Search This Blog

Tuesday, April 7, 2020

কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে ওযু সংক্রান্ত সহিহ ফতোয়া/মাসলা মাসায়েল



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে
ওযু সংক্রান্ত
সহিহ ফতোয়া/মাসলা মাসায়েল



ওযূর সংজ্ঞা ও এর শারঈ প্রমাণঃ
ওযূ এর আভিধানিক অর্থ : وضوء শব্দটি الوضائة শব্দ থেকে গৃহীত। এর আভিধানিক অর্থ: পরিছন্নতা ও উজ্জ্বলতা    وضوء  শব্দের واو  বর্ণে পেশ পড়লে, তখন তা فعل (ত্রিয়া) এর অর্থ  দিবে। আর واو বর্ণে যবর পড়লে, এর অর্থ হবে: ওযূর পানি এবং সেটা  مصدر(ক্রিয়ামূল)ও হবে অথবা এ দু’টি আলাদা শব্দও হতে পারে।[1]        
পরিভাষায়: সালাত অথবা অনুরূপ ইবাদাত থেকে বাধা প্রদান করে, এমন অপবিত্রতা হতে পবিত্রতা অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা মুখ, দু’হাত, মাথা ও দু’পায়ে পানি ব্যবহার করার নাম ওযূ।
কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা ওযূ শারঈভাবে প্রমাণিত। যথা:
(ক) কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
অর্থাৎ: হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দ-ায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত কর (সূরা মায়েদা-৬)
(খ) হাদীসে বলা হয়েছে-
 عَنْ أَبى هُرَيْرَةَ قَالَ رَسُولُ اللهِ لَا تُقْبَلُ صَلَاةُ أَحَدِكُمْ إِذَا أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ
(১) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল¬াহ () বলেছেন: যে ব্যক্তির বায়ু নির্গত হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওযূ করে।[2]
عَنْ ابْنَ عُمَرَ قَالَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ  يَقُولُلَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلَا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ
(২) ইবনে উমার (রাঃ) বললেন: আমি রাসূলুল¬াহ () কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: পবিত্রতা ছাড়া সালাত কবুল হয় না এবং আত্নসাৎ বা খেয়ানতের সম্পদ থেকে সাদকা কবুল হয় না।[3]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ إِنَّمَا أُمِرْتُ بِالْوُضُوءِ إِذَا قُمْتُ إِلَى الصَّلَاةِ
(৩) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () বলেছেন: আমাকে তো সালাত আদায়ের সময় ওযূ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।[4]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল () বলেন: সালাতের চাবি হলো পবিত্রতা (অর্থাৎ ওযূ বা গোসল) এর তাকবীর পার্থিব যাবতীয় কাজকে হারাম করে এবং সালাম (অর্থাৎ সালাম ফিরানো) যাবতীয় ক্রিয়া কর্মকে হালাল করে দেয়।[5]
(গ) আর এ ব্যাপারে ইজমা হলো: উম্মতের সকল আলিম এ বিষয়ে ঐক্যমত যে, পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম হলে পবিত্রতা ব্যতীত সালাত কবুল হবে না।[6]
দলীলের উৎসঃ
[1] আল-কামুস (১/৩৩), মুখতারুস সিহাহ (৫৭৫), আল-মাজমু’ (১/৩৫৫)।
[2] সহীহ; বুখারী (১৩৫), মুসলিম (২২৫) প্রভৃতি।
[3] সহীহ; মুসলিম (২২৪)।
[4] সহীহ; তিরমিযী (১৮৪৮), আবূ দাউদ (৩৭৬০), নাসাঈ (১/৭৩) সহীহুল জামে’ (২৩৩৩)।
[5] হাসান লিগাইরহী; তিরমিযী (৩), আবূ দাউদ (৬০), ইবনে মাজাহ (২৭৫), আলবানী তার সহীহুল জামে’ (৫৭৬১) গ্রন্থে সহীহ বলেছেন।
[6] ‘‘আল আউসাত’’ (১/১০৭) ইবনু মুনযির প্রণীত।
 সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ  ওযূ  আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম
ওযূর ফযীলত
১। এটাকে ঈমানের অর্ধেক হিসাবে গণ্য করা হয়:
আবূ মালিক আশআ'রী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () বলেছেন: পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।[1]
২। ওযূ ছোট-ছোট পাপগুলো মোচন করে:
(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল () বলেছেন: কোন মুসলিম বান্দা ওযূর সময় যখন মুখম-ল ধৌত তখন তার চোখ দিয়ে অর্জিত গুনাহ পানির সাথে অথবা (তিনি বলেছেন) পানির শেষ বিনদুর সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে দু‘খানা হাত ধৌত করে তখন তার দু’হাতের স্পর্শের মাধ্যমে সব গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিনদুর সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে পা দু‘খানা ধৌত করে, তখন তার দু‘পা দিয়ে হাঁটার মাধ্যমে অর্জিত সব গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিনদুর সাথে ঝরে যায়, এভাবে সে যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নণ হয়ে যায়।[2]
(খ) উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার এই ওযূর ন্যায় ওযূ করবে তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ফলে তার  সালাত ও মাসজিদে যাওয়া অতিরিক্ত আমল হিসেবে গণ্য হবে।[3]
যে ব্যক্তি এ ওযূ করার পর ফরয ও নফল  সালাত আদায় করবে তার জন্য এ ফযীলত ও সাওয়াবের তা‘কীদ দেয়া হয়েছে। যেমন
(গ) উসমান (রাঃ) এর হাদীসে আছে, তিনি রাসূল () এর ওযূর বিবরণের হাদীসে বলেন, রাসূল () বলেছেন:
অর্থাৎ: যে ব্যক্তি আমার এই ওযূর ন্যায় ওযূু করার পর একাগ্র চিত্তে দু‘রাকআত সালাত পড়বে এবং এ সময় অন্য কোন ধারণা তার অন্তরে উদয় হবে না। তাহলে তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।[4]
৩। ওযূর দ্বারা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়:
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল () বলেছেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ্ (বান্দাহর) গুনাহসমূহ মাফ করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল আপনি বলুন। তিনি বললেন: কষ্টকর অবস্থায়ও পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করা, সালাতের জন্য মাসজিদে বারবার যাওয়া এবং এক সালাতের পর আর এক সালাতের জন্য প্রতীক্ষা করা; আর এ কাজগুলোই হলো সীমান্ত প্রহরা।[5]
৪। জান্নাত যাওয়ার পথ সুগম করে:
(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () একদিন ফযরের সালাতের সময় বেলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে বিলাল তুমি ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক আশাব্যঞ্জক কি আমল করেছে, তার কথা আমার নিকট ব্যক্ত কর। কেননা জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বিলাল (রাঃ) বলেন, দিন রাতের যে কোন প্রহরে আমি ত্বহারাত ও পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে ত্বহারাত দ্বারা আমি সালাত আদায় করেছি, যে পরিমাণ সালাত আদায় করা আমার তক্দিরে লেখা ছিল। আমার কাছে এর চাইতে (অধিক) আশাব্যঞ্জক, এমন কোন বিশেষ আমল আমি করি নি।[6]
(খ) উকবা ইবন আমীর জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল¬াহ () বলেছেন: যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ করে তারপর দু‘রাকআত সালাত নিষ্ঠার সাথে আদায় করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।[7]
৫। এটা এমন একটা নিদর্শন যার দ্বারা হাওযে কাওসারের নিকট উপস্থিত হওয়ার সময় উম্মতকে পৃথক করা হবে:
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল () কবরস্থানে গিয়ে বললেন: তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, এটা তো ঈমানদারদের কবর স্থান। ইনশা আল্লাহ্ আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হবো। আমার মনে আমাদের ভাইদের দেখার আকাংখা জাগে। যদি আমরা তাদেরকে দেখতে পেতাম। সাহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহ্র রাসূল ()! আমরা কি আপনার ভাই নই? জবাবে তিনি বললেন: তোমরা হচ্ছো আমার সঙ্গী সাথী! আর যেসব ঈমানদার এখনও (দুনিয়াতে) আগমন করে নি তারা হচ্ছে আমার ভাই। তারা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল ()! আপনার উম্মাতের যারা এখনও (দুনিয়াতে) আসে নি, আপনি তাদেরকে কিভাবে চিনতে পারবেন? তিনি বললেন: অনেকগুলো কালো ঘোড়ার মধ্যে যদি কোন ব্যক্তির একটি কপাল চিত্রা ঘোড়া থাকে, তবে কি সে উক্ত ঘোড়াটিকে চিনতে পারবে না? তারা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল ()! তা অবশ্যই পারবো। তখন তিনি বললেন: তারা (আমার উম্মতরা) ওযূর প্রভাবে জ্যোর্তিময় চেহারা ও হাত পা নিয়ে উপস্থিত হবে। আর আমি আগেই হাওযে কাওসারের কিনারে উপস্থিত থাকবো। সাবধান! কিছু সংখ্যক লোককে আমার হাওয থেকে এমন ভাবে তাড়িয়ে দেয়া হবে যেমন বেওয়ারিশ উটকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আমি তাদেরকে ডেকে ডেকে বলবো: আরে এদিকে এসো, এদিকে এসো। তখন বলা হবে, এরা আপনার ইমিত্মকালের পর (নিজেদের দ্বীন) পরিবর্তন করে ফেলেছে। তখন আমি তাদেরকে বলবো: (আমার নিকট থেকে) দূর হও, দূর হও।[8]
 الغرةএর অর্থ উজ্জ্বল শুভ্রতা, যা ঘোড়ার কপালে দেখা যায়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য নূর বা উজ্জ্বলতা, যা উম্মতে মুহাম্মাদীর চেহারায় দেখা দিবে। আরالتحجيل -অর্থ এমন শুভ্রতা, যা ঘোড়ার তিন পায়ে দেখা যায়। এর দ্বারাও নূর বা উজ্জ্বলতা উদ্দেশ্য।[9]
৬। এটা ক্বিয়ামতের দিন বান্দার জন্য জ্যোতি স্বরূপ:
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন: আমি আমার বন্ধু  রাসূল () কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: যে স্থান পর্যন্ত ওযূর পানি পৌঁছবে সে স্থান পর্যন্ত মু‘মিন ব্যক্তির চাকচিক্য অথবা সৌন্দর্যও পৌঁছবে।[10] الْحِلْيَةُ অর্থ: ক্বিয়ামত দিবসের জ্যোতি।
৭। ওযূ শয়তানের গ্রন্থি খুলে দেয়:
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার গ্রীবাদেশে তিনটি গিট দেয়। প্রতি গিটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি ঘুমাও। তার পর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহ্কে স্বরণ করে তখন একটি গিট খুলে যায়, পরে ওযূ করলে আর একটি গিট খুলে যায়, তার পর সালাত আদায় করলে আরও একটি গিট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় প্রফুলস্ন মনে ও নির্মল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলস চিত্তে।[11]
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ; মুসলিম (২২৩) প্রভৃতি।
[2] সহীহ; মুসলিম (২৪৪) প্রভৃতি।
[3] সহীহ; মুসলিম (২২৯) প্রভৃতি।
[4] সহীহ; বুখারী (৬৪৩৩), মুসলিম (২২৬) প্রভৃতি।
[5] সহীহ; মুসলিম (২৫১) প্রভৃতি।
[6] বুখারী (১১৪৯), মুসলিম (২৪৫৮)।
[7] সহীহ; মুসলিম (২৩৪), নাসাঈ (১/৮০) প্রভৃতি।
[8] সহীহ; মুসলিম (২৩৪), নাসাঈ (১/৮০) প্রভৃতি।
[9] ইমাম নববী প্রণীত ‘সারহু মুসলিম’ (৩/১০০)।
[10] সহীহ; মুসলিম (২৫০), নাসাঈ (১/৮০)।
[11] সহীহ; বুখারী (১১৪২), মুসলিম (৭৭৬)।
 সংক্ষিপ্তভাবে ওযূর পূর্ণাঙ্গ নিয়মাবলী
হুমরান থেকে বর্ণিত, তিনি উসমান বিন আফ্ফান (রাঃ) কে দেখেছেন যে, তিনি পানির পাত্র আনিয়ে উভয় হাতের তালুতে তিন বার পানি ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন। এর পর ডান হাত পাত্রের মধ্যে ঢুকালেন। তার পর কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। তারপর তার মুখম-ল তিন বার ধুয়ে দুই হাত তিনবার কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নিলেন। এর পর মাথা মাসাহ করলেন। তার পর উভয় পা গিরা পর্যন্ত তিনবার ধুয়ে নিলেন। পরে বললেন, রাসূল () বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম ওযূ করবে তারপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খিয়াল করবে না। তার পেছনের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।[1]
এ হাদীস এবং সামনে বিস্তারিত বর্ণনায় যে সকল হাদীস আসবে, সেগুলোর আলোকে ওযূর বর্ণনা নিম্নরূপ:
(১) অপবিত্রতা দূর করার জন্য ওযূর নিয়ত করা।
(২) বিসমিল্লাহ বলে ওযূ শুরু করা।
(৩) দু‘ হাতের কব্জি ৩ বার করে ধৌত করা।
(৪) ডান হাতের এক অঞ্জলি পানি নিয়ে মুখে ও নাকে দেয়া। অতঃপর কুলি করা ও নাক  পরিষ্কার করা
(৫)তার পর বাম দিকে নাক ঝেড়ে ফেলা। এরূপ তিন বার করবে।
(৬) দাড়ি খিলাল সহ সমস্ত মুখম-ল তিন বার ধৌত করা
(৭) দু’হাতের আঙ্গুলগুলো খিলালসহ ডান হাত ও বাম হাত পর্যায়ক্রমে কনুই পর্যন্ত ধৌত      করা।
(৮) সমস্ত মাথার সামনে থেকে পিছনে একবার মাসাহ করা। (৯) দু কানের বাহির ও ভিতর মাসাহ করা।
(১০) দু’পায়ে গিট পর্যন্ত ধৌত করা। প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা এবং দু’পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করা।
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ; বুখারী (১৫৮), মুসলিম (২২৬)।
 ওযূ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত[1]
ওযূ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়তকে শর্ত করা হয়েছে। আর তা হলো: ওযূ করার জন্য অন্তরে দৃঢ় সংকল্প করা, যেন আল্লাহ্ ও রাসূলের () নির্দেশ বাসত্মবায়িত হয়। যেমন: সমস্ত উদ্দেশ্য মূলক ইবাদাতকে লক্ষ করে আল্লাহ্ বলেন:
অর্থাৎ: আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল¬াহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে (সূরা বায়্যিনা-৫)।
রাসূল () বলেন:
অর্থাৎ: প্রত্যেকটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই হবে যা সে নিয়ত করবে।[2]
এটা ইমাম মালিক শাফেঈ, আহমাদ, আবূ সাওর ও দাউদ এর অভিমত।[3]
অপর পক্ষে, ইমাম আবূ হানীফা এর মতে ওযূতে নিয়ত শর্ত নয়,[4] কারণ এটা যুক্তিগত ইবাদাত। এটা নিজেই উদ্দেশ্যমূলক ইবাদাত নয়। তা যেন অপবিত্রকে পবিত্র করার সাদৃশ্য রাখে।
অধিকাংশের মতামতটিই সঠিক। কেননা দলীল প্রমাণ করছে যে, প্রত্যেক ওযূতে সাওয়াব রয়েছে। আর সকলের ঐকমত্যে, নিয়ত ব্যতীত কোন সাওয়াব হয় না। তা এমন ইবাদাত যা শরীয়াত ছাড়া কল্পনা করা যায় না। সুতরাং ওযূতে নিয়ত শর্ত।[5]
 নিয়তের স্থান হলো ক্বলব বা অন্তর:
শাইখুল ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:[6] সকল ইবাদাতের ক্ষেত্রে মুসলিম ইমামদের ঐকমত্যে, নিয়ত করার স্থান হল ক্বলব বা অন্তর। এর স্থান জিহবা বা মুখ নয়।
যেমন: ত্বহারাত, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ, দাস মুক্ত করা, জিহাদ করা প্রভৃতি। সুতরাং নিয়ত জোরে পাঠ করা শরীয়াতসম্মত নয় এবং তা বার বার পাঠ করা যাবে না। বরং তাকে এ ক্ষেত্রে সতর্ক করার পরও যদি এরূপ করে তাহলে তাকে ধমক দিয়ে শিক্ষা দেয়া উচিৎ। বিশেষ করে যখন সে এটা বার বার বলে ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। জোরে উচ্চারণ করে নিয়তকারী ক্রটিকারী হিসেবে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি এটাকে দ্বীন হিসেবে বিশ্বাস করবে এবং তা মুখে উচ্চারণ করে আল্লাহ্র ইবাদাত করবে, সে বিদ‘আত করবে। কেননা মহানাবী () এবং তার সাহাবাগণ কখনও এভাবে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করেন নি এবং এ ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে কোন বর্ণনাও পাওয়া যায় না । যদি তা শরীয়াতের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ্ তার রাসূলের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নিতেন। উপরন্তু নিয়ত উচ্চারণের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা আল্লাহ্ মানুষের মনের খবর জানেন।[7]
 উপকারীতা:
(১) শাইখুল ইসলাম বলেন: সকল মুসলিম ইমামের ঐকমত্যে, যদি কেউ অন্তরে যা নিয়ত করেছে তার বিপরীত মুখে কিছু বলে, তাহলে যা নিয়ত করেছে সেটাই ধর্তব্য হবে। মুখে যা উচ্চারণ করেছে তা ধর্তব্য নয়। আর যদি কেউ মুখে উচ্চারণ করেছে কিন্তু অন্তরে নিয়ত করে নি, তাহলে তা ধর্তব্য নয়। কেননা নিয়তটা হলো সংকল্প ও দৃঢ়তার ব্যাপার।
(২) যখন অনেকগুলো নাপাকী এক সঙ্গে একত্রিত হবে তখন ওযূ ওয়াজিব হবে। যেমন: কেউ পেশাব করলো তারপর পায়খানা করলো, তারপর ঘুমালো। তাহলে এ ক্ষেত্রে যে কোন একটি অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের নিয়ত কররে, সবগুলো নাপাকীর পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। এটাই বিশুদ্ধ মতামত। কেননা অপবিত্রতা একটিই অবস্থা, যদিও তার কারণ ভিন্ন ভিন্ন হয়।[8]
(৩) আলিমদের সর্বসম্মতিক্রমে, সর্বোত্তম হলো, ওযূকারী নিয়তের সকল সুরাত বা রূপগুলো ঠিক রাখার জন্য সাধারণভাবে অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করবে। ওযূর ক্ষেত্রে নিয়তের সুরাত বা রূপগুলো হলো: অপবিত্রতা দূর করার নিয়ত করা, অথবা যে পবিত্রতা তার জন্য ওয়াজিব তার জন্য নিয়ত করা, অথবা যে পবিত্রতা অর্জন করা তার জন্য সুন্নত তার জন্য নিয়ত করা। অথবা সুন্নাত পালনের জন্য নতুন ওযূ করার সময় নিয়ত করা।[9]
দলীলের উৎসঃ
[1] শর্ত বলা হয়, যেটি না হলে অন্যটি না হওয়া অবধারিত হয়ে যায় এবং তার প্রাপ্তি অন্যটির প্রাপ্তিকে অবধারিত করে না ও তার মূলকেও বাতিল করে না। আর শর্ত কোন কাজের পূর্বেই সংঘটিত হয় এবং তা মূল কাজের বাইরের বিষয়।
[2] সহীহ; বুখারী (১), মুসলিম (১৯০৭)।
[3] বিদায়াতুল মুজতাহিদ (১/৬), আল-মাজমু’ (১/৩৭৪) আত-তামহীদ (২২/১০০, ১০১)।
[4] বাদায়ূস ছানাঈ (১/১৯-২০)।
[5] অনুরূপ এসেছে ইবনু মুফলিহ প্রণীত আল-ফুরু (১/১১১) গ্রন্থে।
[6] মাজমুআতুর রাসাঈলুল কুবরা (১/২৪৩)।
[7] মাদুল মায়াদ (১/১৯৬), ইগাসাতুল লাহফান (১/১৩৪) বাদায়ূল ফাওয়াঈদ (৩/১৮৬), আল ফুরু’ (১/১১১), ‘শারহুল মুমতি’ (১/১৫৯)।
[8] আল-মাজমু’ (১/৩৮৫), শারহুল মুমনি’ (১/১৬৫)।
[9] এ মাসাআলার ব্যাপারে উলামাদের মতভেদ আলোচিত হয়েছে আল-মাজমু’ (১/৩৮৫) এবং অন্যান্য গ্রন্থে।
ওযূর রুকনসমূহ
ওযূর রুকন হলো: যার মাধ্যমে ওযূর মূল কাঠামো গঠিত হয়। যদি একটি রুকন উলট-পালট হয়ে যায় তাহলে, ওযূ বাতিল হয়ে যাবে এবং তা শরীয়াতসম্মত হবে না। সেগুলো হলো:
১। সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ধৌত করা:
মুখমন্ডল দ্বারা সমস্ত চেহারা উদ্দেশ্য। তার সীমা হলো: দৈর্ঘের দিক থেকে মাথার অগ্রভাগের কপালের গোড়া তথা চুল গজানোর স্থান হতে চোয়াল ও থুৎনীর নীচ পর্যন্ত, আর প্রস্থে এক কানের লতি থেকে অপর কানের লতি পর্যন্ত।
মুখমন্ডল ধৌত করা ওযূর রুকন সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি রুকন। এটা ব্যতীত ওযূ বিশুদ্ধ হবে না। মহান আল্লাহ্ বলেন:
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ধৌত কর (সূরা মায়েদা-৬)
 যে সমস্ত রাবী মহানাবী () এর ওযূর নিয়মাবলীর হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই মুখমন্ডল ধৌত করা রুকনটি সাব্যাস্ত করেছেন এবং বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
 কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া ওয়াজিব :
মুখ ধৌত করা ও তাতে পানি দিয়ে গড়গড়া করাকে কুলি বলা হয়। নাকের মধ্যে পানি প্রবেশ করিয়ে নি:শ্বাস দ্বারা তা নাকের প্রান্ত সীমায় পৌঁছানোকে إستنشاق বা নাকে পানি দেয়া বলে। আর নাকে পানি দেয়ার পর তা থেকে পানি ঝেড়ে বের করে দেয়াকে إستنثار বা নাক ঝাড়া বলে। আলিমদের বিশুদ্ধ অভিমতে কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া ওয়াজিব। এর কারণ নিম্নরূপ:
(১) আল্লাহ্ তা‘আলা মুখমন্ডল ধৌত করার আদেশ দিয়েছেন। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আর মুখ ও নাক মুখমন্ডরের অন্তর্ভুক্ত। মুখের ভিতরের অংশ ছাড়া শুধু বাহিরের অংশকে মুখ বলে নির্দিষ্ট করা উচিৎ নয়, কেননা আরবী ভাষায় সবকিছুর সমষ্টিকে মুখমন্ডল বলা হয়। যদি তুমি বল যে, মুখ ও নাকের ছিদ্রের তো আলাদা নাম রয়েছে। আরবী ভাষায় তো এগুলোকে মুখ বলা হয় না?
