বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে সিয়াম (রোজা) সম্পর্কিত সহিহ ফতোয়া
(পর্ব-১)
(পর্ব-১)
প্রশ্ন: (১) সিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কী?
উত্তর: পবিত্র কুরআনের নিম্ন লিখিত আয়াত পাঠ করলেই
আমরা জানতে পারি সিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কী? আর তা হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন
করা ও আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ
ءَامَنُواْ كُتِبَ
عَلَيكُمُ ٱلصِّيَامُ
كَمَا كُتِبَ
عَلَى ٱلَّذِينَ
مِن قَبلِكُم
لَعَلَّكُم تَتَّقُونَ
﴾ [البقرة:
١٨٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা
হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন
করতে পার।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩] তাক্বওয়া হচ্ছে হারাম কাজ পরিত্যাগ করা। ব্যাপক
অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় বাস্তবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে
থাকা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
لَمْ
يَدَعْ
قَوْلَ
الزُّورِ
وَالْعَمَلَ
بِهِ
والْجَهْلَ
فَلَيْسَ
لِلَّهِ
حَاجَةٌ
فِي
أَنْ
يَدَعَ
طَعَامَهُ
وَشَرَابَهُ»
“যে ব্যক্তি (সাওম রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যার
কারবার ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খানা-পিনা পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোনো দরকার
নেই।”[1]
অতএব, এ কথা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, সাওম আদায়কারী
যাবতীয় ওয়াজিব বিষয় বাস্তবায়ন করবে এবং সবধরণের হারাম থেকে দূরে থাকবে। মানুষের গীবত
করবে না, মিথ্যা বলবে না, চুগলখোরী করবে না, হারাম বেচা-কেনা করবে না, ধোঁকাবাজী করবে
না।
মোটকথা: চরিত্র ধ্বংসকারী অন্যায় ও অশ্লীলতা বলতে
যা বুঝায় সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকবে। আর একমাস এভাবে চলতে পারলে বছরের অবশিষ্ট
সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ সাওম আদায়কারী
রামাযানের সাথে অন্য মাসের কোনো পার্থক্য করে না। অভ্যাস অনুযায়ী ফরয কাজে উদাসীনতা
প্রদর্শন করে, হালাল-হারামে কোনো পার্থক্য নেই। তাকে দেখলে বুঝা যাবে না তার মধ্যে
সিয়ামের মর্যাদার কোনো মূল্য আছে। অবশ্য এ সমস্ত বিষয় সিয়ামকে ভঙ্গ করে দিবে না। কিন্তু
নিঃসন্দেহে তার ছাওয়াব বিনষ্ট করে দিবে।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সিয়াম রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং তার কারবার পরিত্যাগ করে না। হাদীসটির বাক্য ইবন
মাজাহ থেকে নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: (২) মুসলিম জাতির একতার লক্ষ্যে কেউ কেউ চাঁদ দেখার বিষয়টিকে
মক্কার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে চায়। তারা বলে মক্কায় যখন রামাযান মাস শুরু হবে তখন বিশ্বের
সবাই সাওম রাখবে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
উত্তর: বিষয়টি মহাকাশ গবেষণার দিক থেকে অসম্ভব।
ইমাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, চন্দ্র উদয়ের স্থান বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বিদ্বানগণ
ঐকমত্য। আর এ বিভিন্নতার দাবী হচ্ছে প্রত্যেক এলাকায় ভিন্ন রকম বিধান হবে। একথার সপক্ষে
দলীল কুরআন হাদীস ও সাধারণ যুক্তি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَمَن
شَهِدَ
مِنكُمُ
ٱلشَّهۡرَ
فَلۡيَصُمۡهُۖ
“অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম পালন করে।” [সূরা
আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] যদি পৃথিবীর শেষ সীমান্তের লোকেরা এ মাসে উপস্থিত না হয় অর্থাৎ
চাঁদ না দেখে আর মক্কার লোকেরা চাঁদ দেখে, তবে কীভাবে এ আয়াত তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
হবে যারা কিনা চাঁদই দেখে নি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, صُومُوا
لِرُؤْيَتِهِ
وَأَفْطِرُوا
لِرُؤْيَتِهِ
“তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখ, চাঁদ দেখে সাওম ভঙ্গ কর।”[1] মক্কার অধিবাসীগণ যদি চাঁদ
দেখে তবে পাকিস্তান এবং তার পূর্ববর্তী এলাকার অধিবাসীদের কীভাবে আমরা বাধ্য করতে পারি
যে তারাও সিয়াম পালন করবে? অথচ আমরা জানি যে, তাদের আকাশে চাঁদ দেখা যায় নি। আর নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামের বিষয়টি চাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন।
যুক্তিগত দলীল হচ্ছে, বিশুদ্ধ ক্বিয়াস; যার
বিরোধিতা করার অবকাশ নেই। আমরা ভালোভাবে অবগত যে, পশ্চিম এলাকার অধিবাসীদের আগেই পূর্ব
এলাকার অধিবাসীদের নিকট ফজর উদিত হয়। এখন পূর্ব এলাকায় ফজর উদিত হলে কি আমরা পশ্চিম
এলাকার লোকদের বাধ্য করব একই সাথে খানা-পিনা থেকে বিরত হতে? অথচ তাদের ওখানে এখনও রাতের
অনেক অংশ বাকী আছে? উত্তর: কখনই না। সূর্য যখন পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের আকাশে অস্তমিত
হয়, তখন পশ্চিম এলাকার দিগন্তে তো সূর্য দেখাই যাচ্ছে তাদেরকে কি আমরা ইফতার করতে বাধ্য
করব? উত্তর: অবশ্যই না। অতএব, চন্দ্রও সম্পূর্ণরূপে সূর্যের মতই। চন্দ্রের হিসাব মাসের
সাথে সংশ্লিষ্ট। আর সূর্যের হিসাব দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ বলেছেন,
أُحِلَّ لَكُمۡ
لَيۡلَةَ
ٱلصِّيَامِ
ٱلرَّفَثُ
إِلَىٰ
نِسَآئِكُمۡۚ
هُنَّ
لِبَاسٞ
لَّكُمۡ
وَأَنتُمۡ
لِبَاسٞ
لَّهُنَّۗ
عَلِمَ
ٱللَّهُ
أَنَّكُمۡ
كُنتُمۡ
تَخۡتَانُونَ
أَنفُسَكُمۡ
فَتَابَ
عَلَيۡكُمۡ
وَعَفَا
عَنكُمۡۖ
فَٱلۡـَٰٔنَ
بَٰشِرُوهُنَّ
وَٱبۡتَغُواْ
مَا
كَتَبَ
ٱللَّهُ
لَكُمۡۚ
وَكُلُواْ
وَٱشۡرَبُواْ
حَتَّىٰ
يَتَبَيَّنَ
لَكُمُ
ٱلۡخَيۡطُ
ٱلۡأَبۡيَضُ
مِنَ
ٱلۡخَيۡطِ
ٱلۡأَسۡوَدِ
مِنَ
ٱلۡفَجۡرِۖ
ثُمَّ
أَتِمُّواْ
ٱلصِّيَامَ
إِلَى
ٱلَّيۡلِۚ
وَلَا
تُبَٰشِرُوهُنَّ
وَأَنتُمۡ
عَٰكِفُونَ
فِي
ٱلۡمَسَٰجِدِۗ
تِلۡكَ
حُدُودُ
ٱللَّهِ
فَلَا
تَقۡرَبُوهَاۗ
كَذَٰلِكَ
يُبَيِّنُ
ٱللَّهُ
ءَايَٰتِهِۦ
لِلنَّاسِ
لَعَلَّهُمۡ
يَتَّقُونَ
[البقرة:
١٨٧]
“সিয়ামের রাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা তোমাদের
জন্য বৈধ করা হয়েছে; তারা তোমাদের জন্য আবরণ এবং তোমরা তাদের জন্য আবরণ। তোমরা যে নিজেদের
খিয়ানত করছিলে, আল্লাহ তা পরিজ্ঞাত আছেন। এ জন্যে তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং তোমাদের
(ভার) লাঘব করে দিলেন। অতএব, এক্ষণে তোমরা (সিয়ামের রাত্রেও) তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত
হতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর এবং প্রত্যুষে
(রাতের) কালো রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর;
অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা সাওম পূর্ণ কর। তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ করার সময় (স্ত্রীদের)
সাথে সহবাস করবে না; এটাই আল্লাহর সীমা। অতএব, তোমরা তার নিকটেও যাবে না। এভাবে আল্লাহ
মানবমন্ডলীর জন্যে তাঁর নিদর্শনসমূহ বিবৃত করেন, যেন তারা সংযত হয়।” [সূরা আল-বাকারাহ,
আয়াত: ১৮৭]
সেই আল্লাহই বলেন, فَمَنْ
شَهِدَ
مِنْكُمْ
الشَّهْرَ
فَلْيَصُمْهُ
“অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন সিয়াম পালন করে।” অতএব,
যুক্তি ও দলীলের নিরীখে সিয়াম ও ইফতারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানের জন্য আলাদা বিধান
হবে। যার সম্পর্ক হবে বাহ্যিক আলামত বা চিহ্ন দ্বারা যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এবং নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাতে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে চাঁদ
প্রত্যক্ষ করা এবং সূর্য বা ফজর প্রত্যক্ষ করা।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম অনুচ্ছেদ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী যখন তোমরা চাঁদ দেখবে; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়:
সিয়াম অনুচ্ছেদ: চাঁদ দেখে রামাযানের সাওম রাখা ওয়াজিব।
প্রশ্ন: (৩) সাওম আদায়কারী যদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর হয়,
কিন্তু আগের দেশে ঈদের চাঁদ দেখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেকি এখন সাওম ভঙ্গ করবে? উল্লেখ্য
যে, দ্বিতীয় দেশে ঈদের চাঁদ এখনও দেখা যায় নি।
উত্তর: কোনো মানুষ যদি এক ইসলামী রাষ্ট্র থেকে
অপর ইসলামী রাষ্ট্রে গমণ করে আর উক্ত রাষ্ট্রে সিয়াম ভঙ্গের সময় না হয়ে থাকে, তবে সে
তাদের সাথে সিয়াম চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না তারা সিয়াম ভঙ্গ করে। কেননা মানুষ যখন
সাওম রাখে তখন সাওম রাখতে হবে, মানুষ যখন সাওম ভঙ্গ করে তখন সাওম ভঙ্গ করতে হবে। মানুষ
যেদিন কুরবানীর ঈদ করে সেদিন কুরবানীর ঈদ করবে। যদিও তার একদিন বা দু’দিন বেশি হয়ে
যায় তার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য হবে। যেমন, কোনো লোক সাওম রেখে পশ্চিম দিকের কোনো দেশে
ভ্রমণে শুরু করল। সেখানে সূর্য অস্ত যেতে দেরী হচ্ছে। তখন সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবশ্যই
দেরী করবে। যদিও সময় সাধারণ দিনের চেয়ে দু’ঘন্টা বা তিন ঘন্টা বা তার চাইতে বেশি হয়।
দ্বিতীয় শহরে সে যখন পৌঁছেছে তখন সেখানে ঈদের
চাঁদ দেখা যায় নি। অতএব, সে অপেক্ষা করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আমাদেরকে চাঁদ না দেখে সাওম রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, صُومُوا
لِرُؤْيَتِهِ
وَأَفْطِرُوا
لِرُؤْيَتِه
“তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখ, চাঁদ দেখে সাওম ভঙ্গ কর।”[1]
এর বিপরীত কেউ যদি এমন দেশে সফর করে যেখানে
নিজের দেশের পূর্বে চাঁদ দেখা গেছে (যেমন, কেউ বাংলাদেশ থেকে সঊদী আরব সফর করে) তবে
সে ঐ দেশের হিসাব অনুযায়ী সাওম ভঙ্গ করবে এবং ঈদের সালাত পড়ে নিবে। আর যে কটা সিয়াম
বাকী থাকবে তা রামাযান শেষে কাযা আদায় করে নিবে। চাই একদিন হোক বা দু‘দিন। কেননা আরবী
মাস ২৯ দিনের কম হবে না বা ৩০ দিনের বেশি হবে না। ২৯ দিন পূর্ণ না হলেও সাওম ভঙ্গ করবে
এজন্য যে, চাঁদ দেখা গেছে। আর চাঁদ দেখা গেলে তো সাওম ভঙ্গ করা আবশ্যক। কিন্তু যেহেতু
একটি সাওম কম হলো তাই রামাযান শেষে তা কাযা করতে হবে। কেননা মাস ২৮ দিনে হয় না।
কিন্তু পূর্বের মাসআলাটি এর বিপরীত। নতুন চাঁদ
না দেখা পর্যন্ত সাওম ভঙ্গ করা জায়েয নয়। কেননা নতুন চাঁদ না উঠা পর্যন্ত রামাযান মাস
বহাল। যদিও দু‘একদিন বেশি হয়ে যায় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটা এক দিনে কয়েক ঘন্টা
বৃদ্ধি হওয়ার মত। (অতিরিক্ত সাওম নফল হিসেবে গণ্য হবে।)
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম অনুচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী যখন তোমরা চাঁদ দেখবে..সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম অনুচ্ছেদ:
চাঁদ দেখে রামাযানের রোযা রাখা ওয়াজিব।
প্রশ্ন: (৩৯৫) যে ব্যক্তি কষ্টকর কঠিন কাজ করার কারণে সাওম রাখতে অসুবিধা
অনুভব করে তার কি সাওম ভঙ্গ করা জায়েয?
উত্তর: আমি যেটা মনে করি, কাজ করার কারণে সাওম ভঙ্গ
করা জায়েয নয়, হারাম। সাওম রেখে কাজ করা যদি সম্ভব না হয়, তবে রামাযান মাসে ছুটি নিবে
অথবা কাজ কমিয়ে দিবে, যাতে করে রামাযানের সিয়াম পালন করা সম্ভব হয়। কেননা রামাযানের
সিয়াম ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। যার মধ্যে শিথীলতা করা জায়েয নয়।
প্রশ্ন: (৪) জনৈক বালিকা ছোট বয়সে ঋতুবতী হয়ে গেছে। সে অজ্ঞতাবশতঃ ঋতুর
দিনগুলোতে সাওম পালন করেছে। এখন তার করণীয় কী?
উত্তর: তার ওপর আবশ্যক হচ্ছে, ঋতু অবস্থায় যে
কয়দিনের সিয়াম আদায় করেছে সেগুলোর কাযা আদায় করা। কেননা ঋতু অবস্থায় সিয়াম পালন করলে
বিশুদ্ধ হবে না এবং গ্রহণীয় হবে না। যদিও তা অজ্ঞতাবশতঃ হয়ে থাকে। তাছাড়া পরবর্তীতে
যে কোনো সময় তা কাযা করা সম্ভব। কাযা আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই।
এর বিপরীত আরেকটি মাসআলা হচ্ছে, অল্প বয়সে
জনৈক বালিকা ঋতুবতী হয়ে গেছে। কিন্তু লজ্জার কারণে বিষয়টি কারো সামনে প্রকাশ করে নি
এবং তার সিয়ামও পালন করে নি। এর ওপর ওয়াজিব হচ্ছে, উক্ত মাসের সিয়াম কাযা আদায় করা।
কেননা নারী ঋতুবতী হয়ে গেলেই প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায় এবং শরী‘আতের যাবতীয় বিধি-বিধান
পালন করা তার ওপর ফরয হয়ে যায়।
প্রশ্ন: (৫) জীবিকা নির্বাহের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সিয়াম ভঙ্গ করার
বিধান কী?
উত্তর: যে ব্যক্তি রামাযানের সিয়াম পরিত্যাগ
করে এ যুক্তিতে যে, সে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা উপার্জনে ব্যস্ত। সে যদি এ তা’বীল
বা ব্যাখ্যা করে যে, অসুস্থ ব্যক্তি যেমন সাওম ভঙ্গ না করলে বেঁচে থাকতে অক্ষম তেমনি
আমিও তো দরিদ্র অভাবী, জীবিকা উপার্জন করতে হলে আমাকে সাওম ভঙ্গ করতে হবে, তবে এ যুক্তি
খোঁড়া এবং নিঃসন্দেহে এ ব্যক্তি মূর্খ। অতএব, অজ্ঞতার কারণে এবং অপব্যাখ্যার কারণে
সে উক্ত সময়ের কাযা আদায় করবে যদি সে জীবিত থাকে। জীবিত না থাকলে তার পরিবার তার পক্ষ
থেকে কাযা আদায় করে দিবে। কেউ কাযা আদায় না করলে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের বিনিময়ে
একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে।
কিন্তু যদি কোনো ধরণের ব্যাখ্যা না করে ইচ্ছাকৃতভাবে
সিয়াম পরিত্যাগ করে থাকে, তবে বিদ্বানদের মতামতসমূহের মধ্যে থেকে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে,
সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদতসমূহ বিনা ওযরে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করে আদায় করলে
তা কবূল হবে না। তাই এ লোকের ওপর আবশ্যক হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তওবা করা, নেক আমল ও নফল
ইবাদতসমূহ বেশি বেশি সম্পাদন করা ও ইস্তেগফার করা। এর দলীল হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ عَمِلَ
عَمَلًا
لَيْسَ
عَلَيْهِ
أَمْرُنَا
فَهُوَ
رَدّ
“যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই। তবে তা প্রত্যাখ্যাত।”[1] সময়ের
সাথে নির্দিষ্ট ইবাদতসমূহ যেমন সময়ের পূর্বে আদায় করলে কবূল হবে না। অনুরূপভাবে সময়
অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তা গ্রহণীয় হবে না। কিন্তু যদি অজ্ঞতা বা ভুলের কোনো ওযর থাকে,
তবে ভুল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
نَسِيَ
صَلَاةً
أو
نام
عنها
فَلْيُصَلِّهَا
إِذَا
ذَكَرَهَا
لَا
كَفَّارَةَ
لَهَا
إِلَّا
ذَلِكَ»
“যে ব্যক্তি সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে
বা ভুলে যায়, তবে স্মরণ হলেই সে তা আদায় করবে। এটাই তার কাফফারা।”[2]
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: বিচার ফয়সালা অনুচ্ছেদ:
বাতিল ফয়সালা ভঙ্গ করা এবং নতুন বিষয় প্রত্যাখ্যান।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মসজিদ ও সালাতের
স্থান, অনুচ্ছেদ: ছুটে যাওয়া সালাত কাযা আদায় করা।
প্রশ্ন: (৩৯৮) সাওম ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ কী কী?
