Search This Blog

Wednesday, August 19, 2020

মুখে বলে মুসলমান কর্মকান্ডে সে কাফের

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

পির-মুরিদ ও বিদআতিরা যেসব কারণে জাহান্নামি

(পর্ব-৪)

মুখে বলে মুসলমান কর্মকান্ডে সে কাফের


ভূমিকাঃ ইহুদি-খৃস্টানরা আল্লাহ ও রাসুল সাঃ কর্তৃক ঘোষিত কাফের। এদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা আল্লাহ ও রাসুল সাঃ নিষেধ করেছেন। এ ছাড়া মূর্তিপূজোকরা মুশরিক। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, যারা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছে, ইসলামকে মনোনীত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে, আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর প্রতি আনুগত্যশীল হয়েছে, যারা পরহেজগার ও তাক্বওয়া অর্জন করেছে সাধারণত তাদেরকে আমরা মুসলমান বলি। আর এসবের বিপরীত যারা তারা কাফের-মুশরিক। কাফের-মুশরিকরা আল্লাহ ও রাসুল সাঃকে মেনে নেয়নি বলে তারা কাফের-মুশরিক কিন্তু মুসলমানরা আল্লাহ ও রাসুল সাঃকে মেনে নেয়ার পরও কেমনে কাফের হয়, সেইটা আমাদের জানা প্রয়োজন। 

আসলে মুসলমান পরিবারে জন্ম নিলেই মুসলমান হওয়া যায় না। তাকে মুসলমান হতে হয়। বর্তমান যুগে অধিকাংশ মুসলমানদের কর্মকান্ড দেখে মনে হয় না সে মুসলমান, নাকি ইহুদি নাকি খৃষ্টান, নাকি হিন্দু-বৌদ্ধ। এইসব মুসলমান একদিকে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে অন্যদিকে তাদের চলাফেরা, কথা বার্তা তথা সার্বিক কর্মকান্ড কুফর, শিরক ও বিদআত এ ভরপুর। তারা স্পষ্টতঃ ইসলামের বিরোধীতাও করে আসছে। এইসব মুসলমান সুদ, ঘুষ, খুন, মদ, জুয়া, দুনীতি, যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষনসহ সকল অপকর্মের সাথে জড়িত। এরা ইসলামি আইন মানে না, পর্দার বিধান মানে না, মেয়েদেরকে ল্যাংটা করতে করতে শুধু অন্তর্বাসে নিয়ে এসেছে। সেটুকুও খোলার অপেক্ষায় আছ। এদের দলে আছে এক শ্রেণির পরিচিত আলেম। এরাও কালিমা পড়ে, সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় ও হজ্জও করে। মূলত এসব হচ্ছে তাদের ভন্ডামি।

এই সব নামধারী মুসলমানরা কুফরী আক্বিদাহ পালন করার কারণে যেভাবে কাফেরে পরিনত হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

কুফর কি?

যা ঈমান ও ইসলামের বিপরীত তা-ই হলো ‘কুফর’। কুফরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঢেকে রাখা। আচ্ছাদিত করা, গোপন করা, অস্বীকার করা, অকৃতজ্ঞতা জানানো। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কুফর হলো, জরুরিয়াতে দ্বীন তথা ইসলামের অত্যাবশ্যকীয়, সুস্পষ্ট, সর্বজনবিদিত বিষয়াবলিকে অস্বীকার করা অথবা তন্মধ্য থেকে কোনো একটি বিষয় অস্বীকার করা।

আর ঈমানের বিপরীত কুফর হলো, যে বিষয়ে ঈমান বা আন্তরিক বিশ্বাস থাকা আবশ্যক, সেখানে ঈমান না থাকা। (শরহুল মাকাসিদ : খন্ড ৩, পৃ. ৪৫৭)।

বিশ্বাসগত নিফাকের বিভিন্ন রূপ আছে। কয়েকটি নিম্নরূপ :

(ক) শরিয়ত বা শরিয়তের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা।

(খ) ইসলামের নবী (সা.), কোরআন, ইসলামী নিদর্শনের কিংবা ইসলামের কোনো বিধানের বিদ্রুপ বা অবজ্ঞা করা।

(গ) ইসলামের কিছু বিশ্বাস ও বিধানকে মানা আর কিছু না মানা।

(ঘ) শরিয়তের কোনো বিধানের ওপর আপত্তি করা বা কোনো স্থায়ী বিধানকে সংস্কারযোগ্য মনে করা।

(ঙ) ইসলামের কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন আকিদা বা বিধানের অপব্যাখ্যা করা।

 কুফরী দুই প্রকার। যথাঃ

(১) প্রথম প্রকার : বড় কুফরী।

(২) দ্বিতীয় প্রকার: ছোট কুফরী।

আলোচনাঃ

(১) প্রথম প্রকার : বড় কুফরীঃ

এ প্রকারের কুফুরী মুসলমান ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত:

(ক)  মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কুফরী:

এর দলীল আল্লাহর বাণী:

‘যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা রচনা করে, অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে, তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে? জাহান্নামই কি এইসব কাফিরের আবাস নয়?  [সূরা আনকাবুত, ৬৮]

(খ) মনে বিশ্বাস রেখেও অস্বীকার অহংকারশতঃ কুফরী:

এর দলীল আল্লাহর বাণী:

‘যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সেজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। [সূরা বাকারা ২:৩৪]

(গ)  সংশয়জনিত কুফুরী:

একে ধারণাজনিত কুফরী ও বলা হয়। এর দলীল আল্লাহ তাআলার বাণী:

 ‘নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার  বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমার মনে হয়না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমি মনে করিনা যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি আমার পালনকর্তার কাছে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়ই, তবে তো আমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তদুত্তরে তার সাথী তাকে বলল, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে? কিন্তু আল্লাহই আমার পালনকর্তা এবং আমি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক করিনা। [সূরা কাহাফ,৩৫-৩৮]

(ঘ) উপেক্ষা প্রদর্শন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কুফরী:

এর দলীল আল্লাহর বাণী:

‘আর কাফিররা যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। [সূরা আহক্বাফ,০৩]

(ঙ)  নিফাকী ও কপটতার কুফরী:

এর দলীল হল:

এটা এজন্যে যে, তারা ঈমান আনবার পর কুফরী করেছে। ফলে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। অতএব তারা বুঝে না। [সূরা মুনাফিকুন, ০৩]

(২) দ্বিতীয় প্রকার: ছোট কুফরীঃ

এ প্রকারের কুফরী মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কৃত করেনা। একে ‘আমলী কুফরী’ ও বলা হয়। ছোট কুফরী দ্বারা সে সব গোনাহের কাজকেই বুঝানো হয়েছে, কুরআন ও সুন্নায় যাকে কুফরী নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের কুফুরী বড় কুফরীর সমপর্যায়ের নামে। যেমন আল্লাহর নিয়ামতের কুফরী করা যা নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

 ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এমন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। তথায় প্রত্যেক স্থান হতে আসত প্রচুর রিযিক ও জীবিকা। অতঃপর সে জনপদের লোকেরা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞা প্রকাশ করল।’ [সূরা নাহল, ১১২]

এক মুসলমান অপর মুসলমানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াও এ ধরনের কুফরীর অন্তর্গত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

 ‘কোন মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী কাজ। আর তার সাথে যুদ্ধ করা কুফুরী।  [বুখারী , মুসলিম]

তিনি আরো বলেন:

 ‘আমার পর তোমরা পুনরায় কাফির হয়ে যেওনা, যাতে তোমরা একে অপরের গর্দান উড়িয়ে দেবে। [বুখারী, মুসলিম]

গায়রুল্লাহর নামে কসম ও এ কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

 ‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে কসম করল। সে কুফরী কিংবা শিরক করল। [তিরমিযী, হাকেম]

কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ মুমিন হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন:

 ‘হে ঈমানদার গণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস গ্রহণ করা ফরয করা হয়েছে।’   [সূরা বাকারা, ১৭৮]

এখানে হত্যাকারীকে ঈমানদারদের দল থেকে বের করে দেয়া হয়নি। বরং তাকে ক্বিসাসের অলী তথা ক্বিসাস গ্রহণকারীর ভাই হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

 ‘অত:পর হত্যাকারীকে তার(নিহত) ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে (নিহতের ওয়ারিসগণ) প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং (হত্যাকারী) উত্তমভাবে তাকে তা প্রদান করবে। ’  [সূরা বাকারা, ১৭৮]

নিঃসন্দেহে ভাইদ্বারা এখানে দ্বীনী ভাই বুঝানো উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

 ‘মুমিনদরে দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মী মা ংসা করে দাও।  [সূরা হুজরাত, ০৯]

এর পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন:

‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাইÑভাই, অতএব তোমরা তোমাদের দু‘ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা কর’।  [সূরা হুজরাত, ১০]

প্রশ্ন?

প্রশ্ন: যারা আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে শাসন করে তাদের ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি?

তারা কি উমাইয়্যা কিংবা আব্বাসিদের মতো ‘কুফর দুনা কুফর’ এর অন্তর্গত? না তাদের কুফরটি এমন বড় কুফর যা কোন ব্যক্তিকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়?

আর আমাদের উপর এসব শাসকদের ব্যাপারে হুকুম কি যেন এ ব্যাপারে আল্লাহর সামনে আমরা ক্ষমা পেতে পারি (সে অনুযায়ী কাজ করে), যদি উভয় প্রেক্ষিতেই হয়?

উত্তর: যারা আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন তা অনুযায়ী শাসন করে না, এবং মানব রচিত আইন দ্বারা শাসন করে, অথবা তাদের খেয়াল খুশি ও ঐতিহ্যনুযায়ী (বাপ দাদা, গোত্রীয় ইত্যাদি) করে, তাহলে তারা কাফের ও মুশরিক।

 প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ : আর আমাদের উপর এসব শাসকদের ব্যাপারে হুকুম কি যেন এ ব্যাপারে আল্লাহর সামনে আমরা ক্ষমা পেতে পারি (সে অনুযায়ী কাজ করে), যদি উভয় প্রেক্ষিতেই হয়?

উত্তরঃ

তাদের মানব রচিত জুলুমের আদালত সমূহে না যাওয়া এবং ইব্রাহীম (আ) এঁর মিল্লাত (বিশুদ্ধ তাওহীদের পথ) আঁকড়ে থাকা।

 ”তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে। ” (সূরা মুমতাহিনা – ৪)।

আর এই আয়াত অনুযায়ী,

“অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।” (সূরা হিজর – ৯৪)।

আল্লাহ বলেন,

“আপনি পথ অনুসরণ করুন, যার আদেশ পালনকর্তার পক্ষ থেকে আসে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুশরিকদের তরফ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।” (সূরা আন’আম – ১০৬)

আল্লাহ বলেন,

“বলুন, হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করিনা,তোমরা যার এবাদত কর।” (সূরা কাফিরুন ১-২)।

আর এটা হওয়া উচিত ঘৃনা ও শত্রুতার মিশেলে এবং এতে কোন ঐক্যের সূর থাকবে না।

আল্লাহ বলেন,

“যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়।” (সূরা মুজাদালাহ – ২২)।

আর সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, যদি হিজরতের পর ক্ষতির সম্ভাবনা অল্প থাকে।

আল্লাহ বলেন,

“হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সেটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান।” (সূরা আত তাহরীম – ৯)।

অথবা অস্ত্র ছাড়া জিহাদ করা (তাদের বিরোধীতার মাধ্যমে) এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর সিদ্ধান্ত প্রেরণ করেন,

আল্লাহ বলেন,

“অতএব আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এর (কুর’আন) সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করুন।” (সূরা ফোরকান – ৫২)।

মুসলমানের জন্যে কুফরি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নেইঃ

“অজুহাত দেখিয়ো না। তোমরা তো (প্রকাশ্যে) ইমান আনার পর কুফরি করেছ।” [সুরা তাওবা, আয়াত : ৬৬ (প্রথমাংশ)]

তাফসির : আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, মুনাফিকরা নামধারী মুসলমান হলেও তাদের স্বভাব ছিল ধর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থ, নবী-রাসুলদের নিয়ে উপহাস করা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা। তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার সময় কিছু মুনাফিক রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। এ বিষয়ে পরে তাদের জিজ্ঞাসা করা হলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বলতে থাকে, ‘আমরা তো এগুলো কথার কথায় বলেছি। আমরা রসিকতা করে এসব বলেছি।’ এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, মহানবী (সা.)-কে নিয়ে হাসিঠাট্টা ও ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা কুফরি। কোনো মুসলমান রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলে সে মুরতাদ ও কাফের হয়ে যায়।

মুখে কুফরি শব্দ উচ্চারণের বিধানঃ

যেকোনো আদর্শ ও বিশ্বাস প্রথমে ধারণ করতে হয়, তারপর সেটি মনেপ্রাণে লালন করতে হয়। কেউ নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসবিরোধী কোনো কাজ করলে তাকে ওই আদর্শচ্যুত ও অবিশ্বাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইমান ও ইসলাম একটি আদর্শ ও বিশ্বাসের নাম। একবার ইমান আনলেই কেউ চিরকাল মুসলমান থাকে না। ইমানের সঙ্গে আমলের সংযোগ স্থাপন করতে হয়। ইমানের ওপর অবিচল থাকতে হয়। তাই কোনো মুসলমানের জন্য কুফরি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নেই। আল্লামা শামি (রহ.) লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি রসিকতা করে কিংবা খেলতামাশাচ্ছলে কুফরি শব্দ উচ্চারণ করে, সব আলেমের ঐকমত্যে সে কাফের হয়ে যাবে।’ (ফতোয়ায়ে শামি : ৪/২২৪)।

ফতোয়ায়ে আলমগিরিতে বিষয়টি আরো সুন্দরভাবে এসেছে— ‘ব্যঙ্গবিদ্রূপকারী যদি শরিয়তের কোনো বিধানকে হালকা মনে করে উপহাস করে এবং কুফরি শব্দ ব্যবহার করে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে, যদিও আন্তরিক বিশ্বাস এর বিপরীত হয়।’ (ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ২/৩৭৬)।

কাফেরদের সাথে মৈত্রীর ২০টি নিষিদ্ধ প্রকারঃ

আল্লাহ তা’আলা কুফফারদের সাথে মৈত্রী প্রতিষ্ঠাকে নিষেধ করেছেন। সাধারণভাবে ২০ প্রকার মৈত্রী সংঘটিত হতে পারে,যার কিছু মানুষকে কাফের বানিয়ে দেয় আর কিছু কঠিন গুনাহের কারণ হয়।

(১) কাফেরদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকাঃ

এই সন্তুষ্টি যদি তাদের  ধর্মমতের প্রতি হয় অর্থাৎ যদি কেউ কাফেরদের ধর্মকে সঠিক মনে করে, তাদের কাজকে সঠিক মনে করে ও তা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়,কিংবা তাদের ধর্মকে বতিল বলতে দ্বিধা করে তাহলে সে ব্যক্তি নিজেও কাফের হয়ে যাবে। কেননা  কাফেরদের যেকোনো ধর্ম বা ধর্মীয় কাজকে অনুমোদনকরা কুফর। [মাজমু’আতুত তাওহীদ,পৃ:১২৯] 

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তার চেয়ে অধিক বিচ্যুত আর কে আছে যে আল্লাহর পথনির্দেশকে অনুসরণ না করে নিজের প্রবৃত্তি কে অনুসরণ করে?”  [সূরা ক্বাসাস: ৫০]

(২) কাফেরদের ভালোবাসা কামনা করাঃ

কাফেরদের ভালোবাসা বা স্নেহ-মমতা আকাঙ্ক্ষা করা মূলত তাদের সাথে একপ্রকার মৈত্রী করা,যা আল্লাহ তা’আলা নিষেধ করেছেন। [শাইখ সাঈদ বিন আলী আল কাহতানী (হাফি:), Al wala wal bara,part 2, pp:117] 

আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন লোক তুমি খুজে পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীতাকারীর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে,যদিও তারা তার বাবা,সন্তান,ভাই কিংবা আত্নীয়।”  {সূরা আল মুজাদালাহঃ২২ } 

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ(রাহ:) লিখেছেন,” আল্লাহ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন যে তুমি এমন মু’মিন খুজে পাবে না যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীতাকারীর ভালোবাসা কামনা করে,কেননা ঈমান নিজেই এটাকে প্রতিহত করবে যেভাবে ২টি বিপরীত বস্তু একে অপরকে প্রতিহত করে। কাজেই যতক্ষণ অন্তরে ঈমান আছে ততক্ষণ আল্লাহর দুশমনের আনুগত্য করা অসম্ভব। যদি কেউ তার অন্তরকে কাফেরদের প্রতি আবদ্ধ করে ফেলে, সেক্ষেত্রে এটাও দলীল।যে তার অন্তর (ইতিমধ্যেই) ঈমানশূন্য হয়ে গেছে।” [আল-ঈমান,পৃ:১৩] 

আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! আমার ও তোমাদের দুশমনদের প্রতি আকর্ষণ দেখিয়ে তাদের বন্ধু বানিয়ে নিও না,যেহেতু তারা সে সত্যকে অস্বীকার করেছে,যা তোমাদের নিকট এসেছে।”  { সূরা আল মুমতাহিনা:১}

বর্তমানকালে এর প্রকোপ খুব বেশি। সাধারণ মানুষ,যারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা যেমন অজ্ঞতাবশত এ কাজে লিপ্ত;তেমনই আলেম শ্রেণির মাঝেও এর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষকরে পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণায় প্রভাবিত এক শ্রেণির আলেম এরূপ কাজ করছে,তারা কাফেরদের দেশে উপদেষ্টা জাতিয় সরকারি Post বাগিয়ে নিচ্ছে। এরা কাফেরদের ভালোবাসা লাভে ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যাও পিছপা নয়।

(৩) কাফেরদের প্রতি ভরসা করাঃ

সাহায্য, সহযোগীতা, নিরাপত্তা কিংবা কাফেরদের দ্বীনে প্রবেশ করার জন্য তাদের উপর ভরসা করা অপর প্রকার মৈত্রী। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “মু’মিনরা মু’মিনদের বদলে কাফেরদের আওলিয়া (সাহায্যকারী, মিত্র,অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করবে না। এবং যে কেউ তা করবে সে কিছুতেই আল্লাহর সাহায্য পাবে না। (ব্যতিক্রম হচ্ছে) যদি তোমরা তাদের থেকে বিপদের আশংকা কর। এবং আল্লাহ তা’আলা নিজের সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন(তাঁর আযাব সম্পর্কে) এবং তাঁর কাছেই শেষ প্রত্যাবর্তন।” { সূরা আলে ইমরান:২৮} ইমাম ইবন জারির আত তাবারী(রাহ:) তাদের আওলিয়া হিসেবে নেয়ার অর্থ লিখেছেন, “তাদের সাহায্য চাওয়া, সমর্থন চাওয়া, কোনো কাজে সাহায়ক হিসেবে তাদের চাওয়া,তাদের ধর্ম,সংস্কৃতি ও জীবন প্রণালীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা,যাতে করে তারা মুসলিমদের উপর বিজয়ী হতে পারে। আল্লাহর প্রতি এরূপ লোকদের কোনো দাবিদাওয়া নেই। আল্লাহ তা’আলার দ্বীন ত্যাগ করে এবং কাফেরদের কুফর গ্রহণ করে এধরণের লোক আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং আল্লাহও তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। ((ব্যতিক্রম হচ্ছে) যদি তোমরা তাদের থেকে বিপদের আশংকা কর) এর অর্থ হচ্ছে যদি কেউ তাদের ক্ষমতার অধীন থাকে,(সেক্ষত্রে) এটা সম্ভব যে তাদের বল প্রয়োগ করা হবে এবং ভয় দেখনো হবে যাতে করে তারা তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে যদিও তাদের অন্তরে ঘৃণা ঠিকই বিদ্যমান,নিজেদের তারা কুফর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাহায্য করতে অস্বীকার করেছে।” [তাফসীরুত তাবারী:৩/২২৮]

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদের আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করো না,তারা (বরং)একে অপরের আওলিয়া। যে কেউ তাদের আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করবে, সে (হবে) তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিমদের হিদায়ত দেন না।”  {সূরা আল মাইদাহ:৫১} 

ইমাম ইবন জারির(রাহ:) লিখেছেন, “যে কেউ মুসলিমদের বদলে হয় ইহুদী নয় খৃষ্টানদের সহযোগীতা করে, সে তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হবে; সে তাদেরই বিশ্বাসের এবং তাদেরই জাতির লোক। (কেননা) কেউ কাউকে মিত্র ও রক্ষক হিসেবে ততক্ষণ গ্রহণ করে না যতক্ষণ না তার সাথে সহমত হচ্ছে এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হচ্ছে। (আর) কেউ যদি কোনো লোকের প্রতি সন্তুষ্ট হয় তাহলে তার ধর্মের প্রতিও অনুরূপ মনোভাব থাকা উচিত। সে ও সেসব বিষয়ের বিরোধীতা করবে যা তার সহযোদ্ধা বিরোধীতা করে। এভাবে তারা একই অবস্থানের অংশীদার হয়,কাজেই তাদের বিধানও একই হবে।” [তাফসীরুত তাবারী : ৬/২৭৭]

ইমাম ইবন হাযম জাহিরী (রাহ:) লিখেছেন, “আল্লাহর বাণী (যে কেউ তাদের আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করবে, সে (হবে) তাদেরই একজন) মানে, অবিকল সেটাই যা তারা বলে যে, এমন লোক কাফেরদের মাঝেও কাফের। এটা এমন বিষয় যাতে ২ জন মুসলিম মতানৈক্য করতে পারেনা।”  [আল মুহাল্লা,খণ্ড ১৩, পৃ:৩৫]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ(রাহ:) এ আলোচনায় আরেকটি আয়াত যুক্ত করেছেন, “যদি তারা আল্লাহ এবং নাবী (স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে (কুর’আন) তাতে বিশ্বাস করত, তাহলে তাদের(কাফেরদের) আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করত না।” {সূরা আল মাইদাহ:৮১}

অতঃপর তিনি লিখেছেন, “এটা নির্দেশ করে যে প্রথমে নির্দেশিত ঈমানের অস্তিত্বই তাদেরকে (ঈমানদারদের) কাফেরদের আওলিয়া হিসেবে গ্রহণে বাধা দেবে এবং এরূপ কর্মের বিরোধীতা করবে। কাজেই তাদের প্রতি আনুগত্য এবং ঈমান একই হৃদয়ে সহাবস্থান করতে পারেনা। এটা (এ বিষয়ে) একটা উদাহরণ যে কিভাবে কুর’আন ব্যাখ্যা করে থাকে(বিভিন্ন বিধান) এবং (এর মাধ্যমে) নিজেকে সাহায্য করে।” [আল ঈমান,পৃ:১৪]

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমরা বরং উল্টোটা দেখছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুসলিম প্রধান দেশগুলো কিভাবে কাফেরদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে কিংবা মুসলিমদের স্বার্থহানী ঘটাচ্ছে।. উপরন্তু তুর্কি মুসলিম খিলাফাত ধবংসের ক্ষেত্রেও হিজাজের শরীফ,আলে সাউদ বংশ; মিসরের রশীদ রেযার ও তার অনুসারীরা এবং তুরস্কের অভ্যন্তরে বহু লোক ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিল।.