এ ক্ষেত্রে আমরা বলব: তাহলে তো দু‘গাল, কপাল, নাকের বাহ্যিক অংশ, দুই ভ্রূ ও মুখমন্ডললের সমস্ত অংশের আলাদা আলাদা বিশেষ নাম রয়েছে, এগুলোকে তাহলে মুখ বলা যাবে না! যদি এরূপ দাবী করা হয়; তাহলে মুখমন্ডল ধৌত করা ওয়াজিব হওয়ার আবশ্যকতা বাতিলের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাবে।[1]
(২)  আল্লাহ্ তা‘আলা শুধু সাধারণভাবে মুখমন্ডল ধৌত করার আদেশ দিয়েছেন। আর মহানাবী () তাঁর কর্ম ও শিক্ষার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফলে তিনি যখন ওযূ করেছেন তখন কুলি ও নাকে পানি দিয়েছেন। তিনি কখনও সামান্য ওযূ করে ওযূকে সংক্ষিপ্ত করেছেন, এমন কোন প্রমাণ তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয় নি। রাসূল () এর পক্ষ থেকে যখন কোন নির্দেশকে বাস্তবায়নের  জন্য কোন কাজ প্রকাশ পায়, তখন তার বিধানটা ওয়াজিব চাহিদা অনুযায়ী ঐ নির্দেশের হুকুমের মতো হয়ে থাকে।[2]
(৩) নাকে পানি দেয়া ও নাক ঝাড়া প্রসঙ্গে আল্লাহ্র রাসূল () এর নির্দেশ প্রমাণিত হয়েছে:
مَنْ تَوَضَّأَ فَلْيَسْتَنْثِرْ  وفى رواية إِذَا تَوَضَّأَ أَحَدُكُمْ فَلْيَجْعَلْ فِي أَنْفِهِ، ثُمَّ لِيَنْثُرْ
(ক) যে ওযূ করবে সে যেন নাক ঝেড়ে ফেলে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে- তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ওযূ করবে তখন সে যে তার নাকের মধ্যে পানি প্রবেশ করায়। অতঃপর যেন নাক ঝেড়ে ফেলে।[3]
إِذَا تَوَضَّأَ أَحَدُكُمْ فَلْيستنشق
(খ) তোমাদের কেউ যখন ওযূ করে, তখন সে যেন তার নাকে পানি দেয়।[4]
وَبَالِغْ فِي الِاسْتِنْشَاقِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ صَائِمًا
(গ) সিয়াম পালনকারী না হলে, নাকে ভালভাবে পানি পৌঁছাও।[5]
 শাইখুল ইসলাম বলেন,[6] ‘‘মহানাবী () নাকে পানি দেয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা মূলত মুখের চেয়ে নাক ধৌত করা বেশি উত্তম এ বিবেচনায় নয়। যদি এমনটি বিবেচনা করা হতো তাহলে মুখকে ধৌত করাই বেশি উত্তম হতো। কেননা নাকের চেয়ে মুখ বেশি মর্যাদার অধিকারী, কারণ মুখ দ্বারা আল্লাহ্র যিকর করা হয়, কুরআন পাঠ করা হয় এবং মুখ থেকেই বেশি দুর্গন্ধ বের হয়। আসলে নাককে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা মুখের সাথে সাদৃশ্য রাখে তাই। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। যেহেতু মিসওয়াক দ্বারা মুখ পবিত্র করার বিধান রয়েছে এবং এ ব্যাপারে জোরালো নির্দেশও দেয়া হয়েছে। আবার শরীয়াতে খাওয়ার পর মুখ ধৌত করার কথা বলা হয়েছে এবং কোন কোন মতে খাওয়ার পূর্বেও মুখ ধৌত করার কথা বলা হয়েছে, সেহেতু বুঝা যায় যে, ইসলামী শরীয়াত নাকের চেয়ে মুখ পবিত্র করার ব্যাপারে বেশি তৎপর। তবে নাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে শুধু তার বিধান বর্ণনা করার জন্য। যেন কেউ নাক ধৌত করা ছেড়ে না দেয়’’।
(৪) অনুরূপভাবে কুলি করার ব্যাপারেও অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার সনদগত অবস্থা হাসান পর্যায়ের। লাকীত বিন সবরাহ এর বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল () বলেন: إِذَا تَوَضَّأْتَ فَمضمض অর্থাৎ: যখন তুমি ওযূ করবে তখন কুলি কর।[7]
আমার বক্তব্য: যদি কেউ বলে যে, কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া ওয়াজিব হওয়ার দলীলগুলোকে  সালাতে ভুলকারীর ঘটনায় বর্ণিত রিফায়াহ বিন রাফেঈ এর হাদীস দ্বারা বৈধতার দিকে ফিরানো যেতে পারে। যেমন সে হাদীসে বলা হয়েছে,
রাসূল () সালাতে ভুলকারীকে বললেন: তোমাদের কারও সালাত ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ্র নির্দেশিত পন্থা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গভাবে ওযূ করা হয়। সুতরাং সে যেন তার মুখমন্ডল ধৌত করে, দু’হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করে, মাথা মাসাহ করে ও দু’পায়ের গিঁঠ পর্যন্ত ধৌত করে।[8]
অত্র হাদীসে আল্লাহ্র নির্দেশের মতই কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং এ হাদীসটি কুরআনের আয়াতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর আয়াতে সংক্ষিপ্তভাবে মুখমন্ডললের কথা উল্লেখ করা হয় নি, যার ফলে এটা বলা যাবে না যে, হাদীস দ্বারা এর ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট করতে হবে। এ মতামতটিও শক্তিশালী এবং  যথোপযুক্ত। আল্লাহ্ই ভাল অবগত।
 কিছু প্রয়োজনীয় কথা:
ওযূ ও গোসল এ দু’টি পবিত্রতার ক্ষেত্রে কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার বিধানের ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে চারটি অভিমত পাওয়া যায়:[9]
১ম অভিমত: কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া শুধু গোসল করার ক্ষেত্রে ওয়াজিব, ওযূর ক্ষেত্রে নয়। ইমাম আবূ হানীফা, সাওরী ও আহলুর রায়গণ এমত পোষণ করেছেন।
২য় অভিমত: ওযূ ও গোসল উভয়ের ক্ষেত্রে এ দু’টি সুন্নাত। এটা ইমাম মালিক, শাফেঈ, লাইস ও আওযায়ীসহ একদল বিদ্বানের অভিমত।
৩য় অভিমত: ওযূ ও গোসল উভয়ের ক্ষেত্রেই এ দু’টি করা ওয়াজিব। এ অভিমত পোষণ করেছেন, আত্বা, ইবনে জুরাইয, ইবনুল মুবারাক ও ইসহাক। এটা ইমাম আহমাদ (রাহি.) এরও একটি রেওয়ায়ত এবং হাম্বলীদের প্রসিদ্ধ মাযহাব।
৪র্থ অভিমত: নাকে পানি দেয়া ওযূ ও গোসলের ক্ষেত্রে ওয়াজিব এবং কুলি করা উভয় ক্ষেত্রে সুন্নাত। একটি বর্ণনা মতে ইমাম আহমাদ এ মত পোষণ করেছেন। আবূ উবাইদ, আবূ ছাওর ও আসহাবে হাদীসের একটি দলও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনুল মুনযির এ মতামতকে পছন্দ করেছেন।
দাড়ি ও মুখমণ্ডলের সমগ্র চুল ধৌত করা:[10]
‘যখন মুখমন্ডলের উপর গজানো সমস্ত চুল তথা দাড়ি, গোঁফ , নিমদাড়ি[11], ভ্রূ, ও দু’চোখের পশমসমূহ ঘন হওয়ার ফলে মুখের চামড়া দেখা না যায়, তাহলে বাহ্যিকভাকে তা ধুয়ে ফেললেই চলবে। আর যদি চামড়া দেখা যায়, তাহলে দাড়ির সাথে চামড়াও ধুয়ে ফেলতে হবে। যদি কিছু অংশ পাতলা হয় আর কিছু অংশ ঘন হয় তাহলে দাড়ির সাথে পাতলা অংশটুকু ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব এবং ঘন অংশটুকু বাহ্যিকভাবে ধুলেই চলবে।
আর যদি দাড়ি লম্বা হয় তাহলে ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) এর মতে ও ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর একটি বর্ণনা মতে, লম্বা অংশটুকু ধোয়া ওয়াজিব নয়, শুধু মুখমন্ডললের সীমানায় যে দাড়িগুলো রয়েছে তা ধৌত করলেই চলবে। কেননা وجه  বা মুখমন্ডল দ্বারা শুধু মুখের চামড়া উদ্দেশ্য।
অপরদিকে, ইমাম শাফেঈর মতে ও ইমাম আহমাদের প্রকাশ্য অভিমতে, লম্বা অংশটুকু ধোয়া ওয়াজিব, দাড়ি যত বড়ই লম্বা হোক না কেন। কেননা যে অংশটুকু ধোয়া ফরয সেখান থেকে এ দাড়ি উদ্গত  হয়েছে। ফলে বাহ্যিকভাবে তা মুখমন্ডললের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
২। দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করাঃ
মহান আল্লাহ্ বলেন:
অর্থাৎ: হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দ-ায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত  হাত ধৌত কর (সূরা মায়েদা- ৬)।
 বিদ্বানগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, ওযূতে উভয় হাত ধৌত করা ওয়াজিব।
জেনে রাখা ভাল যে, আল্লাহ্র বাণী: وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ এর মধ্যে ‘ إِلَى’ অব্যয়টি مع (সাথে) এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ্র বাণী:  وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ অর্থাৎ: তোমরা তাদের মালকে তোমাদের মালের সহিত ভক্ষণ করো না (সূরা নিসা-২)। অন্যত্রে বলা হয়েছে- وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُم - অর্থাৎ: مع قُوَّتِكُم  (এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরও শক্তি বৃদ্ধি করবেন)।
মুবাররাদ বলেন: যখন সীমারেখাটা সীমায়িত বস্ত্তর সত্তা হবে, তখন সীমারেখাটি তার মধ্যে প্রবিষ্ট হবে। এর উপর ভিত্তি করে দু’হাতের কনুইকে ধৌত করার মধ্যে শামিল করা ওয়াজিব। কতিপয় মালিকী ব্যতীত এটাই অধিকাংশ বিদ্বানের অভিমত।[12]
আল্লাহ্র রাসূল () এর আমল এমতামতকে শক্তিশালী করে:
নু’আইম ইবনে আবদুলস্নাহ্ আল-মুজমির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ) কে ওযূ করতে দেখেছি। তিনি খুব ভালোভাবে মুখমন্ডল ধুলেন, এরপর ডান হাত ধুলেন এবং বাহুর কিছু অংশ ধুলেন। পরে বাম হাত ও বাহুর কিছু অংশসহ ধুলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর ডান পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধুলেন, এরপর বাম পাও একইভাবে ধুলেন। অতঃপর বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ () কে এভাবে ওযূ করতে দেখেছি।[13]
এর পর একটি কায়দা হলো: যে বিষয় ছাড়া ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, তা পালন করা ওয়াজিব । তদ্রম্নপভাবে হাত পূর্ণভাবে ধৌত করা বুঝা যায় না যতক্ষণ না দু’কনুই বরাবর পানি প্রবাহিত  করা হয়।[14]
৩। মাথা মাসাহ  করা:
আল্লাহ্ বলেন:
অর্থাৎ: তোমরা তোমাদের মাথা মাসাহ কর (সূরা মায়েদা - ৬) ।
বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, মাথা মাসাহ করা ফরয। তবে কতটুকু পরিমাণ মাসাহ করলে যথেষ্ট হবে, সে পরিমাণ নিয়ে মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনটি মতামত পাওয়া যায়:
 ১ম মতামত: নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা ওয়াজিব:
এটা ইমাম মালিক (রাহি.) এর মাযহাব। ইমাম আহমাদ ও তার অধিকাংশ অনুসারীদের প্রসিদ্ধ মতামত এটিই। আবূ উবাইদ ও ইবনে মুনযিরও এ মত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে তাইমিয়াহ  এ মতটিকে পছন্দ করেছেন।[15] তাদের দলীল  নিম্নরূপ:
(১) আল্লাহ্ বাণী:  وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ - অত্র আয়াতে ‘ب’ (বা) অব্যয়টি إلصاق বা মিলানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং আয়াতের মূল উদ্ধৃতি হবে - وَامْسَحُوا رُءُوسكُمْ - যেমনটি তায়াম্মুমের ক্ষেত্রে সমস্ত মুখমন্ডল মাসাহ করা হয়। কেননা উভয় বিধানটি কুরআনে একই শব্দে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ মুখমন্ডল মাসাহ করার ব্যাপারে বলেন:  فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ ﴿ অর্থাৎ: সমস্ত মুখমন্ডল মাসাহ কর (সূরা মায়েদা -৬)।
(২) এই নির্দেশটিকে মহানাবী () এর বর্ণিত হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে । মহানাবী () যখন ওযূ করতেন তখন সমগ্র মাথা মাসাহ করতেন। তন্মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ বিন যায়েদ বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন:
অর্থাৎ: একবার রাসূল () আমাদের বাড়িতে এলেন। আমরা তাঁকে পিতলের একটি পাত্রে পানি দিলাম। তিনি তা দিয়ে ওযূ করলেন। তার মুখমন্ডল তিনবার ও উভয় হাত দু’বার করে ধৌত করলেন এবং তাঁর হাত সামনে ও পেছনে এনে মাথা মাসাহ করলেন। আর উভয় পা ধৌত করলেন।
অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি তার সমস্ত মাথা মাসাহ করলেন।[17]
(৩) মুগিরাহ বিন শু‘বা (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
অর্থাৎ: রাসূল () একদা ওযূ করলেন, অতঃপর মোজার উপর, মাথার অগ্রভাগে এবং পাগড়ির উপর মাসাহ করলেন।[18]
যদি মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করাই যথেষ্ট হতো, তাহলে তিনি কেন পাগড়ির উপর মাসাহ করলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত মাথাই মাসাহ করা ওয়াজিব।
 ২য় অভিমত : মাথার কিছু অংশ মাসাহ করলেই যথেষ্ট হবে:
এটা ইমাম আবূ হানীফা ও শাফেঈ (রাহি.) এর অভিমত।[19] তারা আবার মতভেদ করেছেন, কতটুকু অংশ মাসাহ করলে যথেষ্ট হবে। কেউ কেউ বলেন, তিন  চুল পরিমাণ মাসাহ করলেই চলবে। কেউ বলেন, মাথার চার ভাগের একভাগ মাসাহ করতে হবে। আবার কারও মতে, মাথার অর্ধেক মাসাহ করতে হবে।  তাদের দলীল হলো:
(১) আল্লাহ্র বাণী -  وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ- আয়াতে ‘ب’ (বা) অব্যয়টি تبعيض তথা আংশিক  অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।  إلصاق বা মিলানোর অর্থে ব্যবহৃত হয় নি।
(২) রাসূল () এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি  ناصيه (নাসিয়া) তথা মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করেছেন।
৩য় অভিমত: নারী ব্যতীত পুরুষদের জন্য সমস্ত মাথা মাসাহ করা ওয়াজিব :
এটা ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর একটি অভিমত। তিনি বলেন, আমি মনে করি: মহিলাদের মাথা মাসাহ করার ব্যাপারে শিথিলতা রয়েছে। হযরত আয়িশা (রা.) তার মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করতেন। ইবনে কুদাম (রাহি.) বলেন, ‘‘ ইমাম আহমাদ (রাহি.) হলেন একজন আহলুল হাদীস বিদ্বান। সুতরাং আল্লাহ্র কৃপায় তাঁর নিকট হাদীস সাব্যাস্ত হওয়া ব্যতীত শুধুমাত্র ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণের প্রত্যাশা করা যায় না।[20]
আমার বক্তব্য (আবূ মালিক): পূর্বের আলোচনার মধ্যে বিশুদ্ধ অভিমত হলো: ওযূতে সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করাই ওয়াজিব। কারণ এর দলীল বেশি শক্তিশালী। আর যারা বলেন যে,  ‘ب’ অব্যয়টি  تبعيض বা আংশিক অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, তাদের এ কথা সঠিক নয়। কেননা সরফের পন্ডিত সিবওয়ায় এ কথাটিকে স্বীয় গ্রন্থে ১৫ বার অস্বীকার করেছেন।  ইবনে বুরহান বলেন: যারা ‘ب’ অব্যয়টি  تبعيض বা আংশিক অর্থ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করেন, তাদের এ কথার কোন ভিত্তি নেই।  কেননা এটা ভাষাবিদদের কাছে অপরিচিত।[21]
রাসূল () এর পক্ষ থেকে একটিও সহীহ হাদীস নেই যে, তিনি মাথার আংশিক মাসাহ করেছেন। তবে তিনি যখন ناصيه (নাসিয়া) বা মাথার অগ্রভগে মাসাহ করেছেন তখন তিনি তা পূর্ণ করার জন্য পাগড়ির উপরও মাসাহ করেছেন।[22]
আর এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য করার ব্যাপারে কোন প্রমাণ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে নারীদের ঘোমটার (খিমার) উপর মাসাহ করা জায়েয । যদি তারা ঘোমটাসহ মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করে তাহলে তা বিতর্কমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তম হবে। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত ।
 প্রয়োজনীয় কথা
মাথায় যদি মেহেদী বা আঠালো দ্রব্যের প্রলেপ লাগানো থাকে, তাহলে তার উপর মাসাহ করা বৈধ:
কেননা মহানাবী () থেকে প্রমাণিত যে, তিনি ইহরাম অবস্থায় মাথার চুলে আঠালো দ্রব্যের প্রলেপ লাগিয়েছেন (এ সংক্রান্ত আলোচনা হাজ্জ অধ্যায়ে আলোচিত হবে)। সুতরাং ওযূর কারণে তা কষ্ট করে খুলে ফেলার প্রয়োজন নেই। কারণ মাথার সাথে যা লাগানো থাকে তা মাথারই আওতাধীন। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত ।
৪। দু’ কান মাসাহ করা:
মাথার সাথে কানদ্বয় মাসাহ করা ওয়াজিব। কেননা  দু’কান মাথার অন্তর্ভুক্ত ।
মহানাবী () এর পক্ষ থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘দু’কান মাথার অন্তর্ভুক্ত’।[23] বিশুদ্ধ অভিমতে হাদীসটি মারফূ সূত্রে যঈফ। তবে অনেক সালাফের পক্ষ থেকে সাব্যাস্ত আছে যে, দু’কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। তাদের মধ্যে ইবনে উমার (রাঃ) অন্যতম।[24]
বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ সাক্ষ্য দেয় যে, মহানাবী () তার মাথা ও দু’কান একবার মাসাহ করেছেন।[25] এটা অনেক সাহাবীর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে। যেমন: আলী (রাঃ), ইবনে আব্বাস(রাঃ), রুবাই (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) । সুনয়ানী (রাহি.) বলেন, তাদের প্রত্যেকেই মাথার সাথে দু’কান একই সাথে মাসাহ করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। যেমন: مرة (&একবার) শব্দটি দ্বারা তা স্পষ্ট বুঝা যায়। যদি তিনি দু‘কানের জন্য নতুনভাবে পানি নিতেন, তাহলে ‘তিনি মাথা ও দু’কান একবার মাসাহ করেছেন’ বলে যে বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে তা সাব্যাস্ত হত না। যদি ধারণা করা হয় যে, এর দ্বরা উদ্দেশ্য তিনি মাসাহ বার বার করেন নি, আর তিনি দু’ কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নিয়েছেন। তাহলে তা হবে সুদূর প্রসারী ধারণা।[26]
আমার বক্তব্য: যদি দু’কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেয়া হয় তাহলে সমস্যা নেই। কেননা এ ব্যাপারে ইবনে উমার (রাঃ) থেকে প্রমাণ সাব্যাস্ত আছে।[27]
সতর্কবাণী: ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা শরীয়াত সম্মত নয় । কেননা এ ব্যাপারে রাসূল () এর পক্ষ থেকে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি।[28]
৫। দুই পা গিঁঠসহ ধৌত করাঃ[29]
অধিকাংশ আহলে সুন্নাহ এর নিকট দু’পা ধৌত করা ওয়াজিব। কেননা মহান আল্লাহ্ বলেন:
 وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ আয়াতে বর্ণিত পূর্বের সকল  مغسولات তথাধৌত করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপর আতফ করার কারণে ‘أَرْجُلَكُمْ’ এ যবর দিয়ে পড়তে হবে।
যে সকল রাবী (বর্ণনাকারী) রাসূল () এর ওযূর করার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তাদের প্রত্যেকেই গিঁঠসহ পা ধৌত করার কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উসমান (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে: ‘অতঃপর তিনি তার দু’পা গিঁঠসহ তিনবার ধৌত করলেন।[30] দু’পায়ের গিঁঠ ধৌত করার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা যখন সীমারেখাটা সীমায়িত বস্ত্তর সত্তা হবে, তখন সীমারেখাটি তার মধ্যে প্রবিষ্ট হবে।  যেমনটি এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারটি ইবনে উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদীস দ্বারাও প্রমাণ করা যায়।
অর্থাৎ: আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সফরে রাসূল () আমাদের পেছনে রয়ে গেলেন। পরে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছলেন, এ দিকে আমরা আসরের সালাত আদায় করতে দেরী করেছিলাম। আর আমরা ওযূ করছিলাম। আমরা আমাদের পা কোনমত পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। তিনি উচ্চস্বরে বললেন: পায়ের গোড়ালীগুলোর (শুষ্কতার) জন্য জাহান্নামের শাস্তি রয়েছে। তিনি দু’বার বা তিনবার একথা বললেন।[31]
আর মহানাবী () এর ওযূর মধ্যে মাসাহ করার ব্যাপারে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা মোজা মাসাহ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটা হলো একটা ওযর। এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করা হবে। এ মাসআলার ব্যাপারে রাফেযী ও অধিকংশ শিয়াপন্থি দ্বিমত পোষণ করেন। তারা বলেন: শুধু দু’পা মাসাহ করা ওয়াজিব, তা ধৌত করার দরকার নেই।
সঠিক কথা হলো: প্রথম মতামতটিই (দু’পা ধৌত করা ওয়াজিব) আমল যোগ্য। আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা বলেন: ‘রাসূল () এর সাহাবাগণ দু’পা ধৌত করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন’।[32]
দু’হাত ও পায়ের আঙ্গুলসমুহ খিলাল করা:
আঙ্গুলসমূহ এবং তার আশে-পাশে  যে অংশ রয়েছে তা ফরযের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা ধৌত করা ওয়াজিব। যদি খিলাল করা ছাড়া ধৌত কার্য সম্পূর্ণ না হয়, তাহলে খিলাল করা ওয়াজিব। আর যদি খিলাল করা ছাড়াই ধৌত কার্য সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে খিলাল করা মুস্তাহাব। সামনে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।
৬। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা:
তারতীব বা ধারাবাহিকতা হলো: ওযূর অঙ্গসমূহকে ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে পবিত্র করা, যে ভাবে আল্লাহ্ আয়াতে কারীমায় নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং প্রথমে মুখমন্ডল, তারপর দু’হাত ধৌত করা, এরপর মাথা মাসাহ করা, এরপর দু’পা ধৌত করা । আলিমদের বিশুদ্ধ অভিমতে: ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব। এটা ইমাম শাফেঈ, হাম্বলী, আবূ সাওর, আবূ ওবাইদ এবং জাহেরী মাযহাবীদের অভিমত।[33]
তারা এটাকে ওয়াজিব বলে নিম্নোক্ত দলীল দিয়ে থাকেন:
(১) আল্লাহ্ তা‘আলা আয়াতে ওযূর ফরযগুলোকে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি দু’পা ধৌত করার কথা থেকে দু‘হাত ধেŠত করার কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন যা কিনা ধৌত করা ফরয, আর হাত ও পা ধৌত করার মাঝে মাথা মাসাহ করার কথা উল্লেখ করেছেন, যা মাসাহ করা ফরয। আর আরবগণ কোন ফায়দা ছাড়া কোন দৃষ্টান্তের একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করেন না। আর এখানে ফায়দা হলো: ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব এ কথাটি বুঝানো।[34]
(২) যে সমস্ত রাবী মহানাবী () এর ওযূর পদ্ধতি বর্ণানা করেছেন, তারা তা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন।[35] আর মহানাবী () এর কর্ম আল্লাহ্র কিতাবের ব্যাখ্যা স্বরূপ।
(৩) বর্ণিত আছে: ‘একদা মহানাবী () ধারাবাহিকভাবে ওযূ করলেন অতঃপর বললেন: এ ভাবেই ওযূ করতে হবে। এ ভাবে ওযূ ব্যতীত সালাত কবুল হবে না’।[36] কিন্তু হাদীসটি যঈফ।
ইমাম মালিক, সাওরী এবং আসহাবে রা’য় এর মতে[37], ওযূতে তারতীব বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা মুস্তাহাব। এটা ওয়াজিব নয়।
তাদের দলীল হলো:
(১) আয়াতে ‘আতফ’ করাটা তারতীব এর দাবীদার নয়। পূর্বের আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
(২) যেমন: আলী  (রাঃ) ও ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন: ‘‘যে অঙ্গগুলোই আগে ধেŠত করা হোক না কেন তাতে কোন সমস্যা নেই’’।[38]
এর বিপক্ষে জবাব দিয়ে ইমাম আহমাদ (রাহি.) ‘মাসাইলু ইবনুহু আবদুল্লাহ’ (২৭-২৮)- তে বলেন: বাম হাতকে ডান হাতের পূর্বে ধৌত করাতে কোন সমস্যা নেই।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দ-ায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা  ধৌত কর (সূরা মায়েদা-৬) সুতরাং ডান হাতকে বাম হাতের পর ধৌত করাতে সমস্যা নেই।
আমার বক্তব্য: সু্ন্নাত অনুসরণের জন্য ডান হাত আগে ধেŠত করাই উত্তম । আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
 ৭। মাওয়ালাত তথা ওযূর অঙ্গগুলো ধৌত করার সময় বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ধৌত করা:
মাওয়ালাত হলো: ওযূর অঙ্গগুলো তাড়াতাড়ি করে ধৌত করা, যেন নাতিশীতোষ্ণ মৌসুমে বিলম্ব করার কারণে ধৌত করা অঙ্গটি পরবর্তী অঙ্গ ধৌত করার আগেই শুকিয়ে না যায়।
ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর প্রাচীন অভিমত ও আহমাদ (রাহি.) এ প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী: মাওয়ালাত ওয়াজিব। ইমাম মালিকও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন । তবে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বকারী এবং ওযরগতভাবে বিলম্বকারীর মাঝে পার্থক্য করেছেন। শাইখুল ইসলাম এ মতটিকে পছন্দ করেছেন।[39]
এটা ওয়াজিব হওয়ার দলীল হলো, উমার ইবনে খাত্ত্বাব (রাঃ) বর্ণিত হাদীস:
অর্থাৎ: একদা এক ব্যক্তি পায়ের নখ পরিমাণ জায়গা বাদ দিয়ে ওযূ করল। নাবী () তা দেখে তাকে বললেন: তুমি গিয়ে উত্তমরূপে ওযূ করে এসো। সুতরাং লোকটি গিয়ে উত্তমরূপে ওযূ করে  সালাত আদায় করল।[40]
অপর এক বর্ণনায় নাবী কারীম ()-এর কতিপয় সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত আছে:
অর্থাৎ: নাবী কারীম () এক ব্যক্তিকে সালাত পড়তে দেখলেন- যার পায়ের পাতার উপরের অংশে এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ঝকঝকে শুকনা ছিল, যাতে ওযূর সময় পানি পৌঁছে নি। নাবী কারীম () তাকে পুনরায় ওযূ করে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন।[41]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) ও শাফেঈ (রাহি.) এর নতুন মতামত অনুযায়ী এটা ওয়াজিব নয়। এটা ইমাম আহমাদ (রাহি.) এরও একটি বর্ণনা এবং ইবনে হাযম এ মতেরই প্রবক্তা।[42] তারা বলেন:
(১) আল্লাহ্ তা‘আলা অঙ্গসমূহ ধৌত করা ফরয করেছেন। সুতরাং যে তা আদায় করবে সে দায়িত্বমুক্ত হবে, চায় সে দেরীতে করুক অথবা যথাসময়ে সুবিন্যস্তভাবে করুক।
(২) না‘ফে থেকে বর্ণিত:
আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বাজারে পেশাব করে ওযূ করলেন, তিনি তার মুখমন্ডল ও উভয় হাত ধৌত করলেন এবং মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর তাকে জানাযার সালাত আদায় করানোর জন্য ডাকা হলো, ফলে তিনি মাসজিদে প্রবেশ করে মোজার উপর মাসাহ করলেন এবং সালাত আদায় করালেন।[1]
(৩) যে সমস্ত হাদীসে ওযূ ও সালাত পুনরায় আদায় করার কথা বলা হয়েছে সে সমস্ত হাদীসকে তারা যঈফ মনে করেন।
(৪) তারা মহানাবী () এর বাণী- ارْجِعْ فَأَحْسِنْ وُضُوءَكَ -এর তাবীল করে বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল পায়ের যে স্থানে পানি পৌঁছে নি তা পরিপূর্ণভাবে ধৌত করা।
আমার বক্তব্য: পূর্বোলেস্নখিত দ্বন্দ্বের সারকথায় বলা যায়, খালিদ বিন মি’দান থেকে নাবী করীম () - এর কতিপয় সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যেখানে ওযূ ও সালাত পুনরায় আদায় করার আদেশ দেয়া হয়েছে’’ সেটিকে যারা সহীহ হাদীস মনে করেন তারা এক অঙ্গ শুকানোর পূর্বে অন্য অঙ্গ ধোয়া ওয়াজিব মনে করেন। এছাড়া বাকি দলীলগুলো সম্ভবনাময়। আমার কাছে মনে হয়, এ হাদীসটির কারণে এক অঙ্গ শুকানোর পূর্বে অন্য অঙ্গ ধোয়া ওয়াজিব। কেননা ওযূ হলো একটি ইবাদাত। সুতরাং তাতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করার ক্ষেত্রে পার্থক্য বা বিলম্বিত করা যাবে না। আর ইবনে উমার এর আসারটিতে প্রকাশ্য বুঝা যায় যে, তা ছিল ওযর ও বাধ্যগত অবস্থায়। সুতরাং, স্বাভাবিক অবস্থাকে তার উপর কিয়াস করা যাবে না । আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
তবে যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধৌত করার ক্ষেত্রে সময়ের সামান্য ব্যবধান হয় তাহলে কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
দলীলের উৎসঃ
[1] নাসলুল আউতার (১/১৭৪), আহকামুল কুরআন (২/৫৬৩) ইবনুল আরাবী প্রণীত।
[2] শারহুল উম্মদাহ (১/১৭৮) ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রণীত। আত-তামাহীদ (৪/৫৬৩) ইবনু আব্দিল বার প্রণীত।
[3] সহীহ; বুখারী (১৬১), মুসলিম (২৩৭) প্রভৃতি।
[4] সহীহ; মুসলিম (২৩৭)।
[5] সহীহ; এর তাহকীক সামনে কয়েকবার আসবে।
[6] শারহুল উম্মদাহ (১/১৭৯-১৮০)।
[7] সহীহ; আবূ দাউদ (১৪০), তিরমিযী (৩৮), নাসাঈ (১/৬৬), ইবনে মাজাহ (৪৪৮)।
[8] সহীহ; আবূ দাউদ (৮৫৯), তিরমিযী (৩০২), নাসাঈ (২/২০, ১৯৩) ইবনে মাজাহ (৪৬০) প্রভৃতি।
[9] আল-মারওয়াযী প্রণীত ‘ইখতিলাফুল উলামা’ (পৃ. ২৩-২৪) আত-তামহীদ (৪/৩৪), আল-আউসাত (১/৩৭৯) ইবনু জাওযীর আত-তাহক্বীক (১/১৪৩), আল-মুহালস্না (২/৫০)।
[10] শরহেফাতহুল কাদীর (১/১২), আল-মুগনী (১/৮৭) আল-মাজেমু’ (১/৩৮০)।
[11] নিচের ঠোঁট ও থুতনির মাঝে গজানো কেশগুচ্ছকে নিমদাড়ী বলা হয়।
[12] আলমাসবূত্ব (১/৬), বিদায়াতুল মুজতাহিদ (১/১১), আলমাজমু (১/৩৮৯), আল-মুগনী (১/৯০)।
[13] সহীহ; মুসলিম (২৪৬)।
[14] আলস্নামা গামেদী প্রণীত ‘ইখতিয়ারাতু ইবনে কুদামাহ’ (১/১৬৪)।
[15] আল-মাদূনাহ (১/১৬), আল-মুগনী (১/৯২), আত্বাহুর (পৃ. ৩৫৮), আল-আউসাত (১/৩৯৯), মাজমু’ আল ফাতাওয়া (২১/১২৩)।
[16] التورঅর্থ: পাত্র অথবা পিয়ালা। আর الصفرঅর্থ: উত্তম পিতল।
[17] সহীহ; বুখারী (১৮৫), মুসলিম (২৩৫)।
[18] মুসলিম (১৭৫), আবূ দাউদ (১৫০), তিরমিযী (১০০), এ হাদীসের ব্যাপারে সমালোচনা করা হয়েছে, তবে আলবানী একে সহীহ বলেছেন।
[19] আল-মাসবূত্ব (১/৮), আল-মাজমু’ (১/৩৯৯), আল-মুগনী (১/৯২)।
[20] আল-মুগনী (১/৯৩)।
[21] নাসলুল আওতার (১/১৫৫), আল মুগনী (১/৮৭)।
[22] মাজমু’ আল ফাতাওয়া (২১/১২২), ইবনুল আরাবী প্রণীত আহকামুল কুরআন (২/৫৭১), সুবুলুস সালাম (১/১০৭)।
[23] যঈফ; এর অনেকগুলো সূত্র রয়েছে, যার প্রত্যেকটিই ত্রম্নটিযুক্ত। এর সমষ্টি দ্বারা ‘হাসান’ আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য করা হয়েছে। এমনকি- আলবানী (রহঃ) তাঁর ‘আছ-সহীহা’ (১/৫৫) গ্রন্থে বলেন, কতিপয় উলামা এ হাদীসকে মুতাওয়াতির পর্যায়ের বলে ধারণা করে থাকেন। আমাদের শাইখ এ হাদীসটি তার আন-নাযরাত কিতাবে উল্লেখ করে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন। আর এটাই অতি উত্তম। অতপর সুপ্রসিদ্ধ শাইখ ‘হাসান’ ইমাম বাইহাক্বী প্রণীত আল-খালাফিয়্যাত (১/৪৪৮) এর হাশিয়া অতিনিপূণ ভাবে অনুসন্ধান শেষে একে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন।
[24] এর সনদ হাসান; দারাকুতনী (১/৯৮), ইবনে আবী শাইবাহ (১/২৮) প্রভৃতি।
[25] সহীহ; আবূ দাউদ (১৩৩), তিরমিযী (৩৬), নাসাঈ (১/৭৪), ইবনে মাজাহ (৪৩৯) প্রভৃতি। ইবনে আববাসের সূত্রে এ হাদীসের বেশ কয়েকটি সূত্র পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে একে সহীহ আখ্যা দেওয়া হয়। এর মূল সনদ ইমাম বুখারী সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন (১৫৭)। এবং রুবাঈ বিনতে মুয়াববিয এর হাদীসটি তার শাহেদ। যা আবূ দাউদ (১২৬) তিরমিযী (৩৩), ইবনে মাজাহ (৪১৮) বর্ণনা করেছেন, আর এমন হাদীস মিকদাম ইবনে মা’দিকারিব থেকে ও বর্ণিত হয়েছে।
[26] সুবুলুস সালাম (১/৪৯)।
[27] তার সনদ সহীহ; মুসনাদে আবদুর রাযযাকে (২৯) বাইহাক্বী (১/৬৫)।
[28] মাজেমু’ ফাতাওয়া (১/৫৬), যাদুল মায়াদ (১/৪৯) আস-সিলসিলাতুয যাঈফা (৬৯-৭৪৪)।
[29] দু‘পায়ের গোঁড়ায় উদ্গত উঁচু হাড্ডিকে কা‘ব গিঠ বলা হয়।
[30] সহীহ; বুখারী (১৫৮), মুসলিম (২২৬)।
[31] সহীহ; বুখারী (১৬১), মুসলিম (২৪১)।
[32] ফতহুল বারী (১/২৬৬), আল-মুগনী (১/১২০)।
[33] আল-মাজমু’ (১/৪৩৩), আল-মুগনী (১/১০০), আল-মুহালস্না (২/৬৬)।
[34] অনুরূপ এসেছে আল মুগনী (১/১০০) তে।
[35] ওজুর বৈশিষ্ট বর্ণনায় নবী (স:) থেকে ২০ জন সাহাবীর বর্ণনা এসেছে, যার মধ্যে এ দুটি যঈফ হাদীস ছাড়া প্রত্যেকটি ধারাবাহিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে আলবানী এ দু’টি হাদীসকে সহীহ বলেছেন। যেমন এসছে তামামুল মিন্না’ (৮৫ পৃ.) গ্রন্থে।
[36] যঈফ; আল-ইরওয়া (৮৫)।
[37] মাদূনাহ্ (১/১৪), আল-মাসবূত্ব (১/৫৫), শরহে ফতহুল কাদীর (১/৩০)।
[38] এটা আলী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি আসার হাদীস যা আহমাদ আল-ইলালে বর্ণনা করেছেন (১/২০৫), ইবনে অবি শায়বাহ (১/৫৫) দারাকুতনী (১/৮৮) গ্রন্থে যঈফ সনদে। এছাড়া এ মর্মে ইবনে মাসউদ থেকেও একটি আসার হাদীস এসেছে, যা ইমাম বুখারী তার আত-তারিখ (১৬৫০), আবু উবাঈদ তার আত-ত্বাহুর (৩২৫) গ্রন্থে হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। তবে সেখানে "إن شاء بدأ فى الوضوء بيساره" শব্দে এসেছে। যেমনটি ইমাম আহমাদ উল্লেখ করেছেন।
[39] আল-উম্ম (১/৩০), আল মাজমু’ (১/৪৫১), কাশশাফুল কান্না (১/৯৩), আল-মাদূনাহ (১/১৫), আল-ইসিত্মযকার (১/২৬৭) মাজমু’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৩৫)।
[40] সহীহ; মুসলিম (২৩২), ইবনে মাজাহ (৬৬৬), আহমাদ (১/২১)। কেউ কেউ এর সমালোচনা করেছেন। তবে এ হাদীসের কিছু শাহেদ হাদীস আছে, যার দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে এ হাদীসকে সহীহ বলা হয়। আত-তালখীস (১/৯৫), আল-ইরওয়্য (৮৬)।
[41] আলবানী একে সহীহ বলেছেন; আবূ দাউদ (১৭৫) আহমাদ (৩/৪২৪), বাকিয়্যাহ বিন ওয়ালীদ বুহাইর থেকে এবং বুহাইর খালেদ থেকে। আহমাদের বর্ণনা মতে, বাকিয়্যাহ বুহাইর থেকে শুনার কথাটি স্পষ্ট করেছেন। আহমাদ এর সনদটি উত্তম বলেছেন। এ জন্য আলবনী (রহ:) ইরওয়াতে (৮৬) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আমার মতে, যদি বাকিয়্যাহ এর পÿ থেকে তাসবিয়্যাহ এর আশঙ্কা না থাকত তাহলে তা হাসান হত। আর বুহাইর খালেদ থেকে শুনেছেন এ কথা স্পষ্ট নয়।
[42] আল-মাসবূত্ব (১/৫৬), আল-উম্ম (১/৩০), আলমাজমু’ (১/৪৫১) আলমুহালস্না (২/৭০)।
[43] এর সনদ সহীহ; মুয়াত্তা মালেক (৪৮), শাফেঈ (১৬) ইমাম বাইহাক্বী প্রণীত আল-মা'রেফাহ (৯৯)।
যে সকল কাজে ওযূ নষ্ট হয় না
এ কাজগুলো করলে ওযূ ভঙ্গ হবে কিনা এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। তবে বাস্তবে এ কাজগুলো করলে ওযূ নষ্ট হয় না। আর সে কাজগুলো হলো:
১। কোন পর্দা ছাড়া পুরুষ মহিলাকে স্পর্শ করলে এ মাসআলাটির ব্যাপারে তিনটি অভিমত পরিলক্ষিত হয়:
১ম : অভিমত:
সাধারণ ভাবে পুরুষ মহিলাকে স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে। এটা ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর অভিমত । ইবনে হাযম এমতটি সমর্থন করেছেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে উমার (রাঃ) এ মতেরই প্রবক্তা।[1]
২য় অভিমত :
সাধারণ ভাবে এ অবস্থায় ওযূ নষ্ট হবে না। এটা ইমাম আবূ হানীফা। মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানী (রাহি.) এর অভিমত। ইবনে আব্বাস, ত্বউস,  হাসান ও আত্বাও এমত পেশ করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ এই মতটি পছন্দ করেছেন।[2] এটিই বিশুদ্ধ অভিমত।
৩য় মতামত:
কাম প্রবৃত্তিসহ যদি মহিলাকে স্পর্শ করা হয়, তাহলে ওযূ নষ্ট হবে। এটা ইমাম মালিক এর মতামত। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী ইমাম আহমাদ (রাহি.) এ অভিমত পেশ করেছেন।[3]
 আমার বক্তব্য: মূলতঃ মহিলাকে স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে মর্মে যারা মতামত দিয়েছেন, তাদের দলীল হলো: আল্লাহ্র বাণী:
﴿أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا 
তোমরা স্ত্রী সম্ভোগ কর, তবে যদি পানি না পাও তাহলে তায়াম্মুম কর। (সূরা : আন-নিসা-৪৩)
ইবনে মাসউদ (রাঃ)ও ইবনে উমার (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, "أن ألمس دون الجماع"  অর্থাৎ: সহবাস ছাড়া শুধু স্পর্শ করাকেই مس বলা হয়।[4]
হিবরুল উম্মাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাদের মতের বিপক্ষে মত পেশ করে বলেন, لمسمس ও مباشرة দ্বারা উদ্দেশ্যجماع   বা সহবাস। মহান আল্লাহ্ এ শব্দগুলো ইঙ্গিতসূচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।[5] আর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, তার তাফসীরটা অন্যান্য মুফাসসিরদের উপর অগ্রগণ্য। উপরন্ত স্বয়ং আয়াত দ্বারাও এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে।
আল্লাহ্র বাণী- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا  ﴿  হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের ধৌত কর (সূরা : মায়েদা -৬)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য, ছোট নাপাকী হতে পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা।
অতঃপর আল্লাহ্ বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا ﴿ যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও (সূরা : মায়েদা -৬)। এর দ্বারা উদ্দেশ্য, বড় নাপাকী হতে পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা। এরপর আল্লাহ্ বলেন:
﴿وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا﴾
আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর (সূরা : মায়েদা -৬)। অত্র আয়াতে ‘فَتَيَمَّمُوا’ শব্দটি দু‘প্রকার ত্বহারাত (ছোট ত্বহারাত ও বড় ত্বহারাত) এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত। সুতরাং, আল্লাহ্র বাণী- أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ দ্বারা ছোট ত্বহারাতের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। আর أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ দ্বারা বড় ত্বহারাতের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।[6]
আর ইমাম শাফেঈ অত্র আয়াতে المس এর অর্থ স্পর্শ করা উদ্দেশ্য নিয়েছেন, মূলত তা তিনি অকাট্য ও সুদৃঢ় ভাবে এ অর্থ গ্রহণ করেন নি বরং বাহ্যিক ভাবে তার কথা দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি সতর্কতা মূলক একথা বলেছেন।[7] যেমন তিনি الأم নামক গ্রন্থের (১/১২ পৃ.) এ আয়াতটি উল্লেখ করার পর বলেন, পেশাব-পায়খানার কারণে ওযূ ওয়াজিব হওয়াটা সাদৃশ্য রাখে স্পর্শ করার কারণে ওযূ ওয়াজিব হওয়ার সাথে। কেননা الملامسة শব্দটি جنابة শব্দ উল্লেখ করার পর غائط শব্দের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং الملامسة শব্দটি সহবাস ছাড়া হাত দ্বারা স্পর্শ করা ও চুমু খাওয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ মতের সমর্থনে ইবনে আব্দুল বার ইমাম শাফেঈ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, ইমাম শাফেঈ বলেন, স্ত্রীকে চুমু খাওয়ার ব্যাপারে মা’বাদ বিন নাবাতহ থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে[8], তিনি বলেন: চুমু খাওয়া ও স্ত্রী স্পর্শ করার কারণে ওযূ করতে হবে বলে আমি মনে করি না। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী তালখীস গ্রন্থে (৪৪ পৃঃ)  অনুরূপ হাদীস সংকলন করেছেন।
 আমার বক্তব্য: স্ত্রীকে স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে না। এর সমর্থনে নিমেণর দলীলগুলো পেশ করা যায়:
(1) عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْفَقَدْتُ رَسُولَ اللهِ  لَيْلَةً مِنَ الْفِرَاشِ فَالْتَمَسْتُهُ فَوَقَعَتْ يَدِي عَلَى بَطْنِ قَدَمَيْهِ وَهُوَ فِي الْمَسْجِدِ وَهُمَا مَنْصُوبَتَانِ وَهُوَ يَقُولُ: «اللهُمَّ أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ....
