বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মানবরচিত ও ইসলামি আইনে
মিথ্যে সাক্ষ্য ও মামলা দায়ের এবং বিচারকের রায়
শাস্তি ও পরিনতি
(ক) তোমরা সত্যকে মিথ্যের সাথে
মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না। (সুরা আল বাকারাঃ ৪২)। (খ) “অতএব আপনি আল্লাহর অবতীর্ণ
করা আইন মোতাবেক লোকদের যাবতীয় বিষয়ে ফায়সালা করুন।’’ (সূরা আল-মায়িদাহঃ ৪৮)। |
ভূমিকাঃ আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত কথা আছে যে, কাউকে
ধ্বংস করতে চাইলে বা প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে চাইলে তাকে আরেকটি বিয়ে করিয়ে দিন, না
হয় তাকে ভোটে দাঁড়িয়ে দিন অথবা তার কোনো সন্তানকে মাদকাক্ত বানিয়ে দিন বা জুয়াড়ু বানিয়ে
দিন কিংবা মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিন। প্রতিটি সমাজে বা পাড়ায় পাড়ায় এমন কিছু মোড়ল
শ্রেণির লোক আছে যারা ভিলেজ পলিটিক্সে খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এদের কুবুদ্ধিতে শত শত লোক
সর্বশান্ত হয়েছে।
বর্তমান সময়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সর্বাধিক
যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে
জেলে পাঠানো। জমিজমা সংক্রান্ত, যৌতুক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে
সাক্ষ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।
অথচ মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে কাউকে
ফাঁসানো যে অন্যায় এই হিতাহিত জ্ঞান মানুষের দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। এরুপ অন্যায়ের
সাথে যারা জড়িত তাদেরকে মানবরচিত ও ইসলামি আইনে শাস্তি পেতে হবে। মানবরচিত আইনে এই
শাস্তির বিধান রাজনৈতিক কারণে নড়চড় হয়ে থাকে। দুর্বল চিত্তের লোককগুলো শাস্তি পায় কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যে মিথ্যে মামলাগুলো
দায়ের করা হয় সেগুলো ক্ষমতাসীন দল যতোদিন থাকে ততোদিন প্রতিপক্ষ মিথ্যে মামলায় শাস্তি
পেতে থাকে কিন্তু ক্ষমতাসীণ দল বিরোধী দলে পরিনত হলে তারাও একইভাবে মিথ্যে মামলায় জড়াতে
থাকে আর শাস্তি পেতে থাকে। এভাবেই চলে রাজনৈতিক খেলা। এই খেলা খেলতে গিয়ে মিথ্যে মামলা
দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদাতাগণ রাজনৈতিক কারণে দুনিয়ায় শাস্তি না পেলেও এদেরকে কিয়ামতে পাকড়াও করা হবে। সেইদিন কোনো রাজনৈতিক
নেতার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। এদের প্রত্যেককেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতেই হবে।
আসুন মানবরচিত ও ইসলামি আইনে মিথ্যে মামলা
দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষদানের ক্ষেত্রে কিরুপ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তা জেনে নেই।
মানবরচিত আইনে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদানের শাস্তি
মানুষ ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশায় আগের তুলনায়
বতর্মানে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আদালতমুখী হয়েছে। যার ফলে দৈনিক আদালতেও বিভিন্ন বিষয়ে
হচ্ছে প্রচুর মামলা। আর এসব ক্ষেত্রে আদালতে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী অপরিহার্য।
সাক্ষ্য ছাড়া বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন না।
অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য
অনেকেই মিথ্যে মামলা দায়ের করেন। আবার অনেকে কার্যসিদ্ধির জন্য আদালতে মিথ্যে সাক্ষ্য
উপস্থাপন করেন। এই সাবির্ক ক্ষেত্রে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক যদি বুঝতে পারেন মামলায় সাক্ষী
মিথ্যে কথা বলছে বা মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে, তাহলে তিনি আইনানুসারে মিথ্যে সাক্ষীকে
সাজা দিতে পারবেন।
সাক্ষ্য গ্রহণের আগে প্রত্যেক সাক্ষীকে শপথ
আইনের ৫ ধারা অনুসারে সত্য বলার হলফ পাঠ করতে হয়। এই হলফ করার পর হলফকারী সত্যকে সত্য
হিসাবে এবং মিথ্যেকে মিথ্যে হিসেবে তুলে ধরতে বাধ্য।
এ ছাড়া দন্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যে সাক্ষী
সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সত্য বলার জন্য আইনত বাধ্যগত ব্যক্তি যদি এমন
কোনো বিবৃতি আদালতে প্রদান করে যা সে মিথ্যে বলে জানে বা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস
করে না, তবে সে বা ওই ব্যক্তি মিথ্যে সাক্ষী দেয় বলে গণ্য হবে।
কিছুদিন আগেও উটকো ঝামেলার ভয়ে মানুষ সহজে
আদালতের দ্বারস্থ হতো না। তবে ইদানীং আদালত অনেকটাই মানুষের আস্থার জায়গা করে নিয়েছে।
আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আছে বলেই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে
প্রতিষ্ঠানের কোনো ঝামেলা হলেই দেখা যায় আদালতের দ্বারস্থ হতে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে,
সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধান বাংলাদেশের
শ্রমগণকে এই অধিকার দিয়েছে। অন্য কোনো আইন দ্বারা এই অধিকার খবর্ করা যাবে না। আইনের
সাধারণ নীতি অনুযায়ী, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেনো আইনের বিচারে সাজা না পায়। আদালত
এবং আইন সুনিদির্ষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই কাউকে সাজা দিয়ে থাকেন। বিচারিক দৃষ্টিতে
সাবির্ক প্রেক্ষিত অনুযায়ী দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমা প্রমাণের পরিমাণ বা মাত্রার
পরিমাপক হিসেবে দুটি মানদন্ড আছে। যেমন,
(ক) ফৌজদারি মানদন্ড যা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের
ঊর্ধ্বে প্রমাণ বা সন্দেহাতীত প্রমাণ এবং
(খ) দেওয়ানি মানদন্ড যা সম্ভাব্য ভারসাম্যপূবর্ক
প্রমাণ করা হয় প্রত্যেক মোকদ্দমার চুড়ান্ত বিচারিক পর্যায়ে।
দেশের আদালত এবং থানাগুলোর দিকে একটু খেয়াল
করে তাকালেই দেখা যায় প্রতিনিয়ত মিথ্যে মামলা হচ্ছে। আদালতে এ সব ধরনের মামলা-মোকদ্দমা
প্রমাণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ জরুরি বটে। আমরা সহজেই বুঝতে পারি অনেকে মিথ্যে মামলা দায়েরের পর তা প্রমাণ করার জন্য
মিথ্যে সাক্ষীর ব্যবস্থা করে। এ সংক্রান্ত কাজে যদি আদালতে প্রমাণিত হয় সাক্ষী মিথ্যে
সাক্ষ্য দিয়েছে, তবে আইন তাকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যে মামলা
দায়ের এবং মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসে এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তবে তার জন্য আইনে
রয়েছে প্রেক্ষিত অনুযায়ী শাস্তির বিধান।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইন ২০০০(সংশোধনী-২০০৩)-এর সঙ্গে সবাই কম-বেশি পরিচিত। এই আইনে মামলার হারটাও অনেক বেশি। এই
আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায়ে
ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য
ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন তবে ওই ব্যক্তির সাত
বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অথর্দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। তবু
এই আইনে অনেক মিথ্যে মামলা দায়ের এবং মিথ্যে মামলায় মিথ্যে সাক্ষ্য উপস্থাপিত হচ্ছে।
ফৌজদারি কাযির্বধি ২৫০ ধারায় মিথ্যে মামলার
শাস্তির বিধান রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেয়ার সময়
প্রমাণ পান যে, মামলাটি মিথ্যে ও হয়রানিমূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর
নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২০৯ ধারা মতে, মিথ্যে অভিযোগ
দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ডসহ অথর্দন্ডে
দন্ডিত হবে।
আবার ২১১ ধারায় বলা হয়েছে, মিথ্যেভাবে ফৌজদারি
মামলা দায়ের করার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির
ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করেন তবে মামলা
দায়েরকারীকে দুই বছর পযর্ন্ত কারাদন্ড বা অথর্দন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত করা যেতে
পারে।
মিথ্যে সাক্ষী বা সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে
দন্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পযর্ন্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
দন্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের সংজ্ঞা
সম্পর্কে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান
বলে আইনত বাধ্য হয়ে বা কোনো বিষয়ে কোনো ঘোষণা করার জন্য আইনবলে বাধ্য হয়ে এরূপ
কোনো বিবৃতি প্রদান করে, যা মিথ্যে এবং যা সে মিথ্যে বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা
সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তা হলে ওই ব্যক্তি মিথ্যে সাক্ষ্য দেয় বলে পরিগণিত হবে। কোনো
বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোনোভাবে দেয়া হোক না কেনো তা এই ধারায় অন্তভুর্ক্ত হবে।
