Search This Blog

Wednesday, September 25, 2019

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব, ফজিলত ও ভয়াবহ পরিনতি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব, ফজিলত ও ভয়াবহ পরিনতি

ভূমিকাঃ

ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মীয়তা সম্পর্কের গুরুত্ব দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে কিছু চাও এবং রক্ত সম্পর্কীয় সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন কর।’ অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধন ছিন্ন করো না। (সুরা আননিসা-১)।

আল্লাহ পাক আরও বলেন,

‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এসব যারা করবে, তাদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।’ (সূরা মুহাম্মদ : ২২, ২৩)।

মানুষ মাত্রই তার কিছু না কিছু আত্মীয়-স্বজন অবশ্যই রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠাই নিতান্ত স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে দুনিয়ার কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো তাদের পরস্পরের মাঝে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ লেগে যাওয়াও অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে তা কখনো দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যাবে না। নতুবা তা এক সময় অপরের প্রতি কঠিন বিদ্বেষ ও নির্মম শত্রুতা পোষণে উৎসাহিত করবে। আর তখনই তা একদা সেই পরম আত্মীয়তার বন্ধনটিকে ছিন্ন করা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে। যা শরী‘আত কিংবা মানব দৃষ্টিতেও কখনোই কাম্য নয়। কারণ, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে একটি মহা পাপ ও মারাত্মক অপরাধ যা পরস্পরের সম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয় এবং যা আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও তাঁর নগদ শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও জান্নাতে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এমনকি যা কখনো কখনো একাকীত্ব, নীচুতা এবং লাঞ্ছনারও কারণ হয়। উপরন্তু তা কখনো কখনো মানব জীবনের এক মহা দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও পেরেশানির ব্যাপারও হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, যার পক্ষ থেকে সর্বদা ভালো ব্যবহার পাওয়াই মানুষের একমাত্র কামনা তার পক্ষ থেকে কখনো কোনো দুর্ব্যবহার বা অসদাচরণ সত্যিই উদ্বেগের বিষয়ই বটে। তাই পার্থিব জীবনে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ।

আত্মীয়র পরিচয়

আত্মীয়’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বজন, জ্ঞাতি, কুটুম্ব। এর আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে الرَّحِمُ (আর-রাহিমু) বা ذُو الرَّحِمِ (যুর রাহিমে)। আত্মীয়তা-এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Relationship. এর সংজ্ঞায় Oxford অভিধানে বলা হয়েছে, এমন পথ-পন্থা যাতে দু’ব্যক্তি, দল বা দেশ পরস্পরের সাথে সদাচরণ করে বা পরস্পরে আলোচনা করে’। ( A.S. Hornby, Oxford Advanced Learner's Dictionary, P. 1285.)

কেউ কেউ বলেন, ‘আত্মীয় হচ্ছে তারা যাদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে, তারা সম্পদের উত্তরাধিকারী হোক বা না হোক, মাহরাম হোক বা না হোক’। (আবু ইউসুফ মুহাম্মাদ যায়েদ, তায়্যিবুল কালাম ফী ছিলাতির রাহিম, পৃঃ ১)।

আত্মীয়তার সম্পর্কের তাৎপর্য

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে স্বজন ও আপনজনের সার্বিক খোঁজ-খবর রাখা ও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা। ইবনুল আছীর বলেন, ‘এটা হচ্ছে বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহ-অনুকম্পা প্রদর্শন করা, তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা, যদিও তারা দূরে চলে যায় এবং খারাপ আচরণ করে। (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, কাতীয়াতুর রাহিমে, পৃঃ ৭)।

আত্মীয়তার প্রকার

আত্মীয় প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ-

 (১) রক্ত সম্পর্কীয় বা বংশীয়। যেমন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, ভাইবোন, চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।

(২) বিবাহ সম্পর্কীয়। যেমন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: অদূর ভবিষ্যতে  তোমরা নিশ্চয় মিসর জয় করবে। তা এমন একটি দেশ যেখানে কীরাত (আঞ্চলিক মুদ্রার নাম) ব্যবহার হয়ে। থাকে। তোমরা যখন তা জয় করবে, তখন সেখানকার অধিবাসীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা তাদের সাথে সৌহার্দ ও আত্মীয়তার অথবা বলেছেন, সৌহার্দ ও শ্বশুরাত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আর যখন দেখবে, দুই লোক একটি ইটের জায়গা নিয়ে পরস্পর বিবাদ করছে তখন তুমি সে স্থান হতে সরে পড়বে। আবূ যার (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি আবদুর রহমান ইবনু শুরাহবিল ইবনু হাসানাহ্ ও তার ভাই (রবীআহ-কে) একটি ইটের স্থান নিয়ে পরস্পর ঝগড়া করতে দেখতে পাই, তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৯১৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৩৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৪৩, মুসনাদে আহমাদ ২১৫৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয় দুই প্রকার।

(১) উত্তরাধিকারী; যেমন- পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি

(২) উত্তরাধিকারী নয়; যেমন- চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার হুকুম

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম ফরয, সুন্নাত ও বৈধ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং আত্মীয়দের ভিন্নতার কারণে। তবে সাধারণভাবে সবার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা ওয়াজিব এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তবে কারো কারো নিকটে কবীরা গোনাহ।

(১) ফরযঃ পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ফরয। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’। (সুরা আনকাবূত ২৯/৮)।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হ’লে তাদেরকে উফ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল’, মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’। (সুরা ইসরা ১৭/২৩-২৪)।

পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে হাদীছে অনেক নির্দেশ এসেছে। আর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বড় গোনাহ বলা হয়েছে।

আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদা তিনবার বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করব না? সকলে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। তিনি হেলান দিয়ে বসেছিলেন; এবার সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, শুনে রাখ! মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, এ কথাটি তিনি বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আর যদি তিনি না বলতেন(সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬৫৪, ৫৯৭৬-৬২৭৩-৬২৭৪-৬৯১৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৭, আহমাদ ১২৩৩৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবদুল্লাহ্ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কবীরা গুনাহ্সমূহ কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ তারপর পিতা-মাতার অবাধ্যতা। সে বলল, তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ তারপর মিথ্যা কসম করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিথ্যা শপথ কী? তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি (শপথের সাহায্যে) মুসলিমের ধন-সম্পদ হরণ করে নেয়। অথচ সে এ শপথের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারী। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬৭৫, আধুনিক প্রকাশনী ৬৪৪০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪৫২, সুনান আবু দাউদ ২৮৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ ‘আমর শায়বানী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.)-এর বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এ বাড়ির মালিক আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ ‘আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ‘যথা সময়ে সালাত আদায় করা। ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, অতঃপর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার। ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অতঃপর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্ (আল্লাহর পথে জিহাদ)। ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.) বলেন, এগুলো তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনই, যদি আমি আরও অধিক জানতে চাইতাম, তাহলে তিনি আরও বলতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫২৭, ২৭৮২, ৫৯৭০, ৭৫৩৪; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৫৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৫, আহমাদ ৪২২৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৯৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বললেন,

শাইবান ইবনু ফাররূখ (রহঃ).....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক। জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তির, হে আল্লাহর রসূল? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে বার্ধক্যাবস্থায় পেল অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪০৪-৬৪০৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫১ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৭৯, ইসলামিক সেন্টার ৬৩২৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) সুন্নাতঃ  অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা সুন্নাত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশকারী আমল সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে বলেন, ‘তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে’।