(১) অর্থাৎ, আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসুলুল্লাহ () কে বিছানায় পেলাম না। আমি তাঁকে খোঁজ করতে লাগলাম। হঠাৎ আমার হাত তাঁর পায়ের তালুতে গিয়ে ঠেকল। তিনি সাজদায় ছিলেন এবং তাঁর পা দুটো দাঁড় করানো ছিল। এ অবস্থায় তিনি বলছেন : ‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার অসন্তুষ্টি থেকে তোমার সন্তুষ্টির আশ্রয় চাই।....[9]
(2) عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ  ، أَنَّهَا قَالَتْكُنْتُ أَنَامُ بَيْنَ يَدَيْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرِجْلاَيَ، فِي قِبْلَتِهِ فَإِذَا سَجَدَ غَمَزَنِي، فَقَبَضْتُ رِجْلَيَّ، فَإِذَا قَامَ بَسَطْتُهُمَا» ، قَالَتْوَالبُيُوتُ يَوْمَئِذٍ لَيْسَ فِيهَا مَصَابِيحُ
(২) অর্থাৎ, ‘আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসুলুল্লাহ () এর সামনে ঘুমাতাম, আমার পা দু’খানা তাঁর কিবলার দিকে ছিল। তিনি সাজদায় গেলে আমার পায়ে মৃদু চাপ দিতেন, তখন আমি পা দু’খানা সংকুচিত করতাম। আর তিনি দাঁড়িয়ে গেলে আমি পা দু’খানা সম্প্রসারিত করতাম। তিনি বলেন : সে সময় ঘরগুলোতে বাতি ছিল না।[10]
অপর বর্ণনায় রয়েছে, حَتَّى إِذَا أَرَادَ أَنْ يُوتِرَ مَسَّنِي بِرِجْلِهِ অর্থাৎ, এমনকি তিনি যখন সাজদা দিতেন, তখন আমাকে তাঁর পা দ্বারা স্পর্শ করতেন।[11]
(৩) মুসলমানরা সর্বদা তাদের স্ত্রীদের স্পর্শ করতেন। তাদের কেউ বর্ণনা করেন নি যে, এর কারণে মহানাবী () তাদের ওযূ করার নির্দেশ দিয়েছন। সাহাবাদের থেকে কেউ এ কথাও বর্ণনা করেন নি যে, মহানাবী () তাঁর জীবদ্দশায় এর কারণে ওযূ করেছেন। এমন কি রাসূল () এর  পক্ষ থেকেও এরূপ বর্ণিত হয় নি যে, তিনি এর জন্য ওযূ করেছেন। বরং মহানাবী () এর পক্ষ থেকে এর বিপরীত এটাই বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘তিনি তার কোন স্ত্রীকে চুম্বন করতেন। অথচ ওযূ করতেন না’’।[12] এ হাদীসটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কোন মতভেদ নেই যে, স্পর্শ করার ফলে ওযূ করতে হবে এমন বর্ণনা রাসূল () এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়নি।[13] আর ‘‘কাম প্রবৃত্তির সাথে স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে এবং কাম প্রবৃত্তির ছাড়া স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে না’’ এমন মতামতের কোন দলীল নেই। তবে এ কথা বলা  হয়ে থাকে যে, যদি সহবাস ব্যতীত কাম প্রবৃত্তিসহ স্পর্শ করার ফলে ওযূ করা হয় তাহলে তা কামপ্রবৃত্তি মিটিয়ে দেয়ার জন্য উত্তম হবে। যেমনটি রাগ মিটানোর জন্য ওযূ করা উত্তম। তবে তা ওয়াজিব নয়। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
২। অস্বাভাবিক রক্তপ্রবাহিত হওয়া, চাই তা যখমের কারণে হোক বা সিঙ্গা লাগানোর জন্যই হোক, কম হোক বা বেশি হোক:
বিদ্বানগণের বিশুদ্ধ মতে, এ কারণে ওযূ নষ্ট হবে না। এটা ইমাম শাফেঈ, মালিক ও আবূ হানীফা (রাহি.) এর অভিমত। আর হাম্বলী মাযহাবের মতে, রক্ত যখন বেশি প্রবাহিত হবে তখন ওযূ নষ্ট হবে।[14] তবে প্রথম মতটি কয়েকটি কারণে বিশুদ্ধ:
(১) যে  হাদীস গুলোতে এর কারণে ওযূ করাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে , তার কোনটিও সহীহ নয়।
(২) মূলতঃ ওযূকারীর ওযূ ঠিক থাকবে। শরীয়াতের দলীল অথবা ইজমা ছাড়া ওযূ ভঙ্গ হবে বলে দাবী করা ঠিক হবে না।
(৩) যাতুর রিকা যুদ্ধের ঘটনায় বর্ণিত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) এর হাদীসে বলা হয়েছে,
অর্থাৎ, মুহাজির সাহাবী বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়েন এবং আনসার সাহাবী সালাত রত হন। তখন শত্রম্ন পক্ষের ব্যক্তি সেখানে আগমন করে এবং মুসলিম বাহিনীর একজন গোয়েন্দা মনে করে তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করে এবং তা আনসার সাহাবীর শরীরে বিদ্ধ হয়। তিনি তা দেহ থেকে বের করে ফেলেন। মুশরিক ব্যক্তি এভাবে পরপর তিনটি তীর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি রুকু সাজদা করে (সালাত শেষ করার পর) তাঁর সাথীকে জাগ্রত করেন। অতঃপর সে ব্যক্তি সেখানে অনেক লোক আছে এবং তারা সতর্ক হয়ে গেছে মনে করে পালিয়ে যায়। পরে মুহাজির সাহাবী আনসার সাহাবীর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে আশ্চর্যন্বিত হয়ে বলেন, সুবহানালস্নাহ! শত্রম্ন পক্ষের প্রথম তীর নিক্ষপের সময় কেন আপনি আমাকে সতর্ক করেননি? জবাবে তিনি বলেন, আমি সালাতের মধ্যে (তন্ময়তার সাথে) এমন একটি সূরা পাঠ করছিলাম যা শেষ না করে পরিত্যাগ করা পছন্দ করিনি।[15]
অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মহানাবী () এ ব্যাপারে জানার পর  এতো রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পরও সালাতে অবিচল থাকতে নিষেধ করেন নি। যদি রক্ত ওযূ ভঙ্গেঁর কারণ হ’ত  তাহলে মহানাবী  () সে ব্যক্তিকে বা সে যুদ্ধে যারা ছিল তাদের কাছে এ বিষয়টি বর্ণনা করতেন। আর প্রয়োজনীয় সময় ছাড়া পরে বর্ণনা করা বৈধ নয়।[16]
(৪) সহীহ সূত্রে বর্ণিত যে,-অর্থাৎ, উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) যখন যখম প্রাপ্ত তখন তিনি  সালাত আদায় করলেন অথচ তাঁর জখম হতে তখন রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল।
(৫) মুতওয়াতির পর্যায়ের অনেক হাদীস রয়েছে যে, আল্লাহ্র রাস্থায় জিহাদ কারী  মোজাহিদ গণ তাদের যখমের কারণে প্রবাহিত রক্ত বন্ধ করতে সক্ষম হতনা। এর ফলে তাদের কাপড় নোংরা হয়ে যেত। অথচ তারা এমতাবস্থায় সালাত আদায় করতেন। রাসুল ()  এর পক্ষ থেকে কেউ এ কথা বর্ণনা করেন নি যে, এমতাবস্থায় মহানাবী () তাদের সালাত বাতিল করতে বলেছেন বা তাদেরকে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। এ জন্য হাসান বসরী (রাহি.) বলেন:  مَا زَالَ المُسْلِمُونَ يُصَلُّونَ فِي جِرَاحَاتِهِمْ অর্থাৎ,‘‘মুসলমানেরা সবদায় তাদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত বা জখম থাকা অবস্থায় সালাত আদায় করতেন’’।[17]
৩। বমি বা অনুরূপ কিছু:
রক্ত প্রবাহিত হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণ যে মতামত পেশ করেছেন, বমির ব্যাপারেও একই মতামত পেশ করেছেন। তবে বিশুদ্ধ মত হলো বমির কারণে ওযূ ভঙ্গ হবে না। কেননা এ ক্ষেত্রে ওযূ করা ওয়াজিব বলে কোন সহীহ প্রমাণ নেই। সুতরাং তা মূলের উপর বহাল থাকবে।
আর আবূ দারদা থেকে মিদান বিন আবূ তালহা বর্ণিত হাদীস-
অর্থাৎ, রাসূল () বমি করলেন। অতঃপর ইফতার করে ওযূ করলেন।[18]
এতে নিসন্দেহ বলা যায় যে, এর দ্বারা বমি হওয়ার ফলে ওযূ করা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেননা এটা শুধু মহানাবী () এর কর্ম। সুতরাং তা মুস্তাহাব হওয়ার উপর প্রমাণ করছে। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
৪। সালাতে বা  সালাতের বাইরে অট্টহাসি হাসা:
বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, সালাতের বাইরে হাসা হাসি করলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না এবং ওযূকে ওয়াজিব করে না। বিদ্বান গণ এ ব্যাপারেও একমত যে, সালাতের মাঝে হাসা-হাসি করলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে। তবে তার সালাতের মাঝে হাসা-হাসি করলে ওযূ ভঙ্গ হবে কিনা এ নিয়ে মতভেদ করেছেন। আবূ হানীফা  আসহাবে রা’য়, সাওরী, হাসান  ও নাখঈ (রাহি.) এর মতে, ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তারা একটি মুনকাতিঈ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন, যা দলীলের যোগ্য নয়। আর তা হল আবূল আলিয়ার হাদীস -
অর্থাৎ, আবূ আলিয়া থেকে বর্ণিত, মহানাবী () একদা সাহাবাদের নিয়ে সালাত আদায় করানো অবস্থায় এক অন্ধ ব্যক্তি এসে মাসজিদের এক গর্তে পড়ে গেলে কওমের একদল মানুষ হাসতে লাগল। ফলে রাসূল () তাদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, যে হেসেছে সে যেন পুনরায় ওযূ করে সালাত আদায় করে।[19]
অপর পক্ষে, মারফূ সূত্রে জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে সাব্যাস্ত আছে যে, একদা তাকে (জাবির কে) জিজ্ঞেস করা হলো, যদি কোন ব্যক্তি সালাতে হাসে তাহলে তার বিধান কি হবে? তখন তিনি উত্তরে বললেন, يعيد الصلاة ولا يعيد الوضوء   -অর্থাৎ, সে পুনরায়  সালাত আদায় করবে। তবে পুনরায় ওযূ করবে না ।[20] অত্র হাদীসে উল্লেখিত মতামতটিই বিশুদ্ধ। এটা ইমাম শাফেঈ, মালিক, আহমাদ, ইসহাক ও আবূ ছাওর (রাহি.) এর অভিমত ।[21]
৫। মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে এবং তাকে বহন করলে :
বিশুদ্ধ মতে, যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাবে অথবা তাকে বহন করবে, তার ওযূ নষ্ট হবে না। তবে কতিপয় বিদ্বান বলেছেন মুস্তাহাব হলো যে ব্যক্তি কোন মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাবে সে গোসল করবে, আর তাকে বহন করলে ওযূ করবে।
যেমন আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ, আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাবে সে গোসল করবে, আর তাকে বহন করলে ওযূ করবে।[22] যদি হাদীসটি সহীহ হয়।
৬। বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে ওযূকারীর সন্দেহ:
যে ব্যক্তি সঠিকভাবে ওযূ করার পর মনে মনে সন্দেহ  করে যে, তার কি বায়ু নির্গত হল না হল না? তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে পবিত্রতার মৌলিকতার উপরই অটল থাকবে। অর্থাৎ তার ওযূ নষ্ট হবে না। আর যদি সালাতের মাঝে বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করে তাহলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সালাত ছাড়বে না। আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) বলেন:
অর্থাৎ: এক ব্যক্তি নাবী করীম () এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করেন যে, সে সালাতের মধ্যে অনুভব করে যে, তার পিছনের রাস্তা হতে বায়ু নির্গত হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন : যে পর্যন্ত কেউ বায়ু নির্গমনের শব্দ বা দুর্গন্ধ না পাবে ততক্ষণ সালাত পরিত্যাগ করবে না।[23]
আল্লামা বাগাভী (রাহি.) ‘‘শারহুস সুন্নাহ’’ গ্রন্থে (১/৩৫৩পৃ;) বলেন, এর অর্থ হলো যতক্ষণ পর্যন্ত বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হবে। কেননা এ ক্ষেত্রে শব্দ শুনা ও বায়ুর অস্তিত্ব পাওয়া শর্ত।
দলীলের উৎসঃ
[1] আলউম্ম (১/১৫), আল-মাজমু’ (২/২৩-এবং তার পরবর্তী অংশ) আল-মুহালস্না (১/২৪৪)।
[2] আল-মাসবূত্ব (১/৬৮), আল-বাদাঈ (১/৩০), আল-আওসাত্ব (১/১২৬), মাজমু’ আল-ফাতাওয়া (২১/৪১০)।
[3] আল-মুদওয়ানাহ (১/১৩), হাশিয়াতুদ দাসওয়াকী (১/১১৯) আল-মুগনী (১/১৯২), আল কাশশাফুল কান্না’ (১/১৪৫)।
[4] সহীহ; তাফসীরে আত-ত্বাবারী (১/২০৫), বিশুদ্ধ সনদে।
[5] এর সনদ সহীহ; ত্বাবারী (৯৫৮১), ইবনু আবী শায়বাহ (১/১৬৬)।
[6] আশ-শারহুল মুমতি’ (১/২৩৯) এবং অনুরূপ বর্ণনা এসেছে আল-আওসাত্ব (১/১২৮) গ্রন্থে।
[7] শায়েখ মাশহুর (আলস্নাহ তাকে হিফাযত করুন) তার বিশেস্নষন গ্রন্থ ‘খিলাফিয়্যাত’ (২/২১৭) এ বর্ণনা করেছেন।
[8] এটা আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস, যাতে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সালাতে বের হওয়ার পূর্বে তাঁর স্ত্রীদের চুম্বন করা প্রসঙ্গে বিবরণ এসেছে। এ সম্পর্কে সামনে আরো হাদীস আসবে।
[9] সহীহ; মুসলিম (২২২), আবূ দাউদ, (৮৬৫), তিরমিযী (৩৮১৯)।
[10] সহীহ; বুখারী (৩৮২), মুসলিম (২৭২) প্রভৃতি।
[11] এর সনদ স সহীহ; নাসাঈ (১/১০১)।
[12] ইমামগণ এর ত্রম্নটি বর্ণনা করেছেন; আবূ দাউদ (১৭৮) নাসাঈ (১/১০৪), পূর্ববর্তী আইম্মায়ে কেরামও এর ত্রম্নটি বর্ণনা করেছেন। যেমন এসেছে ‘সুনানু আদ-দারাকুতনী (১/১৩৫-১৪২)।
[13] মাজমু’ আল-ফাতওয়া (২১/৪১০, ২০/২২২) এছাড়া আরও কয়েক জায়গায় এ সম্পর্কিত আলোচনা এসেছে।
[14] আল-উম্ম (১/১৮০), আল-মাজমু’ (২/৫৫), আল-ইসিত্মযকরে (২/২৬৯) আল-মাসবূত্ব (১/৭৪), আল-মুগনী (১/১৮৪)।
[15] এর সনদ দুর্বল; ইমাম বুখারী (১/২৮০) মুয়ালস্নাক সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবূ দাউদ (১৯৫) আহমাদ (৩/৩৪৩), ইবনে হিববান (১০৯৬), হাকিম (১/১৫৬) দারাকুতনী (১/২২৩) এর সনদে আক্বিল বিন যাবের আসার কারণে যঈফ। আলবানী তার সহীহ আবূ দাউদ (১৯৩) গ্রন্থে সহীহ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
[16] আস-সায়লুল জারার (১/৯৯)।
[17] বুখারী (১/২৮০) মুয়ালস্নাক সূত্রে। ইবনু আবী শায়বাহ এ হাদীসটি সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। যেমনটি এসেছে-ফাতহুলবারী (১/২৮১)।
[18] সহীহ; তিরমিযী (৮৭), আবূ দাউদ (২৩৮১), আল-ইরওয়া (১১১)।
[19] এর সনদ খুবই দুর্বল; দারাকুতনী (১/১৬২), ইবনু আদী (২/৭১৬)।
[20] মাওকুফ সহীহ; বুখারী (১/২৮০) মুয়ালস্নাক সূত্রে, বাইহাকী (১/১৪৪) দারাকুতনী (১/১৭২)।
[21] আল-মাজমু’ (২/৬১), আল-কাফী (১/১৫১), আল-মুগনী (১/১১৭) আল-আওসাত্ব (১/২২৭)।
[22] আবূ দাউদ (৩১৬২), তিরমিযী (৯৯৩), ইবনে মাজাহ (১৪৬৩), আহমাদ (২/৪৩৩), ইমাম তিরমিযী, ইবনে হাজার আসকালানী ও আলবানী এ হাদীসকে হাসান বলেছেন, আল-ইরওয়া (১/১৭৪)। তবে স্পষ্ট কথা হলো, এটি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা এটাকে ত্রম্নটিযুক্ত বলা হয়েছে।
[23] সহীহ; কিছু পূর্বেই এর তাখরীজ করা হয়েছে।
ওযূর সুন্নাতসমূহ
১। মিসওয়াক করা:
কোন কোন সময় মিসওয়াক করা মুস্তাহাব: সে বিষয়ে ‘‘سنن الفطرة’’ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
২। ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা:
সকল কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা শরীয়াত সম্মত উত্তম কাজ। ওযূর সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলার ব্যাপারে কিছু যঈফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যদিও কতিপয় আলিম এগুলোকে সহীহ বলেছেন।
তন্মধ্যে একটি হাদীস হলো:
অর্থাৎ: যে ওযূর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলল না তার ওযূ হবে না।[1] এ ব্যাপারে আরও হাদীস রয়েছে, যেগুলো নিতান্তই যঈফ। এটা দলীলের অযোগ্য। এজন্য ইমাম আহমাদ (রাহি.) বলেন, এ ব্যাপারে সহীহ সনদে বর্ণিত কোন হাদীস আছে বলে আমার জানা নেই।
আমার বক্তব্য: যে সমস্ত রাবী রাসূল () এর ওযূর পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন, তাদের বর্ণিত হাদীসগুলো ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব না হওয়াকেই শক্তিশালী করে। তারা কেউ হাদীসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার কথা উল্লেখ করেন নি। এটা ইমাম সাওরী, মালিক, শাফেঈ ও আসহাবে রা’য়দের অভিমত এবং ইমাম আহমাদের একটি বর্ণনা।[2]
৩। ওযূর শুরুতে দু’হাত কব্জিসহ ধৌত করা:
যেমন- ওসমান (রাঃ) রাসূল () এর ওযূর পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
فَأَفْرَغَ عَلَى كَفَّيْهِ ثَلاَثَ مِرَارٍ، فَغَسَلَهُمَا
 তিনি উভয় হাতের তালুতে তিনবার পানি ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন ।[3]
৪। এক অঞ্জলি পনি নিয়ে একই সাথে কুলি ও নাকে পানি দিবে, এরূপ তিনবার করবে:
যেমন- মহানাবী () এর ওযূর পদ্ধতি শিক্ষা প্রদানে আবদুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) এর হাদীস:
فمَضْمَضَ، وَاسْتَنْشَقَ مِنْ كَفٍّ وَاحِدَةٍ فَفَعَلَ ذَلِكَ ثَلَاثًا
অর্থাৎ: তিনি এক অঞ্জলি পনি নিয়ে একই সাথে কুলি ও নাকে পানি দিলেন, এরূপ তিনি তিনবার করলেন।[4]
৫। সিয়াম পালনকারী ব্যতীত অন্যরা  ভালভাবে কুলি করবে ও নাকে পানি দেবে:
যেমন লাকীত্ব বিন সাবরাহ থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,
অর্থাৎ: সিয়াম পালনকারী না হলে, নাকে ভালভাবে পানি পৌঁছাও।[5]
৬। বাম হাতের পূর্বে ডান হাত ধৌত করা :
যেমন: মহানাবী () এর ওযূর পদ্ধতি বর্ণনায় ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
এরপর আর এক অাঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে ডান হাত ধুলেন। এরপর আর এক অাঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে তাঁর বাঁ হাত ধুলেন। এরপর তিনি মাথা মাসাহ  করলেন। এরপর আর এক অাঁজলা পানি নিয়ে ডান পায়ের উপর ঢেলে দিয়ে তা ধুয়ে ফেললেন। এরপর আর এক আজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে বাম পা ধুলেন।[6]
রাসূল () জুতা পরিধান, মাথা আঁচড়ানো ও পবিত্রতা অর্জন তথা সকল কাজ ডান দিক থেকে শুরু করতে ভালবাসতেন।[7]
৭। অঙ্গসমূহ তিনবার করে ধৌত করা:
মহানাবী () থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘তিনি এবার একবার করে ওযূ করেছেন’’।[8] তিনি দু’বার ‘‘দু’বার করে ওযূ করেছেন’’।[9] ওযূর ক্ষেত্রে অধিক পরিপূর্ণতা হল, অঙ্গসমূহ তিনবার করে ধৌত করা, যেমনটি মহানাবী () করেছেন।  পূর্বে বর্ণিত উসমান (রাঃ)ও আবদুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) এর হাদীসদ্বয়ে তা বর্ণিত হয়েছে।
 দু’টি সতর্ক বাণী:
(ক) মাথা মাসাহ একবার করতে হবে। দু’বার বা তিনবার করা যাবে না ।
এ ব্যাপারে মহানাবী () এর ওযূর পদ্ধতিতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনবার মাসাহ করার ব্যাপারে বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলোর একটিও সহীহ নয়। আর যে বর্ণনা গুলো দু’বার মাসাহ করার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে  সেগুলো মহানাবী () এর বাণী- ‘ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ’ এ ব্যাখ্যা। যেমনটি ইবনু আব্দিল বার বলেছেন।[10] মাসাহ করার সময় মাথার উপর বারবার হাত ফিরানোকে পুনরাবৃত্তি বলা যায় না। কেননা পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে কেবল নতুন পানি নেয়ার মাধ্যমে। উপরন্তু পুনরাবৃত্তি করা হয় অঙ্গসমূহ ধৌত করার ক্ষেত্রে। মাসাহ করার ক্ষেত্রে নয়।[11] মাথা মাসাহ পুনরাবৃত্তি না করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী দলীল হলো, জনৈক আরাবীর হাদীস, যিনি মহানাবী () এর কাছে এসে ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মহানাবী () তাকে প্রত্যেক অঙ্গ তিনবার তিনবার করে ধৌত করে দেখিয়ে দিলেন।
অতঃপর বললেন:
هَكَذَا الْوُضُوءُ، فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا فَقَدْ أَسَاءَ وَتَعَدَّى وَظَلَمَ
অর্থাৎ: এভাবেই ওযূ করতে হবে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশিবার ধৌত করবে, সে ভুল করবে, সীমালঙ্ঘন করবে ও জুলুম করবে।[12]
হাফেজ ‘ফাতহ’ গ্রন্থে (পৃ:১/২৯৮) বলেন, সাঈদ ইবনে মানসুর এর বর্ণনায় সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মহানাবী () একবার মাসাহ করেছেন। সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, একবারের অধিক মাসাহ করা পছন্দনীয় নয়। আর তিনবার মাসাহ করার হাদীসগুলো যদি সহীহ হয়, তাহলে দলীলগুলো একত্রিত করার স্বার্থে বলা যায় যে, তা মাসাহ পূর্ণ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা তা সম্পূর্ণ মাথার জন্য পূর্ণাঙ্গ মাসাহ।
আমার বক্তব্য: এটা ইমাম শাফেঈ  ব্যতীত ইমাম আবূ হানীফা, মালিক ও আহমাদ (রাহি.) এর  সহীহ অভিমত।[13]
(খ) যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে ওযূ করবে তার জন্য তিন বারের বেশি অঙ্গ ধৌত করা মাকরূহ:
ওযূর অঙ্গসমূহ তিনবার করে ধৌত করার ফলে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ হয়। তবে তিন বারের বেশি ধৌত করা মাকরূহ। যেমন হাদীস বর্ণিত হয়েছে - فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا فَقَدْ أَسَاءَ وَتَعَدَّى وَظَلَمَ -অর্থাৎ, যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশিবার ধৌত করবে, সে ভুল করবে, সীমালঙ্ঘন করবে ও জুলুম করবে। তবে এ অতিরিক্তটা ক্ষতি পূরণের ক্ষেত্রে হলে প্রযোজ্য নয়। যদি তিনবার কিংবা তার কম ধৌত করার মাধ্যমেই উত্তমরূপে ওযূ করা যায়, তাহলে তিনবারের বেশি ধৌত করা মাকরূহ। এ মাসআলাটির ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।[14]
৮। ঘন দাড়ি খিলাল করা:
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, দাড়ি যদি ঘন হওয়ার ফলে মুখের চামড়া দেখা না যায়, তাহলে বাহ্যিকভাবে তা ধুয়ে ফেললেই চলবে।  এখানে আমরা অতিরিক্তভাবে বর্ণনা করছি যে, পানি দ্বারা তা খিলাল করা মুস্তাহাব।
আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () যখন ওযূ করতেন, তখন তিনি এক কোশ পানি হাতে নিয়ে থুতনির নীচে দিয়ে তা দ্বারা দাড়ি খিলাল করতেন। তিনি আরো বলেন, আমার প্রতিপাল আমাকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন।[15]
এ বিষয়টিকে মুস্তাহাব বলে প্রমাণ করা যায়, পূর্বে উল্লেখিত ‘মাসীউস সালাত বা সালাতে ভত্বলাকারী’ এর ঘটনায় বর্ণিত রিফায়াহ বিন রা‘ফে এর হাদীস দ্বারা।
৯। অঙ্গসমূহ ঘর্ষণ করা:
আবদুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল () কে ওযূ করতে দেখলাম। অতঃপর তিনি তার দু‘বাহু কচ্লাতে শুরু করলেন।[16]
১০। দু’হাত ও পায়ের আঙ্গুলসমূহ খিলাল করা:
-অর্থাৎ, উত্তমরূপে ওযূ কর, আঙ্গুলসমূহের মাঝে খিলাল কর এবং সিয়াম পালনকারী না হলে, নাকে ভালভাবে পানি পৌঁছাও।[17]
 যদি আঙ্গুল সমূহ ও তার আশে-পাশের অংশ খিলাল করা ছাড়া ভালভাবে ধৌত করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা খিলাল করা ওয়াজিব। যেমনটি  আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
