Search This Blog

Friday, June 25, 2021

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক সহিহ চিকিৎসা ব্যবস্থা

 

بسم الله الرحمن الرحيم

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক

সহিহ চিকিৎসা ব্যবস্থা

(ঔষধী উপকরণ, ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ)

ভূমিকাঃ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্য তিনটি। (ক) শারীরিক সুস্থতার সংরক্ষণ (খ) দুর্ভোগ ও কষ্ট লাঘব এবং (গ) শরীর হতে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। আলোচ্য অধ্যায়ে দু’ প্রকার চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে।

প্রথমত শারীরিক চিকিৎসা, মূলত এটিই এখানে উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়ত অন্তরের চিকিৎসা, যার মৌলিক উপাদান হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত আল্লাহ তা‘আলার বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআন।

শারীরিক ব্যাধির চিকিৎসার বিষয়টি হাদীসে বিভিন্নভাবে এসেছে যা ত্বিবিব নবী হিসেবে পরিচিত।

অন্যদের থেকেও বর্ণিত হয়েছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়। শারীরিক ব্যাধির এ চিকিৎসা আবার দুই ধরনের। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাণীকুলের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কিছু প্রাকৃতিক বিষয়, যেমন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। অন্যটি চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।

ইসলামী শারী‘আর আলোকে চিকিৎসার আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে ঝাড়ফুঁক। যা বাস্তবসম্মত ও পরীক্ষিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। ইমাম বাযযার (রহিমাহুল্লাহ) ‘উরওয়াহ্ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে বললাম, আপনি চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কীয় প্রচুর জ্ঞান কিভাবে অর্জন করলেন? তিনি বললেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিভিন্ন সময়ের ব্যাধিতে ‘আরব চিকিৎসকগণ তাঁর চিকিৎসার প্রাক্কালে আমি এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছি।

ইমাম সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থও রচিত হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতামত বিদিত রয়েছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে এ সম্পর্কিত কতক বিষয় নবীগণ ওহীর মাধ্যমে অবগত হয়েছেন। তবে অধিকাংশ বিষয়ই অভিজ্ঞতালব্ধ।

ইমাম বাযযার ও ত্ববারানী (রহিমাহুমাল্লাহ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস হতে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সুলায়মান (আ.) যখনই সালাতে দাঁড়াতেন তিনি তাঁর সম্মুখে একটি বৃক্ষ দেখতে পেতেন। তিনি বৃক্ষটিকে বলতেন, তোমার নাম কী? সেটি তার নাম উল্লেখ করলে, আবারো জিজ্ঞেস করতেন। তুমি কী জন্য? সেটি ঔষধি হলে তিনি তা লিখে রাখতেন ও পরে তা রোপণ করতেন।

অত্র অধ্যায়ের সারমর্ম এই যে, প্রত্যেক মানুষের সুস্থতা ও অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ হতে লিখিত ভাগ্যলিপির অংশ। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।

কুরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যাপারে নানা দিক নির্দেশনা রয়েছে। চিকিৎসা বিষয়ে কোরআনে উল্লেখিত বিষয়াদির ব্যাপক গুরুত্বের কারণে অদ্যাবধি এ ইস্যুতে বহু সেমিনার ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি-২০১৭ 'কুরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান' শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সেমিনারে কুরআন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

জ্ঞানার্জন বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যার উপর ইসলাম গুরুত্বারোপ করার কারণে মুসলমানরা ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এর ফলে মুসলমানরা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হন। আবু আলী সিনা, জাকারিয়া ও ইবনে রূশদসহ আরও বহু মুসলিম মনীষী চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তারা চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। ইসলামের প্রথম শতাব্দিতেই মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু সমৃদ্ধ হাসপাতাল গড়ে ওঠেছিল। এসব হাসপাতালে বিশেষ বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য পৃথক ইউনিটও ছিল। ফ্রান্সের বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তাবিদ পিয়েরে রুসো তার বিজ্ঞানের ইতিহাস বইয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একবার স্পেনের এক বাদশা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে উপায়ান্তর না দেখে কর্ডোভা শহরে মুসলমানদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন’।

চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনার আগে বলে রাখা ভাল যে, আল-কুরআনে চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দিকনির্দেশনা থাকলেও এটাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের বই হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য সরল ও সঠিক পথের নির্দেশক এবং তা পারলৌকিক ও পার্থিব জীবনের কল্যাণ নিশ্চিতকারী গ্রন্থ। কোরআনে চিকিৎসাবিদ্যার কথা উল্লেখ করার অর্থ হলো মানুষের কল্যাণে এর গুরুত্বকে তুলে ধরা। 'কুরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান' শীর্ষক সেমিনারের সচিব মোহাম্মদ আব্বাসি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আল-কুরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলৌকিক দিকগুলোর একটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান, যা বিশ্বের গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমরা যদি মনোযোগের সাথে কোরআনের আয়াতগুলো লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, আসমানী এ গ্রন্থে মানুষের দৈহিক ও মানসিক রোগ নিরাময়ের বিষয়টি একইসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সুরা আর রা'দের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘জেনে রাখুন, কেবলমাত্র আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যমেই আত্মা প্রশান্তি লাভ করে’।

অন্যদিকে, আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাবার কারণে মানুষ দুরবস্থায় পতিত হয় বলেও এই মহাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সংকট ও সমস্যার মুহুর্তে ধৈর্য্য ধারণ করতে বলা হয়েছে। ধৈর্য্য ধারণের পাশাপাশি আল্লাহর স্মরণ মানুষকে আত্মিক প্রশান্তি দেয়। এর ফলে মানুষের কঠিন পরিস্থিতি ও সমস্যা মোকাবেলার শক্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলাম মুসলমানদেরকে এ শিক্ষা দেয় যে, আনন্দ এবং দুঃখ-কষ্ট উভয়ই ক্ষণস্থায়ী। কাজেই মানুষকে যে কোন কঠিন পরিস্থিতির জন্যও সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে এবং এসব দুঃখ-কষ্টকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা হিসেবে গণ্য করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা নানা ভাবে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন, যাতে তার ঈমান আরও সুদৃঢ় হয়।

পবিত্র কুরআনে এমন সব দিক-নির্দেশনা রয়েছে, যা মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যা থেকে মানুষকে দূরে রাখে। যেমন ইসলামে তরুণদের বিয়ে এবং পরিবার গঠনের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সুরা  আর রূমের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীলদের জন্য এতে  রয়েছে নিদর্শন।'

ইসলাম ধর্ম পারিবাবিক ও আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় রাখার উপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। সকল আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বারবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পারস্পরিক বন্ধন ও সুসম্পর্ক, মানুষকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ থাকতে সহায়তা করে। মুসলমানদেরকে পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন, নামাজ আদায়, রোজা পালন, দোয়া এবং অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর ফলে মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত হবে। মানুষ যদি মনপ্রাণ দিয়ে আন্তরিকতার সাথে তার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে তাহলে অবশ্যই সে এর ফল পাবে। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’।

পবিত্র কোরআন, মানসিক ও আত্মিক সমস্যার সমাধানসূত্রের পাশাপাশি দেহের নানা রোগ নিরাময়ের পথও বাতলে দিয়েছে। ইসলাম ধর্ম রোগ প্রতিরোধের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং হাদিসে এমন সব দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। যেমন, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ক্ষুধার্ত না হলে খেতে বসবে না এবং পেট পরিপূর্ণ হবার আগেই খাওয়া শেষ কর। রাসূল (সাঃ) ও ইমামগণ এমন সব খাদ্যদ্রব্যের নাম উল্লেখ করেছেন, যা ব্যাথা উপশমসহ নানা রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। একই সাথে কুরআনে এমন অনেক খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানুষের মন-মানসিকতার ওপর খাদ্যের প্রভাবের কথাও কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল-বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মানব-জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্য আছে, তা হতে তোমরা খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ । মহাগ্রন্থ আল কুরআনে কিছু কিছু খাদ্য ও পানীয়কে হারাম বা অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, এসব খাদ্য ও পাণীয় মানুষের শরীর ও মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে মদ, শুকরের গুশত ও মৃত প্রাণীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কুরআনে রোগ নিরাময়কারী কিছু খাদ্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালার শক্তি ও সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশও বটে। এছাড়া পবিত্র কুরআনে কিছু ওষুধের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের একটি সূরার নাম আন- নাহল বা মৌমাছি। ফুলের মধু আহরণ ও মৌচাক তৈরীসহ মৌমাছির বিভিন্ন কর্মপ্রণালী সম্পর্কে বর্ণনা তুলে ধরে সূরা আন- নাহলের ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওদের উদর হতে বিবিধ বর্ণ-বিশিষ্ট পানীয় নির্গত হয়ে থাকে, এতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগ-ব্যাধির প্রতিকার’। অর্থাৎ এই আয়াতে মধুর গুণাবলী সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে মধুর মতো এত বেশী কার্যকর আর কোন উপাদান নেই’। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মধুর নানা বিশেষত্ব রয়েছে এবং তা রোগ নিরাময়ে ব্যাপক কার্যকর।

পবিত্র কুরআনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরেকটি দিক সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। অঅর তা হলো, শুক্রানু থেকে ভ্রুণ গঠন ও ভ্রুণের বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়। কুরআনে বর্ণিত এ বিষয়গুলো আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। চৌদ্দ'শ বছরেরও বেশি সময় আগে যখন তৎকালীন সমাজে এ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা বিরাজ করছিল, তখন পবিত্র কুরআন স্পষ্ট ভাবেই ঘোষণা করে যে, শুক্রাণু জরায়ুতে স্থাপিত হয়। সূরা আল-মু'মিনুনের ১২ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে মৃত্তিকার উপাদান হতে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংস পিণ্ডে পরিণত করি এবং মাংস পিণ্ডকে অস্থি-পঞ্জরে, অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দেই। অবশেষে আমি তাকে চরম সৃষ্টিতে পরিণত করি, অতএব আল্লাহ মহান, যিনিই মহান সৃষ্টিকর্তা’।

এছাড়া পবিত্র কুরআনে মানুষের সুস্থতার প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রোজা তথা সিয়ামের বিধান অন্যতম। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘রোজা রাখুন তাহলে সুস্থ্য থাকবেন’। চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নীতিবিদ্যা। তেহরানে অনুষ্ঠিত কুরআন ও চিকিৎসা শীর্ষক সেমিনারে এ সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা চিকিৎসা শাস্ত্রের নীতিবিদ্যা সম্পর্কিত একটি প্রধানতম বিষয়। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন মুসলিম চিকিৎসক, রোগীর সাথে সুন্দর আচরণ করতে বাধ্য। বলা হয়ে থাকে, ডাক্তারের আচার-ব্যবহার, রোগীকে অর্ধেক সুস্থ্য করে তোলে। কোরআনে সদাচরণের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেমিনারে কানাডার একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ভ্রুণ বিশেষজ্ঞ কেইথ মোর বলেছেন, গবেষকরা নতুন নতুন বিষয় আবিস্কার করছে আর এটা বুঝতে পারছে যে, এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন বহু পূর্বেই মানুষকে অবহিত করেছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূচনা। মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাগিদে জন্ম থেকেই চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মানুষের ভালো ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে শারীরিক সুস্থতার ওপর। মন ফুরফুরে থাকার মধ্যে। আর কেউ পীড়িত বা রোগা থাকলে মন-মেজাজে, চলনে-বলনে হয়ে ওঠে অসাড়। এমন ব্যক্তি থেকে পৃথিবী ভালো কিছু আশা করতে পারে না। সুস্থ মানুষ মানেই সুস্থ পৃথিবী। সুতরাং মানুষ ও পৃথিবীকে সুস্থ-সুন্দর রাখতে চাই সুস্থ জীবন।

জগতের প্রথম মানুষরা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে খাদ্য সংগ্রহ ও রোগ-ব্যাধি মোকাবেলায় যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তা থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূত্রপাত। আর তখনকার চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল তাদেরই আবিষ্কৃত ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি। রোগের সুস্থতার জন্য ঝাড়ফুঁক ছিল তাদের একমাত্র পথ্য। এরপর মানুষের হাত ধরে আসে লতা-পাতা ও গাছগাছড়ার ব্যবহার। গাছের পাতা, গাছের গোটা ও ফলে খুঁজে পায় সুস্থতার নিরাময়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীপাড়ার অলিগলিতে বনজ বা গাছগাছালির সাহায্যে চিকিৎসা অব্যাহত আছে।

হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে চিকিৎসাশাস্ত্র একটি অবকাঠামোর রূপ পায়। ইতিহাসবিদ আল কিফতি তাঁর ‘তারিখুল হুকামাত’-এ লিখেছেন, ‘ইদ্রিস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। এ বিষয়ে তাঁর কাছে ওহি আসে।’

ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)ও চিকিৎসাশাস্ত্রে রেখে যান যুগান্তকারী অবদান। তাঁর হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পূর্ণতা ও সজীবতা আসে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তাঁর ওপর নাজিলকৃত কোরআন চিকিৎসাশাস্ত্রের আকরগ্রন্থ। মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চার ধরন ও ধারণের কথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে পবিত্র কোরআন। কোরআন জগতের বিস্ময়। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পণ্ডিত ড. কার্ল অপিতজি তাঁর ‘Die Midizin Im Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট। ৩৫৫টি আয়াতে মানবদেহের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হয়েছে।

ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে অনেক থিওরি বর্ণনা করেছেন। রোগ নিরাময় ও উপশমের পদ্ধতি বলেছেন। নিজ হাতে চিকিৎসা করেছেন এবং নিজ আবিষ্কৃত পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন। হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বুখারি শরিফে ‘তিব্বুন নববী’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের অধীনে হাদিস রয়েছে কয়েকটি করে। সব হাদিসই রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ কার্যাবলি সংবলিত। আর তিনি নিজ হাতে শিক্ষা দিয়েছেন সঙ্গীদের। Prof. Brown বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন।’ রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে মহানবী (সা.) মোটামুটি পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন—১. হাজামাত বা রক্তমোক্ষণ পদ্ধতি। ২. লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৩. সা’উত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৪. মাসী’ঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার। ৫. কাওয়াই বা পেটের বিশোধনের ওষুধ ব্যবহার। আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন মধু, কালিজিরা, সামুদ্রিক কুন্তা বা বুড়, খেজুর, মান্না বা ব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ, উটের দুধ প্রভৃতি। (সূত্র : বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, মুহাম্মদ রহুল আমীন, পৃষ্ঠা ৬০)।

ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ার জগতে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাসপাতাল ছিল অস্থায়ী। যুদ্ধের ময়দানে অসুস্থ বা জখম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য তাঁবু করে সেখানে তাদের রোগ নিরাময়ে ওষুধ ব্যবহার ও সেবা-যত্ন করতেন। সাহাবিদের দিয়ে অসুস্থদের সেবা করাতেন।

রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে কেউ কেউ চিকিৎসাব্যবস্থা জানতেন। এ বিষয়ে আলী (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে পাওয়া যায়। ইসলামী খেলাফত আমলে মিসরের গভর্নর হজরত আমর ইবনুল আস (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসাবিষয়ক উপদেষ্টা ইয়াহইয়া আন নাহবি চিকিৎসাবিষয়ক অমূল্য গ্রন্থাবলি রচনা করেন। তিনি প্রথম আরব চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি ইজিয়ান দ্বীপের কালজয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রিটিস (৪৬০-৩৭৭ খ্রিস্টপূর্ব) এবং গ্যালেনের (২০০-১৩০ খ্রিস্টপূর্ব) গ্রন্থগুলোর ওপর গবেষণাধর্মী পুস্তকও প্রণয়ন করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতির এ ধারা উমাইয়া শাসনামলেও অব্যাহত থাকে। খালিদ ইবনে ইয়াজিদ বা জ্ঞানী খালেদের উদ্যোগে চিকিৎসাবিজ্ঞানসংক্রান্ত গ্রিক গ্রন্থগুলো আরবিতে অনূদিত হয়। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের উদ্যোগে চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থাবলিসহ প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিটি সিরিয়ার দামেস্কে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যুগে বসরার ইহুদি চিকিৎসাবিদ হারুন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে লেখেন বিখ্যাত ‘মেডিক্যাল ইনসাইক্লোপিডিয়া’। ইয়াজিদ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহিম লেখেন ‘কিতাবুল উসুল আত তিব্ব’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থটি। খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান সর্বপ্রথম বিপুল অর্থ ব্যয় করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা আল মামুন ও মুতাসিমের আমলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানোন্নয়নে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানের সূচনা বলতে যা বোঝায়, তা হয়েছিল আব্বাসীয় শাসনামলে। অধ্যাপক কে আলী লেখেন—‘আরবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয় আব্বাসীয় আমলে। রাজধানী বাগদাদসহ বড় বড় শহরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। সর্বপ্রথম আলাদা আলাদা ইউনিটে পুরুষ ও মহিলাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। যথাযথ চিকিৎসক কর্তৃক যাতে যথার্থ ওষুধ প্রয়োগ নিশ্চিত হয়, সে জন্যও চিকিৎসাবিষয়ক পরীক্ষক নিযুক্ত করা হয়।

নবম শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীরাই সভ্যতার প্রকৃত পতাকার বাহক ছিলেন। নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। এ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন আবু আলী আল হুসাইন ইবনে সিনা। ইসলামের অন্যতম এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী পুরো বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলে সুপরিচিত। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁকে একই সঙ্গে ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা তাঁদের জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে দাবি করেন।

ইবনে সিনা ছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় অভাবনীয় অবদান রাখেন প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুসলিম মনীষী। তাঁদের মধ্যে হাসান ইবনে হাইসাম, আলবেরুনি (৯৭৩-১০৪৮), আলী ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), আবুল কাসেম জাহরাবি মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ), জুহান্না বিন মাসওয়াই (চক্ষুশাস্ত্রের ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন), সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, কুস্তা বিন লুকা, জাবির ইবনে হাইয়ান, আলী আত তাবারি, আর-রাজি, ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮), আলী ইবনে আব্বাস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

ইবনে সিনাঃ

সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক আবু আলী হুসাইন ইবনে সিনা বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী বুখারার কাছে (৯৮০-১০৩৭) জন্মগ্রহণ করেন। ইউরোপে আভিসিনা নামে পরিচিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কানুন ফিত তিব’ আরবজগৎ থেকে আনীত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। ইবনে সিনার কানুন সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্রি বলেন, কানুনের আরবি সংস্করণ ১৫৯৩ সালে রোমে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটি একটি প্রারম্ভিক যুগের মুদ্রিত গ্রন্থ। আরবি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর স্থান অদ্বিতীয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ এখনো পর্যন্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। পাঁচ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই চিকিৎসা বিশ্বকোষে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যেক যেন একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন।

আলী আত-তাবারিঃ

আলী আত তাবারি (৮৩৯-৯২০) ছিলেন মুসলিম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের গৃহচিকিৎসক। তিনি খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফেরদৌস উল হিকমা’ নামে একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রই নয়—দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে। এটি গ্রিক, ইরানি ও ভারতীয় শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আর-রাজিঃ

মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাজি (৮৬২-৯২৫) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিদ। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কীয়। প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেন পাথর হয়, সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। লাশ কাটার বিষয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেন ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’। এটি লাতিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনুবাদ করা হয়। শুধু ইংরেজি ভাষায়ই চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় বইটি। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘আল হাবি’। এতে সব ধরনের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ে ২০টি খণ্ড আছে। আল হাবির নবম খণ্ড ইউরোপের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ষোলো শতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। বইটিতে তিনি প্রতিটি রোগ সম্পর্কে প্রথমে গ্রিক, সিরীয়, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।

আবুল কাশিম আল জাহরাউয়ি (৯৬৩-১০১৩):

পুরো নাম আবু আল কাশিম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহরাউয়ি। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি অ্যালবুকাসিস নামে পরিচিত। তাকে মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে মহৎ শল্যবিদ এবং তাকে আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে তার লেখা বইয়ের নাম ‘কিতাব আল তাসরিফ। এটি চিকিৎসা সংক্রান্ত ৩০ খন্ডের বিশ্বকোষ। অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে মেডিসিন, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল এই গ্রন্থে। বলা যায় এই গ্রন্থের  পেছনেই তিনি তার সারা জীবন দিয়েছেন। বইটিতে খুঁটিনাটি নানা বিষয় সংযোজন করতে তার লেগেছিল ৫০ বছরেরও বেশি সময়। এই গ্রন্থের সব থেকে বড় খন্ড ‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস লেখা হয়েছে শল্যচিকিৎসা নিয়ে। এই বইটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হওয়ার কারণ মূলত এটাই। এই খন্ডে তিনি প্রায় দুই শতাধিক অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দেন। এছাড়া সেই গ্রন্থে ছিল প্রায় ২০০টি অস্ত্রোপচার সরঞ্জামের ছবি। এই সরঞ্জামের ছবি তিনি নিজেই এঁকেছিলেন। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে অন্যতম ছিল দাঁত তোলা, দাঁতের গোড়া পরিষ্কার, চোখের ছানি অপারেশন, ভাঙা হাড় বের করার, জরায়ুর মুখ প্রশস্ত করার, মৃত ভ্রƒণকে বের করাসহ নানা ধরনের যন্ত্র। এই সব যন্ত্র কখন কোথায় কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এই গ্রন্থে। ‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস খণ্ডটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সচিত্র ‘সার্জিক্যাল গাইড। ঐতিহাসিকদের মতে জাহরাউয়িই সর্বপ্রথম আরব বৈজ্ঞানিক যিনি ইউরোপে বৈজ্ঞানিক প্রথায় সার্জারির প্রচলন এবং এর বিশদ বিবরণ প্রচার করেন। এছাড়া চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম অ্যাবডোমিনাল প্রেগনেন্সি ও এক্টোপিক প্রেগনেন্সি নিয়ে বর্ণনা করেছেন। বিস্তারিত লিখেছেন মৃত ভ্রƒণকে কীভাবে বের করতে হবে সেটা নিয়েও।

জাহরাউয়ির জন্ম ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়ার আজহারা শহরে। জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি স্পেনের কর্ডোভায় কাটিয়েছেন সেখানেই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সেখানেই তিনি চিকিৎসা শিখিয়েছেন ছাত্রদের, সেখানেই করেছেন চিকিৎসা। ১০১৩ সালে তিনি মারা যান।

ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮):

মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও পণ্ডিত হিসেবে ইবনে রুশদের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। ইবনে রুশদের পুরো নাম আবু আল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ। তবে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত ‘অ্যাভেরোস নামে। অ্যাভেরোসের ভিন্ন কোনো অর্থ নেই। তার পুরো নামের সংক্ষিপ্ত অংশ ইবনে রুশদেরই ল্যাটিন উচ্চারণ হয়েছে অ্যাভেরোস।

স্পেনের কর্দোভায় ১১২৬ সালে এক সম্ভ্রান্ত ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে রুশদ। তার দাদা আলমোরাভিদ রাজবংশের শাসনামলে কর্দোভার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার বাবা আবুল কাসিম আহমাদও আলমোরাভিদ রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। শিক্ষাজীবনের শুরুই করেছিলেন হাদিস শিক্ষা, কুরআন ও ফিকহশাস্ত্র, সাহিত্য এবং আইনশিক্ষা দিয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার আগ্রহ জন্মে মূলত আরও পরে। চিকিৎসা ছাড়াও তিনি দর্শন, ইসলামি শরিয়াহ, গণিত, আইন, ওষুুধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।

কর্ডোভার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক আবু জাফর ইবনে হারুনের কাছে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক নিজের অসাধারণ গ্রন্থ ‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আল তিব্ব-এ তিনি হারুনের কাচে

কৃতজ্ঞ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার এই বই পরবর্তী প্রায় কয়েক শতাব্দী যাবৎ সমগ্র ইউরোপ এবং আরব বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান পাঠ্যবই ছিল। এতে রয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের তিনটি মৌল বিষয় : রোগ বিশ্লেষণ (ডায়াগনোসিস), নিরাময় (কিউরি) এবং প্রতিরোধ (প্রিভেনশন)। বইটি তিনি রচনা করেছিলেন ১১৬২ খ্রিস্টাব্দে। ইবনে রুশদ মারাকেশ ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে তিনি খলিফা আবদ আল মুমিনের সংস্পর্শে আসেন। খলিফা তাকে তার দার্শনিক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় যথেষ্ট সহায়তা করেন। ১১৯৮ সালে মারাকেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইবনে রুশদ। কর্ডোভায় তাকে দাফন করা হয়।

ইবনে নাফিস (১২০৮-১২৮৮):

পুরো নাম আলাউদ্দিন আবুল হাসান আলি ইবনে আবুল হাজম ইবনুন নাফিস আল কোরায়েশি আল দামেস্কি। তিনি ইবনুন নাফিস বা ইবনে নাফিস নামেই বেশি পরিচিত। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান দামেস্ক, মিসর না সিরিয়া এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, ধর্ম, দর্শনে পারদর্শী। শৈশবে তার আগ্রহ ছিল দর্শন ও সাহিত্যচর্চায়। তারপর মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। সেটা ছিল দামেস্কের নুরি হাসপাতালে। ১২৩৬ সালে নাফিস মিসরে যান সুলতান আল কামিলের অনুরোধে। সেখানে আল-নাসরি নামক হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে তিনি কাজ করেন।

পরবর্তী সময়ে ৭৪ বছর বয়সে আল-মুনসুরি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া কায়রোর সুলতান বাইবার্সের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবেও নিযুক্ত করা হয় তাকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই হাসপাতালেই কাজ করে গেছেন। মিসরেই হয় তার খ্যাতি ও প্রাচুর্য। মুসলিম এই মহামনীষী ১২৮৮খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার বাড়ি, লাইব্রেরিসহ সমস্ত সম্পত্তি আল মনসুরি হাসপাতালকে দান করে যান। মানবদেহে বায়ু ও রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। তার এ যুগান্তকারী আবিষ্কার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। দেহে রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালির অভ্যন্তরীণ অবস্থা, হৃৎপিন্ড, শরীরে শিরা-উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন। রক্ত চলাচল সম্বন্ধে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৩০০ শতাব্দীতে বিপ্লবের সূচনাও হয়েছিল তার হাত ধরেই। তিনি প্রমাণ করেন যে হৃৎপিন্ডের মাত্র দুইটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার যুগান্তকারী গ্রন্থ হলো ‘আল-শামিল ফি আল-তিব্ব। এই গ্রন্থটি হওয়ার কথা ছিল ৩০০ খন্ডে। তবে মাত্র ৮০টি খ- তিনি তার মৃত্যুর আগে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। বইয়ের পান্ডুলিপি বর্তমানে দামেস্কে সংরক্ষিত আছে। মনোরোগ চিকিৎসা এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। চোখ এবং আলোকবিজ্ঞান বিষয়েও অনেক মৌলিক তথ্যের আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।

আলী আল মাওসুলিঃ

চক্ষু চিকিৎসায় মুসলমানদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আলী আল মাওসুলি চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টনও তাঁকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁর ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ চক্ষু চিকিৎসায় সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। চোখের ১৩০টি রোগ ও ১৪৩টি ওষুধের বর্ণনা রয়েছে এ বইয়ে। তিনিই প্রথম চোখের রোগের সঙ্গে পেট ও মস্তিষ্কের রোগের সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই গৌরবময় ইতিহাস আছে মুসলমানদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সব কিছু থেকে আধিপত্য কমতে থাকে। চুরি হয়ে যায় অনেক থিওরি। ১৩০০ শতকে মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সেনারা ৩০ বছর ধরে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে অসংখ্য গ্রন্থাগার ও পুস্তাকালয় বিনষ্ট হয়। আজ যদি মুসলমানদের আবিষ্কার, থিওরি ও লিখিত গ্রন্থাদি থাকত, তাহলে বিশ্ব পেত সভ্যতার চূড়ান্ত পাঠ ও আশাতীত কিছু উদ্ভাবন। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ পেত অভূতপূর্ব আরশি।

সহিহ চিকিৎসা ব্যবস্থা

রোগের কাফফারা ও ক্ষতিপূরণ

আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে তাকে সেই কাজের প্রতিফল দেয়া হবে।’ (সূরাহ আন্-নিসা ৪/১২৩)।

(ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণী ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল বিপদ-আপদ আসে এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ দূর করে দেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে ফুটে এর দ্বারাও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪০, মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭২, আহমাদ ২৪৮৮২, আধুনিক প্রকাশনী-৫২২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (খ) আবূ সা‘ঈদ খুদরী ও আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪১-৫৬৪২, মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ সা‘ঈদ খুদরী ও আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪১-৫৬৪২, মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মু’মিন ব্যক্তির উদাহরণ হল শস্যক্ষেতের নরম চারা গাছের মত, যাকে বাতাস একবার কাত করে ফেলে, আরেকবার সোজা করে দেয়। আর মুনাফিকের দৃষ্টান্ত, ভূমির উপর শক্তভাবে স্থাপিত বৃক্ষ, যাকে কিছুতেই নোয়ানো যায় না। শেষে এক ঝটকায় মূলসহ তা উপড়ে যায়। যাকারিয়্যা .... কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের কাছে এরকম বর্ণনা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৩, মুসলিম ৫০/১৪, হাঃ ২৮১০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মু’মিন ব্যক্তির দৃষ্টান্ত হল, শস্যক্ষেতের নরম চারাগাছের মত। যে কোন দিক থেকেই তার দিকে বাতাস আসলে বাতাস তাকে নুইয়ে দেয়। আবার যখন বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হয় তখন তা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বালা মুসিবত মু’মিনকে নোয়াতে থাকে। আর ফাসিক হল শক্ত ভূমির উপর শক্তভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ানো গাছের মত, যাকে আল্লাহ যখন ইচ্ছে করেন ভেঙ্গে দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৪, ৭৪৬৬, মুসলিম ৫০/১৪, হাঃ ২৮০৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ কামনা করেন তাকে তিনি দুঃখকষ্টে পতিত করেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগের তীব্রতা

(ক) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে বেশী রোগ যন্ত্রণা ভোগকারী অন্য কাকেও দেখিনি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৬, মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭০, আহমাদ ২৫৪৫৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে গেলাম। এ সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি বললামঃ নিশ্চয়ই আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। আমি এও বললাম যে, এটা এজন্য যে, আপনার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব। তিনি বললেনঃ হাঁ। যে কেউ রোগাক্রান্ত হয়, তাত্থেকে গুনাহসমূহ এভাবে ঝরে যায়, যেভাবে গাছ হতে তার পাতাগুলো ঝরে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৭, ৫৬৪৮, ৫৬৬০, ৫৬৬১, ৫৬৬৭; মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭১, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন নাবীগণ। এরপরে ক্রমশ প্রথম ব্যক্তি এবং পরবর্তী প্রথম ব্যক্তি

 ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলাম। তখন তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। তিনি বললেনঃ হাঁ। তোমাদের দু’ব্যক্তি যতটুকু জ্বরে আক্রান্ত হয়, আমি একাই ততটুকু জ্বরে আক্রান্ত হই। আমি বললামঃ এটি এজন্য যে, আপনার জন্য আছে দ্বিগুণ সাওয়াব। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ তাই। কেননা যে কোন মুসলিম দুঃখ কষ্টে পতিত হয়, তা একটা কাঁটা কিংবা আরো ক্ষুদ্র কিছু হোক না কেন, এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহগুলোকে মুছে দেন, যেমন গাছ থেকে পাতাগুলো ঝরে পড়ে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৮, ৫৬৪৭, ৫৬৪৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর সেবা করা ওয়াজিব

(ক) আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, রোগীর সেবা কর এবং কষ্টে পতিতকে উদ্ধার কর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৪৯, ৩০৪৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৩৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) বারাআ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাতটি জিনিসের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদের নিষেধ করেছেনঃ সোনার আংটি, মোটা ও পাতলা এবং কারুকার্য খচিত রেশমী কাপড় ব্যবহার করতে এবং কাস্সী ও মীসারাহ  কাপড় ব্যবহার করতে। আর তিনি আমাদের আদেশ করেছেনঃ আমরা যেন জানাযার পশ্চাতে যাই, পীড়িতের সেবা করি এবং সালামের প্রসার ঘটাই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫০, ১২৩৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সংজ্ঞাহীন ব্যক্তির সেবা করা

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি ভীষণভাবে পীড়িত হয়ে গেলাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বাকর (রাঃ) পায়ে হেঁটে আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আমার নিকট আসলেন। তাঁরা আমাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পেলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযূ করলেন। তারপর তিনি তাঁর অবশিষ্ট পানি আমার গায়ের উপর ছিটিয়ে দিলেন। ফলে আমি জ্ঞান ফিরার পর দেখলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার সম্পদের ব্যাপারে আমি কী করব? আমার সম্পদ সম্পর্কে কীভাবে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব? তিনি তখন আমাকে কোন জবাব দিলেন না। শেষে মীরাসের আয়াত অবতীর্ণ হল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫১, ১৯৪,  মুসলিম ২৩/২, হাঃ ১৬১৬, আহমাদ ১৪৩০২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মৃগী রোগে আক্রান্ত রোগীর ফযীলত

 ‘আত্বা ইবনু আবূ রাবাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) আমাকে বললেনঃ আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললামঃ অবশ্যই। তখন তিনি বললেনঃ এই কালো রঙের মহিলাটি, সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসেছিল। তারপর সে বললঃ আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হই এবং এ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়। সুতরাং আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি যদি চাও, ধৈর্য ধারণ করতে পার। তোমার জন্য আছে জান্নাত। আর তুমি যদি চাও, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, যেন তোমাকে অরোগ্য করেন। স্ত্রীলোকটি বললঃ আমি ধৈর্য ধারণ করব। সে বললঃ ঐ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়, কাজেই আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন যেন আমার লজ্জাস্থান খুলে না যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য দু‘আ করলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫২, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

‘আত্বা (রহ.) হতে বর্ণিত যে, তিনি সেই উম্মু যুফার -কে দেখেছেন কা’বার গিলাফ ধরা অবস্থায়। সে ছিল দীর্ঘ দেহী কৃষ্ণ বর্ণের এক মহিলা। (মুসলিম ৪৫/১৪, হাঃ ২৫৭৬, আহমাদ ৩২৪০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যে ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তি হীন হয়ে পড়েছে তার ফযীলত

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেছেনঃ আমি যদি আমার কোন বান্দাকে তার অতি প্রিয় দু’টি বস্ত্ত সম্পর্কে পরীক্ষায় ফেলি, আর সে তাতে ধৈর্য ধরে, তাহলে আমি তাকে সে দু’টির বিনিময়ে জান্নাত দান করব। আনাস বলেন, দু’টি প্রিয় বস্ত্ত হল সে ব্যক্তির চক্ষুদ্বয়। এরকম বর্ণনা করেছেন আশ্‘আস ইবনু জাবির ও আবূ যিলাল (রহ.) আনাস -এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে।[1] (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

[1] উপরিউক্ত হাদীসে রসূল () দু’ চোখ হারানো ব্যক্তির ফাযীলাত বর্ণনা করে তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। যদি উক্ত অন্ধ লোকটি আন্তরিকতার সাথে সবর করতে পারে। আফসোসের ব্যাপার এই যে, আমাদের সমাজের জাহিলী চরিত্রের লোকেরা চোখ হারানো লোকটি যত বড় ‘আলিম, বুযুর্গ, পরহেজগার হোন না কেন, তাকে নিয়ে উপহাস তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আর বলে, ঐ লোকের পাপ আল্লাহ তা‘আলা সহ্য করতে না পেরে ওর দু’টি চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন। ঐ লোক যদি ভালই হবে, তবে তার এক চোখ বা দুই চোখ কানা হবে কেন? পবিত্র কুরআন সাক্ষ্য দেয়ঃ ইয়াকূব (আ.)-এর দুই চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হারানো ছেলের চিন্তায় তাঁর উভয় চোখ সাদা (অন্ধ) হয়ে গিয়েছিল। এখন বুঝতে হবে আল্লাহর নাবী ইয়াকূব (আ.) যদি অন্ধ হতে পারেন তাহলে সাধারণ পরহেজগার লোকের অন্ধ হওয়াটা তো কোন বিষয়ই হতে পারে না। আল্লাহর নাবীর এ হাদীস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অন্ধ লোকের প্রতি আমরা যেন যথাযথ আচরণ করতে সচেষ্ট হই। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মহিলাদের পুরুষ রোগীর সেবা করা