(৪) কোনো কুফরী বিষয়ে একমত হওয়াঃ

কাফেরদের সাথে মৈত্রীর একটা প্রকার হচ্ছে কোনো কুফরী বিষয়ে তাদের সাথে একমত হওয়া এবং আল্লাহর কথার বিপরীতে তাদের মত গ্রহণ করা। এটা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিকে কাফেরও বানিয়ে ছাড়ে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তুমি কি তাদের দেখনি যাদের কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল? তারা জিবত এবং ত্বাগুতে ঈমান এনেছিল (বিশ্বাস করেছিল) এবং কাফেরদের বলেছিল যে তারা (কাফেররা) মু’মিনদের থেকে বেশি অধিক হেয়াদায়েতের পথে রয়েছে!” { সূরা আন নিসা:৫১} 

[জিবত এবং ত্বাগুত অর্থ এমন কিছু, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদাত করা হয়। যেমনঃ মিথ্যা দেবতা,শয়তান, পুতুল,কবর,পাথর,চন্দ্র-সূর্য,মানুষ, নাবী,ঈসা(আ:), উযাইর(আ:), সাধু-সন্নাসীরা] তিনি আরও বলেন, “যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন নবী তাদের কাছে এলো (পূর্ব থেকে) তাদের কাছে যা ছিল তা সত্যায়ন করতে, তখন কিতাবপ্রাপ্তদের একদল আল্লাহর কিতাবকে পেছনে (এমনভাবে) ছুড়ে মারল যেন তারা কিছু জানেই না!” { সূরা বাক্বারাহ:১০১-১০২} 

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ(রাহ:) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “আল্লাহ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন যে তারা আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করেছিল জাদুর জন্য; অনেক ইহুদীর মত কিছু নামধারী মুসলিমও এরূপ ছিল। সমাজ থেকে যে কেউ কাফেরদের সাথে যোগ দিক না কেন,তা সে আহলে কিতাব হোক বা না হোক, যদি সে কাফেরদের মিথ্যা কথা ও আমলের সঙ্গী হয় তাহলে সে নিজের উপর কেবল মুনাফিকীর যন্ত্রণা ও লজ্জাকেই ডেকে আনবে।”  [মাজমু’উল ফাতাওয়া: ২৮/১৯৯-২০১]

বর্তমান সমাজে আমরা এরূপ বিশ্বাসের অনুগামী অগণিত মানুষকে দেখতে পাই। এদের কেউ মনে করে খৃষ্টান কিংবা ইহুদীদের ধর্মে এমন সত্য আছে যা আমাদের কাছে নেই! এদের কেউ বলে, আমি একটা দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী! কেউ বলে, আমি সেক্যুলারিযমে বিশ্বাসী। গণতন্ত্র একটা উত্তম রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সংবিধান তো সেক্যুলার হওয়া উচিত!  “তারা এসকল কুফরী নীতিমালা গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম ভূখণ্ডসমূহে প্রয়োগ করেছে, সেই সাথে মানুষকে এসব বিশ্বাসের জন্য কাজ করতে বাধ্য করেছে। এ ধরণের বিষয়ের জন্য তাদের দরকার ছিল আনুগত্য, আত্নসমর্পণ ও সেবা। (তাই) কোনো মুসলিম যদি কিতাবুল্লাহ ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে যাবার আহ্বান করে তাহলে তাকে জাতীয় শত্রু আখ্যা দেয়া হয়। এধরণের বিশ্বাসের একটা দিক হচ্ছে সেক্যুলার কর্তৃপক্ষকে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ থেকে পৃথকীকরণ। অর্থাৎ এই ধারণা যে ইসলাম ও রাজনীতির মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই! এরও মূল হচ্ছে ইউরোপ, যেখানে গীর্জা ও খৃষ্টান সমাজের অবশিষ্টাংশের মধ্যে বিবাদ ছিল। কিন্তু খৃষ্টান সংস্কারকদের মতবাদ দিয়ে ইসলাম কী করবে?“ [শাইখ সাঈদ বিন আলী আল কাহতানী (হাফি:), Al wala wal bara,part 2,pp: 116].

(৫) কাফেরদের দিকে ঝোঁকাঃ

কেউ কেউ কাফেরদের প্রতি ঝুকে পড়ে আর এভাবে মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়। এ-বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন,.

 “যালিমদের প্রতি ঝুকে পড়ো না,নয়ত আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে,এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কোনো আওলিয়া পাবে না,অতঃপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।” {সূরা হূদ:১১৩} ইমাম কুরতুবী (রাহ:) বলেন,”কোনো কিছুর প্রতি ঝুকে পড়ার মানে কোনো সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের জন্য সত্যিকার অর্থে তার প্রতি ভরসা করা এবং সাহায্যের জন্য নির্ভর করা।” [তাফসিরুল কুরতুবী: ৯/১০৮]  ক্বাতাদাহ (রাহ:)

এই আয়াতের তাফসিরে বলেছেন যে, কোনো মুসলিমেরই কাফেরদের পছন্দ করা উচিত নয় এবং তাদের ইচ্ছাপূরণ করাও উচিত নয়। মনে রাখা জরুরী যে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলকে (স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

 “আমি যদি তোমাকে দৃঢ় না রাখতাম তাহলে তুমি তো তাদের প্রতি সামান্য ঝুকেই পড়তে। সেক্ষত্রে(যদি ঝুকে পড়তে) আমি তোমাকে (তোমার) জীবনে দ্বিগুণ (আযাব) ও মৃত্যর পর দ্বিগুণ (আযাবের) স্বাদ আস্বাদন করাতাম। তখন তুমি আমার বিপক্ষে কাউকে সাহায্যকারী হিসেবে পেতে না।” {সূরা আল ইসরা:৭৪-৭৫}

কাজেই,“মনে রাখুন এই সম্বোধন সৃষ্টির সেরা স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে করা হয়েছিল,তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে?” [মাজমু’আতুত তাওহীদ,পৃ: ১১৭]

(৬) কাফেরদের ধর্মের প্রশংসা করাঃ

কাফেরদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশংসা করা ও তোষামোদ করা আজকাল এক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।. আল্লাহ তা’আলা বলেন,

 “তারা আশা করে যে তোমরা (ভদ্রতাবশত ধর্মের ব্যাপারে) তাদের সাথে আপস করবে,তাহলে তারাও তোমাদের সাথে আপস করবে।” { সূরা আল কলম:৯}

যখন কাফেররা দুনিয়ার শক্তি অর্জন করল,খিলাফাতের পতন ঘটল, তখন এক শ্রেণির নামসর্বস্ব মুসলিম কাফেরদের ঐশ্বর্য ও উন্নয়ন দেখে স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে গেল। এরা প্রাণ খুলে কাফেরদের ও তাদের ধর্মের গুণগান গাইতে লাগল। এরা ভুলে গেল তাদের ধর্মের শিক্ষা। এদের ব্যাপারেই রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে,

 “ অবশ্যই তোমরা তোমাদের আগের লোকেদের নীতি-পদ্ধতিকে বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি দাব্ব-এর(আরবে প্রাপ্ত এক প্রকার সরীসৃপ, কেউ কেউ গুইসাপ অনুবাদ করেছে ভুলবশত, এটা উপমহাদেশে কেবল রাজস্থানেই পাওয়া যায়। দাব্ব খাওয়া জায়েজ আর গুইসাপ হারাম) গর্তে ঢুকে, তাহলে তোমরাও তাদের অনুকরণ(তাবি’ করা ব্যাপক অর্থবোধক- যেমন অনুসরণ, অনুকরণ, আনুগত্য) করবে।”  আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি ইয়াহূদী ও নাসারা? তিনি বললেনঃ আর কারা? [সহীহুল বুখারী, কিতাবুল ই’তিসাম,হা:৭৩২০]

বস্তুত আজ মুসলিম উম্মাহ এ-রোগেই আক্রান্ত। তারা মনে করেছে কাফেরদের অনুসরণেই বুঝি সাফল্য আসবে,জীবনে এগিয়ে যাওয়া যাবে,পার্থিব উন্নতি অর্জিত হবে। সেকারণে তারা কাফেরদের ধর্ম-বিশ্বাস ও জীবনপদ্ধতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এজন্যই ইসলামের শিক্ষাকে উপেক্ষা করে তারা বিভিন্ন কুসংস্কার, রসম-রেওয়াজ অনুসরণ করছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে হাস্যকর কাজকর্মে লিপ্ত হয়েছে,অথচ এসব মূর্তির না ভালো করার ক্ষমতা আছে আর না খারাপ করার ক্ষমতা আছে। কেউ এসব পেঁচার উপর প্রস্রাব করে দিলেও এদের কিছু করার নেই। উপরন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষ তো দূরের বিষয় মিসর,কাতার, ভারত,বাংলাদেশের একাধিক বড় (কথিত) আলেমের অবস্থা এই যে তারা কাফেরদের ধর্ম ও তাদের বিভিন্ন বিশ্বাসে খুব প্রশংসা করে থাকে! কেউ কেউ এতদূরও বলে যে তাদের ধর্মে অনেক ভালো বিষয় আছে! সুবহানাল্লাহ! অথচ এই কথাগুলো মক্কার কাফেররা শুনতে চেয়েছিল কিন্তু রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভুলেও বলেন নি। উপরোক্ত আয়াত এর সাক্ষ্য। মুসলিমদের উন্নতি ও অগ্রগতি কেবল ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসরণেই লাভ করা সম্ভব। আমীরুল মু’মিনিন উমার ইবনুল খাত্তাব(রা:) বলেছিলেন, “আমরা ছিলাম সর্বাপেক্ষা গুরুত্বহীন জাতি, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা আমাদের ইসলামের মাধ্যমে উন্নত করেছেন। আমরা যদি আল্লাহ তা’আলার মহিমা (ইসলাম) ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চাই,তাহলে আল্লাহ তা’আলা নিশ্চয় আমাদের লাঞ্ছিত করবেন।” [ ইমাম হাকিম (রাহ:), আল মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন:১/৬২ ; কিতাবুল ঈমান]

এ-কথা হৃদয়ে গভীরভাবে লালন করা জরুরী। আল্লাহ তা’আলা তাওফীক্ব দিন-আমিন। [গোটা দুনিয়ার অগণিত আলেমই আজ এরূপ কাজ করছে। যেসব দেশের নামোল্লেখ করেছি,কেবল তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তবে এসব দেশের প্রখ্যাত কয়েকজন আলেমের নাম জানা আছে বিধায় এগুলোর নাম লিখেছি।]

(৭) কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করাঃ

কাফেরদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা হচ্ছে তাদের সাথে মৈত্রীর অন্যতম মাধ্যম।. . আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আপনজন (মু’মিন) ব্যতীত অপর কাউকে বিতানাহ (বন্ধু, সাহায্যকারী, উপদেষ্টা,পরামর্শক ইত্যাদি) হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে ত্রুটি করবে না; যা তোমাদের বিপন্ন করে তা-ই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছি,যদি তোমরা অনুধাবন কর।” {সূরা আলে ইমরান:১১৮}

আমরা যদি এই আয়াতের শানে নুযুল বা নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানি তাহলে এর প্রেক্ষাপট আমাদের নিকট অধিক স্পষ্ট হবে। “এই আয়াতগুলো একদল মু’মিন সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল, যারা মুনাফিক ও ইহুদীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখত; কারণ সেসময় তারা ছিল তাদের (মু’মিনদের) বন্ধু ও প্রতিবেশী। আল্লাহ তা’আলা এই আয়াত নাযিল করে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করে দেন, কেননা তা (এ সম্পর্ক) তাদের দ্বীনের জন্য বিপদজনক ছিল।”  [আল ওয়াহিদী (রাহ:), আসবাবুন নুযুল,পৃ:৬৮] 

এখানে ঘনিষ্ঠতা বলতে বিশ্বাস ও আস্থার ক্ষেত্রে নৈকট্য বুঝিয়েছে। সর্বদা এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের উপর আমরা অন্যদের থেকে বেশি আস্থা রাখি এবং যারা অধিক বিশ্বাসী হয়। কাফেরদের এরূপ ঘনিষ্ঠ করা যাবে না। আল্লাহ তা’আলা এর কারণ বর্ণনা করেছেন যে, “তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে ত্রুটি করবে না”। তারা তোমাদের জন্য সমস্যা ও কাঠিন্য সৃষ্টি করতে বিশেষ চেষ্টা করবে এবং তোমাদের কষ্ট ও দুর্ভাগ্য থেকে আনন্দ লাভ করবে। তাদের শত্রুতা মুসলিমদের নিন্দা করা অথবা তাদের কাজে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে হতে পারে। বলা হয়ে থাকে যে তারা মুশরিকদের সেসব জানিয়ে দিত যা তারা (মুসলিমদের ব্যাপারে) জানতে পারত। [ তাফসিরুল বাগাভী:১/৪০৮; তাফসিরু ইবন কাসির: ২/৮৯]

এসব কারণেই মূলত আল্লাহ তা’আলা কাফেরদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে,আস্থা ভাজন ও বিশ্বাসীরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।এছাড়া রাসূলুল্লাহ (স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,  “মানুষ তার খলীলের( ঘনিষ্ঠ বন্ধু) দ্বীনের অনুসারী। সুতরাং তোমাদের খেয়াল রাখা উচিত যে কাকে সে খলীল বানাচ্ছে।”  [সুনানু তিরমিযী, কিতাবুয যুহদ,হা: ২৩৭৯;

ইমাম তিরমিযীর (রাহ:) মতে হাদিস হাসান গারীব। সুনানু আবি দাউদ, কিতাবুল আদাব,হা:৪৮৩৩ (দারুস সালাম,রিয়াদ)

শাইখ যুবাইর আলী ঝাই (রাহ:) এর মতে হাসান] বর্তমানে এর বিপরীত অবস্থার ছড়াছড়ি আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই,তাহলে দেখতে পাব মুসলিম স্পেনের পতন থেকে শুরু করে তাতারীদের হাতে বাগদাদের পতন,এমনকি বাংলার পরাধীনতার পেছনেও আল্লাহর এই নির্দেশ অমান্য করার ফল ক্রিয়াশীল ছিল। আজও মুসলিমদের পুনর্জাগরণের জন্য আল্লাহর এই বিধান দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরা জরুরী।

(৮) কাফেরদের আনুগত্যঃ

কাফেরদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার আনুগত্য করাও তাদের সাথে মৈত্রীর একটা প্রকার।. আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এমন কোনো ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তর আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি,যে নিজ খেয়াল-খুশীর পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে।” { সূরা কাহাফ:২৮}

এবং তিনি আরও বলেন, “হে মু’মিনগণ! যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তোমরা যদি তাদের কথা মান,তবে তারা তোমাদেরকে তোমাদের পেছন দিকে (কুফরের দিকে) ফিরিয়ে দেবে। ফলে তোমরা উল্টে গিয়ে কঠিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”  {সূরা আলে ইমরান:১৪৯} 

তিনি আরও বলেন, “(হে মুসলিমগণ!) শয়তান তার বন্ধুদের তোমাদের সাথে বিতর্ক করার জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। তোমরা যদি তাদের কথা মত চল তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে।”  {সূরা আন’আম:১২১}

এই শেষের আয়াত সম্পর্কে ইমাম ইবন কাসির (রাহ:) বলেছেন,”যখন আল্লাহর বিধান ও শরী’আতকে অন্যের কথার সমকক্ষ হিসেবে ধরা হবে (যেমন আজকাল মানবরচিত বিভিন্ন আইনের ক্ষেত্রে করা হচ্ছে, বরং শাসকরা এসকল আইনকে আরও উত্তম মনে করে) তখন তা হবে শির্ক।. . এটা এই আয়াতেও প্রকাশ্য,” তারা তাদের পাদ্রী ও সন্নাসীদের আল্লাহর সাথে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।” { সূরা আত তাওবাহ:৩১} [তাফসির ইবন কাসির: ৩/৩২২]

আল্লাহ তা’আলা এসকল কর্ম হতে আমাদের বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দিন-আমিন।

[কুর’আনের তর্জমা মুফতী তাকী উসমানী (হাফি:) কৃত তাফসিরে তাওযীহুল কুর’আন হতে গৃহীত, অনুঃ মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম(মাকতাবাতুল আশরাফ,এপ্রিল ২০১০)। শেষ আয়াতের তর্জমা ড. তাকিউদ্দীন হিলালী ও মুহসিন খানের The Noble Qur’an হতে গৃহীত।]

(৯) কুর’আন  নিয়ে তামাশাকারী কাফেরদের সাথে বসাঃ

কাফেররা যখন কুর’আন তথা ইসলাম বা ইসলামী বিধি-বিধান নিয়ে হাসি-তামাশায় লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে বসার মাধ্যমেও তাদের সাথে মৈত্রী করা হয়। আল্লাহ তা’আলা একাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন,

 তোমাদের প্রতি তো কিতাবে (কুর’আনে) ইতিমধ্যে নাযিল করা হয়েছে যে, যখন তোমরা শুনবে যে আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং (তা নিয়ে) হাসি-ঠাট্টা করা হচ্ছে,তখন তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণনা তারা অন্য বিষয়ে কথোপকথনে লিপ্ত হচ্ছে।(কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে থাক) নিশ্চয় সেক্ষেত্রে তোমরা তাদের মতই হবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মুনাফিক ও কাফিরদের জাহান্নামে একত্রিত করবেন।” {সূরা আন নিসা:১৪০} 

ইমাম ইবন জারির আত তাবারী (রাহ:) এর ব্যাখ্যায় বলেন, “এর মানে হচ্ছে যদি তুমি তাদের এসব করতে শোন,এবং এ বিষয়ে তাদের কোনো কথাই না বল, তাহলে তাদের সাথে থাকার ক্ষেত্রে তোমার এই অবাধ্যতাই (আল্লাহর বিধান মানার ক্ষেত্রে অবাধ্যতা) তোমাকে তাদের মত বানিয়ে দেবে। কাফের ও মুনাফিকরা যখন তাদের বোকামীপূর্ণ কাজে লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে সকল প্রকার বসাকে এই আয়াত পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।” [ তাফসিরুত তাবারী: ৫/৩৩০]

একই ভাবে নাবী (স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,” যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছে তাদের বাসস্থানে ক্রন্দনরত অবস্থা ব্যতীত প্রবেশ করো না,নয়ত তাদের উপর যে আযাব নিপতিত হয়েছিল তা তোমাদের উপরও  হবে।” [সহীহুল বুখারী,কিতাবুল মাগাযী,হা: ৪৪১৯; সহীহুল মুসলিম,কিতাবুয যুহদ,হা: ২৯৮০]

(১০) মুসলিমদের উপর  কাফেরদের কর্তৃত্ব দেয়াঃ

মুসলিমদের উপর কাফেরদের Authority হিসেবে official appointment দেয়া তাদের সাথেকৃত একপ্রকার মৈত্রী। কেননা যে কাফের ব্যক্তি মুসলিমদের উপর কর্তৃত্ব পায়,সে মুসলিমদের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হতে পারেনা,কেননা সে সর্বপ্রথম তার নিজ ধর্মের প্রতি অনুগত। সেজন্য মুসলিমদের বিরোধীতায় সে ঠিকই কাফেরদের সাহায্য করবে এবং করেও থাকে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াইকালে মুসলিম ভূখণ্ডে কর্মরত নেস্টোরিয়ান খৃষ্টানরা তাদের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের চাহিদামাফিক মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাতারদের সাহায্য করেছিল। মুসলিম স্পেনের পতনকালীন ইতিহাস ঘাটলে সেসময় খৃষ্টানরা কীভাবে গাদ্দারী করেছিল তাতো সহজেই জানা সম্ভব। এপ্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিমিল জাওযিয়্যাহ (রাহ:) একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। “একদা এক ধার্মিক সুলতানের এক খৃষ্টান প্রধানমন্ত্রী ছিল,তার নাম ছিল আবুল ফাদ্বল ইবন দুখান। সে ছিল তার জাতির সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি,কিন্তু সেইসাথে সে মুসলিমদের জন্য ছিল কাঁটার মত,আর ছিল এক প্রকাশ্য বিব্রতকর বিষয়। খৃষ্টান ও অন্যান্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে, এবং সে তাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। সে তাদের সকল প্রয়োজন পূরণ করত এবং সকল প্রকার আতিথিসেবা দিত। কোনো মুসলিমেরই তার কাছে যাবার অধিকার ছিল না,তা সে যে পদমর্যাদার ব্যক্তিই হোক না কেন। যদি কোন মুসলিম তার সাথে দেখা করতে সক্ষমও হত,তাহলে না সে তাকে সাদরে বরণ করত আর না তার প্রতি মনোযোগ দিত।তো একদিন সুলতান কলা ও বিজ্ঞানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রীয় নেতাদের একত্রিত করলেন। অবশেষে তাদের আলোচনা এই কুখ্যাত খৃষ্টানের দিকে মোড় নিল,এবং তারা তাদের অসন্তোষের ব্যাপারে সুলতানকে জানালেন।তাদের একজন মন্তব্য করলেন যে খৃষ্টানদের গণনার উপলব্ধি ক্ষমতা খুবই নিম্ন মানের কেননা তাদের মাঝে এক ও তিনকে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা আছে । আল্লাহ বলেন, “যারা বলে যে আল্লাহ তিনের এক, তারা কুফর করেছে।” { ৫:৭৩}