১১। যে স্থানসমূহ ধৌত করা ফরয তা বেশি করে ধৌত করা:
মুস্তাহাব হলো: পরিপূর্ণভাবে ওযূ করা এবং মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত মুখমন্ডল বেশি করে ধৌত করা। এটাকে ‘‘إطالة الغرة’’  তথা, উজ্জ্বলতা দীর্ঘ করণ বলা হয়। আর দু’কনুই ও পায়ে গিঁট বেশি করে ধেŠত করা। এটাকে  ‘‘إطالة التحجيل’’ তথা; শ্রভ্রতা দীর্ঘকরণ বলা হয়। আবূ হুরাইরা (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মাতকে এমন অবস্থায় ডাকা হবে যে ওযূর প্রভাবে তাদের হাত-পা ও মুখমন্ডল থাকবে উজ্জ্বল। তাই তোমাদের মধ্যে যে এ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নিতে পারে, সে যেন তা করে।[18]
নু’আইম ইবনে আবদুলস্নাহ্ আল-মুজমির থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ) কে ওযূ করতে দেখেছি। তিনি খুব ভালোভাবে মুখমন্ডল ধুলেন, এরপর ডান হাত ধুলেন এবং বাহুর কিছু অংশ ধুলেন। পরে বাম হাত ও বাহুর কিছু অংশসহ ধুলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর ডান পা ও নলার কিছু অংশ ধুলেন, এরপর বাম পা ও নলার কিছু অংশ একইভাবে ধুলেন। অতঃপর বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ () কে এভাবে ওযূ করতে দেখেছি।[19] আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন:
আমি আমার বন্ধু রাসূল () কে বলতে শুনেছি, যে স্থান পর্যন্ত ওযূর পানি পৌঁছবে, সে স্থান পর্যন্ত মু‘মিন ব্যক্তির চাকচিক্য অথবা সৌন্দর্যও পৌঁছবে।[20]
১২। পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়া:
হযরত আনাস (রা.) বলেন,
রাসূল () এক ছা (৪ মুদ) থেকে ৫ মুদ পর্যন্ত পানি দিয়ে গোসল এবং এক মুদ পানি দিয়ে ওযূ করতেন।[21]
১ সা = ৪ মুদ, আর এক মুদ = প্রসিদ্ধ প্রায় আধা লিটারের সমান ।
১৩। ওযূর পর দু‘আ পাঠ করা:
ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন:
অর্থাৎ: তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি উত্তম ও পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করার পর বলে:
অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আলস্নাহ্ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই , তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ () তাঁর বান্দাহ্ ও রাসূল। তাহলে তার জন্যে জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে এর যে কোনো দরজা দিয়ে (জান্নাতে) প্রবেশ করতে পারবে।[22]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেছেন, যে ব্যক্তি ওযূ করার পর বলবে:
অর্থাৎ:‘মহা পবিত্র আপনি হে আল্লাহ্! আপনার প্রশংসার সাথে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি আপনার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই ফিরে যাচ্ছি (অর্থাৎ তাওবা করছি)। তাহলে তার জন্য কাগজে তার আমল নামা লিখে এমনভাবে মুদ্রণ করা হবে, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত নষ্ট হবে না।[23]
১৪। ওযূর পর দু’রাকআত সালাত আদায় করা:
উসমান (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল () কে আমার এ ওযূর মত করে ওযূ করতে দেখেছি। এর পর রাসূল () বলেছেন:
‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযু করবে, তারপর দু’রাক’আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পেছনের গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে’।[24]
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী () একদিন ফজরের সালাতের সময় বিলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন: হে বিলাল! ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক আশাব্যঞ্জক যে আমল তুমি করেছ, তার কথা আমার নিকট ব্যক্ত কর। কেননা, জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার পাদুকঠোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বিলাল (রাঃ) বললেন: দিন রাতের যে কোন প্রহরে আমি ত্বহারাত বা পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে ত্বহারাত দ্বারা সালাত আদায় করেছি, যে পরিমাণ সালাত আদায় করা আমার তাক্দীরে লেখা ছিল। আমার কাছে এর চাইতে অধিক আশাব্যঞ্জক হয়, এমন কোন বিশেষ আমল আমি করিনি।[25]
ওযূর পর অঙ্গ সমূহ মুছে শুষ্ক করা বৈধ:
এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়নি। সুতরাং তা বৈধ। যদি বলা হয় যে, এ ব্যাপারে হযরত মায়মুনা (রা.) থেকে হাদীস বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি রাসূল () এর গোসলের পর একটি গামছা নিয়ে আসলেন, কিন্তু তা দিয়ে তিনি শরীর মুছলেন না। বরং হাত দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে চলে গেলেন।[26]
এ ক্ষেত্রে আমরা বলব, এটি শুধু এক দিনের ঘটনা, যা কয়েকটি বিষয়ের সম্ভবনা রাখে। হয়তবা তিনি গামছাটি গ্রহণ করেন নি তা অপরিষ্কারর থাকার কারণে , অথবা তিনি পানি দ্বারা গামছাটি ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন, ইত্যাদি। হযরত মায়মুনা (রা.) এর গামছা আনার মাধ্যমে এ নিদর্শন পাওয়া যায় যে, তাঁর অঙ্গ মুছার অভ্যাস ছিল।[27] নিম্নোক্ত হাদীসটি এটা বৈধ হওয়ার দলীল কে আরও শক্তিশালী করে।
অর্থাৎ, একদা রাসূল () ওযূ করলেন এবং তিনি তার পরিধানের পশমী জুববা উঠিয়ে তাঁর মুখমন্ডল মাসাহ করলেন।[28]
ইমাম তিরমিযি  (রাহি.) (৫৪) বলেন, মহানাবী () এর সাহাবাগণ ও তাদের পরবর্তী বিদ্বানগণ ওযূর পর রুমাল বা গামছা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। যারা এটাকে অপছন্দ মনে করেন। তাদের অপছন্দের কারণ হল- তারা বলে থাকেন যে, ওযূকে পরিমাপ করা হবে।
 নখের উপর প্রলেপ থাকলে ওযূ বিশুদ্ধ হবে না:[29]
কেননা এর ফলে যে সমস্ত স্থানে পানি পেঁŠছানো ফরয, সে সমস্ত স্থানে তা পানি পেঁŠছাতে বাধা প্রদান করে। তবে শুধু রং , যেমনঃ মেহেদী দ্বারা রং করা বা অনুরূপ কিছু হলে, তাতে কোন সমস্যা নেই, তথাপিও তা ওযূ ও সালাতের পূর্বে দূর করাই উত্তম। যেমন:
অর্থাৎ: ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমাদের মহিলারা উত্তম খেজাব ব্যবহার করে। তারা ঈশার সালাতের পরে খেজাব ব্যবহার করে এবং ফজরের পূর্বে তা খুলে ফেলে।[30]
যে মহিলা ওযূ ছাড়াই হাতে মেহেদী বা খেজাব লাগাবে অতঃপর সালাতের সময় হবে, তার ব্যাপারে ইবরাহীম আন নাখঈ বলেন, تنزع ما على يديها إذا أرادت أن تصلي . - অর্থাৎ: যখন সে সালাত আদায় করার জন্য ইচ্ছা করবে, তখন হাতে যা লাগানো থাকবে তা মুছে ফেলবে।[31]
দলীলের উৎসঃ
[1] যঈফ; আবূ দাউদ (১০১), তিরমিযী (২৫), আহমাদ (২/৪১৮) প্রভৃতি। এখানে হাদীসটি যঈফ হওয়াটাই অপ্রাধিকার প্রাপ্ত। যদিও আলবানী তার আল-ইরওয়া (১/১২২) গ্রন্থে একে হাসান আখ্যা দিয়েছেন।
[2] ফাতহুল কাদীর (১/২২২), মাওয়াহিবুল জালিল (১/২৬৬) আল-মাজমু’ (১/৩৮৫), আল-ইনসাফ (১/১২৮)।
[3] সহীহ; বুখারী (১৫৯), মুসলিম (২২৬)।
[4] সহীহ; মুসলিম (২৩৫), তিরমিযী (২৮), ইবনে মাজাহ (৪০৫)।
[5] সহীহ; আবূ দাউদ (১৪২), নাসাঈ (১/৬৬), ইবনে মাজাহ (৪০৭) আহমাদ (৪/৩৩)।
[6] সহীহ; বুখারী (১৪০)।
[7] সহীহ; বুখারী (১৬৮), মুসলিম (২৬৮)।
[8] সহীহ; বুখারী (১৫৬), ইবনে আববাসের সূত্রে।
[9] সহীহ; বুখারী (১৫৭), আবদুলস্নাহ ইবনে যায়েদ এর সূত্রে।
[10] ইমাম বাইহাক্বী প্রণীত আল-খালাফীয়াত (১/৩৩৬)।
[11] মুকাদ্দামাতু ইবনে রাশাদ আলাল মাদূনাহ (পৃ. ১৬)।
[12] সহীহ; নাসাঈ (১/৮৮), ইবনে মাজাহু (৪২২), আহমাদ (২/১৮০)।
[13] আল-মাসবূত্ব (১/৫), হাশিয়াতুদ দাসূক্বী (১/৯৮) আল-মুগনী (১/১২৭), আল-উম্ম (১/২৬)।
[14] আত-তামহীদ (২০/১১৭) ইবনু আব্দিলবার প্রণীত।
[15] সহীহ লিগাইরীহী; আবূ দাউদ (১৪৫), বাইহাক্বী (১/৫৪), হাকিম (১/১৪৯), আল ইরওয়া (৯২)।
[16] সহীহ; ইবনে হিববান (১০৮২), বাইহাক্বী (১/১৯৬)।
[17] সহীহ; এর তাখরীজ পূর্বে করা হয়েছে।
[18] সহীহ; বুখারী (৩৬), মুসলিম (২৪৬)।
[19] সহীহ; মুসলিম (২৪৬)।
[20] মুসলিম (২৫০)।
[21] সহীহ; বুখারী (১৯৮), মুসলিম (৩২৫)।
[22] সহীহ; মুসলিম (২৩৪)।
[23] সহীহ; ইমাম নাসাঈ তাঁর আল-কুবরা (৯৯০৯), হাকিম (১/৫৬৪) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের আরও কিছু শাহিদ হাদীস রয়েছে।
[24] সহীহ; বুখারী (৬৪৩৩), মুসলিম (২২৬)।
[25] সহীহ; বুখারী (১১৪৯), মুসলিম (২৪৫৮)।
[26] সহীহ; বুখারী (২৭০)।
[27] আশ-শারহুল মুমতি’ (১/১৮১), যাদুল মায়াদ (১/১৯৭)।
[28] এর সনদ হাসানের নিকটবর্তী; ইবনে মাজাহ (৪৬৮,৩৫৬৪)।
[29] ফিক্বহুস সুন্নাহ লিননিসা (পৃ. ৩৯)।
[30] এর সনদ সহীহ; ইবনে আবি শায়বা (১/১২০)।
[31] এর সনদ সহীহ; বাইহাকী (১/৭৭, ৭৮)।
ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ [প্রথম অংশ]
ওযূ ভঙ্গের কারণ বলতে এমন বিষয় বুঝায়, যার মাধ্যমে ওযূ নষ্ট হয়ে যায়। ওযূ ভঙ্গের কারণগুলো হলো:
১। দু’রাস্তা দিয়ে পেশাব, পায়খানা অথবা বায়ু নির্গত হওয়া:
পেশাব ও পায়খানার ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ বলেন:
﴿أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ﴾
তোমাদের কেউ যদি পায়খানা থেকে আসে (সূরা মায়েদা -৬) ।
 অত্র আয়াতে ‘الْغَائِطِ’ শব্দ উল্লেখ  করে মল-মূত্র ত্যাগ তথা পেশাব পায়খানাকে বুঝানো হয়েছে। বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দু’রাস্তা তথা সামনে ও পিছন দিয়ে পেশাব-পায়খানা নির্গত হওয়ার কারণে ওযূ নষ্ট  হয়ে যাবে।[1]
আর যদি তা সামনে বা পেছনের রাস্তাদিয়ে বের না হয়ে অন্য স্থান দিয়ে বের হয়। যেমন: মুত্রাশয় বা পেটের কোন স্থান যখম হয়ে নির্গত হয়। এ ক্ষেত্রে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ শুধু নির্গত হওয়াকেই ধর্তব্য মনে করেন, যেমন আবূ হানীফা, সাওরী, আহমাদ ও ইবনে হাযম (রাহি.)। তারা বলেন, শরীরের যে কোন স্থান দিয়ে না পাক নির্গত হলে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে।
আবার কেউ শুধু দু’রাস্তা দিয়ে নির্গত হওয়াকেই ধর্তব্য মনে করেন। যেমন: ইমাম শাফেঈ। তিনি বলেন, যদি এ দু’রাস্তা দিয়ে কোন কিছু নির্গত হয়, তাহলে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে, যদিও নির্গত বস্ত্তটি  না পাক না হয়। যেমন: কংকর বা অনুরূপ কিছু।[2]
আর বায়ু যদি পিছনের রাস্তা দিয়ে শব্দসহ বা শব্দ বিহীন নির্গত হয়, তাহলে সকলের ঐকমত্যে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে।  মহানাবী () বলেন,
‘যে ব্যক্তির হাদস হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওযূ করে। হাযরা-মাওতের এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আবূ হুরাইরা! হাদস কী?’ তিনি বললেন, ‘নিঃশব্দে বা সশব্দে বায়ু বের হওয়া’।[3]
যদি সামনের রাস্তা দিয়ে বায়ু নির্গত হয়, তাহলে জমহুরের মতে[4] ওযূ নষ্ট হবে এবং ইমাম আবূ হানীফা ও ইবনে হাযমের মত অনুসারে ওযূ নষ্ট হবে না। কেননা ‘فُسَاءٌ’ এবং ‘ضُرَاطٌ’ এমন দু‘টি নাম, যা পেছনের রাস্তাদিয়ে বের না হলে তাকে বায়ু বলা যায় না।[5]
 আমার বক্তব্য: যদি বায়ু নির্গত হওয়া  স্পষ্ট বুঝা যায়, তাহলে তা সামনের বা পেছনের যে কোন রাস্তা দিয়ে নির্গত হোক না কেন, ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি স্পষ্ট বুঝা না যায়, তাহলে শুধু পেছনের রাস্তাই ধর্তব্য।
 সতর্ক বাণীঃ কখনও কখনও মহিলাদের লজ্জস্থান থেকে বায়ুর মত কিছু নির্গত হওয়া অনুভব করা যায়। মূলতঃ এটা একটা আলোড়ন বা ঝাকুনী। এটা নির্গত হওয়া বায়ু নয়। এ ক্ষেত্রে তার ওযূ নষ্ট হবে না। কেননা এটা একটা আওয়াজ বা অনুরূপ কিছুর স্থলাভিষিক্ত। কিন্তু যদি মহিলার পেশাব পায়খানার দার ছিড়ে একত্রিত হয়ে যায়, তাহলে গুহ্যদার দিয়ে বায়ু নির্গত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় সতর্কতা মূলক ওযূ করবে।
২। মনি, ওদি ও মযি নির্গত হলে:
মনি নির্গত হলে সকলের ঐকমত্যে ওযূ নষ্ট হবে এবং গোসল ওয়াজিব হবে। গোসলের ব্যাপারে সামনে  আলোচনা করা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে যেসব কারণে গোসল ওয়াজিব হয় সেসব কারণে ওযূ নষ্ট হয়।[6] মযির মাধ্যমে ওযূ নষ্ট হয়। যেমন আলী ইবনে তালিব (রাঃ) বলেন:
 আমার অধিক মযি বের হত। নাবী () এর কন্যা আমার স্ত্রী হওয়া লজ্জার কারণে আমি একজন কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পাঠালাম। তিনি প্রশ্ন করলে রাসূল () তাকে বললেন যে, তুমি ওযূ কর ও লজ্জাস্থান ধুয়ে ফেল।[7]
ওদির হুকুমও অনুরূপ। সুতরাং উভয়টি (মযি ও ওদির) ক্ষেত্রে লজ্জাস্থান ধৌত করা ও ওযূ করা ওয়াজিব।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন মনি, ওদি ও মযির হুকুম হল, মনি নির্গত হলে তা ধৌত করতে হবে। আর ওদি ও মযির ব্যাপারে তিনি বলেন, তা নির্গত হলে তোমার লজ্জাস্থান ধৌত কর এবং সালাতের জন্য ওযূ কর।[8]
প্রয়োজনীয় কথা:
যে ব্যক্তি বহুমূত্র রোগে ভুগে অথবা অত্যধিক মযি নির্গত হয় কিংবা পূর্বোলেস্নখিত নাপাকী গুলো বারবার নির্গত হয়, যার ফলে শারিরীক অসুস্থতার কারণে চলাফেরা কষ্টকর হয় পড়ে, তাহলে সে তার কাপড়ে ও শরীরে যা লেগেছে তা ধুয়ে ফেলবে এবং প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযূ করবে । যেমনটি মুস্তাহাযার রোগী করে থাকে (মুস্তাহাযার ব্যাপারে সামনে আলোচনা করা হবে)। এরূপ করার পর সালাতে অথবা ওযূ ও সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে যা নির্গত হবে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। 
৩। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তি, যার কোন অনুভূতি নেই:
ঘুমের কারণে ওযূ নষ্ট হবে কি না, এ সংক্রান্ত আসার গুলো একটি অপরটির প্রকাশ্য বিরোধি। এ সংক্রান্ত এমন কিছু হাদীস রয়েছে, যা স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে, মূলত ঘুমের কারণে ওযূ নষ্ট হয় না। আবার এমনও হাদীস রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে ঘুম হাদাস (ওযূ ভঙ্গকারী) হওয়াকে আবশ্যক করছে। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে বিদ্বানদের দু‘টি মাযহাব পরিলক্ষিত হয়। ১. সমন্বয় প্রদানকারী মাযহাব। ২. প্রাধান্য দানকারী মাযহাব। যারা প্রাধান্য দানকারী তাদের কেউ বলেছেন, সাধারণভাবে ঘুম ওযূকে নষ্ট করে, তা হাদাস নয়। আবার কেউ সাধারণভাবে গুমের কারণে ওযূ করা ওয়াজিব বলেছেন। তারা আরো বলেন, ঘুম হাদাসের অন্তর্ভুক্ত। আর সমন্বয়কারী মাযহাবের অনুসারীরা বলেন, ঘুম হাদাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এটা শুধু হাদাসের ধারণা সৃষ্টি করে। এ সমস্ত বিদ্বানগণ মূলতঃ যে ঘুম ওযূকে ওয়াজিব করে সে ঘুমের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিদ্বানগণ তিনটি পথ অবলম্বন করেছেন। ফলে তাদের মাঝে ৮ টি অভিমতের জন্ম হয়েছে।[9] তা হলো-
১ম মতামত: ঘুম সাধারণভাবে ওযূ নষ্ট করে না:
এটা সাহাবাদের একটি জামাত তথা ইবনে উমার, আবূ মুসা আল আশয়ারী (রা.) এর অভিমত। সাঈদ ইবনে যুবাইর, মাকহুল, ইবাইদাতুস সালমানী ও আওযায়ী সহ অন্যান্য বিদ্বানরাও এ মত পেশ করেছেন। তাদের দলীল হলো,
(১) আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদিন সালাতের জন্য ইকামত দেয়া হয়ে গেল। কিন্তু নাবী () তখনও এক ব্যক্তির সাথে চুপি চুপি আলাপ করছিলেন। তিনি দীর্ঘক্ষণ আলাপ করলেন। এমনকি সাহাবারা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এরপর তিনি আসলেন এবং তাদের সাথে করে সালাত পড়লেন।[10]
(২) কাতাদাহ্ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি আনাসকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ ()-এর সাহাবাগণ ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু পরে ওযূ না করেই সালাত পড়তেন। শুবা বলেছেন, আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আপনি একথা আনাসের কাছ থেকে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আলস্নাহর কসম আমি এটি শুনেছি![11] অপর বর্ণনায় আছে:
অর্থাৎ: তারা সালাতের জন্য অপেক্ষা করতেন। ফলে তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন, এমন কি তাদের মাথা ঢোলে পড়ত। অতঃপর তারা সালাতের জন্য দ-ায়মান হতেন।
(৩) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাতে আমি আমার খালা মায়মূনা (রা.) এর ঘরে রাত্রি যপন করলাম। আমি আমার খালাকে বললাম রাসূল () রাতের সালাতের জন্য উঠলে আমাকে জাগিয়ে দিবেন। অতঃপর রাতে রাসূল () সালাত আদায়ের জন্য উঠলে আমিও তাঁর সাথে উঠলাম এবং তাঁর বাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন তিনি আমার হাত ধরে তাঁর ডান পাশে নিলেন। পরে যখনই আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, তখন তিনি আমার কানের নিমণভাগ ধরে টান দিচ্ছিলেন। ইবনে আব্বাস বলেন, এগারো রাকআত সালাত আদায় করলেন।[12]
(৪) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) মায়মূনা (রা.) এর বাড়িতে অবস্থানকালে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে:
এর পর তিনি শুয়ে পড়লেন। এমন কি আমি তাঁর নাক ডাকঠোর শব্দ শুনতে পেলাম। এর পর উঠে তিনি সালাতের জন্য বের হলেন।[13]
অপর বর্ণনায় রয়েছে,  অর্থাৎ: তিনি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করলেন। অথচ ওযূ করলেন না।
২য় অভিমত: ঘুম সাধারণ ভাবে ওযূ নষ্ট করে:
অল্প ঘুম হোক আর বেশি হোক, কেউ ঘুমালেই ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে। এটা আবূ হুরাইরা, আবূ রাফে, উরওয়াহ বিন যুবাইর, আত্বা, হাসাহ বসরী, ইবনুল মুসাইয়্যিব, যুহরী, মাযিনী, ইবনুল মুনযির ও ইবনে হাযম এর অভিমত। আলবানী এমতটিকে পছন্দ করেছেন।
(১) সফওয়ান বিন আস্সাল (রাঃ) বলেন,
অর্থাৎ, আমরা যখন সফরে থাকতাম, তখন রাসূল () আমাদেরকে জানাবাতের অপবিত্রতা ছাড়া তিনদিন ও তিন রাত মোজা না খুলে তার উপর মাসাহ করার নির্দেশ দিতেন। তবে পেশাব-পায়খান ও ঘুমের কারণে কোন সমস্যা হত না।[14]
তারা বলেন, মহানাবী () আম ভাবে ঘুমের কথা বলেছেন। তিনি কম বা বেশি ঘুমকে খাস করেন নি এবং কোন অবস্থাকেও খাস করেন নি। আর তিনি ঘুমকে পেশাব-পায়খানার সাথে তুলনা করে সমানভাবে বর্ণনা করেছেন।
(২) হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল () বলেছেন, অর্থাৎ, দু‘চোখ হল গুহ্যদারের বাঁধন স্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি ঘুমাবে, সে যেন ওযূ করে।[16] এ হাদীসটি যঈফ।
(৩) হযরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () বলেছেন, সালাত আদায়ের অবস্থায় তোমাদের কারও যদি তন্দ্রা আসে, তবে সে যেন ঘুমের রেশ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে নেয়। কারণ, তন্দ্রা অবস্থায় সালাত আদায় করলে সে জানতে পারে না, সে কি ক্ষমা চাচ্ছে, না নিজেকে গালি দিচ্ছে।[17]
অত্র হাদীস দ্বারা ইমাম বুখারী (রাহি.) তাঁর স্বীয় গ্রন্থ ‘‘সহীহুল বুখারী’’ -তে ঘুমের কারণে ওযূ ওয়াজিব হওয়ার দলীল দিয়েছেন। ইমাম বুখারী (রাহি.) এর এ দলীলের ব্যাপারে একটু ভাবার বিষয় রয়েছে, বলে আমি মনে করি। কেননা, অত্র হাদীসে ঘুমের কারণে সালাত পরিত্যাগ করার কারণ হিসেবে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো, ঘুমন্ত অবস্থায় সালাত আদায় করলে নিজেকে গালি দেয়া, অবান্তর কথা-বার্তা বলা অথবা এ সময় সালাতে মনোনিবেশ না থাকার আশঙ্কা থাকে। ফলে সালাতের একাগ্রতা নষ্ট হয়। ঘুমের কারণে ওযূ করতে হবে এ কথা এখানে বলা হয় নি। বরং এ হাদীস দ্বারা কেউ কেউ ঘুমের কারণে ওযূ নষ্ট না হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। সুতরাং বিষয়টি ভেবে দেখা উচিৎ।
(৪) তারা বলেন: বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, যে ব্যক্তি পাগল হওয়ার কারণে আকল নষ্ট হয় অথবা অজ্ঞান হয় তার ওযূ করা ওয়াজিব। সুতরাং ঘুমের হুকুমও অনুরূপ।
 ৩য় অভিমত: অধিক ঘুম হলে সর্বাবস্থায় ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে, তবে অল্প ঘুম হলে নষ্ট হবে না:
এটা ইমাম মালিক এর অভিমত এবং একটি রেওয়ায়েতে ইমাম আহমাদ (রাহি.) এ অভিমত পেশ করেছেন। যুহরী, রাবিয়া ও আওয়াযীও এমতের প্রবক্তা। তারা আনাস (রাঃ) এর হাদীসকে সাহাবাদের কম ঘুমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করেন। এর প্রমাণে তারা আবূ হুরাইরা (রাঃ) এর হাদীস পেশ করেন:
অর্থাৎ: যে ব্যক্তি প্রবল ঘুমে আচ্ছন্ন হবে, তার ওযূ করা ওয়াজিব।[18] হাদীসটি মাওকূফ সূত্রে সহীহ। আর ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত আছে:
অর্থাৎ: ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যেক ঘুমন্ত ব্যক্তির জন্য ওযূ করা ওয়াজিব। তবে যদি একবার অথবা দু‘বার মাথা ঢোলে তাহলে তার ওযূ ওয়াজিব নয়।[19]
 ৪র্থ অভিমত: শুয়ে বা হেলান দিয়ে ঘুমালে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে:
আর যে ব্যক্তি সালাতের কোন অবস্থা তথা রুকু, সিজদ, দ-ায়মান বা বসা অবস্থায় ঘুমাবে, তার ওযূ নষ্ট হবে না। চাই সালাতে হোক বা সালাতের বাইরে হোক। এটা হাম্মাদ, সাওরী, আবূ হানীফা ও তাঁর অনুসারী, ইমাম দাউদ ও ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর মতামত। তাদের দলীল হলো:
(১) আমর বিন শুয়াইব তার পিতা হতে, তার পিতা তার দাদা হতে বর্ণনা করেন , রাসূল () বলেছেন: যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বা বসে ঘুমায় তাকে ওযূ করতে হবে না। তবে জমিনে হেলান দিয়ে ঘুমালে ওযূ করতে হবে।[20] এ হাদীসটি যঈফ।  সহীহ নয়।
(২) হযরত আনাস (রাঃ) রাসূল () থেকে বর্ণনা করে বলেন:
অর্থাৎ: যখন কোন বান্দা সাজদারত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এ নিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা ফেরেশতাদের কাছে গর্ববোধ করে বলে, তোমরা আমার বান্দার দিকে দেখ, তার আত্না আমার কাছে রয়েছে এবং তার শরীর আমার আনুগত্য করছে![21]
তারা মুসলিস্নর সালাত আদায়ের সকল অবস্থাকে সাজদার উপর ক্বিয়াস করে।
আমার বক্তব্য: এ হাদীসটি সনদগত ভাবে দুর্বল। ইমাম বায়হাকী বলেন, এ হাদীসে ঘুমের কারণে সালাত বাতিল করতে হবে এ কথাও বলা হয়নি। তবে হাদীসটি যদি সহীহ হয় তাহলে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ঐ বান্দার প্রশংসা করা, যে সালাতে অটল থাকে, এমনকি এক পর্যায়ে সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়।   
৫ম মতামত: শুধু রুকু ও সাজদারত অবস্থায় ঘুমালে ওযূ নষ্ট হবে:
ইমাম নববী এ অভিমতটিকে ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর দিকে সম্বধোন করেছেন। সম্ভবত এর কারণ হল, রুকু ও সাজদারত অবস্থায় ঘুমানোর ফলে ওযূ ভঙ্গের ধারণা সৃষ্টি হয়।
৬ষ্ঠ মতামত: শুধু সাজদারত অবস্থায় ঘুমালে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে:
অনুরূপভাবে এটাও ইমাম আহমাদের বর্ণনা বলা হয়ে থাকে।
৭ম মতামত: সালাতের মধ্যে যে কোন অবস্থায় ঘুমালে ওযূ নষ্ট হবে না:
তবে সালাতের বাইরে ঘুমালে ওযূ নষ্ট হবে। এটা আবূ হানীফা (রাহি.) এর বর্ণনা। ৪র্থ মতামতে যে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে, সে হাদীসের কারণে ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) এ মতামত দিয়েছেন।
 ৮ম মতামত: যদি কেউ জমিনে বসে ঘুমায়, চায় তা সালাতে হোক কিংবা সালাতের বাইরে হোক, কম ঘুম হোক কিংবা বেশি ঘুম হোক, তাহলে ওযূ নষ্ট হবে না:
এটা ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর অভিমত। কারণ তাঁর নিকট ঘুম নিজে হাদাস (নাপাক) নয়। বরং তা হাদাসের ধারণা সৃষ্টি করে। ইমাম শাফেঈ বলেন, ‘‘কেননা বসে ঘুমন্ত ব্যক্তির পিছন জমিনে লেগে থাকার ফলে তা থেকে কিছু বের হওয়ার সম্ভবনা থাকেনা। বরং বের হওয়ার সময় তাকে তা সতর্ক করে দিতে পারে’’। ইমাম কঠোরকানী (রাহি.) এ অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন। আমি মনে করি, এ মতের অনুসারীরা আনাস (রাঃ) এর হাদীসটিকে সাহাবাদের বসে ঘুমানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করেন। অথচ হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রাহি.) ‘ফতহুল বরী’ (১/২৫১ পৃঃ) তে তা প্রত্যাখান করে বলেন যে, এ হাদীসের ব্যাপারে ‘মুসনাদুল বায্যার’ এ সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবাগণ তাদের পার্শ রেখে কেউ কেউ ঘুমিয়ে যেতেন। অতঃপর উঠে সালাত আদায় করতেন।[22] 
 বিশুদ্ধ অভিমত:
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তি যে কোন কিছু বুঝতে পারে না, এমন কি তার পাশের ব্যক্তির কোন শব্দ শুনতে পায় না অথবা তার হাত থেকে কোন কিছু পড়ে গেলে তা বুঝতে পারে না কিংবা মুখ দিয়ে লালা বা এ জাতীয় কিছু নির্গত হলে তা টের পায় না, এমন ব্যক্তির ওযূ নষ্ট ইয়ে যাবে। কেননা তা হাদাসের ধারণা সৃষ্টি করে। চায় সে দাড়িয়ে, বসে, শুয়ে, রুকু কিংবা সাজদা যে কোন অবস্থায় থাক না কেন। এগুলোর কোনটির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদি ১ম মতের অনুসারীরা ঘুম দ্বারা এ প্রকারের ঘুম উদ্দেশ্য করে থাকেন, তাহলে আমরা তাদের মতকে সমর্থন করি। এছাড়া স্বল্প ঘুম যাকে তন্দ্রা বলা হয়, যার কারণে মানুষ কিছু অনুধাবন করতে পারে না যা পূবে আলোচিত হয়েছে, তার ফলে ওযূ নষ্ট হবে না, সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন। কেননা সাহাবাদের ঘুমের ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তাদের মাথা ঢোলে পড়ত’। আবার আল্লাহ্র রাসূলের সাথে সালাত আদায়ের ব্যাপারে বর্ণিত ইবনে আব্বাসের হাদীসও এর প্রমাণ বহন করে। এভাবেই এ ব্যাপারে বর্ণিত সকল দলীল গুলোর মাঝে আমরা সমাধান দিতে পারি। ولله الحمد والمنة ( সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ আল্লাহ্রই)।
 প্রসঙ্গ কথাঃ
যেহেতু ঘুমের মাধ্যমে, ওযূ ওয়াজিব করে এমন হাদাসের ধারণা সৃষ্টি হয়, সেহেতু ওযূ ভঙ্গের বিধানটা ওযূকারীর ঘুমের অবস্থাভেদে তার উপর অর্পিত হবে এবং প্রবল ধারণাটাই বিবেচিত হবে। যদি সে সন্দেহ করে যে, ঘুমের কারণে তার ওযূ নষ্ট হয়েছে, না হয়নি? তাহলে স্পষ্ট কথা হল, ওযূ ভঙ্গ না হওয়ার বিধানই কার্যকর হবে। কেননা পূর্বে থেকেই নিশ্চিতভাবে পবিত্রতা সাব্যাস্ত আছে। সুতরাং তা সন্দেহ দ্বারা দূর হবে না। শায়খুল ইসলাম তাঁর ‘ফতওয়া’ (২১/২৩০ পৃঃ) তে এ অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন।  
৪। নেশাগ্রস্থ, জ্ঞান শূন্য কিংবা পাগল হওয়ার ফলে আকল নষ্ট হলে: সর্বসম্মতিক্রমে ওযূ নষ্ট হবে।[23] ওযূ ভঙ্গ হওয়ার ক্ষেত্রে এ অবস্থা গুলোর কারণে স্মৃতি নষ্ট হওয়াটা, ঘুমের চাইতেও বেশী গুরুতর।
৫। কোন আবরণ ছাড়া লজ্জাস্থান স্পর্শ করা চাই, তা কাম প্রবৃত্তিসহ হোক বা না হোক:
বিদ্বানগণ ওযূর ক্ষেত্রে লজ্জাস্থান স্পর্শ করার ব্যাপারে চারটি অভিমত পেশ করেছেন। এ চারটি অভিমতের দু‘টিকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, আর দু‘টিকে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে।
১ম মতামত: সাধারণত লজ্জাস্থান স্পর্শের ফলে ওযূ নষ্ট হয় না:
এটা ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) এর অভিমত। ইমাম মালিক (রাহি.) এর কয়েকটি রেওয়ায়েতের মধ্যে এটি একটি রেওয়ায়েত। সাহাবাদের একটি দলের পক্ষ থেকেও এ অভিমটি বর্ণিত হয়েছে।[24]
 নিম্নোক্তভাবে তারা দলীল পেশ করে থাকেন-
(ক) ত্বলাক বিন আলী থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি এমন অন্য এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে মহানাবী () কে জিজ্ঞাসা করলেন যিনি ওযূ করার পর পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করেছিলেন, রাসুলুল্লাহ () বলেন: পুরুষাঙ্গ তো একটি গোশতের টুকরা অথবা গোশতের খ- মাত্র।[25]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূল (স:) কে প্রশ্ন করে বললেন:
অর্থাৎ, আমি যদি সালাত রত অবস্থায় রান চুলকানোর সময় লজ্জাস্থান স্পর্শ করে ফেলি, তাহলে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি? তখন তিনি বললেন, এটাতো তোমার দেহের অংশ মাত্র।[26]
(খ) তারা বলেন যে, যদি লজ্জাস্থান রান বা উরুকে স্পর্শ করে, তহলে ওযূ ওয়াজিব নয়। এব্যাপারে কেউ মতভেদ করেন নি। আর হাত ও রানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সামনে আলোচিত বুসরাহ[27] এর হাদীসে লজ্জাস্থান স্পর্শের ফলে ওযূ করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা তার সামলোচনা করেন।
২য় অভিমত: সাধারণত লজ্জাস্থান স্পর্শকরলে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবেঃ
এটা ইমাম মালিক (রাহি.) এর প্রসিদ্ধ অভিমত। ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইবনে হাযমও এ মতামত পেশ করেছেন। এটা অধিকংশ ছাহাবাদের পক্ষ থেকে বর্ণিত।[28] তাদের দলীল হল:
(ক) বুসরাহ বিনতে সাফওয়ান থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন, "من مس ذكره فليتوضأ" অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার লিঙ্গ স্পর্শ করবে, সে যেন ওযূ করে।[29]
(খ) উম্মে হাবীবাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন,"অর্থাৎ, যে তার গুপ্তাঙ্গ স্পর্শ করবে, সে যেন ওযূ করে।[30]
উপরোক্ত দু‘জনের হাদীসের অনুরূপ আবূ হুরাইরা, আরওয়া বিনতে উনেইস, আয়িশা, জাবের, যায়েদ বিন খালেদ ও আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) এর পক্ষ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তারা বলেন, বুসরাহ এর হাদীস ত্বলাক এর হাদীসের উপর প্রাধান্য পাবে।
তার কারণ হল:
(১) ত্বলাক (রাঃ) বর্ণিত হাদীসটি ক্রটিযুক্ত। আবূ যুর‘আ ও আবূ হাতেম হাদীসটি ত্রুটি পূর্ণ বলে অবহিত করেছেন। আর ইমাম নববী (রাহি.) ‘আল মাজমু’ গ্রন্থের (২/৪২ পৃঃ) তে হাদীসটি ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, ‘‘হাদীস বিকারওদগণ হাদীসটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন’’। 
(২) আর যদি তা সহীহ হয়, তাহলে বুসরাহ এর হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত আবূ হুরাইরা (রা.) এর হাদীসটিই অগ্রগণ্য হবে। কেননা সাহাবারা মাসজিদে কুবা নির্মানের সময় ত্বলাক (রা.) মদিনায় গিয়েছেন। আর আবূ হুরাইরা (রাঃ) তার ছয় বছর পর খাসবারের বছর ইসলাম গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আবূ হুরাইরা (রাঃ) এর হাদীস ত্বলাক (রাঃ) এর হাদীস কে মানসুখ বা রহিতকারী।[31]
(৩) ত্বলাকের হাদীসটি মূলের উপর অবশিষ্ট আছে। আর বুসারার হাদীসটি তার নাকেল (বর্ণনা কারী) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। আর নাকেল সর্বদা অগ্রগণ্য। কেননা শরীয়াত প্রণেতার হুকুমগুলো পূর্বে যা ছিল তা থেকে নকল কারী।
(৪) লজ্জাস্থান স্পর্শের কারণে ওযূ ভঙ্গ হওয়ার বর্ণনাগুলোই অধিক এবং হাদীসগুলো বেশি প্রসিদ্ধ।
(৫) এটা অধিকাংশ সাহাবীর অভিমত।
(৬) ত্বলাক (রাঃ) এর হাদীসটি রান চুলাকানোর সময় কাপড়ের উপর দিয়ে হাত লজ্জা স্থানে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমনটি হাদীসটির বর্ণনা দ্বারাই বুঝা যাচ্ছে যে, প্রশ্নকারী সালাত রত অবস্থায় এরূপ করেছিলেন।
৩য় অভিমত: কাম প্রবৃত্তি সহ লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে, আর কাম প্রবৃত্তি ছাড়া করলে ওযূ নষ্ট হবে না:
এটা ইমাম মালিক (রাহি.) এর একটি বর্ণনা। আল্লামা আলবানী (রাহি.) তা পছন্দ করেছেন।[32] এ অভিমত কারীদের মতে, বুসরা (রাঃ) এর হাদীস কাম প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং ত্বলাক (রাঃ) এর হাদীসটি কাম প্রবৃত্তি ছাড়া স্পর্শ করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তারা বলেন, মহানাবী () এর বাণী ‘‘এটা তোমার শরীরের একটি অংশ’’ এর দ্বারাই তা প্রমাণিত হয়। কেননা যখন কাম প্রবৃত্তি ছাড়াই লিঙ্গস্পর্শ করা হবে, তখন তা সমস্ত অঙ্গ স্পর্শ করার মতই হবে।
৪র্থ মতামত: লিঙ্গ স্পর্শ করার কারণে সাধারণভাবে ওযূ করা মুস্তাহাব,ওয়াজিব নয়ঃ
এটা ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর দু‘টি বর্ণনার মধ্যে একটি বর্ণনা। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহও এ মতামত পেশ করেছেন। আল্লামা ইবনে ওসাইমীন (রাহি.) এ মতের দিকেই ধাবিত হয়েছেন। তবে তিনি কাম প্রবৃত্তি ছাড়া লিঙ্গ স্পর্শ করার ক্ষেত্রে ওযূ করা মুস্তাহাব এবং কাম প্রবৃত্তিসহ স্পর্শ করলে দৃঢ়ভাবে ওযূ করার ওয়াজিব হবে বলেছেন । সতর্কতা মূলক তিনি এ কথা বলেছেন।[33] সুতরাং তারা বুসরাহ (রাঃ) এর হাদীসকে মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন। আর ত্বলাকের হাদীসে যে প্রশ্নটা ছিল তা মূলত ওযূ ওয়াজিব কিনা সে ব্যাপারে।
 শেষোক্ত সমন্বয়কারী উভয়দল নিম্নোক্তভাবে দলীল দিয়ে থাকেনঃ
(১) ত্বলাক (রাঃ) এর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ ও বুসরাহ (রাঃ) পরে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে নাসখের যে দাবী করা হয়েছে তা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কেননা উসূল বিদগণের নিকট এটা নাসখ (রহিত) হওয়ার উপর দলীল নয়। কারণ হলো, অনেক সময় দেখা যায় যে, পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
(২) ত্বলাক (রাঃ) এর হাদীসে এমন কারণ রয়েছে যা দূর করা সম্ভব নয়। আর তা হল, ‘লজ্জাস্থান শরীরেরই অংশ’। যখন কারণটি কোন হুকুমের সাথে জড়িত হয়ে যায়, যা দূর করা সম্ভব হয় না, তখন তার হুকুমও দূর করা সম্ভব নয়। সুতরাং তা মানসূখ করা সম্ভব নয়।
(৩) দু‘টি হাদীসের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব হলে, নাসখ (রহিত) করার বিধান কার্যকর হবে না। আর পূর্বের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, এখানে নাসখের বিধান কার্যকর করা বিশুদ্ধ হবে না।
আমার বক্তব্য: ত্বলাক ইবনে আলী (রাঃ) এর হাদীসটি সহীহ হতো, তাহলে শেষোক্ত মতামতটিই শক্তিশালী স্থানে থাকত। কিন্ত ত্বলাক বিন আলী (রাঃ) এর হাদীসটি সহীহ হওয়ার মতামতটি ঠিক নয়। বরং যঈফ হওয়ার মতামতটিই যথোপযুক্ত। সুতরাং এ কথাটিই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সাধারণভাবে লিঙ্গ স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে। চায় তা কামোত্তেজনা সহ হোক কিংবা কামোত্তেজনা ছাড়া হোক। কেননা কামোত্তেজনার কোন সীমা নেই এবং এটা ধর্তব্য হওয়ার উপর কোন দলীল নেই। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
 পূর্বের আলোচনার আলোকে কিছু প্রয়োজনীয় কথা:
১। মহিলা যদি তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করে তাহলে সে ওযূ করবে:
আমর বিন শু‘আইব তার পিতা থেকে তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল () বলেন, -অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার লিঙ্গ স্পর্শ করবে, সে যেন ওযূ করে এবং কোন মহিলা যদি তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করে তাহলে সে যেন ওযূ করে।[34]
হযরত আয়িশা (রা.) এর উক্তিও এ বিধানটিকে শক্তিশালী করে। অর্থাৎ, ‘‘মহিলা যদি তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করে তাহলে সে ওযূ করবে’’।[35] মূলত মহিলারা শারঈ বিধান পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের অনুরূপ। আর এটা হল ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ (রাহি.) এর অভিমত। আবূ হানীফা ও মালিক (রাহি.) এর বিপরীত মত পেশ করেছেন।
২। অন্যের লজ্জাস্থান স্পর্শ করা:
কোন পুরুষ তার স্ত্রীর লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে অথবা কোন নারী স্বামীর পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করলে, তাদের ওযূ নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে কোন দলীল নেই। তবে এর ফলে মযি বা মনি নির্গত হলে, ওযূ নষ্ট হবে। শুধু স্পর্শ করার কারণে ওযূ নষ্ট হবে না। ইমাম মালিক ও শাফেঈ (রাহি.) এর মতে, এ ক্ষেত্রে ওযূ ওয়াজিব হবে।[36] মূলতঃ তাদের মাযহাবের মূল কথা হল, মহিলাদের স্পর্শ করলেই ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে। সামনের আলোচনায় এর বিপরীত মতামতটিকেই প্রাধান্য দেয়া হবে।
অনুরূপ ভাবে যদি কোন নারী অথবা পুরুষ ছোট বাচ্চার লিঙ্গ স্পর্শ করে তাহলে ওযূ নষ্ট হবে না। ইমাম মালিক (রাহি.) এ মতকে সমর্থন করেছেন। এটা যুহরী ও আওয়ায়ী এর অভিমত।[37]
৩। ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলবশত হোক, লজ্জাস্থান স্পর্শ করার বিধান সমান:[38]
এটা আওযায়ী, শাফেঈ, ইসহাক ও আহমাদ (রাহি.) এর অভিমত। আর একদল বলেন, শুধু ইচ্ছাকৃত ভাবে বা স্বেচ্ছায় লিঙ্গ স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে। তারা হলেন, মাকহুল, জাবের বিন যায়েদ, সাঈদ বিন যুবাইর। এটা ইবনে হাযমের মাযহাব। এব্যাপারে দলীল হলো, আল্লাহ্র বাণী:
অর্থাৎ: আর এ বিষয়ে তোমরা কোন ভুল করলে তোমাদের কোন পাপ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (পাপ হবে)।
প্রথমোক্ত মতামতটিই বিশুদ্ধ। ইবনে মুনযির বলেন, ‘‘লিঙ্গ স্পর্শ করার অর্থ যারা ‘হাদাস’ বলে থাকেন যা ওযূ ওয়াজিব করে, তারা স্পর্শ করাকে ভুল বশত বা ইচ্ছাকৃত উভয়টি সমান ধর্তব্য মনে করেন’’।
আমার বক্তব্য: ভুল-ত্রুটিগুলো শর্তসমূহ ও আরকান সমূহের সাথে সম্পৃক্ত, যার মাধ্যমে পাপের বিধান রহিত হয় কিন্তু হুকুম বহাল থাকে। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবহিত।
৪। কাপড়ের উপর দিয়ে লিঙ্গ স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হবে না:
কেননা এটা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, এভাবে স্পর্শ করলে তাকে হাদাসের স্পর্শ বলা যায় না। মারুফ সূত্রে আবূ হুরাইরা (রাঃ) এর বির্ণত হদীছও এ বিধানটিকে শক্তিশালী করে-
"-অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার লিঙ্গ স্পর্শ করবে, এমতাবস্থায় তার মাঝে ও লিঙ্গের মাঝে কোন পর্দা থাকেনা, সে যেন ওযূ করে।[39]
শেষ অংশ......
দলীলের উৎসঃ
[1] আল-ইজমা’ (পৃ. ১৭), ইবনু মুনযির প্রণীত আল আউসাত (১/১৪৭)।
[2] আল মুহালস্না (১/২৩২), বিদায়াতুল মুজতাহিদ (১/৪০), আল-আউসাত (১/১৩৭)।
[3] সহীহ; বুখারী (১৩৫), মুসলিম (২২৫)।
[4] বিদায়াতুল মুজতাহিদ (১/৪০), আল-উম্ম (১/১৭)।
[5] আল মুহালস্না (১/২৩২), আল-মাসবূত্ব (১/৮৩)।
[6] আল-ইফসাহ (১/৭৮), আল-ইজমা’ (পৃ. ৩১)।
[7] সহীহ; বুখারী (২৬৯), মুসলিম (৩০৩)।
[8] এর সনদ সহীহ; বাইহাক্বী (১/১১৫)।
[9] আল মুহালস্না (১/২২২-২৩১), আল ইসিত্মযকার (১/১৯১) আল আউসাত (১/১৪২), ফাতহুল বারী (১/৩৭৬), ইমাম নববী প্রণীত ‘শরহে মুসলিম’ (২/৩৭০), নাসলুলআওতার (১/২৪১)।
[10] সহীহ; বুখারী (৬৪২), মুসলিম (৩৭৬)।
[11] সহীহ; মুসলিম (৩৭৬), তিরমিযী (৭৮)।
[12] সহীহ; বুখারী (১১৭), মুসলিম (৭৬৩) শব্দগুলো মুসলিমের।
[13] সহীহ; বুখারী (১১৭), মুসলিম (১৮৪), আহমাদ (১/৩৪১)।
[14] হাসান; নাসাঈ (১/৩২), তিরমিযী (৩৫৩৫) ইবনে মাজাহ (৪৭৮), আল ইরওয়া (১০৪)।
[15] "السه"বলা হয়, গুহ্যদ্বারের বৃত্তকে। আর "الوكاء"বলা হয়, এমন ফিতা বা দড়িকে যার দ্বারা মশকের মুখ বাঁধা হয়। সুতরাং দু‘চোখ জেগে থাকাকে মশকের দড়ির সাথে তুলোনা করা হয়েছে। কেননা যখন দু‘চোখ ঘুমিয়ে যায় তখন দড়ি বা বাধন খুলে যায়। ফলে তা থেকে বায়ূ নির্গত হয়।
[16] যঈফ; আবূ দাউদ (২০৩), ইবনে মাজাহ (৪৭৭) প্রভৃতি। এভাবে যঈফ হওয়াটাই অগ্রাধিকারযোগ্য। যদিও আলবানী তাকে হাসান আখ্যা দিয়েছেন।
[17] সহীহ; বুখারী (২১২), মুসলিম (২২২)।
[18] মাওকুফ সহীহ; ইবনু আবি শায়বাহ (১/১৫৮), আবদুর রাযযাক (৪৮১) সহীহ সনদে মাওকুফ হাদীস হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি মারফূ সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে, তবে তা সহীহ নয়। যেমন দারাকুতনী তার আলঈলাল (৮/৩২৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আয-যাঈফা (৯৫৪)।
[19] মাওকুফ ও মারফূ’ সূত্রে যঈফ; আবদুর রাযযাক (৪৭৯), বাইহাক্বী (১/১১৯), ঈলালুদ দারাকুতনী (৮/৩১০)।
[20] মুনকার; ইবনু আদী প্রণীত আল কামিল (৬/২৪৫৯) দারাকুতনী (১/১৬০) এবং ইমাম ত্বাবারাণী তার আল-আওসাত্ব গ্রন্থে।
[21] যঈফ; সিলসিলাতুয যঈফাহ (৯৫৩)।
[22] এর সনদ সহীহ; ইমাম বাযযার ও তার মত অনেকেই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এবং আবূ দাউদ তার মাসায়েলে আহমাদ (পৃ. ৩১৮), গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের সনদ শাইখাইনের শর্তানুসারে সহীহ। যেমনটি এসেছে ‘তামামুল মিন্না (পৃ. ১০০) গ্রন্থে।
[23] ইবনু মুনযির প্রণীত আলআওসাত্ব (১/১৫৫)।
[24] আল-বাদাঈ (১/৩০), শরহে ফাতালে কাদীর (১/৩৭), আল মাদূনাহ (১/৮-৯), আল-ইসিত্মযকার (১/৩০৮ থেকে পরবর্তী)।
[25] এর সনদ লাইয়্যিন; আবূ দাউদ (১৮২), তিরমিযী (৮৫), নাসাঈ (১/১০১)। এ হাদীসের সহীহ হওয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে কায়েস বিন ত্বাল্ক এর কারেনে যঈফ হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন।
[26] এর সনদ যঈফ; আবূ দাউদ (১৮৩), আহমাদ (৪/২৩), বাইহাক্বী (১/১৩৫), প্রভৃতি।
[27] আল-আওসাত্ব (১/২০৩), শরহে মায়ানীল আসার (১/৭১-৭৯)।
[28] আল-ইসিত্মযকার (১/৩০৮), আল-মাদূনাহ (১/৮-৯) আল-উম্ম (১/১৯), আলমাজমু (১/২৪), আল-মুগনী (১/১৭৮) আল-ইনসাফ (১/২০২), আল-মুহালস্না (১/২৩৫)।
[29] সহীহ; আবূ দাউদ (১৮১), নাসাঈ (১/১০০), ইবনে হিববান (১১১২)।
[30] শাহেদ থাকার কারণে সহীহ; ইবনে মাজাহ (৪৮১), আবু ইয়া’লা (৭১৪৪), বাইহাক্বী (১/১৩০), আল-ইরওয়া (১১৭)।
[31] যারা এটাকে মানসূখের কথা বলেছেন তারা হলেন, ত্বাবারাণী তাঁর আল কাবীর (৮/৪০২) গ্রন্থে, ইবনুহিববান (৩/৪০৫ إحسان- পর্যন্ত), ইবনু হাযম তার আল মুহালস্না (১/২৩৯), হাযেমী তাঁর আল ইতেবার (৭৭) ইবনুল আরাবী তাঁর আল-আরেযা (১/১১৭), বাইহাক্বী তার আল খালাফিয়্যাত (২/২৮৯) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
[32] দেখুন! পূর্বোলেস্নখিত মালেকী মাযহাবের উদ্বৃত গ্রন্থসহ তামামুল মিন্নাহ (১০৩ পৃঃ), এখানে ‘তামামুল মিন্নাহ’ গ্রন্থকার বলেন, আমার যতটুকু স্মরণ হচ্ছে যে, এ অভিমতটি হবে ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ:) এর অভিমত। তবে লেখক বলেন, আমার মতে, বরং ইবনে তাইমিয়্যাহ এর অভিমত হবে ৪র্থটি, যেমন সামনে দেখবেন। সুতরাং যে ভুল করে না সে সম্মানিত।
[33] মাজমু’ আল ফাতওয়া (২১/২৪১), শারহুল মুমতি’ (১/২৩৩)।
[34] সহীহ লিগায়রিহী; আহমাদ (২/২২৩), বাইহাক্বী (১/১৩২)।
[35] এর সনদ সহীহ; শাফেঈ তাঁর আল মুসবাদ (৯০) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বাইহাক্বী (১/১৩৩) ইমাম হাকিম একে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন এবং এর উপরই অটল থেকেছেন। যেমন হাকিম (১/১৩৮)।
[36]মাওয়াহিবুল জালিল (১/২৯৬), আল-উম্ম (১/২০)।
[37] ইবনু আব্দিল বার প্রণীত আল-কাফী (১/১৪৯), আল-আওসাত্ব (১/২১০)।
[38] আল-মুহালস্না (১/২৪১), আল-আওসাত্ব (১/২০৫-২০৭)।
[39] হাসান; দারাকুতনী (১/১৪৭), বাইহাক্বী (১/১৩৩) আছ-সহীহাহ (১২৩৫)।
ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ [শেষ অংশ]
প্রথম অংশের পর......