দন্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি
সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিচারবিভাগীয় মোকদ্দমায় কোনো পর্যায়ে
ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যে সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে সেই ব্যক্তির
যে কোনো বণর্নার কারাদন্ড হতে পারে, যার মেয়াদ সাত বছর তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।
কেউ যদি আবার অন্য কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান করে তবে তার শাস্তি
তিন বছরের কারাদন্ড এবং অথর্দন্ড হতে পারে।
সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের
জন্য মৃত্যুদন্ডের শাস্তির বিধানও রয়েছে। দন্ডবিধির ১৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো
ব্যক্তি কাউকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যে সাক্ষ্য দান বা মিথ্যে সাক্ষ্য
তৈরি করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে অথবা ১০ বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের
কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং তাকে অর্থদন্ডেও দন্ডিত করা হবে। আবার যদি ওই মিথ্যে সাক্ষ্যের
ফলে কোনো নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড কাযর্কর হয়, তবে যে ব্যক্তি অনুরূপ মিথ্যে
সাক্ষ্য প্রদান করবে তাকেও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
আসলে মিথ্যে মামলা এবং মিথ্যে সাক্ষ্য বতর্মান প্রেক্ষাপটে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যার ফলাফল অনেক ভয়াবহ। কিছু অসুস্থ মনের মানুষ দিন দিন তার স্বার্থ উদ্ধারে নীতি-নৈতিকতার বিসজর্ন দিচ্ছে এবং মনুষ্যত্বে কালিমা লেপন করছে যা দেশ ও জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তাই মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্যদানকারীদের আইনের আওতায় এনে সঠিক শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা গেলে এই প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে।
ইসলামি আইনে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্যদানের শাস্তি
ইসলামে মিথ্যে সাক্ষ্য দানের ভয়াবহতা
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দেহে জিহবা ও দুই ঠোঁট
সংযোজন করেছেন (বালাদ ৯০/৯), যাতে তারা কথা বলতে পারে। আর আল্লাহর দেওয়া মুখ ও ঠোঁট
দিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত সত্য কথা বলবে, সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিবে যদিও তা তার নিজের,
নিজ পিতা-মাতার এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত
থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার
অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে
আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর
কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে
যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ (সূরা নিসা, আয়াত ১৩৫)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায়
সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার
পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা
যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সূরা: মায়েদা,
আয়াত ৮)।
উত্তম সাক্ষ্য দাতার আলোচনায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি উত্তম সাক্ষী সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করবো না? তলব (আহবান)
করার পূর্বেই যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দেয় সে হলো উত্তম সাক্ষী। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২২৯৫, ২২৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
প্রয়োজনের সময় সাক্ষ্য না দিয়ে তা গোপন করা
গুনাহের অন্তর্ভূক্ত।
‘তোমরা
সাক্ষ্য গোপন করো না, যে ব্যক্তি তা গোপন করে নিশ্চয় তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা কিছু
কর, আল্লাহ সে সম্বন্ধে সম্যক অবগত।’ (সূরা বাকারা, আয়াত
২৮৩)।
মিথ্যে সাক্ষ্য-এর পরিচয়
মিথ্যে সাক্ষ্যকে আরবীতেشهادة
الزور
বলে। شهادة
শব্দের অর্থ সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। (ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান (ঢাকা:
রিয়াদ প্রকাশনী), পৃ: ৬০৮)।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, কোন জিনিস সবচেয়ে বড়
সাক্ষী? (আন‘আম ৬/১৯)।
আর الزور অর্থ মিথ্যে, জাল, প্রতারণা
ইত্যাদি। (ঐ, ৫৪১ পৃঃ)।
যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং অবশ্যই তারা যুলুম
ও মিথ্যে নিয়ে এসেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)। অতএব شهادة
الزور
অর্থ মিথ্যে সাক্ষ্য।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) মিথ্যা সাক্ষ্যের পরিচয়ে
বলেন, ‘মিথ্যে সাক্ষ্য এমন সাক্ষ্য, যা মানুষকে বাতিলের দিকে ধাবিত করে, চাই সেটা কোন
মানুষের ধ্বংসসাধন অথবা সম্পদ কেড়ে নেওয়া অথবা হারামকে হালাল করা অথবা হালালকে হারাম
করার ক্ষেত্রে হৌক’। (হাশিয়া তাহতাবী আলা দুররিল মুখতার
(বৈরূত: দারুল মা‘আরিফ), ৩/২৬০। গৃহীত: আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া (কুয়েত: ওয়াযারাতুল
আওকাফ ওয়াশ শুঊনিল ইসলামিয়া), ২৬/২৫৩; নাযরাতুন নাঈম (জেদ্দা : দারুল ওয়াসিলাহ, ১ম
প্রকাশ, ১৯৯৮), ১০/৪৭৭৬)।
মিথ্যে সাক্ষ্য না দেওয়ার হুকুম
সকল বিদ্বান একমত যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
কবীরা গুনাহ। (বুখারী হা/৫৯৭৬; মুসলিম হা/৮৭)।
আবূ বকরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের সব থেকে বড় গুনাহ সম্পর্কে
সতর্ক করব না? আমরা বললামঃ অবশ্যই সতর্ক করবেন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ আল্লাহর
সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার গণ্য করা, পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি
হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসলেন এবং বললেনঃ মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য
দেয়া, দু’বার
করে বললেন এবং ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৭৬, ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস
একাডেমী) ১৬০, ১৬১, ১৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
৮৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া আল্লাহর বান্দার অন্যতম
গুণ। আল্লাহ বলেন,‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন
হয় তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে’ (ফুরক্বান ২৫/৭২)।
আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হ’ল, না জেনে কথা
কথা বলার ন্যায় অপরাধ’। (মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়া (রহঃ) বলেন, আল্লাহর বাণী,وَلَا
تَقْفُ
مَا
لَيْسَ
لَكَ
بِهِ
عِلْمٌ
এর অর্থ হ’ল ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া’। (দ্র. তাফসীর ইবনে
কাছীর, সূরা ইসরা ৩৬ নং আয়াতের তাফসীর)।
অনুরূপভাবে সাক্ষ্য গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষীর
মত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে,
তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (বাক্বারাহ ২/২৮৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘মিথ্যা
সাক্ষ্য দেওয়া ও সাক্ষ্য গোপন করা সবচেয়ে বড় গুনাহ’। (তাফসীর
ইবনে কাছীর, সূরা বাক্বারাহ ২/২৮৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র:)।
অনুরূপভাবে সাক্ষীর জন্যও ওয়াজিব হ’ল সত্য
সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা
ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের
কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব
হৌক (সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী।
অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা
পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কুফল
(১) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবীরা গুনাহঃ
কবীরা গুনাহের অন্যতম হলো মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান
করা। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে
হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ২৬৫৩, ৫৯৭৭, ৬৮৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬১-১৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
৮৮, আহমাদ ১২৩৩৮, আধুনিক প্রকাশনী ২৪৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৪৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahi
আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না?
