Sunday, March 29, 2020

ইসলামি জিজ্ঞাসা ও সহিহ জবাব (পর্ব-৪)


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ইসলামি জিজ্ঞাসা ও সহিহ জবাব
(পর্ব-৪)
 
প্রশ্নোত্তর
পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে জান্নাতে প্রবেশ করবে?
(১৩৬) প্রশ্ন: পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে জান্নাতে প্রবেশ করবে?
উত্তর:
বহু সংখ্যক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, পুরুষদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। যেমন:
  আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتفْتِحُ، فَيَقُولُ الْخَازِنُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُولُ: مُحَمَّدٌ، فَيَقُولُ: بِكَ أُمِرْتُ لَا أَفْتَحُ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ »
“কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় দিয়ে দরজা খোলার অনুমতি চাইলে জান্নাতের রক্ষক বলবে, কে আপনি?
আমি বলব: মুহাম্মদ।
তিনি বলবেন: আপনার জন্যই দরজা খোলার অনুমতি আছে। আপনার পূর্বে কারও জন্য দরজা খোলার অনুমতি নাই।” (মুসলিম, হাদিস নং ১৯৮)
  অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“আমি কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করব।” [সহিহ জামে তিরমিযী ও মাজমাউয যাওয়ায়েদ। শাইখ আলবানী বলেন: سنده جيد، رجاله رجال الشيخين এর সনদটি ভালো। আর বর্ণনাকারীগণ সবাই বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনাকারী (সহীহাহ ১০০/৪)]
এ মর্মে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ বলেন, মহিলাদের মধ্যে কে সর্বপ্রথম প্রবেশ করবেন সে ব্যাপারে সহিহ হাদিস পাওয়া যায় না।
অবশ্য মুসতাদরাকে হাকিমে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “মহিলাদের মধ্যে ফাতিমা রা. সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন।” কিন্তু ইমাম যাহাবী এ হাদিসের সমালোচনা করে বলেন, এ বর্ণনাটি (সনদের দিক দিয়ে) মুনকার (অত্যন্ত দুর্বল)।
বিধায় দলিল হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তাই বলব, যেহেতু বিষয়টি ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু বিশুদ্ধ হাদিসের প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। আল্লাহু আলাম-এ বিষয়ে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
(১৩৭) ইকামতে দ্বীন (দ্বীন প্রতিষ্ঠা) এর প্রকৃত অর্থ এবং একটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যার অপনোদনঃ
বর্তমানে আমাদের সমাজে ‘দ্বীন কায়েম’ প্রসঙ্গে যথেষ্ট বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিধায় বিষয়টি স্পষ্ট করা আবশ্যক মনে করছি।
তাই প্রথমে আমরা দ্বীন কায়েম প্রসঙ্গে কুরআনের ব্যাপক আলোচিত একটি আয়াত পেশ করে যুগে যুগে মুফাসসিরগণ তার কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা তুলে ধরব। তারপর দ্বীন কায়েম মানে কি ইসলামী হুকুমত (ইসলামী রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠা না কি অন্য কিছু এবং কিভাবে প্রকৃত দ্বীন কায়েম করা সম্ভব তা সংক্ষেপে উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
وما توفيقى إلا بالله
  ইকামতে দ্বীন (দ্বীন প্রতিষ্ঠা) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না।” (সূরা শুরা: ১৩)
উপরোক্ত আয়াতে ’‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
উপরোক্ত আয়াতে ‘দ্বীন কায়েম’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা মুফাসিরগণের বক্তব্যের আলোকে তুলে ধরা হল:
  ১. জগদ্বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন:
أن أقيموا الدين وهو توحيد الله وطاعته ، والإيمان برسله وكتبه وبيوم الجزاء ، وبسائر ما يكون الرجل بإقامته مسلما
‘দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করা’র অর্থ হল: “আল্লাহর তাওহীদ ও আনুগত্য করা, নবী-রাসূল ও প্রতিদান দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং মুসলিম হিসেবে যা কিছু কর্তব্য সেগুলো বাস্তবায়ন করা।” (তাফসির কুরতুবী, সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতের তাফসীর)
  ২. তাফসির শাস্ত্রের আরেক দিকপাল ইমাম ত্বাবারী রহ. বলেন:
أن اعملوا به على ما شرع لكم وفرض
“দ্বীন কায়েম করো” অর্থ: তোমাদের জন্য যা শরিয়ত সম্মত ও ফরয করা হয়েছে তদনুযায়ী আমল করো।” (তাফসীরে ত্বাবারী, সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতের তাফসীর)
  ৩. সর্বজন স্বীকৃত তাফসীরে ইবনে কাসীর রহ. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
الدين الذي جاءت به الرسل كلهم هو : عبادة الله وحده لا شريك له ، كما قال : ( وما أرسلنا من قبلك من رسول إلا نوحي إليه أنه لا إله إلا أنا فاعبدون ) [ الأنبياء : 25 ] . وفي الحديث : ” نحن معشر الأنبياء أولاد علات ديننا واحدأي : القدر المشترك بينهم هو عبادة الله وحده لا شريك له ، وإن اختلفت شرائعهم ومناهجهم
“সকল নবী-রাসূল যে দ্বীন নিয়ে আগমন করেছিলেন তা হল, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
“আপনার পূর্বে আমি যে রসুলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো।” (সূরা আম্বিয়া: ২৫)
আর হাদিসেও বর্ণিত হয়েছে:
نحن معشر الأنبياء أولاد علات ديننا واحد
‘আমরা নবীরা হলাম বৈমাত্রেয় ভাইস্বরূপ। আমাদের সকলের দ্বীন একটাই।’’ (সহীহ বুখারী) অর্থাৎ যুগে যুগে সকল নবী-রসুলের মধ্যে যে বিষয়টি এক ও অভিন্ন ছিল তা হল, লা শারিক এক আল্লাহর ইবাদত করা-যদিও তাদের শরিয়ত ও পদ্ধতিগত বিষয়ে ভিন্নতা ছিল।”(তাফসিরে ইবনে কাসির,শুরা শুরা এর ১৩ নং আয়াতের তাফসির)
  ৪. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাফসীর তাফসীরে বিন সা’দিতে বলা হয়েছে:
أمركم أن تقيموا جميع شرائع الدين أصوله وفروعه، تقيمونه بأنفسكم، وتجتهدون في إقامته على غيركم، وتعاونون على البر والتقوى ولا تعاونون على الإثم والعدوان
” তিনি আদেশ করেছেন যে,তোমরা দ্বীনের মূল ও শাখা গত বিষয়গুলো নিজেরা বাস্তবায়ন করবে এবং অন্যদের উপর বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। তোমরা নেকি ও আল্লাহ ভীরুতার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে না।” [তাইসীরিল কারীমির রাহমান ফী তাফসীরে কালামিল মান্নান (তাফসীরে বিন সাদী নামে সুপরিচিত) লেখক: আব্দুর রহমান বিন নাসের আস সাদী রহ.]
এ ছাড়া বিখ্যাত হাদিসে জিবরিল এ ইসলাম ও তার ৫টি রোকন, ঈমান ও তার ৬টি রোকন এবং ইহসানকে ‘দ্বীন’ বলা হয়েছে। (উমর ইবনুল খাত্তাব রা., আবু হুরায়রা রা. প্রমূখ হতে সহিহ বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদিস)
সুতরাং একজন মানুষ যদি ইসলাম ও ঈমানের রোকনগুলো বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি ইহসান পর্যায়ে উপনিত হতে পারে তাহলে এর চেয়ে বড় দ্বীন কায়েম আর কী হতে পারে?
মোটকথা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বলতে বুঝায়, তাওহীদ বা একাত্মবাদ বাস্তবায়ন করা তথা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার এবাদত করা এবং তার বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধগুলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে চলা।
সুতরাং শরিয়তের ছোট-বড় সকল প্রকার কাজই দ্বীন কায়েমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন:
 তাওহিদের আলোকে ঈমান-আকিদা ঢেলে সাজানো।
 সুন্নাহর আলোকে আমল-আখলাক পরিশুদ্ধ করা।
 শিরক এবং বিদআত থেকে দূরে থাকা এবং মানুষকে এগুলো থেকে সতর্কতা করা।
 সকল প্রকার ইবাদত তথা নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি সঠিক নিয়মে বাস্তবায়ন করা।
 সকল ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলা।
 হালাল পন্থায় আয়-উপার্জন করা এবং হারাম সম্পদ থেকে দূরে থাকা।
 পুরুষদের দাড়ি রাখা, টাখনুর উপর কাপড় পরা, মহিলাদের পর্দা করা ইত্যাদি।
 নিজে দ্বীন পালনের পাশাপাশি স্ত্রী-পরিবার কে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালনা করা্।
 মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া।
 দ্বীন শিক্ষা করা এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়া।
 আল্লাহ বিধান অনুযায়ী বিচার কার্য ও রাষ্ট্রপরিচালনা করা ইত্যাদি। মোটকথা, জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া শরিয়তের বিধিবিধানগুলো বাস্তবায়ন করাটাই ইকামতে দ্বীন।
ইকামতে দ্বীন কি কেবল ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা?
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি বিশেষ মতবাদ হল, ইকামতে দ্বীন মানে কেবল ইসলামী হুকুমত (রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠা করা। আর নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি হল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রেনিং মাত্র। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে ‘ইকামতে দ্বীন’ হল না। এদের মতে, “সব ফরজের বড় ফরজ দ্বীন কায়েম তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।” আর নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, হালাল, হারাম ইত্যাদি ইসলামের অন্যান্য বিধিবিধান এর চেয়ে কম মর্যাদার-সবই এর চেয়ে নিম্নস্তরের। যার কারণে এ মতবাদে বিশ্বাসী লোকদেরকে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতা গ্রহণের জন্য যতটা চেষ্টা-পরিশ্রম করতে এবং যত বেশি উদগ্রীব দেখা যায় তাওহীদ শিক্ষা, সুন্নাহর প্রতি আমল, আকিদার পরিশুদ্ধতা, শিরক ও বিদআত বর্জন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণে সালাত, সিয়াম, হজ্জ ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ ও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
আমরা বলব, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ  করা নি:সন্দেহে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নাই। কিন্তু শুধু এই একটি বিষয়ের মধ্যে দ্বীন কায়েমকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া নিতান্ত বিভ্রান্তি মূলক এবং কুরআনের অপব্যাখ্যা-যেমনটি  ইতোপূর্বে উল্লেখিত তাফসীর কারকদের তাফসীর থেকে প্রতিয়মান হয়েছে।
কিভাবে সম্ভব দ্বীন কায়েম করা?
দ্বীন কায়েম সম্ভব একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকায়। এর বিকল্প কোনো থিওরি ও মতাদর্শ দ্বারা সম্ভব নয়।
যাহোক, এ ক্ষেত্রে তাঁর তরিকা ছিল, প্রথমত: আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওহীদের আলোকে মানুষের চিন্তার জগতকে পরিবর্তন করা এবং শিরকি ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করা। তাই তো তিনি মক্কী জীবনের ১৩টি বছর কেবল কালিমাতুত তাওহীদ তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর বাণীকে জনে জনে মানুষের কর্ণ কুহুরে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কারণ মানুষের মনে এই আকীদা-বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া ব্যতিরেকে কখনই প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি ইসলামের অন্যান্য বিধিবিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন।
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব ছিল, তাওহীদ তথা এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে আহ্বান করা এবং তাগুত থেকে মানুষকে সতর্ক করা। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّـهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ۖ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুতকে বর্জন করো।” (সূরা আন নহল: ৩৬)
আল্লাহ ছাড়া যত কিছুর ইবাদত করা হয় তাকেই তাগুত বলা হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রখ্যাত সাহাবী মুআয বিন জাবাল রা.কে ইয়েমেনে প্রেরণের সময় তিনি সর্বপ্রথম তাওহীদ দ্বারা দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তারপর পর্যায়ক্রমে সালাত, সাওম, যাকাত ইত্যাদি দ্বীনের বিধিবিধানের দিকে আহ্বান করতে বলেছেন।
এই তাওহীদের জ্ঞানার্জন করাই প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের উপর সর্বপ্রথম ও সর্ব বৃহৎ ফরজ। এর চেয়ে বড় ফরজ অন্য কিছু নেই।
  অত:এব, আলেম-উলামা, দাঈ, প্রচারক, লেখক, গবেষক, সংগঠক সকলের উপর অপরিহার্য দায়িত্ব হল, তাওহীদ ও বিশুদ্ধ আকীদা প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করা। তাওহীদকে সব কিছুর আগে অগ্রাধিকার দেয়া; এর পরে অন্য কিছু। কেননা শিরকের পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খাওয়া জাতির মননকে তাওহীদের আলোকে আলোকিত করা ছাড়া কখনোই প্রকৃত দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যখন মানুষ তার তিন হাত শরীরের মধ্যে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম হবে তখন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবে। আর তাওহীদ বাদ দিয়ে যত কিছু করা হোক না কেন তা হবে প্রাসাদ তৈরির জন্য মূল ফাউন্ডেশন শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা না করে ঘরের দরজা-জানালা ও ডেকোরেশনের কাজে সময় নষ্ট করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বুজ দান করতঃ তদনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন। আল্লাহু আলাম।
বাংলাদেশও ভারতের মুসলিমগণ আরাফাত দিবসের রোযা কোন দিন রাখবে?
(১৩৮) প্রশ্ন: বাংলাদেশও ভারতের মুসলিমগণ আরাফাত দিবসের রোযা কোন দিন রাখবে? সৌদি আরবের সাথে কি মিল রেখে রাখবে না কি দেশের চাঁদের হিসেবে রাখবে?
উত্তর:
আরাফা দিবসে একটি রোযার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা পেছনের ও সামনের দু বছরের গুনাহ মোচন করে দেন। আল হামদুলিল্লাহ।
এ মর্মে হাদীস হল:
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالَّتِي بَعْدَهُ
আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমি আল্লাহর নিকট আরাফাত দিবসের রোযার এই সওয়াব আশা করি যে, তিনি তাঁর বিনিময়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।” (সহীহ ইবনে মাজাহ হা/১৭৩০)
এ দিন হাজী সাহেবগণ আরাফার ময়দানে অধিক পরিমানে দুআ, তাসবীহ ও আল্লাহর ইবাদতে সময় অতিবাহিত করবেন আর বিশ্বমুসলিমগণ সে দিন রোযা অবস্থায় অতিবাহিত করবেন। এ দিন আল্লাহ তাআলা নিচের আসমানে অবতণ করে অসংখ্য হাজীকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত ঘোষণা করবেন।
আরাফা দিবস কোনটি?
অধিকাংশ আলেমের বক্তব্য হলো, যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ যে দিন হাজী সাহেবগণ আরাফার ময়দানে উপস্থিত থাকবেন সে দিনটি আরাফার দিন। সুতরাং এই দিনটিতে রোজা থাকতে হবে।
তবে কোন কোন আলেম (যেমন: আল্লামা মোহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন রহঃ) বলেন, সৌদি আরব এবং পার্শবর্তী অঞ্চলের মুসলিমগণ যাদের চাঁদের উদায়চল অভিন্ন তারা তাদের হিসেবে ৯ জিলহজে রোযা থাকবে। আর যে সব দেশের চাঁদের উদয়াচল ভিন্ন তারা তাদের দেশের চাঁদের হিসেবে ৯ যিলহজ্জ এ রোযা থাকবে। কারণ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ আর চাঁদ দেখে রোযা ছাড়ো।”
অর্থাৎ রোযা রাখার বিষয়টি চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত। এ বিধান রামাযান শুরু ও শেষ, আরাফা, আশুরা এবং অন্যান্য সকল রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এই হিসেবে এ বছর (২০১৯) সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমগণ ১০ আগস্ট, শনিবার রোজা থাকবে
আর বাংলাদেশ-ভারত ও তৎসংলগ্ন দেশে সমূহে তার এক দিন পর ১১ আগস্ট রবিবার রোজা থাকবে।
তবে মতবিরোধ থেকে বাঁচার স্বার্থে সৌদি আরবের ৯ তারিখ এবং বাংলাদেশ, ভারত এবং তৎসংলগ্ন এলাকার ৯ তারিখ (১০ ও ১১ আগস্ট, ২০১৯) এই দুইদিন রোজা রাখা হলে আশা করা যায়, নিশ্চিতভাবে এই মর্যাদা লাভ করা সম্ভব হবে।
অবশ্য কেউ যদি সৌদি আরবের হিসেবে ৯ জিলহজে কেবল একটি রোযা থাকে অথবা কেউ যদি দেশের তারিখের হিসেবে এক দিন পরে একটি রোযা রাখে তাহলে উভয়েই ইনশাআল্লাহ এই সওয়াব পাবেন। তবে উভয় দিন রোযা থাকা অধিক উত্তম এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
(১৩৯) কুরবানী সম্পর্কে ১২টি যঈফ হাদীস
লেখক: শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
কুরবানীর গুরুত্ব, ফযীলত এবং তৎ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীছগুলোর অবস্থা:
নিঃসন্দেহে কুরবানী একটি ইবাদত এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কারা যায়। এবং তাতে ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত আদায় করা হয়। সেই সাথে আমাদের প্রিয় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতও প্রতিপালিত হয়। কারণ, এ কুরবানী স্বয়ং নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিয়েছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
من كان به سعة ولم يضح فلا يقربن مصلانا
“কুরবানী দেয়ার সমর্থ থাকার পরও যে ব্যক্তি কুরবানী দেয় না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে।” (আহমাদ, ইবনু মাজাহ্)
তবে এটিকে অনেক মুহাদ্দিস মাওকুফ বা সাহাবীর উক্তি বলেছেন। অবশ্য মুহাদ্দিস আলবানী হাদীছটিকে মারফু তথা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী হিসাবে হাসান বলেছেন। (দ্রঃ ছহীহ ইবনু মাজাহ) হাফেজ ইবনু হাজার হাদীছটি সম্পর্কে বলেন, “কুরবানী করার ফযীলতে অনেকগুলি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর একটিও বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়নি। বরং তার সবগুলোই যঈফ (দুর্বল) অথবা মউযূ (জাল)। মালিকী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন:
ليس في فضل الأضحية حديث صحيح وقد روى الناس فيها عجائب لم تصح منها((إنها مطاياكم إلى الجنة)) -عارضة الأحوذي شرح جامع الترمذي (6/288)
“কুরবানীর ফযীলতে একটিও ছহীহ হাদীছ নেই। তবে মানুষ এ সম্পর্কে অনেক আজগুবী হাদীছ বর্ণনা করেছে যা মোটেও ছহীহ নয়। সে সব আজগুবী হাদীসের মধ্যে অন্যতম হল এই কথাটি:
(( إنها مطاياكم إلى الجنة))
“উহা তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন স্বরূপ”। (দ্রঃ তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ আরেযাতুল আহওয়াযী ৬/২৮৮)
  নিম্নে কুরবানীর ফযীলত সংক্রান্ত হাদীছগুলো পর্যালোচনা সহ পরিবেশিত হল:
  ১নং হাদীছঃ
عَنْ عَائِشَةَ ، أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلًا ، أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ ، وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا ، وَأَظْلَافِهَا ، وَأَشْعَارِهَا ، وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا
(أخرجه ابن ماجة برقم ৩১২৬ والترمذي برقم ১৪৯৩ والحاكم (৪/ ২২১-২২২ وانظر فقه الأضحية)
“আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী বলেন, “কুরবানীর দিনে কোন আদম সন্তান কুরবানীর পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল করে না। সে কিয়ামত দিবসে উক্ত পশুর শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার খুন জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কুরবানীকর।” (ইবনু মাজাহ, হা/৩১২৬, তিরমিযী, হা/১৪৯৩, হাকেম৪ /২২১-২২২ দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ)
  মন্তব্য: হাদীছটি যঈফ। কারণ, হাদীছটির সনদে কয়েকটি দোষ আছে:
১) উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুল্লাহ বিন নাফে নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার স্মৃতি শক্তিতে দুর্বলতা ছিল।
২) হাদীসটির সনদে আবুল মুসান্না নামক আরেকজন রাবী রয়েছে তার আসল নাম হল সুলাইমান বিন ইয়াজিদ। তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও বাজে। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যা)
৩) উক্ত হাদীছের প্রায় অনুরূপ হাদীছ ইমাম আব্দুর বাযযাক তার মুছান্নাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। (হা/৮১৬৭) উক্ত হাদীসটির সনদেও আবু সাঈদ শামী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে তিনি একজন ‘পরিত্যক্ত’ রাবী। (দ্রঃ প্রাগুক্ত)
  ২নং হাদীছঃ
عن زيد بن أرقم قال قال أصحاب رسول الله: يارسول الله ماهذه الأضاحي؟ قال: سنة أبيكم إبراهيم قالوا: فما لنا فيها؟ قال: بكل شعرة حسنة، قالوا: فالصوف يارسول الله؟! قال بكل شعرة من الصوف حسنة
“যায়েদবিন আরকাম (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানীর পশুগুলির তাৎপর্য কি? (কেন আমরা এগুলো যবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন: “ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী সওয়াব রয়েছে? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, পশমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে ওগুলোরও কি বিনিময় তাই? নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ছোট ছোট প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” (ইবনু মাজাহ্, হা/৩১২৭, আহমাদ (৪/৩৬৮), ইবনু হিব্বান ফিল মাজরুহীন (৩/৫৫))