উম্মু দারদা (রাঃ) মসজিদে অবস্থানকারী এক আনসারের সেবা করেছিলেন।

 ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আসলেন, তখন আবূ বাকর ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তিনি বলেনঃ আমি তাঁদের কাছে গেলাম এবং বললামঃ হে আব্বাজান! আপনাকে কেমন লাগছে? হে বিলাল, আপনাকে কেমন লাগছে? আবূ বাকর (রাঃ)-এর অবস্থা ছিল, তিনি যখন জ্বরে আক্রান্ত হতেন তখন তিনি আওড়াতেনঃ

‘‘সব মানুষ সুপ্রভাত ভোগ করে আপন পরিবার পরিজনের মধ্যে,

আর মৃত্যু অপেক্ষা করে তার জুতার ফিতার চেয়ে নিকটে।’’

বিলাল -এর জ্বর যখন থামত তখন তিনি বলতেনঃ

‘‘হায়! আমি যদি লাভ করতাম একটি রাত কাটানোর সুযোগ

এমন উপত্যকায় যে আমার পাশে আছে ইযখির ও জালীল ঘাস।

যদি আমার অবতরণ হতো কোন দিন মাজিন্নার কূপের কাছে।

হায়! আমি কি কখনো দেখা পাব শামাহ্ ও ত্বফীলের।’’

‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে তাঁকে এদের অবস্থা অবগত করলাম। তখন তিনি দু‘আ করে বললেনঃ হে আল্লাহ! মদিনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দাও, যেমন তুমি আমাদের কাছে মক্কা প্রিয় করে দিয়েছিলে কিংবা সে অপেক্ষা আরো অধিক প্রিয় করে দাও। হে আল্লাহ! আর মদিনাকে উপযোগী করে দাও এবং মদিনার মুদ্দ ও সা‘ এর ওযনে বারাকাত দান কর। আর এখানকার জ্বরকে সরিয়ে দাও জুহ্ফা এলাকায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৪, ১৮৮৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অসুস্থ শিশুদের সেবা করা

উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এক কন্যা (যাইনাব) তাঁর কাছে খবর দিয়েছেন, এ সময় উসামাহ, সা‘দ ও সম্ভবতঃ ‘উবাই (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ছিলেন। খবর এই ছিল যে, (যায়নাব বলেছেন) আমার এক শিশুকন্যা মৃত্যুর দুয়ারে উপনীত। কাজেই আপনি আমাদের এখানে আসুন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছে সালাম পাঠিয়ে বলে দিলেনঃ আল্লাহ যা চান নিয়ে নেন, যা চান দিয়ে যান। তাঁর কাছে সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। কাজেই তুমি ধৈর্য ধর এবং উত্তম বিনিময়ের আশা পোষণ কর। অতঃপর পুনরায় তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কসম ও তাগিদ দিয়ে প্রেরণ করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম।

এরপর শিশুটিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোলে তুলে দেয়া হল। এ সময় তার নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। সা‘দ (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! এটা কী? তিনি উত্তর দিলেনঃ এটা হল রহমত। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছে করেন তার হৃদয়ে এটি দিয়ে দেন। আর আল্লাহ তাঁর দয়াদ্র বান্দাদের প্রতিই দয়া করে থাকেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৫, ১২৮৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অসুস্থ বেদুঈনদের সেবা করা

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বেদুঈনের নিকট গিয়েছিলেন, তার রোগ সম্পর্কে জানার জন্য। বর্ণনাকারী বলেন, আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিয়ম ছিল, তিনি যখন কোন রোগীকে দেখতে যেতেন তখন তাকে বলতেনঃ কোন ক্ষতি নেই। ইনশাআল্লাহ তুমি তোমার গুনাহসমূহ থেকে পবিত্রতা লাভ করবে। তখন বেদুঈন বললঃ আপনি বলেছেন, এটা গুনাহ থেকে পবিত্র করে দেবে? কক্ষনো না, বরং এটা এমন এক জ্বর যা এক অতি বৃদ্ধকে গরম করছে কিংবা সে বলেছে উত্তপ্ত করছে, যা তাকে কবরে পৌঁছাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হাঁ, তাহলে তেমনই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৬, ৩৬১৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুশরিক রোগীর দেখাশুনা করা

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এক ইয়াহূদীর ছেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেবা করত। ছেলেটির অসুখ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অসুখের খোঁজ নিতে এলেন। এরপর তিনি বললেনঃ তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে ইসলাম গ্রহণ করল। সা‘ঈদ ইবনু মুসায়্যাব (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ তালিব মারা গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে এসেছিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৭, ১৩৫৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কোন রোগীকে দেখতে গিয়ে সালাতের সময় হলে সেখানেই উপস্থিত লোকদের নিয়ে জামা‘আতবদ্ধভাবে সালাত আদায় করা

 ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতার সময় লোকজন তাঁকে দেখার জন্য তাঁর কাছে আসলে তিনি তাঁদের নিয়ে বসা অবস্থায় সালাত আদায় করেন। লোকজন দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করেছিল, ফলে তিনি তাদের ইঙ্গিত করলেন, বসে যাও। সালাত শেষ করে তিনি বলেনঃ ইমাম হল এমন ব্যক্তি যাকে অনুসরণ করতে হয়। সে রুকু করলে তোমরাও রুকু করবে। সে যখন মাথা উঠাবে, তোমরাও মাথা উঠাবে। সে যখন বসে সালাত আদায় করবে, তখন তোমরাও বসে সালাত আদায় করবে। হুমাইদী (রহ.) বলেছেনঃ এ হাদীসটি রহিত হয়ে গেছে। [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৬৮৮]

আবূ ‘আবদুল্লাহ বুখারী (রহ.) বলেন, কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে শেষ যে সালাত আদায় করেন তাতে তিনি নিজে বসে সালাত আদায় করেন আর লোকজন তাঁর পেছনে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর দেহে হাত রাখা

(ক) ‘আয়িশাহ বিনত সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তাঁর পিতা বলেছেন, আমি যখন মক্কায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখার জন্য আসেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর নবী! আমি সম্পদ রেখে যাচ্ছি। আর আমার একটি মাত্র কন্যা ব্যতীত আর কেউ নেই। এ অবস্থায় আমি কি আমার দু’তৃতীয়াংশ সম্পদ অসীয়ত করে এক-তৃতীয়াংশ রেখে যাব? তিনি উত্তর দিলেনঃ না। আমি বললামঃ তা হলে অর্ধেক রেখে দিয়ে আর অর্ধেক অসীয়ত করে যেতে পারি? তিনি বললেনঃ না। আমি বললামঃ তাহলে দু’তৃতীয়াংশ রেখে দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ অসীয়ত করে যেতে পারি? তিনি উত্তর দিলেনঃ এক-তৃতীয়াংশ পার, তবে এক-তৃতীয়াংশও অনেক। তারপর তিনি আমার কপালের উপর তাঁর হাত রাখলেন এবং আমার চেহারা ও পেটের উপর তাঁর হাত বুলিয়ে বললেনঃ হে আল্লাহ, সা‘দকে তুমি আরোগ্য কর। তাঁর হিজরাত পূর্ণ করে দাও। আমি তাঁর হাতের শীতল স্পর্শ এখনও পাচ্ছি এবং মনে করি আমি তা ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) পর্যন্ত পাব। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৫৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে প্রবেশ করলাম। তখন তিনি ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তাঁর গায়ে আমার হাত বুলিয়ে দিলাম এবং বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ আমি এমন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হই, যা তোমাদের দু’জনের হয়ে থাকে। আমি বললামঃ এটা এজন্য যে, আপনার জন্য বিনিময়ও দ্বিগুণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ! এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যে কোন মুসলিমের উপর কোন কষ্ট বা রোগ-ব্যাধি হলে আল্লাহ তাঁর গুনাহগুলো ঝরিয়ে দেন, যেমনভাবে গাছ তার পাতাগুলো ঝরিয়ে দেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬০, ৫৬৪৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর সামনে কী বলতে হবে এবং তাকে কী জবাব দিতে হবে

(ক) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতার সময় তাঁর কাছে এলাম। এরপর তাঁর শরীরে হাত বুলিয়ে দিলাম। এ সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি বললামঃ আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত এবং এটা এজন্য যে, আপনার জন্য আছে দ্বিগুণ সাওয়াব। তিনি বললেনঃ হাঁ! কোন মুসলিমের উপর কোন কষ্ট আপতিত হলে তাত্থেকে গুনাহগুলো এমনভাবে ঝরে যায়, যেভাবে গাছ হতে পাতা ঝরে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬১, ৫৬৪৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রোগীকে দেখার জন্য তার কাছে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি বলেনঃ কোন ক্ষতি নেই, ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে তুমি পবিত্রতা লাভ করবে। রোগী বলে উঠলঃ কক্ষনো না বরং এটি এমন জ্বর, যা এক অতি বৃদ্ধের শরীরে টগবগ করে ফুটছে যেন তাকে কবরে পৌঁছাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হাঁ, তবে তাই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬২, ৩৬১৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর দেখাশুনা করা, আরোহী অবস্থায়, পায়ে চলা অবস্থায় এবং গাধার পিঠে সাওয়ারীর পিছনে বসে

উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাধার পিঠে আরোহণ করলেন। গাধাটির পিঠে ছিল ‘ফাদক’ এলাকায় তৈরী চাদর মোড়ানো একটি গদি। তিনি নিজের পেছনে উসামাহ -কে বসিয়ে অসুস্থ সা‘দ ইবনু ‘উবাদাহ -কে দেখতে গিয়েছিলেন। এটা বাদ্র যুদ্ধের পূর্বেকার ঘটনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলতে চলতে এক পর্যায়ে এক মজলিসের পার্শ্ব অতিক্রম করতে লাগলেন। সেখানে ছিল ‘আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল। এ ঘটনা ছিল ‘আবদুল্লাহর ইসলাম গ্রহণের আগের। মজলিসটির মধ্যে মুসলিম, মুশরিক, মূর্তিপূজক ও ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের লোকও ছিল। ‘আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা-ও সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন।

সাওয়ারী জানোয়ারটির পায়ের ধূলা-বালু যখন মজলিসের লোকদের মাঝে উড়তে লাগল, তখন ‘আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার চাদর দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরল এবং বললঃ আমাদের উপর ধূলাবালু উড়াবেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম দিলেন এবং নীচে অবতরণ করে তাদের আল্লাহর প্রতি আহবান জানালেন। এরপর তিনি তাদের সামনে কুরআন পাঠ করলেন। তখন ‘আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তাঁকে বললঃ জনাব, আপনি যা বলেছেন আমার কাছে তা পছন্দনীয় নয়। যদি এসব কথা সত্য হয়, তাহলে আপনি এ মজলিসে আমাদের কষ্ট দিবেন না। বরং আপনি নিজের বাড়ীতে চলে যান এবং সেখানে যে আপনার কাছে যাবে, তার কাছে এসব বিবরণ প্রকাশ করবেন।

ইবনু রাওয়াহা বলে উঠলেনঃ অবশ্য, হে আল্লাহর রাসূল! এসব কথাবার্তা নিয়ে আমাদের মজলিসে আসবেন। আমরা এগুলো পছন্দ করি। এরপর মুসলিম, মুশরিক ও ইয়াহূদীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে গেল, এমনকি তারা পরস্পর মারামারি করতে উদ্যত হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শান্ত ও নীরব করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে সবাই শান্ত হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ারীর উপর আরোহণ করেন এবং সা‘দ ইবনু ‘উবাদাহ -এর বাড়ীতে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি তাঁকে অর্থাৎ সা‘দ -কে বললেনঃ তুমি কি শুনতে পাওনি আবূ হুবাব অর্থাৎ ‘আবদুল্লাহ ইবনু উবাই কী উক্তি করেছে?

সা‘দ উত্তর দিলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তাকে ক্ষমা করুন এবং উপেক্ষা করুন। আল্লাহ আপনাকে যে মর্যাদা দান করার ইচ্ছে করেছেন তা দান করেছেন। আমাদের এ উপ-দ্বীপ এলাকার লোকজন একমত হয়েছিল তাকে রাজমুকুট পরিয়ে দেয়ার জন্য এবং তাকে নেতৃত্ব দান করার জন্য। এরপর যখন আপনাকে আল্লাহ যে হক ও সত্য দান করেছেন তখন এর দ্বারা তার ইচ্ছে বরবাদ হয়ে গেল। এতে সে ভীষণ মনোক্ষুণ্ণ হল। আর আপনি তার যে ব্যবহার দেখলেন, এটিই তার কারণ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৩, ২৯৮৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর উক্তি ‘‘আমি যাতনাগ্রস্ত’’ কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার অসুস্থতা দেখার জন্য আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় তিনি গাধার পিঠে আরোহী ছিলেন না, ঘোড়ার পিঠেও ছিলেন না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৪, ১৯৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর উক্তি ‘‘আমি যাতনাগ্রস্ত’’ কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা

আর আইয়ূব ‘আ.)-এর উক্তিঃ ‘আমি দুঃখ কষ্টে নিপতিত হয়েছি, তুমি তো দয়ালুদের সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সূরাহ আল-আম্বিয়া ২১: ৮৩)

কা‘ব ইবনু ‘উজরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথ অতিক্রম করছিলেন, এ সময় আমি হাঁড়ির নীচে লাকড়ি জ্বালাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমার মাথার উকুন কি তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি বললামঃ জ্বি, হ্যাঁ। তখন তিনি নাপিত ডাকলেন। সে মাথা মুড়িয়ে দিল। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ‘ফিদ্ইয়া’ আদায় করার নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৫, ১৮১৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর উক্তি ‘‘আমি যাতনাগ্রস্ত’’ কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা

কাসিম ইবনু মুহাম্মাদ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছিলেন ‘হায় যন্ত্রণায় আমার মাথা গেল’। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যদি এমনটি হয় আর আমি জীবিত থাকি তাহলে আমি তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব, তোমার জন্য দু‘আ করব। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেনঃ হায় আফসোস, আল্লাহর শপথ। আমার ধারণা আপনি আমার মৃত্যুকে পছন্দ করেন। আর তা হলে আপনি পরের দিনই আপনার অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে রাত কাটাতে পারবেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ বরং আমি আমার মাথা গেল বলার অধিক যোগ্য। আমি তো ইচ্ছে করেছিলাম কিংবা বলেছেন, আমি ঠিক করেছিলামঃ আবূ বাকর ও তার ছেলের নিকট সংবাদ পাঠাব এবং অসীয়ত করে যাব, যেন লোকদের কিছু বলার অবকাশ না থাকে কিংবা আকাঙ্ক্ষাকারীদের কোন আকাঙ্ক্ষা করার অবকাশ না থাকে। তারপর ভাবলাম। আল্লাহ আবূ বাকর ছাড়া অন্যের খলীফা হওয়া) তা অপছন্দ করবেন, মু’মিনগণ তা বর্জন করবেন। কিংবা তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ তা প্রতিহত করবেন এবং মু’মিনগণ তা অপছন্দ করবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৬, ৭২১৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর উক্তি ‘‘আমি যাতনাগ্রস্ত’’ কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলাম। তখন তিনি জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তাঁর গায়ে আমার হাত দিলাম এবং বললামঃ আপনি কঠিন জ্বরে আক্রান্ত। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, যেমন তোমাদের দু’জনকে ভুগতে হয়। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বললেনঃ আপনার জন্য আছে দ্বিগুণ সওয়াব। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, কোন মুসলিম কষ্ট বা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা অন্য কোন যন্ত্রণায় পতিত হলে, আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন, যেমনভাবে বৃক্ষ তার পাতাগুলো ঝরিয়ে দেয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৭, ৫৬৪৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর উক্তি ‘‘আমি যাতনাগ্রস্ত’’ কিংবা আমার মাথা গেল, কিংবা আমার যন্ত্রণা প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে এর বর্ণনা

 ‘আমির ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিদায় হাজ্জের সময় আমার রোগ কঠিন আকার ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন। আমি বললামঃ (মৃত্যু) আমার সন্নিকটে এসে গেছে যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন অথচ আমি একজন বিত্তবান ব্যক্তি। একটি মাত্র কন্যা ব্যতীত আমার কোন ওয়ারিশ নেই। এখন আমি আমার সম্পদের দু’তৃতীয়াংশ সদাক্বাহ করতে পারি কি? তিনি উত্তর দিলেনঃ না। আমি বললামঃ তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেনঃ না। আমি বললামঃ এক তৃতীয়াংশ। তিনি বললেনঃ এও অনেক অধিক। নিশ্চয়ই তোমার ওয়ারিশদের স্বাবলম্বী রেখে যাওয়াই শ্রেয় তাদের নিঃস্ব ও মানুষের দ্বারস্থ করে যাবার চেয়ে। আর তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে যে ব্যয়ই কর না কেন, তার বিনিময়ে তোমাকে সাওয়াব দেয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে আহার তুলে দাও, তাতেও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৫৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও, রোগীর এ কথা বলা

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের সময় আগত হল, তখন ঘরের মধ্যে অনেক মানুষের জমায়েত ছিল। যাঁদের মধ্যে ‘উমার ইবনু খত্তাব-ও ছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রোগ কাতর অবস্থায়) বললেনঃ লও, আমি তোমাদের জন্য কিছু লিখে দেব, যাতে পরবর্তীতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। তখন ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর রোগ যন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠেছে, আর তোমাদের কাছে কুরআন মাওজুদ। আর আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এ সময়ে আহলে বাইতের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হল। তাঁরা বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হলেন, তন্মধ্যে কেউ কেউ বলতে লাগলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কাগজ পৌঁছে দাও এবং তিনি তোমাদের জন্য কিছু লিখে দেবেন, যাতে পরবর্তীতে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট না হও। আবার তাদের মধ্যে ‘উমার (রাঃ) যা বললেন, তা বলে যেতে লাগলেন। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে তাঁদের বাকবিতন্ডা ও মতভেদ বেড়ে চলল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা উঠে যাও।

‘উবাইদুল্লাহ (রহঃ) বলেনঃ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলতেন, বড় মুসীবত হল লোকজনের সেই মতভেদ ও তর্ক-বিতর্ক, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সেই লিখে দেয়ার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৬৯, ১১৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দু‘আ নেয়ার উদ্দেশে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে যাওয়া

সায়িব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার খালা আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে গেলেন। এরপর তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার বোনের ছেলে পীড়িত। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার মাথায় হাত বুলালেন এবং আমার জন্য বারাকাতের দু‘আ করলেন। এরপর তিনি অযূ করলেন। আমি তাঁর অযূর বেঁচে যাওয়া পানি পান করলাম এবং তাঁর পৃষ্ঠের পশ্চাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন আমি মোহরে নবুওয়াতের পানে চেয়ে দেখলাম। সেটি তাঁর দু’স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এবং খাটিয়ার গোলাকৃতি ঘুন্টির মত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭০, ১৯০, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগী কর্তৃক মৃত্যু কামনা করা

(ক)  আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ দুঃখ কষ্টে পতিত হবার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কিছু করতেই চায়, তা হলে সে যেন বলেঃ হে আল্লাহ! আমাকে জীবিত রাখ, যতদিন আমার জন্য বেঁচে থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার জন্য মরে যাওয়া কল্যাণকর হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭১, ৬৩৫১, ৭২৩৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) কায়স ইবনু আবূ হাযিম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা অসুস্থ খব্বাব (রাঃ)-কে দেখতে গেলাম। এ সময় চিকিৎসার জন্য তাঁকে) সাতবার দাগ লাগানো হয়েছিল। তখন তিনি বললেনঃ আমাদের সাথীরা ইন্তিকাল করেছেন। তাঁরা এমন অবস্থায় চলে গেছেন যে, দুনিয়া তাঁদের ‘আমলের সাওয়াবে কোন রকম কমতি করতে পারেনি। আর আমরা এমন জিনিস লাভ করেছি, যা মাটি ভিন্ন অন্য কোথাও রাখার জায়গা পাচ্ছি না। যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মৃত্যুর জন্য দু‘আ কামনা করতে নিষেধ না করতেন, তবে আমি মৃত্যুর জন্য দু‘আ করতাম। অতঃপর আমরা আরেকবার তাঁর কাছে এসেছিলাম। তখন তিনি তাঁর বাগানের দেয়াল তৈরী করছিলেন। তিনি বললেনঃ মুসলিমকে তাঁর যাবতীয় ব্যয়ের জন্য সাওয়াব দান করা হয়, তবে এ মাটিতে স্থাপিত জিনিসের কথা আলাদা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭২, ৬৩৪৯, ৬৩৫০, ৬৪৩০, ৬৪৩১, ৭২৩৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের কোন ব্যক্তিকে তার নেক ‘আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। লোকজন প্রশ্ন করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও নয়? তিনি বললেনঃ আমাকেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত না করেন। কাজেই মধ্যমপন্থা গ্রহণ কর এবং নৈকট্য লাভের চেষ্টা চালিয়ে যাও। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা, সে ভাল লোক হলে (বয়স দ্বারা) তার নেক ‘আমল বৃদ্ধি হতে পারে। আর খারাপ লোক হলে সে তওবা করার সুযোগ পাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৩, ৩৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার পায়ের উপর হেলান দেয়া অবস্থায় বলতে শুনেছিঃ হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি দয়া কর, আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত কর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৪. ৪৪৪০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৬৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৫৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর জন্য শুশ্রুষাকারীর দু‘আ করা

‘আয়িশাহ বিনত সা‘দ তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ! সা‘দকে আরোগ্য কর।

 ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিয়ম ছিল, তিনি যখন কোন রোগীর কাছে আসতেন কিংবা তাঁর নিকট যখন কোন রোগীকে আনা হত, তখন তিনি বলতেনঃ কষ্ট দূর করে দাও। হে মানুষের রব, আরোগ্য দান কর, তুমিই একমাত্র আরোগ্যদানকারী। তোমার আরোগ্য ছাড়া অন্য কোন আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দান কর যা সামান্যতম রোগকেও অবশিষ্ট না রাখে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৫, ৫৭৪৩, ৫৭৪৪, ৫৭৫০; মুসলিম ৩৯/১৯, হাঃ ২১৯১, আহমাদ ২৪২৩০)।

‘আমর ইবনু আবূ কায়স ও ইবরাহীম ইবনু তুহমান হাদীসটি মানসূর, ইবরাহীম ও আবুয্ যুহা থেকে إِذَا أُتِيَ بِالْمَرِيضِ ‘‘যখন কোন রোগীকে আনা হত’’, এভাবে বর্ণনা করেছেন।

জারীর হাদীসটি মানসূর, আবুয্ যুহা সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি إِذَا أَتٰى مَرِيضًا ‘‘যখন রোগীর কাছে আসতেন’’ এ শব্দসহ বর্ণনা করেছেন। (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর শুশ্রুষাকারীর অযূ করা

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে প্রবেশ করলেন, তখন আমি পীড়িত ছিলাম। তিনি অযূ করলেন। অতঃপর আমার গায়ের উপর অযূর পানি ছিটিয়ে দিলেন। কিংবা বর্ণনাকারী বলেছেনঃ এরপর তিনি উপস্থিত লোকদের বলেছেনঃ তার গায়ে পানি ছিটিয়ে দাও। এতে আমি সংজ্ঞা ফিরে পেলাম। আমি বললামঃ কালালাহ্ (পিতাও নেই, সন্তানও নেই) ছাড়া আমার কোন ওয়ারিশ নেই। কাজেই আমার রেখে যাওয়া সম্পদ কীভাবে বণ্টন করা হবে? তখন ফারায়েয সম্বন্ধীয় আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৬, ১৯৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জ্বর, প্লেগ ও মহামারী দূর হবার জন্য কোন ব্যক্তির দু‘আ করা

 ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মদিনা) আসলেন, তখন আবূ বাকর (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তিনি বলেনঃ আমি তাঁদের নিকট বললামঃ আব্বাজান, আপনি কেমন অনুভব করছেন? হে বিলাল! আপনি কেমন অনুভব করছেন? তিনি বলেনঃ আবূ বাকর (রাঃ) যখন জ্বরে আক্রান্ত হতেন তখন তিনি আবৃত্তি করতেন,

‘‘সব মানুষ সুপ্রভাত ভোগ করে আপন পরিবার পরিজন নিয়ে,

আর মৃত্যু অপেক্ষা করে তার জুতার ফিতার চেয়েও নিকটে।’’

আর বিলাল -এর নিয়ম ছিল যখন তাঁর জ্বর ছেড়ে যেত, তিনি তখন উচ্চ আওয়াজে বলতেনঃ

হায়! আমি যদি পেতাম একটি রাত অতিবাহিত করার সুযোগ

এমন উপত্যকায় যেখানে আমার পাশে আছে ইয্খির ও জালীল ঘাস।

যদি আমার অবতরণ হত কোন দিন মাযিন্না এলাকার কূপের কাছে,

যদি আমার চোখে ভেসে উঠত শামা ও তাফীল।

‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলাম এবং তাঁকে সংবাদ দিলাম। তখন তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ! আমাদের কাছে মদিনাকে প্রিয় করে দাও, যেভাবে আমাদের কাছে প্রিয় ছিল মক্কা এবং মদিনা্কে স্বাস্থ্যকর বানিয়ে দাও। আর মদিনার মুদ্দ ও সা’তে বরকত দাও এবং মদিনার জ্বরকে স্থানান্তরিত কর ‘জুহ্ফা’ এলাকায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৭, ১৮৮৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর জন্য দু’আ তার সুস্থতার কারণ হয়

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন লোক যদি কোন রোগীকে দেখতে যায় যার মৃত্যুক্ষণ আসেনি, সে তাকে সাতবার এই দুআ করলেঃ “আমি মহান আরশের রব (প্রভু) মহামহিম আল্লাহ্ তা'আলার নিকট দুআ প্রার্থনা করছি, তিনি তোমাকে রোগ হতে সুস্থতা দান করুন", তাকে রোগমুক্ত করা হবে। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৮৩, মিশকাত ১৫৫৩, আল কালিমুত তাইয়্যিব ১৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

চিকিৎসা

আল্লাহ এমন কোন রোগ পাঠাননি যার আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননিঃ

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ এমন কোন রোগ পাঠাননি যার আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৮, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৩৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫১৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ এমন কোন রোগ পাঠাননি, যার প্রতিষেধক পাঠাননি। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৩৮, আহমাদ ৪৩২২, রাওদুন নাদীর ৯৯৩, সহীহাহ ৪৫২, ৫১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(গ)  জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক রোগের জন্য ঔষধ রয়েছে। সুতরাং সঠিক ঔষধ যখন রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে রোগী রোগমুক্ত হয়ে যায়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫১৫,সহীহ মুসলিম (২২০৪)-৬৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬০৬৩, নাসায়ী আল কুবরা ৭৫৫৬, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮২১৯, আল জামি‘উস্ সগীর ৯২৯৫, সহীহুল জামি‘ ৫১৬৪, মা‘রিফাতুস্ সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাক্বী ৫৯৫৪, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২০০৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) উসামাহ ইবনু শরীক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এস দেখলাম তাঁর সাহাবীদের মাথার উপর যেন পাখী বসে আছে, অর্থাৎ শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। আমি সালাম দিয়ে বসলাম। অতঃপর এদিক-সেদিক থেকে কিছু বেদুঈন এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো? তিনি বলেন, তোমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করো; কেননা মহান আল্লাহ একমাত্র বার্ধক্য ছাড়া সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৫৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৩৮, আহমাদ ১৭৯৮৫, গায়াতুল মারাম ২৩৬, সহীহাহ ৪৩৩, মিশকাত ৪৫৩২, ৫০৭৯। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে অজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও যে চিকিৎসা করে

আমর ইবনে শোআইব (রাঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন না করেই চিকিৎসা করলে সে দায়ী হবে। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬৬, নাসায়ী ৪৮৩০, আবূ দাউদ ৪৫৮৬, সহীহাহ ৬৩৫)।  হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

পুরুষ স্ত্রীলোকের এবং স্ত্রীলোক পুরুষের চিকিৎসা করতে পারে কি?

রুবায়ঈ বিন্ত মু‘আওয়ায ইবনু ‘আফরা হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতাম। তখন আমরা লোকজনকে পানি পান করাতাম, তাদের সেবা-শুশ্রুষা করতাম এবং নিহত ও আহতদের মাদ্বীনায় নিয়ে যেতাম। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৭৯, ২৮৮২, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা

উম্মুল মুনযির বিনতু কায়িস আল-আনসারিয়্যাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে আমার নিকট এলেন। আলী সুস্থ হয়ে উঠেছেন মাত্র কিন্তু দুর্বলতা এখনো কাটেনি। আমাদের ঘরে খেজুর গুচ্ছ লটকানো ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা খেতে শুরু করলেন। আলীও খেতে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে বললেনঃ তুমি এগুলো খেয়ো না; কারণ তুমি এখনো দুর্বল। আলী (রাঃ) বিরত থাকলেন। বর্ণনাকারিণী বলেন, আমি যব বীট চিনি দিয়ে খাদ্য তৈরী করে তাঁর জন্য আনলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে আলী! এটা খাও, এটা তোমার জন্য উপকারী। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৫৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৩৭, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৪২, আহমাদ ২৬৫১১, মিশকাত ৪২১৬, সহীহাহ ৫৯, মুখতাসারুশ শামাইল ১৫৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

রোগিদের জোরপূর্বক পানাহারে বাধ্য করা যাবে না

উকবা ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের রোগিদের জোরপূর্বক পানাহারে বাধ্য করো না। কেননা, প্রাচুর্যময় আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে পানাহার করান। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৩৩, ইবনু মাজাহ ৩৪৪৪, সহীহাহ ৭২৭, মিশকাত ৪৫৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নিরাময় আছে তিনটি জিনিসে

(ক) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, তিনটি জিনিসের মধ্যে রোগমুক্তি আছে। মধু পানে, শিঙ্গা লাগানোতে এবং আগুন দিয়ে দাগ লাগানোতে। আমার উম্মাতকে আগুন দিয়ে দাগ দিতে নিষেধ করছি। হাদীসটি ‘মারফূ’।

কুম্মী হাদীসটি লায়স, মুজাহিদ, ইবনু ‘আব্বাস সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে فِي الْعَسَلِ وَالْحَجْمِ শব্দে বর্ণনা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮০, ৫৬৮১, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রোগমুক্তি আছে তিনটি জিনিসে। শিঙ্গা লাগানোতে, মধু পানে এবং আগুন দিয়ে দাগ দেয়াতে। আমার উম্মাতকে আগুন দিয়ে দাগ দিতে নিষেধ করছি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮১, ৫৬৮০,  সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৯১, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) মধুর সাহায্যে চিকিৎসা। মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘এর মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য নিরাময়।’’ সূরাহ আন-নাহলঃ ৬৯)।

 ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিষ্টান্ন দ্রব্য ও মধু অধিক পছন্দ করতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮২, ৪৯১২, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের ঔষধসমূহের কোনটির মধ্যে যদি কল্যাণ থাকে তাহলে তা আছে শিঙ্গাদানের মধ্যে কিংবা মধু পানের মধ্যে কিংবা আগুন দিয়ে ঝলসানোর মধ্যে। রোগ অনুসারে। আমি আগুন দিয়ে দাগ দেয়া পছন্দ করি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৩, ৫৬৯৭, ৫৭০২, ৫৭০৪; মুসলিম ৩৯/২৬, হাঃ ২২০৫, আহমাদ ১৪৬০৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মধুর সাহায্যে চিকিৎসা

মধুর সাহায্যে চিকিৎসা। মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘এর মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য নিরাময়।’’ সূরাহ আন-নাহলঃ ৬৯)।

আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললঃ আমার ভাইয়ের পেটে অসুখ হয়েছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাকে মধু পান করাও। এরপর লোকটি দ্বিতীয়বার আসলে তিনি বললেনঃ তাকে মধু পান করাও। অতঃপর তৃতীয়বার আসলে তিনি বললেন তাকে মধু পান করাও। এরপর লোকটি এসে বললঃ আমি অনুরূপই করেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ সত্য বলেছেন, কিন্তু তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। তাকে মধু পান করাও। অতঃপর সে তাকে পান করাল। এবার সে রোগমুক্ত হল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৪, ৫৭১৬, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫২১, মুসলিম ৩৯/৩১, হাঃ ২২৬৭, আহমাদ ১১১৪৬] (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭৩, ৫২৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৯, ৫১৯৪ সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

গরম লোহা দিয়ে দাগানো

(ক) ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোহা গরম করে শরীরে দাগ দিতে বারণ করেছেন। তবুও আমরা লোহা দাগিয়ে চিকিৎসা করেছি; কিন্তু সুস্থ হইনি, সফলকামও হইনি। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, তিনি (ইমরান) ফিরিশতাদের সালাম শুনতেন। তিনি লোহার দাগ গ্রহণের পর তা আর শুনতে পাননি। তিনি তা ত্যাগ করলে আগের ন্যায় সালাম শুনতে পান। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৬৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪৯, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) জাবির (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। সা‘দ ইবনু মুআয (রাঃ)-এর তীরের আঘাতের স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গরম লোহার স্যাক দিয়ে চিকিৎসা করেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৬৬, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫০, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৯৩, ৩৪৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঔষধ হিসাবে মেহেদীর প্রয়োগ

আলী ইবনু উবাইদুল্লাহ (রহঃ) হতে তার দাদীর সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদিমা (সেবিকা) ছিলেন। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহে কোন তলোয়ার বা দা-এর আঘাতে ক্ষত হতো, তিনি তাতে মেহেদী লাগানোর জন্য আমাকে নির্দেশ দিতেন। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫৪, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫০২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৪১। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উটের দুধের সাহায্যে চিকিৎসা

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। কতক লোক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের আশ্রয় দিন এবং আমাদের খাদ্য দিন। অতঃপর যখন তারা সুস্থ হল, তখন তারা বললঃ মদিনা’র বায়ু ও আবহাওয়া অনুকূল নয়। তখন তিনি তাদেরকে তাঁর কতগুলো উট নিয়ে ‘হাররা’ নামক জায়গায় থাকতে দিলেন। এরপর তিনি বললেনঃ তোমরা এগুলোর দুধ পান কর। যখন তারা আরোগ্য হল তখন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর রাখালকে হত্যা করে ফেলল এবং তাঁর উটগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলল। তিনি তাদের পশ্চাতে ধাওয়াকারীদের পাঠালেন। এরপর তিনি তাদের হাত পা কেটে দেন এবং তাদের চক্ষুগুলোকে ফুঁড়ে দেন। বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি তাদের এক ব্যক্তিকে দেখেছি। সে নিজের জিভ দিয়ে মাটি কামড়াতে থাকে, অবশেষে মারা যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৫, ২৩৩)।

বর্ণনাকারী সাল্লাম বলেনঃ আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে যে, হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফ আনাস (রাঃ)-কে বলেছিলেন, আপনি আমাকে সবচেয়ে কঠোর শাস্তি সম্পর্কে বলুন, যেটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছিলেন। তখন তিনি এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। এ খবর হাসান বসরীর কাছে পৌঁছলে তিনি বলেছিলেনঃ যদি তিনি এ হাদীস বর্ণনা না করতেন তবে আমার মতে সেটাই ভাল ছিল। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উটের পেশাব ব্যবহার করে চিকিৎসা

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। কতকগুলো লোক মাদ্বীনায় তাদের প্রতিকূল আবহাওয়া অনুভব করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের হুকুম দিলেন, তারা যেন তাঁর রাখাল অর্থাৎ তাঁর উটগুলোর নিকট গিয়ে থাকে এবং উটের দুগ্ধ ও প্রস্রাব পান করে। তারা রাখালের সাথে গিয়ে মিলিত হল এবং উটের দুধ ও পেশাব পান করতে লাগল। অবশেষে তাদের শরীর সুস্থ হলে তারা রাখালটিকে হত্যা করে ফেলে এবং উটগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি তাদের খোঁজে লোক পাঠান। এরপর তাদের ধরে আনা হল। এরপর তিনি তাদের হাত পা কেটে দেন এবং তাদের চক্ষু ফুঁড়ে দেন।

 (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৬, ১৫০১, ৩০১৮, ৪১৯২, ৪১৯৩, ৪৬১০, ৫৬৮৫, ৫৭২৭, ৬৮০২, ৬৮০৪, ৬৮০৫, ৬৮৯৯,   সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪২, ৭২, ৭৩, ১৮৪৫, মুসলিম ১৬৭১, নাসায়ী ৩০৫, ৩০৬, ৪০৪২, ৪০২৫, ৪০২৭, ৪০২৮, ৪০২৯, ৪০৩০, ৪০৩১, ৪০৩২,৪০৩৪, ৪০৩৫, আবূ দাউদ ৪৩৬৪, আহমাদ ১১৬৩১, ১২২২৮, ১২৪০৮, ১২৬৩৩, ১২৭১৫, ১৩৬৪৭, ১৩৬৭২, সহীহাহ ২১৭০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৭৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭১)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

গাধীর দুধ প্রসঙ্গে

(ক) আবূ সা‘লাবা খুশানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাবতীয় নখরবিশিষ্ট হিংস্র প্রাণী খেতে নিষেধ করেছেন। যুহরী (রহ.) বলেন, আমি সিরিয়ায় চলে আসা অবধি এ হাদীস শুনিনি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৮০, ৫৫৩০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  লায়স আরো বলেছেন যে, ইউনুস (রহ.) ইবনু শিহাব (রহ.) থেকে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, আমি এ হাদীসের বর্ণনাকারী (আবূ ইদরীস)-কে জিজ্ঞেস করেছি যে, গাধীর দুগ্ধ, হিংস্র প্রাণীর পিত্তের রস এবং উটের পেশাব পান করা বা তা দিয়ে অযু বৈধ কিনা? তিনি বলেছেনঃ আগেকার মুসলিমগণ উটের প্রস্রাবের সাহায্যে চিকিৎসার কাজ করতেন এবং এটা তারা কোন পাপ মনে করতেন না। আর গাধীর দুগ্ধ সম্পর্কে কথা হলোঃ গাধার গোশত খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা আমাদের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু তার দুগ্ধের ব্যাপারে আদেশ বা নিষেধ কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছেনি। আর হিংস্র প্রাণীর পিত্তরস সম্পর্কে ইবনু শিহাব (রহ.) আবূ ইদরীস খাওলানী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাবতীয় নখরওয়ালা হিংস্র প্রাণী খেতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৫৩০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৭৮১, ৫৩৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কালো জিরার ব্যবহার

(ক) খালিদ ইবনু সা‘দ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (যুদ্ধের অভিযানে) বের হলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন গালিব ইবনু আবজার। তিনি পথে অসুস্থ হয়ে গেলেন। এরপর আমরা মদিনায় ফিরলাম তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে দেখাশুনা করতে আসেন ইবনু আবূ ‘আতীক। তিনি আমাদের বললেনঃ তোমরা এ কালো জিরা সাথে রেখ। এত্থেকে পাঁচটি কিংবা সাতটি দানা নিয়ে পিষে ফেলবে, তারপর তন্মধ্যে যাইতুনের কয়েক ফোঁটা তৈল ঢেলে দিয়ে তার নাকের এ দিক-ওদিকের ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে প্রবিষ্ট করাবে। কেননা, ‘আয়িশাহ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেনঃ এই কালো জিরা ‘সাম’ ছাড়া সব রোগের ঔষধ। আমি বললামঃ ‘সাম’ কী? তিনি বললেনঃ মৃত্যু। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৭, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৪৯, আহমাদ ২৪৫৪৬, ২৪৬০৯, সহীহাহ ৮৬৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেনঃ কালো জিরা ‘সাম’ ছাড়া যাবতীয় রোগের ঔষধ।

ইবনু শিহাব বলেছেনঃ আর ‘সাম’ অর্থ হল মৃত্যু এবং কালো জিরাকে ‘শুনীয’ও বলা হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৬৮৮,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫২০, মুসলিম ২২১৫, তিরমিযী ২০৪১, আহমাদ ৭২৪৫, ৭৫০৪, ৭৫৮২, ৮৩১২, ৮৮১৩, ৯২৫৮, ৯৭০৩, ৯৯১২, ১০১৭২, ১০২৪৮, সহীহাহ ৮৫৯, ১০৬৯, আধুনিক প্রকাশনী ৫২৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫১৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা এই কালো বীজ (কালোজিরা) নিজেদের জন্য ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করে নাও। কেননা, মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের নিরাময় এর মধ্যে রয়েছে। আস-সাম' অর্থ মৃত্যু। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০২১, ইবনু মা-জাহ ৩৪৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ অবশ্যই তোমরা এই কালো দানা ব্যবহার করবে। কেননা তাতে মৃত্যু ছাড়া সব রোগের নিরাময় রয়েছে। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কালোজিরা থেকে উপকৃত হতে হলে কী করণীয়?

