Search This Blog

Friday, May 27, 2022

ফরজ গোসলের পরেও মুসলমান কেনো নাপাক?

 

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম 

ফরজ  গোসলের পরেও  মুসলমান কেনো নাপাক?

ভূমিকাঃ আমি ২০১৪ সালে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত অবস্থায় খৃস্টান ধর্মাবলম্বী মার্টিন নামক একজন আমার সহকর্মী ছিলেন। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মার্টিন সাহেব আপনারা ফরজ গোসল তথা স্বামী স্ত্রী মিলনের পর বা অন্য কোনোভাবে অপবিত্র হলে কিভাবে পবিত্র হোন? জবাবে তিনি বললেন, কেনো স্যার, আমরা তো গোসলের আগে এক ঘটি বা এক মগ পানি নিয়ে তিনবার নমোঃ নমোঃ নমোঃ বলে মাথায় ঢেলে দেই। এরপর পুরো শরীর সাবান দিয়ে ঘষে পানি দিয়ে ধুয়ে নেই। এভাবে পবিত্র হয়ে যাই। এরা নমোঃ নমোঃ বলে এ জন্যে যে, এদের পূর্বপুরুষ সকলে হিন্দু ছিলো। যাই হোক, এদের ধর্মানুসারে এরা এভাবেই পবিত্র হয়। আসলে ইসলামি বিধান মোতাবেক এভাবে গোসল করলে কি পবিত্র হওয়া যায়? এরা যেমন ইসলামি বিধান মোতাবেক পবিত্র নয় তেমনি ইসলামি সহিহ বিধান মোতাবেক মুসলমানগণও গোসল না করলে তারাও পবিত্র নয়। এখানে সহিহ হাদিস ভিত্তিক যেভাবে গোসলের বর্ণনা দেয়া আছে আপনি পড়ার পর বুঝতে পারবেন আপনি নিজেও অপবিত্র।

বর্তমান মুসলিম সমাজের দিকে লক্ষ্য করুন, দিন দিন পরকিয়া প্রেমসহ ছেলে মেয়েদের অবৈধ সম্পর্ক, অবৈধ মেলামেশা কিংবা প্রেম-প্রীতি, ভিডিও-অডিও চ্যাটিং বেড়েই চলছে। এসব কাজে জড়িতজনেরা ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টাই নাপাক থেকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিভিন্ন পার্ক, নদীর তীর তথা বিনোদন স্পটগুলোতে গেলে দেখা যায় প্রকাশ্যে যুবক-যুবতীগণে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আর্থিং হয়ে বসে আছে। এভাবে বসে থাকায় তাদের মধ্যে দৈহিক ও মানসিক আকর্ষণে নাপাক হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের কৃষক শ্রেণি, শ্রমিক শ্রেণি তেমনি শহুরে শ্রমিক শ্রেণি, বস্তিবাসী, ধণিক শ্রেণি, স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এবং ইসলাম বিরোধী মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় এরা ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম কানুন সম্পর্কে উদাসীন। ফরজ গোসল কিভাবে করতে হয় যেমন জানে না, তেমনি শেখার চেষ্টাও করে না। এরা বিয়ে করে, বাসর করে, সাবান আর পানি ঢেলে সেই মার্টিন এর মতোই গোসল সেরে পবিত্র হয়। যা ইসলামের দৃষ্টিতে আজীবনই নাপাক। তাই আসুন সঠিক পদ্ধতিতে ফরজ গোসল করা শিখি, পবিত্র থাকি।

ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক। এমনকি ধর্মীয় সব হুকুম-আহকাম পালন পবিত্রতার ওপর নির্ভর করে। এজন্য ইসলামের পরিভাষায় পবিত্রতাকে ইমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। আবূ মালিক আল আশ্’আরী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাক-পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮১,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪২২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৩, আহমাদ ৫/৩৪২-৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতএব একজন মানুষকে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করতে হলে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার নাপাকি থেকে পবিত্র হতে হবে।

আল্লাহ কোরআনে পবিত্রতার কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন।’ (সূরা আল বাকারা : ২২২)।

এ প্রসঙ্গে হাদিসে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন কোন মুসলিম অথবা মু’মিন বান্দা উযূ  করে এবং তার চেহারা ধুয়ে নেয়, তখন তার চেহারা হতে পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার চোখের দ্বারা কৃত সকল গুনাহ বের হয়ে যায় যা সে চোখ দিয়ে দেখেছে। যখন সে তার দুই হাত ধোয় তখন তার দুই হাত দিয়ে করা গুনাহ পানির সাথে বা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায় যা তার দু’ হাত দিয়ে ধরার কারণে সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সে যখন তার দুই পা ধোয়, তার পা দ্বারা কৃত গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায় যে পাপের জন্যে তার দু’ পা হাঁটছে। ফলে সে উযূর জায়গা হতে উঠার সময়) সকল গুনাহ হতে পাক-পবিত্র হয়ে যায়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮৫,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৬৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৮, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইসলামে পবিত্রতা অর্জনের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পন্থা রয়েছে। যেমন গোসল, অজু, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, দাঁত পরিষ্কার রাখতে মিসওয়াক করা, শরীরে ময়লা লাগলে ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি।

সহিহ হাদিস ভিত্তিক ফরজ গোসলের নিয়ম

গোসলের সংজ্ঞাঃ ‘গোসল’ অর্থ ধৌত করা। শারঈ পরিভাষায় গোসল অর্থ: পবিত্রতা অর্জনের নিয়তে ওযূ করে সর্বাঙ্গ ধৌত করা।

গোসলের প্রকারভেদ

গোসল দু’প্রকারঃ ফরয ও মুস্তাহাব।

(১) ফরযঃ ঐ গোসলকে বলা হয়, যা করা অপরিহার্য। বালেগ বয়সে নাপাক হ’লে গোসল ফরয হয়। যেমন- আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা নাপাক হয়ে থাক, তবে গোসল কর’ (মায়েদাহ ৬)।

(২) মুস্তাহাবঃ ঐ গোসলকে বলা হয়, যা অপরিহার্য নয়। কিন্তু করলে নেকী আছে। যেমন- জুম‘আর দিনে বা দুই ঈদের দিনে গোসল করা। সাধারণ গোসলের পূর্বে ওযূ করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সাইয়িদ সাবিক্ব একে ‘মানদূব’ (পসন্দনীয়) বলেছেন। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪১)।

গোসলের নিয়তঃ আমাদের সমাজে প্রচলিত গোসলের নিয়ত, “নাওয়াইতুয়ান গোসলা লিরাফইল জানাবাতি” কোনো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। গোসলের নিয়তের এই বাক্যটি শুধুই জনশ্রুতি। তাই মুখে উচ্চারণ করে এই নিয়ত করা যাবে না। আপনি পবিত্র হওয়ার জন্যে গোসল করছেন তা মনে মনে থাকলেই হবে। এখানে ওযুর নিয়মে গোসল করার কয়েকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেই পবিত্রতা অর্জন হবে। মুখে নিয়ত উচ্চারণ করতে হবে না।

রাসুল সাঃ এরুপ করেননি তাই আমরাও করবো না।

প্রকাশ যে, গোসল, ওযু বা অন্যান্য কর্মের সময় নিয়ত আরবীতে বা নিজ ভাষায় মুখে উচ্চারণ করা বিদআত।

গোসলের নিয়ত যেমন মুখে উচ্চারণ করে বলার কোনো হাদিস নেই তেমনি গোসলের পূর্বে “বিছমিল্লাহ” বলারও কোনো হাদিস নেই। তবে গোসলের বিষয়টি যেহেতু ওযুর সাথে সম্পৃক্ত আর ওযুর পূর্বে “বিছমিল্লাহ” না বললে যেহেতু ওযু হয় না তাই গোসলের শুরুতে “বিছমিল্লাহ” বলতে হবে।

অনেকে শুরুতেই “বিছমিল্লাহ” পাঠ করেন আবার অনেকে দুই হাতের কবজি ধৌত করার পর বাম হাত দিয়ে নাপাকি দূর করে বাম হাত ধুইয়ে “বিছমিল্লাহ” বলে সালাতের ওযুর মতো ওযু শুরু করেন।

আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি উযূর সময় আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করেনি তার উযূ হয়নি। (সুনানে ইবনে মাজাহ. ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯ দারিমী ৬৯১, ইরওয়াহ ৮১, মিশকাত ৪০৪, সহীহ আবূ দাউদ ৯০, ১০১, তিরমিযী ২৫ । হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

ফরজ  গোসলের সহিহ পদ্ধতি

(ক)  প্রথমে ৩ বার দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুতে হবে।

(খ) অতঃপর বাম হাতের উপর পানি ঢেলে দিয়ে দেহের যেসব স্থানে নাপাকী লেগেছে সেইসব স্থান ভালভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।

(গ)  তারপর বাম হাতকে মাটি অথবা সাবান দ্বারা ধুয়ে নিতে হবে।

(ঘ)  এরপর সালাতের জন্য ওযু করার মত পূর্ণ ওযু করতে হবে।

অবশ্য গোসলের জায়গা পরিষ্কার না হলে ওযু করার সময় দুই পা না ধুয়ে গোসল শেষে সেই স্থান থেকে একটু সরে গিয়ে দুই পা ধুয়ে নিতে হবে।

(ঙ)  ওযুর পর প্রথমে ৩ বার মাথায় পানি ঢেলে ভাল করে চুলগুলো ধুয়ে নিতে হবে, যাতে সমস্ত চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছে যায়। তারপর সারা দেহে ৩ বার পানি ঢেলে ভালরুপে ধুতে হবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৪৩৫-৪৩৬)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্রতার জন্য ফরয গোসল করার সময় প্রথমে (কব্জি পর্যন্ত) দুই হাত ধুতেন। এরপর সালাতের উযূর মতো উযূ করতেন। অতঃপর আঙ্গুলগুলো পানিতে ডুবিয়ে তা দিয়ে মাথার চুলের গোড়া খিলাল করতেন। অতঃপর মাথার উপর তিন অঞ্জলি পানি ঢালতেন, তারপর শরীরের সর্বাঙ্গ পানি দিয়ে ভিজাতেন।

কিন্তু ইমাম মুসলিম-এর অপর বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাত্রে হাত ডুবিয়ে দেয়ার আগে কব্জি পর্যন্ত হাত ধুতেন। তারপর ডান হাত দিয়ে বাম হাতের তালুতে পানি ঢেলে লজ্জাস্থান ধুতেন, অতঃপর উযূ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৩৫-৪৩৬, সহীহ বুখারী ২৪৮, মুসলিম ৩১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এখানে সুস্পষ্ট করে মনে রাখতে হবে যে, উল্লেখিত পদ্ধতি মোতাবেক যারা ফরজ গোসল করেন না তারা ২৪ ঘন্টাই নাপাক অবস্থায় থাকেন। এমতাবস্থায় তারা সর্বত্র বিচরন করেন, এমনকি এই নাপাক দেহ নিয়ে মসজিদে বা একাকী সালাতসহ অন্যান্য ইবাদতগুলো পালন করেন। অথচ তিনি জানেনই না যে, তার ফরজ গোসল হয়নি। তিনি অপবিত্র।

মনে রাখবেন, গোসল শুদ্ধ না হলে দেহ পবিত্র হবে না, দেহ পবিত্র  না হলে সালাত আদায় হবে না।

গোসল সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়

(১) মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে। (বুখারী, মিশকাত ৪৩৮)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

উম্মু সালামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি আমার চুলের খোপা খুব শক্ত করে বেঁধে থাকি। আমি নাপাকির গোসল করতে কি তা খুলে নিব? তিনি বলেনঃ তোমার হাতে করে তিনবার মাথায় পানি ঢাললেই তা তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। অতঃপর তুমি তোমার সমস্ত দেহে পানি ঢেলে দিবে এবং তাতেই তুমি পবিত্র হয়ে যাবে অথবা তিনি বলেছেনঃ এরূপ করলেই তুমি পবিত্র হয়ে গেলে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৩৭৬, ৬০৩, ৬০৪, তাখরীজ আলবানী: ইরওয়াহ ১৩৬, সহীহ আবূ দাউদ ২৪৫, সহীহহাহ ১৮৯, তাখরীজ কুতুবুত সিত্তাহ: বুখারী ২৫০, ২৬১, ২৬৩, ২৭৩, ৩০১; মুসলিম ৩৩০, ৩২১-৫, ৩৩১; তিরমিযী ১০৫,  ১৭৫৫, নাসায়ী ২২৮, ২৩১-২৩৫, ৪১০-৪১৪, ৪১৬, ২৪১ আবূ দাঊদ ৭৭, ২৩৮, ২৫১, আহমাদ ২৩৪৯৪, ২৩৫৬৯, ২৩৬৪০, ২৩৮২৮, ২৪০৭৮, ২৪১৯৮, ২৪৩৪৫, ২৪৩৯৪, ২৪৪৩২, ২৪৪৫৭, ২৪৪৭০, ২৪৭০৭, ২৪৭৪৯, ২৪৮২৫, ২৪৮৪১, ২৪৮৫২, ২৪৮৬১, ২৪৮৭৭, ২৫০৩৫, ২৫০৫৫, ২৫০৮০, ২৫১০৬, ২৫২৩৬, ২৫৩৯৪, ২৫৪১০, ২৫৪৪৯, ২৫৬৪৫, ২৫৭৫৬, ২৭৬৫৯, ২৫৯৩৭, ২৬১৩৭, দারিমী ৭৪৯-৫০, ১১৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) নখে নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট্‌ থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ (?) থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না।

(৩) বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ৬০ পৃ: দ্র:)।

(৪) গোসলের পর সালাতের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই সালাত হয়ে যাবে। (মিশকাত ৪৪৫,আবূ দাঊদ ২৫০, তিরমিযী ১০৭, নাসায়ী ২৫২, ইবনু মাজাহ্ ৫৭৯)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসলের পর (সালাত বা অন্যান্য ’ইবাদাতের জন্য নতুন করে) উযূ করতেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৪৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৫০, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১০৭, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ২৫২, সুনান ইবনু মাজাহ ৫৭৯। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় সালাত মাফ নয়। (মিশকাত ৫৬০-৫৬১, আবূ দাঊদ ২৯৭, তিরমিযী ১২৬, সহীহুল জামি‘ ৬৬৯৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)। আবূ দাঊদ ২৮৭, তিরমিযী ১২৮, ইরওয়া ২০৫, আহমাদ ২৭৪৭৪। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

’আদী ইবনু সাবিত (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি তার পিতার মাধ্যমে তার দাদা হতে, ইয়াহ্ইয়া ইবনু মা’ঈন বলেন, ’আদী এর দাদার নাম দীনার, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুসতাহাযা স্ত্রীলোক সম্পর্কে বলেছেন, সে হায়যগ্রস্ত অবস্থা থাকাকালীন সালাত পরিত্যাগ করবে। অতঃপর মেয়াদ শেষে গোসল করবে এবং প্রত্যেক সালাতের সময় উযূ করবে। আর সওম (রোযা) পালন করবে ও সালাত আদায় করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ১২৬, সহীহুল জামি ৬৬৯৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৬) সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩০৪)।

(৭) রাসূল (ছাঃ) এক মুদ্দ (৬২৫ গ্রাম) পানি দিয়ে ওযূ এবং অনধিক পাঁচ মুদ্দ (৩১২৫ গ্রাম) বা প্রায় সোয়া তিন কেজি পানি দিয়ে গোসল করতেন। (আবুদাঊদ ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৬, নাসায়ী ৩৪৫, ইবনু মাজাহ ২৬৮, ৩৮৬৪, আহমাদ ৮৬, ৮৭, ১২১, ২১৮, ২২৪, ২৩৮, ৩০৩, ৩৭০,আবদ ইবনু হুমাইদ ১১১৪, ইবনু খুযাইমাহ ১১৭,  নাসায়ী ৭৪, ইবনু হিব্বান ১৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুদ্দ পানি দিয়ে উযূ করতেন এবং এক সা পানি দিয়ে গোসল করতেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৬৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৯২, আহমাদ ২৪৪৯৪, ২৫৪৪৩, ২৫৫৮৯, ২৫৮৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপচয় করা ঠিক নয়।