হাদিসঃ

আবূ আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, জনৈক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বললেনঃ আমাকে এমন একটি ‘আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তার কী হয়েছে! তার কী হয়েছে! এবং বললেনঃ তার দরকার রয়েছে তো। তুমি আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে, তাঁর সঙ্গে অপর কোন কিছুকে শরীক করবে না। সালাত আদায় করবে, যাকাত আদায় করবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩৯৬, আদাবুল মুফরাদ ৪৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৩) মানদূব বা বৈধঃ কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখা বৈধ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে’। (সুরা লোক্বমান ৩১/১৫)।

আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে আমার আম্মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট এলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট ফাতওয়া চেয়ে বললাম, তিনি আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সদাচরণ কর।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৬২০, ৩১৮৩, ৫৯৭৮, ৫৯৭৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২১৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০০৩, আহমাদ ২৬৯৮১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আত্মীয়দের মাঝে মর্যাদা বা স্তরের ভিন্নতা

আত্মীয় নিকটত্ব ও দূরত্বের ভিত্তিতে এবং বংশ ও স্থানের দূরত্বের দৃষ্টিকোণে ভিন্নতর হয়ে থাকে। সুতরাং বংশীয় দিক দিয়ে নিকটাত্মীয় হচ্ছেন পিতা-মাতা। তবে এর মধ্যে মায়ের স্তর ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট’। (সুরা লোক্বমান ৩১/১৪)।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেনঃ তোমার মা। লোকটি বললঃ অতঃপর কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার মা। সে বললঃ অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললঃ অতঃপর কে? তিনি বললেনঃ অতঃপর তোমার বাপ।

ইবনু শুবরুমাহ বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু আইউব আবূ যুর’আ থেকে এ রকমই বর্ণনা করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৩৯৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৪৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৩৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র তিনি বলেন, মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়ের নাফরমানী, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া, কারো প্রাপ্য না দেয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেয়া আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা, আর মাল বিনষ্ট করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪০৮, ৮৪৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ভাই-বোনও অন্তর্ভুক্ত। তবে ভাই-বোন বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় হয়ে থাকে। আবার সম্পর্কের কারণে তারা দূরবর্তীও হয়। যেমন চাচাত, মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই।

আবার স্থানের দূরত্বের কারণেও স্তরের ভিন্নতা হয়। যেমন নিজ মহল্লা ও নিজ শহরে বসবাসকারী আত্মীয় নিকটের। পক্ষান্তরে ভিন্ন মহল্লায় ও ভিন্ন শহরে বসবাসকারী আত্মীয় দূরের অন্তর্ভুক্ত। তবে রক্ত বা বংশ সম্পর্কিত আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা যরূরী অন্যদের অপেক্ষা। এখানে সময়ের কোন নির্ধারিত সীমা নেই। আজীবন এ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

প্রকৃত জ্ঞাতি সম্পর্ক

কোন ব্যক্তি যখন তার কোন আত্মীয়ের সাক্ষাৎ করার কারণে ঐ আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে, এটাকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা বলে না। বরং এটা হচ্ছে প্রতিদান স্বরূপ। অনুরূপভাবে যদি কোন কাজে সহযোগিতা ও প্রয়োজন পূর্ণ করা হয় আত্মীয়ের অনুরূপ কাজের বিনিময়ে তাহ’লে এটাকেও আত্মীয়তা রক্ষা করা বলা হবে না। এটাও হচ্ছে প্রতিদান বা বিনিময়। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা রক্ষা হচ্ছে সম্পর্ক ছিন্ন করা হ’লেও যে তা বজায় রাখে। আত্মীয় দুর্ব্যবহার করলেও যে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, খোঁজ-খবর নেয়, তারা তার সাথে অসদাচরণ করলেও সে উত্তম আচরণ করে।

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাবী সুফ্ইয়ান বলেন, আমাশ এ হাদীস মারফূ’রূপে বর্ণনা করেননি। অবশ্য হাসান (ইবনু আমর) ও ফিতর (রহ.) একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও তা বজায় রাখে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৯১, আধুনিক প্রকাশনী ৫৫৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৪৫২, সুনান আততিরমিযী ২০২৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদীছে এসেছে,

মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ)....আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করে থাকি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সহনশীলতা প্রদর্শন করে থাকি আর তারা আমার সঙ্গে মূৰ্খসুলভ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, তুমি যা বললে, তাহলে যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয় তুমি যেন তাদের উপর জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করছ। আর সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯২৪, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৫৩৪, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩৭, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৫৯৭, আহমাদ- ৯৩৪৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৫০, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৫৬৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৮৬, আল-আদাবুল মুফরাদ ৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতি যরূরী। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।’ (সুরা নিসা ৪/৩৬)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা এক অপরের নিকট যাচ্ঞা কর এবং তোমরা সতর্ক থাক জ্ঞাতি-বন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন’। (সুরা নিসা ৪/১)।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’। (সুরা রা‘দ ১৩/২১)।

আল্লাহ বলেন ‘স্মরণ কর, যখন আমরা বানী ইসরাঈলের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না, পিতামাত, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে’। (সুরা বাক্বারাহ ২/৮৩)।

তিনি আরো বলেন, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে?’। (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/২২)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন’। (সুরা নাহল ১৬/৯০)।

তিনি আরো বলেন, ‘আত্মীয়কে তার অধিকার প্রদান কর’। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/২৬; রূম ৩১/৩৮)।

হাদীছেও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে অনেক তাকীদ এসেছে।

কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ).....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়: “তোমার নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দাও" (সূরাহ আশ শু’আরা ২৬ - ২১৪)। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরায়শদের ডাকলেন। তারা একত্রিত হলো। তারপর তিনি তাদের সাধারণ ও বিশেষ সকলকে সম্বোধন করে বললেন, হে কাব ইবনু লুওয়াই-এর বংশধর। জাহান্নাম থেকে তাদের আত্মরক্ষা কর। ওহে মুররাহ ইবনু কাব এর বংশধর। জাহান্নাম থেকে তোমরা আত্মরক্ষা কর। ওহে আবদ শামস এর বংশধর! জাহান্নাম থেকে তোমরা আত্মরক্ষা কর। ওহে আবদ মানাফ এর বংশধর! জাহান্নাম থেকে তোমরা নিজেদের বাঁচাও। ওহে হাশিমের বংশধর। জাহান্নাম থেকে তোমরা আত্মরক্ষা কর। ওহে আবদুল মুত্তালিব এর বংশধর! জাহান্নাম থেকে তোমরা নিজেদের বাঁচাও। ওহে ফাতিমা! জাহান্নাম থেকে তুমি নিজেকে বাঁচাও। কারণ, আল্লাহর (আযাব) থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমার কোন ক্ষমতা নেই। অবশ্য আমি তোমাদের সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করব। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৮৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৯৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪০৮, আল-আদাবুল মুফরাদ ৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, জনৈক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বললেনঃ আমাকে এমন একটি ‘আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তার কী হয়েছে! তার কী হয়েছে! এবং বললেনঃ তার দরকার রয়েছে তো। তুমি আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে, তাঁর সঙ্গে অপর কোন কিছুকে শরীক করবে না। সালাত আদায় করবে, যাকাত আদায় করবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩৯৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ আইঊব আনছারী (রাঃ) বলেন, জনৈক বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর এক ভ্রমণকালে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, ‘যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম হ’তে দূরবর্তী করবে, সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বললেন, ‘ইবাদত করবে আল্লাহর এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবে না। ছালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫০৮)।