  মন্তব্য: হাদীছটি যঈফ। কারণ, এ হাদীসটির সনদে আবু দাউদ আল আম্মী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার প্রকৃত নাম হল, নুফাই ইবনুল হারিস। সে মুহাদ্দিসগণের নিকট ‘পরিত্যক্ত’ রাবী। এতে আরও একজন রাবী রয়েছে তার নাম হল আয়েযুল্লাহ, সে ‘যঈফ’ রাবী।
  ৩নং হাদীছঃ
عن أبي سعيد الخدري قال قال رسوالله صلى الله عليه وسلم لفاطمة عليها الصلاة والسلام!)) قومي إلى أضحيتك فاشهديها فإن لك بأول قطرة تقطر من دمها يغفر لك ماسلف من ذنوب((، قالت: يارسول الله! هذا لنا أهل البيت خاصة أو لنا وللمسلمين عامة؟ قال:))لنا وللمسلمين عامة(( ( رواه الحاكم ৪/২২২ والبزار ২/ ৫৯ مع كشف الأستار )
আবু সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমা (রা:) কে বললেন, “(হে ফাতেমা!) তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকট (যবেহ কালীন) দাঁড়াও এবং উপস্থিত থাক। কারণ তার প্রথম ফোটা খুন (জমিনে) পড়ার সাথে সাথে তোমার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।” ফাতেমা (রা:) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি আমরা আহলুল বায়ত তথা নবী পরিবারের জন্যই খাস নাকি তা আমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য।” (হাকেম ৪/২২২) বাযযার ২/৫৯ কাশফুল আসতার)
  মন্তব্য: হাদীছটি যঈফ। কারণ, এর সনদে আব্দুল হামীদ নামে একজন রাবী রয়েছে যে যঈফ। আরেকটি কারণ হল, এর সনদে আতিয়া আল আওফী নামে আরেকজন রাবী রয়েছে সেও যঈফ এবং মুদাল্লিস। আবু হাতিম তার ইলাল (علل) গ্রন্থে (হা/৩৮) বলেন, “এটি একটি ‘মুনকার’ হাদীছ।” (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ ১০)
  ৪নং হাদীছঃ
عن علي رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لفاطمة: يا فاطمة فاشهدي أضحيتك أما إن لك بأول قطرة من دمها مغفرة لكل ذنب أما إنه يجاء بها يوم القيامة بلحومها ودمائها سبعين ضعفا حتى توضع في ميزانك
আলী (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: “হে ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকট জবেহ করার সময় উপস্থিত থাকিও। জেনে রেখ, ঐ পশুর রক্তের প্রথম ফোটা (মাটিতে) পড়ার সাথে সাথে তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। জেনে রেখ! কিয়ামত দিবসে কুরবানীর ঐ পশুগুলোকে রক্ত, মাংস সহ সত্তরগুণ বৃদ্ধি করে নিয়ে আসা হবে এবং তোমার দাঁড়িপাল্লায় তা রাখা হবে।” (বাইহাকী (৯/২৮৩) আবদুবনু হুমাইদ (৭/৮)
 মন্তব্য: এ হাদীছের সনদে আমর বিন খালিদ ওয়াসেতী রয়েছে সে একজন ‘পরিত্যক্ত’ রাবী। অনুরূপ হাদীছ ইমাম আব্দুর রাযযাক যুহরী হতে ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটির সনদে আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার নামক একজন রাবী রয়েছে, তিনিও অত্যন্ত যঈফ। অনুরূপ হাদীছ ইমরান বিন হুসাইন হতে বায়হাকী (৯/২৮৩), হাকিম (৪/২২২) এবং তাবারানী (১৮/২৩৯) প্রমুখগণ তাদের স্ব স্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন)। উক্ত হাদিছটিকে ইমাম তায়ালিসী (মুসনাদ তায়ালিসী, হা/২৫৩০) ও ইবনু আদী (৭/২৪৯২) বর্ণনা করেছেন। তবে তার সনদেও দুজন যঈফ রাবী রয়েছে তারা হলেন, নাযর বিন ইসমাইল এবং আবু হামযাহ্ শেমালী। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহ্)
  ৫ নং হাদীছঃ
عن على عن النبي صلى الله عليه وسلم : ))ياأيها الناس ضحوا واحتسبوا بدمائها وإن الدم وإن وقع في الأرض فإنه يقع في حرز الله عزو جل(( رواه الطيالسي برقم ৮৩১৫ ،والطبراني في الأوسط وفيه موسى بن زكريا وعمرو بن الحصين العقيلي وهما متروكان ، انظر: فقه الأضحية ومجمع الزوائد ৪/১৭)
আলী (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন, (তিনি বলেন) “হে মানব মণ্ডলী! তোমরা কুরবানী কর এবং তার খুনকে সওয়াব লাভের মাধ্যম মনে কর। নিশ্চয়ই কুরবানীর পশুর খুন জমিনে পতিত হলে তা আল্লাহর হেফাজতে চলে যায়।” [আবু দাউদ তায়ালেসী (হা ৮৩১৫)।]
 মন্তব্য: হাদীসটির সনদে মুসা বিন যাকারিযা এবং আমর ইবনুল হুসাইন রয়েছে। তারা উভয়ে ‘পরিত্যক্ত’ রাবী।
  ৬ নং হাদীছ:
عن عبد الله ابن عباس رضى الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ماأنفقت الورق في شيئ أحب إلى الله من نحر ينحر يوم عيد (رواه الطبراني(১১/১৭) والدارقطني )৪/২৮২( والشجري في الأمالي )২/৭৯-৮০( وفي إسناده إبراهيم بن يزيد الخوزي وهو متروك ، انظر: فقه الأضحي)
“আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “চাঁদি (টাকা-পয়সা) যেসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয় তার মধ্যে আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয় হল কুরবানী যা ঈদের দিনে যবেহ করা (তাবারানী ১১/১৭) দারাকুতনী ৪/২৮২ প্রভৃতি।
  মন্তব্য: উক্ত হাদীসটি যঈফ। কারণ হাদীসটির সনদে ইবরাহীম বিন ইয়াজিদ আল খোযী নামক একজন পরিত্যক্ত রাবী রয়েছে।
  ৭নং হাদীছ:
عن الحسين بن علي قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((من ضحى طيبة بها نفسه محتسبا لأضحيته كانت له حجابا من النار ( رواه الطبراني ৩/ ৮৪، وفي إسناده : أبو داود النخعي (سليمان بن عمرو وهو كذاب
হুসাইন ইবনু আলী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি কুরবানীর পশুকে খুশী মনে ও নেকীর আশায় যবেহ করবে তার এই কুরবানীর পশু জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্দা বা অন্তরায় হয়ে যাবে।”
  মন্তব্য: এটি একটি মওযূ বা জাল হাদীস। এর সনদে আবু দাউদ নাখঈ (যার প্রকৃত নাম সুলাইমান বিন আমর) নামক একজন মহা মিথ্যুক রাবী রয়েছে।
  ৮নং হাদীছঃ
عن عبدالله بن عباس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (( في يوم أضحى ))ماعمل ابن آدم في هذا اليوم أفضل من دم يهراق في سبيل الله إلا أن يكون رحما مقطوعة توصل(( (رواه الطبراني ১১)/ وفي إسناده الحسن بن يحى الخشني وهو صدوق كثير الغلط وفيه ليث ابن أبي سليم وإسماعيل بن عياش وكلاهما ضعيف، انظر: فقه الأضحية
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানীর দিন বললেন, “কোন অদম সন্তান এই দিনে (কুরবানীর) খুন প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক সৎ আমল করে না। তবে ছিন্ন আত্মীয়তা সম্পর্ককে আবার অবিচ্ছিন্ন করার কথা ভিন্ন। (তাবারানী ১১/৩২)
  মন্তব্য: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে হাসান বিন ইয়াহয়া আল খোশানী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তিনি সত্যবাদী তবে প্রচুর ভুল করতেন। আরেকজন বর্ণনাকারী রয়েছে তার নাম লাইস বিন আবী সুলাইম তিনিও একজন যঈফ রাবী। এতে ইসমাইল বিন আয়্যাশ নামক অপর এক জন রাবী রয়েছে। তিনি যখন তিনি শামবাসী ছাড়া অন্য এলাকার মুহাদ্দিস গনের নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করবেন তখন তার হাদীস যঈফ বলে বিবেচিত হবে। আর এখানে তিনি শামবাসী ছাড়া অন্যদের থেকে হাদীসটি বর্ণনা করায় তা যঈফের অন্তর্ভুক্ত।
অনুরূপ হাদীছ ইবনু আব্দুল বার তার ইস্তেযকার (৫/১৬৪) ও তামহীদ (২৩/১৯২) গ্রন্থে ইবনু আব্বাসের সূত্রে বর্ণনা করে সেটাকে ‘গারীব’ হাদীছ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটির সনদে সাঈদ বিন যায়দ নামক যঈফ বারী রয়েছে। তিনি ইমাম মালিক (রহঃ) হতে মুনকার বা অগ্রহণীয় অনেক কিছু বর্ণনা করতেন। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ ১১)
  ৯ নং হাদীছঃ
عن أبي هريرة عن النبي قال: استفرهوا ضحاياكم فإنها مطاياكم على الصراطرواه الديلمي في مسند الفردوس )১/৮৫( وهوحديث ضعيف جدا ، انظر : فقه الأضحية )
আবু হুরাইরা (রা:) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের কুরবানীর পশুগুলো শক্তিশালী ও মোটা-তাজা দেখে নির্বাচন কর। কারণ এগুলো তোমাদের পুলসিরাতের উপর চড়ে যাওয়ার বাহন হবে।” (দাইলামী-মুসনাদুল ফিরদাউস ১/৮৫)
  মন্তব্য: হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ। হাফেয ইবনু হাজার তালখীছুল হাবীর গ্রন্থে (৪/১৩৮) বলেন: “হাদীছটি মুসনাদুল ফিরদাউস গ্রন্থের গ্রন্থকার ইবনুল মুবারক এর সূত্রে ইয়াহয়্যা বিন ওবায়দুল্লাহ্ বিন মাওহাব বর্ণনা করেছেন তার পিতা থেকে। তিনি আবু হোরায়রা হতে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেছেন …..। তবে সনদে বর্ণিত ইয়াহয়্যা অত্যন্ত যঈফ। হাদীছটি ইমাম আলবানীও যঈফ বলেছেন। (দ্রঃ যঈফুল জামে হা/৯২৪)
  ১০ নং হাদীছঃ
عن عبد الله بن عمرو بن العاص أن النبي قال: أمرت بيوم الأضحى عيدا جعله الله لهذه الأمةقال الرجل: أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال: لا، ولكن تأخذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فتلك تمام أضحيتك عندالله ( أخرجه أبو داود برقم ২৭৮৮ وهو حديث ضعيف )
অর্থ: আমর ইবনুল ’আস হতে বর্ণিত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “আমি কুরবানীর দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছি যা আল্লাহ এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি বলল: আপনার কি মত এ ব্যাপারে-আমি যদি একমাত্র দান কৃত দুধাল বকরি ছাড়া আর কিছু না পাই তবে কি আমি ওটা জবাই (কুরবানী) করব? নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “না (তা করবে না) বরং তুমি তোমার চুল, নখ, গোফ ও নাভির নিম্নদেশের লোম কাটবে। ইহাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণা ঙ্গ কুরবানী বলে গণ্য হবে।” (আবু দাউদ, কুরবানীর অধ্যায়, হা/২৭৮৮, নাসায়ী হাকেম (বৈরুত) ৪/২২৩ সনদ যঈফ। (দ্রঃ যঈফ আবু দাউদ হা/৫৯৫, যঈফ নাসায়ী হা/২৯৪।
মন্তব্য: হাদীছটিকে ইমাম হাকেমও উক্ত যঈফ সনদে বর্ণনা করেছেন।)
  ১১ নং হাদীছঃ
عن عائشة رضى الله عنها أيها الناس ضحوا وطيبوا بها أنفسا فإني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: مامن عبد توجه بأضحيته ألى القبلة إلا كان دمها وقرنها وصوفها حسنات محضرات في ميزانه يوم القيامة، فإن الدم إن وقع في التراب فإنما يقع في حرز الله حتى يوفيه صاحبه يوم القيامة- ذكره أبو عمر بن عبد البر في كتاب التمهيد ، انظر: تفسير القرطبي )
আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “হে লোক সকল! আপনারা কুরবানী করুন এবং তা খুশী মনে করুন। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি যে, যদি কোন ব্যক্তি তার কুরবানীর পশু সহ কিবলা মুখী হয় (এবং যবেহ করে) তাহলে তার রক্ত, শিং এবং লোম নেকীতে পরিণত করে কিয়ামত দিবসে তার দাঁড়িপাল্লায় উপস্থিত করা হবে। কুরবানীর পশুর খুন যদিও তা মাটিতে পড়ে কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর হিফাজতে পড়ে। তিনিই এর প্রতিদান তাকে কিয়ামত দিবসে প্রদান করবেন। (কিতাবুত তামহীদ এর বরাতে তাফসীরুল কুরতুবী)
মন্তব্য: উক্ত হাদীছটির সনদও যঈফ।
  ১২নং হাদীছঃ
عن ابن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم:(( مامن نفقة بعد صلة الرحم أفضل عندالله من إهراق الدم (قال أبو عمر ابن عبد البر: وهو حديث غريب من حديث مالك، انظر: تفسير القرطبي))
ইবনু আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন: “আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি ছাড়া এমন কোন খরচ নেই যা আল্লাহর নিকট কুরবানীর পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে উত্তম হতে পারে।” (তাফসীরুল কুরতুবী)।
আবু ওমার ইবনে আব্দুল বার বলেন: “এ হাদীসটি ইমাম মালেকের সূত্রে বর্ণিত একটি ‘গারীব’ হাদীছ” (দ্র: প্রাগুক্ত)।
  নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা কুরবানীর ফযীলত প্রমাণিত হয়:
কুরবানীর ফযীলতে খাছ কোন ছহীহ বা হাসান হাদীছ না থাকলেও নিম্ন বর্ণিত হাদীছ দ্বারা পরোক্ষভাবে তার কিছু ফযীলত প্রমাণিত হয়। হাদীছটি হল:
عن ابن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((ما من أيام العمل الصالح فيها أحب إلى الله عز وجل من هذه الأيام يعني أيام العشر قالوا: ياررسول الله ولا الجهاد في سبيل الله ؟ قال: ولا الجهاد في سبيل الله إلا رجلا خرج بنفسه وماله ثم لم يرجع من ذلك بشيئ (رواه البخاري )
ইবনু আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুলাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন “যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় কোন আমল নেই।” ছাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয়? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “জিহাদও নয়। তবে ঔ ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) বেরিয়েছে এবং আর সে কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি (বুখারী)
অন্য হাদীছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “আরাফার দিনের ছিয়াম পালন করলে (যারা হজ্জব্রত পালনকারী নয় তাদের জন্য) পূর্ববতী এবং পরবর্তী একবছরের গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়।” (ছহীহ মুসলিম)
যেহেতু কুরবানী করা ১০ যিলহাজ্জের অন্যতম একটি করণীয় কাজেই সাধারণভাবে কুরবানীরও ফযীলত এ হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয়। আল্লাহু আলাম।
ঋণে কুরবানি করার বিধান
(১৪০)  প্রশ্ন: কারো যদি ঋণ (মোটামুটি পরিমাণ) থাকে তাহলে তার উপর কুরবানি করা জরুরি না। এ কথা ঠিক?
উত্তর: যদি ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকে তবে কুরবানি দেয়া ভালো। অর্থাৎ বর্তমানে হাতে টাকাপয়সা না থাকলেও তার কাছে এমন কিছু সম্পদ আছে যা দ্বারা ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব তাহলে সাময়িকভাবে কারো নিকট ঋণ নিয়ে কুরবানি করতে কোনো আপত্তি নাই।
অনুরূপভাবে যদি এককালীন বা কিস্তিতে কুরবানির দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে কুরবানি ক্রয় করা হয় তাহলে তাতেও কোনো আপত্তি নাই-যদি ঋণ পরিশোধ করার মত অন্যান্য সম্পদ তার মালিকানায় থাকে।
উল্লেখ্য যে, কুরবানির বিধান হল, অধিকাংশ আলেমের মতে তা সুন্নতে মুআক্কাদা। মতান্তরে ওয়াজিব।
  ঋণে কুরবানি করার ব্যাপারে আলেমদের মতামত পেশ করা হল:
 শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ কে জিজ্ঞেস করা হল, যে ব্যক্তির কুরবানি করার ক্ষমতা নেই সে কি (কুরবানির করার জন্য) ঋণ নিতে পারে?
উত্তরে তিনি বলেন:
إن كان له وفاء فاستدان ما يضحي به فحسن ، ولا يجب عليه أن يفعل ذلكانتهى
مجموع الفتاوى” (26/305) .
“যদি ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা থাকে তাহলে কুরবানি করার সমপরিমাণ ঋণ নেয়া ভালো। কিন্তু এমনটি করা তার জন্য ওয়াজিব নয়।” (মাজমু ফাতাওয়া ২৬/৩০৫)
  শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহঃ কে জিজ্ঞেস করা হল, যার কুরবানি দেয়ার ক্ষমতা নেই তার জন্য কি কুরবানি দেয়া ওয়াজিব? আর বেতন এর উপর ঋণে কুরবানি নেয়া কি জায়েজ আছে?
তিনি বলেন:
الأضحية سنة وليست واجبة . . . ولا حرج أن يستدين المسلم ليضحي إذا كان عنده القدرة على الوفاءانتهىفتاوى ابن باز” (1/37)
কুরবানি করা সুন্নত; ওয়াজিব নয়। আর ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকলে মুসলিম ব্যক্তি ঋণ নিয়ে কুরবানি করলে তাতে কোনো আপত্তি নেই। (ফাতাওয়া বিন বায ১/৩৭)
আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ আল উসাইমীনকে জিজ্ঞেস করা হল:
দরিদ্র ব্যক্তির জন্য কি ঋণ করে কুরবানি করা শরিয়ত সম্মত?
উত্তরে তিনি বলেন:
ঈদুল আযহা আগমনের সময় কোনো দরিদ্র ব্যক্তির হাতে যদি টাকাপয়সা না থাকে কিন্তু আশা করে যে, সে তা সংগ্রহ করতে পারবে। যেমন: তার মাসিক বেতন আছে। অথবা ঈদের দিন তার হাতে কিছু নাই কিন্তু তার কোনো সাথী-বন্ধুর নিকট ঋণ নিতে পারবে। পরে বেতন পেলে পরিশোধ করে দিবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, তুমি ঋণ নিয়ে কুরবানি করবে। আর পরে তা পরিশোধ করে দিবে। কিন্তু যদি জলদি ঋণ পরিশোধ করার আশা না থাকে তাহলে আমরা বলি না যে, কুরবানি করার জন্য ঋণ নেয়া উত্তম। কেননা এ ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে তার মাথায় ঋণের চাপ পড়ে গেলো এবং সে মানুষের দয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে গলো। আর সে জানে না যে, ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি না। (মাজমু ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল ২৫/১১০)
আল্লাহু আলাম।
(১৪১) পশু জবেহ করার সঠিক পদ্ধতিঃ
ইসলাম দয়া ও মমতার ধর্ম। যে কারণে ইসলামে পশুর প্রতিও দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন: হাদিসে এসেছে,
  সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ ِ
“আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে সুন্দর ও দয়া সুলভ আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দর ভাবে করবে। তোমাদের কেউ (জবেহ করতে চাইলে) যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং জবাইয়ের পশুটিকে প্রশান্তি দেয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৯৫৫)
  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি একটি ছাগল জবাই করার জন্য মাটিতে শুইয়ে ছুরি ধার করতে লাগল। তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ধমক দিয়ে বললেন,
أتريدُ أن تُميتَها موتاتٍ هلَّا حَدَدْتَ شَفْرَتكَ قبلَ أنْ تُضجِعَها
“তুমি কি একে কয়েকবার মৃত্যু দিতে চাও? তাকে মাটিতে শোয়ানোর আগে কেন তোমার ছুরি ধার দিলে না!”
[মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৭৫৬৩, সহিহ]
পশু জবেহ করা সঠিক পদ্ধতি:
  ১. আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রহঃ. বলেন: “(গরু, ছাগল, দুম্বা ইত্যাদি পশু) জবেহ করার সময় ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং গলদেশের দু পার্শ্বস্থ দুটি মোটা রগ কর্তন করা উত্তম। তবে যদি কেবল খাদ্য ও শ্বাসনালী এবং এক পাশের একটা মোটা রগ কাটা হয় তাহলেও যথেষ্ট। এমনকি শুধু খাদ্য ও শ্বাসনালী কাটা হলেও যথেষ্ট। তবে উক্ত চারটা রগ কর্তন করা অধিক উত্তম।” (শাইখ বিন বায রহ. এর অফিসিয়াল ওয়েব সাইট)
ধারালো অস্ত্র দ্বারা এভাবে কর্তন করার পর পশুকে কিছুক্ষণ ধরে রাখলেই ভেতর থেকে রক্তগুলো বের হয়ে দ্রুতই নিস্তেজ হয়ে যাবে এবং প্রাণ ত্যাগ করবে।
  ২. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোনো অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন: ঘাড় মটকানো, পায়ের রগ কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি।
  ৩. অনুরূপভাবে, দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে, তাহলে প্রাণ ত্যাগ করার কাল পর্যন্ত আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়।
  ৪. পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে চেপে রাখা যায়।
  ৫. জবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত।কিন্তু যদি অসতর্কতা বশত: যদি মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলেও হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
তবে আল্লাহর নামে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে প্রথমে বর্ণিত পদ্ধতির আলোকে জবেহ করার পর প্রাণ ত্যাগের পূর্বে যদি পশুর শরীরের কোথাও ছুরি ঢুকানো হয়, ছুরি দ্বারা গুঁতা দেয়া হয় বা আঘাত করা হয় তাহলে তাতে পশুটি হারাম হবে না। কিন্তু এভাবে করলে পশুটিকে কষ্ট দেয়ার কারণে গুনাহ হবে।
আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমীন।
  ৬) পশুকে শুইয়ে জবেহ কারী কেবলা মুখি হয়ে এবং পশুর মাথাটা কেবলার দিকে একটু ঘুরিয়ে জবেহ করা উত্তম। তবে আবশ্যক নয়। অর্থাৎ কিবলা ছাড়া অন্য দিকে মুখ করে আল্লাহর নামে জবেহ করলেও তা হালাল হবে। (আল্লামা বিন বায. রহ.)
  ৭) আল্লাহর নামে জবেহ করা:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلاَ تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ
‘‘(জবেহ করার সময়) যে পশুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না, তোমরা তা ভক্ষণ কর না।” (সূরা আনআম: ২১)
  ৮)জবেহ করার সময় ”বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার” বলে পশুর কাঁধের পার্শ্বে পা দ্বারা চেপে ধরে ধারালো অস্ত্র দ্বারা শক্তি দিয়ে গলায় ছুরি চালাবে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عن أنس بن مالك -رضي الله عنه- قال: ضحى النبي صلى الله عليه وسلم بكبشين أملحين، ذبحهما بيده، وسمى وكبر، ووضع رجله على صفاحهما [رواه البخاري ومسلم] وفي لفظ البخاري أقرنين قبل أملحين.
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানি করেছেন।
(জবেহ করার সময়) তিনি ’বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার’ বলেছেন এবং পা দিয়ে সেগুলোর কাঁধের পার্শ্বদেশ চেপে রাখেন। (বুখারি: ৫৫৬৫, মুসলিম: ১৯৬৬)
বুখারিতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিং ওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।
উল্লেখ্য যে, কোন মুসলিম জবেহ করার সময় অসাবধানতা বশত: মুখে বিসমিল্লাহ-আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করতে ভুলে গেলে উক্ত জবেহকৃত প্রাণী হারাম হবে না। কেননা, মুসলিমেরর অন্তরে আল্লাহর নাম রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাব তা পরিত্যাগ করা বৈধ নয়।
আল্লাহু আলাম।
জিলহজ্জ মাসে আইয়ামে বীযের রোযা রাখার বিধান কি?
(১৪২) প্রশ্ন: জিলহজ মাসে আইয়ামে বীযের রোজা রাখার বিধান কি?
