Search This Blog

Thursday, February 16, 2023

জাহান্নামের বর্ণনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

নবি সাঃ এর উম্মত জাহান্নামে যাবে কেনো?

(জান্নাত এতো সহজ নয়)

(ক) প্রথম অংশ দেখতে এখানে ক্লিক করুন (PMMRC)

(খ) দ্বিতীয় অংশ দেখতে এখানে ক্লিক করুন (PMMRC)

(গ) যেসব কারণে অধিকাংশ নারী জাহান্নামী (PMMRC)

(তৃতীয় অংশ)

জাহান্নামের বর্ণনা

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়

 


জাহান্নাম বা দোযখ এর বর্ণনা

ভূমিকাঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হ্যাঁ, যে পাপ উপার্জন করেছে এবং তার পাপরাশি তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে”। (সুরা আল বাকারা ৮১)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“আর আমরা তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি; তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে তা দ্বারা তারা শুনে না; তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চেয়েও বেশী বিভ্রান্ত। তারাই হচ্ছে গাফেল”। (সুরা আরাফ ১৭৯)।

জান্নাত ও জাহান্নাম জ্বিন ও মানুষের জন্যে তৈরী। যারা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে চলবে তারা জান্নাতে যাবে আর যারা তাগুতের পথে চলবে তারা জাহান্নামে যাবে। কী কী কাজ করলে জান্নাত ও জাহান্নামে যাওয়া যাবে তার সুনির্দষ্ট গাইড লাইন রাসুল সাঃ আমাদেরকে দিয়েছেন। সব কিছু জানা ও শোনার পরও মানবজাতি উল্টো পথে চলে। যেহেতেু তারা উল্টো পথে চলে তাই তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ানক আযাবের স্থান জাহান্নাম।

জাহান্নাম সেই আগুনের বাসস্থানকে বলা হয়, যেখানে রেখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তার অবাধ্যদেরকে শাস্তি দেবেন। ফারসীতে একে ‘দোযখ’ বলা হয়, বাংলাতে নরক।

এটিকে আগুনের কারাগার বা জেলখানাও বলা যেতে পারে, যেখানে আল্লাহদ্রোহীরা চিরবন্দী থাকবে। যারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করে, জান্নাত-জাহান্নাম অবিশ্বাস করে, নবী-রসূলকে মিথ্যা মনে করে, যারা পাপ করে, অন্যায় ও অপরাধ করে, তাদের পারলৌকিক ঠিকানা হবে এই জাহান্নামে।

এই জাহান্নাম হলো মানুষের সবচেয়ে বড় লাঞ্ছনা, সবচেয়ে বড় ক্ষতি। মহান আল্লাহই সে কথা বলেছেন,

“হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যাকে দোযখে প্রবেশ করাবে, তাকে নিশ্চয় লাঞ্ছিত করবে। আর অত্যাচারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই”। (সুরা আলে ইমরানঃ ১৯২)।

“তারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাহলে সুনিশ্চিতভাবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন; সে তাতে অনন্তকাল থাকবে। এটা হচ্ছে চরম লাঞ্ছনা”। (সুরা তাওবাহঃ ৬৩)।

“যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি”। (সুরা নিসা ১৪)।

“আল্লাহ জাহান্নামে মুনাফেক ও কাফেরদেরকে একই জায়গায় সমবেত করবেন”। (সুরা নিসা ১৪০)।

“যারা অবিশ্বাস করে এবং আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তারা জাহিমবাসী”। (সুরা মায়িদা ১০)।

“বল, আসল ক্ষতিগ্রস্ত তো তারাই; যারা কিয়ামতের দিন নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিজনবর্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জেনে রাখ, এটিই সুস্পষ্ট ক্ষতি”। (সুরা যুমারঃ ১৫)।

জাহান্নাম জাহান্নামীদের বড় নিকৃষ্ট ঠিকানা, বড় নিকৃষ্ট বিশ্রামাগার, নিকৃষ্ট শয়নাগার। মহান আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয় তা আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে অতীব নিকৃষ্ট”! (সুরা ফুরকানঃ ৬৬)।

“এ হলো (সাবধানীদের জন্য) আর সীমালংঘনকারীদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট পরিণাম; জাহান্নাম, সেখানে ওরা প্রবেশ করবে, সুতরাং কত নিকৃষ্ট সে শয়নাগার”। (সুরা স্বাদঃ ৫৫-৫৬)।

“বল, ‘সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সমাগত; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করুক। আমি সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেওয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়; যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে; কত নিকৃষ্ট সেই পানীয় এবং কত নিকৃষ্ট সেই (অগ্নির) আশ্রয়স্থল”। (সুরা কাহ্‌ফঃ ২৯)।

জাহান্নাম পূর্ব হতেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে

মহান আল্লাহ তায়ালা পূর্ব হতেই জাহান্নাম সৃষ্টি করে রেখেছেন।  তিনি বলেছেন,

“যদি তোমরা তা (আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে”। (সুরা বাক্বারাহঃ ২৪)।

“তোমরা সেই আগুনকে ভয় কর, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে”। (সুরা আলে ইমরানঃ ১৩১)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা যখন জান্নাত তৈরি করলেন, তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, যাও জান্নাতখানা দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা এবং তার অধিবাসীদের জন্য যে সকল জিনিস আল্লাহ তা’আলা তৈরি করে রেখেছেন, সবকিছু দেখে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জান্নাতের সম্পর্কে শুনবে, সে অবশ্যই তাতে প্রবেশ (আকাঙ্ক্ষা) করবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের চতুষ্পর্শ কষ্টসমূহ দ্বারা বেষ্টন করে দিলেন, অতঃপর আবার জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, হে জিবরীল! আবার যাও এবং পুনরায় জান্নাত দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা দেখে এসে বললেন, হে আমার প্রভু! এখন যা কিছু দেখলাম, তার প্রবেশপথ যে,

কষ্টকর। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, কেউই তাতে প্রবেশ করবে না। তিনি (সা.) বলেন, অতঃপর আলাহ তা’আলা যখন জাহান্নামকে তৈরি করলেন, তখন বললেন, হে জিবরীল! যাও জাহান্নামটি দেখে আসো, তিনি গিয়ে দেখলেন, অতঃপর এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জাহান্নামের ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা শুনবে, সে কখনো তাতে প্রবেশ করবে না। অতঃপর জাহান্নামের চতুষ্পর্শ্বে আল্লাহ তা’আলা বেষ্টন করলেন প্রবৃত্তির আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা এবং পুনরায় জিবরীল আলায়হিস সালাম -কে বললেন, আবার যাও এবং দ্বিতীয়বার তা দেখে আসো। তিনি গেলেন এবং এবার দেখে এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ করে বলছি, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, একজন লোকও তাতে প্রবেশ ব্যতীত অবশিষ্ট থাকবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৯৬, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৭৪৪, সিলসিলাতুস সহীহাহ ১৮৬৬, সহীহুল জামি ৫২১০, মুসনাদে আহমাদ ৮৬৩৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৯৪, আবূ ইয়া'লা ৫৯৪০, শুআবূল ঈমান ৩৮৪, তিরমিযী ২৬৯৮, ইবনু মাজাহ ১৮৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

মহানবি সাঃ জাহান্নাম স্বচক্ষে দর্শন করেছেন। সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ জিবরীলকে দেখিয়েছেন।

(১) সামুরাহ ইবনু জুনদাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই তাঁর সাহাবীদেরকে বলতেন, তোমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? রাবী বলেন, যাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা, তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করত। তিনি একদিন সকালে আমাদেরকে বললেনঃ গত রাতে আমার কাছে দু’জন আগন্তুক আসল। তারা আমাকে উঠাল। আর আমাকে বলল, চলুন। আমি তাদের সঙ্গে চললাম। আমরা কাত হয়ে শুয়ে থাকা এক লোকের কাছে আসলাম। দেখলাম, অন্য এক লোক তার নিকট পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর পাথর নিচে গিয়ে পড়ছে। এরপর আবার সে পাথরটি অনুসরণ করে তা আবার নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মত আবার ভাল হয়ে যায়। ফিরে এসে আবার তেমনি আচরণ করে, যা পূর্বে প্রথমবার করেছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের (সাথীদ্বয়কে) বললাম, সুবহান্নাল্লাহ্! এরা কারা? তিনি বললেন, তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।

তিনি বলেন, আমরা চললাম, এরপর আমরা চিৎ হয়ে শোয়া এক লোকের কাছে আসলাম। এখানেও দেখলাম, তার নিকট এক লোক লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে তার চেহারার একদিকে এসে এটা দ্বারা মুখমন্ডলের একদিক মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে নাসারন্ধ্র,চোখ ও মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। আওফ (রহ.) বলেন, আবূ রাজা (রহ.) কোন কোন সময় ’ইয়ুশারশিরু’ শব্দের পরিবর্তে ’ইয়াশুক্কু’ শব্দ বলতেন। এরপর ঐ লোকটি শায়িত লোকটির অপরদিকে যায় এবং প্রথম দিকের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছে তেমনি আচরণই অপরদিকের সঙ্গেও করে। ঐ দিক হতে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মত ভাল হয়ে যায়। তারপর আবার প্রথমবারের মত আচরণ করে। তিনি বলেনঃ আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ্! এরা কারা? তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম।

রাবী বলেন, আমার মনে হয় যেন তিনি বলেছিলেন, আর তথায় শোরগোলের শব্দ ছিল। তিনি বলেন, আমরা তাতে উঁকি মারলাম, দেখলাম তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ রয়েছে। আর নিচ থেকে বের হওয়া আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করে, তখনই তারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠে। তিনি বলেন, আমি তাদেরকে বললাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। তিনি বলেন, আমরা চললাম এবং একটা নদীর (তীরে) গিয়ে পৌঁছলাম। রাবী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, নদীটি ছিল রক্তের মত লাল। আর দেখলাম, এই নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অন্য এক লোক আছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। আর ঐ সাঁতারকারী লোকটি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সে লোক কাছে এসে পৌঁছে যে নিজের নিকট পাথর একত্রিত করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার মুখ খুলে দেয় আর ঐ লোক তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সে চলে যায়, সাঁতার কাটতে থাকে; আবার তার কাছে ফিরে আসে, যখনইসে তার কাছে ফিরে আসে তখনই সে তার মুখ খুলে দেয়, আর ঐ ব্যক্তি তার মুখে একটা পাথর ঢুকিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বলল, চলুন, চলুন। তিনি বরৈন, আমরা চললাম এবং এমন একজন কুশ্রী লোকের কাছে এসে পৌঁছলাম, যা তোমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কুশ্রী বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার নিকট রয়েছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোকটি কে? তারা বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং একটা সজীব শ্যামল বাগানে হাজির হলাম, যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের থেকে অধিক উঁচু দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চারপাশে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত অধিক আর কখনো আমি দেখিনি। আমি তাদেরকে বললাম, উনি কে? এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং একটা বিরাট বাগানে গিয়ে পৌঁছলাম। এমন বড় এবং সুন্দর বাগান আমি আর কখনো দেখিনি। তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, এর ওপরে চড়ুন। আমরা ওপরে চড়লাম। শেষ পর্যন্ত সোনা-রূপার ইটের তৈরি একটি শহরে গিয়ে আমরা হাজির হলাম।

আমরা শহরের দরজায় পৌঁছলাম এবং দরজা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেয়া হল, আমরা তাতে প্রবেশ করলাম। তখন সেখানে আমাদের সঙ্গে এমন কিছু লোক সাক্ষাৎ করল যাদের শরীরের অর্ধেক খুবই সুন্দর, যা তোমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। আর শরীরের অর্ধেক এমনই কুশ্রী ছিল যা তোমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কুশ্রী মনে হয়। তিনি বলেন, সাথীদ্বয় ওদেরকে বলল, যাও ঐ নদীতে গিয়ে নেমে পড়। আর সেটা ছিল প্রশস্ত প্রবাহিত নদী, যার পানি ছিল দুধের মত সাদা। ওরা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। অতঃপর এরা আমাদের কাছে ফিরে এল, দেখা গেল তাদের এ শ্রীহীনতা দূর হয়ে গেছে এবং তারা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, এটা জান্নাতে আদন এবং এটা আপনার বাসস্থান। তিনি বলেন, আমি বেশ উপরের দিকে তাকালাম, দেখলাম ধবধবে সাদা মেঘের মত একটি প্রাসাদ আছে। তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, এটা আপনার বাসগৃহ। তিনি বলেন, আমি তাদেরকে বললাম, আল্লাহ্ তোমাদের মাঝে বরকত দিন! আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এতে প্রবেশ করি।

তারা বলল, আপনি অবশ্য এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়। তিনি বলেন, আমি এ রাতে অনেক বিস্ময়কর বিষয় দেখতে পেলাম, এগুলোর তাৎপর্য কী? তারা আমাকে বলল, আচ্ছা! আমরা আপনাকে বলে দিচ্ছি। ঐ যে প্রথম ব্যক্তিকে যার কাছে আপনি পৌঁছেছিলেন, যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হল ঐ ব্যক্তি যে কুরআন গ্রহণ করে তা ছেড়ে দিয়েছে। আর ফরজ সালাত ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে। আর ঐ ব্যক্তি যার কাছে গিয়ে দেখেছেন যে, তার মুখের এক ভাগ মাথার পিছন দিক পর্যন্ত, এমনিভাবে নাসারন্ধ্র ও চোখ মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল সে হল ঐ ব্যক্তি, যে সকালে নিজ ঘর থেকে বের হয়ে এমন কোন মিথ্যা বলে যা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সকল উলঙ্গ নারী-পুরুষ যারা চুলা সদৃশ গর্তের ভিতর আছে তারা হল ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর দল।

আর ঐ ব্যক্তি, যার কাছে পৌঁছে দেখেছিলেন যে, সে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সে হল সুদখোর। আর ঐ কুশ্রী ব্যক্তি, যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল আর সে এর চারপাশে দৌড়াচ্ছিল, সে হল জাহান্নামের দারোগা, মালিক ফেরেশ্তা। আর এ দীর্ঘকায় ব্যক্তি যিনি বাগানে ছিলেন, তিনি হলেন, ইবরাহীম (আঃ)। আর তাঁর আশেপাশের বালক-বালিকারা হলো ঐসব শিশু, যারা ফিত্রাতের (স্বভাবধর্মের) ওপর মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি বলেন, তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের শিশু সন্তানরাও কি? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ঃ মুশরিকদের শিশু সন্তানরাও। আর ঐসব লোক যাদের অর্ধাংশ অতি সুন্দর ও অর্ধাংশ অতি কুশ্রী তারা হল ঐ সম্প্রদায় যারা সৎ-অসৎ উভয় কাজ মিশ্রিতভাবে করেছে। আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭০৪৭, ৮৪৫; মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৬২১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৮৩১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৭৫, সুনান আত তিরমিযী ৭০৪৮, ‘বায়হাক্বী’র কুবরা ১০৭৭৬, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৬৮৪৫।আহমাদ ২০১১৫, আধুনিক প্রকাশনী ৬৫৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৭১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২)  আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সালাত আদায় করালেন। অতঃপর মিম্বারে উঠলেন এবং মসজিদের কিবলার দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে বললেন, আমি এখন তোমাদেরকে সালাত আদায় করার সময় জান্নাত ও জাহান্নামকে এ দেয়ালের সামনে এক বিশেষ বিশেষ রূপ ও আকৃতিতে দেখতে পেয়েছি, কিন্তু আজকের মতো এত উত্তম এবং এত নিকৃষ্ট এর আগে আর কখনো দেখতে পাইনি। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৯৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৪৯, ৯৩,  মুসনাদে আহমাদ ১৩৭৪৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ৭০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামের তত্ত্বাবধান

জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে অসংখ্য ফিরিস্তা মোতায়েন আছেন। সেই ফিরিশতাগণের প্রকৃতি সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

“হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারপরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিস্তাগণ, যারা আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে”। (সুরা তাহরীম ৬)।

জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফিরিশতার সংখ্যা

জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফিরিস্তার সংখ্যা উনিশ। মহান আল্লাহ বলেন,

“আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাক্কার (জাহান্নামে)। কিসে তোমাকে জানাল, সাক্বার কী? ওটা তাদেরকে (জীবিত অবস্থায়) রাখবে না, আর (মৃত অবস্থায়ও) ছেড়ে দেবে না। ওটা দেহের চামড়া দগ্ধ করে দেবে। ওর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশ জন প্রহরী। আমি ফেরেশ্তাদেরকেই করেছি জাহান্নামের প্রহরী। আর অবিশ্বাসীদের পরীক্ষা স্বরূপই আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি, যাতে কিতাবধারীদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, বিশ্বাসীদের বিশ্বাস বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসীরা ও কিতাবধারীগণ সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা ও অবিশ্বাসীরা বলবে, এ বর্ণনায় আল্লাহর উদ্দেশ্য কি? এইভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথ নির্দেশ করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (জাহান্নামের) এই বর্ণনা তো মানুষের জন্য উপদেশ বাণী”। (সুরা মুদ্দাসসিরঃ ২৬-৩১)।

উক্ত আয়াতে কুরাইশ বংশের মুশরিকদের খন্ডন করা হয়েছে। যখন জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফিরিস্তাদের কথা আল্লাহ উল্লেখ করলেন, তখন আবু জাহল কুরাইশদেরকে সম্বোধন করে বলল, তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেক দশজনের একটি দল এক একজন ফিরিস্তার জন্য যথেষ্ট নয় কি? কেউ বলেন, কালাদাহ নামক এক ব্যক্তি---যার নিজ শক্তির ব্যাপারে বড়ই অহংকার ছিল---সে বলল, 'তোমরা কেবল দু’জন ফিরিশ্তাকে সামলে নিও, অবশিষ্ট ১৭ জন ফিরিশ্তার জন্য আমি একাই যথেষ্ট!’ বলা বাহুল্য, (কুরআনে উল্লিখিত) এই সংখ্যাও তাদের উপহাস ও বিদ্রুপের বিষয়রূপে পরিণত হল। (আহসানুল বায়ান)।

উক্ত ১৯ জন ফিরিস্তা জাহান্নামের দারোগা বলে প্রসিদ্ধ। যাদের কথা মহান আল্লাহ বলেছেন,

“জাহান্নামীরা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতিপালককে বল, তিনি যেন আমাদের নিকট থেকে একদিনের শাস্তি লাঘব করেন”। (সুরা মু’মিনঃ ৪৯)।

তাঁদের মধ্যে একজনের নাম হল মালেক। মহান আল্লাহ বলেন,

“ওরা চিৎকার করে বলবে, হে মালেক (দোযখের অধিকর্তা)! তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন। সে বলবে, তোমরা তো (চিরকাল) অবস্থান করবে”। (সুরা যুখরুফঃ ৭৭)।

জাহান্নামের বিশালতা

এ বিশ্ব চরাচরে মহান আল্লাহর জায়গার অভাব নেই। যে সূর্যকে আমরা দূর থেকে ভাতের থালার মত মনে করি, সেই সূর্য এই পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। আর তার সবটাই অগ্নিকুণ্ড। এই রকম আরো কত এবং আরো বড় বড় সূর্য রয়েছে মহাশূন্যে। জান্নাত-জাহান্নামও কোথাও আছে। জান্নাত যেমন বিশাল, জাহান্নামও তেমনই।

জাহান্নাম যে অতি বিশাল, তা বুঝতে পারা যায় নিম্নভাবেঃ

(১) জিন-ইনসান মিলে অগণিত কোটি সংখ্যক ব্যক্তি জাহান্নামে স্থান পাবে। আবার কোনো কোনো জাহান্নামীর দেহ এত বিরাট হবে যে, তার দাঁতটাই হবে উহুদ পাহাড়ের সমান! দুই কাঁধের ব্যবধান হবে তিন দিনের পথ!

রাসুল সাঃ বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে কাফিরের দেহের চামড়া হবে বিয়াল্লিশ হাত মোটা, দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান এবং জাহান্নামে তার বসার স্থান হবে মক্কাহ্-মদীনার মধ্যবর্তী দূরত্ব সমান পরিমাণ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭৫, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৭৭, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩২২, সিলসিলাতুস সহীহাহ ১১০৫, সহীহুল জামি ২১১৪, সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৮২, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৪১৫৫, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৬০, সহীহাহ ১১০৫, আযযিলা-ল ৬১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অপর এক বর্ণনায় আছে,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে কাফিরদের উভয় ঘাড়ের দূরত্ব হবে কোন দ্রুতগামী অশ্বারোহীর তিন দিনের ভ্রমণের দূরত্ব পরিমাণ। অপর এক বর্ণনায় আছে- কাফিরের এক একটি দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান এবং তার দেহের চামড়া হবে তিন দিনের সফরের দূরত্ব পরিমাণ পুরু বা মোটা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৫১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭০৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৫২, সহীহুল জামি ৫৫৯১, সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৮১, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ৬২৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১০৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রকাশ থাকে যে, উহুদ পাহাড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিমি. প্রস্থ প্রায় ২-৩ কিমি. এবং উচ্চতা ৩৫০ মিটার।

জানি না, এই শ্রেণির জাহান্নামীর সংখ্যাই বা কতো। তা সত্ত্বেও জাহান্নাম পরিপূর্ণ হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

“সেদিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করব, তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ?’ জাহান্নাম বলবে, আরো আছে কি?” (সূরা ক্বাফ ৩০ আয়াত)।

মহানবি সাঃ বলেন,

আনাস (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ লোকদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। খালীফা ও মুতামির (রহ.) আনাস (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ জাহান্নামীদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হতে থাকবে। তখন জাহান্নাম বলতে থাকবে আরো বেশি আছে কি? আর শেষে আল্লাহ্ রাববুল আলামীন, তাঁর কদম জাহান্নামে রাখবেন। তখন এর এক অংশ অন্য অংশের সঙ্গে মিশে স্থির হতে থাকবে। আর বলবে আপনার ইয্যত ও করমের কসম! যথেষ্ট হয়েছে। জান্নাতের কিছু জায়গা শূন্য থাকবে। অবশেষে আল্লাহ্ সেই শূন্য জায়গার জন্য নতুন কিছু মাখলুক সৃষ্টি করবেন এবং জান্নাতের সেই খালি জায়গায় এদের বসতি করে দেবেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩৮৪, ৪৮৪৮, ৪৮৫০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭০৬৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪৮, ২৮৪৬,, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৯৪, মুসনাদে আহমাদ ৮১৪৯, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ২০৮৯৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৪৪৭, আস সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ৭৭৪০, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(২) জাহান্নামের গভীরতা কতোটুকু?

(ক) আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদা আমরা রাসূল(সা.) -এর সঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একটি শব্দ শুনলেন এবং বললেন, তোমরা কি বলতে পার এটা কিসের শব্দ? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। নবী করীম (সা.) বললেন, এটা একটা পাথর। আজ থেকে ৭০ বছর পূর্বে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সেটা এখন জাহান্নামের শেষ প্রান্তে পৌঁছল। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, নবী করীম (সা.) বললেন, পাথরটি জাহান্নামের নিম্নে পৌঁছল, তোমরা তার শব্দ শুনতে পেলে’। (মুসলিম, ২য় খন্ড, ৩৮১ পৃঃ)।

(খ) উতবা ইবনে গায্ওয়ান (রা.) হতে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেছেন, একটি বড় পাথর যদি জাহান্নামের কিনারা হতে নিক্ষেপ করা হয়, আর সে পাথর ৭০ বছর নীচে যেতে থাকে তবুও জাহান্নামের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পারবে না। (সিলসিলা ছাহীহা হা/১৪৬০)।

(গ)  উত্বা ইবনে গাযওয়ান হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমাদের সামনে নবী করীম(সা.) -এর হাদীছ বর্ণনা করা হয় যে, যদি জাহান্নামের উপর হতে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হয়, সত্তর বছরেও জাহান্নামের নীচে পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহর কসম! জাহান্নামের এ গভিরতা কাফের-মুশরিক জিন ও মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ করা হবে এবং এটাও বলা হয়েছে যে, জান্নাতের দরজার উভয় কপাটের মধ্যবর্তী জায়গা ৪০ বছরের দুরত্ব হবে। নিশ্চয়ই একদিন এমন আসবে যে, জান্নাতের অধিবাসী দ্বারা জান্নাতও পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। (মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩৮৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ)  আবু মূসা আশ‘আরী (রা.) বলেন, রাসূল(সা.) বলেছেন, যদি একটি পাথর জাহান্নামের মুখ হ’তে নিক্ষেপ করা হয়, পাথরটি ৭০ বছর নীচে যেতে থাকে, তবুও জাহান্নামের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পারবে না। (সিলসিলা ছাহীহা হা/১৪৯৬)।

(ঙ) মুজাহিদ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, ইবনে আববাস (রা.) আমাকে বললেন, আপনি কি জাহান্নামের প্রশস্ততা সম্পর্কে কিছু জানেন? আমি বললাম, জি-না। তিনি বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর কসম! আপনি জানেন না। নিশ্চয়ই জাহান্নামীদের কারো কানের লতি এবং তার কাঁধের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান হচ্ছে ৭০ বছরের পথ। তার মধ্যে চালু থাকবে পুঁজ ও রক্তের নালা। আমি বললাম সেগুলি কি নদী? তিনি বললেন, না; বরং সেগুলি হচ্ছে নালা বা ঝর্ণা। ইবনে আববাস (রা.) আবার বললেন, আপনি কি জাহান্নামের প্রশস্ততা সম্পর্কে কিছু জানেন? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর কসম! আপনি জানেন না। আয়েশা (রাঃ) আমাকে বলেছেন, তিনি রাসূল(সা.) -কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, وَالْاَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ ‘ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত জমিন আল্লাহর হাতের মুষ্টিতে থাকবে আর সমস্ত আকাশ তার ডান হাতে পেঁচানো থাকবে। (যুমার ৬৭)।

হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! সেদিন মানুষ কোথায় থাকবে? নবী করীম(সা.) বললেন, সেদিন তারা জাহান্নামের পুলের উপর থাকবে। (সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৫১৩)।

অত্র হাদীছে জাহান্নামের প্রশস্ততা প্রমাণ হয়। কারণ জাহান্নামীদের কানের লতি ও কাঁধের দুরত্বের ব্যবধান যদি ৭০ বছরের পথ হয় তাহ’লে ব্যক্তি কত বড় হ’তে পারে এবং প্রতি হাজারে নয়শত নিরানহবই জন লোক যদি জাহান্নামে যায়, তবে জাহান্নাম কত বড়। তারপর আল্লাহর নবী বললেন, যেদিন আসমান যমিন আল্লাহ হাতে গুটিয়ে নিবেন সমস্ত সেদিন মানুষ জাহান্নামের পুলের উপর থাকবে। তাহ’লে জাহান্নাম কত বড় এবং পুল কত বড় তা মানুষ বিবেচনা করতে পারবে কি?

