Friday, November 29, 2024

হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন সত্য ঘটনা (২০টি সহিহ হাদিস)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন সত্য ঘটনা (২০টি সহিহ হাদিস)

 


দেনা ও কর্জের ব্যাপারে দেহ এবং অন্য কিছুর আর্থিক দায় প্রসঙ্গে

(ঘটনা-১): লায়স (রহ.)...আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের কোন এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অপর এক ব্যক্তির নিকট এক হাজার দ্বীনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আন, আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর (ঋণদাতা) বলল, তা হলে একজন যামিনদার উপস্থিত কর। সে বলল, যামিনদার হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাজার দ্বীনার দিয়ে দিল। তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাজার দ্বীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জান আমি অমুকের নিকট এক হাজার দ্বীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিন হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাজী হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট, তাতে সে রাজী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার নিকট সোপর্দ করলাম, এই বলে সে কাষ্ঠখন্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখন্ডটি সমুদ্রে প্রবেশ করল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়ত বা ঋণগ্রহীতা কোন নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখন্ডটির উপর পড়ল, যার ভিতরে মাল ছিল। সে কাষ্ঠখন্ডটি তার পরিবারের জ্বালানীর জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাজার দ্বীনার নিয়ে এসে হাযির হল এবং বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছিয়ে দেয়ার উদ্দেশে সব সময় যানবাহনের খোঁজে ছিলাম। কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হতে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাজার দ্বীনার নিয়ে ফিরে চলে এল। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২২৯১, ১৪৯৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ কিতাবুল কিফালাহ অনুচ্ছেদ-১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ  অনুচ্ছেদ ১৪২৫ শেষাংশ)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সবচেয়ে জ্ঞানী কে?

(ঘটনা-২):  সা‘ঈদ ইবনু জুবায়র (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.)-কে বললাম, নাওফ আল-বাকালী দাবী করে যে, মূসা (আ) [যিনি খাযির (আ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন তিনি] বনী ইসরাঈলের মূসা নন বরং তিনি অন্য এক মূসা। (একথা শুনে) তিনি বললেনঃ আল্লাহর দুশমন মিথ্যা বলেছে। উবাঈ ইবনু কা’ব (রাযি.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ মূসা (আ) একদা বনী ইসরাঈলদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তিনি বললেন, ‘আমি সবচেয়ে জ্ঞানী।’ মহান আল্লাহ্ তাঁকে সতর্ক করে দিলেন। কেননা তিনি ‘ইল্মকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ করেন নি। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর নিকট এ ওয়াহী প্রেরণ করলেনঃ দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে আমার বান্দাদের মধ্যে এক বান্দা রয়েছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। তিনি বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! কীভাবে তার সাক্ষাৎ পাব?’ তখন তাঁকে বলা হল, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও। অতঃপর যেখানে সেটি হারিয়ে ফেলবে সেখানেই তাকে পাবে। অতঃপর তিনি ইউশা ‘ইবনু নূনকে সাথে নিয়ে যাত্রা করলেন। তাঁরা থলের মধ্যে একটি মাছ নিলেন। পথিমধ্যে তাঁরা একটি বড় পাথরের নিকট এসে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। তারপর মাছটি থলে হতে বেরিয়ে গেল এবং সুড়ঙ্গের মত পথ করে সমুদ্রে চলে গেল। এ ব্যাপারটি মূসা (আ) ও তাঁর খাদিম-এর জন্য ছিল আশ্চর্যের বিষয়।

অতঃপর তাঁরা তাদের বাকী দিন ও রাতভর চলতে থাকলেন। পরে ভোরবেলা মূসা (আ) তাঁর খাদিমকে বললেন, ‘আমাদের নাশতা নিয়ে এস, আমরা আমাদের এ সফরে খুবই ক্লান্ত, আর মূসা (আ)-কে যে স্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সে স্থান অতিক্রম করার পূর্বে তিনি ক্লান্তি অনুভব করেন নি। তারপর তাঁর সাথী তাঁকে বলল, ‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন পাথরের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম?’ মূসা (আ) বললেন, ‘আমরা তো সেই স্থানটিরই খোঁজ করছিলাম।’ অতঃপর তাঁরা তাঁদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন। তাঁরা সেই পাথরের নিকট পৌঁছে দেখতে গেলেন, এক ব্যক্তি (বর্ণনাকারী বলেন,) কাপড় মুড়ি দিয়ে আছেন। মূসা (আ) তাঁকে সালাম দিলেন। তখন খাযির বললেন, এ দেশে সালাম কোথা হতে আসল! তিনি বললেন, ‘আমি মূসা।’ খাযির প্রশ্ন করলেন, ‘বনী ইসরাঈলের মূসা (আ)?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। তিনি আরো বললেন, ‘‘সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য আমি কি আপনাকে অনুসরণ করতে পারি?’ খাযির বললেন, ‘‘তুমি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না। হে মূসা (আ)! আল্লাহর ‘ইল্মের মধ্যে আমি এমন এক ‘ইল্ম নিয়ে আছি যা তিনি কেবল আমাকেই শিখিয়েছেন, যা তুমি জান না। আর তুমি এমন ‘ইল্মের অধিকারী, যা আল্লাহ তোমাকেই শিখিয়েছেন, তা আমি জানি না।’’ ‘মূসা (আ) বললেন, ‘‘আল্লাহ্ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার আদেশ অমান্য করব না।

অতঃপর তাঁরা দু’জন সমুদ্র তীর দিয়ে চলতে লাগলেন, তাঁদের কোন নৌকা ছিল না। ইতোমধ্যে তাঁদের নিকট দিয়ে একটি নৌকা যাচ্ছিল। তাঁরা নৌকাওয়ালাদের সাথে তাদের তুলে নেয়ার কথা বললেন। তারা খাযিরকে চিনতে পারল এবং ভাড়া ব্যতিরেকে তাঁদের নৌকায় তুলে নিল। তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসে একবার কি দু’বার সমুদ্রে তার ঠোঁট ডুবাল। খাযির বললেন, ‘হে মূসা (আ)! আমার এবং তোমার জ্ঞান (সব মিলেও) আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় চড়ুই পাখির ঠোঁটে যতটুকু পানি এসেছে তার চেয়েও কম।’ অতঃপর খাযির নৌকার তক্তাগুলোর মধ্য থেকে একটি খুলে ফেললেন। মূসা (আ) বললেন, এরা আমাদের বিনা ভাড়ায় আরোহণ করিয়েছে, আর আপনি আরোহীদের ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকাটি ছিদ্র করে দিলেন?’ খাযির বললেন, ‘‘আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না?’’ মূসা (আ) বললেন, ‘আমার ত্রুটির জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার ব্যাপারে অধিক কঠোর হবেন না।’ বর্ণনাকারী বলেন, এটা মূসা (আ)-এর প্রথমবারের ভুল। অতঃপর তাঁরা দু’জন (নৌকা থেকে নেমে) চলতে লাগলেন। (পথে) একটি বালক অন্যান্য বালকের সাথে খেলা করছিল। খাযির তার মাথার উপর দিক দিয়ে ধরলেন এবং হাত দিয়ে তার মাথা ছিন্ন করে ফেললেন। মূসা (আ) বললেন, ‘আপনি হত্যার অপরাধ ছাড়াই একটি নিষ্পাপ জীবন নাশ করলেন?’ খাযির বললেন ‘‘আমি কি তোমাকে বলিনি যে, তুমি আমার সঙ্গে কখনো ধৈর্য ধরতে পারবে না?’’ ইব্ন ‘উয়ায়নাহ (রহ.) বলেন, এটা ছিল পূর্বের চেয়ে অধিক জোরালো। ‘‘তারপর আবারো চলতে লাগলেন; চলতে চলতে তারা এক গ্রামের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে তাদের নিকট খাদ্য চাইলেন কিন্তু তারা তাঁদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। অতঃপর সেখানে তাঁরা ধ্বসে যাওয়ার উপক্রম এমন একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন। খাযির তাঁর হাত দিয়ে সেটি দাঁড় করে দিলেন। মূসা (আ) বললেন, ‘‘আপনি ইচ্ছে করলে এর জন্য মজুরী নিতে পারতেন। তিনি বললেন, ‘এখানেই তোমার আর আমার মধ্যে সম্পর্কের অবসান।’’(সূরাহ কাহ্ফঃ ৭৭-৭৮)  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা‘আলা মূসার উপর রহম করুন। আমাদের কতই না মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতো যদি তিনি সবর করতেন, তাহলে আমাদের নিকট তাঁদের আরো ঘটনাবলী বর্ণনা করা হতো। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২২, ৭৪; ৩৪০১, ৪৭২৫, ৪৭২৬, ৪৭২৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬০৫৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩৮০, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩১৪৯, আহমাদ ২১১৬৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১২০, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)  ১২৪, ৩১৬২, ৫৯৪৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২২, ৩৪০১, ইসলামিক সেন্টার ৫৯৮৭, আল-লুলু ওয়াল মারজান ১৫৩৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা

(ঘটনা-৩): ‘‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, আবূ সুফইয়ান ইবনু হরব তাকে বলেছেন, রাজা হিরাক্লিয়াস একদা তাঁর নিকট লোক প্রেরণ করলেন। তিনি তখন ব্যবসা উপলক্ষে কুরাইশদের কাফেলায় সিরিয়ায় ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সময় আবূ সুফইয়ান ও কুরাইশদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্ধিতে আবদ্ধ ছিলেন। আবূ সুফইয়ান তার সাথী সহ হিরাক্লিয়াসের নিকট আসলেন এবং তখন হিরাক্লিয়াস জেরুযালেমে ছিলেন। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে তাঁর নিকটে ডেকে পাঠালেন। তাঁর নিকটে তখন রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিল। অতঃপর তাদের নিকটে ডাকলেন এবং দোভাষীকে ডাকলেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করে-তোমাদের মাঝে বংশের দিক হতে তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে’? আবূ সুফইয়ান বলেন, ‘আমি বললাম, বংশের দিক দিয়ে আমিই তাঁর নিকটাত্মীয়।’ তিনি বললেন, ‘তাঁকে আমার অতি নিকটে আন এবং তাঁর সাথীদেরকেও তার পেছনে বসিয়ে দাও।’

অতঃপর তাঁর দোভাষীকে বললেন, ‘তাদের বলে দাও, আমি এর নিকট সে ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করব, যদি সে আমার নিকট মিথ্যা বলে, তখন সঙ্গে সঙ্গে তোমরা তাকে মিথ্যুক বলবে। আবূ সুফ্ইয়ান বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার যদি এ লজ্জা না থাকত যে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে, তবে আমি অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম।’

অতঃপর তিনি তাঁর সম্পর্কে আমাকে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন করেন তা হলো, ‘বংশমর্যাদার দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে সে কিরূপ?’ আমি বললাম, ‘তিনি আমাদের মধ্যে খুব সম্ভ্রান্ত বংশের।’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এর পূর্বে আর কখনো কি কেউ এরূপ কথা বলেছে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ কি বাদশাহ ছিলেন?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘সম্ভ্রান্ত মর্যাদাবান শ্রেণীর লোকেরা তাঁর অনুসরণ করে, নাকি দুর্বল লোকেরা?’ আমি বললাম, ‘দুর্বল লোকেরা।’ তিনি বললেন, ‘তাদের সংখ্যা কি বাড়ছে, না কমছে?’ আমি বললাম, ‘তারা বেড়েই চলেছে।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর ধর্মে ঢুকে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তার দাবীর পূর্বে তোমরা কি কখনো তাঁকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তিনি কি সন্ধি ভঙ্গ করেন?’ আমি বললাম, ‘না। তবে আমরা তাঁর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সন্ধিতে আবদ্ধ আছি। জানি না, এর মধ্যে তিনি কী করবেন।’ আবূ সুফ্ইয়ান বলেন, ‘এ কথাটি ব্যতীত নিজের পক্ষ হতে আর কোন কথা যোগ করার সুযোগই আমি পাইনি।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা তাঁর সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেছ কি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধের পরিণাম কি হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘তাঁর ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল কুপের বালতির ন্যায়।’ কখনো তাঁর পক্ষে যায়, আবার কখনো আমাদের পক্ষে আসে।’ তিনি বললেন, ‘তিনি তোমাদের কিসের আদেশ দেন?’ আমি বললাম, ‘তিনি বলেনঃ তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা বলে তা ত্যাগ কর। আর তিনি আমাদের সালাত আদায়ের, সত্য বলার, চারিত্রিক নিষ্কলুষতার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেন।’