রোমের বাদশাহ হিরাকল আবু সুফিয়ানকে যে প্রশ্ন করেছিল, সে সম্পর্কিত হাদীছে আছে,

হিরাকল বলল, তিনি তোমাদের কি আদেশ করেন? আবু সুফিয়ান বলেন, তখন আমি বললাম, তিনি বলেন, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক কর না। তোমাদের পিতৃপুরুষ যে সবের ইবাদত করত, তা ছেড়ে দাও। তিনি আমাদের আদেশ করেন ছালাত আদায় করতে, ছাদাক্বাহ দিতে, পূতপবিত্র থাকতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭, ২৯৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং ঐ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ও অটুট রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা সবার জন্য আবশ্যক। যে ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্ক বজায় রাখলে ইহকালীন ও পরকালীন ফায়দা রয়েছে। আবার এ সম্পর্ক ছিন্ন করলে পরকালে শাস্তি রয়েছে। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক সংরক্ষণে আমাদেরকে যথা সম্ভব সচেষ্ট হ’তে হবে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফজিলত

আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার ফযীলত বহুবিধ। তন্মধ্যে কতিপয় দিক এখানে উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানের পরিচায়কঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন কল্যাণকর কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬১৩৮, ৫১৮৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫৯৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২)  আল্লাহর আনুগত্যের প্রকাশঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য করার বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে’। (সুরা রা‘দ ১৩/২১)।

(৩)  আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ রেহেম (রক্তের বাঁধন) রহমানের অংশবিশেষ। সে বলবে, “হে প্ৰভু! আমি মযলুম, হে প্ৰভু! আমি ছিন্নকৃত, হে প্ৰভু! আমি আমি...। তখন আল্লাহ তাকে জবাব দিবেন, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তোমাকে যে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্ন করবো এবং যে তোমাকে সংযুক্ত রাখবে, আমিও তাকে সংযুক্ত রাখবো? (আল-আদাবুল মুফরাদ ৬৫)।  হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(৪)  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত প্রতিপালন করাঃ

নবী করীম (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতকে বিভিন্ন বিষয়ে অছিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। সুতরাং আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা হলে তাঁর উপদেশ প্রতিপালন করা হবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার বন্ধু নবী করীম (ছাঃ) আমাকে কতিপয় উত্তম গুণের ব্যাপারে উপদেশ দেন। তিনি আমাকে উপদেশ দেন যে, আমি যেন আমার চেয়ে উঁচু স্তরের লোকের দিকে লক্ষ্য না করি; বরং আমার চেয়ে নিম্নস্তরের লোকের দিকে তাকাই। তিনি আরো উপদেশ দেন, দরিদ্রদের ভালবাসতে ও তাদের নিকটবর্তী হ’তে। তিনি উপদেশ দেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে, যদিও তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে...’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৫, সনদ ছহীহ)।

(৫)  আল্লাহর নিকট অন্যতম প্রিয় আমলঃ

মানুষের কৃত অনেক আমল আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও পসন্দনীয়। তন্মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা অন্যতম। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

‘খাছ‘আম গোত্রের জনৈক লোক হ’তে বর্ণিত সে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে আসলাম। তিনি তখন ছাহাবীদের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে ছিলেন। আমি বললাম, আপনিতো সেই ব্যক্তি যিনি ধারণা করেন যে, আপনি আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে পসনদনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর উপরে ঈমান আনা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন আমল আল্লাহর নিকটে অপসন্দনীয়? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরপর কি? তিনি বললেন, গর্হিত কাজের নির্দেশ দেওয়া এবং সৎকাজে নিষেধ করা’। (ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২২, সনদ ছহীহ)।

(৬)  বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির উপায়ঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে মানুষের বয়স ও জীবিকা বৃদ্ধি পায়। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি শুনেছি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০৬৭, ৫৯৮৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৪১৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৯২২ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৩৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র তিনি বলেন,

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি চায় যে, তার রিযক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বর্ধিত হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৮৬, ২০৬৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

এখানে বয়স বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে হায়াতে বরকত লাভ করা। সেই সাথে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ দেহ, শক্তিমত্তা এবং অধিক কাজ করার ক্ষমতা লাভ করা।  (কাতী‘আতুর রাহিমু, ১/৯ পৃঃ)।

কেউ কেউ বলেন, বয়স ও রিযিক বৃদ্ধির তাৎপর্য হচ্ছে যে, আল্লাহ প্রকৃতই বান্দার বয়স ও জীবিকা বাড়িয়ে দেন। এখানে এ প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নেই যে, বয়স ও রিযিক নির্ধারিত; সুতরাং তা কিভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে? কেননা হায়াত ও রিযক দু’ধরনের। যথা- ১. সাধারণ, যা কেবল আল্লাহ জানেন। এটা অপরিবর্তিত। ২. লিপিবদ্ধ, যা তিনি ফেরেশতাদের মাধ্যমে লিখিয়েছেন ও তাদের অবহিত করেছেন; বিভিন্ন কারণ ও ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘ ফাতাওয়া, ৮/৫১৭, ৫৪০)।

(৭) আত্মীয়দের মাঝে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধির মাধ্যমঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জুড়ে রাখে, তার মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া হয়, তার সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৮, সনদ হাসান)।

অন্য শব্দে এসেছে এভাবে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখে, তার আয়ু বর্ধিত করা হয়, তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে।  (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯, সনদ হাসান)।

তিনি আরো বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের বংশ পরিচয় শিক্ষা করো, তাহলে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারবে। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক আপনজনের মধ্যে সম্প্রীতি, ধন-সম্পদের প্রবৃদ্ধি এবং আয়ুতে দীর্ঘজীবী হওয়ার উপলক্ষ হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯৩৪, সুনান আতআত্ তিরমিযী ১৯৭৯, আস্ সহীহাহ্ ২৭৬, সহীহুল জামি‘ ২৯৬৫, সহীহ আত্ তারগীব ২৫২০, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩২, আহমাদ ৮৮৬৮, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১১৮৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৮৩০৮, আল মুসতাদরাক ৭২৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৮) পৃথিবীর অধিবাসীদের উন্নয়নঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পৃথিবীবাসীদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং তাদের বয়স বৃদ্ধি করে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেছেন, ‘যাকে নম্রতা দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বহু কল্যাণ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, উত্তম চরিত্র ও সৎ প্রতিবেশী দুনিয়ার অধিবাসীদের উন্নয়ন ঘটায় এবং বয়স বৃদ্ধি করে’। (মুসনাদ আহমাদ; সিলিসিলা ছহীহাহ হা/৫১৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫২৪)।

(৯)  দ্রুত ছওয়াব লাভের উপায়ঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে অবিলম্বে ছওয়াব বা প্রতিদান লাভ করা যায়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যে সম্পন্ন এমন কোন কাজ নেই, যার মাধ্যমে দ্রুত ছওয়াব লাভ করা যায় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ব্যতীত। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বিদ্রোহ করা ব্যতীত কোন কাজে দ্রুত শাস্তি আপতিত হয় না’। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ১০/৬২; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৯১; ছহীহাহ হা/৯৭৮)।

(১০) আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দিবেঃ

যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে ক্বিয়ামতের দিন অপরাপর আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘রক্তের বন্ধন ক্বিয়ামতের দিন তার সংশ্লিষ্টজনের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং যদি সে তাকে দুনিয়ায় যুক্ত রেখে থাকে, তবে সে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, যদি সে তাকে দুনিয়ায় ছিন্ন করে থাকে, তবে সে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৭)।

