Search This Blog

Monday, March 9, 2020

উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ [1]

সার্বজনীন দীন: ইসলাম আল্লাহর একমাত্র দীন। ইসলাম ব্যতীত কোনো দীন তার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ١٩ [ال عمران: ١٩]
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম”।[2] তিনি অন্যত্র বলেন:
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ ٣﴾ [المائدة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে”।[3] অন্যত্র বলেন:
﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [ال عمران: ٨٥]
“আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায়, তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”।[4]
আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের নিকট তার দীন প্রচারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ١٥٨ [الاعراف: ١٥٧]
“বল, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল’।[5] অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٨﴾ [سبا: ٢٨]
“আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”।[6] অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [الاحزاب : ٤٠]
“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী, আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ”।[7] অতএব ইসলাম সার্বজনীন দীন, যা সমগ্র মানবজাতির নিকট পৌঁছানোর দায়িত্ব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ন্যাস্ত।
একটি প্রশ্ন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির নিকট সর্বশেষ রাসূল, তারপর কোনো নবী ও রাসূল আসবে না, তাহলে তিনি সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত কিভাবে দীন পৌঁছাবেন, কারণ তিনি একা, তার হায়াত মাত্র তেষট্টি বছর?
তিনটি উত্তর: প্রথমটি অসম্ভব, যেমন তিনি সবার নিকট সশরীরে গিয়ে দীন পৌঁছাবেন। দ্বিতীয়টি অবাস্তব, যেমন সকল মানুষ তার নিকট এসে দীন শিখবে। তৃতীয়টি যৌক্তিক ও বাস্তব, যেমন তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন, যার সাথে তার সাক্ষাত হবে, কিংবা যারা তার নিকট আসবে, তাদেরকে তিনি দীন শিখাবেন। অতঃপর তারা পরবর্তীদের দীন শিখাবে, যারা তার সাক্ষাত পায়নি, কিংবা তার নিকট উপস্থিত হতে পারেনি। এভাবে সমগ্র বিশ্বে সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত দীন পৌঁছবে। কেউ বলতে পারবে না, আমার নিকট দীন পৌঁছেনি, কিংবা দীন শিখার সুযোগ আমি পাইনি। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম "علم الرواية" অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিকে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ বলা হয়।‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র পদ্ধতিতে সবার নিকট দীন পৌঁছবে, কিন্তু দীনের স্বকীয়তা ও অক্ষুণ্নতা বহাল রাখার জন্য এ পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। কারণ এ পদ্ধতিতে দীনের বাহন মানুষ, মানুষ ভুলের স্থান। তাদের থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল হতে পারে। তাই পৌঁছানো দীন সঠিক কি-না যাচাইয়ের উপায় থাকা জরুরি। তাহলে দীনের অক্ষুণ্নতা বজায় থাকবে ও সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম "علم الدراية" অর্থাৎ সহি, দ্বা‘ঈফ ও জাল হাদিস চিহ্নিত করার নীতিকে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়। আমরা ‘উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’-এ ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ এবং মূলগ্রন্থে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ সম্পর্কে আলোচনা করব।[8]
 [1] أ.د. عبد الرحمن البر ‘আব্দুর রহমান’ কর্তৃক উসুলের হাদিসের উপর লিখিত ১-৭টি প্রবন্ধ এ ভূমিকার উৎস।
[2] সূরা আলে ইমরান: (১৯)
[3] সূরা মায়েদা: (৩)
[4] সূরা আলে ইমরান: (৮৫)
[5] সূরা আরাফ: (১৫৮)
[6] সূরা সাবা: (২৮)
[7] সূরা আহ্যাব: (৪০)
[8] অর্থাৎ হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি মুক্ত বর্ণনা করাকে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ বলা হয়। আর হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃত মুক্ত বর্ণিত হল কি না, তা নির্ণয়ে সনদ ও মতন যাচাই করার নিয়ম-নীতিকে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়। এ প্রকারকেই উসুলে হাদিস বলা হয়। [দেখুন, ইবন উসাইমীন, শারহুল মানযূমাতিল বাইকূনিয়্যাহ, পৃ. ১১-১২ (সম্পাদক)]
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র সূচনা করেন। অতঃপর প্রয়োজনের তাগিদে ধীরে ধীরে তার পরিসর বর্ধিত হয়। এ ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَة»
“একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও”।[1] অন্যত্র তিনি বলেন:
«لِيُبَلِّغْ الشَّاهِدُ مِنْكُمُ الْغَائِبَ»
“তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয়”।[2] অন্যত্র তিনি বলেন:
«تَسْمَعُونَ مِنِّى، وَيُسْمَعُ مِنْكُمْ، وَيُسْمَعُ مِمَّنْ يَسْمَعُ مِنْكُمْ»
“তোমরা আমার নিকট শ্রবণ কর, তোমাদের থেকে শ্রবণ করা হবে এবং যারা তোমাদের থেকে শ্রবণ করে তাদের থেকেও শ্রবণ করা হবে”।[3]
সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত দ্বিতীয় স্তরের রাবি বা বর্ণনাকারীদের নিকট বর্ণনা করবে। অতঃপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পরবর্তী স্তরের রাবিগণ তাদের পরবর্তী রাবিদের নিকট হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত পূর্ববৎ বর্ণনা করবে। দীনকে চলমান ও অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি, অন্যথায় দীন বিকৃত ও মৌলিকত্ব হারাতে বাধ্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বৃদ্ধি থেকে বারণ করেছেন, কখনো হ্রাস থেকে সতর্ক করেছেন, কখনো বিকৃতির উপর কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন, যেমন:
দীনে বৃদ্ধি করা নিষেধ:
দীনে যেন বৃদ্ধি না ঘটে, এ জন্য বক্তা ও শ্রোতা উভয়কে পৃথক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে সত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও মিথ্যা থেকে বারণ করা হয়েছে, আর শ্রোতাকে বক্তার সংবাদ যাচাই পূর্বক গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
“যে আমার উপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[4] মিথ্যাবাদী বক্তার পরিণতি জাহান্নাম। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন, প্রায় সত্তুরজন সাহাবি থেকে এ হাদিস বর্ণিত, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবি যাদের মধ্যে অন্যতম। তাই এ হাদিসকে আহলে ইলম মুতাওয়াতির বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ ٦﴾ [الحجرات: ٦]
“হে ইমানদারগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও”।[5] এ আয়াতে আল্লাহ শ্রোতাদের সতর্ক করেছেন, যেন তারা বক্তাদের কথা যাচাই ব্যতীত গ্রহণ না করে।
সাহাবিগণ মিথ্যা বলতেন না, তখন আরবের কাফেরদের মধ্যেও মিথ্যা বলার প্রবণতা ছিল না, মিথ্যাকে তারা ঘৃণা করত। জনৈক কাফের সম্পর্কে আছে, সে তার মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বোবা উটের সাথেও মিথ্যা বলেনি, সে মিথ্যা না-বলার কারণ সম্পর্কে বলেছিল:
 أُرِيدُ أُمَنِّيكِ الشَّرَابَ لِتَهْدَئِي                    وَلَكِنَّ عَارَ الْكَاذِبِينَ يَحُولُ
‘আমার ইচ্ছা হয় তোমাকে পানীয় বস্তুর আশা দেই, যেন তুমি শান্ত হও, কিন্তু মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপবাদ প্রতিবন্ধক হয়েছে’। মরুভূমিতে একটি উটকে পানি পান করানোর মিথ্যা আশ্বাস দিতে বিব্রত বোধ করেছেন জনৈক মুশরিক! আবু সুফিয়ানের ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। বাদশাহ হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করার প্রাক্কালে তার সাথীদের বলে দেন: “আমি তাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি, সে যদি আমাকে মিথ্যা বলে তোমরা তাকে মিথ্যা বলবে”। আবু সুফিয়ান বলেন: ‘আল্লাহর শপথ, আমার উপর মিথ্যার অপবাদ আরোপ করা হবে এ লজ্জা যদি না হত, তাহলে অবশ্যই আমি তার সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম’।[6] সে সময় আবু সুফিয়ান নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিপক্ষ ছিল, সে জানত মিথ্যা বললেও তার সাথীরা হিরাক্লিয়াসের সামনে তাকে মিথ্যারোপ করবে না, কারণ তারা সবাই কাফের, তবুও আবু সুফিয়ান অপবাদের ভয়ে মিথ্যা বলেনি।
 [1] বুখারি: (৬/৪৯৬), হাদিস নং: (৩৪৬১), হাদিসটি আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস রা. থেকে বর্ণিত।
[2] বুখারি: (১/১৯৯), হাদিস নং: (১০৫), হাদিসটি আবু বাকরাহ নুফাই ইব্ন হারেস রা. থেকে বর্ণিত।
[3] আবু দাউদ: (৩/৩২১), হাদিস নং: (৩৬৫৯), ইব্ন আব্বাস রা. থেকে সহি সনদে বর্ণিত।
[4] বুখারি: ((৩/১৬০), হাদিস নং: (১২৯১), হাদিস নং: (১১০), মুসলিম: (১/১০), এ হাদিস বুখারি ও মুসলিম একাধিক সাহাবি থেকে একাধিক স্থানে বর্ণনা করেছেন, যেমন মুগিরাহ ইব্ন শু‘বাহ, আবু হুরায়রাহ, আলি ইব্ন আবি তালিব, জুবায়ের ইব্নুল ‘আউআম, আনাস ইব্ন মালেক, সালামাহ ইব্ন আকওয়া‘ প্রমুখ সাহাবিগণ।
[5] সূরা হুজুরাত: (৪৯/৬)
[6] বুখারি: (১/৩১), হাদিস নং: (৬)
সাহাবিদের সময় মিথ্যা ছিল না