অতঃপর তিনি দোভাষীকে বললেন, ‘তুমি তাকে বল, আমি তোমার নিকট তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তুমি তার জবাবে উল্লেখ করেছ যে, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের। প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণকে তাঁদের কওমের উচ্চ বংশেই পাঠানো হয়ে থাকে। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, এ কথা তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে আর কেউ বলেছে কিনা? তুমি বলেছ, ‘না।’ তাই আমি বলছি, পূর্বে যদি কেউ এরূপ বলত, তবে আমি অবশ্যই বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর পূর্বসূরীর কথারই অনুসরণ করছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কোন বাদশাহ ছিলেন কি না? তুমি তার জবাবে বলেছ, ‘না।’ তাই আমি বলছি যে, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে যদি কোন বাদশাহ থাকতেন, তবে আমি বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর বাপ-দাদার বাদশাহী ফিরে পেতে চান। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি-এর পূর্বে কখনো তোমরা তাঁকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ কিনা? তুমি বলেছ, ‘না।’ এতে আমি বুঝলাম, এমনটি হতে পারে না যে, কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা পরিত্যাগ করবে আর আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, সম্ভ্রান্ত লোক তাঁর অনুসরণ করে, না সাধারণ লোক? তুমি বলেছ, সাধারণ লোকই তাঁর অনুসরণ করে। আর বাস্তবেও এই শ্রেণীর লোকেরাই হন রাসূলগণের অনুসারী। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ, বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমানে পূর্ণতা লাভ করা পর্যন্ত এ রকমই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর দ্বীনে প্রবেশ করে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে? তুমি বলেছ, ‘না।’ ঈমানের স্নিগ্ধতা অন্তরের সঙ্গে মিশে গেলে ঈমান এরূপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি সন্ধি ভঙ্গ করেন কিনা? তুমি বলেছ, ‘না।’ প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণ এরূপই, সন্ধি ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদের কিসের আদেশ দেন? তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর বন্দেগী করা ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুর অংশীদার স্থাপন না করার নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে আর তোমাদের আদেশ করেন সালাত আদায় করতে, সত্য বলতে ও সচ্চরিত্র থাকতে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে শীঘ্রই তিনি আমার এ দু’পায়ের নীচের জায়গার অধিকারী হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে হবেন, এ কথা ভাবতে পারিনি। যদি জানতাম, আমি তাঁর নিকট পৌঁছতে পারব, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি যে কোন কষ্ট সহ্য করে নিতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম তবে অবশ্যই তাঁর দু’খানা পা ধৌত করে দিতাম। অতঃপর তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সেই পত্রখানি আনার নির্দেশ দিলেন, যা তিনি দিহ্ইয়াতুল কালবী (রাঃ)-কে দিয়ে বসরার শাসকের মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তা পড়লেন। তাতে (লেখা) ছিলঃ

বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম (পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পক্ষ হতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। - শান্তি (বর্ষিত হোক) তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে। তারপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সকল প্রজার পাপই আপনার উপর বর্তাবে।

‘‘হে আহলে কিতাব! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন। তা হল, আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করি , কোন কিছুকেই যেন তাঁর শরীক সাব্যস্ত না করি এবং আমাদের কেউ যেন কাউকে পালনকর্তারূপে গ্রহণ না করে আল্লাহকে ত্যাগ করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বল, ‘‘তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা তো মুসলিম।’’ (সূরাহ্ আলে-‘ইমরান ৩/৬৪)

আবূ সুফইয়ান বলেন, ‘হিরাক্লিয়াস যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন এবং পত্র পাঠও শেষ করলেন, তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, চীৎকার ও হৈ-হল্লা চরমে পৌঁছল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হলো। আমাদেরকে বের করে দিলে আমি আমার সাথীদের বললাম, আবূ কাবশার* ছেলের বিষয় তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনূ আসফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে! তখন থেকে আমি বিশ্বাস রাখতাম, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করলেন।

ইবনু নাতূর ছিলেন জেরুযালেমের শাসনকর্তা এবং হিরাক্লিয়াসের বন্ধু ও সিরিয়ার খৃস্টানদের পাদ্রী। তিনি বলেন, ‘হিরাক্লিয়াস যখন জেরুযালেম আসেন, তখন একদা তাঁকে অত্যন্ত মলিন দেখাচ্ছিল। তাঁর একজন বিশিষ্ট সহচর বলল, ‘আমরা আপনার চেহারা আজ এত মলিন দেখছি, ইবনু নাতূর বলেন, হিরাক্লিয়াস ছিলেন জ্যোতির্বিদ, জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তারা জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদের বললেন, ‘আজ রাতে আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, খতনাকারীদের বাদশাহ আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান যুগে কোন্ জাতি খাতনা করে’? তারা বলল, ‘ইয়াহূদ জাতি ব্যতীত কেউ খাতনা করে না। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আপনি মোটেও চিন্তাগ্রস্থ হবেন না। আপনার রাজ্যের শহরগুলোতে লিখে পাঠান, তারা যেন সেখানকার সকল ইয়াহূদীকে কতল করে ফেলে।’ তারা যখন এ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত ছিল, তখন হিরাক্লিয়াসের নিকট জনৈক ব্যক্তিকে হাযির করা হলো, যাকে গাস্সানের শাসনকর্তা পাঠিয়েছিল। সে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খবর দিচ্ছিল। হিরাক্লিয়াস তার কাছ থেকে খবর জেনে নিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে নিয়ে গিয়ে দেখ, তার খাতনা হয়েছে কি-না।’ তারা তাকে নিয়ে গিয়ে দেখে এসে সংবাদ দিল, তার খাতনা হয়েছে। হিরাক্লিয়াস তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জওয়াব দিল, ‘তারা খাতনা করে।’ অতঃপর হিরাক্লিয়াস তাদের বললেন, ‘ইনি [আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ] এ উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।’ অতঃপর হিরাক্লিয়াস রোমে তাঁর বন্ধুর নিকট লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাক্লিয়াস হিমস চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তাঁর নিকট তাঁর বন্ধুর চিঠি এলো, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আবির্ভাব এবং তিনিই যে প্রকৃত নবী, এ ব্যাপারে হিরাক্লিয়াসের মতকে সমর্থন করছিল। তারপর হিরাক্লিয়াস তাঁর হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সকল দরজা বন্ধ করার আদেশ দিলে দরজা বন্ধ করা হলো। অতঃপর তিনি সম্মুখে এসে বললেন, হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি মঙ্গল, হিদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর বায়’আত গ্রহণ কর।’ এ কথা শুনে তারা বন্য গাধার ন্যায় দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ দেখতে পেল। হিরাক্লিয়াস যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ‘ওদের আমার নিকট ফিরিয়ে আন।’ তিনি বললেন, ‘আমি একটু পূর্বে যে কথা বলেছি, তা দিয়ে তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করছিলাম। এখন তা দেখে নিলাম।’ একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলো। এটাই ছিল হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা।

আবূ ‘আবদুল্লাহ [বুখারী (রহ.)] বলেন, সালিহ ইবনু কায়সান (রহ.), ইউনুস (রহ.) ও মা’মার (রহ.) এ হাদীস যুহরী (রহ.) থেকে রিওয়ায়াত করেছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭, ৫১, ২৬৮১, ২৮০৪, ২৯৪১, ২৯৭৮, ৩১৭৪, ৪৫৫৩, ৫৯৮০, ৬২৬০, ৭১৯৬, ৭৫৪১, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সৎকাজের ওয়াসীলা ধরে আল্লাহর নিকট দুআ করা

 (ঘটনা-৪): ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একবার তিন জন লোক পথ চলছিল, তারা বৃষ্টিতে আক্রান্ত হল। অতঃপর তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ পাহাড় হতে এক খন্ড পাথর পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তখন তারা একে অপরকে বলল, নিজেদের কৃত কিছু সৎকাজের কথা চিন্তা করে বের কর, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে এবং তার ওয়াসীলা করে আল্লাহর নিকট দু‘আ কর। তাহলে হয়ত আল্লাহ তোমাদের উপর হতে পাথরটি

সরিয়ে দিবেন। তাদের একজন বলতে লাগল, হে আল্লাহ! আমার আববা-আম্মা খুব বৃদ্ধ ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট সন্তানও ছিল। আমি তাদের ভরণ-পোষণের জন্য পশু পালন করতাম। সন্ধ্যায় যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন দুধ দোহন করতাম এবং আমার সন্তানদের আগে আমার আববা-আম্মাকে পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে দেরী হয় এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে আসতে পারলাম না। এসে দেখি তারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। যখন আমি দুধ দোহন করলাম, যেমন প্রতিদিন দোহন করি। তারপর আমি তাঁদের শিয়রে (দুধ নিয়ে) দাঁড়িয়ে রইলাম। তাদেরকে জাগানো আমি পছন্দ করিনি এবং তাদের আগে আমার বাচ্চাদেরকে পান করানোও অসঙ্গত মনে করি। অথচ বাচ্চাগুলো দুধের জন্য আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছিল। এভাবে ভোর হয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্যই এ কাজটি করে থাকি তবে আপনি আমাদের হতে পাথরটা খানিক সরিয়ে দিন, যাতে আমরা আসমানটা দেখতে পাই। তখন আল্লাহ পাথরটাকে একটু সরিয়ে দিলেন এবং তারা আসমান দেখতে পেল। দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। পুরুষরা যেমন মহিলাদেরকে ভালবাসে, আমি তাকে তার চেয়ে অধিক ভালবাসতাম। একদিন আমি তার কাছে চেয়ে বসলাম (অর্থাৎ খারাপ কাজ করতে চাইলাম) কিন্তু তা সে অস্বীকার করল যে পর্যন্ত না আমি তার জন্য একশ’ দিনার নিয়ে আসি। পরে চেষ্টা করে আমি তা যোগাড় করলাম (এবং তার কাছে এলাম)। যখন আমি তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম (অর্থাৎ সম্ভোগ করতে তৈরী হলাম) তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়ভাবে মাহর (পর্দা) ছিঁড়ে দিয়ো না। (অর্থাৎ আমার কুমারীর সতীত্ব নষ্ট করো না) তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমি যদি শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে আপনি আমাদের জন্য পাথরটা সরিয়ে দিন। তখন পাথরটা কিছু সরে গেল। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমি এক ফারাক চাউলের বিনিময়ে একজন শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। যখন সে তার কাজ শেষ করল আমাকে বলল, আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি তাকে তার পাওনা দিতে গেলে সে তা নিল না। আমি তা দিয়ে কৃষি কাজ করতে লাগলাম এবং এর দ্বারা অনেক গরু ও তার রাখাল জমা করলাম। বেশ কিছু দিন পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, আল্লাহকে ভয় কর (আমার মজুরী দাও)। আমি বললাম, এই সব গরু ও রাখাল নিয়ে নাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার সাথে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, ওইগুলো নিয়ে নাও। তখন সে তা নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! আপনি জানেন, যদি আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজটি করে থাকি, তবে পাথরের বাকীটুকু সরিয়ে দিন। তখন আল্লাহ পাথরটাকে সরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ২৩৩৩, ২২১৫, ৩৪৬৫, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৬৫, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২১২৮, ৩২১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৭২, ২৩৩৩, ৩৪৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৮৪২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৬৯৮, ইসলামিক সেন্টার ৬৭৫২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

পিতা মাতার দোয়া কবুল হয়

(ঘটনা-৫):শাইবান ইবনু ফাররূখ (রহঃ) ..... আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জুরায়জ (বনী ইসরাঈলের একজন আবিদ ব্যক্তি) তার ইবাদাতখানায় ইবাদাতে নিমগ্ন থাকতেন। (একবার) তার মাতা তার কাছে আসলেন। হুমায়দ (রহঃ) বলেন, আমাদের কাছে আবু রাফি এমন ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেন, যেমনভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মায়ের ডাকের ভঙ্গিতে আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) এর কাছে ব্যক্ত করেছেন। কিভাবে তার হাত তাঁর ভ্রুর উপর রাখছিলেন। এরপর তার দিকে মাথা উঁচু করে তাকে ডাকছিলেন। বললেন, হে জুরায়জ! আমি তোমার মা, আমার সাথে কথা বলো। এ কথা এমন অবস্থায় বলছিলেন, যখন জুরায়জ সালাতে নিমগ্ন ছিলেন। তখন তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ! (একদিকে) আমার মা আর (অপরদিকে) আমার সালাত (আমি কী করি?)"।