উত্তর:
ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা এবং আইয়ামে তাশরিকের তিন দিন রোজা রাখা নিষেধ। (মোট ৫ দিন)।
ঈদুল আযহার পরের তিন দিন তথা জিলহজ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখকে ‘আইয়ামে তাশরীক’ বলা হয়।
হাদীসে এ দিনগুলোকে ‘পানাহার ও আল্লাহর যিকির’ এর দিন বলা হয়েছে। এ তিন দিন ফরয বা নফল রোযা রাখা নিষেধ।
 ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে বলেন,
«لَمْ يُرَخَّصْ فِي أَيَّامِ التَّشْرِيقِ أَنْ يُصَمْنَ، إِلَّا لِمَنْ لَمْ يَجِدِ الهَدْيَ»
“যে (হাজী)র নিকট الهَدْيَ/ কুরবানীর পশু নেই তিনি ছাড়া অন্য কারও জন্য আইয়্যামে তাশরীকে সাওম পালন করার অনুমতি দেওয়া হয় নি”। (সহিহ বুখারী হা/১৯৯৭)
  নুবাইশা আল-হুযালী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَيَّامُ التَّشْرِيقِ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكْرٍ لِلَّهِ
“আইয়্যামে তাশরীক পানাহার ও আল্লাহর যিকিরের দিন”।[সহীহুল জামে হা/২৬৮৯-নুবাইশা আল হুযালী রা. থেকে বণিত]
 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
لا تَصُومُوا هَذِهِ الأَيَّامَ فَإِنَّهَا أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ
“তোমরা এই দিনগুলোতে রোযা রাখিও না। কেননা, এগুলো পানাহারের দিন।” (সহীহল জামে, হা/৭৩৫৫-হামযা বিন আমর আল আসলামীন থেকে বর্ণিত )
সুতরাং এ দিনগুলোতে কাযা, কাফফারা, মানত বা অন্য কোন ধরণের নফল রোযা রাখা বৈধ নয়। (কেবল হাজীদের বিশেষ ক্ষেত্রে রোজা রাখার বিষয়টি ভিন্ন)
উল্লেখ্য যে, আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজ বলা হয়। প্রতি মাসে এই তিনটি রোজা রাখলে সারা মাস রোজা থাকার সওয়াব পাওয়া যায়।
কিন্তু জিলহজ মাসের ১৩ তারিখ যেহেতু আইয়ামে তাশরীক এর অন্তর্ভুক্ত সেহেতু ওই দিন রোজা রাখা জায়েজ নেই।
অতএব জিলহজ মাসের ১৪ এবং ১৫ তারিখে এবং ১৩ তারিখের পরিবর্তে ১৬ তারিখ বা অন্য যেকোনো দিন রোজা রাখা যাবে। তাহলেও সারা মাস রোজা থাকার সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।
কাদের জন্য কুরবানীর পরের আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন রোযা রাখা জায়েয
১৭ নভেম্বর, ২০১৯ by Asad Rony
সাধারণভাবে ঈদুল আযহা এবং এর পরের তিন দিন (আইয়ামে তাশরিকে) রোযা রাখা হারাম। কিন্তু বিশেষ তিন শ্রেণীর মানুষের জন্য জায়েয। আসুন জেনে নি, তারা কারা?
প্রশ্ন: কাদের জন্য কুরবানীর পরের আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন রোযা রাখা জায়েয?
উত্তর:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল আযহার দিন ও তার পরে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন (জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ- মোট চার দিন) সব ধরণের রোযা রাখা নিষেধ করেছেন। চাই তা কাযা হোক, মানত হোক অথবা নফল হোক। তবে তিন শ্রেণীর মানুষের জন্য আইয়ামে তাশরীকের তিন দিনও রোযা রাখা জায়েয। এর সবগুলোই হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত। নিম্নে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হল:
১) তামাত্তু অথবা কিরান হজ্জকারী ব্যক্তি যদি হাদী (কুরবানী) দিতে না পারে তাহলে সে দশটি রোযা থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۚ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ ۗ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ۗ ذَٰلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ
“আর যে ব্যক্তি হজ্জ ও ওমরা একত্রে একই সাথে পালন করতে চাও, তবে যাকিছু সহজলভ্য, তা দিয়ে কুরবানী করাই তার উপর কর্তব্য। বস্তুতঃ যারা কোরবানীর পশু পাবে না, তারা হজ্জ্বের দিনগুলোর মধ্যে রোজা রাখবে তিনটি আর সাতটি রোযা রাখবে ফিরে যাবার পর। এভাবে দশটি রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে। এ নির্দেশটি তাদের জন্য, যাদের পরিবার পরিজন মসজিদুল হারামের আশে-পাশে বসবাস করে না।” (সূরা বাকারা: ১৯৬ নং আয়াত)
উল্লেখ্য যে, মক্কার তিনটি রোযা হয় ইহরাম এর পর থেকে শুরু করে আরাফা দিবসের (কারও মতে ইয়ামুন নহর বা কুরবানীর দিনের) পূর্বেই শেষ করবে অথবা আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন রাখবে।
২) কেউ যদি ইহারামের নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে কোন একটি করে তাহলে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে।
আর ফিদিয়া হল:
একটি দম তথা একটি ছাগল/দুম্বা জবাই করে হারামের সীমানার মধ্যে গরিব লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে। সেখান থেকে কিছুই নিজে খাওয়া যাবে না। কিন্তু কেউ যদি আর্থিক অসচ্ছলতা বা কোন কারণে দম দিতে না পারে তাহলে
তিনটি রোযা থাকবে (এ তিনটি রোযা আইয়ামে তাশরীকের তিন দিনও রাখা জায়েয)
অথবা ছয়জন গরিব-অসহায় মানুষকে খাদ্য দান করবে। প্রতিজনকে আধা সা তথা প্রায় সোয়া কিলো পরিমান খাদ্যদ্রব্য।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِّن رَّأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِّن صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ
“যারা তোমাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বে কিংবা মাথায় যদি কোন কষ্ট থাকে, তাহলে তার পরিবর্তে রোজা করবে কিংবা সদকা করবে অথবা কুরবানী করবে।” (সূরা বাকারা: ১৯৬)
এ ব্যাপার হাদীস:
عن كعب بن عجرة، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر به زمن الحديبية فقال: «قد آذاك هوام رأسك» قال: نعم. فقال النبي صلى الله عليه وسلم: «احلق، ثم اذبح شاة نسكا، أو صم ثلاثة أيام، أو أطعم ثلاثة آصع من تمر على ستة مساكين» رواه البخاري، ومسلم
কাব ইবনু উজরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ায় তার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, পোকাগুলো কি তোমার মাথায় উপদ্রব করছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, মাথা মুড়িয়ে ফেল। অতঃপর একটি বকরী কুরবানী কর অথবা তিন দিন সাওম পালন কর অথবা ছয়জন মিসকিনকে তিন সা খেজুর খেতে দাও।” (সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম- সহীহ মুসলিম এর হাদিস নম্বর 2753-(ইফাঃ) ]
৩) কোন ব্যক্তি যদি হজ্জের কোন ওয়াজিব পরিত্যাগ করে তাহলে তাকে একটি দম দিতে হবে।
তবে দম দিতে না পারলে দশটি রোযা থাকবে। তিনটি মক্কায় আর সাতটি বাড়ি ফিরে আসার পর [অর্থাৎ তামাত্তু বা কিরান হজ্জকারী যদি হাদী (কুরবানী) দিতে না পারে তাহলে রোযা রাখার ক্ষেত্রে তার জন্যও একই হুকুম।]
এটি জুমহুর এর অভিমত। শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায ও অনুরূপ ফতোয়া দিয়েছেন।
তবে কোন কোন আলেম বলেন, ওয়াজিব তরক কারী দম দিতে না পারলে তার জন্য রোযা রাখা বা অন্য কিছু করণীয় নাই আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া ছাড়া। কেননা, এ মর্মে দলিল পাওয়া যায় না। যেমনটি বলেছেন আল্লামা উসাইমীন রাহ.।
আল্লাহু আলাম।
হজ্জ ও উমরা সফরে মৃত্যুবরণকারীদের মর্যাদা
(১৪৩) প্রশ্ন: লোকমুখে বলতে শোনা যায় যে, “যারা হজ্ব বা উমরা করতে গিয়ে মারা যায় তারা জান্নাতি।” এ কথাটা কি সঠিক?
উত্তর:
হজ্জ ও উমরা সফর নি:সন্দেহে বরকতপূর্ণ সফর। এ সফরে কেউ মৃত্যু বরণ করলে তার জন্য হাদীসে বিশেষ কতিপয় ফযিলত/মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ সংক্রান্ত হাদীসগুলো সহীহ নয়। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপাস্থাপন করা হল:
  ১) কেউ যদি দৃঢ়ভাবে হজ্জ/উমরা আদায়ের জন্য দৃঢ়ভাবে নিয়ত করে বা এই নিয়তে যাত্রা করে কিন্তু সে যদি হজ্জ বা উমরা আদায় করার পূর্বেই মৃত্যু বরণ করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে পূর্ণ হজ্জ ও উমরার পূর্ণ সওয়াব দান করবেন। কেননা, কোন ব্যক্তি যদি সৎ আমলের দৃঢ় নিয়ত করার পরে মারা গেলে আল্লাহ তাকে সে কাজটির পূর্ণ সওয়াব দান করেন। যেমন আল্লাহ বলেন:
وَمَن يَخْرُجْ مِن بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّـهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّـهِ ۗ
“যে কেউ নিজ গৃহ থেকে বের হয় আল্লাহ ও রসূলের প্রতি হিজরত করার উদ্দেশে, অতঃপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তার সওয়াব আল্লাহর কাছে অবধারিত হয়ে যায়।” (সূরা নিসা, ১০০ নং আয়াত) এ মর্মে একাধিক হাদীসও বিদ্যমান রয়েছেে।
  ২) কেউ যদি হজ্জ/উমরা করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তার সওয়াব লিপিবদ্ধ করতেই থাকেন। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«من خرج حاجًا فمات؛ كتب الله له أجر الحاج إلى يوم القيامة، ومن خرج معتمرًا فمات، كتب الله له أجر المعتمر إلى يوم القيامة، ومن خرج غازيًا فمات، كتب الله له أجر الغازي إلى يوم القيامة» (صحيح لغيره).
‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর মারা যাবে, সে ব্যক্তির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের সওয়াব লেখা হতে থাকবে। আবার যে ব্যক্তি ওমরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে মারা যাবে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত ওমরার সওয়াব লেখা হতে থাকবে।’ (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব, সহীহ লিগাইরিহ)
  ৩) যে ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে কিয়ামতের দিন সে লাব্বাইক..পাঠ করতে করতে উঠবে। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এক ইহরামধারী ব্যক্তিকে তার বাহনটি ফেলে দিলে তার ঘাড় ভেঙ্গে সে মারা যায়। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
اغْسِلُوهُ بِمَاءٍ وَسِدْرٍ وَكَفِّنُوهُ فِي ثَوْبَيْهِ وَلاَ تُخَمِّرُوا وَجْهَهُ وَلاَ رَأْسَهُ فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلَبِّيًا
“তাকে কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল দাও, তার পরনের বস্ত্রদ্বয় দিয়ে তাকে কাফন দাও এবং তার মুখমণ্ডল ও মাথা ঢেকো না। কারণ তাকে কিয়ামতের দিন তালবিয়া (লাব্বাইক…) পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।”
রাসূলুল্লাহ আরও বলেনঃ “তাকে সুগন্ধি মাখিও না। কারণ তাকে কিয়ামতের দিন তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।” (সহীহুল বুখারী ১২৬৫, ১২৬৬, ১২৬৭, ১২৬৮, মুসলিম ১২০৬)
‘হজ্জ ও উমরা আদায় করতে এসে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতী’ এ মর্মে বর্ণিত হাদীসগুলো সহীহ নয়:
হজ্জ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে মর্মে বর্ণিত হাদীসগুলো একটিও সহীহ নয়।
এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে “যে ব্যক্তি হজ্জ করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করবে তার হিসেব নেয়া হবে না, এমনকি হিসেবের জন্য তাকে উপস্থাপনও করা হবে না এবং বলা হবে, জান্নাতে প্রবেশ কর।” এ হাদীসটিকে খতীব বাগদাদী যঈফ বলেছেন। ইমাম শাওকানী বলেন, এর সনদে ইসহাক বিন বিশর আল কাহেলী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, সে মিথ্যুক। আর আলবানী এটিকে ‘মুনকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে “হজ্জ ও উমরা আদায়কারী এবং গাজী বা আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী ব্যক্তি আল্লাহর বাহিনী। তারা সবাই আল্লাহর জিম্মায় থাকে। মারা গেলে তাদেকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে আর ফিরে আসলে ক্ষমা করা হবে। ” এটিও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে যঈফ বা দুর্বল। কেননা, এর সনদে একাধিক সমস্যা আছে। যেমন এর বর্ণনা সূত্রে উসমান ইবনে আমর ইবনে সাজ নামক বর্ণনাকারীর ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের আপত্তি রয়েছে। আরেক বর্ণনাকারী মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর পরিচয় অজ্ঞাত।
(উক্ত হাদিসদ্বয় ইমাম আল ফাকেহী আর আখবার মক্কা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।)
উক্ত হাদীসদ্বয়ের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য নিম্নরূপ: (আরবী)
الْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ وَالْغَازِي وَفْدُ اللهِ، ضَمَانُهُمْ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ حَتَّى يُدْخِلَهُمُ الْجَنَّةَ إِنْ تَوَفَّاهُمْ، أَوْ يُرْجِعَهُمْ وَقَدْ غُفِرَ لَهُمْ
قل : هذا إسناد ضعيف ، عثمان هو ابن عمرو بن ساج قال أبو حاتم : ( يكتب حديثه ولا يحتج به ) .
ومحمد بن عبد الله هذا لم أعرفه ، لم أجد في ترجمة عثمان بن ساج أنه روى عن أحد اسمه محمد بن عبد الله ؛ أخشى أن يكون تحرف من محمد بن السائب الكلبي ، فإنه كثير الرواية عنه . والله أعلم .
مَن مات في هذا الوجهِ من حاجٍّ أو مُعْتَمِرٍ ، لم يُعْرَضْ ولم يُحَاسَبْ ، وقيل له : ادْخُلِ الجنةَ
الراوي:عائشة أم المؤمنين المحدث:الألباني المصدر:السلسلة الضعيفة الجزء أو الصفحة:2187 حكم المحدث:منكر

কাবা ঘরে স্থাপিত হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) সম্পর্কে জরুরি কিছু জ্ঞাতব্য
(১৪৪) প্রশ্ন: ক. কাবা গৃহের হাজারে আসওয়াদ কি জান্নাতের পাথর? এটি কালো কেন?
খ. হাজারে আওয়াদে চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করার ফযিলত কি?
গ. শুনেছি যে, “হাজারে আসওয়াদটি একটি ফেরেশতা ছিল। আল্লাহ তাকে পাথর বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।” এটি কি সত্য?
ঘ. এ পাথর সম্পর্কে বানোয়াট হাদিস।
উত্তর:
নিম্নে উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহের উত্তর দেয়া হল:
ক. কাবা গৃহের হাজারে আসওয়াদ কি জান্নাতের পাথর? এটি কালো কেন?
উত্তর: হ্যাঁ, কাবা ঘরের এক কর্নারে স্থাপিত হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথরটি জান্নাতের পাথর। এ মর্মে হাদিস একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
  ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
نزل الحجر الأسود من الجنة وهو أشد بياضا من اللبن فسودته خطايا بني آدم
“হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথরটি জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন এটি ছিল দুধের চেয়েও সাদা। কিন্তু মানুষের গুনাহ তাকে কালো করে দিয়েছে।” (তিরমিযী, হা/৮৭৭, মুসনাদ আহমদ, হা/২৭৯২, ইবনে খুযাইমা হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন, ৪/২১৯)
আল্লামা মুবারক পুরী রহ. মিরকাত গ্রন্থে বলেন, “অর্থাৎ যে সকল মানুষ এই পাথরকে স্পর্শ করে তাদের পাপের কারণে এটি কালো হয়ে গেছে।”
  অন্য হাদিসে এসেছে:
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আমি বলতে শুনেছি:
إِنَّ الرُّكْنَ وَالْمَقَامَ يَاقُوتَتَانِ مِنْ يَاقُوتِ الْجَنَّةِ طَمَسَ اللَّهُ نُورَهُمَا وَلَوْ لَمْ يَطْمِسْ نُورَهُمَا لأَضَاءَتَا مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ
“হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীম জান্নাতের দুটো ইয়াকুত পাথর। আল্লাহ তা’আলা এই দুটির আলোক প্রভা নিষ্প্রভ করে দিয়েছেন। এ দুটির প্রভা যদি তিনি নিষ্প্রভ না করতেন তাহলে তা পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে যা কিছু আছে সব আলোকিত করে দিত।
(তিরমিযী, অধ্যায়: হজ্জ, অনুচ্ছেদ: হাজারে আসওয়াদ, রোকন ও মাকামে ইবরাহীমের ফযিলত। শাইখ আলবানী বলেন: সহিহ তিরমিযী হা/৮৭৮। এ ছাড়াও এটি সহিহ ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান ও হাকিমে বর্ণিত হয়েছে)
খ. হাজারে আওয়াদে চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করার ফযিলত কি?
উত্তর:
হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করলে স্পর্শকারীর গুনাহ মোচন হবে এবং কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে:
 যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مَسْحَ الْحَجَرِ الْأَسْوَدِ، وَالرُّكْنِ الْيَمَانِيِّ يَحُطَّانِ الْخَطَايَا حَطًّا
ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,:
“যে ব্যক্তি রোকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে, এ দু’টি তার গুনাহগুলো ঝরিয়ে দিবে।”
[সহিহুল জামে-শাইখ আলবানী, হা/২১৯৪, সহিহুত তারগীব হা/১১৩৯]
  অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
وَاللهِ لَيَبْعَثَنَّهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَهُ عَيْنَانِ يُبْصِرُ بِهِمَا وَلِسَانٌ يَنْطِقُ بِهِ يَشْهَدُ عَلَى مَنِ اسْتَلَمَهُ بِحَقٍّ
“আল্লাহর কসম, আল্লাহ কিয়ামতের দিন হাজারে আসওয়াদকে উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দু’টি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি জবান থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য দিবে, যে ব্যক্তি খালেস অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছ”। সহিহুল জামে হা/৫৩৪৬-ইবনে মাজাহ- ইবনে আব্বাস রা. থকে বর্ণিত-সহিহ)
গ. প্রশ্ন: শুনেছি “হাজারে আসওয়াদটি একটি ফেরেশতা ছিল। আল্লাহ তাকে পাথর বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।” এ কথা কি সত্য?
উত্তর:
পূর্বোল্লিখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এটি জান্নাত থেকে আসা একটি পাথর।
সুতরাং “এটি আগে ফেরেশতা ছিল” এ কথা যে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট এতে কোনো সন্দেহ নাই।
ঘ. হাজারে আসওয়াদ প্রসঙ্গে বানোয়াট হাদিস:
এ প্রসঙ্গে নিচে দুটি হাদিস পেশ করা হল:
যেমন:
الحَجَرُ الأسودُ يمينُ اللهِ في الأرضِ؛ فمَن صافَحَه وقبَّلَه، فكأنَّما صافَحَ اللهَ وقبَّل يمينَه
“হাজারে আসওয়াদ ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর ডান হাত। সুতরাং যে তাতে হাত লাগাল এবং চুমু খেলো সে যেন আল্লাহর সাথে মুসাফাহা করলো এবং তার ডান হাতে চুমু খেলো।”
হাদিসটি বানোয়াট।
– বিখ্যাত হাদিস বিশারদ শুআইব আরনাবুত বলেন, এ হাদিসের সনদে ইসহাক বিন বিশর আল কাহেলী নামক একজন বর্ণনাকারী আছে যাকে একাধিক মুহাদ্দিস মিথ্যুক বলে চিহ্নিত করেছেন।
– ইবনুল জাওযী বলেন, এ হাদিসটি সহিহ নয়।
– আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহ. বলেন, এ হাদিসটি বানোয়াট-বাতিল।
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
الحجَرُ الأسوَدُ يمينُ اللَّهِ في الأرضِ يصافحُ بِها عبادَهُ
“হাজারে আসওয়াদ ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর ডান হাত। তিনি তা দ্বারা বান্দাদের সাথে মুসাফাহা করেন।”
হাদিসটির মান: মুনকার/বাতিল।
– শাইখ আলবানী বলেন, এটি মুনকার বা মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল। (সিলসিলা যঈফা হাদিস নং ২২৩)
– শুওয়াইব আরনাউত বলেন: এটি বাতিল। (তাখরীজ সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৯/৫২৩)
আল্লাহু আলাম।
(১৪৫) আদর্শ সন্তান গঠনে ২০টি নির্দেশনাঃ
সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট নিয়ামত এবং আমানত। যার কারণে সন্তানকে সৎ, আদর্শবান ও উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান করে গড়ে তোলার দায়িত্ব সর্ব প্রথম পিতা-মাতার উপর। তারা এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে বা আমানতের খেয়ানত করলে মহান আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
আজকের যারা শিশু তারাই আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালক, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং দেশের নাগরিক। সুতরাং তাদেরকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই আদর্শ সন্তান গঠনে নিন্মোক্ত বিষয় সমূহ লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
১) আদর্শ সন্তানের জন্য পিতা-মাতার সৎ ও আদর্শবান হওয়া অপরিহার্য।
২) সন্তানদের জন্য আল্লাহর নিকট দুয়া করা।
৩) শিশুদেরকে ভুত-প্রেত, চোর-ডাকাত ইত্যাদির কথা বলে ভয় না দেখানো।
৪) শিশুদেরকে অন্যদের সামনে অপমান বা হেয় প্রতিপন্ন না করা।
৫) খারাপ বা অপ্রীতিকর শব্দ ব্যবহার করে তাকে সম্বোধন না করা। যেমন, নির্বোধ, অপদার্থ, গাধা, গরু, ছাগল ইত্যাদি।
৬) কোন ক্ষেত্রে ভুল হলে নম্র ও ভদ্রভাবে ভুল সংশোধন করা (বিশেষ করে প্রথম বার)
৭) সন্তানদের সাথে সমতা রক্ষা করা (স্নেহ, ভালবাসা বা কোন কিছু দেয়া..ইত্যাদি ক্ষেত্রে)
৮) দশ বছর বয়স হলে তাদেরকে আলাদা বিছানায় রাখা।
৯) তাদের নিকট দাম্পত্য জীবনের বিষয়াদি গোপন রাখা (সন্তান ছোট হলেও)
১০) শিশুদের সামনে মায়ের পাতলা, টাইট বা এমন পোশাক পরিধান না করা যাতে তার গোপনাঙ্গ সমূহ ফুটে উঠে।
১২) শিশুদেরকে অশ্লীল, নোংরা ছবি বা ফিল্ম দেখা কিংবা খারাপ গল্প, উপন্যাস ম্যাগাজিন ইত্যাদি পড়ার সুযোগ না দেয়া।
১৩) সাত বছর বয়স পূর্ণ হলে নামাযের আদেশ দেয়া এবং দশ বছর বয়স থেকে নামায না পড়লে হালকা ভাবে প্রহার করা।
১৪) সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া, অসহায়কে সাহায্য করা, মেহমানকে সম্মান করা ইত্যাদি উত্তম চরিত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া।
১৫) মিথ্যা, গালাগালি, নোংরা ও নিচু মানের শব্দ ব্যবহার না করতে অভ্যস্ত করা।
১৬) বাল্যবয়সে ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান করা। যেমন, ঈমান ও ইসলামের রোকন সমূহ, আল্লাহর ভয়, পাঁচ ওয়াক্ত সলাত, কুরআন পড়া, প্রয়োজনীয় দুয়া ও জিকির সমূহ ইত্যাদি।
এবং বিশুদ্ধ আকীদা নির্ভর দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
১৭) অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যেমন, পিতা-মাত, ভাই-বোন, প্রতিবেশী, শিক্ষক, ক্লাসমেট, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি।
১৮) সামাজিকতা শিক্ষা দেয়া। যেমন, সালাম দেয়া, বৈঠকে বসার ভদ্রতা, মানুষের সাথে কথা বলার ভদ্রতা, কারো বাড়িতে প্রবেশের আগে অনুমতি ইত্যাদি।
১৯) কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদি টেকনোলোজি ব্যবহারের আদব শিক্ষা দেয়া এবং এগুলোর অন্যায় ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা।
২০) সর্বদা ভয়-ভীতি প্রদর্শন না করে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যাতে তারা তাদের যে কোন সমস্যা পিতা-মাতাকে বলতে পারে।
মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন, প্রত্যেক পিতা-মাতাকে সঠিকভাবে তাদের সন্তান-সন্ততি প্রতিপালনের তাওফিক দান করেন। যারা হবে পিতা-মাতার জন্য চক্ষু শিতলকারী, দেশ ও সমাজের জন্য উপকারী এবং পরকালে পিতা-মাতার নাজাতের ওসীলা। আল্লাহই তাওফিক দান কারী।
(১৪৬) গোস্তের টুকরা, গাছের পাতা, মাছের গায়ে, রুটিতে, বাচ্চার শরীর ইত্যাদিতে আল্লাহ নামঃ-
গোস্তের টুকরা, গাছের পাতা, মাছের গায়ে, রুটিতে, বাচ্চার শরীরে কোন চিহ্ন যা দেখতে আল্লাহ, মুহাম্মদ বা ইসলামের বিশেষ কোন চিহ্নের মত মনে হলে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। হতে পারে বিষয়টি কাকতালীয়। এটি ইসলামের সত্যতার প্রমাণ বহন করে না। কেননা, এমন বহু চিহ্ন দেখা যায়, যা দেখতে খৃষ্টানদের ক্রুশ, হিন্দুদের গণেশ বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় সিম্বল মনে হয়। তাই বলে তখন সেগুলো সে সব ধর্মের সত্যতার প্রমাণ হয়ে যায় না।
সুতরাং এ সব চিহ্ন, দাগ বা আকৃতি দেখে আমাদের কোন কিছুই করণীয় বা বর্জনীয় নেই। আমাদের কর্তব্য কুরআন-সুন্নাহ দেখে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করা এবং তদনুযায়ী আমল করা।
আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন যে, অমুসলিমরা অনেক সময় ফেইক ছবি ফটোশপে ইডিট করে বা ফেইক ভিডিও বানিয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিমদেরকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে এবং তাদের ঈমানকে কৌতুকের বস্তুতে পরিণত করে । যেমন, আফ্রিকার জঙ্গলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সদৃশ গাছ, কাবা শরীফে ফেরেশতা অবতরণের দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবি, নেপালে মসজিদের মিনারা উড়ে যাওয়ার ভিডিও ইত্যাদি। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
আধুনিক চ্যালেঞ্জের মুখে সন্তান প্রতিপালনের দশটি দিক নির্দেশনা
(১৪৭) প্রশ্ন: বাচ্চাদেরকে শিশুকাল থেকে কিভাবে সম্মান, মনুষ্যত্ববোধ, সমতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধ শিক্ষা দান করা যায়? কিভাবে তাদেরকে মধ্যপন্থা সম্পর্কে জ্ঞান দান এবং কট্টরপন্থা Extremism সম্পর্কে সচেতন করা যায়? অনুরূপভাবে আধুনিক চ্যালেঞ্জ, যেমন- technology, free mixing, homosexualities, Sex education ইত্যাদি মোকাবেলায় কী করণীয় রয়েছে?