(১১)  জান্নাতে প্রবেশের উত্তম মাধ্যমঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে জান্নাতে প্রবেশ করা সহজ হয়। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন এক গ্রাম্য লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি ’আমল বলে দিন যে ’আমলের দরুন আমি জান্নাতে যেতে পারি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যদিও তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে, কিন্তু তুমি ব্যাপক বিষয় জানতে চাচ্ছ। তুমি একটি প্রাণী মুক্ত কর এবং গোলাম মুক্ত কর। সে বলল, এ কাজ দু’টি কি একই নয়? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, (অবশ্যই) না। কেননা প্রাণী মুক্ত করার অর্থ হলো তুমি একাকী একটি প্রাণ মুক্ত করা, আর গোলাম মুক্ত করার অর্থ হলো তার মুক্তিপণের মাধ্যমে সাহায্য করা। অধিক দুগ্ধদানকারী প্রাণী দান করা এবং অত্যাচারী আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়াপ্রবণ হওয়া। যদি তুমি এসব কাজ করতে সক্ষম না হও, তাহলে ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াও এবং তৃষ্ণার্তকে পান করাও। সৎকর্মের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজে বাধা দাও। আর যদি তুমি এ কাজ করতেও অক্ষম হও, তাহলে উত্তম কথোপকথন ছাড়া তোমার জিহবাকে সংযত রাখ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৩৮৪, আহমাদ ১৮৬৪৭, শু‘আবুল ঈমান ৪০২৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৮৯৮, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৮০। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,

’আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পর আমি তাঁর কাছে গেলাম। তাঁর ’চেহারা মুবারাক’ দেখেই আমি চিনতে পেরেছি এ কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। সর্বপ্রথম তিনি যে কথা বলেছিলেন তা ছিল, ’’হে লোকেরা! তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, ক্ষুধার্তকে খাবার দাও, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচরণ করো, রাতের বেলা যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকবে, তখন তাহাজ্জুদের সালাত আদায় কর, তাহলে প্রশান্তচিত্তে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯০৭, আত্ তিরমিযী ২৪৮৫, সুনান ইবনু মাজাহ ৩২৫১, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৫৮৪৭, আহমাদ ২৩৭৮৪, দারিমী ১৪৬০, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪২৮৩, সহীহ আত্ তারগীব ৬১৬, সিলসিলা ছহীহাহ ৫৬৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(১২)  আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার সাওয়াব পাওয়া যায়ঃ

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে সদকা করার উপদেশ দিলে নিজ স্বামীদেরকেও সদকা করা যাবে কি না সে ব্যাপারে দু’ জন মহিলা সাহাবী বিলাল এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,

“(স্বামীদেরকে দিলেও চলবে) বরং তাতে দু’টি সাওয়াব রয়েছে: একটি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার সাওয়াব এবং আরেকটি সদকার সাওয়াব”। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৬৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২০৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০০০, আহমাদ ১৬০৮৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৭২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বৃদ্ধির কতিপয় উপায়

আত্মীয়তার সম্পর্ককে সুদৃঢ় ও মযবূত করা এবং তা অক্ষুণ্ণ ও অবিচল রাখার জন্য কিছু কাজ সম্পন্ন করা যরূরী। নিম্নে সেসব উল্লেখ করা হলোঃ

(১)  আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়াঃ

কোন জিনিসের ফলাফল ও শুভ পরিণতি অবগত হ’লে সে কাজ সম্পাদনে মানুষ উৎসাহী ও আগ্রহী হয় এবং তা সম্পাদনে সচেষ্ট ও যথাসাধ্য তৎপর হয়। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত অবগত হওয়া আবশ্যক।

(২) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি জানাঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার পাপ ও পরিণতি অবগত হ’লে মানুষ এসব থেকে সাবধান হবে। তাছাড়া এ কারণে যে পার্থিব অনিষ্ট রয়েছে তা জানলে এ বন্ধন সংরক্ষণে সচেষ্ট হবে।

(৩) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনাঃ

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা নেকীর কাজ। তাই এ কাজ করার জন্য আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করতে হবে। পক্ষান্তরে এ সম্পর্ক ছিন্ন করা পাপ। তাই এ পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্যও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।

(৪) আত্মীয়-স্বজনের দুর্ব্যবহার সুন্দরভাবে মোকাবিলা করাঃ

জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মাঝে মুহাববত বজায় রাখা, তাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা এবং অসদাচরণেও ধৈর্য ধারণ করা ও তা সুন্দরভাবে মোকাবিলা করা। যেমন হাদীছে এসেছে,

মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ)...আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করে থাকি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সহনশীলতা প্রদর্শন করে থাকি আর তারা আমার সঙ্গে মূৰ্খসুলভ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, তুমি যা বললে, তাহলে যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয় তুমি যেন তাদের উপর জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করছ। আর সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯২৪, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৫৩৪, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৩৭, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ২৫৯৭, আহমাদ- ৯৩৪৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৫০, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৫৬৯, আল মু‘জামুল আওসাত্ব ২৭৮৬, আল-আদাবুল মুফরাদ ৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৯৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(৫) ভুলের পর তাদের পেশকৃত কৈফিয়ত গ্রহণ করাঃ

আত্মীয়-স্বজন ভুল করার পর কৈফিয়ত পেশ করলে তাদের সে কৈফিয়ত গ্রহণ করা এবং তাদের ক্ষমা করে দেওয়া। যেমন ইউসুফ (আঃ) স্বীয় ভাইদের পেশকৃত কৈফিয়ত গ্রহণ করেন এবং তাদের ক্ষমা করে দেন। (সুরা ইউসুফ ১২/৯১-৯২)।

(৬) তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়াঃ

মানুষ মাত্রই ভুল করে, অপরাধ করে। সুতরাং আত্মীয়-স্বজনের কৃত অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া উদার চিত্ত ও ভদ্র-শালীন মানুষের পরিচয়। তাদের এ অপরাধ ভুলে যাওয়া এবং পরবর্তীতে কখনো এসব তাদের সামনে উচ্চারণ না করা। এতে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে।

(৭)  তাদের সাথে বিনয়ী ও নম্র আচরণ করাঃ

আত্মীয়দের সাথে নম্র-ভদ্র আচরণ করলে সর্ম্পক মযবূত হয়। সম্পর্কের সেতুবন্ধন অক্ষুণ্ণ থাকে। আত্মীয়-স্বজন আরো নিকটতর হয়। তাই আত্মীয়দের ভুল-ত্রুটি আমলে না নিয়ে তা উপেক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে।

(৮)  তাদের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করাঃ

মানুষের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করা মহত্ত্বের পরিচয়। বিশাল হৃদয়ের মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব। এর মাধ্যমে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়, বৈরিতা দূরীভূত হয়।

(৯)  তাদের জন্য সাধ্যমত ব্যয় করাঃ

আত্মীয়দের জন্য সাধ্যমত ব্যয় করা। কেননা তাদের জন্য দান করলে অধিক ছওয়াব পাওয়া যায় এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা হয়।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) মদীনার আনসারদের মধ্যে খেজুর বাগানের মালিক হিসেবে সর্বাধিক সম্পদশালী ছিলেন। আর তার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল মসজিদে নাবাবী সামনের ’বায়রাহা-’ (নামক বাগানটি)। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাগানটিতে প্রায়ই প্রবেশ করতেন ও এর পবিত্র পানি পান করতেন। আনাস (রাঃ) বলেন, যখন অর্থাৎ ’’তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে অবশ্যই পৌঁছতে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাদের প্রিয়তর জিনিস আল্লাহর পথে খরচ না করবে’’- (সূরাহ্ আ-লি ’ইমরান ৩: ৯২) এ আয়াত নাযিল হলো; তখন ত্বলহাহ্ (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! যেহেতু আল্লাহ তা’আলা বলেন, অর্থাৎ আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ ’বায়রাহা-’ আল্লাহর নামে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করলাম। আমি আশা করব আমি এর জন্য আল্লাহর কাছে সাওয়াব পাব। হে আল্লাহর রসূল! আপনি তা কবূল করুন। যে কাজে আল্লাহ চান তাতে আপনি তা লাগান। (এ ঘোষণা শুনে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবাশ! সাবাশ!! বলে উঠলেন। (তিনি বললেন) এ সম্পদ খুবই কল্যাণকর হবে। তোমার ঘোষণা আমি শুনেছি। এ বাগানটি তুমি তোমার গরীব নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দাও। আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি তাই করব। অতঃপর আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) খেজুর বাগানটিকে তাঁর নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৪৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ১৪৬১, ২৩১৮, ২৭৫২, ২৭৫৮, ২৭৬৯, ৪৫৫৪, ৪৫৫৫, ৫৬১১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২০৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯৯৮, মুয়াত্ত্বা মালিক ৩৬৫২, আহমাদ ১২৪৩৮, সহীহ আত্ তারগীব ৮৭৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদীছে এসেছে,