উত্তর: সাওম ভঙ্গের কারণসমূহ হচ্ছেঃ
১) অসুস্থতা, ২) সফর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত
হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن
كَانَ
مِنكُم
مَّرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَۚ﴾
[البقرة:
١٨٤]
“আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে
(সে সাওম ভঙ্গ করে) অন্য দিনে তা কাযা আদায় করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
৩) গর্ভবতী নারীর নিজের বা শিশুর জীবনের আশংকা
করলে সাওম ভঙ্গ করবে।
৪) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী নারী যদি সাওম
রাখলে নিজের বা সন্তানের জীবনের আশংকা করে তবে সাওম ভঙ্গ করবে।
৫) কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সাওম
ভঙ্গ করা: যেমন পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার, আগুন থেকে বাঁচাতে গিয়ে দরকার হলে
সাওম ভঙ্গ করা।
৬) আল্লাহর পথে জিহাদে থাকার সময় শরীরে শক্তি
বজায় রাখার জন্য সাওম ভঙ্গ করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের
সময় সাহাবীগণকে বলেছিলেন, إِنَّكُمْ مُصَبِّحُو
عَدُوِّكُمْ
وَالْفِطْرُ
أَقْوَى
لَكُمْ
فَأَفْطِرُوا
“আগামীকাল তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করবে, সাওম ভঙ্গ করলে তোমরা অধিক শক্তিশালী থাকবে,
তাই তোমরা সাওম ভঙ্গ কর।”[1]
বৈধ কোনো কারণে সাওম ভঙ্গ করলে দিনের বাকী
অংশ সাওম অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। কেননা সে তো গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণেই সাওম ভঙ্গ করেছে।
এজন্য এ মাসআলায় বিশুদ্ধ কথা হচ্ছেঃ কোনো রুগী যদি অসুস্থতার কারণে দিনে সাওম ভঙ্গ
করে আর দিন শেষ হওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যায়, তবে দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার কোনো
আবশ্যকতা নেই। কোনো মুসাফির যদি সাওম ভঙ্গ অবস্থায় দিন থাকতেই সফর থেকে ফিরে আসে তারও
দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার আবশ্যকতা নেই। অনুরূপ বিধান ঋতুবতী নারীর। কেননা
এরা সবাই বৈধ কারণে সাওম ভঙ্গ করেছে। তাই ঐ দিবস তাদের জন্যই। তাতে তাদের প্রতি সিয়ামের
আবশ্যকতা নেই। কেননা শরী‘আত তাদেরকে সাওম ভঙ্গের অনুমতি প্রদান করে আবার তা আবশ্যক
করবে না।এর বিপরীত মাসআলা হচ্ছে, রামাযান মাসের চাঁদ দেখা গেছে একথা যদি দিনের বেলায়
প্রমাণিত হয়, তবে খবর পাওয়ার সাথে সাথে সাওমের নিয়ত করে নিতে হবে এবং দিনের বাকী সময়
সাওম অবস্থায় কাটাতে হবে। উভয় মাসআলায় পার্থক্য সুস্পষ্ট। কেননা যখন কিনা দিনের বেলায়
রামাযান মাস শুরু হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়েছে, তখন তাদের ওপর সে দিনের সিয়াম পালন করা
ওয়াজিব হয়ে গেছে। কিন্তু না জানার কারণে তাদের ওযর গ্রহণযোগ্য এবং তাদের সিয়াম বিশুদ্ধ।
এ কারণে তারা যদি জানতে পারত যে আজ রামাযান শুরু হয়েছে, তবে সাওম রাখা তাদের জন্য আবশ্যক
হত।
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সফরে কাজের দায়িত্বে থাকলে সিয়াম ভঙ্গ করার প্রতিদান।
প্রশ্ন: (৬) রামাযান মাস শুরু হয়েছে কিনা এসংবাদ না পেয়েই জনৈক ব্যক্তি
রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে সে সিয়ামের নিয়ত করে নি ফজর হয়ে গেছে। ফজরের সময় সে জানতে পারল
আজ রামাযানের প্রথম দিন। এ অবস্থায় তার করণীয় কী? উক্ত দিনের সিয়াম কি কাযা আদায় করতে
হবে?
উত্তর: যখন সে জানতে পারবে তখনই সিয়ামের নিয়ত করে
ফেলবে এবং সিয়াম পালন করবে। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে এ দিনটির সিয়াম পরে সে কাযা আদায়
করবে। তবে ইমাম ইবন তায়মিয়া রহ. এতে বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, জানার সাথে নিয়তের
সম্পর্ক। এ লোক তো জানতেই পারেনি। অতএব, তার ওযর গ্রহণযোগ্য। সে জানতে পারলে রাতে কখনই
সিয়ামের নিয়ত করা ছাড়তো না, কিন্তু সে তো ছিল অজ্ঞ। আর অজ্ঞ ব্যক্তির ওযর গ্রহণযোগ্য।
অতএব, জানার পর যদি সাওমের নিয়ত করে ফেলে তবে সিয়াম বিশুদ্ধ। তাকে কাযা আদায় করতে হবে
না।
অধিকাংশ বিদ্বান বলেন, তাকে উক্ত দিনের সাওম
রাখা আবশ্যক এবং তার কাযা আদায় করাও আবশ্যক। এর কারণ হিসেবে বলেন, এ লোকের দিনের একটি
অংশ নিয়ত ছাড়া অতিবাহিত হয়েছে। তাই তাকে কাযা আদায় করতে হবে। আমি মনে করি, সতর্কতাবশতঃ
উক্ত দিনের সাওম কাযা করে নেওয়াই উচিৎ।
প্রশ্ন: (৭) কারণবশতঃ কোনো ব্যক্তি যদি সাওম ভঙ্গ করে আর দিন শেষ হওয়ার
আগেই উক্ত ওযর দূর হয়ে যায়। সে কি দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় কাটাবে?
উত্তর: না, দিনের বাকী অংশ সিয়াম অবস্থায় থাকা
আবশ্যক নয়। তবে রামাযান শেষে উক্ত দিবসের কাযা তাকে আদায় করতে হবে। কেননা শরী‘আত অনুমদিত
কারণেই সে সিয়াম ভঙ্গ করেছে। উদাহরণস্বরূপ অসুস্থ ব্যক্তির অপারগতার কারণে শরী‘আত তাকে
ঔষুধ সেবনের অনুমতি দিয়েছে। ঔষুধ সেবন করা মানেই সাওম ভঙ্গ। অতএব, পূর্ণ এ দিনটির সিয়াম
তার ওপর আবশ্যক নয়। দিনের বাকী অংশ সাওম অবস্থায় থাকার অবশ্যকতায় শরী‘আতসম্মত কোনো
ফায়েদা নেই। যেখানে কোনো উপকার নেই তা আবশ্যক করাও চলে না।
উদাহরণস্বরূপ জনৈক ব্যক্তি দেখল একজন লোক পানিতে
ডুবে যাচ্ছে। সে বলছে আমি যদি পানি পান করি তবে এ ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পারব। পানি
পান না করলে তাকে বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে পানি পান করবে এবং
তাকে পানিতে ডুবা থেকে উদ্ধার করবে। অতঃপর দিনের অবশিষ্ট অংশ খানা-পিনা করবে। এ দিনের
সম্মান তার জন্য আর নেই। কেননা শরী‘আতের দাবী অনুযায়ীই সাওম ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ
হয়েছে। তাই দিনের বাকী অংশ সাওম রাখা আবশ্যক নয়।
যদি কোনো লোক অসুস্থ থাকে তাকে কি আমরা বলব,
ক্ষুধার্ত না হলে খানা খাবে না? পিপাসিত না হলে পানি পান করবে না? অর্থাৎ প্রয়োজন না
হলে খানা-পিনা করবে না? না, এরূপ বলব না। কেননা এ লোককে তো সাওম ভঙ্গের অনুমতি দেওয়া
হয়েছে। অতএব, শর‘ঈ দলীলের ভিত্তিতে রামাযানের সাওম ভঙ্গকারী প্রত্যেক ব্যক্তির দিনের
অবশিষ্ট অংশ সাওম অবস্থায় অতিবাহিত করা আবশ্যক নয়।
এর বিপরীত মাসআলায় বিপরীত সমাধান। অর্থাৎ বিনা
ওযরে যদি সাওম ভঙ্গ করে তবে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ সাওম অবস্থায় থাকতে হবে। কেননা
সাওম ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ ছিল না। শরী‘আতের অনুমতি ছাড়াই সে এদিনের সম্মান নষ্ট করেছে।
অতএব, দিনের বাকী অংশ সিয়াম পালন করা যেমন আবশ্যক তেমনি কাযা আদায় করাও যরূরী।
প্রশ্ন: (৮) জনৈক মহিলা কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ডাক্তারগণ তাকে
সাওম রাখতে নিষেধ করেছে। এর বিধান কী?
উত্তর: আল্লাহ বলেন,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ
ٱلَّذِيٓ
أُنزِلَ
فِيهِ
ٱلۡقُرۡءَانُ
هُدٗى
لِّلنَّاسِ
وَبَيِّنَٰتٖ
مِّنَ
ٱلۡهُدَىٰ
وَٱلۡفُرۡقَانِۚ
فَمَن
شَهِدَ
مِنكُمُ
ٱلشَّهۡرَ
فَلۡيَصُمۡهُۖ
وَمَن
كَانَ
مَرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَۗ
يُرِيدُ
ٱللَّهُ
بِكُمُ
ٱلۡيُسۡرَ
وَلَا
يُرِيدُ
بِكُمُ
ٱلۡعُسۡرَ﴾
[البقرة:
١٨٥]
“রামাযান হচ্ছে সেই মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে
কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। আর
ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে,
সে এ মাসের সাওম রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে
গণনা পূরণ করে নিবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য কঠিন কামনা করেন
না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
মানুষ যদি এমন রোগে আক্রান্ত হয় যা থেকে সুস্থ
হওয়ার কোনো আশা নেই। তবে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে। খাদ্য
দেওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে, মিসকীনকে পরিমাণমত চাউল প্রদান করা এবং সাথে মাংস ইত্যাদি তরকারী
হিসেবে দেওয়া উত্তম। অথবা দুপুরে বা রাতে তাকে একবার খেতে দিবে। এটা হচ্ছে ঐ রুগীর
ক্ষেত্রে যার সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। আর নারী এ ধরণের রোগে আক্রান্ত। তাই আবশ্যক
হচ্ছে সে প্রতিদিনের জন্য একজন করে মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করবে।
প্রশ্ন: (৯) কখন এবং কীভাবে মুসাফির সালাত ও সাওম আদায় করবে?
উত্তর: মুসাফির নিজ শহর থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিয়ে
প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত দু দু রাকাত সালাত আদায় করবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,
«أَوَّلَ
مَا
فُرِضَتِ
الصَّلَاةُ
رَكْعَتَيْنِ
فَأُقِرَّتْ
صَلَاةُ
السَّفَرِ
وَأُتِمَّتْ
صَلَاةُ
الْحَضَر»
“সর্বপ্রথম যে সালাত ফরয করা হয়েছিল তা হচ্ছে
দু’রাকাত। সফরের সালাতকে ঐভাবেই রাখা হয়েছে এবং গৃহে অবস্থানের সময় সালাতকে পূর্ণ
(চার রাকাত) করা হয়েছে।” অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, “গৃহে অবস্থানের সময় সালাত বৃদ্ধি
করা হয়েছে।”[1] আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের সাথে মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনি মদীনা ফিরে আসা
পর্যন্ত দু’ দু রাকাত করে সালাত আদায় করলেন।
কিন্তু মুসাফির যদি স্থানীয় ইমামের সাথে সালাত
আদায় করে তবে পূর্ণ চার রাকাতই পড়বে। চাই সালাতের প্রথম থেকে ইমামের সাথে থাকুক বা
পরে এসে অংশ গ্রহণ করুক। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ বাণী একথার
দলীল।
«إِذَا
سَمِعْتُمُ
الْإِقَامَةَ
فَامْشُوا
إِلَى
الصَّلَاةِ
وَعَلَيْكُمْ
بِالسَّكِينَةِ
وَالْوَقَارِ
وَلَا
تُسْرِعُوا
فَمَا
أَدْرَكْتُمْ
فَصَلُّوا
وَمَا
فَاتَكُمْ
فَأَتِمُّوا»
“যখন সালাতের ইকামত প্রদান করা হয় তখন হেঁটে
হেঁটে ধীর-স্থীর এবং প্রশান্তির সাথে সালাতের দিকে আগমণ করবে। তাড়াহুড়া করবে না। অতঃপর
সালাতের যতটুকু অংশ পাবে আদায় করবে। আর যা ছুটে যাবে তা পরে পূর্ণ করে নিবে।”[2]
এ হাদীসটি স্থানীয় ইমামের পিছনে সালাত আদায়কারী
মুসাফিরদেরও শামিল করে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এটা কি
কথা মুসাফির একাকী সালাত পড়লে দু’রাকাত পড়বে আর স্থানীয় ইমামের পিছনে পড়লে চার রাকাত
পড়বে? তিনি বললেন, এটা সুন্নাত।
মুসাফিরের জন্য জামা‘আতের সালাত রহিত নয়। কেননা
আল্লাহ বলেন,
﴿وَإِذَا كُنتَ
فِيهِمۡ
فَأَقَمۡتَ
لَهُمُ
ٱلصَّلَوٰةَ
فَلۡتَقُمۡ
طَآئِفَةٞ
مِّنۡهُم
مَّعَكَ
وَلۡيَأۡخُذُوٓاْ
أَسۡلِحَتَهُمۡۖ
فَإِذَا
سَجَدُواْ
فَلۡيَكُونُواْ
مِن
وَرَآئِكُمۡ
وَلۡتَأۡتِ
طَآئِفَةٌ
أُخۡرَىٰ
لَمۡ
يُصَلُّواْ
فَلۡيُصَلُّواْ
مَعَكَ﴾
[النساء:
١٠٢]
“আর যখন আপনি তাদের সাথে থাকেন আর তাদেরকে
জামা‘আতের সাথে সালাত পড়ান, তবে তা এইভাবে হবে যে, তাদের মধ্যে থেকে একদল আপনার সাথে
সালাতে দাঁড়াবে এবং নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্র সাথে রাখবে। অনন্তর যখন তারা সাজদাহ করবে
(এক রাকাত পূর্ণ করবে), তখন তারা আপনাদের পিছনে চলে যাবে এবং অন্য দল যারা এখনও সালাত
পড়ে নি তারা আসবে এবং আপনার সাথে সালাত পড়ে নিবে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০২]
অতএব, মুসাফির যদি নিজ শহর ছেড়ে অন্য শহরে
অবস্থান করে, তবে আযান শুনলেই মসজিদে জামা‘আতের সালাতে উপস্থিত হবে। তবে যদি মসজিদ
থেকে বেশি দূরে থাকে বা সফর সঙ্গীদের ক্ষতির আশংকা করে তবে মসজিদে না গেলেও চলবে। কেননা
সাধারণ দলীলসমূহ একথাই প্রমাণ করে যে, আযান বা এক্বামত শুনলেই জামা‘আতে উপস্থিত হওয়া
ওয়াজিব।
নফল বা সুন্নাত সালাতের ক্ষেত্রে মুসাফির যোহর,
মাগরিব ও এশার সুন্নাত ছাড়া সবধরণের নফল ও সুন্নাত আদায় করবে। রাতের নফল (তাহাজ্জুদ),
বিতর, ফজরের সুন্নাত, চাশত, তাহিয়্যাতুল অযু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, সফর থেকে ফেরত এসে
দু’রাকাত সালাত আদায় করবে।
দু’সালাত একত্রিত করার বিধান হচ্ছেঃ সফর যদি
চলমান থাকে তবে উত্তম হচ্ছে দু’সালাতকে একত্রিত করা। যোহর ও আছর এবং মাগরিব ও এশা একত্রিত
আদায় করবে। প্রথম সালাতের সময়ই দু’সালাত একত্রিত আদায় করবে অথবা দ্বিতীয় সালাতের সময়
দু’সালাতকে একত্রিত করবে। যেভাবে তার জন্য সুবিধা হয় সেভাবে করবে।
কিন্তু সফরে গিয়ে কোনো জায়গায় যদি অবস্থান
করে তবে উত্তম হচ্ছে দু’সালাতকে একত্রিত না করা। একত্রিত করলেও কোনো অসুবিধা নেই। কেননা
উভয়টিই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত আছে। সিয়ামের ক্ষেত্রে
মুসাফিরের জন্য উত্তম হচ্ছে সিয়াম পালন করা। সিয়াম ভঙ্গ করলেও কোনো অসুবিধা নেই। পরে
উক্ত দিনগুলোর কাযা আদায় করে নিবে। তবে সিয়াম ভঙ্গ করা যদি বেশি আরামদায়ক হয় তাহলে
সিয়াম ভঙ্গ করাই উত্তম। কেননা আল্লাহ বান্দাকে যে ছুটি দিয়েছেন তা গ্রহণ করা তিনি পসন্দ
করেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সালাত কছর করা, অনুচ্ছেদ:
নিজ এলাকা থেকে বের হলে সালাত কছর করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরের সালাত এবং কছর
করা, অনুচ্ছেদ: মুসাফিরের সালাত এবং কছর করা।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: আযান, অনুচ্ছেদ:
সালাতে দ্রুত যাবে না; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মসজিদ ও সালাতের স্থান, অনুচ্ছেদ: ধীরস্থীরভাবে
মসজিদে আগমণ করা।
প্রশ্ন: (১০) সফর অবস্থায় কষ্ট হলে সাওম রাখার বিধান কী?