আমরা বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপন
করা ও পিতা-মাতার নাফরমানী করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। এরপর (সোজা
হয়ে) বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। সাবধান! মিথ্যা কথা
বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। অতঃপর ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয়
থামবেন না’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৭৬; ২৬৫৪,
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
২৩০১, গাইয়াতুল মারাম ২৭৭,আধুনিক প্রকাশনী ৫৫৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪৩৮)।হাদিসের
মানঃ সহিহ (Sahih)।
উক্ত হাদীছ হ’তে মিথ্যা সাক্ষ্যদান যে একটি
মহা পাপ তা তিনভাবে প্রমাণিত হয়। প্রথমত: এ কাজ করলে মহাপাপী হ’তে হয়, যা শিরকের মত
মহাপাপের সাথে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা মূর্তিরূপ
অপবিত্রতা বর্জন কর এবং মিথ্যা কথা (সাক্ষ্য) হ’তে দূরে থাক’ (হজ্জ ২২/৩০)।
দ্বিতীয়ত: রাসূল
(ছাঃ) হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু এই দুষ্কর্মের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে সকলকে
সাবধান করতে উঠে বসে তা উল্লেখ করলেন।
তৃতীয়ত: তা বার বার উল্লেখ করে তার অনিষ্টকারিতা
বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং জিহবার এমন পাপ অত সহজ নয়, যত সহজে মানুষ তা জিহবা দ্বারা
করে থাকে। (আবদুল হামিদ ফায়যী, জিভের আপদ পৃ: ৪০)।
(২) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের সমতুল্য আপরাধঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের ন্যায় মহাপাপ।
এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আল্লাহর সাথে
শিরক করার সাথে সমতুল্য। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পড়লেন, ‘অতএব তোমরা মূর্তির অপবিত্রতা
হ’তে দূরে থাক, মিথ্যা কথা পরিহার কর, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। তাঁর সাথে
কাউকে শরীক কর না’ (হজ্জ ২২/৩০-৩১)। (বায়হাকী শু‘আবুল
ঈমান হা/৪৫২১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৭০৩৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৩০১, সনদ হাসান)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য শিরকের
মত’ (হজ্জ ২২/৩০)। (ইবনু কাছীর, সূরা হজ্জ ৩০-এর তাফসীর
দ্রঃ; নাযরাতুন নাঈম ৮/৪৭৮০)।
এর কারণ হচ্ছে, ‘মিথ্যা কথা’ শব্দটি ব্যাপক।
এর সবচেয়ে বড় প্রকার হচ্ছে শিরক। তা যে শব্দের মাধ্যমেই হোক না কেন। আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে
শরীক করা এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকার তথা ইবাদতে তাঁর বান্দাদেরকে অংশীদার
করা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। অনুরূপভাবে পারস্পরিক লেন-দেন ও সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যাও এ আয়াতের
অন্তর্ভুক্ত। এ সঙ্গে মিথ্যা কসমও একই বিধানের আওতায় আসে। (কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) (সঊদী আরব: বাদশাহ ফাহদ
কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স ১৪৪০ হিঃ), পৃ. ১৭৬৬-১৭৬৭)।
(৩) অন্যের প্রতি যুলুমঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অন্যের প্রতি যুলুম করার
শামিল। এই যুলুমের দ্বারা কখনো অন্যের সম্পদ এমনকি কখনো অন্যের জীবনও চলে যেতে পারে।
উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
একদিন দুই ব্যক্তি উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে সাক্ষী ব্যতীত শুধু
প্রাপ্যের দাবী নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসেছিল।এমতাবস্থায়
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আমি যদি তোমাদের কাউকে তার ভাইয়ের হক
(তোমাদের একজনের মিথ্যার বলার দরুন) প্রদান করি, তখন আমার সে ফায়সালা দোষী ব্যক্তির
জন্য হবে জাহান্নামের একখন্ড আগুন। এ কথা শুনে তারা উভয়েই বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল!