সাহাবিরা একে অপরকে বিশ্বাস করতেন, তাদের সময় মিথ্যা ছিল না। উপস্থিত সাহাবি থেকে অনুপস্থিত সাহাবি পূর্ণ আস্থার সাথে দীন গ্রহণ করতেন। বারা ইব্ন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«لَيْسَ كُلُّنَا كَانَ يَسْمَعُ حَدِيثَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَتْ لَنَا ضَيْعَةٌ (يعني عقاراً وأراضي) وَأَشْغَالٌ، وَلَكِنِ النَّاسُ لَمْ يَكُونُوا يَكْذِبُونَ يَوْمَئِذٍ، فَيُحَدِّثُ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ»
“আমাদের প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিস শ্রবণ করত না, আমাদের জায়গা-জমি ও ব্যস্ততা ছিল। তবে তখন মানুষেরা মিথ্যা বলত না, উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট বর্ণনা করত”।[1] আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«وَاللَّهِ مَا كُلُّ مَا نُحَدِّثُكُمْ بِهِ سَمِعْنَاهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ، وَلَكِنْ كَانَ يُحَدِّثُ بَعْضُنَا بَعْضًا، وَلا يَتَّهِمُ بَعْضُنَا بَعْضًا»
“আল্লাহর শপথ, তোমাদেরকে আমরা যা বলি, তা সব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করিনি, তবে আমাদের কতক কতককে বলত, কেউ কাউকে অপবাদ দিত না”।[2]
সাহাবিগণ যেরূপ পরস্পর মিথ্যা বলেনি, অনুরূপ তাবে‘ঈদের সাথেও তারা মিথ্যা বলেনি। ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ্ নিজ সনদে আব্দুল্লাহ ইব্ন ইয়াযিদ খাতমি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«حَدَّثَنَا الْبَرَاءُ بْنُ عَازِبٍ وَهُوَ غَيْرُ كَذُوبٍ، قَالَ: كُنَّا نُصَلِّي خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا قَالَ: " سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، لَمْ يَحْنِ أَحَدٌ مِنَّا ظَهْرَهُ حَتَّى يَضَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَبْهَتَهُ عَلَى الْأَرْضِ»
আমাদেরকে বারা ইব্ন আযেব বলেছেন, আর তিনি মিথ্যাবাদী নয়, তিনি বলেছেন: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করতাম, যখন তিনি বলতেন: سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ আমাদের কেউ স্বীয় পিঠ নিচু করত না, যতক্ষণ না তিনি নিজ কপাল মাটিতে রাখতেন”।[3]
এখানে তাবে‘ঈ আব্দুল্লাহ ইব্ন ইয়াযিদ খাতমি সাহাবি বারা ইব্ন আযেব সম্পর্কে বলেছেন: وَهُوَ غَيْرُ كَذُوبٍ বা ‘তিনি মিথ্যাবাদী নয়’। তার এ কথার অর্থ সন্দেহ দূর করা নয়, বরং হাদিস শক্তিশালী করা ও সাহাবির সত্যায়ন করা উদ্দেশ্য।
ইমাম খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: এ কথার অর্থ রাবিকে অপবাদ দেওয়া নয়, বরং বক্তার কথায় পূর্ণ আস্থা প্রকাশের জন্য আরবরা এরূপ বলে, যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন: سمعت خليلي الصادق المصدوق ‘আমি আমার সত্যবাদী ও সত্যায়িত বন্ধুকে বলতে শুনেছি’। ইব্ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন: حدثني الصادق المصدوق ‘সত্যবাদী ও সত্যায়িত সত্ত্বা আমাকে বলেছেন’। এসব বাক্য দ্বারা সাহাবিগণ যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আস্থা পোষণ করেছেন, একইভাবে তাবী‘ঈগণ সাহাবিদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন, সন্দেহ দূর করার জন্য তা বলেননি; কারণ তারা সন্দেহ করতেন না।নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মুসলিম ও অমুসলিম কারো মাঝে মিথ্যার প্রচলন ছিল না, তবুও মিথ্যা হাদিস রচনাকারীকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। বক্তার সংবাদ গ্রহণ করার পূর্বে আল্লাহ শ্রোতাদেরকে যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমরা নিশ্চিত সাহাবিদের যুগে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীতে কোনো প্রকার বৃদ্ধি ঘটেনি।
 [1] রামাহুরমুযী রচিত: ‘আল-মুহাদ্দিসুল ফাসিল’: (পৃ.২৩৫), (১৩৩), ইমাম খতিব রহ. রচিত আল-জামে‘: (১/১৭৪), (১০২)
[2] হাকেম: (৩/৫৭৫), আত-তাবকাত লি ইব্ন সাদ: (৭/২১), আল-জামে: (১/১৭৪)
[3] বুখারি: (২/১৮১), হাদিস নং: (৬৯০)
২. দীনে হ্রাস করা নিষেধ:
দীনের কোনো অংশ যেন হ্রাস না পায়, সে জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন: ১. দীন প্রচারের নির্দেশ ও ২. দীন গোপন করার নিষেধাজ্ঞা। এ মর্মে কয়েকটি হাদিস আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এখানে অপর একটি হাদিস উল্লেখ করছি, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«نَضَّرَ اللهُ امْرَءاً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثاً، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ غَيْرَهُ، فَإِنَّهُ رُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ. ثَلاثُ خِصَالٍ لا يَغِلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ مُسْلِمٍ أَبَداً: إِخْلاصُ الْعَمَلِ لِلّهِ، وَمُنَاصَحَةُ وُلاةِ الْأَمْرِ، وَلُزُومُ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ، فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ»
“আল্লাহ সে ব্যক্তিকে শুভ্রোজ্জল করুন, যে আমাদের থেকে কোনো হাদিস শ্রবণ করল এবং অপরকে পৌঁছানো পর্যন্ত তা সংরক্ষণ করল। কারণ অনেক ফিকহধারণকারী ফকিহ হয় না, আবার অনেক ফিকহ ধারণকারী তার চেয়ে বিজ্ঞ ফকিহ এর নিকট ইলম পৌঁছায়। তিনটি স্বভাব যেগুলোতে কোনো মুসলিমের অন্তর খিয়ানত বা বিদ্বেষ থাকতে পারে না (অর্থাৎ মুসলিমের অন্তরে তা থাকাই স্বাভাবিক; অথবা এগুলো থাকলে সে অন্তরে হিংসা, হানাহানি থাকবে না) : আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে আমল করা, দায়িত্বশীলদের সৎ উপদেশ প্রদান করা ও মুসলিমদের জামা‘আত আঁকড়ে ধরা। কারণ মুসলিমদের দাওয়াত তাদের সবাইকে বেষ্টন করে নেয়”।[1]
দীন গোপনকারীকে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلۡهُدَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا بَيَّنَّٰهُ لِلنَّاسِ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أُوْلَٰٓئِكَ يَلۡعَنُهُمُ ٱللَّهُ وَيَلۡعَنُهُمُ ٱللَّٰعِنُونَ ١٥٩ إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُواْ وَأَصۡلَحُواْ وَبَيَّنُواْ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَتُوبُ عَلَيۡهِمۡ وَأَنَا ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٠﴾ [البقرة: ١٥٩،  ١٦٠]        
“নিশ্চয় যারা গোপন করে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হিদায়েত যা আমি নাযিল করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লানত করেন এবং লানতকারীগণ লানত করে। তারা ছাড়া, যারা তওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব, আমি তাদের তওবা কবুল করব। আর আমি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু”।[2] উল্লেখ্য ইলম গোপন করে যে পাপ করে, তার তাওবা হচ্ছে গোপন করা ইলম প্রকাশ করে দেওয়া।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
«مَنْ كَتَمَ عِلْما ً تَلَجَّمَ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
“যে কোনো ইলম গোপন করল, সে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পড়বে”।[3]
এসব আয়াত ও হাদিসের প্রভাব আমরা সাহাবিদের জীবনে দেখতে পাই। তারা দীন প্রচারের দায়িত্ব আঞ্জাম ও দীন গোপন করার পাপ থেকে মুক্তির জন্য জীবন সায়াহ্নেও ইলম প্রচার করেছেন। একদা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে অধিক হাদিসের কারণে দোষারোপ করা হয়, তিনি প্রতিবাদ করে বলেন: “আল্লাহর শপথ, যদি আল্লাহর কিতাবে দু’টি আয়াত না থাকত, আমি তোমাদেরকে কোনো হাদিস বলতাম না”। অতঃপর তিনি সূরা বাকারার উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন”।[4] উসমান ইব্ন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«والله لأحدثنكم حديثاً، والله لولا آية في كتاب الله ما حدَّثْتُكُمُوه»
“আল্লাহর শপথ, আমি তোমাদেরকে একটি হাদিস শুনাব, আল্লাহর শপথ যদি আল্লাহর কিতাবে একটি আয়াত না থাকত আমি তোমাদেরকে হাদিস বলতাম না”।[5] তার উদ্দেশ্যও উপরোক্ত আয়াত। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, সাহাবিগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনা কোনো বাণী গোপন করেননি, কিংবা তার কোনো অংশ তারা হ্রাস করেননি।
 [1] আবু দাউদ: (৩/৩২২), হাদিস নং:(৩৬৬০), তিরমিযি: (৫/৩৩), হাদিস নং: (২৬৫৬), ইব্ন মাজাহ: (১/৮৪), হাদিস নং: (২৩০), সহিহ ইব্ন হিব্বান: (১/২৭০), হাদিস নং: (৬৭) এবং (২/৪৫৪), হাদিস নং: (৬৮০), হাদিসটি জায়েদ ইব্ন সাবেত রা. থেকে বর্ণিত। এ হাদিসের একাধিক সনদ ও শাহেদ রয়েছে।
[2] সূরা বাকারা: (১৫৯-১৬০)
[3] সহি ইব্ন হিব্বান: (১/২৭১), হাদিস নং: (৯৫), হাদিসটি আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত।
[4] বুখারি: (৫/২৮), হাদিস নং: (২৩৫০)
[5] মুসলিম: (১/২০৫), হাদিস নং: (২২৭)
৩. দীনকে বিকৃতি করা নিষেধ:
দীনের স্বকীয়তা রক্ষার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিকৃতিহীন হাদিস বর্ণনা করা। এ ধাপ অতিক্রম করা খুব কঠিন, কারণ ভুল মানুষের স্বভাব। ভুল ও সন্দেহ থেকে নবী ব্যতীত কেউ নিরাপদ নয়। অতএব প্রত্যেক হাদিসে শব্দ ও অর্থের অক্ষুণ্নতা এবং রাবিদের সন্দেহ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার দাবি করা খুব কঠিন। তাহলে প্রশ্ন হয়, এ ক্ষেত্রে করণীয় কি?
এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় বর্তায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর। তিনি সাহাবিদেরকে হাদিস মুখস্থ করাবেন, তারা তার কথা ও কর্মগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও মুখস্থ করবেন। ভুল হলে শুধরানোর ব্যবস্থা করবেন এবং সন্দেহ কিংবা গাফলতি হলে দূর করার পন্থা অবলম্বন করবেন। এটাই এ ক্ষেত্রে করণীয়, এ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। তাই দেখি হাদিস সংরক্ষণ ও তাতে বিকৃতি ঠেকানোর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করেছেন, যেমন:
হাদিস শিক্ষা দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি:
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কথা বারবার বলতেন, কখনো তিনবার, কখনো তার চেয়ে অধিক বলতেন, যেন শ্রোতারা তার কথা বুঝে ও মুখস্থ করতে সক্ষম হয়। ইমাম বুখারি প্রমুখ আনাস ও আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন:
«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلاَثاً حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاَثًا».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বিষয়ে কথা বলতেন, তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তার কথা বুঝা যায়। যখন তিনি কোনো কওমের নিকট আসতেন, তাদেরকে সালাম করতেন, তিনবার সালাম করতেন”।[1]
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শব্দসমূহ পৃথক উচ্চারণ করতেন ও ধীরে কথা বলতেন, যেন শ্রোতারা মুখস্থ ও স্মরণ রাখতে সক্ষম হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারী গণনা করতে চাইত অবশ্যই গণনা করতে সক্ষম হত”।[2] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের ন্যায় দ্রুত বলতেন না, তিনি পৃথক পৃথক বাক্য উচ্চারণ করতেন, যে তার কাছে বসত মুখস্থ করতে সক্ষম হত”।[3]
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথার সময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন, যেন শ্রোতারা বিরক্ত না হয় এবং তাদের আলস্য না আসে। কখনো কয়েকটি শব্দে কথা শেষ করতেন, যেমন একদা তিনি বলেন: «النَّدَمُ تَوْبَةٌ» ‘লজ্জিত হওয়াই তওবা’।[4] অপর হাদিসে তিনি বলেন:
«الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ، وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ»
“একতা রহমত ও বিচ্ছিন্নতা শাস্তি”।[5]
৪. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশের জন্য উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, যেন শ্রোতারা গভীর আগ্রহে শ্রবণ করে ও মুখস্থের প্রতি যত্নশীল হয়। কখনো দু’টি উপদেশের মাঝে দীর্ঘ বিরতি নিতেন, যেন তাদের উদ্যমতা বৃদ্ধি পায় ও স্মৃতি শক্তি প্রখর হয়। আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَتَخَوَّلُنَا بِالْمَوْعِظَةِ فِي الْأَيَّامِ، كَرَاهَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا»
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াযের জন্য দিনসমূহে উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, কারণ তিনি আমাদের বিরক্তিকে অপছন্দ করতেন”।[6]
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো উদাহরণ পেশ করতেন, কারণ উদাহরণ বুঝা সহজ, দ্রুত অন্তরে আছর কাটে এবং অর্থগত বস্তুকে সহজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে পরিণত করা যায়। বিশেষ করে অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের নিকট উদাহরণের খুব মূল্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক উদাহরণ পেশ করতেন, আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক হাজার উদাহরণ মুখস্থ করেছি”।[7]
এ ছাড়া তিনি আরো পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, যে কারণে সাহাবিগণ তার কথা, কর্ম, সমর্থন ও গুণগানগুলো সংরক্ষণ ও পরবর্তীদের নিকট পূর্ণরূপে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।শ্রোতা হিসেবে সাহাবিরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আদব ও মনোযোগসহ শ্রবণ করতেন, যেন কোনো বাণী তাদের থেকে বিচ্যুত না হয়, কোনো হাদিসে ভুল কিংবা সন্দেহ প্রবেশ না করে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করছি:
 [1] বুখারি: (১/১৮৮), হাদিস নং: (৯৪,৯৫), আবু উমামার হাদিস তাবরানি ফিল কাবিরে দেখুন: (৮/২৮৫), হাদিস নং: (৮০৯৫), হায়সামি তার সনদকে হাসান বলেছেন। আল-মাজমা: (১/১২৯)
[2] আবু দাউদ: (৩/৩২০), হাদিস নং: (৩৬৫৪)
[3] তিরমিযি: (৫/৬০০), হাদিস নং: (৩৬৩৯), আহমদ: (৬/২৫৭)
[4] ইব্ন মাজাহ: (২/১৪২০), হাদিস নং: (৪২৫২), ইব্ন হিব্বান: (২/৩৭৭), হাদিস নং: (৬১২-৬১৪)
[5] মুসনাদুশ শিহাব: (১/৪৩), হাদিস নং: (১৫), আব্দুল্লাহ ইব্ন আহমদ: (৪/২৭৮), হাদিস নং: (১৮৪৪৯, ১৮৪৫০), বাজ্জার: (২/২২৬), হাদিস নং: (৩২৮২), হায়সামি ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’: (৫/২১৮) গ্রন্থে বলেন: ‘এ হাদিসের রাবিগণ সেকাহ’ বা শক্তিশালী।
[6] বুখারি: (১/১৬২), হাদিস নং: (৬৮)
[7] ‘আল-আমসাল’ লি রামাহুরমুযী: (পৃ.২৯-৩০), ‘আস-সিয়ার’ লিয যাহাবি: (৩/৮৭), আল-হিলইয়াহ’ লি আবি নু‘আইম: (৫/১৬৯)
হাদিস স্মরণ রাখার পদ্ধতি
১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কথা বলতেন সাহাবিগণ চুপ করে শ্রবণ করতেন, যেন তার কোনো কথা তাদের হাত ছাড়া না হয়। ইমাম আবু দাউদ ও আহমদ রাহিমাহুমাল্লাহ্ উসামাহ ইব্ন শারিক থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«‏أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم‏ ‏‏وَإِذَا أَصْحَابُهُ كَأَنَّمَا عَلَى رُءُوسِهِمْ الطَّيْرُ».
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করলাম, তখন তার সাথীগণ এমতাবস্থায় ছিল যে, যেন তাদের মাথার উপর পাখিকুল বসে আছে”।[1] ইমাম তাবরানি রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, উসামাহ ইব্ন শারিক বলেন:
«كُنَّا جُلُوساً عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَأَنَّمَا عَلَى رُؤُوسِنَا الطَّيْرُ، مَا يَتَكَلَّمُ مِنَّا مُتَكَلِّمٌ».
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম, যেন আমাদের মাথার উপর পাখিকুল রয়েছে। আমাদের কেউ কথা বলত না”।[2]
২. সাহাবিগণ জটিল বিষয় বারবার জিজ্ঞাসা করতেন, বুঝার আগ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি ছিল। ইব্ন আবি মুলাইকা থেকে ইমাম বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশার অভ্যাস ছিল অজানা বিষয় জিজ্ঞাসা করা, একদা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«‏َمْن حُوسِبَ عُذِّبَ»
“যার হিসাব নেওয়া হবে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে”। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেননি:
﴿ فَسَوۡفَ يُحَاسَبُ حِسَابٗا يَسِيرٗا ٨ [الانشقاق: ٨]
“অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে”।[3] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
«إِنَّمَا ذَلِكَ الْعَرْضُ، وَلَكِنْ مَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ يَهْلِكْ».
“এটা হচ্ছে শুধু সামনে পেশ করা, কিন্তু যাকে হিসাবের জন্য জবাবদিহি করা হবে সে ধ্বংস হবে”।[4]
৩. সাহাবিগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পর্যবেক্ষণ করতেন, অযথা প্রশ্ন করে বিরক্ত করতেন না। ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ ইব্ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏ : أَيُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «الصَّلَاةُ لِوَقْتِهَا» قَالَ: قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ : «‏بِرُّ ‏‏الْوَالِدَيْنِ» قَالَ: قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: «الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ» فَمَا تَرَكْتُ أَسْتَزِيدُهُ إِلَّا ‏إِرْعَاءً ‏عَلَيْهِ. يعني رِفْقاً به صلى الله عليه وسلم.