উত্তর: সফর অবস্থায় যদি এমন কষ্ট হয় যা সহ্য
করা সম্ভব, তবে সে সময় সাওম রাখা মাকরূহ। কেননা একদা সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম দেখলেন জনৈক ব্যক্তির পাশে লোকজন ভীড় করছে এবং তাকে ছাঁয়া করছে। তিনি বললেন,
এর কি হয়েছে? তারা বলল, লোকটি সাওম পালনকারী। তখন তিনি বললেন, لَيْسَ
مِنَ
الْبِرِّ
الصَّوْمُ
فِي
السَّفَرِ
“সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোনো পূণ্যের কাজ নয়।”[1]
কিন্তু সফরে সাওম রাখা যদি অধিক কষ্টদায়ক হয়
তবে ওয়াজিব হচ্ছে সাওম ভঙ্গ করা। কেননা সফর অবস্থায় লোকেরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের নিকট অভিযোগ করল যে তাদের কষ্ট হচ্ছে তখন তিনি সাওম ভঙ্গ করলেন। অতঃপর
বলা হলো, কিছু লোক এখনও সাওম রেখেছে। তিনি বললেন, أُولَئِكَ
الْعُصَاةُ
أُولَئِكَ
الْعُصَاةُ
“ওরা নাফরমান, ওরা নাফরমান।”[2]
কিন্তু সাওম রাখতে যার কোনো কষ্ট হবে না, তার
জন্য উত্তম হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে সাওম পালন করা।
কেননা সফর অবস্থায় তিনি সাওম রাখতেন। আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন,
«خَرَجْنَا
مَعَ
رَسُولِ
اللَّهِ
صَلَّى
اللَّه
عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ
فِي
شَهْرِ
رَمَضَانَ
فِي
حَرٍّ
شَدِيدٍ
وَمَا
فِينَا
صَائِمٌ
إِلَّا
رَسُولُ
اللَّهِ
صَلَّى
اللَّه
عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ
وَعَبْدُ
اللَّهِ
ابْنُ
رَوَاحَةَ»
“একদা রামাযান মাসে কঠিন গরমের সময় আমরা নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা ছাড়া আর কেউ সাওম রাখেন নি।”[3]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
কঠিন গরমে যাকে ছাঁয়া দেওয়া হচ্ছিল তার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
বাণী: “সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।” সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম,
অনুচ্ছেদ: পাপের সফর না হলে রামাযান মুসাফিরের সাওম রাখা ও ভঙ্গ করা উভয়টিই বৈধ।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
পাপের সফর না হলে রামাযান মুসাফিরের সাওম রাখা ও ভঙ্গ করা উভয়টিই বৈধ।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
নং ৩৫; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সফরে সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা ইচ্ছাধীন।
প্রশ্ন: (১১) আধুনিক যুগের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ও আরামদায়ক হওয়ার
কারণে সফর অবস্থায় সাওম রাখা মুসাফিরের জন্য কষ্টকর নয়। এ অবস্থায় সাওম রাখার বিধান
কী?
উত্তর: মুসাফির সাওম রাখা ও ভঙ্গ করার ব্যাপারে
ইচ্ছাধীন। আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن شَهِدَ
مِنكُمُ
ٱلشَّهۡرَ
فَلۡيَصُمۡهُۖ
وَمَن
كَانَ
مَرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَۗ
يُرِيدُ
ٱللَّهُ
بِكُمُ
ٱلۡيُسۡرَ
وَلَا
يُرِيدُ
بِكُمُ
ٱلۡعُسۡر﴾
[البقرة:
١٨٥]
“আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে,
সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] সাহাবায়ে কেরাম নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে থাকলে কেউ সাওম রাখতেন কেউ সাওম ভঙ্গ করতেন।
কোনো সাওম ভঙ্গকারী অপর সাওম পালনকারীকে দোষারোপ করতেন না, সাওম পালনকারীও সাওম ভঙ্গকারীকে
দোষারোপ করতেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সফর অবস্থায় সাওম রেখেছেন।
আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “একদা রামাযান মাসে কঠিন গরমের সময় আমরা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা ছাড়া আর কেউ সাওম রাখে নি।”[1]
মুসাফিরের জন্য মূলনীতি হচ্ছে, সে সাওম রাখা
ও ভঙ্গ করার ব্যাপারে ইচ্ছাধীন। কিন্তু কষ্ট না হলে সাওম রাখাই উত্তম। কেননা এতে তিনটি
উপকারিতা রয়েছে:
প্রথমত: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের অনুসরণ।
দ্বিতীয়ত: সাওম রাখতে সহজতা। কেননা সমস্ত মানুষ
যখন সাওম রাখে তখন সবার সাথে সাওম রাখা অনেক সহজ।
তৃতীয়ত: দ্রুত নিজেকে যিম্মামুক্ত করা।
কিন্তু কষ্টকর হলে সাওম রাখবে না। এ অবস্থায়
সাওম রাখা পূণ্যেরও কাজ নয়। কেননা এক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন
জনৈক ব্যক্তির পাশে লোকজন ভীড় করছে এবং তাকে ছাঁয়া দিচ্ছে। তিনি বললেন, এর কি হয়েছে?
তারা বলল, লোকটি সাওম পালনকারী। তখন তিনি বললেন, لَيْسَ
مِنَ
الْبِرِّ
الصَّوْمُ
فِي
السَّفَرِ
“সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোনো পূণ্যের কাজ নয়।”[2] এ ভিত্তিতে আমরা বলব, বর্তমান
যুগে সাধারণতঃ সফরে তেমন কোনো কষ্ট হয় না। তাই সিয়াম পালন করাই উত্তম।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
নং ৩৫; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সফরে সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা ইচ্ছাধীন।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
কঠিন গরমে যাকে ছাঁয়া দেওয়া হচ্ছিল তার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
বাণী: “সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।” মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
পাপের সফর না হলে রামাযান মাসে মুসাফিরের সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা উভয়টিই বৈধ।
প্রশ্ন: (১২) সাওম অবস্থায় মুসাফির যদি মক্কায় পৌঁছে তবে ওমরা আদায়
করতে শক্তি পাওয়ার জন্য সাওম ভঙ্গ করা জায়েয হবে কী?
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মক্কা বিজয়ের সময় রামাযান মাসের বিশ তারিখে মক্কায় প্রবেশ করেন। সে সময় তিনি সাওম ভঙ্গ
অবস্থায় ছিলেন। সেখানে দু দু রাকাত করে সালাত কসর আদায় করেছেন। আর মক্কাবাসীদের বলেছেন,
“হে মক্কাবাসীগণ! তোমরা সালাত পূর্ণ করে নাও। কেননা আমরা মুসাফির।”[1] সহীহ বুখারীতে
একথাও প্রমাণিত হয়েছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো
সাওম ভঙ্গ অবস্থাতেই অতিবাহিত করেছেন। কেননা তিনি ছিলেন মুসাফির।
তাই উমরাকারী মক্কা পৌঁছলেই তার সফর শেষ হয়ে
যায় না। যদি সাওম ভঙ্গ অবস্থায় মক্কা পৌঁছে থাকে, তবে দিনের বাকী অংশ পানাহার ত্যাগ
করা আবশ্যক নয়। কিন্তু বর্তমান যুগে যেহেতু সফর আরামদায়ক তাই সাওম রাখাও তেমন কষ্টকর
নয়। সেহেতু কেউ যদি সাওম রেখে মক্কায় পৌঁছে অত্যধিক ক্লান্তি অনুভব করে, তখন চিন্তা
করে আমি কি সাওম পূর্ণ করে ইফতারের পর ওমরার কাজ শুরু করবো? নাকি সাওম ভঙ্গ করব এবং
সর্বপ্রথম ওমরা আদায় করে নিব?
এ অবস্থায় আমরা তাকে বলব, আপনার জন্য উত্তম
হচ্ছে, সুস্থাবস্থায় ওমরা পালন করার জন্য সাওম ভঙ্গ করা। কেননা হজ-ওমরা আদায়কারীর জন্য
সুন্নাত হচ্ছে, উক্ত উদ্দেশ্যে মক্কা আগমণ করলে, সেখানে পৌঁছার সাথে সাথেই হজ-ওমরার
কাজে আত্মনিয়োগ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মক্কা আগমণ
করলে দ্রুত মসজিদে হারামে গমণ করতেন। এমনকি আরোহীকে মসজিদের নিকটবর্তী স্থানে বসাতেন।
অতএব, উমরাকারীর জন্য উত্তম হচ্ছে, দিনের বেলায়
কর্মশক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে সাওম ভঙ্গ করে ওমরা পালন করা। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করা।
সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের জন্য যখন সফরে ছিলেন এবং তিনি সাওম অবস্থায় ছিলেন,
তখন কতিপয় লোক এসে অভিযোগ করল, সাওম রাখতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি কি করছেন এটা
দেখার অপেক্ষায় আছে তারা। তখন সময়টি ছিল আছরের পর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
পানি চাইলেন এবং পান করলেন। লোকেরা সবাই দেখল।[2] অতএব, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সফর অবস্থায় দিনের শেষ প্রহরে সাওম ভঙ্গ করলেন। একাজ যে জায়েয একথা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে
তিনি এরূপ করেছেন। উল্লেখ্য যে, সফরে কষ্ট স্বীকার করে কিছু লোক যে সিয়াম পালন করতেই
থাকে নিঃসন্দেহে তা সুন্নাহ্ বিরোধী কাজ। তার ব্যাপারেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, لَيْسَ
مِنَ
الْبِرِّ
الصَّوْمُ
فِي
السَّفَر
“সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোনো পূণ্যের কাজ নয়।”[3]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: মাগাযী, অনুচ্ছেদ:
রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
পাপের সফর না হলে রামাযান মাসে মুসাফিরের সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা উভয়টিই বৈধ।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
কঠিন গরমে যাকে ছাঁয়া দেওয়া হচ্ছিল তার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
বাণী: “সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।”; মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
পাপের সফর না হলে রামাযান মাসে মুসাফিরের সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা উভয়টিই বাধা।
প্রশ্ন: (১৩) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী কি সাওম ভঙ্গ করতে পারবে? ভঙ্গ
করলে কীভাবে কাযা আদায় করবে? নাকি সাওমের বিনিময়ে খাদ্য দান করবে?
উত্তর: দুগ্ধদানকারীনী সাওম রাখার কারণে যদি সন্তানের
জীবনের আশংকা করে অর্থাৎ সাওম রাখলে স্তনে দুধ কমে যাবে ফলে শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হবে,
তবে মায়ের সাওম ভঙ্গ করা জায়েয। কিন্তু পরবর্তীতে তার কাযা আদায় করে নিবে। কেননা এ
অবস্থায় সে অসুস্থ ব্যক্তির অনুরূপ। যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَن كَانَ
مَرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَۗ﴾
[البقرة:
١٨٥]
“আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে,
সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
অতএব, সাওম রাখার ব্যাপারে যখনই বাধা দূর হবে
তখনই কাযা আদায় করবে। চাই তা শীতকালে অপেক্ষাকৃত ছোট দিনে হোক অথবা সম্ভব না হলে পরবর্তী
বছর হোক। কিন্তু ফিদইয়াস্বরূপ মিসকীন খাওয়ানো জায়েয হবে না। তবে ওযর যদি চলমান থাকে
অর্থাৎ সার্বক্ষণিক সাওম রাখায় বাধা দেখা যায় যা বাধা দূর হওয়ার সম্ভবনা না থাকে, তখন
প্রতিটি সাওমের বদলে একজন করে মিসকীনকে খাওয়াবে।
প্রশ্ন: (১৪) ক্ষুধা-পিপাসা ও অতিরিক্ত ক্লান্তির সাথে সাওম পালন করলে
সাওমের বিশুদ্ধতায় কি কোনো প্রভাব পড়বে?
উত্তর: ক্ষুধা-পিপাসা ও অতিরিক্ত ক্লান্তির
সাথে সাওম পালন করলে সাওমের বিশুদ্ধতায় এর কোনো প্রভাব পড়বে না; বরং এতে অতিরিক্ত ছাওয়াব
পাওয়া যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু
‘আনহাকে বলেছিলেন, “তোমার ক্লান্তি ও কষ্ট অনুযায়ী তুমি ছাওয়াব পাবে।”[1] অতএব, আল্লাহর
আনুগত্যের ক্ষেত্রে মানুষের ক্লান্তি যত বেশি হবে ততই তার প্রতিদান বেশি হবে। তবে সাওমের
ক্লান্তি দূর করার জন্য মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢালা বা ঠাণ্ডা শীতল স্থানে আরাম গ্রহণ করা
যেতে পারে।
[1]
সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ওমরাহ্, অনুচ্ছেদ: ক্লান্তি অনুযায়ী উমরার সাওয়াব; সহীহ মুসলিম,
অধ্যায়: হজ, অনুচ্ছেদ: নিফাস বিশিষ্ট নারীদের ইহরাম করা।
প্রশ্ন: (১৫) রামাযানের প্রত্যেক দিনের জন্য আলাদা আলাদাভাবে কি নিয়ত
করা আবশ্যক? নাকি পূর্ণ মাসের নিয়ত একবার করে নিলেই হবে?
উত্তর: রামাযানের প্রথমে পূর্ণ মাসের জন্য
একবার নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। কেননা সাওম আদায়কারী যদি প্রতিদিনের জন্য রাতে নিয়ত না
করে, তবে তা রামাযানের প্রথমের নিয়তের শামিল হয়ে তার সিয়াম বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু
সফর, অসুস্থতা প্রভৃতি দ্বারা যদি মাসের মধ্যখানে বিচ্ছিন্নতা আসে, তবে নতুন করে আবার
নিয়ত আবশ্যক। কেননা মাসের প্রথমে সে যে সিয়ামের নিয়ত করেছিল তা সফর বা অসুস্থতা প্রভৃতির
মাধ্যমে ভঙ্গ করে ফেলেছে।
প্রশ্ন: (১৬) সাওম ভঙ্গের জন্য অন্তরে দৃঢ় নিয়ত করলেই কি সাওম ভঙ্গ
হয়ে যাবে?
উত্তর: একথা সর্বজন বিদিত যে, সিয়াম হচ্ছে নিয়ত
এবং পরিত্যাগের সমষ্টির নাম। অর্থাৎ সাওম বিনষ্টকারী যাবতীয় বস্তু পরিত্যাগ করে সাওম
আদায়কারী সাওমের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের নিয়ত করবে। কিন্তু সত্যিই
যদি এটাকে সে ভঙ্গ করার দৃঢ় সংকল্প করে ফেলে তবে তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। আর এটা
রামাযান মাসে হলে দিনের অবশিষ্ট অংশ তাকে পানাহার ছাড়াই কাটাতে হবে। কেননা বিনা ওযরে
যে ব্যক্তি রামাযানে সিয়াম ভঙ্গ করবে তাকে যেমন দিনের বাকী অংশ সিয়াম অবস্থাতেই কাটাতে
হবে, অনুরূপভাবে তার কাযাও আদায় করতে হবে।
কিন্তু যদি দৃঢ় সংকল্প না করে বরং দ্বিধা-দ্বন্দে
থাকে, তবে তার ব্যাপারে বিদ্বানদের মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেছেন, তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। কেননা
দ্বিধা-দ্বন্দ দৃঢ়তার বিপরীত।
কেউ বলেছেন, বাতিল হবে না। কেননা আসল হচ্ছে,
নিয়তের দৃঢ়তা অবশিষ্ট থাকা, যে পর্যন্ত তা আরেকটি দৃঢ়তা দ্বারা বিচ্ছিন্ন না করবে।
আমার দৃষ্টিতে এমতই বিশুদ্ধ। (আল্লাহই অধিক জ্ঞান রাখেন)
প্রশ্ন: (১৭) রোজাদার ভুলক্রমে পানাহার করলে তার সিয়ামের বিধান কী?
কেউ এটা দেখলে তার করণীয় কী?