’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ)-এর স্ত্রী যায়নাব (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে রমণীগণ! তোমরা দান খয়রাত করো। তা তোমাদের অলংকারাদি হতে। যায়নাব বলেন, (এ কথা শুনে) আমি ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ-এর কাছে এলাম। তাঁকে বললাম, আপনি রিক্তহস্ত মানুষ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দান সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করতে বলেছেন। তাই আপনি তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে আসুন (আমি যদি আপনাকে ও আপনার সন্তানদের জন্য সদাক্বাহ্ (সাদাকা) হিসেবে খরচ করি তাহলে তা আদায় হবে কিনা?) যদি হয়, তাহলে আমি আপনাকেই সদাক্বাহ্ (সাদাকা) দিয়ে দেব। আর না হলে আপনি ছাড়া অন্য কাউকে দেব। যায়নাব বলেন, ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) (এ কথা শুনে) আমাকে বললেন, ’’তুমিই যাও’’। তাই আমি নিজেই তাঁর কাছে গেলাম। আমি গিয়ে দেখলাম, তাঁর ঘরের দরজায় আনসারের এক মহিলাও দাঁড়িয়ে আছে। আমার ও তার প্রয়োজন একই।

যায়নাব বলেন, যেহেতু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্বের কারণে (তাঁর নিকট যাবার সাহস আমাদের হলো না), তাই বিলাল (রাঃ)আমাদের কাছে এলে আমরা তাঁকে বললাম, আপনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে খবর দিন যে, দু’জন মহিলা দরজায় আপনার কাছ থেকে জানতে চায়, তারা যদি তাদের (গরীব) স্বামী, অথবা তাদের পোষ্য ইয়াতীম সন্তানদেরকে দান-খয়রাত করে তাতে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) আদায় হবে কিনা? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমাদের পরিচয় দেবেন না। সে মতে বিলাল (রাঃ)রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন।

(এ কথা শুনে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা কারা? বিলাল (রাঃ)বললেন, একজন আনসার মহিলা, অপরজন যায়নাব। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ যায়নাব? বিলাল বললেন, ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদের স্ত্রী। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাদের জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব। এক গুণ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার হক আদায়ের জন্য, আর এক গুণ দান-খয়রাতের জন্য। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৩৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৬৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২০৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০০০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৩১৫২, সহীহ আত্ তারগীব ৮৯১, ইবনু খুযায়মাহ্ ২৪৬৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৭২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৭৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

মায়মূনাহ বিনতে হারিস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুমতি ব্যতীত তিনি আপন বাঁদীকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তার ঘরে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অবস্থানের দিন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি জানেন না আমি আমার বাঁদী মুক্ত করে দিয়েছি? তিনি বললেন, তুমি কি তা করেছ? মায়মূনাহ (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, শুন! তুমি যদি তোমার মামাদেরকে এটা দান করতে তাহলে তোমার জন্য বেশি নেকির কাজ হত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৯২, ২৫৯৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২০৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯৯৯, আহমাদ ২৬৮৮৬) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,

সালমান ইবনু ’আমির (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মিসকীনকে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করা এক প্রকার, আর নিকটাত্মীয়ের কাউকে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) দেয়া দু’ প্রকার সাওয়াবের কারণ। এক রকম সাওয়াব নিকটাত্মীয়ের হক আদায় এবং অন্য রকম সাওয়াব সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করার জন্য। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৩৯, সুনান আতআত্ তিরমিযী ৬৫৮, সুনান আননাসায়ী ২৫৮২, সুনান ইবনু মাজাহ্ ১৮৪৪, আহমাদ ১৬২৩, দারিমী ১৭২২, ইবনু খুযায়মাহ্ ২৩৮৫, মুসতাদরাক লিল হাকিম ১৪৭৬, ইরওয়া ৮৮৩, সহীহ আত্ তারগীব ৮৯২, সহীহ আল জামে আস্ সগীর ৩৮৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahi।

(১০)  খোঁটাদান পরিহার ও তাদের নিকট দাবী-দাওয়া থেকে বিরত থাকাঃ

দান করে খোঁটা  দ্বারা  কেবল  দান-খয়রাত  ও  পরোপকারের  ছওয়াবই  নষ্ট  হয়  না;  বরং  এটা  একটা  কঠিন  পাপও  বটে। কেননা  এর  দ্বারা  উপকৃত  ব্যক্তির  অন্তরে  আঘাত  দেওয়া হয়। মানুষের  মনে  আঘাত  দেওয়া  কবীরা গুনাহ। সুতরাং খোঁটা দেওয়া ইসলাম ও ঈমানের সংগে সংগতিপূর্ণ নয়।

(ক)  আল্লাহ তাআলা বলেন:

যারা নিজ সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে আর ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না এবং কোনো কষ্টও দেয় না, তারা নিজ প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রতিদান পাবে। তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না”। (সূরা বাকারা : ২৬২)।

(খ)  আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যাক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অত:পর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল”। (সূরা বাকারা: ২৬৪)।

(গ)  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:  “সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যে উপকার করে খোটা দেয়। (সুনান নাসাঈ, হা/ ৫৬৮৮)।

(ঘ)  আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, সর্বদা মদপানকারী এই তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সুনান আননাসায়ি : ৫৫৭৭)।

(ঙ) আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা? তারা তো বিফল হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেনঃ (১) যে ব্যক্তি পায়ের গোছার নিচে পরিধেয় ঝুলিয়ে পরে, (২) যে ব্যক্তি দান করার পর খোঁটা দেয় এবং (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে নিজের মাল বিক্রয় করে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৯৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১২১১, নাসায়ী ২৫৬৩, ২৫৬৪, ৪৪৫৮, ৪৪৫৯, ৫৩৩৩, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪০৮৭, আহমাদ ২০৮১১, ২০৮৯৫, ২০৯২৫, ২০৯৭০, ২১০৩৪, দারেমী ২৬০৫, গায়াতুম নারাম ১৭০, ইরওয়া ৯০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ২০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বিধায় আত্মীয়-স্বজনকে দান করে খোঁটা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তেমনি তাদের নিকট থেকে কোন কিছু চাওয়া বা তাদের নিকটে কোন কিছু দাবী করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

(১১)  স্বজনদের অল্প উপঢৌকনেও তুষ্ট থাকাঃ

উপহার-উপঢৌকন দিলে পারস্পরিক মুহাববত বৃদ্ধি পায়। মানুষের সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় না ঘটলে, পরস্পরকে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত বস্ত্ত উপহার প্রদান করতে পারে না। তাই আত্মীয়দের প্রদত্ত উপহারে সন্তুষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।