(চ) আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রাসূল(সা.) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে একটি গ্রীবা বা গলা বের হবে, সে কথা বলবে। সে বলবে, আজ তিন শ্রেণীর মানুষকে আমার নিকট সমর্পণ করা হয়েছে। ১. প্রত্যেক অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী, অবাধ্য ও জেদী মানুষকে ২. আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে মা‘বুদ হিসাবে গ্রহণ করত অর্থাৎ শিরক করত ৩. আর যে ব্যক্তি মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল। তারপর জাহান্নাম তাদেরকে ঘিরে ধরবে এবং জাহান্নামের গভীরতায় নিক্ষেপ করবে। (সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৫২৩)।

জাহান্নাম উক্ত তিন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলবে এবং তাদের ঘিরে ধরে জাহান্নামের গভীরতায় নিক্ষেপ করবে।

(ছ) মুফাসসির আল্লামা সুদ্দী (রহঃ) বলেন, আমি একদা হামদানী (রা.) -কে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম,وَاِنْ مِّنْكُمْ اِلاَّ وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, জাহান্নামের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে না। (সুরা মরিয়ম ৭১)।

হামদানী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আমাদেরকে বলেছেন। নবী করীম(সা.) আমাদের বলেছেন, সকল মানুষকেই জাহান্নামের উপর দিয়ে পার হ’তে হবে। তারা তাদের আমলের ভিত্তিতে জাহান্নামের উপর দিয়ে পার হয়ে যাবে। তাদের প্রথম দল পার হবে বিদ্যুৎ গতিতে, তারপরের দল পার হবে বাতাসের গতিতে, তারপরের দল পার হবে ঘোড়ার গতিতে, তারপরের দল স্বাভাবিক আরোহীর গতিতে, তারপরের দল পায়ে চলার গতিতে পার হবে। (সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৫২৬)।

সকল মানুষকেই জাহান্নামের উপর দিয়ে পার হ’তে হবে। মানুষ তাদের আমল অনুপাতে পার হবে। এ জন্য পার হওয়ার গতি বিভিন্ন ধরনের হবে।

(৩) জাহান্নামকে টেনে আনবেন ৪৯০ কোটি ফিরিশ্তা! তাতেও তার বিশালতা অনুমান করা যায়। উমর ইবনু হাফস ইবনু গিয়াস (রহঃ).....আবদুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জাহান্নামকে এভাবে উপস্থিত করা হবে। সেদিন তাতে সত্তর হাজার লাগাম লাগানো থাকবে। প্রতিটি লাগামের সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে তারা তাকে টেনে নিয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৭০৫৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৯০১, ইসলামিক সেন্টার ৬৯৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৪) জাহান্নাম এত বিশাল যে, চাঁদ-সূর্যকে একত্রিত করে তার গর্ভে নিক্ষিপ্ত করা হবে! (সিঃ সহীহাহ ১২৪)।

জাহান্নাম কয়টি?

জান্নাত একটি আর জাহান্নামও একটি। তবে জান্নাত এবং জাহান্নামের অনেকগুলি স্তর রয়েছে।

জাহান্নামের স্তরসমূহ

অবাধ্য মানুষের অবাধ্যতা ও অপরাধ যেমন বিভিন্ন প্রকার, তেমনি জাহান্নামের স্তরও আছে ভিন্ন ভিন্ন। আযাবের কঠিনতাও ভিন্ন ভিন্ন হবে। যত নিম্নস্তরের আগুন হবে, তার উত্তাপ তত বেশি হবে।

মুনাফিকরা যেহেতু ঘর শত্রু, তাদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি বেশি, তাই তাদের ঠাই হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা অবশ্যই দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোন সাহায্যকারী পাবে না”। (সুরা নিসঃ ১৪৫)।

জান্নাতের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চই হল সর্বশ্রেষ্ঠ। আর জাহান্নামের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বনিম্নই হল সর্বনিকৃষ্ট।

অনেকে বলেছেন, জাহান্নামের স্তর হলো সাতটি। এর প্রথম স্তরে থাকবে গোনাহগার মুসলিমরা, দ্বিতীয় স্তরে ইয়াহুদীরা, তৃতীয় স্তরে খ্রিষ্টানরা, চতুর্থ স্তরে সাবায়ীরা, পঞ্চম স্তরে মজুসী (অগ্নিপূজক)রা, ষষ্ঠ স্তরে পৌত্তলিকরা এবং সর্বনিম্ন সপ্তম স্তরে থাকবে মুনাফিকরা।

অনেকে উক্ত সাতটি স্তরের নির্দিষ্ট নামও উল্লেখ করেছেন; জাহান্নাম, লাযা, হুত্বামাহ, সাঈর, সাক্বার, জাহীম ও হাবিয়াহ। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন স্তরের নাম কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং সঠিক কথা এই যে, উক্ত নামগুলি আমভাবে জাহান্নামেরই নাম। যেমনঃ

জাহান্নামঃ

এ শব্দটি আল-কুরআনের ৭৭ জায়গায় এসেছে। এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,

“সুতরাং তোমরা জাহান্নামের দরজাগুলিতে প্রবেশ কর সেথায় চিরস্থায়ী থাকার জন্য। দেখ অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট”। (সুরা নাহলঃ ২৯)।

লাযাঃ

‘লাযা’ মানে লেলিহান আগুন। মহান আল্লাহ বলেন,

“না, কখনই নয়! এটা তো লেলিহান অগ্নি। যা দেহ হতে চামড়া খসিয়ে দেবে। জাহান্নাম ঐ ব্যক্তিকে ডাকবে, যে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে সম্পদ পুঞ্জীভূত এবং সংরক্ষিত করে রেখেছিল”। (সুরা মাআরিজঃ ১৫-১৮)।

হুত্বামাহঃ

'হুত্বামাহ' মানে প্রজ্বলিত আগুন। মহান আল্লাহ বলেন,

“কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুত্বামায়। কিসে তোমাকে জানাল, হুত্বামা কি? তা হল আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি। যা হৃদয়কে গ্রাস। করবে। নিশ্চয়ই তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে”। (সুরা হুমাযাহঃ ৪-৯)।

সাঈরঃ

‘সাঈর’ মানেও প্রজ্বলিত আগুন। এ নামটিও বহু জায়গায় এসেছে। তার মধ্যে এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,

“শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে এ জন্য আহবান করে যে, ওরা যেন (সাঈর) জাহান্নামবাসী হয়”। (সুরা ফাত্বিরঃ ৬)।

সাক্কারঃ

‘সাক্বার’ মানে ঝলসিয়ে দেওয়া, গলিয়ে দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেছেন,

“যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; (সেদিন বলা হবে) সাক্কার (জাহান্নামের) যন্ত্রণা আস্বাদন কর”। (সুরা কামারঃ ৪৮)।

“আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাক্কার (জাহান্নামে)। কিসে তোমাকে জানাল, সাক্বার কী? ওটা তাদেরকে (জীবিত অবস্থায় রাখবে না, আর (মৃত অবস্থায়ও) ছেড়ে দেবে না। ওটা দেহের চামড়া দগ্ধ করে দেবে। ওর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশ জন প্রহরী”। (সুরা মুদ্দাসসিরঃ ২৬-৩০)।

“তারা থাকবে জান্নাতে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে--- অপরাধীদের সম্পর্কে, তোমাদেরকে কিসে সাক্কার (জাহান্নাম)এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে অন্নদান করতাম না এবং আমরা সমালোচনাকারীদের সাথে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম। পরিশেষে আমাদের নিকট মৃত্যু আগমন করল। ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না”। (ঐঃ ৪০-৪৮)।

জাহীমঃ

‘জাহীম’ মানে কঠিন অগ্নিদাহ। এ নামটিও বহু জায়গায় এসেছে। তার মধ্যে দুই জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,

“আর যারা অবিশ্বাস করে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করে, তারাই (জাহীম) জাহান্নামের অধিবাসী”। (সুরা মাইদাহঃ ১০, ৮৬)।

হাবিয়াহঃ ‘হাবিয়াহ’ মানে গভীর গর্ত, পাতাল। মহান আল্লাহ বলেছেন,

“কিন্তু যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার স্থান হবে হাবিয়াহ। কিসে তোমাকে জানাল, তা কি? তা অতি উত্তপ্ত অগ্নি”। (সুরা কারিআহঃ ৮-১১)।

অনেকে ‘অইল’ বা ‘ওয়াইল’কেও জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম গণ্য করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, (অইল) দুর্ভোগ সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীদের। (সুরা তুরঃ ১১)।

অর্থাৎ, (অইল) ধংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। (সুরা মুত্বাফফিফীনঃ ১)।

যেমন 'গাই' জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তিগণ, তারা নামায নষ্ট করল ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হল; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। (সুরা মারয়ামঃ ৫৯)।

প্রকাশ থাকে যে, গাই’ অর্থ ধ্বংস, অমঙ্গল, অশুভ পরিণামও করা হয়েছে। যেমন অইল’-এর অর্থ দুর্ভোগ বা ধ্বংস করা হয়ে থাকে।

জাহান্নামের দরজাসমূহ

ছহীহ হাদীছে জান্নাতের আটটি দরজা আর জাহান্নামের সাতটি দরজার কথা বর্ণিত হয়েছে। (ছহীহুল জামে‘ হা/৩১১৯; ছহীহাহ হা/১৮১২)।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, অবশ্যই (শয়তানের অনুসারীদের) তাদের সবারই প্রতিশ্রুত স্থান হবে জাহান্নাম। ওর সাতটি দরজা আছে; প্রত্যেক দরজার জন্য তাদের মধ্য থেকে পৃথক পৃথক দল আছে। (সুরা হিজরঃ ৪৩-৪৪)।

হিসাবের পর দলে দলে কাফেরদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের নিকটে পৌছনো মাত্র তার দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন ওরা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে, তখন তার দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা ওদেরকে বলবে, ‘তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে রসূল আসেনি; যারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত আবৃত্তি করত এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তোমাদেরকে সতর্ক করত? ওরা বলবে, অবশ্যই এসেছিল। কিন্তু সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি শাস্তির বাক্য বাস্তবায়িত হয়েছে। ওদেরকে বলা হবে, জাহান্নামে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য তোমরা ওতে প্রবেশ কর। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল!’ (সুরা যুমারঃ ৭১-৭২)।

জাহান্নামে প্রবিষ্ট হলে তার দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেখান থেকে বের হওয়ার কোন পথ থাকবে না কাফেরদের। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, পক্ষান্তরে যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হল হতভাগ্য। তাদের উপরই রয়েছে অবরুদ্ধ অগ্নি। (সুরা বালাদঃ ১৯-২০)।

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে। (সুরা হুমাযাহঃ ৮-৯)।

অবশ্য কিয়ামতের পূর্বে সে দরজাসমূহ খোলা ও বন্ধ করা হয়। যেমন নবী () বলেছেন,

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন রমাযান মাস আরম্ভ হয়, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানদেরকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩২৭৭, ১৮৯৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৩৮৫, ২৩৮৬, ২৩৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৭৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৬৮২, সুনান আননাসায়ী ২০৯৭, ২০৯৮, ২০৯৯, ২১০০, ২১০১, ২১০২, ২১০৪, ২১০৫, ২১০৬, সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৪২, আহমাদ ৭১০৮, ৭৭২৩, ৭৮৫৭, ৮৪৬৯, ৮৬৯২, ৮৭৬৫, ৮৯৫১, ৯২১৩, মুওয়াত্তা মালিক ৬৯১, দারেমী ১৭৭৫, তা’লীকুর রগীব ২/৬৮, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩০৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামের ইন্ধন

জাহান্নামের ইন্ধন বা জ্বালানী হবে এক শ্রেণির মানুষ ও এক শ্রেণির পাথর। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, যদি তোমরা তা (আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে। (সুরা বাক্বারাহঃ ২৪)।

অর্থাৎ, হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারপরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিশ্তাগণ, যারা আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে। (সুরা তাহরীমঃ ৬)।

এক শ্রেণির জ্বিনও হবে জাহান্নামের ইন্ধন। মহান আল্লাহ জ্বিনদের কথা বলেন,

অর্থাৎ, অপরপক্ষে সীমালংঘনকারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন। (সুরা জ্বিনঃ ১৫)।

পৃথিবীর বুকে উপাস্যরূপে যা পূজিত হয়, তাও জাহান্নামের জ্বালানী হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের উপাসনা কর, সেগুলি তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা উপাস্য হত, তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না; তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে। (সুরা আম্বিয়াঃ ৯৮-৯৯)।

জাহান্নামের আগুনের উত্তাপ

জাহান্নামের আগুন কতো গরম ও জ্বালাময় হবে, সে কথা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ

অর্থাৎ, কিন্তু যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার স্থান হবে হাবিয়াহ। কিসে তোমাকে জানাল, তা কি? তা অতি উত্তপ্ত অগ্নি। (সুরা কারিআহঃ ৮-১১)।

অর্থাৎ, আর বাম হাত-ওয়ালারা, কত হতভাগা বাম হাত-ওয়ালারা! (যাদেরকে বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে।) তারা থাকবে অতি গরম বায়ু ও উত্তপ্ত পানিতে। কালোবর্ণ ধোয়ার ছায়ায়। যা শীতলও নয়, আরামদায়কও নয়। (সুরা ওয়াক্বিআহঃ ৪১-৪৪)।

বলা বাহুল্য, জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত। তার বাতাসও অতিশয় উষ্ণ। তার পানিও অতিরিক্ত গরম। আগুনকে ঠাণ্ডা করার জিনিসগুলিও গরম।

জাহান্নামে যে ছায়ার কথা বলা হয়েছে, সে ছায়ার বিবরণ এসেছে অন্য স্থানে। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য। তোমরা যাকে মিথ্যাজ্ঞান করতে, চল তারই দিকে। চল তিন শাখা বিশিষ্ট ছায়ার দিকে। যে ছায়া শীতল নয় এবং যা রক্ষা করে না অগ্নিশিখা হতে। এটা উৎক্ষেপ করবে বৃহৎ স্ফুলিঙ্গ অট্টালিকা তুল্য। ওটা হলুদ বরণ উটদলের মত। (সুরা মুরসালাতঃ ২৮-৩৩)।

জাহান্নামের আগুন কতোটা প্রভাবশালী হতে পারে, সে কথা রয়েছে আর এক স্থানে,

অর্থাৎ, আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাক্কার (জাহান্নামে)। কিসে তোমাকে জানাল, সাক্বার কী? ওটা তাদেরকে (জীবিত অবস্থায় রাখবে না, আর (মৃত অবস্থায়ও) ছেড়ে দেবে না। ওটা দেহের চামড়া দগ্ধ করে দেবে। (সুরা মুদ্দাসসিরঃ ২৬-২৯)।

অন্যত্র বলা হয়েছে,

অর্থাৎ, যা দেহ হতে চামড়া খসিয়ে দেবে। (সুরা মাআরিজঃ ১৬)।

দুনিয়ার আগুনই সহ্য করার মতো নয়, তাহলে জাহান্নামের আগুন কতো অসহনীয় হতে পারে, তা অনুমেয়।

মহানবী () বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: তোমাদের (ব্যবহৃত) আগুনের উত্তাপ জাহান্নামের আগুনের সত্তর অংশের এক অংশ মাত্র। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! (জাহান্নামীদের শাস্তিদানের জন্য) দুনিয়ার আগুন তো যথেষ্ট ছিল। তিনি (সা.) বললেন, দুনিয়ার আগুনের উপর তার সমপরিমাণ তাপসম্পন্ন জাহান্নামের আগুন আরো ঊনসত্তর ভাগ বর্ধিত করা হয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৬৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩২৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০৫৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪৩, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩১৮,মুসনাদে আহমাদ ৮১১১, সুনান আততিরমিযী ২৫৮৯, ২৫৯০, সহীহুল জামি ৬৭৪২, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৬৬, তা’লীকুর রাগীব ৪/২২৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩০২৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০৩৪)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উপরন্তু সে আগুন স্তিমিত হওয়ার নয়, নির্বাপিত হওয়ার নয়। তা বৃদ্ধি বৈ হ্রাস পাবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, সুতরাং তোমরা আস্বাদন কর, এখন তো আমি শুধু তোমাদের শাস্তিই বৃদ্ধি করতে থাকব। (সুরা নাবাঃ ৩০)।

অর্থাৎ, পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। ওদের মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে ওরা মরবে এবং ওদের জন্য জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবে আমি প্রত্যেক অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (সুরা ফাত্বিরঃ ৩৬)।

অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়; অন্ধ, বোবা ও কালা করে। তাদের আবাসস্থল। জাহান্নাম; যখনই তা স্তিমিত হবে, তখনই আমি তাদের জন্য অগ্নি বৃদ্ধি করে দেব। (সুরা বানী ইসরাঈলঃ ৯৭)।

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে, তাদেরকে আমি অচিরেই আগুনে প্রবিষ্ট করব। যখনই তাদের চর্ম দগ্ধ হবে, তখনই ওর স্থলে নূতন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা নিসা ৫৬)।

পৃথিবীর এই গ্রীষ্মতাপকে জাহান্নামেরই তাপ বলা হয়েছে।

কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ, মুহাম্মাদ ইবনু রুমূহ (রহঃ).....আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গরমের প্রচণ্ডতা দেখা দিলে (যুহরের) সালাত দেরী করে গরমের প্রচণ্ডতা কমলে আদায় করো। গরমের তীব্রতা জাহান্নামের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়া থেকেই হয়ে থাকে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২৮২, ১২৮৫, ১২৮৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬১৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১২৬৯, ইসলামীক সেন্টার ১২৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হারূন ইবনু সাঈদ আল আয়লী, ’আমর ইবনু সাওওয়াদ ও আহমাদ ইবনু ঈসা (রহঃ).....আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গরমের দিনে (যুহরের) সালাত (গরমের প্রচণ্ডতা হ্রাস পেয়ে ঠাণ্ডা হলে) আদায় করো। কারণ গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের উত্তাপ ছড়ানো থেকেই হয়ে থাকে। আমর বলেছেনঃ আবূ ইউনুস আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) এর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা উত্তাপ ঠাণ্ডা হলে যুহরের সালাত আদায় কর, কেননা গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের উত্তাপ ছড়ানো থেকেই হয়ে থাকে। ইবনু শিহাব, ইবনু মুসাইয়্যিব এবং আবূ সালামাহ ও আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) এর মাধ্যমে আমর (রহঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১২৮৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬১৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১২৭১, ইসলামীক সেন্টার ১২৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জাহান্নাম তার প্রভুর নিকট অভিযোগ করে বললো, হে আমার রব! আমার একাংশ অপরাংশকে গ্রাস করেছে। তখন আল্লাহ তাকে দু’বার নিঃশ্বাস নেয়ার অনুমতি দিলেনঃ একটি শীতকালে অপরটি গ্রীষ্মকালে। তোমরা দুনিয়াতে যে ঠান্ডা অনুভব করো তা হলো জাহান্নামের হিম শীতলতা থেকে এবং যে গরম অনুভব করো তা হলো জাহান্নামের আগুনের উষ্ণতা থেকে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩১৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৩৭, ৩২৬০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬১৫, ৬১৭, সুনান আততিরমিযী ১৫৭, ২৫৯২, সুনান আননাসায়ী ৫০০, সুনান আবূ দাউদ ৪০২, আহমাদ ৭০৯০, ৭২০৫, ৭৪২৪, ৭৫৫৮, ৭৬৬৫, ৭৭৭০, ২৭৪৪৩, ৮৩৭৮, ৮৬৮৩, ৮৮৬১, ৮৮৮১, ৮৯৩৯, ২৭৪৯৪, ৯৬৩৯, ১০১২৮, ১০১৬০, ১০২১৪, ১১১০৪, মুয়াত্তা মালেক ২৮২৯, দারেমী ১২০৭, ২৮৪৫, সহীহাহ ১৪৫৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫০৪ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫১০ শেষাংশ)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামের অতিথিদের আগমনের সময় হলে তার পূর্বে তাকে দস্তুরমতো প্রজ্বলিত করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, জাহান্নামের অগ্নিকে যখন প্রজ্বলিত করা হবে এবং জান্নাতকে যখন নিকটবর্তী করা হবে। তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে, সে কি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। (সুরা তাকবীরঃ ১২-১৪)।

জাহান্নামের দর্শন ও কথন

জাহান্নামীরা জাহান্নাম দেখবে ও কথা বলবে এবং রাগে গর্জন ছাড়বে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, বরং ওরা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে। আর যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। দূর হতে (জাহান্নাম) যখন ওদেরকে দেখবে, তখন ওরা তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার শুনতে পাবে। (সুরা ফুরকানঃ ১১-১২)।

অর্থাৎ, আর যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি, আর তা বড় নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল! যখন তারা তাতে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন জাহান্নামের গর্জন শুনবে, আর তা উদ্বেলিত হবে। রোষে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে, যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে তার রক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি?’ (সুরা মুল্‌কঃ ৬-৮)।

আল্লাহর রসূল () বলেন, আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে জাহান্নাম হতে একটি গর্দান (মাথা) বের হবে। এর দুটি চোখ থাকবে যা দিয়ে সে দেখবে, দুটি কান থাকবে যা দিয়ে সে শুনবে এবং একটি জিহবা থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। সে বলবে, তিন ধরনের লোকের জন্য আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছেঃ (১) প্রতিটি অবাধ্য অহংকারী যালিমের জন্য, (২) আল্লাহ তা’আলার সাথে অন্য কোন কিছুকে যে ব্যক্তি ইলাহ বলে ডাকে তার জন্য এবং (৩) ছবি নির্মাতাদের জন্য। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৮৪, সহীহাহ (৫১২), তা’লীকুর রাগীব ৪/৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামের আগুনের রঙ কালো

জাহান্নাম ও তার অগ্নি কৃষ্ণাকার। (সিঃ যয়ীফাহ ১৩০৫নং) জাহান্নামবাসীরাও বীভৎস কৃষ্ণকায়। ওদের মুখমন্ডল যেন অন্ধকার নিশীথের আস্তরণে আচ্ছাদিত। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, যারা মন্দ কাজ করে, তারা তাদের মন্দ কাজের শাস্তি পাবে ওর অনুরূপ মন্দ। আর লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেবে। আল্লাহ (এর শাস্তি) হতে তাদের রক্ষাকর্তা কেউই থাকবে না। তাদের মুখমন্ডল যেন। অন্ধকার রাত্রির আস্তরণে আচ্ছাদিত। এরা হচ্ছে জাহান্নামের অধিবাসী, তারা ওর মধ্যে অনন্তকাল থাকবে। (সুরা ইউনুসঃ ২৭)।

অত্যুষ্ণ বায়ু, পান করবে উত্তপ্ত পানি এবং অবস্থান করবে (জাহান্নামের) কৃষ্ণবর্ণ ধূম্রের ছায়ায়। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, আর বাম হাত-ওয়ালারা, কত হতভাগা বাম হাত-ওয়ালারা! (যাদেরকে বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। তারা থাকবে অতি গরম বায়ু ও উত্তপ্ত পানিতে। কালোবর্ণ ধোয়ার ছায়ায়। যা শীতলও নয়, আরামদায়কও নয়। (সুরা ওয়াক্বিআহঃ ৪১-৪৪)।

জাহান্নামকে পরিপূর্ণ করা হবে

জাহান্নামে অধিকাংশ মানব-দানব নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ?’ জাহান্নাম বলবে, আরও আছে কি? (সুরা ক্বাফঃ ৩০)।

তখন আল্লাহ পাক নিজের কদম (পা) দোযখে রাখবেন। তখন সংকুচিত হয়ে সে বলবে, ব্যস, ব্যস্। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩৮৪, ৪৮৪৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০৬৯-৭০৭১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪৮, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৬৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮৮০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামে কাফেরদের আযাব চিরস্থায়ী

জাহান্নামে জাহান্নামীরা চিরস্থায়ী বসবাস করবে। অবশ্য যদি কোন পাপের কারণে কোন মু’মিন জাহান্নামে যায়, তাহলে এক দিন না একদিন আল্লাহর দয়া ও ক্ষমায় অথবা কারো সুপারিশে অথবা পাপফল ভোগ করার শেষে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাবে। হৃদয়ে তওহীদ থাকলে অর্থাৎ, শির্ক না করে থাকলে পাপী মুসলিমকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে।

আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ (হিশামের বর্ণনায়) জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে অথবা (শুবাহুর বর্ণনায়) যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত কোন প্ৰভু নেই) বলেছে তাকে বের করে আন তার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ ঈমান থাকলেও। আর যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে যদি গমের দানা পরিমাণও ঈমান থাকে তবে তাকেও জাহান্নাম হতে বের করে আন। যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে যদি অণু পরিমাণও (শুবাহুর বর্ণনায় আছে, একটি হালকা জোয়ারদানা পরিমাণ) ঈমান থাকে তবে তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৯৩, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩১২, আহমাদ ১১৭৪৩, আয-যিলাল ৮০৪, ৮১০, ৮৪৯, হাদিস সম্ভার ৭, আহমাদ ৩/২৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস।