আমার অংশটি আমার সঙ্গীকে দিয়ে দিন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,
না; বরং তোমরা উভয়ে (সমানভাবে) ভাগ-বণ্টন করে নাও। আর ভাগ-বণ্টনের মধ্যে হক পন্থা অবলম্বন
করবে এবং পরস্পরের মধ্যে লটারী করে নিবে। অতঃপর তোমরা একে অপরকে ঐ অংশ থেকে ক্ষমা করে
দিবে।
অপর এক বর্ণনাতে আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আমি তোমাদের মাঝে এ ফায়সালা স্বীয় জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা করছি।
এ ব্যাপারে আমার নিকট কোনো ওয়াহী অবতীর্ণ হয়নি। (মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৭০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৮৪, ইরওয়া ১৪২৩)। হাদিসের মানঃ
হাসান (Hasan)।
(৪) অন্যের হক নষ্ট করা হয়ঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে অন্যের হক
নষ্ট করা হয়। একজনের হক অন্যকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং অন্যকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত
করা হয়। আর এটা যেহেতু বান্দার হক সেহেতু বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন
না।
কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ ও ’আলী ইবনু হুজর (রহঃ)....আবু
হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা
কি বলতে পার, অভাবী লোক কে? তারা বললেন, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা কড়ি) ও ধন-সম্পদ
নেই সে তো অভাবী লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে
ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে,
সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা
করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক ’আমল থেকে দেয়া হবে, অমুককে
নেক আমল থেকে দেয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হাক তার নেক ’আমল থেকে পূরণ করা না যায়
সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে
নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৩,
আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮১, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪১৮, সহীহাহ (৮৪৫), আহকামুল
জানাইয (৪), ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ।
(৫) মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে নাঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে ব্যক্তির ভাল
আমলও আল্লাহর নিকটে গ্রহণীয় হবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)
ছিয়াম সম্পর্কে বলেন ‘যে লোক মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার
করল না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই’। (বুখারী হা/৬০৫৭; আবূদাঊদ হা/২৩৬২; তিরমিযী হা/৭০৭; ইবনু মাজাহ
হা/১৬৮৯)।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার
করলো না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০৫৭, সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৮৯,
সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭০৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৩৬২, আধুনিক প্রকাশনী
৫৬২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৫১৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৬) হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করাঃ
মিথ্যা সাক্ষ্যের দ্বারা আল্লাহর হালালকৃত
বিষয় অনেক সময় হারাম করা হয় আবার অনেক সময় হারামকে হালাল করা হয়।
(৭) ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামতঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করে সালাম দেয়ার
প্রচলন ঘটবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফলে স্বামীর ব্যবসায়ে স্ত্রীও সহযোগিতা
করবে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করা হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যদানের প্রচলন হবে এবং
সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে, লেখনীর প্রসার ঘটবে’। (আহমাদ
হা/৩৮৭০; ছহীহাহ হা/৬৪৭; ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/৮০১)।
(৮) জাহান্নামে যাওয়ার কারণঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য অনেকের জাহান্নামে যাওয়ার কারণও
হ’তে পারে। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, কোন লোক
জ্ঞাতসারে নিজ পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পিতা বলে দাবী করলে সে আল্লাহর সাথে কুফরী
করল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার
কোন সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল’। (বুখারী হা/৩৫০৮; মুসলিম
হা/৬১)।
আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, কোন লোক যদি নিজ পিতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও
অন্য কাকে তার পিতা বলে দাবী করে তবে সে আল্লাহর কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন
বংশের সঙ্গে বংশ সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার কোন বংশ সম্পর্ক নেই, সে যেন
তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ৩৫০৮, ৬০৩৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২০, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ৬১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২৪৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
ইসলামি শরিয়তে মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের শাস্তি
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অন্যতম কবীরা গুনাহ হ’লেও
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দিষ্ট কোন শাস্তি ইসলামী শরী‘আতে নেই। তাই এর শাস্তি হ’ল
তা‘যীর তথা ভৎর্সনা করা। (তা‘যীর হবে ঐ সকল পাপের জন্য, যে পাপের কোন হদ্দ (দন্ড) বা
কাফ্ফারা নির্ধারিত নেই)।
আর এটা অবস্থা অনুযায়ী বিচারক নির্ধারণ করবেন।
তবে শাফেঈ, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাবের কোন কোন ইমাম বলেন, এর শাস্তি ১০টি বেত্রাঘাতের
অধিক হবে না। আর ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার শাস্তি দশ চাবুকের অধিক
নয়। (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া, ২৬/২৫৫)।
নবী করীম (ছাঃ) বলতেন, আবূ বুরদা (রাঃ) হতে
বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ আল্লাহর নির্দিষ্ট হদসমূহের
কোন হদ ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে দশ বেত্রাঘাতের বেশি দন্ড দেয়া যাবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৮৪৮, ৬৮৪৯, ৬৮৫০; সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ৪৩৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭০৮, আহমাদ ১৬৪৮৬, আধুনিক প্রকাশনী ৬৩৭১,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
তবে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা সাক্ষীর কারণে যদি হদ্দ
জারী হয় এবং পরে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রকাশিত হয় তাহ’লে ক্বিছাছ কার্যকর করা হবে। আলী
(রাঃ)-এর কাছে দু’জন লোক কোন এক ব্যক্তির চুরির ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করার কারণে
ঐ ব্যক্তির হাত কাটা হয়। পরে ঐ দু’ব্যক্তি এসে তাদের ভুল স্বীকার করে এবং বলে, সে চোর
নয়। তখন তিনি বলেন, যদি আমি জানতাম যে, তোমরা ইচ্ছা করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, তাহলে
আমি তোমাদের দু’জনের হাত কেটে দিতাম। (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া,
২৬/২৫৮)।
অর্থাৎ মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে চুরির শাস্তি
কার্যকর হয়ে থাকলে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীর উপর অনুরূপ শাস্তি বর্তাবে। আর হত্যা
কার্যকর হয়ে থাকলে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীকেও বিচারক হত্যার নির্দেশ
দিবেন। (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়া ২৬/৫৮)।
তবে হানাফী ও মালেকী বিদ্বানগণ মনে করেন, মিথ্যা
সাক্ষ্য প্রমাণিত হলে সাক্ষ্য প্রদানকারীর উপর দিয়াত কার্যকর হবে, কিছাছ কার্যকর হবে
না। (কাসানী, বাদায়েঊছ ছানায়ে‘ ৭/২৮৬; আশ-শারহুছ ছাগীর
৪/২৯৫)।
এই মাস‘আলার ক্ষেত্রে হানাফী ও মালেকী বিদ্বানের
অভিমতই গ্রহণরযাগ্য। কারণ মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান হদ্দ কায়েমের কোন কারণ নয়।
মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়ার পরকালীন শাস্তি
(১) আল-আশ্আছ ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, আমার এবং এক ইহূদীর যৌথ মালিকানাধীন এক খন্ড জমি ছিল। সে আমার অংশ অস্বীকার করলে
তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট পেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেনঃ তোমার কি দলীল-প্রমাণ আছে? আমি বললাম,
না। তিনি ইহূদীকে বলেনঃ শপথ করো। আমি বললাম, এ সম্পর্কে সে শপথ করার সাথে সাথে আমার
সম্পত্তি নিয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন (অনুবাদ) ’’নিশ্চয় যারা আল্লাহর
সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন
অংশ নেই’’। (সূরা আল ইমরানঃ ৭৭)...আয়াতের শেষ পর্যন্ত। (সুনান
ইবনু মাজাহ ২৩২২, আহমাদ ২১৩৩০, ইরওয়া ২৬৩৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২) আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ, ইবনু নুমায়র এবং
ইসহাক ইবনু ইবরাহীম আল হানযালী (রহঃ).....আবদুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত চূড়ান্ত কসমের মাধ্যমে
কোন মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে অথচ সে মিথ্যাবাদী। এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে তার
সাক্ষাৎ ঘটবে যে, তিনি তার প্রতি রেগে থাকবেন। রাবী বলেন, আশ’আস ইবনু কায়স তথায় প্রবেশ
করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আবূ আবদুর রহমান (আবদুল্লাহ) তোমাদেরকে কি বর্ণনা করলেন?
