Search This Blog

Wednesday, April 1, 2020

মধ্য শাবান রাতে "কথিত শবেবরাত বনাম বিদআতী আমল"

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মধ্য শাবান রাতে

"কথিত শবেবরাত বনাম বিদআতী আমল"

 


ভূমিকাঃ আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে ‘শবেবরাত’ বা ‘লায়লাতুল বারাআত’ বলা হয়। ‘শবেবরাত’ শব্দটি ফার্সী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে শবেবরাত ‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবেই পালিত হয়। এজন্যে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। লোকেরা ধারণা করে যে, এ রাতে বান্দার গোনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়। সারা বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। এ রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ এই রাতে ঘরে ফেরে। এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে তারা সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধূপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে সুগন্ধিময় ও আলোকিত করা হয়। অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। আত্মীয়-স্বজন সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়। হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে রাত কাটিয়ে দেয়। সেই সাথে চলে মীলাদ-ক্বিয়াম ও নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও এ রাতে মসজিদে গিয়ে ‘ছালাতে আলফিয়াহ’ বা ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করে থাকে। যেখানে প্রতি রাক‘আতে ১০ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করা হয়। সংক্ষেপে এই হলো এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র।

ধর্মীয় ভিত্তি

মোটামুটি ৩টি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে থাকে।

(১) এ রাতে আগামী এক বছরের জন্য বান্দার ভালমন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত হয় এবং এ রাতে কুরআন নাযিল হয়।

(২) এ রাতে বান্দার গোনাহ সমূহ মাফ করা হয়।

(৩) এ রাতে রূহগুলি সব ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। ফলে মোমবাতি, আগরবাতি, পটকা ও আতশবাযী হয়তোবা রূহগুলিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্য করা হয়। হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, এ দিন ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হয়েছিল। ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখ শনিবার সকালে। আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস পূর্বে শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে...!

এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয় ভিত্তি কতোটুকু তা খুঁজে দেখবো।

প্রথমটির সপক্ষে যেসব আয়াত ও হাদিস পেশ করা হয়, তা হলোঃ

(১) সূরা দুখান-এর ৩ ও ৪ আয়াত- অর্থ : ‘আমরা তো এটি অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী’। ‘এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৪৪/৩-৪)।

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ লায়লাতুল ক্বদর’। যেমন সূরা ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা এটা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’। আর সেটি হ’ল রামাযান মাসে। যেমন সূরা বাক্বারাহ ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এই সেই রামাযান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’। তিনি বলেন, এ রাতে এক শা‘বান হ’তে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদিস প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ এবং কুরআন ও সহিহ হাদিস সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ক্বদর রজনীতেই লওহে মাহফূযে রক্ষিত ভাগ্যলিপি হতে পৃথক করে আগামী এক বছরের নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি লেখক ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়। এরূপভাবেই বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ বিন ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ সালাফে ছালেহীনের নিকট হতে।

অতঃপর ‘তাক্বদীর’ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বক্তব্য হলো, ‘তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আছে আমলনামায়, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছুই লিপিবদ্ধ’ (ক্বামার ৫৪/৫২-৫৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে মাখলূক্বের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন, (তখন) আল্লাহর ‘আরশ (সিংহাসন) পানির উপর ছিল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৭৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৫৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫০৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৫৮) । হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে’ (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০৭৬; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৮৮, নাসায়ী ৩২১৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৩৪৬৫, সহীহ আল জামি‘ ৭৮৩২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৭০৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৭০৫ শেষাংশ) । হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাকদীর সম্পর্কে আরো হাদিস হলোঃ