রাবী বলেন, অবশেষে তিনি তার সালাতকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং তার মা ফিরে গেলেন। পরে তিনি দ্বিতীয়বার আসলেন এবং বললেন, হে জুরায়জ। আমি তোমার মা, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো। তিনি বললেন, ইয়া আল্লাহ! আমার মা, আমার সালাত। তখন তিনি তার সালাতে ব্যস্ত রইলেন। তখন তার মা বললেন, “হে আল্লাহ! এ জুরায়জ আমারই ছেলে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। সে আমার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করল। হে আল্লাহ তার মৃত্যু দিয়ো না, যে পর্যন্ত তাকে ব্যভিচারিণীর মুখ না দেখাও। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যদি তার মাতা তার বিরুদ্ধে অন্য কোন বিপদের জন্য বদদুআ করতেন তাহলে অবশ্যই সে, বিপদে পতিত হত।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, এক মেষ রাখাল জুরায়জ এর ইবাদাতখানার নিকটেই (মাঝে মাঝে) আশ্রয় নিত। তিনি বলেন, এরপর গ্রাম থেকে এক মহিলা বের হয়ে এলে উক্ত রাখাল তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। এতে মহিলাটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। তখন লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করল, এ (সন্তান) কোথা থেকে? সে উত্তর দিল, এ ইবাদাতখানায় যে বাস করে, তার থেকে। তিনি বলেন, এরপর তারা শাবল কোদাল ইত্যাদি নিয়ে এলো এবং চীৎকার করে ডাক দিল। তখন জুরায়জ সালাতে মশগুল ছিলেন। কাজেই তিনি তাদের সাথে কথা বললেন না। তিনি বলেন, এরপর তারা তার ইবাদাতখানা ধ্বংস করতে লাগল।

তিনি এ অবস্থা দেখে নীচে নেমে এলেন। এরপর তারা বলল, এ মহিলাকে জিজ্ঞেস করো (সে কী বলছে)। তিনি বলেন, তখন জুরায়জ মুচকি হেসে শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার পিতা কে? তখন শিশুটি বলল, আমার পিতা সে মেষ রাখাল। যখন তারা সে শিশুটির মুখে এ কথা শুনতে পেল তখন তারা বলল, (হে দরবেশ) আমরা তোমার ইবাদাতখানার (গীর্জার) যতটুকু ভেঙ্গে ফেলেছি তা সোনা-রূপা দিয়ে পুনঃনির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না; বরং তোমরা মাটি দ্বারাই পূর্বের ন্যায় তা নির্মাণ করে দাও। এরপর তিনি তার ইবাদাতগাহে উঠে বসলেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৪০২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৫৫০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৩৬, ১২০৬, ২৪৮২, ৩৪৬৬, আহমাদ ১০০৪৮, ৮০১০, ৮৭৬৮, ৯৩১৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩১৮২, সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)  ১১৩৩, ৩১৯৪,  আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১২০৬, ৩৪৩৬,  আল-আদাবুল মুফরাদ ৩৩)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ঋণ ও দেনার ব্যাপারে দেহ এবং অন্য কিছুর যামিন হওয়া

(ঘটনা-৬): আবূ যিনাদ (রহঃ) মুহাম্মদ ইব্ন হামযা ইব্ন আমর আসলামী (রহঃ) এর মধ্যমে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, উমর (রাঃ) তাকে সাদকা উশুলকারী নিযুক্ত করে পাঠান। সেখানে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর দাসীর সাথে ব্যভিচার করে বসল। তখন হামযা (রহঃ) কিছু লোককে তার পক্ষ হতে যামিন স্থির করলেন। পরে তিনি উমর (রাঃ) এর নিকট ফিরে আসলেন। উমর (রাঃ) উক্ত লোকটিকে একশ’ বেত্রাঘাত করলেন এবং লোকদের বিবরণকে সত্য বলে গ্রহণ করেন। তারপর লোকটি তার অজ্ঞতার জন্য (স্ত্রী দাসীর সাথে যৌন সম্ভোগ করা যে অবৈধ তা সে জানত না) অব্যাহতি দেন। জারীর ও আশআশ (রহঃ) মুরতাদ-ধর্মচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আবদুল্লাহ [ইব্ন মাসউদ (রাঃ)]-কে বলেন, তাদেরকে তাওবা করতে বলুন এবং তাদের পক্ষ হতে কাউকে যামিন গ্রহণ করুন। ধর্মচ্যুতরা তাওবা করল এবং তাদের গোত্রের লোকেরা তাদের যামিন হয়ে গেল।

হাম্মাদ (রহঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি যামিন হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করে তবে সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। হাকাম (রহঃ) বলেন, তার উপর দায়িত্ব থেকে যাবে (অর্থাৎ ওয়ারিশদের উপর সে দায়িত্ব বর্তাবে)। লায়স (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের কোন এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অপর এক ব্যক্তির নিকট এক হাজার দীনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণ দাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আন, আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তারপর (ঋণ দাতা) বলল, তাহলে একজন যামিনদার উপস্থিত কর। সে বলল, যামিনদার হিসাবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাজার দীনার দিয়ে দিল।

তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাজার দীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ্! তুমি তো জান আমি অমুকের নিকট এক হাজার দীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহ্ই যামিন হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট, তাতেও সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়য়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার নিকট সোপর্দ করলাম, এই বলে সে কাষ্ঠখণ্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখণ্ডটি সমুদ্রে প্রবেশ করল।

অতঃপর লোকটি ফিরে গেল। এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়তবা ঋণগ্রহীতা কোন নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখণ্ডটির উপর পড়ল, যার ভিতরে মাল ছিল। সে কাষ্ঠখণ্ডটি তার পরিবারের জ্বালানির জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাজার দীনার নিয়ে এসে হাযির হল। এবং বলল, আল্লাহ্র কসম আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সব সময় যানবাহনের খোঁজে ছিলাম। কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে এর আগে আর কোন নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ্ তোমার পক্ষ হতে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাজার দীনার নিয়ে ফিরে চলে এল। (সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ২১৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৯০ – ২২৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অগ্নিকুণ্ডের অধিপতি যাদুকর, ধর্মযাজক ও যুবকের ঘটনা

(ঘটনা-৭): হাদ্দাব ইবনু খালিদ (রহঃ).....সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী যামানায় এক বাদশাহ ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। বার্ধক্যে পৌছে সে বাদশাহকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, সুতরাং একজন যুবককে আপনি আমার কাছে প্রেরণ করুন, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব। অতঃপর যাদুবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য বাদশাহ তার কাছে এক যুবককে প্রেরণ করল। বালকের যাত্রা পথে ছিল এক ধর্মযাজক। যুবক তার কাছে বসল এবং তার কথা শুনল। তার কথা যুবকের পছন্দ হলো। তারপর যুবক যাদুকরের কাছে যাত্রাকালে সর্বদাই ধর্মযাজকের কাছে যেত এবং তার নিকট বসত। তারপর সে যখন যাদুকরের কাছে যেত তখন সে তাকে মারধর করত। ফলে যাদুকরের ব্যাপারে সে ধর্মযাজকের কাছে অভিযোগ করল। তখন ধর্মযাজক বলল, তোমার যদি যাদুকরের ব্যাপারে ভয় হয় তবে বলবে, আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে আসতে দেয়নি। আর যদি তুমি তোমার গৃহকর্তার ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ করে তবে বলবে, যাদুকর আমাকে বিলম্বে ছুটি দিয়েছে।

এমনিভাবে চলতে থাকাবস্থায় একদিন হঠাৎ সে একটি ভয়ানক হিংস্র প্রাণীর সম্মুখীন হলো, যা লোকেদের পথ আটকিয়ে রেখেছিল। এ অবস্থা দেখে সে বলল, আজই জানতে পারব, যাদুকর উত্তম না ধর্মযাজক উত্তম। অতঃপর একটি পাথর হাতে নিয়ে সে বলল, হে আল্লাহ! যদি যাদুকরের চাইতে ধর্মযাজক আপনার কাছে পছন্দনীয় হয়, তবে এ পাথরাঘাতে এ হিংস্র প্রাণীটি নিঃশেষ করে দিন, যেন লোকজন চলাচল করতে পারে। অতঃপর সে সেটার প্রতি পাথর ছুড়ে দিল এবং সেটাকে মেরে ফেলল। ফলে লোকজন আবার যাতায়াত শুরু করল। এরপর সে ধর্মযাজকের কাছে এসে তাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলল। ধর্মযাজক বলল, বৎস! আজ তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠ। তোমার মর্যাদা এ পর্যন্ত পৌছেছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শীঘ্রই তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যদি পরীক্ষার মুখোমুখি হও তবে আমার কথা গোপন রাখবে।

এদিকে যুবক আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করতে লাগল এবং লোকেদের সমুদয় রোগ-ব্যাধির নিরাময় করতে লাগল। বাদশাহর পরিষদবর্গের এক লোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার সংবাদ সে শুনতে পেয়ে বহু হাদিয়া ও উপটৌকন নিয়ে তার নিকট আসলো এবং তাকে বলল, তুমি যদি আমাকে আরোগ্য দান করতে পার তবে এসব মাল আমি তোমাকে দিয়ে দিব। এ কথা শুনে যুবক বলল, আমি তো কাউকে আরোগ্য দান করতে পারি না। আরোগ্য তো দেন আল্লাহ তা’আলা। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনো তবে আমি আল্লাহর কাছে দুআ করব, আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। তারপর সে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো। আল্লাহ তা’আলা তাকে রোগ মুক্ত করে দিলেন। এরপর সে বাদশাহর কাছে এসে অন্যান্য দিনের ন্যায় এবারও বসল। বাদশাহ তাকে প্রশ্ন করল, কে তোমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে? সে বলল, আমার পালনকর্তা। এ কথা শুনে বাদশাহ তাকে আবার প্রশ্ন করল, আমি ছাড়া তোমার অন্য কোন পালনকর্তাও আছে কি? সে বলল, আমার ও আপনার সকলের প্রতিপালকই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন।

অতঃপর বাদশাহ্ তাকে পাকড়াও করে অবিরতভাবে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ঐ বালকের অনুসন্ধান দিল, অতঃপর বালককে নিয়ে আসা হলো। বাদশাহ তাকে বলল, হে প্রিয় বৎস! তোমার যাদু এ পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তুমি অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকেও নিরাময় করতে পার। বালক বলল, আমি কাউকে নিরাময় করতে পারি না। নিরাময় করেন আল্লাহ। ফলে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ধর্মযাজকের (দরবেশের) কথা বলে দিল। এরপর ধর্মযাজককে ধরে আনা হলো এবং তাকে বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সে অস্বীকার করল, ফলে তার মাথার তালুতে করাত রেখে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো। এতে তার মাথাও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। অবশেষে ঐ যুবকটিকে আনা হলো এবং তাকেও বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সেও অস্বীকার করল।

অতঃপর বাদশাহ তাকে তার কিছু সহচরের হাতে তাকে অর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সহ পাহাড়ে আরোহণ করো। পর্বত শৃঙ্গে পৌছার পর সে যদি তার ধর্ম থেকে ফিরে আসে তবে ভাল। নতুবা তাকে সেখান থেকে ছুড়ে মারবে। তারপর তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে সহ পর্বতে আরোহণ করল। তখন সে দুআ করে বলল, হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করো। তৎক্ষণাৎ তাদেরকে সহ পাহাড় কেঁপে উঠল। ফলে তারা পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়ল। আর সে হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ্ তাকে প্রশ্ন করল, তোমার সাথীরা কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের চক্রান্ত হতে সংরক্ষণ করেছেন।

আবারো বাদশাহ্ তাকে তার কতিপয় সহচরের হাতে সমর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে নিয়ে নাও এবং নৌকায় উঠিয়ে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তার দীন (ধর্ম) হতে ফিরে আসে তবে ভাল, নতুবা তোমরা তাকে সমুদ্রে ফেলে দাও। তারা তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। এবারও সে দু’আ করে বলল, হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা তুমি আমাকে তাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করো। তৎক্ষণাৎ নৌকাটি তাদেরসহ উল্টে গেল। ফলে তারা সকলেই পানিতে ডুবে গেল। আর যুবক হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ্ তাকে আবার প্রশ্ন করল, তোমার সঙ্গীগণ কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র হতে রক্ষা করেছেন।

অতঃপর সে বাদশাহকে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তুমি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করবে। বাদশাহ বলল, সে আবার কি? যুবক বলল, একটি ময়দানে তুমি লোকেদেরকে জমায়েত করে। অতঃপর একটি কাঠের শুলীতে আমাকে উঠিয়ে আমার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রাখে। এরপর بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ "বালকের প্রভুর নামে" বলে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ কর। এ যদি কর তবে তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। তার কথা অনুসারে বাদশাহ লোকেদেরকে এক মাঠে জমায়েত করল এবং তাকে একটি কাষ্ঠের শূলীতে চড়ালো। অতঃপর তার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রেখে بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ "বালকের প্রভুর নামে" বলে তার দিকে তা নিক্ষেপ করল। তীর তার কানের নিম্নাংশে গিয়ে বিধল। অতঃপর সে তীরবিদ্ধ স্থানে নিজের হাত রাখল এবং সাথে সাথে প্রাণত্যাগ করল। এ দৃশ্য দেখে রাজ্যের লোকজন বলে উঠল, آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ আমরা এ যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান আনলাম।