(১২) তাদের অবস্থা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখাঃ

মাঝে-মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা, বছরে একবার হ’লেও তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা প্রত্যেকের কর্তব্য। সেটা সম্ভব না হ’লে অন্তত টেলিফোন বা মোবাইলে খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যরূরী। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলা এবং যথাসাধ্য সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তাদের অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। এছাড়া তাদের মর্যাদা ও স্তর অনুযায়ী যথোপযুক্ত সম্মান করা। এতে করে আত্মীয়তার বন্ধন অটুট থাকবে এবং পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

(১৪) তাদের কষ্ট না দেওয়া ও তাদের সমস্যা দূর করাঃ

কোন আত্মীয়কে কখনও কষ্ট না দেওয়া এবং তাদের সমস্যাবলী যথাসাধ্য দূর করার চেষ্টা করা। আত্মীয়-স্বজন যখন জানবে যে, অমুক ব্যক্তি আত্মীয়দের সাথে উত্তম ব্যবহার করে, সে কাউকে কষ্ট দেয় না এবং তাদের অসুবিধা দূর করতে সচেষ্ট ও তাদের সমস্যায় সহযোগিতা করে, তখন তার সাথে সকলে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে; তার প্রতিও সকলে সহমর্মী ও সহযোগী হবে।

(১৪)  তাদের ভৎর্সনা ও তিরস্কার করা থেকে বিরত থাকাঃ

আত্মীয়-স্বজন বাড়ীতে আসলে আনন্দিত হওয়া এবং তাদের সমাদর করা। কখনও কোন কাজে ত্রুটি হলে তাদের ভৎর্সনা ও তিরস্কার না করা। শালীন ব্যক্তি মাত্রই মানুষের যথোপযুক্ত হক প্রদান করে থাকেন। তিনি নিজের হকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না; অপরে তার অধিকার আদায় করুক বা না করুক সেদিকেও লক্ষ্য রাখেন না; বরং অপরের হক আদায়ে তৎপর থাকেন। তেমনি কোন আত্মীয় কারো যথাযথ হক আদায় না করলেও তাকে তিরস্কার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(১৫)  আত্মীয়দের সমালোচনা সহ্য করাঃ

বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের অন্যতম গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সাথে অতি জঘন্য, যন্ত্রণা ও পীড়াদায়ক আচরণ করা হ’লেও তাঁরা সেসব অম্লান বদনে সহ্য করেন এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন না, বরং উত্তম ব্যবহার করেন। সুতরাং আত্মীয়দের সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে হবে। কখনও তারা সমালোচনা করলেও তা সহ্য করতে হবে। এতে তারা আরো নিকটতর হবে।

(১৬) আত্মীয়দের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করাঃ

সমাজের সকল মানুষ সব জিনিস পসন্দ করে না। যেমন অনেকে হাসি-ঠাট্টা পসন্দ করেন না। আত্মীয়দের মাঝেও অনুরূপ মানুষ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই তাদের মন মেজায বুঝে হাসি-মশকরা করতে হবে এবং এতেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। যাতে এসব তুচ্ছ কারণে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন না হয়।

(১৭)  ঝগড়া-বিবাদের পথ পরিহার করাঃ

মানুষ হিসাবে পরস্পর মনোমালিন্য সৃষ্টি হ’তে পারে। আর এটা কখনো ঝগড়া-বিবাদে রূপ নেয়। কিন্তু আত্মীয়দের মাঝে যাতে এরূপ না ঘটে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা এর মাধ্যমে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, অন্তরে প্রতিশোধ পরায়ণতা জেগে ওঠে। কাজেই ঝগড়া-বিবাদের পথ সর্বোতভাবে পরিহার করতে হবে।

(১৮) পরস্পর উপঢৌকন বিনিময় করাঃ

উপহার-উপঢৌকন মুহাববত বৃদ্ধি করে, খারাপ ধারণা দূরীভূত করে এবং আন্তরিক বিদ্বেষকে প্রতিহত করে। তাই আত্মীয়দের মাঝে পরস্পর হাদিয়া বিনিময় করা আবশ্যক।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরকে হাদিয়া দাও, একে অপরের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি কর’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪, সনদ হাসান)।

(১৯)  আত্মীয়কে চোখের মণি ভাবাঃ

আত্মীয়-স্বজনকে নিজের দেহের অংশ হিসাবে জ্ঞান করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চিন্তা মনে না আনা। বরং তাদের সম্মান-মর্যাদাকে নিজের সম্মান এবং তাদের অপমানকে নিজের লাঞ্ছনা মনে করা। আত্মীয়দের প্রতি কারো এরূপ মনোভাব থাকলে এ বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে।

(২০)  আত্মীয়দের সাথে বৈরিতা অনিষ্ট ও বিপদের কারণঃ

আত্মীয়-স্বজনের সাথে শত্রুতা ও বৈরী মনোভাব না থাকা। এতে অকল্যাণ ও বিপদের পথ প্রশস্ত হয়। কেননা মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নিজের জীবন চলার পথে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা তার প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আত্মীয়রা সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। আর আত্মীয়দের সাথে বৈরিতা থাকলে তারা বিপদ-মুছীবতের সময়ও দূরে থাকে। ফলে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আরো অকল্যাণ ও বিপদের সম্মুখীন হয়। এজন্য আত্মীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

(২১)  যথাসময়ে আত্মীয়দের স্মরণ করতে আগ্রহী হওয়াঃ

যথাসময়ে আত্মীয়দের স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে বিবাহ-শাদী, ওয়ালীমা বা এ ধরনের অনুষ্ঠান ও সমাবেশে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া এবং তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভুলবশত কেউ বাদ পড়ে গেলে তার কাছে গিয়ে কৈফিয়ত পেশ করে, সাধ্যমত তাকে রাযী-খুশি করা। এতে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে।

(২২)  আত্মীয়দের মাঝে বিবাদ মীমাংসায় উৎসাহী হওয়াঃ

আত্মীয়দের পরস্পরের মাঝে বিবাদ মীমাংসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কেননা আত্মীয়দের মাঝের ঝগড়া-বিবাদ ও ফিৎনা-ফাসাদ মিটিয়ে না ফেললে এটা বাড়তে থাকে। যা এক সময় অন্যান্য আত্মীয়দের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই বিবাদের অগ্নি সকলকে জ্বালিয়ে মারে। পক্ষান্তরে বিবাদ মিটিয়ে ফেললে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

(২৩)  পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনে দ্রুততাঃ

কোন স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মাঝে দ্রুত বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে বণ্টনে ন্যায়-ইনছাফ বজায় রাখা, যাতে প্রত্যেক প্রাপক তার যথাযথ অংশ পায়। আর পরিত্যক্ত সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির পূর্বেই এ কাজ সম্পন্ন করা শ্রেয়। এতে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে সম্পর্ক কালিমামুক্ত ও নিষ্কলুষ হয়।

(২৪)  যৌথ অনুষ্ঠানে ঐক্যমতের প্রতি আগ্রহী হওয়াঃ

কোন যৌথ অনুষ্ঠানে সকল ক্ষেত্রে সবার সাথে ঐক্যমত পোষণ করার প্রতি আগ্রহী হওয়া। নিজের মত প্রতিষ্ঠা বা নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকার মন-মানসিকতা পরিহার করা। তাদের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি, পরামর্শ প্রদান, সকলের প্রতি অনুগ্রহ করা এবং সততা ও আমানত রক্ষা করা। আর প্রত্যেকেই নিজের জন্য যা পসন্দ করবে অন্যের জন্যও তাই পসন্দ করবে। তদ্রূপ প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের হক সম্পর্কে অবগত হওয়া। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য বিস্তারিত ও খোলামেলা আলোচনা করা। তাদের সাথে ঘনিষ্ট আচরণ করা এবং অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকা। কখনও তাদেরকে উপেক্ষা না করা। কেউ কোন ব্যাপারে একমত না হ’লেও তার সাথে ভাল ব্যবহার করা। এভাবে চলতে পারলে তাদের মধ্যে রহমত অবধারিত হবে, হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের মধ্যে বরকত নাযিল হবে।

