই ঘটে থাকে। আমি যদি গায়েব জানতাম
তাহলে আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করতে পারতাম এবং কোন অমঙ্গল ও অকল্যাণ কখনো আমাকে স্পর্শ
করতে পারতো না। আমি অন্য কিছু নই। বরং আমি শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী
ও সুসংবাদবাহী’’। (আ’রাফ : ১৮৮)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘এভাবেই
আমি আপনার নিকট আমার প্রত্যাদেশ রূহ তথা কোর’আন পাঠিয়েছি। ইতিপূর্বে আপনি কখনোই জানতেন
না কোর’আন কি এবং ঈমান কি? মূলতঃ আমি কোর’আন মাজীদকে নূর হিসেবে অবতীর্ণ করেছি। যা
কর্তৃক আমার বান্দাহ্দের যাকে ইচ্ছে হিদায়াত দিয়ে থাকি। আর আপনিতো নিশ্চয়ই মানুষকে
সঠিক পথ দেখিয়ে থাকেন’’। (যুখরুফ : ৫২)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল (সা.) ঘর থেকে বের হলে জনৈক ব্যক্তি
(জিব্রীল) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, কিয়ামত কখন হবে? তখন তিনি উত্তরে বললেন:
‘‘যাকে
কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তিনি কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাকারী চাইতে বেশি
জানেন না। তবে আমি আপনাকে উহার আলামত সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিতে পারি। যখন কোন দাসী
তার প্রভুকে জন্ম দিবে তখন এটি কিয়ামতের একটি আলামত এবং যখন উলঙ্গ ও খালি পা ব্যক্তিরা
মানুষের নেতৃস্থানীয় হবে তখন এটি কিয়ামতের আরেকটি আলামত। আর যখন পশু রাখালরা বিরাট
বিরাট অট্টালিকা বানাতে প্রতিযোগিতা করবে তখন এটি কিয়ামতের আরেকটি আলামত’’। (বুখারী,
হাদীস ৫০ মুসলিম, হাদীস ৯)।
রাসূল
(সা.) যদি সত্যিই গায়েব জানতেন তাহলে তিনি বিলাল (রা.) কে সাথে নিয়ে তায়েফে গিয়ে পাথর
খেয়ে রক্তাক্ত হতেন না। কারণ, রাসূল (সা.) গায়েব জেনে থাকলে তিনি প্রথম থেকেই জানতেন
তারা তাঁকে সংবর্ধনা জানাবে। না পাথর নিক্ষেপে রক্তাক্ত করবে।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি ক্বাবা শরীফের সামনে সিজ্দাহ্রত থাকাবস্থায় তাঁর
পিঠে কাফিররা উটের ফুল চাপিয়ে দিতে পারতো না।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে হা’ত্বিব্ বিন্ আবু বাল্তা’আহ্ (রা.) যখন জনৈকা মহিলাকে
মক্কার কাফিরদের নিকট এ সংবাদ লিখে পাঠালেন যে, রাসূল (সা.) অচিরেই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ
করতে আসছেন। অতএব তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য অতিসত্বর প্রস্ত্ততি নিয়ে নাও। তখন
রাসূল (সা.) কে ওহীর মারফত তা জেনে অনেক দূর থেকে সে মহিলাকে ধরে আনার জন্য সাহাবাদেরকে
পাঠাতে হতোনা। কারণ, তিনি গায়েব জেনে থাকলে প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে জানতেন।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে যখন তাঁর দাসী মারিয়াকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হলো তখন
তিনি হযরত ’আলী (রা.) কে ব্যভিচারী গোলামকে হত্যা করার জন্য বহু দূর পাঠাতেন না। অথচ
তার কোন লিঙ্গই ছিলোনা। যাতে ব্যভিচার সংঘটিত হতে পারে।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে যখন মক্কার কাফিররা ’উসমান (রা.) কে হত্যা করে দিয়েছে
বলে গুজব ছড়ালো তখন তিনি ঐতিহাসিক ’হুদাইবিয়াহ্ এলাকায় মক্কার কাফিরদের থেকে ’উসমান
হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সাহাবাদের থেকে দ্রুত বায়’আত গ্রহণ করতেন না। যা ইতিহাসের
ভাষায় ‘‘বায়’আতুর্ রিযওয়ান’’ নামে পরিচিত।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে তাঁকে খায়বারে গিয়ে ইহুদী মহিলার বিষাক্ত ছাগলের গোস্ত
খেয়ে দীর্ঘ দিন বিষক্রিয়ায় ভুগতে হতো না।
রাসূল
(সা.) যদি গায়েব জানতেন তাহলে মুনাফিকরা যখন ’আয়েশা (রাঃ)-কে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছিলো
তখন তিনি ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) কে এ ব্যাপারে সন্দেহ করে তাঁর সাথে সম্পূর্ণরূপে
কথাবার্তা বন্ধ দিয়ে তাঁকে তাঁর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাসূল
(সা.) যখন গায়েব জানেন না তখন তিনি ছাড়া অন্য কোন পীর বা বুযুর্গ গায়েব জানেন বলে বিশ্বাস
করা সত্যিই বোকামি বৈ কি?
কাশ্ফ
ও গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সূফীদের নিকটে কারোর কাশফ হয় বা কেউ কাশ্ফ
ওয়ালা মানে, তার অলক্ষ্যে কিছুই নেই। সকল লুক্কায়িত বা দূরের বস্ত্তও সে খোলা চোখে
দেখতে পায়। দুনিয়া-আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম, ’আর্শ-কুরসী, লাওহ্-ক্বলম সব কিছুই সে
নির্দ্বিধায় দেখতে পায়। এমনকি মানব অন্তরের লুক্কায়িত কথাও সে জানে।
বরং
কাশ্ফের ব্যাপারটি গায়েবের জ্ঞানের চাইতেও আরো মারাত্মক। কারণ, গায়েবের জ্ঞানের সাথে
খোলা চোখে দেখার কোন শর্ত নেই। কিন্তু কাশফের মানে, খোলা চোখে দেখা।
অতএব
যখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া গায়েবের জ্ঞান আর কারোর নেই তখন কাশ্ফও একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলারই হবে। আর কারোর নয়। যদিও কাশ্ফ শব্দের অস্তিত্ব উক্ত অর্থে কোর’আন ও হাদীসের
কোথাও পাওয়া যায় না। বরং তা সূফীদের নব আবিষ্কার।
(২৭) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন নবী
বা ওলী মানব অন্তরের কোন লুক্কায়িত কথা জানতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই মানব অন্তরের লুক্কায়িত কথা জানতে পারেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানতে
কখনোই সক্ষম নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
তোমাদের কথা যতই গোপনে বলো অথবা প্রকাশ্যে আল্লাহ্ তা’আলা তা সবই শুনেন। এমনকি তিনি
অন্তরে লুক্কায়িত বস্ত্তও জানেন। যিনি সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন তিনি কি সকল কিছু জানবেন
না? না কি অন্য কেউ জানবেন। তিনিই সূক্ষ্মদর্শী এবং সকল বিষয়ে অবগত’’। (মুলক : ১৩-১৪)।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রি’ল,
যাক্ওয়ান, ’উসাইয়াহ্ ও বানী লাহ্’ইয়ান নামক চারটি সম্প্রদায় রাসূল (সা.) এর নিকট শত্রুর
বিপক্ষে সাহায্য চাইলে রাসূল (সা.) তাদেরকে সত্তর জন আন্সারী দিয়ে সহযোগিতা করলেন।
আমরা তাদেরকে সে যুগের ক্বারী সাহেবান বলে ডাকতাম। তারা দিনে লাকড়ি কাটতো আর রাত্রিতে
বেশি বেশি নফল নামায পড়তো। যখন তারা মা’ঊনা কূপের নিকট পৌঁছালো তখন তারা উক্ত সাহাবাদেরকে
হত্যা করে দিলো। নবী (সা.) এর নিকট সংবাদটি পৌঁছালে তিনি এক মাস যাবৎ ফজরের নামাযে
ক্বুনূত পড়ে তাদেরকে বদ্ দো’আ করেন’’। (বুখারী, হাদীস ৪০৯০ মুসলিম, হাদীস ৬৭৭)।
যদি
রাসূল (সা.) তাদের মনের লুক্কায়িত কথা জানতেন তাহলে প্রথম থেকেই তিনি তাদেরকে সাহাবা
দিয়ে সহযোগিতা করতেন না। কারণ, তখন তিনি তাদের মনের শয়তানির কথা অবশ্যই জানতেন।
(২৮) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও কেউ কাউকে রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতা দিতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
কাউকে
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। অন্য কেউ নয়। তিনি ইচ্ছে করলেই
কেউ কোন না কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতে পারে। নতুবা নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘হে
নবী! আপনি বলুন: হে আল্লাহ্! আপনি হচ্ছেন রাজাধিরাজ। আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দেন এবং
যার নিকট থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। আপনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দেন এবং যাকে ইচ্ছা
লাঞ্ছিত করেন। আপনারই হাতে সকল কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’’। (আ’লি-ইমরান
: ২৬)
(২৯) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কেউ কারোর
অন্তরে কোন ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই যে কারোর অন্তরে যে কোন ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অন্য কেউ নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর হুকুম পালন করো যখন তিনি তোমাদেরকে
কোন বিধানের প্রতি আহবান করেন যা তোমাদের মধ্যে সত্যিকারের নব জীবন সঞ্চার করবে। জেনে
রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকেন
(অর্থাৎ তাঁর হাতেই মানুষের অন্তর। তাঁর যাই ইচ্ছা তাই করেন) এবং পরিশেষে তাঁর কাছেই
সবাইকে সমবেত হতে হবে’’। (আন্ফাল : ২৪)
শাহ্র
বিন্ ’হাউশাব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমি
উম্মে সালামাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) কে বললাম: হে উম্মুল মু’মিনীন! আপনার নিকট থাকাবস্থায়
রাসূল (সা.) অধিকাংশ সময় কি দো’আ করতেন? তিনি বললেন: অধিকাংশ সময় রাসূল (সা.) বলতেন:
হে অন্তর নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনি ইসলামের উপর অটল অবিচল রাখুন।
উম্মে সালামাহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন: আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনাকে
দেখছি আপনি অধিকাংশ সময় উপরোক্ত দো’আ করেন। মূলতঃ এর রহস্য কি? রাসূল (সা.) বললেন:
হে উম্মে সালামাহ্! প্রতিটি মানুষের অন্তর আল্লাহ্ তা’আলার দু’টি আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত।
ইচ্ছে করলে তিনি কারোর অন্তর সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর ইচ্ছে করলে তিনি কারোর অন্তর
বক্র পথে পরিচালিত করেন। বর্ণনাকারী মু’আয বলেন: এ জন্যই আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে সর্বদা
তাঁর নিকট নিম্নোক্ত দো’আ করতে আদেশ করেন যার অর্থ: (তিরমিযী, হাদীস ৩৫২২)।
হে
আমার প্রভু! আপনি আমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন। অতএব আমাদের অন্তরকে আর বক্র পথে পরিচালিত
করবেন না।
(৩০) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কারোর ইচ্ছা স্বকীয়ভাবে
প্রতিফলিত হতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছাই স্বকীয়ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে। অন্য কারোর ইচ্ছা নয়। সে যে
পর্যায়েরই হোক না কেন।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ্ তা’আলা যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছে করেন তখন তিনি শুধু এতটুকুই বলেন: হয়ে যাও,
তখন তা হয়ে যায়’’। (ইয়াসীন : ৮২)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি নবী (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা এবং আপনি চেয়েছেন বলে কাজটি
হয়েছে। নতুবা হতো না। তখন নবী (সা.) বললেন: তুমি কি আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার শরীক বানাচ্ছো?
এমন কথা কখনো বলবে না। বরং বলবে: একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই চেয়েছেন বলে কাজটি হয়েছে।
নতুবা হতো না’’।
(আহমাদ
: ১/২১৪, ২২৪, ২৮৩, ৩৪৭ বুখারী/আদাবুল্ মুফরাদ্, হাদীস ৭৮৩ নাসায়ী/আমালুল্ ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ্,
হাদীস ৯৮৮ বায়হাক্বী : ৩/২১৭ ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস ১৩০০৫, ১৩০০৬ আবু নু’আইম/হিল্ইয়াহ্
: ৪/৯৯)
(৩১) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কেউ কাউকে
সন্তান-সন্ততি দিতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই যাকে চান তাকে সন্তান-সন্ততি দিয়ে থাকেন। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ কাউকে
ইচ্ছে করলেই সন্তান-সন্ততি দিতে পারে না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘আকাশ
ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। তিনি
যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান। আর যাকে ইচ্ছা পুত্র
ও কন্যা উভয়টাই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে রাখেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ ও
সর্বশক্তিমান’’। (শূরা : ৪৯-৫০)।
ইমাম
ইবনু শিহাব যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘’উসমান
(রা.) এর স্ত্রী এবং রাসূল (সা.) এর মেয়ে রুক্বাইয়াহ্ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) যখন ইন্তিকাল
করেন তখন রাসূল (সা.) তাঁর আর এক মেয়ে উম্মে কুল্সুম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) কে ’উসমান
(রা.) এর নিকট বিবাহ দেন। অতঃপর উম্মে কুলসুম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ও ইন্তিকাল করেন।
তবে তাঁর কোন সন্তান হয়নি। এরপর নবী (সা.) ’উসমান (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন: যদি
আমার দশটি মেয়েও থাকতো এবং পর পর সবাই ইন্তিকাল করতো তাহলেও আমি একটির পর আর একটি মেয়ে
তোমার নিকট বিবাহ দিতাম। (ত্বাবারানী, হাদীস ১০৬১, ১০৬২)
উম্মে
কুল্সুম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এর কোন সন্তান হয়নি এমতাবস্থায় তিনি ইন্তিকাল করেন। যদি
আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া কেউ কাউকে সন্তান দিতে পারতো তা হলে নবী (সা.) অবশ্যই তাঁর মেয়েকে
সন্তান দিতেন। কারণ, তিনি ’উসমান (রা.) কে খুব বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর ভালোবাসার চিহ্ন
এটাও যে তিনি তার আনন্দ দেখবেন। আর এ কথা সবারই জানা যে, যে কোন ব্যক্তি (সে পাগলই
হোক না কেন) তার ঘরে নব সন্তান আসলে সে অত্যধিক খুশি হয়। উপরন্তু নবীর মেয়ের ঘরের সন্তান।
অপর
দিকে নবী (সা.) ’উসমান (রা.) কে বেশি ভালোবাসার দরুন তাকে উদ্দেশ্য করে আপসোস করে এ
কথা বললেন যে, যদি আমার দশটি মেয়েও থাকতো এবং পর পর সবাই ইন্তিকাল করতো তা হলেও আমি
একটির পর আর একটি মেয়ে তোমার নিকট বিবাহ দিতাম। এ কথা এটাই প্রমাণ করে যে, সন্তান দেয়া
আল্লাহ্ তা’আলার হাতে। তাঁর হাতে এর কিছুই নেই। নতুবা তিনি আরো কয়েকটি মেয়ে সন্তান
জন্ম দিয়ে পর পর ’উসমান (রা.) এর নিকট বিবাহ দিতেন।
(৩২) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও কেউ কাউকে সুস্থতা
দিতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই কাউকে সুস্থতা দিতে পারেন। অন্য কেউ নয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
‘‘তিনিই
(আল্লাহ্ তা’আলা) আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তিনিই আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন। তিনিই আমাকে
খাওয়ান ও পান করান এবং আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনিই
আমাকে মৃত্যু দিবেন এবং পুনরুজ্জীবিত করবেন। আশা করি তিনিই কিয়ামতের দিন আমার অপরাধসমূহ
ক্ষমা করবেন। (শু’আরা’ : ৭৮-৮২)।
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) তাঁর স্ত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে
ব্যথার জায়গায় ডান হাত রেখে নিম্নোক্ত দো’আ পড়তেন।
‘‘হে
মানব প্রভু! রোগটি দূর করুন এবং পূর্ণ সুস্থতা দান করুন। যার পর আর কোন রোগ থাকবেনা।
কারণ, আপনিই সুস্থতা দানকারী এবং সুস্থতা একমাত্র আপনিই দিয়ে থাকেন’’। (বুখারী, হাদীস
৫৬৭৫, ৫৭৪২, ৫৭৪৩, ৫৭৪৪, ৫৭৫০ মুসলিম, হাদীস ২১৯১)।
(৩৩) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার তাওফীক ছাড়াও কেউ ইচ্ছে
করলেই কোন ভালো কাজ করতে বা কোন খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই ইচ্ছে করলে কাউকে কোন ভালো কাজ করার অথবা কোন খারাপ কাজ থেকে বেঁচে
থাকার তাওফীক দিয়ে থাকেন। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ ইচ্ছে করলেই তা করতে পারে না।
আল্লাহ্
তা’আলা শু’আইব (আ.) সম্পর্কে বলেন:
‘‘আমি
শুধু তোমাদেরকে সংশোধন করতে চাই যত টুকু আমার সাধ্য। আমি যা করেছি অথবা সামনে যা করবো
তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে তাওফীক বা সুযোগ দিয়েছেন বলেই হয়েছে বা হবে। তাঁর
উপরই আমার সার্বিক নির্ভরতা এবং তাঁর নিকটই আমাকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে’’। (হূদ্
: ৮৮)
মু’আয
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমার হাত ধরে বললেন:
‘‘হে
মু’আয! আল্লাহ্’র কসম! আমি তোমাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসি। আল্লাহ্’র কসম! আমি তোমাকে নিশ্চয়ই
ভালোবাসি। হে মু’আয! আমি তোমাকে ওয়াসীয়ত করছি যে, তুমি প্রতি বেলা নামায শেষে নিম্নোক্ত
দো’আ করতে ভুলবে না। যার অর্থ: হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে আপনার যিকির, শুকর ও উত্তম ইবাদাত
করার তাওফীক দান করুন। (আবু দাউদ, হাদীস ১৫২২)
(৩৪) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়াও কেউ নিজ ইচ্ছায় কারোর
কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলা ইচ্ছা করলেই কেউ কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে। নতুবা নয়। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
ওদেরকে বলে দিন: আল্লাহ্ তা’আলা যদি তোমাদের কারোর কোন ক্ষতি অথবা লাভ করতে চান তাহলে
কেউ কি তাঁকে উক্ত ইচ্ছা থেকে বিরত রাখতে পারবে? বস্ত্ততঃ আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের কর্ম
সম্পর্কে সম্যক অবগত’’। (ফাত্হ : ১১)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল (সা.) আমাকে
কিছু মূল্যবান বাণী শুনিয়েছেন যার কিয়দাংশ নিম্নরূপ:
‘‘কিছু
চাইলে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই চাবে। কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার নিকটই কামনা করবে। জেনে রেখো, পুরো বিশ্ববাসী একত্রিত হয়েও যদি তোমার
কোন কল্যাণ করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই কল্যাণ করতে পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
আর তারা সকল একত্রিত হয়েও যদি তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় তাহলে তারা ততটুকুই ক্ষতি করতে
পারবে যা তোমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তাক্বদীর লেখার কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তাক্বদীর
লেখা বালাম শুকিয়ে গেছে। অর্থাৎ লেখা শেষ। আর নতুন করে লেখা হবে না’’। (তিরমিযী, হাদীস
২৫১৬)
(৩৫) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও কেউ কাউকে জীবন
বা মৃত্যু দিতে পারে এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলাই ইচ্ছে করলে কাউকে জীবন বা মৃত্যু দিতে পারে। অন্য কেউ নয়। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তিনিই
জীবন ও মৃত্যু দান করেন। যখন তিনি কিছু করতে চান তখন তিনি বলেন: হয়ে যাও, তখন তা হয়ে
যায়’’। (মু’মিন : ৬৮)
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমরা
‘‘যাতুর রিক্বা’’’ যুদ্ধে নবী (সা.) এর সাথে ছিলাম। পথিমধ্যে যখন আমরা একটি ছায়া বিশিষ্ট
গাছের নিকট পৌঁছুলাম তখন আমরা তা নবী (সা.) এর জন্য ছেড়ে দিলাম। যাতে তিনি উহার নীচে
বিশ্রাম নিতে পারেন। নবী (সা.) বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এমতাবস্থায় জনৈক মুশরিক নবী (সা.)
এর নিকট আসলো এবং গাছে ঝুলন্ত তাঁর তলোয়ার খানি খাপ থেকে বের করে তাঁকে বললো: তুমি
কি আমাকে ভয় পাচ্ছো না? নবী (সা.) বললেন: না। মুশরিকটি বললো: তাহলে এখন আমার হাত থেকে
তোমাকে কে বাঁচাবে? নবী (সা.) বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে বাঁচাবেন এবং রাসূল (সা.)
তাকে একটুও শাস্তি দেননি। (বুখারী, হাদীস ৪১৩৫, ৪১৩৬, ৪১৩৯ মুসলিম, হাদীস ৮৪৩)
(৩৬) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও অন্য কোন নবী-ওলী অথবা অন্য কোন
গাউস-ক্বুতুব সর্বদা জীবিত রয়েছেন এমন মনে করার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ চিরঞ্জীব নয়। চাই সে যে কেউই হোক না কেন। আল্লাহ্ তা’আলা
বলেন:
‘‘ভূ
পৃষ্ঠে যা কিছুই রয়েছে তা সবই নশ্বর। যা একদা ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু থাকবে আপনার প্রতিপালক।
যিনি মহিমাময় মহানুভব’’। (রহমান : ২৬-২৭)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘সকল জীবকে একদা মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।
কেউই সর্বদা বেঁচে থাকবে না’’। (আ’লি ’ইম্রান : ১৮৫)
আমাদের
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) ও এ মৃত্যু থেকে রেহাই পাননি। তিনিও একদা মৃত্যু বরণ করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আপনি মরণশীল এবং নিশ্চয়ই তারাও মরণশীল। কেউই এ দুনিয়াতে চিরদিন থাকবে না’’। (যুমার
: ৩০)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আমি
আপনার পূর্বের কাউকেই (কোন মানুষকেই) অনন্ত জীবন দেইনি। সুতরাং আপনি যদি মৃত্যু বরণ
করেন তাহলে তারাকি চির জীবন এ দুনিয়াতে থাকতে পারবে বলে আশা করে? সবাইকেই একদা মরতে
হবে। কেউই চিরঞ্জীব নয়’’। (আম্বিয়া : ৩৪)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘মুহাম্মাদ
(সা.) একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার রাসূল। এ ছাড়া তিনি অন্য কিছু নন। তাঁর পূর্বেও বহু
রাসূল মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মৃত্যু
বরণ করেন অথবা তাঁকে হত্যা করা হয় তাহলে তোমরা কি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে তথা কাফির
হয়ে যাবে? জেনে রাখো, তোমাদের কেউ কাফির হয়ে গেলে সে আল্লাহ্ তা’আলার এতটুকুও ক্ষতি
করতে পারবে না। অচিরেই আল্লাহ্ তা’আলা কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন’’। (আ’লি ’ইমরান
: ১৪৪)
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল (সা.) মৃত্যু বরণ করেছেন। অথচ আবু বকর (রা.)
সেখানে উপস্থিত নেই। তিনি ছিলেন ‘‘সুনহ’’ নামক এলাকায়। ইতিমধ্যে ’উমর (রা.) দাঁড়িয়ে
বললেন: আল্লাহ্ তা’আলার কসম! রাসূল (সা.) মৃত্যু বরণ করেননি। ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু
আন্হা) বলেন: ’উমর (রা.) বলেছেন: আল্লাহ্ তা’আলার কসম! তখন আমার এতটুকুই বুঝে আসছিলো।
আমি ধারণা করতাম, তিনি ঘুমিয়ে আছেন এবং অবশ্যই তিনি ঘুম থেকে উঠে সবার হাত-পা কেটে
দিবেন। ইতিমধ্যে আবু বকর (রা.) এসে রাসূল (সা.) এর চেহারা উন্মোচন করে তাতে একটি চুমো
দিলেন এবং বললেন: আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোক! আপনি জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায়ই
পূত-পবিত্র। সে সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! আপনাকে আল্লাহ্ তা’আলা দু’ বার মৃত্যু
দিবেন না। শুধু সে মৃত্যুই আপনি বরণ করেছেন যা আপনার জন্য বরাদ্দ ছিলো। অতঃপর আবু বকর
(রা.) রাসূল (সা.) এর নিকট থেকে বের হয়ে বললেন: হে কসমকারী! তুমি একটু শান্ত হও। আবু
বকর (রা.) যখন কথা শুরু করলেন তখন ’উমর (রা.) বসে গেলেন। আবু বকর (রা.) আল্লাহ্ তা’আলার
প্রশংসা করে বললেন: তোমরা জেনে রাখো, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সা.) এর ইবাদাত করতো তার
জানা উচিৎ তিনি আর এখন জীবিত নেই। মৃত্যু বরণ করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার
ইবাদাত করতো তার কোন অসুবিধে নেই। তিনি নিশ্চয়ই জীবিত। তিনি কখনো মৃত্যু বরণ করবেন
না। অতঃপর আবু বকর (রা.) যুমার ও আ’লু ’ইম্রানের উপরোক্ত আয়াতদ্বয় তিলাওয়াত করেন। আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) বলেন: আল্লাহ্ তা’আলার কসম! পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো
যে, কেউ বুঝতে পারেনি আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত আয়াত ইতিপূর্বে নাযিল করেছেন। অতএব আবু বকর
(রা.) তা তিলাওয়াত করার পরপরই সবাই তা গ্রহণ করে নেয় এবং তিলাওয়াত করতে শুরু করে’’।
(বুখারী, হাদীস ১২৪১, ১২৪২, ৩৬৬৭, ৩৬৬৮, ৪৪৫২, ৪৪৫৩, ৪৪৫৪)। হে আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে
সকল ধরনের শির্ক থেকে মুক্ত করুন।
ছোট শিরক-প্রকাশ্য
ছোট
শির্ক আবার দু’ প্রকার। যা নিম্নরূপ:
(ক) প্রকাশ্য শির্ক।
(খ) অপ্রকাশ্য বা গোপনীয় শির্ক।
প্রকাশ্য শির্কঃ
প্রকাশ্য
শিরক বলতে সে সকল কথা ও কাজকে বুঝানো হয় যা সবাই চোখে দেখতে পায় অথবা কানে শুনতে পায়
অথবা অনুভব করতে পারে। তা আবার কয়েক প্রকার:
১. সুতা বা রিং পরাঃ সুতা বা রিং পরার শির্ক বলতে কোন বালা-মুসীবত
দূরীকরণ বা প্রতিরোধের জন্য দম করে গেরো দেয়া সুতা বা রিং পরিধান করাকে বুঝানো হয়।
এটি
ছোট শির্ক হিসেবে গণ্য করা হবে ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবহারকারী এ রূপ বিশ্বাস করে
যে, আল্লাহ্ তা’আলা এর মাধ্যমেই আমার আসন্ন বালা-মুসীবত দূরীভূত করবেন। এটি এককভাবে
আমার কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারেনা। আর যখন এ বিশ্বাস করা হয় যে, এটি এককভাবেই আমার
বিপদাপদ দূরীকরণে সক্ষম তখন তা বড় শির্কে রূপান্তরিত হবে।
আমাদের
জানার বিষয় এইযে, কোন বস্ত্ত তা যাই হোকনা কেন তা কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারেনা।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
ওদেরকে বলুন: তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছো যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমার কোন অনিষ্ট করতে চাইলে
তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা
আল্লাহ্ তা’আলা আমার প্রতি কোন অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে?
আপনি বলুন: আমার জন্য আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট। নির্ভরকারীদের তাঁর উপরেই নির্ভর করতে
হবে’’। (যুমার : ৩৮)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা মানুষের প্রতি কোন অনুগ্রহ অবারিত করলে কেউ তা নিবারণ করতে পারেনা। আর তিনি
কিছু নিবারণ করলে তিনি ছাড়া আর কেউ তা পুনরায় অবারিত করতে পারে না। তিনি পরাক্রমশালী
প্রজ্ঞাময়’’। (ফাতির : ২)
আসন্ন
বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেউ নিজের শরীরের সাথে কোন জিনিস ঝুলিয়ে রাখলে তা তাকে
কোনভাবেই বিপদাপদ থেকে রক্ষা করতে পারেনা। বরং আল্লাহ্ তা’আলা তখন তাকে ওজিনিসের প্রতি
সোপর্দ করে দেন। এতে করে তখন যা হবার তাই হয়ে যায়।
আবু
মা’বাদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কেউ
কোন বস্ত্ত কোন উদ্দেশ্যে শরীর বা অন্য কোথাও ঝুলিয়ে রাখলে আল্লাহ্ তা’আলা ওকে উহার
প্রতিই সোপর্দ করেন তথা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করা হয় না বরং যা হবার তাই হয়ে যায়’’।
(তিরমিযী, হাদীস ২০৭২)
রুওয়াইফি’
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমাকে ডেকে বললেন:
‘‘হে
রুওয়াইফি’! হয়তো তুমি বেশি দিন বাঁচবে। তাই তুমি সকলকে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে দিবে যে, নিশ্চয়ই
যে ব্যক্তি (নামাযরত অবস্থায়) দাড়ি পেঁচায়, গলায় তার ঝুলায় অথবা পশুর মল বা হাড্ডি
দিয়ে ইস্তিঞ্জা করে মুহাম্মাদ (সা.) সে ব্যক্তি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত’’। (আহমাদ
: ৪/১০৮)
শুধু
মানুষের শরীরেই কোন কিছু ঝুলানো নিষেধ যে তা সঠিক নয়। বরং আসন্ন বালা-মুসীবত বা কুদৃষ্টি
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উট, ঘোড়া, গরু, ছাগল ইত্যাদির গলায়ও তার বা এ জাতীয় কোন কিছু
ঝুলানো নিষেধ।
আবু
বাশীর আন্সারী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি কোন এক সফরে রাসূল (সা.) এর সফরসঙ্গী
ছিলাম। তখন সবাই ঘুমে বিভোর। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) এ মর্মে জনৈক প্রতিনিধি পাঠান
যে,
‘‘কোন
উটের গলায় তার বা অন্য কিছু ঝুলানো থাকলে তা যেন কেটে ফেলা হয়’’। (বুখারী, হাদীস ৩০০৫
মুসলিম, হাদীস ২১১৫ আবু দাউদ, হাদীস ২৫৫২)
তবে
শুধু বেঁধে রাখার উদ্দেশ্যে কোন পশুর গলায় কোন জিনিস লাগিয়ে রাখা নিষেধ নয়। বরং তা
প্রয়োজনে করতে হয়। যাতে পশুটি পালিয়ে না যায়।
আবু
ওহাব জুশামী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
ঘোড়া বেঁধে রাখো এবং ওর কপাল বা পাছায় হাত বুলিয়ে দাও। প্রয়োজনে ওর গলায় কিছু বেঁধে
দিতে পারো। কিন্তু আসন্ন বালা-মুসীবত বা কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার বা অন্য
কিছু ঝুলিয়ে দিওনা’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২৫৫৩)
২. ঝাঁড় ফুঁকের শির্কঃ
ঝাঁড়
ফুঁকের শির্ক বলতে এমন মন্ত্র পড়ে ঝাঁড় ফুঁক করাকে বুঝানো হয় যে মন্ত্রের মধ্যে শির্ক
রয়েছে।
যায়নাব
(রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমার স্বামী ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ
(রা.) একদা আমার গলায় একটি সুতো দেখে বললেন: এটি কি? আমি বললাম: এটি মন্ত্র পড়া সুতো।
এ কথা শুনা মাত্রই তিনি তা খুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। অতঃপর বললেন: নিশ্চয়ই
আব্দুল্লাহ্’র পরিবার শির্কের কাঙ্গাল নয়। বরং ওরা যে কোন ধরনের শির্ক হতে সম্পূর্ণরূপে
মুক্ত। তিনি আরো বললেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
ঝাঁড় ফুঁক, তাবিজ কবচ ও ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার্য বস্ত্ত শির্ক। যায়নাব বললেন:
আমি বললাম: আপনি এরূপ কেন বলছেন? আল্লাহ্’র কসম! আমার চোখ উঠলে ওমুক ইহুদীর নিকট যেতাম।
অতঃপর সে মন্ত্র পড়ে দিলে তা ভালো হয়ে যেতো। তখন ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ (রা.) বলেন:
এটি শয়তানের কাজ। সেই নিজ হাতে তোমার চোখে খোঁচা মারতো। অতঃপর যখন মন্ত্র পড়ে দেয়া
হতো তখন সে তা বন্ধ রাখতো। তোমার এতটুকু বলাই যথেষ্ট ছিলো যা রাসূল (সা.) বলতেন। তিনি
বলতেন: হে মানুষের প্রভু! আপনি আমার রোগ নিরাময় করুন। আপনি আমাকে সুস্থ করুন। কারণ,
আপনিই একমাত্র সুস্থতা দানকারী। আপনার নিরাময়ই সত্যিকার নিরাময়। যার পর আর কোন রোগ
থাকে না’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৩ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৫৯৬)
সকল
মন্ত্রই শির্ক নয়। বরং সেই মন্ত্রই শির্ক যাতে শির্কের সংমিশ্রণ রয়েছে। যাতে ফিরিশ্তা,
জিন ও নবীদের আশ্রয় বা সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। তাদের নিকট ফরিয়াদ কামনা করা হয়েছে
বা তাদেরকে ডাকা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব আল্লাহ্ তা’আলার নাযিল করা কিতাব, তাঁর
নাম ও বিশেষণ দিয়ে ঝাঁড় ফুঁক করা জায়িয।
’আউফ
বিন্ মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা জাহিলী যুগে অনেকগুলো মন্ত্র পড়তাম।
তাই আমরা রাসূল (সা.) কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
‘‘তোমরা
তোমাদের মন্ত্রগুলো আমার সামনে উপস্থিত করো। কারণ, শির্কের মিশ্রণ না থাকলে যে কোন
মন্ত্র পড়তে কোন অসুবিধে নেই’’। (মুসলিম, হাদীস ২২০০ আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৬)
আনাস
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
সা. কুদৃষ্টি তথা বদনযর, বিচ্ছু বা সর্পবিষ ইত্যাদি এবং পিপড়ার মন্ত্র পড়ার অনুমতি
দেন’’। (মুসলিম, হাদীস ২১৯৬ তিরমিযী, হাদীস ২০৫৬ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৫৮১)
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সা. মন্ত্র পড়া নিষেধ করে দিলে ’আমর বিন্ ’হায্মের
গোত্ররা তাঁর নিকট এসে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমরা একটি মন্ত্র পড়ে বিচ্ছুর বিষ
নামাতাম। অথচ আপনি মন্ত্র পড়তে নিষেধ করে দিয়েছেন। অতঃপর তারা রাসূল (সা.) কে মন্ত্রটি
শুনালে তিনি বললেন:
‘‘এতে
কোন অসুবিধে নেই। তোমাদের কেউ নিজ ভাইয়ের উপকার করতে পারলে সে তা অবশ্যই করবে’’। (মুসলিম,
হাদীস ২১৯৯)
শুধু
কোন মন্ত্রের ফায়দা প্রমাণিত হলেই তা পড়া জায়িয হয়ে যায়না। বরং তা শরীয়তের কষ্টি পাথরে
যাচাই করে নিতে হয়। দেখে নিতে হয় তাতে শির্কের কোন মিশ্রণ আছে কি না?