এ সংবাদ বাদশাহকে জানানো হলো এবং তাকে বলা হলো, লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যে পরিস্থিতি হতে আশঙ্কা করছিলেন, আল্লাহর শপথ! সে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিই আপনার মাথার উপর চেপে বসেছে। সকল মানুষই যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান এনেছে। এ দেখে বাদশাহ সকল রাস্তার মাথায় গর্ত খননের নির্দেশ দিল। গর্ত খনন করা হলো এবং ওগুলোতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হলো। অতঃপর বাদশাহ আদেশ করল যে, যে লোক তার ধর্মমত বর্জন না করবে তাকে ওগুলোতে নিপতিত করবে। কিংবা সে বলল, তাকে বলবে, যেন সে অগ্নিতে প্রবেশ করে। লোকেরা তাই করল। পরিশেষে এক মহিলা একটি শিশু নিয়ে অগ্নিগহবরে পতিত হবার ব্যাপারে ইতস্তত করছিল। এ দেখে দুধের শিশু তাকে (মাকে) বলল, ওহে আম্মাজান! সবর করুন, আপনি তো সত্য দীনের (ধর্মের) উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৪০১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩০০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭২৩৯, ইসলামিক সেন্টার ৭২৯৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৩৪০,সহীহঃ তাখরীজ আল-কালিমুত তাইয়্যিব  ১২৫/৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মু'জিযার বর্ণনা

(ঘটনা-৮): আবূ মূসা আল-আশ'আরী (রাযিঃ) বলেনঃ কিছু প্রবীণ কুরাইশসহ আবূ তালিব (ব্যবসার উদ্দেশে) সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে রওয়ানা হন। তারা (বুহাইরাহ) পাদ্রীর নিকট পৌছে তাদের নিজেদের সওয়ারী থেকে মালপত্র নামাতে থাকে, তখন উক্ত পাদ্রী (গীর্জা থেকে বেরিয়ে) তাদের নিকটে এলেন। অথচ এ কাফিলা এর আগে অনেকবার এখান দিয়ে চলাচল করেছে কিন্তু তিনি কখনও তাদের নিকট (গীর্জা) বেরিয়ে আসেননি বা তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেননি। রাবী বলেন, লোকেরা তাদের বাহন থেকে সামানপত্র নামাতে ব্যস্ত থাকাবস্থায় উক্ত পাদ্ৰী তাদের ভেতরে ঢোকেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাত ধরে বলেন, ইনি “সাইয়্যিদুল আলামীন” (বিশ্ববাসীর নেতা), ইনি রাসূল রাব্বিল আলামীন (বিশ্ববাসীর প্রতিপালকের রাসূল) এবং আল্লাহ তা'আলা তাকে রহমাতুল্লিল আলামীন করে (বিশ্ববাসীর জন্য করুণা স্বরূপ) পাঠাবেন।

তখন কুরাইশদের বৃদ্ধ লোকেরা তাকে প্রশ্ন করে, কে আপনাকে জানিয়েছে? তিনি বলেন, যখন তোমরা এ উপত্যকা হতে নামছিলে, (তখন আমি লক্ষ্য করেছি যে,) প্রতিটি গাছ ও পাথর সিজদায় লুটিয়ে পড়ছে। এই দুটি নবী ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টিকে সিজদা করে না। এতদভিন্ন তার ঘারের নীচে আপেল সদৃশ গোলাকার মোহরে নবুওয়াতের সাহায্যে আমি তাকে চিনেছি। খাদ্যদ্রব্যসহ যখন তাদের নিকটে এলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের পাল চরাতে গিয়েছিলেন। পাদ্রী বলেন, তোমরা তাকে ডেকে আনার ব্যবস্থা কর। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন, তখন একখণ্ড মেঘ তার উপর ছায়া বিস্তার করেছিল এবং কাফিলার লোকেরা যারা তার পূর্বেই এসেছিল তাদেরকে তিনি গাছের ছায়ায় বসা অবস্থায় পেলেন।

তিনি বসলে গাছের ছায়া তার দিকে ঝুকে পড়ে। পাদ্রি বলেন, তোমরা গাছের ছায়ার দিকে লক্ষ্য কর, ছায়াটি তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। রাবী বলেন, ইত্যবসরে পাদ্রী তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদেরকে শপথ দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা তাকে নিয়ে রোম সাম্রাজ্যে যেও না। কেননা রূমীয়রা যদি তাকে দেখে তাহলে তাকে চিহ্নগুলোর দ্বারা সনাক্ত করে ফেলবে এবং তাকে মেরে ফেলবে। এমতাবস্থায় পাদ্রী লক্ষ্য করেন যে, রূমের সাতজন লোক তাদের দিকে আসছে। পাদ্রী তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রশ্ন করেন, তোমরা কেন এসেছ? তারা বলে, এ মাসে আখিরী যামানার নবীর আগমন ঘটবে। তাই চলাচলের প্রতিটি রাস্তায় লোক পাঠানো হয়েছে, তাই আমাদেরকে আপনাদের পথে পাঠানো হয়েছে।

পাদ্রী রোমীয় নাগরিকদের প্রশ্ন করেন, তোমাদের পেছনে তোমাদের চেয়েও ভাল কোন ব্যক্তি আছে কি (কোন পাদ্রী তোমাদেরকে এই নবীর সংবাদ দিয়েছ কি)? তারা বলল, আপনার এ রাস্তায়ই আমাদেরকে ঐ নবীর আসার খরব দেয়া হয়েছে। পাদ্রী বলেন, তোমাদের কি মত, আল্লাহ তা'আলা যদি কোন কাজ কারার ইচ্ছা করেন তবে কোন মানুষের পক্ষে তা প্রতিহত করা কি সম্ভব? তারা বলল, না (অর্থাৎ শেষ যামানার নবীর আগমন ঘটবেই, কোন মানুষ তা ঠেকাতে পারবে না)।

রাবী বলেন, তারপর তারা তার নিকট আনুগত্যের শপথ করে এবং তার সাহচর্য অবলম্বন করে। তারপর পাদ্রী (কুরাইশ কাফিলাকে) আল্লাহর নামে শপথ করে প্রশ্ন করেন, তোমাদের মধ্যে কে তার অভিভাবক? লোকেরা বলল, আবূ তালিব। পাদ্রী আবূ তালিবকে অবিরতভাবে আল্লাহ তা'আলার নামে শপথ করে তাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আবূ তালিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে (মক্কায়) ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং আবূ বাকর (রাযিঃ) বিলাল (রাযিঃ)-কে তার সাথে দেন। আর পাদ্রী তাকে পাথেয় হিসেবে কিছু রুটি ও যাইতুনের তৈল দেন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৬২০, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৯১৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩১৭৩৩, মুসনাদে বাযযার ৩০৯৬, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪২২, সহীহ ফিকহুস সীরাহ, দিফা আনিল হাদীসিন নাবাবী ৬২-৭২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

গির্জাকে মসজিদে বানানো

(ঘটনা-৯): হান্নাদ ইবনু সাররী (রহঃ)...তাল্ক ইবনু আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিধি হিসাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আগমনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। পরে তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করলাম এবং তাঁর সাথে সালাত আদায় করলাম। তারপর আমরা তাকে অবহিত করলাম যে, দেশে আমাদের একটা গির্জা রয়েছে। আমরা তাকে পানি দিতে অনুরোধ জানালাম। তিনি কিছু পনি আনিয়ে উযু এবং কুল্লি করলেন-তারপর একটি পাত্রে তা ঢেলে দিলেন। আর আমাদের তা নিতে নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা যাও। যখন তোমরা তোমাদের দেশে পৌছবে- তখন তোমাদের ঐ গির্জাটি ভেঙ্গে ফেলবে আর সেখানে এ পানি ঢেলে দেবে। তারপর সেটাকে মসজিদ বানাবে। আমরা বললাম, আমাদের দেশ অনেক দূরে, গরমও অত্যধিক, পানি শুকিয়ে যাবে। তিনি বললেন, এর সাথে আরও পানি মিশ্রিত করে নেবে। তাতে ঐ পানির সুঘ্রাণ আরও বাড়বে। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের দেশে পৌছলাম এবং আমাদের গির্জাটি ভেঙ্গে ফেললাম। তারপর তার স্থানে পানি ঢেলে দিলাম আর ওটাকে মসজিদরুপে ব্যবহার করলাম। আমরা তাতে আযান দিলাম। রাবী বলেনঃ পাদ্রী ছিল তার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। সে আযান ধ্বনি শুনে বলল, এ তো সত্যের প্রতি আহবান। তারপর সে ঢালূ স্থানের দিকে চলে গেল। তাকে আমরা আর দেখিনি। (সূনান নাসাঈ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৭০২, তা'লিকাতুল হাসসান ১১১৯, সহিহাহ ২৫৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুরাক্বাবাহ্ (আল্লাহর ধ্যান)

(ঘটনা-১০): আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, বানী ইসরাইলের মধ্যে তিনজন লোক ছিল। একজন শ্বেতরোগী, একজন মাথায় টাকওয়ালা আর একজন অন্ধ। মহান আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। কাজেই, তিনি তাদের নিকট একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে শ্বেত রোগীটির নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট কোন্ জিনিস অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, সুন্দর রং ও সুন্দর চামড়া। কেননা, মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীরের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে তার রোগ সেরে গেল। তাকে সুন্দর রং এবং সুন্দর চামড়া দান করা হল। অতঃপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ ধরনের সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, ’উট’ অথবা সে বলল, ’গরু’। এ ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়েছে যে শ্বেতরোগী না টাকওয়ালা দু’জনের একজন বলেছিল ’উট’ আর অপরজন বলেছিল ’গরু’। অতএব তাকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী উটনী দেয়া হল। তখন ফিরশতা বললেন, ’’এতে তোমার জন্য বরকত হোক।’’

বর্ণনাকারী বলেন, ফেরেশতা টাকওয়ালার নিকট গেলেন এবং বললেন, তোমার নিকট কী জিনিস পছন্দনীয়? সে বলল, সুন্দর চুল এবং আমার হতে যেন এ রোগ চলে যায়। মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। বর্ণনাকারী বলেন, ফেরেশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ মাথার টাক চলে গেল। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হল। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল, ’গরু’। অতঃপর তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দান করলেন। এবং ফেরেশতা দু’আ করলেন, এতে তোমাকে বরকত দান করা হোক। অতঃপর ফেরেশতা অন্ধের নিকট আসলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ জিনিস তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, আল্লাহ্ যেন আমার চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে দেন, যাতে আমি মানুষকে দেখতে পারি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তখন ফেরেশতা তার চোখের উপর হাত ফিরিয়ে দিলেন, তৎক্ষণাৎ আল্লাহ্ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ সম্পদ তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে জবাব দিল ’ছাগল’। তখন তিনি তাকে একটি গর্ভবতী ছাগী দিলেন। উপরে উল্লেখিত লোকদের পশুগুলো বাচ্চা দিল। ফলে একজনের উটে ময়দান ভরে গেল, অপরজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেল এবং আর একজনের ছাগলে উপত্যকা ভরে গেল।

অতঃপর ঐ ফেরেশতা তাঁর পূর্ববর্তী আকৃতি প্রকৃতি ধারণ করে শ্বেতরোগীর নিকট এসে বললেন, আমি একজন নিঃস্ব ব্যক্তি। আমার সফরের সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ আমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছার আল্লাহ্ ব্যতীত কোন উপায় নেই। আমি তোমার নিকট ঐ সত্তার নামে একটি উট চাচ্ছি, যিনি তোমাকে সুন্দর রং, কোমল চামড়া এবং সম্পদ দান করেছেন। আমি এর উপর সাওয়ার হয়ে আমার গন্তব্যে পৌঁছাব। তখন লোকটি তাকে বলল, আমার উপর বহু দায়িত্ব রয়েছে। তখন ফেরেশতা তাকে বললেন, সম্ভবত আমি তোমাকে চিনি। তুমি কি এক সময় শ্বেতরোগী ছিলে না? মানুষ তোমাকে ঘৃণা করত। তুমি কি ফকীর ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তোমাকে দান করেছেন। তখন সে বলল, আমি তো এ সম্পদ আমার পূর্বপুরুষ হতে ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছি। ফেরেশতা বললেন, তুমি যদি মিথ্যাচারী হও, তবে আল্লাহ্ তোমাকে সেরূপ করে দিন, যেমন তুমি ছিলে। অতঃপর ফেরেশতা মাথায় টাকওয়ালার নিকট তাঁর সেই বেশভূষা ও আকৃতিতে গেলেন এবং তাকে ঠিক তেমনই বললেন, যেরূপ তিনি শ্বেত রোগীকে বলেছিলেন। এও তাকে ঠিক অনুরূপ জবাব দিল যেমন জবাব দিয়েছিল শ্বেতরোগী।