বাকী যাদের ঈমান নেই, সেই বেঈমানরা চিরদিন সেখানে আযাবের মধ্যে বসবাস করবে। তাদের শাস্তি ক্ষমা করা হবে না, লাঘব করা হবে না এবং তারা বা জাহান্নাম ধ্বংস হয়ে যাবে না।

আবূ ‘আবদুল্লাহ বুখারী (রহ.) বলেন, কুরআনের যে ঘোষণায় তারা জাহান্নামে আবদ্ধ রয়েছে তা হল মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।’’ (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৪৭৬, ৪৪; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৯৩, আহমাদ ১২১৫৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪১১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪১২১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শনকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তারাই অগ্নিবাসী সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সুরা বাক্বারাহঃ ৩৯)।

অর্থাৎ, যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সুরা আরাফঃ ৩৬)।

অর্থাৎ, অবশ্যই যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা বেহেশ্তেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। এরূপে আমি অপরাধীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সুরা আরাফঃ ৪০)।

অর্থাৎ, নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ওদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং ওরা তাতে (শাস্তি ভোগ করতে করতে) হতাশ হয়ে পড়বে। (সুরা যুখরুফঃ ৭৪-৭৫)।

অর্থাৎ, যারা অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। ওদের মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে, ওরা মরবে এবং ওদের জন্য জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবে আমি প্রত্যেক অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (সুরা ফাত্বিরঃ ৩৬)।

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করে (কাফের) এবং অবিশ্বাসী (কাফের) থাকা অবস্থায় মারা যায়, তাদের উপর আল্লাহ, ফিরিশ্তাগণ এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত। তারা চিরকাল তাতে (অভিসম্পাত ও দোযখে) অবস্থান করবে, তাদের শাস্তিকে লঘু করা হবে না এবং তারা কোন অবকাশও পাবে না। (সুরা বাক্বারাহঃ ১৬১-১৬২)।

অর্থাৎ, তারা আগুন থেকে বের হতে চাইবে, কিন্তু তারা তা থেকে বের হতেই পারবে না এবং তাদের জন্য স্থায়ী শাস্তি রয়েছে। (সুরা মাইদাহঃ ৩৭)।

অর্থাৎ, অতঃপর যালেমদেরকে বলা হবে, চিরস্থায়ী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে থাকো, তোমাদেরকে তো তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফলই দেওয়া হচ্ছে।' (সুরা ইউনুসঃ ৫২)।

রাসুল সাঃ বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “মৃত্যু’’ নামক সৃষ্টিকে এনে কিয়ামতের দিন পুলসিরাতের উপর স্থাপন করা হবে। অতঃপর ডাকা হবে, হে জান্নাতবাসীগণ! তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আবির্ভূত হবে, না জানি তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে তাদেরকে বহিস্কার করা হয়। অতঃপর বলা হবে, হে জাহান্নামবাসীরা! তারা আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে, হয়তো তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে। অতঃপর বলা হবে, তোমরা কি একে চিনো? তারা বলবে, হাঁ, এ হলো ’’মৃত্যু’’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ অতঃপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হলে তাকে পুরসিরাতের উপর যবেহ করা হবে। অতঃপর জান্নাতাবাসী ও জাহান্নামবাসীদের বলা হবে, তোমরা উভয় দল স্ব স্ব স্থানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করো। এখানে কখনো মৃত্যু নেই। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩২৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৪৫, আহমাদ ৯১৮৬, দারেমী ২৮১১, আত-তালীকুর রাগীব ৪/২৭৮-২৭৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৬০৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১০২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, (হে রসূল!) তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিন সম্বন্ধে, যেদিন সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে; অথচ (এখন) তারা উদাসীন আছে এবং তারা বিশ্বাস করে না। (সুরা মারয়্যামঃ ৩৯)।

জাহান্নাম কাফের ও মুশরিকদের স্থায়ী বাসস্থান

জান্নাত যেমন মুমিনদের স্থায়ী বাসঘর, তেমনি জাহান্নামও কাফেরদের স্থায়ী আবাসস্থল। সেটাই তাদের বিশ্রামাগার; যদিও কোন বিশ্রাম তাদের নেই৷ সেটাই তাদের শয়নাগার; যদিও শয়নে কোন আরাম তাদের নেই। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, জাহান্নাম হবে তাদের নিবাস। আর অনাচারীদের আবাসস্থল অতি নিকৃষ্ট! (সুরা আলে ইমরানঃ ১৫১)।

অর্থাৎ, এই লোকদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে ঠিকানা হবে জাহান্নাম। (সুরা ইউনুসঃ ৮)।

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তার নিকট হতে আগত সত্যকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তার অপেক্ষা অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? অবিশ্বাসীদের আশ্রয়স্থল কি জাহান্নামে নয়? (সুরা আনকাবুতঃ ৬৮)।

অর্থাৎ, আজ তোমাদের নিকট হতে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা অবিশ্বাস করেছিল তাদের নিকট হতেও নয়। তোমাদের আবাসস্থল জাহান্নাম, এটাই তোমাদের চিরসঙ্গী। আর কত নিকৃষ্ট এই পরিণাম!' (সুরা হাদীদঃ ১৫)।

অর্থাৎ, যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার আত্মাভিমান তাকে অধিকতর পাপাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট এবং নিশ্চয়ই তা অতি মন্দ শয়নাগার। (সুরা বাক্বারাহঃ ২০৬)।

অর্থাৎ, জাহান্নাম, সেখানে ওরা প্রবেশ করবে, সুতরাং কত নিকৃষ্ট সে শয়নাগার। (সুরা স্বাদঃ ৫৬)।

অর্থাৎ, এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাস! (সুরা নিসাঃ ৯৭)।

অর্থাৎ, আমি সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেওয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়; যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে; কত নিকৃষ্ট সেই পানীয় এবং কত নিকৃষ্ট সেই (অগ্নির) আশ্রয়স্থল। (সুরা কাহ্‌ফঃ ২৯)।

অর্থাৎ, নিশ্চয় তা আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে অতীব নিকৃষ্ট! (সুরা ফুরকানঃ ৬৬)।

নির্দিষ্ট কতিপয় জাহান্নামী ব্যক্তি

কেউ জান্নাতের কাজ করলেই তাকে জান্নাতী এবং জাহান্নামের কাজ করলেই তাকে জাহান্নামী মনে করা ঠিক নয়। কারণ হতে পারে, সে মরণের পূর্বে অথবা আল্লাহর কাছে তার বিপরীত হতে পারে। তবে শরীয়ত নির্দিষ্টভাবে যাকে জাহান্নামী বলে উল্লেখ করেছে, তাকে জাহান্নামী মনে করতে হবে। যেমনঃ ফিরআউন। মহান আল্লাহ তার সম্বন্ধে বলেছেন,

অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন সে নিজ সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে, অতঃপর তাদেরকে উপনীত করবে দোযখে। আর তা অতি নিকৃষ্ট স্থান যাতে তারা উপনীত হবে। (সুরা হূদঃ ৯৮)।

নূহ ও লূত (আলাইহিমাস সালাম)-এর স্ত্রী ও মহান আল্লাহ তাদের সম্বন্ধে বলেন,

অর্থাৎ, আল্লাহ অবিশ্বাসীদের জন্য নূহ ও লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন; তারা ছিল আমার দাসদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ দাসের অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ফলে তারা (নূহ ও লূত) তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হল, ‘জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও তাতে প্রবেশ কর। (সুরা তাহরীমঃ ১০)।

এখানে খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা বলতে দাম্পত্যের খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, কোন নবীর স্ত্রী ব্যভিচারিণী ছিলেন না। (ফাতহুল কাদীর) খিয়ানত বলতে বুঝানো হয়েছে, এরা তাদের স্বামীদের উপর ঈমান আনেনি। তারা মুনাফিক্বী ও কপটতায় লিপ্ত ছিল এবং নিজেদের কাফের জাতির প্রতি তারা সমবেদনা পোষণ করত। যেমন, নূহ (আঃ)-এর স্ত্রী নূহ (আঃ)-এর ব্যাপারে লোকদেরকে বলে বেড়াত যে, এ একজন পাগল। আর লূত (আঃ)-এর স্ত্রী তার গোত্রের লোকদেরকে নিজ বাড়ীতে আগত অতিথির সংবাদ পৌছে দিত। কেউ কেউ বলেন, এরা উভয়ই তাদের জাতির লোকদের মাঝে নিজ নিজ স্বামীর চুগলি করে বেড়াত।

নূহ (আঃ) এবং লূত (আঃ) তাঁরা উভয়েই ছিলেন আল্লাহর পয়গম্বর, আর পয়গম্বররা আল্লাহর অতি নিকটতম বান্দাদের মধ্যে গণ্য হন, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবেন না।

আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ও তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন উপকারে আসবে না। অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট (জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহন করে। তার গলদেশে থাকবে খেজুর আঁশের পাকানো রশি। (সূরাঃ লাহাব)।

আমর বিন আমের আল-খুযায়ীঃ মহানবী () তাকে জাহান্নামে নিজের নাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে বেড়াতে দেখেছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ)।

আম্মার (রাঃ)-এর ঘাতক ও তার ব্যাপারে মহানবী () বলেছেন, “সে জাহান্নামী।” (সঃ জামে’ ৪১৭০নং)।

কাফের জ্বিনরাও জাহান্নামী

মানুষের মতই জ্বিনদেরও ভাল-মন্দ উভয়ই আছে। ভাল জ্বিনরা যেমন জান্নাতে যাবে, তেমনি খারাপ জ্বিনরা যাবে জাহান্নামে৷ মহান আল্লাহ উভয় জাতিকেই ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

অর্থাৎ, আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (সুরা যারিয়াতঃ ৫৬)।

সুতরাং ইবাদত না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। জ্বিনকেও হাশরের ময়দানে জমায়েত করা হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

অর্থাৎ, যেদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন (এবং বলবেন,) ‘হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা অনেক মানুষকে তোমাদের অনুগত করেছিলে। আর মানব-সমাজের মধ্যে তাদের বন্ধুগণ বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা পরস্পর পরস্পর দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং তুমি আমাদের জন্য যে সময় নির্ধারিত করেছিলে এখন আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামই তোমাদের বাসস্থান, সেখানে তোমরা চিরদিন থাকবে; যদি না আল্লাহ অন্য রকম ইচ্ছা করেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত। (সুরা আনআমঃ ১২৮)।

অর্থাৎ, সুতরাং শপথ তোমার প্রতিপালকের! আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে সমবেত করব। অতঃপর আমি অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চতুর্দিকে উপস্থিত করব। অতঃপর প্রত্যেক দলের মধ্যে যে পরম দয়াময়ের প্রতি সর্বাধিক অবাধ্য আমি তাকে টেনে অবশ্যই বের করব। তারপর আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা জাহান্নাম প্রবেশের অধিকতর যোগ্য তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। (সুরা মারয়ামঃ ৬৮-৭০)।

জাহান্নামে প্রবেশ করতে আদেশ দিয়ে বলা হবে,

অর্থাৎ, তোমাদের পূর্বে যে জ্বিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা দোযখে প্রবেশ কর। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে, তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। পরিশেষে যখন সকলে। ওতে একত্র হবে, তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! ওরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, সুতরাং তুমি ওদেরকে দোযখের দ্বিগুণ শাস্তি দাও। আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না।' (সুরা আ'রাফ ৩৮)।

সুতরাং জ্বিনরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও। (সুরা শুআরাঃ ৯৪-৯৫)।

মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, তিনি জ্বিন-ইনসান দিয়ে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করবেন। তিনি বলেছেন,

অর্থাৎ, আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ তোমার প্রতিপালকের এই বাণী পূর্ণ হবেই। (সুরা হূদঃ ১১৯)।

জাহান্নামীদের সংখ্যাধিক্য

পূর্বেই বলা হয়েছে, জাহান্নামীদের সংখ্যা জান্নাতীদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি হবে। যেহেতু এ সংসারে অসৎ লোকের সংখ্যাই অধিক, আল্লাহর বাধ্য বান্দা কম, শয়তানের বাধ্য গোলামই বেশি। মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন,

অর্থাৎ, তুমি যতই আগ্রহী হও না কেন, অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করবার নয়। (সুরা ইউসুফঃ ১০৩)।

অর্থাৎ, ওদের উপর ইবলীস তার অনুমান সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল, ফলে ওদের মধ্যে একটি বিশ্বাসী দল ছাড়া সকলেই তার অনুসরণ করল। (সুরা সাবাঃ ২০)।

তিনি শয়তানকে বিতাড়িত করার সময় বলেছিলেন,

অর্থাৎ, তোমার দ্বারা ও ওদের মধ্যে তোমার সকল অনুসারীদের দ্বারা আমি অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।” (সুরা স্বাদঃ ৮৫)।

বলা বাহুল্য, অধিকাংশ জ্বিন-ইনসানই জাহান্নামের অধিবাসী।

৭৩টি দলের মধ্যে ১টি দল জান্নাতী

(ক) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইহূদী জাতি একাত্তর ফেরকায় (উপদলে) বিভক্ত হয়েছে এবং আমার উম্মাত তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৯১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৪০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫৯৬, আহমাদ ২৭৫১০, রাওদুন নাদীর ৫০, সহীহাহ ২০৩, আত-তালীক আলাত তানকীল ২/৫৩)।  হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(খ) আওফ ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইহূদী জাতি একাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে। তার মধ্যে একটি ফেরকা জান্নাতী এবং অবশিষ্ট সত্তর ফেরকা জাহন্নামী। খৃস্টানরা বাহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে। তার মধ্যে একাত্তর ফেরকা জাহান্নামী এবং একটি ফেরকা জান্নাতী। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হতে মুহাম্মাদের প্রাণ! অবশ্যই আমার উম্মাত তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে একটি মাত্র ফেরকা হবে জান্নাতী এবং অবশিষ্ট বাহাত্তরটি হবে জাহান্নামী। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ফেরকাটি জান্নাতী। তিনি বলেনঃ জামাআত (একতাবদ্ধ দলটি)। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৯২, আয-যিলাল ৬৩, সহীহাহ ১৪৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আনাস মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বনী ইসরাঈল একাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মাত বাহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। একটি ফেরকা ব্যতীত সকলেই হবে জাহান্নামী। সেটি হচ্ছে জামাআত। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৯৩, আহমাদ ১১৭৯৮, ১২০৭০, আয-যিলাল ৬৪, সহীহাহ ২০৪, ১৪৯২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতের ওপর এমন একটি সময় আসবে যেমন বনী ইসরাঈলের ওপর এসেছিল। যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। এমনকি বনী ইসরাঈলের মধ্যে যদি কেউ তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে কুকর্ম করে থাকে, তাহলে আমার উম্মাতের মধ্যেও এমন লোক হবে যারা অনুরূপ কাজ করবে। আর বনী ইসরাঈল ৭২ ফিরক্বায় (দলে) বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার উম্মাত বিভক্ত হবে ৭৩ ফিরক্বায়। এদের মধ্যে একটি ব্যতীত সব দলই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! জান্নাতী দল কারা? উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যার ওপর আমি ও আমার সাহাবীগণ প্রতিষ্ঠিত আছি, যারা তার উপর থাকবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৭১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৪১, সহীহুল জামি‘ ৫৩৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ/যঈফ [মিশ্রিত]।

নবি সাঃ এর উম্মত জান্নাতবাসীদের হবে এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক

(ঙ) আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। একদিন তিনি (সা.) বললেন: (কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা আদম আলায়হিস সালাম-কে লক্ষ্য করে বলবেন, হে আদম! আদম আলায়হিস সালাম উত্তরে বলবেন, হে আমার প্রভু! আমি উপস্থিত! আপনার আনুগত্যই আমার জন্য সৌভাগ্য। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তোমার আওলাদের মধ্য হতে জাহান্নামের দলকে বের কর। আদম আলায়হিস সালাম বলবেন, জাহান্নামের দলে কতজন? আল্লাহ তা’আলা বলবেন, প্রত্যেক হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন। এ সময় শিশু বৃদ্ধ হয়ে যাবে, প্রত্যেক সন্তানধারী মহিলার গর্ভপাত হয়ে যাবে। আর তোমরা লোকেদেরকে দেখবে নেশাগ্রস্ত, মূলত তারা নেশাগ্রস্ত নয়, বরং আল্লাহর আযাবই কঠিন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, আমাদের মধ্য থেকে কে হবে সেই একজন? তিনি বললেন, বরং তোমরা এ সুসংবাদ জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্য থেকে একজন এবং ইয়াজুজ-মাজুজদের থেকে এক হাজার। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, সে মহান সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! আমি আশা করি যে, তোমরা হবে জান্নাতবাসীদের এক-চতুর্থাংশ। আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, এ কথা শুনে আমরা সকলে আল্লা-হু আকবার বলে উঠলাম। অতঃপর বললেন, আমি আশা করি, তোমরা হবে জান্নাতীদের এক-তৃতীয়াংশ। তখন আমরা পুনরায় বললাম ’আল্লা-হু আকবার’। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, আমি আশা করি যে, তোমরা জান্নাতীদের অর্ধেক হবে। এ কথা শুনে আমরা আবার বললাম, আল্লা-হু আকবার। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, মানুষের মধ্যে তোমাদের সংখ্যার তুলনা হবে যেমন একটি সাদা গরুর চামড়ার মধ্যে একটি কালো লোম অথবা একটি কালো গরুর চামড়ার মধ্যে একটি সাদা লোম। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৫৪১, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৪১, ৩৩৪৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২২, সহীহুল জামি ১৪১০২, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩৮০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামবাসী অধিক হওয়ার কারণ

জাহান্নামবাসী অধিক হওয়ার কারণ এই নয় যে, অধিকাংশ মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছেনি। বরং অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। যেহেতু যে মানুষের কাছে ইসলামের কথা পৌছেনি, মহান আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন না।

তিনি বলেছেন,

অর্থাৎ, আর আমি রসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না। (সুরা বানী ইস্রাঈলঃ ১৫)।

আর তিনি প্রত্যেক জাতির ভিতরে রসূল বা সতর্ককারী পাঠিয়েছেন।

তিনি বলেন,

অর্থাৎ, আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি। (সুরা ফাত্বিরঃ ২৪)।

অর্থাৎ, অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও তাগূত থেকে দূরে থাক। (সুরা নাহলঃ ৩৬)।

অর্থাৎ, প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক একজন রসূল ছিল। (সুরা ইউনুসঃ ৪৭)।

কিন্তু আম্বিয়ার দাওয়াত গ্রহণ না করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জাহান্নামের উপযুক্ত হয়েছে।

এ গেলো প্রত্যেক নবির অনুসারীর কথা। পক্ষান্তরে শেষ নবীকে অধিকাংশ মানুষ অস্বীকার করল। আবার অনুসারীদের মধ্যেও নানা মতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ৭৩টির মধ্যে ৭২টি জাহান্নামের উপযুক্ত হল। যার কারণ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, প্রবৃত্তি ও সন্দেহের বশবর্তী হয়েই অধিকাংশ মানুষ ভ্রষ্ট হয়েছে। যেহেতু মানুষের সৃষ্টিকর্তাই বলেছেন,

অর্থাৎ, নারী, সন্তান-সন্ততি, জমাকৃত সোনা-রূপার ভান্ডার, পছন্দসই (চিহ্নিত) ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট লোভনীয় করা হয়েছে। এ সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহর নিকটেই উত্তম আশ্রয়স্থল রয়েছে। (সুরা আলে ইমরানঃ ১৪)।

আর সেই কারণেই জিবরীলের আশংকা সঠিক ছিল।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা যখন জান্নাত তৈরি করলেন, তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, যাও জান্নাতখানা দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা এবং তার অধিবাসীদের জন্য যে সকল জিনিস আল্লাহ তা’আলা তৈরি করে রেখেছেন, সবকিছু দেখে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জান্নাতের সম্পর্কে শুনবে, সে অবশ্যই তাতে প্রবেশ ( আকাঙ্ক্ষা ) করবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের চতুষ্পর্শ কষ্টসমূহ দ্বারা বেষ্টন করে দিলেন, অতঃপর আবার জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, হে জিবরীল! আবার যাও এবং পুনরায় জান্নাত দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা দেখে এসে বললেন, হে আমার প্রভু! এখন যা কিছু দেখলাম, তার প্রবেশপথ যে,

কষ্টকর। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, কেউই তাতে প্রবেশ করবে না। তিনি (সা.) বলেন, অতঃপর আলাহ তা’আলা যখন জাহান্নামকে তৈরি করলেন, তখন বললেন, হে জিবরীল! যাও জাহান্নামটি দেখে আসো, তিনি গিয়ে দেখলেন, অতঃপর এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জাহান্নামের ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা শুনবে, সে কখনো তাতে প্রবেশ করবে না। অতঃপর জাহান্নামের চতুষ্পর্শ্বে আল্লাহ তা’আলা বেষ্টন করলেন প্রবৃত্তির আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা এবং পুনরায় জিবরীল আলায়হিস সালাম -কে বললেন, আবার যাও এবং দ্বিতীয়বার তা দেখে আসো। তিনি গেলেন এবং এবার দেখে এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ করে বলছি, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, একজন লোকও তাতে প্রবেশ ব্যতীত অবশিষ্ট থাকবে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৯৬, সুনান আততিরমিযী ২৬৯৮, সুনান আবূ দাউদ ৪৭৪৪, সুনান ইবনু মাজাহ ১৮৬৬, সিলসিলাতুস সহীহাহ ১৮৬৬, সহীহুল জামি ৫২১০, মুসনাদে আহমাদ ৮৬৩৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৯৪, আবূ ইয়া'লা ৫৯৪০, শুআবূল ঈমান ৩৮৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অবশ্য সেই সাথে আরো একটি কারণ যুক্ত করা যায়, আর তা হলো। দাদুপন্থীদের অন্ধানুকরণ। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, এভাবে তোমার পূর্বে কোনো জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই ওদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।' (সুরা যুখরুফঃ ২৩)।

আর আসলে এ সবে রয়েছে মূলতঃ শয়তানের তাবেদারি। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাকে যাতে পেয়েছি, আমরা তো তাই মেনে চলব। যদিও শয়তান তাদেরকে দোখযন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তবুও কি তারা বাপ-দাদারই অনুসরণ করবে)? (সুরা লুকমানঃ ২১)।

জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী মহিলা

জাহান্নামীদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি হবে। আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী () বলেছেন, আমিতো জান্নাত দেখেছিলাম এবং এক গুচ্ছ আঙ্গুরের প্রতি হাত বাড়িয়েছিলাম। আমি তা পেয়ে গেলে দুনিয়া কায়িম থাকা পর্যন্ত অবশ্য তোমরা তা খেতে পারতে। অতঃপর আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়, আমি আজকের মত ভয়াবহ দৃশ্য কখনো দেখিনি। আর আমি দেখলাম, জাহান্নামের অধিকাংশ বাসিন্দা নারী। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কী কারণে? তিনি বললেনঃ তাদের কুফরীর কারণে। জিজ্ঞেস করা হল, তারা কি আল্লাহর সাথে কুফরী করে? তিনি জবাব দিলেন, তারা স্বামীর অবাধ্য থাকে এবং ইহ্সান অস্বীকার করে। তুমি যদি তাদের কারো প্রতি সারা জীবন সদাচরণ কর, অতঃপর সে তোমার হতে (যদি) সামান্য ত্রুটি পায়, তা হলে বলে ফেলে, তোমার কাছ থেকে কখনো ভাল ব্যবহার পেলাম না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১০৫২, ২৯,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৯৯৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯০৭, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬০২, ২৬০৩, আহমাদ ২৭১১, ৩৩৭৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯৮৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯৯৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কুফরী ও শির্ক ছাড়াও এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার আরো অন্য কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে হাদিসে।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ একবার ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের জন্য আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেনঃ হে মহিলা সমাজ! তোমার সদাক্বাহ করতে থাক। কারণ আমি দেখেছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই অধিক। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেনঃ কী কারণে, হে আল্লাহ্র রাসূল? তিনি বললেনঃ তোমরা অধিক পরিমানে অভিশাপ দিয়ে থাক আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও। বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রাসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৪৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৯, আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮, হাদিস সম্ভার ২৬০৭) হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামীদের দেহাকৃতির বিশালতা

পাপের শাস্তি অধিকরূপে ভোগাবার জন্য জাহান্নামীদের দেহাকৃতি খুব বিশাল করা হবে। অনুমান করার জন্য হাদিসে সেই বিশালত্ব কয়েকভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ-

(ক) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে কাফিরদের উভয় ঘাড়ের দূরত্ব হবে কোন দ্রুতগামী অশ্বারোহীর তিন দিনের ভ্রমণের দূরত্ব পরিমাণ। অপর এক বর্ণনায় আছে- কাফিরের এক একটি দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান এবং তার দেহের চামড়া হবে তিন দিনের সফরের দূরত্ব পরিমাণ পুরু বা মোটা। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৫১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০৭৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৫২, সহীহুল জামি ৫৫৯১, সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৮১, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ৬২৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১০৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) অন্য এক বর্ণনায় আছে, আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জাহান্নামে কাফির ব্যক্তির গায়ের চামড়া হবে বিয়াল্লিশ গজ মোটা, তার মাড়ির দাত হবে উহুদের সমান বড় এবং মক্কা-মদীনার দূরত্বের সমান বিস্তৃত হবে তার বসার জায়গা (নিতম্বদেশ)। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৭৭, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭৫, আযযিলা-ল ৬১০, সিলসিলাতুস সহীহাহ ১১০৫, সহীহুল জামি ২১১৪, সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৮২, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৪১৫৫, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৬০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (গ) অন্য এক বর্ণনায় আছে, আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে কাফির ব্যক্তির মাড়ির দাঁত হবে উহুদ পাহাড়সম বড়, তার উরু হবে বাইযা পাহাড়সম বিশাল এবং তার নিতম্বদেশ হবে রাবাযার মতো তিনদিন চলার পথের দূরত্বের সমান বিস্তৃত। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৭৮, ২৫৭৯, সহীহাহ ৩/৯৫)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(ঘ) আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস (রাঃ) বলেন, এক রাতে আমি আবূ বুরদা (রাঃ)-র নিকট উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে হারিস ইবনে উকাইস (রাঃ) আমাদের নিকট প্রবেশ করলেন। হারিস (রাঃ) সে রাতে আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও হবে যার শাফা’আতে মুদার গোত্রের লোকসংখ্যার চেয়ে অধিক সংখ্যক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবার আমার উম্মাতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও হবে, যে জাহান্নামের জন্য এতো হৃষ্টপুষ্ট হবে যে, এমনকি তার এক কোণা ভরে যাবে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩২৩, আহমাদ ২২১৫৭। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামীদের খাদ্য ও পানি