ইবনুত্
তীন (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
‘‘সাপ
স্বভাবগতভাবে মানুষের শত্রু হওয়ার দরুন তার সাথে মানুষের আরেকটি শত্রু শয়তানের ভালো
সখিত্ব রয়েছে। এতদ্কারণেই সাপের উপর শয়তানের নাম পড়ে দম করা হলে সে তা মান্য করে নিজ
স্থান ত্যাগ করে। তেমনিভাবে সাপের ছোবলে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও শয়তানের নামে ঝাঁড় ফুঁক
করা হলে মানুষের শরীর হতে বিষ নেমে যায়’’।
মোটকথা, চার শর্তে ঝাঁড় ফুঁক করা জায়িয। যা নিম্নরূপ:
১. তা আল্লাহ্ তা’আলার নাম বা গুণাবলীর
মাধ্যমে হতে হবে।
২. নিজস্ব ভাষায় হতে হবে। যাতে করে তা
সহজেই বোধগম্য হয় এবং তাতে শির্কের মিশ্রণ আছে কিনা তা বুঝা যায়।
৩. যাদুমন্ত্র ব্যতিরেকে এবং শরীয়ত সমর্থিত
জায়িয পন্থায় হতে হবে। কারণ, যে কোন উদ্দেশ্যে যাদুর ব্যবহার শরীয়তের দৃষ্টিতে কুফরীর
শামিল।
৪. এ বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকতে হবে যে, আল্লাহ্
তা’আলার ইচ্ছে ছাড়া মন্ত্র (তা যাই হোক না কেন) কোন কাজই করতে পারবেনা। আর এর বিপরীত
বিশ্বাস হলে তা বড় শির্কে রূপান্তরিত হবে।
৩.
তা’বীয-কবচের শির্ক
তা’বীয-কবচের
শির্ক বলতে বালা-মুসীবত, কুদৃষ্টি ইত্যাদি দূরীকরণ অথবা প্রতিরোধের জন্য দানা গোটা,
কড়ি কঙ্কর, কাষ্ঠ খন্ড, খড়কুটো, কাগজ, ধাত ইত্যাদি শরীরের যে কোন অঙ্গে ঝুলানোকে বুঝানো
হয়।
শরীয়তের
দৃষ্টিতে রোগ নিরাময়ের জন্য দু’টি জায়িয মাধ্যম অবলম্বন করা যেতে পারে। যা নিম্নরূপ:
ক.
শরীয়ত সমর্থিত মাধ্যম। যা দো’আ ও জায়িয ঝাঁড় ফুঁকের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। যা ক্রিয়াশীল
হওয়া কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত। এ মাধ্যমটি গ্রহণ করা আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল
হওয়াই প্রমাণ করে। কারণ, তিনি নিজেই বান্দাহ্কে এ মাধ্যম গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন।
খ.
প্রকৃতিগত মাধ্যম। যা মাধ্যম হওয়া মানুষের বোধ ও বিবেক প্রমাণ করে। যেমন: পানি পিপাসা
নিবারণের মাধ্যম। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তৈরিকৃত ওষুধ নির্ধারিত রোগ নিরাময়ের মাধ্যম।
তাবিজ
কবচ উক্ত মাধ্যম দু’টোর কোনটিরই অধীন নয়। না শরীয়ত উহাকে সমর্থন করে, না প্রকৃতিগতভাবে
উহা কোন ব্যাপারে ক্রিয়াশীল। অতএব তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘যদি
আল্লাহ তা’আলা তোমাকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন করেন তাহলে তিনিই একমাত্র তোমাকে তা থেকে
উদ্ধার করতে পারেন। আর যদি তিনি তোমার কোন কল্যাণ করতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের গতিরোধ
করার সাধ্য কারোর নেই। তিনি নিজ বান্দাহদের মধ্য থেকে যাকে চান অনুগ্রহ করেন। তিনি
অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়ালু’’। (ইউনুস : ১০৭)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার উপরই ভরসা করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (মায়িদাহ্ : ২৩)
আবু
মা’বাদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কেউ
কোন বস্ত্ত কোন মাকসুদে শরীর বা অন্য কোথাও ঝুলিয়ে রাখলে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে উহার
প্রতিই সোপর্দ করেন তথা তার মাকসুদটি পূর্ণ করা হয়না বরং যা হবার তাই হয়ে যায়’’। (তিরমিযী,
হাদীস ২০৭২)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাস্ঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
ঝাঁড় ফুঁক, তাবিজ কবচ ও ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার্য যে কোন বস্ত্ত শির্ক’’। (আবু
দাউদ, হাদীস ৩৮৮৩ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৫৯৬)
’উক্ববা
বিন্ ’আমির (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) এর নিকট দশ জন ব্যক্তি আসলে তিনি তম্মধ্যে নয় জনকেই বায়’আত করান। তবে এক জনকে
বায়’আত করাননি। সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি নয় জনকেই বায়’আত করিয়েছেন।
তবে একে করাননি কেন? তিনি বললেন: তার হাতে তাবিজ আছে। অতঃপর লোকটি তাবিজটি ছিঁড়ে ফেললে
রাসূল (সা.) তাকে বায়’আত করিয়ে বললেন: যে তাবিজ কবচ ঝুলালো সে শির্ক করলো’’। (আহমাদ
: ৪/১৫৬)
সাঈদ
বিন্ জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কারোর তাবিজ কবচ কেটে ফেললো তার আমলনামায় একটি গোলাম আযাদের সাওয়াব লেখা হবে’’।
বিশেষভাবে
জানতে হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলী এবং কোর’আন মাজীদের আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস
দিয়ে তাবিজ কবচ করার ব্যাপারে সাহাবাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিলো।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আমর বিন্ ’আস্ (রা.) ও ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এ জাতীয় তাবিজ কবচ জায়িয হওয়ার
পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। আবু জা’ফর মুহাম্মাদ্ আল্ বাক্বির ও ইমাম আহমাদ (এক বর্ণনায়)
এবং ইমাম ইবনুল্ কাইয়িম (রাহিমাহুমুল্লাহ্) ও এ মতের সমর্থন করেন।
অন্য
দিকে ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আব্বাস, হুযাইফা, ’উক্ববা বিন্
’আমির, ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উক্বাইম এবং ’আলক্বামা, ইব্রাহীম বিন্ ইয়াযীদ্ নাখা’য়ী,
আস্ওয়াদ্, আবু ওয়া’ইল্, ’হারিস্ বিন্ সুওয়াইদ্, ’উবাইদাহ্ সাল্মানী, মাসরূক্ব, রাবী’
বিন্ খাইসাম্, সুওয়াইদ্ বিন্ গাফলা (রাহিমাহুমুল্লাহ্) সহ আরো অন্যান্য বহু সাহাবী
ও তাবিয়ীন তাবিজ ও কবচ না জায়িয বা শির্ক হওয়ার ব্যাপারে মত ব্যক্ত করেন। ইমাম আহমাদও
(এক বর্ণনায়) এ মত গ্রহণ করেন। চাই তা কোর’আন ও হাদীস এবং আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলী
দিয়ে হোক অথবা চাই তা অন্য কিছু দিয়ে হোক। কারণ, হাদীসের মধ্যে তাবিজ ও কবচ শির্ক হওয়ার
ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাতে কোন পার্থক্য করা হয়নি এবং এ ব্যাপকতা হাদীস
বর্ণনাকারীরাও বুঝেছেন। শুধু আমরাই নয়।
অন্য
দিকে তাবিজ ও কবচ জায়িয হওয়ার ব্যাপারটিকে ঝাঁড় ফুঁকের সাথে তুলনা করা যায়না। কারণ,
ঝাঁড় ফুঁকের মধ্যে কাগজ, চামড়া ইত্যাদির প্রয়োজন হয়না যেমনিভাবে তা প্রয়োজন হয় তাবিজ
ও কবচের মধ্যে। বরং তাবিজ ও কবচ না জায়িয হওয়ার ব্যাপারকে শির্ক মিশ্রিত ঝাঁড় ফুঁকের
সাথে সহজেই তুলনা করা যেতে পারে।
যখন
অধিকাংশ সাহাবা ও তাবিয়ীন সে স্বর্ণ যুগে কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক তাবিজ ও কবচ দেয়া না
জায়িয বা অপছন্দ করেছেন তা হলে এ ফিতনার যুগে যে যুগে তাবিজ ও কবচ দেয়া বিনা পুঁজিতে
লাভজনক একটি ভিন্ন পেশা হিসেবে রূপ নিয়েছে কিভাবে তা জায়িয হতে পারে? কারণ, এ যুগে
তাবিজ ও কবচ দিয়ে সকল ধরনের হারাম কাজ করা হয় এবং এ যুগের তাবিজদাতারা এর সাথে অনেক
শির্ক ও কুফরের সংমিশ্রণ করে থাকে। তারা মানুষকে সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল
না করে নিজের তাবিজ ও কবচের উপর নির্ভরশীল করে। এমনকি অনেক তাবিজদাতা এমনও রয়েছে যে,
কেউ তার নিকট এসে কোন সামান্য সমস্যা তুলে ধরলে সে নিজ থেকে আরো কিছু বাড়িয়ে তা আরো
ফলাও করে বর্ণনা করতে থাকে। যাতে খদ্দেরটি কোনভাবেই হাতছাড়া না হয়ে যায়। তাতে করে মানুষ
আল্লাহ্ভক্ত না হয়ে তাবিজ বা তাবিজদাতার কঠিন ভক্ত হয়ে যায়।
মোটকথা,
কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক তাবিজ কবচ দেয়া বহু হারাম কাজ ও বহু শির্কের গুরুত্বপূর্ণ বাহন।
যা প্রতিহত করা দল মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানেরই কর্তব্য। এরই পাশাপাশি তাবিজ ও কবচ
ব্যবহারে কোর’আন ও হাদীসের প্রচুর অপমান ও অসম্মান হয় যা বিস্তারিতভাবে বলার এতটুকুও
অপেক্ষা রাখে না।
৪. বরকতের শির্ক:
বরকতের
শির্ক বলতে শরীয়ত অসমর্থিত কোন ব্যক্তি, বস্ত্ত বা সময়কে অবলম্বন করে ধর্ম বা বিষয়গত
কোন প্রয়োজন নিবারণ অথবা অধিক কল্যাণ ও পুণ্যের আশা করাকে বুঝানো হয়।
সহজ
ভাষায় বলতে হয়, কোর’আন ও হাদীসের দৃষ্টিতে আল্লাহ্ তা’আলা যে ব্যক্তি, বস্ত্ত বা সময়ের
মধ্যে বরকত রাখেননি সেগুলোর মাধ্যমে বরকত কামনা করাকে বুঝানো হয়।
তাবাররুকের
প্রকারভেদ:
তাবাররুক
বা বরকত কামনা সর্ব সাকুল্যে দু’ ধরনের হয়ে থাকে। যা নিম্নরূপ:
বৈধ তাবাররুক:
বৈধ
তাবাররুক বলতে যে ধরনের ব্যক্তি বা বস্ত্তর মাধ্যমে বরকত কামনা করা ইসলামী শরীয়তে জায়িয
সে গুলোর মাধ্যমে বরকত কামনা করাকে বুঝানো হয়। তা আবার চার প্রকার:
১. নবী সত্তা বা তাঁর নিদর্শনসমূহ কর্তৃক বরকত গ্রহণ:
এ
জাতীয় তাবার্রুক শরীয়ত কর্তৃক প্রমাণিত। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা নবী সত্তা ও তদীয় নিদর্শনসমূহে
এমন বিশেষ বরকত রেখেছেন যা অন্য কারোর সত্তা বা নিদর্শনসমূহে রাখেননি।
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমাদের
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর নিজ পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তিনি তার উপর সূরা ফালাক্ব,
নাস্ ইত্যাদি পড়ে দম করতেন। অতঃপর তিনি যখন শেষ বারের মতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন যাতে তাঁর
ইন্তিকাল হয়ে যায় তখন আমিই তাঁর উপর সূরা ফালাক্ব, নাস্ ইত্যাদি পড়ে দম করতাম এবং তাঁর
নিজ হাত দিয়েই আমি তাঁর শরীর বুলিয়ে দিতাম। কারণ, তাঁর হাত আমার হাতের চাইতে অধিক বরকতময়’’।
(বুখারী, হাদীস ৪৪৩৯, ৫০১৬, ৫৭৩৫, ৫৭৫১ মুসলিম, হাদীস ২১৯২)
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
’’রাসূল
(সা.) ফজরের নামায শেষ করলেই মদীনার গোলাম ও খাদিমরা পানি ভর্তি পাত্র নিয়ে তাঁর নিকট
উপস্থিত হতো। যে কোন পাত্রই তাঁর নিকট উপস্থিত করা হতো তাতেই তিনি নিজ হস্ত মুবারাক
ঢুকিয়ে দিতেন। এমনকি অনেক সময় শীতের ভোর সকালে তাঁর নিকট পানি ভর্তি পাত্র নিয়ে আসা
হতো। অতঃপর তিনি তাতেও নিজ হস্ত মুবারাক ঢুকিয়ে দিতেন’’। (মুসলিম, হাদীস ২৩২৪)
আনাস্
(রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমি
রাসূল (সা.) কে দেখতাম, নাপিত তাঁর মাথা মুন্ডাচ্ছে। আর এ দিকে সাহাবারা তাঁকে বেষ্টন
করে আছে। কোন একটি চুল পড়লেই তা পড়তো যে কোন এক ব্যক্তির হাতে। তারা তা কখনোই মাটিতে
পড়তে দিতোনা’’। (মুসলিম, হাদীস ২৩২৫)
মিস্ওয়ার্
বিন্ মাখ্রামা ও মার্ওয়ান (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন:
‘‘অতঃপর
’উর্ওয়া নবী কারীম (সা.) এর সাহাবাদেরকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করছিলো। সে আশ্চর্য হয়ে
বললো: আল্লাহ্ তা’আলার কসম! রাসূল (সা.) কখনো এতটুকু কফ ফেলেননি যা তাদের কোন এক জনের
হাতে না পড়ে মাটিতে পড়েছে। অতঃপর সে তা দিয়ে নিজ মুখমন্ডল ও শরীর মলে নেয়নি। নবী (সা.)
তাদেরকে কোন কাজের আদেশ করতেই তারা তা করার জন্য দৌড়ে যেতো। আর তিনি ওযু করলে তাঁর
ওযুর পানি সংগ্রহের জন্য তারা উঠে পড়ে লাগতো’’। (বুখারী, হাদীস ২৭৩১, ২৭৩২)
উক্ত
হাদীস এবং এ সংক্রান্ত আরো অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদীস এটিই প্রমাণ করে যে, রাসূল সত্তা
এবং তাঁর শরীর থেকে নির্গত ঘাম, কফ, থুতু ইত্যাদি এবং তাঁর চুল ও ব্যবহৃত পোশাক পরিচ্ছদ,
থালা বাসন ইত্যাদিতে আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষভাবে এমন কিছু বরকত রেখেছেন যা তিনি অন্য
কোথাও রাখেননি।
তবে
দুনিয়ার কোথাও এ জাতীয় কোন কিছু পাওয়া গেলে সর্ব প্রথম সঠিক বর্ণনাসূত্রে আমাদেরকে
এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে, তা একমাত্র রাসূল (সা.) এর। অন্য কারোর নয়। কারণ, এ
জাতীয় কোন কিছু কারোর সংগ্রহে থেকে থাকলে একান্ত বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে সে মৃত্যুর
সময় তার কবরে তার সঙ্গে তা দাফন করার জন্য অবশ্যই অসিয়ত করে যাবে। বোকামি করে সে তা
কখনো কারোর জন্য রেখে যাবেনা। তবে ঘটনাক্রমে তা থেকেও যেতে পারে। এ জন্য আমাদেরকে অবশ্যই
এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।
২. আল্লাহ্’র যিকির ও নেককারদের সাথে বসে বরকত হাসিল করা:
এটিও
বহু বিশুদ্ধ হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ্ তা’আলার এমন অনেকগুলো ফিরিশ্তা রয়েছেন যারা পথে পথে ঘুরে বেড়ান এবং যিকিরকারীদের
অনুসন্ধান করেন। যখন তারা কোন জন সমষ্টিকে যিকির করতে দেখেন তখন তারা পরস্পরকে এ বলে
ডাকতে থাকেন যে, আসো! তোমাদের কাজ মিলে গেলো। অতঃপর তারা নিজ পাখাগুলো দিয়ে দুনিয়ার
আকাশ পর্যন্ত তাদেরকে বেষ্টন করে রাখেন। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন,
অথচ তিনি এ ব্যাপারে তাদের চাইতেও বেশি জানেন, আমার বান্দাহ্রা কি বলে? ফিরিশতারা বলেন:
তারা আপনার পবিত্রতা, বড়ত্ব, প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
তারা কি আমাকে দেখেছে? ফিরিশ্তারা বলেন: না, আল্লাহ্’র কসম! তারা আপনাকে দেখেনি। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: তারা আমাকে দেখতে পেলে কি করতো? ফিরিশ্তারা বলেন: তারা আপনাকে দেখতে পেলে
আরো বেশি ইবাদাত করতো। আরো অধিক আপনার সম্মান, প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করতো। আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: তারা আমার কাছে কি চায়? ফিরিশতারা বলেন: তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফিরিশ্তারা বলেন: না, আল্লাহ্’র কসম!
হে প্রভু! তারা জান্নাত দেখেনি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা জান্নাত দেখলে কি করতো?
ফিরিশ্তারা বলেন: তারা জান্নাত দেখতে পেলে জান্নাতের প্রতি তাদের উৎসাহ ও লোভ আরো বেড়ে
যেতো। আরো মরিয়া হয়ে জান্নাত কামনা করতো। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা কি বস্ত্ত থেকে
আমার আশ্রয় কামনা করে? ফিরিশতারা বলেন: জাহান্নাম থেকে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা
কি জাহান্নাম দেখেছে? ফিরিশ্তারা বলেন: না, আল্লাহ্’র কসম! হে প্রভু! তারা জাহান্নাম
দেখেনি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা জাহান্নাম দেখলে কি করতো? ফিরিশতারা বলেন: তারা
জাহান্নাম দেখতে পেলে জাহান্নামকে আরো বেশি ভয় পেতো এবং জাহান্নাম থেকে আরো বেশি পলায়নপর
হতো। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি: আমি তাদেরকে ক্ষমা করে
দিয়েছি। জনৈক ফিরিশতা বলেন: তাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে তাদের অন্তর্ভূত নয়।
বরং সে কোন এক প্রয়োজনে তাদের কাছে এসেছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তারা আমার উদ্দেশ্যেই
বসেছে। সুতরাং তাদের সাথে যে বসেছে সেও আমার রহমত হতে বঞ্চিত হতে পারে না’’। (বুখারী,
হাদীস ৬৪০৮ মুসলিম, হাদীস ২৬৮৯)
উক্ত
হাদীসে যিকিরের মজলিশ বিশেষ বরকত ও মাগফিরাতের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।
এমনকি ইহার বরকত এমন ব্যক্তির ভাগ্যেও জুটবে যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সে কোন এক
প্রয়োজনে তাদের সাথে বসেছে।
৩. যে কোন মসজিদে নামায ও ইবাদাতের মাধ্যমে বরকত গ্রহণ:
যে
কোন মসজিদে বিশেষভাবে তিনটি মসজিদে নামায ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে বরকত কামনা করা
শরীয়ত সম্মত। সে তিনটি মসজিদ হলো: মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে ’আকসা।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমার
মসজিদে এক ওয়াক্ত নামায পড়া অন্য মসজিদে হাজার ওয়াক্ত নামাযের চাইতেও উত্তম। তবে শুধু
মসজিদে হারাম। তাতে নামায পড়ার সাওয়াব আরো অনেক বেশি’’। (বুখারী, হাদীস ১১৯০ মুসলিম,
হাদীস ১৩৯৪ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৪২৪, ১৪২৬)
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমার
মসজিদে এক ওয়াক্ত নামায পড়া অন্য মসজিদে হাজার ওয়াক্ত নামাযের চাইতেও উত্তম। তবে শুধু
মসজিদে হারাম। কারণ, তাতে এক ওয়াক্ত নামায পড়া অন্য মসজিদে লক্ষ ওয়াক্ত নামাযের চাইতেও
উত্তম’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৪২৭ আহমাদ : ৩/৩৪৩, ৩৯৭)
আবু
যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমার
মসজিদে এক ওয়াক্ত নামায পড়া বাইতুল মাক্বদিসে চার ওয়াক্ত নামাযের চাইতেও উত্তম। ভাগ্যবান
সে মুসল্লী যে বাইতুল মাক্বদিসে নামায পড়েছে। অতি সন্নিকটে সে দিন যে দিন কারোর নিকট
তার ঘোড়ার রশি পরিমাণ জায়গা থাকাও অধিক পছন্দনীয় হবে দুনিয়া ও দুনিয়ার সব কিছুর চাইতে।
যে জায়গা থেকে সে বাইতুল মাক্বদিস দেখতে পাবে’’। (হাকিম্ : ৪/৫০৯ ইবনু ’আসাকির্ : ১/১৬৩-১৬৪
ত্বাহাবী/মুশকিলুল্ আসার্ : ১/২৪৮)
তবে
এ সকল মসজিদে নামায বা যে কোন ইবাদাতে বরকত রয়েছে বলে এ মসজিদগুলোর দেয়াল, পিলার, দরোজা,
চৌকাঠ ইত্যাদিতে এমন কোন বরকত নেই যা সেগুলো স্পর্শ করার মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।
কারণ, এ ব্যাপারে শরীয়তের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
৪. শরীয়ত স্বীকৃত খাদ্য, পানীয় বা ওষুধ কর্তৃক বরকত গ্রহণ:
শরীয়তের
দৃষ্টিতে যে যে খাদ্য, পানীয় বা ওষুধে বরকত রয়েছে যা কোর’আন বা হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত
তা নিম্নরূপ:
ক. যাইতুনের তেল কর্তৃক বরকত
গ্রহণ:
এ
তেল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘যা
প্রজ্বলিত করা হয় পূত-পবিত্র যাইতুন বৃক্ষের তেল দিয়ে যা প্রাচ্যেরও নয়, প্রতিচ্যেরও
নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও সে তেল যেন উজ্জ্বল আলো দেয়’’। (নূর : ৩৫)
’উমর,
আবু উসাইদ্ ও আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
যাইতুনের তেল খাও এবং শরীরে মালিশ করো। কারণ, তা বরকতময় গাছ থেকে সংগৃহীত’’। (তিরমিযী,
হাদীস ১৮৫১, ১৮৫২ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৩৮২ হাকিম্, হাদীস ৩৫০৪, ৩৫০৫ আহমাদ : ৩/৪৯৭)
খ. দুধ পান ও তাতে বরকত কামনা
করা:
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা যাকে কোন খাদ্য গ্রহণের সুযোগ দেন সে অবশ্যই বলবে: হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের
জন্য এতে বরকত দিন এবং আমাদেরকে এর চাইতেও আরো ভালো রিযিক দিন। আর যাকে আল্লাহ্ তা’আলা
দুধ পানের সুযোগ দেন সে অবশ্যই বলবে: হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের জন্য এতে বরকত দিন এবং
আমাদেরকে তা আরো বাড়িয়ে দিন। কারণ, আমি দুধ ছাড়া এমন অন্য কোন বস্ত্ত দেখছিনা যা একইসঙ্গে
খাদ্য ও পানীয়ের কাজ করে’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৩৮৫)
গ. মধু পান ও তা কর্তৃক উপশম
কামনা করা:
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘ওর
(মৌমাছি) উদর থেকে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় (মধু); যাতে রয়েছে মানুষের জন্য রোগমুক্তি’’।
(নাহল্ : ৬৯)
আবু
সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি নবী (সা.) কে বললেন: আমার ভাইয়ের পেটের রোগ (কলেরা) দেখা দিয়েছে। তিনি বললেন:
তাকে মধু পান করাও। সে আবারো এসে আপত্তি জানালো। রাসূল (সা.) আবারো বললেন: তাকে মধু
পান করাও। সে আবারো এসে আপত্তি জানালে নবী (সা.) আবারো বললেন: তাকে মধু পান করাও। সে
আবারো এসে বললো: আমি মধু পান করিয়েছি। কিন্তু কোন ফায়েদা হয়নি। তখন রাসূল (সা.) বললেন:
আল্লাহ্ তা’আলা সত্যিই বলেছেন: মধুর মধ্যে রোগের উপশম রয়েছে। তবে তোমার ভাইয়ের পেঠ
মিথ্যা বলছে। তাকে আবারো মধু পান করাও। অতঃপর সে আবারো মধু পান করালে তার ভাইয়ের পেটের
রোগ ভালো হয়ে যায়’’। (বুখারী, হাদীস ৫৬৮৪, ৫৭১৬ মুসলিম, হাদীস ২২১৭)
ঘ. যমযমের পানি কর্তৃক বরকত
গ্রহণ:
এর
মধ্যেও প্রচুর বরকত রয়েছে।
আবু
যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: যখন রাসূল (সা.) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মক্কা নগরীতে
এ ত্রিশ দিন পর্যন্ত তোমাকে কে খাইয়েছে? তখন আমি বললাম:
‘‘এতোদিন
যমযমের পানি ছাড়া কোন খাদ্য আমার নিকট ছিলনা। তবুও আমি মোটা হয়ে গিয়েছি। এমনকি আমার
পেটে ভাঁজ পড়ে গেছে এবং আমি খিদের কোন দুর্বলতা অনুভব করছিনে। রাসূল (সা.) বললেন: নিশ্চয়ই
যমযমের পানি বরকতময়। নিশ্চয়ই তা খাদ্য বৈ কি?’’ (মুসলিম, হাদীস ২৪৭৩)
অবৈধ
বা শির্ক জাতীয় তাবাররুক:
অবৈধ
বা শির্ক জাতীয় তাবার্রুক বলতে যে ধরনের ব্যক্তি, বস্ত্ত বা সময়ের মাধ্যমে বরকত কামনা
করা ইসলামী শরীয়তে নাজায়িয সে গুলোর মাধ্যমে বরকত কামনা করাকে বুঝানো হয়। তা আবার তিন
প্রকার:
১. বরকতের নিয়্যাতে কোন ঐতিহাসিক
জায়গা ভ্রমণ বা কোন বস্ত্ত স্পর্শ করণ:
যেমন:
বরকতের নিয়্যাতে আরক্বাম্ বিন্ আরক্বাম্ সাহাবীর ঘর, হেরা ও সাউর গিরিগুহা যিয়ারাত
এবং কোন কোন মসজিদ বা মাযারের দেয়াল, জানালা, চৌকাঠ বা দরোজা স্পর্শ বা চুমু দেয়া ইত্যাদি।
এ সব বিদ্’আত, শির্ক ও না জায়িয কাজ। কারণ, বরকত গ্রহণ একটি ইবাদাত যা অবশ্যই শরীয়ত
সম্মত হতে হবে। যদি এগুলোতে কোন বরকত থাকতো তা হলে অবশ্যই রাসূল (সা.) তা নিজ উম্মাতকে
জানিয়ে দিতেন এবং সাহাবায়ে কিরামও অবশ্যই এ গুলোতে বরকত কামনা করতেন। কারণ, তাঁরা কোন
পুণ্যময় কর্মে আমাদের চাইতে কোনভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। যখন তাঁরা এতে কোন বরকত দেখেননি
তাহলে কি করে আমরা সেগুলোতে বরকত কামনা করতে যাবো। তা একেবারেই যুক্তি বহির্ভূত।
রাসূল
(সা.) কোন বস্ত্ত কর্তৃক বরকত হাসিলকে মূর্তিপূজার সাথে তুলনা করেছেন।
আবু
ওয়াক্বিদ্ লাইসী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) যখন ’হুনাইন্ অভিমুখে রওয়ানা করলেন তখন পথিমধ্যে তিনি মুশরিকদের ‘‘যাতু আন্ওয়াত’’
নামক একটি গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যার উপর তারা যুদ্ধের অস্ত্রসমূহ বরকতের আশায়
টাঙ্গিয়ে রাখতো। তখন সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি আমাদের জন্যও একটি গাছ
ঠিক করে দিন যেমনিভাবে মুশরিকদের জন্য একটি গাছ রয়েছে। নবী (সা.) বললেন: আশ্চর্য! তোমরা
সে দাবিই করছো যা মূসা (আ.) এর সম্প্রদায় তাঁর নিকট করেছিলো। তারা বলেছিলো: হে মূসা!
আপনি আমাদের জন্যও একটি মূর্তি বা মা’বূদ ঠিক করে দিন যেমনিভাবে অন্যদের অনেকগুলো মূর্তি
বা মা’বূদ রয়েছে। (আ’রাফ : ১৩৮)
রাসূল
(সা.) বললেন: ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার জীবন। তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীদের
হুবহু অনুসারী হবে। (তিরমিযী, হাদীস ২১৮০ ’হুমাইদী, হাদীস ৮৪৮ ত্বায়ালিসী, হাদীস ১৩৪৬
আব্দুর্ রায্যাক্ব, হাদীস ২০৭৬৩ ইবনু হিববান্/মাওয়ারিদ্, হাদীস ১৮৩৫ ত্বাবারানী/কাবীর,
হাদীস ৩২৯০, ৩২৯৪)
২. শরীয়ত অসম্মত কোন সময়
কর্তৃক বরকত কামনা করণ:
যেমন:
নবী (সা.) এর জন্ম দিন, মি’রাজের রাত্রি এবং হিজরত, বদর যুদ্ধ ইত্যাদির দিনকে বরকতময়
মনে করা।
যদি
এ সময় গুলোতে কোন বরকত থাকতো তা হলে রাসূল (সা.) অবশ্যই তা নিজ উম্মাতকে শিখিয়ে যেতেন
এবং সাহাবায়ে কিরামও তা অবশ্যই পালন করতেন। যখন তাঁরা তা করেননি তা হলে বুঝা গেলো এতে
কোন বরকত নেই। বরং তা কর্তৃক বরকত গ্রহণ বিদ্’আত ও শির্ক।
৩.