কালোজিরা থেকে প্রকৃত উপকার পেতে হলে অবশ্যই তার ব্যবহার পদ্ধতি জেনে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

কখনো কালোজিরার তেল, কখনো পাউডার, কখনো মধু বা অন্যান্য জিনিসের সাথে মিশ্রণ, কখনো ফোটা আকারে ঢেলে, কখনো ব্যান্ডেজ করে এবং ব্যবহারের সঠিক সময় ও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়গুলো গবেষণা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে জানতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, কালোজিরা ব্যবহার করে সকল প্রকার রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ইচ্ছে মত কালোজিরা ব্যবহার করলেই সকল রোগের ক্ষেত্রে সমান ভাবে সাফল্য নাও পাওয়া যেতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে, রোগ থেকে আরোগ্য দান কারী একমাত্র আল্লাহ। ঔষধ-পথ্য কেবল মাধ্যম। সুতরাং আল্লাহ যদি না চান তাহলে কোন ওষুধই কাজ করে না।

কারণ আল্লাহ হয়তো বান্দাকে রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন অথবা এর মাধ্যমে তার গুনাহ মোচন করেন, আখিরাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং সেখানে তাকে এর চেয়েও বড় পুরস্কারে ভূষিত করেন যা দুনিয়ার সকল কল্যাণ এর থেকেও অধিক উত্তম। এ মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

সুতরাং ঝাড়ফুঁক, কালোজিরা, মধু, হোমিও, এলোপ্যাথি, ইউনানি সকল প্রকার ওষুধ ব্যবহার করে 100% রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ আল্লাহ সুবহানাতায়ালা রোগ থেকে মুক্তি দান কারী। এটা একমাত্র তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

আমাদের কাজ হবে, আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং বিভিন্ন পথ্য ও ঔষধ ব্যবহার করা।

আল্লাহ চাইলে অবশ্যই সুস্থতা অর্জিত হবে। অন্যথায় তিনি অন্যভাবে বান্দাকে এর বিনিময় দান করবেন। এ বিশ্বাস রাখাই মুমিনের কর্তব্য।

যেমন জমিনে সঠিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ ও চাষাবাদ করেও অনেক সময় ফসল পাওয়া যায় না, সঠিকভাবে গাছ পরিচর্যা করার পরেও তাতে ফল ও ফুল ধরে না, দাম্পত্য জীবন সঠিকভাবে অতিবাহিত করার পরেও সন্তান ভাগ্যে জোটে না, এ্যালোপ্যাথিক, হোমিও, ইউনানি ইত্যাদি ঔষধ যথার্থ নিয়মে ব্যবহার করার পরেও অনেক সময় রোগ সারে না। কারো উপকার হয়; কারো হয় না।

সুতরাং এই বিষয়গুলো সর্বদা মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু যথার্থ নিয়মে কালোজিরা ব্যবহার না করার ফলে প্রত্যাশিত ফলাফল লাভ না করলে কোনোভাবেই হাদিসের প্রতি কু ধারণা পোষণ করা বৈধ নয়। যদিও ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকরা এ হাদিসের ব্যাপারে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে।

আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত করুন। আমীন।

বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান কালোজিরা গবেষণা করে এর মাধ্যমে অনেক রোগের চিকিৎসায় বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন করেছে। আশা করি, সময়ের ব্যবধানে এর আরও ওষধি গুণ মানবজাতির সামনে প্রতিভাত হবে ইনশাআল্লাহ।

রোগীর জন্য তালবীনা (তরল খাদ্য)

(ক) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি রোগীকে এবং কারো মৃত্যুজনিত শোকাহত ব্যক্তিকে তরল জাতীয় খাদ্য খাওয়ানোর আদেশ করতেন। তিনি বলতেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তালবীনা’ রোগীর কলিজা মযবূত করে এবং নানাবিধ দুশ্চিন্তা দূর করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৮৯, ৫৪১৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি তালবীনা খেতে আদেশ দিতেন এবং বলতেনঃ এটি হল অপছন্দনীয়, তবে উপকারী। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯০, ৫৪১৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নাকে ঔষধ সেবন

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিঙ্গা লাগিয়েছেন এবং যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগিয়ে দেয় তাকে পারিশ্রমিক দিয়েছেন আর তিনি নাকে ঔষধ টেনে নিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯১, ১৮৩৫, মুসলিম ১৫/১১, হাঃ ১২০২, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৬) ।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ভারতীয় ও সামুদ্রিক এলাকার চন্দন কাঠের ধোঁয়া

(ক) উম্মু কায়স বিনত মিহসান হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা ভারতীয় এই চন্দন কাঠ ব্যবহার করবে। কেননা তাতে সাতটি আরোগ্য রয়েছে। শ্বাসনালীর ব্যথার জন্য এর (ধোঁয়া) নাক দিয়ে টেনে নেয়া যায়, পাঁজরের ব্যথা বা পক্ষাঘাত রোগ দূর করার জন্যও তা ব্যবহার করা যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯২, ৫৭১৩, ৫৭১৫, ৫৭১৮, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬৮, আহমাদ ১৩৯৭৬, ১৮৮০২, ২৬৪৫৬, ২৬৪৫৯, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ১৪৮৫, ১৪৮৬, মু'জামুল আওসাত ৫২৮২, ৬২৪৭, শারহুস সুন্নাজ ৩২৩৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আমার এক শিশু পুত্রকে নিয়ে এলাম, সে খাবার খেতে চাইত না। এ সময় সে তাঁর কাপড়ে পেশাব করে দিল। তিনি পানি চেয়ে পাঠালেন। তারপর কাপড়ে পানি ছিটিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-২২৩; ৫৬৯৩, মুসলিম ৩৯/২৮, হাঃ ২২১৪, আহমাদ ২৭০৬৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শিঙ্গা লাগা

(ক) ইবনু ‘আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওমরত অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৪, ১৮৩৫] আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৮২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৫, ১৮৩৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তাঁকে শিঙ্গা লাগানোর পারিশ্রমিক দেয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিঙ্গা লাগিয়েছেন। আবূ তাইবা তাঁকে শিঙ্গা লাগায়। এরপর তিনি তাকে দু সা‘ খাদ্যবস্তু প্রদান করেন। সে তার মালিকের সঙ্গে এ সম্পর্কে কথা বললে, তারা তাঁর থেকে পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ তোমরা যে সব জিনিস দিয়ে চিকিৎসা কর, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল শিঙ্গা লাগানো এবং সামুদ্রিক চন্দন কাঠ। তিনি আরো বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের জিহবা, তালু টিপে কষ্ট দিও না। বরং তোমরা চন্দন কাঠ দিয়ে চিকিৎসা কর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৬, ২১০২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৮৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আসিম ইবনু ‘উমার ইবনু ক্বাতাদাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত যে, জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) অসুস্থ মুকান্নাকে দেখতে যান। এরপর তিনি বলেনঃ আমি হটব না, যতক্ষণ না তুমি শিঙ্গা লাগাবে। কেননা, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ নিশ্চয় এতে আছে নিরাময়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৭, ৫৬৮৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু বুহাইনা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মক্কার পথে ‘লাহয়ী জামাল’ নামীয় জায়গায় তাঁর মাথার মাঝখানে শিঙ্গা লাগান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আনসারী (রহ.) হিশাম ইবনু হাসসান (রহ.) ইকরামার সূত্রে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাথায় শিঙ্গা লাগান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯৯, ১৮৩৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৮৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) ইবনু ‘আব্বাস হতে বর্ণিত যে, মাথার ব্যথায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় ‘লাহয়ী জামাল’ নামের একটি কুয়োর ধারে মাথায় শিঙ্গা লাগান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০০, ১৮৩৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের অবস্থায় আধ কপালির কারণে তাঁর মাথায় শিঙ্গা লাগান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০১, ১৮৩৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যদি তোমাদের ঔষধগুলোর কোনটিতে কল্যাণই থাকে, তাহলে তা আছে মধুপানে কিংবা শিঙ্গা লাগানোতে কিংবা আগুন দিয়ে দাগ লাগানোতে। তবে আমি দাগ দেয়া পছন্দ করি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০২, ৫৬৮৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কষ্ট দূর করার জন্য মাথা মুড়ানো

কা‘ব ইবনু উজরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ হুদাইবিয়ার সফরকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন। আমি তখন পাতিলের নীচে আগুন দিতেছিলাম, আর আমার মাথা থেকে তখন উকুন ঝরছিল। তিনি বললেনঃ তোমার উকুনগুলো তোমাকে কি খুব কষ্ট দিচ্ছে? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি মাথা মুড়িয়ে নাও এবং তিন দিন সওম পালন কর অথবা ছয়জন মিসকীন) কে খাদ্য দাও, কিংবা একটি কুরবানীর পশু যবহ্ করে নাও।

আইউব (রহ.) বলেনঃ আমি বলতে পারি না, এগুলোর কোনটি তিনি প্রথমে বলেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৩, ১৮১৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৮৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

যে ব্যক্তি আগুনের দ্বারা দাগ দেয় কিংবা অন্যকে দাগ লাগিয়ে দেয় এবং যে ব্যক্তি এভাবে দাগ দেয়নি তার ফযীলত

(ক) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ যদি তোমাদের চিকিৎসাসমূহে কোনটির মধ্যে আরোগ্য থাকে, তাহলে তা আছে শিঙ্গা লাগানোতে কিংবা আগুন দ্বারা দাগ লাগানোতে, তবে আমি আগুন দিয়ে দাগ দেয়া পছন্দ করি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৪, ৫৬৮৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ বদ-নযর কিংবা বিষাক্ত দংশন ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক নেই। বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর এ হাদীস আমি সা‘ঈদ ইবনু যুবায়র (রহ.)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেনঃ আমাদের নিকট ইবনু ‘আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার সামনে সকল উম্মাতকে পেশ করা হয়েছিল। তখন আমি দেখেছি) দু’একজন নবী পথ চলতে লাগলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁদের সঙ্গে রয়েছে লোকজনের ছোট ছোট দল। কোন কোন নবী এমনও আছেন যাঁর সঙ্গে একজনও নেই। অবশেষে আমার সামনে তুলে ধরা হল বিশাল দল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা কী? এ কি আমার উম্মাত? উত্তর দেয়া হলঃ না, ইনি মূসা আঃ) এবং তাঁর কওম। আমাকে বলা হলঃ আপনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকান। তখন দেখলামঃ বিশাল একটি দল যা দিগন্তকে ঢেকে রেখেছে।

তারপর আমাকে বলা হলঃ আকাশের দিগন্তসমূহ ঢেকে দিয়েছে এমন একটি বিশাল দলের প্রতি লক্ষ্য করুন। তখন বলা হলঃ এরা হল আপনার উম্মাত। আর তাদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে চলে গেলেন। উপস্থিতদের কাছে কথাটির কোন ব্যাখ্যা প্রদান করলেন না। যে বিনা হিসাবের লোক কারা হবে?) ফলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শুরু হল। তারা বললঃ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অনুসরণ করে থাকি। সুতরাং আমরাই তাদের অন্তর্ভুক্ত। কিংবা তারা হল আমাদের সে সকল সন্তান-সন্ততি যারা ইসলামের যুগে জন্মগ্রহণ করেছে। আর আমাদের জন্ম হয়েছে জাহিলী যুগে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং বললেনঃ তারা হল সে সব লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে না, পাখির মাধ্যমে কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ণয় করে না এবং আগুনের সাহায্যে দাগ লাগায় না। বরং তারা তো তাদের রবের উপরই ভরসা করে থাকে। তখন উক্কাশা ইবনু মিহসান বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তাদের মধ্যে কি আমি আছি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন আরেকজন দাঁড়িয়ে বললঃ তাদের মধ্যে কি আমিও আছি? তিনি বললেনঃ ‘উক্কাশাহ এ সুযোগ তোমার আগেই নিয়ে নিয়েছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৫, ৩৪১০, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

চোখের রোগে সুরমা ব্যবহার করা

(ক) উম্মু সালামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এক মহিলার স্বামী মারা গেলে তার চোখে অসুখ দেখা দেয়। লোকজন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে মহিলার কথা উল্লেখ করতঃ সুরমা ব্যবহারের কথা আলোচনা করল এবং তার চোখ সংকটাপন্ন বলে জানাল। তখন তিনি বললেনঃ তোমাদের একেকটি মহিলার অবস্থাতো এমন ছিল যে, তার ঘরে তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাপড়ে সে থাকত কিংবা তিনি বলেছেনঃ সে তার কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘরে (বছরের পর বছর) অবস্থান করত। অতঃপর যখন কোন কুকুর হেঁটে যেত, তখন সে কুকুরটির দিকে উটের বিষ্ঠা নিক্ষেপ করে (বেরিয়ে আসার অনুমতি পেত)। অতএব, সে চোখে সুরমা লাগাবে না বরং চার মাস দশ দিন সে অপেক্ষা করবে।

(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৬, ৫৩৩৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সাদা কাপড় পরিধান করো এবং তা দিয়ে তোমাদের মৃতদের কাফন পরাও; কেননা তা তোমাদের উত্তম পোশাক। আর তোমাদের জন্য উত্তম সুরমা হলো ‘ইসমিদ’ সুরমা; কারণ তা দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং চোখের পাতার চুল গজায়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা অবশ্যই ইসমিদ সুরমা ব্যবহার করবে। কেননা তা চোখের ময়লা দূর করে, দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং চোখের পাতায় লোম গজায়। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৯৫, ৩৪৯৬, ৩৪৯৭, তিরমিযি ১৭৫৭, আবু দাউদ ২৩৭৭, দারিমী ১৭৩৩, আহমাদ ২০৪৮, ২৪৭৫, ১৫৪৭৬, ১৫৬৪২, মু'জামুল আওসাত ১০৬৪, ২৪৯৫, ৩৩৩৪, ৬০৫৬, শারহুস সুন্নাহ ৩২০১, ৩২০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মোটা হওয়ার ঔষধ

আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মায়ের ইচ্ছা ছিলো আমাকে স্বাস্থ্যবর্তী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পাঠাবেন। এজন্য তিনি অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শেষে তিনি আমাকে পাকা খেজুরে সাথে শসা বা খিরা খাওয়াতে থাকলে আমি তাতে উত্তমরূপে স্বাস্থ্যের অধিকারী হই। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুষ্ঠ রোগ

(ক)  আফফান (রহ.) বলেন, সালীম ইবনু হাইয়ান, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগের কোন সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোন অশুভ নেই। কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৭, ৫৭১৭, ৫৭৫৭, ৫৭৭০, ৫৭৭৩, ৫৭৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কুষ্ঠ রোগীদের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থেকো না।  (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৪৩, আহমাদ ২০৭৬, সহীহাহ ১০৬৪)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ) শারীদ গোত্রের আমর (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ছাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলে এক কুষ্ঠরোগী ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট লোক পাঠিয়ে বলেনঃ তুমি ফিরে যাও, আমি তোমার বাইয়াত করেছি। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৪৪, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৮১, মুসলিম ২২৩১, আহমাদ ১৮৯৭৪, ১৮৯৮০, ১৯৪৭৪,  ৪১৮২, ইবনু মাজাহ ৩৪৫৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৯৬৮, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৬৪০৬, শু‘আবুল ঈমান ১৩৫৭, ‘নাসায়ী’র কুবরা ৮৭১৫, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৪৬৩৩, আস্ সুনানুস্ সুগরা ২৬৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জমাট শিশির চোখের জন্য শেফা

(ক) সা‘ঈদ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ ছত্রাক এক প্রকারের শিশির থেকে হয়ে থাকে। আর এর রস চোখের আরোগ্যকারী। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৮, ৪৪৭৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  শু‘বাহ (রহ.) বলেনঃ হাকাম ইবনু উতাইবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমার কাছে এরূপ বর্ণনা করেছেন। শু‘বাহ (রহ.) বলেনঃ হাকাম যখন আমাকে হাদীসটি বর্ণনা করেন তখন ‘আবদুল মালিক বর্ণিত হাদীসকে তিনি অগ্রাহ্য করেননি। (আধুনিক প্রকাশনী- দ্বিতীয় অংশ নেই, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আজওয়া খেজুর ও ছত্রাক (ব্যাঙের ছাতা) প্রসঙ্গে

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কয়েকজন সাহাবী তাঁকে (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) বললেনঃ কাম্আত (ব্যাঙের ছাতা) হলো জমিনের বসন্ত। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ব্যাঙের ছাতা তো মান্ন সদৃশ। এটার পানি চক্ষু রোগের ঔষধবিশেষ। আর ‘আজওয়াহ্ (খেজুর) জান্নাতী ফল। তা বিষনাশক।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ আমি তিনটি অথবা পাঁচটি অথবা সাতটি ব্যাঙের ছাতা নিয়ে তার রস নিংড়িয়ে একটি শিশির মধ্যে রাখলাম। অতঃপর আমার এক রাতকানা দাসীর চোখের মধ্যে সে পানি সুরমার সাথে ব্যবহার করলাম। তাতে সে আরোগ্য লাভ করল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬৯, ইবনু মাজাহ ৩৪৫৩, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৩৬৯৬, আহমাদ ৮০৫১, আবূ ইয়া‘লা ৬৩৯৮, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১০৩৭, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ২০০৫২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৬৬, ২০৬৭, ২০৬৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) আবূ সাঈদ ও জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ছত্রাক হলো ‘মান্ন’ নামক আসমানী খাদ্যোর অন্তর্ভুক্ত এবং তার পানি চক্ষুরোগের নিরাময়। ‘আজওয়া’ হলো জান্নাতের খেজুর এবং তা উন্মাদনার প্রতিষেধক। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৫৩, ৩৪৫৪, রাওদুন নাদীর ৪৪৪, মিশকাত ৪২৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সানা ও সান্নূত (উদ্ভিজ্জ ও ঘি)

উম্মু হারাম (রাঃ) -র পুত্র আবূ উবাই (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সাথে উভয় কিবলার (বাইতুল মুকাদ্দাস ও কাবা) দিকে নামায পড়েছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ অবশ্যই তোমাদের সানা ও সান্নুত ব্যবহার করা উচিত। কারণ তাতে সাম ছাড়া সব রোগের প্রতিষেধক রয়েছে। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘সাম’ কী? তিনি বলেনঃ ‘মৃত্যু’। রাবী আমর (রাঃ) বলেন, ইবনে আবূ আবলা বলেছেন, সান্নুত হলো এক ধরনের উদ্ভিজ্জ, অন্যরা বলেন, বরং তা ঘী রাখার চামড়ার পাত্রে রক্ষিত মধু। যেমন কবি বলেনঃ ‘‘তারা পরস্পর মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ থাকে ঘি ও সান্নুতের মত, তাই তাদের মধ্যে নাই কোন বিবাদ। তারা প্রতিবেশীকে ধোঁকার আশ্রয় নিতে বারণ করে’’। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৫৭, তিরমিযি ২০৮১, আহমাদ ২৬৫৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগীর মুখে ঔষধ ঢেলে দেয়া

(ক) ইবনু ‘আব্বাস ও ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আবূ বাকর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃতদেহে চুমু দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৯-৫৭১০-৫৭১১, ১২৪১, ১২৪২, ৪৪৫৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু ‘আব্বাস ও ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আবূ বাকর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃতদেহে চুমু দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭০৯-৫৭১০-৫৭১১, ১২৪১, ১২৪২, ৪৪৫৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) বর্ণনাকারী বলেন, ‘আয়িশাহ (রাঃ) আরো বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুখের সময় আমরা তাঁর মুখে ঔষধ ঢেলে দিলাম। তখন তিনি আমাদের ইঙ্গিত দিতে থাকলেন যে, তোমরা আমার মুখে ঔষধ ঢেল না। আমরা মনে করলাম, এটা ঔষধের প্রতি একজন রোগীর স্বভাবজাত অনীহা প্রকাশ মাত্র। এরপর তিনি যখন সুস্থবোধ করলেন তখন বললেনঃ আমি কি তোমাদের আমার মুখে ঔষধ ঢেলে দিতে নিষেধ করিনি? আমরা বললামঃ আমরাতো ঔষধের প্রতি রোগীর স্বভাবজাত অনীহা ভেবেছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ আমি এখন যাদেরকে এ ঘরে দেখতে পাচ্ছি তাদের সবার মুখে ওষুধ ঢালা হবে। ‘আব্বাস ছাড়া কেউ বাদ যাবে না। কেননা, তিনি তোমাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭১২, ৪৪৫৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) উম্মু কায়স (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আমার এক পুত্র সন্তানকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গেলাম। ছেলেটির আলাজিহ্বা ফোলার কারণে আমি তা দাবিয়ে দিয়েছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ এ রকম রোগ-ব্যাধি দমনে তোমরা নিজেদের সন্তানদের কেন কষ্ট দিয়ে থাক? তোমরা ভারতীয় চন্দন কাঠ ব্যবহার কর। কেননা, তাতে সাত রকমের নিরাময় আছে। তার মধ্যে পাঁজরের ব্যথা বা পক্ষাঘাত রোগ অন্যতম। আলাজিহবা ফোলার কারণে এটির ধোঁয়া নাক দিয়ে টেনে নেয়া যায়। পাঁজরের ব্যথার রুগী বা পক্ষাঘাত রুগীকে তা সেবন করানো যায়। সুফিয়ান বলেনঃ আমি যুহরীকে বলতে শুনেছি যে, তিনি আমাদের কাছে দু’টির কথা বর্ণনা করেছেন। আর পাঁচটির কথা বর্ণনা করেননি।

বর্ণনাকারী ‘আলী বলেনঃ আমি সুফ্ইয়ানকে বললাম মা‘মার স্মরণ রাখতে পারেননি। তিনি বলেছেন أَعْلَقْتُ عَلَيْهِ আর যুহরী তো বলেছেন, أَعْلَقْتُ عَنْه শব্দ দ্বারা। আমি যুহরীর মুখ থেকে শুনে মুখস্থ করেছি। আর সুফ্ইয়ানের রিওয়ায়াতে তিনি ছেলেটির অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন যে, আঙ্গুল দিয়ে তার তালু দাবিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় সুফ্ইয়ান নিজের তালুতে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে দেখিয়েছেন অর্থাৎ তিনি তাঁর আঙ্গুলের দ্বারা তালুকে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু أَعْلِقُوا عَنْه شَيْئًا এভাবে কেউই বর্ণনা করেননি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭১৩, ৫৬৯২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উযরা-আলাজিহবা যন্ত্রণার বর্ণনা

 ‘উবাইদুল্লাহ ইবনু ‘আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত। আসাদ গোত্রের অর্থাৎ আসাদে খুযাইমা গোত্রের উম্মু কায়স বিন্ত মিহসান আসাদিয়া ছিলেন প্রথম যুগের হিজরাতকারীদের অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন। আর তিনি ছিলেন ‘উকাশাহ (রাঃ)-এর বোন। তিনি বলেছেন যে, তিনি তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসেছিলেন। ছেলেটির আলাজিহ্বা ফুলে যাওয়ার কারণে তিনি তা দাবিয়ে দিয়েছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা এ সব রোগ দমনে তোমাদের সন্তানদের কেন কষ্ট দাও? তোমরা এই ভারতীয় চন্দন কাঠ সংগ্রহ করে রেখে দিও। কেননা এতে সাত রকমের আরোগ্য আছে। তার মধ্যে একটি হল পাঁজর ব্যথা। এর দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন কোস্ত। আর কোস্ত হল ভারতীয় চন্দন কাঠ।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৬৯২, ৫৬৯৩, ৫৭১৩, ৫৭১৫, ৫৭১৮ সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭৭, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫২৩, ৪৫২৪, মুসলিম ২৮৭, আহমাদ ২৬৪৫৬, ২৬৪৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯৭)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পাছার বাতরোগের চিকিৎসা

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ পাছার বাতরোগের চিকিৎসায় দুম্বার নিতম্ব গলিয়ে নিয়ে তা তিন ভাগ করতে হবে, অতঃপর প্রতি দিন এক ভাগ পান করতে হবে। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬৩, আহমাদ ১২৮৮২, রাওদুন নাদীর ৪৪৪, সহীহাহ ১৮৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পাঁজরের ব্যথা

(ক) ‘উবাইদুল্লাহ ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, উম্মু কায়স বিন্ত মিহসান, তিনি ছিলেন প্রথম কালের হিজরাতকারিণী ‘উকাশাহ ইবনু মিহসান -এর বোন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট বাই‘আত গ্রহণকারিণী মহিলা সাহাবী। তিনি বলেছেনঃ তিনি তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে আসেন। ছেলেটির আলাজিহবা ফুলে গিয়েছিল। তিনি তা দাবিয়ে দিয়েছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহকে ভয় কর, কেন তোমরা তোমাদের সন্তানদের তালু দাবিয়ে কষ্ট দাও। তোমরা এই ভারতীয় চন্দন কাঠ ব্যবহার কর। কেননা, এতে রয়েছে সাত প্রকারের চিকিৎসা। তন্মধ্যে একটি হল পাঁজরের ব্যথা। কাঠ বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য হল কোস্ত। الْقُسْطَ শব্দেও তার আভিধানিক ব্যবহার আছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭১৮, ৫৬৯২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আবূ ত্বালহা ও আনাস ইবনু নাযর (রাঃ) তাকে আগুন দিয়ে দাগ দিয়েছেন। আর আবূ ত্বালহা (রাঃ) তাকে নিজ হাতে দাগ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭১৯, ৫৭২১, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ)  ‘আব্বাদ ইবনু মানসূর বলেন, আইউব আবূ কিলাবাহ ...... আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের এক পরিবারের লোকদের বিষাক্ত দংশন ও কান ব্যথার কারণে ঝাড়ফুঁক গ্রহণ করার জন্য অনুমতি দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭২০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমাকে পাঁজর ব্যথা রোগের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবিত কালে আগুন দিয়ে দাগ দেয়া হয়েছিল। তখন আমার নিকট উপস্থিত ছিলেন আবূ ত্বালহা, আনাস ইবনু নাযর এবং যায়দ ইবনু সাবিত (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। আর আবূ ত্বালহা (রাঃ) আমাকে দাগ দিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭২১, ৫৭১৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) ।

রক্ত বন্ধ করার জন্য চাটাই পুড়িয়ে ছাই লাগানো

সাহল ইবনে সাদ আস-সাইদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হলেন। তাঁর সামনের পাটির দাঁত ভেঙ্গে গেলো এবং শিরস্ত্রাণের আংটা তাঁর মাথায় ঢুকে গেলো। আলী (রাঃ) ক্ষতস্থানে তার ঢাল দ্বারা পানি ঢালছিলেন এবং ফাতিমা (রাঃ) তার ক্ষতের রক্ত ধুয়ে দিচিছলেন। ফাতিমা (রাঃ) যখন দেখলেন যে, পানিতে আরো অধিক রক্ত নির্গত হচেছ, তখন তিনি এক খন্ড চাটাই নিয়ে তা পোড়ালেন, অতঃপর তার ছাই তাঁর ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিলেন। এতে রক্ত নির্গমন বন্ধ হয়ে গেলো। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬৪, ৩৪৬৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-২৪৩, ৫৭২২,  সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৮৫, মুসলিম ১৭৯০, আহমাদ ২২২৯৩, ২২৩২২, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জ্বর প্রসঙ্গে

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সামনে জ্বরের বিষয় উল্লিখিত হলে এক ব্যক্তি জ্বরকে গালি দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জ্বরকে গালি দিও না। কেননা তা পাপসমূহ দূর করে, যেমন আগুন লোহার ময়লা দূর করে। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬৯, মুসলিম ২৫৭৮, মু'জামুল আওসাত ৬২৪৮, মা'রিফাতুস সাহাবাহ ৭৮৪০, ৮০০১, ৮০৯০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জ্বরে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে বললেন, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ সেটা আমার অগ্নি, আমার গুনাহগার বান্দার উপর উহা চাপিয়ে দিয়ে থাকি, যাতে উহা তার জাহান্নামের শাস্তির অংশ হয়ে যায় অর্থাৎ পরকালের পরিবর্তে দুনিয়াতেই তার শাস্তি হয়ে যায়। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৮৮, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৭০, আহমাদ ৯৯৮৪,  সহীহাহ ৫৫৭)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইবনু ‘উমার (রাঃ) এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ জ্বর জাহান্নামের উত্তাপ থেকে হয়। কাজেই তাকে পানি দিয়ে নিভাও।

নাফি‘ (রহ.) বলেন, ‘আবদুল্লাহ তখন বলতেনঃ আমাদের উপর থেকে শাস্তিকে হালকা কর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৩২৬৪, ৫৭২৩, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৭২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫২৫, মুসলিম ২২০৯, আহমাদ ৪৭০৫, ৫৫৫১, ৫৯৭৪, ৬১৪৮, মুয়াত্তা মালেক ১৭৬১, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) ফাতিমাহ বিনত্ মুনযির (রহ.) হতে বর্ণিত যে, আসমা বিনত আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট যখন কোন জ্বরে আক্রান্ত স্ত্রীলোকদেরকে দু‘আর জন্য নিয়ে আসা হত , তখন তিনি পানি হাতে নিয়ে সেই স্ত্রীলোকটির জামার ফাঁক দিয়ে তার গায়ে ছিটিয়ে দিতেন এবং বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ করতেন, আমরা যেন পানির সাহায্যে জ্বরকে ঠান্ডা করি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭২৪, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৭৪, মুসলিম ২২১১, তিরমিযী ২০৭৪, আহমাদ ২৬৩৮৬, মুয়াত্তা মালেক ১৭৬০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০০)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ জ্বর হয় জাহান্নামের তাপ থেকে। কাজেই তোমরা পানি দিয়ে তা ঠান্ডা কর। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৩২৬৩, ৫৭২৫, ২২১০, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৭১, তিরমিযী ২০৭৪, আহমাদ ২৩৭০৮, ২৪০৭৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (চ) রাফে ইবনে খাদীজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ জ্বর হলো জাহান্নামের উত্তাপ থেকে। তোমরা পানি ঢেলে তা ঠান্ডা করো। তিনি আম্মার (রাঃ)-র এক পুত্রকে দেখতে গেলেন এবং বললেনঃ

‘‘ইকশিফিল বাসা রববান নাস ইলাহান নাস ’’

(হে মানুষের রব, হে মানবের ইলাহ! আপনি ক্ষতি বিদূরিত করুন)। (সহীহুল বুখারী ৩২৬২, ৫৭২৬, মুসলিম ২২১২, তিরমিযী ২০৭৩, আহমাদ ১৫৩৮৩, ১৬৮১৫, দারেমী ২৭৬৯, সহীহাহ ১৫২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগ যন্ত্রনা বৃদ্ধি পেলে

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বয়স বেড়ে গেল এবং রোগ-যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করল, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে অনুমতি চাইলেন যে, তিনি যেন আমার গৃহে অসুস্থ কালীন সময় অবস্থান করতে পারেন। এরপর তাঁরা অনুমতি দিলে তিনি দু’ব্যক্তি অর্থাৎ ‘আব্বাস ও আরেকজনের সাহায্যে এভাবে বেরিয়ে আসলেন যে, মাটির উপর তাঁর দু’পা হেঁচড়াতে ছিল। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-কে হাদীসটি জানালে তিনি বলেনঃ আপনি কি জানেন, আরেক ব্যক্তি- যার নাম ‘আয়িশাহ উল্লেখ করেননি, তিনি কে ছিলেন? আমি উত্তর দিলামঃ না।

তিনি বললেনঃ তিনি বলেন ‘আলী। ‘আয়িশাহ বলেনঃ যখন তাঁর রোগ-যন্ত্রণা আরো তীব্র হল তখন তিনি বললেন, যে সব মশ্কের মুখ এখনো খোলা হয়নি এমন সাত মশ্ক পানি আমার গায়ে ঢেলে দাও। আমি লোকজনের কাছে কিছু অসীয়ত করে আসার ইচ্ছে পোষণ করছি। তিনি বলেন, তখন আমরা তাঁকে তাঁর স্ত্রী হাফসা্ -এর একটি কাপড় কাচার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসালাম। এরপর তাঁর গায়ের উপর সেই মশকগুলো থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। অবশেষে তিনি আমাদের দিকে ইশারা দিলেন যে, তোমরা তোমাদের কাজ করেছ। তিনি বলেনঃ এরপর তিনি লোকজনের দিকে বেরিয়ে গেলেন। আর তাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদের সম্মুখে খুত্বা দিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭১৪, ১৯৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্লেগ রোগ