জাহান্নাম গহবরে আগুনের লেলিহান শিখা পাপী মানুষকে উপর-নীচ, ডান-বাম সকল দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। সেখানে পার্থিব আগুনের ৭০ গুণ উত্তাপ সম্পন্ন এই মহা হুতাশনে জাহান্নামের অধিবাসীরা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। সেখানে তাদের কোন সাহায্যকারী বন্ধু থাকবে না। থাকবে না শান্তিদায়ক কোন উপাদান। সেখানে শুধু থাকবে চূড়ান্ত দুঃখ, ধিক্কার, অপমান, অনুতাপ আর লজ্জা। এ রকম জটিল ও কঠিন মুহূর্তে তারা চরম তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে হাহাকার করবে। কিন্তু কোথাও কোন ঠান্ডা পানীয় ও উত্তম আহারের ব্যবস্থা থাকবে না। থাকবে না পরিতৃপ্ত হওয়ার মত কোন খাদ্য। থাকবে শুধু রক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ, কাঁটাযুক্ত বৃক্ষের ফল, সর্বাধিক কদর্যপূর্ণ নোংরা এবং গলায় আটকে যাওয়া খাবার প্রভৃতি। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে জাহান্নামীদের মোট চার ধরনের খাবারের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলোঃ

(১) তেতো ফলবিশিষ্ট এক প্রকারের কাঁটাযুক্ত বৃক্ষঃ দুর্গন্ধযুক্ত তেতো কাঁটাযুক্ত এক প্রকার ভারী খাবারকে زَقُّوم বলে। যা খাদ্য হিসাবে জাহান্নামীদের দেওয়া হবে। তা জাহান্নামের নিম্নদেশ থেকে উদ্গত হবে। এর গুচ্ছ হবে শয়তানের মস্তকের ন্যায়। কাফেররা সেখানে এটা ভক্ষণ করবে এবং তাদের উদর পূর্ণ করবে। এটি এমন একটি বৃক্ষ যা দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ জাহান্নামের বিভিন্ন শাস্তির মত এটাকেও সৃষ্টি করবেন। (তাফসীরে ত্বানত্বাবী, পৃঃ ৪০৬৬)।

এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, “আপ্যায়নের জন্য কি এটাই শ্রেষ্ঠ, নাকি যাক্কূম বৃক্ষ? এটাকে আমরা অত্যাচারীদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ তৈরী করেছি। এ বৃক্ষ উদ্গত হয় জাহান্নামের তলদেশ থেকে। তার গুচ্ছ যেন শয়তানের মস্তকের ন্যায়। অবশ্যই তারা এটা হ’তে ভক্ষণ করবে এবং তাদের পেট পূর্ণ করবে”। (সুরা ছাফফাত ৩৭/৬২-৬৬)।

উল্লেখ্য যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাক্কূম গাছের কথা বলে মানুষদের জাহান্নাম সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করতেন, তখন আবূ জাহল তার সাথীদের উদ্দেশ্য করে বলত যে, তোমরা শুন! আগুনে নাকি গাছ হবে? অথচ আগুন গাছকে খেয়ে ফেলে। এটা কোন ধরনের কথা? তখন আল্লাহ إِنَّهَا شَجَرَةٌ تَخْرُجُ فِيْ أَصْلِ الْجَحِيْمِ আয়াতটি নাযিল করে তাদেরকে কঠোরভাবে জওয়াব দেন। মূলতঃ যাক্কূম গাছ আগুন থেকেই তৈরী এবং আগুনই তার খাদ্য’। (তাফসীর ইবনু কাছীর ৭/২০ পৃঃ ‘উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য’)।

(২) যারীঃ (সর্বাধিক কদর্যপূর্ণ কাঁটাযুক্ত শুষ্ক নোংরা খাবার)

মূলত ضَرِيع আগুনের একটি বৃক্ষের নাম এবং জাহান্নামের পাথর। এতে বিষাক্ত কণ্টক বিশিষ্ট ফল ধরে থাকবে। এটা হবে দুর্গন্ধযুক্ত খাদ্য ও অত্যন্ত নিকৃষ্ট আহার্য। এটা ভক্ষণে দেহ পরিপুষ্টও হবে না, ক্ষুধাও নিবৃত হবে না এবং অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। (তাফসীর ইবনু কাছীর ৮/৩৮৫ পৃঃ; আদ-দুররুল মানছুর ৮/৪৯১ পৃঃ)।

আল্লামা ত্বানতাবী (রহঃ) বলেন, এটি জাহান্নামীদেরর প্রদত্ত আযাবের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটি স্তরের আযাব। তাদের মধ্যে কেউ যাক্কূম, কেউ গিসলীন আবার কেউ যরী‘ ভোগ করবে। (তাফসীরে ত্বানত্বাবী পৃঃ ৪৪৯৩)।

ইমাম বুখারী (রহঃ) মুজাহিদের সূত্রে বলেন, এটি একপ্রকার কাঁটাযুক্ত গুল্ম। তা যখন সবুজ থাকে তখন তাকে ضَرِيع বলা হয়, আর যখন শুকিয়ে যায় তখন হিজাযবাসীরা একেই ضَرِيع বলে। এটা এক প্রকার বিষাক্ত আগাছা। (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৮/৩৮৫ পৃঃ)।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “তাদের জন্য বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত গুল্ম ছাড়া কোন খাবার থাকবে না। যা তাদের পরিপুষ্টও করবে না এবং ক্ষুধাও নিবৃত করবে না”। (সুরা গা-শিয়াহ ৮৮/৫-৭)।

(৩) গলায় আটকে যায় এমন খাদ্যঃ

এটি এমন খাবার যা কণ্ঠনালীতে আটকে থাকে এবং যেখান থেকে কোন কিছু বের হ’তে পারে না ও কোন কিছু ঢুকতেও পারে না। বরং কদর্যতা, দুর্গন্ধ ও তিক্ততার কারণে সেখানে তা আটকে থাকে। (তাফসীরে ত্বানত্বাবী ৪৩৬১ পৃঃ; তাফসীর ইবনু কাছীর ৮/২৫৬ পৃঃ; তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/৬৯১ পৃঃ)।

 অন্যত্র কাঁটাযুক্ত খাবার গলায় আটকে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনভাবে তাদের প্রতি শাস্তি অব্যাহত থাকবে। (তাফসীরে বাহরুল ঊলূম ৩/৪৮৮ পৃঃ; তাফসীরে জালালাইন পৃঃ ৭৭৪; তাফসীরে খাযেন ৭/১৬৯ পৃঃ; তাফসীরে ত্বাবারী ২৩/৬৯১ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী ১৯/৪৬ পৃঃ)।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “আমাদের নিকটে রয়েছে শৃঙ্খল ও প্রজ্বলিত বহ্নিশিখা। আর আছে এমন খাদ্য যা গলায় আটকে যায় এবং যন্ত্রণাদায়ক কঠিন শাস্তি”। (সুরা মুযযাম্মিল ৭৩/১২-১৩)।

(৪) গিসলীনঃ

জাহান্নামীদের ক্ষতনিঃসৃত স্রাব। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, অতএব এই দিন সেখানে তার কোন সুহৃদ থাকবে না এবং কোন খাদ্য থাকবে না ক্ষতনিঃসৃত পুঁজ ব্যতীত; যা অপরাধীরা ব্যতীত কেউ খাবে । (সুরা হা-ক্বাহঃ ৩৫-৩৭)।

(৫) জাহান্নামের আগুনঃ

জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন,

“না, কখনো নয়, এটাতো (লাযা) লেলিহান অগ্নিশিখা। যা চামড়া তুলে দিবে। সে ঐ ব্যক্তিকে আহবান করবে যে, (সত্যের প্রতি) পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল এবং বিমুখ হয়েছিল, সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছিল এবং তা আগলে রেখেছিল”। (সুরা মা‘আরিজ ৭০/১৫-১৮০)।

আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করার জন্য অত্যন্ত রুক্ষ্ম, নির্দয় এবং কঠোর স্বভাব সম্পন্ন ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। যাদের সংখ্যা হবে ১৯ জন। এ মর্মে তিনি বলেন,

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর ঐ আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করেন না আল্লাহর কোন নির্দেশ। যা করতে আদিষ্ট হন তারা কেবলমাত্র তাই করেন”। (সুরা তাহরীম ৬৬/৬)।

 “আর জাহান্নামের ওপর প্রহরী হিসাবে নিয়োজিত রয়েছে ১৯ ফেরেশতা”। (সুরা মুদ্দাচ্ছির ৭৪/৩০)।

জাহান্নামের প্রহরীরা জাহান্নামের আগুন অনবরত প্রজ্বলিত করছে এবং সর্বদা করবে। যা কখনো শীতল হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“যখনই (আগুন) স্তিমিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে, তখনই আমরা তাদের জন্য আগুন আরো বৃদ্ধি করে দেব”। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/৯৭)।

পৃথিবীতে প্রজ্বলিত আগুনের তুলনায় জাহান্নামে আগুন ৬৯ গুণ অধিক উত্তাপ সম্পন্ন। আর তার প্রতিটি অংশের উত্তাপের তীব্রতা দুনিয়ার আগুনের তীব্রতার ন্যায়। মূলতঃ তার তীব্রতা ও প্রচন্ডতা এত শক্তিশালী যে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের এই আগুন যা তোমরা প্রজ্বলিত কর তা জাহান্নামের আগুনের উত্তাপের সত্তর ভাগের এক ভাগ। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর কসম! এ আগুনই তো জাহান্নামীদের আযাবের জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি বললেনঃ এটাকে উনসত্তর গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং প্রতিটি অংশের উত্তাপ এর সমান হবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৮৯, তা’লীকুর রাগীব ৪/২২৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

জাহান্নামের আগুন এত দাহ্যশক্তি সম্পন্ন হবে যে, সেখানে জাহান্নামীরা জ্বলতে জ্বলতে কয়লায় পরিণত হবে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যখন জান্নাতীগণ জান্নাতে এবং জাহান্নামীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যার হৃদয়ে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তাদেরকে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পুড়ে কালো কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে ’হায়াত’ নামক নহরে ফেলে দেয়া হবে। তাতে তারা স্রোতের ধারে যেন ঘাসের বীজ উদ্গত হয় তেমনি স্বচ্ছ-সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমরা কি দেখনি, উক্ত গাছগুলো হলুদ রং জড়িত অবস্থায় অংকুরিত হয়? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৫৮০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২২, সুনান আততিরমিযী ২১৭৯, সুনান ইবনু মাজাহ ৫৯, সুনান আবূ দাঊদ ৪০৯১, আহমাদ ৩৭৭৯, ৩৯০৩, ৩৯৩৭, ৪২৯৮, সহীহুল জামি ৮০৭৩, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২৯৯৪, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমায়দ ৪৪৬, আবূ ইয়া'লা ৫৩৩০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৬৮০, শু’আবূল ঈমান ৩০৮, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৯৮৫৮, আল মু'জামুস সগীর লিত্ব তবারানী ৮৭৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত হয়েছে,

জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিছু তাওহীদবাদী লোককেও জাহান্নামের শাস্তি প্রদান করা হবে। এমনকি তারা তাতে পুড়তে পুড়তে কয়লার মতো হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা’আলার রহমতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং জান্নাতের দরজায় নিক্ষেপ করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জান্নাতে বসবাসকারীরা তাদের উপর পানি ছিটিয়ে দিবে। যার ফলে তারা সজীব হয়ে যাবে যেমনটি বন্যার স্রোত চলে যাবার পর মাটিতে উদ্ভিদ গজায়। তারপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৯৭, সহীহাহ ২৪৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাছাড়া সেখানে সঊদ নামক একটি আগুনের পাহাড় রয়েছে এবং জাহান্নামীদের পরিধেয় বস্ত্র, বিছানাপত্র, ছাতা-বেষ্টনীসহ সবকিছু হবে অগ্নি নির্মিত। যা ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তির চরম সীমায় পৌঁছানো হবে।

জাহান্নামীদের পানীয়

পিপাসায় পানি না দিয়ে জাহান্নামীদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। আর অধিক আযাব দেওয়ার জন্য তাদেরকে কয়েক প্রকার পানি পান করতে দেওয়া হবেঃ

(১) হামীমঃ অত্যুষ্ণ ফুটন্ত পানি। কাফেরদেরকে জাহান্নামে ফুটন্ত পানীয় পান করতে দেওয়া হবে। এতে তার নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। তাদেরকে যখন খাদ্য হিসাবে যাক্কূম গাছের তিক্ত কাঁটাযুক্ত ফল দেওয়া হবে, তখন তা গলায় বিঁধে গেলে তারা পানি চাইবে। তখন তাদেরকে গরম পানি দেয়া হবে এবং তারা তা তৃষ্ণার্ত উটের ন্যায় পান করতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

 “অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যাবাদীরা! তোমরা অবশ্যই যাক্কূম বৃক্ষ হ’তে আহার করবে এবং তা দিয়ে তোমাদের পেট পূর্ণ করবে। তারপর তোমরা পান করবে টগবগে ফুটন্ত পানি। তা পান করবে তৃষ্ণার্ত উষ্ট্রের ন্যায়। ক্বিয়ামতের দিন এটাই হবে তাদের আপ্যায়ন”। (সুরা ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৫১-৫৬)।

এ মর্মে তিনি আরো বলেন,

 “তা থেকে তারা অবশ্যই আহার করবে এবং তাদের পেট পূর্ণ করবে। অতঃপর তাদের জন্য থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ”। (সুরা ছাফফাত ৩৭/৬৬-৬৭)।

জাহান্নাম অস্বীকারকারীদের শাস্তির বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 “এটা সেই জাহান্নাম, যাকে অপরাধীরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করত। তারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটাছুটি করবে”। (সুরা আর-রহমান ৫৫/৪৩-৪৪)।

পৃথিবীর মানুষদের নিকটে আল্লাহ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন,

“(মুত্তাক্বীরা কি তাদের মত) যারা জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হবে এবং যাদের পান করতে দেওয়া হবে উত্তপ্ত পানি, যা তাদের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলবে?” (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/১৫)।

(২) গাস্‌সাকঃ

অতিশয় দুর্গন্ধময় তিক্ত অথবা নিরতিশয় শীতল পানীয়। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এটি জাহান্নামীদের গলিত রস বিশেষ। (আল-জান্নাতু ওয়ান্নার, পৃঃ ১৬৮)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “সুতরাং তারা আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানি ও পুঁজ”। (সুরা ছোয়াদ ৩৮/৫৫-৫৮)।

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে---সীমালংঘনকারীদের প্রত্যাবর্তনস্থল রূপে। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। সেখানে তারা কোন ঠান্ডা (বস্তুর) স্বাদ গ্রহণ করতে পাবে না, আর কোন পানীয়ও (পাবে না); ফুটন্ত পানি ও (প্রবাহিত) পুঁজ ব্যতীত। এটাই (তাদের) উপযুক্ত প্রতিফল। (সুরা নাবাঃ ২১-২৬)।

(৩)  স্বাদীদঃ

জাহান্নামীদের শরীরের পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত মাংসকে বা ফোঁড়া থেকে নির্গত পুঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিকে غِسْلِيْن বলা হয়। (আল-জান্নাতু ওয়ান্নার, পৃঃ ১৬৮)।

আর صَدِيد বলা হয় ফোঁড়া বা ক্ষতস্থান থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত রস বা পুঁজকে। (ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী, (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ১১শ সংস্করণ, জানুয়ারী ২০০৫), পৃঃ ৬২৫)।

উপরোক্ত দুর্গন্ধযুক্ত অপবিত্র পানি, পুঁজ হবে জাহান্নামীদের পানীয়। যা তারা অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,

“তাদের প্রত্যেকের পরিণাম জাহান্নাম এবং সকলকে পান করানো হবে অপবিত্র দুর্গন্ধযুক্ত গলিত পুঁজ। যা সে অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করবে, আর তা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তার নিকটে মৃত্যুযন্ত্রণা আসবে চতুর্দিক থেকে। কিন্তু তার মৃত্যু হবে না এবং এরপর সে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে থাকবে”। (সুরা ইবরাহীম ১৪/১৬-১৭)।

অন্যত্র তিনি বলেন,

 “অতএব সেখানে সেদিন তার কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু থাকবে না এবং কোন খাদ্য থাকবে না রক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ ব্যতীত। যা শুধুমাত্র অপরাধীরাই ভক্ষণ করবে”। (সুরা হা-ক্কাহ ৬৯/৩৫-৩৭)।

(৪) গলিত ধাতু অথবা তৈলকিট্টের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ, গাঢ় ও দুর্গন্ধময় পানীয়ঃ

উত্তপ্ত তৈলাক্ত পানীয়কে الْمُهْلِ مَاءُ বলে। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, الْمُهْلُ হ’ল উত্তপ্ত তেলের সর্বশেষ অংশ। (তাফসীরে ত্বাবারী ২২/৪৬ পৃঃ)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কদর্যপূর্ণ গরম তৈলাক্ত পানীয়কে الْمُهْلُ বলা হয়। (তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩৯৪ পৃঃ; আদ-দুররুল মানছূর ৫/৩৮৫ পৃঃ, তাফসীরে ইবনু কাছীর ৫/১৫৪ পৃঃ)।

যাহহাক (রহঃ) বলেন, অতি গাঢ় কৃষ্ণ পানীয়কে الْمُهْلُ বলে। (বাহরুল ঊলূম ২/৩৪৫ পৃঃ)।

 এটা জাহান্নামীদের পানীয় হিসাবে প্রদান করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তারা পানি চাইলে তাদেরকে বিগলিত গরম তৈলাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় প্রদান করা হবে। যা তাদের মুখমন্ডল বিদগ্ধ করবে। এটা নিকৃষ্ট পানীয় আর জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল’! (সুরা কাহাফ ১৮/২৯)।

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

 “নিশ্চয়ই যাক্কূম বৃক্ষ হবে পাপীদের খাদ্য, যা গলিত তাম্রের মত, তা তার পেটে ফুটতে থাকবে ফুটন্ত পানির মত”। (সুরা দুখান ৪৪/৪৩-৪৬)।

(৫) খাবাল নদীর পানিঃ

জাহান্নামীদের শরীর থেকে নির্গত ঘাম অথবা শরীরের ফোঁড়া থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজকে طِيْنَةُ الْخَبَالِ বলা হয়। (আদ-দুররুল মানছুর ৩/১৭৫ ও ৭/২৪২ পৃঃ; তাফসীর ইবনু কাছীর ৩/১৮৭ পৃঃ; তাফসীরে খাযেন ১/২০৯ পৃঃ)।

 পৃথিবীতে যারা মদ কিংবা নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করত এবং যারা অহংকারে স্ফীত হয়ে দুনিয়ায় চলাচল করত, তাদেরকে জাহান্নামে শরীর থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম বা বিষাক্ত পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ইয়ামান থেকে জনৈক ব্যক্তি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ’জোয়ার’ হতে প্রস্তুতকৃত মদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, যা ’মিয্র’ বলে পরিচিত তাদের দেশে পান করা হয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তা কি নেশা উদ্রেক করে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, নেশা উদ্রেককারী এমন প্রত্যেক জিনিসই হারাম। আর আল্লাহ তা’আলার ওয়া’দাহ্ হলো, যে ব্যক্তি কোনো নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস পান করবে, তিনি তাকে ’ত্বীনাতুল খবাল’ পান করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রসূল! ’ত্বীনাতুল খবাল’ কি জিনিস? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তা জাহান্নামীদের শরীরের ঘাম অথবা বলেছেন, জাহান্নামীদের রক্ত ও পুঁজ। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৬৩৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫১১২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২০০২, নাসায়ী ৫৭০৯, আহমাদ ১৪৮৮০, সহীহ আল জামি ৪৫৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫০৪৭, ইসলামিক সেন্টার ৫০৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদীছে এসেছে আমর ইবনু শু‘আয়ব তাঁর পিতা থেকে তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

আমর ইবনু শু’আয়ব (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। তাঁর দাদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন দাম্ভিক বা অহংকারীদেরকে ছোট পিপীলিকার মতো একত্রিত করা হবে; কিন্তু আকৃতি-অবয়ব হবে মানুষের। চতুর্দিক থেকে অপমান তাদেরকে ঘিরে থাকবে। তাদেরকে “বূলাস’’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। তাদের ওপর আগুনের কুণ্ডলী হবে এবং তাদেরকে জাহান্নামীদের নিংড়ানো পঁচা রক্ত ও পুঁজ পান করানো হবে, যার নাম “ত্বীনাতুল খবাল’’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫১১২, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪৯২, সহীহুল জামি ৮০৪০, সহীহ আত্ তারগীব ২৯১১, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ৪৩৪, আহমাদ ৬৬৭৭, শু‘আবুল ঈমান ৮১৮৫, আল-আদাবুল মুফরাদ ৫৫৭; তা’লীকুর রাগীব ৪/১৮)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে যারা তথাকথিত অভিজাত ছিল, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করত এবং যারা তাদের প্রতিপালক আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করত ও অযথা তর্ক-বিতর্ক করত, ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামের মাঝখানে নিয়ে মাথার উপর ফুটন্ত উত্তপ্ত পানি বর্ষণ করা হবে। এতে তাদের চর্বি, চামড়া, নাড়ি-ভুঁড়ি, কলিজা সহ সব কিছুই জ্বলে যাবে। অতঃপর তা পশ্চাৎদেশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। তারপর পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে। এভাবেই চলতে থাকবে শাস্তি।

আল্লাহ বলেন, “তাকে ধর এবং টেনে-হেচড়ে জাহান্নামের মাঝখানে নিয়ে যাও। অতঃপর তার মাথার উপর ফুটন্ত উত্তপ্ত পানি ঢেলে শাস্তি দাও এবং (বলা হবে) স্বাদ গ্রহণ কর, তুমিতো ছিলে মর্যাদাবান অভিজাত। এটা তো সেটাই যে বিষয়ে তোমরা সন্দেহ পোষণ করতে”। (সুরা দুখান ৪৪/৪৭-৫০)।

অন্য আয়াতে তিনি বলেন, “এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ। তারা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করে। আর যারা কুফরী করে তাদের জন্য প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে আগুনের পোশাক; তাদের মাথার উপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি। যা দ্বারা তাদের পেটে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত করা হবে। আর তাদের জন্য লৌহ নির্মিত হাতুড়ী সমূহ থাকবে। যখনই তারা তাতে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সেখান থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই আবার ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং (বলা হবে) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন কর”। (হজ্জ ২২/১৯-২২)।

এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ফুটন্ত উত্তপ্ত পানি কাফেরদের মাথায় ঢালা হবে, যা তাদের মাথা ছিদ্র করে পেটে গিয়ে পৌঁছবে এবং পেটে যা কিছু আছে তা বের করে ফেলবে এবং তার পেট থেকে বের হয়ে পায়ে এসে পড়বে। আর এটাই الصَّهْرُ শব্দের ব্যাখ্যা। অতঃপর পুনরায় সে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে’ (এভাবেই চলতে থাকবে শাস্তি)। (মুসনাদে আহমাদ হা/৮৮৫১; শারহুস সুন্নাহ হা/৪৪০৬ ‘জাহান্নামের বৈশিষ্ট্য ও তার অধিবাসী’ অনুচ্ছেদ; মুসনাদে ইবনু মুবারক হা/১২৮; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব হা/৩৬৭৯)।  হাদিসের মানঃ হাসান।

জাহান্নামীদের পোষাক

জাহান্নামীদের পোষাক হবে আলকাতরার অথবা গলিত পিতলের এবং আগুনের। মহান আল্লাহ বলেন,

অর্থাৎ, সেদিন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে শিকল দ্বারা বাঁধা অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার (বা গলিত পিতলের) এবং অগ্নি আচ্ছন্ন করবে তাদের মুখমন্ডল। (ইব্রাহীমঃ ৪৯-৫০)।

তিনি আরো বলেন,

অর্থাৎ, সুতরাং যারা অবিশ্বাস করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আগুনের পোশাক; তাদের মাথার উপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি। যার ফলে তাদের উদরে যা আছে তা এবং তাদের চর্ম বিগলিত করা হবে। আর তাদের জন্যে থাকবে লৌহনির্মিত হাতুড়িসমূহ। যখনই তারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে জাহান্নাম হতে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে; আর (তাদেরকে বলা হবে,) আস্বাদ কর দহন-যন্ত্রণা।” (হজ্জঃ ১৯-২২)।

জাহান্নামীদের শাস্তির ধরণ

আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি কারো উপর যুলুম করেন না। পৃথিবীতে মানুষের কর্মকান্ডের উপরে ভিত্তি করেই তার পরকালীন জীবনের চূড়ান্ত ঠিকানা নির্ধারিত হবে। আল্লাহ মানুষের মধ্যে ফায়ছালা করবেন। তাদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে জাহান্নামের আযাবে তারতম্য হবে। যেমন মুনাফিক্বদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হবে। (সুরা নিসা ৪/১৪৫)।

