Search This Blog

Friday, June 30, 2023

বান্দার যেসব গুণ আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

বান্দার যেসব গুণ আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন


সৎকর্মশীল ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন। এ ছাড়া মানুষের বিভিন্ন গুণাবলি, চারিত্রিক সৌন্দর্য ও মানবিক আচরণকর্ম রয়েছে, বান্দাদের মধ্যে তিনি সেসব গুণাবলি দেখতে ভালোবাসেন।

মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কৃরআনে বলেন, ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করো, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)।

যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না, আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না। বিপরীতে যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে, আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ করেন।

জারীর ইবনু ’আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হয় না। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০১৩, ৭৩৭৬,  সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৯২৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩১৯, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৭৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) অপর হাদিসে বলেছেন,

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ দয়াশীলদের উপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৪৯৪১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অনুগ্রহ লাভের সহজ উপায়ঃ

উল্লিখিত হাদিসদ্বয়ের আলোকে মুহাদ্দিসরা বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের সহজ উপায় হলো সৃষ্টি জগতের প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করা এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও অনুগ্রহ মহান স্রষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা ও অনুগ্রহকে ত্বরান্বিত করে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত ইহসানকারীদের (অনুগ্রহশীল) নিকটবর্তী।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত: ৫৬)।

মানব হৃদয়ে দয়া-মায়া যেমন হয়ঃ  মানবহৃদয়ে মায়া-দয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে।

(এক) বিশেষ অনুগ্রহঃ

যা আল্লাহ তার বিশেষ বান্দাদের দান করে থাকেন। বিশেষ অনুগ্রহস্বরূপ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহ কোমলহৃদয় করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের কোমলহৃদয় হয়েছিলেন।

যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরহৃদয় হতেন তবে তারা আপনার পাশ থেকে সরে যেতো।’ (সুরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৫৯)।

(দুই) সাধারণ অনুগ্রহঃ

যা আল্লাহর সব সৃষ্টি লাভ করে থাকে। এমনকি অবিশ্বাসীরাও এই শ্রেণির অনুগ্রহের অধিকারী হয়। যেমনঃ পিতা হিসেবে সন্তানের প্রতি স্নেহ ও মমতা অনুভব।

 উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোন এক কন্যার এক ছেলের মৃত্যু উপস্থিত হলে তাঁর কন্যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যাওয়ার জন্য একজন লোক পাঠালেন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোক পাঠিয়ে জানালেনঃ আল্লাহ্ যা নিয়ে নেন আর যা দেন সবই তাঁরই জন্য। আর প্রতিটি বস্তুর জন্য একটা সময়সীমা নির্দিষ্ট আছে। কাজেই সে যেন ধৈর্য ধরে এবং অবশ্যই সওয়াবের আশা করে। তারপর নবী-কন্যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যাওয়ার জন্য কসম দিয়ে আবার লোক পাঠালেন। তিনি যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়ালেন।

বর্ণনাকারী উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) বলেন, আমি, মু’আয ইবনু জাবাল, উবাই ইব্ন কা’ব, ’উবাদাহ ইবনু সামিতও তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়ালাম। আমরা সেখানে গিয়ে প্রবেশ করলে তখন তারা শিশুটিকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে দিলেন। আর তখন বাচ্চার বুকের মধ্যে এক অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেছিলেনঃ এ তো যেন মশকের মত। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁদলেন। তা দেখে সা’দ ইবনু ’উবাদাহ (রাঃ) বললেন, আপনি কাঁদছেন? তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তাঁর দয়ালু বান্দাদের উরপই দয়া করেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৪৪৮, ১২৮৪, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৯৩০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯৪০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদিসে এসেছে,

’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললো। আপনারা শিশুদের চুম্বন করেন, কিন্তু আমরা ওদের চুম্বন করি না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ যদি তোমার হৃদয় হতে দয়া উঠিয়ে নেন, তবে তোমার উপর আমার কি কোন অধিকার আছে? (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৯৯৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৯২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩১৭, আহমাদ ২৪৪৬২, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৬৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৫৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

জীবজন্তুর প্রতিও অনুগ্রহ করাঃ

 মানুষই কেবল মানুষের অনুগ্রহ লাভের যোগ্য নয়, বরং বন্য ও গৃহপালিত প্রাণী, পশু-পাখির প্রতি দয়াশীল আচরণ করতে হবে। যেমনঃ

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আযাব দেয়া হয়। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল, অবশেষে বিড়ালটি ক্ষুধায় মারা যায়। এ কারণে মহিলা জাহান্নামে প্রবেশ করল। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি [রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ] বলেন, আল্লাহ ভালো জানেন, বাঁধা থাকাকালীন তুমি তাকে না খেতে দিয়েছিলে, না পান করতে দিয়েছিলে এবং না তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছিলে, তা হলে সে জমিনের পোকা-কামড় খেয়ে বেঁচে থাকত। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৩৬৫, ৩৩১৮, ৩৪৮২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৭৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৪২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২১৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২২০৯)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির প্রতি দয়া নয়ঃ

আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করতে বলেছেন। তবে তা অবশ্যই তাঁর আনুগত্যের শর্তে। আল্লাহর অবাধ্য হয়ে কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা যাবে না।

হাদ্দাব ইবনু খালিদ ও শাইবান ইবনু ফাররূখ (রহঃ)...আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রাত্রে আমার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, আমি তার নাম আমার পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর নামে রাখি। এরপর তিনি উম্মু সায়ফ নামক একজন মহিলাকে ঐ সন্তানটি দিলেন। তিনি একজন কর্মকারের সহধর্মিণী। কর্মকারের নাম আবূ সায়ফ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আবূ সায়ফ এর নিকট যাচ্ছিলেন আর আমিও তার সঙ্গে যাচ্ছিলাম। যখন আমরা আবূ সায়ফের গৃহে উপস্থিত হই তখন সে তার হাপর বা ফুকনীতে ফুঁক দিচ্ছিল, সারা গৃহ ধুয়ায় ভরপুর ছিল। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগে দৌড়ে গিয়ে আবূ সায়ফকে বললাম, তুমি একটু থামো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসছেন। সে থামলো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলেকে ডাকলেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং যা আল্লাহর ইচ্ছা রয়েছে তা বললেন।

আনাস (রাযিঃ) বলেন, আমি এ ছেলেকে দেখলাম, সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে বড় বড় শ্বাস ফেলছিল। তা দেখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু’ নয়ন অশ্রু ভিজে গেল। আর তিনি বললেনঃ চোখ কাঁদছে, মন কাতর হচ্ছে, মুখে আমরা তাই বলব রব্বুল আলামীন যা পছন্দ করেন। হে ইবরাহীম! আল্লাহর শপথ! আমরা তোমার জন্য খুবই ব্যথিত। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৫৯১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৩১৫, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৩০৩,  আহমাদ ১৩০১৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১২১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১২২৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাওবা ও পরিচ্ছন্নতা

তওবা অর্থ হলো ফিরে আসা। মানুষ যখন ভুল পথে যায় বা বিপথগামী হয়, তখন সেখান থেকে সঠিক পথে বা ভালো পথে ফিরে আসাকে তওবা বলা হয়। তওবার পারিভাষিক অর্থ হলো লজ্জিত হওয়া। অর্থাৎ স্বীয় কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে সঠিক পথে ফিরে আসা। তওবার জন্য করণীয় হলো, স্বীয় কৃতকর্মের প্রতি লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া, সেই অপরাধ আর না করার দৃঢ় প্রত্যয় ও সংকল্প গ্রহণ করা এবং নেক আমলের প্রতি বেশিমাত্রায় মনোযোগী হওয়া।

কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুমিনদের তাওবার প্রতি আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে, তাদের পছন্দ করেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২২)।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-“ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা। আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে”। (সূরা তাহরিম, আয়াত-৮)।

উক্ত আয়াতে তওবাতুন নাসুহা বলতে খাটি তওবার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ- গুনাহ থেকে এমনভাবে ফিরে আসা যেন আর কখনো সেদিকে ফিরে না যায়। যেমনিভাবে দুধ দোহন করার পর তা আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না। (বান্দাহ তার গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ বিরত হয়ে তার জন্য লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে আর গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করে যে তওবা করা হয় তাকেই তওবাতান নাসূহা বা সত্যিকারের তওবা অথবা খাঁটি তওবা বলা হয়)। (তওবাকারী তওবা করার পর বান্দা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেন সে কোন গুনাহ-ই করেনি অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে তওবাকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়)।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা বান্দার তওবার কারণে সেই লোকটির চেয়েও অধিক খুশী হন, যে লোকটি মরুভূমিতে তাঁর উট হারিয়ে পরে তা পেয়ে যায়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৩০৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৮৫৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭৪৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৮৬৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৭৫৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih।

তাকওয়া বা  আল্লাহভীতি

তাকওয়া হলো মহান আল্লাহর নিষেধ থেকে দূরে থাকা এবং কুরআন যা কিছুর আদেশ দিয়েছে, তা পালন করা। অল্পে সস্তুষ্ট থাকা এবং সর্বোপরি পরকালের সফরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি তোমাদের পূর্ববর্তী গ্রন্থের অধিকারীদের এবং তোমাদের নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা সবাই আল্লাহকে ভয় করতে থাকো।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৩১)।