উত্তর:
বর্তমানে চর্তুমুখী ফিতনার সয়লাব চলছ। এ সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ববোধ। চলছে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থা। আধুনিক টেকনলোজি বর্তমানে সকল প্রকার অন্যায় ও অপকর্মের দরজা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে সন্তান-সন্ততিকে উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাহোক তারপরও আমাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের উপর দাঁড়িয়ে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের রেখে যাওয়া আদর্শ ও মানহাজকে আঁকড়ে ধরতে থাকতে হবে আর পাশাপাশি সন্তানদেরকে রক্ষা করতে হবে জাহান্নামের আগুন থেকে। এটি মহান রবের পক্ষে থেকে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর।” (সূরা আত তাহরীম/৬ নং আয়াত)
তাই এ মর্মে কয়েকটি ১০টি করণীয় ও পরামর্শ প্রদান করা হল:
  ১. সন্তানকে এ সকল চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত করার জন্য সঠিক ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নাই।
তাই তাকে ইসলামিক মধ্যপন্থার ধারক ও বাহক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে হবে।
যে প্রতিষ্ঠানে তাওহীদ, সুন্নাহ, নৈতিকতা বোধ, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয় এবং বাড়াবাড়ি, কট্টরপন্থা, জঙ্গিবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতন করা হয়। (এ বিষয়গুলো জানা যাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস, এক্সট্রা কারিকুলাম, প্রোস্পেক্টস, শিক্ষকমণ্ডলীর সাথে কথা বলে এবং লোকমুখে শুনার মাধ্যমে।)
  ২. পারিবারিক ভাবে তাদেরকে উত্তম চরিত্র, সহমর্মিতা, সমতা, ন্যায়-ইনসাফ, পারষ্পারিক ভ্রাতৃত্ব বোধ, সম্মানবোধ, নীতি-নৈতিকতা, পর্দাশীলতা, লজ্জাশীলতা, মাহরাম-ননমাহরাম পার্থক্য, আল্লাহর ভয়, সালাত, সিয়াম, সততা, সত্যবাদিতা এ বিষয়গুলো শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এ সব বিষয়ে তারা ভুল করলে ধৈর্যের সাথে অনতিবিলম্বে তাদেরকে সঠিক জিনিসটি শিক্ষা দিতে হবে।
  ৩. সাত বছর বয়স (সাত বছর পূর্ণ হয়ে ৮ম বছরে পা রাখলে) তাদেরকে নামাযের আদেশ করতে হবে, দশ বছরে নামাযের জন্য প্রয়োজনে হালকা ভাবে প্রহার করতে হবে এবং তাদের বিছানা আলাদা করতে হবে। (এটি হাদিসের নির্দেশ)।
  ৪. সঠিকভাবে সন্তান প্রতিপালনের জন্য পিতামাতাকে উত্তম আদর্শবান হওয়া জরুরি। তাদের সামনে এমন কোন আচরণ করা যাবে না যাতে তারা নেতিবাচক শিক্ষা পায়।
  ৫. বাচ্চারা কোন শ্রেণীর সাথী ও বন্ধুদের সাথে মিশে সে ব্যাপারে অভিভাবকদেরকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ বাচ্চারা সঙ্গদোষে পাপ-পঙ্গিলতার পথে হাঁটা শুরু করে।
  ৬. তাদেরকে কম্পিউটার, প্যাড, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ দিলে তারা এমন স্থানে এগুলো ব্যবহার করবে যাতে পিতামাতা বা পরিবারের লোকজনের দৃষ্টির মধ্যে থাকে। একান্ত নিভৃতে তাদেরকে ইন্টারনেট এবং এ সব আধুনিক ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার মানে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া।
৭. বাচ্চাদেরকে টেকনলোজিকে দ্বীন ও দুনিয়ার উপকারী কাজে ব্যবহারের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া।
৮. সঠিক ইসলাম প্রচার করে এমন ইসলামী চ্যানেল ছাড়া অন্য সকল চ্যানেলকে বাড়ি থেকে বিদায় জানানো।
৯. বাড়িকে গানবাজনা, অশ্লীলতা, ধুমপান ও নেশা ও মাদকের স্পর্শ থেকে মুক্ত করা।
১০. শিশুদেরকে কল্যাণকর ও বৈধ কাজে টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারে উৎসাহিত করা এবং পাপাচার ও বিনা প্রয়োজনে অর্থ অপচয় করার ব্যাপারে জ্ঞান দান করা।
পারিবারিক ভাবে দাওয়াতি কাজের কয়েকটি স্মার্ট পদ্ধতি:
পারিবারিক লাইব্রেরী: (লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তাতে পরিবারের সকল সদস্যের উপযোগী বই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি থাকে।)
পারিবারিক দেয়ালিকা প্রকাশ: এতে বিভিন্ন ধরণের দাওয়াতি প্রবন্ধ, বিজ্ঞাপন থাকবে। তাতে নতুনত্ব থাকবে এবং পরিবারের সকল সদস্য তাতে শরীক হবে।
পারিবারিক দরসের ব্যবস্থা: (এটা নির্দিষ্ট কোন কিতাব থেকে পাঠ দান হতে পারে বা কোন অডিও ভিডিও ক্লিপ শোনা বা কুরআন বা হাদিস থেকে কিছু মুখস্থ করার মাধ্যমে হতে পারে।)
পারিবারিক প্রতিযোগিতা: (পুরস্কার হিসেবে বোর্ডে বিজয়ীর নাম লিখবে অথবা ছোটখাটো পুরস্কার নির্ধারণ করবে)
পারিবারিক পত্রিকা: (যদিও তা কোন ম্যাগাজিন বা পত্রিকা হতে বাছাই করা প্রবন্ধও হয় না কেন। এসব লিখনিতে পরিবারের সদস্যরা শরীক হবে।)
পরিবারের সামনে সৎ আমল প্রকাশ করা: (যেমন: নামায, কুরআন তিলাওয়াত, সদকা প্রভৃতি তাদেরকে দেখিয়ে করা যাতে করে তারা আপনার অনুসরণ করতে পারে এবং শিখতে পারে।)
আল্লাহ তাআলা তওফিক দান করুন। আমীন।
ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব ও বিধান
(১৪৮)  প্রশ্ন: যদি কোনো ছেলে বা মেয়ে জীবনেও বিয়ে না করে তাহলে সে কি জাহান্নামে যাবে অথবা সে কি গুনাহগার হবে?
উত্তর:
বিয়ে ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে একাধিক বিয়ে করেছেন এবং তার উম্মতকে বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তান সাহাবায়ে কেরাম বিবাহ করে ঘর-সংসার করেছেন। বিয়ের মাধ্যমে বৈধ সান্তান দ্বারা বংশ বিস্তার হয় এবং এই পৃথিবী আবাদ হয়। এর মাধ্যমে সমাজ থেকে অনেক অন্যায়-অপকর্ম বিদূরিত হয়। গড়ে উঠে একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বৈধ পন্থায় মাুনষ নিজেদের প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করে। এতে মানুষের হৃদয়পটে ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর ইচ্ছায় ভালবাসা, দয়া ও পারস্পারিক সৌহার্দপূর্ণ সুস্থ ও সুন্দর জীবন লাভে ধন্য হয় মানব সমাজ।
তাই এই চমৎকার বিধানটির ব্যাপারে কোনরূপ অবহেলা প্রদর্শন করা কাম্য নয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ইবাদতের ব্যাঘাত সৃষ্টির ওজুহাতে এক ব্যক্তি জীবনে কখনো বিয়ে করবে না বলে ওয়াদা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সাবধান করেন। দেখুন নিম্নোক্ত হাদীসটি:
عنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، فَلَمَّا أُخبِروا كأَنَّهُمْ تَقَالَّوْها وقالُوا : أَين نَحْنُ مِنْ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قَدْ غُفِر لَهُ ما تَقَدَّم مِنْ ذَنْبِهِ وما تَأَخَّرَ . قالَ أَحَدُهُمْ : أَمَّا أَنَا فأُصلِّي الليل أَبداً ، وقال الآخَرُ : وَأَنا أَصُومُ الدَّهْرَ أبداً ولا أُفْطِرُ ، وقالَ الآخرُ : وأَنا اعْتَزِلُ النِّساءَ فلا أَتَزوَّجُ أَبداً، فَجاءَ رسول اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم إلَيْهمْ فقال : ্র أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كذا وكذَا ؟، أَما واللَّهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ للَّهِ وَأَتْقَاكُم له لكِني أَصُومُ وَأُفْطِرُ ، وَأُصلِّي وَأَرْقُد، وَأَتَزَوّجُ النِّسَاءَ، فمنْ رغِب عن سُنَّتِي فَلَيسَ مِنِّى: متفقٌ عليه.
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনজন লোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের ঘরে আসল। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জানতে চাইল। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হল, তখন তারা যেন এটাকে অপ্রতুল মনে করল। আর বলল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় আর আমরা কোথায়? তাঁর আগের পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।
– তাদের একজন বলল, আমি সম্পূর্ণ রাত নামাজ পড়তে থাকব।
– আরেকজন বলল, আমি সারা জীবন রোযা রাখব। কখনো রোযা ছাড়ব না।
– আরেকজন বলল, আমি মেয়েদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখব, কখনো বিয়ে করব না।
ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসলেন। আর বললেন, তোমরা তো এ রকম সে রকম কথা বলেছ? আল্লাহর কসম! তোমাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে বেশী ভয় করি। তাঁর সম্পর্কে বেশী তাকওয়া অবলম্বন করি। কিন্তু আমি রোযা রাখি আবার রোযা ছেড়ে দেই। আমি নামায পড়ি আবার নিদ্রা যাই। আবার মহিলাদেরকে আমি বিয়েও করি।
সুতরাং যে ব্যক্তি আমার আদর্শ (সুন্নাত) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার দলভুক্ত নয়।” (বুখারী ও মুসলিম)
বিয়ে করার বিধান:
ব্যক্তির অবস্থার আলোক বিয়ে করার বিধান ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই কথা।
কেউ যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে তা জন্যে বিয়ে করা ফরয। না করলে গুনাহগার হবে।
এ অবস্থায় কেউ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমর্থ না হয় তাহলে সে রোযা পালন করবে। কেননা, রোযা প্রবৃত্তিকে দমন করতে সহয়তা করে। তবে সামর্থ হলে অনতি বিলম্বে বিয়ে করবে। কিন্তু তথাকথিত অর্থনৈতিক দুর্বলতার অজুহাতে বিয়ে বিলম্ব করা অগ্রহনযোগ্য।
কেউ যদি শারীরিক দিক থেকে বিয়ে করতে সমর্থ থাকে কিন্তু বিয়ে না করলেও যৌন সংক্রান্ত বিভিন্ন পাপাচার ও ব্যভিচারে লিপ্ত হবার আশঙ্কা না করে তাহলে তার জন্য বিয়ে করা মুস্তাহাব।
কেউ যদি জৈবিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হয় তাহলে তার জন্য বিবাহ করা বৈধ নয়। কেনানা, এতে করে অন্যের অধিকার নষ্ট করা হয়।
কিন্তু যদি কেউ সার্বিক দিক থেকে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও রসূল সা. এর সুন্নাতের প্রতি অনীহা ও অবহেলার কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করে, তাহলে সে রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর তরীকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গুনাগার হবে।
আর কোন নারী বা পুরুষ যদি ইচ্ছা থাকার পরও বহুচেষ্টা সত্বেও কোন কারণে বিয়ে করতে ব্যার্থ হয় বা বিশেষ কোন ওজরের কারণে বিবাহ করতে না পারে তাহলে ইনশাআল্লাহ এতে সে গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। কেননা, বিয়ের ক্ষেত্রে তার পক্ষ থেকে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
তবে ইসলামের বিধান এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত পালনের উদ্দেশ্যে বিয়ের চেষ্টা অব্যহত রাখা কতর্ব্য। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
মুযারাবা তথা একজনের অর্থ আরেকজনের শ্রম ভিত্তিতে ব্যবসা করার পদ্ধতি ও বিধিবিধান
(১৪৯) প্রশ্ন: এক ব্যক্তি নিজে ব্যবসা করতে পারে না বিধায় আরেকজনকে ব্যবসার জন্য অর্থ দিল। এখন যদি ব্যবসা কারী তার ইচ্ছেমত অর্থ দাতাকে কিছু লভ্যাংশ দেয় তাহলে কি তা বৈধ হবে না কি তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে? এভাবে ব্যবসা করার বিধান কি?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে ’একজনের অর্থ আরেকজনের শ্রম’ ভিত্তিতে ব্যবসা করা জায়েজ আছে। ফিকহের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় ’মুযারাবা’।
● এ ক্ষেত্রে ব্যবসায় লাভ হলে উভয়ে চুক্তি অনুযায়ী লাভের অংশ ভাগাভাগি করে নিবে। (দ্রষ্টব্য: আল মাউসূআতুল ফিকহিয়াহ বা ফিকাহ বিশ্বকোষ ৮/১১৬)
● ব্যবসায় যদি মূলধন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে যার অর্থ সে পরিপূর্ণ ক্ষতি বহন করবে কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু শ্রম দিয়েছে সে আর্থিক কোনো ক্ষতি বহন করবেন না। কারণ তার শ্রম বিফলে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
● আর যদি লাভ-লোকসান কোনোটাই না হয় তাহলে যার মূলধন সে তা ফেরত নিবে।
এ পদ্ধতিতে ব্যবসা করায় ইসলামে কোনো বাধা নেই।
আবু নুয়াঈম প্রমুখ বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রা.কে বিয়ে করার পূর্বে এই মুযারাবা পদ্ধতিতে তার মালামাল মক্কা থেকে শাম (সিরিয়া) নিয়ে ব্যবসা করেছেন। সাহাবীদের যুগেও এটি প্রচলিত ছিলো। মূলত: এ ব্যবসা প্রথাটি জাহেলী যুগ থেকেই প্রচলিত। পরবর্তীতে ইসলাম তার অনুমোদন দিয়েছে।
এ ধরণের ব্যবসার ক্ষেত্রে শর্ত হল, দু জনের মধ্যে কে কী পরিমাণ লাভ নিবে অবশ্যই তা পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে। যেমন: ৪০%, ৫০%, ৬০% ইত্যাদি। যে শ্রম দিয়ে ব্যবসা করছে তার ইচ্ছার উপর লাভের পরিমাণ ছেড়ে দেয়া শরিয়ত সম্মত নয়। অন্যথায় সময়ের ব্যবধানে উভয়ের মাঝে মনোমালিন্য ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। আর ইসলাম চায় স্বচ্ছতা। তাই এ সমস্যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবসা শুরু করার পূর্বেই লাভের পার্সেন্টিজ নির্ধারণ করা জরুরি। আল্লাহু আলাম।
(১৫০) পেশাব-পায়খানা করার পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন: ঢিলা-কুলুপ ব্যবহার করা কি আবশ্যক?
ইসলাম আমাদেরকে জীবনের নিতান্ত গোপনীয় এবং ছোট্ট ছোট্ট বিষয় সম্পর্কেও অত্যন্ত চমৎকার নির্দেশনা দিয়েছে আল হামদুলিল্লাহ-সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর।
যা হোক, নিম্নে মানব জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয় পেশাব-পায়খানার পরে পরিচ্ছন্নতা অর্জনের বিষয়টি হাদিস ও ফিকদের দৃষ্টিকোন থেকে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:
পরিচ্ছন্নতা অর্জন: কী কারণে এবং কোন জিনিস দ্বারা?
পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে বায়ু ছাড়া অন্য কোনো কিছু-যেমন: পেশাব, পায়খানা, রক্ত, কৃমি, ধাতু, মযী বা এক প্রকার হালকা তরল আঠালো পদার্থ, মহিলাদের সাদা স্রাব ইত্যাদি বের হলেই পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা অপরিহার্য (ওয়াজিব)। চাই তা পানি দ্বারা হোক বা টিস্যু পেপার, কাপড়ের টুকরা, পাথর খণ্ড, শুকনো মাটি ইত্যাদি দ্বারা হোক।
তবে কুরআন-হাদিস, দুআ, যিকির ও আল্লাহ-রাসূল নাম লেখা সম্মানযোগ্য কাগজ, হাড্ডি, গোবর, কয়লা, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি বস্তুকে কুলুপ হিসেবে ব্যাবহার করা জায়েয নাই।
– এ ক্ষেত্রে ডান হাত ব্যবহার করাও সঙ্গত নয়। বরং বাম হাত ব্যবহার করতে হবে।
– পানি বা কুলুপ সর্ব নিম্ন তিনবার ব্যবহার করা উচিৎ। প্রয়োজনে তিনের অধিক যতবার প্রয়োজন ততবার ব্যবহার করা যায়।
পেশাব-পায়খানার পরে পরিচ্ছনতা অর্জনের আবশ্যকতা:
পেশাব-পায়খানা শেষে পরিপূর্ণভাবে পরিচ্ছন্নতা অর্জনের ক্ষেত্রে অলসতা বা অবহেলা করা উচিৎ নয়। কেননা পেশাব-পায়খানা থেকে পবিত্র না হওয়া কবরের শাস্তি হওয়ার অন্যতম কারণ। যেমন: হাদিসে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’টি কবরের নিকট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন:
إنَّهُماَ لَيُعَذَّباَنِ وَماَ يُعَذَّباَنِ فِيْ كَبِيْرٍ, ثُمَّ قَالَ: بَلَى, أماَّ أحَدُهُماَ فَكاَنَ يَسْعَي بِالنَّمِيْمَةِ, وَأمَّا الآخَرَ فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ
“ এ দুটি কবর বাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। অত:পর বললেন:
“হ্যাঁ, তাদের একজন চুগলখোরি করত (তথা একজনের কাছে আরেকজনের কুৎসা রটনা করত বা ঝগড়া-দন্দ্ব লাগানের উদ্দেশ্যে একজনের কথা আরেকজনকে লাগাত)
অপর জন নিজেকে পেশাব থেকে পবিত্র রাখত না।” (বুখারী ও মুসলিম)
পেশাব-পায়খানার পরে পরিচ্ছন্নতা অর্জনের পদ্ধতি:
 পেশাব-পায়খানা করার পর শৌচকার্য বা পবিত্রতা অর্জনের সবচেয়ে উত্তম উপায় হল, ইস্তিনজা বা পানি ব্যবহার করা।
তবে পানি না পেলে বিকল্প উপায় হিসেবে কুলুপ তথা টিস্যু পেপার, পাথর, মাটির ঢিলা, কাপড়ের টুকরা, ইত্যাদি বস্তু দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে।
 কেউ যদি পানির পরিবর্তে কেবল টিস্যু, কাপড় বা ঢিলা-পাথর দ্বারা যথার্থভাবে পরিচ্ছন্ন হয় তাহলেও যথেষ্ট। কারণ উদ্দেশ্য হল, পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা।
আবার কেউ যদি প্রথমে টিস্যু, কাপড় বা মাটির ঢিলা বা পথর দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করার পর পুনরায় পানি দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে তাহলেও জায়েয আছে।
কিন্তু উভয়টি ব্যবহার করাকে ওয়াজিব বা সুন্নত মনে করা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ছাড়া অন্য কিছু নয়। অথচ দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ পেশাব-পায়খানার পরে পানি ব্যবহারের পূর্বে টিস্যু বা কুলুপ ব্যবহার করাকে ওয়াজিবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে! অথচ তা কাম্য নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীগণ ছিলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারা কেবল পানি দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতেন এবং পানি না পেলে ঢিলা-কুলুপ দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতেন। কিন্তু তারা উভয়টি ব্যবহার করতেন-এমন কেনো বিশুদ্ধ কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।
আল্লাহ তাআলা কি পাথর অত:পর পানি ব্যবহার করার কারণে কুবাবাসীর প্রশংসা করেছেন?