সামুরাহ্ ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন: জাহান্নামীদের মধ্যে কোন কোন লোক এমন হবে, জাহান্নামের আগুন তার পায়ের টাখনু অবধি পৌছবে। তাদের মধ্যে কারো হাঁটু পর্যন্ত আগুন পৌছবে, কারো কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো কারো ঘাড় পর্যন্ত পৌছবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০৬১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৪৫, মুসনাদে আহমাদ ২০১১৫, সহীহুল জামি ২২৩৭, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৮৯, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ ৩৫৪৫, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৪১৭৯, মুসনাদে আহমাদ ২০১১৫, শু’আবূল ঈমান ৩১৭, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ৬৮২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৯০৬, ইসলামিক সেন্টার ৬৯৬৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে,কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির সর্বাপেক্ষা লঘু ’আযাব হবে, যার দু’পায়ের তলায় দু’টি প্রজ্জ্বলিত অঙ্গার রাখা হবে। এতে তার মগয টগবগ করে ফুটতে থাকবে। যেমন ডেক বা কলসী ফুটতে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬২, ৬৫৬১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬০৪, সহীহাহ ১৬৮০, আধুনিক প্রকাশনী ৬১০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬১১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

নুমান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তি ঐ লোকের হবে, যাকে আগুনের ফিতাসহ দু’খানা জুতা পরানো হবে, তাতে তার মগজ এমনিভাবে ফুটতে থাকবে, যেমনিভাবে তামার পাত্রে পানি ফুটতে থাকে। সে ধারণা করবে, তার অপেক্ষা কঠিন শাস্তি আর কেউ ভোগ করছে না, অথচ সে হবে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তিপ্রাপ্ত লোক। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৬৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৪, ৪০৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১৩, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬০৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ১৬৮০, সহীহুল জামি ২০৩৩, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৮৫, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৮৪৪৭, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৪১৩২, মুসনাদে ‘আদ ইবনু হুমায়দ ৭১১, মুসনাদে বাযযার ৩২৩৫, মুসনাদে আহমাদ ২৬৯০, দারিমী ২৮৪৮, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৩৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জাহান্নামীদের মাথায় গরম পানীয় ঢালা হবে, এমনকি তা পেট পর্যন্ত পৌছবে এবং পেটের সব নাড়িভূড়ি গলিয়ে দিবে, তারপর তা পায়ের দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়বে। এটাই হল সাহর’ (গলে যাওয়া)। আবার তা পূর্বের ন্যায় হয়ে যাবে (এবং এমনিভাবে শাস্তির প্রক্রিয়া চলতে থাকবে)। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৮২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৭৯, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৩৪৭০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৭৯, হিদায়াতুর রুওয়াত ৫৬০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ.....ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (চির) জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা শাস্তি হবে আবূ তালিব এর। তাকে দুটি (আগুনের) জুতা পরিয়ে দেয়া হবে, ফলে এ দুটির কারণে তার মগজ পর্যন্ত উথলাতে থাকবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১২, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৬৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬২, মুসনাদে আহমাদ ২৬৩৬, সহীহুল জামি ২৫৩২, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৮৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৪১৩৫, মুসনাদে ‘আবদ ইবনু হুমায়দ ৭১১, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪০৮, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪২২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এমনিভাবে জাহান্নামে পাপিষ্ঠদের বিভিন্ন আযাব দেওয়া হবে। নিম্নে জাহান্নামে শাস্তি প্রদানের কতিপয় ধরন আলোচনা কর হলোঃ-

(ক)  আগুনের বেড়ী ও শৃঙ্খলঃ

জাহান্নামে জাহান্নামীকে প্রবেশ করানোর জন্য সত্তর হাত আগুনের শিকল দিয়ে শৃঙ্খলিত করা হবে এবং তাকে আগুনের ভারী বেড়ী পরিধান করানো হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাকে ধর এবং গলায় বেড়ী পরিয়ে দাও। তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। অতঃপর সত্তর হাত শৃঙ্খল দ্বারা তাকে শৃঙ্খলিত কর। কেননা সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না আর ইয়াতীমদের খাদ্যদানে উৎসাহিত করত না’। (সুরা হা-ক্কাহ ৬৯/৩০-৩৪)।

এ মর্মে তিনি আরো বলেন, ‘যখন তাদের গলদেশে বেড়ী ও শৃঙ্খল থাকবে, তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে। অতঃপর তাদের দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে’। (সুরা মুমিন ৪০/৭১-৭২)।

পৃথিবীতে যারা যাকাত আদায় করে না বরং সম্পদ গচ্ছিত করে রাখে ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে বিষাক্ত সাপের বেড়ী পরিধান করানো হবে। এগুলি তাদেরকে ছোবল মারতে থাকবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা ধন-সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে ঐ ধন-সম্পদের যাকাত আদায় করেনি, সে ধন-সম্পদকে কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন টাকমাথা সাপে পরিণত হবে। এ সাপের দু’ চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে (অর্থাৎ বিষাক্ত সাপ)। এরপর ঐ সাপ গলার মালা হয়ে ব্যক্তির দু’ চোয়াল আঁকড়ে ধরে বলবে, আমিই তোমার সম্পদ, আমি তোমার সংরক্ষিত ধন-সম্পদ। এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, অর্থাৎ ’’যারা কৃপণতা করে, তারা যেন মনে না করে এটা তাদের জন্য উত্তম বরং তা তাদের জন্য মন্দ। কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন অচিরেই যা নিয়ে তারা কৃপণতা করছে তা তাদের গলার বেড়ী করে পরিয়ে দেয়া হবে’’- (সূরাহ্ আ-লি ’ইমরান ৩: ১৮০) আয়াতের শেষ পর্যন্ত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৭৭৪, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪০৩, ৪৫৬৫, ৪৬৫৯, ৬৯৫৭, আহমাদ ৮৬৬১, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৩১১৩, সহীহ আত্ তারগীব ৭৬১, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১৫৬০, নাসাঈ ২৪৮২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আগুনের খুঁটিতে বেঁধে রাখাঃ

জাহান্নামে অসংখ্য অগ্নিনির্মিত লম্বা লম্বা খুঁটি থাকবে। যাতে বিভিন্ন অপরাধীদের অত্যন্ত মযবূত করে বেঁধে রেখে আযাব দেওয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কখনো নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়। আপনি কি জানেন হুতামা কি? এটি আল্লাহর জ্বলন্ত প্রজ্বলিত আগুন। যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয়ই তা তাদের আবদ্ধ করে রাখবে লম্বা লম্বা স্তম্ভসমূহে’। (সুরা হুমাযাহ ১০৪/৪-৯)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘সেদিন তাঁর আযাবের ন্যায় কেউ আযাব দিতে পারবে না এবং তাঁর বন্ধনের মতো কেউ বাঁধতে পারবে না’ । (সুরা ফাজর ৮৯/২৫-২৬)।

(গ) বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছুর দংশনঃ

জাহান্নামে অসংখ্য বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছু থাকবে। সেখানের সাপ ও বিচ্ছুর আকৃতি হবে উট ও খচ্চরের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

’আবদুল্লাহ ইবনু হারিস ইবনু জাযই (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে খুরাসানী উটের মতো বিরাট বিরাট সাপ আছে, সেই সাপের একটি একবার দংশন করলে তার বিষ ও ব্যথার ক্রিয়া চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। আর জাহান্নামের মাঝে এমন সব কিছু আছে, যা পালান বাঁধা খচ্চরের মতো। এর একটি একবার দংশন করলে তার বিষ বেদনার ক্রিয়াও চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৯১, মুসনাদে আহমাদ ১৭৭৪৯; ইবনু হিববান ৭৪৭১; সিলসিলা ছহীহাহ ৩৪২৯)।

(ঘ)  উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়াঃ

আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ কাফেরদেরকে উল্টো করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তারা অন্ধ, মূক ও বধির হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্ত। যেদিন তাদেরকে উপুড় অবস্থায় মুখের উপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে, সেদিন বলা হবে, জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর’। (সুরা ক্বামার ৫৪/৪৭-৪৮)।

অন্যত্র তিনি আরো বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখের উপর ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, মূক ও বধির করে। আর তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যখনই তা স্তিমিত হওয়ার উপক্রম হবে, তখনই তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব’। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭/ ৯৭)।

সেদিন পাপিষ্ঠদের পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। বাধা দেওয়ার মত কেউ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সেদিন অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের (মলিন) চেহারা দেখে। তাদেরকে সেখানে পাকড়াও করা হবে তাদের পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে’। (সুরা আর-রহমান ৫৫/৪১)।

তিনি আরো বলেন, ‘(আবু জাহালকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন) সাবধান! সে যদি বিরত না হয় তবে অবশ্যই আমি তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাব, মস্তকের সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ ধরে- মিথ্যাচারী, পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’। (‘সুরা আলাক্ব ৯৬/১৫-১৬)।

এ মর্মে হাদিসে এসেছে,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন কাফিরদেরকে কিরূপে মুখের উপরে হাঁটিয়ে একত্রিত করা হবে? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, যিনি দুনিয়াতে মানুষকে দুই পায়ে চালিয়েছিলেন তিনি কি কিয়ামতের দিন তাকে মুখের উপর চালানোর সাধ্য রাখেন না? (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৫৩৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৭৬০, ৬৫২৩; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৯৮০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮০৬, মুসনাদে আহমাদ ১৩৪১৬, সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৫৮১, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ ৩৫০৭, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমায়দ ১১৮১, মুসনাদে আহমাদ ১৩৪১৬, আবূ ইয়া'লা ৩০৪৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩২৩, হিলওয়াতুল আওলিয়া ২/৩৪৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঙ) লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাতঃ

জাহান্নামে কাফেরদের ভারী হাতুড়ির আঘাতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে। এতে তার মাথা দলিত-মথিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তাদের জন্য থাকবে লৌহ নির্মিত (ভারী) হাতুড়িসমূহ। যখনই তারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, আস্বাদন কর দহন যন্ত্রণা’। (সুরা হজ্জ ২২/২১-২২)।

কবরে মৃত ব্যক্তিকে রাখার পর ফেরেশতা কর্তৃক প্রশ্নোত্তর সংক্রান্ত হাদীছে কাফির-মুনাফিকদের যে শাস্তির বিবরণ পেশ করা হয়েছে সেখানেও তাকে হাতুড়ি দিয়ে শাস্তির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কবরে মৃত ব্যক্তির (মু’মিনের) নিকট দু’জন মালাক (ফেরেশতা) আসেন। অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তাকে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ’’তোমার রব কে?’’ সে উত্তরে বলে, ’’আমার রব হলেন আল্লাহ।’’ তারপর মালায়িকাহ্ জিজ্ঞেস করেন, ’’তোমার দীন কী?’’ সে ব্যক্তি উত্তর দেয়, ’’আমার দীন হলো ইসলাম।’’ আবার মালায়িকাহ্ জিজ্ঞেস করেন, ’’তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে যে ব্যক্তি প্রেরিত হয়েছিল, তিনি কে?’’ সে বলে, ’’তিনি হলেন আল্লাহর রসূল (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।’’ তারপর মালায়িকাহ্ তাকে জিজ্ঞেস করেন, “এ কথা তোমাকে কে বলেছে?’’ সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার উপর ঈমান এনেছি ও তাঁকে সমর্থন করেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, এটাই হলো আল্লাহ তা’আলার এ বাণীর ব্যাখ্যাঃ ’’আল্লাহ তা’আলা সেসব লোকেদেরকে (দীনের উপর) প্রতিষ্ঠিত রাখেন যারা প্রতিষ্ঠিত কথার (কালিমায়ে শাহাদাতের) উপর ঈমান আনে... আয়াতের শেষ পর্যন্ত- (সূরাহ্ ইবরাহীম ১৪: ২৭)।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আকাশমণ্ডলী থেকে একজন আহবানকারী ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। আর তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। অতএব তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দেয়া হবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ফলে তার দিকে জান্নাতের বাতাস ও সুগন্ধি দোলা দিতে থাকবে এবং দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত তার কবরকে প্রশস্ত করে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাফিরদের মৃত্যু প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ’’তারপর তার রূহকে তার শরীরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তাকে দু’জন মালাক এসে তাকে উঠিয়ে বসান এবং বসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ’’তোমার রব কে?। তখন সে উত্তরে বলে, ’’হায়! হায়!! আমি তো কিছুই জানি না।’’ তারপর তারা তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, ’’তোমার দীন কী?’’ সে বলে, হায়! হায়!! তাও তো আমার জানা নেই। তারপর তারা জিজ্ঞেস করেন, ’’এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল?’’ সে বলে, ’’হায়! হায়!! এটাও তো জানি না।’’ তারপর আকাশ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করে বলেন, এ ব্যক্তি মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য আগুনের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে আগুনের পোশাক পরিয়ে দাও। আর জাহান্নামের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও। সে অনুযায়ী তার জন্য দরজা খুলে দেয়া হয়।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তার কবরকে তার জন্য সঙ্কুচিত করে দেয়া হয়, যাতে তার একদিকের হাড় অপরদিকের হাড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। এরপর একজন অন্ধ ও বধির মালাক নিযুক্ত করে দেয়া হয়, যার সাথে লোহার এক হাতুড়ি থাকে। সে হাতুড়ি দিয়ে যদি পাহাড়ের উপর আঘাত করা হয় তাহলে সে পাহাড় গুঁড়া গুঁড়া হয়ে মাটি হয়ে যাবে। সে অন্ধ মালাক এ হাতুড়ি দিয়ে সজোরে তাকে আঘাত করতে থাকে। (তার বিকট চীৎকারের শব্দ) পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত জিন্ ও মানুষ ছাড়া সকল মাখলূক্বই শুনতে পাবে। এর সাথে সাথে সে মাটিতে মিশে যাবে। অতঃপর পুনরায় তার মধ্যে রূহ্ ফেরত দেয়া হবে (এভাবে অনবরত চলতে থাকবে)। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৩১, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৭৫৩; আহমাদ হা/১৮৫৫৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ৩/২১৯ পৃঃ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(চ)  মুখমন্ডল বিদগ্ধকরণঃ

জাহান্নামে জাহান্নামীদের মুখমন্ডল ওলট-পালট করে দগ্ধিভূত করা হবে। তাদের চেহারাকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা আবৃত করে রাখবে এবং আলকাতরা সদৃশ কালো জামা পরিধান করানো হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘যেদিন তাদের মুখমন্ডল জাহান্নামের আগুনে ওলট-পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করতাম’। (সুরা আহযাব ৩৩/৬৬)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়, তাদের জামা হবে আলকাতরার এবং আগুন দগ্ধিভূত করবে তাদের মুখমন্ডলকে’। (সুরা ইবরাহীম ১৪/৪৯-৫০)।

যাহ্হাক (রহঃ) বলেন, জাহান্নাম এমন একটি ভয়ংকর আবাসস্থল যেখানে সকল কিছু কৃষ্ণবর্ণের হবে। তার পানি হবে কালো, তার গাছ হবে কালো এমনকি তার অধিবাসীরাও হবে কৃষ্ণবর্ণের। (তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩৯৪ পৃঃ ‘সূরা কাহফ-এর ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য)।

জাহান্নামে কাফেরদের মুখমন্ডল যখন কঠিন আযাবে পতিত হবে, তখন তারা তাদের সুন্দর মুখমন্ডলকে আগুন থেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল দ্বারা কঠিন আযাব ঠেকাতে চাইবে, (সে কি তার মতো যে নিরাপদ?) অতঃপর যালেমদের বলা হবে, তোমরা যা অর্জন করতে তার আযাব আস্বাদন কর’। (সুরা যুমার ৩৯/২৪)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হায় আফসোস! কাফেররা যদি সেই সময়ের কথা জানতে পারত যেদিন তারা জাহান্নামের অগ্নিশিখা সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিক থেকে প্রতিরোধ করতে পারবে না এবং তাদেরকে (একাজে) কোন সাহায্যও করা হবে না’। (সুরা আম্বিয়া ২১/৩৯)।

এছাড়া জাহান্নামে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য বৃদ্ধিকরণ, তীব্র তৃষ্ণা, কৃষ্ণকায় আগুনের গভীর অন্ধকার ও সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ, তীব্র ঠান্ডা, আগুনের পাহাড়ে চড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে জাহান্নামীদের শাস্তি প্রদান করা হবে।

জাহান্নামীদের কথোপকথন

জাহান্নামবাসীরা জাহান্নামের আযাবের তীব্রতা ও প্রখরতা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সর্বদা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সে সময় তারা কখনো আল্লাহর সাথে, কখনো জাহান্নামের প্রহরীদের সাথে, কখনো পৃথিবীতে তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে, কখনো দুনিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে, আবার কখনো জান্নাতবাসীদের সাথে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য কথোপকথন করবে। সেদিন তাদের এসব কথোপকথন কোন কাজে আসবে না। থাকবে না কোন সাহায্যকারী বন্ধু। নিম্নে জাহান্নামীদের কথোপকথনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করা হ’ল।-

(ক)  আল্লাহর সাথে কাফেরদের কথোপকথনঃ

জাহান্নামীরা যখন আল্লাহর নিকটে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আবেদন করবে, তখন আল্লাহ ও তাদের মাঝে যে কথোপকথন হবে তা নিম্নরূপ-

‘তোমাদের নিকট কি আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হ’ত না, অথচ তোমরা ওগুলো অস্বীকার করতে? তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে পেয়ে বসেছিল এবং আমরা ছিলাম এক পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়। (তারা বলবে) হে আমাদের প্রতিপালক! এই আগুন হ’তে আমাদেরকে রক্ষা করুন, অতঃপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী করি তাহ’লে আমরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী হব। আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বলো না। আমার বান্দাদের মধ্যে একদল ছিল যারা বলত, হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের উপর দয়া করুন, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে তোমরা এত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে যে, তা তোমাদেরকে আমার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। বস্ত্ততঃ তোমরা তো তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করতে। আমি আজ তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হ’ল সফলকাম। আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর অবস্থান করেছিলে? তারা বলবে, আমরা অবস্থান করেছিলাম একদিন অথবা একদিনের কিয়দংশ, আপনি না হয় গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন! তিনি বলবেন, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে, যদি তোমরা জানতে। তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সুরা মুমিনূন ২৩/১০৫-১১৫০)।

অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘হায়! তুমি যদি দেখতে যখন তাদের প্রভুর সামনে দন্ডায়মান করা হবে। তখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, ক্বিয়ামত কি সত্য নয়? উত্তরে (জাহান্নামীরা) বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের প্রতিপালকের শপথ করে বলছি, এটা বাস্তব সত্য বিষয়। তখন আল্লাহ বলবেন, তবে তোমরা এটাকে অস্বীকার করার ফলস্বরূপ শাস্তি আস্বাদন কর’। (সুরা আন‘আম ৬/৩০)।

এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

‘আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে ছিলাম, এমন সময় দু’জন সাহাবী আসলেন, তাদের একজন দারিদ্রের অভিযোগ করছিলেন আর অপরজন রাহাজানির অভিযোগ করছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ রাহাজানির অবস্থা এই যে, কিছু দিন পর এমন সময় আসবে যখন কাফিলা মক্কা পর্যন্ত বিনা পাহারায় পৌঁছে যাবে। আর দারিদ্রের অবস্থা এই যে, তোমাদের কেউ সাদাকা নিয়ে ঘোরাফিরা করবে, কিন্তু তা গ্রহণ করার মত কাউকে পাবে না। এমন সময় না আসা পর্যন্ত ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) কায়িম হবে না। অতঃপর (বিচার দিবসে) আল্লাহর নিকট তোমাদের কেউ এমনভাবে খাড়া হবে যে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন আড়াল থাকবে না বা কোন ব্যাখ্যাকারী দোভাষীও থাকবে না। অতঃপর তিনি বলবেনঃ আমি কি তোমাকে সম্পদ দানকারিণী? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ। এরপর তিনি বলবেন, আমি কি তোমার নিকট রাসূল প্রেরণ করিনি? সে অবশ্যই বলবে হাঁ, তখন সে ব্যক্তি ডান দিকে তাকিয়ে শুধু আগুন দেখতে পাবে, তেমনিভাবে বাম দিকে তাকিয়েও আগুন দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের উচিত এক টুকরা খেজুর (সাদাকা) দিয়ে হলেও যেন আগুন হতে আত্মরক্ষা করে। যদি কেউ তা না পায় তবে যেন উত্তম কথা দিয়ে হলেও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪১৩, ১৪১৭, ৩৫৯৫, ৬০২৩, ৬৫৩৯, ৬৫৪০, ৬৫৬৩, ৭৪৪৩, ৭৫১২, আহমাদ ১৮২৮০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩২৭, ইবনু হিববান ৭৩৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  জাহান্নামের প্রহরীদের সাথে কাফেরদের কথোপকথনঃ

জাহান্নাম হাশরের মাঠে কাফেরদের দেখে ক্রোধে ফেটে পড়বে। সে দূর থেকে যখন কাফেরদের দেখবে, তখন তারা তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও ভয়ংকর চিৎকার শুনতে পাবে। যখন তাদেরকে জাহান্নামের নিকট উপস্থিত করা হবে তখন তার প্রবেশদারগুলো খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তার প্রহরীরা কাফেরদের সাথে কথা বলবে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘ক্রোধে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে, যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, (জাহান্নামের) রক্ষীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা বলবে, অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল। আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা তো স্পষ্টতঃ মহাভ্রান্তিতে রয়েছ। তারা আরো বলবে, আমরা যদি শুনতাম এবং বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহ’লে আমরা জাহান্নামবাসী হ’তাম না। তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে, অভিশাপ জাহান্নামীদের জন্য!’। (সুরা মুলক ৬৭/৮-১১)।

এ মর্মে অন্যত্র বলা হয়েছে,

‘কাফেরদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে তখন তার প্রবেশদ্বারগুলো খুলে দেওয়া হবে। আর জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেনি? যারা তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত তেলাওয়াত করত এবং তোমাদের এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সাবধান করত। তখন তারা বলবে, অবশ্যই এসেছিল। বস্ত্তত কাফেরদের প্রতি শাস্তির কথা বাস্তবায়িত হয়েছে। তাদের বলা হবে, জাহান্নামের দ্বারসমূহে প্রবেশ করো তাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। আর কতই না নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল’। (সুরা যুমার ৩৯/৭১-৭২)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘আর যারা জাহান্নামে থাকবে তারা জাহান্নামের দারোয়ানদেরকে বলবে, তোমাদের রবকে একটু ডাক না! তিনি যেন একটি দিন আমাদের আযাব লাঘব করে দেন। তারা বলবে, তোমাদের নিকট কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রাসূলগণ আসেননি? জাহান্নামীরা বলবে, হ্যাঁ অবশ্যই। দারোয়ানরা বলবে, তবে তোমরাই দো‘আ কর। আর কাফিরদের প্রার্থনা কেবল নিষ্ফলই হয়’। (সুরা মুমিন ৪০/৪৯-৫০)।

(গ) পৃথিবীর অনুসরণীয় ব্যক্তি ও অনুসরণকারীদের মাঝে কথোপকথনঃ

দুনিয়াতে ছোট হোক বা বড় হোক সকল অনুসৃত ব্যক্তি এবং তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা এবং আযাবের ভয়াবহতা দেখে জাহান্নামে প্রবেশের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করবে। অনুসারীরা অনুসৃত ব্যক্তির কাছে জাহান্নামের আগুনের আযাব থেকে পরিত্রাণ চাইবে। কিন্তু তাদের সেদিন কোন কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না। এমতাবস্থায় তাদের মাঝে চরম তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে-

‘এ এক বাহিনী, তোমাদের সাথে (জাহান্নামে) প্রবেশকারী। তাদের জন্য নেই কোন অভিনন্দন। বরং তারা জাহান্নামে জ্বলবে। (তখন অনুসারীরা) বলবে, বরং তোমরাও তো (জাহান্নামী), তোমাদের জন্যও কোন অভিনন্দন নেই। তোমরাই তো পূর্বে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছ। কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল। তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! এটা যে আমাদের সম্মুখীন করেছে, জাহান্নামে তার শাস্তি দ্বিগুণ বর্ধিত করুন’। (সুরা ছোয়াদ ৩৮/৫৯-৬১)।

অন্যত্র তিনি আরো বলেন,

‘যখন তারা জাহান্নামে পরস্পরে বিতর্কে লিপ্ত হবে, তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। এখন কি তোমরা আমাদের থেকে জাহান্নামের (আযাবের) কিছু নিবারণ করবে? অহংকারীরা বলবে, আমরা তো সবাই জাহান্নামে আছি। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন’। (সুরা মুমিন ৪৭/৪৮)।

পৃথিবীতে যারা মূর্খ ও পথভ্রষ্ট আলেম এবং তাদের যারা অনুসারী ছিল জাহানণামে তারা পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হ’য়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ডান দিক থেকে আসতে। তারা বলবে, বরং তোমরাতো বিশ্বাসী ছিলে না এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্বও ছিল না। বস্তুত তোমরাই ছিলে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিপালকের কথা সত্য হয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই শাস্তি আস্বাদন করতে হবে। আমরা তোমাদের বিভ্রান্ত করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিলাম। সুতরাং তারা সকলেই সেইদিন শাস্তিতে শরীক হবে’। (সুরা ছা-ফফাত ৩৭/২৭-৩৩)।

(ঘ)  রাজনৈতিক নেতা ও তাদের অনুসারীদের মাঝে কথোপকথনঃ

রাজনীতি ও সমাজনীতির নামে যারা আল্লাহর আইনের বিরোধিতা করে এবং সমাজে সংঘাত-সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য গুপ্ত ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করে, ক্বিয়ামাতের দিন তাদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং কঠিন হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘আর তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের অনুসরণ করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রভু! তাদের দ্বিগুণ আযাব প্রদান করুন এবং তাদের উপর মহা লা‘নত বর্ষণ করুন’। (সুরা আহযাব ৩৩/৬৭-৬৮)।