(২৫)  আত্মীয়তার প্রমাণ সংরক্ষণঃ আত্মীয়তার প্রমাণ সংরক্ষণ দু’ভাবে করা যায়।

(ক) কাগজে আত্মীয়দের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে সংরক্ষণ করা এবং সকলকে কপি দেওয়া। বংশীয় সম্পর্ক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক লিখে বা মুখস্থ করে সংরক্ষণের ব্যাপারে হাদীছে নির্দেশ এসেছে। যেমন জুবায়র ইবনু মুতঈম (রাঃ) বলেন, তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর ভাষণরত অবস্থায় বলতে শুনেছেন,

অর্থাৎ তোমাদের বংশপঞ্জিকা (নসবনামা) জেনে রাখ এবং (তদনুযায়ী) ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা কর। আল্লাহর কসম! অনেক সময় কোন ব্যক্তি ও তার (বংশানুক্রমিক) ভাইয়ের মধ্যে (অপ্রীতিকর) কিছু একটা ঘটে যায়; যদি সে জানতে পারত যে, তার এবং এর মধ্যে রক্তের বন্ধন বিদ্যমান রয়েছে, তবে তারা তাকে তার ভাইকে অপদস্থ করা হ’তে নিবৃত্ত করত। (আল-আদাবুল মুকরাদ হা/৭২, সনদ ছহীহ)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,

বংশপঞ্জিকা সংরক্ষণ কর (এবং তদনুযায়ী) ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ। কেননা দূরের আত্মীয়ও ঘনিষ্ঠ আচরণ দ্বারা ঘনিষ্ঠতর হয়ে যায় এবং নিকটাত্মীয়ও ঘনিষ্ঠ আচরণের অভাবে দূর হয়ে যায়। রক্তের বন্ধন কিয়ামতের দিন তার সংশ্লিষ্টজনের সম্মুখে এসে দাঁড়াবে এবং যদি সে তাকে দুনিয়ায় যুক্ত রেখে থাকে, তবে সে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, যদি সে তাকে দুনিয়ায় ছিন্ন করে থাকে, তবে সে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’। (আল-আদাবুল মুকরাদ হা/৭৩, সনদ ছহীহ)।

(খ) আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় সন্তান-সন্ততিকে সঙ্গে নেওয়া। যাতে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তারা অভ্যস্ত হয় এবং তাদের সাথে পরিচিত হয়।

(২৬)  আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করাঃ

সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর রাযী-খুশির উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে, এতে অন্য কাউকে শরীক করা চলবে না। সকল কাজ হবে নেকী ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা, জাহিলী কোন বিষয়ের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন লক্ষ্য হবে না। তেমনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকে ছওয়াব অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করলে এ সম্পর্কে কখনও চিড় ধরবে না।

আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকার নিদর্শন

কতিপয় আলামত দেখে সহজেই অনুমতি হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। এগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিদর্শন নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-

(১) হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় না করা। এটা কখনও কৃপণতার কারণে হয়ে থাকে। কখনওবা এ ধারণায় হয়ে থাকে যে, যাকে হাদিয়া দেওয়া হবে তার এ ধরনের উপহার-উপঢৌকনের প্রয়োজন নেই। যদিও এ ধারণা ভুল। কেননা কোন উপহার সাধারণত মানুষের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য করে দেওয়া হয় না। বরং উপহার-উপঢৌকন পারস্পরিক মুহাববত, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪, সনদ হাসান)।

(২) আত্মীয়-স্বজন সম্পর্ক বজায় রাখলে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা আর তারা সম্পর্ক ঠিক না রাখলে বন্ধন ছিন্ন করা। এটা প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা নয়। বরং এটা হচ্ছে বিনিময়।

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাবী সুফ্ইয়ান বলেন, আ’মাশ এ হাদীস মারফূ’রূপে বর্ণনা করেননি। অবশ্য হাসান (ইবনু ’আমর) ও ফিতর (রহ.) একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও তা বজায় রাখে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৯১, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ)...আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করে থাকি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের সহনশীলতা প্রদর্শন করে থাকি আর তারা আমার সঙ্গে মূৰ্খসুলভ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, তুমি যা বললে, তাহলে যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয় তুমি যেন তাদের উপর জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করছ। আর সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৯৪, ইসলামিক সেন্টার ৬৩৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ

আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট ও ছিন্ন হওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ, অনুকম্পা পরিহার করা, পূর্ববর্তী আত্মীয়দের বংশধরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শারঈ ওযর ব্যতীত তাদের প্রতি ইহসান না করা, কারো প্রতি আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার দোষ চাপানো ইত্যাদি। (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, কাতী‘আতুর রাহিম, পৃঃ ২)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবীরা গোনাহ।  (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ ২৫/২৪৭)।

কেননা আল্লাহ আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করতে এবং তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও কোন কিছুকে তার শরীক করো না; এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দুর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহারকরো নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে”। (সুরা নিসা ৪/৩৬)।

আল্লাহতায়ালা আরো বলেন,

“আর আত্মীয়-স্বজনকে দাও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্ৰস্ত ও মুসাফিরদেরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় কর না। নিশ্চয় যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রাবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ”। (সুরা বানী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)।

আবূ আইয়ূব (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, জনৈক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বললেনঃ আমাকে এমন একটি ‘আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তার কী হয়েছে! তার কী হয়েছে! এবং বললেনঃ তার দরকার রয়েছে তো। তুমি আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে, তাঁর সঙ্গে অপর কোন কিছুকে শরীক করবে না। সালাত আদায় করবে, যাকাত আদায় করবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩৯৬, ৫৯৮২, ৫৯৮৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩, আহমাদ ২৩৫৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩১১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ বলেন,

যুবায়র ইবনু মুত’ইম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৮৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৬, আহমাদ ১৬৭৩২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৪৫, সুনান আততিরমিযী ১৯০৯; সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬৯৬; আব্দুর রায্যাক ২০২৩৮; বায়হাকী ১২৯৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম। রাসুল সাঃ বলেন,

মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়ের নাফরমানী, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া, কারো প্রাপ্য না দেয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেয়া আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা, আর মাল বিনষ্ট করা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৪০৮, ৮৪৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৬০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৯০১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২৪৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আর অন্যান্য আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা গোনাহের কারণ, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ভয়াবহ পরিনতি

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়, বংশীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়, শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, বিচ্ছিন্নতা ও একে অপরকে পরিত্যাগ করা অবধারিত হয়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হৃদ্যতা ও ভালবাসা দূর করে, অভিশাপ ও শাস্তি ত্বরান্বিত করে, জান্নাতে প্রবেশের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, হীনতা ও লাঞ্ছনা আবশ্যক করে। এছাড়া এর কারণে মানবমনে চিন্তা ও পেরেশানী বৃদ্ধি পায়। কেননা মানুষ যার নিকট থেকে ভাল ব্যবহার, কল্যাণ ও সুসম্পর্ক কামনা করে, তার পক্ষ থেকে কোন বিপদ আসলে সেটা অধিক পীড়াদায়ক ও অসহনীয় হয়। এতদ্ব্যতীত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনামতে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন করার কিছু পাপ ও অপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-