আমাদের সমাজে যারা পানি ব্যবহারের পূর্বে ঢিলা-কুলুপ ব্যবহারকে সুন্নত বা ওয়াজিব বলতে চান তারা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করে থাকেন। তা হল:
আল্লাহ তাআলা মদিনার উপকণ্ঠে অবস্থিত কুবা বাসীদের প্রশংসায় বলেন:
فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُوا ۚ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ
“সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতা অর্জন করাকে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন।” (সূরা তওবা: ১০৮)
এই আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রহ. অনেকগুলো হাদিস পেশ করেছেন। যেগুলোর মূল বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলা কুবা বাসীর প্রশংসা করেছেন এ কারণে যে, তারা পেশাব-পায়খানার পর পানি দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতেন। এ মর্মে তিনি একাধিক সহিহ হাদিস ও মুফাসরিদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
পক্ষান্তরে তিনি ‘পাথর ও পানি উভয়টি ব্যবহার করা’র ব্যাপারেও একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বড় বড় মুহাদ্দিস যেমন: ইবনুল মুলাক্কিন, হায়সামী, ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ এ বর্ণনাটিকে যঈফ বা দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইবনে হাজার তার ‘আত তালখীসুল হাবীর’ গ্রন্থে উক্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:
“পাথর ও পানি উভয়টি ব্যবহারের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসের সনদে রয়েছে মুহাম্মদ বিন আব্দুল আযিয় নামীয় এক বর্ণনাকারী। তাকে আবু হাতিম দুর্বল বলেছেন। এছাড়াও আরেক বর্ণনাকারী আছে যার নাম আব্দুল্লাহ বিন শাইব। তিনি অত্যন্ত দুর্বল।” (উৎস: আত তালখীসুল হাবীর ১/১৬৯)
শৌযকার্য করার পর হাত সাবান, মাটি ইত্যাদি দ্বারা ঘোষে তারপর পানি দ্বারা ভালোভাবে ধৌত করা নি:সন্দেহ উত্তম-যেন হাতে কোন দুর্গন্ধ অবশিষ্ট না থাকে। আল্লাহু আলাম।
জিহাদ কখন ফরজ
(১৫১) প্রশ্ন: জিহাদ কখন ফরজ? কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে চাই।
উত্তর:
তিন অবস্থায় প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজ। যথা:
  প্রথম: যদি কাফির ও মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে যুদ্ধ সক্ষম প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ করা ফরজে আইন। এই যুদ্ধ থেকে পলায়ন করা কবিরা গুনাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَوَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِّقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِّنَ اللَّـهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে (যুদ্ধ শুরু হবে) তখন পশ্চাদপসরণ করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাদপসরণ করবে, অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তন কল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের নিকট আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত অন্যরা আল্লাহর গযব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। বস্তুত: সেটা হল নিকৃষ্ট অবস্থান।” (সূরা আনফাল: ১৫ ও ১৬)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোকে সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় ও কবিরা গুনাহের মধ্যে গণ্য করেছেন।
  দ্বিতীয়: যদি কাফেররা মুসলিম দেশকে ঘিরে ফেলে তাহলে প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তির উপর দেশ ও মুসলিমদের ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের স্বার্থে জিহাদ করা ফরজ।
এ যুদ্ধ সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করবে ওলিউল আমর তথা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান। অন্যথায় তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। যতক্ষণ ওলিউল আমর থাকবে সে-ই তা শৃঙ্খলা বিধান করবে। এটাকে বলা হয়, প্রতিরক্ষা মূলক জিহাদ।
 তৃতীয়: মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যদি দেশের নাগরিক ও প্রজা সাধারণকে জিহাদের জন্য আহ্বান জানায় তাহলে প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির উপর জিহাদে অংশ গ্রহণ করা ফরজে আইন হয়ে যায়। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا
“যখন তোমাদেরকে জিহাদে বের হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা (জিহাদের উদ্দেশে) বের হয়ে যাও।” (সহীহ মুসলিম, হা/৪৭২৩ অধ্যায়ঃ ৩৪। প্রশাসন ও নেতৃত্ব -كتاب الإمارة)
যারা এই আহ্বান পাওয়ার পরও তাতে সাড়া দেয় না আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তিরষ্কার করে বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ ۚ أَرَضِيتُم بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ
“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হল, যখন আল্লাহর পথে (জিহাদে) বের হবার জন্যে তোমাদের বলা হয়, তখন মাটি জড়িয়ে ধর, তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প।” (সূরা তওবা: ৩৮)
অর্থাৎ মুসলিমদের ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধান যখন জিহাদের জন্য আহ্বান জানাবেন এবং অন্যান্য মুসলিম সাথে জিহাদে যাওয়ার নির্দেশ দিবে তখন সক্ষমতা থাকা অবশ্যই তাতে সাড়া দেয়া ফরজ।
বোরকা মডেলিং: কতটুকু শরিয়ত সম্মত?
(১৫২) প্রশ্ন: বর্তমানে ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইন শপিং সাইটে দেখা যাচ্ছে, কিছু যুবতী নারী হরেক রকম ডিজাইনের দৃষ্টি নন্দন বোরকা পরিধান করে আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে মডেলিং করে ছবি পোস্ট করছে। যদিও তাতে তার কেবল দুটি চোখ ছাড়া সব কিছু পরিপূর্ণভাবে ঢাকা থাকে। উদ্দেশ্য হল, বোরকা বিক্রয়। এ কাজটা কতটুকু শরিয়ত সম্মত?
উত্তর:
মহিলারা যত বেশি নিজেদেরকে পর পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে রাখবে ততই উত্তম-চাই বাস্তবে হোক অথবা ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে হোক। বোরকা সহ হোক অথবা বোরকা ছাড়া হোক।
হাদিসে তাওহীদের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাতের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য মসজিদে যাওয়ার চেয়ে নিজ বাড়িকে অধিক উত্তম বলা হয়েছে। নিজ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে গোপনীয় স্থানে নামায পড়াকে আরও অধিক উত্তম বলা হয়েছে। মহিলাদের জন্য জুমা ও জামাতে সালাত আবশ্যক করা হয় নি। যেন তারা তাদেরকে পরপুরুষদের দৃষ্টি থেকে সংরক্ষণ করতে পারে এবং ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে প্রথমত: বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু জাহেলি জামানার মত পর্দা হীনভাবে নয়। আল্লাহ বলেন:
قَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
“তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে।” (সূরা আহযাব: ৩৩)
সব মিলিয়ে কথা হল, নারীরা যথাসম্ভব পরপুরুষ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে নিজেদের ইজ্জত-সম্ভ্রম সংরক্ষণ করবে এবং একান্ত জরুরি না হলে পরপুরুষের সামনে যাবে না-বাস্তব জগতে হোক বা ভার্চুয়াল জগতে হোক। এটা তাদের পবিত্রতা ও নিরাপত্তার জন্য জন্য অধিক উপযোগী এবং ইসলামের বিধান।
সুতরাং এখান থেকে বলব, ফেসবুক ও অনলাইনের এ ফেতনাময় জগতে বোরকা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বোরকা পরিধান করে আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে মহিলাদের মডেলিং করা ছবি পোস্ট করা উচিৎ নয়। আর যদি কোনও সুন্দর গঠনধারী যুবতী মেয়ের মাধ্যমে বোরকা ব্যবসার জন্য মডেলিং করা হয় (সাধারণ এমটাই হয়) তাহলে তা তার নিজের জন্য যেমন ফেতনার কারণ অন্যের জন্যও ফেতনার কারণ-তাতে কোনও সন্দেহ নাই।
তবে বোরকা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যদি পোশাক ডিসপ্লে করার জন্য বর্তমানে
যেকল আধুনিক উপায়-উপকরণ রয়েছে (যেমন মস্তকবিহীন ডামি বা ডল) সেগুলো ব্যবহার করা হয় তাহলে তাতে কোনো আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ।
এছাড়াও বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক বহু ফ্যাশন শপের পক্ষ থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ফেসবুক ও ইউটিউটবে সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে বোরকা পরিধানের লাইভ কলা-কৌশল দেখানো হচ্ছে। চেহারা খোলা মডেলদের মাধ্যমে বেরাকা প্রদর্শনী করা হচ্ছে-যেগুলো মহিলাদের পাশাপাশি দেখছে বিভিন্ন শ্রেণীর পুরুষ। এ কাজগুলো যে শরিয়া পরিপন্থী এবং নাজায়েয তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বোরকা বা হিজবের উদ্দেশ্য হল, পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজের সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখা। কিন্তু বর্তমানে অনেক বোরকা/হিজাব এতটা কালারফুল, ফ্যাশনেবল, কারুকার্য খঁচিত ও টাইট-ফিট যে, সেটা নারীকে আরও আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করে তুলে ধরে। কোনো মুসলিম নারীর জন্য এ ধরণের বোরকা পরা জায়েয নয়। কারণ এ দ্বারা বোরকার মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়। জনৈক মনিষী যর্থাথই বলেছেন: “এ ধরণের বোরকাকে ঢাকার জন্য প্রয়োজন আরেকটি বোরকা।”
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরণের ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
ছেঁড়া-ফাটা ও টেপ লাগানো টাকা: শরিয়তের দৃষ্টিতে কী করণীয়?
(১৫৩) প্রশ্ন: বাসে, বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে অনেক সময় হেল্পার ও বিক্রেতা টাকা চেঞ্জ করার সময় ছেঁড়া ও টেপ দেওয়া টাকা দিয়ে থাকে। আমরাও অনেক সময় খেয়াল না করে তা নিয়ে নেই। পরবর্তীতে আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কোনভাবে টাকা টা চালিয়ে দেওয়ার। এটি কতটুকু শরিয়ত সম্মত এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
উত্তর
টাকাটা যদি এমন ছেঁড়া-ফাটা, আঠা বা কস্টেপ দিয়ে জোড় লাগানো হয় যে, কোনো সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টিগোচর হলে সে নিতে চাইবে না বা আসলেই তা বাজারে অচল তাহলে এমন টাকা অন্যান্য ভালো টাকার মধ্যে ভরে কৌশল করে কোনোমতে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা প্রতারণার শামিল। এমনটি করা জায়েজ নেই। বরং উক্ত টাকাটা অন্যান্য টাকার উপরে রাখতে হবে যেন, গ্রহীতা তা দেখতে পারে। ইচ্ছে হলে তা গ্রহণ করবে অন্যথায় পরিত্যাগ করবে।
এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَرضي الله عنهأَنَّ رَسُولَ اللَّهِصلى الله عليه وسلممَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ، فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا، فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلًا، فَقَالَ: «مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ» ? قَالَ: أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَارَسُولَ اللَّهِ. قَالَ: «أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ; كَيْ يَرَاهُ النَّاسُ? مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي» رَوَاهُ مُسْلِمٌ
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক খাদ্য স্তূপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি খাদ্য স্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাতর আঙ্গুল ভিজে গেছে।
তিনি বললেন: হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি?
উত্তরে খাদ্যের মালিক বলল: হে আল্লাহর রাসূল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “তাহলে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।” (সহিহ মুসলিম; মিশকাত হা/২৮৬০)
অবশ্য যদি টাকার নোট সামান্য ছেঁড়া-ফাটা বা টেপ লাগানো হয় যা সাধারণত: মানুষ গ্রহণ করে বা বাজারে প্রচলিত তাহলে তাতে সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। তবুও তা অন্যান্য টাকার উপরে রাখা বা গ্রহীতাকে জানিয়ে দেয়া উত্তম।
কোনো টাকা বেশি পরিমাণে ছেঁড়া-ফাটা হলে কৌশলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করে একটু কষ্ট করে দেশের যে কোনো ব্যাংকের শাখায় গিয়ে তা পরিবর্তন করে নিন। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী (শর্ত সাপেক্ষে) দেশের যে কোনো ব্যাংকের যেকোনো শাখা থেকে ছেঁড়া–ফাটা, খণ্ডিত, আগুনে পোড়া ও ময়লা টাকার নোট বদল করা যায়।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
আমার এক বান্ধবীর প্রেমের সম্পর্ক এক নাস্তিকের সাথে
(১৫৪) প্রশ্ন: আমার এক বান্ধবীর নাস্তিকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক। তাকে আমি বুঝানোর পরও সে তাকে ছাড়তে পারছে না। এতে সে দিন দিন নামাজ-রোজা কোন কিছুই ঠিক ভাবে করছে না। আমি তাকে ইসলামের কথা বলেও লাভ হচ্ছে না। সে চায়, আমি যেন বন্ধুত্বে ধর্ম না টানি! এক্ষেত্রে আমার কী করণীয়? তাকে কিভাবে বুঝানো যাবে?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক হারাম। এটি শয়তানের ফাঁদ এবং জাহান্নামের রাস্তা। কিন্তু শয়তান মানুষের সামনে এই হারাম বিষয়টিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে। যার কারণে প্রেম মগ্ন তরুণ-তরুণীরা ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় এবং অন্ধ ও বধিরে পরিণত হয়।
আল্লাহ আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
যা হোক, আপনার করণীয় হল, আপনার বান্ধবীকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া এবং শয়তানের পথে অগ্রসর হতে নিষেধ করা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَن رَأَى مِنكُم مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بيَدِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسانِهِ، فإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وذلكَ أضْعَفُ الإيمانِ
“তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় কাজ থেকে দেখবে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিরোধ করে। যদি সে এর সামর্থ্য না রাখে তবে যেন মুখ দ্বারা বাধা দেয়। যদি এরও সামর্থ্য না রাখে তবে অন্তর দ্বারা।” (সহিহ মুসলিম, হা/৪৯, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত)
তাকে বুঝানো ও নিষেধ করার পরেও যদি নিজেই ধ্বংসের রাস্তা বেছে নেয় তাহলে এখানে আপনার কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করে তাকে কেউ পথ দেখাতে পারে না।
তাই আপনি আন্তরিকতার সাথে তাকে দ্বীনের পথে ফিরে আসার আহ্বান করুন,
ইসলামের বাণী তার কর্ণ কুহুরে পৌঁছিয়ে দিন এবং তার হেদায়েতের জন্য দুআ করুন। এতটুকুই আপনার দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন:
وَمَا عَلَيْنَا إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
“পরিষ্কারভাবে (আল্লাহর বাণী) পৌঁছে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব।” (সূরা ইয়াসিন: ১৭)
এই দায়িত্ব পালনের কারণে আপনি সওয়াব পাবেন কিন্তু সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান কারণে আখিরাতে ফেঁসে যাবে যদি বেঁচে থাকা অবস্থায় তওবা করে ফিরে না আসে।
আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীন ইসলামের পথে টিকিয়ে রাখুন দম বন্ধ হওয়া পর্যন্ত। আমীন
বিনয়ের গুরুত্ব এবং বিনয়ী হওয়ার ২০ উপায়
(১৫৫) প্রশ্ন: ‘বিনয়’ অর্থ কি, ইসলামের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব কতটুকু এবং কিভাবে ‘বিনয়ী’ হওয়া যায়?
উত্তর:
নিন্মে বিনয়ের অর্থ, এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস এবং বিনয়ী হওয়ার কতিপয় উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
বিনয় অর্থ:
বিনয় ও নম্রতা দু’টি সমার্থক শব্দ। বিনয়ী অর্থ: ঔদ্ধত্য হীন, নিরহঙ্কার, অবনত, নরম, কোমল, শান্ত-শিষ্ট ইত্যাদি।
বিনয়-নম্রতা প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদিস:
বিনয় মানব জীবনের একটি অত্যন্ত মহৎ গুণ এবং আকর্ষণীয় চারিত্রিক ভূষণ। বিনয়ী ব্যক্তি যেমন আল্লাহর নিকট ভালবাসার পাত্র তেমনি মানুষের কাছেও প্রিয়ভাজন।
নিন্মে এর গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হল:
  আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْداً بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزّاً وَمَا تَواضَعَ أحَدٌ للهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ رواه مسلم
“দানে সম্পদ কমে না এবং ক্ষমায় আল্লাহ তা‘আলা সম্মান বৃদ্ধি করেন। আর কেউ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হলে, আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন।” (মুসলিম ৬৭৫৭)
তিনি আরও বলেছেন:
وَإِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوْا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ
”আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি ওহী করেছেন যে, তোমরা পরস্পর বিনয় প্রদর্শন করবে, যাতে কেউ কারো উপর বাড়াবাড়ি ও গর্ব না করে।” (মুসলিম হা/২৮৬৫; আবু দাঊদ হা/৪৮৯৫; সহীহুল জামে‘ হা/১৭২৫; সহীহাহ হা/৫৭০।)
 তিনি বিনয়ী ও ভদ্র লোকদের প্রশংসায় বলেছেন:
, الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ
“মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়।” (তিরমিযী হা/১৯৬৪; মিশকাত হা/৫০৮৫।)
মনিষীগণ বলেন: ”বিনয় এমন একটি গুণ যা দেখে কেউ হিংসা করে না।” সুতরাং বিনয়ী ব্যক্তি যেমন আল্লাহ নিকট প্রিয় তেমন মানুষের কাছেও প্রিয়।
কিভাবে বিনয়ী হওয়া যায়?
নিম্নে বিনয়ী হওয়ার ২০টি উপায় প্রদান করা হল:
১. অন্তর থেকে অহংকারকে বিদায় জানানো।
২. সত্যকে ও হককে গ্রহণ করা যদিও তা বয়স, জ্ঞান-গরিমা ও পদমর্যাদায় ছোট কোন ব্যক্তির নিকট থেকে পাওয়া যায়।
৩. কাউকে হেয় না করা বা ছোট নজরে না দেখা।
৪. ভুল হলে নি:সঙ্কোচে স্বীকার করা। ভুল স্বীকার করলে মানুষের সম্মান কমে না বরং বৃদ্ধি পায়।
৫. যথাসাধ্য মানুষের উপকার করা এবং এ জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা বা প্রতিদান পাওয়ার আশা না করা।
৬. কেউ উপকার করলে তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা।
৭. মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা।
৮. ধনী-গরিব সবার সাথে মিলমিশ ও উঠবস করা।
৯. নিজের অর্থ-সম্পদ, জ্ঞান-গরিমা, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, সৌন্দর্য, পোশাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে অন্যের উপর নিজেকে শ্রেষ্ঠ না ভাবা।
১০. কেউ উপকার করলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং কখনো তা না ভোলা।
১১. কারো উপকার করলে কখনই তা কারো সামনে উচ্চারণ না করা।
১২. অন্যের কষ্ট, শ্রম ও অবদানের স্বীকৃতি দেয়া।
১৩. বিপদগ্রস্তকে নি:স্বার্থ ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
১৪. মানুষের সাথে আচার-আচরণ ও কথা-বার্তা বলার সময় নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা ও শিষ্টতা বজায় রাখা।
১৫. অন্যের মতামত মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং তা মূল্যায়ন করা।
১৬. কোনো বিষয়ে নিজের মধ্যে দুর্বলতা থাকলে তা স্বীকার করতে সংকোচ না করা।
১৭. কোনো বিষয় না জানলে ’জানি না’ বলতে সঙ্কোচ না করা।
১৮. আইনকে শ্রদ্ধা করা।
১৯. মানুষের ভালো কাজের প্রশংসা করতে বিলম্ব না করা।
২০. লজ্জাবোধ থাকা এবং নিষ্প্রয়োজনীয় কোনো কথা বা কাজ না করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিনয় নামক অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মহৎ গুণ দ্বারা আমাদের চরিত্রকে সুসজ্জিত করার তাওফিক দান করুন। আমীন
(১৫৬) প্রশ্ন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কেউ যদি মনে কু ধারণা পোষণ করে বা এমনিতেই খারাপ ধারণা চলে আসে তাহলে কি তার ঈমান চলে যাবে? এমনটি হলে কী করণীয়?
উত্তর:
মহান আল্লাহ সাত আসমানের উপর থেকে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়েছেন। যা কুরআনে উল্লেখিত রয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব মানবতার নিকট আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এটি দ্যার্থহীন ঘোষণা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
”(হে রাসূল,) আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা আল ক্বালাম: ৪)
যার কারণে তৎকালীন তাঁর ঘোরতর দুশমনরাও তাঁর চরিত্রের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করতে সাহস করে নি। আল হামদুলিল্লাহ।
কিন্তু বর্তমান যুগের সব চেয়ে নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী কিছু ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক-কুলাঙ্গার সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ বা বিভিন্ন ওয়েব সাইটে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চরিত্রের ব্যাপারে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় অভিযোগ তুলে লেখালেখি করছে এবং তার পবিত্র স্বত্বাকে অপমান করার চেষ্টা করছে।
আল্লাহ তাআলা এই জাহেলদেরকে হেদায়েত দান করুন অথবা ধ্বংস করে দিন। আমীন
যাহোক, কোনো ইমানদারের অন্তরে যদি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চরিত্র, তার রিসালাত বা অন্য কোনো বিষয়ে কু ধারণা বা বাজে চিন্তার উদ্রেক হয় তাহলে বুঝতে হবে শয়তান তার ঈমানের উপর আঘাত হেনেছে। সুতরাং অতিদ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য।
এ ক্ষেত্রে তার কর্তব্য হল:
১. তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা (অর্থাৎ আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম-“বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি” পাঠ করা।
২. আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার করা (ক্ষমা চাওয়া) ।
৩. এ জাতীয় বাজে চিন্তা ও কু ধারণাকে মনে আশ্রয় না দেয়া।
৪. এবং এ সব কুচিন্তার কথা মুখ খুলে কারো সামনে না বলা বা তদনুযায়ী কোনো কাজ না করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ মন থেকে এ শয়তানী কুমন্ত্রণা বিদায় নিবে এবং তার আমলনামায় গুনাহ লেখা হবে না।
৫. কোন বিষয়ে মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হলে বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে উত্তর জেনে নেয়া।
৬. নাস্তিক ও ধর্ম বিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগের উত্তর সম্পর্কিত ইসলামী স্কলারদের বই পড়া এবং লেকচার শোনা।
৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন চরিত্র জানতে নির্ভর যোগ্য সীরাতের বই পড়া (যেমন: আল্লামা সফিউর রহমান মুবারক পূরী রচিত আর রাহীকুল মাখুতম)
৮. ইসলাম সম্পর্কে পরিপক্ব জ্ঞান ছাড়া নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী ও সংশয়বাদীদের বই-পুস্তক না পড়া বা তাদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।
কারো মনে যদি আল্লাহ, রাসূল বা ইসলাম সম্পর্কে খারাপ চিন্তা সৃষ্টি হয় তাহলে সে কি তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে?
উত্তর:
  কেউ যদি মনে মনে ইসলাম, ঈমান, আল্লাহ, রাসূল বা দ্বীনের কোন বিষয়ে ধরণের কুচিন্তা অনুভব করে, অন্তরে দ্বীনের ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ দেখা যায় কিন্তু পরক্ষণেই যদি এ থেকে মুক্তির জন্য মনে অস্থিরতা অনুভব করে বা এ ভয়ে আতঙ্কিত হয় যে, এতে করে সে পাপের মধ্যে ডুবে গেলো কি না, ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল কি না, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল কিনা.. তাহলে বুঝতে হবে, সে একজন ইমানদার। এই মনের অস্থিরতা ও পাপবোধ তার সুস্পষ্ট ঈমানের পরিচায়ক। আল হামদুলিল্লাহ।
মনে মনে কোন বিষয়ে খারাপ চিন্তা-ভাবনা করলেই সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে না। তবে যদি কু ধারণাগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করা হয় বা তদনুযায়ী কোনো বাজে কাজ করা হয় তাহলে তার আমলনামায় মারাত্মক গুনাহ লেখা হবে। এমনকি এ কারণে তার ঈমানও নষ্ট যেতে পারে। আল্লাহ হেফাজত করুন।
এ প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত হাদিসদ্বয় পড়ুন:
  আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ لأُمَّتِي عَمَّا وَسْوَسَتْ أَوْ حَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا، مَا لَمْ تَعْمَلْ بِهِ أَوْ تَكَلَّمْ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতের ঐ সকল ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) মাফ করে দিয়েছেন যা তাদের মনে উদয় হয় বা যে সব কথা মনে মনে বলে থাকে; যতক্ষণ না তা কাজে পরিণত করে বা সে সম্পর্কে কারও কাছে কিছু বলে।” [সহীহ বুখারী ও মুসলিম। সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর: [6209] অধ্যায়ঃ ৭১/ শপথ ও মানত (كتاب الأيمان والنذور) ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
  ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إنِّى اُحَدِّثُ نَفْسِى بِالشَّيْءِ لَأَنْ يَكُونَ حُمَمَةً أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَن ْ يَتَكَلَّمَ بِهِ فَقَالَ النبي صلى الله عليه وسلم الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي رَدَّ أَمْرَهُ إِلَى الْوَسْوَسَةِ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে একজন লোক আগমন করে বলল, আমার মনে কখনো এমন কথার উদয় হয়, যা উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আমার কাছে বেশী ভাল মনে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি এই বিষয়টিকে নিছক একটি মনের ওয়াস্ওয়াসা (কুমন্ত্রণা) হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।” (সুনানে আবু দাউদ)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও মনের খারাপি থেকে হেফাজত করুন।
আমীন।
যে সকল মেয়েদের বিভিন্ন কারণে বিয়ে হচ্ছে না তাদের প্রতি
(১৫৭) প্রশ্ন: সমাজে কিছু মহিলা আছে, যাদের বিয়ে হয় না বিভিন্ন কারণে। কারো হয়ত শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, অর্থ সম্পদ বা ভালো ঘরবাড়ি নেই। কাউকে হয়ত অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরিতে চাকুরী করতে হচ্ছে। কেউ আবার যৌতুক দিতে পারে না। এমনও কিছু মেয়ে আছে, যাদের দেখাশোনা করার মত কেউ না থাকার কারণে সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে জীবনের সর্বস্ব বিলীন করে দিতে হয়েছে কিন্তু বিনিময়ে তারা কিছুই পায় নি। এ সব কারণে কোনো জীবন সঙ্গী তাদের কপালে জোটে নি।
এদের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? আসলেই কি বিয়ে না হওয়ার পেছনে তারা দোষী বা এ কারণে তারা গুনাহগার হবে?