উত্তর: রামাযানের সাওম রেখে কেউ যদি ভুলক্রমে
খানা-পিনা করে তবে তার সিয়াম বিশুদ্ধ। তবে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে বিরত হওয়া ওয়াজিব।
এমনকি খাদ্য বা পানীয় যদি মুখের মধ্যে থাকে এবং স্মরণ হয়, তবে তা ফেলে দেওয়া ওয়াজিব।
সিয়াম বিশুদ্ধ হওয়ার দলীল হচ্ছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
نَسِيَ
وَهُوَ
صَائِمٌ
فَأَكَلَ
أَوْ
شَرِبَ
فَلْيُتِمَّ
صَوْمَهُ
فَإِنَّمَا
أَطْعَمَهُ
اللَّهُ
وَسَقَاهُ»
“যে ব্যক্তি সাওম রেখে ভুলক্রমে পানাহার করে,
সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহ্ই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।”[1] তাছাড়া
ভুলক্রমে নিষিদ্ধ কাজ করে ফেললে তাকে পাকড়াও করা হবে না। আল্লাহ বলেন رَبَّنَا
لَا
تُؤَاخِذۡنَآ
إِن
نَّسِينَآ
أَوۡ
أَخۡطَأۡنَاۚ
“হে আমাদের রব আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোনো কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও
করবেন না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬] আল্লাহ বলেন, আমি তাই করলাম।
কেউ যদি দেখতে পায় যে ভুলক্রমে কোনো মানুষ
খানা-পিনা করছে, তবে তার ওপর ওয়াজিব হচ্ছে, তাকে বাঁধা দেওয়া এবং সিয়ামের কথা স্মরণ
করিয়ে দেওয়া। কেননা তা গর্হিত কাজে বাধা দেওয়ার অন্তর্গত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
رَأَى
مِنْكُمْ
مُنْكَرًا
فَلْيُغَيِّرْهُ
بِيَدِهِ
فَإِنْ
لَمْ
يَسْتَطِعْ
فَبِلِسَانِهِ
فَإِنْ
لَمْ
يَسْتَطِعْ
فَبِقَلْبِهِ
وَذَلِكَ
أَضْعَفُ
الْإِيمَانِ»
“যে ব্যক্তি কোনো গর্হিত কাজ হতে দেখবে, সে
যেন হাত দ্বারা বাধা প্রদান করে, যদি সম্ভব না হয় তবে যবান দ্বারা বাধা দিবে, যদি তাও
সম্ভব না হয় তবে অন্তর দ্বারা তা ঘৃণা করবে।”[2] সন্দেহ নেই সাওম রেখে খানা-পিনা করা
একটি গর্হিত কাজ। কিন্তু ভুল ক্রমে হওয়ার কারণে তাকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি
তা দেখবে তার জন্য তাতে বাধা না দেওয়ার কোনো ওযর থাকতে পারে না।
[1]
সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ভুলক্রমে পানাহার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়:
সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ভুলক্রমে পানাহার করলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ:
গর্হিত কাজে বাধা দেওয়া ঈমানের অন্তর্ভূক্ত।
প্রশ্ন: (১৮) সাওম রেখে সুরমা ব্যবহার করার বিধান কী?
উত্তর: সাওম আদায়কারীর জন্য সুরমা ব্যবহার করায়
কোনো অসুবিধা নেই। অনুরূপভাবে চোখে বা কানে ঔষুধ (ড্রপ) ব্যবহার করতেও কোনো অসুবিধা
নেই, যদিও এতে গলায় ড্রপের স্বাদ অনুভব করে। এতে সাওম ভঙ্গ হবে না। কেননা ইহা খাদ্য
বা পানীয় নয় বা খানা-পিনার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত নয়। একথার দলীল হচ্ছে, সিয়ামের ক্ষেত্রে
যে নিষেধাজ্ঞা তা হচ্ছে খানা-পিনা করা। সুতরাং যা খানা-পিনার অন্তর্ভুক্ত নয় তা এ নিষেধাজ্ঞার
মধ্যে গণ্য হবে না। ইমাম ইবন তাইমিয়া রহ. একথাই বলেছেন। আর এটাই বিশুদ্ধ মত। কিন্তু
যদি নাকে ড্রপ ব্যবহার করে এবং তা পেটে পৌঁছে, তবে সাওম ভঙ্গ হবে- যদি সাওম ভঙ্গের
উদ্দেশ্য করে থাকে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَبَالِغْ
فِي
الِاسْتِنْشَاقِ
إِلَّا
أَنْ
تَكُونَ
صَائِمًا»
“সিয়াম অবস্থায় না থাকলে অযুর ক্ষেত্রে নাকে
অতিরিক্ত পানি নিবে।”[1]
[1] আবু দাঊদ, অধ্যায়: নাক ঝাড়া, ১৪২; তিরমিযী,
অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: আঙ্গুল খিলাল করার বর্ণনা; নাসাঈ, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ:
নাকে পানি নেওয়ায় বাড়াবাড়ি করা; ইবন মাজাহ, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: আঙ্গুল খিলাল
করার বর্ণনা।
প্রশ্ন: (১৯) সাওম অবস্থায় মিসওয়াক ও সুগন্ধি ব্যবহার করার বিধান কী?
উত্তর: বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে দিনের প্রথম ভাগে যেমন
শেষ ভাগেও তেমন মেসওয়াক করা সুন্নাত। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«السِّوَاكُ
مَطْهَرَةٌ
لِلْفَمِ
ومَرْضَاةٌ
لِلرَّبِّ»
“মিসওয়াক হচ্ছে মুখের পবিত্রতা ও প্রভুর সন্তুষ্টি
অর্জনের মাধ্যম।”[1] তিনি আরো বলেন,
«لَوْلا
أَنْ
أَشُقَّ
عَلَى
أُمَّتِي
أَوْ
عَلَى
النَّاسِ
لأَمَرْتُهُمْ
بِالسِّوَاكِ
مَعَ
كُلِّ
صَلاةٍ
»
“আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করলে আমি
প্রত্যেক সালাতের সময় তাদেরকে মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।”[2] অনুরূপভাবে আতর-সুগন্ধি
ব্যবহার করাও সাওম আদায়কারীর জন্য জায়েয। চাই তা দিনের প্রথম ভাগে হোক বা শেষ ভাগে।
চাই উক্ত সুগন্ধি ভাপ হোক বা তৈল জাতীয় বা সেন্ট প্রভৃতি হোক। তবে ভাপের সুগন্ধি নাকে
টেনে নেওয়া জায়েয নয়। কেননা ধোঁয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ ও অনুভবযোগ্য কিছু অংশ আছে যা নাক
দ্বারা গ্রহণ করলে নাকের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে পেটে পৌঁছায়।[3] এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাক্বীত ইবন সাবুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেছেন, بَالِغْ
فِي
الاسْتِنْشَاقِ
إِلاَّ
أَنْ
تَكُونَ
صَائِمًا
“সিয়াম অবস্থায় না থাকলে অযুর ক্ষেত্রে নাকে অতিরিক্ত পানি নিবে।”[4]
[1]
বুখারী মুআল্লাক সনদে, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সিয়ামদারের কাঁচা ও শুকনা মিসওয়াক
ব্যবহার করা।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সিয়ামদারের কাঁচা ও শুকনা মিসওয়াক ব্যবহার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ:
মিসওয়াক করা।
[3] ধুমপানের ক্ষেত্রে যেহেতু ধুঁয়াটাই নাকের
মধ্যে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে এজন্য তা দ্বারা সিয়াম ভঙ্গ হবে। অবশ্য ধুমপান মূলতঃ হারাম
কাজ। যা থেকে বেঁচে থাকা মুসলিম তো অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।
[4] আবু দাঊদ, অধ্যায়: নাক ঝাড়া, ১৪২। তিরমিযী,
অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: আঙ্গুল খিলাল করার বর্ণনা।
প্রশ্ন: (২০) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় কী কী?
উত্তর: সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়গুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ
ক) স্ত্রী সহবাস।
খ) খাদ্য গ্রহণ।
গ) পানীয় গ্রহণ।
ঘ) উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করা।
ঙ) খানা-পিনার অন্তর্ভুক্ত এমন কিছু গ্রহণ
করা। যেমন সেলাইন ইত্যাদি।
চ) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা।
ছ) শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করা।
জ) হায়েয বা নেফাসের রক্ত প্রবাহিত হওয়া।
উল্লিখিত বিষয়গুলোর দলীল নিম্নরূপঃ
সহবাস ও খান-পিনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ
وَٱبۡتَغُواْ
مَا
كَتَبَ
ٱللَّهُ
لَكُمۡۚ
وَكُلُواْ
وَٱشۡرَبُواْ
حَتَّىٰ
يَتَبَيَّنَ
لَكُمُ
ٱلۡخَيۡطُ
ٱلۡأَبۡيَضُ
مِنَ
ٱلۡخَيۡطِ
ٱلۡأَسۡوَدِ
مِنَ
ٱلۡفَجۡرِۖ
ثُمَّ
أَتِمُّواْ
ٱلصِّيَامَ
إِلَى
ٱلَّيۡلِۚ﴾
[البقرة:
١٨٧]
“অতএব, এক্ষণে তোমরা (সিয়ামের রাত্রেও) তাদের
সাথে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর এবং
প্রত্যুষে (রাতের) কাল রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও
ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা সাওম পূর্ণ কর।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত:
১৮৭]
উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত সাওম ভঙ্গের কারণ।
দলীল, হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা সাওম আদায়কারীর উদ্দেশ্যে বলেন, “সে খানা-পিনা
ও উত্তেজনা পরিত্যাগ করে আমারই কারণে।”[1] উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করার ক্ষেত্রে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَفِي
بُضْعِ
أَحَدِكُمْ
صَدَقَةٌ
قَالُوا
يَا
رَسُولَ
اللَّهِ
أَيَأتِي
أَحَدُنَا
شَهْوَتَهُ
وَيَكُونُ
لَهُ
فِيهَا
أَجْرٌ
قَالَ
أَرَأَيْتُمْ
لَوْ
وَضَعَهَا
فِي
حَرَامٍ
أَكَانَ
عَلَيْهِ
فِيهَا
وِزْرٌ
فَكَذَلِكَ
إِذَا
وَضَعَهَا
فِي
الْحَلَالِ
كَانَ
لَهُ
أَجْرًا»
“স্ত্রী সঙ্গমেও তোমাদের জন্য সাদকার সাওয়াব
রয়েছে। সাহাবীগণ (আশ্চর্য হয়ে) জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের একজন তার উত্তেজনার
চাহিদা মেটাবে, আর এতে সাওয়াবের হকদার হবে এটা কেমন কথা? তিনি জবাবে বললেন, তোমরা কি
মনে কর, সে যদি এ কাজ কোনো হারাম স্থানে করত তবে পাপের অধিকারী হত না? তেমনি হালাল
স্থানে ব্যবহার করার কারণে অবশ্যই সে পুরস্কারের অধিকারী হবে।”[2] আর উত্তেজনার চাহিদা
মেটানোর মাধ্যম হচ্ছে স্ববেগে বীর্য নির্গত হওয়া। এজন্য বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, মযী[3] বের
হলে সিয়াম বিনষ্ট হবে না, যদিও তা উত্তেজনা, চুম্বন ও স্পর্শ করার কারণে হয়।
খানা-পিনার অন্তর্ভুক্ত এমন কিছু গ্রহণ করা
সাওম ভঙ্গের কারণ। যেমন, খানা-পিনার অভাব পূর্ণ করবে এরকম সেলাইন গ্রহণ করা। কেননা
ইহা যদিও সরাসরি খানা-পিনা নয় কিন্তু ইহা খানা-পিনার কাজ করে এবং তার প্রয়োজন মেটায়।
একারণেই তো ইহা দ্বারা শরীরের গঠন প্রকৃতি ঠিক থাকে, খানা-পিনার অভাব অনুভব করে না।
কিন্তু খানা-পিনার কাজ করে না এরকম ইন্জেকশন
গ্রহণ করলে সাওম ভঙ্গ হবে না। চাই উহা শিরার মধ্যে প্রদান করা হোক বা পেশীতে বা শরীরের
যে কোনো স্থানে।
ইচ্ছাকৃত বমি করা। অর্থাৎ বমির মাধ্যমে পেটের
মধ্যে যা আছে তা মুখ দিয়ে বাইরে বের করা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
ذَرَعَهُ
الْقَيْءُ
فَلَيْسَ
عَلَيْهِ
قَضَاءٌ
وَمَنِ
اسْتَقَاءَ
عَمْدًا
فَلْيَقْضِ»
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে সে যেন
সাওম কাযা আদায় করে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত যার বমি হয় তার কোনো কাযা নেই।”[4] এর কারণ
হচ্ছে, মানুষ বমি করলে তার পেট খাদ্যশুন্য হয়ে যায়। তখন তার এ শুন্যতা পূরণের প্রয়োজন
পড়ে। এ কারণে আমরা বলব, সিয়াম ফরয হলে কোনো মানুষের বমি করা জায়েয নয়। কেননা বমি করলে
তার ফরয সিয়াম বিনষ্ট হয়ে যাবে। তবে অসুস্থতার কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে সাওম নষ্ট
হবে না।
শিঙ্গা লাগানো। অর্থাৎ শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে
শরীর থেকে রক্ত বের করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أَفْطَرَ
الْحَاجِمُ
وَالْمَحْجُومُ
“যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের সাওম ভঙ্গ হয়ে যাবে।”[5]
হায়েয বা নিফাসের রক্ত প্রবাহিত হওয়া। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের সম্পর্কে বলেন, أَلَيْسَ
إِذَا
حَاضَتْ
لَمْ
تُصَلِّ
وَلَمْ
تَصُمْ
“সে কি এমন নয় যে, ঋতুবতী হলে সালাত পড়ে না ও সাওমও রাখে না?”[6]
উল্লিখিত বিষয়গুলো নিম্নলিখিত তিনটি শর্তের
ভিত্তিতে সাওম ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য হবে”
১. জ্ঞান থাকা।
২. স্মরণ থাকা।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে করা।
প্রথম শর্ত: জ্ঞান থাকা। অর্থাৎ উক্ত বিষয়ে
লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অথবা সিয়ামের জন্য যে সময়
নির্দিষ্ট সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা।
যদি শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে তবে
তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা আল্লাহ বলেন, رَبَّنَا
لَا
تُؤَاخِذنَآ
إِن
نَّسِينَآ
أَو
أَخطَأنَا “হে আমাদের রব আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোনো
কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও করবেন না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬] আল্লাহ
বলেন, আমি তাই করলাম। আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَلَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ
جُنَاحٞ
فِيمَآ
أَخۡطَأۡتُم
بِهِۦ
وَلَٰكِن
مَّا
تَعَمَّدَتۡ
قُلُوبُكُمۡۚ﴾
[الاحزاب:
٥]
“ভুলক্রমে তোমরা যা করে ফেল সে সম্পর্কে তোমাদের
কোনো গুনাহ্ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তর যার ইচ্ছা করে তার কথা ভিন্ন।” [সূরা আল-আহযাব,
আয়াত: ৫]
সুন্নাহ থেকে সিয়ামের ক্ষেত্রে বিশেষ দলীল
হচ্ছে, সহীহ হাদীসে আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি সাওম রাখার
উদ্দেশ্যে শেষ রাতে উট বাঁধার দু‘টো রশী বালিশের নীচে রেখে দিলেন। একটি কালো রঙের অন্যটির
রং সাদা। এরপর খানা-পিনা করতে থাকলেন। যখন স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সাদা ও কালো রশী চিনতে
পারলেন তখন খানা-পিনা বন্ধ করলেন। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে
গিয়ে বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি তাকে বললেন, কুরআনের আয়াতে সাদা ও কালো সুতা বলতে আমাদের
পরিচিত সূতা বা রশী উদ্দেশ্য নয়। এ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাদা সুতা বলতে দিনের শুভ্রতা
(সুবহে সাদেক বা ফজর হওয়া) আর কালো সূতা বলতে রাতের অন্ধকার উদ্দেশ্য। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সিয়াম কাযা আদায় করার আদেশ করেন নি।[7] কেননা বিষয়টি সম্পর্কে
তিনি ছিলেন অজ্ঞ। ভেবেছিলেন এটাই আয়াতের অর্থ।
আর সিয়ামের জন্য যে সময় নির্দিষ্ট সে সম্পর্কে
অজ্ঞ থাকলেও তার সিয়াম বিশুদ্ধ। দলীল: সহীহ বুখারীতে আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে ইফতার করে নিয়েছিলাম। তার কিছুক্ষণ পর আবার সূর্য দেখা
গিয়েছিল।” কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে উক্ত সিয়ামের কাযা আদায়
করার আদেশ করেন নি। কেননা কাযা আদায় করা ওয়াজিব হলে তিনি অবশ্যই সে আদেশ প্রদান করতেন।
আর সে আদেশ থাকলে আমাদের কাছেও তার বর্ণনা পৌঁছতো। কেননা আল্লাহ বলেন, إِنَّا
نَحۡنُ
نَزَّلۡنَا
ٱلذِّكۡرَ
وَإِنَّا
لَهُۥ
لَحَٰفِظُونَ
“নিশ্চয় আমি যিকির অবতীর্ণ করেছি আর আমিই তার সংরক্ষণকারী।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
অতএব, প্রয়োজন থাকা সত্বেও যখন এক্ষেত্রে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না, তাই বুঝা যায় যে,
তিনি তাদেরকে এর কাযা আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন নি। অতএব, অজ্ঞতাবশতঃ দিন থাকতেই
পানাহার করে ফেললে তার কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়। জানার সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত
থাকবে এবং দিনের বাকী অংশ সিয়াম অবস্থায় অতিবাহিত করবে।
অনুরূপভাবে কোনো লোক যদি খানা-পিনা করে এ ভেবে
যে এখনও রাত আছে- ফজর হয় নি। কিন্তু পরে জানলো যে সে ফজর হওয়ার পরই পানাহার করেছে,
তবে তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে। তাকে কাযা আদায় করতে হবে না। কেননা সে ছিল অজ্ঞ।
দ্বিতীয় শর্ত: স্মরণ থাকা। অর্থাৎ সে যে সাওম
রেখেছে একথা ভুলে না যাওয়া। অতএব, সাওম রেখে ভুলক্রমে কোনো মানুষ যদি খানা-পিনা করে
ফেলে, তবে তার সিয়াম বিশুদ্ধ এবং তাকে কাযা আদায় করতে হবে না। কেননা আল্লাহ বলেন, رَبَّنَا
لَا
تُؤَاخِذۡنَآ
إِن
نَّسِينَآ
أَوۡ
أَخۡطَأۡنَاۚ
“হে আমাদের রব আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোনো কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও
করবেন না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬] আল্লাহ বলেন, আমি তাই করলাম। আবু হুরায়রা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
نَسِيَ
وَهُوَ
صَائِمٌ
فَأَكَلَ
أَوْ
شَرِبَ
فَلْيُتِمَّ
صَوْمَهُ
فَإِنَّمَا
أَطْعَمَهُ
اللَّهُ
وَسَقَاهُ»
“যে ব্যক্তি সাওম রেখে ভুলক্রমে পানাহার করে,
সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।”[8]
তৃতীয় শর্ত: ইচ্ছাকৃত করা। অর্থাৎ সাওম আদায়কারী
নিজ ইচ্ছায় উক্ত সাওম ভঙ্গের কাজে লিপ্ত হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলে তার সিয়াম বিশুদ্ধ
হবে চাই তাকে জোর জবরদস্তী করা হোক বা না হোক। কেননা বাধ্য করে কুফুরীকারীকে আল্লাহ
বলেন,
﴿مَن كَفَرَ
بِٱللَّهِ
مِنۢ
بَعۡدِ
إِيمَٰنِهِۦٓ
إِلَّا
مَنۡ
أُكۡرِهَ
وَقَلۡبُهُۥ
مُطۡمَئِنُّۢ
بِٱلۡإِيمَٰنِ
وَلَٰكِن
مَّن
شَرَحَ
بِٱلۡكُفۡرِ
صَدۡرٗا
فَعَلَيۡهِمۡ
غَضَبٞ
مِّنَ
ٱللَّهِ
وَلَهُمۡ
عَذَابٌ
عَظِيمٞ﴾
[النحل:
١٠٦]
“যার ওপর জবরদস্তী করা হয়েছে এবং তার অন্তর
বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফুরীর
জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় তাদের ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।”
[সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ১০৬] বাধ্য অবস্থায় কুফুরীতে লিপ্ত হওয়ার পাপ যদি ক্ষমা করা
হয়, তবে তার নিম্ন পর্যায়ের পাপে বাধ্য হয়ে লিপ্ত হলে ক্ষমা হওয়াটা অধিক যুক্তিযুক্ত।
তাছাড়া হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন,
«إِنَّ
اللَّهَ
وَضَعَ
عَنْ
أُمَّتِي
الْخَطَأَ
وَالنِّسْيَانَ
وَمَا
اسْتُكْرِهُوا
عَلَيْهِ»
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতের ভুল ক্রমে
করে ফেলা এবং আবশ্যিক বিষয় করতে ভুলে যাওয়া ও বাধ্য অবস্থায় করে ফেলা পাপ ক্ষমা করে
দিয়েছেন।”[9]
এ ভিত্তিতে কারো নাকে যদি ধুলা ঢুকে পড়ে এবং
তার স্বাদ গলায় পৌঁছে ও পেটের ভিতর প্রবেশ করে, তবে তার সাওম ভঙ্গ হবে না। কেননা সে
এটার ইচ্ছা করে নি।
অনুরূপভাবে কাউকে যদি সাওম ভঙ্গ করতে জবরদস্তি
করা হয় আর সে বাধ্য হয়ে সাওম ভঙ্গ করে ফেলে, তবে তার সিয়াম বিশুদ্ধ। কেননা সে অনিচ্ছাকৃতভাবে
একাজ করেছে।
এমনিভাবে ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নদোষ হলে, তার
সিয়ামও বিশুদ্ধ। কেননা সে ছিল ঘুমন্ত, ইচ্ছাও ছিল না তার একাজে। কোনো ব্যক্তি যদি স্ত্রীকে
তার সাথে সহবাস করতে বাধ্য করে এবং স্ত্রী বাধ্যগত হয়ে সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে তার (স্ত্রীর)
সিয়াম বিশুদ্ধ। কেননা একাজে তার কোনো এখতিয়ার ছিল না।
একটি মাসআলা: খুবই সতর্ক থাকা উচিৎ। কোনো মানুষ
যদি রামাযানে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে নিম্নলিখিত পাঁচটি বিধান তার
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেঃ
১. সে গুনাহগার হবে।
২.