(ক) ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদী স্বীকৃত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন রক্তপিন্ড, তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন গোশত পিন্ডাকারে থাকে। তারপর আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিযিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য- এ চারটি বিষয় লিখার জন্য আদেশ দেয়া হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৯৪, ৩২০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৬১৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আল্লাহ্ রেহেমে (মাতৃগর্ভে) একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, হে প্রতিপালক! এটি বীর্য। হে প্রতিপালক! এটি রক্তপিন্ড। হে প্রতিপালক! এটি গোশতপিন্ড। আল্লাহ্ যখন তার সৃষ্টি পূর্ণ করতে চান, তখন ফেরেশতা বলে, হে প্রতিপালক! এটি নর হবে, না নারী? এটি দুর্ভাগা হবে, না ভাগ্যবান? তার রিযক্ কী পরিমাণ হবে? তার জীবনকাল কী হবে? তখন (আল্লাহর নির্দেশমত) তার মায়ের পেটে থাকাকালে ঐ রকমই লিখে দেয়া হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৯৫, ৩১৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ).....হুযইফাহ্ ইবনু আসীদ (রহঃ) হতে মারফু সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জরায়ুতে চল্লিশ অথবা পয়তাল্লিশ দিন রেণু জমা থাকার পর সেখানে ফেরেশতা গমন করে। অতঃপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রভু! সে কি হতভাগ্য না সৌভাগ্যবান? তখন উভয়টাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর সে বলতে থাকে, হে আমার রব! সে কি পুরুষ না মহিলা? তখন আদেশ অনুসারে উভয়টা লিপিবদ্ধ করা হয়। তার আমল, আচরণ, মৃত্যুক্ষণ ও জীবনোপকরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ফলকটিকে পেঁচিয়ে দেয়া হয়। তাতে কোন অতিরিক্ত করা হবে না এবং ঘাটতিও হবে না! (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৬১৮-৬৬২৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৪৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৮৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এতে বুঝা যায় যে, শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই। বরং ‘লায়লাতুল বারাআত’ বা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামী শরী‘আতে এই নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

(২) এই রাতে বান্দার গোনাহ মাফ হয়। সেজন্য দিনে ছিয়াম পালন ও রাতে ইবাদত করতে হয়। অন্ততঃ ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হয়। প্রতি রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও ১০ বার করে সূরা ইখলাছ (কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ) পড়তে হয়। এই ছালাতটি গোসল করে আদায় করলে গোসলের প্রতি ফোঁটা পানিতে ৭০০ রাক‘আত নফল ছালাতের ছওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে প্রধান যে দলীলগুলি পেশ করা হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপঃ

(ক) আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে সালাত  পড়ো এবং এর দিনে সওম রাখো। কেননা এ দিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ পৃথিবীর নিকটতম আকাশে নেমে আসেন এবং বলেনঃ কে আছো আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো রিযিকপ্রার্থী, আমি তাকে রিযিক দান করবো। কে আছো রোগমুক্তি প্রার্থনাকারী, আমি তাকে নিরাময় দান করবো। কে আছো এই প্রার্থনাকারী। ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (তিনি এভাবে আহবান করেন)। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৮৮; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৩০৮ মাওযূ, যঈফ তারগীব ৬৩২ মাওযূ, যাঈফা ২১৩২ মাওযূ, যঈফাহ ২১৩২, কারণ এর সানাদের বর্ণনাকারী ইবনু আবী সাবরাহ্ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ এবং ইবনু মা‘ঈন (রহঃ) বলেছেন, সে হাদীস বানিয়ে বর্ণনা করে)। হাদিসের মানঃ জাল (Fake)।

অথচ একই মর্মে প্রসিদ্ধ ‘হাদীছে নুযূল’ ইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে (হা/১৩৬৬) এবং বুখারী শরীফের (মীরাট ছাপা ১৩২৮ হিঃ) ১৫৩, ৯৩৬ ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় এবং ‘কুতুবে সিত্তাহ’ সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে সর্বমোট ৩০ জন ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ‘মধ্য শা‘বান’ না বলে ‘প্রতি রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ’ বলা হয়েছে। অতএব ছহীহ হাদীছ সমূহের বর্ণনানুযায়ী আল্লাহ প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন ও বান্দাকে ফজর পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান জানিয়ে থাকেন; শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে মধ্য শা‘বানের একটি রাত্রিতে নয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন লোককে করয দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১৪৫, ৬৩২১, ৭৪৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৫৭-১৬৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২২৩, আহমাদ ৭৫৯৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ তায়ালা শুধু মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতেই দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন না তিনি প্রতি রাতেই নেমে আসেন।

অতএব “আল্লাহ তায়ালা মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন” এই হাদিস দিয়ে শুধু মধ্য শাবানে কথিত শবেবরাত নামক রাত্রি উদযাপন করে সময় কাটাবে আর বছরের অন্যান্য রাতে কোনো আমল করবে না তারা হচ্ছে প্রকৃত আমল চোর।

