Search This Blog

Tuesday, April 21, 2020

ইসলামি সহিহ প্রশ্নোত্তর (পর্ব-১)


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম 
ইসলামি সহিহ প্রশ্নোত্তর
(পর্ব-১)
(৮২টি প্রশ্নোত্তর)


(১) মহিলাদের দাওয়াত ও তালিমের কাজ করা এবং এ উদ্দেশ্যে তাদের নিজ বাড়ি ছেড়ে দূরে গমন করার বিধানঃ
প্রশ্ন: মেয়েরা যে বিভিন্ন হালকায় বসে তা কি জায়েজ? একজন বললেন যে, আয়েশা রা., খাদিজা রা. ওনারা কখনও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে দাওয়াত দিতেন না। অনেক সময় পাশের জেলা বা আশে-পাশে কোথাও মেয়েরা কি দাওয়াতি কাজের উদ্দেশ্যে যেতে পারে? এ ক্ষেত্রে কি মাহরাম সাথে থাকা আবশ্যক? দেখা যায়, যে এসব মেয়েলি প্রোগ্রামে ছেলে মানুষ থাকাতেও সমস্যা আর দূরত্বও তো একদিন একরাতেরও সমান নয়।
উত্তর:
পুরুষ-নারী প্রতিটি মানুষের জন্য দাওয়াতি কাজ করা ফরজ তার সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী। একজন নারীর দাওয়াতি কাজের সর্ব শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্রে হল তার পরিবার, সন্তান-সন্ততি। তাকে স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালন, তার ঘর গোছানো, সম্পদ হেফাজত, সন্তান-সন্ততিদের লালন-পালন ইত্যাদি নানা কাজে সময় দিতে হয়। এগুলো তার প্রধানতম দায়িত্ব।
সুতরাং এ সকল দায়িত্ব ফেলে দিয়ে দূর দূরান্তে তাকে দাওয়াতের কাজ করে বেড়াতে হবে- ইসলাম তাকে এ দায়িত্ব দেয় নি।
আনাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ”কোনো নারী যখন
১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে,
২. রমাদানের সিয়াম পালন করে,
৩. লজ্জা স্থানের হেফাজত করে ও
৪) স্বামীর আনুগত্য করে। তখন সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।” (মিশকাত, হা/৩২৫৪ সনদ হাসান)
শর্ত হল, শিরক-বিদআত মুক্ত আমল করতে হবে এবং মানুষের হক নষ্ট করা যাবে না।
এ কাজগুলো করলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে কেউ যদি উপরোক্ত কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পাদন করার পর স্বামী বা মাহরাম পুরুষ সহকারে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য দূরে কোথাও গমন করে তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই ইনশাআল্লাহ।
সে ইচ্ছে করলে সে নিজ বাড়িতেও দীনী তালিমের হালাকা করতে পারে সেখানে তার প্রতিবেশী মহিলারা অংশ গ্রহণ করবে। অথবা স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে বাড়ির আশে পাশে অন্য কোথাও তালিমি বৈঠক করতে পারে যদি এতে নিজের বাড়ির দায়িত্বে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় এবং ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকে।
তবে বর্তমান যুগে দেখা যায়, কিছু মহিলা স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ছাড়া একসাথে কয়েকজন মহিলা মিলে দাওয়াত, তালীম আর ইসলামী সংগঠনের নামে এক জেলা থেকে আরেক জেলা ছুটে বেড়াচ্ছেন অথচ অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বামীর অনুমতিরও প্রয়োজন অনুভব করে না! অথবা স্বামীকে একপ্রকার চাপে ফেলে অনুমতি দিতে বাধ্য করে!!
একাজগুলো অবশ্যই শরীয়ত অনুমোদন করে না।
তাই দাওয়াতি কাজে আগ্রহী মহিলাদের কর্তব্য হল, তারা নিজ স্বামী ও পরিবারের প্রতি আরও অধিক যত্নশীল হবেন। তারপর সাধ্যানুযায়ী দাওয়াতি কাজ করবেন।
বর্তমান যুগে ঘরে বসেই নানা ধরণের দাওয়াতি কাজের সুযোগ আছে। সেগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। আর দূরে কোথাও যেতে হলে (যদিও তা সফরের দূরত্ব নাও হয়) অবশ্যই স্বামী বা মাহরাম পুরুষ সহকারে যাবেন এবং সব ধরণের ফিতনা থেকে দুরে অবস্থান করবেন। কেননা, বর্তমান যুগে কারও অজানা নেই যে, একজন মহিলা তার বাড়ির বাইরে যাওয়টাই কতটা অনিরাপদ ও ফেতনার কারণ।
দাওয়াত ও তালিমের পূর্বে জ্ঞানার্জনের আবশ্যকতা:
তালীমের পূর্বে একজন পুরুষ/নারী যে বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতে চায় সে বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক। ইলম বা জ্ঞান ব্যতিরেকে তালিম করা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার শামিল।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“(হে নবী) আপনি বলে দিন: এই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীরা আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই সুস্পষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ।” (সূরা ইউনুস: ১০৮)
জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বুঝাতে ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুছেদ রচনা করেছেন ‘কথা এবং কাজের পূর্বে জ্ঞানার্জন করা’ অনুচ্ছেদ। এর পর তিনি এর প্রমাণে কুরআনের আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করেছেন।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে তালিমের নামে, দ্বীনের মেহনতের নামে বহু মানুষ সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছে; এমনকি দেশ ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশ ঘুরছে অথচ তার কাছে দ্বীনের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। সম্পূর্ণ অজ্ঞতা ও মূর্খতার উপর ভিত্তি করে এদের দাওয়াত ও তালিমের কাজ চলছে। এটি দ্বীনের জন্য মারাত্মক হুমকি। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমীন।
সুতরাং কোন মহিলা যদি দ্বীনের তালিমী বৈঠক করতে চায় বা দূর দূরান্তে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করতে চায় কিন্তু তার কাছে যদি দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকে তাহলে স্বামী বা মাহরাম পুরুষের অনুমতি থাকলেও তা বৈধ হবে না। কারণ ইলম হীন দাওয়াত যেমন নিজের পথভ্রষ্টতার কারণ তেমনি অন্যদেরও পথ ভ্রষ্টতার কারণ। আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে সুপথে পরিচালিত করুন এবং ভ্রষ্টতার কবল থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
(২) বিশ্বব্যাপী একসাথে রোযা শুরু এবং একসাথে ঈদ পালন: কতটুকু সঠিক?
প্রশ্ন : মতোবিরোধপূর্ণ মাসায়েলের ক্ষেত্রে কি যে কোনো একটা মানলেই হবে? যেমন: পৃথিবীর যে কোনো এক স্থানে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে সারাবিশ্বে এক দিনে রোযা শুরু করা বা ঈদ পালন করা কিংবা এলাকা ভিত্তিক চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে এসব ইবাদত করা। এ বিষয়ে সবার পক্ষেই হাদিস সহিহ সনদে বর্ণিত। তাহলে এ ক্ষেত্রে যেকোনো এক ভাবে করলেই কি যথেষ্ট হবে?
উত্তর:
বর্তমানে সারা বিশ্বে একই সাথে রোযা ও ঈদ পালনের বিষয়ে মুসলিমদের মাঝে মতভেদ ব্যাপকতা লাভ করেছে। হচ্ছে যথেষ্ট বিশৃঙ্খলা-যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
তবে এ মর্মে কথা হল, ইতিহাস সাক্ষী, কোন কালেই সারা বিশ্বে একই দিন রোযা বা ঈদ পালিত হয় নি। এটা সম্ভব নয়। বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমেও তা প্রমাণিত নয়।
১৪০১ হিজরী সালে মক্কা মুকাররমায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে OIC এর আল ফিকহ একাডেমি এবং সৌদি সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ সারা বিশ্বে একসাথে সিয়াম ও ঈদ পালনকে শরিয়ত, আকল, যুক্তি সব দিক দিয়ে অসম্ভব বলে মত প্রকাশ করেছে।
 (৩) প্রশ্ন: পৃথিবীতে মুসলমানরা সকলে একই দিনে রোযা রাখা, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা পালন করার ব্যাপারে একতাবদ্ধ নয় কেন?
উত্তর:
ডাঃ জাকির নায়েক বলেন, এই ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে। একদল বলেন, সারা বিশ্বের মুসলমানদের মক্কার সময় অনুসরণ করা উচিত। অন্য দলের আলেমগণ বলেন, এই সময়টি বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় সময়ে হওয়া উচিৎ।
আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
“রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর।” [বাকারা আয়াত ১৮৫]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ““তোমরা যখন নতুন চাঁদ দেখ তখন রোযা রাখ এবং নতুন চাঁদ দেখলে রোযা ভেঙ্গে ফেল।” [বুখারী, হাদিস নং ১৯০৭ ও ১৯০৯]
সুতরাং এই হাদিসটির উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন যে, সারা বিশ্বের সব জায়গা থেকে একই দিনে রমজানের চাঁদ দেখা অসম্ভব। সুতরাং মক্কার সময়টি সারা বিশ্বে একযোগে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, “ঐ দিন রোযা আরম্ভ হবে যেদিন সকলে রোযা রাখবে, রোযা ভাঙ্গতে হবে ঐ দিন যেদিন সবাই রোযা ভাঙ্গে আর কুরবানি করতে হবে ঐ দিন যে দিন সকলে কুরবানি করে।” [তিরমিযী, হাদিস নং ৬৯৭]
কুরআনে বলা হয়েছে যে, “আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত”
[বাকারাঃ ১৮৭]
কিন্তু সূর্যোদয় সারা বিশ্বে একই সময়ে হয় না বরং একেক দেশে একেক সময়ে হয়। সুতরাং রোযা পালনে স্থানীয় সময় অনুসরণ করতে হবে।
 (৪) সালাতে মাতৃভাষায় দুআ করার বিধানঃ
প্রশ্ন: সালাতে সেজদা অবস্থায় অধিক পরিমাণে দুআ করার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। প্রশ্ন হল, এ ক্ষেত্রে আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় দুআ করা জায়েয আছে কি?
উত্তর:
নামাযে অনারব ভাষায় দুআ করা যাবে কি না এ বিষয়ে আলেমদের মাঝে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন, জায়েয নাই। কেউ বলেছেন, জায়েয আছে। কেউ আবার যারা আরবি পারে না কেবল তাদের জন্য জায়েয বলেছেন। তবে সার্বিক বিচারে সর্বাধিক সঠিক মত হল, আরবি না জানলে নিজ ভাষাতেই দুনিয়া ও আখিরাতের যে কোন কল্যাণের জন্য দুয়া করা জায়েয রয়েছে। সর্ব শেষ মতটিকেই সউদী বড় আলেমগণ সমর্থন করেছেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম বলেছেন,
“সিজদা অবস্থায় বান্দা আপন প্রভুর সবচেয়ে অধিক নিকটতম হয়ে থাকে। সুতরাং (ঐ অবস্থায়) তোমরা বেশী-বেশী করে দুআ কর।” (মুসলিম, সহীহ ১/৩৫৮, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪৫৬নং)
ইবনে মাসউদের হাদিসে যখন তিনি তাশাহহুদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন বলেছিলেন :
“অত:পর তার কাছে যে দু’আ পছন্দনীয়, তা নির্বাচন করে দু’আ করবে।
 অন্য এক বর্ণনায় আছে,
” অতঃপর যা ইচ্ছা চেয়ে দু’আ করতে পারে।” (বুখারী হা/৮৩৫ ও মুসলিম হা/৪০২)
সুতরাং সেজদা অবস্থায় অথবা সালাম ফিরানোর পূর্বে দুনিয়া ও আখিরাতের মঙ্গল কামনা করে নিজের পছন্দমত যে কোন দু’আ করবে। পিতা-মাতা ও অন্যান্য মুসলমানের জন্য দু’আ করবে, নিজের বিভিন্ন সমস্যার জন্য দুআ করবে, স্ত্রী-পরিবারের জন্য দুআ করবে…।
মোটকথা, উপরোক্ত ক্ষেত্রে নিজের মত করে যত খুশি দুআ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ফরজ অথবা নফল নামাযে কোনই পার্থক্য নেই।
আরবিতে দুআ করার শর্ত করা হলে, হাদিসের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। কারণ পৃথিবীতে সব মানুষের ভাষা আরবি নয়। সুতরাং তাদের দ্বারা আরবিতে দুআ করা আদৌ সম্ভবপর নয়।
উল্লেখ্য যে, সেজদায় গিয়ে সেজদার তাসবীহগুলো আরবিতে পাঠ করার পর সর্ব প্রথম চেষ্টা করবে, হাদিস বা কুরআনে বর্ণিত আরবি ভাষায় দুআগুলো যথাসম্ভব পাঠ করার। তারপর নিজের সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়া মহান রবের দরবারে নিজের ভাষায় কাকুতি-মিনতি সহ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তুলে ধরে দুআ করবে। আল্লাহু আলাম।
(৫) আকিকার সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে কন্যা সন্তানের মাথার চুল মুণ্ডন করা কি বৈধ?
প্রশ্ন: নবজাতক কন্যা সন্তানের সপ্তম দিনে দিনে মাথার চুল মুণ্ডন করা জায়েয আছে কি? না কি এ বিধান কেবল ছেলে সন্তানের জন্য? এবং জন্মের সপ্তম দিনে মেয়ে সন্তানের মাথার চুল মুণ্ডন করার পর আর কখনো তা মুণ্ডন করা জায়েয নয়-এ কথা কি সঠিক?
উত্তর:
সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পিতামাতার জন্য তার আকিকা দেয়া সুন্নত মুআক্কাদা। কেননা, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
 ‘প্রত্যেক শিশুই তার আকিকার সাথে আবদ্ধ থাকে। জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে (আকিকার পশু) জবাই করা হবে এবং তার মাথার চুল মুণ্ডন করা হবে আর নাম রাখা হবে। [আবু দাউদ : ২৮৪০, মুসনাদ আহমদ : ২০০৯৫।]
এখন প্রশ্ন হল, মাথার মাথার চুল মুণ্ডন করা ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশু উভয়ের জন্যই কি সুন্নত না কি কেবল ছেলে শিশুর জন্য?
এ বিষয় সম্মানিত ইমামদের মাঝে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালিক সহ একদল আলেম বলেন, এ হাদিসটি সকল নবজাতক শিশুকে শামিল করবে সে ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক। অর্থাৎ পুত্র ও কন্যা উভয়ের জন্যই সপ্তম দিনে আকিকা করা এবং মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত। কেননা, আরবি ভাষায় যখন কেবল পুরুষ লিঙ্গ ব্যবহৃত হয় তখন তা দ্বারা পুরুষ ও মহিলা উভয় উদ্দেশ্য হয়। স্ত্রী লিঙ্গকে পৃথক করতে হলে আলাদা দলীল প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখানে এমন কোন দলীল নাই। সুতরাং পুত্র ও কন্যা উভয়ের উপর একই বিধান প্রযোজ্য হবে।
এ ছাড়াও তারা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা তাদের মতের পক্ষে দলীল দেন। হাদিসটি হল, ইমাম মালিক বর্ণনা করেন, জাফর বিন মুহাম্মদ থেকে- জাফর বর্ণনা করেন তার পিতা মুহাম্মদ থেকে। তিনি বলেন,
“ফাতিমা রা. তার তার দুই ছেলে হাসান ও হুসাইন এবং দুই মেয়ে যয়নব ও উম্মে কুলসুম এর (মাথার চুল মুণ্ডন করে) তাদের চুলের ওজন বরাবর রৌপ্য সদকা করেছেন।” (মুয়াত্তা মালিক। তবে মুরসাল হওয়ার কারণে হাদিসটি যঈফ)। এ মর্মে আরেকটি হাদিস আছে কিন্তু সেটাও মুনকাতি বা সনদ (বর্ণনা সূত্র) বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে যঈফ।
পক্ষান্তরে হাম্বলী মাযহাবের একটি মত হল, এ হাদিসটি কেবল ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য; মেয়েদের জন্য নয়। কেননা হাদীসে সাধারণভাবে মেয়েদের চুল মুণ্ডনে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সুতরাং তা এখানেও তা প্রযোজ্য হবে। এতে মেয়ের সৃষ্টিগত বিকৃতি সাধিত হয়।
তাই এ মতানুসারে মেয়েদের জন্য মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত নয় বরং সপ্তম দিনে সাধারণভাবে নবজাতক কন্যা সন্তানকে গোসল দিবে এবং তার শরীরে লেগে থাকা, রক্ত ও ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে কিন্তু মাথার চুল মুণ্ডন করবে না।
(বিন বায, উসাইমীন প্রমুখ আলেমগণ এ পক্ষেই মত দিয়েছেন।)
তবে দুটি মতের মধ্যে জুমহুর বা অধিকাংশ ইমামদের মতই অধিক নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ ৭ম দিনে আকিকার সময় ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত ইনশাআল্লাহ। কেননা হাদিসের ভাষা থেকে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই প্রমাণিত হয় এবং নবজাতক মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করার নিষেধের পক্ষে আলাদা কোন দলীল নাই।
অবশ্য কোন মহিলা যদি কোন মৃত্যুর প্রতি শোক প্রকাশার্থে মাথার চুল মুণ্ডন করে ফেলে তাহলে সর্বসম্মত ক্রমে তা হারাম। (কিন্তু তা নবজাতকের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।) হাদিসটি হল:
আবু বুরদাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: (তাঁর পিতা) আবু মূসা আশআরী (রাঃ) যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর (ঐ সময়) তাঁর মাথা তাঁর এক স্ত্রীর কোলে রাখা ছিল এবং সে চিৎকার ক’রে কান্না করতে লাগল। তিনি (অজ্ঞান থাকার কারণে) তাকে বাধা দিতে পারলেন না। সুতরাং যখন তিনি চেতনা ফিরে পেলেন, তখন বলে উঠলেন,
“আমি সেই মহিলা থেকে সম্পর্ক মুক্ত, যে মহিলা থেকে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কমুক্ত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেই মহিলা থেকে সম্পর্কমুক্ত হয়েছেন, যে শোকে উচ্চ স্বরে মাতম ক’রে কান্না করে, মাথা মুণ্ডন করে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।” (বুখারী ১২৯৬, মুসলিম ২৯৮)
আকিকার সময় ছাড়া অন্য সময় ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করার হুকুম:
আকিকা ব্যতিরেকে অন্য সময় একান্ত দরকার ছাড়া মেয়েদের চুল মুণ্ডন করা ঠিক নয়। তবে যদি রোগের চিকিৎসার জন্য মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রয়োজন হয় অথবা যদি প্রমাণিত হয় যে, চুল মুণ্ডন করলে মাথায় ভালোভাবে চুল গজাবে, চুল ঘন হবে, চুলের গোড়া শক্ত হবে ইত্যাদি তাহলে এ সব কারণে ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করা জায়েয রয়েছে। অন্যথায় মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডানো ঠিক নয়। কারণ, চুল থাকা মেয়েদের একটি সৃষ্টিগত সৌন্দর্য। সুতরাং তা বিকৃত করা যাবে না। তাছাড়া এতে করে ছেলেদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। আর ইসলামে মেয়েদের জন্য ছেলেদের সাদৃশ্য অবলম্বনের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিশাপ দিয়েছেন যেসব নারী পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং যেসব পুরুষ নারীদের বেশ ধারণ করে। [আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ,অনুচ্ছেদ: নারীদের পোশাক। সহীহ]
সুতরাং কোন অভিভাবক যদি একান্ত জরুরি দরকার ছাড়া ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করে তাহলে তারা গুনাহগার হবে। কেউ অজ্ঞতা বশত: এমনটি করে থাকলে তার তওবা করা কর্তব্য।
(৬) তালাক প্রাপ্তা মেয়ের অন্যত্র বিয়ে দিতে চাইলে বরপক্ষকে কি পূর্বের বিয়ে সম্পর্কে জানানো জরুরি?
প্রশ্ন: একটা মেয়ের আগে খোলা তালাক হয়েছিলো। বিয়েটা ছোট থাকতেই দেওয়া হয়েছিলো। সে বাবার বাড়িতেই থাকতো। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে তার খোলা তালাক নেয়া হয়। এখন মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে হলে কি বরপক্ষকে আগের কথাগুলো সব জানানো আবশ্যক?
উত্তর:
বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘মেয়েটির পূর্বে একবার বিয়ে হয়েছিলো’ এ কথা নিজ থেকে বর পক্ষকে জানানো জরুরি না হলেও ভবিষ্যৎ বিশৃঙ্খলা ও সমস্যা থেকে বাঁচার স্বার্থে বিষয়টি তাদের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করি- স্বচ্ছতা রক্ষা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। কেননা বিয়ের সময় যদি তা গোপন করা হয় এবং বরপক্ষকে বলা হয় যে, মেয়েটি কুমারী/অবিবাহিত কিন্তু বাস্তবে কুমারী/অবিবাহিত না হয় তাহলে তা প্রতারণা এবং মিথ্যা হিসেবে পরিগণিত হবে-যা এক দিকে গুনাহের কারণ হবে, অপর দিকে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে তাদের দাম্পত্য জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
সুতরাং ভবিষ্যতে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর যেন এ নিয়ে সমস্যা তৈরি না হয় তাই অগ্রিম মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে বরপক্ষকে জানানো ভালো।
উল্লেখ্য যে, ইসলামের বিধান হল, বিয়ের সময় বর যদি শর্ত করে যে, মেয়েকে কুমারী হতে হবে (যেমন: কাবিন নামায় যদি লেখা থাকে যে, “কনে কুমারী না কি বিবাহিত” তাহলে এটাই শর্ত হিসেবে পরিগণিত হবে।) কিন্তু বিয়ের পরে যদি প্রমাণিত হয় যে, মেয়েটি কুমারী নয় (বিবাহের মাধ্যমে হোক অথবা জিনার মাধ্যমে হোক) তাহলে শর্ত লঙ্ঘন হওয়ার কারণে স্বামীর অধিকার রয়েছে উক্ত স্ত্রীকে তালাক দেয়ার। আল্লাহু আলাম।
(৭) ফেসবুক-ইউটিউবে স্বামী-স্ত্রীর ভিডিও আপলোড করার বিধানঃ
প্রশ্ন: ফেসবুকে আজকাল দেখা যাচ্ছে, অনেক মুসলিম দম্পতি ফেসবুকে তাদের ভিডিও পোস্ট করে। সেখানে অবশ্য স্ত্রী পূর্ণ পর্দা অবস্থায় থাকে। হয়তো তারা এ জন্য যে এসব পোস্ট করে যে, মানুষ যেন বুঝতে পারে পর্দা করেও রোমান্স করা যায় এবং এ থেকে অন্যদের পর্দা করা বা নেক সঙ্গী নির্বাচন করার জন্য উৎসাহিত হয়। এখন প্রশ্ন হল, এ গুলো ভিডিও করে অনলাইনে পোস্ট করা কি বৈধ? আর যারা শেয়ার করছে তারা কি বৈধ কাজটা করছে?
উত্তর:
আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে ঘরে থাকতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর তোমাদের বাড়িতে তোমরা অবস্থান করবে, আর -মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না।“ (সূরা আহযাব: ৩৩)
হ্যাঁ, প্রয়োজনে একজন মহিলার জন্য পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে বাইরে যাওয়া জায়েয আছে। তাই বলে তাকে বোরকা পরিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে হাজার হাজার দর্শকের সমানে “প্রদর্শনী” বানানো জায়েয নাই। কারণ একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, বোরকা পরলেও একজন যুবতী মহিলার দেহের গঠন, সৌন্দর্য অনেকটা উপলব্ধি করা যায়। আর একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে বোরকা পরিয়ে তাদের দুষ্টুমি ও খুনসুটির ভিডিও ফেসবুক বা ইউটিউবে পাবলিকের উদ্দেশ্য ছড়িয়ে দেয় তখন সে যেন সকল দর্শকের জন্য তার স্ত্রীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা বা তার দেহের গঠন, সৌন্দর্য, হাসি, দুষ্টুমি ইত্যাদি মনে মনে উপভোগ করার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলো! লা হাওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কোনো পুরুষ এমনটি করতে পারে না। এটি নিতান্ত ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব।
তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটি,দুষ্টামি, রোমান্স ইত্যাদিগুলো জনসম্মুখ প্রকাশ করার বিষয় নয়। বরং এগুলো হতে হবে নিতান্ত গোপনে-লোকচক্ষুর আড়ালে।
সুতরাং এভাবে স্বামী-স্ত্রীর দুষ্টামি, হাসাহাসি, দৌড়াদৌড়ি, দোলনায় উঠা, একসাথে আইসক্রিম আর ফুচকা খাওয়ার ভিডিও আপলোড করা বা শেয়ার করা কোনটাই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয়। এসব ভিডিওর ফলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ফেতনায় পড়ে তাদের সুখের সংসার নষ্ট হতে পারে। তারা শিকার হতে পারে হিংসা, বদ নজর ও নানা ফেতনার। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন।
(৮) হায়েযের সর্বোচ্চ মেয়াদ কত দিনঃ
হায়েযের সর্বোচ্চ মেয়াদ কত দিন?
হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার আলামত কি?
হায়েয থেকে পবিত্রতা অর্জনের পর যদি হলুদাভ বা ময়লার মত স্রাব দেখা যায় তাহলে কী করণীয়?
প্রশ্ন: এক জায়গায় শুনেছি, হায়েযের নির্দিষ্ট সময় পার হলেই (৫,৭, ১০ দিন) সাদা স্রাব না বের হলেও (হলদে, বাদামি রঙ থাকলেও) নামাজ শুরু করে দিতে হবে। যেহেতু ওই নারীর নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গিয়েছে। আবার আরেক জায়গায় শুনলাম, সাদা স্রাব না বের হলে কোনো ভাবেই নামাজ শুরু করা যাবে না। তা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ২/৩ দিন বেশি হলেও-এমন কি ১৫ দিন পর্যন্তও হতে পারে। আসলে কোনটা সঠিক?
হায়েযের শেষ এর দিকে সাদা স্রাব বের হওয়ার পরে সাথে সাথেই হলদে স্রাব বের হলে তা কি হায়েয বলেই গণ্য হবে নাকি সাদা স্রাব বের হওয়ার কারণে তার সলাত শুরু করে দিতে হবে?
উত্তর:
প্রথমে আমাদের জানা উচিৎ হায়েযের সর্বোচ্চ মেয়াদ কত দিন। এর সর্বোচ্চ মেয়াদ কি ১৫ দিন না কি অন্য কোনো কিছু?
হায়েযের সর্বোচ্চ মেয়াদ কত দিন সে বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। যেমন:
একদল আলেম বলেন, হায়েয বা ঋতুস্রাবের রক্তের রং, গন্ধ বা ধরণ-প্রকৃতি সুপরিচিত। এটি সাধারণ রক্ত থেকে আলাদা। হায়েযের মেয়াদ বৃদ্ধি হতে পারে বিভিন্ন কারণে। যেমন: জন্মনিরোধক ঔষধ সেবন।
অতএব, কোন মহিলার ঋতুস্রাব যদি তার প্রতি মাসের নিয়মের বাইরেও অব্যাহত থাকে তাহলে যতদিন তা চলতে থাকে ততদিন তা ঋতুস্রাব হিসেবেই গণ্য হবে যত দিন তা বন্ধ না হয়। কেননা, ঋতুস্রাবের বিষয়টি খুবই ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও কুরআন-সুন্নায় এর মেয়াদ নির্ধারণ সম্পর্কে কোন বক্তব্য আসে নি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে হায়েয (ঋতুস্রাব) সম্পর্কে। বলে দাও, এটা অশুচি। কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তম রূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন।” (সূরা বাকারা: ২২)
মোটকথা, যতদিন এই হায়েয অব্যাহত থাকবে ততদিন হায়েযের বিধান প্রযোজ্য হবে। আর হায়েজের রক্ত না থাকলে তখন তার বিধানও প্রযোজ্য হবে না।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন (মজমু ফতোয়া ১৯/২৩৭)। আল্লামা উসাইমীন রহ. এ মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
তবে জুমহূর তথা অধিকাংশ বিদ্বানের মত হল, হায়েযের সর্বোচ্চ সময়সীমা ১৫ দিন। ১৫ দিন হয়ে গেলে গোসল করে পবিত্র হতে হবে যদিও রক্তস্রাব চলতেই থাকে। ঐ অবস্থায় প্রত্যেক ফরয সালাতের জন্যে আলাদাভাবে ওযু করবে। আর পোশাক থেকে ইস্তিহাযার রক্তের চিহ্ন ধুয়ে ফেলবে। তখন পনের দিনের পর নির্গত রক্তকে ইস্তেহাযা (রক্তপ্রদর) এর রক্ত বলা হবে।
এই মতকে গ্রহণ করেছেন সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রহ.।
১৫ দিন নির্দিষ্ট করার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহ থেকে কোনো দলিল না থাকলেও তারা মহিলাদের সাধারণ অবস্থা ও অভ্যাসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা বলেন, মহিলাদের ঋতুস্রাব ১৫ দিনের বেশি হয় না।
তবে ১৫ দিন নির্দিষ্ট করার পক্ষে দলিল না থাকায় ১ম অভিমতটিকে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. গ্রহণ করেছেন এবং শাইখ উসাইমীন রহ. এটিকে সমর্থন করেছেন। আর এটাই অধিক বিশুদ্ধ ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং কারো নিয়মিত ৫/৭/১০ দিন সময়-সীমার চেয়ে বেশি ১৫ দিন বা ততোধিক সময় ধরে যদি স্রাব অব্যাহত থাকে আর তা যদি অবিকল হায়েজের রক্তের অনুরূপ হয় তাহলে তা হায়েয হিসেবেই ধরতে হবে এবং সে সময় সালাত-সিয়াম থেকে বিরত থাকতে হবে।
 হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার আলামত:
হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার আলামত হল, যখন স্রাব সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা লজ্জা স্থান পরিপূর্ণভাবে শুষ্ক হয়ে যাওয়া অথবা বা সাদা স্রাব নির্গত হওয়া। এ দুটি আলামতের কোন একটি পাওয়া গেলে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করবে এবং যথারীতি সালাম-সিয়াম শুরু করবে।
হায়েয বা ঋতুস্রাব থেকে পবিত্রতা অর্জনের পর যদি হলুদাভ বা ময়লার মত স্রাব দেখা যায়:
মহিলারা ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হওয়ার পর সাধারণ দিনগুলোতে যদি বিবর্ণ হলুদাভ বা ময়লাযুক্ত পানির মত ধুসর রঙ্গের স্রাব দেখতে পায় তাহলে তা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা, উম্মে আত্বিয়া রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
 “আমরা (হায়েয বা ঋতুস্রাব) থেকে পবিত্রতা অর্জনের পর ময়লাযুক্ত ধুসর রঙ্গের পানি ও বিবর্ণ হলুদাভ স্রাবকে কিছুই মনে করতাম না।” (অর্থাৎ এগুলোকে হায়েয হিসেবে গণ্য করতাম না।)
[সুনান আবু দাউদ, শাইখ আলবানী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলেন।]
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে:
 “আমরা ময়লাযুক্ত ধুসর রঙ্গের পানি ও বিবর্ণ হলুদাভ স্রাবকে কিছুই মনে করতাম না।” (সহীহ বুখারী হা/ ৩২৬)
সুতরাং কোন মহিলার এমনটি হলে, সে স্বাভাবিক নিয়মে নামায-রোযা অব্যাহত রাখবে। এটা পেশাবের মত নাপাকি হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তা ধৌত করবে এবং প্রত্যেক ওয়াক্তে আলাদা ওযু করে সালাত আদায় করবে। আর রোযা অবস্থায় এমনটি দেখা গেলে স্বাভাবিক নিয়মে রোযা পূর্ণ করবে।
তবে হায়েযের সাথে যুক্ত অবস্থায় অর্থাৎ হায়েয শেষ হওয়ার শেষ দিকে এ ধরণের হলুদ বা ময়লার মত স্রাব নির্গত হলে তা হায়েয হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
 (৯) মুসাফাহা করার পদ্ধতি কী? তা কি এক হাতে হবে না দু হাতে?
উত্তর:
সালাম বিনিময় ও মুসাফাহা করা নি:সন্দেহে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। প্রখ্যাত সাহাবী বারা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“দু’জন মুসলিম সাক্ষাৎকালে মুসাফাহা করলেই একে অপর থেকে পৃথক হবার পূর্বেই তাদের (গুনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।’’
[আবু দাউদ ৫২১২, ৫২১১, তিরমিযি২৭২৭, ইবনে মাজাহ ৩৭০৩, সহীহ-সহীহ তারগীব]
 মুসাফাহা করার পদ্ধতি কি?
এ ব্যাপারে কথা হল, সুন্নত হল উভয় পক্ষ ডান হাত দ্বারা মুসাফাহা করবে। কারণ, এ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এটি একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হল, “এক হাতের তালুকে অপর ব্যক্তির হাতের তালুতে রাখা।” (মু’জামু মাকায়ীসিল লুগাহ ৩/২৩৯ ইত্যাদি।) এবং যে সব হাদিসে মুসাফাহা আলোচনা এসেছে সেগুলো থেকে বাহ্যিক অর্থ এটাই বুঝা যায়।
তাই উভয় পক্ষ থেকে দু হাত দ্বারা ব্যবহার করলেই মুসাফাহা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। চার হাত ব্যবহার করার আদৌ প্রয়োজন নেই।
এছাড়াও শুধু ডান হাত দ্বারা মুসাফাহা করার ব্যাপারে কিছু হাদিস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো সনদগতভাবে দুর্বল হওয়া সেগুলো উল্লেখ করা হল না।
কিন্তু দু হাতে মুসাফাহা করার কথা কোন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
তবে কোন কোন হাদিসে পাওয়া যায় যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ কোন কারণে দু হাত দিয়ে কোন সাহাবীর হাত ধরেছেন। যেমন, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে সেভাবে তাশাহহুদ পড়ার নিয়ম শিখিয়েছেন যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের কোন সূরা শিখাতেন। তখন আমার হাত তাঁর দু হাতের মাঝে ছিল।” (সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ নামাযে তাশাহহুদ পাঠ করা।)
এখানে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য এবং শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য তার দু হাত ধরেছেন। এর মাধ্যমে আমাদের দেশে যেভাবে দু হাত দ্বারা মুসাফাহা করা হয় তা প্রমাণিত হয় না। বরং এখান থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাধারণ নিয়ম ছিল এক হাতে মুসাফাহা করা। কারণ, তা না হলে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ অত্র হাদিসে দু হাতে ধরার কথাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতেন না। দু হাত ধরার কথাটি এজন্য উল্লেখ করেছেন যে, তা ছিল সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ।
মোটকথা সুন্নত হল, একজন মুসলিম তার ডান হাতকে অপর মুসলমান ভাইয়ের ডান হাতে রেখে মুসাফাহা করবে। এটাই উত্তম নিয়ম।
সৌদী আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন:
“দু হাতে মুসাফাহা করার ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু জানা নাই। কিন্তু তা উচিৎ নয় বরং উত্তম হল এক হাতে মুসাফাহা করা।”
(১০) বিয়ের মোহর কুরআন শিখানোঃ
প্রশ্ন: বিয়েতে অর্থ-সম্পদ দ্বারা মোহর দেয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা না দিয়ে কেবল কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে গণ্য করা যাবে কি?
অথবা আর্থিক মোহর দেয়ার পাশাপাশি কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে ধরা জায়েজ আছে কি?
উত্তর:
মোহর স্ত্রীর অধিকার বা পাওনা। এটি আল্লাহর নির্দেশ। তাআলা বলেন:
 “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তবে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।” (সূরা নিসা: ৪)
কী জিনিস দ্বারা মোহর দিতে হবে?
এ ব্যাপারে ফকীহগণ বলেছেন যে, মোহর হওয়ার জন্য শর্ত হল,
– সেটি হয় এমন জিনিস হতে হবে যার অর্থমূল্য রয়েছে। যেমন টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-রৌপ্যের অলংকার, জায়গা-জমি,আসবাবপত্র ইত্যাদি।
– অথবা এমন কোন কাজ বা সেবা হতে হবে যার বিনিময় মূল্য রয়েছে। যেমন কুরআন শিখানো। বিয়ের পূর্বে এ মর্মে চুক্তি হবে যে, মোহর হিসেবে স্বামী তার স্ত্রীকে কুরআন শেখাবে। অথবা এ মর্মে চুক্তি হবে যে, সে তাকে পড়ালেখা শেখাবে অথবা স্বামী স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিশেষ কোন কর্ম সম্পাদন করবে।
বিয়ের সময় যদি এ ধরণের কাজ বা সেবা দানের শর্তে উভয়পক্ষ সম্মত হয় তাহলেও তা মোহর হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ এগুলোর বিনিময় মূল্য রয়েছে।
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবাহ প্রার্থী এক দরিদ্র সাহাবীকে বললেন,
“যাও, তালাশ কর, একটি লোহার আংটি হলেও।”
লোকটি চলে গেল এবং খুঁজে দেখল। এরপর এসে বলল,আমি কিছুই পেলাম না;এমনকি একটি লোহার আংটিও না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,তোমার কি কিছু কুরআন জানা আছে? সে বলল, অমুক অমুক সূরা আমার জানা আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তমার নিকট যে পরিমাণ কুরআন আছে তার বিনিময়ে এ মহিলাকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম।” (সহীহ বাখারী, অধ্যায়:পোশাক, অনুচ্ছেদ: লোহার আংটি, হা/৫৫৩৩, সহীহ মুসলিও বর্ণিত হয়েছে)
উক্ত হাদীস থেকে ইমাম শাফেঈ রহ. এবং ইমাম আহমদ রহ. (একটি বর্ণনা মোতাবেক) কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে গণ্য করেছেন।
বরং কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে গণ্য করার ব্যাপারে অধিকাংশ আলেম একমত।
কিন্তু যদি শুধু কুরআনের সূরা বা আয়াতকে মোহর ধরা হয় অর্থাৎ বর নিজে নিজে কুরআন পড়বে অথবা কুরআন মুখস্থ করবে-এটাই মোহর। তবে এ বিষয়ে সঠিক কথা হল, এটি মোহর হিসেবে গণ্য হবে না। বরং কুরআন তিলাওয়াত শিখানো বা বিশেষ কোন কাজ করে দেয়ার শর্ত থাকলে তা মোহর হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
অর্থ-সম্পদ থাকার পরও শুধু কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে গণ্য করা বৈধ নয়:
অর্থ-সম্পদ থাকার পরও শুধু কুরআন শিখানোকে মোহর হিসেবে গণ্য করা বৈধ হবে না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি লোহার আংটি হলেও খোঁজার কথা বলেছেন।
সুতরাং আর্থিক মোহর দেয়ার সামর্থ্য থাকলে তাই প্রদান করতে হবে। অর্থ সম্পদ না থাকলে তখন তার জন্য উক্ত বিকল্প পথ। কিন্তু অর্থ-সম্পদ একেবারে না দিয়ে শুধু কুরআন শিখানোকেই মোহর হিসেবে ধার্য করা বৈধ হবে না।
তবে যদি আর্থিক মোহরের পাশাপাশি এটাও বলা হয় যে,স্বামী স্ত্রীকে কুরআন শেখাবে অর্থাৎ আর্থিক মোহর তো থাকলই পাশাপাশি কুরআনও শিখাতে হতে তাহলে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটিও মোহর হিসেবে পরিগণিত হবে ইনশাআল্লাহ।
 (১১) আমার বান্ধবীদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলে খুবই বিরক্ত হয়ঃ
প্রশ্ন: আমি দ্বীনের পথে এসেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। কিন্তু আমার কিছু বান্ধবী আগের মতোই আছে। আমি তাদেরকে ইসলামিক ভিডিও, বই পুস্তক, হাদিস ইত্যাদি জিনিস দিলে তারা বিরক্ত হয়। তাদের কথা হল, বারবার এসব দিলে ইসলামের প্রতি অনীহা এবং বিরক্তি চলে আসবে। এতে নাকি আমারই গুনাহ হবে?
তারা আমার অনেক ভালো বান্ধবী ছিল। তাদের কখনো ছাড়বো না এ ওয়াদা দিয়ে ছিলাম। এখন আমার করণীয় কি?
উত্তর:
আপনি যথাসম্ভব হেকমত (প্রজ্ঞা ও কৌশল) এবং সদুপদেশ সহকারে তাদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবেন। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করবেন, সময় নিবেন-তাড়াহুড়া করবেন না, তাদের হেদায়েতের জন্য নীরবে-নিভৃতে আল্লাহর নিকট দুআ করবেন, তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবেন এবং যথাসাধ্য তাদের উপকার করার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ আপনি নিজেকে তাদের কল্যাণকামী বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করবেন। যেন তারা আপনার প্রতি বিশ্বাস করতে পারে।
এভাবে আপনার সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
কিন্তু তারা যদি বেশি বিরক্ত হয় -যার কারণে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে এবং দাওয়াত দেয়ার পথ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তাদের বিরক্তিকর পন্থা বাদ দিয়ে ভিন্ন পন্থায় চেষ্টা করবেন।
মনে রাখতে হবে, আমাদের কাজ আল্লাহর দ্বীনের আহ্বানকে সুন্দর পন্থায় মানুষেরর কানে পৌঁছিয়ে দেয়া। তাদেরকে হেদায়েত করা আমাদের দায়িত্ব নয়। কারণ হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।
আপনি দাওয়াত দেয়ার কারণে সওয়াব পাবেন কিন্তু তারা গ্রহণ না করলে তারা আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন জববাদাহী করবে।
 (১২) কসম ভঙ্গের কাফফারা এবং ওয়াদা ও কসমের মাঝে পার্থক্যঃ
প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি যদি কোন কাজ করবে বলে আল্লাহর নামে কসম করে তারপর তা ভঙ্গ করে তাহলে তার জন্য কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব।
কসম ভঙ্গের কাফফারা হল:
– দশজন মিসকিনকে মধ্যম ধরণের খাবার খাবার খাওয়ানো।
– অথবা ১০ জন মিসকিনকে পোশাক দেয়া।
– অথবা একজন গোলাম আযাদ করা।
– এ তিনটি কোনটি সম্ভব না হলে তিনটি রোযা রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাধ। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; মধ্যম শ্রেনীর খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্তু প্রদান করবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দিবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না, সে তিন দিন রোযা রাখবে। এটা কাফফরা তোমাদের শপথের, যখন শপথ করবে। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” সূরা মায়িদাহ: ৮৯)
সুতরাং কেউ যদি আর্থিক সংকটের কারণে উপরোক্ত তিনটি জিনিসের কোনটি দ্বারা কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে তিনটি রোযা রাখবে।
কসম ও ওয়াদার মাঝে পার্থক্য:
এখানে এ বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, ওয়াদা করা আর কসম খাওয়া এক জিনিস নয়। কেউ হয়ত মনে মনে বা কারো কাছে ওয়াদা করল যে, সে এ কাজটা করবে কিন্তু পরে কোন কারণে তা করতে পারল না। তাহলে তা ‘কসম ভঙ্গ’ হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ সে আল্লাহর নামে কসম করে নি।
পক্ষান্তরে কেউ যদি বলে, “আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, উমুক কাজটা করব।” তাহলে এটা হল কসম। এখন সে যদি উক্ত কাজটা না করে তাহলে তা ‘কসম ভঙ্গ’ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে কসম ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে। কিন্তু সাধারণ ওয়াদা/অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তার কোন কাফফারা নেই। কিন্তু ওয়াদা রক্ষা না করতে পারার কারণে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং যার সাথে ওয়াদা করেছিল তার কাছে ক্ষমা চাইবে। আল্লাহু আলাম।
(১৩) কসম ভংগের কাফফারা হিসেবে যে ৩ টি রোযা রাখতে হয় তা কি একাধারে ৩ দিন রাখতে হবে?
প্রশ্ন: কসম ভংগের কাফফারা হিসেবে যে ৩ টি রোযা রাখতে হয় তা কি একাধারে ৩ দিন রাখতে হবে? নাকি ছেড়ে ছেড়ে ৩ দিন রাখলেও যথেষ্ট হবে?
উত্তর:
কসম ভঙ্গের কাফফারার তিনটি রোযা ধারাবাহিকভাবে রাখা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাধ। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; মধ্যম শ্রেনীর খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্তু প্রদান করবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দিবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না, সে তিন দিন রোযা রাখবে। এটা কাফফরা তোমাদের শপথের, যখন শপথ করবে। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” সূরা মায়িদাহ: ৮৯)
শাইখ উছাইমীন বলেন: যদি কেউ ক্রীতদাস না পায়, পোশাক বা খাবার দিতে না পারে তাহলে সে তিনদিন রোযা রাখবে। এ রোযাগুলো লাগাতরভাবে রাখতে হবে। মাঝে কোনদিন রোযা ভাঙ্গা যাবে না।[ফাতাওয়া মানারুল ইসলাম (৩/৬৬৭)
(১৪) সুন্নত বা নফল সালাতের পর যে সকল দুআ ও তাসবীহ পাঠ করতে হয়ঃ
প্রশ্ন: ফরয সালাতের পর বিভিন্ন দুআ ও তাসবীহ পাঠ করার ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সুন্নত বা নফল নামাজের পরও কি এ সকল দুয়া-তাসবীহ পাঠ করা যায়?
উত্তর:
সুন্নত ও নফল নামাজের সালাম ফেরানোর পর নিম্নোক্ত দুটি দুআ/তাসবীহ পাঠ করা যায়। যথা:
১. আস্তাগফিরুল্লাহ (তিনবার)
২. তারপর “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম।” (একবার)
এ ব্যাপারে হাদিস হল:
সাওবান রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করে তিনবার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন (অর্থাৎ আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করতেন)
অতঃপর বলতেনঃ
“আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম।”
“হে আল্লাহ্! আপনি শান্তিদাতা এবং আপনার পক্ষ থেকে শান্তি পাওয়া যায়। হে মহত্ব ও মর্যাদার অধিকারী! আপনি বরকতময় প্রাচুর্যময়।” (সহিহ মুসলিম)
এ হাদিসে কেবল ফরয সালাতের পরে উক্ত তাসবীহদ্বয় পাঠ করার কথা বলা হয় নি বরং সাধারণভাবে সালাতের শেষে পাঠ করতে বলা হয়েছে। এতে বুঝা যায়, এ তাসবীহদ্বয় কেবল ফরয সালাত শেষে নয় বরং সুন্নাহ, নফল ইত্যাদি সালাতের শেষেও পাঠ করা যাবে।
অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে সামনে রেখে বলেছেন যে, সালাত শেষে পাঠের দুআ গুলো ফরয সালাতের পরই পড়াই কর্তব্য; সুন্নাত বা নফল সালাত শেষ নয়।
(আল্লামা বিন বায রহ. এর ফতোয়া থেকে নেয়া)
(১৫) বিয়েতে দেনমোহর বাকি রাখা কি জায়েয?
প্রশ্ন: বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারণ করার পর বলা হয়, যে এত টাকা উসুল আর এত টাকা বাকি। এভাবে দেনমোহর বাকি রাখা কি জায়েয? কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জানতে চাই।
উত্তর:
দেনমোহর বিয়ের অন্যতম শর্ত। এটি মূলত: বর ও কনের মাঝে একটি চুক্তি। এতে উভয় পক্ষ যেভাবে সম্মত হবে ইসলামের দৃষ্টিতে সেভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে। এর পরিমাণ কমবেশি, নগদ-বাকি যাই হোক না কেন।
সুতরাং তারা যদি দেনমোহরের পুরোটাই নগদ কিংবা পুরোটাই বাকি অথবা মোহরের কিছু অংশ নগদ (উসুল) এবং কিছু অংশ বাকি রাখতে সম্মত হয় এতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো আপত্তি নেই। তবে যেটা বাকি রাখা হবে সেটা পরিশোধ করা ফরয। কেননা এটি এক দিকে স্ত্রীর হক (পাওনা) অন্যদিকে চুক্তি। মুমিন ব্যক্তি অবশ্যই চুক্তি পূরণ করবে। চুক্তি লঙ্ঘন করা মুনাফেকির বৈশিষ্ট্য। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
 “তোমাদেরকে (বিয়ের চুক্তির) যে সকল শর্ত পালন করতে হয় তার মধ্যে সেসব শর্তই সবচেয়ে বেশি পালনীয় যার দ্বারা কোন মহিলাকে তোমরা হালাল কর।” (সহিহ ও মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
 “মুসলিমগণ তাদের সাথে কৃত শর্তের উপর অবিচল থাকবে।” (তিরমিযী : ১৩৫২, আবু দাউদ :৩৫৯৪-সহীহ)
পরিশোধ না করার নিয়তে মোহর নির্ধারণ করা বৈধ নয়:
পরিশোধ না করার নিয়তে মোহর নির্ধারণ করা বৈধ নয়। কেননা, এটি একটি ঋণ-যা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। অথচ বর্তমানে লোকেরা বিশাল অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ করে কিন্তু পরিশোধ করে খুবই সামান্য। আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশাল অঙ্কের মোহর নির্ধারণ একটি সামাজিক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামী যেমন তা পরিশোধ করার গরজ অনুভব করে না তেমনি স্ত্রীর পক্ষ থেকেও ধরে নেয়া হয় যে, এটি কেবল কাবিননামায় লিখার বিষয়; পরিশোধ করার বিষয় নয়। কিন্তু এটিকে আবার স্বামীর জন্য একটি ফাঁদ হিসেবে গণ্য করা হয়, যেন এ বিশাল অর্থ পরিশোধ করার ভয়ে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে না পারে!
অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়েতে দেনমোহর কম হওয়াকে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর জন্য একটি বরকতের কারণ বলা হয়েছে। আর স্বামীর জন্যও এই ঋণ পরিশোধ করাও সহজ হয়।
অবশ্য পরবর্তীতে স্ত্রীর পক্ষ থেকে দেনমোহরের কিয়দংশ ছাড় দেওয়া হলে স্বামী তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
 “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।” (সূরা নিসা: ৪)
 (১৬) বাংলাদেশ থেকে হজ যাত্রীগণ কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?
প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে হজ্জ করতে গেলে হাজিরা কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে? দেশ থেকেই বাঁধবে নাকি মিকাত থেকে?
আর হজ্জ করতে গেলে, একজন ব্যক্তি ফরয ওমরা ছাড়াও কি মৃত ব্যক্তিদের নামে একাধিক বার ওমরা করতে পারবে? যদি পারে, তবে বারবার কি মিকাত গিয়ে ইহরাম বাধবে? আর তওয়াফ কি একাধিক বার করা যাবে?
উত্তর:
যারা বাংলাদেশ/ভারত ইত্যাদি পূর্বাঞ্চল থেকে উমরা করতে আসবে তারা ফ্লাইটে উঠার পূর্বে প্রয়োজনীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গোসল করার পর ইহরামের কাপড় পরিধান করবে। কিন্তু ইহরামের নিয়ত করবে না। তারপর ফ্লাইট জেদ্দার সন্নিকটে ইয়ালামলাম পাহাড় অতিক্রম করার পূর্বে তারা ফ্লাইটে বসা অবস্থায় নিয়ত করে ‘আল্লাহু্ম্মা লাব্বাইকা উমরাহ’ বলে ইহরামে প্রবেশ করবে। (ইয়ালামলাম পৌঁছার বিষয়টি বিমান ক্রুদের মাধ্যমে জানা যায়।)
[ইয়ালামলাম- মক্কা থেকে ১২০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত একটি উপত্যকার নাম যা সা‘দিয়া নামেও পরিচিত। এটি ইয়ামেন বাসী ও পাক-ভারত-বাংলাদেশসহ প্রাচ্য ও দূর প্রাচ্য থেকে আগমনকারীদের মিকাত।]
এক সফরে একাধিক উমরা করা ঠিক নয় (চাই নিজের উদ্দেশ্যে হোক অথবা জীবিত বা মৃতের পক্ষ থেকে হোক)। কেননা বিদায় হজ্জের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বা তাঁর সঙ্গী লক্ষাধিক সাহাবীদের একজনও একাধিক উমরা করেছেন বলে প্রমাণিত হয় নি। যদি তা সঠিক হত, তাহলে তাঁরা অবশ্যই এ সুযোগ হাতছাড়া করতেন না।
অবশ্য কেউ যদি মদিনা যিয়ারতে যায় বা কোনো কাজে তায়েফ যায় তাহলে পুনরায় মক্কা আগমন করতে চাইলে সেখান থেকে ইহরাম বেধে নতুন করে উমরা আদায় করতে পারে।
 উমরা সম্পন্ন করার পর যতবার খুশি ততবার তওয়াফ করা যায়। সাত চক্করে হয় এক
তওয়াফ।তওয়াফকারী এভাবে সাত চক্কর দিয়ে একটি তওয়াফ করবে তারপর দু রাকআত তওয়াফের সালাত আদায় করবে। এভাবে যত ইচ্ছা নফল তওয়াফ করা যায়।
হাদিসে বলা হয়েছে, তওয়াফ হল সালাতের অনুরূপ। তাই মক্কার বাহির থেকে গমনকারীদের জন্য মক্কায় নফল সালাতের চেয়ে তওয়াফ করা অধিক উত্তম।
 (১৭) বাবা মারা যাওয়ার পর মা জীবিত থাকায় যদি বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি, ছেলে মেয়েরা ভাগ/বণ্টন না করেঃ
প্রশ্ন: বাবা মারা যাওয়ার পর মা জীবিত থাকায় যদি বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি, ছেলে মেয়েরা ভাগ/বণ্টন না করে এতে কি শরিয়ত ভাবে কোন অন্যায় হবে?
আর এ সম্পত্তি নিয়ে কারো তরফ থেকে কোনো সমস্যাও নাই। অর্থাৎ ভাগাভাগি নিয়ে কারো কোন কমপ্লেইন নাই।
উত্তর:
কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে তথা তার ছলে, মেয়ে, বাবা, মা, স্বামী/স্ত্রী যারা যারা বেঁচে আছে তাদের মাঝে শরিয়ত নির্দেশিত পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। তবে এদের মাঝে কেউ যদি তার অংশ স্বেচ্ছায় না নিতে চায় তাহলে তাহলে সেটা সে করতে পারে। আর উত্তরাধিকারীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে যদি উক্ত সম্পদ বণ্টন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয় বা নিজেরা তা গ্রহণ না করে কোন জনকল্যাণ খাতে দান করে দিতে চায় তাহলেও কোনো আপত্তি নাই। তবে উত্তরাধিকারীদের মাঝে একজন ব্যক্তিও যদি তার অংশ দাবী করে তাহলে অবশ্যই তার অংশ তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
 (১৮) মাগরিব ও ইশার সালাতের মাঝে নফল সালাত পড়া এবং সালাতুত তাওয়াবীন প্রসঙ্গঃ
প্রশ্ন: মাগরিবের পরে দু দু রাকাত করে নফল নামায পড়া যাবে কি? এ ব্যাপারে হাদিসে কী আছে? কেননা কিছু মানুষ মাগরিবের পরে দু দু রাকাত করে ‘আওয়াবিন’ এর নামাজ পরে। মাগরিব নামাযের পরে এই আওয়াবীনের নামায পড়াটা কি সঠিক?
উত্তর:
মাগরির ও ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে দু দু রাকআত করে নফল সালাত আদায় করার কথা সহীহ হাদিসে রয়েছে। তবে তাকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলার হাদিসটি জঈফ। বরং সহীহ হাদিস অনুযায়ী ‘সালাতুল আওয়াবীন’ হল, চাশতের সালাতের অপর নাম।
এ বিষয়ে ডঃ শাইখ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. বলেন:
রাসূলুল্লাহ () নিজে ও তাঁর সাহাবীগণ মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন বলে সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
হুযাইফা (রা) বলেন, ‘‘আমি নবীজী ()-র কাছে এসে তাঁর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে ইশা’র সালাত পর্যন্ত নফল সালাতে রত থাকলেন।’’ হাদিসটি সহীহ।[1] অন্য হাদিসে আনাস (রা) বলেন, ‘‘সাহাবায়ে কেরাম মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতেন এবং নফল সালাত আদায় করতেন।’’ হাদিসটি সহীহ।
তাবিয়ী হাসান বসরী বলতেন, মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ের নামাযও রাতের নামায বা তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে।[2]
বিভিন্ন হাদিসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো সাহাবী তাবিয়ীগণকে এ সময়ে সালাত আদায়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।[3]
এ সকল হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে মুমিন কিছু নফল সালাত আদায় করবেন। যিনি যত বেশি সালাত আদায় করবেন তিনি তত বেশি সাওয়াব লাভ করবেন। এ সময়ের সালাতের রাক‘আত সংখ্যা বা বিশেষ ফযিলতে কোনো সহীহ হাদিস বর্ণিত হয় নি।
কিছু জাল বা অত্যন্ত জয়ীফ সনদের হাদিসে এ সময়ে ৪ রাক’আত, ৬ রাক’আত, ১০ বা ২০ রাক’আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযিলতের কথা বলা হয়েছে। যেমন:
 যে ব্যক্তি এ সময়ে ৪ রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জিহাদ করার সাওয়াব পাবে।
যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কোনো কথা বলার আগে ৬ রাক’আত সালাত আদায় করবে তাঁর ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অথবা তাঁর সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।
যে ব্যক্তি এ সময়ে ১০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য জান্নাতে বাড়ি তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি এ সময়ে ২০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য আল্লাহ জান্নাতে বাড়ি তৈরি করবেন।
এসকল হাদিস সবই বানোয়াট বা অত্যন্ত জয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম তিরমিযী এ সময়ে ৬ রাক‘আত নামায আদায় করলে ১২ বছরের সাওয়াব পাওয়ার হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদিসটি অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদিসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
আমাদের দেশে এ ৬ রাক‘আতে সূরা ফাতিহার পরে কোন্ সূরা পাঠ করতে হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী বলেছেন, সালাতুল মাগরিবের পর থেকে সালাতুল ইশা পর্যন্ত যে নফল সালাত আদায় করা হয় তা ‘সালাতুল আওয়াবীন’ অর্থাৎ ‘বেশি বেশি তাওবাকারীগণের সালাত’।[5] বিভিন্ন সহীহ হাদিসে রাসূলুল্লাহ () চাশতের নামাযকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]
টিকা:
[1] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১, ৫/৮০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯; আবূ দাউদ, সুনান ২/৩৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[3] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৬।
[4] তিরমিযী, সুনান ২/২৯৮, নং ৪৩৫, ইবনু মাজাহ, সুনান ১/৩৬৯, নং ১১৬৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৫, বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ৩/১৩৩, ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬, শাওকানী, নাইলুল আউতার ৩/৬৫-৬৭, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০।
[5] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ২/১৪; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯।
[6] মুসলিম, সহীহ ১/৫১৫-৫১৬; ইবনু খুযাইমা, সহীহ ২/২২৭-২২৮; হাকিম, মুসতাদরাক ১/৪৫৯।