আবু উমামা (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায় হাজের ভাষণে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর, তোমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় কর। তোমাদের রামাযান মাসের রোযা রাখ, তোমাদের ধন-দৌলতের যাকাত আদায় কর এবং তোমাদের আমীরের অনুসরণ কর, তবেই তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। আমি (সুলাইম) আবু উমামা (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, আপনি কতদিন পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এ হাদীস শুনেছেন? তিনি বলেনঃ আমি তিরিশ বছর বয়সে তার নিকট এ হাদীস শুনেছি। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৬১৬, আস-সহীহাহ ৮৬৭, মুসনাদ আহমদ ২২২১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহভীতি মানুষের জীবনের মূল ভিত্তি। তাক্বওয়াশীল মানুষই জান্নাতে যাবে। এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে ক্ৰন্দনকারী ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যেরূপ দোহনকৃত দুধ আবার স্তনে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। আর আল্লাহ তা’আলার পথের (জিহাদের) ধুলা ও জাহান্নামের ধোয়া কখনো একত্র হবে না। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩১১, ১৬৩৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩৮২৮, সুনান আননাসায়ী ৩১০৮, মুসনাদ আহমাদ ১০৫৬০, সহীহ আল জামি ৭৭৭৮, সহীহ আত্ তারগীব ১২৬৯, তা’লীকুর রাগীব ২/১৬৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে নত মুখে লুটিয়ে পড়ে এবং কান্নার শব্দ শুনে তাদের নিবিড় আনুগত্য আরো বৃদ্ধি পায়’। (সুরা ইসরা ১০৯)।

আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

‘তোমরা ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় কথা শুনে আশ্চর্য হচ্ছ, হাসছ অথচ কাঁদছ না? আর গান-বাজনায় মত্ত হয়ে এসব এড়িয়ে যাচ্ছ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধুলায় লুটিয়ে পড় এবং তাঁর ইবাদতে মগ্ন হও’। । (সুরা নাজম ৫৯-৬২)।

যে ব্যক্তি আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করে আল্লাহ তার সকল বিষয় সমাধান করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার মুক্তির পথ বের করে দেন এবং এমন সূত্রে তাকে রিযিক দেন যার কল্পনা সে করেনি’। (সুরা তালাক ২-৩)।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেরূপ ভয় করা উচিৎ। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ কর না’। (সুরা আলে ইমরান ১০২)।

উপরোক্ত আয়াত সমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। আর তাঁকে যে ভয় করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, তার রিযিকের ব্যবস্থা করবেন এবং তাকে মর্যাদা দান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সেই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হতে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি জান্নাত’। (সুরা আর-রহমান ৪৬)।

তাক্বওয়া মুমিনের একমাত্র সম্বল। যা মানুষকে সম্মানিত করে। তাক্বওয়াশীলদেরকেই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) সবচেয়ে সম্মানিত বলেছেন। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

‘হে মানুষ সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানি সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত’। (সুরা হুজুরাত ১৩)।

এখানে আল্লাহ তা‘আলা পরহেযগার মানুষকেই সবচেয়ে বড় সম্মানিত মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন। অত্র আয়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, বংশ মর্যাদা সম্মানিত হওয়ার মাধ্যম নয় এবং নারী বা পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়াও সম্মানিত হওয়ার মাধ্যম নয়। মানুষ কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে ইহাকাল ও পরকালে সম্মান লাভ করতে পারে।

আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে যথা সম্ভব ভয় কর’। (সুরা তাগাবুন ১৬)।

অত্র আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তার সাধ্য অনুযায়ী পরহেযগারিতা অবলম্বন করার জন্য আদেশ করেছেন।

অন্যত্র তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’। (সুরা আহযাব ৭০)।

এ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে পরহেযগারিতা অবলম্বন করতে বলেন এবং সত্য কথা বলতে আদেশ করেন।

অপর এক আয়াতে পরহেযগারিতা অবলম্বনের উপকারিতা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন,  ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করে চল, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার মানদন্ড দান করবেন। তোমাদের পাপ মিটিয়ে দিবেন। আর তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। কারণ আল্লাহ বড় অনুগ্রহশীল’। (সুরা আনফাল ২৯)।

তাকওয়া বা  আল্লাহভীতির পুরস্কারসমূহঃ

(ক) আল্লাহভীতি জীবনকে সহজ করে দেয়ঃ

আল্লাহভীরু মানুষের জন্য আল্লাহ জীবনকে সহজ ও সাবলীল করে দেন। ফলে জীবন তার কাছে বোঝা মনে হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দেবেন।’ (সুরা: তালাক, আয়াত: ৪)।

(খ) মর্যাদা বৃদ্ধি করেঃ

তাকওয়া পার্থিব ও পরকালীন জীবনে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। তা মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রিয় ও সম্মানিত করে। আর আল্লাহর কাছে যখন কারো সম্মান বৃদ্ধি হয় তখন মানুষের কাছেও তার সম্মান বেড়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানী যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।’ (সুরা: হুজরাত, আয়াত: ১৩)।

(গ) পরকালে উত্তম পরিণতিঃ

পরকালে উত্তম পরিণতি তাকওয়ার অন্যতম পুরস্কার।

আল্লাহ খোদাভীরুদের জন্য উত্তম পরিণতির ঘোষণা দিয়েছেন, ‘শুভ পরিণতি আল্লাহভীরুর জন্য।’ (সুরা: কাসাস, আয়াত: ৮৩)।

(ঘ) তাকওয়া পাপ মোচন করেঃ

আল্লাহভীতি শুধু মানুষকে পাপের হাত থেকেই রক্ষা করে না, বরং অতীতের পাপও মোচন করে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে তার গুনাহ মুছে ফেলা হবে এবং তাকে পুরস্কৃত করা হবে।’ (সুরা: তালাক, আয়াত: ৫)।

(ঙ) আল্লাহভীরুদের পার্থিব জীবনেও রয়েছে সুসংবাদঃ

যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা পৃথিবীতেও নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) হয়েছে, তাদের জন্য জাগতিক জীবনে রয়েছে সুসংবাদ।’ (সুরা: ইউনুস, আয়াত: ৬৩-৬৪)।

(চ) আল্লাহভীরুরাই সফলঃ

আল্লাহভীরুদের জন্য সাফল্য ও হেদায়েতের ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম।’ (সুরা: নুর, আয়াত: ৫২)।

(ছ) তাকওয়া কিয়ামতে পরিত্রাণের মাধ্যমঃ

আল্লাহ তাআলা আল্লাহভীরুদের কিয়ামতের দিন মুক্তি দান করবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘পরে আমি আল্লাহভীরুদের উদ্ধার করব এবং জালিমদের সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দেব।’ (সুরা আল মারিয়াম ৭২)।

(জ) তাকওয়া রিজিকের দুয়ার খুলে দেয়ঃ

পৃথিবীতে যারা আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তাদের জীবিকার দুয়ার খুলে দেবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, তার জন্য আল্লাহ পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিজিক দান করবেন।’ (সুরা: তালাক, আয়াত: ২-৩)।

(ঝ) আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেনঃ

তাকওয়া বা আল্লাহভীরুদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো আল্লাহর ভালোবাসা। আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খোদাভীরুদের ভালোবাসেন।’ (সুরা: হুদ, আয়াত: ১১৩)।

(ঞ) আল্লাহভীরুদের জন্য জান্নাতঃ

যারা পৃথিবীতে আল্লাহকে ভয় পাবে, তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে, পরকালে আল্লাহ তাদের জান্নাত দ্বারা পুরস্কৃত করবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘জান্নাতকে আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে।’ (সুরা: শুআরা, আয়াত: ৯০)।

আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়ার ফজিলতঃ

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তাঁর ছায়া দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, (২) সেই যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে বড় হয়েছে, (৩) সে ব্যক্তি যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর তথায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত, (৪) এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর ওয়াস্তে পরস্পরকে ভালবাসে। আল্লাহর ওয়াস্তে উভয়ে মিলিত হয় এবং তাঁরজন্যই পৃথক হয়ে যায়, (৫) এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার দুই চক্ষু অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে, (৬) এমন ব্যক্তি যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী আহবান করে আর সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং (৭) সে ব্যক্তি যে গোপনে দান করে। এমনকি তার বাম হাত জানতে পারে না তার ডান হাত কি দান করে’। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৭০১,  সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬৬০, ১৪২৩, ৬৪৭৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৭০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৩১, সুনান আননাসায়ী ৫৩৮০, সুনান আততিরমিযী ২৩৯১, আহমাদ ৯৬৬৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪৮৬, ইরওয়া ৮৮৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৬২০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬২৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘দুই প্রকার চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চক্ষু আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়’। (তিরমিযী, আত-তারগীব হা/৪৭০৭)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে যাবে না। দুধ যেমন গাভীর ওলানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। আল্লাহর পথের ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন এক সাথে জমা হবে না’। (আত-তারগীব হা/৪৭০৯)।