দিনের বাকী অংশ তাকে সিয়াম অবস্থায় কাটাতে হবে।
৩. তার উক্ত সিয়াম বিনষ্ট হবে।
৪. তাকে কাযা আদায় করতে হবে।
৫. কাফ্ফারা আদায় করতে হবে।
সহবাসে লিপ্ত হলে কি ধরণের কাফফারা দিতে হবে
এ সম্পর্কে জানা থাক বা না জানা থাক কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি রামাযানের
দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলো (সাওমও তার ওপর ফরয)[10] কিন্তু তার এ জ্ঞান নেই
যে, একাজ করলে তাকে এত কাফফারা দিতে হবে, তবুও তার ওপর উল্লিখিত বিধানসমূহ প্রযোজ্য
হবে। কেননা সে ইচ্ছাকৃতভাবে সাওম ভঙ্গ করেছে। আর ইচ্ছাকৃতভাবে সাওম ভঙ্গের কাজে লিপ্ত
হলে, তার ওপর যাবতীয় বিধান প্রযোজ্য হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত।
জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল!
আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, “কিসে তোমাকে ধ্বংস করল?” সে বলল, রামাযানের সাওম
রেখে আমি স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাফফারা
আদায় করার আদেশ করলেন।[11] অথচ লোকটি জানতো না যে তাকে কাফফারা দিতে হবে কি হবে না।
আমরা বলেছি, তার ওপর সাওম ফরয। অর্থাৎ সে মুসাফির
নয় নিজ গৃহে মুক্বীম হিসেবে অবস্থান করছে। যদি সফরে থেকে কোনো ব্যক্তি সাওম ভঙ্গ করে
এবং স্ত্রী সহবাস করে তবে কাফফারা দিতে হবে না। কেননা সফর অবস্থায় সাওম রাখা ফরয নয়।
সাওম ভঙ্গ করা ও রাখার ব্যাপারে সে স্বাধীন। তবে ভঙ্গ করলে পরে কাযা আদায় করতে হবে।
[1]
ইবন মাজাহ, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ছিয়ামের ফযীলত।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ:
প্রত্যেক সৎকাজকে সাদকা বলা হয় তার বর্ণনা।
[3] মযী, স্ত্রী শৃঙ্গার করার কারণে বা যে
কোনোভাবে উত্তেজিত হলে লিঙ্গের আগায় যে আঠালো পানি বের হয় তাকে আরবীতে মযী বলা হয়।
এতে অযু আবশ্যক হয় গোসল নয়।
[4] আবু দাঊদ, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ইচ্ছাকৃত
বমি করা। তিরমিযী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করার বর্ণনা।
[5] বুখারী সনদ বিহীন মুআল্লাক বর্ণনা করেন।
অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সিয়ামদারের শিঙ্গা লাগানো ও বমি করা। তিরমিযী, অধ্যায়: সিয়াম,
অনুচ্ছেদ: সিয়ামদারের শিঙ্গা লাগানো ঠিক না।
[6] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: হায়েয, অনুচ্ছেদ:
ঋতুবতীর সিয়াম পালন না করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান, অনুচ্ছেদ: নেক কাজ কম হলে ঈমানও
কমে যায়।
[7] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
আল্লাহর বাণী, ‘প্রত্যুষে (রাতের) কালো রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত
তোমরা খাও ও পান কর।’; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলেই সিয়াম
শুরু হয়ে যাবে।
[8] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
ভুলক্রমে পানাহার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ভুলক্রমে পানাহার করলে
সিয়াম ভঙ্গ হবে না।
[9] ইবন মাজাহ, অধ্যায়: তালাক, অনুচ্ছেদ: ভুল
ক্রমে এবং বাধ্য করে তালাক।
[10] অর্থাৎ- সিয়াম ভঙ্গের বৈধ কোন কারণ তার
সামনে নেই। যেমন সে সফরেও নয়, অসুস্থও নয়।
[11]সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
রামাযানে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করলে; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সিয়ামদারের
রামাযানের দিনে স্ত্রী সহবাস কঠোরভাবে হারাম।
প্রশ্ন: (২১) সাওম অবস্থায় শ্বাসকষ্টের কারণে স্প্রে (nabulijer) ব্যবহার
করার বিধান কী? এ দ্বারা কি সিয়াম ভঙ্গ হবে?
উত্তর: এ স্প্রে নাকে প্রবেশ করে কিন্তু পেট
পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই সাওম রেখে ইহা ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধা নেই। এতে সাওম ভঙ্গও
হবে না। কেননা এটা এমন বস্তু যা উড়ে বেড়ায় নাকে প্রবেশ করে এবং বিলীন হয়ে যায়, এর অংশ
বিশেষ পেটের মধ্যে প্রবেশ করে না। তাই এদ্বারা সিয়াম ভঙ্গ হবে না।
প্রশ্ন: (২২) বমি করলে কি সাওম ভঙ্গ হবে?
উত্তর: কোনো লোক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে তবে
তার সাওম ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে সাওম ভঙ্গ হবেনা। আবু হুরায়রা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
«مَنْ
ذَرَعَهُ
الْقَيْءُ
فَلَيْسَ
عَلَيْهِ
قَضَاءٌ
وَمَنِ
اسْتَقَاءَ
عَمْدًا
فَلْيَقْضِ»
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করবে সে যেন সাওম
কাযা আদায় করে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত যার বমি হয় তার কোনো কাযা নেই।”[1]
কিন্তু বমি যদি আপনাকে পরাজিত করে ফেলে- বমি
বের হয়েই যায়, তবে সাওম ভঙ্গ হবেনা। মানুষ যদি পেটের মধ্যে খিচুনী অনুভব করে, মনে হয়
যেন ভিতর থেকে সব কিছু বের হয়ে আসবে, তখন তাতে বাধা দিবে না। সাধারণভাবে থাকার চেষ্টা
করবে। ইচ্ছা করে কোনো কিছু বের করার চেষ্টা করবে না। নিজে নিজে বের হয়ে আসলে কোনো ক্ষতি
হবে না এবং সাওমও নষ্ট হবে না।
[1] আবু দাঊদ, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ইচ্ছাকৃতভাবে
বমি করা; তিরমিযী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করার বর্ণনা।
প্রশ্ন: (২৩) সাওম আদায়কারীর দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে কি সাওম
নষ্ট হবে?
উত্তর: দাঁত থেকে রক্ত প্রবাহিত হলে সাওমের
ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সাধ্যানুযায়ী রক্ত গিলে নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
অনুরূপভাবে নাক থেকে রক্ত বের হলেও সাওম নষ্ট হবে না। কিন্তু রক্ত ভিতরে যাওয়া থেকে
সতর্ক থাকবে। নাক বা দাঁত থেকে রক্ত বের হওয়া সাওম ভঙ্গের কারণ নয়। অতএব, কাযা আদায়
করার প্রশ্নই উঠে না।
প্রশ্ন: (২৪) ঋতুবতী যদি ফজরের পূর্বে পবিত্র হয় এবং ফজর হওয়ার পর গোসল
করে, তবে তার সাওমের বিধান কী?
উত্তর: ফজরের পূর্বে পবিত্র হয়েছে এব্যাপারে
নিশ্চিত হলে, তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা নারীদের মধ্যে অনেকে এমন আছে, ধারণা করে
যে পবিত্র হয়ে গেছে অথচ সে আসলে পবিত্র হয় নি। এ কারণে নারীরা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু
‘আনহার কাছে আসতেন তাদের লজ্জাস্থানে তুলা লাগিয়ে উক্ত তুলার চিহ্ন দেখানোর জন্য যে,
তারা কি পবিত্র হয়েছেন? তখন তিনি বলতেন, لَا
تَعْجَلْنَ
حَتَّى
تَرَيْنَ
الْقَصَّةَ
الْبَيْضَاء
‘তোমরা তাড়াহুড়া করবে না যতক্ষণ না তোমরা ‘কাছ্ছা বাইযা’ (বা সাদা পানি) না দেখ।’ অতএব,
নারী অবশ্যই ধীরস্থীরতার সাথে লক্ষ্য করবে এবং নিশ্চিত হবে পূর্ণরূপে পবিত্র হয়েছে
কিনা। যদি পবিত্র হয়ে যায় তবে সিয়ামের নিয়ত করে নিবে। ফজর হওয়ার পর গোসল করবে কোনো
অসুবিধা নেই। কিন্তু সালাতের দিকে লক্ষ্য রেখে দ্রুত গোসল সেরে নেওয়ার চেষ্টা করবে,
যাতে করে সময়ের মধ্যেই ফজর সালাত আদায় সম্ভব হয়।
আমরা শুনতে পাই অনেক নারী ফজরের পূর্বে বা
পরে ঋতু থেকে পবিত্র হয়, কিন্তু তারা গোসল করতে দেরী করে সালাতের সময় পার করে দেয়।
পরিপূর্ণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার যুক্তিতে সূর্য উঠার পর গোসল করে। কিন্তু এটা মারাত্মক
ধরণের ভুল। চাই তা রামাযান মাসে হোক বা অন্য মাসে। কেননা তার ওপর ওয়াজিব হচ্ছে সময়মত
সালাত আদায় করার জন্য দ্রুত গোসল সেরে নেওয়া। সালাতের স্বার্থে গোসলের ওয়াজিব কাজগুলো
সারলেই যথেষ্ট হবে। তারপর দিনের বেলায় আবারো যদি পরিপূর্ণরূপে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতার
জন্য গোসল করে, তবে কি অসুবিধা আছে? ঋতুবতী নারীর মতো অন্যান্য নাপাক ব্যক্তিগণ (যেমন,
স্ত্রী সহবাস বা স্বপ্নদোষের কারণে নাপাক) নাপাক অবস্থাতেই সিয়ামের নিয়ত করতে পারবে
এবং ফজর হওয়ার পর গোসল করে সালাত আদায় করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
কখনো কখনো স্ত্রী সহবাসের কারণে নাপাক অবস্থাতেই সিয়ামের নিয়ত করতেন এবং ফজর হওয়ার
পর সালাতের আগে গোসল করতেন।[1] (আল্লাহই অধিক জ্ঞান রাখেন।)
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সিয়ামদারের গোসল করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: নাপাক অবস্থায় ফজর হয়ে
গেলেও সিয়াম বিশুদ্ধ হবে।
প্রশ্ন: (২৫) সাওম অবস্থায় দাঁত উঠানোর বিধান কী?
উত্তর: সাধারণ দাঁত বা মাড়ির দাঁত উঠানোতে যে
রক্ত প্রবাহিত হয়, তাতে সাওম ভঙ্গ হবে না। কেননা এতে শিঙ্গা লাগানোর মত প্রভাব পড়ে
না। তাই সাওমও ভঙ্গ হবে না।
প্রশ্ন: (২৬) সাওম রেখে রক্ত পরীক্ষা (Blood test) করার জন্য রক্ত প্রদান
করার বিধান কী? এতে কি সাওম নষ্ট হবে।
উত্তর: ব্লাড টেষ্ট করার জন্য রক্ত বের করলে সাওম
ভঙ্গ হবে না। কেননা ডাক্তার অসুস্থ ব্যক্তির চেক আপ করার জন্য রক্ত নেওয়ার নির্দেশ
দিতে পারে। কিন্তু এ রক্ত নেওয়া অল্প হওয়ার কারণে শিঙ্গা লাগানোর মতো এর কোনো প্রভাব
শরীরে দেখা যায় না, তাই এতে সাওম ভঙ্গ হবেনা। আসল হচ্ছে সিয়াম ভঙ্গ না হওয়া- যতক্ষণ
পর্যন্ত সাওম ভঙ্গের জন্য শরী‘আতসম্মত দলীল না পাওয়া যাবে। আর সামান্য রক্ত বের হলে
সাওম ভঙ্গ হবে এখানে এমন কোনো দলীল পাওয়া যায় না।
কিন্তু রোগীর শরীরে রক্ত প্রবেশ করার জন্য
বেশি পরিমাণে রক্ত প্রদান করা সাওম ভঙ্গের অন্যতম কারণ। কেননা এর মাধ্যমে শিঙ্গা লাগানোর
মত শরীরে প্রভাব পড়ে। অতএব, সিয়াম যদি ওয়াজিব হয়, তবে এভাবে বেশি পরিমাণে রক্ত দান
করা জায়েয নয়। তবে রোগীর অবস্থা যদি আশংকাজনক হয়, মাগরিব পর্যন্ত অপেক্ষা করলে তার
প্রাণ নাশের সম্ভাবনা থাকে এবং ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত যে, এ সাওম আদায়কারীর রক্তই শুধু
রোগীর উপকারে আসবে ও তার প্রাণ বাঁচানো সম্ভবপর হতে পারে, তবে এ অবস্থায় রক্ত দান করতে
কোনো অসুবিধা নেই। রক্ত দানের মাধ্যমে সাওম ভঙ্গ করে পানাহার করবে। অতঃপর এ সাওমের
কাযা আদায় করবে। (আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞান রাখেন।)
প্রশ্ন: (২৬) সাওম আদায়কারী হস্ত মৈথুন করলে কি সাওম ভঙ্গ হবে? তাকে
কি কোনো কাফফারা দিতে হবে?