তখন ফেরেশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যাচারী হও, তবে আল্লাহ্ তোমাকে তেমন অবস্থায় করে দিন, যেমন তুমি ছিলে। শেষে ফেরেশতা অন্ধ লোকটির নিকট তাঁর আকৃতিতে আসলেন এবং বললেন, আমি একজন নিঃস্ব লোক, মুসাফির মানুষ; আমার সফরের সকল সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আজ বাড়ি পৌঁছার ব্যাপারে আল্লাহ্ ব্যতীত কোন গতি নেই। তাই আমি তোমার নিকট সেই সত্তার নামে একটি ছাগী প্রার্থনা করছি যিনি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন আর আমি এ ছাগীটি নিয়ে আমার এ সফরে বাড়ি পৌঁছতে পারব। সে বলল, প্রকৃতপক্ষেই আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ্ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি ফকীর ছিলাম। আল্লাহ্ আমাকে সম্পদশালী করেছেন। এখন তুমি যা চাও নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম। আল্লাহর জন্য তুমি যা কিছু নিবে, তার জন্যে আজ আমি তোমার নিকট কোন প্রশংসাই দাবী করব না। তখন ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তুমি রেখে দাও। তোমাদের তিন জনের পরীক্ষা নেয়া হল মাত্র। আল্লাহ্ তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তোমার সাথীদ্বয়ের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।  (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৬৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭৩২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৬৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২০৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহর প্রিয় বন্ধুদের কারামত (অলৌকিক কর্মকাণ্ড) এবং তাঁদের মাহাত্ম্য

(ঘটনা-১১): ‘আমর ইবনু আবূ সুফ্ইয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠালেন এবং আসিম ইবনু সাবিত আনসারীকে তাঁদের দলপতি নিয়োগ করেন। যিনি আসিম ইবনু ’উমার ইবনু খাত্তাবের নানা ছিলেন। তাঁরা রওনা করলেন, যখন তাঁরা উসফান ও মক্কার মাঝে হাদআত নামক স্থানে পৌঁছেন, তখন হুযায়েল গোত্রের একটি প্রশাখা যাদেরকে লেহইয়ান বলা হয় তাদের নিকট তাঁদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়। তারা প্রায় দু’শত তীরন্দাজকে তাঁদের পিছু ধাওয়ার জন্য পাঠান। এরা তাঁদের চিহ্ন দেখে চলতে থাকে। সাহাবীগণ মদিনা্ হতে সঙ্গে নিয়ে আসা খেজুর যেখানে বসে খেয়েছিলেন, অবশেষে এরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে গেল, তখন এরা বলল, ইয়াসরিবের খেজুর। অতঃপর এরা তাঁদের পদচিহ্ন দেখে চলতে লাগল। যখন আসিম ও তাঁর সাথীগণ এদের দেখলেন, তখন তাঁরা একটি উঁচু স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। আর কাফিররা তাঁদের ঘিরে ফেলল এবং তাঁদেরকে বলতে লাগল, তোমরা অবতরণ কর ও স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ কর। আমরা তোমাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমাদের মধ্য হতে কাউকে আমরা হত্যা করব না। তখন গোয়েন্দা দলের নেতা আসিম ইবনু সাবিত (রাঃ) বললেন, ’আল্লাহর কসম! আমি তো আজ কাফিরদের নিরাপত্তায় অবতরণ করবো না। হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নবীকে সংবাদ পৌঁছিয়ে দিন।’ অবশেষে কাফিররা তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করল। আর তারা আসিম (রাঃ) সহ সাত জনকে শহীদ করলো। অতঃপর অবশিষ্ট তিনজন খুবাইব আনসারী, যায়দ ইবনু দাসিনা (রাঃ) ও অপর একজন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর নির্ভর করে তাদের নিকট অবতরণ করলেন। যখন কাফিররা তাদেরকে আয়ত্বে নিয়ে নিল, তখন তারা তাদের ধনুকের রশি খুলে ফেলে তাঁদের বেঁধে ফেললো। তখন তৃতীয় জন বলে উঠলেন, ’গোড়াতেই বিশ্বাসঘাতকতা! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো না, যাঁরা শহীদ হয়েছেন আমি তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করব।’ কাফিররা তাঁকে শহীদ করে ফেলে এবং তারা খুবাইব ও ইবনু দাসিনাকে নিয়ে চলে যায়। অবশেষে তাঁদের উভয়কে মক্কায় বিক্রয় করে ফেলে। এটা বাদার যুদ্ধের পরের কথা। তখন খুবাইবকে হারিস ইবনু ’আমিরের পুত্রগণ ক্রয় করে নেয়। আর বাদার যুদ্ধের দিন খুবাইব (রাঃ) হারিস ইবনু ’আমিরকে হত্যা করেছিলেন। খুবাইব (রাঃ) কিছু দিন তাদের নিকট বন্দী থাকেন।

ইবনু শিহাব (রহ.) বলেন, আমাকে ’উবায়দুল্লাহ ইবনু আয়ায্ অবহিত করেছেন, তাঁকে হারিসের কন্যা জানিয়েছে যে, যখন হারিসের পুত্রগণ খুবাইব (রাঃ)-কে শহীদ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল, তখন তিনি তার কাছ থেকে ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশে একটা ক্ষুর ধার চাইলেন। তখন হারিসের কন্যা তাকে একখানা ক্ষুর ধার দিল। সে সময় ঘটনাক্রমে আমার এক ছেলে আমার অজ্ঞাতে খুবাইবের নিকট চলে যায় এবং আমি দেখলাম যে, আমার ছেলে খুবাইবের উরুর উপর বসে রয়েছে এবং খুবাইবের হাতে রয়েছে ক্ষুর। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুবাইব আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি ভয় পাচ্ছি। তখন তিনি বললেন, তুমি কি এ ভয় করো যে, আমি এ শিশুটিকে হত্যা করে ফেলব? কখনো আমি তা করব না। আল্লাহর কসম! আমি খুবাইবের মত উত্তম বন্দী কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ! আমি একদা দেখলাম, তিনি লোহার শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় ছড়া হতে আঙ্গুর খাচ্ছেন, যা তাঁর হাতেই ছিল। অথচ এ সময় মক্কা্য় কোন ফলই পাওয়া যাচ্ছিল না। হারিসের কন্যা বলতো, এ তো ছিল আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে প্রদত্ত জীবিকা, যা তিনি খুবাইবকে দান করেছেন। অতঃপর তারা খুবাইবকে শহীদ করার উদ্দেশে হারাম এর নিকট হতে হিল্লের দিকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল, তখন খুবাইব (রাঃ) তাদের বললেন, আমাকে দু’রাক’আত সালাত আদায় করতে দাও। তারা তাঁকে সে অনুমতি দিল। তিনি দু’রাকআত সালাত আদায় করে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ’তোমরা যদি ধারণা না করতে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি তবে আমি সালাতকে দীর্ঘ করতাম। হে আল্লাহ! তাদেরকে এক এক করে ধ্বংস করুন।’ (অতঃপর তিনি এ কবিতা দু’টি আবৃত্তি করলেন)

“যখন আমি মুসলিম হিসেবে শহীদ হচ্ছি তখন আমি কোন রূপ ভয় করি না।

আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাকে যেখানেই মাটিতে লুটিয়ে ফেলা হোক না কেন।

আমার এ মৃত্যু আল্লাহ তা’আলার জন্যই হচ্ছে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন,

তবে আমার দেহের প্রতিটি খন্ডিত জোড়াসমূহে বরকত সৃষ্টি করে দিবেন।’’

অবশেষে হারিসের পুত্র তাঁকে শহীদ করে ফেলে। বস্তুত যে মুসলিম ব্যক্তিকে বন্দী অবস্থায় শহীদ করা হয় তার জন্য দু’রাক’আত সালাত আদায়ের এ রীতি খুবাইব (রাঃ)-ই প্রবর্তন করে গেছেন। যে দিন আসিম (রাঃ) শাহাদত বরণ করেছিলেন, সেদিন আল্লাহ তা’আলা তাঁর দু’আ কবুল করেছিলেন। সেদিনই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে তাঁদের সংবাদ ও তাঁদের উপর যা’ যা’ আপতিত হয়েছিল সবই অবহিত করেছিলেন। আর যখন কুরাইশ কাফিরদেরকে এ সংবাদ পৌঁছানো হয় যে, আসিম (রাঃ)-কে শহীদ করা হয়েছে তখন তারা তাঁর কাছে এক লোককে পাঠায়, যাতে সে ব্যক্তি তাঁর লাশ হতে কিছু অংশ কেটে নিয়ে আসে, যেন তারা তা দেখে চিনতে পারে। কারণ, বাদার যুদ্ধের দিন আসিম (রাঃ) কুরাইশদের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। আসিমের লাশের (রক্ষার জন্য) মৌমাছির ঝাঁক প্রেরিত হল যারা তাঁর দেহ আবৃত করে রেখে তাদের ষড়যন্ত্র হতে হিফাযত করল। ফলে তারা তাঁর শরীর হতে এক খন্ড গোশ্তও কেটে নিতে পারেনি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩০৪৫, ৩৯৮৯, ৪০৮৬, ৭৪০২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৮১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৮২৮, সুনান আবূ দাউদ ২৬৬০, আহমাদ ৭৮৬৯, ৮০৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ক্ষমা ও তাওবাহ্র উদাহরণ

(ঘটনা-১২): মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ)....আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের আগেকার লোকেদের মধ্যে এক লোক ছিল। সে নিরানব্বই লোককে হত্যা করেছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, এ দুনিয়াতে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান লোক কে? তাকে এক আলিম দেখিয়ে দেয়া হয়। সে তার নিকট এসে বলল যে, সে নিরাব্বই লোককে হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় তার জন্য কি তওবা আছে? আলিম বলল, না। তখন সে আলিমকেও হত্যা করে ফেলল। সুতরাং সে আলিমকে হত্যা করে একশ’ সম্পূর্ণ করল। অতঃপর সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, এ দুনিয়াতে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তখন তাকে জনৈক ’আলিম লোকের সন্ধান দেয়া হলো। সে ’আলিমকে বলল যে, সে একশ’ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, তার জন্য কি তওবা্ আছে? আলিম লোক বললেন, হ্যাঁ। এমন কে আছে যে ব্যক্তি তার মাঝে ও তার তাওবার মাঝে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে? তুমি অমুক দেশে যাও। সেখানে কিছু লোক আল্লাহর ইবাদাতে নিমগ্ন আছে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদাতে লিপ্ত হও। নিজের ভূমিতে আর কক্ষনো প্রত্যাবর্তন করো না। কেননা এ দেশটি ভয়ঙ্কর খারাপ।

তারপর সে চলতে লাগল। এমনকি যখন সে মাঝপথে পৌছে তখন তার মৃত্যু আসলো। এবার রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতার মধ্যে তার ব্যাপারে বাক-বিতণ্ডা দেখা গেল। রহমতের ফেরেশতারা বললেন, সে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাওবার উদ্দেশে এসেছে। আর আযাবের ফেরেশতারা বললেন, সে তো কক্ষনো কোন সৎ কাজ করেনি। এমতাবস্থায় মানুষের আকৃতিতে এক ফেরেশতা আসলেন। তারা তাকে তাদের মাঝে মধ্যস্থতা বানালেন। তিনি উভয়কে বললেন, তোমরা উভয় স্থান পরিমাপ কর (নিজ ভূখণ্ড ও যাত্রাকৃত ভূখণ্ড)। এ দুটি ভূখণ্ডের মধ্যে যা সন্নিকটবর্তী হবে সে অনুযায়ী তার ফায়সালা হবে। তারপর উভয়ে পরিমাপ করে দেখলেন যে, সে ঐ ভূখণ্ডেরই বেশি নিকটবর্তী যেখানে পৌছার জন্যে সংকল্প করেছে। অতঃপর রহমতের ফেরেশতা তার রূহ কবয করে নিলেন। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, হাসান (রহঃ) বলেছেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন তার মৃত্যু এলো, তখন সে বুকের উপর ভর দিয়ে কিছু এগিয়ে গেল। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী ৬৯০১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৬৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪৭০,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৩২৭, সুনান ইবনু মাজাহ ২৬২২, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৫৮৩৬, শু‘আবূল ঈমান ৬৬৬৩, ইবনু হিব্বান ৬১৫, সহীহাহ্ ২৬৪০, সহীহ আত্ তারগীব ৩১৫১, সহীহ আল জামি‘ ২০৭৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩২১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩২২১, ৩২২৪, সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৬৭৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বারবার দোয়া করা