কোন বুযুর্গ ব্যক্তি বা তদীয় নিদর্শনসমূহ কর্তৃক বরকত গ্রহণ:
ইতিপূর্বে
দলীল-প্রমাণসহ উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র রাসূল (সা.) এবং তাঁর
শরীর থেকে নির্গত ঘাম, কফ, থুতু ইত্যাদি এবং তাঁর চুল ও ব্যবহৃত পোশাক পরিচ্ছদ, থালা
বাসন ইত্যাদিতে আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষভাবে এমন কিছু বরকত রেখেছেন যা তিনি অন্য কোথাও
রাখেননি।
কেউ
কেউ ভাবতে পারেন যে, রাসূল (সা.) ও তদীয় নিদর্শনসমূহ কর্তৃক যখন বরকত হাসিল করা জায়িয
তখন অবশ্যই ওলী-বুযুর্গ ও তদীয় নিদর্শনসমূহ কর্তৃক বরকত হাসিল করাও জায়িয হতে হবে।
কারণ, তাঁরা নবীর ওয়ারিশ।
উত্তরে
বলতে হবে যে, প্রবাদে বলে: কোথায় আব্দুল আর কোথায় খালকূল। কোথায় রাসূল (সা.) আর কোথায়
আমাদের ধারণাকৃত বুযুর্গরা। আর যদ অবশ্যই আবু বকর, ’উমর, ’উস্মান, ’আলী ও জান্নাতের
সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কিরাম এর সত্তা ও নিদর্শনাবলী কর্তৃক বরকত হাসিল করতেন। যখন
তাঁরা তা করতে যাননি। তাহলে বুঝা যায়, এ রকম তুলনা করা সত্যিই বোকামো।ি উভয়ের মধ্যে
তুলনা করা সম্ভবই হতো তাহলে সাধারণ সাহাবায়ে কিরাম
অন্য
দিকে আমরা কাউকে নিশ্চিতভাবে ওলী বা বুযুর্গ বলে ধারণা করতে পারি না। কারণ, বুযুর্গী
বলতে সত্যিকারার্থে অন্তরের বুযুর্গীকেই বুঝানো হয়। আর এ ব্যাপারে কোর’আন ও হাদীসের
মাধ্যম ছাড়া কেউ কারোর ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। শুধু আমরা কারোর সম্পর্কে এতটুকুই
বলতে পারি যে, মনে হয় তিনি একজন আল্লাহ্’র ওলী। সুতরাং তাঁর ভালো পরিসমাপ্তির আশা করা
যায়। নিশ্চয়তা নয়। এমনো তো হতে পারে যে, আমরা জনৈক কে বুযুর্গ মনে করছি। অথচ সে মৃত্যুর
সময় ঈমান নিয়ে মরতে পারেনি।
আরেকটি
বিশেষ কথা এই যে, আমাদের ধারণাকৃত কোন বুযুর্গের সাথে বরকত নেয়ার আচরণ দেখানো হলে তাতে
তাঁর উপকার না হয়ে বেশিরভাগ অপকারই হবে। কারণ, এতে করে তাঁর মধ্যে গর্ব, আত্মম্ভরিতা
ও নিজকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবার রোগ জন্ম নেয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা কারোর সম্মুখবর্তী
প্রশংসারই শামিল যা শরীয়তে নিষিদ্ধ।
৫. যাদুর শির্ক:
যাদুর
শির্ক বলতে এমন কতোগুলো মন্ত্র বা অবোধগম্য শব্দসমষ্টিকে বুঝানো হয় যা যাদুকর নিজ মুখ
দিয়ে উচ্চারণ করে থাকে। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন ওষুধ, সুতায় গিরা বা ধুনা দিয়েও যাদু
করা হয়।
এগুলো
সব শয়তানের কাজ। তবে আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছায় কখনো কখনো তা কারো কারোর অন্তরে বা শরীরে
বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যদ্দরুন কেউ কেউ কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং
কারো কারোকে এরই মাধ্যমে হত্যা করা হয়। আবার কখনো কখনো এরই কারণে স্বামী ও স্ত্রীর
মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি হয়। আরো কতো কি।
সর্ব
সাকুল্য দু’টি কারণেই যাদু শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কারণ দু’টি নিম্নরূপ:
১. এগুলো করতে গেলে জিনদের সহযোগিতা নেয়ার
জন্য তাদের নামে মানত বা কোরবানি দিতে হয়। কিংবা যে কোনভাবে তাদের নৈকট্য লাভ করতে
হয়। যা শির্কের অন্তর্গত।
২. জাদুকররা ইল্মুল্ গাইবের দাবি করে থাকে।
তাও একটি মারাত্মক শির্ক বৈ কি?
উক্ত
কারণেই রাসূল (সা.) যাদুর ব্যাপারটিকে শির্কের পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
সর্বনাশা সাতটি গুনাহ্ থেকে বিরত থাকো। সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! ওগুলো
কি? তিনি বললেন: আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে অংশীদার করা, যাদুর আদান-প্রদান, অবৈধভাবে
কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীম-অনাথের সম্পদ ভক্ষণ, সম্মুখযুদ্ধ থেকে পলায়ন ও
সতী-সাধ্বী মু’মিন মহিলাদের ব্যাপারে কুৎসা রটানো’’। (বুখারী, হাদীস ২৭৬৬, ৬৮৫৭ মুসলিম,
হাদীস ৮৯)
যাদু
বাস্তবিকপক্ষে একটি মহা ক্ষতিকর বস্ত্ত। যা বিশ্বাস না করে কোন উপায় নেই। তবে আল্লাহ্
তা’আলার একান্ত ইচ্ছা ছাড়া তা এককভাবে কারোর কোন ক্ষতি করতে পারে না।
আমাদের
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কেও যাদু করা হয়েছে এবং তা আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত
ইচ্ছায় তাঁর প্রচুর ক্ষতি সাধন করেছে।
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘নবী
(সা.) কে যাদু করা হয়েছে। তখন এমন মনে হতো যে, তিনি কোন একটি কাজ করেছেন অথচ তিনি সে
কাজটি আদৌ করেননি। একদা তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট করুণ প্রার্থনা করেন।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: তুমি জানো কি? আল্লাহ্ তা’আলা আমার চিকিৎসা বাতলে দিয়েছেন।
আমার নিকট দু’জন ফিরিশ্তা আসলেন। তম্মধ্যে এক জন আমার মাথার নিকট আর অপর জন আমার পায়ের
নিকট বসলেন। অতঃপর একে অপরকে জিজ্ঞাসা করলেন: লোকটির সমস্যা কি? অপর জন বললেন: তাঁকে
যাদু করা হয়েছে। আবারো প্রথম জন জিজ্ঞাসা করলেন: কে যাদু করেছে? অপর জন বললেন: লাবীদ
বিন্ আ’সাম্। আবারো প্রথম জন জিজ্ঞাসা করলেন: কি জিনিস দিয়ে সে যাদু করলো? অপর জন বললেন:
চিরুনি, দাড়ি বা কেশ দিয়ে। যা রাখা হয়েছে নর খেজুরের মুকুলের আবরণে। আবারো প্রথম জন
জিজ্ঞাসা করলেন: তা কোথায় ফেলানো হয়েছে? অপর জন বললেন: যার্ওয়ান কূপে। অতঃপর রাসূল
(সা.) সে কুয়ায় গিয়ে পুনরায় ফিরে এসে ’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) কে বললেন: কুয়ো পাশের
খেজুর গাছ গুলোকে শয়তানের মাথার ন্যায় মনে হয়। ’আয়েশা জিজ্ঞাসা করলেন: জিনিস গুলো উঠিয়ে
ফেলেননি? রাসূল (সা.) বললেন: না, আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন। তবে আমার
ভয় হয়, ব্যাপারটি ভবিষ্যতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। অতঃপর কুয়োটি ভরাট করে দেয়া হয়’’।
(বুখারী, হাদীস ৩১৭৫, ৩২৬৮, ৫৭৬৩, ৫৭৬৫, ৫৭৬৬, ৬০৬৩, ৬৩৯১ মুসলিম, হাদীস ২১৮৯)
যাদু
কুফরও বটে। তেমনিভাবে তা ক্ষতিকরও। তবে তা আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত ইচ্ছা ছাড়া কারোর
কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে না।
আল্লাহ
তা’আলা বলেন:
‘‘সুলাইমান
(আ.) এর রাজত্বকালে শয়তানরা যাদুকরদেরকে যা শেখাতো ইহুদীরা তারই অনুসরণ করেছে। সুলাইমান
(আ.) কখনো কুফুরি করেননি। বরং শয়তানরাই কুফুরি করেছে, তারা লোকদেরকে যাদু শেখাতো বাবেল
শহরে বিশেষ করে হারূত-মারূত ব্যক্তিদ্বয়কে। (জিবরীল ও মীকাঈল) ফিরিশতাদ্বয়ের উপর কোন
যাদু অবতীর্ণ করা হয়নি (যা ইহুদিরা ধারণা করতো)। তবে উক্ত ব্যক্তিদ্বয় কাউকে যাদু শিক্ষা
দিতো না যতক্ষণ না তারা বলতো: আমরা পরীক্ষাসরূপ মাত্র। অতএব তোমরা (যাদু শিখে) কুফরী
করো না। এতদ্সত্ত্বেও তারা ব্যক্তিদ্বয় থেকে তাই শিখতো যা দিয়ে তারা স্বামী স্ত্রীর
মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতো। তবে তারা আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়া তা কর্তৃক কারোর ক্ষতি করতে
পারতো না। তারা তাই শিখেছে যা তাদের একমাত্র ক্ষতিই সাধন করবে। সামান্যটুকুও উপকার
করতে পারবে না। তারা নিশ্চিতভাবেই জানে যে, যে ব্যক্তি যাদু শিখেছে তার জন্য পরকালে
কিছুই নেই। তারা যে যাদু ও কুফরীর বিনিময়ে নিজ সত্তাকে বিক্রি করে দিয়েছে তা সত্যিই
নিকৃষ্ট, যদি তারা তা জানতো’’। (সূরা বাকারাহ : ১০২)
যাদুকরের
শাস্তি হচ্ছে, কারো ব্যাপারে তা সত্যিকারভাবে প্রমাণিত হলে তাকে হত্যা করা। এ ব্যাপারে
সাহাবাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
জুনদুব
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘যাদুকরের
শাস্তি তলোয়ারের কোপ তথা শিরশ্ছেদ’’। (তিরমিযী, হাদীস ১৪৬০)
জুনদুব
(রা.) শুধু এ কথা বলেই ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি তা বাস্তবে কার্যকরী করেও দেখিয়েছেন।
আবু
’উসমান নাহ্দী (রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘ইরাকে
ওয়ালীদ্ বিন্ ’উক্ববার সম্মুখে জনৈক ব্যক্তি খেলা দেখাচ্ছিলো। সে আরেক ব্যক্তির মাথা
কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। এতে আমরা খুব বিস্মিত হলে লোকটি কর্তিত মাথা খানি
যথাস্থানে ফিরিয়ে দিলো। ইতিমধ্যে হযরত জুনদুব (রা.) এসে তাকে হত্যা করলেন’’। (বুখারী/আততা’রীখুল্
কাবীর : ২/২২২ বায়হাক্বী : ৮/১৩৬)
তেমনিভাবে
উম্মুল্ মু’মিনীন ’হাফ্সা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ও নিজ ক্রীতদাসীকে জাদুকর প্রমাণিত হওয়ার
পর হত্যা করে।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘’হাফ্সা
বিন্ত ’উমর (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) কে তাঁর এক ক্রীতদাসী যাদু করে। এমনকি সে এ ব্যাপারটি
স্বীকার করে এবং যাদুর বস্ত্তটি উঠিয়ে ফেলে দেয়। এতদ্ কারণে ’হাফ্সা ক্রীতদাসীকে হত্যা
করে। সংবাদটি ’উসমান (রা.) এর নিকট পৌঁছুলে তিনি রাগান্বিত হন। অতঃপর আব্দুল্লাহ্ বিন্
’উমর (রা.) তাঁকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললে তিনি এ ব্যাপারে চুপ হয়ে যান তথা তাঁর সন্তুষ্টি
প্রকাশ করেন। বর্ণনাকারী বলেন: ’উসমান (রা.) এর অনুমতি না নিয়ে ক্রীতদাসীকে হত্যা করার
কারণেই তিনি রাগান্বিত হন’’। (’আব্দুর রায্যাক, হাদীস ১৮৭৪৭ বায়হাক্বী : ৮/১৩৬)
অনুরূপভাবে
’উমর (রা.) ও তাঁর খিলাফতকালে সকল যাদুকর পুরুষ ও মহিলাকে হত্যা করার আদেশ জারি করেন।
বাজালা
(রাহিমাহুল্লাহ্) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘’উমর
(রা.) নিজ খিলাফতকালে এ আদেশ জারি করে চিঠি পাঠান যে, তোমরা সকল যাদুকর পুরুষ ও মহিলাকে
হত্যা করো। বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আমরা তিনজন মহিলা যাদুকরকে হত্যা করি’’।
(আবু
দাউদ, হাদীস ৩০৪৩ বায়হাকী : ৮/১৩৬ ইবনু আবী শাইবাহ্, হাদীস ২৮৯৮২, ৩২৬৫২ আব্দুর রায্যাক,
হাদীস ৯৯৭২ আহমাদ, হাদীস ১৬৫৭ আবু ইয়া’লা, হাদীস ৮৬০, ৮৬১)
’উমর
(রা.) এর খিলাফতকালে উক্ত আদেশের ব্যাপারে কেউ কোন বিরোধিতা দেখাননি বিধায় উক্ত ব্যাপারে
সবার ঐকমত্য রয়েছে বলে প্রমাণ করে।
যাদুকর
কখনো সফলকাম হতে পারে না। দুনিয়াতেও নয়। আখিরাতেও নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘যাদুকর
কোথাও সফলকাম হতে পারে না’’। (ত্বা-হা : ৬৯)
যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির চিকিৎসা:
যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির চিকিৎসা দু’ ধরনের:
১. যাদুগ্রস্ত হওয়ার আগে। তা হচ্ছে রক্ষামূলক।
আর তা হবে শরীয়ত সম্মত দো’আ ও যিকিরের মাধ্যমে। যেমন: সকাল-সন্ধ্যা ও প্রতি ফরয নামাযের
পর আয়াতুল কুর্সী এক বার এবং সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস তিন তিন বার পাঠ করা। প্রতি
রাতে শোয়ার সময় সূরা বাক্বারাহ্’র শেষ দু’ আয়াত পাঠ করা এবং বেশি বেশি আল্লাহ্’র যিকির
ও নিম্নোক্ত দো’আ দু’টো পাঠ করা।
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ
اللهِ التَّامَّاتِ
مِنْ شَرِّ
مَا خَلَقَ
بِسْمِ اللهِ
الَّذِيْ لاَ
يَضُرُّ مَعَ
اسْمِهِ شَيْءٌ
فِيْ الْأَرْضِ
وَلاَ فِيْ
السَّمَاءِ وَهُوَ
السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
২. যাদুগ্রস্ত হওয়ার পর। আর তা হচ্ছে,
প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ রোগ উপশমের জন্য সবিনয়ে আকুতি জানাতে হবে। দ্বিতীয়তঃ
শরীয়ত সম্মত দো’আ ও যিকিরের আশ্রয় নিতে হবে। আর তা হচ্ছে নিম্নরূপ:
#
সূরা ফাতিহা, কা’ফিরূন্, ইখ্লাস্, ফালাক্ব, নাস্ ও আয়াতুল্ কুরসী পাঠ করবে।
#
নিম্নোক্ত যাদুর আয়াতসমূহ পাঠ করবে।
«
وَأَوْحَيْنَا إِلَى
مُوْسَى أَنْ
أَلْقِ عَصَاكَ،
فَإِذَا هِيَ
تَلْقَفُ مَا
يَأْفِكُوْنَ، فَوَقَعَ
الْـحَقُّ وَبَطَلَ
مَا كَانُوْا
يَعْمَلُوْنَ، فَغُلِبُوْا
هُنَالِكَ وَانْقَلَبُوْا
صَاغِـرِيْنَ، وَأُلْقِيَ
السَّحَرَةُ سَاجِدِيْنَ،
قَالُوْا آمَنَّا
بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ،
رَبِّ مُوْسَى
وَهَارُوْنَ »
(আ’রাফ
: ১১৭-১২২)
«
وَقَالَ فِرْعَوْنُ
ائْتُوْنِيْ بِكُلِّ
سَاحِرٍ عَلِيْمٍ،
فَلَمَّا جَآءَ
السَّحَرَةُ قَالَ
لَـهُمْ مُوْسَى
أَلْقُوْا مَا
أَنْتُمْ مُلْقُوْنَ،
فَلَمَّا أَلْقَوْا
؛ قَالَ
مُوْسَى: مَا
جِئْتُمْ بِهِ
السِّحْرُ، إِنَّ
اللهَ سَيُبْطِلُهُ،
إِنَّ اللهَ
لاَ يُصْلِحُ
عَمَلَ الْـمُفْسِدِيْنَ،
وَيُحِقُّ اللهُ
الْـحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ،
وَلَوْ كَرِهَ
الْـمُجْرِمُوْنَ »
(ইউনুস্
: ৭৯-৮২)
«
قَالُوْا يَا
مُوْسَى إِمَّا
أَنْ تُلْقِيَ
وَإِمَّا أَنْ
نَكُوْنَ أَوَّلَ
مَنْ أَلْقَى،
قَالَ بَلْ
أَلْقُوْا فَإِذَا
حِبَالُـهُمْ وَعِصِيُّهُمْ
يُخَيُّلُ إِلَيْهِ
مِنْ سِحْرِهِمْ
أَنَّهَا تَسْعَى،
فَأَوْجَسَ فِيْ
نَفْسِهِ خِيْفَةً
مُوْسَى، قُلْنَا
لاَ تَخَفْ
إِنَّكَ أَنْتَ
الْأَعْلَى، وَأَلْقِ
مَا فِيْ
يَمِيْنِكَ تَلْقَفْ
مَا صَنَعُوْا،
إِنَّمَا صَنَعُوْا
كَيْدُ سَاحِرٍ،
وَلاَ يُفْلِحُ
السَّاحِرُ حَيْثُ
أَتَى » (ত্বা-হা : ৬৫-৬৯)
«
قَالُوْا أَرْجِهْ
وَأَخَاهُ وَابْعَثْ
فِيْ الْـمَدآيِنِ
حَاشِرِيْنَ، يَأْتُوْكَ
بِكُلِّ سَحَّارٍ
عَلِيْمٍ، فَجُمِعَ
السَّحَرَةُ لِـمِيْقَاتِ
يَوْمٍ مَعْلُوْمٍ،
وَقِيْلَ لِلنَّاسِ
هَلْ أَنْتُمْ
مُجْتَمِعُوْنَ، لَعَلَّنَا
نَتَّبِعُ السَّحَرَةَ
إِنْ كَانُوْا
هُمُ الْغَالِبِيْنَ،
فَلَمَّا جَآءَ
السَّحَرَةُ قَالُوْا
لِفِرْعَوْنَ أَئِنَّ
لَنَا لَأَجْرًا
إِنْ كُنَّا
نَحْنُ الْغَالِبِيْنَ،
قَالَ نَعَمْ
وَإِنَّكُمْ إِذًا
لَمِنَ الْـمُقَرَّبِيْنَ،
قَالَ لَـهُمْ
مُوْسَى أَلْقُوْا
مَا أَنْتُمْ
مُلْقُوْنَ، فَأَلْقَوْا
حِبَالَـهُمْ وَعِصِيَّهُمْ
وَقَالُوْا بِعِزَّةِ
فِرْعَوْنَ إِنَّا
لَنَحْنُ الْغَالِبُوْنَ،
فَأَلْقَى مُوْسَى
عَصَاهُ فَإِذَا
هِيَ تَلْقَفُ
مَا يَأْفِكُوْنَ،
فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ
سَاجِدِيْنَ، قَالُوْا
آمَنَّا بِرَبِّ
الْعَالَمِيْنَ» (শু’আরা : ৩৬-৪৭)
#
নিম্নোক্ত শিফার আয়াত ও দো’আসমূহ পাঠ করবে।
«
يَا أَيُّهَا
النَّاسُ قَدْ
جَآءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ
مِنْ رَبِّكُمْ
وَشِفَآءٌ لـِمَا
فِيْ الصُّدُوْرِ
وَهُدًى وَرَحْمَةٌ
لِلْمُؤْمِنِيْنَ » (ইউনুস্ : ৫৭)
«وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا
أَعْجَمِيًّا لَقَالُوْا
لَوْلاَ فُصِّلَتْ
آيَاتُهُ، أَأَعْجَمِيٌّ
وَعَرَبِيٌّ، قُلْ
هُوَ لِلَّذِيْنَ
آمَنُوْا هُدًى
وَشِفَآءٌ، وَالَّذِيْنَ
لاَ يُؤْمِنُوْنَ
فِيْ آذَانِهِمْ
وَقْرٌ وَهُوَ
عَلَيْهِمْ عَمًى،
أُوْلآئِكَ يُنَادَوْنَ
مِنْ مَّكَانٍ
بَعِيْدٍ » (হা-মীম আসসাজদাহ্ : ৪৪)
اللَّهُمَّ رَبَّ
النَّاسِ أَذْهِبِ
الْبَأْسَ، وَاشْفِ
أَنْتَ الشَّافِيْ
لاَ شِفَاءَ
إِلاَّ شِفَاؤُكَ
شِفَاءً لاَ
يُغَادِرُ سَقَمًا
بِسْمِ اللهِ
أَرْقِيْكَ، مِنْ
كُلِّ شَيْءٍ
يُؤْذِيْكَ، وَمِنْ
شَرِّ كُلِّ
نَفْسٍ أَوْ
عَيْنِ حَاسِدٍ،
اللهُ يَشْفِيْكَ،
بِسْمِ اللهِ
أَرْقِيْكَ
যাদুর
সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, যাদু কর্মটি কোথায় বা কি দিয়ে করা হয়েছে তা
ভালোভাবে জেনে সে বস্ত্তটি সমূলে বিনষ্ট করে দেয়া।
অপর
দিকে যাদুর চিকিৎসা যাদু দিয়ে করা যা আরবী ভাষায় নুশরাহ্ নামে পরিচিত তা সম্পূর্ণরূপে
হারাম। কারণ, তা শয়তানের কাজ।
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) কে নুশ্রাহ্ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি
বলেন:
‘‘তা
(নুশরাহ্) শয়তানি কর্মসমূহের অন্নতম’’।
(আবু
দাউদ, হাদীস ৩৮৬৮ আহমাদ : ৩/২৯৪ আব্দুর রাযযাক্ব : ১১/১৩)
শরীয়তের
দৃষ্টিতে যাদুকরের নিকট যাওয়াই হারাম। বরং তা কুফরিও বটে। চাই তা চিকিৎসা গ্রহণের জন্যই
হোক অথবা যে কোন উদ্দেশ্যেই হোকনা কেন।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাসঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন গণক বা যাদুকরের নিকট গেলো এবং তার কথা বিশ্বাস করলো তৎক্ষণাৎ সে কাফির
হয়ে গেলো’’। (ত্বাবারানী/কাবীর খন্ড ১০ হাদীস ১০০০৫)
’ইমরান
বিন্ ’হুসাইন ও ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল (সা.)
ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন কর্ম যাত্রার অশুভতা নির্ণয় করে অথবা যার জন্য তা করা হয় এবং যে ব্যক্তি
ভবিষ্যদ্বাণী করে অথবা যার জন্য তা করা হয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি যাদু করে অথবা যার
জন্য তা করা হয় এ সকল ব্যক্তি আমার উম্মত নয়’’। (বায্যার : ৩০৪৩, ৩০৪৪)
৬. গণনার শির্কঃ
গণনার
শির্ক বলতে যে কোন পন্থায় বা যে কোন বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করাকে বুঝানো হয়।
এর
মূল হচ্ছে ঐশী বাণী চুরি। অর্থাৎ জিনরা কখনো কখনো ফিরিশ্তাদের কথা চুরি করে গণকদের
কানে পৌঁছিয়ে দেয়। অতঃপর গণকরা এর সাথে আরো শত শত মিথ্যা কথা জুড়িয়ে মানুষকে বলে বেড়ায়।
তাই তাদের কথা কখনো কখনো সত্য প্রমাণিত হয়।
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘সাহাবায়ে
কিরাম নবী (সা.) কে গণকদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: তারা কিছুই নয়। তখন সাহাবারা
বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! তারা কখনো কখনো সত্য কথা বলে থাকে। তখন তিনি বললেন: সে
সত্য কথাটি ঐশী বাণী। জিনরা ফিরিশ্তাদের মুখ থেকে তা ছোঁ মেরে নিয়ে মুরগির করকর ধ্বনির
ন্যায় তাদের ভক্তদের কানে পৌঁছিয়ে দেয়। অতঃপর তারা এর সাথে আরো শত শত মিথ্যা কথা জুড়িয়ে
দেয়।
(বুখারী,
হাদীস ৫৭৬২, ৬২১৩, ৭৫৬১ মুসলিম, হাদীস ২২২৮ বাগাওয়ী, হাদীস ৩২৫৮ আব্দুর রায্যাক, হাদীস
২০৩৪৭ বায়হাক্বী : ৮/১৩৮ আহমাদ : ৬/৮৭)
গণনা বা ভবিষ্যদ্বাণী করা
দু’টি কারণেই শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কারণ দু’টি নিম্নরূপ:
১. এগুলো করতে গেলে জিনদের সহযোগিতা নেয়ার
জন্য তাদের নামে মানত বা কোরবানি দিতে হয় কিংবা যে কোন ভাবে তাদের নৈকট্য লাভ করতে
হয়। যা শির্কের অন্তর্গত।
২. গণকরা ইল্মুল্ গায়েবের দাবি করে থাকে।
তাও একটি মারাত্মক শির্ক বৈ কি?
গণকের
নিকট যাওয়াই শরীয়ত বিরোধী তথা হারাম কাজ। বরং কুফরিও বটে।
মু’আবিয়া
বিন্ ’হাকাম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমি
বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল! বেশি দিন হয়নি আমি বরবর ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে
মুসলমান হওয়ার তাওফীক দিয়েছেন। আর এ দিকে আমাদের অনেকেই গণকদের নিকট আসা যাওয়া করে।
তাদের নিকট যেতে কোন অসুবিধে আছে কি? তখন রাসূল (সা.) বললেন: তাদের নিকট কখনো যেও না।
(মুসলিম,
হাদীস ৫৩৭ আবু দাউদ, হাদীস ৯৩০, ৩৯০৯ ইবনু হিববান/ইহ্সান, হাদীস ২২৪৪, ২২৪৫ নাসায়ী
: ৩/১৪-১৬ বায়হাক্বী : ২/২৪৯-২৫০ ইবনু আবী শাইবাহ্ : ৮/৩৩ আহমাদ : ৫/৪৪৭)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাসঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন গণক বা যাদুকরের নিকট গেলো এবং তার কথা বিশ্বাস করলো তখনই সে মুহাম্মাদ
(সা.) এর প্রতি অবতীর্ণ বিধান তথা কুর’আন মাজীদকে অস্বীকার করলো অর্থাৎ কাফির হয়ে গেলো’’।
(ত্বাবারানী/কাবীর খন্ড ১০ হাদীস ১০০০৫)
’ইম্রান
বিন্ ’হুসাইন ও ’আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল (সা.)
ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন কর্ম যাত্রার অশুভতা নির্ণয় করে অথবা যার জন্য তা করা হয় এবং যে ব্যক্তি
আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করে অথবা যার জন্য তা করা হয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি যাদু করে অথবা
যার জন্য তা করা হয় এ সকল ব্যক্তি আমার উম্মত নয়’’। (বায্যার, হাদীস ৩০৪৩, ৩০৪৪)
গণককে
কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে জিজ্ঞাসাকারীর চল্লিশ দিনের নামায বিনষ্ট হয়ে যায়।
’হাফসা
(রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন গণকের নিকট গেলো এবং তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলো তাতে করে তার চল্লিশ
দিনের নামায কবুল করা হবেনা’’। (মুসলিম, হাদীস ২২৩০)
অপর
দিকে গণকের কথা বিশ্বাস করলে বিশ্বাসকারী সাথে সাথে কাফির হয়ে যায়।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন ঋতুবতী মহিলার সাথে সহবাস করলো অথবা কোন মহিলার মলদ্বার ব্যবহার করলো অথবা
কোন গণকের নিকট গেলো এবং তার কথা বিশ্বাস করলো তখনই সে মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি অবতীর্ণ
বিধান তথা কুর’আন মাজীদকে অস্বীকার করলো অর্থাৎ কাফির হয়ে গেলো’’।
(তিরমিযী,
হাদীস ১৩৫ আবু দাউদ, হাদীস ৩৯০৪ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৬৪৪ ত্বাহাওয়ী/মুশকিলুল্ আ-সার,
হাদীস ৬১৩০ ইবনুল্ জারূদ/মুনতাক্বা, হাদীস ১০৭ বায়হাক্বী : ৭/১৯৮ আহমাদ : ২/৪০৮, ৪৭৬)
৭. জ্যোতিষীর শির্কঃ
জ্যোতিষীর
শির্ক বলতে রাশি-নক্ষত্রের সাহায্যে ভূমন্ডলে ঘটিতব্য ঘটনাঘটনসমূহের আগাম ভবিষ্যদ্বাণী
করাকে বুঝানো হয়। যেমন: আকাশের কোন লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বৃষ্টি, বন্যা, শীত, গরম,
মহামারী ইত্যাদির আগাম সংবাদ দেয়া।
সর্ব
সাকুল্য দু’টি কারণেই জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা করা শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কারণ দু’টি নিম্নরূপ:
১. জ্যোতিষীরা এ কথা দাবি করে থাকে যে,
নক্ষত্রাদি স্বেচ্ছা স্বয়ংক্রিয়। যে কোন অঘটন এদেরই প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ জাতীয় ধারণা সর্বসম্মতিক্রমে কুফরি। কারণ, এটি হচ্ছে এক আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য
আরেকটি কর্তৃত্বশীল সৃষ্টিকর্তা মানার শামিল।
২. গ্রহ-নক্ষত্রাদির কক্ষপথ পরিভ্রমণ,
সম্মিলন বা বিক্ষিপ্ত অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে কোন অঘটন প্রমাণ করা। এটিও একটি হারাম
কাজ। কারণ, তা ইল্মুল্ গায়েবের দাবি বৈ কি? তেমনিভাবে তা যাদুরও অন্তর্গত।
আবু
মিহজান্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমি
আমার মৃত্যৃর পর আমার উম্মতের উপর তিনটি বস্ত্তর আশঙ্কা করছি। নেতৃস্থানীয়দের যুলুম-অত্যাচার,
রাশি-নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাস ও তাক্বদীরে (ভাগ্যে) অবিশ্বাস’’। (ইবনু ’আব্দিল্ বার্
/জা-মি’উ বায়ানিল্ ’ইল্মি ওয়া ফায্লিহি : ২/৩৯)
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমি
আমার মৃত্যুর পর আমার উম্মতের উপর দু’টি চরিত্রের আশঙ্কা করছি। রাশি-নক্ষত্রের প্রতি
বিশ্বাস ও তাক্বদীরে (ভাগ্যে) অবিশ্বাস’’। (আবু ইয়া’লা, হাদীস ১০২৩ ইবনু ’আদি’/কা-মিল:
৪/৩৪)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি রাশি-নক্ষত্রের জ্ঞান শিখলো সে যেন যাদুর কোন একটি বিভাগ শিখে নিলো। সুতরাং
যত বেশি সে রাশি-নক্ষত্রের জ্ঞান শিখলো তত বেশি সে যাদু শিখলো’’। (আবু দাউদ, হাদীস
৩৯০৫ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৭৯৪ আহমাদ : ১/৩১১)
আল্লাহ্ তা’আলা এ গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে তিনটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। যা
নিম্নরূপ:
১. আকাশের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য।
২. তা নিক্ষেপ করে শয়তানকে তাড়ানোর জন্য।
যাতে তারা যে কোন বিষয়ে আল্লাহ্ তা’আলার সিদ্ধান্ত মূলক বাণী চুরি করে শুনতে না পায়।
৩. দিক নির্ণয় তথা পথ নির্ধারণের জন্য।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আমি
দুনিয়ার আকাশকে সুশোভিত করেছি গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে এবং ওগুলোকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের
উপকরণ’’। (মুলক : ৫)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘আর
তিনিই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন নক্ষত্ররাজিকে যেন তোমরা এগুলোর মাধ্যমে জল ও স্থলের
অন্ধকারে সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারো’’। (আন’আম : ৯৭)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘আর
ওরা নক্ষত্রের সাহায্যে পথের সন্ধান পায়’’। (না’হল : ১৬)
তেমনিভাবে
সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থানক্ষেত্র সম্পর্কীয় জ্ঞানের সহযোগিতায় কিবলার দিক নির্ণয়, নামাযের
সময় সূচী নির্ধারণ ও ষড় ঋতুর জ্ঞানার্জনে কোন অসুবিধে নেই। তবে তাই বলে এ গুলোর সহযোগিতায়
ইল্মুল্ গায়েবের অনুসন্ধান বা দাবি করা কখনোই জায়িয হবে না।
৮. চন্দ্রের অবস্থানক্ষেত্র অথবা অন্য কোন নক্ষত্রের
প্রতি বিশ্বাসের শির্কঃ
চন্দ্রের
অবস্থানক্ষেত্র অথবা অন্য কোন নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসের শির্ক বলতে প্রতি তেরো রাত
পর পর চন্দ্রের অবস্থানক্ষেত্রের পরিবর্তন বা অন্য কোন নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণে বৃষ্টি
হয় বলে বিশ্বাস করাকে বুঝানো হয়।
আরবী
ভাষায় প্রতি তেরো রাত পর পর চন্দ্রের অবস্থানক্ষেত্রের পরিবর্তন বা অন্য কোন নক্ষত্রের
উদয়কে ‘‘নাউ’’’ বলা হয়।
জাহিলী
যুগে আরবরা এ কথা বিশ্বাস করতো যে, প্রতি তেরো রাত পর পর চন্দ্রের অবস্থানক্ষেত্রের
পরিবর্তন বা অন্য কোন নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণেই বৃষ্টি হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) এ বিশ্বাসকে
দৃঢ়ভাবে নস্যাৎ করেন।
আবু
মালিক আশ্’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমার
উম্মতের মাঝে জাহিলী যুগের চারটি কাজ চালু থাকবে। তারা তা কখনোই ছাড়বে না। বংশ নিয়ে
গৌরব, অন্যের বংশে আঘাত, কোন কোন নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস
এবং বিলাপ’’।
(মুসলিম,
হাদীস ৯৩৪ ’হা-কিম : ১/৩৮৩ ত্বাবারানি/কাবীর, হাদীস ৩৪২৫, ৩৪২৬ বায়হাক্বী : ৪/৬৩ বাগাওয়ী,
হাদীস ১৫৩৩ ইবনু আবী শাইবাহ্ : ৩/৩৯০ আহমাদ : ৫/৩৪২, ৩৪৩, ৩৪৪ ’আব্দুর রাযযাক : ৩/৬৬৮৬)
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে এ হাদীসটি বলতে শুনেছি। তিনি বলেন:
‘‘আমি
আমার মৃত্যুর পর আমার উম্মতের উপর তিনটি বস্ত্তর আশঙ্কা করছি। রাশি-নক্ষত্রের উদয়াস্তের
কারণে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস, নেতৃস্থানীয়দের যুলুম-অত্যাচার ও তাক্বদীরে (ভাগ্যে)
অবিশ্বাস’’। (আহমাদ : ৫/৮৯-৯০ ইবনু আবী ’আসিম্, হাদীস ৩২৪ ত্বাবারানি/কাবীর : ২/১৮৫৩)
নবী
যুগের কাফির ও মুশরিকরা এ কথায় বিশ্বাস করতো যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই বৃষ্টি দিয়ে
থাকেন। তবে তারা উপরন্তু এও বিশ্বাস করতো যে, রাশি-নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণেই এ বৃষ্টি
হয়ে থাকে। আর এটিই হচ্ছে ছোট শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
যদি ওদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেছেন কে? যা কর্তৃক তিনি পৃথিবীকে
সঞ্জীবিত করেছেন নির্জীবতার পর। তারা অবশ্যই বলবে: একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই। আপনি বলুন:
সুতরাং সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই। তবে ওদের অধিকাংশই এটা বুঝে না’’।
(আনকাবূত : ৬৩)
যায়েদ
বিন্ খালিদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) আমাদেরকে নিয়ে ’হুদাইবিয়া নামক এলাকায় ফজরের নামায আদায় করলেন। ইতিপূর্বে সে
রাত্রিতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিলো। নামায শেষে রাসূল (সা.) মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে বললেন:
তোমরা জানো কি? তোমাদের প্রভু কি বলেছেন। সাহাবারা বললেন: আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল এ ব্যাপারে
ভালোই জানেন। রাসূল (সা.) বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: সকাল পর্যন্ত আমার বান্দাহ্রা
মু’মিন ও কাফির তথা দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। যারা বললো: আল্লাহ্ তা’আলার কৃপা ও অনুগ্রহে
বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলো এবং গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী
হলো। আর যারা বললো: গ্রহ-নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণেই বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার উপর অবিশ্বাসী
হলো এবং গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলো’’।
(বুখারী,
হাদীস ৮৪৬, ১০৩৮, ৪১৪৭, ৭৫০৩ মুসলিম, হাদীস ৭১ আবু দাউদ, হাদীস ৩৯০৬ ইবনু হিববান/ইহসান,
হাদীস ৬০৯৯ ইবনু মান্দাহ্, হাদীস ৫০৩, ৫০৪, ৫০৫, ৫০৬ বাগাওয়ী, হাদীস ১১৬৯ ত্বাবারানী/
কাবীর, হাদীস ৫১২৩, ৫১২৪, ৫১২৫, ৫১২৬ ’হুমাইদী, হাদীস ৮১৩ মা-লিক : ১/১৯২ আব্দুর রায্যাক
: ১১/২১০০৩ আহমাদ : ৪/১১৭)।
আর
যারা এ বিশ্বাস করে যে, গ্রহ-নক্ষত্রের স্বকীয় প্রভাবেই বৃষ্টি হয়ে থাকে তারা কাফির।
বৃষ্টি
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই ইচ্ছায় হয়ে থাকে। এতে অন্য কারোর সামান্যটুকু ইচ্ছারও কোন
প্রভাব নেই।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
সর্বদা যে পানি পান করে থাকো সে সম্পর্কে কখনো চিন্তা করে দেখেছো কি? তোমরাই কি তা
মেঘ হতে নামিয়ে আনো না আমিই তা বর্ষণ করে থাকি’’। (ওয়াকি’আহ্ : ৬৮, ৬৯)
৯. আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামত অস্বীকার করার শির্কঃ
আল্লাহ্
তা’আলার নিয়ামত অস্বীকার করার শির্ক বলতে যে কোন নিয়ামত একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার দান
বা অনুগ্রহ বলে স্বীকার না করে তা নিজ বা অন্য কারোর কৃতিত্বের সুফল অথবা নিজ মেধা
বা যোগ্যতার পাওনা বলে দাবি করাকে বুঝানো হয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তারা
আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ সম্পর্কে জেনেও তা অস্বীকার করে। আসলে তাদের অধিকাংশই কাফির’’।
(নাহল : ৮৩)
আল্লাহ্
তা’আলা আরো বলেন:
‘‘তোমরা
যে সব নিয়ামত ভোগ করছো তা সবই আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে’’। (নাহল : ৫৩)
বর্তমান
যুগের সকল কল্যাণকে একান্ত আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ না বলে আধুনিক প্রযুক্তির সুফল
বলাও আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামত অস্বীকার করার শামিল তথা শির্ক।
তেমনিভাবে
কোন সম্পদকে আল্লাহ্ প্রদত্ত না বলে বাপ-দাদার মিরাসি সম্পত্তি বলে দাবি করা এবং এমন
বলা যে, অমুক না হলে এমন হতোনা, আবহাওয়া ভালো এবং মাঝি পাকা হওয়ার দরুন বাঁচা গেলো।
নচেৎ নৌকো ডুবে যেতো, পীর-বুযুর্গের নেক নজর থাকার দরুন বাঁচা গেলো। নচেৎ মরতে হতো
বলাও আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামত অস্বীকার করার শামিল তথা শির্ক।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমাদের
প্রভু তিনিই যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রে জলযান পরিচালিত করেন। যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ
তথা রিয্ক অনুসন্ধান করতে পারো। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু’’। (ইসরা/বানী
ইস্রাঈল : ৬৬)
আল্লাহ্
তা’আলা তাঁর নিয়ামত অস্বীকারকারী পূর্বেকার এক সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেনঃ
‘‘আমি
যদি মানুষকে অনেক দুঃখ-কষ্টের পর অনুগ্রহের স্বাদ আস্বাদন করাই তখন সে নিশ্চিতভাবেই
বলবে: এটা আমারই প্রাপ্য (আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত অনুগ্রহ নয়) এবং আমি মনে করি না যে,
কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর যদি আমি ঘটনাচক্রে আমার প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তিত হইও তখন তাঁর
নিকট তো আমার জন্য কল্যাণই থাকবে। আমি কাফিরদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত
করবো এবং তাদেরকে আস্বাদন করাবো কঠোর শাস্তি’’। (ফুসসিলাত/হা-মীম আসসাজদাহ্ : ৫০)
কারূন
যখন আল্লাহ্ তা’আলার দেয়া ধন-ভান্ডারকে তাঁর একান্ত অনুগ্রহ বলে স্বীকার না করে বরং
তার নিজ মেধার প্রাপ্য বলে দাবি করেছে তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে
তলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘কারূন
বললো: নিশ্চয়ই আমাকে এ সম্পদ দেয়া হয়েছে আমার জ্ঞানের প্রাপ্তি হিসেবে। ... অতঃপর আমি
কারূন ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে তলিয়ে দিলাম। তখন তার স্বপক্ষে এমন কোন দল ছিলোনা যারা
আল্লাহ্ তা’আলার শাস্তি হতে তাকে রক্ষা করতে পারতো এবং সে নিজেও তার আত্মরক্ষায় সক্ষম
ছিলো না’’। (কাসাস্ : ৭৮, ৮১)
আল্লাহ্
তা’আলা বনী ইস্রাঈলের কয়েকজন ব্যক্তিকে অঢেল সম্পদ দিয়ে পুনরায় তাদেরকে ফিরিশ্তার মাধ্যমে
পরীক্ষা করেন। তাদের অধিকাংশই তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত অনুগ্রহ নয় বলে তাঁর
নিয়ামত অস্বীকার করতঃ তা তাদের বাপ-দাদার সম্পদ বলে দাবি করলে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের
উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেন। আর যারা তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ
বলে স্বীকার করলো তাদের উপর তিনি সন্তুষ্ট হন এবং তাদের সম্পদ আরো বাড়িয়ে দেন।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন:
‘‘বনী
ইস্রাঈলের তিন ব্যক্তি শ্বেতী রোগী, টাক মাথা ও অন্ধের নিকট আল্লাহ্ তা’আলা জনৈক ফিরিশ্তা
পাঠিয়েছেন তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে। ফিরিশ্তাটি শ্বেতী রোগীর নিকট এসে বললেন: তোমার
নিকট কোন্ বস্ত্তটি অধিক পছন্দনীয়? সে বললো: আমার নিকট পছন্দনীয় বস্ত্ত হচ্ছে সুন্দর
রং ও মনোরম চামড়া এবং আমার এ রোগটি যেন ভালো হয়ে যায়। যার কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণা করে।
তৎক্ষণাৎ ফিরিশ্তাটি তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে তার কদর্যতা দূর হয়ে যায় এবং তাকে সুন্দর
রং ও মনোরম চামড়া দেয়া হয়। আবারো ফিরিশ্তাটি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: কোন্ ধরনের সম্পদ
তোমার নিকট অধিক পছন্দনীয়? উত্তরে সে বললো: উট অথবা গরু। শ্বেতি রোগী অথবা টাক মাথার
যে কোন এক জন উট চেয়েছে আর অন্য জন গাভী। বর্ণনাকারী ইস্হাক এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছে।
যা হোক তাকে দশ মাসের গর্ভবতী একটি উষ্ট্রী দেয়া হলো এবং ফিরিশ্তাটি তার জন্য দো’আ
করলেন: আল্লাহ্ তা’আলা তোমার এ উষ্ট্রীর মধ্যে বরকত দিক!
এরপর
ফিরিশ্তাটি টাক মাথা লোকটির নিকট এসে বললেন: তোমার নিকট কোন্ বস্ত্তটি অধিক পছন্দনীয়?
সে বললো: আমার নিকট পছন্দনীয় বস্ত্ত হচ্ছে সুন্দর চুল এবং আমার এ রোগটি যেন ভালো হয়ে
যায়। যার কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। তৎক্ষণাৎ ফিরিশ্তাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে
তার কদর্যতা দূর হয়ে যায় এবং তাকে সুন্দর চুল দেয়া হয়। আবারো ফিরিশ্তাটি তাকে জিজ্ঞাসা
করলেন: কোন্ ধরনের সম্পদ তোমার নিকট অধিক পছন্দনীয়? উত্তরে সে বললো: গাভী। অতএব তাকে
গর্ভবতী একটি গাভী দেয়া হলো এবং ফিরিশ্তাটি তার জন্য দো’আ করলেন: আল্লাহ্ তা’আলা তোমার
এ গাভীর মধ্যে বরকত দিক!
এরপর
ফিরিশ্তাটি অন্ধ লোকটির নিকট এসে বললেন: তোমার নিকট কোন্ বস্ত্তটি অধিক পছন্দনীয়? সে
বললো: আমার নিকট পছন্দনীয় বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলা যেন আমার চক্ষুটি ফিরিয়ে দেয়।
যাতে আমি মানুষ জন দেখতে পাই। তৎক্ষণাৎ ফিরিশ্তাটি তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলে আল্লাহ্
তা’আলা তার চক্ষুটি ফিরিয়ে দেন। আবারো ফিরিশ্তাটি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: কোন্ ধরনের
সম্পদ তোমার নিকট অধিক পছন্দনীয়? উত্তরে সে বললো: ছাগল। অতএব তাকে গর্ভবতী একটি ছাগী
দেয়া হলো। অতঃপর প্রত্যেকের উষ্ট্রী, গাভী ও ছাগী বাচ্চা দিতে থাকে। এতে করে কিছু দিনের
মধ্যেই প্রত্যেকের উট, গরু ও ছাগলে এক এক উপত্যকা ভরে যায়।
আরো
কিছু দিন পর ফিরিশতাটি শ্বেতী রোগীর নিকট পূর্ব বেশে উপস্থিত হয়ে বললেন: আমি এক জন
গরিব মানুষ। আমার পথ খরচা একেবারেই শেষ। এখন এক আল্লাহ্ অতঃপর তুমি ছাড়া আমার কোন উপায়
নেই। তাই আমি আল্লাহ্ তা’আলার দোহাই দিয়ে তোমার নিকট একটি উট চাচ্ছি যিনি তোমাকে সুন্দর
রং, মনোরম চামড়া ও সম্পদ দিয়েছেন যাতে আমার পথ চলা সহজ হয়ে যায়। উত্তরে সে বললো: দায়িত্ব
অনেক বেশি। তোমাকে কিছু দেয়া এখন আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। ফিরিশ্তাটি তাকে বললেন: তোমাকে
চেনা চেনা মনে হয়। তুমি কি শ্বেতী রোগী ছিলে না? মানুষ তোমাকে ঘৃণা করতো। তুমি কি দরিদ্র
ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন। সে বললো: না, আমি কখনো গরিব ছিলাম
না। এ সম্পদগুলো আমি বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। অতঃপর ফিরিশ্তাটি বললেন:
তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তবে আল্লাহ্ তা’আলা যেন তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
অনুরূপভাবে
ফিরিশ্তাটি টাক মাথার নিকট পূর্ব বেশে উপস্থিত হয়ে তার সঙ্গে সে জাতীয় কথাই বললেন যা
বলেছেন শ্বেতী রোগীর সঙ্গে এবং সেও সে উত্তর দিলো যা দিয়েছে শ্বেতী রোগী। অতঃপর ফিরিশ্তাটি
বললেন: তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তবে আল্লাহ্ তা’আলা যেন তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে
দেন।
তেমনিভাবে
ফিরিশ্তাটি অন্ধের নিকট পূর্ব বেশে উপস্থিত হয়ে বললেন: আমি দরিদ্র মুসাফির মানুষ। আমার
পথ খরচা একেবারেই শেষ। এখন এক আল্লাহ্ অতঃপর তুমি ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। তাই আমি
আল্লাহ্ তা’আলার দোহাই দিয়ে তোমার নিকট একটি ছাগল চাচ্ছি যিনি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে
দিয়েছেন যাতে আমার পথ চলা সহজ হয়ে যায়। উত্তরে সে বললো: আমি নিশ্চয়ই অন্ধ ছিলাম। অতঃপর
আল্লাহ্ তা’আলা আমার চক্ষু ফিরিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমার যা ইচ্ছা নিয়ে যাও এবং যা ইচ্ছা
রেখে যাও। আল্লাহ্’র কসম খেয়ে বলছি: আজ আমি তোমাকে বারণ করবো না যাই তুমি আল্লাহ্’র
জন্য নিবে। ফিরিশ্তাটি বললেন: তোমার সম্পদ তুমিই রেখে দাও। তোমাদেরকে শুধু পরীক্ষাই
করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কিছু নয়। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং
তোমার সাথীদ্বয়ের উপর হয়েছেন অসন্তুষ্ট’’। (বুখারী, হাদীস ৩৪৬৪, ৬৬৫৩ মুসলিম, হাদীস
২৯৬৪)
উক্ত
হাদীসে প্রথমোক্ত ব্যক্তিদ্বয় আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ অস্বীকার ও তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা
জ্ঞাপনের কারণে তিনি তাদের উপর অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁর দেয়া নিয়ামত তিনি তাদের থেকে
ছিনিয়ে নেন। অন্য দিকে অপর জন তাঁর নিয়ামত স্বীকার করেন এবং তাতে তাঁর অধিকার আদায়
করেন বিধায় আল্লাহ্ তা’আলা তার উপর সন্তুষ্ট হন এবং তার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দেন।
অতএব
নিয়ামতের শুকর আদায় করা অপরিহার্য। নিয়ামতের শুকর বলতে বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে অনুগ্রহকারীর
অনুগ্রহ স্বীকার করাকেই বুঝানো হয়।
সুতরাং
যে ব্যক্তি নিয়ামত সম্পর্কে একেবারেই অবগত নয় সে নিয়ামতের শুকর আদায় করেনি। আর যে নিয়ামত
সম্পর্কে অবগত তবে নিয়ামতদাতা সম্পর্কে অবগত নয় সেও নিয়ামতের শুকর আদায় করেনি। আর যে
ব্যক্তি নিয়ামত ও নিয়ামতদাতা সম্পর্কে অবগত তবে সে তা স্বীকার করে না সেও নিয়ামতের
শুকর আদায় করেনি। আর যে ব্যক্তি নিয়ামত ও নিয়ামতদাতা সম্পর্কে অবগত এমনকি সে তা স্বীকারও
করে কিন্তু তা বিনয় ও ভালোবাসা নিয়ে নয় তা হলে সেও নিয়ামতের শুকর আদায় করেনি। আর যে
ব্যক্তি নিয়ামত ও নিয়ামতদাতা সম্পর্কে অবগত এমনকি সে তা বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে স্বীকারও
করে এবং সে তা নিয়ামতদাতার আনুগত্যেই খরচ করে তা হলে সে সত্যিকারার্থেই নিয়ামতের শুকর
আদায়কারী।
১০. কোন বস্ত্ত, ব্যক্তি বা প্রাণী দর্শনে বা উহার
বিশেষ আচরণে কোন অমঙ্গল রয়েছে বলে বিশ্বাস করার শির্কঃ
কোন
বস্ত্ত, ব্যক্তি বা প্রাণী দর্শনে বা উহার বিশেষ আচরণে কোন অমঙ্গল রয়েছে বলে বিশ্বাস
করার শির্ক বলতে যাত্রা লগ্নে কোন ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্ত্তর বিশ্রী রূপদর্শন অথবা
এ গুলোর কোনরূপ আচরণ এমনকি কোন শব্দ বা ধ্বনির শ্রবণ অথবা কোন জায়গায় অবতরণ কারোর জন্য
কোন অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে বলে বিশ্বাস করাকে বুঝানো হয়।
এ
জাতীয় কুলক্ষণবোধ ব্যাধি আজকের নতুন নয়। বরং তা অনেক পুরাতন যুগেরই বটে। তখন মানুষ
নবী ও তাঁর সঙ্গীদেরকে অলক্ষুনে ভাবতো।
আল্লাহ্
তা’আলা মূসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন:
‘‘যখন
তাদের কোন সুখ-শান্তি বা কল্যাণ সাধিত হতো তখন তারা বলতো: এটি আমাদেরই প্রাপ্য। আর
যখন তাদের কোন দুঃখ-দুর্দশা বা বিপদ-আপদ ঘটতো তখন তারা বলতো: এটি মূসা (আ.) ও তাঁর
সঙ্গী-সাথীদের কারণেই ঘটেছে। তাদের জানা উচিত যে, তাদের সকল অকল্যাণও একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলার পক্ষ থেকে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এ কথা জানে না’’। (আ’রাফ্ : ১৩১)
আল্লাহ্
তা’আলা সা’লিহ্ (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন:
‘‘তারা
বললো: আমরা তোমাকে ও তোমার সঙ্গী-সাথীদেরকেই সকল অকল্যাণের মূল মনে করছি। সা’লিহ্
(আ.) বললেন: তোমাদের সকল কল্যাণাকল্যাণ আল্লাহ্’র হাতে। মূলতঃ তোমাদেরকে পরীক্ষা করা
হচ্ছে’’। (নাম্ল : ৪৭)
আল্লাহ্
তা’আলা এক মফস্বল এলাকার অধিবাসী ও তাদের রাসূল সম্পর্কে বলেন:
‘‘তারা
বললো: আমরা তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ বলেই মনে করি। যদি তোমরা নিজ তৎপরতা বন্ধ না করো
তাহলে আমরা তোমাদেরকে অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা করবো এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর
অবশ্যই নিপতিত হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। রাসূলগণ বললেন: তোমাদের অমঙ্গল তোমাদেরই কারণে।
তোমরা কি মূর্খতার কারণে এটাই মনে করো যে, তোমাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছে বলেই অমঙ্গল
নেমে আসছে। বরং তোমরা একটি সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়’’। (ইয়াসীন : ১৮)
আল্লাহ্
তা’আলা মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন:
‘‘তাদের
উপর যখন কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হয় তখন তারা বলে: এটা আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে। আর যখন
তাদের প্রতি কোন অকল্যাণ নিপতিত হয় তখন তারা বলে: এটা আপনারই পক্ষ থেকে তথা আপনারই
কারণে। আপনি বলে দিন: সবই আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে। এদের কি হলো যে, তারা কোন কথাই
বুঝতে চায় না’’। (নিসা’ : ৭৮)
সকল
মঙ্গলামঙ্গল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার হাতে। কোন ব্যক্তি, বস্ত্ত বা প্রাণীর বিশ্রী
রূপদর্শন বা আচরণে এমন কোন অকল্যাণ নিহিত নেই যার অমূলক আশঙ্কা করা যেতে পারে। বরং
সকল কল্যাণকে আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত অনুগ্রহ এবং পুণ্যের ফল হিসেবে স্বীকার করতে হবে।
আর সকল অকল্যাণকে আল্লাহ্ তা’আলার ইনসাফ ও নিজ গুনাহ্’র শাস্তি হিসেবে মেনে নিতে হবে।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমার
যদি কোন কল্যাণ সাধিত হয় তাহলে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকেই হয়েছে। আর যদি
তোমার কোন অকল্যাণ সাধিত হয় তাহলে তা একমাত্র তোমার কর্ম দোষেই হয়েছে’’। (নিসা’ : ৭৯)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘ছোঁয়াচে
রোগ বলতে কিছুই নেই। কুলক্ষণ বলতেই তা একান্ত অমূলক। হুতোম পেঁচা, সফর মাস, রাশি-নক্ষত্র
অথবা পথ ভুলানো ভূত কারোর কোন ক্ষতি করতে পারে না। তখন এক গ্রাম্য ব্যক্তি বললো: হে
আল্লাহ্’র রাসূল! কখনো এমন হয় যে, মরুভূমির মধ্যে শায়িত কিছু উট। দেখতে যেমন হরিণ।
অতঃপর দেখা যাচ্ছে, চর্ম রোগী একটি উট এসে এগুলোর সাথে মিশে গেলো। তাতে করে সবগুলো
উট চর্ম রোগী হয়ে গেলো। তখন রাসূল (সা.) বললেন: বলো তো: প্রথমটির চর্ম রোগ কোথা থেকে
এসেছে?
(বুখারী,
হাদীস ৫৭০৭, ৫৭১৭, ৫৭৭০, ৫৭৭৩ মুসলিম, হাদীস ২২২০, ২২২২ আবু দাউদ, হাদীস ৩৯১১, ৩৯১২,
৩৯১৩, ৩৯১৫ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৬০৫, ৩৬০৬ আহমাদ : ২/২৬৭, ৩৯৭ আব্দুর রায্যাক : ১০/৪০৪
ত্বাহাওয়ী/মুশকিলুল্ আসা-র, হাদীস ২৮৯১)।
উম্মে
কুর্য (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
‘‘তোমরা পাখীগুলোকে নিজ স্থানে থাকতে দাও। ওদেরকে
তাড়িয়ে কুলক্ষণ নির্ধারণ করার কোন মানে হয় না। কারণ, ওগুলো তোমাদের কোন ক্ষতি করতে
পারে না’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২৮৩৫ মুসতাদরাক্ : ৪/২৩৭)
‘‘তাত্বাইয়ুর’’
তথা কুলক্ষণবোধ ব্যাধি শির্ক এ জন্য যে, কেননা তাতে আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টিকে ক্ষতিসাধক
হিসেবে মেনে নেয়া হয়। অথচ সকল কল্যাণাকল্যাণের মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা।
তিনি ভিন্ন অন্য কেউ নয়। অন্যদিকে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি
বা বস্ত্তর সাথে বান্দাহ্’র সুগভীর সম্পর্ক কায়েম করার শামিল এবং তা তাওয়াক্কুল তথা
আল্লাহ্ নির্ভরশীলতা বিরোধীও বটে। এমনকি এ বিশ্বাসের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে
প্রচুর ভয়েরও উদ্রেক ঘটে। বস্ত্ততঃ তা শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কুলক্ষণবোধ
নিরেট শির্ক। নবী (সা.) এ কথাটি তিন বার বলেছেন। আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাসঊদ (রা.) বলেন:
আমাদের প্রত্যেকেই কিছুনা কিছু এ ব্যাধিতে ভোগে থাকেন। তবে আল্লাহ্ তা’আলার উপর সত্যিকারের
তাওয়াক্কুল থাকলে তা অতিসত্বর দূর হয়ে যায়’’।
(বুখারী/আদাবুল্
মুফরাদ্, হাদীস ৯০৯ আবু দাউদ, হাদীস ৩৯১০ তিরমিযী, হাদীস ১৬১৪ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৬০৪
ত্বাহাওয়ী/মুশ্কিলুল্ আসা-র, হাদীস ৭২৮, ১৭৪৭ ইবনু হিববান/মাওয়ারিদ্, হাদীস ১৪২৭ হা-কিম
: ১/১৭-১৮ বাগাওয়ী, হাদীস ৩২৫৭ বায়হাক্বী : ৮/১৩৯ ত্বায়ালিসী, হাদীস ৩৫৬ আহমাদ : ১/৩৮৯,
৪৩৮, ৪৪০)।
আপনি
যখন শরীয়ত সম্মত কোন কাজ করতে ইচ্ছে করবেন তখন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা
করেই শুরু করে দিন। কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর কুৎসিত রূপ দেখে অথবা কোন অরুচিকর বাক্য
শুনে সে কাজ বন্ধ করে দিবেননা। যদি তা করেন তাহলে আপনি আপনার অজান্তেই শির্কে লিপ্ত
হবেন।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যাকে
কুলক্ষণবোধ নিজ প্রয়োজন মেটানো থেকে বিরত রেখেছে বস্ত্ততঃ সে শির্ক করলো। সাহাবারা
জিজ্ঞাসা করলেন: এর কাফ্ফারা কি হতে পারে? রাসূল (সা.) বললেন: তখন সে বলবে: হে আল্লাহ্!
আপনার কল্যাণ ছাড়া আর কোন কল্যাণ নেই। তেমনিভাবে আপনার অকল্যাণ ছাড়া আর কোন অকল্যাণ
নেই এবং আপনি ছাড়া সত্যিকারের কোন মা’বুদ নেই’’। (আহমাদ : ২/২২০)
মু’আবিয়া
বিন্ ’হাকাম্ সুলামী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম:
‘‘আমাদের
অনেকেই কোন না কোন কিছু দেখে বা শুনে কুলক্ষণ বোধ করেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন: এটি
হচ্ছে মনের ওয়াস্ওয়াসা। অতএব তারা যেন এ কারণে কোন কাজ বন্ধ না করে’’। (মুসলিম, হাদীস
৫৩৭)
তবে
কোন ব্যক্তি কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তির বিশ্রী রূপ দেখে তার মধ্যে কোন অকল্যাণ রয়েছে বলে
ধারণা করলে তার এ অমূলক ধারণার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে শাস্তি সরূপ তার কোন
ক্ষতি হতে পারে।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘শরীয়তের
দৃষ্টিতে কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে অলক্ষণ শাস্তি সরূপ ওর পক্ষে হতে পারে যে শরীয়ত
বিরোধীভাবে কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে অলক্ষুনে ভাবলো। শরীয়তের দৃষ্টিতে সত্যিকারার্থে
যদি কোন বস্ত্তর মাঝে অকল্যাণ নিহিত থাকতো তা হলে ঘর-বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া ও স্ত্রীমহিলাদের
মধ্যে তা থাকা যুক্তিসঙ্গত ছিলো’’। (ইবনু হিববান, হাদীস ৬০৯০)
আল্লাহ্
তা’আলা কখনো কখনো তাঁর একান্ত ইচ্ছায় কোন না কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তির মধ্যে অকল্যাণ
নিহিত রাখেন যা একান্তভাবেই তাঁরই ইচ্ছায় উহার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কিছু না কিছু
ক্ষতিসাধন করতে পারে। এরপরও শুরু থেকেই সতর্কতামূলক পন্থায় সে ব্যাপারে একনিষ্ঠভাবে
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার শরণাপন্ন হলে তা থেকে তিনি বান্দাহ্কে নিশ্চয়ই নিষ্কৃতি দিবেন
ইনশা আল্লাহ্। তারপরও কোন অকল্যাণ ঘটে গেলে তা তাক্বদীরে ছিলো বলে বিশ্বাস করতে হবে।
এ কারণেই নবী (সা.) কেউ কোন নতুন বিবাহ করলে অথবা কোন নতুন গোলাম বা পশু খরিদ করলে
তার মধ্যে নিহিত কল্যাণ প্রাপ্তি ও তার মধ্যে নিহিত অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্যে সে ব্যক্তিকে
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার শরণাপন্ন হতে আদেশ করেছেন।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আমর বিন্ ’আস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমাদের
কেউ বিবাহ করলে অথবা নতুন গোলাম খরিদ করলে সে যেন বলেঃ হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট
এর ও এর মধ্যে নিহিত সকল কল্যাণ কামনা করি এবং আপনার নিকট আশ্রয় চাই এর ও এর মধ্যে
নিহিত সকল অকল্যাণ থেকে। তেমনিভাবে কোন উট কিনলে উহার কুব্জ পৃষ্ঠশৃঙ্গ ধরে অনুরূপ
বলবে’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২১৬০ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৯৪৫ হা-কিম : ২/১৮৫ বায়হাক্বী,
হাদীস ৭/১৪৮)
তবে
দীর্ঘ প্রয়োজনীয় কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তির প্রতি (ঘর-বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া ও স্ত্রীমহিলা ইত্যাদি)
বিরক্তি এসে গেলে তা প্রত্যাখ্যান বা বদলানো জায়িয। যাতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঈমানটুকু
শির্কমুক্ত থাকে এবং শরীয়ত অসম্মত কুলক্ষণবোধের দরুন তার উপর শাস্তি সরূপ কোন অকল্যাণ
আপতিত না হয়।
আনাস্
বিন্ মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমরা ইতিপূর্বে একটি ঘরে বসবাস করতাম। তখন আমাদের
জনসংখ্যা বেশি ছিলো এবং সম্পদও বেশি। অতঃপর আমরা আরেকটি ঘরে বসবাস শুরু করলাম। এখন
আমাদের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং সম্পদও। তখন রাসূল (সা.) বললেন: এ ঘরটি
ছেড়ে দাও। কারণ, তা নিন্দনীয়’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩৯২৪)
তবে
কোন উত্তম ব্যক্তি বা বস্ত্ত দেখে অথবা কোন ভালো কথা শুনে যে কোন কল্যাণের আশা করা
বা সুলক্ষণ ভাবা শরীয়ত বিরোধী নয়। কারণ, এতে করে আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভালো ধারণা জন্মে
এবং তাঁর উপর নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যায়। এমনকি সে কল্যাণ পাওয়ার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার
নিকট সাহায্য প্রার্থনার উদগ্র মানসিকতা তৈরি হয়। এ কারণেই রাসূল (সা.) কোন ভালো কথা
বা শব্দ শুনে কল্যাণের আশা করতেন এবং তা তাঁর পছন্দনীয় অভ্যাসও ছিলো বটে।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘ছোঁয়াচে
রোগ বলতে কিছুই নেই। কুলক্ষণ বলতেই তা একান্ত অমূলক। তবে সুলক্ষণই আমার নিকট পছন্দনীয়।
সাহাবাগণ বললেন: সুলক্ষণ বলতে কি বুঝানো হচ্ছে? তিনি বললেন: ভালো কোন শব্দ শুনে কল্যাণের
আশা করা’’।
(বুখারী,
হাদীস ৫৭৫৬, ৫৭৭৬ মুসলিম, হাদীস ২২২৪ তিরমিযী, হাদীস ১৬১৫ আবু দাউদ, হাদীস ৩৯১৬ ইবনু
মাজাহ্, হাদীস ৩৬০৩ বায়হাক্বী: ৮/১৩৯ ত্বায়ালিসী, হাদীস ১৯৬১ আহমাদ: ৩/১১৮, ১৩০, ১৭৩,
২৭৫ ২৭৬ ইবনু আবী শাইবাহ্: ৯/৪১)।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কুলক্ষণ
বলতেই তা একান্ত অমূলক। তবে সুলক্ষণই হচ্ছে সর্বোত্তম। সাহাবাগণ বললেন: সুলক্ষণ বলতে
কি বুঝানো হচ্ছে? তিনি বললেন: ভালো কোন শব্দ শুনে কল্যাণের আশা করা’’। (বুখারী, হাদীস
৫৭৫৪, ৫৭৫৫ মুসলিম, হাদীস ২২২৩)।
যাদের
মধ্যে কুলক্ষণবোধ নামক ব্যাধি বলতে কিছুই নেই বরং তাদের মধ্যে রয়েছে শুধু আল্লাহ্ তা’আলার
উপর চরম নির্ভরশীলতা একমাত্র তারাই পরকালে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘অতঃপর
আমাকে বলা হলো: এরা আপনার উম্মত। তাদের সাথে রয়েছে সত্তর হাজার মানুষ যারা বিনা শাস্তি
ও বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা ওরা যারা কখনো নিজেও ঝাঁড় ফুঁক করেনি এবং
অন্যকে দিয়েও করায়নি। কোনভাবেই কখনো কোন কিছুকে অলক্ষুনে ভাবেনি। বরং তারা শুধুমাত্র
নিজ প্রভুর উপর চরম নির্ভরশীল রয়েছে। অন্য কারোর উপর নয়’’। (বুখারী, হাদীস ৫৭৫২ মুসলিম,
হাদীস ২২০)
১১. অসিলা ধরার শির্ক - ১
অসিলা
ধরার শির্ক বলতে যে কোন উদ্দেশ্য হাসিল অথবা যে কোন প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরাসরি আল্লাহ্
তা’আলার নিকট আবেদন না করে শরীয়ত অসম্মত কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ
করাকে বুঝানো হয়।
অসিলার প্রকারভেদ:
শরীয়তের
দৃষ্টিতে অসিলা দু’ প্রকার। যা নিম্নরূপ:
শরীয়ত সম্মত অসিলাঃ
শরীয়ত
সম্মত অসিলা বলতে সে সকল বস্ত্তকে বুঝানো হয় যে গুলোকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা কোর’আন
ও হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত। যে গুলো নিম্নরূপ:
ক. আল্লাহ্ তা’আলার সকল নাম
অথবা যে কোন বিশেষ নামের অসিলা ধরা:
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলার অনেকগুলো সুন্দর নাম রয়েছে যেগুলোকে মাধ্যম বানিয়ে তোমরা তাঁর নিকট দো’আ করতে
পারো। তোমরা ওদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে যারা আল্লাহ্ তা’আলার নামকে বিকৃত করে। অতিসত্বর
তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি দেয়া হবে’’। (আ’রাফ : ১৮০)
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাস’ঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) এভাবে দো’আ করেন:
‘‘হে
আল্লাহ্! নিশ্চয়ই আমি আপনার বান্দাহ্ এবং আপনার বান্দাহ্ ও বান্দির সন্তান। আমার ভাগ্য
আপনার হাতে। আমার ব্যাপারে আপনার আদেশ অবশ্যই কার্যকর এবং আপনার ফায়সালা আমার ব্যাপারে
নিশ্চয়ই ইনসাফপূর্ণ। আপনার সকল নামের অসিলায় যা আপনি নিজের জন্য চয়ন করেছেন অথবা যা
আপনি নিজ মাখলূকের কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন অথবা যা আপনি নিজ কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন অথবা
যা আপনি আপনার গায়েবী ইল্মে সংরক্ষণ করেছেন আপনার এ সকল নামের অসিলায় আমি আপনার নিকট
এ আবেদন করছি যে, আপনি কোর’আন মাজীদকে আমার অন্তরের সজীবতা, আমার বুকের নূর এবং আমার
সকল চিন্তা ও ভাবনা দূরীকরণের সহায়ক বানাবেন’’। (আহমাদ : ১/৩৯১)
আল্লাহ্
তা’আলার বিশেষ কোন নামের অসিলা ধরার মানে, আপনি যে জাতীয় আবেদন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট
করতে চান সে জাতীয় আল্লাহ্ তা’আলার কোন একটি গুণবাচক নামের অসিলা ধরবেন। যেমন: আপনার
কোন অনুগ্রহের প্রয়োজন হলে আপনি বলবেন:
‘‘হে
দয়ালু! আপনি আমার উপর দয়া করুন’’।
আবু
বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমাকে নামাযের মধ্যে এ দো’আটি পড়ার আদেশ
করেন:
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি নিজের উপর প্রচুর যুলুম করেছি। আপনি ছাড়া আমার গুনাহ্ মাফ করার আর কেউ
নেই। সুতরাং আপনি নিজ দয়ায় আমার সকল গুনাহ্ মাফ করে দিন এবং আপনি আমার উপর দয়া করুন।
নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু’’।
(বুখারী,
হাদীস ৮৩৪, ৬৩২৬, ৭৩৮৮ মুসলিম, হাদীস ২৭০৫)
উক্ত
দো’আর শেষাংশে আল্লাহ্ তা’আলার দু’টি গুণবাচক নাম তথা ‘‘গাফূর’’ ও ‘‘রাহীম’’ এর অসিলা
ধরা হয়েছে।
খ. আল্লাহ্ তা’আলার যে কোন
গুণের অসিলা ধরা:
সকল
গুণের অসিলা ধরা। যেমন:
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি আপনার সকল গুণের অসিলা ধরে এ প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমার সকল গুনাহ্
ক্ষমা করে দিবেন’’।
কোন
বিশেষ গুণের অসিলা ধরা। যেমন:
’উসমান
বিন্ আবুল্ ’আস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি রাসূল (সা.) কে পুরাতন একটি ব্যথার কথা জানালে
রাসূল (সা.) তাঁকে ব্যথার জায়গায় হাত রেখে সাত বার নিম্নোক্ত দো’আ পড়তে বলেন:
‘‘আমি
আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর কুদরতের অসিলায় প্রাপ্ত ও আশঙ্কিত সকল ব্যথা হতে তাঁর আশ্রয়
কামনা করছি’’। (মুসলিম, হাদীস ২২০২)
উক্ত
দো’আয় আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও তাঁর বিশেষ গুণ ‘‘কুদরত’’ এর অসিলা ধরা হয়েছে।
গ.