(৮) নারী হৌক পুরুষ হৌক সকলকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পর্দার মধ্যে গোসল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৪৭, সহীহ আবূ দাঊদ ৪০১২, নাসায়ী ১/৭০, আহমাদ ৪/২২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

ইয়া’লা [ইবনু মুররাহ্] (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উলঙ্গ উন্মুক্ত জায়গায় গোসল করতে দেখলেন এবং (রাগভরে) তিনি মিম্বারে দাঁড়ালেন। প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন, এরপর বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বড় লজ্জাশীল ও পর্দাশীল। তিনি লজ্জাশীলতা ও পর্দা করাকে বেশী পছন্দ করেন। তাই তোমাদের কেউ গোসল করতে গেলে যেন পর্দা অবলম্বন করে।

নাসায়ীর এক বর্ণনায় আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা বড় পর্দাশীল। অতএব তোমাদের কেউ গোসল করতে ইচ্ছা করলে সে যেন কোন কিছু দিয়ে পর্দা করে নেয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৪৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪০১২, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ১/৭০, আহমাদ ৪/২২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(৯) বাথরুমে বা পর্দার মধ্যে বা দূরে লোক চক্ষুর অন্তরালে নগ্নাবস্থায় গোসল করায় কোন দোষ নেই। (মুসলিম ৩৩৯; বুখারী ২৭৮, মিশকাত ৫৭০৬-০৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ বনী ইসরাঈলের লোকেরা নগ্ন হয়ে একে অপরকে দেখা অবস্থায় গোসল করতো। কিন্তু মূসা (‘আঃ) একাকী গোসল করতেন। এতে বনী ইসরাঈলের লোকেরা বলাবলি করছিল, আল্লাহর কসম, মূসা (‘আঃ) ‘কোষবৃদ্ধি’ রোগের কারণেই আমাদের সাথে গোসল করেন না। একবার মূসা (‘আঃ) একটা পাথরের উপর কাপড় রেখে গোসল করছিলেন। পাথরটা তাঁর কাপড় নিয়ে পালাতে লাগল। তখন মূসা (‘আঃ) “পাথর! আমার কাপড় দাও, “পাথর! আমার কাপড় দাও”, বলে পেছনে পেছনে ছুটলেন। এদিকে বাণী ইসরাঈল মূসার দিকে তাকাল। তখন তারা বলল, আল্লাহর কসম মূসার কোন রোগ নেই। মূসা (‘আঃ) পাথর থেকে কাপড় নিয়ে পরলেন এবং পাথরটাকে পিটাতে লাগলেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, পাথরটিতে ছয় কিংবা সাতটা পিটুনীর দাগ পড়ে গেল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৭৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৭, ৬০৪০, ৬০৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৩৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৭০৬, মুসনাদে আহমাদ ৯০৮০, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩১৮৪৯, সহীহুল জামি ৪৪৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১০) ওযূ সহ গোসল করার পর ওযূ ভঙ্গ না হ’লে পুনরায় ওযূর প্রয়োজন নেই। (মিশকাত ৪৪৫,সহীহ আবূ দাঊদ ২৫০, তিরমিযী ১০৭, নাসায়ী ২৫২, ইবনু মাজাহ্ ৫৭৯। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

 ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসলের পর সালাত (বা অন্যান্য ’ইবাদাতের জন্য নতুন করে) উযূ করতেন না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৪৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৫০, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১০৭, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ২৫২, সুনান ইবনু মাজাহ ৫৭৯। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (১১) ফরয গোসলের পূর্বে নাপাক অবস্থায় পবিত্র কুরআন স্পর্শ করা যাবে না। তবে মুখে কুরআন পাঠ করা এবং মসজিদে প্রবেশ করা জায়েয আছে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫১-৫২)।

নাপাক অবস্থায় কুরআন পাঠ করা যাবে না মর্মে যেসব হাদিস আছে সেগুলো জইফ ও মুনকার।

দেখুন,

(ক) আবদুল্লাহ ইবনু সালামাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) এর নিকট গেলাম। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়খানায় গিয়ে তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে বের হয়ে এসে আমাদের সাথে রুটি ও গোশত খেতেন, কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং তাঁকে কোন জিনিস এ থেকে বিরত রাখতো না। রাবী কখনো বলতেন, গোসলের প্রয়োজন হয় এরূপ নাপাক অবস্থা ব্যতীত কোন জিনিস তাঁকে কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখতো না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৯৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ১৪৬, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত)  ২৬৫-৬৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)  ২২৯, আহমাদ ৬২৮, ৬৪০, ৬৮৮, ৮৪২, ১০১৪, ১১২৬)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

দেখুন,

(খ) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নাপাক ব্যাক্তি ও ঋতুবতী স্ত্রীলোক কুরআন তিলাওয়াত করবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৯৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)  ১৪৬, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ২৬৫-৬৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)  ২২৯, আহমাদ ৬২৮, ৬৪০, ৬৮৮, ৮৪২, ১০১৪, ১১২৬)। হাদিসের মানঃ মুনকার (সহীহ হাদীসের বিপরীত)।

দেখুন,

(গ) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নাপাক ব্যাক্তি ও ঋতুবতী স্ত্রীলোক কুরআনের কিছুই তিলাওয়াত করবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৯৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩১)। হাদিসের মানঃ মুনকার (সহীহ হাদীসের বিপরীত)।

উল্লেখ্য যে, সাধারণ অপবিত্রতায় কুরআন স্পর্শ করা বা বহন করা জায়েয আছে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৩)।

 ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ বাকর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আমর ইবনু হাযম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমর ইবনু হাযম-এর কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতে এ কথাও লেখা ছিল যে, পবিত্র লোক ছাড়া যেন কোন ব্যক্তি কুরআন স্পর্শ না করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬৫, সহীহ: মালিক ৪৬৮, দারাকুত্বনী, সহীহুল জামি‘ ৭৭৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১২) পানি - পুরুষ এবং নারীর একে অপরের গোসলের অবশিষ্ট পানি দ্বারা গোসল করা নিষেধ।

(১৩) আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (রহমতের) ফিরিশতাবর্গ তিন ব্যক্তির নিকটবর্তী হন না; কাফেরের দেহ, খালূক মাখা ব্যক্তি এবং নাপাক ব্যক্তি; যদি উযূ না করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬৪, হাদিস সম্ভার-৫৩০, ৫৩১, আবূ দাঊদ ৪১৮২)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৪) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমাদের কেউ স্ত্রীলোকের চার শাখার (দুই হাত দুই পা) মাঝখানে বসে সঙ্গমে রত হয় তখন তার ওপর গোসল করা ফরয হয়ে যায়, যদিও বীর্যপাত না হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত),৪৩০, সহীহ মুসলিম ৩৪৮, বুখারী ৩৪৮)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৫)  গনগোসলখানায় মহিলাদের প্রবেশ নিষেধঃ

(ক) উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সকল! অবশ্যই আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন অবশ্যই এমন (ভোজনের) দস্তরখানে না বসে, যাতে মদ্য পরিবেশিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন সাধারণ গোসলখানায় বিবস্ত্র হয়ে প্রবেশ না করে। আর যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন সাধারণ গোসলখানায় প্রবেশ না করে। (হাদিস সম্ভার-৫৫১, আহমাদ ১২৫, সহীহ তারগীব ১৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) উম্মে দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি সাধারণ গোসলখানা হতে বের হলাম। ইত্যবসরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি আমাকে বললেন, কোত্থেকে, হে উম্মে দারদা?! আমি বললাম, গোসলখানা থেকে। তিনি বললেন, সেই সত্তার শপথ; যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! যে কোনও মহিলা তার কোন মায়ের ঘর ছাড়া অন্য স্থানে নিজের কাপড় খোলে, সে তার ও দয়াময় (আল্লাহর) মাঝে প্রত্যেক পর্দা বিদীর্ণ করে ফেলে। (হাদিস সম্ভার-৫৫২, আহমাদ ২৭০৩৮, ত্বাবারানীর কাবীর, সহীহ তারগীব ১৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৬) উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন (আনাস (রাঃ)-এর মা) উম্মু সুলায়ম (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ তা‘আলা হক কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না। স্ত্রীলোকের স্বপ্নদোষের কারণে তার ওপর কি গোসল ফরয হয়? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেনঃ হাঁ, যদি (ঘুম থেকে জেগে উঠে) বীর্য দেখে। এ উত্তর শুনে উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) (লজ্জায়) স্বীয় মুখ ঢেকে ফেললেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল! স্ত্রীলোকেরও আবার স্বপ্নদোষ হয় (পুরুষের ন্যায় বীর্যপাত হয়)। উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। কি আশ্চর্য! (তা না হলে) তার সন্তান তার সদৃশ হয় কীভাবে? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত),৪৩৩, ৪৪১, সহীহ : বুখারী ১৩০, মুসলিম ৩১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৭) আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পুরুষের খতনার জায়গা মহিলার খতনার জায়গা অতিক্রম করলেই গোসল করা ফরয হয়ে যাবে। তিনি [‘আয়িশাহ্ (রাঃ)] বলেন, আমি ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেছি, তারপর দু’জনেই গোসল করেছি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৪২, সহীহ তিরমিযী ১০৮, ইবনু মাজাহ্ ৬০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৮)  নাপাক অবস্থায় ঘুমানোর নিয়মঃ

(ক) ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস বললেন, (কোন সময়) রাতে তার নাপাকী হয়ে গেলে (তৎক্ষণাৎ তার কী করা উচিত)? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তখন তুমি উযূ করবে, তোমার গুপ্তাঙ্গ ধুয়ে নিবে, অতঃপর ঘুমাবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত),৪৫২, সহীহ বুখারী ২৯০, মুসলিম ৩০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (খ) আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপবিত্র হওয়ার পর ঘুমানোর ইচ্ছা করলে তার পূর্বে সালাতের উযূর ন্যায় উযূ করে নিতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৯১, ৫৯৩, ৫৮৪, ৫৮৫, ৫৮৬, বুখারী ২৮৬, ২৮৭, ২৮৮, ২৮৯-৯০, মুসলিম ৩০১-২, ৩০৬, তিরমিযী ১১৮, নাসায়ী ২৫৫-৫৮, ২৫৯-৬০,  আবূ দাঊদ ২২১, ২২২, ২২৪, ৩৯০, আহমাদ ৩৬১, ৫০৩৬, ৫১৬৮, ৫২৯২, ৫৪১৯, ৫৪৭৩, ৫৯৩১, ২৩৫৬৩, ২৪০৭৮, ২৪১৯৩, ২৪১৯৬, ২৪৩৪৫, ২৪৩৫৩, ২৪৩৬১, ২৪৪২৮, ২৪৪৪৮, ২৪৫৮০, ২৪৬৩৪, ২৪৮০৩, ২৫০৫৫, ২৫০৬৫, ২৫১৩৯, ২৫২৮৬, ২৫৪৭২, ২৫৮১০, ২৫৮৫১; দারিমী ৭৫৬, ৭৫৭, মুওয়াত্ত্বা মালিক ১০৯ , সহীহাহ ৩৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ)  নাপাক অবস্থায় খেতে চাইলে তার নিয়মঃ

আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাপাক অবস্থায় কিছু খাওয়ার ইচ্ছা করলে উযূ করে নিতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৮৪, ৫৯১, ৫৯২, ৫৯৩, বুখারী ২৮৬, ২৮৮; মুসলিম ৩০১-২, তিরমিযী ১১৮, নাসায়ী ২৫৫-৫৮, আবূ দাঊদ ২২০, ২২২, ২২৪; আহমাদ ২৩৫৬৩, ২৪০৭৮, ২৪১৯৩, ২৪১৯৬, ২৪৩৪৫, ২৪৩৫৩, ২৪৩৬১, ২৪৪২৮, ২৪৪৪৮, ২৪৫৮০, ২৪৬৩৪, ২৪৮০৩, ২৫০৫৫, ২৫০৬৫, ২৫১৩৯, ২৫২৮৬, ২৫৪৭২, ২৫৮১০, ২৫৮৫১; দারিমী ৭৫৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  নাপাক অবস্থায় কেই খেতে চাইলে দু হাত ধুয়ে নিতে হবেঃ

আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাপাক অবস্থায় খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছা করলে তাঁর দু হাত ধুয়ে নিতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৫৮৪, ৫৯১, ৫৯৩, বুখারী ২৮৬, ২৮৮; মুসলিম ৩০১-২, তিরমিযী ১১৮, নাসায়ী ২৫৫-৫৮, আবূ দাঊদ ২১৯, ২২২, ২২৪; আহমাদ ২৩৫৬৩, ২৪০৭৮, ২৪১৯৩, ২৪১৯৬, ২৪৩৪৫, ২৪৩৫৩, ২৪৩৬১, ২৪৪২৮, ২৪৪৪৮, ২৪৫৮০, ২৪৬৩৪, ২৪৮০৩, ২৫০৫৫, ২৫০৬৫, ২৫১৩৯, ২৫২৮৬, ২৫৪৭২, ২৫৮১০, ২৫৮৫১; দারিমী ৭৫৭, । হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১৯) নাপাক অবস্থায় আবার স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে চাইলে তার নিয়মঃ

আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করার পর আবারও যদি সঙ্গম করতে চায়, তাহলে সে যেন মধ্যখানে (সালাতের উযূর মতো) উযূ করে নেয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৮৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত),৪৫৪, ৪৫৫, সহীহ মুসলিম ৩০৮, তিরমিযী ১৪১, নাসায়ী ২৬২, আবূ দাঊদ ২১৬, ২২০, আহমাদ ১০৭৭৭, ১০৮৪৩। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সকল  স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পর একবার গোসল করা

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সকল স্ত্রীর সাথে সহবাস শেষে একবার গোসল করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৮৮, ৫৮৯, বুখারী ২৬৮, ২৮৪, ৫০৬৮, ৫২১৫; মুসলিম ৩০৯, তিরমিযী ১৪০, নাসায়ী ২৬৩-৬৪, ৩১৯৮, আহমাদ ১১৫৩৫, ১২২২১, ১২২৯০, ১২৫১৪, ১২৫৫৫, ১২৯৪২, ১৩০৯৩, ১৩২৩৬; দারিমী ৭৫৩-৫৪, সহীহ আবূ দাউদ ২১৮,  ২১১-২১৩। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে অধিকতর বিশুদ্ধ, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হলো প্রত্যেকের সাথে সহবাসের পর পর গোসল করাঃ

আবূ রাফি (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাতে তাঁর স্ত্রীগণের সাথে সহবাস করলেন। তিনি তাদের প্রত্যেকের সাথে সহবাসের পর পর গোসল করেন। তাঁকে বলা হল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আপনি কেন একবার গোসল করলেন না? তিনি বলেনঃ সেটি অধিকতর বিশুদ্ধ, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ৫৯০, আবূ দাঊদ ২১৯। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

মুস্তাহাব গোসলসমূহ

(১) জুম‘আর ছালাতের পূর্বে গোসল করা।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ জুমু’আর সালাত আদায় করতে চাইলে (এর আগে) সে যেন গোসল করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৫৩৭-৫৩৯, সহীহ বুখারী ৮৭৭, ৮৫৮, মুসলিম ৮৪৪, ৮৪৬, ৮৪৯, ৮৯৮, নাসায়ী ১৩৭৬, ১৩৭৭, মালিক ১০৩/৩৩৮, আহমাদ ৫৩১২, ১১৫৭৮, দারেমী ১৫৭৭, সহীহ আল জামি ৪৫৮, ৩১৫৪, আবূ দাঊদ ৩৪১, ইবনু মাজাহ্ ১০৮৯, দারেমী ১৫৭৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ১২২৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৪২০। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) মোর্দা গোসল দানকারীর জন্য গোসল করা।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মৃত ব্যক্তিকে যে লোক গোসল দেয় সে নিজেও যেন গোসল করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৫৪১, সহীহ  আবূ দাঊদ ৩১৬১, তিরমিযী ৯৯৩, ইবনু মাজাহ্ ১৪৬৩, ইরওয়া ১৪৪, আহমাদ ৯৮৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) ইসলাম গ্রহণের সময় গোসল করা।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