(ঘটনা-১৩): ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যাদু করা হলো। অবস্থা এমন হল যে, তাঁর খেয়াল হতো যে, তিনি একটা কাজ করেছেন, অথচ তিনি তা করেননি। সেজন্য তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। এরপর তিনি [’আয়িশাহ ]-কে বললেনঃ তুমি জেনেছ কি? আমি যে বিষয়টা আল্লাহর নিকট হতে জানতে চেয়েছিলাম, তা তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। ’আয়িশাহ (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তা কী? তিনি বললেনঃ (স্বপ্নের মধ্যে) আমার নিকট দুজন লোক আসলেন এবং একজন আমার মাথার কাছে, আরেক জন আমার দু পায়ের কাছে বসলেন। তারপর একজন তার সাথীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এ লোকের রোগটা কী? তখন অপরজন বললেনঃ তিনি যাদুগ্রস্ত। আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাকে কে যাদু করেছে? অপরজন বললেনঃ লাবীদ ইবনু আসাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা কিসের মধ্যে করেছে। তিনি বললেন, চিরুনী, ছেঁড়া চুল ও কাঁচা খেজুর গাছের খোসার মধ্যে। আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ এটা কোথায়? তিনি বললেনঃ যুরাইক গোত্রের ’যারওয়ান কূপের মধ্যে।

আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গেলেন (তা বের করিয়ে নিয়ে) ’আয়িশাহর কাছে ফিরে এসে বললেনঃ আল্লাহর কসম! সেই কূপের পানি যেন মেন্দি তলানি পানি এবং এর খেজুর গাছগুলো ঠিক যেন শয়তানের মাথা। ’আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এসে তাঁর কাছে কূপের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। তখন আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এ বিষয়টি লোকেদের মাঝে প্রকাশ করে দিলেন না কেন? তিনি বললেনঃ আল্লাহ তাআলা তো আমাকে রোগমুক্ত করেছেন। সুতরাং আমি লোকজনের মাঝে উত্তেজনা ছড়ানো পছন্দ করি না। ’ঈসা ইবনু ইউনুস ও লায়স (রহ.) .... ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যাদু করা হলে তিনি বারবার দুআ করলেন, এভাবে পূর্ণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৯৩, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৭৬৫, ৩১৭৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৫৯৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৮৯, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৫৪৫, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ২৩৫১৯, আবূ ইয়ালা ৪৮৮২, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৬৯৩৬, মুসনাদে আহমাদ ২৪৩৪৫, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ৭৬১৫, আল মু'জামুল আওসাত্ব ৫৯২৬, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৬৯৩৬, আস্ সুনানুস্ সুগরা ৩৩৭৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৯৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৮৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

আরোহীসহ ঘোড়া তার পেট পর্যন্ত মাটিতে দেবে গেল, শক্ত মাটিতে

(ঘটনা-১৪): ’বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আবূ বকর (রাঃ) আমার পিতার কাছে আমাদের বাড়িতে আসলেন। তিনি আমার পিতার কাছ হতে একটি হাওদা কিনলেন এবং আমার পিতাকে বললেন, তোমার ছেলে বারাকে আমার সঙ্গে হাওদাটি বয়ে নিয়ে যেতে বল। আমি হাওদাটি বয়ে তাঁর সঙ্গে চললাম। আমার পিতাও ওটার মূল্য নেয়ার জন্য আমাদের সঙ্গী হলেন। আমার পিতা তাঁকে বললেন, হে আবূ বকর! দয়া করে আপনি আমাদেরকে বলুন, আপনারা কী করেছিলেন যে রাতে আপনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথী ছিলেন? তিনি বললেন, হাঁ। অবশ্যই আমরা সারা রাত পথ চলে পরদিন দিন দুপুর অবধি চললাম। যখন রাস্তাঘাট লোকশূন্য হয়ে পড়ল, রাস্তায় কোন মানুষের আনাগোনা ছিল না।

হঠাৎ একটি লম্বা ও চওড়া পাথর আমাদের নযরে পড়লো, যার ছায়ায় সূর্যের তাপ প্রবেশ করছিল না। আমরা সেখানে গিয়ে নামলাম। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নিজ হাতে একটি জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিলাম, যাতে সেখানে তিনি ঘুমাতে পারেন। আমি ওখানে একটি চামড়ার বিছানা পেতে দিলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি আপনার নিরাপত্তার জন্য পাহারায় থাকলাম। তিনি শুয়ে পড়লেন। আর আমি চারপাশের অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন মেষ রাখাল তার মেষপাল নিয়ে পাথরের দিকে ছুটে আসছে। সেও আমাদের মত পাথরের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়।

আমি বললাম, হে যুবক! তুমি কার রাখাল? সে মদিনার কি মক্কার এক লোকের নাম বলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মেষপালে কি দুধেল মেষ আছে? সে বলল, হাঁ আছে। আমি বললাম, তুমি কি দুহে দিবে? সে বলল, হাঁ। অতঃপর সে একটি বক্রী ধরে নিয়ে এল। আমি বললাম, এর স্তন ধূলা-বালি, পশম ও ময়লা হতে পরিষ্কার করে নাও। রাবী আবূ ইসহাক (রহ.) বলেন, আমি বারাআ (রাঃ)-কে দেখলাম এক হাত অন্য হাতের উপর রেখে ঝাড়ছেন। অতঃপর ঐ যুবক একটি কাঠের বাটিতে কিছু দুধ দোহন করল। আমার সঙ্গেও একটি চামড়ার পাত্র ছিল। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উযূর পানি ও পান করার পানি রাখার জন্য নিয়েছিলাম। আমি দুধ নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম। তাঁকে জাগানো ভাল মনে করলাম না।

কিছুক্ষণ পর তিনি জেগে উঠলেন। আমি দুধ নিয়ে হাযির হলাম। আমি দুধের মধ্যে কিছু পানি ঢেলেছিলাম তাতে দুধের নীচ পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দুধ পান করুন। তিনি পান করলেন, আমি তাতে সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখন কি আমাদের যাত্রা শুরুর সময় হয়নি? আমি বললাম, হ্যাঁ হয়েছে। পুনরায় শুরু হল আমাদের সফর। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সুরাকা ইবনু মালিক আমাদের পিছন নিয়েছিল।

আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনুসরণে কে যেন আসছে। তিনি বললেন, চিন্তা করোনা, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিরুদ্ধে দুআ করলেন। তৎক্ষণাৎ আরোহীসহ ঘোড়া তার পেট পর্যন্ত মাটিতে দেবে গেল, শক্ত মাটিতে। রাবী যুহায়র এই শব্দটি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন আমার ধারণা এ রকম শব্দ বলেছিলেন। সুরাকা বলল, আমার বিশ্বাস আপনারা আমার বিরুদ্ধে দুআ করেছেন। আমার জন্য আপনারা দুআ করে দিন।

আল্লাহর কসম আপনাদের খোঁজকারীদেরকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দুআ করলেন। সে বেঁচে গেল। ফিরে যাবার পথে যার সঙ্গে তার দেখা হত, সে বলত আমি সব দেখে এসেছি। যাকেই পেয়েছে, ফিরিয়ে দিয়েছে। আবূ বকর (রাঃ) বলেন, সে আমাদের সঙ্গে করা অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৬১৫, ২৪৩৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫১৩৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০০৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৬৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৩৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৩৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই হাত তুলে দোয়া করতেই বৃষ্টি শুরু হলো

(ঘটনা-১৫): ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, ইয়াহইয়া ইবনু আইয়ুব, কুতায়বাহ ও ইবনু হুজুর (রহঃ).....আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত জনৈক ব্যক্তি জুমুআর দিন মসজিদে নবাবীতে দারুল কাযার দিকে স্থাপিত দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! (অনাবৃষ্টির ফলে) মাল সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অতএব আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন তিনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু হাত উঠিয়ে দুআ করলেন,

‘আল্ল-হুম্মা আগিসনা- আল্ল-হুম্মা আগিসনা-, আল্ল-হুম্মা আগিসনা-”

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।)। [৩ বার]

আনাস (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! এ সময় আসমানে কোন মেঘ বা মেঘের চিহ্নও ছিল না। আর আমাদের ও সালই পাহাড়ের মাঝে কোন ঘর-বাড়ী কিছুই ছিল না। (ক্ষণিকের মধ্যে) তার পেছন থেকে ঢালের ন্যায় অখণ্ড মেঘ উদিত হল। একটু পর তা মাঝ আকাশে এলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং বৃষ্টি শুরু হল। বর্ণনাকার বলেন, এরপর আল্লাহর শপথ আমরা সপ্তাহকাল যাবৎ আর সূর্যের মুখ দেখিনি।

অতঃপর পরবর্তী জুমুআয় আবার এক ব্যক্তি ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল! মাল সম্পদ সব বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অতএব, আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার হাত উঠিয়ে দুআ করলেন,

“আল্ল-হুম্মা হাওলানা- ওয়ালা- আলায়না- আল্ল-হুম্মা ’আলাল আ-কা-মি ওয়ায় যিরা-বি ওয়া বুতনিল আওদিয়াত ওয়া মানা-বিতিশ শাজার

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ আমাদের অবস্থা পাল্টে দাও আমাদের ওপর এ অবস্থা চাপিয়ে দিও না। হে আল্লাহ! পাহাড়ী এলাকায়, মালভূমিতে মাঠের অভ্যন্তরে ও গাছপালা গজানো স্থলে তা ফিরিয়ে নিয়ে যাও।)।

এরপর বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বের হয়ে সূর্য তাপের মধ্যে চলাচল করতে লাগলাম। শারীক বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যক্তি কি প্রথম ব্যক্তি? আনাস বললেন, আমার জানা নেই। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৯৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৮৯৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৫৮২, ৯৩২, ৯৩৩, ১০১৩, ১০১৪, ১০১৫, ১০১৬, ১০১৭, ১০১৮, ১০১৯, ১০২১, ১০২৯, ১০৩৩, ৩৫৮২, ৬০৯৩, ৬৩৪২,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৯০২, সুনান আননাসায়ী ১৫১৫, সুনান ইবনু মাজাহ ১২৬৯, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৪৭৯, ইরওয়া ৪১৬, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার ২০৫৫, মুসান্নাফ আবদুর রযযাক ৪৯১০, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ২৯২২৫, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমায়দ ১২৮২, মুসনাদুশ শাফি'ঈ ৩৫৬, মুসনাদে আহমাদ ১২০৩৮, আবূ ইয়া'লা ৩৩৩৪, সহীহ ইবনু খুযায়মা ১৪২৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৯৯২, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১৮১৮, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১০৫২৫, আল মু'জামুল আওসাত্ব ৫৯২, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ৬৬৬৬, আদাবুল মুফরাদ ৬১২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৩১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৩২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মুশরিক ও মুনাফিকদের হাতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুঃখ-যাতনা

(ঘটনা-১৬): ’আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার নিকটে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। আর কুরাইশের একদল তাদের মাজলিসে উপবিষ্ট ছিল। তাদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি বললঃ তোমরা কি এই রিয়াকারকে লক্ষ করছ না? তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে অমুক গোত্রের উট যবেহ করার স্থান পর্যন্ত যেতে পার? সেখান হতে গোবর, রক্ত ও নাড়িভুড়ি নিয়ে এসে অপেক্ষা করবে। যখন তিনি সাজদায় যাবেন, তখন এগুলো তার দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দিবে। এ কাজের জন্য তাদের চরম দুর্ভাগা ব্যক্তি (’উক্ববাহ ইবনু আবূ মুআইত) উঠে দাঁড়াল (এবং তা নিয়ে আসলো)। যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাজদায় গেলেন তখন সে তাঁর দুকাঁধের মাঝখানে সেগুলো রেখে দিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদা্য় স্থির রয়ে গেলেন। এতে তারা পরস্পর হাসাহাসি করতে লাগলো। এমনকি হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের উপর লুটোপুটি করতে লাগল। (এ অবস্থা দেখে) এক ব্যক্তি ফাতিমাহ (রাযি.)-এর নিকট গেলেন।