উত্তর: সাওম আদায়কারী হস্ত মৈথুন করে যদি বীর্যপাত
করে তবে তার সাওম ভঙ্গ হয়ে যাবে। দিনের বাকী অংশ তাকে সিয়াম অবস্থায় কাটাতে হবে। এ
অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে এবং উক্ত দিনের সাওম কাযা আদায় করতে হবে।
কিন্তু কাফফারা আবশ্যক হবে না। কেননা কাফফারা শুধুমাত্র সহবাসের মাধ্যমে সাওম ভঙ্গ
করলে আবশ্যক হবে।
প্রশ্ন: (২৭) সাওম আদায়কারীর জন্য আতর-সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়ার বিধান
কী?
উত্তর: সাওম আদায়কারীর আতর-সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতে
কোনো অসুবিধা নেই। চাই তৈল জাতীয় হোক বা ধোঁয়া জাতীয়। তবে ধোঁয়ার সুঘ্রাণ নাকের কাছে
নিয়ে শুঁকবে না। কেননা এতে একজাতীয় পদার্থ আছে যা পেট পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন সাওম ভঙ্গ
হয়ে যাবে। যেমন পানি বা তদানুরূপ বস্তু। কিন্তু সাধারণ ভাবে তার সুঘ্রাণ নাকে ঢুকলে
কোনো অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: (২৮) নাকে ধোঁয়া টানা এবং চোখে বা নাকে ড্রপ দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য
কী?
উত্তর: উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, নাকে ভাপের
ধোঁয়া টানা নিজ ইচ্ছায় হয়ে থাকে। যাতে করে ধোঁয়ার কিছু অংশ পেটে প্রবেশ করে, তাই এতে
সাওম ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু ড্রপ ব্যবহার করে তা পেটে পৌঁছানোর ইচ্ছা করা হয় না; বরং
এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে নাকে বা চোখে শুধু ড্রপ ব্যবহার করা।
প্রশ্ন: (২৯) সাওম আদায়কারীর নাকে, কানে ও চোখে ড্রপ ব্যবহার করার বিধান
কী?
উত্তর: নাকের ড্রপ যদি নাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে তবে সাওম
ভঙ্গ হয়ে যাবে। কেননা লাক্বীত ইবন সাবুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেন, وَبَالِغْ
فِي
الِاسْتِنْشَاقِ
إِلَّا
أَنْ
تَكُونَ
صَائِمًا
“সিয়াম অবস্থায় না থাকলে অযুর ক্ষেত্রে নাকে অতিরিক্ত পানি নিবে।”[1] অতএব, পেটে পৌঁছে
এরকম করে সাওম আদায়কারীর নাকে ড্রপ ব্যবহার করা জায়েয নয়। কিন্তু পেটে না পৌঁছলে কোনো
অসুবিধা নেই।
চোখে ড্রপ ব্যবহার করা সুরমা ব্যবহার করার
ন্যায়। এতে সাওম নষ্ট হবে না। অনুরূপভাবে কানে ড্রপ ব্যবহারেও সাওম বিনষ্ট হবে না।
কেননা এসব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কোনো দলীল নেই এবং যে সব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা এসেছে
এগুলো তারও অন্তর্ভুক্ত নয়। চোখ বা কান দ্বারা পানাহার করা যায় না। এগুলো শরীরের অন্যান্য
চামড়ার লোম কুপের মতো।
বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন, কোনো লোকের পায়ের
তলায় যদি তরল কোনো পদার্থ লাগানো হয় এবং এর স্বাদ গলায় অনুভব করে, তবে সাওমের কোনো
ক্ষতি হবে না। কেননা উহা খানা-পিনা গ্রহণের স্থান নয়। অতএব, সুরমা ব্যবহার করলে, চোখে
বা কানে ড্রপ ব্যবহার করলে সাওম নষ্ট হবে না- যদিও এগুলো ব্যবহার করলে গলায় স্বাদ অনুভব
করে।
অনুরূপভাবে চিকিৎসার জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে
যদি কেউ তৈল ব্যবহার করে, তাতেও সাওমের কোনো ক্ষতি হবে না।এমনিভাবে শ্বাস কষ্ট দূর
করার জন্য যদি মুখে পাইপ লাগিয়ে অক্সিজেনের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াকে চলমান
করা হয়, এবং তা পেটে পৌঁছে, তাতেও সাওমের কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা তা পানাহারের অন্তর্ভুক্ত
নয়।
[1] আবু দাঊদ, অধ্যায়: নাক ঝাড়া, ১৪২; তিরমিযী, অধ্যায়:
পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: আঙ্গুল খিলাল করার বর্ণনা; নাসাঈ, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ:
নাকে পানি নেওয়ায় বাড়াবাড়ি করা; ইবন মাজাহ, অধ্যায়: পবিত্রতা, অনুচ্ছেদ: আঙ্গুল খিলাল
করার বর্ণনা।
প্রশ্ন: (৩০) সাওম অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে কি সিয়াম বিশুদ্ধ হবে?
উত্তর: হ্যাঁ, তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা
স্বপ্নদোষ সাওম বিনষ্ট করে না। স্বপ্নদোষ তো মানুষের অনিচ্ছায় হয়ে থাকে। আর নিদ্রা
অবস্থায় সংঘটিত বিষয় থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি সতর্কতা: বর্তমান
যুগে অনেক মানুষ রামাযানের রাতে জেগে থাকে। কখনো আজেবাজে কর্ম এবং কথায় রাত কাটিয়ে
দেয়। তারপর গভীর নিদ্রায় সমস্ত দিন অতিবাহিত করে; বরং মানুষের উচিৎ হচ্ছে, সাওমের সময়টাকে
যিকির, কুরআন তিলাওয়াত প্রভৃতি আনুগত্যপূর্ণ ও আল্লাহর নৈকট্যদানকারী কাজে অতিবাহিত
করা।
প্রশ্ন: (৩১) সাওম আদায়কারীর ঠাণ্ডা ব্যবহার করার বিধান কী?
উত্তর: ঠাণ্ডা-শীতল বস্তু অনুসন্ধান করা সাওম
আদায়কারী ব্যক্তির জন্য জায়েয, কোনো অসুবিধা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সাওম রেখে গরমের কারণে বা তৃষ্ণার কারণে মাথায় পানি ঢালতেন।[1] ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু সাওম রেখে গরমের প্রচণ্ডতা অথবা পিপাসা হ্রাস করার জন্য শরীরে কাপড় ভিজিয়ে রাখতেন।
কাপড়ের এ সিক্ততার কোনো প্রভাব নেই। কেননা উহা এমন পানি নয়, যা নাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে
দেয়।
[1] আবু দাঊদ, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: তৃষ্ণায়
সিয়ামদারের মাথায় পানি ঢালা।
প্রশ্ন: (৩২) সাওম আদায়কারী কুলি করা বা নাকে পানি নেওয়ার কারণে যদি
পেটে পৌঁছে যায়, তবে কি তার সাওম ভঙ্গ হয়ে যাবে?
উত্তর: সাওম আদায়কারী কুলি করা বা নাকে পানি
নেওয়ার কারণে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে পানি পেটে পৌঁছে যায়, তবে তার সাওম ভঙ্গ হবে না। কেননা
এতে তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ বলেন,
]وَلَيْسَ
عَلَيْكُمْ
جُنَاحٌ
فِيمَا
أَخْطَأْتُمْ
بِهِ
وَلَكِنْ
مَا
تَعَمَّدَتْ
قُلُوبُكُمْ[
“ভুলক্রমে তোমরা যা করে ফেল সে সম্পর্কে তোমাদের
কোনো গুনাহ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তর যার ইচ্ছা করে তার কথা ভিন্ন।” [সূরা আল-আহযাব,
আয়াত: ৫]
প্রশ্ন: (৩৩) সাওম আদায়কারীর আতরের সুঘ্রাণ ব্যবহার করার বিধান কী?
উত্তর: সাওম আদায়কারীর আতর-সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতে
কোনো অসুবিধা নেই। চাই তৈল জাতীয় হোক বা ধোঁয়া জাতীয়। তবে ধোঁয়ার সুঘ্রাণ নাকের কাছে
নিয়ে শুঁকবে না। কেননা এতে একজাতীয় পদার্থ আছে যা পেট পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন সাওম ভঙ্গ
হয়ে যাবে। যেমন পানি বা তদানুরূপ বস্তু। কিন্তু সাধারণ ভাবে তার সুঘ্রাণ নাকে ঢুকলে
কোনো অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: (৩৪) নাক থেকে রক্ত বের হলে কি সাওম নষ্ট হবে?
উত্তর: নাক থেকে রক্ত বের হলে সাওম নষ্ট হবে না-
যদিও বেশি পরিমাণে বের হয়। কেননা এখানে ব্যক্তির কোনো ইচ্ছা থাকে না।
প্রশ্ন: (৩৫) রামাযানের কোনো কোনো ক্যালেন্ডারে দেখা যায় সাহুরের জন্য
শেষ টাইম নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তার প্রায় দশ/পনর মিনিট পর ফজরের টাইম নির্ধারণ করা
হয়েছে। সুন্নাতে কি এর পক্ষে কোনো দলীল আছে নাকি এটা বিদ‘আত?
উত্তর: নিঃসন্দেহে এটি বিদ‘আত। সুন্নাতে নববীতে
এর কোনো প্রমাণ নেই। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত কিতাবে বলেন,
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا
حَتَّى
يَتَبَيَّنَ
لَكُمْ
الْخَيْطُ
الْأَبْيَضُ
مِنْ
الْخَيْطِ
الْأَسْوَدِ
مِنْ
الْفَجْرِ
ثُمَّ
أَتِمُّوا
الصِّيَامَ
إِلَى
اللَّيْلِ
“এবং প্রত্যুষে (রাতের) কাল রেখা হতে (ফজরের)
সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা
সাওম পূর্ণ কর।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
«أَنَّ
بِلَالًا
كَانَ
يُؤَذِّنُ
بِلَيْلٍ
فَكُلُوا
وَاشْرَبُوا
حَتَّى
يُؤَذِّنَ
ابْنُ
أُمِّ
مَكْتُومٍ
فَإِنَّهُ
لَا
يُؤَذِّنُ
حَتَّى
يَطْلُعَ
الْفَجْرُ»
“নিশ্চয় বেলাল রাত থাকতে আযান দেয়, তখন তোমরা
খাও ও পান কর, যতক্ষণ না ইবন উম্মে মাকতূমের আযান শোন। কেননা ফজর উদিত না হলে সে আযান
দেয় না।”[1] ফজর না হতেই খানা-পিনা বন্ধ করার জন্য লোকেরা সময় নির্ধারণ করে যে ক্যালেন্ডার
তৈরি করেছে তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর নির্ধারিত ফরযের ওপর বাড়াবাড়ী। আর এটা হচ্ছে আল্লাহর
দীনের মাঝে অতিরঞ্জন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«هَلَكَ
الْمُتَنَطِّعُونَ
هَلَكَ
الْمُتَنَطِّعُونَ
هَلَكَ
الْمُتَنَطِّعُونَ»
“অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক। অতিরঞ্জনকারীগণ
ধ্বংস হোক। অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক।”[2]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী তোমাদেরকে যেন বাধা না দেয়...।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইলম, অনুচ্ছেদ:
“অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক।”
প্রশ্ন: (৩৬) এয়ারপোর্টে থাকাবস্থায় সূর্য অস্ত গেছে মুআয্যিন আযান
দিয়েছে, ইফতারও করে নিয়েছে। কিন্তু বিমানে চড়ে উপরে গিয়ে সূর্য দেখতে পেল। এখন কি পানাহার
বন্ধ করতে হবে?
উত্তর: খানা-পিনা বন্ধ করা অবশ্যক নয়। কেননা যমীনে
থাকাবস্থায় ইফতারের সময় হয়ে গেছে সূর্যও ডুবে গেছে। সুতরাং ইফতার করতে বাধা কোথায়?
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا
أَقْبَلَ
اللَّيْلُ
مِنْ
هَا
هُنَا
وَأَدْبَرَ
النَّهَارُ
مِنْ
هَا
هُنَا
وَغَرَبَتِ
الشَّمْسُ
فَقَدْ
أَفْطَرَ
الصَّائِمُ»
“এ দিক থেকে যখন রাত আগমণ করবে এবং ঐদিক থেকে
দিন শেষ হয়ে যাবে ও সূর্য অস্ত যাবে, তখন সাওম আদায়কারী ইফতার করে ফেলবে।”[1] অতএব,
এয়ারপোর্টের যমীনে থাকাবস্থায় যখন সূর্য ডুবে গেছে, তখন তার দিনও শেষ হয়ে গেছে, তাই
সে শরী‘আতের দলীল মোতাবেক ইফতারও করে নিয়েছে। সুতরাং শরী‘আতের দলীল ব্যতীরেকে আবার
তাকে পানাহার বন্ধ করার আদেশ দেওয়া যাবে না।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সফরে সিয়াম রাখা ও সিয়াম ভঙ্গ করা।
প্রশ্ন: (৩৭) সাওম আদায়কারীর কফ অথবা থুথু গিলে ফেলার বিধান কী?
উত্তর: কফ বা শ্লেষা যদি মুখে এসে একত্রিত না
হয় গলা থেকেই ভিতরে চলে যায় তবে তার সাওম নষ্ট হবে না। কিন্তু যদি গিলে ফেলে তবে সে
ক্ষেত্রে বিদ্বানদের দু’টি মত রয়েছে:
১ম মত: তার সাওম নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা তা পানাহারের
স্থলাভিষিক্ত।
২য় মত: সাওম নষ্ট হবে না। কেননা তা মুখের সাধারণ
থুথুর অন্তর্গত। মুখের মধ্যে সাধারণ পানি যাকে থুথু বলা হয় তা দ্বারা সাওম নষ্ট হয়
না। এমনকি যদি থুথু মুখের মধ্যে একত্রিত করে গিলে ফেলে তাতেও সিয়ামের কোনো ক্ষতি হবে
না।
আমরা জানি আলিমগণ মতবিরোধ করলে তার সমাধান
কুরআন-সুন্নাহ থেকে খুঁজতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাতে সুস্পষ্ট কোনো উক্তি
নেই। এ বিষয়ে যখন সন্দেহ হয়ে গেল, তার ইবাদতটি নষ্ট হয়ে গেল না নষ্ট হলো না। তখন আমাদেরকে
মূলের দিকে ফিরে যেতে হবে। মূল হচ্ছে দলীল ছাড়া ইবাদত বিনষ্ট না হওয়া। অতএব, কফ গিলে
নিলে সাওম নষ্ট হবে না।
মোটকথা: কফ নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিবে। তা গলার নিচে
থেকে মুখে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে না। কিন্তু মুখে এসে পড়লে বাইরে ফেলে দিবে। চাই
সাওম আদায়কারী হোক বা না হোক। কিন্তু গিলে ফেললে সাওম নষ্ট হবে এর জন্য দলীল দরকার।
প্রশ্ন: (৩৮) খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করলে কি সিয়াম নষ্ট হবে?
উত্তর: খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করে যদি তা গিলে
না ফেলে, তবে সিয়াম নষ্ট হবে না। কিন্তু একান্ত দরকার না পড়লে এরূপ করা উচিৎ নয়। এ
অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত যদি পেটে কিছু ঢুকে পড়ে তবে সিয়ামের কোনো ক্ষতি হবে না।
প্রশ্ন: (৩৯) সাওম রেখে হারাম বা অশ্লীল কথাবার্তা উচ্চারণ করলে কি
সিয়াম নষ্ট হবে?
উত্তর: আমরা আল্লাহ তা’আলার নিম্ন লিখিত আয়াত
পাঠ করলেই জানতে পারি সিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কী? আর তা হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি
অর্জন করা ও আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ
ءَامَنُواْ
كُتِبَ
عَلَيۡكُمُ
ٱلصِّيَامُ
كَمَا
كُتِبَ
عَلَى
ٱلَّذِينَ
مِن
قَبۡلِكُمۡ
لَعَلَّكُمۡ
تَتَّقُونَ
١٨٣﴾
[البقرة:
١٨٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা
হয়েছে। যেমন, ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন
করতে পার।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩] তাক্বওয়া হচ্ছে হারাম কাজ পরিত্যাগ করা। ব্যাপক
অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় বাস্তাবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে
থাকা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
لَمْ
يَدَعْ
قَوْلَ
الزُّورِ
وَالْعَمَلَ
بِهِ
والْجَهْلَ
فَلَيْسَ
لِلَّهِ
حَاجَةٌ
فِي
أَنْ
يَدَعَ
طَعَامَهُ
وَشَرَابَهُ»
“যে ব্যক্তি (সাওম রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যা
অভ্যাস ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোনো দরকার
নেই।”[1] অতএব, এ কথা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, সাওম আদায়কারী যাবতীয় ওয়াজিব বিষয় বাস্তবায়ন
করবে এবং সবধরণের হারাম থেকে দূরে থাকবে। মানুষের গীবত করবে না, মিথ্যা বলবে না, চুগলখোরী
করবে না, হারাম বেচা-কেনা করবে না, ধোঁকাবাজী করবে না। মোটকথা: চরিত্র ধ্বংসকারী অন্যায়
ও অশ্লীলতা বলতে যা বুঝায় সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকবে। আর একমাস এভাবে চলতে পারলে
বছরের অবশিষ্ট সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ
সাওম আদায়কারী রামাযানের সাথে অন্য মাসের কোনো পার্থক্য করে না। অভ্যাস অনুযায়ী ফরয
কাজে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, হালাল-হারামে কোনো পার্থক্য নেই। গর্হিত ও অশ্লীল কথা
কাজে লিপ্ত থাকে। মিথ্যা, ধোঁকাবাজী প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাকে দেখলে বুঝা
যাবে না তার মধ্যে সিয়ামের মর্যাদার কোনো মূল্য আছে। অবশ্য এ সমস্ত বিষয় সিয়ামকে ভঙ্গ
করে দিবে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে তার ছাওয়াব বিনষ্ট করে দিবে।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সিয়াম
রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং তার কারবার পরিত্যাগ করে না। হাদীসটির বাক্য ইবন মাজাহ
থেকে নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: (৪০) মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার বিধান কী? তা কি সিয়াম নষ্ট করে?