এ মর্মে আরো বলা হয়েছে,

‘দুর্বলরা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হ’তাম। অতঃপর ক্ষমতাদর্পীরা দুর্বলদের বলবে, তোমাদের নিকট সৎপথের দিশা আসার পরেও আমরা কি তোমাদেরকে ওটা হ’তে নিবৃত করেছিলাম? বস্ত্ততঃ তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। অতঃপর দুর্বল লোকেরা পুনরায় বলবে, বরং প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো রাত-দিনে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর শরীক স্থাপন করি। যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং আমি কাফেরদের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে দেব। সুতরাং তাদেরকে (দুর্বলদেরকে) তারা (ক্ষমতাদর্পীরা) যা করতো তারই প্রতিফল দেওয়া হবে’। (সুরা সাবা ৩৪/৩১-৩৩)।

(ঙ) জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মাঝে কথোপকথনঃ

জাহান্নামীরা দুনিয়ায় যে সমস্ত মুমিনদের সাথে বসবাস করত জাহান্নামের ভয়ংকর আগুনের লেলিহান শিখা থেকে মুক্তির জন্য তারা তাদের নিকটে প্রার্থনা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মুমিনদের বলবে, তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম। যেন আমরা তোমাদের জ্যোতির কিছু অংশ গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও এবং আলো তালাশ কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত ও বহির্ভাগে থাকবে আযাব। মুনাফিক্বরা মুমিনদের ডেকে বলবে, আমরা কি পৃথিবীতে তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবে, হ্যাঁ, তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছ। তোমরা প্রতীক্ষা করেছিলে, সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং অলীক আকাঙ্খা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল আল্লাহর হুকুম (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোঁকা দিয়েছিল এক মহা প্রতারক’ (শয়তান)। (সুরা হাদীদ ৫৭/১৩-১৪)।

জাহান্নামে ইবলীস শয়তানের বক্তব্য

দুনিয়াতে যারা শয়তানী প্ররোচনায় জড়িয়ে ছিল অর্থাৎ যারা ইবলীসের অনুসরণ ও উপাসনা করত জাহান্নামে প্রবেশের পর তাদের লক্ষ্য করে ইবলীস একটি বক্তব্য দিবে। যেখানে সে তার অনুসারী পাপিষ্ঠদের ভৎর্সনা করবে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“যখন সবকিছুই মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান (তার অনুসারীদের) বলবে, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তবে আমি তোমাদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের উপর কোন ক্ষমতা ছিল না। আমি শুধুমাত্র তোমাদের আহবান করেছিলাম। আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। কাজেই তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ কর না। তোমরা তোমাদের প্রতিই দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করেছিলে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যালিমদের জন্য তো বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে”। (সুরা ইবরাহীম ১৪/২২)।

জাহান্নামের সবচেয়ে ছোট আযাব

 (ক) নুমান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তি ঐ লোকের হবে, যাকে আগুনের ফিতাসহ দু’খানা জুতা পরানো হবে, তাতে তার মগজ এমনিভাবে ফুটতে থাকবে, যেমনিভাবে তামার পাত্রে পানি ফুটতে থাকে। সে ধারণা করবে, তার অপেক্ষা কঠিন শাস্তি আর কেউ ভোগ করছে না, অথচ সে হবে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তিপ্রাপ্ত লোক। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৬৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১২, সুনান আততিরমিযী ২৬০৪, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ১৬৮০, সহীহুল জামি ২০৩৩, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৮৫, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ১৮৪৪৭, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৪১৩২, মুসনাদে ‘আদ ইবনু হুমায়দ ৭১১, মুসনাদে বাযযার ৩২৩৫, মুসনাদে আহমাদ ২৬৯০, দারিমী ২৮৪৮, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৩৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ)  ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তি হবে আবূ ত্বালিব-এর। তার দুই পায়ে দু’টি আগুনের জুতা পরিয়ে দেয়া হবে। তাতে তার মাথার মগজ ফুটতে থাকবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৬৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২১২, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬২, মুসনাদে আহমাদ ২৬৩৬, সহীহুল জামি' ২৫৩২, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৬৮৮, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ৩৪১৩৫, মুসনাদে ‘আবদ ইবনু হুমায়দ ৭১১, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৮৭৩৫, আধুনিক প্রকাশনী- ৬১০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জাহান্নামীদের আর্তি ও আর্জি

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(ক) “আযাবের কঠিনতায় জাহান্নামীরা ভীষণ চীৎকার ও আর্তনাদ করতে থাকবে”। (সুরা হুদ ১১/১০৬)।

(খ)  “কিন্তু ওরা তো স্থায়ীভাবে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে। ওদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং ওরা শাস্তি ভোগ করতে করতে হতাশ হয়ে পড়বে”। (সুরা আয যুখরুফ ৪৩/৭৪-৭৫)।

(গ) “ওদের মৃত্যুরও আদেশ দেওয়া হবে না, যে ওরা মরবে। ওরা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে নিষ্কৃতি দাও, আমরা সৎকাজ করব পুর্বে যা করতাম, তা আর করব না। আল্লাহ বলবেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এত দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারত? তোমাদের নিকটে তো সতর্ককারীও এসেছিল। সুতরাং শাস্তি আস্বাদন কর; যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (সুরা ফাতির ৩৫/৩৬-৩৭)।

(ঘ) “ওরা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে ঘিরে ছিল এবং আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! এ অগ্নি হতে আমাদেরকে উদ্ধার কর, অতঃপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী (অবিশ্বাস) করি, তবে তো আমরা অবশ্যই সীমা লংঘনকারী (যালেম) হব। আল্লাহ বলবেন, তোরা হীন অবস্থায় এখানেই থাক এবং আমার সঙ্গে কোন কথা বলিস না। আমার বান্দাদের মধ্যে একদল ছিল যারা বলত, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা ঈমান এনেছি (বিশ্বাস স্থাপন করেছি) তুমি আমাদের ক্ষমা কর ও দয়া কর, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। কিন্তু তাদেরকে (মুমিন দলকে) নিয়ে তোমরা উপহাস (ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ) করতে এত বিভোর ছিলে যে, তা তোমাদেরকে আমার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। তোমরা তো তাদের (ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের)কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে। আমি আজ তাদের ধৈর্যের কারণে তাদেরকে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হল সফলকাম।” (সুরা আল মুমিনুন ২৩/১০৬-১১০)।

(ঙ) “যখন হস্তপদ শৃঙ্খলিত অবস্থায় ওদেরকে তার কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন ওরা সেখানে ধ্বংস কামনা করবে। (ওদেরকে বলা হবে,) আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা করো না; বরং বহুবার ধ্বংস কামনা করতে থাক।” (সূরা ফুরক্বানঃ ১৩-১৪ আয়াত)।

(চ) “যখন ওরা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হবে, তখন দুর্বলেরা প্রবলদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম, এখন কি তোমরা আমাদের থেকে জাহান্নামের আগুনের কিয়দংশ নিবারণ করবে?’

প্রবলেরা বলবে, আমরা সকলেই তো জাহান্নামে আছি, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর দাসদের মাঝে ফায়সালা করে দিয়েছেন। জাহান্নামীরা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, 'তোমাদের প্রতিপালককে বল, তিনি যেন আমাদের নিকট থেকে একদিনের শাস্তি লাঘব করেন। তারা বলবে, তোমাদের নিকট কি স্পষ্ট নিদর্শনাবলী সহ তোমাদের রসুলগণ আসেনি?” (জাহান্নামীরা) বলবে, 'অবশ্যই এসেছিল। (প্রহরীরা) বলবে, তবে তোমরা প্রার্থনা করতে থাক। আর সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রার্থনা ব্যর্থই হয়। (সুরা মু'মিনঃ ৪৭-৫০ আয়াত)।

(ছ)  “সবাই আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে; যারা অহংকার করত দুর্বলেরা তাদেরকে বলবে, 'আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম; এখন তোমরা কি আল্লাহর শাস্তি হতে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারবে? তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করলে আমরাও তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করতাম; এখন আমাদের ধৈর্যচ্যুত হওয়া অথবা ধৈর্যশীল হওয়া একই কথা; আমাদের কোন নিস্কৃতি নেই। যখন সব কিছুর ফায়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি। আর আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি; আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে আহবান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতিই দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও; তোমরা যে পূর্বে আমাকে (আল্লাহর) শরীক করেছিলে সে কথা তো আমি মানিই না।’ অত্যাচারীদের জন্য তো বেদনাদায়ক শাস্তি আছে।” (সূরা ইব্রাহীমঃ ২১-২২ আয়াত)।

(জ) “ওরা অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যু কামনা করবে এবং চীৎকার করে বলবে, ‘হে মালেক (দোযখের অধিকর্তা)! তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন।” সে বলবে, 'তোমরা তো এভাবেই অবস্থান করবে। আল্লাহ বলবেন, আমি তো তোমাদের নিকট সত্য পৌছায়ে ছিলাম, কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই তো সত্য-বিমুখ ছিল।” (সুরা আয যুখরুফ ৪৩/৭৭-৭৮)।

আনাস (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেনঃ হে মানুষ সকল! তোমরা (আল্লাহর ভয়ে) খুব বেশি বেশি ক্রন্দন কর। যদি কাঁদতে ব্যর্থ হও, তাহলে ক্রন্দনের রূপ ধারণ কর। কেননা জাহান্নামী জাহান্নামের মধ্যে কাঁদতে থাকবে, এমনকি পানির নালার মতো তাদের চেহারার অশ্রু প্রবাহিত হবে। এমন সময় অশ্রুও শেষ হয়ে যাবে এবং রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে, তাতে তার চক্ষুসমূহে এমন গভীরভাবে ক্ষত হবে যে, যদি তাতে নৌকা চালাতে হয় তবে তাও চলবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৬৮৫, শারহুস্ সুন্নাহ্ ৪৪১৮, সঃ জামে’ ২০৩২)। হাদিসের মানঃ যঈফ (Dai'f)।

যে লোক সবার শেষে জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে

(ক) আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সবশেষে যে লোক জাহান্নাম থেকে বের হবে এবং সবশেষে যে ব্যক্তি জান্নাতে দাখিল হবে তার সম্পর্কে আমি জানি। এক ব্যক্তি হামাগুড়ি দেয়া অবস্থায় জাহান্নাম থেকে বের হবে। তখন আল্লাহ্ বলবেন, যাও জান্নাতে দাখিল হও। তখন সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত ভরতি হয়ে গেছে এবং সে ফিরে আসবে ও বলবে, হে প্রতিপালক! জান্নাত তো ভরতি দেখতে পেলাম। আবার আল্লাহ্ বলবেন, যাও জান্নাতে দাখিল হও। তখন সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত ভর্তি হয়ে গেছে। তাই সে ফিরে এসে বলবে, হে প্রতিপালক! জান্নাত তো ভর্তি দেখতে পেলাম।

তখন আল্লাহ বলবেন, যাও জান্নাতে দাখিল হও। কেননা জান্নাত তোমার জন্য দুনিয়ার সমতুল্য এবং তার দশগুণ। অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুনিয়ার দশ গুণ। তখন লোকটি বলবে, (হে প্রতিপালক)! তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা বা হাসি-তামাশা করছ? (রাবী বলেন) আমি তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর মাড়ির দাঁত প্রকাশ করে হাসতে দেখলাম। এবং তিনি বলছিলেন এটা জান্নাতীদের সর্বনিম্ন অবস্থা। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৭১, ৭৫১১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৮৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৯৫, ২৫৯৬, সুনান ইবনু মা-জাহ ৪৩৩৯, আহমাদ ৩৫৮৪, ৪৩৭৭, মুখতাসারুশ শামাইল ১৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৫৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৬৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিছু তাওহীদবাদী লোককেও জাহান্নামের শাস্তি প্রদান করা হবে। এমনকি তারা তাতে পুড়তে পুড়তে কয়লার মতো হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা’আলার রহমতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং জান্নাতের দরজায় নিক্ষেপ করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জান্নাতে বসবাসকারীরা তাদের উপর পানি ছিটিয়ে দিবে। যার ফলে তারা সজীব হয়ে যাবে যেমনটি বন্যার স্রোত চলে যাবার পর মাটিতে উদ্ভিদ গজায়। তারপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৯৭, ২৫৯৮, সহীহাহ ২৪৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফাআতে একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে জাহান্নামী বলেই সম্বোধন করা হবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫৬৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬০০, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩১৫, আবূ দাউদ ৪৭৪০, আহমাদ ১৯৩৯৬, আধুনিক প্রকাশনী ৬১১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬১২০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়

জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া ও জান্নাতে যাওয়া এতো সহজ নয়। কারণ রাসুল সাঃ বলেছেন, কারো আমল তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে না। এমনকি রাসুল সাঃকেও না। তিনি বলেছেন, আল্লাহর করুণা ও দয়া ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৬৭৩, ৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৫২৭১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৬৭৩, আধুনিক প্রকাশনী ৫২৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫১৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাহলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যেতে চাইলে আল্লাহর রহমতের প্রয়োজন। আর আল্লাহর রহমত পেতে চাইলে আল্লাহ ও রাসুল সাঃ যা নিষেধ করেছেন তা মেনে চলতে হবে এবং যা করার আদেশ দিয়েছেন তা সঠিকভাবেই পালন করতে হবে। সামান্যতম পাপ যেমন যার অন্তরে অনু পরিমান অহংকার থাকবে সেও জান্নাতে যাবে না সে পরিমান পাপ কাজও করা যাবে না।

আমি ইতিপূর্বে “নবি (সাঃ) এর উম্মত জাহান্নামে যাবে কেনো?”  এর প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশে ১৫০টি জাহান্নামে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করেছি। এইসব কারণের সাথে কেউ জড়িত থাকলে তিনি জাহান্নামে যাবেন। নিম্নের হাদিসটি লক্ষ্য করি,

ইয়ায ইবনু হিমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তিন প্রকার লোক জান্নাতবাসী। যথা-

(১) দেশের শাসক- যিনি সুবিচারক ও দাতা, যাকে ভালো ও সৎ কাজ করার যোগ্যতা দান করা হয়েছে,

(২) যিনি সকলের প্রতি অনুগ্রহকারী- নিকটাত্মীয় ও মুসলিমদের প্রতি কোমলপ্রাণ এবং

(৩) যিনি নিষিদ্ধ বস্তু এবং ভিক্ষাবৃত্তি থেকে আত্মরক্ষাকারী- সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার ওপর ভরসাকারী।

পাঁচ প্রকার লোক জাহান্নামবাসী। যথা-

(১) দুর্বল জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি,- যে নিজের স্থুল বুদ্ধির কারণে নিজেকে কুকর্ম থেকে ফেরাতে পারে না। আর এ ব্যক্তি তোমাদের অধীনস্থ চাকর-বকরদেরই একজন। সে স্ত্রীও চায় না, হালাল মালেরও পরোয়া করে না। অর্থাৎ- নিজে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকার কারণে স্ত্রীর প্রয়োজনবোধ করে না। হারাম মাল উপার্জনেই সন্তুষ্ট। হারাম হোক আর হালাল হোক, তার পেট ভরলেই সে যথেষ্ট মনে করে।

(২) এমন খিয়ানাতকারী- যার লালসা গোপন ব্যাপার নয়, তুচ্ছ ব্যাপার হলেও সে অসাধুতা অবলম্বন করে।

(৩) সে ব্যক্তি- যে তোমাকে তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের মধ্যে ধোঁকায় ফেলার জন্য সকাল-সন্ধ্যা চিন্তামগ্ন থাকে।

অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম),

(৪) কৃপণ ও মিথ্যাবাদী এবং

(৫) দুশ্চরিত্র ও অশ্লীল বাক্যালাপকারীর কথা বর্ণনা করেছেন।

(মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৪৯৬০, মুসলিম ৬৩-(২৮৬৫), নাসায়ী’র কুবরা ৮০৭০, সহীহুল জামি‘ ২৬৩৭, সহীহ আত্ তারগীব ২১৮৪, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ২০০৮৮, আহমাদ ১৮৩৪০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৪৫৩, শু‘আবুল ঈমান ১১০৪৫, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ৮০৭০, হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১৬, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৪৩৯৭, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ২০৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 অতএব  কুরআন ও হাদিসে উল্লেখিত ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল যে কাজগুলো আছে সেগুলো পালন তো করতেই হবে তার পাশাপাশি জাহান্নামে যাওয়ার অন্যান্য কারণগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।

ধরুন আপনি একজন প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম বা অলি বা পির কিংবা দাবী করেন আওলাদে রাসুল কিন্তু মৃত্যুর আগে আপনার অন্তরে যদি জিহাদের কামনা বাসনা না থাকে তাহলে আপনার মৃত্যু হবে মুনাফিক্বী অবস্থায়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ২৫০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ জন্যেই রাসুল সাঃ বলেছেন, ৭৩টি দলের মধ্যে ১টি দল জান্নাতী। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৯১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৬৪০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৫৯৬, আহমাদ ২৭৫১০, রাওদুন নাদীর ৫০, সহীহাহ ২০৩, আত-তালীক আলাত তানকীল ২/৫৩)।  হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

তিনি আরো বলেছেন, কিয়ামতে যার হিসাব নেয়া হবে, সে ধ্বংস হবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৫৪৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৪৯৩৯, ১০৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭১১৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৭৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬৯, সহীহুল জামি ৬২২০, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৫৯৪, আবূ ইয়া'লা ৪৪৫৩, আস্ সুনানুল কুবরা লিন্ নাসায়ী ১১৬৫৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৫৭০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ বলেছেন,  কে জান্নাতী কে জাহান্নামী সেটা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯৫, মুয়াত্ত্বা মালিক ১৩৯৫, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪০৮১, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩০০১)।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে নিরাশ হবেন না। কারণ রাসুল সাঃ জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় বলে দিয়েছেন। আমরা তাঁর তরীকা মোতাবেক চলতে পারলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবো ইনশাআল্লাহ।

জাহান্নামের আযাবের ভয়াবহতা, লেলিহান আগুনের তীব্রতা ও প্রখরতা অত্যন্ত কঠিন। এজন্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা একটি খেজুর দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো। যদি তাও না থাকে, তাহলে ভাল কথার মাধ্যমে হলেও (জাহান্নাম থেকে বাঁচ)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪১৩, (১৪১৭, ৩৫৯৫, ৬০২৩, ৬৫৩৯, ৬৫৪০, ৬৫৬৩, ৭৪৪৩, ৭৫১২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৩৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০১৬, আহমাদ ১৮২৮০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩২৭; ইবনু হিববান ৭৩৭৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং জাহান্নাম থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে এবং আমাদের নিকটাত্মীয়দের বাঁচানোর জন্যও চেষ্টা করতে হবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথ ও পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

মূলতঃ জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের উপায় দু’টি। যেমনঃ-

(১) ঈমান আনা ও সৎকর্ম সম্পাদন করা ও

(২) জাহান্নাম হতে আল্লাহর কাছে সর্বদা আশ্রয় প্রার্থনা করা।

(১) ঈমান আনা ও সৎকর্ম সম্পাদন করাঃ

জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হওয়ার মূল কারণ হ’ল কুফুরী। সুতরাং তা থেকে বেঁচে থাকাই জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রধান উপায়। সেক্ষেত্রে ঈমানের ছয়টি রুকনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অত্যাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান আনলাম। অতএব আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন’। (সুরা আলে-ইমরান ২/১৬)।

অন্যত্র তিনি আরো বলেছেন,

‘হে আমাদের রব! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। সুতরাং তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই তুমি যাকে আগুনে প্রবেশ করাবে, অবশ্যই তুমি তাকে লাঞ্ছিত করবে। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা একজন আহবানকারীকে ঈমানের দিকে আহবান করতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা কর, বিদূরিত কর আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং আমাদেরকে মৃত্যু দাও নেককারদের সাথে। হে আমাদের রব! আর তুমি আমাদেরকে তাই প্রদান কর যার ওয়াদা তুমি আমাদেরকে দিয়েছ তোমার রাসূলগণের মাধ্যমে। আর ক্বিয়ামতের দিনে তুমি আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবে না। নিশ্চয়ই তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ কর না’। (সুরা আলে ইমরান ২/১৯১-১৯৪)।

আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ (হিশামের বর্ণনায়) জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে অথবা (শুবাহুর বর্ণনায়) যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত কোন প্ৰভু নেই) বলেছে তাকে বের করে আন তার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ ঈমান থাকলেও। আর যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে যদি গমের দানা পরিমাণও ঈমান থাকে তবে তাকেও জাহান্নাম হতে বের করে আন। যে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার অন্তরে যদি অণু পরিমাণও (শুবাহুর বর্ণনায় আছে, একটি হালকা জোয়ারদানা পরিমাণ) ঈমান থাকে তবে তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৫৯৩, সুনান ইবনু মাজাহ ৪৩১২, আহমাদ ১১৭৪৩, আয-যিলাল ৮০৪, ৮১০, ৮৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এছাড়া অসংখ্য সৎকর্ম রয়েছে। যা সঠিক ও বিশুদ্ধভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায়। যেমন-

(ক) বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণঃ

ঈমানে মুফাছ্ছাল ও ঈমানে মুজমাল সহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত সকল বিষয়ের উপর দৃঢ় ঈমান ও বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করতে হবে। যা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্যতম উপায়।

(খ) পরিশুদ্ধ নিয়তঃ

নিয়ত পরিশুদ্ধ না হলে জীবনের উপার্জিত সকল আমল বা ইবাদতই বরবাদ হয়ে যাবে। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিশ্ব মানবতার প্রত্যেক কাজ তার অন্তরে পরিকল্পিত চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাই মানুষের সকল কাজ তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল।

’উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয়ই প্রতিটি আমলের গ্রহণযোগ্যতা তার নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল। কোন ব্যক্তি তা-ই লাভ করবে যা সে নিয়্যাত করে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যই হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া লাভের জন্য হবে অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার জন্য হবে তার হিজরত সে উদ্দেশেই হবে যে জন্য সে হিজরত করেছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬৮৯, আধুনিক প্রকাশনী ৬২২২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬২৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সুতরাং একনিষ্ঠচিত্তে ও নিবিষ্ট মনে কেবলমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণই হবে বিশুদ্ধ নিয়তের মৌলিক দাবী।

(গ) শিরক না করাঃ

শিরক একটি জঘন্য অপরাধ। যা খালেছ তওবা ব্যতীত আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এর মাধ্যমে জান্নাত হারাম হয়ে যায় এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হ’তে হয়। সুতরাং শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করবে তার উপর জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম হবে তার চূড়ান্ত ঠিকানা। আর সেদিন যালেমদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না’। (সুরা মায়েদা ৫/৭২)।

মু‘আয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উফাইর নামক একটি গাধার পিঠে আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পেছনে আরোহী ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে মু‘আয, তুমি কি জান বান্দার উপর আল্লাহর হক কী? এবং আল্লাহর উপর বান্দার হক কী? আমি বললাম, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো, বান্দা তাঁর ‘ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো, তাঁর ‘ইবাদাতে কাউকে শরীক না করলে আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দিবেন না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমি কি লোকদের এ সুসংবাদ দিব না? তিনি বললেন, তুমি তাদের সুসংবাদটি দিও না, তাহলে লোকেরা এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৮৫৬, ৫৯৬৭, ৬২৬৭, ৬৫০০, ৭৩৭৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩০, আহমাদ ২২০৫২, হাদিস সম্ভার ৪, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৬৪৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(ঘ) বিদ‘আত পরিহার করাঃ

বিদ‘আত আমল বিধ্বংসী এমন একটি অস্ত্র যার মাধ্যমে জাহান্নামের পথ সুগম হয়। মানুষ দ্রুত জান্নাতের রাস্তা থেকে দূরে সরে যায়। ক্বিয়ামতের কঠিন ময়দানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং বিদ‘আত পরিহার করতে হবে এবং সুন্নাতের সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

ইরবায ইবনু সারিয়াহ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় আমাদের নাসীহাত করেন, যাতে অন্তরসমূহ ভীত হল এবং চোখগুলো অশ্রু বর্ষণ করলো। তাঁকে বলা হল, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি তো বিদায় গ্রহণকারীর উপদেশ দিলেন। অতএব আমাদের নিকট থেকে একটি প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করুন (একটি সুনির্দিষ্ট আদেশ দিন)। তিনি বলেনঃ তোমরা আল্লাহ্ভীতি অবলম্বন করো, শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো (নেতৃ-আদেশ), যদিও সে কাফরী গোলাম হয়। আমার পরে অচিরেই তোমরা মারাত্নক মতভেদ লক্ষ্য করবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদ্বীনের সুন্নাত অবশ্যই অবলম্বন করবে, তা দাঁত দিয়ে শক্তভাবে কামড়ে ধরবে। অবশ্যই তোমরা বিদআত কাজ পরিহার করবে। কারণ প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪২, তিরমিযী ২৬৭৬, আবূ দাঊদ ৪৬০৭, আহমাদ ১৬৬৯২, দারিমী ৯৫, ইরওয়াহ ২৪৫৫, মিশকাত ১৬৫, ফিলাল ২৪-২৬, সালাতুত তারাবীহ ৮৮-৮৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তিনি আরও বলেন,

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো দ্বীনে নব আবিষ্কৃত কাজ এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।” (মুসলিম শরীফ, জুময়া অধ্যায়: খুৎবা ও নামায হালকাকরণ অনুচ্ছেদ, হাদীস নং ৮৬৭)।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, অতঃপর (তাদের আনুগত্য না করে) তোমাদের আমলসমূহকে বিনষ্ট কর না’। (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।

সুতরাং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর বিদ‘আতকে সর্বদা পরিহার করতে হবে।

বিদআতিদের কোনো ফরজ-নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট গৃহিত হবে না