ক্বায়স ইবনু ’আসিম (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বরই পাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৫৪৩, সহীহ  আবূ দাঊদ ৩৩৫, তিরমিযী ৬০৫, নাসায়ী ১৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) হজ্জ বা ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

যায়দ বিন সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের কাপড় খুলে গোসল করেছেন। তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন। (বুলুগুল মারাম, ৭৩০, দারাকুৎনী, হাকেম, ইরওয়াউল গালীল হা/১৪৯, ১/১৭৯ পৃঃ,  তিরমিযী ৮৩০, দারেমী ১৭৯৪)।  হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৫) আরাফার দিন গোসল করা। (বায়হাক্বী, ইরওয়া হা/১৪৬, ‘ফায়েদা’ দ্রষ্টব্য; নায়ল ১/৩৫৭)।

(৬) দুই ঈদের দিন সকালে গোসল করা। (বায়হাক্বী, ইরওয়া হা/১৪৬, ‘ফায়েদা’ দ্রষ্টব্য; নায়ল ১/৩৫৭)।

হায়েজ-নিফাজ

আর আল্লাহর বাণীঃ ‘‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে রক্তস্রাব সম্বন্ধে। আপনি বলুনঃ তা অশুচি। কাজেই রক্তস্রাব অবস্থায় তোমরা স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাকবে এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না। সুতরাং যখন তারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হবে তখন তোমরা তাদের কাছে ঠিক সেভাবে গমন করবে যেভাবে আল্লাহ্ তোমাদের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালবাসেন।’’ (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ্ ২/২২২)।

হায়েজ নিফাজ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়

(ক) হায়েজ অবস্থায় বাইতুল্লাহর ত্বওয়াফ ছাড়া হাজ্জের বাকী সব কাজ করা যাবেঃ

‘আয়িশাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা হাজ্জের উদ্দেশেই (মদিনা হতে) বের হলাম। ‘সারিফ’ নামক স্থানে পৌঁছার পর আমার হায়য আসলো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে আমাকে কাঁদতে দেখলেন এবং বললেনঃ কী হলো তোমার? তোমার হায়য এসেছে? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেনঃ এ তো আল্লাহ্ তা‘আলাই আদম-কন্যাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি বাইতুল্লাহর ত্বওয়াফ ছাড়া হাজ্জের বাকী সব কাজ করে যাও। ‘আয়িশাহ (রাযি.) বলেনঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে গাভী কুরবানী করলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ), ২৯৪, ৩০৫, ৩১৬, ৩১৭, ৩১৯, ৩২৮, ১৫১৬, ১৫১৮, ১৫৫৬, ১৫৬০, ১৫৬১, ১৫৬২, ১২৩৮, ১৬৫০, ১৭০৯, ১৭২০, ১৭৩৩, ১৭৫৭, ১৭৬২, ১৭৭১, ১৭৭২, ১৭৮৩, ১৭৮৬, ১৭৮৭, ১৭৮৮, ২৯৫২, ২৯৮৪, ৪৩৯৫, ৪৪০১, ৪৪০৮, ৫৩২৯, ৫৫৪৮, ৫৫৫৯, ৬১৫৭,৭২২৯;  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৮০০-২৮০৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২১১, আধুনিক প্রকাশনী- ২৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ২৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তার কোলে মাথা রেখে কুরআন তিলাওয়াত করাঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েযের অবস্থায় ছিলাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ),২৯৭)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) হায়েজ অবস্থায় একই চাঁদরে ঘুমানোঃ

উম্মু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে একই চাদরের নীচে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার হায়েয দেখা দিলে আমি চুপি চুপি বেরিয়ে গিয়ে হায়েযের কাপড় পরে নিলাম। তিনি বললেনঃ তোমার কি নিফাস দেখা দিয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর সঙ্গে চাদরের ভেতর শুয়ে পড়লাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ), ২৯৮, ৩২২, ৩২৩, ১৯২৯; মুসলিম ৩/২, হাঃ ২৯৬, আহমাদ ২৬৫৮৭) (আ.প্র. ২৮৯, ই.ফা. ২৯৪)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) হায়েজ অবস্থায় সালাত আদায়ঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ ফাতিমা বিনতে আবূ হুবায়শ (রাঃ) এর ইস্তিহাযা হতো। তিনি এ বিষয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন। আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ হচ্ছে রগের রক্ত, হায়েযের রক্ত নয়। সুতরাং হায়েয শুরু হলে সালাত ছেড়ে দেবে। আর হায়েয শেষ হলে গোসল করে সালাত আদায় করবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ) ২২৮, ৩২০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) হায়েজ অবস্থায় কাজা সালাত আদায়ঃ

মু’আযাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ জনৈকা মহিলা ‘আয়িশা (রাঃ) কে বললেনঃ হায়েযকালীন কাযা সালাত পবিত্র হওয়ার পর আদায় করলে আমাদের জন্য চলবে কি-না? ‘আয়িশা (রাঃ) বললেনঃ তুমি কি হারূরিয়্যাহ? (খারিজীদের একদল) আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে ঋতুবতী হতাম কিন্তু তিনি আমাদের সালাত কাযার নির্দেশ দিতেন না। অথবা তিনি [‘আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ আমরা তা কাযা করতাম না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ), ৩২১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৩৫, আহমাদ ২৪৭১৪) (আ.প্র. ৩১০, ই.ফা. ৩১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হায়েজ নিফাস থেকে নারী কখন পবিত্র হবে?

এক:

নীচের দুটো আলামতের কোন একটির মাধ্যমে হায়েয থেকে পবিত্র হওয়া জানা যায়:

(১) সাদা স্রাব নির্গত হওয়া। সেটা হচ্ছে স্বচ্ছ পানি; নারীরা যে পানিটা চিনে থাকে।

(২) লজ্জা স্থানটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ স্থানটির ভিতরে যদি কটন বা এ জাতীয় অন্য কিছু রাখা হয় তাহলে পরিষ্কার বেরিয়ে আসে। কটনের মধ্যে রক্তের দাগ, হলেদেটে বা লালচে দাগ থাকে না।

নারীর উচিত গোসল করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা; যাতে করে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে।

ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন:

হায়েযের আগমন ও প্রস্থান শীর্ষক পরিচ্ছেদ। নারীরা আয়েশা (রাঃ) এর কাছে ন্যাকড়ার থলেটি পাঠাত; যে ন্যাকড়াতে হলদেটে পানি থাকত। তখন তিনি বলতেন: তোমরা তাড়াহুড়া করো না; যতক্ষণ পর্যন্ত না সাদা স্রাব দেখতে পাও। তিনি এর দ্বারা উদ্দেশ্য করেছেন: হায়েয থেকে পবিত্রতা। যায়েদ বিন ছাবেতের মেয়ের কাছে খবর পৌঁছেছে যে, নারীরা রাতের বেলায় পবিত্রতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য চেরাগ চেয়ে পাঠাত। তখন তিনি বললেন: আগের নারীরা তো এভাবে করতেন না। তিনি তাদের এ কর্মের সমালোচনা করলেন।"[সমাপ্ত]

দুই:

যদি কোন নারী ফজরের আগে তার পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তাহলে তার উপর রোযা রাখা আবশ্যক হবে।

আর যদি পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হন তাহলে তার রোযা সহিহ হবে না; এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে, সারাদিনে তার থেকে কোন কিছু নির্গত হয়নি তবুও। কেননা হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া রোযার নিয়ত করা শুদ্ধ নয়।

তিন:

(ক) যদি কোন নারী পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে প্রথম রাত্রিতে গোসল করে ফেলেন; এরপর ফজরের আগে পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত হন এবং পুনরায় গোসল না করে রোযা রাখেন ও নামায পড়েন তাহলে তার রোযা সহিহ হবে; কিন্তু নামায সহিহ হবে না। কারণ রোযার জন্য কেবল হায়েযের রক্ত বন্ধ হওয়া শর্ত; যদি গোসল নাও করে। কিন্তু নামাযের জন্য অবশ্যই গোসল করতে হবে। আর হায়েযের রক্ত বন্ধ হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যাওয়ার কারণে তার প্রথম গোসল শুদ্ধ নয়।

(খ) "মুনতাহাল ইরাদাত" গ্রন্থে (১/৫২) বলেন: "'হায়েয ও নিফাসের গোসল করার জন্য শর্ত হল এ দুটো থেকে অবসর হওয়া।' অর্থাৎ হায়েয ও নিফাস বন্ধ হওয়া। যেহেতু এ দুটো চলমান থাকাটা গোসলের সাথে সাংঘর্ষিক"।[সমাপ্ত]।

(গ) "কাশ্‌শাফুল ক্বিনা" গ্রন্থে (১/১৪৬) গোসল ফরয হওয়ার কারণগুলো সম্পর্কে বলেন: "পঞ্চম কারণ হল: হায়েয নির্গত হওয়া"। দলিল হচ্ছে ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ (রাঃ)কে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: "(হায়েয) যখন চলে যাবে তখন গোসল করে নামায পড়বে"। [মুত্তাফাকুন আলাইহি]।

(ঘ) এবং তিনি উম্মে হাবিবা (রাঃ), সাহলা বিনতে সুহাইল (রাঃ) ও হামনা (রাঃ) প্রমুখ নারীদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এর পক্ষে সমর্থন রয়েছে আল্লাহ্‌তাআলার এই বাণীতে: "তারপর তারা যখন প্রকৃষ্টভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে তখন তাদের কাছে যাও।" [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২২] অর্থাৎ তারা যখন গোসল করবে। এখানে স্ত্রী গোসল করার আগে স্বামীকে সহবাস করতে বারণ করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, গোসল করা ওয়াজিব। কারণের সাথে বিধানকে সম্পৃক্ত করার হেতুবশতঃ রক্তপাত শুরু হওয়ার মাধ্যমেই গোসল ফরয হয়েছে। আর রক্তপাত বন্ধ হওয়া গোসল শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত।[সমাপ্ত]।

সহিহ হাদিস ভিত্তিক ওজু ও তায়াম্মুম এর সহিহ নিয়ম

ওযু আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় পরিষ্কার পানি দ্বারা এক বিশেষ পদ্ধতিতে মুখমন্ডল, হাত ও পা ধৌত করা এবং মাথা মাসেহ্ করাকে ওযু বলে। (সূরা বাকারা, আয়াত:২২২)।

ওযূ করার সঠিক পদ্ধতি

 (১) মুছল্লী প্রথমে মনে মনে ওযূ করার নিয়ত বা সংকল্প করবে। (ছহীহ বুখারী হা/১; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬; মিশকাত হা/১)।

হাদিসঃ

 “উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিয়্যাতের উপরই কাজের ফলাফল নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়্যাত অনুযায়ী ফল পাবে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহের জন্য হিজরত করবে সে হিজরত তার নিয়্যাত অনুসারেই হবে যে নিয়্যাতে সে হিজরত করেছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৮২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৯০৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২২০১, তিরমিযী ১৬৩৭, নাসায়ী ৭৫, সুনান ইবনু মাজাহ্ ৪২২৭, আহমাদ ১৬৯, ৩০২)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। (তিরমিযী ২৫;  ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭, মিশকাত ৪০২)।

হাদিসঃ

আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যাক্তি উযূর সময় আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করেনি তার উযূ হয়নি। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪০৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫, দারিমী ৬৯১, ইরওয়াহ ৮১, সহীহ আবূ দাউদ ৯০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অতঃপর,

(৩) ডান হাতে পানি নিয়ে (আবুদাঊদ ১০৮)।

হাদিসঃ

’উসমান ইবনু ’আবদুর রহমান আত-তাইমী সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু আবূ মুলায়কাহকে অযু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি ’উসমান ইবনু ’আফফান (রাঃ)-কে অযু সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে দেখেছি। তিনি (’উসমান) পানি চাইলেন। একটি পাত্রে পানি আনা হলে তিনি প্রথমে উক্ত পাত্র স্বীয় ডান হাতের উপর কাঁত করলেন (অর্থাৎ ডান হাত ধৌত করলেন)। এরপর পাত্রে ডান হাত ডুবিয়ে পানি নিয়ে তিনবার কুলি করলেন, তিনবার নাকে পানি দিলেন, তিনবার মুখমন্ডল ধুলেন, তিনবার ডান হাত ধুলেন, তিনবার বাম হাত ধুলেন, অতঃপর হাত ডুবিয়ে পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ্ করলেন- উভয় কানের ভিতর ও বহিরাংশ একবার করে মাসাহ্ করলেন। তারপর উভয় পা ধৌত করে বললেনঃ অযু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাকারীরা কোথায়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এরূপই অযু করতে আমি দেখেছি।’ (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করবে। (বুখারী ১৫৯, ইফাবা ১৬১, মিশকাত ২৮৭)।

হাদিসঃ

 উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি এরূপে উযূ করলেন, তিনবার নিজের দু’ হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুলেন, তারপর তিনবার কুলি করলেন, নাকে পানি দিয়ে তা ঝেড়ে পরিষ্কার করলেন, তিনবার মুখমণ্ডল ধুলেন, তারপর কনুই পর্যন্ত তিনবার ডান হাত ধুলেন, এভাবে বাম হাতও কনুই পর্যন্ত ধুলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন, তারপর ডান পা তিনবার ও বাম পা তিনবার করে ধুলেন। এরপর তিনি ’উসমান (রাঃ) বললেন, আমি যেভাবে উযূ করলাম এভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উযূ করতে দেখেছি। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি আমার ন্যায় উযূ করবে ও মনোযোগ সহকারে দুই রাক্’আত (নফল) সালাত আদায় করবে, তার পূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯৩৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৬-৪২৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সেই সাথে হাতের আঙ্গুলগুলো খিলাল করবে। (তিরমিযী ৭৮৮, নাসাঈ ১১৪; মিশকাত ৪০৫)।

হাদিসঃ

লাক্বীত্ব ইবনু সবুরাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে উযূ সম্পর্কে বলুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, উযূর অঙ্গগুলো পরিপূর্ণভাবে ধুবে। আঙ্গুলগুলোর মধ্যে (আঙ্গুল ঢুকিয়ে) খিলাল করবে এবং উত্তমরূপে নাকে পানি পৌঁছাবে, যদি সিয়াম পালনকারী (রোযাদার) না হও। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪০৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭৮৮, সুনান ইবনু মাজাহ্ ৪৪৮,  আহমাদ ১৫৯৪৫-৪৬, নাসায়ী ১১৪,  দারিমী ৭০৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আংটি থাকলে পানি পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। (ছহীহ বুখারী, তরজমাতুল বাব ‘ওযূ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৯, হা/১৬৫-এর পূর্বের আলোচনা, ইবনু সীরীন আংটির জায়গা ধৌত করতেন- ১/২৮ পৃঃ)।

(৪) ডান হাতে পানি নিয়ে একই সঙ্গে মুখে এবং নাকে পানি দিবে ও নাক ঝাড়বে। (বুখারী ১৯১, ইফাবা ১৯০,  মুসলিম ৫৭৮, ইফাবা ৪৪৬; মিশকাত ৩৯৪ ও ৪১২)।