(ক) উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) থেকে, তিনি সা’দ (রাঃ)-এর কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ যখন তোমরা কোন্ অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। বর্ণনাকারী (হাবীব ইবনু আবূ সাবিত বলেন) আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আপনি কি উসামাহ (রাঃ)-কে এ হাদীস সা’দ (রাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করতে শুনেছেন যে, তিনি (সা’দ) তাতে কোন অসম্মতি জ্ঞাপন করেননি? ইবরাহীম ইবনু সা’দ বলেনঃ হাঁ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৩৪৭৩, ৫৭২৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, ‘উমার ইবনু খাত্তাব সিরিয়ার দিকে রওনা করেছিলেন। শেষে তিনি যখন সারগ এলাকায় গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে সৈন্য বাহিনীর প্রধানগণ তথা আবূ ‘উবাইদাহ ইবনু জার্রাহ ও তাঁর সঙ্গীগণ সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানালেন যে, সিরিয়া এলাকায় প্লেগের বিস্তার ঘটেছে। ইবনু ‘আব্বাস বলেন, তখন ‘উমার বললঃ আমার নিকট প্রবীণ মুহাজিরদের ডেকে আন। তখন তিনি তাঁদের ডেকে আনলেন। ‘উমার তাঁদের সিরিয়ার প্লেগের বিস্তার ঘটার কথা জানিয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তখন তাঁদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হল। কেউ বললেনঃ আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বের হয়েছেন; কাজেই তা থেকে প্রত্যাবর্তন করা আমরা পছন্দ করি না। আবার কেউ কেউ বললেনঃ বাকী লোক আপনার সঙ্গে রয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ। কাজেই আমরা সঠিক মনে করি না যে, আপনি তাদের এই প্লেগের মধ্যে ঠেলে দিবেন।

‘উমার (রাঃ) বললেনঃ তোমরা আমার নিকট থেকে চলে যাও। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট আনসারদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম। তিনি তাদের কাছে পরামর্শ চাইলে তাঁরাও মুহাজিরদের পথ অবলম্বন করলেন এবং তাঁদের মতই মতপার্থক্য করলেন।

‘উমার (রাঃ) বললেনঃ তোমরা উঠে যাও। এরপর আমাকে বললেনঃ এখানে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ কুরাইশী আছেন, যাঁরা মক্কা জয়ের বছর হিজরাত করেছিলেন, তাদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম, তখন তাঁরা পরস্পরে মতভেদ করলেন না। তাঁরা বললেনঃ আপনার লোকজনকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করা এবং তাদের প্লেগের মধ্যে ঠেলে না দেয়াই আমরা ভাল মনে করি। তখন ‘উমার লোকজনের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সাওয়ারীর পিঠে আরোহণ করব (ফিরার জন্য)। অতএব তোমরাও সকালে সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে।

আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) বললেনঃ আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন? ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ হে আবূ ‘উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলত! হাঁ, আমরা আল্লাহর, এক তাকদীর থেকে আল্লাহর আরেকটি তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি। তুমি বলত, তোমার কিছু উটকে যদি তুমি এমন কোন উপত্যকায় নিয়ে যাও যেখানে আছে দু’টি মাঠ। তন্মধ্যে একটি হল সবুজ শ্যামল, আর অন্যটি হল শুষ্ক ও ধূসর। এবার বল ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ মাঠে চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তাহলে তাও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) আসলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কোন প্রয়োজনের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন।

তিনি বললেনঃ এ ব্যাপারে আমার নিকট একটি তথ্য আছে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা যখন কোন এলাকায় প্লেগের) বিস্তারের কথা শোন, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোন এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাক, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর ‘উমার (রাঃ) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর প্রত্যাবর্তন করলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭২৯, ৫৭৩০, ৬৯৭৩; মুসলিম ৩৯/৩২, হাঃ ২২১৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমির (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘উমার (রাঃ) সিরিয়া যাবার জন্য বের হলেন। এরপর তিনি ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছলে তাঁর কাছে খবর এল যে সিরিয়া এলাকায় মহামারী দেখা দিয়েছে। তখন ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) তাঁকে জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমরা কোন স্থানে এর বিস্তারের কথা শোন, তখন সে এলাকায় প্রবেশ করো না; আর যখন এর বিস্তার ঘটে, আর তোমরা সেখানে অবস্থান কর, তাহলে তাত্থেকে পালিয়ে যাওয়ার নিয়তে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩০, ৫৭২৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মাদ্বীনায় ঢুকতে পারবে না মাসীহ্ দাজ্জাল, আর না প্লেগ মহামারী। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩১, ১৮৮০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) হাফসাহ বিনত সীরীন (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়াহ্ইয়া কী রোগে মারা গেছে? আমি বললামঃ প্লেগ রোগে। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্লেগ রোগে মারা গেলে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য তা শাহাদাত হিসাবে গণ্য। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩২, ২৮৩০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ উদরাময় রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, আর প্লেগ রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৩, ৬৫৩, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জানান যে, এটি হচ্ছে এক রকমের আযাব। আল্লাহ যার উপর তা পাঠাতে ইচ্ছে করেন, পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটিকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব প্লেগ রোগে কোন বান্দা যদি ধৈর্য ধরে, এ বিশ্বাস নিয়ে আপন শহরে অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোন বিপদ তার উপর আসবে না; তাহলে সেই বান্দার জন্য থাকবে শহীদের সাওয়াবের সমান সাওয়াব। দাঊদ থেকে নাযরও এ রকম বর্ণনা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৪, ৩৪৭৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আধুনিক লকডাউনের জনক রাসুল সাঃ

বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের জন্যে দেশে দেশে বা এলাকা ভিত্তিক যে লকডাউন চলছে সেই লকডাউনের কথা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই রাসুল সা. বলে গেছেন।

উপরোল্লিখিত হাদিসগুলো তার প্রমান। তাই রাসুল সা. কে লকডাউনের জনক বলা হয়।

নাকে ঔষধ প্রয়োগ করা

ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকে ঔষধ ব্যবহার করেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৬৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নিষিদ্ধ ঔষধ ব্যবহার

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাপাক/হারাম ঔষধ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৩৯, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪৫, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৫৯, আহমাদ ৭৯৮৭, ৯৪৬৪, ৯৮৩৮, মিশকাত ৪৫৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আব্দুর রাহমান ইবনু উসমা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা এক ডাক্তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ব্যাঙ দিয়ে ঔষধ তৈরী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ব্যাঙ হত্যা করতে নিষেধ করলেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বিষ পান করবে সে নিজ হাতে দোযখের আগুনে বিষ পান করবে এবং চিরকালের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪৪)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আলকামা ইবনু ওয়ায়েল (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, তারিক ইবনু সুওয়াইদ বা সুওয়াইদ ইবনু তারিক (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মদ ব্যবহার সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! এটা তো ঔষধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘‘না, বরং এটা ব্যাধি।’’ (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭৩, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৪৬, ইবনু মাজাহ ৩৫০০, আহমাদ ১৮৩১০, ২১৯৯৬, গায়াতুল মারাম ৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তা’ইয বা ঝাড় ফুঁক

পার্থিব জীবনে মানুষ নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। শরী‘আতে এসব অসুখের চিকিৎসার নির্দেশও রয়েছে। ঔষধ সেবনের পাশাপাশি ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমেও আরোগ্য লাভ হয়। কিন্তু সেসব ঝাড়-ফুঁক শিরকমুক্ত ও কুরআন-হাদীছ সম্মত হওয়া আবশ্যক। আর কুরআন মাজীদ ও নবী করীম (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত ‘রুক্বইয়া’ তথা ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা একটি উপকারী ও আরোগ্য লাভকারী দাওয়াই। (বনুল কাইয়্যিম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, পৃঃ ২০)।

আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا هُدًى وَّشِفَاءٌ ‘বল, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও আরোগ্য’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৪৪)। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কুরআন হ’তে (ক্রমশঃ) অবতীর্ণ করি যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৮২)।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নছীহত এবং তোমাদের অন্তরে যা আছে তার নিরাময়। আর মুমিনদের জন্য সঠিক পথের দিশা ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)।

অতএব কুরআন হ’ল সকল প্রকার মানসিক ও শারীরিক রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দানকারী।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘সুতরাং যাকে কুরআন রোগমুক্ত করেনি, তাকে আল্লাহ রোগমুক্ত না করুন! আর কুরআন যার জন্য যথেষ্ট নয়, আল্লাহ তার জন্য কোন কিছুকেই যথেষ্ট না করুন! (যাদুল মা‘আদ, ৪/৩৫২)।

অনুরূপভাবে নবী করীম (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত ‘রুক্বইয়া’ বা ঝাড়-ফুঁক একটি উত্তম চিকিৎসা। কেননা কোন দো‘আ যদি কবুল হওয়ার সকল বাধা থেকে মুক্ত হয়, তবে তা হয় অপছন্দনীয় বস্ত্ত প্রতিরোধ এবং ঈপ্সিত বস্ত্ত লাভের সবচেয়ে উপকারী উপায়ের অন্যতম। দো‘আ বিপদকে আটকে রাখে ও বাধা দেয়, কিংবা বিপদ আসলেও তাকে লঘু করে। (আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃঃ ২২-২৫)।

নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে বিপদ ঘটেছে এবং যে বিপদ ঘটেনি সবগুলোতেই দো‘আ উপকারী। কাজেই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমাদের উচিত দো‘আ করা’। (আহমাদ হা/২২০৯৭; তিরমিযী হা/৩৫৪৮, সনদ হাসান)।

তিনি আরো বলেন, ‘তাক্বদীর রদ হয় কেবল দো‘আর মাধ্যমে আর আয়ু বৃদ্ধি হয় কেবল সৎকাজের মাধ্যমে’। (ইবনু মাজাহ হা/৯০, ৪০২২; ছহীহাহ হা/১৫৪)।

কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, যেসব আয়াত, যিকির, দো‘আ ও আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার শাব্দাবলীর মাধ্যমে আরোগ্য কামনা করা হয় এবং রুক্বইয়া বা ঝাড়-ফুঁক করা হয়, সেগুলো অবশ্যই উপকারী ও আরোগ্যদানকারী; কিন্তু সেগুলো কার্যকর হ’তে হ’লে ঝাড়-ফুঁককারীর গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। সুতরাং যদি আরোগ্য না হয় তবে তা হবে ঝাড়-ফুঁককারীর দুর্বলতার কারণে অথবা ঝাড়-ফুঁককৃত ব্যক্তি তা গ্রহণ না করার কারণে কিংবা ঝাড়-ফুঁককৃত ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে, যা তার মধ্যে রুক্বইয়া কার্যকর হ’তে বাধা দেয়। কেননা ঝাড়-ফুঁক দু’টি বিষয়ের সমন্বয়ে কার্যকর হয়-রোগী ও চিকিৎসক।

ঝাড়ফুঁকের বিধান

ঝাড়-ফুঁক শরী‘আত সম্মত একটি প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। রাসূল (ছাঃ) নিজেও ঝাড়-ফুঁক করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) যে রোগে মৃত্যুবরণ করেন সেই সময়ে তিনি নিজ দেহে ‘মু‘আবিবযাত (সূরা নাস ও ফালাক্ব) পড়ে ফুঁক দিতেন’। (বুখারী হা/৫৭৩৫)।

মহিলাদেরকে ঝাড়-ফুঁক করার পদ্ধতি

ঝাড়-ফুঁককারী মাহরাম ব্যতীত কোন মহিলার মাথায় বা শরীরের কোন স্থানে স্পর্শ করতে পারবে না। পরপুরুষ পর্দা ব্যতীত তাকে ফুঁক দিতে পারবে না। (ড. আব্দুর রহমান জীবরীন, আন-নাযিরুল উরয়ান, পৃঃ ২৬৭)।

সঊদী আরবের স্থায়ী ফৎওয়া বোর্ডের সদস্যবৃন্দ বলেন, ফুঁকদানকারী মহিলা রোগীর শরীর স্পর্শ করতে পারবে না। স্পর্শ ব্যতীত ফুঁক দিবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের বিষয়টি ভিন্ন। কেননা চিকিৎসকের পক্ষে আক্রান্ত স্থান স্পর্শ না করে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে ফুঁকদানকারী কেবল দো‘আ বা আয়াত পড়বে আর ফুঁক দিবে। স্পর্শ করা তার জন্য আবশ্যক নয়। (মানশূরাতু দারিল ওয়াতান, ১০ম খন্ড, ফৎওয়া নং ২০৩৬১)।

ঝাড়-ফুঁকের প্রকারভেদ

ঝাড়-ফুঁক চার প্রকার। যথা-

১. কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ ও গুণাবলী দ্বারা ঝাড়-ফুঁক।

২. ছহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত যিকির-আযকার ও দো‘আ সমূহ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক।

৩. এমন যিকির-আযকার ও দো‘আ দ্বারা ঝাড়-ফুঁক, যা কোন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর বিপরীতও নয়।

৪. এমন মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা, যার অর্থ বুঝা যায় না। যেমনভাবে জাহেলী যুগে করা হ’ত। এ প্রকার মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হারাম এবং এসব হ’তে দূরে থাকা ওয়াজিব। কারণ এর মধ্যে শিরক থাকতে পারে অথবা শিরক পর্যন্ত পেঁŠছাতে পারে। (মুবারক ইবনু মুহাম্মাদ, রিসালাতুশ শিরক, (দারু রায়া, ১ম সংস্করণ, ২০০১), পৃঃ ২৪৬)।

ঝাড়-ফুঁকের জন্য শর্তসমূহ

ঝাড়-ফুঁকের জন্য শর্ত তিনটি। যথা-

১. কুরআনের আয়াত অথবা আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী দ্বারা হ’তে হবে।

২. আরবী ভাষায় হ’তে হবে অথবা এমন ভাষা দ্বারা হ’তে হবে যার অর্থ রোগী বুঝে। দুর্বোধ্য ও অজ্ঞাত ভাষায় হবে না।

৩. যিনি ঝাড়-ফুঁক করবেন এবং যাকে ঝাড়-ফুঁক করা হবে উভয়ে এ বিশ্বাস রাখবেন যে, ঝাড়-ফুঁকের নিজস্ব কোন কার্যকারিতা নেই। বরং আল্লাহর অনুমতিতে ঝাড়-ফুঁকের প্রভাব পড়ে। (ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফৎহুল বারী, ১০/১৯৫; ইমাম নববী, শরহু মুসলিম, ১৪/১৬৪)।

শারঈ ঝাড়-ফুঁকের নিয়ম

ঝাড়-ফুঁককারী রোগীর ব্যথার স্থানে ঝাড়বেন বা হাত দিয়ে রোগীকে মাসাহ করবেন বা পানি ও অনুরূপ তরল পদার্থ দ্বারা রোগীকে মালিশ করে দিবেন অথবা ঝাড়-ফুঁকের পর রোগীকে থুক দিবেন। (বুখারী হা/৫৭৩৫, ৫৭৫১)।

(ক) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু পড়ে ঝাড়ফুঁক করতেন। (ইবনু মাজাহ ৩৫২৮, ৩৫২৯, সহীহুল বুখারী ৪৪৩৯, ৫০১৬, ৫০১৭, ৫৭৩৫, ৫৭৪৮, ৫৭৫১, মুসলিম ২১৯২, আবূ দাউদ ৩৯০২, আহমাদ ২৪২০৭, ২৪৩১০, ২৪৪০৬, ২৪৮০৭, ২৪৯৫৫, ২৫৬৫৭, ২৫৭৩১, মুয়াত্তা মালেক ১৭৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আওফ ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা জাহিলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। অতঃপর আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেনঃ তোমাদের ঝাড়ফুকের ব্যবস্থাগুলো আমার সামনে পেশ করো; তবে যেসব ঝাড়ফুঁক শির্কের পর্যায়ে পড়ে না, তাতে কোনো দোষ নেই। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮৬, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫১৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৩০, মুসলিম ২১৯৮, সহীহাহ ৪৭৩।)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির অনুমতি  প্রদান প্রসঙ্গে

(ক) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, জ্বর, বদ-নজর ও ব্ৰণ-ফুসকুড়ি (ক্ষুদ্র ফোড়া) ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়ফুঁক দেয়ার সম্মতি প্রদান করেছেন। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫৬,  সুনান ইবনু মাজাহ ৩৫১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাপ ও বিছার দংশনে ঝাড়ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছেন। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫১৭, সহীহুল বুখারী ৫৭৪১, মুসলিম ২১৯৩, আহমাদ ২৩৪৯৮, ২৩৮০৫, ২৫০৪৩, ২৫২১১, ২৫৬৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আশ-শিফা বিনতু আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি হাফসাহ (রাঃ)-এর নিকট ছিলাম, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এসে বললেনঃ তুমি ওকে (হাফসাহকে) যেভাবে লেখা শিখিয়েছ, সেখাবে পিপড়া (পোকা) কামড়ের ঝাড়ফুঁক শিক্ষা দাও না কেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬১, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৭৮, আর জামি‘উস্ সগীর ৪৪১৫, সহীহুল জামি ২৬৫০, মুসান্নাফ ‘আবদুর রায্যাক ১৯৭৬৮, আহমাদ ২৭০৯৫, নাসায়ী’র কুবরা ৭৫৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুরআন পড়ে এবং সূরা নাস ও ফালাক অর্থাৎ (মু‘আব্বিযাত) পড়ে ফুঁক দেয়া

ইবরাহীম ইবনু মূসা (রহঃ)...‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রোগে ওফাত পান সেই রোগের সময়ে তিনি নিজ দেহে ‘মু‘আব্বিযাত’ পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর যখন রোগের তীব্রতা বেড়ে গেল, তখন আমি সেগুলো পড়ে ফুঁক দিতাম। আর আমি তাঁর নিজের হাত তাঁর দেহের উপর বুলিয়ে দিতাম। কেননা, তাঁর হাতে বারাকাত ছিল। রাবী বলেনঃ আমি যুহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কীভাবে ফুঁক দিতেন? তিনি বললেনঃ তিনি তাঁর দু’ হাতের উপর ফুঁক দিতেন, অতঃপর সেই দু’ হাত দিয়ে আপন মুখমন্ডল বুলিয়ে নিতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৫, ৪৪৩৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০২, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সূরা ফালাক ও সূরা নাস-এর মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করা

(ক) আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিন এবং মানুষের কু-দৃষ্টি হতে আশ্রয় চাইতেন। তারপর সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাযিল হলে তিনি এ সূরা দুটি গ্রহণ করেন এবং বাকীগুলো পরিত্যাগ করেন। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬৩, ইবনু মাজাহ ৩৫১১, ‘নাসায়ী’র কুবরা ৭৮৫৩, আল জামি‘উস্ সগীর ৯০৩৩, সহীহুল জামি‘ ৪৯০২, নাসায়ী ৫৪৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও অসুস্থ বোধ করলে আরোগ্য লাভের জন্য সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে নিজের দেহে ফুঁ দিতেন। তাঁর অসুস্থতা বেড়ে গেলে আমি তা তাঁর উপর পাঠ করতাম এবং তাঁর হাত তাঁর দেহে বরকতের আশায় মলে দিতাম। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫২৯, সহীহুল বুখারী ৪৪৩৯, ৫০১৬, ৫০১৭, ৫৭৩৫, ৫৭৪৮, ৫৭৫১, মুসলিম ২১৯২, আবূ দাউদ ৩৯০২, আহমাদ ২৪২০৭, ২৪৩১০, ২৪৪০৬, ২৪৮০৭, ২৪৯৫৫, ২৫৬৫৭, ২৫৭৩১, মুয়াত্তা মালেক ১৭৫৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ‘আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন এক রাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আাদয় করছিলেন, এ অবস্থায় তিনি জমিনে তাঁর হাত রাখতেই একটি বিচ্ছু তাঁকে দংশন করল। তৎক্ষণাৎ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জুতা দ্বারা বিচ্ছুটিকে মেরে ফেললেন। অতঃপর সালাত শেষ করে বললেনঃ বিচ্ছুটির ওপর আল্লাহর লা‘নাত হোক। সে সালাত আদায়কারী-অনাদায়কারী অথবা বলেছেনঃ নবী কিংবা অন্য কাউকেও ছাড়ে না। অতঃপর তিনি কিছু লবণ ও পানি চেয়ে নিলেন এবং তা একটি পাত্রে মিশালেন, অতঃপর অঙ্গুলির দংশিত স্থানে পানি ঢালতে এবং উক্ত স্থান মুছতে লাগলেন এবং মু‘আব্বাযাতায়ন (সূরাহ্ ফালাক ও নাস) দ্বারা ঝাড়তে লাগলেন। (বায়হাক্বী হাদীস দু’টি ‘‘শু‘আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন।) (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬৭, সহীহ শু‘আবুল ঈমান ২৫৭৫, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৩৫৫৩, ইবনু মাজাহ ১২৪৬, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৫৪৭, সহীহুল জামি‘ ৯২২৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৫৮৮৯, ৭৩২৯, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুস্ সগীর ৮৩০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সূরাহ্ ফাতিহার দ্বারা ফুঁক দেয়া

 (ক) আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদের কতক সাহাবী আরবের এক গোত্রের নিকট আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন আতিথেয়তা করল না। তাঁরা সেখানে থাকতেই হঠাৎ সেই গোত্রের নেতাকে সর্প দংশন করল। তখন তারা এসে বললঃ আপনাদের কাছে কি কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁককারী লোক আছেন কি? তাঁরা উত্তর দিলেনঃ হাঁ। তবে তোমরা আমাদের কোন আতিথেয়তা করনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা তা করব না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল বক্রী পারিশ্রমিক দিতে রাযী হল।

তখন একজন সাহাবী উম্মুল কুরআন (সূরা আল-ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং মুখে থুথু জমা করে সে ব্যক্তির গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। ফলে সে রোগমুক্ত হল। এরপর তাঁরা বকরীগুলো নিয়ে এসে বলল, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করার পূর্বে এটি স্পর্শ করব না। এরপর তাঁরা এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে হেসে দিলেন এবং বললেনঃ তোমরা কীভাবে জানলে যে, এটি রোগ সারায়? ঠিক আছে বকরীগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক ভাগ রেখে দিও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৬, ২২৭৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০০, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৬৩, ২০৬৪, ইবনু মা-জাহ ২১৫৬),আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (খ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণের একটি দল একটি কূয়ার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। কূপের পাশে অবস্থানকারীদের মধ্যে ছিল সাপে কাটা এক ব্যক্তি কিংবা তিনি বলেছেন, দংশিত এক ব্যক্তি। তখন কূপের কাছে বসবাসকারীদের একজন এসে তাদের বললঃ আপনাদের মধ্যে কি কোন ঝাড়-ফুঁককারী আছেন? কূপ এলাকায় একজন সাপ বা বিচ্ছু দংশিত লোক আছে। তখন সাহাবীদের মধ্যে একজন সেখানে গেলেন। এরপর কিছু বক্রী দানের বিনিময়ে তিনি সূরা ফাতিহা পড়লেন। ফলে লোকটির রোগ সেরে গেল। এরপর তিনি ছাগলগুলো নিয়ে তাঁর সাথীদের নিকট আসলেন, কিন্তু তাঁরা কাজটি পছন্দ করলেন না। তাঁরা বললেনঃ আপনি আল্লাহর কিতাবের উপর পারিশ্রমিক নিয়েছেন। অবশেষে তাঁরা মাদ্বীনায় পৌঁছে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি আল্লাহর কিতাবের উপর পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যে সকল জিনিসের উপর তোমরা বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তন্মধ্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি হক রয়েছে আল্লাহর কিতাবের। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) খারিজাহ ইবনুস সালদ আত-তামীমা (রাঃ) থেকে তার চাচার সূত্রে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতঃপর তাঁর কাছ থেকে ফেরার পথে তিনি এক গোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। সেই গোত্রের এক পাগল লোহার শিকলে বাঁধা ছিলো। গোত্রের লোকেরা তাকে বললো, আমরা জানতে পারলাম যে, তোমাদের এক সাথী (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাকি কল্যাণ নিয়ে এসেছেন? তোমাদের এমন কিছু জানা আছে কি যাতে তোমরা এর চিকিৎসা করতে পারো?

অতঃপর আমি সূরা ফাতিহা পড়ে তাকে ফুঁক দিলাম। সে সুস্থ হয়ে গেলো। তারা আমাকে একশটি বকরী দিলো। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে ঘটনাটি জানালে তিনি বললেনঃ এ সূরা ছাড়া অন্য কিছু পড়ে ফুঁক দিয়েছো কি? মুসাদ্দাদ অন্যত্র বলেন, এ সূরা ছাড়া অন্য কিছু বলেছো কি? আমি বললাম, না। তিনি বলেনঃ তবে এ উপহার নিতে পারো। আমার জীবনের কসম! লোকরো বাতিল মন্ত্র পড়ে রোজগার করে! আর তুমি তো সত্য ঝাড়ফুঁক দ্বারা রোজগার করেছো। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) খারিজাহ ইবনু সালত (রাঃ) থেকে তার চাচার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি তিনদিন পর্যন্ত সকাল-সন্ধ্যা সূরা ফাতিহা পাঠ করে ফুঁক দিলেন। যখনই তা শেষ করেন তার মুখের থুথু একত্র করে তার উপর ছিটিয়ে দেন। দেখা গেলো, বন্দী যেন শিকল থেকে মুক্তি পেলো। অতঃপর তারা তাকে এর কিছু বিনিময় দিলেন। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ সংবাদ পেলাম। অতঃপর মুসাদ্দাদ বর্ণিত হাদীসের অর্থ উল্লেখ করেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯৭, ৩৯০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বদনযর লাগা

নযর লাগা বা চোখ লাগা অর্থ যখন কেউ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের প্রতি আশ্চর্য হয়ে কিংবা হিংসা করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতঃ ‘বারাকাল্লাহু ফীকা’ বা ‘বারাকাল্লাহু ফীহ্’ না বলে মনে মনে বা সশব্দে তার গুণাগুণ বর্ণনা করে, তখন শয়তান সে সময় বর্ণিত ব্যক্তি বা জিনিসের মাঝে ঢুকে পড়ে তার ক্ষতি করে বসে। এটাকে বদ নযর বলে।

নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের অথবা নিজের কিংবা তার সম্পদের কিছু দেখে আশ্চর্যবোধ করে তখন যেন তার জন্য বরকতের দো‘আ করে। কেননা নযরলাগা সত্য’। (মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৭০০; ছহীহাহ হা/২৫৭২)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নযর লাগা সত্য। যদি কোন কিছু ভাগ্যের লিখনকে অতিক্রম করত, তাহ’লে নযর লাগাই করত’। (মুসলিম হা/৫৮৩১; তিরমিযী হা/২১৯৯)।

তিনি আরো বলেন, ‘বদনযর (মানুষকে) কবরে এবং উটকে পাতিলে প্রবেশ করেই ছাড়ে’। (হিলয়াতুল আউলিয়া, ছহীহুল জামে‘ হা/৪১৪৪, হাদীছ হাসান)।

(ক)  আমের ইবনে রাবীআ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ বদনজর সত্য। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫০৬, ৩৫০৭, ৩৫০৮,আহমাদ ১৫২৭৪, রাওদুন নাদীর ১১৯৪, সহীহাহ ৭৮১, ১২৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আদেশ করেছেন কিংবা তিনি বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন, নযর লাগার জন্য ঝাড়ফুঁক করতে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৮, মুসলিম ৩৯/২১, হাঃ ২১৯৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (গ) উম্মু সালামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে একটি মেয়েকে দেখলেন যে, তার চেহারা মলিন। তখন তিনি বললেনঃ তাকে ঝাড়ফুঁক করাও, কেননা তার উপর নযর লেগেছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৩৯, মুসলিম ৩৯/২১, হাঃ ২১৯৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঘ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বদ নযর লাগা সত্য। আর তিনি উলকি অংকন করতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪০, ৫৯৪৪; সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭৯, মুসলিম ৩৯/১৬, হাঃ ২১৮৭, আহমাদ ৮২৫২, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) উবাইদ ইবনু রিফাআ আয-যুরাকী (রাহঃ) হতে বর্ণিত আছে, আসমা বিনতু উমাইস (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জাফরের সন্তানদের তাড়াতাড়ি বদ-নজর লেগে যায়। আমি কি তাদেরকে ঝাড়ফুক করতে পারি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। কেননা, কোন জিনিস যদি ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারত তাহলে বদ-নজরই তা অতিক্রম করতে পারত। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬০, ইবনু মাজাহ ৩৫১০, আহমাদ ২৭৪৭০, তিরমিযী ২০৫৯, ইবনু মাজাহ ৩৫১০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১২৫২, সহীহুল জামি‘ ৯৪১৭, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৩৫৯১, ‘নাসায়ী’র কুবরা ৭৫৩৭, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৯৮৫৯, বায়হাক্বী’র কুবরা ২০০৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদনযরকারীকে নির্দেশ দেয়া হতো যেন সে উযু করে এবং সেই পানি দিয়ে নযর লাগা ব্যক্তি বা বস্তু ধুয়ে নেয়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) আবূ উমামা ইবনে হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমের ইবনে রবীআ (রাঃ) সাহল ইবনে হুনাইফ (রাঃ)-র নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন গোসল করছিলেন। আমের (রাঃ) বলেন, আমি এমন খুবসুরত সুপুরুষ দেখিনি, এমনকি পর্দানশীন নারীকেও এরূপ সুন্দর দেখিনি, যেমন আজ দেখলাম। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহল (রাঃ) বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট নিয়ে যাওয়া হলো এবং তাঁকে বলা হলো, ধরাশায়ী সাহলকে রক্ষা করুন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কাকে অভিযুক্ত করছো? তারা বললো, আমের ইবনে রবীআকে। তিনি বলেনঃ তোমাদের কেউ বদনজর লাগিয়ে তার ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়? তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের মনোমুগ্ধকর কিছু দেখলে যেন তার জন্য বরকতের দোয়া করে। অতঃপর তিনি পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর আমেরকে উযু করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি তার মুখমন্ডল, দু’ হাত কনুই পর্যন্ত, দু’ পা গোছা পর্যন্ত এবং লজ্জাস্থান ধৌত করলেন। তিনি আমেরকে পাত্রের পানি সকলের উপর ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি সাহলের পেছন দিক থেকে পানি ঢেলে দেয়ার জন্য আমেরকে নির্দেশ দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫০৯, আহমাদ ১৫৫৫০, মুয়াত্তা মালেক ১৭৪৭,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬২, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৩২৪৫, নাসায়ী’র কুবরা ৭৬১৯, ত্ববারানী ৫৪৪১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১০৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৫৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিন ও মানুষের বদনজর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। অতঃপর সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাযিল হলে তিনি এ সূরা দু’টি গ্রহণ করেন এবং অন্যগুলো ত্যাগ করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫১১, তিরমিযী ২০৫৮, নাসায়ী ৫৪৯৪, মিশকাত ৪৫৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) ‘উসমান ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাওহাব (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পরিবারের লোকেরা পানির একটি পেয়ালা দিয়ে আমাকে উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। তখন নিয়ম ছিল, যদি কারো ওপর বদনযর লাগত কিংবা অন্য কোন অসুখ হত তখন উম্মু সালামার কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে দিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু পশম মুবারক বের করতেন, যা তিনি একটি রৌপ্য কৌটার মধ্যে রাখতেন। অতঃপর তিনি উক্ত পশম মুবারক পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিতেন এবং সে পানিগুলো রোগীকে পান করানো হত। বর্ণনাকারী বলেন, আমি রূপার সে নলটির মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম, তাতে (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) কয়েকটি লাল বর্ণের পশম রয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৬৮, সহীহ বুখারী ৫৮৯৬, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৯/৩১ পৃঃ, ইবনু মাজাহ ৩৬২৩, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫০০৯, আহমাদ ২৬৫৩৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শিশুর কপালে কালো টিপ দেয়ার বিধান কী?

ওমর শাহ: মুসলিম শিশুদের অনেকেই কপালে টিপ দিয়ে থাকে। কেউ বদ নজর থেকে রক্ষা করতে এ টিপ ব্যবহার করে কেউ সুন্দরের জন্য। এছাড়াও নারীরা কপালে টিপ ব্যবহার করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এটি একটি হিন্দু সম্প্রদায়ের রীতি। হিন্দুদের প্রাচীন বিয়ে পদ্ধতির মাঝে একটি ছিল নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া। হিন্দু দেবতা কৃষ্ণ অনেক নারীকে অপহরণ করে বিয়ে করেছিলেন। এমন কি বহুল প্রচলিত কৃষ্ণের প্রেমিকা রাধা ছিল তারই আপন মামার বিবি। কৃষ্ণ তাকে অপহরণ করে বিয়ে করেছেন।

বিবাহিত নারীরা অপহরণ থেকে বাঁচতে তারা তাদের সিঁথিতে সিঁদুর দিতো। এখনো বিবাহিত হিন্দু নারীরা তাই করে থাকে।

বর্তমানে সেই হিন্দুয়ানী সিঁদুর প্রথা সৌন্দর্যের নামে কতিপয় মুসলিমরাও ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।

আরেকটি কুপ্রথা হল, শিশুদের বদনজর থেকে বাঁচতে কপালে টিপ দেয়া। এটিও পরিত্যাজ্য। টিপ দিলে বদনজর থেকে বাঁচা যায় এটি লোকমুখে প্রচলিত একটি কথা মাত্র। কুরআন ও হাদীসতো দূরে থাক বাস্তবতার সাথেও এর কোন সম্পর্ক নেই।

তাই একাজ অবশ্য পরিত্যাজ্য।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঈদ রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ব্যক্তি [কিয়ামতের দিন] তার সাথে থাকবে যাকে সে মোহাব্বত করে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৩৭১৮, বুখারী, হাদীস নং-৬১৬৮, ৫৮১৬)।

হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪০৩১)।

সাপ কিংবা বিচ্ছু দংশনে ঝাড়-ফুঁক

(ক) ‘আবদুর রহমান ইবনুল আসওয়াদের পিতা আসওয়াদ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের কারণে ঝাড়-ফুঁক করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল প্রকার বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪১, ২১৯৩, আহমাদ ২৫৭৯৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি বিছা এক ব্যক্তিকে দংশন করলে ঐ রাতে সে আর ঘুমাতে পারেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলা হলো, অমুক ব্যক্তিকে বিছায় দংশন করায় সে গত রাতে ঘুমাতে পারেনি। তিনি বলেনঃ আহা, সে যদি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে বলতো,

‘‘আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক’’

(আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালামের উসীলায় তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই), তাহলে বিছার দংশন সকাল পর্যন্ত তার কোন ক্ষতি করতে পারতো না। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫১৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঝাড়-ফুঁক

(ক) আবদুল ‘আযীয (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ও সাবিত একবার আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। সাবিত বললেন, হে আবূ হামযা! আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তখন আনাস (রাঃ) বললেনঃ আমি কি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করেছিলেন তা দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করে দেব? তিনি বললেনঃ হাঁ। তখন আনাস (রাঃ) পড়লেন-

 اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ مُذْهِبَ الْبَاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لاَ شَافِيَ إِلاَّ أَنْتَ شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا.

হে আল্লাহ! তুমি মানুষের রব, রোগ নিরাময়কারী, আরোগ্য দান কর, তুমি আরোগ্য দানকারী। তুমি ব্যতীত আর কেউ আরোগ্য দানকারী নেই। এমন আরোগ্য দাও, যা কোন রোগ অবশিষ্ট রাখে না।

(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন রোগীর নিকট এলে তিনি এই দোয়া করতেনঃ

‘‘আযহিবিল বাসা রববান নাস ওয়াশফে আনতাশ শাফী লা শিফাআন ইল্লা শিফাউকা শিফাআন লা ইউগাদিরু সাকামান’’

(হে মানুষের প্রভু! ব্যাধি ও কষ্ট দূর করে দাও, রোগমুক্তি দান করো, তুমিই আরোগ্য দানকারী, তোমার আরোগ্য দানই আসল, যা কোন রোগকেই ছাড়ে না)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৩. ৪৪৩৬, ৫৬৭৪, ৫৬৭৫, মুসলিম ২১৯১, ২৪৪৪, তিরমিযী ৩৪৯৬ আহমাদ ২৩৬৫৬, ২৩৬৬২, ২৩৭১৪, ২৪২৫৩, ২৪৩১৭, ২৪৩৭০, ২৪৪১৪, ২৪৪২৫, ২৪৪৩৮, ২৪৪৭৪, ২৫২১২, ২৫৭১১, ২৫৮৩৭, ২৫৮৬৮, মুয়াত্তা মালেক ৫৬২, তাখরীজুল মিশকাত ৪৫৫২, সহীহাহ ২৭৭১, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ)   أَحْمَدُ ابْنُ أَبِي رَجَاءٍ حَدَّثَنَا النَّضْرُ عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ قَالَ أَخْبَرَنِي أَبِي عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَرْقِي يَقُوْلُ امْسَحْ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ بِيَدِكَ الشِّفَاءُ لاَ كَاشِفَ لَهإِلاَّ أَنْتَ.

‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়-ফুঁক করতেন। আর এ দু‘আ পাঠ করতেনঃ

ব্যথা দূর করে দাও, হে মানুষের পালনকর্তা। আরোগ্যদানের ক্ষমতা কেবল তোমারই হাতে। এ ব্যথা তুমি ছাড়া আর কেউ দূর করতে পারে না।

(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৪, ৫৬৭৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আংগুলে লালা লাগিয়ে রোগীর জন্য এই বলে দোয়া করতেনঃ

‘‘বিসমিল্লাহ তুরবাতু আরদিনা বিরীকাতি বাদিনা লিয়াশফা সাকীমুনা বিইযনি রব্বিনা”

(আল্লাহর নামে আমাদের এ যমীনের মাটি আমাদের কারো লালার সাথে মিশিয়ে দিলাম, যেন তাতে আমাদের প্রভুর নির্দেশে আমাদের রোগী আরোগ্য লাভ করে)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৫, ৫৭৪৬; মুসলিম ৩৯/২১, হাঃ ২১৯৪, আহমাদ ২৪৬৭১, আবূ দাউদ ৩৮৯৫, আহমাদ ২৪০৯৬, তাখরীজুল কালিমুত তায়্যিব ১৪৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। জিবরাঈল (আ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট এসে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ! আপনি কি রোগাক্রান্ত হয়েছেন? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। জিবরীল (আ) বলেন,

‘‘বিছমিল্লাহি আরকীকা মিন কুল্লি শায়ইন ইউযীকা মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আয়নিন আও হাসিদিন, আল্লাহ ইয়াশফীকা বিসমিল্লাহি আরকীকা ’’

(আমি আল্লাহর নামে এমন প্রতিটি জিনিস থেকে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রতিটি সৃষ্টিজীবের এবং প্রতিটি চোখের এবং প্রতিটি হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আমি আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি)। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫২৩, মুসলিম ২১৮৬, তিরমিযী ৯৭২, আহমাদ ১১১৬৩, ১১৩১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জিবরাঈল (আ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় তাঁর নিকট আসেন। তিনি তাকে ঝাড়ফুঁক করে বলেনঃ

‘‘বিসমিল্লাহি আরকীকা মিন কুল্লি শায়ইন ইয়ূযীকা মিন শাররি হাসাদি হাসিদিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন আল্লাহ ইয়াশফীকা’’

(আমি আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি এমন প্রতিটি জিনিস থেকে যা আপনাকে কষ্ট দেয়, হিংসুকের হিংসা থেকে এবং সকল বদনযর থেকে, আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন)। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫২৭)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(হাসান-হুসাইন (রাঃ)-কে ঝাড়ফুঁক)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন (রাঃ) কে ঝাড়ফুঁক করে বলতেনঃ

‘‘আউযু বিকালিমা তিল্লাহি তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আয়নিল লাম্মাতিন’’

(আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কল্যাণময় বাক্যাবলীর উসীলায় প্রতিটি শয়তান, প্রাণনাশী বিষাক্ত জীব ও অনিষ্টকারী বদনজর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। তিনি বলতেনঃ আমাদের পিতা ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) -কে এই দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করতেন অথবা রাবী বলেছেন, ইসমাঈল ও ইয়াকূব (আ)-কে ঝাড়ফুঁক করতেন। শেষোক্ত বর্ণনা ওয়াকী (রাঃ)-এর। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫২৫, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৬০, বুখারী ৩৩৭১, আবু দাউদ ৪৭৩৭, আহমাদ ২১১৩, ২৪৩০, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৯৮৭, মু'জামুল আওসাত ২২৭৫, ৪৭৯৩, ৪৮৯৯, ৯১৮৩, শারহুস সুন্নাহ ১৪১৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঝাড়-ফুঁকে থুথু দেয়া

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঝাড়-ফুঁক।

(ক)  ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়-ফুঁকে পড়তেনঃ আমাদের দেশের মাটি এবং আমাদের কারও থুথুতে আমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে আমাদের রোগী আরোগ্য লাভ করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৬, ৫৭৪৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঝাড়-ফুঁকে থুথু দেয়া

(খ) আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আর মন্দ স্বপ্ন হয় শয়তানের তরফ থেকে। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি এমন কিছু স্বপ্ন দেখে যা তার কাছে খারাপ লাগে, তা হলে সে যখন ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন সে যেন তিনবার থুথু ফেলে এবং এর ক্ষতি থেকে আশ্রয় চায়। কেননা, তা হলে এটা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৩২৯২]

আবূ সালামাহ বলেনঃ আমি যখন এমন স্বপ্ন দেখি যা আমার কাছে পাহাড়ের চেয়ে ভারি মনে হয়, তখন এ হাদীস শোনার ফলে আমি তার কোন পরোয়াই করি না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৭, মুসলিম পর্ব ৪২/হাঃ ২২৬১, আহমাদ ২২৭০৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩২৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আপন বিছানায় আসতেন, তখন তিনি তাঁর দু’ হাতের তালুতে সূরা ইখলাস এবং মুআওব্বিযাতায়ন পড়ে ফুঁক দিতেন। তারপর উভয় তালু দ্বারা আপন চেহারা ও দু’হাত শরীরের যতদূর পৌঁছায় মাসাহ্ করতেন। ‘আয়িশাহ রাঃ) বলেনঃ এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অসুস্থ হন, তখন তিনি আমাকে ঐ রকম করার নির্দেশ দিতেন।

ইউনুস (রহ.) বলেন, আমি ইবনু শিহাব (রহ.)-কে, যখন তিনি তাঁর বিছানায় শুতে যেতেন, তখন ঐ রকম করতে দেখেছি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৮, ৫০১৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একদল সাহাবী একবার এক সফরে যান। অবশেষে তাঁরা আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে এক গোত্রের নিকট এসে মেহমান হতে চান। কিন্তু সে গোত্র তাঁদের মেহমানদারী করতে প্রত্যাখ্যান করে। ঘটনাচক্রে সে গোত্রের সর্দারকে সাপে দংশন করে। তারা তাকে সুস্থ করার জন্য সবরকম চেষ্টা করে, কিন্তু কোন ফল হয় না। তখন তাদের কেউ বললঃ তোমরা যদি ঐ দলের কাছে যেতে যারা তোমাদের মাঝে এসেছিল। হয়ত তাদের কারও কাছে কোন ঔষধ থাকতে পারে। তখন তারা সে দলের কাছে এসে বললঃ হে দলের লোকেরা! আমাদের সর্দারকে সাপে দংশন করেছে। আমরা তার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন ফল হয়নি। তোমাদের কারও নিকট কি কোন তদবীর আছে? একজন বললেনঃ হাঁ। আল্লাহর কসম, আমি ঝাড়-ফুঁক করি। তবে আল্লাহর কসম! আমরা তোমাদের নিকট মেহমান হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদের মেহমানদারী করনি।

তাই আমি ততক্ষণ পর্যন্ত ঝাড়-ফুঁক করব না, যতক্ষণ না তোমরা আমাদের জন্য মজুরী নির্ধারণ করবে। তখন তারা তাদের একপাল ছাগল দিতে রাজী হল। তারপর সে সাহাবী সেখানে গেলেন এবং আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন সূরা ফাতিহা) পড়ে ফুঁক দিতে থাকলেন। অবশেষে সে ব্যক্তি এমন সুস্থ হল, যেন বন্ধন থেকে মুক্তি পেল। সে চলাফেরা করতে লাগল, যেন তার কোন রোগই নেই। রাবী বলেনঃ তখন তারা যে মজুরীর চুক্তি করেছিল, তা আদায় করল। এরপর সাহাবীদের মধ্যে একজন বললেনঃ এগুলো বণ্টন করে দাও। এতে যিনি ঝাড়-ফুঁক করেছিলেন তিনি বললেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট গিয়ে যতক্ষণ না এসব ঘটনা জানাব এবং তিনি আমাদের কী আদেশ দেন তা না জানব, ততক্ষণ তোমরা তা ভাগ করো না। তারপর তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট এসে ঘটনা জানাল। তিনি বললেনঃ তুমি কী করে জানলে যে, এর দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা যায়? তোমরা ঠিকই করেছ। তোমরা এগুলো বণ্টন করে নাও এবং আমার জন্যে একটা ভাগ রাখ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৪৯, ২২৭৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঝাড়-ফুঁককারীর ডান হাত দিয়ে ব্যথার স্থান মাসাহ্ করা

(ক) ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ শাইবাহ (রহ.) ‘আয়িশাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাউকে ঝাড়ার সময় ডান হাত দিয়ে মাসাহ্ করতেন (এবং বলতেন),

أَحْمَدُ ابْنُ أَبِي رَجَاءٍ حَدَّثَنَا النَّضْرُ عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ قَالَ أَخْبَرَنِي أَبِي عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَرْقِي يَقُوْلُ امْسَحْ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ بِيَدِكَ الشِّفَاءُ لاَ كَاشِفَ لَهإِلاَّ أَنْتَ.

হে মানুষের প্রতিপালক! তুমি রোগ দূর করে দাও এবং আরোগ্য দান কর। তুমিই তো আরোগ্যদানকারী, তোমার আরোগ্য ভিন্ন আর কোন আরোগ্য নেই, এমন আরোগ্য দাও, যারপর কোন রোগ থাকে না।

এ হাদীস আমি মানসূরের কাছে উল্লেখ করলে তিনি ইব্রাহীম, মাসরূক, ‘আয়িশাহ থেকে এ রকমই বর্ণনা করেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫০, ৫৬৭৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) উসমান ইবনে আবুল আস আস-সাকাফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এমন মারাত্মক ব্যথা নিয়ে উপস্থিত হলাম, যা আমাকে অকেজো প্রায় করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেনঃ তুমি তোমার বাম হাত ব্যথার স্থানে রেখে সাতবার বলোঃ

‘‘আউযু বি-ইজ্জাতিল্লাহি ওয়া কুদরাতিহী মিন শাররি মা আজিদু ওয়া উহাযিরু’’

(আল্লাহর নামে আমি আল্লাহর অসীম সম্মান ও তাঁর বিশাল ক্ষমতার উসীলায় আমার অনুভূত এই ব্যথার ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি)। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫২২, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত),৩৮৯১, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৮০, মুসলিম ২২০২, আহমাদ ১৫৮৩৪, ১৭৪৪৯, আহমাদ ১৭৫৪, আত-তহাবিয়াহ ৭০, সহীহাহ ৩/৪০৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইয়াযীদ ইবনু আবূ উবাইদাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি সালামাহ (রাঃ)-এর পায়ের গোছায় একটি ক্ষত চিহ্ন দেখে বললাম, এটা কি? তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধে এখানে আঘাত পেয়েছিলাম। লোকেরা বলতে লাগলো যে, সালামাহ আহত হয়েছেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার নিকট আনা হলে তিনি আমার ক্ষতস্থানে তিনবার ফুঁ দিলেন। ফলে আজ পর্যন্ত আমি তাতে কোনো ব্যথা অনুভব করি না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ভীতিকর পরিস্থিতি ও নিদ্রাহীনতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার দোয়া

খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ কোন গন্তব্যে পৌঁছে যদি এই দোয়া পড়েঃ

‘‘আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক’’

(আমি আল্লাহ পাকের কল্যাণকর বাক্যাবলীর উসীলায় তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি), তাহলে সে স্থান থেকে বিদায় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৪৭, মুসলিম ২৭০৮, তিরমিযী ৩৪৩৭, আহমাদ ২৬৫৭৯, ২৬৭৬৫, দারেমী ২৬৮০, সহীহ আল-জামি ৫২৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

স্ত্রীলোক দ্বারা পুরুষকে ঝাড়-ফুঁক করা

‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রোগে মারা যান, সে রোগে তিনি সূরা নাস ও সূরা ফালাক্ব পড়ে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন রোগ বেড়ে গেল, তখন আমি সেগুলো পড়ে ফুঁক দিতাম এবং তাঁর হাত বুলিয়ে দিতাম বারাকাতের আশায়। বর্ণনাকারী [মা‘মার (রহ.)] বলেন, আমি ইবনু শিহাবকে জিজ্ঞেস করলামঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে ফুঁক দিতেন? তিনি বললেনঃ নিজের দু’ হাতে ফুঁক দিতেন, তারপর তা দিয়ে চেহারা মুছে নিতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫১, ৪৪৩৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যে ব্যক্তি ঝাড়-ফুঁক করে না

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আসলেন এবং বললেনঃ আমার সামনে (পূর্ববর্তী নবীগণের) উম্মাতদের পেশ করা হল। (আমি দেখলাম) একজন নবী যাচ্ছেন, তাঁর সাথে আছে মাত্র একজন লোক এবং আর একজন নবী যাঁর সঙ্গে আছে দু’জন লোক। অন্য এক নবীকে দেখলাম, তাঁর সঙ্গে আছে একটি দল, আর একজন নবী, তাঁর সাথে কেউ নেই। আবার দেখলাম, একটি বিরাট দল যা দিগন্ত জুড়ে আছে। আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম যে, এ বিরাট দলটি যদি আমার উম্মাত হত। বলা হলঃ এটা মূসা (আঃ) ও তাঁর কওম। এরপর আমাকে বলা হলঃ দেখুন। দেখলাম, একটি বিশাল জামাআত দিগন্ত জুড়ে আছে। আবার বলা হলঃ এ দিকে দেখুন। ও দিকে দেখুন। দেখলাম বিরাট বিরাট দল দিগন্ত জুড়ে ছেয়ে আছে। বলা হলঃ ঐ সবই আপনার উম্মাত এবং ওদের সাথে সত্তর হাজার লোক এমন আছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর লোকজন এদিক ওদিক চলে গেল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর তাদের (সত্তর হাজারের) ব্যাখ্যা করে বলেননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ এ নিয়ে নানান কথা শুরু করে দিলেন। তাঁরা বলাবলি করলেনঃ আমরা তো শির্কের মাঝে জন্মেছি, পরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। বরং এরা আমাদের সন্তানরাই হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে এ কথা পৌঁছলে তিনি বলেনঃ তাঁরা (হবে) ঐ সব লোক যাঁরা অবৈধভাবে মঙ্গল অমঙ্গল নির্ণয় করে না, ঝাড়-ফুঁক করে না এবং আগুনে পোড়ানো লোহার দাগ লাগায় না, আর তাঁরা তাঁদের প্রতিপালকের উপর একমাত্র ভরসা রাখে। তখন ‘উকাশাহ বিন মিহসান দাঁড়িয়ে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন আর একজন দাঁড়িয়ে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেনঃ এ বিষয়ে ‘উকাশাহ তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫২, ৩৪১০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যে লোক ঝাড়ফুক করায় সে তাওয়াক্কুল (আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরশীলতা) হতে বিচ্যুত হয়েছে

আক্কার ইবনুল মুগীরা (রহঃ) হতে তার বাবার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (মুগীরা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক (শরীরে) দাগ নেয় অথবা ঝাড়ফুক করায় সে তাওয়াক্কুল (আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরশীলতা) হতে বিচ্যুত হয়েছে। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৫৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৫৫, ইবনু মাজাহ ৩৪৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুরআন সংশ্লিষ্ট দুআ-তদবীর বিষয়ক জ্ঞাতব্য

আমাদের দেশে কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরা বা আয়াত বিষয়ক দু প্রকারের কথা প্রচলিত। এক প্রকারের কথা ফযীলত বা আখিরাতের মর্যাদা, সাওয়াব, আল্লাহর দয়া ইত্যাদি বিষয়ক। দ্বিতীয় প্রকারের কথা ‘তদবীর’ বা দুনিয়ায় বিভিন্ন ফলাফল লাভ বিষয়ক।

উমার আল-মাউসিলীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন সূরা ও আয়াতের ফযীলতে কিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত বাকি হাদীসগুলো অধিকাংশই যয়ীফ অথবা বানোয়াট। বিশেষত, তাফসীর কাশ্শাফ ও তাফসীর বায়যাবীর প্রতিটি সূরার শেষে সে সূরার ফযীলত বিষয়ক যে সকল কথা বলা হয়েছে তা মূলত এ বিষয়ক দীর্ঘ জাল হাদীসটি থেকে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত পাঞ্জ-সূরার ফযীলত বিষয়ক অধিকাংশ কথাই যয়ীফ অথবা জাল। এ বিষয়ক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এগুলোর বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এ বইয়ের কলেবর ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এজন্য আমরা এ বইয়ে ফযীলত বিষয়ক যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো আর আলোচনা করছি না। বরং এখানে আমল-তদবীর বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।

কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেওয়া বা এগুলোর পাঠ করে রোগব্যাধি বা বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য ‘আমল’ করা বৈধ। হাদীস শরীফে ‘কুরআন’ দ্বারা ‘রুক্ইয়া’ বা ঝাড়ফুঁক করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীসের দোয়া বা যে কোনো ভাল অর্থের বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেয়া বৈধ।

ঝাড়ফুঁক বা তদবীর দুই প্রকারের। কিছু ঝাড়ফুঁক বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রকারের ঝাড়ফুঁক ও আমল সীমিত। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ঝাড়ফুঁক, আমল ইত্যাদি পরবর্তী যুগের বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো। যেমন, অমুক সূরা বা অমুক আয়াতটি এত বার বা এত দিন বা অমুক সময়ে পাঠ করলে অমুক ফল লাভ হয় বা অমুক রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এইরূপ সকল আমল বা তদবীরই বিভিন্ন বুযুর্গের অভিজ্ঞতা প্রসূত।

কেউ ব্যক্তিগত আমল বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ‘তদবীর’ বা ‘রুকইয়া শরঈয়্যা’ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে এগুলির কোনো খাস ফযীলত আছে বা এগুলি হাদীস-সম্মত এরূপ ধারণা করলে রাসূলুল্লাহ () এর নামে মিথ্যা বলা হবে। এছাড়া তদবীর বা আমল হিসেবেও আমাদের উচিত সহীহ হাদীসে উল্লিখিত তদবীর, দোয়া ও আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।

শুভ-অশুভ/লক্ষণ-কুলক্ষণ

(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা শিরক, কোনো বন্তুকে কুলক্ষণ ভাবা শিরক। একথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দিবেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯১০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৮৪, ইবনু মাজাহ ৩৫৩৮, তিরমিযী ১৬৭৯, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৪৩০, গয়াতুল মারাম ৩০৩, আল জামি‘উস্ সগীর ৭৪০৭, সহীহুল জামি‘ ৩৯৬০, আবূ ইয়া‘লা ৫২১৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১২২, শু‘আবুল ঈমান ১১৬৭, আল মুসতাদরাক ৪৩, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৬৯৫৯।)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই, পেঁচা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত তা সঠিক নয়, কোনো নক্ষত্রের নির্দিষ্ট তারিখে আকাশের কোনো স্থানে অবস্থান করলে বৃষ্টিপাত হয় এরূপ বিশ্বাসও ঠিক নয় এবং সফর মাসকে অশুভ মনে করবে না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯১২,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৭৯, মুসলিম (২২২০)-১০৬, আবূ ইয়া‘লা ৬৫০৮, আবূ দাঊদ ৩৯১২, তাখরীজুস্ সুন্নাহ্ ২৭৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১৩৩, আহমাদ ৯১৬৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) বাকিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনু রাশিদ (রহঃ)-কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী অর্থাৎ পেঁচা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, জাহিলী যুগে লোকেরা ধারণা করতো কাউকে মৃত্যুর পর দাফন করা হলে ঐ মৃত ব্যক্তি কবর থেকে পেঁচা হয়ে বেরিয়ে আসে। অতঃপর তাঁর বাণী অর্থাৎ সফর মাস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, জাহিলী যুগে লোকেরা সফর মাসে কোথাও যাত্রা করাকে কুলক্ষুণে মনে করতো। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর মাসকে অশুভ মনে করতে নিষেধ করেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে যুগে কেউ যদি বলতো, সফর মাসে পেটে ব্যথা হয়। সবাই বলতো, এটা সংক্রামক। তাই তিনি বলেছেনঃ সফর মাস এরূপ নয় যেরূপ তোমরা ধারণা করে থাকো। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পশু-পাখি তাড়িয়ে শুভ-অশুভ নির্ণয়

(ঘ) ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ছোঁয়াচে ও শুভ-অশুভ বলতে কিছু নেই। অমঙ্গল তিন বস্তুর মধ্যে স্ত্রীলোক, গৃহ ও পশুতে।[1] (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৩, ২০৯৯; সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯২১, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৮৬, মুসলিম ৩৯/৩৪, হাঃ ২২২৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৭৮৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১২৭, আবূ ইয়া‘লা ৭৯৮, আহমাদ ১৫৫৪, আল জামি‘উস্ সগীর ১৩৫২০, সহীহুল জামি ৭৫৬২, আহমাদ ৪৫৪৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২২৯)।

[1] কোন কোন স্ত্রীলোক স্বামীর অবাধ্য হয়। আবার কেউ হয় সন্তানহীনা। কোন গৃহে দুষ্ট জ্বিনের উপদ্রব দেখা যায়, আবার কোন গৃহ প্রতিবেশীর অত্যাচারের কারণে অশান্তিময় হয়ে উঠে। গৃহে সালাত আদায় ও যিকর-আযকারের মাধ্যমে জ্বিনের অমঙ্গল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কোন কোন পশু অবাধ্য বেয়াড়া হয়। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আবূ হুরাইরাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, শুভ-অশুভ নির্ণয়ে কোন লাভ নেই, বরং শুভ আলামত গ্রহণ করা ভাল। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ শুভ আলামত কী? তিনি বললেনঃ ভাল কথা, যা তোমাদের কেউ শুনে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৪, ৫৭৫৫; মুসলিম ৩৯/৩৪, হাঃ ২২২৩, আহমাদ ৯৮৫৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শুভ-অশুভ আলামত

(চ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শুভ-অশুভ বলে কিছু নেই এবং এর কল্যাণই হল শুভ আলামত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! শুভ আলামত কী? তিনি বললেনঃ ভাল কথা, যা তোমাদের কেউ (বিপদের সময়) শুনে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৫, ৫৭৫৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩১। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগের সংক্রমণ ও শুভ-অশুভ বলতে কিছু নেই। শুভ আলামতই আমার নিকট পছন্দনীয়, আর তা হল উত্তম বাক্য। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৬, ৫৭৭৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পেঁচাতে অশুভ আলামত নেই

(জ)  আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগে সংক্রমণ নেই; শুভ-অশুভ আলামত বলে কিছু নেই। পেঁচায় অশুভ আলামত নেই এবং সফর মাসে অকল্যাণ নেই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৭, ৫৭০৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৭৭, আল জামি‘উস্ সগীর ১৩৪৮৭, সহীহুল জামি ৭৫৬০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৭৮২, ৭৮৩; আহমাদ ৯৭২২, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৪৫৪৩, মুসান্নাফ ‘আবদুর রায্যাক ১৯৫০৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগের মধ্যে কোন সংক্রমণ নেই, সফর মাসের মধ্যে অকল্যাণের কিছু নেই এবং পেঁচার মধ্যে কোন অশুভ আলামত নেই। তখন এক বেদুঈন বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে যে উট পাল মরুভূমিতে থাকে, হরিণের মত তা সুস্থ ও সবল থাকে। উটের পালে একটি চর্মরোগওয়ালা উট মিশে সবগুলোকে চর্মরোগগ্রস্ত করে দেয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তবে প্রথম উটটির মধ্যে কীভাবে এ রোগ সংক্রামিত হল? (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭০, ৫৭০৭, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯১১,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৭৮,  মুসলিম (২২২০)-১০১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১১৬, ‘নাসায়ী’র কুবরা ৭৫৯১, মুসান্নাফ ‘আবদুর রায্যাক ১৯৫০৭, আহমাদ ৭৬২০, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৪৬২২, আবূ দাঊদ ৩৯১১, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৭৮২, ৯৭১, আল জামি‘উস্ সগীর ৭৬৭৯, সহীহুল জামি‘ ৪২৬০, হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/২৫০, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৪৬১৪, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১১৫৯৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঙ) আবূ সালামাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ যেন কখনও রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের সাথে না রাখে। আর আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) প্রথম হাদীস অস্বীকার করেন। আমরা বললামঃ আপনি কি لاَ عَدْوى হাদীস বর্ণনা করেননি? তখন তিনি হাবশী ভাষায় কী যেন বললেন। আবূ সালামাহ (রহ.) বলেনঃ আমি আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)-কে এ হাদীস ছাড়া আর কোন হাদীস ভুলে যেতে দেখিনি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭১, ৫৭৭৪; মুসলিম ৩৯/৩৩, হাঃ ২২২১, আহমাদ ৯২৭৪, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঘর হতে বের হওয়ার সময় ‘ইয়া- রা-শিদ’,  ‘ইয়া- নাজীহ’ বলা

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন প্রয়োজনে ঘর হতে রওয়ানা হতেন, তখন কারো মুখে ‘ইয়া- রা-শিদ’ (হে সঠিক পথের অনুসারী!), ‘ইয়া- নাজীহ’ (হে সফলতা লাভকারী!) বা এ জাতীয় কোন শব্দ শুনা পছন্দ করতেন।

(মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৮৭, সহীহ তিরমিযী ১৬১৬, আল জামি‘উস্ সগীর ৯১০৯৬, সহীহুল জামি‘ ৪৯৭৮, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৪১৮১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুস্ সগীর ৫৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রোগের সংক্রমণ

রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই।

(ক) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই, অশুভ কেবল ঘোড়া,নারী ও ঘর এ তিন জিনিসের মধ্যেই রয়েছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭২, ২০৯০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ সংক্রমণ বলতে কিছু নেই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭৩, ৫৭০৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ সালামাহ ইবনু ‘আবদুর রহমান (রহঃ) বলেন, আমি আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে শুনেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগাক্রান্ত উট নীরোগ উটের সাথে মিশ্রিত করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭৪, ৫৭৭১, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) যুহরী সূত্রে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সংক্রমণ বলতে কিছু নেই। তখন এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বললঃ এ সম্পর্কে আপনার কী অভিমত যে, হরিণের মত সুস্থ উট যে মরুভূমির পালের মাঝে থাকে। পরে কোন চর্মরোগগ্রস্ত উট সেগুলোর সাথে মিশে গিয়ে সবগুলোকে চর্মরোগে আক্রান্ত করে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তা হলে প্রথমটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিল? (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭৫, ৫৭০৭, ৫৭১৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই এবং পাখি উড়াতে কোন শুভ-অশুভ নেই আর আমার নিকট ‘ফাল’ পছন্দনীয়। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ফাল’ কী? তিনি বললেনঃ ভাল কথা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭৬, ৫৭৫৬, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৫৩৭, মুসলিম ৩৯/৩৪, হাঃ ২২২৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৮, তিরমিযী ১৬১৫, আবূ দাউদ ৩৯১৬, আহমাদ ১১৭৬৯, ১১৯১৪, ১২১৫৪, ১২৩৬৭, ১২৪১১, ১৩২২১, ১৩৫০৮, ১৩৫৩৭, ১৩৯৫১। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, রোগে ছোঁয়াচে লাগা, সফর মাস অশুভ হওয়া বা ভূত-প্রেতের ধারণার কোন অস্তিত্ব নেই। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৮০, মুসলিম (২২২২)-১০৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১২৮, আহমাদ ১৫১০৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অসুস্থকে সুস্থদের সংস্পর্শে নেয়া উচিত নয়

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অসুস্থকে সুস্থদের সংস্পর্শে নেয়া উচিত নয়। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৪১, মুসলিম ২২২১, আবূ দাউদ ৩৯১১, আহমাদ ৯৩২৯, সহীহাহ ৯৭১। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ। লিম ২২২০, আহমাদ ৭৫৬৩, ৯০০৯, ৯৫৩৯, ৯৯৪৮, ১০২০৪, ১০৪১১, আয-যিলাল ২৬৯, সহীহাহ ৭৮৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

গণনা বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, জ্ঞানবান ও যুক্তিবাদী হয়ে গেছে। সভ্যতার চাকাও এগিয়ে গেছে অনেকখানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আধুনিকতার ছদ্মাবরণে বহু অন্ধকার ও কুসংস্কার ঢুকে গেছে আমাদের সমাজে। ইসলাম সম্প্রীতি, সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের কথা বলে। এর অর্থ এই নয় যে মুসলমানরা নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ হারিয়ে ভিন্নধর্ম ও মতাদর্শকে গ্রহণ করবে। বিশেষত যেসব বিষয়ে শরিয়তের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও সচেতন হওয়া মুসলমানদের জন্য ফরজ। সম্প্রতি আমাদের মুসলিম সমাজে জ্যোতিষী ও গণকদের 'ভবিষ্যদ্বাণী'র প্রচার ও প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে 'রাশিফল কালচার' যুক্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। আশ্চর্য, একেক পত্রিকায় একই ব্যক্তির একই দিনের 'রাশিফল' সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভিন্ন রকম প্রকাশ করছে। তবুও মানুষের বোধোদয় হচ্ছে না। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে জ্যোতিষীদের 'ভবিষ্যদ্বাণী' মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবুও তাদের হুঁশ ফিরছে না। অনেকে গণকের কাছে নিজ ভাগ্যের কথা জিজ্ঞেস করে। বিদেশ যাত্রা, ব্যবসার উন্নতি-অবনতি, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে অনেকে জ্যোতিষীর কাছে যায়। বিভিন্ন গণনার মাধ্যমে গণকরা এসব বিষয়ে মতামত দেয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে গণকের গণনা ও তার কাছে যাওয়া উভয়টি অকাট্যভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ।

রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর কাছে গেল, অতঃপর তার কাছে কোনো কিছু জানতে চাইল, ৪০ দিন পর্যন্ত তার তাওবা কবুল হবে না। আর যদি সে তার কথা বিশ্বাস করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে'- (তারগিব তারহিব : ৪৫৯৮) ।

শত আফসোস, অসংখ্য মুসলমান অবহেলার কারণে এই মারাত্মক গুনাহের মধ্যে লিপ্ত। অন্য হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি কোনো গণক বা জ্যোতিষীর কাছে গেল এবং সে যা বলল, তাই বিশ্বাস করল, তাহলে সে মুহাম্মদের ওপর নাজিলকৃত শরিয়তের সঙ্গে কুফরি করল'- (আবু দাউদ: ৩৯০৪, ইবনে মাজাহ : ১৩৫)।

অন্য হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি জ্যোতিষশাস্ত্রের কোনো জ্ঞান চয়ন করল, সে জাদু-টোনার একটি শাখা চয়ন করল'- (আবু দাউদ: ৩৯০৫, ইবনে মাজাহ: ৩৭২৬)।

 'রাশিফল' ও 'রাশিচক্রে'র নামে বর্তমানে আমাদের সমাজে যা চলছে, তা জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এটা বিশ্বাস করা কুফরি। রাশি হলো, সৌরজগতের কতগুলো গ্রহ-নক্ষত্রের কল্পিত প্রতীক। জ্যোতিষশাস্ত্রের ধারণানুযায়ী এসব গ্রহ-নক্ষত্রের গতি, স্থিতি ও সঞ্চারের প্রভাবে ভবিষ্যৎ শুভ-অশুভ নির্ণয় করা যায়। এ নির্ণয়কে ভাগ্য বিচারও বলা হয়।

প্রথমত, ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসমতে, গ্রহ-নক্ষত্রের নিজস্ব কোনো প্রভাব নেই। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই সব ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ'- (সুরা আনআম: ৫৭)।

দ্বিতীয়ত, এ ভাগ্যবিচারের মাধ্যমে ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকিদা 'তাকদিরে বিশ্বাস'কে চ্যালেঞ্জ করা হয়। জ্যোতির্বিদদের খবরের অন্ধ বিশ্বাস কোনো কোনো ধর্মে থাকলেও ইসলামে তা শক্তভাবে পরিত্যাজ্য। একইভাবে মণি, মুক্তা, হিরা, চুন্নি, পান্না, আকিক প্রভৃতি পাথর ও রত্ন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে, মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারে- এমন বিশ্বাস রাখা মুশরিকদের কাজ, মুসলমানদের কাজ নয়। বড় বড় বাজারে, শহরে-বন্দরে, রাস্তার মোড়ে হস্তরেখা বিচারকদের কাছে স্বধর্মীয় লোকেরা যেতেই পারে; কিন্তু মুসলমানরা তাদের কাছে যাওয়া কুফরি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, কোনো কোনো অবিশ্বাসী কুসংস্কার নির্মূলকারী ইসলামধর্মকেই কুসংস্কার বলছে! আসলে তারা ধর্মবিমুখ হয়ে আরো বেশি কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ছে।

গণনা বিদ্যাকে ইসলাম সমর্থন করে না

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোনো ব্যক্তি গণকের নিকট গেলে (বর্ণনাকারী মূসা তার হাদীসে বলেন) এবং তার কথা বিশ্বাস করলে অথবা স্ত্রীর সাথে (মুসাদ্দাদের বর্ণনায় রয়েছে) ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে অথবা স্ত্রীর সাথে পশ্চাৎ দ্বারে সহবাস করলে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, সে তা থেকে দায়মুক্ত (অর্থাৎ ইসলামের গন্ডির বাইরে)। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০৪, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৯, আহমাদ ৯৫৩৬, আবূ দাঊদ ৩৯০৪, ইবনু মাজাহ ৬৩৯, আল জামি‘উস্ সগীর ১০৮৮৬, সহীহুল জামি‘ ৫৯৪২, বায়হাক্বী’র কুবরা ১৪৫০৪, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৬৬৭০, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৬৫০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩০৪৪ )।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হুযাইল গোত্রের দু’জন মহিলার মধ্যে বিচার করেন। তারা উভয়ে মারামারি করেছিল। তাদের একজন অন্যজনের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পাথর গিয়ে তার পেটে লাগে। সে ছিল গর্ভবতী। ফলে তার পেটের বাচ্চাকে সে হত্যা করে। তারপর তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অভিযোগ দায়ের করে। তিনি ফায়সালা দেন যে, এর পেটের সন্তানের বদলে একটি পূর্ণদাস অথবা দাসী দিতে হবে। জরিমানা আরোপকৃত মহিলার অভিভাবক বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! এমন সন্তানের জন্য আমার উপর জরিমানা কেন হবে, যে পান করেনি, খাদ্য খায়নি, কথা বলেনি এবং কান্নাকাটিও করেনি। এ অবস্থায় জরিমানা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ তো দেখছি) গণকদের ভাই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৮, ৫৭৫৯, ৫৭৬০, ৬৭৪০, ৬৯০৪, ৬৯০৯, ৬৯১০; মুসলিম ২৮/১১, হাঃ ১৬৮১, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। দু’জন মহিলার একজন অন্যজনের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে। এতে সে তার গর্ভপাত ঘটায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনার বিচারে গর্ভস্থ শিশুর বদলে একটি দাস বা দাসী দেয়ার ফয়সালা দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৫৯, ৫৭৫৮, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) সা‘ঈদ ইবনু মুসায়্যিব (রহঃ) এর সূত্রে বর্ণিত যে, যে গর্ভস্থ শিশুকে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দাস বা দাসী প্রদানের ফয়সালা দেন। যার বিপক্ষে এ ফয়সালা দেয়া হয়, সে বলেঃ আমি কীভাবে এমন শিশুর জরিমানা আদায় করি, যে পানাহার করেনি, কথা বলেনি এবং কান্নাকাটিও করেনি। এ রকম হত্যার জরিমানা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এ তো দেখছি গণকদের ভাই। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬০, ৫৭৫৮; মুসলিম ২৮/১১, হাঃ ১৬৮১, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) আবূ মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুকুরের মূল্য, যিনাকারিণীর পারিশ্রমিক ও গণকের পারিশ্রমিক দিতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬১, ২২৩৭, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৭১, ইবনু মাজাহ ২১৫৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) হাফসাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি গণকের কাছে যায় এবং (তার কথা সত্য ভেবে) তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করে, তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল হয় না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৫, সহীহ  মুসলিম (২২৩০)-১২৫, আল জামি‘উস্ সগীর ১০৮৮৪, সহীহুল জামি ৫৯৪০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩০৪৬, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৯১৮, আহমাদ ১৬৬৩৮, আবূ ইয়া‘লা ৫৪০৮, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৯১৭২, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৯৮৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জ্যোতির্বিদ্যা

জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy)  মহাবিশ্বে বিরাজমান গ্রহ, নক্ষত্র ও অন্যান্য জ্যোতিষ্কের গতি-প্রকৃতি সমন্ধীয় বিদ্যা। বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখাসমূহের অন্যতম হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যা বা জ্যোতির্বিজ্ঞান। প্রাচীনকালের বহু সভ্যতায়ই জ্যোতিষ্কসমূহের নিয়মপূর্ণ গতিবিধি পন্ডিতদের কাছে পরম কৌতূহলের বিষয় ছিল। প্রাচীন পন্ডিতবর্গ সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহাদির পারস্পরিক স্থান পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন এবং তা থেকে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আদিতে পন্ডিতগণ জ্যোতিষ্কসমূহের গতিবিধি ও আবর্তন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কাল গণনা (দিন, মাস ও বছর) সূচনা করেন এবং এর ভিত্তিতেই বর্ষপঞ্জি গণনাপদ্ধতির উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চালব্ধ জ্ঞান নৌচালনায় বিশেষ করে দিক নির্ণয়ে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকেই চীনারা তাদের কাজকর্মের প্রয়োজনে বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করত। প্রায় ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনা পন্ডিত শি শেন (Shih Shen) ৮০০টি নক্ষত্রের বর্ণনা সম্বলিত একটি নক্ষত্রপঞ্জি তৈরি করেছিলেন। এটিই জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে প্রাচীনতম নক্ষত্রপঞ্জি বলে বিবেচিত। প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরোহিত, যার ফলে তাদের অনেকেই ক্রমে ক্রমে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও গতিবিধির সঙ্গে মানুষের ভাগ্যের সম্পর্ক আছে বলে মত প্রকাশ করতে থাকেন। এভাবে জ্যোতির্বিদ্যা ধীরে ধীরে জ্যোতিষ শাস্ত্রে (Astrology) রূপ নিতে থাকে। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে জ্যোতিষ শাস্ত্রকে জ্যোতির্বিদ্যা থেকে আলাদা করা হয়েছে। গ্রহ ও নক্ষত্রাদির দূরত্ব, ওজন, বস্ত্তবিন্যাস, গঠনপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক আলোচনাকেই বর্তমানকালে জ্যোতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে জ্যোতিষ শাস্ত্রের কোনো স্থান নেই। ফলে এখন পদার্থর্বিদ্যা,  গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

ভারতবর্ষে বৈদিক কাল থেকেই জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সেসময় কেবলমাত্র সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধিই পর্যবেক্ষণ করা হতো। সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন বিভাগের মাধ্যমে ঋতুকাল নিরূপণ করা হতো এবং বৎসর গণনা করা হতো। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার দ্বারা বৎসরকে মাসে ভাগ করা হতো। পুরাকালের কতিপয় গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার স্বরূপ সমন্ধে জানা যায়। এ সকল গ্রন্থের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছে বেদ। বেদের আনুষঙ্গিক ছয় প্রকার শাখা আছে, এগুলিকে বেদাঙ্গ বলে। বেদাঙ্গগুলোর পঞ্চম বেদাঙ্গ হচ্ছে জ্যোতিষ্ক যাতে গ্রহ-নক্ষত্রাদির বিবরণ রয়েছে। হিন্দুদের যাবতীয় ধর্ম-কর্মে গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির অবস্থান জানার প্রয়োজন হওয়াতে হিন্দুদের সকল শাস্ত্রেই জ্যোতির্বিদ্যার উল্লেখ রয়েছে এবং সকল যুগেই জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করা হয়েছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা তিনটি শাখায় বিভক্ত: গণিত, হোরা এবং সংহিতা। যে শাখায় গ্রহগসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, তাকে গণিত শাস্ত্র বা গণিত তন্ত্র বলে। হোরা শাস্ত্রে গ্রহসমূহের অবস্থান ও লগ্ন অনুযায়ী যাত্রা, বিবাহ প্রভৃতির শুভাশুভ নির্ণয় করা হয় এবং জন্মকালে গ্রহের অবস্থানদৃষ্টে জাতকের কোষ্ঠী নির্ণয় করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রের গণিত শাখা আবার দুই প্রকার: সিদ্ধান্ত ও করণ। সিদ্ধান্তে প্রমাণাদি প্রয়োগের পর প্রত্যেকটি গণনার ফল নির্ণয় করা হতো। করণে শুধুমাত্র গণনাপদ্ধতি লিপিবদ্ধ থাকে। অবস্থান বিষয়ক সূত্র দ্বারা গ্রহের অবস্থান নির্ণয় করা যায়, কিন্তু কি উপায়ে সেই সূত্র আবিষ্কার করা যেতে পারে, করণে তার কোনো উল্লেখ নেই। সম্পূর্ণরূপে করণের ওপর নির্ভর করার ফলে কালক্রমে ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার পরিবর্তে জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা প্রাধান্য পেতে থাকে। জ্যোতিষীরা শুধুমাত্র কোষ্ঠী নির্ণয় এবং করণের সাহায্যে নানাবিধ গণনা করাতেই নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন।

বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা বাংলাদেশে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ইতিহাস একেবারেই সাম্প্রতিক কালের। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই বাংলাদেশে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা প্রধানত তাত্ত্বিক পর্যায়ের, বিশেষ করে, পাকিস্তান আমলে। কেননা, পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মহাকাশ প্রযুক্তি অনেক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে কোনো সংগঠিত প্রয়াস সাধিত হয় নি। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণিতের শাখা হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানো হতো।

স্বাধীনতা উত্তরকালে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এদের মধ্যে বিশিষ্ট গণিতবিদ  মোহাম্মদ আব্দুল জববার স্মরণযোগ্য যাকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে। তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিকল্পনায় নির্মিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সিলেসশিয়াল গ্লোব বা ‘খ-গোলক’। জ্যোতির্বিজ্ঞান শাস্ত্রকে বাংলাভাষায় জনপ্রিয় করার জন্য তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তারা পরিচিতি, খগোল পরিচয় এবং প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান জাদুঘর ১৯৮০ সাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কার্যক্রম শুরু করে। একটি চার ইঞ্চি প্রতিফলন টেলিস্কোপের মাধ্যমে জনসাধারণকে সে সময় আকাশ পর্যবেক্ষণ করানো হতো। এছাড়া ১০ আসনবিশিষ্ট একটি মিনি প্লানেটরিয়াম বা নভোথিয়েটারের মাধ্যমে রাতের আকাশ চেনাবার ব্যবস্থা ছিল।

জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী একদল তরুণ ১৯৮৮ সালে  বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন গঠন করলে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানে সুসংগঠিতভাবে কিছু কাজ শুরু হয়। তারা মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনা যেমন - চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণ, কোনো উজ্জ্বল ধুমকেতুর আগমন, উল্কাঝড়, গ্রহদের প্রতিযোগ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে এবং সাধারণ মানুষের জন্য ক্যাম্প উন্মুক্ত রাখে। যদিও এর পূর্বে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি নামে অপর একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করেছিল, তবে তার সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল খুবই সীমিত এবং বেশিরভাগই বিজ্ঞান জাদুঘরকেন্দ্রিক। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন তাদের মহাকাশ বিষয়ক পত্রিকা মহাকাশ বার্তা এর নিয়মিত প্রকাশনার মধ্য দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়াবলীকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতসব সত্ত্বেও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা খুবই সীমিত এবং প্রাথমিক পর্যায়েরই বলা চলে।

জ্যোতিষী বিদ্যাকে ইসলাম সমর্থন করে না

(ক) মু‘আবিয়াহ্ ইবনু হাকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগের অন্যান্য কাজের মধ্যে জ্যোতিষীর কাছেও যেতাম। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমরা আর কখনো গণকদের কাছে যাবে না। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আমরা (কোন কাজের জন্য) অশুভ লক্ষণ মেনে থাকি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এটা এমন একটি ব্যাপার যে, (অনিচ্ছাকৃতভাবেই) তোমাদের কারো মনে তার উদ্রেক হয়ে থাকে, তবে তা যেন তোমাদেরকে বিরত না রাখে। রাবী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আমাদের কেউ রেখা টেনে (ভাগ্য পরীক্ষার কাজ করে) থাকে। তিনি বললেনঃ কোন একজন নবী (আল্লাহর হুকুমে) রেখা টানার কাজ করতেন, সুতরাং যার রেখা টানা সে নবীর রেখার সাথে মিলে যায় তা জায়িয আছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯২, সহীহ মুসলিম (৫৩৭)-১২১, আহমাদ ১৫৬৬৩, মা‘রিফাতুস্ সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাক্বী ৪৭৭৬, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৫৬৬০, আস্ সুনানুস্ সুগরা ৯০৪, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ৩৪৭৯, নাসায়ী ১২১৮, ইরওয়া ৩৯০, আল জামি‘উস্ সগীর ৮৫৯০, সহীহুল জামি‘ ৪৪৬২, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ৮৫৯, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১১৪১, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৬৩০৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ২২৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর জ্ঞান শিক্ষা করলো সে যাদু বিদ্যার একটা শাখা শিক্ষা করলো। তা যতো বৃদ্ধি পাবে যাদুবিদ্যাও ততো বাড়বে। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৮, আহমাদ ২৮৪০, ইবনু মাজাহ ৩৭২৬, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৭৯৩, আল জামি‘উস্ সগীর ১১০১৯, সহীহুল জামি‘ ৬০৭৪, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩০৫১, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৬৪৬, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৬৯৫৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(গ) যায়িদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুদায়বিয়ার সময় এক রাতে সামান্য বৃষ্টি হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। সালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেনঃ তোমরা কি জানো, তোমাদের রব কি বলেছেন? তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।

অতঃপর তিনি বলেনঃ আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দাদের কেউ আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং কেউ অবিশ্বাসী হয়েছে। যে বলেছে, আল্লাহর দয়া ও রহমতে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৯০৬, সহীহ বুখারী ৮৪৬, মুসলিম (৭১)-১২৫, নাসায়ী ১৫২৫, ইরওয়া ৬৮১, আবূ দাঊদ ৩৯০৬, আল জামি‘উস্ সগীর ১২৯৮৪, সহীহুল জামি‘ ৭০২৮, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৭০১, মুওয়াত্ত্বা মালিক ৫৬৩, মা‘রিফাতুস্ সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাক্বী ২০৮১, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ২১০০৩, মুসনাদুশ্ শাফি‘ঈ ৩৫৮, আহমাদ ১৭০৬১, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৮৮, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১৮৩৩, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫০৬৫, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৬১৮৬, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ৬৬৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

(ঘ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যখনই আল্লাহ তা‘আলা আসমান হতে কোন বারাকাত নাযিল করেন, তখন তার দ্বারা একদল লোক কাফিরে পরিণত হয়। বৃষ্টি তো আল্লাহ তা‘আলাই বর্ষণ করে থাকেন; অথচ একশ্রেণীর লোক বলে যে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবেই বৃষ্টি হয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৭, সহীহ মুসলিম (৭২)-১২৬, আহমাদ ৯৪৬৩, আল জামিউ সগীর ১০৪৯৮, সহীহুল জামি‘ ৫৫৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঙ) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিছু লোক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জ্যোতিষীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেনঃ তারা কিছুই নয়। তারা বলল : হে আল্লাহর রসূল! তারা কোন কোন সময় এমন কথা বলে, যা সত্য ও সঠিক হয়ে থাকে। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঐ কথাটি সত্য যা জীন শয়তান (ঊর্ধ্বজগৎ হতে) ত্বরিত শুনে নেয়। অতঃপর মোরগের করকরানোর মতো শব্দ করে তার বন্ধুর কানে তা পৌঁছিয়ে দেয়। এরপর সে গণক ঐ একটি সত্য কথার সাথে শত শত মিথ্যা মিলিয়ে প্রকাশ করতে থাকে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৩,সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬২, ৩২১০, মুসলিম (২২২৮)-১২৩, আহমাদ ২৪৫৭০, বায়হাক্বী’র কুবরা ১৬৯৫৩, আল আদাবুল মুফরাদ ৮৮২, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৬৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১৩৬, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ২০৩৪৭, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (চ) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- মালায়িকাহ্’র (ফেরেশতাগণের) একদল মেঘের দেশে (অর্থাৎ- পৃথিবী হতে নিকটতম আকাশমণ্ডলীতে) নেমে আসেন এবং আসমানে যার ফায়সালা হয়েছে পরস্পর তার আলোচনা করেন, সে সময় জীন-শয়তান কান লাগিয়ে রাখে। আর যখনই সে কোন কথা শুনতে পায়, তখনই তা গণকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয় এবং তারা নিজেদের পক্ষ হতে শত শত মিথ্যা তার সাথে মিলিয়ে প্রকাশ করতে থাকে (যার দরুন সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটে)।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৯৪, সহীহ  বুখারী ৩২১০, আল জামি‘উস্ সগীর ৩৭১৮, সহীহুল জামি‘ ১৯৫৫, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৬৮১, তিরমিযী ৩২২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ছ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলীতে যখন কোন ফায়সালা করেন, তখন সে নির্দেশে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাদের পাখাসমূহ নাড়াতে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলার সে নির্দেশটির আওয়াজ সে শিকলের শব্দের মতো যা কোন একটি সমতল পাথরের উপরে টেনে নেয়া হলে শোনা যায়। অতঃপর যখন মালায়িকাহ্ অন্তর হতে সে ভীতি দূর হয়ে যায়, তখন সাধারণ মালাক (ফেরেশতা) আল্লাহর নিকটতম মালাক-কে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের রব্ কি নির্দেশ দিয়েছেন? তাঁরা বলেন, আমাদের প্রভু যা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ সঠিকই বলেছেন। (এবং সে নির্দেশটি কি তা জানিয়ে দেন,) এরপর বলেন, আল্লাহ তা‘আলা হলেন সুমহান ও মর্যাদাসম্পন্ন।

আল্লাহর নবী আরো বলেছেনঃ আল্লাহর ফায়সালাকৃত বিধান সম্পর্কে ফেরেশতাদের মধ্যে যেসব আলোচনা হয়, জীন-শায়ত্বনেরা চোরা পথে একজন আরেকজনের উপরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করে। বর্ণনাকারী সুফ্ইয়ান নিজের হাতের অঙ্গুলিগুলো ফাঁক করে শয়তানরা কিভাবে একজন আরেকজন হতে কিছুটা ফাঁক করে কিভাবে একজন আরেকজন হতে কাছাকাছি দাঁড়ায় তা অনুশীলন করে দেখিয়েছেন। অতঃপর যে শয়তান প্রথমে নিকট হতে শুনতে পায় সে তা তার নিচের শয়তানকে বলে দেয় এবং সে তার নিচের জনকে, এভাবে কথাটি জাদুকর ও গণকের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়।

অনেক সময় এমন হয় যে, ঐ কথাটি পৌঁছার পূর্বেই আগুনের ফুলকি তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয় (ফলে আর তা গণকদের পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না)। আবার কখনো তারকা নিক্ষেপ হওয়ার পূর্বেই তা তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। অতঃপর তারা ঊর্ধ্বজগতে শুনা সে (সত্য) কথাটির সাথে (নিজেদের মনগড়া) শত শত মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে মানুষের কাছে বলে। আর যখন তাকে বলা হয় যে, অমুক দিন তুমি আমাদেরকে এই এই কথা বলেছিলে, (তা তো মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।) তখন ঐ একটি কথা দ্বারা তার সত্যতা প্রমাণ করা হয়, যা ঊর্ধ্বজগৎ হতে শ্রুত হয়েছিল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬০০, সহীহ বুখারী ৪৭০১, ইবনু মাজাহ ১৯৪, আল জামি‘উস্ সগীর ৭৩৬, সহীহুল জামি‘ ৭৩৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬, তিরমিযী ৩২২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(জ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জনৈক আনসারী সাহাবী আমাকে বর্ণনা করেছেন যে, এক রাতে তাঁরা (সাহাবীরা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বসেছিলেন। তখন হঠাৎ একটি তারকা (আকাশ হতে) ছুটল এবং তাতে চতুর্দিক আলোকিত হয়ে গেল। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা এভাবে তারকা ছোটাকে জাহিলিয়্যাতের যুগে তোমরা কি বলতে? তাঁরা বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূলই অধিক অবগত। তবে আমরা বলতাম : আজ কোন একজন বড় লোকের জন্ম হয়েছে অথবা কোন একজন বড় লোকের মৃত্যু ঘটেছে।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুর দরুন তারকা নিক্ষিপ্ত হয় না। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমাদের রব, যাঁর নাম অতীব বারাকাতময়, যখন কোন নির্দেশ দেন তখন সর্বপ্রথম আল্লাহর ‘আরশ বহনকারী মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তাসবীহ পাঠ করেন। অতঃপর তাঁদের নিকটবর্তী আসমানের মালায়িকাহ্ তাসবীহ পাঠ করেন, এভাবে তাসবীহ পাঠ করার সিলসিলাহ্ পর্যায়ক্রমে দুনিয়ার আকাশে অবস্থানরত মালায়িকাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

অতঃপর ‘আরশ বহনকারী মালায়িকাহ্’র নিকটবর্তী মালায়িকাহ্ ‘আরশ বহনকারীদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের রব্ কি বলেছেন? তখন তারা আল্লাহ যা বলেছেন তা তাদেরকে বলে দেন এবং সাথে সাথে পরস্পরের জানা-জানির মধ্যে দুনিয়ার আকাশে অবস্থানরত মালায়িকাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং চোরাপথে খবর সংগ্রহকারী জীন-শয়তান ত্বরিত গতিতে সে খবরটি সংগ্রহ করে এবং তাদের বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দেয়। সুতরাং যে সমস্ত কথা তারা অবিকল বর্ণনা করে, এটা সঠিক ও সত্য। কিন্তু গণক ও জাদুকররা তার সাথে আরো অনেক (মিথ্যা) মিশিয়ে প্রকাশ করতে থাকে।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬০১, সহীহ মুসলিম (২২২৯)-১২৪, আবূ ইয়া‘লা ৭১৮২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬১২৯, ‘নাসায়ী’র কুবরা ১১২৭২, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/১৪৩, বায়হাক্বী’র কুবরা ১৬৯৫৪, আহমাদ ১৮৮২, তিরমিযী ৩২২৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) কতাদাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এসব নক্ষত্র তিন উদ্দেশে সৃষ্টি করেছেন। ১. আকাশের শোভা বৃদ্ধি, ২. জীন-শয়তানদের বিতাড়িত করা এবং ৩. পথভোলা পথিকের দিক নির্ণয়। আর যে কেউ এছাড়া অন্য কোন উদ্দেশে বর্ণনা করে, সে মারাত্মক ভুল করে এবং নিজের ভাগ বরবাদ করে। আর এমন অসাধ্য সাধনের পিছনে পড়ে, যে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান নেই।

আর ইমাম রযীন বর্ণনা করেছেন যে, এমন একটি কাজের পিছনে কষ্ট করল যা তার কোন উপকারে আসবে না এবং সে বিষয়ে তার সামান্যতম জ্ঞানও নেই। যার তথ্য জানতে আল্লাহর নবীগণ ও মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাকুল) অক্ষম রয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬০২, সহীহ বুখারী ৮/২৪৬ পৃঃ, তা‘লীক সহকারে)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জ্যোতিষী প্রকৃতপক্ষে গণক, আর গণক জাদুকর, জাদুকর কাফির

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নক্ষত্র বিদ্যা বিষয়ে আল্লাহর বাতলানো উদ্দেশ্য ব্যতীত কিছু শিক্ষাও গ্রহণ করেছে, সে বস্তুতঃ জাদুবিদ্যার এক অংশ হাসিল করেছে। আর জ্যোতিষী প্রকৃতপক্ষে গণক, আর গণক জাদুকর। আর জাদুকর কাফির।

(মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৬০৪, সহীহ  আল ইসতিযকার (৩৭৯৪২)-(৯৫৬), আত্ব ত্বিববু লি আবী দাঊদ (৪/১৫), ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১৬৯৫৫, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১১১১, শু‘আবুল ঈমান ৫১৯৭, আহমাদ ২০০০, ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৬৪, আবূ দাঊদ ৩৮০৫, ইবনু মাজাহ ৩৭২৬, সহীহুল জামি‘ ৬০৭৪, আল জামি‘উস্ সগীর ১০১৯, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩০৫১, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৭৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যাদু বিদ্যা

যাদু, টোনা, উচ্চাটন, মারণ, বশীকরণ, বান মারা, তাবিজ করা বা কুফরি যাদু— এই শব্দগুলি সম্বন্ধে কমবেশি আমরা অনেকেই পরিচিত। এইগুলিকে এক কথায় ‘কালো যাদু’ বা ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে।

কালো জাদু বা অন্ধকার জাদু হলো এমন এক ধরনের চর্চা যা অন্যের অনিষ্ট সাধনে কিংবা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে করা হয়। এটি অতিমানবিক ও অশুভ শক্তির সংশ্লিষ্টতা। কালো জাদু সাধারনত অতিমানবিক শক্তি দ্বারা করা হয় । তবে অনেকে বলেন, এতে ভূত, প্রেত, আত্মা, প্রেতাত্মা ব্যবহার করা হয় । অর্থাৎ বলা হয় যে, কালো জাদু দিয়ে ভুত, প্রেত, প্রেতাত্মা ইত্যাদি বশ করে তাদের দিয়ে নানা কাজ করা যায়। যারা কালো জাদু করে তাদেরকে কালো জাদুকর বলা হয়।

কালো যাদু এক ধরনের সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার, যাকে খারাপ উদ্দেশ্যে অন্যের ক্ষতি করার জন্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ নেই যেখানে কালো যাদু চর্চা না হয়ে থাকে। হিন্দু ও বৌদ্ধরা বহু প্রাচীন কাল থেকেই কালো যাদুর সাহায্য নিয়ে আসছে। হিন্দু তন্ত্রসাধনায় মূলত কালো যাদুরই চর্চা হয়ে থাকে।

জাদুর পরিচয়

গোপন অদৃশ্য উপকরণকে কাজে লাগিয়ে অভিনব কারিশমা দেখানোকে জাদু বলে। জাদুবিদ্যা অর্জনের জন্য অদৃশ্য উপকরণ বলতে গ্রহ-নক্ষত্র, জিন-শয়তানের সহায়তা লাভ করতে কুফরি, শিরকি ও পাপাচারকে অবলম্বন করা। যার মাধ্যমে অদৃশ্যভাবে মানুষের ক্ষতিসাধন করা হয়।

বিশেষ ধরনের সাধনা ও যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমেও এ বিদ্যা অর্জিত হয়। এগুলো মুশরিক ও জাহেলি যুগের লোকদের মাঝে প্রাচীনকাল থেকেই এর বহুল প্রচলন ছিল। যার রেশ এখনো রয়েছে। ইসলামি শরিয়তে এগুলো হারাম ও চরম অবৈধ এবং গোনাহের কাজ।

দেশ বিদেশে আমাদের মুসলিম সমাজের কথিত ভন্ড দরবেশ বাবা, পির বাবা, অলি বাবা, কবিরাজ বাবা, ফকির বাবা ইত্যাদি ইত্যাদি নামক যাদুকরগণ টিভিতে ও বিভিন্ন পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলে যে, আমাদের এই বাবা আজমিরি শরিফ হতে বা অনুরুপ কোনো জায়গা হতে অবাধ্য জিনকে সাধনা বলে বাধ্যগত করে আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছে। এখন বাবায় নিম্নোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারে।

মনের মানুষকে কাছে পাওয়া, প্রেমে ব্যর্থ, স্বামী স্ত্রীর অমিল, ব্যবসায় উন্নতি, মামলা মোকদ্দমায় জয়লাভ, পরকীয়া থেকে মুক্তি, শনি রাহু,  যাদু টোনা থেকে মুক্তি, বয়স হয়েছে বিয়ে হচ্ছেনা ইত্যাদি। ১ থেকে ৩ দিনে সমাধান ইনশাআল্লাহ।

যারা এইসব কাজের সাথে জড়িত, জেনে রাখবেন এরা প্রত্যেকেই শযতানী শক্তির দ্বারা প্রভাবিত। এরাও মাঝে মধ্যে অলৌকিক ঘটনা দেখায় তবে তা সম্পূর্ণ শয়তান জীনের মাধ্যমে ঘটিয়ে থাকে।

যাদু বিদ্যাকে ইসলাম সমর্থন করে না

মহান আল্লাহর বাণীঃ শায়ত্বনরাই কুফুরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত এবং যা বাবিলের দু’জন ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর পৌঁছানো হয়েছিল.....পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না পর্যন্ত- (সূরাহ আল-বাকারাহ ২/১০২)।

মহান আল্লাহর বাণীঃ যাদুকর যেরূপ ধরেই আসুক না কেন, সফল হবে না- সূরাহ ত্বহা ২০/৬৯)।

মহান আল্লাহর বাণীঃ তোমরা কি দেখে-শুনে যাদুর কবলে পড়বে?- (সূরাহ আম্বিয়া ২১/৩)।

মহান আল্লাহর বাণীঃ তখন তাদের যাদুর কারণে মূসার মনে হল যে, তাদের রশি আর লাঠিগুলো ছুটোছুটি করছে- (সূরাহ ত্বহা ২০/৬৬)।

মহান আল্লাহর বাণীঃ এবং (জাদু করার উদ্দেশে) গিরায় ফুৎকারকারিণীদের অনিষ্ট হতে- (সূরাহ ফালাক্ব ১১৩/৪)।

النَّفَّاثَاتُ অর্থ যাদুকর নারী, যারা যাদু করে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বেঁচে থাক। আর তা হল আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করা ও যাদু করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬৪, ২৭৬৬, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ কে যাদু করার ঘটনা

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যুরাইক গোত্রের লাবীদ ইবনে আসাম নামক জনৈক ইহূদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যাদু করে। শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনে হতো যে, কোন কাজ তিনি করেছেন অথচ তা তিনি করেননি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, শেষে একদিন বা এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার ডাকার পর বললেনঃ হে আয়েশা! তুমি কি অবগত আছো, আমি যে বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম, আল্লাহ তা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন? আমার নিকট দু‘জন লোক (ফেরেশতা) এসে তাদের একজন আমার শিয়রের কাছে এবং অপর জন আমার পায়ের কাছে বসেন। আমার মাথার কাছেরজন আমার পায়ের কাছের জনকে অথবা আমার পায়ের কাছেরজন আমার শিয়রের কাছের জনকে বললেন, লোকটার কী অসুখ হয়েছে? সাথী বলেন, তাঁকে যাদু করা হয়েছে। তিনি বলেন, কে তাকে যাদুগ্রস্ত করেছে? অপরজন বলেন, লাবীদ ইবনুল আসাম। তিনি বলেন, কোন জিনিসের মধ্যে? অপরজন বলেন, চিরুনীর ভগ্নাংশ ও চিরুনীর সাথে লেগে থাকা চুল নর খেজুর গাছের সরু খোলসে ঢুকিয়ে। তিনি বলেন, তা কোথায় আছে? অপরজন বলেন, যী-আরওয়ান কূপের মধ্যে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একদল সাহাবীসহ সেখানে গেলেন (এবং সেগুলো কূপ থেকে বের করা হলো)। অতঃপর তিনি ফিরে এসে বলেনঃ হে আয়েশা, আল্লাহর শপথ! ঐ কূপের পানি মেহেদী পেষা পানির মত হয়ে গেছে এবং তথাকার খেজুর গাছগুলো যেন শয়তানের মাথার মত। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল! আপনি সেগুলো কি ভস্মীভূত করেন নি? তিনি বলেনঃ না। আল্লাহ তো আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। তাই আমি মানুষের মাঝে এর অপচর্চা ছাড়িয়ে দেয়া পছন্দ করি না। অতঃপর তিনি কূপটি ভরাট করার নির্দেশ দিলে তা ভরাট করে দেয়া হয়। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৪৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬৩, ৫৭৬৫, ৫৭৬৬, ৩১৭৫, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪১, মুসলিম ৩৯/১৭, হাঃ ২১৮৯, আহমাদ ২৪৩৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নুশরাহ (শয়তানী মন্ত্র)

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নুশরাহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ এগুলো শয়তানের কার্যকলাপ। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৬৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

কোন কোন ভাষণ হল যাদু

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার পূর্ব অঞ্চল (নজদ এলাকা) থেকে দু’জন লোক এল এবং দু’জনই ভাষণ দিল। লোকজন তাদের ভাষণে বিস্মিত হয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কোন কোন ভাষণ অবশ্যই যাদুর মত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬৭, ৫১৪৬, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রচলিত কিছু জাদু

আমাদের দেশে এখনো কিছু কিছু কাজে যাদু মন্ত্রের প্রচলন আছে। যেমন, পানি পড়া, ডালিম পড়া, চিনি পড়া, কারো জিনিস হারালে বাটি চালান দেয়া, তুলা রাশি লোককে দিয়ে গণনা করা, বান মারা, সাপের বিষ ঝাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব কাজে যেসব যাদু মন্ত্র ব্যবহার করা হয় তা সবগুলোই শয়তানী মন্ত্র ছাড়া কিছুই না। অনেক হুজুরকে এসব কাজ করতে দেখা যায়, তিনি মুখে যতোই বলুক যে, এসব কুরআন দিয়ে করা হয় তবুও তা শিরক। কারন কুরআন হাদিসে এসব উল্লেখ নেই। তিনি মিথ্যে বলছেন।

আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এমন কিছু হুজুর আছেন যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়সহ ইসলামের সব কাজই করে আবার পাশাপাশি তাবিজের ব্যবসাসহ তন্ত্র মন্ত্রের কাজও করে। এরা আবার বলে তাদের এসব কেরামতি নাকি আল্লাহ প্রদত্ত। যারা এসব বলে তারা চরম মিথ্যেবাদী। এরা মুশরিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাফির।

জাদু থেকে মুক্তির উপায়

জাদুকর জাদুর মাধ্যমে মানুষের নানাবিধ ক্ষতি সাধন করে থাকে। জাদুকরের কবল থেকে রাসূল (ছাঃ)ও রেহাই পাননি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জাদু করা হয়েছিল। এমনকি জাদুর প্রভাবে তাঁর কাছে এমন কিছু কাজের ধারণা হ’ত যা তিনি করেননি’। (বুখারী হা/৩১৭৫, ৩০৯৫, ৫৪৩০,  ৫৪৩৩, ৫৭১৬, ৬০২৮)।

জাদুর কুপ্রভাব কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। তবে জাদুর বিভিন্ন প্রকার ও ধরন রয়েছে।

জাদু থেকে মুক্তির জন্য করণীয়

(ক) জাদু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে করণীয় :

১. সকাল-সন্ধ্যায় ৩ বার এ দো‘আ পাঠ করা :

‘আল্লাহর নামে যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোন কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী’। (তিরমিযী হা/৩৩৮৮; ইবনে মাজাহ হা/৩৮৬৯, হাদীছ ছহীহ)।

২. প্রতি ছালাতের পর, ঘুমের সময় এবং সকাল-সন্ধ্যায় ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করা। (হাকেম ১/৫৬২; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হ/৬৫৮)।

৩. সকাল-সন্ধ্যায় ও ঘুমের সময় ৩ বার তিন কুল অর্থাৎ সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস পাঠ করা।

৪. প্রতিদিন ১০০ বার নিম্নোক্ত দো‘আ পাঠ করা: ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। (বুখারী হা/৮৪৪, ১১৫৪; মুসলিম হা/৫৯৩)।

৫. সম্ভব হলে ৭টি ‘আজওয়া’ খেজুর সকাল বেলা খালি পেটে খাওয়া। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাতটি আজওয়া খেজুর দিয়ে সকাল করবে, কোন বিষ বা জাদু সে দিনে তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।

আজ্ওয়া খেজুর দিয়ে যাদুর চিকিৎসা প্রসঙ্গে

সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকালবেলায় কয়েকটি আজ্ওয়া খুরমা খাবে, ঐ দিন রাত অবধি কোন বিষ ও যাদু তার কোন ক্ষতি করবে না।

অন্যান্য বর্ণনাকারীরা বলেছেনঃ সাতটি খুরমা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৬৮, ৫৭৬৯, ৫৪৪৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৭৬, মুসলিম হা/২০৪৭; মিশকাত হা/৪১৯০, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) জাদু সংঘটিত হওয়ার পরে করণীয় : প্রথমতঃ জাদু বের করে নষ্ট করে ফেলা, যদি এর স্থান শরী‘আত সম্মত উপায়ে জানা যায়। এটি জাদুকৃত ব্যক্তির চিকিৎসার সবচেয়ে কার্যকারী মাধ্যমগুলোর অন্যতম। (যাদুল মা‘আদ, ৪/১২৪ পৃঃ; বুখারী হা/৫৭৬৫, মুসলিম হা/২১৮৯; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৩/২২৮)।

অতঃপর শরী‘আত সম্মত রুক্বইয়া বা ঝাড়-ফুঁক করা। (ফাতহুল হাক্ক আল-মুবীন ফী ‘ইলাজিস ‘সার’ই ওয়াস সিহরি ওয়াল আইন, পৃঃ ১৩৮)।

১. ‘বিতাড়িত শয়তান হ’তে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ দো‘আ পড়ে পানিতে ফুঁক দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঐ পানি দিয়ে গোসল করানো।

পানিতে ফুঁক দিয়ে তা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি তিন বার পান করবে ও অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবে। তাতেই ইনশাআল্লাহ রোগমুক্ত হবে। যদি তা দুই বা ততোধিক বার প্রয়োজন হয়, তবে সমস্যা নেই। রোগ দূর না হওয়া পর্যন্তকরতে থাকবে। (ফাতাওয়া ইবনে বায, ৩/২৭৯; ফতহুল মাজীদ. পৃঃ ৩৪৬; ওয়াহীদ আব্দুস সালাম, আস-সারিমুল বাত্তার ফিত তাসাদ্দী লিস সাহারাতি ওয়াল আশরার, পৃঃ১০৯-১১৭; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, ১১/১৩, ইবন হাজার, ফতহুল বারী, ১০/২৩৩)।

২. সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক্ব, সূরা নাস ৩ বার পড়ে ফুঁক দিবে ও আক্রান্ত স্থানে ডান হাত দিয়ে বুলাবে। (বুখারী হা/৫০১৬; মুসলিম হা/২১৯২; ফৎহুল বারী ১০/২০৮)।

(গ) সামগ্রিকভাবে আশ্রয় লাভের কিছু দো‘আ ও ঝাড়-ফুঁক :

أَسْأَلُ اللهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ

১. আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যিনি মহান আরশের রব, তিনি যেন আপনাকে রোগমুক্ত করেন (সাতবার)। (আবূদাঊদ হা/৩১০৬; তিরমিযী হা/২০৮০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২২)।

২. রোগী তার শরীরের যে অংশে ব্যথা অনুভব করবে, সেখানে হাত রেখে তিন বার,بِاسْمِ اللهِ  ‘আল্লাহর নামে’ বলবে। অতঃপর সাতবার বলবে,

أَعُوذُ بِاللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ

‘এই যে ব্যথা আমি অনুভব করছি এবং যার আমি আশঙ্কা করছি, তা থেকে আমি আল্লাহর এবং তাঁর কুদরতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। (মুসলিম হা/২২০২)।

أَذْهِبِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ، وَاشْفِ أَنْتَ الشَّافِى، لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا-

৩. ‘হে মানুষের রব! আপনি সমস্যা দূর করে দিন। আপনি রোগ মুক্ত করে দিন। আপনিই আরোগ্য দানকারী। আপনার আরোগ্য ব্যতীত কোন আরোগ্য নেই। অতএব এমন আরোগ্য দিন, যা কোন রোগকে ছাড়বে না’। (বুখারী হা/৫৭৫০; মুসলিম হা/২১৯১)।

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ-

৪. ‘আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের আশ্রয় নিচ্ছি যাবতীয় শয়তান ও বিষধর জন্তু থেকে এবং যাবতীয় ক্ষতিকর চক্ষু (বদনযর) থেকে’ । (বুখারী হা/৩৩৭১)।

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ.