আনাস (রাঃ) ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘দুই শ্রেণীর চক্ষু জাহান্নাম দেখবে না। ১. যে চক্ষু আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়। ২. যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কাঁদে’। (আত-তারগীব হা/৪৭১১)।

মু‘আবিয়া ইবনু হায়দা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যাদের চক্ষু জাহান্নাম দেখবে না। এক. যারা আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়। দুই. যারা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। তিন. যারা বেগানা নারীকে দেখে চক্ষু নীচু করে’। (আত-তারগীব হা/৪৭১৩)।

আবু ওমামা বাহেলী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট দু’টি ফোটা বা বিন্দু এবং দু’টি চিহ্নের চেয়ে প্রিয় কিছু নেই। ১.আল্লাহর ভয়ে চক্ষু হতে প্রবাহিত পানির ফোঁটা। ২. আল্লাহর রাস্তায় প্রবাহিত রক্তের ফোঁটা। আর প্রিয় চিহ্ন হচ্ছে আল্লাহর পথে জখমের চিহ্ন এবং আল্লাহর ফরয আদায় করতে করতে পায়ে বা কপালের চিহ্ন’। (তিরমিযী, আত-তারগীব হা/৪৭১৭)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তিনজনের তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, আমি এক দিনের জন্য একজন দিন মজুর নিয়েছিলাম। সে আমার অর্ধ দিন কাজ করেছিল। আমি তাকে মজুরি দিলাম। সে অসন্তুষ্ট হল এবং পারিশ্রমিক গ্রহণ করল না। আমি সে পয়সাকে বাড়ালাম। শেষ পর্যন্ত তা প্রচুর সম্পদে পরিণত হল। তারপর হঠাৎ একদিন এসে সে তার পারিশ্রমিক চাইল। আমি বললাম, এসব সম্পদ তুমি নিয়ে নাও। আমি ইচ্ছা করলে শুধু সেদিনের পারিশ্রমিক দিতে পারতাম। তুমি যদি মনে কর আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির আশায় এবং তোমার শাস্তির ভয়ে করেছি, তাহলে তুমি আমাদের এ গর্তের মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দাও। আল্লাহ পাথর সরিয়ে দিলেন এবং তারা বের হয়ে চলতে লাগল’। (বুখারী, আত-তারগীব হা/৪৭৮১)।

এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা গর্তের মধ্যে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী হয়ে তাঁর শাস্তির ভয়ে কান্নাকাটি করে বিপদ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। মানুষ বিপদে পড়ে কান্নাকাটি করে এভাবে বাঁচতে চাইলে আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আমার মর্যাদার কসম! আমি আমার বান্দার মাঝে দু’টি ভয় ও দু’টি নিরাপত্তা এক সাথে জমা করি না। যদি দুনিয়াতে আমাকে ভয় করে, আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন নিরাপত্তা দিব। আর যদি দুনিয়াতে আমার ব্যাপারে নিরাপদ থাকে, তাহলে আমি তাকে পরকালে ভীত-সন্ত্রস্ত করব’। (আত-তারগীব হা/৪৭৮৬)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সে রাতে ইবাদত করে আর যে রাতে ইবাদত করে সে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়। মনে রেখ নিশ্চয়ই আল্লাহর সম্পদ দামী। মনে রেখ নিশ্চয়ই আল্লাহর সম্পদ হচ্ছে জান্নাত’। (তিরমিযী, আত-তারগীব হা/৪৭৮৭)।

এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যারা আল্লাহর ভয়ে রাতে কাঁদে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে।

আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) একদা এমন খুৎবা দিলেন, যার মত খুৎবা আমি কখনো শুনিনি। যদি তোমরা জানতে যা আমি জানি। তবে কম হাসতে আর বেশী কাঁদতে। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ তাদের মুখ নিচু করে নিলেন এবং নীরবে কাঁদতে লাগলেন’। (বুখারী, তারগীব হা/৪৭৯৪)।

ধৈর্য ও সহনশীলতা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং ধৈর্য ধারণে প্রতিযোগিতা কর।” (সূরা আলে ইমরান ২০০)।

তিনি আরও বলেন,

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধনপ্রাণ এবং ফলের (ফসলের) নোকসান দ্বারা পরীক্ষা করব; আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।” (সূরা বাকারাহ ১৫৫)।

ধৈর্য ও সহনশীলতা এ দুটি গুণ নবী-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অভ্যাস। আর বর্তমানে ধৈর্য ও সহনশীলতার চর্চা খুব জরুরি। কারণ বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও কাজের মুখোমুখি হতে হয় এবং এতে ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া খুব কঠিন। ধৈর্যের মাধ্যমে প্রত্যয়ী ও ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় সংকল্পের মানুষ এবং অকর্মণ্য ও কাপুরুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়। আর আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের অগণিত সওয়াব ও পুণ্য দান করেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন,  ‘ধৈর্যধারণের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতে তাদের কক্ষ দেওয়া হবে এবং সেখানে তারা অভ্যর্থনা ও সালাম পাবে।’ (সুরা ফুরকান, হাদিস: ৭৫)।

আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা ধৈর্যধারণের কারণে তোমাদের ওপর শান্তিবর্ষিত হোক। আর তোমাদের এই শেষ ঠিকানা কতই না চমৎকার।’ (সুরা রাদ, আয়াত: ২৪)।

তিনি আরও বলেন,

 “ধৈর্যশীলদেরকে তো অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।” (সূরা যুমার ১০)।

তিনি অন্যত্র বলেন,

“অবশ্যই যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে, নিশ্চয় তা দৃঢ়-সংকল্পের কাজ।” (সূরা শুরা ৪৩)।

 “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।” (সূরা বাকারাহ ১৫৩)।

আবূ মালিক আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সুষ্ঠুভাবে উযূ (ওজু/অজু/অযু) করা ঈমানের অর্ধেক। আল-হামদুলিল্লাহ (নেকীর) পাল্লা পূর্ণ করে। সুবহানাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পৃথিবী ও আকাশমন্ডলী ভরে দেয়। সালাত হল নূর, যাকাত হল দলীল, ধৈর্য হল আলোকমালা এবং কুরআন হল তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষের প্রমাণ। প্রত্যেক মানুষ ভোরে উপনীত হয়ে নিজেকে বিক্রয় করে, এতে সে হয় তাকে মুক্ত করে অথবা ধ্বংস করে। (সুনান ইবনু মাজাহ ২৮০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪২২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২২৩, সুনান আততিরমিযী ৩৫১৭, আহমাদ ২২৩৯৫, ২২৪০১; দারিমী ৬৫৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, কিছু সংখ্যক আনসারী সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট কিছু চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন, পুনরায় তাঁরা চাইলে তিনি তাঁদের দিলেন। এমনকি তাঁর নিকট যা ছিল সবই শেষ হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট যে মাল থাকে তা তোমাদের না দিয়ে আমার নিকট জমা রাখি না। তবে যে চাওয়া হতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন আর যে পরমুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোন নি‘আমত কাউকে দেয়া হয়নি। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৪৬৯, ৬৪৭০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৩১৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৫৩, আহমাদ ১১৮৯০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৭৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৮১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হাদ্দাব ইবনু খালিদ আল আযদী ও শাইবান ইবনু ফাররূখ (রহঃ)....সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকর-গুজার করে আর অস্বচ্ছলতা বা দুঃখ-মুসীবাতে আক্রান্ত হলে সবর করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩৯০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭২২৯, ইসলামিক সেন্টার ৭২৮২)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিপদের প্রথম আঘাতে ধৈর্য ধারণই হচ্ছে প্রকৃত ধৈর্য। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৫৯৬, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১২৮৩, ১৩০২, ৭১৫৪, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২০২৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯২৬, সুনান আততিরমিযী ৯৮৭, ৯৮৮, সুনান আননাসায়ী ১৮৬৯, সুনান আবূ দাউদ ৩১২৪, আহমাদ ১২০৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেছেনঃ আমি যদি আমার কোন বান্দাকে তার অতি প্রিয় দু’টি বস্ত্ত সম্পর্কে পরীক্ষায় ফেলি, আর সে তাতে ধৈর্য ধরে, তাহলে আমি তাকে সে দু’টির বিনিময়ে জান্নাত দান করব। আনাস বলেন, দু’টি প্রিয় বস্ত্ত হল সে ব্যক্তির চক্ষুদ্বয়। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৬৫৩, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৩৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

রাসুল সাঃ এর ধৈর্যশীলতার পরিচয়ঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। তখন তাঁর গায়ে একখানা গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানী চাদর ছিল। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদরখানা ধরে খুব জোরে টান দিল। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাঁধের উপর তাকিয়ে দেখলাম যে, জোরে চাদরখানা টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈনটি বললঃ হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর দেয়া যে সম্পদ আছে, তাত্থেকে আমাকে দেয়ার আদেশ কর। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন এবং তাকে কিছু দান করার আদেশ করলেন। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৬০৮৮, ৩১৪৯, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫৮০৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২৩১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৫৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৫৬৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫৪৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