আল্লাহ্ তা’আলার যে কোন কাজের অসিলা ধরা:
কা’ব
বিন্ ’উজ্রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা রাসূল (সা.) কে তাঁর উপর দুরূদ পড়া
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাদেরকে এভাবে দুরূদ পড়া শিক্ষা দেন:
‘‘হে
আল্লাহ্! আপনি রহমত বর্ষণ করুন মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর যেমনিভাবে আপনি
রহমত বর্ষণ করেছেন ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর’’। (বুখারী, হাদীস ৩৩৭০ মুসলিম,
হাদীস ৪০৬)
উক্ত
দুরূদে ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর রহমত বর্ষণের অসিলা ধরা হয়েছে।
ঘ.
আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূলের উপর ঈমানের অসিলা ধরা:
যেমন
বলবে:
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি আপনার ও আপনার রাসূলের উপর ঈমানের অসিলায় আপনার নিকট এ প্রার্থনা করছি
যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন’’।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আমার
বান্দাহ্দের এক দল এমন ছিলো যে, তারা বলতো: হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি। অতএব
আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের উপর দয়া করুন। আপনি তো দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ’’।
(মু’মিনূন : ১০৯)
উক্ত
আয়াতে ঈমানের অসিলা ধরা হয়েছে।
ঙ.
নিজের দীনতা, অক্ষমতা ও প্রয়োজন উল্লেখ করে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দো’আ করা:
যেমন
বলবে:
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট খাদ্য কামনা করছি। আমি আপনার মুখাপেক্ষী’’।
আল্লাহ্
তা’আলা মূসা (আ.) সম্পর্কে বলেন:
‘‘অতঃপর
মূসা (আ.) বললেন: হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন আমি উহার কাঙ্গাল’’।
(ক্বাসাস্ : ২৪)
আল্লাহ্
তা’আলা যাকারিয়া (আ.) সম্পর্কে বলেন:
‘‘তিনি
বললেন: হে আমার প্রভু! আমার অস্থি শীর্ণ প্রায় এবং আমার মাথা বার্ধক্যের দরুন শুভ্রোজ্জ্বল।
হে আমার প্রভু! এরপরও আমার আস্থা এতটুকু যে, আপনার নিকট দো’আ করে কখনো আমি ব্যর্থ হইনি’’।
(মারইয়াম : ৪)
চ. জীবিত কোন নেক বান্দাহ্’র
দো’আর অসিলা ধরা:
যেমন:
রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় সাহাবারা যে কোন সমস্যায় তাঁর দো’আ কামনা করতেন।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমাদের
প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) জুমার দিন জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন এমতাবস্থায় লোকেরা চিৎকার
করে দাঁড়িয়ে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! বহু দিন থেকে বৃষ্টি বন্ধ, গাছগুলো লালচে হয়ে
গেছে এবং পশুগুলো মরে যাচ্ছে। সুতরাং আপনি আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে দো’আ করুন, যেন তিনি
আমাদেরকে বৃষ্টি দেন। তখন রাসূল (সা.) দু’ বার এ দো’আ করলেন: হে আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে
বৃষ্টি দিন। বর্ণনাকারী বলেন: আল্লাহ্’র কসম! ইতিপূর্বে আমরা আকাশে সামান্যটুকু মেঘও
দেখতে পাইনি। কিন্তু রাসূল (সা.) এর দো’আর সাথে সাথে হঠাৎ কোথা হতে এক টুকরো মেঘ এসে
প্রচুর বৃষ্টি বর্ষালো। অতঃপর রাসূল (সা.) মিম্বার থেকে নেমে নামায আদায় করলেন। নামায
শেষ হওয়ার পর হতে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত বিরতিহীন বৃষ্টি হলো। এ জুমা বারেও যখন নবী
(সা.) খুতবা দিতে দাঁড়ালেন তখন লোকেরা চিৎকার দিয়ে বললোঃ ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে গেলো, পথ-ঘাট
ডুবে গেলো। অতএব আপনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দো’আ করুন, যেন তিনি বৃষ্টি বন্ধ করে দেন।
নবী (সা.) মুচকি হেসে বললেন: হে আল্লাহ্! আমাদের আশপাশে বর্ষণ করুন। আমাদের উপর নয়।
বর্ণনাকারী বলেন: মদীনা হতে মেঘ একদম কেটে গেলো এবং উহার আশপাশে বর্ষাতে লাগলো। মদীনাতে
আর একটি বৃষ্টির ফোঁটাও পড়েনি। এমনকি মদীনাকে দেখে মনে হলো, তাজ পরা এক ফরসা নগরী’’।
(বুখারী, হাদীস ১০২১ মুসলিম, হাদীস ৮৯৭)
অনুরূপভাবে
নবী (সা.) যখন সাহাবাদেরকে এ বলে হাদীস শুনালেন যে, আমার উম্মতের সত্তর হাজার মানুষ
বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে তখন ’উক্কাশা বিন্ মিহ্’সান (রা.) রাসূল (সা.) কে দাঁড়িয়ে
বললেন:
‘‘হে
আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি আল্লাহ্’র দরবারে দো’আ করুন, আমি যেন তাদের একজন হই। রাসূল
(সা.) বললেন: তুমি তাদেরই একজন’’। (বুখারী, হাদীস ৫৭৫২ মুসলিম, হাদীস ২২০)
তবে
এ কথা ভালোভাবে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, শরীয়তে কোন মৃত ব্যক্তির দো’আর অসিলা ধরা জায়েয
নেই। কারণ, সে মৃত। সে আপনার জন্য কিছুই করতে পারবে না। এ কারণেই ’উমর বিন্ খাত্তাব
(রা.) এর খিলাফতকালে অনাবৃষ্টি দেখা দিলে সাহাবারা রাসূল (সা.) এর কবরে গিয়ে তাঁর দো’আ
কামনা না করে বরং তাঁর চাচা ’আব্বাস (রা.) এর দো’আ কামনা করেন।
আনাস্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘মদীনায়
কোন অনাবৃষ্টি দেখা দিলে ’উমর বিন্ খাত্তাব (রা.) রাসূল (সা.) এর চাচা ’আব্বাস (রা.)
এর দো’আর অসিলা ধরে বৃষ্টির জন্য দো’আ করতেন। তিনি দো’আ করতে গিয়ে বলতেন: হে আল্লাহ্!
আমরা আপনার নিকট আপনার নবীর দো’আর অসিলা ধরলে আপনি তখন আমাদেরকে বৃষ্টি দিতেন। এখন
আপনার নিকট আপনার নবীর চাচার দো’আর অসিলা ধরছি। সুতরাং আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দিন। অতঃপর
তাদেরকে বৃষ্টি দেয়া হতো’’। (বুখারী, হাদীস ১০১০, ৩৭১০)
উক্ত
হাদীস আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কোন সম্মানজনক ব্যক্তির অস্তিত্বের অসিলা ধরা অথবা কোন
মৃত মহান ব্যক্তির দো’আর অসিলা ধরা নাজায়িয হওয়া প্রমাণ করে। তা না হলে ’উমর বিন্ খাত্তাব
(রা.) কর্তৃক রাসূল (সা.) এর চাচা ’আব্বাস (রা.) এর দো’আর অসিলা ধরে বৃষ্টির জন্য দো’আ
করার কোন মানে হয় না। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ’আব্বাস (রা.) এর সম্মান কোনোভাবেই
রাসূল (সা.) এর সম্মানের ঊর্ধ্বে নয়।
ছ. যে কোন নেক আমলের অসিলা
ধরা:
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন:
‘‘পূর্ববর্তী
উম্মতের তিন ব্যক্তি সফরে বের হলো। পথিমধ্যে তারা রাত্রি যাপনের জন্য এক গিরি গুহায়
অবস্থান নিলো। হঠাৎ পাহাড়ের উপর থেকে এক প্রকান্ড পাথর গড়িয়ে এসে তাদের গিরি গুহার
মুখ বন্ধ করে দিলো। তখন তারা পরস্পর বলাবলি করলো যে, নিশ্চয়ই তোমরা নিজ নেক আমলের অসিলা
ধরে দো’আ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে এ জগদ্দল পাথর হতে মুক্তি দিবেন। অতঃপর তাদের
একজন বললো: হে আল্লাহ্! আমার বৃদ্ধ মাতা-পিতা ছিলো। আর আমি তাদেরকে সন্ধ্যার পানীয়
পান না করিয়ে নিজ স্ত্রী পরিজনকে পান করাতাম না। একদা আমি কোন এক প্রয়োজনে বহু দূর
চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম আমার মাতা-পিতা ঘুমিয়ে গেছে। অতঃপর আমি তাদের জন্য সন্ধ্যার
পানীয় তথা দুধ দোহালাম। কিন্তু তারা ঘুমিয়ে রয়েছে বলে আমি তাদেরকে তা পান করাতে পারিনি।
অন্য দিকে তাদেরকে তা পান না করিয়ে নিজ স্ত্রী পরিজনকে পান করানো আমার একেবারেই অপছন্দ।
তাই আমি তাদের ঘুম থেকে জাগার অপেক্ষায় দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে ফজর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে
থাকলাম। অতঃপর তারা ঘুম থেকে জেগে দুধ পান করলো। হে আল্লাহ্! আমি যদি তা একমাত্র আপনাকে
পাওয়ার জন্য করে থাকি তাহলে আপনি আমাদের এ জগদ্দল পাথরটি সরিয়ে দিন। তখন পাথরটি একটু
করে সরে গেলো। কিন্তু তারা এতটুকুতে গুহা থেকে বের হতে পারলো না।
অপর
জন বললো: হে আল্লাহ্! আমার একটি চাচাতো বোন ছিলো যাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। অতঃপর আমি
তার সাথে ব্যভিচার করতে চাইলে সে তা করতে অস্বীকার করে। তবে হঠাৎ সে দুর্ভিক্ষের কবলে
পড়ে আমার নিকট সাহায্য কামনা করলে আমি তাকে ১২০ দীনার দেই ব্যভিচার করার শর্তে। এতে
সে রাজি হলো। অতএব আমি যখন শর্তানুযায়ী ব্যভিচারে উদ্যত হলাম তখন সে আমাকে বললো: আমি
তোমাকে শরীয়ত সম্মত অধিকার ছাড়া আমার সতীত্ব নষ্ট করতে দেবো না। তখন আমি তার সঙ্গে
ব্যভিচার করতে কুণ্ঠাবোধ করলাম। অতএব আমি তাকে এমতাবস্থায় ছেড়ে আসলাম। অথচ আমি তাকে
খুবই ভালোবাসি। এমনকি আমি তার কাছ থেকে টাকাগুলোও ফেরত নিলাম না। হে আল্লাহ্! আমি যদি
তা একমাত্র আপনাকে পাওয়ার জন্য করে থাকি তাহলে আপনি আমাদের এ জগদ্দল পাথরটি সরিয়ে দিন।
তখন পাথরটি একটু করে সরে গেলো। কিন্তু তারা এতটুকুতে গুহা থেকে বের হতে পারলো না।
তৃতীয়
জন বললো: হে আল্লাহ্! আমি কোন এক কাজের জন্য কয়েক জন দিন মজুর নিয়েছিলাম এবং তাদের
সবাইকে দিন শেষে নির্ধারিত দিন মজুরি দিয়ে দিয়েছি। তবে তাদের একজন মজুরি না নিয়ে চলে
গেলো। অতঃপর আমি তার মজুরিটুকু লাভজনক খাতে খাটালে সম্পদ প্রচুর বেড়ে যায়। কিছুদিন
পর সে আমার নিকট এসে বললো: হে আল্লাহ্’র বান্দাহ্! আমার মজুরি দিয়ে দাও। আমি তাকে বললাম:
তুমি উট, গরু, ছাগল, গোলাম যাই দেখতে পাচ্ছো সবই তোমার মজুরি। সে বললো: হে আল্লাহ্’র
বান্দাহ্! তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম: আমি তোমার সাথে এতটুকুও উপহাস
করছি না। অতঃপর সে সবগুলো পশু হাঁকিয়ে নিয়ে গেলো। একটি পশুও ছেড়ে যায়নি। হে আল্লাহ্!
আমি যদি তা একমাত্র আপনাকে পাওয়ার জন্য করে থাকি তাহলে আপনি আমাদের এ জগদ্দল পাথরটি
সরিয়ে দিন। তখন পাথরটি সম্পূর্ণরূপে সরে গেলো এবং তারা গুহা থেকে সুস্থভাবে বের হয়ে
পথ চলতে শুরু করলো’’। (বুখারী, হাদীস ২২১৫, ২২৭২ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৩)
১১. অসিলা ধরার শির্ক - ২
শরীয়ত বিরোধী অসিলা:
শরীয়ত
বিরোধী অসিলা বলতে ও সকল ব্যক্তি বা বস্ত্তকে বুঝানো হয় যে গুলোকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ
করা কোর’আন ও হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত নয়। যে গুলো নিম্নরূপ:
ক. কোন সম্মানিত ব্যক্তি
সত্তার অসিলা ধরা:
যেমন:
নবী (সা.) এর অসিলা ধরে এভাবে দো’আ করা,
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি আপনার নবীর মর্যাদার অসিলায় আপনার জান্নাত কামনা করছি। কারণ, আল্লাহ্
তা’আলার নিকট যে কোন মৃত ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা শুধু তাঁরই কাজে আসবে। অন্যের কাজে
নয়। জীবিত ব্যক্তির কাজে আসবে শুধু তারই আমল ও প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট
তার ব্যক্তিগত সম্মান ও মর্যাদা’’।
তবে
এমন বলা যেতে পারে,
‘‘হে
আল্লাহ্! আমি আপনার রাসূলের উপর ঈমান ও তাঁর আনুগত্যের অসিলায় আপনার নিকট এ কামনা করছি
যে, আপনি আমার সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন’’।
কেউ
কেউ ব্যক্তি সত্তার অসিলা ধরা জায়িয হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত প্রমাণগুলো উল্লেখ করে
থাকে। যা নিম্নরূপ:
১. আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘হে
ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করো। তাঁর সান্নিধ্য (তাঁর আনুগত্য ও নেক আমলের
মাধ্যমে) অন্বেষণ করো এবং তাঁর পথে জিহাদ করো। আশাতো, তোমরা সফলকাম হবে’’। (মা’য়িদাহ্
: ৩৫)
পীর
পূজারীরা বলে থাকে: উক্ত আয়াতে অসিলা বলতে পীর বুযুর্গদেরকেই বুঝানো হচ্ছে। অতএব তাদের
নিকট বায়’আত হতে হবে। তাদের অসিলা ধরতে হবে।
মূলতঃ
উক্ত আয়াতে অসিলা বলতে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য এবং নেক আমলকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ,
আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের অসংখ্য আয়াতে ঈমান ও নেক আমলকে জান্নাত পাওয়ার একান্ত
মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য কিছুকে নয়। অতএব আমাদেরকে উক্ত আয়াতের অসিলা শব্দ
থেকে ঈমান ও নেক আমলই বুঝতে হবে। অন্য কিছু নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘যারা
ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তারাই জান্নাতী। তম্মধ্যে তারা চিরকাল থাকবে’’। (বাক্বারাহ্
: ৮২)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে। অনুরূপ যারা একান্তভাবে নিজ প্রতিপালক অভিমুখী
হয়েছে। তারাই জান্নাতী। তাতে তারা অনন্তকাল থাকবে’’। (হূদ্ : ২৩)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে জান্নাতুল্ ফিরদাউস্ হবে তাদের আপ্যায়ন’’। (কাহ্ফ
: ১০৭)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘সুতরাং
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে একান্ত ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা’’।
(হাজ্জ : ৫০)
তিনি
আরো বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত’’। (লোকমান
: ৮)
উক্ত
আয়াতসমূহ বিবেচনা করলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, অসিলা বলতে আল্লাহ্ তা’আলা নেক আমলকেই
বুঝিয়েছেন। কোন পীর-বুযুর্গকে নয়।
তেমনিভাবে
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সা. ও হাদীসের মধ্যে ঈমান ও নেক আমলকে জান্নাতে যাওয়ার
মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
গ্রাম্য ব্যক্তি নবী (সা.) এর নিকট এসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল!
আপনি আমাকে এমন একটি কাজ শিক্ষা দিন যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো। রাসূল
(সা.) উত্তরে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করবে। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। ফরয
নামায প্রতিষ্ঠা ও ফরয যাকাত আদায় করবে। রমযান মাসের রোযা পালন করবে। গ্রাম্য ব্যক্তিটি
বললো: আল্লাহ্’র কসম! আমি এর চাইতে এতটুকুও বেশি করবো না। ব্যক্তিটি যখন এ কথা বলে
ফিরে যাচ্ছিলো তখন নবী (সা.) বললেন: যার মনে চায় জান্নাতী লোক দেখতে সে যেন এ ব্যক্তিকে
দেখে নেয়’’। (বুখারী, হাদীস ১৩৯৭)
আবু
আইয়ূব আন্সারী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি নবী (সা.) এর নিকট এসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি
আমাকে এমন একটি কাজ শিক্ষা দিন যা করলে আমি জান্নাতের অতি নিকটবর্তী হবো এবং জাহান্নাম
থেকে বহু দূরে সরে যাবো। রাসূল (সা.) উত্তরে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করবে। তাঁর
সাথে কাউকে শরীক করবে না। নামায প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে। আত্মীয়তা রক্ষা করবে।
লোকটি যখন ফিরে গেলো তখন রাসূল (সা.) বললেন: সে যদি আদিষ্ট কর্মগুলো ভালোভাবে আদায়
করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে’’। (মুসলিম, হাদীস ১৩)
উক্ত
আয়াত ও হাদীসগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা অসিলার আয়াতে অসিলা বলতে ঈমান
ও নেক আমলকেই বুঝিয়েছেন। পীর-বুযুর্গ জাতীয় অন্য কিছুকে নয়।
২. তারা বলে থাকে: আদম (আ.) জান্নাতে থাকাবস্থায়
নিষিদ্ধ গাছের ফল খেলে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেন। তখন তিনি
‘‘মুহাম্মাদ’’ নামের অসিলায় আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমা চাইলে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে
ক্ষমা করে দেন।
উক্ত
হাদীস সকল হাদীস গবেষকের ঐকমত্যে একেবারেই জাল ও বানোয়াট। কোনভাবেই তা বিশুদ্ধ নয়।
৩. তারা বলে থাকে: জনৈক অন্ধ ব্যক্তি নবী
(সা.) এর নিকট এসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি আল্লাহ্ তা’আলার
নিকট দো’আ করুন, যেন তিনি আমাকে ভালো করে দেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন:
’’তুমি
যদি চাও তাহলে আমি তোমার জন্য দো’আ করতে পারি। আর যদি তুমি চাও ধৈর্য ধরবে তাহলে সেটি
হবে তোমার জন্য খুবই উত্তম। সে বললো: আপনি আমার জন্য দো’আ করে দিন। তখন রাসূল (সা.)
তাকে ভালোভাবে ওযু করে এ দো’আ করার পরামর্শ দেন। যার অর্থ: হে আল্লাহ্! নিশ্চয়ই আমি
আপনার নিকট কামনা করছি এবং আপনার দয়ালু নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর দো’আর অসিলায় আপনার
নিকট কাকুতি-মিনতি করছি। আমার প্রভুর নিকট আমি রাসূল (সা.) এর দো’আর অসিলায় আমার প্রয়োজন
পূরণের জন্য কাতর অনুনয় করছি। হে আল্লাহ্! আপনি আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ বা দো’আ
কবুল করুন’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৮ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৪০৪)
মূলতঃ
উক্ত হাদীসে রাসূল (সা.) এর দো’আর অসিলা ধরা হয়েছে। তাঁর ব্যক্তি সত্তার নয়। তা না
হলে রাসূল (সা.) এর নিকট এসে তাঁর দো’আ চাওয়ার কোন মানে হয়না। কারণ, রাসূল (সা.) এর
ব্যক্তি সত্তার অসিলা তাঁর অনুপস্থিতিতেও দেয়া যেতে পারে। তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন হয়
না। উপরন্তু রাসূল (সা.) তার জন্য দো’আ করার ওয়াদা দিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তি সত্তার অসিলা
যথেষ্ট হলে তিনি কখনো তার জন্য দো’আ করার ওয়াদা করতেন না। তেমনিভাবে সেও আল্লাহ্ তা’আলার
নিকট তার ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর দো’আ কবুল হওয়ার মিনতি জানাতো না। কারণ, রাসূল (সা.)
এর ব্যক্তি সত্তার অসিলাই তখন তার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
এ
ছাড়াও নবী (সা.) তাঁর পুরো জীবদ্দশায় নিজ দো’আর মধ্যে কখনো তিনি ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা
বা অন্যান্য কোন সম্মানিত নবীর অসিলা ধরেননি। তেমনিভাবে সাহাবাদের কেউ নিজ দো’আয় কখনো
রাসূল (সা.) এর ব্যক্তি সত্তার অসিলা ধরেননি অথবা তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবরের নিকট
গিয়ে তাঁর মাধ্যমে কারোর জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট দো’আ করান নি।
খ. কোন মৃত ব্যক্তির দো’আর
অসিলা ধরা:
যেমন:
রাসূল (সা.) এর কবরের পাশে গিয়ে বলা: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আপনি আমার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার
দরবারে দো’আ করুন, আমি যেন অতিসত্বর ধনী হয়ে যাই। কারণ, কোন ব্যক্তির ইন্তেকালের পর
সে কোন ধরনের ইবাদাত করতে পারে না। এ কারণেই সাহাবারা রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর পর তাঁর
দো’আর অসিলা না ধরে হযরত ’আব্বাস (রা.) এর দো’আর অসিলা ধরেছেন।
একদা
ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) জনৈক ব্যক্তিকে কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে
শুনেছেন। সে বলছে: হে কবরবাসীরা! তোমরা কি জানো না আমি কয়েক মাস যাবৎ তোমাদের কবরের
নিকট এসে তোমাদেরকে দিয়ে শুধু আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আমার জন্য দো’আ করাতে চাচ্ছি। তোমরা
জানো কি জানোনা? ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্) তার এ কথা শুনে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন:
তারা তোমার কথার কোন উত্তর দেয়নি? সে বললো: না। তখন ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ্)
তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
‘‘দূর
হও এবং তোমার হস্তদ্বয় কর্দমাক্ত হোক! কিভাবে তুমি এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলছো যারা
তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নয়। যারা কোন কিছুর মালিক নয়। যারা কোন আওয়াজ শুনতে
পায় না। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেন যার অর্থ: হে নবী! আপনি কবরবাসীকে কিছু
শুনাতে সক্ষম হবেন না’’। [ফাতির : ২২ (কিতাবুত্ তাওহীদঃ ইক্ববাল কিলানী]
গ. জীবিত কিংবা মৃত ওলী অথবা
কোন মূর্তির ইবাদাতের অসিলা ধরা:
এটি
জঘন্যতম শির্ক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
‘‘জেনে
রেখো, অবিমিশ্র আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য। আর যারা আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত
অন্য কাউকে অভিভাবক বা সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা বলে: আমরা তো এদের পূজা
এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। তারা যে বিষয়
নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা সে বিষয়ের সঠিক ফায়সালা দিবেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা ঐ ব্যক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেননা যে মিথ্যাবাদী ও কাফির’’।
(যুমার : ৩)
১২. নামায ত্যাগের শির্ক
নামায
ত্যাগের শির্ক বলতে নিজের খেয়াল-খুশিকে প্রাধান্য দিয়ে ইচ্ছাকৃত বা অলসতা বশত নিয়মিতভাবে
দীর্ঘ দিন যাবৎ দৈনন্দিনের ফরয নামায আদায় না করাকে বুঝানো হয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
কি লক্ষ্য করেছেন ওর প্রতি যে নিজ খেয়াল-খুশিকে মা’বূদ বানিয়েছে? জ্ঞানানুযায়ী না চলার
দরুন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, তার কর্ণ ও হৃদয়ের উপর মোহর মেরে দিয়েছেন
এবং তার চোখের উপর আবরণ ঢেলে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য আর কে তাকে হিদায়াত
দিতে পারে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’’ (জাসিয়াহ্ : ২৩)
জাবির
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কোন
ব্যক্তি এবং শির্ক ও কুফরির মাঝে শুধু নামায না পড়াই পার্থক্য। অন্য কিছু নয়’’। (মুসলিম,
হাদীস ৮২)
১৩. আল্লাহ্ তা’আলা এবং তুমি না চাইলে কাজটা হতোনা এমন বলার শির্কঃ
এ
জাতীয় কথা বলা ছোট শির্ক।
’আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি নবী (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা এবং আপনি চেয়েছেন বলে কাজটি
হয়েছে। নতুবা হতো না। তখন নবী (সা.) বললেন: তুমি কি আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার শরীক বানাচ্ছো?