উত্তর: মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া অন্যতম কাবীরা গুনাহ্।
আর তা হচ্ছে না জেনে কোনো বিষয়ে স্বাক্ষ্য দেওয়া অথবা জেনে শুনে বাস্তবতার বিপরীত সাক্ষ্য
প্রদান করা। এতে সিয়াম বিনষ্ট হবে না। কিন্তু সিয়ামের সাওয়াব কমিয়ে দিবে।
প্রশ্ন: (৪১) সিয়ামের আদব কী কী?
উত্তর: সিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে, আল্লাহভীতি
অর্জন করা তথা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ
ءَامَنُواْ
كُتِبَ
عَلَيۡكُمُ
ٱلصِّيَامُ
كَمَا
كُتِبَ
عَلَى
ٱلَّذِينَ
مِن
قَبۡلِكُمۡ
لَعَلَّكُمۡ
تَتَّقُونَ
١٨٣﴾
[البقرة:
١٨٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা
হয়েছে। যেমন, ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন
করতে পার।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
لَمْ
يَدَعْ
قَوْلَ
الزُّورِ
وَالْعَمَلَ
بِهِ
والْجَهْلَ
فَلَيْسَ
لِلَّهِ
حَاجَةٌ
فِي
أَنْ
يَدَعَ
طَعَامَهُ
وَشَرَابَهُ»
“যে ব্যক্তি (সাওম রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যা
কাজ-কারবার ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোনো
দরকার নেই।”[1]
সিয়ামের আরো আদব হচ্ছে, বেশি বেশি দান-খায়রাত
করা, নেককাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজ বাস্তবায়ন করা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি। রামাযান মাসে যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম
তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিতেন তখন তিনি আরো বেশি দান করতেন।[2]
আরো আদব হচ্ছে, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা
থেকে দূরে থাকা। যাবতীয় মিথ্যাচার, গালিগালাজ, ধোকা, খিয়ানত, হারাম অশ্লীল বস্তু দেখা
বা শোনা প্রভৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা প্রতিটি মানুষের ওপর ওয়াজিব। বিশেষ করে সাওম
আদায়কারীর জন্য তো অবশ্যই।
সাওমের আদব হচ্ছে, সাহুর খাওয়া এবং তা দেরী
করে খাওয়া। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, تَسَحَّرُوا
فَإِنَّ
فِي
السَّحُورِ
بَرَكَةً
“তোমরা সাহুর খাও। কেননা সাহুরে রয়েছে বরকত।”[3]
সিয়ামের আদব হচ্ছে, দ্রুত ইফতার করা। সূর্য
অস্ত যাওয়া নিশ্চিত হলে বা অস্ত যাওয়ার অনুমান প্রবল হলেই সাথে সাথে দেরী না করে ইফতার
করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لَا
يَزَالُ
النَّاسُ
بِخَيْرٍ
مَا
عَجَّلُوا
الْفِطْرَ
“মানুষ কল্যাণের মাঝে থাকবে, যতদিন তারা দ্রুত ইফতার করবে।”[4]
ইফতারের আদব হচ্ছে, কাঁচা খেজুর দিয়ে ইফতার
করা, সম্ভব না হলে যে কোনো খেজুর দ্বারা। খেজুর না পেলে পানি দ্বারাই ইফতার করবে।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সিয়াম রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং তার কারবার পরিত্যাগ করে না। হাদীসটির বাক্য ইবন
মাজাহ থেকে নেওয়া হয়েছে।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানে সর্বাধিক দানশীল হতেন।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সাহুরের বরকত; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সাহুরের ফযীলত।
[4] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
দ্রুত ইফতার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সাহুরের ফযীলত।
প্রশ্ন: (৪২) ইফতারের জন্য কোনো দো‘আ কি প্রমাণিত আছে? সাওম আদায়কারী
কি মুআয্যিনের জবাব দিবে নাকি ইফতার চালিয়ে যাবে?
উত্তর: দো‘আ কবূল হওয়ার অন্যতম সময় হচ্ছে ইফতারের
সময়। কেননা সময়টি হচ্ছে ইবাদতের শেষ মূহুর্ত। তাছাড়া মানুষ সাধারণতঃ ইফতারের সময় অধিক
দুর্বল হয়ে পড়ে। আর মানুষ যত দুর্বল হয় তার অন্তর তত নরম ও বিনয়ী হয়। তখন দো‘আ করলে
মনোযোগ আসে বেশি এবং আল্লাহর দিকে অন্তর ধাবিত হয়। ইফতারের সময় দো‘আ হচ্ছে: اللَّهُمَّ
لَكَ
صُمْتُ
وَعَلَى
رِزْقِكَ
أَفْطَرْتُ
“হে আল্লাহ আপনার জন্য সাওম রেখেছি এবং আপনার রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।”[1] নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় এ দো‘আ পাঠ করতেন: ذَهَبَ
الظَّمَأُ
وَابْتَلَّتِ
الْعُرُوقُ
وَثَبَتَ
الْأَجْرُ
إِنْ
شَاءَ
اللَّهُ
“তৃষ্ণা বিদূরিত হয়েছে, শিরা-উপশিরা তরতাজা হয়েছে এবং আল্লাহ চাহে তো প্রতিদান সুনিশ্চিত
হয়েছে।”[2] হাদীস দু’টিতে যদিও দুর্বলতা রয়েছে কিন্তু কোনো কোনো বিদ্বান এটাকে হাসান
বলেছেন। মোটকথা এগুলো দো‘আ বা অন্য কোনো দো‘আ পাঠ করবে। ইফতারের সময় হচ্ছে দো‘আ কবূল
হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত। কেননা হাদীসে এরশাদ হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّ لِلصَّائِمِ
عِنْدَ
فِطْرِهِ
لَدَعْوَةً
مَا
تُرَدُّ
“সিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময়কার দো‘আ প্রত্যাখ্যান করা হয় না।”[3] আর ইফতারের সময়
মুআয্যিনের জবাব দেওয়া শরী‘আতসম্মত। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا
سَمِعْتُمُ
الْمُؤَذِّنَ
فَقُولُوا
مِثْلَ
مَا
يَقُولُ
“মুআয্যিনের আযান শুনলে তার জবাবে সে যা বলে তোমরাও তার অনুরূপ বল।”[4] এ হাদীসটি প্রত্যেক
অবস্থাকে শামিল করে। তবে দলীলের ভিত্তিতে কোনো অবস্থা ব্যতিক্রম হলে ভিন্ন কথা।
[1] আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
ইফতারের দো‘আ। তবে এই দু’আটির সনদ (সূত্র) দুর্বল তাই উহা গ্রহণযোগ্য নয়। (দ্র. ইরওয়াউল
গালীল, ৪/৩৬-৩৯ পৃঃ যঈফ আবু দাঊদ, আলবানী)
[2] আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
ইফতারের দো‘আ। (এ হাদীসটি ছহীহ, দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হাদীস নং ৯২০)
[3] [হাদীছ ছহীহ] ইবন মাজাহ, অধ্যায়: সিয়াম
হাদীস নং ১৭৪৩, ১৭৫৩।
[4] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: আযান, অনুচ্ছেদ:
আযান শুনলে কি বলতে হয়; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সালাত, অনুচ্ছেদ: মুআয্যিনের অনুরূপ জবাব
দেওয়া মুস্তাহাব।
প্রশ্ন: (৪৩) সিয়াম কাযা থাকলে শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখার বিধান কী?
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ
صَامَ
رَمَضَانَ
ثُمَّ
أَتْبَعَهُ
بِسِتٍّ
مِنْ
شَوَّالٍ
فَكَأَنَّمَا
صَامَ
الدَّهْرَ»
“যে ব্যক্তি রামাযানের সাওম রাখার পর শাওয়াল
মাসে ছয়টি সাওম রাখবে, সে সারা বছর সাওম রাখার প্রতিদান লাভ করবে।”[1] কোনো মানুষের
যদি সাওম কাযা থাকে আর সে শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখে, সে কি রামাযানের পূর্বে সাওম রাখল
না রামাযানের পর।
উদাহরণ: জনৈক লোক রামাযানের ২৪টি সাওম রাখল।
বাকী রইল ছয়টি। এখন সে যদি কাযা আদায় না করেই শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখে, তাকে কি বলা
যাবে সে রামাযানের সাওম পূর্ণ করার পর শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখল? কেননা সে তো রামাযানের
সাওম পূর্ণই করে নি। অতএব, রামাযানের সাওম কাযা থাকলে শাওয়ালের ছয় সাওমের প্রতিদান
তার জন্য প্রমাণিত হবে না।অবশ্য আলিমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, কারো সাওম কাযা থাকলে
তার জন্য নফল সাওম জায়েয কি না? কিন্তু আমাদের এ মাসআলাটি এ মতবিরোধের অন্তর্ভুক্ত
নয়। কেননা শাওয়ালের ছয়টি সাওম রামাযানের সাথে সম্পর্কিত। যে ব্যক্তি রামাযানের সাওম
পূর্ণ করে নি তার জন্য উক্ত ছয় সাওমের সাওয়াব সাব্যস্ত হবে না।
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখা মুস্তাহাব।
প্রশ্ন: (৪৪) জনৈক অসুস্থ ব্যক্তি রামাযানে সাওম কাযা করেছে। কিন্তু
পরবর্তী মাস শুরু হওয়ার চারদিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়। তার পক্ষ থেকে কি কাযা সাওমগুলো
আদায় করতে হবে?
উত্তর: তার এ অসুখ যদি চলতেই থাকে সুস্থ না হয় এবং
শেষ পর্যন্ত মারা যায়, তবে তার পক্ষ থেকে কাযা আদায় করতে হবেনা। কেননা আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَن كَانَ
مَرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَۗ﴾
[البقرة:
١٨٥]
“আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে,
সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] অতএব, অসুস্থ ব্যক্তির
ওপর ওয়াজিব হচ্ছে, সুস্থ হলেই কাযা সাওমগুলো দ্রুত আদায় করে নেওয়া। কিন্তু সাওম রাখতে
সমর্থ হওয়ার পূর্বেই যদি মৃত্যুবরণ করে, তবে সাওমের আবশ্যকতা রহিত হয়ে যাবে। কেননা
সে তো এমন কোনো সময় পায়নি যাতে সে সাওমগুলো কাযা আদায় করতে পারে। যেমন একজন লোক রামাযান
আসার পূর্বেই শাবানে মারা গেল। অতএব, রামাযানের সাওম রাখা তার জন্য আবশ্যক নয়। কিন্তু
অসুস্থতা যদি এমন হয় যা সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের
বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য দান করবে।
প্রশ্ন: (৪৫) রামাযানের সাওম বাকী থাকাবস্থায় পরবর্তী রামাযান এসে গেলে
কি করবে?
উত্তর: একথা সবার জানা যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿فَمَن شَهِدَ
مِنكُمُ
ٱلشَّهۡرَ
فَلۡيَصُمۡهُۖ
وَمَن
كَانَ
مَرِيضًا
أَوۡ
عَلَىٰ
سَفَرٖ
فَعِدَّةٞ
مِّنۡ
أَيَّامٍ
أُخَرَ﴾
[البقرة:
١٨٥] فَمَنْ
شَهِدَ
مِنْكُمْ
الشَّهْرَ
فَلْيَصُمْهُ
وَمَنْ
كَانَ
مَرِيضًا
أَوْ
عَلَى
سَفَرٍ
فَعِدَّةٌ
مِنْ
أَيَّامٍ
أُخَرَ[
“কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে,
সে এ মাসের সাওম রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে
গণনা পূরণ করে নিবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] অতএব, এ লোকটি যখন শরী‘আত সম্মত
দলীলের ভিত্তিতে সাওম ভঙ্গ করেছে, তখন আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নার্থে তা কাযা আদায়
করা উচিৎ। পরবর্তী রামাযান আসার পূবেই উহা কাযা আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব। কেননা আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘আমার রামাযানের কিছু সাওম বাকী রয়ে যেত। কিন্তু শাবান মাস
না আসলে আমি তা কাযা আদায় করতে পারতাম না।’[1] আর তার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর ব্যস্ততা। সুতরাং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উক্ত বাণী
থেকে প্রমাণিত হয় যে, পরবর্তী রামাযান আসার পূর্বে তা অবশ্যই কাযা আদায় করতে হবে।কিন্তু
সে যদি পরবর্তী রামাযান পর্যন্ত দেরী করে এবং সাওমটি রয়েই যায়, তবে তার ওপর আবশ্যক
হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তাওবা ইস্তেগফার করা, এ শীথিলতার জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হওয়া এবং
যত দ্রুত সম্ভব তা কাযা আদায় করে নেওয়া। কেননা দেরী করলে কাযা আদায় করার আবশ্যকতা রহিত
হয়ে যায় না।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
কাযা সিয়াম কখন আদায় করবে।
প্রশ্ন: (৪৬) শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন করার ক্ষেত্রে উত্তম পদ্ধতি কী?
উত্তর: শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন করার ক্ষেত্রে
উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, ঈদের পর পরই উহা আদায় করা এবং পরস্পর আদায় করা। বিদ্বানগণ এভাবেই
বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কেননা এতে রামাযানের অনুসরণ বাস্তবায়ন হয়। হাদীসে বলা হয়েছে
“যে ব্যক্তি রামাযানের পরে পরে শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখে..।” তাছাড়া এতে নেক কাজ সম্পাদনে
তাড়াহুড়া করা হলো, যে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া এতে
বান্দার দৃঢ়তার প্রমাণ রয়েছে। দৃঢ়তা মানুষের পরিপূর্ণতার লক্ষণ। সচেতন বান্দা সুযোগ
হাতছাড়া করে না। কেননা মানুষ জানে না পরবর্তীতে কি তার জন্য অপেক্ষা করছে। অতএব, বান্দা
কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইলে তাকে প্রতিটি নেক কর্মের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে সুযোগের
সৎ ব্যবহার করতে হবে।
প্রশ্ন: (৪৭) শাওয়ালের ছয়টি সাওম রাখার জন্য কি ইচ্ছামত দিন নির্ধারণ
করা জায়েয? নাকি তার জন্য কোনো সময় নির্দিষ্ট করা আছে? এ দিনগুলো সাওম রাখলে কি উহা
ফরযের মত হয়ে যাবে এবং প্রতি বছর আবশ্যিকভাবে সাওম পালন করতে হবে?
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে
সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে তিনি বলেন,
«مَنْ
صَامَ
رَمَضَانَ
ثُمَّ
أَتْبَعَهُ
بِسِتٍّ
مِنْ
شَوَّالٍ
فَكَأَنَّمَا
صَامَ
الدَّهْر»
“যে ব্যক্তি রামাযানের সাওম রাখার পর শওয়াল
মাসে ছয়টি সাওম রাখবে, সে সারা বছর সাওম রাখার প্রতিদান লাভ করবে।”[1] এ ছয়টি সাওমের
জন্য কোনো দিন নির্দিষ্ট করা নেই। মাসের যে কোনো সময় সাওমগুলো রাখা যায়। চাই মাসের
প্রথম দিকে হোক বা মধ্যখানে বা শেষের দিকে। লাগাতার হোক বা ভেঙ্গে ভেঙ্গে হোক- সবই
জায়েয। বিষয়টি প্রশস্ত- সুযোগ সম্পন্ন (আল-হামদুল্লিাহ)। তবে রামাযান শেষ হওয়ার পর
পরই মাসের প্রথম দিকে দ্রুত করে নেওয়া বেশি উত্তম। কেননা এতে নেক কাজে প্রতিযোগিতা
করা হলো, যা কাম্য।
কোন বছর এ সিয়াম পালন করবে কোনো বছর করবে না
তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা এ সিয়াম নফল ফরয নয়।
[1] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রাখা মুস্তাহাব
প্রশ্ন: (৪৮) আশুরা সিয়ামের বিধান কী?
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত
করে মদীনা আগমণ করে দেখেন ইয়াহূদীরা মুহার্রামের দশ তারিখে সাওম পালন করছে। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«فَأَنَا
أَحَقُّ
بِمُوسَى
مِنْكُمْ
فَصَامَهُ
وَأَمَرَ
بِصِيَامِهِ»
“আমরা মূসার অনুসরণ করার ব্যাপারে তোমাদের
চাইতে অধিক হকদার। তিনি নিজে সে দিনের সাওম রাখলেন এবং সাহাবীগণকেও নির্দেশ দিলেন।”[1]
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত ইবন আববাসের হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আশুরা দিবসে সাওম রেখেছেন এবং সাহাবীগণকে সাওম রাখার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সাওমের
ফযীলত সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أَحْتَسِبُ
عَلَى
اللَّهِ
أَنْ
يُكَفِّرَ
السَّنَةَ
الَّتِي
قَبْلَهُ
“আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।”[2] কিন্তু ইয়াহূদীদের
বিরোধীতা করার জন্য তিনি এর একদিন পূর্বে ৯ তারিখ অথবা এক দিন পরে ১১ তারিখ সাওম রাখার
নির্দেশ দিয়েছেন।সুতরাং আশুরার সাওমের ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে, মুহার্রমের দশ তারিখের
সাথে ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখের সাওম রাখা। অবশ্য ১১ তারিখের চেয়ে ৯ তারিখ সাওম রাখা
অধিক উত্তম।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
আশুরার সিয়াম সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: আশুরার সিয়াম।
[2] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
প্রত্যেক মাসে তিনটি এবং ‘আরাফার দিবসে সিয়াম রাখা মুস্তাহাব।
প্রশ্ন: (৪৯) শাবান মাসে সাওম রাখার বিধান কী?