হাদিসঃ

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু যায়দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। একদা তিনি পাত্র হতে দু’হাতে পানি ঢেলে দু’হাত ধৌত করলেন। অতঃপর এক খাবল পানি দিয়ে (মুখ) ধুলেন বা কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিলেন। তিনবার এরূপ করলেন। তারপর দু’ হাত কনুই পর্যন্ত দু’-দু’বার ধুলেন এবং মাথার সামনের অংশ এবং পেছনের অংশ মাসেহ করলেন। আর টাখনু পর্যন্ত দু’ পা ধুলেন। অতঃপর বললেনঃ ‘‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর উযূ এরূপ ছিল।’’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯১, ১৮৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪১২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)১১৯,সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৮, আধুনিক প্রকাশনী ১৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯০)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তারপর,

(৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতীসহ থুৎনীর নীচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ধৌত করবে। (বুখারী ১৫৯, ইফাবা ১৬১, মিশকাত ২৮৭)।

হাদিসঃ

হুমরান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি ‘উসমান ইবনু আফফান (রাযি.)-কে দেখেছেন যে, তিনি পানির পাত্র আনিয়ে উভয় হাতের তালুতে তিনবার ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন। অতঃপর ডান হাত পাত্রের মধ্যে ঢুকালেন। তারপর কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। তারপর তাঁর মুখমন্ডল তিনবার ধুয়ে এবং দু’হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। অতঃপর মাথা মাসেহ করলেন। অতঃপর দুই পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। পরে বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযূ করবে, অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৫৯, ১৬০, ১৬৪, ১৯৩৪, ৬৪৩৩; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৬, আহমাদ ৪৯৩, ৫১৩, আধুনিক প্রকাশনী ১৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তারপর,

এক অঞ্জলি পানি নিয়ে থুৎনীর নীচে দিয়ে দাড়ি খিলাল করবে। (আবুদাঊদ ১৪৫, তিরমিযী ৩১)।

হাদিসঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। তারপর ঐ পানি চোয়ালের নিম্নদেশে (থুতনির নীচে) লাগিয়ে দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেনঃ আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩১, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩০, বায়হাক্বী ‘সুনানুল কুবরা’ (১/৫৪), হাকিম (১/১৪৯), ইরওয়াউল গালীল (১/১৩০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতঃপর,

(৬) প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে। (বুখারী ১৪০, ইফাবা ১৪২)।

হাদিসঃ

ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি উয়ু করলেন এবং তাঁর মুখমন্ডল ধুলেন। এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। অতঃপর আর এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে অনুরূপ করলেন অর্থাৎ আরেক হাতের সাথে মিলিয়ে মুখমন্ডল ধুলেন। অতঃপর আর এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে ডান হাত ধুলেন। অতঃপর আর এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে তাঁর বাঁ হাত ধুলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসহ(মাসেহ) করলেন। অতঃপর আর এক আজলা পানি নিয়ে ডান পায়ের উপর ঢেলে দিয়ে তা ধুয়ে ফেললেন। অতঃপর আর এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে বাম পা ধুলেন। অতঃপর বললেনঃ ‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে এভাবে উযূ করতে দেখেছি।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এরপর,

(৭) নতুন পানি নিয়ে (মুসলিম ৫৮২, (ইফাবা ৪৫০), মিশকাত ৪১৫)।

হাদিসঃ

 ’আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উযূ  করতে দেখেছেন। আর এটাও দেখেছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাথা মাসাহ করলেন এমন পানি দিয়ে, যা তাঁর দুই হাতের পানির অবশিষ্টাংশ নয় (অর্থাৎ- নতুন পানি দিয়ে মাসাহ করলেন)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪১৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দুই হাত দ্বারা মাথার সম্মুখ হতে পিছনে ও পিছন হতে সম্মুখে নিয়ে গিয়ে একবার পুরো মাথা মাসাহ করবে। (বুখারী ১৮৫, (ইফাবা ১৮৫, মিশকাত ৩৯৪)।

হাদিসঃ

’আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ ইবনু ’আসিম (রাঃ)-কে বলা হলো, যেভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উযূ  করতেন ঠিক সেভাবে আপনি আমাদের সামনে উযূ করুন। তাই তিনি [’আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ)] পানি আনালেন। পাত্র কাত করে পানি নিয়ে দুই হাতের উপর পানি ঢেলে তিনবার হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর পাত্রের ভিতর হাত ঢুকিয়ে পানি এনে এক কোষ পানি দিয়ে কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন। তারপর আবার নিজের হাত পাত্রে ঢুকিয়ে পানি এনে তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন। আবার পাত্রে হাত ঢুকিয়ে পানি এনে নিজের মাথা মাসাহ এভাবে করলেন, প্রথমে নিজ হাত দু’টি সামনে থেকে পেছনের দিকে নিয়ে গেলেন। আবার পেছন থেকে সামনের দিকে নিয়ে এলেন, তারপর নিজের দুই পা গিরা পর্যন্ত ধুইলেন। অতঃপর বললেন, এরূপই ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উযূ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৯৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৫, ১৮৬, ১৯১, ১৯২, ১৯৭, ১৯৯; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৫, আহমাদ ১৬৪৪৫, আধুনিক প্রকাশনী ১৮০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

একই সঙ্গে ভিজা শাহাদাত আংগুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আংগুল দ্বারা কানের পিঠ মাসাহ করবে। (নাসাঈ ১০২, নায়ল ১/২৪২-৪৩; আবুদাঊদ ১৩৭; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১৬১; মিশকাত ৪১৩)।

হাদিসঃ

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মাথা ও দুই কান মাসাহ করেছেন। কানের ভিতরাংশ নিজের দুই শাহাদাত আঙ্গুল ও উপরিভাগ বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মাসাহ করেছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪১৩, নাসায়ী ১০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতঃপর,

(৮) ডান ও বাম পায়ের টাখনুসহ ভালভাবে ধৌত করবে। (বুখারী ১৮৫, ইফাবা ১৮৫, মিশকাত ৩৯৪)।

হাদিসঃ

সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ’আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ ইবনু ’আসিম (রাঃ)-কে বলা হলো, যেভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উযূ করতেন ঠিক সেভাবে আপনি আমাদের সামনে উযূ করুন। তাই তিনি [’আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ)] পানি আনালেন। পাত্র কাত করে পানি নিয়ে দুই হাতের উপর পানি ঢেলে তিনবার হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর পাত্রের ভিতর হাত ঢুকিয়ে পানি এনে এক কোষ পানি দিয়ে কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন। তারপর আবার নিজের হাত পাত্রে ঢুকিয়ে পানি এনে তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন। আবার পাত্রে হাত ঢুকিয়ে পানি এনে নিজের মাথা মাসাহ এভাবে করলেন, প্রথমে নিজ হাত দু’টি সামনে থেকে পেছনের দিকে নিয়ে গেলেন। আবার পেছন থেকে সামনের দিকে নিয়ে এলেন, তারপর নিজের দুই পা গিরা পর্যন্ত ধুইলেন। অতঃপর বললেন, এরূপই ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উযূ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর এক বর্ণনায় আছে, (মাসাহ করার জন্য) নিজের দুই হাতকে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে নিয়ে গেলেন। আবার পিছনের দিক থেকে সামনের দিকে নিয়ে এলেন। অর্থাৎ মাথার সামনের অংশ হতে ’মাসাহ’ শুরু করে দুই হাত পিছন পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর আবার পিছন থেকে শুরু করে হাত সেখানে নিয়ে এলেন যেখান থেকে শুরু করেছিলেন। অতঃপর দুই পা ধুইলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর অপর বর্ণনায় এভাবে বলা হয়েছে, তিনি এক কোষ পানি দিয়ে কুলি করলেন, আর নাকে পানি দিলেন। এভাবে তিনবার করলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বুখারীর বর্ণনার শব্দ হলো, তারপর তিনি মাথা মাসাহ করলেন। নিজের দুই হাতকে সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে নিয়ে গেলেন। আবার পেছন থেকে সামনের দিকে নিয়ে এলেন। আর এটা তিনি একবার করেছেন। অতঃপর টাখনু পর্যন্ত দুই পা ধুইলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ১৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বুখারীরই এক বর্ণনার শব্দ হলো, অতঃপর তিনি কুলি করলেন ও নাক ঝাড়লেন তিনবার এক কোষ পানি দিয়ে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ১৯৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ সময় বাম হাতের কনিষ্ঠা আংগুল দ্বারা পায়ের আংগুল সমূহ খিলাল করবে। (আবুদাঊদ ১৪৮, তিরমিযী ৪০; মিশকাত ৪০৬-০৭)।

হাদিসঃ

মুস্তাওরিদ ইবনু শাদ্দাদ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উযূ করার সময় দেখেছি যে, তিনি বাম হাতের ছোট আঙ্গুল দিয়ে দুই পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪০৭, ৪০৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৯,  সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৪৮, সহীহুল জামি ৪৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(৯) ওযূ শেষে বাম হাতে কিছু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিবে। (আবুদাঊদ ১৬৮, মিশকাত ৩৬১)।

হাদিসঃ

হাকাম ইবনু সুফ্ইয়ান (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্রাব করার পর উযূ করতেন এবং নিজের লজ্জাস্থানে পানি ছিটিয়ে দিতেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৬৮, নাসায়ী ১৩৫, দারিমী ৭৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১০) অতঃপর দু‘আ পাঠ করবে। উল্লেখ্য যে, ওযূর অঙ্গগুলো এক, দুই ও তিনবার ধোয়া যায়। এর বেশী ধোয়া যাবে না। (বুখারী ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯; মিশকাত ৩৯৫, ৩৯৬, ৩৯৭)।

একবার ধোয়াঃ

হাদিসঃ

’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (উযূর স্থানসমূহ) একবার করে উযূ করলেন। একবারের অধিক ধুলেন না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৫৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৯৫, আধুনিক প্রকাশনী ১৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৫৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

দুইবার ধোয়াঃ

‘আবদুল্লাহ্ ইবন যায়দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উযূতে দু’বার করে ধুয়েছেন।’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ১৫৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৫৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনবার ধোয়াঃ

হুমরান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি ‘উসমান ইবনু আফফান (রাযি.)-কে দেখেছেন যে, তিনি পানির পাত্র আনিয়ে উভয় হাতের তালুতে তিনবার ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন। অতঃপর ডান হাত পাত্রের মধ্যে ঢুকালেন। তারপর কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। তারপর তাঁর মুখমন্ডল তিনবার ধুয়ে এবং দু’হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। অতঃপর মাথা মাসেহ করলেন। অতঃপর দুই পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুলেন। পরে বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযূ করবে, অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৫৯, ১৬০, ১৬৪, ১৯৩৪, ৬৪৩৩; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২৬-৪২৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৬, আহমাদ ৪৯৩, ৫১৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ওযূর ফযীলতসমূহ

হযরত ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে এবং উত্তমরূপে ওযূ করে, তার শরীর হ’তে তার সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, এমনকি তার নখের নীচ হ’তেও তা বের হয়ে যায়’। (মুসলিম হা/২৪৫; আহমাদ হা/৪৭৬; মিশকাত হা/২৮৪)।

অন্যত্র এসেছে,

 আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যখন কোন মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা ওযূ করে এবং তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারা হ’তে পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার চোখের দ্বারা কৃত সকল গুনাহ বের হয়ে যায়। যা সে চোখ দিয়ে দেখেছে। যখন সে তার দুই হাত ধৌত করে তখন তার দুই হাত দিয়ে করা সকল গুনাহ পানির সাথে বা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায়। যা তার দু’হাত দিয়ে ধরার কারণে সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সে যখন তার দুই পা ধৌত করে, তার পা দ্বারা কৃত গুনাহ সমূহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায় যে পাপের জন্য তার দু’পা হেঁটেছে। ফলে সে (ওযূর জায়গা হ’তে উঠার সময়) সকল গুনাহ হ’তে পাক-পবিত্র হয়ে যায়’। (মুসলিম হা/২৪৪; তিরমিযী হা/৪৭৬; মিশকাত হা/২৮৫)।

ক্বিয়ামতের মাঠে মহানবী (ছাঃ) উম্মতে মুহাম্মাদীর ওযূর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উজ্জ্বল্য দেখে তাদেরকে চিনতে পারবে এবং হাউযে কাউছারে পানি পান করানোর জন্য আগেই পৌঁছে যাবে। হাদীছে এসেছে,

আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরস্থানে এসে কবরবাসীদের সালাম দিলেন এবং বললেনঃ ’’আসসালামু আলাইকুম দারা কাওমিম মুমিনীন ওয়াইন্না ইনশাআল্লাহ তাআলা বিকুম লাহিকুন(ঈমানদার কবরবাসীরা! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অচিরেই আল্লাহর মর্জি আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হবো)। অতঃপর তিনি বলেনঃ নিশ্চয় আমাদের আকাঙ্ক্ষা এই যে, আমরা আমাদের ভাইদের দেখতে পাবো। তারা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বলেনঃ তোমরা আমার সাহাবী। আর যারা আমাদের পরে আসবে তারা আমার ভাই। আমি তোমাদের আগেই হাওযের নিকট উপস্থিত হবো। তারা জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন লোকেদের আপনার উম্মাতরূপে কিভাবে চিনবেন, যারা এখনও জন্মগ্রহণ করেনি?

তিনি বলেনঃ তোমরা কি দেখো না, যদি কোন ব্যক্তির একটি সাদা পা ও সাদা পেশানীযুক্ত ঘোড়া অপর ব্যক্তির কোলো ঘোড়ার পালে মিশে যায়, তবে সে কি তার ঘোড়াটি চিনতে পারবে না? তারা বলেন, হাঁ, নিশ্চয় চিনতে পারবে। তিনি বলেনঃ তারা কিয়ামতের দিন উযুর বদৌলতে সাদা পেশানী ও সাদা হাত-পাবিশিষ্ট অবস্থায় আসবে। তিনি আরো বলেনঃ আমি তোমাদের আগেই হাওয কাওছারে উপস্থিত হবো। একদল লোক আমার হাওয থেকে বিতাড়িত হবে, যেমন পথভোলা উট বিতাড়িত হয়। আমি তাদেরকে ডেকে বলবোঃ তোমরা এদিকে এসো তোমরা এদিকে এসো। তখন বলা হবে, এসব লোক আপনার পর (দীনকে) পরিবর্তন করেছে এবং অবিরত তারা তাদের পশ্চাতে ফিরে গেছে। তখন আমি বলবোঃ সাবধান! দূর হও দূর হও। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩০৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৯৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৭২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৪৯, আহমাদ ৯০৩৭, আল-আহকাম ১৯০, ইরওয়া ৭৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কষ্ট সত্বেও যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযূ করে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং পদ মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে

ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতাইবাহ ও ইবনু হুজর (রহঃ).....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ (বান্দার) পাপরাশি দূর করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদে আসার জন্যে বেশি পদচারণা করা এবং এক সালাতের পর আর এক সালাতের জন্যে প্রতীক্ষা করা; আর এ কাজগুলোই হল সীমান্ত প্রহরা*।

* রিবাত (সীমান্ত প্রহরী) অর্থঃ কোন জিনিস থেকে বন্ধ থাকা, অর্থাৎ ইতাআতের উপর নিজের আত্মাকে বন্ধ রাখা, তাতে যত কষ্টই হোক। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৭৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫১, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত) ১৪৩, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৫১; মুয়াত্তা মালিক ৫৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৭৮, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ওযূর দো‘আর ফযীলত

 যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযূ করবে এবং শেষে ওযূর দো‘আ পাঠ করবে তার জন্য জান্নাতের সব কয়টি দরজা খুলে দেওয়া হবে। সে যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছামত প্রবেশ করতে পারবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযূ করার পর বলবে,

‘(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। হে আল্লাহ আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারী অন্তর্ভুক্ত কর)। তাঁর জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। যেটা দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করবে’। (মুসলিম হা/২৩৪; তিরমিযী হা/৫৫; মিশকাত হা/২৮৯)।

হাদিসঃ

’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি উযূ  করবে এবং উত্তমভাবে অথবা পরিপূর্ণভাবে উযূ করবে, এরপর বলবেঃ

“আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান ’আবদুহূ ওয়া রসূলুহ”

অর্থাৎ- ’আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল। আর এক বর্ণনায় আছেঃ

“আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা- শারীকা লাহূ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ’আবদুহূ ওয়া রসূলুহ”

(অর্থাৎ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল।) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে। এসব দরজার যেটি দিয়ে খুশী সে সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৮৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৪, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৫৫, সহীহুল জামি ৬১৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ওযু বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণা

ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা

মুখে নিয়ত বলার শারঈ কোন বিধান নেই। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি মানুষের তৈরী বিধান। অতএব তা পরিত্যাগ করে মনে মনে নিয়ত করতে হবে। (ছহীহ বুখারী হা/১; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬; মিশকাত হা/১)।

উল্লেখ্য যে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর নামে প্রকাশিত ‘পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও যরূরী মাসআলা মাসায়েল’ নামক বইয়ে বলা হয়েছে যে, ক্বিবলার দিকে মুখ করে উঁচু স্থানে বসে ওযূ করতে হবে। (হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ), ‘পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল’, সংকলনে ও সম্পাদনায়- মাওলানা আজিজুল হক (ঢাকা : মীনা বুক হাউস, ৪৫, বাংলা বাজার, চতুর্থ মুদ্রণ-আগস্ট ২০০৯), পৃঃ ৪২; উল্লেখ্য যে, মাওলানার নামে বহু রকমের ছালাত শিক্ষা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে চালু আছে। কোন্টি যে আসল অনুবাদ তা আল্লাহই ভাল জানেন)।

অথচ উক্ত কথার প্রমাণে কোন দলীল পেশ করা হয়নি। উক্ত দাবী ভিত্তিহীন।

ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রাহীম আল-ইসলামু হাক্কুন, ওয়াল কুফরু বাতিলুন, আল-ঈমানু নূরুন, ওয়াল কুফরু যুলমাতুন’ দু‘আ পাঠ করা

উক্ত দু‘আর প্রমাণে কোন ছহীহ দলীল নেই। যদিও মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) উক্ত দু‘আর সাথে আরো কিছু বাড়তি কথা যোগ করে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোন প্রমাণ উল্লেখ করেননি। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪৩)।

এটা পড়লে সুন্নাতের বিরোধিতা করা হবে। উক্ত দু‘আটি দেশের বিভিন্ন মসজিদের ওযূখানায় লেখা দেখা যায়। উক্ত দু‘আ হতে বিরত থাকতে হবে। বরং ওযূর শুরুতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। (ছহীহ তিরমিযী হা/২৫, ১/১৩ পৃঃ; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২, সনদ হাসান)।

প্রতিটি অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দু‘আ পড়া

ওযূর প্রত্যেক অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দু‘আ পড়তে হবে মর্মে আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি কোন দলীল পেশ করেননি। অন্য শব্দে একটি জাল হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

(রাসূল (ছাঃ) বলেন) হে আনাস! তুমি আমার নিকটবর্তী হও, তোমাকে ওযূর মিক্বদার শিক্ষা দিব। অতঃপর আমি তার নিকটবর্তী হলাম। তখন তিনি তাঁর দুই হাত ধৌত করার সময় বললেন, ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল হামদুল্লিা-হি ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হি’। যখন তিনি ইস্তিঞ্জা করলেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা হাছ্ছিন ফারজী ওয়া ইয়াস্সিরলী আমরী’। যখন তিনি ওযূ করেন ও নাক ঝাড়েন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা লাক্কিনী হুজ্জাতী ওয়ালা তারহামনী রায়েহাতাল জান্নাতি’। যখন তার মুখমন্ডল ধৌত করেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা বাইয়িয ওয়াজহী ইয়াওমা তাবইয়ায্যু উজূহুওঁ’। যখন তিনি দুই হাত ধৌত করলেন তখন বললেন, ‘আল্লাহুম্মা আ‘ত্বিনী কিতাবী ইয়ামানী’। যখন হাত দ্বারা মাসাহ করলেন তখন বললেন, ‘আল্লা-হুম্মা আগিছনা বিরহমাতিকা ওয়া জান্নিবনা আযাবাকা’। যখন তিনি দুই পা ধৌত করলেন তখন বললেন, ‘আল্ল-হুম্মা ছাবিবত ক্বাদামী ইয়াওমা তাযিল্লু ফীহি আক্বদাম’।

অতঃপর তিনি বলেন, হে আনাস! ঐ সত্তার কসম করে বলছি, যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, যে বান্দা ওযূ করার সময় এই দু‘আ বলবে, তার আঙ্গুল সমূহের ফাঁক থেকে যত ফোঁটা পানি পড়বে তার প্রত্যেক ফোঁটা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা একজন করে ফেরেশতা তৈরি করবেন। সেই ফেরেশতা সত্তরটি জিহবা দ্বারা আল্লাহর তাসবীহ বর্ণনা করবেন। এই ছওয়াব ক্বিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ, পৃঃ ১৩, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৩৩)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে উবাদা বিন ছুহাইব ও আহমাদ বিন হাশেমসহ কয়েকজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুৎনীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছও তাদেরকে পরিত্যক্ত বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, এই বর্ণনাটি বাতিল, এর কোন ভিত্তি নেই। (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ‘আহ, পৃঃ ১৩, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৩৩)।

ওযূর পানি পাত্রের মধ্যে পড়লে উক্ত পানি দ্বারা ওযূ হবে না বলে বিশ্বাস করা

এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) লিখেছেন, ‘উঁচু স্থানে বসবে, যেন ওযূর পানির ছিটা শরীরে আসতে না পারে’। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২)।

অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাত্রের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিতেন আবার বের করতেন। এভাবে তিনি ওযূ করতেন। (বুখারী হা/১৮৬, ১/৩১ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৮৬, ১/১১৯ পৃঃ); ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮; ১/১২৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৪৬); মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১, পৃঃ ৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭)।

ত্রুটিপূর্ণ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায়। ওযূর সময় কথা বললে ফেরেশতারা রুমাল নিয়ে চলে যায়

ওযূকারীর মাথার উপর চারজন ফেরেশতা রুমাল নিয়ে ছায়া করে রাখে। পর পর চারটি কথা বললে রুমাল নিয়ে চলে যায় বলে যে কাহিনী সমাজে প্রচলিত আছে, তা উদ্ভট, মিথ্যা ও কাল্পনিক। তাছাড়া খারাপ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায় এ আক্বীদাও ঠিক নয়। এ মর্মে যে হাদীছ রয়েছে তা জাল।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, অপবিত্রতা দুই প্রকার। জিহবার ও লজ্জাস্থানের অপবিত্রতা। দুইটি এক সমান নয়। লজ্জাস্থানের অপবিত্রতার চেয়ে জিহবার অপবিত্রতা বেশী। আর এর কারণে ওযূ করতে হবে। (আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনিল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ ফিল আহাদীছিল ওয়াহিয়াহ (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪০৩), হা/৬০৪; দায়লামী ২/১৬০, হা/২৮১৪; ইমাম সুয়ূত্বী, জামিউল আহাদীছ হা/১১৭২৬)।

তাহকবীক্ব : হাদীছটি বাতিল। (জাওয়াযকানী, আল-আবাতিল ১/৩৫৩ পৃঃ)।

এর সনদে বাক্বিয়াহ নামক রাবী রয়েছে, সে ত্রুটিপূর্ণ। সে দুর্বল রাবীদের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনাকারী। রাসূল (ছাঃ) থেকে উক্ত মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়নি। (আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ হা/৬০৪-এর আলোচনা দ্রঃ)।

কুলি করার জন্য আলাদা পানি নেওয়া

সুন্নাত হল হাতে পানি নিয়ে একই সঙ্গে মুখে ও নাকে পানি দেয়া। রাসূল (ছাঃ) এভাবেই ওযূ করতেন। ‘তিনি এক অঞ্জলি দ্বারাই কুলি করেন ও নাক পরিষ্কার করেন’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/১৯১, ১/৩১ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৯০, ১/১২১ পৃঃ), ‘ওযূ’ অধ্যায়, ‘এক অঞ্জলি পানি দিয়ে মুখ ও নাক পরিষ্কার করা’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮, ১/১২৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৪৬); মিশকাত হা/৩৯৪ ও ৪১২, পৃঃ ৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭)।

আলাদাভাবে পানি নেওয়ার যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। যেমন-

ত্বালহা (রাঃ) তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, আমি যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম তখন তিনি ওযূ করছিলেন। আর পানি তাঁর মুখমন্ডল ও দাড়ি থেকে তাঁর বুকে পড়ছিল। অতঃপর আমি তাকে দেখলাম, তিনি কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় পৃথক করলেন। (আবুদাঊদ হা/১৩৯, ১/১৮-১৯ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৪৯, পৃঃ ১৮)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে লাইছ ও মুছাররফ নামের দু’জন রাবী রয়েছে, যারা ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়াও আরো ত্রুটি রয়েছে। এই হাদীছ যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ একমত। (যঈফ আবুদাঊদ হা/১৩৯-এর আলোচনা দ্রঃ)।

শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, তালক বিন মুছাররফের হাদীছ পৃথক করা প্রমাণ করে, কিন্তু তা যঈফ। (শরহে বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৬)।

কান মাসাহ করার সময় নতুন পানি নেওয়া

ওযূতে কান মাসাহ করার ক্ষেত্রে মাথা ও কান একই সঙ্গে একই পানিতে মাসাহ করবে। ‘অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এক অঞ্জলি পানি নিতেন এবং হাত ঝাড়তেন। তারপর এর দ্বারা তাঁর মাথা ও কান মাসাহ করতেন’। (ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৩৭, ১/১৮ পৃঃ)।

এ জন্য পৃথকভাবে নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’। (তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪)।

তাছাড়া বায়হাক্বীতেও একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করার ছহীহ হাদীছ এসেছে। (বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১, সনদ ছহীহ)।

নতুনভাবে পানি নেয়ার হাদীছটি ছহীহ নয়। যেমন-

(ক) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছেন যে, পানি দ্বারা মাথা মাসাহ করেছেন। অতঃপর তা ব্যতীত কান মাসাহ করার জন্য পৃথক পানি নিয়েছেন। (বায়হাক্বী, মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১৯১, ১/২২৯ পৃঃ; বলূগুল মারাম হা/৩৯, পৃঃ ২৩)।

তাহক্বীক্ব: উক্ত শব্দে বর্ণিত হাদীছ যঈফ। উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার পরে হাদীছটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী ও বায়হাক্বীর যে মন্তব্য ইবনু হাজার আসক্বালানী তুলে ধরেছেন তা মূলতঃ এই হাদীছের ক্ষেত্রে নয়; বরং হাত ধৌত করার পর নতুন করে পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছটির ব্যাপারে, যা ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ)।

তাই আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,

‘সমালোচনা থেকে মুক্ত এমন কোন মারফূ হাদীছ এ ব্যাপারে আছে বলে আমি অবগত নই, যার দ্বারা নতুন পানি নিয়ে কান মাসাহ করা যাবে’। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১/১২২ পৃঃ, হা/২৮-এর আলোচনা; বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/১০৪৬ ও ৯৯৫; মাজমূউ ফাতাওয়া আলবানী, পৃঃ ৩৬)।

(খ) নাফে‘ বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) যখন ওযূ করতেন, তখন কান মাসাহ করার জন্য দুই আঙ্গুলে পানি নিতেন। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩১৪; মুওয়াত্ত্বা হা/৯২)।

তাহক্বীক্ব: এ বর্ণনাটিও যঈফ। বায়হাক্বীর মুহাক্কিক মুহাম্মাদ আব্দুল কবাদির ‘আতা বলেন, রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ঐ হাদীছগুলো যঈফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (বায়হাক্বী হা/৩১৭-এর ভাষ্য দ্রঃ)।

উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর ব্যক্তিগত আমলকে ইবনুল ক্বাইয়িম ছহীহ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু উক্ত ত্রুটি থাকার কারণে তা যঈফ। যেমন তিনি বলেন,

‘রাসূল (ছাঃ) দুই কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নিয়েছেন এমন হাদীছ প্রমাণিত হয়নি। তবে ইবনু ওমর থেকে সেটা ছহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে’। (ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ১/২০০ পৃঃ; বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৩-এর উক্ত হাদীছের ভাষ্য দ্রঃ)।

শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,

‘দুই কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং মাথা মাসহের জন্য নেয়া পানির সিক্ততা দিয়েই দুই কান মাসাহ করা জায়েয’। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬-এর ভাষ্য দ্রঃ)।

অতএব কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং মাথা ও কান একই সঙ্গে মাসাহ করতে হবে।

জ্ঞাতব্য: অনেকে কান মাসাহকে ফরয বলেন না। অথচ কানসহ মাথা মাসাহ করা ফরয। কারণ দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’। (তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪)।

তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন-

 ‘অতঃপর তিনি এক অঞ্জলি পানি নিতেন এবং মাথা ও দুই কান মাসাহ করতেন’। (ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৩৭; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১, সনদ ছহীহ)।

মাথা ও কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি না নেওয়া

অনেকে দুই হাত ধৌত করার পর সরাসরি মাথা মাসাহ করে, নতুন পানি নেয় না। যেমন আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেছেন, ‘কান ও মাথা মাছহে করার জন্য নতুন পানি নেয়ার প্রয়োজন নেই, ভেজা হাত দ্বারাই মাছহে করবে’। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২)।

এটি সুন্নাতের বরখেলাফ। কারণ রাসূল (ছাঃ) দুই হাত ধৌত করার পর নতুন পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন- ‘হাতের অতিরিক্ত পানি ছাড়াই তিনি নতুন পানি দ্বারা তাঁর মাথা মাসাহ করতেন’। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ, ‘নবী (ছাঃ)-এর ওযূ’ অনুচ্ছেদ)।

মাথার এক-চতুর্থাংশ মাসাহ করা

মাথা মাসাহ করার ব্যাপারে অবহেলা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ চুল স্পর্শ করাকেই মাসাহ মনে করেন, কেউ মাথার চার ভাগের একভাগ মাসাহ করেন এবং কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় নেমে পড়েন। কুদূরী ও হেদায়ার লেখক চার ভাগের এক ভাগ মাসাহ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আর দলীল হিসাবে পেশ করেছেন ছহীহ মুসলিমের হাদীছ। অথচ উক্ত হাদীছে পাগড়ী থাকা অবস্থায় মাসাহ করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কুদূরী এবং হেদায়াতে মুগীরা (রাঃ)-এর নামে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তা ভুল হয়েছে। (দ্রঃ ছহীহ মুসলিম হা/৬৪৭, ১/১৩৩ পৃঃ ও হা/৬৫৬, ১/১৩৪ পৃঃ)।

যা হেদায়ার টীকাতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তারা দুইটি হাদীছকে একত্রে মিশ্রিত করে উল্লেখ করেছেন। (আবুল হাসান বিন আহমাদ বিন জা‘ফর আল-বাগদাদী আল-কুদূরী, মুখতাছারুল কুদূরী (ঢাকা): ইসলামিয়া কুতুবখানা, বাংলাবাজার ১৯৮২/১৪০৩), পৃঃ ৩; শায়খুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনু আবী বকর আল-মারগীনানী (৫১১-৫৯৩ হিঃ), আল-হেদায়াহ (নাদিয়াতুল কুরআন কুতুবখানা (১৪০১), ১/১৭ পৃঃ; বঙ্গানুবাদ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ : মার্চ ২০০৬), ১/৬ পৃঃ)।

সুধী পাঠক! শরী‘আতের ব্যাখ্যা হিসাবে রাসূল (ছাঃ) সুন্দরভাবে মাথা মাসাহ করার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। কারণ পবিত্র কুরআন তাঁর উপরই নাযিল হয়েছে। আর তিনি মাথার সামনের দিক থেকে শুরু করে পিছনে চুলের শেষ পর্যন্ত দুই হাত নিয়ে যেতেন এবং সেখান থেকে সামনে নিয়ে এসে শেষ করতেন। এভাবে তিনি পুরো মাথা মাসাহ করতেন। যেমন-