ধৈর্যশীলতার একটি ঘটনাঃ

হাদ্দাব ইবনু খালিদ (রহঃ)....সুহায়ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী যামানায় এক বাদশাহ ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। বার্ধক্যে পৌছে সে বাদশাহকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, সুতরাং একজন যুবককে আপনি আমার কাছে প্রেরণ করুন, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব। অতঃপর যাদুবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য বাদশাহ তার কাছে এক যুবককে প্রেরণ করল। বালকের যাত্রা পথে ছিল এক ধর্মযাজক। যুবক তার কাছে বসল এবং তার কথা শুনল। তার কথা যুবকের পছন্দ হলো। তারপর যুবক যাদুকরের কাছে যাত্রাকালে সর্বদাই ধর্মযাজকের কাছে যেত এবং তার নিকট বসত। তারপর সে যখন যাদুকরের কাছে যেত তখন সে তাকে মারধর করত। ফলে যাদুকরের ব্যাপারে সে ধর্মযাজকের কাছে অভিযোগ করল। তখন ধর্মযাজক বলল, তোমার যদি যাদুকরের ব্যাপারে ভয় হয় তবে বলবে, আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে আসতে দেয়নি। আর যদি তুমি তোমার গৃহকর্তার ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ করে তবে বলবে, যাদুকর আমাকে বিলম্বে ছুটি দিয়েছে।

এমনিভাবে চলতে থাকাবস্থায় একদিন হঠাৎ সে একটি ভয়ানক হিংস্র প্রাণীর সম্মুখীন হলো, যা লোকেদের পথ আটকিয়ে রেখেছিল। এ অবস্থা দেখে সে বলল, আজই জানতে পারব, যাদুকর উত্তম না ধর্মযাজক উত্তম। অতঃপর একটি পাথর হাতে নিয়ে সে বলল, হে আল্লাহ! যদি যাদুকরের চাইতে ধর্মযাজক আপনার কাছে পছন্দনীয় হয়, তবে এ পাথরাঘাতে এ হিংস্র প্রাণীটি নিঃশেষ করে দিন, যেন লোকজন চলাচল করতে পারে। অতঃপর সে সেটার প্রতি পাথর ছুড়ে দিল এবং সেটাকে মেরে ফেলল। ফলে লোকজন আবার যাতায়াত শুরু করল। এরপর সে ধর্মযাজকের কাছে এসে তাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলল। ধর্মযাজক বলল, বৎস! আজ তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠ। তোমার মর্যাদা এ পর্যন্ত পৌছেছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শীঘ্রই তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যদি পরীক্ষার মুখোমুখি হও তবে আমার কথা গোপন রাখবে।

এদিকে যুবক আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করতে লাগল এবং লোকেদের সমুদয় রোগ-ব্যাধির নিরাময় করতে লাগল। বাদশাহর পরিষদবর্গের এক লোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার সংবাদ সে শুনতে পেয়ে বহু হাদিয়া ও উপটৌকন নিয়ে তার নিকট আসলো এবং তাকে বলল, তুমি যদি আমাকে আরোগ্য দান করতে পার তবে এসব মাল আমি তোমাকে দিয়ে দিব। এ কথা শুনে যুবক বলল, আমি তো কাউকে আরোগ্য দান করতে পারি না। আরোগ্য তো দেন আল্লাহ তা’আলা। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনো তবে আমি আল্লাহর কাছে দুআ করব, আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। তারপর সে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো। আল্লাহ তা’আলা তাকে রোগ মুক্ত করে দিলেন। এরপর সে বাদশাহর কাছে এসে অন্যান্য দিনের ন্যায় এবারও বসল। বাদশাহ তাকে প্রশ্ন করল, কে তোমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে? সে বলল, আমার পালনকর্তা। এ কথা শুনে বাদশাহ তাকে আবার প্রশ্ন করল, আমি ছাড়া তোমার অন্য কোন পালনকর্তাও আছে কি? সে বলল, আমার ও আপনার সকলের প্রতিপালকই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন।

অতঃপর বাদশাহ্ তাকে পাকড়াও করে অবিরতভাবে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ঐ বালকের অনুসন্ধান দিল, অতঃপর বালককে নিয়ে আসা হলো। বাদশাহ তাকে বলল, হে প্রিয় বৎস! তোমার যাদু এ পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তুমি অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকেও নিরাময় করতে পার। বালক বলল, আমি কাউকে নিরাময় করতে পারি না। নিরাময় করেন আল্লাহ। ফলে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ধর্মযাজকের (দরবেশের) কথা বলে দিল। এরপর ধর্মযাজককে ধরে আনা হলো এবং তাকে বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সে অস্বীকার করল, ফলে তার মাথার তালুতে করাত রেখে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো। এতে তার মাথাও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। অবশেষে ঐ যুবকটিকে আনা হলো এবং তাকেও বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সেও অস্বীকার করল।

অতঃপর বাদশাহ তাকে তার কিছু সহচরের হাতে তাকে অর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সহ পাহাড়ে আরোহণ করো। পর্বত শৃঙ্গে পৌছার পর সে যদি তার ধর্ম থেকে ফিরে আসে তবে ভাল। নতুবা তাকে সেখান থেকে ছুড়ে মারবে। তারপর তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে সহ পর্বতে আরোহণ করল। তখন সে দুআ করে বলল, হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করো। তৎক্ষণাৎ তাদেরকে সহ পাহাড় কেঁপে উঠল। ফলে তারা পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়ল। আর সে হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ্ তাকে প্রশ্ন করল, তোমার সাথীরা কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের চক্রান্ত হতে সংরক্ষণ করেছেন।

আবারো বাদশাহ্ তাকে তার কতিপয় সহচরের হাতে সমর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে নিয়ে নাও এবং নৌকায় উঠিয়ে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তার দীন (ধর্ম) হতে ফিরে আসে তবে ভাল, নতুবা তোমরা তাকে সমুদ্রে ফেলে দাও। তারা তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। এবারও সে দু’আ করে বলল, হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা তুমি আমাকে তাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করো। তৎক্ষণাৎ নৌকাটি তাদেরসহ উল্টে গেল। ফলে তারা সকলেই পানিতে ডুবে গেল। আর যুবক হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ্ তাকে আবার প্রশ্ন করল, তোমার সঙ্গীগণ কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র হতে রক্ষা করেছেন।

অতঃপর সে বাদশাহকে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তুমি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করবে। বাদশাহ বলল, সে আবার কি? যুবক বলল, একটি ময়দানে তুমি লোকেদেরকে জমায়েত করে। অতঃপর একটি কাঠের শুলীতে আমাকে উঠিয়ে আমার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রাখে। এরপর "বালকের প্রভুর নামে" বলে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ কর। এ যদি কর তবে তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। তার কথা অনুসারে বাদশাহ লোকেদেরকে এক মাঠে জমায়েত করল এবং তাকে একটি কাষ্ঠের শূলীতে চড়ালো। অতঃপর তার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রেখে "বালকের প্রভুর নামে" বলে তার দিকে তা নিক্ষেপ করল। তীর তার কানের নিম্নাংশে গিয়ে বিধল। অতঃপর সে তীরবিদ্ধ স্থানে নিজের হাত রাখল এবং সাথে সাথে প্রাণত্যাগ করল। এ দৃশ্য দেখে রাজ্যের লোকজন বলে উঠল, আমরা এ যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান আনলাম।

এ সংবাদ বাদশাহকে জানানো হলো এবং তাকে বলা হলো, লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যে পরিস্থিতি হতে আশঙ্কা করছিলেন, আল্লাহর শপথ! সে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিই আপনার মাথার উপর চেপে বসেছে। সকল মানুষই যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান এনেছে। এ দেখে বাদশাহ সকল রাস্তার মাথায় গর্ত খননের নির্দেশ দিল। গর্ত খনন করা হলো এবং ওগুলোতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হলো। অতঃপর বাদশাহ আদেশ করল যে, যে লোক তার ধর্মমত বর্জন না করবে তাকে ওগুলোতে নিপতিত করবে। কিংবা সে বলল, তাকে বলবে, যেন সে অগ্নিতে প্রবেশ করে। লোকেরা তাই করল। পরিশেষে এক মহিলা একটি শিশু নিয়ে অগ্নিগহবরে পতিত হবার ব্যাপারে ইতস্তত করছিল। এ দেখে দুধের শিশু তাকে (মাকে) বলল, ওহে আম্মাজান! সবর করুন, আপনি তো সত্য দীনের (ধর্মের) উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৪০১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩০০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭২৩৯, ইসলামিক সেন্টার ৭২৯৩)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তাওয়াক্কুল বা ভরসা

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।’’ (সুরা মায়েদা: ২৩)।

আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেন,

‘‘একমাত্র তারাই মোমিন যাদের সামনে আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে তাদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হয়।’’ (সুরা আনফাল. ২)।

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।’’ (সূরা তালাক. ৩)।

আল্লাহর প্রতি পূর্ণমাত্রায় ভরসা করার নাম তাওয়াক্কুল। মানবজীবনের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সবকিছু তার প্রতি ন্যস্ত করলে কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জন সহজ হয়। মন্দ থেকে বেঁচে থাকা ও কল্যাণ লাভ করা যায়। আল্লাহর প্রতি বান্দার তাওয়াক্কুলকে আল্লাহতায়ালা ভীষণ পছন্দ করেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি পাষণ্ড ও কঠিন হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তখন আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করুন; নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা ইমরান, আয়াত: ১৫৯)।