উত্তর: শাবান মাসে সাওম রাখা এবং অধিক হারে রাখা
সুন্নাত। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, مَا
رَأَيْتُهُ
أَكْثَرَ
صِيَامًا
مِنْهُ
فِي
شَعْبَان
“শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো সময় আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এত বেশি সাওম
রাখতে দেখি নি।”[1] এ হাদীস অনুযায়ী শাবান মাসে অধিকহারে সাওম রাখা উচিৎ।
বিদ্বানগণ বলেন, শাবান মাসে সাওম রাখা সুন্নাতে
মুআক্কাদা সালাতের অনুরূপ। এ সাওম যেন রামাযান মাসের ভুমিকা। অর্থাৎ রামাযানের পূর্বের
সুন্নাত সাওম। অনুরূপভাবে শাওয়ালের সাওম রামাযানের পরের সুন্নাতস্বরূপ। যেমন ফরয সালাতের
আগে ও পরে সুন্নাত রয়েছে।তাছাড়া শাবান মাসে সাওমের উপকারিতা হচ্ছে, নিজেকে রামাযানের
সাওম রাখার ব্যাপারে প্রস্তুত করা, সাওময় অভ্যস্ত করে তোলা। যাতে করে ফরয সাওম রাখা
তার জন্য সহজসাধ্য হয়।[2]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
শাবানের সিয়াম।
[2] কিন্তু নির্দিষ্ট আকারে শুধুমাত্র মধ্য
শাবানে অর্থাৎ ১৫ তারিখে সিয়াম রাখা বিদআত। আমাদের দেশে এটাকে শবে বরাতের সিয়াম বলা
হয়। কেননা এর ভিত্তি সহীহ সুন্নাহ্ থেকে প্রমাণিত নয়। ইবনু মাজার বর্ণনায় বলা হয়ঃ
“মধ্য শাবান এলে তোমরা রাত্রিতে ইবাদত করবে ও দিনে সিয়াম পালন করবে..।” এ হাদীসটি জাল।
কেননা এর সনদে ইবনু আবী সাবরাহ্ নামক জনৈক বর্ণনাকারী রয়েছে। সে হাদীস জাল করত। (আহকামু
রজব ওয়া শাবান।)- অনুবাদক।
প্রশ্ন: (৫০) যার অভ্যাস আছে একদিন সাওম রাখা ও একদিন ছাড়া। সে কি শুক্রবারেও
সাওম রাখতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ। কোনো মানুষ যদি এক দিন পর পর সাওম
রাখার অভ্যাস করে থাকে এবং তার সাওমের দিন শুক্রবার হয় বা শনিবার বা রোববার হয়, তবে
কোনো অসুবিধা নেই। তবে সে দিন যেন এমন না হয় যখন সাওম রাখা হারাম। যেমন দু’ঈদের দিন,
আইয়্যামে তাশরীকের দিন (কুরবানী ঈদের পরের তিন দিনকে আইয়্যামে তাশরীক বলা হয়)। তখন
সাওম পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতু বা নিফাসের দিনগুলো সাওম রাখা হারাম।
প্রশ্ন: (৫১) সাওমে বিছাল কাকে বলে? এটা কি শরী‘আত সম্মত?
উত্তর: সাওমে বিসাল বা অবিচ্ছিন্ন সিয়াম হচ্ছে,
ইফতার না করে দু’দিন একাধারে সাওম রাখা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকম সাওম
রাখতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন, কেউ যদি অবিচ্ছিন্ন করতে চায়, তবে শেষ রাতে সাহুরের
সময় পর্যন্ত মিলিত করতে পারে।”[1] সাহুর পর্যন্ত সাওমকে অবিচ্ছিন্ন করণ জায়েয, সুন্নাত
নয়; কোনো ফযীলতপূর্ণ কাজও নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যাস্তের
সাথে সাথে ইফতার করাকে কল্যাণের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
«لا
يَزَالُ
النَّاسُ
بِخَيْرٍ
مَا
عَجَّلُوا
الْفِطْر»
“মানুষ ততদিন কল্যাণের মাঝে থাকবে, যতদিন তারা
দ্রুত ইফতার করবে।”[2] কিন্তু সাহুরের সময় পর্যন্ত সাওমকে চালিয়ে যাওয়া বৈধ করেছেন।
লোকেরা যখন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো ইফতার না করেই সাওম চালিয়ে যান? তিনি বললেন,
“আমার অবস্থা তোমাদের মত নয়, আমাকে আমার রব খাওয়ান ও পান করান।”[3]
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সাহুরের সময় পর্যন্ত সিয়াম মিলিত করা।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
দ্রুত ইফতার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: সাহুর খাওয়ার ফযীলত।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
সাহুর খাওয়ার বরকত; কিন্তু সাহুর খাওয়া ওয়াজিব নয় সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ:
মিলিতভাবে সিয়াম রাখা নিষেধ।
প্রশ্ন: (৫২) বিশেষভাবে জুমু‘আর দিবস সাওম নিষেধ। এর কারণ কী? কাযা
সিয়ামও কি এদিন রাখা নিষেধ?
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে
সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, لا
تَخُصُّوا
يَوْمَ
الْجُمُعَةِ
بِصِيَامٍ
ولا
ليلتها
بقيام
“এককভাবে শুধুমাত্র শুক্রবারের দিনে সাওম রাখবে না এবং রাতে ক্বিয়াম করবে না।”[1] সাওম
রাখার জন্য এককভাবে এ দিনকে বেছে নেওয়া নিষেধের হিকমত হচ্ছে, জুমু‘আর দিন সপ্তাহিক
ঈদের দিন। জুমু‘আ ইসলামের তৃতীয় ঈদ হিসেবে গণ্য। প্রথম ঈদ হচ্ছে রামাযান শেষে ঈদুল
ফিতর। দ্বিতীয়টি কুরবানীর ঈদ। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, সাপ্তাহিক ঈদ জুমু‘আর দিন।[2] একারণেই
আলাদাভাবে এদিনে সাওম রাখতে নিষেধ করা হয়েছে।
তাছাড়া এদিনে পুরুষদের জন্য উচিৎ হচ্ছে আগেভাগে
জুমু‘আর সালাতে যাওয়া, দো‘আ যিকির ও কুরআন তিলাওয়াতে মাশগুল হওয়া। এ দিনটি ‘আরাফার
দিবসের অনুরূপ। আরাফার দিবসে হাজীগণ সাওম রাখবেন না। কেননা এদিন তিনি দো‘আ ও যিকিরে
মাশগুল থাকবেন। একটি মূলনীতি হচ্ছে: কয়েকটি ইবাদত যদি একত্রিত হয়, তখন যেটা পিছানো
সম্ভব হবে না সেটা তাৎক্ষণিক আদায় করবে এবং যেটি পিছানো সম্ভব হবে তা পিছিয়ে দিয়ে পরে
আদায় করবে।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, জুমু‘আর দিন সাপ্তাহিক
ঈদের দিন হওয়ার কারণে যদি সাওম রাখা নিষেধ হয়ে থাকে, তবে তো অপর দু’টি ঈদের মত এদিনে
অন্যান্য সাওম রাখাও হারাম হয়ে যায়?
উত্তরে আমরা বলব: এ দিনটির বিধান অন্য দু’
ঈদের চেয়ে ভিন্ন। কেননা এটি প্রতি মাসে চারবার আগমণ করে। একারণে এদিনে সাওম রাখার নিষেধাজ্ঞা
সম্পূর্ণরূপে হারাম নয়। তাছাড়া দু’ঈদের মাঝে আরো বিশেষ যে বৈশিষ্ট রয়েছে তা জুমু‘আর
দিনে নেই।
কিন্তু যদি জুমু‘আর পূর্বে একদিন ও পরে একদিন
সাওম পালন করে, তখন বুঝা যাবে যে, এককভাবে জুমু‘আর দিবস সাওম পালন করার উদ্দেশ্য ছিল
না। আর এটা জায়েয।[3]এককভাবে জুমু‘আর দিনে সাওম রাখার নিষেধাজ্ঞা নফল এবং কাযা উভয়ের
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা হাদীসের নিষেধাজ্ঞা থেকে সাধারণভাবে একথাই বুঝা যায়। তবে
যদি কোনো মানুষ এরকম ব্যস্ত থাকে যে, তার কাযা সিয়াম জুমু‘আর দিবস ছাড়া অন্য সময় আদায়
করা সম্ভব নয়, তখন তার জন্য এককভাবে সে দিন সাওম পালন করা মাকরূহ নয়। কেননা তার ওযর
রয়েছে।
[1]
সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সিয়াম, অনুচ্ছেদ: এককভাবে জুমু‘আর দিন সিয়াম রাখা মাকরূহ।
[2] রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “নিশ্চয় জুমু‘আর দিন ঈদের দিন।” (আহমাদ হাদীস নং ৭৬৮২)
[3] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “তোমাদের কেহ যেন শুধুমাত্র জুমআর দিবসে সিয়াম না রাখে। তবে এর পূর্বে একদিন
বা পরে একদিন মিলিয়ে সিয়াম রাখতে পারে।” (বুখারী, অধ্যায়: সিয়াম হাদীস নং ১৮৪৯)
প্রশ্ন: (৫৩) কোনো মানুষ যদি নফল সিয়াম ইচ্ছাকৃত ভঙ্গ করে ফেলে, তবে
কি গুনাহগার হবে? যদি সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করে, তবে কি কাফফারা দিতে হবে?
উত্তর: কোনো মানুষ নফল সাওম রেখে যদি পানাহার বা
স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করে ফেলে, তবে কোনো গুনাহ্ নেই। নফল সাওম শুরু করলেই তা
পূর্ণ করা আবশ্যক নয়। তবে হজ-ওমরার কাফফারার সাওম পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু নফল সিয়াম
শুরু করার পর পূর্ণ করাই উত্তম। তাই নফল সিয়াম রেখে স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করলে
কাফফারা দিতে হবে না। কেননা তা পূর্ণ করা আবশ্যক নয়।
কিন্তু সিয়াম যদি ফরয হয় এবং স্ত্রী সহবাস
করে তবে তা নাজায়েয। কেননা বিশেষ প্রয়োজন না দেখা দিলে ফরয সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয নয়।
তবে রামাযানের সাওম যদি তার ওপর ফরয থাকে এবং দিনের বেলা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে
কাফফারা দিতে হবে। “রামাযানের সাওম যদি তার ওপর ফরয থাকে” একথার অর্থ হচ্ছে: যদি স্বামী-স্ত্রী
দু’জনই সফরে থাকে, দু’জনেই সাওম রাখে, তারপর সহবাসের মাধ্যমে সাওম ভঙ্গ করে, তবে তারা
গুনাহগার হবে না। তাদেরকে কাফফারা দিতে হবে না। অবশ্য তাদেরকে উক্ত দিনের সিয়াম কাযা
আদায় করতে হবে।
প্রশ্ন: (৫৪) ই‘তিকাফ এবং ই‘তিকাফকারীর বিধান কী?
উত্তর: ই‘তিকাফ হচ্ছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য
করার জন্য মসজিদে অবস্থান করা। লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করার জন্য ই‘তিকাফ করা সুন্নাত।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ
وَأَنتُمۡ
عَٰكِفُونَ
فِي
ٱلۡمَسَٰجِدِۗ﴾
[البقرة:
١٨٧]
“মসজিদে ই‘তিকাফ করা অবস্থায় তোমরা স্ত্রীদের
সাথে সহবাস করো না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] সহীহ বুখারীতে প্রমাণিত আছে, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ করেছেন, তাঁর সাথে ছাহাবায়ে কেরামও ই‘তিকাফ
করেছেন।[1] ই‘তিকাফের এ বিধান শরী‘আতসম্মত। তা রহিত হয়ে যায় নি। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করেছেন, এমনকি আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেছেন।
মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীরা ই‘তিকাফ করেছেন।”[2]
সহীহ মুসলিমে আবু সাঈ‘দ খুদরী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাযানের প্রথম
দশকে ই‘তিকাফ করেছেন। তারপর দ্বিতীয় দশকে ই‘তিকাফ করেছেন। অতঃপর বলেন,
«إِنِّي
اعْتَكَفْتُ
الْعَشْرَ
الأَوَّلَ
أَلْتَمِسُ
هَذِهِ
اللَّيْلَةَ
ثُمَّ
اعْتَكَفْتُ
الْعَشْرَ
الأَوْسَطَ
ثُمَّ
أُتِيتُ
فَقِيلَ
لِي
إِنَّهَا
فِي
الْعَشْرِ
الأَوَاخِرِ
فَمَنْ
أَحَبَّ
مِنْكُمْ
أَنْ
يَعْتَكِفَ
فَلْيَعْتَكِفْ»
“নিশ্চয় আমি রামাযানের প্রথম দশকে ই‘তিকাফ
করে এ রাত্রি (লায়লাতুল কদর) অনুসন্ধান করেছি। তারপর দ্বিতীয় দশকে ই‘তিকাফ করেছি। অতঃপর
ঐশী আগন্তুক কর্তৃক আমাকে বলা হয়েছে, নিশ্চয় উহা শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ই‘তিকাফ
করতে চায়, সে যেন ই‘তিকাফ করে।”[3]
অতঃপর লোকেরা তাঁর সাথে ই‘তিকাফ করেছে। ইমাম
আহমাদ রহ. বলেন, ই‘তিকাফ করা যে সুন্নাত সে সম্পর্কে আলিমদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ আমার
জানা নেই।’
তাই কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার দলীলের ভিত্তিতে
ই‘তিকাফ করা সুন্নাত।
ই‘তিকাফ করার স্থান হচ্ছে, যে কোনো শহরে অবস্থিত
মসজিদ। যেখানে জামাতে সালাত অনুষ্ঠিত হয়। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “মসজিদসমূহে ই‘তিকাফ
করা অবস্থায়..।” উত্তম হচ্ছে জুমু‘আর মসজিদে ই‘তিকাফ করা। যাতে করে জুমু‘আ আদায় করার
জন্য বের হতে না হয়। অন্য মসজিদে ই‘তিকাফ করলেও কোনো অসুবিধা নেই, তবে জুমু‘আর জন্য
আগে ভাগে মসজিদে চলে যাবে।
ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, আল্লাহর
আনুগত্যপূর্ণ কাজ তথা কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, নফল সালাত প্রভৃতিতে মাশগুল থাকা। কেননা
ই‘তিকাফের উদ্দেশ্যই হচ্ছে এটা। মানুষের সামান্য কথাবার্তায় কোনো অসুবিধা নেই বিশেষ
করে কথা যদি উপকারী হয়।
ই‘তিকাফকারীর জন্য স্ত্রী সহবাস ও স্ত্রী সোহাগ
বা শৃঙ্গার প্রভৃতি হারাম। মসজিদ থেকে বের হওয়া তিন ভাগে বিভক্ত:
১. জায়েয। শরী‘আত অনুমদিত ও অভ্যাসগত যরূরী
কাজে বের হওয়া। যেমন জুমু‘আর সালাতের জন্য বের হওয়া, পানাহার নিয়ে আসার কেউ না থাকলে
সে উদ্দেশ্যে বের হওয়া। অযু, ফরয গোসল, পেশাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া।
২. ওয়াজিব নয় এমন নেকীর কাজে বের হওয়া। যেমন,
রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় শরীক হওয়া। তবে ই‘তিকাফ শুরু করার সময় এসমস্ত কাজের জন্য
বের হওয়ার যদি শর্ত করে নেয়, তবে জায়েয হবে। অন্যথায় নয়।
৩. ই‘তিকাফের বিরোধী কাজে বের হওয়া। যেমন বাড়ী
যাওয়া বা কেনা-বেচার জন্য বের হওয়া। স্ত্রী সহবাস করা। এ সমস্ত কাজ কোনোভাবেই ই‘তিকাফকারীর
জন্য জায়েয নয়।
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ই‘তেকাফ, অনুচ্ছেদ:
এ‘তেকাফ করা।
[2] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ই‘তেকাফ, অনুচ্ছেদ:
শেষ দশকে ই‘তেকাফ করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ই‘তেকাফ, অনুচ্ছেদ: রামাযানের শেষ দশকে
ই‘তেকাফ করা।
[3] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ই‘তিকাফ, অনুচ্ছেদ:
শেষ দশকে ই‘তিকাফ করা।
(মূল উৎস গ্রন্থ-ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম)
(সমাপ্ত)
(১) রমযান বিষয়ে জাল ও দুর্বল হাদিসসমূহ জানতে-
(১) রমযান বিষয়ে জাল ও দুর্বল হাদিসসমূহ জানতে-
(২) রমজান ও সিয়াম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ১২৬টি প্রশ্নোত্তর জানতে -
(৩) সহিহ হাদিসের আলোকে ছিয়াম (রোজা) পালনের সহিহ নিয়ম জানতে-
এখানে ক্লিক করুন।
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড
(ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি
চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি,
গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।
আপনিও
হোন ইসলামের প্রচারক
প্রবন্ধের
লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের
Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির
লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ
উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের
আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে
ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে,
আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“যে
হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে
তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়,
তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস
করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে
আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও
একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি
ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে
বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস
সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড
(ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি
চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি,
গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।
ইসলামি
সকল পর্ব এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন-
Please Share On
No comments:
Post a Comment