৫। নিতম্ব স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হয় না:[1]
কেননা নিতম্বকে লিঙ্গ হিসেবে গণ্য করা হয় না। লিঙ্গ ও নিতম্ব স্পর্শ করার ক্ষেত্রে সমতার কোন প্রমাণ না থাকায়, নিতম্বকে লিঙ্গের উপর কিয়াস করা যাবে না। যদি বলা হয় যে, উভয়টি নাপাক নির্গত হওয়ার স্থান? তাহলে বলা হবে যে, তা স্পর্শ করার ফলে ওযূ ভঙ্গের কোন কারণ পাওয়া যায় না। উপরন্তত্ম, নাপাক স্পর্শ করলে ওযূ নষ্ট হয় না, সুতরাং নাপাক বের হওয়ার স্থান স্পর্শ করলে কিভাবে ওযূ নষ্ট হবে?!! এটা ইমাম মালিক সাওরী ও আসহাবে রা‘য়ের অভিমত। ইমাম শাফেঈ এর বিরোধিতা করেছেন।
৬। উটের গোশত খাওয়ার ফলে ওযূ নষ্ট হওয়ার বিধান:
যে ব্যক্তি কাঁচা, পাকানো বা ভোনা করা উটের গোশত ভক্ষণ করবে, তার ওযূ করা ওযাজিব।
অর্থাৎ, জাবির বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি রাসূল () কে জিজ্ঞেস করল, আমি কি ছাগলের গোশত ভক্ষণ করলে ওযূ করব?  রাসূল () জবাবে বললেন, চাইলে করতে পার অথবা না পার। আমি কি উটের গোশত ভক্ষণ করলে ওযূ করব? রাসূল () জবাবে বললেন, হ্যাঁ উটের গোশত খেলে উযু কর।[2]
অর্থাৎ, বাররা বিন আযেব থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন, উটের গোশত খেলে উযু কর এবং ছাগলের গোশত খেলে ওযূ কর না।[3]
এটা ইমাম আহমাদ, ইসহাক, আবূ খাসসামাহ, ইবনুল মুনযির এবং ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর দু’টি অভিমতের একটি অভিমত। শাইখুল ইসলাম এমতটিকে পছন্দ করেছেন। ইবনে উমার ও জাবের ইবনে সামুরাহ থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। অপর পক্ষে জমহুর বিদ্বান তথা আবূ হানীফা, মালিক শাফেঈ, সাওরী ও সালাফদের একটি দলের মতে, উটের গোশত খাওয়ার ফরে ওযূ ওয়াজিব হয় না। বরং এ ক্ষেত্রে ওযূ করা মুস্তাহাব।[4]
কেননা জাবের বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে,
অর্থাৎ, রাসূল (স:) এর দু‘টি কাজের সর্বশেষ কাজ ছিল যে, তিনি রান্না করা খাবারের পর ওযূ করতেন না।[5]  তারা বলেন, মহানাবী () এর সাধারণ বাণী- ‘‘مِمَّا مَسَّتِ النَّارُ’’ উটের গোশতকেও শামিল করে। আর ‘উটের গোশমত খেলে ওযূ করতে হবে’  মর্মে বর্ণিত হাদীসটি মাসূখ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
 দু’ ভাবে এ কথার জবাব দেয়া যায়। [6]
১ম মতঃ জবির বর্ণিত হাদীসটি আম। আর ‘উটের গোশত ভক্ষণের ফলে ওযূ নষ্ট হবে’ মর্মে বর্ণিত হাদীসটি খাস। আম হাদীস খাস হাদীসের উপর ব্যবহার করা হয়। ফলে খাস হওয়ার দলীল পাওয়ার কারণে আম হাদীস থেকে উক্ত বিধান বের হয়ে যাবে। সুতরাং, উভয় হাদীসের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব হওয়ার কারণে ‘উটের গোশত ভক্ষণের ফলে ওযূ নষ্ট হবে’ মর্মে বর্ণিত হাদীসটিকে মানসূখ বলা যাবে না।
২য় মতঃ উটের গোশত খাওয়ার ফলে ওযূ করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা খাস নির্দেশ। চাই তা আগুণে পাকানো হোক বা না হোক। শুধু আগুণে পাকানোর কথা বলা হয়নি। সুতরাং, শুধু পাকানো উটের গোশত খেলেই যে ওযূ নষ্ট হবে, বিষয়টি এমন নয়। বরং উটের গোশতের বিধানটার আগুনে পাকানো খাবার খেলে ওযূ নষ্ট হবে অথবা হবে না এমন যে দু‘টি বিধান রয়েছে, তা থেকে বহির্ভূত।
 কেউ কেউ বলেন: হাদীসে উল্লেখিত ওযূ দ্বারা হাত ধোয়া উদ্দেশ্য। এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়।[7] কেননা মহানাবী () এর বাণীতে যে ওযূর কথা বর্ণিত হয়েছে, তাতে শুধু সালাতের ওযূর কথাই বলা হয়েছে। আবার সহীহ মুসলিমে জাবের বিন সামুরাহ এর হাদীসে ‘উটের গোশত খেলে ওযূ করতে হয়’ বিধানটিকে ‘উট বাঁধার স্থানে সালাত আদায় করতে হয়’ এই বিধানের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ‘উট বাঁধার স্থানে  সালাত আদায় করা’ ও ‘ছাগল বাঁধার স্থানে  সালাত আদায় করা’ র বিধানের মাঝে পার্থক্য হয়ে গেছে। সুতরাং, এতে নিশ্চিতভাবে বুঝা যায় যে, এটা সালাতের ওযূ।
বিশুদ্ধ মতামত হলো:
উটের গোশত ভক্ষণ করলে সর্বাবস্থায় ওযূ ওয়াজিব। এজন্য ইমাম নববী (রাহি.) মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থের (১/৩২৮ পৃ: কল‘আজী) বলেন, এই মতামতটিই দলীলের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী, যদিও জমহুর বিদ্বান এর বিপরীত মত পেশ করেছেন।
 ২টি সতর্কবাণী:
১ম: ইমাম নববী (রাহি.) মুসলিমের শারহ এর ১/৩২ পৃ: উটের গোশত খাওয়ার ফলে ওযূ না করার মাতামতটিকে চার খলীফা (রা.) এর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। এ দাবীর পেছনে কোন দলীল নেই এবং এ ব্যাপারে তাদের পর্যন্ত কোন সনদ জানা যায় না । এ ভুল দাবীর ব্যাপারে সতর্ক করে ইবনে তাইমিয়া্যাহ (রাহি.) বলেন, খোলাফায়ে রাশেদ্বীনসহ জমহুর ছাহাবা উটের গোশত খাওয়ার পর ওযূ করতেন না বলে যারা বর্ণনা করেছেন তারা তাদের প্রতি ভুল দাবী উত্থাপন করেছেন। মূলতঃ ‘আগুণে পাকানো খাবার খেয়ে তারা ওযূ করতেন না’ এ আম বর্ণনা কে কেন্দ্র করেই তারা এই ভুল ধারণা পোষণ করেছেন।[8]
২য়ঃ একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা যার কোন ভিত্তি নেইঃ[9]
সর্বসাধারণের কাছে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ রয়েছে, যা জ্ঞান পিপাষু ছাত্র সমাজ শুনলে উটের গোশত খাওয়ার পর ওযূ করা আবশ্যক মনে করবে। ঘটনাটি হল, একদা মহানাবী () এক দল সাহাবাদের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। অতঃপর তাদের একজনের কাছ থেকে তিনি গন্ধ অনুভব করছিলেন, ফলে ব্যক্তিটি মানুষের মাঝে দাঁড়াতে লজ্জাবোধ করছিল। মূলতঃ ব্যক্তিটি উটের গোশত খেয়েছিল। ফলে মহানাবী () তাকে বললেন, যে ব্যক্তি উটের গোশত খাবে সে ওযূ করবে। অতঃপর উটের গোশত খেয়েছিল এমন একদল ব্যক্তিবর্গ দাঁড়িয়ে গেল এবং তারা সবাই ওযূ করল। এই ঘটনাটি সনদগতভাবে দুর্বল এবং মতনগত ভাবে মুনকার।
দলীলের উৎসঃ
[1] আল-মুহালস্না (১/২৩৮), আল-আউসাত (১/২১২)।
[2] সহীহ; মুসলিম (৩৬০), ইবনু মাজাহ (৪৯৫)।
[3] সহীহ; আবূ দাউদ (১৮৪), তিরমিযী (৮১), ইবনে মাজাহ (৪৯৪)।
[4] আল-মাসবূত্ব (১/৮০), মাওয়াহিবুল জালীল (১/৩০২), আল-মাজমু’ (১/৫৭), আল-মুগনী (১/১৩৮), আল-মুহালস্না (১/২৪১), আল-আওসাত্ব (১/১৩৮)।
[5] সহীহ; আবূ দাউদ (১৯২), তিরমিযী (৮), নাসাঈ (১/১০৮)।
[6] আল-মুহালস্না (১/২৪৪), আল-মুমতিঈ (১/২৪৯)।
[7] মাজমু’ আল-ফাতাওয়া (২১/২৬০-এবং তার পরবর্তী অংশ)।
[8] আল-কাওয়ায়েদুল নাওরানিয়্যাহ (পৃ. ৯), থেকে গৃহীত; তামামুল মিন্নাহ (পৃ. ১০৫)।
[9] আলবানী প্রণীত আয-যাঈফাহ (১১৩২), মাশহুর হাসান প্রণীত ‘আল কাসাসু লা তাসবুত’ (পৃ. ৫৯)।
সালাতের জন্যই শুধু ওযূ ওয়াজিব, অন্য কিছুর জন্য ওয়াজিব নয়:
যে ব্যক্তি অপবিত্র (ওযূ বিহীন) রয়েছে এবং সালাত আদায়ের ইচ্ছা করে তার জন্য ওযূ করা ওয়াজিব। চায় তা ফরয সালাত হোক বা নফল সালাত হোক কিংবা জানাযার সালাত হোক । মহান আল্লাহ্ বলেন:
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমরা ধৌত কর। (সূরা মায়েদা-৬)
রাসূল () বলেন:    لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُور» »
অর্থাৎ: পবিত্রতা ব্যতীত সালাত গৃহীত হবে না।[1]
সালাত ব্যতীত অন্যক্ষেত্রে ওযূ ওয়াজীব নয়। অপবিত্র ব্যক্তির উপর সালাত ব্যতীত অন্য কিছু হারাম নয়।
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ; মুসলিম (২২৪) প্রভৃতি।
নিম্নোক্ত কাজগুলোর ক্ষেত্রে ওযূ করা মুস্তাহাব তবে নিম্নোক্ত কাজগুলোর ক্ষেত্রে ওযূ করা মুস্তাহাব।
কা’বা শরীফ ত্বওয়াফ করার সময়:
ত্বওয়াফকারীর জন্য ওযূ করা আবশ্যক হওয়ার ক্ষেত্রে কোন সহীহ দলীল আছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ অসংখ্য মুসলমান, যাদের সংখ্যা আল্লাহ্ তায়ালা ব্যতীত কেউ নির্ণয় করতে পারবে না। তারা আল্লাহ্র রাসূল () এর যুগে তওয়াফ করতেন। কিন্তু তাদের কাউকেও তিনি তওয়াফের জন্য ওযূ করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমাদের কাছে বর্ণিত হয় নি। অথচ তওয়াফ চলাকালীন সময় অনেকের ওযূ নষ্ট হত এবং অনেকেই ওযূ বিহীন তওয়াফ করতেন। বিশেষ করে ঐ সমস্ত দিন গুলোতে যে দিন গুলোতে বেশি ভিড় জমত। যেমন; তওফে কুদুম, ইফাযাহ ইত্যাদি। অতএব যখন তওয়াফের ক্ষেত্রে ওযূ করা ওয়াজিব হওয়ার জন্য কোন দলীল বর্ণিত হয়নি এবং এটা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণের কোন ইজমা নেই। অথচ এর জন্য ইজমা বা দলীলের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং তা ওয়াজিব না হওয়ার উপরই প্রমাণ করে।[1]
কিছু বিদ্বান তওয়াফের জন্য ওযূ ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস বর্ণিত মারফূ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন:
অর্থাৎ: বাইতুলস্নাহ তওয়াফ করা এক প্রকার সালাত। তবে তাতে আল্লাহ্ কথা বলা বৈধ করেছেন।[2]
তারা বলেন, তওয়াফ যেহেতু সালাত, সুতরাং তাতে সালাতের মত ওযূ ওয়াজিব। কিন্তু দু‘টি কারণে এমতামতটি গ্রহণযোগ্য নয়:
প্রথমত: এ হাদীসটি মারফূ  সূত্রে বর্ণিত নয়। সঠিক কথা হল এটি মাওকূফ  সূত্রে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রা.) এর উক্তি। যেমনটি ইমাম তিরমিযি, বাইহাক্বী, ইবনে তাইমিয়াহ ও ইবনে হাজাহ আসকালানী সহ আরো অনেকেই এ কথাটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
২য়ত: ধরে নেয়া হল হাদীসটি সহীহ। তবুও তওয়াফটা সকল ক্ষেত্রে সালাতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এমনকি সালাতে যে শর্ত রয়েছে তওয়াফে সে শর্ত নেই।[3] উপরন্ত সালাত এমন একটি শারীঈ ইবাদাত, যাতে ত্বহারাসহ আরো অনেক কিছু শর্ত রয়েছে। যার তাকবররের মাধ্যমে সকল কাজ হারাম হয় এবং সালামের মাধ্যমে সকল কাজ বৈধ হয়।
এজন্যই শাইখুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘আমার কাছে একথা স্পষ্ট যে, নিঃসন্দেহে তওয়াফের ক্ষেত্রে অপবিত্রতার কারণে ত্বহারাত বা পবিত্রতা শর্ত নয় এবং তা ওয়াজিবও নয় । তবে এ ক্ষেত্রে ছোট পবিত্রতা তথা ওযূ করা মুস্তাহাব। কেননা শারঈ দলীল এ ক্ষেত্রে ওযূ ওয়াজিব না হওয়ার উপরই প্রমাণ করে। আর ইসলামী শরীয়াতে এ ক্ষেত্রে ছোট পবিত্রতা ওয়াজিব হওয়ারও কোন প্রমাণ নেই।[4] আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাযম এ মতমকেই সমর্থন করেছেন।
আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাযম এ মতমকেই সমর্থন করেছেন।[5]
মাসাহাফ (কুরআন) স্পর্শ করা:
ইমাম মালিক, শাফেঈ, আহমাদ ও জমহুর বিদ্বানের মতে, ওযূ বিহীন অবস্থায় মাসাহাফ স্পর্শ করা বৈধ নয়।[6] এ ব্যাপারে তারা দু‘টি দলীল পেশ করে থাকেন-
(ক) আল্লাহ্র বাণী- لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ -অর্থাৎ, কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া (সূরা ওয়াক্বিয়াহ-৭৯)।
(খ) আমর বিন হাযম এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানাবী () ইয়ামান বাসীর নিকট একটি চিঠি লিখে ছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল:    
অর্থাৎ: পবিত্রতা ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে না।[7]
আমার বক্তব্য: নিম্নোক্তভাবে তাদের দলীলের জবাব দেয়া যায়:
(ক) আয়াতে বর্ণিত يَمَسُّهُ এর সর্বনামটি কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করা ছাড়া অত্র আয়াত দ্বারা দলীল দেয়া সম্পূর্ণ হবে না। অথচ অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট এটা সুস্পষ্ট যে, সর্বনামটি ‘সুরক্ষিত কিতাব’ এর দিকে প্রত্যাবর্তন হয়েছে, যা আসমানে রয়েছে। তা হলো লাওহে মাহফূজ। আর الْمُطَهَّرُونَ বলতে ফেরেশতাগণ উদ্দেশ্য। নিম্নোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা এটা বুঝা যায়
অর্থাৎ: নিশ্চয় এটি মহিমান্বিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে, কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া (সূরা ওয়াক্বিয়াহঃ ৮৮-৭৯)।
এর সমর্থনে অন্য আয়াতও উল্লেখ করা যেতে পারে-
অর্থাৎ: এটা আছে সম্মাণিত সহীফাসমূহে। সমুন্নত, পবিত্র, লেখকদের হাতে, যারা মহা সম্মানিত, অনুগত (সূরা আবাসাঃ ১৩-১৬)।
(খ) আর যে হাদীস দ্বারা দলীল দেয়া হয়েছে তা যঈফ। এটা দলীলের যোগ্য নয়। কেননা সহীফাহ এর ব্যাপারে এরূপ কোন বাণী পাওয়া যায় না। এ হাদীসের সনদের রাবীদের ব্যাপারে অনেক মতানৈক্য রয়েছে।
যদি ধরে নেয়া হয় যে, সর্বনামটি কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্ত্যন করেছে, তাহলে এক্ষেত্রে আমরা বলব:
الطاهر শব্দটি মুশতারিক বা বহু অর্থবোধক শব্দ সমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তার অর্থটি মু‘মিন ব্যক্তি, বড় পবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনকারী ব্যক্তি, ছোট পবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনকারী ব্যক্তি অথবা শরীরে কোন নাপাক নেই এমন ব্যক্তি উপর প্রযোজ্য হতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে মাসআলাটি উসূল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দিয়ে প্রত্যাবর্তিত হবে।
 যারা মুশতারিক শব্দটিকে তার সমস্ত অর্থের উপর প্রযোজ্য হওয়া বৈধ মনে করেন, তারা এখানে সেটাই প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু যখন নাজাসাত বা নাপাক নামটি ওযূ বিহীন মু’মিন অথবা জুনাবী মু’মিন এর উপর প্রয়োগ করা হবে তখন তা বিশুদ্ধ হবে না। চাই তা প্রকৃত অর্থে হোক, রূপক অর্থে হোক কিংবা আভিধানিক অর্থেই হোক। কেননা আল্লাহ্র রাসূলের বাণী-
অর্থাৎ: ‘‘মু‘মিন কখনও নাপাক হয় না’’।[8] আর এ কথা প্রমাণিত যে, মু’মিন সর্বদা পবিত্র থাকে। কুরআন ও হাদীস দ্বারা মুমিন নাজাসাত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। সুতারাং শব্দটি প্রযোজ্য হবে এমন ব্যক্তির উপর যে মুশরিক নয়। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
অর্থাৎ: মুশরিকগণ নাপাক (সূরা তাওবা-২৮)। 
আর হাদীসে শত্রম্নদের এলাকায় কুরআন নিয়ে ভ্রমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যারা বলেন মুশতারিক শব্দটি এক্ষেত্রে মুজমাল বা সংক্ষিপ্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং তার অর্থ স্পষ্ট হওয়া ছাড়া তার উপর আমাল করা যাবে না। তাহলে বলা হবে, কুরআন ও হাদীসে এর কোন প্রমাণ নেই। এমন কি যদিও الطاهر নামটি ছোট নাপাক বা বড় নাপাক ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য হয়।[9]
সুতরাং বুঝা গেল, মাসাহাক (কুরআন) স্পর্শ করার জন্য ওযূ করা ওয়াজিব নয়। এটা ইমাম আবূ হানীফা, দাউদ ও ইবনে হাযম (রাহি.) এর মতামত। ইবনে আব্বাস ও সালফের একটি দলও এ মতামত পেশ করেছেন। ইবনে মুনযির এমতটিকে পছন্দ করেছেন।[10] এ ব্যাপারে আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
প্রসঙ্গ কথা:
বিদ্বানদের বিশুদ্ধ অভিমতে, যদি নাপাক অবস্থায় স্পর্শ ছাড়া শুধু কুরআন পাঠ করা হয় তাহলে কোন সমস্যা নেই, চাই তা ছোট নাপাকী হোক কিংবা বড় নাপাকী হোক। এক্ষেত্রে মাসাহাফ স্পর্শ করার বিধানের চেয়ে এ বিধানটি অনেক শিথিল। কারণ-
(১) এ ক্ষেত্রে কুরআন পাঠে নিষেধজ্ঞার ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ মারফূ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ ব্যাপারে যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই যঈফ। তা দলীলের যোগ্য নয়।
যেমন, আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে মারফূ সূত্র বর্ণিত আছে যে:
অর্থাৎ: জুনুবী ব্যক্তি ও হায়েযওয়ালী কুরআন থেকে কিছু পাঠ করবে না।
ইবনে রওয়াহাহ এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
অর্থাৎ: ‘‘রাসূল () নিষেধ করেছেন যে, আমাদের কেউ যেন জুনাবী অবস্থায় কুরআন পাঠ না করে’’।
আবদুল্লাহ বিন মালিক এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
অর্থাৎ: ‘‘আমি জুনাবী অবস্থায় যখন ওযূ করি, তখন খাই ও পান করি। কিন্তু গোসল না করা পর্যন্ত  সালাত আদায় করি না ও কুরআন পাঠ করি না’’। এ হাদীস গুলোর কোনটিই  সহীহ নয়।[11]
(২) হযরত আয়িশা (রা.) থেকে সাব্যাস্ত আছে যে, মহানাবী () সবাস্থায় আল্লাহ্র যিকির করতেন।[12]
(৩) রাসূল () হায়েযওয়ালী মহিলাদের ঈদগাহে বের হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন:
অর্থাৎ: তারা মানুষের পেছনে দাঁড়াবে তাদের তাকবীরে সাথে তাকবীর দিবে ও তাদের সাথে দোয়ায় অংশ গ্রহণ করবে।[13]
সুতরাং এর দ্বারা বুঝা যায়, হায়েয ওয়ালী মহিলা তাকবীর দিতে পারবে ও আল্লাহ্ তা‘আলার যিকির করতে পারবে।
(৪) হযরত আয়িশা (রা.) যখন ঋতুবর্তী ছিলেন তখন মহানাবী () তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:
অর্থাৎ: ‘‘বাইতুলস্নাহ তওয়াফ ছাড়া তুমি হাজ্জের সকল কর্ম পালন কর’’।[14] এতে বুঝা গেল, হাজীগণ আল্লাহ্র যিকির করতে পারবে ও কুরআন পাঠ করতে পারবে।
উপরের আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, নাপাক ব্যক্তির কুরআন পাঠ করতে বাধা নেই। শাইখুল ইসলাম বলেন, এটা ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) এর মাযহাব এবং ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ এর প্রসিদ্ধ মাযহাব।[15]
দলীলের উৎসঃ
[1] জামি আহকামুন নিসা (২/৫১৫)।
[2] মাওকুফ; তিরমিযী, নাসাঈ, হাকিম সহ অনেকেই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মারফূ সূত্রে এ হাদীসটি সহীহ নয় এ হাদীসটি মাওকূফ হওয়াটাই অধিক বিশুদ্ধ। যেমনটি আমাদের শাঈখ উল্লেখ করেছেন তার জামি’ আহকামুন নিসা (২/৫১৫-৫২১) গ্রন্থে। আলবানী এর বিরvাধিতা করেছেন এবং একে মারফূ’ আখ্যা দিয়েছেন। আল-ইরওয়া (১/১৫৬)।
[3] মাজমু’ আল ফাতাওয়া (২৬/১৯৮), জামি’ আহকামুন নিসা (২/৫২২) এখানে সালাত ও ত্বওয়াফের মধ্যে ১১টি পার্থক্য উল্লেখ করা হয়েছে।
[4] মাজমু’ আলফাতাওয়া (২৬/২৯৮)।
[5] আল-মুহালস্না (১/১৭৯)।
[6] আল-মাজমূ (১/১৭), ইসিত্মযকার (৮/১০), আল-মুগনী (১/১৪৭), আল-আওসাত্বব (২/১০২)।
[7] যঈফ; এর অনেকগুলো যঈফ সনদ রয়েছে এবং সকল সনদ একত্রিত করে হাসান পর্যায়ে উন্নিত করার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। ফলে আলবানী তার ‘ইরওয়া’ গ্রন্থে (১/১৫৮ পৃ:) একে সহীহ বলেছেন। তবে স্পষ্ট কথা হল এটা হাসান পর্যায়ে উন্নিত হবে না।
[8] সহীহ বুখারী (২৭৯), মুসলিম (৩৭১)।
[9] নাসলুল আওতার (১/২৬০-দারুল হাদীস)
[10] আল-বাদাঈ (১/৩৩), হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন (১/৭৩), আল-মুহালস্না (১/১৮), আল-আওসাত্বব (২/১০৩)।
[11] আলবানী প্রণীত আল-ইরওয়াহ (১৯২,৪৮৫), বাইহাক্বী প্রণীত ‘খিলাফিয়্যাত’ (২/১১) এ শায়েখ মাশহুর এর বিশেস্নষণ।
[12] সহীহ; মুসলিম (৩৭৩) , হাদীসের পূর্বে ইমাম বুখারী মুয়ালস্নাক সূত্রে বর্ণনা করেছেন (৬০৮)।
[13] সহীহ; বুখারী (৯৭১), মুসলিম (৮৯০)।
[14] সহীহ; বুখারী (১৬৫০) ।
[15] মাজমূ আল-ফাতওয়া (২১/৪৫৯), আল-আওসাত্বব (২/৯৭)।
যে সমস্ত কাজে ওযূ করা মুস্তাহাব
১। আল্লাহ্ তা‘আলার যিকির করার সময়:
এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে সাধারণ যিকির, কুরআন তিলাওয়াত, কাবা শরীফ তওয়াফ ইত্যাদি। এসব কারণে ওযূ করা মুস্তাহাব।
অর্থাৎ: আল-মুহাজির বিন কুনফুয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন যে, একদা তিনি নাবী করীম () এর খেদমতে এমতাবস্থায় পৌঁছলেন যখন তিনি (স:) পেশাবরত ছিলেন। তিনি তাঁকে সালাম দেন। কিন্তু নাবী করীম () উযু না করা পর্যন্ত তার সালামের জবাব থেকে বিরত থাকেন। অতঃপর তিনি তার নিকট ওযর পেশ করে বলেন: আমি পবিত্র হওয়া বা পবিত্রতা অর্জন করা ব্যতীত অলস্নাহ তাআলার নাম স্মরণ করা অপছন্দ করি।[1]
যদিও এটি অবশ্যক নয়, কেননা  সহীহ মুসলিমে (৪/৬৮) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘‘মহানাবী () সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র যিকির করতেন’’।
২। ঘুমানোর সময়:
অর্থাৎ: বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নাবী () বলেছেন, যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন  সালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করে নিবে। তার পর ডান পার্শে শুয়ে বলবে হে আল্লাহ্! আমার জীবন আপনার কাছে সমর্পণ করলাম, ....।[2]
৩। জুনুবী ব্যক্তি যখন খাওয়া, পান করা, ঘুমানো কিংবা পুনরায় সহবাস করার ইচ্ছা করবে:
আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল () যখন জুনাবী অবস্থায় খাওয়া বা ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন তখন  সালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করতেন।[3]
অর্থাৎ: আবূ সাঈদ (রাঃ) মহানাবী () থেকে বর্ণনা করে বলেন, তিনি বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি স্ত্রী সহবাসের পর পুনরায় সহবাস করতে চায় তাহলে সে যেন  সালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করে।[4]
৪। গোসল করার পূর্বে ওযূ করা:
আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () যখন জানাবাতের গোসলের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি ডান হাতে পানি নিয়ে বাম হাতে ঢালতেন এবং লজ্জাস্থান ধুয়ে নিতেন। অতঃপর  সালাতের ওযূর ন্যায় ওযূ করতেন।[5]
৫। আগুনে স্পর্শ করা খাবার তথা পাকানো খাবার খেলে ওযূ করা:
মহানাবী () এর বাণী- «تَوَضَّئُوا مِمَّا مَسَّتِ النَّارُ»
অর্থাৎ: ‘‘তোমরা আগুনে পাকানো খাবার খেলে ওযূ কর’’।[6] এখানে আদেশটি মুস্তাহাব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা আমর বিন উমাইয়্যাহ আযযমারী এর হাদীসে রয়েছে-
অর্থাৎ: আমর বিন উমাইয়্যাহ আযযমারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী করীম () কে একটি বকরীর কাঁধের গোশ্ত কেটে খেতে দেখলাম। এ সময়  সালাতের জন্য ডাকা হল, তখন তিনি ছুরি ফেলে দিয়ে  সালাত আদায় করলেন; কিন্তু ওযূ করলেন না।[7]
৬। প্রত্যেক  সালাতের জন্য নতুন ভাবে ওযূ করা:
অর্থাৎ: হযরত বুবদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () প্রত্যেক সালাতের জন্য ওযূ করতেন। তবে মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ওযূ করছেন ও দু’মোজার উপর মাসাহ করেছেন এবং এক ওযূ দ্বারাই কয়েক ওয়াক্ত  সালাত আদায় করেছেন।[8]
৭। যে সমস্ত নাপাকীর কারণে ওযূ নষ্ট হয় তা সংঘটিত হওয়ার পর ওযূ করা:
যেমন: পূর্বোলেস্নখিত বিলাল (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানববী () জান্নাতে (বেলালের) জুতার আওয়াজ শুনে বলেছিলেন, কি কারণে তুমি আমার অগ্রগামি হয়েছ? তখন বেলাল বললেন,
অর্থাৎ: হে আল্লাহ্র রাসূল ()! আমি যখনই আযান দিতাম তখনই দু‘রাকআত  সালাত আদায় করতাম এবং যখনই আমার ওযূ ভঙ্গ হয়ে যেত, কখনই ওযূ করে নিতাম। তখন মহানাবী () বললেন, এ জন্যই।[9]
৭। বমি হওয়ার পর ওযূ করাঃ
অর্থাৎ: মি’দান বিন আবূ ত্বলহা আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেন, রাসূল () বমি করলেন, ফলে তিনি ওযূ করলেন। মিদান বলেন, আমি দামেশকের মাসজিদে সাওবান (রা.) এর সাথে দেখা করে তাঁকে এ কথা বললাম। তিনি বললেন, আবূ দারদা (রাঃ) ঠিকই বলেছেন, এ সময় আমি তাঁর (রাসূল ) এর ওযূর পানি ঢেলেছিলাম।[10]
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ; আবূ দাউদ (১৭), নাসাঈ (১/১৬), ইবনে মাজাহ (৩৫০), দারেমী (২/২৮৭),আহমাদ (৫/৮০) এটা সহীহ, যেমনটি ‘‘সিলসিলা সহীহা’ -তে বর্ণিত হয়েছে (৮৩৪)।
[2] সহীহ; বুখারী (২৪৭), মুসলিম (২৭১০) প্রভৃতি।
[3] সহীহ; বুখারী (২৮৮), মুসলিম (৩০৫) শব্দ গুলো তার, আবূ দাউদ (২২২), তিরমিযী (১১৮), নাসাঈ (১/১৩৮) প্রভৃতি।
[4] সহীহ; মুসলিম (৩/২১৭), আবূ দাউদ (২১৭), তিরমিযী (১৪১), নাসাঈ (১/৪২)।
[5] সহীহ; বুখারী (২৪৮), মুসলিম (৩১৬) প্রভৃতি।
[6] সহীহ; মুসলিম (৩৫১), আবূ দাউদ (১৯২), তিরমিযী (৭৯), নাসাঈ (১/১০৫), ইবনে মাজাহ (৪৮৫)।
[7] সহীহ; বুখারী (১/৫০), মুসলিম (৪/৪৫, নববী প্রণীত), ইবনে মাজাহ (৪৯০)।
[8] সহীহ; মুসলিম (২৭৭), আবূ দাউদ (১৭১), তিরমিযী (৬১), নাসাঈ (১/৮৯), ইবনে মাজাহ (৫১০)।
[9] এর সনদ সহীহ, তিরমিযী তার হাদীসে অযুসহ উল্লেখ করেছেন (৩৬৮৯),আবূ দাউদ (৩০৫৫), আহমাদ (২১৯৬২) শব্দগুলো তার, সহীহাইনে এটা বর্ণিত হয়েছে শাহেদের অংশ ছাড়া।
[10] সহীহ; তিরমিযী (৮৭), আবূ দাউদ (২৩৮১), সনদ সহীহ।
আবরণীর উপর মাসাহ
প্রথমত: দুই মোজার উপর মাসাহ করা
خف এর সংজ্ঞা:
দুই টাখনুকে ঢেঁকে রাখে এমন চামড়ার জুতাকে خف বলা হয়।[1] পাঁয়ে বেড়ে থাকা দুই হাড্ডিকে কা’ব বলা হয়।
المسح এর আভিধানিক অর্থঃ
 مسح শব্দটি مسح মাসদার হতে গৃহীত। কোন বস্ত্তর উপর মৃদু হাত বুলানোকে মাসাহ বলা হয়।[2] আর মোজার উপর মাসাহ করা বলতে বুঝায়, ওযূতে দু’পা ধোয়ার বিকল্প হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে ও নির্দিষ্ট মোজার উপর ভিজা হাত বুলানো।[3]
মোজার উপর মাসাহ করার ব্যাপারে শরীয়াতের বিধান:
বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কোন ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে পবিত্রতা অর্জন করে মোজা পরিধান করার পর ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে সে মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করতে পারবে।[4] ইবনুল মুবারাক বলেন, মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই, বরং তা বৈধ। এক্ষেত্রে রাসূল () এর সাহাবীদের পক্ষ থেকে মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করা মাকরূহ ও জায়েয উভয়টিই বর্ণিত আছে। [5] তবে রাসূল () থেকে মুতওয়াতির পর্যায়ের সহীহ হাদীস দ্বারা এটা শরীয়াত সম্মত হওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
অর্থাৎ: হাম্মাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদিন জারীর পেশাব করার পর ওযূ করলেন এবং মোজার ওপর শুধু মাসাহ করলেন। তাকে প্রশ্ন করা হলো (সম্ভবতঃ প্রশ্নকারী হাম্মাম নিজেই) আপনি এরূপ করছেন কেন? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ! আমি রাসূলুললস্নাহ্ () কে দেখেছি, তিনি পেশাব করার পর ওযূ করে মোজার ওপর মাসাহ করেছেন। ইবরাহীম বলেন, জারীরের এ কথাটি তাদের কাছে খুবই ভাল লেগেছে। কেননা, জারীর সূরা মায়েদা নাযিল হওয়ার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন।[6]
মোজার উপর মাসাহ করার বিধান:
জমহুর বিদ্বানের মতে, মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করা বৈধ। তবে এর চেয়ে পা ধৌত করার উত্তম। আর হাম্বলী মাযহারের মতে, এ ব্যাপারে অবকাশ থাকার কারণে মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করা উত্তম।[7]
বিশুদ্ধ অভিমত: প্রত্যেক ব্যক্তির পায়ের অবস্থা অনুযায়ী উত্তম হওয়ার বিষয়টি বিবেচিত হবে। সুতরাং যে মোজা পরিধান করবে সে তার উপর মাসাহ করবে এবং মোজা খুলবে না। এতে মহানাবী () ও সাহাবাদের অনুসরণ করা হবে। আর যে ব্যক্তির পা খোলা থাকবে তার জন্য পা ধৌত করা উত্তম। আর পা খোলা থাকলে তাতে মোজা পরিধান করে তার উপর মাসাহ করার প্রয়াস চালাবে না[8] এবং মোজা পরে থাকলে, সময়ের মধ্যে তা খুলে পা ধৌত করারও প্রয়াস চালাবে না। আল্লাহ্ ভাল জানেন।
মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করার সময়সীমা:
ইসলামী শরীয়াত মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিন রাত ও মুকীমের জন্য একদিন একরাত মোজার উপর মাসাহ করার সময় সীমা নির্ধারণ করেছে। এটা জমহুর বিদ্বান তথা হানাফী, হাম্বলী মাযহাবের অভিমত। নতুন অভিমত অনুযায়ী এটা ইমাম শাফেঈ এর প্রকাশ্য অভিমত। জাহেরী মাযহাবও এ অভিমত পেশ করেছেন।[9] এর প্রমাণ নিমণরূপ:
(১) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল () মুসাফিরের জন্য তিন দিন-তিন রাত এবং মুকীমের জন্য এক দিন ও এক রাত মোজার উপর মাসাহ করার অনুমতি দিয়েছেন।[10]
(২) আওফ বিন মালিক আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল () তাবুক যুদ্ধের দিন মুসাফিরের জন্য তিন দিন-তিন রাত এবং মুকীমের জন্য এক দিন ও এক রাত মোজার উপর মাসাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন।[11]
(৩) সফওয়ান বিন আস্সাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
অর্থাৎ: আমরা যখন সফরে থাকতাম, তখন রাসূল () আমাদেরকে জানাবাতের অপবিত্রতা ছাড়া তিনদিন ও তিন রাত আমাদের মোজা না খুলতে নির্দেশ দিতেন। তবে পেশাব-পায়খানা ও ঘুমের কারণে কোন সমস্যা হতো না।[12]
এ ক্ষেত্রে ইমাম মালিক (রাহি.) এর বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। আর এটা ইমাম শাফেঈর (রাহি.) পুরাতন অভিমত। তাদের মতে মোজার উপর মাসাহ করার কোন সময়সীমা নেই। বরং যতক্ষণ পর্যন্ত মোজা খোলা না হবে ও জুনুবী না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মোজার উপর মাসাহ করা যাবে। এটা লাইস (রাহি.) এরও অভিমত।[13] তারা কিছু যঈফ হাদীস দ্বারা দলীল দিয়ে থাকেন, তন্মধ্যে-
(১) অর্থাৎ, উবাই ইব্ন ইমারা (রা.) হতে বর্ণিত। ইয়াহ্ইয়া ইবন আইঊব বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ () এর সাথে উভয় কিবলার দিকে মুখ করে সালাত পড়েছিলেন। তিনি বলেন, ইয়া রাসূলালস্নাহ। আমি কি মোজার উপর মাসাহ করব? তিনি বলেন: হ্যাঁ। রাবী তাঁকে এক, দুই ও তিন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে- তিনি বলেন: তুমি যত দিনের জন্য ইচ্ছা কর। অপর এক বর্ণনায় আছে: তিনি প্রশ্ন করতে করতে সাত দিন পর্যন্ত পৌঁছান। জবাবে রাসূল () বলেন, হ্যাঁ যত দিন তুমি প্রয়োজন বোধ কর।[14]
(২) খুযাইমা ইবন সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি () বলেন: মোজার উপর মাসাহ করার নির্ধারিত সময়সীমা হল তিন দিন। আমরা যদি তাঁর নিকট অধিক সময়সীমা প্রার্থনা করতাম, তবে তিনি আমাদের জন্য অধিক সময় অনুমোদন করতেন।[15] অর্থাৎ, এর দ্বারা মুসাফিরের জন্য দু‘মোজার উপর মাসাহ করা বুঝানো হয়েছে। এ হাদীসটি যদিও সহীহ হয় তবুও এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। কেননা এটা সাহাবীর একটি ধারণা মাত্র। এর দ্বারা ইবাদাত করা যেতে পারে না।
(৩) আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত; রাসূল () বলেন, তোমাদের কেউ যদি ওযূ করে মোজা পরিধান করে অতঃপর তা পরিধান করে সালাত আদায় করে, তাহলে পরে যদি সে চায় তবে মোজা না খুলে মোজার উপর মাসাহ করলেই চলবে। তবে জানাবাতের নাপাকীর কারণে মাসাহ বৈধ হবে না।[16]
উল্লেখিত সব হাদীসগুলোই যঈফ। এগুলো দলীল যোগ্য নয়।
(৪) আলকামা বিন আমের আল জুহানী এর আসারে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একদা আমি শাম থেকে মদিনার  উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমি শাম থেকে বের হয়ে ছিলাম জুম‘আর দিন এবং মদিনায় পৌঁছেছিলাম তার পরবর্তী জুম‘আর দিন। অতঃপর আমি উমার বিন খাত্তাবের কাছে গেলে তিনি আমাকে বলেন, তুমি কখন তোমার পায়ে মোজা পরিধান করেছ? তখন আমি উত্তরে বললাম, জুম‘আর দিন। তখন তিনি বললেন তুমি কি মোজাদ্বয়কে আর খুলেছিলে? আমি বলালম না, তখন তিনি বললেন তুমি ঠিক করেছ।[17] অনুরূপভাবে এ বর্ণনাটিও যঈফ।
বাইহাক্বী বলেন, আমাদের কাছে উমার (রাঃ) থেকে সময়-সীমার কথা বর্ণিত হয়েছে। হয়ত তিনি রাসূল () এর থেকে হাদীস পাওয়ার কারণে এ মতের( সময়-সীমার) দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন অথবা তার মতামতটি প্রসিদ্ধ সহীহ হাদীস অনুযায়ী হওয়াটাই উত্তম।
এজন্য ইবনে হাযম (রাহি.) ‘‘মুহালস্না’’ গন্থে (২/৯৩পৃ) বলেন, ‘‘শুধু ইবনে উমার ছাড়া সাহাবাদের পক্ষ থেকে আর কেউ সময় নির্ধারণের ব্যাপারে কোন মতানৈক্য করেননি’’।
মোজার উপর মাসাহ করার সময় সীমার সূচনা:
শরীয়াত কর্তৃক এটা নির্ধারিত যে, মুকীম হলে তার মাসাহ করার সময়সীমা একদিন একরাত এবং মুসাফির হলে তিনদিন তিনরাত। কিন্তু কখন থেকে এ সময়ের গণনা শুরু হবে? বিদ্বানদের মাঝে এ ব্যাপারে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়-
১ম: মোজা পরিধানের পর প্রথম হাদস (ওযূ ভঙ্গ) থেকে এ সময়ের সূচনা হবে:
এটা সুফয়ান সাওরী, শাফেঈ, আবূ হানীফা ও তার অনুসারী এবং হাম্বলী মাযহারের প্রকাশ্য অভিমত।[18] তারা বলেন, কেননা মাসাহ এর ক্ষেত্রে যেমন দূরুত্ব নির্ধরণ করা হয় তেমনি  প্রথম হাদীসের পরের সময় থেকেই মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ হয়।
২য়: মোজা পরিধান করার পর থেকেই এ সময়ের সূচনা হবে: এটা হাসান বুখারী (রাহি.) এর অভিমত।[19]
৩য়: মুকীম হলে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সমপরিমাণ মাসাহ করবে। আর মুসাফির হলে ১৫ ওয়াক্ত সালাত সমপরিমাণ সময় মাসাহ করবে। এর বেশি সময় মাসাহ করবে নাঃ এটা ইমাম শাফেঈ, ইসহাক ও আবূ সাওরসহ অন্যান্যদের অভিমত।[20]
৪র্থ: হাদাসের (ওযূ ভঙ্গের) পরেই যখন তার জন্য মাসাহ করা বৈধ হবে তখন থেকেই এ সময় সূচনা হবে। চায় সে মাসাহ করুক বা ওযূ ও মাসাহ না করুকঃ এমনকি যদি মাসাহ বৈধ হওয়ার পর কিছু সময় অতিক্রম করার পর মাসাহ করে, তাহলে শুধু বাকি সময় মাসাহ করতে পারবে। এটা ইবনে হাযম (রাহি.) এর অভিমত। তিনি অনেক মাযহাবের কথা তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেখে নিন![21]
৫ম: হাদাসের (ওযূ ভঙ্গের) পরে যখন প্রথম মাসাহ করা হবে তখন থেকে এ সময়ের সূচনা হবে:[22] এটা আহমাদ ইবনে হাম্বল ও আওযায়ী (রাহি.) এর অভিমত। ইমাম নববী, ইবনে মুনযির ও ইবনে ওসাইমীন (রাহি.) এ অভিমতকে পছন্দ করেছেন। এটাই প্রাধান্য প্রাপ্ত অভিমত। যেহেতু মহানাবী () প্রকাশ্য ভাবেই বলে দিয়েছেন- ‘‘মুসাফির মাসাহ করবে’’ ও ‘‘মুকীম মাসাহ করবে’’। আর মাসাহ করা কার্যটি সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত কাউকে মাসাহকারী বলা সম্ভব নয়। সুতরাং দলীল ছাড়া প্রকাশ্য অর্থ ব্যতীত অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করা বৈধ হবে না। আল্লাহ্ ভাল জানেন।
এর উপর ভিত্তি করে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন ব্যক্তি যদি যূহরের সালাতের সময় ওযূ করে এবং ১২ টার সময় মোজা পরিধান করে আসরের সময় তথা ৩টা পর্যন্ত পবিত্র অবস্থায় থাকে। এরপর ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায়, এবং আসরের পর বিকাল ৪ টার সময় ওযূ করে মোজার উপর মাসাহ করে। তাহলে সে যদি মুকীম হয়, তবে পরবর্তী দিন আসরের সময় বিকাল ৪টা পর্যন্ত মাসাহ করতে পারবে। আর মুসাফির হলে ৪র্থ দিন ঐ সময় পর্যন্ত মাসাহ করতে পারবে।
দলীলের উৎসঃ
[1] নাসলুল আওতার (১/২৪১)।
[2] আল-কামুসুল মুহীত্ব, মাকাবয়িসুল লুগাহ্।
[3] আদ-দুররুল মুখতার (১/১৭৪)।
[4] আল-ইজমা’ (২০) ইবনে মুনযির প্রণীত। আল-আওসাত্বব (১/৪৩৪)।
[5] আল-আওসাত্বব (১/৪৩৪), সুনানুল বাইহাক্বী (১/২৭২), আল-ফাতহ্ (১/৩০৫)।
[6] সহীহ; বুখারী (৩৮৭), মুসলিম (১৫৬৮) তবে শব্দগুলো মুসলিমের।
[7] ফাতহুল কাদীর (১/১২৬), শারহুস সগীর (১/২২৭), আল-মাজমূ’ (১/৫০২) মুনতাহাল ইরাদাত (১/২৩)।
[8] এটা শাইখুল ইসলামের মতামত, যা এসেছে আল-ইখতিয়ারাত গ্রন্থে (১৩ পৃ.)।
[9] আল-মাসবূত্ব (১/৯৮), আল-উম্ম (১/৩৪), আল-মুগনী (১/২০৯), আল-মুহালস্না (২/৮০)।
[10] সহীহ; মুসলিম (২৭৬), নাসাঈ (১/৮৪)।
[11] সহীহ; আহমাদ (৬/২৭), সহীহ সনদে, আবু বাকরাহর হাদীসটি এর শাহেদ, ইবনে মাজাহ (৫৫৬), প্রভৃতি।
[12] হাসান; কিছু পূর্বে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে।
[13] আল-মাদূনাহ (১/৪১), বিদায়াতুল মুজতাহিদ (১/২৪)।
[14] যঈফ; আবূ দাউদ (১৫৮) ইবনু আব্দিল বার বলেন, এ হাদীসটি প্রমাণিত নয় এবং এর নির্ভরযোগ্য সূত্রও নেই।
[15] যঈফ; আবূ দাউদ (১৫৭), তিরমিযী, ইবনে মাজাহ (৫৫৩)।
[16] যঈফ, বাইহাক্বী (১/২৮০)।
[17] যইফ, বাইহাক্বী (১/২৮০), ত্বাহাবী (১/৪৮), আদ-দারাকুতনী (৭২)।
[18] আল-মাসবূত্ব (১/৯৯), আল-মাজমু (১/৪৭০), আল-মুগনী (১/২৯১) আল-আওসাত্বব (১/৪৪৩)।
[19] ‘আল-ইকলিল শারহু মানারিস সাবিল’, শাইখ ওয়াহিদ আবদুস সালাম প্রণীত (১/১৩৬) আলস্নাহ তাঁকে এর দ্বারা উপকৃত করুন।
[20] আল-মুগনী (১/২৯১), আল-মাজমু (১/৪৪৬), আল-আওসাত্বব (১/৪৪৪)।
[21] আল-মুহালস্না (২/৯৫-পরবর্তী অংশ), ইবনু হাযম প্রণীত।
[22] মাসাইলু আহমাদ (১০) আবূ দাউদ প্রণীত। আল-মুহালস্না (২/৯৫)।
যদি মুকীম ব্যক্তি মোজায় মাসাহ করার পর সফর করে তাহলে তার বিধান
যে ব্যক্তি মুকীম অবস্থায় মোজার উপর মাসাহ করে একদিন ও এক রাত এর কম সময় অবস্থান করার পর সফরে বের হয়, তাহলে এ মাস‘আলাটির ক্ষেত্রে বিদ্বানদের দু’টি অভিমত পরিলক্ষিত হয়-
১ম: মুকীম অবস্থায় যে পরিমাণ সময় মাসাহ করেছে তা সহ বাকি তিন দিন তিন রাত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সে মোজায় মাসাহ করতে পারবেঃ এটা সাওরী আবূ হানীফা ও তাঁর অনুসারী এর অভিমত। একটি বর্ণনা মতে, ইমাম আহমাদও এ মত পেশ করেছেন। ইমাম ইবনে হাযমও এ মতের প্রবক্তা।[1]
২য়: সে একদিন এক রাত পূর্ণ করা পর্যন্ত মাসাহ করতে পারবে। এর পর তার জন্য ওযূ করার সময় দু’পা ধৌত করা আবশ্যক হবে: এটা ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক (রাহি.) এর অভিমত।[2]
বিশুদ্ধ অভিমত হল, তিন দিন তিন রাত পরিপূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সে মাসাহ করতে পারবে। কেননা এই ব্যক্তিটি যখন মুসাফির অবস্থায় একদিন একরাত অতিবাহিত করবে, তখন সে মুসাফিরের মুদ্দাত বা সময় পূরণ করতে পারবে, কারণ হাদীসে স্পষ্টই বলা হয়েছে- ‘‘মুসাফির তিনদিন-তিনরাত মাসাহ করবে’’। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
যদি কেউ মুসাফির অবস্থায় মোজার উপর মাসাহ করে বাড়িতে ফিরে আসে তাহলে তার বিধান:
যে ব্যক্তি মুসাফির অবস্থায় একদিন একরাত কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় মোজার উপর মাসাহ করে, অতঃপর বাড়িতে ফিরে আসে, তার জন্য ওযূ করার সময় মোজা খুলে দু’পা ধৌত করা আবশ্যক। এরপর মুকীম ব্যক্তির জন্য যা কর্তব্য তা পালন করবে। আর যদি মুসাফির অবস্থায় একদিন এক রাতের কম সময় মাসাহ করে তাহলে বাড়ি ফিরার পর দিন ও রাতের বাকি অংশ মাসাহ করে মুদ্দাত পূর্ণ করা তার জন্য বৈধ। এর পর খুলে ফেলা আবশ্যক। ইবনে মুনযির বর্ণনা করেন- বিদ্বানগণের মাঝে যারা মাসাহ এর সময়সীমা নির্ধারণ করার কথা বলেছেন তাদের সকলেই এই মতের উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন।[3]
দলীলের উৎসঃ
[1] ‘ইখতিলাফুল উলামা’ (৩১ পৃ.) আল-মারওয়াযী প্রণীত। আল-মুগনী (১/২৯৯), আল-মুহালস্না (২/১০৯)।
[2] আল-উম্ম (১/৩৫), ইখতিলাফুল উলামা (৩১ পৃ.), আল-আওসাত্বব (১/৪৪৬)।
[3] আল-আওসাত্ব (১/৪৪৬)।
চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করার শর্ত সমূহ
মোজার উপর মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো: পবিত্র অবস্থায় মোজা পরিধান করতে হবে। মুগীরা ইবনে শোবা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন:
কোনো এক সফরে (শেষে) রাতের বেলা আমি নাবী () এর সাথে ছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কাছে কি পানি আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ আছে। তখন তিনি সওয়ারী থেকে নেমে চলতে থাকলেন এবং (কিছুক্ষণের মধ্যে) রাতের অন্ধকার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরে আসলে আমি পাত্র থেকে তাঁকে পানি ঢেলে দিলাম। তিনি মুখমন্ডল ধুলেন। তখন তাঁর গায়ে ছিলো একটি পশমের জুব্বা। তিনি তা থেকে হাত দু’খান (বের করার চেষ্টা করেও) বের করতে পারলেন না। অবশেষে জুববার নীচ দিয়ে বাহু দু’খানা বের করে নিয়ে ধুলেন এবং মাথা মাসাহ করলেন। এরপর আমি তাঁর মোজা খুলতে উদ্যত হলে, তিনি বললেন: রাখো। আমি পবিত্র অবস্থায় এ দু‘টি পরিধান করেছিলাম। এ বলে তিনি মোজার উপরে মাসাহ করলেন।[1]
অত্র হাদীসে মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য পবিত্র অবস্থায় মোজা পরিধান করাকে শর্ত করা হয়েছে। আর শর্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সে বিষয়ের শর্তের অস্তিত্ব ছাড়া বিশুদ্ধ হয় না। জমহুর বিদ্বানের মতে, পবিত্রতা বলতে শারঈ পন্থায় ওযূ করে পবিত্রতা অর্জন করাকে বুঝায়।[2]
প্রয়োজনীয় কথা:
যে ব্যক্তি এক পা ধৌত করার পর তাতে মোজা পরিধান করালো অতঃপর অন্য পা ধুয়ে তাতে মোজা প্রবেশ করালো, তাহলে এরূপ ক্ষেত্রে ইমাম মালিক, শাফেঈ ও আহমাদ (রাহি.) বলেন[3], তাহলে তার জন্য ওযূ ভঙ্গের পর মোজাদ্বয়ের উপর মাসাহ করা বৈধ হবে না। কেননা সে ত্বহারাত পূর্ণ করার পূর্বেই পায়ে মোজা প্রবেশ করিয়েছে। তবে যদি সে প্রথমটি খুলে আবার পরিধান করে তাহলে তাদের নিকট মাসাহ বৈধ বলে গণ্য হবে।
অপর পক্ষে ইমাম আবূ হানীফা, আহমাদের দু’টি অভিমতের একটিতে ও ইবনে হাযমের মতে, উভয় মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ। কেননা সে উভয় মোজাকে দু’পা পবিত্র করেই প্রবেশ করিয়েছে। ইবনে মুনযির ও শাইখুল ইসলাম এ মতকে পছন্দ করেছেন।[4]
আমার বক্তব্য: বৈধ হওয়ার অভিমতটি যুক্তিযুক্ত। এ ক্ষেত্রে গোঁড়ামী করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত ‘‘কিছু অংশ পবিত্র করার কারণে তা নিষিদ্ধ হবে’’ এরূপ কোন দলীল না পাওয়া যায়। তবে প্রত্যেকটির উপর আমল করা যায়। আর সতর্কতার কথা বিবেচনা করলে ওযূ সম্পূর্ণ করার পরই দু’পা মোজায় প্রবেশ করানো দরকার। আল্লাহ্ ভাল জানেন।
ছেঁড়া মোজার উপর কি মাসাহ করা যাবে?