এবং কবি বলেছেন,. তারা কি করে করবে গণনা,. যারা এক রবকে বানিয়েছে তিনজনা?” তারপর তারা তাকে (সুলতানকে) প্রশ্ন করলেন যে তিনি কীভাবে এমন লোকের উপর আস্থাবান হলেন যে সে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে প্রয়োগের সময়ও সেই ভুল করবে না,যা সে তার ধর্মের মাঝে করেছে? হতেও তো পারে যে সে যখনই সুলতানের জন্য ৩ দিনার সংগ্রহ করেছে তখন সে এক দিনার রাষ্ট্রকে দিয়ে বাকি ২ দিনার নিজের জন্য রেখেছে এই বিশ্বাসে যে হিসাব সম্পূর্ণ ঠিক আছে।. . তারা এ বিষয়ে একমত হলেন যে সে (প্রধানমন্ত্রী) তার প্রকৃত চেহারা লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে যদিও তা তাকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে ফেলেছে। সে পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়।” [ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিমিল জাওযিয়্যাহ (রাহ:), আহকামু আহলিয যিম্মাহ,খণ্ড ১, পৃ:২৪২-২৪৪]।

(১১) কাফেরদের কাজকর্মে সন্তুষ্টি প্রকাশ করাঃ

“তাদের কাজকর্মে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা,পোশাকপরিচ্ছদে তাদের অনুকরণ করা,অথবা তাদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনো সংশোধন গ্রহন করাও তাদের সাথে এক প্রকার মৈত্রী।” [শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব ওয়া আওলাদুহ (রাহ:), মাজমু’আতুত তাওহীদ,পৃ;১১৭]

(১২) তাদের উপর  আস্থা রাখাঃ

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

 “কোন কোন আহলে কিতাব এমনও রয়েছে, তোমরা যদি তাদের কাছে বহু ধন-সম্পদ আমানত রাখ, তাহলেও তা তোমাদের যথারীতি পরিশোধ করবে। আর তোদের মধ্যে অনেক এমনও রয়েছে যারা একটি দীনার গচ্ছিত রাখলেও ফেরত দেবে না-যে পর্যন্ত না তুমি তার মাথার উপর দাঁড়াতে পারবে। এটা এজন্য যে, তারা বলে রেখেছে যে, উম্মীদের (মুসলিমদের) অধিকার বিনষ্ট করাতে আমাদের কোন পাপ নেই। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে জেনে শুনেই মিথ্যা বলে।” {সূরা আলে ইমরান:৭৫}

(১৩) কাফেরদের নৈকট্যশীল হওয়াঃ

তাদের সাথে আনন্দ উপভোগ করা,হৃদয়ের গভীর ভাব প্রকাশ করা, তাদের নৈকট্য অর্জন করা এবং তাদের সম্মান প্রদর্শন করাও তাদের সাথে কৃত মৈত্রী। [ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব ওয়া আওলাদুহ (রাহ:), মাজমু’আতুত তাওহীদ,পৃ:১১৭]

(১৪) কাফেরদের যুলমে (অত্যাচারে) তাদের সাহায্য করাঃ

কাফেরদের অন্যায়কর্মে সাহায্য কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে তাদের সাথে মৈত্রী করা হয়।কুর’আন ২টি ঘটনায় এ বিষয়টা পরিষ্কার করে দিয়েছে। প্রথমটা হচ্ছে লুত (আ:) এর স্ত্রীর ঘটনা,যে কি-না তার নগরবাসীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল,তাদের অবক্ষয়ে আমোদিত হয়েছিল এমনকি লুত (আঃ) এর অতিথিদের সংবাদও তাদের পৌঁছে দিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে নূহ (আঃ) এর স্ত্রীর ঘটনা। [ তাফসিরু ইবন কাসির:৬/২১০]

আর আল্লাহ তা’আলা উভয়কে ধবংস করে দিয়েছিলেন। কাজেই আজ আমরা যেসব মুসলিম নামধারী শাসকরূপী শোসক ও আলেমরূপী জালেমদের দেখছি,যারা কাফেরদের সাহায্যে নিবেদিতপ্রাণ, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা জরুরী। কেননা আল্লাহর আযাব নিকটবর্তী।মুসলিম কখনো কাফেরদের অপকর্মে,অন্যায়ে,জুলমে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারেনা। যে বাড়ায়, তার ঈমানই সংশয়যুক্ত।

(১৫) কাফেরদের উপদেশ চাওয়াঃ

কাফেরদের উপদেশ চাওয়া,তাদের প্রশংসা করা, তাদের সাথেকৃত একপ্রকার মৈত্রী। [শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল ওয়াহহাব (রাহঃ), মাজমু’আতুত তাওহীদ, পৃ:১১৭; রাসাইলু সা’দ ইবন আতিক, পৃ:১০১] 

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সাঈদ আল কাহতানী এর ব্যাখ্যায় বলেন, মৈত্রীর এই ধরণগুলো সাম্প্রতিককালে আবির্ভূত বহুপ্রচলিত বিষয়। আমরা ইতিমধ্যে প্রাচ্যবিদদের উত্থান,তাদের জালিয়াতি এবং নতুন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া আবিষ্কারের দাবি দেখেছি।. . এটাকে অনুসরণ করে অন্যরা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিক্রিয়াশীল, সেকেলে এবং প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষ, ইতিহাসের যাত্রায় পেছনে পড়া জাতি প্রভৃতি কালিমালেপন করে নতুন যুগ ও সভ্যতার ঘোষণা দিচ্ছে। [শাইখ মুহাম্মদ ইবন সাঈদ আল কাহতানী, আল ওয়ালা ওয়াল বারা ফিল ইসলাম, পৃ:২৪৫]

শাইখের বক্তব্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফুটে উঠেছে। আজকাল মুসলিম দেশের শাসকরা যেমন কাফেরদের পরামর্শে চলে (যেমন UNO,World Bank, IMF, USA,UK প্রভৃতি) তেমনি দেখা যায় সাধারণ মুসলিম ও আলেমরাও কাফেরদের পরামর্শ গ্রহণ করছে, তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে (যুক্তরাষ্ট্র, জিম্বাবুয়ে, ভারত প্রভৃতি দেশের একাধিক পরিচিত আলেম এ কাজে জড়িত)। এজন্য উম্মাহ এখন পথহারা। তাই সচেতনতা গড়ে তোলা আবশ্যক।

(১৬) কাফেরদের সম্মান করাঃ

তাদের সম্মান করা আর গালভরা উপাধী দেওয়া তাদের সাথেকৃত একপ্রকার মৈত্রী যা আজকাল অনেক বেকুবকে করতে দেখা যায়। অনেককে দেখা যায় বিভিন্ন মিটিং এ কাফেরদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে নিজের হাতকে বুকে স্থাপন করে। এসব কাজের মাধ্যমে মুসলিমদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার বদলে ভয় হওয়া উচিত,কেননা এভাবে তারা আল্লাহর শত্রুদের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। [শাইখ হামুদ আত তুওয়াইজিরী,তুহফাতুল ইখওয়ান,পৃ:১৯, ১ম সংস্করণ, রিয়াদ্ব]

তাদের সম্মান দেয়া বা গালভরা উপাধী দেয়া এগুলো মূলত তাদের বড় করে দেখানো। অথচ তাদের পাওয়ার কথা কেবল অবজ্ঞা ও নিন্দা। সহীহ হাদিসে এসেছে যে রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগ বাড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে নিষেধ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,”ইহুদী ও খৃষ্টানদের আগ বাড়িয়ে সালাম দিও না,তাদের কারো সাথে রাস্তায় দেখা হলে তাকে রাস্তার পাশে চলতে বাধ্য করবে।” [ সহীহু মুসলিম,কিতাবুস সালাম,হা:৫৫৫৪]

অথচ আজ আমরা দেখছি কি বাংলাদেশ কি সৌদি আরব,সব দেশের সরকারই কাফেরদের আগ বাড়িয়ে সালাম দিতে আগ্রহী। সৌদি সরকার তো মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের পদক আর উপাধীর সয়লাব করে ফেলেছেন।

(১৭) কাফেরদের সাথে বসবাস করাঃ

কাফেরদের মাঝে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করার মাধ্যমে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে তাদের সাথেকৃত মৈত্রী। (যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন মুসলিমরা যাওয়ার মাধ্যমে ওদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে, সেই সাথে তাদের tax,বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক সেবা দেয়ার মাধ্যম তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে), [শাইখ আব্দুল লাফিত ইবন আব্দির রহমান আলুশ শাইখ (রাহঃ),আর রাসাইলুল মুফিদাহ,পৃ: ৬৪; ব্র্যাকেটের ব্যাখ্যা আমার]

রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“যে মুশরিকদের সাথে মিশে যায়/একত্রিত হয়/যোগ দেয়,এবং তাদের মাঝে বসবাস করে সে তাদের মতই।” [ সুনানু আবি দাউদ,কিতাবুল জিহাদ,হা: ২৭৭৮; শাইখ আলবানীর(রাহঃ) মতে হাদিস হাসান,সহীহুল জামিঈস সগীর:২/২৭৯; হা:৬০৬২]

তিনি আরও বলেছেন,“মুশরিকদের সাথে বসবাস করও না,তাদের সাথে মিশেও যেও না/যোগ দিও না। যে কেউ তাদের সাথে বসবাস করে বা মিশে যায়/যোগ দেয় সে আমাদের কেউ নয়।”

[ইমাম হাকিম,আল মুস্তাদ্রাক:২/১৪১; ইমাম হাকিমের (রাহঃ) মতে ইমাম বুখারীর (রাহঃ) শর্তে সহীহ,ইমাম যাহাবী(রাহঃ) একমত পোষণ করেছেন],

তিনি স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “মুশরিকদের মাঝে অবস্থানরত /বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিমদের প্রতি আমি রুষ্ট।” [ইমাম ইবন হাজার আসকালানী,বুলুগুল মা’আম মিন আদিল্লাতিল আহকাম,হা: ১২৬৪, ইমাম ইবন হাজারের(রাহঃ) মতে সনদ সহীহ]

কাজেই কাফের-মুশরিকদের দেশে গিয়ে তাদের সাথে বসবাস করা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অনুচিত।

(১৮) তাদের সাথে আঁতাত করাঃ

তাদের সাথে আঁতাত করা, তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায় সাহায্য করা ,তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ,তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করা, মুসলিমদের খবরাখবর তাদের জানিয়ে দেয়া কিংবা তাদের দলে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করা,এসবই তাদের মিত্রতাসূলভ কাজ। [ড মুহাম্মাদ নাঈম ইয়াসিন, আল ঈমানঃ হাক্বীকাতুহু আরকা-নুহু নাওয়াক্বিদুহু,পৃঃ ১৪৭]

বর্তমানকালে মুসলিমরা যেসব রোগে আক্রান্ত তার মধ্যে এটা হচ্ছে অন্যতম খারাপ রোগ। এটাকে কখনো কখনো Fifth Column বা পঞ্চম বাহিনী বলা হয়ে থাকে। এটা একটা সম্পূর্ণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে , এবং শিক্ষা থেকে রাজনীতি, সরকারি অফিস,কলা,সাহিত্য,ধর্ম এবং সমাজ তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রই এ রোগে আজ আক্রান্ত।

মিসরে ইংরেজ দখলদারিত্বের অবসানের পর উস্তাদ সাইয়্যিদ কুতুব(রাহঃ) বলেছিলেন,

“সাদা ইংরেজরা চলে গেছে কিন্তু বাদামীগুলো এখনো আমাদের সাথে রয়ে গেছে”। এই বাদামী ইংরেজরা আমাদের এখনো আক্রান্ত করে চলেছে। আল্লাহর দুশমনেরা যা কখনো সম্ভব বলে কল্পনাও করেনি মুসলিমদের ওয়েস্টার্নাইজড সন্তানেরা তা বাস্তবায়ন করে দিয়েছে। কিন্তু এতে কোনো উপকার হবে না।আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এই বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে,

“অবশ্যই তাঁরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী” {সূরাহ আস সাফফাতঃ১৭১-৭৩} [শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সাঈদ ইবন আলী আল কাহতানী, আল ওয়ালা ওয়াল বারা’আ ফিল ইসলাম,পৃঃ২৪৬]

 (১৯) মুসলিমদের ঘৃণা করে ও কাফেরদের ভালোবাসেঃ

যারা দারুল ইসলাম থেকে দারুল হারবে পালিয়ে যায়, মুসলিমদের ঘৃণা করে ও কাফেরদের ভালোবাসে, তারা কাফেরদের সাথে মৈত্রী করে। [আর রিদ্দাহ বাইনাল আমসি ওয়াল ইয়াউম,পৃ: ৩৩]

(২০) কাফেরদের মতাদর্শের সমর্থন করাঃ

যারা সেক্যুলার রাজনীতি, কমিউনিসম,সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এর সমর্থক,এসব মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়, এরা সবাই কাফেরদের সাথে মৈত্রীর সম্পর্কে রাখে। [ আর রিদ্দাহ বাইনাল আমসি ওয়াল ইয়াউম,পৃ: ৪০]

এটা ছিল এই সিরিজের শেষ পর্ব। সব শেষে জানিয়ে রাখি,কাফেরদের সাথে মৈত্রী আল্লাহ তা’আলা নিষিদ্ধ করেছেন। কাজেই যে কেউ উল্লেখিত ২০ প্রকার মৈত্রীর কোনো এক প্রকারে জড়িত আছে তাদের উচিত তাওবাহ করে সংশোধিত হয়ে যাওয়া।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “মু’মিনরা মু’মিনদের বদলে কাফেরদের আওলিয়া (সাহায্যকারী, মিত্র,অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করবে না। এবং যে কেউ তা করবে সে কিছুতেই আল্লাহর সাহায্য পাবে না। (ব্যতিক্রম হচ্ছে) যদি তোমরা তাদের থেকে বিপদের আশংকা কর। এবং আল্লাহ তা’আলা নিজের সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন(তাঁর আযাব সম্পর্কে) এবং তাঁর কাছেই শেষ প্রত্যাবর্তন” { সূরা আলে ইমরান:২৮}।

আল্লাহকে বিধানদাতা মেনে নিতে সংশয় করা ঈমানের অন্তরায়ঃ

মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও পরিচালনা যাদের ওপর ন্যস্ত, তাদের ফরজ দায়িত্ব ইসলামী নীতি ও বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, হদ, কিসাস ও ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর করা, রাষ্ট্র পরিচালনার (আইন, বিচার, নির্বাহী) ক্ষেত্রে নতুন-পুরনো জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান এবং নতুন-পুরনো সব তাগুতি ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে ইসলামী বিধি-বিধানের আনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি করো, তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ না করো এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও, যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তারা তার কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখো যে কোনো কোনো পাপের কারণে আল্লাহ তাদের বিপদাপন্ন করতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী। তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠতর?’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৯-৫০)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদ-বিসংবাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে মেনে নেয়।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৬৫)

কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে শাসকদের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হচ্ছে, যেখানে কোরআন-সুন্নাহ নিশ্চুপ এবং ইজমায়ে উম্মত ও খুলাফায়ে রাশেদিনের ঐকমত্যপূর্ণ ফায়সালায় যার নজির নেই। অন্য ভাষায়, নব উদ্ভূত প্রসঙ্গগুলো, বৈধ ক্ষেত্রগুলো এবং ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদি—এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসকদের আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে এবং এর অবকাশও তাদের আছে। আর এর প্রথমটি অর্থাৎ নব উদ্ভূত প্রসঙ্গগুলোর বিধানও সমসাময়িক ফকিহদের ওপর ন্যস্ত করা অপরিহার্য।

যেসব বিষয়ে কোরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নির্দেশনা আছে, সেখানে হুবহু ওই নির্দেশনার অনুসরণ করা এবং তা কার্যকর করা জরুরি। এসব বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস ও সংকলনের কাজ হতে পারে, কিন্তু তা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তদ্রূপ সেসব থেকে বিমুখ হয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন কিংবা তার স্থলে মানবরচিত (যে-ই হোক এর রচয়িতা) আইন গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই।

হ্যাঁ, কেউ ওই শরিয়তবিরোধী কাজ করেও যদি নিজেকে অপরাধী মনে করে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি, রাসুল ও কোরআনের প্রতি, আল্লাহর বিধান ও শরিয়তের প্রতি ঈমান থাকে, আর এই উপলব্ধি থাকে যে আল্লাহর বিধান অনুসারেই রাজ্য পরিচালনা করা ফরজ, এতেই আছে কল্যাণ, কিন্তু ঈমানি কমজোরির কারণে আমি তা করতে পারছি না; তাহলে অন্তরে ঈমান থাকার কারণে এবং ওই হারাম কাজে নিজেকে অপরাধী মনে করার কারণে তার ওপর কাফির-মুনাফিকের হুকুম আরোপিত হবে না।

পক্ষান্তরে অবস্থা যদি এই হয় যে আল্লাহর বিধান তার পছন্দ নয়, ইসলামকে সে ঘর ও মসজিদে আবদ্ধ রাখতে চায়, জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামের নেতৃত্বে তার ঈমান নেই, আসমানি বিধি-বিধানের ওপর মানবরচিত আইনের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই, তার এই কর্ম ও অবস্থান সরাসরি কুফর। আল্লাহর নির্দেশ—‘হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করো তবে তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী; কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তা পেশ করো আল্লাহ ও রাসুলের কাছে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। তুমি তাদের দেখো নাই, যারা দাবি করে যে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদের ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। তাদের যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসুলের দিকে আসো, তখন মুনাফিকদের তুমি তোমার থেকে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৯-৬১)

‘তাগুতে’র অর্থ আল্লাহর ওই বিদ্রোহী বান্দা, যে আল্লাহর মোকাবেলায় নিজেকে বিধানদাতা মনে করে এবং মানুষের ওপর তা কার্যকর করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে কোনো তাগুত ব্যক্তি বা দলের বানানো আইন হচ্ছে ইসলামের বিপরীতে ভিন্ন ‘ধর্ম’, যা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়া ঈমান সাব্যস্ত হয় না।

আল্লাহকে হাকিম ও বিধানদাতা মেনে নিতেই দ্বিধা ও সংকোচ কিংবা অস্বীকৃতি থাকে, রাজনীতি ও রাজ্য চালনায় আসমানি বিধানের ‘অনুপ্রবেশ’ কেন—এই যদি হয় মনের কথা তাহলে নিশ্চিত বুঝতে হবে, সে ইসলামের গণ্ডি থেকে খারিজ। (ঈমান সবার আগে, পৃষ্ঠা : ১৪)

ইসলামের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা করাঃ

আকাইদ ও আহকামগুলোর কোনো একটিরও এমন কোনো ব্যাখ্যা করাও সরাসরি কুফর, যার দ্বারা তার প্রতিষ্ঠিত অর্থই বদলে যায়। ঈমানের বিষয়গুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থেই ঈমান আনতে হবে। নিজের পক্ষ থেকে সেগুলোর কোনো অর্থ নির্ধারণ করে, কিংবা কোনো বেদ্বিনের নব উদ্ভাবিত অর্থ গ্রহণ করে ঈমানের দাবি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও সুস্পষ্ট মুনাফেকি।

যেখানে কোনো বিধান বা বিশ্বাসের অর্থ ও মর্ম আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে অসংখ্য মুমিনের সুসংহত সূত্রে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসে এবং যাতে প্রতি যুগে মুসলিম উম্মাহর ইজমা ও ঐকমত্য বিদ্যমান থাকে, সেখানে ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ কোথায়? ওখানে ভিন্ন ব্যাখ্যার অর্থ ওই অকাট্য ও প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে অস্বীকার করা। যেমন—কেউ বলল, ‘নামাজ সত্য, কিন্তু তা পাঁচ ওয়াক্ত নয়, দুই ওয়াক্ত।’

কিংবা বলল, ‘নামাজ সত্য, কিন্তু আসল নামাজ তা নয়, যা মুসল্লিরা মসজিদে আদায় করেন; আসল নামাজ তো মনের নামাজ। যে তা আদায় করতে পারে তার দেহের নামাজের প্রয়োজন নেই।’

কিংবা বলল, ‘শরিয়ত তো প্রাচীন যুগের, আজকের উন্নতির যুগে এর সংস্কার প্রয়োজন।’

কিংবা বলল, ‘শরিয়ত মানা একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। মানলে ভালো, না মানলেও দোষ নেই।’

এসব কুফরি ব্যাখ্যা এবং এজাতীয় আরো অসংখ্য ব্যাখ্যা, যার আবরণে বেদ্বিন-মুলহিদ চক্র দ্বিনের সর্বজনবিদিত বিষয়ের অস্বীকার করে এবং সেই কুফরিকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টা করে। আল্লাহ তাআলার এই হুঁশিয়ারি এদের সবার মনে রাখা উচিত, ‘যারা আমার আয়াতকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয়। শ্রেষ্ঠ কে? যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, সে? না, যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে, সে? তোমাদের যা ইচ্ছা করো; তোমরা যা করো তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা : হা-মীম আসসাজদা, আয়াত : ৪০)।

আরো কিছু কুফরি বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডঃ

রাশিচক্র ও গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব বিশ্বাস করা : ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে রাশিচক্র ও গ্রহ-নক্ষত্রের নিজস্ব কোনো প্রভাব বা ক্ষমতা নেই। সুতরাং ভাগ্য ও শুভ-অশুভ গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে হওয়ার আকিদা রাখা শিরক। (বুখারি, হাদিস : ১২৭)।

হস্তরেখা বিচার বিদ্যার মাধ্যমে রেখা ইত্যাদি দেখে ভূত-ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ সম্পর্কে বিশ্লেষণ দেওয়া এবং এগুলো বিশ্বাস করা কুফরি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩০)।

রত্ন ও পাথর ইত্যাদির মাধ্যমে ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ সম্পর্কে বিশ্লেষণ দেওয়া ও তা গ্রহণ করা কুফরি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৩৭)।