‘অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাত দ্বারা মাথা মাসাহ করেন। এতে দুই হাত তিনি সামনে করেন এবং পিছনে নেন। তিনি মাথার অগ্রভাগ থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যেতেন অতঃপর যে স্থান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন’। (ছহীহ বুখারী হা/১৮৫, ১/৩১ পৃঃ; বুখারী (ইফাবা হা/১৮৫); মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪, পৃঃ ৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২/৭৮ পৃঃ; ছহীহ তিরমিযী হা/৩৪)।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৪১ হিঃ) বলেন,

‘রাসূল (ছাঃ) কখনো মাথার কিছু অংশ মাসাহ করেছেন মর্মে কোন একটি হাদীছ থেকেও প্রমাণিত হয়নি’। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৮৫ পৃঃ, ‘মাসাহ করার বর্ণনা’)।

উল্লেখ্য, পাগড়ী পরা অবস্থায় থাকলে মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করা যাবে। (ছহীহ মুসলিম হা/৬৫৬, ৫৭, ৫৯, ১/১৩৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৫২৪ ও ৫২৫); মিশকাত হা/৩৯৯, পৃঃ ৪৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬৭, ২/৮১ পৃঃ; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৮৫ পৃঃ, ‘মাসাহ করার বর্ণনা’)।

আরো উল্লেখ্য যে, পাগড়ীর নীচে মাসাহ করতেন বলে আবুদাঊদে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (যঈফ আবুদাঊদ হা/১৪৭, ১/১৯-২০ পৃঃ; যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৫৬৪)।

ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা

ওযূতে ঘাড় মাসাহ করার পক্ষে ছহীহ কোন প্রমাণ নেই। এর পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সবই জাল ও মিথ্যা। অথচ কিছু আলেম এর পক্ষে মুসলিম জনতাকে উৎসাহিত করেছেন। আশরাফ আলী থানবী ঘাড় মাসাহ করার দাবী করেছেন এবং এ সময় পৃথক দু‘আ পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২ ও ৪৪)।

ড. শাইখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফয়সাল (মদ্বীনা মুনাওয়ারাহ) প্রণীত ও মারকাযুদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিইয়াহ, ঢাকার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ অনুদিত ‘নবীজীর নামায’ বইয়ে ওযূর সুন্নাত আলোচনা করতে গিয়ে গর্দান মাসাহ করার কথা বলেছেন। এর পক্ষে জাল হাদীছও পেশ করেছেন। (ঐ, (ঢাকা: মুমতায লাইব্রেরী, ১১, বাংলাবাজার, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১১৪-১১৫)।

এভাবেই ভিত্তিহীন আমলটি সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। জাল দলীলগুলো নিম্নরূপ :

(ক) ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন। ..অতঃপর তিনি তিনবার তার মাথা মাসাহ করেন এবং দুই কানের পিঠ মাসাহ করেন ও ঘাড় মাসাহ করেন, দাড়ির পার্শ্ব মাসাহ করেন মাথার অতিরিক্ত পানি দিয়ে। (ত্বাবারাণী কাবীর হা/১৭৫৮৪, ২২/৫০)।

তাহক্বীক্ব: مِنْ كَلاَمِ النَّبِىِّ ‘এটা জাল। নবী (ছাঃ)-এর বক্তব্য নয়। (আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব ১/৪৬৫ পৃঃ)।

বর্ণনাটি জাল। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯ ও ৭৪৪)।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,

(খ) আমর ইবনু কা‘ব বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ওযূ করার সময় আমি দাড়ির পার্শ্ব এবং ঘাড় মাসাহ করতে দেখেছি। (ত্বাবারাণী কাবীর ১৯/১৮১)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। ইবনুল ক্বাত্ত্বান বলেন, এর সনদ অপরিচিত। মুছাররফসহ তার পিতা ও দাদা সবাই অপরিচিত। (লিসানুল মীযান ৬/৪২ পৃঃ; তানক্বীহ, পৃঃ ৮৩)।

(গ) ত্বালহা ইবনু মুছাররফ তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি তিনি একবার তাঁর মাথা মাসাহ করতেন এমনকি তিনি মাথার পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তা হল ঘাড়ের অগ্রভাগ। (আবুদাঊদ হা/১৩২, ১/১৭-১৮ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি মুনকার বা অস্বীকৃত। মুসাদ্দাদ বলেন, তিনি মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিক পর্যন্ত মাসাহ করেন এমনকি তার দুই হাত কানের নিচ দিয়ে বের করে নেন’ এই কথা ইয়াহইয়ার কাছে বর্ণনা করলে তিনি একে অস্বীকৃতি জানান। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, আমি ইমাম আহমাদকে বলতে শুনেছি, ইবনু উ‘আইনাহ বলতেন, মুহাদ্দিছগণ ধারণা করতেন এটা ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তিনি এটাও বলতেন, ত্বালহা তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে এ কথা কোথায় পেল? (যঈফ আবুদাঊদ হা/১৩২-এর আলোচনা দ্রঃ)।

(ঘ) ‘ঘাড় মাসাহ করলে বেড়ী থেকে নিরাপদ থাকবে’।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯, ১/১৬৮ পৃঃ)।

ইমাম সুয়ূত্বী জাল হাদীছের গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। (হাফেয জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, আল-লাআলিল মাছনূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃঃ ২০৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৮ পৃঃ)।

(ঙ) ‘যে ব্যক্তি ওযূ করবে এবং ঘাড় মাসাহ করবে, তাকে ক্বিয়ামতের দিন বেড়ী দ্বারা বাঁধা হবে না’। (আবু নু‘আইম, তারীখুল আছবাহান ২/১১৫ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৭৪৪, ২/১৬৭ পৃঃ)।

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী উক্ত বর্ণনাকে জাল বলেছেন। (আল-মাছনূ‘ ফী মা‘রেফাতিল হাদীছিল মাওযূ‘, পৃঃ ৭৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ)।

উক্ত বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু আমল আল-আনছারী ও মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনে মুহাররম নামের দু’জন রাবী ত্রুটিপূর্ণ। মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে দুর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ)।

উল্লেখ্য যে, ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা আরো আছে। এর দ্বারা প্রতারিত হওয়া যাবে না। বরং ঘাড় মাসাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে।

ওযূর পর অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা

ওযূ করার পর রুমাল, গামছা কিংবা কাপড় দ্বারা অঙ্গ মুছতে পারে। এটা ইচ্ছাধীন। (বায়হাক্বী, সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৬৮; আওনুল মা‘বূদ ১/৪১৭-১৮ পৃঃ)।

 যে বর্ণনায় অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা হয়েছে, তা জাল বা মিথ্যা।

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর, ওমর, আলী এবং ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ওযূর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছতেন না। (ইবনু শাহীন, নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫, দ্রঃ যাকারিয়া বিন গুলামা ক্বাদের পাকিস্তানী, তানকীহুল কালাম ফিল আহাদীছিয যঈফাহ ফী মাসাইলিল আহকাম (বৈরুত : দারু ইবনে হাযম, ১৯৯৯/১৪২০), পৃঃ ৯৬)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে সাঈদ বিন মাইসারা নামে একজন রাবী রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছও তাকে মিথ্যুক বলেছেন। ইবনু হিববান তাকে জাল হাদীছের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বলেছেন। (আওনুল মা‘বূদ ১/২৮৭ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ১/২২০ পৃঃ; নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫)।

উল্লেখ্য, উক্ত মর্মে যঈফ হাদীছও আছে।

হাত ধোয়ার সময় কনুই-এর উপরে আরো বেশী করে বাড়িয়ে ধৌত করা

হাত ধৌত করতে হবে কুনই পর্যন্ত। এর বেশি নয়। আল্লাহর নির্দেশ এটাই (সূরা মায়েদাহ ৬)। হাদীছের শেষে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করার যে বক্তব্য এসেছে, তার উদ্দেশ্য অঙ্গ বাড়িয়ে ধৌত করা নয়; বরং ভালভাবে ওযূ সম্পাদন করা। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫২ নং-এর ভাষ্য দ্রঃ, উল্লেখ্য, উক্ত অংশটুকু সংযোজনের ক্ষেত্রে ত্রুটি সাব্যস্ত হয়েছে বলেও মুহাদ্দিছগণ উল্লেখ করেছেন। (দ্রষ্টব্য আহমাদ হা/৮৩৯৪; ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী হা/১৩৬-এর আলোচনা, ‘ওযূর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ; ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৩ পৃঃ)।

চামড়ার মোজা ছাড়া মাসাহ করা যাবে না বলে ধারণা করা

উক্ত ধারণা সঠিক নয়। বরং যেকোন পবিত্র মোজার উপর মাসাহ করা যাবে। (ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৫৯, ১/২১ পৃঃ; ছহীহ তিরমিযী হা/৯৯; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫২৩, পৃঃ ৫৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৮, ২/১৩২ পৃঃ)।

হাদীছে কোন নির্দিষ্ট মোজার শর্তারোপ করা হয়নি। (আলোচনা দ্রঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া ১/২৬২ পৃঃ; আলবানী, আছ-ছামারুল মুস্তাত্বাব, পৃঃ ১৪-১৫)।

মোজার উপরে ও নীচে মাসাহ করা

অনেককে মোজার উপরে-নীচে উভয় দিকে মাসাহ করতে দেখা যায়। অথচ সুন্নাত হল মোজার উপরে মাসাহ করা। (ছহীহ বুখারী হা/১৮২, ১/৩০ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৮২, ১/১১৫ পৃঃ); মুসলিম হা/৬৪৯; ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৬১ ও ১৬২, ১/২২ পৃঃ; তিরমিযী হা/৯৮, ১/২৮-২৯ পৃঃ)।

উপরে-নীচে উভয় দিকে মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তার সনদ যঈফ এবং ছহীহ হাদীছের বিরোধী। যেমন-

মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ) বলেন, আমি তাবুক যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-কে ওযূ করিয়েছি। তিনি দুই মোজার উপরে এবং নীচে মাসাহ করেছেন। (আবুদাঊদ হা/১৬৫, ১/২২ পৃঃ; তিরমিযী হা/৯৭, ১/২৮ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫৫০, পৃঃ ৪২; মিশকাত হা/৫২১, পৃঃ ৫৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬, ২/১৩১ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘এই হাদীছটি ত্রুটিপূর্ণ। আমি ইমাম আবু যুর‘আহ ও ইমাম বুখারীকে এই হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আবুদাঊদও একে দুর্বল বলেছেন। (তিরমিযী হা/৯৭, ১/২৮ পৃঃ)।

এই হাদীছের সনদে ছাওর নামক একজন রাবী রয়েছে। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, সে রাজা ইবনু হাইওয়া থেকে না শুনেই বর্ণনা করেছে। (যঈফ আবুদাঊদ হা/১৬৫, ১/২২ পৃঃ)।

জ্ঞাতব্য: বর্তমানে অনেকেই মোজা পরিহিত অবস্থায় টাখনুর নীচে লুঙ্গি-প্যান্ট পরিধান করাকে জায়েয বলছেন ও পরিধান করছেন। এটা শরী‘আতকে ছোট করার মিথ্যা কৌশল মাত্র। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির সাথে আপোস করে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে নস্যাৎ করতে চায়। এই মিথ্যা কৌশল থেকে সাবধান থাকতে হবে।

ওযূর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দু‘আ পড়া

ওযূর দু‘আ পড়ার সময় আকাশের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। উক্ত মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।

উক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ভালভাবে ওযূ করল, অতঃপর আকাশের দিকে চোখ তুলে দু‘আ পড়ল, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। যেকোন দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে। (আহমাদ হা/১২১; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৩)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি মুনকার। ‘আকাশের দিকে তাকানো’ অংশটুকু ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তাই শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘এই অতিরিক্ত অংশটুকু অস্বীকৃত। কারণ ইবনু আম আবী উক্বাইল এককভাবে বর্ণনা করেছে। সে অপরিচিত’। (ইরওয়াউল গালীল হা/৯৬-এর আলোচনা দ্রঃ, ১/১৩৫ পৃঃ)।

ওযূর পরে সূরা ক্বদর পড়া

ওযূর পর সূরা ক্বদর পড়া যাবে না। উক্ত মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল।

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ওযূর পর ‘ইন্না আনযালনা-হু ফী লায়লাতিল ক্বাদরি’ অর্থাৎ সূরা ক্বদর একবার পাঠ করবে সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবে, যে দুই বার পাঠ করবে তার নাম শহীদদের দফতরে লিখা হবে এবং যে ব্যক্তি তিনবার পাঠ করবে আল্লাহ তাকে নবীদের সাথে হাশর-নাশর করাবেন। (দায়লামী, মুসনাদুল ফেরদাঊস; সুয়ূত্বী, আল-হাবী লিল ফাতাওয়া ২/১১ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর কোন সনদই নেই। (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৪৪৯ ও ১৫২৭)।

উল্লেখ্য যে, আশরাফ আলী থানবী তার বইয়ে সূরা ক্বদর পড়ার কথা বলেছেন এবং ওযূর পরের দু‘আর সাথে অনেকগুলো নতুন শব্দ যোগ করেছেন যা হাদীছের গ্রন্থ সমূহে পাওয়া যায় না। (পূর্ণাঙ্গ নামায, পৃঃ ৪৫)।

অতএব সাবধান! ওযূ করার পর শুধু নিম্নের দু‘আ পাঠ করতে হবে, যা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৬, ১/১২২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪৪৪), ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬; মিশকাত হা/২৮৯, পৃঃ ৩৯, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়; ছহীহ তিরমিযী হা/৫৫, ১/১৮ পৃঃ সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/২৮৯, পৃঃ ৩৯; ইরওয়া হা/৯৬, সনদ ছহীহ)।

উচ্চারণ: আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আবদুহূ ওয়া রাসূলুহু। আল্ল-হুম্মাজ্‘আল্নী মিনাত্ তাউওয়াবীনা ওয়াজ্‘আলনী মিনাল মুতাত্বাহ্হিরীন।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে ওযূ করবে ও কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজার সবই খুলে দেওয়া হবে। যেটা দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করতে পারবে’। (ছহীহ মুসলিম হা/৪৭৬, ১/১২২ পৃঃ; মিশকাত হা/২৮৯)।

অতএব মিথ্যা ফযীলতের প্রয়োজন নেই। মুছল্লীর প্রয়োজন জান্নাত।

রক্ত বের হলে ওযূ ভেঙ্গে যায়

শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া ওযূ ভঙ্গের কারণ নয়। রক্ত বের হলে ওযূ করতে হবে মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।

ওমর ইবনু আব্দুল আযীয তামীম দারী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, প্রত্যেক প্রবহমান রক্তের কারণেই ওযূ করতে হবে। (দারাকুৎনী ১/১৫৭; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০; মিশকাত হা/৩৩৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩০৭, ২/৫৭)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০)।

ইমাম দারাকুৎনী (রহঃ) বলেন, ওমর ইবনু আব্দুল আযীয তামীম দারীর নিকট থেকে শুনেননি। আর ইয়াযীদ ইবনু খালেদ ও ইয়াযীদ ইবনু মুহাম্মাদ দুইজনই অপরিচিত। (দারাকুৎনী ১/১৫৭ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৩৩ )।

তাছাড়া রক্ত বের হওয়া অবস্থায় ছাহাবায়ে কেরাম ছালাত আদায় করতেন। (আবুদাঊদ হা/১৯৮, ১/২৬ পৃঃ, সনদ হাসান, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৯)।

তারা ওযূ করতেন না মর্মে ছহীহ আছার বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