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছি কোন্ আমল সর্বোত্তম? তিনি বললেন: সময়মত সালাত আদায় করা। আমি বললাম: অতঃপর? তিনি বললেন: ‘পিতা-মাতার সদাচরণ’। তিনি বলেন: আমি বললাম: অতঃপর? তিনি বললেন: ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। আমি আরো জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থার খাতিরে ত্যাগ করেছি”।[5]
৪. সাহাবিদের মধ্যে যিনি লিখতে জানতেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী লিখে রাখতেন। ইমাম আবু দাউদসহ একাধিক মুহাদ্দিস সহি সনদে বর্ণনা করেন: আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনে মুখস্থ করার বস্তুগুলো আমি লিখে রাখতাম। কুরাইশরা আমাকে বারণ করল, তারা বলল: তুমি শোনা প্রত্যেক বিষয় লিখে রাখ, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ, তিনি সন্তুষ্টি ও গোস্বায় কথা বলেন?! আমি বিরত থাকি, অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘটনাটি বলি। তিনি মুখের দিকে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বললেন:
«‏اكْتُبْ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلَّا حَقٌّ».
“তুমি লিখ, ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার নফস, এ মুখ থেকে সত্য ব্যতীত কিছু বের হয় না”।[6]
৫. অধিকন্তু সাহাবিদের পরিষ্কার চিন্তা ও প্রখর স্মৃতিশক্তি স্মরণ রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তাদের মাঝে শিক্ষার ব্যাপকতা না থাকার ফলে বংশ, বিভিন্ন ঘটনা, ওয়াদা ও চুক্তিপত্র তারা মুখস্থ রেখে অভ্যস্থ ছিল, যার ফলে তাদের স্মৃতি শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পেত। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কর্মগুলো চর্চা করেন। এভাবে তারা আল্লাহর দীনকে হিফাজত করতে সক্ষম হন, শুধু দায়িত্বের খাতিরে নয়, দীন ও দীন প্রচারকের মহব্বতও তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আল্লাহ সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।এ ছিল প্রথম উস্তাদ ও প্রথম ছাত্রদের অবস্থা। এ থেকে আমরা জানলাম যে, যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করলে ছাত্রগণ তাদের আদর্শ উস্তাদের সকল শিক্ষা মুখস্থ করতে সক্ষম হন, তার প্রত্যেকটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণ করেছেন। অপর দিকে আদর্শ ছাত্র হিসেবে উস্তাদের পাঠ গ্রহণ করার যাবতীয় কৌশল সাহাবিগণ অবলম্বন করেছেন।
 [1] আবু দাউদ: (৪/৩), হাদিস নং: (৩৩৪৫৫), আহমদ: (৪/২৭৮), হাদিস নং: (১৮৪৭৬)
[2] তাবরানি ফিল কাবির: (১/১৮), হাদিস নং: (৪৭১), হায়সামি রহ. বলেছেন: এ হাদিসের রাবিগণ সহি হাদিসের রাবি: (৮/২৪), হাকেম: (৪/৪০০), তিনি হাদিসটি সহি বলেছেন।
[3] সূরা ইনশিকাক: (৮)
[4] বুখারি: (১/১৯৬-১৯৭), হাদিস নং: (১০৩), মুসলিম: (৪/২২০৪), হাদিস নং: (২৮৭৬)
[5] মুসলিম: (১/৮৯), হাদিস নং: (১৩৭)
[6] আবু দাউদ: (৩/৩১৮), হাদিস নং: (৩৬৪৬)
শিক্ষক হিসেবে সাহাবিগণ
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবিগণ শিক্ষকরূপে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তখন দীন প্রচার ও দীনকে অবিকৃত রাখা উভয় দায়িত্ব বর্তায় তাদের উপর, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জানার সুযোগ নেই। তাই সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে কতক নীতির অনুসরণ করেন, যেমন তারা হাদিস বর্ণনা কমিয়ে দেন, বর্ণনার পূর্বে শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন ও অপরকে শুনিয়ে যাচাই করেন, নিম্নে তার কতক নমুনা পেশ করছি:
১. সাহাবিগণ শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিস বর্ণনা কমিয়ে দেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনার সংখ্যা কমিয়ে দেন, যেন তাতে ভুল ও মিথ্যা প্রবেশ না করে। এক সাহাবি হাদিসের খিদমত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হলে অপর সাহাবি চুপ থাকেন। কম বর্ণনা হাদিস স্মরণ রাখার একটি পদ্ধতি। অনেক সাহাবি বার্ধক্য জনিত স্মরণ শক্তি হ্রাস পেয়েছে সন্দেহে হাদিস বর্ণনা বন্ধ রাখেন। মাস ও বছর পার হত, তবু কতক সাহাবি বলতেন না: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’। ভুল থেকে সুরক্ষার জন্য তারা এরূপ করতেন। কুরআন ত্যাগ করে মানুষ যেন হাদিসের প্রতি বেশী মনোযোগী না হয়, সে জন্যও তারা হাদিস বর্ণনা কম করেন।ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো দেশে মুজাহিদ বা শিক্ষকরূপে কাউকে প্রেরণ করার সময় বলতেন: “তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কম বর্ণনা কর, এ ক্ষেত্রে আমি তোমাদের অংশীদার”।[1] তার উদ্দেশ্য হাদিস গোপন করা নয়, বরং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো বিষয়কে সম্পৃক্ত করার পূর্বে সতর্কতা অবলম্বন করা। তাই অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবির সংখ্যা খুব কম।
 [1] তাবরানি ফিল আওসাত: (২/৩২৬), হাদিস নং: (২১১৭), হাকেম: (১/১০২) হাদিসটি সহি বলেছেন, আর ইমাম হাবি তার সমর্থন করেছেন।
অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিগণ
হাজারের ঊর্ধ্বে মাত্র সাতজন সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যথা: ১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (৫৩৭৪), ২. আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২৬৩০), ৩. আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২২৮৬), ৪. উম্মুল মুমেনিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহা, হাদিস সংখ্যা: (২২১০), ৫. আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৬৬০), ৬. জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৫৪০), ৭. আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১১৭০), তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন।
২. সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন:
হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সাহাবিগণ হাদিস বলতেন না। তবু ভুল হয়েছে ভয়ে হাদিস বর্ণনার সময় কেউ আঁতকে উঠতেন, কোথাও সন্দেহ হলে বিনা সংকোচে বলে দিতেন। কেউ একটি হাদিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বহুদূর পর্যন্ত সফর করেন, যেমন জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ একটি হাদিসের জন্য আব্দুল্লাহ ইব্ন উনাইসের নিকট শামে গিয়েছেন।[1] আবু আইয়ূব আনসারি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি হাদিসের জন্য উকবাহ ইব্ন আমের-এর নিকট মিসরে গিয়েছেন।[2]
৩. সাহাবিগণ হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করেন:
সাহাবিগণ হ্রাস-বৃদ্ধি ব্যতীত হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করতেন। কখনো হুবহু শব্দ বলা কঠিন হলে ভাবার্থ বলতেন। তারা ভাষা জানতেন, শরীয়তের উদ্দেশ্য বুঝতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেক্ষাপট দেখেছেন, তাই এতে সাধারণত তাদের ভুল হত না।
৪. সাহাবিগণ হাদিস যাচাই করেন:
সাহাবিগণ কোনো হাদিস প্রসঙ্গে সন্দেহ হলে যাচাই করেন। বিশেষভাবে আবু বকর এরূপ বেশী করেন, অতঃপর তার অনুসরণ করেন ওমর। তারা কখনো রাবির নিকট সাক্ষী তলব করেন, যেমন মুগিরা ইব্ন শু‘বা যখন বলেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাতির পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দাদিকে এক ষষ্ঠাংশ মিরাস প্রদান করেছেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার নিকট সাক্ষী তলব করেন, আর মুহাম্মদ ইব্ন মাসলামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।[3] অনুরূপ আবু মুসা আশ‘আরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন তিনবার অনুমতি প্রসঙ্গে হাদিস বলেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার হাদিস গ্রহণ করেননি যতক্ষণ না আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সাথে সাক্ষ্য দিয়েছেন।[4] আলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাদিসের শুদ্ধতার জন্য কখনো রাবি থেকে কসম নিতেন।
তাদের উদ্দেশ্য কখনো হাদিসের পথ সংকীর্ণ কিংবা রুদ্ধ করা ছিল না, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভুল ও মিথ্যার সুযোগ নষ্ট করা, যেন সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো হাদিস সম্পৃক্ত করার পূর্বে সতর্ক হয়।
৫. সাহাবিগণ সনদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন:
সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিসের সনদ তলব করেন, অপরকে গ্রহণযোগ্য রাবি থেকে শ্রবণ করার নির্দেশ দেন। কারণ মানুষ যখন দলেদলে ইসলামে প্রবেশ করছিল, তখন একটি কুচক্রী মহল দীনের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা আরম্ভ করে, তাই হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে রাবির অবস্থা জানা আবশ্যক হয়, বিশেষ করে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত পরবর্তী সময়ে। তখন মুসলিম সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল:
«إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ»
“নিশ্চয় এ ইলম দীনের অংশ, অতএব পরখ করে দেখ কার থেকে তোমরা তোমাদের দীন গ্রহণ করছ”।[5] মুহাম্মদ ইব্ন সিরিন রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:
«لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ، قَالُوا: سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ، فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ، وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ، فَلَا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ».
“তারা সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না, কিন্তু যখন ফিতনা (উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত) সংঘটিত হল, তারা বলল: তোমরা আমাদেরকে তোমাদের রাবিদের নাম বল, আহলে সুন্নাহ হলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হবে, আর বিদআতি হলে তাদের হাদিস ত্যাগ করা হবে”।[6]
উকবাহ ইব্ন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সন্তানদের উপদেশ দিয়ে বলেন: “হে বৎসগণ, আমি তোমাদেরকে তিনটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি, ভালো করে স্মরণ রেখ: নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ব্যতীত কারো থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস গ্রহণ কর না, উলের মোটা কাপড় পরলেই দীনদার হবে না, আর কবিতা লিখে তোমাদের অন্তরকে কুরআন বিমুখ করো না”।[7]
আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্বীয় ছাত্র সাবিত ইব্ন আসলাম আল-বুনানিকে বলেন: “হে সাবিত আমার থেকে গ্রহণ কর, তুমি আমার অপেক্ষা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না, কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি জিবরীল থেকে গ্রহণ করেছেন, আর জিবরীল আল্লাহ তা‘আলা থেকে গ্রহণ করেছেন”।[8]
৬. সাহাবি সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করেন:
এক সাহাবি অপর সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করে শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তাদের বিশ্বাস ছিল কোনো সাহাবি মিথ্যা বলে না, বা সজ্ঞানে বিকৃতি করে না, তবে কারো ভুল হতে পারে, কারো স্মৃতি থেকে কোনো বিষয় হারিয়ে যেতে পারে, তাই ভুল হওয়া অসম্ভব নয়। অতএব তারা অপরকে শুনিয়ে হাদিস যাচাই করতেন। ইমাম বুখারি ও মুসলিম[9] বর্ণনা করেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
 «‏إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ» 
“নিশ্চয় মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের কতক কান্নায় শাস্তি দেওয়া হয়”। ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যুর পর আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে এ হাদিস বলি। তিনি বললেন: আল্লাহ ওমরের উপর রহম করুন। আল্লাহর শপথ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বলেননি:
«‏إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ» 
তবে তিনি বলেছেন:
«إِنَّ اللَّهَ لَيَزِيدُ الْكَافِرَ عَذَابًا بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»
“নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরের শাস্তি বৃদ্ধি করেন, তার উপর তার পরিবারের কান্নার কারণে”। অতঃপর তিনি বলেন: (এ ব্যাপারে) তোমাদের জন্য কুরআন যথেষ্ট।
﴿ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰۚ ١٨ [فاطر: ١٨]
“কোনো বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না”।[10]
৭. রাবিদের সমালোচনার সূচনা:
সাহাবিদের যুগ থেকে রাবিদের যাচাই করা আরম্ভ হয়। কারো হাদিস তারা প্রত্যাখ্যান করেন, কারো হাদিস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ্ মুজাহিদ ইব্ন জাবর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট বুশাইর আদাবি এসে বলতে লাগল: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন”, কিন্তু ইব্ন আব্বাস তাকে হাদিস বলার অনুমতি দেননি, তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। সে বলল: হে ইব্ন আব্বাস, আপনি কেন মনোনিবেশ করছেন না! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বলছি, আপনি শুনছেন না! ইব্ন আব্বাস বলেন: “আমরা এক সময়ে ছিলাম, যখন কাউকে বলতে শুনতাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের চোখ তাকে লুফে নিত, তার দিকে আমরা মনোযোগ দিতাম, কিন্তু লোকেরা যখন কঠিন ও নরম বাহনে আরোহণ করল (হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রশংসিত ও নিন্দনীয় উভয় পন্থা অবলম্বন করল), তখন থেকে পরিচিত বস্তু গ্রহণ করি”। অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন মিথ্যা বলা হত না, তখন আমরা হাদিস বলতাম, কিন্তু লোকেরা যখন উঁচু-নিচু উভয় বাহনে আরোহণ করল, আমরা তার থেকে হাদিস বর্ণনা করা ত্যাগ করি”।[11]এভাবে সাহাবিদের যুগ শেষ না হতেই সনদ তলব করা আরম্ভ হয় এবং علم الجرح والتعديل তথা ‘সমালোচনা শাস্ত্রে’র সূচনা হয়। তারা সহি হাদিস ও সেকাহ রাবি চিহ্নিত করার কতক নীতি তৈরি করেন, যা সবার নিকট প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বতন্ত্র গ্রন্থে জমা করার প্রয়োজন হয়নি।
 [1] বুখারি: (১/১৭৩)
[2] আহমদ: (৪/১৫৩, ১৫৯), ‘মুসনাদ’ লিল হুমাইদি: (১/১৮৮৯-১৯০), হাদিস নং: (৩৮৪), ‘মারেফাতু উলুমুল হাদিস’ লিল হাকেম: (৭-৮), ‘আর-রেহলাহ’ লিল খতিব: (পৃ.ই১১৮), হাদিস নং: (৩৪), ‘আল-আসমাউল মুবহামাহ’: (পৃ.৬৩-৬৪), হাদিস নং: (৩৭), ‘জামে বায়ানুল ইলম’: (১/৩৯২), হাদিস নং: (৫৬৭)
[3] আবু দাউদ: (৩/১২১), হাদিস নং: (২৮৯৪), তিরমিযি: (৪/৪১৯), হাদিস নং: (৪১৯-৪২০), ইব্ন মাজাহ: (২/৯০৯-৯১০), মালেক: (৪০৭)
[4] বুখারি: (১১/২৬-২৭), হাদিস নং: (৬২৪৫), মুসলিম: (৩/১৬৯৪-১৬৯৬)
[5] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।
[6] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।
[7] মু‘জামুল কাবির: (১৭/২৬৮), মাজমাউয যওয়ায়েদ: (১/১৪০)
[8] তিরমিযি: (৫/৬১৪), হাদিস নং: (৩৮৩১)
[9] বুখারি: (৩/১৫০), হাদিস নং: (১২৮৭), মুসলিম: (২/৬৪২), হাদিস নং: (৯২৯)
[10] সূরা ফাতের: (১৭)
[11] মুসলিম: (১/১৩), দেখুন: মুকাদ্দামাহ।
একটি সন্দেহ ও তার নিরসন
সাহাবিগণ ও মুনাফিকরা একসঙ্গে বাস করত, সে সুযোগে হয়তো কোনো মুনাফিক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করেছে, আর মানুষেরা তাদের বাহ্যিক সাথীত্ব দেখে সেগুলো গ্রহণ করেছে, এ জাতীয় সন্দেহ হতে পারে। কারণ, মুনাফিকরা মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন:
﴿إِذَا جَآءَكَ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ قَالُواْ نَشۡهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَكَٰذِبُونَ ١﴾ [المنافقون: ١]
“যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী”।[1] অতএব তাদের মিথ্যা প্রচার করার বাস্তবতা কতটুকু?
কয়েকটি কারণে তারা এরূপ করতে পারেনি:
১. মুনাফিকরা দীনের প্রচার থেকে বিমুখ ছিল। কতক মুনাফিক কুরআন শ্রবণ করত, কিন্তু কুরআনের কোনো অংশ তাদের অন্তরে প্রবেশ করত না, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَسۡتَمِعُ إِلَيۡكَ حَتَّىٰٓ إِذَا خَرَجُواْ مِنۡ عِندِكَ قَالُواْ لِلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ مَاذَا قَالَ ءَانِفًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَٱتَّبَعُوٓاْ أَهۡوَآءَهُمۡ ١٦﴾ [محمد : ١٦]
“আর তাদের মধ্যে এমন কতক রয়েছে, যারা তোমার প্রতি মনোযোগ দিয়ে শুনে। অবশেষে যখন তারা তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায় তখন তারা যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এই মাত্র সে কী বলল?’ এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে”।[2] তারা যেহেতু ভাল করে শ্রবণ করেনি, তাই তাদের পক্ষে দীন বিকৃত করা সম্ভব হয়নি।
২. মুসলিমরা কোনো বিষয়ে মুনাফিকদের শরণাপন্ন হত না, কারণ কুরআনে বর্ণিত তাদের স্বভাব ও নিদর্শনের কারণে তারা চিহ্নিত ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলে:
﴿ وَلَتَعۡرِفَنَّهُمۡ فِي لَحۡنِ ٱلۡقَوۡلِۚ ٣٠ [محمد : ٣٠]
“তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে”।[3] অতএব তারা চিহ্নিত ছিল, যার নিফাক স্পষ্ট ছিল না সেও সন্দেহের পাত্র ছিল। ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করতে পেরে কা‘ব ইব্ন মালিক আফসোস করে বলেন:
«فَكُنْتُ إِذَا خَرَجْتُ فِي النَّاسِ بَعْدَ خُرُوجِ رَسُولِ اللَّهِ ‏صلى الله عليه وسلم ‏فَطُفْتُ فِيهِمْ أَحْزَنَنِي أَنِّي لَا أَرَى إِلَّا رَجُلًا ‏مَغْمُوصًا ‏عَلَيْهِ النِّفَاقُ، أَوْ رَجُلًا مِمَّنْ عَذَرَ اللَّهُ مِنْ الضُّعَفَاءِ».
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্থানের পর আমি যখন মানুষের নিকট যেতাম ও তাদের মাঝে ঘুরতাম, আমাকে খুব দুঃখিত করত, কারণ আমি শুধু তাদেরকে দেখতাম যারা নেফাকের দোষে দুষ্ট ছিল, অথবা এমন কাউকে দেখতাম যাদেরকে আল্লাহ অক্ষমতার কারণে ছাড় দিয়েছেন”।[4]
এ থেকে প্রমাণিত হল যে, মুনাফিকরা চিহ্নিত ছিল, তাই কোনো মুসলিম দীনি বিষয়ে তাদের শরণাপন্ন হবে সম্ভব ছিল না।৩. আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি, সাহাবিগণ নির্দিষ্ট নীতির অধীন হাদিস শ্রবণ করতেন, বলতেন ও যাচাই করতেন এবং বিনা সংকোচে অপরের সমালোচনা করতেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো বিষয় সম্পৃক্ত করা হবে, যা তিনি বলেননি, আর তারা চুপ থাকবে, এরূপ সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তার নবীকে মুনাফিকদের থেকে পূর্ণরূপে রক্ষা করেছেন।
 [1] সূরা মুনাফিকুন: (১)
[2] সূরা মুহাম্মদ: (১৬)
[3] সূরা মুহাম্মদ: (৩০)
[4] বুখারি : (৮/১১৩), হাদিস নং:(৪৪১৮)
তাবে‘ঈ ও তাদের পরবর্তী যুগে হাদিস
হিজরি প্রথম শতাব্দীর অর্ধেক শেষ না-হতেই অধিকাংশ সাহাবি জীবন সংগ্রাম শেষ করে জান্নাতুল ফিরদউসে পাড়ি জমান। ইতোপূর্বে তারা ইসলামের দাওয়াত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে পূর্ব-পশ্চিম বিচরণ করেন, ফলে বিভিন্ন দেশের তাবে‘ঈগণ তাদের থেকে ইলম হাসিল করার সুযোগ পান, তবে তারা কতক সমস্যার মুখোমুখি হন, যেমন:
১. তারা দেখলেন, নবী যুগ থেকে দূরত্বের সাথে মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পাচ্ছে, লেখা-লেখির উপর নির্ভরতা বাড়ছে ও আরব-অনারব মিশ্রিত হচ্ছে।
২. ধীরে ধীরে সনদ দীর্ঘ হচ্ছে, সাহাবি থেকে তাবে‘ঈ, কখনো তাবে‘ঈ থেকে তাবে‘ঈ ইলম শিখছেন।
৩. মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রাবি ও হাদিসের সনদ বাড়ছে।
৪. তাবে‘ঈদের যুগে কয়েকটি বাতিল ফের্কার আত্মপ্রকাশ ঘটে, যেমন শিয়া, খাওয়ারেজ, অতঃপর মুতাযিলা, মুরজিয়াহ ও জাবরিয়া ইত্যাদি। তারা দেখলেন বাতিল ফিরকাগুলো তাদের বিদআতের সমর্থনে মিথ্যা হাদিস রচনায় লিপ্ত।
তাবে‘ঈগণ এসব সমস্যার সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারা হাদিসের সুরক্ষার স্বার্থে সাহাবিদের থেকে শেখা নীতির সাথে নতুন কতিপয় নীতি তৈরি করেন, যেমন:
তাবে‘ঈদের অনুসৃত নীতি:
১. তাবে‘ঈগণ রাবি ও সনদ যাচাই করেন, যেন মিথ্যাবাদীদের কোনো রচনা হাদিসের স্বীকৃতি না পায়। তারা রাবিদের অবস্থা, নাম, উপাধি, উপনাম, জন্ম ও সফর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন। রাবিদের দেশ সফর, অবস্থান, মৃত্যু এবং প্রত্যেকের ভালো-মন্দ জানেন, তাদের স্মৃতি শক্তি ও হাদিসের উপর দক্ষতা সংরক্ষণ করেন। এভাবে তারা গ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবিদের পৃথক করেন।[1]
তারা সনদকে দীনের অংশ মনে করেন, কারণ সহি, দুর্বল ও জাল হাদিস জানার সনদ একটি মাধ্যম। ইমাম মুসলিম সহি মুসলিমের ভূমিকায়[2] আব্দুল্লাহ ইব্ন মুবারক থেকে বর্ণনা করেন:
«‏الْإِسْنَادُ مِنْ الدِّينِ، وَلَوْلَا الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ »، وقَالَ أيضاً: «‏بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْقَوَائِمُ» ‏يَعْنِي الْإِسْنَادَ».
“সনদ দীনের অংশ, যদি সনদ না থাকত তাহলে যে যা ইচ্ছা তাই বলত”। তিনি অন্যত্র বলেন: “আমাদের ও পূর্ববর্তীদের মাঝে সিঁড়ি [সনদ] রয়েছে”। আবু ইসহাক ইবরাহিম ইব্ন ঈসা তালাকানি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইব্ন মুবারককে বললাম: হে আবু আব্দুর রহমান, এ হাদিসটি কেমন:
«إِنَّ مِنْ الْبِرِّ بَعْدَ الْبِرِّ أَنْ تُصَلِّيَ لِأَبَوَيْكَ مَعَ صَلَاتِكَ وَتَصُومَ لَهُمَا مَعَ صَوْمِكَ»
“নিশ্চয় সদাচরণের সাথে আরো সদাচরণ হচ্ছে যে, তুমি তোমার সালাতের সাথে তোমার পিতা-মাতার জন্য সালাত পড়বে এবং তোমার সিয়ামের সাথে তাদের জন্য সিয়াম রাখবে”। আব্দুল্লাহ বললেন: হে আবু ইসহাক, এ হাদিস কার থেকে বর্ণিত? তিনি বলেন: আমি বললাম: শিহাব ইব্ন খিরাশ থেকে। তিনি বললেন: সে সেকাহ, সে কার থেকে? আমি বললাম: হাজ্জাজ ইব্ন দিনার থেকে। তিনি বললেন: সে সেকাহ, সে কার থেকে? আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। তিনি বললেন: হে আবু ইসহাক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হাজ্জাজ ইব্ন দিনারের মাঝে অনেক দূরত্ব রয়েছে, যেখানে উটের গর্দান নুইয়ে যায়, তবে সদকার ক্ষেত্রে দ্বিমত নেই। অর্থাৎ হাজ্জাজ ইব্ন দিনার ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে অপর রাবি রয়েছে, যাদেরকে হাজ্জাজ উল্লেখ করেনি, অতএব সনদ মুত্তাসিল নয়, তাই হাদিস সহি নয়।
এ যুগে হাদিসের কতক পরিভাষা সৃষ্টি হয়, যেমন ‘মুদাল্লাস’। মুহাদ্দিসগণ মুদাল্লিসের হাদিস গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না সে বাদ দেওয়া রাবির নাম বলে দিত। অনুরূপ ‘মুরসাল’, ‘মুত্তাসিল’, ‘মারফূ‘’, ‘মাওকুফ’ ও ‘মাকতু’ ইত্যাদি পরিভাষার সৃষ্টি হয়।
২. তাবে‘ঈগণ রাবিদের গুণাগুণ নির্ণয়ে বিভিন্ন পরিভাষা গ্রহণ করেন, যেমন ‘দ্বা‘ঈফ’, ‘কাযযাব’, ‘সেকাহ’, ‘আদিল’ ও ‘দাবেত’ ইত্যাদি, যেন সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী, দুর্বল ও সবল রাবিদের চিহ্নিত করা যায়।
৩. তাবে‘ঈগণ সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদিস লিপিবদ্ধ করা আরম্ভ করেন। কতক তাবে‘ঈ হাদিসের কিতাব লিখেন, যেমন হাম্মাম ইব্ন মুনাব্বিহ আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো জমা করেন। খলিফা ওমর ইব্ন আব্দুল আযিয রাহিমাহুল্লাহ সরকারি তত্ত্বাবধানে আবু বকর ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন হাযম ও মুহাম্মদ ইব্ন শিহাব যুহরিকে বিভিন্ন দেশ থেকে হাদিস সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন, যেন আলেমদের মৃত্যুর কারণে ইলম বিনষ্ট না হয় ও মিথ্যা হাদিস দীনে প্রবেশ না করে। এ সময়ে লিখিত সবচেয়ে পুরনো কিতাব হিসেবে আমাদের নিকট পৌঁছেছে মা‘মার ইব্ন রাশেদ সান‘আনি (মৃ.১৫৪হি.) রচিত جامع ‘জামে’ ও ইমাম মালিক (মৃ.১৭৯হি.) রচিত ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ গ্রন্থদ্বয়।
৪. তাবে‘ঈগণ বিভিন্ন দেশ থেকে হাদিসের সনদগুলো জমা করে পরখ করেন ও এক হাদিসের সাথে অপর হাদিস তুলনা করেন। এভাবে হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
৫. যারা পেশা হিসেবে হাদিস শিক্ষা করেনি বা হাদিস বর্ণনার নীতি জানেনি, তাবে‘ঈগণ তাদের হাদিস ত্যাগ করেন। অর্থাৎ এক শ্রেণীর ইবাদত গোজার ও দুনিয়া ত্যাগীদের হাদিস তারা ত্যাগ করেন, যারা উসুলে হাদিস জানতেন না, তবে মানুষদেরকে ইবাদত ও নেক আমলের প্রতি আহ্বান করতেন। তারা নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও খারাপ আমল থেকে সতর্ক করে অনেক হাদিস রচনা করেন। আলেমগণ তাদের হাদিস থেকে সতর্ক করেন। তারা বলেন: কারো হাদিস গ্রহণ করার জন্য রাবির নেককার হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং আলেমদের ইলমি মজলিসে বসা ও বর্ণনা নীতি জানা আবশ্যক। ইমাম মালিকের উস্তাদ আবুয যিনাদ আব্দুল্লাহ ইব্ন যাকওয়ান বলেন: “আমি মদিনায় এক শো ব্যক্তিকে পেয়েছি, তারা সবাই বিশ্বস্ত, তবে তাদের হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তারা হাদিস বর্ণনার উপযুক্ত নয়”।[3] তারা নেককার, তবে তারা সহি-দ্বা‘ঈফ চিনে না, তাদের থেকে ভুলের সম্ভাবনা বেশী।৬. নবীন তাবে‘ঈগণ প্রবীণ তাবে‘ঈদের নিকট হাদিস পেশ করতেন, যেমন স্বর্ণকারের নিকট স্বর্ণ পেশ করা হয়। তারা হাদিসের দোষ-ত্রুটি বলে দিতেন। তখনো হাদিস যাচাইয়ের নীতিগুলো স্বতন্ত্র কোনো কিতাবে লিখা হয়নি, কারণ হাদিসের প্রত্যেক ছাত্রের নিকট তা প্রসিদ্ধ ছিল।
[1] উদাহরণের জন্য দেখুন: বুখারি: (১১/২০১), হাদিস নং: (৬৪০৩)
[2] মুসলিম: (১/১৫), হাদিস নং: (১৫-১৬)
[3] মুসলিম: (১/১৫)
হাদিস ও উসুলে হাদিসের স্বর্ণযুগ
দ্বিতীয় হিজরির শেষার্ধ থেকে চতুর্থ হিজরির প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কে ইলমে হাদিসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তৃতীয় শতাব্দীতে মুহাদ্দিসগণ হাদিসের কিতাব রচনায় মনোযোগী হন। এ সময় হাদিসের মূল কিতাবগুলো রচনা করা হয়, যেমন:
১. ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বলের মুসনাদ (মৃ.২৪১হি.), সহি বুখারি (মৃ.২৫৬হি.), সহি মুসলিম (মৃ.২৬১হি.), সুনানে আবু দাউদ সিজিসতানি (মৃ.২৭৫হি.), সুনানে তিরমিযি (মৃ.২৭৯হি.), সুনানে নাসায়ি (মৃ.৩০৩হি), সুনানে ইব্ন মাজাহ (মৃ.২৭৫হি.) সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।
২. অনেক মুহাদ্দিস علم الرجال ‘ইলমুর রিজাল’ বা রাবিদের জীবনীর উপর একাধিক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন: ইমাম বুখারি ক. আত-তারিখুল কাবির, খ. আত-তারিখুল আওসাত, গ. আত-তারিখুস সাগির। ঘ. ‘কিতাবুদ দুয়াফা’; ইয়াহইয়া ইব্ন মায়িন (মৃ.২৩৪হি.) ‘আত-তারিখ’; মুহাম্মদ ইব্ন সা‘দ (মৃ.২৩০হি.) ‘আত-তাবকাতুল কুবরা’; নাসায়ি ‘কিতাবুদ দু‘আফা’; ইব্ন আবি হাতেম (মৃ.৩২৭হি.) ‘আল-জারহু ওয়াততা‘দিল’; ইব্ন হিব্বান (মৃ.৩৫৪হি.) ‘কিতাবুস সিকাত’ ইত্যাদি রচনা করেন। এসব কিতাবে তারা রাবিদের নাম, কে সেকাহ- কে দুর্বল, কে গ্রহণযোগ্য- কে পরিত্যক্ত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন।
৩. কতক মুহাদ্দিস বিশেষ প্রকার হাদিস স্বতন্ত্র কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন, যেমন ইমাম বুখারি ও মুসলিম সহি হাদিস জমা করেন; ইমাম আবু দাউদ মুরসাল হাদিস জমা করেন; ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল ও আবু দাউদ উভয়ে ‘নাসেখ ও মানসুখে’র উপর স্বতন্ত্র কিতাব লিখেন; ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল ও আলি ইব্ন মাদিনি (মৃ.২৩৪হি.) ‘ইলাল’ (হাদীসের গোপন দোষ-ত্রুটি)-এর উপর কিতাব লিখেন; অনুরূপ ইমাম তিরমিযি ‘ইলালে’র উপর কিতাব লিখেন; ইমাম শাফে‘ঈ ও ইব্ন কুতাইবাহ (মৃ.২৭৬হি.) প্রমুখগণ জটিল অর্থ সম্পন্ন হাদিসগুলো স্বতন্ত্র কিতাবে জমা করেন। এভাবে হাদিসের বিশেষ প্রকার স্বতন্ত্র কিতাবে জমা করা হয়।
মুহাদ্দিসগণ এসব কিতাবে ‘উসুলে হাদিসে’র পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কেউ তার সংজ্ঞা দেননি। যেমন বুখারি ও মুসলিম ‘সহি’ হাদিসের সংজ্ঞা দেননি, অথবা সহির শর্ত বলেননি। ইমাম আহমদ ‘নাসেখ ও মানসুখে’র উপর কিতাব লিখেছেন, কিন্তু তার সংজ্ঞা দেননি। অনুরূপ ই‘লাল ও মারাসিল হাদিসের গ্রন্থকারগণ ‘ইল্লত’ ও ‘মুরসালে’র সংজ্ঞা দেননি। তাদের কিতাবসমূহ ছিল ‘উসুলে হাদিস’ বা হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষার বাস্তব অনুশীলন, সবাই তার অর্থ জানত, তাই কেউ পরিভাষার সংজ্ঞা দেননি।
সর্বপ্রথম হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা সংক্রান্ত সংজ্ঞা দেন ইমাম শাফে‘ঈ রাহিমাহুল্লাহ্। তিনি উসুলে ফিকহের উপর লিখিত ‘আর-রিসালাহ’ গ্রন্থে ‘উসুলে হাদিসে’র কতক পরিভাষার সংজ্ঞা দেন, যেমন দলিল যোগ্য হাদিসের শর্ত, খবরে ওয়াহেদের প্রামাণিকতা, রাবির গ্রহণযোগ্যতা ও হাদিসের ভাবার্থ বর্ণনার শর্ত, মুদাল্লিস রাবির হাদিসের হুকুম এবং মুরসাল হাদিসের হুকুম ইত্যাদি বিষয়গুলো তিনি উসুলে ফিকহের অধীন বর্ণনা করেন। অনুরূপ ইমাম মুসলিম সহি মুসলিমের ভূমিকায় এবং ইমাম তিরমিযি ‘ইলালুস সাগির’ গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত কেউ উসুলে হাদিসের পরিভাষা সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেননি।
হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষার উপর স্বতন্ত্রগ্রন্থ রচনা
চতুর্থ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে যখন হাদিসের কিতাব লেখা প্রায় শেষ, তখন আলেমগণ হাদিসের পরিভাষাগুলো স্বতন্ত্র কিতাবে জমা করা আরম্ভ করেন। তারা প্রথমে সনদসহ পরিভাষাগুলো জমা করেন, তার উপর টিকা সংযোজন করেন ও তাদের নীতি থেকে বেশ-কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করেন।
সর্বপ্রথম এ বিষয়ে কলম ধরেন কাযী আবু মুহাম্মদ হাসান ইব্ন আব্দুর রহমান ইব্ন খাল্লাদ রামাহুরমুযি (মৃ.৩৬০হি.), তিনি "الْمُحَدِّث الفاصل بين الراوي والواعي"  নামে উসুলে হাদিসের উপর স্বতন্ত্র কিতাব লিখেন। এতে তিনি হাদিস বর্ণনা করা, শ্রবণ করা, শিক্ষা দেওয়া ও হাদিস সংক্রান্ত মুহাদ্দিসের জরুরি জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো জমা করেন, কিন্তু পরিপূর্ণ কিতাবের ন্যায় উসুলে হাদিসের বিভিন্ন প্রকারগুলো তিনি উল্লেখ করেননি।
অতঃপর তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ নিসাপুরি (মৃ.৪০৫হি.), যিনি হাকেম নামে প্রসিদ্ধ। তিনি "معرفة علوم الحديث" নামে একখানা কিতাব রচনা করেন। সর্বপ্রথম উসুলে হাদিসের উপর এটা স্বতন্ত্র রচনা। এতে তিনি উসুলে হাদিসের ৫২-টি পরিভাষা উল্লেখ করেন। প্রত্যেক পরিভাষার সংজ্ঞা দেন, যার ভাগ হয় তার ভাগ করেন এবং উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট করে।
অতঃপর উসুলে হাদিসের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেন আবু বকর আহমদ ইব্ন আলি ইব্ন সাবিত, যিনি খতিবে বাগদাদি (মৃ.৪৬৩হি.) নামে প্রসিদ্ধ। উসুলে হাদিসের উপর তিনি একাধিক কিতাব রচনা করেন, যেমন "الكفاية في علم الرواية"  এতে তিনি হাদিস বর্ণনার পদ্ধতি, নীতিমালা ও আলেমদের মতামত জমা করেন। তার দ্বিতীয় কিতাব "الجامع لأخلاق الراوي وآداب السامع"  এতে তিনি মুহাদ্দিস, হাদিস অন্বেষণকারী ও তাদের জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। তার তৃতীয় কিতাব "الرحلة في طلب الحديث"  এতে তিনি হাদিসের জন্য আলেমদের বিভিন্ন দেশ সফর ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জমা করেন। তার চতুর্থ কিতাব "تقييد العلم"  এতে তিনি হাদিস লেখা ও তার সাথে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো জমা করেন। তার পঞ্চম কিতাব "المزيد في متصل الأسانيد" এতে তিনি হাদিসের বিভিন্ন প্রকারগুলো উল্লেখ করেন। উসুলে হাদিসের সনদ কিংবা মতনের সাথে সম্পৃক্ত এমন কোনো ইলম নেই যার উপর তিনি স্বতন্ত্র কিতাব কিংবা পুস্তিকা রচনা করেননি। পরবর্তী আলেমদের নিকট তার কিতাবগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়। তার কিতাব থেকে সবাই উপকৃত হন, অনেকে বলেন: “ইনসাফের দৃষ্টিতে সবাই স্বীকার করবে যে, খতিবের পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তার কিতাবের উপর নির্ভরশীল”।
অতঃপর এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব লিখেন কাযী ইয়াদ ইব্ন মুসা ইয়াহসুবি (মৃ.৫৪৪হি.), তার কিতাবের নাম "الإلماع إلى معرفة أصول الرواية وتقييد السماع"  এতে তিনি হাদিস বর্ণনা করা ও শিক্ষা দেওয়ার নীতিমালা জমা করেন। এভাবে উসুলে হাদিসের উপর লিখিত গ্রন্থসমূহের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
‘ইবনে সালাহ’র হাতে উসুলে হাদিসের জাগরণ
হাদিসের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফেয আবু আমর উসমান ইব্নুস সালাহ শাহরুযুরি (মৃ.৬৪৩হি.) উসুলে হাদিসের উপর"علوم الحديث"  নামে বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন, যা "مقدمة ابن الصلاح" নামে প্রসিদ্ধ। কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের এ কিতাব সবচেয়ে বেশী সমাদৃত:
১. হাদিসের প্রায় সকল প্রকার উল্লেখ করা হয়, যা পূর্বের কিতাবসমূহে বিক্ষিপ্ত ছিল। এতে ৬৫-প্রকার হাদিস রয়েছে। ২. পাঠকদের সুবিধার্থে সনদ উল্লেখ করা হয়নি, পূর্বের কিতাবগুলো যার দ্বারা পূর্ণ ছিল। ৩. সহজ ও সাবলীল ভাষায় হাদিসের নীতিমালা সূক্ষ্মভাবে প্রণয়ন করা হয়। ৪. পূর্বের আলেমদের বাণী ও আমল থেকে বিভিন্ন মাসাআলা বের করা হয়। ৫. সংজ্ঞাসহ প্রত্যেক প্রকার উল্লেখ করা হয়, যার সংজ্ঞা পূর্বে ছিল না তার সংজ্ঞা তৈরি করা হয়। ৬. পূর্ববর্তী আলেমদের নীতি ও অনুসৃত পদ্ধতির সুন্দর সমালোচনা করা হয়। এ জন্য আলেমগণ মনে করেন, এ কিতাব মুহাদ্দিসদের সামনে উসুলে হাদিসের নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
পরবর্তী আলেমগণ ‘ইবনে সালাহ’র কিতাব যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন, কেউ তার সংক্ষিপ্ত লিখেন, কেউ তার ব্যাখ্যা লিখেন, কেউ সংক্ষিপ্তের ব্যাখ্যা লিখেন, কেউ ব্যাখ্যার সংক্ষিপ্ত লিখেন, কেউ তার কিতাবকে কবিতার আকৃতি দেন, কেউ কবিতার ব্যাখ্যা লিখেন এবং কেউ তার নীতিমালার সমালোচনা করেন। ইব্নুস সালাহ ও তার কিতাব এতটাই গ্রহণযোগ্য যে, উসুলের হাদিসের মূল কিতাব বললে তার কিতাব বুঝানো হয় এবং শায়খ বললে তিনি উদ্দেশ্য হন।
উসুলে হাদিসের অপর দিকপাল ইব্ন হাজার
উসুলে হাদিসের অপর দিকপাল ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ সহজ ও সাবলীল ভাষায় অতি সংক্ষেপে একখানা কিতাব লিখেন "نُخْبَة الفِكَرِ في مصطلحِ أهلِ الأثر" নামে, যা মাত্র কয়েক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। অতঃপর তিনি নিজেই তার নাতিদীর্ঘ এক ব্যাখ্যা লিখেন "نُزْهَة النظر شرح نُخْبَةِ الفِكَر" নামে। পরবর্তীতে তার ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা লিখেন শায়খ আলি ইব্ন সুলতান আল-কারি (মৃ.১০১৪হি.), "شرح الشرح" নামে। তার ব্যাখ্যার অপর ব্যাখ্যাকার শায়খ মুহাম্মদ আকরাম নাসরপুরি সিন্ধি, তার কিতাবের নাম "إمعان النظر شرحُ شرحِ نخبة الفكر" ইবন হাজারের হাতে উসুলে হাদিস পরিপক্ব ও সংহত হয়, পরবর্তী আলেমগণ তার কিতাবের উপর অধিক নির্ভরশীল।
আমরা দেখলাম হাদিস প্রচার ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে ধীরেধীরে তার পরিধি বাড়তে থাকে। যখন যতটুকু প্রয়োজন ছিল, তখন ততটুকু অস্তিত্ব লাভ করে। নববী যুগ থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়ার সাথে আদর্শের পতন তরান্বিত হয়।[1] কখনো মিথ্যার প্রসার ঘটে, কখনো কুচক্রীরা অনুপ্রবেশ করে, কখনো বাতিল ফির্কার জন্ম হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান যথাযথ সংরক্ষণ করার জন্য আলেমগণ ঘাম ঝরান। তারা বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করেন ও কঠোর নিয়ম মেনে চলেন। হাদিসের কিতাবগুলো রচনা সম্পন্ন হলে দীন বিপদ মুক্ত হয়। অতঃপর আরম্ভ হয় বিভিন্ন কিতাবে সংগৃহীত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করা। কোনো মুহাদ্দিসের শিথিলতা, কারো কঠোরতা এবং কারো মধ্যমপন্থা চিহ্নিত হয়। মুহাদ্দিসগণ সহি, হাসান, দা‘য়িফ ও জাল হাদিসসমূহ নির্ণয় করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো পরখ করে সহি, দুর্বল ও জাল হাদিস নির্ণয় করার পদ্ধতিকে পরিভাষায় ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়।
এ পর্যন্ত হাদিস শাস্ত্রের দু’টি পদ্ধতি জানলাম: একটি "علم الرواية"  অপরটি "علم الدراية"  
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কর্ম, সমর্থন, চারিত্রিক ও সৃষ্টিগত গুণগান, অনুরূপ সাহাবি ও তাবে‘ঈদের কথা ও কর্মের জ্ঞানার্জন করা, সূক্ষ্মভাবে সংরক্ষণ করা, যথাযথ অপরের নিকট পৌঁছানো ও তার শব্দগুলো পরিপূর্ণ আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সাথে লিপিবদ্ধ করা।
‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’: এমন কতক বিধান ও নীতিমালা, যার দ্বারা হাদিসের সনদ ও মতনের অবস্থা জানা যায় এবং তার উপর ভিত্তি করে সহি, হাসান, দুর্বল ও তার প্রকারসমূহ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। সনদের অবস্থার অর্থ ইত্তেসাল, ইনকেতা ও তাদলিস; উঁচু সনদ ও নিচু সনদ, রাবি দুর্বল না সেকাহ ইত্যাদি। মতনের অবস্থার অর্থ মারফূ‘, মাওকুফ, মাকতু, শায, মু‘আল্লাল, সহি, দ্বা‘ঈফ অথবা মনসুখ ইত্যাদি। হাদিসের ফিকহ তথা অর্থ জানা ও তার থেকে মাসআলা আবিষ্কার করা এ ইলমের অন্তর্ভুক্ত, কারণ হাদিসের অর্থ জানা মতনের একটি বিশেষ গুণ, যার উপর ভিত্তি করে ইল্লত ও মুখালিফাত জানা যায়।
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ ও ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’-কে "علم مصطلح الحديث" বা শুধু "مصطلح الحديث" বলা হয়। অর্থাৎ যে শাস্ত্রে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ ও ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, সে শাস্ত্রকে ‘ইলমু মুসতালাহিল হাদিস’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’কে ‘ইলমু মুসতালাহিল হাদিস’ বলা হয়। ‘মুসতালাহুল হাদিসের’ অপর নাম "علم علوم الحديث"  ‘ইলমু উলুমিল হাদিস’ বা "علم أصول الحديث" ‘ইলমু উসুলিল হাদিস’ বা শুধু "علم الحديث" ‘ইলমুল হাদিস’।
উসুলে হাদিস উম্মতে মুসলিমার বৈশিষ্ট্য, পূর্বের কোনো জাতির নিকট এ ইলম নেই। অসংখ্য হাফেযে হাদিস গুরুত্বের সাথে এ ইলম গ্রহণ করেন, রাবিদের জীবনী ও তাদের ভাল-মন্দ সংবাদ সংগ্রহ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবি ও তাদের অনুসারী তাবে‘ঈদের সাথে সম্পৃক্ত হাদিসগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধ চিহ্নিত করেন, যা একমাত্র এ উম্মতের গর্বের বস্তু। আল্লাহ এভাবে দীন হিফাজত করেন, যার ওয়াদা তিনি নিম্নের আয়াতে করেছেন: 
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ [الحجر: ٩]
“নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই তার হিফাযতকারী”।[2] আল্লাহ তাআলার সরাসরি তত্ত্বাবধানে কুরআনুল কারিম সংরক্ষিত। আর তার তৌফিকপ্রাপ্ত একদল বান্দার তত্ত্বাবধানে হাদিস সংরক্ষিত।
[1] নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
" خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ".
“আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম, অতঃপর তাদের সাথে যারা মিলিত হবে, অতঃপর তাদের সাথে যারা মিলিত হবে”। বুখারি: (২৬৫২), মুসলিম: (২৫৩৫)
[2] সূরা হিজর: (৯
(সমাপ্ত))

প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:     
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” 
(বুখারী ৩৪৬১, হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৩৮৮।)
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

ইসলামের অন্যান্য সকল বিষয় সহিহভাবে জানতে  এর উপর ক্লিক করুনঃ


PLEASE SHARE ON

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...