তদুত্তরে সকলে উক্ত হাদীসটির কথা বললেন। তিনি বললেন, আবূ আবদুর রহমান সত্যই বর্ণনা
করেছেন, ঘটনাটি আমাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। ব্যাপার হলো ইয়ামানে জনৈক ব্যক্তির সাথে
আমারও একখণ্ড ভূমি ছিল। এর মীমাংসা করার জন্য আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর খিদমাতে উপস্থিত হই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে
জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দাবীর স্বপক্ষে তোমার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি? আমি বললাম, না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বললেন, তা হলে বিবাদীর কসম নেয়া হবে। আমি বললাম, এ ব্যক্তি তো কসম করবেই। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত চূড়ান্ত কসমের মাধ্যমে
কোন মুসলিমের সম্পদ গ্রাস করে অথচ সে মিথ্যাবাদী আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় তার সাক্ষাৎ
ঘটবে যে, আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকবেন। এরপর এ আয়াত নাযিল হয়, “যারা আল্লাহর
সাথে কৃত ওয়াদা এবং নিজেদের কসম তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই।
কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে
পরিশুদ্ধ করবেন না; তাদের জন্য রয়েছে মর্মম্ভদ শাস্তি"- (সূরাহ্ আলে ইমরান ৩:
৭৭)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
১৩৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩৫৭, ২৪১৬, ২৫১৫, ২৬৬৬, ২৬৬৯, ২৬৭৩, ২৬৭৬, ৪৫৪৯,
৬৬৫৯, ৬৬৭৬, ৭১৮৩, ৭৪৪৫, ২৩৫৩, ২৪১৭, ২৫১৬, ২৬৬৭, ২৬৭০, ২৬৭৭, ৪৫৫০, ৬৬৬০, ৬৬৭৭, ৭১৮৪,
সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৯৯৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩২৪৩, আহমাদ ৩৫৬৬, ৩৫৮৬, ৩৯৩৬, ৪০৩৯, ৪২০০, ৪৩৮১, রাওদুন নাদীর ২৪০, ৬৪০, আধুনিক প্রকাশনীঃ
২১৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৩) ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ
ও আলী ইবনু হুজুর (রহঃ)....আবূ উমামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের হক বিনষ্ট করে তার
জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে রেখেছেন। তখন জনৈক
ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! অতি সামান্য বস্তু হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আরাক (বাবলা গাছের মত এক ধরনের কাঁটাযুক্ত) গাছের ডাল হলেও
এ শাস্তি দেয়া হবে*। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৪, সহীহ মুসলিম
(হাদীস একাডেমী) ২৫০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
১৩৭, নাসায়ী ৫৪১৯, আহমাদ ২১৭৩৬, মুয়াত্তা মালেক ১৪৩৫, দারেমী ২৬০৩, রাওদুন নাদীর ২৪০,
ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫২. ইসলামিক সেন্টারঃ ২৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৪) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার এই মিম্বারের
নিকট দাঁড়িয়ে মিথ্যা শপথ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়, যদিও তা একটি
সবুজ মিসওয়াকের জন্যও হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩২৫, সুনান
আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩২৪৬, আহমাদ ১৪২৯৬, ১৪৬০৬, মুয়াত্তা মালেক ১৪৩৪, রাওদুন নাদীর
২৪০, আত-তালীকুর রাগীব ৩/৪৮, ইরওয়া ২৬৯৭। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৫) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এই মিম্বারের নিকট কোন পুরুষ অথবা
নারী মিথ্যা শপথ করলে সে যেন জাহান্নামে তার আবাস নির্দ্ধারণ করলো, তা একটি কাঁচা দাঁতনের
জন্য হলেও। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩২২৬, আহমাদ ১০৩৩৩, বায়হাকী
ফিস সুনান ৬/৬৮, ইরওয়া ৮/৩১৩, মিশকাত ৩৭৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
অন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী বানানো হলেও সাক্ষ্য না দেয়া
(১) নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, আমার মাতা আমার পিতাকে তার মালের কিছু আমাকে দান করতে বললেন। পরে তা’ দেয়া ভালো
মনে করলে আমাকে তা দান করেন। তিনি (আমার মাতা) তখন বললেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)-কে সাক্ষী মানা ব্যতীত আমি রাজী নই। অতঃপর তিনি (আমার পিতা) আমার হাত ধরে
আমাকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে গেলেন, আমি তখন বালক মাত্র।
তিনি বললেন, এর মা বিনতে রাওয়াহা একে কিছু দান করার জন্য আমার নিকট আবেদন জানিয়েছে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যতীত তোমার আর কোন ছেলে আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আছে। নু‘মান
(রাঃ) বলেন, আমার মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, আমাকে অন্যায় কাজে সাক্ষী করবেন না। আর আবূ
হারীয (রহ.) ইমাম শা‘বী (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আমি অন্যায় কাজে সাক্ষী হতে পারি
না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫০, ২৫৮৬, আধুনিক
প্রকাশনীঃ ২৪৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
(২) ‘ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে
সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা।
‘ইমরান (রাঃ) বলেন, আমি বলতে পারছি না, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (তাঁর
যুগের) পরে দুই যুগের কথা বলেছিলেন, বা তিন যুগের কথা। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
বলেছেন, তোমাদের পর এমন লোকেরা আসবে, যারা খিয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না। সাক্ষ্য
দিতে না ডাকলেও তারা সাক্ষ্য দিবে। তারা মান্নত করবে কিন্তু তা পূর্ণ করবে না। তাদের
মধ্যে মেদওয়ালাদের প্রকাশ ঘটবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ
পাবলিকেশন) ২৬৫১, ৩৬৫০, ৬৪২৮, ৬৬৯৫, মুসলিম ৪৪/৫২ হাঃ ২৫৩৫, আহমাদ ১৯৮৫৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ
২৪৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৩) আবদুল্লাহ (ইবনু মাস‘ঊদ) (রাঃ) সূত্রে নবী
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম
ব্যক্তি, অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী। অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী এরপরে এমন সব ব্যক্তি
আসবে যারা কসম করার আগেই সাক্ষ্য দিবে, আবার সাক্ষ্য দেয়ার আগে কসম করে বসবে। ইবরাহীম
(নাখ্ঈ) (রহ.) বলেন, আমাদেরকে সাক্ষ্য দিলে ও অঙ্গীকার করলে মারতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫২, ৩৬৫১, ৬৪২৯, ৬৬৫৮, সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৩৬৩, আন্তর্জাতিক
নাম্বারঃ ২৫৩৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩০২, ২৩০৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৯,
আহমাদ ৪১৩০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
ইসলামি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকারভেদ
(ক) যিনা বা ব্যভিচার,
(খ) যিনা এর উপর মিথ্যা অপবাদ,
(গ) চুরি,
(ঘ) ডাকাতি,
(ঙ) মাদক গ্রহণ,
(চ) ইসলাম ধর্ম ত্যাগ,