বাকর (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু ওমর (রাঃ)-কে দেখেছি, তিনি তার মুখমন্ডলে উঠা ফোড়ায় চাপ দিলেন ফলে কিছু রক্ত বের হল। তখন তিনি আঙ্গুল দ্বারা ঘষে দিলেন। অতঃপর ছালাত আদায় করলেন। কিন্তু ওযূ করেননি। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/১৪৬৯, সনদ ছহীহ; আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৭০-এর আলোচনা দ্রঃ, ১/৬৮৩ পৃঃ)।

শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, রক্ত বের হলে ওযূ করা ওয়াজিব হবে মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। তা কম হোক বা বেশী হোক। (আলবানী, মিশকাত হা/৩৩৩-এর টীকা দ্রঃ ১/১০৮ পৃঃ)।

বমি হলে ওযূ ভেঙ্গে যায়

ওযূ ভঙ্গের কারণ হিসাবে বিভিন্ন গ্রন্থে বমিকে উল্লেখ করা হয়েছে। আর মানুষও তাই আমল করে থাকে। অথচ তার পক্ষে কোন ছহীহ হাদীছ নেই।

(ক) আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ছালাতের মধ্যে কারো যদি বমি হয় অথবা নাক থেকে রক্ত ঝরে বা মুখ দিয়ে খাদ্যদ্রব্য বের হয় কিংবা মযী নির্গত হয়, তাহলে সে যেন ফিরে যায় এবং ওযূ করে। এরপর পূর্ববর্তী ছালাতের উপর ভিত্তি করে ছালাত আদায় করে। আর এই সময়ে সে কোন কথা বলবে না। (ইবনু মাজাহ হা/১২২১, ‘ছালাত কায়েম ও তার সুন্নাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৩৭)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত হাদীছের সনদে ইসমাঈল ইবনু আইয়াশ নামে একজন রাবী আছে, সে যঈফ। সে হিজাযের দুই ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু তারাও যঈফ। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/১২২১; যঈফ আবুদাঊদ (আল-উম্ম), পৃঃ ৬৮; যঈফুল জামে‘ হা/৫৪২৬)।

(খ) যায়েদ ইবনু আলী তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, বমি অপবিত্র। (দারাকুৎনী ১/১৫৫ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি নিতান্ত যঈফ। ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, এর সনদে সাওর নামক রাবী রয়েছে। সে যায়েদ বা অন্য কারো নিকট থেকে বর্ণনা করেনি। (দারাকুৎনী ১/১৫৫ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০৭৫, ৯/৭২ পৃঃ; যঈফুল জামে‘ হা/৪১৩৯)।

অতএব বমি হলে ওযূ করতে হবে মর্মে কোন ছহীহ বিধান নেই।

জ্ঞাতব্য: হেদায়া ও কুদূরীতে রক্ত বের হওয়া ও বমি হওয়াকে ওযূ ভঙ্গের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (হেদায়া ১ম খন্ড, পৃঃ ২৩; বঙ্গানুবাদ ১/৮-৯ পৃঃ; কুদূরী, পৃঃ ৫)।

আর সে কারণেই এই আমল চালু আছে। দুঃখজনক হল, ইমাম দারাকুৎনীর উক্ত মন্তব্য থাকতে হেদায়া ও কুদূরীতে কিভাবে তা পেশ করা হল?

ওযূ থাকা সত্ত্বেও ওযূ করলে দশগুণ নেকী

উক্ত ফযীলত সঠিক নয়। কারণ এ মর্মে বর্ণিত হাদীছ যঈফ।

(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন যোহরের আযান দেয়া হল তখন তিনি ওযূ করলেন এবং ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর যখন আছরের আযান দেয়া হল তখনও ওযূ করলেন। রাবী বলেন, আমি তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ওযূ অবস্থায় ওযূ করবে, তার জন্য আল্লাহ দশটি নেকী লিপিবদ্ধ করবেন। (আবুদাঊদ হা/৬২, ১/৯ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫১২, পৃঃ ৩৯; তিরমিযী হা/৫৯, ১/১৯ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৩, ২/৪৩ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৭)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী, মুনযেরী, ইরাক্বী, নববী, ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিছ হাদীছটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে একমত। (যঈফ আবুদাঊদ হা/১০)।

উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যিয়াদ ইফরীক্বী ও গুত্বাইফ নামক দুইজন দুর্বল ও অপরিচিত রাবী আছে। (আবুদাঊদ হা/৬২; ইবনু মাজাহ হা/৫১২; তিরমিযী হা/৫৯; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৩, ১/৯৬ পৃঃ)।

(খ) ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি একবার করে ওযূ করবে সে ব্যক্তি ওযূর নিয়ম পালন করল, যা তার জন্য আবশ্যক ছিল। যে ব্যক্তি দুইবার করে ধৌত করবে সে দ্বিগুণ ছওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি তিনবার করে ধৌত করবে তার ওযূ আমার ও আমার পূর্বের নবীগণের ওযূর ন্যায় হল। (মুসনাদে আহমাদ হা/৫৭৩৫; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৪)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৩৬; তাহক্বীক্ব মুসনাদ হা/৫৭৩৫)।

উক্ত যঈফ হাদীছ হেদায়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। (ঐ, ১/১৯ পৃঃ)।

এর সনদে যায়েদ আল-আম্মী নামে একজন দুর্বল রাবী আছে। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৪২০)।

(গ) ওছমান (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, কোন বান্দা যখন উত্তমরূপে ওযূ করে তখন আল্লাহ তার সামনের ও পিছনের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদুল বাযযার হা/৪২২, ১/৯৩ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯২)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি মুনকার বা অস্বীকৃত। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫০৩৬, ১১/৬২ পৃঃ)।

মুছল্লীর ওযূতে ত্রুটি থাকলে ইমামের ক্বিরাআতে ভুল হয়

অনেক আলেমের মাঝে উক্ত বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু উক্ত মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।

শাবীব আবী রাওহ ছাহাবীদের কোন একজন থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) একদা ফজরের ছালাত আদায় করলেন এবং সূরা রূম পড়লেন। কিন্তু পড়ার মাঝে কিছু গোলমাল হল। ছালাত শেষে তিনি বললেন, তাদের কী হয়েছে যে, যারা আমাদের সাথে ছালাত আদায় করে অথচ উত্তমরূপে ওযূ করে না। এরাই আমাদের কুরআন তেলাওয়াতে গোলযোগ সৃষ্টি করে। (নাসাঈ হা/৯৪৭, ১/১১০ পৃঃ; আলবানী, মিশকাত হা/২৯৫, পৃঃ ৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৭৫, ২/৪৪)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুল মালেক বিন উমাইর নামে একজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী রয়েছে। (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/২৯৫-এর টীকা দ্রঃ; নাসাঈ হা/৯৪৭; যঈফুল জামে‘ হা/৫০৩৪)।

মাথার চুলের গোড়ায় নাপাকি থাকবে মনে করে সর্বদা মাথার চুল ছোট করে রাখা বা কামিয়ে রাখা

নাপাকির ভয়ে এক শ্রেণীর মুরববী সর্বদা মাথা ন্যাড়া করে রাখেন বা চুল খুব ছোট করে রাখেন এবং একে খুব ফযীলতপূর্ণ মনে করেন। আলী (রাঃ) এরূপ করতেন বলে তারা এর অনুসরণ করে থাকেন। অথচ উক্ত মর্মে যে বর্ণনা প্রচলিত আছে তা যঈফ। মোটেই আমলযোগ্য নয়।

(ক) আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নাপাকীর একচুল পরিমাণ স্থানও ছেড়ে দিবে এবং উহা ধৌত করবে না, তার সাথে আগুনের দ্বারা এই এই ব্যবস্থা করা হবে। আলী (রাঃ) বলেন, সে অবধিই আমি আমার মাথার সাথে শত্রুতা করেছি। একথা তিনি তিনবার বললেন। তিনি তার মাথার চুল খুব ছোট করে রাখতেন। (আবুদাঊদ হা/২৪৯, ১/৩৩ পৃঃ; আহমাদ হা/১১২১; মিশকাত হা/৪৪৪, পৃঃ ৪৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪০৮)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৩০; ইরওয়াউল গালীল হা/১৩৩; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৪৪৪, ১/১৩৮ পৃঃ)।

উক্ত বর্ণনার সনদে ‘আত্বা, হাম্মাদ ও যাযান নামের ব্যক্তি ত্রুটিপূর্ণ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৩০, ২/২৩২ পৃঃ)।

(খ) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক চুলের নীচেই নাপাকি রয়েছে। সুতরাং চুলগুলোকে ভালভাবে ধৌত করবে এবং চামড়াকে সুন্দর করে পরিষ্কার করবে। (আবুদাঊদ হা/২৪৮, ১/৩৩ পৃঃ; তিরমিযী হা/১০৬, ১/২৯ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৫৯৭, পৃঃ ৪৪; আলবানী, মিশকাত হা/৪৪৩, পৃঃ ৪৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪০৭, ২/৯৭ পৃঃ)।

তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮০১)।

এর সনদে হারিছ ইবনু ওয়াজীহ নামক এক রাবী আছে। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, তার হাদীছ মুনকার আর সে দুর্বল রাবী। (যঈফ আবুদাঊদ হা/২৮৪; তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৪৪৩, ১/১৩৮ পৃঃ)।

(গ) আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুম‘আ থেকে অপর জুম‘আ, আমানত আদায় করা- এর মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা। আমি বললাম, আমানত আদায়ের অর্থ কী? তিনি বললেন, জানাবাতের গোসল করা। কারণ প্রতিটি পশমের গোড়ায় নাপাকি রয়েছে। (ইবনু মাজাহ হা/৫৯৮, পৃঃ ৪৪, ‘পবিত্রতা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০৬)।

তাহক্বীক্ব: উক্ত হাদীছও যঈফ। (যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৫৯৮)।

এর সনদে উতবা ইবনু আবী হাকীম নামে একজন দুর্বল রাবী আছে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৮০১, ৮/২৭২)।

তায়াম্মুম

তায়াম্মুমেম শাব্দিক ও পারিভাষিক পরিচিতি

সংজ্ঞা: তায়াম্মুম অর্থ ‘সংকল্প করা’। পারিভাষিক অর্থে: ‘পানি না পাওয়া গেলে ওযূ বা গোসলের পরিবর্তে পাক মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের ইসলামী পদ্ধতিকে ‘তায়াম্মুম’ বলে’। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর অন্যতম বিশেষ অনুগ্রহ। যা ইতিপূর্বে কোন উম্মতকে দেওয়া হয়নি। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৯)।

এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য আবুবকর-পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কেননা সম্ভবত: ৫ম হিজরী সনে বনুল মুছত্বালিক্ব যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে মদীনার উপকণ্ঠে ‘বায়দা’ (البَيْدَاء) নামক স্থানে পৌঁছে আয়েশা (রাঃ)-এর গলার হার হারিয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটি খোঁজার জন্য কাফেলা থামিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে কোন পানি ছিল না। ফলে এভাবেই পানি ছাড়া সকাল হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন (মায়েদাহ ৬)।

ছাহাবী উসায়েদ বিন হুযায়ের (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)-কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, হে আবুবকর-পরিবার! এটি উম্মতের জন্য আপনাদের প্রথম অবদান নয় (مَا هِىَ بِأَوَّلِ بَرَكَتِكُمْ يَا آلَ أَبِى بَكْرٍ)’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমরা উট উঠিয়ে দিলাম, যার উপরে আমরা ছিলাম এবং তার নীচে হারটি পেয়ে গেলাম’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৬০৮,  ৩৩৪, আধুনিক প্রকাশনী ৪২৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ বলেন,

‘আর যদি তোমরা পীড়িত হও কিংবা সফরে থাক অথবা পায়খানা থেকে আস কিংবা স্ত্রী স্পর্শ করে থাক, অতঃপর পানি না পাও, তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ কর ও তা দ্বারা তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় মাসাহ কর’...। (মায়েদাহ ৫/৬, নিসা ৪/৪৩)।

পবিত্র মাটি

আরবী পরিভাষায় ‘মাটি’ বলতে ভূ-পৃষ্ঠকে বুঝায়। যেমন বলা হয়েছে, الصعيد وجه الأرض ترابا كان أو غيره। ‘মাটি হ’ল ভূ-পৃষ্ঠ। চাই তা নিরেট মাটি হৌক বা অন্য কিছু হৌক’ (আল-মিছবাহুল মুনীর)।

আরব দেশের মাটি অধিকাংশ পাথুরে ও বালুকাময়। বিভিন্ন সফরে আল্লাহর নবী (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ বালুকাময় মরুভূমির মধ্য দিয়ে বহু দূরের রাস্তা অতিক্রম করতেন। বিশেষ করে মদ্বীনা হ’তে প্রায় ৭৫০ কি: মি: দূরে ৯ম হিজরীর রজব মোতাবেক ৬৩০ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাবূক যুদ্ধের সফরে তাঁরা মরুভূমির মধ্যে দারুণ পানির কষ্টে পড়েছিলেন। কিন্তু ‘তায়াম্মুমের’ জন্য দূর থেকে মাটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। অতএব ভূ-পৃষ্ঠের মাটি, বালি বা পাথুরে মাটি ইত্যাদি দিয়ে ‘তায়াম্মুম’ করা যাবে। তবে ধুলা-মাটিহীন স্বচ্ছ পাথর, কাঠ, কয়লা, লোহা, মোজাইক, প্লাষ্টার, টাইলস, চুন ইত্যাদি দ্বারা ‘তায়াম্মুম’ জায়েয নয়। (আলোচনা দ্রষ্টব্য : ছাদেক শিয়ালকোটি, ছালাতুর রসূল; টীকা, পৃঃ ১৪৮-৪৯)।

তায়াম্মুম ফরয হওয়ার শর্তাবলী

ক- বালেগ বা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া।

খ- মাটি ব্যবহারে সক্ষম হওয়া।

গ- অপবিত্রতা নষ্টকারী কোনো কিছু ঘটা।

তায়াম্মুমের ফরযসমূহ

ক- নিয়ত।

খ- পবিত্র মাটি।

গ- একবার মাটিতে হাত মারা।

ঘ- মুখমণ্ডল ও হাতের কবজি পর্যন্ত মাসাহ করা।

তায়াম্মুমের কারণসমূহ

(১) যদি পাক পানি না পাওয়া যায়

(২) পানি পেতে গেলে যদি ছালাত ক্বাযা হওয়ার ভয় থাকে

(৩) পানি ব্যবহারে যদি রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকে

(৪) যদি কোন বিপদ বা জীবনের ঝুঁকি থাকে ইত্যাদি। উপরোক্ত কারণ সমূহের প্রেক্ষিতে ওযূ বা ফরয গোসলের পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘদিন যাবৎ একটানা ‘তায়াম্মুম’ করা যাবে। (মায়েদাহ ৫/৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত ৫২৭ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-১০; বুখারী ৩৪৪, ১/৪৯ পৃঃ; আহমাদ, তিরমিযী ইত্যাদি মিশকাত ৫৩০)।

হাদিসঃ

’ইমরান (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে ছিলাম। তিনি আমাদেরকে সালাত আদায় করালেন। সালাত শেষ করার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখলেন এক ব্যক্তি পৃথক হয়ে বসে আছে, অথচ সে মানুষের সাথে জামা’আতে সালাত আদায় করেনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, হে অমুক! মানুষের সাথে জামা’আতে সালাত আদায় করতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? লোকটি বলল, আমি নাপাক ছিলাম, অথচ তখন পানি পাচ্ছিলাম না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার মাটি (তায়াম্মুমের মাধ্যমে) ব্যবহার করা উচিত ছিল। আর (পবিত্রতা অর্জনে) এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫২৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৪৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৮২, নাসায়ী ৩২১, আহমাদ ১৯৮৯৮, দারেমী ৭৭০, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৩০১, ইরওয়া ১৫৬, সহীহ আল জামি ৪০৪৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