এমন কথা কখনো বলবে না। বরং বলবে: একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই চেয়েছেন বলে কাজটি হয়েছে।
নতুবা হতো না।
(আহমাদ
: ১/২১৪, ২২৪, ২৮৩, ৩৪৭ বুখারী/আদাবুল্ মুফরাদ্, হাদীস ৭৮৩ নাসায়ী/আমালুল্ ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ্,
হাদীস ৯৮৮ বায়হাক্বী : ৩/২১৭ ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস ১৩০০৫, ১৩০০৬ আবু নু’আইম/হিল্ইয়াহ্
: ৪/৯৯)
’হুযাইফাহ্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: স্বপ্নের মধ্যে জনৈক মুসলমানের সাথে জনৈক ইহুদী বা খ্রিষ্টানের
সাক্ষাৎ হলে সে মুসলমানকে বললোঃ তোমরা তো উৎকৃষ্ট সম্প্রদায় যদি তোমরা শির্ক না করতে।
তোমরা বলে থাকো: আল্লাহ্ তা’আলা এবং মুহাম্মদ (সা.) কাজটি চেয়েছে বলে হয়েছে। নতুবা
হতো না। নবী (সা.) কে ব্যাপারটি জানানো হলে তিনি বলেন:
‘‘জেনে
রাখো, আল্লাহ্’র কসম! নিশ্চয়ই আমি ব্যাপারটি জানতাম। তোমরা বলবে: আল্লাহ্ তা’আলা অতঃপর
মুহাম্মদ (সা.) কাজটি চেয়েছেন বলে হয়েছে। নতুবা হতো না। কারণ, এবং (ওয়াও) শব্দটি সমকক্ষতা
বুঝায় যা শির্ক। এর বিপরীতে অতঃপর (সুম্মা) শব্দটি কখনো সমকক্ষতা বুঝায় না’’। (ইবনু
মাজাহ্, হাদীস ২১৪৮ আহমাদ : ৫/৩৯৩)
মানুষের
মুখে এ জাতীয় আরো অনেক বাক্য প্রচলিত রয়েছে। যেমন: ‘‘আল্লাহ্ এবং আপনি না থাকলে আমার
অনেক সমস্যা হয়ে যেতো’’। ‘‘আমার জন্য শুধু আল্লাহ্ এবং আপনিই রয়েছেন’’। ‘‘আমি আল্লাহ্
এবং আপনার উপর নির্ভরশীল’’। ‘‘এটি আল্লাহ্ এবং আপনার পক্ষ হতে’’। ‘‘এটি আল্লাহ্ এবং
আপনার বরকতেই হয়েছে’’। ‘‘আমার জন্য আকাশে আছেন আল্লাহ্ এবং জমিনে আছেন আপনি’’।
১৪. আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর
নামে কসম খাওয়ার শির্কঃ
একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর নামে কসম খাওয়া ছোট শির্ক।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নিশ্চয়ই আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি। তিনি
ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর কসম খাবে সে মুশরিক হয়ে যাবে’’।
(আবু
দাউদ, হাদীস ৩২১৫ তিরমিযী, হাদীস ১৫৩৫ ইবনু হিব্বান/মাওয়ারিদ, হাদীস ১১৭৭ হা’কিম :
১/১৮, ৫২ ৪/২৯৭ বায়হাক্বী : ১০/২৯ আব্দুর রাযযাক : ৮/১৫৯২৬ ত্বায়ালিসী, হাদীস ১৮৯৬
আহমাদ : ২/৩৪, ১২৫)
’উমর
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে নিজ পিতার কসম খেতে নিষেধ করেছেন। যে ব্যক্তি কসম খেতে চায়
সে যেন আল্লাহ্’র কসম খায়। নতুবা সে যেন চুপ থাকে’’।
(বুখারী,
হাদীস ২৬৭৯, ৬১০৮, ৬৬৪৬ মুসলিম, হাদীস ১৬৪৬ আবু দাউদ, হাদীস ৩২৪৯ তিরমিযী, হাদীস ১৫৩৪
মালিক : ২/৪৮০ দারামী : ২/১৮৫ বায়হাক্বী : ১০/২৮ বাগাওয়ী, হাদীস ২৪৩১ ত্বায়ালিসী, হাদীস
১৯ আহমাদ : ২/১১, ১৭, ১৪২ হুমাইদী, হাদীস ৬৮৬)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
পিতা-মাতার কসম খেয়ো না। এমনকি আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য যে কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর
কসম খেয়ো না। তা যাই হোক না কেন। শুধু কসম খাবে আল্লাহ্ তা’আলার। তবে আল্লাহ্ তা’আলার
কসম হতে হবে সত্যি সত্যি। মিথ্যা নয়’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩২৪৮)
বুরাইদাহ্
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি আমানতের কসম খাবে সে আমার উম্মত নয়’’। (আবু দাউদ, হাদীস ৩২৫৩)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ মাস্ঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমার
নিকট মিথ্যাভাবে আল্লাহ্’র কসম খাওয়া অনেক ভালো সত্যিকারভাবে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্যের
কসম খাওয়া চাইতে’’। (ত্বাবারানী/কাবীর : ৯/৮৯০২)
আল্লাহ্
তা’আলা ভিন্ন অন্য কারোর কসম খেলে যা করতে হয়:
আল্লাহ্
তা’আলা ভিন্ন অন্য কারোর কসম খেলে কালিমায়ে তাওহীদ পড়ে নিবে।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘কোন
ব্যক্তি ‘‘লাত’’ ও ‘‘’উযযা’’ এর কসম খেলে সে যেন বলেঃ আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই’’।
(বুখারী,
হাদীস ৬৬৫০ মুসলিম, হাদীস ১৬৪৭ আবু দাউদ, হাদীস ৩২৪৭ তিরমিযী, হাদীস ১৫৪৫ ইবনু মাজাহ্,
হাদীস ২১২৬ বায়হাক্বী ১০/৩০ আহমাদ ২/৩০৯)
সা’আদ
বিন্ আবী ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘আমি
একদা ‘‘লাত’’ ও ‘‘’উযযা’’ এর কসম খেয়েছিলাম। তখন নবী (সা.) আমাকে বললেন: তুমি বলো:
আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই’’।
(ইবনু
হিববান, হাদীস ১১৭৮ আহমাদ : ১/১৮৩, ১৮৬-১৮৭ আবু ইয়া’লা, হাদীস ৭১৯, ৭৩৬ নাসায়ী/আল্
ইয়াওমু ওয়াল্লাইলাহ্, হাদীস ৯৮৯, ৯৯০)
যেমনিভাবে
রাসূল (সা.) নিজ উম্মতকে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্যের কসম খেতে নিষেধ করেছেন তেমনিভাবে তিনি
কেউ আল্লাহ্ তা’আলার কসম খেলে তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেতে উৎসাহিত করেছেন যাতে সে
আল্লাহ্ ভিন্ন অন্যের কসম খেতে বাধ্য না হয়।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা নবী (সা.) জনৈক ব্যক্তিকে নিজের পিতার
কসম খেতে দেখলে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
‘‘তোমরা
নিজ পিতার কসম খেয়ো না। কেউ আল্লাহ্ তা’আলার কসম খেলে সে যেন সত্য কসম খায়। আর যার
জন্য আল্লাহ্ তা’আলার কসম খাওয়া হলো সে যেন সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে নেয়। যে ব্যক্তি
তার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার কসম খাওয়ার পরও সে তা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয় না তার সাথে
আল্লাহ্ তা’আলার কোন সম্পর্ক নেই’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ২১৩১)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘ঈসা
(আ.) জনৈক ব্যক্তিকে চুরি করতে দেখে বললেন: তুমি কি চুরি করেছো? সে বললো: না, আল্লাহ্
তা’আলার কসম যিনি এক ও একক। তখন ঈসা (আ.) বললেন: আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করে মেনে নিচ্ছি,
তুমি সত্যই বলেছো আর আমি মিথ্যা দেখেছি’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ২১৩২)
১৫. যুগ বা বাতাসকে গালি দেয়ার শির্কঃ
যুগ
বা বাতাসকে গালি দেয়া ছোট শির্ক। কারণ, যে ব্যক্তি যুগ বা বাতাসকে গালি দেয় সে অবশ্যই
এ কথা বিশ্বাস করে যে, যুগ বা বাতাস এককভাবে কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে। নতুবা
যুগ বা বাতাসকে গালি দেয়ার কোন মানে হয় না।
যুগ
বা বাতাসকে দোষারোপ করার চরিত্র শুধু আজকের নয় বরং তা মক্কার মুশরিকদের মধ্যেও বর্তমান
ছিলো।
আল্লাহ্
তা’আলা মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন:
‘‘তারা
(মুশরিকরা) বলে: একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন। এখানে আমরা মরি ও বাঁচি এবং একমাত্র
যুগই আমাদের ধ্বংস সাধন করে। বস্ত্ততঃ এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত কোন জ্ঞানই নেই। তারা
তো শুধু মনগড়া কথা বলে’’। (জাসিয়াহ্ : ২৪)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আল্লাহ্
তা’আলা বলেন: মানুষ আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যুগকে গালি দেয়। অথচ আমিই যুগ নিয়ন্ত্রক।
সকল বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ আমার হাতেই। আমার আদেশেই রাত-দিন সংঘটিত হয়’’।
(বুখারী,
হাদীস ৪৮২৬, ৬১৮১, ৭৪৯১ মুসলিম, হাদীস ২২৪৬ আবু দাউদ, হাদীস ৫২৭৪ আহমাদ : ২/২৩৮ ’হুমাইদী,
হাদীস ১০৯৬ বায়হাক্বী : ৩/৩৬৫ ইবনু হিব্বান/ইহসান, হাদীস ৫৬৮৫ হা’কিম : ২/৪৫৩)
উবাই
বিন্ কা’ব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
বাতাসকে গালি দিও না। তবে তোমরা কোন অসুবিধাকর পরিবেশ দেখলে বলবে: হে আল্লাহ্! আমরা
এ বাতাসের কল্যাণ কামনা করি, এ বাতাসে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং এ বাতাসকে যে কল্যাণের
আদেশ করা হয়েছে। হে আল্লাহ্! আমরা আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি এ বাতাসের অকল্যাণ হতে,
এ বাতাসে যে অকল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং এ বাতাসকে যে অকল্যাণের আদেশ করা হয়েছে’’।
(বুখারী/আদাবুল্
মুফরাদ্, হাদীস ১৯ তিরমিযী, হাদীস ২২৫২ নাসায়ী/আমালুল্ ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ্, হাদীস
৯৩৩-৯৩৬ ইবনুস্ সুন্নী/আমালুল্ ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ্, হাদীস ২৯৮ হা’কিম : ২/২৭২ আহমাদ
: ৫/১২৩)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘তোমরা
বাতাসকে গালি দিও না। কারণ, তা আল্লাহ্’র রহমত। তবে তা কখনো রহমত নিয়ে আসে আবার কখনো
আযাব। কিন্তু ব্যতিক্রম কিছু দেখলে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বাতাসের কল্যাণ এবং উহার অকল্যাণ
হতে তাঁর আশ্রয় কামনা করবে’’।
(বুখারী/আদাবুল্
মুফরাদ্, হাদীস ৭২০, ৯০৬ নাসায়ী/আমালুল্ ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ্, হাদীস ৯২৯, ৯৩১, ৯৩২
আবু দাউদ, হাদীস ৫০৯৭ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৩৭৯৫ হা’কিম : ৪/২৮৫ ইবনু আবী শাইবাহ্ : ১০/২১৬
আহমাদ : ২/২৫০, ২৬৮, ৪০৯, ৪৩৬-৪৩৭, ৫১৮ আব্দুর রাযযাক : ১১/২০০০৪)
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘বাতাসকে
অভিশাপ দিওনা। কারণ, সে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট। আর যে ব্যক্তি অভিশাপের
অনুপযুক্ত বস্ত্তকে অভিশাপ দেয় সে অভিশাপ পুনরায় তার উপরই ফিরে আসে’’।
(তিরমিযী,
হাদীস ১৯৭৮ আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৮ ত্বাবারানী/কাবীর : ১২/১২৭৫৭ ইবনু হিব্বান, হাদীস
১৯৮৮)
যুগ বা বাতাসকে গালি দেয়ার
মধ্যে তিনটি অপকার রয়েছে। যা নিম্নরূপ:
১. গালির অনুপযুক্ত বস্ত্তকে গালি দেয়া।
কারণ, যুগ বা বাতাস আল্লাহ্’র সৃষ্টি এবং তারা আল্লাহ্’র আদেশেই পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত।
সুতরাং ওরা গালি খাওয়ার কোনভাবেই উপযুক্ত নয়।
২. ওদেরকে গালি দেয়া শির্ক। কারণ, যে ওদেরকে
গালি দেয় সে অবশ্যই এমন মনে করে যে, ওরা আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ ছাড়া কারোর কোন লাভ বা
ক্ষতি করতে পারে।
৩. ওদেরকে গালি দেয়া মানে পরোক্ষভাবে আল্লাহ্
তা’আলাকেই গালি দেয়া। কারণ, তাঁর আদেশেই সবকিছু হয়ে থাকে।
১৬. কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ‘যদি এমন করতাম তাহলে এমন হতোনা’ বলার
শির্কঃ
এ
জাতীয় কথা বলা তাক্বদীরে অবিচল বিশ্বাস বিরোধী এবং ছোট শির্ক ও বটে। কারণ, কোন ঘটনা
ঘটে যাওয়ার পর এমন বলা: ‘‘যদি এমন করতাম তাহলে এমন হতো না’’ অথবা ‘‘যদি এমন না করতাম
তাহলে এমন হতো না’’ এ কথাই প্রমাণ করে যে, বান্দাহ্ আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়াও স্বেচ্ছায়
নিজের লাভ বা ক্ষতি তথা যে কোন কাজ করতে পারে।
’উহুদের
যুদ্ধে মুসলমানদের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ নেমে আসলে তাদের মধ্যে যারা মুনাফিক তারা
এ ব্যাপারে উপরোল্লিখিত উক্তি উচ্চারণ করে। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সম্পর্কে নিন্দা করে
বলেন:
‘‘তারা
বলে: যদি এ ব্যাপারে (যুদ্ধের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে) আমাদের কোন হাত থাকতো তাহলে
আজ আমাদেরকে এখানে হত্যা করা হতো না। আপনি বলে দিন: যদি তোমরা আজ তোমাদের ঘরেও থাকতে
তবুও যাদের ব্যাপারে আজ নিহত হওয়া লিপিবদ্ধ রয়েছে তারা অবশ্যই নিজ মৃত্যুস্থানে উপস্থিত
হতে’’। (আ’লি ইমরান : ১৫৪)
উক্ত
আয়াত এটাই প্রমাণ করে যে, কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ‘‘যদি’’ শব্দ উচ্চারণ করা মুনাফিকের
বৈশিষ্ট্য। খাঁটি মুসলমানের বৈশিষ্ট্য নয়। খাঁটি মুসলমানের বৈশিষ্ট্য হলো, তার উপর
কোন বিপদ আসলে সে এমন শব্দ উচ্চারণ করবে যা ধৈর্য, সাওয়াবের আশা ও তাক্বদীরে দৃঢ় বিশ্বাস
বুঝাবে।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘শক্তিশালী
মু’মিন দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা অনেক ভালো এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট অধিক পছন্দনীয়। তবে
উভয়ের মধ্যে কম ও বেশি কল্যাণ রয়েছে। যা তোমার উপকারে আসবে তা করতে সর্বদা তুমি উৎসাহী
থাকবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার সাহায্য কামনা করবে। অক্ষমের ন্যায় বসে থাকবে না। কোন অঘটন
ঘটলে এ কথা বলবে না যে, যদি এমন করতাম তা হলে এমন এমন হতো। বরং বলবে: আল্লাহ্ তা’আলা
ইহা আমার ভাগ্যে রেখেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কারণ, ‘‘যদি’’ শব্দটি শয়তানের
শয়তানীর দরোজা খুলে দেয়’’। (মুসলিম, হাদীস ২৬৬৪)
অপ্রকাশ্য শিরক বা গোপনীয়
শিরকঃ
অপ্রকাশ্য
শির্ক বলতে এমন সব ব্যাপারকে বুঝানো হচ্ছে যা চোখে দেখা যায় না অথবা কানে শুনা যায়না
অথবা অনুভব করা যায় না।
অপ্রকাশ্য
শির্ক আবার তিন প্রকার। যা নিম্নরূপ:
১. নিয়্যাতের শির্ক:
নিয়্যাতের
শির্ক বলতে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে না করে শুধুমাত্র দুনিয়া
কামানোর উদ্দেশ্যে করাকে বুঝানো হয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘যারা
পার্থিব জীবন ও উহার সাজসজ্জা চায় আমি তাদের কৃতকর্মের ফল পূর্ণভাবে দুনিয়াতেই দিয়ে
দেবো। এতটুকুও তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরা এমন যে, আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া
আর কিছুই থাকবে না। তাদের সকল আমল তখন অকেজো এবং নিষ্ফল বলে বিবেচিত হবে’’। (হূদ: ১৫,
১৬)
মানুষ
যে নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে না করে অন্য কোন উদ্দেশ্যে করে থাকে
তা চার প্রকার:
১. কোন নেক আমল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য করেছে
ঠিকই। কিন্তু সে এর মাধ্যমে আখিরাতের কোন পুণ্য চায় না। বরং সে এর মাধ্যমে নিজ পরিবার
ও পরিজনের হিফাজত অথবা ধন-সম্পদের উন্নতি ও রক্ষা এমনকি নিয়ামতের স্থায়িত্ব কামনা করে।
এমন ব্যক্তির জন্য আখিরাতে কিছুই নেই। আল্লাহ্ চান তো দুনিয়াতে তার আশা পূর্ণ হবে মাত্র।
এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
২. কোন নেক আমল মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে
করা। পরকালের পুণ্যের আশায় নয়। এর জন্যও আখিরাতে কিছুই থাকবে না।
৩. শুরু থেকেই কোন নেক আমল দুনিয়ার জন্য
করা। আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য নয়। যেমন: সম্পদের জন্য হজ্জ বা জিহাদ করা।
৪. কোন নেক আমল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য করেছে
ঠিকই। কিন্তু সাথে সাথে সে এমন কাজও করে যাচ্ছে যা তাকে ইসলামের গন্ডী থেকে সম্পূর্ণরূপে
বের করে দেয়। অথবা সে আদতেই কাফির। এ ব্যক্তি তার আমলগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার
জন্য করে থাকলেও তা আল্লাহ্ তা’আলার জন্য হবে না। কারণ, সে কাফির এবং এ ব্যক্তির জন্য
আখিরাতে কিছুই থাকবে না।
দুনিয়া
কামানোর জন্য কোন নেক আমল করা হলে দুনিয়া যে নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে তাও কিন্তু সঠিক
নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলা যাকে যতটুকু দিতে চাবেন সে ততটুকুই পাবে। এর বেশি কিছু সে পাবে
না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
‘‘কোন
ব্যক্তি পার্থিব কোন সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে ইচ্ছা এবং যা ইচ্ছা অতিসত্বর দিয়ে
থাকি। অতঃপর আমি তার জন্য নির্ধারিত করে রাখি জাহান্নাম। যাতে সে প্রবেশ করবে অপমানিত
ও লাঞ্ছিতভাবে’’। (ইস্রা/বানী ইস্রাঈল : ১৮)
রাসূল
(সা.) দুনিয়াকামী ব্যক্তিদেরকে দুনিয়ার গোলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা কখনো আল্লাহ্
তা’আলার গোলাম হতে পারে না।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘ধ্বংস
হোক দীনার ও দিরহামের গোলাম! ধ্বংস হোক পোশাক-পরিচ্ছদের গোলাম! তাকে কিছু দিলে খুশি।
না দিলে বেজার। ধ্বংস হোক! কখনো সে সফলকাম না হোক! সমস্যায় পড়লে সমস্যা থেকে উদ্ধার
না হোক! (কাঁটা বিঁধলে না খুলুক)। জান্নাত ঐ ব্যক্তির জন্য যে সর্বদা আল্লাহ্’র রাস্তায়
ঘোড়ার লাগাম ধরেই আছে। মাথার চুলগুলো তার এলোমেলো। পা যুগল ধূলিমলিন। সেনাবাহিনীর পাহারায়
দিলেও রাজি। পশ্চাতে দিলেও রাজি। উপরস্থদের নিকট অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়
না। কারোর জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না’’। (বুখারী, হাদীস ২৮৮৬,
২৮৮৭ বায়হাক্বী : ৯/১৫৯, ১০/২৪৫)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! জনৈক ব্যক্তি আল্লাহ্’র পথে জিহাদ করতে চায়। অথচ
তার উদ্দেশ্য দুনিয়া কামানো। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তার কোন সাওয়াব হবে না। লোকটি
রাসূল (সা.) কে এ কথাটি তিন বার জিজ্ঞাসা করলো। আর রাসূল (সা.) প্রত্যেকবারই একই উত্তর
দিলেন’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২৫১৬ হাকিম : ২/৮৫ বায়হাক্বী : ৯/১৬৯ আহমাদ : ২/২৯০, ৩৬৬)
ক্বাতাদা
(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘‘দুনিয়াই
যার আশা, ভরসা, চাওয়া ও পাওয়া হবে আল্লাহ্ তা’আলা তার সকল নেক আমলের প্রতিদান দুনিয়াতেই
দিয়ে দেবেন। আখেরাতের জন্য একটি নেক আমলও তার জন্য গচ্ছিত রাখা হবে না। তবে খাঁটি ঈমানদার
তার নেক আমলের ফল দুনিয়াতেও পাবে আখেরাতেও’’।
২. কারোর সন্তুষ্টি কামনার শির্কঃ
কারোর
সন্তুষ্টি কামনার শির্ক বলতে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য
না করে অন্য কারোর সন্তুষ্টির জন্য করাকে বুঝানো হয়। যে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই করতে হয়। অন্য কারোর জন্যে নয়। সুতরাং কোন নেক আমল একমাত্র
আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কারোর সন্তুষ্টির জন্য করা হলে তা হবে মারাত্মক
শির্ক।
কোর’আন
মাজীদে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনাকারীদেরকেই সফলকাম বলা হয়েছে। অন্য
কাউকে নয়।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘অতএব
আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। এ কাজটি সর্বোত্তম ওদের
জন্যে যারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং ওরাই সত্যিকার সফলকাম’’।
(রূম : ৩৮)
আল্লাহ্
তা’আলা সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
‘‘তারা
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ কামনা করে’’। (ফাত্হ : ২৯)
যে
ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য দান-সাদাকা করে থাকে আল্লাহ্ তা’আলা
তাকে কোর’আন মাজীদের মধ্যে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্যতম বলে আখ্যায়িত
করেছেন।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তবে
পরম মুত্তাকী ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হবে। যিনি স্বীয় সম্পদ দান করে
আরো কল্যাণ প্রাপ্তি তথা তা বৃদ্ধির আশায়। তার প্রতি কারোর অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে
নয়। শুধুমাত্র তার মহান প্রভুর একান্ত সন্তুষ্টি লাভের আশায়। সে জান্নাত পেয়ে অচিরেই
সন্তুষ্ট হবে’’। (লাইল : ১৭-২১)
’আয়েশা
(রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
‘‘যে
ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করে মানুষের
ব্যাপারে তার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলাকে অসন্তুষ্ট
করে একমাত্র মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দেন।
তিনি তার কোন ধরনের সহযোগিতা করেন না’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৪১৪)
আবু
উমামা বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘নিশ্চয়ই
আল্লাহ্ তা’আলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যার মাধ্যমে
শুধুমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হয়’’। (নাসায়ী, হাদীস ৩১৪০ বায়হাক্বী, হাদীস ৪৩৪৮)
৩. কাউকে দেখানো বা শুনানোর শির্কঃ
কাউকে
দেখানো (রিয়া) বা শুনানো (সুম্’আহ্) এর শির্ক বলতে কোন নেক আমল করার সময় তা কাউকে দেখানো
বা শুনানোর উদ্দেশ্যে করাকে বুঝানো হয়। যাতে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো যায়।
কোন
নেক আমল লুক্কায়িতভাবে করার পর পুনরায় তা কাউকে জানিয়ে দেয়াও এ শির্কের অন্তর্গত।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘আপনি
বলে দিন: নিশ্চয়ই আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে আমার প্রতি এ প্রত্যাদেশ হয়
যে, তোমাদের মা’বূদই একমাত্র মা’বূদ। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে
সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে যেন শরীক না করে’’। (কাহ্ফ :
১১০)
ইমাম
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ্) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
‘‘যখন
আল্লাহ্ তা’আলা একক। তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। তখন সকল ইবাদাত একমাত্র তাঁরই জন্য
হতে হবে। অতএব নেক আমল বলতে রাসূল (সা.) এর আদর্শ সম্মত রিয়ামুক্ত ইবাদাতকেই বুঝানো
হয়। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকলে তা নেক আমল বলে গণ্য হবে না’’।
আল্লাহ্
তা’আলা কোর’আন মাজীদে রিয়াকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন:
‘‘নিশ্চয়ই
মুনাফিকরা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে প্রতারণা করে। তিনি অচিরেই তাদের প্রতারণার শাস্তি
দিবেন। যখন তারা নামাযের জন্য দাঁড়ায় তখন তারা লোকদেরকে দেখানোর জন্য আলস্যভাবেই দাঁড়ায়
এবং তারা আল্লাহ্ তা’আলাকে খুব কমই স্মরণ করে থাকে’’। (নিসা’ : ১৪২)
উক্ত
ব্যাধিটি কাফিরদের মধ্যেও প্রচলিত ছিলো। তারা যে কোন কাজ দাম্ভিকতার সঙ্গে লোকদেরকে
দেখানোর জন্যই করতো।
আল্লাহ্
তা’আলা বলেন:
‘‘তোমরা
তাদের (কাফিরদের) ন্যায় আচরণ করোনা যারা নিজেদের ঘর হতে বের হয়েছে সদর্পে ও লোকদেরকে
নিজেদের শক্তি দেখানোর জন্য। তারা মানুষকে আল্লাহ্’র পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আল্লাহ্
তা’আলা তাদের কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’’। (আন্ফাল্ : ৪৭)
কেউ
কোন নেক আমল শুধু মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করলে অথবা সাওয়াবের জন্য এবং মানুষকে দেখানোর
উদ্দেশ্যে করলে তাতে কোন সাওয়াব হবে না। বরং তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘আমি
শির্কের প্রতি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোন নেক আমলের মধ্যে আমি ছাড়া
অন্য কাউকে আমার সাথে শরীক করলো আমি সে আমল ও সে শরীককে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান
করি’’। (মুসলিম, হাদীস ২৯৮৫ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৭৭)
আবু
উমামা বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘জনৈক
ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! জনৈক ব্যক্তি যুদ্ধ করছে
সাওয়াব ও সুনামের জন্য। এমতাবস্থায় সে পুণ্য পাবে কি? রাসূল (সা.) বললেন: সে কিছুই
পাবে না। লোকটি রাসূল (সা.) কে এ কথাটি তিন বার জিজ্ঞাসা করলো। আর রাসূল (সা.) প্রতিবারই
তাকে বললেন: সে কিছুই পাবে না। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা এমন
আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যা শুধু তাঁরই জন্য নিবেদিত’’।
(নাসায়ী, হাদীস ৩১৪০ বায়হাক্বী, হাদীস ৪৩৪৮)
আবু
হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
‘‘নিশ্চয়ই
কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির হিসেব হবে সে একজন শহীদ। সুতরাং তাকে উপস্থিত
করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে দেয়া হবে যা সে দুনিয়াতে ভোগ
করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন: এ গুলোর শুকরিয়া
সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি আপনার দ্বীন দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য
যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গিয়েছি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি
যুদ্ধ করেছো এ জন্য যে, তোমাকে বলা হবে বীর সাহসী। আর তা বলা হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে
আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরেক
ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেছে এবং অন্যকেও শিখিয়েছে। তেমনিভাবে কোর’আন মাজীদও তিলাওয়াত
করেছে। সুতরাং তাকে উপস্থিত করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে
দেয়া হবে যা সে দুনিয়াতে ভোগ করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা
তাকে বলবেন: এ গুলোর শুকরিয়া সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি জ্ঞানার্জন
করেছি এবং অন্যকেও শিখিয়েছি। তেমনিভাবে কোর’আন মাজীদও তিলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ্
তা’আলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি জ্ঞানার্জন করেছো এ জন্য যে, তোমাকে আলিম
বা জ্ঞানী বলা হবে এবং কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করেছো এ জন্য যে, তোমাকে ক্বারী বা কোর’আন
তিলাওয়াতকারী বলা হবে। আর তা বলা হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের
উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরেক
ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা’আলা ধনী বানিয়েছেন এবং তাকে সর্ব ধরনের সম্পদ দিয়েছেন। সুতরাং
তাকে উপস্থিত করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে দেয়া হবে যা সে
দুনিয়াতে ভোগ করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন:
এ গুলোর শুকরিয়া সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি এমন কোন খাত বাকি রাখিনি
যেখানে দান করা আপনার নিকট পছন্দনীয় অথচ আমি দান করিনি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন:
তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি দান করেছো এ জন্য যে, তোমাকে দানবীর বলা হবে। আর তা বলা
হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ
করা হবে’’। (মুসলিম, হাদীস ১৯০৫)
জুন্দুব
(রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
‘‘যে
ব্যক্তি কোন নেক আমল মানুষকে দেখানোর জন্য করবে আল্লাহ্ তা’আলা তা মানুষকে দেখিয়ে দিবেন।
আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি কোন নেক আমল মানুষকে শুনানোর জন্য
করবে আল্লাহ্ তা’আলা তা মানুষকে শুনিয়ে দিবেন। আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না’’।
(ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৮২)
আবু
সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) আমাদের নিকট আসলেন যখন আমরা দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন: আমি
কি তোমাদেরকে এমন বস্ত্ত সম্পর্কে সংবাদ দেবো যা আমার জানা মতে তোমাদের জন্য দাজ্জাল
চাইতেও অধিক ভয়ঙ্কর। আমরা বললাম: হাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন: লুক্কায়িত শির্ক। যেমন:
কোন ব্যক্তি নামায পড়ছিলো অতঃপর কেউ তাকে দেখছে বলে সে নামাযকে খুব সুন্দর করে পড়তে
শুরু করলো’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৭৯ আহমাদ : ৩/৩০ হা’কিম : ৪/৩২৯)
মাহমূদ
বিন্ লাবীদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘নবী
(সা.) নিজ হুজরা থেকে বের হয়ে বললেন: হে মানব সকল! তোমরা গুপ্ত শির্ক থেকে বেঁচে থাকো।
সাহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! গুপ্ত শির্ক কি? তিনি বললেন: যেমন: কোন ব্যক্তি
নামায পড়ছে। এমতাবস্থায় কেউ তাকে দেখছে বলে সে অত্র নামাযটি খুব সুন্দরভাবে পড়তে শুরু
করলো। এটিই হলো গুপ্ত শির্ক’’। (ইবনু খুজাইমাহ্, হাদীস ৯৩৭ বায়হাক্বী : ২/২৯০-২৯১)
তবে
কোন ব্যক্তি যদি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য কোন নেক আমল করে। অতঃপর মানুষ
তা দেখে তার কোন প্রশংসা করে এবং সে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে এ কাজের জন্য তাওফীক দিয়েছেন
বলে তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে মনে মনে খুশি হয়। গর্বিত নয়। তাতে কোন অসুবিধে নেই।
বরং তা হবে তার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে অগ্রিম পাওনা। আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত
তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) কে বলা হলো: আপনি এ ব্যাপারে কি বলেন? জনৈক ব্যক্তি কোন নেক আমল করছে। আর মানুষ
এতে করে তার প্রশংসা করছে। রাসূল (সা.) বললেন: এটি হচ্ছে একজন মু’মিনের জন্য অগ্রিম
সুসংবাদ’’। (মুসলিম, হাদীস ২৬৪২ আহমাদ : ৫/১৫৬)
হে
আল্লাহ্! আপনি আমাদের সকলকে শির্ক থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আ’মীন সুম্মা আ’মীন।
পির-মুরিদ বা সুফি এবং বিদআতিদের
ঈমান বিধ্বংসী শিরকী আক্বিদাহসমূহঃ
(ক) রাসূল ও রিসালাত:
নবু’ওয়াত
ও রিসালাত সম্পর্কে সূফীদের ঈমান বিধ্বংসী ধারণার কিয়দাংশ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
সূফীদের
নিকট ‘‘বিলায়াত’’ তথা বুযুর্গী নবু’ওয়াত এবং রিসালাত চাইতেও উত্তম।
শাইখ
মুহয়ুদ্দীন ইবনু ’আরাবী বলেন:
‘‘নবু’ওয়াতের
অবস্থান মধ্যম পর্যায়ের। বিলায়াতের নীচে ও রিসালাতের উপরে’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা:
১১৮)।
বায়েযীদ
বুস্তামী বলেন:
‘‘আমি
(মা’রিফাতের) সাগরে ডুব দিয়েছি; অথচ নবীরা আশ্চর্য হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন’’। তিনি আরো
বলেন:
‘‘আমার
পতাকা কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদ (সা.) এর পতাকা চাইতেও অনেক উঁচু হবে’’। আমার পতাকা হবে
নূরের। যার নিচে থাকবেন সকল নবী ও রাসূলগণ। সুতরাং আমাকে একবার দেখা আল্লাহ্ তা’আলাকে
এক হাজার বার দেখার চাইতেও উত্তম।
সূফীদের
কেউ কেউ ধারণা করেন: রাসূল (সা.) হচ্ছেন বিশ্বের কেন্দ্র স্থল। তিনিই হচ্ছেন স্বয়ং
আল্লাহ্। যিনি আর্শের উপর রয়েছেন। আকাশ ও জমিন, আর্শ এবং কুর্সী এমনকি বিশ্বের তাঁর
নূর থেকেই তৈরি করা হয়েছে। তাঁর অস্তিত্বই সর্ব প্রথম। আল্লাহ্’র আর্শের উপর তিনিই
সমাসীন। (সূফিয়্যাত, শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১২০)
নিযামুদ্দীন
আউলিয়া বলেন: ‘‘পীরের কথা রাসূল (সা.) এর কথার সম পর্যায়ের’’। (সূফীবাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ
কিতাব, পৃষ্ঠা: ৬৯)
’হাফিয
শীরাযী বলেন: ‘‘যদি তোমাকে তোমার পীর সাহেব নিজ জায়নামায মদে ডুবিয়ে দিতে বলে তাহলে
তুমি তাই করবে। কারণ, বুযুর্গীর রাস্তায় চলন্ত ব্যক্তি সে রাস্তার আদব-কায়দা সম্পর্কে
ভালোই জানেন’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
(খ) কুর’আন ও হাদীস:
কুর’আন
ও হাদীস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা:
সূফী
’আফীফুদ্দীন তিলমাসানী বলেন:
‘‘কোর’আন
মাজীদের মধ্যে তাওহীদ কোথায়? তা তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শির্ক দিয়েই পরিপূর্ণ। যে
ব্যক্তি সরাসরি কোর’আনকে অনুসরণ করবে সে কখনো তাওহীদের উচ্চ শিখরে পৌঁছুতে পারবে না’’।
(শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
জনাব
বায়েযীদ বোস্তামী বলেন: ‘‘তোমরা (শরীয়তপন্থীরা) নিজেদের জ্ঞান মৃত ব্যক্তিদের থেকে
(মুহাদ্দিসীনদের থেকে) সংগ্রহ করে থাকো। আর আমরা নিজেদের জ্ঞান সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলা
থেকে সংগ্রহ করি যিনি চিরঞ্জীব। আমরা বলি: আমার অন্তর আমার প্রভু থেকে বর্ণনা করেছে।
আর তোমরা বলো: অমুক বর্ণনাকারী আমার নিকট বর্ণনা করেছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ওই বর্ণনাকারী
কোথায়? উত্তর দেয়া হয়, সে মৃত্যু বরণ করেছে। যদি বলা হয়: সে বর্ণনাকারী কার থেকে বর্ণনা
করেছে এবং সে কোথায়? বলা হবে: সেও মৃত্যু বরণ করেছে। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
(গ) ইবলিস ও ফির’আউন:
অভিশপ্ত
ইবলিস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে আল্লাহ্ তা’আলার কামিল বান্দাহ্। সর্ব
শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্’র সৃষ্টি। খাঁটি তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া
আর কাউকে সিজদাহ্ করেনি। আল্লাহ্ তা’আলা তার সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাকে
জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
ফির’আউন
সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে একজন শ্রেষ্ঠ তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে ঠিকই বলেছে:
‘‘আনা রাব্বুকুমুল-আ’লা’’ (আমিই তো তোমাদের সুমহান প্রভু)। মূলতঃ সেই তো হাক্বীক্বতে
পৌঁছেছে। কারণ, সব কিছুই তো স্বয়ং আল্লাহ্। তাই সে খাঁটি ঈমানদার এবং জান্নাতী।
(ঘ) ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্:
সূফীদের
পরিভাষায় নামায বলতে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে আন্তরিক সাক্ষাতকেই বুঝানো হয়। আবার কারো
কারোর নিকট পীরের প্রতিচ্ছবি কাল্পনিকভাবে নামাযীর চোখের সামনে উপস্থিত না হলে সে নামায
পরিপূর্ণই হয় না। রোযা বলতে হৃদয়ে গায়রুল্লাহ্’র চিন্তা (একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া
দুনিয়াতে অন্য কিছু আছে বলে মনে করা) না আসাকেই বুঝানো হয় এবং হজ্জ বলতে নিজ পীর সাহেবের
সাথে বিশেষভাবে সাক্ষাৎ করাকেই বুঝানো হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা প্রচলিত নামায, রোযা,
হজ্জ ও যাকাতকে সাধারণ লোকের ইবাদাত বলে আখ্যায়িত করে। যা বিশেষ ও অতি বিশেষ লোকদের
জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ যিকির, নিতান্ত একা জীবন যাপন, নির্দিষ্ট
খাবার, নির্দিষ্ট পোষাক ও নির্দিষ্ট বৈঠক।
ইসলামে
ইবাদাতের উদ্দেশ্য ব্যক্তি বা সমাজ শুদ্ধি হয়ে থাকলেও সূফীদের ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে
আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্তরের বিশেষ বন্ধন সৃষ্টি যার দরুন তাঁর থেকেই সরাসরি কিছু
শিখা যায় এবং তাঁর মধ্যে বিলীন হওয়া যায়। তাঁর রাসূল থেকে গায়েবের জ্ঞান সংগ্রহ করা
যায়। এমনকি আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত হওয়া যায়।
তা হলে সূফী সাহেবও কোন কিছুকে হতে বললে তা হয়ে যাবে। মানুসের গুপ্ত রহস্যও তিনি বলতে
পারবেন। এমনকি আকাশ ও জমিনের সব কিছুই তিনি সচক্ষে দেখতে পাবেন।
এ
ছাড়াও সূফীরা ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্’র ক্ষেত্রে এমন কিছু পন্থা আবিষ্কার করেছে যা কুর’আন
ও হাদীসের সম্পূর্ণ বিরোধী। নিম্নে উহার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
(১) বলা হয়: আব্দুল কাদির জিলানী পনেরো
বছর যাবৎ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ’ইশা থেকে ফজর পর্যন্ত এক খতম কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করেছেন।
(শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)
একদা
তিনি নিজেই বলেন: আমি পঁচিশ বছর যাবৎ ইরাকের জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি আমি
এক বছর পর্যন্ত তো শুধু ঘাস ও মানুষের পরিত্যক্ত বস্ত্ত খেয়েই জীবন যাপন করেছি। পুরো
বছর একটুও পানি পান করিনি। তবে এর পরের বছর পানিও পান করতাম। তৃতীয় বছর তো শুধু পানি
পান করেই জীবন যাপন করেছি। চতুর্থ বছর না কিছু খেয়েছি না কিছু পান করেছি না শুয়েছি।
(গাউসুস্ সাক্বালাইন, পৃষ্ঠা: ৮৩ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)।
(২) বায়েযীদ বোস্তামী তিন বছর যাবৎ সিরিয়ার
জঙ্গলে রিয়াযাত (সূফীবাদের প্রশিক্ষণ) ও মুজাহাদাহ্ করেছেন। একদা তিনি হজ্জে রওয়ানা
করলেন। যাত্রাপথে তিনি প্রতি কদমে কদমে দু’ রাক্’আত দু’ রাক্’আত নামায আদায় করেছেন।
এতে করে তিনি বারো বছরে মক্কা পৌঁছেন। (সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা: ৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত,
পৃষ্ঠা: ৪৩১)।
(৩) মু’ঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরি বেশি বেশি
মুজাহাদাহ্ করতেন। তিনি সত্তর বছর যাবৎ পুরো রাত এতটুকুও ঘুমাননি। (তারীখে মাশায়েখে
চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৫৫ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫৯১)।
(৪) ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্র চল্লিশ দিন
যাবৎ কুয়ায় বসে চিল্লা পালন করেছেন। (তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৭৮ শরীয়ত ও তরীক্বত,
পৃষ্ঠা: ৩৪০)।
(৫) জুনাইদ বাগ্দাদী ত্রিশ বছর যাবৎ ’ইশার
নামায পড়ার পর এক পায়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেছেন। (সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা:
৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)।
(৬) খাজা মুহাম্মাদ্ চিশ্তী নিজ ঘরে এক
গভীর কুয়া খনন করেছেন। তাতে তিনি উল্টোভাবে ঝুলে থেকে আল্লাহ্’র স্মরণে ব্যস্ত থাকতেন।
(সিয়ারুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৪৬ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)।
(৭) মোল্লা শাহ্ কাদেরী বলতেন: পুরো জীবনে
আমার স্বপ্নদোষ বা সহবাসের গোসলের কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কারণ, এগুলোর সম্পর্ক বিবাহ্
ও ঘুমের সঙ্গে। আর আমি না বিবাহ্ করেছি না কখনো ঘুমিয়েছি। (হাদীক্বাতুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা:
৫৭ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ২৭১)
রাসূল
(সা.) এর আদর্শের সঙ্গে উক্ত আদর্শের কোন মিল নেই। বরং তা রাসূল (সা.) প্রদর্শিত আদর্শের
সম্পূর্ণ বিপরীত।
আব্দুল্লাহ্
বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘রাসূল
(সা.) আমার নিকট এসে বললেন: আমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে তুমি পুরো রাত নামায পড়ো এবং প্রতিদিন
রোযা রাখো। এ সংবাদ কি সঠিক নয়? আমি বললাম: অবশ্যই। তিনি বললেন: তাহলে তুমি আর এমন
করোনা। তুমি রাত্রে নামাযও পড়বে এবং ঘুমুবে। রোযা রাখবে এবং কখনো কখনো আবার রাখবেনা।
কারণ, তোমার উপর তোমার শরীরেরও অধিকার আছে। তেমনিভাবে চোখ, মেহমান এবং স্ত্রীরও। হয়তোবা
তুমি বেশি দিন বেঁচে থাকবে। তাই তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি প্রতি মাসে তিনটি
রোযা রাখবে। কারণ, তুমি একটি নেকি করলে দশটি নেকির সাওয়াব পাবে। এ হিসেবে প্রতি মাসে
তিনটি রোযা রাখলে পুরো বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি।
তাই আমার উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে
প্রতি সপ্তাহে তিনটি রোযা রাখবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি। তাই আমার
উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে আল্লাহ্’র
নবী দাঊদ (আ.) এর ন্যায় রোযা রাখবে। আমি বললাম: দাঊদ (আ.) এর রোযা কেমন? তিনি বললেন:
অর্ধ বছর। অর্থাৎ একদিন পর একদিন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি এর চাইতেও ভালো পারি। তিনি
বললেন: এর চাইতে আর ভালো হয় না। শেষ জীবনে আব্দুল্লাহ্ বলেন: এখন তিন দিন মেনে নেয়াই
আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় যা রাসূল (সা.) বলেছিলেন আমার পরিবার, ধন-সম্পদ চাইতেও। (বুখারী,
হাদীস ৬১৩৪ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯)
অন্য
বর্ণনায় তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন:
‘‘তুমি
প্রতি মাসে কোর’আন মাজীদ এক খতম দিবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী!
আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি বিশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র
নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি দশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম:
হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি সপ্তাহে এক খতম দিবে।
কিন্তু এর চাইতে আর বেশি পড়বেনা। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু
আনহুমা) বলেন: আমি এর চাইতেও বেশি পড়তে সক্ষম। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তাহলে তুমি তিন
দিনে এক খতম দিবে। ওব্যক্তি কোর’আন কিছুই বুঝেনি যে তিন দিনের কমে কোর’আন খতম করেছে’’।
(মুসলিম, হাদীস ১১৫৯ আবু দাউদ, হাদীস ১৩৯০, ১৩৯১, ১৩৯৪ তিরমিযী, হাদীস ২৯৪৯ ইবনু মাজাহ্,
হাদীস ১৩৬৪)
একদা
সাল্মান (রা.) তাঁর আন্সারী ভাই আবুদ্দারদা’ (রা.) এর সাক্ষাতে তাঁর বাড়ি গেলেন। দেখলেন,
উম্মুদ্দারদা’ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) ময়লা কাপড় পরিহিতা। তখন তিনি তাঁকে বললেন: তুমি
এমন কাপড়ে কেন? তোমার তো স্বামী আছে। তিনি বললেন: তোমার ভাই আবূদ্দারদা’র দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের
প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ইতিমধ্যে আবূদ্দারদা’ ঘরে ফিরে সাল্মান (রা.) এর জন্য খানা
প্রস্ত্তত করে বললেন: তুমি খাও। আমি এখন খাবোনা। কারণ, আমি রোযাদার। সাল্মান (রা.)
বললেন: আমি খাবোনা যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি না খাবে। অতএব আবূদ্দারদা’ (রা.) খানা খেলেন।
যখন রাত্র হয়ে গেল তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.)
বললেন: ঘুমাও। তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) ঘুমিয়ে গেলেন। অতঃপর আবারো আবূদ্দারদা’ (রা.)
নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.) বললেন: ঘুমাও। তবে রাত্রের শেষ ভাগে সাল্মান
(রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে বললেন: এখন উঠতে পারো। অতএব উভয়ে উঠে নামায পড়লেন। অতঃপর
সাল্মান (রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার প্রভুর
অধিকার আছে। তেমনিভাবে তোমার এবং তোমার পরিবারেরও। অতএব প্রত্যেক অধিকার পাওনাদারকে
তার অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। ভোর বেলায় আবুদ্দারদা’ (রা.) নবী (সা.) কে উক্ত ঘটনা জানালে
তিনি বলেন:
‘‘সালমান
(রা.) সত্যই বলেছে’’। (বুখারী, হাদীস ৬১৩৯)
আনাস্
(রা.) বলেন: একদা তিন ব্যক্তি নবী (সা.) এর স্ত্রীদের নিকট এসে তাঁর ইবাদাত সম্পর্কে
জিজ্ঞাসা করলে তাদেরকে সে সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হলো। তারা তা সামান্য মনে করলো এবং
বললো: নবী (সা.) এর সাথে আমাদের কোন তুলনাই হয়না। তাঁর আগ-পর সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে
দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের এক জন বললো: আমি কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবো সর্বদা পুরো রাত
নফল নামায আদায় করবো। দ্বিতীয় জন বললো: আমি কিন্তু পুরো জীবন রোযা রাখবো। কখনো রোযা
ছাড়বোনা। তৃতীয় জন বললো: আমি আদৌ বিবাহ করবোনা এমনকি কখনো মহিলাদের সংস্পর্শেও যাবোনা।
রাসূল (সা.) কে এ সম্পর্কে জানানো হলে তিনি বলেন:
‘‘তোমরাই
কি এমন এমন বলেছো? জেনে রাখো, আল্লাহ্’র কসম! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতেও অনেক অনেক
বেশি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করি। তবুও আমি কখনো কখনো রোযা রাখি। আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে
নফল নামাযও পড়ি। আবার ঘুমও যাই। বিবাহও করি। অতএব যে ব্যক্তি আমার আদর্শ বিমুখ হলো
সে আমার উম্মত নয়’’। (বুখারী, হাদীস ৫০৬৩ মুসলিম, হাদীস ১৪০১)।
(ঙ) পুণ্য ও শাস্তি:
‘‘হুলূল’’
ও ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ এর দর্শন অনুযায়ী মানুষতো কিছুই নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহ্
তা’আলাই অবস্থান করছেন বলে (না’ঊযু বিল্লাহ্) সে যাই করুক না কেন তা একমাত্র আল্লাহ্
তা’আলার ইচ্ছায়ই করে থাকে। মানুষের না কোন ইচ্ছা আছে না অভিরুচি। যার দরুন সূফীবাদীদের
নিকট ভালো-খারাপ, হালাল-হারাম, আনুগত্য-নাফরমানি, পুণ্য ও শাস্তি বলতে কিছুই নেই। তাই
তো তাদের মধ্যে রয়েছে বহু যিন্দীক্ব ও প্রচুর সমকামী। বরং তাদের কেউ কেউ তো প্রকাশ্য
দিবালোকে গাধার সাথেও সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো মনে করেন, তাঁদের আর শরীয়ত
মানতে হবে না। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের জন্য সব কিছুই হালাল করে দিয়েছেন। এ কারণেই অধিকাংশ
সূফীগণ জান্নাত ও জাহান্নাম নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করেছেন। বরং তাঁরা জান্নাত কামনা করাকে
একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ মনে করেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া হচ্ছে, ফানা ফিল্লাহ্,
গায়েব জানা ও বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ এবং এটাই তাঁদের বানানো জান্নাত। তেমনিভাবে জাহান্নামকে
ভয় পাওয়াও একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ। কারণ, তা গোলামের অভ্যাস ; স্বাধীন লোকের
নয়। বরং তাঁদের কেউ কেউ তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে এমনো বলেছেন যে, আমি যদি চাই জাহান্নামের
জ্বলন্ত আগুনকে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই নিভিয়ে দিতে পারি। আরেক ক্বুতুব বলেনঃ আমি
যদি আল্লাহ্ তা’আলাকে লজ্জা না করতাম তা হলে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই জাহান্নামকে
জান্নাত বানিয়ে দিতাম।
নিযামুদ্দীন
আওলিয়া তাঁর সংকলিত বাণী ‘‘ফাওয়ায়িদুল্ ফুওয়াদ্’’ কিতাবে বলেন:
’’কিয়ামতের
দিন মা’রূফ কার্খীকে জান্নাতে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হবে। কিন্তু তিনি তখন বলবেনঃ আমি
জান্নাতে যাবো না। আপনার জান্নাতের জন্য আমি ইবাদাত করিনি। অতএব ফিরিশ্তাদেরকে আদেশ
করা হবে, একে নূরের শিকলে মজবুত করে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে জান্নাতে নিয়ে যাও’’।
বায়েযীদ
বোস্তামী বলেন: জান্নাত তো বাচ্চাদের খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাপী আবার কারা ? কার
অধিকার আছে মানুষকে জাহান্নামে ঢুকাবে? (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫০০)।
রাবে’আ
বস্রী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একদা ডান হাতে পানির পেয়ালা এবং বাম হাতে আগুনের জ্বলন্ত
কয়লা নিয়ে বলেন: আমার ডান হাতে জান্নাত এবং বাম হাতে জাহান্নাম। অতএব আমি জান্নাতকে
জাহান্নামের উপর ঢেলে দিচ্ছি। যাতে করে জান্নাতও না থাকে এবং জাহান্নামও। তাহলে মানুষ
একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করবে।
(চ ) কারামাত:
সূফীগণ
‘‘’হুলূল’’ ও ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদে’’ বিশ্বাস করার দরুন তাঁরা মনে করেন যে, আল্লাহ্
তা’আলা এককভাবে যা করতে পারেন তাঁরাও তা করতে পারেন। তাই তো মনে করা হয়, তাঁরা বিশ্ব
পরিচালনা করেন। গাউসের নিকট রয়েছে সব কিছুর চাবিকাঠি। চার জন ক্বুতুব গাউসেরই আদেশে
বিশ্বের চার কোণ ধরে রেখেছেন। সাত জন আব্দাল গাউসেরই আদেশে বিশ্বের সাতটি মহাদেশ পরিচালনা
করেন। আর নজীবগণ নিয়ন্ত্রণ করেন বিশ্বের প্রতিটি শহর। প্রত্যেক শহরে একজন করে নজীব
রয়েছেন। হেরা গুহায় তাঁরা প্রতি রাত্রে একত্রিত হন এবং সৃষ্টিকুলের ভাগ্য নিয়ে খুব
নিবিড়ভাবে তাঁরা চিন্তা করেন। তাঁরা জীবিতকে মারতে পারেন এবং মৃতকে জীবিত করতে পারেন।
বাতাসে উড়তে পারেন এবং মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন ; অথচ কোর’আন ও হাদীসের দৃষ্টিতে
এ সবগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই করতে বা করাতে পারেন। অন্য কেউ নয়।
নিম্নে সূফীদের কিছু বানানো
কাহিনী উল্লেখ করা হলো:
(১) একদা আব্দুল কাদের জিলানী মুরগীর তরকারি
খেয়ে হাড়গুলো পাশে রেখেছেন। অতঃপর হাড়গুলোর উপর হাত রেখে বললেন: আল্লাহ্’র আদেশে দাঁড়িয়ে
যাও। ততক্ষণাতই মুরগীটি জীবিত হয়ে গেলো। (সীরাতে গাউস্, পৃষ্ঠা: ১৯১ শরীয়ত ও তরীক্বত,
পৃষ্ঠা: ৪১১)।
(২) একদা আব্দুল কাদের জিলানী জনৈক গায়কের
কবরে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: আমার আদেশে দাঁড়িয়ে যাও। তখন কবর ফেটে লোকটি গাইতে
গাইতে কবর থেকে বের হয়ে আসলো। (তাফরীজুল্ খা’ত্বির, পৃষ্ঠা: ১৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা:
৪১২)।
(৩) খাজা আবু ইস্হাক্ব চিশ্তী যখনই সফর
করতে চাইতেন তখনই দু’ শত মানুষকে সাথে নিয়ে চোখ বন্ধ করলেই সাথে সাথে গন্তব্যস্থানে
পৌঁছে যেতেন। (তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৯২ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪১৮)
(৪) সাইয়েদ মাওদূদ চিশ্তী ৯৭ বছর বয়সে
মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর প্রথম জানাযা মৃত বুযুর্গরা পড়েছেন। দ্বিতীয় জানাযা সাধারণ লোকেরা।
অতঃপর জানাযাটি একা একা উড়তে থাকে। এ কারামত দেখে অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
(তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৬০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৭৪)।
(৫) খাজা ’উস্মান হারুনী দু’ রাক’আত তাহিয়্যাতুল্
ওযু নামায পড়ে একটি ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে ঢুকে পড়লেন। উভয়ে দু’ ঘন্টা
পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। আগুন তাদের একটি পশমও জ্বালাতে পারেনি। তা দেখে অনেক
অগ্নিপূজক মুসলমান হয়ে যায়। (তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১২৪ শরীয়ত ও তরীক্বত,
পৃষ্ঠা: ৩৭৫)।
(৬) জনৈকা মহিলা কাঁদতে কাঁদতে খাজা ফরীদুদ্দীন
গাঞ্জে শুক্রের নিকট এসে বললোঃ রাষ্ট্রপতি আমার বেকসুর ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছে। এ কথা
শুনে তিনি নিজ সাথীদেরকে নিয়ে ওখানে পৌঁছে বললেনঃ হে আল্লাহ্! যদি ছেলেটি বেকসুর হয়ে
থাকে তাহলে আপনি তাকে জীবিত করে দিন। এ কথা বলার সাথে সাথেই ছেলেটি জীবিত হয়ে তাঁর
সাথেই রওয়ানা করলো। তা দেখে এক হাজার হিন্দু মুসলমান হয়ে যায়। (আস্রারুল আউলিয়া, পৃষ্টা:
১১০-১১১ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩৭৬)।
(৭) জনৈক ব্যক্তি আব্দুল কাদির জিলানীর
দরবারে একজন ছেলে
সন্তান
চেয়েছিলো। অতএব তিনি তাঁর জন্য দো’আ করেন। ঘটনাক্রমে লোকটির মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়।
অতএব তিনি লোকটিকে বললেন: তাকে ঘরে নিয়ে যাও এবং কুদরতের খেলা দেখো। যখন লোকটি ঘরে
ফিরলো তখন মেয়েটি ছেলে হয়ে গেলো। (সাফীনাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ১৭ শরীয়ত ও তরীক্বত,
পৃষ্ঠা: ২৯৯)।
(৮) আব্দুল কাদির জিলানী মদীনা যিয়ারত শেষে
খালি পায়ে বাগদাদ ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর সাথে জনৈক চোরের সাক্ষাৎ হয়। লোকটি চুরি
ছাড়তে চাচ্ছিলো। অতএব লোকটি গাউসে আ’জমকে চিনতে পেরে তাঁর পায়ে পড়ে বলতে শুরু করলো:
হে আব্দুল কাদির! আমাকে বাঁচান। তিনি তার এ অবস্থা দেখে তার উপর দয়ার্দ্র হয়ে তার ইস্লাহের
জন্য আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে দো’আ করলেন। গায়েব থেকে আওয়াজ আসলো, তুমি চোরকে হিদায়াত
করতে যাচ্ছো। তা হলে তুমি তাকে ক্বুতুব বানিয়ে দাও। অতএব চোরটি তাঁর এক দৃষ্টিতেই ক্বুতুব
হয়ে গেলো। (সীরাতে গাউসিয়া, পৃষ্ঠা: ৬৪০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৭৩)।
(৯) মিয়া ইসমাঈল লাহোরী ফজরের নামাযের পর
সালাম ফেরানোর সময় ডান দিকে দয়ার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকের সকল মুসল্লী
কোর’আন মাজীদের হাফিজ হয়ে যায় এবং বাম দিকের সকল মুসল্লী কোর’আন শরীফ দেখে দেখে পড়তে
পারে। (হাদীক্বাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ১৭৬ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩০৪)।
(১০) খাজা আলাউদ্দীন সাবের কালীরিকে খাজা
ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্র ‘‘কালীর’’ পাঠিয়েছেন। এক দিন খাজা সাহেব ইমামের নামাযের জায়গায়
বসে গেলেন। লোকেরা তাতে বাধা প্রদান করলে তিনি বললেন: ক্বুতুবের মর্যাদা কাজীর চাইতেও
বেশি। অতঃপর সবাই তাঁকে জোর করে সেখান থেকে উঠিয়ে দিলে তিনি মসজিদে নামায পড়ার জন্য
কোন জায়গা পাননি। তখন তিনি মসজিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন: সবাই সিজদাহ্ করছে। সুতরাং
তুমিও সিজদাহ্ করো। সাথে সাথে মসজিদটি ছাদ ও দেয়াল সহ ভেঙ্গে পড়লো এবং সবাই মরে গেলো।
(হাদীক্বাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৭০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৯৬)।
(১১) একদা কা’বা শরীফের প্রতিটি পাথর শায়েখ
ইব্রাহীম মাত্বূলীর চতুর্দিকে তাওয়াফ করে পুনরায় নিজ জায়গায় ফিরে আসে।
(১২) ইব্রাহীম আল-আ’যাব সম্পর্কে বলা হয়,
আগুনকে বেশি ভয় পায় এমন লোককে তিনি বলতেন: আগুনে ঢুকে পড়ো। এ কথা বলেই তিনি আগুনে প্রবেশ
করে সেখানে দীর্ঘক্ষণ থাকতেন ; অথচ তাঁর জামা-কাপড় এতটুকুও পুড়তো না এবং তাঁর কোন ক্ষতিও
হতো না। এমনিভাবে তিনি নির্ভয়ে সিংহের পিঠে চড়ে এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াতেন।
(১৩) ইব্রাহীম আল-মাজ্যূব সম্পর্কে বলা হয়,
তিনি কখনো কোন জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করলেই তা পূরণ হয়ে যেতো। তাঁর জামাগুলো গলা কাটা
থাকতো। গলাটি সঙ্কীর্ণ হলে সকল মানুষই খুব কষ্টে জীবন যাপন করতো। আর গলাটি প্রশস্ত
হলে সকল মানুষই খুব আরাম অনুভব করতো।
(১৪) ইব্রাহীম ’উস্বাইফীর সম্পর্কে বলা হয়,
তিনি সাধারণত শহরের বাইরে গিয়ে নিচু ও গভীর জায়গায় ঘুমুতেন। বাঘের পিঠে চড়ে তিনি শহরে
ঢুকতেন। পানির উপর দিয়ে তিনি হাঁটতেন। তাঁর নৌকার কোন প্রয়োজন ছিলো না।
(১৫) ইব্রাহীম মাত্বূলী সম্পর্কে আরো বলা
হয়, তিনি যখন কোন বাগানে ঢুকতেন তখন সেখানকার সকল গাছ ও উদ্ভিদগুলো নিজেদের সকল গুণাগুণ
তাঁকে ডেকে ডেকে বলতো।
(১৬) ইব্রাহীম মাত্বূলী সম্পর্কে আরো বলা
হয়, তিনি কখনো মিসরে জোহরের নামায পড়তেন না। একদা জনৈক মুফতী সাহেব তাঁকে তিরস্কার
করেন। অতঃপর তিনি ফিলিস্তিন সফর করে দেখেন, ইব্রাহীম মাত্বূলী রামাল্লাহ্’র সাদা মসজিদে
জেহরের নামায আদায় করছেন। মসজিদের ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেনঃ এ তো
সর্বদা এখানেই নামায পড়ে।
(১৭) শায়েখ ইব্রাহীম ’উরয়ান সম্পর্কে বলা
হয়, যখন তিনি কোন শহরে ঢুকতেন তখন সেখানকার ছোট-বড়ো সবাইকে তিনি তাদের নাম ধরে ডাকতেন।
যেন তিনি এখনকার দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা। অতঃপর তিনি মিম্বরে উঠে উলঙ্গ অবস্থায় খুতবা
দিতেন।
(১৮) শায়েখ আবু ’আলী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি
ছিলেন বহু রূপী। কখনো তাঁকে সৈন্য রূপে দেখা যেতো। আবার কখনো নেকড়ে বাঘ রূপে। কখনো
হাতী রূপে। আবার কখনো ছোট ছেলের রূপে। তিনি মানুষকে মুষ্ঠি ভরে মাটি দিলে তা স্বর্ণ
বা রুপা হয়ে যেতো।
(১৯) ইউসুফ আজ্মী সম্পর্কে বলা হয়, একদা
হঠাৎ তাঁর চোখ একটি কুকুরের উপর পড়ে গেলে সকল কুকুর তার পিছু নেয়। কুকুরটি হাঁটলে সেগুলোও
হাঁটে। আর কুকুরটি থেমে গেলে সেগুলোও থেমে যায়। মানুষ এ ব্যাপারটি তাঁকে জানালে তিনি
কুকুরটির নিকট খবর পাঠিয়ে বললেন: তুমি ধ্বংস হয়ে যাও। তখন সকল কুকুর কুকুরটিকে কামড়াতে
শুরু করলো। অন্য দিন আরেকটি কুকুরের উপর তাঁর হঠাৎ দৃষ্টি পড়লে সকল কুকুর আবার তার
পিছু নেয়। তখন মানুষ কুকুরটির নিকট গেলে তাদের সকল প্রয়োজন সমাধা হয়ে যেতো। কুকুরটি
একদা রোগাক্রান্ত হলে সকল কুকুর একত্রিত হয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তারা কুকুরটির জন্য
আপসোস করতে লাগলো। একদা কুকুরটি মরে গেলে সকল কুকুর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো। আল্লাহ্
তা’আলার ইলহামে কিছু মানুষ কুকুরটিকে দাপন করে দিলো। কুকুরগুলো যতোদিন বেঁচে ছিলো তারা
উক্ত কুকুরটির যিয়ারত করতো।
কে নিয়ে তাঁর সামনেই উপস্থিত। আলী (রা.) তাঁকে মৃদু
ধাক্কা দিয়ে বললেন: উঠো, রাসূল (সা.) এসেছেন। অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.) এর দু’
চোখের মাঝে চুমু খেলেন। রাসূল (সা.) তাঁকে একটি রুটি দিলেন। যার অর্ধেক তিনি স্বপ্নে
খেয়েছেন। আর বাকি অর্ধেক ঘুম থেকে উঠে নিজের হাতেই দেখতে পেলেন।
(২০) আবুল খায়ের মাগরিবী সম্পর্কে বলা হয়,
তিনি একদা মদীনায় গেলেন। তিনি পাঁচ দিন যাবত কিছুই খাননি। নবী (সা.), আবু বকর ও ’উমর
(রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কে সালাম দিয়ে তিনি রাসূল (সা.) কে আবদার করে বললেনঃ হে আল্লাহ্’র
রাসূল (সা.)! আমি আজ রাত আপনারই মেহমান। এ কথা বলে তিনি মিম্বরের পেছনে শুয়ে পড়লেন।
স্বপ্নে দেখেন স্বয়ং রাসূল (সা.) আবু বকর, ’উমর ও ’আলী
(২১) বায়েযীদ বোস্তামী সম্পর্কে বলা হয়,
তিনি এক বছর যাবত ঘুমাননি এবং পানিও পান করেননি।
(২২) শায়েখ মুহাম্মাদ আহমাদ ফারগালী সম্পর্কে
শুনা যায়, একদা একটি কুমির মুখাইমির নাক্বীবের মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তখন সে কাঁদতে
কাঁদতে তাঁর নিকট আসলে তিনি বললেন: যেখান থেকে তোমার মেয়েটিকে কুমির ছিনিয়ে নিলো সেখানে
গিয়ে উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বলবে: হে কুমির! ফারগালীর সাথে কথা বলে যাও। তখন কুমিরটি
সাগর থেকে উঠে সোজা ফারগালীর বাড়িতে চলে আসলো। আর মানুষ তা দেখে এদিক ওদিক ছুটোছুটি
করছিলো। তখন তিনি কামারকে বললেন: এর দাঁতগুলো উপড়ে ফেলো। তখন সে তাই করলো। অতঃপর তিনি
কুমিরকে মেয়েটি উগলে দিতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটি জীবিতাবস্থায় কুমিরের পেট
থেকে বের হয়ে আসলো। তখন তিনি কুমিরটিকে এ মর্মে অঙ্গিকার করালেন যে, যতোদিন সে বেঁচে
থাকবে কাউকে আর এ এলাকা থেকে ছিনিয়ে নিবে না। তখন কুমিরটি কাঁদতে কাঁদতে সাগরের দিকে
নেমে গেলো।
(২৩) শায়েখ আব্দুর রহীম ক্বান্নাভী সম্পর্কে
বলা হয়, একদা তাঁর বৈঠকে আকাশ থেকে একটি মূর্তি নেমে আসলো। কেউ চিনলো না মূর্তিটি কি?