উত্তর:
কোন ব্যক্তির-চাই পুরুষ হোক অথবা নারী হোক- বিয়ের আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকার পরও যদি কোনো কারণে বিয়ে না হয় তাহলে সে জন্য সে গুনাহগার হবে না। কারণ সে তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছে। আর আল্লাহ তাআলা সাধ্যের অতিরিক্ত বান্দার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না এবং যা তার ক্ষমতার মধ্যে নাই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَا يُكَلِّفُ اللَّـهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যাতীত কোন কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।” (সূরা বাকারা: ২৮৬)
তবে কোন মেয়ে যদি বিয়ের উপযুক্ত বয়সে লেখাপড়া, ক্যারিয়ার, চাকুরী বা নিজের পায়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি অজুহাতে বিয়ে বিলম্ব করে কিন্তু পরবর্তীতে আর বিয়ে না হয় অথবা বিয়ের প্রতি অবহেলা বশত: তা থেকে দূরে থাকে তাহলে নি:সন্দেহে সে গুনাহগার হবে। কারণ এটি আল্লাহর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রর্শনের শামিল। আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমীন।
যা হোক, প্রবল ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার পরও বিয়ে সংঘটিত না হলে এ ক্ষেত্রে করণীয় হবে, আল্লাহর ফয়সালার উপর ধৈর্য ধারণ করা, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, নফল রোযা রাখা, নেকির কাজে সময় অতিবাহিত করা, ইসলামের সেবা, মানুষের সেবা, জ্ঞান চর্চা, আল্লাহর পথে দাওয়াত ইত্যাদি অসংখ্য কল্যাণকর পথ খোলা আছে সেগুলোতে সময় কাটানো।
মনে রাখতে হবে, বিয়ে জীবনের একটি অংশ। কিন্তু এটাই সব কিছু নয়। একটি পথ বন্ধ হলেও আল্লাহর পথে জীবন কাটানোর অসংখ্য পথ খোলা আছে-আল হামদুলিল্লাহ।
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক দিগ্বিজয়ী আলেম ও মনিষীর নাম পাওয়া যায় যারা জীবনে বিয়ে করতে পারেন নি। কিন্তু ইসলাম ও মানবতার সেবায় তাদের কালজয়ী অবদান বিশ্বকে ঋণী করে রেখেছে।
দুনিয়ার জীবনে ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকার স্বত্বেও যদি কারো বিয়ে না হয় এবং এতে সে যদি সবর করে, হারাম থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহর দ্বীনের উপর জীবন পরিচালনা করার মাধমে জান্নাতে প্রবেশ করে তাহলে সেখানে মহান আল্লাহ তাকে অফুরন্ত নিয়ামত দ্বারা সম্মানিত করবেন এবং জান্নাতি যুবকের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন হাতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। বরং মনে করতে হবে, নিশ্চয় আল্লাহ যা করেন তাতেই বান্দার কল্যাণ রয়েছে। এমনও হতে পারে, আল্লাহ তাআলা তাকে বিয়ে থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে জীবনের আরও বড় কোনো ফেতনা ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন।
অথবা তাকে দুনিয়ার ছোট নিয়ামত থেকে বঞ্চিত রেখে আখিরাতে বিশাল নিয়ামত দ্বারা প্রতিদান দিবেন-যা তার জন্য দুনিয়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি মুল্যবান।
নিশ্চয় আল্লাহ পরম প্রজ্ঞাময়, অসীম জ্ঞানের অধিকারী এবং সর্বময় কর্ম বিধায়ক।
আল্লাহু আলাম।
(১৫৮) প্রশ্ন: আজানের সময় আজানের জবাব দিচ্ছি। এমন সময় স্বামী ডাকল অথবা কল দিল। আমার জন্য উত্তম কোনটা হবে-আজানের জবাব দেওয়া নাকি তার কল ধরা বা ডাকে সাড়া দেয়া? আর সহবাসের সময় আজানের জবাব দেয়া যাবে কি?
উত্তর:
যদি মনে হয়, স্বামীর কল ধরতে বিলম্ব হলে তিনি রাগ করবেন বা মন খারাপ করবেন তাহলে আজানের জবাব বাদ দিয়ে তার সাথে কথা বলা জরুরি।
আর আশেপাশে থাকা অবস্থায় ডাকলে তার ডাকে সাড়া দেয়ার মধ্যেও আজানের জবাব দেয়ার চেষ্টা করা ভালো যদি সম্ভব হয়। কারণ কারো সাথে টুকটাক কথা বলার ফাঁকে বা কাজ করা অবস্থায় মুখে আজানের জবাব দেয়া সম্ভব।
তবে মনে রাখতে হবে, আজানের জবাব দেয়া ফরয বা ওয়াজিব নয় বরং মোস্তাহাব আর স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়া ফরয। সুতরাং স্বামীর হক আগে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
অবশ্য স্বামী-স্ত্রী মিলনের সময় আজানের জবাব দেয়া ঠিক নয়:
ইমাম নওবী রহ. সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় বলেন:
ويكره للقاعد على قضاء الحاجة أن يذكر الله تعالى بشيء من الاذكار فلا يسبح ولا يهلل ولا يرد السلام ولا يشمت العاطس ولا يحمد الله تعالى اذا عطس ولا يقول مثل ما يقول المؤذن. قالوا وكذلك لا يأتي بشيء من هذه الأذكار في حال الجماع، وإذا عطس في هذه الاحوال يحمد الله تعالى في نفسه ولا يحرك به لسانه. وهذا الذي ذكرناه من كراهة الذكر في حال البول والجماع هو كراهة تنزيه لا تحريم فلا إثم على فاعله. انتهى.
والله أعلم.
“হাজত পূরণের জন্য (পেশাব-পায়খানার জন্য) বসা অবস্থায় কোনো ধরণের আল্লাহর জিকির করা মাকরূহ (অ পছন্দনীয় কাজ)। সুতরাং এ অবস্থায় তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করবে না, সালামের জবাব দিবে না, হাঁচির জবাব দিবে না, হাঁচি দিলে আল ‘হামদু লিল্লাহ’ পড়বে না এবং মুয়াজ্জিনের অনুরূপ শব্দ উচ্চারণ করে আজানের জবাব দিবে না।
ফকিহগণ আরও বলেছেন: স্বামী-স্ত্রীর মিলনের সময়ও এ সব জিকির-আজকার উচ্চারণ করবে না। তবে এ অবস্থায় হাঁচি দিলে মনে মনে আল হামদুলিল্লাহ পাঠ করবে কিন্তু জিহ্বা নেড়ে তা উচ্চারণ করবে না।
তবে এই যে পেশাব-পায়খানা এবং সহবাসের সময় জিকির পাঠ করার
মাকরূহ বা অ পছন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলাম এটা মাকরূহে তানযিহী; তাহরিমী নয়। সুতরাং কেউ যদি এমনটি করেও তাতে গুনাহ হবে না। আল্লাহু আলাম।”
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
যে ঘরে প্রাণীর ছবি, কার্টুন, প্রতিকৃতি বা মূর্তি আছে সে ঘরে সালাত আদায় করার বিধান
(১৫৯) প্রশ্ন: আমাদের ঘরে খাতা-পত্র, প্যাকেট ইত্যাদিতে ছবির মতো কার্টুন থাকে। কিছু ঘরে মানুষ, পশু-পাখি ইত্যাদির ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয় অথবা শোকেস-আলমরিতে পশু-পাখির ছোট ছাট মূর্তি সাজিয়ে রাখা হয়। ঘরের আসবাব-পত্রেও বাঘ-সিংহ, ময়ূর, পাখি ইত্যাদির ছবি অংকিত থাকে। এ সব ঘরে নামায পড়লে কি তা সহিহ হবে?
এতে করে কি ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করবে না?
উত্তর:
ঘরে প্রাণীর ছবি, কার্টুন, প্রতিকৃতি, মূর্তি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হারাম। যে ঘরে এসব থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। এ মর্মে একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
 আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ، وَلَا صُورَةٌ
“ফেরেশতাগণ ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর অথবা ছবি থাকে। (সুনানে আন-নাসায়ী হা/৫৩৪৭-সহিহ)
 ইবনে ‘আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী মাইমূনাহ রা. আমার নিকট বর্ণনা করেন:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জিবরাঈল আলাহিস সালাম আমার সাথে রাতে সাক্ষাত করার ওয়াদা করেছিলেন কিন্তু সাক্ষাত করেননি।
অতঃপর তাঁর মনে পড়লো যে, আমাদের খাটের নীচে একটি কুকুর ছানা আছে। তিনি এটাকে বের করে দিতে আদেশ দিলে তা বের করা হলো। অতঃপর তিনি নিজেই পানি দিয়ে সে স্থানটা ধুয়ে ফেলেন।
এরপর জিবরাঈল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাতের সময় বললেন: “যে ঘরে কুকুর এবং ছবি থাকে সে ঘরে আমরা কখনো প্রবেশ করি না।”
সকালবেলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুকুর মারতে আদেশ দিলেন। এমনকি ছোট বাগান পাহারার কুকুর হত্যা করারও আদেশ দেন, বড় বাগানের পাহারাদার কুকুর ছাড়া।
(সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ-৪৭ ছবি সম্পর্কে, হা/৪১৫৭-সহিহ)
  তিনি আরও বলেছেন:
أَنْ لاَ تَدَعَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ وَلاَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ
“কোন উঁচু কবরকে (মাটি) সমান করা ব্যতীত ছাড়বে না, আর কোন প্রতিকৃতি বিধ্বংস করা ব্যতীত ছাড়বে না।” (সহিহ মুসলিম, হা/৯৬৯ ও তিরমিজী হাদিস নম্বর: ১০৪৯ [আল মাদানি প্রকাশনী]) সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
وَلاَ صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا
”আর কোনো ছবি পেলে তা মুছে দিবে।”
এ মর্মে বহু হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিসগণ বলেন: মুহাদ্দিসগণ বলেন: উল্লেখিত হাদিসগুলোতে যে সকল ফেরেশতা প্রবেশ করবে না বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হল, রহমত ও বরকতের ফেরেশতাগণ। অর্থাৎ কোনো ঘরে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ও কুকুর থাকলে ঐ সকল প্রবেশরতাগণ তাতে প্রবেশ করে না যারা রহমত ও বরকত নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে আগমন করে থাকেন। কিন্তু বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ তাদের দায়িত্ব পালনার্থে অবশ্যই প্রবেশ করে- ঘরে যতই ছবি, মূর্তি ও কুকুর থাকুক না কেন। যেমন: প্রাণ সংহারের দায়িত্বে নিয়োজিত মালাকুল মওত বা মৃত্যু দূত, তাঁর সঙ্গে আগত ফেরেশত মণ্ডলী, মানুষের কার্যবিবরণী লেখার দায়িত্ব প্রাপ্ত কিরামান কাতিবীন বা সম্মানিত লেখক ফেরেশতাবৃন্দ ইত্যাদি।
মোটকথা, এ সকল ছবিকে ঘর থেকে সরানো জরুরি অথবা আসবাব-পত্রে যে সকল প্রাণীর ছবি বা প্রাণীর কার্টুনের ছবি আছে কমপক্ষে সেগুলোর মুখমণ্ডল কালি দিয়ে বা যে কোনভাবে মুছে দেয়া জরুরি। মুখ মণ্ডল তথা চোখ, মুখ, নাক, কান ইত্যাদি মুখাবয়বের চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকলে তার উপর ছবির বিধান প্রযোজ্য হবে না।
সম্ভব হলে ছবি-কার্টুন ও প্রতিকৃতি মুক্ত ঘরে সালাত আদায় করা উত্তম। কিন্তু এ সব প্রাণীর ছবি, কার্টুন ইত্যাদি থাকা স্বত্বেও যদি সালাতের সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে সালাত আদায় করা হয় তাহলে তা সহিহ হবে ইনশাআল্লাহ। তবে যথাসম্ভব এমনটি করা উচিৎ নয়। আল্লাহু আলম।
(১৬০) বাচ্চাদের খেলনা হিসেবে প্রাণীর ছবিযুক্ত কার্টুন, স্টিকার, পুতুল ইত্যাদি ব্যবহার করার হুকুম কি?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদির ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। তাই এগুলো তৈরি করা, ক্রয় করা, বিক্রয় করা, ব্যবহার করা, ঘরে সংরক্ষণ করা ইত্যাদি সবই হারাম।
বাচ্চাদের জন্য প্রাণীর ছবিযুক্ত স্টিকার, কার্টুন, পুতুল ইত্যাদিও নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। অতএব অবিভাবকদের জন্য তাদেরকে এ সব জিনিস খেলনা হিসেবে দেয়া মোটেই উচিৎ নয়। কঠোরভাবে নিষেধ কৃত বিষয়ে ঢিলেমি করা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
অনুরূপভাবে বাচ্চাদেরকে খেলনা হিসেবে হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণীর পুতুল বা প্রতিমূর্তি দেয়া উচিৎ নয়। তবে যদি কস্টেপ বা অন্য কিছু দিয়ে সেগুলোর মুখমণ্ডলের অবয়বগুলো ঢেকে দেয়া হয় বা আগুন বা অন্য কিছু দ্বারা মুছে দেয়া হয় তাহলে আর কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ।
বিনা বাধায় আল্লাহর দরবারে হজ্জ কবুলের উপায়
(১৬১) প্রশ্ন: কেউ যদি চায় তার যে, তার হজ্জ আল্লাহর দরবারে বিনা বাধায় কবুল হোক তাহলে ওই ব্যক্তির কী কী করা উচিৎ? ঈমান ও আমলের কোন বিশেষ দিকগুলির দিকে তাকে যত্নবান হতে হবে?
উত্তর:
নি:সন্দেহ হজ্জ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হলে তার একমাত্র প্রতিদান জান্নাত। হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার অতীতের গুনাহগুলো মোচন করে দেন। এ মর্মে একাধিক হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।
যাহোক নিন্মে আল্লাহর দরবারে হজ্জ কবুলের জন্য কতিপয় নির্দেশনা প্রদান করা হল। এগুলো অনুসরণ করলে আশা করা যায়, মহান আল্লাহ হজ্জ কবুল করবেন। যথা:
 ১. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ সম্পাদন করা।
 ২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পদ্ধতি অনুযায়ী হজ্জ সম্পাদন করা।
 ৩. যেন হজ্জের কোনো আহকাম বা আদব ছুটি না যায় বা কোথাও ভুলত্রুটি না হয় এ জন্য আগে থেকে সহিহ সুন্নাহ অনুযায়ী হজ্জের বিধিবিধানগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করা এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তারপরও ভুল হয়ে গেলে (যথা নিয়মে) ফিদিয়া প্রদান করা এবং আল্লাহর নিকট তওবা করা।
 ৪. সম্পূর্ণ হালাল উপার্জন থেকে হজ্জ সম্পাদন করা।
 ৫. ভালো লোকদের সাথে হজ্জ সফরে গমন করা। এ সময় মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা, মানুষের উপকার করা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া এবং যথাসম্ভব কুরআন তিলাওয়াত, দুআ, নফল সালাত, তাসবিহ, যিকির-আযকার, দান-সদকা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে সময় কাটানো।
 ৬. হজ্জ সফরে অধিক পরিমাণে তওবা-ইস্তিগফার করা।
 ৭. মানুষের অধিকার নষ্ট করে থাকলে প্রাপককে তার পাওনা ফেরত দেয়া, কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার করে থাকলে তার নিকট ক্ষমা চাওয়া বা যে কোনো মূল্যে তা নিষ্পত্তি করা।
 ৮. হজ্জে গিয়ে সব ধরণের অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে দুরে থাকা।
 ৯. হজ থেকে ফিরে এসে যথাসাধ্য শিরক-বিদআত সহ সকল প্রকার আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাকা এবং বাকি জীবন ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় কাটানোর জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার করা। তারপরও ভুলত্রুটি হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।
মোটকথা, এমন আন্তরিকতা সহকারে সঠিক পদ্ধতিতে হজ সম্পাদনের চেষ্টা করতে হবে যেন মনের মধ্যে এই ধারণা জন্মে যে, আল্লাহর তাআলা হজ কবুল করেছেন। সেই সাথে কবুলের জন্য তাঁর দরবারে দুআও করতে হবে।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
ফরয কাযা রোযা এবং নফল রোযা রাখার নিয়ত করার পর তা ভেঙ্গে ফেলার বিধান
(১৬২) প্রশ্ন: নফল রোজা রাখার নিয়ত করে যদি তা রাখতে না পারি তাহলে কি গুনাহ হবে? আর তা কি আবার রাখতেই হবে?
অনুরূপভাবে যদি রমাযানের ফরয রোযা বা মানতের রোযা রাখার পর তা ভেঙ্গে ফেলি তাহলে কি গুনাহ হবে?
উত্তর:
কেউ যদি নফল রোযা রাখার নিয়ত করে রোযা শুরু করে তাহলে তা ইচ্ছে করলে ভেঙ্গে ফেলা জায়েয আছে। তবে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া না ভঙ্গ করাই উত্তম। যেমন: অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত কষ্ট, শারীরিক অসুস্থতা, মেহমানের আগমন, বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
  হাদিস বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا، فَقَالَ: «هَلْ عِنْدَكُمْ شَيْءٌ؟»، فَقُلْتُ: لَا، قَالَ: «فَإِنِّي صَائِمٌ»، ثُمَّ مَرَّ بِي بَعْدَ ذَلِكَ الْيَوْمِ وَقَدْ أُهْدِيَ إِلَيَّ حَيْسٌ فَخَبَأْتُ لَهُ مِنْهُ، وَكَانَ يُحِبُّ الْحَيْسَ، قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّهُ أُهْدِيَ لَنَا حَيْسٌ فَخَبَأْتُ لَكَ مِنْهُ، قَالَ: «أَدْنِيهِ أَمَا إِنِّي قَدْ أَصْبَحْتُ وَأَنَا صَائِمٌ فَأَكَلَ مِنْهُ»، ثُمَّ قَالَ: «إِنَّمَا مَثَلُ صَوْمِ الْمُتَطَوِّعِ مَثَلُ الرَّجُلِ يُخْرِجُ مِنْ مَالِهِ الصَّدَقَةَ، فَإِنْ شَاءَ أَمْضَاهَا، وَإِنْ شَاءَ حَبَسَهَا»
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আমার কাছে আসলেন এবং বললেন: তোমার কাছে কি খাওয়ার কিছু আছে?
আমি বললাম: না।
তিনি বললেন: তাহলে আমি রোযার নিয়ত করে নিলাম।
এরপর তিনি আরেক দিন আমার কাছে আসলেন এবং সে দিন আমাকে কিছু “হায়স” (খেজুর এবং ঘি ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত এক প্রকার খাদ্য), উপহার দেওয়া হয়েছিল, আমি তা থেকে কিছু রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য রেখে দিয়েছিলাম। আর তিনি হায়স খুব পছন্দ করতেন।
তিনি বললেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আমাকে কিছু হায়স উপহার দেওয়া হয়েছিল, আমি সেখান থেকে আপনার জন্য কিছু পৃথক করে রেখে দিয়েছি।
তিনি বললেন: নিয়ে এসো, আমি তো আজকে সকালে সাওমের নিয়ত করে ফেলেছিলাম।
অতঃপর তা থেকে খেলেন। তারপর বললেন:
“নফল রোযার দৃষ্টান্ত হল ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে স্বীয় ধন-ম্পদ থেকে দান করার নিয়তে কিছু মাল বের করল। এখন সে ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তা দানও করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে রেখেও দিতে পারে।”
[সুনান নাসাঈ, অধ্যায়: সাওম (রোযা), পরিচ্ছেদ: সাওমের নিয়ত এবং এবং এ প্রসঙ্গে আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত হাদীসে তালহা ইবনে ইয়াহ্য়া ইব্ন তালহা (রহঃ) থেকে বিভিন্নতার উল্লেখ, হাদিস নং ২৩২২, সনদ সহিহ]
  অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
উম্মু হানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে আসেন এবং পানি আনতে বলেন। তা হতে তিনি নিজে পান করলেন, তারপর উম্মু হানীকে দিলেন এবং তিনিও তা পান করলেন। তারপর উম্মু হানী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো রোযা রেখেছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
الصَّائِمُ الْمُتَطَوِّعُ أَمِينُ نَفْسِهِ إِنْ شَاءَ صَامَ وَإِنْ شَاءَ أَفْطَرَ
“নফল রোযা পালনকারী নিজের ব্যাপারে আমানতদার (অন্য বর্ণনায়”নফল রোযা পালনকারী নিজের ব্যাপারে কর্তৃত্ব শীল)। সে ব্যক্তি চাইলে রোযা পূর্ণও করতে পারে আবার ভাঙ্গতেও পারে।”
{সূনান আত তিরমিজী [তাহকীককৃত], অধ্যায়ঃ ৬/ রোযা (সাওম) (كتاب الصوم عن رسول الله ), পরিচ্ছদঃ ৩৪. নফল রোযা ভেঙ্গে ফেলা প্রসঙ্গে, হাদিস নম্বরঃ [732]-সহিহ}
  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল বিশেষজ্ঞ সাহাবী ও অন্যান্যদের মতে নফল রোযা পালনকারী যদি তা ভেঙ্গে ফেলে তাহলে তার উপর কোন কাযা নেই। তবে ইচ্ছা করলে (মুস্তাহাব হিসাবে) সে লোক কাযা আদায় করতে পারে। এ মত সুফিয়ান সাওরী, আহমাদ, ইসহাক ও শাফিঈর।
  আল্লামা খাত্ত্বাবী (রহঃ) বলেন, “এখানে এই বর্ণনায় রয়েছে যে, নফল সিয়াম ভঙ্গ করলে তা কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে কাযার কথা উল্লেখ করেননি। যদি তা ওয়াজিব হত অবশ্যই বর্ণনা করতেন।”
  ফরয রোযা তথা রমাযানের ফরয, মানত, কাফফারা ইত্যাদি রোযা কাযা করার ক্ষেত্রে শরিয়ত সম্মত ওজর (যেমন, সফর, অসুস্থতা ইত্যাদি) ব্যতিরেকে তা ভাঙ্গা শরিয়ত সম্মত নয়।
  কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
“তোমরা তোমাদের আমল বাতিল করো না।” (সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩) এটি নামায, রোযা স সকল প্রকার ফরয ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য-তবে শরিয়ত সম্মত ওজর হলে ভিন্ন কথা।
এ মর্মে নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:
উম্মু হানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন ফাতিমা (রাঃ) এলেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাম পাশে বসলেন। আর উম্মু হানী (রাঃ) ছিলেন তাঁর ডান পাশে। এ সময় একটি দাসী হাতে একটি পাত্র নিয়ে এলো। এতে কিছু পানীয় ছিল। দাসীটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পান পাত্রটি রাখল। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে কিছু পান করে তা উম্মু হানীকে দিলেন। উম্মু হানী (রাঃ)-ও ঐ পাত্র হতে কিছু পান করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি তো রোযা ভঙ্গ করে ফেললাম অথচ আমি রোযা রেখেছিলাম।
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: “তুমি কি রমাযান (রমাযান) মাসের রোযা কাযা বা মানতের রোযা কাযা করছিলে?”