এখানে সকলের একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, আল্লাহ তায়ালা সশরীরে কখনো দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন না। তিনি প্রতি রাতে নেমে আসেন বলতে আল্লাহ তাঁর রহমতের দৃষ্টি দিয়ে দুনিয়াটাকে ঢেকে নেন বা রহমতের দৃষ্টি অবতরণ করেন বা রহমতের দৃষ্টি দিয়ে সকলকে ডাকেন।

এখানে একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, আসমান-জমিনসহ এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবগুলো একত্রিত করলে আল্লাহর নিকট তা একটা সরিষা দানার চেয়েও ছোট হবে। সে তুলনায় পৃথিবী তো আরো ছোট। আর সবকিছুই তাঁর চোখের সামনেই ঘটছে। অতএব এতো সামনে আর ছোট জায়গায় আল্লাহ তায়ালার নেমে আসার প্রশ্নই আসে না।

(খ) আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি বাকির কবরস্থানে, তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন: হে আয়িশাহ! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন। তিনি বলেনঃ মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোকের গুনাহ মাফ করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৮৯; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২৯৯,  মুসলিম ৯৭৩-৭৪, তিরমিযী ৭৩৯, নাসায়ী ২০৩৭, আহমাদ ২৫৪৮৭, দারাকুত্বনী ৮৯, শু‘আবুল ঈমান ৩৮২৬, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৯৯২, এর সানাদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে, কারণ ইয়াহ্ইয়া ইবনু আনবী কাসীর ‘উরওয়াহ্ থেকে শুনেননি)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

 (গ) ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘ইমরানকে অথবা অন্য কোন লোককে জিজ্ঞেস করেছেন, আর ‘ইমরান তা শুনছিলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে অমুক ব্যক্তির পিতা! তুমি কী শা‘বান মাসের শেষ দিনগুলো সওম রাখো না? তখন তিনি বললেন, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি (রমাযানের শেষে শা‘বান মাসের) দু’টি সওম পালন করে নিবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২০৩৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯৮৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬৩৫-২৬৪৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৬১, আহমাদ ১৯৯৪৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৫৮৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

‘সিরার’ অর্থ মাসের শেষ। উক্ত ব্যক্তি শা‘বানের শেষাবধি ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত ছিলেন অথবা ঐটা তার মানতের ছিয়াম ছিল। রামাযানের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নিষেধাজ্ঞা লংঘনের ভয়ে তিনি শা‘বানের শেষের ছিয়াম দু’টি বাদ দেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ঐ ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেন। এর সাথে প্রচলিত শবেবরাতের কোনো সম্পর্ক নেই।

(ঘ) আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পাঁচ রাতে দো‘আ ফেরত দেওয়া হয় না। রজব মাসের প্রথম রাতে, মধ্য শা‘বানে, জুম‘আর রাত, ঈদুল ফিতর এবং কুরবানীর রাতের দো‘আ’। হাদীছটি জাল। (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৪৫২)।

(ঙ) আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৩৯০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৩০৬, জামি সগীর ১৮১৯, সহীহা ১৫৬৩, ফিলাল ৫১০, সহীহ আবী দাউদ ১১৪৪, ১৫৬৩, যদিও এ সানাদে ইবনু লাহইয়া এবং তার উসতায যহ্হাক ইবনু আয়মান-এর দুর্বলতার কারণে হাদীসের সানাদটি য‘ঈফ। কিন্তু এর অনেক শাহিদমূলক হাদীস থাকায় তা হাসানের স্তরে উন্নীত হয়েছে)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,  ইমাম আহমাদ (রহঃ) এ হাদীসটি ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের এক বর্ণনায় এ বাক্যটি আছে যে, কিন্তু দু’ লোকঃ ‘হিংসা পোষণকারী ও আত্মহত্যাকারী ব্যতীত আল্লাহ তার সকল সৃষ্টিকে মাফ করে দেন)’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)  ১৩০৭, আহমাদ ৬৬৪২, আত-তারগীব ৬২১)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

৮টি যঈফ সূত্র উল্লেখ করে সেগুলি হাদীছটিকে শক্তিশালী করেছে মন্তব্য করে শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘নিঃসন্দেহে ছহীহ’ বলেছেন। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১৪৪, ৩/১৩৮, ১৫৬৩, ৪/১৩৭)।