ক্বান্নাভী সাহেব কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাঁর মাথাটি নিচু করে রাখলেন। অতঃপর মূর্তিটি উঠে
গেলো। লোকেরা এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন: একজন ফিরিশ্তা দোষ করে বসলো।
তাই সে আমার নিকট সুপারিশ কামনা করলো। আমি সুপারিশ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তা কবুল করেন।
অতঃপর ফিরিশ্তাটি চলে গেলো।
(২৪)
সাইয়েদ আহমাদ স্বাইয়াদী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যখনই নদীর পাড়ে যেতেন তখন নদীর মাছগুলো
তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়তো। কোন মরুভূমি দিয়ে তিনি চলতে থাকলে সকল পশু তাঁর পায়ে গড়াগড়ি
করতো। এমনকি তাঁর স্বাভাবিক চলার পথেও রাস্তার দু’ পার্শ্বে পশুরা তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে
যেতো।
তাঁর
সম্পর্কে আরো বলা হয়: তিনি একটি সিজ্দায় পূর্ণ একটি বছর কাটিয়ে দিলো। একটি বারের জন্যও
তিনি সিজ্দাহ্ থেকে মাথাটি উঠাননি। যার দরুন তাঁর পিঠে গাস জন্মে গেলো।
(২৫)
সাইয়েদ বাদাভী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তিনটি দো’আ করেন। যার মধ্যে
দু’টি দো’আ আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেছেন। আরেকটি দো’আ কবুল করেননি। তিনি আল্লাহ্ তা’আলার
নিকট এ মর্মে দো’আ করেছেন যে, কেউ যদি তাঁর কবর যিয়ারত করে তা হলে আল্লাহ্ তা’আলা যেন
তার ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে যে কোন সুপারিশ কবুল করেন। আল্লাহ্ তা’আলা তা কবুল করলেন।
তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ মর্মেও দো’আ করেছেন যে, কেউ যদি তাঁর কবর যিয়ারত করে তা
হলে আল্লাহ্ তা’আলা যেন তাকে একটি হজ্জ ও একটি ’উমরাহ্’র পূর্ণ সাওয়াব দেন। আল্লাহ্
তা’আলা তাও কবুল করলেন। তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ মর্মেও দো’আ করেছেন যে, আল্লাহ্
তা’আলা যেন তাঁকে জাহান্নামে প্রবেশ করান। আল্লাহ্ তা’আলা কিন্তু তা কবুল করলেন না।
লোকেরা এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেনঃ আমি যদি জাহান্নামে ঢুকে গড়াগড়ি
করি তা হলে জাহান্নাম সবুজ বাগানে পরিণত হবে। আর আল্লাহ্ তা’আলার তো এ অধিকার অবশ্যই
রয়েছে যে, তিনি কাফিরদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
আরো
জানার জন্য দেখতে পারেন শা’রানী রচিত আত-ত্বাবাক্বাতুল-কুবরা’।
(ছ) জা’হির ও বা’তিন শব্দদ্বয়ের আবিষ্কার:
সূফীদের
আক্বীদা-বিশ্বাস কোর’আন ও হাদীসের সরাসরি বিরোধী হওয়ার দরুন মানুষ যেন সেগুলো বিনা
প্রশ্নে মেনে নিতে পারে সে জন্য তারা বা’তিন শব্দের আবিষ্কার করে। তারা বলে: কুর’আন
ও হাদীসের দু’ ধরনের অর্থ রয়েছে। একটি জা’হিরী। আরেকটি বা’তিনী এবং বা’তিনী অর্থই মূল
ও সঠিক অর্থ। তারা এ বলে দৃষ্টান্ত দেয় যে, জা’হিরী অর্থ খোসা বা খোলসের ন্যায় এবং
বা’তিনী অর্থ সার, মজ্জা ও মূল শরীরের ন্যায়। জা’হিরী অর্থ আলিমরা জানে। কিন্তু বা’তিনী
অর্থ শুধু ওলী-বুযুর্গরাই জানে। অন্য কেউ নয় এবং এ বা’তিনী জ্ঞান শুধুমাত্র কাশ্ফ,
মুরাক্বাবাহ্, মুশাহাদাহ্, ইল্হাম অথবা বুযুর্গদের ফয়েয বা সুদৃষ্টির মাধ্যমেই অর্জিত
হয়। আর এ গুলোর মাধ্যমেই তারা শরীয়তের মনমতো অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
যেমন:
তারা কোর’আন মাজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে:
‘‘তুমি
তোমার প্রভুর ইবাদাত করো এক্বীন বা মা’রিফাত হাসিল হওয়া পর্যন্ত। যখন মা’রিফাত হাসিল
হয়ে যাবে তথা আল্লাহ্ তা’আলাকে চিনে যাবে তখন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও তিলাওয়াতের
কোন প্রয়োজন হবেনা। অথচ মূল অর্থ এই যে, তুমি তোমার প্রভুর ইবাদাত করো মৃত্যু আসা পর্যন্ত’’।
(’হিজ্র : ৯৯)।
তেমনিভাবে
তারা নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে:
‘‘তোমরা
যারই ইবাদাত করোনা কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত হিসেবেই গণ্য করা হবে। ব্যক্তি
পূজা, পীর পূজা, কবর পূজা ও মূর্তি পূজা সবই আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত। প্রকাশ্যে অন্য
কারোর ইবাদাত মনে হলেও তা তাঁরই ইবাদাত হিসেবে গণ্য করা হবে। অথচ মূল অর্থ এই যে, আপনার
প্রভু এ বলে আদেশ করেছেন যে, তোমরা তিনি (আল্লাহ্) ছাড়া অন্য কারোর ইবাদাত করবে না’’।
(বানী ইস্রাঈল : ২৩)।
তারা
কালিমায়ে তাওহীদের অর্থ করতে গিয়ে বলে থাকে, দুনিয়াতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্। তিনি
ভিন্ন অন্য কিছু কল্পনাই করা যায় না।
সূফীরা
কোন হালাল বস্ত্তকে হারাম এবং হারাম বস্ত্তকে হালাল করার জন্য বা’তিন শব্দ ছাড়াও আরো
কিছু পরিভাষা আবাষ্কিার করেছে যা নিম্নরূপ:
‘‘অবস্থা’’,
‘‘জযবা’’, ‘‘পাগলামি’’, ‘‘মত্ততা’’, ‘‘চেতনা’’ ও ‘‘অবচেতনা’’।
তারা
আরো বলে: ঈমান বলতে আল্লাহ্ তা’আলার খাঁটি প্রেমকে বুঝানো হয়। আর নকল প্রেম ছাড়া খাঁটি
প্রেম কখনো অর্জিত হয়না। তাই তারা নকল প্রেমের সকল উপকরণ তথা নাচ, গান, বাদ্য, সুর,
তাল, মদ, গাঁজা, রূপ-সৌন্দর্য ও প্রেমের কাহিনী শুনে মত্ত হওয়াকে হালাল মনে করে।
(জ) হিন্দু
ধর্ম:
খ্রিস্টপূর্ব
পনেরো শত বছর আগে আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে এসে ‘‘সিন্ধু’’ তথা ‘‘হড়প্পা’’ ও ‘‘মহেঞ্জুদাড়ু’’
এলাকায় বসবাস শুরু করে। তখন এ সকল এলাকাকে উপমহাদেশের সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে
বিবেচনা করা হতো। হিন্দুদের প্রথম গ্রন্থ ‘‘ঋগ্বেদ’’ এ আর্যদেরই লেখা। যা ওদের দেব-দেবীদের
সম্মানগাথায় পরিপূর্ণ। এখান থেকেই হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি।
এ
ছাড়াও খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শত বছর আগে উপমহাদেশে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রচলন ছিলো। অতএব
নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে, আড়াই বা সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্ব থেকে এ উপমহাদেশের
সভ্যতা, সংস্কৃতি, চাল-চলন ও ধর্মে-কর্মে উক্ত ধর্মমতগুলো অবর্ণনীয় প্রভাব বিস্তার
করে চলছে। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৫৯)।
উক্ত
তিনটি ধর্ম ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ ও ‘‘’হুলূলে’’ বিশ্বাস করতো। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা
গৌতম বুদ্ধকে আল্লাহ্ তা’আলার অবতার বলে মনে করে তার মূর্তি পূজা করে। জৈন ধর্মের অনুসারীরা
মহাবীরের মূর্তি ছাড়াও সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, গাছ, পাথর, নদী, সাগর, অগ্নি, বায়ু
ইত্যাদির পূজা করে। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা নিজ ধর্মের বড় বড় ব্যক্তিদের (পুরুষ-মহিলা)
মূর্তি ছাড়াও পূর্বোক্ত বস্ত্তগুলোর পূজা করে। তাদের পূজার বস্ত্তগুলোর মধ্যে বলদ,
গাভী, হাতি, সিংহ, সাপ, ইঁদুর, শুকর, বানরের মূর্তিও রয়েছে। এমনকি তারা পুরুষ বা মহিলার
লজ্জাস্থান পূজা করতেও দ্বিধা করেনা। তারা শিবজী মহারাজের পুরুষাঙ্গ এবং শক্তিদেবীর
স্ত্রী লিঙ্গ পূজা করে তাদের প্রতি ভক্তি-সম্মান প্রদর্শন করে।
ধর্ম
তিনটির সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের পর আমরা এখন হিন্দু ধর্মের কিছু আচার-অনুষ্ঠানের কথা আলোচনা
করতে যাচ্ছি। যাতে আপনারা বুঝতে পারবেন যে, উপমহাদেশে শির্ক ও বিদ্’আত বিস্তারে হিন্দু
ধর্মের কতটুকু প্রভাব রয়েছে।
(ঝ) হিন্দু ধর্মের ইবাদাত ও তপস্যা পদ্ধতি:
হিন্দু
ধর্মের শিক্ষানুযায়ী তার অনুসারীরা পরকালের মুক্তি ও শান্তির জন্য জঙ্গলে বা গিরি গুহায়
বসবাস করতো। তারা নিজ শরীরকে হরেক রকমের কষ্ট দেয়ায় সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। গরম, ঠান্ডা,
বৃষ্টি ও বালুকাময় জমিনে উলঙ্গ শরীরে থাকাকে তারা পবিত্র তপস্যা বলে বিশ্বাস করতো।
নিজকে পাগলের ন্যায় কষ্ট দিয়ে, উত্তপ্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উপর উপুড় হয়ে, টাটানো সূর্যতাপে
উলঙ্গ শরীরে বসে, কাঁটার উপর শুয়ে, গাছের ডালে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝুলে অথবা মাথার উপর
উভয় হাত দীর্ঘক্ষণ উঁচিয়ে রেখে অনুভূতিহীন করে বা শুকিয়ে কাঁটা বানিয়ে তপস্যা করতো।
এ শারীরিক কষ্ট ছাড়াও তারা নিজ মস্তিষ্ক এবং রূহ্কে কষ্ট দেয়া নাজাতের কাজ বলে মনে
করতো। এ কারণেই হিন্দুরা মানব জনপদের বাইরে একা একা ধ্যান করতো। তাদের কেউ কেউ ঝোপ-ঝাড়ে
কয়েক জন একত্রে মিলে বসবাস করতো। আবার কেউ কেউ ভিক্ষার উপর নির্ভর করে দেশ-বিদেশে ঘুরে
বেড়াতো। কেউ কেউ উলঙ্গ থাকতো। আবার কেউ কেউ লেংটি পরতো। পুরো ভারত ঘুরলে এখনো আপনি
জঙ্গল, নদী ও পাহাড়ে অনেক জটাধারী, উলঙ্গ ও ময়লাযুক্ত সাধুর সাক্ষাৎ পাবেন। সাধারণ
হিন্দু সমাজে এদেরকে আবার পূজাও করা হয়। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৯)।
রূহানী
শক্তি ও সংযম অর্জনের জন্য ‘‘যোগ সাধন’’ নামক তপস্যার এক অভিনব পদ্ধতিও হিন্দু সমাজে
আবিষ্কৃত হয়েছিলো। যে পদ্ধতি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সকলেই সমভাবে পালন করতো। এ
পদ্ধতি অনুযায়ী যোগী ব্যক্তি এতো বেশি সময় পর্যন্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখতো যে তা দেখে
মনে হতো, সে মরে গেছে। এমনকি তখন হৃদকম্পনও বুঝা যেতোনা। গরম-ঠান্ডা তাদের উপর সামান্যটুকুও
প্রভাব বিস্তার করতে পারতোনা। যোগী ব্যক্তি উক্ত সাধনার কারণে অনেক দিন পর্যন্ত না
খেয়ে থাকতে পারতো। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১২৯)।
যোগ
সাধনের এক ভয়ানক চিত্র এই যে, সাধু ও যোগীরা ফুলকি ঝরা জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটে যেতো।
অথচ তাদের পা একটুও জ্বলতোনা। এ ছাড়া ধারালো ফলক বিশিষ্ট খঞ্জর দিয়ে এক গন্ড থেকে আরেক
গন্ড পর্যন্ত, নাকের উভয় অংশ এবং উভয় ঠোঁট এপার ওপার চিঁড়ে দেয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে
থাকা, তরতাজা কাঁটা এবং ফলক বিশিষ্ট কয়লার উপর শুয়ে থাকা, দিন-রাত উভয় পা অথবা এক পায়ের
উপর দাঁড়িয়ে থাকা, এক পা অথবা এক হাতকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত অকেজো রাখা যাতে তা শুকিয়ে
যায়, লাগাতার উল্টোভাবে ঝুলে থাকা, পুরো জীবন অথবা বর্ষাকালে উলঙ্গ থাকা, পুরো জীবন
বিবাহ না করে সন্ন্যাসী সেজে থাকা, নিজ পরিবারবর্গ ছেড়ে একা উঁচু গিরি গুহায় ধ্যানে
মগ্ন থাকাও যোগীদের ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১৩০)।
হিন্দু
ও বৌদ্ধ ধর্মে যাদু-মন্ত্রের মাধ্যমেও ইবাদাত করা হয়। এ জাতীয় ইবাদাতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে
তান্ত্রিক বলা হয়। এরা জ্ঞান-ধ্যানকে পরকালের নিষ্কৃতির বিশেষ কারণ বলে মনে করে। পুরাণ
বেদীয় আলোচনায় পাওয়া যায় যে, সাধুরা যাদু ও নিম্ন কর্মে লিপ্ত থাকতো। এ দলের লোকেরা
কড়া নেশাকর মদ্য পান করা, গোস্ত এবং মাছ খাওয়া, অস্বাভাবিক যৌন কর্ম করা, নাপাক বস্ত্ত
সামগ্রীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামে মানব হত্যা করার মতো
নিকৃষ্ট কাজও ইবাদাত হিসেবে পালন করতো। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১১৭)।
(ঞ) হিন্দু বুযুর্গদের অলৌকিক ক্ষমতা:
মুসলমানদের
মধ্যে যেমন গাউস, ক্বুতুব, নাজীব, আব্দাল, ওলী, ফকির, দরবেশকে বড় বড় বুযুর্গ ও অলৌকিক
ক্ষমতার উৎস বলে মনে করা হয় তেমনিভাবে হিন্দুদের মধ্যে মুনি, ঋষি, মহাত্মা, অবতার,
সাধু, সন্ত, যোগী, সন্ন্যাসী, শাস্ত্রীকেও বড় বড় বুযুর্গ এবং অলৌকিক ক্ষমতার উৎস বলে
মনে করা হয়। হিন্দুদের পবিত্র কিতাবাদির ভাষ্যানুযায়ী এ সকল বুযুর্গরা গত, বর্তমান
ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে পারে। জান্নাতে দৌড়ে যেতে পারে। দেবতাদের দরবারে তাদের বিশেষ
সম্মান রয়েছে। তারা এমন যাদুশক্তি রাখে যে, মনে চাইলে দুনিয়ার পাহাড়গুলোকে এক নিমিষে
উঠিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারে। নিজ শত্রুকে চোখের পলকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে।
ঋতুগুলোকে এলোমেলো করে দিতে পারে। এরা খুশি হলে পুরো শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে
পারে। ধন-দৌলত বাড়িয়ে দিতে পারে। দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে পারে। শত্রুর আক্রমণ নস্যাৎ
করে দিতে পারে। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৯-১০০)।
তাদের
ধারণা মতে মুনি এমন পবিত্র ব্যক্তি যে কোন কাপড় পরেনা। বায়ুকে পোশাক মনে করে। চুপ থাকাই
তার খাদ্য। সে বাতাসে উড়তে পারে। এমনকি পাখিদেরও অনেক উপরে যেতে পারে। মানুষের সকল
লুক্কায়িত কথা বলতে পারে। কারণ, তারা এমন পানীয় পান করে যা সাধারণ মানুষের জন্য বিষ
সমতুল্য। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৮)।
শিবজীর
ছেলে লর্ড গনেশ সম্পর্কে ধারণা করা হয়, সে ইচ্ছে করলে যে কোন সমস্যা দূরীভূত করতে পারে।
ইচ্ছে করলে কারোর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। উক্ত কারণেই হিন্দুদের যে কোন ছেলে পড়ার
বয়সের হলে তাকে সর্বপ্রথম গনেশের পূজাই শিক্ষা দেয়া হয়। (রোজনামায়ে সিয়াসাত: কালাম,
ফিক্র ও নযর ; তারিখঃ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ হায়দারাবাদ, ভারত)।
(ট) হিন্দু বুযুর্গদের কিছু কারামাত:
হিন্দুদের
পবিত্র কিতাবসমূহে তাদের বুযুর্গদের অনেক অনেক কারামাতের সংবাদ পাওয়া যায়। আমরা দৃষ্টান্ত
স্বরূপ কয়েকটি কারামাত সবার সম্মুখে তুলে ধরছি।
(১) হিন্দুদের ধর্মীয় পুস্তক রামায়ণে রাম
ও রাবণের লম্বা ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। রাম নিজ স্ত্রী সীতাকে নিয়ে জঙ্গলে বসবাস করতো।
লঙ্কার রাজা রাবণ তার স্ত্রীকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলো। রাম হনুমানের সহযোগিতায় কঠিন রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের পর নিজ স্ত্রীকে ফেরত পায়। কিন্তু রাম এরপর তার স্ত্রীকে তাদের পবিত্র বিধি-বিধানানুযায়ী
পরিত্যাগ করে। সীতা তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার জন্য আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু অগ্নি
দেবতা আগুনকে নিবে যাওয়ার আদেশ করলেন। সুতরাং সীতা জ্বলন্ত আগুন থেকে সুস্থ বের হয়ে
আসলো।
(২) একদা বৌদ্ধ ধর্মের ভক্শু দরবেশ একটি
অলৌকিক কান্ড দেখালেন। তিনি একটি পাথর থেকে একই রাতে হাজার শাখা বিশিষ্ট একটি আম গাছ
তৈরী করেন। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১১৬-১১৭)
(৩) কামদেব, কামদেবী ও তাদের বিশেষ বন্ধু
বসন্তের খোদা যখন পরস্পর খেলাধুলা করতো তখন কামদেব নিজের ফুলের তীর দিয়ে শিবদেবের উপর
বৃষ্টি বর্ষণ করতো এবং শিবদেব নিজের তৃতীয় চক্ষু দিয়ে সে তীরগুলোর উপর দৃষ্টি দিতেই
তা নির্বাপিত মাটির ন্যায় ভস্ম হয়ে যেতো। এভাবে শিবদেব সব ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতো।
কারণ, তার কোন শরীর ছিলো না। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯০)।
(৪) হিন্দুদেব লর্ড গনেশের পিতা শিবজী সম্পর্কে
বলা হয়, লর্ড শিব পার্বতী দেবীকে গোসলের সময় গোসলখানায় ঢুকে কষ্ট দিতো। তাই পার্বতী
দেবী (শিবের স্ত্রী) এ ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একদা এক মানব মূর্তি তৈরী করে
তার মধ্যে জীবন দিয়ে গোসলখানার গেইটে প্রহরী হিসেবে বসিয়ে দিলো। অতঃপর অন্য দিনের মতো
শিবজী পার্বতীকে কষ্ট দেয়ার জন্য গোসলখানার দিকে রওয়ানা করলো। শিবজী গোসলখানায় ঢুকতে
চাইলে প্রহরী মানব মূর্তি সুন্দর ছেলেটি তার পথ রুদ্ধ করে দেয়। শিবজী ক্রদ্ধ হয়ে ত্রিশূল
দিয়ে ছেলেটির মাথা কেটে দেয়। পার্বতী দেবী এতে অসন্তুষ্ট হলে শিবজী তার কর্মচারীদেরকে
অতি তাড়াতাড়ি যে কারোর একটি মাথা কেটে নিয়ে আসার জন্য আদেশ করলো। কর্মচারীরা তড়িঘড়ি
একটি হাতীর মাথা কেটে নিয়ে আসলে শিবজী ছেলেটির ধড়ের সাথে হাতীর মাথা লাগিয়ে তাতে জীবন
দিয়ে দিলো। পার্বতী দেবী তাতে খুব খুশি হলো। (রোজনামায়ে সিয়াসাত: কালাম, ফিকর ও নযর
; তারিখঃ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ হায়দারাবাদ, ভারত)।
হিন্দু
ধর্মের কিছু শিক্ষাদীক্ষা শুনার পর আপনারা এ কথা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে, সূফীদের
আক্বীদা-বিশ্বাস, শিক্ষাদীক্ষা হিন্দু ধর্ম কর্তৃক কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে। ‘‘ওয়াহ্দাতুল্
উজূদ্’’ ও ‘‘’হুলূল’’ এর বিশ্বাস একই। ইবাদাত ও তপস্যা পদ্ধতি একই। বুযুর্গদের অলৌকিক
ক্ষমতা একই। কারামাতও একই। ব্যবধান শুধু নামেরই। অন্য কিছুর নয়।
উক্ত
আলোচনার পর যখন আমরা শুনবো যে, ভারতের অমুক পীর বা ফকিরের মুরীদ হিন্দুও ছিলো এবং অমুক
মুসলমান হিন্দু সাধু ও যোগীর জ্ঞান-ধ্যানে অংশ গ্রহণ করেছে তখন আমাদের আশ্চর্যের কিছুই
থাকবে না।
বলা
হয়, হাফিয গোলাম কাদির নিজ যুগের একজন গাউস ও ক্বুতুব ছিলেন। তাঁর রূহানী ফয়েয প্রত্যেক
বিশেষ অবিশেষের জন্য এখনো চালু রয়েছে। এ কারণেই হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান তথা প্রত্যেক
দল ও ধর্মের লোক তাঁর কাছ থেকে ফয়েয হাসিল করতো। (রিয়াযুস্ সা’লিকীন, পৃষ্ঠা: ২৭২ শরীয়ত
ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৭৭)।
পীর
স্বাদ্রুদ্দীন ইস্মাঈলী ভারতে এসে নিজের নাম শাহ্দেব রাখলেন এবং জনগণকে বললেনঃ বিষ্ণুর
দশম অবতার ’আলী (রা.) এর ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে। তার অনুসারী সূফীরা মুহাম্মাদ্ (সা.)
এবং ’আলী (রা.) এর প্রশংসায় ভজন গাইতো। (ইসলামী সূফীবাদে ইসলাম বিরোধী সূফীবাদের সংমিশ্রণ,
পৃষ্ঠা: ৩২-৩৩)।
(ঠ) এ যুগের
প্রশাসকবর্গ:
পাক-ভারতে
শির্ক ও বিদ’আত প্রচলনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই এ কথা বলে থাকেন যে, ভারতবর্ষে
ইসলাম পৌঁছে প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ ভাগে। যখন মুহাম্মদ বিন্ ক্বাসিম (রাহিমাহুল্লাহ্)
৯৩ হিজরী সনে সিন্ধু বিজয় করেন। সে সময় তিনি ও তাঁর সৈন্যরা ভারত থেকে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছিলেন
বলে কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল খাঁটি ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ
ইসলামের এ দা’ওয়াত খুব সীমিত পরিসরে ছিলো বলে মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু ও মুশ্রিকদের
রীতি-নীতি চালু রয়েছে।
ঐতিহাসিক
দৃষ্টিকোণানুযায়ী এ কথা সঠিক নয়। বরং ’উমর ফারূক্ব (রা.) এর যুগেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে
ইসলাম প্রবেশ করে। ’উমর ফারূক্ব ও ’উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এর যুগে ইসলামী খিলাফতের
অধীনে যে যে এলাকাগুলো ছিলো তম্মধ্যে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া), মিশর, ইরাক, ইয়েমেন, তুর্কিস্তান,
সমরকন্দ, বুখারা, তুরস্ক, আফ্রিকা এবং হিন্দুস্তানের মালাবার, মালদ্বীপ, চরণদ্বীপ,
গুজরাত ও সিন্ধু এলাকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সে যুগে ভারতে আসা সাহাবাদের সংখ্যা ২৫,
তাবিয়ীর সংখ্যা ৩৭ এবং তাব্য়ে তাবিয়ীনের সংখ্যা ১৫ জন ছিলো। (ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার,
গাজী আজীজ)
অতএব
বলতে হবে, প্রথম হিজরী শতাব্দীর শুরুতেই ভারতবর্ষে খাঁটি ইসলাম পৌঁছে গেছে।
তবে
ঐতিহাসিক একটি নিশ্চিত সত্য এই যে, যখনই কোন ঈমানদার ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখনই
ইসলামের প্রচার-প্রসার ও মর্যাদা-সম্মান বৃদ্ধি পায়। উক্ত কারণেই হযরত মুহাম্মদ বিন্
ক্বাসিমের পর সুলতান সবক্তগীন, সুলতান মাহমূদ গজনভী, সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ গুরীর
যুগে (৯৮৬-১১৭৫ খ্রিঃ) ভারত উপমহাদেশে ইসলাম একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত
হয়েছিলো। ঠিক এর বিপরীতেই যখন কোন মুল্’হিদ্ ও বেদ্বীন ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখন
ইসলাম তারই কারণে লাঞ্ছিত ও পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য। ভারত উপমহাদেশে এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ
হচ্ছে আকবরী যুগ। সে যুগে সরকারীভাবে মুসলমানদের জন্য কালিমা ঠিক করে দেয়া হলো:
‘‘আল্লাহ্
ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। আকবর বাদশাহ্ আল্লাহ্’র খলীফা’’।
সে
যুগে আকবরের দরবারে তার সম্মুখে সিজদাহ্ করা হতো, নবুওয়াত, ওহী, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম
নিয়ে ঠাট্টা করা হতো। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রকাশ্যভাবে
প্রশ্ন উত্থাপন করা হতো। সে যুগে সুদ, জুয়া, মদ ইত্যাদি হালাল করে দেয়া হয়েছিলো। শুকরকে
পবিত্র পশু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। হিন্দুদের সন্তুষ্টির জন্য গরুর গোস্তকে হারাম
করে দেয়া হয়েছিলো। দেয়ালী, রাখি, দশাবতার, পূর্ণিমা, শিবরাত্রির মতো হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানগুলো
সরকারীভাবে পালন করা হতো। (ঈমান নবায়ন, পৃষ্ঠা: ৮০)।
বর্তমান
যুগের প্রশাসকরাও ইসলামের খিদমতের নামে শির্ক ও বিদ্’আত বিস্তারে বিপুল সহযোগিতা করে
যাচ্ছে। পীর ফকিরদের প্রতি অঢেল ভক্তি-শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। তাদের মাযারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের
ইসলাম বিধ্বংসী মুবারক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। শুধু এতেই ক্ষান্ত নয়। বরং দু’ একটি
রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রত্যেক ছোট-বড় রাজনৈতিক দলেরই এক একজন নির্দিষ্ট পীর সাহেব রয়েছেন।
যাঁরা তাদেরকে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে শির্ক ও বিদ্’আতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি দলই নিজ নিজ পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে তাঁদের
দো’আ ও বরকত হাসিল করে থাকে। আর যাঁদের নিজস্ব কোন পীর সাহেব নেই তারাও পীর ধরাকে ভালো
চোখেই দেখে থাকেন। অথচ পীর ও ফকিররা বিশ্বের বুকে ইসলামের নামে এতো কঠিন কঠিন শির্ক
ও বিদ্’আত চালু করেছে যা অন্য কোন মানুষ কর্তৃক সম্ভব হয়নি।
(ড) প্রচলিত
ওয়ায মাহ্ফিল:
আমাদের
দেশের সাধারণ ওয়ায মাহ্ফিলগুলোও শির্ক এবং বিদ্’আত বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে
থাকে। কারণ, কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল ওয়াযের সংখ্যা খুবই কম। গণা কয়েকজন ছাড়া যে কোন
ওয়ায়িয কোর’আন ও হাদীস সম্পর্কে আলোচনা না করে বরং বুযুর্গদের নামে বানানো কাহিনী বলতে
খুবই পছন্দ করেন। যে গুলোর অধিকাংশই শির্ক ও বিদ্’আত নির্ভরশীল। পীর সাহেবদের ওয়ায
মাহফিলের তো কোন কথাই নেই। তা তো শির্ক ও বিদ্’আতের বিশেষ আড্ডাই বলা চলে। তাতে শির্ক
ও বিদ্’আতের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাই এক বাক্যে বলা চলে, বর্তমান যুগে কোর’আন
ও হাদীস নির্ভরশীল ওয়াযের খুবই অকাল।
(ঢ) প্রচলিত
তাবলীগ জামাত:
বর্তমান
যুগের তাবলীগ জামাতও শির্ক এবং বিদ্’আত বিস্তারে কম ভূমিকা রাখছেনা। বরং তা ওয়ায মাহফিল
চাইতেও আরো ভয়ঙ্কর। কারণ, ওয়ায মাহফিল তো সাধারণত আলিমরাই করে থাকেন। যদিও তাদের কেউ
নামধারী আলিম হোকনা কেন। কোন গন্ড মূর্খ ওয়ায মাহফিল করতে সাহস পায়না। তবে ইলিয়াস
(রাহিমাহুল্লাহ্) এর আবিষ্কৃত তাবলীগ জামাত মূর্খদের নসীব ভালোভাবেই খুলে দিয়েছে। কারণ,
যে কোন গন্ড মূর্খ যে কোন কথা ‘‘মুরুববীরা বলেছেন’’ বলে ইসলামের নামে চালিয়ে দিতে পারে।
কেউ তাতে কোন বাধা দিচ্ছেনা। মূর্খদেরকে দাওয়াতী কাম শিক্ষা দেয়ার নামে ধর্মীয় ব্যাপারে
কথা বানানোর খুব শক্ত তা’লীম দেয়া হচ্ছে। অথচ রাসূল (সা.) নিজ উম্মতকে সুস্পষ্টভাবেই
সতর্ক করে বলেন:
‘‘যে
ব্যক্তি ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যে বলেছে (আমার নামে এমন কথা বলেছে যা আমি বলিনি) সে
যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয় (সে জাহান্নামী)’’। (বুখারী, হাদীস ১০৭, ১১০,
১২৯১, ৩৪৬১, ৬১৯৭)।
এ
ছাড়া তারা ‘‘তাবলীগী নেসাব’’ বা ‘‘ফাযায়িলে আ’মাল’’ নামে যে কিতাবগুলো নিয়মিতভাবে মানুষকে
পড়ে পড়ে শুনাচ্ছে সেগুলোকে শির্ক, বিদ্’আত ও কেচ্ছা-কাহিনীর কিতাব বললেই চলে। এ কিতাবগুলো
তাবলীগী ভাইদেরকে কেচ্ছা নির্ভরশীল একটি জামাতে পরিণত করেছে। এ ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।
যা শির্ক ও বিদ্’আতে ভরপুর। এ কিতাবগুলোর বেশির ভাগ জায়গাটুকুই দখল করে আছে দুর্বল
ও জাল হাদীস এমনকি অহেতুক ও যুক্তিহীন কেচ্ছা-কাহিনী। হয়তোবা তাবলীগের মুরুববীগণ একদা
অতি সরলতার দরুন কিংবা মূর্খদেরকে নেক আমল ও কল্যাণের কাজে অতি দ্রুত উৎসাহিত করার
নেশায় পড়ে ফাযায়েল সাপ্লাই দিতে গিয়ে সত্যতা ও বিশুদ্ধতার তোয়াক্কা করেননি। তবে যেখানে
এ আমলগুলোর অধিকাংশই বিশুদ্ধ হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত সেখানে এ দীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদের
এ জাতীয় অশুদ্ধ হাদীস ও অযুক্তিক কেচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়া এমনকি কখনো কখনো
দা’ওয়াতের ফযীলত বুঝাতে গিয়ে তাদের বিশিষ্টজনদের মুখ থেকে বিশুদ্ধ কুর’আন ও হাদীসের
অপব্যাখ্যা দেয়া সত্যিই তাদের মূর্খতা ও অন্ধত্বের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্ত্ততঃ
তাদের দা’ওয়াত কর্তৃক বিপুল সংখ্যক অমোসলমানের মোসলমান হওয়া কিংবা আল্লাহ্ তা’আলার
অবাধ্যতার পথ ছেড়ে বাধ্যতার পথে ফিরে আসা সত্যিই অনস্বীকার্য। তবে দ্বীনের উপর উঠার
পর দ্বীনের নামে বদ্দ্বীনির উপর অটলতা ও অন্ধত্ব কোন বিজ্ঞজনের নিকট কখনোই গ্রহণযোগ্য
হতে পারেনা। আশা করি বুদ্ধিমান ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পরিপক্ক আলিম মুরুববীগণ এ
ব্যাপারটি অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।
কুরআন ও সহিহ হাদিসে শিরকের ভয়াবহ পরিণতিঃ
(ক) শিরকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ
তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর সঙ্গে করা শিরকের গোনাহ ক্ষমা করবেন না।
এছাড়া অন্যান্য গত গোনাই হোক না কেন, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর
সঙ্গে কাউকে শরিক করেছে সে তো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গোনাহের কাজ করেছে।
(সুরা নিসা : আয়াত ৪৮)।
(খ) আল্লাহ তাআলা শিরককারীর জন্য জান্নাত
হারাম করেছেন। তাদেরকে জালিক বা অত্যাচারী ঘোষণা করে তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে
না বলেও ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেছে;
আল্লাহ তাঁর ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। এ সব জালিমদের
জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা মায়িদা : আয়াত ৭২)।
(গ) আল্লাহ তাআলা শিরকরে ভয়াবহতা উল্লেখ
করে পূর্ববর্তী নবিদেরকে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তাঁরা (সব নবি-রাসুলগণ) শিরক
করতো তবে অবশ্যই তাদের করা সব নেক আমল বরবাদ হয়ে যেত।’ (সুরা আনআ’ম : আয়াত ৮৮)।
(ঘ) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহর
সঙ্গে শিরক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অত:পর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে
গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ (সুরা হজ : আয়াত
৩১)।
সর্বোপরি
শিরকের ভয়াবহতার কথা ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ
তাআলা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে সুস্পষ্টভাবে কুরআনে
ইরশাদ করেন, ‘(হে নবি!) আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তী নবিদের প্রতি ওহি করা হয়েছে
যে, যদি আল্লাহর সঙ্গে শরিক স্থাপন করেন, তাহলে আপনার সব আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনি
ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবেন।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৬৫)।
সহিহ হাদিস হতেঃ
(ক) জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে বিন্দুমাত্র শরীক
করবে সে জাহান্নামে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে বিন্দুমাত্র শরীক করবে না সে
জান্নাতে যাবে’ (মুসলিম, মিশকাত, বাংলা মিশকাত ১ম খণ্ড হা/৩৪, ‘ঈমান’ অধ্যায় হা/৩৮)।
হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
(খ) শিরককারী কবরে কঠিন আজাব
ভোগ করবেঃ
যায়দ
ইবনু সাবিত (রাঃ)-এর সূত্রে আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আবূ
সা‘ঈদ আল খুদ্রী (রাঃ) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর
কাছে উপস্থিত ছিলাম না, বরং আমাকে যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
একদিন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাজ্জার গোত্রের একটি প্রাচীর
ঘেরা বাগানে তাঁর একটি খচ্চরের উপর আরোহী ছিলেন। এ সময় আমরা তাঁর সাথে ছিলাম। অকস্মাৎ
তা লাফিয়ে উঠল এবং তাঁকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করল। দেখা গেল, সেখানে ছয়টি কিংবা পাঁচটি
অথবা চারটি কবর রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, জুরাইরী এমনটিই বর্ণনা করতেন। অতঃপর তিনি প্রশ্ন
করলেন, এ কবরবাসীদেরকে কে চিনে? তখন এক ব্যক্তি বললেন, আমি চিনি। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তারা কখন মৃত্যুবরণ করেছে? তিনি বললেন, তারা শিরকের
অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
এ উম্মাতকে তাদের কবরের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে। তোমরা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা বর্জন
করবে, এ আশঙ্কা না হলে আমি আল্লাহর নিকট দু‘আ করতাম যেন তিনি তোমাদেরকেও কবরের ‘আযাব
শুনান যা আমি শুনতে পাচ্ছি। তারপর তিনি আমাদের প্রতি মনোনিবেশ করে বললেন, তোমরা সাবই
জাহান্নামের ‘আযাব হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। সহাবাগণ বললেন, জাহান্নামের
শাস্তি হতে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। তারপর তিনি বললেন, তোমরা সকলে কবরের শাস্তি
হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। সহাবাগণ বললেন, কবরের ‘আযাব হতে আমরা আল্লাহর
নিকট আশ্রয় চাই। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার ফিতনা হতে আল্লাহর
নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। তারা বললেন, প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার ফিতনা হতে আমরা
আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। তিনি আবারো বললেন, তোমরা দাজ্জালের ফিতনা হতে আল্লাহর কাছে
আশ্রয় চাও। সহাবাগণ বললেন, দাজ্জালের ফিতনা হতে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। (ই.ফা.
৬৯৪৯, ই.সে. ৭০০৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৭১০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
প্রিয় মুত্তাকি মুসলমান
ভাইয়েরাঃ পিরের দরবার মানেই শিরক, কুফর ও বিদআতের কারখানা যা ইতোপূর্বে
বিভিন্ন আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি। আজকের আলোচনায় শিরকের আদ্যোপান্ত আলোচনা করা হয়েছে।
(সমাপ্ত)
অন্যান্য Related পর্ব দেখতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ
(১) পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ বনাম ইসলাম-(শয়তানের ওহী কার উপর নাযিল হয়?)।
(২) পির-অলিদের ভ্রান্ত আক্বিদাহসমূহ।
(৪) মুখে বলে মুসলমান কর্মকান্ডে সে কাফের।
-----------------------------------------------------
Please Share On
No comments:
Post a Comment