উপায়-উকরণ গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়ঃ

নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন আল্লাহর উপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী। তা সত্ত্বেও তিনি বহুক্ষেত্রে জাগতিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করেছেন তাঁর উম্মতকে একথা বুঝানোর জন্য যে, উপায়-উকরণ গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।

ওহোদ যুদ্ধে তিনি একটার পর একটা করে দু’টো বর্ম গায়ে দিয়েছিলেন। সায়েব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘ওহোদ যুদ্ধের দিনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি বর্ম পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন’। (আহমাদ হা/১৫৭৬০, শু‘আইব আল-আরনাউত হাদীছটিকে ছহীহ গণ্য করেছেন)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উম্মতের জন্যও যুদ্ধের পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন। (ছহীহ ইবনু হিববান ৭০২৮)।

মক্কা বিজয়ের দিনে তিনি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছিলেন।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন মক্কায় প্রবেশ করার সময় তাঁর মাথায় ছিল লোহার শিরস্ত্রাণ। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিরস্ত্রাণটি খুললেন জনৈক ব্যক্তি এসে বললো, ইবনু খাত্বাল কা’বার গেলাফের সাথে ঝুলে (আশ্রয় নিয়েছে) রয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাকে হত্যা করো। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২৭১৮, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ১৮৪৬, ৩০৪৪, ৩২৮৬, ৫৮০৮, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৩১৯৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৩৫৭, সুনান আবূ দাঊদ ২৬৮৫, সুনান আননাসায়ী ২৮৬৮, সুনান আততিরমিযী ১৬৯৩, সুনান ইবনু মাজাহ ২৮০৫, মুয়াত্ত্বা মালিক ১৫৯৯, আহমাদ ১২৯৩২, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ৩০৬৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৮৪০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৭১৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৭১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৭২৪ )। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

হিজরতের সময় তিনি একজন পথপ্রদর্শক সাথে নিয়েছিলেন, যে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাত্রাপথে কোন পদচিহ্ন যাতে না থাকে তিনি সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তিনি যাত্রার জন্য এমন সময় বেছে নিয়েছিলেন যখন লোকজন সাধারণতঃ সজাগ থাকে না। আবার জনগণ সচরাচর যে পথে চলাচল করে তিনি তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিলেন।

এসব কিছুই উপায় ও মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্গত। তিনি তাঁর উম্মতকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর উপর ভরসাকারী কোন মুসলিমই উপায়-উপকরণ গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে পারে না।

উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি, (রাসূল (সাঃ) বলেছেন) যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে অনুরূপ রিযক দান করবেন, যেরূপ পাখিকে রিযক দিয়ে থাকেন। তারা ভোরে খালি পেটে বের হয় এবং দিনের শেষে ভরা পেটে (বাসায়) ফিরে আসে। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫২৯৯, সুনান আততিরমিযী ২৩৪৪, সুনান ইবনু মাজাহ ৪১৬৪, মুসনাদে ‘আবদ ইবনু হুমায়দ ১০, মুসনাদে আহমাদ ২০৫, আবূ ইয়া'লা ২৪৭, হাকেম ৭৮৯৪, ৪/৩৫৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এ হাদীছে উপায়-উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। যে পাখির খাবার যোগাড়ের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন সে তো তার কাছে খাবার আপনা থেকে আসবে সেই আশায় তার বাসায় বসে থাকে না। বরং খুব ভোরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ তার ইচ্ছে পূরণ করে দেন। ফলে সে যখন বাসায় ফিরে তখন তার পেট ভরা ও পরিতৃপ্ত থাকে।

অবশ্য মুসলমানকে জাগতিক কোন উপকরণ ও পন্থা অবলম্বন করতে হ’লে প্রথমেই তাকে দেখতে হবে শরী‘আতের নিরিখে তা বৈধ কি-না। আমরা কিছু লোককে দেখি, তারা তাদের উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য কর্মচারীদের ঘুষ প্রদান করে আর বলে, এটা তাওয়াক্কুলের অংশ। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় নকল করে অথচ বলে এটাও তাওয়াক্কুল। অথচ এর কোনটাই আদৌ তাওয়াক্কুল নয়। বরং এগুলো তাওয়াক্কুলের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী। এহেন মুসলিম যদি আল্লাহর উপর প্রকৃতই ভরসা করত তাহ’লে তারা কখনই শরী‘আত গর্হিত  কোন কাজ করত না।

আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের উপকারিতাঃ

(১) যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্টঃ

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য বেরোনোর পথ বের করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে জীবিকা দেন যা সে ভাবতেও পারে না। আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ চূড়ান্তকারী। অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক কাজের জন্য একটা পরিমাপ ঠিক করে রেখেছেন’। (সুরা তালাক্ব ৬৫/২-৩)।

আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকটি কাজের সমজাতীয় প্রতিফল নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি তাওয়াক্কুলের প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন প্রাচুর্যতা। সুতরাং যে আল্লাহকে যথেষ্ট জানবে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হবেন। আর আল্লাহ যার তত্ত্বাবধান করবেন তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।

যেহেতু নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন আল্লাহর উপর সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী তাই আল্লাহও তাকে যথোপযুক্ত প্রতিফল দিয়েছেন। তিনি তার জন্য যথেষ্ট হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তোমার ও তোমার অনুসারী মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’। (সুরা আনফাল ৮/৬৪)।

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার জন্য যথেষ্ট, আর সেই মুমিনরাও আপনার জন্য যথেষ্ট যারা আল্লাহর নিকটে তাদের তাওয়াক্কুলকে সত্য প্রমাণ করতে পেরেছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায়, তবে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন স্বীয় সাহায্য দিয়ে ও মুমিনদের মাধ্যমে’। (সুরা আনফাল ৮/৬২)।

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) حَسْبُكَ اللهُ এর অর্থ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ তিনি তাঁর জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ যার জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহ যার রক্ষাকারী তার শত্রু তাকে হেনস্তা করার আদৌ কোন সুযোগ পায় না। সে তার কোনই ক্ষতি করতে পারে না, তবে যে কষ্টটুকু তার নছীবে আছে তা থেকে অবশ্য তার নিষ্কৃতি মিলবে না। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না কিছু কষ্ট দেওয়া ব্যতীত’। (সুরা আলে ইমরান ৩/১১১)।

এ কষ্ট যেমন শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, পিপাসা ইত্যাদি। তবে তার ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে মুমিনদের যে ক্ষতি করবে তা সম্ভব হবে না। (ইবনুল ক্বাইয়িম, বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ২/৪৬৫)।

লেখক ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, হজ্জের মওসুমে আমাকে জনৈক চেচেন (شيشانى) এই ঘটনাটি ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেন, রুশবাহিনী আমার বাড়ী ঘেরাও করে। বাড়ীর সকল লোক পালিয়ে যায়, কিন্তু আমি পালাতে পারিনি। এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে আমি বাড়ীর পাশে একটা গর্তের দিকে যাই। সেখানে আমি কিছু আলুর উপজাত মরা গাছ ইত্যাদি জড়ো করি এবং নিজেকে গর্তের মাঝে সঁপে দেই। আমার কাছে না আত্মরক্ষা করার মত কোন অস্ত্র ছিল, না পালানোর কোন সামর্থ্য ছিল। সৈন্যরা যখন গর্তের নিকটে এসে গেল তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর ছিল না। আমি তখন এই আয়াত পড়ছিলাম- ‘আর আমরা তাদের সামনে ও পিছনে (হঠকারিতার) দেওয়াল স্থাপন করেছি। অতঃপর তাদেরকে (মিথ্যার অন্ধকারে) ঢেকে ফেলেছি। ফলে তারা (সত্য) দেখতে পায় না’। (সুরা ইয়াসীন ৩৬/৯)।

একজন সৈনিক গর্তের মধ্যে কেউ আছে কি-না তার অনুসন্ধান করতে আসে। সে সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখে; কিন্তু তারপরও তার সঙ্গীদের বলে ওঠে- চলো যাই, এখানে কেউ নেই। তারা তখন বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল এবং আমাকে ছেড়ে গেল’। এটি আল্লাহর উপর প্রকৃত তাওয়াক্কুলের একটি নমুনা।

(২) আল্লাহ সঙ্গে থাকার অনুভূতিঃ

মানুষ যখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার উপর যত ভরসা করে ততই সে অনুভব করে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে আছে। তার ইচ্ছা পূরণে তিনি অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। এ ধরনের চিন্তা-চেতনাই সর্বদা আল্লাহ সাথে থাকার অনুভূতি।