ভাষ্যকার শু‘আয়েব আরনাঊত্ব হাদীছটির সনদ যঈফ বলেছেন। অতঃপর বিভিন্ন শাওয়াহেদ-এর কারণে ‘ছহীহ লেগায়রিহি’ বলেছেন। (আহমাদ হা/৬৬৪২)।

ভাষ্যকার আহমাদ শাকের একইরূপ বলেছেন (১০/১২৭)। কিন্তু ‘ছহীহ’ বলা সত্ত্বেও এ রাত্রি উপলক্ষ্যে বিশেষ কোন আমল করাকে শায়খ আলবানী কঠোরভাবে বিদ‘আত বলেছেন।

মন্তব্যঃ

(ক) উক্ত হাদীছটি বুখারী-মুসলিম সহ অন্যান্য ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী।

(খ) সকল ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহবান করতে থাকেন।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন লোককে করয দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১১৪৫, ৬৩২১, ৭৪৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬৫৭-১৬৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১২২৩, আহমাদ ৭৫৯৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ তায়ালা শুধু মধ্য শা‘বানের দিবাগত রাতেই দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন না তিনি প্রতি রাতেই নেমে আসেন।

অথচ অত্র হাদীছে এটি ১৫ই শা‘বানের রাতের জন্য খাছ করা হয়েছে। যদিও এরূপ ক্ষমা প্রদানের কথা অন্য ছহীহ হাদীছ সমূহে এসেছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা খোলা হয় এবং প্রত্যেক বান্দাকে ক্ষমা করা হয় এ শর্তে যে, সে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করবে না। আর সে ব্যক্তি এ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়, যে কোন মুসলিমের সাথে হিংসা ও শত্রুতা পোষণ করে। মালায়িকাহ্’কে (ফেরেশতাদেরকে) বলা হয় যে, এদের অবকাশ দাও, যেন তারা পরস্পর মীমাংসা করে নিতে পারে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০২৯-৫০৩০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪৩৮-৬৪৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৬৫, আবূ দাঊদ ৪৬১৬, তিরমিযী ২১০৯, সহীহুল জামি ২৯৭০, ২৯৫৮, সহীহ আত্ তারগীব ২৭৬৬, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩১, মুওয়াত্ত্বা মালিক ৩৩৭০, আহমাদ ৯০৫৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৬৬১, ৫৬৬৭, শু‘আবুল ঈমান ৬৬২৬, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৬৬২৪, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২১২০)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অথচ ঐ দু’রাতে কেউ বিশেষভাবে তথা শবেবরাতের মতো করে কোন ইবাদত বা অনুষ্ঠানাদি করেনা এবং করার বিধানও নেই।

(গ) এই রাতে বা দিনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম কোনরূপ বাড়তি আমল বা ইবাদত করেননি।

(ঘ) মতভেদের সময় রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে তাঁর ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। (আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫)।

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

‘ইরবায ইবনু সারিয়াহ্] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সালাত আদায় করালেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে গেলেন। আমাদের উদ্দেশে এমন মর্মস্পর্শী নাসীহাত করলেন যাতে আমাদের চোখ গড়িয়ে পানি বইতে লাগল। অন্তরে ভয় সৃষ্টি হলো মনে হচ্ছিল বুঝি উপদেশ দানকারীর যেন জীবনের এটাই শেষ উপদেশ। এক ব্যক্তি আবেদন করলো, হে আল্লাহর রসূল! আমাদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার, (ইমাম বা নেতার) আদেশ শোনার ও (তাঁর) অনুগত থাকতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী (কৃষ্ণাঙ্গ) গোলাম হয়। আমার পরে তোমাদের যে ব্যক্তি বেঁচে থাকবে সে অনেক মতভেদ দেখবে। এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নাতকে ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ি রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরা এবং এ পথ ও পন্থার উপর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দীনের ভেতরে নতুন নতুন কথার (বিদ্‘আত) উদ্ভব ঘটানো হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেকটা নতুন কথাই [বা কাজ শারী‘আতে আবিষ্কার করা যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ করেননি তা] বিদ্‘আত এবং প্রত্যেকটা বিদ্‘আতই ভ্রষ্টতা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৬৫, সুনান ইবনু মাজাহ ৪২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৭৬, আবূ দাঊদ ৪৬০৭, আহমাদ ১৬৬৯২, ১৬৬৯৪, দারিমী ৯৫, ইরওয়াহ ২৪৫৫, ফিলাল ২৪-২৬, সালাতুত তারাবীহ ৮৮-৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি বলেন,

আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনু সাব্বাহ ও আবদুল্লাহ ইবনু আওন হিলালী (রহঃ)....আয়িশাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মীয় কাজের বিষয়ে এমন বিষয় উদ্ভাবন করে যা তাতে নেই (দলীলবিহীন), তা পরিত্যাজ্য।

আয়িশাহ্ (রাযিঃ) বলেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এমন কোন কর্ম করলো যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৩৮৪-৪৩৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৩৪৩, ইসলামিক সেন্টার ৪৩৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অতএব ১৫ই শা‘বান উপলক্ষ্যে প্রচলিত সকল প্রকার ইবাদত ও অনুষ্ঠানাদি নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

(৩) এ রাতে রূহগুলি সব মর্ত্যে নেমে আসে। এ বিষয়ে সূরা ক্বদরের ৪ ও ৫ আয়াতকে প্রমাণ হিসাবে বলা হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, ‘সে রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি; ফজরের উদয়কাল পর্যন্ত’ (ক্বদর ৯৭/৪-৫)।

এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে ক্বদরের রাত্রি এবং ‘রূহ’ বলতে ফেরেশতাদের সর্দার জিব্রীলকে বুঝানো হয়েছে (ইবনু কাছীর)।

প্রত্যেক মৃতের রূহ মর্ত্যে নেমে আসে এ ধারণা ভুল। কেননা মৃত্যুর পরে কোন রূহ আর পৃথিবীতে ফেরৎ আসতে পারে না। কেননা ‘তাদের সামনে পর্দা থাকে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত’। (মুমিনূন ২৩/১০০)।

আরও এসেছে, “আর সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করুন, আমরা যা করতাম তার পরিবর্তে সৎকাজ করব।’ আল্লাহ বলবেন, “আমরা কি তোমাদেরকে এতো দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ উপদেশ গ্ৰহণ করতে চাইলে উপদেশ গ্ৰহণ করতে পারতো? আর তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল। কাজেই শাস্তি আস্বাদন কর; আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।” [সূরা ফাতির: ৩৭]

শবেবরাতের ছালাত

এই রাত্রির ১০০ রাক‘আত ছালাত সম্পর্কে যেসব হাদীছ বলা হয়ে থাকে তা ‘মওযূ’ বা জাল। (ইবনুল জাওযী, আল-মওযূ‘আত ২/১২৭-২৯)।

মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) বলেন, ‘জুম‘আ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ‘ছালাতে আলফিয়াহ’ নামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর সপক্ষে যেসব হাদীছ ও আছার বলা হয়, তার সবই জাল অথবা যঈফ। এব্যাপারে (ইমাম গাযালীর) ‘এহ্ইয়াউল উলূম’ ও (আবু তালেব মাক্কীর) ‘কূতুল ক্বুলূব’ দেখে যেন কেউ ধোঁকা না খায়।... এই বিদ‘আত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম যেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়।মসজিদের মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করেন। এর মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং নেতৃত্ব করা ও পেট পুর্তি করার একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্র। এই বিদ‘আতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে নেককার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধ্বসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন’। (মিরক্বাত শরহ মিশকাত হা/১৩০৮-এর ব্যাখ্যা দ্র. ৪/৪৪৬-৪৭ পৃ.)।

শা‘বান মাসের করণীয়

রামাযানের আগের মাস হিসাবে শা‘বান মাসের প্রধান করণীয় হলো অধিকহারে ছিয়াম পালন করা।

‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (নফল) সওম রাখা শুরু করতেন, এমনকি আমরা বলতাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি এখন সওম বন্ধ করবেন না। আবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন সওম রাখা ছেড়ে দিতেন আমরা বলতাম, এখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি আর সওম রাখবেন না। রমাযান (রমজান) ছাড়া অন্য কোন মাসে তাঁকে পূর্ণ মাস সওম রাখতে দেখিনি। আর শা‘বান ছাড়া অন্য কোন মাসে তাঁকে আমি এত বেশী সওম রাখতে দেখিনি। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে তিনি [‘আয়িশাহ্ (রাঃ)] বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু দিন ছাড়া শা‘বানের গোটা মাস সওম পালন করতেন।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২০৩৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯৬৯, ১৯৭০, ৬৪৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ২৬১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫৬, আবূ দাঊদ ২৪৩৪, নাসায়ী ২১৭৭, মুয়াত্ত্বা মালিক ১০৯৮, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৮৬১, আহমাদ ২৪৭৫৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪২৭, সহীহ ইবনু হিববান ৩৬৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ১০২৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনের দিন ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শা‘বান মাসের অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে তোমরা সওম পালন করবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৭৪, সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৫১, আবূ দাঊদ ২৩৩৭, তিরমিযী ৭৩৮, সহীহ আল জামি ৩৯৭, আহমাদ ৯৪১৪; দারেমী ১৭৪০, সহীহ আবী দাউদ ২০২৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হোন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।

মোট কথা শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত। ছহীহ দলীল ব্যতীত কোনো দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন, শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল হলে কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা বিদ‘আতী কোনো আমল আল্লাহ কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৬৫, আহমাদ ১৬৬৯৪, আবূ দাঊদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৬৭৬, ইবনু মাজাহ্ ৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজ নিজ আমলসমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন-আমিন!

উল্লেখিত দলীলসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, শবেবরাত উপলক্ষে যেসব অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয় তা সম্পূর্ণ বিদআত। যারা জাল-জইফ হাদিস দিয়ে শবেবরাত পালনের পক্ষে  মত দিয়ে আসছেন তারা ১০০% গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত। আর প্রত্যেক গোমরাহীর স্থান হবে জাহান্নামে।

শবেবরাতে নামায পড়া, রোযা রাখা ও ইবাদত করার ব্যাপারে যে হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলো যয়ীফ (দুর্বল) শ্রেণীর হাদিস নয়; বরং মাওযু (বানোয়াট) ও বাতিল শ্রেণীয়। এমন হাদিস গ্রহণ করা ও এর উপর আমল করা জায়েয নয়; সেটা ফযিলতের হোক কিংবা অন্য ক্ষেত্রে হোক।

প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা! শাবান মাসে শুধু মাত্র রোজা ছাড়া অতিরিক্তি আর কোনো আমল নেই। অন্যান্য মাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিধান আছে আপনি শাবান মাসেও রাখতে পারেন। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারে রাসুল সাঃ রোজা রাখতেন আপনিও শাবান মাসের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারে রোজা রাখেন। প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানের নিকটবর্তী রহমতের দৃষ্টি দিয়ে ডাকাডাকি করেন সেটা ৩৬৫ দিনেই করা হয়। শুধু মাত্র মধ্য শাবানেই করা হয় না। তাছাড়া এই হাদিসটির চেয়ে সারা বছর ডাকাডাকির হাদিসটির গ্রহণযোগ্যতা বেশী।

আপনি রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ অনুসরন না করে দলিলবিহীন শবেবরাত পালন করেন বা তার পক্ষে জাল জঈফ হাদিস পেশ করেন তাহলে আপনি কোন স্তরের মুসলমান। আসুন এইসব বিদআতি কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকি। তবে হ্যাঁ মধ্য শাবান রাতে আপনি অন্যান্য মাস ও রাতের মতোই মধ্য শাবান রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠে তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করবেন, বিভিন্ন দোয়ার আমল বা জিকির করবেন, তওবার দোয়াগুলো পাঠ করবেন, দরুদ পাঠ করবেন ইত্যাদি শেষে একাকী দুই হাত তুলে আল্লাহর নিকট যা চাওয়ার তাই চাইবেন। তবে এটা কিন্তু প্রতিদিনের রুটিন। মধ্য শাবানে শবেবরাত উপলক্ষ্যে কোনো আমল নেই।

বিদআতী আলেমদের তওবাও কবুল হয় না যতক্ষণ না---

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আল্লাহ প্রত্যেক বিদআতীর তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত স্থগিত রাখেন (গ্রহণ করেন না), যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার বিদআত বর্জন না করেছে।” (ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৪২০২, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৯৪৫৭, সহীহ তারগীব ৫৪নং)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

======================================

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...