(ছ) ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। (বাদায়ে
উস সানায়ে, ৭ম খন্ড)।
(জ) সালাত পরিত্যাগকারীকেও অসংখ্য আলিম মুরতাদ
গণ্য করেন।
(তথ্য সূত্রঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
কর্তৃক প্রকাশিত- অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল)।
ইসলাম উক্ত বিষয়গুলোতে দন্ডবিধি সুনির্দিষ্ট
করে দিয়েছে। যেমন. খুনের বদলা খুন, যিনা করলে যদি বিবাহিত হয় তাহলে পাথর মেরে হত্যা
করা, অবিবাহিত হলে ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্যে নির্বাসন, চুরি করলে হাত কেটে দেয়া,
মুরতাদ হলে হত্যা করা ইত্যাদি। উক্ত বিষয়ে ইসলামি ও মানবরচিত আইনে কিন্তু পার্থক্য
আছে। তবে রাষ্ট্র যদি কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক পরিচালিত না হয় তথা ইসলামি রাষ্ট্র না
হলে ইসলামি দন্ডবিধি প্রয়োগ করা যাবে না।
উক্ত অপরাধগুলো ছাড়াও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে
শত শত অপরাধ আছে যেগুলো প্রতিনিয়ত ঘটেই চলছে। যেমন, মিথ্যে মামলা দায়ের, মিথ্যে সাক্ষ্য
দেয়া, মিথ্যে কথা বলা, অযথা অন্যকে প্রহার করা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, ঘুষ নেয়া,
দুর্নীতি করা, টেন্ডারবাজি করা, ভূমিদস্যুতা করা ইত্যাদি। এসব অপরাধের জন্যে ইসলামে
সুনির্দিষ্ট কোনো দন্ডবিধি তৈরী করা নেই।
এসব অপরাধের জন্যে ইসলামে ১০ বেত্রাঘাতের কথা
বলা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে অপরাধের ধরণ অনুসারে এই ১০ বেত্রাঘাত যথেষ্ট নয়। যেমন,
একজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী একটা অবৈধ পিস্তল বের করে একজনকে গুলি করতে উদ্ধত হলো।
এধরণের অপরাধে ১০ বেত্রাঘাত যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্র হলে শুরা সদস্যগণ
সময়োপযোগি ইজমার ভিত্তিতে আইন তৈরী করবেন। এখানে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য
প্রদানের ক্ষেত্রে মানবরচিত আইনে যে শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে তা কমবেশী করে
ইসলামি শরিয়তে গ্রহণ করা যেতে পারে বা অনুরুপ আইন তৈরী করা যেতে পারে।
কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে প্রমাণিত হলে করণীয়
ইমামদের মতে, যে ব্যক্তি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা
প্রমাণিত হবে তার নাম চারদিকে প্রচার করে দিতে হবে (কুরতুবী)।
ওমর (রাঃ) বলেন, ‘তার পিঠে চাবুক মারতে হবে,
মাথা ন্যাড়া করে দিতে হবে, মুখ কালো করে দিতে হবে এবং দীর্ঘদিন অন্তরীণ রাখতে হবে’।
ওমর (রাঃ)-এর আদালতে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য মিথ্যা
প্রমাণিত হয়। তিনি তাকে একদিন প্রকাশ্যে জনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং ঘোষণা করে দেন
যে, এ ব্যক্তি হচ্ছে অমুকের ছেলে অমুক, এ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, একে নিচে রাখো। তারপর
তাকে কারাগারে বন্দী করেন’। (বায়হাকী, মা‘রিফাতুস সুনান
ওয়াল আছার, ১৪/২৪৩; কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), পৃঃ ১৭৬৭)।
মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে তওবা করা
তওবা করলে আল্লাহ বান্দার সকল গুনাহ মাফ করে
দিবেন। বান্দা যখন তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে পাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর দৃঢ়
সংকল্প করে এবং আল্লাহর নিকট কৃত অপরাধের জন্য ইসতিগফার করে তখন আল্লাহ তার অতীতের
সকল পাপ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তবে যারা (মুরতাদ হওয়ার পরে) তওবা করেছে
এবং নিজেদের সংশোধন করেছে, সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৮৯)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পাপ থেকে তওবাকারী
নিষ্পাপ ব্যক্তির মতো’। (ইবনু মাজাহ হা/৪২৫০; ছহীহুল জামে‘
হা/৩০০৮)।
আবূ উবায়দা ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে তার
পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গুনাহ
থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তিতুল্য। (সুনান ইবনু মাজাহ
৪২৫০)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।
তিনি
আরো বলেন, ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ বান্দা যখন গুনাহ করার পর তা স্বীকার করে (অনুতপ্ত হয়) আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা
চায়। আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
২৬৬১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৯১৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৭০, মিশকাতুল মাসাবীহ
(মিশকাত) ২৩৩০, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৭৪৮, ইবনু হিব্বান ৪২১২, শু‘আবূল ঈমান ৬৬২৮, সুনানুল
কুবরা লিল বায়হাক্বী ২০৫৫৭, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।
মিথ্যা সাক্ষ্য যেহেতু অন্যের হকের সাথে জড়িত
সেহেতু যার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে অথবা মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে যার
ক্ষতি করা হয়েছে তার নিকট থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কেউ
তার কোন ভাইয়ের সম্মান বা অন্য কিছুর ব্যাপারে তার উপর যুলুম করে থাকে, তাহ’লে সেই
দিন আসার পূর্বেই যেন তা থেকে মুক্ত হয়ে যায়, যে দিন তার কাছে কোন টাকা-পয়সা থাকবে
না। যদি তার কোন সৎ আমল থাকে তাহলে তার অন্যায়ের সমপরিমাণ নেকী কেটে নেওয়া হবে। আর
যদি তার সৎকর্ম না থাকে তাহ’লে যার সাথে অন্যায় করা হয়েছে, তার পাপ নিয়ে তার উপরে চাপিয়ে
দেয়া হবে’। (বুখারী হা/২৪৪৯; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/২১০)।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি
বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হতে মাফ করিয়ে নেয়,
সে দিন আসার পূর্বে যে দিন তার কোন দ্বীনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোন সৎকর্ম
না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট হতে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে
তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪৪৯, ৬৫৩৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ
২২৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘(আল্লাহ)
ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই পাওনাদারের পাওনা আদায় করবেন। এমনকি শিংওয়ালা বকরী থেকে শিং
বিহীন বকরীর প্রতিশোধও গ্রহণ করা হবে’। (মুসলিম হা/২৫৮০;
রিয়াযুছ ছালেহীন হা/২০৪)।
ইয়াহইয়া ইবনু আইয়্যুব, কুতাইবাহ ও ইবনু
হুজর (রহঃ)....আবু হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক পাওনাদারকে তার পাওনা চুকিয়ে দিতে হবে।
এমনকি শিং বিশিষ্ট বকরী থেকে শিং বিহীন বকরীর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৭৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৮২,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৪৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়
(১) অন্যায় কাজে সাক্ষ্য দেওয়া যাবে নাঃ
মুমিনগণ সব সময় সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিপক্ষে