(৩) মালিকের ভালবাসা লাভঃ

যে আল্লাহর উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। কেননা এই তাওয়াক্কুলকারী আল্লাহর হুকুম মত কাজ করেছে; যেসব উপায়-উপকরণ আল্লাহ বৈধ করেছেন সে তা গ্রহণ করেছে; তার মনটা তার প্রভুর সাথে সর্বদা জুড়ে রয়েছে। সুতরাং মালিকের সাথে তার ভালবাসা তো অবশ্যই তৈরী হবে। তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে বান্দা তার রব ও খালেকের সঙ্গে মহববত বৃদ্ধি করে থাকে। কেননা সে জানে আল্লাহ তার হেফাযতকারী, সাহায্যকারী, তাকে ঐশ্বর্য দানকারী এবং তার জীবিকা দানকারী।

(৪) শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্যঃ

যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাকে তার শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন, তাদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের উপকরণ যুগিয়ে দেন এবং তার সামনে তাদেরকে অপদস্থ করেন। ছাহাবীগণ একথা ভালমত জানতেন এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতেন বলেই তারা বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! ‘অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ সহ ফিরে এল। কোনরূপ অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি। তারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল’। (সুরা আলে ইমরান ৩/১৭৩-৭৪)।

আহযাব (খন্দক) যুদ্ধে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনায় আল্লাহ বলেন,

‘অতঃপর যখন মুমিনগণ শত্রুদল সমূহকে দেখল, তখন তারা বলল, এটা তো তাই, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। আর এটি তাদের ঈমান ও আনুগত্যকে আরও বৃদ্ধি করল’। (সুরা আহযাব ৩৩/২২)।

(৫) বিনা হিসাবে জান্নাত লাভঃ

হাদীছে এসেছে উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্য থেকে সত্তর হাযার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। তারা ঐ সকল লোক যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করত।

ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ বদ-নযর কিংবা বিষাক্ত দংশন ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক নেই। বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর এ হাদীস আমি সা’ঈদ ইবনু যুবায়র (রহ.)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেনঃ আমাদের নিকট ইবনু ’আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার সামনে সকল উম্মাতকে পেশ করা হয়েছিল। তখন আমি দেখেছি) দু’একজন নবী পথ চলতে লাগলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁদের সঙ্গে রয়েছে লোকজনের ছোট ছোট দল। কোন কোন নবী এমনও আছেন যাঁর সঙ্গে একজনও নেই। অবশেষে আমার সামনে তুলে ধরা হল বিশাল দল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা কী? এ কি আমার উম্মাত? উত্তর দেয়া হলঃ না, ইনি মূসা আঃ) এবং তাঁর কওম। আমাকে বলা হলঃ আপনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকান। তখন দেখলামঃ বিশাল একটি দল যা দিগন্তকে ঢেকে রেখেছে।

তারপর আমাকে বলা হলঃ আকাশের দিগন্তসমূহ ঢেকে দিয়েছে এমন একটি বিশাল দলের প্রতি লক্ষ্য করুন। তখন বলা হলঃ এরা হল আপনার উম্মাত। আর তাদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে চলে গেলেন। উপস্থিতদের কাছে কথাটির কোন ব্যাখ্যা প্রদান করলেন না। যে বিনা হিসাবের লোক কারা হবে?) ফলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শুরু হল। তারা বললঃ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অনুসরণ করে থাকি। সুতরাং আমরাই তাদের অন্তর্ভুক্ত। কিংবা তারা হল আমাদের সে সকল সন্তান-সন্ততি যারা ইসলামের যুগে জন্মগ্রহণ করেছে। আর আমাদের জন্ম হয়েছে জাহিলী যুগে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং বললেনঃ তারা হল সে সব লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে না, পাখির মাধ্যমে কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ণয় করে না এবং আগুনের সাহায্যে দাগ লাগায় না। বরং তারা তো তাদের রবের উপরই ভরসা করে থাকে। তখন উক্কাশা ইবনু মিহসান বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তাদের মধ্যে কি আমি আছি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন আরেকজন দাঁড়িয়ে বললঃ তাদের মধ্যে কি আমিও আছি? তিনি বললেনঃ ’উক্কাশাহ এ সুযোগ তোমার আগেই নিয়ে নিয়েছে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৭০৫, ৩৪১০, আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৯১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৮৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (৬) জীবিকা লাভঃ

উমার (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহর উপর ভরসা করতে, তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে পাখির মত রিযিক দান করতেন। ভোরবেলা পাখিরা খালিপেটে (বাসা থেকে) বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলা উদর পূর্তি করে (বাসায়) ফিরে আসে। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪১৬৪, সুনান আততিরমিযী ২৩৪৪, আহমাদ ৩৭২, তাখরীজুল মুখতার ২১৭, ২১৮, সহীহাহ ৩১০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (৭) নিজ জীবন, পরিবার ও সন্তান-সন্ততির হেফাযতঃ

হযরত ইয়াকূব (আঃ) তাঁর পুত্রদের মিসর গমনকালে আত্মরক্ষামূলক কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজের বিষয়-আশয়কে আল্লাহর যিম্মায় সোপর্দ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু হুকুম চলে না। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি এবং তাঁর উপরেই ভরসা করা উচিত সকল ভরসাকারীর’। (সুরা ইউসুফ ১২/৬৭)।

আল্লাহর উপর ভরসা এজন্যই করতে হবে যে, তিনিই হেফাযতকারী। নিজের জীবন, পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততি রক্ষায় তাঁর উপরই নির্ভর করা কর্তব্য।

(৮) শয়তান থেকে রক্ষাঃ

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘গোপন সলাপরামর্শ তো কেবল শয়তানের পক্ষ থেকে হয়, যাতে মুমিনরা কষ্ট পায়। কিন্তু আল্লাহর হুকুম না হ’লে সে তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর মুমিনদের কর্তব্য তো আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা’। (সুরা মুজাদালাহ ৫৮/১০)।

এ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন যে, তার অনুমোদন ব্যতীত শয়তান তাঁর বান্দাদের ক্ষতি করতে পারে না। তারপর তিনি তার বান্দাদেরকে শয়তানের হাত থেকে নিরাপদে থাকার জন্য তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করতে বলেছেন।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন কোন ব্যক্তি নিজ বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় বলে ‘বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কালতু আলাল্লা-হি লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লা-হ’ (আল্লাহর নামে বের হ’লাম, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলাম, আল্লাহ ছাড়া পাপ থেকে বাঁচা এবং পুণ্য কাজ করার কোনই উপায় নেই’)। তাকে লক্ষ্য করে বলা হয়, তোমার জন্য এটা যথেষ্ট হয়েছে এবং তোমার নিরাপত্তা মিলেছে। আর শয়তান তখন তার থেকে দূরে সরে যায়। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ৩৪২৬, মিশকাত তাহকীক সানী ২৪৪৩, তা’লীকুর রাগীব ২/২৬৪, আল-কালিমুত তাইয়্যিব ৫৮/৪৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(৯) মানসিক প্রশান্তিঃ

মানুষ তার লক্ষ্য পূরণে যত প্রকারের উপকরণই ব্যবহার করুক না কেন তাতে এমন কিছু ফাঁক-ফোঁকর থেকেই যাবে যা সে বন্ধ করতে পারেনি। যে কারণে তার ভয় থাকে- হয়তো ব্যর্থতা এসে তাকে ঘিরে ধরবে এবং তার আশা পূরণ হবে না।

কিন্তু যখনই সে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে এবং বিশ্বাস করবে যে, তার যাবতীয় কাজে আল্লাহই তার পক্ষে যথেষ্ট তখন আর তার ঐ সকল ফাঁক-ফোঁকরের ভয় থাকবে না। তখন সে এক ধরনের আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি ও আরাম উপভোগ করবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে মানুষ মানসিক ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।

মনোরোগ চিকিৎসকগণ যদি তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব ও উপকারিতা বুঝতেন তাহ’লে তাওয়াক্কুলকে তারা তাদের চিকিৎসার প্রথম কাতারে রাখতেন। আর যদি যথার্থভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করত তাহ’লে তারা আত্মহত্যা করত না; বরং আল্লাহর উপর কাজ সোপর্দ করে তারা তার ফায়ছালা ও তাকদীরে রাযী-খুশী থাকত।

(১০) কাজের প্রতি দৃঢ়তাঃ

আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ব্যক্তির মনে কাজের প্রতি দৃঢ়তা ও প্রগাঢ় নিষ্ঠা জন্মিয়ে দেয়। কেননা তাওয়াক্কুলের ফলে বৈধ উপায়ের দ্বার খুলে যায়। মানুষ যখন এই তাওয়াক্কুলের বুঝ সঠিকভাবে লাভ করতে পারে তখন সে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে উৎপাদনে মনোবল বেড়ে যায়।

(১১) সম্মান ও মানসিক ঐশ্বর্য লাভঃ

একজন মুসলিম যখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তার কাজ-কর্ম আল্লাহর হাতে সপে দেয় তখন সে নিজের মাঝে ইয্যত ও সম্মান অনুভব করতে পারে। কেননা সে তো মহাসম্মানিত পরাক্রমশালী আল্লাহর উপর নির্ভর করেছে। একইভাবে মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকেও সে বেঁচে যায়; কেননা সে ঐশ্বর্যময় আল্লাহ গনীর ধনে ধনী। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত  ও প্রজ্ঞাময়’। (সুরা আনফাল ৮/৪৯)।