উম্মু হানী (রাঃ) বললেন, না।
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন:
فَلَا يَضُرُّكِ إِنْ كَانَ تَطَوُّعًا
“নফল রোযা হলে কোন ক্ষতি হবে না।”
(আবূ দাঊদ, তিরমিযী, দারিমী), শাইখ আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন-সহিহ আবু দাউদ মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে: فلا بأس عليك “তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।”)
অর্থাৎ যদি নফল রোযা ভঙ্গ করো তাহলে তাতে তোমার কোন ক্ষতি নেই কিন্তু যদি ওজর ছাড়া ফরয রোযা ভঙ্গ করো তাহলে এতে তোমার ক্ষতি রয়েছে অর্থ এতে তোমার গুনাহ হবে।
তবে কেউ যদি শরিয়ত সম্মত ওজর ছাড়া ফরয কাযা রোযা ভঙ্গ করে তাহলে এ জন্য তওবা করত: অনতিবিলম্বে তা পূরণ করে নিবে।
আল্লাহু আলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে অন্ত:স্বত্বা স্ত্রীর সাথে সহবাস এবং তার খাওয়া-দাওয়া ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ঃ
(১৬৩) প্রশ্ন: বর্তমানে ডাক্তাররা গর্ভবতী নারীদের উদ্দেশ্যে বলে থাকে যে, গর্ভ ধারণের ১ম তিন মাস এবং শেষ তিন মাস স্বামী সহবাস করা ঠিক নয়। এ সময় বাম কাত হয়ে শুলে গর্ভস্থ সন্তান ভালো থাকে, গর্ভাশয়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয়। এ ছাড়াও এ সময় দূরে সফর করা এবং ভারি কাজ করা উচিৎ নয়। তাছাড়া মান সম্মত পুষ্টিকর খাবার খেলে প্রসূতি মা ও গর্ভস্থ সন্তান ভালো থাকে ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন হল, ইসলাম কি এ সকল বিধিবিধান সমর্থন করে? গর্ভবতী নারীদের কি এ সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলা উচিৎ?
উত্তর:
বৈষয়িক ও স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার ওপরে নির্ভরশীল। সুতরাং বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সকল আচরণ গর্ভবতী নারীর জন্য ক্ষতিকারক এবং যে সকল কার্যক্রম তাদের জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে সেগুলো অনুসরণ করতে ইসলাম বাধা দেয় না। ইসলাম বৈষয়িক ক্ষেত্রে সব সময় উপকারী ও কল্যাণকর বিষয়কে সমর্থন করে-যদি না তাতে শরিয়া বিরোধী কোনো কিছু থাকে।
  গর্ভকালীন স্ত্রী সহবাস করা:
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষ্য হল, “যদি গর্ভকালীন অবস্থা স্বাভাবিক ভাবে চলমান থাকে তাহলে সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত সহবাস করা যায়। সহবাসের সময় স্বাভাবিক নড়াচড়া গর্ভের শিশুর কোন ক্ষতি করে না। শিশু তলপেট এবং জরায়ুর শক্ত পেশী দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। জরায়ুর মুখ মিউকাস প্লাগ দ্বারা সীল করা থাকে। সহবাসের সময় পুরুষেরে গোপনাঙ্গ গর্ভের শিশু পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই গর্ভে শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা নেই।”
আর ইসলামী শরিয়ায় অনুযায়ীও অন্ত:সত্তা নারীর শারীরিক কোন সমস্যা না থাকলে সন্তান গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস, শেষ তিন মাস বা এর মধ্যবর্তী সময়ে স্বামী-স্ত্রীর মিলনে সমস্যা নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করা নিঃসন্দেহে উত্তম। এ ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ جُدَامَةَ بِنْتِ وَهْبٍ الأَسَدِيَّةِ أَنَّهَا سَمِعَتْ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَنْهَى عَنِ الْغِيلَةِ حَتَّى ذَكَرْتُ أَنَّ الرُّومَ وَفَارِسَ يَصْنَعُونَ ذَلِكَ فَلاَ يَضُرُّ أَوْلاَدَهُمْ . قَالَ مُسْلِمٌ وَأَمَّا خَلَفٌ فَقَالَ عَنْ جُذَامَةَ الأَسَدِيَّةِ . وَالصَّحِيحُ مَا قَالَهُ يَحْيَى بِالدَّالِ .
জুদামাহ্ বিনতে ওয়াহব আসাদিয়্যাহ্ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “আমি গীলা তথা স্তন্য দায়িনী অথবা অন্ত:সত্তা স্ত্রী সঙ্গম নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ইচ্ছে করলাম। এরপর আমার নিকট আলোচনা করা হল যে, রোম ও পারস্যের লোকরা এ সময় সহবাস করে কিন্তু এতে তাদের গর্ভস্থ সন্তানের কোন ক্ষতি হয় না।”
(সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: বিবাহ ‘গীলাহ্’ অর্থাৎ স্তন্য দায়িনী স্ত্রীর সাথে সঙ্গমের বৈধতা এবং ‘আয্ল মাকরূহ হওয়া প্রসঙ্গে, হা/৩৪৫৬)
অর্থাৎ তৎকালীন রোম ও পারস্য দেশে সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় বা সন্তানকে দুধ পান করানোর সময় স্ত্রী সহবাসের বিষয়টি প্রচলিত ছিলো। কিন্তু এতে তাদের কোন ক্ষতি হয় নি – রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তা জানতে পেরে এই অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর সহবাস করাকে নিষেধ করেন নি।
গর্ভবতী মহিলার স্বাস্থ্য সম্মত ও পুষ্টিকর খাবার:
গর্ভবতী নারীর জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্য সম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। কেননা, এতে মা ও ভ্রূণের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়েছ: “খাদ্য ঘাটতিতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের সন্তান হয় ওজনে কম ও লম্বায় ছোট। বহু ক্ষেত্রে গর্ভেই সন্তান মরে যায়, জন্মের কিছু সময় পর সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হয়, গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে, সময় হওয়ার আগেই সন্তানের জন্ম হয়ে যায়, ফলে শিশু থাকে অপরিণত।”
এ কারণে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদরা গর্ভবতী মায়েদের শরীরের যত্ন নিতে এবং পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যপ্রদ খাবার গ্রহণের সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
গর্ভাবস্থায় দীর্ঘ সফর:
গর্ভ অবস্থায় দীর্ঘ সফর ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই যথাসম্ভব এ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ডাক্তারগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু নিয়ম-কানুন মেনে আরামদায়ক সফর করা যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় পরিশ্রম ও ভারী কাজ করা:
গর্ভাবস্থায় একজন মা কতোটা পরিশ্রম করবেন তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়৷ সাধারণভাবে বলা যায়, মা গর্ভাবস্থায় তার স্বাভাবিক সংসারের সব কাজই করবেন৷ তবে প্রথম তিন মাস এবং শেষের দু-এক মাস খুব ভারী বা পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো৷ যেমন- কাপড় কঁাচা, ভারী জিনিস তোলা, পানি আনা, ধান ভানা ইত্যাদি না করা৷ গর্ভাবস্থায় সিঁড়িতে ওঠা-নামার সময় যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত৷
  অন্ত:স্বত্বা নারীর বাম দিকে শোয়ার বিষয়টি যদি বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ডাক্তারি নির্দেশনা মোতাবেক তার জন্য উপকারী হয়ে থাকে তাহলে সে ভাবে শুতে কোন সমস্যা নেই। আল্লাহু আলম।

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রচলিত কুসংস্কার এবং আমাদের করণীয়
(১৬৪) প্রশ্ন: আমাদের সমাজে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মাকে অনেক নিয়ম পালন করতে বলা হয় এবং অনেক কিছুতে বাধা দেয়া হয়। অন্যথায় গর্ভস্থ সন্তানের নাকি ক্ষতি হয়। এ বিষয়টি কুরআন-হাদিসের আলোকে কতটুকু সঠিক? এবং চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ কালে আমাদের কী করা উচিত?
উত্তর:
নি:সন্দেহে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগত ও মহাবিশ্বের মধ্যে দুটি বিশাল প্রাকৃতিক পরিবর্তন-যা মহান আল্লাহর অসীম শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে।
বিজ্ঞান বলে, চাঁদ যখন পরিভ্রমণ অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই সূর্যগ্রহণ (Solar eclipse) বা কুসুফ। আর পৃথিবী যখন তার পরিভ্রমণ অবস্থায় চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখনই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই চন্দ্রগ্রহণ (Lunar eclipse) বা খুসুফ।
সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় করণীয়:
এ সময় সকল মুসলিমদের জন্য করণীয় হল, সালাতুল কুসুফ/খুসুফ বা চন্দ্রগ্রহণ/সূর্যগ্রহণের সালাত আদায় করা, আল্লাহর কাছে নিজেদের পাপাচারের জন্য ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাকবীর পাঠ করা, আল্লাহর নিকট দুআ করা, দান-সদকা করা এবং এত বড় নিদর্শন দেখে মহান আল্লাহর প্রতি মনে ভয়-ভীতি জাগ্রত করা। এগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য-এমনকি একজন গর্ভবতী নারীর জন্য।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহধর্মিণী মা জননী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ مِنْ آيَاتِ اللهِ، وَإِنَّهُمَا لَا يَنْخَسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ، وَلَا لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُمَا فَكَبِّرُوا، وَادْعُوا اللهَ وَصَلُّوا وَتَصَدَّقُوا،
”সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর কুদর (ক্ষমতার) বিশেষ নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ হয় না। অত:এব যখন তোমরা সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পাও, তখন তাকবীর বলো, আল্লাহর নিকট দু’আ করো, সালাত আদায় করো এবং দান-সদকা করো।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: [1964], অধ্যায়ঃ ১১/ সালাতুল কুসূফ (كتاب الكسوف) ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
  সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণকে কেন্দ্র করে সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার:
সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে আমাদের সমাজে (বিশেষ করে প্রসূতি মাদের বিষয়ে) অনেক কুসংস্কার ও ভুল বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন:
– এ সময় কোন কিছু খেতে নেই। বলা হয়, সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা এবং চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা বারণ!
– এ সময় তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হবে!
– এ সময় যৌন সংসর্গ করা যাবে না!
– গর্ভবতী মায়েরা এ সময় যা করে, তার প্রভাব সন্তানের ওপর পড়বে!
– সূর্যগ্রহণে গর্ভবতী মায়েদের কাত হয়ে শুতে বারণ নইলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়!
– সূর্যগ্রহণের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপারে দুই ধরনের গপ্প শুনতে পাওয়া যায়। এক, শিশুটি অসুস্থ হবে এবং দুই, শিশুটি চালাক হবে!
– প্রসূতি মা সূর্যগ্রহণ দেখলে তার অনাগত সন্তানের বিকলঙ্গ হবে!
– চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়—এ গুলো সবই কুসংস্কার ও ভুল বিশ্বাস।
– এ সময় কোনো নারীকে ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করাও অন্যায়।
এছাড়া গর্ভবতী নারীর করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে সমাজে বহু কিছু প্রচলিত রয়েছে সেগুলো সব কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত ধারণা।আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন। ইসলামী শরিয়াহ ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়।
জাহেলি যুগেও এ ধরণের কিছু ধারণা প্রচলিত ছিল। সেকালে মানুষ ধারণা করত যে, চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ হলে অচিরেই দুর্যোগ বা দুর্ভিক্ষ হবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষের জন্ম বা মৃত্যুর বার্তাও বহন করে বলে তারা মনে করত। বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু, মহান সংস্কারক, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোকে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মুগিরা ইবনে শুবা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হলে আমরা বলাবলি করছিলাম যে, নবী পুত্রের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এসব কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ তাআলার অগণিত নিদর্শনের দুটি। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না।” (সহিহ বুখারি :১০৪৩)
সুতরাং চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের মাঝে যে সকল কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে সেগুলো দূর করার জন্য দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে উম্মতকে যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে সেগুলো পালনে সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
কোনো অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলে তার জন্য কী কী করণীয়?
(১৬৫) প্রশ্ন: একজন হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। তাকে ইসলামে ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য কী কী কাজ করতে হবে?
উত্তর:
ইসলাম অত্যন্ত সহজ, সুন্দর ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। এটি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার চূড়ান্ত মনোনীত দ্বীন এবং মানবতার মুক্তির একমাত্র ঠিকানা। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। একজন অমুসলিম যখন ইসলামে ছায়াতলে প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর অতীত জীবনের সকল পাপ রাশী মোচন করে তাকে নির্মল, পরিশুদ্ধ ও সম্পূর্ণ নিষ্পাপ মানুষে পরিণত করেন। যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ
“ইসলাম পূর্ববর্তী সকল পাপ মিটিয়ে দেয়।“ (সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: ইসলাম গ্রহণ এবং হিজরত ও হজ্জ পালনের দ্বারা পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। হা/২২০)
যাহোক, কোনো অমুসলিম যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাহলে তার জন্য সহজ কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন:
 ১) ইসলাম গ্রহণ কারতে ইচ্ছুক ব্যক্তি প্রথমে মনের মধ্যে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর প্রেরিত দূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণ এবং তা পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
 ২) অত:পর আরবিতে এই সাক্ষ্য বাণী পাঠ করবে (অথবা কেউ তাকে পাঠ করে শুনাবে আর সে তা শুনে শুনে পাঠ করবে):
“আশহাদু আল্লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ ওয়া আন্না মুহাম্মদার রাসূলুল্লাহ।”
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল বা প্রেরিত দূত।
এই ‘সাক্ষ্য বাণী’ উচ্চারণের সাথে সাথে সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। একজন ব্যক্তি যদি একাকী তার নিজের ঘরে বসেও এই কালিমা পাঠ করে তাহলেও সে মুসলিম হয়ে যাবে। এ জন্য আলাদা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। আর ইসলামে প্রবেশের সাথে সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ও পূত-পবিত্র মানুষে পরিণত হবে। অর্থাৎ কালিমা পাঠ করার পরপরই যদি সে মারা যায় তাহলে সে সরাসরি জান্নাতে প্রবেশ করবে-সুবহান আল্লাহ!
 ৩) এরপর গোসল করা উত্তম। কেননা, কালিমা শাহাদাহ উচ্চারণ তথা ঈমান আনয়নের মাধ্যমে অন্তরাত্মা পবিত্র হয় আর গোসলের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয়।
 ৪) ওযু এবং নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা শুরু করতে হবে।
 ৫) তাওহীদ, শিরক, ওযু, গোসল, নামায, যাকাত, রোযা, হজ ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে।
 ৬) ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির নাম যদি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তা পরিবর্তন করে একটি সুন্দর অর্থবোধক ইসলামী নাম গ্রহণ হবে।
 ৭) এবং ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি পুরুষ হলে সময় সাপেক্ষে তার খতনার ব্যবস্থা করতে হবে। (এটি অধিক অগ্রাধিকারযোগ্য মতানুসারে সুন্নতে মুআক্কাদা)
 ৮) মুসলিমদের উচিৎ, নব দীক্ষিত মুসলিম ভাইকে স্বাগত জানানো এবং তার সাথে সুন্দর আচরণ করা। তৎসঙ্গে সে যদি আর্থিক সমস্যায় থাকে তাহলে বা আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা লাঘবের চেষ্টা করা নি:সন্দেহে উত্তম কাজ।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
বিনা প্রয়োজনে ছবি তোলা প্রসঙ্গে জানতে চাই
(১৬৬) প্রশ্ন: বিনা প্রয়োজনে ছবি তোলা প্রসঙ্গে জানতে চাই। বর্তমানে ফেসবুকে মেয়েরা হিজাব পরিধান করে মুখ খোলা রেখে ছবি দিচ্ছে, একে অপরকে ট্যাগ করছে এবং তাদের স্বামীরা তাদের ওয়াইফের ছবি পোস্ট করছে । বিনা প্রয়োজনে আসলে এগুলা করা আর কতটুকু যুক্তিসঙ্গত ?এটা কোন পর্যায়ে পড়বে? একটু জানাবেন।
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে একান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে ছবি তোলা জায়েয নেই। বিশেষ করে ফেসবুকে মহিলাদের হিজাব পরিধান করা অথচ মুখ খোলা কিংবা হিজাব ছাড়া বেপর্দা ছবি আপলোড করা আরও গর্হিত কাজ। কারণ, সন্দেহাতীতভাবে তা তার নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ফিতনা ও ক্ষতির কারণ।
আর কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর বেপর্দা ছবি ফেসবুকে আপলোড, শেয়ার বা ট্যাগ দেয় তাহলে সে স্বামী দাইউস হিসেবে গণ্য হবে। আর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দাইঊস ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটি ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাহীন কাজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এমনকি পর্দা পরানো অবস্থায়ও স্ত্রীর ছবি ফেসবুকে দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সামনে প্রদর্শণীয় বানানো নিতান্ত গর্হিত কাজ। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
কোন মহিলা নিজে বা তার স্বামী ফেসবুকে হিজাব পরিধান করে পর্দা সহকারে মুখ খোলা অথবা বেপর্দা ছবি আপলোড দিয়ে থাকলে তাতে লাইক দেয়া বা তাতে কমেন্ট করাও গুনাহের শামিল। কেননা, এতে করে সেই ছবি অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয়া হল এবং সে ব্যক্তিকে আরও উৎসাহিত করা হল। বরং উচিৎ হল, সে ব্যক্তিকে পার্সোনালভাবে নসিহত করা যেন স, তা মুছে ফেলে এবং ভবিষ্যতে আর না দেয়। আল্লাহ আলাম।
(১৬৭) প্রশ্ন: আমরা জানি, ইসলামে গান-বাজনা হারাম। এখন প্রশ্ন হল, ”বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সন্তানরা যদি গান-বাজনায় লিপ্ত হয় তাহলে কবরে বাবা-মার উপর শাস্তি বৃদ্ধি যায়” এ কথাটি কি সত্য?
উত্তর:
ইসলামে গান-বাজনা করা বা শোনা হারাম। এ দ্বারা অন্তর কলুষিত হয়, মনের সুপ্ত বাসনা (কু প্রবৃত্তি) জাগ্রত হয়, অন্তর রোগাক্রান্ত হয় ফলে ধীরে ধীরে অন্তরে , কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য ও উপদেশপূর্ণ ভালো কথার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয় এবং কুরআন তিলাওয়াত শুনার আগ্রহ হারিয়ে যায় ইত্যাদি। সুতরাং গানবাজনা থেকে দূরে থাকা জরুরি।
তবে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সন্তানরা যদি গান-বাজনা করে তাহলে তাদের কবরে শাস্তি বৃদ্ধি পায়-এ কথা ঠিক নয়।
অবশ্য যদি বাবা-মা দুনিয়াতে বেঁচে থাকা অবস্থায় সন্তানকে গানবাজনা শিক্ষার ব্যবস্থা করে যায় বা তাদেরকে এতে বাধা না দেয় বা তাদেরকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা না দিয়ে থাকে তাহলে বাবা-মার কবরে থেকেও সন্তানের সকল পাপাচার ও অন্যায়-অপকর্মের ভাগীদার হবে। কারণ তারাই সন্তানের বিপথে যাওয়ার পেছনে মূল দায়ী।
তাদের দায়িত্ব ছিলো সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে গড়ে তোলা, বাল্যকাল থেকে হারাম, অশ্লীল, গান-বাজনা ইত্যাদি আল্লাহর নাফরমানি মূলক কার্যক্রম থেকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা এবং ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে নি। আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
”হে ইমানদারগণ, তোমারা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গ (স্ত্রী-সন্তানদেরকে) জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।” (সূরা তারহীম: ৬)
অতএব তারা সন্তানদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ না নিলে সন্তানদের পাপাচারিতা ও অন্যায়-অপকর্মের দায়ভার তাদেরকেও বহন করতে হবে। এমন কি তারা মারা যাওয়ার পরও সন্তানের গুনাহের একটা অংশ তাদের আমলনামায় জমা হতে থাকবে। (আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ سَنَّ سُنَّةَ خَيْرٍ فَاتُّبِعَ عَلَيْهَا فَلَهُ أَجْرُهُ وَمِثْلُ أُجُورِ مَنِ اتَّبَعَهُ غَيْرَ مَنْقُوصٍ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ سَنَّ سُنَّةَ شَرٍّ فَاتُّبِعَ عَلَيْهَا كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهُ وَمِثْلُ أَوْزَارِ مَنِ اتَّبَعَهُ غَيْرَ مَنْقُوصٍ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئًا
“কেউ ভালো কাজের প্রচলন করলে এবং তার অনুসরণ করা হলে সে তার নিজের সাওয়াবও পাবে এবং তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে, তবে তাদের সাওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না। আবার কেউ মন্দ কাজের প্রচলন করলে এবং তার অনুসরণ করা হলে তার উপর নিজের গুনাহ বর্তাবে উপরন্তু তার অনুসারীদের সম-পরিমাণ গুনাহর অংশীদারও হবে, কিন্তু তাতে অনুসরণকারীদের গুনাহর পরিমাণ একটুও কমানো হবে না।” (সহীহঃ ইবনে মাজাহ (২০৩), মুসলিম)
এ মর্মে বহু হাদিস রয়েছে।
অবশ্য বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে দ্বীন শিক্ষায় শিক্ষিত করার পর বা গানবাজনা, অশ্লীলতা ও সব ধরণের আল্লাহর নাফরমানী মূলক কার্যক্রম থেকে সতর্ক করার পরও তারা যদি বাবা-মার কথা ও নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে নিজেরা এ সব গুনাহের কাজে লিপ্ত হয় তাহলে পিতামাতার উপর কোনও দায়-দায়িত্ব বর্তাবে না এবং এ জন্য তারা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
আল্লাহু আলাম
জন্মদিন পালন করা এবং এ উপলক্ষে উইশ করা ও উপহার লেনদেন করার বিধান
(১৬৮) প্রশ্ন: আমরা জানি জন্মদিন পালন করা বিদআত যেহেতু এইটা বিজাতীয়দের কালচার। এখন কেউ যদি আমাকে জন্মদিন এর সময় উইশ করে বা গিফট দেয় এতে আমার করণীয় কি? আমাকে উইশ করলে কি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা যাবে?