(১৯) মাগরিব ও ইশার সালাতের মাঝে নফল সালাত পড়া এবং সালাতুত তাওয়াবীন প্রসঙ্গ
প্রশ্ন: মাগরিবের পরে দু দু রাকাত করে নফল নামায পড়া যাবে কি? এ ব্যাপারে হাদিসে কী আছে? কেননা কিছু মানুষ মাগরিবের পরে দু দু রাকাত করে ‘আওয়াবিন’ এর নামাজ পরে। মাগরিব নামাযের পরে এই আওয়াবীনের নামায পড়াটা কি সঠিক?
উত্তর:
মাগরির ও ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে দু দু রাকআত করে নফল সালাত আদায় করার কথা সহীহ হাদিসে রয়েছে। তবে তাকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলার হাদিসটি জঈফ। বরং সহীহ হাদিস অনুযায়ী ‘সালাতুল আওয়াবীন’ হল, চাশতের সালাতের অপর নাম।
এ বিষয়ে ডঃ শাইখ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. বলেন:
রাসূলুল্লাহ () নিজে ও তাঁর সাহাবীগণ মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন বলে সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
হুযাইফা (রা) বলেন, ‘‘আমি নবীজী ()-র কাছে এসে তাঁর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে ইশা’র সালাত পর্যন্ত নফল সালাতে রত থাকলেন।’’ হাদিসটি সহীহ।[1] অন্য হাদিসে আনাস (রা) বলেন, ‘‘সাহাবায়ে কেরাম মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতেন এবং নফল সালাত আদায় করতেন।’’ হাদিসটি সহীহ।
তাবিয়ী হাসান বসরী বলতেন, মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ের নামাযও রাতের নামায বা তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে।[2]
বিভিন্ন হাদিসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো সাহাবী তাবিয়ীগণকে এ সময়ে সালাত আদায়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।[3]
এ সকল হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে মুমিন কিছু নফল সালাত আদায় করবেন। যিনি যত বেশি সালাত আদায় করবেন তিনি তত বেশি সাওয়াব লাভ করবেন। এ সময়ের সালাতের রাক‘আত সংখ্যা বা বিশেষ ফযিলতে কোনো সহীহ হাদিস বর্ণিত হয় নি।
কিছু জাল বা অত্যন্ত জয়ীফ সনদের হাদিসে এ সময়ে ৪ রাক’আত, ৬ রাক’আত, ১০ বা ২০ রাক’আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযিলতের কথা বলা হয়েছে। যেমন:
যে ব্যক্তি এ সময়ে ৪ রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জিহাদ করার সাওয়াব পাবে।
যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কোনো কথা বলার আগে ৬ রাক’আত সালাত আদায় করবে তাঁর ৫০ বছরের গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অথবা তাঁর সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।
 যে ব্যক্তি এ সময়ে ১০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য জান্নাতে বাড়ি তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি এ সময়ে ২০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তাঁর জন্য আল্লাহ জান্নাতে বাড়ি তৈরি করবেন।
এসকল হাদিস সবই বানোয়াট বা অত্যন্ত জয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম তিরমিযী এ সময়ে ৬ রাক‘আত নামায আদায় করলে ১২ বছরের সাওয়াব পাওয়ার হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদিসটি অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদিসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
আমাদের দেশে এ ৬ রাক‘আতে সূরা ফাতিহার পরে কোন্ সূরা পাঠ করতে হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী বলেছেন, সালাতুল মাগরিবের পর থেকে সালাতুল ইশা পর্যন্ত যে নফল সালাত আদায় করা হয় তা ‘সালাতুল আওয়াবীন’ অর্থাৎ ‘বেশি বেশি তাওবাকারীগণের সালাত’।[5] বিভিন্ন সহীহ হাদিসে রাসূলুল্লাহ () চাশতের নামাযকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]
টিকা:
[1] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১, ৫/৮০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯; আবূ দাউদ, সুনান ২/৩৫, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।
[3] ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৬।
[4] তিরমিযী, সুনান ২/২৯৮, নং ৪৩৫, ইবনু মাজাহ, সুনান ১/৩৬৯, নং ১১৬৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯, ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৪-১৫, বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ৩/১৩৩, ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬, শাওকানী, নাইলুল আউতার ৩/৬৫-৬৭, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০।
[5] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ২/১৪; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯।
[6] মুসলিম, সহীহ ১/৫১৫-৫১৬; ইবনু খুযাইমা, সহীহ ২/২২৭-২২৮; হাকিম, মুসতাদরাক ১/৪৫৯।

(২০) মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা সমান এটা কি হাদিসের কথা?

উত্তর:
“মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গার সমান কথা” এটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস নয় বরং লোকসমাজে প্রচলিত একটি উক্তি মাত্র। আমাদের সমাজে এ কথাটি মুখেমুখে প্রচলিত রয়েছে এবং শিল্পীরা গানের মধ্যে এ জাতীয় কথা বলে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হাদিসের বক্তব্য নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া, কারো মনে আঘাত করা, কারো সাথে প্রতারণা করা, অঙ্গিকার ভঙ্গ করা, গালি দেয়া, মিথ্যাচার করা ইত্যাদি অত্যন্ত জঘন্য গুনাহের কাজ- তাতে কোন সন্দেহ নাই। তবে উক্ত কথাটিকে হাদিস মনে করা বৈধ নয়। কেননা তা কোনো হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায় না।
মুমিনদেরকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া মারাত্মাক অন্যায় ও কবিরা গুনাহ (বড় পাপ)। এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর কতিপয় বক্তব্য উপস্থাপন করা হল:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।” (সূরা আহযাব: ৮৫)
আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারে উঠে উচ্চ স্বরে বলেন:
‘‘হে লোক সকল! তোমরা যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছো; অথচ ঈমান তোমাদের অন্তরে ঢুকেনি,
– তোমরা মুসলিমদেরকে কষ্ট দিও না।
– তাদেরকে লজ্জা দিও না।
– তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না।
কারণ, যে ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের দোষ অনুসন্ধান করলো আল্লাহ্ তা‘আলাও তার দোষ অনুসন্ধান করবেন। আর যার দোষ আল্লাহ্ তা‘আলা অনুসন্ধান করবেন তাকে অবশ্যই তিনি লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন যদিও সে নিজ ঘরের অভ্যন্তরেই অবস্থান করুক না কেন’’।
(তিরমিযী ২০৩২, মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ-হাদিসটি সহিহ, দ্রষ্টব্য সহিহ আবু দাউদ- আলবানী, হা/৪৮৮০)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ
“একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানাকানি করবে না। কেননা ইহা মুমিনের কষ্ট দেয়। আর আল্লাহ তা’আলা তো মুমিনকে কষ্ট দেয়া অপছন্দ করেন”।
(সূনান আত তিরমিজী [তাহকীককৃত],অধ্যায়ঃ ৪১/ শিষ্টাচার, পরিচ্ছদঃ ৫৯. তৃতীয় ব্যাক্তিকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানাকানি করবে না, হা/28250)
এছাড়াও হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা জিজ্ঞেস করলেন:
“তোমরা কি জান নি:স্ব কে?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন:
“আমাদের মধ্যে নি:স্ব তো সে যার কোন দিনার-দিরহাম বা অর্থ-সম্পদ নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
“আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার নি:স্ব হলো সেই ব্যক্তি যে কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও যাকাতসহ অনেক ভাল কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, করো সম্পদ আত্নসাত করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মারধোর করেছিল। ফলে তার থেকে নেক আমলগুলো নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে।
এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেয়া হবে। ফলে সে ( নিঃস্ব অবস্থায়) জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সহিহ মুসলিম)। আল্লাহু আলাম-আল্লা সবচেয়ে বেশি জানেন।

(২১) ইফতারী তৈরি, ইফতারের নানা আইটেম আর ইফতার পার্টির বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে শেয়ারঃ

প্রশ্ন: ইফতারী তৈরি, ইফতারের নানা আইটেম আর ইফতার পার্টির বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে শেয়ার দেয়া কি ঠিক?
উত্তর:
ফেসবুকে এ সব ছবি প্রচার-প্রসার করার কী উদ্দেশ্য?
আমাদের জানা দরকার যে, মানুষকে ইফতার খাওয়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কারণ হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায় সে ব্যক্তি সমপরিমান সওয়াবের অধিকারী হয়।
অনুরূপভাবে ইফতারী তৈরি করাও নেকির কাজ। এর মাধ্যমে একটি ইবাদত পালনে সহায়তা করা হয়। এ কারণে এতেও সওয়াব রয়েছে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু দ্বীনী উদ্দেশ্য ছাড়া লোক দেখানোর জন্য এ সব বিষয় ফেসবুকে প্রচার করলে তা ‘রিয়া’ বা লোকদেখানো আমল হিসেবে গুনাহগার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মূলত: যারা ফেসবুকে এ সব আপলোড দেয়া তারা কিছু লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট পাওয়ার আশায় থাকে। যার কারণে তারা কিছুক্ষণ পরপর টাইমলাইন চেক করতে থাকে। আর পর্যাপ্ত লাইক না বা কমেন্ট না পেলে তাদের মন খারাপ থাকে!! তাহলে এগুলো ‘রিয়া’ হতে বাকি থাকল কোথায়?
সুতরাং এ সব অসুস্থ মানসিকতা থেকে বের হয়ে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মহিমান্বিত মাহে রামাযানে যথাসম্ভব নিভৃতে এ সব ইবাদত করা দরকার। তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার পাশাপাশি আখিরাতে লাভ করা যাবে অবারিত সওয়াব। কিন্তু এগুলোর পেছনে দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্য থাকলে এ সকল কর্মকাণ্ড শুধু নিষ্ফল হবে না বরং তা রিয়া (ছোট শিরক) এর রূপান্তরিত হয়ে তাদের জন্য আখিরাতে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন।

(২২) রমজানের শেষ দশকে কি ধরণের আমল করা উচিতঃ

প্রশ্ন: রমজানের শেষ দশকে কি ধরণের আমল করা উচিত?
উত্তর:
আলেমগণ বলেছেন, “বছরের শ্রেষ্ঠ ১০টি দিন হল, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন আর শ্রেষ্ঠ রাত হল, রমজানের শেষের দশ রাত।
আমাদের কর্তব্য হল, রমজানের শেষ দশ দিনে রোজা থাকা এবং রাতে বেশি বেশি এবাদত-বন্দেগী করা। যেমন: কিয়ামুল লাইল তথা তারাবিহ/তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত, কুরআনের তরজমা ও তাফসীর পড়া, দীনী জ্ঞান চর্চা, জিকির-আজকার, তাসবীহ-তাহলীল, ইস্তেগফার, দোআ, দান-সদকা ইত্যাদি।
মোটকথা, মহিমান্বিত এই দিনগুলোতে যত প্রকার নেকি ও কল্যাণকর কাজ আছে সেগুলো যথাসম্ভব বেশি বেশি করার চেষ্টা করা উচিত। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।

(২৩) বাড়িতে থেকে বা কাজ-কর্ম ও ডিউটি পালন করে ‘লাইলাতুল কদর’ এর মর্যাদা লাভ করার উপায় কি?

প্রশ্ন: লাইলাতুল কদরের ফজিলত পেতে হলে কি মসজিদে গিয়ে সারা রাত ইবাদত করা শর্ত নাকি যে যেখানে থাকে সেখানে ইবাদত করলে হবে?
অনুরূপভাবে এ জন্য কি সারা রাত জেগে ইবাদত করা জরুরি না কি কিছু ঘুমানো যাবে?
উত্তর:
লাইলাতুল কদর ফজিলত পেতে হলে মসজিদে গিয়ে সারা রাত ইবাদত করা শর্ত নয়। অর্থাৎ পুরুষরা যদি ইশা এবং ফজরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে এবং রাতের বাকি অংশ ঘরে নফল সালাত আদায় ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি করে তাহলেও ইনশাআল্লাহ এ রাতের মর্যাদা লাভ করা সম্ভব। তদ্রূপ মহিলারাও বাড়িতে ইবাদত করে এ মর্যাদা লাভ করতে পারে। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি নিজস্ব কাজকর্ম, দোকানদারী বা ডিউটি পালন রত অবস্থায়ও এ রাতের মর্যাদা লাভের নিয়তে মুখে তাসবীহ-তাহলীল, জিকির-আজকার, দুআ, ইস্তিগফার, লাইলাতুল কদরের বিশেষ দুআ (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন….) পাঠ করে, দেখে বা মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করে বা তাফসীর-হাদিস পাঠ করে, দীনী ইলম চর্চা করে এবং সময় পেলে মাঝে-মধ্যে কিছু নফল সালাত আদায় করে তাহলেও এ মর্যাদা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।
অনুরূপভাবে এ রাতের মর্যাদা লাভ করার জন্য পুরো রাত জাগাও শর্ত নয়। কেউ যদি শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে রাতের কিয়দংশ ঘুমায় বা প্রয়োজনীয় কাজ করে আর বাকি অংশ সাধ্যানুযায়ী ইবাদতে কাটায় তাহলেও এ রাতের মর্যাদা লাভ করা যাবে ইনশাআল্লাহ। (আল মুনাবী, ফয়যুল কাদীর)
মোটকথা, এ রাতে প্রত্যেকেই তার সাধ্যানুযায়ী ইবাদত-বন্দেগি করার চেষ্ট করবে। যে যতটুকু করতে সক্ষম হবে সে ততটুকেই প্রতিদান পাবে। তবে এ জন্য কেবল একটি রাত জাগাই যথেষ্ট নয় বরং শেষ দশকের কমপক্ষে ৫টি বেজোড় রাত তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ জেগে ইবাদত করার চেষ্ট করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা যেন, আমাদেরকে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ মহিমান্বিত রাতে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে তার সৌভাগ্যবান ও মুক্তিপ্রাপ্ত প্রিয় বান্দাদের দলভূক্ত করে নেন। আমীন।

(২৪) রমাযান মাসে যে কোন ইবাদতের সওয়াব ৭০গুণ বৃদ্ধি করা হয়” এটি কতটকু সহীহ?

প্রশ্ন: “রমাযান মাসে যে কোন ইবাদতের সওয়াব ৭০গুণ বৃদ্ধি করা হয়” এটি কতটকু সহীহ?
উত্তর:
“রামাযান মাসে যে কোন ইবাদতের সওয়াব ৭০গুণ বৃদ্ধি করা হয়”- এটি ভিত্তিহীন কথা। তবে এ ধরণের একটি হাদীস পাওয়া যায় কিন্তু তা মুনকার বা মারাত্মক দুর্বল। তা হল,
“যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করেন, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরয সম্পাদন করল।”
(এ হাদীসটি মুনকার : য‘ঈফ আত্ তারগীব ৫৮৯, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৮৮৭, শু‘আবূল ঈমান ৩৩৩৬। কারণ এর সানাদে ‘আলী ইবনু যায়দ ইবনু জাদ্‘আন একজন দুর্বল রাবী।)

 (২৫) সুন্নত পালনার্থে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা দিন টাকা দিয়ে নয়ঃ

প্রশ্ন: যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে টাকা দেয়া সুন্নত না কি খাদ্যদ্রব্য?
উত্তর:
হাদীসে ফিতরা হিসেবে খাদ্যদ্রব্য প্রদানের কথাই বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তারা কখনো খাদ্যদ্রব্য ছাড়া দিনার-দিরহাম বা অন্য কিছু দ্বারা ফিতরা প্রদান করেছেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
কি কি জিনিস দ্বারা এবং কত পরিমাণ ফিতরা দেওয়া সুন্নত?
এর উত্তর সহীহ হাদীসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে যার, ফল কথা হল: খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর কিংবা প্রধান খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা দেওয়া সুন্নত, মূল্য দ্বারা নয়। আর এক জন ব্যক্তিকে এক সা’ ফিতরা দিতে হবে, যার পরিমাণ সাধারণ মানুষের চার পূর্ণ অঞ্জলি সমান। [ফাতাওয়া মাসায়েল, মাওলানা কাফী, পৃঃ ১৭২-১৭৩] কেজির ওজনে তা আড়াই কিলোর কম নয়।
ইবনে উমার (রাযি:) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
‘‘ আল্লাহর রাসূল যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক ’সা কিংবা এক ’সা যব ফরয করেছেন মুসলিম দাস, স্বাধীন ব্যক্তি, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড়র প্রতি। আর তা লোকদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন”। [ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩/ মুসলিম নং ২২৭৫]
উক্ত হাদীসে দুটি খাদ্য দ্রব্যের নাম পাওয়া গেল যা, দ্বারা নবীর যুগে ফিতরা দেওয়া হত। একটি হচ্ছে খেজুর অপরটি যব। এবার নিম্নে আর একটি হাদীস পাঠ করুন।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযি:) বলেন :
‘‘আমরা-নবীজীর যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক শ্বা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা’ পনীর কিংবা এক শ্বা কিশমিশ’’ [ বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১]
এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল : কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবীজীর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া (রাযি:) এর খেলাফত কালে অনেকে গম দ্বারা ফিতরা দিতেন। [ বুখারী হাদীস নং ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১ ]
তাই আমরা যদি সুন্নত অনুসরণ করতে চাই তাহলে আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রধান খাদ্যদ্রব্য তথা চাল দ্বারা ফিতরা দেয়া কর্তব্য। ফিতরার মুল্য দ্বারা অথবা সেটাকা দিয়ে পোশাক, চিনি, তেল, মসলা, শেমাই, গোস্ত ইত্যাদি কিনে দেয়া সুন্নত পরিপন্থী।
তবে একান্ত জরুরি অবস্থায় টাকা দ্বারা ফিতরা দেয়া যেতে পারে বলে, অনেক আলেম মন্তব্য করেছেন। যেমন, রোগীর চিকিৎসার জন্য জন্য এই মুর্হতে টাকা প্রয়োজন। চাল দিলে সেটা বিক্রয় করে টাকা সংগ্রহ করতে গেলে রোগীর সমস্যা বেড়ে যেতে পারে…বা এ জাতীয় পরিস্থিতে ফিতরার মূল্য দিলেও আদায় হয়ে যাবে। কারণ এখানে বিশেষ পরিস্থিতে মুল্য দ্বারা ফিতরা প্রদান করা হয়েছে।
সুতরাং আমাদের কতর্ব্য খাদ্যদ্রব্য দেয়া। কেউ যদি তা নিতে না চায় তাহলে এমন ব্যক্তিকে দেয়া উচিৎ যে তা গ্রহণ করবে।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের হানাফী সামাজ থেকে খাদ্যদ্রব্য দেয়ার সুন্নতটি প্রায় উঠে যাওয়ার কারণে তারা প্রতি বছর টাকা নির্ধারণ করে থাকেন আর গরীবরাও টাকা ছাড়া অন্য কিছু নিতে চায় না। তবে আল হামদুলিল্লাহ অধিকাংশ আহলে হাদীস সমাজে খাদ্যদ্রব্য দেয়ার সুন্নতটি এখনো প্রচলিত রয়েছে।
সৌদি আবরেও এখনো ফিতরা হিসেবে চাল দেয়ার সুন্নতটি চালু আছে। এখানে চেরিটেবল সোসাইটিগুলোতে চাল ও টাকা উভয়টি নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা দ্বারা চাল কিনে গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

 (২৬) শবে কদরের বিশেষ দুআ এবং তা কখন কিভাবে পড়তে হয়?

প্রশ্ন: শবে কদরের বিশেষ দুআ এবং তা কখন কিভাবে পড়তে হয়?
উত্তর:
শবে কদর/লাইলাতুল কদরে রাত জেগে অধিক পরিমাণে নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দ্বীনী ইলম চর্চা সহ বিভিন্ন ধরণের ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি বেশি বেশি দুআ করা উত্তম কাজ। আর সে সব দুআর মধ্যে নিম্নোক্ত দুআটি অধিক পরিমাণে পাঠ করা উচিৎ যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মা আয়েশা রা. কে শিখিয়েছিলেন।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দুয়াটি পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি বল:
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারীম তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।
“হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অত:এব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।”
(তিরমিযী, অনুচ্ছেদ, কোন দুয়াটি শ্রেষ্ঠ। তিনি বলেন: হাদিসটি হাসান, সহীহ, শাইখ আলবানী রহ. এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। দ্র: সহীহুত তিরমিযী, হা/৩৫১৩)।
মুসনাদে আহমাদে كريمٌ ”কারীমুন” শব্দ ছাড়া বর্ণিত হয়েছে। উভয়টি সহীহ।
এ দুআটি কখন কিভাবে পাঠ করতে হয়?
উক্ত দুআটি সিজদা অবস্থায়, দুআ কুনুতে, নামাযের বাইরে হাত তুলে দুআ/মুনাজাত করার সময় এবং সাধারণভাবে বসা অবস্থায়, চলা-ফেরা করার সময় বা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে অধিক পরিমাণে পাঠ করা যায়। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।

(২৭) শবে কদরের কি বিশেষ সালাত আছে?

প্রশ্ন: শবে কদরের কি বিশেষ সালাত আছে? এ রাতে কি সালাতুত তওবা, সালাতুল হাজত বা সালাতুল তাসবীহ পড়া যাবে?
উত্তর:
শবে কদরের জন্য আলাদা কোন নামায নেই। বরং সাধারণ তারাবীহ/তাহাজ্জুদ সালাতগুলো দীর্ঘ কিয়াম, কিরাআত, রুকু, সেজদা ইত্যাদির মাধ্যমে পড়াই যথেষ্ট।
তবে কেউ ইচ্ছা করলে এ রাতে সালাতুত তওবা বা তওবার দু রাকআত নামায পড়তে পারে। কিন্তু এটি এ রাতের সাথে নির্দিষ্ট নয় বরং তা যে কোন সময় পড়া যেতে পারে। 
 আর সালাতুল হাজত বা অভাব পূরণের নামায সম্পর্কে কোন সহীহ হাদিস নাই। এ ব্যাপারে কিছু হাদিস পেশ করা হয় কিন্তু সেগুলো কিছু বানোয়াট আর কিছু দুর্বল। বরং ফরয, সুন্নাত অথবা সাধারণ নফল সালাত আদায় করার সময় সেজদায় বা তাশাহুদে বসে সালাম ফিরানো পূর্বে নিজের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে দুয়া করা যায়। অনুরূপভাবে সালাত আদায় করার পরও নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য দুআ করা যেতে পারে।
(সালাতুল হাজত প্রসঙ্গে আমাদের আলাদা পোস্ট রয়েছে)
আর সালাতুত তাসবীহ পড়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মাঝে প্রবল দ্বিমত আছে। কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা পড়া জায়েজ বলেই একদল মুহাদ্দিস মত প্রকাশ করেছেন। সুতরাং কেউ যদি শবে কদরে এ সালাত আদায় করতে চায় করতে পারে। কিন্তু তা এ রাতের জন্য নির্দিষ্ট নয় বরং যে কোন দিন তা পড়া জায়েজ রয়েছে।
(সালাতুত তাসবীহ প্রসঙ্গেও আমাদের আলাদা পোস্ট রয়েছে)

 (২৮) পড়ালেখার কৌশল ও স্মরণ শক্তি বৃদ্ধির উপায়ঃ

প্রশ্ন: স্মরণ শক্তি বৃদ্ধির উপায় কি? কিভাবে পড়ালেখা করলে আমি পড়ালেখা মুখস্থ রাখতে পারব? দয়া করে এমন কিছু দুআ ও আমলের কথা বলুন যেগুলোর মাধ্যমে আমি ভুলে যাওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
উত্তর:
জ্ঞানার্জনের জন্য একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। যেমন:
১. জ্ঞানার্জনের প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা
২. পূর্ণ বোধশক্তি (বোঝার ক্ষমতা) থাকা।
৩. মনের মধ্যে প্রশান্ত ভাব ও স্থিরতা থাকা। মনে অস্থিরতা ও বিক্ষিপ্ততা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা।
৪. সব সময় পড়ালেখার মধ্যে থাকা।
৫. প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে পড়া।
ভুলে যাওয়ার চিকিৎসা:
১. ভুলে গেলে পড়াটা আবার পড়া। যতবার ভুলে যাবেন ততবারই বই খুলে দেখে নিতে হবে।
২. মুখস্থ কৃত বিষয়গুলো বারবার রিপিট করা বা কাউকে শোনানো।
৩. বইয়ের সিরিয়াল অনুযায়ী নয় বরং মূল পয়েন্টগুলো সংক্ষেপে নিজস্ব সিরিয়াল অনুযায়ী সাজিয়ে লিখা। পড়াগুলোকে নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়াটা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ধরে রাখার জন্য খুবই কার্যকর।
৪. পুরোটা টেক্সট মুখস্থ না করে কেবল অল্প কয়েকটা পয়েন্ট মুখস্থ রাখা যেগুলো স্মরণ করলে বাকি কথাগুলো অনেকটাই স্মরণ হবে।
৫. কয়েকজন আগ্রহী শিক্ষার্থী একসাথে স্টাডি করা। একজন শিক্ষকের মত বাকিদেরকে পড়াবে। কোথাও ত্রুটি হলে অন্যরা সংশোধন করে দিবে। যে যে বিষয়টা ভালো বুঝে সে অন্যদেরকে সে বিষয়টা পড়াবে।
স্মৃতিশক্তি প্রখর করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ:
১) সব ধরণের পাপাচার থেকে দূরে থাকা। পাপাচার স্মৃতিশক্তি ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ।
২) সুস্বাস্থ্য। এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম ও পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার।
৩) নিম্নোক্ত তিনটি খাবার স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। যথা:
ক. আদা
খ. মধু
গ. কিশমিশ।
পূর্ববর্তী মনিষীগণ স্বরণশক্তি বৃদ্ধির জন্য এ তিনটি খাবারের প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
৪) আল্লাহর নিকট জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য দুআ করা। সেজদা অবস্থায়, আযান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়, ভোর রাতে তাহাজ্জুদ সালাতের পরে, জুমার দিন আসর থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত সময়, রোযা অবস্থায়, সফর অবস্থায় এবং অন্যান্য সময় হাত উঠি আল্লাহর কাছে নিজের ভাষায় স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি এবং নিজের সমস্যা ও প্রয়োজন তুলে ধরে দুআ করতে হবে।
বেশি বেশি পাঠ করুন:
“রাব্বি যিদনী ইলমা” (হে আল্লাহ, আপনি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।)

 (২৯) মহিলাগণ কোথায় ইতিকাফ করবে?

প্রশ্ন: (এক বোনের প্রশ্ন) আমার এক খালাম্মা প্রতি রমজানের শেষে ঘরের মধ্যে ইতিকাফে বসেন। তাকে নিষেধ করা হলেও বসবে। কারণ, মসজিদের হুজুররা বলে, ঘরে মহিলাদের ইতিকাফ হবে। কুরআন- হাদিসের দলিলের আলোকে এ ক্ষেত্রে সঠিক বিষয়টি জানতে চাই।
উত্তর:
ইতিকাফের জন্য শর্ত হল, মসজিদ। মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহীহ নয়। এই শর্ত পুরুষ-মহিলা সবার জন্য প্রযোজ্য।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।” (সূরা বাকারা: ১২৫)
আল্লাহ আরও বলেন:
“আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। ” (সূরা বাকরা:১৮৭)
এ আয়াতগুলোতে মসজিদে ইতিকাফ করার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
“রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রামযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন আর তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”
নারীদের জন্য তার ঘরকে মসজিদ বলা ঠিক নয়। কারণ, মসজিদে ঋতুবতি মহিলাদের দীর্ঘ সময় অবস্থান করা নিষেধ। ঘর যদি মসজিদ হত তাহলে সে ঘরে মহিলাদের অবস্থান করা বৈধ হত না। অনুরূপভাবে ঐ ঘর বিক্রয় করাও বৈধ হত না।
বি: দ্র:
মসজিদের মধ্যে মহিলাদের যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে এবং তার ইতিকাফের কারণে যদি সন্তান প্রতিপালন, ঘর-সংসারের নিরাপত্তা এবং তার উপর অর্পিত অপরিহার্য কবর্ত্য পালনে ব্যাঘাত না ঘরে তবে স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি স্বাপেক্ষে ইতিকাফ করা বৈধ হবে। অন্যথায়, তার জন্য ইতিকাফ না করে বরং নিজ দায়িত্ব যাথাযথভাবে পালন, সংসার দেখা-শোনা, স্বামীর সেবা ইত্যাদিতেই অগণিত কল্যাণ নিহীত রয়েছে। তিনি কাজের ফাঁকে যথাসাধ্য দুয়া, তাসবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবেন। আল্লাহই তাওফীক দাতা।

(৩০) অমুসলিমদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ইফতার খাওয়া কি জায়েয?

প্রশ্ন: এক ব্যক্তি হিন্দু মালিকের অধীন এ জব করে। সে হিন্দু মালিক প্রতি বছর ইফতার এর আয়োজন করেন। এখন সে কি হিন্দু মালিক এর আয়োজন কৃত ইফতারে অংশগ্রহণ করতে পারবে?
উত্তর:
কোন অমুসলিম যদি ইফতারের আয়োজন করে তাহলে তা মুসলিমদের খেতে কোনো আপত্তি নাই যদি তা নিরাপদ মনে হয়।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, বিভিন্ন সময় কাফির- মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে উপহার দিলে তিনি সেগুলো গ্রহণ করেছেন, তিনি ইহুদী মহিলা কর্তৃক প্রদত্ত জবেহ কৃত ছাগলের গোস্ত খেয়েছেন-যেটাতে বিষ মেশানো ছিল। (কিন্তু তিনি তা না জানার কারণে খেয়েছিলেন।) [সহীহ বুখারী ও মুসলিম], তিনি ইহুদির দাওয়াত কবুল করে তাদের বাড়িতে গিয়েও তাদের খাবার খেয়েছেন।
মোটকথা, কোনো অমুসলিম যদি ইফতার হিসেবে হালাল খাবারের ব্যবস্থা করে তাহলে মুসলিম রোজাদারদের জন্য তা খেতে কোনো আপত্তি নাই ইনশাআল্লাহ-যদি সেখানে খাওয়া নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু যদি তাতে ক্ষতির আশঙ্কা করে তাহলে বিরত থাকা অপরিহার্য। আল্লাহু আলাম।

(৩১) উমর রা. কি ২৩ রাকআত তারাবীহ সালাত চালু করেছিলেন?

প্রশ্ন: উমর রা. কি ২৩ রাকআত তারাবীহ সালাত চালু করেছিলেন?
হারামাইন তথা মক্কা-মদিনায় কেন ২৩ রাকআত পড়া হয়?
উত্তর:
উমরা রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তিনি (৮+৩=) ১১ রাকআত তারাবীহ সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে ২৩ রাকআত চালু করার হাদিসকে মুহাদ্দিসগণ যঈফ বা দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
নিম্নে উভয় প্রকার হাদিসের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হল:
উমর রা. কর্তৃক ১১ রাকআত তারাবীহ চালু করার এর হাদিস: (সহীহ)
নির্ভরযোগ্য রাবী মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ রাহ. সায়েব বিন ইয়াজিদ রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
“উমর বিন খাত্তাব রা. উবাই বিন কা’ব এবং তামীম দারী রা.কে নির্দেশ দিয়েছেন লোকদেরকে নিয়ে ১১ রাকআত তারাবীহ সালাত পড়ার।”
( মুআত্তা মালিক, শাইখ আলবানী রহ. বলেন, এর সনদ অত্যন্ত সহীহ, গ্রন্থ: সালাতুত তারাবীহ, পৃষ্ঠা ৫৩। আরও দেখুন, শরহুয যুরকানী ১/১৩৮)
উমর রা. কর্তৃক ২৩ রাকআত তারাবীহ চালু করার এর হাদিস: (যঈফ)
উমর রা. কর্তৃক ২০ রাকআত পড়ার নির্দেশ দানের হাদিসটিকে মুহাদ্দিসগণ যইফ (দুর্বল) বলেছেন। হাদিসটি হল:
ইমাম মালিক তার মুআত্তা গ্রন্থে ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
“ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে বর্ণিত, লোকেরা উমর বিন খাত্তাব (রা:)এর আমলে রমাযান মাসে কিয়ামুল লইল (বিতরসহ) ২৩ রাকআত আদায় করতেন।”
এ হাদিসটি দুর্বল। কয়েকটি কারণে:
 (১) এর সনদে ইনকিতা (বিচ্ছিন্নতা) রয়েছে। অর্থাৎ এর বর্ণনা সূত্রে কোন একজন রাবী (বর্ণনাকারী) বাদ পড়েছে। কারণ ইয়াজিদ বিন রুমান উমর (রা:) এর যুগ পায় নি। যেমন ইমাম নববী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ ঘোষণা করেছেন।
 (২) ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদীসটি ইমাম মালিক রহ. তাঁর মুআত্তা গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য রাবী মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত সহীহ হাদিসের বিরোধী (পূর্বোল্লিখিত হাদিস)
৩) ১১ রাকআতের ব্যাপারে সায়েব বিন ইয়াজিদের হাদীছটি দোষ থেকে মুক্ত। তার সনদ মুত্তাসিল (অবিচ্ছিন্ন)। আর ইয়াজিদ বিন রুমানের হাদিস দুর্বল। সায়েব বিন ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ বিন ইউসুফ। তিনি ইয়াজিদ বিন রুমান থেকে অধিক নির্ভর যোগ্য। কেননা মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন ثقة ثبت (সিকাহ সাবত)। আর ইয়াজিদ বিন রুমান সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, তিনি শুধু ثقة (ছিকাহ)। আর উসুলে হাদীসের পরিভাষায় সিকাহ সাবেত রাবীর বর্ণনা শুধু সিকাহ রাবীর বর্ণনা থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য।
এছাড়াও বহু হানাফি মুহাদ্দিস উক্ত ২০ রাকআত পড়ার হাদিসকে যঈফ বলেছেন।
 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের নফল সালাত কত রাকআত পড়তেন? এবং তার ধরণ কেমন ছিল?
আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত যে হাদিসটির প্রতি ফতহুল বারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ ইঙ্গিত করেছেন, তা ইমাম বুখারী এবং মুসলিম স্বীয় কিতাব দ্বয়ে উল্লেখ করেছেন। আবু সালামা আব্দুর রাহমান আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন: রমাযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায ১১ রাকআতের বেশী পড়তেন না। (সহীহ বুখারী)
মুসলিমের শব্দে বর্ণিত হয়েছে, তিনি প্রথমে আট রাকআত পড়তেন। অতঃপর বিতর পড়তেন।
ইবনে আব্বাস (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের নামাযের ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি দুই রাকআত নামায পড়তেন, অতঃপর আরও দুই রাকআত পড়তেন। তারপর আরও দুই রাকআত, এভাবে ১২ রাকআত পূর্ণ করে বিতর পড়তেন। (সহীহ মুসলিম) এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে তাঁর রাতের নামায ১১ রাকআত বা ১৩ রাকআতের মধ্যেই ঘূর্ণ্যমান ছিল।
 তারাবীহর সালাত ১১/১৩ রাকআতের বেশি পড়া:
রাতের নফল সালাত ১১ বা ১৩ রাকআত এর বেশি পড়লেও আপত্তি নাই। রাতে যত খুশি নফল সালাত পড়ার অনুমতির ব্যাপারে আলাদা হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। যেমন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“রাতের সালাত দু’রাকাত, দু’রাকাত, যখন তোমাদের কেউ ভোর হওয়ার আশংকা করবে, সে এক রাকাত সালাত আদায় করবে, যা তার পূর্বের সালাতগুলো বেজোড় করে দিবে” (বুখারী, হা/ ৯৯০ ও মুসলিম হা/৭৪৯)
২৩ রাকআত তারাবীহ কি যুগে যুগে চলে আসা ইজমা?
না, ইজমা নয়। কারণ হাফেজ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফতহুল বারীতে এ ব্যাপারে মতপার্থক্যের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন:
আবান বিন উসমান এবং উমর বিন আব্দুল আজীজের আমলে মদিনাতে ৩৩ রাকআত তারাবী পড়া হতো। ইমাম মালিক (র:) বলেন একশ বছরেরও বেশী সময় পর্যন্ত চলমান ছিল। (দেখুন ফতহুল বারী, আল মাকতাবা সালাফীয়া ৪/২৫৩) (মূল কথাগুলো আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন এর লেখা থেকে সংকলিত)
বর্তমানেও দু হারাম তথা মক্কা-মদিনায় রমাযানের শেষ দশকে ৩৩ রাকআত পড়ার নিয়ম চালু আছে।
মোটকথা, ৮ তারাবীহ এবং তিন রাকআত বিতর সহ মোট এগারো রাকআত পড়া অধিক উত্তম। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ দ্বারা সু প্রমাণিত। (যেমনটি ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।)
তবে এর চেয়ে বেশি পড়াও জায়েয আছে।
সুতরাং কেউ যদি ১১ রাকআতের বেশি পড়াকে বিদআত বলে অথবা কেউ যদি ২৩ রাকআতের কম বা বেশি পড়াকে বিদআত বলে তাহলে সে নি:সন্দেহে ভুলের মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমীন।
(৩২) রমজান মাসে কোনটির দিকে বেশী গুরুত্ব দিব
প্রশ্ন: রমজান মাসে কোনটির দিকে বেশী গুরুত্ব দিব?
কুর’আনের অক্ষরের তিলাওয়াতের দিকে? নাকি অনুবাদসসহ তিলাওয়াতের দিকে?🔸🔸
উত্তর :
এক্ষেত্রে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়। অনেক আলেম বলেছেন, এ মাসে অধিকমাত্রায় তিলাওয়াত করা উত্তম। আর অনেক আলেম বলেছেন কুরআনে অর্থ, ব্যাখ্যা জেনে কুরআন গবেষণার মনোভাব নিয়ে তিলাওয়াত করা অধিক উত্তম।
তবে দলীলের আলোকে ‘কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি এর মমার্থ জানার চেষ্টা করা অধিক উত্তম’ এটি অধিক অগ্রগণ্য মত বলে বিবেচিত হয়। কেননা,
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।” (সূরা স্বদ-২৯)
আল্লাহ আরও বলেন:
“তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মদ: ২৪)
 আল্লাহ আরও বলেন:
 “রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।” (সূরা বাকরা: ১৮৫)
কুরআনের মমার্থ জানার চেষ্টা ছাড়া তিলাওয়াত করলে সওয়াব অর্জন হলেও কুরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে এবং হক ও বাতিলের মাধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কুরআনের ব্যাখ্যা জানা ও কুরআন নিয়ে গবেষণা ছাড়া কী করে সম্ভব?
 সহীহ বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হয়েছে,
“জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রমাযানের প্রতিরাতে রাসূল সা. এর নিকট এসে তার সাথে কুরআন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন।”
 সহীহ বুখারীতে এ ও বর্ণিত হয়েছে যে,
জিবরাঈ আ. প্রতি রামাযানে রাসূল সা. এর নিকট একবার করে পূরো কুরআন পেশ করতেন কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যু বরণ করেন সে বছর দুবার কুরআন পেশ করেছেন।” (বুখারী, হা/৪৬১৬)
এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, রামযান মাসে অধিক পরিমানে কুরআন পাঠ করা, কুরআন খতম করা এবং কুরআন নিয়ে আলোচনা-পর্যালচনা করা মুস্তাহাব।
তবে আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, যারা কুরআনের ভাষা জানেন এবং কুরআন পড়ে তার মৌলিক মর্মবাণী উপলদ্ধি করতে সক্ষম তাদের জন্য বেশী বেশী তিলাওয়াত করা অধিক উত্তম। যেমন, অনেক সালাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা রামযানে অধিকমাত্রায় কুরআন তিলওয়াতের দিকে ঝুঁকতেন। আর যারা কুরআনের ভাষা বুঝেন না এবং তিলাওয়াত করেই এর মমার্থ বুঝতে পারেন না তাদের জন্য তরজমা ও তাফসীর জানার চেষ্টা করা সর্বাধিক উত্তম এতে কোন সন্দেহ নাই।
সুতরাং আমাদের করণীয় হল, রামাযানে সাধ্যানুযায়ী অধিক পরিমানে কুরআন তিলাওয়াত করা সেই সথে কুরআনের তরজমা ও তাফসীর জানার চেষ্টা করা।
মোটকথা,রামাযান হল কুরআনের মাস। আমরা যেন বিশেষ করে এ মাসে কুরআন পাঠ, পঠন, শিক্ষাদান, মুখস্থ করণ, কুরআনের শিক্ষা পর্যালোচনার পাশাপাশি বাস্তব জীবন তা বাস্তবায়নের প্রেরণা গ্রহণ করি সে জন্য আামাদের সর্বাত্তক তৎপরতা থাকা কতর্ব্য। আল্লাহ তাওফিক দানকারী।

 (৩৩) ১৭ রমাযান ‘বদর দিবস’ পালন করার বিধান এবং ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের শিক্ষাঃ

২য় হিজরির রমাযান মাসের সতের তারিখে মদিনার প্রায় ১৩০ কি:মি: দূরে অবস্থিতি ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার জানবাজ সাহসী সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এক যুগান্তকারী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্র সম্ভার এবং জনবলে এক অসম যুদ্ধ। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নেতৃত্বে মুসলিমগণ অতি নগণ্য সংখ্যক জনবল আর খুব সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সুদূর মক্কা থেকে ছুটে আসা একদল রক্ত পিপাষু হিংস্র কাফেরদের বিশাল অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর প্রতিরোধ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা সে দিন অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে বিশাল সম্মানজনক বিজয় দান করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার মাঝে চূড়ান্ত পার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
এ এক ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তাই বলে কি প্রতি বছর নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে ‘বদর দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার অনুমতি ইসলামে রয়েছে? রাসুল সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের অনুসারী তাবেঈনগণ কি এমন কিছু করেছেন? উত্তর, কখনো নয়। তাহলে কেন দ্বীনের নামে এই বিদআতের আয়োজন?
যদিও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির প্রচলন তেমন নেই। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের বিদআতের পৃষ্ঠপোষকতা কারী কতিপয় প্রতিষ্ঠান, খানকা, দরবার এবং ইসলামী সংগঠন প্রতি বছর বেশ জাঁকজমক ভাবে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করে থাকে! এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়, আলোচনা সভা, দুআ অনুষ্ঠান, মিলাদ ও কিয়াম মাহফিল,আজিমুশান নূরানি মাহফিল ইত্যাদি।
অথচ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার সর্বোত্তম আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং সালাফে সালেহীন থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের কোন ভিত্তি নাই।
বদর যুদ্ধের এ ঘটনা নি:সন্দেহে মুসলিম জাতির প্রেরণার উৎস। এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘দিবস পালন’ করা শরীয়ত সম্মত হতে পারে না।
বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন চরিতের অংশ হিসেবে আমরা সিরাতের কিতাবগুলো থেকে এবং বিজ্ঞ আলেমদের বক্তব্য শুনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করব। কিন্তু প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে দিবস পালন করার যেহেতু কোন ভিত্তি নাই সেহেতু অবশ্যই আমাদেরকে এ সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।
(আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের মধ্যে নিত্য-নতুন আবিষ্কার থেকে হেফাজত করুন। আমীন।)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়ত জীবনে রয়েছে অনেক বক্তৃতা, সন্ধি-চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা, যেমন, বদর, হুনাইন, খন্দক, মক্কা বিজয়, হিজরত মূহুর্ত, মদিনায় প্রবেশ, বিভিন্ন বক্তৃতা যেখানে তিনি দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি তো এ দিনগুলোকে উৎসব/দিবস হিসেবে পালন করা আবশ্যক করেন নি। বরং এ জাতীয় কাজ করে খৃষ্টানরা। তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইহুদীরাও এমনটি করে। ঈদ-উৎসব হল শরীয়তের একটি বিধান। আল্লাহ তায়ালা শরীয়ত হিসেবে যা দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।”[ ইকতিযাউয সিরাতিল মুস্‌তাকীম। (২/৬১৪ ও ৬১৫)]
 মূলত: এ জাতীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরীয়ত থেকে দূরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। শরীয়ত যে কাজ করতে আদেশ করে নি তা হতে দূরে অবস্থান করে রমাযান মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায আদায় করা, জিকির-আযকার এবং অন্যান্য এবাদত-বন্দেগি বেশি বেশি করা দরকার। কিন্তু মুসলিমদের একটি বড় অংশের অন্যতম সমস্যা হল, শরিয়ত অনুমোদিত ইবাদত বাদ দিয়ে নব আবিষ্কৃত বিদআতি আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।
(৩৪) বদর যুদ্ধের শিক্ষা এবং আমাদের করণীয়ঃ
বদর যুদ্ধ মুসলিম জাতিকে শিক্ষা দেয়:
তাওহীদ ও শিরকের সংঘাত চিরন্তন। এ সংঘাতে প্রকৃত তাওহীদ পন্থীদের বিজয় হয়।
এ পথে বিজয় অর্জন করতে চাইলে হৃদয়ে শিরক মুক্ত ঈমান চাষ করতে হবে।
সামরিক শক্তির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আল্লাহর প্রতি অবিচল ভরসা ও সুদৃঢ় ঈমানি শক্তি।
বিজয় আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহর সাহায্য ব্যতিরেকে মুমিনদের বিজয় সম্ভব নয়।
অহংকারীদের পতন অনিবার্য। বদর যুদ্ধে মক্কার বাঘা বাঘা অহংকারী, উদ্ধত নেতাদের ধ্বংস ও পরাজয় এর প্রমাণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অত্যন্ত বিচক্ষণতা পূর্ণ নেতৃত্ব। তাঁর নেতৃত্বকে মানলে দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্যের শীর্ষে উপনীত হওয়া সম্ভব।ইত্যাদি।
পরিশেষে বলব, ঘটা করে ১৭ রমাযান ‘বদর দিবস’ পালন নয় বরং বছরের যে কোন সময় এ বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা ইত্যাদি করা করা যেতে পারে। শুধু বদরকে কেন্দ্র করে নয় রবং ইসলামের প্রতিটি ঘটনাকে নিয়েই এ সব শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে মুসলিমগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস নিয়ে খুব কমই আলোচনা-পর্যালোচনা করে! অথচ এসব ঘটনা আমাদের হৃদয় কন্দরে সীমাহীন প্রেরণা ও এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়।
আল্লাহ আমাদেরকে বদরের শিক্ষায় উজ্জীবিত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন

(৩৫) মাজলুম কাকে বলে? আখিরাতে জুলুমের পরিণতি কি?

প্রশ্ন: মজলুম কাকে বলে? যেমন: আমাকে কেউ একজন অন্যায়ভাবে গালি দিয়ে কষ্ট দিলো। আমি এতে কষ্ট পেয়ে কাঁদলাম। এখন আমি কি মজলুম হয়ে গেলাম? মজলুমের বদ দুয়া আর আল্লাহর মধ্যে পর্দা থাকে না-এ কথা কি ঠিক? আর সে যদি মাফ না চায় আর আমি যদি তাকে নিজ থেকে মাফ না করি তাহলে কি আমার গুনাহ হবে?
উত্তর:
কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করাকেই জুলুম বলা হয়। যে অন্যায় করল সে জালিম (অত্যাচারী) আর যার উপর অন্যায় করা হল সে মাজলুম (অত্যাচারিত)।
 জুলুমের উদাহরণ:
অন্যায়ভাবে আঘাত করা, রক্তপাত ঘটানো, সম্পদ লুণ্ঠন করা, অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, ন্যায় বিচার না করা, গালি দেয়া, অপবাদ দেয়া, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, গিবত বা অসাক্ষাতে দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করা বা অন্য কোনো উপায়ে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া ইত্যাদি। এগুলো সবই জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।
জুলুমের পরিণতি:
মাজলুমের বদদুআ আর আল্লাহর মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মাজলুমের দুআ সরাসরি কবুল করেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছেে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“মাজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাক। কারণ তার বদদোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই।।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আখিরাতে জুলুমের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সে দিন মানুষের অন্যায়-জুলুম-অবিচারগুলো অন্ধকার রূপ ধারণ করে সামনে এসে হাজির হবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
 “তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো। কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার রূপ নিয়ে হাজির হবে।” (সহীহ মুসলিম)
সবচেয়ে মহান ন্যায় বিচারক মহান আল্লাহ সে দিন বিচারের কাঠ গড়ায় জালিমদের বিচার করবেন। তিনি মাজলুমের পক্ষে রায় দিবেন। তিনি জালিমের নেকি কর্তন করে মাজলুমকে দান করবেন আর মাজলুমের গুনাহ জালিমের উপর চাপিয়ে দিবেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন।
ক্ষমা ও সমঝোতা উত্তম:
যদি দুনিয়াতেই একে অপরের সাথে সমঝোতা করে নেয়, ক্ষমা চায় অথবা মাজলুম ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে জালিমকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে তা নি:সন্দেহে উত্তম। এ জন্য সে আখিরাতে প্রতিদান পাবে।
 আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যদি তোমরা মার্জনা কর, উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” (সূরা তাগাবুন: ১৪)
আল্লাহ আরও বলেন:
“আর তোমরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) এর অধিক নিকটবর্তী।” (সূরা বাকারা: ২৩৭)
উল্লেখ্য যে, সব চেয়ে বড় জুলুম হল, আল্লাহর ইবাদতে শিরক করা। তাছাড়া মানুষ যখন আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপকর্মে লিপ্ত হয় তখন সে যেন নিজের উপর নিজেই জুলুম করে। প্রতিটি পাপকর্মই জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জুলুম, অবিচার ও সকল প্রকার অন্যায় আচরণ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৩৬) প্রবাসীরা কি তাদের ফিতরা দেশে দিতে পারে?

প্রশ্ন: প্রবাসীরা কি তাদের ফিতরা দেশে দিতে পারে? দিলে কিভাবে দিবে?
উত্তর:
প্রবাসীরা যদি প্রবাসে গরীব মানুষ পায় তাহলে সেখানে ফিতরা দিবে। এটাই উত্তম। একজন মানুষ যেখানে বসবাস ও আয়-ইনকাম করে সেখানকার গরিব-অসহায় মানুষরা ফিতরা পাওয়ার বেশি হকদার।
কিন্তু যদি মনে হয়, সে দেশের চেয়ে নিজ দেশে বা অন্য কোথাও সঙ্কট ও অভাব-অনটন বেশি তাহলে সেখানে ফিতরা প্রেরণ করা যেতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে প্রবাসে যে পরিমাণ ফিতরা দিতে হত অন্যত্র দিলে সে পরিমাণটা ঠিক রাখা উত্তম। অর্থাৎ প্রবাসে প্রায় আড়াই বা তিন কিলো পরিমাণ চালের মূল্য সমপরিমাণ দেশে বা যেখানে ফিতরা দিতে চান সেখানে চাল দেয়া উত্তম। এতে হয়ত গরিবরা একটু বেশি উপকৃত হবে।
উল্লেখ্য যে, হাদিসে যেহেতু খাদ্যদ্রব্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাই সুন্নত অনুসরণ করতে চাইলে খাদ্যদ্রব্য (নিজ এলাকার প্রধান খাদ্যদ্রব্য যেমন, চাল) দিতে হবে। একান্ত অপরিহার্য পরিস্থিতি না হলে মূল্য বা টাকা দ্বারা ফিতরা দেয়া সুন্নত পরিপন্থী।

(৩৭) যাকাতুল ফিতর/ফিতরার সংক্ষিপ্ত বিধি-বিধানঃ

যাকাতুল ফিতর/ফিতরা দেয়ার হুকুম কি? ফরয।
কার জন্য ফিতরা দেয়া ফরয? বাড়ির প্রতিটি সদস্য পুরুষ-নারী, বড়-ছোট সবার জন্য।
ফিতরা দেয়ার দায়িত্ব কার? গৃহকর্তা নিজের ফিতরা দিবে এবং তার অধিনস্থ ব্যক্তিদের ফিতরা দিবে যাদের ভোরণ-পোষণ দেয়া তার জন্য ফরয।
কোন জিনিস দ্বারা ফিতরা প্রদান করা উচিৎ? প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য। যেমন আমাদের দেশে, চাউল পরিমাণ কত? এক ’সা তথা প্রায় দুই কেজি ৪০০ গ্রাম (চাল বা প্রাধান খাবার)। (অনেক আলেমের মতে ৩ কেজি দেয়া উত্তম) হাদিসে যেহেতু খাদ্যদ্রব্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাই সুন্নত অনুসরণ করতে চাইলে খাদ্যদ্রব্য দিতে হবে। একান্ত অপরিহার্য পরিস্থিতি না হলে ফিতরার মূল্য বা টাকা দ্বারা ফিতরা দেয়া সুন্নত পরিপন্থী।
সময়: ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে। তবে দু/তিন দিন আগেও দেয়া জায়েজ।
উদ্দেশ্য: ঈদের দিন গরিব-অসহায় মানুষের খাবারের ব্যবস্থা এবং রোজাদারকে অর্থহীন কাজ, অশ্লীলতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্র করা।
বণ্টনের খাত: গরীব-অসহায় মানুষ।
মাসায়েল:
প্রয়োজনে এক দেশে থেকে অন্য দেশে ফিতরা প্রেরণ করা জায়েজ।
একজনের ফিতরা একাধিক ব্যক্তিকে যেমন দেয়া জায়েয তদ্রূপ একাধিক ব্যক্তির ফিতরা প্রয়োজনে একজনকেও দেয়া জায়েয।
ঈদের দিনের নিজ পরিবারে খাওয়ার মত অর্থ-সম্পদ এবং ফিতরা দেয়ার সামর্থ থাকলে ফিতরা প্রদান করা আবশ্যক।
গর্ভস্থ সন্তানের ফিতরা দেয়া আবশ্যক নয় তবে দেয়া উত্তম।

(৩৮) অত্যাচারকারীকে ক্ষমা করা অথবা অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করা অথবা বিচারের ভার আল্লাহর উপর সমর্পন করা-কোনটি উত্তম?

কেউ কারো প্রতি জুলুম/অত্যাচার করলে প্রতিশোধ গ্রহন না করে যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। তবে ইচ্ছে করলে জুলুমের প্রতিশোধ নেয়া জায়েয আছে। তবে তা যেন যতটুকু যুলুম করা হয়েছে ততটুকুই হয়; এর চেয়ে অতিরিক্ত না হয়।
এ বিষয়ে নিম্নোক্ত হাদীস দুটি দেখুন:
১) সম্মানিত সাহাবী আবু বকর রা. এর ঘটনা:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। এক লোক এসে আবু বকর রা.কে বকাবকি করতে লাগল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানেই বসে ছিলেন। তিনি এ কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। লোকটি বেশি মাত্রায় বকাবকি শুরু করলে আবু বকর তার দু একটি কথার জবাব দিলেন। এতে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
আবু বকর পেছনে পেছনে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, লোকটি আমাকে বকাবকি করছিল আর আপনি সেখানে বসে ছিলেন। কিন্তু যখনই তার কিছু কথার জবাব দিলাম আপনি রেগে সেখান থেকে চলে আসলেন!!
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিল যে তোমার পক্ষ থেকে উত্তর দিচ্ছিল। আর যখনই তুমি উত্তর দিলে সেখানে শয়তানডুকে পড়ল।
আর হে আবু বকর, তিনটি জিনিস খুবই সত্য:
ক. কেউ কোন ব্যাপারে জুলুমের শিকার হওয়ার পর সে যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা ক্ষমা করে দেয় তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মান জনকভাবে সাহায্য করেন।
খ. কেউ যদি (কোন আত্মীয়ের সাথে বা সাধারণ মুসলমানের সাথে) সুসম্পর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে দানের রাস্তা খুলে তবে আল্লাহর তার সম্পদ আরও বৃদ্ধি করে দেন।
গ. আর কেউ যদি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে ভিক্ষার দরজা উন্মুক্ত করে তবে আল্লাহ তাআলা তার সম্পদ কমিয়ে দেন। (মুসনাদ আহমদ,আলবানী বলেন: হাদীসটি হাসান। মিশকাত হাদীস নং ৫১০২)
২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “দু জন লোক যদি পরস্পরকে গালাগালি করে তবে যাবতীয় গুনাহ তার উপর বর্তাবে যে আগে শুরু করেছে যদি অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রতিদত্তরে অতিরিক্ত না বলে।” (সহীহ মুসলিম)
এ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি আগে কাউকে কষ্ট দেয় বা গালি দেয় তবে তার সমপরিমাণ প্রতিদত্তর দেয়া জায়েজ আছে আর তার যাবতীয় গুনাহ যে আগে শুরু করেছে তার উপর বর্তাবে। কারণ, সেই এর মূল কারণ। অবশ্য যদি প্রতিদত্তরে সে অতিরিক্ত গালমন্দ করে তবে যে পরিমাণ অতিরিক্ত গালমন্দ করেছে তার জন্য গুনাহগার হবে। কারণ,ইসলামে কেবল সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়ার অনুমোদন রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“অন্যায়ের প্রাপ্য শুধু সমপরিমাণ অন্যায়। তবে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় এবং সমঝোতা করে সে আল্লাহর নিকট পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। তিনি তো অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা শূরা: ৪০)
যদিও সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়া জায়েজ আছে তবুও ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। যেমনটি আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদীসটিতে বর্ণিত হয়েছে।
তবে কেউ যদি জুলুমকারীকে ক্ষমাও না করে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বরং আখিরাতে আল্লাহর নিকট বিচারের ভার সপে দেয় তাহলে তা জায়েয রয়েছে।
নিশ্চয় আল্লাহ আখিরাতে এর যথাপযু্ক্ত ন্যায় সঙ্গত বিচার করবেন। সে দিন মহান বিচারক আল্লাহ তাআলা জালিমের সওয়াবগুলো মাযলুমকে দিবেন এবং মাযলুমের গুনাহগুলো যালিমের উপর চাপিয়ে দিবেন। এভাবে অত্যাচাকারী ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি লাভবান হবে। ইনশাআল্লাহ।
উল্লখ্য যে, কেউ কারো উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর নিকট তওবার মাধ্যমে তা ক্ষমা হবে না যতক্ষণ অত্যাচারিত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করে বা দুজনের মাঝে দুনিয়াতে সমঝোতা না হয়।

 (৩৯) যেসকল কারণে সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েযঃ

প্রশ্ন: সিয়াম ভঙ্গ করার গ্রহণযোগ্য কারণ সমূহ কি কি?
সিয়াম ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ সমূহ হল:
১) অসুস্থতা,
২) সফর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলেন, “আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে (সে রোজা ভঙ্গ করে) অন্য দিনে তা কাযা আদায় করে নিবে।” (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)
৩) গর্ভবতী নারীর নিজের বা শিশুর জীবনের আশংকা করলে রোজা ভঙ্গ করবে।
৪) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী নারী যদি রোজা রাখলে নিজের বা সন্তানের জীবনের আশংকা করে তবে রোজা ভঙ্গ করবে।
৫) কোন বিপদগ্রস্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে রোজা ভঙ্গ করা: যেমন পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার, আগুন থেকে বাঁচাতে গিয়ে দরকার হলে রোজা ভঙ্গ করা।
৬) আল্লাহ্‌র পথে জিহাদে থাকার সময় শরীরে শক্তি বজায় রাখার জন্য রোজা ভঙ্গ করা। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের সময় ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “আগামীকাল তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করবে, রোজা ভঙ্গ করলে তোমরা অধিক শক্তিশালী থাকবে, তাই তোমরা রোজা ভঙ্গ কর।”
বৈধ কোন কারণে রোজা ভঙ্গ করলে দিনের বাকি অংশ রোজা অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। কেননা সে তো গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণেই রোজা ভঙ্গ করেছে। এজন্য এ মাসআলায় বিশুদ্ধ কথা হচ্ছেঃ কোন রোগী যদি অসুস্থতার কারণে দিনে রোযা ভঙ্গ করে আর দিন শেষ হওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যায়, তবে দিনের বাকি অংশ রোযা অবস্থায় থাকার কোন আবশ্যকতা নেই। কোন মুসাফির যদি রোযা ভঙ্গ অবস্থায় দিন থাকতেই সফর থেকে ফিরে আসে তারও দিনের বাকি অংশ রোযা অবস্থায় থাকার আবশ্যকতা নেই। অনুরূপ বিধান ঋতুবতী নারীর। কেননা এরা সবাই বৈধ কারণে রোযা ভঙ্গ করেছে। তাই ঐ দিবস তাদের জন্যই। তাতে তাদের প্রতি ছিয়ামের আবশ্যকতা নেই। কেননা শরীয়ত তাদেরকে রোযা ভঙ্গের অনুমতি প্রদান করে আবার তা আবশ্যক করবে না।
এর বিপরীত মাসআলা হচ্ছে, রামাযান মাসের চাঁদ দেখা গেছে একথা যদি দিনের বেলায় প্রমাণিত হয়, তবে খবর পাওয়ার সাথে সাথে রোযার নিয়ত করে নিতে হবে এবং দিনের বাকী সময় রোযা অবস্থায় কাটাতে হবে। উভয় মাসআলায় পার্থক্য সুস্পষ্ট। কেননা যখন কিনা দিনের বেলায় রামাযান মাস শুরু হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়েছে, তখন তাদের উপর সে দিনের ছিয়াম পালন করা ওয়াজিব হয়ে গেছে। কিন্তু না জানার কারণে তাদের ওযর গ্রহণযোগ্য এবং তাদের ছিয়াম বিশুদ্ধ। এই কারণে তারা যদি জানতে পারত যে আজ রামাযান শুরু হয়েছে, তবে রোযা রাখা তাদের জন্য আবশ্যক হত।

(৪০) সেহরি সংক্রান্ত বিদআতঃ

আমাদের দেশে দেখা যায়, রমাযান মাসের মধ্যরাত থেকেই মুয়াজ্জিনগণ মাইকে কুরআন তিলাওয়াত, গজল, ইসলামী সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে অথবা টেপ রেকর্ডার, মোবাইল, ইউটিউব ইত্যাদি থেকে বক্তাদের ওয়াজ, গজল ইত্যাদি বাজাতে থাকে। সেই সাথে চলতে থাকে অনবরত ডাকাডাকি: রোযাদার ভায়েরা, মা ও বোনেরা, উঠুন, সেহরীর সময় হয়েছে, রান্নাবান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন” ইত্যাদি। অথবা কোথাও বা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইশেল বাজানো হয়!
এর থেকে আরো আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন, এলাকার কিছু যুবক রমাযানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালি গেয়ে বা অডিও রেকর্ড বাজিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে! এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম দেখা যায়।
আমাদের জানা উচিত যে, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটি দুআ কবুলের গুরুত্বপূর্ণ সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দুআ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তাআলা তায়ালা দরবারে রোনাজারি-কান্নাকাটি করেন।
সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গজল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহর কাজ। এতে রোগী, শিশু বা যাদের উপর রোযা ফরয নয় তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এদের হাঁকডাকে অস্থির হয়ে অনেকে সেহরির শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সেহরি শেষ করে দেয়।
তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে এ ক্ষেত্রে সুন্নত কি?
এ ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে, ফজরের আগে সেহরির জন্য আলাদা একটি আযান দেয়া। এই আযান হল সেহরি খাওয়ার জন্য এবং তারপর ফজর সালাতের জন্য আরেকটি আযান দেয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে দুজন মুয়াজ্জিন নিয়োগ করা ছিল। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“বেলাল রাতে আযান দেয়। অত:এব তোমরা বেলালের আযান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আযান দেয়া পর্যন্ত।” [বুখারী, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আযান দেয়া। মুসলিম: অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলে রোযা শুরু হবে……।]
সহীহ মুসলিমের বর্ণনা রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“বিলাল রা. আযান দেয় এজন্য যে, যেন ঘুমন্ত লোক জাগ্রত হয় আর তাহাজ্জুদ আদায়কারী ফিরে আসে অর্থাৎ নামায বাদ দিয়ে সেহরি খায়।” সহিহ মুসলিম,কিতাবুস সওম, হা/ ১০৯৩)
সুতরাং এ দুটির বেশি কিছু করতে যাওয়া বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
এজন্যই ওলামাগণ বলেছেন: “যেখানে একটি সুন্নত উঠে যায় সেখানে একটি বিদআত স্থান করে নেয়।” আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। সুন্নত উঠে গিয়ে সেখানে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতি স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় সুন্নতের দিকে ফিরে আসার তাওফিক দান করুন। আমীন।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে এলাকায় দুটি আযান দেয়ার প্রচলন নেই সেখানে রমাযান মাসে হঠাৎ করে দুটি আযান দেয়া ঠিক নয়। কেননা, এতে মানুষের মাঝে সেহরি খাওয়া ও ফজর সালাতের সময় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। দুটি আযান চালু করার পূর্বে জনগণের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি করা আবশ্যক। অন্যথায় ফেতনা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে তা না করাই উত্তম।
আল্লাহ আমাদেরকে রমাযান কেন্দ্রিক সব ধরণের বিদাআত ও শরিয়ত গর্হিত কাজ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৪১) সেহরি খাওয়ার পূর্বে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত এবং নিয়তের সঠিক পদ্ধতিঃ

প্রশ্ন: সেহরি খাওয়ার পূর্বে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করার বিধান কি এবং আমরা কিভাবে নিয়ত করব?
উত্তর: সেহরি খাওয়ার পূর্বে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত। কেননা, হাদিসে নিয়ত করার কথা এসেছে কিন্তু মুখে উচ্চারণ করার কথা আসে নি। সালাত, সওম, যাকাত, হজ্জ, ওযু, গোসল ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই নয়।
সুতরাং নিয়তের নামে গদ বাধা কতগুলো আরবী বা বাংলা বাক্য উচ্চারণ করা দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন ছাড়া অন্য কিছু নয়। যার কারণে এ সকল গদ বাধা বাক্য মুখে উচ্চারণ করা জঘণ্য বিদআত হিসেবে অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম। (আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।)
আমাদেরকে জানতে হবে যে, সেহরি খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারীর প্রথম হাদিস)
তাই রোযা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যে রাতে (ফজরের আগে) রোযা রাখার নিয়ত করে নি তার রোযা হবে না।” (সুনান নাসাঈ, আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।) কিন্তু জানা দরকার, নিয়ত কি বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
নিয়ত কি বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
ইমাম নববী রাহ. বলেন: “মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়াকেই নিয়ত বলা হয়।” সুতরাং রোযা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কেননা, ইসলামী শরীয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমাণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওযুর নিয়ত, নামাযের নিয়ত, সেহরি খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামায শিক্ষা, রোযার মাসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইয়ে এ সব নিয়ত আরবিতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেয়া হয়! কিন্তু আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন:
 “যে আমাদের এই দ্বীনে এমন নতুন কিছু তৈরি করল যা তার অন্তর্ভুক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।” (বুখারী ও মুসলিম)
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদ বাধা নিয়ত (নাওয়াই আন…..) সহ সব ধরণের বিদআতি কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার এবং বিদআত বর্জন করার তওফিক দান করুন। আমীন।

(৪২) তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাআত অন্তর অন্তর ‘সুবহানা যিল মুলকে ওয়াল মালাকূতে..এ দুআটি নিয়ম করে পাঠ করা বিদআতঃ

প্রশ্ন : তারাবীহর নামাযে প্রতি চার রাকআত পর: “সুবহানা যিল মুলকি….মর্মে যে দোয়াটি পড়া হয় তা কি সহীহ?
উত্তর: 
অনেক মসজিদে দেখা যায়, তারাবীহ নামাযের প্রতি চার রাকাত শেষে মুসল্লিগণ উঁচু আওয়াজে ‘সুবহানা যিল মুলকে ওয়াল মালাকূতে…” দুআটি পাঠ করে থাকে। এভাবে নিয়ম করে এই দুয়া পাঠ করা বিদআত। অনুরূপভাবে এ সময় অন্য কোন দুআ এক সাথে উঁচু আওয়াজে পাঠ করাও বিদআত। কারণ, এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদিস নেই।
বরং নামায শেষে যে সকল দুআ ও যিকির সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পাঠ করা সুন্নত। যেমন, তিনবার আস্‌তাগফিরুল্লাহ”, একবার আল্লাহুম্মা আন্‌তাস সালাম ওয়ামিন্‌কাস সালাম, তাবারাক্‌তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকারাম” ইত্যাদি। এ দুয়াগুলো প্রত্যেকেই চুপি স্বরে নিজে নিজে পাঠ করার চেষ্টা করবে।
আল্লাহ তাআলা বিদআত থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন এবং সুন্নাহ অনুযায়ী ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

(৪৩) রমজান মাসে মেয়েদের রোজা যেন কাযা না হয় এই উদ্দেশ্যে পিল খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রাখাঃ

প্রশ্ন: রমযান মাসে মেয়েদের রোজা যেন কাযা না হয় এই উদ্দেশ্যে পিল খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রাখা জায়েজ আছে কি ?
উত্তর: হ্যাঁ, এই উদ্দেশ্যে পিল/বড়ি খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রাখা জায়েজ রয়েছে অর্থাৎ রমযান মাসে রোযা যেন কাযা না হয় অথবা এতেকাফ করার সম্ভব হয় অথবা উমরাহ আদায় করা সম্ভব হয় কিংবা রমযানের শেষ দশক রাত জেগে কিয়ামুল লাইল, তাহাজ্জুদ সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি করা সম্ভব হয়, এ সকল নেক উদ্দেশ্যে কেউ যদি পিল খেয়ে সাময়িকভাবে ঋতুস্রাব বিলম্বিত করে তবে তা জায়েজ রয়েছে ইনশাআল্লাহ। তবে এমনটি করা উত্তম নয়। বরং মহিলাদের এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দেয়াই ভালো। এটি তার স্বাস্থ্যরে জন্য অধিক উপযোগী।
যাহোক কোন মহিলা যদি এমনটি করতে চায় তাহলে শর্ত হল, উক্ত ঔষধ/পিল যেন তার জন্য ক্ষতিকারক না হয়ে যায়। তাই ঔষধ গ্রহণের পূর্বে নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন। কেননা এ ধরণের ঔষধ খাওয়ার পরে নারীদের পিরিয়ডের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যদি শারীরিকভাবে কোনো সমস্যা না হয় বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে এ ধরণের ঔষধ বা পিল খেয়ে সৎ উদ্দেশ্যে পিরিয়ড বিলম্বিত করা জায়েজ রয়েছে।
উপরোক্ত শর্ত সাপেক্ষে এ বৈধতার পক্ষে আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রা. সহ একদল বড় আলেম এর ফতোয়া প্রদান করেছেন।

 (৪৪) যদি কারো পিরিয়ড শেষ হয় সকালের দিকে সূর্য উঠার পরেঃ

প্রশ্ন: যদি কারো পিরিয়ড শেষ হয় সকালের দিকে সূর্য উঠার পরে। তাহলে কি পুরোটা দিন তাকে না খেয়ে থাকতে হবে? এই অবস্থায় কী করা উচিৎ?
উত্তর:
দিনের যখনই পিরিয়ড শেষ হোক না কেন দিনের বাকি অংশ (অধিক বিশুদ্ধ মতনুসারে) পানাহার বা অন্যান্য রোযা ভঙ্গের কারণগুলো থেকে বিরত থাকা আবশ্যক নয়। কেননা যেহেতু সে দিনের প্রথম থেকে রোযা রাখে নি সেহেতু বাকি অংশ রোযা থাকায় কোনো ফায়দা নেই। সুতরাং এ সময় পানাহার করা জায়েয তবে রোযাদারদের থেকে আড়ালে করা উচিৎ।
প্রশ্ন: যদি কারো সূর্য উঠার পর পিরিয়ড শুরু হয় তাহলে কি দিনের বাকি অংশ পানাহার করবে না কি পানাহার থেকে বিরত থাকবে?
উত্তর:
রোযা অবস্থায় ঋতুস্রাব শুরু হলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর রোযা ভঙ্গ হলে সে স্বাভাবিকভাবে পানাহার করতে পারে।
সুতরাং ফরজের পর ঋতুস্রাব শুরু হলে দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নাই বরং স্বাভাবিক নিয়মে সে খাদ্যপানীয় গ্রহণ করতে পারে তবে অন্য রোযাদারদের সামনে পানাহার না করে যথাসম্ভব আড়ালে করা উচিৎ। আল্লাহু আলাম।

(৪১) রমজান মাসে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও কিভাবে তারা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়ঃ

প্রশ্ন: আমরা তো জানি, রমজানে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি থাকে। তাহলে তারা কিভাবে মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দেয় এবং কিভাবে পাপাচার সংঘটিত হয়?
উত্তর:
রমাযান মাসে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার ব্যাপারে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল:
হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যখন রমযান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শেকল দিয়ে বেধে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এর একটি দরজাও বন্ধ হয় না এবং একজন ঘোষক ডেকে বলেন, হে সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি! অগ্রসর হও, হে অসৎকর্মপরায়ণ! থেমে যাও। আল্লাহ্ (রমযানের) প্রতিটি রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।” (সহীহুল বুখারী ১৮৯৮, ১৮৯৯, ৩২৭৭, মুসলিম ১০৭৯)
শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও তারা কিভাবে মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়?
সুনানে নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে: “রমাযান মাসে অবাধ্য ও উগ্র শয়তানদেরকে বন্দি করা হয়।” অর্থাৎ সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না বরং যেগুলো বেশি উগ্র ও অবাধ্য কেবল সেগুলোকে শেকল পারানো হয়।
সুতরাং অন্যান্য ছোট শয়তানগুলো মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দিতে পারে। তবে যে ব্যক্তি রোযার আদব ও শর্তবলীর প্রতি লক্ষ রেখে ইখলাস ও আন্তরিকতা সহকারে রোযা রাখে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে আল্লাহর সাহায্যে শয়তানরা তাদের অন্তরে প্রভাব ফেলতে পারে না এবং তাদের ক্ষতি করতে পারে না।
শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও কিভাবে মানুষ পাপাচার করে?
রমাযানে শয়তানদেরকে বন্দি রাখা হয় এর অর্থ এই নয় যে, রমাযানে কোন পাপাচার সংঘটিত হবে না। কারণ মানুষ কেবল শয়তানের কুমন্ত্রণায় পাপ করে না বরং পাপাচার সংঘটিত হওয়ার পেছনে শয়তান ছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। যেমন: মানুষ রিপুর কামনা-বাসনা ও কু প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপ করে। আবার মানুষরূপী শয়তানের খপ্পরে পড়ে এবং বদ অভ্যাসের বশবর্তী হয়েও পাপ করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যখন আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে প্রথম মানব আদম আ. কে সেজদা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন সে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘণ করেছিলো। এখানে প্রশ্ন হল, কোন শয়তান তাকে আল্লাহর অবাধ্যতা করতে প্ররোচিত করেছিলো? না, কোনো শয়তান নয় বরং তার ভেতরের অহংবোধ ও কুপ্রবৃত্তির কারণে সে আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিলো।
তাই তো হাদিসে রমাযান মাসে রোযাদারদেরকে কুপ্রবৃত্তি, বদ অভ্যাস ও খারাপ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। যেমন হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তাআলা বলেন:”রোযা আমার জন্যে রাখা হয় এবং আমিই এর প্রতিদান দিব। কারণ রোযাদার ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির তাড়না ও খাবার-দাবার শুধু আমার জন্য পরিহার করে।”
আরও বলা হয়েছে:
“তোমাদের যে কেউ যেদিন রোযা রাখবে হবে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে আর শোরগোল বা উচ্চবাচ্য না করে। তাকে কেউ যদি গালি দেয় বা কটু কথা বলে অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে দেয়, ‘আমি একজন রোযাদার”। (সহীহ : বুখারী ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১)
সুতরাং শয়তানকে শিকল বন্দি করে রাখা হলেও উপরোক্ত একাধিক কারণে মানুষ পাপাচার করে।
তবে এটা ঠিক যে, শয়তানদেরকে শেকল পরানোর কারণে সমাজে পাপাচারের পরিমাণ কমে যায়। কারণ সে অবাধে সর্বত্র চলাফেরা করতে পারে না এবং খাঁটি অন্তরে রোযা পালনকারীদের  মনে সহজে কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। তাইতো এ মাসে মানুষ অধিক পরিমাণে সৎকর্মের দিকে ধাবিত হয়, অনেক পাপিষ্ঠ ব্যক্তি পাপ-পঙ্কিলতা ছেড়ে মসজিদমুখী হয়, নামায-রোযা শুরু করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, উমরা আদায় করে, যাকাত দেয়, অনেক বেপর্দা মহিলা পর্দা ধরে, সমাজে নানা ধরণের সৎকর্মের চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং প্রকাশ্য পাপাচার কম হয়। এটা বাস্তব ও স্পষ্ট সত্য।
এটাই হল শয়তানদেরকে বন্দি করার ফায়দা। আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের ষড়যন্ত্র ও কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৪২) মৃত ব্যক্তিদের প্রতি জীবিতদের দায়িত্ব ও কতর্ব্যঃ

প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির প্রতি আমাদের করণীয় কি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জানতে চাই।
উত্তর:
মৃত ব্যক্তিদের প্রতি জীবিতদের কিছু দায়িত্ব ও কতর্ব্য রয়েছে। নিম্নে সেগুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:
১) মৃত্যুর সংবাদ শুনে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন” পাঠ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।
২) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, কাফন, জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করা।
৩) তার জন্য দুয়া করা।
৪) তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করা।
৫) তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ বা উমরা আদায় করা।
৬) তার মানতের রোযা বাকি থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তা পালন করা। আর রামাযানের রোযা বাকি থাকলে প্রত্যেক রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করা।
৭) সে যদি ঋণ রেখে মারা যায় অথবা কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বা ওসিয়ত করে যায় তবে তা প্রাপকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া।
৮) মহিলার জন্য স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে শোক পালন করা।
উপরোক্ত বিষয়গুলো দলিল সহকারে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:
 ১) মৃত্যুর সংবাদ শুনে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন” পাঠ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা:
কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন:
 “যখন তারা বিপদে পতিত হয়,তখন বলে, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো) তারা সে সমস্ত লোক,যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। “[সূরা বাকারা: ১৫৬ ও ১৫৭]
 ২) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, কাফন, জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করা:
কোন মুসলিম মৃত্যু বরণ করলে জীবিত মানুষদের উপর আবশ্যক হল, তার গোসল, কাফন, জানাযা এবং দাফন কার্য সম্পন্ন করা:এটি ফরযে কেফায়া। কিছু সংখ্যক মুসলিম এটি সম্পন্ন করলে সকলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে।
এ বিষয়টি মুসলিমদের পারস্পারিক অধিকারের মধ্যে একটি এবং তা অনেক সওয়াবের কাজ। যেমন আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
 “যে ব্যক্তি জানাযার নামাযে উপস্থিত হবে তার জন্য রয়েছে এক কিরাত সমপরিমাণ সওয়াব আর যে দাফনেও উপস্থিত হবে তার জন্য দু কিরাত সমপরিমাণ সওয়াব। জিজ্ঞাসা করা হল, কিরাত কী? তিনি বললেন: দুটি বড় বড় পাহাড় সমপরিমাণ। “[বুখারী ও মুসলিম]
 ৩) মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করা:
আল্লাহ বলেন:
 “যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে,হে আমাদের প্রতিপালক,আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমানের সাথে (দুনিয়া থেকে) চলে গেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মুমিনদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখিও না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তো অতি মেহেরবান এবং দয়ালু।”[সূরা হাশর: ১০]
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার আমলের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত: যদি সে সাদকায়ে জারিয়া রেখে যায়,এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করে যায় যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে এবং এমন নেককার সন্তান রেখে যায় যে তার জন্য দুয়া করবে।” [সহীহ বুখারী,অধ্যায়: মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ এবং মানত পালন করা এবং পুরুষ মহিলার পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারে।]
তবে এ দুয়া করতে হবে একাকী, নীরবে-নিভৃতে। উচ্চ আওয়াজে বা সম্মিলিতভাবে অথবা হাফেজ-কারী সাহেবদেরকে ডেকে দুয়া করিয়ে নেয়া এবং তাদেরকে পয়সা দেয়া ভিত্তিহীন এবং বিদয়াত যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
৪) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দান-সদকা করা:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞাসা করল যে,আমার মা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছে। আমার ধারণা মৃত্যুর আগে কথা বলতে পারলে তিনি দান করতেন। এখন আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করি তবে কি তিনি সওয়াব পাবেন? তিনি বলেন: হ্যাঁ। [সহীহ বুখারী,অনুচ্ছেদ: হঠাৎ মৃত্যু। হাদীস নং ১৩৮৮,মাকতাবা শামেলা]
এমন জিনিস দান করা উত্তম যা দীর্ঘ দিন এবং স্থায়ীভাবে মানুষের উপকারে আসে।
উপকারী এবং স্থায়ী দান কয়েক প্রকার:
১) পানির ব্যবস্থা করা
২) এতিমের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা
৩) অসহায় মানুষের বাসস্থান তৈরি করা
৪) গরীব তালিবে ইলমকে সাহায্য-সহযোগিতা করা
৫) দাতব্য চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নির্মান
৬) মসজিদ নির্মান ইত্যাদি।
৫) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করা:
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,বনী জুহাইনা সম্প্রদায়ের এক মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, আমার মা হজ্জের মানত করেছিলেন,কিন্তু হজ্জ করার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করব? তিনি বললেন,“তোমার মায়ের উপর যদি ঋণ থাকত তবে কি তুমি তা আদায় করতে না? আল্লাহর পাওনা আদায় কর। কারণ,আল্লাহ তো তাঁর পাওনা পাওয়ার বেশী হকদার।” [বুখারী,অধ্যায়: মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ এবং মানত পালন করা এবং পুরুষ মহিলার পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারে।]
তবে যে ব্যক্তি বদলী হজ্জ করবে তার জন্য আগে নিজের হজ্জ সম্পাদন করা আবশ্যক:
এ ব্যাপারে হাদীসে বণির্ত হয়েছে:
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বিদায় হজ্জে যাওয়া প্রাক্কালে এহরাম বাঁধার সময়) এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, সে বলছে: لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ লাব্বাইকা আন শুবরুমা অর্থাৎ: “শুবরুমার পক্ষ থেকে উপস্থিত। “
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: শুবরুমা কে? উত্তরে লোকটি বলল, সে আমার ভাই অথবা বলল, আমার নিকটাত্মীয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি নিজের হজ্জ সম্পাদন করেছ? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, নিজের হজ্জ আগে সম্পাদন কর পরে শুবরুমার পক্ষ থেকে করবে। ” [সুনান আবু দাউদ। অনুচ্ছেদ: বদলী হজ্জ সম্পাদন করা। হাদীসটি সহীহ]
৬) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা:
মানতের রোযার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে আর ফরয রোযার ক্ষেত্রে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন গরিব মানুষকে একবেলা খানা খাওয়াবে। (শাইখ আলবানী সহ একদল আলিমের মতে এটি অধিক বিশুদ্ধ অভিমত)
 হাদিসে এসেছে:
সাদ ইবনে উবাদা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন: আমার মা মৃত্যু বরণ করেছেন কিন্তু তার উপর মানত ছিল। তিনি তাকে বললেনে: তুমি তার পক্ষ থেকে তা পূর্ণ কর। ”[ সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ, কোন ব্যক্তি হঠাৎ মৃত্যু বরণ করলে তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করা এবং মানত পুরা করা মুস্তাহাব।]
আয়েশা রা. এর সিদ্ধান্ত: উমরা রা. বর্ণনা করেন, তার মা মারা যান এবং তার উপর রামাযানের রোযা বকি ছিল। আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন: আমি কি আমার মায়ের পক্ষ থেকে উক্ত রোযাগুলো পুরা করব? তিনি বললেন: না। বরং প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে অর্ধ সা (প্রায় সোয়া কেজি চাল, গম ইত্যাদি) খাদ্য দ্রব্য প্রদান কর। [তাহাবী এবং ইবন হাযাম, ইবনুত তুরকুমানী বলেন, এ সনদটি সহীহ।]
ইবনে আব্বাস রা. থেকেও অনুরূপ ফতোয়া রয়েছে।
৭) মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ এবং ওসীয়ত পালন করা:
কোন ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যায় অথবা কোন কিছু দান করার ওসিয়ত করে যায় তবে তার উত্তরাধীকারীদের জন্য আবশ্যক হল, তার পরিত্যাক্ত সম্পদ থেকে সবার আগে ঋণ পরিশোধ করা। আল্লাহ বলেন:
“(মৃতের পরিত্যাক্ত সম্পদ বণ্টন করা হবে) ওসিয়তের পর, যা করে সে মৃত্যু বরণ করেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। ”[সূরা নিসা: ১১]
 ৮ ) স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে মহিলাদের শোক পালন করা:
কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে তার জন্য শোকপালন‌ করা আবশ্যক। এর ইদ্দত (মেয়াদ) হল, চার মাস দশ দিন যদি সে গর্ভবতী না হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে,তখন স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। “ [সূরা বাকারা: ১৩৪]
আর গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
 “গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। ” [সূরা তালাক: ৪]
অনুরূপভাবে পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সন্তান ইত্যাদি নিকটাত্মীয় মারা গেলে তার জন্য সবোর্চ্চ তিন দিন শোক পালন জায়েজ আছে কিন্তু ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়।
আবু সালামার মেয়ে যয়নব বলেন, শাম থেকে আবু সুফিয়ান রা. এর মৃত্যু সংবাদ আসার পর তৃতীয় দিন (তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনীন) উম্মে হাবীবা রা. কিছু হলুদ বা যাফরান (অন্য বর্ণনায় সুগন্ধি) আনতে বললেন। অত:পর তা আনা হলে তিনি তা তার চেহারার দুপাশে ও দুগালে এবং দুবাহুতে মাখলেন। অত:পর বলেন: এটা করার আমার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু আমি এমনটি এজন্যই করলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
 “যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে তার জন্য স্বামী ছাড়া কারও মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ নয়। স্বামীর মৃত্যুতে সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। “[সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে মহিলার শোক পালন করা।]
তবে স্বামীকে খুশি রাখতে যদি অন্য কোন মানুষের মৃত্যুতে স্ত্রী শোক পালন না করে তবে সেটাই উত্তম।
শোক পালনের সময় আকর্ষণীয় পোশাক, আতর-সুগন্ধি, অলঙ্কার ইত্যাদি পরিধান থেকে দূরে থাকবে এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দূরে কোথাও বেড়াতে যাবে না।
মোটকথা, স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী এমন সব আচরণ করবে না বা এমন সৌন্দর্য অলম্বন করবে না যা তাকে বিয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে।

(৪৩) অতীত জীবনে ছুটে যাওয়া রোযার ক্ষেত্রে করণীয়

প্রশ্ন: অতীত জীবনে অনেক রোযা ছুটে গেছে। এখন যদি সেগুলো পূরণ করা হয় তবে তা হবে কি এবং রোযার ক্ষেত্রে উমরি কাযা আছে কি?
উত্তর:
অতীত জীবনে অজ্ঞতা বা অবহেলা বশত: যে সমস্ত রোযা রাখা হয় নি সে সমস্ত রোযা তাকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তার আগে মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে সেই ভুলের জন্যে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে এবং তার পাশাপাশি যে রোযাগুলো ছুটে গেছে সেগুলো কাযা করতে হবে।
যদি মনে না থাকে যে কতগুলো রোযা ছুটেছে তাহলে আনুমানিক ধারণা করে সে রোযাগুলো পূরণ করবে।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি করণীয় ওলামায়ে কিরাম উল্লেখ করেছেন। সেটি হল যে, এক বছরের কাযা রোযা সে বছরে পূরণ না করে তার পরবর্তী বছরে বিলম্বিত করার কারণে কাফফারাও দিতে হবে-যদি সামর্থ্য থাকে। সামর্থ্য না থাকলে কেবল রোযাগুলো কাজা করাই যথেষ্ট।
(এই মর্মে আল্লামা বিন বাজ রহ. এবং সউদি আরবের বড় ওলামাগণ ফতোয়া প্রদান করেছেন)।
কাফফারা হল, একটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে এক বেলার খাদ্য প্রদান করা। এর পরিমাণ (নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী) প্রত্যেক দেশে প্রচলিত প্রায় সোয়া কিলোগ্রাম পরিমাণ প্রধান খাদ্যদ্রব্য। আমাদের দেশে যেহেতু প্রধান খাদ্যদ্রব্য চাল। তাই প্রতিটি রোযার বিনিময়ে সোয়া কিলোগ্রাম পরিমান চাল দিলেই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং আমরা জানতে পারলাম যে অতীত জীবনে ছুটে যাওয়া রোযার জন্যে করণীয় হচ্ছে তিনটি। যথা:
১. রোযা পরিত্যাগ করার কারণে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করা।
২. ছুটে যাওয়া রোযাগুলো কাযা করা।
৩. যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে এক বেলার খাদ্য প্রদান করা। আর সামর্থ্য না থাকলে শুধু রোযা কাজা করাই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু ‘আলাম।

(৪৪) দুআ, তাসবীহ, যিকির-আযকার পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির সময় কি মহিলাদের জন্য মাথা ঢাকা বা পর্দা করা জরুরি?

প্রশ্ন: আমরা মহিলারা যেভাবে সতর ঢেকে নামাজ পড়ি অনুরূপভাবে নামাজের পরে যিকির-আযকার ও দোয়া-তাসবীহ পরার সময়ও কি সতর ঢাকা আবশ্যক? অনুরূপভাবে রাতে ঘুমানোর আগে আমরা বিছানায় শুয়ে যে সুন্নতি দোয়াগুলো পড়ি, সে সময়ও কি মাথায় কাপড় থাকা আবশ্যক?
উত্তর:
সালাত অবস্থায় মহিলাদের মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি দ্বয় ছাড়া সারা শরীর আবৃত করা ফরয। তবে সালাতের বাইরে দুআ, যিকির, তাসবীহ-তাহলীল, দরুদ, ইস্তিগফার, কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস পাঠ, ইসলামী বই-পুস্তক পাঠ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য পর্দা করা আবশ্যক নয়। অনুরূপভাবে বিছানায় শুয়ে দুআ-তাসবীহগুলো পড়ার সময়ও মাথা ঢাকা বা পর্দা করা আবশ্যক নয়।
মোটকথা, সালাতের জন্য মহিলাদের মুখ মণ্ডল ও হাতের কব্জি দ্বয় ছাড়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর আবৃত করা আবশ্যক। অন্যান্য ক্ষেত্রে তা আবশ্যক নয় যদি পর পুরুষ দেখার সম্ভাবনা না থাকে। পর পুরুষ দেখার সম্ভাবনা থাকলে সালাত অথবা সালাতের বাইরে সর্বাবস্থায় মুখমণ্ডল সহ (অধিক বিশুদ্ধ মতানুসারে) সারা শরীর ঢেকে রাখা আবশ্যক।
আল্লাহু আলাম

(৪৫) তাকবীরে উলা এর সাথে চল্লিশ দিন জামাআতে সালাত আদায় জাহান্নাম ও নিফাক থেকে মুক্তির বিশাল সুসংবাদঃ

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“কেউ যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে চল্লিশ দিন তাকবীরে উলা এর সাথে জামাআতে (অর্থাৎ ইমামের তাকবীরে তাহরিমার সাথে সাথে) সালাত আদায় করে তবে তাকে দুটি মুক্তি সনদ লিখে দেয়া হয়। যথা:
-একটি হল জাহান্নাম থেকে মুক্তির
– অপরটি হল মুনাফিকী থেকে মুক্তির।”
(সুনান তিরমিজী, হাদিস নম্বরঃ [241]
অধ্যায়ঃ ২/ সালাত (নামায)
পরিচ্ছদঃ তাকবীরে উলার ফযীলত। হা/২৪১, হাসান ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
এবং তা’লীকুর রাগীব ১/১৫১, সিলসিলা সহিহাহ ২৬৫২)
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

(৪৬) সন্তান দুধ পানের সময় মায়ের স্তনে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেঃ

প্রশ্ন: বাচ্চার বয়স সতের মাস চলছে। প্রায় দু মাস ধরে বাবুটা মায়ের স্তনে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। এতে তার অনেক কষ্ট হয়। এমতাবস্থায় তিনি দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দিতে চান। কিন্তু ইসলাম যেহেতু সন্তানকে দু বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়াতে বলে সেহেতু এতে তিনি কি গুনাহগার হবেন?
উত্তর:
মায়ের স্তন থেকে সন্তানকে দুধ পান করাতে গিয়ে যদি মা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে বুকের দুধ খওয়ানো বন্ধ করা জায়েয রয়েছে। তবে সন্তানের জন্য বিকল্প খাবারের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
আল্লাহু আলাম

(৪৭) এক বোন প্রশ্ন করেছে যে, সে আগে একটা হারাম প্রেম করেছিলঃ

প্রশ্ন: এক বোন প্রশ্ন করেছে যে, সে আগে একটা হারাম প্রেম করেছিল। তাই তখন না বুঝে আল্লাহ কে বলেছিল, হে আল্লাহ, অমুককে তুমি আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে দাও। যদি তাকে দাও আর কাউকে দিও না। সে না বুঝে ভুল করে আল্লাহর কাছে এমন একটা বাজে আবদার করেছে।
পরে সে বুঝতে পারে যে, সে হারাম কাজ ও হারাম জিনিস চেয়েছে। সে ভুল করছে। এখন সে বোন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঐ পথ থেকে সরে আসে। এখন তার কথা হচ্ছে, তার হারাম চাওয়া কি কবুল হয়েছে? এজন্য তার কি পাপ হবে যদি এখন তওবা করে?
উত্তর:
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহপূর্ব প্রেম/রিলেশন করা হারাম। তবে কোন নারী যদি কোনো ব্যক্তির দ্বীনদারী, তাকওয়া, জ্ঞান, যোগ্যতা ইত্যাদি ভালো দিক দেখে তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করে তাহলে তাতে কোনো দোষ নেই। তবে অধিক উত্তম হল, আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা। অর্থাৎ এভাবে দুআ করা: হে আল্লাহ, যার সাথে বিয়ে হলে আমার দ্বীন, দুনিয়া ও চরিত্র সংরক্ষণের জন্য উত্তম হবে তার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও।
কেননা বাহ্যত কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য দুআ করা হল। কিন্তু তার প্রকৃত অবস্থা তো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। হয়ত সে তার জীবনের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে। তাই বিয়ের বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে দুআ করা অধিক উত্তম।

 (৪৮) পাত্র নির্বাচনের মানদণ্ড কী?

মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে চরিত্রবান ও দ্বীনদার যুবককে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ। কেনানা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যখন তোমাদের নিকট এমন কোন ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দীনদারীতে তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না কর, তবে তা পৃথিবীর মধ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।”
[তিরমিযী, অধ্যায়: বিবাহ, পরিচ্ছেদ: যখন তোমাদের নিকট এমন ব্যক্তি আসে যার দীনদারীতে তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা কর ইবনু মাজাহ, অধ্যায়: বিবাহ, পরিচ্ছেদ: সমতা হাদিস নং- ১৯৬৭]
বিশেষ করে চরিত্রবান সহীহ আকীদা সম্পন্ন কোন যুবক পেলে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেননা, তার মধ্যেই প্রকৃত দ্বীন পাওয়া যাবে। কিন্তু যদি কোন মেয়ের বিবাহ বিলম্ব হয়ে যাওয়ার কারণে ঈমানের কমতি ও চারিত্রিক স্খলনের আশংকা করে এবং সহীহ আকীদাওয়ালা দ্বীনদার পাত্র না পাওয়া যায় তাহলে তুলনা মূলক যাকে ভালো পাওয়া যায় তার সাথে বিবাহ দেয়া যেতে পারে। আল্লাহ সাহায্যকারী।

 (৪৯) আসর সালাতের পূর্বে চার রাকআত নফল সালাত আদায় করার ফযিলত ও পদ্ধতিঃ

আসর সালাতের পূর্বে চার রাকআত নফল সালাত আদায় করা ফযিলত পূর্ণ আমল।
কেননা হাদিসে এসেছে:
আলী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাকাআত নামায আদায় করতেন। তিনি (আল্লাহর) নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা ও তাদের অনুগামী মুসলমান- মুমিনদের প্রতি সালাম করার মাধ্যমে এ নামাযের মাঝখানে বিভক্তি করতেন (অর্থাৎ দুই সালামে চার রাকাআত আদায় করতেন।)
(সূনান আত তিরমিজী [তাহকীককৃত] অধ্যায়ঃ ২/ রাসূলুল্লাহ হতে নামাযের সময়সূচী হাদিস নম্বরঃ [429], হুসাইন আল-মাদানী।
হাসান। ইবনু মাজাহ– (১১৬১))
 অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহম করুন, যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকআত সালাত আদায় করে।”
[আবু দাউদ ১২৭১, তিরমিযি ৪৩০ম আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন, সহীহুত তরাগীব ওয়াত তরাহীব, হা/৫৮৮]
 ইমাম শাফিঈ এবং আহমাদের মতে, রাত এবং দিনের (ফরয নামায ছাড়া অন্যান্য সব) নামায দুই রাকাআত করে আদায় হবে। তারা উভয়ে আসরের পূর্বের চার রাকাআতে দুই রাকাআত পর পর সালাম ফিরানোই পছন্দ করেছেন। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“রাত ও দিনের নফল (ফরজ ছাড়া অন্যান্য নামায) দু রাকাআত রাকাআত করে।” (আবুদাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ-সহীহ)
অবশ্য কোনো আলেম আসরের পূর্বে এই চারকআত এক সালামে পড়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন। কিন্তু হাদিসের আলোকে দু রাকআত দু রাকআত করে পড়ার মতটি অধিক অগ্রাধিকারযোগ্য বলে প্রতিভাত হয়।
 উল্লেখ্য যে, আসরের পূর্বে চার রাকআত নামায দৈনন্দিন ১২ রাকআত সুন্নাতে রাতেবা/সুন্নতে মুআক্কাদা এর এর অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং তা সাধারণ নফল। সুতরাং কেউ যদি তা আদায় করে তাহলে ইনশাআল্লাহ সওয়াব লাভ করবে।

(৫০) রমজানে অসুস্থ, মুসাফির, অতিবৃদ্ধ ও মৃত্যপথযাত্রীর রোযার ক্ষেত্রে করণীয় এবং টাকা দ্বারা ফিদিয়া প্রদানের বিধানঃ

প্রশ্ন: কোনও ব্যক্তি যদি রমজান মাসে রোজা রাখতে সক্ষম না হয় তাহলে তার ফিদিয়া হিসেবে ৫০০টাকা গরিব-মিসকিনকে দান করলেই আদায় হয়ে যাবে- একথাটা কতটুকু সঠিক? বা রোজা কেউ রাখতে সক্ষম না হলে ইসলামের দৃষ্টিতে তার করণীয় কি?
উত্তর:
কোনো ব্যক্তি যদি রমজানুল মোবারকে অসুস্থ হয়ে যায় অথবা সফরে থাকে তাহলে তার জন্যে কী করণীয় আর কেউ যদি রমজানে রোযা রাখতে মোটেও সক্ষম না হয় সে ব্যাপারে ইসলাম কী বলেছে এর উত্তর আমরা সুরা বাকারার ১৮৪ নাম্বার আয়াতে পাই। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
“কোনো ব্যক্তি যদি অসুস্থ থাকে অথবা সফরে থাকে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে।
অর্থাৎ যে কয়দিন অসুস্থ থাকবে, অসুস্থ থাকার কারণে রোজা রাখতে সক্ষম হয়নি অথবা সফরে থাকার কারণে রোজা ভেঙে ফেলেছে তার জন্যে করণীয় হল, রমজানের পরে আগামী রমজান আসার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় সেই রোযাগুলো কাযা করে নেয়া।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলছেন
“আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে।”
এই আয়াতের তাফসীর হল, কোনো ব্যক্তি যদি অতিরিক্ত বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে অথবা শয্যাশায়ী রোগে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে রোজা রাখতে সক্ষম না হয় অর্থাৎ এমনভাবে অসুস্থ হয়েছে যে, এই রোগ থেকে আর মুক্তি পাওয়ার আর সম্ভাবনা দেখা যায় না বা প্রায় মৃত্যু পথযাত্রী। তাহলে এধরণের লোকের ক্ষেত্রে ফিদিয়া দিতে হবে। আর তা হল, একটা রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্যদ্রব্য প্রদান।
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“একজন অসহায় মানুষকে খাদ্যদ্রব্য ফিদিয়া দিবে।”
খাদ্যদ্রবের পরিমাণ কতটুকু এই মর্মে সম্মানিত মুফাসসির ও ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন যে, প্রত্যেক দেশে প্রচলিত প্রায় সোয়া কিলো পরিমান প্রধান খাদ্যদ্রব্য। অর্থাৎ যে সমাজে যে খাবারটা প্রধান খাবার হিসেবে প্রচলিত রয়েছে সেটা প্রায় সোয়া কিলো পরিমাণ দিলেই একজন মিসকিনের একবেলার খাদ্য হিসেবে যথেষ্ট হবে।
সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি একমাস রোযা রাখতে না পারে মৃত্যু পথযাত্রী হওয়ার কারণে অথবা অতিরিক্ত বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে অথবা এমন রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে যে রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই তাহলে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন গরীব-অসহায় মানুষকে সোয়া কিলো পরিমাণ চাল (যেটা আমাদের দেশের প্রধান খাদ্রদ্রব্য) দিলেই যথেষ্ট হবে ইনশা আল্লাহ।
এভবে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে সোয়া কিলোগ্রাম করে চাল দিলেই ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে।
আর যেমনটি আপনি যেমনটি প্রশ্ন করেছেন যে, ৫০০টাকা দিলে ফিদিয়া আদায় হবে কিনা? আমরা বলব, যেহেতু কুরআনে কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা طَعَام বলেছেন, طَعَام মানে হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। সুতরাং খাদ্যদ্রব্যই দিতে হবে। এর পরিবর্ততে টাকা-পয়সা, পোশাক বা আসবাব-সামগ্রী কিনে দেয়া ঠিক হবে না।
সুতরাং যারা বলে যে ৫০০টাকা দিলেই ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে আমরা বলব, এ কথা সঠিক নয়। সঠিক হলো প্রতিজন মিসকিনকে একবেলার খাবার দিতে হবে। আর তা যদি আমরা সোয়া কিলো চাল দেই (যেমনটি সম্মানিত ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন)তাহলে ইন শা আল্লাহ যথেষ্ট হবে।
অবশ্য যদি কেউ ফিদিয়া হিসেবে টাকা প্রাদান করে কিন্তু সেই টাকা দিয়ে গরীব-মিসকিনদেরকে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে দেয়া হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ তাতেও অসুবিধা নেই। আল্লাহু আলাম।

(৫১) উমরার মর্যাদা এবং উমরা সফরের পূর্বে প্রস্তুতি মূলক দশটি নির্দেশনাঃ

প্রশ্ন: উমরার গুরুত্ব কতটুকু? আমি উমরা আদায় করতে চাই। কিন্তু আমি জানি না, এখন থেকে কি ভাবে কি আমল করবো বা কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবো। তাই দয়া করে এ সম্পর্কে জানালে উপকৃত হব ইনশাআল্লাহ।
উত্তর:
দুআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন, আপনার উমরা আদায়ের বিষয়টিকে সহজ করে দেন এবং তা কবুল করেন। আমীন।
উমরার গুরুত্ব ও ফযিলত:
সামর্থবান ব্যক্তির জন্য হজ্জ ও উমরা আদায় করা ফরয:
ইবনে ‘উমর রা. বলেন,
প্রত্যেক (সামর্থবান ব্যক্তি)র জন্য হজ ও ‘উমরাহ অবশ্য পালনীয়। ইবনে ‘আব্বাস রা. বলেন, কুরআনুল কারিমে হজের সাথেই উমরার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: ‘‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে হজ ও ‘উমরাহ পূর্ণভাবে আদায় কর’’। (সূরা বাকারা: ১৯৬) [সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ২৬/ উমরাহ, পরিচ্ছদঃ ২৬/১. ‘উমরাহ (আদায়) আবশ্যক হওয়া এবং তার ফযিলত।]
উমরা অত্যন্ত ফযিলত পূর্ণ একটি ইবাদত এবং গুনাহ মোচনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: আবু হুরায় রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর কাফফারা (গুনাহ মোচনের মাধ্যম) হয়ে যায়।” (সহীহ বুখারী, হাদিস : ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৪৯)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে ব্যক্তি এই ঘরে এলো, অতঃপর যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং শরীয়ত বহির্ভূত কাজ/পাপাচার থেকে বিরত থাকল, সে মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মত (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরে গেল।’
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. এর মতানুসারে এখানে হজ কারী ও উমরা কারী উভয় ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়েছে। [ফাতহুল বারী : ৩/৩৮২।]
ইবনে ‘আববাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“রমযানের একটি ‘উমরাহ একটি হাজ্জের সমতুল্য।” [সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বরঃ [1782] অধ্যায়ঃ ২৬/ উমরাহ এবং সহীহ মুসলিম]
 আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে চার বার উমরা আদায় করেছেন এবং তিনি হজ-উমরার কাজগুলো তার নিকট থেকে শিখে নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
তাই এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি বিশুদ্ধভাবে আদায়ের চেষ্টা করা একান্ত অপরিহার্য।
নিম্নে উমরা আদায়ের প্রস্তুতি হিসেবে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও করণীয় উপস্থাপন করা হল:
১) একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উমরা আদায় করা নিয়ত করা। কারণ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং কেউ যদি মানুষকে দেখানো বা মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে উমরা আদায় করে তাহলে তার উমরা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না।
২) হালাল অর্থ দ্বারা উমরা করা এবং আয়-ইনকাম ও অর্থ-সম্পদকে হারামের স্পর্শ মুক্ত করা। কারণ আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।
৩) অতীত জীবনের ভুল-ত্রুটি ও গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা।
৪) উমরার বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। যে কোনো ইবাদতের পূর্বে সে সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক। কেননা তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির পাশাপাশি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদ্ধতি অনুযায়ী সম্পন্ন না হয় তাহলে তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না।
৫) কোনো মানুষের সাথে মনোমালিন্য হয়ে থাকলে উমরা সফরে যাওয়ার পূর্বে তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়া বা সমস্যা সমাধান পূর্বক সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা।
৬) কারো হক/অধিকার হরণ করে থাকলে উমরা সফরের পূর্বে প্রাপককে তার হক ফিরিয়ে দেয়া বা তার সাথে সমঝোতা করা।
৭) মানুষের সাথে আর্থিক লেনদেন থাকলে তা পরিষ্কার করা। ঋণ থাকলে পরিশোধ করা অথবা কাগজে লিখে তারপর সাক্ষ্য রাখা। তৎসঙ্গে ঋণদাতার কাছে অনুমতি নেয়া।
৮) সালাত আদায়ে যত্নবান হওয়া। কারণ সালাত ঠিক না থাকলে শতবার উমরা করেও কোনো লাভ নেই।
৯) শিরক ও বিদআতের সাথে পরিপূর্ণভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
১০) আল্লাহ তাআলা যেন সুস্থতা ও নিরাপত্তার সাথে উমরার যাবতীয় কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার তৌফিক দান করেন সে জন্য তার দরবারে খালিস ভাবে দুআ করা।

(৫২) দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য সুরা কাহাফ এর ১ম দশ আয়াত, নাকি শেষ দশ আয়াত, না কি পুরো সূরা মুখস্থ করবঃ

প্রশ্ন: আমরা হাদিস থেকে জেনেছি যে, সূরা কাহাফ এর প্রথম এবং শেষ দশ আয়াত মুখস্থ থাকলে দজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্ত থাকা যায়। তার মানে শুধু প্রথম দশ আয়াত অথবা শেষ দশ আয়াত মুখস্থ রাখাই যথেষ্ট না কি বিশ আয়াতই মুখস্থ রাখতে হবে?
উত্তর:
আমাদের জানা প্রয়োজন যে, দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য হাদিসে বিশুদ্ধ সূত্রে ছয় ভাবে সূরা কাহাফ পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো হল নিম্নরূপ:
১. পুরো সূরা কাহাফ পাঠ করা।
২. অনির্দিষ্টভাবে সূরা কাহাফের যে কোনো স্থান থেকে দশ আয়াত পাঠ করা।
৩. সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে কয়েকটি আয়াত পাঠ করা।
৪. সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে দশ আয়াত তিলাওয়াত করা।
৫. সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করা।
৬ . সূরা কাহাফের শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করা।
এ বর্ণনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আলেম সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করার হাদিসকে অধিক শক্তিশালী ও অধিক প্রসিদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা এটি সহিহ মুসলিমে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং এ দশটি আয়াতের মর্মার্থও দাজ্জালের ফেতনা থেকে সংরক্ষিত থাকা প্রসঙ্গে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ।
আর বর্ণনার ভিন্নতা প্রসঙ্গে আলেমগণ বলেন,এর দ্বারা ক্রমান্বয়ে পুরো সূরা কাহাফ পড়া বা মুখস্থ করার দিকে ইঙ্গিত করা রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি পুরো সূরাটা মুখস্থ করে বা নিয়মিত পড়ে তাহলে এটাই সবচেয়ে উত্তম।
যাহোক নিম্নে এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো পেশ করা হল:
১) দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য পুরো সূরা কাহাফ পাঠ করার হাদিস:
আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
“যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ যেভাবে নাযিল হয়েছে সেভাবে তেলাওয়াত করবে অতঃপর দাজ্জালের জন্য বাহির হবে তার উপর দজ্জাল কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না অথবা তার উপর দাজ্জালের (প্রভাব ফেলার) কোন পথ থাকবে না।” (মুস্তাদরাক আলস সাহীহাইন ৪/৫৫৭, হা/৮৫৬২, ইমাম যাহাবী তালখীস গ্রন্থে বলেন: সহীহ। মুহাদ্দিসদের মতে এটি মারফু হাদিস হুকুমে)
এখানে বলা হয়েছে পুরো সূরা কাহাফ বিশুদ্ধ ও সুন্দরভাবে পাঠ করলেই দাজ্জালের প্রভাব থকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
২) সূরা কাহাফের যে কোনো স্থান থেকে দশ আয়াত পাঠ করার হাদিস:
“যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের দশটি আয়াত পাঠ করবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে সংরক্ষিত থাকবে।“ (সহীহ ইবনে হিব্বান ৩/৫৬, হা/৭৮৫, শুআইব আরনাউত বলেন, সহিহ মুসলিম এর শর্তানুযায়ী এর সনদ সহিহ)
এখানে বলা হয়েছে, সূরা কাহাফের দশটি আয়াত পাঠ করলেই দাজ্জালের ফেতনা থেকে সংরক্ষিত থাকা যাবে। তা সূরার যে কোনো স্থান থেকে হোক না কেন। প্রথম বা শেষ দিক থেকে পড়া শর্ত নয়। অনুরূপভাবে মুখস্থ করাও শর্ত নয়।
৩. সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে কয়েকটি আয়াত পাঠ:
প্রখ্যাত সাহাবী নাওয়াস বিন সামআন রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“এরপর তোমরা যারা তার (দাজ্জালের) দেখা পাবে, সে যেন লক্ষ করে সূরা কাহাফের প্রথম দিকের আয়াতগুলি পাঠ করে।”
(সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: ফিতনা সমুহ ও কিয়ামতের নিদর্শনা বলী, অনুচ্ছেদ: দজ্জাল এর বর্ণনা, তার পরিচয় এবং তার সাথে যা থাকবে, হা/৭২৬৩)
এ হাদিসে দাজ্জালের মুখোমুখি হলে তাকে লক্ষ করে সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে কয়েকটি আয়াত পড়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে নির্ধারিত আয়াত সংখ্যা উল্লেখ করা হয় নি।
৪) সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে দশ আয়াত পাঠ করার হাদিস:
আবুদ দারদা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে দশটি আয়াত পাঠ করবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে সংরক্ষিত থাকবে।“ (মুসনাদ আহমদ ৬/৪৪৬, হাদিস নং ২৭৫৫৬, সনদ সহিহ)
– প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের শেষ দশটি আয়াত পাঠ করবে দজ্জাল বের হলেও তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।“ (মুসনাদে হাকিম-তিনি এটিকে সহিহ বলেছেন। বায়হাকী, আল মুজামুল আওসাত-ত্বাবারানী প্রমূখ)
এ হাদিস দ্বয়ে সূরা কাহাফের শেষের দশ আয়াত তেলাওয়াতের কথা বলা হয়েছে। মুখস্থ করার কথা বলা হয় নি।
৫) সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে দশ আয়াত মুখস্থ করার ব্যাপারে হাদিস:
আবুদ দারদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছে:
‘‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দজ্জালের (ফিতনা) থেকে পরিত্রাণ পাবে।’’ (সহীহ মুসলিম ১/৫৫৫, হা/৮০৯, ২৫৭)
আবু দাউদে একই সাহাবী থেকে সহীহ সনদে হুবহু অনুরূপ হাদিস বর্ণিত।
এখানে প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করার কথা বলা হয়েছে।
এ বর্ণনাটা অন্যান্য বর্ণনার তুলনায় অধিক শক্তিশালী ও প্রসিদ্ধ।
৬) সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে দশ আয়াত মুখস্থ করার হাদিস:
সহীহ মুসলিমে প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করার হাদিস বর্ণনার পরক্ষণেই বলা হয়েছে যে, অন্য বর্ণনায় রয়েছে: «مِنْ آخِرِ الْكَهْفِ» ‘কাহফ সূরার শেষ দিক থেকে।“ অর্থাৎ যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে সংরক্ষিত থাকবে।“ (সহীহ মুসলিম, হা/ ৮০৯)
আবু দাউদ (রহঃ) প্রথম দশ আয়াত এর কথা বর্ণনা করার পর বলেন: হিশাম দাসতাওয়ারী রহ. কাতাদা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
 “যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে (দশ আয়াত) মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।”
‘শুবা (রহঃ) বলেছেন: “সূরা কাহাফের শেষ দিক থেকে (যার দশটি আয়াত মুখস্থ থাকবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।)”
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বরঃ [4272], অধ্যায়ঃ ৩২/ যুদ্ধ-বিগ্রহ (ই.ফা., হাদিসটি সহীহ]
এসকল হাদিস থেকে শেষ দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করারকে দাজ্জালের ফেতনা থেকে আত্মরক্ষার উপায় বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সূরা কাহাফের প্রথম তিন আয়াত পাঠ সংক্রান্ত হাদিসটিকে আল্লামা আলবানী ‘শায’ হিসেবে যঈফের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
সুতরাং আমরা চেষ্টা করব, সূরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করার এবং তিলাওয়াত করার পাশাপাশি সেগুলো মমার্থ উপলদ্ধি করত সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার। সেই সাথে যদি শেষ দশ আয়াতও মুখস্থ করা হয় তাহলে আরও উত্তম হয়। আর যদি পূরো সূরাটাই মুখস্থ করা হয় তাহলে সবচেয়ে উত্তম।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফিতনা-দাজ্জালের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

 (৫৩) সালাতরত অবস্থায় কান্না করলে সালাত ভঙ্গ হয় কি?

প্রশ্ন: আমি এক বই থেকে পেলাম যে, নামাযে কান্না করলে নাকি নামায ভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যখন জামাতে (বিশেষ করে তারাবীহ) নামাজ আদায় করি তখন ইমাম সাহেবের কুরআন তেলাওয়াতের সাথে অনেকেরই কান্না আসে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত?
উত্তর:
সালাতরত অবস্থায় যদি আল্লাহর ভয়, কবরের আযাব, জাহান্নামের শাস্তি, মৃত্যু যন্ত্রণা, আখিরাতের ভয়াবহ দৃশ্য ইত্যাদি স্মরণ করে অথবা কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন শাস্তির হুমকি ও করুণ পরিণতির কথায় প্রভাবিত হয়ে যদি কেউ কান্না করে তাহলে তা মুস্তাহাব (উত্তম) বরং তা মুত্তাকীন ও সালেহীনদের বৈশিষ্ট্য।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
মুত্বররিফ ইবনে ‘আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রহঃ) নিজের পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি সলাত আদায় করছিলেন এবং তাঁর ভিতর ডেগের ফুটন্ত পানির মত আওয়াজ হচ্ছিল। অর্থাৎ তিনি কান্নাকাটি করছিলেন।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বর্ণনাকারী বলেছেন,
“আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সলাত আদায় করতে দেখছি। এমতাবস্থায় তাঁর সিনার মধ্যে চাক্কির আওয়াজের ন্যায় কান্নার আওয়াজ থাকত।” (আহমদ; নাসায়ী প্রথমাংশটুকু, আবু দাউদ দ্বিতীয়াংশটুকু বর্ণনা করেছেন)
[আবু দাউদ ৯০৪, নাসায়ী ১২১৪, সহীহ আত্ তারগীব ৫৪৪, আহমদ ১৬৩১২, সহীহ ইবনে হিব্বান ৭৫৩। শাইখ আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন]
আল্লামা মুবারকপূরী বলেন: ”অত্র হাদিসের প্রকাশমান অর্থ এই যে, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন সলাত বিনষ্ট করে না-চাই তার মুখে কোনো শব্দ উচ্চারিত হোক বা না হোক। ইমাম তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদিস থেকে এটাই বুঝেছেন। তাদের গ্রন্থে এ হাদিসের ভিত্তিতে ‘অধ্যায়’ রচনা করা দ্বারা তাই সাব্যস্ত হয়।”
তবে যদি অসুখ-বিসুখ, শারীরিক ব্যথা-বেদনা, মানসিক কষ্ট বা দুনিয়াবি বিপদ-মুসিবতের কথা স্মরণ করে কান্না আসে তাহলে তা যথাসম্ভব প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি চেষ্টা থাকা স্বত্বেও কান্না প্রতিহত করা সম্ভব না হয় তাহলে সালাত নষ্ট হবে না ইনশাআল্লাহ। কেননা তা তার সাধ্যের বাইরে।
কিন্তু যদি কান্না বন্ধ করার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও আওয়াজ করে কান্না অব্যাহত রাখে তাহলে তাতে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা, তা সালাত বহির্ভূত বিষয়। অধিকাংশ ফিকাহবীদ এ বিষয়ে একমত।
আল্লাহু আলাম-আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।

(৫৪) তারাবীহ সালাতে মুসহাফ (কুরাআন) হাতে নিয়ে দেখে দেখে তিলাওয়াত করা কি জায়েয?

প্রশ্ন: তারাবীহ সালাতে মুসহাফ (কুরাআন) হাতে নিয়ে দেখে দেখে তিলাওয়াত করা কি জায়েয?
উত্তর:
তারাবীহ সালাতে কুরআন মুখস্ত পড়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে কুরআন দেখে পড়াও জায়েয আছে ইনশাআল্লাহ।
শাইখ আব্দুল হামীদ ফায়যী (হাফিযাহুল্লাহ) সালাতে মুবাশশির কিতাবে লিখেছেন:
“তারাবীহ্‌ প্রভৃতি লম্বা নামাযে (লম্বা ক্বিরাআতের) হাফেয ইমাম না থাকলে ‘কুল-খানী’ করে ঠকাঠক কয়েক রাকআত পড়ে নেওয়ার চেয়ে মুসহাফ (কুরআন মাজীদ) দেখে দেখে পাঠ করে দীর্ঘ ক্বিরাআত করা উত্তম। (অবশ্য কুরআন খতমের উদ্দেশ্যে নয়।) অনুরুপ (জামাআতে অন্য হাফেয মুক্তাদী না থাকলে) হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুক্তাদীর কুরআন দেখে যাওয়া বৈধ। এ সব কিছু প্রয়োজনে বৈধ; ফলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।”
মা আয়েশা এর আযাদকৃত গোলাম যাকওয়ান রমযানে (তারাবীতে) দেখে দেখে কুরআন পাঠ করে তাঁর ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
হযরত আনাস (রাঃ) নামাযে ক্বিরাআত পড়তেন আর তাঁর গোলাম তাঁর পশ্চাতে মুসহাফ ধরে দাঁড়াতেন। তিনি কিছু ভুলে গেলে গোলাম ভুল ধরিয়ে দিতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২২২ নং)
ইমাম হাসান, মুহাম্মদ, আত্বা প্রমুখ সলফগণ এরূপ (প্রয়োজনে) বৈধ মনে করতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২১৪, ৭২১৮, ৭২১৯, ৭২২০, ৭২২১ নং)
সৌদি আরবের উলামা ও মুফতী কমিটির সিদ্ধান্ত মতেও প্রয়োজনে মুসহাফ (কুরআন) দেখে তারাবীহ্‌ পড়ানো বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৩৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৫৪, ২১/৫৬) সৌদি আরবের প্রায় অধিকাংশ মসজিদে আমলও তাই।

(৫৫) স্বামী যদি স্ত্রীকে তার বাবা-মার খেদমত করতে অনুমতি না দেয়ঃ

প্রশ্ন: এক বোনের প্রশ্ন, তিনি বাবা-মার একমাত্র সন্তান এবং বাবা-মার বয়স হয়েছে। বিয়ের পর তার হাজবেন্ড যদি তাকে তার বাবা-মার খেদমত করতে না দেয় তবে বোনটির করণীয় কি?
উত্তর:
বিয়ের পূর্বে একজন মেয়ের জন্য আবশ্য হল তার পিতামাতার অনুগত্য ও সেবা-শুশ্রুষা করা। কিন্তু বিয়ের পর আনুগত্য করা আবশ্যক তার স্বামীর। এটাই ইসলামের বিধান।
তবে বিয়েরে পরও সে সময়-সুযোগ বুঝে যথাসম্ভব পিতামাতার খোঁজ-খবর নিবে এবং নিজস্ব অর্থ থেকে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে অথবা স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে তার টাকা-পয়সা দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করবে। সেই সাথে তাদের জন্য দুআ ও কল্যাণ কামনা করবে।
কিন্তু তাদের দেখতে যাওয়া বা তাদের সেবার জন্য সময় দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। তার অবাধ্যতা করে বা জোর পূর্বক বাবামাকে দেখতে যাওয়া বৈধ নয়। এটি তার গুনাহের কারণ হবে।
অবশ্য স্বামীর কতর্ব্য, স্ত্রীকে তার পিতামাতার সাথে দেখা করতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া। বিশেষ করে যদি তারা কষ্টে থাকে তাহলে এই কতর্ব্য ও দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।
সুতরাং একজন বিবাহিত মহিলা স্বামীর সাথে সমঝোতা সাপেক্ষে যথাসাধ্য তার পিতামাতাকে দেখাশোনা করবে। তার নিষেধ অমান্য করে পিতামাতার সেবা করতে যাওয়া উচিৎ নয়।
স্বামী যদি তাকে তার বাবা মার সেবা-শুশ্রুষা করার অনুমতি না দেয় তাহলে এ নিয়ে স্ত্রী স্বামীর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হয়ে তার কথার অবাধ্যতা করা যাবে না বরং তাকে বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করবে। কারণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিয়ের পরে পিতামাতার চেয়ে স্বামীর আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আল্লাহু আলাম।

 (৫৬) রমজানে কি তাহাজ্জুদ পড়া যাবে?

প্রশ্ন:-রমজানে কি তাহাজ্জুদ পরা যাবে? যদি ইশার পরে তারাবীর নামাজ কিছু বাকি রেখে শেষ রাতে আরো একটু এড করে কিছু নামাজ পড়ি তাহলে কি তা পরা যাবে?
উত্তর:-তারাবীহ ও বিতর সহ ১১ বা ১৩ রাকআতে সীমাবদ্ধ থাকাই শ্রেয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান অথবা অন্যমাসে এই সংখ্যায় রাতের নফল সালাত আদায় করতেন। তবে খুব বেশি আগ্রহ হলে আরও অতিরিক্ত রাতের নফল সালাত আদায় করা যাবে। এর অনুমতি প্রসঙ্গে আলাদা হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
 “রাতের সালাত দু’রাকাত, দু’রাকাত, যখন তোমাদের কেউ ভোর হওয়ার আশংকা করবে, সে এক রাকাত সালাত আদায় করবে, যা তার পূর্বের সালাতগুলো বেজোড় করে দিবে” (বুখারি, হা/ ৯৯০ ও মুসলিম হা/৭৪৯)
– ইচ্ছা করলে ইশার পরে তারাবীহ সালাত কিছু বাকি রেখে ভোর রাতে সেগুলো অথবা সেগুলোর সাথে যুক্ত করে আরও কিছু নফল সালাত আদায় করতেও কোনো আপত্তি নাই ইনশাআল্লাহ।

(৫৭) রোযা রাখার ক্ষেত্রে বাচ্চাদের সাথে মিথ্যা বলাঃ

প্রশ্ন: অনেক মায়েরা ছোট ছেলেমেয়ে-যারা রোজা রাখতে ইচ্ছুক-তাদের কে বলেন: “একবার দুপুরে খাবার খেয়ে নিবে এরপর আবার সন্ধ্যায় ইফতারি করবে তাহলে তোমার দুটি রোজা হয়ে যাবে।” এসব কথা বলে কি বাচ্চাদের দ্বীনের ব্যাপারে মিথ্যা বা ভুল ধারণা দেয়া হচ্ছে না?
উত্তর:
এভাবে বলা ঠিক নয়। কারণ প্রথমত: এটি একটি মিথ্যা কথা। ইসলামে বাচ্চাদের সাথেও সাথেও মিথ্যা বলা হারাম।
২য়ত: দ্বীন সম্পর্ক ভুল শিক্ষা দেয়া।
আমাদের আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম কিভাবে ছোট বাচ্চাদেরকে রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন তার উদাহরণ দেখা যেতে পারে নিম্নোক্ত হাদিস থেকে:
রুবায়’ই বিনতু মু’আব্‌বিয ইবনু ‘আফরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
“এরপর আমরা এ দিন সাওম পালন করতাম এবং আমাদের ছোট ছোট সন্তানদেরকেও আল্লাহ চাহে তো সওম পালনে অভ্যস্ত করে তুলতাম। আমরা তাদেরকে মাসজিদে নিয়ে যেতাম এবং তাদের জন্য পশমের খেলনা বানিয়ে দিতাম। যখন তারা খাওয়ার জন্য কাঁদত, তখন আমরা তাদেরকে সে খেলনা প্রদান করতাম। এমনি করে ইফতারের সময় হয়ে যেত।”
(সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সওম, হ/২৫৫৮)

 (৫৮) রাসুলুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়েছেনঃ

প্রশ্ন: রাসুলুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়েছেন?
নাকি তিনি সবসময়ই ১১ রাকাত পড়েছেন?
উত্তরঃ ৫৬ নং এ আছে।

(৫৯) রমাযান কারিম অভিবাদনটি কি সঠিক?

প্রশ্নঃ “রমাযান কারিম” অভিবাদনটি কি সঠিক? রমাযানের পর “কারিম” যোগ করাটা কতটুকু সঠিক?
উত্তরঃ
বিজ্ঞ আলেমদের মতে, ‘রমাযান কারীম’ বলা ঠিক নয়-যদিও এটি আরব সহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কেননা, কারীম অর্থ দয়ালু, দাতা, মহানুভব ও উদার। এটি আল্লাহর সিফত বা গুণ। তিনিই রমাযান মাসকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, তিনি এ মাসে বান্দার গুনাহ মোচন করে এবং তার নেক কর্মের প্রতিদান দান করেন। মাস কখনো দয়ালু ও উদার হতে পারে না। তবে এ মাসকে রমাযান মোবারক/মাহে মোবারক বা বরকতময় মাস বলা যেতে পারে। হাদিসে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসকে ‘বরকতময় মাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“তোমাদের জন্য রমাযান-বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্য সওম/রোযা রাখা ফরয করেছেন।” (সহীহ : নাসায়ী ২১০৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৮৬৭, আহমাদ ৭১৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ৯৯৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৫, শু‘আবূল ঈমান ৩৩২৮)
হাদিসে রমাযান মাসকে কোথাও কারীম বলা হয় নি। সুতরাং রমাযান মাসের সাথে এ শব্দটি ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
(আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন, সালেহ আল ফাওযান প্রমূখ বড় আলেমগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।) আল্লাহু আলাম।
উত্তর:
‘রাসূল আল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েছেন’ মর্মে বর্ণিত একটিও সহীহ নয়। পক্ষান্তরের রমাযান‌ মাসে এবং রমাযান ছাড়া অন্য মাসে রাতের নফল সালাত তিন রাকাত বেতের সহ মোট ১১ রাকআত পড়ার হাদিস সহিহ বুখারীর বিশুদ্ধতম হাদিস।
এছাড়াও ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর যুগে কত রাকাত তারাবিহ পড়া হতো সে বিষয়ে দু ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মুয়াত্তা মালিকে বর্ণিত এক হাদিসে দেখা যায়, তিনি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে সেটি যফঈ বা দুর্বল হিসেবে প্রমাণিত।
আরেক বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি‌ ৮ রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর সনদ বিশুদ্ধ।

(৬০) আমরা ছোট কালে যে রোযা করেছি সেগুলোর কি আমরা সওয়াব পাবো?

প্রশ্নঃ ক. আমরা ছোট কালে যে রোযা করেছি সেগুলোর কি আমরা সওয়াব পাবো?
খ. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে যে ৭ দিনের রোযা কাজা হয়েছিলো সেগুলো কাজা করি নি। এখন কি সে রোজা গুলো কাজা করতে হবে ? কতগুলো রোযা কাজা হয়েছে তা মনে নেই। তবে আমি কখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি হয়েছি সেটা আমার আনুমানিক মনে আছে। এখন কী করণীয়?
উত্তর:
ক. বাল্যকালে কৃত নেক আমলের সওয়াব প্রত্যেকের নিজস্ব আমলনামায় জমা হবে। তবে তার পিতামাতা তাকে শেখানো, উৎসাহিত করা বা সাহায্য করার জন্য সওয়াব পাবে।
খ. অতীতে ঋতুস্রাব অবস্থায় যে সকল রোযা ছুটেছিলো সেগুলো কাজা না করা হয়ে থাকলে এখন তওবা করত: সেগুলো কাযা করে নিতে হবে। সংখ্যা মনে না থাকলে আনুমানিক ধারণা করে কাযা করবে।

(৬১) অর্ধ শাবানের রাতে (কথিত শবে বরাতে) ব্যক্তিগতভাবে বাড়ীতে বা মসজিদে কি বিশেষ কিছু এবাদত-বন্দেগী করা শরিয়ত সম্মত?

প্রশ্ন: অর্ধ শাবানের রাতে (কথিত শবে বরাতে) ব্যক্তিগতভাবে বাড়ীতে বা মসজিদে কি বিশেষ কিছু এবাদত-বন্দেগী করা শরিয়ত সম্মত?
উত্তর:
এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কথা হল, কথিত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। চাই তা বাড়িতে হোক বা মসজিদে হোক। একাকী হোক বা দলবদ্ধভাবে হোক। (যদিও কতিপয় আলেম মনে করেন এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের কথা দলীল দ্বারা সমর্থিত নয়।)
কেননা, এ রাতে ইবাদত করার বিশুদ্ধ কোন দলীল নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন প্রমাণ নেই যে, তারা এ রাতে কোন ধরণের এবাদত-বন্দেগী করতেন।
সুতরাং এটি একটি দ্বীনের মধ্যে একটি সংযোজিত বিদআত। যার পক্ষে কুরআন, সুন্নাহর দলীল নেই এবং সাহাবী-তাবেঈগণেরও এজমা তথা সম্মিলিত কোন সিদ্ধান্তও পাওয়া যায় না।
এ রাতে যদি বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করা ফযীলতপূর্ণ হত তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিতেন এবং সাহাবীগণ তা পালনে পিছুপা থাকাটা অকল্পনীয় ব্যাপার।
তবে কারও যদি আগে থেকে অন্যান্য রাতে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দুআ, তাসবীহ পাঠ এবং নফল সালাত আদায়ের অভ্যাস থাকে তাহলে সে এ রাতেও তা অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু আগেও নাই পরেও নাই…হঠাৎ করে এ রাতে উঠে বিশেষ ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হতে হলে এ বিষয়ে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের আমল থাকতে হবে। অন্যথায় তা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে।
*অর্ধ শাবানে দিনে রোযা রাখা ও রাতে নফল সালাত সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় জাল ও যঈফ হাদীস:*
*অর্ধ শাবানে দিনে রোযা রাখা ও রাতে নফল সালাত সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় জাল ও যঈফ হাদীস:*
সাধারণত: মানুষ অর্ধ শাবানের দিনের বেলা রোযা রাখা ও রাতে নফল নামায পড়ে কতিপয় বানোয়াট ও দুর্বল হাদীসের উপরে ভিত্তি করে। নিম্নে এ ধরণের কিছু হাদীস পেশ করা হল মুহাদ্দিসদের পর্যালোচনা সহ:
ক) আলী ইবনে আবী তালিব রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন শাবান মাসের পনের তারিখ আসে তোমরা দিনে রোযা রাখ আর রাতে নফল নামায আদায় কর। কারণ, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা নিচের আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, এমন কেউ আছো যে আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি তাকে ক্ষমা করে দিব? এমন কেউ আছো যে আমার নিকট রিযিক চাও আমি তাকে রিযিক দিব? এমন কেউ আছো যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাও আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দিব?…এভাবে আল্লাহ তায়ালা ফজর উদীত হওয়া পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।”
হাদীসটির মান: মুহাদ্দিসের মতে এ হাদীসটি মাউযু (জাল/বানোয়াট) হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন- ১]
 খ) “হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।”
হাদীসটির মান: এটি একটি মাউযু (জাল/বানোয়াট) হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন-২]
গ) “যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার-তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে বের হবে না।”
হাদীসটির মান: এটি একটি মউযু বা বানোয়াট হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন-৪]
ঘ) আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “এক রাতে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (আমার ঘরে) না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে তাকে বাকী গোরাস্থানে পেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, “তুমি কি এ আশংকা কর যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন?” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করে ছিলাম যে, আপনি হয়ত আপনার অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন।
একথা শুনে তিনি বললেন: “আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে নিচের আসমানে নেমে আসেন এবং কালব গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সমপরিমান মানুষকে ক্ষমা করে দেন।”
হাদীসটির মান: এটি যঈফ বা দুর্বল। [ পর্যালোচনা দেখুন-৪]
ঙ) “রজব আল্লাহর মাস। শাবান আমার মাস এবং রামাযান আমার উম্মতের মাস।”
হাদীসটির মান: এটি যঈফ বা দুর্বল। [ পর্যালোচনা দেখুন-৫]
টিকা:
[১] ইবনে মাজাহ, নামায অধ্যায়: নামায প্রতিষ্ঠা করা। ইমাম বুসীরী যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে বলেন: উক্ত হাদীসের বর্ণনাসূত্রে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে তার নাম ইবনে আবী সুবরাহ (তার প্রকৃত নাম: আবু বকর ইবনে আব্দুিল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবী সুবরাহ)।
ইমাম ইয়াহয়া ইবনে মাঈন এবং আহমদ বিন হাম্বল রাহ. বলেন, এ ব্যক্তি হাদীস তৈরি করত (অর্থাৎ জাল হাদীস বর্ণনা করত)। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাকরীব কিতাবে (২/৩৯৭) বলেন, মুহাদ্দিসগণ এই ব্যক্তিকে হাদীস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। উকাইলী ‘আল যুআফা আল কাবীর’ গ্রন্থে (২/২৭১) একই কথা বলেছেন।
[২ ] ইবনুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দুর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। অথচ আমরা অনেক মানুষকে দেখি যারা এ সারা রাত ধরে নামায পড়ার পর এদের ফজর নামায ছুটে যায় কিংবা সকালে যখন উঠে অলসতা সহকারে উঠে। কিছু মসজিদের ইমাম শবে বরাতের এ সব নামাযকে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের রুটি-রুযি ও উন্নতির মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরা জনগণকে একত্রিক করে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করে থাকে। মুলত: এ সবই ভ্রান্ত এবং হকের সাথে সম্পর্ক হীন।
ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়।
অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
[৩] এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিও জাল। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম রাহ. আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
[৪ ] তিরমিযী। অনুচ্ছেদ; অর্ধ শাবানের ব্যাপারে যা এসেছে। তবে তিনি নিজেই এর পরে উল্লেখ করেছেন, মুহাম্মাদ অর্থাৎ ইমাম বুখারী (রাহ:)কে বলতে শুনেছি তিনি এ হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন।
ইমাম দারাকুতনী রাহ. বলেন: এ হাদীটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তবে সনদগুলো মুযতারাব এবং সুপ্রমাণিত নয়।
বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা আলবানী রাহ. ও এ হাদীসটিকে যঈফ বলে সাব্যস্থা করেছেন। দেখুন: সহীহ ওয়া যঈফ তিরমিযী, হাদীস নং ৭৩৯, মাকতাবা শামেলা)
[৫] ইমাম সুয়ূতী রাহ. কর্তৃক লিখিত আল জামিউল কাবীর বা জামউল জাওয়ামি’গ্রন্থে‘র ১২৮৩০ নং হাদীস। তিনি নিজেই বলেছেন: হাদীসটি মুরসাল। আরও হাদীসটি দায়লামী আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন। আল্লামা আলবানী রাহ. বলেন: হাদীসটি যঈফ বা দূর্বল। দেখুন: সিলসিলা যঈফা মুখতাসারাহ হাদীস নং ৪৪০০ মাকতাবা শামেলা।

(৬২) যাকাত বিষয়ক কিছু খুঁটিনাটিঃ

প্রশ্নাবলী:
ক. কারো কাছে যদি ৪৫ লাখ টাকা থাকে তাহলে এর যাকাত কী পরিমাণ হবে?
খ. বর্তমানে বাজার মূল্য অনুযায়ী স্বর্ণ বিক্রয় করতে গেলে ২০% মূল্য কমে বিক্রি করতে হয়। তাহলে এই ২০% বাদ দিয়ে তারপর যে টাকা থাকবে সে টাকা থেকে কি যাকাত দিতে হবে?
গ. কাপড় দিয়ে যাকাত আদায় শুদ্ধ হবে কি? ইতোপূর্বে কাপড় দিয়ে যাকাত দেয়া হয়েছ। এতে কি যাকাত আদায় হয়েছে? এখন টাকা দিলে গ্রামের মানুষ উল্টাপাল্টা কথা বলবে। তাই যদি মানুষের কথার ভয়ে কাপড় দিয়ে যাকাত দেয়া হয় তাহলে কি যাকাত আদায় হবে?
ঘ. কোন কোন অত্মীয়কে যাকাতের টাকা দেওয়া জায়েয ও কেমন আর্থিক পরিস্থিতি হলে আত্মীয়কে যাকাত দেওয়া যাবে?
উত্তর:
ক. কারো নিকট সর্ব নিম্ন ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ, তার মূল্য সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা ব্যবসায়িক পণ্য এক বছর জমা থাকলে তাতে ২.৫০% হারে যাকাত ফরয হয়। অর্থাৎ এক লাখ টাকায় ২,৫০০ টাকা।
সুতরাং ৪৫ লাখ টাকায় যাকাত আসবে (৪৫,০০০০০×২.৫%)= ১,১২৫০০ টাকা।
খ. বাড়িতে গচ্ছিত স্বর্ণের যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে টাকা দ্বারা যাকাত আদায়ের পদ্ধতি হল, উক্ত পুরাতন স্বর্ণ বাজারে বিক্রয় করলে যে দাম পাওয়া যাবে তার হিসাব ধরতে হবে; নতুন স্বর্ণের দাম নয়।
সুতরাং পুরাতন স্বর্ণের দাম নতুন স্বর্ণের চেয়ে ২০% কম হলে তাই ধর্তব্য হবে এবং সে আলোকে স্বর্ণের মূল্য দ্বারা যাকাত বের করতে হবে।
অবশ্য সরাসরি নগদ টাকার যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে নতুন স্বর্ণের বাজার মূল্য হিসেব করতে হবে।
গ. একান্ত জরুরি না হলে টাকা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে যাকাত দেয়া ঠিক নয়। কেননা টাকা দ্বারা গরিব মানুষ অধিক লাভবান হবে এবং সে ইচ্ছেমত তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু যদি এ আশংকা থাকে যে, টাকা দিলে যাকাত গ্রহীতা অপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে তা খরচ করে ফেলবে বা টাকা নষ্ট করবে তাহলে সে ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন অনুসারে যাকাতের টাকা দ্বারা কাপড়-চোপড়, টিউবওয়েল, ঘর-বাড়ি তৈরি সহ তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেয়া যেতে পারে।
তবে বর্তমান যুগে কিছু অর্থশালী মানুষ ট্রাকের উপর থেকে যেভাবে গরিবদের মাঝে ‘যাকাতের কাপড়’ ছিটায় আর তা সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা হুড়োহুড়ির মধ্যে পদপিষ্ট হয়ে মরা যায় এটি শুধু শরিয়া বিরোধী নয় বরং অত্যন্ত গর্হিত ও অমানবিক কাজ। এটি দরিদ্র মানুষের প্রতি ধনীদের এক নির্মম উপহাস ছাড়া কিছু নয়। তাই এভাবে যাকাত বণ্টন পদ্ধতি বন্ধ হওয়া জরুরি।
– ইতোপূর্বে না জানার কারণে কাপড় দ্বারা যাকাত দিয়ে থাকলে দুআ করি, আল্লাহ কবুল করুন। কিন্তু জানার পর থেকে আর এমনটি করা ঠিক হবে না।
ঘ. এমন গরিব-অসহায় আত্মীয়-স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েয যাদের ভরণ -পোষণ দেয়া আপনার জন্য ফরয নয়। যেমন: পিতা, মাতা, স্ত্রী প্রমুখকে যাকাত দেয়া যাবে না। কেননা তাদের ভরণ-পোষণ দেয়া আপনার উপর ফরয।
কিন্তু ভাই, বোন, চাচা, চাচী, ফুফা, খালু, মামা ইত্যাদি ব্যক্তিদেরকে যাকাত দেয়া যাবে যদি তারা যাকাত পাওয়ার হকদার হয়। এমন কি স্ত্রী যদি ধনী হয় আর স্বামী যদি গরিব হয় তাহলে স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাত দিতে পারে। কেননা, স্বামীর ভরণ-পোষণ দেয়া স্ত্রীর জন্য ফরয নয়।
আল্লাহু আলাম।

(৬৩) ইদানীং সালাতে নিয়মিত হতে পারছি নাঃ

প্রশ্ন: ইদানীং নামাযে নিয়মিত হতে পারছি না। আগে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে যেত। ফরজ নামাযে চক্ষু শীতল হত। কিন্তু দিনদিন আমার পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। গতকাল এক ওয়াক্তও নামায পড়ি নি। আজ এখনও না। আমার করণীয় কী?
উত্তর:
দুআ করি, আল্লাহ আপনার মনকে দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
যাহোক সংক্ষপে আপনার জন্য কয়েকটি দিক নির্দেশনা হল:
১) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা (বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা)
২) শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া (বেশি বেশি ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ পাঠ করা)
৩) মনকে দ্বীনের পথে অবিচল রাখার জন্য আল্লাহ নিকট দুআ করা।
৪) কুরআন পাঠ করা এবং তরজমা ও তাফসীর পাঠ করা।
৫) মনের মধ্যে কেন এমন পরিবর্তন হল তা খুঁজে বের করা।
৬) বিশেষ কোনো গুনাহে জড়িয়ে পড়লে অনতিবিলম্বে তওবা করে আল্লাহ পথে ফিরে আসা।
৭) মানসিক কোনো কারণে অস্থিরতা থাকলে তার সমাধান খোঁজা।
৮) নামায ছাড়ার ভয়াবহ শাস্তির কথা স্মরণ করা।
৯) সৎসঙ্গী-সাথীদের সাথে চলাফেরা করা।
১০) ভালো কোনো আলেমের সাথে দেখা করে তাঁর নিকট আপনার সমস্যাগুলো খুলে বলা এবং তার সুদপুদেশ ও পরামর্শ গ্রহণ করা ইত্যাদি।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

(৬৪) আযানের ১৫ মিনিট আগে নামাজ পড়া যায়। এটা কতটুকু সত্যঃ

প্রশ্ন: শুনেছি যে, আযানের ১৫ মিনিট আগে নামাজ পড়া যায়। এটা কতটুকু সত্য?
উত্তর:
নামাজের সময় হলেই নামাজ পড়া যাবে। সময় হওয়ার আগে অথবা শরিয়ত সম্মত ওজর ব্যতিরেকে সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পড়লে তা শুদ্ধ হবে না। কেননা নামাযের অন্যতম একটি শর্ত হল, সময় হওয়া। আযান হোক বা না হোক।
তবে সাধারণত: সময় হওয়ার পরই আযান দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, 
“নিশ্চয় নামায মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।” (সূরা নিসা: ১০৩)
যাহোক, নামাজ পড়ার পূর্বে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, সময় হয়েছে কি না। সময় না হলে পড়া যাবে না।
উল্লেখ্য যে, পুরুষদের জন্য জামাআতের সাথে সালাত আদায় করা সুন্নতে মুআক্কাদা। অনেক আলেমের মতে ওয়াজিব। সুতরাং বিনা কারণে জামাআত পরিত্যাগ করা একদম অনুচিত। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

(৬৫) লাইসেন্স বিহীন অনলাইন ব্যবসা এবং ভেজাল পণ্য বিক্রয়ের বিধানঃ

ব্যবসা-বাণিজ্য (অনলাইন হোক বা অফ লাইন হোক) সহ সকল ক্ষেত্রেই প্রতিটি নাগরিকের রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলা জরুরি-যদি তা আল্লাহর নাফরমানী মূলক না হয়।
সুতরাং সরকারী আইন লঙ্ঘন করে অনলাইন ব্যবসা করা যেমন বৈধ নয় তেমনি সেখানে চাকুরী করাও বৈধ নয়। এতে যে চাকুরী দিবে আর জেনেবুঝে যে চাকুরী করবে উভয়েই গুনাহগার হবে। তবে উক্ত ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থকে হারাম বলা যাবে না যদি ক্রয়-বিক্রয় সঠিকভাবে করা হয় এবং পণ্যটি হালাল হয়।
অর্থাৎ সরকারী আইন লঙ্ঘন করার জন্য গুনাহ হবে। এ জন্য আল্লাহর নিকট তওবা করত: যথাসম্ভব দ্রুত লাইসেন্স নিতে হবে। কিন্তু এ অবস্থায় সঠিক পদ্ধতিতে হালাল পণ্য বিক্রয় থেকে উপার্জিত অর্থ হালাল হবে ইনশাআল্লাহ।
অনুরূপভাবে উক্ত ব্যবসার সাথে নিযুক্ত কর্মচারীদের বেতন গ্রহণ করাও হালাল হবে ইনশাআল্লাহ।
অবশ্য ফেসবুক, হোয়াটসআ্যাপ গ্রুপ ইত্যাদির মাধ্যমে ছোটখাটো ব্যবসার জন্য দেশের আইনে লাইসেন্স প্রয়োজন না কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। যদি লাইসেন্স প্রয়োজন না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে এ সব ছোটখাটো ব্যবসা করতে কোনো আপত্তি নেই।
ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’[মুসলিম: ১০১।]
যারা খাদ্য, পানীয়, ঔষধ বা অন্য কিছুতে ভেজাল দেয় বা মানুষের সাথে প্রতারণা করে তারা একদিকে যেমন ইসলামি দৃষ্টিতে হারামের সাথে যুক্ত অন্য দিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও অপরাধী। এরা দেশ ও জনগণের শত্রু। এটি চারিত্রিক স্খলন ও নৈতিকতা হীন কর্ম। কোন মুসলিমের জন্য এমনটি করা শোভনীয় নয়।
যারা ভেজাল পণ্য বিক্রয় করে তাদের উপার্জিত অর্থ হারাম এবং তাদের অধীনে চাকুরী করা যেমন হারাম তেমনি তাদের বেতনও হারাম। কারণ তারা সরাসরি প্রতারণার সাথে জড়িত। যারা জেনে শুনে এমন ভেজাল পণ্য বিক্রয় কারীদের অধীনে চাকুরী করবে তারা মানুষের সাথে প্রতারণা এবং অন্যায় কাজে সহযোগী হিসেবে গুনাহগার হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরণের নীতি-নৈতিকতা হীন ও আইন বহির্ভূত কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৬৬) রমজান ও তারাবীহ সংক্রান্ত কতিপয় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন:
১) তারাবীর নামাজ কত রাকাত পড়া সুন্নত?
২) সুন্নত নামাজে কি ৪ রাকাতেই সুরা মিলাতে হয়?
৩) তারাবীহ এর ৪ রাকাতে বসে বসে কি কি দোয়া করব অথবা মুনাজাত বা জিকির করবো?
৪) রমজানে কি কবরের আযাব মাফ থাকে?
৫) সহবাসে যদি রোজা ভাঙ্গে তবে কী করতে হয়?
৬) অতীতে ফরয রোজা কারণ বশত: ছুটেছে। এখন কি যে কোন সময় তা কাযা করতে পারব?
৭) রমজান মাসে কি তাহাজ্জুদ পড়তে হয়?
উত্তর:
১) তারাবীহ এর সালাত ৮ রাকাআত পড়া উত্তম। তবে ২০ রাআত পড়া জায়েয। ইচ্ছে করলে তার কম ও বেশি করা যেতে পারে আগ্রহেরে উপর ভিত্তি করে।
২) সুন্নাত নামায দু রাকাআত দু রাকাআত করে পড়া অধিক উত্তম। তবে যোহরের পূর্বে কখনো কখনো দুই তাশাহুদে চার রাকআত পড়া জায়েয আছে।
এ ক্ষেত্রে ফরজ ও সুন্নতে নিয়ত ও একামত ছাড়া আর কোন পার্থক্য নাই। সুতরাং পরের দু রাকাআতে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করবেন; অন্য কোন সুরা মিলাবেন না।
৩) প্রতি দু রাকআত পরে সালাম ফিরানোর পর পাঠ করবেন:
এছাড়াও অন্যান্য দুআ-তাসবীহ পাঠ করা যাবে।
তবে প্রতি চার রাকআত পরপর “সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতে…” এ দুআ পাঠ করার ব্যাপারে কোন হাদিস এসেনি। তাই নিয়ম করে তা পাঠ করা বিদআত।
৪) রামযানে কবরের আযাব মাফ থাকে-এ কথা সঠিক নয়।
৫) রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে তার জন্য তওবার পাশাপাশি কাফফারা হল,
ক. একটি গোলাম আযাদ করা
খ. তা সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দুমাস রোযা থাকা
 গ. তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন গরীব-মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো।
৬) ওজর বশত: রোযা ছুটে গেলে করণীয় হল, সেগুলো পরবর্তী রোযা আসার পূর্বে যে কোন সময় কাযা করে নেয়া।
৭) রামাযানে তারাবীহ পড়াই যথেষ্ট। তবে কেউ ইচ্ছে করলে শেষ রাতে তাহাজ্জুদও পড়তে পারে।

(৬৭) রাসুলুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়েছেনঃ

প্রশ্ন: রাসুলুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়েছেন?
নাকি তিনি সবসময়ই ১১ রাকাত পড়েছেন?
উত্তর:
‘রাসূল আল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েছেন’ মর্মে বর্ণিত একটিও সহীহ নয়। পক্ষান্তরের রমাযান‌ মাসে এবং রমাযান ছাড়া অন্য মাসে রাতের নফল সালাত তিন রাকাত বেতের সহ মোট ১১ রাকআত পড়ার হাদিস সহিহ বুখারীর বিশুদ্ধতম হাদিস।
এছাড়াও ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর যুগে কত রাকাত তারাবিহ পড়া হতো সে বিষয়ে দু ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মুয়াত্তা মালিকে বর্ণিত এক হাদিসে দেখা যায়, তিনি ২০ রাকাত তারাবিহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে সেটি যফঈ বা দুর্বল হিসেবে প্রমাণিত।
আরেক বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি‌ ৮ রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর সনদ বিশুদ্ধ।

(৬৮) রমাযান কারিম অভিবাদনটি কি সঠিক?

প্রশ্নঃ “রমাযান কারিম” অভিবাদনটি কি সঠিক? রমাযানের পর “কারিম” যোগ করাটা কতটুকু সঠিক?
উত্তরঃ
বিজ্ঞ আলেমদের মতে, ‘রমাযান কারীম’ বলা ঠিক নয়-যদিও এটি আরব সহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কেননা, কারীম অর্থ দয়ালু, দাতা, মহানুভব ও উদার। এটি আল্লাহর সিফত বা গুণ। তিনিই রমাযান মাসকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, তিনি এ মাসে বান্দার গুনাহ মোচন করে এবং তার নেক কর্মের প্রতিদান দান করেন। মাস কখনো দয়ালু ও উদার হতে পারে না। তবে এ মাসকে রমাযান মোবারক/মাহে মোবারক বা বরকতময় মাস বলা যেতে পারে। হাদিসে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসকে ‘বরকতময় মাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“তোমাদের জন্য রমাযান-বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্য সওম/রোযা রাখা ফরয করেছেন।” (সহীহ : নাসায়ী ২১০৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৮৬৭, আহমাদ ৭১৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ৯৯৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৫, শু‘আবূল ঈমান ৩৩২৮)
হাদিসে রমাযান মাসকে কোথাও কারীম বলা হয় নি। সুতরাং রমাযান মাসের সাথে এ শব্দটি ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
(আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন, সালেহ আল ফাওযান প্রমূখ বড় আলেমগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।) আল্লাহু আলাম।

(৬৯) আমরা ছোট কালে যে রোযা করেছি সেগুলোর কি আমরা সওয়াব পাবো?

প্রশ্নঃ ক. আমরা ছোট কালে যে রোযা করেছি সেগুলোর কি আমরা সওয়াব পাবো?
খ. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে যে ৭ দিনের রোযা কাজা হয়েছিলো সেগুলো কাজা করি নি। এখন কি সে রোজা গুলো কাজা করতে হবে ? কতগুলো রোযা কাজা হয়েছে তা মনে নেই। তবে আমি কখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি হয়েছি সেটা আমার আনুমানিক মনে আছে। এখন কী করণীয়?
উত্তর:
ক. বাল্যকালে কৃত নেক আমলের সওয়াব প্রত্যেকের নিজস্ব আমলনামায় জমা হবে। তবে তার পিতামাতা তাকে শেখানো, উৎসাহিত করা বা সাহায্য করার জন্য সওয়াব পাবে।
খ. অতীতে ঋতুস্রাব অবস্থায় যে সকল রোযা ছুটেছিলো সেগুলো কাজা না করা হয়ে থাকলে এখন তওবা করত: সেগুলো কাযা করে নিতে হবে। সংখ্যা মনে না থাকলে আনুমানিক ধারণা করে কাযা করবে।

(৭০) অর্ধ শাবানের রাতে (কথিত শবে বরাতে) ব্যক্তিগতভাবে বাড়ীতে বা মসজিদে কি বিশেষ কিছু এবাদত-বন্দেগী করা শরিয়ত সম্মত?

প্রশ্ন: অর্ধ শাবানের রাতে (কথিত শবে বরাতে) ব্যক্তিগতভাবে বাড়ীতে বা মসজিদে কি বিশেষ কিছু এবাদত-বন্দেগী করা শরিয়ত সম্মত?
উত্তর:
এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কথা হল, কথিত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। চাই তা বাড়িতে হোক বা মসজিদে হোক। একাকী হোক বা দলবদ্ধভাবে হোক। (যদিও কতিপয় আলেম মনে করেন এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের কথা দলীল দ্বারা সমর্থিত নয়।)
কেননা, এ রাতে ইবাদত করার বিশুদ্ধ কোন দলীল নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন প্রমাণ নেই যে, তারা এ রাতে কোন ধরণের এবাদত-বন্দেগী করতেন।
সুতরাং এটি একটি দ্বীনের মধ্যে একটি সংযোজিত বিদআত। যার পক্ষে কুরআন, সুন্নাহর দলীল নেই এবং সাহাবী-তাবেঈগণেরও এজমা তথা সম্মিলিত কোন সিদ্ধান্তও পাওয়া যায় না।
এ রাতে যদি বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করা ফযীলতপূর্ণ হত তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিতেন এবং সাহাবীগণ তা পালনে পিছুপা থাকাটা অকল্পনীয় ব্যাপার।
তবে কারও যদি আগে থেকে অন্যান্য রাতে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দুআ, তাসবীহ পাঠ এবং নফল সালাত আদায়ের অভ্যাস থাকে তাহলে সে এ রাতেও তা অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু আগেও নাই পরেও নাই…হঠাৎ করে এ রাতে উঠে বিশেষ ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হতে হলে এ বিষয়ে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের আমল থাকতে হবে। অন্যথায় তা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে।
*অর্ধ শাবানে দিনে রোযা রাখা ও রাতে নফল সালাত সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় জাল ও যঈফ হাদীস:*
*অর্ধ শাবানে দিনে রোযা রাখা ও রাতে নফল সালাত সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় জাল ও যঈফ হাদীস:*
সাধারণত: মানুষ অর্ধ শাবানের দিনের বেলা রোযা রাখা ও রাতে নফল নামায পড়ে কতিপয় বানোয়াট ও দুর্বল হাদীসের উপরে ভিত্তি করে। নিম্নে এ ধরণের কিছু হাদীস পেশ করা হল মুহাদ্দিসদের পর্যালোচনা সহ:
● ক) আলী ইবনে আবী তালিব রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন শাবান মাসের পনের তারিখ আসে তোমরা দিনে রোযা রাখ আর রাতে নফল নামায আদায় কর। কারণ, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা নিচের আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, এমন কেউ আছো যে আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি তাকে ক্ষমা করে দিব? এমন কেউ আছো যে আমার নিকট রিযিক চাও আমি তাকে রিযিক দিব? এমন কেউ আছো যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাও আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দিব?…এভাবে আল্লাহ তায়ালা ফজর উদীত হওয়া পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।”
হাদীসটির মান: মুহাদ্দিসের মতে এ হাদীসটি মাউযু (জাল/বানোয়াট) হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন- ১]
● খ) “হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।”
হাদীসটির মান: এটি একটি মাউযু (জাল/বানোয়াট) হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন-২]
গ) “যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার-তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে বের হবে না।”
হাদীসটির মান: এটি একটি মউযু বা বানোয়াট হাদীস। [পর্যালোচনা দেখুন-৪]
● ঘ) আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “এক রাতে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (আমার ঘরে) না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে তাকে বাকী গোরাস্থানে পেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, “তুমি কি এ আশংকা কর যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন?” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করে ছিলাম যে, আপনি হয়ত আপনার অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন।
একথা শুনে তিনি বললেন: “আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে নিচের আসমানে নেমে আসেন এবং কালব গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সমপরিমান মানুষকে ক্ষমা করে দেন।”
হাদীসটির মান: এটি যঈফ বা দুর্বল। [ পর্যালোচনা দেখুন-৪]
● ঙ) “রজব আল্লাহর মাস। শাবান আমার মাস এবং রামাযান আমার উম্মতের মাস।”
হাদীসটির মান: এটি যঈফ বা দুর্বল। [ পর্যালোচনা দেখুন-৫]
টিকা:
[১] ইবনে মাজাহ, নামায অধ্যায়: নামায প্রতিষ্ঠা করা। ইমাম বুসীরী যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে বলেন: উক্ত হাদীসের বর্ণনাসূত্রে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে তার নাম ইবনে আবী সুবরাহ (তার প্রকৃত নাম: আবু বকর ইবনে আব্দুিল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবী সুবরাহ)।
ইমাম ইয়াহয়া ইবনে মাঈন এবং আহমদ বিন হাম্বল রাহ. বলেন, এ ব্যক্তি হাদীস তৈরি করত (অর্থাৎ জাল হাদীস বর্ণনা করত)। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাকরীব কিতাবে (২/৩৯৭) বলেন, মুহাদ্দিসগণ এই ব্যক্তিকে হাদীস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। উকাইলী ‘আল যুআফা আল কাবীর’ গ্রন্থে (২/২৭১) একই কথা বলেছেন।
[২ ] ইবনুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দুর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। অথচ আমরা অনেক মানুষকে দেখি যারা এ সারা রাত ধরে নামায পড়ার পর এদের ফজর নামায ছুটে যায় কিংবা সকালে যখন উঠে অলসতা সহকারে উঠে। কিছু মসজিদের ইমাম শবে বরাতের এ সব নামাযকে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের রুটি-রুযি ও উন্নতির মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরা জনগণকে একত্রিক করে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করে থাকে। মুলত: এ সবই ভ্রান্ত এবং হকের সাথে সম্পর্ক হীন।
ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়।
অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
[৩] এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিও জাল। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম রাহ. আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
[৪ ] তিরমিযী। অনুচ্ছেদ; অর্ধ শাবানের ব্যাপারে যা এসেছে। তবে তিনি নিজেই এর পরে উল্লেখ করেছেন, মুহাম্মাদ অর্থাৎ ইমাম বুখারী (রাহ:)কে বলতে শুনেছি তিনি এ হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন।
ইমাম দারাকুতনী রাহ. বলেন: এ হাদীটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তবে সনদগুলো মুযতারাব এবং সুপ্রমাণিত নয়।
বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা আলবানী রাহ. ও এ হাদীসটিকে যঈফ বলে সাব্যস্থা করেছেন। দেখুন: সহীহ ওয়া যঈফ তিরমিযী, হাদীস নং ৭৩৯, মাকতাবা শামেলা)
[৫] ইমাম সুয়ূতী রাহ. কর্তৃক লিখিত আল জামিউল কাবীর বা জামউল জাওয়ামি’গ্রন্থে‘র ১২৮৩০ নং হাদীস। তিনি নিজেই বলেছেন: হাদীসটি মুরসাল। আরও হাদীসটি দায়লামী আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন। আল্লামা আলবানী রাহ. বলেন: হাদীসটি যঈফ বা দূর্বল। দেখুন: সিলসিলা যঈফা মুখতাসারাহ হাদীস নং ৪৪০০ মাকতাবা শামেলা।

(৭১) ইদানীং নামাযে নিয়মিত হতে পারছি নাঃ

প্রশ্ন: ইদানীং নামাযে নিয়মিত হতে পারছি না। আগে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে যেত। ফরজ নামাযে চক্ষু শীতল হত। কিন্তু দিনদিন আমার পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। গতকাল এক ওয়াক্তও নামায পড়ি নি। আজ এখনও না। আমার করণীয় কী?
উত্তর:
দুআ করি, আল্লাহ আপনার মনকে দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
যাহোক সংক্ষপে আপনার জন্য কয়েকটি দিক নির্দেশনা হল:
১) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা (বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা)
২) শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া (বেশি বেশি ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ পাঠ করা)
৩) মনকে দ্বীনের পথে অবিচল রাখার জন্য আল্লাহ নিকট দুআ করা।
৪) কুরআন পাঠ করা এবং তরজমা ও তাফসীর পাঠ করা।
৫) মনের মধ্যে কেন এমন পরিবর্তন হল তা খুঁজে বের করা।
৬) বিশেষ কোনো গুনাহে জড়িয়ে পড়লে অনতিবিলম্বে তওবা করে আল্লাহ পথে ফিরে আসা।
৭) মানসিক কোনো কারণে অস্থিরতা থাকলে তার সমাধান খোঁজা।
৮) নামায ছাড়ার ভয়াবহ শাস্তির কথা স্মরণ করা।
৯) সৎসঙ্গী-সাথীদের সাথে চলাফেরা করা।
১০) ভালো কোনো আলেমের সাথে দেখা করে তাঁর নিকট আপনার সমস্যাগুলো খুলে বলা এবং তার সুদপুদেশ ও পরামর্শ গ্রহণ করা ইত্যাদি।

(৭২) আযানের ১৫ মিনিট আগে নামাজ পড়া যায়। এটা কতটুকু সত্যঃ

প্রশ্ন: শুনেছি যে, আযানের ১৫ মিনিট আগে নামাজ পড়া যায়। এটা কতটুকু সত্য?
উত্তর:
নামাজের সময় হলেই নামাজ পড়া যাবে। সময় হওয়ার আগে অথবা শরিয়ত সম্মত ওজর ব্যতিরেকে সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পড়লে তা শুদ্ধ হবে না। কেননা নামাযের অন্যতম একটি শর্ত হল, সময় হওয়া। আযান হোক বা না হোক।
তবে সাধারণত: সময় হওয়ার পরই আযান দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, 
 “নিশ্চয় নামায মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।” (সূরা নিসা: ১০৩)
যাহোক, নামাজ পড়ার পূর্বে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, সময় হয়েছে কি না। সময় না হলে পড়া যাবে না।
উল্লেখ্য যে, পুরুষদের জন্য জামাআতের সাথে সালাত আদায় করা সুন্নতে মুআক্কাদা। অনেক আলেমের মতে ওয়াজিব। সুতরাং বিনা কারণে জামাআত পরিত্যাগ করা একদম অনুচিত। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

(৭৩) লাইসেন্স বিহীন অনলাইন ব্যবসা এবং ভেজাল পণ্য বিক্রয়ের বিধানঃ

ব্যবসা-বাণিজ্য (অনলাইন হোক বা অফ লাইন হোক) সহ সকল ক্ষেত্রেই প্রতিটি নাগরিকের রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলা জরুরি-যদি তা আল্লাহর নাফরমানী মূলক না হয়।
সুতরাং সরকারী আইন লঙ্ঘন করে অনলাইন ব্যবসা করা যেমন বৈধ নয় তেমনি সেখানে চাকুরী করাও বৈধ নয়। এতে যে চাকুরী দিবে আর জেনেবুঝে যে চাকুরী করবে উভয়েই গুনাহগার হবে। তবে উক্ত ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থকে হারাম বলা যাবে না যদি ক্রয়-বিক্রয় সঠিকভাবে করা হয় এবং পণ্যটি হালাল হয়।
অর্থাৎ সরকারী আইন লঙ্ঘন করার জন্য গুনাহ হবে। এ জন্য আল্লাহর নিকট তওবা করত: যথাসম্ভব দ্রুত লাইসেন্স নিতে হবে। কিন্তু এ অবস্থায় সঠিক পদ্ধতিতে হালাল পণ্য বিক্রয় থেকে উপার্জিত অর্থ হালাল হবে ইনশাআল্লাহ।
অনুরূপভাবে উক্ত ব্যবসার সাথে নিযুক্ত কর্মচারীদের বেতন গ্রহণ করাও হালাল হবে ইনশাআল্লাহ।
অবশ্য ফেসবুক, হোয়াটসআ্যাপ গ্রুপ ইত্যাদির মাধ্যমে ছোটখাটো ব্যবসার জন্য দেশের আইনে লাইসেন্স প্রয়োজন না কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। যদি লাইসেন্স প্রয়োজন না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে এ সব ছোটখাটো ব্যবসা করতে কোনো আপত্তি নেই।
ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’[মুসলিম: ১০১।]
যারা খাদ্য, পানীয়, ঔষধ বা অন্য কিছুতে ভেজাল দেয় বা মানুষের সাথে প্রতারণা করে তারা একদিকে যেমন ইসলামি দৃষ্টিতে হারামের সাথে যুক্ত অন্য দিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও অপরাধী। এরা দেশ ও জনগণের শত্রু। এটি চারিত্রিক স্খলন ও নৈতিকতা হীন কর্ম। কোন মুসলিমের জন্য এমনটি করা শোভনীয় নয়।
যারা ভেজাল পণ্য বিক্রয় করে তাদের উপার্জিত অর্থ হারাম এবং তাদের অধীনে চাকুরী করা যেমন হারাম তেমনি তাদের বেতনও হারাম। কারণ তারা সরাসরি প্রতারণার সাথে জড়িত। যারা জেনে শুনে এমন ভেজাল পণ্য বিক্রয় কারীদের অধীনে চাকুরী করবে তারা মানুষের সাথে প্রতারণা এবং অন্যায় কাজে সহযোগী হিসেবে গুনাহগার হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরণের নীতি-নৈতিকতা হীন ও আইন বহির্ভূত কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৭৪) রমজান ও তারাবীহ সংক্রান্ত কতিপয় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরঃ

প্রশ্ন:
১) তারাবীর নামাজ কত রাকাত পড়া সুন্নত?
২) সুন্নত নামাজে কি ৪ রাকাতেই সুরা মিলাতে হয়?
৩) তারাবীহ এর ৪ রাকাতে বসে বসে কি কি দোয়া করব অথবা মুনাজাত বা জিকির করবো?
৪) রমজানে কি কবরের আযাব মাফ থাকে?
৫) সহবাসে যদি রোজা ভাঙ্গে তবে কী করতে হয়?
৬) অতীতে ফরয রোজা কারণ বশত: ছুটেছে। এখন কি যে কোন সময় তা কাযা করতে পারব?
৭) রমজান মাসে কি তাহাজ্জুদ পড়তে হয়?
উত্তর:
১) তারাবীহ এর সালাত ৮ রাকাআত পড়া উত্তম। তবে ২০ রাআত পড়া জায়েয। ইচ্ছে করলে তার কম ও বেশি করা যেতে পারে আগ্রহেরে উপর ভিত্তি করে।
২) সুন্নাত নামায দু রাকাআত দু রাকাআত করে পড়া অধিক উত্তম। তবে যোহরের পূর্বে কখনো কখনো দুই তাশাহুদে চার রাকআত পড়া জায়েয আছে।
এ ক্ষেত্রে ফরজ ও সুন্নতে নিয়ত ও একামত ছাড়া আর কোন পার্থক্য নাই। সুতরাং পরের দু রাকাআতে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠ করবেন; অন্য কোন সুরা মিলাবেন না।
৩) প্রতি দু রাকআত পরে সালাম ফিরানোর পর পাঠ করবেন:
এছাড়াও অন্যান্য দুআ-তাসবীহ পাঠ করা যাবে।
তবে প্রতি চার রাকআত পরপর “সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতে…” এ দুআ পাঠ করার ব্যাপারে কোন হাদিস এসেনি। তাই নিয়ম করে তা পাঠ করা বিদআত।
৪) রামযানে কবরের আযাব মাফ থাকে-এ কথা সঠিক নয়।
৫) রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে তার জন্য তওবার পাশাপাশি কাফফারা হল,
ক. একটি গোলাম আযাদ করা
খ. তা সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দুমাস রোযা থাকা
গ. তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন গরীব-মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো।
৬) ওজর বশত: রোযা ছুটে গেলে করণীয় হল, সেগুলো পরবর্তী রোযা আসার পূর্বে যে কোন সময় কাযা করে নেয়া।
৭) রামাযানে তারাবীহ পড়াই যথেষ্ট। তবে কেউ ইচ্ছে করলে শেষ রাতে তাহাজ্জুদও পড়তে পারে।

(৭৫) পিতা যদি তার মেয়েকে তার অনিচ্ছা স্বত্বেও ঘুস দিয়ে চাকুরী নিতে বাধ্য করেঃ

প্রশ্ন: আমি একজন মেয়ে। আমার বাবা-মা আমার চাকরির interview এ ঘুস দিতে চায় যাতে চাকরি হয়। আমি নিষেধ করেছি। কিন্তু তারা রাজি নয়। তারা আমাকে শিক্ষকতা পেশায় যেভাবে হোক ঢুকাতে চায়। আমি আবার ব্যবসা বুঝি না। এখন বাবার কথা শুনে রাজি হয়ে এভাবে ঘুস দিয়ে চাকরি নিলে তা কি আমার জন্য হালাল হবে? এখন আমার করণীয় কি?
উত্তর:
আমাদের অজানা নয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুস দেয়া ও নেয়া উভয়টি কবিরা গুনাহ ও অভিসম্পাত যোগ্য কাজ এমনকি সামাজিক দৃষ্টিতেও অপরাধ।
ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামী।” (তিরমিযী হা/১৩৩৭, ত্ববারানী, ইবনে হিব্বান, সনদ সহীহ)
তিনি আরও বলেন:
“ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন।” (ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে হা/৫০৯৩-আলবানী)
এ মর্মে আরও হাদিস আছে।
মোটকথা ঘুস দিয়ে চাকুরী নেয়া চরম অন্যায় ও বড় গুনাহ। এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
পিতার জন্য বৈধ নয় ঘুস দিয়ে তার মেয়ের জন্য চাকুরী নেয়া। আর মেয়ের জন্যও বৈধ নয় তাতে সম্মতি দেয়া।
সুতরাং মেয়ে যেন ঘুস দিয়ে চাকুরী নেয়ার ব্যাপারে মোটেও সম্মতি না দেয়। তবে পিতা যদি মেয়ের নিষেধ স্বত্বেও ঘুস দেয় তাহলে যথাসম্ভব চাকুরী করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু এতে যদি সে পিতামাতার পক্ষ থেকে অত্যাচারের শিকার হওয়ার আশংকা করে তাহলে মনে ঘৃণা বোধ জাগ্রত রেখে চাকুরীতে যুক্ত হতে পারে। তৎসঙ্গে অন্য কোথাও হালাল কর্মসংস্থানের জন্য মহান আল্লাহর নিকট দুআ করবে এবং সে জন্য চেষ্টা অব্যহত রাখবে।
যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে নিশ্চয় মহান আল্লাহ তার জন্য অকল্পনাতীতভাবে হালাল জীবিকার ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা তালাক/২ ও ৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের হালাল কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করুন এবং সব ধরণের হারাম থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

(৭৬) পুরাতন, ছেঁড়া ও পড়ার অযোগ্য কুরআন কী করা উচিৎঃ

প্রশ্ন: পুরাতন, ছেঁড়া ও পড়ার অযোগ্য কুরআন কী করা উচিৎ?
উত্তর:
প্রথমত: সম্ভব হলে পুরাতন,ছেড়া-ফাটা কুরআন মেরামত/বাইন্ডিং করে ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা করতে হবে। এতে একটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম আল্লাহর কিতাবের প্রতি যত্ন নেয়ার কারণে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাওয়া যাবে।
কিন্তু কোনোভাবে তা মেরামত করা সম্ভব না হলে তখন সেগুলো অত্যন্ত সম্মানের সাথে আগুন দ্বারা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
কুরআন অতীব পবিত্র ও সম্মানের বস্তু। আর তাই কোনভাবে যেন তার সম্মানহানি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই সম্ভবত: সাহাবায়ে কেরাম অব্যবহারযোগ্য কুরআনের কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মূল কুরায়শী আরবিতে কুরআন নাযিল হয়েছিল। পরে অন্য উপভাষাতেও কুরআন পাঠের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাতে শব্দ ও মর্ম গত বিপত্তি দেখা দিলে ৩য় খলীফা উসমান (রাঃ) কুরআনের মূল কুরায়শী কপি রেখে বাকি সব কপি পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বর্তমানে কেবল সেই কুরআনই সর্বত্র পঠিত হয় (বুখারী, মিশকাত হা/২২২১)। আল হামদুলিল্লাহ।
পোড়ানোর ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে যেন, কুরআনের অক্ষরগুলো চেনা না যায়। কেননা, অনেক সময় পোড়ানো কাগজেও অক্ষর দেখা যায়। তাই ছাইগুলোও এমনভাবে গুড়া করে দিতে হবে যেন কুরআনের অক্ষরগুলো সম্পূর্ণরূপে মুছে যায়।
আধুনিক যুগে কাগজ গুড়া করার মেশিন (Paper shredder)পাওয়া যায়। এ সব মেশিন ব্যবহার করেও কুরআনের অকেজো পাতাগুলোকে খুব সূক্ষ্মভাবে গুড়া করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন, গুড়া করার পর কুরআনের কোন অক্ষর অক্ষত না থাকে।
তবে অনেক আলেম বলেছেন যে, তা এমন স্থানে দাফন করাও জায়েয রয়েছে যেখানে মানুষজন চলাফেরা করে না বা যেখানে ময়লা ফেলা হয় না।
তবে ১ম পদ্ধতিটি সর্বোত্তম। কেননা, এ মর্মে সাহাবীদের আমল রয়েছে।
একটি সতর্কতা:
আমাদের দেশে সময় দেখা যায়, ছেড়া-ফাটা ও ব্যবহার অনুপযোগী কুরআন বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে আসা হয়! কিন্তু এমনটি করা সঙ্গত নয়। কারণ পানিতে ডুবে থাকলেও কুরআনের অক্ষরগুলো দীর্ঘ দিন অবশিষ্ট থাকে। আর তা অনেক সময় জেলেদের জালে উঠে আসে বা নদীতে গমনকারীদের পদদলিত হয়। সুতরাং এ কাজটি নি:সন্দেহে পরিত্যাজ্য।

 (৭৭) ভিড়ের সময় হাতিমে কা’বা বা মাকামে ইবরাহীমের পেছনে সালাত আদায়ের বিধানঃ

প্রশ্ন: ভিড়ের সময় হাতিমের ভিতর বা মাকামে ইবরাহীমের পেছনে সালাত আদায়ের সময় তো সামনে দিয়ে লোকজন চলাচল করে বা দাঁড়ানো থাকে। সুতরাং যদি কেউ নামাযির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দেয় বা চলাচলকারীদেরকে নামাযীর সামনে দিয়ে যেতে বাধা দেয় তাহলে কি কোনো সমস্যা আছে? আর তাতে কি সে নামায শুদ্ধ হবে? কারণ সালাতের সামনে সুতরা দিতে হয়। কিন্তু সেখানে সুতরার ব্যবস্থা নাই।
উত্তর:
হাতিম কা’বার ভেতর অথবা অথবা মাকামে ইবরাহীমের নিকট অথবা কাবা প্রাঙ্গণের অন্য কোথাও তওয়াফ কারীদের প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা ঠিক নয়। কিছু মানুষকে দেখা যায়, কেউ ওখানে সালাত পড়ছে আর কয়েকজন ব্যক্তি মিলে হাতে হাতে ধরে উক্ত নামাযরত ব্যক্তিকে ঘিরে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে তওয়াফ কারী লোকদেরকে সামনে দিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে!!
এটি শুধু শরীয়ত বহির্ভূত নয় বরং তওয়াফ কারী লোকদের প্রতি জুলুম এবং চরম বেয়াদবি মূলক আচরণ। দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরাই এ ধরণের কাজ করে। যারা এমনটি করে তারা আল্লাহর ঘরের তওয়াফ কারী লোকদেরকে কষ্ট দেয়ার কারণে গুনাহগার হবে। আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমীন।
সঠিক নিয়ম হল, প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে উক্ত স্থানগুলোতে সালাত আদায় না করা। বরং মসজিদে হারামের যে কোনো সুবিধাজনক স্থানে দাঁড়িয়ে তওয়াফ শেষের দু রাকআত সালাত অথাব অন্যান্য নফল সালাত আদায় করবেে। এতে সে নিজে যেমন পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে সালাত আদায় করতে পারবে তেমনি লোকজনকে কষ্ট দেয়া থেকেও বেঁচে যাবে। এতে সওয়াবেরও কোনো ঘাটতি হবে না ইনশাআল্লাহ।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, উমর ইবনুল খাত্তাব রা. কোনো একবার ‘যি তুওয়া’ নামক স্থানে তওয়াফের দু রাকআত সালাত আদায় করেছেন। যেমন:
‘উমর (রাঃ) ফজরের সালাতের পর তাওয়াফ করে বাহনে আরোহণ করেন এবং তাওয়াফের দু’ রাক’আত সালাত যু-তুওয়া (নামক স্থানে) পৌঁছে আদায় করেন।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ২২/ হজ্ব, পরিচ্ছদঃ ১০৩৩. ফজর ও ‘আসর-এর (সালাতের) পর তাওয়াফ করা। হা/১৫২৯]
যি তুওয়া হল, মসজিদে হারাম থেকে বাইরে হারাম সীমানার মধ্যে অবস্থিতি একটি স্থানের নাম।
অনুরূপভাবে উম্মে সালামা রা. হতেও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মসজিদে হারামের বাইরে এসে তওয়াফের দু রাকআত সালাত আদায় করেছেন।
তারা এমনটি করেছেন এ জন্য যে, যেন মানুষ বুঝতে পারে, হারামের যে কোনো স্থানে তওয়াফের দু রাকআত আদায় করা জায়েয আছে।
সুতরাং তওয়াফ কারীদের ভিড়ের মধ্যে নামায পড়তে গিয়ে তাদেরকে বাধাগ্রস্থ করা এবং কষ্ট দিয়ে নামায পড়া মোটেই সঙ্গত নয়। বরং তার পরিবর্তে মসজিদে হারামের যেখানে সুবিধা হয়-এমন কি মসজিদের বাইরে হারাম সীমানার মধ্যে যে কোনো সুবিধাজনক সেখানে তওয়াফ শেষের দু রাকআত সালাত পড়ার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

 (৭৮) ক্রসিং বিয়ে: কখন বৈধ কখন অবৈধঃ

প্রশ্ন: এক দীনি ভায়ের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। অন্য আরেক দীনি ভায়ের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারা দুই ছেলে মেয়ের সাথে দুই ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়। এভাবে কি বিয়ে দেয়া যাবে? শরিয়তে কি এমন ক্রসিং বিয়ে নিষিদ্ধ?
উত্তর:
নিকাহে শিগার বা ক্রসিং বিয়ে (যাকে অদল-বদল বিয়েও বলা হয়) এর তিনটি পদ্ধতি আছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হারাম, আরেকটি বিরোধপূর্ণ হলেও সঠিক মতানুযায়ী হারাম এবং আরেকটি হালাল।
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১ম পদ্ধতি-হারাম:
যদি কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলে যে, আমি আমার ছেলেকে তোমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিব। তবে শর্ত হল, তোমার ছেলেকে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে কোনো মোহর থাকবে না।
অথবা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে প্রস্তাব দিলো, তুমি আমার সাথে তোমার মেয়েকে অথবা বোনকে বিয়ে দাও এবং তার পরিবর্তে আমি আমার মেয়েকে অথবা বোনকে তোমার সাথে বিয়ে দিবো। আর এতে কোন মোহর থাকবে না।
অর্থাৎ এখানে দুটি বিষয় থাকবে। যথা:
এক. বিয়েতে এই শর্ত থাকবে যে, ‘একে অপরের ছেলে/মেয়ের বিয়ে দিবে বা অদল-বদল বিয়ে হবে। এই শর্ত পূরণ না হলে বিয়ে হবে না।
দুই. উপরোক্ত শর্তানুযায়ী বিয়েকেই মোহরের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গণ্য করা হবে। আলাদা কোনো আর্থিক মোহর নির্ধারণ করা হবে না।
এটি নিষিদ্ধ শিগার বা ক্রসিং বিবাহের অন্তর্ভুক্ত। এটি হারাম।
এ মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
 তন্মধ্যে একটি হল:
ইবনে ‘উমার (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিগার নিষিদ্ধ করেছেন।
‘শিগার’ হলোঃ “কোন ব্যক্তি নিজের কন্যাকে অন্য এক ব্যক্তির পুত্রের সাথে বিয়ে দিবে এবং তার কন্যা নিজের পুত্রের সাথে বিয়ে দিবে এবং এক্ষেত্রে কোনো মোহর থাকবে না।” (বুখারী পর্ব ৬৭/২৭ হাঃ ৫১১২, মুসলিম ১৬/৬ হাঃ ১৪১৫)
আরেকটি হাদিস হল:
ইবনে উমর (রা:) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিগার বিবাহ নিষিদ্ধ করেছেন।
বর্ণনাকারী বলেন, শিগার বিবাহ এই যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে প্রস্তাব দিলো, তুমি আমার সাথে তোমার মেয়েকে অথবা বোনকে বিয়ে দাও এবং তার পরিবর্তে আমি আমার মেয়েকে অথবা বোনকে তোমার সাথে বিয়ে দিবো, আর এতে কোন মাহর থাকে না। [সহীহুল বুখারী ৫১১২, ৬৯২০, মুসলিম ১৪১৫]
২য় পদ্ধতি- অগ্রাধিকার যোগ্য মতে হারাম:
উপরে বর্ণিত হুবহু একই পদ্ধতি। তবে পার্থক্য হল, এখানে আর্থিক মোহর নির্ধারণ করা হবে (কম বেশি যাই হোক)।
অর্থাৎ এখানে ‘একে অপরের ছেলে/মেয়ের বিয়ে বা আদল-বদল বিয়ের’ শর্ত ঠিক থাকবে। কিন্তু পাশাপাশি মোহরও নির্ধারণ করা হবে।
এ বিয়ের ব্যাপারে দ্বিমত থাকলেও সঠিক কথা হল, এটিও নিষিদ্ধ শিগার বা ক্রসিং বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। এটি হারাম। কেননা, এখানে বদল বিয়ের শর্তারোপ করা হয়েছে। সুতরাং তা ‘শিগার’ বিয়ে হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ পক্ষে মত দিয়েছেন আল্লামা বিন বায এবং সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি (লাজনাহ দায়েমা)।
৩য় পদ্ধতি- বৈধ/হালাল:
উপরে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ী একে অপরের মেয়ে বা বোনের বিবাহ দিবে। কিন্তু এখানে উপরোক্ত দুটি জিনিস থাকবে না। যথা:
 এক. একে অপরের মেয়ে বা বোনের বিয়ের শর্ত থাকবে না। অর্থাৎ এক বিয়ের সাথে অপর বিয়ে নির্ভরশীল হবে না।
দুই. উভয় পক্ষের ছেলে/মেয়ের বিয়ে যথারীতি মোহর থাকবে।
এই বিয়ে হালাল। এটি নিষিদ্ধ শিগার বা ক্রসিং বিয়ের অন্তর্গত নয়।
সুতরাং প্রশ্নে উল্লেখিত বিয়ে যদি ৩য় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাহলে তা বৈধ; অন্যথায় বৈধ নয়। অর্থাৎ উক্ত বিয়েতে অদল-বদল বিয়ের শর্তারোপ থাকবে না এবং শরিয়ত সম্মত পদ্ধতিতে মোহর নির্ধারণ করা হবে। তাহলে তা বৈধ হবে।

 (৭৯) রাতের বেলায় যে সকল সূরা ও আয়াত পড়ার ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত হয়েছেঃ

রাতের বেলায় যে সকল সূরা ও আয়াত পড়ার ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ:
ক. আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল সূরা পাঠ না করে ঘুমাতেন না সেগুলো হল ৪টি সূরা। যথা:
১) আলিফ লাম তানযীল (সূরা সাজদাহ)
২) তাবারাকাল্লাযি বিইয়াদিহিল মুলক (সূরা মুলক)
৩) সূরা ইসরা ও
৪) সূরা যুমার।
এ মর্মে হাদিস হল:
খ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল সূরা পড়ে শরীর মাসেহ করতেন (শরীরে হাত বুলাতেন )। সেগুলো হল ৩টি সূরা। যথা:
১) সূরা ইখলাস
২)সূরা ফালাক
৩) সূরা নাস।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানায় গিয়ে হাতের তালুতে ফুঁ দিয়ে এ ৩টি সুরা পড়ে তাঁর মাথা, মুখমণ্ডল এবং শরীরের উপরিভাগে যতদূর সম্ভব মাসেহ করতেন (হাত বুলাতেন)। তিনি এমনটি তিনবার করতেন।
গ. সূরা কাফিরূন: শিরক থেকে মুক্তির ঘোষণা
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “এ সূরাটির মধ্যে রয়েছে শিরক থেকে মুক্তির ঘোষণা। তাই তিনি ঘুমের পূর্বে এটি পাঠ করতে বলেছেন।
ঘ. আয়াতুল কুরসী:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: “বিছানায় গিয়ে এই আয়াতটি পাঠ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন প্রহরী (ফেরেশতা) নিয়োগ দেয়া হয় এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তার কাছে আসতে পারে না।
ঙ) সূরা বাকারা এর শেষ দুই আয়াত পাঠ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাকারা এর শেষ দুটি আয়াত পাঠ করবে তা তার সারা রাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।” (হাদিসের ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন: রাতে এ দুটি আয়াত পাঠ কারীর জন্য রাতে নফল সালাত আদায় অথবা বিপদাপদ থেকে রক্ষা অথবা উভয়টির জন্য যথেষ্ট হয়)
চ. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশটি আয়াত পাঠ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাকে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এ দশটি আয়াত পাঠ করতেন।
আল্লাহু আলাম।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উক্ত আমলগুলো সম্পাদন করার তওফিক দান করুন। আমীন।

(৮০) দরিদ্র ভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা না করলে কি হজ্জ-উমরা, দান-সদকা ইত্যাদি ইবাদত কবুল হয় নাঃ

প্রশ্ন: এক ভায়ের সম্পদের উপর আরেক ভায়ের কতটুকু হক রাখে? যদি কোনো ভাই তার অসুস্থ দরিদ্র ভাইকে সাহায্য সহযোগিতা না করে হজ-উমরা পালন করে, এমন জায়গায় দান-সদকা করে যেখানে লোকেরা তাকে চিনবে অথচ তার আপন ভাই-বোনদের খোঁজ-খবর নেয়া বা তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা দরকার মনে করে না। এসব লোকদের হজ্জ-উমরা ও দান-সদকা কি কবুল হবে?
উত্তর:
এক মুসলিমের উপরে আরেক মুসলিমের কিছু অবশ্য পালনীয় কর্তব্য রয়েছে। যেগুলোকে বলা হয় পারস্পরিক “হক বা অধিকার।” সেগুলো হল পাঁচটি:
১) সালামের উত্তর দেওয়া
২) রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করা বা রোগী দেখতে যাওয়া।
৩) মারা গেলে জানাযার অনুগমন করা।
৪) দাওয়াত দিলে গ্রহণ করা।
৫) হাঁচির জবাব দেয়া।
(বুখারী ও মুসলিম-আবু হুরায় রা. হতে বর্ণিত)
অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, উপরোক্ত পাঁচটির সাথে আরেকটি তা হল: পরামর্শ চাইলে সু পরামর্শ দেওয়া।
এগুলো অপরিহার্য পালনীয় অধিকার। এগুলো পালন না করলে গুনাহগার হতে হবে।
এর পাশাপাশি আরও এমন কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সেগুলো অবশ্য পালনীয় না হলেও অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং মুসলিম হিসেবে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার দাবি।
যেমন:
● অভাব-অনটন ও বিপদ-আপদে যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করা।
● সমস্যা ও সংকটে পাশে থাকা।
● খোঁজ-খবর নেওয়া।
● একে অপরের সুখে-দুখে কাছে থাকা।
● কল্যাণ কামনা করা।
● দোয়া করা।
● দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা।
● কোন বিষয় না জানলে শিক্ষা দেওয়া।
● ভুল করলে সংশোধন করা
● দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা ইত্যাদি।
এই বিষয়গুলো মুসলিম হিসেবে একে অপরের প্রতি ঈমানই দায়িত্ব। আর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় হলে সে ক্ষেত্রে এই দাবিটি আরো জোরালো হয়।
তাই ভাই-বোন বা রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আরো বেশি সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
যাহোক, কোন ভাই যদি তার আপন ভাইকে তার বিপদ মুহূর্তে সামর্থ্য থাকার পরেও সাহায্য-সহযোগিতা না করে বা দরিদ্র অবস্থায় তাকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না দেয় তাহলে এর জন্য গুনাহগার না হলেও নিঃসন্দেহে বিশাল সোয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। এই ক্ষেত্রে গুনাহগার না হওয়ার কারণ হল, ‌ভাইয়ের ভরণপোষণ ও দায়-দায়িত্ব পালন অপর ভাইয়ের জন্য ফরজ নয়।
সে কারণে উক্ত ভাইয়ের নামাজ, রোজা, হজ, উমরা, দান-সদকা বা অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী কবুল হবে না- এমনটি বলার সুযোগ নেই। তবে সে বিশাল সোয়াব থেকে বঞ্চিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার তৌফিক দান করুন।
(৮১) রমজান মাসে অধিক পরিমাণে নেক আমল করার জন্য প্রস্তুতি মূলক ১০টি টিপসঃ
প্রশ্ন: রমজান মাসে আমরা কিভাবে ভাল আমল করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারি?
উত্তর:
মাহে রমজান মূলত: গুনাহ মোচন, তাকওয়া অর্জন, চরিত্র সংশোধন, নিজেকে পরিবর্তন এবং বিভিন্ন ধরণের নেকির কাজ করে আমলনামা ভরে নেয়ার অফুরন্ত সম্ভাবনাময় মাস। ইমানদার ব্যক্তিগণ এ মাসের প্রতিটি মূহুর্তেকে সৎকর্মে ব্যয় করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে।
নিম্নে রমাযানুল মোবারকে অধিক পরিমাণে নেকি উপার্জনের দশটি টিপস প্রদান করা হল:
১) অতীত জীবনের পাপাচার ও অন্যায়-অপকর্মের জন্য খাঁটি অন্তরে আল্লাহর দরবারে তওবা করা।
২) রমাযানে রোযা রাখার ব্যাপারে অন্তরে মজবুত নিয়ত করা এবং এ জন্য মহান রবের নিকট তাওফিক কামনা করে দুআ করা।
৩) রমাযানের আগমনে আনন্দিত হওয়া।
৪) পূর্বের রোযা বাকি থাকলে তা আগামী রমাযান আসার পূর্বে কাযা করে নেয়া।
৫) রোযার বিধিবিধান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করা।
৬) রমাযান আসার পূর্বে যথাসম্ভব দুনিয়াবি কর্মব্যস্ততা কমিয়ে ফেলা।
৭) শাবান মাসে নফল সিয়াম পালন করা।
৮) শাবান মাস থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করা।
৯) রমাযান মাসে রোজাদারদেরকে ইফতার করানো, দাওয়াতি কাজ করা, যাকাত আদায় (যদি তা আদায় করার ইচ্ছা থাকে) সহ বিভিন্ন ধরণের নেকির কাজ করার জন্য অগ্রিম প্রস্তুতি নেয়া।
১০) রমাযানে মক্কায় এসে উমরা আদায় করার এবং সেই সাথে মক্কার মসজিদে হারাম অথবা মসজিদে নববী অথবা এলাকার জুমার মসজিদে ইতিকাফের প্রস্তুতি নেয়া।

 (৮২) স্ত্রীর পক্ষ স্বামীকে যাকাত প্রদানের বিধানঃ

প্রশ্ন: স্বামীর যদি অনেক ঋণ থাকে এবং বউ যদি কাজ করেন আর তা কাছে যাকাত দেওয়ার মতো টাকা এবং সোনা-গহনা ইত্যাদি থাকে তাহলে সে কি তার স্বামীকে ঋণ পরিশোধের জন্য যাকাতের টাকা থেকে কিছু দিতে পারবে? এটা কতটুকু জায়েজ হবে?
উত্তর:
হ্যাঁ, স্ত্রী সম্পদশালী হলে তার ঋণগ্রস্ত স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে।
কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে এমন গরিব-অসহায় ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া জায়েজ যাদের ভরণ-পোষণ দেয়া যাকাত দাতার জন্য ফরয নয়। যেমন: পিতা, মাতা, স্ত্রী প্রমুখকে যাকাত দেয়া যাবে না। কেননা তাদের ভরণ-পোষণ দেয়া ফরয।
কিন্তু ভাই, বোন, চাচা, চাচী, ফুফা, খালু, মামা ইত্যাদি ব্যক্তিদেরকে যাকাত দেয়া যাবে যদি তারা যাকাত পাওয়ার হকদার হয়।
এমন কি স্ত্রী যদি সম্পদশালী হয় আর স্বামী ঋণগ্রস্ত হয় আর আর্থিক অভাবে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় তাহলে তাহলে স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। শরিয়তে এতে কোনো বাধা নেই। কেননা, স্বামীর ভরণ-পোষণ দেয়া স্ত্রীর জন্য ফরয নয়।
এ মর্মে হাদিস হল:
আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ঈদুল আযহা বা ঈদুল ফিতর দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে গেলেন এবং সালাত শেষ করলেন। পরে লোকদের উপদেশ দিলেন এবং তাদের সদকা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন আর বললেন:
“লোক সকল! তোমরা সদকা দিবে। তারপর মহিলাগণের নিকট গিয়ে বললেন: মহিলাগণ তোমরা সদকা দাও। আমাকে জাহান্নামে তোমাদেরকে অধিক সংখ্যক দেখানো হয়েছে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর কারণ কি? তিনি বললেন: তোমরা বেশী অভিশাপ দিয়ে থাক এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞ হয়ে থাক। হে মহিলাগণ! জ্ঞান ও দ্বীনে অপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও দৃঢ়চেতা পুরুষের বুদ্ধি হরণ কারিণী তোমাদের মত কাউকে দেখিনি।”
যখন তিনি ফিরে এসে ঘরে পৌঁছলেন, তখন ইবনে মাস’উদ (রাঃ) এর স্ত্রী যায়নাব (রাঃ) তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন।
বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল, যায়নাব এসেছেন।
তিনি বললেন, কোন যায়নাব?
বলা হল, ইবনে মাস’উদের স্ত্রী।
তিনি বললেন: হ্যাঁ, তাকে আসতে দাও।
তাকে অনুমতি দেওয়া হল।
তিনি বললেন: হে আল্লাহর নবী, আজ আপনি সা’দকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার অলংকার আছে। আমি তা সা’দকা করব ইচ্ছা করেছি। ইবনে মাস’উদ (রাঃ) (তার স্বামী) মনে করেন, আমার এ সদকায় তাঁর এবং তার সন্তানদেরই হক বেশী।
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ইবনে মাস’উদ (রাঃ) ঠিক বলেছে। “তোমার স্বামী ও সন্তানই তোমার এ সদকায় অধিক হকদার।”
সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বর: [1377], অধ্যায়ঃ ২১/ যাকাত -ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
(সমাপ্ত)
দ্বিতীয় পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উপদেষ্টা-
মোঃ আনোয়ার হোসাইন আকন্দ (কামিল, ফার্স্ট ক্লাশ- আল হাদিস)
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।

আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Addressসহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)
“তার চেয়ে ভাল কথা আর কি হতে পারে, যে মানুযকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন। (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
 “যে হেদায়েতের প্রতি আহবান জানায়, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে, তবে তা তাদের সওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না। আর যে পথভ্রষ্টতার প্রতি আহবান জানায়, তার ওপর তার অনুসারীদের সমপরিমাণ পাপ আরোপিত, তবে তা তাদের পাপ থেকে কোন কিছু হ্রাস করবে না।” [মুসলিম (২৬৭৪)]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে জনগণকে (আল্লাহর বিধান) পৌঁছে দাও, যদিও একটি আয়াত হয়। বনী-ইস্রাঈল থেকে (ঘটনা) বর্ণনা কর, তাতে কোন ক্ষতি নেই। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা (বা জাল হাদীস) আরোপ করল, সে যেন নিজ আশ্রয় জাহান্নামে বানিয়ে নিল।” (বুখারী ৩৪৬১,হাদিস  সম্ভার, হাদিস নং ১৫৪৮,  রিয়াদুস  সলেহিন,  হাদিস নং  ১৩৮৮।)
লেখক ও সংকলকঃ
মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।
(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উপদেষ্টা-
মোঃ আনোয়ার হোসাইন আকন্দ (কামিল, ফার্স্ট ক্লাশ- আল হাদিস)
সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ইসলামি সকল পর্ব এক সাথে দেখতে চাইলে এর উপর ক্লিক করুন-

 
Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...