অধিকাংশ ফক্বীহ মোজা মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য ওযূর সময় ধৌত করতে হয় এমন ফরযকৃত স্থানকে ঢাকা শর্ত করেছেন। ফলে তারা ছেঁড়া মোজার উপর মাসাহ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এতে ওযূর অঙ্গ দেখা যায়, যা ধেŠত করা ফরয। আর ধৌত ও মাসাহ কখনও একত্রিত হয় না। এমন হলে ধৌত করার হুকুমটিই প্রধান্য পেয়ে যাবে। এটা ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ (রাহি.) এর অভিমত।[5]
অন্যদিকে ইমাম মালিক ও আবূ হানীফা (রাহি.) বলেন, ছেঁড়া মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ, যতক্ষণ পর্যন্ত তা পরিধান করে চলাফেরা করা সম্ভব হবে ও তার নাম অবশিষ্ট থাকবে। এটা সাওরী, ইসহাক, আবূ সাওর ও ইবনে হাযমের অভিমত। ইবনে মুনযির ও ইবনে তাইমিয়াহ এই অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন।[6] এ অভিমতটিই বিশুদ্ধ। কেননা মোজার উপর মাসাহ করার অনুমতিটা সাধারণভাবে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্য খবর অনুযায়ী মোজা নামে অবহিত এমন প্রত্যেক মোজা এর অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং দলীল ব্যতীত মোজার মধ্যে কিছু মোজাকে বাদ দেয়া যাবে না। যদি ছিঁড়া মোজার উপর মাসাহ করা নিষেধ হত, তাহলে এ ব্যাপারে মহানাবী () বর্ণনা করতেন। বিশেষ করে, মহানাবী () জামানায় অনেক গরীব সাহাবা ছিলেন তাদের অধিকংশরাই ছিঁড়া মোজা পরিধান করতেন।
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ, বুখারী (২০৬), মুসলিম (২৩২)।
[2] ফাতহুল বারী (১/৩৭০)।
[3] আল-মুয়াত্তা (১/৪৬), আল-উম্ম (১/৩৩), আল-মুগনী (১/২৮২)।
[4] আল-মাসবূত্বব (১/৯৯), আল-আওসাত্ব (১/৪৪২), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/২০৯), আল-মুহালস্না (২/১০০)।
[5] আল-উম্ম (১/২৮), মাসায়িলু আহমাদ (১/১৮) ইবনু হানী প্রণীত, আল-মুগনী (১/২৮৭)।
[6] আল-মাদূনাহ (১/৪৪), আল-মাসবূত্ব (১/১০০), আল-আওসাত্ব (১/৪৪৯), আল-মুহালস্না (২/১০০), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৭৩)।
মাসাহ করার স্থান ও তার নিয়ম
শরীয়াতে মোজার উপর মাসাহ করার নিয়ম হলো, একবার মোজাদ্বয়ের উপর অংশে মাসাহ করতে হবে। নিচের অংশে নয়।
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ধর্মের মাপকাঠি যদি রায়ের (বিবেক-বিবেচনা) উপর নির্ভরশীল হত, তবে মোজার উপরের অংশে মাসাহ না করে নিম্নাংশে মাসাহ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ () কে তাঁর মোজার উপরের অংশে মাসাহ করতে দেখেছি।[1]
এটা সাওরী, আওযায়ী, আহমাদ, আবূ হানীফা ও তার অনুসারীদের অভিমত।[2] এই অভিমতটিই বিশুদ্ধ।
আর মালিক ও শাফেঈ (রা.) এর মতে[3], মোজাদ্বয়ের উপরে ও নিচে উভয় অংশেই মাসাহ করতে হবে। তবে যদি শুধু উপর অংশে মাসাহ করে তাহলে যথেষ্ট হবে। তারা মুগীরাহ বিন শুবা এর হাদীস দ্বারা প্রমাণ দিয়ে থাকেন-
অর্থাৎ: ‘‘মুগিরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল () একদা ওযূ করলেন। অতঃপর মোজার উপর ও নিচ অংশে মাসাহ করলেন’’।[4] এ হাদীসটি যঈফ। বরং মুগীরাহ থেকে বর্ণিত আছে:
অর্থাৎ: রাসূল () মোজার উপর অংশে মাসাহ করেছেন।[5]
সুতরাং শুধু মোজার উপর অংশ ছাড়া মাসাহ করা যাবে না। আর যদি উপর অংশ ছাড়া শুধু নিচের অংশে মাসাহ করা হয় তাহলে মাসাহ বৈধ হবে না। আল্লাহ্ ভাল জানেন।
দলীলের উৎসঃ
[1] সহীহ; আবূ দাউদ (১৬২), আদ-দারাকুতনী (৭৩), আল-বাইহাক্বী (২/১১১), আল-ইরওয়া (১০৩)।
[2] ইখতিলাফুল উলামা (৩০ পৃ.), মাসায়িলু আহমাদ (১/২১) ইবনু হানী প্রণীত আল-আওসাত্ব (১/৪৫৩), আল-মুহালস্না (২/১১১)।
[3] নিহায়াতুল মুহতাজ (১/১৯১), আল-মাদূনাহ (১/৩৯), আল-খারাশী (১/১৭৭)।
[4] যঈফ; আবূ দাউদ (১৬৫), তিরমিযী (৯৭), ইবনে মাজাহ (৫৫০) আহমাদ (৪/২৫১)। ইমাম আহমাদ, বুখারী, আবু হাতিম, দারাকুতনী, ইবনে হাজার প্রমুখ বিদ্বানগণ এ হাদীসের ত্রম্নটি বর্ণনা করেছেন।
[5] হাসান; আবূ দাউদ (১৬১), তিরমিযী (৯৮) প্রভৃতি।
 যে কারণে মোজার উপর মাসাহ করার বিধান বাতিল হবে
সফওয়ান বিন আসসাল (রাঃ) এর হাদীসে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে-
অর্থাৎ: ‘‘আমরা যখন সফরে থাকতাম, তখন রাসূল () আমাদেরকে জানাবাতের অপবিত্রতা ছাড়া তিন দিন ও তিন রাত আমাদের মোজা না খুলতে নির্দেশ দিতেন। তবে পেশাব-পায়খানা ও ঘুমের কারণে কোন সমস্যা হত না’’। সুতরাং, বুঝা গেল, নিমেণর কারণগুলো সংঘটিত হলে মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ হবে না-
১। জানাবাত ও এ জাতীয় বিষয় যা গোসল ওয়াজিব করে। যেমন হায়েয ও নিফাস থেকে পবিত্রতা অর্জন।
২। মাসাহ এর সময়সীমা শেষ হলে।
৩। মোজা খুলে ফেললে এবং মোজা পরিধানের পূর্বেই পবিত্রতা নষ্ট হলে:
যদি কেউ মোজা খুলে ফেলে, যদিও তা সময়সীমা শেষ হওয়ার পূর্বে হয় অতঃপর পবিত্রতা নষ্ট হয়, তাহলে তার জন্য তা পরিধান করা বৈধ হবে না ও তা উপর মাসাহ করা বৈধ হবে না। কেননা এ সময় সে পবিত্র অবস্থায় তার পায়ে মোজা পরিধান করেনি। উল্লেখিত ৩টি বিষয়ের যে কোন একটি সংঘটিত হলে মোজার উপর মাসাহ করা বৈধ হবে না। বরং যখন পবিত্রতা নষ্ট হবে তখন তার জন্য ওযূ করে পা ধৌত করা আবশ্যক। এর পর পূর্বোলেস্নখিত নিয়ম অনুযায়ী মোজা পরিধান করে তার উপর মাসাহ করবে।
সতর্কবাণী: মাসাহ এর বিধান বাতিল হলে ওযূ নষ্ট হয় না:
যে ব্যক্তি মোজার উপর মাসাহ করার পর তা খুলে ফেলল। কিন্তু সে অপবিত্র হলো না, তাহলে এরূপ ক্ষেত্রে তার বিধানের ব্যাপারে বিদ্বানদের মাঝে ৪টি অভিমত পরিলক্ষিত হয়।
১ম: এ অবস্থায় তাকে পুনরায় ওযূ করতে হবে: এটি নাখঈ আওযায়ী, আহমাদ ও ইসহাক (রাহি.) এর অভিমত।[1] পুরাতন একটি মত অনুযায়ী ইমাম শাফেঈও এমত প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, মাসাহ হল ধৌত করার স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং যখন মাসাহকে দূর করা হবে তখন দু’পায়ের পবিত্রতা বতিল হয়ে যাবে। এ দ্বারা সমস্ত পবিত্রতা বাতিল বলে গণ্য হবে। কেননা এর ফলে পবিত্রতা যথেষ্ট হয় না।
২য়: তার জন্য শুধু দু’পা ধৌত করা আবশ্যক: এটা সাওরী, আবূ হানীফা ও তার অনুসারী এবং আবূ সাওর এর অভিমত। নতুন মত অনুযায়ী ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এ মত পেশ করেছেন।[2]
৩য়: তার জন্য মোজা খুলার পর দ্রুত দু’পা ধৌত করা আবশ্যক। যদি দেরী হয়ে যায় তাহলে তাকে পুনরায় ওযূ করতে হবে: এটা ইমাম মালিক ও লাইস এর অভিমত।[3]
৪র্থ: তাকে ওযূ করতে হবে না এবং দু’পাও ধৌত করতে হবে না:
এটা নাখঈ এর একটি বর্ণনা। হাসান বসরী, আত্বা ও ইবনে হাযম (রাহি.) এ মত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম নববী, ইবনে মুনযির ও ইবনে তাইমিয়াহ এ মতটিকে পছন্দ করেছেন।[4] এটাই বিশুদ্ধ অভিমত। কেননা মোজা পরিহীত পা পবিত্র এবং তা প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ দ্বারা পরিপূর্ণ পবিত্রতার আওতাধীন। সুতরাং সুন্নাহ ও ইজমার প্রমাণ ছাড়া ‘‘মোজা খুললেই ওযূ নষ্ট হবে’’ এমনটি বলা বৈধ নয়। যারা পুনরায় ওযূ করতে বলেন অথবা দু’পা ধৌত করতে বলেন তাদের কোন প্রমাণ নেই। বরং এর সমর্থনে আবূ যিবইয়ান এর হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য-
আবূ জিবয়্যান হতে বর্ণিত, তিনি আলী (রাঃ) কে দেখলেন যে, তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন ও পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর তিনি ওযূ করলেন ও দুই জুতার উপর মাসাহ করলেন, এর পর মাসজিদে প্রবেশ করে জুতা খুলে সালাত আদায় করলেন।[5]
আবার কিয়াস করে বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তি চুল মাসাহ করে মাথা মুণ্ডন করল, এ ক্ষেত্রে তারা তো পুনরায় মাথা মাসাহ করতে অথবা পুনরায় ওযূ করতে বলেন না! এ মাসআলটির ক্ষেত্রে এ যুক্তিটি খুবই যুক্তিযুক্ত। সুতরাং, যদি মোজা খুলার পর অপবিত্র না হয় তাহলে ওযূ নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত যত ইচ্ছা সালাত আদায় করা যাবে। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
দলীলের উৎসঃ
[1] ইখতিলাফুল উলামা (৩১ পৃ.), মাসায়িলু আহমাদ (১/১৯) ইবনুহানী প্রণীত, আল-মাজমূ’ (১/৫৫৭)।
[2] ‘ইখতিলাফুল উলামা’ (৩১ পৃ.) আল-আওসাত্ব (১/৪৫৮)।
[3] আল-মাদূনাহ (১/৪১)।
[4] আল-মুহালস্না (২/১০৫), আল-আওসাত্ব, (১/৪৬০), আল-মাজমূ’ (১/৫৫৮) আল-ইখতিয়ারাত (১৫ পৃ.)।
[5] এ হাদীসের সনদ সহীহ; বাইহাক্বী (১/২৮৮), ত্বাহাবী (১/৫৮), তাবামুল মিন্না (১১৫ পৃ.)।
জাওরাব ও জুতার উপর মাসাহ প্রসঙ্গে
(ক) জাওরাবের উপর মাসাহ:
 جورب(জওরাব): পশমী সুতা, শণের  তৈরি এক ধরনের মোজা বিশেষ যা মানুষেরা তাদের দু‘পায়ে পরিধান করে। এ সংজ্ঞটিকে মদ্য পানীয়র সাথে তুলনা করা যেতে পারে। (শারাব বা পানীয় যেমন বিভিন্ন বস্ত্ত থেকে তৈরি করা হয়, জাওরাবও তেমনি বিভিন্ন উপাদান হতে তৈরি হতে পারে (অনুবাদক))।
জাওরাবের উপর মাসাহ এর হুকুম নিয়ে উলামাদের মাঝে তিন ধরনের বক্তব্য রয়েছে।
প্রথম: জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ নয়, তবে তার উপর চামড়ার জুতা থাকলে বৈধ: এটা আবূ হানীফা (অবশ্য তিনি পরবর্তীতে এমত থেকে প্রত্যাবর্তন করেন), মালিক ও শাফেঈর মাযহাব।[1] তাঁরা বলেন: যেহেতু জাওরার কে جورب বা মোজা নামে নামকরণ করা যায় না, সেহতু তাতে মোজার হুকুম চলবেনা। আর জাওরাবের উপর মাসাহ প্রসঙ্গে কোন হাদীসও বর্ণিত হয়নি (!!)।
দ্বিতীয়: পুরু ও ওযূতে পায়ের যে অংশ ধৌত করা ফরয় সে অংশ আচ্ছাদনকারী হলে জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ: এটা হাসান, ইবনুল মুসাইয়িব, আহমাদ, ও হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী প্রমুখ বিদ্বানগণের অভিমত।[2]
তৃতীয়: সাধারণভাবে সকল ধরনের জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ, এমনকি যদি তা খুব পাতলা হয় তবুও: এটাই ইবনু হাযম ও ইবনু তাইমিয়ার স্পষ্ট মাযহাব। আর এ মতকেই ইবনু উছাইমীন ও আল্লামা শানক্বীতী পছন্দ করেছেন।[3] এটাই অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত।
এখানে জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ মর্মে বর্ণিত শেষ দু‘টি অভিমতের প্রবক্তাগণ নিম্নোক্ত দলীল গুলোকে দলীল হিসাবে দাড় করান। যথা-
 (১) মুগীরা বিন শোবা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস: ‘নিশ্চয় রাসূল () একবার ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন।[4]
(২) আয়রাক্ব ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনে মালিককে লক্ষ্য করেছি, তিনি বায়ু নিঃসরণ হলে তাঁর চেহারা ও দুহাত ধৌত করতেন এবং পশমের  তৈরি জাওরাবের উপর মাসাহ করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি জাওরাবের উপর মাসাহ করলেন? তিনি বললেন, এ দু’টি মোজা যা পশমের  তৈরি।[5]
এখানে আনাস (রাঃ) খাফ বা মোজা চামড়ার  তৈরি হওয়ার ব্যাপারে আম (ব্যাপক), সে কথা স্পষ্ট করেছেন। উলেস্নখ্য যে, তিনি আরবী ভাষাবিদদের অন্যতম একজন সাহাবী ছিলেন।
(৩) জাওরাবের উপর মাসাহ করার হাদীস ১১ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাদের মধ্যে উমার তাঁর ছেলে আবদুলস্নাহ বিন উমার, আলী, ইবনে মাসউদ আনাস প্রমুখ সাহাবী অন্যতম। তাদের সমসাময়িক কোন সাহাবী তাদের বিরোধিতা করেন নি। বরং, সকলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পরবর্তীতে জমহুর উলামা পাতলা জাওরাবের উপর মাসাহ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা দ্বারা ফরযের স্থান আচ্ছাদিত হয় না। অথচ এটা মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত নয় যা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে।
যেহেতু বর্তমানকালে আনুপাতিক হারে পাতলা জাওরাবের প্রচলন বেশি। সেহেতু এই শর্ত সংকীর্ণতা ও জটিলতা সৃষ্টির কারণে শরীয়ত দাতার প্রশস্ততার ইচ্ছার বিপরীত। (আল্লাহ্ই অধিক অবগত আছে)।
উপকারিতাঃ
জাওরাব এর অর্থের মধ্যে ঐ সকল পট্টি অন্তর্ভুক্ত হবে যা কোন বিশেষ ওজরে দু‘পায়ে পরিধান করা হয়। এ বিধানটি মুলতঃ কষ্ট দূর করার জন্য। এ জন্যে তার উপর মাসাহ বৈধ। যেমনটি শাইখুল ইসলাম পছন্দ করেছেন। আর জাওরাবের উপর মাসাহ করার হুকুম খাফ এর উপর মাসাহ করার হুকুমের মতই।
যখন একটা জাওরাবের উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করা হবে, তখন তার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে:
(১) যখন ওযূ করার পর একটি জাওরবের উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করা হবে, এ ক্ষেত্রে ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে উপরের জাওরাবের উপর মাসাহ করলেই চলবে। এটা আবূ হানীফার মাযহাব এবং হাম্বলী ও মালিকীদের কাছে অধিক প্রাধান্য যুক্ত মত। আর শাফেঈদের এটা পুরাতন মত, নতুন মত এর বিপরীত।[6]
(২) ওযূ করার পর দু‘টি জাওরাব পরিধান করবে অতঃপর উভয়টির উপর মাসাহ করবে। আর যদি মাসাহ করার পর উপরের জাওরাবটি খুলে ফেলে, সেক্ষেত্রে নিচের জাওরাবের উপর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসাহ জায়েয। কেননা সে পবিত্র অবস্থায় দু পায়ে জাওরাব পরিধান করেছে।
(৩) ওযূ করার পর একটি জাওরাব পরিধান করবে এবং ওযূ ভঙ্গের পূর্বেই তার উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করবে। তখন দু‘টির যে কোন একটির উপর মাসাহ করার ইখতিয়ার (ঐচ্ছিকতা) রয়েছে।[7]
(৪) ওযূ করার পর একটি জাওরাব পরিধান করবে এবং তার উপর মাসাহ করার পর আরেকটি জাওরাব পরিধান করবে, সেক্ষেত্রে যদি সে পবিত্র অবস্থায় পরের জাওরাবটি পরিধান করে থাকে তাহলে উপরেরটির উপর মাসাহ বৈধ। কেননা সে পবিত্র অবস্থায় দু‘পা প্রবেশ করিয়েছে।[8] কিন্তু যদি ওযূ ভঙ্গের পর পরবর্তী জাওরাব পরিধান করে থাকে তাহলে, উপরের জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ হবে না বরং নিচেরটার উপর মাসাহ বৈধ হবে।
(খ) জুতার উপর মাসাহ:
এ মর্মে মুগীরা বিন শু’বার (রাঃ) হাদীস গত হয়ে গেছে যে,্র
‘নিশ্চয় রাসূল () একদা ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন।[9]
সঠিক ভাবে বিবেচনা করলে এ হাদীসটি নিম্নোক্ত দু‘টি অবস্থার সম্ভাবনা রাখে। যথা-
১। জাওরাবের উপর জুতা পরিধান করবে এবং তার উপর মাসাহ করবে, তখন উভয়টির হুকুম একই হবে। যেমন একটি জাওরাব আরেকটি জাওরাবের উপর একটি খাফ আরেকটি খাফের উপর পরিধান করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।
২। হয়ত মুগীরা (রাঃ) একবার জাওরাবের উপর আরেকবার জুতার উপর রাসূল () কে মাসাহ করতে দেখেছিলেন। তখন এটা জুতার উপর মাসাহ বৈধ হওয়ার দলীল হিসেবে সাব্যাস্ত হবে যদিও তা জাওরাব বিহীন হয়। কিছু কারণে এ দলীল গ্রহণ করা যদিও দূরবর্তী ব্যাপার, তার পরও এর দ্বারা জায়েয হওয়ার দলীল গ্রহণ করা যায় ইতিপূর্বে উল্লেখিত আবূ যিবয়্যান এর হাদীস দ্বারা,
অর্থাৎ, আবূ যিবয়্যান হতে বর্ণিত, তিনি আলী (রাঃ) কে দেখলেন যে, তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন ও পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর তিনি ওযূ করলেন ও দুই জুতার উপর মাসাহ করলেন, এর পর মাসজিদে প্রবেশ করে জুতা খুলে সালাত আদায় করলেন।[10] এ হাদীসের মধ্যে জাওরাবের কথা উল্লেখ নেই।
অনুরূপভাবে জুতার উপর মাসাহ করার সমর্থনে আরো বলা যেতে পারে যে, বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাসাহকৃত বস্ত্ত দ্বারা ফরযের স্থানটি আবৃত করা শর্ত নয়।
দলীলের উৎসঃ
[1] আল-মাসবূত্ব (১/১০২), আল-মাদূনাহ (১/৪০), আল-উম্ম (১/৩৩), আল-আওসাত্ব (১/৪৬৫)।
[2] মাসায়িলু আহমাদ (১/২১) ইবনু হানী প্রণীত, আল আওসাত্ব (১/৪৬৪), ‘আল-মাজমূ’ (১/৫৪০), ফাতহুল ক্বাদীর (১/১৫৭)।
[3] আল-মুহালস্না (২/৮৬), আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ (৫৮ পৃ.), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৪), আল-মুমতি’ (১/১৯০), আযওয়াউল বায়ান (২/১৮, ১৯), এখানে এ বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে।
[4] এ হাদীসকে আলবানী সহীহ বলেছেন, আবূ দাউদ (১৫৯), তিরমিযী (৯৯), আহমাদ (৪/২৫২), এ ব্যাপারে বিসত্মারিত ‘আল-ইরওয়া (১০১)-দ্রষ্টব্য।
[5] এ হাদীসকে আহমাদ শাকির সহীহ বলেছেন; আলকূনী (১/১৮১) দাওলাবী প্রণীত।
[6] হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন (১/১৭৯), জাওয়াহিরুল ইকলিল (১/২৪) রওযাতুতত্বালিবীন (১/১২৭), এখানে তাদের বক্তব্য خف বা চামড়ার মোজার মত। এ ÿÿত্রে উভয়ের একই হুকুম।
[7] হাম্বলীগণ এ বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘কাশশাফুল কান্না’ (১/১১৭-১১৮)।
[8] এ বিষয়টিকে ‘কাশশাফুল কান্না’ গ্রন্থে (১/১১৭-১১৮) এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তাতে (উপরটির উপর) মাসাহ করা যাবে না। কেনানা নিচের যে মোজাটির উপর মাসাহ করা হয়েছে তা ধৌতের বিকল্প স্বরূপ। আর একটি বিকল্প আরেকটি বিকল্পের জন্য জায়েয নয়। বরং নিচেরটির উপর মাসাহ করতে হবে। কেননা সংশিস্নষ্ট বিষয়টির সাথেই শুধু ছাড় রয়েছে। আমার মতে, এ ব্যাখ্যাটির ব্যাপারে কিছু কথা থেকে যায়। কেননা মাসআলাটির ÿÿত্রে শুধু একটিই মূলনীতি ধর্তব্য, তা হল, দু‘পায়ে পবিত্র অবস্থায় মোজা পরিধান করা। আর তা তো অর্জিত হয়ে গেছে, যদিও উপরেরটি পরার পূর্বেই নিচেরটির উপর মাসাস করা হোক। আর এর দ্বারা সালাত বৈধ হবে।
[9] কিছু পূর্বে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে।
[10] কিছু পূর্বে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে।
মাথার আবরণীর উপর মাসাহ
১। ওযূর সময় পাগড়ীর উপর মাসাহ:
সাধারণ ভাবে ওযূতে মাথার পরিবর্তে পাগড়ীর উপর মাসাহ বৈধ। এটা আহমাদ, ইসহাক্ব, আবূ সাওর, আওযায়ী, ইবনু হাযম, ইবনে তাইমিয়াহ এবং সাহাবীদের মধ্য হতে আবূ বকর, উমার, আনাস প্রমুখ এর অভিমত।[1] এটা রাসূল () থেকে সাব্যাস্ত।
যেমন আমর ইবনে উমাইয়া আয-যামেরী বলেন,রرَأَيْتُ النَّبِيَّ  يَمْسَحُ عَلَى عِمَامَتِهِ وَخُفَّيْهِগ্ধ ‘‘আমি রাসূল () কে খাফ (চামড়ার মোজা) ও পাগড়ীর উপর মাসাহ করতে দেখেছি’’।[2] অনুরূপ মুগীরা বিন শু’বা (রাঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।[3] বিলাল (রা.) বলেন,  عَنْ بِلَالٍ:্রأَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ وَالْخِمَارِগ্ধ ‘‘রাসূল () খাফ (চামড়ার মোজা) ও আচ্ছাদনী উপর মাসাহ করতেন’’।[4] এখানে الْخِمَار হলো, মাথার আচ্ছাদন যা দ্বারা পাগড়ী উদ্দেশ্য।
অপর দিকে আবূ হানীফা ও তার মতাবলম্বী বিদ্বানগণ, মালিক ও শাফেঈ (রাহি.) এর মতে,[5] শুধু গাপড়ীর উপর মাসাহ বৈধ নয়। বরং নাসিয়াহ তথা মাথার অগ্রভাগ সহ মাসাহ বৈধ। এ ক্ষেত্রে মাথার অগ্রভাগ মাসাহ ফরয এবং পাগড়ীর উপর মাসাহ অতিরিক্ত। যেহেতু তারা মাথার কিছু অংশ মাসাহ করা বৈধ করেন!! কিন্তু ইমাম শাফেঈ বলেন, ‘‘যদি পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হাদীসটি সহীহ হয় তাহলে আমার মতে, শুধু পাগড়ীর মাসাহ করা বৈধ’’। যেহেতু পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হাদীসটি সহীহ, সুতরাং শুধু পাগড়ীর মাসাহ করা বৈধ হওয়াটা তারই অভিমত। 
যারা পাগড়ীর উপর মাসাহ করার বিরোধি তারা যাবের বিন আবদুলস্নাহ থেকে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করে থাকেন। তিনি বলেন, আমি রাসূল () কে মাথা থেকে পাগড়ী খুলে নাসিয়াহ বা মাথার অগ্রভাগ পরিমাণ মাসাহ করতে দেখেছি’’।[6] আমি (লেখক) এ হাদীসটির সনদ কোন হাদীস গ্রন্থে খুঁজে পাইনি’’!!
মুগিরাহ বিন শু‘বা থেকে বর্ণিত- রাসূল () একদা ওযূ করলেন, অতঃপর মোজার উপর, মাথার অগ্রভাগে এবং পাগড়ির উপর মাসাহ করলেন।[7]
আমার বক্তব্য: অধিক যুক্তিযুক্ত মত হল, নাবী কারীম () এবং তার পর দু’জন বিশিষ্ট খলীফা থেকে স্পষ্ট, হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণে সাধারণ ভাবে পাগড়ীর উপর মাসাহ বৈধ। আর এর বিরোধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন দলীল বিদ্যমান নেই।[8] অবশ্য দ্বন্ধ নিরসনের ক্ষেত্রে বলা যায়, মাথার অগ্রভাগসহ পাগড়ীর উপর মাসাহ উত্তম। আল্লাহ্ই অধিক অবগত আছেন।
২। মহিলাদের ঘোমটার উপর মাসাহ:
শাইখুল ইসলাম বলেন: মহিলারা যদি ঠান্ডা বা অনুরূপ কিছুর ভয় করে তাহলে ঘোমটার উপর মাসাহ করবে। কেননা উম্মে সালমা (রা.) তার ঘোমটার উপর মাসাহ করতেন। তবে মাথার কিছু চুলসহ মাসাহ করতে হবে। আর যদি এরূপ প্রয়োজন না দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে মাসাহ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উলামাদের মাঝে মতানৈক্য বিদ্যমান।[9]
আমার বক্তব্য: একটা বর্ণনেইুযায়ী আবূ হানীফা, মালিক, শাফেঈ ও হাম্বলী মতাবালম্বীদের মতে,[10] ঘোমটার উপর মাসাহ বৈধ নয়। যেমনটি আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে, তিনি ঘোমটার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তাতে মাসাহ করতেন এবং তিনি বলতেন, এভাবেই রাসূল (স:) আমাকে আদেশ করেছেন’’।[11]
তারা বলেন: যেহেতু ঘোমটা মহিলাদের মাথার একটি পরিধেয় বস্ত্ত এবং তা খুলে ফেলা কঠিন নয়। সুতরাং তার উপর মাসাহ বৈধ হবে না।
অপর পক্ষে হাসান বসরী ঘোমটার উপর মাসাহ বৈধ মনে করেন। এটা হাম্বলী মাযহাবের অভিমত। তবে তারা শর্তারোপ করেন যে, মহিলাদের ঘোমটা টা গলা পর্যন্ত হতে হবে (!!) পাগড়ীর উপর কিয়াস করে, যেহেতু ঘোমটা নিত্য অভ্যাসগত পরিধেয় পোষাক।
আমার বক্তব্য: যদি আয়িশা (রা.) বর্ণিত হাদীসটি সহীহ হত, তাহলে ঘোমটার উপর মাসাহ নাজায়েয হওয়ার জন্যে এটাই যথেষ্ট হত। আর পাগড়ীর উপর কিয়াস করাটা অগ্রহণযোগ্য। তবে সতর্কতা মূলক খিমারসহ মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করা ভাল। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
৩। ওযূতে টুপির উপর মাসাহ:
জমহুর উলামার মতে, ওযূতে মাথার পরিবর্তে টুপির উপর মাসাহ বৈধ নয়। কেননা মাথা মাসাহ ফরয। মূলতঃ জমহুরের নিকট পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হুকুম দেয়া হয়েছে, তা খোলা কষ্টকর হওয়ার কারণে। আর আহমাদের নিকট দলীলের ভিত্তিতে এ হুকুম দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ইবনু হাযম, ইবনু তাইমিয়া[12] ও মুহাক্কিক একদল বিদ্বানের মতে, টুপির উপর মাসাহ জায়েয। যেহেতু রাসূল () পাগড়ীর বা অনুরূপ পোষাক বিশেষের উপর মাসাহ করেছেন। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে,, সরাসরি মাথায় পানি স্পর্শ করানো ফরয নয়। যে কোন বস্ত্ত বিশেষ মাথায় পরিধান করা হলে তার উপর মাসাহ বৈধ। যদিও তা ফরযের স্থানকে  আচ্ছাদনকারী নাও হয় এবং তা খোলে ফেলাও কষ্টকর না হয়। আর এটাই অধিক বিশুদ্ধ মত। (আল্লাহ্ই অধিক অবগত আছেন)।
উপকারিতা: মাসাহ জায়েয হওয়ার জন্য মাথার আচ্ছাদন পবিত্র অবস্থায় পরিধান করা শর্ত নয়। এ ক্ষেত্রে মোজার উপর কিয়াস করা যাবে না। যেহেতু এ দু’টির মাঝে একত্রিত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাসুল () মোজা পরিধানের ব্যাপারে পবিত্রতাকে শর্ত করেছেন। যা পাগড়ী পরিধানের ব্যাপারে করেননি। যদি তা আবশ্যক হত অবশ্যই বর্ণনা করতেন।[13]
আমার বক্তব্য: এখানে মোজা পরিধানের স্থানটি ধৌত করা ফরয আর মাথাতে ফরয হল মাসাহ করা। মাথার ব্যাপারে এমন কোন বিষয় নেই যার দ্বারা এর উপর মোজার হুকুমের ন্যায় হুকুম আরোপ করা যায়। বরং এটা আলাদা বিষয়। আল্লাহ্ই অধিক অবগত আছেন।
মাথার আবরণের উপর মাসাহ করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা বা সীমারেখা নেই:
কারণ মোজার উপর মাসাহ এর কিয়াস বিশুদ্ধ নয়। অথচ রাসূল () পাগড়ীর উপর মাসাহ করেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা বেঁধে দেননি। এটা উমার বিন খাত্তাব থেকে বর্ণিত হয়েছে।[14]
 ৪। ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ:
جبيره (জাবীরাহ) হলো, কাষ্টফলক দ্বারা ভাঙ্গা হাড়কে জোড়া লাগানোর জন্য ব্যান্ডেজ করা এবং সুস্থ্য হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় ব্যান্ডেজ করা।
জমহুর উলামা, চার ইমামসহ অনেকের মতে, ওযূর অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গর মধ্যে হাতের কব্জি, পা প্রভৃতিতে যে কাঠের ফলক ব্যবহার করা হয়, এর উপর মাসাহ করা জায়েয।[15]
তাদের দলীল গুলো নিমণরূপ:
(১) জনৈক ব্যক্তির শরীরে আঘাত লাগা মর্মে বর্ণিত জাবেরের হাদীস। তার ব্যাপারে রাসূলের উক্তি
অর্থাৎ: ‘‘তার জন্যে যখমের উপর ব্যান্ডেজ ব্যবহার করাই যথেষ্ট হতো এবং সে তার উপর মাসাহ করলেই চলতো’’।[16] এ হাদীসটি যঈফ।
(২) ইবনু উমারের উক্তি: ‘‘যে ব্যক্তির ব্যান্ডেজযুক্ত যখম থাকবে, সে ওযূর সময়ে যখমের উপর শুধু মাসাহ করবে এবং ব্যান্ডেজের আশেপাশের জায়গা ধৌত করবে’’।[17] এ ক্ষেত্রে সাহাবাদের কেউ ইবনে উমারের বিরোধিতা করেছেন বলে জানা যায় না।
(৩) মোজার মাসাহ এর উপর কিয়াস বা অনুমান করেও এর দলীল দেয়া যায়। যেহেতু কোন প্রয়োজন ছাড়াই মোজার উপর মাসাহ জায়েয, অতএব প্রয়োজনের তাগিদে কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ জায়েয হওয়া আরও অধিক যুক্তিযুক্ত।
তবে হাযমের মতে, কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ করার কোন প্রয়োজন নেই। বরং এ স্থানের হুকুম অতীত হয়ে গেছে।[18]
আমার বক্তব্য: যেহেতু ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে যঈফ আখ্যা দেয়া হয়েছে, সেহেতু কিয়াসকে প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করানোর কোন সুযোগ নেই (!!) এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যখন তার রুকন ও শর্তগুলো ঠিক থাকবে তখন কিয়াসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মূল থেকে শাখার হুকুমটি ভিন্ন হওয়ার কারণে কিয়াস বাতিল হিসাবে গণ্য হবে। এটা (জমহুরের নিকট কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ করা) ওয়াজিবকে (মোজার উপর মাসাহ করা) বৈধ এর উপর কিয়াস করা হচ্ছে। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে  ইবনু হাযমের মতটিই প্রাধান্য পাবে।।
উপকারিতা:
১। জাবীরা বা ব্যন্ডেজের উপর মাসাহ করা ওযূ ও গোসল উভয় অবস্থায় বৈধ:
কেননা ব্যন্ডেজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। ছোট বা বড় নাপাকী কোন অবস্থায় খোলার প্রয়োজন নেই। যা মোজা মাসাহ এর হুকুম থেকে আলাদা। এটা এক ধরনের ছাড়।
২। ব্যান্ডেজের ক্ষেত্রে পবিত্র অবস্থা ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবহারের কোন শর্ত আরোপ করা যাবেনা:
পবিত্রতাবস্থায় ব্যান্ডেজ পরিধান করতে হবে এমন কোন শর্ত আরোপ করা যাবেনা। কেননা শরীয়াত প্রণেতা মাসাহ বৈধ করার মাধ্যমে ক্ষতি ও কষ্ট লাঘবের যে উদ্দেশ্য করেছেন এটা তার বিপরীত। এছাড়া ব্যান্ডেজের বিষয়টি বাধ্যতামূলক যা আকষ্মিক চাপিয়ে দেয়া হয়, যা মোজার বিপরীত। উপরন্ত কুরআন-হাদীস ও ইজমা থেকে এর কোন দলীলও নেই। অনুরূপ ভাবে ব্যন্ডেজের উপর মাসাহ এর কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। বরং যখন তা খোলে ফেলা হবে অথবা আক্রান্ত অংশ আরোগ্য পাবে তখন মাসাহ বৈধ হবে না।
৩।ওযূর অঙ্গে যদি চিকিৎসার দরূণ কোন ব্যন্ডেজ করা হয়, তাহলে তার হুকুম জাবীরার হুকুমের ন্যায়। যেমনটি শাইখুল ইসলাম বলেছেন।[19]
দলীলের উৎসঃ
[1] মাসায়িলু আবী দাউদ (৮), আল-মুগনী (১/৩০০), আল-মাজমু’ (১/৪০৬), আল-আওসাত্ব (১/৪৬৮), আল-মুহালস্না (২/৫৮), মাজমূ’আল ফাতাওয়া (২১/১৮৪)।
[2] সহীহ; বুখারী (২০৫)।
[3] সহীহ; মুসলিম (২৭৫)।
[4] সহীহ; মুসলিম (২৮৫)।
[5] ইবনু আবেদীন এর হাশিয়া (১/১৮১), আলস্নামা দাসূকীর হাশিয়া (১/১৬৪), আল-মাজমু’ (১/৪০৭)।
[6] আমার নিকট যত হাদীস গ্রন্থ তার কোনটিতেও এর কোন সূত্র পাইনি; তবে ইবনে মুনযির (১/৪৬৯) সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন।
[7] সহীহ এ হাদীস ওজুর অধ্যায়ে চলে গেছে।
[8] আল-মুহালস্না (২/৬১) -গ্রন্থে তাদের দলীল এবং এর প্রত্যাখ্যান দেখুন!
[9] মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/২১৮)।
[10] আল-মাদূনাহ (১/৪২), আল-উম্ম (১/২৬), আল-বাদাঈ (১/৫), আল-মুগনী (১/৩০৫)।
[11] আমি এ সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি; এ হাদীসটি আলস্নামা কাসানী তাঁর আল-বাদাঈ (১/৫) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অথচ হাদীসের কোন কিতাবেই এ হাদীসটি আমি অবগত হতে পারিনি (!!)।
[12] আল-মুহালস্না (২/৫৮), মাজমূ’ আল ফাতাওয়া (২১/১৮৪-১৮৭, ২১৪)।
[13] আল-মুহালস্না (২/৬৪)।
[14] আল-মুহালস্না (২/৬৫)।
[15] শারহু ফাতহুল ক্বাদীর (১/১৪০), আল মাদূনাহ (১/২৩), আল-মুগনী (১/২০৩), আল-মাজমূ’ (২/৩২৭)।
[16] যঈফ; আবূ দাউদ (২৩৬), প্রভৃতি। ইরওয়াউল গালীল (১০৫)।
[17] এ হাদীসের সনদ সহীহ; ইবনু আবী শাইবাহ (১/১২৬), বায়হাকী (১/২২৮)।
[18] আল-মুহালস্না (২/৭৪)।
[19] মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৫)।
(সমাপ্ত)

সহিহ হাদিসের আলোকে রাসুল সাঃ এর ওযু ও জাল-জইফ হাদিসের প্রচলিত ওযু জানতে 



মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

মোঃ আনোয়ার হোসাইন আকন্দ (কামিল, ফার্স্ট ক্লাশ- আল হাদিস)
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮।)


মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
মোঃ আনোয়ার হোসাইন আকন্দ (কামিল, ফার্স্ট ক্লাশ- আল হাদিস)
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।


ইসলামি সকল পর্ব এক সাথে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন-


  
Please Share On


No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...