৫. ‘আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের অসীলায় আমি তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টির ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই’ । (মুসলিম হা/২১৯১)।

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِيْنِ وَأَنْ يَحْضُرُوْنِ-

৬. ‘আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্যসমূহের অসীলায় তাঁর ক্রোধ থেকে, তাঁর শাস্তি থেকে, তাঁর বান্দাদের অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা ও তাদের উপস্থিতি থেকে’। (আবুদাঊদ হা/৩৮৯৮; তিরমিযী, হা/৩৫২৮, হাদীছ হাসান)।

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ الَّتِى لاَ يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌّ وَلاَ فَاجِرٌ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَذَرَأَ وَبَرَأَ وَمِنْ شَرِّ مَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمِنْ شَرِّ مَا يَعْرُجُ فِيْهَا وَمِنْ شَرِّ مَا ذَرَأَ فِى الأَرْضِ وَمِنْ شَرِّ مَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمِنْ شَرِّ فِتَنِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمِنْ شَرِّ كُلِّ طَارِقٍ إِلاَّ طَارِقاً يَطْرُقُ بِخَيْرٍ يَا رَحْمَنُ.

৭. ‘আমি আল্লাহর ঐ সকল পরিপূর্ণ বাণী সমূহের সাহায্যে আশ্রয় চাই, যা কোন সৎলোক বা অসৎলোক অতিক্রম করতে পারে না। আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্বে এনেছেন এবং তৈরী করেছেন তার অনিষ্ট থেকে আসমান থেকে যা আসে তার অনিষ্ট থেকে, যা আকাশে উঠে তার অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবীতে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসে তার অনিষ্ট থেকে; দিন-রাতে সংঘটিত ফিৎনার অনিষ্ট থেকে, আর রাত্রিবেলা হঠাৎ করে আগত অনিষ্ট থেকে, তবে রাতে আগত যে বিষয়ে কল্যাণ নিয়ে আসে তা ব্যতীত, হে দয়াময়’! (মুসনাদ আহমাদ হা/১৫৪৬১; ছহীহাহ ৭/১৯৬)।

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ وَرَبَّ الأَرْضِ وَرَبَّ كُلِّ شَىْءٍ فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى مُنَزِّلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ ذِى شَرٍّ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَىْءٌ.

৮. ‘হে আল্লাহ! হে আসমান সমূহের রব, যমীনের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব ও প্রত্যেক বস্তুর রব! হে শস্য-বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী! হে তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন নাযিলকারী! আমি প্রত্যেক এমন বস্তুর অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, যার মাথার অগ্রভাগ আপনি ধরে রেখেছেন (নিয়ন্ত্রণ করেছেন)। হে আল্লাহ! আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছুই ছিল না। আপনিই সর্বশেষ আপনার পরে কোন কিছু থাকবে না। আপনি সব কিছুর উপরে, আপনার উপরে কিছুই নেই। আপনি সর্বনিকটে, আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কিছু নেই’। (মুসলিম হা/২৭১৩)।

بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيْكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ

৯. ‘আল্লাহর নামে আমি তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি ঐসব বস্তু থেকে যা তোমার ক্ষতি করে আর হিংসুক আত্মা বা বদ নযরের অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ তোমাকে রোগ মুক্ত করুন। আল্লাহর নামে আমি তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি’। (মুসলিম হা/২১৮৬)।

بِاسْمِ اللهِ يُبْرِيكَ وَمِنْ كُلِّ دَاءٍ يَشْفِيكَ وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ وَشَرِّ كُلِّ ذِى عَيْنٍ.

১০. ‘আল্লাহর নামে, তিনি তোমাকে সুস্থ করবেন। তিনি তোমাকে মুক্ত করবেন সব রোগ থেকে, সব হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে, আর সব বদনযরকারীর অনিষ্ট থেকে’। (মুসলিম হা/২১৮৫)।

بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيْكَ مِنْ حَسَدِ حَاسِدٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ اللهُ يَشْفِيكَ.

১১. ‘আল্লাহর নামে তোমার ঝাড়-ফুঁক করছি ঐসব বস্তু থেকে, যা তোমার ক্ষতি করে। কোন হিংসুকের হিংসা থেকে, আর সকল বদ নযর থেকে। আল্লাহ তোমাকে রোগমুক্ত করুন’। (ইবনু মাজাহ হা/৩৫২৭ সনদ ছহীহ)।

এসব দো‘আ ও ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে জাদু, বদ নযর জিনের আছর ও সকল রোগের চিকিৎসা করা যায়। কেননা আল্লাহর রহমতে এগুলো সামগ্রিকভাবে উপকারী ঝাড়-ফুঁক।

(ঘ) প্রাকৃতিক ঔষধ :

কিছু উপকারী প্রাকৃতিক চিকিৎসা হ’ল মধু  (নাহল ১৬/৬৯)।

কালো জিরা (বুখারী হা/৫৬৮৭-৮৮; মুসলিম হা/২২১৫; মিশকাত হা/৪৫২০)।

ও যমযম পানি, (ইবনু মাজাহ হা/৩০৬২; ছহীহাহ হা/৮৮৩, ১০৫৬)।

যয়তুন তেল। কেননা নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা যয়তুন তেল খাও এবং তা মাখ। কেননা তা এক বরকতময় গাছ থেকে তৈরি’। (আহমদ হা/১৬০৫৫; তিরমিযী হা/১৮৫১; সনদ ছহীহ)।

জিন ধরা রোগীর ঝাড়-ফুঁক

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘যারা সূদ ভক্ষণ করে, তারা (ক্বিয়ামতের দিন) দাঁড়াতে পারবে না জ্বিনে ধরা রোগীর ন্যায় ব্যতীত’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।

নবী করীম (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে বলেন, ‘গত রাত্রে একজন দুষ্ট জিন হঠাৎ করে এসে আমার ছালাত নষ্ট করতে চেয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধরার জন্য আমাকে শক্তি দান করেন। আমি তাকে মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার ইচ্ছা পোষণ করি, যাতে করে তোমরা সবাই সকালে তাকে দেখতে পাও। কিন্তু আমার ভাই সুলাইমান (আঃ)-এর কথা-  ‘আর আমাকে এমন রাজত্ব দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)  স্মরণ করে ছেড়ে দিয়েছি। আর তাকে নিরাস করে ভাগিয়ে দিয়েছি’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৩৪২৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট একজন পাগল বাচ্চাকে নিয়ে আসা হ’লে তিনি বলেন, আল্লাহর দুশমন বের হও! আমি আল্লাহর রাসূল। রাবী বলেন, এরপর বাচ্চাটি আরোগ্য লাভ করে’। (আহমাদ হা/১৭৫৪৯, ১৭৫৫৯, ১৭৫৬৩, ১৭৫৬৪, ১৭৫৬৫)।

ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, মানুষের উপর জিন আছর করে বা তার মাঝে প্রবেশ করে। এটা মুসলমানদের কেউ অস্বীকার করে না। বরং এটা আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বীদা। আর যে অস্বীকার করে সে শরী‘আতকে মিথ্যারোপ করে। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২৪/২৭৬-২৭৭)।

জিনের আছরের কিছু আলামত

জিনে ধরা মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। একাকী কথা বলে। উপসর্গ ছাড়াই তার বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

জিনের আক্রমণ থেকে বাঁচার ঝাড়-ফুঁক

সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক্ব, সূরা নাস ৩ বার পড়ে ফুঁক দিবে ও আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে হাত দিয়ে বুলাবে। (বুখারী হা/৫০১৬; মুসলিম হা/২১৯২; ফৎহুল বারী ১০/২০৮)।

এগুলো পড়ে পানিতে ফুঁক দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে খাওয়ানো ও গোসল করানো যায়।

জিন ছাড়ানোর ভিন্ন কৌশল

অভিজ্ঞতার আলোকে জিন, পরী, ভূত, পেত্নি ও রাক্ষস ছাড়ানোর কিছু তন্ত্র মন্ত্র আলোচনা করবো। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ভূত, পেত্নি ও রাক্ষস বলতে কিছু নেই। দুষ্ট জিনেরাই পরিবেশভেদে ভিন্নরুপ ধারণ করে থাকে। যাই হোক, এখানে যে পদ্ধতি বা কৌশল আলোচনা করবো তা হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই।

(ক)  আপনি বাড়ি বা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনবার আয়াতুল কুরসী পড়ে নিজের শরীরে তিনটি ফুঁ দিবেন।

(খ) এক মুষ্ঠি বালু হাতে নিয়ে তিনবার আয়াতুল কুরসী পড়ে বালুতে তিনবার ফুঁ দিবেন। এরপর ঐ বালুগুলো নিজ বাড়ীর চতুর্দিকে ছুড়ে মারবেন। তাহলে নিজ শরীর ও বাড়ী বন্ধ হবে। জিন এসে পাল্টা আপনাকে ও বাড়ীর অন্য কারো ক্ষতি করতে পারবে না। আয়াতুল কুরসীর সাথে সুরা ইয়াছিনের প্রথম মুবিন, সুরা ফালাক্ব ও সুরা নাস পড়া যেতে পারে।

(গ) জিনে ধরা রোগীর কাছে গিয়ে প্রথমে এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়াতুল কুরসী-তিনবার, সুরা ইয়াছিনের প্রথম মুবিন-একবার,  সুরা ফালাক্ব-তিনবার, সুরা নাস-তিনবার ও সুরা ফাতিহা-সাতবার পড়ে পানিতে ফুঁ দিবেন। এরপর এই পানি রোগীকে পার করতে দিবেন। রোগী যদি পান করে তাহলে জিনে আছর করে নাই বুঝতে হবে।

এখন আপনাকে বুঝতে হবে, রোগী কি নতুন বিবাহিত স্ত্রী লোক বা পুরুষ? অনেক সময় মহিলারা স্বামী পছন্দ না হলে জিনে ধরা রোগীর মতো আচরণ করে। সেক্ষেত্রে রোগীকে বসিয়ে শুকনো মরিচে আগুন ধরিয়ে মরিচের ঝাঁঝালো ধোয়া রোগীর নাকের সামনে ধরবেন। শুধু একবার নাকের মধ্যে গেলেই জিন পালাবে। অনেকে গরুর শুকনো হাড় পুড়িয়েও তার ধোয়া নাকের সামনে ধরে।

আর যদি পানি পান না করে পানি মুখে নিয়ে আপনার দিকেই কুলি করে দেয় বা গ্লাস হাতে নিয়ে ফেলে দেয় অথবা দৌঁড় দিয়ে পালাতে চায় তখন বুঝতে হবে জিন ধরেছে বা জিনে আছড় করেছে।

তখন আপনি সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক্ব, সূরা নাস ৩ বার পড়ে ফুঁক দিতে হবে ও আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে হাত দিয়ে বুলাতে হবে। তবে মহিলা হলে গায়ে হাত দেয়া যাবে না।

অধিকাংশ হুজুরই জিন ছাড়ানোর পর রোগীকে কয়েক প্রকার তাবিজ দিয়ে থাকে। অনেকে রোগীর ঘর বা বাড়ীর চতুর্দিকে তথা চার কোণায় বাঁশ পুতে আবার বাঁশের মাথায় মাটির হাড়ি বা মাটির ঢাকনায় তাবিজ লিখে লটকিয়ে রাখে। অনেকের দরজায় হরেক রকমের তাবিজ ঝুলতে দেখা যায়। এসব করা শিরক। হাদিসে এসব কর্মকান্ডের কোনো ঘটনা উল্লেখ নেই।

প্রকৃত ইমানদার মুত্তাকি আলেম হলে আর তিনি ঐসব সুরা পড়ে ফুক দিয়ে যদি জিনকে হুকুম করে বলেন যে, আজ থেকে এই এলাকায় আর আসবি না, জিন আর আসবে না।

ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ

ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ। ঝাড়-ফুঁককারী রোগীর নিকট থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারবেন। (মুসলিম হা/৫৮৬৩)।

ইসলামী শরী‘আতে ঝাড়-ফুঁক বৈধ যদি তা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা করা হয় এবং পদ্ধতি শিরক-বিদ‘আত মুক্ত হয়। বর্তমানে অধিকাংশ ঝাড়-ফুঁককারীই শিরকের মাধ্যমে এসব করে থাকে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন- আমীন!

ভুনা বকরীর মাংসে বিষ প্রয়োগ এর ঘটনা

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খাইবার যখন বিজয় হয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হাদীয়া স্বরূপ একটি (ভুনা) বকরী পাঠানো হয়। এর মধ্যে ছিল বিষ। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এখানে যত ইয়াহূদী আছে আমার কাছে তাদের একত্রিত কর। তাঁর কাছে সকলকে একত্র করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উদ্দেশে বললেনঃ আমি তোমাদের নিকট একটি ব্যাপারে জানতে চাই, তোমরা কি সে বিষয়ে আমাকে সত্য কথা বলবে?

তারা বললঃ হাঁ, সে আবুল কাসিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাদের পিতা কে? তারা বললঃ আমাদের পিতা অমুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা মিথ্যে বলেছ বরং তোমাদের পিতা অমুক। তারা বললঃ আপনি সত্য বলেছেন ও সঠিক বলেছেন। এরপর তিনি বললেনঃ আমি যদি তোমাদের নিকট আর একটি প্রশ্ন করি, তাহলে কি তোমরা সেক্ষেত্রে আমাকে সত্য বথা বলবে? তারা বললঃ হাঁ, হে আবুল কাসিম যদি আমরা মিথ্যে বলি তবে তো আপনি আমাদের মিথ্যা জেনে ফেলবেন, যেমনিভাবে জেনেছেন আমাদের পিতার ব্যাপারে।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেনঃ জাহান্নামী কারা? তারা বললঃ আমরা সেখানে অল্প কয়দিনের জন্যে থাকব। তারপর আপনারা আমাদের স্থানে যাবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরাই সেখানে অপমানিত হয়ে থাকবে। আল্লাহর কসম! আমরা কখনও সেখানে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত হবো না। এরপর তিনি তাদের বললেনঃ আমি যদি তোমাদের কাছে আর একটি বিষয়ে প্রশ্ন করি, তবে কি তোমরা সে বিষয়ে আমার কাছে সত্য কথা বলবে? তারা বললঃ হাঁ।

তখন তিনি বললেনঃ তোমরা কি এ ছাগলের মধ্যে বিষ মিশিয়েছ? তারা বললঃ হাঁ। তিনি বললেনঃ কিসে তোমাদের এ কাজে প্রেরণা যুগিয়েছে? তারা বললঃ আমরা চেয়েছি, যদি আপনি মিথ্যাচারী হন, তবে আমরা আপনার থেকে রেহাই পেয়ে যাব। আর যদি আপনি সত্য) নবী হন, তবে এ বিষয় আপনার কোন ক্ষতি করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৭৭৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৬৯, আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫২৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিষ পান করা, বিষের সাহায্যে চিকিৎসা করা, ভয়ানক কিছু দ্বারা চিকিৎসা করা যাতে মারা যাবার আশঙ্কা আছে এবং হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করা

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)-৫৭৭৮, ১৩৬৫; সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৪৬০, মুসলিম ১০৯, তিরমিযী ২০৪৪, ২০৪৩, নাসায়ী ১৯৬৫, আবূ দাউদ ৩৮৭২, আহমাদ ৭৩৯৯, ৯৮৩৯, ৯৯৬৪, দারেমী ২৩৬২, গায়তুল মারাম ৪৫৩, আধুনিক প্রকাশনী ৫৩৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫২৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

দু’ মুখো সাপ নিধন

(ক) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'মুখো সাপ নিধনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা এই নিকৃষ্ট সাপ দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে এবং গর্ভপাত ঘটায়।

(সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৩৪, সহীহুল বুখারী ৩৩০৮, মুসলিম ২২৩২, আহমাদ ২৩৬৯৯, ২৩৭৩৪, ২৪০১৪, ২৪৫০৪, ২৪৬১৮, ২৫৪০৭, মুয়াত্তা মালেক ১৮২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  সালিম (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা সাপ মেরে ফেলো, বিশেষত দু'মুখো সাপ এবং লেজবিহীন সাপ! কেননা এ দু’টি সাপ দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে এবং গর্ভপাত ঘটায়। 

(সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৩৫, সহীহুল বুখারী ৩২৯২, ৩৩১১, ৩৩১৩, মুসলিম ২২৩৩, আবূ দাউদ ৫২৫২, আহমাদ ৪৫৪৩, ৫৯৮৯, আল-কালিমুত তায়্যিব ২৪৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সাপের খেলা, ওঝা ও তাবিজ বিক্রি

আমাদের দেশে বেদে নামের একটা জাত আছে তাদের মহিলাগণ গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দর বা পাড়ায় পাড়ায় সাপের খেলা দেখায় আর মাদুলিতে ভরে তাবিজ বিক্রি করে। এছাড়াও  এলাকা ভিত্তিক কিছু সাপুড়ে আছে তারা বিভিন্ন হাট বাজারে সাপের খেলা দেখায় ও মাদুলিতে ভরে তাবিজ বিক্রি করে। এসব তাবিজের মধ্যে অনেকে কাগজে লেখা নকশা বা গাছের ছোট ছোট টুকরা মাদুলিতে ভরে তাবিজ হিসেবে বিক্রি করে। এরা বলে যে, এসব তাবিজ কাছে থাকলে সাপ দংশন করবে না বা দংশন করলেও সাপের বিষ উঠবে না। একসময় এগুলো ব্যাপক বিক্রি হতো। এখন ডিজিটাল যুগ এসে এসব কেউ আর বিশ্বাস করে না। দেখা যায় যে, সাপুড়ে বা ওঝা সাপের বিষ নামাতে গিয়ে সেই ওঝা সাপের দংশনেই  মারা গেছে।

যারা সাপুড়ে বা ওঝা এরা হিন্দুদের সাপের দেবতা পদ্মার নামের শত শত মন্ত্র মুখস্থ করেছে। মূলত সাপের বিষ নামাতে এরা এই পদ্মার জারি গেয়ে বিষ ঝাড়ে। এই মন্ত্রগুলোর মধ্যে শিরক ও কুফরি মিশ্রিত কথা আছে। তাই একজন মুসলমান এগুলো পাঠ করতে পারে না। তবে একটা কথা মনে রাখতে, বিষধর সাপ দংশন করলে ওঝার কোনো তন্ত্র মন্ত্রই কাজ করবে না। এইসব গ্রাম্য ঝাড় ফুক ও কবিরাজি চিকিৎসার উপর ভরসা না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।

তাবীজ এর ব্যবহার

তাবিজ ঝুলানো/ব্যবহার করা স্পষ্ট শির্ক।

(ক) আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর স্ত্রী যাইনাব (রাঃ) আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যাদু, তাবীজ ও অবৈধ, প্রেম ঘটানোর মন্ত্র শির্ক-এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি (যাইনাব) বলেন, আমি বললাম, আপনি এসব কি বলেন? আল্লাহর কসম! আমার চোখ থেকে পানি পড়তো, আমি অমুক ইয়াহুদী কর্তৃক ঝাড়ফুঁক করাতাম।

সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করলে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, এগুলো শয়তানের কাজ। সে নিজ হাতে চোখে যন্ত্রণা দেয়, যখন সে ঝাড়ফুঁক দেয় তখন সে বিরত থাকে। এর চেয়ে বরং তোমার জন্য এরূপ বললেই যথেষ্ট হতো, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ ‘‘হে মানবজাতির রব! যন্ত্রণা দূর করে দিন, আরোগ্য দান করুন, আপনি আরোগ্যদাতা, আপনার দেয়া নিরাময়ই যথার্থ নিরাময়, যার পরে আর কোনো রোগ বাকী থাকে না। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (খ) ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কেবল বদনযর লাগা কিংবা বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে চিকিৎসায় ঝাড়ফুঁক দেয়া যায়।

(সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮৪, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৫৭,আহমাদ ১৯৯০৮, তিরমিযী ২০৫৭, ইবনু মাজাহ ৩৫১৩, সহীহুল জামি ৭৪৯৬, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৩৫৩৭, ইমাম বুখারী মাওকূফভাবে বর্ণনা করেছেন ৫৭০৫, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ১৪৯৮৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ১৪৪৯, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ২০০২৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদিসটি প্রমাণ করে, ঝাড়ফুঁক ব্যতীত কোনো তাবিজ দেয়া যাবে না।

(গ) ঈসা ইবনু আবদুর রাহমান ইবনু আবূ লাইলা (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু উকাইম আবূ মা’বাদ আল-জুহানীর অসুস্থ অবস্থায় তাকে দেখতে গেলাম। তিনি বিষাক্ত ফোঁড়ায় আক্রান্ত ছিলেন। আমি বললাম, কিছু তাবিজ-তুমার ঝুলিয়ে রাখছেন না কেন? তিনি বললেন, মৃত্যু তো এর চেয়েও নিকটে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক কোনকিছু ঝুলিয়ে রাখে (তাবিজ-তুমার) তাকে তার উপরই সোপর্দ করা হয়। (সহীহ, গাইয়াতুল মারাম (২৯৭)।

আবূ ঈসা বলেন আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু উকাইমের হাদিসটি শুধুমাত্র মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান-এর সূত্রেই জেনেছি। আবদুল্লাহ ইবনু উকাইম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল পেলেও তার কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ করতে পারেননি। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে চিঠি লিখেন।

মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার-ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ হতে, তিনি ইবনু আবূ লাইলা (রহঃ)-এর সূত্রে উক্ত মর্মে একইরকম হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবূ ঈসা বলেনঃ উকবা ইবনু আমির (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ২০৭২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৫৬, তিরমিযী ২০৭২, আহমাদ ১৮৮০৩, আল মুসতাদরাক ৭৫০৩, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ২০০৯৭, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৪৫৬, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৩৪৭৪)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবদুল্লাহ (রাঃ)-র স্ত্রী যয়নব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক বৃদ্ধা আমাদের একানে আসতো এবং সে চমপ্রদাহের ঝাড়ফুঁক করতো। আমাদের একটি লম্বা পা-বিশিষ্ট খাট ছিল। আবদুললাহ (রাঃ) ঘরে প্রবেশের সময় সশব্দে কাশি দিতেন। একদিন তিনি আমার নিকট প্রবেশ করলেন। সে তার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে একটু আড়াল হলো। তিনি এসে আমার পাশে বসলেন এবং আমাকে স্পর্শ করলে এক গাছি সুতার স্পর্শ পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? আমি বললাম, চর্মপ্রদাহের জন্য সূতা পড়া বেঁধেছি। তিনি সেটা আমার গলা থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেললেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, আবদুল্লাহর পরিবার শিরকমুক্ত হলো।

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ‘‘মন্ত্র, রক্ষাকবচ, গিটযুক্ত মন্ত্রপূত সূতা হলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত’’। আমি বললাম, আমি একদিন বাইরে যাচ্ছিলাম, তখন অমুক লোক আমাকে দেখে ফেললো। আমার যে চোখের দৃষ্টি তার উপর পড়লো তা দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। আমি তার মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলে তা থেকে পানি ঝরা বন্ধ হলো এবং মন্ত্র পড়া বন্ধ করলেই আবার পানি পড়তে লাগলো। তিনি বলেন, এটা শয়তানের কাজ। তুমি শয়তানের আনুগত্য করলে সে তোমাকে রেহাই দেয় এবং তার আনুগত্য না করলে সে তোমার চোখে তার আঙ্গুলের খোঁচা মারে। কিন্তু তুমি যদি তাই করতে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছিলেন, তবে তা তোমার জন্য উপাকারী হতো এবং আরোগ্য লাভেও অধিক সহায়ক হতো।।

তুমি নিন্নোক্ত দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা তোমার চোখে ছিটিয়ে দাওঃ

‘‘আযহিবিল বাস রব্বান নাস, ইশফি আনতাশ শাফী, লা শিফাআ ইল্লা শিফাউকা শিফাআন লা ইউগাদিরু সাকামান’’

(হে মানুষের প্রভু! কষ্ট দূর করে দাও, আরোগ্য দান করো, তুমিই আরোগ্য দানকারী, তোমার আরোগ্যদান ছাড়া আরোগ্য লাভ করা যায় না, এমনভাবে আরোগ্য দান করো যা কোন রোগকে ছাড়ে না)। (সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫৩০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৫২, আবূ দাউদ ৩৮৮৩, আহমাদ ৩৬০৪, সহীহাহ ৩৩১, গায়াতুল মারাম ২৯৯, তাখরীজুল ঈমান লি ইবনুস সালাম ৮১,  আবু দাউদ ৩৮৮৩, ৩৬০৪, মু'জামুল আওসাত ১৪৪২, শারহুস সুন্নাহ ৩২৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) উকবা বিন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:  “যে তামিমাহ ঝুলালো, আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দেবেন না, আর যে শঙ্খ ঝুলালো আল্লাহ তাকে নিরাপত্তা দিবেন না”।  (আহমদ: (১৬৯৫১), হাকেম: (৪/২১২), মুসনাদে আবি ইয়ালা আল-মুসিলি: (১৭৫৯)।

( তামিমার সংজ্ঞাঃ রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ অথবা বদ-নজর প্রতিরোধ অথবা সম্ভাব্য কোনো অনিষ্ট দূর করার জন্য শরীরে ঝুলানো বস্তুকে তামিমাহ বলা হয়, হোক সেটা কড়ি, অথবা লাকড়ি, অথবা তাগা, অথবা কাগজ কিংবা কোনো বস্তু। ইসলাম পূর্বযুগে বদ-নজর থেকে সুরক্ষা এবং গৃহ-পালিত পশু-পাখী ও দুষ্ট প্রাণীকে বশ করার জন্য, কখনো আত্মরক্ষার জন্য মুশরিকরা তামিমাহ গলায় বা শরীরের কোনো অংশে ঝুলাত। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাকদির প্রতিরোধ ও অনাগত অনিষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখে তামিমাহ।

তারা কখনো তামিমাহ দ্বারা গায়রুল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করত, যা ছিল সরাসরি শিরক ও তাওহীদ পরিপন্থী। ইসলাম তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে)।

(চ) তাবিজ ও তিওয়ালাহ (আসমায়ি বলেন: তিওয়ালাহ: একপ্রকার যাদু, স্বামীর নিকট স্ত্রীকে প্রিয় করার জন্য যার ব্যবহার করা হয়। মোল্লা আলি কারি বলেন: ‘তিওয়ালাহ’ একপ্রকার যাদু, অথবা যাদুর মন্ত্র পাঠ করা তাগা, অথবা কাগজ, তাতে মহব্বত সৃষ্টির মন্ত্র পাঠ করা হয়। আউনুল মাবুদ, হাদিস নং: (৩২৭২)।

নিঃসন্দেহে শিরক”। (আবু দাউদ: (৩৮৮৩), আহমদ: (৩৬০৪), ইবনে হিব্বান: (৬০৯০), ইবনে মাজাহ: (৩৫৩০), সহি হাদিস সমগ্র: (১৩১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এসব দলিল বলে, রোগ-ব্যাধি দূর বা প্রতিরোধ করার জন্য মানুষ বা জীব-জন্তুর শরীরে, কিংবা ক্ষেত-খামারে তাবিজ, তাগা, কড়ি ও সুতা ইত্যাদি ব্যবহার করা শিরক। কারণ, তামিমাহ ও তামিমাহ জাতীয় বস্তুর উপর নিষেধাজ্ঞার হাদিসগুলো ব্যাপক, তাই সবধরণের তাবিজ শিরক। কুরআন/ গায়রে কুরআন কোনো বিভেদ নেই।

দ্বিতীয়ত যেসব দলিলে তাবিজের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাতে কুরআন-হাদিসের তাবিজ বৈধ বলা হয়নি, যেমন শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুঁক বৈধ বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আওফ ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা জাহিলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। অতঃপর আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেনঃ তোমাদের ঝাড়ফুকের ব্যবস্থাগুলো আমার সামনে পেশ করো; তবে যেসব ঝাড়ফুঁক শির্কের পর্যায়ে পড়ে না, তাতে কোনো দোষ নেই। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৩৮৮৬, সুনান ইবনু মাজাহ, ৩৫১৫, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৪৫৩০, মুসলিম ২১৯৮, সহীহাহ ৪৭৩, ইবনে হিব্বান: (৬০৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ হাদিসে যেরূপ কুরআনুল কারিমের তাবিজকে পৃথকভাবে বৈধ বলা হয়নি, যেমন শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুককে বৈধ বলা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু

‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদের জীবনে তাবিজের কোনো প্রমাণ নেই।

হাদিসের পাঠকমাত্র দেখবে, দোয়া ও যিকর সংক্রান্ত সকল হাদিসের ভাষা হচ্ছে, ‘যে ইহা বলবে’, অথবা ‘যে ইহা পড়বে’ ইত্যাদি; একটি হাদিসেও নেই ‘যে ইহা লিখে রাখবে’, অথবা ‘যে ইহা ঝুলাবে’। ইবনে আরাবি বলেন: “কুরআন ঝুলানো সুন্নত নয়, কুরআন পাঠ করা সুন্নত”।

ইব্রাহিম নখয়ি রহ. বলেন, “আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের সাথীগণ কুরআন ও গায়রে কুরআন সর্বপ্রকার তাবিজ অপছন্দ করতেন,

যেমন আলকামা, আসওয়াদ, আবু ওয়ায়েল, মাসরুক ও রাবি বিন খায়সাম প্রমুখ তাবেয়িগণ”। (ফতহুল মজিদ)।

শিরক ও পাপের পথ বন্ধ করার স্বার্থে সকল তাবিজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। কুরআনের তাবিজ শিরকী তাবিজের পথ উন্মুক্ত করে। আদর্শ মনীষীগণ তাবিজ অপছন্দ করতেন, অথচ তাদের যুগ ছিল বিদআত ও শিরক মুক্ত, ওহী ও ঈমানের নিকটবর্তী। আমাদের যুগ মূর্খতা ও বিদআত সয়লাবের যুগ, এতে তাবিজ বৈধ বলার অর্থ উম্মতকে শিরকের দিকে ঢেলে দেওয়া।

দ্বিতীয়ত তাবিজে ব্যবহৃত কুরআন নাপাক বস্তু বা স্থানের সম্মুখীন হয়, বিশেষত বাচ্চাদের গলার তাবিজ, যা থেকে কুরআনকে পবিত্র রাখা জরুরি। তাবিজ ব্যবহারকারীরা সাধারণত কুরআন-হাদিসের ঝাড়-ফুঁক করে না, তাবিজকেই যথেষ্ট ভাবে। তাদের অন্তর তাবিজের সাথে ঝুলন্ত থাকে,

যদিও তারা স্বীকার করে না, তবে তাবিজ খুললে তার সত্যতা প্রকাশ পায়! কারো চেহারা বিবর্ণ হয়, কারো শরীরে কাঁপুনি উঠে। যদি তাদের অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত থাকত ও তাতে পূর্ণ বিশ্বাসী হত, কখনো তারা মন এমন বস্তুর দিকে ধাবিত হত না, যার সম্পর্ক কুরআন-হাদিসের সাথে নেই। বস্তুত তাবিজ ব্যবহার করে তারা কুরআনের সাথে নয়, বরং কাগজ ও জড় বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত হয়। তাবিজ একটি জড়-বস্তু, তার সাথে রোগ-মুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। তাবিজকে রোগ মুক্তির উপায় সাব্যস্ত করার জন্য অবশ্যই দলিল প্রয়োজন, তার পক্ষে কোনো শরীয় দলিল নেই। কারো রোগ-ব্যাধি হলে শরয়ী ঝাড়-ফুঁক করা সুন্নত, যেমন জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের করেছেন। এটাই বৈধ ও শরীয়ত অনুমোদিত পন্থা। বৈধ ঝাড়-ফুঁকের বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ, যদি তার দ্বারা আরোগ্য লাভ হয় এবং সুন্নত মোতাবেক ঝাড়-ফুঁক করা হয়; যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ বিনিময় গ্রহণ করেছেন, কিন্তু আমাদের সমাজের একশ্রেণীর আলেম তাবিজ দেন ও আরোগ্য লাভের পূর্বে বিনিময় গ্রহণ করেন। তারাও দলিল হিসেবে বুখারি হতে হাদিসটি পেশ করেন, অথচ সেখানে স্পষ্ট আছে সাহাবিগণ তাবিজ দেননি, বরং সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন এবং আরোগ্য লাভ করার পর বিনিময় গ্রহণ করেছেন, আগে নয়। অতএব এ হাদিসকে তাবিজ দেয়া ও তার বিনিময় গ্রহণ করার দলিল হিসেবে পেশ করা অপব্যাখ্যা ব্যতীত কিছু নয়।

“তাবিজ ব্যবহার করা শিরক তবে ঝাড়ফুক জায়েজ” এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন। (তাবিজ)

রত্নপাথর/আংটির ব্যবহার

যারা বড় লোক বা কোটিপতি তারা হীরা, চুনি, পান্না, নীলাসহ খুব দামী দামী পাথরের আংটি ব্যবহার করে থাকে। আর যারা গরিব তারা বড়জোর রাস্তার ধারে বসে থাকা তাবিজ ব্যবসায়ীর নিকট থেকে অস্টধাতুর আংটি ২০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে শখ মিটায়। এসব আংটি ব্যবহার করলে নাকি অর্থ সম্পদ বাড়ে, রতি শক্তি বাড়ে, সকল প্রকার বিপদ আপদ কেটে যায়। যাই হোক অনেককে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নামী দামী পাথর কিনে ব্যবহার করতে দেখা য়ায়। আসলে এসব পাথর এর প্রতি বিশ্বাস করা ও এগুলোর মাধ্যমে কাজ হাসিল হওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুল সা. একটি রুপার আংটি ব্যবহার করতেন তবু সেটি সিল মোহর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাই হোক, পাথরে এ করে সে করে এরুপ বিশ্বাস করা শিরক। পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই। এখানে বিভিন্ন পাথরের গুণাগুণ তুলে ধরা হলো যা পাথর বিক্রেতাগণ প্রচার করে থাকে।

রত্ন পাথরের বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুণ (Benefits of Using Gemstone)

সুখের পাশাপাশি মানুষের জীবনে রয়েছে দুঃখ। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও। সবাই চায় জীবনে সুখী হতে, সফলতা পেতে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। এই  নেতিবাচক পরিস্থিতিকে এড়াতে কেউ কেউ গ্রহণ করেন বিভিন্ন রত্ন পাথর। এর মাধ্যমে হাসিল করতে চান সাফল্য। সফলতা ও ব্যর্থতা আসলে মানুষের নিজ হাতেই। তারপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব রত্ন পাথর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে একটি বিশ্বাসের প্রচলন আছে দুনিয়ায়। এসব পাথর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানতে হয় কিছু দিকনির্দেশনা। আর জানা দরকার রত্ন পাথরেরও নর ও নারী লিঙ্গভেদ আছে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য নারী ও নারীদের জন্য নর শ্রেণীর রত্ন পাথর প্রযোজ্য। ব্যবহারে ঠিকমতো সমন্বয় ঘটলে ফল মেলে। বদলে যেতে পারে মানুষের ভাগ্য। কেউ কেউ এসব রত্ন পাথর ধারণ করে রাতারাতি সাফল্য চান। তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ অনেক সময় এসব রত্ন পাথরের উপর গ্রহ নক্ষত্রের শুভ-অশুভ প্রভাব বিরাজমান। কষ্টি বিচারের সময় দুর্বল লগ্নপতি, রাশিপতি অথবা গ্রহের দৃষ্টিচক্র বিবেচনা ও সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে এক বা সর্বোচ্চ দু’টি যথোপযুক্ত রত্ন পাথর নির্বাচন করা উচিত। আর কারও কষ্টি না থাকলে রত্ন পাথর নির্বাচন করতে হবে হস্তরেখা বিচার করে। নিম্নে বিভিন্ন রত্নপাথরের কার্যকারিতা বা গুণ পত্রস্থ হলো—

রত্ন পাথরের গুনাগুন ও উপকারিতা নিম্নরূপ:

পোখরাজঃ (Yellow Sapphire)

পোখরাজ বৃহস্পতি গ্রহের রতন এক ধরনের স্বচ্ছ ও সুন্দর রত্ন। অনেক সময় সৌন্দযের কারণে এ পাথর কে পুষ্পরাগ মণিও বলা হয়। তবে সামান্য হলুদ রঙের পোখরাজ গুন ও অভিজাতের দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত। অনেক সময় পোখরাজ রত্নের ভেতরে কাটা দাগ বা চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। স্বর্ণ যাচাইয়ে কষ্টিপাথর আস্তে আস্তে ঘষলে পোখরাজের উজ্জ্বলতা কমে যায়। পোখরাজ ব্যবহারে জাতক/জাতিকার কর্মদক্ষতা, কর্মপটুতা, উৎসাহী কেতৃত্ব, যশ-খ্যাতি, বুদ্ধি ইত্যাদি বাড়ে। বৃহস্পতি গ্রহকে সতেজ রাখে। যারা জীবনের বিভিন্ন পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত হীনতায় ভোগেন, তাদের জন্য পোখরাজ খুবই উপকারী।