ন্যায়-সুবিচার ও  ইনসাফ

ইনসাফ বা ন্যায় হলো, প্রতিটি বিষয়কে সঠিক স্থানে রাখা এবং প্রাপককে তার প্রাপ্য আদায় করে দেওয়া। যাদের কাছে ন্যায়-নিষ্ঠা রয়েছে, আল্লাহতায়ালা তাদের পছন্দ করেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি বিচার করেন, তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৪২)।

আল্লাহতায়ালা আরো বলেন,

“হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষাদানে তোমরা অবিচল থাকবে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি শক্ৰতা তোমাদেরকে যেন সুবিচার বুর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত”। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮)।

এমনকি সন্তানদের মধ্যেও সুবিচার করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তার পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এলেন এবং বললেন, আমি আমার এই পুত্রকে একটি গোলাম দান করেছি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব পুত্রকেই কি তুমি এরূপ দান করেছ। তিনি বললেন, না; তিনি বললেন, তবে তুমি তা ফিরিয়ে নাও। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৫৮৬, ২৫৮৭, ২৬৫০, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪০৬৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬২৩, আহমাদ ১৮৩৮৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৩৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৪১৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

কিন্তু আমাদের সমাজে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা চালু না থাকায় অনৈসলামিক রাষ্ট্রে মানবরচিত আইনে ৫% লোক ন্যায়বিচার পায় কিনা সন্দেহ আছে। যখন যে ক্ষমতায় আসে বিচারিক আসনে পছন্দের বিচারক নিয়োগ দিয়ে বিচারিক কার্যক্রম তাদের মতোই করেই চালিয়ে থাকে।

যুদ্ধ-সংগ্রামে সুদৃঢ় থাকা

আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তার পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে; যেন তারা সিসা গলানো প্রাচীর।’ (সুরা সাফ, আয়াত: ৬১: ৪)।

আল্লাহতায়ালা আরো বলেন,

“যুদ্ধ তোমাদের জন্যে ফরয করা হলো, যদি তোমরা তা অপছন্দ কর। (বস্তুত) এমন অনেক বিষয়কে তোমরা পছন্দ কর না অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর এবং এমন অনেক কিছু তোমরা শ্রেয় মনে কর অথচ আসলেই তা তোমাদের জন্যে ক্ষতিকর। (এর কারণ এই যে) আল্লাহই জানেন এবং তোমরা জান না”। (সূরা আল বাকারা: ২১৬)।

আল্লাহতায়ালা বলেন,

“যারা দুনিয়ার জীবনের বিনিময়ে আখেরাতকে খরিত করে, তাদের উচিত আল্লাহর রাহে লড়াই করা। যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, সে তাতে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট প্রতিদান দেব।” (সূরা আন নিসা: ৭৪)।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যে ঈমান আনল, সালাত আদায় করল ও রমাযানের সিয়াম পালন করল সে আল্লাহর পথে জিহাদ করুক কিংবা স্বীয় জন্মভূমিতে বসে থাকুক, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি লোকদের এ সুসংবাদ পৌঁছে দিব না? তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতে একশ’টি মর্যাদার স্তর প্রস্তুত রেখেছেন। দু’টি স্তরের ব্যবধান আসমান ও যমীনের দূরত্বের মত। তোমরা আল্লাহর নিকট চাইলে ফেরদাউস চাইবে। কেননা এটাই হলো সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। আমার মনে হয়, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এও বলেছেন, এর উপরে রয়েছে আরশে রহমান। আর সেখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। মুহাম্মদ ইবনু ফুলাইহ্ (রহ.) তাঁর পিতার সূত্রে (নিঃসন্দেহে) বলেন, এর উপর রয়েছে আরশে রহমান। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৭৯০, ৭৪২৩, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৫৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫৯৫)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হলে এবং আল্লাহ্ই ভাল জানেন কে তাঁর পথে আহত হবে কিয়ামতের দিন সে তাজা রক্ত বর্ণে রঞ্জিত হয়ে আসবে এবং তা থেকে মিশ্কের সুগন্ধি ছড়াবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ২৮০৩, ২৩৭, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৫৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৬০৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

উত্তম ও কল্যাণকর কাজ

ভালো কাজের প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়াকে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন। হুসাইন ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা উচ্চমার্গীয় ও সর্বোৎকৃষ্ট আমলগুলো পছন্দ করেন। তুচ্ছ ও অহেতুক কাজ অপছন্দ করেন।’ (তাবরানি, হাদিস: ২৮৯৪)।

আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার যেসব কাজে সন্তুষ্ট হোন, রাজি খুশি হোন আমাদেরকে সেইসব কাজ বা আমল করতে হবে। আপনি দুনিয়াতে যতো আমলই করেন না কেনো কিয়ামতে আল্লাহতায়ার করুণা বা রহমত কিংবা দুনিয়ার কর্মকান্ডে আল্লাহতায়ালার রাজি খুশি ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। এমনকি রাসুল সাঃও না। তাই আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে আল্লাহতায়ালার আদেশ নিষেধগুলো সম্পূর্ণরুপে মেনে চলা।

আল্লাহর করুণা বা সন্তুষ্টি ব্যতীত কেহ জান্নাতে যেতে পারবে না

(ক) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের কোন ব্যক্তিকে তার নেক ’আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। লোকজন প্রশ্ন করলঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও নয়? তিনি বললেনঃ আমাকেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত না করেন। কাজেই মধ্যমপন্থা গ্রহণ কর এবং নৈকট্য লাভের চেষ্টা চালিয়ে যাও। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা, সে ভাল লোক হলে (বয়স দ্বারা) তার নেক ’আমল বৃদ্ধি হতে পারে। আর খারাপ লোক হলে সে তওবা করার সুযোগ পাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৫৬৭৩, ৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৫২৭১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৬৭৩, আধুনিক প্রকাশনী ৫২৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫১৫৮)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(খ) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কস্মিনকালেও তোমাদের কাউকে তার নিজের ’আমল কক্ষনো নাজাত দিবে না। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও না? তিনি বললেনঃ আমাকেও না। তবে আল্লাহ্ আমাকে তাঁর রহমত দিয়ে আবৃত রেখেছেন। তোমরা যথারীতি ’আমল করে নৈকট্য লাভ কর। তোমরা সকালে, বিকালে এবং রাতের শেষভাগে আল্লাহর ইবাদাত কর। মধ্য পন্থা অবলম্বন কর। মধ্য পন্থা তোমাদেরকে লক্ষ্যে পৌঁছাবে। (সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)  ৬৪৬৩, ৩৯; সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০০৪, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮১৬, আধুনিক প্রকাশনী ৬০১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬০১৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(হাদীসটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহর রহমত ব্যতীত শুধু আমলের দ্বারা কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না-ফাতহুল বারী)।

(গ) কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ)....আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) এর সূত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমাদের কোন লোকের আমলই তাকে পরিত্রাণ দিতে পারবে না। এ কথা শুনে এক লোক বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনাকেও না? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমাকেও না। তবে যদি আল্লাহ তা’আলা তার করুণা দ্বারা আমাকে ঢেকে নেন। তোমরা অবশ্য সঠিক পন্থা অবলম্বন করবে। (সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭০০৪, ৭০০৬, ৭০০৭, ৭০০৮, ৭০০৯, ৭০১০, ৭০১৪, ৭০১৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮১৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮৫১, ইসলামিক সেন্টার ৬৯০৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

(ঘ) কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ)...আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার আমল তাকে জান্নাতে দাখিল করতে পারে। অতঃপর তাকে প্রশ্ন করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনিও কি নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমিও নই। তবে আমার পালনকর্তা যদি তার অনুগ্রহের দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন। (সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৬৮৫২, ৬৮৫৫, ৬৮৬০, ৬৮৬১)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

যে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে পদক্ষেপ নেন, আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হন, ভালোবাসেন। ফেরেশতারাও তাকে ভালোবাসেন। জমিনেও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিশেষে ওই ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভে ধন্য হন।

কখন বুঝবেন আল্লাহতায়ালা আপনাকে ভালোবাসেন

আল্লাহ তাআলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করে তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। সকল বান্দার প্রতিই তাঁর দয়া অফুরন্ত। গুনাহগার বান্দাকে তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আবার কোনো বান্দাকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন আমল ও তাকওয়ার কারণে। ৪টি আলামত দেখেই চেনা যায় তাঁদের। নিচে হাদিসের আলোকে আলামতগুলো বর্ণনা করা হলো।

(১) মানুষ তাকে ভালোবাসবেঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিবরীল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসী, তুমিও তাকে ভালোবাসো। রাবী বলেন, অতঃপর জিবরীল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসতে থাকেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আকাশমণ্ডলীর অধিবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। অতঃপর সে বান্দার জন্য জমিনেও স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়। আর যখন আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিবরীল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুক বান্দাকে ঘৃণা করি, তুমিও তাকে ঘৃণা করো। রাবী বলেন, অতঃপর জিবরীল (আ.)-ও তাকে ঘৃণা করেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন, তোমরাও তাকে ঘৃণা করো এবং আকাশবাসীরাও তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। অতঃপর তার জন্য জমিনেও ঘৃণা স্থাপন করা হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫০০৫, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৬৫৯৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৩৭,  সহীহুল জামি ২৫৮৫, আহমাদ ৮৫০০, সুনানুন্ নাসায়ী আল কুবরা ৭৭৪৭)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

এখানে উল্লেখ্য, অনেক বেঈমানকেও মানুষ ভালোবাসে, তাদের বহু সংখ্যক ফ্যান ফলোয়ার আছে, তাহলে তাদেরকেও কি আল্লাহ ভালোবাসেন? না। তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।

এখানে ‘জমিনওয়ালাদের ভালোবাসা’ বলতে মূলত ঈমানদার বা মুমিনদের ভালোবাসা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যে বান্দাকে ভালোবাসেন, তাকে মুমিন বা নেককারদের পছন্দের ব্যক্তিতে পরিণত করবেন। 

এখান থেকে বোঝা যায়,  মুত্তাকি বা নেককার ব্যক্তিরা সবাই কাউকে ভালোবাসলে, বুঝতে হবে আল্লাহও তাঁকে ভালোবাসেন। আর আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা চেয়ে বেড়ানোর দরকার নেই। সঠিক পথে চললে আল্লাহ তাআলাই তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।

(২) বিপদ-আপদ লেগে থাকবে, তবুও তিনি আল্লাহর ওপর সন্তুষ্টঃ

বিপদে মুসিবতে সন্তুষ্টচিত্তে থাকেন এমন বান্দাকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। ইবরাহিম (আ.)-এর অনেক পরীক্ষা নিয়েছেন মহান আল্লাহ। কোরআনের কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাআলা ফেরাউন কিংবা নমরুদের পরীক্ষা নিয়েছেন। বরং তিনি তাঁর ভালোবাসার বান্দাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তাই বহু ঈমানদারের জীবনে দেখবেন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ লেগেই থাকে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে রাসুল (স.) বলেন,

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুনিয়া মুমিনের জেলখানা (কারাগার) এবং কাফেরের বেহেশতখানা (জান্নাত)। (সুনান ইবনু মাজাহ ৪১১৩, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৭৩০৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৯৫৬, সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২৩২৪, আহমাদ ৮০৯০, ৯৯১৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

আল্লাহর রাসুল (স.) আরও বলেন, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ চাইলে আগে-ভাগে দুনিয়াতেই তাকে তার গুনাহখাতার জন্য কিছু শাস্তি দিয়ে দেন। আর কোন বান্দার অকল্যাণ চাইলে দুনিয়ায় তার পাপের শাস্তিদান হতে বিরত থাকেন। পরিশেষে কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন তাকে তার পূর্ণ শাস্তি দিবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৫৬৫, আত্ তিরমিযী ২৩৯৬, শারহুস্ সুন্নাহ্ ১৪৩৫, সিলসিলাহ্ আস্ সহীহাহ্ ১২২০, সহীহ আল জামি‘ আস্ সগীর ৩০৮)।  হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তখন সেই বান্দারাও এই পরীক্ষা ও মসিবতকে কল্যাণকর মনে করেন।

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট গেলাম, তখন তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তাঁর উপর আমার হাত রাখলে তার গায়ের চাদরের উপর থেকেই তাঁর দেহের প্রচন্ড তাপ অনুভব করলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কত তীব্র জ্বর আপনার। তিনি বলেনঃ আমাদের (নবী-রাসূলগণের) অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। আমাদের উপর দ্বিগুণ বিপদ আসে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারও দেয়া হয়। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কার উপর সর্বাধিক কঠিন বিপদ আসে? তিনি বলেনঃ নবীগণের উপর। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারপর কার উপর? তিনি বলেনঃ তারপর নেককার বান্দাদের উপর। তাদের কেউ এতটা দারিদ্র পীড়িত হয় যে, শেষ পর্যন্ত তার কাছে তার পরিধানের কম্বলটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাদের কেউ বিপদে এত শান্ত ও উৎফুল্ল থাকে, যেমন তোমাদের কেউ ধন-সম্পদ প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে। (সুনান ইবনে মাজাহ ৪০২৪, সহীহাহ ১৪৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,  মুহাম্মাদ ইবনু খালিদ (রহঃ) থেকে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ কোনো ব্যক্তির জন্য বিনাশ্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদার আসন নির্ধারিত হলে আল্লাহ তার দেহ, সম্পদ অথবা সন্তানকে বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর সে তাতে ধৈর্য ধারণ করলে শেষ পর্যন্ত বরকতময় মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত উক্ত মর্যাদার স্তরে উপনীত হয়। (সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) ৩০৯০, সহীহাহ ২৫৯৯)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

 (৩) দুনিয়ামুখিতা থাকবে নাঃ

আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার মধ্যে পদ-পদবী, অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি—এসব দুনিয়াবি কোনোকিছুতে তাঁর আকর্ষণ থাকবে না। আল্লাহ তাআলা কিছু বান্দাকে ভালোবেসে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। চাইলেও তাঁকে এসবকিছু দেওয়া হয় না। মূলত আল্লাহ তাআলা সেই বান্দাকে পরিকল্পিতভাবে দুনিয়াবি ফায়দা থেকে সরিয়ে রাখেন। সুবহানাল্লাহ। এবিষয়ে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে—

কাতাদা ইবনুন নুমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যখন কোন বান্দাহকে ভালবাসেন তাকে দুনিয়া হতে বাঁচিয়ে রাখেন, যেমন তোমাদের কেউ তার রোগীকে পানি হতে বাচিয়ে রাখে। (সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত) ২০৩৬, মিশকাত তাহকীক ছানী ৫২৫০)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

তবে, এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ কাউকে দুনিয়া দিলে তিনি আল্লাহর ঘৃণিত ব্যক্তি হয়ে যাবেন। প্রিয় বান্দাদের অনেককে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার প্রাচুর্যও দিয়েছেন। এসব ব্যক্তিদের মধ্যে ওসমান (রা.), সোলায়মান (আ.), দাউদ (আ.)সহ অনেকেই রয়েছেন। তবে তাঁদের কারো মধ্যেই দুনিয়াপ্রীতি ছিল না। এসব বান্দাদেরকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া দিয়েছেন, আবার ভালোবাসেনও।

(৪) দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী এবং নেক আমল করার অবারিত সুযোগঃ

আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার বান্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হলো- তাঁকে আল্লাহ দ্বীনের বুঝ দান করবেন এবং সে অনুযায়ী বেশি বেশি নেক আমল করার সুযোগ দান করবেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—

মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করেন। বস্ত্তত আমি শুধু বণ্টনকারী। আর আল্লাহ তা’আলা আমাকে দান করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ২০০, সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) ৭৩১২, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ২২৭৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১০৩৭, আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮১৪)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তাকে মৃত্যুর আগে পবিত্র করেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, পবিত্র করেন কীভাবে? তিনি বললেন, মৃত্যুর আগে তাকে নেক আমলের তাওফিক দেন। অতঃপর তার উপর তার মৃত্যু ঘটান’। (সহিহুল জামে: ৩০৬)।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নিশ্চয় নবী (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা যখন কোন বান্দার কল্যাণ কামনা করেন তখন তাকে ভালো কাজে নিয়োজিত করেন। প্রশ্ন করা হলো- হে আল্লাহর রসূল! কিরূপে তার দ্বারা ভালো কাজ করান? তিনি (সা.) বললেন : মৃত্যুর আগে তাকে ভালো কাজ করার তাওফীক দান করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৫২৮৮, সুনান আততিরমিযী ২১৪২, সহীহুল জামি ৩০৫, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ৩৩৫৭, মুসনাদে আহমাদ ১২০৫৫, আবু ইয়া'লা ৩৭৫৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৪১, আল মু'জামুল আওসাত্ব ৪৬৫৬)। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণ চান, তখন সে বান্দাকে সুমিষ্ট করেন। জিজ্ঞেস করা হলো সুমিষ্ট কী? তিনি বললেন, মৃত্যুর আগে ভাল কাজ তার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। অতঃপর এর উপরই তার মৃত্যু হয়’। (আহমদ ১৭৮১৯; সহিহ ইবনে হিববান ৩৪২; সহিহাহ ১১১৪)।

আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনাকে, মুসলিম উম্মাহর সবাইকে তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার মতো আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক ও সংকলকঃ

মো: ইজাবুল আলম-এম.এ, সি.ইন,এড (ইসলামিক স্টাডিজ-রংপুর কারমাইকেল ইউনিভার্সিটি  কলেজ, রংপুর), বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক।

(মহাপরিচালক-পিএমএমআরসি, এমএসএইসআরসি, গুলশান-২, ঢাকা, বাংলাদেশ।

...........................................................................................

কুরআন ও সহিহ হাদিস ভিত্তিক লেখকের অন্যান্য সকল বই এক সাথে দেখতে চাইলে PMMRC এর উপর ক্লিক করুন।

(PMMRC)

Please Share On

No comments:

Post a Comment

দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দান-ছাদাক্বা করার গুরুত্ব ও ফজিলত   আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস...