বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
শরীয়াহ ও যুক্তি-বিজ্ঞানের আলোকে আল্লাহর পরিচয়
মো: ইজাবুল আলম, এম এ, সি ইন এড, ইসলামিক স্টাডিজ।
শরীয়াহ ও যুক্তি-বিজ্ঞানের আলোকে আল্লাহর পরিচয়
আল্লাহ একটি আরবি শব্দ। এ শব্দটি এমন এক সত্তার জন্যে নির্ধারিত, যিনি অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী, যিনি যাবতীয় পবিত্রতা, পরিপূর্ণতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার গুণাবলিতে ভূষিত এবং সকল প্রকার অসম্পূর্ণতা, অপবিত্রতা ও যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনিই হলেন আল্লাহ। সর্বময় ক্ষমতার মালিক ও শক্তির একক আধার। আল্লাহকে জানবার অসংখ্য পন্থা তার সৃষ্টিজগতে উপস্থিত রয়েছে। বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির মাঝেই মূলত আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। তবে পবিত্র কোরআন আল্লাহর পরিচয় জানার সর্বোত্তম মাধ্যম ।
‘আল্লাহ’ শব্দটি সৃষ্টিকর্তার ‘ইসমে যাত’ বা সত্তাবচক নাম। আল্লামা তাফতাযানি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ’ শব্দটি ঐ চিরন্তন সত্তার নাম যার অস্তিত্ব অবশ্যাম্ভাবী এবং যিনি সমস্ত প্রশংসনীয় ও উত্তম গুণের অধিকারী। [শরহে তাহযীব, ২য় খন্ড]
‘আল্লাহ’ শব্দটি ইলাহুন শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ উপাস্য বা মাবুদ। আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ইসলামের মৌলিক ভিক্তি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সঠিক জ্ঞান থাকা প্রতিটি মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই। আল্লাহ নামের কোনো বহুবচন হয়না। আরবি ভাষায় ‘আল্লাহ’ শব্দের হুবহু অর্থজ্ঞাপক আর কোনো শব্দ নেই। তিনি অনাদি, অনন্ত । [বুক অব ইসলামিক নলেজ, ইকবাল কবীর মোহন]
আল্লাহর পরিচয় : আল্লাহর সমকক্ষ মর্যাদায় মর্যাদাবান আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে তিনি একক, অনন্য। তার সমকক্ষ ও সমতুল্য কেউ নেই এবং থাকতে পারে না। তিনি তার সত্তা, গুণাবলি ও কার্যাবলির ব্যাপারে এক কথায় সর্বদিক থেকে একক, অনন্য ও অদ্বিতীয়। তাই তিনি শিরক থেকে যেমন পবিত্র, তেমনি মুক্ত ও পবিত্র সৃষ্টির সাথে যাবতীয় সাদৃশ্যতা থেকে। বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল ওজুদ)। যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর সাথে সাদৃশ্য থেকে তিনি পবিত্র। মোটকথা, গোটা সৃষ্টিজগতের কেউ কোনো দিক থেকে তাঁর মতো নয়। তাঁর সাথে কারোই যেমন কোনো প্রকার তুলনা হয় না, তদ্রুপ কোনো কিছুর সাথে তাঁরও সামান্যতম তুলনা বা সাদৃশ্য নেই। আল্লাহ তাআল আহাদ তথা একক ও অনন্য হওয়ার প্রকৃত অর্থ এটাই। তাঁর সম্পর্কে এরূপ আকিদা বিশ্বাস পোষণ করাকেই ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় তাওহীদ। আর এটাই ইসলামের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। আল্লাহ কোনো বস্তু নন এবং তাঁর গুণরাজি শুধু তাঁরই জন্য। তাঁর কোনো গুণই অপর কারো মধ্যে কল্পনা করা যায় না। [ইসলাম প্রচার ব্যুরো প্রকাশিত গবেষণাপ্রবন্ধ- আল্লাহর পরিচয়, লেখক-গবেষক- হাফেজ নেছার উদ্দীন]
পবিত্র কোরআনে আল্লাহর পরিচয় : তিনি কোরআনে নিজ পরিচয় দিয়েছেন এভাবে—
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ.
আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তার কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে বা পিছনে যা কিছু রয়েছে, তিনি তার সবই জানেন। তাঁর জ্ঞান-সীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না-তবে যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর আসন (সার্বভৌম ক্ষমতা) সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনি সর্বোচ্চ ও সর্বাপেক্ষা মহান। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৪]
তিনি আরও বলেছেন—
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴾ الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ ﴾ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ ﴾ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ.
পুণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব বা সর্বময় ক্ষমতা। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান, যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমতাময়। তিনি সপ্তম আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোনো ভ্রান্তি দেখতে পাও কি ? অতপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে। [সূরা মুলক, আয়াত ১-৪]
এছাড়া পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। [সূরা ইখলাস, ১-৪]
হাদিসের আলোকে আল্লাহর পরিচয় : রাসূলকে (সা.) হজরত আবূ যর (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি তাঁর রব্বকে দেখেছেন কিনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জবাবে বলেছেন, আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পারি? আমি তো একটি নূর দেখেছি মাত্র। [মুসলিম ও বুখারী]।
আল্লাহ কোথায় আছেন বা কেথায় থাকেন? এমন একটা প্রশ্ন আমাদের মনে অনেক সময়ই ঘুরপাক খায়। আল্লাহ আমাদের প্রভু, আমাদের একমাত্র প্রতিপালক। আমাদের সবচেয়ে আপনজন তিনি। আমরা তারই ইবাদত করি । তিনি কোথায় আছেন, কোথায় থাকেন তিনি, সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখা তার একজন বান্দা হিসেবেই আমাদের জন্য জরুরি বৈকি। বান্দা যার বন্দেগি করে, তার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জানাশোনা না থাকলে তার বন্দেগিতে সংশয় থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
কোরআন কী বলে : আল্লাহ কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন- পরম করুণাময় আরশের উপর সমাসীন আছেন। [সুরা তাহা, আয়াত ৫]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে আছেন। [সুরা আনআম, আয়াত ৩]
আয়াত থেকে জানা যায়, আল্লাহ আসমানে আছেন। তার আরশ আসমানে। কোরআনে এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়লার ‘কুরসি’, যেখানে তিনি সমাসীন আছেন, তা আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত । আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, এর সমর্থনে আরো একটি আয়াত পাওয়া যায়, সুরা নাহলে আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন, তারা তাদের উপরের প্রতিপালককে ভয় করে । [সূরা নাহল, আয়াত ৫০]
হাদিস কী বলে : হাদিসের দিকে তাকালেও দেখবো, আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসূলের (সা.) অনেক বাণী ও সাহাবীদের উক্তি থেকেও । রাসূলকে (সা.) আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলেন মেরাজের উদ্দেশ্যে। সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। [বুখারী ও মুসলিম]
এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তবে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। [তিরমিযি]
রাসূল (সা.) একবার এক ক্রীতদাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বললো, আসমানে। তারপর তিনি বললেন, বলতো আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। রাসূল (সা.) বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা । [মুসলিম]
সাহাবিদের বক্তব্য : রাসূলের (সা.) সাহাবিরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করতেন । হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপরে জীবিত আছেন, কখনোই মৃত হবেন না। [সুনানে দারেমি]
ইমামদের অভিমত : আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে (রহ.) আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে আলাদা হয়ে। অর্থাৎ তার এই উপরে থাকা সৃষ্টির থাকার মতো নয়। চার মাযহাবের ইমামগণও এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, তাফসিরকারকগণ এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, জাহমিয়ারা আল্লাহ সম্বন্ধে বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের এ জাতীয় কথা থেকে পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। আর আয়াতের ব্যখ্যা হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা । এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই প্রমাণ বহন করে । [তাফসিরে জালালাইন, ইবনে কাসির]
ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর উক্তি : ইমাম আবু হানীফাহ (রহ.) বলেন,
«من قال: لا أعرف ربي في السماء أو في الأرض فقد كفر، وكذا من قال: إنه على العرش ولا أدري العرش أفي السماء أو في الأرض، والله تعالى يُدعى من أعلى لا من أسفل» [الفقه الأكبر 1135]
যে ব্যক্তি বলবে, আমি জানি না, আমার রব আসমানে না জমিনে – সে কাফির। অনুরূপ (সেও কাফির) যে বলবে, তিনি আরশে আছেন, তবে আমি জানি না, ‘আরশ আসমানে না জমিনে। [আল ফিকহুল আকবার: ১/১৩৫]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর উক্তি : তার ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া বলেন, একদা আমরা ইমাম মালিক ইবন আনাস (রহ.) এর কাছে বসা ছিলাম, এমন সময় তার কাছে এক লোক এসে বলল,
«يا أبا عبد الله، [الرحمن على العرش استوى]، كيف استوى؟ قال: فأطرق مالك رأسه، حتى علاه الرحضاء، ثم قال: الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة، وما أراك إلا مبتدعاً، فأمر به أن يخرج. وفي رواية: الاستواء معلوم والكيف غير معلوم، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة. [الاعتقاد للبيهقي [1/67]، حاشية السندي على ابن ماجه [1/167]، حاشية السندي على النسائي [6/38]، مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح [2/17، و13/89]
হে আবু আব্দুল্লাহ! (মহান আল্লাহ বলেন) রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন [সূরা ত্বাহা: ২০:৫]। এই উপরে উঠা কীভাবে? এর রূপ ও ধরণ কেমন? প্রশ্নটি শোনামাত্র ইমাম মালিক (রহ.) মাথা নীচু করলেন, এমনকি তিনি ঘর্মাক্ত হলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ইসতিওয়া শব্দটির অর্থ (উপরে উঠা) সকলের জানা, কিন্তু এর ধরণ বা রূপ অজানা, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বিদআত। আর আমি তোমাকে বিদআতী ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। অতঃপর তিনি (রহ.) তাকে মজলিস থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। [ইতিকাদ লিল বাইহাকী ১/৬৭, হাশিয়াতুস সিন্ধী আলা ইবনি মাজাহ ১/১৬৭, মিরকাতুল মাফাতীহ ২/১৭, ১৩/৮৯]।
ইমাম শাফিঈ (রহ.)-এর উক্তি : তিনি বলেন,
«وأن الله على عرشه في سمائه» تهذيب سنن أبي داود، وإيضاح مشكلاته [2/406].
আর নিশ্চয় আল্লাহ আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপর উঠেছেন। [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (রহ.)-এর উক্তি : মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-কাইসী বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করলাম,
«يُحكى عن ابن المبارك أنه قيل له: كيف يُعرف ربنا؟ قال: في السماء السابعة على عرشه، قال أحمد: هكذا هو عندنا» تهذيب سنن أبي داود وإيضاح مشكلاته [2/406].
এ মর্মে ইবনুল মুবারাক (রহ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, আমাদের রবের পরিচয় কীভাবে জানবো? উত্তরে তিনি বললেন, সাত আসমানের উপর আরশে। (এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?) ইমাম আহমাদ (রহ.) বললেন, বিষয়টি আমাদের নিকট এ রকমই। [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
উল্লিখিত দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা মহান আল্লাহ তাআলার আসমানে বা আরশে অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। [ইসলামি আকিদা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর, মূল : শাইখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী, শাইখ মুহাম্মাদ আবদুন নূর মাদানী, অনুবাদ ও সম্পাদনা- ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, প্রকাশ : ইসলাম হাউজ ডট কম]
সুতরাং সুস্থ বিবেকও বলে যে, আল্লাহ যদি তিনি সর্বত্রই বিরাজমান থাকেন তার সত্তাগতভাবে। সুতরাং এটাই সত্য যে, তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তার দেখা, শোনা ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত আছেন।
বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব : আবিষ্কার-উদ্ভাবন আবিষ্কারক-উদ্ভাবক এর অস্তিত্বের সত্যতা বিষয়ে ধারণা দেয়, বিশ্বাস জন্মায়। কোনো ঘটনা তার সংঘটকের-সম্পাদকের অস্তিত্বের প্রতি নির্দেশ করে শতসিদ্ধভাবে। সরল প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদ বলা যেতে পারে উল্লিখিত ধরনের প্রমাণ প্রক্রিয়াকে। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কী? প্রাচীন আরবের জনৈক বেদুইন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেছেন এ ধরনের প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদের সারল্যে। তিনি বললেন, উটের বর্জ্য উটের অস্তিত্বের প্রমাণ। গাধার বর্জ্য গাধার অস্তিত্বের দলিল। পদচিহ্ন, হেঁটে যাওয়ার প্রমাণ। অতঃপর, কক্ষপথসম্পন্ন আকাশ, পথঘাটবিশিষ্ট জমিন, তরঙ্গসর্বস্ব সাগর প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। [দ্রঃ আস সায়াদাহ আল আবাদিয়াহ ফিশ শারিয়াহ আল ইসলামিয়াহ : ৪২ ]
বোধ যাদের স্বচ্ছ, বুদ্ধি যাদের উন্মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর এ প্রমাণটি তাদের কাছে স্পষ্ট -অকাট্য। তবে দর্শনের পাঁক সৃষ্টিতে যারা অভ্যস্ত এ প্রমাণ তাদের পরীক্ষায় অপর্যাপ্ত। তাদের বক্তব্য, এ প্রমাণটি প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। তার মানে কিছু আলামত- ইঙ্গিতের নির্ভরতায় ধরে নেয়া হয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্বের একটা বাস্তবতা আছে।
এ প্রশ্নটি খুবই জোরালো মনে হতো আগেকার যুগে। কেননা মহাবিশ্ব, মানুষের জ্ঞানের-উপলব্ধির বলয়ে, সরাসরি ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমানায় আসার মতো একটি বিষয় বলে ধারণা করা হতো। প্রাচীন ধারণা মতে প্রতিটি জিনিসের সর্বশেষ বিশ্লিষ্ট রূপের একক হলো পরমাণু -এটম। এমনকি নিউটনের কাছেও —আলো— ছোট ছোট পরমাণুর সমন্বয়ের নাম ছিল যা আলোকিত বস্তু থেকে বের হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে যেতো। এ-তত্ত্বটিকে corpuscles theory of light বলে ডাকা হয়েছে।
যতদিন মানুষের অধ্যয়ন ও গবেষণার পদচারণা Microcosmic level – এ সীমিত ছিল ততদিন এ-তত্ত্বও চলেছে বীরদর্পে । কিন্তু, যেই মানুষের জ্ঞান এই ভাসমান স্তর অতিক্রম করে অতিক্ষুদ্র মহাজাগতিক স্তরে [Microcosmic level] প্রবেশ করার অধিকার পেল অমনি উল্টাপাল্টা হয়ে গেল সবকিছুই। যে পরমাণুকে মনে করা হতো অখন্ড, ভাঙ্গন-বিরোধী সেই পরমাণু ভেঙ্গে খন্ডিত হয়ে চমক দেখাল সবাইকে। তার জায়গা দখল করল এমনসব তরঙ্গমালা [waves] যা না আসে প্রত্যক্ষের আওতায় না অনুগত হয় কোন মাপযন্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের এ-পরিবর্তন বিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারেই সৃষ্টি হয়। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি অথবা প্রমাণ-প্রক্রিয়ার মূলনীতিতেও ঘটে পরিবর্তন ।
মহাবিশ্বের কোনো কিছুরই সর্বশেষ প্রকৃতি সরাসরি জানা যায় না, এ-বিষয়টি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনো জিনিসের প্রভাব বা ফলাফল [effects ] দেখে ওই জিনিসটির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে বলে বিশ্বাস করে নেয়া, এতটুকুই শুধু মানুষের পক্ষে সম্ভব। আর এভাবেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা সরাসরি-যুক্তি-প্রক্রিয়ার যে ধারণা ইতোপূর্বে বদ্ধমূল ছিল , চিড় ধরল তার শক্ত দেয়ালে। বিজ্ঞানের স্বীকৃত বলয়েও মেনে নেয়া হলো, পরোক্ষ প্রমাণও একটি আইনসিদ্ধ- বৈধ-বৈজ্ঞানিক প্রমাণ।
তিনশ বছর পূর্বে মনে করা হতো- প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ এ-দু’প্রকার প্রমাণের যেকোনো একটিকে বেছে নেয়া ব্যতীত অন্যকোনো সুযোগ নেই আমাদের হাতে । প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই, তাই, কেবল বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু কাল। পরে জানা গেল ব্যাপারটা আসলে সে রকম নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ এ-দুয়ের মাঝে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো সুযোগই নেই, এ-ধারণা বিজ্ঞানের জগতে এখন আর প্রবাহিত নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার বলয়ে, পরোক্ষ প্রমাণ যুক্তিসিদ্ধ- বৈধ, এ- কথায় বিশ্বাস করাই হলো, বর্তমানে, বিজ্ঞানমনস্কতার আলামত।
আধুনিকযুগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলতে যা বুঝায়- যার ওপর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গোটা সৌধ দাঁড়িয়ে তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠিত পরোক্ষ প্রমাণের ভিতে।
এই নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের আলোকে উল্লিখিত আরব-বেদুইনের প্রদত্ত যুক্তি পরীক্ষা করে দেখলে বিজ্ঞানের দাঁড়িপাল্লায় শতভাগ যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ বলে মনে হবে। বিজ্ঞান প্রকৌশল ও যুক্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে তা উল্লিখিত ধরনের সরল-সহজ প্রমাণকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। বর্তমানে এ-দুয়ের মাঝে আর পার্থক্য থাকেনি।
পুরাতন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বলয়ে অসরাসরি হওয়াটাই পরোক্ষ প্রমাণের ত্রুটি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে খোদ বিজ্ঞানের কাছে বৈজ্ঞানিক ধারণা পেশ করার এটাই হলো যৌক্তিক বুনিয়াদ। মূলনীতির দৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল যুক্তি এযাবৎ যাকে ধর্মীয় যুক্তি বলে ডাকা হয়েছে – তারই অনুরূপ। ধর্মীয় যুক্তির বুনিয়াদ মহাবৈশ্বয়িক প্রকৃতির সারল্যে অবস্থিত। অর্থাৎ মানুষ তার অধিকারে থাকা যোগ্যতা-শক্তি-মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে যতদূর পৌঁছুতে পারে অথবা বর্তমান মহা-বিশ্ব যুক্তির সীমানা যতটুকু টেনে নিতে অনুমতি দেয়, ধর্ম এর সবটাই অবলম্বন করে আছে প্রথম দিন থেকেই। তবে বিগত শতাব্দীগুলোতে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ হিসেবে যাদের উত্থান ঘটেছে এ বাস্তবতাটি না বুঝে তারা এমন জমিনের ওপর দাঁড়াতে চেয়েছেন যার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। ফলে ধর্ম তার বিশালতা ঠিকই বজায় রাখলো, পক্ষান্তরে মানুষের দাবি ঘুমুতে গেল ইতিহাসের আর্কাইভে। আধুনিক ইতিহাসের এ-ঘটনা মনুষ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মীয় বা ওহী নির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিনাশী অবস্থাকে নির্দেশ করছে। ধর্মীয় জ্ঞানের সত্যতাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডের আলোকে করে দিচ্ছে প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত। [গবেষণাপত্র- আল্লাহর অস্তিত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান। গবেষক- ড. শামসুল হক সিদ্দিক]
আল্লাহর জাতি-সিফাতি নাম ও আমাদের বিশ্বাস : আল্লাহ সোবহানাহু তাআলা গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। মহান সে আল্লাহর রয়েছে অসংখ্য সিফাতি বা গুণবাচক নাম। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সিফাত ও নাম অগণিত। প্রচলিত আছে, আল্লাহ তাআলার নামের সংখ্যা তিন হাজার। ফেরেশতাদের (আ.) জ্ঞানে আছে এক হাজার নাম, নবী-রাসূলদের জ্ঞানে ছিল এক হাজার নাম, ঐশীগ্রন্থ চার কিতাবের মধ্যে তাওরাতে ছিল তিনশ, জবুরে তিনশ এবং ইঞ্জিলে ছিল আল্লাহর তিনশ নাম।
আলিমদের কাছে উপরোক্ত হিসাবটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছি। তাঁরা বলেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার তিন হাজার নামের এই হিসাবের কোনো দলিল নেই। তবে হাদিস শরিফে মহান আল্লাহর ৯৯টি সিফাতি নাম রয়েছে। আবার ‘আল্লাহ’ও আল্লাহ তাআলার একটি নাম। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজেই বলেছেন, তাঁর নাম আল্লাহ। সে হিসেবে উপরোক্ত ৯৯টি নামসহ মহান আল্লাহর গুণবাচক নাম ১০০টি। এর বাইরেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার আরো অনেক সিফাতি নামের উল্লেখ পাই। যেমন- ইয়া সাত্তারু, ইয়া হান্নানু, ইয়া মান্নানু, ইয়া মুজিরু ইত্যাদি। এসব নাম আল্লাহর ৯৯ সিফাতি নামের তালিকার বাইরেই আছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, মহান আল্লাহ তাআলার রয়েছে অসংখ্য সিফাতি বা গুণবাচক নাম।
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কোরআনে তাঁর সিফাতি বা গুণবাচক নাম প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে; যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদের বর্জন করবে; শিগগিরই তাদের কৃতকর্মের ফল দেওয়া হবে। [সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮০]
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম কোরআন তাফসিরকারীদের অন্যতম আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, উত্তম নামগুলো শ্রেষ্ঠতম গুণাবলি যথা- সর্বময় জ্ঞান, সর্বময় শক্তি ও ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি আল্লাহরই; তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে; যারা তাঁর নাম বিকৃত করে, তাঁর নাম ও গুণাবলিকে অস্বীকার করে; অপর ব্যাখ্যায় তাঁর নামের সঙ্গে লাত, মানাত ও উজ্জার সাদৃশ্য সৃষ্টি করে, তাদের বর্জন করবে, দুনিয়ায় তাদের কৃতকর্মের সব খারাপ কাজ ও কথার ফল তাদের আখিরাতে দেওয়া হবে। [আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ‘তাফসিরে ইবন আব্বাস’, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ২০০৪, পৃষ্ঠা ৪৭৮]।
বিশ্বে পবিত্র কোরআনের আধুনিক তাফসিরকারদের অন্যতম মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি সুরা আরাফের এই ১৮০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার নামগুলোর ব্যাপারে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত কোনো নাম দ্বারাই আল্লাহ তাআলার জিকির ও তাঁর কাছে দোয়া করা চাই। নিজের পক্ষ থেকে তাঁর জন্য কোনো নাম তৈরি করে নেওয়া ঠিক নয়। কাফেরদের মনে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল, তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ কিংবা ভ্রান্ত ও তাদের ভাবনা অনুসারে আল্লাহ তাআলার জন্য কোনো নাম বা বিশেষণ স্থির করে নিয়েছিল। এ আয়াত সতর্ক করছে যে তাদের অনুসরণে সেই সব নাম বা বিশেষণ আল্লাহ তাআলার প্রতি আরোপ করা জায়েজ নয়। সুতরাং মুসলিমদের এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। [মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি : তাফসিরে তাওজিহুল কোরআন, মাকতাবুল আশরাফি প্রকাশনী, ঢাকা-২০১০, পৃষ্ঠা ৪৭৪]।
পবিত্র কোরআনের সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা যায়, মহান আল্লাহর সিফাতি বা গুণবাচক নামগুলোতে রয়েছে এমন সব শব্দ, যা একমাত্র তাঁরই মহত্ত্বের, বড়ত্বের ও একত্বের উপযোগী। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম তাঁদের সংকলিত হাদিসে বর্ণনা করেন যে আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলোকে আয়ত্ত করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুফতী মুহাম্মদ শফী [রহ.], পবিত্র কোরআনুল করিম, বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির, অনুবাদ- মাওলানা মুহিউদ্দীন খান], খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মক্কা-মদিনা, ১৪১৩ হিজরি, পৃষ্ঠা ৫০৫]।
হাদিসটিতে উল্লিখিত ‘আয়ত্ত’ শব্দের আরেকটি ব্যাখ্যা দেখি অন্য কিতাবে। সেখানে বলা হয়েছে, আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ভালোভাবে আল্লাহ তাআলার নামগুলো মুখস্থ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মাওলানা সাআদ, মুন্তাখাব হাদিস, দারুল কিতাব, ঢাকা-২০০২, পৃষ্ঠা ৭২]।
‘আয়ত্ত’ শব্দের পরিবর্তে এখানে ‘মুখস্থ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে এর মর্যাদা আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর সুন্দরতম নামের নিয়মিত চর্চার ওপরই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে। আর এতে আল্লাহর সিফাতি নামগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ জন্য যে তা যেন কখনোই বিকৃত না হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জমানাতেই বিকৃতির ঘটনাগুলো ঘটেছিল। কাফেররা দাবি করছিল যে তাদের সৃষ্ট দেবতাগুলো ‘লাত’, ‘উজ্জা’, ‘মানাত’ প্রভৃতি আল্লাহর নামেরই অংশ। তাদের দাবি ছিল, ‘লাত’ নামটি এসেছে ‘আল্লাহ’ থেকেই, ‘উজ্জা’ এসেছে ‘আজিজ’ থেকে। এমন সব যুক্তি তারা প্রদর্শন করছিল। এ বিষয়েই নবী (সা.)-এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার সুন্দরতম নামের ব্যবহার সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করা হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমানকালে বিভিন্ন অমুসলিমের লেখা গ্রন্থে, কিছু encyclopedia-তে কাফের-মুশরিকদের এ ধারণাকেই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ইসলাম-পূর্ব দেব-দেবীদের নামগুলো আল্লাহর সিফাতি নাম থেকেই এসেছে (নাউজুবিল্লাহ)। কিন্তু এগুলোকে শুধু অজ্ঞানতা বলেই শেষ করা যাবে না; বরং এসব ধারণাই খুব বেশি করে তাদের মূর্খতাকে প্রকাশ করে। কারণ ‘লাত’, ‘উজ্জা, ‘মানাত’ প্রভৃতি শব্দ মূলত আরবি হলেও এদের অনেক নাম অনারবি ভাষারও রয়েছে; কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার সিফাতি নামের শব্দগুলো আরবি ভাষার। এগুলো পবিত্র কোরআনেরই বিভিন্ন আয়াতে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব ও একত্ব বোঝাতে। [সাক্ষাৎকার : মুফতি মাহমুদুল আমীন, পরিচালক মাহাছুল বহসিল ইসলামিয়া, বসিলা, মোহাম্মদপু, ঢাকা। ]
সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতে আসমায়ে হুসনা বা উত্তম নাম বলতে যেসব নামকে বোঝানো হয়েছে, সেসব নাম গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে সর্বোচ্চ স্তরের এবং তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্যই নির্দিষ্ট রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্য লাভ করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সে মাটি বা পাথরের তৈরি তথাকথিত দেব-দেবীর পক্ষে তো নয়ই, জিন বা মানুষ, এমনকি ফেরেশতাদের পক্ষেও সম্ভব নয়।
মুফতী শফী (রহ.) লিখেছেন, আল্লাহকে ডাকার জন্য মানুষ এমন মুক্ত নয়, যেকোনো শব্দে ইচ্ছা ডাকতে থাকবে; বরং আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা দয়া করে তাঁকে ডাকার জন্য নানা রকম সিফাতি নামের শব্দও মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আর মানুষ সেসব শব্দ দ্বারাই আল্লাহকে ডাকতে বাধ্য, মানুষ ইচ্ছা মতো আল্লাহর গুণবাচক নামের শব্দ পরিবর্তন করতে পারে না। আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সব দিক লক্ষ রেখে তাঁর মহত্ত্বের উপযোগী শব্দ চয়ন করতে পারা মানুষের সাধ্যের ঊর্ধ্বে।
শাফী (রহ.) আরো লিখেছেন, আল্লাহকে সে নামেই ডাকতে হবে, যা আল্লাহ তাআলার নাম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর শব্দের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। এ জন্য তিনি সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষের অনুবাদ করেছেন এভাবে, আর তাদের বর্জন করো, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে।
বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ অংশের প্রথম অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন এই অংশের অনুবাদ করেছেন এভাবে, যাহারা তাঁহার নামেতে কুটিলতা করে, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করো। [গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআন শরিফ, বিশ্বসাহিত্য ভবন সংস্করণ, ঢাকা-২০০৪, পৃষ্ঠা ২০২]।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আল-কুরআনুল করীম অনুবাদ করেছে, যাহারা তাঁহার নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করিবে। [আল কুরআনুল করীম : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা [গ্রন্থ প্রকাশ ১৯৬৮], ৪৩তম সংস্করণ ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৫৯]
এসব অনুবাদের পারস্পরিক তুলনা করলে গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদটিতে রাসূল (সা.)-এর আমলের এ নিয়ে সমস্যাটি অনুধাবন করা যায়। অন্যদের থেকে পৃথক করে গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যাহারা কুটিলতা করে। অন্যরা যেখানে অনুবাদ করেছেন ‘বিকৃত করে’, অথবা ‘বাঁকা করে’। প্রকৃতপক্ষে, কাফের-মুশরিকরা আল্লাহর নাম নিয়ে কুটিলতারই আশ্রয় নিয়েছিল, তারা বলতেছিল, তাদের দেব-দেবীর নামগুলো আল্লাহর নাম থেকেই এসেছে। এ হলো কুটিলতা- বক্র, বাঁকা বা বিকৃত নয়।
মহান আল্লাহর নাম ব্যবহারের ওপর আলিমদের ফতোয়াও রয়েছে। তাঁরা বলেছেন, আল্লাহর যেকোনো নাম যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, আল্লাহকে ‘কারিম’ বলা যাবে; কিন্তু ‘সখী’ বলা যাবে না। ‘নূর’ বলা যাবে, ‘জ্যোতি’ বলা যাবে না। ‘শাফী’ বলা যাবে; কিন্তু ‘চিকিৎসক’ বলা যাবে না। কারণ হিসেবে আলিমরা বলছেন, দ্বিতীয় শব্দগুলো প্রথম শব্দের সমার্থক হলেও তা কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়নি। [মুফতী শফী (রহ.), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫]।
আলিমদের ফতোয়ায় আল্লাহর নামে নাম রাখা বিষয়েও মন্তব্য রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আসমায়ে হুসনাগুলোর মধ্যে কিছু নাম এমনও আছে, যেগুলো স্বয়ং কোরআন ও হাদিসে অন্যান্য লোকের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। আর কিছু নাম রয়েছে, সেগুলো শুধু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যবহার করার কোনো প্রমাণ কোরআন-হাদিসে নেই। যেসব নাম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, সেসব নাম অন্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- রহিম, রাশিদ, আলী, কারিম, আজিজ প্রভৃতি। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যেসব নামের ব্যবহার কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এগুলো ব্যবহার করাই ‘ইলহাদ’ তথা বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত এবং নাজায়েজ ও হারাম। যেমন- রহ্মান, সুবহান, রাজজাক, খালেক, গাফফার, কুদ্দুস প্রভৃতি। [মুফতী শফী (রহ.) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫-৫০৬]।
মহান আল্লাহর নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আলিমদের মতামত ও নির্দেশনার উপরোক্ত বর্ণনাটি আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছেছে। মুসলিমদের করণীয় হলো, কোরআন, হাদিস, শরিয়াহ [ইসলামী অনুশাসন] বিষয়ে আলিমদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি দৃঢ় থাকা। প্রশ্ন থাকলে আলিমদের কাছে গিয়ে তা নিরসন করা। আলিম মানে সত্যনিষ্ঠ আলিম।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম ও অর্থবোধক এসব নাম নিয়ে দোয়া করার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষ প্রতিনিয়ত নানা রকম কষ্ট-ক্লেশ, পেরেশানি, দুশ্চিন্তা ও জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তখন সে আশ্রয় নেবে আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, সে ছায়া পড়ে আছে আল্লাহর নানা সিফাতি বা গুণবাচক নামের তাৎপর্যের মধ্যে। [ দৈনিক কালের কণ্ঠ ধর্ম পাতায় প্রকাশিত ড. মোহাম্মদ হান্নান রচিত গবেষনা প্রবন্ধ আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামের ইতিবৃত্ত]
‘আল্লাহ’ শব্দটি সৃষ্টিকর্তার ‘ইসমে যাত’ বা সত্তাবচক নাম। আল্লামা তাফতাযানি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ’ শব্দটি ঐ চিরন্তন সত্তার নাম যার অস্তিত্ব অবশ্যাম্ভাবী এবং যিনি সমস্ত প্রশংসনীয় ও উত্তম গুণের অধিকারী। [শরহে তাহযীব, ২য় খন্ড]
‘আল্লাহ’ শব্দটি ইলাহুন শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ উপাস্য বা মাবুদ। আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ইসলামের মৌলিক ভিক্তি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সঠিক জ্ঞান থাকা প্রতিটি মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই। আল্লাহ নামের কোনো বহুবচন হয়না। আরবি ভাষায় ‘আল্লাহ’ শব্দের হুবহু অর্থজ্ঞাপক আর কোনো শব্দ নেই। তিনি অনাদি, অনন্ত । [বুক অব ইসলামিক নলেজ, ইকবাল কবীর মোহন]
আল্লাহর পরিচয় : আল্লাহর সমকক্ষ মর্যাদায় মর্যাদাবান আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে তিনি একক, অনন্য। তার সমকক্ষ ও সমতুল্য কেউ নেই এবং থাকতে পারে না। তিনি তার সত্তা, গুণাবলি ও কার্যাবলির ব্যাপারে এক কথায় সর্বদিক থেকে একক, অনন্য ও অদ্বিতীয়। তাই তিনি শিরক থেকে যেমন পবিত্র, তেমনি মুক্ত ও পবিত্র সৃষ্টির সাথে যাবতীয় সাদৃশ্যতা থেকে। বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল ওজুদ)। যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর সাথে সাদৃশ্য থেকে তিনি পবিত্র। মোটকথা, গোটা সৃষ্টিজগতের কেউ কোনো দিক থেকে তাঁর মতো নয়। তাঁর সাথে কারোই যেমন কোনো প্রকার তুলনা হয় না, তদ্রুপ কোনো কিছুর সাথে তাঁরও সামান্যতম তুলনা বা সাদৃশ্য নেই। আল্লাহ তাআল আহাদ তথা একক ও অনন্য হওয়ার প্রকৃত অর্থ এটাই। তাঁর সম্পর্কে এরূপ আকিদা বিশ্বাস পোষণ করাকেই ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় তাওহীদ। আর এটাই ইসলামের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। আল্লাহ কোনো বস্তু নন এবং তাঁর গুণরাজি শুধু তাঁরই জন্য। তাঁর কোনো গুণই অপর কারো মধ্যে কল্পনা করা যায় না। [ইসলাম প্রচার ব্যুরো প্রকাশিত গবেষণাপ্রবন্ধ- আল্লাহর পরিচয়, লেখক-গবেষক- হাফেজ নেছার উদ্দীন]
পবিত্র কোরআনে আল্লাহর পরিচয় : তিনি কোরআনে নিজ পরিচয় দিয়েছেন এভাবে—
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ.
আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তার কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে বা পিছনে যা কিছু রয়েছে, তিনি তার সবই জানেন। তাঁর জ্ঞান-সীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না-তবে যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর আসন (সার্বভৌম ক্ষমতা) সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনি সর্বোচ্চ ও সর্বাপেক্ষা মহান। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৪]
তিনি আরও বলেছেন—
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴾ الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ ﴾ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ ﴾ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ.
পুণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব বা সর্বময় ক্ষমতা। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান, যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমতাময়। তিনি সপ্তম আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোনো ভ্রান্তি দেখতে পাও কি ? অতপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে। [সূরা মুলক, আয়াত ১-৪]
এছাড়া পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। [সূরা ইখলাস, ১-৪]
হাদিসের আলোকে আল্লাহর পরিচয় : রাসূলকে (সা.) হজরত আবূ যর (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি তাঁর রব্বকে দেখেছেন কিনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জবাবে বলেছেন, আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পারি? আমি তো একটি নূর দেখেছি মাত্র। [মুসলিম ও বুখারী]।
আল্লাহ কোথায় আছেন বা কেথায় থাকেন? এমন একটা প্রশ্ন আমাদের মনে অনেক সময়ই ঘুরপাক খায়। আল্লাহ আমাদের প্রভু, আমাদের একমাত্র প্রতিপালক। আমাদের সবচেয়ে আপনজন তিনি। আমরা তারই ইবাদত করি । তিনি কোথায় আছেন, কোথায় থাকেন তিনি, সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখা তার একজন বান্দা হিসেবেই আমাদের জন্য জরুরি বৈকি। বান্দা যার বন্দেগি করে, তার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জানাশোনা না থাকলে তার বন্দেগিতে সংশয় থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
কোরআন কী বলে : আল্লাহ কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন- পরম করুণাময় আরশের উপর সমাসীন আছেন। [সুরা তাহা, আয়াত ৫]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে আছেন। [সুরা আনআম, আয়াত ৩]
আয়াত থেকে জানা যায়, আল্লাহ আসমানে আছেন। তার আরশ আসমানে। কোরআনে এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়লার ‘কুরসি’, যেখানে তিনি সমাসীন আছেন, তা আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত । আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, এর সমর্থনে আরো একটি আয়াত পাওয়া যায়, সুরা নাহলে আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন, তারা তাদের উপরের প্রতিপালককে ভয় করে । [সূরা নাহল, আয়াত ৫০]
হাদিস কী বলে : হাদিসের দিকে তাকালেও দেখবো, আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসূলের (সা.) অনেক বাণী ও সাহাবীদের উক্তি থেকেও । রাসূলকে (সা.) আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলেন মেরাজের উদ্দেশ্যে। সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। [বুখারী ও মুসলিম]
এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তবে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। [তিরমিযি]
রাসূল (সা.) একবার এক ক্রীতদাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বললো, আসমানে। তারপর তিনি বললেন, বলতো আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। রাসূল (সা.) বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা । [মুসলিম]
সাহাবিদের বক্তব্য : রাসূলের (সা.) সাহাবিরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করতেন । হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপরে জীবিত আছেন, কখনোই মৃত হবেন না। [সুনানে দারেমি]
ইমামদের অভিমত : আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে (রহ.) আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে আলাদা হয়ে। অর্থাৎ তার এই উপরে থাকা সৃষ্টির থাকার মতো নয়। চার মাযহাবের ইমামগণও এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, তাফসিরকারকগণ এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, জাহমিয়ারা আল্লাহ সম্বন্ধে বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের এ জাতীয় কথা থেকে পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। আর আয়াতের ব্যখ্যা হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা । এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই প্রমাণ বহন করে । [তাফসিরে জালালাইন, ইবনে কাসির]
ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর উক্তি : ইমাম আবু হানীফাহ (রহ.) বলেন,
«من قال: لا أعرف ربي في السماء أو في الأرض فقد كفر، وكذا من قال: إنه على العرش ولا أدري العرش أفي السماء أو في الأرض، والله تعالى يُدعى من أعلى لا من أسفل» [الفقه الأكبر 1135]
যে ব্যক্তি বলবে, আমি জানি না, আমার রব আসমানে না জমিনে – সে কাফির। অনুরূপ (সেও কাফির) যে বলবে, তিনি আরশে আছেন, তবে আমি জানি না, ‘আরশ আসমানে না জমিনে। [আল ফিকহুল আকবার: ১/১৩৫]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর উক্তি : তার ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া বলেন, একদা আমরা ইমাম মালিক ইবন আনাস (রহ.) এর কাছে বসা ছিলাম, এমন সময় তার কাছে এক লোক এসে বলল,
«يا أبا عبد الله، [الرحمن على العرش استوى]، كيف استوى؟ قال: فأطرق مالك رأسه، حتى علاه الرحضاء، ثم قال: الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة، وما أراك إلا مبتدعاً، فأمر به أن يخرج. وفي رواية: الاستواء معلوم والكيف غير معلوم، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة. [الاعتقاد للبيهقي [1/67]، حاشية السندي على ابن ماجه [1/167]، حاشية السندي على النسائي [6/38]، مرقاة المفاتيح شرح مشكاة المصابيح [2/17، و13/89]
হে আবু আব্দুল্লাহ! (মহান আল্লাহ বলেন) রহমান (পরম দয়াময় আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন [সূরা ত্বাহা: ২০:৫]। এই উপরে উঠা কীভাবে? এর রূপ ও ধরণ কেমন? প্রশ্নটি শোনামাত্র ইমাম মালিক (রহ.) মাথা নীচু করলেন, এমনকি তিনি ঘর্মাক্ত হলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ইসতিওয়া শব্দটির অর্থ (উপরে উঠা) সকলের জানা, কিন্তু এর ধরণ বা রূপ অজানা, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বিদআত। আর আমি তোমাকে বিদআতী ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। অতঃপর তিনি (রহ.) তাকে মজলিস থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। [ইতিকাদ লিল বাইহাকী ১/৬৭, হাশিয়াতুস সিন্ধী আলা ইবনি মাজাহ ১/১৬৭, মিরকাতুল মাফাতীহ ২/১৭, ১৩/৮৯]।
ইমাম শাফিঈ (রহ.)-এর উক্তি : তিনি বলেন,
«وأن الله على عرشه في سمائه» تهذيب سنن أبي داود، وإيضاح مشكلاته [2/406].
আর নিশ্চয় আল্লাহ আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপর উঠেছেন। [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (রহ.)-এর উক্তি : মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আল-কাইসী বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করলাম,
«يُحكى عن ابن المبارك أنه قيل له: كيف يُعرف ربنا؟ قال: في السماء السابعة على عرشه، قال أحمد: هكذا هو عندنا» تهذيب سنن أبي داود وإيضاح مشكلاته [2/406].
এ মর্মে ইবনুল মুবারাক (রহ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, আমাদের রবের পরিচয় কীভাবে জানবো? উত্তরে তিনি বললেন, সাত আসমানের উপর আরশে। (এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?) ইমাম আহমাদ (রহ.) বললেন, বিষয়টি আমাদের নিকট এ রকমই। [তাহযীবু সুনানে আবী দাউদ ২/৪০৬]
উল্লিখিত দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা মহান আল্লাহ তাআলার আসমানে বা আরশে অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। [ইসলামি আকিদা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর, মূল : শাইখ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী, শাইখ মুহাম্মাদ আবদুন নূর মাদানী, অনুবাদ ও সম্পাদনা- ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, প্রকাশ : ইসলাম হাউজ ডট কম]
সুতরাং সুস্থ বিবেকও বলে যে, আল্লাহ যদি তিনি সর্বত্রই বিরাজমান থাকেন তার সত্তাগতভাবে। সুতরাং এটাই সত্য যে, তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তার দেখা, শোনা ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত আছেন।
বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব : আবিষ্কার-উদ্ভাবন আবিষ্কারক-উদ্ভাবক এর অস্তিত্বের সত্যতা বিষয়ে ধারণা দেয়, বিশ্বাস জন্মায়। কোনো ঘটনা তার সংঘটকের-সম্পাদকের অস্তিত্বের প্রতি নির্দেশ করে শতসিদ্ধভাবে। সরল প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদ বলা যেতে পারে উল্লিখিত ধরনের প্রমাণ প্রক্রিয়াকে। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কী? প্রাচীন আরবের জনৈক বেদুইন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেছেন এ ধরনের প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদের সারল্যে। তিনি বললেন, উটের বর্জ্য উটের অস্তিত্বের প্রমাণ। গাধার বর্জ্য গাধার অস্তিত্বের দলিল। পদচিহ্ন, হেঁটে যাওয়ার প্রমাণ। অতঃপর, কক্ষপথসম্পন্ন আকাশ, পথঘাটবিশিষ্ট জমিন, তরঙ্গসর্বস্ব সাগর প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। [দ্রঃ আস সায়াদাহ আল আবাদিয়াহ ফিশ শারিয়াহ আল ইসলামিয়াহ : ৪২ ]
বোধ যাদের স্বচ্ছ, বুদ্ধি যাদের উন্মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর এ প্রমাণটি তাদের কাছে স্পষ্ট -অকাট্য। তবে দর্শনের পাঁক সৃষ্টিতে যারা অভ্যস্ত এ প্রমাণ তাদের পরীক্ষায় অপর্যাপ্ত। তাদের বক্তব্য, এ প্রমাণটি প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। তার মানে কিছু আলামত- ইঙ্গিতের নির্ভরতায় ধরে নেয়া হয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্বের একটা বাস্তবতা আছে।
এ প্রশ্নটি খুবই জোরালো মনে হতো আগেকার যুগে। কেননা মহাবিশ্ব, মানুষের জ্ঞানের-উপলব্ধির বলয়ে, সরাসরি ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমানায় আসার মতো একটি বিষয় বলে ধারণা করা হতো। প্রাচীন ধারণা মতে প্রতিটি জিনিসের সর্বশেষ বিশ্লিষ্ট রূপের একক হলো পরমাণু -এটম। এমনকি নিউটনের কাছেও —আলো— ছোট ছোট পরমাণুর সমন্বয়ের নাম ছিল যা আলোকিত বস্তু থেকে বের হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে যেতো। এ-তত্ত্বটিকে corpuscles theory of light বলে ডাকা হয়েছে।
যতদিন মানুষের অধ্যয়ন ও গবেষণার পদচারণা Microcosmic level – এ সীমিত ছিল ততদিন এ-তত্ত্বও চলেছে বীরদর্পে । কিন্তু, যেই মানুষের জ্ঞান এই ভাসমান স্তর অতিক্রম করে অতিক্ষুদ্র মহাজাগতিক স্তরে [Microcosmic level] প্রবেশ করার অধিকার পেল অমনি উল্টাপাল্টা হয়ে গেল সবকিছুই। যে পরমাণুকে মনে করা হতো অখন্ড, ভাঙ্গন-বিরোধী সেই পরমাণু ভেঙ্গে খন্ডিত হয়ে চমক দেখাল সবাইকে। তার জায়গা দখল করল এমনসব তরঙ্গমালা [waves] যা না আসে প্রত্যক্ষের আওতায় না অনুগত হয় কোন মাপযন্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের এ-পরিবর্তন বিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারেই সৃষ্টি হয়। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি অথবা প্রমাণ-প্রক্রিয়ার মূলনীতিতেও ঘটে পরিবর্তন ।
মহাবিশ্বের কোনো কিছুরই সর্বশেষ প্রকৃতি সরাসরি জানা যায় না, এ-বিষয়টি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনো জিনিসের প্রভাব বা ফলাফল [effects ] দেখে ওই জিনিসটির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে বলে বিশ্বাস করে নেয়া, এতটুকুই শুধু মানুষের পক্ষে সম্ভব। আর এভাবেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা সরাসরি-যুক্তি-প্রক্রিয়ার যে ধারণা ইতোপূর্বে বদ্ধমূল ছিল , চিড় ধরল তার শক্ত দেয়ালে। বিজ্ঞানের স্বীকৃত বলয়েও মেনে নেয়া হলো, পরোক্ষ প্রমাণও একটি আইনসিদ্ধ- বৈধ-বৈজ্ঞানিক প্রমাণ।
তিনশ বছর পূর্বে মনে করা হতো- প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ এ-দু’প্রকার প্রমাণের যেকোনো একটিকে বেছে নেয়া ব্যতীত অন্যকোনো সুযোগ নেই আমাদের হাতে । প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই, তাই, কেবল বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু কাল। পরে জানা গেল ব্যাপারটা আসলে সে রকম নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ এ-দুয়ের মাঝে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো সুযোগই নেই, এ-ধারণা বিজ্ঞানের জগতে এখন আর প্রবাহিত নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার বলয়ে, পরোক্ষ প্রমাণ যুক্তিসিদ্ধ- বৈধ, এ- কথায় বিশ্বাস করাই হলো, বর্তমানে, বিজ্ঞানমনস্কতার আলামত।
আধুনিকযুগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলতে যা বুঝায়- যার ওপর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গোটা সৌধ দাঁড়িয়ে তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠিত পরোক্ষ প্রমাণের ভিতে।
এই নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের আলোকে উল্লিখিত আরব-বেদুইনের প্রদত্ত যুক্তি পরীক্ষা করে দেখলে বিজ্ঞানের দাঁড়িপাল্লায় শতভাগ যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ বলে মনে হবে। বিজ্ঞান প্রকৌশল ও যুক্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে তা উল্লিখিত ধরনের সরল-সহজ প্রমাণকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। বর্তমানে এ-দুয়ের মাঝে আর পার্থক্য থাকেনি।
পুরাতন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বলয়ে অসরাসরি হওয়াটাই পরোক্ষ প্রমাণের ত্রুটি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে খোদ বিজ্ঞানের কাছে বৈজ্ঞানিক ধারণা পেশ করার এটাই হলো যৌক্তিক বুনিয়াদ। মূলনীতির দৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল যুক্তি এযাবৎ যাকে ধর্মীয় যুক্তি বলে ডাকা হয়েছে – তারই অনুরূপ। ধর্মীয় যুক্তির বুনিয়াদ মহাবৈশ্বয়িক প্রকৃতির সারল্যে অবস্থিত। অর্থাৎ মানুষ তার অধিকারে থাকা যোগ্যতা-শক্তি-মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে যতদূর পৌঁছুতে পারে অথবা বর্তমান মহা-বিশ্ব যুক্তির সীমানা যতটুকু টেনে নিতে অনুমতি দেয়, ধর্ম এর সবটাই অবলম্বন করে আছে প্রথম দিন থেকেই। তবে বিগত শতাব্দীগুলোতে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ হিসেবে যাদের উত্থান ঘটেছে এ বাস্তবতাটি না বুঝে তারা এমন জমিনের ওপর দাঁড়াতে চেয়েছেন যার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। ফলে ধর্ম তার বিশালতা ঠিকই বজায় রাখলো, পক্ষান্তরে মানুষের দাবি ঘুমুতে গেল ইতিহাসের আর্কাইভে। আধুনিক ইতিহাসের এ-ঘটনা মনুষ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মীয় বা ওহী নির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিনাশী অবস্থাকে নির্দেশ করছে। ধর্মীয় জ্ঞানের সত্যতাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডের আলোকে করে দিচ্ছে প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত। [গবেষণাপত্র- আল্লাহর অস্তিত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান। গবেষক- ড. শামসুল হক সিদ্দিক]
আল্লাহর জাতি-সিফাতি নাম ও আমাদের বিশ্বাস : আল্লাহ সোবহানাহু তাআলা গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। মহান সে আল্লাহর রয়েছে অসংখ্য সিফাতি বা গুণবাচক নাম। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সিফাত ও নাম অগণিত। প্রচলিত আছে, আল্লাহ তাআলার নামের সংখ্যা তিন হাজার। ফেরেশতাদের (আ.) জ্ঞানে আছে এক হাজার নাম, নবী-রাসূলদের জ্ঞানে ছিল এক হাজার নাম, ঐশীগ্রন্থ চার কিতাবের মধ্যে তাওরাতে ছিল তিনশ, জবুরে তিনশ এবং ইঞ্জিলে ছিল আল্লাহর তিনশ নাম।
আলিমদের কাছে উপরোক্ত হিসাবটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছি। তাঁরা বলেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার তিন হাজার নামের এই হিসাবের কোনো দলিল নেই। তবে হাদিস শরিফে মহান আল্লাহর ৯৯টি সিফাতি নাম রয়েছে। আবার ‘আল্লাহ’ও আল্লাহ তাআলার একটি নাম। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজেই বলেছেন, তাঁর নাম আল্লাহ। সে হিসেবে উপরোক্ত ৯৯টি নামসহ মহান আল্লাহর গুণবাচক নাম ১০০টি। এর বাইরেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার আরো অনেক সিফাতি নামের উল্লেখ পাই। যেমন- ইয়া সাত্তারু, ইয়া হান্নানু, ইয়া মান্নানু, ইয়া মুজিরু ইত্যাদি। এসব নাম আল্লাহর ৯৯ সিফাতি নামের তালিকার বাইরেই আছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, মহান আল্লাহ তাআলার রয়েছে অসংখ্য সিফাতি বা গুণবাচক নাম।
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কোরআনে তাঁর সিফাতি বা গুণবাচক নাম প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে; যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদের বর্জন করবে; শিগগিরই তাদের কৃতকর্মের ফল দেওয়া হবে। [সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮০]
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম কোরআন তাফসিরকারীদের অন্যতম আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, উত্তম নামগুলো শ্রেষ্ঠতম গুণাবলি যথা- সর্বময় জ্ঞান, সর্বময় শক্তি ও ক্ষমতা, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি আল্লাহরই; তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে; যারা তাঁর নাম বিকৃত করে, তাঁর নাম ও গুণাবলিকে অস্বীকার করে; অপর ব্যাখ্যায় তাঁর নামের সঙ্গে লাত, মানাত ও উজ্জার সাদৃশ্য সৃষ্টি করে, তাদের বর্জন করবে, দুনিয়ায় তাদের কৃতকর্মের সব খারাপ কাজ ও কথার ফল তাদের আখিরাতে দেওয়া হবে। [আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ‘তাফসিরে ইবন আব্বাস’, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ২০০৪, পৃষ্ঠা ৪৭৮]।
বিশ্বে পবিত্র কোরআনের আধুনিক তাফসিরকারদের অন্যতম মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি সুরা আরাফের এই ১৮০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার নামগুলোর ব্যাপারে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত কোনো নাম দ্বারাই আল্লাহ তাআলার জিকির ও তাঁর কাছে দোয়া করা চাই। নিজের পক্ষ থেকে তাঁর জন্য কোনো নাম তৈরি করে নেওয়া ঠিক নয়। কাফেরদের মনে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল, তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ কিংবা ভ্রান্ত ও তাদের ভাবনা অনুসারে আল্লাহ তাআলার জন্য কোনো নাম বা বিশেষণ স্থির করে নিয়েছিল। এ আয়াত সতর্ক করছে যে তাদের অনুসরণে সেই সব নাম বা বিশেষণ আল্লাহ তাআলার প্রতি আরোপ করা জায়েজ নয়। সুতরাং মুসলিমদের এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। [মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি : তাফসিরে তাওজিহুল কোরআন, মাকতাবুল আশরাফি প্রকাশনী, ঢাকা-২০১০, পৃষ্ঠা ৪৭৪]।
পবিত্র কোরআনের সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা যায়, মহান আল্লাহর সিফাতি বা গুণবাচক নামগুলোতে রয়েছে এমন সব শব্দ, যা একমাত্র তাঁরই মহত্ত্বের, বড়ত্বের ও একত্বের উপযোগী। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম তাঁদের সংকলিত হাদিসে বর্ণনা করেন যে আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলোকে আয়ত্ত করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুফতী মুহাম্মদ শফী [রহ.], পবিত্র কোরআনুল করিম, বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির, অনুবাদ- মাওলানা মুহিউদ্দীন খান], খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মক্কা-মদিনা, ১৪১৩ হিজরি, পৃষ্ঠা ৫০৫]।
হাদিসটিতে উল্লিখিত ‘আয়ত্ত’ শব্দের আরেকটি ব্যাখ্যা দেখি অন্য কিতাবে। সেখানে বলা হয়েছে, আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলেপাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ভালোভাবে আল্লাহ তাআলার নামগুলো মুখস্থ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মাওলানা সাআদ, মুন্তাখাব হাদিস, দারুল কিতাব, ঢাকা-২০০২, পৃষ্ঠা ৭২]।
‘আয়ত্ত’ শব্দের পরিবর্তে এখানে ‘মুখস্থ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে এর মর্যাদা আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর সুন্দরতম নামের নিয়মিত চর্চার ওপরই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে। আর এতে আল্লাহর সিফাতি নামগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ জন্য যে তা যেন কখনোই বিকৃত না হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জমানাতেই বিকৃতির ঘটনাগুলো ঘটেছিল। কাফেররা দাবি করছিল যে তাদের সৃষ্ট দেবতাগুলো ‘লাত’, ‘উজ্জা’, ‘মানাত’ প্রভৃতি আল্লাহর নামেরই অংশ। তাদের দাবি ছিল, ‘লাত’ নামটি এসেছে ‘আল্লাহ’ থেকেই, ‘উজ্জা’ এসেছে ‘আজিজ’ থেকে। এমন সব যুক্তি তারা প্রদর্শন করছিল। এ বিষয়েই নবী (সা.)-এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার সুন্দরতম নামের ব্যবহার সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করা হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমানকালে বিভিন্ন অমুসলিমের লেখা গ্রন্থে, কিছু encyclopedia-তে কাফের-মুশরিকদের এ ধারণাকেই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ইসলাম-পূর্ব দেব-দেবীদের নামগুলো আল্লাহর সিফাতি নাম থেকেই এসেছে (নাউজুবিল্লাহ)। কিন্তু এগুলোকে শুধু অজ্ঞানতা বলেই শেষ করা যাবে না; বরং এসব ধারণাই খুব বেশি করে তাদের মূর্খতাকে প্রকাশ করে। কারণ ‘লাত’, ‘উজ্জা, ‘মানাত’ প্রভৃতি শব্দ মূলত আরবি হলেও এদের অনেক নাম অনারবি ভাষারও রয়েছে; কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার সিফাতি নামের শব্দগুলো আরবি ভাষার। এগুলো পবিত্র কোরআনেরই বিভিন্ন আয়াতে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব ও একত্ব বোঝাতে। [সাক্ষাৎকার : মুফতি মাহমুদুল আমীন, পরিচালক মাহাছুল বহসিল ইসলামিয়া, বসিলা, মোহাম্মদপু, ঢাকা। ]
সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতে আসমায়ে হুসনা বা উত্তম নাম বলতে যেসব নামকে বোঝানো হয়েছে, সেসব নাম গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে সর্বোচ্চ স্তরের এবং তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্যই নির্দিষ্ট রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্য লাভ করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সে মাটি বা পাথরের তৈরি তথাকথিত দেব-দেবীর পক্ষে তো নয়ই, জিন বা মানুষ, এমনকি ফেরেশতাদের পক্ষেও সম্ভব নয়।
মুফতী শফী (রহ.) লিখেছেন, আল্লাহকে ডাকার জন্য মানুষ এমন মুক্ত নয়, যেকোনো শব্দে ইচ্ছা ডাকতে থাকবে; বরং আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা দয়া করে তাঁকে ডাকার জন্য নানা রকম সিফাতি নামের শব্দও মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আর মানুষ সেসব শব্দ দ্বারাই আল্লাহকে ডাকতে বাধ্য, মানুষ ইচ্ছা মতো আল্লাহর গুণবাচক নামের শব্দ পরিবর্তন করতে পারে না। আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সব দিক লক্ষ রেখে তাঁর মহত্ত্বের উপযোগী শব্দ চয়ন করতে পারা মানুষের সাধ্যের ঊর্ধ্বে।
শাফী (রহ.) আরো লিখেছেন, আল্লাহকে সে নামেই ডাকতে হবে, যা আল্লাহ তাআলার নাম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর শব্দের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। এ জন্য তিনি সুরা আরাফের ১৮০ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষের অনুবাদ করেছেন এভাবে, আর তাদের বর্জন করো, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে।
বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ অংশের প্রথম অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন এই অংশের অনুবাদ করেছেন এভাবে, যাহারা তাঁহার নামেতে কুটিলতা করে, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করো। [গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআন শরিফ, বিশ্বসাহিত্য ভবন সংস্করণ, ঢাকা-২০০৪, পৃষ্ঠা ২০২]।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আল-কুরআনুল করীম অনুবাদ করেছে, যাহারা তাঁহার নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করিবে। [আল কুরআনুল করীম : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা [গ্রন্থ প্রকাশ ১৯৬৮], ৪৩তম সংস্করণ ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৫৯]
এসব অনুবাদের পারস্পরিক তুলনা করলে গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদটিতে রাসূল (সা.)-এর আমলের এ নিয়ে সমস্যাটি অনুধাবন করা যায়। অন্যদের থেকে পৃথক করে গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যাহারা কুটিলতা করে। অন্যরা যেখানে অনুবাদ করেছেন ‘বিকৃত করে’, অথবা ‘বাঁকা করে’। প্রকৃতপক্ষে, কাফের-মুশরিকরা আল্লাহর নাম নিয়ে কুটিলতারই আশ্রয় নিয়েছিল, তারা বলতেছিল, তাদের দেব-দেবীর নামগুলো আল্লাহর নাম থেকেই এসেছে। এ হলো কুটিলতা- বক্র, বাঁকা বা বিকৃত নয়।
মহান আল্লাহর নাম ব্যবহারের ওপর আলিমদের ফতোয়াও রয়েছে। তাঁরা বলেছেন, আল্লাহর যেকোনো নাম যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, আল্লাহকে ‘কারিম’ বলা যাবে; কিন্তু ‘সখী’ বলা যাবে না। ‘নূর’ বলা যাবে, ‘জ্যোতি’ বলা যাবে না। ‘শাফী’ বলা যাবে; কিন্তু ‘চিকিৎসক’ বলা যাবে না। কারণ হিসেবে আলিমরা বলছেন, দ্বিতীয় শব্দগুলো প্রথম শব্দের সমার্থক হলেও তা কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়নি। [মুফতী শফী (রহ.), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫]।
আলিমদের ফতোয়ায় আল্লাহর নামে নাম রাখা বিষয়েও মন্তব্য রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আসমায়ে হুসনাগুলোর মধ্যে কিছু নাম এমনও আছে, যেগুলো স্বয়ং কোরআন ও হাদিসে অন্যান্য লোকের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। আর কিছু নাম রয়েছে, সেগুলো শুধু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যবহার করার কোনো প্রমাণ কোরআন-হাদিসে নেই। যেসব নাম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, সেসব নাম অন্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- রহিম, রাশিদ, আলী, কারিম, আজিজ প্রভৃতি। পক্ষান্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যেসব নামের ব্যবহার কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এগুলো ব্যবহার করাই ‘ইলহাদ’ তথা বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত এবং নাজায়েজ ও হারাম। যেমন- রহ্মান, সুবহান, রাজজাক, খালেক, গাফফার, কুদ্দুস প্রভৃতি। [মুফতী শফী (রহ.) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫-৫০৬]।
মহান আল্লাহর নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আলিমদের মতামত ও নির্দেশনার উপরোক্ত বর্ণনাটি আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছেছে। মুসলিমদের করণীয় হলো, কোরআন, হাদিস, শরিয়াহ [ইসলামী অনুশাসন] বিষয়ে আলিমদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি দৃঢ় থাকা। প্রশ্ন থাকলে আলিমদের কাছে গিয়ে তা নিরসন করা। আলিম মানে সত্যনিষ্ঠ আলিম।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম ও অর্থবোধক এসব নাম নিয়ে দোয়া করার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। মানুষ প্রতিনিয়ত নানা রকম কষ্ট-ক্লেশ, পেরেশানি, দুশ্চিন্তা ও জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তখন সে আশ্রয় নেবে আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, সে ছায়া পড়ে আছে আল্লাহর নানা সিফাতি বা গুণবাচক নামের তাৎপর্যের মধ্যে। [ দৈনিক কালের কণ্ঠ ধর্ম পাতায় প্রকাশিত ড. মোহাম্মদ হান্নান রচিত গবেষনা প্রবন্ধ আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামের ইতিবৃত্ত]
No comments:
Post a Comment