‘নিশ্চয়ই পবিত্র মাটি মুসলমানদের জন্য ওযূর মাধ্যম স্বরূপ। যদিও সে ১০ বছর পর্যন্ত পানি না পায়’। (আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত ৫৩০, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ-১০)।

হাদিসঃ

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাক-পবিত্র মাটি মুসলিমকে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে, যদি দশ বছরও সে পানি না পায়। পানি যখন পাবে তখন সে যেন তার গায়ে পানি লাগায়। এটাই তার জন্য উত্তম। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৩০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২৪, ইরওয়া ১৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ব্যান্ডেজ ও ক্ষতস্থানে তায়াম্মুম

কারো হাড় ভেঙ্গে গেলে বা শরীরে ক্ষত বা জখম হলে পানি ব্যবহারে ক্ষতির আশংকা করলে ও কষ্ট হলে তবে ব্যান্ডেজ ও ক্ষতস্থানে তায়াম্মুম করবে এবং বাকী অংশ ধুয়ে ফেলবে।

কেউ পানি ও মাটি কোনটিই না পেলে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই সালাত আদায় করে নিবে। তাকে উক্ত সালাত পুনরায় আদায় করতে হবে না।

মোজা ও বন্ধ ফলকের উপর মাসাহ

ইবন মুবারক বলেছেন, মোজার উপর মাসাহর ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। ইমাম আহমাদ বলেছেন, মোজার উপর মাসাহর ব্যাপারে আমার অন্তরে কোনো সংশয় নেই। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে চল্লিশটি হাদীস বর্ণিত আছে। পা ধোয়ার চেয়ে মোজার উপর মাসাহ করা উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ উত্তমটিই তালাশ করতেন।

সময়সীমা

মুকিমের জন্য একদিন ও একরাত এবং মুসাফিরের জন্য তিনদিন ও তিনরাত মাসাহ করা জায়েয। মোজা পরিধান করার পরে প্রথম বার অপবিত্র হওয়া থেকে সময়সীমা শুরু হয়।

মোজার উপর মাসাহর শর্তাবলী

পরিধেয় মোজা বৈধ ও পবিত্র হওয়া। ফরয পরিমাণ অংশ ঢেকে থাকা এবং মোজা পবিত্র অবস্থায় পরিধান করা।

মোজার উপর মাসাহর পদ্ধতি

পানিতে হাত ভিজিয়ে পায়ের উপরিভাগের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে নলা পর্যন্ত একবার মাসাহ করা। পায়ের নিচে ও পিছনে মাসাহ নয়।

মোজার উপর মাসাহ ভঙ্গের কারণসমূহ

নিচের চারটির যে কোনো একটি কারণে মোজার উপর মাসাহ নষ্ট হয়ে যায়:

(ক) পায়ের থেকে মোজা খুলে ফেললে।

(খ) মোজা খুলে ফেলা অত্যাবশ্যকীয় হলে, যেমন গোসল ফরয হলে।

(গ) পরিহিত মোজা বড় ছিদ্র বা ছিড়ে গেলে।

(ঘ) মাসাহের মেয়াদ পূর্ণ হলে।

সব ধরণের পট্টি বা ব্যান্ডেজ খুলে না ফেলা পর্যন্ত তার উপর মাসাহ করা জায়েয, এতে মেয়াদ যতই দীর্ঘ হোক বা জানাবত তথা বড় নাপাকী লাগুক।

তায়াম্মুমের সঠিক পদ্ধতি

মুছল্লী পবিত্র হওয়ার নিয়ত করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মাটিতে দুই হাত একবার মারবে। (বুখারী ১; মিশকাত ১; তিরমিযী ২৫,  ইবনু মাজাহ ৩৯৭, মিশকাত ৪০২)।

অতঃপর ফুঁক দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দুই হাত দিয়ে প্রথমে মুখমন্ডল তারপর বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জি এরপর ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত একবার করে মাসাহ করবে। যেমনঃ রাসূল (ছাঃ) বলেন,

‘তোমার জন্য এইরূপ করাই যথেষ্ট ছিল। এই বলে তিনি তাঁর দুই হাত মাটির উপর মারলেন এবং ফুঁক দিলেন। অতঃপর দুই হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন। (বুখারী ৩৩৮, ইফাবা ৩৩১, মুসলিম ৮৪৬, মিশকাত ৫২৮)।

হাদিসঃ

ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, আবূ বকর ইবনু আবী শাইবাহ ও ইবনু নুমায়র (রহঃ).....শাকীক (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার আবদুল্লাহ (ইবনু মাসউদ) ও আবূ মূসা (রাযিঃ) এর কাছে বসেছিলাম। তখন আবূ মূসা (রাযিঃ) বললেন, হে আবূ আবদুর রহমান! কোন লোক যদি জুনুবী হয় (যার ফলে তার গোসল ফরয হয়) এবং সে এক মাস যাবৎ পানি না পায় তাহলে সে কিভাবে সালাত আদায় করবে? আবদুল্লাহ বললেন, সে তায়াম্মুম করবে না যদিও একমাস পানি না পায়। আবূ মূসা (রাযিঃ) বললেন, তাহলে সূরাহ মায়িদাহ এর এ আয়াত-....."যদি তোমরা পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম কর"- (সূরাহ আল মায়িদাহ ৫: ৬) এর কি হবে?

আবদুল্লাহ বললেন, এ আয়াতের দ্বারা তাদেরকে যদি তায়াম্মমের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে (ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে পৌছবে যে) পানি ঠাণ্ডাবোধ হলে তারা মাটি দিয়ে তায়াম্মুম শুরু করবে। আবূ মূসা (রাযিঃ) তখন আবদুল্লাহ-কে বললেন, আপনি কি আম্মার-এর বর্ণনা শোনেননি (তিনি বলেন) যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কোন এক প্রয়োজনে পাঠালেন। (পথিমধ্যে) আমি অপবিত্র হয়ে গেলাম এবং পানি পেলাম না। তখন আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিলাম চতুষ্পদ জন্তু যেভাবে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়।

তারপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে এ ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, তোমার জন্যে দু’হাত দিয়ে এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল-এ বলে তিনি তার দু’হাত একবার মাটিতে মারলেন। তারপর বামহাত দিয়ে ডানহাত মাসাহ করলেন এরং উভয় হাতের কব্জির উপরিভাগ ও মুখমণ্ডল মাসাহ করলেন। আবদুল্লাহ বললেন, তুমি কি দেখনি যে, উমার (রাযিঃ) আম্মার (রাযিঃ) এর কথা যথেষ্ট মনে করেননি? (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭০৪-৭০৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৬৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৩৮, ৩৩৯, ৩৪০, ৩৪১, ৩৪২, ৩৪৩, ৩৪৫, ৩৪৬, ৩৪৭; আহমাদ ১৮৩৫৬) (আ.প্র. ৩২৬, ই.ফা. ৩৩১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জ্ঞাতব্যঃ আবুদাঊদে দুইবার হাত মারা ও পুরো হাত বগল পর্যন্ত মাসাহ করা সংক্রান্ত যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তার সনদ বিশুদ্ধ হলেও সেগুলো মূলতঃ কতিপয় ছাহাবীর ঘটনা মাত্র, যা রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার আগে ঘটেছিল। (আবুদাঊদ ৩১৮, মিশকাত ৫৩৬)।

অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তায়াম্মুমের উক্ত পদ্ধতি শিক্ষা দেন। যেমন- ইমাম মুহিউস সুন্নাহ বলেন,

‘এটা ছাহাবীদের কাজের ঘটনা, যা আমরা রাসূল (ছাঃ) থেকে নকল করতে পারিনি। যেমনটি আম্মার (রাঃ) জুনবী অবস্থায় মাটিতে গড়াগড়ি করার ঘটনা নিজের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর যখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি শুধু মুখমন্ডল ও দুই কব্জি মাসাহর নির্দেশ দান করেন। এ পর্যন্তই শেষ করেছেন। আর আম্মার (রাঃ) তার কাজ থেকে ফিরে আসেন। (মিশকাত ৫৩৬)।

হাদিসঃ

’আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অবস্থানকালে পানি না থাকার কারণে ফজরের (ফজরের) সালাতের জন্য মাটি দিয়ে মাসাহ করলেন। তারা তাদের হাতকে মাটিতে মারলেন, তারপর একবার তাদের চেহারা মাসাহ করলেন। আবার মাটিতে হাত মারলেন এবং সম্পূর্ণ হাত বাহুমূল পর্যন্ত এবং হাতের ভিতর দিকে বগল পর্যন্ত মাসাহ করলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৩৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তায়াম্মুমের সময় দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করা

তায়াম্মুম করার সময় একবার মাটিতে হাত মারতে হবে অতঃপর মুখমন্ডল এবং দুই হাত কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে। দুইবার হাত মারা ও কনুই পর্যন্ত মাসাহ করা সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। যেমন-

(ক) ইবনু ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, তায়াম্মুমে দুইবার হাত মারবে। মুখের জন্য একবার আর দুই হাত কনুই পর্যন্ত মাসাহ করার জন্য একবার। (বায়হাক্বী হা/১০৫৪, ১/২০৭; হাকেম হা/৬৩৪ ও ৬৩৬; আবুদাঊদ হা/৩৩০, ১/৪৭ পৃঃ; দারাকুৎনী ১/১৭৭; বুলূগুল মারাম হা/১২৮; বিস্তারিত দ্রঃ তানক্বীহ, পৃঃ ১৯৪-১৯৭)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে কয়েকজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর আল-উমরা নামক রাবীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল হিসাবে যঈফ। আলী ইবনু যাবইয়ান নামক রাবী অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম ইবনু মাঈন বলেন, সে মিথ্যুক, অপবিত্র। ইমাম বুখারী বলেন, সে মুনকার হাদীছ বর্ণনাকারী। ইমাম নাসাঈ বলেন, সে হাদীছের পরিত্যক্ত রাবী। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৪২৭; যঈফুল জামে‘ হা/২৫১৯; যঈফ আবুদাঊদ হা/৩৩০)।

প্রশ্ন হল, উক্ত হাদীছ হেদায়া ও কুদূরীতে কিভাবে স্থান পেল? (হেদায়া ১ম খন্ড, পৃঃ ৫০, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ; কুদূরী, পৃঃ ১২)।

আর ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে তায়াম্মুম করার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সমস্ত ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সেগুলো কেন প্রত্যাখ্যান করা হল? (ছহীহ বুখারী হা/৩৩৮, ১/৪৮ পৃঃ, (ইফাবা হা/৩৩১, ১/১৮৮ পৃঃ), ‘তায়াম্মুম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪; মুসলিম হা/৮৪৬, ১/১৬১ পৃঃ; মিশকাত হা/৫২৮, পৃঃ ৫৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৩, ২/১৩৫ পৃঃ)।

(খ) নাফি (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু ’উমার (রাঃ) কোন কাজে গেলে আমিও তার সাথে গেলাম। তিনি তাঁর কাজ শেষ করলেন। সেদিন তাঁর কথার মধ্যে এ কথাটি ছিল, তিনি বললেন, এক ব্যক্তি কোন একটি গলি দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্রাব বা পায়খানা সেরে বের হলেন। ঐ লোকটির সাথে তাঁর দেখা হলে সে সালাম দিল। কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সালামের উত্তর দিলেন না। লোকটি যখন অন্য গলির দিকে মোড় নিচ্ছিল, তিনি (তায়াম্মুম করার জন্য) দেওয়ালে দুই হাত মেরে মুখমণ্ডল মাসেহ করলেন। অতঃপর আবার দেওয়ালে হাত মেরে কনুইসহ দুহাত মাসাহ করলেন (অর্থাৎ- তায়াম্মুম করলেন)। এরপর লোকটির সালামের উত্তর দিলেন এবং বললেন, তোমাকে সালামের উত্তর দিতে পারিনি। কারণ আমি বে-উযূ ছিলাম, এটাই ছিল (তোমার সালামের উত্তর দিতে আমার) বাধা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩০)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, ‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে বলতে শুনেছি, মুহাম্মাদ বিন ছাবিত তায়াম্মুম সম্পর্কে একটি মুনকার হাদীছ বর্ণনা করেছে’। (যঈফ আবুদাঊদ হা/৩৩০)।

ইমাম বুখারী এবং ইয়াহইয়া ইবনু মাঈনও অনুরূপ বলেছেন। ইবনু হাজার আসক্বালানী তাকে যঈফ বলেছেন। ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, হাদীটি ছহীহ নয়। কারণ মুহাম্মাদ ইবনু ছাবিত আল-আবদী অত্যন্ত দুর্বল। তার হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয় না। (যঈফ আবুদাঊদ (আল-উম্ম) হা/৫৮, পৃঃ ১৩৬)।

ইমাম আবুদাঊদ আরো বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ছাবিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দুইবার হাত মারা ও ইবনু ওমরের কাজের যে বর্ণনা করেছে, এই ঘটনার ব্যাপারে সে নির্ভরযোগ্য নয়। (যঈফ আবুদাঊদ হা/৩৩০)।

জ্ঞাতব্যঃ

(১) ‘তায়াম্মুম’ করে ছালাত আদায়ের পরে ওয়াক্তের মধ্যে পানি পাওয়া গেলে পুনরায় ঐ ছালাত আদায় করতে হবে না। (আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত ৫৩৩; আবুদাঊদ ৩৩৮)।

হাদিসঃ

আবূ সা’ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, দুই লোক সফরে বের হলো। পথিমধ্যে সালাতের সময় হলো, অথচ তাদের কাছে পানি ছিল না। তাই তারা দু’জনই পাক মাটিতে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করে নিলো। অতঃপর সালাতের সময়ের মধ্যেই তারা পানি পেয়ে গেল। তাই তাদের একজন উযূ  করে আবার সালাত আদায় করে নিলো এবং দ্বিতীয়জন তা করলো না। এরপর তারা ফিরে এসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তা বর্ণনা করলো। যে ব্যক্তি সালাত আদায় করেনি তাকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি সুন্নাতের উপরই ছিলে। এ সালাতই তোমার জন্য যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি উযূ করে পুনরায় সালাত আদায় করেছে তাকে বললেন, তোমার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব রয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৩৩, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩৮, সুনান আন-নাসায়ী (তাহকীককৃত)  ৪৩৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) ওযূর মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায়, তায়াম্মুমের দ্বারা সেসব কাজ করা যায়। অমনিভাবে যেসব কারণে ওযূ ভঙ্গ হয়, সেসব কারণে ‘তায়াম্মুম’ ভঙ্গ হয়।

(৩) যদি মাটি বা পানি কিছুই না পাওয়া যায়, তাহ’লে বিনা ওযূতেই ছালাত আদায় করবে। (বুখারী ৩৩৬; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ ও অন্যান্য; নায়লুল আওত্বার ১/৪০০, ‘পানি ও মাটি ব্যতীত ছালাত’ অনুচ্ছেদ)।

হাদিসঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি একদা (তাঁর বোন) আসমা (রাঃ) এর হার ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। (পথিমধ্যে) হারখানা হারিয়ে গেল। আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সেটির অনুসন্ধানে লোক পাঠালেন। তিনি হারটি এমন সময় পেলেন, যখন তাঁদের সালাতের সময় হয়ে গিয়েছিল অথচ তাঁদের কাছে পানি ছিল না। তাঁরা সালাত আদায় করলেন। তারপর বিষয়টি তাঁরা আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করেন। সেজন্য উসায়দ ইব্নু হুযায়র (রাঃ) ‘আয়িশা (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বললেনঃ আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আল্লাহ্র কসম! আপনি যে কোন অপছন্দনীয় অবস্থার মুখোমুখী হয়েছেন, তাতেই আল্লাহ্ তা’আলা আপনার ও সমস্ত মুসলিমের জন্য মঙ্গল রেখেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৩৬, ৩৩৪, আ.প্র. ৩২৪, ই.ফা. ৩২৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম (যুক্তিবাদী)-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক, লেখক ও সংকলক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।


কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

PMMRC

====================================================

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...