উত্তর:
জন্মদিন (Birthday) পালন করা এবং এ উপলক্ষে উইশ (wish) করা বা গিফট লেনদেন করা শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ তা অমুসলিমদের সংস্কৃতি। আর ইসলামে অমুসলিমদের অনুসরণ-অনুকরণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ-চাই তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক অথবা আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি বা কৃষ্টি-কালচারের ক্ষেত্রে হোক। কেননা হাদিসে এসেছে:
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।” [সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ হা/৪০৩১-হাসান সহিহ]
এছাড়াও হাদিসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে অনেক মুসলিম ইহুদি-খৃষ্টানদের রীতি-নীতি অনুসরণ করবে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছেন-বর্তমানে যার বাস্তব প্রতিফলন আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
সাহাবী আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حذو القذة بالقذة حَتَّى لَوْ دخلوا جُحْرَ ضَبٍّ لَدخلتتُمُوهُ قالوا: يَا رسول الله الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى. قَالَ: فَمَنْ؟»
‘‘তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী উম্মতদের অভ্যাস ও রীতি-নীতির ঠিক ঐ রকম অনুসরণ করবে, যেমন এক তীরের ফলা অন্য এক তীরের ফলার সমান হয়। অর্থাৎ তোমরা পদে পদে তাদের অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি শাণ্ডা (মরুভূমিতে বসবাসকারী গুই সাপের ন্যায় এক ধরণের জন্তু বিশেষ) এর গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে।”
সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী উম্মত দ্বারা আপনি কি ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বোঝাচ্ছেন?
তিনি বললেন: তবে আর কারা?
[বুখারী, অধ্যায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: ”তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতির অনুসরণ করবে।” তবে বুখারীর বর্ণনায় حذو القذة بالقذة – এই শব্দসমূহ নেই। তার স্থলে شبرا بشبر وذراعا بذراع শব্দগুলো রয়েছে। অর্থাৎ এক হাতের বিঘত যেমন অন্য হাতের বিঘতের সমান হয় এবং এক হাতের বাহু অন্য হাতের বাহুর সমান হয়।]
যা হোক, ইসলামে যেহেতু জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করার অস্তিত্ব নেই সেহেতু অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বনে জন্মদিবস (Birth Day) পালন করার সুযোগ নাই।
সুতরাং এ উপলক্ষে কাউকে উইশ (wish) করা, শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো, গিফট দেয়া, কেক কাটা, মোমবাতি জ্বালানো বা ফুঁ দিয়ে নিভানো, বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা, জন্ম দিনের পার্টি করা সবই হারাম।
কোন মুসলিম ব্যক্তি অজ্ঞতা বশত: এমনটি করলে তাকে নিষেধ করতে হবে এবং এ সম্পর্কে ইসলামের বিধান জানাতে হবে। কিন্তু কেউ যদি আপনার জন্ম দিবসে উপহার নিয়ে হাজির হয়ে যায় বা উইশ করে আর তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করলে বা উপহার ফেরত দিলে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে (সম্পর্ক নষ্ট হলে দাওয়াতের পথ বন্ধ হয়ে যাবে) তাহলে দাওয়াতের বৃহত্তর স্বার্থেে আপাত:ত তার উপহার গ্রহণ করত: ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে। তবে তার কাছে ইসলামের বিধানটি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে যে, ইসলামে জন্ম দিবস পালন করা বা এ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান-আয়োজন করা, ইউশ বা উপহার বিনিময় করা বৈধ নয়। তাকে এও বলতে হবে যে, ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এমটি না করে এবং আপনিও তার জন্ম দিবসে উদযাপনে অংশ নিবেন না।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
নির্জনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পর্দা কতটুকু?
(১৬৯) প্রশ্ন: যখন স্বামী-স্ত্রী নির্জনে সময় কাটায় তখন তাদের মাঝে কতটা পর্দা রক্ষা করা জরুরি? (একান্ত ঘনিষ্ঠ সময় ছাড়া বাকি সময়গুলোতে)। কেননা আমাদের আশে পাশে সর্বদা জিন ও ফেরেশতাগণ ঘুরা ফেরা করে।
উত্তর:
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনও পর্দা নেই। আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের জন্য ‘পোশাক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ হালাল করেছেন। সুতরাং তারা নির্জনে যেভাবে খুশি একে অপরের সামনে থাকতে পারে এবং আনন্দ-বিনোদন করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
“তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।” (সূরা বাকারা: ১৮৬)
তাফসিরে কুরতুবিতে এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে:
“পোশাক মূলত: কাপড়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য পোশাক বলা হয়েছে এ জন্য যে, দেহের সাথে দেহের সংযোগ ঘটে, একে অপরের সাথে মিলিত হয় এবং পোশাকের মত একে অপরের সঙ্গে থাকে।” (সূরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা, তাফসিরে কুরতুবী)
এ ছাড়াও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
ﻋَﻦْ ﺑَﻬْﺰِ ﺑْﻦِ ﺣَﻜِﻴﻢٍ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ ﻋَﻦْ ﺟَﺪِّﻩِ ﻗَﺎﻝَ ﻗُﻠْﺖُ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻋَﻮْﺭَﺍﺗُﻨَﺎ ﻣَﺎ ﻧَﺄْﺗِﻰ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺬَﺭُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺣْﻔَﻆْ ﻋَﻮْﺭَﺗَﻚَ ﺇِﻻَّ ﻣِﻦْ ﺯَﻭْﺟَﺘِﻚَ ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﻳَﻤِﻴﻨُﻚَ ﻗَﺎﻝَ ﻗُﻠْﺖُ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﺫَﺍ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡُ ﺑَﻌْﻀُﻬُﻢْ ﻓِﻰ ﺑَﻌْﺾٍ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻥِ ﺍﺳْﺘَﻄَﻌْﺖَ ﺃَﻥْ ﻻَ ﻳَﺮَﻳَﻨَّﻬَﺎ ﺃَﺣَﺪٌ ﻓَﻼَ ﻳَﺮَﻳَﻨَّﻬَﺎ ﻗَﺎﻝَ ﻗُﻠْﺖُ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﺫَﺍ ﻛَﺎﻥَ ﺃَﺣَﺪُﻧَﺎ ﺧَﺎﻟِﻴًﺎ ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺃَﺣَﻖُّ ﺃَﻥْ ﻳُﺴْﺘَﺤْﻴَﺎ ﻣِﻨْﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ .
বাহয বিন হাকিম তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা হ’তে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের আবরণীয় অঙ্গসমূহ কার সামনে আবৃত রাখব এবং কার সামনে অনাবৃত করতে পারি?
তিনি বললেন: “তোমার স্ত্রী ও দাসী (*) ব্যতীত সকলের সামনে তা আবৃত রাখ।”
কেউ যদি বাড়িতে প্রবেশের সময় সালাম দেয়, প্রবেশের দুআ পাঠ করে, সকাল-সন্ধ্যার তাসবীহ ও জিকিরগুলো পড়ে, ঘরে সূরা বাকারা তিলাওয়াত করে এবং নফল সালাত আদায় করে তাহলে জিন-শয়তান বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহু আলাম।
ফুটনোট:
(*) উল্লেখিত হাদিসে ‘দাসী’ বলতে কাকে বুঝানো হয়েছে?
উত্তর:
ইসলামে ‘দাসী’ বলতে বুঝানো হয়, মুসলিম ও কাফেরদের মাঝে সংঘটিত যুদ্ধে বিজয়ী মুসলিমদের হাতে যুদ্ধবন্দী কাফের নারীগণ।
মুসলিম সেনাপতি সে সকল যুদ্ধবন্দি নারীদেরকে যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করবেন। অত:পর তারা তাদের বাসস্থান ও ভরন-পোষণের ব্যবস্থা করবে এবং তাদের এক হায়েয অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের সাথে সহবাস করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রয়োজন নাই।
ক্রয় করার মাধ্যমেও মালিক দাসীর মালিক হওয়া জায়েয আছে।
আল্লাহ তাআলা সফলকাম মুমিনের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ
“যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না।” সূরা মুমিনূন: ৫ ও ৬)
উল্লেখ্য যে, এ সকল দাসীরা স্ত্রী মর্যাদা না পেলেও তাদের প্রতি করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে ইসলামে চমৎকার নির্দেশনা রয়েছে।
কুরআন ও হাদিসে দাস-দাসী মুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানের কাফফারা হিসেবে (যেমন: মানত ও কসম ভঙ্গ, স্ত্রীর সহবাসের মাধ্যমে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ ইত্যাদি ক্ষেত্রে) দাস-দাসী মুক্তির বিষয়টিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন তাদের মুক্তির পথ সুগম হয়। বর্তমান যুগে দাস-দাসীর অস্তিত্ব নেই।
জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত নারীগণ
(১৭০) প্রশ্ন: মহিলা সাহাবীদের মধ্যে কি কেউ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হয়েছেন? হলে তাদের নাম কি?
উত্তর:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহির মারফতে কতিপয় পুরুষ সাহাবীর পাশাপাশি কতিপয় মহিলার ব্যাপারে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। কিন্তু পুরুষ সাহাবীদের বিষয়টি সুপ্রসিদ্ধ হলেও মহিলাদের মধ্যে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্তদের সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে।
তাই নিম্নে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সৌভাগ্যবতী মহিলাদের মধ্যে ১২ জনের নামের একটি তালিকা তুলে ধরা হল: (যদিও তাদের সংখ্যা আরও বেশি):
১) আসিয়া আ. (ফেরআউনের স্ত্রী)
২) মরিয়ম বিনতে ইমরান আ. (আল্লাহর রাসূল ঈসা আলাইহিস সালাম এর মা)
৩) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা. (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম এর স্ত্রী)
৪) আয়েশা রা. (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী এবং আবু বকর সিদ্দীক রা. এর কন্যা)
৫) ফাতিমা রা. (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কন্যা ও আলী রা. এর স্ত্রী)
৬) হাফসা রা. (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রী এবং উমর রা. এর কন্যা)
৭) উম্মে সুলাইম রা. (আবু তালহা রা. এর স্ত্রী)
৮) গুমায়সা বিনতে মিলহান রা.
৯) রবী বিনতে মুআওয়ায (মদীনার আনসারী মহিলা সাহাবী- যিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট যুদ্ধের বাইআত নিয়েছিলেন। বাইআত গ্রহণকারী সর্বমোট দু জন মহিলার মধ্যে তিনি একজন)
১০) সুমাইয়া রা. (ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহিদ)
১১) সুয়াইরা আল আসাদিয়া রা.
১২) উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (আনাস রা. এর খালা)
উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত ১২ জন ছাড়াও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত মহিলার সংখ্যা আরও রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান ঐ সকল সৌভাগ্যবান পুরুষ ও সৌভাগ্যবতী নারীদের দলভুক্ত হয়ে মুমিন জীবনের অভীষ্ট লক্ষ এবং অবর্ণনীয় নিয়ামত সমৃদ্ধ চূড়ান্ত প্রত্যাশার নীড় জান্নাতে প্রবেশের তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
মুহররম মাসে কি বিয়ে-শাদী নিষিদ্ধ
(১৭১) প্রশ্ন: লোকমুখে শোনা যায় যে, মুহররম মাসে না কি বিয়ে-শাদী নিষিদ্ধ? এ কারণে অনেক মানুষ এ মাসে বিয়ে করে না এবং বিয়ে দেয়ও না। এটা কি সঠিক?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে মুহররম মাসে বিয়ে-শাদি নিষিদ্ধ নয়। বরং বছরের কোন মাসেই কোন সময়ই বিয়ে-শাদী নিষিদ্ধ নয়। এ মর্মে যে সব কথা প্রচলিত রয়েছে সবই ভিত্তিহীন ও কুসংস্কার।
মুহররম মাস নিয়ে শিয়াদের বাড়াবাড়ি:
মুহররম মাসে বিয়ে-শাদী করা ঠিক নয়- মর্মে প্রচলিত কথাটি শিয়া-রাফেযী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মিথ্যা প্রচারণা হতে পারে। কেননা, এ মাসে (মুহররম মাসের ১০ তারিখে) হুসাইন রা. কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা মিথ্যা মায়াকান্না আর অতিভক্তি দেখিয়ে এ মাসে অনেক বিদআতি কার্যক্রম করে থাকে এবং শরীয়তের অনেক বৈধ জিনিসকে অবৈধ করে থাকে। যেমন তারা বলে, মুহররম মাসে নতুন জামা পড়া যাবে না, গোস্ত-মাছ ইত্যাদি ভালো খাবার খাওয়া যাবে না বরং কেবল নিরামিষ খেতে হবে, বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শুতে হবে, বিয়াশাদী দেয়া বা করা বৈধ নয়…ইত্যাদি। অথচ এ সব কথা শুধু দলীল বহির্ভূত নয় বরং দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন ছাড়া অন্য কিছু নয়। ইসলামী শরিয়ত যা নিষেধ করে নি তা নিষেধ করা মানে দ্বীনের মধ্যে সীমালঙ্ঘন এবং ধৃষ্টতা প্রদর্শন।
নি:সন্দেহে হুসাইন রা. এর মৃত্যুতে আমরা বেদনাহত ও মর্মাহত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে সবরের পরিচয় দিতে হবে এবং তাদের জন্য দুআ করতে হবে। কারণ হুসাইন রা. এর পূর্বে তার পিতা আলী ইবনে তালিব রা., উসমান বিন আফফান রা., উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সহ অসংখ্য সাহাবী শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। অথচ তাদের মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্ব মর্মাহত হলেও এ সব নিয়ে কোন ধরণের বাড়াবড়ি মূলক কার্যক্রম করে না। কেননা ইসলাম কারো মৃত্যু/শাহাদতকে কেন্দ্র করে বিলাপ করা, শরীরে আঘাত করা, শরীর রক্তাক্ত করা, পরিধেয় কাপড় ছেঁড়া, মাটিতে গড়াগড়ি করা, উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা, শোক দিবস পালন করা, কালো পোশাক ও কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক র্যালী ও তাজিয়া মিছিল করা…ইত্যাদি কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ হারাম ও জাহেলিয়াতের কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
“সে ব্যক্তি আমাদের লোক নয় যে গালে চপেটাঘাত করে, জামার পকেট ছিঁড়ে এবং জাহেলিয়াতের মত ডাকে। “ [সহীহ বুখারী: অনুচ্ছেদ: সে আমাদের লোক নয় যে, গালে চপেটাঘাত করে। হাদিস নং ১২৯৭, মাকতাবা শামেলা]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
النِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ
“বিলাপ করা (কারও মৃত্যুতে চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, মৃত ব্যক্তির বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ করে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করা, শরীরে আঘাত করা, জামা-কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি) জাহেলী যুগের কাজ। ” [ইবনে মাজাহ, অনুচ্ছেদ: মৃতকে কেন্দ্র করে চিৎকার করে বিলাপ করা নিষিদ্ধ। আল্লামা আলাবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন: দেখুন: সহীহ ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১২৮৬, মাকতাবা শামেলা] আল্লাহ হেফাজত করুন। আমীন।
সুতরাং মুহররম মাসকে কেন্দ্র করে, আমাদের সমাজে যে সেকল বাতিল ও বিদআতি কার্যক্রম এবং ভিত্তিহীন বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে সেগুলো থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে এবং সামাজিকভাবে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ একদিন আমাদের সমাজ বিদআত ও কুসংস্কারের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ধর্মের নামে সকল অধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
আশুরা তথা মুহররমের ১০ তারিখে রোযা রাখার ফযিলত কি
(১৭২) প্রশ্ন: আশুরা তথা মুহররমের ১০ তারিখে রোযা রাখার ফযিলত কি? এ দিন ভালো খাবারের আয়োজন করলে সারা বছর ভালো খাওয়া যায়-এ কথা কি ঠিক?
উত্তর:
◈◈ আশুরার রোযা রাখার ফযিলত:
বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আশুরা তথা মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোযা রাখলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা পেছনের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দিবেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
আবু কাতাদা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন:
ثَلاثٌ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ فَهَذَا صِيَامُ الدَّهْرِ كُلِّهِ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ
“প্রতি মাসে তিন দিন এবং এক রমাযান থেকে আরেক রমাযান পর্যন্ত রোযা রাখলে সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব অর্জিত হয়। আরাফার দিন রোযা রাখলে আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে পেছনের এক বছরের এবং সামনেরে এক বছরের (মোট দু বছরের) গুনাহ মোচন করবেন। আর আশুরার দিন (মুহররম মাসের ১০ তারিখে) রোযা রাখলে আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে পেছনের এক বছরের গুনাহ মোচন করবেন।” (সহীহ মুসলিম হা/১১৬২)
উল্লেখ্য যে, ৯ ও ১০- দু দিন রোযা রাখা অধিক উত্তম। তবে কোনো কারণে ৯ তারিখে রোযা রাখা সম্ভব না হলে ১০ ও ১১ তারিখে রাখা জায়েজ।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহঃ বলেন: ”মাসের শুরু চিনতে অসুবিধা হলে (৯, ১০ ও ১১ এ) তিন দিন রোযা রাখবে। যেন ৯ ও ১০ তারিখে রোযা নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করা যায়। (মুগনী ৩/১৭৪)
◈◈ আশুরার দিন ভালো খাবারের আয়োজন করা:
‘আশুরার দিন ভালো খাবার খেলে বা মানুষকে খাওয়ালে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে’ এটি একটি বাতিল ও কুসংস্কার পূর্ণ কথা। আল্লাহর দুশমন শিয়া রাফেযী সম্প্রদায়ের পক্ষ এ সব কথা আবিষ্কার করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে আর দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান বঞ্চিত অজ্ঞ-মূর্খ মানুষেরা এ সব কথায় বিশ্বাস করে। জাহেল বিদআতিরা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত (কথিত শবে বরাত) সম্পর্কেও এ ধরণের কথাবার্তা বলে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সব কথা ভিত্তিহীন ও বাতিল।
মোটকথা, ‘এক দিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর ভালো খাবার খাওয়া যাবে’- এই জাতীয় কথা ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না-উপলক্ষ যাই হোক না কেন।
উল্লেখ্য যে, আশুরার দিন নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য খোলা হাতে খরচ করা বা ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করার ব্যাপারে কিছু হাদিস পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো একটিও সহিহ নয় বরং সবগুলো জঈফ বা দুর্বল।
(১৭৩) প্রশ্ন: শিয়ারা আশুরার দিন যে খাবার রান্না করে তা কি খাওয়া জায়েজ হবে? উল্লেখ্য যে, তারা বলে, এই খাবারটা আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিন্তু খাবারের সওয়াব হুসাইন রা. এর উদ্দেশ্য।
আরেকটি কথা হল, আমি যদি তাদের খাবারটা গ্রহণ না করি, তাহলে এতে আমার সমস্যা বা বিপদ হতে পারে। কারণ আমি ইরাকে আছি। আর আপনারা জানেন, তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর সাথে কেমন আচরণ করে।
উত্তরে তিনি বলেন:
هذا منكر شنيع وبدعة منكرة ، يجب تركه ولا تجوز المشاركة فيه ، ولا يجوز الأكل مما يقدم فيه من الطعام “.
وقال : ” ولا تجوز المشاركة فيه , ولا الأكل من هذه الذبائح ، ولا الشرب من هذه المشروبات ، وإن كان الذابح ذبحها لغير الله من أهل البيت أو غيرهم فذلك شرك أكبر ؛ لقول الله سبحانه : ( قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَلا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ) الأنعام/162-163،
وقوله سبحانه : ( إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ) الكوثر /1-2 ”
انتهى منفتاوى الشيخ عبد العزيز ابن باز” (8/320)
“এটি একটি মারাত্মক অন্যায় ও জঘন্য বিদআত। এটি বর্জন করা ওয়াজিব (অবশ কর্তব্য)। এতে অংশ গ্রহণ করা জায়েজ নাই এবং এ দিন যে খাবার পরিবেশন করা হয় তা খাওয়া জায়েজ নাই।
তিনি আরও বলেন:
“এতে অংশ গ্রহণ করা জায়েজ নাই। তাদের এ এসব জবেহ কৃত প্রাণীর গোস্ত খাওয়া বা পানীয় পান করা জায়েজ নাই। আর যদি পশুগুলো জবেহ করে গাইরুল্লাহ তথা আহলে বাইত বা অন্য কারো উদ্দেশ্যে তাহলে এটি শিরকে আকবর (বড় শিরক)। আল্লাহ তাআলা বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَلَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
“আপনি বলুন: আমার সালাত, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্য শীল।” (সূরা আনআম: ১৬২)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
“অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানি করুন।” (সূরা কাওসার: ২) [ফাতাওয়া শাইখ বিন বায ৮/৩২০]
আল্লাহু আলাম।
আলেম ও দ্বীনদার মানুষকে হুজুর বলা কি ঠিক?
(১৭৪) প্রশ্ন: আমাদের দেশে মসজিদের ইমামকে ‘হুজুর’ বলা হয়। এভাবে কাউকে ‘হুজুর’ বলাটা কতটুকু সঠিক? দয়া করে জানাবেন।
উত্তর:
‘হুজুর’ শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত: আলেম, মসজিদের ইমাম ও দ্বীনদার-পরহেযগার মানুষদেরকে ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করা হয়।
নিম্নে এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হল:
‘হুজুর’ শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:
‘হুজুর’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল, উপস্থিত হওয়া।
“পরিভাষায় এটি সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মানসূচক সম্বোধনের জন্য ব্যবহার করা হয়।” (ফার্সী অভিধান গিয়াসুল লুগাত, পৃষ্ঠা/১৭৪)
  অনলাইন ভিত্তিক অভিধান ebanglalibrary.com এ বলা হয়: হুজুর [ hujura] বি. নৃপতি, বিচারপতি, মনিব প্রভৃতিকে সম্মানসূচক সম্বোধন।
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে।
এটি বাংলা ভাষায় জনাব, মহাশয়, মহোদয় ইত্যাদি এবং ইংরেজিতে স্যার এর মত একটি সম্মান সূচক শব্দ।
পূর্ব যুগে রাজা-বাদশাহ, বিচারপতি, মনীব প্রমূখ ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করার রীতি প্রচলিত ছিল।
সুতরাং এ অর্থে হুজুর শব্দের ব্যবহারে কোন দোষ নেই ইনশাআল্লাহ।
 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে হুজুর শব্দের ব্যবহারও প্রচলিত রয়েছে। এখানেও মূলত: তাঁকে সম্মান দেখানোর নিমিত্তে তার শানে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়।
তবে কেউ যদি এ শব্দটির শব্দিক অর্থের দিক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বত্র হাজির-নাজির মনে করে তার শানে এই শব্দ ব্যবহার করে তাহলে নি:সন্দেহে তা জায়েয নয়। কেননা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাজির তথা সর্বত্র উপস্থিত, তিন সব কথা শুনেনন, জানেন ইত্যাদি বিশ্বাস থাকা শিরক। এগুলো একমাত্র আল্লাহর গুণ। আল্লাহর মত আল্লাহর নবীও সব জায়গায় বিরজমান, সবজায়গায় হাজির থাকার বিশ্বাস আল্লাহর সাথে শিরকের নামান্তর।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলা সত্তাগতভাবে সপ্ত আসমানে আরশে আজিমের উপরে অবস্থান করেন কিন্তু তাঁর জ্ঞান, নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব, সার্বভৌম ক্ষমতা ইত্যাদি সর্বত্র বিরাজমান। এটি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা। আল্লাহু আলাম।
(সমাপ্ত)
(১) প্রথম পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(২) দ্বিতীয় পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(৩) তৃতীয় পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(৪) পঞ্চম পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।


মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
 “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

ইসলামের অন্যান্য সকল বিষয় সহিহভাবে জানতে  এর উপর ক্লিক করুনঃ


PLEASE SHARE ON

No comments:

Post a Comment

আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার গুরুত্ব ও ফজিলত ভূমিকা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ...