Search This Blog

Sunday, March 29, 2020

ইসলামি জিজ্ঞাসা ও সহিহ জবাব (পর্ব-১)


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ইসলামি জিজ্ঞাসা ও সহিহ জবাব
(পর্ব-১)
প্রশ্নোত্তর
(১)প্রশ্নঃ  মানুষের সফলতা ও মুক্তি নিহিত আছে কোন তিনটি জিনিসের মধ্যে?
উত্তরঃ
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ عُقبَةَ بنِ عَامرٍ رضي الله عنه قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا النَّجَاةُ ؟ قَالَ: «أَمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ» . رواه الترمذي، وقال: حديث حسن
উকবা বিন আমের রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হে আল্লাহর রসূল, কিসে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?’
তিনি বললেন:
– জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করো।
– তোমার ঘর তোমার জন্য প্রশস্ত হোক। (অর্থাৎ অবসর সময়ে নিজ গৃহে অবস্থান করো।)
– আর নিজ পাপের জন্য ক্রন্দন করো।”
(তিরমিযি, তিনি বলেন: হাদিসটি হাসান। রিয়াদুস সলেহিন, অধ্যায়: নিষিদ্ধ বিষয়াবলী, পরিচ্ছেদ:২৫৪: গিবত (পরনিন্দা) নিষিদ্ধ এবং বাক সংযমের নির্দেশ ও গুরুত্ব-সহিহ)
ব্যাখ্যা:
সাহাবায়ে কেরাম আখিরাতে মুক্তি এবং সফলতার জন্য নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপায় জিজ্ঞাসা করতেন। তাই উকবা বিন আমের রা. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে মুক্তি এবং সফলতার তিনটি উপায়ে বলেছেন। যথা:
১) “জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করো।” এর অর্থ: খারাপ ভাষা ব্যবহার না করা, মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য না দেয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে গালাগালি না করা, কারো প্রতি অপবাদ ও অভিশাপ না করা, মানুষের বদনাম ও সমালোচনা করা থেকে দূরে থাকা, অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি মূলক কথাবার্তা থেকে মুখ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।
কারণ মানুষ মুখ দিয়ে যা কিছু বলে ফেরেশতা মণ্ডলী তা সংরক্ষণ করে নেয় এবং মুখের ভাষার অপব্যবহারের কারণে কিয়ামতের দিন কিছু মানুষকে নাক ও মুখের ভরে ছেঁচড়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন।
২) “তোমার ঘর তোমার জন্য প্রশস্ত হোক।” (অর্থাৎ অবসর সময়ে নিজ গৃহে অবস্থান কর)
এ কথার উদ্দেশ্য হল, প্রয়োজন হীনভাবে বাড়ির বাইরে সময় কাটানো উচিৎ নয়। বরং প্রত্যেকের উচিৎ, বাইরের কাজ সেরে বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেয়া, বাকি সময় স্ত্রী-পরিবারের সাথে কাটানো, ঘরকে আল্লাহর নাফরমানি ও ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে থেকে হেফাজত করা এবং নিজেও বাইরের ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে আত্মরক্ষা করা, পরিবারকে দ্বীনের শিক্ষা দেয়া, দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে কিছু সময় বাড়িতে নির্জনে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করা ইত্যাদি।
৩) “নিজ পাপের জন্য ক্রন্দন করো।” অর্থাৎ নিজের অন্যায় ও পাপাচারের কারণে আল্লাহর নিকট লজ্জিত অন্তরে তওবা করা এবং বাস্তবে ক্রন্দন করো। কেননা, তওবার ও ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করেন এবং এর দ্বারা আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়।
মহান আল্লাহর নিকট দুআ করি, তিনি যেন আমাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দেখানো পথে চলে দুনিয়ায় সুখ, শান্তি, সফলতা এবং আখিরাতে মুক্তি দান করেন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
(২) প্রশ্ন: আংটি, হাতঘড়ি ইত্যাদি কি ডান হাতে পরা সুন্নত না কি বাম হাতে?
উত্তর:
নিম্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর আলোকে আংটি পরার বিধান আলোচনা করা হল:
কোন হাতে আংটি পরা উত্তম?
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান এবং বাম উভয় হাতে আংটি পরেছেন বলে একাধিক হাদিসে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং যে কোনো হাতে আংটি পরা জায়েজ আছে ইনশাআল্লাহ।
নিম্নে উভয় হাতে আংটি পরার ব্যাপারে একটি করে হাদিস উল্লেখ করার পর এ ব্যাপারে আলেমদের অভিমত তুলে ধরা হল:
বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আংটি পরার হাদিস:
আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«كَانَ خَاتَمُ النَّبِيﷺفِي هَذِهِ، وَأَشَارَ إِلَى الْخِنْصِرِ مِنْ يَدِهِ الْيُسْرَى» رَوَاهُ مُسْلِمٌ
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আংটি এই আঙ্গুলে পরিধান করতেন বলে তিনি বাম হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলির দিকে ইঙ্গিত করলেন। (সহিহ : মুসলিম (২০৯৫)-৬৩, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি ৭৮১৭, ইরওয়া ৮১৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৫৪৯৯, শু‘আবুল ঈমান ৬৩৬৯।
ডান হাতে আংটি পরার হাদিস:
عَنِ الصَّلْتِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ، قَالَ : كَانَ ابْنُ عَبَّاسٍ ، يَتَخَتَّمُ فِي يَمِينِهِ , وَلا إِخَالُهُ إِلا قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَيَتَخَتَّمُ فِي يَمِينِهِ ” .
সালত ইবনে আবদুল্লাহ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস রা. তার ডান হাতে আংটি পরিধান করতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি শুধু বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে আংটি পরিধান করতেন।” (শামায়েলে তিরমিযি, অধ্যায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে আংটি পরিধান করতেন, পরিচ্ছদ: সাহাবিগণও তাঁর অনুসরণে ডান হাতে আংটি পরিধান করতেন, হা/৭৭-সহিহ)
উভয় হাতে আংটি পরার ব্যাপারে আরও একাধিক হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।
এ বিষয়ে আলেমদের মতামত:
তিরমিযির ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইমাম নওবী রহ. বলেন:
أجمع الفقهاء على جواز التختم في اليمين، وعلى جوازه في اليسار، ولا كراهة في واحدة منهما
“ফকিহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, ডান হাতে আংটি পরা যেমন জায়েজ তেমনি বাম হাতে পরাও জায়েজ। যে কোনও এক হাতে পরা মাকরূহ (অ পছন্দনীয়) হবে না।”
শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন রহ. বলেন:
والصحيح أنه سنة في اليمين واليسار- الشرح الممتع ” (6/110)
“আর সঠিক কথা হল, ডান এবং বাম উভয় হাতে আংটি পড়া সুন্নত।” (শারহুল মুমতি ৬/১১০)
শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন:
لبس الخاتم لا بأس به، سواء كان في اليمنى أو في اليسرى، والأفضل في الخنصر كما لبسه النبيُّ والصحابة.
“আংটি পরায় কোন অসুবিধা নেই-চাই ডান হাতে পরা হোক অথবা বাম হাতে পরা হোক। তবে কনিষ্ঠা আঙ্গুলে পরা উত্তম-যেমনটি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবিগণ পরেছেন।” [উৎস: binbaz.org.sa]
কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আংটি পরা সুন্নত:
ডান হাতে হোক অথবা বাম হাতে হোক কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আংটি পরা উত্তম। যেমন হাদিস বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَنَسٍ، قَالَ كَانَ خَاتِمُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي هَذِهِ . وَأَشَارَ إِلَى الْخِنْصَرِ مِنْ يَدِهِ الْيُسْرَى
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আংটি ছিল এ আঙ্গুলে- এ কথা বলে তিনি বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলের দিকে ইঙ্গিত করেন। (সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: পোশাক ও সাজসজ্জা, অনুচ্ছেদ:
হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আংটি পরা)
আরেকটি হাদিস:
حديث أَنَسٍ رضي الله عنه، قَالَ: صَنَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، خَاتَمًا، قَالَ: إِنَّا اتَّخَذْنَا خَاتَمًا، وَنَقَشْنَا فِيهِ نَقْشًا فَلاَ يَنْقُشْ عَلَيْهِ أَحَدٌ قَالَ: فَإِنِّي لأَرَى بَرِيقَهُ فِي خِنْصَرِهِ
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি আংটি তৈরী করেন। তারপর তিনি বলেন, আমি একটি আংটি তৈরী করেছি এবং তাতে একটি নকশা করেছি। সুতরাং কেউ যেন নিজের আংটিতে নকশা না করে। তিনি (আনাস) বলেনঃ আমি যেন তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে আংটিটির দ্যূতি (এখনও) দেখতে পাচ্ছি।“ (সহিহ বুখারী পর্ব ৭৭, অধ্যায় ৫১, হাদীস নং ৫৮৭৪; সহিহ মুসলিম ৩৭/১২ হাঃ ২০৯২, ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে: باب الخاتم في الخنصر অনুচ্ছেদ: কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আংটি পরা)
উল্লেখ্য যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আংটিতে তিন লাইনে আরবিতে নকশা করে “মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” (মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল) কথাটি লেখা ছিলো। তা তিনি অনারব দেশের রাজাদের নিকট পত্র মারফত দাওয়াত দেয়ার সময় সময় উক্ত আংটিকে সীল মোহর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর তাই তার অনুরূপ আংটিতে নকশা করতে নিষেধ করা হয়েছিলো।
মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুলে আংটি পরা নিষেধ:
এ মর্মে হাদিস হল,
عَنْ أَبِي بُرْدَةَ، قَالَ قَالَ عَلِيٌّ نَهَانِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَتَخَتَّمَ فِي إِصْبَعِي هَذِهِ أَوْ هَذِهِ . قَالَ فَأَوْمَأَ إِلَى الْوُسْطَى وَالَّتِي تَلِيهَا .
আবূ বুরদাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে এই অথবা এই আঙ্গুলে আংটি পরতে নিষেধ করেছেন- বলে তিনি তাঁর মধ্যমা ও তাঁর পার্শ্বের তর্জনী আঙ্গুলের দিকে ইশারা করলেন। (সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: পোশাক ও সাজসজ্জা, অধ্যায়ঃ মধ্যমা ও তার সাথের (শাহাদাত/তর্জনী) আঙ্গুলে আংটি পরার নিষেধাজ্ঞা )
মোটকথা, ডান-বাম উভয় হাতে আংটি পরা জায়েজ আছে। তবে তা কনিষ্ঠা আঙ্গুলে পরা উত্তম আর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলে নিষেধ-যেমনটি উপরোক্ত হাদিস সমূহ থেকে প্রমাণিত হল।
সুতরাং আপনি আপনার সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো হাতে আংটি, হাতঘড়ি ইত্যাদি পড়তে পারেন। ইসলামী শরিয়তে এ ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
উল্লেখ্য যে, পুরুষদের জন্য স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করা হারাম। আর কেবল সৌন্দর্য ও ফ্যাশন হিসেবে আংটি ব্যবহার করা জায়েজ আছে। তবে রোগ-ব্যাধি, জাদু-টোনা, জিন, বদনজর ইত্যাদি উদ্দেশ্যে অষ্টধাতু, তামা বা মূল্যবান পাথর দ্বারা আংটি ব্যবহার করা হারাম।
আল্লাহু আলাম।
(৩) প্রশ্ন: ঘরের দেয়ালে কুরআনের আয়াত, দুআ, আল্লাহর নাম বা ইত্যাদি লেখা ঝুলানোর বিধান কি? আর কোনো ঘরে এগুলো ঝুলানো থাকলে কি ঐ ঘরে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা যাবে? দয়া করে হাদিসের আলোকে জানাবেন।
উত্তর:
মূল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে কয়েকটি বিষয় জানা জরুরি:
প্রথমত:
আমাদের জানা প্রয়োজন যে, শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে ঘরের দেয়ালে কুরআনের আয়াত, দুআ, আল্লাহর নাম ইত্যাদি টাঙ্গিয়ে রাখা জায়েজ নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা এগুলো আমাদেরকে ওয়ালমেট বানিয়ে ঘরের শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে দেন নি। বরং এ জন্য দিয়েছেন যে, আমরা যেন নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করি, কুরআন বুঝি, প্রয়োজনীয় দোয়া-তসবিহগুলো যথাসময়ে পড়ি, আল্লাহর নামগুলো মুখস্থ করি, সেগুলোর অর্থ বুঝি, তার কথা স্মরণ করি এবং সেই আলোকে আমাদের জীবন গঠন করি।
যেমন:
● আল্লাহ তাআলা কুরআন নাজিলে উদ্দেশ্য কুরআনের শুরুতেই বলে দিয়েছেন:
ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ
“এটি সেই গ্রন্থ যাতে কোনই সন্দেহ নেই। যা সঠিক পথ দেখায় ঐ সকল মানুষকে যারা আল্লাহকে ভয় করে।” (সূরা বাকারা: ২)
● তিনি আরও বলেন:
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّـهُ
“এটা নির্ঘাত সত্য যে, আমি আপনার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যাতে করে আল্লাহর দেখানো সঠিক বিধান অনুসারে আপনি মানুষের মাঝে বিচার-ফয়সালা করতে পারেন।” (সূরা নিসা: ১০৫)
এভাবে আল্লাহ তাআলা আরও বহু আয়াতে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে বলেছেন।
◈◈ দ্বিতীয়ত:
ঘরে বরকত নাজিল হবে অথবা জিন, শয়তান, যাদু-টোনা ইত্যাদি থেকে ঘর রক্ষা পাবে এই নিয়তে এসব লেখা ঝুলিয়ে রাখা বিদআত।
কারণ কুরআন-হাদিসে এমন কোন কথা বলা হয় নি যে, এগুলো ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখলে তাতে বরকত নাজিল হবে বা তা জিন-শয়তান ও যাদু-টোনা থেকে রক্ষা পাবে। বরং এ জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখানো পদ্ধতিতে কুরআনের নির্দিষ্ট আয়াত ও সূরাগুলো (যেমন: সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস, সূরা বাকারা, আলে ইমরান, আয়াতুল কুরসি ইত্যাদি) এবং হাদিসে বর্ণিত দুআগুলো যথানিয়মে পাঠ করতে হবে।
যেমন:
● হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: “রাতে বিছানায় গিয়ে ঘুমের পূর্বে আয়াতু কুরসি পাঠ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন প্রহরী (ফেরেশতা) নিয়োগ দেয়া হয় এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তার কাছে আসতে পারে না।
روى البخاري (3275) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : ” وَكَّلَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحِفْظِ زَكَاةِ رَمَضَانَ فَأَتَانِي آتٍ فَجَعَلَ يَحْثُو مِنَ الطَّعَامِ فَأَخَذْتُهُ ، فَقُلْتُ لَأَرْفَعَنَّكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَفَذَكَرَ الحَدِيثَ، فَقَالَ : إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الكُرْسِيِّ ، لَنْ يَزَالَ عَلَيْكَ مِنَ اللَّهِ حَافِظٌ ، وَلاَ يَقْرَبُكَ شَيْطَانٌ حَتَّى تُصْبِحَ ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوبٌ ذَاكَ شَيْطَانٌ )
● সূরা বাকারা এর শেষ দুই আয়াত পাঠের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাকারা এর শেষ দুটি আয়াত পাঠ করবে তা তার সারা রাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।” (হাদিসের ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন: রাতে এ দুটি আয়াত পাঠ কারীর জন্য রাতে নফল সালাত আদায় অথবা বিপদাপদ থেকে রক্ষা অথবা উভয়টির জন্য যথেষ্ট হয়)
এ মর্মে হাদিস হল:
روى البخاري (4008) ، ومسلم (807) عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ البَدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( الآيَتَانِ مِنْ آخِرِ سُورَةِ البَقَرَةِ ، مَنْ قَرَأَهُمَا فِي لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ
এমন বহু হাদিসে আমাদেরকে কখন কোন সূরা, দুআ, তাসবিহ পাঠ করতে হবে তার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল হামদু লিল্লাহ।
◈◈ তৃতীয়ত:
কেউ যদি বিশেষ কোন আয়াত বা হাদিসের দুআ বা আল্লাহর নাম কেবল মুখস্থ করা বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখে তাহলে তাতে কোন আপত্তি নেই। তবে উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলে তা নামিয়ে ফেলতে হবে।
শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন:
لا مانع من تعليق الآيات القرآنية، والأحاديث النبوية في المجالس والمكاتب كل ذلك لا بأس به؛ للتذكير والعظة والفائدة، لا اتخاذها حروزا تمنع من الجن
“বৈঠকখানা, অফিস ইত্যাদিতে কুরআনের আয়াত ও হাদিস টাঙ্গিয়ে রাখতে বাধা নেই। এগুলোতে কোন অসুবিধা নেই যদি স্বরণ, উপদেশ ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে হয়। তবে জিন-শয়তান ইত্যাদি থেকে থেকে বাঁচার রক্ষাকববজ হিসেেব হলে জায়েজ নাই।”
আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহ. বলেন:
تعليق الآيات القرآنية على الجدران وأبواب المساجد وما أشبهها- هو من الأمور المحدثة التي لم تكن معروفة في عهد السلف الصالح الذين هم خير القرون،
“কুরআনের আয়াত ঘরের দেয়াল, মসজিদের দরজা বা এ জাতীয় স্থানে লাগানো দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত যা সালাফে-সালেহীন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই হওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনদের খাইরুল কুরুন বা শ্রেষ্ঠ যুগে পরিচিত ছিলো না।” (সৌদি আরবের ‘নূরুন আলাদ দারব’ শীর্ষক জনপ্রিয় ইসলামি প্রশ্নোত্তর মূলক রেডিও প্রোগামে প্রদত্ব উত্তর )
◈◈ ঘরে কুরআনের আয়াত, হাদিসের দুআ, আল্লাহর নাম ইত্যাদি টাঙ্গিয়ে রাখা হলে ওই ঘরে স্ত্রী সহবাস করার বিধান:
কেউ যদি দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ঘরের মধ্যে কুরআনের আয়াত, হাদিসের দুআ, আল্লাহর নাম ইত্যাদি টাঙ্গিয়ে রাখে তাহলে ওই ঘরে স্ত্রী সহবাসে কোন আপত্তি নেই। তবে পূর্বোক্ত আলোচনার আলোকে বলব, এগুলো ঘরে ঝুলিয়ে রাখা উচিৎ নয়। কেউ করে থাকলে অনতিবিলম্বে তা নামিয়ে ফেলা কর্তব্য। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
উমর রা. এর জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব
(৪) প্রশ্ন: হজরত উমর রা. এর জ্ঞান এক পাল্লায় আর সমস্ত উম্মতের জ্ঞান আরেক পাল্লায় রাখা হলে উমর রা. এর জ্ঞানই বেশি ভারি হবে।” এ হাদিসটা কি সহিহ?
উত্তর:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একান্ত ঘনিষ্ঠ সহচর, তাঁর পরে মুসলিম উম্মাহর ২য় কাণ্ডারি, খলিফুতুল মুসলীন, আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. দ্বীনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা, জ্ঞানের গভীরতা ও বিচক্ষণতায় ছিলেন এক অনন্য কালপুরুষ। তাই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ব্যাপারে বলেছেন:
لَوْ كَانَ بَعْدِي نَبِيٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ
“আমার পরে কেউ নবি হলে উমর ইবনুল খাত্তাব নবি হতেন।”
( মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি, হাকিম ইত্যাদি-উকবা বিন আমের রা. হতে বর্ণিত। ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। অনুরূপভাবে শাইখ আলবানিও)
এ হাদিসটি তাঁর দ্বীনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও ইলমের গভীরতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
এ ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ওহি নাজিলে প্রাক্কালে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে উমর রা. মতামতের আলোকে প্রায় ১৫টি কুরআনের আয়াত নাজিল হয়েছে (ফাতহুল বারী ১/৫০৫)। যেমন: হিজাব, মাকামে ইবরাহিম, বদরের যুদ্ধবন্দী ইত্যাদি। যা তাঁর মর্যাদার বিশাল স্বাক্ষর বহন করে। পাশাপাশি তার ব্যাপারে আরও বহু হাদিস ও সাহাবীদের মতামত বর্ণিত হয়েছে।
◈◈ উমর রা. এর ইলম (জ্ঞান) এর ব্যাপারে হাদিস:
أَنَّ ابْنَ عُمَرَ، قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ أُتِيتُ بِقَدَحِ لَبَنٍ، فَشَرِبْتُ مِنْهُ، حَتَّى إِنِّي لأَرَى الرِّيَّ يَخْرُجُ مِنْ أَظْفَارِي، ثُمَّ أَعْطَيْتُ فَضْلِي ‏‏. يَعْنِي عُمَرَ. قَالُوا فَمَا أَوَّلْتَهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْعِلْمَ ‏‏.
ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, “আমি একবার ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার কাছে একটি দুধের পেয়ালা পেশ করা হলে আমি তা থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করলাম। তৃপ্তির চিহ্ন আমার নখ দিয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। অতঃপর বাকি অংশ অবশিষ্টাংশ উমারকে দিলাম।”
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি এর কী ব্যাখ্যা দিলেন?
তিনি বললেনঃ ইলম (জ্ঞান)।
(সহিহ বুখারী, অধ্যায়: স্বপ্নের ব্যখ্যা প্রদান স্বপ্নে দুধ দেখা ।আধুনিক প্রকাশনী- ৬৫২১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৫৩৪)
উল্লখ্য যে, নবীদের স্বপ্নও ওহি তথা আল্লাহর প্রত্যাদেশ।
◈◈ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর মন্তব্য:
● মাজমাউয যাওয়ায়ে গ্রন্থে হাইসামি বলেন: আবু ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:
قال عبد الله بن مسعود: لو أن علم عمر بن الخطاب وضع في كفة الميزان، ووضع علم الأرض في كفة لرجح علم عمر
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, “যদি ওমর ইবনুল খাত্তাব এর জ্ঞানকে এক পাল্লায় রাখা হয় এবং বিশ্ববাসীর জ্ঞানকে আরেক পাল্লায় রাখা হয় তাহলে উমরের ইলম (জ্ঞান) ভারী হবে।”
● তিনি আরো বলেন:
إني لأحسب عُمر قد ذهب بتسعة أعشار العلم (رواه الطبراني بأسانيد ورجال هذا رجال الصحيح غير أسد بن موسى وهو ثقة)
“আমার ধারণা, উমর জ্ঞানের দশ ভাগের নয় ভাগ নিয়ে গেছেন।” (তবারানী একাধিক সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এর বর্ণনাকারীগণ সহিহ বুখারীর বর্ণনাকারী। তবে আসাদ বিন মূসা বিশ্বস্ত)
আল্লাহ তাআলা এই দিগ্বিজয়ী মহাবীর মুসলিম জাতির গর্ব ক্ষণজন্ম মহাপুরুষ উমর ইবনুল খাত্তাব রা. কে মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। রাযিআল্লাহু আনহু-আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
উল্লেখ্য যে, উমর রা. এ জ্ঞানের গভীরতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহাবিদের মধ্যে অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়ার পরও কোন কোন ক্ষেত্রে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্য জন তার চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখতেও পারেন বা অন্যের মতামতটা বেশি শক্তিশালী হতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
উদহারণ স্বরূপ:
– যাকাত অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ঘটনায় খলিফতুল মুসলেমিন আবু বকর রা. ও উমর রা. এর মাঝে দ্বিমত সৃষ্টি হলে পরবর্তীতে আবু বকর রা. এর মতামতটি অধিক বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয় এবং তিনি তা মেনে নেন।
– নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয বিন জাবাল রা. কে হালাল-হারাম বিষয়ে এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:«أعلم أمتي بالحلال والحرام»
সুতরাং এ বিষয়ে তিনি আবু বকর রা., উমর রা. সহ অন্য সকল সাহাবির থেকে অধিক পারদর্শী ছিলেন।
– হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু হুরায়রা রা. এর কোন তুলনা নেই।
– কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস রা. অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জন বেশি পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় উমর রা. এর ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এ মত ব্যক্ত করেছেন।
আল্লাহু আলাম।
(৫) প্রশ্নঃ মেয়েদের একাকী বাইরে থাকার বিধান কি?
উত্তর:
কোন মেয়ের যদি লেখাপড়া অথবা বিশেষ প্রয়োজনে পরিবার থেকে দূরে কোথাও একাকী থাকা জরুরি হয় তাহলে তা জায়েজ আছে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে। যেমন:
১. বাড়ি থেকে যেখানে থাকা হবে তার দূরত্ব যদি সফরের দূরত্ব (কমপক্ষে প্রায় ৮০ কি.মি.) হয় তাহলে যাতায়াতের পথে সঙ্গে স্বামী অথবা বাবা, ছেলে, ভাই, দাদা ইত্যাদি একজন মাহরাম পুরুষ (যাদের সাথে স্থায়ীভাবে বিয়ে বন্ধন হারাম) থাকা আবশ্যক। কারণ হাদিসে মহিলাদেরকে স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ছাড়া সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে।
২. যেখানে থাকা হবে সেখানে সার্বিক নিরাপত্তা থাকা।
৩. থাকার স্থানে পরপুরুষের আনাগোনা ও ফেতনা মুক্ত পরিবেশ থাকা। যদি অন্যান্য সৎ, বিশ্বস্ত ও দ্বীনদার মহিলাদের সাথে থাকা হয় তাহলে নি:সন্দেহে তা উত্তম।
৪. বাইরে বের হওয়ার সময় পূর্ণ হিজাব সহকারে বের হওয়া এবং নিজেকে ফেতনা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা।
৫. বাইরে যাওয়ার সময় আতর-সুগন্ধি ব্যবহার না করা..ইত্যাদি।
তবে মনের রাখা কর্তব্য যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে যেভাবে ফিতনা-ফ্যাসাদের সয়লাব চলছে তাতে একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো নারীর পরিবার থেকে দূরে থাকা মোটেও উচিৎ নয়।
আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন:
يجوز لها السكن وحدها سواء كانت أرملة أو مطلقة لا بأس أن تسكن وحدها إذا كانت في محل آمن لا خطر عليها، أما إذا كان المحل ليس بآمن فإنها لا تسكن وحدها بل تسكن مع غيرها من أهلها أو من النساء الثقات اللاتي لا خطر في السكنى معهن، وهذا معروف من قواعد الشرع المطهر.
“মহিলার জন্য একাকী থাকা জায়েজ আছে-চাই সে বিধবা হোক বা তালাক প্রাপ্তা হোক। থাকার জায়গাটা যদি নিরাপদ হয়-যা তার জন্য বিপদ জনক নয়-তাহলে একাকী থাকায় কোনো অসুবিধা নেই। তবে যদি থাকার জায়গাটা অনিরাপদ হয় তাহলে একাকী থাকবে না বরং তার পরিবারের অন্য কারো সাথে অথবা অন্যান্য বিশ্বস্ত মহিলা-যাদের সাথে থাকলে কোনো বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা নাই- তাদের সাথে থাকবে।
এটি পবিত্র ইসলামি শরিয়তের একটি স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি।”
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল খারাপি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
(৬) প্রশ্ন: আমি পড়া-শোনার জন্য একটি ম্যাচে উঠেছি। তো আমার রুমমেট হিন্দু। তার সাথে একই পাতিলে খাবার খেতে হচ্ছে। এতে কি কোন সমস্যা হবে? মানে ইসলাম কি এটা অনুমোদন করে?
উত্তর:
খাবারটা যদি হালাল হয়-যেমন: শাক-সবজি, মাছ, ডাল, ডিম ইত্যাদি তাহলে এক পাতিলে রান্না করেে একসাথে খাওয়া জায়েজ আছে ইনশাআল্লাহ।
তবে তার হাতের জবাই করা কোন প্রাণীর গোস্ত খাওয়া জায়েজ নয়, অনুরূপভাবে তাদের পূজা বা ধর্মীয় উপলক্ষে বিশেষ কিছু রান্নাবান্না করা বা তা খাওয়া জায়েজ হবে না।
قال قتادة : ” لا بأس بأكل طعام المجوسي ، ما خلا ذبيحته “. انتهى منمصنف عبد الرزاق” (6/109)
কাতাদা রহ. বলেন: “অগ্নীপূজক এর খাবার খেতে অসুবিধা নেই-তার জবেহকৃত প্রাণীর গোস্ত ছাড়া।” (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৬/১০৯)
وقال القرطبي : ” ولا بأس بأكل طعام من لا كتاب له ، كالمشركين ، وعبدة الأوثان ، ما لم يكن من ذبائحهم “. انتهى منالجامع لأحكام القرآن” (6/77)
কুরতুবী বলেন: “যারা কিতাবধারী নয় (আহলে কিতাব নয়) যেমন: মুশরিক, মূর্তীপূজারী-তাদের খাবার খাওয়ায় কোন দোষ নেই যদি তাদের তাদের জবেহকৃত প্রাণীর গোস্ত না হয়।” (আল জামে লি আহকামিল কুরআন-তাফসিরে কুরতুবী ৬/৭৭)
(৭)  প্রশ্ন: কোন মুসলিমের জন্য কি কোন কাফেরের সাথে খাওয়া-দাওয়া করা সম্ভব?
إذا كان الطعام حلالا جاز الأكل معه ، ولا سيما إذا دعت الحاجة إلى ذلك ؛ لكونه ضيفاً ، ولقصد دعوته إلى الإسلام ، ونحو ذلك ، مع بقاء بغضه في الله حتى يُسلم “. انتهى منفتاوى اللجنة الدائمة ” (22/413).
“খাবারটা যদি হালাল হয় তাহলে কাফেরের সাথে খাবার খাওয়া জায়েজ আছে। বিশেষ করে যদি প্রয়োজন দেখা যায়। যেমন: হয়ত সে মেহমান এসেছে অথবা তাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে আছে ইত্যাদি। তবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার প্রতি মনের মধ্যে বিদ্বেষ পোষণ হবে যতক্ষণ না সে মুসলিম হয়।” (সৌদি স্থায়ী ফতোয়া কমিটি ২২/৪১৩)
মনে রাখা কর্তব্য যে, মুসলিমদের জন্য যথাসম্ভব মুসলিম দ্বীনদার ও সৎচরিত্রবান রুমমেটের সাথে থাকার চেষ্টা করা উচিৎ। এটা উভয়ের জন্যেই মানসিক প্রশান্তি ও দ্বীন পালন ও চরিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে অধিক নিরাপদ।
তবে যদি বিশেষ পরিস্থিতিতে অমুসলিমর সাথে একই রুমে থাকতে হয় তাহলে একজন মুসলিমের দায়িত্ব হল, তার সঙ্গীকে দ্বীনের পথে নিয়ে এসে আখিরাতের নিশ্চিত জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। এ জন্য তার কাছে ইসলামের সৌন্দর্য, উদারতা ও মহত্ম প্রকাশ করে তাকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে।
কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয় বরং উল্টো মনে হয় যে, সে নিজেই তার সাথে থাকার ফলে দ্বীনদারী ও চারিত্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাহলে অনতিবিলম্বে তার জন্য রুম পরিবর্তন করার চেষ্টা করা জরুরি-যদি সম্ভব হয়।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
দুআর প্রথমে ও শেষে দরূদ পাঠের গুরুত্ব এবং দুআ সংক্রান্ত কিছু মাসায়েল
(৮) প্রশ্ন:
১. দোয়ায় হাত তুলে কি দরুদ শরীফ পড়া যাবে নাকি হাত তোলার আগেই দরূদ পড়তে হবে?
২. দোয়ায় কোন সুরা বা আয়াত পড়া যাবে কিনা (সুরা ফাতিহা, সুরা নাস, সুরা ফালাক, আয়াতুল কুরসি)? যদি পড়া যায় তাহলে তার আগে কি বিসমিল্লাহর রহমানির বলা যাবে কি না?
৩. দোয়া কিভাবে শেষ করতে হবে? অনেকে সুরা সফফাতের শেষ তিন আয়াত দিয়ে দোয়া শেষ করে। এটা সহীহ কিনা?
উত্তর:
নিম্নে এ সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল:
ক. একাকী দুআ-মুনাজাত করার অন্যতম একটি আদব হল, দু হাত উত্তোলন করা এবং দুআ করার পূর্বে আল্লাহর প্রশংসা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ পেশ করা যদিও তা অপরিহার্য নয়। তবে এটি দোয়া কবুলের অন্যতম কারণ।
ফাযালা ইবনে উবাইদ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লোককে সালাতে দুআ করতে শুনলেন। কিন্তু সে তাতে আল্লাহর প্রশংসা করেনি এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদও পড়েনি। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “লোকটি তাড়াহুড়ো করল।” অতঃপর তিনি তাকে ডাকলেন এবং তাকে অথবা অন্য কাউকে বললেন:
«إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَحْمِيدِ رَبِّهِ سُبْحَانَهُ، وَالثَّنَاءِ عَلَيْهِ، ثُمَّ يُصَلِّي عَلَى النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم، ثُمَّ يَدْعُو بَعْدُ بِمَا شَاءَ»
“যখন তোমাদের কেউ সালাত পড়বে (অর্থাৎ সালাতে দুআ করবে) তখন সে যেন প্রথমে তার মহান প্রতিপালকের প্রশংসা ও গুণগান করে অত:পর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরূদ পেশ করে। তারপর যা ইচ্ছে দুআ করে। (সহিহ আবু দাউদ হা/১৩১৪, তিরমিযি)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ اَنسِ رضى اللهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ: رَسُولَ اللهِ صلي الله عليه وسلم : كُلُّ دُعَاءٍ مَحْجُوْبٌ حَتَّى يُصَلّى عَلَى النَّبِىِّ صلي الله عليه وسلم. (حسن ، رواه الطبرانى-قال المحدث الألباني فى السلسلة الصحيحة الجزء أو الصفحة:2035 أنه حسن لشواهده
“আনাস রা. বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যতক্ষণ রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়া হবে না ততক্ষণ তা বাধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকবে (অর্থাৎ আল্লাহর নিকট পৌঁছবে না এবং দুআও কবুল করা হয় না।) [ত্বাবরানী: ২০৩৫ শাইখ আলবানী বলেন: অন্যান্য শাওয়াহেদ এর মাধ্যমে হাদিসটি হাসান]
এ মর্মে আরও একাধিক হাদিস আছে।
খ. দুআর শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা হিসেবে সূরা ফাতিহার প্রথম কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করা যেতেে পারে। কারণ এই আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে।
এরপরে করণীয় হল, কুরআন ও হাদিসের দুআগুলো যথাসাধ্য পাঠ করার পাশাপাশি নিজের ভাষায় একান্ত একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা ও বিনয়-নম্রতা সহকারে আল্লাহর নিকট নিজের প্রয়োজন তুলে ধরে দুআ করা।
গ. দুআ শেষ করার সময় পুনরায় নবি-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ পেশ করা ভালো কিন্তু তা জরুরি নয়।
ইমাম নওবি রহ. বলেন:
أجمع العلماء على استحباب ابتداء الدعاء بالحمد لله تعالى والثناء عليه ، ثم الصلاة على رسول الله صلى الله عليه وسلم ، وكذلك تختم الدعاء بهما، والآثار في هذا الباب كثيرة مرفوعة
“এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, দুআর শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরুদ পেশ করা মুস্তাহাব। অনুরূপভাবে এ দুটির মাধ্যমে দুআ শেষ করাও মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে অনেক মারফূ আসার রয়েছে।” (আল আজকার: ১৭৬)
ঘ. দুআর মাঝে যে সকল আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা বা দুআ আছে সেগুলো পাঠ করতেও আপত্তি নাই।
ঙ. দুয়া শেষ করার সময় কেউ যদি মাঝে-মধ্যে সূরা সাফফাতের শেষের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো পড়ে তাহলেও আপত্তি নাই:
سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী তোমার প্রতিপালক তারা যে সব কথা বলে থাকে (তার প্রতি যে সব অপবাদ দিয়ে থাকে) সেগুলো থেকে পূত-পবিত্র। রাসূলদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্তে। ”(সূরা সাফফাত: ১৮০-১৮২)
কেননা এ আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী-রাসূলদের প্রতি সালাম রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ফরজ সালাত শেষে বা বৈঠক শেষের দুআ হিসেবে উক্ত আয়াতগুলো পাঠ করা ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলো সহিহ সনদে প্রমাণিত নয় বরং মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল। সুতরাং তা আমলযোগ্য নয়।
স্ত্রী সহবাসের পর তৎক্ষণাৎ গোসল এবং কিছু ভুল ধারণা
(৯) প্রশ্ন: সহবাস এর পরপরই কি গোসল করতে হবে? যদি ভুল বশত: না করা হয় তাহলে উপায় কি?
উত্তর:
নিম্নে প্রশ্নটির উত্তর প্রদান করা হল। পাশাপশি তুলে ধরা হল, সমাজে প্রচলিত সহবাস পরবর্তী কতিপয় কুসংস্কার ও ভুল ধারণা:
গোসল ফরজ হলে সালাতের পূর্ব পর্যন্ত গোসল বিলম্ব করা জায়েজ আছে:
স্ত্রী সহবাস, স্বপ্নদোষ ইত্যাদির কারণে গোসল ফরজ হলে তৎক্ষণাৎ গোসল করা আবশ্যক নয়। বরং ঘুম, ব্যস্ততা বা প্রয়োজনে বিলম্ব করা জায়েজ আছে। এ মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
১) হাদিসে এসেছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ لَقِيَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فِي طَرِيقٍ مِنْ طُرُقِ الْمَدِينَةِ وَهُوَ جُنُبٌ فَانْسَلَّ فَذَهَبَ فَاغْتَسَلَ فَتَفَقَّدَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا جَاءَهُ قَالَ أَيْنَ كُنْتَ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ . قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَقِيتَنِي وَأَنَا جُنُبٌ فَكَرِهْتُ أَنْ أُجَالِسَكَ حَتَّى أَغْتَسِلَ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سُبْحَانَ اللَّهِ إِنَّ الْمُؤْمِنَ لاَ يَنْجُسُ .
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি একবার মদিনার কোন এক রাস্তায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি (আবু হুরায়রা রা.) তখন (জানবাত) অপবিত্র অবস্থায় ছিলেন। এই কারণে তিনি আস্তে করে পাশ কেটে চলে গেলেন এবং গোসল করলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তালাশ করলেন। পরে তিনি এলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: আবু হুরায়রা। তুমি কোথায় ছিলে?
তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আপনার সঙ্গে যখন আমার সাক্ষাৎ হয় তখন আমি অপবিত্র অবস্থায় ছিলাম। তাই আমি গোসল না করে আপনার সাথে উঠবস করাকে অপছন্দ করেছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “সুবহানাল্লাহ! মুমিন তো অপবিত্র হয় না।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম। সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর/৭১০ অধ্যায়ঃ ৩/ হায়েজ)
হাদিসের বক্তব্য: “মুমিন তো অপবিত্র হয় না” এর অর্থ হল, মুমিন অভ্যন্তরিণভাবে কখনো নাপাক হয় না। বাহ্যিকভাবে শরীরে নাপাকি লাগলে শরীর নাপাক হয় কিন্তু তার মধ্যে ঈমান থাকায় সে অভ্যন্তরিণভাবে সে পবিত্র থাকে (জীবিত ও মৃত সর্বাবস্থায়)। পক্ষান্তরে কাফির বাহ্যিকভাবে যদি পরিষ্কারও থাকে তবে ঈমান না থাকার কারণে সে অভ্যন্তরিণভাবে নাপাক।
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন:
فيه جواز تأخير الاغتسال عن أول وجوبه
“এ হাদিসে গোসল ফরজ হওয়ার পর তা বিলম্ব করার বৈধতা পাওয়া যায়।” (সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারী)
২) আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن غضيف بن الحارث، قال: قلت لعائشة: أكان النبي صلى الله عليه وسلم يغتسل قبل أن ينام؟ وينام قبل أن يغتسل؟ قالت: نعم. قلت: الحمد لله الذي جعل في الأمر سعة
গাযীফ ইবনুল হারিস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আয়েশা রা. কে প্রশ্ন করলাম, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ঘুমের পূর্বে গোসল করতেন অথবা গোসলের পূর্বে ঘুমাতেন?
তিনি বললেন: হ্যাঁ।
আমি বললাম: আল হামদু লিল্লাহ-সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিষয়টিতে ছাড় রেখেছেন। (সহিহ আবু দাউদ, হা/২২৬)
৩) এ ছাড়াও সহিহ সনদে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী সহবাসের পর শরীর নাপাক অবস্থায় রমাযান মাসে ভোর রাতে সেহরি খেয়েছেন। তারপর ফজরের আজান হলে গোসল করে মসজিদে সালাত আদায়ের জন্য গেছেন।
উল্লেখ্য যে, একটি হাদিসে এসেছে: “যে ঘরে জুনুবি ব্যক্তি (গোসল ফরজ হয়েছে এমন নাপাক ব্যক্তি) এবং কুকুর থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” এই হাদিসটি মুহাদ্দিসগণের জইফ বা দুর্বল।
তবে সালাতের সময় হলে গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার পর সালাত আদায় করা আবশ্যক। কেননা সালাতের জন্য পাক-পবিত্রতা অর্জন করা পূর্বশর্ত।
◉◉ স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করতে বিলম্ব করলে ওজু করা মুস্তাহাব:
স্ত্রী সহবাসের পর কেউ ইচ্ছে করলে তৎক্ষণাৎ গোসল করে নিতে পারে আবার ইচ্ছে করলে বিলম্বও করতে পারে। বিলম্ব করতে চাইলে অজু করে নেওয়া উত্তম।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
في الصحيحين أن عمر استفتى رسول الله صلى الله عليه وسلم: أينام أحدنا وهو جنب؟ قال: “نعم، إذا توضأ”.
ওমর রা. রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট প্রশ্ন করলেন, শরীর নাপাক অবস্থায় কি কেউ ঘুমাতে পারে?
তিনি বললেন: “হ্যাঁ, যদি অজু করে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
قال ابن عبد البر: ذهب الجمهور إلى أنه ـ أي: الأمر بالوضوء للجنب الذي يريد
النومللاستحباب
“ইবনে আব্দুল বার বলেন, জুমহুর তথা অধিকাংশ আলেম এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, যে জুনুবি (নাপাক) ব্যক্তি ঘুমাতে চায় তার জন্য ওজু করার নির্দেশ টি মুস্তাহাব পর্যায়ের।”
সহবাসের পর গোসল করা সম্পর্কে কতিপয় ভুল ধারণা ও ভিত্তিহীন কথা:
১. সহবাসের সাথে সাথেই গোসল করতে হবে; নয়তো গুনাহ হবে।
২. সহবাস করে গোসলের পূর্বে মাটিতে পা রাখা যাবে না। অন্যথায় মাটি বদ দুআ করবে এবং অভিশাপ দিবে!
৩. সহবাস করার পর গোসলের পূর্বে কোন কিছুতে হাত দেয়া যাবে না। এই অবস্থায় কোন কিছুতে হাত দিলে তা অপবিত্র হয়ে যাবে!
৪. এ অবস্থায় রান্না-বান্না করলে বাড়ি থেকে লক্ষ্মী চলে যাবে। (এটি স্পষ্ট শিরক)।
৫. গোসলের পূর্বে হাতে কিছু নিয়ে দরজা ধরতে হবে।
৬. নাপাক অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করা যাবে না।
৭. এ অবস্থায় রান্না-বান্না করা যাবে না।
৮. ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দেয়া যাবে না।
৯. সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো যাবে না।
১০. অবস্থায় দুআ-তসবিহ, জিকির-আজকার পাঠ করা যাবে না।
এ সবই কুরআন-সুন্নাহ বর্হিভূত ভুল ধারণা ও বাতিল কথা। ইসলামে এ সব কথার কোন ভিত্তি নাই।
আল্লাহ আমাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ দান করুন এবং সর্ব প্রকার বাতিল ও কুসংস্কার থেকে হেফাজত করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
(১০) প্রশ্ন: পুরুষ মানুষ কি বাসায় হাফপ্যান্ট পরলে গুনাহ হবে? অনেকে বলে মহিলারা ঘরে সতর খোলা রাখতে পারলে পুরুষদের রাখলেও সমস্যা নাই। এটা কি ঠিক?
উত্তর: বাড়িতে কেবল স্বামী-স্ত্রী থাকার সময় তারা যেরকম ইচ্ছা সে রকম পোশাক পরে থাকতে পারে। এতে শরিয়তে কোনো বাধা নেই। এমনকি এ সময় সতর খোলা থাকলেও আপত্তি নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ হালাল করেছেন এবং তাদের মাঝে কোন ধরণের পর্দা আবশ্যক করেনি।
সুতরাং ঘরে স্বামী অথবা স্ত্রী উভয়েই তাদের অভিরুচি অনুযায়ী যে কোনও পোশাক পরতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
“তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।” (সূরা বাকারা: ১৮৬)
তাফসিরে কুরতুবিতে এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে:
“পোশাক মূলত: কাপড়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য পোশাক বলা হয়েছে এ জন্য যে, দেহের সাথে দেহের সংযোগ ঘটে, একে অপরের সাথে মিলিত হয় এবং পোশাকের মত একে অপরের সঙ্গে থাকে।” (সূরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা, তাফসিরে কুরতুবী)
এ ছাড়াও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
ﻋَﻦْ ﺑَﻬْﺰِ ﺑْﻦِ ﺣَﻜِﻴﻢٍ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ ﻋَﻦْ ﺟَﺪِّﻩِ ﻗَﺎﻝَ ﻗُﻠْﺖُ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻋَﻮْﺭَﺍﺗُﻨَﺎ ﻣَﺎ ﻧَﺄْﺗِﻰ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺬَﺭُ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺣْﻔَﻆْ ﻋَﻮْﺭَﺗَﻚَ ﺇِﻻَّ ﻣِﻦْ ﺯَﻭْﺟَﺘِﻚَ ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﻳَﻤِﻴﻨُﻚَ
বাহয বিন হাকিম তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা হ’তে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের আবরণীয় অঙ্গসমূহ কার সামনে আবৃত রাখব এবং কার সামনে অনাবৃত করতে পারি?
তিনি বললেন: “তোমার স্ত্রী ও দাসী ব্যতীত সকলের সামনে তা আবৃত রাখ।”
তবে বুঝমান ছেলেমেয়ে, অন্যান্য মহিলা বা মাহরাম পুরুষ থাকলে তাদের সামনে অবশ্যই সতর ঢাকতে হবে এবং শালীন পোশাক পরে চলাফেরা করতে হবে।
নাপাক কাপড়ে ওজু করা
(১১) প্রশ্ন: নাপাক কাপড় পরে ওজু করে নামাজ এর সময় পাক কাপড় পরলে কি ওজু থাকবে?
উত্তর:
উত্তর: নাপাক কাপড়ে ওজু করা ওজু করার সময় নাপাক কাপড় পরে থাকলে ওজুর কোন ক্ষতি হবে না। তবে সালাতের পূর্বে অবশ্যই তা পরিবর্তন করত: পবিত্র কাপড় পরিধান করতে হবে। কেননা সালাতের জন্য পবিত্রতা (শরীর, কাপড় ও সালাতের স্থান) পূর্ব শর্ত।
উল্লেখ্য যে, কাপড় পরিবর্তন করার কারণে ওজু ভঙ্গ হবে না- সতর খুলে গেলেও। অবশ্য যদি এ সময় লজ্জাস্থানে কাপড় বা কোন কিছুর আবরণ ছাড়া সরাসরি হাতের স্পর্শ লাগে তাহলে ওযু নষ্ট হয়ে যাবে এবং সালাতের পূর্বে পূণরায় ওজু করতে হবে। (এ বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও এটি অধিক বিশুদ্ধ মত)
কেননা মারুফ সূত্রে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত:
إذا أفضى أحدكم بيده إلى ذكره ليس بينه وبينها شيء فليتوضأ
“যে ব্যক্তি তার লিঙ্গ স্পর্শ করবে, এমতাবস্থায় তার মাঝে ও লিঙ্গের মাঝে কোন পর্দা থাকে না সে যেন ওযু করে।” হাসান; দারাকুতনী (১/১৪৭), বাইহাক্বী (১/১৩৩) সিলসিলা আস-সহীহাহ (১২৩৫)।
আমর বিন শু‘আইব তার পিতা থেকে তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
من مس ذكره فليتوضأ وأيما امرأة مست فرضها فلتتوضأ
“যে ব্যক্তি তার লিঙ্গ স্পর্শ করবে, সে যেন ওযু করে এবং কোন মহিলা যদি তার লজ্জা স্থান স্পর্শ করে তাহলে সে যেন ওযু করে।” [সহীহ লিগায়রিহী; আহমাদ (২/২২৩), বাইহাক্বী (১/১৩২)।
(১২) প্রশ্ন: কৃষিজমিতে বিষ দিয়ে ঘাস মারা কি জায়েজ আছে?
উত্তর:
বিষ দিয়ে ঘাস মারা বিষয়টি একটি দুনিয়াবি বিষয়; দ্বীনের কোন বিষয় নয়। তাই এ বিষয়ে সরাসরি ইসলামে কিছু বলা না হলেও ইসলামের মূলনীতির আলোকে যেটা মানুষের জন্য কল্যাণকর বলে প্রমাণিত তা করা যাবে আর যা ক্ষতিকর তা করা যাবে না।
সুতরাং যদি কৃষিজমিতে বিষ প্রয়াগের ফলে ফসলের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, পরিবেশ দূষণ হয় অথবা বিষ দেয়া মাটির স্পর্শে গেলে কিংবা সেখান থেকে উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে অবশ্যই বিরত থাকা জরুরি। কেননা, হাদিসে এসেছে:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ
“আর তোমরা নিজেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)
  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও উবাদাহ ইবনুস সামিত থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ
‘‘তোমরা নিজের বা অন্যের ক্ষতি করতে পারবে না এবং তোমরা পরস্পর (প্রতিশোধের ভিত্তিতে) একে অপরের ক্ষতি করতে পারবে না।’’। (ইবনে মাজাহ্ ২৩৬৯, ২৩৭০)
অর্থাৎ যে সকল কথা, কাজ ও আচরণ দ্বারা নিজের অথবা অন্যের শারীরিক, মানসিক, অর্থ-সম্পদ, মর্যাদা-সম্ভ্রম ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইসলামে তা করা বৈধ নয়।
কিন্তু এমন আশঙ্কা না থাকলে ঘাস বা আগাছা দূর করতে বা পোকা-মাকড়ের উপদ্রব থেকে সফলকে রক্ষা করতে কৃষি বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে সহনীয় মাত্রায় বিষ প্রয়োগে সমস্যা নেই।
তাই কৃষিজমি থেকে আগাছা ও পোকামাকড় নিধনের উদ্দেশ্যে বিষ প্রয়োগের পূর্বে সতর্কতা হিসেবে কৃষি বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
(১৩) প্রশ্ন: শরীরের কোন অংশে ফোঁড়া হলে এবং সেটা পেকে যাওয়ার পর তার রস যদি কাপড়ে লাগে তাহলে নামাজ হবে?
উত্তর:
শরীরের আহত স্থান বা ফোঁড়া থেকে নির্গত পুঁজ জুমহুর তথা অধিকাংশ আলেমের মতে নাপাক।। কেননা তা মূলত রক্ত-যা পচে গিয়েছে। সুতরাং রক্ত যেহেতু নাপাক (পূর্ববর্তী আলেমদের সর্বসম্মত মতে) সেহেতু পচা রক্ত তথা ক্ষতস্থান বা ফোঁড়া থেকে নির্গত পুঁজও নাপাক।
অবশ্য তা যদি খুব সামান্য পরিমাণ হয় তাহলে কাপড়ে লাগলে তা ধৌত করা আবশ্যক নয় এবং এমন কাপড়ে সালাত আদায়েও কোনো সমস্যা নেই। কারণ এ থেকে সম্পূর্ণ বেঁচে থাকাটা কষ্টসাধ্য। যেভাবে প্রবাহমান রক্ত নাপাক হলেও হালাল প্রাণী জবেহ করার পর গোস্তের সাথে যে সামান্য রক্ত লেগে থাকে তা নাপাক নয়।
অপরপক্ষে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এর মতে পুঁজ নাপাক নয়। সুতরাং তা কাপড়ে লাগলে ধৌত করা আবশ্যক নয়। কেননা তার মতে এ বিষয়ে কোন দলিল নেই।
কিন্তু এই মতবিরোধ থেকে বাঁচার স্বার্থে সতর্কতার জন্য-বিশেষ করে সালাতের মত এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের ক্ষেত্রে-কাপড়ে লেগে থাকা পুঁজ ধুয়ে ফেলা অধিক নিরাপদ- তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমি কাউকে মোবাইল ফোন উপহার দেয়ার পর সে যদি তা অন্যায় কাজে ব্যবহার করে তাহলে কি আমিও গুনাহগার হবো?
(১৪) প্রশ্ন: আমি ফেইসবুকে অনেকের ছবি দেখি, তারা মসজিদের উপরে উঠে জুতা পরা অবস্থায় ঘুরাফেরা করে। এতে কি তাদের কোন পাপ হবে কি না? ঘুরাঘুরি করার জন্য অনেকেই মসজিদের উপরে গম্বুজ এর সাথে ছবি তুলে জুতা পড়া অবস্থায়। এতে কি পাপ হবে?
উত্তর:
মসজিদের ছাদে চলাফেরা করার সময় পায়ে ইট, পাথর, কাটা ইত্যাদির আঘাত বা ধুলাবালি ও ময়লা-আবর্জনা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে পায়ের জুতা পড়ে উঠলে কোন সমস্যা নেই। আর সাধারণত: মানুষ এই উদ্দেশ্যেই জুতা পরে।
তবে মসজিদকে অপমান করার উদ্দেশ্য যদি কেউ জুতা পড়ে উঠে তাহলে নিঃসন্দেহে গুনাহ হবে।
উল্লেখ্য যে, জুতায় যদি নাপাকি লেগে না থাকে তাহলে জুতা পরেও সালাত আদায় করা জায়েজ আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন সময় জুতা পরে সালাত আদায় করেছেন। সে হিসেবে বিশেষ প্রয়োজন বোধে মসজিদের প্রতি সম্মানবোধ বজায় রেখে মসজিদের মধ্যেও জুতা পরে প্রবেশ করা বৈধ। যেমন: মসজিদ মেরামত, মসজিদ নির্মাণ, কোনো কারণবশত মসজিদে অতিরিক্ত ময়লা আবর্জনা থাকলে ইত্যাদি।
(১৫) প্রশ্নঃ  হিন্দুদের বিয়েতে উপহার দেয়া এবং অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা আল্লাহর হুকুম কি?
উত্তর:
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনাদর্শের নাম। এটি সামাজিকতা ও মানতাবাদী এক মহান ধর্ম। সুতরাং ইসলামের উদারতা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ করার উদ্দেশ্যে অমুসলিমদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিয়েশাদি বা সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপহার লেনদেন করায় কোন আপত্তি নেই- যদি তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র ও শত্রুতায় লিপ্ত না হয় বা ইসলামের শত্রুদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা না করে।
তাআলা বলেন,
لَّا يَنْهَاكُمُ اللَّـهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
“দ্বীন-ইসলামের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।” (সূরা মুমতাহিনা: ৮)
তবে এমন জিনিস উপহার দেয়া জায়েজ নাই যা মূলত: হারাম অথবা যা অমুসলিমরা তাদের ধর্মীয় উপকরণ ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন: মদ, শুকরের গোস্ত, বাদ্যযন্ত্র, তাদের ধর্মীয় বই, হিন্দু-খৃষ্টানদের ধর্মীয় রীতি হিসেবে ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন: শাখা, পৈতা, ক্রুশ বা অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতীক ইত্যাদি।
অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে জরুরি কথা:
আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলিমরা অমুসলিমদের সাথে যতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুক না কেন, যতই তাদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা ও সদাচার করুক না কেন তারা কখনো মুসলিমদেরকে ‘অন্তরঙ্গ বন্ধু’ মনে করে না। বরং তারা কতটা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তা আল্লাহ তাআলা ফাঁস করে দিয়েছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِّن دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ ۚ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ ۖ إِن كُنتُمْ تَعْقِلُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ রূপে গ্রহণ করো না। তারা (কাফিররা) তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ক্রটি করে না। তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসুত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশি জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও “ (সূরা আলে ইমরান: ১৮)
অত্র আয়াতে আমরা দেখতে পেলাম যে, কাফিরগোষ্ঠি ঈমানদারদের প্রতি চরম বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে। যদিও তারা অনেক সময় বাহ্যিকভাবে তা প্রকাশ করে না কিন্তু সুযোগ পেলেই তাদের আসল চেহারা প্রকাশিত হয়ে যায়। ভারত, বার্মা, আমেরিকা, রাশিয়া, চিন সহ পৃথিবীর দিকে দিকে তা দিবালোকের মত পরিষ্কার। আল্লাহ কত সত্য কথাই না বলেছেন!!
সে কারণে আল্লাহ তাদেরকে ‘আন্তরিক বন্ধু’ হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُم مِّنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ ۙ أَن تُؤْمِنُوا بِاللَّـهِ رَبِّكُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রসূলকে ও তোমাদেরকে বহিষ্কার করে এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ।” (সূরা মুমতাহিনাহ: ১)
কিন্তু তাই বলে তাদের সাথে কোনও ধরণের সম্পর্ক রাখা যাবে না তা ঠিক নয়। বরং তাদের মধ্যে যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করে না অথবা যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শত্রুদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে না তাদের সাথে সদাচরণ, উপহার লেনদেন (তাদের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে উপহার দেয়া ছাড়া), অভাবীকে সাহায্য করা, খাবার খাওয়ানো, বিপদাপদে এগিয়ে আসা, ধার-কর্জ দেওয়া বা নেওয়া, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, কথাবার্তা বলা, প্রতিবেশী সুলভ ভালো আচরণ করা ইত্যাদি জায়েজ আছে ইনশাআল্লাহ। সেই সাথে দাওয়াতি স্বার্থে, তাদের ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে অথবা বিশেষ কারণে যেমন: ব্যবসা, কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে সম্পর্ক রাখা দোষণীয় নয়। বরং এটাই ইসলামের সৌন্দর্য ও উদারতার প্রমাণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের জীবন থেকে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে।
কিন্তু তাদের ধর্মীয় বিষয়ে একাত্মতা প্রকাশ বা তাদেরকে ‘অন্তরঙ্গ বন্ধু’ হিসেবে গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম এবং ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ তথা ‘আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্যই সম্পর্কচ্ছেদ’ এই মূলনীতির পরিপন্থী।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীন বুঝার তওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
(১৬) প্রশ্ন: দুআ মুমিনের অস্ত্র” এটা কি সহিহ হাদিস? রেফারেন্স সহ জানতে চাচ্ছি।
উত্তর:
এটি মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে সহিহ সনদে প্রমাণিত নয় মতান্তরে বানোয়াট কথা।
তবে এ কথাটির মর্মার্থ সঠিক। অবশ্যই দুআ মুমিনের অস্ত্র। জিন, শয়তান, যাদু-টোনা, বদনজর, বিপদ-মুসিবত এবং আল্লাহর আজাব-গজব থেকে আত্মরক্ষার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বিভিন্ন দুআ ও জিকির শিক্ষা দিয়েছেন। এগুলো বাস্তবেই মুমিন জীবনে অস্ত্র ও প্রতিরক্ষার কাজ করে।
ইমাম যাহাবী রহ. এ প্রসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ হাদিসটি তুলে ধরে বলেন:
الدعاءُ سلاحُ المؤمنِ ، وعمادُ الدينِ ، ونورُ السمواتِ والأرضِ
“দুআ মুমিনের অস্ত্র, দ্বীন স্তম্ভ এবং আসমান সমূহ ও জমিনের নূর।” এটি মুনকার (মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল) [সূত্র: মিযানুল ইতিদাল ৩/৫১৩]
হায়সামী বলেন: এর সনদে মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আবী ইয়াযিদ নামক একজন বর্ণনাকারী আছে। মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে সে মাতরূক (পরিত্যাজ্য) [সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১৫০]
শাইখ আলবানি বলেন: এটি মওযু বা বানোয়াট কথা। (সূত্র: যঈফুল জামে হা/৩০০১, সিলসিলা যঈফা হা/১৭৯)
(১৭) প্রশ্ন: বন্ধ্যা ব্যক্তির জন্য কি বিয়ে করা জায়েজ?
উত্তর:
কেউ যদি নিজের সম্পর্কে জানতে পারে যে সে বন্ধ্যা, তারপরেও সে বিয়ে করতে পারবে। তবে শর্ত হল, যদি সে স্ত্রীর ভরণপোষণ এবং জৈবিক চাহিদা পূরণে সামর্থ্যবান হয়। অন্যথায় বিয়ে করা বৈধ নয়। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ.
“হে যুব সম্প্রদায়, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে অবনত রাখতে এবং লজ্জাস্থানকে সংযত করার ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি সহায়ক। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সওম পালন করে। সওম তার প্রবৃত্তিকে দমন করে।” [বুখারী ১৯০৫, ৫০৬৫ ও মুসলিম ১৪০০]
বন্ধ্যত্ব দূর করার জন্য যথাসাধ্য অভিজ্ঞ ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা করার পাশাপাশি আল্লাহর নিকট দুয়া ও কান্নাকাটি করতে হবে। আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হওয়া যাবে না। কারণ জীবনের একটা সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মহান আল্লাহ মানুষকে সন্তান দান করেছেন-এর বহু নজির আছে।
মহান আল্লাহ সম্মানিত রসূল ইবরাহীম আলাইস সালাম কে বহু বছর বন্ধ্যত্ব কাটানোর পর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্ত্রীর সারা আ. এর গর্ভে ইসহাক আ. কে দান করেছিলেন।
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছে সন্তান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ার ভুক্ত বিষয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
لِّلَّـهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا ۖ وَيَجْعَلُ مَن يَشَاءُ عَقِيمًا ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ
“নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।” (সূরা শূরা: ৪৯ ও ৫০)
সুতরাং বিয়ের পর আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ না হয়ে যথাসম্ভব চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহর নিকট দুআ করতে হবে। দয়াময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সন্তান দানের মাধ্যমে তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম প্রজ্ঞাবান ক্ষমতাশীল।
(১৮) প্রশ্ন: খাসি হওয়া কি জায়েজ?
উত্তর:
প্রথমে আমরা জানব, খাসি করা বলতে কী বুঝায়?
সহজ কথায়, পুরুষের অণ্ডকোষে অস্ত্রোপচার করে অথবা মেডিসিন বা কেমিক্যাল প্রয়োগের মাধ্যমে পুরুষের যৌন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করাকে খাসি করা বলা হয়।
পূর্ব যুগে বিভিন্ন দেশে ধর্ষক, অপরাধের শাস্তি হিসেবে অপরাধীর অথবা দাস যেন তার মহিলা মনিবের প্রতি যৌন বাসনা অনুভব করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে বা আরও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে তাদের যৌন ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হতো।
আবার কিছু মানুষ হয়তো বিশেষ কারণে যেন নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব না করে সে উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় এমনটি করত।
ইসলামের দৃষ্টিতে এটি নিষিদ্ধ কাজ।
খাসি হওয়া জায়েজ নয়। কেননা এ মর্মে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন:
حديث عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ رضي الله عنه، قَالَ: كُنَّا نَغْزُو مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَيْسَ مَعَنَا نِسَاءٌ، فَقُلْنَا: أَلاَ نَخْتَصِي فَنَهَانَا عَنْ ذَلِكَ،
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে যুদ্ধে বের হতাম, তখন আমাদের সাথে স্ত্রীগণ থাকত না, তখন আমরা বলতাম আমরা কি খাসি হয়ে যাব না? তিনি আমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করেছেন। (বুখারী পর্ব ৬৫/৫ হা/৬১৫, মুসলিম পর্ব ১৬/২, হাঃ ১৪০৪)
আল্লাহু আলাম
জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল না করার ভয়াবহ পরিণতি
(১৯) প্রশ্ন: ইলম জানার পর না মানলে কী সমস্যা ?
উত্তর:
কুরআন ও হাদিসে দ্বীনের জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে অনেক বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনের প্রথম আয়াত হল, ‘ইকরা’ “পড়ো”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ইলম বা জ্ঞানান্বেষণকে ফরজ (অত্যাবশ্যক) বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে পর্যাপ্ত আলোচনা এসেছে।
ইসলামে জ্ঞানার্জনের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এ জন্য যে, যেন তারা জ্ঞানের আলোকে সত্য-মিথ্যা, হক-নাহক, হালাল-হারাম, বৈধ-অবৈধ ইত্যাদি জেনে-বুঝে আমল করে, নিজের মধ্যে থেকে জাহেলিয়াত বা মূর্খতা সূলভ আচরণ দূর করে এবং সমাজকে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাষিত করে। সুতরাং কেউ যদি জ্ঞানার্জন করার পরও তা নিজের জীবনে প্রয়োগ না করে তাহলে সে মূলত: জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করল। তাই নিম্নে কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের বক্তব্যের আলোকে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হল।
জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল না করার পরিণতি:
যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো সে ফরজ লঙ্ঘন করার কারণে গুনাহগার তো হবেই কিন্তু যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করার পরও আমল থেকে দূরে থাকলো তার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।
নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:
১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ বিচারের কাঠগড়ায় কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবে:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ
[رواه الترمذي: 2417، وقَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ]
আবু বারযা নাদলা ইবনে উবায়েদ আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামতের দিন বান্দাহর পদযুগল সরবে না, যে পর্যন্ত না তাকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ তার জীবনকাল কিরূপে অতিবাহিত করেছে, তার জ্ঞান কি কাজে লাগিয়েছে, তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং কিসে খরচ করেছে এবং তার শরীর কিভাবে পুরানো করেছে?” [ইমাম তিরমিযী এ হাদীস (নং-২৪১৭) বর্ণনা করে বলেন, হাদীস টি হাসান ও সহীহ।]
২. ইলম অনুযায়ী আমল না করলে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে:
হাদিসে এসেছে:
وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ . قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ . وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ . فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ .
“তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে-যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন অধ্যায়ন করেছে। তখন তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা তাকে স্বরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তার স্বীকার করবে।
তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ এই জ্ঞান দ্বারা তুমি কী করেছো?
জবাবে সে বলবে: আমি জ্ঞানার্জন করেছি এবং তা (অন্যকে) শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছি।
আল্লাহ তায়ালা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞানার্জন করেছিলে এজন্যে যে, লোকেরা তোমাকে জ্ঞানী বলবে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে যে, লোকেরা তোমাকে কারী (কুরআন পাঠক) বলবে। আর তা তো বলা হয়েছে।
তারপর আল্লাহর আদেশ ক্রমে তাকেও উপুড় করে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”
[সহীহ মুসলিম (ইফাঃ) হাদিস নম্বরঃ (৪৭৭০) অধ্যায়ঃ ৩৪/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন]
৩. ইলম অনুযায়ী আমল না আল্লাহর ক্রোধের কারণ:
ইলম অনুযায়ী আমল না আল্লাহর ক্রোধের কারণ এবং এটি মূলত: করা ইহুদিদের চরিত্র। তাইতো আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতিহার মধ্যে ইহুদিদেরকে الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ বা “আল্লাহর ক্রোধের শিকার” বলা হয়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ হল, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল কৃত আসমানি কিতাব তওরাতের জ্ঞান রাখত কিন্তু তদনুযায়ী আমল করতো না। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সন্তানের মত করে চিনতো কিন্তু তারপরও তাকে স্বীকার করে নি। (দেখুন, সূরা আনআম: ২০)
জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল করার গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েক জন মুসলিম মনিষীর বক্তব্য:
নিম্নে জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল করার গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েক জন মুসলিম মনিষীর বক্তব্য তুলে ধরা হল:
● ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (জন্ম: ১০৭-মৃত্যু: ১৮৭ হিজরি) বলেন:
على الناس أن يتعلموا فإذا علموا فعليهم العمل
“মানুষের জন্য শিক্ষার্জন করা আবশ্যক। আর যখন শিক্ষার্জন করবে তখন তা আমল করা আবশ্যক।”
● আব্বাসিয় খলিফা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুতায (মৃত্যু: ২৪৭ হি:) বলেন:
علم بلا عمل كشجرة بلا ثمرة
“আমল ছাড়া ইলম ফলহীন বৃক্ষের মত।”
● তিনি আরও বলেন:
علم المنافق في قوله وعلم المؤمن في عمله
“মুনাফিকের জ্ঞান হল, তার কথার মধ্যে আর মুমিনের জ্ঞান হল, তার কর্মের মধ্যে।”
● আবু আব্দিল্লাহ রুযবারি (মৃত্যু: ৩৬৯ হিজরি) বলেন:
العلم موقوف على العمل والعمل موقوف على الإخلاص والإخلاص لله يورث الفهم عن الله عز وجل
ইলম (জ্ঞান) নির্ভর করে আমল (কর্ম) এর উপর। আর কর্ম নির্ভরশীল ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর উপর। আর ইখলাস বা একনিষ্ঠতা আল্লাহর তরফ থেকে বুঝার ক্ষমতা এনে দেয়।”
এ প্রসঙ্গে সালাফে সালেহীন ও বিজ্ঞজনদের অনেক সুন্দর সুন্দর বক্তব্য আছে।
মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞানর্জন করে তদনুযায়ী আমাদের জীবনকে ঢেলে সাজানোর তওফিক দান করেন। আমীন।
(২০) প্রশ্ন: ইসলাম ধর্মে জীব-জন্তুর ছবি আঁকতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি যে, গাছেরও জীবন আছে। এ বিষয়ে ইসলামের ব্যাখ্যা জানতে চাই।
উত্তর:
ইসলামের বিধান হল, বিনা প্রয়োজনে মানুষ, পশু-পাখি ইত্যাদি জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কন করা বা তোলা জায়েজ নাই। আকাধিক হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। তবে গাছ-পালা, বাগান, ফল-ফুল অথবা মসজিদ, ঘরবাড়ি, জঙ্গল, পাহাড়, সাগর, ঝরণা, নদ-নদী ইত্যাদি প্রকৃতি ও জড়স্তুর ছবি তোলা বা অঙ্কন করা হাদিস দ্বারা অনুমদিত।
যেমন: নিম্নোক্ত হাদিসটি,
ﻋَﻦْ ﺳَﻌِﻴﺪِ ﺑْﻦِ ﺃَﺑِﻰ ﺍﻟْﺤَﺴَﻦِ ﻗَﺎﻝَ ﺟَﺎﺀَ ﺭَﺟُﻞٌ ﺇِﻟَﻰ ﺍﺑْﻦِ ﻋَﺒَّﺎﺱٍ ﻓَﻘَﺎﻝَ ﺇِﻧِّﻰ ﺭَﺟُﻞٌ ﺃُﺻَﻮِّﺭُ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺼُّﻮَﺭَ ﻓَﺄَﻓْﺘِﻨِﻰ ﻓِﻴﻬَﺎ . ﻓَﻘَﺎﻝَ ﻟَﻪُ ﺍﺩْﻥُ ﻣِﻨِّﻰ . ﻓَﺪَﻧَﺎ ﻣِﻨْﻪُ ﺛُﻢَّ ﻗَﺎﻝَ ﺍﺩْﻥُ ﻣِﻨِّﻰ . ﻓَﺪَﻧَﺎ ﺣَﺘَّﻰ ﻭَﺿَﻊَ ﻳَﺪَﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺃْﺳِﻪِ ﻗَﺎﻝَ ﺃُﻧَﺒِّﺌُﻚَ ﺑِﻤَﺎ ﺳَﻤِﻌْﺖُ ﻣِﻦْ ﺭَﺳُﻮﻝِ ﺍﻟﻠَّﻪِﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢﺳَﻤِﻌْﺖُ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠَّﻪِﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢﻳَﻘُﻮﻝُ « ﻛُﻞُّ ﻣُﺼَﻮِّﺭٍ ﻓِﻰ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﻳَﺠْﻌَﻞُ ﻟَﻪُ ﺑِﻜُﻞِّ ﺻُﻮﺭَﺓٍ ﺻَﻮَّﺭَﻫَﺎ ﻧَﻔْﺴًﺎ ﻓَﺘُﻌَﺬِّﺑُﻪُ ﻓِﻰ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ » . ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺖَ ﻻَ ﺑُﺪَّ ﻓَﺎﻋِﻼً ﻓَﺎﺻْﻨَﻊِ ﺍﻟﺸَّﺠَﺮَ ﻭَﻣَﺎ ﻻَ ﻧَﻔْﺲَ ﻟَﻪُ .
সাঈদ বিন আবুল হাসান বলেন, এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর কাছে এসে বলল, আমি চিত্রকর এবং চিত্র অংকন করি। এতএব এ সম্পর্কে আমাকে শরিয়তের বিধান বলে দিন।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন: আমার কাছে আস। সে ব্যক্তি তাঁর কাছে গেল। তিনি পুনরায় বললেন: আরও কাছে আস। সে ব্যক্তি আরও কাছে গেল। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাঁর মাথায় হাত রেখে বললেন: আমি তোমাকে এ সম্পর্কে এমন একটি হাদিস শুনাচ্ছি, যা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে শুনেছি।
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে,
ﻛُﻞُّ ﻣُﺼَﻮِّﺭٍ ﻓِﻰ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﻳَﺠْﻌَﻞُ ﻟَﻪُ ﺑِﻜُﻞِّ ﺻُﻮﺭَﺓٍ ﺻَﻮَّﺭَﻫَﺎ ﻧَﻔْﺴًﺎ ﻓَﺘُﻌَﺬِّﺑُﻪُ ﻓِﻰ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ
“সকল চিত্রকরই জাহান্নামে যাবে। আর প্রত্যেক চিত্রের পরিবর্তে একজন মানুষ বানানো হবে, যা জাহান্নামে তাকে শাস্তি দেবে। তিনি আরও বললেনঃ যদি তোমাকে তা করতেই হয়, তাহলে গাছ-পালা বা এমন বস্তুর ছবি তৈরি কর যার আত্মা নাই। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৬৬২)
সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার ইমাম নওবি রহ. বলেন এখানে ﺻُﻮﺭَﺓٍ ﺻَﻮَّﺭَﻫَﺎ ﻧَﻔْﺴًﺎ ﻓَﺘُﻌَﺬِّﺑُﻪُ ﻓِﻰ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ এ কথা দু রকম অর্থ বলেছেন। তিনি বলেন, এর অর্থ হতে পারে:
ক. প্রত্যেক ছবি/চিত্রের পরিবর্তে একজন মানুষ বানানো হবে, যা তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেবে।
খ. অথবা যে ছবিটি সে অঙ্কণ করেছিলো তাতে প্রাণের সঞ্জার ঘটানো হবে যা তাকে জাহান্নামে শাস্তি প্রদান করবে। (শরহে মুসলিম-ইমাম নওবি রাহ.)
সুতরাং যেহেতু গাছ-পালার ছবি তোলার ব্যাপারে হাদিসে অনুমতি আছে সেহেতু এতে কোন আপত্তি নাই-যদিও বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, গাছের প্রাণ আছে।
(২১) প্রশ্নঃ কারোর উপর ‘আল্লাহর গজব নাজিল হোক’, ‘আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুক’, এগুলো বলার বিধান কি?
উত্তর:
কখন কার উপর অভিশাপ দেয়া জায়েজ আর কখন নাজায়েয তা কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:
◉◈ এক:
নির্দিষ্ট ভাবে কোনও ব্যক্তির উপর অভিশাপ দেওয়া জায়েজ নেই-চাই সে মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম হোক। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
سَالِمٌ عَنْ أَبِيْهِ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنْ الرُّكُوْعِ فِي الرَّكْعَةِ الْآخِرَةِ مِنَ الْفَجْرِ يَقُوْلُ : اللهُمَّ الْعَنْ فُلَانًا وَفُلَانًا وَفُلَانًا بَعْدَ مَا يَقُوْلُ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ فَأَنْزَلَ اللهُ {لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ} إِلَى قَوْلِهِ {فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ} رَوَاهُ إِسْحَاقُ بْنُ رَاشِدٍ عَنْ الزُّهْرِيِّ.
সালিম (রহ.) থেকে বর্ণিত, তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে শুনেছেন যে, তিনি ফজরের সলাতের শেষ রাকআতে রুকু থেকে মাথা তুলে ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ্ (আল্লাহ তাঁর প্রশংসাকারীর প্রশংসা শোনেন। হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার জন্য সমস্ত প্রশংসা)’, ‘রব্বানা ওয়ালাকাল হামদ’ বলার পর এটা বলতেনঃ হে আল্লাহ! অমুক, অমুক এবং অমুককে লানত করুন। তখন আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ ….. فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ “তিনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদের শাস্তি দিবেন, এ বিষয়ে তোমার করণীয় কিছুই নেই। কারণ তারা জালিম।”(সূরা আলু ‘ইমরান ৩/১২৮)
[সহিহ বুখারী, অধ্যায়: তাফসীর, অনুচ্ছেদ: আল্লাহর বাণীঃ এই বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই।]
এ হাদিস থেকে জানা গেল, আল্লাহ তাআলা নির্দিষ্টভাবে কোন কাফিরকেও অভিশাপ দেয়ার অনুমতি দেন নি।
এ মর্মে আরেকটা হাদিস:
উমর ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তির নাম ছিল ‘আবদুল্লাহ, কিন্তু তাকে ‘হিমার’ (গাধা) উপাধিতে ডাকা হতো। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাসাতো। একদিন মদপানের অপরাধের জন্য নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করেছিলেন। এরপর আবার একদিন তাকে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আনা হলে তিনি তাকে চাবুক মারার নির্দেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহ, এই লোকের উপর তোমার অভিসম্পাত হোক। কতবারই না তাকে এ অপরাধে আনা হল!
তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
«لَا تَلْعَنُوْهُ فَوَ اللهِ مَا عَلِمْتُ أَنَّه يُحِبُّ اللّٰهَ وَرَسُوْلَه»
“তাকে অভিশাপ দিও না। আল্লাহর শপথ! আমি তার সম্পর্কে জানি যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে ভালোবাসে।” (বুখারী)
এ হাদিসে দেখা গেলো ,প্রিয় নবি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্টভাবে একজন পাপী ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়ার অনুমতি দেন নি।
◉◈ দুই:
অনির্দিষ্টভাবে পাপিষ্ঠ, কাফের-মুশরিক ও ইসলামের দুশমনদের ধ্বংস কামনা করা বা তাদেরকে অভিশাপ দেয়া জায়েজ আছে। যেমন: ,
«لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا»
“ইহুদি ও খৃষ্টানদের ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ, তারা তাদের নবিদের কবরকে (সেজদার জায়গা) মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।”
(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে আলী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি বিষয়ে আমাকে অবহিত করেছেন:
«لَعَنَ اللَّهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللَّهِ وَلَعَنَ اللَّهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا وَلَعَنَ اللَّهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَيْهِ وَلَعَنَ اللَّهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الْأَرْضِ»
ক. যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করে তার উপর আল্লাহর লা’নত।
খ. যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত।
গ. যে ব্যক্তি কোনও পাপাচারী কিংবা বিদআতিকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত।
ঘ. যে ব্যক্তি জমিনের সীমানা পরিবর্তন করে, তার উপর আল্লাহর লা’নত’’।
[সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য পশু জবেহ করা হারাম।]
এ বিষয়ে প্রচুর হাদিস আছে।
◉◈ তিন:
নির্দিষ্ট কোন-কাফের মুশরিককে অভিসম্পাত করা জায়েজ আছে যদি কুরআন ও হাদিসে তাকে অভিসম্পাত করা হয়ে থাকে। যেমন: ইবলিসকে অভিশাপ দেয়া। আল্লাহ বলেন:
وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ
”এবং তোমার প্রতি বিচারের দিন (কিয়ামত) পর্যন্ত অভিসম্পাত।” (সূরা হিজর: ৩৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে লানত বা অভিসম্পাত দিয়েছেন।
এছাড়াও ঐ ব্যক্তিদেরকে নির্দিষ্টভাবে লানত দেয়া জায়েজ কুরআন-হাদিস দ্বারা জানা যায় যে, তারা কুফরির উপর মারা গেছে। যেমন: ফিরআউন, নমরূদ, আবু লাহাব, আবু জাহেল ইত্যাদি।
(২২) প্রশ্নঃ শুধু ‘লা ইলাহা’ ও ‘ইল্লাল্লা-হ’ জিকিরকারীর ইসলামি বিধান কি?
উত্তরঃ কেবল ‘লা ইলাহা’ (কোনও উপাস্য নাই) হল, নাস্তিকতাবাদি ও কুফরি জিকির। শুধু ‘ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া) হল বিদআতি জিকির।
সঠিক ও সুন্নতি জিকির হল, দুটি বাক্যের সমন্বিত জিকির তথা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই)।
সুতরাং যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ বাক্য ছাড়া কেবল ১ম অংশ জিকির করবে কুফরি করবে আর শেষ অংশ জিকির করলে বিদআত করবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أفضل الذكر لا إله إلا الله
وأفضل الدعاء الحمد الله
“শ্রেষ্ঠ জিকির হল, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ।
আর শ্রেষ্ঠ দুয়া হল, আল হামদু লিল্লাহ।”
(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ-হাদিসটি সহিহ। উৎস: সহিহুল জামে-১১০৪, সহিহুত তারগিব ১৫২৬)
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক দ্বীন বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
(২৩) প্রশ্ন: স্বামী যদি স্ত্রীর কাছে সুন্দর দেখানোর জন্যে দাড়ি শেভ করে তাহলে কি করা উচিৎ?
উত্তর:
দাড়ি রাখা ফরজ। দাড়ি কাটা, ছাটা, মুণ্ডন ও ফ্যাশন করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। সুতরাং স্ত্রীকে খুশি করার জন্য দাড়ি কাটা বৈধ নয়।
দাড়ি বিষয়ে নিম্নে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হল:
● আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন,
ﺇﻧﻪ ﺃﻣﺮ ﺑﺈﺣﻔﺎﺀ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ ﻭﺇﻋﻔﺎﺀ ﺍﻟﻠﺤﻴﺔ
“আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোচ কাটার ও দাড়ি লম্বা করার আদেশ করেছেন।’
(সহীহ মুসলিম ১/১২৯)
● বিভিন্ন হাদিসে আদেশের শব্দগুলোও বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
ﺧﺎﻟﻔﻮﺍ ﺍﻟﻤﺸﺮﻛﻴﻦ، ﻭﻓﺮﻭﺍ ﺍﻟﻠﺤﻰ ﻭﺍﺣﻔﻮﺍ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ
“মুশরিকদের বিরোধিতা কর। দাড়ি বাড়াও ও মোচ কাট।” (আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বুখারী ২/৮৭৫)
● রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
ﺧﺎﻟﻔﻮﺍ ﺍﻟﻤﺸﺮﻛﻴﻦ، ﻭﺍﺣﻔﻮﺍ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ ﻭﺃﻭﻓﻮﺍ ﺍﻟﻠﺤﻰ
“মুশরিকদের বিরোধিতা কর এবং মোচ কাট ও দাড়ি পূর্ণ কর।” (ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে মুসলিম ১/১২৯)
● তিনি আরও বলেন:
ﺍﻧﻬﻜﻮﺍ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ ﻭﺍﻋﻔﻮﺍ ﺍﻟﻠﺤﻰ
“মোচ উত্তমরূপে কাট এবং দাড়ি লম্বা কর।” (ইবনে ওমর রা. এর সূত্রে বুখারী ২/৮৭৫)
● হাদিসে আরও এসেছে:
ﺟﺰﻭﺍ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ ﻭﺍﺭﺧﻮﺍ ﻟﻠﺤﻰ، ﺧﺎﻟﻔﻮﺍ ﺍﻟﻤﺠﻮﺱ
“মোচ কাট ও দাড়ি ঝুলিয়ে দাও, অগ্নি পূজারীদের বিরোধিতা কর।” (আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে মুসলিম ১/১২৯)
উপরের হাদিসগুলোতে চারটি শব্দ পাওয়া গেল :
ﺍﺭﺧﻮﺍ ـ ﺍﻋﻔﻮﺍ ـ ﺃﻭﻓﻮﺍ ـ ﻭﻓﺮﻭﺍ
এই সবগুলো শব্দ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লম্বা ও পূর্ণ দাড়ি রাখার আদেশ করেছেন। সুতরাং দাড়ি রাখা ফরজ।
তাছাড়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর মানুষ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে নবীদের পরেই সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ সাহাবায়ে কেরাম দাড়ি রাখতেন।
সুতরাং আমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাই তাহলে আমাদের জন্য আবশ্যক হল নিঃস্বার্থভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করা।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।” (সূরা আহযাব ২১) অর্থাৎ আমরা আখারিতে সফলতা ও মুক্তি পেতে চইলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে অনুসরণ করা ফরজ।
তিনি আরও বলেন:
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّـهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّـهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّـهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মোচন করবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
তিনি আরও বলেন:
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ
“রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা আল হাশর: ৭)
সুতরাং স্ত্রীকে খুশি করার জন্য অথবা সমাজের বাঁকা দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য দাড়ি কাটা, ছাটা বা মুণ্ডণ করা নাজায়েজ। বর্তমান সমাজে দীন নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে সকল ভ্রুকুটি ও ঝড়ঝঞ্জা উপেক্ষা করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্যথায় এই সমাজ আমাদেরকে দীন থেকে সরিয়ে দেবে।
স্ত্রীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ পালন করার আবশ্যকতার বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে বোঝাবেন। স্ত্রী যদি বুঝে তবে তো ভালো অন্যথায় স্ত্রীকে বাদ দেয়া গেলেও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ ও ইসলামের একটি ফরজ বিধান কে কখনোই জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না। এটাই ঈমানের দাবী।
আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমীন।
(২৪) প্রশ্ন: ইসলামে কি ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করা হয়েছে?
উত্তর:
এ উত্তরটি ভালোভাবে জানার জন্য নিম্নোক্ত লেখাটি পড়ুন:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا عَدْوَى وَلا طِيَرَةَ وَلا هَامَةَ وَلا صَفَرَ
“রোগ সংক্রমণ, কুলক্ষণ, পেঁচা এবং সফর মাস বলতে কিছু নাই।” (সহীহু বুখারী, হা/৫৭০৭)
মুহাদ্দিসগণ বলেন, উক্ত হাদীসে পেঁচা ও সফর মাসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় নি বরং জাহেলী যুগে পেঁচার ডাক এবং সফর মাসকে কুলক্ষণে মনে করা হত (বর্তমানেও মূর্খ লোকদের মাঝে এ কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে) এই বাতিল ও ভ্রান্ত বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সংক্রমন রোগের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা হয় নি বরং একটি ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনোদন করা হয়েছে। তা হল, জাহেলী যুগে কোনো কোন ব্যাধিকে এমন মনে করা হত যে, তা নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। কিন্তু ইসলামের সৃষ্টিভঙ্গী হল, রোগ কখনও নিজে নিজে সংক্রমিত হতে পারে না। বরং তা আল্লার ইচ্ছার সাথে সংম্পৃক্ত। তার লিখিত তাকদীর ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না।
উক্ত হাদীসের এই ব্যাখ্যাটি নিন্মোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়:
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নাই বললে জনৈক বেদুঈন আরব জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রসূলুল্লাহ! তবে সেই উটপালের অবস্থা কি যা কোনো বালুকাময় প্রান্তরে অবস্থান করে এবং সুস্থ-সবল থাকে? অতঃপর তথায় কোনো খুজলী-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট তাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং সবগুলোকে ঐ রোগে আক্রান্ত করে ছাড়ে?
(এর জবাবে) তিনি বললেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিলো?” (সহীহ মুসলিম)
এ হাদীসের অর্থ হল, যে মহান আল্লাহ প্রথম উটটিকে আক্রান্ত করেছিলেনে তিনিই অন্যান্য উটকেও আক্রান্ত করেছেন। অর্থাৎ রোগ-ব্যাধী নিজে নিজে সংক্রমিত হয় না যদি আল্লাহর হুকুম না থাকে।
মোটকথা, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত হওয়া একটি বাস্তব বিষয়। তবে সংক্রমনের এই ক্ষমতা রোগের নিজস্ব নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত। তাই তিনি চাইলে সংক্রমণ হবে নতুবা হবে না এবং এটি যেহেতু রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি বাস্তব কারণ তাই রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ থেকে বেঁচে থাকতে যেমনিভাবে কোনো দোষ নেই তেমনি এক্ষেত্রেও উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা দোষের নয়। বরং কিছু হাদীসে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। [বাযলুল মাজহূদ ১৬/২৪২; শরহুন নববী ২/২৩০; ফয়যুল কাদীর ৬/৪৩৩)
ইসলামে ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করা হয় নি:
ইসলামে ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করা হয় নি তার প্রমাণে অনেক হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে নিচের হাদীসগুলো অন্যতম:
  আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لا يورد ممرض على مصح
“অসুস্থ উটগুলোর মালিক তার উটগুলোকে সুস্থ পশুর দলে পাঠিয়ে দেবে না। (কারণ এতে ঐসুস্থ প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হতে পারে।) [সহীহ মুসলিম]
  তিনি আরও বলেন:
فر من المجذوم فرارك من الأسد
“সিংহের আক্রমণ থেকে যেভাবে পলায়ন কর কুষ্ঠরোগী থেকেও সেভাবে পলায়ন করো।” (সহীহ আল বুখারী)
আবার তিনি কুষ্ঠরোগীর সাথে বসেও খাবার খেয়েছেন আর বলেছেন:
كل بسم الله ثقة بالله
“আল্লাহর উপর আস্থা রেখে আল্লাহর নামে খাওয়া শুরু করো।” (তিরমিযী, অধ্যায়: খাদ্যদ্রব্য, অনুচ্ছেদ: কুষ্ঠরোগীর সাথে খাবার খাওয়া)
এটা তিনি এ জন্য করেছেন যে, কুষ্ঠ রোগীর কাছে গেলেই যে, সে রোগে আক্রান্ত হতে হবে তা জরুরি নয়। বরং কখনও হতে পারে আবার কখনও নাও হতে পারে। এটা আল্লাহ ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
জন্ম সনদে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে তার মাধ্যমে চাকুরী করার বিধান
(২৫) প্রশ্ন: আমি যে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাচ্ছি, তা শুধু আমার জন্য না। আমার ধারণা, এ দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণীর জন্যও একই মাসআলার প্রয়োজন।
আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা হল, বেকার সমস্যা। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকুরীতে আবেদন করার সময় পায়। সমস্যাটি এখানেই। আমাদের দেশে প্রচলিত একটি রীতি হল, স্কুলে ফরম ফিলাপের সময় জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে বয়স কমিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অনেকের শিক্ষক আবার অনেকের বাবা-মা এ ব্যাপারটি করে থাকে।
আমার প্রশ্ন হল:
১) এই ভাবে বয়স কমিয়ে দিয়ে (আসল ৩০ বছর বয়সে) সরকারি চাকুরী হলে তার উপার্জন হালাল হবে কিনা?
২) এই ভাবে বয়স কমিয়ে দিয়ে (আসল ৩০ বছর বয়সের পর ) সরকারি চাকুরী হলে তার উপার্জন হালাল হবে কিনা? আশা করছি, রেফারেন্স সহ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির যথাযথ উত্তর পাবো।
উত্তর:
স্কুলে ফরম ফিলাপ, জন্ম নিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট তৈরির সময় প্রকৃত জন্ম তারিখের পরিবর্তে অন্য তারিখ ব্যবহার করা নি:সন্দে মিথ্যা ও প্রতারণার শামিল। ইসলামের দৃষ্টিতে তা কবিরা গুনাহ এবং দেশের প্রচলিত আইনেও অপরাধ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا »
“যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সহিহ মুসলিম: ১০১) অর্থাৎ সে ইসলামের আদর্শ থেকে দূরে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
وإياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وإن الرجل يكذب ويتحرى الكذب حتى يكتب عند الله كذابا.
“আর মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা পথ দেখায় পাপাচারের। আর পাপাচার উপনীত করে জাহান্নামে। যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে ও মিথ্যার অন্বেষায় থাকে, এভাবে একসময় আল্লাহর কাছে সে চরম মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৬০৭)
সুতরাং জন্ম তারিখ পরিবর্তন করা করা জায়েজ নাই। চাকুরীতে অ্যাপ্লায়ের মেয়াদ বৃদ্ধি বা চাকুরীর বয়স বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এমনটি করলে আল্লাহর নিকট অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি সে নিজের বিবেকের কাছেও অপরাধী হয়ে থাকে।
যাহোক, কেউ যদি এ ধরণের কাগজ সাবমিট করার মাধ্যমে হালাল কাজের চাকুরীতে প্রবেশ করে এবং উক্ত কাজের জন্য তার মধ্যে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকে, যথাযথভাবে কাজ সম্পাদন করে এবং কাজের ক্ষেত্রে কোন ধরণের অবহেলা প্রদর্শন না করে তাহলে এর মাধ্যমে তার উপার্জিত সম্পদ হালাল। তবে জন্ম সনদে বয়স কমিয়ে লিখার মাধ্যমে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার কারণে আল্লাহর নিকট খাঁটি অন্তরে তওবা করা আবশ্যক।
উল্লেখ্য যে, জাল সার্টিফিকেট ও ডকুমেন্টস দ্বারা চাকুরী করার বিধানও একই।
আল্লাহ আমাদেরকে হারাম থেকে রক্ষা করুন এবং হালাল পথে জীবিকা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন।
ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বিধান ও শর্তাবলী
(২৬) প্রশ্ন: ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং এর কাজ করা কি জায়েজ আছে?
উত্তর:
ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তলব অনুযায়ী কাজ করার নাম হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং। এ জগতে হাজার হাজার কাজ আছে। সেগুলো থেকে যদি আপনি কিছু শর্ত সাপেক্ষে হালাল কর্মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন তাহলে নি:সন্দেহে তা হালাল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَا أكَلَ أَحَدٌ طَعَاماً قَطُّ خَيْراً مِنْ أنْ يَأكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِه، وَإنَّ نَبيَّ الله دَاوُدَ عليه السلام كَانَ يَأكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ ». رواه البخاري
‘‘নিজের হাতের উপার্জন থেকে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায় নি। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতের উপার্জন থেকে খেতেন।’’(সহীহুল বুখারী ২০৭২, ইবনু মাজাহ ২১৩৮, আহমাদ ১৬৭২৯, ১৫৭৩৯)
তবে সর্বদা হালাল-হারামের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে এবং হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে থাতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«إنَّ الحَلاَلَ بَيِّنٌ، وَإنَّ الحَرامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبَهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ، اسْتَبْرَأَ لِدِينهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ في الحَرَامِ
‘‘অবশ্যই হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দুটির মাঝখানে রয়েছে কিছু সন্দেহপূর্ণ বস্তু; যা অনেক লোকেই জানে না। অতএব যে ব্যক্তি এই সন্দেহপূর্ণ বিষয় সমূহ হতে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করবে এবং যে সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে পতিত হবে সে হারামে পতিত হবে।” (সহীহুল বুখারী ৫২, ২০৫১, মুসলিম ১৫৯৯)
মোটকথা, কাজের উপর নির্ভর করে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা কখনো বৈধ আবার কখনো অবৈধ।
এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হল, যদি আপনি এমন কাজ করেন যেটা মূলত শরিয়তে হালাল-যাতে হারামের সংস্পর্শ নাই তাহলে তা হালাল এবং সেখান থেকে উপার্জিত অর্থও হালাল আর যদি কাজটা হারাম হয় তাহলে তা করা হারাম এবং সেখান থেকে উপার্জিত অর্থও হারাম।
ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের শর্তাবলী:
কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে ফ্রিল্যান্সিং করা এবং তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা বৈধ। যথা:
১. ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কাজটি হালাল হওয়া (হারাম না হওয়া)।
২. দেশের প্রচলিত আইন পরিপন্থী না হওয়া।
৩. মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতি কারক না হওয়া।
৪.কারো অধিকার খর্ব না করা। (যেমন: কপিরাইট লঙ্ঘন করা)।
৫. আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদ, ঘুস বা দুর্নীতির আশ্রয় না নেয়া।
৬. মিথ্যা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া ইত্যাদি।
যদিও এগুলো অনলাইন-অফলাইন সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু অনলাইনে
আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ ক্ষেত্রে প্রতারণা ও অন্যায়-অপকর্মের সুযোগ বেশি থাকে।
কয়েকটি উদাহরণ:
গ্রাফিক্স ডিজাইন। গ্রাফিক্সে ডিজাইনে যদি কোন অশ্লীলতা না থাকে এবং পুরুষ-মহিলা বা অন্য কোনো প্রাণীর ছবি যুক্ত করা না করা হয় বা কপিরাইট কৃত কোন ছবি ব্যবহার না করা হয় তাহলে তা হালাল; অন্যথায় হারাম।
ডাটা এন্ট্রি বা (লেখা)। এতে যদি শরিয়ত বিরোধী কিছু না থাকে তাহলে কোন আপত্তি নাই; অন্যথায় হারাম। যেমন: কোনো লেখকের কপি রাইট কৃত বই থেকে নকল করা, নাস্তিকতা ও ইসলাম বিরোধী প্রপাগাণ্ডা মূলক লেখা, অবৈধ প্রেমভালবাসা ও নোংরা-সেক্সুয়াল বিষয়ে লেখা ইত্যাদি। এগুলো লিখে অনলাইনে পয়সা কামানো হারাম।
অনলাইন ভিত্তিক সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ/বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা। পণ্যটি যদি হালাল হয় তাহলে তা হালাল কিন্তু পণ্যটি হারাম হলে তা অবশ্যই হারাম। যেমন: মদ-নেশা, বিড়ি-সিগারেট, মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক, খাঁটি পণ্যের লেভেল লাগানো নকল পণ্য, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ পণ্য ইত্যাদি। এগুলো অনলাইনে বিক্রয় সেবা দিয়ে পয়সা কামানো হালাল নয়।
এভাবে হালাল-হারামের বিষয়টি ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, SCO, নেটওয়ার্কিং ও তথ্যব্যবস্থা (ইনফরমেশন সিস্টেম), প্রশাসনিক সহায়তা, মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা (Customer Service) ইত্যাদি যতপ্রকার কাজ আছে সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আল্লাহু আলাম।
মহান আল্লাহ আামাদেরকে বৈধ পন্থায় কাজ করে অর্থ উপর্জন করার এবং সকল প্রকার হারাম ও অসদুপায় অবলম্বন থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অজ্ঞাত ব্যক্তি আমার ফোনে ১০০ টাকা পাঠিয়েছে। এখন আমি তা কী করব?
(২৭) প্রশ্ন: গত কাল আমার ফোনে কে যেন ১০০ টাকা দিয়েছে কিন্তু কেউ কলও দিচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, আমাকে যারা টাকা দেওয়ার মত তারা কেউ দেয় নি আর আমার নাম্বারটাও খুব কম মানুষ জানে। আমি এখন কী করতে পারি যদি না জানতে পারি যে, কে দিয়েছে?
উত্তর:
হয়ত আপনার কোন পরিচিত ব্যক্তি উপহার হিসেবে আপনার কাছে এই টাকা পাঠিয়ে নিজেকে গোপন রেখেছে। অথবা কেউ ভুল বশত: আপনার নাম্বারে এই টাকা রিচার্জ করেছে।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হল, প্রথমত: যে নাম্বার থেকে টাকা এসেছে সে নাম্বারে কল দিয়ে বা ফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে কল দিয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে যে, কে এই টাকা পাঠিয়েছে বা এর উৎস কী? কেননা, অর্থের উৎস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বান্দাকে প্রশ্ন করবেন। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বান্দাকে পাঁচটি প্রশ্ন করবেন। সেগুলোর উত্তর যথাযথভাবে না দিতে পারলে সে দিন কাউকে এক পা অগ্রসর হতে দেয়া হবে না। সে দুটি প্রশ্ন হল:
وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ
“(কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বান্দাকে প্রশ্ন করবেন) তার ধন-সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং তা কোন খাতে খরচ করেছে?” (তিরমিযী হা/২৪১৬; মিশকাত হা/৫১৯৭।)
কিন্তু যদি চেষ্টা সত্যেও টাকার উৎস জানা সম্ভব না হয় তাহলে আপনি তা ব্যবহার করতে পারেন তবে পরবর্তীতে যদি কেউ দাবী করে যে, ভুল বশত: আপনার নাম্বারে টাকা পাঠানো হয়েছিলো তাহলে তাকে তা ফেরত দিতে হবে।
প্রতি সপ্তাহে কবর জিয়ারত করা এবং জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করার বিধান
(২৮) প্রশ্ন: কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূরে কোথাও যাওয়া নাকি নিষেধ? কিন্তু আবার অনেকেই বলে যে, সপ্তাহে একদিন কবর জিয়ারত করা উচিত। কথা দুটি পরস্পর বিরোধী হয়ে গেছে না? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
উত্তর:
কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন, ক্ষণ, সপ্তাহ বা মাস নাই। বরং যখন খুশি তখনই জিয়ারত করা যাবে। প্রতি শুক্রবার, প্রতি সপ্তাহে একবার, প্রতি মাসে একবার, দু ঈদের রাতে, কথিত শবে বরাতের রাতে….এমন কোন নির্দেশনা ইসলামে আসে নি। সুতরাং কবর বাসীদের প্রতি সালাম প্রদান, তাদের জন্য দুআ করা এবং মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করার উদ্দেশ্যে যখন সুবিধা হয় পুরুষদের জন্য কবর জিয়ারত করা বৈধ।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ : “ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর তিনি বললেন,“আমি মায়ের কবর যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। আর তার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয় নি। অতএব তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা কবর জিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ”[সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬, মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয, অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
أَلا فَزُورُوهَا ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ
“সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর, কেননা এতে আখিরাতের কথা স্মরণ হয়।”
তাই আমরা আমাদের সুবিধাজনক সময়ে কবর জিয়ারত করতে যাবো। এতে আমাদের মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ হবে।
শুধু কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করার বিধান:
অধিক বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী কেবল কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করা জায়েজ নাই। চাই তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর হোক বা অন্য কোন কবর হোক। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা, মসজিদে নব্বী ও মসজিদুল আকসা এই তিনটি মসজিদ ছাড়া কোন স্থান থেকে আলাদা সওয়াব লাভের নিয়তে বা রবকত লাভের আশায় সফর করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, এটি শিরকের মাধ্যম।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَشُدُّوا الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَسْجِدِ الْأَقْصَى
“তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন কোথাও (বিশেষ বরকত ও ফযিলত পূর্ণ স্থান মনে করে) সফর করো না। সেগুলো হল: মসজিদুল হারাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদ এবং মসজিদুল আকসা।” (বুখারিও মুসলিম)
বাসরা বিন আবী বাসরা গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আবু হুরাইরাহ্ (রা.) কে তুর পাহাড় থেকে আসতে দেখে বললেন:
لَوْ أَدْرَكْتُكَ قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ إِلَيْهِ لَـمَا خَرَجْتَ، سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ: لاَ تُعْمَلُ الْـمَطِيُّ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ: الْـمَسْجِدِ الْـحَرَامِ، وَمَسْجِدِيْ هَذَا، وَالْـمَسْجِدِ الْأَقْصَى
‘‘আমি আপনাকে তুর পাহাড়ের দিকে যাওয়ার পূর্বে দেখতে পেলে অবশ্যই আপনি বের হতেন না। কারণ, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি: ( (বিশেষ বরকত ও ফযিলত পূর্ণ স্থান মনে করে) তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করা যাবে না। সে মসজিদগুলো হলো: মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ (মদিনার মসজিদে নববী) ও মসজিদে আকসা’’। (মুআত্তা মালিক : ১/১০৮-১০৯ আহমাদ : ৬/৭ ’হুমাইদী, হাদীস ৯৪৪, শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিস বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ। ইরওয়াউল গালিল ৪/১৪১)
উক্ত হাদিস দ্বয়ের আলোকে একদল আলেম বরকত ও সওয়াব লাভের নিয়তে কোন কবর, মাজার, দরবার, বিশেষ কোন স্মৃতি স্থল ও কথিত পুণ্যভূমি, এমনকি রাসূল সা. এর মসজিদ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর থেকে সফর করাকে নাজায়েজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জাহেলি যুগের লোকেরা, তুর পাহাড়, সিনাই পর্বত, ঈসা আ. এর জন্মস্থান, পূর্ববতী বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধিস্থল ইত্যাদি বরকত লাভের উদ্দেশ্যে সফর করত। ইসলাম সে সব জাহেলি ধ্যান-ধারণাকে উৎখাত করে স্থানগত মর্যাদা কেবল এ তিনটি মসজিদে জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সুতরাং ইলম চর্চা, দ্বীনের দাওয়াত, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরি, পর্যটন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে একদেশ থেকে আরেক দেশ, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ভ্রমণ করা এ হাদিসের অন্তর্ভূক্ত নয়।
শাইখ আবু মহাম্মদ আল জুওয়াইনী (ইমামুল হারামাইন খ্যাত আবুল মাআলী আল জুওয়াইনীর পিতা, মৃত্যু: ৪৩৮ হিজরি/১০৪৭) বলেন:
يحرم شد الرحال إلى غيرها عملا بظاهر هذا الحديث وأشار القاضي حسين إلى اختياره وبه قال عياض وطائفة، ويدل عليه ما رواه أصحاب السنن من إنكار بصرة الغفاري على أبي هريرة خروجه إلى الطور وقال له: لو أدركتك قبل أن تخرج ما خرجت، واستدل بهذا الحديث فدل على أنه يرى حمل الحديث على عمومه ووافقه أبو هريرة.
“এ হাদিসের বাহ্য অর্থের উপর আমল করলে এই তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও (বরকত হাসিল বা পুণ্যভূমি মনে করে) সফর করা হারাম। কাজি হুসাইন এই মতটি গ্রহণ করার দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন আর কাজি ইয়াজ সহ একদল আলেম এ কথাই বলেছেন।
এর দলিল হল, আসহাবুস সুনান (তথা আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি। তা হল: বাসরা আল গিফারি আবু হুরায়রা রা. এর তুর পাহাড়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করার পর এই হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি এই ব্যাপক অর্থেই হাদিসটিকে প্রযোজ্য মনে করতেন আর আবু হুরায়রা . ও তার সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন।”
মদিনা জিয়ারতের উদ্দেশ্য হবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদে সালাত আদায় করা। কেননা সেখানে এক রাকআত সালাত কাবা শরীফ ছাড়া অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক হাজারগুণ বেশি সওয়াবের। মসজিদে নব্বীতে সালাত আদায় করার পর করণীয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর, তাঁরপাশে অবস্থিত তাঁর দু সাথী আবু বকর রা. ও উমর রা. এর কবর এবং তার সন্নিকটস্থ বাকি গোরস্থান জিয়ারত করা।
দু:খজনক বাস্তবতা হল, বর্তমানে অনেক মানুষকে দেখা যায় যারা, বহু দূর-দূরান্ত থেকে বাস রিজার্ভ করে বা ভিসা-টিকেট নিয়ে শাহজালাল, শাহপরান, শাহ মাখদুম, বাইজিদ বোস্তামি, ভারতের আজমির শরিফ, বড়পীর (!) খ্যাত ইরাকের আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর মাজার ইত্যাদি জিয়ারত করতে যায়। উপরোক্ত হাদিস দ্বয় এবং সালাফদের ব্যাখ্যার আলোকে তা হারাম বলে প্রতীয়মান হয়।
তবে যদি নিজস্ব এলাকায় বা বাড়ির আশেপাশে কবর থাকে অথবা যদি পর্যটন বা কোন কাজের উদ্দেশ্যে দূরে কোথাও যাওয়া হয় এবং সেখানে কবর/মাজার থাকে তাহলে তাহলে এ সকল কবর বাসীর উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান, দুআ করা এবং শিক্ষা নেয়ার উদ্দেশ্যে জিয়ারত করায় কোনও আপত্তি নাই। এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলেমদের এবং বর্তমান যুগের সৌদি আরবের বড় আলেমদের ফতোয়াও রয়েছে।আল্লাহ আমদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
(২৯) প্রশ্ন: কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বিভিন্ন সুরা-কিরাআত পড়ার বিধান কি?
উত্তর:
কবর জিয়ারত করতে গিয়ে হাদিসে বর্ণিত পদ্ধতিতে কবর বাসীদের উদ্দেশ্যে সালাম দেয়া ও কবর জিয়ারতের দোয়া পাঠ করতে হবে। এটাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা ও শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে কুরআন তিলাওয়াত করা শরীয়ত সম্মত নয়।
সুতরাং আমাদের সমাজে কবর জিয়ারত করতে গিয়ে এত বার সূরা ইখলাস, এত বার সূরা ফালাক, এতবার সূরা নাস, এতবার দরুদ শরীফ ইত্যাদি পড়ার যে পদ্ধতি চালু আছে তার কোনো ভিত্তি নাই। এগুলো মনগড়া পদ্ধতি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কখনোই এমনটি করেন নি।
আর আমাদের জানা কথা যে, দ্বীনের মধ্যে ইবাদত হিসেবে নতুন কিছু সংযোগ করাই হল বিদআত।
এ ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لاَ تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِى تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ
“তোমরা তোমাদের বাড়ীকে গোরস্থানে পরিণত করোনা। যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় শয়তান সে ঘর থেকে পলায়ন করে। ” (সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: বাড়ীতে নফল নামায পড়া মুস্তাহাব তবে মসজিদেও পড়া জায়েয। হাদিস নং ১৮৬০ আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত)
তিনি আরও বলেন:
صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ وَلَا تَتَّخِذُوهَا قُبُورًا
“তোমরা তোমাদের ঘরে (নফল) নামায আদায় কর এবং তা কবরস্থানে পরিণত কর না। ” (তিরমিযী, ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। অনুচ্ছেদ: বাড়ীতে নফল নামায পড়া মুস্তাহাব। হাদিস নং ৪৫৩। ইমাম তিরমিযী এ হাদিসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
এ দুটি হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, গোরস্থান নামায ও কুরআনের তিলাওয়াতের জায়গা নয়। কেননা হাদিসের অর্থ হল, কবরে যেমন নামায পড়া হয় না কিংবা কুরআন তেলাওয়াত করা হয় না তদ্রূপ ঘরে নফল নামায এবং কুরআন পড়া বাদ দিয়ে ঘরকে গোরস্থানে পরিণত কর না।
সুতরাং সব ধরণের বিদআতি কার্যক্রম থেকে বাঁচা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দীনের মধ্যে নব সংযোজিত প্রতিটি বিষয় গোমরাহি এবং প্রত্যেকটি গোমরাহির পরিণতি জাহান্নাম।
আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের বিদআতি কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
তাই আসুন, মনগড়া ও বিদআতি পদ্ধতি বাদ দিয়ে আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর অনুসরণ করি। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
সহিহ হাদিসে বর্ণিত কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে সালাম ও কবর জিয়ারতের দুআা:
বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীগণ কবর যিয়ারত করতে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই দুয়াটি পড়তে বলতেন:
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ
“কবর গৃহের হে মুমিন-মুসলিম অধিবাসীগণ,আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ চাইলে আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। আমি আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করছি। ”[সহীহ মুসলিম,অধ্যায়ঃ গোরস্থানে প্রবেশ কালে কী বলতে হয়? হাদিস নং ১৬২০]
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কবর যিয়ারতের দুয়া হিসেবে আমাদের সমাজে একটি দুয়া ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। সেটি হল,
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ
“হে কবর বাসীগণ,তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তোমাদেরকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের আগে চলে গেছ। আমরা তোমাদের অনুগামী।” (তিরমিযী) কিন্তু এ হাদিসটি সনদগতভাবে দুর্বল-যেমনটি ইমাম আলবানী রাহ. যঈফ তিরমিযীতে উল্লেখ করেছেন। তাই সেটি না পড়ে পূর্বোল্লিখিত সহীহ মুসলিম সহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে সহীহ সনদে যে দুয়াগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পড়ার চেষ্টা করা উচিৎ। আল্লাহু আলাম।

সুতা বা কাপড়ের তৈরি মোজার উপর মাসেহ করার বিধান
(৩০) প্রশ্ন: ওজুর সময় মোজার ওপর পা মাসেহ করা জায়েজ কিনা? আমরা জানি আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করতেন ।এখন প্রশ্ন হল, নরমাল সব মোজার ওপর মাসেহ করা যাবে কি না? রেফারেন্স সহ জানালে উপকৃত হব।
উত্তর:
মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয় চাই তা চামড়ার তৈরি হোক বা সুতার তৈরি হোক। সাহাবীগণ অনেকেই কাপড়ের তৈরি মোজা পরিধান করতেন আর তার উপর মাসেহ করতেন।
উল্লেখ্য যে, আরবিতে চামড়ার তৈরি মোজাকে ‘খুফ’ আর সুতার তৈরি মোজাকে ‘জাওরাব’ বলা হয়। উভয় প্রকার মোজার উপর মাসেহ করা বৈধ।
চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করা সর্ব সম্মতিক্রমে বৈধ। তবে সুতার তেরি মোজার উপর মাসেহ করা বৈধ কি না- এ বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও সঠিক মত হল, জায়েজ।
বিস্তারিত:
সাধারণভাবে সকল ধরণের জাওরাব (সুতার তৈরি মোজা) এর উপর মাসাহ বৈধ, এমনকি যদি তা খুব পাতলা হয় তবুও: এটাই ইবনে হাযম ও ইবনে তাইমিয়ার স্পষ্ট অভিমত। আর এ মতকেই ইবনে উসাইমীন ও আল্লামা শানক্বীতী পছন্দ করেছেন।
[আল-মুহাল্লাহ (২/৮৬), আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ (৫৮ পৃ.), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৪), আল-মুমতি’ (১/১৯০), আযওয়াউল বায়ান (২/১৮, ১৯), এখানে এ বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে।]
এটাই অধিক প্রাধান্য প্রাপ্ত মত।
এখানে জাওরাবের উপর মাসেহ বৈধ মর্মে বর্ণিত শেষ দু‘টি অভিমতের প্রবক্তাগণ নিম্নোক্ত দলীল গুলোকে দলীল হিসাবে দাঁড় করান। যথা:
عَنِ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ، وَالنَّعْلَيْنِ
(১) মুগীরা বিন শোবা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস: ‘নিশ্চয় রাসূল () একবার ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন।
(এ হাদিসকে আলবানী সহীহ বলেছেন, আবু দাউদ (১৫৯), তিরমিযী (৯৯), আহমদ (৪/২৫২), এ ব্যাপারে বিস্তারিত ‘আল-ইরওয়া (১০১)-দ্রষ্টব্য।)
عَنِ الأزرق بن قيس قال رأيت أنس بن مالك أحدث فغسل وجهه ويديه ومسح برأسه ، ومسح على جوربين من صوف فقلت : أتمسح عليهما ؟ فقال : إنهما خفان ولكنهما من صوف
(২) আয়রাক্ব ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনে মালিককে লক্ষ্য করেছি, তিনি বায়ু নিঃসরণ হলে তাঁর চেহারা ও দুহাত ধৌত করতেন এবং পশমের তৈরি জাওরাবের উপর মাসাহ করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি জাওরাবের উপর মাসাহ করলেন? তিনি বললেন, এ দু’টি মোজা যা পশমের তৈরি। [এ হাদিসকে আহমদ শাকির সহীহ বলেছেন; আলকূনী (১/১৮১) দাওলাবী প্রণীত।]
এখানে আনাস রা. খুফ বা মোজা চামড়ার তৈরি হওয়ার ব্যাপারে আম (ব্যাপক), সে কথা স্পষ্ট করেছেন। উল্লেখ্য যে, তিনি আরবি ভাষাবিদদের অন্যতম একজন সাহাবী ছিলেন।
(৩) জাওরাবের উপর মাসাহ করার হাদীস ১১ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাদের মধ্যে উমর তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বিন উমর, আলী, ইবনে মাসউদ আনাস (রা.) প্রমুখ সাহাবী অন্যতম। তাদের সমসাময়িক কোন সাহাবী তাদের বিরোধিতা করেন নি। বরং সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পরবর্তীতে জমহুর উলামা পাতলা জাওরাবের উপর মাসেহ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা দ্বারা ফরযের স্থান আচ্ছাদিত হয় না। অথচ এটা মাসেহ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত নয় যা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তাআলা মোজার উপর মাসেহ করার বিধান দিয়েছেন দ্বীন পালনকে সহজকরণার্থে। যেমন আল্লাহ বলেন:
مَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَـٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।” (সূরা মায়িদাহ: ৬) আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চামড়ার তৈরি মোজার বার বার খুলে পরিধান করতে যেমন মানুষের সমস্যা হয় তেমনি কাপড়ের তৈরি মোজাও বারবার খুলে পরতে সমস্যা হয়।
সুতরাং চামড়ার তৈরি মোজা মাসেহ করার শর্তারোপ করা আল্লাহর বিধানের মূল উদ্দেশ্য পরিপন্থী কাজ করা। এই শর্তারোপ করা ইসলাম প্রদত্ত প্রশস্ত বিধানকে সংকুচিত করে দেয়ার শামিল। (আল্লাহু আলাম)
(৩১) সফর সংক্রান্ত দশটি জরুরি মাসায়েল
প্রশ্ন: আমি জাহাজে চাকরি করি। আমি তো সব সময় এক জায়গা থাকি না। কিছুদিন পর পর এক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাই। তাহলে তো আমরা মুসাফির হিসেবে গণ্য হবো।
প্রশ্ন হল, মুসাফিরের জন্য নামাজ পড়ার নিয়ম কি? দয়া করে সফরে নামায-রোযা সংক্রান্ত জরুরি কিছু মাসআলা-মাসায়েল জানাবেন।
উত্তর:
নিম্নে অতি সংক্ষেপে সফর সংক্রান্ত দশটি জরুরি মাসায়েল পেশ করা হল:
●১. আপনি যদি আপনার এলাকা ছেড়ে সফরের দূরত্বে গমন করেন (একটি শক্তিশালী মত অনুযায়ী তা প্রায় ৮০ কিলোমিটার) তাহলে আপনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন।
সুতরাং আপনি যদি জাহাজে চাকরি করা অবস্থায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে বা দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করেন তাহলে আপনি এ পুরোটা সময় ‘মুসাফির’ হিসেবে গণ্য হবেন।
●২. অনুরূপভাবে উড়োজাহাজের পাইলট ও কেবিন ক্রুবৃন্দ, ট্রেনের চালক ও তার সহকর্মীরা, দূর পাল্লার বাস-ট্রাকের চালক ও তাদের স্টাফরা-যারা নিয়মিত দূর-দূরান্তে সফর করে-তারা এ সফরের পুরোটা সময় ‘মুসাফির’ হিসেবে গণ্য হবে।
● ৩. সফরে চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো (যোহর, আসর ও ইশা) দু রাকাত করে আদায় করবেন। সুন্নতগুলো পড়বেন না। আর মাগরিব ও ফজর যথানিয়মেই তিন ও দু রাকআত আদায় করবেন।
● ৪. সফর অবস্থায় সুন্নত না পড়াটাই সুন্নত। কেবল বিতর এবং ফজরের দু রাকআত সুন্নত পড়া ভালো। পাশাপাশি যত খুশি নফল সালাত আদায় করা যায়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম সফর অবস্থায় সুন্নত সালাতগুলো না পড়লেও উটের পিঠে বসে নফল সালাত আদায় করতেন।
● ৫. সফর অবস্থায় যোহর ও আসরকে এবং মাগরিব ও ইশাকে একসাথে (অগ্রীম বা পিছিয়ে) জমা করার সুযোগ আছে। কিন্তু আসর ও মাগরিবকে এবং ফজর ও যোহরকে, অনুরূপভাবে অধিক বিশুদ্ধ মতে জুমা ও আসরকে একসাথে জমা করা যাবে না।
● ৬. সম্ভব হলে ফরজ সালাত যানবাহন থেকে নেমে পড়াই উত্তম। তবে সম্ভব না হলে যানবাহনের মধ্যেই আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সম্ভব হলে দাঁড়িয়ে, না হলে নিজ আসনে বসেই কিবলামূখী হয়ে সালাত শুরু করতে হবে। তারপর যানবাহন অন্য দিকে ঘুরলেও সলাত যথানিয়মে অব্যাহত রাখবে। কিবলার দিকে ঘুরার প্রয়োজন নাই।
● ৭. মুসাফিরদের জন্য জুমার সালাত আদায় করা ফরজ নয়। তবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সাথে আদায় করা উচিৎ যদি সুযোগ থাকে।
● ৮. সফর অবস্থায় মোজার উপর মাসেহ করার সময় সীমা তিন দিন ও তিন রাত বা ৭২ ঘণ্টা।
● কোন কারণে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া না গেলে বা পানি ব্যবহারে সমস্যা হলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েজ আছে। অজু এবং ফরজ গোসল উভয় ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য।
● ৯.সফর অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ আছে। তবে কষ্ট হলে রোজা না রাখাই উত্তম। আর কষ্ট না হলে রোজা রাখা উত্তম। সফর অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে সেগুলো কাজা করে নিতে হবে।
● ১০. আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের দুআ ফেরত দেন না বলে সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেে। তাই মুসাফিরের উচিৎ, বেশি পরিমাণে আল্লাহর নিকট দুআ করা।
দুআ করি, আল্লাহ আপনাকে সফর অবস্থায় সব ধরণের অনাকঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করুন। আমীন। আল্লাহু আলাম।
(৩২) প্রশ্ন: একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসে। ছেলের পরিবার ঐ মেয়েকে মানতে নারাজ। কিন্তু মেয়ে এবং ছেলে কেউই কাউকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারেনা। ছেলেকে না পেলে মেয়ে আত্মহত্যাও করতে পারে। এমন অবস্থায় ছেলের করণীয় কি?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূতভাবে তথাকথিত প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম এবং শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে ছেলে ও মেয়ে উভয়ে জিনার দিকে ধাবিত হয়। কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই হারাম।
আল্লাহ আমাদেরকে জিনার নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَىٰ ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
“আর জিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।”(সূরা ইসরা: ৩২)
তবে দয়াময় আল্লাহ বৈধ উপায়ে বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ভালবাসা প্রকাশ ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন। মানুষের কর্তব্য, বিয়ের পূর্বে হারাম সম্পর্কের দিকে পা না বাড়িয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করা।
এ ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য অভিভাবকের অনুমতি নেয়াকে আবশ্যক করা হয় নি। কারণ পুরুষ স্বয়ং সম্পন্ন। পক্ষান্তরে নারীর জন্য অভিভাবকের সম্মতি নেয়াকে অপরিহার্য শর্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া (অধিক বিশুদ্ধ মতানুসারে) বিয়ে শুদ্ধ হবে না। কারণ নারীরা সাধারণত: আবেগ প্রবণ হওয়ায় তারা চক্রান্তকারীদের কবলে পড়ে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে।
সুতরাং ঐ যুবকের কর্তব্য, হারাম সম্পর্ক থেকে তওবা করে মেয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বিয়ে করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামে যেহেতু তার পিতার নিকট অনুমতি নেয়াকে বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত করা হয় নি সেহেতু সে প্রথমত: তার পিতাকে এই বিয়েতে সম্মত করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তিনি সম্মত না হলে নিজ সিদ্ধান্তে উক্ত মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলে দ্রুত বিয়ে করে প্রয়োজনে আলাদা সংসার গড়তে পারে। এতে দোষের কিছু নাই।
প্রশ্ন আসতে পারে, বাবা-মার সম্মতি ছাড়া ছেলে বিয়ে করলে তো তারা কষ্ট পাবে। এতে কি সে গুনাহগার হবে?
উত্তরে বলব, ইসলাম প্রদত্ত অধিকার পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মা যদি কষ্ট পায় এতে সন্তান গুনাহগার হবে না। কেননা সে আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন কাজ করছে না।
এ ক্ষেত্রে বাবা-মার কর্তব্য, বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের পছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়া, তাকে সুপরামর্শ দেয়া ও সহযোগিতা করা।
তবে বাবা, মা, ভাই, বোন সবার সাথে পরামর্শ করে যদি বিয়ে হয় তাহলে তা অতি উত্তম। এতে পারিবারিকভাবে ভেজাল কম হবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলাম তা আবশ্যক করেনি।
দুআ করি, মহান আল্লাহ উক্ত যুবক ও যুবতী দ্বয়কে শয়তানের চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন এবং বিয়ে করার মাধ্যমে বৈধ ও পবিত্র জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমীন।
জাতীয় পতাকাকে স্যালুট জানানো বা দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া কি জায়েজ
(৩৩) প্রশ্ন: জাতীয় পতাকাকে স্যালুট জানানো বা দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া কি জায়েজ? যদি স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জাতীয় পতাকায় দাঁড়িয়ে সম্মন প্রদর্শন করতে আদেশ করে তাহলে কী করণীয়?
উত্তর:
কোন মুসলিমের জন্য জাতীয় পতাকা কে স্যালুট দেওয়া বা দাঁড়িয়ে সালাম করা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ নেই। মূলত এটি অমুসলিমদের থেকে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। এটি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। জড় পদার্থকে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া বা স্যালুট করা মূর্খতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটির ফতোয়া হল:
لا يجوز للمسلم القيام إعظاماً لأي علم وطني، أو سلام وطني، بل هو من البدع المنكرة التي لم تكن في عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا في عهد خلفائه الراشدين رضي الله عنهم، وهي منافية لكمال التوحيد الواجب وإخلاص التعظيم لله وحده، وذريعة إلى الشرك، وفيها مشابهة للكفار وتقليد لهم في عاداتهم القبيحة، ومجاراة لهم في غلوهم في رؤسائهم ومراسيمهم، وقد نهى النبي صلى الله عليه وسلم عن مشابهتهم أو التشبه بهم. انتهى.
“কোন দেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো বা জাতীয় সালাম প্রদান জায়েজ নাই বরং এটি জঘন্য বিদআত যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে ছিল না। এটি অত্যাবশ্যকীয় তাওহীদের পূর্ণতা এবং এক আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ সম্মান প্রদর্শনের পরিপন্থী। এটি শিরকের মাধ্যম। এটি কাফেরদের সাদৃশ্য এবং নিকৃষ্ট রীতি-নীতির অন্ধ অনুকরণ মাত্র। কাফেররা তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের অনুষ্ঠানাদিতে যেভাবে বাড়াবাড়ি করে এর মাধ্যমে তাদের সাথে মিল দেয়া হয়। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন বা তা তাদের সাথে মিল দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।” [ফতোয়া ১/২৩৫, ফতোয়া নং ২১২৩]
এগুলো মূলত দেশকে ভালোবাসার নামে মেকি প্রদর্শনী। দেশের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার অর্থ হল, দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করা, সব ধরণের দুর্নীতি, অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা।
দেশ বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকা, দুর্নীতি ও অন্যায়-অপকর্ম করা, সরকারি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা, সরকারী সম্পদ লুটপাট করা, মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার নাম দেশ প্রেম নয়। বরং এগুলো দেশ ও দেশের পতাকাকে অবমাননার শামিল।
মোটকথা, আমরা দেশ এবং দেশের পতাকার ভালোবাসা ও সম্মান অন্তরে ধারণ করব। কিন্তু তাই বলে মুসলিম হিসেবে ভিনদেশি অমুসলিমদের কালচারকে প্রশ্রয় দিতে পারি না।
প্রশ্ন: যদি স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদেরক জাতীয় পতাকায় দাঁড়িয়ে সম্মন প্রদর্শন করতে আদেশ করে তাহলে কী করণীয়?
উত্তর:
যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জাতীয় পতাকাকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয় এবং নির্দেশ পালন না করলে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে তারা এ ক্ষেত্রে মাজুর। যারা এর নির্দেশ দিবে তারা গুনাহগার হবে। কেউ যদি তা মন থেকে সমর্থন না করে এবং প্রতিবাদ করারও সামর্থ না থাকে বরং সরকারী আইনে তা করতে বাধ্য হয় তাহলে তারা ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আল্লাহ আামাদেরকে ক্ষমা করুন এবং বুঝার শক্তি দান করুন। আমীন।
(৩৪) প্রশ্ন: ‘অধিক পরিমাণে স্ত্রী সহবাস করলে মানুষের আয়ু কমে যায়’ কথাটা কতটুকু সত্য?
উত্তর:
‘অতিরিক্ত স্ত্রী সহবাস করলে আয়ু কমে যায়’ এমন কোন কথা কুরআন-হাদিসে আসেনি। তবে এ কথা স্বত:সিদ্ধ যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অতিরিক্ত সহবাসে স্বাস্থ্যহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। অধিক পরিমাণে স্ত্রী সহবাস করলে শারীরিক দুর্বলতা ও প্রচুর ক্লান্তি অনুভূত হয়, শরীরের বিভিন্ন জোড় ও গ্রন্থিতে ব্যথা সৃষ্টি হয়। এমনকি শরীরে পর্যাপ্ত বীর্য ঘাটতির কারণে যৌন দুর্বলতা ও অনাগ্রহ ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
তাই এ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত। অবশ্য খেজুর, দুধ, ঘি, দেশি মুরগির ডিম, কিশমিশ ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলে স্বাস্থ্য ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। আল হামদু লিল্লাহ। যদিও সবার অবস্থা এক রকম নয়। মানুষের বয়স অনুপাতে শক্তি, সামর্থ্য ও শৌর্য-বীর্যের উপরে বিষয়টি নির্ভরশীল। আল্লাহু আলাম।
(৩৫) প্রশ্ন: তুবা কি? ইউটিউব ভিডিওতে একটি গজল শুনলাম। সেখানে বলা হচ্ছে, “তুবা নামক গাছের পাতায় লেখা আছে মানুষের হায়াত।” এই কথাটা কতটুকু সঠিক?
উত্তর:
“তুবা নামের গাছের পাতায় লেখা আছে মানুষের হায়াত।” এটা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
আমাদের জানা থাকা দরকার যে, সৃষ্টি জগতের আদি থেকে অন্ত যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে আর ঘটবে সব কিছু লেখা আছে মহান আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত ফলক লাওহে মাহফুজে; অন্য কোথাও নয়। মানুষের জীবন-মৃত্যু, জীবিকা, বিবাহ, ভালো-মন্দ কোন কিছুই এর বাইরে নয়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَىٰ وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ ۚ وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُّبِينٍ
“আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু ‘স্পষ্ট কিতাবে’ সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসিন: ১২)
ইমাম ইবনে কাসির রহ. বলেন: স্পষ্ট কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হল, লাওহে মাহফুজ (সংরক্ষিত ফলক)।
তিনি আরও বলেন:
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّـهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۗ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّـهِ يَسِيرٌ
“তুমি কি জান না যে, আল্লাহ জানেন যা কিছু আকাশে ও ভুমণ্ডলে আছে এসব কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহর কাছে সহজ।” (সূরা হজ্জ: ৭০) ইবনে
আবু মুহাম্মদ আব্দুল হক আতিয়া রহ. (গ্রানাডা) বলেন: এখানে ‘কিতাব’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, লাওহে মাহফুজ (সংরক্ষিত ফলক)-যেমনটি বলেছেন ত্ববারী রহ.। এ ছাড়াও এ প্রসঙ্গে একাধিক আয়াত ও হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।
তুবা কি এবং তা কাদের জন্য?
আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ طُوبَىٰ لَهُمْ وَحُسْنُ مَآبٍ
“যারা (আল্লাহর ওপর) বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে ‘তুবা’ (জান্নাতের বৃক্ষবিশেষ)। আর শুভ পরিণাম তাদেরই।” (সুরা : রাদ: ২৯)
তুবার ব্যাখ্যা:
উক্ত আয়াতে তুবা দ্বারা কী উদ্দেশ্য এ মর্মে হাদিস, সাহাবী ও তাবেঈদের বক্তব্য তুলে ধরা হল:
● উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আবু তালহা (রহ.) ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন فرح وقرة عين ‘তুবা’ অর্থ “আনন্দ ও চোখের শীতলতা।”
● ইবরাহীম নাখঈ বলেন: তুবা অর্থ: خير لهم “তাদের জন্য কল্যাণ।”
● সুদ্দী ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন: তুবা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, জান্নাত।
● ইবনে জারির ত্বাবারী শাহর ইবনে হাওশাব থেকে বর্ণনা করেন: طوبى شجرة في الجنة “তুবা হল, জান্নাতের একটি বৃক্ষ।”
● আবু সাঈদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
طوبى : شجرة في الجنة مسيرة مائة سنة ، ثياب أهل الجنة تخرج من أكمامها
“তুবা হল বেহেশতের একটি গাছ। ১০০ বছরের পথ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এই গাছের পাপড়ি থেকেই বেহেশত বাসীদের পোশাক তৈরি হবে।” (সহিহ ইবনে হিব্বান, হা/৭৪১৩, সহিহুল জামে-আলবানী হা/৩৯১৮)
[তাফসিরে ইবনে কাসির থেকে নেয়া]
আরও যারা তুবা’র অধিকারী হবেন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
طوبَى لِمَن وُجِدَ في صَحيفَتِه استِغفارًا كثيرًا
“তুবা (জান্নাতের তুবা নামক বৃক্ষ) ঐ ব্যক্তির জন্য যার আমলনামায় প্রচুর পরিমাণ ইস্তিগফার পাওয়া গেছে।” (সহিহ ইবনে মাজাহ হা/৩০৯৩)
তিনি আরও বলেন:
طوبى لِمَنْ هُدِيَ لِلإِسْلامَ وكان عَيْشُهُ كَفَافًا ، وقَنَعَ
“তুবা (জান্নাতের তুবা নামক বৃক্ষ) ঐ ব্যক্তির জন্য যে ইসলামের পথের সন্ধান প্রাপ্ত হয়েছে, যার নিকট পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবিকার ব্যবস্থা আছে (কমও নয়; বেশিও নয়) এবং তাতে সে পরিতুষ্ট।” (সুনানে তিরমিযী, হা/২৩৪৯ সহিহ হাসান)
কোন কোন বৈশিষ্টের মানুষ তুবা’র অধিকারী হবে তাদের প্রসঙ্গে আরও একাধিক হাদিস রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সৎকর্ম করার মাধ্যমে জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং তার নিয়ামতের ফল্গুধারায় আমাদের জীবনকে সিক্ত করুন। আমীন।
(৩৬) প্রশ্ন: মুশরিক বিয়ে করে সন্তান হলে সে কি জারজ সন্তান হবে?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে কোন মুসলিমের জন্য (চাই পুরুষ হোক অথবা নারী হোক) মুশরিককে বিয়ে করা হারাম।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَا تَنكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّىٰ يُؤْمِنَّ ۚ وَلَأَمَةٌ مُّؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِّن مُّشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ ۗ وَلَا تُنكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّىٰ يُؤْمِنُوا ۚ وَلَعَبْدٌ مُّؤْمِنٌ خَيْرٌ مِّن مُّشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ ۗ أُولَـٰئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ ۖ وَاللَّـهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ ۖ وَيُبَيِّنُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
“আর তোমরা মুশরিক নারীদেরকে বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। একজন মুসলিম ক্রীতদাসী মুশরেক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোন মুশরিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত সে ঈমান না আনে। একজন মুসলিম ক্রীতদাসও একজন মুশরেকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা জাহান্নামের আগুনের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও ক্ষমার দিকে। আর তিনি মানুষকে নিজের নির্দেশ বাতলে দেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা বাকারা: ২২১)
আর ইসলামের একটি মূলনীতি হল, “বিয়ে বৈধ হলে সন্তান বৈধ আর বিয়ে অবৈধ হলে সন্তানও অবৈধ।”
সুতরাং কোন মুসলিম যদি কোনও হিন্দু, বৌদ্ধ, অগ্নিপূজক, গাছ, মাছ, কবর পূজারী ইত্যাদি মুশরিককে বিয়ে করে তাহলে তার বিয়ে বাতিল। এভাবে তথাকথিত বিয়ে করে ঘর সংসার করলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং তাদের ঔরসজাত সন্তানও হবে অবৈধ (জারজ) সন্তান।
উল্লেখ্য যে, এই সন্তানের কোনও দোষ নেই। সে নিষ্পাপ। তার প্রতি কোনও ধরণের কু ধারণা রাখা যাবে না। মান-মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা যাবে না। আলেম হলে তার পেছনে নামাজ পড়তেও কোন সমস্যা নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম।
 (৩৭) প্রশ্ন: আমাদের দেশে জানাযার নামাজের প্রথম তকবীরের পর সানা পড়া হয় কিন্তু সুরা ফাতেহা পড়া হয় না। মধ্যপ্রাচ্য সানা পড়া হয় না কিন্তু সুরা ফাতেহা পড়া হয়। প্রথম তকবীরের পর সানা আর সুরা ফাতেহা উভয়টা পড়া যেতে পারে কি? এ বিষয়ে সঠিক বিধান কোনটি?
উত্তর:
বিষয়টি যদিও দ্বিমতপূর্ণ তবে অধিক হাদিস সম্মত কথা হল, জানাযার সালাতে প্রথম তাকবিরের পর কেবল সূরা ফাতিহা পড়তে হবে; সানা নয়। কারণ সূরা ফাতিহা পড়ার বিষয়টি হাদিস ও সাহাবীদের আমল দ্বারা সুপ্রমাণিত। কিন্তু সানা পড়ার কথা কোন হাদিসে বর্ণিত হয় নি। তাছাড়া জানাযার সালাতে রুকু, সেজদা, তাশাহুদের বৈঠক ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে যেন, তাড়াতাড়ি দাফন করা যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ، فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُوْنَهَا إِلَيْهِ، وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ فَشَرٌّ تَضَعُوْنَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ
“তোমরা দ্রুত জানাজার নামাজ পড়ে লাশ দাফন কর। কেননা যদি মৃত ব্যক্তি পুণ্যবান হয়, তবে তোমরা ‘ভালো’ কে দ্রুত কবরে সমর্পণ কর। আর যদি তা না হয়, তাহ’লে ‘মন্দ’-কে দ্রুত তোমাদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও। (বুখারি ১৩১৫)
তাই তো আল্লামা উসাইমীন রহ. কে প্রশ্ন করা হয়, জানাযার সালাতে কি দুআউল ইস্তিফতাহ (বা সালাত শুরুর দুআ/সানা) পাঠ করা শরিয়ত সম্মত?
তিনি বলেন:
ذكر العلماء أنه لا يستحب ، وعللوا ذلك بأن صلاة الجنازة مبناها على التخفيف ، وإذا كان مبناها على التخفيف ، فإنه لا استفتاحانتهى
مجموع فتاوى ابن عثيمين” (17/119) .
“আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, এটি মুস্তাহাব নয়। তারা কারণ বর্ণনা করেছেন যে, জানাযার সালাতের ভিত্তি হল সংক্ষিপ্ত করণ। সুতরাং যদি তার ভিত্তিটা হয় সংক্ষিপ্ত করণের উপর তাহলে তাতে ইস্তিফতাহ (সালাত শুরুর দুআ বা সানা) নেই।” (মাজমু ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ১৭/১১৯)
জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে দলিল:
১) প্রখ্যাত সাহাবী উবাদা বিন সামেত রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
« لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ »
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না তার সালাত হবে না।” [বুখারী ও মুসলিম] আর জানাযা অবশ্যই একটি সালাত। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ
“আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও (জানাযার) সালাত পড়বেন না।” [সূরা তাওবা: ৮৪]
আল্লাহ তায়ালা এখানে জানাযার সালাতকেও সালাত বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং জানাযার সালাতেও সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
২) ইমাম বুখারী রহ. জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ার বৈধতার ব্যাপারে একটি অনুচ্ছেদ আলাদাভাবে উল্লেখ করে তার নিচে একাধিক হাদিস উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল:
عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍرضى الله عنهماعَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قَالَ لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ
“তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ বিন আউফ বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা. এর পেছনে জানাযার সালাত পড়লাম। তিনি ফাতিহাতুল কিতাব তথা সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। অত:পর বললেন, “এটাই আল্লাহর নবীর আদর্শ।” [সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা।] আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ তাআলা যেন, সুন্নাহ অনুসারে আমল করার তাওফিক দান করেন। আমীন।
(৩৮) প্রশ্ন: “আমি আমার একটা উম্মত রেখে জান্নাতে যাব না।” এটি কি হাদিস? আর হাদিস হলে তার রেফারেন্স কি?
উত্তর:
“আমি আমার একটা উম্মত রেখে জান্নাতে যাব না।”
এটা হাদিসের নামে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।”
বরং বহু সংখ্যক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। যেমন:
  আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتفْتِحُ، فَيَقُولُ الْخَازِنُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُولُ: مُحَمَّدٌ، فَيَقُولُ: بِكَ أُمِرْتُ لَا أَفْتَحُ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ »
“কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় দিয়ে দরজা খোলার অনুমতি চাইলে জান্নাতের রক্ষক বলবে, কে আপনি?
আমি বলব: মুহাম্মদ।
তিনি বলবেন: আপনার জন্যই দরজা খোলার অনুমতি আছে। আপনার পূর্বে কারও জন্য দরজা খোলার অনুমতি নাই।” (মুসলিম, হাদিস নং ১৯৮)
  অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“আমি কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করব।” [সহিহ জামে তিরমিযী ও মাজমাউয যাওয়ায়েদ। শাইখ আলবানী বলেন: سنده جيد، رجاله رجال الشيخين এর সনদটি ভালো। আর বর্ণনাকারীগণ সবাই বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনাকারী (সহীহাহ ১০০/৪)]
এ মর্মে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
তবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার তাওহিদপন্থী গুনাহগার উম্মতের জন্য শাফায়াত করবেন। এটি বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহু আলাম।
(৩৯) প্রশ্ন: ইমাম মাহদির আগমনের আলামত হিসেবে “আরব দেশে তুষারপাত হবে” এ কথাটা কি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত?
উত্তর:
ইমাম মাহদির আগমণের আলামত হিসেবে নয় বরং কিয়ামতের আলামত প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে যে, আরব উপদ্বীপ নদ-নদী এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবে। ‘তুষারপাত হবে’ এমন কথা আসে নি। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রচুর বরফপাত হলে বরফ গলে নদী প্রবাহিত হয়।
নিম্নে এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো দেখুন:
১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَعُودَ أَرْضُ الْعَرَبِ مُرُوجًا وَأَنْهَارًا
‘‘ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যে পর্যন্ত না আরব উপদ্বীপ গাছপালা ও নদী-নালায় পূর্ণ হবে’’।[মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুয যাকাত।]
হাদীসের প্রকাশ্য বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আরব দেশসমূহে কিয়ামতের পূর্বে পানির অভাব হবে না। বরং প্রচুর নদ-নদী প্রবাহিত হবে। ফলে গাছ-পালা ও নানা উদ্ভিদ উৎপন্ন হবে এবং বন-জঙ্গলে ভরে যাবে।
২. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا لَا تُكِنُّ مِنْهُ بُيُوتُ الْمَدَرِ وَلَا تُكِنُّ مِنْهُ إِلَّا بُيُوتُ الشَّعَرِ
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এতে মাটির তৈরি ঘরগুলো ভেঙ্গে পড়বে এবং পশমের ঘরগুলো রক্ষা পাবে’’।[মুসনাদে আহমদ, আহমদ শাকের সহীহ বলেছেন]
৩. তিনি আরও বলেন:
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُمْطَرَ النَّاسُ مَطَرًا عَامًّا وَلَا تَنْبُتَ الْأَرْضُ شَيْئًا
‘‘ততদিন কিয়ামত হবেনা যে পর্যন্ত না ব্যাপক বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু জমিনে কোন ফসলই উৎপন্ন হবেনা’’। [মুসনাদে আহমদ, ইমাম হায়সামী মাজমাউয্ যাওয়াদে বর্ণনা করেছেন, (৭/৩৩০)। ইমাম ইবনে কাসির রাহ. বলেন: হাদীছের সনদ খুব ভাল। নেহায়া, (১/১৮০)]
স্বাভাবিক নিয়ম হল বৃষ্টির মাধ্যমে জমিনে ফসল উৎপন্ন হবে। কিন্তু কিয়ামতের পূর্বে স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যাবে।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হল যে, আরব দেশে বৃষ্টিপাত ও নদ-নদী প্রবাহিত হওয়ার হাদিসগুলো কিয়ামতের আলামত প্রসঙ্গে এসেছে ; ইমাম মাহদির আগমনের আলামত প্রসঙ্গে নয়। কিন্তু এটা ঠিক যে, ইমাম মাহদির আগমনও কিয়ামতের একটি অন্যতম আলামত। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে কিয়ামত-ইমাম মাহদির আগমন-আরব দেশে নদ-নদীর প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি একই সূত্রে গাঁথা। আল্লাহু আলাম।
নির্ধারিত পারিশ্রমিকের উপর আলাদা বখশিশ দাবী করার বিধান
(৪০) প্রশ্ন: অনেক সময়ই দেখা যায়, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে শ্রমিকরা বকশিশের নামে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। তখন ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই এই টাকা দেয়া লাগে। তাদের এই টাকা চাওয়া জায়েজ কি না?
উত্তর:
নির্ধারিত বেতন থাকার পরও শ্রমিক কর্তৃক মালিকের কাছে অতিরিক্ত সম্মানী বা বখশিশ দাবী করা মোটেও উচিৎ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত: বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বখশিশ যেন শ্রমিকের প্রাপ্য। অনেক সময় অল্প বখশিশ পেলে তারা মন কষাকষি করে এবং মালিকের সাথে খারাপ ব্যাবহার করে। কিছু শ্রমিক এমনও আছে যে, যদি সে জানতে পারে যে, মালিক বখশিশ দেয় না তাহলে মনোযোগ সহকারে কাজ করে না বা কাজে ঢিলেমি করে। এমনটি করা নি:সন্দেহে হারাম।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, বখশিশ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে শ্রমিক/কর্মচারী যদি মালিকের কর্তব্য-কর্মে অবহেলা প্রদর্শন করে বা কাজে ফাঁকিবাজি করে তাহলে তা অন্যের হক নষ্ট করার শামিল। যা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
বখশিশ দাবি করার কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন:
● ১- হালাল কাজ করে ন্যায্য পারিশ্রমিক নেয়ার আত্মমর্যাদা ও অনাবিল সুখের পরিবর্তে মনের মধ্যে লাঞ্ছনা দায়ক ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
● ২- এতে মনের মধ্যে অন্যের সম্পদের প্রতি অন্যায় লোভ-লালসা বাসা বাধে
● ৩- এ কারণে মালিক অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে অথচ কাউকে অযাচিতভাবে বিব্রত করা নি:সন্দেহে উত্তম চরিত্র পরিপন্থী।
● ৪- অনেক সময় বখশিশ দেয়া-নেয়াকে কেন্দ্র করে মালিক-শ্রমিকের মাঝে মন কষাকষি, নানা কটু মন্তব্য প্রয়োগ ও ঝগড়াও সৃষ্টি হয়। যা কোনভাবে কাম্য নয়।
মোটকথা, শ্রমিক নির্দিষ্ট বেতন বা পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে চুক্তি মোতাবেক মালিকের কাজ করবে। কাজ শেষে মালিক কর্মচারীকে তার পাওনা যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিবে। এর অতিরিক্ত বখশিশের আশা করা বা দাবি করা মোটেও উচিৎ নয়। আল্লাহু আলাম
সালাতুল ইশরাকের গুরুত্ব
(৪১) প্রশ্ন: সালাতুল ইশরাকের গুরুত্ব কতটুকু? ফজরের নামাজ পড়ে, মসজিদে না বসে বাড়িতে এসে ইশরাকের নামাজ পড়লে কি হবে বা এতে সওয়াবের কি কোন কমতি হবে?
উত্তর:
সালাতুল ইশরাক বা সালাতুশ শুরুক অর্থ: সূর্যোদয়ের সালাত। এর গুরুত্ব ও মর্যাদার ব্যাপারে হাদিস এসেছে।
নিম্নে হাদিস তুলে ধরে এ প্রসঙ্গে জরুরি কিছু মাসায়েল তুলে ধরা হল:
আনাস বিন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِيْ جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ
“যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে ফজরের সালাত আদায়ের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকল অতঃপর (সূর্যোদয়ের পর) দুই রাকআত সালাত আদায় করল, তার জন্য একটি পূর্ণ হজ্জ ও একটি পূর্ণ ওমরার নেকী রয়েছে।’ [[তিরমিযী হা/৫৮৬; মিশকাত হা/৯৭১। এ হাদিসটি সহিহ না কি জইফ এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। শাইখ আলবানি সহ কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস এটিকে হাসান এবং অন্য একদল আলিম এ হাদিসটিকে যঈফ (দুর্বল) বলেছেন]
যাহোক, কেউ যদি পড়তে চায় তাহলে পড়তে পারে। এতে আশা করা যায়, আল্লাহ তাকে হাদিসে বর্ণিত উক্ত সওয়াব দান করবেন।
কতিপয় লক্ষণীয় বিষয়:
● এখানে ফজর সালাত জামাআতে পড়ার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এ ফযিলত লাভ করতে হলে মসজিদে গিয়ে ফজর সালাত জামাআতে আদায় করা শর্ত।
● জামাআতে পড়ার পর থেকে নামাযের স্থানে বসে জিকির-আজকার, তাসবীহ-তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআনের তরজমা ও তাফসির পাঠ ইত্যাদি নেকির কাজে লিপ্ত থাকতে হবে। (অবশ্য পেশাব-পায়খানা বা প্রয়োজনে ওযু করার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর আবার যথাস্থানে ফিরে এসে জিকির-আজকার, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে লিপ্ত হলেও কোন সমস্যা নেই।)
● এক ধনুক পরিমাণ সূর্য উদিত হওয়ার পর (সূর্য ওঠাার প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর) উক্ত সালাত আদায় করতে হবে। কেননা, ফজরের সালাতের পর থেকে সূর্য এক ধনুক পরিমাণ উদিত হওয়া পর্যন্ত (সূর্য ওঠার প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর্যন্ত) সাধারণ নফল সালাত পড়া নিষিদ্ধ।
সুতরাং কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে এসে সূর্য উদিত হওয়ার ১৫/২০ মি: পর দু রাকআত সালাতুল ইশরাক পড়ে তাহলে উক্ত সাওয়াব লাভ করবে না। তবে দু রাকআত ইশরাকের নফল সালাতের সাধারণ সওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ।
অবশ্য -বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন- যদি ফজর সালাতের পরে মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয় (যেমনটি শহরের অনেক মসজিদে করা হয়) বা বিশেষ কোন কারণে মসজিদে থাকা সম্ভব না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে যদি মসজিদ থেকে ফিরে আসে এবং বাড়িতে বসে জিকির-আজকার করা অবস্থায় সূর্য উদিত হওয়ার ১৫/২০ মি: পর উক্ত সালাত পড়ে তাহলেও যথাযথ সওয়াব পাওয়া যাবে আশা করি।
কুরআন কোলে নিয়ে পড়া যাবে কি এবং মসজিদের ফ্লোরে রাখা যাবে কি
(৪২)  প্রশ্ন: কুরআন কোলে নিয়ে পড়া যাবে কি?
উত্তর:
কোলের উপরে কুরআন রেখে আদবের সাথে পড়তে কোন আপত্তি নেই, ইনশাআল্লাহ।
কুরআন তিলাওয়াত অবস্থায় মুসহাফ (কুরআন) কোলে রাখা সম্পর্কে আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রাহ. কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এটি কি আদবের খেলাপ?
জবাবে তিনি বলেছেন: “না।” (উৎস: ইসলামকিউএ ইনফো)।
  (৪৩) প্রশ্ন: মাসজিদের ফ্লোরের উপর কুরআন রাখা যাবে কিনা বা ভুলে রাখলে পাপ হবে কি?
উত্তর:
কুরআন মাটি থেকে একটু উপরে রাখা উত্তম। যেমন: রেহাল, টেবিল, চেয়ার, তাক, আলমারি, দেয়াল, দেয়ালের ছিদ্র, অন্য সাধারণ বইয়ের উপর ইত্যাদি।
এটি কুরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শের জন্য অধিক উপযোগী।
তবে যদি দরকার বশত: ــــযদি কুরআনকে অপমান করার উদ্দেশ্যে না থাকেـــــপবিত্র মাটির উপর কুরআন রাখা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ গুনাহ নেই। যেমন: যদি উঁচু স্থানে রাখার কোন ব্যবস্থা না থাকে অথচ তিলাওয়াতে সেজাদা দিতে হবে। তাহলে এ অবস্থায় পবিত্র মাটির উপর রাখা জায়েয আছে। দরকার বশত: পবিত্র মাটির উপর রাখা নিষেধ এমন কোন হাদিস পাওয়া যায় না। তবে নি:সন্দেহে কুরআনের সম্মান প্রদর্শনার্থে মাটি থেকে উঁচুতে রাখা অধিক উত্তম। আল্লাহু আলাম
(বিন বায রহ. এর ফতোয়ার সারমর্ম)
(৪৪) প্রশ্নঃ মৃতের লাশ ময়না তদন্ত করার বিধান কি?
মৃতের লাশ পোস্ট মর্টেম বা ময়না তদন্ত করার ব্যাপারে সংক্ষেপে কথা হল:
আমাদের জানা জরুরি যে, মুসলিম ব্যক্তির দেহ সম্মানের পাত্র জীবদ্দশায় হোক অথবা মৃত্যুর পরে হোক। তাই তো ইসলামে অতি যত্নের সাথে মৃতের গোসল, কাফন-দাফন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে সসম্মানে তার লাশ কবর দেয়ার নির্দেশ এসেছে। আর মৃত ব্যক্তিকে অপদস্থ করা বা শরীরে আঘাত করা বা তার হাড়-হাড্ডি ভাঙ্গার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞায় হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
عَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ رَسُولَ اللّهِ قَالَ: كَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِه حَيًّا
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মৃত ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গা, জীবিতকালে তার হাড় ভাঙারই মতো।”
(আবু দাউদ, হা/৩২০৭, ইবনে মাজাহ হা/ ১৬১৬, সহীহ আত্ তারগীব, হা/ ৩৫৬৭-সনদ সহিহ)
ব্যাখ্যা: এ হাদিসে মৃত ব্যক্তিকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
আলোচ্য হাদিসের বর্ণনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) আবু দাঊদের হাশিয়ার মধ্যে উল্লেখ করেছেন, জাবির (রাঃ) বলেন, একবার আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এক জানাযায় গেলাম। সেখানে গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কবরের কাছে বসলেন এবং তার সাথে সাহাবীরাও বসলেন। এমন সময় একজন গর্ত খননকারী বেশ কিছু হাড় বের করে আনল এবং সে এগুলো ভাঙ্গার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো ভাঙ্গিও না। কেননা َ كَسْرُ عَظْمِ الْمَيِّتِ كَكَسْرِه حَيًّا “মৃত অবস্থায় হাড় ভাঙ্গা জীবদ্দশায় হাড় ভাঙ্গার অনুরূপ।”
আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন: এ হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, জীবিত ব্যক্তিকে যেমন অপমান-অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করা যায় না ঠিক তেমনিভাবে মৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যাবে না।
ইবনে আবদুল বার বলেন, এ হাদিস থেকে এ ফায়দা গ্রহণ করা যায় যে, জীবিত ব্যক্তি যে সব কারণে কষ্ট ও ব্যথা অনুভব করে মৃত ব্যক্তিও সেসব কারণে ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করে। (হাদিস বিডি ডট কম থেকে সংগৃহীত)
তবে বর্তমানে মানুষ হত্যা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে তদন্তের স্বার্থে অথবা বিশেষ কোন সংক্রামক রোগের কারণ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে মৃতের দেহের অংশ বিশেষ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এ কাজটি বৃহত্তর স্বার্থে জায়েজ বলে নির্ভরযোগ্য আলেমগণ ফতোয়া প্রদান করেছেন এবং এটি Islamic Fiqh Academy এর সিদ্ধান্ত। আল্লাহু আলাম।
(৪৫) প্রশ্ন: আমি কি একই সালাত দু বার জামাআতে পড়তে পারব?
উত্তর:
বিশেষ কারণ ছাড়া ফরয সালাত পূণরায় পড়া জায়েয নেই। একাকী হোক অথবা জামাআতে হোক। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«لَا تُصَلُّوا صَلَاةً فِي يَوْمٍ مَرَّتَيْنِ»
“তোমরা একই দিনে একই সালাত দু বার পড়ো না”।(আবু দাউদ-হাসান/সহিহ, সহিহুল জামে লিল আলবানী, হা/৭৩৫০)
অর্থাৎ একই দিনে একই ফরজ সালাত ফরজের নিয়তে দু বার পড়া। এটা জায়েজ নয়।
তবে বিশেষ কারণে একই ফরজ সালাত দ্বিতীয়বার পড়া জায়েজ আছে। যেমন:
ক. কোনো সালাত একবার একাকী ফরজের নিয়তে পড়ার পর দ্বিতীয়বার নফলের নিয়তে জামাআতের সাথে পড়া। এটা শরিয়ত সম্মত।
যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
ইযাযিদ ইবনুল আসওয়াদ রা. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে আমি হজ্জে হাযির ছিলাম। তাঁর সঙ্গে মসজিদে খায়ফে ফজরের সালাত আদায় করলাম। সালাত শেষে তিনি যখন ফিরলেন তখন শেষ প্রান্তে দুই ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। এরা তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করেনি। তিনি বললেন এদেরকে আমার কাছে নিয়ে এস। তাদের নিয়ে আসা হল। তখন ভয়ে তাঁদের ঘাড়ের রগ পর্যন্ত কাঁপছিল।
তিনি তাদের বললেন, আমাদের সঙ্গে সালাত আদায় করতে তোমাদের কিসে বাধা দিল?
তাঁরা বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আমাদের অবস্থান স্থলে সালাত পড়ে নিয়েছিলাম।
তিনি বললেন: “এরূপ করবে না। যদি তোমাদের অবস্থান স্থলে সালাত পড়ে মসজিদে জামা’আতে আস তবে তাদের সঙ্গে জামাআতে শরিক হয়ে যাবে। তোমদের জন্য তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।” (সহিহ আবু দাউদ ৫৯০, তিরমিজি, হাদিস নাম্বার: ২১৯ [আল মাদানি প্রকাশনী])
আল ইসতিযকার গ্রন্থে এসেছে যে, আহমদ বিন হাম্বল ও ইসহাক রাহওয়াইহ এ ব্যাপারে একমত যে,
সুনানে আবু দাউদ এর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ আউনুল মাবুদে বলা হয়েছে: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: «لَا تُصَلُّوا صَلَاةً فِي يَوْمٍ مَرَّتَيْنِ» “তোমরা একই দিনে একই সালাত দু বার পড়ো না।” এ কথার অর্থ হল, ফরজ সালাত একবার আদায় করার পর পুনরায় তা ফরযের নিয়তে আদায় করা। (এটি জায়েজ নয়)। তবে কেউ যদি দ্বিতীয় বার তা নফল হিসেবে জামাআতের সাথে আদায় করে-যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন-তাহলে তা একই দিনে দু বার সালাত আদায় হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা প্রথমটি ফরয আর দ্বিতীয়টি নফল। সুতরাং এটি তখন পুনরাবৃত্তি হবে না।” (আউনুল মাবুদ ২/২০২)
আরেকটি হাদিস:
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَبْصَرَ رَجُلاً يُصَلِّي وَحْدَهُ فَقَالَ أَلاَ رَجُلٌ يَتَصَدَّقُ عَلَى هَذَا فَيُصَلِّيَ مَعَهُ
আবু সাঈদ আল খুদরী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে (জামাআতের পর) একাকী নামায আদায় করতে দেখে বলেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে, এই ব্যক্তির উপর সদকা করবে এবং তার সাথে জামাতে অংশ গ্রহণ করবে? (অর্থাৎ তার সাথে জামাতে অংশ গ্রহণ করে তার সওয়াব বৃদ্ধি করবে) (তিরমিযী, সহিহ-তাখরীজ মিশকাতুল মাসাবিহ, হা/১১০৪)।
এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে, একবার জামাআতের সাথে ফরজ সালাত আদায় করার পর একই সালাত দ্বিতীয়বার জামাআতের সাথে আদায় করা জায়েয আছে। তবে ২য়টি নফল এর নিয়তে আদায় করবে; ফরজের নিয়তে নয়। যেমনটি অন্যান্য হাদিস থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায়।
খ. অনুরূপভাবে প্রয়োজন হলে ফরজ সালাত একবার জামআতের সাথে পড়ার পর দ্বিতীয়বার লোকদেরকে নিয়ে ইমাম হিসেবে উক্ত সালাত পড়া জায়েজ আছে। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
كان معاذٌ يُصلِّي مع النبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم العِشاءَ، ثم يَطلُع إلى قومِه فيُصلِّيها لهم؛ هي له تطوُّعٌ، ولهم مكتوبةُ العِشاءِ
واه الشافعيُّ في ((المسند)) (237)، والطحاوي في ((شرح معاني الآثار)) (2360)، والدارقطني في ((السنن)) (1075)، والبيهقي في ((معرفة السنن والآثار)) (4/153)
وقال ابنُ الملقِّن في ((البدر المنير)) (4/476): أصلُه متَّفق عليه، وصححه ابن حجر في ((فتح الباري)) (2/229).
মুআয বিন জাবাল রা. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ইশার সালাত আদায় করার পর নিজে গোত্রে গিয়ে ইমাম হিসেবে উক্ত সালাত আদায় করতেন। এটি তার জন্য নফল হিসেবে আর অন্যান্য লোকদের জন্য ইশার ফরয সালাত হিসেবে গণ্য হত।”
(মুসনাদে শাফেঈ, শারহু মাআনিল আসার লিত ত্বহাবী, দারাকুতনি, বায়হাকি প্রমুখ। এটি সর্বসম্মতভাবে সহিহ) আল্লাহু আলাম।
(৪৬) প্রশ্ন: আজানের সময় কি কথা বলা ঠিক?
উত্তর:
আজান এর সময় উত্তম হল, মনোযোগ সহকারে আজান শোনা এবং আজানের জবাব দেয়া। কেননা এটি অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ কাজ। তবে যদি বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলার দরকার হয় তাহলে এতে কোনও আপত্তি নেই। সুতরাং আজান চলাকালীন সময়ে দরকারি কথা বলা, হাঁচির জবাব দেওয়া, সালামের উত্তর দেওয়া বা বিশেষ কোনো কাজ করা ইত্যাদি জায়েজ আছে ইনশাআল্লাহ।
আযানের সময় আযানের জবাব ছাড়াও অন্য কথা বলা জায়েজ হওয়ার পক্ষে এ হাদিসটি প্রযোজ্য:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يُغِيرُ إِلاَّ عِنْدَ صَلاَةِ الْفَجْرِ فَإِنْ سَمِعَ أَذَانًا أَمْسَكَ وَإِلاَّ أَغَارَ فَاسْتَمَعَ ذَاتَ يَوْمٍ فَسَمِعَ رَجُلاً يَقُولُ اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ . فَقَالَ عَلَى الْفِطْرَةِ . فَقَالَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ . فَقَالَ خَرَجْتَ مِنَ النَّارِ
আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ফজরের সময়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কোন জনপদে) নৈশ হামলা করতেন। তিনি আযান শুনলে হামলা হতে বিরত থাকতেন, অন্যথায় হামলা করতেন। একদিন তিনি কানকে সজাগ রাখলেন।
তিনি একজন লোককে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ বলতে শুনে বললেন: “ফিতরাতের (ইসলামের) উপর আছে।”
ঐ লোকটি আবার বলল: “আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই)।
তিনি বললেনঃ “তুমি জাহান্নাম হতে বেরিয়ে গেলে।” (সহীহ, সহীহ আবু দাউদ (২৩৬৮), মুসলিম)
আল্লাহু আলাম।
এক মুসলিমের প্রতি আরেক মুসলিমের অধিকার এবং তা পালন করার আবশ্যকতা
(৪৭) প্রশ্ন: বান্দার হক অর্থাৎ হাক্কুল ইবাদ (বান্দার হক) পালন না করলে কি বান্দা গুনাগার হবে? যেমন: আত্মীয়-স্বজন দাওয়াত দিলে সেখানে না যাওয়া।
উত্তর:
একজন মুসলিমের উপরে আরেকজন মুসলিমের যেসকল হক (অধিকার/প্রাপ্য) রয়েছে সেগুলো পালন করা ওয়াজিব। কেউ বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত ভাবে সেগুলো পালন না করলে গুনাগার হতে হবে। এগুলো পালনের মাধ্যমে মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। অন্যথায় পারস্পরিক মনোমালিন্য হিংসা-বিদ্বেষ এবং দূরত্ব তৈরি হয় যা একটি মুসলিম সমাজের জন্য আদৌ কাম্য নয়।
তাই তো রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ: رَدُّ السَّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ، وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِز،ِ وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ، وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ
“এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক (অধিকার) হল, পাঁচটি। যথা:
● ক. সালামের উত্তর দেওয়া।
● খ. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া।
● গ. জানাজায় অনুগমন করা।
● ঘ. দাওয়াতে সাড়া দেয়া।
● ঙ. এবং হাঁচির জবাব দেয়া [অর্থাৎ কেউ হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ (সকল প্রশংসা আল্লাহর) পাঠ করলে এর উত্তরে ‘ইয়ারহামু কুমুল্লাহ’ (আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন) বলা।]” [মুত্তাফাকুন আলাইহি। সহিহ বুখারি, হা/ ১২৪০]
সহিহ মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে, এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক ছয়টি। যেমন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
قُّ المُسْلِم عَلَى المُسْلِم ستٌّ : إِذَا لَقيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأجبْهُ، وإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ الله فَشَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ، وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ
‘‘এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের (হক) অধিকার ছয়টি। যথা:
● ক. তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তাকে সালাম দাও।
● খ. সে তোমাকে দাওয়াত দিলে তার দাওয়াত গ্রহণ কর।
● গ. সে তোমার কাছে উপদেশ চাইলে তুমি তাকে উপদেশ দাও।
● ঘ. সে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে তার জবাব দাও।
● ঙ. সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাও।
● চ. এবং সে মারা গেলে তার জানাজায় অংশ গ্রহণ করো।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
আর বিশেষভাবে দাওয়াতের ক্ষেত্রে কথা হল,
শরিয়ত সম্মত কোন ওজর থাকলে দাওয়াত দাতার নিকট কথা বলে নিজের অপারগতা প্রকাশ করা উচিৎ।
তবে স্মরণ রাখা জরুরি যে, কেউ যদি বিদআতি ও পাপাচার সংঘটিত হয় এমন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয় তাহলে তাতে অংশগ্রহণ করা জায়েজ নেই। যেমন:
– মিলাদ মাহফিল
– কুলখানি
– চল্লিশা
– জন্মবার্ষিকী
– মৃত্যুবার্ষিকী
– বিবাহ বার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠান।
– এবং যে সকল অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, গান-বাজনা এবং বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম রয়েছে। এ জাতীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত গ্রহণ করা বৈধ নয়।
এছাড়া আকিকা, ওলিমা, ঈদ উপলক্ষে বা বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উচিত। একান্ত ওজর ব্যতিরেকে এসকল দাওয়াত গ্রহণ না করলে মুসলিম হিসেবে প্রাপ্য হক পালন না করার কারণে গুনাহগার হতে হবে। আল্লাহু আলাম।
(৪৮) প্রশ্ন: আমি একটি কুরআন কারিম দান করার নিয়ত করেছি। এখন আমি যদি কুরআন না দিয়ে সেই পরিমাণ টাকা কোন অসুস্থ লোককে দান করি তাহলে কি কোন সমস্যা হবে? এতে আমার নিয়ত কি পূরণ হবে?
উত্তর:
আপনি যদি একটি কুরআন দান করার নিয়ত করে থাকেন তারপর যদি মনে হয় কোন অসহায় অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসা করার জন্য আর্থিকভাবে সাহায্য করা এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন তাহলে আপনি অবশ্যই নিয়ত পরিবর্তন করে সেই টাকাটা তার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দান করতে পারেন। ইসলামি শরীয়তে এতে কোনও বাধা নেই। কেননা নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়ত পরিবর্তন করা জায়েজ আছে।
এতে ইনশাআল্লাহ আপনি দানের সওয়াব পাবেন এবং আপনার নিয়ত পূরণ হবে। নিঃসন্দেহে মানবতার কল্যাণে অর্থ খরচ করা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ।
এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রযোজ্য:
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মদিনার আনসারি সাহাবিদের মধ্যে আবূ তালহা রা. সর্বাপেক্ষা বিত্তবান ছিলেন। তার সস্পড়ির মধ্যে ‘বায়রুহা’ ছিল সর্বাধিক প্রিয় সম্পদ। সেটি মসজিদুন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মুখে অবস্থিত ছিল। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গিয়ে এর সুপেয় পানি পান করতেন। আনাস রা. বলেন,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ “তোমরা যা ভালবাসো তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা তোমরা কখনো নেকি পাবে না” এ আয়াত নাযিল হলে তখন আবু তালহা রা. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে বলছেন:
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
“তোমরা যা ভালবাস তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পূন্যতা লাভ করবে না।”
‘বায়রুহা’ আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ। অতএব আমি তা আল্লাহর পথে দান করলাম। বিনিময়ে আমি আল্লাহর কাছে নেকী ও সঞ্চয় আশা করি এবং আখিরাতে পুঁজির আশা রাখি। হে আল্লাহর রাসূল, আপনার মর্জি মাফিক আপনি তা সদ্ব্যবহার করুন। এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
بَخْ ذَلِكَ مَالٌ رَابِحٌ ذَلِكَ مَالٌ رَابِحٌ قَدْ سَمِعْتُ مَا قُلْتَ فِيهَا وَإِنِّي أَرَى أَنْ تَجْعَلَهَا فِي الأَقْرَبِينَ‏
বাহ! সম্পদটি লাভজনক। সম্পদটি লাভজনক। এ সম্পর্কে তুমি যা বললে, অবশ্যই আমি তা শুনেছি তবে আমার পছন্দ হচ্ছে তা তুমি তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বণ্টন করে দাও। অতঃপর আবূ তালহা (রাঃ) আত্নীয়-স্বজন ও তার চাচাতো ভাইদের মাঝে তা বণ্টন করে দিলেন।
{সহীহ মুসলিম (ইফাঃ), হাদিস নম্বরঃ [2187], অধ্যায়: ১৩/ যাকাত (كتاب الزكاة), পরিচ্ছদ: ৯. নিকটাত্মীয়, স্বামী, সন্তান-সন্তুতি ও মাতা-পিতার জন্য খরচ করার ফজিলত, যদিও তারা মুশরিক হয়. পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন}
তবে আল্লাহ তাআলা যদি আপনাকে পর্যাপ্ত সম্পদ দিয়ে থাকেন তাহলে গরীব অসহায় মানুষকে দান করার পাশাপাশি যদি কুরআন কিনে দেওয়ার সামর্থ্য হয় তাহলে সেটাও দিবেন। এতে ইনশাআল্লাহ আপনি দুই দিক থেকেই সওয়াবের অধিকারী হবেন আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
(৪৯) প্রশ্ন: আমার পরিচিত এক ভাইয়ের দাম্পত্য জীবন আজ আট বছর প্রায়। তার স্ত্রী সম্পর্কে আপন খালাতো বোন। তাদের তিন বছরের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে জানা গেছে যে, বিশেষ প্রয়োজনে বা নিরুপায় হয়ে আমার সেই ভাইয়ের মায়ের দুগ্ধ পান করেছিলো তার উক্ত খালাতো বোন বর্তমানে যে তার স্ত্রী। তাদের বিয়ের সময় অভিভাবকদের অজ্ঞতা হোক বা ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবের কারণেই হোক বিষয়টি তখন দৃষ্টিগোচর হয় নি। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টি জানাজানি হয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে কী বলে? পুনরায় উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, তাদের তিন বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
তাই এক্ষেত্রে ইসলামের শরিয়ত অনুযায়ী সঠিক করণীয় বলে দিলে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকবো।
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে দুধ ভাই-বোনের মাঝে বিবাহ বন্ধন চিরকালের জন্য হারাম। কেননা আল্লাহ তাআলা যে সকল মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধন হারাম করেছেন সেগুলোর মধ্য একজন হল, দুধবোন। যেমন: আল্লাহ বলেন,
وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ
“(তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে) তোমাদের সে মা’ দেরকে যারা তোমাদেরকে দুধ পান করিয়েছে (দুধ মাগণ) এবং তোমাদের দুধ বোনদেরকে।” (সূরা নিসা: ২৩)
এ ব্যাপারে একাধিক সহিহ হাদিসও বিদ্যমান রয়েছে।
সুতরাং যদি কোন পুরুষ এবং নারী নির্দিষ্ট কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে একই মায়ের ‘দুধ পান’ করেছে বলে সাব্যস্ত হয় তাহলে তাদের মাঝে বিবাহ বন্ধন চিরকালের জন্য হারাম।
সম্মানিত ফকিহগণ উল্লেখ করেছেন যে, রাযআত বা দুগ্ধ পান এর কারণে বিবাহ হারাম হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। সেগুলো হল:
● ক. দু বছর বয়সের মধ্যে শিশুর দুধ পান করা।
● খ. কমপক্ষে পাঁচ বার তৃপ্তি সহকারে দুধ পান করা।
● গ. পাঁচ বার দুধ পান করার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া।
● ঘ. দুধ শিশুর পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছা।
● ঙ. এবং এ বিষয়ে কমপক্ষে একজন বিশ্বস্ত মহিলা সাক্ষ্য প্রদান করা।
যদি উপরোক্ত শর্তাবলী অনুযায়ী কোন শিশু কোন মহিলার দুধ পান করেছে বলে সাব্যস্ত হয় তাহলে তাদের মাঝে রাযআত বা দুধ পান জনিত কারণে মাহরামিয়াত সাব্যস্ত হবে। অর্থাৎ উক্ত শিশুর সাথে ওই মহিলা ও তার স্বামীর সাথে সম্পর্ক হবে হুবহু নিজের জন্মদাতা পিতামাতার অনুরূপ এবং তাদের সন্তানাদির সাথে সম্পর্ক হবে হুবহু জন্মসূত্রের ভাই-বোনের অনুরূপ। অর্থাৎ তাদের মাঝে পর্দা করা আবশ্যক নয় এবং তাদের মাঝে চিরতরে বিবাহ বন্ধন হারাম। (এতে সম্পদের উত্তরাধিকার সাব্যস্ত হবে না।)
কিন্তু যদি কোনো পুরুষ ও নারীর মাঝে বিয়ে সংঘটিত হওয়ার পরে জানা যায় যে, তারা শিশুকালে একই মায়ের দুধ পান করেছিলো (এবং তা যথাযথ শর্তাবলীর আলোকে সুসাব্যস্ত হয়) তাহলে সাথে সাথে তাদের বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তাদেরকে তৎক্ষণাৎ পৃথক হতে হয়ে যেতে হবে।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে, তিনি তাদেরকে আলাদা করে দেন। এ মর্মে হাদিস হল:
উকবা ইবনে হারিস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি আবু ইহাব ইবনে আজিজের কন্যাকে বিবাহ করলেন। পরে এক মহিলা এসে বলল, আমি তো উকবাহ এবং যাকে সে বিয়ে করেছে দু জনকেই দুধ পান করিয়েছি। উকবাহ রা. তাকে বললেন, এটা তো আমার জানা নেই যে, আপনি আমাকে দুধ পান করিয়েছেন আর আপনিও এ বিষয়ে আমাকে অবহিত করেন নি।
অতঃপর আবু ইহাব পরিবারের নিকট লোক পাঠিয়ে তিনি তাদের নিকট জানতে চাইলেন। তারা বলল, সে আমাদের মেয়েকে দুধ পান করিয়েছে বলে তো আমাদের জানা নেই। তখন তিনি মদিনার উদ্দেশে সওয়ার হলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “যখন এরূপ বলা হয়েছে তখন এ (বিবাহ) কিভাবে সম্ভব?”
অত:পর উকবাহ রা. তাকে ত্যাগ করলেন। আর সে অন্য জনকে বিয়ে করল।
(সহিহ বুখারি, অধ্যায়: সাক্ষ্যদান, অনুচ্ছেদ: ৫২/৪. অধ্যায়: এক বা একাধিক ব্যক্তি কোন বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করলে আর অন্যরা এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে সাক্ষ্য দাতার কথা অনুযায়ী ফায়সালা হবে।)
অজ্ঞতা বশত: এমন বিয়ে হওয়ার পর যদি তাদের সন্তান হয় তাহলে তা পিতার সন্তান হিসেবে গণ্য হবে এবং সন্তান হিসেবে বাবার মৃত্যুর পর সে উত্তরাধিকারী সম্পদ ভাগ পাবে। কারণ এখানে বিবাহটি ছিল শুবহা তথা সংশয়পূর্ণ। (যা অজ্ঞতাবশত সংঘটিত হয়েছিল)
এ কথাই বলেছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.। তিনি বলেন:
আর যেহেতু বিষয়টি তাঁদের অজানা বশত: হয়েছিল সেহেতু ইনশাআল্লাহ তারা গুনাহগার হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
“হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাওয়ার কারণে কিংবা অনিচ্ছাবশত: অন্যায় করে ফেলি তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না।” (সূরা বাকারা: ২৮৬)। আল্লাহু আলাম।
(৫০) প্রশ্ন: কেউ যদি তার বাবা-মা’র জীবদ্দশায় ভুল বশত: বা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকার কারণে তাদের সাথে কোন বেয়াবদি মূলক আচরণ করে ফেলে আর তাদের মৃত্যুর পূর্বে যদি মাফ চেয়ে নিতে না পারে তাহলে এখন তার করণীয় কি? কিভাবে পিতামাতার সাথে কৃত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা পেতে পারে?
উত্তর:
এ কথা সর্বজন বিদিত যে, ইসলামে পিতামাতাকে যে সম্মান দেয়া হয়েছে তা এক কথায় নজির বিহীন। এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় অসংখ্য বক্তব্য এসেছে। তন্মধ্যে অন্যতম হল, নিম্নোক্ত আয়াতটি:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً
“আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং ধমক দিও না এবং তাদের সাথে বলো সম্মান জনক কথা।” (সূরা ইসরা/ বনী ইসরাঈলঃ ২৩)
এই আয়াতে আল্লাহর ইবাদতের পরক্ষণেই পিতামাতার প্রতি সম্মান ও দয়াসুলভ সদ্ব্যাবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, হাদিসে পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জনকে স্বয়ং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কেউ তার পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট রেখে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। যেমন:
হাদিসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:رَضَىَ الرَّبِّ فِىْ رِضَى الْوَالِدِ وَسُخْطُ الرَّبِّ فِىْ سُخْطِ الْوَالِدِ
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং প্রতিপালকের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে।”
(তিরমিযী ১৮৯৯, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ৫১৫, মুসনাদুল বাযযার ২৩৯৪, আল মুসতাদরাক ৭২৪৯)
অত:এব প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য, তার পিতামাতার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রেখে আচরণ করা এবং তাদেরকে কোনোভাবে কষ্ট না দেয়া।
কেননা, তাদেরকে কষ্ট দেয়া বা তাদের সাথে অসদাচরণ করা কবিরা গুনাহ এবং জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ। (আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন)
কখনো কোনও কারণে তাদের প্রতি বেআদবি বা কষ্টদায়ক আচরণ করে ফেললে কর্তব্য হল, তৎক্ষণাৎ তাদেরকে নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাদেরকে খুশি করার চেষ্টা করা।
কিন্তু কেউ যদি পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তাদের সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলে কিন্তু তাদের নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বেই তারা দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করে চলে যায় তাহলে কীভাবে এই ভয়ানক গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে পারে?
নিম্নে এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর নির্যাস থেকে কয়েকটি করণীয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:
১) অতীত অন্যায় আচরণের জন্য অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
«وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ»
“তিনি তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন, পাপসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমরা যা কিছু করো তিনি সে সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।” (সূরা শুরা: ২৫)
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الْإِسْلَامُ يُجبُّ مَا قَبْلَهُ وَالتَّوْبَةُ تجبُّ مَا كَانَ قَبْلَهَا»
“ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয় এবং তওবা তার পূর্বের সকল গুনাহ মোচন করে”। (মুসনাদে আহমদ: ১৯৮/৭ আল্লামা হাইসামী বলেন, হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আহমদ ও তাবরানী। উভয়ের বর্ণনা কারীগণ বিশুদ্ধ।)
২) সেই সাথে কর্তব্য হল, পিতা-মাতার জন্য অধিক পরিমাণে দোয়া করা।
৩) তারা ঋণ রেখে গেলে সম্পদ বণ্টনের পূর্বে তাদের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধ করা।
৪) তারা কিছু ওসিয়ত করে গেলে তাদের বৈধ ওসিয়ত পূর্ণ করা।
৫) তাদের উদ্দেশ্যে সন্তানের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য দান-সদকা করা।
৬) তাদের পক্ষ থেকে হজ ও ওমরা আদায় করা (যদি নিজের হজ উমরা আদায় করা হয়ে থাকে)।
৭) তাদের আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করা, তাদের সাথে সদাচরণ করা, তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া, তাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করা ইত্যাদি।
উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে আশা করা যায় দয়াময় আল্লাহ তার উক্ত গুনাহ মোচন করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু।
(সমাপ্ত)

(১) দ্বিতীয় পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(২) তৃতীয় পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(৩) চতুর্থ পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

(৪) পঞ্চম পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।


মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
 “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

ইসলামের অন্যান্য সকল বিষয় সহিহভাবে জানতে  এর উপর ক্লিক করুনঃ


PLEASE SHARE ON

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...