তখন তিনি ছিলেন ছোট বালিকা। তিনি দৌড়ে চলে এলেন। তখনও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদা্য় স্থির ছিলেন। অবশেষে তিনি [ফাতিমাহ (রাযি.)] সেগুলো তাঁর উপর হতে ফেলে দিলেন এবং মুশরিকদের লক্ষ্য করে তিরস্কার করতে লাগলেন। যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করলেন তখন তিনি বললেনঃ ’’হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের ধ্বংস কর। “হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের ধ্বংস কর।“ ’’আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের ধ্বংস কর।”  অতঃপর তিনি নাম নিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি ১. ’আমর ইবনু হিশাম (আবূ জাহল), ২. ’উতবাহ্ ইবনু রবীআহ্, ৩, শায়বাহ্ ইবনু রবীআহ, ৪. ওয়ালীদ ইবনু ’উতবাহ, ৫. উমাইয়্যাহ ইবনু খালফ, ৬. ’উকবাহ্ ইবনু আবূ মুআয়ত্ব এবং ৭. ’উমারাহ্ ইবনুল ওয়ালীদেরকে পাকড়াও কর। ’আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযি.) বলেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি এদের সকলকেই বদরের দিন নিহত লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। অতঃপর তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে বাদ্র কূপে নিক্ষেপ করা হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ এই কুয়াবাসীদের উপর চিরস্থায়ী অভিসম্পাত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫২০, ২৪০,   সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৪৫৪১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৯৪,  মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৪৭, মুসনাদে আহমাদ ২২২৫, আবূ ইয়া'লা ২৬০৪, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ১৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১১০৬১, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৮১৮৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ৩৪৭২।আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বদর যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) যার জন্য যে স্থানটি দেখিয়েছিলেন যুদ্ধ শেষে দেখা গেলো সে সেই স্থানেই পড়ে আছে

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা মক্কাহ্ এবং মদীনার মাঝামাঝি স্থানে ’উমার (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম, তখন আমরা নতুন চাঁদ দেখতে চেষ্টা করি। আমি ছিলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন লোক। অতএব আমি চাঁদ দেখে ফেললাম। আর আমি ব্যতীত অন্য কেউই চাঁদ দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেনি। আমি ’উমার (রাঃ)-কে বললাম, আপনি কি চাঁদ দেখছেন না? কিন্তু তিনি তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ’উমার (রাঃ) বললেন, শীঘ্রই আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে তা দেখব। অতঃপর ’উমার (রাঃ) বদর যুদ্ধের ঘটনাবলী বর্ণনা করতে লাগলেন এবং বললেন, যুদ্ধের একদিন আগে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে ঐ সমস্ত স্থানগুলো দেখিয়ে দিলেন, যে যে স্থানে কাফিরদের লাশ পড়ে থাকবে। তিনি বললেন, ইনশা-আল্ল-হ আগামীকাল এ জায়গা অমুক (কাফির)-এর লাশ পড়বে। ইনশাআল্ল-হ আগামীকাল এ স্থানে অমুকের লাশ পড়বে। উমার (রাঃ) বলেন, সেই মহান সত্তার শপথ! যিনি তাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন; যে সকল স্থান রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দিষ্ট করেছিলেন, ঐ স্থান হতে একটুখানিও এদিক-সেদিক সরে পড়েনি।

(বর্ণনাকারী বলেন,) অতঃপর লাশগুলোকে একটি (অনাবাদ) কূপের মাঝে একটির উপর অপরটিকে নিক্ষেপ করা হলো এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) কূপটির কাছে এসে বললেন, হে অমুকের পুত্র অমুক! হে অমুকের পুত্র অমুক! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তোমরা কি তা ঠিক ঠিক পেয়েছ? তবে আমার আল্লাহ আমাকে যা ওয়াদা দিয়েছেন, আমি অবশ্য তা ঠিক ঠিকভাবে পেয়েছি। তখন ’উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কিভাবে এমন দেহসমূহের সাথে কথা বলছেন, যাদের মধ্যে কোন প্রাণ নেই। তিনি বললেন, আমি তাদেরকে যা বলছি, তোমরা তা তাদের চেয়ে বেশি শুনছ না, অবশ্য তারা আমার কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম নয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৯৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭১১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৭৩, আবূ ইয়া'লা ১৪০, মুসনাদে বাযার ২২২, আবূ ইয়া'লা ১৪০, আল মু'জামুস্ সগীর লিত্ব তবারানী ১০৮৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih। 

খন্দকের যুদ্ধের শুরুতে ১০০০ লোক পেট পুরে খাওয়ার পরও ডেকছির মাংস ও আটার খামির আগের মতোই রইল

(ঘটনা-১৭): জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের শুরুতে আমরা পরিখা খনন করছিলাম। এ সময় এক খণ্ড শক্ত পাথর দেখা দিল। তখন লোকেরা এসে নবী (সা.) -কে বলল, খাল খননকালে একটি শক্ত পাথর দেখা দিয়েছে (যা কোদাল কিংবা শাবল দ্বারা ভাঙা যাচ্ছে না)। তখন নবী (সা.) বললেন, আচ্ছা, আমি নিজেই গর্তে নামব। অতঃপর তিনি (সা.) দাঁড়ালেন, সে সময় তার পেটে পাথর বাধা ছিল। আর আমরাও তিনদিন যাবৎ কিছুই খেতে পাইনি। এমতাবস্থায় নবী (সা.) কোদাল হাতে নিয়ে পাথরটির উপর আঘাত করলে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বালুকণায় পরিণত হয়। জাবির (রাঃ) বলেন, [নবী (সা.)-কে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পেয়ে] আমি আমার স্ত্রীর কাছে এসে বললাম, তোমার কাছে কি খাওয়ার মতো কিছু আছে? কেননা আমি নবী (সা.) -কে ভীষণ ক্ষুধার্ত দেখেছি। তখন সে একটি চামড়ার পাত্র হতে এক সা পরিমাণ যব বের করল আর আমাদের পোষা একটি বকরির ছানা ছিল। তখন আমি সেই ছানাটি যাবাহ করলাম এবং আমার স্ত্রীও যব পিষল। অবশেষে আমরা হাঁড়িতে মাংস চড়ালাম। অতঃপর নবী (সা.) -এর কাছে এসে তাকে চুপে চুপে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আমাদের ছোট একটি বকরির বাচ্চা যাবাহ করেছি। আর এক সা যব ছিল, আমার স্ত্রী তা পিষেছে। অতএব আপনি আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। (এ কথা শুনে) নবী (সা.) উচ্চৈঃস্বরে সকলকে ডেকে বললেন, হে খাল খননকারীগণ! আসো, তোমরা তাড়াতাড়ি চল, জাবির তোমাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেছে।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যাও, কিন্তু আমি না আসা পর্যন্ত মাংসের ডেকচি নামাবে না এবং খামিরগুলো নবী (সা.) -এর সামনে আগিয়ে দিলে তিনি তাতে মুখের লালা মিশালেন এবং বরকতের জন্য দুআ করলেন। অতঃপর ডেকচির কাছে অগ্রসর হয়ে তাতেও লালা মিশিয়ে বরকতের জন্য দু’আ করলেন। এরপর তিনি (আমার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে) বললেন, তুমি আরো রুটি প্রস্তুতকারিণীকে আহ্বান কর, যারা তোমাদের সাথে রুটি বানায় এবং চুলার উপর হতে ডেকচি না নামিয়ে তা হতে নিয়ে পরিবেশন কর। (জাবির রা. বলেন) সাহাবীদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সকলে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যাওয়ার পরও তরকারি ভর্তি ডেচকি ফুটছিল এবং প্রথম অবস্থার মতো আটার খামির হতে রুটি প্রস্তুত হচ্ছিল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮৭৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪১০২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৫২১০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০৩৯, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪৩২৪, আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৪৯৯১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫১৪২, ইসলামিক সেন্টার ৫১৫৪ )।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবরাহীম (আঃ)  এর স্ত্রী হাযেরা (আঃ) এবং তাঁর শিশু ছেলে ইসমাঈল (আঃ)

(ঘটনা-১৮): সাঈদ ইবনু জুবাইর (রহ.) হতে বর্ণিত। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, নারী জাতি সর্বপ্রথম কোমরবন্দ বানানো শিখেছে ইসমাঈল (আঃ)-এর মায়ের নিকট থেকে। হাযেরা (আঃ) কোমরবন্দ লাগাতেন সারাহ (আঃ) থেকে নিজের মর্যাদা গোপন রাখার জন্য। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) হাযেরা (আঃ) এবং তাঁর শিশু ছেলে ইসমাঈল (আঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এ অবস্থায় যে, হাযেরা (আঃ) শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কাবার ঘর অবস্থিত, ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের উঁচু অংশে যমযম কূপের উপরে অবস্থিত একটি বিরাট গাছের নীচে তাদেরকে রাখলেন। তখন মক্কা্য় না ছিল কোন মানুষ, না ছিল কোনরূপ পানির ব্যবস্থা। পরে তিনি তাদেরকে সেখানেই রেখে গেলেন। আর এছাড়া তিনি তাদের নিকট রেখে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে কিছু পরিমাণ পানি। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পিছু পিছু আসলেন এবং বলতে লাগলেন, হে ইবরাহীম! আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাদেরকে এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী আর না আছে কোন ব্যবস্থা। তিনি এ কথা তাকে বারবার বললেন। কিন্তু ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দিকে তাকালেন না। তখন হাযেরা (আঃ) তাঁকে বললেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ। হাযেরা (আঃ) বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। অতঃপর তিনি ফিরে আসলেন। আর ইবরাহীম (আঃ)-ও সামনে চললেন। চলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌঁছলেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তখন তিনি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি দুহাত তুলে এ দুআ করলেন, আর বললেন, ’’হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার পরিবারের কতককে আপনার সম্মানিত ঘরের নিকট এক অনুর্বর উপত্যকায় ...... যাতে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে- (ইবরাহীম ৩৭)। আর ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে স্বীয় স্তন্যের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজে তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তাঁর শিশু পুত্রটিও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুটির দিকে দেখতে লাগলেন। তৃষ্ণায় তার বুক ধড়ফড় করছে অথবা রাবী বলেন, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। শিশু পুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের নিকটবর্তী পর্বত ’সাফা-কে একমাত্র তাঁর নিকটতম পর্বত হিসাবে পেলেন। অতঃপর তিনি তার উপর উঠে দাঁড়ালেন এবং ময়দানের দিকে তাকালেন। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথায়ও কাউকে দেখা যায় কিনা? কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন ’সাফা পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। এমন কি যখন তিনি নিচু ময়দান পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের মত ছুটে চললেন। অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে ’মারওয়া পাহাড়ের নিকট এসে তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর এদিকে সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কিনা? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এমনিভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন।

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এজন্যই মানুষ এ পর্বতদ্বয়ের মধ্যে সায়ী করে থাকে। অতঃপর তিনি যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছ। যদি তোমার নিকট কোন সাহায্যকারী থাকে। হঠাৎ যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন অথবা তিনি বলেছেন, আপন ডানা দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে পানি বের হতে লাগল। তখন হাযেরা (আঃ)-এর চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে এক হাউজের মত করে দিলেন এবং হাতের কোষভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। তখনো পানি উপচে উঠছিল। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে যমযমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন কিংবা বলেছেন, যদি কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হতো। রাবী বলেন, অতঃপর হাযেরা (আঃ) পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন আশঙ্কা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দুজনে মিলে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না। ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি যমীন থেকে টিলার মত উঁচু ছিল। বন্যা আসার ফলে তার ডানে বামে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অতঃপর হাযেরা (আঃ) এভাবেই দিন যাপন করছিলেন। অবশেষে জুরহুম গোত্রের একদল লোক তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল। অথবা রাবী বলেন, জুরহুম পরিবারের কিছু লোক কাদা নামক উঁচু ভূমির পথ ধরে এদিকে আসছিল। তারা মক্কা্য় নীচু ভূমিতে অবতরণ করল এবং তারা দেখতে পেল একঝাঁক পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপর উড়ছে। আমরা এ ময়দানের পথ হয়ে বহুবার অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখানে কোন পানি ছিল না। তখন তারা একজন কি দুজন লোক সেখানে পাঠালো। তারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেল। তারা সেখান থেকে ফিরে এসে সকলকে পানির সংবাদ দিল। সংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হল। রাবী বলেন, ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পানির নিকট ছিলেন। তারা তাঁকে বলল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তবে, এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ, বলে তাদের মত প্রকাশ করল।