সাক্ষ্য প্রদান করবেন। সে কখনো মিথ্যার সাক্ষী হবে না।
মুহাম্মাদ ইবনু সাববাহ, যুহায়র ইবনু হারব
ও উসমান ইবনু আবূ শাইবা (রহঃ)....জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের
উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৯৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৫৯৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৩৩৩, সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৭, তিরমিযী ১২০৬, আহমাদ ৩৭২৯,
৩৭৯৯, ৩৮৭১, ৪০৭৯, ৪২৭১, ৪৩১৫, ৪৩৮৯, ৪৪১৪, দারেমী ২৫৩৫, ইরওয়া ৫/১৮৪, আত-তালীকুর রাগীব
৩/৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩৯৪৮, ইসলামিক সেন্টার ৩৯৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
আমির (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু‘মান
ইবনু বাশীর (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন।
তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত সম্মত নই। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু
দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে
জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর।
[নু‘মান (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৮৭, ২৫৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস
একাডেমী) ৪০৬৯-৪০৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬২৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৩৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ
২৪১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(২) সাক্ষ্য গোপন করা যাবে নাঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যেমন অপরাধ তেমনি সাক্ষ্য
গোপন রাখাও অপরাধ। যেহেতু উভয়টি নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে। যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা
সাক্ষ্যের কারণে অন্যায়ভাবে ফেঁসে যায়, তখন সত্য সাক্ষ্য দিয়ে তাকে উদ্ধার করা নৈতিক
দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং কেউ তা গোপন করলে, অবশ্যই
তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা আমল কর, আল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত’ (বাক্বারাহ ২/২৮৩)।
(৩) মুসলিম, বালেগ, আক্বেল ও আদেল ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য
হবে নাঃ
কোন বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সাক্ষ্যদানকারী
ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলিম, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ হ’তে হবে। এক্ষেত্রে কাফের, নাবালক ও
ফাসেকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না’ (তালাক ৬৫/৩, বাক্বারাহ
২/২৮২-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য)।
(৪) বিচারক প্রকাশ্য বিষয় দেখে ফায়ছালা দিবেনঃ
বিচারক প্রকাশ্য বিষয় দেখেই বিচার করবেন, চাই
সে সাক্ষ্য মিথ্যা হোক বা সত্য। উম্মে সালামা (রাঃ) সূত্রে নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। আর তোমরা আমার কাছে বিবাদ মীমাংসার জন্য এসে থাক। তোমাদের
এক পক্ষ অন্য পক্ষ অপেক্ষা দলীল-প্রমাণ পেশ করায় বেশি পারদর্শী হ’তে পারে। ফলে আমি
আমার শোনার কারণে যদি কাউকে তার অন্য ভাইয়ের হক দিয়ে দেই, তাহ’লে যেন সে তা গ্রহণ না
করে। কেননা আমি তার জন্য জাহান্নামের একটা অংশই নির্ধারণ করে দিচ্ছি’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৯৬৭, ৭১৬৯, ২৪৫৮, ইবনে হিববান
৫০৭০, আধুনিক প্রকাশনী ৬৪৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
(৫) বিচারকের নিকট সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হ’লে সে সাক্ষ্য অনুযায়ী বিচার
করা যাবে নাঃ
সাক্ষ্যের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও সেই সাক্ষ্যের
ভিত্তিতে রায় দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আবদুল্লাহ
ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
বলতে শুনেছি, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল, সুতরাং প্রত্যেকে অবশ্যই তার অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা
বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। দেশের শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে
জবাবদিহী করবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, অতএব সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত
হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের দায়িত্বশীলা, কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা
হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল, সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই
দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতা ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৫৮, ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪,
২৭৫১, ৫১৮৮, ৫২০০, ৭১৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস
একাডেমী) ৪৬১৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮২৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৭০৫, সুনান
আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৯২৮, আহমদ ৪৪৮১, ৫১৪৮,
৫৮৩৫, ৫৮৬৭, ৫৯৯০, আল লুলু ওয়াল মারজান-১১৯৯। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।
অন্য হাদীসে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইবনু বুরাইদাহ (রহঃ)
থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিচারক
তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’ প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী
বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয়
বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক প্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী।
(সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
ন্যায় অন্যায়ে ওকালতি পেশা
চুরি, ডাকাতি, মারামারি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণসহ
অনুরুপ অন্যায়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যখন মামলা হয় তখন একশ্রেণির উকিল অর্থের
বিনিময়ে তাকে বাঁচানোর জন্যে আদালতে ওকালতি শুরু করে দেন। হয়তো উকিল সাহেব বলবেন, সে
যে অন্যায়ের সাথে জড়িত তার কী প্রমাণ আছে। প্রমাণ তো হবে সাক্ষ্য গ্রহণের পর। তবে এটা
সত্য যে, মামলা হাতে নেয়ার পর উকিল ঠিকই বুঝতে পারেন তার মোয়াক্কেল অন্যায়ের সাথে জড়িত
কিনা। এরপর ব্রেন খাটিয়ে আইনের ফাঁক ফোঁকর বের করেন ও আদালতে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন
করেন। প্রতিপক্ষ সঠিক প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হলে হয়তো হেরে যান। তবে অন্যায়কারী যে
জিতে গেলো আর সেটা যে অন্যায়ভাবে হয়েছে উকিল তা ভালভাবে জানেন। তিনি যে, অন্যায়ের সহযোগি
হলেন এটা প্রমাণিত। অথচ আল্লাহ তায়ালা অন্যায়মূলক কাজে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন।
তাহলে তার উপার্জিত অর্থ কি হালাল হলো?
আল্লাহ তায়ালা বলেন, সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে
অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে
ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা মায়িদা,
২)।
বিচারক ও রায়
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অতএব আপনি আল্লাহর অবতীর্ণ
করা আইন মোতাবেক লোকদের যাবতীয় বিষয়ে ফায়সালা করুন।’’ (সূরাআল-মায়িদাহঃ ৪৮)।
আল্লাহ তায়ালা যেমন ন্যায়বিচারক ও ইনসাফকারী
ঠিক তেমনি তিনি চান যে, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এ দুনিয়ায় যারা বিচারাসনে বসে আছেন তাঁরাও
ন্যায়বিচার করবেন। সুবিচার প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন
যে, তোমরা যেনো প্রাপকের হাতে তাদের প্রাপ্য আমানত পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের
মধ্যে কোনো বিচার-মীমাংসা করবে তখন ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচার-মীমাংসা করবে। আল্লাহ
তোমাদের সদুপদেশ দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু শুনেন এবং সব কিছু জানেন’’। (সূরা নিসা ৫৮)।
তিনি আরো বলেন, নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে
স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি,
যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরো নাযিল করেছি লোহা, তাতে প্রচন্ড শক্তি ও
মানুষের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে। আর যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন, কে না দেখেও তাঁকে
ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। অবশ্যই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। (সূরা আল হাদিদ ২৫)।
আল্লাহর রাসূল সা: ইনসাফকারী বিচারক প্রসঙ্গে
বলেন,
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত
কোন ছায়া থাকবে না সে দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।
(১)
ন্যায়পরায়ণ শাসক।
(২)
যে যুবক আল্লাহর ইবাদতের ভিতর গড়ে উঠেছে।
(৩)
যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সাথে থাকে।
(৪)
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে দু’ব্যক্তি পরস্পর মহববত রাখে, উভয়ে একত্রিত হয় সেই
মহববতের উপর আর পৃথক হয় সেই মহববতের উপর।
(৫)
এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহবান জানিয়েছে। তখন
সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।
(৬) যে
ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে সাদাকা করে যে, তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে
না।
(৭)
যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাতে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ হতে অশ্রু বের
হয়ে পড়ে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪২৩, ৬৬০,সহীহ
মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৩১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৩১, ইসলামিক
ফাউন্ডেশনঃ ১৩৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
বিচারকের নিরপেক্ষতা ও সুবিচার করার ওপর আখিরাতে
তার নাজাত নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেছেন,
ইবনু বুরাইদাহ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে
বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার
বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’ প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে
বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে
জাহান্নামী এবং যে বিচারক প্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৭৩, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১৫, মিশকাতুল
মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৩৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩২২, ইরওয়া ২৬১৪, সহীহ আল জামি
৪৪৪৬, সহীহ আত্ তারগীব ২১৭২, নাসায়ি, ৫৩৮০, মুয়াত্তা মালিক ১৭৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
বিচারক ভুল করলে
’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরেছেনঃ কোন বিচারক বিচারকালে ভেবেচিন্তে
সিদ্ধান্ত দিয়ে যদি সে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয় তার জন্য দু’টি সওয়াব রয়েছে। পক্ষান্তরে
বিচারক যদি চিন্তা-ভাবনার পর ভুল সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে তার জন্য একটি সওয়াব রয়েছে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৭৪, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১৪, সহীহ
বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩৫২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৭৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ
১৭১৬, আহমাদ ৬৭১৬, ১৭৩২০, ১৭৩৬০, ইরওয়া ২৫৫৮, রাওদুন নাদীর ৬৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ
(Sahih)।
ইসলামি আইন মোতাবেক যারা বিচার ফয়সালা করে না
ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। মহান আল্লাহর
বাণীঃ যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান মোতাবেক বিচার ফায়সালা করে না, তারা কাফির... তারাই
ফাসিক’’ (সূরা মায়িদাহঃ ৪৫-৪৭) পর্যন্ত। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৭৬)। হাদিসের মানঃ হাসান
(Hasan)।
কর্মকর্তাদের প্রাপ্ত উপহার
আদী ইবনু উমাইরাহ আল-কিন্দা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যকার কোন
ব্যক্তিকে আমাদের সরকারী কোন পদে নিয়োগ করার পর সে যদি আমাদের তহবিল থেকে একটি সূঁই
কিংবা তার অধিক আত্মসাৎ করে তবে সে খেয়ানতকারী। কিয়ামতের দিন সে তার এই খেয়ানাতের বোঝা
নিয়ে উপস্থিত হবে। তখন কালো বর্ণের জনৈক আনসার ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। বর্ণনাকারী বলেন,
আমি যেন তাকে দেখছি। সে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি নিয়ে
নিন। তিনি বললেনঃ তুমি কি বললে? সে বললো, আমি আপনাকে এরূপ এরূপ বলতে শুনেছি। তিনি বলেনঃ
আমি বলেছি, যাকে আমরা কোন দায়িত্ব দিয়েছি, সে কম-বেশি যা কিছুই আদায় করে আনবে তা জমা
দিবে। তা থেকে তাকে যা প্রদান করা হবে সে তা নিবে, আর তাকে যা থেকে বিরত থাকতে বলা
হবে সে তা থেকে বিরত থাকবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫৮১, মুসলিম, আহমাদ, ইবনু খুযাইমাহ, হুমাইদী)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
কিভাবে বিচার করবে
আলী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ইয়ামেনে বিচারক হিসাবে প্রেরণ করলেন। আমি বললাম,
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে বিচারক করে ইয়ামেনে পাঠাচ্ছেন, অথচ আমি একজন নব যুবক,
বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি বলেনঃ আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার অন্তরকে
সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে পথ দেখাবেন এবং তোমার কথাকে প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। যখন তোমার সামনে
বাদী-বিবাদী বসবে তখন তুমি যেভাবে এক পক্ষের বক্তব্য শুনবে অনুরূপভাবে অপর পক্ষের বক্তব্য
না শোনা পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নিবে না। এতে তোমার সামনে মোকদ্দমার আসল সত্য প্রকাশিত
হবে। আলী (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সন্দেহ পতিত হইনি। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৮২, সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১০, সুনান
আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৩৩১, ইরওয়া ২৫০০।)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।
রাগের সাথে বিচারকের সিদ্ধান্ত দেয়া নিষেধ
আবূ বকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ বিচারক যেন রাগান্বিত অবস্থায় দু’ (বিবদমান) পক্ষের মধ্যকার
বিচারকার্য পরিচালনা না করে। রাবী হিশাম (রাঃ) তার হাদীসে বলেনঃ রাগান্বিত অবস্থায়
দু’ (বিবদমান) পক্ষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করা বিচারকের জন্য সংগত নয়। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭১৫৮,
আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩৫৮৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৮২,আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭১৭, সুনান আত তিরমিজী
(তাহকীককৃত) ১৩৩৪, নাসায়ী ৫৪০৬, ৫৪২১, আহমাদ ১৯৮৬৬, ১৯৮৭৬, ১৯৮৮০, ১৯৯৫৪, ১৯৯৯৯, ইরওয়া
২৬২৬, রাওদুন নাদীর ৯২৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।
ন্যায় বিচারকের সাথে আল্লাহ থাকেন
আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কাযী যতক্ষণ পর্যন্ত
জুলুম না করে, আল্লাহ তার সাথে থাকেন। যখন সে জুলুম করে, তখন তিনি তাকে তার নিজের উপর
ছেড়ে দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৩১২, সুনান আত তিরমিজী
(তাহকীককৃত) ১৩৩০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৭৪১, সহীহ আল জামি ১২৫৩, সহীহ আত্ তারগীব
২১৯৬)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।
পরিশেষে বলা যায়, মিথ্যে
মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। মিথ্যে মামলা ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মানবরচিত আইনে
যেমন কঠোর শাস্তির বিধান আছে তেমনি ইসলামি বিধান মোতাবেক এর ভয়াবহতাও ভয়ংকর। জাহান্নামে
যাওয়ার যতোগুলো কারণ আছে তার মধ্যে মিথ্যে মামলা দায়ের ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান একটি।
তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য যে, দুনিয়াবী কিছু স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে সত্য পথে
গমন করা।
তাহলে পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয়
জীবনেও শান্তি নেমে আসবে। আল্লাহ আমাদেরকে সত্য বলার ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ
করার তাওফীক দান করুন-আমীন!
Related অন্যান্য বই দেখতে চাইলে এদের উপর ক্লিক করুনঃ-
(২) যিনা/ব্যভিচার ও ধর্ষণ বনাম ইসলামি আইন।
(৩) ঈমান বিধ্বংসী অস্ত্র-মুসলিম সমাজে মাদকের ব্যাপকতা।
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক
ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
.................................................................................................................
এক সাথে সকল পর্ব দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন
---------------------------------------------
No comments:
Post a Comment