কোনো কিছুকে কুলক্ষণ মনে করা : কোনো বস্তু বা অবস্থা থেকে কুলক্ষণ গ্রহণ করা বা কোনো সময়, দিন বা মাসকে অমঙ্গল মনে করা ভ্রান্ত বিশ্বাস। কোরআন হাদিসে প্রমাণিত নেই এরূপ কোনো লক্ষণ বিশ্বাস করা ভ্রান্ত বিশ্বাস। (বুখারি, হাদিস : ৫৭১৭)।

অমুসলিমদের উপাসনালয়ে গমন ও তাদের পূজা-অর্চনায় অংশগ্রহণ : কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিমদের উপাসনালয়ে গিয়ে তাদের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা, মন্দিরে গিয়ে মূর্তিকে সম্মান জানানো এবং পূজা-অর্চনায় অংশগ্রহণ ঈমানবিধ্বংসী কাজ। (তিরমিজি, হাদিস : ১৭৮৫; রদ্দুল মুহতার ৪/২২৩-২২৪; ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৬৯)।

পীর সাহেবকে বা মাজারে সিজদা করা : পীর সাহেব বা মাজারকে উদ্দেশ করে সিজদা বা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানানো কুফরি কাজ। (ফাতাওয়ায়ে বায্যাযিয়া ৬/৩৩৩)।

পর্দা নিয়ে উপহাস করা : শরিয়তের যেসব বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত বা ধর্মের সর্বজনবিদিত আবশ্যকীয় বিষয়, পর্দার বিধানও তার অন্তর্ভুক্ত। তা নিয়ে উপহাস করা কুফরি। (রদ্দুল মুহতার ৪/২২৩)

দাড়ি-টুপি নিয়ে উপহাস : দাড়ি-টুপির উপহাস করা মূলত নবী (সা.)-এর সুন্নত নিয়ে উপহাস। তাই উপহাসকারী ঈমানহারা হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে বায্যাযিয়া ৬/৩৩৭)।

আলেমদের অপমান ও অবজ্ঞা করা : ইলমের কারণে বা দ্বিনের ধারক-বাহক হওয়ায় উলামায়ে কেরামকে হেয় প্রতিপন্ন করা বা কটাক্ষ করা কুফরি। হ্যাঁ, পার্থিব বিষয়ে তাদের কারো কোনো ব্যক্তিগত কর্মের কারণে কটাক্ষ করার দ্বারা কাফের হবে না। (আলবাহরুর রায়েক ৫/১২৩)।

কোরআনের অবমাননা কুফরি : কোরআন শরিফের অবমাননা করা বা পুড়িয়ে ফেলা বা ছিঁড়ে ফেলা স্পষ্ট কুফরি। (আলবাহরুর রায়েক ৫/১২০)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছবি ও ব্যঙ্গচিত্র আঁকা : রাসুলে কারিম (সা.)-এর অবমাননা যেকোনোভাবেই করা মুখে হোক কিংবা ছবি এঁকে হোক কুফরি, বিশেষত নবীজি (সা.)-এর ছবি আঁকাও প্রকাশ্য নবীদ্রোহ। সুতরাং এ ধরনের বেআদব, রাসুলদ্রোহীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দায়িত্বশীলদের ওপর ফরজ। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৮৬)।

নবী কারিম (সা.)-এর পর নবুয়তের দাবিদার ও তাঁর অনুসারী কাফের : মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী, তাঁর পর আর কেউ নবী হবে না—এ কথার ওপর ঈমান রাখতেই হবে। যদি কেউ আল্লাহর ওপর ঈমান আনে কিন্তু নবী কারিম (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে না মানে সে কাফের। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৪০)।

অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব  স্থাপন করা ইসলামে নিষেধঃ

কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে আলোচনাঃ

(ক) সুরা মায়েদা ৫:৫১, “হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”

(খ) সুরা ইমরান ৩:২৮ , “মুমিনগন যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কেন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে আল্লাহ তা'আলা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন। এবং সবাই কে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।”

(গ) সুরা নিসা ৪:৮৯, “তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না।”

(ঘ) সুরা নিসা ৪:১৩৯, “যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।”

(ঙ) সুরা নিসা ৪:১৪৪, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফেরদেরকে বন্ধু বানিও না মুসলমানদের বাদ দিয়ে। তোমরা কি এমনটি করে নিজের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য দলীল কায়েম করে দেবে?”

(চ) সুরা মুমতাহিনা ৬০:১৩, “মুমিনগণ, আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। তারা পরকাল সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছে যেমন কবরস্থ কাফেররা নিরাশ হয়ে গেছে।”

(ছ) সুরা মায়েদা ৫:৫১ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ডঃ মুজিবুর রহমান অনুবাদ, তাফসীরে ইবনে কাসিরে, ৪ খণ্ড, ৮৫১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, এখানে আল্লাহ্ ইসলামের শত্রু ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন । তিনি বলেছেন তারা কখনো তোমাদের বন্ধু হতে পারে না । কেননা তোমাদের ধর্মের প্রতি তাদের হিংসা ও শত্রুতা রয়েছে । হ্যাঁ, তারা নিজেরা একে অপরের বন্ধু বটে । সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করবে তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে ।

(জ) সুরা ইমরান ৩:২৮, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না, তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ক্রটি করে না-তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসুত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।”

(ঝ) এবং সুরা ইমরান ৩:১১৯, “দেখ! তোমরাই তাদের ভালবাস, কিন্তু তারা তোমাদের প্রতি মোটেও সদভাব পোষণ করে না। আর তোমরা সমস্ত কিতাবেই বিশ্বাস কর। অথচ তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, বলে, আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয়ে যায়, তখন তোমাদের উপর রোষবশতঃ আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক। আর আল্লাহ মনের কথা ভালই জানেন।”

(ঞ) এবং সুরা ইমরান ৩:১২০ = তোমাদের যদি কোন মঙ্গল হয়; তাহলে তাদের খারাপ লাগে। আর তোমাদের যদি অমঙ্গল হয় তাহলে আনন্দিত হয় আর তাতে যদি তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে সে সমস্তই আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে।

আয়াত সমুহে পরিষ্কার হচ্ছে যে, যেহেতু অমুসলিমরা মুসলিমদের ভাল চায় না , মুসলিমদের ক্ষতিতে অমুসলিমরা খুশি হয়, ক্ষতি চায়, এবং মুসলিমদের ক্ষতি হলে অমুসলিমরা আনন্দিত হয় তাই আল্লাহ্ তাদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধু স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন ।

(ট) সুরা নিসা ৪:৮৯ আয়াতেই পরিষ্কার বলা হচ্ছে যে কাফেররা চায় মুসলিমরাও তাদের সাথে কাফের হয়ে যাক তাই আল্লাহ্ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন । তবে পরের আয়াতেই আবার আল্লাহ্ বলছেন তথা সুরা নিসা ৪:৯০, “কিন্তু যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় যে, তোমাদের মধ্যে ও তাদের মধ্যে চুক্তি আছে অথবা তোমাদের কাছে এভাবে আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং স্বজাতির সাথেও যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক। যদি আল্লাহ ইচ্ছে করতেন, তবে তোমাদের উপর তাদেরকে প্রবল করে দিতেন। ফলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত। অতঃপর যদি তারা তোমাদের থেকে পৃথক থাকে তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের সাথে সন্ধি করে, তবে আল্লাহ তোমাদের কে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ দেননি। এই আয়াত থেকে এটি বুঝা যাচ্ছে যে যদি অমুসলিমরা শান্তি চুক্তি করে তাহলে তাদের সাথে চুক্তি করা যাবে ।

(ঠ) সুরা নিসা ৪:১৩৯, এই আয়াতের ব্যাখ্যা , ডঃ মুজিবুর রহমান অনুবাদ, তাফসীরে ইবনে কাসির, ৪ খণ্ড, ৫৯৮ পৃষ্ঠাঃ হযরত আলী (রা) এই আয়াত পাঠ করে ধর্মত্যাগীদের বলতেন তওবা করে নেও ? এরপরে আল্লাহ্ বলেন এই মুনাফিকদের অবস্থা এই যে শেষে তাদের অন্তরে মোহর লেগে যায় । তাই তারা মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের বন্ধু রুপে গ্রহণ করে । এই দিকে বাহ্যত মুমিনদের সাথে মিলামিশা করে ঐ দিকে কাফেরদের সাথে বসে মুমিনদের নিয়ে উপহাস মূলক কথা বলে বেশ আনন্দ উপভোগ করে। তাদেরকে বলে আমরা মুসলমানদের বোকা বানিয়ে দিয়েছি । আসলে আমরা তোমাদেরই সঙ্গী ।

সুতরাং আয়াতটি মুনাফিক মুরতাদদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে যারা মুসলিমদের ছাড়া কাফেরদের বন্ধু রুপে গ্রহণ করেছে  এবং মুসলিমদের নিয়ে হাঁসি তামাশা করেছেন ।

(ড) সুরা নিসা ৪:১৪৪ এই আয়াতের ব্যাখ্যা , ডঃ মুজিবুর রহমান অনুবাদ, তাফসীরে ইবনে কাসিরের, ৪ খণ্ড , ৬০৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেঃ কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে, তাদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা রাখতে, তাদের সাথে সর্বদা উঠাবসা করতে, মুসলিমদের গুপ্ত কথা তাদের নিকট প্রকাশ করতে, তাদের সাথে গোপন সম্পর বজায় রাখতে আল্লাহ্ মুসলিমদের নিষেধ করেছেন।

(ঢ) সুরা মুমতাহিনা ৬০:১৩ সঠিক কথাই কুরআন বলেছে । আল্লাহ্ যে জাতির প্রতি অখুশি আমরা তাঁর বান্দা হয়ে কেন তাদের সাথে বন্ধুত্ব করব। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন কোন এক দেশের প্রধান ঘোষণা দিল যে আমি মায়ানমারের সরকারের প্রতি অখুশি কোন মানবতাবাদী যেন তাদের সাথে বন্ধুত্ব না করে কারন তারা অন্যায়ভাবে মুসলিমদের হত্যা করেছেন । আচ্ছা এখানে কি আমরা মায়ানমারের সাথে বন্ধুত্ব ছিন্ন করে ভুল করেছি? উত্তর হচ্ছে না । একই উত্তর কুরানের ক্ষেত্রে আল্লাহ্কে যারা অস্বীকার করে আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে, মুসলিমদের হত্যা করতে চায় তাদের সাথে আমরা কেন বন্ধুত্ব করব ?

(ণ) সুরা মায়েদা ৫:৫৭, “হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।  যেহেতু অমুসলিমরা ইসলাম নিয়তে হাঁসি তামাশা করে, উপহাস করে তাই এদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না ।

(ত) সুরা আন’য়াম ৬:৭০, “তাদেরকে পরিত্যাগ করুন, যারা নিজেদের ধর্মকে ক্রীড়া ও কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। কোরআন দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দিন, যাতে কেউ স্বীয় কর্মে এমন ভাবে গ্রেফতার না হয়ে যায় যে, আল্লাহ ব্যতীত তার কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী নেই এবং যদি তারা জগতের বিনিময়ও প্রদান কবে, তবু তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। একাই স্বীয় কর্মে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাদের জন্যে উত্তপ্ত পানি এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে-কুফরের কারণে।

সামাজিকতার খাতিরে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করা, চলা ফেরা ইত্যাদি জায়েজঃ

(ক) নবী মুহাম্মদ (সা) অমুসলিমদের সাথে রাষ্ট্রীয় শান্তি চুক্তি করেছেন যাকে আমরা "মদিনা সনদ" বলা হয়ঃ

(খ) জামে আত তিরমিজি, হাদিসঃ ১৯৪৩, সহিহ হাদিসঃ মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর জন্য তার পরিবারে একটি ছাগল যবেহ করা হল। তিনি এসে বললেন, তোমরা কি আমাদের ইয়াহুদী প্রতিবেশীকে (গোশত) উপহার পাঠিয়েছ? আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ

প্রতিবেশীর অধিকার প্রসঙ্গে জিবরাঈল (আঃ) আমাকে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। এমনকি আমার ধারণা হল যে, হয়ত শীঘ্রই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবে। এখানে ইহুদীদের প্রতিবেশি বলা হয়েছে ।

(গ) সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ২৫১৩, সহিহ হাদিসঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক ইয়াহুদী হতে কিছু খাদ্যদ্রব্য কিনেছিলেন এবং তার কাছে নিজের বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।

(ঘ) সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ২৬৯২, সহিহ হাদিসঃ রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-বলেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাচারী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে।

(ঙ) সুরা মুমতাহিনা ৬০:৮ = ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।

(চ) সুরা মুমতাহিনা ৬০:৯ = আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেছে এবং বহিস্কারকার্যে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তারাই জালেম।

(ছ) আল ইসাবা,৪/৩৪৭ এবং সীরাতুল মুস্তফা (সা),৩/৩০৬, আল্লামা ইদরীস কান্ধলবী (রহ): হযরত উমর (রা) বলেন সাফিয়ার এক দাসী হযরত উমর (রা) এর নিকট গিয়ে অভিযোগ করলো যে, হযরত সাফিয়া ইহুদী সংস্কৃতি অনুকরনে শনিবারকে গুরুত্ব দেন এবং ইহুদীদের সাথে ভাল আচরণ করেন । হযরত উমর (রা) , হযরত সাফিয়া (রা) থেকে বিষয়টি জানতে চাইলেন। হযরত সাফিয়া (রা) জবাবে জানালেন! যখন আল্লাহ্ তা'লা হযরত মুহাম্মদ (সা) কে শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবার দান করেছেন তখন থেকে আমি শনিবারকে আর পছন্দ করি না । অন্যদিকে আমার কিছু ইহুদী আত্মীয় আছে । আমি তাদের আত্মীয়তার হক অনুযায়ী ভাল আচরণ করি । তিনি হযরত উমর (রা) কে এই জবাব জানিয়ে পাঠালেন অন্যদিকে সেই বাদীকে জিজ্ঞেস করলেন তোমাকে আমার বিরুদ্ধে এই কাজে কে উস্কে দিয়েছে ? সে সত্যি সত্যি জবাব দিল শয়তান আমাকে প্ররোচনা দিয়েছে । হযরত সাফিয়া (রা) বললেন ঠিক আছে । আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম । - খেয়াল করুন হযরত সাফিয়া (রা) ইহুদীদের সাথে আত্মীয়তার অধিকার হিসেবে ভাল ব্যাবহার করেছেন ।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে রাসুল সাঃ এর নামে কটূক্তিকারী ও মুরতাদের শাস্তিঃ

আল্লাহ তাআলা মানুষের সৃষ্টিকর্তা। ইসলাম তাঁর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। মানুষের জন্য তিনি এই দ্বীন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ-ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা ধর্ম মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসরণ করবে, তার পক্ষ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (আলে ইমরান ৩ : ৮৫)।

আল্লাহ বলেন,

 “তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।” (সূরা কাহাফ–২৬)।

আল্লাহ আরও বলেন,

 “নির্দেশ চলে আল্লাহর” (সূরা ইউসূফ – ৬৭)।

ইজমা অনুযায়ী তাদের কুফর হচ্ছে বড় কুফর (কুফর আল আকবার),আর এ ইজমার ব্যাপারে ইবনে কাসির ও আধুনিক যুগের আহলে সুন্নাতের অনেক উলামা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ বলেন,

“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।” (সূরা মায়েদা – ৪৪)।

আল্লাহ আরও বলেন,

“আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা বিরোধীয় বিষয়কে শয়তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।” (সূরা নিসা – ৬০)।

এবং আল্লাহ বলেন,

তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? যদি চুড়ান্ত সিন্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ব্যাপারে ফয়সালা হয়ে যেত। নিশ্চয় যালেমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা আশ-শুরা ২১)।

 আর আজ আমরা এটাই ঘটতে দেখছি। আপনি দেখবেন, আদালত গুলো মানব রচিত আইন দ্বারা মানুষদের মাঝে বিচার ফয়সালা করে, যদিও কোন কোন স্থানে এর আসল গোমর ফাঁস করা হয় না (অর্থ্যাত এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা ধোঁকা ও জুলুমের আসল চরিত্র প্রকাশ পায় না)।

আসল বিষয় হচ্ছে এগুলো (তাদের আইন) কি অর্থ ও প্রকৃত অবস্থা বহন করে সেটা, তাদের দেয়া এসবের (আইন কানুনের) নাম ও এর ব্যাপারে ধোঁকাবাজি (মানুষের কাছে ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা) ধর্তব্যের বিষয় নয়।

আর শাসক ও বিচারকের ব্যাপারে বলতে হলে, যদি তারা কোন একটি বিশেষ ব্যাপারে তাদের লালসা-বাসনার চরিতার্থ হয়ে হুকুম প্রদান করে, এবং সেটি (মানব রচিত) আইন, রীতি, প্রতিষ্ঠান, প্রথা অনুযায়ী না হয়, তবে তা ‘কুফর দুনা কুফর’ (ছোট কুফর), নিম্নোক্ত হাদীস অনুযায়ীঃ

 “বিচারক তিন প্রকারেরঃ এদের দু’জন জাহান্নামে…” তারপর তিনি (সা) উল্লেখ করেন মূর্খ বিচারক এবং যে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে বিচার করে, আর এটাই আমরা সাক্ষ্য দেই। (আবু দাউদ, তিরমিযী)।

 ইবনে আব্দুল বার তাঁর ‘আত-তামহীদে’ এ ব্যাপারে ইজমার বর্ননা করেছেন যে, এগুলো হচ্ছে কবিরা গুনাহর উদাহরণ। আর এটা উমাইয়্যাহ ও আব্বাসীয়দের সময় হয়েছিলো।

মুনাফেক, মুরতাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের শাস্তিঃ

মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা এবং মদীনাতে ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা যদি নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল করে দিব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাও থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায়, যেখানেই এমন লোককে পাওয়া যাবে, ধরে ধরে একে একে হত্যা করে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলার এ নিয়ম পূর্ববর্তী লোকদের জন্যও বলবৎ ছিল। আল্লাহর নিয়মে কোনো দিন আপনি কোনো ব্যত্যয় খুজে পাবেন না। (আহযাব ৩৩ : ৬০-৬২)।

যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (মায়েদা ৬ : ৩৩)।

ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না।’ আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)।

আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দু’জনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দু’জন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।

বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)।

যখন উমর রা. এর নিকট ‘তুসতার’ নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)।

কাফেরদের শেষ পরিনতিঃ

(ক) “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রাসুল ও তাঁর কিতাবের উপর, যা তিনি নাজিল করেছেন স্বীয় রাসুলের উপর এবং সেসমস্ত কিতাবের উপর, যেগুলো নাজিল করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। যে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে।” (সুরা নিসা : আয়াত ১৩৬)।

(খ) মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,

“যারা ঈমান আনার পর কুফরী করল, তারপর তাদের কুফরী বেড়েই চলল, তাদের তাওবাহ কখনো কবুল করা হবে না এবং এ লোকেরাই পথভ্রষ্ট। যারা কুফরী করে এবং সেই কাফির অবস্থায়ই মারা যায়,তাদের কেউ পৃথিবী-ভরা স্বর্ণও বিনিময়স্বরুপ প্রদান করতে চাইলে তা তার কাছ থেকে কখনো গ্রহন করা হবে না। এরাই তারা, যাদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি রয়েছে এবং তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” (সূরা: আলে- ইমরান, আয়াত: ৯০-৯১)।

“আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কী যখন তাদের কারো মাথার ওপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে: আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।” (সূরা: আন-নিসা,আয়াত: ১৮)।

(গ) আয়িশাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে-

“রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু জুন‘আন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি একজন বড় অতিথী সেবক ও গোলাম আজাদকারী লোক ছিল। তার এ সওয়াব কোনো কাজে আসবে কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘না, কেননা সে সারা জীবন একবারও ‘হে আমার প্রভু! কিয়ামতের দিন আমাকে ক্ষমা করুন বলেনি”। (মুসলিম-১/১৯৬, আহমাদ-৬/১২০, হাকিম-২/৪০৫. হিলাইয়াতুল আওলিয়া-৩/২৭৮,সহীহ- ২৪৯)।

(ঘ) “নিশ্চয়ই যারা কাফির, যদি তাদের কাছে বিশ্বের সমস্ত সম্পদও থাকে এবং এর সঙ্গে সমপরিমাণ আরো থাকে  এবং এগুলোর বিনিময়ে কেয়ামতের শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে চায়, তবুও এই সম্পদ তাদের থেকে কবুল করা হবে না, আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা: আল মায়িদাহ,আয়াত: ৩৬)।

(ঙ) “কারো নিকট হতে বিনিময় গৃহীত হবে না, সুপারিশও ফলপ্রদ হবে না।” (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ১২৩)।

(চ) “নিশ্চয় সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল না।’(সূরা: আল হা-ক্বক্বাহ,আয়াত: ৩৩)।

(ছ) “নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছেন। তথায় তারা অনন্তকাল থাকবে। সেখানে তারা কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমণ্ডল ওলট-পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে,হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসূলের আনুগত্য করতাম।” (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ৬৪-৬৬)।

(জ) “দ্বীন (গ্রহণ)-এর বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। হেদায়েতের পথ গোমরাহী থেকে পৃথকরূপে স্পষ্ট হয়ে গেছে।” (বাকারা ২ : ২৫৬)।

(ঝ) “তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (বাকারা ২ : ২০৮)।

“আল্লাহ এমন একটা কওমকে কীভাবে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করতে পারেন; যে সমাজ একবার ঈমান আনার পর, রাসূলকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ এসে যাওয়ার পর আবার কাফের হয়ে যায়? অবস্থা এই যে, আল্লাহ এমন জালিম সমাজকে কখনো হেদায়েতের পথ দেখান না। এই যে লোকগুলো, এদের কর্মফল হলো, এদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ! তবে এর পরে যারা তওবা করবে আর (নিজেদেরকে) সংশোধন করে নেবে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। পরন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মহাক্ষমাশীল করুণাময়। (কিন্তু) যারা একবার ঈমান আনার পর আবার কাফের হয়ে যায় এবং তাদের কুফরী আচরণ আরও বেড়ে চলে, তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না।” (আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৯০)।

(ঞ) “আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে।” (বাকারা ২ : ২১৭)।

(ট) “নিশ্চয় যারা কুফরি করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সব লোকের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, ফেরেশতাদের অভিশাপ এবং সব মানুষের অভিশাপ। এরা চিরকাল এ অভিশাপের মাঝেই থাকবে। তাদের উপর থেকে আজাব কখনও হালকা করা হবে না বরং এরা বিরামও পাবে না।” (সুরা বাকারা : আয়াত ১৬১-১৬২)।

(ঠ) “যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতিত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।” (সুরা নাহল : আয়াত ১০৬)।

(ড) “যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কিছু বিষয় বিশ্বাস করি এবং কিছু বিষয় অস্বীকার করি আর এরই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (আল্লাহ বলেন) তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আজাব।” (সুরা নিসা : আয়াত ১৫০-১৫১)।

(ঢ) “যারা কুফরি করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর সামনে কখনও কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০)।

(ণ) “যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে এবং অন্যায়ভাবে পয়গম্বরগণকে হত্যা করে আর সেসব লোককে হত্যা করে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। এরাই হলো সেসব লোক যাদের সব আমল দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোনো সাহায্যকারীও নেই।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ২১-২২)।

(প) আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দু’জনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দু’জন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।

বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)।

(ফ) যখন উমর রা. এর নিকট ‘তুসতার’ নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)।

সালাত পরিত্যাগ করলে সে কাফেরঃ যদিও সে মুসলমান-

বিস্তারিত আলোচনাঃ

নিশ্চয় এই বিষয়টি অত্যন্ত জ্ঞানপূর্ণ বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম বড় একটি বিষয়, যার ব্যাপারে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল যুগের আলিমগণ বিতর্ক বা মতবিরোধ করেছেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন

“সালাত বর্জনকারী মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কার হয়ে যাওয়ার মত কাফির, সে তাওবা করে সালাত আদায় করা শুরু না করলে তাকে হত্যা করা হবে।”

আর ইমাম আবূ হানিফা মালেক ও শাফেঈ রহ. বলেন: “সে ফাসিক হবে কাফির হবে না।”

অতঃপর তাঁরা (তিনজন) তার শাস্তির ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন; ইমাম মালেক ও শাফে‌য়ী রহ. বলেন: “তাকে হদ তথা শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তি হিসেবে হত্যা করা হবে।” আর ইমাম আবূ হানিফা রহ. বলেন: “তাকে তা‘যীরী তথা শাসনমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে হত্যা করা হবে না।”

আর এই মাসআলাটি (বিষয়টি) যখন একটি বিরোধপূর্ণ মাসআলা তখন আবশ্যক হলো এটাকে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর সামনে পেশ করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন তার ফয়সালা তো আল্লাহরই কাছে।” [সূরা আশ-শুরা আয়াত: ১০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

“অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ্ ও রাসূলের নিকট যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।” [সূরা আন-নিসা আয়াত: ৫৯]

তাছাড়া মতভেদকারীগণের একজনের কথাকে অপরজনের জন্য দলীল হিসেবে পেশ করা যায় না। কারণ তাদের প্রত্যেকেই নিজের মতকে সঠিক মনে করে এবং তাদের একজন মত গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে অপরজনের মতের চেয়ে অধিক উত্তম নয়। ফলে এই ব্যাপারে তাদের মাঝে মীমাংসা করার মত একজন মীমাংসাকারীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে; আর সেই মীমাংসাকারী হলো আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ।

আর আমরা যখন এই বিরোধটিকে কুরআন ও সুন্নাহর নিকট উপস্থাপন করব তখন আমরা দেখতে পাব যে কুরআন ও সুন্নাহর মত শরী‘য়তের উভয় উৎসই সালাত বর্জনকারী ব্যক্তির কাফির হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা ও প্রমাণ পেশ করে যা এমন মারাত্মক পর্যায়ের কুফুরী যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ (বহিষ্কার) করে দেয়।

প্রথমত: আল-কুরআন থেকে দলীল-প্রমাণ:

আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাওবায় বলেন:

“অতএব তারা যদি তাওবা করে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে দ্বীনের মধ্যে তারা তোমাদের ভাই।” [সূরা আত-তাওবাহ আয়াত: ১১] আর সূরা মারইয়ামে তিনি বলেন:

“তাদের পরে আসল অযোগ্য উত্তরসূরীরা তারা সালাত নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুবর্তী হলো। কাজেই অচিরেই তারা ক্ষতিগ্রস্ততার সম্মুখীন হবে। কিন্তু তারা নয় যারা তাওবা করেছে ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে; তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।” [সূরা মারইয়াম আয়াত: ৫৯-৬০]

সুতরাং সূরা মারইয়াম থেকে (আলোচ্য প্রবন্ধে) উল্লিখিত দ্বিতীয় আয়াত সালাত বর্জনকারীর কুফুরী এইভাবে প্রমাণ করে যে আল্লাহ তা‘আলা সালাত বিনষ্টকারী ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণকারীদের সম্পর্কে বলেন

“কিন্তু তারা নয় যারা তাওবা করেছে ঈমান এনেছে।” [সূরা মারইয়াম আয়াত: ৬০] সুতরাং এর দ্বারা বুঝা যায় যে তারা সালাত বিনষ্ট করার সময় এবং মনের কামনা-বাসনার অনুসরণ কালে মুমিন ছিল না।

আর সূরা তাওবা থেকে (আলোচ্য প্রবন্ধে) উল্লিখিত প্রথম আয়াত সালাত বর্জনকারীর কুফুরী এইভাবে প্রমাণ করে যে এতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এবং মুশরিকদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সাব্যস্ত করার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করেছেন:

১. শির্ক থেকে তাওবা করে ফিরে আসা

২. সালাত আদায় করা ও

৩. যাকাত প্রদান করা।

সুতরাং তারা যদি শির্ক থেকে তাওবা করে কিন্তু সালাত আদায় না করে এবং যাকাত প্রদান না করে তাহলে তারা আমাদের ভাই নয়। আর তারা যদি সালাত আদায় করে কিন্তু যাকাত প্রদান না করে তবুও তারা আমাদের ভাই নয়।

আর দীনী ভ্রাতৃত্ব তখনই পুরোপুরিভাবে নির্বাসিত হয় যখন মানুষ দীন থেকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ হয়ে যায়। ফাসেকী ও ছোট কুফুরীর কারণে দীনী ভ্রাতৃত্ব খতম হতে পারে না।

তুমি কি দেখ না যে হত্যার প্রসঙ্গে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার বাণী যাতে তিনি বলেছেন:

“তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য।” [সূরা আল-বাকারা আয়াত: ১৭৮] এখানে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম বড় ধরণের কবীরা গুনাহ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন তাকে লা‘নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।” [সূরা আন-নিসা আয়াত: ৯৩]

অতঃপর তুমি দেখ আল্লাহ তা‘আলার ঐ বাণীর দিকে যাতে মুমিনগণের দুই দলের মধ্যে সংঘটিত পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন:

“আর মুমিনদের দু’দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি তারা ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে আপোষ মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালবাসেন। মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও।” [সূরা আল-হুজুরাত আয়াত: ৯-১০] সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা সংস্কারপন্থী গ্রুপ এবং পরস্পর যুদ্ধরত দুই দলের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অবশিষ্ট থাকার কথা ঘোষণা করেছেন অথচ মুমিন ব্যক্তির সাথে লড়াই করা কুফুরী কাজের অন্তর্ভুক্ত যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম বুখারী রহ. এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ কাজ এবং তার সাথে মারামারি করা কুফুরী।”[1] কিন্তু তা এমন কুফুরী যা তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ করে না। কেননা যদি তা মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিষ্কারকারী হত তাহলে তার সাথে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক অটুট থাকত না অথচ উক্ত আয়াতটি মারামারিতে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও ঈমানী ভ্রাতৃত্ব বহাল থাকা প্রমাণ করে।

আর এর দ্বারা বুঝা গেল যে সালাত ত্যাগ করা এমন কুফুরী কাজ যা সালাত বর্জনকারী ব্যক্তিকে দীন ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়; কেননা তা যদি ফাসেকী অথবা যেনতেন নিম্নমানের কুফুরী হত তাহলে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব সালাত বর্জনের কারণে নির্বাসিত হয়ে যেত না যেমনিভাবে তা (ঈমানী ভ্রাতৃত্ব) বিলুপ্ত হয়ে যায় না মুমিনকে হত্যা করা এবং তার সাথে মারামারি করার কারণে।

আর যদি কোনো প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে যে আপনারা কি যাকাত আদায় না করার কারণে কেউ কাফির হয়ে যাবে বলে মনে করেন? যেমনটি সূরা তাওবার আয়াত থেকে বুঝা যায়।

জবাবে আমরা বলব: কতিপয় আলিমের মতে যাকাত আদায় না করা ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে; আর এটা ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. এর থেকে বর্ণিত দু‘টি মতের একটি।

কিন্তু আমাদের নিকট জোরালো মত হলো সে কাফির হবে না তবে তাকে ভয়ানক শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবের মধ্যে আলোচনা করেছেন আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন তাঁর সুন্নাহর মধ্যে। তন্মধ্যে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে আছে তাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত দানে বিরত থাকা ব্যক্তির শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন আর সেই হাদীসের শেষাংশে রয়েছে:

“অতঃপর তাকে তার পথ দেখানো হবে- হয় জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে।” ইমাম মুসলিম রহ. হাদীসটি “যাকাতে বাধাদানকারীর অপরাধ” (باب إِثْمِ مَانِعِ الزَّكَاةِ) নামক পরিচ্ছেদে দীর্ঘ আকারে বর্ণনা করেছেন।”[2] আর এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে সে কাফির হবে না। কারণ সে যদি কাফির হয়ে যেত তাহলে তার জন্য জান্নাতে যাওয়ার কোনো পথ থাকত না।

অতএব এই হাদীসটির সরাসরি বক্তব্য সূরা তাওবার আয়াতের ভাবার্থের ওপর প্রাধান্য পাবে। কারণ সরাসরি বক্তব্য ভাবার্থের ওপর প্রাধান্য পায় যেমনটি জানা যায় ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতিমালার মধ্যে।

দ্বিতীয়ত: আস-সুন্নাহ থেকে দলীল-প্রমাণ:

(১) নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

 “কোনো লোক এবং শির্ক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত পরিত্যাগ করা।” ইমাম মুসলিম রহ. হাদীসটি কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ে জাবির ইবন আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।”[3]

(২) বুরাইদা ইবন হোসাইব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

 “আমাদের ও তাদের মাঝে অঙ্গীকার বা চুক্তি হলো সালাতের সুতরাং যে ব্যক্তি তা বর্জন করল সে কুফুরী করল।”[4]

আর এখানে কুফর (الكفر) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন কুফুরী যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত (সম্প্রদায়) থেকে বের করে দেয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিন ও কাফিরদের মাঝে সালাতকে পৃথককারী সূচক বানিয়ে দিয়েছেন আর এটা সকলের নিকট সুবিদিত যে কাফির মিল্লাত এবং মুসলিম মিল্লাত একে অপরের বিপরীত। ফলে যে ব্যক্তি এই (সালাতের) অঙ্গীকার পূরণ করবে না সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

(৩) আর সহীহ মুসলিমের মধ্যে উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত আছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“অচিরেই এমন কতক আমীরের (নেতার) উদ্ভব ঘটবে তোমরা তাদের কিছু কর্মকাণ্ডের ভালো-মন্দ চিনতে পারবে আর কিছু কর্মকাণ্ড অপছন্দ করবে; সুতরাং যে ব্যক্তিস্বরূপ চিনে নিল (কোনোরূপ সন্দেহে পতিত না হয়ে তা থেকে বাঁচার জন্য কোনো উপায় বেছে নিল) সে মুক্তি পেল; আর যে ব্যক্তি তাদেরকে অপছন্দ করল সে (গুনাহ থেকে) নিরাপদ হলো; কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের পছন্দ করল এবং অনুসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো)। সাহাবীগণ জানতে চাইলেন: আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব না? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলরেন: না যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।”[5]

(৪) আর সহীহ মুসলিমের মধ্যে ‘আউফ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“তোমাদের সর্বোত্তম নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ভালবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে, আর তারা তোমাদের জন্য দো‘আ করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দো‘আ কর। পক্ষান্তরে তোমাদের নিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তারাই যাদেরকে তোমরা ঘৃণা করা এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, আর তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হলো হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাদেরকে তরবারী দ্বারা প্রতিহত করব না? তখন তিনি বললেন: না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম রাখবে।”[6]

সুতরাং এই শেষ দু‘টি হাদীসের মধ্যে একথা প্রমাণিত হয় যে নেতাগণ যখন সালাত কায়েম করবে না তখন তাদেরকে তরবারি দ্বারা প্রতিহত করা আবশ্যক হবে, আর ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা যুদ্ধ করা বৈধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা প্রকাশ্য কুফুরীতে লিপ্ত হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নিকট আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। কেননা ওবাদা ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ডাকলেন তারপর আমরা তাঁর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করলাম, তিনি তখন আমাদেরকে যে শপথ গ্রহণ করান তার মধ্যে ছিল: আমরা আমাদের সুখে ও দুঃখে বেদনায় ও আনন্দে এবং আমাদের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিলেও পূর্ণঙ্গরূপে শোনা ও মানার ওপর বায়‘আত করলাম। আরো (বায়‘আত করলাম) আমরা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হব না। তিনি বলেন: তবে যদি তোমরা এমন সুস্পষ্ট কুফুরী দেখ যে বিষয়ে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান তাহলে ভিন্ন কথা।”[7]

আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায়- তাদের সালাত বর্জন করা সুস্পষ্ট কুফুরী বলে বিবেচিত হবে যার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে তরবারী নিয়ে লড়াই করার বিষয়টিকে শর্তযুক্ত করে দিয়েছেন যে ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে আমাদের জন্য জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে।

আর কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে কোথাও বর্ণিত হয় নি যে, সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি কাফির নয় অথবা সে মুমিন; বড়জোর এই ব্যাপারে (কুরআন ও সুন্নায়) এমন কতগুলো ভাষ্য এসেছে যা তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের ফযীলত এবং এর সাওয়াবের প্রমাণ বহন করে, আর সে তাওহীদ হলো: এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তবে এ ভাষ্যগুলোরও রয়েছে কয়েকটি অবস্থা:

* সে সকল ভাষ্যে রয়েছে এমন কিছু শর্ত যে শর্তের কারণেই সালাত ত্যাগ করা যায় না,

* অথবা তা এমন এক বিশেষ অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে বর্ণিত হয়েছে যাতে সালাত ত্যাগ করার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মা‘যুর বা অপারগ বলা যেতে পারে,

*অথবা ভাষ্যগুলো ব্যাপক (عام) যা সালাত বর্জনকারী কাফির হওয়ার দলীলসমূহের ওপর প্রযোজ্য হবে। কারণ, সালাত বর্জনকারী কাফির হওয়ার দলীলসমূহ বিশেষ (خاص) দলীল, আর খাস (বিশেষ দলীল) ‘আমের (ব্যাপকতাপূর্ণ দলীলের) ওপর অগ্রাধিকার পাবে।

সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি বলে: এই কথা বলা কি সঠিক হবে না যে যেসব দলীল সালাত বর্জনকারী কাফির হওয়া প্রমাণ করে সেগুলো ঐ ব্যক্তির বেলায় প্রযোজ্য হবে যে ব্যক্তি সালাতের আবশ্যকতাকে অস্বীকারকারী হিসেবে তা বর্জন করে?

জবাবে আমরা বলব: এটা সঠিক নয়। কারণ, তা দু’টি কারণে নিষিদ্ধ:

প্রথম কারণ: সেই গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে উপক্ষো করা যাকে শরী‘আত প্রবর্তক গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তার সাথে বিধান সংশ্লিষ্ট করেছেন।

কারণ শরী‘আত প্রবর্তক সালাত ত্যাগ করাকেই কুফুরী বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যা, সালাত অস্বীকার করার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের। তাছাড়া সালাত প্রতিষ্ঠার ওপর দীনী ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়, সালাতের আবশ্যকতার স্বীকৃতির প্রদানের ওপর নয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সুতরাং তারা যদি তাওবা করে এবং সালাতের আবশ্যকতাকে স্বীকার করে..., আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেন, নিঃসন্দেহে বান্দা এবং শির্ক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো সালাতের আবশ্যকতাকে অস্বীকার করা অথবা তিনি বলেন নিঃসন্দেহে আমাদের ও তাদের মাঝে অঙ্গীকার বা চুক্তি হলো সালাতের আবশ্যকতার স্বীকৃতি প্রদান করা। সুতরাং যে ব্যক্তি তার আবশ্যকতাকে অস্বীকার করল সে কুফুরী করল[8]।

আর যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্য এটা[9]ই হতো তাহলে তা থেকে অন্য দিকে প্রত্যাবর্তন করাটা সেই কথার পরিপন্থি হত যে বক্তব্য আল-কুরআনুল কারীম নিয়ে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আমরা প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি।” [সূরা আন-নাহল আয়াত: ৮৯] তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“আর আমরা তোমার প্রতি যিকির (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিতে পার সেসব বিষয় যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল।” [সূরা আন-নাহল আয়াত: ৪৪]

দ্বিতীয় কারণ: এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় রাখা যার ওপর শরী‘আত প্রবর্তক কোনো বিধানের ভিত্তি রাখেন নি।

কেননা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করা কুফুরী, যদি না সে ব্যক্তির পক্ষে এ বিষয়টি না জানার কোনো গ্রহণযোগ্য ওযর না থাকে চাই সে সালাত আদায় করুক অথবা ত্যাগ করুক। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে এবং তার নির্ধারিত শর্তাবলী আরকান (ফরয) ওয়াজিব ও মুস্তাহাবসমূহসহও যথাযথভাবে আদায় করে কিন্তু সে তার (সালাতের) ফরয হওয়ার বিষয়টিকে বিনা ওজরে অস্বীকার করে তাহলে সে সালাত বর্জন না করা সত্ত্বেও কাফির বলে বিবেচিত হবে।

সুতরাং এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেল যে উপরে বর্ণিত (সালাত ত্যাগকারী কাফের হওয়া বিষয়ক) শরী‘য়তের ভাষ্যসমূহকে যে ব্যক্তি সালাতের অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করে- তার জন্য নির্ধারণ করা সঠিক নয়; বরং সঠিক কথা হলো (এগুলোকে সালাত পরিত্যাগকারীর ওপর প্রয়োগ করা হবে সে হিসেবে) সালাত বর্জনকারী এমন কাফির হিসেবে গণ্য হবে যা তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়, যেমনটি পরিষ্কারভাবে এসেছে ইবন আবি হাতিম কর্তৃক তাঁর সুনান বর্ণিত হাদীসের মধ্যে তিনি ‘উবাদা ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন:

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এই বলে উপদেশ দিয়েছেন: তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত বর্জন করো না। কারণ, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত বর্জন করবে সে ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাবে।”

আর আমরা যদি উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহকে (যাতে সালাত পরিত্যাগকারীকে কাফের বলা হয়েছে) সালাতের আবশ্যকতা অস্বীকারকারীর জন্য নির্ধারণ করি তাহলে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের মধ্যে বিশেষভাবে সালাতকেই উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। কারণ, এই বিধান সাধারণভাবে যাকাত সাওম ও হজকেও শামিল করে। কেননা যে ব্যক্তি এগুলোর মধ্যে কোনো একটিরও আবশ্যকতাকে অস্বীকারকারী হয়ে তা বর্জন করবে সে কাফির হয়ে যাবে যদি না সেটা না জানার ব্যাপারে তার কোনো ওযর থাকে[10]।

আর যেমনিভাবে সালাত বর্জনকারীর কাফির হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও হাদীসের দলীলসম্মত ঠিক তেমনিভাবে তা জ্ঞান ও যুক্তিসম্মতও। কারণ, এমন সালাত ত্যাগ করার পরেও কিভাবে কোনো ব্যক্তির ঈমান থাকতে পারে যে সালাত হচ্ছে দীনের খুঁটি? যার ফযীলত ও মাহাত্মের বর্ণনা এমনভাবে হয়েছে যাতে প্রত্যেক জ্ঞানী মুমিন ব্যক্তি তা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে অগ্রসর হবে, আর সেই সালাত বর্জন করার অপরাধে এমন শাস্তির হুমকি এসেছে যাতে প্রত্যেক জ্ঞানী মুমিন ব্যক্তি তা বর্জন ও বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে। অতএব, এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সালাত বর্জন করলে বর্জনকারীর ঈমান অবশিষ্ট থাকতে পারে না।

তবে কোনো প্রশ্নকর্তা যদি প্রশ্ন করে বলে: সালাত বর্জনকারীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কুফর (الكفر) শব্দটির অর্থ কি কুফরে মিল্লাত (দীন অস্বীকার) না হয়ে কুফরে নিয়ামত (নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা) হওয়ার সম্ভাবনা রাখে না? অথবা তার অর্থ কি বৃহত্তর কুফুরী না হয়ে ক্ষুদ্রতর কুফুরী হতে পারে না? তা কি হতে পারে না নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীর মত যাতে তিনি বলেছেন:

“দু’টি স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে যে দু’টি কুফর বলে গণ্য: (১) বংশের প্রতি কটাক্ষ করা এবং (২) উচ্চস্বরে বিলাপ করা।”[11] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:

“মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ কাজ এবং তার সাথে মারামারি করা কুফুরী।”[12] অনুরূপ আরও অন্যান্য হাদীস।

তার জবাবে আমরা বলব: সালাত ত্যাগকারীর কুফুরীর বিষয়ে এ ধরণের সম্ভাবনা ও উপমা প্রদান কয়েকটি কারণে সঠিক নয়:

প্রথমত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতকে কুফর ও ঈমানের মাঝে এবং মুমিনগণ ও কাফিরদের মাঝে পৃথককারী সীমানা বানিয়ে দিয়েছেন। আর সীমানা তার অন্তর্ভুক্ত এলাকাকে অন্যান্য ক্ষেত্রে থেকে পৃথক করে এবং এক এলাকাকে অন্য এলাকা থেকে বের করে দেয়। কারণ, নির্ধারিত ক্ষেত্র দু’টির একটি অপরটির বিপরীত যাদের একটি অপরটির মধ্যে অনুপ্রবেশ করবে না।

দ্বিতীয়ত: সালাত হচ্ছে ইসলামের রুকনসমূহের (স্তম্ভসমূহের) একটি অন্যতম রুকন। কাজেই সালাত বর্জনকারীকে যখন কাফির বলা হয়েছে তখন পরিস্থিতির দাবি করে যে সেই কুফুরী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। কারণ, সে ব্যক্তি ইসলামের রুকনসমূহের একটি রুকনকে ধ্বংস করল; কিন্তু যে ব্যক্তি কুফুরী কর্মসমূহের কোন কাজ করে ফেলল তার ওপর কুফর শব্দের প্রয়োগ করার বিষয়টি এর (সালাতের বিধানের) চেয়ে ভিন্ন রকম।

তৃতীয়ত: এই ব্যাপারে অনেক দলীল রয়েছে যা থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে সালাত বর্জনকারী এমন কুফুরীতে আক্রান্ত যা তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। তাই কুফুরীর সেই অর্থই নেয়া আবশ্যক যা দীললসমূহ প্রমাণ করে যেন এসব দলীল একে অপরের অনুকুলে এবং সম্মিলিতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

চতুর্থত: কুফর (الكفر) শব্দের ব্যাখ্যা বা প্রকাশ-রীতি বিভিন্ন রকম; সুতরাং সালাত বর্জনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“বান্দা এবং শির্ক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত পরিত্যাগ করা।”[13] এখানে আল-কুফর (الكفر) শব্দটি আলিফ লাম (ال) যোগে ব্যবহার করা হয়েছে যা প্রমাণ করে যে কুফরের অর্থ হচ্ছে প্রকৃত কুফুরী। কিন্তু আলিফ লাম (ال) ছাড়া কুফর (كفر) শব্দটি যখন নাকেরা (অনির্দিষ্ট) হিসেবে ব্যবহৃত হয় অথবা কাফারা (كَفَرَ ) শব্দটি ফেল (ক্রিয়া) হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন তা প্রমাণ করে যে এটা কূফরীর অন্তর্ভুক্ত অথবা সে এই কাজের ক্ষেত্রে কুফুরী করেছে; আর সেই সাধারণ কুফুরী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ (বের) করে দেয় না।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. (আস-সুন্নাতুল মুহাম্মাদীয়া প্রকাশনা কর্তৃক মুদ্রিত) ‘ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম’ (اقتضاء الصراط المستقيم) নামক গ্রন্থের ৭০ পৃষ্ঠায় এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,

“দু’টি স্বভাব মানুষের মাঝে রয়েছে যে দু’টি তাদের মধ্যে কুফর বলে গণ্য।”[14]

ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: «هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ» “তাদের মধ্যকার স্বভাব দু’টি কুফুরী” এর অর্থ হলো: মানুষের মধ্যে বিদ্যমান এই স্বভাব দু’টি কুফুরী; সুতরাং এখানে প্রকৃতপক্ষে স্বভাব দু’টি কুফুরীর অর্থ হলো কাজ দু’টি কুফুরী যা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে যে কোন ব্যক্তির মধ্যে কুফুরীর কোনো শাখা পাওয়া যাবে সে সম্পূর্ণরূপে কাফির হয়ে যাবে যতক্ষণ না তার মধ্যে প্রকৃত কুফুরী বিদ্যমান থাকবে। যেমনিভাবে যে কোনো ব্যক্তির মধ্যে ঈমানের কোনো একটি শাখা পাওয়া গেলে তাতেই সেই মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে তার মধ্যে মূল ঈমান না আসবে। আর আলিফ লাম (ال) দ্বারা নির্দিষ্টভাবে যে কুফর (كفر ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি:

“বান্দা এবং শির্ক অথবা কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে শুধু সালাত বর্জন করা।”[15] (এর মধ্যকার ال সম্বলিত ‘আল-কুফর’ শব্দ) এবং যে হাঁ সূচক বাক্যে আলিফ লাম (ال) ব্যতীত অনির্দিষ্টভাবে যে কুফর (كفر) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে- এই দু’টির মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

অতঃপর যখন উপরোক্ত দলীলসমূহের দাবি অনুযায়ী একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে শরী‘আতসম্মত কোনো ওযর ব্যতীত সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেওয়ার মত কাফির হিসেবে গণ্য হবে তখন সে মতটিই সঠিক যা ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. অবলম্বন করেছেন; আর এটা ইমাম শাফেয়ী রহ. এর দু’টি মতের অন্যতম একটি মত যেমনটি ইবন কাছীর রহ. এই আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“তাদের পরে আসল অযোগ্য উত্তরসূরীরা তারা সালাত নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুবর্তী হলো।” [সূরা মারইয়াম আয়াত: ৫৯] আর ইবনুল কাইয়্যেম রহ. ‘কিতাবুস সালাত’ (كتاب الصلاة) এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে এটা হচ্ছে ইমাম শাফেঈ রহ. এর দু’টি মতের অন্যতম, আর ইমাম ত্বাহাভী রহ. তা স্বয়ং ইমাম শাফেঈ থেকেই বর্ণনা করেছেন।

আর এই মতামত বা বক্তব্যের ওপরই অধিকাংশ সাহাবী একমত ছিলেন, এমনকি অনেকে এর ওপর সাহাবীদের ইজমা সংঘটিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবন শাকীক রাহেমাহুল্লাহ বলেন:

“মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সালাত ব্যতীত অন্য কোনো আমল বর্জন করাকে কুফুরী বলে মনে করতেন না।” (ইমাম তিরমিযী ও হাকেম রহ. হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাকেম হাদীসটিকে বুখারী ও মুসলিমের শর্তের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন)।[16]

প্রখ্যাত ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়িয়াহ রহ. বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে যে সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি কাফির; আর অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আমাদের এই যুগ পর্যন্ত আলিমগণের মতে বিনা ওযরে সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি সালাতের সময় অতিক্রম করলে কাফির বলে গণ্য হবে।”

ইমাম ইবন হাযম রহ. উল্লেখ করেন যে (সালাত বর্জনকারী কাফির) একথা উমর ফারুক আবদুর রহমান ইবন আউফ মুয়ায ইবন জাবাল আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে; অতঃপর তিনি বলেন: “আমরা এসব সম্মানিত সাহাবীগণের মধ্যে কোন মতবিরোধ পাইনি।” তাঁর থেকে বর্ণনাটি আল্লামা মুনযেরী ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ (الترغيب و الترهيب) এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন।[17] তিনি আরও কয়েকজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেন। যেমন, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস জাবির ইবন আবদিল্লাহ এবং আবূদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম।

তারপর তিনি বলেন উপরোক্ত সাহাবীগণ ব্যতীত অন্যান্যদের মধ্যে যারা তা বলেছেন তারা হলেন: ইমাম আহম্মদ ইবন হাম্বল ইসহাক ইবন রাহওয়িয়াহ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক নাখ‘য়ী হাকাম ইবন উতাইবা আইয়ুব সাখতাইয়ানী আবূ দাউদ আত-তায়ালসী আবূ বকর ইবন আবি শাইবা যুহাইর ইবন হারব রহ. প্রমূখ।

অতঃপর কোনো প্রশ্নকর্তা যদি প্রশ্ন করে বসে: সেসব দলীলের কী জবাব হবে যা ঐসব লোকজন পেশ করে থাকে যাদের মতে: সালাত বর্জনকারী কাফির নয়?

তার জবাবে আমরা বলব: (তারা যেসব দলীল পেশ করে থাকে) তাতে একথা নেই যে সালাত বর্জনকারী কাফির হয় না অথবা সে মুমিন থেকে যায় অথবা সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না অথবা সে জান্নাতের মধ্যে থাকবে অথবা অনুরূপ কিছু।

আর যে ব্যক্তি এসব দলীল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করবে তাহলে সে দেখতে পাবে যে এসব দলীল পাঁচ প্রকারের বাইরে নয় যার মধ্যে একটি প্রকারও সেসব দলীল ও প্রমাণের পরিপন্থী নয় যা প্রমাণ করে যে সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি হচ্ছে কাফির।

প্রথম প্রকার: কতিপয় দুর্বল ও অস্পষ্ট হাদীস দ্বারা তারা নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তা কোনো ফলদায়ক নয়।

দ্বিতীয় প্রকার: এমন দলীল যার সঙ্গে প্রকৃত মাসআলার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর মাধ্যমে দলীল পেশ করেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এর ছেয়ে নিম্ন পর্যায়ের অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করেন।” [সূরা আন-নিসা আয়াত: ৪৮] কেননা আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীতে উল্লিখিত ﴿مَا دُونَ ذَٰلِكَ﴾ এর অর্থ হলো: শির্ক থেকে ছোট গুনাহ; তার অর্থ এই নয় যে ‘শির্ক ব্যতীত অন্য সকল গুনাহ’। এই অর্থের স্বপক্ষে দলীল হলো: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংবাদ দিয়েছেন তা মিথ্যা মনে করবে সে ব্যক্তি কাফির এবং সে এমনই কুফুরী করল যে যার কোনো ক্ষমা নেই, অথচ তার এই গুনাহটি শির্কের অন্তর্ভুক্ত নয়।

আর আমরা যদি মেনেও নেই যে ﴿مَا دُونَ ذَٰلِكَ﴾ এর অর্থ হলো: ‘শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ’ তাহলে এটা হবে ব্যাপক অর্থপূর্ণ বাণী যাকে সেসব দলীল দ্বারা বিশেষায়িত করা হয়েছে যা প্রমাণ করে যে শির্ক ছাড়াও কুফুরী হতে পারে এবং (সেসব দলীল দ্বারা বিশেষায়িত) যা প্রমাণ করে যে যে কুফর কাউকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয় সেটি এমন গুনাহ যা ক্ষমা করা হবে না, যদিও তা শির্ক না হয়।

তৃতীয় প্রকার: যেসব দলীল সাধারণ অর্থ বহন করে তাকে বিশেষায়িত করা হয়েছে ঐসব হাদীস দ্বারা যা প্রমাণ করে যে সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি কাফির। যেমন মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

 “যে কোনো বান্দা সাক্ষ্য দিবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন”।[18] আর এটি উক্ত হাদীসের এক বর্ণনার শব্দ, অনুরূপ বর্ণনা এসেছে আবূ হুরায়রা[19] ‘উবাদা ইবন সামিত[20] এবং ‘ইতবান ইবন মালেক[21] রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মধ্যেও।

চতুর্থ প্রকার: যেসব দলীল ‘আম (ব্যাপক অর্থবোধক) যা এমন বিষয়ের সাথে সম্পর্ক বা শর্তযুক্ত যার সাথে[22] সালাত ত্যাগ করা সম্ভব নয়। যেমন, ‘ইতবান ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ’ (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ) বলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।”[23] আর মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে কোনো বান্দা আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।”[24] সুতরাং হাদীসে উল্লিখিত এই দু’টি সাক্ষ্যতে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এবং অন্তরের সততার শর্তারোপ করা হয়েছে যা তাকে সালাত বর্জন করা থেকে বিরত রাখবে; কারণ যে কোনো ব্যক্তি সততা ও একনিষ্ঠতার সাথে এই সাক্ষ্য দেবে তার সততা ও একনিষ্ঠতা অবশ্যই তাকে সালাত আদায় করতে বাধ্য করবে; কেননা সালাত হচ্ছে ইসলামের মূলস্তম্ভ; আর তা হচ্ছে বান্দা এবং তার রবের (প্রভুর) মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। সুতরাং সে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সৎ হয় তাহলে অবশ্যই সে এমন কাজ করবে যা তার সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছায়, আর এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে যে কাজ তার এবং তার প্রভূর মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করে। আর অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে এ সাক্ষ্য দিবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তার এই সততা তাকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়ে সালাত আদায় করতে বাধ্য করবে। কারণ, এসব হচ্ছে ঐ সত্য সাক্ষ্যের আবশ্যকতার অন্তর্ভুক্ত।

পঞ্চম প্রকার: সেসব দলীল যা এমন অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট যে অবস্থায় সালাত ত্যাগ করার ওযর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ ইমাম ইবন মাজাহ রহ. কর্তৃক হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“ইসলাম মুছে যাবে যেমনিভাবে কাপড়ের নকসা আস্তে আস্তে মুছে যায়,... “মানুষের মাঝে অতি বৃদ্ধ ও অক্ষমদের একটি দল থাকবে যারা বলবে: আমাদের পূর্ব-পূরুষদের এই কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ’ (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ) (আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই) বলতে শুনেছি অতঃপর আমরাও তাই বলছি।” তারপর সেলা রা. নামক সাহাবী তাঁকে (হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে) উদ্দেশ্য করে বললেন: শুধু কি ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ’ (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ) বলাটাই তাদের মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে, অথচ তারা জানে না যে, সালাত, সাওম, হজ, যাকাত ও সাদকা কী? হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি (সেলা রাদিয়াল্লাহু আনহু) তিনবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, প্রত্যেক বারই হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু (উত্তর না দিয়ে) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি (হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর দিকে ফিরে তিনবার বললেন: হে সেলা! এই কালেমা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে।”[25]

অতএব, ঐসব মানুষ যাদেরকে এই কালেমা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিল তারা ইসলামের বিধানসমূহ ত্যাগের ব্যাপারে নির্দোষ ছিল। কারণ, তারা এই বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল, কাজেই তারা যতটা পালন করেছে ততটাই তাদের শেষ সামর্থ ছিল। তাদের অবস্থা ঠিক সেই লোকদের মত যারা ইসলামের বিধি-নিষেধ নির্ধারিত হওয়ার পূর্বেই মারা গিয়েছে অথবা বিধান পালনের শক্তি অর্জনের পূর্বেই মারা গিয়েছে। যেমন, সেই ব্যক্তি যে (একত্ববাদের) সাক্ষ্য দেয়ার পরে শরী‘আতের বিধিবিধান পালন করার সক্ষমতা অর্জনের পূর্বেই মারা গিয়েছে অথবা সে কাফিরের দেশে ইসলাম গ্রহণ করল তারপর শরী‘আতের বিধিবিধানের জ্ঞান লাভের সুযোগ পাওয়ার পূর্বেই মারা গেল।

ফলকথা এই যে, যারা সালাত ত্যাগকারীকে কাফির মনে করে না তারা যেসব দলীল পেশ করে সেসব দলীল যারা সালাত ত্যাগকারীকে কাফির মনে করে তাদের দেওয়া দলীল-প্রমাণের সমকক্ষ নয়। কারণ, (যারা কাফির মনে করে না) তারা যেসব দলীল পেশ করে থাকে সেগুলো হয়তো দুর্বল ও অস্পষ্ট অথবা তাতে মোটেই তার প্রমাণ নেই; অথবা সেগুলো এমন এমন গুণের সাথে সম্পৃক্ত যার বর্তমানে সালাত ত্যাগ করা সম্ভব নয় অথবা সেগুলো এমন অবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাতে সালাত ত্যাগের ওযর গ্রহণযোগ্য অথবা হতে পারে সেই দলীলগুলো ‘আম (ব্যাপাক অর্থবোধক) যা সালাত বর্জনকারীর কুফুরীর দলীলসমূহ দ্বারা খাস (নির্দিষ্ট) করা হয়েছে।

সুতরাং যখন সালাত বর্জনকারী ব্যক্তির কাফির হওয়ার বিষয়টি এমন বলিষ্ঠ দলীল দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে দলীলের বিরুদ্ধে তার সমতুল্য কোনো দলীল নেই। ফলে তার ওপর কুফুরী ও মুরতাদ হওয়ার বিধান অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। আর সঙ্গত কারণেই বিধানটি তার ইল্লতের (কারণ বা হেতুর) সাথে ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে সংশ্লিষ্ট; অর্থাৎ সেই বিধানের কারণ পাওয়া গেলে তা প্রযোজ্য হবে আর যদি কারণ না পাওয়া যায় তবে তার বিধান প্রযোজ্য হবে না।

মুরতাদের ওপর কতিপয় ইহলৌকিক ও পরলৌকিক বিধান প্রযোজ্য হয়ে থাকে:

প্রথমত: পার্থিব বিধানসমূহ:

(১) তার অভিভাবক হওয়ার যোগ্যতা শেষ হয়ে যাওয়াঃ

সুতরাং তাকে এমন কোনো কাজের অভিভাবক বানানো জায়েয হবে না যে কাজের জন্য ইসলাম অভিভাবকত্বের শর্তারোপ করেছে। আর এর ওপর ভিত্তি করে তাকে তার অনুপযুক্ত সন্তান ও অন্যান্যদের ওপর অভিভাবক (ওলী) নিযুক্ত করা বৈধ হবে না এবং তার তত্ত্বাবধানে তার যেসব মেয়েরা বা অন্য কেউ রয়েছে তাদের কাউকে বিয়ে দিতে পারবে না।

আর আমাদের ফিকহশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত গ্রন্থগুলোতে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন: যখন কোনো অভিভাবক মুসলিম মেয়েকে বিবাহ দিবে তখন সেই অভিভাবকের জন্য শর্ত হলো মুসলিম হওয়া, আর তারা বলেন:

“মুসলিম মেয়ের ওপর কোনো কাফির ব্যক্তির অভিভাবকত্ব চলবে না।”

আর আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

“যোগ্য অভিভাবক ব্যতীত কোনো বিবাহ চলবে না।” আর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো দীন ইসলামকে গ্রহণ করা, আর সবচেয়ে বোকামী বা মূর্খতা ও অযোগ্যতা হচ্ছে কুফুরী করা ও ইসলাম থেকে বিমূখ হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর যে নিজেকে নির্বোধ করেছে, সে ছাড়া ইবরাহীমের মিল্লাত থেকে আর কে বিমুখ হবে!” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৩০]

(২) তার আত্মীয়দের মীরাস (পরিত্যক্ত সম্পদ) থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়াঃ

কেননা কাফির ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না, আর মুসলিম ব্যক্তি কাফিরের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। কারণ, উসামা ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“মুসলিম কাফিরের ওয়ারিস হবে না এবং কাফিরও মুসলিমের ওয়ারিস হবে না।”[26]

(৩) তার জন্য মক্কা ও তার হারামের এলাকায় প্রবেশ করা হারামঃ

 কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র, কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মাসজিদুল হারামের ধারে-কাছে না আসে।” [সূরা আত- তাওবা আয়াত: ২৮]

(৪) তার দ্বারা যবাইকৃত জীবজন্তু হারাম, অর্থাৎ গৃহপালিত জন্তু উট গরু ছাগল ইত্যাদি ধরনের জীবজন্তু যা হালাল হওয়ার জন্য যবেহ করার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। কারণ, যবেহ করার জন্য অন্যতম শর্ত হলো যবেহকারীকে মুসলিম অথবা কিতাবধারী ইয়াহূদী বা খ্রিষ্টান হওয়া, আর মুরতাদ মূতিপূজক অগ্নিপূজক বা অনুরূপ কোনো ব্যক্তি যা যবেহ করবে তা খাওয়া হালাল হবে না।

প্রখ্যাত তাফসীরকারক খাযেন রহ. তাঁর তাফসীরের মধ্যে বলেছেন: “আলিমগণ এই ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, অগ্নিপূজক আরবের মুশরিকগণ ও মূতিপূজারীগণসহ সকল মুশরিক এবং যাদেরকে কোনো কিতাব দেওয়া হয় নি, এমন সকল ব্যক্তির যবাইকৃত সকল পশু-পাখি হারাম।”

আর ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন:

“কোনো ব্যক্তি এর বিপরীত মত পোষণ করেছেন বলে আমার জানা নেই, তবে হ্যাঁ বিদ‘আতপন্থী ব্যক্তি হলে বলতে পারে।”

(৫) তার মৃত্যুর পরে তার ওপর জানাযার সালাত পড়া এবং তার জন্য ক্ষমা ও রহমতের দো‘আ করা হারামঃ

কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত পড়বেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না; তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং ফাসেক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” [সূরা আত- তাওবাহ, আয়াত: ৮৪] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী। আর ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে, তারপর যখন এটা তার কাছে সুস্পষ্ট হলো যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ইবরাহীম তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল।” [সূরা আত- তাওবা আয়াত: ১১৩–১১৪]

আর যে কোনো কারণেই হউক না কেন, যে ব্যক্তি কুফুরীর ওপর মারা গেল তার জন্য কোনো মানুষের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও রহমতের দো‘আ করাটা দো‘আর ক্ষেত্রে এক প্রকার বাড়াবাড়ির শামিল, আল্লাহর সাথে এক ধরনের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনগণের পথ থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার অন্তর্ভুক্ত।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখে তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব যে সে এমন ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দো‘আ করবে যার মৃত্যু হয়েছে কুফুরী অবস্থায় এবং সে হচ্ছে আল্লাহর শত্রু? যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“যে কেউ আল্লাহ তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর রাসূলগণ এবং জিবরীল ও মীকাঈলের শত্রু হবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৯৮] সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, তিনি স্বয়ং প্রত্যেক কাফিরের শত্রু। ফলে প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য হলো প্রত্যেক কাফির থেকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর স্মরণ করুন যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা যেগুলোর ইবাদাত কর নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত, তবে তিনি ব্যতীত যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর নিশ্চয় তিনি শীঘ্রই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন।” [সূরা আয-যুখরুফ আয়াত: ২৬-২৭] আর আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন:

“অবশ্যই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল তোমাদের সংগে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদাত কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্যঅ, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন।” [সূরা আল-মুমতাহিনাহ আয়াত: ৪] আর এর মাধ্যমে সে যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে পারে, যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর মহান হজের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও।” [সূরা আত- তাওবা আয়াত: ৩]

আর ঈমানের সবচেয়ে মজবুত রশি হলো: আল্লাহর জন্য ভালোবাসা আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন করা আর আল্লাহর জন্য শত্রুতা করা যাতে আপনি আপনার নিজের ভালোবাসার স্বার্থে ঘৃণার স্বার্থে বন্ধত্ব স্থাপনে এবং শত্রুতা প্রদর্শনে মহান আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির সন্ধানী হয়ে যেতে পারেন।

(৬) মুসলিম নারীকে তার পক্ষে বিয়ে করা হারাম:

কারণ সে কাফির, আর কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য এবং ইজমা তথা মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যমত্যের দ্বারা প্রমাণিত যে কাফির ব্যক্তির জন্য মুসলিম নারী বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে মুমিন নারীরা হিজরত করে আসলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করো; আল্লাহ্ তাদের ঈমান সম্বন্ধে সম্যক অবগত। অতঃপর যদি তোমরা জানতে পার যে তারা মুমিন নারী তবে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ো না। মুমিন নারীগণ কাফিরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফিরগণ মুমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়।” [সূরা আল-মুমতাহিনাহ আয়াত: ১০]

আল-মুগনী (المغني) নামক কিতাবে (৬/৫৯২) বলা হয়েছে: “আহলে কিতাব ব্যতীত সমস্ত কাফিরের মেয়েরা এবং তাদের যবাইকৃত জীবজন্তু হারাম হওয়ার ব্যাপারে আলিমগণের মাঝে কোনো মতভেদ নেই।” তিনি আরো বলেন: “মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারী) মেয়েকে বিয়ে করা হারাম, সে যে কোনো ধর্মের অনুসারীই হউক না কেন। কারণ, তার জন্য ঐ দীনের অনুসারীর বিধান সাব্যস্ত হয় নি, যে দীনে সে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।”

আর একই গ্রন্থের মুরতাদের পরিচ্ছেদে (৮/১৩০) বলা হয়েছে: “যদি সে বিয়ে করে তার বিয়ে শুদ্ধ হবে না। কারণ, তাকে বিয়ের ওপর স্থির রাখা যায় না, আর যা বিয়ের ওপর স্থির রাখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তা বিয়ে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে যেমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় কাফির কর্তৃক মুসলিম নারীকে বিয়ে করার সময়।”[27]

সুতরাং আপনি তো দেখতে পেলেন যে মুরতাদ মেয়েকে বিয়ে করা পরিষ্কাভাবে হারাম করা হয়েছে; অপরপক্ষে মুরতাদ পুরুষের সঙ্গে (মুসলিম মেয়ের) বিয়ে অশুদ্ধ। অতএব, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর যদি মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে কী হতে পারে?

আল-মুগনী (المغني) নামক কিতাবে (৬/২৯৮) বলা হয়েছে: “যখন স্বামী ও স্ত্রীর কোনো একজন বাসরের পূর্বেই মুরতাদ হয়ে যায় তখন সাথে সাথেই বিয়ে বাতিল হয়ে যাবে এবং তাদের একজন অপর জনের ওয়ারিস (সম্পদের উত্তরাধিকারী) হবে না। আর যদি বাসরের পরে মুরতাদ হয় তাহলে এই ব্যাপারে দু‘টি মত রয়েছে: তন্মধ্যে প্রথম মতটি হলো: সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যকার বিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, আর দ্বিতীয় মত হলো: ইদ্দত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বিয়ে স্থগিত হয়ে থাকবে (ইদ্দত পূর্ণ হলেই বিয়ে বাতিল হয়ে যাবে)।”

আল-মুগনী (المغني) নামক কিতাবে (৬/639) আরো বলা হয়েছে: “বাসরের পূর্বে মুরতাদ হওয়ার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে- এটা সকল আলিমের বক্তব্য এবং এর স্বপক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে।”

আর তাতে আরো বলা হয়েছে: বাসরের পর মুরতাদ হলে ইমাম মালেক ও আবূ হানিফা রহ.-এর মতে সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে, আর ইমাম শাফেঈ রহ.-এর মতে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদ হবে।

এ কথার দাবি হচ্ছে চার ইমামের ঐক্যবদ্ধ মতের ভিত্তিতে স্বামী ও স্ত্রীর কোনো একজন মুরতাদ হলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে; কিন্তু যদি বাসরের পূর্বে মুরতাদ হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। আর যদি বাসরের পর মুরতাদ হয় তবে ইমাম মালেক ও ইমাম আবূ হানিফা রহ.-এর মতে তাৎক্ষণিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটবে, আর ইমাম শাফেঈ রহ.-এর মতে ইদ্দত পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে তারপর বিচ্ছেদ ঘটবে। উপরোক্ত দুই মাযহাবের অনুরূপ ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. থেকে দু‘টি বর্ণনা রয়েছে।

আল-মুগনী (المغني) নামক গ্রন্থের ৬৪০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে: “স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে যদি একই সঙ্গে মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে তাদের হুকুমও অনুরূপ যেমন হুকুম রয়েছে উভয়ের মধ্য থেকে কোনো একজন মুরতাদ হলে, যদি বাসরের পূর্বে মুরতাদ হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। আর যদি বাসরের পর মুরতাদ হয় তবে কি সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে নাকি ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদ হবে? এই ব্যাপারে দু‘টি বর্ণনা রয়েছে: ইমাম শাফেঈ রহ.-এর মতে ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। আর ইমাম আবূ হানিফা রহ.-এর মতে এই ক্ষেত্রে (স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে একই সঙ্গে মুরতাদ হলে) ইস্তিহসান (استحسان) এর ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না। কারণ, তাদের উভয়ের ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় নি, আর এটা ঠিক তেমনই যেমন দু‘জনই যদি একই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করে।” অতঃপর আল-মুগনী (المغني) নামক গ্রন্থের লেখক তার (ইমাম আবূ হানিফা রহ.-এর) উক্ত কিয়াস-এর (طرد) তথা গঠনমূলক ও (عكس) বা বিপরীতমূখী প্রমাণ প্রদানের মাধ্যমে খণ্ডন করেছেন।

আর যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে মুরতাদের বিবাহ কোনো মুসলিমের সঙ্গে শুদ্ধ নয় চাই সে নারী হউক বা পুরুষ, আর এটাই কুরআন ও সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত; আর এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে সালাত বর্জনকারী হচ্ছে কাফির যা কুরআন সুন্নাহ ও সকল সাহাবীর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। আর এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে কোনো ব্যক্তি যদি সালাত আদায় না করে এবং কোনো মুসলিম নারীকে বিয়ে করে তাহলে তার বিয়ে শুদ্ধ নয় আর এই বন্ধন দ্বারা সেই নারী তার জন্য হালালও নয়, তবে সে যদি আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাওবা করে এবং ইসলামের দিকে ফিরে আসে তাহলে তার ওপর বিবাহকে আবার নবায়ন করা আবশ্যক হবে। আর অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য হবে ঐ নারীর ক্ষেত্রেও যে সালাত আদায় করে না।

আর এটা কাফিরদের কুফুরী অবস্থায় সংঘটিত বিবাহ থেকে ভিন্ন রকম; যেমন একজন কাফির পুরুষ একজন কাফির মেয়েকে বিয়ে করল অতঃপর উক্ত স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করল এই পরিস্থিতিতে যদি সে মেয়ের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি বাসরের পূর্বে হয়ে থাকে তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। আর যদি সে মেয়ের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি বাসরের পরে হয়ে থাকে তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না বরং স্বামীর ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় থাকবে। তারপর যদি ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই স্বামী ইসলাম গ্রহণ তাহলে সে মেয়ে তারই স্ত্রীরূপে বহাল থাকবে। আর যদি স্বামীর ইসলামের পূর্বেই ইদ্দত শেষ হয়ে যায় তাহলে সেই স্বামীর জন্য তার ওপর কোনো অধিকার থাকবে না। কারণ, এখানে পরিষ্কার হয়ে গেল যে সেই মেয়ের ইসলাম গ্রহণ করার সময় থেকেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কাফিরগণ তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে একই সময় ইসলাম গ্রহণ করত এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের নিজ নিজ বিয়ের ওপর স্থির রাখতেন, তবে যদি তাদের মধ্যে বিয়ে হারাম হওয়ার কারণ বিদ্যমান থাকত তাহলে ভিন্ন কথা, যেমন স্বামী-স্ত্রী দু‘জনই অগ্নিপূজক এবং তাদের উভয়ের মাঝে এমন আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে যার কারণে তাদের একে অপরের সঙ্গে বিয়ে হারাম। অতএব, যখন তারা দু‘জন ইসলাম গ্রহণ করবে তখন তাদের মধ্যে বিয়ে হারাম হওয়ার কারণ বিদ্যমান থাকার কারণে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেওয়া হবে।

আর এই মাসআলাটি ঐ মুসলিম ব্যক্তির মাসআলার মত নয়, যে সালাত ত্যাগ করার কারণে কাফির হয়েছে। অতঃপর মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছে। কারণ, মুসলিম নারী কাফিরের জন্য হালাল নয় এটা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে যদিও সে কাফিরটি মৌলিকভাবে মুরতাদ নয়, আর এই জন্য যদি কোনো কাফির কোনো মুসলিম নারীকে বিয়ে করে তাহলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেয়া আবশ্যক (ওয়াজিব) হবে। আর যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে আবার নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যতীরেকে তার জন্য এটা সম্ভব হবে না।

(৭) সালাত বর্জনকারী কর্তৃক মুসলিম নারীকে বিয়ে করার পর জন্ম হওয়া সন্তানদের বিধান: মায়ের দিকে লক্ষ্য করলে সর্বাবস্থায় সন্তান হচ্ছে মায়ের। আর স্বামীর দিকে লক্ষ্য করলে যারা সালাত বর্জনকারীকে কাফির মনে করেন না তাদের মতে সেসব সন্তান তার সাথে সম্পৃক্ত হবে; কারণ (তাদের মতে) তার বিবাহ শুদ্ধ ছিল। আর যারা সালাত বর্জনকারীকে কাফির মনে করেন এবং এটাই সঠিক যেমনটি তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ প্রথম পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে; আমরা সেই মতের ওপর ভিত্তি করে বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখব:

*যদি স্বামী একথা না জানে যে তার বিবাহ বাতিল ছিল অথবা তার এই বিশ্বাস ছিল না যে (সালাত বর্জনকারী কাফির) তাহলে সন্তানগুলো তার সন্তান বলেই গণ্য হবে। কারণ, এই অবস্থায় তার ধারণা মতে স্ত্রী মিলন বৈধ ছিল। সুতরাং তার এই মিলন সংশয়ের মিলন ছিল যাতে বংশ সাব্যস্ত হয়ে যাবে।

*আর স্বামী যদি একথা জানে যে তার বিবাহ বাতিল ছিল অথবা তার এই বিশ্বাস ছিল যে (সালাত বর্জনকারী কাফির) তাহলে সন্তানগুলো তার সন্তান বলে গণ্য হবে না। কারণ, তার সন্তান এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে যার সম্বন্ধে তার ধারণা ও বিশ্বাস ছিল তার সহবাস হারাম হয়েছে; কেননা তার সেই সহবাস হয়েছে এমন এক স্ত্রীর সাথে যে স্ত্রী তার জন্য হালাল ছিল না।

দ্বিতীয়ত: মুরতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পরকালীন বিধানসমূহ:

(১) ফিরিশতাগণ কর্তৃক তাকে ধমকের সুরে তিরস্কার ও আঘাত করা বরং তারা তাদের মুখমণ্ডলে ও পিঠে আঘাত করবেঃ

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আর আপনি যদি দেখতে পেতেন যখন ফিরিশতাগণ যারা কুফুরী করেছে তাদের প্রাণ হরণ করছিল, তাদের মুখমণ্ডলে ও পিঠে আঘাত করছিল, আর বলছিল তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ কর। এটা তো সে কারণে যা তোমাদের হাত আগে পাঠিয়েছিল, আর আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যাচারী নন।” [সূরা আল-আনফাল আয়াত: ৫০-৫১]

(২) তার হাশর হবে কাফির ও মুশরিকদের সাথে। কেননা সে তাদেরই একজনঃ

কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“(ফিরিশতাদেরকে বলা হবে) ‘একত্র কর যালিম ও তাদের সহচরদেরকে এবং তাদেরকে যাদের ‘ইবাদাত করত তারা আল্লাহর পরিবর্তে। আর তাদেরকে পরিচালিত কর জাহান্নামের পথে।” [সূরা আস-সাফ্ফাত আয়াত: ২২-২৩] আর আয়াতে উল্লিখিত أزواج শব্দট زوج শব্দের বহুবচন, আর তা হলো الصنف (শ্রেণী বা প্রকার) অর্থাৎ যারা যালিম এবং তাদের শ্রেণীভুক্ত কাফির ও যালিমদেরকে একসাথে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে।

(৩) তারা জাহান্নামে স্থায়ীভাবে চিরদিন অবস্থান করবেঃ

কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে করেছেন অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত আগুন। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে এবং তারা কোন অভিভাবক পাবে না কোন সাহায্যকারীও নয়। যেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে উলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম আর রাসূলকে মানতাম!” [সূরা আল-আহযাব আয়াত: ৬৪-৬৬]

আর এখানেই সমাপ্ত হয়ে গেল এই বিরাট মাসআলার ব্যাপারে আমি যা বলতে চেয়েছিলাম যে সমস্যায় বহু লোকজন জর্জরিত।

*আর যে ব্যক্তি তাওবা করতে চায় তার জন্য তাওবার দরজা খোলা রয়েছে। সুতরাং হে মুসলিম ভাই! অতীতের পাপের প্রতি লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাওবা করুন এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন যে আমি আর পাপের কাজে যাব না এবং খুব বেশি বেশি সৎ কাজ করব। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“তবে যে তাওবা করে ঈমান আনে ও সৎকাজ করে ফলে আল্লাহ তাদের গুণাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আর যে তাওবা করে ও সৎকাজ করে সে তো সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর অভিমুখী হয়।” [সূরা আল-ফুরকান আয়াত: ৭০-৭১]

সালাত বর্জনকারী এমন কাফির, যে কুফুরীর কারণে দীনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়। তবে তওবা করে ফিরে এলে আল্লাহ ক্ষমাশীল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সালাত পরিত্যাগকারীর মধ্যে ৯৮% লোক তওবা করার সুযোগ পায় না। কাফের হয়েই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আর এটাই তার পুরস্কার।

দলিলের উৎসঃ

[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: অজ্ঞাতসারে মুমিনের আমল নষ্ট হওয়ার আশংকা (باب خوف المؤمن من أن يحبط عمله وهو لا يشعر), হাদীস নং ৪৮; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: মুসলিমকে গালি দেওয়া গুনাহর কাজ এবং তার সাথে মারামারি করা কুফুরী (باب بَيَانِ قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم : سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ), হাদীস নং ৬৪।

[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত (كتاب الزكاة ), পরিচ্ছেদ: যাকাতে বাধাদানকারীর অপরাধ (باب إِثْمِ مَانِعِ الزَّكَاةِ ), হাদীস নং ৯৮৭।

[3] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: সালাত পরিত্যাগকারীর উপর কুফর শব্দের প্রয়োগ (باب بَيَانِ إِطْلاَقِ اسْمِ الْكُفْرِ عَلَى مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ), হাদীস নং ২৫৬।

[4] আহমদ: ৫/৩৪৬; তিরমিযী, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان), পরিচ্ছেদ: সালাত বর্জন প্রসঙ্গে যেসব হাদীস এসেছে (باب ما جاء في ترك الصلاة), হাদীস নং ২৬২১ এবং তিনি বলেছেন: হাদীসটি হাসান, সহীহ ও গরীব; নাসাঈ, অধ্যায়: সালাত (كتاب الصلاة ), পরিচ্ছেদ: সালাত বর্জনকারীর বিধান প্রসঙ্গে (باب الحكم  في تارك الصلاة), হাদীস নং ৪৬৩; ইবন মাজাহ, অধ্যায়: সালাত কায়েম করা (كتاب إقامة الصلاة ), পরিচ্ছেদ: সালাত বর্জনকারী ব্যক্তি প্রসঙ্গে যেসব হাদীস এসেছে (باب ما جاء فيمن ترك الصلاة), হাদীস নং ১০৭৯।

[5] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: নেতৃত্ব বা প্রশাসন (كتاب الإمارة ), পরিচ্ছেদ: শরী‘য়ত গর্হিত কাজে আমীরের আনুগত্য বর্জন করা ওয়াজিব, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সালাত আদায় করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না (باب وُجُوبِ الإِنْكَارِ عَلَى الأُمَرَاءِ فِيمَا يُخَالِفُ الشَّرْعَ وَتَرْكِ قِتَالِهِمْ مَا صَلَّوْا وَنَحْوِ ذَلِكَ), হাদীস নং ৪৯০৬।

[6] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: নেতৃত্ব বা প্রশাসন (كتاب الإمارة ), পরিচ্ছেদ: উত্তম শাসক ও অধম শাসক  (باب خِيَارِ الأَئِمَّةِ وَشِرَارِهِمْ), হাদীস নং ৪৯১০।

[7] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ফিতনা (كتاب الفتن), পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: আমার পরে তোমার এমন কিছু দেখতে পাবে, যা তোমরা পছন্দ করবে না (باب قول النبي صلى الله عليه و سلم (سترون بعدي أمورا تنكرونها), হাদীস নং ৬৬৪৭; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: নেতৃত্ব বা প্রশাসন (كتاب الإمارة ), পরিচ্ছেদ: পাপের কাজ ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে শাসকের আনুগত্য করা জরুরি, আর পাপ কাজের ব্যাপারে তা করা হারাম  (باب وُجُوبِ طَاعَةِ الأُمَرَاءِ فِى غَيْرِ مَعْصِيَةٍ وَتَحْرِيمِهَا فِى الْمَعْصِيَةِ), হাদীস নং ৪৮৭৭।

[8] অর্থাৎ এটা বলেন নি, বরং আল্লাহ বলেছেন, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের জন্য শর্ত হচ্ছে সালাত প্রতিষ্ঠা করা, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শির্ক ও কুফরির মাঝে পার্থক্য হচ্ছে সালাত ছেড়ে দেওয়া; সুতরাং উপরোক্ত বিধান সালাতের আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপর নয়, বরং সালাত পরিত্যাগ করাই হচ্ছে কাফের হওয়ার কারণ। [সম্পাদক]

[9] ‘সালাত কায়েম করা’ উদ্দেশ্য না হয়ে, ‘সালাতের আবশ্যকতাকে স্বীকার করা’ই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আল্লাহ যে কুরআনুল কারীমকে সবকিছুর স্পষ্ট বর্ণনাকারী হিসেবে নাযিল করেছেন বলে জানিয়েছেন সেটার বিপরীত হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে, যা কখনো হতে পারে না।

[10] অর্থাৎ, ইসলামের যে কোনো প্রমাণিত বিষয়কে অস্বীকারকারীই কাফির, সেটা সালাতের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হলেও, যা উম্মতের সর্বসম্মত মত। সুতরাং যদি উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যসমূহকে সালাত পরিত্যাগকারীর ওপর নির্ধারণ না করে সালাত অস্বীকারকারীর জন্য নির্ধারণ করা হয়, তবে সালাতকে নির্দিষ্ট করে এ সব ভাষ্যের কোনো বিশেষত্ব প্রকাশ পায় না। কারণ, অন্যান্য বিষয় অস্বীকারকারীও যদি কাফের হয়ে যায়, তবে সালাতের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের এসব ভাষ্যের প্রয়োজন পড়ে না। তাই বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, সালাত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারেই এসব ভাষ্য প্রযোজ্য হবে। [সম্পাদক]

[11] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: বংশের প্রতি কটাক্ষের এবং উচ্চস্বরে বিলাপের ওপর কুফর শব্দের প্রয়োগ (باب إِطْلاَقِ اسْمِ الْكُفْرِ عَلَى الطَّعْنِ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةِ عَلَى الْمَيِّتِ), হাদীস নং ২৩৬।

[12] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: অজ্ঞাতসারে মুমিনের আমল নষ্ট হওয়ার আশংকা (باب خوف المؤمن من أن يحبط عمله وهو لا يشعر), হাদীস নং ৪৮; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: মুসলিমকে গালি দেওয়া গুনাহর কাজ এবং তার সাথে মারামারি করা কুফুরী (باب بَيَانِ قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم : « سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ »), হাদীস নং ৬৪।

[13] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: সালাত পরিত্যাগকারীর ওপর কুফর শব্দের প্রয়োগ (باب بَيَانِ إِطْلاَقِ اسْمِ الْكُفْرِ عَلَى مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ), হাদীস নং ২৫৬।

[14] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: বংশের প্রতি কটাক্ষের এবং উচ্চস্বরে বিলাপের উপর কুফর শব্দের প্রয়োগ (باب إِطْلاَقِ اسْمِ الْكُفْرِ عَلَى الطَّعْنِ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةِ عَلَى الْمَيِّتِ), হাদীস নং ২৩৬।

[15] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: সালাত পরিত্যাগকারীর উপর কুফর শব্দের প্রয়োগ (باب بَيَانِ إِطْلاَقِ اسْمِ الْكُفْرِ عَلَى مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ), হাদীস নং ২৫৬।

[16] তিরমিযী, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), পরিচ্ছেদ: সালাত পরিত্যাগ করার ব্যাপারে যেসব হাদীস এসেছে (باب ما جاء في ترك الصلاة), হাদীস নং ২৬২২; হাকেম: ১/৭।

[17] ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ (الترغيب و الترهيب ): ১ / ৪৪৫ - ৪৪৬

[18] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইলম বা জ্ঞান (كتاب العلم ), পরিচ্ছেদ: বুঝতে না পারার আশংকায় ইলম শিক্ষায় কোন এক গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে অন্য আরেক গোষ্ঠীকে নির্বাচন করা (باب من خص بالعلم قوما دون قوم كراهية أن لا يفهموا), হাদীস নং ১২৮; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان), পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি নির্ভেজাল ঈমান নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাবে (باب مَنْ لَقِىَ اللَّهَ بِالإِيمَانِ وَهُوَ غَيْرُ شَاكٍّ فِيهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَحَرُمَ عَلَى النَّارِ َ), হাদীস নং ১৫৭।

[19] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), হাদীস নং ১৪৭।

[20] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان ), হাদীস নং ১৫১।

[21] তার তথ্যসূত্র সামনে আসছে।

[22] অর্থাৎ সে শর্তগুলোর দিকে তাকালে আর সালাত ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। সুতরাং সে সব হাদীস সালাত ত্যাগকারীর কাফের হওয়ার বিপরীতে পেশ করা যায় না; বরং সে সব হাদীসই প্রমাণ করে যে তাকে অবশ্যই সালাত আদায় করতে হবে। [সম্পাদক]

[23] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সালাত (كتاب الصلاة), পরিচ্ছেদ: ঘরের মধ্যে সালাত আদায়ের স্থান (باب المساجد في البيوت ), হাদীস নং ৪১৫; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মসজিদ এবং সালাত আদায়ের স্থানসমূহ (كتاب المساجد و مواضع الصلاة ), পরিচ্ছেদ: শরী‘আত সম্মত কারণে সালাতের জামা‘আতে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যাহতি প্রসঙ্গে (باب الرُّخْصَةِ فِى التَّخَلُّفِ عَنِ الْجَمَاعَةِ بِعُذْرٍَ), হাদীস নং ১৫২৮।

[24] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইলম বা জ্ঞান (كتاب العلم ), পরিচ্ছেদ: বুঝতে না পারার আশংকায় ইলম শিক্ষায় কোন এক গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে অন্য আরেক গোষ্ঠীকে নির্বাচন করা (باب من خص بالعلم قوما دون قوم كراهية أن لا يفهموا), হাদীস নং ১২৮; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান (كتاب الإيمان), পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি নির্ভেজাল ঈমান নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাবে (باب مَنْ لَقِىَ اللَّهَ بِالإِيمَانِ وَهُوَ غَيْرُ شَاكٍّ فِيهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَحَرُمَ عَلَى النَّارِ َ), হাদীস নং ১৫৭।

[25] ইবন মাজাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: ফিতনা (كتاب الفتن ), পরিচ্ছেদ: কুরআন ও ইলম বিলীন হয়ে যাওয়া (باب ذهاب القرآن والعلم), হাদীস নং ৪০৪৯; হাকেম: ৪/৪৭৩; বুসাইরী আয-যাওয়ায়েদ (الزوائد) এর মধ্যে বলেন: হাদীসটির সনদ সহীহ এবং তার বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য, আর হাকেম রহ. বলেন: হাদীসটি ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্তে সহীহ।

[26] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: উত্তরাধিকার বণ্টনের বিধান (كتاب الفرائض ), পরিচ্ছেদ: মুসলিম কাফিরের ওয়ারিস হবে না (باب لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ ), হাদীস নং ৬৩৮৩; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: উত্তরাধিকার বণ্টনের বিধান (كتاب الفرائض ), পরিচ্ছেদ: মুসলিম কাফিরের ওয়ারিস হবে না (باب لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ ), হাদীস নং ৪২২৫।

[27] হানাফী কিতাব মাজমা‘উল আনহুর (المجمع الأنهر ) এর কাফিরের বিয়ে নামক পরিচ্ছেদ (باب نكاح الكافر ) এর শেষে (১ / ২০২) রয়েছে: “মুরতাদ পুরুষ এবং মুরতাদ নারীকে বিয়ে করা বৈধ নয়।” কারণ, এই ব্যাপারে সকল সাহাবীর ঐক্যবদ্ধ ইজমা সংঘটিত হয়েছে।

কোনো মুসলিমকে নাম ধরে ডাকার মতো ‘কাফের’ বলে ডাকা হারামঃ

কোনো মুসলমানকে কাফের বলা যাবে কিনা এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। রাসুল সাঃ বলেন,

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন কেউ তার মুসলিম ভাইকে ‘কাফের’ বলে, তখন তাদের উভয়ের মধ্যে একজনের উপর তা বর্তায়, যা বলেছে তা যদি সঠিক হয়, তাহলে তো ভাল। নচেৎ (যে বলেছে) তার উপর ঐ কথা ফিরে যায় (অর্থাৎ সে ‘কাফের’ হয়)।’’ (সহীহুল বুখারী ৬১০৪, মুসলিম ৬০, তিরমিযী ২৬৩৭, আবূ দাউদ ৪৬৮৭, আহমাদ ৪৬৭৩, ৪৭৩১, ৫০১৫, ৫০৫৭, ৫২৩৭, ৫৭৯০, ৫৮৭৮, ৫৮৯৭, ৬২৪৪, মুওয়াত্তা মালিক ১৮৪৪, রিয়াদুস সলেহীন-১৭৪১) হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

আবূ যার্র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, ‘‘যে কাউকে ‘ওরে কাফের’ বলে ডাকে অথবা ‘ওরে আল্লাহর দুশমন’ বলে অথচ বাস্তবিক ক্ষেত্রে যদি সে তা না হয়, তাহলে তার (বক্তার) উপর তা বর্তায়।’’ (সহীহুল বুখারী ৬০৫৫, মুসলিম ৬১, আহমাদ ২০৯৫৪, ২১০৬১, রিয়াদুস সলেহীন-১৭৪2), হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

অপর দিকে আল্লাহতায়ালা বলেন,

(ক) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফয়সালা ও শাসনকার্য পরিচালনা করেনি,তারা কাফের।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৪)।

(খ) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা জালেম।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৫)।

(গ) “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা করে নি তারা ফাসেক (পাপাচারী)।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৪৭)।

এখানে আল্লাহতায়ালা মুসলমান বিচারক বা শাসকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন।

সালাত পরিত্যাগকারী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,

“অতঃপর তাদের পরে আসলো পরবর্তী অপদার্থ লোকগুলো। তারা সালাত নষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুবর্তী হলো। সুতরাং তারা অচিরেই পথভ্রষ্টতার শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা তওবা করেছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে। সুতরাং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কোনো জুলুম করা হবে না।” (সুরা মরিয়ম ,আয়াত ৫৯-৬০)।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত (নিক্ষেপ) করেছে? তারা বলবে- আমরা সালাত আদায় না।” (সুরা মুদাসসির : আয়াত ৪২-৪৩)।

আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তারা যদি তওবা করে, ছালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে তবেই তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই’ । (তওবা ১১)।

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছা)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি আর মুশরিক ও কাফেরের মাঝে পার্থক্য হল, ছালাত পরিত্যাগ করা’। “ছহীহ মুসলিম হা/২৫৬ ও ২৫৭, ১/৬১ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৪৯ ও ১৫০), ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৭; মিশকাত হা/৫৬৯।”

আব্দুল্লাহ ইবনু বুরায়দা (রাঃ) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমাদের ও তাদের (কাফের, মুশরিক ও মুনাফিক) মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা হল ছালাত। সুতরাং যে ব্যক্তি ছালাত ছেড়ে দিবে, সে কুফুরী করবে’। “তিরমিযী হা/২৬২১, ২/৯০ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ছালাত ত্যাগ করা’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ হা/৪৬৩; ইবনু মাজাহ হা/১০৭৯; মিশকাত হা/৫৭৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫২৭, ২/১৬২ পৃঃ, সনদ ছহীহ।”

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ছালাত ছেড়ে দিবে সে শিরক করবে’। (ইবনু মাজাহ হা/১০৮০, পৃঃ ৭৫, ‘ছালাত কায়েম করা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭, সনদ ছহীহ।)

আব্দুল্লাহ ইবনু শাক্বীক্ব উকায়লী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল ছেড়ে দেওয়াকে কুফুরী বলতেন না, ছালাত ব্যতীত। (তিরমিযী হা/২৬২২, ২/৯০ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ছালাত’ পরিত্যাগ করা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৫৭৯, পৃঃ ৫৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩২, ২/১৬৪ পৃঃ, সনদ ছহীহ।)

অতএব যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করবে না, সে নিঃসন্দেহে কুফুরী করবে। অলসতা ও অবহেলায় কোন মুসলিম নামধারী যদি ছালাত আদায় না করে তাহলে উক্ত অপরাধের কারণে জাহান্নামে যাবে। শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর দয়ায় কালেমা ত্বাইয়েবার বরকতে মুক্তি পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। ( ইবনু মাজাহ হা/৬০, পৃঃ ৭, সনদ ছহীহ।)

 কিন্তু কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ছালাত ছেড়ে দিলে বা অস্বীকার করলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। (দেখুন: শায়খ আলবানী, হুকমু তারিকিছ ছালাহ, পৃঃ ৬।)

প্রিয় ইমানদার ও মুত্তাক্বি মুসলমান ভাইয়েরা, যেখানে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ একজন মুসলমানকে তার কুফরি কর্মকান্ডের জন্যে কাফের বলছেন সেখানে আমরা বললে দোষ কোথায়? অনেকে রাসুল সাঃ এর (এখানে আলোচনার প্রথম) হাদিস দিয়ে দলিল দেয় যে, কোনো মুসলমানকে কাফের বলা নিষেধ যদি না সে কাফের হয়। এরুপ যে বলবে সেটা তার উপর বর্তাবে। এখানে বিষয়টি হচ্ছে, যে মুসলমান কুফরি কর্মকান্ডের সহিত জড়িত নেই তাকে বলা যাবে না। তথা গালি অর্থে বা মন্দ নামে কোনো মুসলমানকে কাফের বলা যাবে না। কিন্তু কুফরি কর্মকান্ডের সহিত জড়িত ব্যক্তিকে কাফের বলা যাবে। তবে যখন তখন কাফের অমুক এভাবে (নাম ধরে ডাকার মতো) ডাকা যাবে না।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

হে ঈমানদারগণ! কোন মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোন মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালিম৷(সুরা আল হুজরাত, আয়াত-১১।)

ব্যাখ্যাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন সেখানকার অধিকাংশ লোকের দুই তিনটি করে নাম ছিল। তন্মধ্যে কোনো কোনো নাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লজ্জা দেয়া ও লাঞ্ছিত করার জন্য লোকেরা খ্যাত করেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা জানতেন না। তাই মাঝে মাঝে সেই মন্দ নাম ধরে তিনিও সম্বোধন করতেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম বলতেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সে এই নাম শুনলে অসন্তুষ্ট হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। [আবু দাউদ: ৪৯৬২, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮০]।

‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বা ‘সেকুলারিজমে’ বিশ্বাসী মুসলমান কাফেরঃ

বাংলাদেশে সেকুলারিজমের অনুবাদ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি নতুন মতবাদ। এটি একটি ভ্রান্ত আন্দোলন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা, দুনিয়া ও দুনিয়ার মজা নিয়ে মেতে থাকা। আখেরাতকে ভুলে গিয়ে, অথবা আখেরাতকে উপেক্ষা করে পার্থিব জীবনকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা। পরকালের আমলের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করা ও গুরুত্ব না দেয়া।

আমাদের প্রথমে জানা প্রয়োজন সেকুলারিজম বলতে কি বুঝায়?

(১) সেকুলারিজম নামকরণের প্রথম উদ্যোক্তা Holyoake যিনি Secular Society গঠন করে এর পক্ষে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন,তার লিখিত English Secularism: A Confession of Belief (Chicago 1896)বইতে সেকুলারিজমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ” ‘সেকুলারিজম’ এমন একটি কর্তব্য পালন পদ্ধতি, যা শুধু ইহজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ও কেবলমাত্র মানবীয় বিবেচনার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এটি তাদের জন্য যারা ধর্মতত্ত্বকে অস্পষ্ট, অপূর্ণ, অনির্ভরযোগ্য ও অবিশ্বাসযোগ্য মনে করে।”

(২) সেকুলারিজম’ ও আস্তিকতা পাশাপাশি চলতে পারেনা। তাই আস্তিকবাদী বিশ্বাসের সাথে লড়াই করা ‘সেকুলারিজম’ -এর জন্য অপরিহার্য। অদৃশ্য বিশ্বাস ও মানব প্রগতি পাশাপাশি চলতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিহত করাই ‘সেকুলারিজম’ -এর কর্তব্য। কেননা এসব কুসংস্কারমূলক ধারনা-বিশ্বাস যতদিন পর্যন্ত পূর্ণ শক্তিতে বিরাজমান থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বস্তুগত উন্নতি লাভ করা কল্পনাতীত হয়ে থাকবে। ধর্ম অজানা জগত নিয়ে কথা বলে। ফলে ইহকালীন বিষয়ে ধর্মের কোন স্থান নেই, যেমন পরকালের ব্যপারে ‘সেকুলারিজম’ -এর কোন বক্তব্য নেই। [ইংল্যান্ডের National Secular Society এর সভাপতি Mr. Charles Bradlaugh রচিত বই Autobiography]

(৩) সেকুলারিজম’ এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদে মানবজাতির ইহজগতের কল্যাণ চিন্তার উপর গড়ে উঠবে এমন এক নৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে থাকবেনা সৃষ্টিকর্তা ও পরকাল বিশ্বাস ভিত্তিক কোন ধরনের বিবেচনা। [Oxford Dictionary]

(৪) ‘সেকুলারিজম’ হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। [Encyclopedia বা বিশ্বকোষ]

(৫) ‘সেকুলারিজম’ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সাধারণ শিক্ষা ও সামাজিক সংস্থা পরিচালনায় কোন ধরনের ধর্মীয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত হবে না। [Encyclopedia বা বিশ্বকোষ]

(৬) ‘সেকুলারিজম’ এমন একটি মতবাদ যা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্র বলে বিবেচিত নয়। যা কোন ভাবেই কোন ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটি ধর্মীয় আইন-কানুন বহির্ভূত একটি ব্যাবস্থা।[Random House Dictionary of English Language College Edition, Newyork-1968]

(৭) ‘সেকুলারিজম’ এমন একটি ব্যবস্থা যার অধীনে নৈতিকতা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মের উপর ভিত্তি করে হবেনা। এটি ইহজাগতিক বা পার্থিব, ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক নয়। [The Advanced Learner’s Dictionary of Current English]

(৮) সমাজ সংগঠন, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে ধর্ম সংশ্লিষ্ট হতে পারবে না এমন বিশ্বাসের নাম হলো ‘সেকুলারিজম’ । [Oxford Advance Learner’s Dictionary]

(৯) ‘সেকুলারিজম’ বলতে সেই ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে মানবকল্যাণ নির্ধারিত হবে যুক্তির মাধ্যমে, ওহী বা ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে নয়। আর যুক্তি পরিক্ষিত হবে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। [Encyclopedia of Religion & Ethics]

(১০) ‘সেকুলারিজম’ বলতে বুঝায় নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্ম কেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয় এই মতবাদ। [বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত English-Bengali Dictionary]

উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে এটা স্পষ্ট যে, “ধর্মনিরপেক্ষতা” বা ‘সেকুলারিজম’ এর আরেক নাম নাস্তিকতা।

মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম এর নামে মানুষকে ইসলামের শিক্ষা থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে,

বলা হচ্ছে, ‘ইসলামে কোন রাজনীতি নেই, কিংবা রাজনীতিতে ইসলাম নিয়ে আসার মানে হল সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা’।

এদের একটি ধোঁকাবাজিপূর্ণ স্লোগান হচ্ছে ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’; অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাসকারী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা আশ্রয় নেয় মানুষের রচিত কিছু আইন কানুন ও বিধানের।

এখন প্রশ্ন হল কোন মুসলিম তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বা সেকুলারিজমে বিশ্বাসী হতে পারবে কিনা?

কোরআন ও হাদিস থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে কোন মুসলিম সেকুলারিজমে বিশ্বাসী হওয়ার সুযোগ নেই।

এখন জেনে নেয়া যাক, “ধর্মনিরপেক্ষতা” বা “সেকুলারিজম” সম্পর্কে কুরআন ও হাদিস কি বলে?

(ক) আল্লাহ বলেন,

তবে কি তোমরা কুরআনের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন। (সূরা আল বাক্বারাহ , আয়াত : ৮৫)।

(খ) আল্লাহ আরো বলেন,

“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী আইন পরিচালনা করে না, তারাই কাফের।” (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৪৪)

(গ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।” (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৪৫)।

(ঘ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই পাপাচারী।” (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৪৭)।

(ঙ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তারপর হে মুহাম্মাদ ! তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং আল কিতাবের মধ্য থেকে তার সামনে যা কিছু বর্তমান আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী ও তার সংরক্ষক৷ কাজেই তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইনি অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করো এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না৷ তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি” (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৪৮)।

(চ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“কাজেই হে মুহাম্মাদ ! তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করো এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না৷ সাবধান হয়ে যাও, এরা যেন তোমাকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেই হেদায়াত থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করছেন৷ যদি এরা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ এদের কোন কোন গোনাহর কারণে এদেরকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন৷ আর যথার্থই এদের অধিকাংশ ফাসেক।” (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৪৯)।

(ছ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায় ? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফায়সালাকারী আর কেউ নেই ৷ (সুরা আল মায়েদাহ আয়াতঃ৫০)।

(জ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত। [সুরা আলি ইমরান, ৩ : ৮৫]

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন যে, ইসলামের বিপরীত অন্য কোন ধর্ম বা জীবনব্যবস্থা কেউ গ্রহণ করলে তা আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত এবং তারা আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ইসলাম কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি উভয় দিক থেকে পরিপূর্ণ। তাই এখানে নতুন করে সংযোজন ও বিয়োজনের কোন সুযোগ নেই। প্রয়োজন নেই অন্য কোন মতবাদ গ্রহণের।

(ঝ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম। [সুরা আল মায়িদা, ৫ : ৩]

সুতরাং ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। তাই মুসলিমদের জন্য ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। হোক তা হিন্দুইজম বা সেক্যুলারিজম।

(ঞ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সুরা বাকারা, ২ : ২০৮]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, পুরোপুরি ইসলামের আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। মহান আল্লাহ তাঁর ওপরে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণকে ও তাঁর নবির সত্যতা স্বীকারকারীগণকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন তাঁর সমস্ত নির্দেশ মেনে চলে এবং সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় হতে বিরত থাকে ও পূর্ণ শরিয়তের ওপর আমল করে।

সেক্যুলারিজমের দর্শন অনুযায়ী রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি তথা জীবনের সকল দিক থেকে ইসলামকে বাদ দিতে হবে। যেখানে কুরআনের একটি বিধান মানতে অস্বীকৃতি জানালে সর্বসম্মতিক্রমে কোন ব্যক্তি মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যায়। সেখানে সেক্যুলার হতে হলে প্রায় গোটা ইসলামকেই ত্যাগ করতে হয়। বিধান সংক্রান্ত শত শত আয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়। সেক্যুলারিজম যে ইসলাম বিরোধী এবং কুফর এতে কারও অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। সেক্যুলারদের দ্রোহ মূলত আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে। তাই এদের বলা উচিৎ আল্লাহদ্রোহী।

অতএব ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম সুস্পষ্ট কুফরি। এ ব্যাপারে বিশ্বের সমস্ত আলেম- উলামা ইসলামী স্কলারগণ একমত। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।কোন মুসলিম কখনও ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেনা।

ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম সম্পূর্ণ তাওহীদের বিপরীত একটি কুফরী ও ভ্রা্ন্ত তাগুতী মতবাদ। তাই এই মতবাদে বিশ্বাস করা মানে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর সাথে লড়াই করা। কিন্তু আমাদের মুসলিম সমাজে এমন কিছু জ্ঞানী গুণী মুসলমান আছেন যারা এই তাগুতী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে দীর্ঘ দিন থেকে লড়াই করে আসছে। সংবিধানে এই মতবাদকে স্থান দেয়া হয়েছে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইহার কার্যকারিতা চালু করা হয়েছে। কাফের মুশরিকরা এসব কর্মকান্ড করে সেটা তাদের জন্যে ঠিক আছে। কিন্তু নামধারী মুসলমানরা তাদের পক্ষ নিয়ে অন্য মুসলমানকে হত্যা করবে, জেল জুলুম করবে সেটা তো হতে দেয়া যায় না। দুঃখের বিষয় আমরা এখন সেই  সেকুলারিজম রাষ্ট্রে বসবাস করছি।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেকুলাজিমে বিশ্বাসীদের শেষ পরিনতিঃ

“দিনার ও দিরহামের পূজারি ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক কারুকাজের পোশাক ও মখমলের বিলাসী। যদি তাকে কিছু দেওয়া হয় সন্তুষ্ট থাকে; আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সে মুখ থুবড়ে পড়ুক অথবা মাথা থুবড়ে পড়ুক। সে কাটা বিদ্ধ হলে কেউ তা তুলতে না পারুক।”[সহিহ বুখারি (২৮৮৭]

তাদের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম হচ্ছে: আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন: “তবে কি তোমরা কিতাবের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই।” [সূরা বাকারা, আয়াত: ৮৫]

সুতরাং যে ব্যক্তি যে বিধানগুলো তার মনঃপুত হয় যেমন পারিবারিক আইন, কিছু কিছু ইবাদত সেগুলো মানে আর যেগুলো তার মনঃপুত হয় না সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে সেও এ আয়াতের বিধানের মধ্যে পড়বে। একই প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: “যে ব্যক্তি পার্থিবজীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, আমি দুনিয়াতেই তাদেরকে তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেব এবং এতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হবে না। এরাই হল সেসব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছু নেই।” [সূরা হুদ, আয়াত: ১৫-১৬]

ধর্মনিরপেক্ষাবাদীদের টার্গেট হলো-দুনিয়া কামাই করা, দুনিয়ার মজা উপভোগ করা। এমনকি ইসলামে সেটা হারাম হলেও, কোন ফরজ ইবাদত পালনে প্রতিবন্ধক হলেও। তাই তারা এ আয়াতের হুমকির অধীনে পড়বে এবং এই আয়াতের অধীনেও পড়বে “যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা অতিসত্ত্বর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্যে জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে।”[সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ১৮] এ অর্থবোধক অন্যান্য আয়াত ও হাদিসগুলো তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে।

 (সমাপ্ত)

অন্যান্য Related পর্ব দেখতে এদের উপর ক্লিক করুনঃ   

(১) পিরতন্ত্র বা সুফিবাদ বনাম ইসলাম-(শয়তানের ওহী কার উপর নাযিল হয়?)।   

(২) পির-অলিদের ভ্রান্ত আক্বিদাহসমূহ। 

(৩) ইসলামি আইন বনাম মুসলমান।

 লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক
 
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮।)
.................................................................................................................
এক সাথে সকল পর্ব দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন
=========================================

BCSসহ যেকোনো সরকারি-বেসরকারি চাকরি সহজে পেতে BBC  এর উপর ক্লিক করুন।

-----------------------------------------------------
Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...