(ক)  ইব্রাহীম তাইমী (রহ.)-এর পিতা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আলী (রাঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব ও এই সহীফায় যা আছে, এছাড়া অন্য কোন কিতাব নেই, যা আমরা পাঠ করে থাকি। তিনি বলেন, এ সাহীফায় রয়েছে, যখমের দন্ড বিধান, উটের বয়সের বিবরণ এবং আইর পর্বত থেকে সওর পর্যন্ত মদিনা্ হারাম হবার বিধান। যে ব্যক্তি এর মধ্যে বিদ্‘আত উদ্ভাবণ করে কিংবা বিদ্আতীকে আশ্রয় দেয়, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত। আল্লাহ তার কোন নফল ও ফরজ ‘ইবাদাত কবূল করেন না। আর যে নিজ মাওলা ব্যতীত অন্যকে মাওলা হিসেবে গ্রহণ করে, তার উপর একই রকম লা‘নত। আর নিরাপত্তা দানের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের মুসলিমগণ একইভাবে দায়িত্বশীল এবং যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের চুক্তি ভঙ্গ করে তার উপরও তেমনি অভিসম্পাত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৭২, ১১১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৯৪৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

(খ) ‘আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআন এবং এ কাগজে যা লিখা আছে তা ছাড়া কোন কিছু লিপিবদ্ধ করিনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আয়ির পর্বত হতে এ পর্যন্ত মদিনার হরম এলাকা। যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে বিদ্‘আত উদ্ভাবণ করে কিংবা কোন বিদ্‘আতীকে আশ্রয় দিবে তার উপর আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা ও সকল মানুষের লা’নত। তার কোন ফরজ কিংবা নফল ‘ইবাদাত গৃহীত হবে না। আর সকল মুসলিমের পক্ষ হতে নিরাপত্তা একই স্তরের। সাধারণ মুসলিম নিরাপত্তা দিলে সকলকে তা রক্ষা করতে হবে। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দেয়া নিরাপত্তা বাধাগ্রস্ত করবে তার উপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত এবং ফেরেশতামন্ডলী ও সকল মানুষের। তার কোন নফল কিংবা ফরজ ‘ইবাদাত গৃহীত হবে না। আর যে স্বীয় মনিবের অনুমতি ব্যতীত অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্বের চুক্তি করে, তার উপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত এবং ফেরেশতামন্ডলী ও সকল মানুষের। তার কোন নফল কিংবা ফরজ ‘ইবাদাত কবূল হবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৩১৭৯, ১১১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৯৪১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৯৫২ প্রথমাংশ)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(গ) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আমি ওদের কৃতকর্মগুলির প্রতি অভিমুখ করে সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণা (স্বরূপ নিষ্ফল) করে দেব”। (সুরা ফুরকান ২৩)।

বিদআতী পির-অলি ও আলেমদের তওবাও কবুল হয় না যতক্ষণ না---

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আল্লাহ প্রত্যেক বিদআতীর তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত স্থগিত রাখেন (গ্রহণ করেন না), যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার বিদআত বর্জন না করেছে।” (ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৪২০২, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৯৪৫৭, সহীহ তারগীব ৫৪নং)।

(ঙ) ফরয ইবাদতগুলি যথাযথভাবে আদায় করাঃ

মহান আল্লাহ কর্তৃক বান্দার উপর যে সমস্ত ইবাদত ফরয করা হয়েছে সেগুলি যথাযথভাবে আদায় করা জাহান্নাম থেকে মুক্তির অন্যতম উপায়। ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জ প্রভৃতি। যেমন- ছালাত আদায় করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের ছালাত বিনয়-নম্রতা সহকারে আদায় করে’। (সুরা মু’মিনূন ২৩/১-২)।

 অন্যত্র তিনি আরো বলেছেন, ‘(তারাও সফলকাম) যারা তাদের ছালাতসমূহের হেফাযত করে’। (সুরা মুমিনূন ২৩/৯)।

ইবাদত হবে সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে। আবূ হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন (মনে করবে) তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও, তাহ’লে (অন্তত এতটুকু বিশ্বাস রাখবে যে) নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে দেখছেন’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫০ ও ৪৭৭৭; আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৬৯৫; সুনান ইবনু মাজাহ ৬৩-৬৪; সুনান আততিরমিযী ২৬১০; সুনান আননাসাঈ ৪৯৯০-৪৯৯১; মিশকাত ২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ছিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

’উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যুদ্ধের মাঠে ঢাল যেমন তোমাদের রক্ষাকারী, রোযাও তদ্রূপ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৩৯, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৯৪, ১৯০৪, ৫৯২৭, ৭৪৯২, ৭৫৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫১, নাসায়ী ২২৩০, ২২৩১, আহমাদ ১৫৮৩৯, ১৫৮৪৪, ১৭৪৪৫, সহীহ তারগীব ৯৭১, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৭০, ছহীহুল জামে ৩৮৭৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(চ) ৪০ দিন তাকবীরে উলার সাথে সলাত আদায় করাঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার সন্তোষ অর্জনের উদ্দেশ্যে একাধারে চল্লিশ দিন তাকবীরে উলার (প্রথম তাকবীর) সাথে জামা’আতে নামায আদায় করতে পারলে তাকে দুটি নাজাতের ছাড়পত্র দেওয়া হয়ঃ জাহান্নাম হতে নাজাত এবং মুনাফিকী হতে মুক্তি। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪১, তা’লীকুর রাগীব ১/১৫১, সহীহাহ ২৬৫২)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

(ছ) অধিক পরিমাণ নফল ইবাদত করাঃ

আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য ফরয ইবাদত সমূহ প্রতিপালন করা আবশ্যক। পাশাপাশি সুন্নাত ও নফল ইবাদত সমূহ ও একজন মুসলিমকে আল্লাহর অধিক নৈকট্যশীল বান্দায় পরিণত করে। তাছাড়া ক্বিয়ামতের দিন যখন আমলনামা হালকা হবে তখন নফল ইবাদত দিয়ে তা পূর্ণ করা হবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

‘আমি যেসব বিষয় ফরয করেছি, তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অনুসন্ধানের চাইতে প্রিয়তর আমার নিকটে আর কিছু নেই। বান্দা নফল ইবাদত সমূহের মাধ্যমে সর্বদা আমার নৈকট্য হাছিলের চেষ্টায় থাকে, যতক্ষণ না আমি তাকে ভালবাসি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমিই তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শ্রবণ করে, চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে, পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলাফেরা করে। তখন সে যদি আমার কাছে কিছু চায় তখন অবশ্যই আমি তাকে দান করে থাকি। যদি সে আমার নিকট আশ্রয় ভিক্ষা করে, আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দিয়ে থাকি। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে কোন দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপসন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপসন্দ করি’। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৫০২, আধুনিক প্রকাশনী- ৬০৫২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬০৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

বান্দা মৃত্যুকে অপছন্দ করে অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি চলে এসো তোমার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির দিকে সন্তুষ্ট চিত্তে। অতঃপর আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ কর এবং প্রবেশ কর জান্নাতে’। (সুরা ফজর ৮৯/২৭-৩০)।

(জ) অধিক পরিমাণ দান করাঃ

দান ও ছাদাক্বার মাধ্যমে আত্মা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে তার নিকটবর্তী হওয়া যায়। রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্যকারীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা সুদৃঢ় হয় এবং জান্নাতের পথ সুগম হয়। মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান কর তবে তা উৎকৃষ্ট এবং যদি গোপনে দান কর এবং দরিদ্রদেরকে প্রদান কর তবে তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর। আর এর দ্বারা তিনি তোমাদের পাপ সমূহ মোচন করে দেন। বস্ত্ততঃ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ যথাযথভাবে খবর রাখেন’। (সুরা আল বাক্বারাহ ২/২৭১)।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন মঙ্গল নিহিত থাকে না। তবে যে ব্যক্তি ছাদাক্বা করে, সৎকর্ম করে, মানুষের মাঝে পরস্পরে সত্য মীমাংসা করে এবং যে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য এরূপ করে সে ব্যতীত। আমি তাকে এর জন্য মহা পুরস্কারে ভূষিত করব’। (সুরা নিসা ৪/১১৪)।

দানের গুরুত্ব বর্ণনায় নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে দিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।

১. ন্যায়পরায়ণ শাসক,

২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে,

৩. সে ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে,

৪. সে দু’ ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য,

৫. সে ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহবান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’,

৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না,

৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকর করে, ফলে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬০, ১৪২৩, ৬৪৭৯; মুসলিম ১২/৩০, হাঃ ১০৩১,আহমদ ৯৬৭১) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৬২০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আরো বলেন,

‘আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে ছিলাম, এমন সময় দু’জন সাহাবী আসলেন, তাদের একজন দারিদ্রের অভিযোগ করছিলেন আর অপরজন রাহাজানির অভিযোগ করছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ রাহাজানির অবস্থা এই যে, কিছু দিন পর এমন সময় আসবে যখন কাফিলা মক্কা পর্যন্ত বিনা পাহারায় পৌঁছে যাবে। আর দারিদ্রের অবস্থা এই যে, তোমাদের কেউ সাদাকা নিয়ে ঘোরাফিরা করবে, কিন্তু তা গ্রহণ করার মত কাউকে পাবে না। এমন সময় না আসা পর্যন্ত ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) কায়িম হবে না। অতঃপর (বিচার দিবসে) আল্লাহর নিকট তোমাদের কেউ এমনভাবে খাড়া হবে যে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন আড়াল থাকবে না বা কোন ব্যাখ্যাকারী দোভাষীও থাকবে না। অতঃপর তিনি বলবেনঃ আমি কি তোমাকে সম্পদ দানকারিণী? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ। এরপর তিনি বলবেন, আমি কি তোমার নিকট রাসূল প্রেরণ করিনি? সে অবশ্যই বলবে হাঁ, তখন সে ব্যক্তি ডান দিকে তাকিয়ে শুধু আগুন দেখতে পাবে, তেমনিভাবে বাম দিকে তাকিয়েও আগুন দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের উচিত এক টুকরা খেজুর (সাদাকা) দিয়ে হলেও যেন আগুন হতে আত্মরক্ষা করে। যদি কেউ তা না পায় তবে যেন উত্তম কথা দিয়ে হলেও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪১৩, ১৪১৭, ৩৫৯৫, ৬০২৩, ৬৫৩৯, ৬৫৪০, ৬৫৬৩, ৭৪৪৩, ৭৫১২, মুসলিম ১২/১৯, হাঃ ১০১৬, আহমাদ ১৮২৮০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঝ) সন্তান বা আপনজনদের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করাঃ

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নারীরা একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলল, পুরুষেরা আপনার নিকট আমাদের চেয়ে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাই আপনি নিজে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারিত করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করলেন; সে দিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের নাসীহাত করলেন ও নির্দেশ দিলেন। তিনি তাদের যা যা বলেছিলেন, তার মধ্যে একথাও ছিল যে, তোমাদের মধ্যে যে স্ত্রীলোক তিনটি সন্তান পূর্বেই পাঠাবে, তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তখন জনৈক স্ত্রীলোক বলল, আর দু’টি পাঠালে? তিনি বললেনঃ দু’টি পাঠালেও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১০১, ১২৪৯,৭৩১০; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৯৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৩৩, আহমাদ ১১২৯৬) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঞ) মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকাঃ

 ’আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবো না, কোন ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম হারাম এবং জাহান্নামের জন্য কোন ব্যক্তি হারাম? যে ব্যক্তি মানুষের কাছাকাছি (জনপ্রিয়), সহজ-সরল, নম্রভাষী ও সদাচারী। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৪৮৮, সহীহাহ ৯৩৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ট) ফরয সিয়ামের পাশাপাশি বেশি-বেশি নফল সিয়াম পালন করাঃ

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সওম পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৯৪, ১৯০৪, ৫৯২৭, ৭৪৯২, ৭৫৩৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৯৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫১, আহমাদ ৭৩০৮)  (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭৭০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় এক দিনও সিয়াম পালন করে, আল্লাহ্ তার মুখমন্ডলকে দোযখের আগুন হতে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৮৪০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬০১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫৩, আহমাদ ১১৭৯০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৬৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৬৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

সহিহ হাদিসে বর্ণিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিয়াম/রোযা পালনের দিনসমূহঃ

শা‘বান মাসের ছিয়ামঃ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযানের ফরয ছিয়ামের পর শা‘বান মাসেই একটানা নফল ছিয়াম পালন করতেন।

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত।

তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (এত অধিক) সওম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সওম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) সওম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সওম পালন করবেন না। আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে রমাযান ব্যতীত কোন পুরা মাসের সওম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে কোন মাসে অধিক (নফল) সওম পালন করতে দেখিনি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯৬৯, ১৯৭০, ৬৪৬৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬০৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫৬, আহমাদ ২৫১৫৫) (আধুনিক প্রকাশনীঃ১৮৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ১৮৪২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তিনি আরো বলেন, ‘

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চাইতে বেশি (নফল) সওম কোন মাসে পালন করতেন না। তিনি (প্রায়) পুরা শা‘বান মাসই সওম রাখতেন এবং তিনি বলতেনঃ তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল কর, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা (সাওয়াব দান) বন্ধ করেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় সালাত ছিল তাই- যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হত, যদিও তা পরিমাণে কম হত এবং তিনি যখন কোন (নফল) সালাত আদায় করতেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৯৭০, ১৯৬৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬০৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৫৬, আহমাদ ২৪৫৯৪) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৩১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৪৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

শা‘বান মাসের কয়েকদিন ব্যতীত ছিয়াম পালন করা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ ছিল।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শাবান মাসের অর্ধেক অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে রমযান মাস না আসা পর্যন্ত কোন রোযা নাই। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৫১, সুনান আততিরমিযী ৭৩৮; সুনান আবূ দাউদ ২৩৩৭; আহমাদ ৯৪১৪; দারেমী ১৭৪০ মিশকাত ১৯৭৪, সহীহ আবী দাউদ ২০২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে কেউ ছিয়াম রাখতে অভ্যস্ত হ’লে সে রাখতে পারে।

শাওয়াল মাসের ছিয়ামঃ

শাওয়াল মাসে ৬টি ছিয়াম রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুক্তাদাস সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের পর ছয় দিন রোযা রাখলো, তা পূর্ণ বছর রোযা রাখার সমতুল্য। ’’কেউ কোন সৎকাজ করলে, সে তার দশ গুণ পাবে’’ (সূরা আন’আমঃ ১৬০)। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭১৫, আহমাদ ২১৯০৬, দারেমী ১৭৫৫, ইরওয়াহ ৪/১০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যিলহজ্জ ও আরাফার ছিয়ামঃ

নফল ছিয়ামের মধ্যে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক ও আরাফার দিনের ছিয়ামের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। যিলহজ্জের প্রথম দশকের ছিয়ামের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট (যুলহিজ্জার) দশ দিনের সৎকাজের চাইতে অধিক পছন্দনীয় সৎকাজ আর নেই। সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি? তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়, কিন্তু যে ব্যক্তি তার জান-মালসহ আল্লাহর পথে বের হয়ে তার কোন কিছু নিয়ে আর ফিরে আসে না (তার মর্যাদা অনেক)। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭২৭, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৯৬৯, সুনান আততিরমিযী ৭৫৭, সুনান আবূ দাউদ ২৪৩৮, আহমাদ ১৯৬৯, ৩১২৯, দারেমী ১৭৭৩, ইরওয়াহ ৯৫৩, সহীহ আবী দাউদ ২১০৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৯১৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আরাফার দিনের ছিয়াম প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি আল্লাহর নিকট আরাফাত দিবসের রোযার এই সওয়াব আশা করি যে, তিনি তাঁর বিনিময়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭৩০, সুনান আততিরমিযী ৭৪৯, আহমাদ ২২০২৪, ইরওয়াহ ৯৫২, আবী দাউদ ২০৯৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উল্লেখ্য, আরাফার দিনে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীগণ ছিয়াম পালন করবেন না। এছাড়া অন্যান্য সকল মুসলমান নফল ছিয়ামের মধ্যে সর্বাধিক নেকী সম্পন্ন এই ছিয়াম পালন করে অশেষ নেকী অর্জনে সচেষ্ট হবেন।

আশূরার ছিয়ামঃ

আশূরার ছিয়াম তথা মুহাররমের ১০ তারিখের ছিয়ামও অধিক ফযীলতপূর্ণ। ইহুদীরাও এইদিন ছিয়াম পালন করত। ফেরাঊনের কবল থেকে মূসা (আঃ)-এর নাজাতের শুকরিয়া স্বরূপ এ ছিয়াম রাখা হয়। কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে এ ছিয়াম পালন করলে শুধু কষ্ট করাই সার হবে। কারণ তার অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদ্বীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ ‘আশূরার দিনে সওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সওম পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আঃ) সওম পালন করেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে সওম পালন করেন এবং সওম পালনের নির্দেশ দেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০০৪, ৩৩৯৭, ৩৯৪৩, ৪৬৮০, ৪৭৩৭,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৫৪৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৩০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৬৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ‘আশূরার দিনের সওমের উপরে অন্য কোন দিনের সওমকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রমাযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০০৬, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ২৫৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৩২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৬৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৭৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

২য় হিজরী সনে রামাযান মাসের ছিয়াম ফরয করা হলে রাসূল (ছাঃ) এই নির্দেশ শিথিল করে দেন।

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ ‘আশূরার সওম পালন করত এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ও এ সওম পালন করতেন। যখন তিনি মাদ্বীনায় আগমন করেন তখনও এ সওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমাযানের সওম ফরজ করা হল তখন ‘আশূরার সওম ছেড়ে দেয়া হলো, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২০০২, ১৫৯২)  (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৭৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আশূরার ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের বিপরীত কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বে একদিন অথবা পরে একদিন ছিয়াম পালন কর’। (বায়হাক্বী ৪/২৮৭ পৃঃ)।

সুতরাং আশূরার ছিয়াম মুহাররমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখে রাখা যায়। তবে ৯, ১০ তারিখে রাখাই সর্বোত্তম। (আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয় (হা.ফা.বা.), পৃঃ ৩, টীকা-৮ দ্রঃ)।

এ ছিয়ামের ফযীলত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া আত তামীমী ও কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহিমাহুমাল্লাহ).....আবূ কাতাদাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আশা করি যে, আমার এতটা শক্তি হোক। তিনি পুনরায় বললেন, প্রতি মাসে তিনদিন সওম পালন করা এবং রমাযান মাসের সওম এক রমাযান থেকে পরবর্তী রমাযান পর্যন্ত সারা বছর সওম পালনের সমান। আর আরাফাহ দিবসের সওম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আর আশুরার সওম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহের কাফফারাহ হয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬৩৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৬১৩, ইসলামীক সেন্টার ২৬১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

প্রতি মাসে তিন দিন ছিয়ামঃ

প্রতি মাসে তিনদিন ছিয়াম রাখা রাসূল (ছাঃ)-এর নিয়মিত ও পসন্দনীয় আমল। তিনদিন ছিয়াম রাখার বিনিময়ে পুরো মাস ছিয়াম রাখার সমান নেকী পাওয়া যায়। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখলো, তা যেন সারা বছর রোযা রাখলো। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কিতাবে এর সমর্থনে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন (অনুবাদ) ’’কেউ কোন সৎকাজ করলে, সে তার দশ গুণ পাবে’’ (সূরা আনআমঃ ১৬০)। অর্থাৎ প্রতিটি দিন দশ দিনের সমান। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭০৮, সুনান আননাসায়ী ২৪১০, ইরওয়াহ ৪/১০২, সুনান আততিরমিযী ৭৬২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে এই ছিয়াম রাখা সুন্নাত। আবূ যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেনঃ হে আবু যার! তুমি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা পালন করতে চাইলে তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখে তা পালন কর। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭৬১, ইরওয়া (৯৪৭), মিশকাত তাহকীক ছানী (২০৫৭)।হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

প্রত্যেক সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযাঃ

মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না ও মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার (রহঃ)....আবূ কাতাদাহ আল আনসারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। এতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হলেন। তখন উমর (রাযিঃ) বললেন, আমরা আল্লাহর উপর (আমাদের) প্রতিপালক হিসেবে, ইসলামের উপর (আমাদের) দীন হিসেবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর (আমাদের) রসূল হিসেবে এবং আমাদের কৃত বাই’আতের উপর আমরা সন্তুষ্ট। অতঃপর সারা বছর সওম পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, সে সওম পালন করেনি, ইফত্বারও করেনি, সে সওম পালন করেনি এবং সওমহীনও থাকেনি। অতঃপর একাধারে দু’দিন সওম পালন করা ও একদিন সওম পালন না করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, এভাবে সওম পালনের সামর্থ্য কার আছে? অতঃপর একদিন সওম পালন ও দু’দিন সওম ত্যাগ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, আল্লাহ যেন আমাদের এরূপ সওম পালনের সামর্থ্য দান করেন। অতঃপর একদিন সওম পালন করা ও একদিন না করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, তা আমার ভাই দাউদ (আঃ) এর সওম।

অতঃপর সোমবারের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, এ দিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং এ দিনই আমি নুবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছি বা আমার উপর (কুরআন) নাযিল করা হয়েছে। তিনি আরও বললেন, প্রতি মাসে তিনদিন এবং গোটা রমযান মাস সওম পালন করাই হল সারা বছর সওম পালনের সমতুল্য। অতঃপর আরাফাহ দিবসের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, তাতে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহের কাফফারাহ হয়ে যাবে। অতঃপর আশুরার সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, বিগত বছরের গুনাহের কাফফারাহ হয়ে যাবে। এ হাদীসে শু’বাহ এর বর্ণনায় আরও আছে, “অতঃপর সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল।" কিন্তু আমাদের বৃহস্পতিবারের কথা ভুলবশতঃ বর্ণিত হয়েছে, তাই আমরা তার উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৬৩৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১১৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৬১৪, ইসলামীক সেন্টার ২৬১৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য আরেক হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহ তা’আলার দরবারে) আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমার আমলসমূহ যেন রোযা পালনরত অবস্থায় পেশ করা হোক এটাই আমার পছন্দনীয়। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭৪৭, তাখরাজুল মিশকাত (২০৫৬), তা’লীকুর রাগীব (৮৪/২), ইরওয়া (৯৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রবীআ ইবনুল গায (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি ’আয়িশাহ্ (রাঃ) এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযার প্রতি খুবই খেয়াল রাখতেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭৩৯, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৭৪৫, সুনান আননাসাঈ ২৩৬০, ২১৮৬, ২৩৬১, ২৩৬২, ২৩৬৩, ২৩৬৪, ইরওয়াহ ৪/১০৫-১০৬, তা’লাক ইবনু খুযাইমাহ ২১৭, মুখতাসার, শামায়িল ২৫৮।)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (ঠ) কন্যাসন্তানদের ভালভাবে লালন-পালন করাঃ

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ভিখারিণী দু’টি শিশু কন্যা সঙ্গে করে আমার নিকট এসে কিছু চাইলো। আমার নিকট একটি খেজুর ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। আমি তাকে তা দিলাম। সে নিজে না খেয়ে খেজুরটি দু’ভাগ করে কন্যা দু’টিকে দিয়ে দিল। এরপর ভিখারিণী বেরিয়ে চলে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আসলেন। তাঁর নিকট ঘটনা বিবৃত করলে তিনি বললেনঃ যাকে এরূপ কন্যা সন্তানের ব্যাপারে কোনরূপ পরীক্ষা করা হয় সে কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নামের আগুন হতে আড় হয়ে দাঁড়াবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪১৮, ৫৯৯৫,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ৬৫৮৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬২৯, আহমাদ ২৪১১০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ড)  ফজর ও আসর সালাত যথাসময়ে আদায় করাঃ

’উমারাহ্ ইবনু রুআয়বাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ এমন ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না, যে সূর্য উঠার ও ডোবার আগে সালাত আদায় করেছে, অর্থাৎ- ফাজর (ফজর) ও ’আসরের সালাত। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৬২৪,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১৩২২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৩৪, সহীহ আল জামি ৫২২৮, সুনানে আবূ দাঊদ ৪২৭, সুনান আননাসায়ী ৪৭১, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৭৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার কাছে এই ২ ওয়াক্ত সলাতের রয়েছে আলাদা মর্যাদা। আর এই ২ ওয়াক্ত সলাত যথার্থ মর্যাদা দিয়ে তারাই আদায় করতে পারবে যারা ৫ ওয়াক্ত সলাতের ব্যাপারে সচেতন। কেননা এই ২ ওয়াক্ত সলাত সবচেয়ে বেশি কষ্টের সময়ে আদায় করা হয়। যারা এই ২ ওয়াক্ত সলাত সঠিক সময়ে আদায় করতে পারে তাদের জন্য বাকি ৩ ওয়াক্ত আদায় করা খুবই সহজ।

(ঢ) চোখকে পাপ থেকে হিফাযত করাঃ

রাসুল (সাঃ) বলেন কিয়ামতের দিন জাহান্নাম দেখবে না। (১) এমন চক্ষু যে আল্লাহ্র ভয়ে কাঁদে, (২) এমন চক্ষু যে আল্লাহ্র রাস্তায় জেগে থাকে, (৩) এমন চক্ষু যে বেগানা মহিলাকে দেখে নিচু হয়ে যায়। (সিলসিলাহ সহীহাহ- হাদিস ১৪৭৭)।

(ণ) যোহরের ফরয নামাজের পূর্বে ৪ এবং পড়ে ৪ রাকাত নামাজ আদায় করাঃ

 উম্মু হাবীবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি যোহরের (ফরযের) আগে চার রাকআত এবং পরে চার রাকআত সালাত পড়লো, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১১৬০, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৪২৭-২৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১২৬৯, আহমাদ ২৬২৩২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(অর্থাৎ যোহরের ফরয নামাজের আগে ৪ রাকাত এবং পড়ে ২ রাকাত ২ রাকাত করে ৪ রাকাত এই মোট ৮ রাকাত যেটা আমরা পড়ে থাকি।

বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু সুন্নত নফল হিসাবে বুঝে থাকে তাদের সুবিধার জন্য বলছি-এই হাদিস অনুযায়ী যোহরের প্রথমে ৪ রাকাত সুন্নত তারপর ৪ রাকাত ফরয তারপর ২ রাকাত সুন্নত এবং শেষে ২ রাকাত নফল, সব মিলে হবে ১২ রাকাত)।

(ত) প্রতিদিন ৩৬০ বার তাসবিহ, তাহলিল, তাকবীর, তাহমিদ আদায় করাঃ

হাসান ইবনু আলী আল হুলওয়ানী (রহঃ).....আয়িশাহ (রাযিঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক আদম সন্তানকেই ৩৬০টি অস্থিসন্ধি বিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঐ সংখ্যা পরিমাণ আল্লা-হু আকবার বলবে, আলহামদু লিল্লাহ’ বলবে, লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ’ বলবে, সুবহা-নাল্ল-হ’ বলবে, আসতাগফিরুল্ল-হ’ বলবে, মানুষের চলার পথ থেকে একটি পাথর বা একটি কাটা বা একটি হাড় সরাবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, সে কিয়ামতের দিন এমনভাবে চলাফেরা করবে যে, সে নিজেকে ৩৬০ ( অস্থিসন্ধি) সংখ্যা পরিমাণ জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে অর্থাৎ বেঁচে থাকবে। আবূ তওবা তার বর্ণনায় এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, সে এ অবস্থায় সন্ধ্যা করবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২১৯৯, ইসলামীক সেন্টার ২২০১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

’আবদুল হামীদ ইবনু বায়ান আল ওয়াসিতী (রহঃ) ....আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাতের শেষে তেত্রিশবার আল্লাহর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করবে, তেত্রিশবার আল্লাহর তাহমীদ বা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং তেত্রিশবার তাকবীর বা আল্লাহর মহত্ব বর্ণনা করবে আর এভাবে নিরানব্বই বার হওয়ার পর শততম পূর্ণ করতে বলবে

“লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহু লা- শারীকা-লাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুওয়া আলা- কুল্লি শাইয়িন কদীর”

(অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তিনি একক ও তার কোন অংশীদার নেই। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র তিনিই। সব প্রশংসা তারই প্রাপ্য। তিনি সবকিছু করতে সক্ষম- তার গুনাহসমূহ সমুদ্রের ফেনারাশির মতো অসংখ্য হলেও ক্ষমা করে দেয়া হয়।)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২৩৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৯৭, (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ৯৬৭, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১২২৮, ইসলামীক সেন্টার ১২৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোনো ব্যক্তি ৫ ওয়াক্ত সলাত আদায় করলেই তার ৩৬০ বার নয় ৫০০ বার উপরোক্ত তাসবিহ, তাহলিল, তাকবীর, তাহমিদ আদায় এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া ৫ ওয়াক্ত সলাত আদায়ে আরোও ১টা বিরাট ফযিলত রয়েছে, সেটা হোল-

ইমাম নাসাঈ (রহ.) আবূ উমামা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি প্রতি ফরয সালাত শেষে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছু বাধা হবে না। (সহীহ আল জামে ৬৪৬৪,  ৫/৩৩৯, সিলসিলাহ সহীহাহ্ ৯৭২)।

(থ) গীবত থেকে দূরে থাকাঃ

আবূদ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক তার কোন ভাইয়ের মান-সম্মানের উপর আঘাত প্রতিরোধ করে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা’আলা তার মুখমণ্ডল হতে জাহান্নামের আগুন প্রতিরোধ করবেন। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ১৯৩১, গাইয়াতুল মারাম ৪৩১, সহীহুল জামে ৬২৪০, মুসনাদে আহমদ ২৭৫৮৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আরো কতিপয় নির্দেশনা

জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাইলে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবেঃ

(ক) মুসলিম রাজনীতিবিদদের মানবরচিত আইন ও সংবিধান বাদ দিতে হবে।

(খ) ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে ইসলামি সংগঠন বা দল করতে হবে।

(ঘ) কুরআনকে সংবিধান বা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আইনীগ্রন্থ হিসেবে মেনে নিতে হবে।

(ঙ) রাষ্ট্রীয়ভাবে সালাত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

(চ) সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠন করতে হবে।

(ছ) মদ আমদানী, উৎপাদন, মদের লাইসেন্স প্রদান ও মদের বার বন্ধ করতে হবে।

(জ) সর্বত্র পর্দার বিধান চালু করতে হবে।

(ঝ) বিদেশী কৃষ্টি-কালচার বন্ধ করতে হবে।

(ঞ) বিচার বহির্ভুত আটক, অপহরণ, গুম ও খুন বন্ধ করতে হবে।

(ট) সকল প্রকার অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বন্ধ করতে হবে।

(ঠ) ঘুষ/দুর্নীতিমুক্ত জীবন অতিবাহিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে হালাল রিজিক ছাড়া কোনো দোয়া কবুল হয় না।

(২) জাহান্নাম হতে আল্লাহর কাছে সর্বদা আশ্রয় প্রার্থনা করা।

জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মতকে কতিপয় দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। যেসব দো‘আ নিয়মিত পাঠের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়াসমূহ

দোয়া অর্থ আহবান বা ডাকা, যা ইসলামে একটি বিশুদ্ধ মিনতি প্রক্রিয়া। এই শব্দটি এসেছে একটি আরবি শব্দ থেকে যার বাংলা অর্থ ডাকো বা তলব করো।

আল্লাহ বলেন,

“আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেবো। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে”। (সুরা আল মুমিন ৪০, আয়াত ৬০)।

রাসুল সাঃ বলেছেন:

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট দু‘আর চেয়ে কোন জিনিসের অধিক মর্যাদা (উত্তম) নেই।  (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২৩২, তিরমিযী ৩৩৭০, ইবনু মাজাহ ৩৭২৯, আহমাদ ৮৭৪৮, মু‘জামুল আওসাত ৩৭০৬, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৮০১, আদ্ দা‘ওয়াতুল কাবীর ৩, শু‘আবূল ঈমান ১০৭১, ইবনু হিববান ৮৭০, আল-আদাবুল মুফরাদ ৭১৮, সহীহ আত্ তারগীব ১৬২৯)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

দুআ দুই প্রকারঃ

(এক) দুআউল ইবাদাহ বা উপাসণামূলক দু'আ। সকল প্রকার ইবাদতকে এ অর্থে দু'আ বলা হয়।

(দুই) দুআউল মাছআলা অর্থাৎ প্রার্থনাকারী নিজের জন্য যা কল্যাণকর তা চাবে এবং যা ক্ষতিকর তা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করবে। (বাদায়ে আল-ফাওয়ায়েদ : ইবনুল কায়্যিম)।

যেমন কেউ সালাত আদায় করল। এ সালাতের মধ্যে অনেক প্রার্থনামূলক বাক্য ছিল। এগুলোই দুআউল ইবাদাহ বা উপাসণামূলক প্রার্থনা। আবার সে পরীক্ষা দেবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল হে আল্লাহ! তুমি আমার পরীক্ষা সহজ করে দাও এবং কৃতকার্য করে দাও! এটা হল দুআ আল-মাছআলা বা চাওয়া।

নেক আমল ও দু’আ ব্যতীত ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না

নেক আমল ও দো‘আর মাধ্যমে মানুষের তাকদীরের পরিবর্তন হয়। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন তা বহাল রাখেন”। (সূরা রা’দ, আয়াত  ৩৯)।

সালমান আল ফারিসী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু‘আ ছাড়া অন্য কিছুই তাকদীদের লিখনকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং নেক ‘আমল ছাড়া অন্য কিছু বয়স বাড়াতে পারে না। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২২৩৩, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২১৩৯,  সুনান ইবনু মাজাহ ৪০২২, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৬১২৮, সহীহাহ্ ১৫৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৬৩৯, সহীহ আল জামি ৭৬৮৭)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)।

আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জিনদের জন্যে পূর্ব খেকেই জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করে রেখেছেন। জাহান্নামের ভয়াবহতা কতো কঠিন তা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহ তায়ালাই নবি সাঃ কে বিভিন্ন উপায় ও দোয়া শিখে দিয়েছেন, আর নবি সাঃ সেসব দোয়া তাঁর উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাইলে “জাহান্নামে যাওয়ার যেসব কারণ” প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে সেইসব কারণ নিজের মধ্যে থাকলে তা পরিহার করতে হবে। নিম্নে জাহান্নাম থেকে মুক্তির কিছু দোয়া উল্লেখ করা হলো। এই দোয়াগুলো সালাতে তাশাহুদ বৈঠকে প্রচলিত দোয়া মাছুরা পাঠ করার পর, একাকি দুই হাত তুলে মুনাজাতে, ফরজ সালাতে সালাম ফিরানোর পর এবং সকাল বিকেল পাঠ করা যাবে।

(দোয়া নং-১):- “আল্লা-হুম্মা আদখিলনিল জান্নাতা ওয়া আজিরনী মিনান্ না-র”। (৩ বার)

অর্থঃ হে আল্লাহ তুমি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ দাও! [তিরমিযী, নাসাঈ,মিশকাত হা/২৪৭৮]

হাদিসটি নিম্নরুপঃ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহর কাছে জান্নাতের প্রত্যাশা করে; জান্নাত বলবে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও। আর যে ব্যক্তি তিনবার জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করবে; জাহান্নাম বলবে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), ২৪৭৮, সহীহ তিরমিযী ৫৫২১, নাসায়ী ৫৫২১, সহীহ ইবনু হিববান ১০৩৪, সহীহ আল জামি‘ ৬২৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দোয়া নং-২):- একদা ক্বাতাদা (রাঃ) আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রাসুল (সাঃ) কোন দোয়াটি বেশী বেশী পড়তেন। আনাস (রাঃ) বললেন, রাসুল (সাঃ) বেশী বেশী বলতেনঃ-

“আল্ল-হুম্মা আ-তিনা- ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আ-খিরতি হাসানাতাও ওয়াকিনা- ‘আযা-বান না-র”।

অর্থঃ হে আমাদের প্রভু প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোত্তম কল্যাণ দান করো এবং আগুনের আযাব হতে আমাদের রক্ষা করো। (বাক্বারাহঃ ২০১, সহীহ মুসলিম ২৬৯০, আবু দাউদ ১৫১৯)।

হাদিসঃ

যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ).....আবদুল আযীয ইবনু সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কাতাদাহ্ আনাস (রাযিঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দুআ সর্বাধিক পড়তেন? তিনি বললেন, তিনি যে দু’আ দ্বারা সর্বাধিক দু’আ করতেন তাতে বলতেনঃ

“আল্ল-হুম্মা আ-তিনা- ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আ-খিরতি হাসানাতাও ওয়াকিনা- ‘আযা-বান না-র”।

অর্থাৎ- "হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতে কল্যাণ দান কর। আর আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে বঁচিয়ে রাখো।"

রাবী বলেন, আনাস (রাযিঃ) যখনই কোন দু’আ করার সংকল্প করতেন তখন তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ন্যায়) দুআ করতেন। তারপর যখন তিনি কোন ব্যাপারে দু’আ করার সংকল্প করতেন তখন তাতে এ দু’আ পড়তেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৭৩৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৯০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৩৮৯, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫১৯, বুখার৬৩৮৯), আহমাদ ১৩৯৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫৯৬, ইসলামিক সেন্টার ৬৬৪৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দোয়া নং-৩):- “রব্বানা–ইন্নানা-আ-মান্না-ফাগফিরলানা–যুনুবানা–ওয়াক্বিনা আযা-বান না-র”।

অর্থঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ইমান এনেছি, কাজেই আমাদের গুণাহ ক্ষমা করে দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা করো। (আলে ইমরান- ১৬)।

(দোয়া নং-৪):- “আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা বি আন্না লাকাল হামদু লা ইলাহা ইল্লা আনতা ওয়াহদাকা লা শারীকা লাকাল মান্না-নু, ইয়া বাদী’আস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল-আরদী, ইয়া যালজালা-লি ওয়াল-ইকরাম। ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু, ইন্নী আস্আলুকাল জান্নাতা ওয়া আ’উযু বিকা মিনান্না-র”।

(বিঃদ্রঃ দোয়াটি সালাতে তাশাহুদ বৈঠকে তাশাহুদ, দরুদ ও দোয়া মাছুরা পাঠ করার পর পাঠ করবেন। এছাড়া দুই হাত তুলে মোনাজাতে সবকিছু বলার পর শেষে উক্ত দোয়াটি পাঠ করবেন। সালাত শেষে সালাম ফিরানোর এবং অন্য সময়েও পাঠ করা যাবে।)

অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাই, কারণ, সকল প্রশংসা আপনার, কেবলমাত্র আপনি ছাড়া আর কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আপনার কোনো শরীক নেই, সীমাহীন অনুগ্রকারী: হে আসমানসমূহ ও যমীনের অভিনব স্রস্টা! হে মহিমাময় ও মহানুভব! হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী-সর্বসত্তার ধারক! আমি আপনার কাছে জান্নাত চাই এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাই”।

হাদিসঃ

আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন, সে সময় এক লোক নামায আদায় করে দু'আ করছিল এবং সে তার দু'আয় বলছিলঃ “হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া আর কোন মা'বূদ নেই, তুমি পরম অনুগ্রহকারী, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, অসীম ক্ষমতাবান ও মহাসম্মানিত।" নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জানো আল্লাহ তা'আলার নিকট সে কিসের মাধ্যমে দুআ করেছে? সে আল্লাহ তা'আলার নিকটে তার মহান নাম এর মাধ্যমে দু'আ করেছে। যে নামে দুআ করা হলে তিনি তা কবুল করেন এবং ঐ নামের মাধ্যমে প্রার্থনা করা হলে তিনি দান করেন। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৫৪৪, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৮৫৮, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)-১৪৯৫, ১৪৯৫, আহমাদ ১১৭৯৫, ১২২০০, ১৩১৫৮, ১৩৩৮৭, রাওদুন নাদীর ১৩৩, আস-সহীহ ১৩৪২, নাসায়ী ১৩০০, ১২৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উক্ত দোয়াটির মধ্যে আল্লাহ তায়ালার মহান তিনটটি নাম আছে যাকে ইসমে আজম বলে। ‘ইসমে আজম’ হলো আল্লাহ তাআলার মহান নাম। ‘ইসমে আজম’ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাওয়া হলে মহান আল্লাহ তাআলা তা পূরণ করেন। এ মহান নামের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করলে, ডাকলে তিনি বান্দার  ডাকে সাড়া দেন।

আল্লাহর নাম নিয়ে দু‘আর ক্ষেত্রে বিশেষ একটি নাম “ইয়া যাল-জালালি ওয়াল-ইকরাম" । দু‘আর মধ্যে এই নাম বেশি বেশি বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন।

আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে কঠিন কাজ হাযির হলে তিনি বলতেনঃ “ইয়া যাল-জালালি ওয়াল-ইকরাম" “হে চিরজীবি, হে চিরস্থায়ী! আমি তোমার রহমতের ওয়াসীলায় সাহায্য প্রার্থনা করি”।

একই সনদসূত্রে আনাস (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সবসময় “ইয়া যাল-জালালি ওয়াল-ইকরাম" পাঠ করাকে অপরিহার্য করে নাও (দু‘আয় বেশি বেশি বলবে)। (সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৫২৪, ৩৫২৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৭৬, মুসনাদ আবী ইয়ালা ৬/৪৪৫, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩৫৯, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৬৯, নং ১২৫০,আল-কালিমুত তাইয়্যিব (হাঃ ১১৮/৭৬),  সিলসিলাতুস সহীহাহ ৪/৪৯-৫১, সহীহাহ (হাঃ ১৫৩৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দোয়া নং-৫):- ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এ দু‘আ শিক্ষা দিতেন যেমন তাদেরকে কুরআনের সূরাহ্ শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমরা বলো,

‘‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন ‘আযা-বি জাহান্নাম, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন ‘আযা-বিল কবরি, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ্ দাজ্জা-ল ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাহ্ইয়া- ওয়াল মামা-তি’’।

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের শাস্তি হতে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই কবরের শাস্তি হতে। তোমার নিকট আশ্রয় চাই দাজ্জালের পরীক্ষা হতে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা হতে।)।

(মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)-৯৪১, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২২০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৯০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫৪২, মুয়াত্তা মালেক ৪৯৯, নাসায়ী ২০৬৩, ৫৫১২, ৯৮৪, ১৫৪২, সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৪৯৪, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৮৪০, আহমাদ ২১৬৯, ২৩৩৮, ২৭০৪, ২৭৭৪, ২৮৩৪, , সহীহ আত্ তারগীব ৩৬৫১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ সালাতের শেষে শেষ তাশাহুদ পড়ে অবসর হয়ে যেন আল্লাহর কাছে চারটি জিনিস হতে পানাহ চায়। (১) জাহান্নামের ‘আযাব। (২) কবরের ‘আযাব। (৩) জীবন ও মৃত্যুর ফিতনাহ্ (ফিতনা)। (৪) মাসীহুদ্ দাজ্জালের অনিষ্ট। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)-৯৪০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩৭৭, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১২১১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৮৮,  সুনান ইবনু মাজাহ ৯০৯, ৯১০, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৯৮৩, নাসায়ী ১৩১০, ৫৫০৫-৬, ৫৫০৮-১১, ৫৫১৩-১৮, ৫৫২০, আহমাদ ৭১৯৬, ৭৮১০, ৭৯০৪, ৯০৯৩, ৯১৮৩, ২৭৫৯৬, ২৭৮৯০, ৯৮২৪, ২৭২৮০, দারেমী ১৩৮৩,১৩৪৪,  সহীহ আল জামি ৬৯৯, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১২০০, ইসলামীক সেন্টার ১২১১ )। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দোয়া নং-৬):- কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ).....আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাতের বেলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতে উঠতেন তখন এ বলে দু'আ করতেনঃ

"আল্ল-হুম্মা লাকাল হামদু আনতা নুরুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি ওয়ালাকাল হামদু আনতা ক্বইয়্যামুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আৱযি ওয়ালাকাল হামদু আনতা রব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরযি ওয়ামান ফীহিন্না আনতাল হাক্কু ওয়া ওয়াদুকাল হাক্কু ওয়াক্বাওলুকাল হাক্কু ওয়ালিকা-উকা হাক্কুন ওয়াল জান্নাতু হাক্কুন ওয়ান্না-রু হাক্কুন ওয়াস সা-আতু হাক্কুন, আল্লহুম্মা লাকা আসলামতু ওয়াবিকা আ-মানতু ওয়া আলায়কা তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলায়কা আনাব্তু ওয়াবিকা খাসামতু ওয়া ইলায়কা হা-কামতু ফাগফিরলী মা- ক্বদ্দাম্তু ওয়া আখখারতু ওয়া আস্রারতু ওয়া আলানতু আনতা ইলা-হী লা-ইলা-হা ইল্লা- আনতা”

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তোমার জন্যই সব প্রশংসা। তুমি আসমান ও জমিনের নূর বা আলো। তোমার জন্যই সব প্রশংসা, তুমিই আসমান ও জমিনের ব্যবস্থাপক। তোমার জন্যই সব প্রশংসা তুমিই আসমান ও জমিনের এবং এ সবের মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর প্রতিপালক। তুমিই হাক্ব বা সত্য। তোমার ওয়া’দা সত্য, তোমার সব বাণী সত্য তোমার সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য। জান্নাত সত্য, জাহান্নামও সত্য এবং কিয়ামতও সত্য। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি, তোমারই প্রতি ঈমান এনেছি, তোমার ওপরই তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করেছি, তোমার কাছেই প্রত্যাবর্তন করেছি, তোমারই জন্যে অন্যদের সাথে বিবাদ করেছি এবং তোমার কাছেই ফায়সালা চেয়েছি। তাই তুমি আমার আগের ও পরের এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে কৃত সব পাপ ক্ষমা করে দাও। একমাত্র তুমিই আমার ইলাহ। তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।)। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)  ১৬৯৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৭৬৯, ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬৭৮, ইসলামীক সেন্টার ১৬৮৫)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(দোয়া নং-৭):- “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিন ফিতনাতিন্নারি অআযাবিন্নারি অমিন শার্রিল গিনা ওয়াল ফাক্ব।“

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের ফিতনা থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে এবং ধনবত্তা ও দারিদ্রের মন্দ থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

হাদিসঃ-

‘আয়িশাহ্ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাক্যগুলো দিয়ে দু‘আ করতেনঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের পরীক্ষা, আগুনের আযাব এবং প্রাচুর্য ও দারিদ্রের মধ্যে নিহিত অকল্যাণ হতে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।’’ (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ১৫৪৩,   সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৩৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

(দোয়া নং-৮):-  “আল্লা-হুম্মা ‘আ-ফিনী ফী বাদানী, আল্লা-হুম্মা ‘আ-ফিনী ফী সাম্‘ঈ আল্লা-হুম্মা ‘আ-ফিনী ফী বাসারী। লা ইলা-হা ইল্লা আনতা। আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘উযু বিকা মিনাল কুফরি ওয়াল-ফাক্বরি ওয়া আ‘উযু বিকা মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরি, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা”। (৩ বার)।

অর্থঃ “হে আল্লাহ! আমাকে নিরাপত্তা দিন আমার শরীরে। হে আল্লাহ! আমাকে নিরাপত্তা দিন আমার শ্রবণশক্তিতে। হে আল্লাহ! আমাকে নিরাপত্তা দিন আমার দৃষ্টিশক্তিতে। আপনি ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কুফরি ও দারিদ্র্য থেকে। আর আমি আপনার আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে। আপনি ছাড়া আর কোনো হক্ব ইলাহ নেই।” (আবূ দাউদ ৪/৩২৪, নং ৫০৯২; আহমাদ ৫/৪২, নং ২০৪৩০; নাসাঈ, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ, নং ২২; ইবনুস সুন্নী, নং ৬৯; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, নং ৭০১। আর শাইখ আল্লামা ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ ‘তুহফাতুল আখইয়ার’ গ্রন্থের পৃ. ২৬ এ এর সনদকে হাসান বলেছেন)।

(দোয়া নং-৯):- “আসবাহ্না ওয়া আসবাহাল মুলকু লিল্লাহি ওয়ালহাম্দু লিল্লাহি, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর। রব্বি আস্আলুকা খাইরা মা ফী হা-যাল ইয়াউমি ওয়া খাইরা মা বা‘দাহু, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন শাররি মা ফী হা-যাল ইয়াউমি ওয়া শাররি মা বা‘দাহু। রব্বি আঊযু বিকা মিনাল কাসালি ওয়া সূইল-কিবারি। রবিব আ‘ঊযু বিকা মিন ‘আযাবিন ফিন্না-রি ওয়া আযাবিন্ ফিল ক্বাবরি”।

অর্থঃ “আমরা সকালে উপনীত হয়েছি, অনুরূপ যাবতীয় রাজত্বও সকালে উপনীত হয়েছে, আল্লাহ্র জন্য। সমুদয় প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

হে রব্ব! এই দিনের মাঝে এবং এর পরে যা কিছু কল্যাণ আছে আমি আপনার নিকট তা প্রার্থনা করি। আর এই দিনের মাঝে এবং এর পরে যা কিছু অকল্যাণ আছে, তা থেকে আমি আপনার আশ্রয় চাই।

হে রব্ব! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই অলসতা ও খারাপ বার্ধক্য থেকে। হে রব্ব! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামে আযাব হওয়া থেকে এবং কবরে আযাব হওয়া থেকে।”

হাদিসঃ

কুতাইবাহ্ ইবনু সাঈদ (রহঃ).....আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন সন্ধ্যা হত তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ “আম্‌সাইনা- ওয়া আম্‌সাল মুল্‌কু লিল্লা-হি ওয়াল হাম্‌দু লিল্লা-হি লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু”, অর্থাৎ- “আমরা সন্ধ্যায় উপনীত হয়েছি এবং আল্লাহর রাজ্যও, প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, তিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি একক সত্তা, তার কোন শারীক নেই।”

হাসান (রহঃ) বলেন, আমাকে যুবায়দ (রহঃ) হাদীস বর্ণনা করেন যে, তিনি ইবরাহীম (রহঃ) হতে এ দু’আটি মুখস্থ করেছেনঃ

“লাহুল মুল্কু ওয়ালাহুল হাম্দু ওয়াহুয়া আলা- কুল্লি শাইয়িন কদীর, আল্ল-হুম্মা আসআলুকা খইরা হা-যিহিল লাইলাতি ওয়া আউযুবিকা মিন্ শাররি হা-যিহিল লাইলাতি ওয়া শাররি মা-বাদাহা আল্ল-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল কাসালি ওয়া সূয়িল কিবারি, আল্ল-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন আযা-বিন ফিন্না-রি ওয়া আযা-বিন ফিল কবরি।”

অর্থাৎ, “রাজত্ব তার মালিকানাধীন, সকল প্রশংসা তারই, তিনিই সকল কিছুর উপর ক্ষমতবান। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এ রাতের কল্যাণ প্রত্যাশা করি এবং আশ্রয় চাই এ রাতের খারাবী হতে এবং এর পরবর্তী রাতের অনিষ্ট থেকেও। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই অলসতা থেকে ও অহংকারের খারাবী থেকে। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই জাহান্নামের শাস্তি থেকে এবং কবরের শাস্তি থেকে।" (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৮০০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৬৫৯, ইসলামিক সেন্টার ৬৭১২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। মানুষের উচিত তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তাঁর নিকটেই মনের আকুলি-বিকুলি প্রকাশ করা। যারা আল্লাহর নিকটে নিজেকে সঁপে দিয়ে দুনিয়াবী জীবন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী পরিচালনা করবে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য অনন্য ও চিরন্তন নেয়ামত সমৃদ্ধ জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে যারা তাঁর আনুগত্য ও রাসূলের ভালবাসার নামে বিভিন্ন মাযহাব, মতবাদ বা ইযমের অন্ধ অনুসরণ করে থাকে এবং যঈফ ও জাল হাদীছ ভিত্তিক আমল করে তাদের জন্য মহান আল্লাহ জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা তৈরী করে রেখেছেন। তাই আসুন সকল পথ মত পরিহার করে একমাত্র রাসুল সাঃ এর তরীকায় জীবন অতিবাহিত করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, বিবিসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

.................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...