(১) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অভিশপ্তঃ

কুরআন মাজীদে আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকে লা‘নত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’। (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী বলেন, এতে দু’টি বিষয় রয়েছে। (ক) আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যকীয় করে নেয়া এবং তাঁর আদেশকে যথার্থভাবে পালন করা। এটা কল্যাণ, হেদায়াত ও কামিয়াবী। (খ) আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া, তাঁর নির্দেশ প্রতিপালন না করা। যার দ্বারা দুনিয়াতে কেবল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাপাচার ও অবাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করার কারণে। তারাই ঐসকল লোক যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় রহমত থেকে তাদেরকে দূর করে দিয়ে এবং তাঁর ক্রোধের নিকটবর্তী করে তাদের অভিসম্পাত করেন’। (আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১/৭/৮৮, সূরা মুহাম্মাদ ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ)।

অন্যত্র তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস’। (সুরা রা‘দ ১৩/২৫)।

(২) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ক্ষতিগ্রস্ত ফাসেকদের দলভুক্তঃ

জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী পাপাচারী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত তিনি ফাসেকদের ব্যতীত কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’। (সুরা বাক্বারাহ ২/২৬-২৭)।

(৩) পার্থিব শাস্তি ত্বরান্বিত হওয়া ও পরকালীন শাস্তি বাকী থাকাঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে পরকালে কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। তাছাড়া দুনিয়াতেও তাদের দ্রুত শাস্তি হবে।

আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন পাপই এতটা যোগ্য নয় যে, পাপীকে আল্লাহ তা’আলা খুব শীঘ্র এ দুনিয়াতেই তার বিনিময় দেবেন এবং আখিরাতেও তার জন্য শাস্তি জমা করে রাখবেন। তবে হ্যাঁ, এরূপ দু’টো পাপ রয়েছে- ১. সমসাময়িক নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং ২. আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯৩২, সুনান আততিরমিযী ২৫১১, সুনান ইবনু মাজাহ ৪২১১, সুনান আবু দাঊদ ৪৯০২; সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৫৩৭, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ২৩, মুসনাদুল বাযযার ৩৬৭৮, আহমাদ ২০৩৯৮, ২০৩৯৬, ২০৪১৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৫৫, ৪৫৬, শু‘আবুল ঈমান ৬৬৭০, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২১৬১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন এবং বিদ্রোহের মত দুনিয়াতেই ত্বরিৎ শাস্তির উপযুক্ত আর কোন পাপ নেই। পরকালে তার জন্য যে শাস্তি সঞ্চিত রাখা হবে, তা তো আছেই’। (আল-আদাবুল মুফরাদ ৬৭, সনদ ছহীহ)।

(৪) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে আল্লাহ সম্পর্ক ছিন্ন করেনঃ

যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেন। এ থেকে তিনি নিস্ক্রান্ত হলে ’রাহিম’ (রক্ত সম্পর্কে) দাঁড়িয়ে পরম করুণাময়ের আঁচল টেনে ধরল। তিনি তাকে বললেন, থামো। সে বলল, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী লোক থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্যই আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। আল্লাহ্ বললেন, যে তোমাকে সম্পর্কযুক্ত রাখে, আমিও তাকে সম্পর্কযুক্ত রাখব; আর যে তোমার হতে থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আমিও তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব এতে কি তুমি খুশী নও? সে বলল, নিশ্চয়ই, হে আমার প্রভু। তিনি বললেন, যাও তোমার জন্য তাই করা হল। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, ইচ্ছে হলে তোমরা পড়, ’’ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বাঁধন ছিন্ন করবে।’ (সুরা মুহামম্দ:২২)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৮৩০, ৪৮৩১, ৪৮৩২, ৫৯৮৭, ৭৫০২; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৪৬৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪৬৭, আল-আদাবুল মুফরাদ, ৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, আমিই রহমান (দয়ালু), আমি আমার নাম (রহমান) থেকেই ‘রাহেম’ (আত্মীয়তার বন্ধন)-এর নাম নির্গত করেছি। সুতরাং যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমা হ’তে ছিন্ন করব’। (আল-আদাবুল মুফরাদ, ৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৫) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ

জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

যুবায়র ইবনু মুত’ইম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৮৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫৬, আহমাদ ১৬৭৩২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৪৫, আল-আদাবুল মুফরাদ ৬৪, সুনান আততিরমিযী ১৯০৯; সুনান আবু দাউদ ১৬৯৬; আব্দুর রায্যাক ২০২৩৮; বায়হাকী ১২৯৯৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও যাদুতে বিশ্বাসী”। (আহমদ, হাদীস নং ১৯৫৮৭; হাকিম, হাদীস নং ৭২৩৪; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৫৩৪৬, সিলসিলা ছহীহাহ ৬৭৮)।

(৬)  আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় নাঃ

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রিতে (আল্লাহ তা‘আলার নিকট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না”। (আহমদ, হাদীস নং ১০২৭৭)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। একাজের মাধ্যমে দুনিয়াতে বিভিন্ন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শাস্তি রয়েছে, পরকালে তো বটেই। তাই আমাদেরকে এ থেকে সাবধান হ’তে হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এমনকি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের থেকে দূরে থাকা জরুরী।

যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বালক ও নির্বোধদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। রাবী সাঈদ ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, ইবনু হাসানা জুহানী তাঁকে বলেছেন, তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, এর নিদর্শন কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে, বিভ্রান্তকারীর আনুগত্য করা হবে এবং সৎপথ প্রদর্শনকারীর অবাধ্যতা করা হবে। (আল-আদাবুল মুফরাদ ৬৬)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শেষ কথাঃ

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতীব জরুরী। কেননা এটা হায়াত ও রিযক বৃদ্ধির মাধ্যম এবং জান্নাত লাভের উপায়। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করা জান্নাত থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে উম্মতকে সাবধান করে বলেন, ‘তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন’ (সম্পর্কে সাবধান হও)। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৩৬, ১৫৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯৪, সনদ ছহীহ)।

রাসুল সাঃ বলেন,

“আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও তা বজায় রাখে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৯১, সুনান আবু দাউদ ১৬৯৭; সুনান আততিরমিযী ১৯০৮; বায়হাকী ১২৯৯৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ আরো বলেন,

উম্মে কুলসুম বিনতে উক্ববাহ, হাকীম ইবন হিযাম ও আবু আইয়ূব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তারা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ সদকা হচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যে আপনার শত্রু তার ওপর সদকা করা”। (ইবন খুযাইমাহ্, হাদীস নং ২৩৮৬; বায়হাকী, হাদীস নং ১৩০০২; দা’রামী, হাদীস নং ১৬৭৯; ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস নং ৩১২৬, ৩৯২৩, ৪০৫১; আওসাত্ব, হাদীস নং ৩২৭৯; আহমাদ, হাদীস নং ১৫৩৫৫, ২৩৫৭৭)।

রাসুল সাঃ আরো বলেন,

উক্ববাহ্ ইবন ‘আমির ও ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তারা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,

“আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো ওর সঙ্গে যে তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, দাও ওকে যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে এবং যালিমের পাশ কেটে যাও তথা তাকে ক্ষমা করো”। (আহমাদ, হাদীস নং ১৭৩৭২, ১৭৪৮৮; হাকিম, হাদীস নং ৭২৮৫; বায়হাকী, হাদীস নং ২০৮৮০; ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস নং ৭৩৯, ৭৪০; আওসাত্ব, হাদীস নং ৫৫৬৭)।

রাসুল সাঃ বলেছেন অন্ততপক্ষে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো। আব্দুল্লাহ্ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অন্ততপক্ষে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো”। (বায্যার, হাদীস নং ১৮৭৭)।

অতএব প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ-নারীকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন-আমীন!

(সমাপ্ত)

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, বিবিসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

...........................................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...