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাকে একটি সুযোগ এনে দিল। আর তিনিও মানুষের সাহচর্য চেয়েছিলেন। অতঃপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল এবং তাদের পরিবার-পরিজনের নিকটও সংবাদ পাঠাল। তারপর তারাও এসে তাদেরও সাথে বসবাস করতে লাগল। পরিশেষে সেখানে তাদেরও কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হল। আর ইসমাঈলও যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের থেকে আরবী ভাষা শিখলেন। যৌবনে পৌঁছে তিনি তাদের নিকট অধিক আকর্ষণীয় ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। অতঃপর যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করলেন, তখন তারা তাঁর সঙ্গে তাদেরই একটি মেয়েকে বিবাহ দিল। এরই মধ্যে ইসমাঈলের মা হাযেরা (আঃ) ইন্তিকাল করেন। ইসমাঈলের বিবাহের পর ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পরিত্যক্ত পরিজনের অবস্থা দেখার জন্য এখানে আসলেন। কিন্তু তিনি ইসমাঈলকে পেলেন না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। স্ত্রী বলল, তিনি আমাদের জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। অতঃপর তিনি পুত্রবধূকে তাদের জীবন যাত্রা এবং অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, আমরা অতি দূরবস্থায়, অতি টানাটানি ও খুব কষ্টে আছি। সে ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট তাদের দুর্দশার অভিযোগ করল। তিনি বললেন, তোমার স্বামী বাড়ী আসলে, তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, সে যেন তার ঘরের দরজার চৌকাঠ বদলিয়ে নেয়। অতঃপর যখন ইসমাঈল বাড়ী আসলেন, তখন তিনি যেন কিছুটা আভাস পেলেন। তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের নিকট কেউ কি এসেছিল? স্ত্রী বলল, হাঁ। এমন এমন আকৃতির একজন বৃদ্ধ লোক এসেছিলেন এবং আমাকে আপনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি তাঁকে আপনার সংবাদ দিলাম। তিনি আমাকে আমাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাঁকে জানালাম, আমরা খুব কষ্ট ও অভাবে আছি। ইসমাঈল (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তোমাকে কোন নাসীহাত করেছেন? স্ত্রী বলল, হাঁ। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আপনাকে তাঁর সালাম পৌঁছাই এবং তিনি আরো বলেছেন, আপনি যেন আপনার ঘরের দরজার চৌকাঠ বদলিয়ে ফেলেন। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, ইনি আমার পিতা। এ কথা দ্বারা তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমি যেন তোমাকে পৃথক করে দেই। অতএব তুমি তোমার আপন জনদের নিকট চলে যাও। এ কথা বলে, ইসমাঈল (আঃ) তাকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং ঐ লোকদের থেকে অন্য একটি মেয়েকে বিবাহ করলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) এদের থেকে দূরে রইলেন, আল্লাহ যতদিন চাইলেন। অতঃপর তিনি আবার এদের দেখতে আসলেন। কিন্তু এবারও তিনি ইসমাঈল (আঃ)-এর দেখা পেলেন না। তিনি পুত্রবধূর নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, তিনি আমাদের খাবারের খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। ইবরাহীম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেমন আছ? তিনি তাদের জীবন যাপন ও অবস্থা জানতে চাইলেন। তখন সে বলল, আমরা ভাল এবং স্বচ্ছল অবস্থায় আছি। আর সে আল্লাহর প্রশংসাও করল। ইবরাহীম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের প্রধান খাদ্য কী? সে বলল, গোশ্ত। তিনি আবার জানতে চাইলেন, তোমাদের পানীয় কী? সে বলল, পানি। ইবরাহীম (আঃ) দুআ করলেন, হে আল্লাহ! তাদের গোশ্ত ও পানিতে বরকত দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ সময় তাদের সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো না। যদি হতো তাহলে ইবরাহীম (আঃ) সে বিষয়েও তাদের জন্য দুআ করতেন। বর্ণনাকারী বলেন, মক্কা ছাড়া অন্য কোথাও কেউ শুধু গোশ্ত ও পানি দ্বারা জীবন ধারণ করতে পারে না। কেননা, শুধু গোশ্ত ও পানি জীবন যাপনের অনুকূল হতে পারে না।

ইবরাহীম (আঃ) বললেন, যখন তোমার স্বামী ফিরে আসবে, তখন তাঁকে সালাম বলবে, আর তাঁকে আমার পক্ষ থেকে হুকুম করবে যে, সে যেন তার ঘরের দরজার চৌকাঠ ঠিক রাখে। অতঃপর ইসমাঈল (আঃ) যখন ফিরে আসলেন, তখন তিনি বললেন, তোমাদের নিকট কেউ এসেছিলেন কি? সে বলল, হাঁ। একজন সুন্দর চেহারার বৃদ্ধ লোক এসেছিলেন এবং সে তাঁর প্রশংসা করল, তিনি আমাকে আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। আমি তাঁকে আপনার সংবাদ জানিয়েছি। অতঃপর তিনি আমার নিকট আমাদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি তাঁকে জানিয়েছি যে, আমরা ভাল আছি। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, তিনি কি তোমাকে আর কোন কিছুর জন্য আদেশ করেছেন? সে বলল, হাঁ। তিনি আপনার প্রতি সালাম জানিয়ে আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখেন। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, ইনিই আমার পিতা। আর তুমি হলে আমার ঘরের দরজার চৌকাঠ। এ কথার দ্বারা তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন তোমাকে স্ত্রী হিসাবে বহাল রাখি। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) এদের থেকে দূরে রইলেন, যদ্দিন আল্লাহ চাইলেন। অতঃপর তিনি আবার আসলেন। (দেখতে পেলেন) যমযম কূপের নিকটস্থ একটি বিরাট বৃক্ষের নীচে বসে ইসমাঈল (আঃ) তাঁর একটি তীর মেরামত করছেন। যখন তিনি তাঁর পিতাকে দেখতে পেলেন, তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর একজন বাপ-বেটার সঙ্গে, একজন বেটা-বাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে যেমন করে থাকে তাঁরা উভয়ে তাই করলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) বললেন, হে ইসমাঈল! আল্লাহ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল (আঃ) বললেন, আপনার রব! আপনাকে যা আদেশ করেছেন, তা করুন। ইবরাহীম (&আ) বললেন, তুমি আমার সাহায্য করবে কি? ইসমাঈল (আঃ) বললেন, আমি আপনার সাহায্য করব। ইবরাহীম (আঃ) বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই বলে তিনি উঁচু টিলাটির দিকে ইশারা করলেন যে, এর চারপাশে ঘেরাও দিয়ে। তখনি তাঁরা উভয়ে কাবা ঘরের দেয়াল তুলতে লেগে গেলেন। ইসমাঈল (আঃ) পাথর আনতেন, আর ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করতেন। পরিশেষে যখন দেয়াল উঁচু হয়ে গেল, তখন ইসমাঈল (আঃ) (মাকামে ইবরাহীম নামে খ্যাত) পাথরটি আনলেন এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্য তা যথাস্থানে রাখলেন। ইবরাহীম (আঃ) তার উপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ করতে লাগলেন। আর ইসমাঈল (আঃ) তাঁকে পাথর যোগান দিতে থাকেন। তখন তারা উভয়ে এ দুআ করতে থাকলেন, হে আমাদে রব! আমাদের থেকে কবূল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানেন। তাঁরা উভয়ে আবার কাবা ঘর তৈরী করতে থাকেন এবং কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে এ দুআ করতে থাকেন। ’’হে আমাদের রব! আমাদের থেকে কবূল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানেন।” (আল-বাকারাহঃ ১২৭)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৩৬৪, ২৩৬৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩১১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩১২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ন্যায় বিচার

(ঘটনা-১৯): আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দুজন মহিলা ছিল। তাদের সাথে দুটি সন্তানও ছিল। হঠাৎ একটি বাঘ এসে তাদের একজনের ছেলে নিয়ে গেল। সঙ্গের একজন মহিলা বললো, ’’তোমার ছেলেটিই বাঘে নিয়ে গেছে।” অন্য মহিলাটি বললো, ’’না, বাঘে তোমার ছেলেটি নিয়ে গেছে।” অতঃপর উভয় মহিলাই দাঊদ (আঃ)-এর নিকট এ বিরোধ মীমাংসার জন্য বিচারপ্রার্থী হলো। তখন তিনি ছেলেটির বিষয়ে বয়স্কা মহিলাটির পক্ষে রায় দিলেন। অতঃপর তারা উভয়ে বেরিয়ে দাউদ (আঃ)-এর পুত্র সুলায়মান (আঃ)-এর নিকট দিয়ে যেতে লাগল এবং তারা দুজনে তাঁকে ব্যাপারটি জানালেন। তখন তিনি লোকদেরকে বললেন, তোমরা আমার নিকট একখানা ছোরা নিয়ে আস। আমি ছেলেটিকে দু টুকরা করে তাদের দুজনের মধ্যে ভাগ করে দেই। এ কথা শুনে অল্প বয়স্কা মহিলাটি বলে উঠলো, তা করবেন না, আল্লাহ্ আপনার উপর রহম করুন, ছেলেটি তারই। তখন তিনি ছেলেটি সম্পর্কে অল্প বয়স্কা মহিলাটির অনুকূলে রায় দিলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩৪২৭, ৬৭৬৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭২০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩১৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩১৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ব্যভিচারের শাস্তি গ্রহণ ও খালেসভাবে তওবা করা

(ঘটনা-২০): বুরায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা মায়েয ইবনে মালেক (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, ‘আক্ষেপ তোমার প্রতি, চলে যাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন এবং সামান্য একটু দূরে গিয়েই পুনরায় ফিরে আসলেন এবং আবারও বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবারও তাঁকে পূর্বের ন্যায় বললেন। এইভাবে তিনি যখন চতুর্থবার এসে বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! আমি তোমাকে কোন্ জিনিস হতে পবিত্র করব? তিনি বললেন, যিনা হতে। তাঁর কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ছাহাবাদেরকে) জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটি কি পাগল? লোকেরা বলল, না তো? তিনি পাগল নন। তিনি আবার বললেন, ‘লোকটি কি মদ পান করেছে? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তাঁর মুখ শুঁকে দেখেন; কিন্তু মদের কোন গন্ধ তাঁর মুখ হতে পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সত্যই যিনা করেছ? তিনি বললেন, জি হ্যাঁ। এরপর তিনি রজমের নির্দেশ দিলেন, তখন তাঁকে রজম করা হল। এই ঘটনার দুই/তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (ছাহাবাদের সম্মুখে) এসে বললেন, তোমরা মায়েয ইবনে মালেকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা সে এমন তওবাই করেছে, যদি তা সমস্ত উম্মতের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়, তবে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে।

অতঃপর আয্দ বংশের গামেদী গোত্রীয় একটি মহিলা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাকে পবিত্র করুন। তিনি বললেন, তোমার প্রতি আক্ষেপ! চলে যাও, আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার কর এবং তওবা কর। তখন মহিলাটি বলল, আপনি মায়েয ইবনে মালেককে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাকেও কি সেভাবে ফিরিয়ে দিতে চান? দেখুন, আমার এই গর্ভ যিনার! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি (সত্যই গর্ভবতী)? মহিলাটি বলল, জি হ্যাঁ।

অতঃপর তিনি বললেন, যাও, তোমার পেটের বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আনছারী এক লোক মহিলাটির সন্তান প্রসব হওয়ার সময় পর্যন্ত তাকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। সন্তান প্রসব হওয়ার পর ঐ লোকটি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে এসে বলল, হুযুর! গামেদী মহিলাটির গর্ভ খালাছ হয়ে গিয়েছে। এবার তিনি বললেন, এই শিশু বাচ্চাটিকে রেখে আমরা মহিলাটিকে রজম করতে পারব না। এমতাবস্থায় যে, তাকে দুধ পান করাবার মত কেউই নেই। এমন সময় আর একজন আনছারী দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমিই তার দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করব। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তাকে রজম করলেন।

অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহিলাটিকে বললেন, ‘তুমি চলে যাও এবং সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। অতঃপর সন্তান প্রসবের পর যখন আসল, তখন বললেন, আবারও চলে যাও এবং তাকে দুধ পান করাও এবং দুধ ছাড়ান পর্যন্ত অপেক্ষা কর। পরে যখন বাচ্চাটির দুধ খাওয়া বন্ধ হয়, তখন মহিলাটি বাচ্চার হাতে এক খণ্ড রুটির টুকরা দিয়ে তাকে সঙ্গে করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে উপস্থিত হল। এইবার মহিলাটি বলল, হে আল্লাহর নবী! এই দেখুন (বাচ্চাটির) দুধ ছাড়ান হয়েছে, এমনকি সে নিজের হাতের খানাও খেতে পারে। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাচ্চাটিকে একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিলেন। পরে মহিলাটির জন্য গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। অতএব তার জন্য বক্ষ পর্যন্ত গর্ত খনন করা হল। তৎপর লোকদেরকে নির্দেশ করলেন, তারা মহিলাটিকে রজম করল। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার মাথায় একখণ্ড পাথর নিক্ষেপ করতেই রক্ত ছিটে এসে তাঁর মুখমণ্ডলের উপর পড়ল। তাই তিনি মহিলাটিকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে গাল-মন্দ করলেন। (এটা শুনে) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে খালেদ, থাম! সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! মহিলাটি এমন (খালেছ) তওবা করেছে, যদি কোন বড় যালেমও এই ধরনের তওবা করে, তারও মাগফেরাত হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়ার আদেশ করলেন। অতঃপর তার জানাযা পড়লেন এবং তাকে দাফনও করা হল। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৫৬২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৩২৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬৯৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪২৮২, ইসলামিক সেন্টার ৪২৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

.................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...