পান্না পাথর (Emerald Stone)

পান্না বুধ গ্রহের রত্ন। রাসায়নিক উপাদান অ্যালুমিনিয়াম-বেরিলিয়াম-সিলপেটের সংমিশ্রণে খণিজ পান্নার উৎপত্তি ও সৃষ্টি। পান্না পাথর ব্যবহারে শত্রুতা হ্রাস পায়। সর্বক্ষেত্রে উন্নতি ও যোগাযোগ বাড়ে। মানসিক অস্থিরতা কমে। কর্মপটুতা, বিচক্ষণতা, ব্যবসাহিক উন্নতি হয়। কোন জাতক/জাতিকার জন্ম চকে বুধ গ্রহ অশুভ থাকলে কিডনি সংক্রান্ত, অর্শ, ভগন্দর রোগের উৎপত্তির হলে পান্না ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়।

গোমেদ পাথর (Garnet Stone)

রাহুর অশুভ প্রভাবমুক্ত থাকলে গোমেদ ব্যবহার করা হয়। গোমেদ ব্যবহারে যশ বৃদ্ধি, শ্ত্রুতা মুক্ত, পারিবারিক জীবনে শান্তি আসে। মামলা-মোকাদ্দমা ও ঋণমুক্ত থাকা যায়। কোন জাতক/জাতিকারা জন্ম চকে বাহুর কু-দৃষ্টি থাকলে সে ব্যাক্তি নিম্ন লিখিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন জয়েন্ট বেদনা, আজে বাজে দুঃখ, যকৃতের রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুদা মন্দা ইত্যাদি ঐ রকম জাতক/জাতিকারা হাতের কজির উপর গোমেদ ব্যবহার করলে প্রচুর উপকার পাওয়া যাবে।

প্রবাল পাথর (Red Coral Stone)

স্বাস্থ্যগত কারণে প্রবাল বেশি ব্যবহার করা হয়। প্রবাল দলবদ্ধ হয়ে বাস করা এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। কোটি কোটি এই প্রাণী এক সঙ্গে বাস করে ও মৃত্যুর পর তাদের দেহ জমাট বেঁধে এই প্রবাল পাথরের সৃষ্টি করা হয়। প্রবাল একটি অস্বচ্ছ পাথর । টকটকে লাল রঙের প্রবাল কে বলে রক্ত প্রবাল, কমলা রঙের প্রবালকে বলে পলাশ প্রবাল, সবুজ রঙের প্রবালকে বলে সবুজ প্রবাল, লাল ও সবুজ রঙ এক সাথে মেশালে বলে মেটে প্রবাল, দুধের মতো সাদা ধবধবে প্রবাল কে শ্বেত প্রবাল। যে সমস্ত মেয়েরা জরায়ু সমস্যার ভূগতেছেন শ্বেতপ্রবাল আংটি ও লকেট করে ব্যবহার করলে উপকার পাবেন। যাদের পুরাতন আমাশয় বা পাকস্থলির সমস্যা বা রক্ত দুষিত রোগ আছে তারা রক্ত প্রবাল ব্যবহারে উপকার পাবেন।

ক্যাটস আই পাথর (Cat’s Eye Stone)

কেতু গ্রহের রত্ন। রাসায়নিক উপাদান সিলিকন-মেগনিসিয়াম-বেরিলিয়াম-সংমিশ্রণে খণিতে জন্মে। দুর্ঘটনা ও রহস্যজনক জটিলতামুক্ত থাকতে ক্যাটস আই ব্যবহার করা যেতে পারে। গোপন শত্রুতা থাকলে ক্যাটস আই ব্যবহার করা হয়। গোপন শত্রুতা মুক্ত রাখে। সোনালি ক্যাটস আই চন্দ্র, বৃহস্পতি ও শুক্রের অশুভ প্রভাবমুক্ত রাখে। ক্যাটস আই কোন জাতক/জাতিকার জন্ম রাশিতে কেতু-গ্রহ অশুভ হলে নিম্ন লিখিত রোগ সমূহ দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্যাটস আই বা লকেট করে গলায় বা ডান হাতে আঙুলে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে।

নীলা পাথর (Blue Sapphire Stone)

সব রত্ন-পাথরের মধ্যে নীলা বা সাফায়ার সবচেয়ে মারাত্মক এবং দুষ্প্রাপ্য। দুষ্প্রাপ্য বলে অন্যান্য রত্ন-পাথরের তুলনায় নীলার দামও বেশি। নীলা অনেক ধরনের পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইন্দ্রনীলা, গঙ্গাজল নীলা পিতাম্বর নীলা, ষ্টার নীলা ইত্যাদি। সব রকম নীলার মধ্যে ইন্দ্রনীলার প্রতিক্রিয়া বা ক্রিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী। বর্তমানে ইন্দ্রনীলা খুব বেশি না পাওয়ার কারণে এবং দাম বেশি হওয়ায় বেশি পরিমাণে ষ্টার নীলা ব্যবহারের পরার্মশ জ্যোতিষীরা দিয়ে থাকেন। নীলার রাসায়নিক উপদান অ্যালুমিনিয়াম অর্কসাইড এবং স্যাফায়ারের অন্যান্য উপাদানে খনিতে নীলার সৃষ্টি। লাল রঙের সামান্য নীলাভ নীলাকে রক্তমুখী নীলা বলা হয়। হালকা বেগুনি আভাযুক্ত নীলাকে বলা হয় অপরাজিতা নীলা । কাশ্নিরে বেশি পাওয়া যায় বলে অনেক সময় কাশ্নিরি নীলাও বলে অবহিত করা হয়ে থাকে । অপরাজিতা নীলা বেশি পাওয়া যায় না বলে এর দাম একটু বেশি । অপরাজিতা নীলায় সামান্য হলুদ আভা থাকলে তাকে বলা হয় পীতাস্বর নীলা। নীলা পুরোপুরি স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলাটে হলে তাকে বলা হয় গঙ্গাজল নীলা। শনির অশুভ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য জাতক/জাতিকাকে নীলা ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। যে কোনো নীলাই অতি মূল্যাবান ।অভিজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ ছাড়া কোনো নীলাই ব্যবহার করা উচিত নয় । কারণ নীলা ব্যবহারে উপকার যতোটুকু, তার থেকে বেশি ক্ষতিকর । নীলা ব্যবহারে দারিদ্র,দুঃখ-কষ্ট হ্রাস পায়, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কাজকর্ম বাধা-বিঘ্ন দূর হয়। নীলার উপকারিতা নীলা যে সমস্ত জাতক/জাতিকার জম্ম চকে বা রাশি অশুভ স্থানে আছে তাদের বিভিন্ন রোগের উপসর্গ আসে। যেমন হার্ড ব্যথা,বাত রোগ,পায়ে আঘাত লাগা এবং কষ্টকর যন্ত্রনা জাতীয় রোগের এবং স্নায়ুর শক্তি বস্তুক । তাছাড়া চর্ম রোগ, মাথা ব্যথা, কানে কম শুনা,মাথা ও হাত পায়ের যন্ত্রনা,মৃগী রোগে আংটি করে ডান হাতের মধ্যমা আঙ্গুলে ধারন করলে প্রচুর উপকার পাওয়া যায়।

চুনি পাথর (Ruby Stone)

চুনি বা রুবি উজ্জ্বল লাল রঙের স্বচ্ছ রত্ন। আরবিতে এ পাথরকে ইয়াকুত পাথ্র বলা হয়। মিয়ানমার,সিংহল,ব্যাংককে প্রচুর চুনি বা রুবি পাথর পাওয়া যায়। চুনি বা রুবি খুবই দামি পাথর বলে বাজারে অনেক নকল পাওয়া যায়। কোনো অবস্থায় সন্দেহযুক্ত চুনি বা রুবি ব্যবহার করা উচিত নয় । রুবির রাসায়নিক উপাদান অ্যালুমিনিয়াম অর্কসাইড-কপার-সালফেট সংমিশ্রণে খনিতে জম্মে। রবি গ্রহ অশুভ হলে চুনি বা রুবি ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ধারণ করতে হয় । এটি ব্যবহারে যশ-খ্যাতি বাড়ে, অর্থ ও সুনাম বৃদ্ধি করে,বাড়ে খ্যাতির বিকাশ,উন্নতি,সম্পদ লাভ হয়, কাজ কর্মে সফলতা আসে। চুনির উপকারিতা যে সমস্ত জাতক/জাতিকার জম্ম চকে রবি অশুভ বা দূর্বল অবস্থানে থাকে তারা আংটি করে ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ধারন করলে পুরাতন জ্বর, চোখের সমস্যা জনীত রোগেও রুবি ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায় ।

হীরা পাথর (Diamond Stone)

হীরা অতি মূল্যবান রত্ন। হীরা ধারণে মনকে প্রফুল্ল রাখে। দেহের সৌন্দর্য, বীর্য ও বল বৃদ্ধি করে। শুক্রের অশুভ প্রভাবমুক্ত থাকতে হীরা ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়। হীরা শুক্র গ্রহের রত্ন-একজন জাতক জাতিকার জম্ম ছকে শুক্র গ্রহ অশুভ হলে শিল্প কাব্য,প্রতিভা,স্ত্রীর ভালবাসা ও রতি শক্তি কমে যাওয়ার আশংকা থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মীয় স্বজনের সাথে বিরোধ ঘটে। শুধু তা নয় শাররিক অসুস্থতা বিশেষ করে চর্ম রোগ, বহু মুত্র, যৌন রোগ, বার বার জ্বর ও দাঁতের রোগ হওয়ার আশংকা থাকে। অশুভ এবং নিচস্থ শুক্রের প্রতিষেধক হিসেবে হীরা ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায় । তুলা ও বৃষ রাশির জাতক জাতিকারা হীরা ব্যবহারে যথেষ্ট উপকার পাবেন। ১ থেকে দেড় রতি হীরা ব্যবহার করাই উত্তম ।

মুক্তা পাথর (Pearl Stone)

পৃথিবীতে যতো পাথর দেখা যায়, সেগুলার মধ্যে মুক্তা আসলে প্রাকৃতিক কোনো পাথর নয়। পানিতে বসবাসকারী প্রানিজ দেহের রস থেকে এর সৃষ্টি। সমুদ্রের নিচে, নদী বা বদ্ধ পুকুরে যেসব ঝিনুক, সঙ্খ বা শামুক জাতীয় প্রাণী বাস করে, তারা নিজেদের অতি কোমল দেহটিকে শক্ত একটি খোসল বা আবরণের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। এই আবরণটিই শামুক, শঙ্খ বা ঝিনুক নামে আমাদের কাছে পরিচিত। কারণ কোমল ছোট দেহটি নিয়ে মূল প্রাণীটি সহজে প্রকাশ্যে ধরা দেয় না। কোনো কারণে এই শক্ত দেহাবরণের ভেতর পাথর, মাটি বা নুড়ি ঢুকে গেলে প্রাণীটির জন্য তার চরম বিরক্তির সৃষ্টি করে ও দেহ থেকে এক রকম রস বের করে তারা অনাহুত সে পাথরটিকে ক্রমেই মসৃণ করে তুলতে থাকে। কালক্রমে পাথরটি তার আসল রূপ ও বর্ণটি হারিয়ে ফেলে এবং প্রানীর দেহ নিসৃত রসগুলো ক্রমেই জমাট বেঁধে পরিণত হয়। মুক্তার সাধারণ রঙ ধবধবে সাদা বা সামান্য হলদে। সিঙ্গাপুর, সিংহল,নেপাল প্রভৃতি দেশে মুক্তা বেশি পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও মুক্তা পাওয়া যায়।

ফিরোজা পাথর (Turquoise Stone)

ফিরোজা নীল সবুজ বর্ণ থেকে আরম্ভ করে হলুদ বর্ণের ও হতে পারে। বর্ণের দিক থেকে নীল সবুজ রংয়ের ফিরোজা সর্বশেষ্ঠ।

প্রাপ্তি স্থানঃ ইরান,মিশর, মেস্কিকো, আফগানিস্তান, তুরস্ক এবং ইষ্টেলিয়াতেও এ রত্ন পাওয়া যায়। আসল ফিরোজায় রংয়ের পরির্বতন হয়। রাসায়নিক বিশ্লেষণ এলুমিনিয়াম ফসফেট ও কপার সংমিশ্রণে সৃষ্টি। ইরানের ফিরোজ সবচেয়ে উন্নত।

উপকারিতাঃ এইটা মুসলিম ধর্মের পবিত্র পাথর। মুসলমানেরাই বেশি ব্যবহার করে থাকেন। তবে ফিরোজা উপরত্ন কার্যক্ষমতা অনেক বেশি এ রত্ন ব্যবহারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ও প্রেমিক/প্রেমিকার মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয় পারিবারিকভাবে সুখী থাকা যায়। আমাদের নবী রসুলগণ যখন ধর্ম যুদ্ধে যেতেন তখন ফিরোজা পাথার সাথে রাখতেন। এই রত্ন দুরঘটনা থেকে মুক্ত রাখতে পারে। মনকে সতেজ রাখে। জীবজন্তু বা হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় যে ব্যক্তি এইটা ধারন করেন।

এখানে পাথরের যেসব ক্ষমতা বর্ণিত হয়েছে আসলে সবই মিথ্যে। পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই। পাথরের যদি এতোই ক্ষমতা থাকতো তাহলে কুরআন হাদিসে উল্লেখ থাকতো।

আমাদের দেশে বেশ কিছু রত্ন পাথর ব্যবসায়ী আছে যারা নামী দামী শপিং মল যেমন, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক ইত্যাদিতে বিলাসবহুল দোকান ভাড়া নিয়ে  দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের দোকানের প্রধান আকর্ষণ সুন্দরী নারী। প্রথম দর্শনেই ক্লায়েন্ট গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে যায়। এরপর সর্বনাশের পালা। এরকম একজন জ্যোতিষী ও রত্ন পাথর বিক্রেতার কাহিনী নিচে আলোচনা করা হলো।

ভাগ্য গণনাকারী ভন্ড জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান নিজের ভাগ্যই গণনায় ব্যর্থ

(ভন্ডামীর জন্যে জ্যোতিষি লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করা হয়)

ভাগ্য গণনাকারী ভন্ড জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান নিজের ভাগ্যই গণনায় ব্যর্থ হয়েছে। নিজের আস্তানা শেষ দর্শন আজমেরী জেমস হাউজসহ বসুন্ধারা সিটি শপিং মল ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার খবর যেমন গননা করে জানতে পারেননি, তেমনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের লোকজন অভিযান চালিয়ে শেষ দর্শন আজমেরি জেমস হাউজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করবে এই খবরটিও গননা করে জানতে পারেননি। এটাই ভন্ড জ্যোতিষি লিটন দেওয়ানের হিকমত। কিন্তু এই ভন্ড বাংলা ফিল্মের একঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রীদের ৫/১০ হাজার টাকায় ভাড়া করে এনে চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্বারা বছরের পর বছর ধরে সাধারন মানুষকে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে মনে হয় তিনিই পৃথিবীতে একমাত্র লোক যে সব মানুষের জীবনে বর্তমান ভবিষ্যতে কি ঘটবে সব বলে দিতে পারে। তাহলে দেশের ভিতরে প্রশাসনের লোকজন বড় বড় অপরাধের আগাম খবর পেতে কেন লিটন দেওয়ানের কাছে আসে না, এই প্রশ্নের উত্তরটি সাধারন জনগন বুঝতে পারলেই ভন্ড লিটন দেওযানের কেরামতি শেষ হবে। রক্ষা পাবে দেশের মানুষ। মানুষকে ধোকা দিয়ে বোকা বানানোর নানা রকম তথ্য উপাত্ত নিয়ে অপরাধ বিচিত্রায় এবারের প্রতিবেদন। জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান ওরফে পাগলা দেওয়ান ওরফে লিটন চিশতি ওরফে আধ্যাত্মিক গুরু লিটন। নামের এমন ফিরিস্তি দেখে মনে হতেই পারে, বাবায় অনেক খেমতার অধিকারী। তবে সমাজের বেশির ভাগ লোক তাকে চেনে লিটন দেওয়ান নামে। একেবারে অজোপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এক সময়ের অখ্যাত মানুষটি এখন বিলাসবহুল চেম্বার খুলে বসেছেন খোদ রাজধানীতে।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বিবন্দী গ্রামের এক দারিদ্র কৃষকের সন্তান এই লিটন। রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে শেষ দর্শন আজমেরি জেমস হাউজ নামে তার জ্যোতিষশাস্ত্রের সদর দফতর। এটি আবার সব মুসকিল আছান দফতর নামেও পরিচিত। কেউ কেউ বলেন, জিন্দা পীরের দরবার। ভক্তদের কেউ আবার পাগলা বাবার দরবার বলতেও পছন্দ করেন। কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, কাজ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব তথ্য ও প্রমাণ। এখানে মূলত মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে লিটন দেওয়ান রীতিমতো বিখ্যাত উপন্যাস ”লালসালুর” কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের মতো ”মাজার” খুলে বসেছেন। নিজেকে বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ দাবি করে দুহাতে খালি করে চলেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পকেট।

তথ্যপ্রমাণসহ লিটন দেওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি আসলে একজন ভন্ড এবং প্রতারক। প্রতারণাই তার আসল ব্যবসা। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তিনি সহজ সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর টাকার জোরে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখেও ধুলো দিতে সক্ষম হয়েছেন। চলচিত্র অভিনেতাদের অন্যতম প্রবীর মিত্র, আহম্মেদ শরীফ সহ আরো অনেকে লিটন দেওয়ানের ভন্ডামি এমন ভাবে প্রচার করেন যেন সাধারন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে লিটন দেওয়ানের দরবারে। বড় অংকের লটারি ও চাকরি পাইয়ে দেয়া, মামলায় জেতানো, ভালো লাগার মানুষ ও পরস্ত্রীকে বশে আনা, বন্ধানারীর সন্তান লাভ, বিদেশ যেতে বাধা দূর করাসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধান দেন লিটন দেওয়ান। এক কথায়, এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান লিটনের কাছে নেই।

খবরের কাগজে ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দিনরাত মিথ্যার বেসাতির মতো লিটন দেওয়ানের গুণগান ও মহত্ত্বকথা ছড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। লিটনের সাক্ষাৎকার ছাপানো হচ্ছে অখ্যাত বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনেও।

আবার শুধু টাকার জন্য এই প্রতারকের বিজ্ঞাপনে মডেল হতে দেখা গেছে নামিদামি অভিনেতাকেও। সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে লিটনের প্রতারণার চেম্বার। ডাক্তারের ফির মতো লিটন দেওয়ানের কর্মচারীরা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম খাতায় এন্ট্রি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে আগাম ফি নিচ্ছেন। জনপ্রতি ৫শ টাকা। ভরদুপুরে সিরিয়াল নম্বর ৯২ দেখে তো ঈগল টিমের সদস্যরা রীতিমতো হতবাক। ‘৯৩ নম্বরে সিরিয়ালে সাক্ষাৎ পেতে হলে রাত ১২ টাও বেজে যেতে পারে। কিছু সুবিধার বিনিময়ে সিরিয়াল কমিয়ে ৩৫ করা গেল। এবার দীর্ঘ অপেক্ষার পালা।

মাথা সাপের মতো আকৃতির পেচানো পাগড়ি আর পরনে সাদা পাঞ্জাবি উপর কটি পরিহিত জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান বসে আছেন কাচঘেরা বিশেষ একটি সুসজ্জিত কক্ষে। অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ তো একেবারেই নিষিদ্ধ। সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমাণ। যাদের বেশী ভাগ লোকজনই বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের। শুধুমাত্র টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখেই তারা এখানে এসেছে। আগে-পরে ঢোকা নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় রীতিমতো ঝগড়াও হচ্ছে। ঝগড়া সামাল দিচ্ছেন লিটনের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা। একজন নারী দর্শনার্থী লিটন দেওয়ানের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলেন, গতবারে এসে ফেরত গেছি। ভিড়ের কারণে “বাবার” সাক্ষাৎ পাইনি। এবার একটু তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন ভাই। এ অনুরোধ শুনে লিটনের এক কর্মচারী রীতিমতো ওই নারীকে কড়া ধমক দিলেন। আপনাকে আগে পাঠালে অন্যরা কি বলবে। চুপচাপ বসে থাকেন। সিরিয়াল এলে তবেই ভেতরে ঢুকতে পারবেন। ধমক খেয়ে টুপসে যান ওই নারী।

কুমিল্লা থেকে এক নবদম্পতি এসেছেন লিটনের সাক্ষাৎ পেতে। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে সমস্যা জানতে চাইলে তারা জানালেন, মাত্র এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সুখী নন। নানা সমস্যা হচ্ছে। জিন-পরীর কু-নজর পড়েছে মনে করে তারা ‘লিটন বাবার কাছে ‘তদ্বির’ নিতে এসেছেন। আরেকজন সৌদি প্রবাসী নারী দর্শনার্থী এসেছেন। পরকীয়ার কারণে তার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিকার পেতে তিনি বাবার আস্তানায় এসেছেন। একজন ব্যবসায়ী এসেছেন তার ব্যবসা ভালো করার তদবির নিতে। লিটন দেওয়ান এসব দর্শনার্থীর কাছ থেকে একের পর এক এসব সমস্যার কথা শুনে সমানে সরকারি হাসপাতালের প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেয়ার মতো পাথর, আংটি ও তাবিজ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ১০০ পার্সেন্ট গ্যারান্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সন্ধ্যা ৭টায় আমাদের ৩৫ন নম্বর সিরিয়ালের ডাক পড়ল। পরিচয় গোপন করে চেম্বারের ভেতরে লিটন দেওয়ানের মুখোমুখি সিডনিনিউজের দুই সদস্য। কিন্তু তার কক্ষে ঢুকে অনেকটা বিস্মিত হতে হল। ঘরময় নানা ধরনের পুরস্কার, ক্রেস্ট আর মন্ত্রী-এমপিসহ গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে লিটনের তোলা ছবি দিয়ে সাজসাজ অবয়ব। ঘরে বড় করে টানানো আছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিটনকে দেয়া সম্মাননা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। বিশাল এক বিলাসবহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন কথিত জ্যোতিষ রাজ লিটন। কক্ষের ভেতরে ঢোকামাত্র বিশেষ ভঙ্গিতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ইশারায় বসতে বললেন। সালাম ও নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিটন দেওয়ানকে বলা হল, ‘চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে। যেভাবেই হোক এবার বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পাওয়াতেই হবে। সমস্যা শুনে দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ফেললেন লিটন। বললেন, তোর সমস্যা অনেক জটিল। তবে আমি সমাধান দেয়ার ওছিলা মাত্র। সব সমাধান দেবেন (উপরের দিকে একটা আঙুল তুলে) তিনি। কোথায় থাকি, নাম পরিচয়, বাবার নাম ইত্যাদি জানতে চাইলেন। এরপর রাশি নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে আতশি কাচ দিয়ে উল্টেপাল্টে হাত দেখলেন।

এরপর বললেন, শনির রাহু গ্রাস করেছে। রাহু কাটাতে নীলা (পাথর) আংটি পরতে হবে। আংটির দাম ১৫ হাজার টাকা। এই আংটি পরলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সবকিছু শুনে কিছুটা খুশি হওয়ার ভান করলাম। এরপর আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতেই বাইরে থাকা লিটনের কর্মচারীরা ঘিরে ধরলেন। তাদের বক্তব্য-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ, এখন টাকা দেন, পাথরের আংটি নিয়ে যান। এত টাকা সঙ্গে নেই জানিয়ে কিছুক্ষণ পরে আসার কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। এসময় আরো জানা গেল, প্রতিদিন লিটন দেওয়ানের কাছে গড়ে দেড়শ মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসেন নানা সমস্যা নিয়ে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫শ টাকা করে শুধু দর্শন ফি বাবদ দৈনিক অন্তত ৭৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। মাসের হিসাবে এই অংক সাড়ে ২০/২২ লাখ, বছরে পরিমাণ দাঁড়ায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। লিটন নিজেই বলেছেন, ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন তিনি।

লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনে অনেক নামিদামি চিত্রতারকারা বলেন, তারা ‘দেওয়ান সাহেবর কাছে এসে উপকৃত হয়েছেন। তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। এসব চিত্রতারকার মধ্যে আছেন শীর্ষস্থানীয় চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎ, নায়ক জাবেদ, প্রবীর মিত্র, খল অভিনেতা আহমেদ শরীফ, চিত্র নায়িকা রতœা, অভিনেত্রী খালেদা আক্তার, রিনা খান, চিত্রনায়ক হেলাল খান ও অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী সহ আরো অনেকে। বিজ্ঞাপন দৃশ্যে চিত্রনায়ক হেলাল খানকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাকে উনি (লিটন দেওয়ান) একটা পাথরের আংটি দিয়েছেন। আমি উপকার পেয়েছি। আপনারাও আসুন, আমার মনে হয় উপকার পাবেন। বিশিষ্ট অভিনেত্রী রিনা খান বিজ্ঞাপনে বলছেন, ‘জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের কাছ থেকে এই পাথর কিনে ব্যবহার করি। এই পাথর ব্যবহার করার পরে আমার জীবনে সুখশান্তি ফিরে আসে। আপনারাও এই পাথর ব্যবহার করুন। এই পাথর আসল পাথর। জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ান মানুষের মুখ দেখেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।

বর্ষীয়ান অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীকে বিজ্ঞাপনে বলতে দেখা যায়, ‘কোন সমস্যায় কি সমাধান দিতে হবে এটাই তার সাধনা। আপনার সমস্যাগুলো তাকে বলুন। নিশ্চয় আপনি উপকৃত হবেন। চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎকে বলতে দেখা যায়, ‘লিটন দেওয়ান একজন নামকরা জ্যোতিষ। তার কাছ থেকে একটি পাথর নিলাম। দেওয়ান সাহেব বললেন, আপনি এই পাথরটি পরবেন। আপনার জীবনে সাফল্য আসবে।  চিত্র নায়িকা রত্নাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি আমার জীবনের নানা সমস্যা উনাকে (লিটন দেওয়ান) বললাম। সব শুনে তিনি আমাকে দুটি আংটি দিলেন। আংটি দুটি আমি ব্যবহার করছি। এখন আমি অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছি। খল অভিনেতা আহেমদ শরীফ বলছেন, লিটন দেওয়ান একজন গুণী ব্যক্তি। তার পিতাও একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন (অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিটনের পিতা শ্রীনগর উপজেলার বিবন্দী গ্রামের একজন অশিক্ষিত কৃষক মাত্র)। তার পিতার মাজার শরিফের ঔরস অনুষ্ঠানে আমি নিজে যাই। আপনারাও যাবেন। লিটন দেওয়ানের কাছে এসে আমি উপকৃত হয়েছি।

এসব চিত্র অভিনেতা কি সত্যি উপকার পেয়ে এসব কথা বলছেন? নাকি শুধু টাকার জন্য শেখানো কথাগুলো ক্যামেরার সামনে মডেল হিসেবে অভিনয় করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে ঈগল টিম কয়েকজন অভিনয় শিল্পীর মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, অভিনয়ই তার পেশা। তবে একটা মান বজায় রেখেই তিনি অভিনয় করেন। লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয় করেছেন মাত্র। কিন্তু অভিনয়ের সময় তারা তাকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিল তার সবকিছু তিনি বলেননি। যেটুকু যৌক্তিক মনে করেছেন সেটুকুই বলেছেন।

অভিনেত্রী রীনা খানের কাছে একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অভিনেত্রী। অভিনয় করাই আমার কাজ। তবে এই বিজ্ঞাপনে তিনি একা নন, আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। এ বিষয়টাতে সবাই যে বক্তব্য দেবেন তারও একই বক্তব্য। আংটি পরার পর অভিনেতা হেলাল খান জেল খেটেছেন।

প্রতারণার অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ও শামীম নামের লিটন দেওয়ানের দুই সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর নিজের সব অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করেন লিটন দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জ্যোতিষ লাইনটাই পীর ফকিরী একটা ভন্ডামি আখড়া। যারাই এসব করতাছে সব ভন্ডামি। আমরাও এর সাথে জড়াইয়া গেছি। চিকিৎসার জন্য আসা নি:সন্তান নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নি:সন্তান মহিলারা আমাদের কাছে কম আসে। তবে বিভিন্ন বয়সী মহিলারা আমাদের কাছে আসে। অনেক সময় আমাদের সান্নিধ্য পেতেও চায়। আমরাও লোভ-লালসায় জড়ায়ে যাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই লাইন ছেড়ে দেব। আমি অনুতপ্ত। র‌্যাবের একটি সুত্র জানান, আধ্যাত্মিক শক্তির দাবিদার এই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে বহু মানুষ। সে অলৌকিক নানা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে বলে প্রচার করত। বলা হতো, তার ঘরের ছাদের ওপর থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ে। পরে তাদের তদন্তে দেখা গেল, সে বিশেষ কৌশলে কেমিক্যাল দিয়ে এসব প্রতারণার আশ্রয় নিত।

এদিকে লিটন দেওয়ান সিডনিনিউজ টিমকে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিউজ টিউজ কইরা কি হইব? আমি তো একা খাই না। সবাই মিল্লা জিল্লা খাই। একদিন আমার অফিসে আসেন। একসাথে লাঞ্চ করবো। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অভিযান পরিচালনা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা তাদেরকে পাথর রপ্তানির কাগজপত্র এবং কিভাবে ভাগ্য পরিবর্তন হয় তার ব্যাখ্যা চেয়ে ছিলাম। জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। আপনারা অন্যদের ভাগ্য গণনা করেন কিন্তু আজকে যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে আমরা আসবো এটা আপনারা জানতেন না? ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে ভাগ্য গণনাকারি প্রতিষ্ঠান লিটন দেয়ানের ম্যানেজার বললেন, ‘স্যার, এই সময় আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, জরিমানা করলে কিভাবে টাকা পরিশোধ করবো। এখন আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।

পুরুষদের জন্য সোনা ও রূপার মালা, আংটি ইত্যাদি পরার বিধান

পুরুষদের জন্য স্বর্ণের তৈরি আংটি, হাত ঘড়ি, ব্রেসলেট, গলার মালা, চশমার ফ্রেম, জামার বোতাম, কলম ইত্যাদি ব্যবহার করা জায়েজ নয়। কেননা, হাদিসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে।

পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার হারামঃ

আবূ মূসা ‘আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘রেশমের পোশাক ও স্বর্ণ আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য অবৈধ করা হয়েছে, আর মহিলাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে।’’ (তিরমিযী ১৭২০, নাসায়ী ৫১৪৮, সিলসিলা সহীহা হা-১৮৬৫/৩০৩০)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি ডান হাতে রেশম ধরলেন এবং বাম হাতে সোনা, অতঃপর বললেন, ‘‘আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য এ দু’টি বস্তু হারাম।’’ (আবূ দাউদ ৪০৫৭, নাসায়ী ৫১৪৪, ইবনু মাজাহ ৩৫৯৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি স্বর্ণের আংটি তৈরি করান। তিনি তা ডান হাতে পরিধান করতেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)ও তাঁর দেখাদেখি স্বর্ণের আংটি তৈরি করান। এক পর্যায়ে তিনি স্বর্ণের আংটিটি খুলে ফেলেন এবং বলেন, আমি কখনো তা পরিধান করব না। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)ও তাঁদের আংটি খুলে ফেলেন। (সহীহ শামায়েলে তিরমিযী, ৮০, শারহুস সুন্নাহ, হা/৩১২৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইমাম নওবী বলেন:

“ইজমা তথা সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম। যদিও তার কিছু অংশ স্বর্ণ আর কিছু অংশ রৌপ্য হয়।” (শরহে মুসলিম ১৪/৩২)

রৌপ্যের তৈরি ঘড়ি, আংটি ইত্যাদি ব্যবহার করা জায়েজঃ

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য রৌপ্যের আংটি, ঘড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

(ক) আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূপার আংটি ব্যবহার করতেন। আর তাঁর আংটিতে আবিসিনীয় পাথর বসানো ছিল। (সহীহ শামায়েলে তিরমিযী ৬৯, আবু দাউদ, হা/৪২১৮)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(খ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি রৌপ্যের আংটি তৈরি করেছিলেন। তিনি তা দ্বারা (চিঠিপত্রে) সীল মারতেন, তবে তিনি (সচরাচর) তা পরিধান করতেন না। (সহীহ শামায়েলে তিরমিযী, ৭০, নাসাঈ, হা/৫২১৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahh।

(গ) আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অনারব রাজা-বাদশাহদের কাছে দাওয়াতপত্র প্রেরণের সংকল্প (ইচ্ছা) করেন তখন তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, তারা সীল ছাড়া চিঠি গ্রহণ করে না। তাই তিনি একটি আংটি তৈরি করান। তাঁর হাতের নিচে রাখা আংটিটির ঔজ্জ্বল্য যেন আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে। (সহীহ শামায়েলে তিরমিযী, ৭১, সহীহ মুসলিম, হা/৫৬০২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হা/৩০৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি রূপার আংটি তৈরি করান। সর্বদা তা তাঁর হাতে থাকত। তারপর তা পালাক্রমে আবু বকর (রাঃ) উমার (রাঃ) এর হাতে আসে। এরপর উসমান (রাঃ) এর হাত থেকে (মু’আয়কিবের সাথে লেনদেনের সময়) তা আরীস নামক কূপে পড়ে যায়। তাতে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অংকিত ছিল। (সহীহ শামায়েলে তিরমিযী,  ৭৪, সহীহ বুখারী, হা/৫৮৭৩; সহীহ মুসলিম, হা/৫৫৯৭; মুসনাদে আহমদ, হা/৪৭৩৪; সুনানে কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৭৮১৪)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের আলেমগণ বলেনঃ

“পুরুষদের জন্য আংটি পরিধান করা জায়েজ যদি তা রৌপ্য অথবা মূল্যবান পাথর থেকে তৈরি হয়-স্বর্ণের তৈরির না হয়। কেননা সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রৌপ্যের তৈরি আংটি ব্যবহার করেছেন।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

পুরুষদের জন্য গলায় মালা পরিধান করার বিধানঃ

গলায় মালা, চেইন বা লকেট পরা নারীদের সাজ-সজ্জার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং পুরুষদের জন্য তা ব্যবহার করা হারাম।অনুরূপভাবে পুরুষদের জন্য হাতের ব্রেসলেইট, চুরি, কানের দুল ইত্যাদি পরাও হারাম। সেটি তৈরির উপাদান স্বর্ণ হোক বা অন্য কিছু হোক। কেননা হাদিসে বিপরীত লিঙ্গের সাদৃশ্য অবলম্বনকে অভিসম্পাত যোগ্য গর্হিত কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা নারীদের পোশাক পরে এবং সেসব নারীকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের পোশাক পরিধান করে।” (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত),  ৪০৯৮। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনু আবূ মুলাইকাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আয়িশাহ (রাঃ)-কে বলা হলো, এক মহিলা (পুরুষদের জুতার মতো) জুতা ব্যবহার করে। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষবেশী নারীদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), ৪০৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

“যে নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যে সব পুরুষ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সহীহুল জামে হা/৪৫৩৩, সহীহ)

আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রাহ. বলেন:

“ঘড়ি যদি স্বর্ণ ছাড়া মূলবান পাথরের তৈরি হয় তাহলে তা পুরুষদের জন্য ব্যবহার করা জায়েজ যদি তা নারীদের অলঙ্কার অথবা তাদের সাদৃশ্য না হয় এবং যদি তাতে অপচয় না করা হয়।” (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল ইবনে ইসাইমীন ১১/৬২)

মোটকথা, পুরুষদের জন্য স্বর্ণের তৈরি কোন কিছুই ব্যবহার কর বৈধ নয়। অনুরূপভাবে নারীদের সাজ-সজ্জার অন্তর্ভুক্ত কোন কিছু ব্যবহার করা বৈধ নয়। তবে রৌপ্য, মূল্যবান স্টোন, ডায়মন্ড বা অন্য যেকোনো মূল্যবান ধাতব বস্তু থেকে হাত ঘড়ি, আংটি ইত্যাদি ব্যবহারে কোন দোষ নাই ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।

(সমাপ্ত)

(বইটি ভবিষ্যতে আরো পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত করা হবে)

লেখক ও সংকলকঃ

মো:ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...